বৃষ্টিমহল ৩.৫

সামি ফোন করছিল আকাশের মোবাইলে। ধরতেই ওপাশ থেকে হড়বড় করে বলল, ‘বলছিস?’ 

—‘ধুর শালা, এত অস্থির হইলে হয় নাকি? বলমু তো!’ 

—‘তাড়াতাড়ি কর, মামা টেনশন হইতাছে।’ 

—‘তুই আয় বাসায়। শোন আমরা বললেও তোকে তো আংকেল আন্টিকে ফেস করতেই হবে তাই না? বাবা মাও তর, বিয়াও তর, মাঝখান থিকা আমরা খাইতাছি প্যারা। সব শোধ দিবি ব্যাটা!’ 

—‘শোধ বোধ সব পরে হবে। কাজ কর আগে তুই।’ 

—‘হ করতাছি। তুই আয়।’ 

ড্রইংরুমে তখনও নাচ গান চলছে। বন্ধুরা ডাইনিং স্পেসে এসে বসল। এদিকটায় আপাতত কেউ নেই। ডাইনিং এর পার্শ্ববর্তী লম্বা করিডোরের একেবারে শেষ মাথায় আছে স্টাডিরুম। এই মুহূর্তে সেখানে মিটিং চলছে। খানিক বাদে বাদে চাকরবাকরদের চায়ের কাপ এবং নানা রকম উপাদেয় খাবার নিয়ে সেই ঘরের দিকে ছুটোছুটি করতে দেখা যাচ্ছে। বন্ধুরা ডাইনিং এ বসে অপেক্ষা করতে লাগল। মিটিং শেষ হলে লোকজন এদিকের করিডোর দিয়েই বেরিয়ে আসবে। লম্বা দশ চেয়ারের কারুকাজওয়ালা ডাইনিং টেবিল আর চেয়ার ছাড়াও এই ঘরে একটি সোফা সেট আছে। ওরা সোফার ওপরেই বসল। 

—‘এইটা কোনো কথা হইল? সামির বাচ্চা একাই সবার সাথে প্রেম করবে কেন? আমাদের কি কারো চোখে পড়ে না?’ রুদ্র বলে উঠল, ভারি আফসোসের গলায়। 

বিভা উদাস নয়নে চাইল রুদ্রর দিকে –’যে রকম বাঁশপাতার মতো শুকনা তুই, চোখে পড়বে ক্যামনে? কৃমির ওষুধ খা, মোটা গোটা হ, সব্বার চোখে পড়বে।’ 

রুদ্র চোখে মুখে এক অদ্ভুত মুদ্রা ফুটিয়ে তুলে কাতর গলায় বলল, ‘দোস্ত তোর পায়ে পড়ি, আর নজর দিস না আমার সুন্দর স্লিম বডিটার উপর। আর হিংসা করিস না প্লিজ!’ 

—‘কিন্তু হৃদি তো আমার ব্যাকআপ ছিল। এখন আমার কী হবে?’ হঠাৎ আকাশ বলে উঠল, একঝাঁক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে। 

রুদ্র বলল, –’চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত বিয়া না হইলে আমার হৃদিরে বিয়া করার কথা ছিল।’ 

—‘মোটেও না। হৃদি আমার ব্যাকআপ ছিল।’ জোরালো গলায় বলল আকাশ। 

এই পর্যায়ে রুদ্র বড়ই আকুলিবিকুলি হয়ে অমৃতাকে বলল, ‘দোস্ত তুই আমার ব্যাকআপ হ, প্লিজ!’ 

—‘ভালোই বলছিস, অমৃতা আজকাল শাড়িটাড়ি পরে, বিয়া শাদি ও করে ফেলবে মনে হয়। ভাবসাব ঠিক লাগতেছে না!’ ঠেস মারা গলায় বলল আকাশ। 

অমৃতা সোফার পিঠে হেলান দিয়ে বসে ছিল। তার মুখটা সিলিং এর দিকে উঁচু করা, চোখ নিবদ্ধ সিলিং এ ঝুলতে থাকা ঝাড়বাতির দিকে আকাশের কথা শুনতে পেয়ে সে সোজা হয়ে বসল। সিলিং থেকে চোখ নামিয়ে সরাসরি তাকালো দুই বন্ধুর দিকে। রুদ্র আগের চাইতেও করুণ গলায় বলল, ‘প্লিজ দোস্ত, বি মাই ব্যাকআপ! 

—‘আমি কখনও বিয়ে করব না। কথাটা কতবার বলা লাগবে তোদেরকে?’ 

—‘কখনো শাড়ি পরবি না এমন কথাও তো বলছিলি তাই না? শাড়ি তো ঠিকই পরলি!’ 

আকাশের কথায় অমৃতার কপালে সৃষ্টি হলো একটি ক্ষীণ কুঞ্চন রেখা। ধীরস্বরে বলল, ‘আমার হবে না।’ 

—‘এটার মানে কী?’ 

—‘মানে সবার সব কিছু হয় না। বুঝিস না?’ 

বিভা অস্বস্তি বোধ করছে। তার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তেই প্রসঙ্গটা পাল্টানো উচিত। সে তৎক্ষণাৎ রুদ্রকে বলল, –’তোর এত চিন্তা কীসের? আমেরিকা গিয়া একটা ব্লন্ড গার্লফ্রেন্ড বানায় ফেলবি।’ 

ব্লন্ড গার্লফ্রেন্ডের কথায় রুদ্রর মন ভিজল না। তাকে আগের চাইতে আরও বেশি চিন্তিত দেখাল। 

—‘দোস্ত তোর কি পরকীয়া করার কোনো ইচ্ছা আছে? তুই আমার পরকীয়ার ব্যাকআপ হয়ে যা! ছাইড়া দে ওই গাধার বাচ্চা অভিজিৎরে।’ 

—‘জীবনেও ছাড়ব না। আমার বরকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না। লাখি খাবি।’ 

—‘আচ্ছা ছাড়া লাগবে না।’ 

বিভা একটা হাই তুলে বলল, ‘তোর মতো বোকচোদা ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আমি পরকীয়া করব? জীবনেও না!’ 

—‘তো কার সাথে করবা তুমি?’ ত্যাড়া গলায় বলে ওঠে রুদ্র। 

বিভা কয়েক সেকেন্ড চোখ পিটপিট করে কিছু একটা ভাবল। বলল, ‘সুন্দর ডাক্তারের কথা মনে আছে তোদের? পরকীয়া করলে আমি ওর সাথেই করব।’ 

সুন্দর ডাক্তারের কথা শুনে এই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময়েও অমৃতা হেসে ফেলল নিজের অজান্তেই। 

‘সুন্দর ডাক্তারটা আবার কে?’ আকাশ অবাক 

অমৃতা হাসতে হাসতে বলল, ‘মনে নাই তোদের? ওইযে দুই গাধী একবার রিকশা অ্যাকসিডেন্ট করল?’ 

রুদ্র ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কই আমার তো কিসু মনে পড়তেছে না!’ 

অমৃতা বলল, ‘কী ভয়ংকর দিন ছিল রে বাবা! মানে এত বড় বিপদের মধ্যেও এমন জোকারগিরি করা পৃথিবীতে শুধু এই দুই জনের দ্বারাই সম্ভব।’ 

—‘কী হইছিল রে?’ আকাশের প্রশ্ন। 

মুচকি হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে রেখেই অমৃতা গল্পটা বলা শুরু করল। ঘটনা ঘটেছিল ঈদের চতুর্থ দিন। ঢাকার রাস্তাঘাট তখন সুনসান নীরব। ঈদের ছুটিতে প্রায় অর্ধেক মানুষ রাজধানী ছেড়েছে। গাড়ির জ্যাম নেই। রাস্তায় কালো ধোঁয়ার ছড়াছড়ি নেই। আছে ঝলমলে স্বচ্ছ রোদ। যেন এক ছিমছাম স্বপ্নের নগরী! রিকশা নিয়ে তিন বান্ধবী যাচ্ছিল বনানীর একটা রেস্তোরাঁয়। ঈদের সময় হুডখোলা রিকশায় চড়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর আনন্দই আলাদা। বনানী এগারো নম্বর রাস্তায় ঢোকার মুখেই ঘটল দুর্ঘটনা। রাস্তা ফাঁকা পেয়ে একটা টয়োটা গাড়ি প্রবল গতিতে ছুটে আসছিল উল্টো দিক থেকে। রিকশাওয়ালা প্রাণপণ চেষ্টা করেও গাড়িটাকে পাশ কাটাতে পারল না। ধাক্কা লেগে গেলো। ধাক্কার চোটে রিকশা থেকে অতর্কিতে রাস্তায় পড়ে গেলো বিভা আর হৃদি। অমৃতা সিটের উপরে বসেছিল। ঝুঁকিটা তারই বেশি ছিল কিন্তু অলৌকিকভাবে ওর কিছুই হলো না। এমনকি রিকশাওয়ালারও কোনো ক্ষতি হলো না। শুধু দুই বান্ধবী রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে কোঁকাতে লাগল। বিভার কপাল গেছে কেটে। হাতের কনুইয়ের চামড়া ছিলে গেছে। হৃদির হাঁটু পিচঢালা রাস্তায় এমনভাবে ঘর্ষণ খেয়েছে যে মনে হচ্ছিল যেন আরেকটু হলেই হাঁটুর বাটি খুলে আসবে ব্যথায়। অমৃতার মুখ তখন আতঙ্কে সাদা। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেছে সে। দুই সুন্দরীকে রাস্তায় চিৎপটাং হয়ে পড়ে যেতে দেখে হইহই করে ছেলে বুড়ো নানা বয়সী লোক ছুটে আসতে লাগল। গাড়ির ড্রাইভার ধাক্কাটা মেরে পালিয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের মধ্যেই। আমজনতা সেই ড্রাইভারকে গালাগালি করে গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল। বিভা বরাবরের মতোই জম্পেশ একটা সাজ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল। তার পরনে ঈদের নতুন জামা। ঈদ এবং পূজা এই দুটোতে তার নতুন জামা চাইই চাই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে হুমড়ি খেয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় যেই চিন্তাটা সবার প্রথমে এলো তা হলো ফাটা মাথা থেকে ঝরে পড়া রক্তে তার মেকআপ এবং নতুন জামা নষ্ট হয়ে যাবে। সে ভিড়ের দিকে ঝাপসা চোখ মেলে তাকালো। এক দাড়িওয়ালা বুড়ো তার দিকে তখন হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ‘উঠেন আম্মা, উঠেন, আমার হাত ধরেন।’ 

বিভা ঘোলাটে গলায় বলল, ‘চাচা, আমার মেকআপ কি নষ্ট হয়ে গেছে?’ 

বুড়ো প্রশ্নটা ঠিক মতো বুঝতে পারল বলে মনে হলো না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল বিভার ব্যথিত মুখখানার দিকে। হৃদি হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকা অবস্থায়ই সামনে দাঁড়ানো এক দোহারা চেহারার কিশোরের দিকে হাত পেতে বলল, ‘ব্রাদার, তোমার কাছে এক টুকরা বরফ হবে? প্লিজ?’ 

—‘বরফ দিয়ে কী করবেন আফা?’ 

হৃদি বশীভূত গলায় বলল, ‘একটু লাগবে ভাই, একটু বরফ লাগবে! 

অমৃতা তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলো। ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীদের ধমক দিয়ে উঠে বলল, ‘তাকায় তাকায় দেখতেছেন কী? এদেরকে হাসপাতালে নিতে হবে না? আসেন, হাত লাগান!’ 

কাছাকাছি একটা হাসপাতালে অতি দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো ওদের। হাসপাতালে যাবার পর অপেক্ষা করতে হলো পাক্কা দশ মিনিট। হৃদির ডান হাঁটুর চামড়া ছিলে গিয়ে ক্রিম কালারের পাজামা হয়ে উঠেছে রক্তাক্ত। বিভার কপাল ফুলে রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বাদে ইমার্জেন্সি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো ওদেরকে। তখন ডিউটিতে ছিলেন এক সুদর্শন তরুণ ডাক্তার। সুদর্শন ডাক্তার বিভার কপাল দেখেশুনে বিনীতভাবে বলল, ‘তেমন গভীর ক্ষত হয়নি। সেলাই টেলাই লাগবে না। আপনার পেইন কি বেশি?’ 

ডাক্তারের চেহারা এবং ভদ্রতার বাহার দেখে বিভা মুগ্ধ হয়ে গেলো, আপ্লুত কণ্ঠে বলল, ‘জি বেশি!’ 

—‘একটু ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ দিয়ে দেবে। পেইন কিলার খেয়ে নিয়েন একটা। আমি প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি। ব্যথা চলে যাবে। গুরুতর কিছু নয়।’ 

এবার ডাক্তার সাহেব হৃদির দিকে এগিয়ে গেলো। অমৃতা বিভার পাশেই বসে ছিল। ডাক্তার অন্য দিকে যেতেই বিভা ফিসফিস করে বলল, ‘ডাক্তারটা জোশ না?’ 

অমৃতা দুই বান্ধবীর আকস্মিক দুর্ঘটনায় চিন্তিত এবং বিচলিত হয়ে পড়েছিল। বিভার কথা শুনে সে একদম ব্যাক্কল বনে গেলো। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘এখন তুই ডাক্তারের সৌন্দর্য দেখতেছিস? মানে তোদের দ্বারাই সম্ভব।’ 

বিভা নির্বিকার গলায় বলল, ‘খুব পছন্দ হইছে। নামটা জেনে নিস তো।’

ডাক্তার তখন হৃদির হাঁটু পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। একটু দেখে শুনে নিয়ে তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, ‘আপনার পায়জামাটা একটু কাটতে হবে। এইযে হাঁটুর কাছটায়। ঠিক আছে?’ 

হৃদি লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘না কাটলে হয় না?’ 

ডাক্তার হাসলেন, ‘না হয় না।’ 

হৃদির কাঁচুমাচু মুখখানা দেখে ওদিকে অমৃতা আর বিভা তখন মিটমিটিয়ে হাসছে। কম বয়সী ডাক্তার মেয়ে দুজনের বাঁকা হাসি দেখে একটু বুঝি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। দ্বিধাগ্রস্ত দেখালো তাকে। অমৃতা বলল, ‘ডাক্তার সাহেব, ওর কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার যা ভালো মনে হয় তাই করুন।’ 

খুব বেশি সময় লাগল না। দুজনেরই ব্যান্ডেজ হয়ে গেলে হসপিটালের বাইরে এসে বিভা বলল, ‘অমৃতা যা, দৌড় দিয়া গিয়া ডাক্তারের ফোন নম্বর নিয়া আয়।’ 

—‘হ্যাঁ, যা দোস্ত, এখনই যা।’ বিভার কথায় সায় দিল হৃদি। 

—‘নম্বর দিয়া কী করবি?’ অমৃতার প্রশ্ন। 

বিভা বলল, ‘প্রেম করব দোস্ত! একটা ডাক্তারের সাথে প্রেম করার আমার বহুদিনের শখ। 

—‘একা একাই করবি? আমারে ভাগ দিবি না?’ হৃদি যোগ করল প্রশ্ন দুটো। বিভা বিরক্ত গলায় বলল, ‘শালি, তোর তো রবিন আছে।’ 

—‘তাতে কী? রবিন তো ডাক্তার না!’ 

বিভা গম্ভীর গলায় বলল, ‘আচ্ছা সেভেন্টি- থার্টি হিসাবে ভাগ হবে।’ 

—‘জি না, ফিফটি – ফিফটি।’ 

অমৃতা ধমক দিয়ে উঠে বলল, ‘কী শুরু করলি তোরা? আমি ফোন নম্বর টম্বর চাইতে পারব না।’ 

বিভা করুণ গলায় বলল, ‘দোস্ত প্লিজ! আমার স্বপ্নটা পূরণ কইরা দে। প্লিজ দোস্ত।’ 

ঠিক সেই সময় ডাক্তার সাহেবকে হসপিটালের গেট পার হয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। হৃদি ফিসফিস করে বলল, ‘দ্যাখ, বলতেই বলতেই সামনে চলে এলো। মনে হচ্ছে এর সাথে আমাদের কোনো কিসমত কানেকশন আছে।’

বিভা অমৃতাকে ঠেলে ঠুলে সামনে এগিয়ে দিলো,বলল, ‘যা দোস্ত, তুই সাহসী। আমাদের তো এত সাহস নাই। আমাদের হয়ে তুই কথা বল, যা।’ 

অগত্যা অমৃতাকে যেতেই হলো। ডাক্তার সাহেব হাত বাড়িয়ে একটা রিকশা দাঁড় করিয়েছিলেন। অমৃতা পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি দাঁত বের করে সহজ হাসি হাসলেন, 

—‘জি বলুন।’ 

অমৃতা আদেশ করার সুরে বলল, ‘ফোন নম্বরটা দেন তো!’ ডাক্তার অবাক, ‘কীসের মানে কার ফোন নাম্বার? ‘ 

—‘আমার আম্মার।’ 

—‘মানে?’ 

—‘মানে আপনার কাছে নিশ্চয়ই আমি আমার মায়ের ফোন নম্বর চাইব না। ডেফিনিটলি আপনার নম্বর!’ 

ডাক্তার সাহেবের মুখে হতভম্ব একটা ভাব খেলে গেলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি চমৎকারভাবে সামলে নিলেন পরিস্থিতি। দাঁত বের করে ঝিকিমিকি একটা হাসি ফুটিয়ে তুললেন মুখে। হাসতে হাসতেই পকেট থেকে ওয়ালেট বের করলেন। একটা কার্ড অমৃতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার নামটা?’ 

—‘আমার নাম জেনে আপনি কী করবেন?’ কার্ডটা হাতে তুলে নিতে নিতে রুক্ষ গলায় প্রশ্ন করল অমৃতা। 

—‘বাহ্, আপনি আমার ফোন নম্বর চাইতে পারলেন, আর আমি আপনার নাম জানতে চাইতে পারি না? 

—‘না পারেন না।’ এটুকু বলে অমৃতা ডাক্তারের মুখের সামনে থেকে একটু সরে দাঁড়ালো। হৃদি আর বিভা গোল গোল চোখে তাকিয়ে দেখছিল ওদের। অমৃতা সরতেই ডাক্তারের দৃষ্টি সোজা গিয়ে পড়ল ওদের ওপর অমৃতা ওদেরকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই দুই সুন্দরীকে দেখতে পাচ্ছেন? আপনার পেশেন্ট? ‘ 

ডাক্তার হাসে, ‘আমি তো আমার সামনে দাঁড়ানো সুন্দরীর ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। অন্যদের দেখার অবকাশ কোথায়? 

অমৃতা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সিরিয়াসলি? আমি আমার ফ্রেন্ডদের জন্য আপনার কাছে তদবীর করতে আসছি আর আপনি আমার সাথেই লাইন মারতেছেন।’

—‘বলুন না, আপনার নামটা!’ 

—‘আমার নাম টিংকু রাণী সর্দার।’ অমৃতা বলল, কাটাকাটা গলায়।

ডাক্তার হেসে ফেলল, ‘কী রাণী সর্দার?’ 

—‘টিংকু রাণী!’ 

অতটুকু বলেই অমৃতা জায়গাটা থেকে সরে পড়ল। ডাক্তার রিকশায় উঠে বসলেন। রিকশাটা ওদের সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি হাত নেড়ে অমৃতাকে বললেন, ‘বায় বায় টিংকু রাণী! আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকব।’ 

হৃদি আর বিভা একদম মুখিয়ে ছিল ওকে আক্রমণ করার জন্য। বাগে পাওয়া মাত্র দুজনে হইহই করে বলে উঠল, ‘এই শয়তান মহিলা, তুই আমাদের জন্য লাইন করতে গিয়া, নিজেই লাইন মাইরা আসলি? এত বড় বেইমানী?’ 

অমৃতা পানসে মুখে বলল, ‘এইসব লাল্টু পোলাপাইনের সাথে লাইন মারার কোনো শখ নাই আমার মামা। এই নে কার্ড। ডাক্তার ইজ অল ইয়োর্স।’ 

সেই ডাক্তারকে অবশ্য পরবর্তীতে আর কখনোই ফোন করা হয়ে ওঠেনি ওদের। বিভা কার্ডটা পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। কখনো মনে চাইলে ফোন করবে বলে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অমৃতা একটু কেমন নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছিল। তার চোখদুটো হয়ে উঠছিল স্বপ্নাতুর। বিভা বলল, ‘কী সুন্দর দিন ছিল, নারে? আমরা কেমন যেন বদলে যাচ্ছি, একটু একটু করে। তোরা কি টের পাস? 

বিভার কথাটায় কী যেন ছিল। সবাই কয়েকটা সেকেন্ড নিজের ভেতরে নিজে ডুব দিয়ে রইল। বদলাতে না চাইলেও যে বদলে যেতে হয়… ভুলে যেতে হয়… না চাইতেও আরো কত কী করতে হয় এক জীবনে! বিভা আবারো বলল, ‘অমৃতা সব সময় আমাদের লিডার ছিল। মনে আছে? আকাশের সাথে ফ্রেন্ডশিপটা কীভাবে হয়েছিল?’ 

শুনে অমৃতা চকিতে তাকালো একবার আকাশের দিকে। বলল, ‘মনে আছে আকাশ?’ 

 আকাশ হাসল। সাথে হাসল ওর চোখ। কত বছর হলো? আট? নাকি নয়? সেই যে কলেজ গেটের সামনে রোদ ডোবা এক দুপুরে পেছন থেকে একটা টমবয় মেয়ে আচমকা বলে উঠল, ‘এই ছেলে, শুনো?’ 

তারপর একটু কাছে এগিয়ে এসে সেই পুতুল পুতুল দেখতে মেয়েটা নির্বিকার গলায় বলেছিল, ‘ইয়ে, লাইটার হবে? 

মনে আছে… হ্যাঁ আকাশের সবকিছু মনে আছে। সেদিন অমৃতার পরনে কোন রঙের শার্ট ছিল,বয়কাট চুলগুলো আঁচড়ানোর ধরনটা কেমন ছিল, কথা বলতে বলতে কতবার সে আড়চোখে চটপটির গাড়ির পেছনে দাঁড়ানো বিভা আর হৃদির দিকে তাকিয়েছিল, সব… সমস্ত কিছু মনে আছে আকাশের। মনে থাকবে আজীবন! কিছু ঘটনা মনে থাকে, জমা থাকে আজীবন বুকের তাকের গোপন ড্রয়ারে। 

কিছু বলছিল না সে। চুপচাপ বসে থেকে তার আকাশময় হাসিটা হেসে যাচ্ছিল। ডাইনিংরুম সংলগ্ন করিডোরে লোকজনের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। মনে হচ্ছে মিটিং শেষ হয়েছে। বন্ধুদের দলটায় তাৎক্ষণিকভাবে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। রুদ্র উঠে পড়ল বসা থেকে। উঁকি দিয়ে নিশ্চিত হলো যে বৈঠক ভেঙেছে। দশবারো জনের একটা দল নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছে। সামির আব্বাকেও দেখা গেলো একেবারে শেষ মাথায়। রুদ্র দৌড়ে বন্ধুদের কাছে ছুটে এসে বলল, ‘আংকেল বের হইছে। এখনই ধরতে হবে উনারে।’ 

বন্ধুরা হেঁটে এসে দাঁড়ালো ডাইনিং এর দরজায়, করিডোরের মুখে। হক ওদের দলটাকে দেখতে পেলেন। চোখে চোখ পড়তেই ছেলেমেয়েরা তাঁকে সালাম দিল। শুধু অমৃতা বাদে। তিনি হেসে সালামের উত্তর দিলেন। থামলেন না এক মুহূর্তের জন্যও। খুব দ্রুত হেঁটে পার হলেন জায়গাটা। আকাশ ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শালা ব্যাক্কলের মতো দাঁড়ায় আছিস ক্যান? ডাক দে না উনারে।’

বিভা শুকনো মুখে বলল, ‘কীভাবে ডাকব? খুব নার্ভাস লাগছে।’ 

—‘নার্ভাস লাগলে তো হবে না, বলতে হবে। সামি আর হৃদি ওয়েইট করতেছে।’ আকাশ বলল। 

রুদ্র একবার ফ্যাসফ্যাসে গলায় ডাকল, ‘আংকেল! এক্সকিউজ মি, আংকেল!’ 

রুদ্রর মিউমিউ ডাকটা গন্তব্যে পৌঁছাবার আগেই যাত্রাপথে মৃত্যুবরণ করল। বিভা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘জোরে ডাকতে পারতেছিস না? বোবায় ধরছে নাকি তোরে?’ 

করিডোরের শেষ প্রান্তে, স্টাডিরুমের মুখোমুখি রয়েছে সদর দরজা। হাতের বামদিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। হক তখন সিঁড়ির কাছাকাছি চলে গেছেন। মিটিং এর লোকজন একে একে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হক এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়ালেন সিঁড়ির গোড়ায়। প্রস্থানরত লোকজনের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বিদায় জানালেন। তারপর সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার জন্য উদ্যত হলেন। ঠিক সেই সময় জোরালো স্বরের ডাকটা ভেসে এলো পেছন থেকে। 

—‘এক্সকিউজ মি! একটু শুনবেন?’ 

গলার স্বরটা চেনা হলেও দাপ্তরিক লোকজনের সামনে ওই আচমকা ডাকটা তাঁকে পুরোদস্তুরভাবে বিব্রত করে তুলল। তিনি থমকে গেলেন। এতক্ষণের সুপ্রসন্ন মুখখানা মুহূর্তের মাঝে থমথমে হয়ে উঠল। চোখে ভেসে উঠল অস্বস্তি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়ালেন। অমৃতা এগিয়ে এলো কয়েক পা। 

—‘একটু শুনবেন?’ 

—‘সময় নেই এখন।’ এটুকু বলে গম্ভীরভাবে একবার হাতঘড়িটা দেখলেন। তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কিছু একটা এমন গলায় বললেন, ‘তোমার পার্সটা পাওয়া গেছে। স্টাডিরুমে রাখা আছে। নিয়ে নিও।’ 

—’সেটা নেয়া যাবে। কিন্তু আপনাকে যে এখন আমাদের কথা শুনতেই হবে!’ 

হক এতক্ষণে লক্ষ্য করলেন মেয়েটার পেছনে তার অন্য বন্ধুরাও দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে। শুধু তাঁর পুত্রটিকে দেখা যাচ্ছে না এদের মাঝে 

—‘কী ব্যাপার?’ 

—‘আপনি এবং আপনার স্ত্রী। আপনাদের দুজনের সাথেই আমাদের একটু কথা আছে।’ 

হক সাহেবের কপালে তৎক্ষণাৎ একটি চিন্তাজনিত রেখা ফুটে উঠল তিনি বুদ্ধিমান মানুষ। ছেলেমেয়েগুলোর মুখ দেখে নিমেষেই বুঝে ফেললেন যে কিছু একটা গড়বড় হয়ে গেছে। ব্যস্তভাবে বললেন, ‘এসো আমার সাথে।’ 

বন্ধুরা তাঁর পেছন পেছন সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলো। উপর তলার বাসিন্দাদের বিয়েবাড়ির আমোদ তখনও ফুরোয়নি। রোমেলা বেডরুমে নিজের আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। তার গায়ে এখনো অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা। পারিবারিক ফটোসেশন শেষ হলো খানিক আগে। হক সাহেবকে পরিবারের সকলেই কম বেশি ভয় পায়। তিনি ঘরে ঢোকা মাত্র বাচ্চারা দৌড়ে পালিয়ে গেলো। তাঁর শ্যালিকারাও উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। তিনি কারো দিকে না তাকিয়ে সরাসরি স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমি একটু শুনে যাও।’ 

রোমেলা খুব একটা বিচলিত হলেন না। তাঁর স্বামীর স্বভাবটা সৰ্বদাই খটোমটো। কারণে অকারণে খিটখিট করা মজ্জাগত অভ্যাস। তিনি হাতে ধরে থাকা অলংকারের একটা বাক্স বোনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা রাখো। আমি আসছি।’ 

তাঁর বোন একটু সংকোচের গলায় বলল, ‘আপা আমরা অন্যঘরে যাচ্ছি। রাত হয়ে গেছে। দুলাভাই হয়তো শুবেন।’ 

সেই মুহূর্তে হক একবার হুংকার ছাড়লেন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে, ‘এত দেরি করছ কেন?’ 

রোমেলা ধমক খেয়ে পড়িমরি করে ছুটে আসলেন স্বামীর কাছে। পেছন পেছন হেঁটে এলেন ছেলের শোবার ঘরে। ছেলের বন্ধুদের দেখতে পেয়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, 

—‘তোমরা সব এখানে? আমার বাচ্চাটা কোথায়?’ 

হক ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। বন্ধুরা সব রক্তশূন্য মুখে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝ বরাবর। বুক কাঁপছে সবার। দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনায় একেকজন অচলিষ্ণু পাথর হয়ে গেছে। 

হক অমৃতার চোখে চেয়েই প্রশ্নটা করলেন, ‘কী হয়েছে?’ 

ঐ গম্ভীর কণ্ঠের অনুসন্ধানী প্রশ্ন শুনে অমৃতা একটু ঘাবড়ে গেলো। বন্ধুদের দিকে বিচলিতভাবে তাকালো একবার। বন্ধুরা এখন মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। কোথাও কোনো শব্দ নেই। টিকটিক করে চলছে শুধু দেয়ালঘড়ির সেকেন্ডের কাটা। 

রোমেলা অস্থিরভাবে বললেন, ‘কী ব্যাপার? তোমরা কেউ কথা বলছ না কেন?’ 

অমৃতা এবার এগিয়ে এসে রোমেলার একটি হাত ধরল আস্তে করে। টেনে নিয়ে বিছানার ওপর বসালো। তারপর নরম গলায় বলল, ‘একটা কথা বলবো, কথাটা মন দিয়ে শুনবেন।’ 

হক সাহেব ধমকে উঠলেন, ‘বলছ না কেন এখনো? তামাশা করছ কেন?’ 

অমৃতা চমকে উঠল ধমক শুনে। এমনিতেই এই বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে বুকটা সারাক্ষণ ধড়ফড় করছে। মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি প্রাণ পাখিটা বেরিয়ে যাবে ফুড়ুৎ করে। তার ওপর আবার এমন বজ্রপাতের মতো ধমক! লোকটা না… একদম বেশি বেশি! 

—‘সামি…’ 

—‘কী হয়েছে সামির?’ 

অমৃতা দম আটকে বলে ফেলল, ‘সামি… সামি আসলে গে!’ 

—‘কী?’ হক সাহেবের মুখ থেকে আর্তনাদের মতো ছিটকে বেরোলো শব্দটা। রোমেলাকে দেখে মনে হলো তিনি এই মুহূর্তে চোখ উল্টে, মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। বন্ধুরা সব হতভম্ব! অমৃতা এসব কী বলছে? 

—‘সামি আর আকাশ… না না মানে সামি আর রুদ্র ওদের মধ্যে আসলে একটা ব্যাপার আছে!’ 

হকের মুখটা হা হয়ে গেছে, চোখদুটি পূর্ণব্যাদিত। তিনি নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছেন। রোমেলা কয়েকটা ক্ষণ অমৃতার দিকে অশ্বীভূত হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর কান্না জড়ানো গলায় প্রায় চিৎকার করে উঠে স্বামীকে বললেন, ‘এই মেয়েটা এসব কী বলছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! 

হক সেই মুহূর্তে রুদ্রর দিকে একবার অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। রুদ্র বিস্ময়ের ধাক্কাটা তখনো সামলে উঠতে পারেনি। থ বনে যাওয়া চেহারা নিয়ে তাকিয়ে ছিল অমৃতার দিকে। এবার হকের আগুন দৃষ্টিটা টের পেয়ে সে একদম কাঁচুমাচু হয়ে গেলো। অনেক কষ্টে মিনমিন করে বলল, ‘অমৃতা, তুই এসব কী বলতেছিস? আমার সাথে সামি? মানে ক্যামনে কী? দোস্ত আমার এখনো বিয়া হয় নায়। প্লিজ এসব অপবাদ দিস না।’ 

অমৃতা শক্ত গলায় বলল, ‘আরে চুপ থাক তুই। আমাকে কথা শেষ করতে দে।’ 

হক দাঁতে দাঁত চিবিয়ে অমৃতাকে বললেন, ‘তুমি এসব কী বলছ? কেন আজেবাজে কথা বলছ আমার ছেলেকে নিয়ে?’ 

রোমেলা তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘হায় আল্লাহ এই দিনও দেখার ছিল আমার ভাগ্যে। এর আগে কেন আমার মরণ হলো না?’ 

অমৃতা একটা বড় শ্বাস নিলো। তারপর খুব স্পষ্টভাবে বলল, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস হক, শুনুন আপনারা, এবার আপনাদের আসল ঘটনাটা বলা হবে। সামি যদি সত্যই গে হতো, কিংবা সামি যদি মরে যেত, তাহলে আপনাদের যতটা খারাপ লাগতো, যতটা কষ্ট আপনারা পেতেন, এখন সত্যটা জানার পর সেই তুলনায় কোন কষ্টই পাবেন না। বরং আল্লাহকে থ্যাংকস দেবেন যে…’ 

হক সাহেব হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘তুমি আসল কথাটা বলো!’ 

—‘ওকে, আসল কথাটা হচ্ছে সামি তানিশাকে বিয়ে করতে পারবে না।’ অমৃতার বুদ্ধিটা খুব একটা কাজে লাগল বলে মনে হলো না। খোলামেলা প্রশস্ত ঘরটায় হঠাৎ করেই যেন বায়ু সংকট দেখা দিল। দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। সামির আম্মার চেহারা আগের চাইতে আরো বেশি ঝুলে গেলো। দিশাহারা চোখে তিনি একবার স্বামীর দিকে তাকালেন। হক সাহেব জড়বৎ চক্ষু নিয়ে অমৃতার দিকে চেয়ে ছিলেন। তাঁর নিশ্বাস আটকে গেছে গলার কাছে। শরীর হয়ে আসছে অসাড়। তিনি কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারলেন না। এদিকে বন্ধুরা সব নত মুখে প্রস্তরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের তলায় ভূমিকম্প টের পাচ্ছে তারা। 

—‘এসব কী বলছ?’ অনেক কষ্টে স্বরনালি দিয়ে ঠেলেঠুলে শব্দগুলো নির্গত করলেন হক। 

অমৃতা স্থির গলায় দ্বিরুক্তি করল, ‘সামি তানিশাকে বিয়ে করতে পারবে না।’ 

কথাটা বলে শেষ করা মাত্র সে আবিষ্কার করল সামনে দাঁড়ানো দীর্ঘকায় শক্তপোক্ত মানুষটার সৌম্যদর্শন মুখখানায় সহসা কেমন অসহায় একটা ভাব ফুটে উঠল। অমৃতার বুকের ভেতর বিদ্যুতের মতো চিলিক দিয়ে উঠল তীক্ষ্ণ ব্যথা। জীবনে প্রথমবার সে টের পেলো যে এই মানুষটা কষ্ট পেলে, তারও কষ্ট হয়! কী আশ্চর্য, আকস্মিক এবং অলৌকিক এই অনুভূতি। সে জানে লোকটা তার কেউ না, কিচ্ছুনা, তবুও কী করে যেন সবকিছু! 

হক ক্লান্তভাবে স্ত্রীর পাশে এসে বসলেন। এই ধরনের একটা আশংকাই তিনি করছিলেন মনে মনে গত দুদিন ধরে। ছেলের মুখে তিনি দ্বিধা এবং সিদ্ধান্তহীনতার উপস্থিতি টের পেয়েছিলেন। আশংকাটি সত্যে পরিণত হলো শেষমেশ। এখন কী হবে! 

ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের ভেতর একটি বিস্ফোরণ ঘটল যেন। রোমেলা রুক্ষভাবে চিৎকার করে উঠে বললেন, ‘এই মেয়ে, তুমি ফাইজলামি করছ আমাদের সাথে? কোথায় আমার ছেলে? ডাকো তাকে!’ 

অমৃতা একটু বিব্রতভাবে বলল, ‘ফাইজলামি করব কেন? আপনার ছেলেকে কোথায় পাবো? সে তো পালিয়ে গেছে!’ 

উন্মাদিনীর মতো ক্ষেপে উঠলেন রোমেলা, ‘পালিয়েছে মানে? কার সাথে পালিয়েছে?’ 

—‘হৃদির সাথে!’ 

অমৃতার বলা শেষ বাক্যটা রোমেলাকে একদম বজ্রাহত করে দিয়ে গেলো। তাঁর চোখের দৃষ্টি এখন নীড় নষ্ট হয়ে যাওয়া পাখির মতো। রাগে গড়গড় করতে করতে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘ওই মেয়ের এত বড় সাহস! আমার ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যায়! 

হক এই পর্যায়ে স্ত্রীকে একটু কড়া গলায় বললেন, ‘থামো তুমি। আমাকে আগে ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে দাও!’ এটুকু বলে তিনি অমৃতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘পালিয়ে গেছে মানে কী? কোথায় পালিয়েছে?’ 

এবার আকাশ কথা বলল, ‘আংকেল আসলে ওরা পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন বলে আবার ফিরে আসছে। মোদ্দাকথা হচ্ছে কালকের আকদের অনুষ্ঠানটা ক্যানসেল করতে হবে।’ 

রোমেলা ফণিনীর ন্যায় ফুঁসে উঠে বললেন ‘অসম্ভব! ওই বেয়াদব মেয়েটা আমার ছেলের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। ওই মেয়েকে আমি ছাড়ব না কিছুতেই। আমার ছেলের বিয়ে তানিশার সাথেই হবে! এসব মেয়েদের আমার চেনা আছে। এরা বুদ্ধি হবার পর থেকেই বড়লোকের ছেলেদের কীভাবে ফাঁসাবে সেই মতলব আঁটতে থাকে। 

হক বাধা দিলেন স্ত্রীকে, ‘আহ, থামো তো!’ 

হৃদিকে নিয়ে বলা বিরোধপূর্ণ, অরুচিকর কথাগুলো বন্ধুরা কেউ সহ্য করতে পারল না। তাদের মুখ থমথম করে উঠল অপমানে। কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। সবাই অপমানটা চুপচাপ মুখ বুজে দাঁড়িয়ে থেকে হজম করে গেলো। কিন্তু অমৃতা তো কখনো চুপ করে থাকতে শেখেনি। সে রুখে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এভাবে বলাটা আপনার উচিত হচ্ছে না। হৃদি মোটেও কোনো মতলব করেনি। সামি ওকে পছন্দ করে।’ 

রোমেলা ধমকে উঠলেন, ‘থামো তুমি! ওই মেয়ে ভরা মজলিশে সবার সামনে আমার ছেলেকে আই লাভ ইউ বলেছে কি এমনি এমনি? কোনো মতলব না থাকলে? বেয়াদব মেয়ে একটা! ও কি ভেবেছে ব্যাপারটা এতই সোজা? এত বড় সাহস?’ 

এরপর রাগে গজগজ করতে করতে রোমেলা এই একটি কথাই বার বার বলতে লাগলেন, ‘এত বড় সাহস? এত বড় সাহস?’ তাকে দেখাচ্ছে অপ্রকৃতস্থের মতো। শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত। খোঁপা করা চুল খুলে ছড়িয়ে গেছে পিঠময়। গোলগাল, ঢলঢলে পুরু প্রসাধনওয়ালা মুখটায় খেলছে চাপা ক্রোধ। হক স্ত্রীর হাতে একটা হাত রাখলেন, সান্ত্বনার গলায় বললেন, ‘চিন্তা করো না। আমি দেখছি ব্যাপারটা।’ 

রোমেলা এবার কেঁদে ফেললেন, ‘সব আত্মীয়স্বজনরা জেনে গেছে। এত বড় করে এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান হলো। পত্রিকায় পর্যন্ত খবর ছাপা হয়ে গেছে। এরকম সময়ে ছেলে বলছে বিয়ে করবে না? আমার ইচ্ছে করছে বিষ খেয়ে মরে যাই।’ 

হক বললেন, ‘বাজে কথা বোলো না। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বিয়েটা কাল হচ্ছে।’ 

বন্ধুরা হিমহিম উদ্বেগে ডুবে গিয়ে একে অন্যের দিকে চাইল। একটা হতভম্ব ভাব কাবু করে ফেলেছে ওদেরকে। কী বলছে এই দুজন মানুষ? এদের কি জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? 

অমৃতা বলল, ‘বিয়ে হতেই হবে মানে কী? সামি তো তানিশাকে বিয়ে করবে না!’ 

রোমেলা ঝেঁঝে উঠলেন, ‘চুপ থাকো! পাজি মেয়ে কোথাকার! তুমি এত মুখের ওপর কথা বলো কেন? একদম চুপ থাকো!’ 

অমৃতা মহিলার অভদ্রতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। সে চকিতে একবার তাকালো মহিলার পাশে বসে থাকা মানুষটার দিকে। মানুষটার স্ত্রী তাকে আর তার বন্ধুদের ক্রমাগত অপমান করে যাচ্ছে অথচ মানুষটা কিছুই বলছে না। মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। আজব কাণ্ড। সেও দমবার পাত্রী নয়, আগের চাইতেও জোরালো গলায় বলল, ‘আপনার ছেলে যদি মরে যেত, কিংবা সত্যিই গে হত, তাহলে কী করতেন? 

রোমেলা ডান হাতের তালু দিয়ে নিজের কপাল চাপড়ে উঠে বললেন, ‘উফ আল্লাহ! এই মেয়েটাকে এখান থেকে বিদায় করো তো! আমার মাথার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে এর কথায়।’ 

আকাশ অমৃতার একটা হাত টেনে ধরল, ‘থাক, তুই আর কিছু বলিস না। চুপ করে থাক।’

হক সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে। তোমাদের ধন্যবাদ বিষয়টা জানানোর জন্য। আমি দেখছি কী করা যায়। আর সামি আসলে আমাকে খবর দেবে। 

বন্ধুরা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বিভা অমৃতাকে বলল, ‘তুই এত কথা বলতেছিলি কেন? ওরা এরকম একটা খবর শুনছে হঠাৎ করে এখন তো রিঅ্যাক্ট করবে এটাই নরমাল তাই না?’ 

অমৃতা রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘হৃদির নামে কী সব আজেবাজে কথা বলতেছিল শুনিস নাই? আমাকেও তো বলল আমি নাকি পাজি।’ 

—‘এসব বলবেই। কিছু করার নাই এখন। এই মহিলা তো এরকমই!’ 

নিচ তলায় নেমে ওরা ডাইনিং স্পেসে এসে বসলো আবার। অমৃতা বলল, ‘সামি এটা মোটেও ঠিক কাজ করে নাই। কে বলছিল ওকে তানিশাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা এত তাড়াহুড়া করে নিতে? কেন বলছিল বিয়ে করবে?’ 

বিভা বলল, ‘তানিশা বেচারির জন্যেও খারাপ লাগতেছেরে এখন। কেমন লাগবে মেয়েটার যখন বিয়ের আগের রাতে শুনতে পাবে বিয়ে ভেঙে গেছে?’ 

আকাশ বলল, ‘যা হবার হয়ে গেছে। এখন এসব নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা করা বাদ দাও তোমরা। শুনো আল্লাহ সবার জন্যেই আলাদা আলাদা প্ল্যান করে রাখছে। এই বিয়েটা ভেঙে যাওয়াই তানিশার জন্য ভালো হবে।’ 

মিনিট দশেকের মধ্যেই রোমেলা তার দুই বোনকে সাথে নিয়ে নিচে নেমে আসলেন। তাঁর গতিবিধি স্বাভাবিক নয়। সর্বাঙ্গে এক উদ্ভ্রান্ত উত্তেজনা। বন্ধুরা তাকে দেখামাত্র বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে তিনি ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আঙুল তাক করে বললেন, ‘তোমাদের আমি ছাড়ব না। তোমরাই আমার ছেলেকে এসব কুবুদ্ধি দিয়েছ। আমার সহজ সরল ছেলেটার মগজ ধোলাই করেছ তোমরা! যাও বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। এখুনি বেরিয়ে যাও!’ 

সামনে দাঁড়ানো চারটা ছেলেমেয়ের মুখ ঝুপ করে ছোট হয়ে গেলো। অপমানে কালো হয়ে চোখ নামিয়ে নিল ওরা। হক সাহেবকে দেখা গেলো দৃশ্যপটে। তাঁর পরনে এখন সাদা পাঞ্জাবি, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। তিনি এসেই দরাজ গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে?’ 

—‘এদেরকে বেরিয়ে যেতে বলো। আর কোনো দিন যেন এদের আমি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি!’ 

হক ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এই ছেলেমেয়েগুলোর সাথে দুর্ব্যবহার করছ কেন শুধু শুধু? এদের তো কোনো দোষ নেই!’ 

—‘এরাই দোষী। আমার বাচ্চাটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে এই বাজে ফ্রেন্ড সার্কেল!’ পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে বললেন রোমেলা। 

হক রোমেলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যালিকা দুজনের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ওকে উপরে নিয়ে যাও। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ কী?’ 

রোমেলাকে অনেকটা জোর জবরদস্তি করে উপরে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে এই ছেলেমেয়েগুলোকে বাড়ি থেকে এখুনি বিদেয় করতে না পারলে তিনি শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারবেন না। হক ছেলের বন্ধুদের দিকে চেয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘স্যরি! ওর মাথা ঠিক নেই। মাইন্ড করো না।’ 

—‘আমরা চলে যাব। সামির জন্য অপেক্ষা করছি।’ বিভা বলল থমথমে মুখে। 

—‘অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন কারো কোথাও যেতে হবে না। কাল সকালে যেও।’ 

কথাটা বলে তিনি অমৃতার দিকে একবার তাকালেন। অমৃতা কাঠের কারুকার্য খচিত ডাইনিং টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার ফর্সা মুখ রাগে আর অপমানে লাল টকটকে হয়ে গেছে। চোখে ধিকধিক করে জ্বলছে তেজ। হক সেই তেজের ঝলকটা টের পেলেন। কিছু একটা বলতে গিয়েও আবার বললেন না। ঢোক গিলে ফেললেন। একটু বিচলিত দেখালো তাকে ক্ষণিকের জন্য। এরপর আর কথা না বাড়িয়ে প্রস্থানোদ্যত হলেন। হেঁটে করিডোর পেরিয়ে ঢুকলেন স্টাডিরুমে। কাঠের দরজাটা বন্ধ হলো সশব্দে। রুদ্র বলল, ‘একটা ব্যাপার খেয়াল করছিস তোরা?’ 

—‘কী ব্যাপার?’ বিভার প্রশ্ন। 

—‘সামির বাপকে একটু কেমন যেন চেঞ্জড মনে হচ্ছে। আমি খুবই অবাক হইছি যে উনি আমাদের স্যরি বলছে।’ 

বিভা আড়চোখে অমৃতাকে দেখল একবার। অমৃতা তখনো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে সটান দাঁড়িয়ে আছে। বিভা একটু তটস্থ গলায় বলল, ‘কই আমার কাছে তো চেঞ্জড মনে হচ্ছে না।’ 

‘সামিরে ফোন দিয়া দেখি। আমার এখানে আর একটা মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছা হইতেছে না।’ পাঞ্জাবির পকেট থেকে সেলফোন বের করল আকাশ। 

অমৃতা যেন হঠাৎ গভীর কোনো ধ্যান থেকে জেগে উঠল। কোনো দিকে না তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে করিডোরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সে। বিভা ওর একটা হাত খামচে ধরে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’ 

অমৃতা এক ঝটকায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল, ‘ছাড় আমাকে!’

—‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’ এবার আকাশের প্রশ্ন। 

অমৃতা দায়সারাভাবে বলল, ‘আমার মোবাইলটা পাচ্ছি না।’ কথাটা বলে সে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। একটা বিভীষণ রাগ লুপ্ত করে দিচ্ছে তার চেতনা। মহিলাটা কেন তার বন্ধুদেরকে নিয়ে এমন সব আজেবাজে কথা বলে গেলো? কেন অপমান করল? আর ওই লোকটা সহজে বলে ফেলল মাইন্ড করো না, ওর মাথা ঠিক নেই! বাহ্ মাথা ঠিক না থাকলেই বুঝি যা তা বলা যায়? বেশ তো তাহলে অমৃতার মাথাও ঠিক নেই এখন! এবার সেও যা তা বলবে! 

স্টাডিরুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করা ছিল। পরপর কয়েকবার উদ্ধতভাবে দরজায় ধাক্কা দিল অমৃতা। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই দরজাটা খুলে গেলো ভেতর থেকে। হক উঁকি দিয়ে দেখলেন অমৃতাকে। দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘এসো।’ 

তাকে দেখে মনে হলো না অমৃতার উপস্থিতিতে তিনি এক ফোঁটা অবাক হয়েছেন। বরং মনে হলো যেন অমৃতার এই অসময়ের আগমন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। 

ঘরটা লম্বাটে। খুব একটা আলো নেই। পশ্চিমের দেয়ালে একটা হলদে বাতির ল্যাম্পশেড জ্বলছে শুধু। পুবদিকে প্রশস্ত খোলা জানালা। জানালার পাশে রাখা আছে একটি ছোটখাটো বইয়ের তাক। লাল কার্পেটে মোড়া মেঝে। কার্পেটের মাঝখানে একটি গোল টেবিল। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফাইলপত্র, ল্যাপটপ এবং স্বাস্থ্যবান কয়েকটি বই। টেবিলের মুখোমুখি দেয়ালে একটি বেশ বড় স্ক্রিনের এল ই ডি টিভি। এছাড়া সারা ঘরে এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে বেশ কিছু কাঠের চেয়ার। 

অমৃতা ফুঁসছিল ভেতরে ভেতরে। খুব কড়া কিছু কথা লোকটাকে শুনিয়ে দেবে বলে মনস্থির করে এসেছিল। কিন্তু ঘরে ঢোকা মাত্র লোকটার চিন্তিত, ক্লান্ত এবং অবসন্ন মুখটা দেখে সে থমকে গেলো। ম্যাজিকের মতো পাল্টে গেলো মনের আকাশের আবহাওয়া। রাগ কেটে গিয়ে তার বদলে ভিড় করল মায়া মায়া এক অনুভূতি! 

তিনি গোল টেবিল সংলগ্ন চেয়ারে বসলেন। বললেন, ‘কিছু বলবে?’

অমৃতাকে সেই মুহূর্তে একটু নার্ভাস দেখাল, ‘ইয়ে, আমার পার্সটা!’

হক হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন, ‘ওখানে আছে।’ 

ইশারা অনুসরণ করে চেয়ে দেখল অমৃতা। জানালার পার্শ্ববর্তী বইয়ের তাকের ওপর তার পার্সটা রাখা। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। তুলে নিল পার্সটা। টের পেল লোকটা শান্ত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। তার মস্তিষ্ক ক্রমশ কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বুক দুরদুর করছে। একটু আগের রাগ, ক্রোধ, উত্তেজনার বিন্দুমাত্র রেশ নেই এখন বুকের মধ্যে। উল্টো সারাটা সত্তাজুড়ে রিমঝিম এক বাজনা বেজে চলেছে। সে পার্সটা বুকে চেপে ধরে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। ম্লান গলায় প্রশ্ন করল, ‘চলে যাবো?’ 

তিনি অমৃতার স্নিগ্ধ, স্মিত মুখখানার দিকে আরো কিছুক্ষণ শান্ত চোখে চেয়ে থেকে বললেন, ‘তোমার ইচ্ছা।’ 

অমৃতা চোখ নামিয়ে নিল, ‘আপনার ইচ্ছেটা জানতে চাইছি।’ 

হক একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেললেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘থাকো। একটু পরে যেও।’ 

সিএনজি থেকে নেমে বাড়ির গেটের সম্মুখে দাঁড়ালো দুজনে। তখন রাত দুপুর। গেটের মাথায় জ্বলতে থাকা হলুদ আলোটা ঢেকে গেছে জমাট বাঁধা কুয়াশায়। চারপাশ সুনসান নীরব। ওদের গায়ে কোন গরম কাপড় নেই। দুজনেরই শীত করছিল। সামি হলুদ মেশানো কুয়াশার মাঝে আবছা হয়ে থাকা হৃদির মুখটার দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল, ‘তুই রেডি?’ 

—‘আমার খুব ভয় লাগতেছে সামি!’ 

সামি একটা হাত বাড়িয়ে হৃদিকে কাছে টেনে নিল। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ভয় পাস না, আমি আছি তো!’ 

হৃদির চোখে তখন জলের প্লাবন নেমেছে। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। কান্না জড়ানো গলায় সে কোনো রকমে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে তোর বাবা মা রাজি হবে না। এদিকে রাহাতের সাথে আমার বিয়ের কথা হয়ে গেছে। আমার আব্বা আম্মাকে কীভাবে বলবো কথাটা?’ 

সামি হৃদির খোলা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তোর কিছু বলতে হবে না। কিছু করতেও হবে না। যা করার আমি করব। আমাদের বন্ধুরা তো আছেই। তুই নিশ্চিন্ত থাক। আল্লাহ ভরসা।’ 

এটুকু বলে সামি হাতের আঙুল দিয়ে হৃদির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের রেখা মুছে দিল, মৃদুভাবে বলল, ‘এত কাঁদিস কেন তুই? তোকে না বলছি যখন তখন কান্না করার স্বভাবটা বাদ দিতে? তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগে না।’

—‘তুই এত দেরি করলি কেন সামি? কেন এত সময় লাগল তোর ব্যাপারটা বুঝতে?’ 

—‘তুই বুঝিস নাই কেন? সব কি আমার একার দায়িত্ব?’ 

—‘আমি বুঝলেই কী? তুই তো সবসময় আমাকে আজেবাজে কথা বলিস। আমি নাকি পেত্নীর মতো দেখতে, বিশ্রী চেহারা আমার। আমি কীভাবে বুঝব যে তুই আমাকে…’ 

—‘আমি তোকে?’ সামি হাসে। ফিচেল হাসি। 

হৃদি ঢোক গিলল একবার। একটু বোধহয় লজ্জাও পেল। শ্যামবর্ণ লম্বা ধাঁচের মুখটা হঠাৎ কেমন এক মায়াবী লালিমায় ছেয়ে গেলো। আস্তে করে বলল ‘জানিনা…’ 

—‘কী জানিস না?’ 

—‘তোকে বুঝি না!’ 

—‘বুঝিস না কেন?’ 

—‘কখনো বলিস না তো কিছু!’ 

—‘সব কথা কি বলতে হয়?’ 

হৃদি মাথাটা আলতোভাবে রাখল সামির বুকের ওপর। আদুরে গলায় বলল, ‘না হয় না। ভালোবাসার কথা অত বলতে নাই।’

সামি হৃদির চুলে মুখ ডুবিয়ে ঠাট্টার ছলে বলল, ‘ভালোবাসা? সেটা আবার কী?’ 

—‘সেটা একটা ফুলের নাম।’ 

—‘কোথায় পাওয়া যায় সেই ফুলটা?’ 

—‘মানুষের বুকের ভেতর। মনের মাঝে।’

—‘তাই?’ 

—‘হুম তাই। সামি! আমি সেই ফুলটার ঘ্রাণ পাচ্ছি এখন। তুই কি পাচ্ছিস?’ 

সামি হৃদির কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘পাচ্ছি!’ 

কথাটা জলতরঙ্গের সুরের মতো স্নিগ্ধ এক আবেশে ডুবিয়ে দিয়েছিল অমৃতাকে, ক্ষণিকের জন্য! 

আবছা হলুদাভ আলোয় সে মুখ তুলে তাকাল মানুষটার দিকে। গভীর চোখ দুটো তাকেই দেখছিল। সেই চোখে এখন ক্রোধ নেই, তেজ নেই, নেই কোনো গাম্ভীর্য। আছে শুধু ক্লান্তি, হতাশা, আর ক্লেশের সুস্পষ্ট ছাপ। অমৃতা দরজার কাছ থেকে সরে এলো। নিঃশব্দে দাঁড়াল টেবিলের সামনে, লোকটার মুখোমুখি। দাঁড়িয়েই থাকল বেশ খানিকক্ষণ। চারপাশ বড় বেশি নিস্তব্ধ। সিলিংয়ে ঝোলানো ফ্যান ঘুরছে না, এয়ারকন্ডিশন চলছে না। নিশ্বাসের ওঠানামার শব্দ আর হৃৎপিণ্ডের টিকটিক নাচনটা কানে এসে লাগছে। 

—‘বসো।’ তিনি বললেন। 

অমৃতা বসলো চেয়ার টেনে। বাধ্য মেয়েটির মতো। 

—‘সামি এসব কী করছে?’ 

অমৃতা একটা বড় শ্বাস ফেলল। স্থিরতার সাথে বলল, ‘ও তানিশাকে বিয়ে করতে পারবে না রাশেদ!’ 

এবার রাশেদের গলা চড়ল, ‘বিয়ে করতে পারবে না এই বিষয়টা একেবারে বিয়ের আগের রাতে এসে রিয়ালাইজ করল?’ 

—‘হ্যাঁ শুনতে বা মানতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি।’ 

রাশেদ উত্তেজিতভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় পায়চারি করতে করতে বললেন, ‘বিয়ে ক্যানসেল করা এখন কোন ভাবেই সম্ভব নয়।’ 

—‘কেনো সম্ভব নয়?’ 

—‘সম্ভব নয় কারণ বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে। মেয়েটার পরিবারকে আমরা এখন কী জবাব দেবো? এটা কি ছেলেখেলা নাকি? তোমার বন্ধু দেখি আমার মান সম্মান না ডুবিয়ে ক্ষান্ত হবে না! 

—‘আপনার কাছে আপনার ছেলে বড়? নাকি মান সম্মান বড়?’ 

তিনি হঠাৎ হাঁটা থামালেন। সরাসরি অমৃতার চোখে চেয়ে বললেন, ‘সামিকে আমার ভীষণ কনফিউজড মনে হচ্ছে।’ 

—‘এমন কেন মনে হলো আপনার? হঠাৎ?’ 

তিনি একটু দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি জানতাম একটা সময় বিভার সাথে ওর মানসিক বোঝাপড়া ছিল। কদিন আগে হুট করে তানিশাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো। আজ শুনলাম হৃদিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। এত ফ্লেক্সিবল কেন আমার ছেলেটা? ও কি প্রায়ই এরকম সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে?’ 

—‘রাশেদ, মাথা ঠান্ডা করে একবার আপনার ছেলের সাইকোলজিটা বোঝার চেষ্টা করুন প্লিজ। আমি বুঝিয়ে বলছি। আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন।’ 

রাশেদ এগিয়ে আসলেন। এবার টেবিলের উল্টোদিকে নয়, অমৃতার পাশের চেয়ারটাই টেনে নিয়ে ওর মুখোমুখি বসলেন। গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘বলো, শুনছি।’ 

—‘সামি তানিশাকে পছন্দ করে না।’ 

—‘তাহলে বিয়েতে রাজি হয়েছিল কেন? –’বিভাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য।’ 

হক সাহেবের কপালে কয়েকটি কুঞ্চন রেখা তৈরি হলো। তিনি প্ৰবল বিস্ময় নিয়ে বললেন, ‘এসব কী বলছ তুমি?’ 

—‘সত্যি বলছি।’ 

—‘বিভাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য মানে? আমি বুঝতে পারছি না।’ অমৃতা বলল, ‘ডুয়ার্সে যাবার পর সামি আর হৃদির মাঝে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। এক্সিডেন্টলি।’ 

রাশেদ বিপন্ন গলায় বললেন, ‘কী ঘটনা? ‘ 

—‘প্রথমে একটা বিষয় জেনে রাখুন যে এসব কথা আমি নিতান্তই নিরুপায় হয়ে আপনাকে বলছি। যাতে করে আপনি সামিকে বুঝতে পারেন। এবং বুঝতে পেরে যেন এই বিয়েটা ক্যানসেল করেন। আমার বন্ধুর ব্যক্তিগত বিষয় আপনার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্য একটাই, বিয়েটা ভেঙে দেওয়া।’ 

—‘বুঝলাম। এখন বলো, ডুয়ার্সে কী হয়েছিল?’ 

—‘ডুয়ার্সের ঘটনার আগে আপনাকে আরেকটা ব্যাপার বলতে হবে। বিভার বিয়ের পর থেকে হৃদিই সর্বক্ষণ সামির সঙ্গে ছিল। মানে আমরাও সাথে ছিলাম বাট হৃদির থাকাটা একটু স্পেশাল ছিল। এই ধরেন দুজন রাত জেগে কথাটথা বলত, আলাদাভাবে হ্যাং আউট করত। বিভার বিয়ের পর তো প্রায় দুই মাসের মতো বিভার সাথে সামির কোনো যোগাযোগ ছিল না। ওই সময় হৃদি যদি সামির পাশে না থাকত, তাহলে কী হতো আল্লাহ জানে! সো বুঝতেই পারছেন সামি আর হৃদির বন্ধুত্ব কতটা স্ট্রং ছিল।’ 

—‘বুঝতে পারছি।’ গম্ভীর স্বরে বললেন তিনি। তার কপাল এখনো কুঞ্চিত। চোখ দুটি তীক্ষ্ণ। 

—‘তো ডুয়ার্সে যাবার পর…’ অমৃতার চোখে হঠাৎ কোত্থেকে যেন এক পশলা সংকোচ এসে ভিড় করল। হক দেখলেন সামনে বসা পুতুলের মতো আদুরে মেয়েটার কানের ডগা লাল হয়ে উঠেছে এবং সেই সময় তিনি আবিষ্কার করলেন যে চরম দুঃসময়েও এই আদুরে মুখটার দিকে চেয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে। এবং এই ভালো লাগাটাকে তাঁর এখন আর কোনোমতেই অশোভন বা বিধিবিরুদ্ধ বলে মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে যেন এটাই স্বাভাবিক, এটাই নিয়তি। হ্যাঁ নিয়তি! নিয়তি মানবজীবনের কোন চোরা পথ দিয়ে যে ঠিক ঠিক গন্তব্যে এসে পৌঁছে যায়, মানুষ যদি তা জানত! 

—‘কী হলো?’ প্রশ্ন করলেন তিনি। 

অমৃতা স্তিমিত কণ্ঠে বলল, ‘ডুয়ার্সের প্রথম সন্ধেবেলায় সামি হৃদিকে বিভা ভেবে ভুল করে কিস করে ফেলেছিল।’ 

হক থমকালেন। অপ্রস্তুত হলেন। অস্বস্তি চিলিক দিয়ে উঠল তাঁর চোখে। নিজ পুত্র সম্পর্কে এমন একটি অপ্রীতিকর তথ্য শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। চোখ সরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। কেন কে জানে চোখ সরিয়ে নেবার পরেও আড়চোখে একবার তাকালেন মেয়েটার দিকে। মেয়েটা এখন মিটমিট করে হাসছে। একটা ঐন্দ্রজালিক রহস্য খেলা করছে তার মিটমিটে হাসিটায়। 

তিনি কেশে গলা পরিষ্কার করলেন একবার। গমগম করে উঠে বললেন, ‘এটা কোনও কথা হলো?’ 

অমৃতার কর্ণকুহরে শব্দগুলো প্রবেশ করল না। তার মুখে তখনো মুচকি হাসিটা ঝুলছে। কী যেন ভাবছে সে, আনমনে! 

—‘কী হলো?’ 

অমৃতার ধ্যান ভাঙল। চোখ তুলে তাকালো একহাত দূরে বসা মানুষটার দিকে। মানুষটা কঠিনভাবে বললেন, 

—‘কথা বলছ না কেন? হাসছ কেন?’ 

অমৃতা হাসতে হাসতে বলল, ‘হঠাৎ একটা কথা মনে হলো, তাই হাসছি।’

—‘কী কথা?’ 

—‘বলা যাবে না।’ 

ভ্রুকুটি করে তাকালেন তিনি অমৃতার দিকে। ডুয়ার্সের ঘটনাটা শোনার পর থেকে তাঁর মুখের ভাব বেশ প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে। হয়তো পুত্রের বন্ধুর মুখ থেকে পুত্র সম্পর্কে এহেন অশোভন তথ্য জানতে পারায় তিনি মনে মনে বিব্রত বোধ করছেন। তাঁর বিবেক বরাবরই বেশ জাগ্রত। কিন্তু এই মুহূর্তে বিবেককে ছাপিয়ে দ্বন্দ্বের মতো কিছু একটা কাজ করছে ভেতরে। একটা মন ভাবছে যে নিজের ছেলের বয়সী একটি মেয়ের সাথে এত খোলামেলা আলাপ করাটা তাঁর জন্য ন্যায়সংগত বা মানানসই নয়। আবার আরেকটা মন বলছে, এই মুহূর্তে শুধু এই একটি মাত্র মানুষের সাথেই মন খুলে কথা বলা যায়। তাবৎ সংসারের হরেক রকম ভান ভণিতা আর কৃত্রিমতায় মোড়া দুর্বোধ্য সব মানুষের ভিড়ে এই একটি মাত্র মানুষই যেন প্রত্যয়যোগ্য বিশ্বাসভাজন। তিনি দেশের একজন প্রভাবশালী নাগরিক। টাকা এবং ক্ষমতার জোরে চাইলেই দিনকে রাত অথবা রাতকে দিন করতে পারেন। অথচ প্রকৃতির কী নির্মম পরিহাস, নিজ পুত্রের হৃদয় ঘটিত মামলায় আজ তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি কোনো কাজে আসছে না। তাঁর মতো ক্ষমতাধর মানুষকে মানসিক নির্ভরতার জন্য হাত পাততে হচ্ছে পুঁচকে এক মেয়ের কাছে। প্রকৃতি সত্যই, বড় বেশি সৃষ্টিছাড়া, গোলমেলে আর বিচিত্র! 

তিনি কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘কথা শেষ কর।’ 

অমৃতা নড়েচড়ে বসে বলল, ‘এরপর হলো কি, বিভাকে যখন ওই ঘটনাটির কথা বলা হলো তখন বিভা ভুল বুঝল। সে সঙ্গে সঙ্গে সামির সাথে ব্রেকআপ করল।’ 

—‘হ্যাং অন! ব্রেকআপ মানে? বিভার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ব্রেকআপ আসলো কোত্থেকে?’ 

—‘বিভা ঠিক করেছিল সে অভিজিৎকে ডিভোর্স দিবে। তারপর সামিকে বিয়ে করবে।’ 

হক উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘এতো সাংঘাতিক ব্যাপার!’ 

কথাটা শুনে অমৃতা কেন যেন একটু থমকে গেলো। কয়েকটা সেকেন্ড নিষ্পলক চেয়ে থাকল লোকটার মুখের দিকে। তারপর স্তিমিত গলায় বলল, 

—‘প্রথমে যখন শুনেছিলাম তখন আমার কাছেও ব্যাপারটা সাংঘাতিক খারাপ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন আমি জানি যে ভালোবাসলে মানুষ অবিবেচকের মতো অনেক সাংঘাতিক কাণ্ড করে বসে।’ 

একটা ইঙ্গিত ছিল কথাটায়। তিনি বুঝলেন এবং বুঝতে পেরে বাস্তবিকই অস্বস্তি বোধ করে উঠলেন। কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে বললেন, ‘তারপর?’ 

—‘তারপর বিভা যখন সামির সাথে ব্রেকআপ করল, তখন সামি ঠিক করলো বিভাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাকেও একটা বিয়ে করতে হবে। ব্যস রাজি হয়ে গেলো বিয়েতে। কিন্তু তানিশার সাথে ওর মিলছিল না কোনো দিক দিয়েই। আপনি জানেন কিনা জানি না। সামিটা অনেক অন্যরকম। আপনি তো সারাজীবন ওকে বিত্তবৈভবের মধ্যেই বড় করেছেন। কিন্তু সেই বিত্ত বৈভবে আপনার ছেলের কখনোই মন লাগেনি। সম্পদের মোহ তাকে বাঁধতে পারেনি। ধন সম্পদ বা পশ লাইফ স্টাইল না, ওর চাই একজন মনের মানুষ। আপনারা কি এটা বোঝেন?’ 

একটু থেমে অমৃতা আবার বলল, ‘তানিশার সাথে ওর মানসিকতার আকাশ পাতাল ফারাক। তানিশা ধনী লোকদের সঙ্গ পছন্দ করে। এদিকে সামি চব্বিশ ঘণ্টা ওঠা বসা করে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ ছেলেমেয়েদের সাথে। তানিশার হয়তো পাঁচতারা হোটেলে ডিনার পছন্দ, আর সামির পছন্দ মোস্তাকিমের চাপ সাথে বন্ধুদের আড্ডা। বিভার মতো করে, কিংবা বিভার চাইতেও বেশি করে সামিকে একমাত্র হৃদিই ভালোবাসতে পারবে। বিভা আর হৃদিতে খুব মিল। দুজনের পছন্দও একই রকম। দুজনেই সামিকে ভালোবাসে! তবে একটা জিনিস জেনে রাখুন, বিভা কিন্তু মন দিয়ে সংসার করছে এখন। সামির প্রতি যে আসক্তিটা ওর ছিল সেটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। কেটে গেছেও অনেকখানি। এদিকে সামি প্রথমবার বিভার চলে যাওয়াটা সামলে উঠতে পারলেও, দ্বিতীয় বার হৃদির চলে যাওয়াটা কিন্তু আর সহ্য করতে পারবে না।’ 

হক চুপ করে রইলেন। তাঁর চোখে মুখে এক ধরনের বিহ্বল ভাব খেলছে। মেয়েটির অকপট বলে যাওয়া কথাগুলো তাঁকে যেন সম্মোহিত করে ফেলছে ধীরেধীরে। তাঁর মনে হচ্ছে এত গোছানো এবং যৌক্তিক কথা তিনি এর আগে কখনো কাউকে বলতে শোনেননি। 

অমৃতা বলল, ‘বিভার চলে যাওয়াটা সামির জীবনের অনেক বড় একটা দুর্ঘটনা ছিল। আপনারা সেটা কতটা বুঝতে পেরেছেন জানি না। আল্লাহর অশেষ রহমত যে আপনার ছেলে বিয়ের আগেই এটা রিয়েলাইজ করতে পেরেছে সে আসলে কাকে চায়। হৃদিকে ছাড়া তার একটা মুহূর্তও চলে না। ট্রাস্ট মি।’ 

হক একটা বড় শ্বাস ফেললেন। ডান কনুইটা টেবিলের ওপর রেখে নিজের কপাল চেপে ধরলেন হাত দিয়ে। ক্লান্তভাবে বললেন, ‘কিন্তু এখন কী করে সম্ভব? কাল এগারোটায় আকদ হওয়ার কথা। আমি ওই মেয়েটার বাবা মাকে কী জবাব দেবো? তাছাড়া সামির আম্মা কোনোভাবেই মানবে না।’ 

অমৃতার পার্সের ভেতরে সেলফোনটা ভাইব্রেট করছিল। ফোন বের করে দেখল সে। আকাশের ফোন। ধরতেই ওপাশ থেকে আকাশ বলল, ‘তুই কোথায়? ওরা চলে আসছে।’ 

—‘আচ্ছা আমি আসতেছি।’ 

ফোন রেখেই অমৃতা উঠে দাঁড়ালো, ‘সামি আসছে। চলেন।’ 

হক সাহেব কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তাকালেন একবার অমৃতার দিকে। গভীর চোখদুটো যেন কিছু একটা বলে উঠল। অমৃতা বোধহয় সেই চোখের ভাষা বুঝে নিয়েই বলল, 

—‘আপনাকে স্ট্রং হতে হবে। আপনার স্ত্রীকে বোঝাতে হবে। এবার যদি আপনারা সামির পছন্দ না মেনে নেন, তাহলে… তাহলে খুব খারাপ হবে।’ এটুকু বলে একটু থেমে সে আবার বলল, ‘আপনি এত চিন্তা করবেন না রাশেদ, আমি আছি তো!’ 

অমৃতার বলা শেষ বাক্যটা শুনে রাশেদ তাঁর ধারওয়ালা সুন্দর মুখখানা ভরে চমৎকার হাসলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। অমৃতা মুগ্ধ হয়ে সেই হাসির দিকে অপলক নেত্রে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল, ‘তখন কী ভাবছিলাম জানেন? 

রাশেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে রোলেক্সের হাতঘড়িটা তুলে নিলেন, ‘কী ভাবছিলে?’ 

—‘ভাবছিলাম যে ভালোবাসার মানুষকে চুমু খেতে কেমন লাগে?’ 

রক্তের একটা ঝলক এসে লাগল তাঁর মুখে। হাতের কবজিতে ঘড়ির বেল্ট বাঁধতে গিয়ে থমকে গেলেন এক মুহূর্তের জন্য। তারপর খানিক বিচলিত গলায় বললেন, ‘তুমি যাও, আমি আসছি।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *