৪০
বন্ধুরা বিয়ের তত্ত্ব সাজানোর কাজ করবে। ঠিক হলো দুজন কাজ করবে হৃদির বাসায়, বাকি দুজন সামির বাসায়। কে কোন পক্ষ নেবে তা নিয়ে একটা বাকবিতণ্ডা লেগে গেলো ওদের মাঝে। অনলাইনে গ্রুপকলে কথা বলছিল ওরা। গতবার সামির আম্মা বন্ধুদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলেন এ কথা ঠিক। কিন্তু সামি পরবর্তীতে মায়ের হয়ে বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। বন্ধুরাও ক্ষমা করে দিয়েছে। তাই সামির বাসায় যেতে এখন কারোরই তেমন কোনো আপত্তি নেই। এমনকি যে অমৃতাকে রোমেলা থাপ্পড় মেরেছিল সেই অমৃতাও একটু গাঁইগুঁই করে বলে ফেলল, ‘ইশে, আমি আর রুদ্র বরপক্ষ। বিভা আর আকাশ কনেপক্ষ। সো আমি সামির বাসায় যাচ্ছি।’ অমৃতার বেহায়াপনা দেখে বিভা আশ্চর্য হয়ে গেলো। কটমটে চোখে ওর দিকে ক্যামেরার ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দৃঢ় গলায় বলল, ‘আমি বরপক্ষ। কোনোমতেই আমি কনেপক্ষ হব না।’
সামি হেসে ফেলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। অমৃতা আর বিভা চইলা আসিস আমার বাসায় কালকে সকালে। আকাশ আর রুদ্র কনেপক্ষ।
অমৃতা বলল, ‘সকালে কোর্টে যাইতে হবে। তিনটা বাজবে তোর বাসায় যাইতে যাইতে।’
—‘আচ্ছা সমস্যা নাই।’ বলল সামি।
গ্রুপ কল শেষ হলে বিভা অমৃতাকে ফোন করল আলাদাভাবে।
—‘ওই ছেমড়ি, তুমি লাফায় লাফায় সামির বাসায় কেন যাইতে চাইতেছ? বুঝি না মনে করছ কিছু?’
অমৃতা ম্লান গলায় বলল, ‘এরকম করিস কেন?’
—’তুই না আমাদের প্রমিজ করছিলি তুই আর কোনোদিন দেখা করবি না?’
—‘দেখা করব না প্রমিজ। শুধু একটু দেখব।
—‘ফাইজলামি করিস?’
—‘প্লিজ দোস্ত! একটাবার দেখতে খুবই ইচ্ছা করতেছে! রাগ করিস না তোরা!’
৪১
বিয়ের কেনাকাটা নিয়ে একটা মৃদুমন্দ ঝড় বয়ে গেলো হৃদিদের ছোট্ট পরিবারটায়। বাবার যে বাজেট তাতে কোনোভাবেই খরচে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। বাবা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না যে তার মেয়ের বিয়ে কোনো সাধারণ পরিবারে হতে যাচ্ছে না। দেশ সেরা ধনী ব্যক্তির পুত্রবধু হতে যাচ্ছে তার কন্যা। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে স্বাভাবিকভাবেই বাজারের সবচেয়ে দামি জিনিসটা বিয়ের তত্ত্ব হিসেবে বরের বাড়িতে যাওয়া উচিত। হৃদি বোঝে অতটা সামর্থ্য তাদের নেই। কিন্তু সামান্য বুদ্ধি খাটিয়ে কিছুটা মানসম্মত সামগ্রী তো কেনাই যায়! বাবা এ ব্যাপারে কারো কোনো কথাই শুনছেন না। এদিকে সামির আম্মা কী ভয়ংকর ঠোঁটকাটা মহিলা তা অন্য কেউ না জানলেও হৃদি জানে। এই মহিলা যদি অপমানজনক কোনো কথা শুনিয়ে দেয় শুরুতেই তাহলে হৃদির ভয়ংকর খারাপ লাগবে! আকদের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে হৃদির বাসায়। এ নিয়েও তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাদের পনেরোশ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটায় অনায়াসে পঞ্চাশজন মানুষ এঁটে যায়। আকদ যেহেতু অত ঘটা করে করা হচ্ছে না তাই দু পরিবার মিলিয়ে হয়তো ষাটজনের মতো লোকসংখ্যা হবে। কিন্তু সামির পরিবারের মানুষগুলোকে হৃদি খুব ভালো করে চেনে। বিলাসিতা এবং দাম্ভিকতা এদের রক্তের মাঝে বিষের মতো ঢুকে গেছে। সামির খালা দুজনেরও প্রচণ্ড নাক উঁচু। হৃদির বাসার মধ্যবিত্ত হালচাল এরা কোনোভাবেই স্বাভাবিকভাবে নেবে না।
বাবা সবকিছু নিয়েই কার্পণ্য করছেন। সাজগোজের পয়সাও ঠিকঠাক দিতে চাচ্ছেন না। হৃদি ঠিক করেছিল নাভিন আহমেদের কাছে সাজবে। কিন্তু পয়সা মনে হচ্ছে কুলোবে না। অনুষ্ঠানের আর মাত্র দুদিন বাকি এখনো বরের ঘড়ি কেনা হয়নি, জুতো কেনা হয়নি। দুশ্চিন্তায় হৃদির ঘুম হারাম হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এরকম রাঘব বোয়াল পরিবারের সাথে বিয়ে না হয়ে সাধারণ একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে বিয়ে হলে চাপ অনেক কম থাকত। সুখের চাইতে স্বস্তি জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সামিকে ফোন করল হৃদি, বিয়ের দুদিন আগের সন্ধ্যায়।
সামি একটু উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘কী হইছে তোর?
—‘সামি শোন। একটা কথা বলব। মন দিয়ে শুনবি।’
—‘হুম, বল।’
হৃদি একটা লম্বা নিশ্বাস নিল। গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘তুই তো জানিস যে আমার বাবার তোর বাবার মতো অত টাকা নাই। আমরা মধ্যবিত্ত। তানিশার ফ্যামিলি যেভাবে এনগেজমেন্টের প্রোগ্রাম করছে কিংবা যেরকম এক্সপেন্সিভ শপিং করছে আমাদের পক্ষে তা কোনোভাবেই সম্ভব না।’
—‘এসব কথা কেন বলতেছিস তুই? আমি কি এরকম কিছু ডিমান্ড করছি কখনো?’
—‘না তুই ডিমান্ড করিস নাই। কিন্তু তোর ফ্যামিলি মেম্বারদের একটা এক্সপেক্টেশন থাকতেই পারে। হয়তো তোর আম্মা ব্যাপারটা পজিটিভলি নিবেন না। তো সেক্ষেত্রে আমি চাই তুই যেন এই ব্যাপারটা দেখিস। আমাকে বা আমার পরিবারকে কেউ যেন অপমান না করে। অফেন্সিভ কথাবার্তা যেন কেউ না বলে।’
সামি প্রবল বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘অপমান করবে কেন? মাথা খারাপ! আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষজনকে অফেন্সিভ কথা বলবে এত সাহস আছে নাকি কারো? তুই নিশ্চিন্ত থাক।’
হৃদি কিছু বলল না। চুপ করে রইল। সামি আবার বলল, ‘শোন, শপিং নিয়ে অত চিন্তা করতে হবে না তোদের। তুই আংকেলকে কোনো প্রেশার দিস না। প্লিজ!’
৪২
বিভা আর অমৃতা সামিদের বাসায় এসে পৌঁছুল দুপুর তিনটায়। ওরা দুজনে আজ একই রকম জামা পরেছে। বাঙ্গি রঙের টি শার্ট। অমৃতার কনুইয়ে ঝুলছে কালো কোট। পিঠে ল্যাপটপের ব্যাগ। সামি প্যাটিওতে বসে ছিল। মায়ের সাথে। বান্ধবীদের জন্যেই অপেক্ষা করছিল সে। তাকে আজ একবার যেতে হবে জুতোর দোকানে। হৃদির বাবা ফোন দিয়ে বলেছেন উনারা শপিংমলে অপেক্ষা করছেন সামির জন্য। মাপ না পাওয়া গেলে তো জুতো কেনা যাবে না।
রোমেলা মালিকে দিয়ে বাগানের কাজ করাচ্ছেন। নতুন কয়েকটা সাদা গোলাপের চারা কিনেছেন তিনি। সেই চারা রোপনের প্রক্রিয়া চলছে। দুই বান্ধবীকে দেখতে পেয়েই সামি উঠে দাঁড়ালো। রোমেলা মেয়েদুটোকে দেখে একটু অবজ্ঞা সূচক হাসলেন শুধু একবার। মুখে কিছু বললেন না। এই বিয়ের আয়োজন নিয়ে তিনি অতটা মাথা ঘামাচ্ছেন না। মাথা না ঘামানোর অন্যতম কারণ হলো বিয়ের অনুষ্ঠানে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ লোকজন আসবেন না। হক সাহেবের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে একেবারে সাদামাটাভাবে। দেশের নামিদামি লোকেরা যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে না সেই অনুষ্ঠান নিয়ে অত মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে বলে রোমেলার মনে হয় না। অযথা আয়োজন করে কী হবে? কে দেখবে? তাঁর তো লোক দেখানোতেই আনন্দ। তবুও তিনি গত সন্ধ্যায় সামির বাবার সাথে গিয়ে কনের জন্য গয়নার অর্ডার দিয়ে এসেছেন। বোনদের সঙ্গে নিয়ে বিয়ের লেহেঙ্গা কিনেছেন। আর কত? তাঁর মন মেজাজ ভালো নেই। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে তিনি কিছু বলতে পারছেন না। মনে মনে এই বিয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। অশান্তিতে ভরে আছে ভেতরটা। সামি বান্ধবীদের বলল, ‘চল আমার ঘরে চল।’
অমৃতা একটু মিনমিনে গলায় বলল, ‘তোর ঘরে কেন? আমরা ড্রইংরুমেই বসতে পারি।’
বিভা চোর চোখে দেখল একবার অমৃতাকে। একটু ভেবে চিন্তে বলল, ‘হুম, সেটাই। ড্রইংরুমে বসি। তোর ঘরে যাওয়ার দরকার নাই।’ সামি আর কথা বাড়ালো না। সমস্ত জিনিসপত্র ড্রইংরুমের কার্পেটের ওপর এনে জড়ো করা হলো। সেই সাথে ডালা কুলা, র্যাপিং পেপার, টেপ, কাঁচি ইত্যাদি। বন্ধুদের সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে আসলো। হবু শ্বশুরের সাথে মিটিং বলে কথা। একটু নার্ভাস ফিল করছিল ভেতরে ভেতরে।
বিভা সাজানো গোছানোর কাজ ভালো পারে। মূলত সব কাজ সে একাই করছিল। অমৃতার এমনিতেও কাজে মন নেই। একটু বাদে বাদে সে সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। দরজার কাচের ভেতর দিয়ে বাইরের বিকেল দেখছে। বাগানের ফুল দেখছে। তার চোখের তলায় অসহিষ্ণুতার গাঢ় ছাপ। নিশ্বাস বড়ই চঞ্চল। কোনো কিছুতেই যেন মন বসছে না তার। রোমেলা একটা বারও এই ঘরে আসেননি। কাজের বুয়া এসে একটু বাদে ওদের চা নাশতা দিয়ে গেলো। বিভা খুব বকবক করছিল। অমৃতা অন্যমনস্কভাবে হু হা করে যাচ্ছে শুধু। এর মধ্যে একটা ভুল করে ফেলল সে। কসমেটিকসের ডালায় অন্যমনস্কভাবে চুড়ির গোছা বসিয়ে দিল। বিভা ধমকে উঠল
—‘কী করতেছিস তুই এসব? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? বলি মনটা থাকে কোথায়?
—‘ওহ স্যরি!’
বিভা রাগে গজগজ করতে লাগল, ‘কাজ করতে মনে না চাইলে বইসা থাকো। দয়া করে আমার কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি কইর না।’
অমৃতার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। বুকে টলমল করে উঠল একগুচ্ছ অভিমান। লোকটা আসছে না কেন? অমৃতা যে তার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে বসে আছে সেই খবরটা কি কোনো এক গোপন হৃদপথ ধরে হেঁটে হেঁটে তার হৃদয় অবধি পৌঁছায়নি এখনও? অশান্তি! বড় বেশি অশান্তি সারাটা অন্তরজুড়ে! সন্ধে নামার খানিক আগে মিতসুবিশি পাজেরোটা গাড়ি বারান্দায় এসে থামল। অমৃতা দেখতে পেলো জানালা দিয়ে। চাপা উচ্ছ্বাস নিয়ে কিশোরীসুলভ চঞ্চল গলায় বলে উঠল, ‘আসছে!’
বিভা হাতের কাজ না থামিয়েই একবার অবহেলায় জানালার বাইরে তাকালো। তারপর বিরস গলায় বলল, ‘আসছে তো কী করব আমি? নাচব?’
কী কারণে যেন রাশেদের মেজাজ আজ সপ্তমে চড়ে ছিল। তিনি ফোন কানে নিয়ে খিটখিটে স্বরে কথা বলতে বলতে বাড়িতে ঢুকলেন। তার পরনে নেভিব্লু কালারের ফুল হাতা ইন করা শার্ট। কালো প্যান্ট। চুলগুলো কিঞ্চিৎ এলোমেলো। মুখে দু তিনদিনের অবহেলার দাড়ি। সদর দরজা পেরিয়ে বসার ঘরে পা ফেলার আগে চাকরটাকে তিনি সম্পূর্ণ বিনা কারণে একটা হাঁক দিলেন। বেচারা চাকর গ্লাসে করে ঠান্ডা শরবত নিয়ে এসেছিল তার জন্য। তিনি হুংকার দিয়ে উঠে বললেন, ‘আমি কি এখন শরবত চেয়েছি?’ হুংকারটা শেষ করেই তিনি সামনে তাকালেন। চারটা চোখ আটকে গেলো চুম্বকের মতো। বাতাস সুরভিত হয়ে উঠল এক অলৌকিক সুখস্পর্শে। তার রাগান্বিত মুখখানায় কী করে যেন একটা তরল ভাব চলে আসলো ম্যাজিকের মতো। তিনি ফোনে কথা বলতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেলেন।
অমৃতার হৃৎপিণ্ড একবার থমকে গেলো। তারপর ট্রেনের গতিতে ছুটতে লাগল দুরন্তভাবে!
লজ্জা পেলে যে মেয়েদের কী সুমিষ্ট সুন্দর দেখায়, সেই অকাট্য সত্যটা আজ এই মুহূর্তে অমৃতাকে না দেখলে তিনি কখনোই বিশ্বাস করতেন না। ড্রইংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে স্পষ্টভাবে অবলোকন করলেন যে দশ কদম দূরে বসে থাকা মেয়েটার মুখে কোত্থেকে যেন পুঞ্জিভূত একরাশ রক্তিম রং এসে ভর করল, এই মাত্র! তিনি চোখ সরালেন না। ওর দিকে চেয়ে থেকেই ফোনে কথা বলতে বলতে ঘরের ভেতর ঢুকলেন। অমৃতা এবারে মুখ নিচু করে হাতে ধরে রাখা স্কচটেপ আর কাঁচি নাড়াচাড়া করতে লাগল অন্যমনস্কভাবে। বিভা নরম স্বরে সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুসলিম বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করতে গিয়ে গুরুজনদের সালাম দেওয়াটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। রাশেদ হাত তুলে ইশারায় বসতে বললেন ওকে। বিভা অমৃতাকে একবার আগাগোড়া দেখে নিয়ে বলল, ‘আমি আসছি। বি রাইট ব্যাক।’
অমৃতা ঘাড় কাৎ করে সম্মতি জানালো। বিভা যাবার পর, ওই বিশাল বড় আলিশান ড্রইংরুমে শুধু ওরা দুজনে ছাড়া আর কেউ রইল না। বাইরে তখন বিকেল মরে এসেছে। বড় কাচের স্লাইডিং ডোর ডিঙিয়ে শেষ বিকেলের ম্লান আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। একটু বাদেই ঝুপ করে সন্ধে নামবে। কাচের ওপাশে ঝিরিঝিরি বাতাসে মাথা দুলিয়ে হালকা তালে নেচে চলেছে বাগানে ফুটে থাকা হরেক রঙের ফুল। লোকটা তখনো ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। অমৃতা হাতের সরঞ্জামগুলি মাটিতে রেখে কার্পেটের ওপর পা ভাঁজ করে নতমুখে বসে আছে। এই মুহূর্তে বুকের ভেতর একটা অনাবিল শান্তির স্রোত বইছে। তার নিজস্ব পৃথিবীটা হাসছে মৃদু মৃদু। হঠাৎ করেই এই বিকেল শেষের আবছা আলোটাকে তার বড় বেশি কাব্যিক বলে মনে হচ্ছে। আহা! জীবন বড় সুন্দর! মানুষটা কাছে থাকুক। ভালো থাকুক। এর চেয়ে আর বেশি কিছু চাইবার নেই!
—‘কেমন আছ?’ ফোনটা কান থেকে সরিয়ে নিয়ে বললেন তিনি। অমৃতা মুখ না তুলেই বলল,
—‘এই তো।’
—‘এই তো মানে?’
—‘খুব একটা ভালো না।’
—‘কেন?’ অমৃতা ওর পুতুল পুতুল চোখদুটো মেলে তাকালো মানুষটার দিকে।
—‘আমার কথা বাদ দিন। আপনি কেমন আছেন?’
—‘আমি ভালো আছি।’
অমৃতা মুচকি হাসল, ‘আপনি কিন্তু রোগা হয়ে গেছেন।’
—‘তাই নাকি?’
—‘হুম। দাড়ি কাটেননি কেন?
হক একটু অন্যমনস্কভাবে নিজের গালে হাত রাখলেন, ধীর স্বরে বললেন, ‘সময় পাইনি।’
—‘ও, আমি ভাবলাম আবার কাউকে বুঝি মিস টিস করছেন! কেমন একটা বিরহ বিরহ ভাব!’
হক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন দুষ্টু মেয়েটার দিকে। কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, ‘মিস করার সময় কোথায়?’
—‘হুম, জানি। বড্ড ব্যস্ত মানুষ আপনি।’
—‘তোমার কী হয়েছে? তুমি ভালো নেই কেন?’
দরজার বাইরে পদশব্দ পাওয়া গেলো। কেউ আসছে। ওরা দুজনেই দরজার দিকে তাকালো একযোগে। হাইহিল জুতোয় ঠকঠক শব্দ তুলে একজন তিরিশ ছুঁই ছুঁই নারী এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে। কলাপাতা রঙের সিল্ক শাড়ি পরনে। মুখে ভারি সাজ। হাতে একটা ফাইল। দরজায় উঁকি দিয়ে মেয়েটি একগাল হেসে বলল, ‘আসব স্যার?’
—‘হ্যাঁ এসো।’
মেয়েটি ঘরের ভেতর ঢুকল। হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার এটায় আপনার সাইন দরকার। আপনার টেবিলে রাখা ছিল আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন। আমাকে ম্যানেজার স্যার পাঠালেন।
হক একটু অপরাধী গলায় বললেন, ‘ওহ, স্যরি। তোমার আবার কষ্ট করে আসতে হলো। এক্সট্রিমলি স্যরি। অফিসের গাড়ি নিয়ে এসেছ তো?’
—‘জি স্যার।
অমৃতা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল মেয়েটার দিকে। আসার আর সময় পেল না। মেয়েটি কি একটু বেশি সাজগোজ করে ফেলেছে? এত সাজগোজের কারণ কী? লোকটার এত গা ঘেঁষেই বা দাঁড়িয়েছে কেন? দূরে দাঁড়ানোটাই তো ভদ্রতা, নাকি? সমস্যা কী? নিজের অবাধ্য কূট চিন্তাসমূহ ক্রমেই তাকে ভেতরে ভেতরে বিব্রত করে তুলছিল। সে বুঝতে পারছে ভাবনাগুলো অতিমাত্রায় মেয়েলি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মনকে কিছুতেই পোষ মানানো যাচ্ছে না। মেয়েটির কোনো দোষ নেই। শুধু লোকটার পাশে একটু গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে বলেই এই মুহূর্তে মেয়েটিকে তার খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার এতকালের পুরোনো শক্তপোক্ত পুরুষালি মনটার ভেতর যে এমন চিরাচরিত হিংসুটে নারীসর্বস্ব একটি মন নিভৃতে লুকিয়ে ছিল তা সে আজ এতদিনে জানতে পারল। রোমেলা উপস্থিত হলেন হঠাৎ, অসময়ের ঝড়ের মতো! মেঝেতে পা লেপটে বসে থাকা অমৃতাকে বক্র চোখে একবার দেখে নিয়ে স্বামীকে বললেন, ‘তুমি কখন এলে?’
হক ফাইল থেকে চোখ না তুলেই স্তিমিত গলায় উত্তর দিলেন, ‘একটু আগে।’
অফিসের মেয়েটি রোমেলাকে দেখে সালাম দিল। রোমেলা ঘাড় নেড়ে সালামের উত্তর দিয়ে উল্টোদিকের সোফায় বসলেন। ব্যস, এখানে বসে থাকার আর কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। অমৃতা উঠে দাঁড়ালো। হক আড়চোখে দেখলেন একবার তাকে। কিছু বললেন না। অমৃতা নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। হাওয়ায় ভাসতে থাকা মনটা ঝুপ করে কাদামাটিতে আছড়ে পড়ে গেলো যেন। এ পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মানুষটার সামনে বসে নিশ্চিন্তে দুদণ্ড কথা বলা যায়। এতই ছোট পৃথিবীটা!
৪৩
—‘হ্যালো বিভা? কী অবস্থা তোদের?’ হৃদি প্রশ্ন করল ফোনের অপর প্রান্ত থেকে। বিভা ডাইনিং এ এসে বসেছে। এদিকটায় আপাতত কেউ নেই। শুধু একজন কমবয়সী বালক চাকর অকারণে ঘুরঘুর করছে। গম্ভীর চোখে চারপাশে নজর বুলাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘোরাফেরা করাটাই তার একমাত্র করণীয় কাজ। এই কাজটির জন্যেই তাকে বেতন দেওয়া হয়। বিভা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে একটু রাশভারি গলায় বলল, ‘তুমি একটু অন্যদিকে যাও তো! আমি ফোনে কথা বলছি।’ ছেলেটি সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে তাকালো বিভার দিকে। যেন বিভা কোনো অসম্ভব আবদার করে ফেলেছে তার কাছে।
—‘কী হলো? কথা কানে যায় না?’
ছেলেটি না পারতে এবার বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। বিভা অনেকটা ফিসফিস করে বলল, ‘কাজ তো এখনো অর্ধেকও হয় নাই। তার আগেই নায়ক নায়িকার দেখা হয়ে গেছে। তুই কোথায়?’
—‘আমরা যমুনা ফিউচার পার্কে আসছি। সামির জুতা কিনতে।’
—‘কেনা হইছে?’
—‘হুম হইছে। আমরা মনে হয় রাতে একসাথে ডিনার করব। বাবা খাওয়াবে।’
—‘ওয়াও। সাউন্ডস গুড। এখন সামি কোথায়?’
—‘ও আছে বাবা মায়ের সাথে। একটু দূরে। সমস্যা নাই তুই বল, কাহিনী কী?
বিভা আগের চাইতেও চাপা গলায় বলল, ‘তোমার শ্বশুরের সমস্যা কী?’
—‘ক্যান কী করছে?’
—‘কী করছে মানে? উনার এত হ্যান্ডসাম হওয়ার কী দরকার ছিল?’
হৃদি হাসতে লাগল, ‘শালি, তুইও কি ক্রাশ খাচ্ছিস নাকি?’
—‘দিস ইজ নট ফেয়ার। কারো বাবা কেন এত সুন্দর হবে দেখতে?’
—‘আল্লাহ! তোমরা আমার শ্বশুরের উপর নজর দেওয়া বন্ধ করো। দোহাই লাগে।’
—‘আজব ব্যাপার কী জানিস, ওদের দুজনকে না অনেক মানায়। আমি আজকে খেয়াল করলাম। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?’
—‘খুবই অদ্ভুত। অমৃতার সামনে এসব কথা ভুলেও বলবি না। প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। তুই কি বুঝতে পারতেছিস?
—‘না বলব না। বাট আমার অমৃতার জন্য খারাপ লাগতেছে আজকে। তোর শাশুড়ির একটা ব্যবস্থা করি চল।’
—‘কী ব্যবস্থা?’
—‘ওখুধ খাওয়ায় পাগল বানায় দেই। তারপর পাগলাগারদে পাঠায় দিব।’ শুনে হৃদি খিলখিল করে হেসে উঠল। সামি তার হবু শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে রেমন্ডের শোরুমে ঢুকেছিল। সাথে ছোট ভাই হৃদয়ও আছে। বেরিয়ে এসে হৃদিকে ওরকম খিলখিলিয়ে হাসতে দেখে সামি অবাক গলায় বলল, ‘কীরে, কী হয়েছে তোর?
হৃদি অনেক কষ্টে হাসি চেপে বিভাকে বলল, ‘এখন রাখি। পরে কথা বলব।’
হৃদির আজ খুব বেশি ভালো লাগছিল। একটা পরিপূর্ণ, নিরবিচ্ছিন্ন তৃপ্তির আমেজে ছেয়ে গিয়েছিল মন। সামি তার পরিবারের জন্য নতুন কেউ নয়। কিন্তু এতকাল তার উপস্থিতি ছিল বন্ধু হিসেবে, ক্ষণিকের অতিথির ন্যায়। এখন সে এই পরিবারেরই একজন সদস্য। তার বাবা মায়ের সাথে এর আগে সামি কখনোই এতটা সময় একত্রে কাটায়নি। সামির মতো হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল, সাদা মনের নিরহংকারী ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসেবে পেয়ে বাবা মাও বেশ খুশি। সত্যই, সামির মতো ছেলে হয় না। হৃদির বাবা মাকে সে খুব সহজেই আপন করে নিয়েছে। শুধু একটু আগে হৃদির মাকে আন্টি ডাকতেই প্রত্যুত্তরে তিনি যখন বললেন, ‘এখন থেকে আর আন্টি ডাকাডাকি চলবে না। আম্মা ডাকতে হবে।’ তখন সে একটু লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। হৃদির মা এই একটি কথা গত তিন চারদিন ধরে অনবরত বলে যাচ্ছেন। সামি এই বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তার কেবলই মনে হচ্ছে শাশুড়িকে ‘আম্মা’ ডাকলে তার নিজের মা মনে মনে কষ্ট পাবে। আজকে মায়ের সাথে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। মা শুনেটুনে ঠান্ডা গলায় বলেছেন, ‘তোমার বিবেক যা বলে তাই করো। আমার কথা এই বাড়ির লোকে কখনো শোনে নাকি? আমাকে জিজ্ঞাসা করে লাভ কী?
বাবা মা বলে সম্বোধন না করলেও সামি হবু শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কোনো কার্পণ্য করছে না। এই অনেকটাই পরিণত, সুশীল, বিনয়ী ছেলেটাকে হৃদির আরো বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ। হঠাৎ মনে হলো, কাছের কয়েকজন মানুষ নিয়ে এইযে ছোট্ট, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন একটি পরিবার তার, এই পরিবারে যদি কখনো আচমকা তুফানের মতো কোনো তৃতীয় ব্যক্তি উড়ে এসে জুড়ে বসে তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? অমৃতা যদি না চাইতেও কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসে? সামি কি সইতে পারবে এই অতর্কিত তুফানের বিভীষণ ঝাপটা? পরিবারটা এখন শুধু সামির একারই নয়। হৃদিও ওই পরিবারের একটি অংশ হতে যাচ্ছে। অমৃতাকে নিরস্ত করতেই হবে! যে করেই হোক!
৪৪
অফিসের মেয়েটা চলে যাবার পর রোমেলা স্বামীকে বললেন, ‘তুমি কি ঘটনা শুনেছ?’
হক বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে একটু অবাক গলায় বললেন, ‘কী ঘটনা?’
‘আমার ছেলেটাকে ওরা ডেকে নিয়ে গেছে সেই বিকেল বেলা। বিয়ের শপিং করছে। একটু আগে ছেলে ফোন দিয়ে বলল রাতে নাকি বাইরে ডিনার করবে। ওই মেয়ের ফ্যামিলির সাথে। আমার ছেলেটাকে কি কিনে ফেলল নাকি?’
হক একটু বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘তোমার ছেলে তার ইন ল’জ কে সময় দিচ্ছে। এটা তো ভালো কথা। এখানে এত দুশ্চিন্তার কী আছে?’ কথাটা শেষ করে তিনি পা বাড়ালেন। রোমেলা তার পেছন পেছন আসতে আসতে বললেন, ‘বিয়ের আগেই এত অধিকার দেখাচ্ছে। বিয়ের পর কী করবে তা ধারণা করতে পারছ তুমি?’
—‘তুমিও ওদের মেয়ের ওপর অধিকার দেখালেই তো পারো। তোমাকে কে মানা করেছে?’
—ওই মেয়ের মা আমার ছেলেকে বলেছে বিয়ের পর নাকি আমার ছেলের তাকে আম্মা বলে ডাকতে হবে। শুনে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে!’
—‘এটাই কি স্বাভাবিক নয়? তোমার মাকেও তো আমি মা বলেই ডাকতাম।’
—‘তুমি আবারও এই বাজে ফ্যামিলিটার সাথে আমাদের ফ্যামিলিকে মেলাচ্ছ?’
হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা দুজনে সিঁড়ির গোড়ায় চলে এসেছিলেন। হক এ পর্যায়ে থেমে পড়ে রোমেলার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, ‘রোজ রোজ তোমার একই কমপ্লেইন শুনতে ভালো লাগে না। আমি প্রচণ্ড টায়ার্ড। ফর গড সেক, এখন এসব বন্ধ করো।’
—‘তুমি সবসময় ওই মেয়েটার সাথে আমাকে মেলাও কেন? এ তো দেখি বাঁদরের সাথে দেবতার তুলনা!’
—‘তুমি এ বাড়ির বৌ এবং ওই মেয়েটিও দুদিন পর এ বাড়ির বৌ হতে যাচ্ছে।’
—‘বাহ্, এতেই আমরা এক সমান হয়ে গেলাম? এটা আমার সংসার। আমার সংসারে আমি কারো মাতব্বরি সহ্য করব না। আর ওই মেয়েটা কোনোদিক দিয়েই এ বাড়ির বৌ হওয়ার যোগ্য না। আত্মীয়স্বজনকে আমি মুখ দেখাতে পারছি না জানো? আজকে আমার সেজ মামা ফোন করে জানতে চাইছিলেন মেয়ের বাবা কী করে? কীসের বিজনেস? আমার বলতে এত লজ্জা লেগেছে যে কী বলব!’
হক সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগলেন বিষণ্ন, মন্থর গতিতে। তাঁর কপালে একটি কুঞ্চন রেখা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে নতুন বউয়ের সাথে তাঁর স্ত্রী মোটেও ভালো ব্যবহার করবে না। কাল বাদে পরশু বিয়ে কিন্তু এখন পর্যন্ত সে ছেলের হবু শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে ভদ্রতাসূচক কোনো বৈঠকে বসেনি। এমন কি ফোনেও কথা বলেনি। গয়নার অর্ডার দিতে যাওয়ার ব্যাপারেও তার মধ্যে আগ্রহের কমতি ছিল। হক জোর করে নিয়ে গেছেন। মা হিসেবে যে দায়িত্বটুকু পালন করা উচিত তার কানা কড়িও সঠিকভাবে সে পালন করছে না। সমস্ত দায়িত্বের ভার ছেলের বাবার কাঁধে এসেই পড়েছে।
বেডরুমে এসে তিনি হাতঘড়ি খুলতে খুলতে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘দেখো রোমেলা, নিজের ছেলের মুখের দিকে চেয়ে হলেও এখন এসব নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা থেকে বিরত থাকো। তোমার ছেলে এসব জানতে পারলে কতটা কষ্ট পাবে তা একবার ভেবে দেখেছ?’
—‘আর আমি যে কষ্ট পাচ্ছি? সেটার কী হবে? আমার কষ্টটা কেউ দেখে না কেন?’
—‘তুমি অহেতুক কেন কষ্ট পাচ্ছ? তোমার ছেলে সুখী হতে যাচ্ছে। এটাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়?’
রোমেলা অগ্নিদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চেয়ে বললেন, –’আমার ছেলের বৌ হিসেবে একটা ক্লাসি, সুন্দরী, হাই স্ট্যাটাসের মেয়ে চেয়েছিলাম আমি। মধ্যবিত্ত ঘরের ল্যাবেন্ডিশ মেয়ে না।’
হক চুপ করে গেলেন। রোমেলা বরাবরই একটু নাকউঁচু স্বভাবের মেয়ে ছিল। যৌবনে তার রূপের অহংকার ছিল আকাশচুম্বী। সে নিঃসন্দেহে এখনো সুন্দরী। কিন্তু আজকাল তার অহংকারের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। শুধু রূপের নয়, প্রভাব প্রতিপত্তি এবং বিত্ত বৈভবের অহংকার এসে গেছে তার ভেতরে। তার বাবা উচ্চপদস্থ চাকরি করতেন। বাপের বাড়িতে তাদের জীবন যাত্রার মান ছিল অত্যধিক আড়ম্বরপূর্ণ। তাই অহং বোধটা হয়তো জন্মগতভাবেই পাওয়া। লোকে অবশ্য হক সাহেবকেও অহংকারী বলে থাকে কদাচিৎ। অমৃতাও বলেছিল! শাওয়ার নেবার সময় গরম জলের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর হঠাৎ করেই অমৃতার কথা মনে পড়ল। অমৃতা কেন ভালো নেই? বাচ্চা একটা মেয়ে! ওর তো এখন হেসে খেলে বেড়াবার সময়। জীবনটাকে উপভোগ করার সময়। সে কেন ভালো থাকবে না? এই মেয়েটি তাঁর প্রতি এতটা আসক্ত কেন? এটা কি ইনফ্যাচুয়েশন? নাকি সত্যিকারের ভালোবাসা? মেয়েরা তো নানা সময়ে নানাভাবে তার দরজায় কড়া নেড়ে গেছে। কখনোই সাড়া দিতে মন চায়নি। কিন্তু আজ এত কাল পরে এসে এই পুঁচকে মেয়েটাকে তিনি এড়িয়ে যেতে পারছেন না কেন? এর কারণ কী? অজান্তেই একটা প্রলম্বিত শ্বাস পড়ল তাঁর। এ কথা ঠিক অমৃতা আর দশটা মেয়ের মতো নয়। অন্যরকম, ভীষণ অন্যরকম! অমৃতা এক বিস্ময়ের নাম! অমৃতা এক অভেদ্য রহস্যের নাম! আজকাল কি এই রহস্যের মায়াজাল তাঁকে একটু একটু টানছে? নইলে আকণ্ঠভাবে পেশাগত এবং পারিবারিক চাপের মধ্যে ডুবে থেকেও তিনি মেয়েটির কথা কেন ভাবছেন অযথা? মেয়েটা বলছিল তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি যেন কাউকে মিস করছেন। মিস করা কাকে বলে? এই যে হঠাৎ হঠাৎ কারণে অকারণে মেয়েটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এটাকে কি মিস করা বলে? রোমেলার বিয়ের আগে একজন প্রেমিক ছিল। সব সুন্দরী মেয়েদেরই যেমন থেকে থাকে। রোমেলার সেই প্রেম অবশ্য বেশ গভীর ছিল। বিয়ের পরেও টানা তিন বছর সেই প্রেমিকটি নানাভাবে জ্বালাতন করে গেছে। তিনি নিজেও বয়সে তখন একেবারে তরুণ। তবে সুন্দরী স্ত্রীর প্রেমিক তাঁর ভেতরে কোনো যন্ত্রণা বা জ্বলুনি সৃষ্টি করেনি। সেই থেকেই তিনি খুব ভালো করে জানেন যে মন নামক জিনিসটা তাঁর বুকের ভেতরে কোনো এক আবছা কোণে বাক্সবন্দি অবস্থায়ই রয়ে গেছে। সেই বাক্স খোলার চাবিটা নিজের কাছে নেই। তাই বাক্সটা চিরদিনের জন্য বন্ধ। তিনি বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে ছিলেন। বিয়ের পর সংসার ধর্ম পালন করা তাঁর দায়িত্ব ছিল। সেই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছেন। স্ত্রীর প্রতি মায়া এবং শ্রদ্ধাবোধ ষোলো আনাই আছে। প্রেমে পড়াটা হয়তো কখনও হয়ে ওঠেনি। তাতে কী এসে যায়? সবার জীবনে সবকিছু হয় না। এরকমই নানাবিধ অহেতুক যুক্তিহীন চিন্তায় অনেকক্ষণ অবধি আত্মলীন হয়ে রইলেন তিনি। এসব চিন্তা তাঁর মাথায় সচরাচর আসে না। আজ ব্যতিক্রম। গোসল সেরে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে তিনি একটু অন্যমনস্ক গলায় স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, ‘রোমেলা, তুমি কি কখনো কাউকে মিস করো?’
রোমেলা অদ্ভুত চোখে তাকালেন, ‘আমি আবার কাকে মিস করব?’ —‘তোমার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল না? কী যেন নাম?’
রোমেলা থমকে গেলেন। বিব্রতভাবে বললেন,
—‘হঠাৎ তার কথা?’
হক হাসলেন, ‘জানতে ইচ্ছে হলো।’
রোমেলার চোখে একটা দুশ্চিন্তার গাঢ় ছায়া পড়ল। হক কখনোই তার অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন না। তিনি অন্যরকম মানুষ। কাজের মানুষ। কাজ কর্ম, পেশাগত ব্যস্ততা এবং রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই তাঁর জীবনটা ঘুরছে। আজ হঠাৎ, এত দিন পর রোমেলার প্রাক্তন প্রেমিকের প্রসঙ্গ কেন আসলো?