বৃষ্টিমহল ৩.৫০

৫০

বরপক্ষ আসতেই ছেলেমেয়েরা হৈহৈ করে ছুটে গেলো গেট ধরতে। হৃদির ছোট ভাই হৃদয় আর অন্যান্য অল্পবয়সী কাজিনদের সাথে অমৃতা আর বিভাও যোগ দিল। আজকে তারা সামির বন্ধু নয়, শালি। গেট ধরার টাকায় তাদের ভাগ চাই ষোলো আনা। ভিডিও ক্যামেরার আলো জ্বলছে সামনে। হইচই হট্টগোলে ভরে আছে চারপাশ। হৃদির দুজন মেয়ে কাজিন একটি লম্বা লাল ফিতে বর আর বরের বন্ধুদের সামনে আড়াআড়ি ভাবে ধরে রেখেছে। ফিতের সামনে হৃদয় দাঁড়িয়ে আছে হাতে কাঁচি নিয়ে। বাচ্চাকাচ্চাদের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতেই বরবেশে সামিকে দেখতে পেলো অমৃতা আর বিভা। ওর দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ আর রুদ্র। সামির মাথায় পাগড়ি নেই, পাগড়ি আছে আকাশের মাথায়। বিভা সামিকে দেখেই দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ‘দুলাভাই!’ বলে একটা চিৎকার দিল। 

অমৃতা উঁচু গলায় বলল, ‘বর কোনটা? পাগড়িওয়ালাটা নাকি পাগড়ি ছাড়াটা?’ 

বিভা যোগ করলো, ‘বর যেহেতু দুজন সেজেছে, সেহেতু আমরা গেট ধরবো দুবার। দুজনকেই টাকা দিতে হবে।’ 

বাচ্চাকাচ্চা বাহিনী ষাট হাজার টাকা ডিমান্ড করেছে। দরাদরি চলল অনেকক্ষণ। শেষ অবধি পঞ্চাশে গিয়ে নিষ্পত্তি হলো মামলা। চকচকে নগদ টাকার বান্ডিল তুলে দেওয়া হলো বাচ্চাদের হাতে। বর ঢুকলো ভেতরে, তার পেছন পেছন ঢুকল বেশ বড়সড় একটা দল। 

আকাশ ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি পরেছিল একটা। তার সাথে মেরুন রঙের পাগড়িতে ভালোই মানিয়েছে ওকে। অমৃতা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘তোকে তো পাগড়িতে মানাইছে। তোরও একটা বিয়ে দিয়ে দেই। কী বলিস?’ 

আকাশ সশব্দে বলে উঠল –’আমারও মনে চাচ্ছে একটা বিয়ে করি বুঝছিস? বিয়ে করলে কত মজা, পাগড়ি পরা যায়, কত কত গিফট পাওয়া যায়! শুধু তাই না, বৌও পাওয়া যায়! জোশ না ব্যাপারটা?’ 

—‘অমৃতা শোন!’ হঠাৎ ডাকলো রুদ্র, পেছন থেকে। ওর গায়ে বাদামি পাঞ্জাবি। চুলে ঝুঁটি বাঁধা। গালের দাড়ি কামানো। বেশ পরিপাটি একটা ভাব। 

—‘হ্যাঁ বল!’ 

রুদ্র ভিড়ের মধ্যে তার ক্যাটস আই মণি খচিত দুটো চোখ নিয়ে অপলক অমৃতার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল, ‘সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে শাড়িতে!’ বলেই আবার সঙ্গেসঙ্গে চোখেমুখে এক অদ্ভুত মুদ্রা ফুটিয়ে তুলল, ‘তেল মারলাম একটু, অত ফুলিস না! 

—‘যা ভাগ!’ 

—‘হ্যাঁ ভাগতেছি। মনীষারে আনতে যাইতেছি।’ 

—‘যা!’ শব্দটা উচ্চারণ করে ঘুরে দাঁড়াতেই হঠাৎ একটা লম্বা মানুষের সাথে ধাক্কা লেগে গেলো অমৃতার। নাকে সুন্দর ঘ্রাণ এসে বাড়ি খেলো। চোখের খুব কাছে সে আবিষ্কার করল একটা সাদা পাঞ্জাবি আর একটা প্রিয় মুখ! ধক করে উঠল বুক। মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক চ— কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করে উঠলেন তিনি। অমৃতা কাঁপা হৃৎপিণ্ড নিয়ে দেখল লোকটার সাদা পাঞ্জাবির হাতায় তার ঠোঁটের লাল রং লেগে গেছে, দুৰ্ঘটনা বশত। রাগে লোকটার কপালের রগ ফুলে গেছে। কটমটে চোখে একবার তাকালেন তিনি অমৃতার দিকে। দুরুদুরু বুক নিয়ে অমৃতা বলল, ‘স্যরি!’ লিপস্টিকের রং লোকটাকে বড়ই বিব্রত করে তুলেছে। তিনি তাড়াতাড়ি পা বাড়ালেন ড্রেসিংরুমের দিকে। অমৃতাও ছুটল তার পেছন পেছন। 

স্টেজে হৃদি বসে আছে বৌ সেজে। তার পরনে হালকা বেগুনি লেহেঙ্গা। গলায় বাবার দেওয়া স্বর্ণের অলংকার। শ্বশুরের দেওয়া হীরের সেট। মাথায় টিকলি আর ঝাপ্টা। নাকে হীরের নাকফুল, ইয়া বড় একটা নথ। হাত ভর্তি সোনার চুরি। তাকে দেখাচ্ছে পরির মতো সুন্দর। সামি ধীরে ধীরে স্টেজে উঠে আসলো। বসলো হৃদির পাশে। চারদিকে চেনা অচেনা মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন কোলাহল। তার কেমন ঘোর ঘোর লাগছে! স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে! সে আড়চোখে পাশে বসা হৃদিকে একবার দেখল। আজকালকার মেয়েরা সাধারণত বিয়ের দিন লজ্জা টজ্জা পায় না। কিন্তু হৃদিকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জা পাচ্ছে। তার মুখ অবনত। চোখ ভাসা ভাসা। সামি বুকের মাঝে একটা অদ্ভুত শিহরণ টের পাচ্ছে। ভালো লাগছে তার। এত বেশি ভালো লাগছে যে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষ! দীর্ঘ 

হৃদিকে স্টেজে বউ সেজে বসে থাকতে দেখে আকাশ আর রুদ্র ‘ভাবি ইইইই!’ বলে ছুটে আসলো নাচতে নাচতে। 

৫১

ড্রেসিংরুমটা দৈবক্রমে খালি ছিল। তিন চারটা টিউব লাইট জ্বলছে চারপাশ আলোকিত করে। রাশেদ ঘরে ঢুকেই কালবিলম্ব না করে বেসিনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির হাতায় লালচে রঙের ছোপ। কী বিচ্ছিরি অবস্থা! অমৃতা পায়ে পায়ে প্রবেশ করল ঘরে। দরজা লক করল সন্তর্পণে। 

—‘আরে করছেন কী? এভাবে হবে নাতো! পুরো পাঞ্জাবি ভিজে যাবে আপনার।’ মুরুব্বিয়ানা গলায় বলল অমৃতা 

তিনি গম্ভীর একটা দৃষ্টি অমৃতার দিকে তাক করে সরোষে গর্জন করে উঠলেন, ‘তুমি? তুমি এখানে এসেছ কেন?’ 

—‘আপনার হেল্প করতে আসলাম।’ 

—‘হেল্প লাগবে না আমার। তুমি যাও।’ বলে তিনি বেসিনের কল ছেড়ে দুহাতের অঞ্জলি ভরে পানি নিতে লাগলেন। তারপর সেই পানি ছিটিয়ে দিতে গেলেন পাঞ্জাবির হাতে। অমৃতা ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে আসলো, ইশ রাশেদ! পানি দিয়েন না, বলছি তো আপনার পুরো জামা ভিজে যাবে। লেট মি হ্যান্ডেল ইট।’ 

রাশেদ তাকালেন একবার অমৃতার দিকে। আঁজলা ভর্তি পানি ছেড়ে দিলেন ধীরে ধীরে বেসিনে। জীবনে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা ঝুলিতে থাকলেও কাপড় থেকে দাগ তোলা সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর আজ অবধি হয়ে ওঠেনি। এসব বাড়ির কাজের লোকেরাই তো করে! মা বেঁচে থাকতে মা করতেন। রোমেলার তো এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেই হয় না। 

অমৃতা চট করে কয়েকটা টিস্যু তুলে নিল টিস্যু বক্স থেকে। বেসিনে লিকুইড হ্যান্ড সোপ রাখা ছিল। একটু সাবান মাখিয়ে নিল সে টিস্যুতে। ভিজিয়ে নিল জলে, হালকাভাবে। মৃদু গলায় বলল, ‘দেখি!’ 

তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন একটু অস্বস্তি নিয়ে। মুখখানা এক অটল গাম্ভীর্যে ভরপুর। চোয়াল পাথরের মতো শক্ত। অমৃতা কাছে এগিয়ে গেলো। নাকে এসে লাগল সুন্দর একটা ঘ্রাণ। আফটার শেভের হবে হয়তো। হাত কাঁপছিল আলতো। কাঁপা হাতেই টিস্যু দিয়ে পাঞ্জাবির রং লাগা জায়গাটা মুছে দিতে লাগল সে। লোকটার উষ্ণ নিশ্বাস এসে পড়ছিল ওর কপালে। একটা নেশাড়ু ভালোলাগায় ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছিল হাওয়া। বুকের খাঁচায় বড্ড দাপাদাপি! আচ্ছা, এই মানুষটার সাথে কি তার আগে… বহু আগে… কোনো রকমের চেনা জানা ছিল? অন্য কোনো জন্মে? বা অন্য কোনো পৃথিবীতে? কেন মনে হয় মানুষটা তার অনেক আপন… অনেক কাছের…আর অনেক বেশি ভরসার? 

—‘আমি ইচ্ছে করে করিনি। বিশ্বাস করুন!’ চোখ নিচের দিকে নামিয়ে রেখেই বলল সে। 

—‘হুম।’ বজ্র গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি। নজর রাখলেন খুব কাছে দাঁড়ানো মেয়েটির অবনত মুখের ওপর। ওর চোখে বেশ রংচং মাখা। ভ্রুযুগলের মাঝখানে একটা কালো টিপ। টেবিল ফ্যানের বাতাসে উড়ছে কপালের কাছে পড়ে থাকা ছোট ছোট কয়েকটা চুল। হঠাৎ চোখ তুলে তাকালো মেয়েটা। চোখে চোখ পড়তেই হৃদয়ের আনাচে কানাচে জ্বলে উঠল যেন একশ ভোল্টের আলো। লম্বাটে ছাঁচের মুখ, কাজল কালো দুটি চোখ, টিকলো নাক… পাতলা জোড়া ঠোঁট! মনে হলো… এই মুখটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে পবিত্র! এরকম মনে হতে নেই… বড্ড অসময় এখন! 

তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। তার কপালের ভাঁজটা ফিরে আসলো আবার। 

—‘কাল আপনার ফ্লাইট কখন?’ 

—‘দুপুর বারোটা।’ মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেই উত্তর দিলেন তিনি। অমৃতা তাঁর ধারালো চোয়ালটার ওপর দৃষ্টি ফেলে বলল, –’শেভ করেছেন?’ তিনি উত্তর দিলেন না। ভ্রু কুঁচকে নিজের পাঞ্জাবির হাতার দিকে তাকালেন একবার। দাগ অনেকখানি গেছে। কিন্তু পুরোপুরি নয়। অমৃতা আবার নতুন করে টিস্যু নিল, ভিজিয়ে নিল। এগিয়ে আসলো। 

—‘একমাস থাকবেন?’ দাগ মুছতে মুছতে প্রশ্ন করল অমৃতা। 

—‘হুম।’ 

—‘সময়টা একটু কমানো যায় না?’ 

তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন তিনি, ‘এসব কথা কেন বলছ?’ 

প্রশ্নের ধরনে একটু কেঁপে ওঠে অমৃতা। অভিমানও হয় হালকা। তবুও গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে, ‘কেন বলছি আপনি বোঝেন না? 

—‘না বুঝি না।’ 

—‘যাবার আগে, আরেকবার দেখা হবে?’ 

—‘জানি না!’ 

—‘আমার লিস্টটা পড়ে দেখেছিলেন?’ 

লোকটার গলার স্বর আগের চাইতেও কঠোর হয়ে গেলো, ‘দেখেছি। এসব কী লিখেছ তুমি?’ 

অমৃতা ফিক করে হেসে দিল। দাগ উঠে গেছে তখন। একটু ভিজে গেছে জায়গাটা। 

—‘আপনিই তো বলেছিলেন আমি যা চাই তা লিখে দিতে।’ 

—‘সব কিছু নিয়ে ফাজলামো করা ভালো না অমৃতা।’ 

সেই সময় পাঞ্জাবির পকেটে ফোনটা বেজে উঠল। তিনি ফোন ধরে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ আসছি।’ ফোন বন্ধ করে ‘চল যাই’ ‘বলে পা বাড়ালেন তিনি। অমৃতা ফট করে পেছন থেকে তাঁর একটা হাত ধরে ফেলে একগুঁয়ে গলায় বলল, ‘ফাজলামো বললেন কেন? আপনার কাছে ফাজলামো মনে হচ্ছে ব্যাপারটা?’ 

তিনি হাত ছাড়িয়ে নিলেন, ‘হ্যাঁ মনে হচ্ছে।’ অমৃতার চোখে বিষণ্নতা ভর করল, ‘সত্যি?’

—‘কেন এরকম করছ?’ 

—‘আপনি কেন এরকম করছেন? খুব ভালো মতোই জানেন আমি কতটা সিরিয়াসলি লিস্টটা করেছি। জেনেও কেন ফাইজলামি বলে চালিয়ে দিতে চাইছেন বিষয়টাকে?’ 

তিনি চুপ করে রইলেন। 

—‘আপনার তো কোনো অভাব নেই। কত্ত টাকা! দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন। তবুও আমি যা চাই তা আপনি আমাকে দিতে পারবেন না? সেই ক্ষমতাই আপনার নেই, তাই না? দেখলেন তো, টাকা দিয়ে সব কেনা যায় না!’ 

রাশেদ একটু দ্বিধা নিয়ে চেয়ে রইলেন মেয়েটির দিকে। তাঁর ভাবনার খাতায় এই মাত্র একটি পৃষ্ঠা বদল হলো। সত্যই তো, সারাটা জীবন ভর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি বিত্তশালী হওয়ার জন্য, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। ক্ষমতার পেছনে ছুটেছেন নাওয়া খাওয়া ভুলে। অথচ আজকে এই মেয়েটা যা চায় তা দেবার মতো কোন সামর্থ্যই তাঁর নেই! আশ্চর্য! আজ তাঁর সব আছে, তবুও যেন কী একটা শূন্যতা! কোথায় যেন কীসের একটা অপূর্ণতা! সেই অপূর্ণতাটুকুকে পূর্ণ করার সাহস, শক্তি বা যোগ্যতা কোনোটাই তাঁর ঘটে নেই। 

—‘আপনি আমাকে একটুও মিস করবেন না? 

—‘অমৃতা, দুষ্টুমি করো না।’ 

—‘করবেন না?’ কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করে অমৃতা 

— না!’ 

–‘সত্যি?’ 

—‘সত্যি।’ 

—‘মিথ্যে কথা। আই নো, ইউ উইল মিস মি।’ 

—‘আই ও’ন্ট।’ 

বলে তিনি প্রস্থানোদ্যত হলেন। 

—‘রাশেদ! আমি মিস করব আপনাকে! সব সময় করি!’ 

তিনি থমকে দাঁড়ালেন। তাকালেন এক ঝলক। গভীর দুটি চোখে গাঢ় এক বিষণ্নতা ভর করল ক্ষণিকের জন্য। কী যেন একটা বলতে গিয়ে মুখ খুললেন। থেমে গেলেন আবার। তারপর নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেন। 

৫২

কাজী সাহেবের গালে মেহেদী রাঙানো লাল দাড়ি। মাথায় টুপি। চোখে সুরমা। তার গা থেকে ভুরভুর করে উড়ে আসছে আতরের ঘ্রাণ। তাকে ঘিরে বসেছেন বর কনের বাবা মা এবং দুপক্ষের মুরুব্বিরা। বরের মাথায় সাদা টুপি। কনের মুখ ঘোমটায় ঢাকা। আলাদা একটা ওড়না দিয়ে তার মুখে লম্বা ঘোমটা টানা হয়েছে। উপস্থিত অন্যান্য পুরুষদের মাথায়ও টুপি। মেয়েদের মাথায় শাড়ির আঁচল অথবা ওড়না। বন্ধুরা স্টেজের সামনে দাঁড়িয়েছে। ফটোগ্রাফার এবং ভিডিও ক্যামেরা ম্যানের দাপটে অবশ্য এই স্থানটিতে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। ভিড় লেগে গেছে। উকিল বাপ হয়েছেন হৃদির মেজো চাচা। তিনি কাবিন নামার শর্ত সমূহ জোরে জোরে একবার পড়লেন সবার সামনে। দেন মোহর নব্বই লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়েছে। এর মাঝে গয়নাগাটি বাবদ উশুল পঞ্চাশ লক্ষ। 

প্রথমে কনের সম্মতি নেয়া হলো। বন্ধুদের খুব শখ ছিল ‘কবুল ‘বলাটা নিজের কানে শুনবে। কিন্তু এত লোকজন আর হই হট্টগোলের মাঝে হৃদির বেড়ালের মতো মিউমিউ স্বরে ‘কবুল’ উচ্চারণ করাটা শুধু মাত্র কাজী সাহেব ব্যতীত অন্য কেউ ঠিকঠাক শুনতে পেল না একটিবারের জন্যেও। হৃদি খুব কাঁদছিল। কান্নার কারণ সম্পর্কে সে শতভাগ সুনিশ্চিত নয়। এই অশ্রু সুখের নাকি দুঃখের, তা কে জানে! জীবন নামের নকশায় সূচনা এবং সমাপ্তি, এই দুই ভিন্ন রেখা আজ এই শুভলগ্নে একটি মাত্র বিন্দুতে মিলিত হতে যাচ্ছে। সমাপ্তি ঘটছে তার বাবা মায়ের ছায়া সুনিবিড় আশ্রয় তলে গড়ে ওঠা শৈশবের কৈশোরের তারুণ্যের একান্ত নিজের স্বাধীন ছোট্ট আমি ময় জীবনটার। বিপরীত প্রান্তে সূচনা হচ্ছে দায়িত্ব কর্তব্য এবং বাস্তবতায় জড়ানো সাংসারিক জীবনের এক পরিণত অধ্যায়। গত হওয়া ঝামেলাবিহীন, চিন্তামুক্ত ঝরঝরে দিনগুলি ফেলে আসার দুঃখ আর অনাগত ভবিষ্যৎ দিনের অনিশ্চয়তার উদ্বেগ, এই দুইয়ে মিলেমিশে তার সমস্ত সত্তা এক অদম্য, মাত্রাহীন অভিশংকায় থরথর করে কাঁপছে! 

পাশের চেয়ারে বসে থাকা হৃদিতার কান্না মিশ্রিত মুখখানা টের পেয়ে সামি ভেতরে ভেতরে একটা চাপ অনুভব করছিল। তার মনে হচ্ছিল জীবনে এই প্রথমবারের মতো সে প্রকৃত অর্থে কোনো গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছে। যে মেয়েটিকে সে সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে সারা জীবনের জন্য নিজের করে নিতে চলেছে, সেই মেয়েটির সমস্ত দায়ভার আজ থেকে শুধু তার ওপরেই বর্তাবে। এই দায়ভার সে কোনোভাবেই অন্য কারো ওপর অর্পণ করতে পারবে না, বাবার ওপরে নয়, মায়ের ওপরেও নয়। আজকের পর থেকে তাকে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল, পরিণত পুরুষ হতে হবে! 

কনের সম্মতি নেবার পর কাজী সাহেব বরের সম্মতি নিলেন। বিয়ের পাত্রপাত্রী কাবিন নামায় দস্তখত করল। দস্তখত করল দুই পক্ষের সাক্ষীরা। বিয়ে সম্পন্ন হবার পর উপস্থিত অতিথিদেরকে সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো বরকে। সামিকে এ সময় একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিল। তার কানের ডগা লাল। কপালে ভাঁজ। মনে হচ্ছে বিয়ে করে সে মস্ত কাজ সেরে ফেলেছে। বেশ ভারিক্কি ভাব তার চোখের চাউনিতে। কাজী সাহেব সালামের আদেশ দেওয়ার পর মিনিট দুয়েক সময় সে চুপচাপ সামনের দিকে চেয়ে বসে রইল। যেন কাজী সাহেবের কথা তার কানেই যায়নি। ছেলেকে নড়তে চড়তে না দেখে হক একটু উঁচু গলায় বললেন, ‘আব্বু! উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দাও সবাইকে!’ বাবার কথাটা তার কানে ঢুকল। বিচলিতভাবে উঠে দাঁড়ালো সে। চোখের দৃষ্টি নিচের দিকে তাক করে হাত তুলে একটা লম্বা সালাম দিল সবাইকে। ওদিকে বরের সালাম দেওয়ার ধরন দেখে বন্ধুরা সব হেসে গড়িয়ে পড়ছে তখন। বন্ধুদের হাসি দেখে বরের ফর্সা গাল টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করল। 

এরপর মোনাজাতের পালা। কাজী সাহেব উপস্থিত সবাইকে দরূদ শরীফ, সুরা ফাতিহা এবং চার কুল পড়তে বললেন। সকলেই পড়ল। সেই সময়টায় কিছুক্ষণের জন্য লোকজনের ফিসফাস কথা আর গুনগুন গুঞ্জন উধাও হয়ে ঝুপ করে পিনপতন নীরবতা নেমে এসেছিল। বিভা মাথায় আঁচল তুলে দিয়েছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছিল চারপাশটা। কলমা পড়ে কবুল বলতে পারেনি বলেই সামির সাথে তার বিয়েটা হয়নি। এ সমাজের কাছে মনের মিল গৌণ, সংস্কারের মিলটাই মুখ্য! মোনাজাতের পর বর কনের সামনে টেবিল পেতে বিভিন্ন মিষ্টান্ন পরিবেশন করা হলো। দলে দলে আত্মীয়স্বজনরা স্টেজে উঠতে লাগল। বিয়ের পাত্র পাত্রীকে মিষ্টিমুখ করাতে লাগল। ছবি তুলতে লাগল। বন্ধুরা স্টেজের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। মনীষা আসতে পারেনি। আজ সকাল থেকেই তার একটু জ্বর জ্বর ভাব। মুখে রুচি নেই। আসতে পারবে না বলে রুদ্রর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে সে। বন্ধুদের ঠিক পেছনেই রোমেলা তার বোনদের নিয়ে বসে আছেন। চারপাশে অনেক শব্দ, অনেক কোলাহল। এত হৈ-হুল্লোড়ের মাঝেও স্পষ্ট ভাবে কিছু কথা কানে এসে লাগল ওদের। কোনো এক নারীকণ্ঠ বলছে, ‘জীবনেও ভাবি নাই বুবু, আমাদের সামির বিয়ে এরকম সিম্পলভাবে হবে। এই হলটার ডেকোরেশন এত বাজে! ছিঃ— 

রোমেলাকে বলতে শোনা গেলো, ‘এই ফ্যামিলির কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাই তো বোকামি। আমি জানতাম এরকম কিছুই হবে। কী আর করা, সবই আমার কপাল!’ 

বন্ধুরা কথাগুলো শুনল। একজন আরেকজনের দিকে তাকালো সতর্কভাবে। চুপ করে রইল। কিন্তু হজম করতে পারল না খুব সহজে। বুকের মধ্যে কাঁটার মতো কথাগুলো বিঁধে রইল অনেকক্ষণ। আধা ঘণ্টা পরে বন্ধুদল অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলেঠুলে উপনীত হলো মঞ্চে। আকাশ, রুদ্র গিয়ে বসলো বরের পাশে, বিভা আর অমৃতা বসলো কনের পাশে। দুই তিনজন ফটোগ্রাফার স্টেজের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যামেরায় ক্লিক করে যাচ্ছে একের পর এক। হৃদি মুখে জোরপূর্বক একটি হাসি ঝুলিয়ে রেখে, ক্যামেরার দিকে চেয়ে থেকে অনেকটা ফিসফিস করে বলল, ‘হাসতে হাসতে আমার গাল ব্যথা হয়ে গেছে। আর কত ছবি তুলব? আর কত হাসব?’ 

বিভা ক্যামেরাম্যানদের দিকে মুখ তাক করে রেখেই বলল, ‘আরো অনেকক্ষণ। আজকের দিনের মডেল হইলা তুমি। তোমাকে ননস্টপ পোজ দিতে হবে।’ 

ওদিকে সামি রুদ্রর কানে কানে বলছে, ‘কাহিনি কী? অনেকেই দেখি খাওয়া দাওয়া শুরু করে দিছে। আমাদের খাওয়া দিবে না? 

—‘বর সবার লাস্টে খায়।’ 

—‘কেন? আমার তো খিদা লাগছে।’ 

—‘কিছু করার নাই। আগে গেস্টরা খাবে তারপর তোরা।’ 

—‘কেন ভাই? বিয়া কইরা কি দোষ কইরা ফেললাম? কেন এই অবিচার? 

সুযোগ বুঝে অমৃতা সামির চেয়ারের সামনে উবু-হাঁটু হয়ে বসল। 

‘দুলাভাইইইই, দেখি তো!’ বলে ভারি যত্নের সাথে সে বরের পা থেকে জুতো দুটো খুলে নিল সন্তর্পণে। চুরিটা সবার প্রথমে আবিষ্কার করল আকাশ, ‘আরে আরে! জুতা নিয়ে যাচ্ছে তো! ধর ধর!’ 

অমৃতা ততক্ষণে জুতো হস্তান্তর করে দিয়েছে হৃদয়ের কাছে। হৃদয় জুতোজোড়া হাতে নিয়েই দিয়েছে ভোঁ দৌড়। রুদ্র আর আকাশ পড়িমরি করে ছুট লাগালো জুতোচোরের পেছনে। অমৃতা আর বিভা গালভর্তি হাসি নিয়ে হাত তুলে হাইফাইভ দিল একজন আরেকজনকে। বিভা তৃপ্তির সাথে বলল, ‘মিশন কমপ্লিট। আয় এখন একটু শান্তিমতো ফটোসেশন করি।’ 

সামি উৎকণ্ঠা নিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল, ‘আমার জুতা নিয়ে কোথায় গেলো?’ 

—‘পালাইছে। এখন টাকা না দিলে তুই জুতা ফেরৎ পাবি না।’ বিভার উত্তর। 

ক্যামেরাম্যানরা খুব বিরক্ত করছে। একজন চেঁচিয়ে উঠে সামিকে বলল, ‘ভাইয়া এদিকে একটু তাকান!’ 

সামি স্টেজে বসে থেকেই খ্যাঁক দিয়ে উঠল, ‘চুপ করেন ভাই! দেখছেন না আমার জুতা চুরি হয়ে গেছে? সিরিয়াস একটা ব্যাপার। জুতা ছাড়া আমি বাসায় যাব কীভাবে?’ 

অতিথিরা খাবার টেবিলের দিকে ভিড় জমাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্টেজের সামনে এখন তেমন মানুষ নেই। দুজন ফটোগ্রাফার এবং একজন ভিডিও ক্যামেরাম্যান দাঁড়ানো। ফটোগ্রাফার দুজন এতক্ষণে বুঝে গেছে যে ছবি তোলায় বর কনের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ছবিটবি তোলার চাইতে নিজেদের মাঝে কথা বলাটাই এদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফটোগ্রাফাররা তাই এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। তারাও নিজেদের মাঝে কথা বলছে। কাজ করতে হচ্ছে না। বেশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করা যাচ্ছে। এইতো ভালো। 

একটু বাদে রুদ্র আর আকাশ হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে আসলো। বিপন্ন গলায় বলল, ‘জুতো তো পাওয়া গেলো না।’ 

—‘এখন কী হবে?’ সামিকে দেখে মনে হলো তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। 

অমৃতা আর বিভা সমস্বরে বলে উঠল, ‘টাকা দিতে হবে! 

সামি কিছু বলে ওঠার আগেই আকাশ আর রুদ্র একদম লাফ দিয়ে প্রতিবাদ করে উঠল, ‘অসম্ভব! গেট দিয়া ঢুকার সময় একবার জ্বালাইছস। কতগুলা টাকা দিছি। এখন মরে গেলেও আর দিব না!’ 

অমৃতা তারিয়ে তারিয়ে বলল, ‘তাহলে বরকে খালি পায়ে বাড়ি ফিরতে হবে।’ 

—‘বরকে প্রয়োজনে কোলে করে বাড়ি নিয়ে যাব তাও তোদের একটা পয়সা দিব না।’ বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা দিল আকাশ। 

—‘তাহলে আমরাও ভাবির জুতা চুরি করব। আমাদেরও পয়সা দিতে হবে।’ রুদ্রর কথা শুনে বিভা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। কোমর বেঁধে লেগে গেলো ঝগড়ায়, ‘তোরা কে এসব বলার? হু দ্যা হেল আর ইউ? আমাদের দুলাভাই আমাদের টাকা দিবে!’ 

রুদ্র সামির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘ওই তোর শালিরা কী বলে এইসব?’ 

সামির মুখে এখন একটু একটু দুষ্টু হাসি। বোঝা যাচ্ছে দুই পক্ষের ঝগড়াটা বেশ উপভোগ করছে সে। তাকে হাসতে দেখে আকাশ তারস্বরে বলল, ‘হাসলে তো হবে না। শালিদের দিতে হবে গালি… তবেই পড়বে মুখে চুনকালি! 

—‘তুই চুপ করে আছিস কেন? তুই কি চাস না আমরা কয়টা টাকা পাই? জুতাজোড়া চুরি করতে কত কষ্ট হইছে আমাদের জানিস?’ ফুঁসে উঠে বলল বিভা, হৃদিকে। 

হৃদি মুখ টিপে হাসতে লাগল। গোটা মঞ্চ এখন দুটো দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। মেয়েপক্ষ ভিড় করেছে বৌয়ের চেয়ারের পাশে, আর ছেলেপক্ষ জামাইয়ের চেয়ারের পাশে। সব মিলিয়ে দশ বারোজন ছেলেমেয়ে হবে। বর কনে বাদে বাকিরা সব দাঁড়িয়েই আছে। 

অমৃতা কোমরে হাত রেখে একদম ওকালতির গলায় আকাশকে বলল, ‘শালি জাতিকে অপমান করে এইমাত্র তুই কী বললি? আবার বল তো?’ 

আকাশ বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘শালিদের দিতে হবে গালি, তবেই পড়বে মুখে চুনকালি!’ 

এই কথা শুনে বরপক্ষের ছোটখাটো দলটা খুশিতে আটখানা হয়ে হাততালি দিয়ে উঠল। রুদ্র দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে উঁচু গলায় সুর করে চ্যাঁচাল, ‘শা —-লি, খায় গা–লিইইইইইই!’ 

রুদ্রর দেখাদেখি বরপক্ষের বাকি ছেলেমেয়েরাও চিৎকার করে বলতে লাগল তালে তালে সুরে সুরে –’শালি, খায় গালি!’ 

অমৃতা হাত তুলে থামালো সবকটাকে, ‘থামো থামো, এবার আমাদের বলতে দাও।’ একটু থেমে একটা শ্বাস নিল সে। তারপর রুদ্রর সুর নকল করেই ছড়াগানের মতো বলল, ‘দেবর, খায় থাপ্পড়।’ 

ব্যস, এবার কনেপক্ষর ছেলেমেয়েরা গলা ফাটিয়ে গাইতে লাগল, ‘দে …বর খায় থাপ্পড়!’ 

বিভা এর সাথে যোগ করল, ‘দে – ব – র… হয় বান্দর!’ 

জামাই বৌ দুজনে খুব হাসছিল। এর মাঝেই সামি সাহসের সাথে টুপ করে ধরে ফেলেছে হৃদির হাত। দুজনের চোখে মুখে এখন নিখাদ আনন্দের প্রতিফলন। আহা আজকের দিনটা যেন সত্য নয়, এ যেন আকাশ থেকে খসে পড়া ঝিলিক দেওয়া তারার মতো এক জ্বলজ্যান্ত স্বপ্ন! 

—‘আরে থামো থামো!’ আকাশ আদেশ দিল ছেলেমেয়েদের। সঙ্গে সঙ্গে থামল না অবশ্য কেউ। চেঁচামেচি একটু কমে আসার পর আকাশ বলল, ‘এভাবে হবে না। একটা কম্পিটিশন করা হোক। যে পক্ষ জিতবে, জুতা তার।’ 

বিভার গলা চড়ল সপ্তমে, ‘জুতা তো অলরেডি আমাদের! এখন তোরা টাকা দিলেই ঝামেলা শেষ।’ 

সামি গলা বাড়িয়ে প্রশ্ন করল, ‘কত টাকা চাস?’ 

বিভা এই প্রশ্ন শুনে অমৃতার কানে কানে কিছু একটা বলল। অমৃতা, হৃদয়সহ বাকি ছেলেমেয়েদের কাছে ডেকে দলবদ্ধভাবে আলোচনা করল মিনিট দুয়েক সময়। তারপর বেশ ভারিক্কি চালে রায় দিল, ‘পঞ্চাশ হাজার!’ 

—‘কী??? এতওওওওওও টাকা!’ 

আকাশ আর রুদ্র পারলে জীবন্ত চিবিয়ে খায় অমৃতাকে। মনে হচ্ছে রাগে ওরা দুজন অন্ধ হয়ে যাবে। বরপক্ষের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তারাও কী যেন শলাপরামর্শ করল গোল হয়ে। এদিকে হৃদয় অমৃতা আর বিভাকে আশ্বস্ত করল, জুতো সে এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে যে চিরুনি অভিযান চালালেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। 

—‘আমরা একটা গেইম খেলব। সেই গেইমে যদি তোমরা জিতো, তাহলেই তোমরা টাকা পাবা। হেরে গেলে জুতা বিনা পয়সায় ফেরত দিবা। ডিল!’ সমস্ত আলোচনার রাশ টানলো রুদ্র। 

অমৃতা প্রতিবাদ করে উঠল, ‘কী আজব আমরা কষ্ট করে খেলতে যাব কেন? জুতা তো অলরেডি আমাদের হেফাজতে আছে। তোমরা টাকা দিয়ে ছাড়ায় নাও, নাইলে বরকে ন্যাংটা পায়ে হাঁটাও। আমাদের কী? আমরা কেন খেলতে যাব?’ 

—‘ভীতুর ডিম!’ বরপক্ষর ভিড় থেকে কে যেন ছুঁড়ে দিল কথাটা।

–-‘হেরে যাবার ভয়ে খেলছে না।’ আরেকজন বলল। 

বিভা মুখ ঝামটা মেরে হৃদিকে বলল, ‘এই তোর দেবরগুলার সমস্যা কী? টাকা দিবে তোর বর, কিন্তু টাকার দুঃখে মরে যাচ্ছে দে-বর, কাহিনি কী মামা?’ 

রুদ্র এক অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করল, ‘ওই সামির বাচ্চা, তোর শালিগুলা এত ভীতু কেন? হারার ভয়ে খেলতে চায় না কেন?’ 

—‘আমরা মোটেও ভীতু না। এসহোল!’ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে গাল দিল অমৃতা। 

হঠাৎ বিভা বলল, ‘ওকে ফাইন। কী খেলবি বল।’ 

—‘কুইজ কম্পিটিশন হবে।’ রুদ্র বলল। 

—‘ফালতু… এটা কি আমরা স্টাডি ট্যুরে আসছি নাকি? বাচ্চাদের মতো কুইজ করব কেন?’ বিভা আপত্তি জানালো। 

অমৃতাও সায় দিল, ‘ঠিকই তো স্টাডি ট্যুর না এইটা, বিয়েবাড়ি। আর কোনো আইডিয়া নাই? ক্লীশে যত্তসব।’ 

—‘তাই না? তাহলে তোমরাই বল কী খেলা যায়? ক্রিকেট খেলতে চাও? শাড়ি পইরা ক্রিকেট খেলতে মনে চাইতেছে খুব?’ 

অমৃতা কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে আকাশপাতাল ভেবে নিয়ে বলল, ‘গানের কলি খেলা যায়।’ 

—‘বাহ কুইজ কম্পিটিশন ক্লীশে আর গানের কলি কী? খ্যাৎ কতগুলা।’ বলল রুদ্র, কিন্তু দেখা গেলো উভয় পক্ষের ছেলেমেয়েদের কুইজের চাইতে গানে বেশি আগ্রহ। ততক্ষণে অনুষ্ঠানে গানের দল চলে এসেছে। এরা রুদ্রর বন্ধু। বুয়েটে পড়াকালীন সময়ে এই ব্যান্ডের সাথে রুদ্র বেশ কিছুদিন ভোকাল হিসেবে কাজ করেছে। ঠিক হলো গানের কলিই খেলা হবে। তবে যে গান গাইবে তাকে গানের দলের সাথে দাঁড়িয়ে ইন্সট্রুমেন্টের সাথে গাইতে হবে। বাংলা গান ছাড়া অন্য কোনো ভাষার গান চলবে না এবং অবশ্যই গানের প্রথম প্যারাটা সম্পূর্ণ গাইতে হবে। 

কোন পক্ষ আগে গান গাইবে তা নিয়ে অবশ্যম্ভাবী বিবাদটা প্রাথমিক পর্যায়েই নিষ্পত্তি লাভ করল। রুদ্র ঘোষণা দিল, প্রথমে সে নিজেই শুরু করবে। অর্থাৎ বরপক্ষর দান প্রথমে। স্টেজের সম্মুখ ভাগ থেকে মিষ্টান্ন পরিবেশনের টেবিলটা সরানো হয়েছে। জামাই বৌয়ের রাজকীয় চেয়ারের পাশে বেশ কিছু সাধারণ চেয়ার জায়গা করে নিয়েছে। দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গেছে ছেলেমেয়েরা। প্রতি দলে আছে ছয়জন সদস্য। হৃদির পাশে অমৃতা আর বিভা বসেছে দল নিয়ে। আর সামির পাশে আকাশ এবং দল। রুদ্র গান গাইবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনবরত ‘হ্যালো হ্যালো’ বলে মাইক পরীক্ষা করছে। স্টেজের পাশেই গান বাজনার সব ইনস্ট্রুমেন্ট সেট করা হয়েছে। গানের দলের সদস্য পাঁচজন। একজন ড্রামার, একজন কীবোর্ডিস্ট, দুজন গিটারিস্ট এবং একজন ভোকাল। 

অতিথিদের খাওয়া দাওয়ার পালা চলছে এখনো। প্রথম ব্যাচ শেষ হবার পর দ্বিতীয় ব্যাচ চলছে। হৃদির আব্বা আম্মা অতিথি আপ্যায়নে মহা ব্যস্ত। এদিকটায় তারা আসতেই পারছেন না, সময়ের অভাবে। অবশ্য হৃদির বন্ধুরা উপস্থিত আছে বলে আপাতত মঞ্চের এই দিকটা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথাও নেই। মেয়ের বন্ধুরাই এসব ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে যথার্থ পারদর্শী, এটা তারা জানেন। 

মঞ্চের সম্মুখের চেয়ারগুলো একটাও খালি নেই। সাজগোজ করা, নানা বয়সী নারী পুরুষ বসে আছে। সকলের চোখ এখন গানের দলের দিকে। এর মাঝেই ভিডিও ক্যামেরাম্যান লাইট আর ক্যামেরা নিয়ে নিরন্তর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিডিও করছে। আলো ফেলছে। কেউ কেউ বিরক্ত হচ্ছে আবার কেউ কেউ ক্যামেরা সামনে এলে আগ্রহের সাথে হাসিমুখে পোজ দিচ্ছে। 

রুদ্রর চুল গুলো ঘাড়ের ওপর এলো করে খোলা। গান গাওয়ার আগে তার চোখে মুখে একটা আচ্ছন্ন ভাব চলে আসে। সেই মুহূর্তে তাকে দেখায় ধ্যানমগ্ন কোনো ঋষির মতো। বাজনা বাজতে শুরু করেছে। চোখ বন্ধ করে মিউজিকের তালে তালে ডান হাতের পাঁচ আঙুল নাচাচ্ছে সে মাইক্রোফোনের শরীরে। 

অমৃতা ফিসফিস করে হৃদয় অর্থাৎ হৃদির ছোট ভাইয়ের কানে কানে বলল, ‘আমাদের গ্রুপে ভালো গান গাইতে পারে কে?’ 

হৃদয় ঠোঁট উল্টে আমতা আমতা করে বলল, ‘কেউই তেমন ভালো গাইতে পারে না।’ 

—‘ইশ, কী মুশকিল হলো। ওদের দলে তো রুদ্র আছে। ও একাই একশ।’ 

—‘রুদ্র ভাইয়া ছাড়াও আরো একজন গায়িকা আছে। ঐযে সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটা। সামি ভাইয়ার খালাতো বোন। ওই মেয়েটা খুব ভালো গান করে। ইনস্টাগ্রামে দেখেছি আমি।’ জ্ঞানী জ্ঞানী গলায় তথ্যটা দিয়ে হৃদয় সবুজ শাড়ি পরিহিতা মেয়েটির দিকে পলক তুলে তাকালো। মেয়েটি বসে আছে আকাশের পাশে। বয়স উনিশ কি বিশ হবে। গোলগাল ফর্সা মুখ। খুঁতনিতে একটা ডিম্পল আছে। 

—‘ইনস্টাগ্রামে তুই ওকে ফলো করিস নাকি?’ 

রোগা লম্বা শরীরে ঢলঢলে ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা, সদ্য গোঁফ ওঠা হৃদয় বুঝি একটু লজ্জা পেলো কথাটা শুনে। 

—‘হ্যাঁ করি।’ 

—‘ফেমাস নাকি?’ 

—‘হুম। আমাদের কলেজেই পড়ত। গত বছর পাশ করে গেছে। 

অমৃতা চিন্তিত গলায় বলল, ‘এখন কী হবে? ওই গ্রুপে দুই দুইটা গাতক। আর আমরা গাতক শূন্য! 

—‘তুমি গাইতে পারো না? 

—‘পারি। কিন্তু সুর হয় নাতো!’ 

—‘সুর লাগবে না। গাইলেই হবে। সুরের ওপর কোনো নম্বর নাই। -’বলছে তোরে।’ 

—‘হ্যাঁ সত্যি।’ 

রুদ্র গাইছে আর্টসেলের ‘পথ চলা—। ড্রাম, গিটার, আর কীবোর্ডের বাজনার পিঠে চড়ে গানের সুর দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে গেলো মুহূর্তের মাঝে। ঢাকা পড়ে গেলো বাদ বাকি আনুষাঙ্গিক কোলাহল আর নরনারীর মৌখিক ফিসফাস। হৃদি আর সামি পরস্পরের হাত ধরে বসে আছে চুপচাপ। গান শুনছে মন দিয়ে। দুজনের চোখ মুখ এক আশ্চর্য খুশিতে উজালা! 

গানের শেষ হলো দন্তন্য দিয়ে। কনেপক্ষর সদস্যদের একটু নার্ভাস দেখাচ্ছিল। ওদের দলে কোনো অভিজ্ঞ গাতক নেই এ সত্য উপলব্ধি করার পর আত্মবিশ্বাস একদম শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। ওদিকে বরপক্ষের ছেলেমেয়েরা তখন চিৎকার করে কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিয়েছে। দশ থেকে শূন্য পর্যন্ত গোণা হবে। এর মাঝে নির্দিষ্ট অক্ষর দিয়ে গান গাইতে না পারলে অপর পক্ষ পেয়ে যাবে এক পয়েন্ট। সবশেষে যে দলের পয়েন্ট বেশি হবে সেই দলই বিজয়ী হবে। 

কনেপক্ষের ছেলেমেয়েরা সব উঠে দাঁড়িয়ে দলবদ্ধভাবে আলোচনা করছে। ওদিকে তখন সাত পর্যন্ত গোণা হয়ে গেছে। বেঁটেখাটো দেখতে একটি কমলা শাড়ি পরা মেয়ে হাত তুলল, ‘থামো থামো। গান পেয়ে গেছি আমরা। এখুনি গাইছি।’ 

বরপক্ষ ওর কথা খুব একটা পাত্তা দিলো না। আকাশ আর রুদ্রসহ দলের প্রত্যেকে সশব্দে গলা ফাটিয়ে কাউন্ট ডাউন করে যেতে লাগল। দর্শক সারিতে বসে থাকা কয়েকজন অতিথিও মহা উৎসাহে চ্যাঁচাচ্ছে। কমলা শাড়ির মেয়েটি ত্রস্ত পায়ে নেমে এলো মঞ্চ থেকে। কাউন্ট ডাউন থামল। চুপ করল জনতা। 

মেয়েটি মাইক হাতে নিয়ে গেয়ে উঠল, ‘নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে…’ গানের সুরের সাথে বাজতে থাকল বাজনা। মেয়েটি কিন্তু খারাপ গাইছে না। সুর, তাল সব ঠিক আছে। একদম পারফেক্ট যাকে বলে। বিভা আনন্দে নাচ শুরু করল। তার দেখাদেখি দলের অন্য ছেলেমেয়েরাও। বরপক্ষ তখন উচ্চস্বরে বুলি ছাড়তে শুরু করেছে, ‘ভুয়া! ভুয়া!’ 

ভুয়া বলতে শুনে অমৃতারা নাচের পাশাপাশি গানও গাইতে লাগল। গলা ছেড়ে, যেন গানের আওয়াজে ‘ভুয়া’ শব্দটা ঢাকা পড়ে যায়। অমৃতা হাত ছুঁড়ে, কোমর বাঁকিয়ে, হেলেদুলে নেচে যাচ্ছিল, মনের আনন্দে। 

‘ছল ছলাইয়া চলুক রে নাও, মাঝ দইরা দিয়া চলুক, মাঝ দইরা দিয়া।’

হঠাৎ চোখ আটকে গেলো নিচ্ছিদ্র গভীরতায়। এত মানুষের মিশমিশে কালো চুলো মাথার ভিড়ে, অসংখ্য উৎসুক জ্বলজ্বলে দৃষ্টির মাঝে, আচানক তার নজর গিয়ে পড়ল একজোড়া প্রগাঢ় চোখের তারায়! 

দ্বিতীয় সারিতে বসে আছেন লোকটা। চেয়ারের হাতলে কনুই ঠেস দিয়ে, চিবুকে হাত রেখে নির্নিমিখ চেয়ে আছেন তার দিকে। সারা দুনিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেও অমৃতার কিচ্ছু যায় আসে না। অডিয়েন্স তার কাছে নতুন কিছুই নয়। নাচ গান খুব কম করেছে এ কথা ঠিক কিন্তু স্কুল জীবনে নিয়মিত বিতর্ক করত সে। টিভিতেও গেছে কয়েকবার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে করেছে মুটকোর্ট। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজয়ী হয়ে ছিনিয়ে এনেছে পুরস্কার। কোর্টপাড়ায় পাকাপোক্ত, সাহসী বক্তা হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। ঠোঁটকাটা হিসেবে দুর্নামের ঝুলিটাও অত হালকা নয়। অথচ আজ ওই লোকটাকে ওরকম অনিমেষ চেয়ে থাকতে দেখে সেই সাহসী মেয়েটা হঠাৎ কেমন কুঁকড়ে গেলো নিজের অজান্তেই। দৃষ্টিটা কলিজায় এসে লাগল যেন। মুহূর্তে হাত গুটিয়ে নিল সে। পা হয়ে গেলো নিশ্চল। এক অপ্রতিরোধ্য লজ্জায় ছেয়ে গেলো মুখ। ইশ! মানুষটা তাকে নাচতে দেখে ফেলল। না জানি কেমন সং এর মতো দেখাচ্ছিল তাকে! 

অমৃতার মুখের আকস্মিক লালিমাটুকু বুঝি তিনি লক্ষ্য করলেন। তার ঠোঁটের প্রান্তিক কোণে ঝিলিক দিল একটি চোখা হাসি। বেচারী মেয়েটাকে আর বিব্রত না করে চোখ সরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। নিলেই কী? অমৃতার পা আর তখন মাটিতে নেই। পাখনা ছাড়াই উড়ে গেছে সে আকাশে। রাশি রাশি শিউলি ফুলের শুভ্র ঘ্রাণে সয়লাব হয়ে গেছে স্থল, জল আর অন্তরীক্ষ! লোকটা তাকেই দেখছিল কি? হ্যাঁ দেখছিল তো! কী অখণ্ড মনোযোগে দেখছিল! 

গান শেষ হয়েছে। অপর দলকে গাইতে হবে ‘আ’ দিয়ে। প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে সবাই ‘নয়, আট, সাত!’ 

আকাশ নেমে এলো মঞ্চ থেকে। বিভা খোঁচা মারতে ভুলল না, ‘আকাশ গাইবে গান? গান হবে নাকি কবিতা?’ 

হৃদি চাপা ধমক দিয়ে উঠল, ‘আহ, চুপ কর। বেচারা সাহস করে গাইতে চাচ্ছে, এটাই তো বেশি।’ 

হৃদয় সতর্ক গলায় দলের লোকদের বলল, ‘এই মনে রেখো, আমরাও কিন্তু ভুয়া বলে চেঁচাবো।’ 

বিভা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে বলল, ‘অবশ্যই!’ ওদের ভাব দেখে মনে হলো আকাশ গান শুরু করার আগেই ভুয়া বলে চেঁচানো শুরু করবে। আকাশ জীবনে কখনই গানটান করেনি। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে এত লোকের সামনে এই প্রথম তার গান গাওয়া। ভ্রু কুঁচকে সামনে বসে থাকা অতিথিদের একবার দেখল সে। অনেকগুলো মুখ একত্রে মিশে হিজিবিজি হয়ে আছে। কে কোনজন তা সঠিকভাবে বোঝা যায় না। বোঝার প্রয়োজনও বোধ করল না সে। চোখ বন্ধ করে গাওয়া শুরু করল, 

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ 

খিলখিল করে টিটকিরির হাসি শুরু করল কনেপক্ষর ছেলেমেয়েরা। 

—‘আর গান খুঁজে পেলো না? জাতীয় সংগীত? বিয়েতে কেউ সোনার বাংলা গায়? সিরিয়াসলি? এই অবস্থা?’ অল্প বয়সী দুজন ছেলে বলে উঠল, আগপিছ কিছু চিন্তা না করেই। 

অমৃতা দেখল তার পছন্দের মানুষটা হাস্যরত ছেলেমেয়েগুলোর দিকে একটি কঠোর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন নিঃশব্দে। দাঁড়ানোর কারণটা বুঝি অমৃতা ছাড়া অন্য কেউই ধরতে পারল না। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। 

—‘এই উঠে দাঁড়া। জাতীয় সংগীত হচ্ছে।’ অমৃতা বলল বরকনেকে উদ্দেশ্য করে। 

সামি এতক্ষণে খেয়াল করল, দর্শক সারিতে ওই তো দাঁড়িয়ে আছেন তার বাবা। জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে অথচ সে এখনো উঠে দাঁড়ায়নি বলে বাবা নিশ্চয়ই মনে মনে খুব রাগ করছেন। বুঝতে পেরে চট করে উঠে দাঁড়ালো সে। সাথে হৃদিও। বিয়ের পাত্র পাত্রীকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বুঝি সবার মাথায় ঢুকল ব্যাপারখানা। কিছুক্ষণের মাঝেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো হল সুদ্ধ সমস্ত লোক। 

আকাশের সাথে গলা মিলিয়ে ধীরে ধীরে সকলেই গাওয়া শুরু করল।

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো 
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে। 
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো, 
মরি হায়, হায় রে 
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥ 

আহা, চারপাশটা কেমন মাটি মাটি গন্ধে আর মায়া মায়া পরশে নিমেষে আন্দোলিত হয়ে উঠল। মাটি আর মায়া এই দুইয়ে যেন জনম জনমের ভালোবাসা। একটির সাথে আরেকটির রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক! 

গানের শেষ হলো ‘স’ অক্ষরে এসে। এবার কনেপক্ষের হয়ে হৃদির ছোটভাই গাইলো, ‘সোহাগ চাঁদ বদনি ধ্বনি নাচতো দেখি।’ 

গানের তালে তালে নাচতে লাগল ছেলেমেয়েরা। দর্শক সারিতে বসে থাকা বেশ কিছু লোকজনও উঠে গেলো নাচতে। শুধু অমৃতা আর নাচলো না। হৃদির পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল সে। স্বরে আ অক্ষরটি ঘুরেফিরে বেশ কয়েকবার পড়ল। দ্বিতীয় বার বরপক্ষ গাইল, ‘আরে টিকাটুলির মোড়ে একটা অভিসার সিনেমা হল রয়েছে, হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে।’ এই গানের সাথে নাচটাও জমে একদম ক্ষীর হয়ে গেলো। 

তৃতীয় বার স্বরে আ নিয়ে কনেপক্ষ বিপদে পড়ে গেলো। বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষার গান তো গাওয়া যাবে না। বিভার এই মুহূর্তে আ দিয়ে সব ইংরেজি আর হিন্দি গান মাথায় আসছে। রুদ্র আর আকাশের দল আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে সংখ্যা গুণে চলেছে। এদিকে কারো মাথায় কিচ্ছু আসছে না। মগজ যেন ঝিম ধরে গেছে। 

হঠাৎ অমৃতা হাত তুলল, ‘আমি গাইব!’ 

গণনা বন্ধ করে আকাশ ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘তুই গাইবি? গান? ইজ ইট ফর রিয়েল? 

অমৃতা চোখ বন্ধ করে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করল যেন, ‘হ্যাঁ গাইবো, গিভ মি আ সেক!’ 

—‘সেক্স?’ ফাজলামো করার সুযোগ হাতছাড়া করল না রুদ্র। আগুন চোখে তাকালো অমৃতা, ‘সেক… মানে সেকেন্ড!’ 

রুদ্র ফিচেল হেসে নিচুস্বরে বলল, ‘তাই বল, আমি ভাবলাম… তুই আবার আমার কাছে এইসব কী চাইতেছিস? তওবা তওবা! মানে সবার সামনে? ক্যামনে কী? ‘ 

রুদ্রর দিকে কঠোর দৃষ্টিটা তাক করে রেখেই অমৃতা মঞ্চ থেকে নেমে আসলো। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে গাওয়া শুরু করল গান। তার সুরে বেশ কমতি আছে কিন্তু আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক সেই অল্পবিস্তর ত্রুটির ওপর অনায়াসে প্রলেপ এঁকে দিচ্ছে। 

‘আমারও পরানও যাহা চায় 
তুমি তাই, তুমি তাই গো 
আমি তোমারে পেয়েছি 
হৃদয়মাঝে 
আর কিছু নাহি চাই গো 
আমি তোমার বিরহে রহিব 
বিলীন 
তোমাতে করিব বাস 
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনি, 
দীর্ঘ বরষ-মাস” 

আবারও ‘স’ তে এসেই থামল। বরপক্ষ গেলো ফেঁসে। এবার আর ‘স’ দিয়ে গান কারো মাথায় আসে না! বিভা আর অমৃতা নাচতে নাচতে কাউন্ট ডাউন করতে লাগল। 

‘পাঁচ… তা ধিন তা ধিন… চার… তা ধিন তা ধিন… তিন’ 

রুদ্রর মুখ শুকিয়ে গেছে। আকাশ চোখ বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে গান স্মরণ করার চেষ্টা করছে। কনেপক্ষের ছেলেমেয়েরা এর মাঝেই হইচই শুরু করে দিয়েছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন জিতেই গেছে তারা। আট পর্যন্ত গোণা হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় বরপক্ষের দুজন ছেলে ধুপধাপ শব্দ তুলে উঠে আসলো মঞ্চে 

—‘পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি! জুতা পেয়ে গেছি! আর গেইম খেলতে হবে না।’ উচ্চস্বরে কথাগুলো উচ্চারণ করে উপস্থিত জনতাকে তথ্যটা জানালো তারা। 

‘হবে না, হবে না! এটাতো চিটিং!’ 

প্রতিবাদ করে উঠল কনেপক্ষ। রুদ্র আর আকাশ তড়িঘড়ি করে জুতোজোড়া হাতে তুলে নিল। এখন তাদের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি! দুই বান্ধবী অগ্নিময়ী রূপ ধারণ করে তেড়ে গেলো ওদের দিকে। 

–‘চিটারের বাচ্চা চিটার!’ দাঁতে দাঁত ঘষে বলল বিভা। 

আকাশ তখন বরের পায়ে জুতো জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে যত্ন সহকারে। অমৃতা ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গেলো। এক ঝটকায় টেনে নিতে গেলো জুতোর পাটি আকাশের হাত থেকে। আকাশও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই জুতোজোড়া হাতছাড়া করবে না সে। অতএব একটা টানাহ্যাঁচড়া পড়ে গেলো দুজনের মধ্যে। হৃদি আর সামি এইসব দৃশ্য দেখে কেঁপে কেঁপে হাসতে লাগল। খুব মজা পাচ্ছে তারা। একেবারে নিখাদ বিনোদন যাকে বলে। 

বিভা ফোঁসফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগল, ‘এত বড় বেঈমানী! হ্যাঁ? এত বড় বেঈমানী?’ 

‘এরকম বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো ডায়লগ দিচ্ছিস ক্যান? প্রব্লেম কী?’ রুদ্রর উদাস প্রশ্ন। 

বিভা কোমরে হাত রেখে ঝেঁঝে উঠে বলল, ‘চুপ থাক! চোরের মার বড় গলা।’ 

—‘চোর তো তোরা। চুরি তো তোরা করছিস। আমরা শুধু উদ্ধার করছি!’ 

বিভা আরো দু পা এগিয়ে আসলো, আঙুল উঁচিয়ে বলল, ‘তাহলে আমাদের দিয়ে গান গাওয়াইছিস ক্যান? ওই লুনুষের বাচ্চা লুনুষ! আমাদের গান কি এত সস্তা?’ 

—‘আহা যা গান! এত দামি গান! আল্লাহ! কত কুটি টাকা তোমাদের গানের দাম? শুনি?’ 

রুদ্রর বহু মুদ্রা ধারী কার্টুন মুখটার দিকে চেয়ে থেকে বিভার রাগ আরো সপ্তমে চড়ল। সে ওর বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে সীমাহীন অধৈর্য গলায় বলল, ‘জুতার টাকা দে কুত্তার বাচ্চা!’ 

—‘কিছুতেই দিব না! মরে গেলেও দিব না!’

—‘দে বলতেছি!’ 

—‘দিব না! দিব না! এক আনাও দিব না!’ 

মঞ্চের ওপর ভালোই হাঙ্গামা বেঁধে গেলো। দুইপক্ষের ছেলেমেয়েরা পরস্পরের সাথে লিপ্ত হয়ে গেলো ঝগড়ায়। সকলে গলা তুলে চ্যাঁচাচ্ছে। একে অন্যকে গাল দিচ্ছে। বর বৌ দাঁড়িয়ে গেছে তখন। ঝগড়ার নিষ্পত্তি করার জন্য তারা ব্যাকুল। কিন্তু লাভ কিছুই হচ্ছে না। হৃদির মেজোমামা আর ছোট চাচা উঠে এসেছেন মঞ্চে। বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে তারাও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। মঞ্চটা বেশ বড়সড় হওয়াতে এতগুলো মানুষ অনায়াসে এঁটে গেছে। 

ওদিকে অমৃতা তখন রাগের চোটে আকাশের টুটি চেপে ধরেছে। আকাশও কম যায় না। অমৃতার চুল ধরে সমানে টানতে লাগল সে। রুদ্রর হাতে চলে গেছে তখন জুতোর দখল। হক সাহেব স্টেজের সামনে এসে দৃশ্যটা দেখে একেবারে থ বনে গেলেন। 

—‘কী হচ্ছে এসব?’ 

বাঁজখাই স্বরের প্রশ্নটা একরোখা, উদ্ধত, ঝগড়ারত ছেলেমেয়েগুলোকে মুহূর্তের জন্য স্থিরচিত্রে রূপান্তরিত করল। সবাই এক নজর তাকালেন তাঁর দিকে। সামির পরিবারের সবাই এই লোকটাকে যমের মতো ভয় পায়। অতএব এঁর উপস্থিতিতে বরপক্ষের সদস্যদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটা ধীরস্থির ভাব নেমে এলো। বরপক্ষকে থেমে যেতে দেখে কনেপক্ষও একটু শিথিল হয়ে আসলো। হইচই কমে গেলো অনেকখানি। অমৃতার হাত আকাশের গলা থেকে উঠে এসেছে তখন। আকাশ অমৃতার কাঁধে সজোরে একটা ধাক্কা মেরে বলল, ‘যা ভাগ! আমার সাথে লাগতে আসিস না!’ 

হক সাহেব হিমায়িত চোখে দেখলেন ঘটনাটা। নিদারুণ কঠোর গলায় বললেন, ‘একটা মেয়েকে তুমি এভাবে আঘাত করতে পারো না।’ 

আকাশের শ্যামলা গায়ের রঙে হঠাৎ একটা আগুন রঙের আঁচ এসে উপস্থিত হলো। চোখে ধক করে উঠল তেজ। তীব্র কণ্ঠে বলল, ‘আমার ফ্রেন্ডের সাথে আমি কী করব না করব সেটা নিয়ে কথা বলার আপনি কেউ না!’ 

লোকটার গাম্ভীর্যে অটল মুখখানা অপমানে থমথম করে উঠল ছেলেটির স্পর্ধা দেখে অবাক না হয়ে পারলেন না তিনি। এরকম উদ্ধত ভঙ্গিতে আজকাল তার সাথে কেউ কথা বলে না। মন থেকে পছন্দ না করলেও মুখে হুজুর হুজুর করে। সামি আকাশের কথা বলার ভঙ্গিটা লক্ষ্য করছিল। এতটা রেগে যাবার মতো কোনো ঘটনা কি ঘটেছে? বাড়ির বড়রা তো এসব উপদেশ দিয়েই থাকে সচরাচর। তার বাবার জায়গায় অন্য কারো বাবা হলেও একই কাজই করতেন। আকাশের কি এটা বোঝা উচিত না?’ 

—‘আমার সামনে যদি কোনো অন্যায় ঘটে থাকে, তবে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ আমাকে করতেই হবে।’ 

আকাশ শ্লেষের হাসি হাসল, ‘লিসেন, অমৃতা আমার ফ্রেন্ড! আমি ওর সাথে যা ইচ্ছা করতে পারি। কারো কিছু বলার নাই এখানে! 

—‘না, তুমি যা ইচ্ছে তা করতে পার না।’ বলিষ্ঠ কণ্ঠে দৃঢ় মতামত জানালেন তিনি। 

—‘আপনি কে বলার?’ 

অমৃতা একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিল। স্তব্ধ হয়ে শুনছিল সে দুজনের কথোপকথন। অন্যরা সবাই নীরব দর্শক। কারো মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ করেই পরিবেশটা একটু থমথমে হয়ে উঠেছে। বাতাস হয়ে গেছে গুমোট। রুদ্র জুতোজোড়া হাতে নিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হক আকাশের প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। রুদ্রর হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সমস্যা কী হয়েছে?’ 

ততক্ষণে রোমেলাও হাজির হয়েছেন দৃশ্যপটে। 

—‘এখানে কী হচ্ছে? জামাই বৌয়ের স্টেজে এত ভিড় কেন? যাও যাও সবাই নামো এখান থেকে।’ এমনই সব ভারি ভারি উপদেশবাণী ছাড়তে লাগলেন তিনি উপস্থিত হওয়া মাত্র। ছেলেমেয়েরা গুটিগুটি পায়ে স্টেজ থেকে নামতে লাগল। 

ঘটনা খুলে বলল রুদ্র। শুনেটুনে হক গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এত সামান্য বিষয় নিয়ে এমন হাঙ্গামা করা কি ঠিক হলো? তোমাদের কোনো কমন সেন্স নেই? ডিসেন্সি বলে তো একটা ব্যাপার আছে নাকি? এখানে এত এত গুরুজনরা উপস্থিত রয়েছেন। এদের সামনে এই চরম অভদ্রতাটা তোমরা করতে পারলে?’ 

আকাশ তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিল তাকে। তিনি টের পাচ্ছিলেন। টের পেয়েও ওর তীক্ষ্ণ নজরটা হজম করে রুদ্রকে বললেন, ‘জুতো ফেরত দিয়ে দাও। আমার ছেলে কি খালি পায়ে বাড়ি ফিরবে নাকি?’ 

রুদ্র তাৎক্ষণিকভাবে জুতোজোড়া সামির পায়ে পরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। হক সাহেব বিভাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কত টাকা চাও?’ বিভা জিজ্ঞাসু নেত্রে অমৃতার দিকে চাইলো। অমৃতা মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে প্রশ্নটা তো তাকে করা হয়নি। সে কেন উত্তর দেবে? বাহ্, তার সাথে কথা বলা যেন নিষিদ্ধ। তা বিভাকে যেহেতু প্রশ্নটা করা হলো, বিভাই উত্তর দিক! 

কথা বলল হৃদয়, ‘আংকেল, পঞ্চাশ হাজার!’ 

—‘ঠিক আছে। টাকা তোমরা পেয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি।’ 

বলা শেষ করে তিনি অমৃতার দিকে একবার তাকালেন। আকাশ ওর চুল টেনেটুনে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। শাড়ির আঁচলও গেছে কুঁচকে। অমৃতা তার ওই দৃষ্টি দেখে নিজের ভূতগ্রস্ত অবস্থাটা একটু উপলব্ধি করতে পারল বোধহয়। বিব্রতভাবে হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে লাগল। তিনি চোখ সরিয়ে নিয়ে জায়গাটা থেকে সরে পড়লেন। রুদ্র পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তড়িঘড়ি করে একটা গান ধরল। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই একটু আগের বিরোধটা ভুলে যেতে সক্ষম হলো। বিয়েবাড়ি আবার মেতে উঠল গানে, সুরে আর নৃত্যে। 

আকাশ দর্শক সারিতে গিয়ে বসেছিল। শেষের দিকের একটা চেয়ারে। অমৃতা পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল ওর পাশে। কাঁধে হাত রেখে বলল, 

—‘দোস্ত, তুই ঠিক আছিস?’ 

—‘ঠিক আছি।’ 

—‘মন খারাপ?’ 

—’না।’ 

অমৃতা পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘তাহলে মুখটাকে এরকম করে রাখছিস কেন?’ 

আকাশ ঘুরে তাকালো, ‘তোর জন্য তো অনেক দরদ দেখলাম।’ 

—‘কার কথা বলছিস?’ 

—‘কার কথা আবার? তোর হিরোর কথা বলতেছি।’ 

অমৃতা হাসে, ‘আরে নাহ, দরদটরদ কিচ্ছু না। আমার জায়গায় বিভা কিংবা হৃদি হলেও উনি একই কাজই করতেন। তুই হঠাৎ এত রেগে গেলি কেন?’ 

—‘ওয়েল, আমি আমার ফ্রেন্ডের সাথে কী করব, তাকে মারব, কাটব নাকি খুন করব এটা নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারবে না।’ 

অমৃতা আকাশের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আচ্ছা থাক দোস্ত। রাগ করিস না। বড়রা একটু এরকম বলেই। ভুলে যা! কেমন?’ 

৫৩

ঢাকা শহরের কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে খুব রাত অবধি থাকা যায় না আজকাল। একটু তাড়াতাড়িই অনুষ্ঠানের ইতি টানতে হয়। এই বিয়েতে ও শেষতক একটু তাড়াহুড়া করা লাগল। বর-কনের খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে বেজে গেলো সাড়ে এগারোটা। বারোটা বাজার আগেই ক্লাব ছাড়তে হবে। অতএব এবার বিদায় ঘণ্টা না বাজালেই নয়। 

ভিড় নেই খুব একটা। অতিথিরা অনেকেই এর মাঝে প্রস্থান করেছেন। এখন যারা আছেন তারা দুই পক্ষের একেবারেই নিকট আত্মীয়। মঞ্চে উঠে বসেছেন পাত্রপাত্রীর বাবা, মা, এবং কয়েকজন বয়স্ক স্বজন। গানের দল টানা দু ঘণ্টা গান গেয়েছে। নাচানাচিও হয়েছে ঢের। এখন শিল্পী এবং বাদ্য বাদকের দল খেতে বসেছে। অনেকক্ষণ যাবৎ লাগাতার হইচইয়ের পর চারপাশ এখন অনেকটা শান্ত। এরকম শান্ত পরিবেশেই সম্পন্ন হলো রুসমতের পালা। লম্বা চওড়া লাল রঙের ওড়না দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো জামাই বউয়ের মুখ। কালো কাঠের ফ্রেম বাঁধানো গোল ঝকঝকে, স্বচ্ছ আয়নায় শুভদৃষ্টি বিনিময় হলো নব দম্পতির। সবাই উৎসাহী হয়ে বরকে প্রশ্ন করলো, ‘কী দেখলে আয়নায়? চাঁদ দেখতে পেলে কি?’ 

সামি আয়নার কাচে পড়ে থাকা হৃদির মায়াবী মুখের প্রতিবিম্বটার দিকে কিছুক্ষণ নিগূঢ় চোখে চেয়ে থেকে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘চাঁদ নয় চাঁদের চাইতেও সুন্দর একটা মুখ দেখতে পেলাম! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুখ!’ 

হৃদি চমকে উঠে আয়নার ভেতর দিয়ে সামির চোখের ওপর পূর্ণ দৃষ্টি রাখল। ও কি সত্য বলছে? কে জানে! সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন, কথাটা শুনতে পেয়ে এক অনির্বচনীয়, আশ্চর্য ভালো লাগায় রমরম করে উঠল সারাটা মন। খুশির ঝংকারে আপনাআপনি প্রসারিত হয়ে উঠল ঠোঁটের দুই প্রান্ত। ততক্ষণে সামির স্তুতিবাক্য শুনে বন্ধুরা সব হইচই আরম্ভ করে দিয়েছে। সামির খালা পাশ থেকে আংটির ছোট্ট একটি বাক্স এগিয়ে দিয়েছে তার দিকে। সামি বাক্স খুলে আংটি বের করল। ধীরস্থিরভাবে পরিয়ে দিল হৃদির আঙুলে। হৃদি হাতে পরা আংটিটা চোখের সামনে তুলে ধরে ভালো মতো দেখল একবার। এই সেই আংটি, যেটা সামি ডুয়ার্সের সন্ধ্যাবেলায় বিভাকে পরাতে গিয়ে ভুল করে হৃদির আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিল। অনেক কষ্টে সেদিন আংটিটা নিজের আঙুল থেকে খুলতে পেরেছিল সে। কে জানত সেই জিনিস দুদিন পর ঘুরে ফিরে প্রকৃত মালিকের কাছে পুনরায় এসে ভিড়বে! 

রুসমতের পর কন্যা সম্প্রদানের পালা। এবার বন্ধুরা নিচে নেমে আসলো। দাঁড়ালো মঞ্চের সামনে দল বেঁধে। এতক্ষণ ধরে আতশবাজির মতো জ্বলতে থাকা আনন্দের জোয়ারে হঠাৎ একটু ভাটার টান লাগল তখন, যখন হৃদির আম্মা স্টেজে বসে থেকে মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন আচমকা। হৃদি ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিল না নিজের অন্তর্দেশের হালচাল। কেমন একটা অবশ অবশ অনুভূতি হচ্ছিল তার। হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ এই সমস্ত স্থূল অনুভূতিকে পাশ কাটিয়ে দিয়ে সমস্ত বুক ভরে আছে এক গুমোট গাম্ভীর্যে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাত পা কাঁপছে প্রবলভাবে। অবাক ব্যাপার হলো মায়ের কান্না দেখে ছিঁচকাঁদুনে হৃদির আজ মোটেও কান্না পাচ্ছে না, বরং একটা কেমন গা ছমছমে ভয় হচ্ছে। ভয়?… হ্যাঁ, এই মাত্র, এই এত লোকের মাঝে নতমুখে, আড়ষ্ট ভাবে জবুথবু হয়ে বসে থেকে, সে তার জ্ঞানেন্দ্রিয় দিয়ে সম্যকরূপে উপলব্ধি করল, যে অনুভূতিটি এই মুহূর্তে তার সমস্ত চেতনাকে বিলুপ্তপ্রায় করে দিচ্ছে সে অনুভূতিটির নাম আসলে ভয়! অথচ আজ কি তার ভয় পাবার দিন? না তো! তপ্ত গ্রীষ্মের খর রোদ্দুর ডিঙিয়ে আজ অনেক দিন পর এক ঝলক ফাগুন হাওয়া এসে উঁকি দেবার কথা ছিল তার ছাব্বিশ বছরের ঘটনাবিহীন, নিস্তরঙ্গ জীবনটায়। আজ তার সমৃদ্ধির দিন, প্রাপ্তির দিন, স্বপ্ন পূরণের দিন! আরো সোজা করে বলতে গেলে মিলনের দিন। মনের মানুষের সাথে মিলন! সে কি যার তার ভাগ্যে জোটে? চোখের সামনে আলোর জোয়ার। ভিডিও ক্যামেরা তার দিকেই তাক করা। ঝিকিমিকি আলোর সরল অথচ প্রবল আঘাতে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না সে। আশেপাশে হরেক মানুষের চাপা ফিসফাস, গুঞ্জন… শব্দ… এত শব্দ যে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। সামির পাশে তার বাবা মা বসে আছেন। ক্যামেরার লাইটটা সীমাহীন বিরক্তির উদ্রেক করছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে তার বন্ধুদের দল। কিছু একটা নিয়ে হো হো করে ডাকাতের মতো হাসছে চারমূর্তি। হৃদির আম্মা উচ্চস্বরে কান্না করছেন। সত্য বলতে কী, সামির বেশ নার্ভাস লাগছিল সেই মুহূর্তে। তার তো কোনো বোন নেই, তাই মেয়ে বিয়ে দেবার কষ্টের স্বরূপ সম্পর্কে সে পরিপূর্ণভাবে অজ্ঞাত। অজ্ঞাত হলেও হৃদির আম্মার কান্না দেখে তার কেমন কষ্ট কষ্ট লাগছে। হৃদিও নিশ্চয়ই কাঁদছে এখন। বাবা মা আর এত লোকের সামনে মাত্র বিয়ে করা বৌয়ের মুখের দিকে সে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না লজ্জায়। কিন্তু একটা বার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে নিজের বৌটাকে। হৃ… দি… তা! এত দিনের পুরোনো বন্ধুটা আজ থেকে তার সহধর্মিণী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষটা তার। শুধুই তার! প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাবার মতো অলৌকিক সুন্দর অনুভূতি বুঝি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। 

হৃদির বাবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। এই শেষ মুহূর্তে এসে বারেবারে মনে হচ্ছে তাড়াহুড়া হয়ে গেলো। বড্ড তাড়াহুড়া! আর কটা দিন পরে মেয়েটাকে বিয়ে দিলে কী হতো? কেন যে সমাজের আর দশজন মানুষের কথা শুনে তিনি উঠেপড়ে লাগলেন মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য! মেয়েটার কোনো শখ আহ্লাদ ঠিকমতো মেটাতে পারেননি। কৃচ্ছতা সাধন করেই তার দিন গেছে। এখন স্বামীর ঘরে মেয়েটা পর্যাপ্ত আদর যত্ন পেলেই হয়। কিন্তু এই বিষয়ে তার মনের মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধে আছে কয়েকদিন ধরে। হৃদির শ্বশুর শাশুড়ির কোনো কন্যা সন্তান নেই। যে বাড়িতে কন্যা নেই, সেই বাড়ির লোকেরা কন্যা সন্তানের যথাযথ মূল্য দিতে পারবে কি? কন্যা সম্প্রদানের সময় চলে আসলো। জামাইয়ের হাতে নিজ কন্যার হাত তুলে দিয়ে কন্যাদায় মুক্ত হলেন ভীত, চিন্তিত, আবেগমথিত কন্যার পিতা। ঠিক সেই মুহূর্তে হৃদির বুকে এতক্ষণ ধরে থমকে থাকা হিমায়িত কান্নার ডেলাটায় প্রখর অগ্নি উত্তাপের হলকা লাগল যেন! জমে থাকা বরফ শীতল অশ্রু পুঞ্জে উত্তাপ লাগামাত্র ঊর্ধ্বমুখি হয়ে প্লাবনের মতো উপচে পড়ল জল চোখের কার্ণিশে। 

তার নিজের… ভীষণ নিজের… কৃপণ, আলাভোলা, বদরাগি, প্রাচীনপন্থী বাবাটা! আহা সাইকেল চালাতে পারতো না হৃদি… বাবা হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন। বয়স কত তখন? নয় কি দশ! অংকে কী ভীষণ কাঁচা! বাবাই জীবনের প্রথম শিক্ষক! অংকের হাতে খড়ি বাবার কাছেই। একটা অংক পারলেই একটা লজেন্স। হ্যাঁ কৃপণ বাবাটাও তখন লজেন্স দিত সঠিক অংকের বিনিময়ে! একবার স্টাডি ট্যুরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি বলে বাবার ওপর রাগ করে সারাদিন সারারাত কিচ্ছু খেলো না হৃদি। পরদিন মায়ের কাছ থেকে জানতে পারল বাবাও এই একটা দিন না খেয়েই ছিলেন। আরো কত কত কত স্মৃতি! কয়টা মনে করবে হৃদি এই মুহূর্তে? তার সেই নিজের আপন বাবাটা আজকে অন্যের হাতে তাকে হাত তুলে দিয়ে দায় মুক্ত হয়ে গেলো। কত্ত সহজে! এভাবেই যদি পর করে দিতে হয়, তবে জন্মটাই বা দেবার কী দরকার ছিল? মা আজ থেকে সঙ্গীহীন হয়ে যাবে। আজকের পর থেকে গভীর রাতে মন খারাপ হলে হৃদি দৌড়ে গিয়ে মায়ের আঁচলের তলায় লুকোতে পারবে না। মুখ গোমড়া দেখলে মায়ের মতো কেউ কানের কাছে এসে সর্বক্ষণ মাছির মতো, কী হয়েছে? কী হয়েছে বলে ভনভন করবে না। আজকের পর থেকে বাবা মায়ের বাড়িতে সে অতিথি হয়ে যাবে। যে আবাসস্থলটিকে নিজের বাড়ি বলে জানত এতদিন, সেই স্থানটি হঠাৎ এক আশ্চর্য জাদুবলে হয়ে যাবে বাবার বাড়ি। আজকের পর থেকে কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। আজকের পর থেকে হৃদির দুটা বাড়ি থাকবে। একটা বাবার বাড়ি, আরেকটা শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু তার নিজের কোনো বাড়ি থাকবে না। এবার তার কান্না বাঁধন ছিঁড়ে ফেলল। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগল সে। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। কাঁদছে তার মা, বাবা, ছোট ভাই এবং খালাত, চাচাতো বোনেরা। সামির চোখ দুটোও হালকা লালচে দেখাচ্ছে। ভীষণ বিব্ৰত সে। 

রুদ্রর মুখ কাঁদো কাঁদো। তার নিজের বড় বোনের বিয়ের দিনটার কথা মনে পড়ছে। অনেক কষ্টে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ক্যাটস আই চোখ দুটোর পর্দা বরাবর অশ্রুজল আটকে রেখেছে সে। কোনোমতেই এই জলকে সীমানা অতিক্রম করতে দেওয়া যাবে না। বন্ধুদের সামনে হাসির পাত্র হতে চায় না সে। বিভা কাঁদতে কাঁদতে অমৃতার কাঁধের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে গেলো একবার। অমৃতা হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘প্লিজ, এইসব ঢং করবি না আমার সাথে। আরে বিয়েই তো হচ্ছে। মরে যাচ্ছে না তো! প্রতিদিন একবার করে বাবার বাড়ি আসতে পারবে।’ 

বিভা অমৃতার প্রত্যাখ্যান মুখ বুজে সহ্য করে আকাশের কাছে গেলো। আকাশ চোখা গলায় বলল, ‘ঢং বন্ধ কর। তোর বিয়া নাকি? তুই কাদঁতেছিস ক্যান?’ রুদ্র এগিয়ে এসে বিভার কাঁধে একটা হাত রাখল। বিভা এতক্ষণে আস্থার জায়গা পেলো যেন। রুদ্রর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল উচ্চস্বরে। মনে হলো যেন এইমাত্র তার অতি আপনজন গত হয়েছে। 

আকাশ চকচকে চোখ নিয়ে হৃদির ভাইকে দেখছিল। স্টেজের সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হৃদয় হাউমাউ করে ‘আপুনি! আপুনি!’ বলে কাঁদছে। যেন আপুনিকে কোন গুণ্ডা কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে। ওর দিকে চেয়ে থেকে আকাশের ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসি ঝিলিক দিচ্ছিল থেকে থেকে। আর না পেরে অমৃতাকে বলেই ফেলল সে, ‘দ্যাখ না, সিনেমাটা দ্যাখ।’ 

—‘ঐদিকে দ্যাখ। আসল সিনেমা ওইখানে!’ অনেক কষ্টে হাসি সামলে বলল অমৃতা। আকাশ দেখল হৃদির এক খালাতো বোন মেঝেতে বসে পড়ে বিলাপ করছে। মনে হচ্ছে এখুনি সে হুঁশ হারাবে। 

—‘আরে আমাদের জামাই বাবাজিই তো মনে হচ্ছে কাইন্দা দিবে আরেকটু হইলেই। দ্যাখ না, লাল হয়ে গেছে চোখ।’ বলল আকাশ, সামিকে ইঙ্গিত করে। তারপর হঠাৎ সুর পাল্টে বলল, ‘তোর বিয়ের সময় তুই কাদবি? 

অমৃতা গলায় একগাদা তাচ্ছিল্য টেনে আনলো, ‘ধুর, আমার বিয়াই হবে না কখনো।’ 

—‘যদি হয়? ধর হয়ে গেলো একদিন হুট করে। সেদিন তুই কাদঁবি?’

অমৃতা চোখ সরু করে ভাবলো খানিকক্ষণ। ঠোঁট উল্টে বলল, ‘না কাঁদব না। বিয়ে হওয়া আর বিয়ে করার মাঝে তফাৎ আছে জানিস তো?’ 

আকাশ চুপ করে গেলো। অমৃতা এবার অপেক্ষাকৃত ক্ষীণতর গলায় বলল, ‘বিয়েশাদি আমার ভাগ্যে নাই। সবাই হৃদির মতো লাকি না।’ 

—‘হৃদি তো প্রথমে রবিনকে ভালোবেসেছিল। এরপর সামিকে। তুই কি পারবি না দ্বিতীয়বার ভালোবাসতে?’ খুব সাবধানে প্রশ্ন করে আকাশ। 

—‘হাতের পাঁচটা আঙুল সমান হয় নারে। বিভা আর হৃদি যা পারছে, আমি তা কোনোদিনই পারব না। এ জন্যেই বললাম, আমার ভাগ্যটা ওদের মতো ভালো না।’ 

আকাশ আড়চোখে তাকায় অমৃতার দিকে। এমন অসাধারণ সুন্দর একটা মেয়ের ভাগ্য কেন খারাপ হবে? বিধাতা কখনোই এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন না। একটা বড় নিশ্বাস পিছলে পড়ল ওর বুক চিরে। ভাগ্য ভালো হোক আর খারাপ, অমৃতাকে তো ভালো থাকতেই হবে। আকাশ নিজের শরীরের সব রক্ত বিক্রি করে হলেও, পৃথিবীর সব সুখ কিনে এনে দেবে এই মেয়েটির পায়ের নিচে! 

হৃদি শ্বশুর শাশুড়ি এবং নিজের বাবা মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। সামিও পা ছুঁয়ে সালাম করল বাবা, মা, শ্বশুর শাশুড়িকে। এরপর কান্নারত হৃদিকে অনেক কষ্টে ধরে ধরে কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে নিয়ে আসা হলো। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বাতাস ক্ষ্যাপা। বৃষ্টি নামবে যে কোনো মুহূর্তে। গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল লাল আর সাদা রঙের কাঁচা গোলাপ দিয়ে সজ্জিত সামির লাল মার্সিডিজ বেঞ্চ। সামি নিজেই গাড়ি চালাবে। বর বৌ উঠে বসার পর চার বন্ধু উঠল পেছনের সিটে। তারপর মধ্যরাতের ছিমছাম রাজপথে সামির লাল মার্সিডিজ বেঞ্চ যাত্রা শুরু করল বাড়ির পথে, নতুন বৌ সঙ্গে নিয়ে। রাত সাড়ে বারোটায় সামিদের উত্তরার প্রাসাদতুল্য বাড়ির সামনে এসে পৌঁছুলো গাড়িটা। তিন চার রকমের লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়ির গেট, বিল্ডিং, গাছগাছালির মাথা। আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। 

৫৪

দেখা হয়ে গেলো দৈবাৎ। রাশেদ বেডরুম থেকে বেরোচ্ছেন। অমৃতা যাচ্ছিল সামির ঘরে, ওর মোবাইলের চার্জার আনতে। সব লোকজন জড়ো হয়েছে নিচতলার ড্রয়িংরুমে। নতুন বৌকে মিষ্টি মুখ করিয়ে বরণ করা হচ্ছে। নাচ, গান হচ্ছে। নতুন বৌয়ের আগমনের আনন্দে ঝুমঝুম করছে পুরো বাড়ি। দোতলায় এখন দু তিনজন চাকর ছাড়া অন্য কেউ নেই বললেই চলে। করিডোরে হলদে রঙের ফকফকা আলো জ্বলছিল। মুখোমুখি পড়তেই তিনি বুঝি একটু বিব্রতবোধ করলেন আজ। হাতে ধরা সেলফোন শক্ত চোয়াল। গভীর চোখের তারায় স্পষ্ট হয়ে ভেসে আছে মৃদু আড়ষ্টতা। কয়েকটা অস্বস্তির মুহূর্ত কাটলো। 

—‘আপনার সাথে বারবার দেখা হয়ে যাচ্ছে!’ চপল গলায় বলল অমৃতা। 

তার শাড়ির আঁচল লুটাচ্ছিল মেঝেতে। সেইদিকে একটা নজর দিয়ে তিনি বললেন, ‘হুম। তাইতো দেখছি। কেন এসেছ এখানে?’

—‘সামির মোবাইলের চার্জার নিতে। আমাকে শাড়িতে কেমন লাগছে?’

—‘ভালোই!’ কিছুটা উদাস গলায় বললেন রাশেদ। 

অমৃতা ফিচেল হাসি হেসে বলল, ‘বয়ফ্রেন্ড বুঝি গার্লফ্রেন্ডকে এভাবে কমপ্লিমেন্ট দেয়? আপনি একদমই রোমান্টিক না! এতদিন বিয়ে টিকে আছে কী করে আপনার?’ 

রাশেদের মুখের রং পাল্টে গেলো। চোখ হয়ে উঠল ক্ষুব্ধ। অত্যন্ত কড়া ভাবে তিনি একটা ধমক দিয়ে উঠলেন। 

—‘এসব আজেবাজে কথা বলতে নিষেধ করেছি না?’ 

অমৃতা একটু থমকে গেলো। রাশেদ আগের চাইতেও কঠিন গলায় বললেন, 

—‘পাগলামির একটা সীমা আছে অমৃতা! কেন তুমি বুঝতে পারছ না যে তোমার প্রতি আমি মোটেও আগ্রহী নই। আর কীভাবে বোঝাতে হবে?’ 

শেষের কথাটা অমৃতার হৃৎপিণ্ডে শেলের মতো গিয়ে বিঁধল। চিলিক দিয়ে উঠল অসহ্য ব্যথা! 

—‘কেন মিথ্যে বলছেন?’ 

রাশেদ চোখ সরিয়ে নিলেন,-–’মিথ্যে বলছি না। এটা ভীষণ সত্য যে তুমি আমাকে বিরক্ত করে যাচ্ছ অনবরত। প্লিজ এসব বন্ধ কর!’ 

অমৃতার চোখে সহসা মুক্তোদানার মতো অশ্রুবিন্দু এসে ভিড় জমাতে লাগল। অপমানে তার সুন্দর পাতলা ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠল থরথর করে। ইচ্ছে করল এই মুহূর্তে মাটির নিচে লুকিয়ে পড়ে বা বাতাসে মিলিয়ে যায়, 

পৃথিবীকে সে আর এই পোড়া মুখ দেখাতে চায় না। ঠিক সেই সময় বেডরুমের দরজা খুলে রোমেলা বেরিয়ে আসলেন করিডোরে। তার হাতে দুটি লাল রঙের লম্বাটে গয়নার বাক্স। দুটিই তার শাশুড়ির দেওয়া। নতুন বৌকে গয়নাগুলো আজ রাতেই পরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হক সাহেব। রোমেলার অবশ্য অত তাড়াহুড়ার ইচ্ছে ছিল না। মাত্র এসেছে মেয়েটা। যাক কয়েকটা দিন। তারপর শাশুড়ির গয়না সময়মতো বুঝিয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু তার স্বামীর সব কিছুতেই তাড়াহুড়া। আজ রাতেই তিনি পুত্রবধূর কাছে নিজের মায়ের দেওয়া গয়না হস্তান্তর করতে চান 

স্বামীকে দণ্ডায়মান দেখে রোমেলা বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘কী ব্যাপার?’ প্রশ্নটা করতে করতেই তার চোখ অমৃতার ওপরে গিয়ে পড়েছিল। হক বিব্রতভাবে বললেন, ‘কিছু না। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’ 

অমৃতা তখন মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, স্থানু হয়ে। ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে চোখের জল। ঠোঁট টিপে কান্না চাপার চেষ্টা করছে প্রাণপনে। একটু আগে আকাশকে বলেছিল নিজের বিয়ের দিন সে কিছুতেই কাঁদবে না। আকাশ যদি এখন এই কাঁদুনে অমৃতাকে দেখতে পেতো! ভাগ্যিস দেখেনি! অমৃতা চায় না এই মুখ কেউ দেখুক। চায় না! চায় না! চায় না! 

—‘এই মেয়ের কী হয়েছে?’ রোমেলা স্তব্ধ গলায় প্রশ্ন করলেন। 

অমৃতার দিকে গম্ভীর দৃষ্টি তাক করে রেখে স্ত্রীর কাঁধে একটা হাত রাখলেন রাশেদ, ‘জানি না। চলো!’ বললেন তিনি ঠিকই, কিন্তু অমৃতার অশ্রুবৎ চোখ দুটোর ওপর থেকে কোনোভাবেই দৃষ্টি সরাতে পারছিলেন না। জরাগ্রস্ত শরীরটা নিয়ে অনেক কষ্টে স্ত্রীর পাশাপাশি হেঁটে গেলেন। হঠাৎ করে তিনি দুর্বল বোধ করছেন। কী আশ্চর্য! এই মেয়েটা কাঁদলে তাঁর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় কেন? 

রোমেলা বললেন, ‘এই মেয়েটাকে আমার একেবারেই পছন্দ না। খুবই বেয়াদব একটা মেয়ে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাটক করছিল কেন? কী ব্যাপার? 

হক অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘হুম? জানি না। বাদ দাও।’ 

সামির ঘরে এসে অমৃতা অনেকক্ষণ ঝুম হয়ে বসে রইল। বুকের খাঁচায় দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুন। আগুন পোড়া গন্ধ সে নিশ্বাসের সাথে টের পাচ্ছিল। এরকম কেন হলো তার সাথে? কেন পৃথিবীতে এত এত মানুষ থাকতে অন্যের স্বামীকে, অন্যের বাবাকেই সে ভালোবাসতে গেলো? আর দশজনের মতো তারও তো একটা সাধারণ জীবন হতে পারত! নিজের ওপর এক তীব্র ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসতে লাগল তার। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *