বৃষ্টিমহল ৩.৪৫

৪৫

সামি বাড়ি ফিরল রাত দশটায়। ততক্ষণে দুই বান্ধবীর কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে এসেছে। কিছু বাকি আছে এখনো। যেগুলো কোনোভাবেই আজ রাতের ভেতর শেষ করা সম্ভব না। বিভার এর মাঝেই হাতে পায়ে ঝিম ধরে গেছে একটানা কাজ করতে গিয়ে। সামি বান্ধবীদের নিয়ে নিজের ঘরে এলো। তার বেডরুমটা বিশাল। সাধারণত ব্যাচেলার ছেলেদের ঘর যেরকম অগোছালো থাকে এই ঘরটা সেরকম নয়। সামি ঘর থেকে বেরোলেই চাকর বাকররা এসে ঘর ধুয়ে মুছে পরিপাটি করে রেখে যায়। তবে তার ঘরে খুব বেশি আসবাব নেই। এমনকি একটা ড্রেসিং টেবিল পর্যন্ত নেই। সারা ঘরের দেয়াল জুড়ে দেশি বিদেশি মিউজিক ব্যান্ড দলের পোস্টার ঠাসা। বিয়ে উপলক্ষে ঘরের আসবাব পরিবর্তন করা হবে। বিভা অনেকক্ষণ যাবৎ কী ধরনের আসবাব কেনা উচিত, কোত্থেকে কেনা উচিত তা নিয়ে সামিকে জ্ঞান দিল। তিন বন্ধু মিলে অনলাইন ঘেঁটে সিদ্ধান্ত নিল কোন ফটোগ্রাফারকে ভাড়া করা হবে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। অনুষ্ঠানে একটি গানের দল এবং একটি নাচের দল আসবে। সেই দল নির্বাচন করার ভার দেওয়া হয়েছে রুদ্রর ওপর। ঠিক করা হলো বরপক্ষ এবং কনেপক্ষ প্রবেশের সময় আলাদা আলাদা বাজনা বাজবে। এসব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বেশ কিছু সময় কেটে গেলো। রাত এগারোটার দিকে বিভা আলোচনায় ইতি টেনে উঠে দাঁড়ালো, ‘বাসায় যাইতে হবে। অনেক রাত হয়ে গেছে।’ 

—‘আজকে থাইকা যা।’ সামি বলল। 

—‘না থাকতে পারব না। কালকে খুব সকালে চেম্বারে যাইতে হবে। কাজ আছে। বাসায় গিয়ে কাজ করতে হবে।’ আপত্তি জানালো অমৃতা। 

—‘চল, নামায় দিয়ে আসি তোদের।’ 

—‘না থাক। তুই টায়ার্ড। আমরা উবার ডাকতেছি।’ 

—‘শিওর?’ 

—‘শিওর।’ 

দুই বান্ধবী ঘর ছেড়ে বেরোবার সময় পেছন থেকে হঠাৎ ডেকে উঠল সামি। দাঁড়ালো ওরা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সামির হাতে একটি সরু লম্বা কাগজ। বিভার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, ‘যাবার সময় এটা বাবাকে একটু দিয়ে যাস তো। বাবা নিচেই আছে। স্টাডিরুমে মনে হয়। আমার দোস্ত টায়ার্ড লাগতেছে। নিচে নামতে ইচ্ছা করতেছে না।’ 

বিভা কাগজটা হাতে নিয়ে একটু অবাক গলায় বলল, ‘কী এটা?’

—‘লিস্ট।’ 

—‘কীসের লিস্ট?’ 

—‘বাবা ইউ এস এ যাচ্ছে আমার বিয়ের পরদিন। আমার জন্য কী কী আনতে হবে তার লিস্ট। এখন না দিলে আমি পরে আবার ভুলে যাব।’ 

—‘এত কিছু! হৃদির জন্য কিছু লিখিস নাই?’ 

—‘ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল কিছু লাগবে না। আর আমি কী লিখব? মেয়েদের জিনিস অত চিনি নাকি?’ 

বিভা আর কথা বাড়াল না। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কাগজটা অমৃতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘যা তুই দিয়ে আয়। আমি ওয়েট করতেছি। বেশি দেরি করিস না।’ অমৃতা একটু আড়ষ্টভাবে কাগজটা তুলে নিল হাতে। ঈষৎ মুচকি হাসল। সৃষ্টিকর্তা মাঝে মাঝে এমনি করেই মানুষের মনের চাওয়া পূরণ করে দেন। মুখ ফুটে চাইতে হয় না তার কাছে। মনের আকুতি নিজ গতিতেই পথ খুঁজে খুঁজে ছুটে যায় বিশ্ববিধাতার দরবারে। 

দরজায় দুবার করাঘাত করল অমৃতা। 

—’কে?’ 

—‘আমি।’ 

ওপাশে শব্দ নেই কোনো। বেশ খানিকক্ষণ পর শব্দটা ছুটে আসলো, ‘এসো।’ 

ঘরের ভেতরে ল্যাম্পশেডের মসৃণ হলুদাভ আলো জ্বলছে। এয়ার কন্ডিশনের বাতাসে ঘরটা বেশ ঠান্ডা। রাশেদ টেবিল সংলগ্ন চেয়ারে বসে ছিলেন। অমৃতাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালেন তিনি। অমৃতা হাতের কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘সামি দিয়েছে।’ 

তিনি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলেন। গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ধন্যবাদ।’ অমৃতা চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বলল –’কতদিনের জন্য যাচ্ছেন?’ 

—‘কোথায়?’ ডান কনুই টেবিলের ওপর রেখে চিবুকে হাত দিয়ে গাঢ় চোখে দেখছিলেন তিনি অমৃতাকে। 

—‘ইউ এস এ?’ 

—‘ও, এক মাস।’ 

অমৃতার চোখদুটোতে হালকা অভিমান ভেসে উঠল, ‘এতদিন!’ রাশেদ হাসলেন, ‘খুব বেশিদিন কি?’ 

—‘বেশিদিন নয়?’ 

—‘নাহ… খুব বেশিদিন নয়। তোমার কিছু চাই?’ 

—‘আমার?’ 

—‘হুম… কিছু লাগবে? মোবাইল, ল্যাপটপ বা অন্য যে কোনো জিনিস। কসমেটিক্স ..অবশ্য তুমি অন্য মেয়েদের মতো কসমেটিক্স ফ্রিক নও বলেই আমার ধারণা।’ 

অমৃতা বক্র হাসে, ‘আমিও কি লিস্ট করে দেবো?’ 

—‘নিশ্চয়ই।’ 

কথাটা বলে রাশেদ একটি কাগজ আর কলম এগিয়ে দিল অমৃতার দিকে। কিছুক্ষণ আকাশ পাতাল ভাবল অমৃতা। তারপর কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে তরতর করে লিখে ফেলল অনেক কিছু। লেখা শেষ করে কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নিয়ে এসেন মনে করে।’ 

—’শিওর!’ 

—‘আর ওই মেয়েটা আপনার অত গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল কেন?’ থমথমে গলায় প্রশ্ন করে অমৃতা। 

রাশেদ ভীষণ অবাক! 

—‘কার কথা বলছ?’ 

—‘আপনার অফিসের মেয়েটা।’ 

অমৃতা কথাটা শেষ করতেই তিনি হো হো শব্দে হেসে উঠলেন। মনে হলো যেন অনেক অনেকদিন পর তিনি এরকম প্রাণ খুলে হাসতে পারলেন। অমৃতা হাসিটা পাত্তা না দিয়ে রাগ রাগ গলায় বলল, ‘ক্যান আই গিভ ইউ আ লিটেল পিস অব এডভাইজ? মেয়েদের অত কাছে ঘেঁষতে দেবেন না। বুঝেছেন?’ রাশেদ কোনো কথা বলতে পারলেন না। হাসতেই থাকলেন। অমৃতা সেদিকে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ চেয়ে থেকে একটা বড় শ্বাস ফেলল। এই হাসির দিকে আরও কিছুক্ষণ একটানা চেয়ে থাকলে ভালো লাগায় তার দম বন্ধ হয়ে যাবে। সে মৃদু গলায় বলল, ‘যাই!’ 

অমৃতা চলে যাবার পর রাশেদ ছেলের দেওয়া লিস্টটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তাঁর ছেলে প্রযুক্তি ভালোবাসে। প্রতিবার বিদেশ যাত্রার সময় একগাদা ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসের তালিকা ধরিয়ে দেয় সে বাবার হাতে। রোমেলাও প্রতিবার লিস্ট বানাতে ভুলেন না। এবারেও একটি লিস্ট করে দিয়েছেন তিনি। কসমেটিকস, ব্যাগ, শ্যাম্পু, জুয়েলারি এমনই সব শৌখিন জিনিসে ঠাঁসা সেই লিস্ট। সামির দেওয়া লিস্টটা সামনে থেকে সরিয়ে তিনি অমৃতার লেখা কাগজটা মেলে ধরলেন সম্মুখে। পড়তে গিয়ে তাঁর চোখ দুটো পূর্ণব্যাদিত হয়ে উঠল, মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়ের গাঢ় রেখা! অমৃতা লিখেছে, 

লিস্ট: 

১/রাশেদ 

২/রাশেদ 

৩/রাশেদ 

৪/রাশেদ 

৫/রাশেদ 

৬/রাশেদ 

৭/রাশেদ 

৮/ রাশেদ 

তালিকাভুক্ত জিনিসপাতি আমার জন্য নিয়ে আসতে ভুলবেন না কিন্তু! 

৪৬

বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসা হলো। পরিবর্তিত পরিকল্পনা দুপক্ষের সম্মতিক্রমেই নেয়া হয়েছে। তবে কনেপক্ষের জন্য এই নতুন সিদ্ধান্তটি হাসিমুখে মেনে নেয়া একটু কষ্টকর হয়ে উঠল। হক সাহেবের ফুপুর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ডাক্তার তাঁকে এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন। এ কদিন তিনি ভাতিজার বাসায়ই থাকবেন। গ্রাম থেকে আত্মীয়স্বজনরা তাঁকে দেখার উদ্দেশ্যে ঢাকা শহরে ভিড় জমানো শুরু করেছে এর মাঝেই। ফুপু ভাতিজার কাছে আবদার করেছেন যে নাতবৌকে যেন এই যাত্রায়ই বাড়ি তুলে আনা হয়। তাঁর বড়ই শখ জীবনের শেষ কয়েকটা দিন তিনি নতুন বৌয়ের সঙ্গে এক ছাদের নিচে কাটাবেন। একমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী ফুপুর উপরোধে হক সাহেবকে সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনতেই হলো। এদিকে হৃদির আব্বার আপাতত মেয়ে বিদায় করার কোনো প্ল্যান ছিল না। আরো কয়েকমাস পর ধুমধামের সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। এর মাঝে বরযাত্রীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। সামিদের গ্রামের বাড়ি থেকে আসা আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতি এখন আর এড়ানো যাবে না বিয়ের অনুষ্ঠানে। এত লোক হৃদিদের পনেরোশ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে কোনো মতেই আঁটবে না। নিরুপায় হয়ে বাড়ির কাছের একটা কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করলেন হৃদির বাবা। ঢাকা শহরে মোটামুটি ভালো মানের কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে অনেক আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো আগামী দু তিনমাসের মধ্যে কোনো শুক্রবারেই এদের কোনোটি ফাঁকা নেই। অগত্যা বাড়ির কাছের অতি সাধারণ সেন্টারটাই একমাত্র ভরসার স্থান হয়ে দাঁড়ালো। হক সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমেরিকা থেকে ফেরার পর ধুমধাম করে বউভাতের অনুষ্ঠান করবেন। রাজনৈতিক লোকজন থেকে শুরু করে দাপ্তরিক এবং মিডিয়ার লোকজন কেউই বাদ পড়বে না সেই যাত্রায়। 

বিয়ের আগের রাতে হৃদির এক ফোঁটা ঘুম হলো না। একই অবস্থা হলো সামিরও। আপাতত মা তার সমস্ত দুশ্চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। ছেলের জীবনের এমন একটি বিশেষ সময়ে মায়ের মুখ কেন যে অমন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের আকাশের মতো থমথমে কালো হয়ে আছে সর্বক্ষণ সেই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? এই একটি প্রশ্নই সামির ভেতরের সমস্ত শিহরণ, উত্তেজনা, এবং আনন্দকে থেঁতলে একদম ভোঁতা বানিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবুও এ কথা সত্যি… কাল থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ভোরবেলা চোখ মেলতেই সে হৃদিকে দেখতে পাবে নিজের পাশে, এই ভাবনাটা ভাবতেই শরীর মন এক স্নিগ্ধ আবেশে ডুবে যাচ্ছে, রক্তকণিকায় এসে লাগছে উষ্ণ ঝাপ্টা। কাল থেকে শুরু হবে তার ইচ্ছে জীবন। যে জীবনে ইচ্ছে হলেই ডুয়ার্সের সেই সন্ধ্যাবেলার মেয়েটিকে কাছে পাওয়া যায়। নিজের করে নেয়া যায়! 

হৃদির দুশ্চিন্তা অন্যরকম। এত দ্রুত নিজের বাড়ি ছেড়ে যাবার কোনো মানসিক প্রস্তুতি তার ছিল না। সে ধরেই নিয়েছিল আরো সাত আট মাস নিশ্চিন্তে এ বাড়িতে কাটাতে পারবে, বাবা মায়ের সাথে। তাই এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত বদলটা তাকে বেশ নাড়া দিয়ে গেছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে সে। কারণে অকারণে বুক মোচড় দিয়ে উঠছে। মায়ের দিকে তাকালে চোখ ভরে আসছে জলে। বাবার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন নিজের এতদিনের ভীষণ আপন আর পুরনো জীবনের খোলস খুলে রেখে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনে জোরপূর্বক পা রাখতে হচ্ছে তার। অথচ সে তো বিভার মতো দেশান্তরী হচ্ছে না। ঢাকা শহরেই তার শ্বশুরবাড়ি। যখন ইচ্ছে তখন বাবা মায়ের কাছে ছুটে আসতে পারবে। বন্ধুদের দেখতে পাবে। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যে মানুষটা তার জীবনসঙ্গী হতে যাচ্ছে সেই মানুষটা তার কাছে একেবারেই নতুন বা অচেনা কেউ নয়। সে তার অনেক দিনের পুরনো বন্ধু। এর চেয়ে বড় স্বস্তির বিষয় আর কী হতে পারে? তবুও সব কিছু সজ্ঞানে উপলব্ধি করার পরেও তার বুকের ভেতরটা কোনো এক অজানা কারণে খানিক বাদে বাদে কম্পান্বিত হয়ে উঠছে। হাঁসফাঁস লাগছে। তবে এই নিদারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ একটি সুতীব্র সুখস্পর্শ বিদ্যুতের মতো চিলিক দিয়ে যাচ্ছে মেরুদণ্ড দিয়ে। ভালোলাগার ভোমরাটা মস্তিষ্কের এবড়োখেবড়ো, উতরোল মুখর শিরা উপশিরার ফাঁক গেলে গুনগুন করে উড়ে বেড়াচ্ছে আবছাভাবে। আল্লাহ তাআলার অসীম কৃপায় শেষ পর্যন্ত সে তার পছন্দের মানুষটিকে পেতে যাচ্ছে সারা জীবনের জন্য! কজনে পায়? বিভা পায়নি। অমৃতাটা তো পাগল। নিজ হাতে নিজের সর্বনাশের ডালা সাজাচ্ছে পাগলিটা। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে হৃদি সত্যই, ভীষণ ভাগ্যবতী! 

ভাবতে গিয়ে অবাক লাগে হৃদির। মানুষের জীবন আসলে বড় বেশি অদ্ভুত, অবিদিত এবং কখনো কখনো বিস্ময়কর! সামির সাথে প্রেম ছিল বিভার, বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তানিশার, কিন্তু শেষ অবধি তাকে জন্ম জন্মান্তরের জন্য পেয়ে গেলো হৃদিতা। পেয়েছে কি সত্যই? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে সে। ভেতর থেকে আরেকটা হৃদি সহাস্যে বলে ওঠে, ‘পেয়েছ, পেয়েছ, সে তোমার, শুধুই তোমার!’ 

৪৭

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ভার অনেকখানিই রুদ্র আর আকাশের ওপর পড়েছে। দুই বন্ধু বিয়ের দিন ভোর বেলা থেকে লেগে গেছে কাজে। বাসরঘর আর বরের গাড়ি সাজানোর জন্য লোক ভাড়া করে আনা হয়েছে। কাজের তদারক করছে রুদ্র। আকাশ সকালবেলা ছুটে গেছে কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানে স্টেজের সাজসজ্জার পালা চলছে। হৃদির আব্বাও সেখানে উপস্থিত আছেন। বাবুর্চি রান্নাবান্নার প্রক্রিয়া দেখাশোনা করছেন তিনি। 

বিভা আর অমৃতা হৃদির সাথে পার্লারে গেলো দুপুর দুটায়। হৃদির লেহেঙ্গাটা হালকা বেগুনি রঙের। সারা গায়ে পাথর আর সুতোর ভারি কাজ করা। দাম লক্ষ টাকার ওপরে। ওজন এত বেশি যে জিনিসটা গায়ে চাপানোর পর মনে হতে লাগল লোহা জুড়ে দেওয়া হয়েছে শরীরের সঙ্গে। নিশ্বাস নেয়া দায়! অমৃতার শাড়ি পরার কোনো ইচ্ছে ছিল না এবারে। কিন্তু হৃদির জোরাজুরিতে তাকে পরতেই হলো। কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তার নিজস্ব কোনো শাড়ির কালেকশন নেই। মায়ের শাড়ি পরা যায় কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্লাউজের মাপ নিয়ে সমস্যা হয়ে যাবে। শেষমেশ বিভার কাছ থেকেই একটা শাড়ি ধার করে পরল। জলপাই রঙের কাতান বালুচরি। জীবনে এই প্রথমবার পার্লারে সাজলো সে। খুব ভয়ে ভয়ে। না জানি কোন সং এর মতো সাজিয়ে দেবে তাকে! সাজ শেষ হবার পর ভীত বক্ষ নিয়ে চোখ মেলে দেখল সে আয়নার ভেতর নিজের মুখটা। পিলে চমকে উঠল 1 আর্ত গলায় করে উঠল স্বগতোক্তি, ‘আল্লাহ! কী ভয়ংকর!’ 

বিভা ওর পাশেই বসা ছিল। একটি পাতলা গড়নের পাহাড়ি মেয়ে যত্নের সাথে তার চোখ সাজাচ্ছিল। অমৃতার আর্তনাদ শুনে মেয়েটির হাত থেমে গেলো। বিভা তার ডাগর দুটি চোখ মেলে দেখল পাশে বসা অমৃতাকে। ওমা, কী সুন্দর লাগছে! বলে কিনা ভয়ংকর দেখাচ্ছে। ধমকে উঠল বিভা, ‘খুবই সুন্দর লাগতেছে। একদম চুপ করে থাক।’ অমৃতা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অসম্ভব আমি এখনই মুখ ধুয়ে আসতেছি। এই জবরজং সাজ আমি রাখবই না।’ 

বিভা আকুলি বিকুলি হয়ে বলল, ‘দোস্ত প্লিজ।’

অমৃতা নিজের সিদ্ধান্তে অটল, ‘ইম্পসিবল!’ 

বিভাকে দেখে মনে হলো সে এখুনি কেঁদে দেবে, ‘দোস্ত পায়ে পড়ি! পায়ে পড়ি তোর!’ 

—‘চুপ থাক। খুব বেশি পায়ে পড়তে শিখছিস আজকাল।’ 

—‘আচ্ছা হৃদির কাছে যা। ওর ওপিনিয়নটা নে এটলিস্ট।’ 

হৃদি আছে ব্রাইডাল মেকআপ রুমে। সেই রুম বিশাল বড়। সারি বেঁধে বসেছে সব বিয়ের কনেরা। উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে ভেতরে। নানা বয়সী মেয়েদের কোলাহলে সরগরম চারপাশ। তবে হেয়ার ড্রায়ারের শো শো শব্দে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে তাদের কণ্ঠস্বর। বাতাসে উড়ছে নানা রকম প্রসাধনের কড়া ঘ্রাণ। এতগুলো বৌয়ের মধ্যে হৃদিতাকে খুঁজে পেতে একটু সময় লাগল অমৃতার। অবশেষে একদম কোণার একটি আসনে ব্লাউজ আর লেহেঙ্গা পরা হৃদিকে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখা গেলো। তার দুটি হাত রাজকীয় ভঙ্গিতে দুদিকে প্রসারিত। চোখ বোজা। দুইজন মেয়ে দুই পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মেহেদী পরাচ্ছে তার হাতে। তৃতীয় জন মুখ সাজাচ্ছে অখণ্ড মনোযোগের সাথে। অমৃতা ওর পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, ‘এই হৃদি!’ 

—‘হুম’ 

—‘চোখ খোল, এদিকে তাকা!’ 

সাজানোতে ব্যস্ত মেয়েটি হাত থামালো। হৃদি চোখের পাতা টেনে ধরে তাকালো অমৃতার দিকে। চকিতে এক মুগ্ধতার আবেশে ভরে উঠল তার মুখ 

—‘ও আল্লাহ! কী সুন্দর লাগতেছে তোকে!’ 

—‘পুরা ভূত সাজায় দিছে আমাকে।’ 

—‘মোটেও না।’ 

—‘আমি ধুয়ে ফেলতেছি মুখ।’ 

—‘প্লিজ দোস্ত না।’ 

—‘প্লিজ প্লিজ করিস না। টাকা খরচ করে এরকম সং সাজার কোনো মানে হয় না।’ 

—‘এই বেশি কথা বলবি না। আমার বিয়ে। আজকে আমার হুকুম চলবে।’ 

— ধুর।’ 

—‘কোনো ধুর না। তোর সাজ একদম ঠিক আছে।’ 

অমৃতা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। কী আর বলবে সে? আজকে মহারাণীর বিয়ে। তার হুকুম চলবে! 

—‘ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখিস। শুধু তোর জন্য আজকে ভূত সাজলাম।’ 

—‘ভূত নারে, শাড়িতে তোকে অনেক হট লাগে।’ বলে এক চোখ টিপলো হৃদি। সত্যই তো, অমৃতার শরীরটা যেন শাড়ির জন্যেই যত্নে গড়া। সবচেয়ে সুন্দর তার কোমরের বাঁকখানি। এরকম নিখুঁত দেহ সৌষ্ঠব সচরাচর চোখে পড়ে না তো! 

বিভা পরেছে সাদা জমিন আর রুপালি পাড়ের কাতান শাড়ি। গলায় কানে রুপোর জুয়েলারি। খোঁপায় সাদা গ্ল্যাডিওলাস ফুল। কপালে লাল টিপ, সিঁথিভর্তি সিঁদুর। তার রূপ বরাবরের মতোই চোখ ধাঁধানো, গ্ল্যামারাস। হৃদিতার সাজ শেষ হতে হতে সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বেজে গেলো। পুরোদস্তুর বৌ সেজে সে যখন সামনে এসে দাঁড়ালো, দুই বান্ধবীর চোখ তখন ঝাপসা! 

জল ভরা চকচকে চোখে হাসল বিভা, 

—‘আমাদের সামির বৌ’টা কী সুন্দর!’ 

অমৃতা পায়ে পায়ে হেঁটে এসে আচমকা জড়িয়ে ধরল হৃদিকে। ওই ভারি গহনাওয়ালা জবরজং বৌ সাজের ওপর দিয়েই। আবেগরুদ্ধ গলায় বলল, ‘অনেক সুন্দর লাগতেছে দোস্ত তোকে। মাশআল্লাহ!’ 

৪৮

সামির ঘরটা কাঁচা ফুলের সুগন্ধে ভরে আছে। খাট সাজানো হয়েছে লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ আর বেগুনি অর্কিড দিয়ে। বরের শেরওয়ানির রং অফ হোয়াইট। সারা গায়ে অফ হোয়াইট সুতোর কাজ করা। সামির ইচ্ছে ছিল কালো কেনার কিন্তু তার হবু শাশুড়ি বাধ সেধেছেন। শাশুড়ি আম্মার মতে কালো একটি অশুভ রং। বিয়ের মতো শুভকাজে অশুভ রঙের পোশাক কোনো মতেই পরা যাবে না। শেরওয়ানির গলার কাছে একটি স্বর্ণ রঙের চেইন লটকানো আছে। সামি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে চেইনটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠিক পেছনে আকাশ আর রুদ্র ইয়া বড় পাগড়ির বাক্সটা খোলার চেষ্টায় রত। দুই বন্ধুর মুখে ঝকঝকে হাসি। মনে হচ্ছে পাগড়ি জিনিসটা এই মুহূর্তে তাদের জন্য নিষ্কলুষ আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাগড়ির মতো মজার জিনিস আর দ্বিতীয়টি নেই ভুবনে! 

সামি গোল্ডেন কালারের চেইনটার দিকে চোখ রেখেই ক্যাটক্যাটে গলায়, বন্ধুদের বলল, ‘এই মালাটা কি কোনোভাবে খোলা যায়? বিরক্ত লাগতেছে। আমি কি মেয়ে নাকি? আমার কাপড়ে মালা ঝুলাইছে ক্যান?’ 

রুদ্র বলল, ‘ঠিকই আছে। এটা স্টাইল। বেশ রাজা রাজা একটা লুক আসছে।’ 

সামি ঘুরে দাঁড়িয়ে দুই বন্ধুর হাতে ধরা পাগড়িটার দিকে চেয়ে গোঁয়ার গলায় বলল, ‘এই কিম্ভূত জিনিসটা আমি মাথায় পরব না।’ 

—‘তুই পরবি না? তাহলে আমি পরি দোস্ত? আমার বেশ পছন্দ হইছে জিনিসটা।’ আকাশ আবদার করল গালভর্তি হাসি নিয়ে। কথাটা বলতে বলতেই পাগড়িটা নিজের মাথায় চড়িয়ে দিয়েছিল সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নড়ে চড়ে, ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখছিল। সামি বলল, ‘হ্যাঁ তুইই পর, তোরে মানাইছে।’ 

রুদ্র ডালা থেকে জুতো জোড়া বের করল। নৌকোর মতো লম্বা নাগ্ৰা। সামির এই জিনিসটাও পছন্দ না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বর সাজা একটি অত্যন্ত কঠিন এবং পীড়াজনক কাজ। রুদ্র নাগ্রা দুটো হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। হালকা চালে দুলে দুলে গাইতে লাগল গান। 

এমন মজা হয়না 
গায়ে সোনার গয়না 

আকাশও যোগ দিল। পাগড়ি পরা অবস্থায়ই হাত পা ছুঁড়ে গানের তালে তালে নাচতে লাগল সে। 

এমন মজা হয় না 
গায়ে সোনার গয়না 
সামিউল হকের বিয়ে হবে 
বাজবে কত বাজনা! 

দুই বন্ধুতে মনের সুখে গান গেয়ে গেয়ে নাচলো বেশ খানিকক্ষণ। সামি বিরক্ত মিশ্রিত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখল শুধু। 

দরজা নাড়ছিল কেউ। রুদ্র নাচ থামিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজাটা খুলল। সামির বাবা মা দাঁড়িয়ে আছেন। রুদ্র সরে দাঁড়াতেই তারা ভেতরে ঢুকলেন। সামি বাবা মাকে দেখে ছেলেমানুষি গলায় বলল, ‘পাগড়ি পরব না আমি!’ 

রোমেলা শেরওয়ানি পরা ছেলেকে একবার আগাগোড়া দেখে দিয়ে সহাস্যে বললেন, ‘কেন? বিয়ের বর পাগড়ি পরবে না, এটা কেমন কথা?’ 

—‘না না খ্যাৎ লাগে।’ এরপর নিজের গায়ে পরা জামার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘এইসব সোনা গয়না খুলে দাও তো মা।’ 

হক এগিয়ে এসে ছেলের কাঁধে দু হাত রেখে নিজের দিকে ফেরালেন। ভালো মতো ছেলেকে পরখ করে নিয়ে বললেন, ‘কেন, ভালো দেখাচ্ছে তো, একদম পারফেক্ট!’ 

—‘না ভালো দেখাচ্ছে না।’ গোঁয়ার গলায় বলল সামি। 

—‘আচ্ছা দেখি কী করা যায়।’ বলে তিনি মনোযোগ দিয়ে ছেলের জামায় লাগানো চেইনটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন। 

আকাশের মাথায় পাগড়ি দেখে রোমেলা বিস্মিত গলায় বললেন, ‘তুমি কেন পরেছ এটা?’ 

আকাশ নির্বিকার গলায় বলল, ‘সামি পরবে না। আমাকে দিয়ে দিছে।’

রোমেলা কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বরের জিনিস বরকেই পরতে দিতে হয়।’ 

হক বললেন, ‘পাগড়ি পরবে না কেন? বিয়ের একটা দিনেই তো এসব পরে মানুষ, তাই না?’ 

—‘তুমি পরেছিলে বাবা? তোমার বিয়েতে?’ সামি প্রশ্ন করে। 

—‘হ্যাঁ পরেছিলাম তো, তুমি ছবি দেখোনি? 

—‘মনে নেই।’ 

রোমেলা বাবা আর ছেলেকে স্নিগ্ধ চোখে দেখছিলেন। তাঁর ছেলেটা কত্ত বড় হয়ে গেলো! ছেলে দেখতে হয়েছে বাবার মতোই সুন্দর। তবে গায়ের রং বাবার চাইতে অনেক বেশি ফর্সা। যদিও উচ্চতায় বাবাকে ছুঁতে পারেনি সে। হক ছেলের থেকেও দুই ইঞ্চি বেশি লম্বা। কী ভালো যে লাগছে দুজনকে একসাথে দেখতে! তার বুকটা এক পরিপূর্ণ তৃপ্তিময় নিশ্বাসে টলমল করে ওঠে। আজ যদি নিজের মনের সাধ মিটিয়ে পছন্দ মতো একটা বৌ আনতে পারতেন ছেলের জন্য তাহলে এ জীবনের সর্বসুখ পাওয়া হয়ে যেত। এমন সোনার টুকরো ছেলেটাকে যাদু টোনা করে হাতিয়ে নিচ্ছে এক কপর্দকশূন্য, নিম্নশ্রেণির পরিবার। এই অন্যায় তাকে চুপচাপ মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। এসব ভেবে ক্ষণে ক্ষণে রোমেলার বুক ভার হয়ে আসছে। রাগে রিরি করছে শরীর। এদিকে মরার ওপর খরার ঘা হয়ে এসে জুটেছে ফুপু শাশুড়ি। এই বুড়িকে দেখতে প্রতিদিন গ্রাম থেকে ছুটে আসছে দূরের কাছের নানা আত্মীয়স্বজন। এই বাড়িটা যেন এক লঙ্গরখানা। বিয়েতে তিনি নিজের পরিবারের মানুষজনদের খুব একটা বলেননি। শুধু বোনরাই আসছে। কিন্তু এই দুদিনে শ্বশুরবাড়ির গ্রাম্য আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভরে গেছে। যাচ্ছেতাই অবস্থা একেবারে। অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছেন তিনি মনে মনে। এই ভীষণ রকমের অশান্তি কাটিয়ে তোলার জন্য আগামী সপ্তাহেই নিজের দুই বোনকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকক বেড়াতে যাচ্ছেন। আর ভালো লাগছে না এসব। একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চান তিনি এবারে। 

শেষমেশ শেরওয়ানির চেইনটা খোলা গেলো। সামি স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে ভারি সুন্দর হাসল, ‘থ্যাংকস বাবা! ইউ আর গ্রেট! তুমি সব পারো!’ 

৪৯

সাড়ে সাতটার দিকে সান্ধ্যকালীন রাস্তার ভয়াবহ জ্যাম ঠেলে বিয়ের কনেকে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ করল বিভা আর অমৃতা। হৃদির বাবা মা, ভাই আর আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই এর মাঝে চলে এসেছে। বরপক্ষ এসে পৌঁছয়নি। কাজী সাহেবও উপস্থিত হননি এখনো। বৌকে প্রথমেই স্টেজে বসানো হলো না। নিয়ে যাওয়া হলো ড্রেসিংরুমে। এই হলরুমটা খুব বেশি বড় নয়। সাজসজ্জাও সাধারণ। টেনেটুনে একশ মানুষ আঁটানো যায়। মঞ্চ সাজানো হয়েছে সাদা আর সোনালি রঙের আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে। মঞ্চের সামনে অল্প একটু জায়গা খালি রেখে চল্লিশটার মতো চেয়ার সারিবদ্ধভাবে রাখা। চেয়ারগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে গোল গোল বেশ কিছু টেবিল। টেবিল ঢাকা পরিচ্ছন্ন সাদা চাদরে। প্লেট গ্লাস পরিপাটি করে সাজানো। কয়েকজন অতিথি এর মাঝেই টেবিল দখল ফেলেছে। 

ড্রেসিংরুমের মাঝামাঝি জায়গায় একটা সোফা রাখা। তার পাশেই ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা কাঠের চেয়ার। কোণায় টেবিল ফ্যান। ঘুরছে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে। একটা বেসিন আছে পুব দিকের দেয়াল ঘেঁষে। সাথে চওড়া আয়না। হৃদি সোফায় বসে ছিল। শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। দুপুরে কিছুই খেতে পারেনি সে। উত্তেজনায় গলা দিয়ে খাবার ঢুকছিল না। এখন মনে হচ্ছে একটু খিদে খিদে পেয়েছে। 

—‘তোর কি শরীর খারাপ লাগতেছে?’ হৃদির সিঁথি থেকে কিঞ্চিৎ সরে যাওয়া টিকলিটা ঠিক করে দিতে দিতে বিভা প্রশ্ন করল। 

—‘কিছু খাওয়া যাবে এখন?’ 

—‘খাওয়া যাবে না কেন? তোর খিদে পেয়েছে?’ 

—‘হুম। 

—‘আচ্ছা দাঁড়া দেখতেছি।’ 

হৃদির কাজিন দুজনের একজন বলল, ‘আপু আপনি বসেন, আমরা কিছু নিয়ে আসি।’ 

—‘রান্না তো হয়ে গেছে। অল্প একটু পোলাও আর মাংস নিয়ে এসো যদি পারো।’ 

—‘ঠিক আছে।’ 

মেয়ে দুজন ছুটে গেলো খাবার যোগাড় করতে। অমৃতা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘরটা একতলায়। জানালা দিয়ে সমতলে বাইরের ঝলমলে বৈদ্যুতিক আলোকময় সন্ধ্যাটা দেখা যাচ্ছে। এই বিল্ডিংটা রাস্তার একদম ধার ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির পার্কিং আন্ডারগ্রাউন্ডে। গাড়ি বিল্ডিঙের সামনে আসতেই লোকজন গাড়ি থেকে নেমে পড়ছে। যাত্রী নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে পাতাল ঘরে। অমৃতার চোখ রাখা ছিল দূরে। একটু আনমনা ভাব কাজ করছে তার মধ্যে। বিভা হেঁটে এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী দেখিস?’ 

—‘দেখি না, ভাবি।’

—‘কী ভাবিস?’ 

—‘ভাবতেছি হৃদির শাশুড়িকে কীভাবে একটু টাইট দেওয়া যায়।’

বিভা ফিক করে হেসে ফেলল, ‘হঠাৎ এই ভাবনা?’ 

অমৃতা চাপা গলায় বলল, ‘ওই বেটি এখন পর্যন্ত হৃদির বাপ মায়ের সাথে কোনো কথা বলে নাই জানিস? আন্টি, মানে হৃদির আম্মা খুব চিন্তিত এই ব্যাপারে। আমাকে একটু আগেই বলতেছিল।’ 

‘কী বলতেছিল?’ হৃদি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল উদ্বিগ্ন গলায়। 

—‘থাক, তোর এসব শুনতে হবে না এখন। তুই চিন্তা করিস না। তোর শাশুড়ি ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধর শুধু।’ 

—‘মনে হয় না ঠিক হবে। ডেঞ্জারাস মহিলা।’ আফসোস নিয়ে বলল হৃদি।

—‘ঠিক হতেই হবে। ফাজলামো নাকি? সামি করে কী? নিজের মাকে দিয়ে একটা ফোন করাইতে পারে নাই শাশুড়ির কাছে? 

বিভা ফোড়ন কাটল, ‘থাক, উনি ফোন না করলে কিছু হবে না। সামির আব্বা তো ঠিক আছে। উনিই আসল।’ 

—‘তোর মাথা। কালকে সকালেই উনি চলে যাবে আমেরিকা। তারপর ওই ডাইনি বুড়ির সাথে একা একা আমার সারাদিন থাকতে হবে। আল্লাহ! চিন্তা করেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার।’ হৃদি বলল আক্ষেপের সুরে। 

—‘একা কেন হবে? সামি আছে না? চিন্তা করিস না তুই।’ কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ থমকে গেলো অমৃতা। চোখ আটকে গেলো জানালার বাইরে। গেটের সামনে একটা পাজেরো গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়িটা অমৃতার চেনা। মিনিট না গড়াতেই গাড়ি থেকে নামলেন মানুষটা। সাদা পাঞ্জাবি তার পরনে। অমৃতার গলার স্বর মুহূর্তে পাল্টে গেলো। 

—‘ওয়াও, দ্যাখ না আমার উনাকে কী সুন্দর লাগতেছে!’ হৃদি উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কার কথা বলিস?’ 

উত্তরটা বিভা দিল, ‘তোর শ্বশুর আসছে।’

অমৃতা তখন মুগ্ধ, বিস্মৃত, বাহ্যজ্ঞানরহিত! 

বিভা বলল, ‘থাক ওরকম হা করে তাকায় থাকিস না, গাধী!’ 

—‘আহ, একটু দেখতে দে! গাইজ, লুক অ্যাট হিজ জ’ লাইন। হট কিন্তু!’

হৃদি ধমকে উঠল, ‘এইসব ফাইজলামির কোনো মানে হয় না। লোকটা আমার শ্বশুর, সামির বাবা আর আমার শাশুড়ির হাজবেন্ড।’ 

অমৃতা ঘুরে তাকালো, ‘তাতে কী?’ 

—‘অন্যের বরের দিকে এভাবে তাকায় থাকতে হয় না। এসব ভালো না।’

অমৃতা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল হৃদির দিকে। তার চোখে একটু অবিশ্বাসের ছাপ 

—‘আজকে হঠাৎ এত চেতলি যে?’ 

—‘চেতব না কেন? ওই বাড়ির সাথে আমার একটা সম্পর্ক হতে যাচ্ছে। এখন ওটা আমারও ফ্যামিলি। আমার ফ্যামিলির ভালো মন্দতো আমাকে দেখতেই হবে।’ 

অমৃতা অস্ফুটে বলে, ‘ওয়াও!’ 

হৃদির সুন্দর সাজওয়ালা মুখটা রাগে একটু থমথম করছিল। সে গজগজ করে বলল, ‘লিমিট ক্রস করা উচিত না। সব কিছুর একটা সীমা আছে।’ 

—‘শোন হৃদি, আমি জানি যে লোকটা তোর শ্বশুর, সামির বাবা এবং তোর শাশুড়ির বর। কিন্তু আমি এটাও জানি যে, এই সবকিছুর ভেতরে যে সত্যিকারের মানুষটা, সেই মানুষটা আমার। শুধুই আমার!’ 

কথাগুলো দাঁতে দাঁত ঘষে বলে শেষ করে, নিজের পক্ষে নিজেই রায় দিয়ে, বেরিয়ে পড়ল অমৃতা। 

বিভা হৃদির কাছে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘বাদ দে দোস্ত। ঐটা একটা পাগল।’ 

—‘পাগলামির একটা সীমা আছে বিভা!’ 

—‘একটা জিনিস ভেবে দ্যাখ, এইযে তোর বিয়ে হচ্ছে আজ এত সুন্দর করে। এর পেছনে কিন্তু পাগলটার অনেক অবদান আছে। অন্তত এটা ভেবে আজ ওকে ক্ষমা করে দে। ভুলে যা সব। আজকে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাব। আজ শুধুই তোর দিন।’ 

—‘হুম!’ অনেক কষ্টে রাগটাকে গিলল হৃদি। 

—‘বাট হিজ জ লাইন দোস্ত! রিয়েলি শাপ!’ 

—‘ফাইজলামি করতে মানা করছি না?’ হৃদির গলা দিয়ে আগুন ঝরল। সেই আগুন দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল বিভা। 

একটু বাদে হৃদির জন্য ছোট একটি প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসা হলো। বিভা হাত ধুয়ে নিয়ে ঝোল দিয়ে মেখে কয়েক লোকমা পোলাও খাইয়ে দিল হৃদিকে। অনেক যত্ন করে সকতর্কতার সাথে সাজগোজ বাঁচিয়ে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *