বৃষ্টিমহল ৩.২৫

২৫

ঠিক হয়েছে আজ রাতে কেউ ঘুমোবে না। সারা রাত আড্ডা হবে। আড্ডার জন্য ওরা গিয়ে বসবে রিসোর্টের পুল সাইডে। এই রিসোর্টে ইনফিনিটি সুইমিংপুল আছে। পুলে নামলে মনে হয় পাহাড়ের কোলে কোনো এক প্রাকৃতিক জলাশয়ে বুঝি সাঁতার কাটা হচ্ছে। সন্ধের পর মেয়েরা তাদের নিজস্ব রুমে এসেছিল সাজসজ্জা পাল্টাবে বলে। বিভা ঢাকা থেকে চিরুনি আনতে ভুলে গেছে। বিছানার ওপর বসে হৃদির চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল সে। হৃদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেকআপ রিমুভার দিয়ে ঘষে ঘষে চোখের কাজল তুলছিল। আর অমৃতা চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে ঘরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। 

বিভা চোখ না তুলেই বলল, ‘তোর কী হইছে? মতলবটা কী?’ 

অমৃতা হাঁটা থামিয়ে বলল, ‘দোস্ত লোকটার সাথে আমি দেখা করতে চাই।’

বিভা চিরুনি চালানো বন্ধ করে চোখ তুলে তাকালো অমৃতার দিকে, ‘কী? কী বললি?’ 

—‘দেখা করব!’ 

—‘মাথার মধ্যে কি গোবর? তুই না কত বড় এডভোকেট? এরকম গোবরভর্তি মাথা নিয়া ওকালতি করস ক্যামনে?’ 

অমৃতা অনুনয় বিনয় করে বলল, ‘প্লিজ দোস্ত আজকে একটা দিন দেখা করি? আর করব না। দ্যাখ ঢাকায় চলে গেলে উনার সাথে আমার আর কোনোদিনও দেখা হবে না।’ 

—‘কে বলছে দেখা হবে না? তুমি কোনো না কোনো বাহানায় নাচতে নাচতে যাবা দেখা করতে। তোমারে আমার চিনা আছে।’ 

—‘না করব না। লাস্ট এক মাস তো দেখা হয় নায়। প্লিজ আজকে একটু ব্যবস্থা করে দে! 

—‘আমি কী করব? আমার কী করার আছে এখানে? আজিব!’ 

হৃদি ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে এসে বলল, ‘দ্যাখ অমৃতা, তোর দেখাদেখি আমার শ্বশুর মশাইও কিন্তু খারাপ হয়ে যাচ্ছে এখন। এইসব কী হ্যাঁ? বেগুনি ফুল সুন্দর মানে? ঢং নাকি এইগুলা? শাশুড়ি জানলে কী হবে জানিস?’ 

বিভা বলল, ‘তোর শ্বশুরের আর দোষ কী? সারাক্ষণ যদি আগুনের মতো সুন্দর একটা জোয়ান মাইয়া পিছন পিছন ঘুরে তাইলে তো ভাই বনবাসে থাকা সাধু সন্ন্যাসীর ধ্যানও ভেঙে যাবে। সব দোষ এই বেগুনি সুন্দরীর। উনার দোষ নাই!’ 

বিভা আর হৃদির কথা শুনে হেসে ফেলল অমৃতা, ‘আচ্ছা এসব কথা তোমরা পরে বইল। এখন একটা বুদ্ধি দাও কীভাবে দেখা করব।’ 

—‘টেক্সট কর।’ বিভার মতামত। 

অমৃতা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ব্যাটা জীবনেও টেক্সটের রিপ্লাই দেয় না। কত সুন্দর একটা কবিতা পাঠাইছিলাম একদিন। সেইটারও রিপ্লাই দেয় নায়। 

শুনে হৃদি বিভার হাতে একটা চিমটি কেটে ঠেসমারা গলায় বলল, ‘দ্যাখ না, আবার কবিতাও পাঠায়!’ 

—‘একবারই পাঠাইছিলাম ভাই! এরকম করার কিছু নাই।’ 

—‘টেক্সট করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। তুই টেক্সট কর যদি উনি রাজি হয় তাইলে আমরা হেল্প করতে পারি। তবে এটাই লাস্ট। প্রমিজ করতে হবে যে জীবনে আর কখনো তুই উনার সাথে দেখা করবি না। 

অমৃতার এতক্ষণের হাস্যেজ্জ্বল মুখটা একথা শুনে দপ করে নিভে গেলো। ম্লান গলায় সে বলল, ‘প্রমিজ করতে হবে?’ 

হৃদি দৃঢ় গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। এই প্রমিজ যদি করতে পারিস তাহলে আমরা তোকে হেল্প করতে পারি। নইলে…’ 

—‘নইলে?’ 

—‘নইলে আমার শাশুড়িকে গিয়ে বলে দিব।’ 

অমৃতা হেসে ফেলল, ‘এটা তোরা জীবনেও করবি না।’ 

—‘কে বলছে করব না? একশবার করব।’ 

অমৃতা এ কথার পরে কিছু বলল না। চুপ করে বসে রইল বিছানার ওপর। মাথা নিচু করে। বিভা বলল, ‘কি প্রমিজ করবি না? ঢাকায় গিয়ে আবার দেখা করবি?’ 

—‘যদি দেখা হয়ে যায়?’ 

—‘জীবনেও দেখা হবে না। আর দেখা হয়ে গেলে সেটা অন্য কথা। তুমি নিজ থেকে দেখা করবা না। আজকেও দিতাম না দেখা করতে। কিন্তু তুমি কান্নাকাটি করতেছ দেখে আমরা তোমাকে পারমিশন দিচ্ছি। বুঝছ?’ 

অমৃতা বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ল। অর্থাৎ সে বুঝেছে। ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আচ্ছা প্রমিজ করলাম। নিজ থেকে দেখা করব না। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেলে সেই দোষ আমার না।’ 

—‘তাহলে এখন টেক্সট কর। দেখি কী রিপ্লাই দেয়।’ বলল বিভা চিন্তিত গলায়। 

অমৃতা একটা বড় শ্বাস ফেলে মোবাইলটা হাতে নিল। অনেকটুকু সময় নিয়ে একটা মাত্র লাইন লিখল ইংরেজিতে, ‘ক্যান উই মিট?’ 

লেখার পর কাঁপা হাতে চোখ বন্ধ করে মেসেজটা সেন্ড করল। শব্দ করে বলল ‘বিসমিল্লাহ! 

২৬

একটা হলুদ আলো নিঃশব্দে এগিয়ে আসছিল। সামি হাতের আঙুলে ধরে থাকা সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। নাচতে নাচতে এগিয়ে আসা টর্চের আলোটার দিকে তাকিয়ে নিস্তরঙ্গ গলায় প্রশ্ন করল, ‘কে?’ আগন্তুক তাৎক্ষণিকভাবে কোনো উত্তর দিল না। আঁধারে মিশে থাকা শরীরটা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল নিচে। কয়েক ধাপ নেমে কাছে আসতেই টর্চের আলোতে তার মুখখানা স্পষ্ট হয়ে উঠল। 

—‘কী ব্যাপার?’ 

সামির পাশে কাঠের সিঁড়ির ওপর বসতে বসতে প্রশ্ন করল আকাশ। মোবাইলের টর্চ নিভিয়ে দিল। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার তীব্র ঝালা। বন্ধুরা সবাই পুলসাইডে গিয়ে বসেছে। সামিকে পাওয়া যাচ্ছিল না। মোবাইলের চার্জার নেবার জন্য আকাশের একবার কটেজে আসতে হয়েছে। আসবার পর পেছন দিকের সিঁড়িতে সামিকে আবিষ্কার করল আচমকা। অন্ধকারে ওকে খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর ব্যাপার ছিল। হঠাৎ‍ সিগারেটের আগুনটা নজর কাড়ল। শূন্যে ওঠানামা করা অগ্নিবিন্দু দেখেই বুঝতে পারল সে, এই আঁধার মানুষ সামি ছাড়া অন্য কেউ না। 

—‘কী ব্যাপার মানে?’ প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করল সামি। 

—‘এইখানে একলা একলা বইসা আছস কেন? ফোন বন্ধ কেন? 

—‘বন্ধ না।’ 

—‘তাহলে তোর ফোনে যায় না কেন?’ 

—‘কী জানি! নেটওয়ার্ক প্রব্লেম মনে হয়।’

—‘তুই ঠিক আছস?’ 

—‘হুম।’ একটু গম্ভীর শোনায় সামির গলা। 

‘সবাই খুঁজতেছে তোরে। চল যাই।’ 

—‘তুই যা। আমি একটু পরে আসতেছি।’ 

আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো সামির দিকে। ঝুপসি অন্ধকারে ডুবে থাকা অস্পষ্ট মুখটায় কী যেন খুঁজল কয়েক সেকেন্ড। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল, 

—‘ড্যুড, ইজ এভরি থিং অলরাইট?’ 

সামি চোখাভাবে বলল, ‘হৃদি কী বলতেছিল তখন?’ 

—‘কখন?’ আকাশ অবাক। 

—‘বিকালে।’

—‘বিকালে?’ 

—‘পাহাড়ে!’ 

আকাশের মুখে একটা ধাঁধাঁ খেলে গেলো, ‘পাহাড়ে মানে? কীসের কথা বলতেছিস?’ 

—‘বিকালে দেখলাম তোরা দুইজন গাছতলায় বইসা কথা বলতেছিলি। কী কথা বলতেছিলি?’ 

আকাশ হতভম্ব গলায় বলল, ‘মানে কী?’ 

—‘বুঝতে এত সমস্যা হইতেছে কেন? বাংলা ভাষায়ই তো কথা বলতেছি।’ 

সামিকে হঠাৎ কেমন দুর্বোধ্য ঠেকল আকাশের কাছে। সন্ধ্যা থেকেই লক্ষ্য করছিল ব্যাপারটা। রিসোর্টে ফিরে আসার সময় সামি গাড়ির মধ্যে কারো সাথে কোনো কথা বলেনি। পৌঁছুবার পর থেকেই লাপাত্তা। বন্ধুরা ফোনের পর ফোন করে যাচ্ছে তার মোবাইলে। কিন্তু ফোনের লাইন কিছুতেই লাগছে না। 

আকাশ গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘কেন জানতে চাইছিস?’ 

এ প্রশ্নে সামির মুখের অভিব্যক্তি অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা গেলো না বটে, তবে একটা তেজের হলকা টের পাওয়া গেলো। সে জাড় গলায় বলল, ‘কেন? জানতে চাইলে কোনো সমস্যা আছে?’ 

—‘থাকতেই পারে।’ 

—‘আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে তোর কী কথা হইছে, সেইটা আমি জানতে চাইতে পারি না?’ 

আকাশ চমকে উঠল। 

—‘কী বললি?’ 

—‘যা বলার একবারই বলছি। বারবার বলব না।’ 

আকাশ হতচেতন ভাবে চেয়ে রইল সামির দিকে। বুকের মধ্যে অনির্বচনীয় এক ব্যথা টের পাচ্ছে সে, কিন্তু মাথায় কোন শব্দ খেলছে না এই মুহূর্তে। মস্তিষ্ক শূন্য। অনেক কষ্টে শূন্য মস্তিষ্ক থেকে হাতড়ে হাতড়ে কয়েকটা এলোমেলো শব্দ খুঁজে নিয়ে সে বলল, ‘তোর গার্লফ্রেন্ডটা আমার কী লাগে? তুই জানিস?’ 

সামি উত্তর দিল না। লাইটার দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো সময় নিয়ে। আকাশ এবার চড়া গলায় বলল, ‘উত্তর দিস না কেন?’ 

—‘কী লাগে?’ কিছুটা নির্বিকারভাবে প্রশ্ন করে সামি। 

—‘শালা! আমার ফ্রেন্ড আমার সাথে কী কথা কইছে সেটা তোরে বলা লাগবে কেন?’ 

—‘কী এমন কথা কথা বলতেছিলি হাতে হাত ধইরা? যা আমারে বলা যায় না?’ 

কথাগুলো বলার সময় সামি লক্ষ্য করল না আকাশের মুখে ধীরেধীরে একটা কষ্টের নীল ছাপ পড়ছিল। অদ্ভুত তোলপাড় হচ্ছিল তার বুকের ভেতর। রাগ হচ্ছে। অন্ধ বোবা রাগটা শুঁয়োপোকার মতো রোমকূপে রোমকূপে কামড়াতে শুরু করেছে। সে সামিকে কিছু না বলে হঠাৎ করেই ফোন হাতে নিয়ে হৃদির নম্বরে ডায়াল করল। খুব দ্রুত ফোন রিসিভ করল হৃদিতা। আকাশ উত্তেজিতভাবে বলল, ‘তুই একটু আমাদের কটেজে আয় তো। এখুনি আয়!’ 

— কেন?’ 

—‘দরকার আছে। শোন ব্যাকসাইডের সিঁড়িতে আসবি।’ সামি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, ‘ওরে ডাকতেছিস ক্যান?’ 

আকাশ কোনো উত্তর দিল না। কাঠ হয়ে বসে রইল। সামি উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। সিঁড়ির রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিল, ধোঁয়া ছাড়ল তারপর অধৈর্য গলায় বলল, ‘চুপ কইরা আছিস যে?’ 

আকাশ এবারেও কিছু বলল না। কথা না বলার ব্রত নিয়েছে যেন সে। হৃদি আসলো মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। আসামাত্র চ্যাঁচামেচি করে বলে উঠল, ‘এই অন্ধকারে বইসা আছিস ক্যান তোরা? 

আকাশ কোন ভূমিকা ছাড়াই উত্তেজিত গলায় বলল, ‘হৃদি শোন, তোর বয়ফ্রেন্ড আমারে জিগাইতেছে যে আজকে বিকালে তুই আর আমি গাছ তলায় হাত ধইরা বইসা কী কথা বলতেছিলাম। আমি কি তারে এই প্রশ্নের উত্তরটা দিব? যেহেতু তুই আমার ফ্রেন্ড তাই ওরে কিছু বলার আগে তোর পারমিশন আমার নিতে হবে! 

হৃদি বিস্ময়ে ডুবে গিয়ে বলল, ‘এটার মানে কী? আমরা কী কথা বলতেছিলাম তা দিয়ে ওর কী?’ 

সামি তখনো রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনোযোগের সাথে সিগারেট ফুঁকছে। তার আচরণে কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক না। হৃদি অসহিষ্ণু গলায় বলল, ‘কাহিনি কী আমারে খুইলা বল। আমি কিছুই বুঝতেছি না।’

আকাশ বলল, ‘না বুঝার কী আছে? সামি জানতে চায় ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমার কী কথা হচ্ছিল।’ 

বিষয়টা পুরোপুরি বুঝে উঠতে একটু সময় লাগল হৃদির। প্রথমত, আকাশের সাথে তার গাছতলায় বসে থাকার দৃশ্যটা জারা ব্যতীত অন্য কারো দেখে থাকার কথা নয়। আর সামি যদি সেই দৃশ্য দেখেও থাকে তাহলে তার উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধু দুজনকে নিজের উপস্থিতির জানান দেওয়া। তা না করে এতক্ষণ বাদে আকাশকে আলাদা ভাবে সেই ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার কারণ কী? সামি তো কখনও এমন সংকীর্ণ মানসিকতার অধিকারী ছিল না। হঠাৎ তার কী হয়ে গেলো? 

একটা প্রগাঢ় হতভম্ব ভাব হৃদির মুখের কথা কেড়ে নিয়েছিল। অনেক কষ্টে সে বলতে পারল, ‘আমরা কী কথা বলতেছিলাম সেটা ওরে বলব ক্যান? আমাদের পার্সোনাল কথা থাকতেই পারে।’ 

—‘পার্সোনাল কথা আবার কীসের? তোরা কি ভুলে গেছিস যে আমাদের বন্ধুদের কিছু লুকানোর নিয়ম নাই?’ হৃদি ঝাঁঝালো গলায় বলল, –’তাহলে তুই যখন আমাদেরকে দেখছিস, তখন জানতে চাস নাই কেন? চোরের মতো দূর থেকে দেইখা পালায় যাওয়ার মানে কী?’ 

সামি একটু কুণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘কেন যেন কিছু বলতে মন চায়নায়।’ 

—‘আজিব!’ অস্ফুটে বলল হৃদি। 

—‘ওকে, অনেস্টলি স্পিকিং, তোদেরকে ওইরকম ইন্টিমেট অবস্থায় দেখে আমার ভালো লাগে নাই। কেন ভালো লাগে নাই তা আমি জানি না। তোরা আমার ফ্রেন্ড। তাই মনের মধ্যে চেপে না রেখে বলে দিলাম সরাসরি।’ 

হৃদি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে ছিল সামির দিকে। অস্বস্তির কাটা বিঁধছিল বুকে। সেই সাথে এক নিদারুণ সীমাহীন লজ্জা। আকাশ তার বন্ধু। সহজ বাংলায় বলতে গেলে বলতে হয়, প্রাণের চেয়ে প্রিয় বন্ধু। সেই প্রাণের চেয়ে প্রিয়বন্ধুর সামনে এতটা লজ্জিত সে জীবনে এই প্রথমবারের মতো বোধ করল। হঠাৎ মনে হলো মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কগুলোর প্রকৃত অর্থে নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। যখন যে পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রের আকার ধারণ করাই মানবিক সম্পর্কের মূল ধর্ম। সামি এবং আকাশ দুজনেই তার ভীষণ কাছের মানুষ। কিন্তু হঠাৎ করেই এই কাছের দুটো মানুষ যেন আয়নার প্রতিবিম্বের মতো উল্টে গেছে। এদের দেখা যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এরা কেউই যেন সত্য নয়। যেন আয়নার ভেতরের উল্টো জগতে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। আজকের ঘটনাটা যদি আকাশ না হয়ে অন্য কোনো পুরুষকে কেন্দ্র করে ঘটত তাহলে হৃদি হয়তো খুশিই হতো মনে মনে এই ভেবে যে সামি তাকে অন্য কারো পাশে দেখে সহ্য করতে পারেনি। এটা হয়তো তার ভালোবাসারই একরকম বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কিছুতেই খুশি হতে পারছে না। বরং এক অবিমিশ্র কুণ্ঠাবোধে কুঁকড়ে গেছে সমস্ত দেহ মন। সামি তাকে অপমান করেছে! তাদের বন্ধুত্বকে অপমান করেছে। এই অপরাধের ক্ষমা নেই! সে তারস্বরে বলল, ‘আমাদের একসাথে দেইখা তোর ভালো লাগে নাই কেন? তুই কি জীবনে এই প্রথমবার আমাদের একসাথে দেখছিস?’ 

সামি মিনমিন করে বলল, ‘না আগেও দেখছি।’ 

আকাশ এতক্ষণে কথা বলল, ‘শোন তোরা। এসব ঝগড়া পরে করিস। আমি চলে যাচ্ছি। আমি যাওয়ার পর প্রাণ খুলে ঝগড়া করিস। কিন্তু সামি! যাওয়ার আগে তোরে একটা কথা বলতে চাই। কান খুলে শোন।’

—‘বল। শুনতেছি।’ 

—‘তুই মনের কথা বইলা দিছিস, এ জন্যে তোরে থ্যাংকস। এখন আমিও একটা মনের কথা বলি, কেমন? অনেক কষ্ট পাইছি আজকে তোর আচরণে। কিন্তু এটা জেনে রাখ যে হৃদিতা আমার ফ্রেন্ড আর ওরে তুই কোনোভাবেই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবি না।’ এটুকু বলে সে নিজের হাতটা সামির মুখের সামনে তুলে ধরে আঙুলে তুড়ি বাজালো পরপর দুবার। শক্ত গলায় বলল, ‘কথাটা মনে থাকে যেন!’ 

ঘুরে দাঁড়ালো আকাশ। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে। ও চলে যাবার পর হৃদি চাপা গর্জনের সাথে বলল, 

—‘আমি আকাশের হাত ধরছি দেখে তুই এত জ্বলতেছিস ক্যান?’ 

—‘হাত ধরাটা ম্যাটার না। তুই ওর কাঁধে মাথা রেখে খুব হাসতেছিলি। আমার সাথে থাকার সময় এই হাসি কই থাকে? আমারে তো বলছিস তোর নাকি আমারে দিয়া হয় না। আরো কিছু লাগবে। আরো কিছুটা কী? গাছতলায় বইসা এইসব রংঢং করা?’ 

ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠল হৃদির। ধিক্কার দিয়ে উঠে বলল, ‘ছিঃ সামি! হাও কুড ইউ বি সো মিন! তুই… তোর সাথে আমার কথা বলতেও ঘেন্না হচ্ছে।’

হৃদির মোবাইলে অমৃতা ফোন করছিল। সে সামির সাথে আর একটা কথাও না বলে ফোন কানে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগল। সামি নড়ল না। দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁয়। মেঘ ডাকছে আকাশে। চারপাশ বড্ড গুমোট। ঝড় আসবে বোধহয়। সামি অন্ধকার অন্তরীক্ষের দিকে মুখ তুলে চাইল। একটা দীর্ঘনিশ্বাস হাহাকারের মতো বেরিয়ে আসলো তার বুক চিরে। মনে হলো যেন ওই ঘন কালো, গম্ভীর মেঘগুলো জমিনে নেমে এসে ধীরেধীরে তার মনের আকাশে ভিড় জমানো শুরু করেছে। বড়ই বিষণ্ণ বোধ করতে লাগল সে। 

২৭

সুইমিংপুলের পাশে পেতে রাখা চেয়ারে বসে আছে বন্ধুরা। ওরা ছাড়াও আরো তিন চারটি পরিবার এই মুহূর্তে উপস্থিত আছে পুলসাইডে। এর মাঝে এক দল ছেলে মেয়ে সুইমিংপুলে নেমে গেছে। দুটি তরুণী মেয়ে হলদে বৈদ্যুতিক আলোর নিচে জলপরির মতো সাঁতার কাটছে। রুদ্র আর বিভা মনোযোগ দিয়ে জলপরি দুজনকে দেখছে। অমৃতা বসে আছে চুপচাপ। তার হাতে ধরা সেলফোন। মিনিটে কম করে হলেও দশবার সে ফোনের পর্দার দিকে তাকাচ্ছে। লোকটাকে মেসেজ পাঠিয়েছে সন্ধ্যা সাতটায়। ঘড়িতে এখন বাজছে রাত নটা। এখন পর্যন্ত কোনো রিপ্লাই আসেনি। হ্যাঁ অথবা না, কিছু একটা তো জানানো উচিত, নাকি? লোকটার অভদ্রতা দেখে অবাক না হয়ে পারছে না অমৃতা। সারা শরীর অপমানে জ্বলে যাচ্ছে। রক্তের কণায় কণায় ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ। অভিজিৎ অমৃতার অস্থিরতাটা লক্ষ্য করছিল বেশ অনেকক্ষণ ধরে। এবার সে বলল, ‘তুমি কি কিছু নিয়ে টেন্সড?’ 

অমৃতা অভিজিতের পাশের চেয়ারেই বসে ছিল। প্রশ্নটা শুনে সে পাশ কাটানো গলায় বলল, ‘না না। আমি ঠিক আছি।’ 

আকাশ চলে এসেছে ততক্ষণে। তার চোখমুখ শুকনো। সে চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। আকাশের পিছ পিছ হৃদিও আসলো। তার মুখটাও বড় থমথমে। বন্ধুদের কাছাকাছি গোল হয়ে একটি পাঁচ সদস্যের দল বসে ছিল। তিনজন পুরুষ এবং দুজন নারী। দুজন পুরুষের বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের কোঠায়। অন্যজন বয়সে যুবক। নারী দুজন প্রৌঢ়া। এদের মধ্যে একজন নারী খুব ভালো গান করেন। এর মাঝেই তিন চারটি রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে ফেলেছেন তিনি। সুইমিংপুলে সাঁতরে বেড়ানো মেয়ে দুটি খুব সম্ভবত এদেরই কারো মেয়ে হবে। 

রুদ্র আর অভিজিতের মাঝখানে বিভা বসে ছিল। রুদ্র বিভাকে ডিঙিয়ে অভিজিৎকে বলল, ‘দাদাবাবু, দুইটার মধ্যে কোনটাকে আপনার ভালো লাগতেছে?’ 

অভিজিৎ ভারি ইনোসেন্ট গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী বিষয়ে কথা বলছ?’

রুদ্র বিরক্ত হলো অভিজিতের বোকাটে প্রশ্ন শুনে। 

—‘আপনার চোখের সামনে দুইটা পরির মতো সুন্দর মেয়ে জলকেলি করতেছে। আপনি দেখতেছেন না?’ 

বিভা ঝেঁঝে উঠে রুদ্রকে বলল, ‘এই লুনুষের বাচ্চা লুনুষ! আমার জামাইটারে খারাপ বানাইতেছিস কেন? এত বড় সাহস? আমি মানুষ জামাই চাই। লুনুষ জামাই চাই না।’ 

রুদ্র বলল, ‘ওরে বাবা, তোর জামাই হইছে দেখে কি মেয়ে দেখতে পারবে না?’ 

—‘না পারবে না!’ 

অভিজিৎ হাসতে হাসতে রুদ্রকে বলল, ‘এবার বোঝো ভাই, বিয়ে কী জিনিস। একদম দিল্লিকা লাড্ডু। খেলেও পস্তাবে। না খেলেও পস্তাবে।’ 

বিভা রুদ্রর একটা কান মলে দিয়ে বলল, ‘এখন মেয়ে দেখা বন্ধ করে গান কর। ঐ মহিলা কি স্মার্ট দেখছিস? একটার পর একটা গান গেয়ে গেলো। তুই কী করতেছিস বসে বসে?’ 

—‘মেয়ে দেখতেছি।’ কানমলা খেতে খেতে ব্যথিত কণ্ঠে উত্তর দিল রুদ্র।

—‘মেয়ে দেখতে হবে না। গান কর। গান গেয়ে মেয়েজাতিকে মুগ্ধ কর। অনেক তো মেয়ে দেখলি, এবার মেয়েরা একটু তোকে দেখুক।’ 

কথাটা বলে বিভা হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তিনবার শব্দ করে হাততালি দিয়ে উঠে বলল, ‘এটেনশন প্লিজ। এতক্ষণ আমরা চমৎকার কিছু গান শুনেছি। গানগুলো শোনানোর জন্য গায়িকা আপুটাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনারা জানেন না যে আমাদের মধ্যে আরো একজন শিল্পী আছে। আমাদের এই বন্ধুটি কিন্তু দারুণ গান করে। এবার ও আপনাদের একটি গান শোনাবে।’ 

উপস্থিত লোকজন রুদ্রর দিকে তাকালো। একজন মহিলা উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলেন, ‘চমৎকার! প্লিজ শুরু করুন। 

সবার এই অখণ্ড মনোযোগ রুদ্রকে বিব্রত করে তুলল ক্ষণিকের জন্য। সে চেয়ারের পায়ের কাছে হেলান দিয়ে রাখা গিটারটা হাতে তুলে নিল কুণ্ঠিতভাবে। গিটার কোলের ওপর রেখে বিভাকে প্রশ্ন করল, ‘কোনটা গাইব?’ 

—‘তোর ইচ্ছা।’ 

—‘আমার কোনো ইচ্ছা নাই।’ 

বিভা গালে হাত দিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে নিয়ে হুকুম দেওয়ার স্বরে বলল, ‘বিউটিফুল-জেমস ব্লান্ট।’ 

সামিকে দেখা গেলো দৃশ্যপটে। সে আসতেই উপস্থিত নারী পুরুষের দলটার মধ্যে একটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। ইনারা সবাই কোম্পানির এমপ্লয়ি। প্রত্যেকেই উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তবুও প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের ছেলে বলে কথা। বসের ছেলেকে দেখে সবার মুখে একটু বিগলিত ভাব চলে আসলো। বয়সে যুবক ছেলেটি এবং একজন প্রৌঢ় পুরুষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামির দিকে এগিয়ে গেলো। সামি দাপ্তরিক লোকজনের সঙ্গ খুব একটা পছন্দ করে না। সে খুব দ্রুত সৌজন্যমূলক কিছু কথা সেরে নিয়ে বন্ধুদের দলে গিয়ে ভিড়ল। বলল, ‘ডিনার করবি না? রেস্টুরেন্টে চল।’ 

রুদ্র তখন গান শুরু করে দিয়েছে। গিটারের টুংটুং বাজনার সাথে চমৎকার গাইছে সে, 

My life is brilliant
My love is pure
I saw an angel
Of that I’m sure
You’re beautiful
You’re beautiful 
You’re beautiful, it’s true 
I saw your face in a crowded place 
And I don’t know what to do 
‘Cause I’ll never be with you 

বিভা গানের তালে তালে বিভোর হয়ে যাচ্ছিল। সে অভিজিতের একটা হাত ধরে বলল, ‘চলো নাচি।’ 

অভিজিৎ লাল হয়ে বলল, ‘আমি এসব নাচটাচ পারি না।’ 

বিভা জোর করে উঠিয়ে নিল অভিজিৎকে বসা থেকে। তারপর নাচ শুরু করল গানের তালে তালে। ওদের দেখাদেখি আরো এক দম্পতি উঠে আসলেন ড্যান্স ফ্লোরে। দৃশ্যটা দেখতে চমৎকার লাগছিল। সুইমিংপুলের নীল জলের ওপর হলদে আলোর ছটা। ওপরে বিস্তৃত খোলা আকাশ। চারপাশে অন্ধকার গায়ে মেখে সমস্ত চেতনা সঙ্গে নিয়ে জেগে আছে মেঘের মুকুট পরা পাহাড় শ্রেণি। তার মধ্যে রুদ্রর ভরাট কণ্ঠের গান আর দুজন যুবক-যুবতী এবং প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ার ধীর লয়ের নাচ। আহা, জীবন সুন্দর! 

২৮

রেস্টুরেন্টে এসে দেখা গেলো খুব একটা ভিড় নেই। অনেকেই হয়তো খাবার নিজ নিজ ঘরে অর্ডার করেছেন। কষ্ট করে নিচে নেমে আসেননি। সামির পরিবার একটি টেবিল দখল করে বসে ছিল আগে থেকেই। সামিকে দেখামাত্র তার মা হাত ইশারা করে ডাকলেন। সামি বাধ্য ছেলের মতো এগিয়ে গেলো মায়ের কাছে। রোমেলা বললেন, ‘সারাক্ষণ তো বন্ধুদের সাথেই আছিস। এখন একটু আমাদের সাথে বয়।’ 

সামি সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে ছোট করে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ 

সে বসল বাবা মায়ের পাশে। ঠিক উল্টোদিকের টেবিলেই বসল বন্ধুরা। অমৃতা লোকটাকে দেখেছে। কিন্তু সরাসরি তাকায়নি। তার আত্মমর্যাদাবোধ বা সেলফ রেসপেক্ট সর্বদাই টানটান। আজ তার আত্মসম্মানে ঘা লেগেছে। ভেতরে একটা অসহায় ভাব টের পাচ্ছে সে। প্রতিটি নিশ্বাসে যেন ফুটছে কাঁটা। লোকটা সামনের টেবিলেই বসে আছে। ছেলের সাথে, স্ত্রীর সাথে খুব কথা বলছে। তার কথার ভঙ্গিতে বেশ প্ৰফুল্ল একটা ভাব। অথচ এদিকে একজন মানুষ তার একটি মাত্র উত্তরের আশায় অধীরভাবে অপেক্ষা করে আছে সন্ধ্যা থেকে। এতে কি তার কিছুই এসে যায় না? মানুষের মনের কোনো মূল্য নেই তার কাছে? শিক্ষা মানুষকে কৃতজ্ঞ হতে শেখায়। সভ্য এবং বিনয়ী হতে শেখায়। একজন সুশিক্ষিত মানুষ হিসেবে শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা ভদ্রতার খাতিরে হলেও একটা ছোট উত্তর লোকটা দিতে পারত। কিন্তু তা সে করেনি। এর মানে সে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে তার জীবনে অমৃতার জন্য কানা কড়ি পরিমাণ জায়গাও নেই। চমৎকার! 

টেবিলে খাবার এসে গেছে তখন। সবাই নিজ নিজ প্লেটে খাবার তুলে নিচ্ছে। রুদ্র হাপুস হুপুস করে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। অমৃতা নড়ছে না। স্থির হয়ে বসে আছে। রাগ তাকে বরাবরই বুদ্ধিভ্রষ্ট করে তোলে। খুব বেশি রাগ এবং কষ্টের সময় সে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। বিভা আর হৃদি একটু একটু বুঝতে পারছিল ঘটনাটা। তাদের দুজনেরই অন্তরের অন্তরাত্মা কাঁপছে। অমৃতা কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসবে না তো আবার? ওদের উচিত ছিল সন্ধেবেলায় অমৃতাকে মেসেজ পাঠানো থেকে বিরত রাখা। ভুল হয়ে গেছে। মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে! 

বিভা অমৃতার প্রস্তরীভূত মুখটার দিকে চেয়ে একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কীরে বসে আছিস কেন? খাবি না?’ 

অমৃতা বিভার প্রশ্নের উত্তর দিল না। চোখের পাতা সম্পূর্ণ প্রসারিত করে তাকালো সম্মুখে। মানুষটা হাসছে। ধারওয়ালা হাসি। অমৃতার প্রিয় হাসি। হাসতে হাসতেই কথা বলছেন তাঁর স্ত্রীর সাথে। রোমেলা বড়ই যত্নের সাথে স্বামীর প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। খুব সাধারণ একটি দৃশ্য। কিন্তু এই সাধারণ দৃশ্যটিই অমৃতার বুকের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদের ঝংকার বাজিয়ে যাচ্ছে। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। পুড়ছে হৃদয়। হৃদয় পোড়া গন্ধে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। সে সালাদের প্লেট থেকে একটি শুকনো শসার টুকরো হাতে তুলে নিল। চিবোতে লাগল অন্যমনস্কভাবে। আকাশ অবাক চোখে ওর দিকে চেয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার? ডায়েট করতেছিস নাকি? ভাত খাবি না? শুধুই সালাদ?’ 

অমৃতা আকাশের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। মেশিনের মতো শসা চিবোতে লাগল। শসা শেষ করে একটা কাঁচামরিচ তুলে নিল হাতে। বন্ধুরা সবাই হা করে চেয়ে রইল তার দিকে। সে নির্বিকার। তার চোখের দৃষ্টি শূন্য। চেতনা অন্য কোনো গ্রহে। পুরো কাঁচামরিচটা কচকচ করে চিবোনোর পর তার চোখমুখ রক্তিম হয়ে উঠল। লালচে চোখের তারা টলমল করে উঠল জলে। সে চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে। 

কটেজে ফিরে এসে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করল। ঢকঢক গিলে খেলো পুরো এক বোতল পানি। তখনও ঝাল কমেনি তার। ঠোঁট জ্বলছে, মুখ জ্বলছে। সেই অবস্থাতেই পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে সজোরে ছুঁড়ে মারল ঘরের দেয়ালের দিকে। বিকট একটা শব্দ হলো। দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়ল অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা। কাটা গাছের মতো ঝপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল অমৃতা মেঝের ওপর। তারপর যে কাজটা সে কখনো কোনোদিন করেনি, ঠিক সেই কাজটাই করে ফেলল আচমকা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হৃদি আর বিভা ফিরে এলো কটেজে। অমৃতার অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া দেখে বুক মোচড় দিয়ে উঠল দুজনের। অমৃতার অমন কাঁদো কাঁদো মুখ জীবনে এই প্রথমবারের মতো দেখতে পেল তারা। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে দুই বান্ধবী। বিভা খুব বকতে লাগল, ‘কেন এরকম করতেছিস? কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস? এমন বোকা মেয়ে তো আমি জীবনে দেখি নাই!’ 

হৃদি দু হাতের আঙুল দিয়ে অমৃতার চোখের জলের রেখা মুছে দিতে দিতে বলল, ‘এই পাগলামি থেকে তোকে বের হয়ে আসতেই হবে! ছোট বাচ্চার মতো করতেছিস কেন? আসলে তুই দেখতে শুনতে বড় হইলে কী হবে। ভিতরে একদম বাচ্চা রয়ে গেছিস এখনও।’ 

খানিক বাদে দরজায় টোকা পড়ল। হৃদি ‘কে?’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই ওপাশ থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ বলল ‘রুম সার্ভিস!’ 

হৃদি উঠে গিয়ে দরজা খুলল। সাদা কালো ফরমাল পোশাক করা এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। তার হাতে একটি খাবার সমেত ট্রে। হৃদি হালকা বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার?’ ছেলেটি বিনয়ের হাসি হাসল, ‘এই ঘরের জন্য খাবার অর্ডার করা হয়েছে।’ 

হৃদি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কে অর্ডার করেছে?’ ছেলেটি ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে সসম্ভ্রমে উত্তর দিল, ‘দুঃখিত, নামটা বলা যাবে না। নিষেধ আছে।’ 

টেবিলের ওপর ট্রে নামিয়ে রাখল সে। মেয়েরা তখন অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে। সে বুক পকেট থেকে একটা ছোট খাম বের করে বলল, ‘মিস অমৃতা কে? ‘ 

—‘কেন? আপনার কী দরকার?’ হৃদির প্রশ্ন। 

—‘এই খামটা উনাকে দিতে বলা হয়েছে।’ 

হৃদি হাত বাড়িয়ে খামটা নিল। মুখে বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’

ছেলেটির প্রস্থানের পর হৃদি খুব ভালো মতো ঘরের দরজাটা বন্ধ করল। অমৃতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তার চুল আলুথালু। তাকে দেখাচ্ছে ভূতগ্রস্থের মতো। ঘটনা কী ঘটছে সে যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। চোখে রাজ্যের বিস্ময়। বিভা দৌড়ে এসে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিল খামটা। লাফিয়ে উঠে বলল, ‘কী এটা? দেখি দেখি!’ 

হৃদি আদেশ করল, ‘আহা তুই খুলিস না। অমৃতাকে দে।’ 

শুনে বিভার আনন্দে একটু ভাটা পড়ল। খামটা তার নিজের হাতে খোলার বড়ই শখ ছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে অমৃতার দিকে বাড়িয়ে দিল হাত। অমৃতা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখল জিনিসটা। ছোট্ট একটা সাদা রঙের খাম। উপরে কোনো সম্বোধন নেই। সম্পূর্ণ ফাঁকা। সে খামের মুখটা খুলল সন্তর্পণে। ভেতর থেকে একটা ছোট চিরকুট বের হলো। নীল রঙের। তার ওপর কালো কালি দিয়ে ইংরেজিতে লেখা, ‘লেটস মিট টুমরো মর্নিং। অ্যারাউন্ড ফাইভ ও ক্লক। হ্যাভ ইউ সুইচড অফ ইওর সেলফোন? আই কলড, বাট কুড নট রিচ ইউ।’ 

এর নিচে কিছু জায়গা ফাঁকা রেখে বাংলায় লেখা, 

বি:দ্র: তুমি না খেয়ে চলে গেলে কেন? খেয়ে নাও লক্ষ্মী মেয়ের মতো। 

হৃদি আর বিভা চিরকুটের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। এক নিমেষে পুরোটা পড়ে নিয়ে ওরা দুজনে হইহই করে উঠল। অমৃতা তখনও কাঁপছিল। বিজলি বাতির মতো চিলিক দিয়ে উঠছিল বুকের ভেতর একটা কষ্ট কষ্ট সুখ। অনেকক্ষণ বাদে সে একটু হাসতে পারল। স্বস্তির হাসি। জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ড থেকে যেন তার অবতরণ হলো জান্নাতের বাগানে। অলৌকিক সুখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মুখ। বিভা ওর গাল দুটো টেনে দিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘কি এখন খুশি?’ 

হৃদি মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অমৃতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ওর অবিন্যস্ত আউলবাউল ছোট ছাটের চুলে একটা আলতো চুমু খেয়ে বলল, ‘তোকে হাসলে কী সুন্দর দেখায় অমৃতা! সব সময় হাসবি। আর কোনোদিন এভাবে কাঁদবি না। কেমন?’ 

২৯

সামি কটেজে ফিরল ঘণ্টা দুয়েক সময় পরে। রেস্টুরেন্ট থেকে সোজা বাবা মায়ের ঘরে গিয়েছিল। কিছুটা সময় ওদের সাথে কাটিয়ে তারপরেই বন্ধুদের কাছে ফিরল সে। ঘরে ফিরে দেখল রুদ্র পায়ের জুতো না খুলেই বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে। তার পা জোড়া ঝুলে আছে বিছানার বাইরে। মুখের সামনে ফোন। সে কথা বলছে তার মা এবং বোনের সাথে। নিজের পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলার সময় তার মুখের ভাষাটা অন্যরকম হয়ে যায়। সে তখন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা এবং শুদ্ধ বাংলা ভাষার মিশেলে কথা বলে। তখন তার প্রতিটি বাক্যের শেষে ‘যে’ শব্দটি যুক্ত হয়। বন্ধুরা ওকে এই টোনে কথা বলতে দেখলেই খুব খ্যাপায়। তবে আজ আকাশের মেজাজ মর্জি ভালো না। তাই রুদ্রর কথাবার্তা শুনতে পেয়েও তার ভেতরে কোনো প্রতিক্রিয়া কাজ করছে না। কফির মগ হাতে নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখের দৃষ্টি দূরে।সামি দরজা একটু হালকা ফাঁকা করে উঁকি দিয়ে দুই বন্ধুকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে একবার দেখে নিল। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করল। এই ঘরে দুটা সিঙ্গেল বেড রাখা। সামি আর রুদ্র বিছানা দুটিতে ঘুমিয়েছে গতরাতে। আকাশ মেঝেতে ফ্লোরিং করেছে। 

সামি বিছানার ওপর বসে পায়ের জুতো খুলল একটু সময় নিয়ে। তার সুন্দর সুকুমার মুখখানায় খেলছে এক চাপা উদ্বেগ। আচার আচরণে অস্থির ভাব। সে জুতোজোড়া খুলে রেখে ঘরের মধ্যে কয়েকবার এলোমেলোভাবে পায়চারি করল। অপ্রস্তুতভাবে কাশল মুখে হাত দিয়ে পর পর তিনবার। দু তিন মিনিট পর আকাশের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই আকাশ!’ 

আকাশ ওর ডাকটা শুনতে পেল না। কিংবা শুনতে পেয়েও না শোনার ভান করল। সামি আকাশের ডান বাহুতে একটা হাত রেখে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘কীরে? ডাকতেছি। শুনতে পাস না?’ 

আকাশ ঘুরে তাকালো। চোখ পাকিয়ে বলল, ‘কী হইছে?’ 

সামি আকাশের ধমক শুনে একটু হকচকিয়ে গেলো। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে পারল না। নিজের মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুলগুলোয় অন্যমনস্কভাবে হাত বুলিয়ে নিল দুবার। গালে গজানো খোঁচা দাড়িতে পাঁচ আঙুল রাখল অন্যমনস্কভাবে। তারপর একটু দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত, তুই… তুই আসলে আমাকে ভুল বুঝতেছিস।’ 

আকাশ জ্বলে উঠল, ‘আমি ভুল বুঝছি? তাহলে ঠিকটা কী একটু শুনি তো! 

সামি একটা প্রলম্বিত শ্বাস টেনে নিল। বলল, ‘কীভাবে বুঝাবো বুঝতে পারতেছি না। আসল পয়েন্ট হচ্ছে, হৃদির সাথে আমার একটু ঝামেলা চলতেছিল।’ 

—‘তো এখানে আমার কী করার আছে? তোর সাথে ঝামেলা চলতেছে দেখে আমি হৃদির সাথে কথা বলতে পারব না? আমি কি তোর পারমিশন নিয়ে হৃদির সাথে ফ্রেন্ডশিপ করছিলাম?’ 

রুদ্র তখন ফোনে কথা বলা শেষ করে উঠে এসেছে। কান খাড়া করে শুনছে দুই বন্ধুর কথোপকথন। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। সামি বলল, ‘সমস্যাটা তোর সাথে হৃদির ফ্রেন্ডশিপ নিয়ে না। সমস্যাটা অন্য জায়গায়।’ 

আকাশের রাগ কিছুতেই কমছিল না। বরং উত্তরোত্তর বাড়ছিল। সে মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘সমস্যাটা তোর মাথায়। সমস্যা অন্য কোনো জায়গায় না। তোর মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে। পাগল হয়ে গেছিস তুই।’ 

রুদ্র এই পর্যায়ে চোখ সরু করে গভীর সন্দেহের গলায় প্রশ্ন করল, ‘মামা প্রব্লেমটা কী? কী কাহিনি চলে, হ্যাঁ?’ আকাশ রুদ্রকেও দিল একটা রাম ধমক, ‘চুপ থাক, কী কাহিনি চলে সেটা বুঝতে হলে চোখ খুলে দ্যাখ। কান খুলে শোন। কথা বলিস না এত!’ ধমক খেয়ে রুদ্র চুপ করে গেলো। সামি বলল, ‘আকাশ শোন, হৃদির সাথে আমার আজকে সকালেই ঝগড়া হইছিল। হৃদি আমারে বলছে যে আমাকে দিয়ে নাকি ওর হয় না। তুই কি বুঝতেছিস আমার কথা? 

আকাশ গিলে খাবার মতো ভয়ংকর চোখ নিয়ে সামির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না বুঝতেছি না। তোকে দিয়ে হয় না মানে কী? তুই কি শালা ইম্পোটেন্ট?’ 

সামি অধৈর্য গলায় বলল, ‘এটাই তো আমি বুঝতেছি না যে আমার প্রব্লেমটা কোন জায়গায়। কেন ওর আমারে দিয়া হইতেছে না। ও কী চায়?’ 

রুদ্র বলল, ‘তুই ওকে সরাসরি প্রশ্ন করলেই পারিস।’ 

—‘প্রশ্ন তো করছি। সে উত্তর দেয় না। বলে আমি নাকি বুঝব না। তার একটু সময় দরকার। বিশ্বাস কর দোস্ত এখানে আসার পর থেকে ও আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে, হাইসা একটা কথা বলে নাই। মানে আমি কিছুতেই বুঝলাম না আমার দোষটা কোথায়? 

আকাশ বলল, ‘কিন্তু এটার সাথে আমার সম্পর্ক কী? আমাকে কেন তুই উল্টাপাল্টা কথা বললি?’ 

সামি একটু বিনীতভাবে বলল, ‘দোস্ত সেই জন্য আমি স্যরি। আমি জানি তোকে আমার ঐভাবে কথাগুলা বলা উচিত হয় নায়। হৃদি তোর বন্ধু। তোরা যা খুশি বলতে পারিস, করতে পারিস, আমার কোনো রাইট নাই এসব নিয়ে কথা বলার। ভুল হয়ে গেছে।’ 

আকাশ কিছু বলল না এই কথার প্রত্যুত্তরে। রুদ্র সামিকে প্রশ্ন করল, ‘তুই কী বলছিস ওরে হৃদির ব্যাপারে?’ 

—‘একটু পরে বলতেছি। আগে ঝামেলাটা শেষ হোক।’ সংক্ষেপে উত্তর দিল সামি। এরপরের কয়েকটা সেকেন্ড আকাশকে চুপ করে থাকতে দেখে সে অসহিষ্ণু গলায় আবার বলল, ‘আকাশ প্লিজ আমাকে বোঝার চেষ্টা কর। আমি তোরে আমার নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস করি, পিরিয়ড।’ 

আকাশ এবারেও কোনো কথা বলল না। চুপচাপ কফির মগে চুমুক দিতে লাগল। সামি বলল, ‘অনেস্টলি স্পিকিং, আমার এটা খারাপ লাগছে যে আমার সাথে কথা বলতে হৃদির ভালো লাগে না, আমার সামনে আসলে ওর মুড অফ হয়ে যায়, অথচ তোর সাথে ঠিকই মন খুলে হাসতেছে। এই একটা কারণেই দোস্ত আমার হঠাৎ করে রাগ লাগছে। এখন আমি জানি না যে এরকম রাগ লাগাটা আমার দোষ কিনা।’ এটুকু বলে সামি খুব বিষণ্ণভাবে চুপ করে রইল কয়েকটা ক্ষণ। বলল, ‘এটা যদি আমার দোষ হয়, তাহলে আমি স্যরি দোস্ত। আমার আর কিছুই বলার নাই।’ 

আকাশ জানালার সামনে থেকে সরে এসে খালি কফির মগটা টেবিলের ওপর রাখল। সামির চোখের দিকে সরাসরি চেয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা তুই প্রথমেই আমাকে খুলে বলতে পারতিস। আর তুই যা দেখছিস সেই দৃশ্যটা আসলে পুরোটা সত্য ছিল না।’ 

— মানে?’ 

—‘মানে আমার এক ছাত্রী আমার পিছু নিছিল আজকে বিকালে। এটুকু বলে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আকাশ বলল, ‘ওইযে রসগোল্লা।’ রসগোল্লার নাম শুনে রুদ্র হো হো করে হেসে ফেলল। আকাশ বলল, ‘আসলে রসগোল্লাকে দেখানোর জন্যেই আমরা একটু ইন্টিমেটভাবে বসে ছিলাম। যেন রসগোল্লা মনে করে যে হৃদি আমার গার্লফ্রেন্ড। কারণ এর আগে একবার রসগোল্লাকে বলছিলাম যে আমার গার্লফ্রেন্ড আছে, সে বিশ্বাস করে নাই।’ 

সামি বিভ্রান্ত গলায় বলল, ‘মানে তোরা প্রেম করার অভিনয় করতেছিলি?’ 

—‘হ্যাঁ। অনেকটা সেরকমই।’ 

সামির মুখে থমথমে ভাবটা আবার ফেরত আসলো, ‘শালা প্রেমের অভিনয়ের জন্যে তুমি আমার গার্লফ্রেন্ডরেই পাইলা?’ 

আকাশ কড়াভাবে বলল, ‘আবার আমার গার্লফ্রেন্ড আমার গার্লফ্রেন্ড করতেছিস? তোর গার্লফ্রেন্ডটা আমার ফ্রেন্ড হয় সামি! এটা ভুলে যাইস না!’ 

সামি বিরক্তি নিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করল। আজকে তার সিগারেট খাওয়ার মাত্রা সীমা ছাড়িয়েছে। একটু পর পর সিগারেট টানছে সে। লাইটার দিয়ে আগুন ধরাবার সময়টুকুতে সে ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা চিন্তা করল অখণ্ড মনোযোগের সাথে। এরপর বুকভর্তি করে নিকোটিন টেনে নিয়ে বলল, ‘এজন্যেই আমার কাছে হঠাৎ একটু কেমন জানি লাগতেছিল। হৃদির মুখে একটা কিছু ছিল। শি ওয়াজ ব্লাশিং!’ 

আকাশ এবার পরিষ্কার গলায় বলল, ‘ইয়েস অফকোর্স শি ওয়াজ ব্লাশিং। কজ আমি ওর প্রশংসা করতেছিলাম। আমার কম্পিলিমেন্ট পেয়ে ও বলছে এত সুন্দর করে এর আগে কেউ কোনোদিন ওর প্রশংসা করে নাই।’ 

সামি অবাক গলায় বলল, ‘প্রশংসা করতেছিলি?’ 

—‘হ্যাঁ। ওকে বলতেছিলাম যে ও আসলে কতটা সুন্দর। আর কোন মেয়ে নিজের রূপের প্রশংসা শুনে খুশি হয় না, তুই বল? 

সামি ব্যাক্কল বনে যাওয়া গলায় অস্ফুটে বলল, ‘বাহ!’ 

আকাশ থামল না ‘হৃদি আমাকে কী বলছে জানিস? বলছে যে তুই নাকি কখনো ওর প্রশংসা করিস না। ওর সামনে তুই অন্যদের প্রশংসা করিস। তানিশা কত সুন্দর, বিভা কত সুন্দর এইসব হাবিজাবি কথা বলিস কিন্তু নিজের গার্লফ্রেন্ডরে শালা একটা ভালো কমপ্লিমেন্ট দিস না কোনোদিন। প্রব্লেম কী তোর? 

সামি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘এইটা একটা কথা হইল? ওর প্রশংসা আলাদা করে করতে হবে কেন? ওরে ভালো লাগে দেখেই তো ওর সাথে প্রেম করতেছি তাই না?’ 

রুদ্র বলল, ‘গাধার মতো কথা বলিস না সামি। প্রত্যেকটা সম্পর্কেরই পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। ভালোলাগা গুলো শেয়ার করতে হয়। মনের কথা সরাসরি বলতে হয়। তাহলে তো আর এত ঝামেলা হয় না। তোদের রিলেশন হইছে মাত্র কয়দিন? এর মাঝেই এত ঝামেলা। সামনে কী হবে?’ 

সামি প্রশ্নটার কোনো উত্তর দিতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল দুই বন্ধুর দিকে। তাকে খানিকটা বিচলিত দেখাতে লাগল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *