বৃষ্টিমহল ৩.২০

২০

সামি টেরেসে ফিরে এসে দেখল বিভা আর হৃদি দুটি চেয়ার দখল করে বসে আছে অন্ধকারে। সে রসিক গলায় প্রশ্ন করল, ‘আমাদের জামাইবাবু কোথায়?’ 

—‘ঘরে গেছে। ওর একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাবার অভ্যেস।’ 

সামি চেয়ার টেনে নিয়ে দুই বান্ধবীর মুখোমুখি বসল। বাতাসে এখন একটা ঝড়ো ভাব আছে। রাতে বৃষ্টি হতে পারে। সামি পকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে আগুন ধরাল। বিভা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোরা থাক। আমি যাই।’ 

সামি খপ করে বিভার একটা হাত ধরে ফেলল। বলল, ‘এত তাড়া কীসের? বয়। পরে যাইস।’ 

বিভা একবার তাকালো হৃদির দিকে। অন্ধকারে মুখের ভাবভঙ্গি বোঝা যায় না। চুপচাপ মূর্তির মতো বসে আছে হৃদি। কোনো নড়চড় নেই। বিভা বলল, ‘না থাক। তোরা এনজয় কর। আমি আসি।’ 

সামি বিভার হাতটা না ছেড়েই বলল, ‘বললাম তো, পরে যা। কথা কানে যায় না?’ 

অন্ধকারে ওদের দুজনের ধরে থাকা হাতের দিকে চেয়ে ছিল হৃদি। চেয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ তার মনে পড়ল সেই রাতটির কথা। যে রাতে সামি সব বন্ধুদের সামনে বিভাকে বলেছিল ‘সব তোর দোষ!’ মনে পড়ল আজ সন্ধ্যায় বিভাকে দেখামাত্র সামির মুখে উচ্চারিত হওয়া প্রশংসা বাক্যটি। সামি কেন সবসময় অমন গালভরে, মনভরে বিভার প্রশংসা করে, কিন্তু হৃদির প্রশংসা করে না? হৃদির কি একটা বার ভালোবাসার মানুষটার মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে ইচ্ছে করে না? তার মনের মধ্যে কোত্থেকে যেন হঠাৎ এক কালবৈশাখীর মত্ততা এসে ভিড় করল। কেমন এলোমেলো লাগতে লাগল সবকিছু। দুয়ে এক অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেলো সমস্ত অন্তর। শুরু হলো মনের সাথে বিবেকের লড়াই। সে বুঝতে পারছে বিভা তার মুখ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে। বিবেক বলছে তার উচিত বিভাকে যেতে না দেওয়া। সামির মতো তারও বলা উচিত, ‘এখন যাস না,এত তাড়া কীসের?’ কিন্তু ওদের দুজনের যুগলবন্দি হাতের দিকে চেয়ে থেকে হৃদি মুখ দিয়ে বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। বিভা কী মনে করে যেন সামির হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। বলল, ‘অভিজিৎ অপেক্ষা করছে। তোরা গল্প কর। আমি এখন যাই। আকাশ, রুদ্র, অমৃতা ওরা আসলে আমাকে কল দিস।’ 

হৃদি এবারেও কিছু বলতে পারল না। তার বুকের ভেতর থেকে একটা কান্নার স্রোত ধেয়ে আসছে ঊর্ধ্বমুখি হয়ে। বিভা চলে যাবার পর সামি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, ‘অমৃতার কিছু একটা হইছে। কেমন কেমন জানি লাগতেছিল ওরে।’ 

হৃদি অতর্কিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। সামির প্রতি জমে থাকা রাগটা এখন তুঙ্গে উঠেছে। অথচ বিবেক বলছে এত রাগার কোনো কারণ তো নেই, বিভা সামির বন্ধু! বন্ধু বন্ধুর হাতে হাত রাখবে এটাই তো স্বাভাবিক! বিভার হাত ধরার অপরাধে সামির ওপর রেগে যাওয়া যে একেবারেই সমীচীন নয় সে কথাটা হৃদি তার বুদ্ধি দিয়ে, বিবেক দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছে। কিন্তু প্রতিবাদ করে উঠছে মন। ভেতরে ভেতরে একটা প্রবল বিদ্রোহের ঝংকার টের পাচ্ছে সে। 

—‘কোথায় যাচ্ছিস?’ 

হৃদির কান্না পেয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে পারল না। কোনো উত্তর না দিয়েই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো টেরেস থেকে। ঘরে এসে দেখল অমৃতা বিছানায় বসে ল্যাপটপ খুলে কাজ করছে। মনে পড়ল অমৃতাও একটু আগে বলেছে সে নাকি ভুল মানুষদের বন্ধু ভেবেছে। পুরো পৃথিবীটার ওপর অভিমান হচ্ছে তার। মনে পড়ে যাচ্ছে সারাজীবনের বিভিন্ন সময়ে পাওয়া বিচিত্র সব কষ্ট, অপমান, অপ্রাপ্তি এবং অতৃপ্তি। ক্লাস নাইনের কেমিস্টি টিচার একবার মুখের ওপর বলে দিয়েছিল ‘তোমার মতো লো আই কিউর মেয়ে এই স্কুলে আর দ্বিতীয়টি নেই। তোমার দ্বারা কিছুই হবে না!’ আজ এতদিন বাদে সম্পূর্ণ বিনা কারণে সেই ঘটনাটি মনে পড়ায় তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগল। মনে হলো, আজ পর্যন্ত কেউ তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেনি। সত্যিকারের ভালোবাসেনি। জীবন নামের সুবিশাল রঙ্গমঞ্চে সে বড়ই দুর্ভাগা, নিগৃহীত এবং অবহেলিত এক মনুষ্য কীট। 

অমৃতার সাথে কোনো কথা বলল না হৃদি। চুপচাপ শুয়ে পড়ল বিছানায়। বালিশে মুখ চেপে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। আকাশের সব মেঘ যেমন সব সময় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে না, ঠিক তেমনি সবার মনের সব কষ্ট ও কান্না হয়ে ঝরে না। তাই তো, হৃদির মনের কষ্টগুলি কান্না হয়ে ঝরলেও, অমৃতার কষ্টগুলি গুমোট মেঘের মতো মনের আকাশে জমা হয়ে রইল। 

ছেলেরা খানিক বাদে ফিরল। পাশের ঘরটাই ওদের। পদশব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। হালকা কিছু কথাবার্তাও কানে এলো। কিছুক্ষণ পর নামল বৃষ্টি। মেঘে মেঘে ঘর্ষণ লেগে বিকট গর্জনে ফেটে পড়তে লাগল মধ্যরাতের আকাশ। 

অভিজিতের চোখ লেগে এসেছিল। আধো ঘুমের ভেতর নানা রকম শব্দ কানে এসে লাগছিল তার। বজ্রপাতের শব্দ, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ, পাহাড়ের বুকের ওপর দামাল বাতাসের হুহু করে বয়ে চলার শব্দ… প্রতিটি শব্দকে অলৌকিক বলে ভ্রম হচ্ছিল। এর মাঝে একটি শব্দ কিঞ্চিৎ অন্যরকম। ঝুম ঝুম ঝুম… কীসের শব্দ ওটা? কী রকম দেখতে? শব্দ কখনো দৃশ্যমান হয় না। কিন্তু অভিজিতের মনে হলো এই শব্দটি বুঝি দৃশ্যমান। ভারি সুন্দর দেখতে একটি পবিত্র ফুলের মতো এই শব্দটি। ঝুম ঝুম ঝুম… চোখ খোলার পর কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল সে সম্মুখে। কিছু দেখতে পারছে না কিন্তু শব্দগুলো এখনও কানে এসে লাগছে ক্রমাগত। কিছুক্ষণের মধ্যেই মস্তিষ্ক আলো বাতাস পেলো। চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট হলো। হলদে একটা মলিন আলোয় ভরে আছে ঘর। খোলা জানালা দিয়ে ধেয়ে আসা হাওয়ায় ফরফর করে উড়ছে ঘরের পর্দা। বাইরে বৃষ্টির ঘেরা টোপ। নীল বিদ্যুতে হঠাৎ হঠাৎ চোখের সম্মুখে চিলিক দিয়ে উঠছে জানালার বাইরের বৃষ্টি ডোবা বন পাহাড়। নিমেষেই আবার ছেয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বিভা। শাড়ির আঁচল বাঁধা কোমরে। পায়ে বাঁধা ঘুঙুর। তার হাঁটার তালে তালে ঘুঙুর বেজে চলেছে। ঝুম ঝুম ঝুম। অভিজিৎকে জেগে উঠতে দেখামাত্র সে বলল, ‘সঠিক সময়ে জেগে উঠেছ। এরকম বৃষ্টির রাতে কেউ ঘুমায়?’ কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সে আইপডে চালিয়ে দিল গান। তারপর গানের তালে 

তালে শুরু করল নাচ। 

‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর/নমঃ নমঃ নমঃ নমঃ নমঃ নমঃ 
শ্রাবণ মেঘে নাচে নটবর/ ঝমঝম রমঝম রমঝম’ 

বৃষ্টির রিমঝিম সুরের সাথে গানের সুর আর নুপুরের শব্দ মিশে গেলো। বাতাসে উড়তে লাগল বিভার খোলা চুল। নাচের দমকে খুলে পড়ল কোমরে গোঁজা আঁচল। অভিজিৎ চেয়ে রইল নির্নিমেষ। বন্ধুরা পাশের ঘর থেকে গানের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। শুনতে পাচ্ছিল নূপুরের শব্দ। শুনতে শুনতে হৃদির মনে হলো যে, বিভা বাস্তবিকই ভালোবাসার যোগ্য পাত্রী। সে নিজে তো হাজার চাইলেও মাঝ রাত্তিরে বরের সামনে ওরকম মন মাতানো নাচ নাচতে পারবে না। নাচ কেন, মানুষকে মুগ্ধ করার মতো কোন গুণই তো তার ঘটে নেই! কী করে সে বিভার সমকক্ষ হবে? হবে না… কোনো দিনও হবে না। আর এ কারণেই হয়তো, সামির মনের ভেতরেও বিভা রয়ে যাবে চিরকাল। হৃদি কখনোই বিভার জায়গা নিতে পারবে না। হাজার চেষ্টা করলেও না! 

অমৃতা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা পড়ল। অমৃতা দোর খুলে দেখল আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। কটেজের খোলা বারান্দা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওকে। প্রবল বেগে বইছে মাতাল বাতাস। নীল বিদ্যুতে ঝলসে যাচ্ছে চারপাশ। বিদ্যুৎ আলোয় এক ঝলক দেখতে পেলো অমৃতা আকাশের মুখটা। বুক কেঁপে উঠল এক অজানা আশংকায়। কী হয়েছে আকাশের? ওকে এমন দেখাচ্ছে কেন? 

—‘অমৃতা!’ আকাশ ডাকল, কেমন আচ্ছন্ন গলায়। 

—‘হ্যাঁ, বলো।’ 

—‘শোন, তোর ফিলিংসকে আমি রেস্পেক্ট করি। আই রিয়েলি ডু রেসপেক্ট ইওর ফিলিংস। তুই… তুই শুধু এটা জেনে রাখ যে যত বড় ঝড়ই আসুক না কেন, আমি সব সময় তোর পাশে আছি। থাকব সব সময়!’ 

এতক্ষণ অবধি চেপে রাখা কান্নাটা এবার বাধ ভাঙতে চাইল। অমৃতা কোনো কথা না বলে দু পা এগিয়ে এসে আকাশকে জাপটে ধরল। আকাশ থমকে গেলো ক্ষণিকের জন্য। এর আগে কোনোদিন অমৃতা ওকে এমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেনি। এই প্রথম! তেরছা হয়ে তেড়ে আসা বৃষ্টির জলে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছিল ওরা। আকাশ অমৃতার পিঠের ওপর একটা হাত রাখল আলতোভাবে। অমৃতাকে দেখতে শুনতে শক্তপোক্ত মনে হলে কী হবে? শরীরটা একদম পাখির মতো নরম! ওর চুল থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ উড়ে আসছিল। আকাশের সমস্ত ইন্দ্রিয় রাশি রাশি শিউলি ফুলের শুভ্রতায় ভরে উঠছিল ক্রমশ। একটা সময় সে অমৃতাকে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে শুনল, ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ দোস্ত! থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ! ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড!’ ওর নিশ্বাসের উষ্ণ মসৃণ ছোবলে আকাশের বুক কাঁপছে তখন। অমৃতা বলে চলল, ‘হি হ্যাজ গট ইনটু মাই ভেইনস। মরে গেলেও ভুলতে পারব না। অনেক বেশি ভালোবাসি মানুষটাকে দোস্ত! আমাকে বুঝতে পারার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ তোকে। আজকে আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নাই। এভাবেই সব সময় পাশে থাকিস!’ 

আকাশ ক্ষীণ গলায় বলল, ‘থাকব। নিশ্চয়ই থাকব।’ 

২১

ঘড়িতে সকাল সাতটা। আকাশের পেঁজা তুলো মেঘের রুপালি পাড় ভেদ করে এই মাত্র উঁকি দিয়েছে স্ফটিক রঙা রোদ্দুর। ঘোর বসন্ত লেগেছে প্রকৃতিতে! নব যৌবনের প্লাবনে ভাসছে চারপাশ। কাঠ দিয়ে বাঁধানো সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছিল তিন বান্ধবী। রেস্টুরেন্টে বসে এক কাপ চা খাওয়াই তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। আশপাশটা সাতসকালেই মানুষজনে গিজগিজ করছে। গতকাল রাত দশটার মধ্যে সব অফিসিয়াল লোকজন চলে এসেছে। এদের বেশিরভাগই এসেছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে। এই রিসোর্টে এত লোক একসঙ্গে জায়গা হবে না বলে কাছেই আরেকটি হোটেলে বেশ কয়েকজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

অমৃতা একটা কালো ট্রাউজারের সাথে বেগুনি রঙের টি শার্ট পরে ছিল। টি শার্টের বুকের ওপরে ছোট্ট একটা টিংকারবেল আঁকা। অনেক দিনের পুরোনো এই শার্ট। সাজপোশাক নিয়ে সে অতটা শৌখিন নয় বলে একই জামা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার পরে। পরিচিত বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজনেরা তাকে একই পোশাকে বহুবার দেখে অভ্যস্ত। 

রেস্টুরেন্টের ছাদটা দোচালা। দোচালা বাড়িটির দুপাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি ছোট্ট জলাশয়। বাড়িটির সম্মুখ ভাগ গড়ে উঠেছে জলাশয়ের ওপরে। হঠাৎ চোখ পড়লে মনে হয় বুঝি বাড়িটি ভাসন্ত। জলাশয়ের বুকে ফুটে আছে কয়েকটি শাপলা ফুল। ওরা তিনজন রেস্টুরেন্টের পোর্চে এসে দাঁড়ালো। ছেলেরা তখনো ঘুমোচ্ছে। এমন কি অভিজিৎও। বিভা বলল, ‘আজকের প্ল্যান কী? কোথায় যাব আমরা? ‘ 

বিভার পরনে একটা হালকা হলুদ রঙের সালওয়ার কামিজ। চুলগুলো চুড়ো করে খোঁপা বাঁধা। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে রাতে ভালো ঘুম হয়েছে। মসৃণ, ঝকঝকে মুখের ত্বক বসন্তের নতুন সবুজ পত্রপল্লবের মতোই সতেজ। চোখের কোল ভরাট। ঠোঁটে হালকা বাদামি লিপস্টিক। বিভার প্রশ্নের উত্তরে অমৃতা বলল, ‘আপাতত রেস্টুরেন্টে গিয়ে নাশতা করব, চা খাব। এরপরেরটা জানি না।’ 

বিভা আড়চোখে হৃদিকে দেখছিল। হৃদির পরনে একটা ছাই রঙের গেঞ্জি, কালো জিন্স। খোলা চুল ছড়ানো পিঠময়। মুখে কোনো প্ৰসাধন নেই। চোখজোড়া ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঠোঁট শুকনো। বিভা ওর ক্লান্ত চোখের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে বলল, ‘তোরে দেখতে এরকম লাগতেছে ক্যান?’ 

–‘কী রকম?’ হৃদি প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করল পানসে গলায়। 

—‘কেমন জানি, মাছের মতো! 

—‘ফালতু কথা বলিস না।’ 

—‘ফালতু কথা না, সত্য। চোখে কাজলটাজল কিছুই দিস নাই। দেখামাত্র মনে হচ্ছে মাছ, মানুষ না। মাছ মাছ একটা গন্ধও পাচ্ছি আমি তোর গা থেকে।’

হৃদি আগুন গরম চোখে তাকালো বিভার দিকে। তারপর অমৃতাকে বলল, ‘ওরে চুপ করতে বলো। মেজাজ কিন্তু গরম আছে।’ 

অমৃতা হৃদির কথাটা শুনল কি শুনল না কে জানে! তার দৃষ্টি আটকে গেছে বিশ গজ দূরে দাঁড়ানো একটি দলের দিকে। মুখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে একটা আবিষ্ট ভাব। চোখজোড়া প্রচ্ছন্ন। অমৃতার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে বাকি দুই বান্ধবী তাকালো সামনে। লোকটা দাঁড়িয়ে আছেন ছোট্ট একটা জটলার মধ্যমণি হয়ে। তাঁর চোখে কালো কাচের রোদ চশমা। গায়ে হালকা আকাশি রঙের ফুল হাতা শার্ট। গালে গুড়িগুড়ি দাড়ি। রোদ এসে পড়ায় তাম্রবর্ণের গালের চামড়া ফর্সা ফর্সা দেখাচ্ছে। কালো কাপড়ের প্যান্টের পকেটে দু হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কিছু একটা বলছেন, তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে। চোখে সানগ্লাস থাকায় বোঝা যাচ্ছে না ঠিক কোনদিকে তাকিয়ে আছেন এই মুহূর্তে। হৃদি অমৃতার কনুইয়ে একটা চিমটি কেটে বলল, ‘এভাবে চায়ে থাকিস না। লোকে কী বলবে?’ 

অমৃতাকে হঠাৎ করেই খুব প্রাণবন্ত দেখাতে লাগল। মনে হলো যেন অনেক দিন পর ঘন কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মেঘ ভেঙে রোদ হেসে উঠেছে ঝলমলিয়ে। সে বান্ধবীদের দিকে ফিরে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘আল্লাহ! এই লোকটা এত জোশ কেন? আমি তো পাগল হয়ে যাব!’ 

বিভা অমৃতার কথাটা শুনে গুনগুন করে একটা সুর ভাজতে লাগল, ‘পাগল হয়ে যাব আমি… পাগল হয়ে যাব।’ গানটা গাইতে গাইতেই সে আড়চোখে বিশ গজ দূরে দাঁড়ানো লোকটার দিকে মনোযোগ দিয়ে আরেকবার তাকালো। তার মুখে একটা বিভ্রম খেলা করল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। একটু উদাস গলায় বলল, ‘ফ্রেন্ডের বাপ না হইলে একটা কথা কইতাম। কিন্তু এখন কিসু কমু না।’

—‘আমার শ্বশুরের দিকে এমন কুনজর দিস না তোরা। প্লিজ!’ অসহায় ভাবে বলল হৃদি। 

বিভার মনটা আজ ফুরফুরে। সে কণ্ঠে ফুরফুরে ভাবটা জীবিত রেখেই বলল, ‘অমৃতা, তুমি কেন বুঝো না যে তোমার হ্যান্ডসাম ড্যাশিং ম্যান কারো বাবা এবং কারো শ্বশুর? আবার কারো সোয়ামি? এরকম ফ্যালফ্যাল করে বেহায়ার মতো চায়া থাইকো না। লোকে খাররাফ বলবে।’ 

—‘দোস্ত ড্যাশিং ম্যান কি এখন আমার দিকে তাকায় আছে?’ অমৃতার প্রশ্ন। 

বিভা নিজের কপালের কাছে পড়ে থাকা এক গাছি চুল আঙুল দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে ভারিক্কি গলায় বলল, ‘সেটা তো একটা রহস্য। তার চোখে চশমা দেওয়া। সে তোমাকে দেখতেছে নাকি আমাকে, সেটা বলা মুশকিল।’ 

এটুকু বলেই বিভা একটু অপ্রস্তুতভাবে খকখক করে কাশল মুখে হাত দিয়ে।

—‘মাই গড ড্যাশিং ম্যান তো এই দিকেই আসতেছে! আমরা ভিতরে যাই।’ বিভা কথাটা বলেই হৃদির হাত ধরে টানতে টানতে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে গেলো। লোকটা দলবল নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। অমৃতা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেস্টুরেন্টের পোর্চে, ব্যাক্কলের মতো। এখন যদি লোকটা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তাহলে কেমন হবে? সহ্য করতে পারবে কি সে এই অপমান? কী করবে অমৃতা? এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে যাবে? মনে হচ্ছিল যেন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগির মতো হাতে পায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আছে। হৃদয়ে ধুকপুক। মানুষটা আসছেন। অমৃতা তাকাতে পারছে না সরাসরি। মুখ নিচের দিকে নামিয়ে রেখেছে সে। লোকটা আজকে তাকে পাত্তা না দিয়ে ভেতরে চলে গেলে সে নির্ঘাৎ একটা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে! 

দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল অমৃতা, নতমুখে। পাঁচ… চার… তিন… দুই… ঠিক তার সামনে এসে পা দুটো থামল। স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল একটা। সে শুনতে পেলো চেনা গলাটা বলছে, ‘আপনারা ভেতরে যান প্লিজ। আমি আসছি।’ 

মুখ তুলে তাকালো অমৃতা। তিনি রোদ চশমাটা খুলে হাতে নিলেন। অমৃতার চোখে চেয়ে হাসলেন। সেই হাসি, যে হাসিটা দেখলে অমৃতার পাগল পাগল লাগে! 

—‘কেমন আছ?’ প্রশ্ন করলেন তিনি। 

অমৃতার ভেতরটা এক আশ্চর্য সুখের আবেশে অবশ হয়ে গিয়েছিল। সুখের পাশাপাশি বুকের মাঝে ব্যথার মতো কী যেন বিঁধছিল অনবরত। চোখ দুটি অকারণে হয়ে উঠেছিল ভাসা ভাসা, টলটলে। সে অনেক কষ্টে মুচকি হেসে বলল, ‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন রাশেদ?’ 

স্ফটিক রঙের রোদ্দুরে ডোবা ওই বাসন্তী সকালটায়, ভাসা ভাসা, টলটলে চোখওয়ালা মুচকি হাসির অমৃতাকে হঠাৎ ভারি সুন্দর দেখতে লাগল। রাশেদ একটু সময় চুপ করে চেয়ে রইলেন ওই মুখের দিকে স্থির চোখে। তারপর মনের অনেক আবছা একটা কোণে তিনি টের পেলেন যে মেয়েটিকে দেখলে তাঁর মনটা হঠাৎ হঠাৎ সম্পূর্ণ বিনা কারণেই স্নিগ্ধতায় ছেয়ে যায়। এই স্নিগ্ধতা অনেকটা আচমকা আসা ঝাপটা বাতাসের মতো। সব ধরনের বাস্তবিক অনুভূতির ঊর্ধে। কোত্থেকে যেন হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসে সারাটা দেহ মন সূক্ষ্ম ভালোলাগায় একাকার করে দেয়। সেই ভালো লাগার ঝাপটাকে ধরে রাখা দায়। সে বন্দি থাকে না। আসে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে, ক্ষনিক পরেই আবার কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। 

—‘আমি ভালো আছি। তুমি কী করছ এখানে? একলা দাঁড়িয়ে?’ 

প্রশ্নটা অমৃতাকে বেশ ভালোই বিব্রত করে তুলল। এখন সে কী উত্তর দেবে? মানুষটার সাথে দুটা কথা বলবার জন্যেই যে এই দাঁড়িয়ে থাকা একলা একলা, সেই নির্লজ্জ সত্য কথাটা কেন যেন তার এই মুহূর্তে একেবারেই বলতে ইচ্ছে হলো না। কী দরকার অতটা সস্তা হবার? একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘আমি… এই তো দাঁড়িয়ে আছি। এমনিই।’ 

— এমনিই?’ 

—‘না মানে, ফুল দেখছিলাম।’ 

—‘ফুল দেখছিলে?’ একটা ভ্রু উঁচু করে কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলেন রাশেদ। 

অমৃতা কেশে গলা পরিষ্কার করল। স্মার্টভাবে বলার চেষ্টা করল, ‘হ্যাঁ, ওইযে দেখেন পানির ওপর শাপলা ফুটে আছে। খুব সুন্দর লাগছে গোলাপি রঙের ফুলটা দেখতে, তাই না?’ 

তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে জলাশয়ের ওপর ফুটে থাকা শাপলার দিকে তাকালেন একবার। তাঁর মুখে ধারওয়ালা হাসিটা ফিরে আসলো আবার। অমৃতার চোখে চেয়ে তিনি স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ সুন্দর। কিন্তু বেগুনি রঙের ফুলটা সবচেয়ে সুন্দর!’ 

কথাটা বলা শেষ করেই তিনি পা বাড়ালেন। হেঁটে ঢুকে গেলেন রেস্টুরেন্টের ভেতর। অমৃতা কয়েক সেকেন্ড বোকার মতো তাঁর চলে যাওয়া পথটার দিকে চেয়ে থেকে স্বগতোক্তি করল, ‘বেগুনি ফুল?’ আশেপাশে তাকিয়ে সে কোনো বেগুনি ফুল খুঁজে পেলো না। একটু দূরের পলাশ গাছ ছেয়ে আছে লাল ফুলে ফুলে। কলাগাছ, বহেড়া আর শিমুল গাছের অরণ্যে কোথাও কোনো বেগুনি রঙের অস্তিত্ব চোখে পড়ল না তার। 

২২

রেস্টুরেন্টে নাশতার বুফে চলছে। বেশ ভিড় আছে এখন। মানুষজন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেছে প্লেটে খাবার তুলে নেবার জন্য। প্রায় পঁচিশ রকমের আইটেম সাজানো আছে টেবিলে। সাথে তাজা ফলমূল, ফ্রেশ ফ্রুট জুস্, চা এবং কফি। অমৃতা ভেতরে ঢুকে দেখল বিভা আর হৃদি কর্ণারের একটা টেবিল দখল করে বসেছে। এর মাঝে তারা খাওয়ার পালাও শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন রকম খাবারে ভরে গেছে টেবিল। অমৃতা ওদের সাথে যোগ দিল। আড়চোখে দেখল মানুষটা কাছাকাছিই বসেছেন দলবল নিয়ে। থানচি উপজেলার ইউ এন ও এসেছেন। নাশতার টেবিলে খুব জোরেশোরে আলোচনা চলছে। অমৃতাকে দেখতে পেয়ে বিভা বলল, ‘কী বলে মিস্টার ড্যাশিং ম্যান?’ 

অমৃতা বলল, ‘কী যে বলল, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না।’ 

বিভা ফ্রেঞ্চ টোস্টে কামড় দিয়ে বলল, ‘ক্যান? চাইনিজ ভাষায় কথা বলছে নাকি?’ 

—‘আরে নাহ!’ 

—‘হিব্রু ভাষায় বলছে?’ 

— ধুর।’ 

—‘তাইলে বুঝস না ক্যান কথা?’ 

অমৃতা পানির বোতলের ক্যাপ খুলে দুই তিন ঢোক পানি গিলল। অপর হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে বলল, ‘আমি বললাম গোলাপি রঙের শাপলা ফুলটা খুব সুন্দর। উনি বললেন, বেগুনি রঙের ফুলটা সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু ওখানে কোনো বেগুনি ফুল ছিল না।’ 

কয়েক সেকেন্ড থমকানো চোখে অমৃতার দিকে চেয়ে থেকে হৃদি আর বিভা একযোগে হেসে উঠল। হৃদি হাসতে হাসতে বলল, ‘ওয়াও! আমার শ্বশুর তো অনেক রোমান্টিক আছে! আর তুই আসলে অনেক গাধা হয়ে গেছিস অমৃতা। প্রেমে পড়লে মানুষ এত গাধা হয়ে যায়। আল্লাহ!’ 

অমৃতা চোখ কটমটিয়ে বলল, ‘গাধা বলতেছিস ক্যান আমাকে?’ 

—‘তো কী বলব? তুই নিজেই তো বেগুনি রঙের টি শার্ট পরে আছিস। তুই বুঝিস নাই উনি কী বলতে চাইছে?’ 

অমৃতা চট করে নিজের পরনের পোশাকের দিকে তাকালো একবার ঘাড় নিচু করে। সে কিছু একটা গায়ে চড়ানো দরকার বলেই চড়িয়ে ফেলে। বেশির ভাগ সময় তার মাথায় সক্রিয়ভাবে এই বিষয়টা কাজ করে না যে ঠিক কোন জামাটা এই মুহূর্তে পরে আছে। বেগুনি ফুলের বিষয়টা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে একটা অপ্রতিরোধ্য খুশিতে তার সারা মুখ ঝলমল করে উঠল। পিঠে চট করে গজিয়ে গেলো দুটো অদৃশ্য ডানা। তারপর পাখির মতো উড়তে লাগল সে শূন্যে, মনে মনে! উড়তে উড়তে খানিক দূরে বসা মানুষটার চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছিল বারংবার। নিগূঢ় এক জালের বুনন তৈরি হচ্ছিল সকলের অলক্ষ্যে, দুটি মানুষের মাঝে। কেউ বুঝতে পারছে না কিন্তু জালের বিস্তার ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে! রোমেলা তার দুই বোনের পরিবার নিয়ে প্রবেশ করলেন রেস্টুরেন্টে। তিন বান্ধবীর দিকে নজর পড়ল না তার। দুই বোন আলাদা একটি টেবিলে বসলেন। তিনি নিজে বসলেন স্বামীর পাশে। সেই মুহূর্তে বন্ধুদলের ছেলেরাও প্রবেশ করল। তিন বন্ধু, সাথে অভিজিৎ। অমৃতার একটা বিষয় ভাবতে ভালো লাগছিল যে বিভা আর হৃদির ব্যবহার আজ যথেষ্ট স্বাভাবিক। রাশেদের ব্যাপারটা নিয়ে অন্যান্য দিনের মতো রেগে যায়নি ওরা। তাছাড়া গতরাতে আকাশ বলেছে যে সে অমৃতার ফিলিংসকে রেসপেক্ট করে। সেই থেকে মনটা এক স্নিগ্ধ তৃপ্তিতে ভরে আছে। আজ বিভা আর হৃদির সহজ সাধারণ ব্যবহার সেই তৃপ্তির মাত্রাটা বাড়িয়ে দিল। সে জানে বন্ধুরা খুব বেশি দিন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে টিকতে পারবে না। সারা পৃথিবী উল্টোপথে হাঁটলেও, বন্ধুরা তার সাথেই হাঁটবে, হাতে হাত রেখে, পাশাপাশি। শুধু একটা ব্যাপার মনের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। রুদ্র গতরাতে ব্যাপারটা শোনার পর থেকে আর একটি কথাও বলেনি তার সাথে। রাতে বেশ কয়েকবার রুদ্রর মোবাইলে ফোন করেছিল। রুদ্র ধরেনি। ফোন কেটে দিয়েছে। এখন এই সকাল বেলাতেও তার মুখখানা গম্ভীর। স্বভাবসুলভ আমুদে আচরণ উধাও। সব কিছু ঠিক থাকলে সে আসা মাত্র নাচতে নাচতে বুফের লাইনে দাঁড়িয়ে যেত। আবোল তাবোল কথা বলে লোক হাসাতো। কিন্তু আজ তাকে দেখাচ্ছে ম্লান, চিন্তিত এবং ক্লান্ত। 

সামি বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে গেলো প্রথমেই। তারপর বন্ধুদের টেবিলে এসে কোনো ভূমিকা ছাড়াই হৃদিকে বলল, ‘তুই ফোন ধরিস না ক্যান?’ 

হৃদি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘ফোনে চার্জ ছিল না।’ 

—‘মানে কী? তুই চার্জার নিয়ে আসিস নাই?’ 

—‘নিয়ে আসছি তো।’ 

সামি হঠাৎ হৃদির ডান কনুইটা খামচে ধরে জোর করে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল ওকে। হৃদি আর্তনাদ করে উঠে বলল, ‘আজিব, চা খাইতেছি তো!’ 

সামি গমগম করে বলল, ‘চা পরেও খাওয়া যাবে। এখন বাইরে আয়। কথা আছে তোর সাথে।’ 

ওদের দুজনের বাক বিতণ্ডায় বাকি বন্ধুরা একটু চুপসে গিয়েছিল। বিভা অভিজিৎকে তাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘বসে রইলে কেন? যাও খাবার নিয়ে এসো। লাইন ধরো।’ ‘এটুকু বলে সে আবার কী মনে করে যেন সুর পাল্টে বলল, ‘আচ্ছা তুমি বসো। আমি যাচ্ছি।’ ‘ 

বিভার পেছন পেছন আকাশ আর অমৃতাও উঠল। রুদ্র বসেই ছিল। তার হাতে মোবাইল। চোখ নিবদ্ধ মোবাইলের স্ক্রিনে। অমৃতা ডাকল, ‘এই রুদ্র, নাশতা খাবি না?’ 

রুদ্র চোখ না তুলেই দায়সারা গলায় বলল, ‘খাব। একটু পরে।’ 

এদিকে হৃদির হাত ধরে সামির ওই হনহনিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা, হক এবং রোমেলা দুজনের কারোরই চোখ এড়াল না। 

—‘তুই কি আমাকে এভয়েড করার চেষ্টা করতেছিস?’ 

কড়া ভাবে বলল সামি। ওরা রেস্টুরেন্টের পোর্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আপাতত এখানটায় কেউ ভিড় করে নেই। সামির পরনে একটা নেভিব্লু টি শার্ট। গালে এবড়োখেবড়ো দাড়ি। কালো কোঁকড়া চুলগুলো কিছুটা অবিন্যস্ত। তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে রাতে ভালো ঘুম হয়নি। 

হৃদি গলায় একটু নির্বিকার ভাব আনার চেষ্টা করে বলল, ‘এভয়েড করার চেষ্টা করব কেন?’ 

—‘তাহলে আমার ফোন ধরিস নাই কেন? ফোনে চার্জ দিস নাই কেন?’

—‘ইচ্ছা করে নাই তাই।’ 

—‘ইচ্ছা করে নাই?’ 

–‘করে নাই!’ 

—‘ফাইজলামি করিস?’ 

—‘ফাইজলামির কী আছে?’ 

সামির মুখ দেখে মনে হলো রাগের চোটে তার ভেতরে যে কোনো মুহূর্তে একটা বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘প্রব্লেম টা কী হৃদি? তুই এখানে আসার পর থেকে আমার সাথে এরকম করতেছিস কেন?’ 

হৃদি অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি আবার কী করলাম!’ সামি হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে হৃদির গাল টিপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। 

—‘এটার মানে কী? 

হৃদি সামির চোখে চেয়ে ম্লান গলায় বলল, ‘মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুই আমাকে আসলে সত্যিকারের ভালোবাসিস না।’ 

—‘আমি তোকে ভালোবাসি না?’ টেনে টেনে শব্দগুলো উচ্চারণ করল সামি।

–’বাসিস কিন্তু… ইউ নো হোয়াট? ডিপ ডাউন ইনসাইড আই ফিল লাইক তুই… তুই আমাকে আন্ডারেস্টিমেট করতেছিস। দাম দিচ্ছিস না।’ 

সামির মুখ থেকে রাগের প্রকোপ কেটে গিয়ে হঠাৎ একটা দারুণ হতভম্ব ভাবের প্রাদুর্ভাব হলো। 

—‘কী বলতেছিস তুই এসব বোকার মতো?’ 

—‘সামি শোন, তুই হয়তো এটাকে হীনমন্যতা বলতে পারিস। হিংসা বলতে পারিস। যা ইচ্ছা বলতে পারিস। বাট সত্যি আমার এরকম মনে হচ্ছে। আই ক্যান্ট হেল্প। এখন আমি কী করব বল?’ 

—‘এরকম মনে হচ্ছে কেন?’ 

—‘জানি না কেন মনে হচ্ছে। আর আমার মনে হয় তোর বাবা মা কখনওই আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে না। উনারা প্রস্তাব না দিলে তো বিয়েটা আল্টিমেটলি হবে না।’ 

—‘তুই কী বলতে চাচ্ছিস?’ 

—‘পরিষ্কারভাবে কিছু বলতে বা ভাবতে পারতেছি না এখন। একটু সময় দে।’ 

—‘কীসের সময়? হৃদি তোর সাথে আমি আমার বিয়ের আগের দিন পুরা ফ্যামিলির সাথে বিট্রে করে পালায় গেছিলাম। তুই কি ভুলে গেছিস?’ 

—‘আমি ভুলি নাই। আমি জানি আমাকে ছাড়া তুই থাকতে পারবি না, কিন্তু আমার… আমার আরো কিছু দরকার!’ 

সামি বিমূঢ়ভাবে তাকায়, মন্ত্র উচ্চারণের মতো বিড়বিড় করে বলে, ‘আরো কিছু দরকার? 

—‘সামি! তুই বুঝবি না! 

হৃদি কথাটা বলা শেষ করে ঘুরে দাঁড়ালো। দ্রুত পা চালিয়ে ঢুকে পড়ল রেস্টুরেন্টের ভেতর। সামি আরো কয়েকটা মুহূর্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জায়গাটায়। 

২৩

মেঘের বাড়ি বোধহয় একেই বলে। গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘের দল পায়রার মতো উড়ছে চিম্বুক পাহাড়ের বুকে। ফিরোজা আকাশে চিকচিক করছে শেষ দুপুরের রুপো রঙের রোদ্দুর। প্রেতের মতো অট্টহাসি হেসে দাপটের সাথে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে ডাকাতিয়া বাতাস। সামি ড্রোন উড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। নব চত্বরের লাল সাদা জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুরা। ড্রোন উড়ার আগে সবাইকে একত্রে একবার ক্যামেরার সামনে জড়ো হতে হবে। ড্রোন ক্যামেরা বন্ধুদের সবাইকে প্ৰথমে একবার ফ্রেমবন্দি করবে তারপর উড়ে যাবে আকাশে। 

চত্বরজুড়ে নানা বয়সি লোকজনের ভিড়। জায়গাটা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১৬০০ ফুট উঁচুতে। চত্বরের কিনার রেলিং দিয়ে ঘেরা। আকাশ রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটু বিব্রত দেখাচ্ছে তাকে। খানিক বাদে বাদে সে ডান দিকে রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটখাটো একটা দলের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে এবং সম্পূর্ণ বিনা কারণে কুঁকড়ে যাচ্ছে। 

পাহাড় বেয়ে ওঠার সময় শব্দটা আচমকা তার কানে এসে লেগেছিল।

‘স্যার!’ 

আকাশ তাকাল পেছনে। থপথপ করে পা ফেলে প্রায় দৌড়ে আসছে একটি স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। মেয়েটিকে আকাশ চেনে। তার ছাত্রী। কোনো এক বিচিত্র কারণে সে এই মেয়েকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। ক্লাসে লেকচার দেবার সময় মেয়েটি মোটা চশমার আড়াল থেকে অদ্ভুত চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে তার দিকে। ঠোঁটে থাকে বিজলী হাসি। চোখের দৃষ্টি অনেকটা ফণা তোলা সাপের মতো। মনে হয় এই বুঝি ছোবল দেবে। মেয়েটির শরীরের ওজন আকাশের চেয়ে দ্বিগুণ হবে। ফোলা ফোলা ফর্সা গাল। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো বব চুল। একদিন ক্লাস শেষে মেয়েটি আকাশের রুমে ঢুকে পড়েছিল। হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল একটি তিন পাতার প্রেমপত্র। আকাশ মেয়েটিকে মিথ্যে করে বলেছিল যে তার গার্লফ্রেন্ড আছে। মেয়েটি গার্লফ্রেন্ডের কাহিনি শুনে সুর করে মুখের ওপর বলে দিয়েছিল ‘বিশ্বাস করলাম না!’ 

এরপর রোজ রোজ টেক্সট করত। গোটা একটা সেমিস্টার ধরে টানা চলেছিল তার এই টেক্সট টেক্সট খেলা। গেলো সেমিস্টারে পাশ করে ভার্সিটি ছাড়ল মেয়েটা। একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল আকাশ। কে জানত বান্দরবানে এসে এই সর্পিণী নাগিনীর সাথে পুনরায় দেখা হয়ে যাবে? জানা থাকলে সে জীবনেও আসত না এই ট্যুরে। আকাশের পাশে রুদ্র দাঁড়িয়ে ছিল। হৃষ্টপুষ্ট মেয়েটিকে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে তরতর করে উঠে আসতে দেখে সে অবাক গলায় বলল, ‘কে এই রসগোল্লা?’ 

আকাশের মুখখানা তখন ঝুলে গেছে। ঝুলন্ত মুখ নিয়েই বলল, ‘কে আবার? সাক্ষাৎ নাগিন!’ 

খুশিতে ঝুমঝুম হয়ে দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটি বলল, ‘স্যার?’ 

স্যার শব্দটির পরে প্রশ্নসূচক সুরটি ঠিক কী কারণে আকাশ তা বুঝে পেলো না। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ?’ 

—‘স্যার?’ 

—‘হ্যাঁ স্যার। বলো!’ 

—‘স্যার আপনি এখানে? বান্দরবানে?’ মেয়েটির গাল দুখানা হাসির দমকে এখন বেলুনের মতো ফুলে গেছে। 

—‘হ্যাঁ আমি বান্দরবানে।’ আকাশকে দেখে মনে হলো সে আরেকটু হলেই কেঁদে দেবে। 

—‘স্যার আমি জারা। আমাকে চিনতে পেরেছেন?’ 

—‘হ্যাঁ জারা আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি।’ বলল আকাশ। কিন্তু নামটা সে আদতে ভুলে গিয়েছিল। 

জারা খুশিতে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘ওয়াও স্যার! বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। কী যে খুশি লাগছে!’ 

আকাশ আড়চোখে দেখল রুদ্র তেরছা ঠোঁটে হাসছে। সে জারাকে বলল, ‘নাইস টু সি ইউ জারা। আমার ফ্রেন্ডরা অপেক্ষা করছে। আসি।’ 

কথাটা বলে আকাশ রুদ্রর হাত ধরে টানতে টানতে উপরে উঠতে লাগল। খাড়া রাস্তা বলে অত সহজে হাঁটা যায় না। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে হাঁপ ধরে যাচ্ছিল। রুদ্র বলল, ‘রসগোল্লা কী চায়?’ 

—‘আরে এইটা তো ওই বদ মাইয়া যে আমারে লাভ লেটার দিছিল। বলছিলাম না?’ 

শুনে রুদ্র হো হো করে দুনিয়া কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতেই বলল, ‘রসগোল্লাটা কিন্তু কিউট আছে মামা। ছোটখাটো একটা হাতির বাচ্চা।’ 

—‘কিউট নাকি কেউটে সাপ সেটা কিছুক্ষণ মিশলেই বুঝবি তাড়াতাড়ি পালা দোস্ত।’ 

চত্বরে এসেও নিরাপদ বোধ করছে না আকাশ। জারা তার পরিবারের সাথে দাঁড়িয়ে আছে খানিক দূরে। হা করে অপলক তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশের মনে হচ্ছে মেয়েটি চোখ দিয়ে তাকে আস্ত গিলে খাবে। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। জীবনে এত ভয় সে অন্য কোনো মেয়েকে দেখে পায়নি কখনো। তার বুক ধুকপুক করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। 

সামি ড্রোন উড়িয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। রিমোট দিয়ে ড্রোন কন্ট্রোল করছে মনোযোগের সাথে। বিভা আর অভিজিতের যুগল ছবি তুলে দিচ্ছে রুদ্র। অমৃতা, আকাশ আর হৃদি, সামির পাশে দাঁড়িয়ে আছে জড়ো হয়ে। অমৃতা আকাশের হাঁসফাঁস অবস্থাটা টের পেয়ে বলল, ‘তোর কী হইছে?’ 

—‘কিছু না।’ 

—‘মুখটাকে এরকম বানাইছিস ক্যান? বাথরুম আসছে? পেট খারাপ?’

—‘আরে না!’ 

হৃদি বলল, ‘ক্ষিদা লাগছে?’ 

আকাশ চোরা চোখে জারার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নারে ভাই!’ শব্দ দুটো বলা শেষ করা মাত্র সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে হৃদির একটা হাত ধরে ফেলল। এরপর ওর হাত ধরে টানতে টানতে চত্বরের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল হনহন করে। পেছন থেকে অমৃতা বলে উঠল, ‘মানে কী? কোথায় যাইতেছিস তোরা? 

হৃদি ঘাড় ঘুরিয়ে অমৃতাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আকাশ তার আগেই চাপা আর্তনাদ করে উঠল, ‘চুপ করে থাক। কথা বলিস না!’ এই ঘটনায় জারার ঠোঁটে ঝুলে থাকা মুচকি হাসির রেখাটা মুছে গেলো চকিতে সে বড়ই চোখ নিয়ে আকাশ আর হৃদির চলে যাওয়া দেখতে লাগল। অভিজিৎকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ছবি তুলতে তুলতে সে ক্লান্ত। কিন্তু বিভার মধ্যে ক্লান্তির ক ও নেই। ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে যেন নামিদামী কোন মডেল। ছবি তোলা শুধু তার নেশা নয়, পেশাও। তার পরনে ঘেরওয়ালা লম্বা একটা সাদা রঙের কামিজ। কামিজের ঘেরজুড়ে রয়েছে সোনালি পাড়। কাঁধে ঝুলছে সোনালি ওড়না। তার মাথার চুলে ভারি স্টাইলিশ এক হাত খোঁপা। বোঝা যাচ্ছে ছবি তোলার জন্যেই আঁটঘাট বেঁধে সাজগোজ করেছে সে আজ। অভিজিতের গোবেচারা মুখটা দেখে রুদ্রর হাসি পাচ্ছিল। সে হাসতে হাসতে বিভাকে বলল, ‘বাপ, অনেক তো ছবি তুলছিস। এখন একটু আমাদের জামাই বাবুকে ছাড়। ছবি তুলতে চাইলে একা একা তোল। জামাই বাবু তো কাইন্দা দিবে আরেকটু হইলে।’ 

শুনে অভিজিৎ টিটকিরির হাসি হেসে বলল, ‘বিয়েটা একবার করে নাও না দাদা! তারপর হাড়ে হাড়ে টের পাবে বুদ্ধিমান লোকেরা কেন বিয়ে করতে চায় না।’

বিভা বরের পেটে একটা খোঁচা মেরে বলল, ‘এই এত কথা বলো কেন? হাসো হাসো। সুন্দর করে হাসো। না হাসলে ছবি বিশ্রী হয়ে যাবে।’ 

অমৃতা হঠাৎ রুদ্রর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দোস্ত, তোর সাথে একটু কথা ছিল।’ 

‘বল।’ ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখেই বলল রুদ্র। 

—‘এভাবে বলতে পারব না। সিরিয়াস কথা।’ 

—‘কাজ করতেছি দেখতেছিস না?’ 

অমৃতা চট করে রুদ্রর হাত থেকে ক্যামেরাটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘বালের কাজ তোমার। অনেক কাজ করছ। আর লাগবে না করা।’ কথাটা বলা শেষ করে সে বিভার হাতে ক্যামেরাটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এত ছবি তুলার কী আছে। একটা ফটোই যথেষ্ট। এক জায়গা এক ফটো। একটা জায়গায়ই যদি একশোটা ফটো তুইলা ফেলো তাহলে অন্য জায়গায় গিয়া কী করবা? আর পাহাড়ে আসছ তুমি এরকম মাঞ্জা মাইরা আসছ ক্যান? পাহাড়ে মানুষ এইসব পইরা আসে? খ্যাত কোথাকার! 

বিভা ঝেঁঝে উঠে বলল, ‘একশবার ছবি তুলব। আর একশবার মাঞ্জা মারব। আমার জামাইয়ের সাথে আমি ছবি তুলতেছি। তাতে তোমার কী? হিংসা হয়?’ 

দুই বান্ধবীর কাণ্ড দেখে অভিজিৎ হেসে ফেলল। অমৃতা ফিরে এলো রুদ্রর কাছে। বাতাসটা ঠাণ্ডা আর বড্ড একরোখা। সাঁই সাঁই করে বয়ে চলেছে গোটা চত্বরজুড়ে। অমৃতা একটা ফুলহাতা কালো রঙের শার্ট পরেছিল। শার্টের সুতি কাপড় ভেদ করে নির্লজ্জের মতো ওর শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছিল দুষ্টু বাতাস। শীত করছিল ওর। দুই বাহু বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে রুদ্রর সামনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো সে। রুদ্রর গায়ে একটা ছাই রঙের টিশার্ট। অকাল্ট থেকে কেনা। শার্টের বুকের ওপর ভয়ংকর একটা চেহারা আঁকা এবং বড় করে ইংরেজিতে লেখা ‘দ্যা ডেভিল।’ ওর খোলা চুল উড়ছে। হাত দিয়ে চুলগুলো মুঠোবন্দি করার চেষ্টা করছে সে। ঠোঁটে ধরে রেখেছে একটা রাবার ব্যান্ড। অমৃতা ওর মুখের দিকে একটু মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘তুই কি আমার ওপর রেগে আছিস?’ 

রুদ্র ঠোঁট থেকে রাবার ব্যান্ডটা তুলে নিল আঙুলে। অন্য হাত দিয়ে ধরে থাকা চুলের গোছায় রাবারটা পেঁচাতে পেঁচাতে বলল, ‘কোন দুঃখে রাগ করব তোর সাথে?’ 

—‘তা তো আমি জানি না।’ 

—‘আজাইরা কথা বলিস না।’ 

অমৃতা একটু অধৈর্যভাবে বলল, ‘সিরিয়াসলি রুদ্র। কী হইছে বল না!

চুল বাঁধা শেষ করে রুদ্র ধীরেসুস্থে ওর ক্যাটস আই চোখ দুটো অমৃতার চোখের ওপর স্থিরভাবে রাখল। বলল, ‘অমৃতা শোন, তুই একটা ভয়ংকর ভুল কাজ করতেছিস। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। তুই বুদ্ধিমতী। একটু মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করলেই পুরা ব্যাপারটা তোর কাছে ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’ 

অমৃতা বুঝতে পারল রুদ্র ঠিক কোন বিষয়ে কথা বলছে। সে পরিষ্কার গলায় বলল, ‘আমার মাথা ঠাণ্ডাই আছে। ভয়ংকর ভুল কাজটা করতে দোস্ত আমার ভয়ংকর ভালো লাগতেছে! কী করব বল? 

রুদ্র আশেপাশে একটা সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে নিশ্চিত হলো যে সামি এই মুহূর্তে নিরাপদ দূরত্বে আছে। সে এক পা এগিয়ে অমৃতার আরো কাছে আসলো। 

‘লিসেন অমৃতা, আই অ্যাম গিভিং ইউ আ ওয়েক আপ কল। প্লিজ ওয়েক আপ!’ 

—‘বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ওয়েক আপ দোস্ত। তুই ও তো মনীষাকে ভালোবাসছিস। মনীষা কম করে হলেও তোর থেকে নয় বছরের বড়। সেটা দোষের কিছু না?’ 

রুদ্র দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘মনীষা আমার ফ্রেন্ডের মা হয় না!

—‘হইলে কী করতি? পছন্দ করতি না?’ 

—‘না করতাম না!’ 

—‘ইউ নেভার নো! এরকম মনে হয়। অন্যের ব্যাপারে খুব সহজে মানুষ মতামত দিয়ে ফেলতে পারে। নিজের সাথে হুবহু একই রকম ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত রিয়েল জিনিসটা ফিল করতে পারে না।’ 

—‘তুই কি পাগল হয়ে গেছিস অমৃতা?’ 

অমৃতা ধীরস্বরে টেনে টেনে বলল, ‘হ্যাঁ রুদ্র, আমি পাগল হয়ে গেছি। পাগল হওয়ায় যে এত আনন্দ তা আমি ওই লোকটাকে না দেখলে কোন দিন জানতাম না!’ 

—‘অমৃতা, তোর এই জিদটা তোকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেবে না। নিজেও কষ্ট পাবি। সেই সাথে আরো কিছু মানুষকে কষ্ট দিবি।’ 

অমৃতা রুদ্রর একটা হাত আলতোভাবে ধরল। নরম গলায় বলল, ‘অন্য কাউকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। আর আমার কষ্টের কথা কী বলব? আমার মনে হয় পৃথিবীতে কিছু কিছু কষ্ট থাকে যেগুলো সুখের চাইতেও অনেক বেশি সুন্দর। তাই ওই সুন্দর কষ্টটা মাথা পেতে নিতে আমার কোনো আপত্তি নাই।’ 

—‘তোর কাছ থেকে আমি এটা আশা করি নাই। তোকে আমি বুদ্ধিমতী বলে জানতাম।’ খুব মন খারাপের গলায় বলে রুদ্র। 

—‘বুদ্ধিমতীই ছিলাম। হঠাৎ বোকা হয়ে গেছি দোস্ত। তুই চিন্তা করিস না। সামিকে আমি কষ্ট দিব না। সামির আম্মাকেও কষ্ট দিব না। বিশ্বাস কর!’ 

রুদ্র কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলেছিল। সামিকে এগিয়ে আসতে দেখে হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গেলো। সামি বলল, ‘হৃদি কোথায়রে?’ 

অমৃতা হাত উঁচিয়ে ইশারা করে বলল, ‘আকাশের সাথে গেছে। ঐদিকে।’ 

—‘কই গেছে?’ 

—‘জানি না।’ নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দিল অমৃতা। 

২৪

—‘কোথায় যাচ্ছিস? সমস্যা কী তোর?’ হৃদি আর্তনাদ করে বলে উঠল তৃতীয়বারের মতো। 

সুন্দর পিচঢালা রাস্তা বয়ে গেছে পাহাড়ের বুক চিরে, এঁকেবেঁকে। এই রাস্তায় দুটি ভিউ পয়েন্ট আছে। ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে পর্যটকরা বিশ্রাম নিতে পারবে। বসে বা দাঁড়িয়ে থেকে পাহাড়ি সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারবে। ঢালু পথ বেয়ে দর্শনার্থীরা দলেদলে উঠে আসছিল। কেউ কেউ আবার নেমে যাচ্ছিল। 

আকাশ আঁকুপাঁকু হয়ে বলল, ‘বিপদে আছি দোস্ত, আমারে বাঁচা!’

হৃদি থতমত খেয়ে গেলো, ‘কী হইছে? কী বিপদ?’ 

—‘আমার এক ছাত্রী আমার পিছে লাগছে।’ 

—‘তো সমস্যা কী? সবসময় তোরা মেয়েদের পিছে লাগিস, আজকে একটা মেয়ে তোর পিছে লাগছে। এটা তো আনন্দের বিষয়। ভয় না পেয়ে সেলিব্রেট করো শালা।’ 

আকাশ কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ‘দেখিস নাই তো এই জন্যে বলতেছিস এসব। দেখলে বুঝতি। আস্ত একটা হাতির বাচ্চা। রসগোল্লার মতো মুখ।’ 

ততক্ষণে জারা ওদের অনুসরণ করে অনেকটা পথ এসে গেছে। পথের ধারের একটা শিমুল গাছের নিচে চোরের মতো ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে সে। ওর উল্টোপাশেই দাঁড়িয়ে আছে আকাশ আর হৃদি। দুই দলের মধ্যে দূরত্ব দশ কদমের মতো হবে। জারা বড় বড় চোখ মেলে, কান খাড়া রেখে চেয়ে আছে ওদের দিকে। আকাশ ওকে দেখামাত্র একেবারে পিলে চমকে উঠল। চট করে হৃদির দুটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কিছু একটা কর। প্লিজ বাঁচা আমারে।’ 

আকাশের কাণ্ড দেখে হৃদি খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, ‘এখন কি আমার প্রেমের অভিনয় করতে হবে তোর সাথে?’ 

—‘হ্যাঁ তাই কর। বেটিরে আমি আগে একবার বলছিলাম আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। বেটি বিশ্বাস করে নাই।’

—‘কেন কষ্ট দিচ্ছিস বেচারিকে? আহারে আমার তো দেখে কিউট লাগতেছে। কী সুন্দর গোল্লা গোল্লা মুখ!’ 

আকাশ হৃদির হাত ধরে টেনে রাস্তার আরেকটু কিনারে নিয়ে আসলো। ওদের মাথার ওপর ছাউনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি পলাশ গাছ। আগুন রঙের ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছটা। বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে চিরল পাতায়। ঝিরিঝিরি একটা মিহি শব্দ হচ্ছে সেই বাতাসে। এই পাহাড়ি রাস্তার দুপাশেই খাদ। খাদের ওপর নিশ্চিন্তে ভেসে বেড়াচ্ছে গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ। 

হৃদি বলল, ‘কিন্তু প্রেমের অভিনয় তো আমি করতে পারি না দোস্ত।’

—‘কিছু করতে হবে না। হাত ধরে চুপচাপ দাঁড়ায় থাক।’ 

হৃদি অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, ‘শুধু দাঁড়ায় থাকলেই হবে?’

—‘হুম হবে।’ 

হৃদি আকাশী আর সাদার মিশেলের একটা সালওয়ার কামিজ পরেছিল। কোমর পর্যন্ত চুলগুলো খোলা। চোখের কোল ভরাট করে কাজল পরেছে সে। কপালের মাঝ বরাবর একটি কালো টিপ। মুখে এসে পড়েছে চম্পক রঙের এক টুকরো ঝিকিমিকি রোদ্দুর। সেই টুকরো রোদ্দুরে চিকচিক করছে নাকের ডগা। আকাশ হঠাৎ ওর ওই রোদে ডোবা মুখখানার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বলে উঠল, ‘আরে দোস্ত, তোরে তো খুব সুন্দর লাগতেছে!’ 

হৃদির চোখে একটা প্রচ্ছন্ন খুশি খুশি ভাব ঝিলিক দিয়ে উঠল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সেই চোখে এসে ভর করল হালকা গম্ভীর ভাব। বলল, ‘এটা কি সত্যিকারের কমপ্লিমেন্ট ছিল? নাকি অভিনয়ের অংশ?’ 

—‘কীসের অভিনয়? সত্যিই তোকে অনেক সুন্দর লাগতেছে।’ 

শুনে হৃদি হাসল। আজ একটু যত্ন করেই সেজেছিল সে। কিন্তু যার জন্য সাজা, সেই মানুষটা একটাবারের জন্যে ভুল করেও প্রশংসা করেনি 1 হৃদির প্রশংসা করা যেন পাপ। এই যে আকাশ কত সহজে কমপ্লিমেন্ট দিয়ে দিল। কত ভালো হতো যদি সামিও মুখের ওপর এমন হুটহাট প্ৰশংসা করে বসত! ভাবতে ভাবতে হৃদির কপালে ধীরেধীরে একটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠছিল। 

—‘কী হলো? কী ভাবতেছিস?’ 

—‘ভাবতেছি যে, তোর কাছে সুন্দর লাগলে কী হবে? যার জন্য সাজলাম সে তো করুণা করেও কিছু বলল না।’ 

—‘বাহ্, এর মানে আমার বলার কোনো দাম নাই?’ 

কথাটা বলতে বলতে আকাশ একটা বেশ বড়োসড়ো কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে পড়ল। খাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে, ধোঁয়া ধোঁয়া উড়ন্ত মেঘ গুচ্ছর ওপর চোখ রেখে। বসল হৃদিও ওর পাশাপাশি। কাছেই পিটিশ ঝোপের মধ্যে কয়েকটা টুনটুনি পাখি উড়ছিল। ডাকছিল টিউটিউ করে। জারা তখনও দাঁড়িয়ে আছে ওদের পেছনে। অখণ্ড মনোযোগের সাথে দেখছে দুজনকে। 

—‘দাম থাকবে না কেন? দাম আছে। কিন্তু সামির চোখে আমি সুন্দর না কেন, এটা তুই বলতে পারিস?’ 

আকাশ এবার একটু বিরক্ত গলায় বলল, ‘তোর এইসব নকড়া আমার একদম পছন্দ না। আচ্ছা সুন্দর হইলেই কি সবসময় বলতে হবে নাকি?’ 

—‘একটু বললে কী হয়?’ করুণ শোনায় হৃদির গলা। 

‘বলতে হবে কেন? তুই জানিস না তুই সুন্দর?’ 

—‘না জানি না।’ 

এবার আকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে হৃদির মুখের ওপর পূর্ণ চোখ মেলে চেয়ে বলল, ‘জেনে রাখ হৃদিতা তুই অনেক সুন্দর! তোর সৌন্দর্যটা খুব স্নিগ্ধ। দেখলে মন পবিত্র হয়ে যায়।’ 

হৃদি আপ্লুত স্বরে বলল –’বাহ্, তুই কী সুন্দর করে বললি দোস্ত! এত সুন্দর করে এর আগে আমাকে কেউ কোনোদিন বলে নাই।’ 

—‘সব সময় এসব বলতে হয় না। মনে মনে রাখতে হয়।’ 

—‘সব সময় বুঝি তোর আমাকে সুন্দর লাগে?’ 

আকাশ প্রশ্নটা শুনে একটু সময় কী যেন ভাবল ভ্রু কুঁচকে। তারপর বলল, ‘প্রায়ই লাগে!’ 

হৃদি মিটমিট করে নিজের মনে হাসল একটু। তারপর আকাশের কাঁধের ওপর ডান হাতের পাঁচ আঙুল বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর নিজের চিবুকটা রাখল। আহ্লাদী গলায় বলল, ‘তাহলে এরপর থেকে যখনই আমাকে সুন্দর লাগবে তুই আজকের মতো মুখের ওপর বলে দিবি। কেমন?’ 

আকাশ বাঁকা গলায় বলল, ‘ইশ নিজের প্রশংসা শুনতে খুব ভালো লাগে তাই না?’ 

—‘কার না ভালো লাগে? তবে এবার কিন্তু গোল্লা মেয়েটা নির্ঘাৎ মনে করবে আমরা প্রেম করছি। আহারে বেচারি। কষ্টই হচ্ছে আমার ওর জন্য।’ 

কথাটা শুনে আকাশ খুব হাসতে লাগল। ওর আকাশময় হাসিটা। যে হাসি হাসলে চোখও হাসে। ওদের তখনও নজরে পড়েনি যে জারা এরমাঝেই জায়গাটা থেকে সরে গেছে। ও চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই পথে সামিকে দেখা গেলো। তার হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। পরনে কালো জ্যাকেট, কালো জিন্স। হৃদি আর আকাশের খোঁজেই এসেছিল সে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই চোখ পড়ল গাছের গুঁড়িতে বসে থাকা দুই যুবক যুবতীর ওপর। হৃদির চিবুক তখনো আকাশের কাঁধের ওপর রাখা। দুজনে বসে আছে খুব কাছাকাছি। কিছু একটা বলছে হৃদি আর আকাশ খুব হাসছে। সামি থমকে গেলো। কেন যে অমনভাবে থমকে গেলো সে কে জানে! একটা ব্যাখ্যাতীত অস্বস্তিকর অনুভূতিতে গাঁট হয়ে রইল ভেতরটা অল্প কয়েকটা ক্ষণ। চেয়ে রইল ওদের দিকে নিষ্পলক! তারপর একটা কথাও না বলে ফিরে চলল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *