বৃষ্টিমহল ৩.১৫

১৫

জানালার কাচ তুলে দিয়েছিল বিভা। তুলতেই এক থোকা মেঘ ফুড়ুৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসলো ঘরের ভেতর। সেই সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিচিরমিচির পাখির ডাক আর বাসন্তী হাওয়া। ঘরটা চারকোণা। আধুনিক ডিজাইনের একটি ডাবল খাট ঘরের অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে। খাটের ওপর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ধবধবে সাদা রঙের বেডকাভার, বেডশিট এবং বালিশ। খাটের পাশে একটি লম্বা চমৎকার দেখতে ল্যাম্পশেড। দখিনের দেওয়ালে বড়সড় একটি এল ই ডি টিভি। খাটের সামনের মেঝেতে পাতা আছে লাল, সবুজ এবং হলুদ রঙের ডোরা কাটা ছোট একটি কার্পেট। কার্পেটের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তেপায়া কালো রঙের কাঠের ভারি টেবিল। টেবিলের ওপর শ্বেতপাথরের মোমদানী। দানীতে রাখা সেন্টেড মোম। মোমবাতি জ্বলছে আর ঘরময় একটা ফুলেল সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে। 

—‘চমৎকার! হানিমুনের জন্য এর চেয়ে সুন্দর জায়গা আর হতেই পারে না।’ বিভা বলল, বুকভর্তি মুগ্ধতা নিয়ে। 

অভিজিৎ হাতের ব্রিফকেসটা টেবিলের ওপর রাখল। চেয়ারে বসে পায়ের জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে মুচকি হেসে বলল, ‘হানিমুন? নাকি ফানিমুন?’ 

বিভা বলল, ‘দুটাই! আমি কতটা লাকি চিন্তা করতে পারো? হানিমুন আর ফানিমুন দুটাই একসাথে করছি।’ 

বিভা জানালার সামনে দাঁড়িয়েছিল। সম্মুখে পাহাড় চূড়ো। সবুজাভ পাহাড়ের মাথার ওপর সূর্যদেব এখন দিনের শেষ আসনে অধিষ্ঠিত। নীল মেঘের পালে আগুন লেগেছে। আকাশের ফিরোজা বুকের ওপর দিয়ে সেই আগুন লাগা মেঘেরা সাঁতার কাটছে নিরুদ্দেশ ভাবে। একঝাঁক সবুজ টিয়া পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে ডিমের কুসুমের মতো গোল নরম সূর্যটার দিকে। 

পাহাড়ের কাছাকাছি এসে বিভার খুব ডুয়ার্সে ফেলে আসা তার ছোট্ট সংসারটির কথা মনে পড়ছিল। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল বাগানের গোলাপগুলো, পোষা পায়রাগুলো কেমন আছে। কেমন আছে উঠোনের মাঝখানের তুলসীগাছটা, নিজের ঘরে প্রিয় কাপড়চোপড়ে ঠাসা কাঠের আলমারিটা। মনে পড়ছিল রান্নাঘরের হাঁড়ি পাতিল, চায়ের কাপ, ডাইনিং টেবিলের ক্লথ আরও অনেক খুঁটিনাটি জিনিসের কথা। আসলে, বাঙালি মেয়েদের প্রথম ভালোবাসা হলো সংসার। পৃথিবীর যে প্রান্তেই সে ছুটে যাক না কেন, সংসারটা তাকে চুল বাঁধার কাঁকড়ার মতোই আঁকড়ে ধরে রাখে সর্বক্ষণ 

অভিজিৎ ঠান্ডা টাইলসের মেঝেতে পা ফেলে হেঁটে এসে দাঁড়ালো বিভার কাছে। পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে চিবুকটা রাখল ওর কাঁধের ওপর। ঘরের ভেতর বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া টুকরো মেঘটা তখন ভারি নিশ্চিন্তে ওদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল। মেঘের ভেজা স্পর্শ, মোমবাতির ফুলেল সুগন্ধ, আর সম্মুখের ওই রক্তিম পাহাড়ি সূর্যাস্ত ওদের দুজনের মনের আকাশে মখমলের মতো রেশমি, নরম এবং পবিত্র একটি অনুভূতির জন্ম দিচ্ছিল ধীরেধীরে। 

অভিজিৎ চাপা গলায় বলল, ‘আজ সকালে মা ফোনে কী বলছিল জানো?’ 

—‘কী বলছিল?’ 

—‘বলছিল যে তার একটা জুনিয়র অভিজিৎ চাই।’ 

বিভা হাসল, ‘জুনিয়র অভিজিৎই হতে হবে? জুনিয়র বিভা হলে হবে না?’ অভিজিৎ বিভার সুন্দর সিল্কি চুলের গোছায় মুখ ডুবিয়ে বলল, ‘আমার তো একটা ছোট্ট বিভাই চাই।’ 

বিভার বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করছিল। এতকাল তার শাশুড়ি মা এ ব্যাপারে হরহামেশাই কথা বলে এসেছেন। কিন্তু অভিজিতের মুখ থেকে এমন কিছু এই প্রথম শুনল সে। মা হবার মতো সময় কিংবা সাহস কোনোটিই এখনো তার হয়ে উঠেছে কিনা তা নিয়ে ষোলো আনা সন্দেহ আছে। কিন্তু সত্যই যদি এমনটা হয়? তার শরীরের ভেতরে আরেকটা শরীর! একদম নিজের একটা মানুষ! ভাবতেই তার হাত পা কেমন শিরশির করে উঠল। 

বিভা ঘুরে দাঁড়ালো। ধারালো বাতাস ওর খোলা চুল উড়াচ্ছিল পূর্ণ উদ্যমে। সে অভিজিতের বুকের ওপর মাথাটা আলতোভাবে রেখে বলল, ‘আমার ছোট্ট অভিজিৎ চাই। বোকা বোকা ভালোমানুষী চেহারার বাচ্চা একটা অভিজিৎ।’ 

—‘না, আমার বিভাই চাই। ছোট্ট বিভার নাম রাখব আশাবরী।’ 

বিভা নাক কুঁচকে ফেলল, ‘আশাবরী? ইশ ভীষণ খ্যাৎ নাম।’ 

—‘খ্যাৎ হবে কেন? বিভাবরীর মেয়ের নাম হবে আশাবরী। এটাই তো পারফেক্ট ম্যাচ।’ 

—‘পারফেক্ট ম্যাচ না ছাই। আচ্ছা শোনো, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। রিসোর্টে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চলো কিছু খাব।’ 

—‘এখনই যাবে? চান করে নিই? একটু অপেক্ষা করো সোনা।’ 

অগত্যা বিভাকে অপেক্ষাই করতে হলো। বাথরুমটা দারুণ অত্যাধুনিক সাজসজ্জায় সজ্জিত। ডিম আকারের চমৎকার বাথটাব। বাথটাবের পাশেই কাচের জানালা। জানালার ওপাশে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ি সবুজ। সাবান সুগন্ধি ফেনা ওঠা গরম জলে ডুবে থেকে সবুজের মায়াজাল দেখতে ভারি চমৎকার লাগে। বিভা নিজেও স্নান করে নিল। জামা পাল্টে পরলো একটা সমুদ্র নীল রঙের শাড়ি। চুল শুকিয়ে নিল ড্রায়ার দিয়ে। ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে নতুন করে সাজল আবার। নীল কাজল পরলো চোখে। কানে পরলো নীল পাথরের দুল, গলায় নীল পাথরের পেন্ডেন্ট। অভিজিৎ এই পুরো সময়টা সোফায় বসে বসে নিবিড় চোখে দেখল ওকে। বিভার এই যত্ন করে নিজের সুন্দর মুখটাকে আরো বেশি সুন্দর করে তোলার গোটা প্রক্রিয়াটা চুপচাপ বসে দেখতে তার ভালো লাগে। মেয়েটা জীবনে দুটা জিনিসই সবচেয়ে ভালো পারে। নাচ আর সাজগোজ! 

১৬

বিভা আর অভিজিৎ রেস্টুরেন্টে এসে দেখল বন্ধুরা আগে ভাগেই একটা টেবিল দখল করে বসে আছে। রিসোর্টের অতিথিরা ছাড়াও এই রেস্টুরেন্টে বাইরের লোকজন এসে খাওয়াদাওয়া করতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে শুধু রেস্টুরেন্ট ছাড়া রিসোর্টের অন্য কোনো স্থান ঘুরে দেখার অনুমতি নেই। 

বিভাকে দেখামাত্র সামি বলে উঠল, ‘আরে বাহ্! তোকে অনেক সুন্দর লাগতেছে তো!’ 

কথাটা খুব সাধারণ। এর আগে কতবার কতভাবে যে সামি বিভাকে সুন্দর বলেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আজ অভিজিতের পাশে দাঁড়িয়ে সামির করা আচমকা প্রশংসাটা বিভাকে একটু বিব্রত করে তুলল। সে চকিতে একবার তাকালো অভিজিতের দিকে। অভিজিৎ হাসল। সেই হাসিতে একটা আস্থার আভাস ছিল। যে আভাসটা বিভার ভালো লাগল। আর ওদিকে সামি কথাটা বলেই নিজের নতুন কেনা আইফোন ইলেভেন প্রো ম্যাক্স এ চোখ ডুবিয়েছে। সে লক্ষ্য করল না যে হৃদির মুখে ভাসতে থাকা কালো ছায়াটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল। সামি সবসময় যেভাবে তানিশা এবং বিভার রূপের প্রশংসা করে ঠিক সেভাবে হৃদির প্রশংসা কোনো কালেই করেনি। 

আকাশের ঠোঁটে অনেকক্ষণ যাবৎ একটি স্ফীত হাসি চিকচিক করছে। তার পরনে একটা ফুলহাতা মেরুন রঙের শার্ট। গালের দাড়ি কামানো। আজ তার মন মেজাজ বেশ ফুরফুরে বলে মনে হচ্ছে। অমৃতা ওর হাসিটা লক্ষ্য করছিল। একসময় প্রশ্নটা করেই ফেলল সে, ‘কাহিনি কী? সেই তখন থেকে ব্যাক্কলের মতো হাসতেছস ক্যান?’ 

আকাশ মুখে হাসিটা বজায় রেখেই বলল, ‘পেছনে তাকায়া দ্যাখ।’ 

অমৃতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একটি লাল জর্জেট কাপড়ের সালওয়ার কামিজ পরা মেয়ে একদম একলা বসে আছে একটি টেবিল দখল করে। 

—‘শুরু হয়ে গেলো?’ অমৃতার কণ্ঠে বিরক্তি।

—‘এই মাইয়ারে আমি আগে দেখছি। তুই কেন নজর দিতেছিস?’ রুদ্র বলল, প্রতিবাদী গলায় 

মেয়েটি গালে হাত দিয়ে উদাস নয়নে জানালার বাইরে চেয়ে আছে। তার চোখা নাক, বড় চোখ, মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল। সামিও দেখল মেয়েটিকে ঘাড় ঘুরিয়ে। বলল, ‘ভালোই তো। বেশ একটা কবি কবি ভাব আছে।’ 

রুদ্র চোখমুখ অদ্ভুত বানিয়ে বলল, ‘বলিস কী? আসলেই? আমি কোনোদিন কবি দেখি নাই। কবিরা এমন হয় দেখতে?’ 

তিন বন্ধু অতি মনোযোগের সাথে মেয়েটিকে দেখছিল। অভিজিৎ ওদের কাণ্ড দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। বিভা অভিজিতের হাসি দেখে বলল, ‘এরা জন্ম থেকেই লুনুষ। যেখানে যাবে সেখানে লুনুষগিরি করবে। বুঝছ?’ 

অভিজিৎ বৌয়ের কথা শুনে আরো বেশি হাসতে লাগল। কেঁপে কেঁপে। খানিক বাদে মেয়েটির টেবিলে খাবার চলে এলো। সাদা ভাত, ডাল আর গরুর মাংস। খাবার দেখে মেয়েটির ধ্যান ভাঙল। কবি কবি ভাবটা উধাও হলো মুখ থেকে। অতি যত্নের সাথে ফুলহাতা কামিজের হাত গুটিয়ে নিলো সে। তারপর গভীর মনোযোগ দিয়ে শুরু করলো খাওয়া। মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে লোকমা বানিয়ে মুখে পুরল, কাঁচামরিচ আঙুলে তুলে দিল জব্বর কামড়। তারপর কচকচ শব্দ তুলে চিবোতে লাগল। খাওয়ার দমক দেখে আকাশ একদম হা হয়ে গেলো। এত সুন্দর একটা মেয়ে যে এমন হাপুসগুপুস করে খেতে পারে এটা যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। রুদ্র আড়চোখে দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘এটা কি মেয়ে নাকি রাক্ষস?’ 

আকাশ হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। বিস্মিত গলায় বলল, ‘মনে হচ্ছে রাক্ষস। হাতি ঘোড়া সব খেয়ে ফেলবে!’ 

অমৃতা বলল, ‘কেন আমার তো ওর খাওয়ার স্টাইলটা বেশ ভালো লাগতাছে। অনেক ডেডিকেটেড সে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে। রুদ্রর মতো। রুদ্র তোর সাথে মানাবে খুব।’ 

রুদ্র বলল, ‘মরে গেলেও আমি এরকম রাক্ষস মেয়ের সাথে প্রেম করব না। আমার খাবার সব খেয়ে ফেলবে। আমি খাব কী? ‘ 

বন্ধুদের টেবিলেও খাবার চলে এলো কিছুক্ষণের মাঝে। গলদা চিংড়ি, মুরগির মাংস, লইট্টা ফ্রাই, সাদা ভাত আর ডাল। সন্ধ্যার সময়ই পুরোদস্তুর ডিনার হয়ে যাচ্ছে। 

গলদা চিংড়ি সাতটা অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। রুদ্র তার পাতে প্ৰথম দফায়ই দুটো তুলে নিল। এই দৃশ্য দেখে রেগে গেলো অমৃতা। 

—‘এই খাদকের বাচ্চা। দুইটা নিছস ক্যান। সবার ভাগে একটা।’ 

রুদ্র খেতে খেতে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি সকাল থেকে কিছুই খাই নাই। তাই আমার এখন একটু বেশি খাওয়া লাগবে।’ 

কিন্তু রুদ্রর কথা কে শোনে, আকাশ ছোঁ মেরে তুলে নিল চিংড়িটা নিজের প্লেটে। রুদ্রও দমবার পাত্র নয়। আকাশের প্লেট থেকে পুনরায় ছিনিয়ে নিল সে চিংড়ি মাছ। দুজনের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেলো। ঝোল ছিটকে গিয়ে পড়ল হৃদির কুর্তায়। হৃদির মেজাজ আগে থেকেই খারাপ আজ। এই মুহূর্তে ঝোলের ছিটা খেয়ে তার মধ্যে যেন একটা আগ্নেয়গিরি ঘটে গেলো। সে গলা ফাটানো চিৎকার করে বলে উঠল, ‘কুত্তার বাচ্চা! এত বড় সাহ হ হ স স!’ রেস্টুরেন্টে উপস্থিত লোকজন বড় বড় চোখ মেলে তাকাল ওর দিকে। এমন কি কবি মেয়েটাও খাওয়া থামিয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল। রুদ্র আর আকাশের চিংড়ি মাছের যুদ্ধ গেলো থেমে। 

১৭

খাওয়া দাওয়ার পর ওরা রেস্টুরেন্টের ওপেন টেরেসে এসে বসল। বিভা আর অভিজিৎ অবশ্য বসল না। আশপাশটা ঘুরে দেখতে বেরোলো। টেরেসের চারদিক খোলা। দিগন্ত জোড়া অন্ধকার রূপের ঝাঁপি খুলে বসেছে। সাদা পেঁজাতুলো মেঘ ভেসে ভেসে উড়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের মাথায়। টেরেসের ওপর কুয়াশার মতো সাদা যে আস্তরটা ওদের ঘিরে রেখেছে ওটা আদতে কুয়াশা নয়, মেঘ। নিচে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে সাঙ্গু নদী। অন্ধকারেও ওই বয়ে চলা নদীর ঢেউ দূর থেকে টের পাওয়া যাচ্ছে। ঝিঁঝি পোকার ঝংকার বেজে চলেছে অনবরত। টেরেসে আপাতত বন্ধুদের দলটা ছাড়া অন্য কেউ নেই। রুদ্র গিটার নিয়ে বসে গেছে। টুংটাং করে তুলছে একটা চেনা সুর। সামি হৃদির পাশে এসে বসেছিল। হাতের ওপর রেখেছিল একটা হাত। হৃদি হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তোকে আমার বিরক্ত লাগতেছে। দূরে যা।’ 

সামি হাতটা আবার ধরল, কঠিনভাবে বলল, ‘তোর সমস্যা কী?’ 

—‘দূর হ এখান থেকে।’ কথাটা বলে হৃদি হাতটা পুনরায় সরিয়ে নিল। সেই সময় সামির সেলফোন বেজে উঠল। উঠে পড়ল সে, ‘আব্বা ফোন দিচ্ছে। ওরা চলে আসছে মনে হয়। থাক তোরা, আমি দেখা কইরা আসি।’ 

হৃদি একবার অমৃতার দিকে তাকালো। অমৃতা হৃদির ঐ চোখের দৃষ্টির অর্থটা বুঝেই হয়তো চোখ সরিয়ে নিল। বুকটা নিজের অজান্তেই ঢিবঢিব করে উঠল তার। হঠাৎ আকাশ বলল, ‘তোরা কি আজকাল ইশারায় কথা বলিস?’ 

হৃদি একটু অবাক, ‘মানে কী? ইশারায় কথা বলব ক্যান?’ 

—‘কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে তোরা একটা কিসু লুকাইতেছিস আমাদের কাছ থেকে। কাহিনি কী? 

হৃদি আর অমৃতা আরও একবার চোখে চোখ ফেলল। অমৃতা বড় শ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ দোস্ত, তোদের আমার একটা কথা বলার আছে।’ 

রুদ্র গিটারের টুংটাং থামিয়ে মুখ তুলল, ‘কী কথা?’ 

হৃদি ঢং করা গলায় বলল, ‘মোহাব্বত হয়ে গেছে।’ 

আকাশ অবাক, ‘মানে কী?’ 

অমৃতা পরিষ্কার গলায় বলল, ‘আমি একজনকে পছন্দ করি দোস্ত!’ গিটারের তারের ওপর অনবরত চলতে থাকা হাতের আঙুল গুলো থামিয়ে রুদ্র অস্ফুটে বলল, ‘পছন্দ? কাকে?’ 

অন্ধকারে আবছা হয়ে থাকা দুই বন্ধুর তীব্র এবং অনুসন্ধানী চোখের দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারছিল না অমৃতা। সে চোখ নামিয়ে নিলো। তার বুক ধড়ফড় করছে। তৃষ্ণায় চৌচির হয়ে যাচ্ছে গলা। হৃদি হঠাৎ তাড়া দিয়ে উঠে অমৃতাকে বলল, ‘বললে বইলা ফ্যাল দোস্ত। তাড়াতাড়ি কর। সামি চইলা আসবে।’ 

এবার আকাশ থমথমে গলায় বলল, ‘হ্যাং অন! হোয়াট আর ইউ আপ টু গাইজ? সামি চইলা আসবে মানে? কাহিনী কী?’ 

হৃদি স্পষ্টভাবে বলল, ‘কারণ সামিকেই কথাটা বলা যায় না।’ 

—‘কিন্তু কেন?’ 

অমৃতা মুখ তুলল। কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল দুই বন্ধুর ফ্যাকাশে মুখের দিকে। তারপর এক দমে বলল, ‘সামির আব্বাকে আমার ভালো লাগে!’ 

—‘ভালো লাগে মানে?’ আকাশের প্রশ্ন! 

‘প্রেমে পড়ছে।’ উত্তরটা এলো হৃদির কাছ থেকে। 

এই নিতান্তই সাধারণ নিরপরাধ দুটি শব্দ সামনে বসা দুই যুবককে অচম্বিতে রূপান্তরিত করল মূর্তিমান পাথরে। সময় যেন থমকে গিয়েছে। থেমে গেছে তাদের ভিতরকার সব তরঙ্গ। অমৃতা মুখ নামিয়ে নিল নিচে। আজকে তার ভীষণ লজ্জা করছে। বিভা আর হৃদিকে ব্যাপারটা বলার সময় কিন্তু একটা ফোঁটাও আত্মা কাঁপেনি। লজ্জা তো অনেক দূরের কথা। গড়গড় করে বলে দিয়েছিল সব। কিন্তু আজ বিপজ্জনক এক অস্বস্তি কেউটে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরেছে তাকে চারদিক থেকে। মনের একদম তলানিতে সে টের পাচ্ছে যে এই দুজনের চোখে শুধু বিস্ময় আর ধিক্কার নয় বরং আরো কিছু আছে। ওদের অমন নিগূঢ় চোখের দৃষ্টি অমৃতা এর আগে কোনোদিন দেখেনি! 

অনেকক্ষণ পর রুদ্র কথা বলতে পারল, ‘এটা কী ধরনের ফাইজলামি?’ হৃদি বলল, ‘হ্যাঁ ফাইজলামি তো বটেই। এখন তোরাই বোঝা এই গাধিকে। আমি আর বিভা বুঝাইতে বুঝাইতে ক্লান্ত।’ 

আকাশের মুখটা তখনো হা হয়ে ছিল। চোখের পলক পড়ছিল না তার। রুদ্র অস্থিরভাবে বলল, ‘সামির বাবা? শিট ম্যান! ক্যামনে কী?’ 

অমৃতা বলল, ‘আমি জানতাম তোরা এরকম রিঅ্যাক্ট করবি। এই জন্যেই শালা তোদের আমি বলতে চাই নাই।’ 

রুদ্র ক্ষিপ্তবৎ কণ্ঠে বলল, ‘তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? সামি জানতে পারলে কী হবে?’ 

অমৃতা একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সামি কি আমাকে বুঝবে না? আমার বিশ্বাস সামি আমাকে বুঝবে।’ 

রুদ্র এই পর্যায়ে অত্যন্ত হতাশ ভাবে তাকালো বাকি দুই বন্ধুর দিকে। হৃদি একটু কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘এবার ঠ্যালা সামলা। গত দুই মাস ধইরা আমরা এসব পাগলামি সহ্য করে আসতেছি।’ 

—‘তুই কি লোকটার সাথে প্রেম করতেছিস?’ রুদ্রর খটোমটো প্ৰশ্ন অমৃতা আঁতকে উঠল, ‘আরে না! উনি তো… মানে… উনি প্রেম করা টাইপ মানুষ না।’ 

—‘কিন্তু আমি তো ভাবছিলাম তুই লোকটাকে ঘেন্না করিস। হঠাৎ করে এত প্রেম আসলো ক্যামনে?’ 

অমৃতা মৃদুস্বরে বলল, ‘ঘেন্না করতাম এ কথা ঠিক। লোকটার এত অহংকার, খ্যাতি, সুনাম, এর কোনোটাই আমার সহ্য হতো না। কিন্তু ফোনে কথা বলতে দারুণ লাগত। কথা বলতে গিয়েই একদিন আবিষ্কার করলাম যে আমার জীবনে এই একজন মাত্র পুরুষমানুষ, যার কণ্ঠস্বর শুনলে আমার বুক কাঁপে। যাকে দেখলে আমার দেবতার চাইতেও বেশি সুন্দর বলে মনে হয়। যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে…’ 

অমৃতা কথাটা শেষ করতে পারল না। আকাশ হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তার মুখে গনগনে আগুনের আঁচ। চোখে ধকধক করছে তেজ। সে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের গায়ে পা দিয়ে বেশ জোরে একটা লাথি মারল। চেয়ারটাই যেন দোষী। তাই চেয়ারে লাথি মেরে উগরে দিতে চাইছে সমস্ত রাগ। তারপর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে প্রস্থানোদ্যত হলো। অমৃতা পেছন থেকে বলে উঠল ‘আকাশ! কই যাস?’ 

আকাশ হাঁটা না থামিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অমৃতার দিকে জ্বলন্ত চোখে। ডান হাতের মধ্যাঙুলি প্রদর্শন করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ফাক ইউ!’ 

রুদ্রও বসল না আর। হাতে ধরা গিটারটা চেয়ারের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। অমৃতার সারা মুখে একটা চাপা কষ্ট থমথম করছে। হৃৎপিণ্ডে ক্রমাগত বিঁধছে সহস্র সুচ। বন্ধুদের সে বড় বেশি ভালোবাসে, বড় বেশি বিশ্বাস করে। তাই তো নিজের জীবনের সবচাইতে অপ্রিয় সত্যটি সে সারা দুনিয়ার কাছ থেকে লুকোতে পারলেও বন্ধুদের কাছ থেকে লুকাতে পারেনি কিছুতেই, লুকোনোর চেষ্টাও করেনি। অথচ সেই বন্ধুরাই তাকে একটা বার বোঝার চেষ্টা করল না। এ পৃথিবীতে কেউ তাকে বোঝে না। এমনকি সেই মানুষটা, যে মানুষটাকে ভালোবেসে সে অষ্টপ্রহর খর দাবানলে দগ্ধ হচ্ছে মনে মনে, বন্ধুদের বিদ্রুপের কারণ হচ্ছে, সেই মানুষটাও তাকে বুঝল না। সে মানুষ তার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে! এই দূরত্ব হাজার চেষ্টা করেও ঘুচানো যাচ্ছে না, যাবে না! 

অমৃতা হেঁটে হেঁটে রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল। আকাশে পুঞ্জীভূত অন্ধকার। সম্মুখে পাহাড় শৃঙ্গ। দিগন্ত ঢেকে আছে ধোঁয়াটে মেঘে। অমৃতার চোখজোড়া বহুদূরে নিবদ্ধ। সে কিছু দেখছে না। তবুও তাকিয়ে আছে। এ পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ কিছু দেখতে না পেলেও তাকিয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকা নিয়ম বলে। সত্যটা জানার পরেও মিথ্যে বলে, সত্য লুকোনো নিয়ম বলে। ভালো না বাসলেও ঘর করে, ঘর করা নিয়ম বলে। কেউ নিয়ম ভাঙলে ধিক্কার দিতে আসে, ধিক্কার দেওয়া নিয়ম বলে। আহা! বড়ই নিয়মসর্বস্ব মানুষের জীবন! 

হৃদি ওর পাশে এসে দাঁড়ালো, আলতোভাবে বলল, ‘আপসেট হইস না। এখনো ভুল শোধরানোর সময় আছে। তুই ভুলতে চাইলেই ভুলতে পারবি, সবকিছু। আর বাচ্চামো করিস না।’ 

অমৃতা হৃদির চোখের উপর স্থির দৃষ্টি রাখল, অদ্ভুত শীতল গলায় বলল, ‘আমি ভুলতে পারব কি পারব না সেটা শুধু আমিই বুঝি হৃদি! ভেবেছিলাম তোরাও বুঝবি। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। আসলে আমার জীবনে ভুলের মাত্রা সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি। ভুল মানুষদের বন্ধু ভেবেছি। 

কথাটা বলে অমৃতা ঘুরে দাঁড়ালো। টেরেস থেকে বেরোবার সময় সামির মুখোমুখি পড়ল সে। সামি ওকে দেখতেই প্রশ্ন করল, ‘কোথায় যাচ্ছিস? 

অমৃতার চোখে তখন চিকচিক করছে কাচের মতো স্বচ্ছ কয়েক বিন্দু জল। সে ঝাপসা চোখে সামির মুখের দিকে চাইল। সামি অবাক গলায় বলল, ‘কী হইছে তোর?’ 

অমৃতা কিছু একটা বলবার জন্য মুখ খুলল। কয়েকটা সেকেন্ড ঠোঁট ফাঁকা করে শুধু বাতাস গিলল সে। বলতে পারল না কিছুই। কেউ যেন তার জিব টেনে ধরেছে। সামি আবার প্রশ্ন করল, ‘কীরে? সব ঠিক আছে তো?’ 

অমৃতা মুখ নামাল নিচে। অস্ফুটে বলল ‘সব ঠিক আছে।’ তারপর আকস্মিক… খুব আকস্মিকভাবে দুহাত বাড়িয়ে সামিকে জড়িয়ে ধরল। দমবন্ধ গলায় বলল, ‘সামি, আই লাভ ইউ দোস্ত! তুই এটা জানিস তো, তাই না?’ 

সামি একটু থমকে গেলো। নিজের বুকের ওপর হঠাৎ আছড়ে পড়া অমৃতার অবনত মুখখানার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ধীরেধীরে সে একটা হাত রাখল অমৃতার সুন্দর ছাটের বয়কাট চুলের ওপর। নরম গলায় বলল, ‘আই লাভ ইউ মোর!’ 

কথাটা বলা শেষ করে সামি অমৃতার চিবুক ধরে ওর মুখটা ওপরে তুলল। সরু দৃষ্টিতে তাকাল ভেজা দুখানা চোখের ওপর। দেখামাত্র তার মনে হলো এই অমৃতাকে যেন সে চেনে না। তার চোখে খেলে গেলো এক তীব্র বিস্ময়।

—‘তোর কী হইছে?’ 

অমৃতা চকিতে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সামলে নিয়ে বলল, ‘কিছু না!’ এরপর আর একটিও কথা না বলে খুব দ্রুত বেরিয়ে গেলো জায়গাটা ছেড়ে। 

অমৃতা চলে যাবার পর সামি ভারি আশ্চর্য গলায় বলল, ‘ওর সমস্যা কী?’ হৃদি পাশ কাটানো উত্তর দিল, ‘বাদ দে। আংকেল আন্টি আসছেন?’

—‘বাবা আসে নাই। মা আসছে খালাদের সাথে।’ 

—‘আংকেল আসবেন না?’ 

—‘কাল সকালে আসবে। কিন্তু অমৃতার কী হইল হঠাৎ?’ 

—‘আরে ধুর। আজাইরা। বাদ দে।’ 

সামি সজোরে মাথা নাড়ল, ‘উঁহু। কিছু একটা নিশ্চয়ই হইছে।’ 

হৃদির বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। কী বলবে সে সামিকে এই কথার প্রত্যুত্তরে? সামি অবশ্য হৃদি কিছু বলার জন্য অপেক্ষা করল না। তার আগেই অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, ‘তুই থাক। আমি আসতেছি।’ 

—‘কই যাস?’ 

সামি কোনো উত্তর দিল না। ও চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভা আর অভিজিৎ এসে পৌঁছুলো টেরেসে। হৃদি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। একা থাকতে তার একটুও ভালো লাগছিল না। 

১৮

নিস্তব্ধ নিশীথ রাত্রি। দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে আছে অন্ধকারের ঘন জাল। বাতাস একটু ক্ষেপেছে সন্ধের পর থেকে। এখন তার ছোঁয়ায় বৃষ্টি বৃষ্টি আভাস। আকাশ হনহনিয়ে হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে রিসোর্টের মূল গেটের সামনে চলে এসেছিল সে। রুদ্র দৌড়ে এসে থামাল ওকে। পেছন থেকে চেপে ধরল একটা হাত। টানতে টানতে জোর জবরদস্তি করে নিয়ে এলো গেটের পাশ ঘেঁষা ঝোপ জঙ্গলের কাছে। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস? শালা বোকাচোদা কোথাকার! বলছিলাম না তোকে? অনেক বেশি লেট হয়ে যাচ্ছে? তুই তো আমার কথা শুনিস নাই। এখন বোঝ ঠ্যালা।’ 

এদিকটায় শাল আর বহেড়ার জঙ্গল। রিসোর্টের কটেজগুলো এমনভাবে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে লুকোনো রয়েছে যে সেইসব কটেজের ভেতর জ্বলতে থাকা বাতির ছিটেফোঁটাও এ পর্যন্ত আসছে না। ঝিঁঝি পোকার তীব্র ঝালা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আকাশ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে আসছে। শরীরটাকে এ মুহূর্তে নিজের বলে মনে হচ্ছে না। 

রুদ্র আবার বলল, ‘এখনই যা। খুলে বল ওকে সবকিছু।’ 

আকাশ অনেক কষ্টে এবার দুটো শব্দ বলতে পারল, ‘মাথা খারাপ!’ রুদ্র রাগে হিসহিস করে ওঠে, ক্ষ্যাপা গলায় বলে, ‘মাথা খারাপের কী আছে?’ 

—‘তুই ও তো বলিস নাই।’ 

—‘শালা! আমি কেন বলব? আমি তো বলছি আমি ওরে এখন আর সেই নজরে দেখি না।’

—‘বললেই সব সত্যি হয় না।’ 

রুদ্র ক্ষিপ্রগতিতে দু পা এগিয়ে এসে আকাশের শার্টের কলার চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে, ‘তুই বেশি জানোস?’ 

আকাশ রুদ্রর দুটো হাত নিজের গলার ওপর থেকে সরিয়ে নিল। হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘আমি জানি।’ 

রুদ্র অস্থিরচিত্তে কয়েকবার পায়চারি করল ভূতগ্রস্থের মতো বহেড়া গাছের ছাউনির নিচে। তারপর আঙুল উঁচিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘লিসেন আকাশ, অমৃতা হয় তোর নইলে আমার। অন্য কারো না।’

—‘রুদ্র, ইউ আর সাউন্ডিং লাইক আ ফাকিং জার্ক। এভাবে হয় না। অমৃতা কাকে পছন্দ করবে সেটা তো আমরা ঠিক করে দিতে পারি না। তাছাড়া ও তো অন্য মেয়েদের মতো না। শি ইজ ডিফারেন্ট।’ 

—‘ডিফারেন্ট তা জানতাম। তাই বলে এতটা ডিফারেন্ট? ফ্রেন্ডের বাবা? কাম অন ম্যান! লোকটা ওর চেয়ে বয়সে কত বড় একবার চিন্তা করে দেখছিস?’ 

—‘আমি সামির কথা ভাবতেছি। আমার তো এখন মনে হচ্ছে আমরা সবাই সামির সাথে চিট করতেছি।’ 

—‘সামিকে এসব ফালতু বিষয় কোনোভাবেই জানানো যাবে না। অমৃতাকে যে কোনো উপায়ে এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’ 

—‘সহজ হবে না ব্যাপারটা ওর জন্য। আমি ওকে চিনি। শতভাগ নিশ্চিত না হলে ও ভালোবাসার কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করত না। দিস ইজ অমৃতা উই আর টকিং অ্যাবাউট। মেয়েটা জীবনে কোনোদিন কারো উপর ক্রাশ পর্যন্ত খায় নাই। সেই মেয়ে যখন বলতেছে সে একজনকে পছন্দ করে, এটার মানে শি ইজ সো ড্যাম সিরিয়াস অ্যাবাউট ইট!’ 

রুদ্র কিছু বলল না। মেঘলা বাতাসে ওর খোলা বাবরি চুলগুলো উড়ছিল। হাত দিয়ে কপাল থেকে চুল সরিয়ে নিয়ে নিবিড়ভাবে চোখ পিটপিট করে কিছু একটা ভাবলো সে। অসহায় গলায় বলল, 

‘কী করব কিছুই বুঝতেছি না!’ 

আকাশ একটা বিষণ্ণ শ্বাস ফেলল। স্থিরতার সাথে বলল, ‘লিসেন, যেটাই হোক না কেন সে আমাদের বন্ধু। অমৃতা সবসময় আমাদের সবার বিপদে আগায় আসে। সাহস দেয়। আজকে ওর জীবনের এরকম একটা সময়ে আমরা ওকে একলা ছাইড়া দিতে পারি না। আমাদের ওর সাথে থাকতে হবে।’ 

—‘আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকতেছে না, ওই বদরাগী, অহংকারী লোকটাকে ও কীভাবে পছন্দ করল? 

আকাশ একটু শ্লেষের হাসি হাসল, ‘অমৃতার দ্বারাই এসব সম্ভব! তবে লোকটা দেখতে শুনতে ভালো, প্রতিষ্ঠিত, ধনী এবং শিক্ষিত, ওরে যে কেউ পছন্দ করবে।’ 

—‘ফালতু কথা বলিস না। যে কেউ করতে পারে কিন্তু সেই যে কেউটা কোনোভাবেই নিজের ছেলের বয়সী কোনো মেয়ে হতে পারে না।’ 

—‘ম্যান! আই ফিল ব্যাড ফর সামি! আমার কিছু ভালো লাগতেছে না।’ আকাশ একটা কাটা বহেড়া গাছের গুঁড়ির ওপর বসল। কাকতালীয়ভাবে ওরা দুজনেই তখন ভাবছিল অমৃতার সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনটির কথা। রুদ্রর প্রথম দেখা পরীক্ষার হলে। আর আকাশের কলেজ গেটের সামনে। তখন বয়স কত হবে? ষোলো কি সতেরো? বয়কাট চুলের আজগুবি মেয়েটাকে দেখলে তখন বুক দুরুদুরু করত। সে আশপাশ দিয়ে হাঁটলে হাওয়া ভরে যেত মিষ্টি ঘ্রাণে। কতবার মনের কথা বলতে যেয়ে থেমে যেতে হয়েছে বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে। হ্যাঁ প্রেমের চাইতে হয়তো বন্ধুত্বটাই ওদের কাছে বরাবর বেশি দামি ছিল। বছর চারেক আগের এক গভীর রাতের আড্ডায় সামি যখন হঠাৎ প্রশ্ন করেছিল, ‘আচ্ছা আমাদের মেয়েদের মধ্যে তোদের কাকে পছন্দ? ধর তোদের যদি চ্যুজ করতে বলা হয় তাহলে কাকে চ্যুজ করবি? আমার বিভাকে পছন্দ। তোরা? ‘ বলাই বাহুল্য দলের মেয়েরা সেদিন সেই আড্ডায় অনুপস্থিত ছিল। 

সামির প্রশ্নের উত্তরে রুদ্র আর আকাশ একত্রে বলে উঠল, ‘অমৃতা।’ 

দুজনেই চমকে তাকালো একে অপরের দিকে। চমকটা কাটতে কিছু সময় লাগল। রুদ্র অবাক গলায় বলল, ‘কখনো কিছু বলিস নাই কেন?’ 

—‘বলার মতো তেমন কিছু না। মানে .. আসলে বলে কী লাভ?’

—‘কী লাভ মানে? গাধা নাকি?’ 

আকাশ মিনমিন করে বলল, ‘না বলাই ভালো। বললে ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট হইতে পারে।’ 

—‘মামা যা করার তাড়াতাড়ি কর। নইলে অমৃতা আমার।’ হালকা রসিকতার সুর বেজে উঠল রুদ্রর গলায়। 

—‘তোরে দিয়া দিলাম। আমার চাই না।’ 

—‘ঢং করিস না।’ 

—‘ঢং এর কী আছে? আমি তো জানি তুই ওরে পছন্দ করিস।’ 

মনীষা রুদ্রর জীবনে আসার পর আকাশ একবার বলেছিল, ‘তুই তাহলে অমৃতাকে আর ভালোবাসিস না?’ 

—‘ভালোবাসব না কেন?’ 

—‘না মানে, রোমান্টিক পাস্পেকটিভ থেকে। 

—‘ও আচ্ছা, না না, ওইসব আমি ভুলে গেছি।’ 

বলেছিল ঠিকই রুদ্র, কিন্তু কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি আকাশ। 

একটা সময় পুরোনো দিনের জার্নাল বন্ধ করে রুদ্র হঠাৎ বলল, ‘অমৃতার কাছে কি প্রেমটাই সব? বন্ধুত্ব কিছুই না? ও কি বুঝতে পারছে না সামি ব্যাপারটা জানতে পারলে ওদের ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট হয়ে যাবে?’ 

আকাশ আচ্ছন্ন গলায় বলল, ‘আমিও এটাই ভাবছি জানিস? ভাবতে গিয়ে একটা জিনিস বুঝতে পারলাম যে, অমৃতা কখনওই কিছু চেপে রাখতে শেখেনি। বন্ধু হারানোর ভয়ে সে সত্য গোপন করবে, এটা কোনভাবেই সম্ভব না। সো ইভেনচুয়েলি সামি উইল গেট টু নো এভরিথিং। অ্যান্ড ইট উইল বি আ ডিজাস্টার!’ 

১৯

দরজায় ধাক্কা পড়ছিল অনবরত। অমৃতা দরজা খুলে দেখল সামি দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের তারায় হরেক প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি। অমৃতা দরজার সম্মুখ ভাগ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আয়!’ 

একটা হলুদ নরম আলোর বাল্ব জ্বলছিল। ঘরের দু কোণে দুটি সিঙ্গেল খাট বসানো। একটি খাটের ওপর সামি বিনা বাক্য ব্যয়েই বসে পড়ল। 

অমৃতার মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা খুঁজল যেন, তারপর বলল, ‘তোর মন খারাপ?’ 

অমৃতা উল্টোদিকের খাটের ওপর বসল। মেঝেতে বিছানো লাল কার্পেটের ওপর চোখ নিবদ্ধ করে বলল, ‘একটু টেনশন হচ্ছিল। এখন ঠিক আছি।’ 

—‘কীসের টেনশন?’ 

অমৃতার বিষণ্ণ মনটা এবার ভয়ংকর রকমের খারাপ হয়ে গেলো। তীব্র এক অপরাধবোধ হাতুড়ির মতো ঠকঠক শব্দ তুলে আঘাত হানতে লাগল মনের দেয়ালে। কষ্টে মুচড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। মিথ্যে কথা বলা তার অভ্যাসে নেই। পেশাগত প্রয়োজনে নিতান্তই বিপাকে পড়ে টুকটাক মিথ্যা তাকে বলতে হয় বৈকি, কিন্তু বন্ধুদের সাথে আজ অবধি সে কোনো মিথ্যা কথা বলেনি। 

সে চোখ কার্পেটের ওপর নিবদ্ধ রেখেই অনেক কষ্টে বলল, ‘তেমন কিছু না।’ 

—‘তুই কিছু লুকাচ্ছিস আমার কাছ থেকে?’ 

—‘তোদের নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল।’ 

সামির মুখে একটা বিভ্রান্তি খেলে গেলো ক্ষণিকের জন্য। 

—‘আমাদের নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল?’ 

—‘হ্যাঁ। তুই কী ভাবলি? প্ল্যান কী?’ 

—‘কীসের প্ল্যান?’ 

—‘চুপচাপ বসে থাকবি হাত গুটায়? বিয়া করতে হবে না?’ 

—‘তুই কানতেছিলি কেন তখন?’ 

অমৃতা হাসার চেষ্টা করল, ‘আরে ধুর, আমি কখনো কাঁদি নাকি?’ 

—‘হঠাৎ করে এত ইমোশনাল হয়ে গেলি?’ 

—‘আমার ফ্রেন্ডের সাথে আমি ইমোশনাল হইতে পারি না? এটা অপরাধ?’

সামি বিরক্ত গলায় বলল, ‘অপরাধ হবে কেন? কিন্তু তুই তো কখনো এসব বলিসটলিস না। হঠাৎ কী হইল?’ 

—‘আমার কিছু হয় নায়। শোন, তুই আর দেরি করিস না। হৃদির বাসা থেকে কিন্তু বেশি দিন ওয়েইট করবে না। জানিস তো ওর বাবা মা একটু ব্যাক ডেটেড। বিয়ে দেওয়ার জন্যে পাগল হয়ে গেছে।’ 

এবার সামিকে একটু চিন্তিত দেখালো। নিচের ঠোঁটে কয়েকবার দাঁত দিয়ে চিমটি কাটলো সে আনমনে। বলল, ‘আমার মা তো রাজিই হইতেছে না। কী করব বল তো?’ 

—‘আন্টিরে বোঝা। তুই একমাত্র ছেলে। আন্টি রাজি না হয়ে যাবে কই? আরেকটা বিষয় দোস্ত। তুই তোদের অফিসে জয়েন করিস না কেন?’ 

—‘অফিসে জয়েন করব কেন?’ 

—‘তোর এবার হাল ধরা উচিত।’ 

শুনে সামি একটু বাঁকা হাসল, ‘ধুর, হাল ধরার সময় এখনো আসে নাই। আমার বাপ এখনো যথেষ্ট ফিট। বাবাই সব সামলাইতেছে। যখন পারবে না, বুড়া হয়ে যাবে, তখন দেখা যাবে।’ 

—‘এটা কোনো কথা না। তোর বাবা কতদিক সামলাবেন? আমার মনে হয় এখন থেকেই তোর বিজনেসটা বুঝে নেয়া উচিত। কাজ শিখতেও তো সময় লাগবে! আর বাসায় বসে বসে করিস কী তুই? এমনে বসে থাকলে তো এমনিই মাথা খারাপ হয়ে যাবে।’ 

—‘দেখি।’ 

—‘দেখিটেখি না। তোর বাবার সাথে কথা বল এ ব্যাপারে। তিনি খুশি হবেন।’ 

সামি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দেখা যাক।’ 

—‘না দেখা যাক না। এবার ঢাকায় ফিরে গিয়েই তুই তোদের অফিসে জয়েন করবি।’ 

সামি বিরক্তি নিয়ে বলল,’মুরুব্বি টাইপ কথা বলিস নাতো। বাল, তুই আমার বন্ধু নাকি গার্ডিয়ান?’ 

অমৃতা হাসে, বলে, ‘গার্ডিয়ান যদি বন্ধু হতে পারে তাহলে বন্ধু কেন গার্ডিয়ান হতে পারবে না? পারহ্যান্স আই এম ইওর গার্ডিয়ান এঞ্জেল!’ 

—‘বাইরে আয়। মন খারাপ করে বসে থাকিস না।’ 

—‘তুই যা। আমি আসতেছি। জরুরি কল করতে হবে একটা।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *