বৃষ্টিমহল ৩.৩০

৩০

বাইরে তখনও পুরোপুরি আলো ফোটেনি। মশারির ভেতর থেকে চারপাশটা যেমন ঘোলাটে দেখায়, ঠিক সেরকম একটা আবছা ঘোলাটে ভাব ছড়িয়ে আছে সমগ্র বিশ্বচরাচরে। অমৃতা কটেজের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। হৃদি ঘুমিয়েছে শেষ রাতে। তাই বেরোনোর সময় ওকে আর ঘুম থেকে ডাকেনি সে। কিন্তু না ডেকে লাভ কিছুই হলো না। দেখা গেলো মিনিট না গড়াতেই হৃদি পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে ওর পেছনে। অমৃতা পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ঘুমো ঘুমো গলায় সে বলল, ‘পাঁচটা বেজে গেছে? 

অমৃতা হাত ঘড়িটা দেখল, ‘না, এখনো চার মিনিট বাকি। 

হৃদি তার চোখের পল্লব ঘেরা ঢাকনাদুটো প্রসারিত করে আগাগোড়া একবার অমৃতাকে দেখল। অমৃতার পরনে লাল সাদা চেক শার্ট। সাথে ব্লু জিন্স। শার্টের বোতামগুলো খোলা। ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে আকাশী রঙের টি শার্ট। টিশার্টের ওপর ইংরেজিতে লেখা ‘মিয়াও’ তার নিচে ছোট্ট একটি বিড়ালের মুখ আঁকা। হৃদি একটু বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘উপরে এই আলখাল্লাটা পরার কী দরকার?’ 

অমৃতা ঘাড় নিচু করে নিজের পরনের শার্টটা একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘কেন? খারাপ দেখাচ্ছে?’ 

—‘জি হ্যাঁ, খারাপ দেখাচ্ছে। আলখাল্লাটা খোল।’ 

অমৃতা ভ্রু কুঁচকে আকাশ পাতাল ভাবল ক্ষণিকের জন্য। তারপর শার্টটা খুলে হাতে নিল। বলল, ‘এখন ঠিক আছি?’ 

হৃদি হাত বাড়িয়ে বলল, ‘হুম, শার্টটা আমাকে দিয়ে দে। পাঁচটা বেজে গেছে। তুই যা এখন। 

—‘কোথায় যে যাবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কোথায় দেখা করবে সেটা তো বলেনি।’ কাঁচুমাচু গলায় বলল অমৃতা। 

—‘ফোন দিয়ে দ্যাখ।’ 

অমৃতা প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করল, ‘ফোন দিব? কেমন যেন লাগতেছে!’ 

–কেমন লাগতেছে?’ 

—‘কেমন জানি। লজ্জা লজ্জা লাগতেছে।’ 

হৃদি একটা হাই তুলে নির্বিকার গলায় বলল, ‘তাহলে ভিতরে গিয়া ঘুমা।’

অমৃতা চোখ পাকালো, ‘ফাইজলামি করিস?’ 

—‘ফাইজলামি তো তুই করতেছিস, সারারাত দেখা করার জন্য নাচানাচি কইরা এখন বলতেছিস লজ্জা লাগে। তামশা করার জায়গা পাস না।’ 

অমৃতা ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। মাথার চুলে হাত চালালো কয়েকবার চিরুনির মতো। বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ডায়াল করল। তিন নম্বর রিংটা পড়তেই ওপাশ থেকে একজন ফোন ধরল। অমৃতা মুখ খুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই একটি নারী কণ্ঠ বিজলিবাতির মতো চিলিক মেরে প্রবেশ করল তার কর্ণকুহরে। থমকে গেলো সে। রক্তশূন্য হয়ে উঠল মুখ। নিশ্বাস গেলো আটকে। নারী কণ্ঠটি ক্রমাগত ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ বলে চলেছে। চারপাশ বড় বেশি নীরব হওয়ায় হৃদিও ফোনের ওপাশের গলার স্বর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। হৃদি চট করে ফোনটা অমৃতার কান থেকে ছিনিয়ে নিল। ফোনের লাইন কেটে দিয়ে হাঁপ ধরা গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘কী সর্বনাশ! সামির মা ফোন ধরছে!’ 

অমৃতা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে ছিল হৃদির দিকে। তার মুখে একটা হতভম্ব ভাব। চোখের পলক পড়ছে না। দেখে মনে হচ্ছে অসদাচরণের কারণে বেশ কিছু সময় অবশিষ্ট থাকার পরেও জোর করে তার পরীক্ষার খাতা টেনে নেয়া হয়েছে। প্রতিবাদ, অপমান, এবং অপরাধবোধের এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া খেলছে তার মুখে। হৃদি সান্ত্বনা দেওয়ার গলায় বলল, ‘ওয়েট কর। লোকটা ফোন করবে। অন্যের জামাইয়ের সাথে প্রেম করতে গেলে এসব তো হবেই। মুখ কালা কইরা এখন লাভ নাই। আগেই মানা করছিলাম।’ 

ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল দু মিনিটের মাথায়। কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকেই ফোন এসেছে। কিন্তু কী করে নিশ্চিত হবে অমৃতা যে ফোনটা সামির মা করছেন না? সে খুব সাবধানে এনসার বাটন প্রেস করল। প্রথমে কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ সুনসান নীরবতার পর ওপাশ থেকে একটা ভরাট পুরুষ কণ্ঠ বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ?’ 

অমৃতা সবার প্রথমে যে কথাটা বলল তা হলো, 

—‘আমার নম্বর কি আপনার ফোনে সেভ করা আছে?’ 

—‘না।’ শব্দটা শুনতে পেয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস গড়িয়ে পড়ল অমৃতার বুক পিছলে। 

—‘যাক বাঁচালেন!’

—‘তুমি কোথায়?’

—‘কটেজে।’ 

—‘আমি রিসোর্টের মেইন গেটের বাইরে আছি।’ 

—’আচ্ছা।’ 

—‘তুমি কি আসছ?’ 

—‘আসছি।’ 

বলে অমৃতা ফোন কাটল। তার বুক তখনও ধড়ফড় করছে। সে হৃদির দিকে তাকিয়ে উদ্বেল গলায় বলল, ‘যাই!’ অমৃতার টি শার্টটা কোমরের দিকে একটু কুঁচকে ছিল। হৃদি এগিয়ে এসে হাত দিয়ে কাপড়টা ঠিক করে দিতে দিতে বলল, ‘মনে রাখিস। এটাই কিন্তু লাস্ট মিটিং। ঢাকায় গিয়ে তুই আর দেখা করবি না।’ 

—‘হুম।’ অমৃতা বলল অন্যমনস্ক গলায়। 

—‘তুই কিন্তু প্রমিজ করছিস আমাদের।’ 

—‘মনে আছেরে ভাই। এতো বারবার বলতে হবে না।’ একটু বিরক্তি নিয়ে বলল অমৃতা। 

মশারির জালটা একটু একটু করে গুটিয়ে নিচ্ছে কেউ আশপাশ থেকে। শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছিল বলে পথঘাট এখনো ভেজা। গাছের পাতায় পাতায় টলমল করছে জলবিন্দু। কত পাখি যে ডাকছে! গোটা জগতটা যেন তাদেরই রাজত্ব। টিউটিউ করে সরব মাতামাতিতে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তারা পৃথিবীবাসীকে। পুব দিকের আকাশে সিঁদুর রঙের খেলা। ওদিকে তাকালে, এক আশ্চর্য স্নিগ্ধতায় মন ভরে যায়! রিসোর্টের বাসিন্দাদের কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি তখনো। চারদিক জনমানবহীন। গেটের সামনে শুধু খাঁকি পোশাক পরা একজন সিকিউরিটি গার্ড বসে আছে। অমৃতাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ম্যাডাম কিছু লাগবে?’ 

অমৃতা হাত নেড়ে বলল, ‘না কিছু লাগবে না। হাঁটতে যাচ্ছি।’ 

গেট পেরোনোর পরে অমৃতা দেখল গোটা পার্কিং লটটায় শুধু সারিবাঁধা গাড়ি ছাড়া কোনো জনমানবের অস্তিত্ব নেই। একটা অদ্ভুত উত্তেজনায় কাঁপছিল শরীরের প্রতিটি রক্তকণা। স্পষ্টভাবে কিছু ভাবতে পারছিল না সে। পার্কিং লট ফেলে রাস্তায় উঠে আসতেই দীর্ঘকায় মানুষটাকে দেখা গেলো। ভোরের আবছা নরম আলোয় দাঁড়িয়ে আছেন একটি নীল রঙের সাইনবোর্ডের সামনে। সাইনবোর্ডে লেখা রুমা ২৭ কি.মি.এবং নীলগিরি ২৮ কি.মি.। মানুষটার পরনে সাদা টি শার্ট, কালো ট্রাউজার। ছিপছিপে লম্বা মেদহীন শরীর। যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে এই বয়সেও তাঁর বডি ফিটনেস এবং আকর্ষণীয় চেহারা যে কোনো কমবয়সি যুবকের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। অমৃতা ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো তাঁর সামনে। তিনি লক্ষ্য করলেন না প্রথমটায়। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা টাইপ করছিলেন স্মার্ট ফোনের কী প্যাডে। এক গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল অমৃতা। অন্তরটায় বড্ড কাঁপাকাঁপি! সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল করছে বুক! সে কোনো কথা বলতে পারল না। নির্বাক চেয়ে রইল শুধু। কতক্ষণ কাটলো কে জানে। খুব বেশিক্ষণ না বোধহয়। লোকটা একসময় কাজ শেষ করে মুখ তুলে চাইলেন। ফোন রাখলেন ট্রাউজারের পকেটে। তারপর ভোর বেলার ওই সাবান ঘোলা পেলব নরম আলো ভেদ করে গভীর চোখ দুটি যখন অমৃতার চোখের ওপর পড়ল, তখন জীবনে প্রথমবারের মতো অমৃতা বুঝল যে প্ৰিয় মানুষটাকে কাছ থেকে শুধু এক পলক চোখের দেখা দেখার মধ্যে যে স্বৰ্গীয় সুখটা নিহিত আছে, তার সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো সুখের তুলনা হয় না! 

—‘কী খবর?’ অমৃতার মুখের ওপর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন করলেন হক।

-–’ভালো।’ বলল অমৃতা, স্তিমিত গলায়। যে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ওরা, সেই রাস্তাটা এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে অনেক দূরে। মূলত এটি একটি ওয়াই জংশন রোড, অর্থাৎ দুটি রাস্তার মিলনস্থল। একটি রাস্তা গেছে নীলগিরির দিকে। অন্যটি গেছে রুমার দিকে। ভোরবেলা বলে এই মুহূর্তে গাড়িঘোড়া, মানুষজন একেবারেই কম। এক দুজন পাহাড়ি মেয়েকে কাঁধে ঝুড়ি অথবা কাঁখে কলসি নিয়ে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে কদাচিৎ। হঠাৎ হঠাৎ সাঁই সাঁই শব্দে জিপ গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে বাস। কয়েকটা মুহূর্ত ওরা দুজনেই চুপ করে থাকল। হক মেয়েটাকে দেখছিলেন মনোযোগ দিয়ে। অমৃতা বুঝতে পারছিল যে আজকে মানুষটা তাকে যেরকম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন, ঠিক এতটা গভীরভাবে এর আগে কোনোদিনই তিনি তাকে লক্ষ্য করেননি। আর এটা বুঝতে পেরে অমৃতার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে সে যথেষ্ট স্মার্ট বলেই জানত। অযথা হাত পা কাঁপাকাঁপি, অকারণ নার্ভাস ফিল করা, এসব ন্যাকা ন্যাকা মেয়েলি ব্যাপারস্যাপার তার মধ্যে একেবারেই ছিল না। আজকের এই বদলে যাওয়া নিজেকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। দুর্বল বোধ করছিল সে ভেতরে ভেতরে। ভীষণ দুর্বল! গভীর চোখদুটো হঠাৎ অমৃতার টিশার্টের ওপর লেখা মিয়াও শব্দটার ওপর থমকে গেলো। 

—‘তোমার পোষা বিড়াল আছে?’ প্রশ্ন করলেন তিনি। 

—‘না নেই। আম্মুর এলার্জি আছে বেড়ালে। তাই আমাদের বাড়িতে আমরা কোনো পেট রাখতে পারি না। আমার ছোটবোনের কুকুর খুব পছন্দ। কিন্তু আমার মায়ের জ্বালায় কুকুর পালা সম্ভব না।’ 

কথাটা বলে শেষ করে অমৃতা আবার বলল, ‘আপনার ওয়াইফ ফোন ধরেছিলেন।’ 

—‘হ্যাঁ। আমি ভুল করে ফোন ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়েছিলাম।’ 

—‘ইশ, যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!’ খুব স্বাভাবিক গলায় বলল অমৃতা কথাটা। বলবার পরে বুঝি একটু লজ্জিতও বোধ করল মনে মনে। তাই মুখ নামিয়ে নিল নিচে। হক এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না। গম্ভীরভাবে অমৃতার নত মুখখানার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি আবার ভয়টয় পাও নাকি? 

—‘আগে পেতাম না। আজকাল পাই!’ 

—‘কেন? আজকাল এত কীসের ভয় তোমার অমৃতা?’ 

—‘হারিয়ে ফেলার ভয়! 

কথাটার মর্মার্থ বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে অতি স্বাভাবিক গলায় তিনি বললেন –’দেখা করতে চেয়েছিলে কেন?’ 

—‘আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল রাশেদ, তাই দেখা করতে চেয়েছি।’ চোখ নিজের পায়ের জুতোর ওপর নিবদ্ধ রেখে কাঁপা অথচ ক্ষীণ গলায় বলল অমৃতা 

রাশেদ একটা বড় নিশ্বাস গোপন করলেন। অনেকগুলো বছর একটানা শুধু ব্যবসা, রাজনীতি এবং সাংসারিক গ্যাড়াকলে চাপা পড়ে থেকে তাঁর বুকের ভেতরে একটা লৌহকণ্টক স্থায়ী ভাবে বিঁধে গিয়েছিল। রাগ, অভিমান, ভালোবাসা এই অনুভূতিগুলোর আলাদা কোনো অস্তিত্ব তিনি টের পাচ্ছিলেন না বহুদিন ধরে। আজকে এই মেয়েটির অকপট স্বীকারোক্তি শুনে বুকের ওপর দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা সেই লৌহখনিতে উত্তাপের একটি হালকা আঁচ লাগল যেন। তার মনে পড়ল না এর আগে, শেষবার কে তাঁকে কবে এমন আকুলভাবে মনের কথা বলেছিল! 

তিনি অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কেন এরকম করছ অমৃতা? তুমি তো অবুঝ নও। বোকাও নও। তুমি কি বুঝতে পারছ না যে তুমি ভুল করছ?’ 

অমৃতা হালকাভাবে বলল, ‘ঠিক ভুল বুঝি না। আমার মনের ইচ্ছাটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ 

—‘তুমি তো এখনো ছোট, তাই অনেক কিছুই বোঝো না। যেদিন আমার মতো বড় হবে সেদিন বুঝবে যে বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্রতর স্বার্থ গুলো, সুখগুলো বিসর্জন দিতে হয়। বৃহৎ স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে বেঁচে থাকার চরম সার্থকতা।’ 

অমৃতা এবার স্পষ্টভাবে বলল, ‘রাশেদ! আমি জানি বয়স, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, যোগ্যতা অনেক দিক দিয়েই আপনি আমার চেয়ে অনেক বড়। আমি হয়তো কখনোই আপনার মতো করে বুঝতে পারব না, ভাবতে পারব না। কিন্তু আমার এই এতটুকু বয়সে আমি আমার মতো করে বুঝেছি যে, মাঝে মাঝে সমাজের নিয়মকানুন, ট্যাবু সবকিছু বিসর্জন দিয়ে জীবনের ছোট ছোট চাওয়াগুলোকে গুরুত্ব দিতে হয়। কারণ… কারণ রাশেদ, জীবনটা খুব ছোট! আজকে এই মুহূর্তে আপনি আর আমি একসাথে আছি। কাল কে কোথায় থাকি তা কে জানে! আজকের পরে আপনার সাথে যদি আমার আর কখনো কোনোদিন দেখা না হয়? যদি আফসোস থেকে যায় সারাজীবনের জন্যে? জীবনে আসলে সত্যিকারের পাওয়ার মতো করে কিছুই পায় না মানুষ। টাকাপয়সা, মানসম্মান, খ্যাতি এর কোনোকিছুই মনের সাথে লেগে থাকে না। মনের সাথে লেগে থাকে শুধু স্মৃতি। তাই মানুষের উচিত বেশি বেশি করে স্মৃতি কুড়িয়ে নেওয়া! 

রাশেদ মেয়েটির দিকে স্নিগ্ধ চোখে তাকালেন। এত গুছিয়ে কথা বলা এই বাচ্চা মেয়েটিকে কে শিখিয়েছে? অবাক লাগে তাঁর। বড়ই অবাক লাগে! তিনি একটু সময় চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুমি হয়তো এখনো বুঝতে পারোনি যে মনের দাবি মেটানোর জন্য একজন শিক্ষিত, সভ্য মানুষ কোনোভাবেই সামাজিক দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। শিক্ষা আমাদেরকে ভাবতে শেখায়। চোখ মেলে দেখতে শেখায়। সমগ্র প্রাণীকূলের মধ্যে একমাত্র মানুষকেই ন্যায়, নীতির বোধ দেওয়া হয়েছে। মানুষ যদি এই বোধটাকে কাজে না লাগিয়ে শুধু ইন্সটিঙ্কট ফলো করে তাহলে কিন্তু মানুষের সাথে পশুর কোনো তফাৎ থাকবে না।’ 

অমৃতা ঘাড় নিচু করে পায়ের জুতো দিয়ে একটা ইটের টুকরো নাড়াচাড়া করছিল। সে অবস্থাতেই একটু লাজুক গলায় বলল, ‘মানুষ যদি মনের পরিচর্যাই না করল, তাহলে আর অত নীতিবোধ দিয়ে কী হবে?’ এটুকু বলে সে চোখ তুলে চাইলো, দৃঢ় গলায় বলল, ‘আপনি বললে আমি এখনই চলে যাব। আপনাকে দেখার ইচ্ছে ছিল। দেখে ফেলেছি। আমার কাজ শেষ। এখন চলে যেতে পারি। যাব?’ 

রাশেদ অমৃতার স্থির দুটি চোখের ওপর থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। আশপাশটা একবার দেখলেন কড়া নজর বুলিয়ে। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, ‘যাও।’ 

শব্দটা শেলের মতো বিঁধল গিয়ে অমৃতার বুকে। হালকা একটা জলজ আভাস পড়ল তার দুচোখের তারায়। পাতলা সুন্দর গোলাপি দুটো ঠোঁট নিজের অজান্তেই বেঁকে গেলো একটু। শ্লেষের গলায় বলল, ‘আপনি এত নিষ্ঠুর কেন?’ হক এই প্রশ্নের উত্তরে দুর্বল চোখে তাকালেন অমৃতার দিকে। তিনি তো এই মুহূর্তে মনপ্রাণ দিয়ে ভীষণভাবে নিষ্ঠুর হতে চাইছেন। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছেন না কেন? কয়েক সেকেন্ড অমৃতার পুতুল মুখখানার দিকে চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন তিনি, ‘চলো হাঁটি!’ 

কথাটা বলতে বলতে তিনি হাঁটা শুরু করলেন। চোখে পড়ল গেট পার হয়ে বেরিয়ে আসছেন মালেক সাহেব। কোম্পানীর ট্রেজারার। মালেক সাহেবকে এক পলক দেখে নিয়ে হক অমৃতাকে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন? হাঁটো, পা চালাও!’ অমৃতা হাঁটা শুরু করল। যে রাস্তাটা রুমার দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তা ধরে। এদিকে কোনো ফুটপাথ নেই। রাস্তার একদম পাশ ঘেঁষেই জংলা ঝোপ আর গাছপালা। গাছের ডালে ডালে কিচিরমিচির করে ডাকাডাকি করছে অগণিত পাখি। একটা মাইক্রোবাস আসছিল রাস্তার উল্টোপাশ থেকে সাঁই সাঁই শব্দে বাতাস কেটে। অমৃতার মুখে তখন চিলতে হাসি লেগে আছে। হাসি নিয়েই আপন মনে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। রাশেদ হাঁটছিলেন রাস্তার ধার ধরে, জঙ্গলের পাশের আগাছা আর মাটিযুক্ত জায়গার ওপর দিয়ে। চলন্ত গাড়িটা দেখতে পেয়ে তিনি হঠাৎ করেই অমৃতার বাহু খামচে ধরে টেনে নিয়ে আসলেন নিজের কাছাকাছি। দাঁড় করিয়ে দিলেন আগাছাওয়ালা মাটির ওপর। একটু কড়া গলায় বললেন, ‘গাড়ি আসছে। বি কেয়ারফুল!’ অমৃতা ঘটনার আকস্মিকতায় কেঁপে উঠেছিল। হৃৎপিণ্ডে চলকে উঠেছিল রক্ত। সে নিশ্বাস বন্ধ করে সচকিতভাবে একবার তাকালো তার বাহুতে সাঁড়াশির মতো আটকে থাকা লোকটার পাঁচ আঙুলের দিকে। অমৃতার ওই তাকানো দেখে অতর্কিতে মানুষটার ধারালো সুন্দর মুখখানায় একটু লালচে আভাস পড়ল। তিনি চট করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘স্যরি!’ 

৩১

দূরের বনে কোকিল ডাকছে মন কেমন করা সুরে। সাবান ঘোলা পানির মতো আলোটা এখন দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে গেছে। পালিয়ে গেছে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা জমাট বাঁধা অন্ধকার। রাস্তার দুপাশে বৃষ্টিভেজা বিশুদ্ধ সবুজ! দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। ‘স্যরি’ শব্দটা উচ্চারণ করেই লোকটা প্রায় একহাত দূরে সরে গিয়েছিল অমৃতার কাছ থেকে। যেন অমৃতার বাহু খামচে ধরা ভীষণ বড় অন্যায় একটি কাজ। অমৃতা যেন অচ্ছ্যুত, তাকে ছোঁয়া নিষেধ! দূরত্ব রেখেই হাঁটছিলেন তিনি। পথের মাঝখানে একটা ভাঙা শিমুল গাছের পাতলা ডাল পড়ে ছিল, ফুল সমেত। অমৃতা নিচু হয়ে ডালটা তুলে নিল। এদিকের রাস্তায় আপাতত তেমন লোকজন নেই। অমৃতা হাতে ধরা শিমুলের ডাল থেকে ফুল ছিঁড়ে নিতে নিতে প্রশ্ন করল, 

—‘আপনি কি রাগ করলেন?’ 

অমৃতার দিকে একবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন তিনি, বললেন, ‘নাতো!’ 

—‘তাহলে এরকম রাগ রাগ হয়ে আছেন কেন?’ 

হক একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘আমি মানুষটাই একটু রাগি।’ 

—‘তাই?’ 

—‘হ্যাঁ। আসলে একটু না। যথেষ্ট রাগি।’ 

হাতের ডানপাশে শাল আর বহেড়ার নিঝুম বন। অমৃতা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘চলুন ওইদিকে যাই।’ 

—‘কোনদিকে?’ 

অমৃতা হাতের আঙুল তুলে ইশারা করল, ‘ওই দিকে।’ 

হক প্রস্তাবটা শুনে একটু দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। কপালে ভাঁজ ফেলে চিন্তা করলেন কিছু একটা। তারপর কোনো কথা না বলেই অমৃতার দেখানো পথে পা বাড়ালেন। বনের রাস্তায় পা রাখতেই একদল হলদে রঙের ছোট্ট বুলবুলি পাখি কিচিরকিচির শব্দ তুলে উড়াল দিল দূর আকাশে। শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছিল বলে মাটি নরম এবং কিছুটা ভেজা এখনো। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল। কিছু দূর এগোনোর পর দেখা গেলো সম্মুখের জংলি পথটা উত্রাই হয়ে নেমে গেছে নিচে, নদীর কাছাকাছি। ওরা যেখানটায় গিয়ে দাঁড়ালো, সেখান থেকে আঁকাবাঁকা বয়ে চলা সাঙু নদীটা স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর ওপাড়েই পাহাড়। একটা গাছের গুঁড়ি দেখতে পেয়ে হক অমৃতাকে বললেন, ‘তুমি বসবে?’ 

—‘না না, আপনি বসুন। আমার দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।’ 

তিনি আর কোনো দ্বিরুক্তি না করে গাছের গুঁড়ির ওপর বসলেন। অমৃতা তাঁর পাশেই এক হাত দূরত্বে একটা রাবার গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। শাল, মহুয়া আর রাবার গাছের পাতায় পাতায় ঝিরঝির শব্দে হাওয়ার নাচন চলছিল। ঝিরঝির শব্দটায় কবিতার মতো একটা কোমল ভাব আছে। শুনতে শুনতে কেমন ঘোর লেগে যায়। এই মিহি বাতাস শরীর ছুঁয়ে দিলে বিশুদ্ধ অনুভূতি হয়। মনে হয় যেন নিশ্বাসের সাথে সাথে ফুসফুসে ঢুকে যাচ্ছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি। ওপারের পাহাড়ের মাথায় মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল নিরুদ্দেশ। একটা নীল পাখনার ভারি সুন্দর দেখতে মাছরাঙা পাখি ওদের চোখের সামনে দিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে গেলো নিচে, নদীর দিকে। মানুষটা দূরের পাহাড়ে চোখ রেখে কী যেন ভাবছেন। খুবই অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাঁকে। অমৃতা হাতে ধরা ডাল থেকে ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছিল অবহেলায়। আড়ে আড়ে দেখছিল খানিক দূরে বসে থাকা মানুষটার ধারালো চোয়াল, তীক্ষ্ণ নাসা, ছোট করে ছাটা চুল, কিছুটা উদ্ধত চিবুক আর চওড়া বুক। 

‘ভিউটা খুব সুন্দর।’ সম্মুখের মেঘ ঢাকা পাহাড়ের ওপর চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল অমৃতা, কিছু একটা বলা দরকার বলে মনে হলো তাই। 

—‘আমাদের পুরো দেশটাই আসলে খুব সুন্দর!’ বললেন তিনি, বিমুগ্ধ কণ্ঠে! 

অমৃতা একটু শ্লেষের হাসি হাসল, ‘সুন্দরের মধ্যে যে অসুন্দরেরা দানা বেঁধে চলেছে দিনের পর দিন। সেদিকে কি আপনাদের খেয়াল আছে?’ 

হক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন, ‘পারফেকশন বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। সব কিছুর মধ্যেই ভালো মন্দ দুটি দিক থাকে। যে লোকটা আজকে সাধু সন্ন্যাসী হয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখো সেই সন্ন্যাসীর জীবনেরও একটি কালো অতীত আছে। আবার যে লোকটা ভয়ংকর অপরাধী, তারও সফেদ একটি অতীত অথবা ভবিষ্যৎ আছে। আমি কি কথাটা বোঝাতে পারলাম?’

—‘পেরেছেন। কিন্তু আপনাদের মতো রাজনীতি করা, সমাজের উঁচু জায়গায় বসে থাকা লোকেরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো কখনোই বুঝবে না। আমাদের সমস্যাগুলো বুঝতে হলে আমাদের লেভেলে নামতে হবে।’ 

—‘সমস্যা কোথায় জানো? মূল সমস্যা হচ্ছে আমরা অল্প বিস্তর অক্ষর জ্ঞান লাভ করেই নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে মনে করি। ঘরে বসে বড় বড় উপদেশ বাণী লিখি। নিষ্কর্মা লোকেরা অনলাইনে লাইভে এসে সেইসব মানুষের নিন্দা করে যারা কিনা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের জন্য লড়ছে। মাঠে নেমে সত্যিকারের কাজটা করতে যে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয় সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। আজকে তোমার মনে হচ্ছে আমার জায়গা থেকে সব সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করা যায়। কিংবা আমি যা করছি তা ভুল। কিন্তু একবার আমার জায়গায় এসে দেখো। হয়তো তোমার ধারণা পাল্টে যাবে। আজকাল বাস্তবিক অর্থেই আমার কী মনে হয় জানো? মনে হয় যে, অক্ষরজ্ঞান লাভ করা আর প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া দুটো এক জিনিস নয়। বেশিরভাগ লোকের কাছে ডিগ্ৰীটা শুধু ড্রয়ারে জমিয়ে রাখা সার্টিফিকেটের কাগজ, জীবিকা নির্বাহের উপায় এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।’

—‘আমি জানি না আমি প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত কিনা, তবে আমার স্বল্প বুদ্ধি দিয়ে আমি বুঝি যে আমাদের এই পরিণতির জন্য সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী। জন্মের পর থেকেই আমরা জেনে এসেছি যে পেটের দায় মেটানোটাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। অন্যকিছু ভাববার অবকাশ নেই। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ওখানকার মানুষগুলোকে মৌলিক অধিকার নিয়ে অন্তত ভাবতে হয় না। শিক্ষা ওদের মনের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম অনেকাংশেই। ওসব দেশে দামি ডিগ্রী না থাকলেও লোকে কিন্তু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারে। সার্টিফিকেট ছাড়াও দিব্যি দিন কেটে যায় স্বচ্ছলভাবে। আর আমাদের দেশে সার্টিফিকেটের কাগজ মুখে খাবার তুলে দেয় রাশেদ! তাই অক্ষর জ্ঞানের সাথে আমাদের সম্পর্কটা কোনোদিক দিয়েই মানসিক নয়। পুরোপুরি দাপ্তরিক বা অর্থনৈতিক।’ 

—‘দাপ্তরিক বা অর্থনৈতিক সম্পর্ক! দারুণ বললে তো!’ 

অমৃতার যেন হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল, জরুরি গলায় বলল, -’আচ্ছা! আপনারা হৃদির বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন না কেন?’ 

আচমকা প্রশ্নটা একটু চমকে দিল রাশেদকে। তিনি অমৃতার দিকে ঘুরে তাকিয়ে কিছুটা হতভম্ব গলায় বললেন, 

—‘বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবার কথা ছিল নাকি?’ 

অমৃতা হাসে, ‘ছেলের বিয়ে দেবেন না?’ 

রাশেদ কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, ‘সামি তো এ ব্যাপারে আমাদেরকে কিছুই বলে নি। সে কি এখন বিয়ে করতে চায়?’ 

—‘অবশ্যই চায়। বিয়ে করে ফেলা ছাড়া আসলে আর কোনো উপায় নেই। হৃদির বাসা থেকে ছেলে দেখছে।’ 

রাশেদকে চিন্তিত দেখালো। কপালের ভাঁজটা সরল না সহজে। বললেন, ‘কিন্তু সামির আম্মা তো একেবারেই রাজি না এই সম্পর্কে। তার অমতে তো আমি ছেলের বিয়ে দিতে পারব না।’ 

অমৃতা অধৈর্য গলায় বলল, ‘উনার সাথে সিরিয়াসলি কথা বলুন। বোঝান ভালোমতো। দেখুন, আপনার ছেলে অনেক লাকি যে জীবনের সঠিক সময়ে সে সঠিক মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছে। সবার ভাগ্য কিন্তু এতো ভালো হয় না!’ কথাটা শুনে রাশেদ একটু থমকানো চোখে তাকালেন অমৃতার দিকে। সঠিক সময়ে, সঠিক মানুষ! ঠিক এভাবে তো এর আগে কখনো ভাবা হয় নি! 

—‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে কী হয় জানেন? দে মিট দ্যা রাইট পারসন অ্যাট আ ভেরি রং টাইম!’ অমৃতা বলল বিষাদ জড়ানো গলায়। রাশেদ চুপ করে রইলেন। স্থিরভাবে চেয়ে রইলেন সম্মুখে। দূর বনের কোকিলটা তখনও কুহুকুহু স্বরে ডেকে যাচ্ছে অক্লান্তভাবে। আকাশ আর পাহাড়ের মিলনস্থলে দিনের প্রথম রোদ্দুর রেখা কোমল ঝিলিক দিচ্ছে। পাতলা মেঘের গায়ে লেগে আছে সদ্য জেগে ওঠা দিনমণির কাঁচা লাল রং। সেই দিকে চেয়ে থেকে ক্রমশ এক চিন্তারাজ্যে ডুবে যাচ্ছিলেন তিনি। মাথার ভেতরে ঘূর্ণির মতো বাক্যটা ঘুরছিল। Meeting the right person at a wrong time! 

—‘কী ভাবছেন?’ অমৃতার প্রশ্ন। 

চিন্তারাজ্যে ডুবে থেকেই তিনি অমৃতার দিকে ফিরে চাইলেন। চোখ থেকে ভাবনার ছায়া তখনো পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। ধীর কণ্ঠে বললেন, —‘তেমন কিছু না। তোমার কথা বলো। তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?’

অমৃতা ফিক করে হেসে দিল। তারপর ফিচেল গলায় বলল, ‘আমি তো আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথেই আছি এখন! 

রাশেদ একটু কড়াভাবে বলে উঠলেন, ‘দুষ্টুমি করো না!’ 

অমৃতা অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, ‘দুষ্টুমি করছি না। আপনার কি আমার বয়ফ্রেন্ড হতে আপত্তি আছে?’ 

—‘তোমাকে এখন আমার খুব জোরে একটা ধমক দেওয়া উচিত, জানো? তোমার বয়সি আমার একটা ছেলে আছে।’ 

—‘ছেলে আছে বলে কি আপনার আলাদা একটা জীবন থাকতে পারে না? বাবা মায়েদের কি ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বলে কিছু নেই?’ 

—‘আমার শুধু ছেলে আছে তাই ই নয়। স্ত্রীও আছে।’ 

—‘জানি তো!’ 

—‘তাহলে কেন আবোলতাবোল বকছ?’ 

—‘ইচ্ছে করছে তাই।’ 

—‘ইচ্ছেতে লাগাম দিতে শেখো।’ 

—‘কেন? একটাই তো ছোট্ট জীবন! ইচ্ছেরা ওদের মতোই থাকুক না! বেচারাদের ওপর এত অত্যাচার কেন?’ 

রাশেদ চুপ করে গেলেন। ঠোঁট টিপে, কপালে ভাঁজ ফেলে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলেন। ভাব দেখে বোঝা গেলো এই আলোচনার এখানেই ইতি টানতে চাইছেন তিনি। অমৃতা বলল,-’সামির সাথে কথা হয়েছে। ওকে বলেছি ঢাকায় ফিরে গিয়ে অফিসে জয়েন করতে। মনে হচ্ছে আপনি একবার মুখ ফুটে বললেই ও রাজি হয়ে যাবে।’ 

রাশেদ কৃতজ্ঞতার গলায় বললেন, ‘ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি আমার অনেক উপকার করলে। আসলে আমার ছেলের বন্ধুভাগ্যটা খুব ভালো। একটা সময় ওর ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে আমার চরম আপত্তি ছিল। এখন আর নেই।’ 

—‘জেনে ভালো লাগল। একটা সময় আপনাকেও আমার চরম অহংকারী বলে মনে হতো। এখন আর মনে হয় না। বরং মনে হয় আপনার মতো মানুষকে বুঝি একটু অহংকারী হলেই মানায়।’ 

ঝুমঝুম আওয়াজে কিছু একটা ডেকে যাচ্ছিল অনবরত। নিঝুম বনের মধ্যে শব্দটা নূপুরের ঝংকার তুলে ছড়িয়ে যাচ্ছিল দিগ্বিদিকে। শুনতে ভালো লাগছিল। রাশেদ বললেন, ‘আওয়াজটা কীসের বল তো?’ 

—‘কী জানি! ঝিঁঝিঁ পোকা হবে হয়তো!’ 

—‘ঝিঁঝিঁ নয়, সিকাডা। বাংলায় বলে ঘুরঘুরে পোকা অথবা উচ্চিংড়ে। এরা জন্মের পর প্রায় সতেরো বছর মাটির নিচে জীবিত থাকে। পূর্ণাঙ্গ পোকা হবার পর মাটির ওপরে উঠে আসে। মাটির ওপর কয়েক সপ্তাহের বেশি বাঁচে না। চীনারা এই পোকা ধরে খায়।’ 

—চৈনিকরা তো সবই খায়। বাদ আছে কিছু? তবে এই ডাকটা কিন্তু ভারি সুন্দর! আমি এর আগে সেভাবে খেয়াল করিনি কখনও। জানতাম না যে এটাই সিকাডার ডাক। যে কবার শুনেছি, ভেবেছি ঝিঁঝিঁ পোকা।’ 

—‘হ্যাঁ খুব সুন্দর। গানের মতো মনে হয়। পুরুষ সিকাডা পেটের নিচের একটি অঙ্গ ব্যবহার করে এই শব্দটি করে থাকে। এটা অ্যাকচুয়েলি মেইল সিকাডাদের মেটিং কল। সঙ্গিনীদের আকৃষ্ট করা ছাড়াও এই গানের পেছনের আরেকটি কারণ হলো খাদক পাখিদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা। তাদের উঁচুস্বরের গান পাখিদের আভ্যন্তরীণ শব্দের আদানপ্রদানকে ব্যাহত করে এবং দল বেঁধে শিকার করায় বাধা সৃষ্টি করে। এনশিয়েন্ট পোয়েটরা এই সিকাডা নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। Come, dear cicada, chip to all the grove/The Nymphs and Pan, a new responsive strain/That I, in the noontide sleep, may steal from love/Reclined beneath the dark overspreading plane! এটা এক গ্রিক কবির লেখা কবিতা। কবির নামটা ভুলে গেছি।’

—‘আপনি কবিতা ভালোবাসেন?’ 

—‘একটা সময় বাসতাম বৈকি, এখন আর সময় কোথায়?’ 

অমৃতা চপল গলায় বলল, ‘একটা ছড়া পড়েছিলাম সিকাডা নিয়ে। মনে পড়ে গেলো, Clickety clack cikada clinging to the wall / When the sun is sleeping you don’t sing at all…’ 

পরের দুটা লাইন রাশেদ বললেন, ‘But when the sun is shining on summer days so long, clickety clack cicada what a noisy song!’ 

বলা শেষ করে তিনি অমৃতার মুখের ওপর চোখ রেখে প্রাণখোলা একটি হাসি হাসলেন। অমৃতা সেই হাসিটার দিকে আবিষ্টভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজের অজান্তেই হঠাৎ ছেলেমানুষী গলায় স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, ‘ওয়াও!’ 

—‘কী হলো?’ 

অমৃতা হাসতে লাগল, ‘কিছু না!’ 

—‘হাসছ কেন?’ 

অমৃতা উত্তর দিল না। মিটমিটে হাসি নিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। তার মুখে একটা অপ্রতিরোধ্য ভালো লাগার ছাপ আঠার মতো লেগে আছে অনেকক্ষণ যাবৎ। ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রুর নিচের চোখ দুটি কিছুটা আরক্ত। ফর্সা গায়ে আকাশি রঙের গেঞ্জিটা ফুলের মতো ফুটে আছে। মিশে আছে তার বাঁক খাওয়া, সর্পিল সরু কায়াখানিতে, শৈল্পিক ভাবে! 

তিনি আবার প্রশ্নটা করলেন, ‘হাসির কী হলো?’ 

অমৃতা কুণ্ঠিতভাবে বলল, ‘বলতে লজ্জা লাগছে। লিখে দেই?’ 

মেয়েটার পাগলামো আর ছেলেমানুষী দেখে তিনি আবারও হেসে ফেললেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই যে, পাগলামোগুলো এখন কোনোভাবেই খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। এই রোজকার পূর্ণমানুষী জীবনে একটুখানি ছেলেমানুষী ছোঁয়া যদি কালেভদ্রে লেগেই যায়, তো মন্দ কী? 

অমৃতা প্যান্টের পকেট থেকে সেলফোন বের করল। তার আচার আচরণে এখন কিশোরী সুলভ চঞ্চলতা। ঠোঁটে চপল হাসি। সে মোবাইলের কিপ্যাডে আঙুল চালালো খুব দ্রুত। টুং করে একটা শব্দ হলো অন্য প্রান্তের সেলফোনে। হক কিঞ্চিৎ আড়ষ্টভাবে সেলফোনের মেসেজবক্স খুললেন। অমৃতা লিখেছে, ‘আপনার হাসিটা। ইউ নো ইট হ্যাজ ম্যাজিক! আপনি হাসলে চারপাশটা ম্যাজিকের মতো পাল্টে যায়!’ 

প্রশংসা তিনি নানাসময়ে নানাজনের কাছ থেকে পেয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু হাঁটুর বয়সি একটি মেয়ের কাছ থেকে এমন খোলামেলা প্রশংসা জীবনে এই প্রথমবার পাওয়া। তিনি মেসেজটা পড়ে একটু সময় চুপ করে থাকলেন। তাঁর কি উচিত মেয়েটিকে একটি বড়সড় ধমক দেওয়া? কিংবা এই মুহূর্তে এখান থেকে উঠে চলে যাওয়া? তিনি আজীবন উচিত কাজটাই করে এসেছেন। তাঁর গোটা জীবনটা নিয়মে গড়া, শৃঙ্খলায় আবদ্ধ। কিন্তু আজকে এই মেয়েটিকে কড়া কথা বলতে কেন যেন বাধছে। তিনি একেবারেই জোর পাচ্ছেন না ভেতরে। কানের কাছে একটা শেকল ভাঙার আওয়াজ পাচ্ছেন। নিয়মের শেকলটা কেউ ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে যেন, ঝনঝন ঝনঝন শব্দে। 

‘থ্যাংক ইউ!’ লিখলেন তিনি, ছোট করে। এরপর দুজনেই চুপ করে গেলো। তাকিয়ে রইল একে অন্যের দিকে। চোখ সরিয়ে নিল, আবার তাকালো। কখনো হাসল, কখনওবা গম্ভীর হয়ে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। ওপাড়ের পাহাড় থেকে সাদা পায়রার মতো পলকা মেঘের দল উড়ে উড়ে আসছিল এপাড়ের পাহাড়ে। বাতাসের ঝাপটায় নাকে এসে লাগছিল মহুয়া ফুলের ঘ্রাণ। শিমুল গাছের ডালে বসে টিউটিউ করে ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছিল এক জোড়া পাহাড়ি টুনটুনি। সেই সাথে ঘুরঘুরে পোকার নূপুরের মতো ঝুমঝুম গান আর হঠাৎ হঠাৎ কোকিলের কুহুতান চারপাশটাকে ইন্দ্রের সুরসভার চেয়েও মোহনীয় করে তুলছিল ক্রমশ। প্রকৃতির মতোই সতেজ এবং বিশুদ্ধ রকমের একটা হাসি লেগে ছিল দুই নর নারীর মুখে। এই বন পাহাড়ের দেশে… শাল আর মহুয়ার গন্ধে… দূরের বনের কোকিলের ডাকে… ঝিরিঝিরি সুর তোলা হাওয়ায়… কোন এক অদৃশ্য যাদুবলে যেন… হঠাৎ করেই সামাজিক রীতিনীতি, সাংসারিক পিছুটান, বয়সের ব্যবধান সমস্ত কিছু কেমন ঝাপসা হয়ে উঠে ইথারে মিলিয়ে গেলো। প্রকৃতির কাছে হয়তো বয়স বা সময় বলে কিছু নেই। প্রকৃতির কাছে সবাই মানুষ এবং মানুষী, নারী এবং পুরুষ। প্রাকৃতিক নিয়মেই নারী পুরুষ কাছে আসে… দূরে যায়… আবার কাছে আসে! 

অমৃতা এবার লিখল, ‘একটা জিনিস চাইব। দেবেন?’ মেসেজটা পাঠানোর পর সে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে রইল। সামনে বসে মেসেজ পাঠানোর এই এক মজা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। মুখে যা বলা যায় না, লিখে ফেলা যায়। দারুণ কিন্তু ব্যাপারটা! মেসেজ পড়ে তার কপালে ভাঁজ পড়ল। একবার তাকাল অমৃতার দিকে। লিখল, ‘বলো কী চাই? 

অমৃতা লিখল, ‘আমি কি একটাবারের জন্যে আপনার হাত ধরতে পারি?’ 

টুং করে শব্দ হলো অন্য প্রান্তের মোবাইলে। তিনি মেসেজ খুলে পড়লেন। পড়তে পড়তে তাঁর ভ্রু কুঁচকে গেলো। কৃষ্ণ মেঘের ছায়া পড়ল চোখে। ধীরে ধীরে চোয়াল হয়ে উঠল শক্ত। কয়েকটা সেকেন্ড থম ধরে বসে রইলেন তিনি। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলো ফিরে যাই।’ 

অমৃতা অপমানে শক্ত হয়ে গেলো। কেউ যেন এইমাত্র বুকের খাঁচায় ধুকপুক করা হৃৎপিণ্ডটা খামচে নিয়ে দুমড়েমুচড়ে আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে, অবহেলায়। সে জায়গাটা থেকে নড়ল না। নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। তিনি কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকালেন, উঁচু গলায় বললেন, ‘কী হলো? যাবে না?’ 

অমৃতা তার দিকে ফিরেও তাকাল না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার নাকের পাটা ফোলা। চোখের পাতায় চিকচিক করছে কয়েক বিন্দু জল। রাশেদ পকেটে হাত রেখে চোখাভাবে তার দিকে কয়েকটা সেকেন্ড চেয়ে রইলেন। এরপর একটু দ্বিধা নিয়ে হেঁটে এগিয়ে আসলেন। অমৃতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ফিরতে হবে না? নাকি এখানে থেকে যাবে আজীবন?’ 

অমৃতা শূন্য চোখে তাকালো তাঁর দিকে। মানুষটা খুব লম্বা। কাছে এসে দাঁড়ানোর পর ঘাড় উঁচু করে কথা বলতে হচ্ছে। 

অমৃতা স্থবিরভাবে বলল, ‘আজকের পর থেকে আমি আর কোনোদিন আপনার সাথে দেখা করতে চাইবো না, জানেন?’ 

বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো মেলে অমৃতার মুখে কিছু একটা খুঁজলেন তিনি লাগাতার কয়েকটা ক্ষণ। কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তি খেলা করল তাঁর মুখে। ঠোঁট টিপে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বেশ তো, ওয়াইজ ডিসিশন!’ 

অমৃতার পাতলা ঠোঁটজোড়া কাঁপছিল হালকা। চোখের কোণ বেয়ে নিঃশব্দে একটা জলের ধারা নেমে আসছিল নাক বরাবর। বাতাসে উড়ছে তার কপালের কাছের ঘাসের মতো ছোট ছোট চুলগুলি। সে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আপনার একটুও কষ্ট হচ্ছে না, তাই না রাশেদ?’ 

রাশেদ অমৃতার টুলটুলে মুখটার দিকে চেয়ে ছিলেন আবিষ্টভাবে। একটা বিষয় তিনি খুব ভালো মতো বুঝতে পেরেছেন যে, এই মেয়েটির মধ্যে কোনো তঞ্চকতা নেই। তিনি এই সুদীর্ঘ, অভিজ্ঞতাময়, ঘটনাবহুল জীবনে এতটা স্বচ্ছ মনের মানুষ খুব কমই দেখেছেন। এই মুহূর্তে মেয়েটির চোখের পানি তিনি সহ্য করতে পারছেন না। দু পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘তুমি কাঁদছ কেন? বোকা মেয়ে?’ 

—‘আমি নিজেও জানি না কেন কাঁদছি। আমি আগে এরকম ছিলাম না। বিশ্বাস করেন!’ 

—‘প্লিজ কান্নাকাটি করো না। আমার ভালো লাগছে না।’ 

—‘কান্নাকাটি আমি কখনোই করতে চাই না। কিন্তু আমার ভাগ্যটা খুব খারাপ, জানেন? আমাকে কেউ ভালোবাসে না!’ 

রাশেদ ছেলে ভোলানোর গলায় বললেন, ‘তোমার ভাগ্য খারাপ হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। তুমি খুব ভালো থাকবে। সবাই তোমাকে ভালোবাসবে।’ অমৃতা তার কম্পনরত একটা হাত মানুষটার প্রশস্ত বুকের ওপর রাখল, বলল –’সবার ভালোবাসা যে আমি চাই না। আমি কী চাই আপনি কি তা বোঝেন না?’ 

রাশেদ নিজের বুকের ওপর রাখা অমৃতার হাতটার দিকে ভাঁজযুক্ত কপাল নিয়ে তাকালেন, একটু দুর্বল গলায় বললেন, ‘তুমি কি বোঝো না যে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়?’ 

অমৃতা একটা বড় শ্বাস ফেলে বিষণ্ণ গলায় বলল, —‘বুঝি! বোঝার পরেও কষ্ট হয়!’ 

—‘কষ্ট পেও না!’ 

—‘আমি জানি আপনি আপনার স্ত্রী, পুত্রকে অনেক ভালোবাসেন। আমাকে সেই ভালোবাসার ভাগ দিতে হবে না। শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিন, অফ দ্যা রেকর্ড। আপনি আমার কাছ থেকে যত দূরেই থাকুন না কেন আমার মনটা যে সব সময় আপনার সাথেই থাকে, সেটা কি আপনি টের পান?’ 

রাশেদ ডান হাতের আঙুল বাড়িয়ে অমৃতার চোখের জল মুছে দিতে দিতে স্তিমিত গলায় বললেন, ‘টের পাই!’ 

—‘সত্যি?’ 

—‘সত্যি!’ 

শব্দটা উচ্চারণ করে তিনি নিজের বুকের ওপর রাখা অমৃতার হাতটা আলতোভাবে ধরলেন। মোমের মতো ফর্সা নরম হাতটার দিকে একটু সময় চেয়ে থেকে ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘এবার চলো!’ 

৩২

—‘ওই, তোর বয়ফ্রেন্ডের জ্বর আসছে। যা গিয়া একটু সেবা যত্ন কর।’ রুদ্র গম্ভীর গলায় ফরমায়েশ দিল হৃদিকে। 

হৃদি কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। ভোরে ভেঙে যাওয়া ঘুমটা আর কোনোভাবেই জোড়া লাগানো গেলো না। রুদ্রর কথাটা শুনতে পেয়ে তার কপালে একটি অনভিপ্রেত কুঞ্চন সৃষ্টি হলো। উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘হঠাৎ জ্বর?’ 

—‘হুম। বড়লোকের পোলা তো। নকড়া বেশি। ভোররাত থেকে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়া আম্মা আম্মা করতেছে।’ হৃদি আর কথা না বাড়িয়ে ভেতরের দিকে রওয়ানা দিল। চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিল রুদ্রর হাতে। 

নব ধরে অল্প ঘোরাতেই খুলে গেলো দরজাটা। ভেতরটা ঠাণ্ডা। বোঝা যাচ্ছে সারারাত এয়ার কন্ডিশন চালানো ছিল। আকাশ মেঝেতে চাদর পেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে হাত দুটো রাখা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভারি নিশ্বাসে বুক উঠানামা করছে। জানালার পর্দা টানা বলে ঘরের ভেতরে এখনো সূর্যের আলো পুরোপুরিভাবে প্রবেশ করতে পারেনি। আধো আলো অন্ধকারে ছেয়ে আছে সারা ঘর। হৃদি পা টিপে টিপে ঘরের ভেতর ঢুকল। সে জানে আকাশের ঘুম খুব পাতলা। টুকটাক একটু শব্দ হলেই ঘুম ছুটে যায় ওর। সামি পাশ ফিরে শুয়ে আছে বিছানায়। তার গায়ের ওপর একটা পাতলা কম্বল জড়ানো। দরজার শব্দ পেয়ে সে একটু নড়ে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল হৃদিকে। হৃদি ফিসফিস করে বলল, ‘তোর নাকি শরীর খারাপ?’ 

সামি প্রশ্নটার কোনো উত্তর দিল না। একটু নড়ে উঠে গায়ের কম্বলটা আরো ভালো মতো টেনেটুনে নিল। তার মাথা ভার। শরীর দুর্বল। হৃদি এগিয়ে এসে ওর কপালে একটা হাত রেখে বলল, ‘জ্বর আসছে তো তোর। হঠাৎ কী হইল?’ 

কথাটা বলতে বলতে সে সামির পাশে বসলো বিছানায়। সামি এবারেও কিছু বলল না। তার মুখটা বড়ই শীর্ণ দেখাচ্ছে। কালচে ঠোঁট দুটো শুকনো। চোখ জোড়া নিষ্প্রভ এবং ঈষৎ লালচে। জ্বরটা অবশ্য তার চেহারার সুকুমার ভাব কেড়ে নিতে পারেনি। ওর শ্রীময় মুখখানার দিকে চেয়ে থেকে হৃদির মনটা ক্রমশ নরম হয়ে আসছে। দুদিন ধরে জমে থাকা বরফের মতো কঠিন রাগের চাইটা ধীরে ধীরে গলতে শুরু করেছে। সে সামির কোঁকড়ানো চুলগুলিতে হাতের আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল, 

—‘তোর কি বেশি শরীর খারাপ লাগতেছে? চোখ এরকম লাল হয়ে আছে কেন? আলতা পরছিস নাকি চোখে?’ 

সামি টানা কিছুক্ষণ তার রাঙা দুটি চোখ হৃদির মুখের ওপর স্থিরভাবে তাক করে রইল। হৃদির কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলগুলি খোলা। পরনে একটা অফ হোয়াইট সুতির সালওয়ার কামিজ। ওড়নাটা চওড়াভাবে ছড়িয়ে আছে, বুকের ওপর। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকের ছোঁয়া। সেই মুহূর্তে, ওর ওই নিষ্কলঙ্ক, নিখাদ মুখটা দেখে সামির হঠাৎ মনে হলো যে, মায়া জিনিসটা আসলে কী তা এই মেয়েটাকে না দেখলে জগতের কোনো মানুষ কোনোদিন পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না। সে বড় একটা শ্বাস টেনে নিল। তার মনে হলো, এতক্ষণ এই ঘরে বুঝি অক্সিজেনের অভাব ছিল। হৃদি এসেছে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে। 

সামি একটু বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘তুই গতকাল রাতে ফোন ধরিস নাই। কেন জানতে পারি?’ 

হৃদি ওর গালে একটা হাত রেখে বলল, ‘এমনি।’ 

—‘এমনি এমনি ফোন ধরিস নাই?’ 

—‘আচ্ছা, এসব কথা পরে হবে। এখন তুই ওঠ। চট করে কিছু খেয়ে নে। ওখুধ খেতে হবে।’ 

—‘ওখুধ খেতে হবে না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। তুই আমার প্রশ্নের জবাব দে।’ 

হৃদি একটু সতর্কভাবে মেঝেতে শুয়ে থাকা আকাশের দিকে তাকালো একবার। আকাশ তখনও ঘুমোচ্ছে। গলা কয়েক পর্দা নিচে নামিয়ে হৃদি বলল, ‘তুই আকাশকে কী সব আজেবাজে কথা বললি। আমার খুব খারাপ লাগছিল।’ 

—‘আকাশ আমার বন্ধু। আমি ওরে যা ইচ্ছা বলতে পারি। এটা নিয়ে তোর আপত্তি করার কিছু নাই।’ 

—‘আকাশ আমারও বন্ধু। এটা ভুলে যাস না।’ 

দরজায় খুট করে একটা শব্দ হলো। ওদের দুজনের কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরের মধ্যে রোমেলা ঢুকলেন আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে। হৃদি সচকিতভাবে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। রোমেলা আর্তনাদ করে বলে উঠলেন, ‘কী হয়েছে আমার বাচ্চাটার?’ প্রশ্নটা করে হৃদির দিকে একবার কঠিনভাবে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন। হৃদি সালাম দিল। তিনি সালামের উত্তর তো দিলেনই না, উপরন্তু তার চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠল রাগে। হৃদি মাথা নিচু করে একপাশে সরে দাঁড়ালো। আকাশের ঘুম তখন ছুটে গেছে। শোয়া থেকে উঠে বসেছে সে। রোমেলা দৌড়ে ছুটে আসলেন ছেলের কাছে। ছেলের কপালে হাত রেখে উদ্বেগের গলায় বললেন, ‘হায় আল্লাহ! আমার ছেলের তো জ্বর! হঠাৎ জ্বর আসলো কেন?’ প্রশ্নটা তিনি আকাশের দিকে চেয়ে করলেন। আকাশ ঘুম জড়ানো গলায় ভারি জিব নেড়ে অনেক কষ্টে বলল, ‘জানি না আন্টি।’ 

সামি মায়ের একটা হাত ধরল, নরম স্বরে বলল, ‘আমি ঠিক আছি মা।’ 

রোমেলা রিসিপশনে ফোন করে নাশতার অর্ডার দিলেন। সাথে নাপা এক্সট্রাও চেয়ে নিলেন একটা। সেই সাথে চাইলেন ছোট রুমাল, জলপট্টি দেবার জন্য। হৃদি ঘরের কোণায় রাখা ছোট ফ্রিজটার সামনে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রোমেলা তার দিকে ভুলেও চোখ মেলে তাকাচ্ছেন না। যেন এই মানুষটার উপস্থিতি তিনি টেরই পাচ্ছেন না। তাঁর পরনে নেভিব্লু রঙের ছাপা সুতির শাড়ি। চুলে বড়সড় একটা খোঁপা। গলায় ঝুলছে হোয়াইট গোল্ডের চেইন তার সাথে হীরের ছোট্ট একটা লকেট। হাতভর্তি স্বর্ণের চুরি। নাকে হীরের ফুল। তাঁর গা থেকে এই সাতসকালেই দামি পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। হৃদি চোরা চোখে দেখছিল। মহিলার গায়ের রং ফর্সা টকটকে। মাথায় ঢেউ খেলানো কোঁকড়ানো চুল। বোঝা যায় সামি মায়ের গায়ের রং আর চুল পেয়েছে জন্মগতভাবে। তার মা নিঃসন্দেহে সুন্দরী। কাটা কাটা সুন্দর বলেই চেহারায় হয়তো নমনীয় ভাবটা একটু কম। 

৩৩

আকাশ হাত মুখ ধুয়ে কটেজের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দু তিনটে তিতির পাখি হেলেদুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে বারান্দার ওপাশে। ডাকছে গলা খুলে। রুদ্র হৃদির দেওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল। বিভা আর অভিজিৎ তখনও ঘর ছেড়ে বেরোয়নি। 

আকাশ রুদ্রকে দেখতে পেয়েই জরুরি গলায় বলল, ‘এই শোন, তুই কি বসুন্ধরার ফ্ল্যাটটা ছাইড়া দেওয়ার প্ল্যান করতেছিস?’ 

—‘নাতো, কেন?’ 

—‘সামি তো তোর সাথে আর থাকবে না। তুই মুভ করবি না অন্য কোথাও?’ 

রুদ্র একটু চিন্তাযুক্ত গলায় বলল, ‘শোন, আমি ভাবতেছি যে সেপ্টেম্বরে তো চলেই যাচ্ছি এব্রোড। চাকরি আছে আমার জুলাই মাস পর্যন্ত। এর মধ্যে আর মুভটুভ করব না। তাছাড়া সামি বলছে এই চার পাঁচ মাস সে ফ্ল্যাটে না থাকলেও ভাড়া শেয়ার করবে। বুঝছস?’ 

—‘হুম। না কাহিনি হইতেছে মামা, কালকে রাত্রে খবর পাইলাম যে আমাদের বাসার ছাদের উপরে চিলেকোঠার মতো যে ঘরটা আছে, ওইটা খালি হইছে। বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়া খুঁজতেছে। তাই ভাবলাম তোরে বলি।’ 

—‘ও তাই নাকি? ভাড়া কী রকম?’ 

—‘খুব বেশি না, দশ বারো হাজার হবে।’ 

—‘একটাই রুম?’ 

—‘হ্যাঁ রুম একটা, এটাচড বাথ আর তোর ইশে… একটা রান্নাঘর আছে।’ 

—‘মনীষা তো বাসা খুঁজতেছে। ওরে বলমু নাকি?’ 

—‘বাসা পায়নায় সে এখনো?’ 

—‘না, তার অফিসের লোকেশন আবার চেঞ্জ হইছে। নতুন অফিস মনে হয় মোহাম্মদপুর থেকে কাছেই হবে। 

—‘আচ্ছা, বলে দেখতে পারিস।’ 

ঠিক সেই সময় অমৃতাকে দেখা গেলো কটেজের সামনে। তার কাছাকাছি দূরত্বে সামির আব্বাকেও দেখতে পেলো বন্ধুরা। অমৃতা সিঁড়ি ভেঙে কটেজের বারান্দায় উঠে এসেই দুই বন্ধুর দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল, ‘সামির কী হইছে?’ 

রুদ্র বিকারহীন গলায় বলল, ‘ঢং হইছে।’ 

মিনিট দুয়েকের মধ্যে হক উঠে আসলেন বারান্দায়। সাধারণত নিজ পুত্রের বন্ধুরা তাকে দেখামাত্রই সালাম দিয়ে ওঠে। একটা বিনয়ী ভাব অতর্কিতে ফুটে ওঠে এদের চেহারায়। কিন্তু আজ, কোনো এক অবিদিত কারণে দুজনের একজনও সালাম দিল না। হক ছেলেদুটোকে এক পলক দেখলেন। লক্ষ্য করলেন দুজনের মুখেই বিনয়ের পরিবর্তে একটা উদ্ধত ভাব বিরাজ করছে। রুদ্রর চোখে চোখ পড়ল তাঁর। রুদ্র চোখ সরিয়ে নিল। এই ব্যতিক্রম আচরণের কারণ তাঁর কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। কিন্তু তিনি বুদ্ধিমান মানুষ। কারণটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারলেন তিনি। 

হক সাহেব জায়গাটা অতিক্রম করে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ অমৃতাকে বলল, ‘তুই কোথায় গেছিলি?’ 

—‘মর্নিং ওয়াকে। 

—‘কার সাথে?’ 

অমৃতা এক চোখ টিপে বলল, ‘কার সাথে আবার? আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে!’ 

কথাটা শুনে আকাশ আর রুদ্র একে অপরের দিকে তাকালো। রুদ্রর মুখটা একটু পাঁশুটে বর্ণ দেখাচ্ছিল। অমৃতা ওর পাঁশুটে চেহারার দিকে চেয়ে বলল, ‘তোর কী হইছে?’ 

—’কিছু না।’ 

—‘মুখ কালা করছস ক্যান?’ অমৃতার প্রশ্ন। 

রুদ্র অমৃতার পুতুল পুতুল মুখটার দিকে কয়েক সেকেন্ড অন্যমনস্কভাবে চেয়ে থেকে যান্ত্রিক গলায় বলল, ‘মেকআউট করতে ইচ্ছা করতেছে।’ 

অমৃতা মুখ বাঁকালো, ‘সব সময় ফালতু প্যাঁচাল।’ 

কথাটা বলে সে আর দাঁড়াল না। হেঁটে চলে গেলো ভেতরে। আকাশ একটু ত্যাড়া গলায় বলল, ‘তুই শালা সব সময় এই কথাটা ওরে কেন বলিস?’ 

রুদ্র দৃপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘কারণ আমি বিশ্বাস করি যে একদিন ও আমার এই কথায় সাড়া দিয়ে বলবে, লেটস ডু ইট!’ 

আকাশ বিস্মিত গলায় বলল, ‘কী বলতেছিস?’ 

রুদ্র হাসে, ‘ঠিকই বলতেছি।’ 

আকাশ কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলো রুদ্রর কথাটা শুনে। ভ্রুকুটি গম্ভীর মুখ নিয়ে চেয়ে রইল সামনে। রুদ্র বলল, ‘তুই কি রাগ করলি নাকি? 

আকাশ রুদ্রর দিকে ফিরে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘দ্যাখ রুদ্র, তুই ওকে পছন্দ করলে সরাসরি বলতে পারিস না? এইসব ফাইজলামির তো কোনো মানে হয় না।’ 

রুদ্রর মুখে একটু বিরক্তি ভাব ফুটে উঠল, ‘এটা আমার স্টাইল। আমার পক্ষে সরাসরি বলা সম্ভব না। তুই বলস না ক্যান? তুই সরাসরি বললেই তো পারিস।’ 

আকাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরস্বরে বলল, ‘আমার কথা বাদ দে।’ 

৩৪

সামি মায়ের হাত ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মা তার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। হৃদি অস্বস্তি নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরেধীরে দরজার দিকে সরে আসলো। এখানে আর তার থেকে কাজ নেই। বিশেষ করে এই মহিলার সাথে এক ঘরে বেশিক্ষণ থাকা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। এই আত্মম্ভরী মহিলার আচার আচরণ তার ভালো লাগছে না একেবারেই। কথার ধরনেই বোঝা যায় যে কাউকে মানুষ বলে পণ্য করে না সে। হৃদি দরজার নবটা ঘুরালো হালকাভাবে। 

—‘হৃদি!’ হঠাৎ সামির গলার আওয়াজ ভেসে আসলো পেছন থেকে।

হৃদি একটু ঘাবড়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘হুম?’ 

—‘কোথায় যাচ্ছিস?’ সামির প্রশ্ন। 

হৃদি টের পেলো রোমেলা তার দিকে ঝাঁঝালো চোখে তাকিয়ে আছেন। এরকম হিংস্র দৃষ্টির সামনে সে এর আগে কোনোদিন পড়েছিল কিনা তা মনে করতে পারল না এই মুহূর্তে। সে একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘বাইরে… বাইরে যাচ্ছি।’ 

সামি কড়াভাবে হুকুম করল, ‘কোথাও যেতে হবে না। এখানেই থাক।’

রোমেলা ব্যস্ত গলায় ছেলেকে বললেন, ‘তুমি কথা বোলো না বাবা, চুপ করে শুয়ে থাকো।’ 

হৃদি অস্বস্তি নিয়ে দরজার কাছ থেকে ফিরে আসলো আবার। রুদ্র যে বিছানায় ঘুমিয়েছে রাতে সেই বিছানাটা বড়ই অগোছালো হয়ে আছে। আর কোনো কাজ না পেয়ে হৃদি বিছানায় পড়ে থাকা এলোমেলো কম্বলটা ভাঁজ করতে লাগল। দুমড়ে মুচড়ে থাকা চাদর ঠিক করতে লাগল। 

—‘বাবা কোথায়?’ সামি প্রশ্ন করল। একটু দুর্বল গলায়। 

রোমেলা বললেন, ‘তোমার বাবা ভোরবেলা উঠেই হাঁটতে বেরিয়েছেন। ফোন করেছিলাম। এখন ফিরে আসছেন।’ 

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই হক সাহেব উপস্থিত হলেন ঘরে। ব্যস্তভাবে ছুটে আসলেন ছেলের কাছে। নরম গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘এখন কেমন লাগছে আব্বু?’ 

সামি হাসল, ‘ভালো বাবা। এখন ভালো লাগছে আমার।’ 

হক চোখ ঘুরিয়ে হৃদিকে দেখলেন একবার। চোখে চোখ পড়তেই হৃদি সালাম দিয়ে উঠল বিনীতভাবে। তিনি ছেলের বিছানার একপাশে বসতে বসতে হেসে সালামের উত্তর দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কেমন আছ মা?’ 

হৃদি হাতের কাজ ফেলে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভালো আছি আংকেল। আপনি কেমন আছেন?’ 

—‘আমি ভালো। তোমার আব্বা আম্মা ভালো আছেন তো?’ 

হৃদি হাসিমুখে বলল, ‘জি ভালো আছেন।’ 

রোমেলা স্বামীর দিকে তির্যক একটা দৃষ্টি দিলেন। মেয়েটির সাথে যেচে পড়ে কথা বলাটা তাঁর মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। এমনিতেই এই মেয়ে তার ছেলের শোবার ঘরে এসে বসে আছে সকাল থেকে। এসব মেয়েদের লাজ শরম বলতে কিছু নেই। চূড়ান্ত বেহায়া আজকালকার মেয়েগুলো। স্বামীর কাণ্ডজ্ঞান দেখে তিনি বিস্মিত না হয়ে পারছেন না। এত কুশল বিনিময় করে এই বেহায়া মেয়েকে আরো মাথায় তোলার কোনো মানে আছে? 

হক স্ত্রীর কঠিন দৃষ্টিটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হৃদিকে বললেন, ‘তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো।’ 

হৃদির ভালো লাগল। সে পূর্ণ চোখ মেলে একবার তাকালো মানুষটার দিকে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে লোকটার মধ্যে বিশেষ একটা সম্মোহনী শক্তি আছে। আশেপাশের সর্বস্তরের মানুষকে সম্মোহন করে রাখতে পারেন ইনি। অমৃতাও কি আর দশজন মানুষের মতো হিপনোটাইজড হয়ে গেলো? অমৃতার মতো কঠিন ব্যক্তিত্বের মেয়েও? আনমনা হয়ে ভাবছিল সে। মানুষ তার গোটা জীবনের একটিমাত্র মঞ্চে নানা সময় নানা ভূমিকায় অভিনয় করে থাকে। যে মানুষকে দেখে অমৃতার মনের মধ্যে প্রেম ভাব উদয় হয়েছে, সেই একই মানুষ হৃদির কাছে শতভাগ পিতৃতুল্য! 

সামির কেন যেন খুব ভালো লাগছিল। স্বস্তির এক অনুভূতি শীতের মিষ্টি রোদ্দুরের মতো আলতোভাবে এলিয়ে পড়েছিল মনের বারান্দায়। ভাগ্যিস জ্বরটা এসেছিল। জ্বর না আসলে বাবা, মা আর হৃদিকে একসাথে একইসময় পাওয়া যেত বুঝি? সে মায়ের কটমটে চেহারার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। মা যে হৃদিকে একটা ফোঁটাও পছন্দ করেন না তা খুব ভালো মতোই জানা আছে তার। তার মনে বড়ই আশা যে খুব শীঘ্রই মায়ের মনোভাব পরিবর্তন হবে। হতেই হবে! 

খাবার চলে আসলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। রোমেলা খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ব্যস্তভাবে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আজ তিনি ছেলেকে নিজের হাতে খাইয়ে দেবেন। আপত্তি করল সামি। এই মুহূর্তে তার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে পেটে কিছু পড়লেই বমি হয়ে যাবে। সে দৃঢ় গলায় মাকে বলল, ‘এখন খাওয়া সম্ভব না। রেখে দাও একটু পরে খাব।’ 

এবার হৃদি কথা বলল, ‘কিছু না খেলে তো ওষুধ খেতে পারবি না। অল্প করে হলেও কিছু খেতে হবে।’ 

সামি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘অসম্ভব!’ 

হৃদি এগিয়ে এসে একরকম জোরজার করে সামিকে শোয়া থেকে টেনে তুলল। হালকা ধমকের সুরে বলল, ‘বেশি কথা বলবি না। চুপচাপ খেয়ে নে। 

অগত্যা, সামিকে খেতেই হলো। তার মা খাইয়ে দিল সময় নিয়ে, যত্ন করে। খুব বেশি কিছু অবশ্য মুখে দিতে পারল না সে। সবজি দিয়ে অর্ধেক রুটি খেয়েই বাচ্চাদের গলায় বলে উঠল, ‘আর খাব না। কিছুতেই আর খাব না। মরে গেলেও খাব না!’ 

হৃদি ওষুধ আর পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। খাওয়া শেষ হতেই সে পানির গ্লাস আর ওষুধ এগিয়ে দিল সামির হাতে। ছেলের ওষুধ খাওয়া হয়ে গেলে, হক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুমি এখন একটু রেস্ট নাও আব্বু। কেমন? ‘এটুকু বলে তিনি স্ত্রীকে বললেন, ‘চল আমরা আসি। 

—‘এত তাড়া কীসের? আরেকটু থাকি।’ 

—‘থাকলে তো ওর সমস্যা হবে। ও একটু ঘুমাক। রেস্ট নিক।’ বললেন হক গম্ভীর গলায়। 

রোমেলা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালেন। ঘর থেকে বেরোনোর পর হক স্ত্রীকে বললেন, ‘মেয়েটাকে তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় নিয়ে আসি। কী বলো?’ 

রোমেলা চমকে উঠলেন স্বামীর কথা শুনে, ‘কোন মেয়েটাকে? কী বলছ তুমি?’ 

হক হেসে বললেন, ‘কোন মেয়ে আবার। তোমার ছেলে যে মেয়েটিকে পছন্দ করে, তার কথা বলছি।’ 

রোমেলা ঝেঁঝে উঠে বললেন, ‘এই বাজে ফ্যামিলির মেয়েটাকে তুমি ছেলের বৌ করবে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ 

—‘বাজে ফ্যামিলি বলছ কেন? ওর বাবা কি চোর ডাকাত নাকি?’ 

রোমেলা চাপা গর্জনের সাথে বলে উঠলেন –’চোর ডাকাত কিনা জানি না তবে আমাদের সাথে কোনোদিক দিয়েই মেলে না ওদের। তুমি জানো ওই মেয়ের বাবা কী করে? মামুলি এক চাকরিজীবী!’ 

হক একটু সময় গম্ভীরভাবে বললেন, ‘চাকরিজীবী হলেই খারাপ লোক, এই ধারণা তোমাকে কে দিয়েছে? আমার যতটুকু মনে পড়ে আমার শ্বশুর মশাইও চাকরিজীবি ছিলেন।’ 

—‘আমার বাবার সাথে তুমি এদেরকে মিলাচ্ছ? আমার বাবা কাতারে কত বড় চাকরি করতেন! আমাদের লাইফ স্ট্যান্ডার্ড কী রকম ছিল তা কি তুমি নিজের চোখে দেখোনি?’ 

হক হেসে বললেন, ‘সামির আম্মা, তোমার মধ্যে এখনো কিছু ছেলেমানুষী রয়ে গেছে। তুমি কি তা জানো?’ 

রোমেলা বিরক্ত হলেন। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সর্বদা তাঁর স্বামী নিজে স্বতন্ত্রভাবে নিয়ে থাকলেও একমাত্র পুত্রের ব্যাপারে তিনি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি কখনো। এবারেও এর ব্যতিক্রম হবে না বলেই তাঁর বিশ্বাস। কিন্তু আজ তাঁকে সম্পূর্ণ রূপে অবাক করে দিয়ে হক বজ্রগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমার ছেলে যাকে পছন্দ করে, তার সাথেই ওর বিয়ে হবে।’ 

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে কটেজের বাইরে চলে এসেছিলেন। কথাটা শুনতে পেয়ে রোমেলা থমকে দাঁড়ালেন। বিস্ফারিত কণ্ঠে বললেন, ‘অসম্ভব! আমার অমতে তুমি আমার ছেলের বিয়ে দিতে পারো না।’ 

হক স্থির গলায় বললেন, ‘দেখো, তোমার মতামতকে আমি সব সময়ই গুরুত্বের সাথে দেখে এসেছি। তোমার সিদ্ধান্ত মোতাবেকই তানিশার সাথে ছেলের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু তুমি নিজেই তো দেখলে। এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তাই এবারে আমি তোমাকে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি। নিজের অহংবোধ দূরে সরিয়ে রেখে ছেলেটার দিকে একবার মুখ তুলে তাকাও। ও কী চায় তা বোঝার চেষ্টা করো। প্লিজ!’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *