১০০
কান থেকে ফোন নামিয়ে রেখে হৃদি দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা খুলল। শাশুড়ির থমথমে গম্ভীর মুখখানা দেখে একটু ভয় খেলো নিজের অজান্তেই। উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’
—‘আমার বাচ্চাটা কোথায়?’
মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে সামি দরজার কাছে এগিয়ে এসেছে তখন। হাতমুখ ধুয়ে মাত্র বাথরুম থেকে বেরিয়েছে সে। পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে ছাই রঙের একটা পাতলা গেঞ্জি। এই অসময়ে মায়ের উপস্থিতি কিঞ্চিৎ চমকে দিল তাকে, ‘কিছু বলবে মা?’
রোমেলা ছেলের ঘরে নিঃশব্দে প্রবেশ করলেন। ঘরটা বেশ অন্ধকার হয়ে আছে। দরজা, জানালা বন্ধ বলে সূর্যের আলো ঢোকেনি এখনও ভেতরে। রোমেলা ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় আদেশ দিলেন, ‘বাতি জ্বালাও।’
সামি বাধ্য ছেলের মতো বাতি জ্বালালো। টিউবলাইটের সাদা আলোয় মায়ের মুখটা একবার ভালোমতো দেখে নিল সে। চোখ পড়ল মায়ের হাতে ধরে থাকা টুকরো কাগজটার দিকে। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী ওটা?’
হৃদি একটা চেয়ার এগিয়ে দিল শাশুড়ির দিকে, ‘বসুন। বসে কথা বলুন।’ বলল সে সসম্মানে।
রোমেলা বসলেন চেয়ারটায়। পায়ের ওপর পা তুলে। ছেলের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘জরুরি কথা বলতে এসেছি।’ সামির কপালে একটা ভাঁজ পড়ে গেছে এর মধ্যেই। চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ। সে মায়ের মুখোমুখি বসল, মোড়া পেতে। বলল, ‘হ্যাঁ বলো। কী জরুরি কথা?’
হৃদি বিছানার ওপর দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা কাঁথাটা ভাঁজ করছিল যত্ন সহকারে। তার মন উৎকর্ণ। সাত সকালে শাশুড়ির কী এমন জরুরি দরকার পড়ে গেলো তা জানবার জন্য কৌতূহলে ভেতরটা একদম আইটাই করছে।
রোমেলা দুএকবার কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর খুব ধীরস্থিরভাবে বললেন, ‘তোমার বাবার ব্যাপারে জানতে পেরেছি। মেয়েটিকে তুমি চেনো।’
সামি প্রথমটায় যেন কিছুই বুঝল না। বিস্মিতভাবে বলল, ‘মানে?’
রোমেলা নড়েচড়ে বসলেন। টেনে টেনে বললেন, ‘তোমার বাবার যে একজনের সাথে সম্পর্ক আছে বলেছিলাম, ভুলে গেছ?’
সামির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। এক মুহূর্তের জন্য ভারি বিচলিত দেখাল তাকে। মায়ের দিকে শূন্য চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে বলল, ‘তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’
রোমেলা ছেলের নির্বুদ্ধিতায় বিরক্ত হলেন। মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক চ’কারান্ত শব্দ করে উঠে বললেন— ‘অবশেষে তোমার বাবার প্রেমিকা সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছি! এখন বুঝেছ?’
একটা দশ মণ ওজনের ভারি পাথর বুঝি দূরের ঢালু রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এসে ঠিক সামির বুক বরাবর আটকে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো মায়ের দিকে চেয়ে থাকল সে। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোলো না।
—‘নাম জানলে অবাক হবে। যাদেরকে তুমি এতকাল বন্ধু ভেবে এসেছ। আপন মনে করেছ। তারাই তলে তলে তোমার সর্বনাশ করে দিয়েছে।’ কথাটা বলে তিনি হৃদির দিকে একবার প্রখর চোখে তাকালেন। সেই দৃষ্টি দেখে বুক কেঁপে উঠল হৃদির। হাত পা অসাড় হয়ে এলো এক উৎকলিত উত্তেজনায়।
সামি একটু কড়াভাবে বলল, ‘যা বলবা সরাসরি বলো। এত প্যাঁচ করতেছ কেন?’
রোমেলা এ কথা শুনে তীক্ষ্ণ হাসলেন। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘ওই যে তোমার একটা বেয়াদব ফ্রেন্ড আছে না? সারাক্ষণ বড়দের মুখে মুখে কথা বলে, ছেলেদের মতো পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়, নিজেকে মহাপণ্ডিত মনে করে! সেই বেয়াদব মেয়েটাই তোমার বাবার মাথাটা খেয়েছে।’
সামির চোখজোড়া চকিতে স্ফীত হয়ে উঠল এক প্রবল বিস্ময়ে, মুখ হয়ে গেলো হা। কয়েকটা সেকেন্ড থ মেরে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেলো সেই মুহূর্তে। তারপর হঠাৎ করেই উৎকট শব্দে ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে। হাসতে হাসতে বলল, ‘তোমার মাথাটা একেবারে গেছে মা। আমার বাবার সাথে আমার বন্ধু? সিরিয়াসলি? এটা কখনো সম্ভব? তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?’
রোমেলা এবার উঠে এসে ছেলের সামনে দাঁড়ালেন। একটু ঝুঁকে হাতে ধরা চিরকুটটা ছেলের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘আমি জানতাম তুমি আমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। এ কারণেই প্রমাণ সাথে করে নিয়ে এসেছি। নাও, এটা পড়।’
সামি আশ্চর্য চোখে তাকালো কাগজটার দিকে। তুলে নিল হাতে। চোখের সামনে মেলে ধরে পড়া শুরু করল। কালো কালি দিয়ে লেখা গোটা গোটা অক্ষরগুলো পড়তে গিয়ে তার হৃৎপিণ্ড থমকে গেলো। ভ্রু দুটো সূচালো হয়ে উঠল ত্রিভুজের মতো। প্রগাঢ় হলো কপালের ভাঁজ। এই হাতের লেখাটা তার অনেক চেনা!
হৃদি কাজ ফেলে রেখে সামির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তখন। বিস্ফারিত চোখে পড়ছে চিরকুটের লেখাগুলো।
—‘এটার মানে কী?’ বিভ্রান্তি, বিস্ময় এবং উত্তেজনায় একাকার হয়ে প্রশ্ন করল সামি।
—‘এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা?’
সামি রুদ্ধশ্বাসে আরেকবার তাকালো হাতে ধরা চিরকুটটার দিকে। গুচ্ছের বিহ্বলতা নিয়ে বলল, ‘কোথাও নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে। এটা সম্ভব না।’
হৃদির চোখ ফেটে জলের ফোয়ারা নেমেছে। ভয়ে আর আতংকে মনে হচ্ছে বুঝি এখুনি ফিট হয়ে যাবে।
রোমেলা কাটা কাটা গলায় বললেন, ‘অসম্ভব ব্যাপারটাই সম্ভব করে দেখিয়েছে তোমার বান্ধবী। বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড থেকে শুরু করে ড্রাইভার পর্যন্ত সকলে জানে। সুলেমানও জানত। জানো না শুধু তুমি। চিন্তা করে দেখো কীভাবে বোকা বানিয়েছে তোমাকে তোমার প্রাণ প্রিয় বন্ধুরা!’
দিশাহারা সামি হাতে ধরা কাগজটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্বিতীয়বার পড়ল। তার মনে হচ্ছিল সে একটা ভয়ংকর বাজে দুঃস্বপ্ন দেখছে। এখুনি ঘুম ভেঙে যাবে এবং ঘুম থেকে উঠে পড়লেই দেখবে সব ঠিক।
‘রাশেদ! আপনাকে ভালোবাসি নিঃশ্বাসের মতো। নিশ্বাস নিতে যেদিন ভুলে যাব সেদিন আশা করি আপনাকেও ভুলতে পারব। আমি কাউকে ভয় পাই না। আপনার স্ত্রী যদি কিছু জানতে পারে তাহলে বলবেন সব দোষ অমৃতা নামের বাজে মেয়েটার। এরপর যে শাস্তিই আপনারা আমাকে দেবেন। আমি মাথা পেতে নেব।’
সামির চারপাশটা ক্রমেই কেমন ঘোলা হয়ে আসছিল। কান হয়ে আসছিল বধির। বুকের ভেতর ঘটছিল একের পর এক বিস্ফোরণ! কাগজটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো সে। বুনো ষাঁড়ের মতো দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। হৃদি দৌড়ে ছুটে আসলো, পেছন থেকে ওর একটা হাত ধরে ফেলে আতভাবে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
সামি ঘুরে তাকালো। চমকে উঠল হৃদি ওর ওই আগুন দৃষ্টি দেখে।
—‘তুই কি কাহিনি কিছু জানিস?’
হৃদির চোখ ভেসে যাচ্ছে নোনাজলে। থরথরিয়ে কাঁপছে ঠোঁট। কথা আটকে যাচ্ছে গলায়। সামি তার বহু বছরের পুরানো বন্ধু এবং পাঁচ মাসের নবীনা স্ত্রীর চোখের দিকে কিছু সময় নির্বাক চেয়ে রইল। তারপর আর উত্তরের আশা না করে এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গটগটিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। কান্নারত অস্থির হৃদি বুঝতে পারল, সামি খুব ভালোমতোই বুঝে গেছে, যে হৃদি এমন কিছু জানে, যা সামি জানে না।
বেডরুমের দরজায় রোমেলা এসে দাঁড়ালেন। হৃদি তাঁকে দেখামাত্ৰ মুখ ঝামটা মেরে বলে উঠল, ‘আপনি এটা কী করলেন?’
মেয়েটির স্পর্ধা রোমেলাকে বিস্মিত করল, ‘আমি কী করেছি, কেন করেছি এসব এখন তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে?’
হৃদি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘কেন এরকম করলেন আপনি? কেন বলতে গেলেন সামিকে? এখন কী হবে? হায় আল্লাহ! এখন কী হবে?’
—‘শোনো মেয়ে, ঢং করোনা। বলব না তো কি তোমাদের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করব নিজের ছেলের সাথে? সত্য লুকাব?’
—‘একটা সত্য না জেনেই না হয় ওর জীবনটা কেটে যেত!’
—‘বাহ্! ওই লোকটা যা খুশি তা করে যাবে আর আমি কোনো প্ৰতিবাদ করব না? কেন এই অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করব আমি?’
—‘একটু ধৈর্য ধরতেন। বাবা নিশ্চয়ই ফিরে আসতেন একটা সময়ে।
—‘চুপ করো! এখন তোমার মতো লো স্ট্যান্ডার্ড একটা মেয়ের কাছ থেকে আমার এসব উপদেশ বাণী শুনতে হবে? তুমি তো সবকিছু জানা সত্ত্বেও মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলে।’
—‘আমি চুপ করে ছিলাম শুধু সামির জন্য। আমি ওকে কষ্ট দিতে চাইনি!’
—‘মিথ্যে কথা বোলো না! তুমি চুপ করে ছিলে তোমার বান্ধবীকে বাঁচানোর জন্য। সামি জেনে গেলে তো তোমাকে আর তোমার বান্ধবীকে লাখি মেরে বের করে দেবে ওর জীবন থেকে। এই ভয়েই চুপ করে ছিলে।’
হৃদি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ রোমেলার দিকে। তারপর অস্ফুটে বলল, ‘সামি কোনোদিনই আমাকে ওর জীবন থেকে বের করে দেবে না।’
রোমেলা হুংকার ছাড়লেন, ‘আলবৎ দেবে! যখন জানতে পারবে তুমি সব জেনেশুনেও চুপ করে বসে ছিলে তখন ঘাড়টা ধাক্কা দিয়ে এই বাড়ি থেকে বিদায় করবে তোমাকে!’ হৃদি আর কিছু বলতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলো শোবার ঘরে।
১০১
রিসিপশনিস্ট আটকে দিল অমৃতাকে।
—‘এক্সকিউজমি ম্যাডাম, আপনি কার কাছে এসেছেন?’
শংকিত এবং অস্থির অমৃতা থমকে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিসিপশনে বসে থাকা ভারি প্রসাধন মাখা মেয়েটির দিকে। চিনতে পারল। মনে পড়ল সেই প্রথম দিনের অভদ্র আচরণের কথা। এ মুহূর্তে অমৃতার বেশি কথা বলার সময় নেই। সে খুব ছোট করে বলল, ‘আপনাদের স্যার আছেন অফিসে?’
—‘কোন স্যার?’ মেয়েটিও চিনেছে অমৃতাকে। তার চোখে মুখে সেদিনের উদ্ধত ভাবটা ফিরে এসেছে। গলার স্বর রুক্ষ।
—‘রাশেদুল হক।’
—‘ও। স্যার তো কনফারেন্স রুমে আছেন। এখন দেখা করা যাবে না।’ অমৃতা অস্থিরভাবে বলল, ‘প্লিজ উনাকে একটা ফোন করে বলুন যে অমৃতা এসেছে। খুব জরুরি দরকার।’
মেয়েটা এমনভাবে হাসল, যেন এমন হাস্যকর কথা জীবনে সে কখনো শোনেনি।
—‘স্যরি ম্যাডাম। স্যারকে তো এখন ডিস্টার্ব করা যাবে না। আপনাকে ওয়েইট করতে হবে।’
অসহনীয় রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল অমৃতার। দাঁতে দাঁতে চেপে বলল, ‘আপনি ফোন করুন। আমার এ মুহূর্তেই উনার সাথে মিট করা দরকার।’
মেয়েটা দুদিকে সজোরে মাথা নাড়ল, ‘এখন ফোন করা যাবে না। ইউ হ্যাভ টু ওয়েইট। আপনার তো কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্টও ছিল না। স্যার তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা করেন না। অবশ্য আত্মীয়স্বজন হলে অন্য কথা। আপনি কি স্যারের আত্মীয়?’
অমৃতা মেয়েটির দিকে একটা অত্যধিক ধারালো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। খুব দ্রুত অতিক্রম করল রিসিপশনের জায়গাটা। পেছন থেকে মেয়েটা সমানে চিৎকার করে যেতে লাগল, ‘আরে আজব, আপনি পারমিশন ছাড়া ভেতরে যেতে পারেন না। অফিসের একটা রুল আছে তো!’
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই দুজন সিকিউরিটি গার্ড ছুটে আসলো অমৃতার পেছন পেছন। অমৃতা তখন লিফটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সিকিউরিটি গার্ড দুজন ক্ষিপ্রগতিতে দৌড়ে এসে ওর পথ আটকে দাঁড়ালো। গার্ডদের পেছনে রিসিপশনের মেয়েটাও এসে দাঁড়িয়েছে। মোচওয়ালা যা চেহারার একজন গার্ড বলে উঠল, ‘আপনি এখন ওপরে যেতে পারবেন না। অপেক্ষা করেন।’
রিসিপশনিস্ট বলল, ‘কী কাজে এসেছেন সেটা বলেন। আমি দেখছি কী করা যায়।’
প্রেতাত্মার মতো ফোঁসফোঁস নিশ্বাস পড়ছিল অমৃতার। রাগ, অপমান, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা এই সমস্ত অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে পিষে ফেলছে একেবারে ভেতরটা। কী করবে সে এখন? সামি কি এতক্ষণে জেনে গেছে ঘটনা? তার পাঠানো ইমেইলটা কি পেয়েছে? কী করছে ও? কী ভাবছে? সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। গলায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে একটা কান্নার দলা। উপোসি শরীর বড়ই দুর্বল। হাতে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে। কী বলবে সে এদেরকে? কী করে বোঝাবে যে লোকটার সাথে একটাবার দেখা করা এ মুহূর্তে তার জন্য কতটা জরুরি!
হঠাৎ পাগলের মতো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল সে, ‘পথ ছাড়ুন! সরে দাঁড়ান সামনে থেকে! আমার এখুনি ওপরে যেতে হবে। রাইট নাও!’
চিৎকার শুনে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রিসিপশনিস্ট। সিকিউরিটি গার্ড দুজনকেও কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত দেখাল।
—‘সরে দাঁড়ান। আপনাদের স্যার জানতে পারলে কিন্তু আপনাদের একজনেরও চাকরি থাকবে না!’
একটু বিভ্রান্তি খেলে গেলো মানুষ তিনজনের মুখে। পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল তারা। অমৃতা এই সুযোগে লিফটের বাটন প্রেস করে দিল। তার ভেতরে এখন স্বভাবসুলভ একরোখা এবং জেদি ভাবটা ফেরত এসেছে। মুখে থমথমে কঠোরতা। চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে তেজ। গার্ড দুজন হতভম্বভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লিফ্ট সমতলে এসে দাঁড়ালো। অমৃতা কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকে গেলো বাক্সটায়। কনফারেন্স রুম কোথায় সে জানে না। লিফটম্যানকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে হলো। লিফ্ট থেকে নেমে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে এলো কনফারেন্স রুমে। তারপর একমুহূর্তও দেরি না করে কনফারেন্স রুমের দরজাটা সটান খুলে ফেলল। বিশাল বড় ঘরটার মাঝামাঝি অবস্থানে একটি লম্বা টেবিল দখল করে দশবারোজন মানুষ বসে আছে। অন্ধকারে জ্বলছে দেয়ালজোড়া প্রজেক্টর। অমৃতা দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরসুদ্ধ লোক তার দিকে ঘুরে তাকালো। পিনপতন নীরবতা। অন্ধকারে কারো মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। অমৃতার মাথা শূন্য। কানে যেন তালা পড়ে গেছে। একটা চিঁচিঁ শব্দ ব্যতীত অন্য কিছু শুনতে পাচ্ছে না সে এই মুহূর্তে। দুশ্চিন্তায় বমি বমি ভাব হচ্ছে।
হঠাৎ একটা চেনা কণ্ঠ কানে এসে লাগল, ‘তুমি এখানে?’
অনেকক্ষণ ধরে উত্তেজনার বশে আটকে রাখা নিশ্বাসটা এবার এক বিন্দু স্বস্তি হয়ে বেরিয়ে আসলো শ্বাসনালি দিয়ে। মানুষটা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, গলায় ঝোলানো কালো টাই। চোখ জোড়া বিস্ময়। কপালে ভাঁজ! দরজার বাইরে হেঁটে আসলেন তিনি
—‘উই নিড টু টক!’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল অমৃতা।
—‘সব ঠিক আছে তো?’
—‘একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।’
কিছু সময় তীক্ষ্ণ চোখে অমৃতার মুখপানে চেয়ে থেকে কী যেন একটা পড়ার চেষ্টা করলেন রাশেদ। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, ‘একটু দাঁড়াও। আসছি।’
অমৃতা দরজার বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাশেদ ফিরে আসলেন।
—‘এসো আমার সাথে।’ কথাটা বলে অমৃতাকে পেছনে ফেলেই তিনি হাঁটা শুরু করলেন। অমৃতা তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে পা বাড়াল। লম্বা করিডোর পেরিয়ে, লিফট চেপে, ওপরতলায় রাশেদের নিজস্ব কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছুতে প্রায় মিনিট পাঁচেক সময় লেগে গেলো। ভেতরে ঢুকে তিনি দরজা আটকে দিলেন। এই ঘরে সচরাচর কেউ অনুমতি ব্যতীত ঢোকে না বলে দরজা লক করার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
—‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’ দরজার সামনে দাঁড়িয়েই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন তিনি।
অমৃতা মুখ তুলে তাকালো। কাচের জানালায় পর্দা টানানো নেই বলে, দিনের আলোর জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে সারা ঘর। এয়ারকন্ডিশনের হিম শীতল বাতাসে চারপাশ ভারি হয়ে আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকেও অমৃতার কপাল ঘামছে অনবরত। সে অস্থিরভাবে বলল, ‘এক গ্লাস পানি হবে?’
—‘নিশ্চয়ই।’ বলে রাশেদ ঘরের মাঝ বরাবর অবস্থিত ডিম শেপের কাঠের টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলেন। টেবিলের এক কোণে পানির জগ আর গ্লাস রাখা। জগ থেকে পানি ঢেলে নিলেন ঝকঝকে কাচের গ্লাসে। এই পুরো সময়টায় অমৃতাকে আড়চোখে দেখছিলেন তিনি। হঠাৎ কী হলো মেয়েটার? খুব নার্ভাস দেখাচ্ছে। খারাপ কিছু হয়নি তো?
অমৃতা তখন সোফার ওপর বসে পড়েছে। রাশেদ পানির গ্লাসটা ওর হাতে তুলে দিলেন। ঢকঢক করে গ্লাসের সম্পূর্ণ পানিটা গিলে ফেলল অমৃতা। মনে হচ্ছিল যেন এক সমুদ্র পানি পান করলেও এই মুহূর্তে তার তৃষ্ণা মিটবে না। বুকজোড়া মরু প্রান্তরের খাঁ খাঁ শূন্যতা! রাশেদ ওর সম্মুখেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। চেয়ে ছিলেন পলকহীন গম্ভীর চোখে। পানি খাওয়া শেষ হলে অমৃতার হাত থেকে তিনি গ্লাসটা তুলে নিলেন। নামিয়ে রাখলেন গোলাকার স্বচ্ছ কাচের সেন্টার টেবিলের ওপর, নীল রঙের চীনা মাটির ফুলদানিটার পাশে। কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রেখে অমৃতা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
—‘আপনার ওয়াইফ আমাদের ব্যাপারটা জেনে গেছেন।’
রাশেদের মুখ থেকে রক্ত সরে গেলো। থমকে গেলো হৃৎপিণ্ড।
-–‘কীভাবে?’ কণ্ঠনালি দিয়ে ঠেলেঠুলে শব্দটা বের করলেন তিনি, অনেক কষ্টে!
অমৃতা কাঁপতে কাঁপতে বলল –’আই হ্যাভ নো আইডিয়া। উনার কাছে আমার লেখা চিরকুট আছে। আমি জানি না কোথায় পেয়েছেন। উনাকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম, উনি যেন সামিকে না বলেন ব্যাপারটা। লাভ হয়নি।’
বিস্ময়, শঙ্কা এবং দুশ্চিন্তায় কয়েকটা সেকেন্ড স্তব্ধীভূত হয়ে রইলেন রাশেদ। পেশাগত জীবনে অনেক সংকটাপন্ন মুহূর্ত তিনি পার করে এসেছেন। দৃঢ় মনোবল, সাহস এবং বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি সংকটই নির্বিঘ্নে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। অপরদিকে তাঁর সাংসারিক জীবন ছিল ছিমছাম, নিস্তরঙ্গ এবং ঝুঁকিমুক্ত। সাংসারিক জীবনে এমন ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হলেন এই প্রথম। এমন বিপদ মোকাবেলা করার নিয়মকানুন তাঁর জানা নেই। আজ তাই নিতান্তই আনাড়ি, দুর্বল এবং বুদ্ধিহীন খেলোয়াড়ের মতো ভেতরে ভেতরে একদম সিঁটিয়ে গেলেন। কুঁকড়ে গেলেন! দুঃসহ আতঙ্কে জমে বরফ হয়ে গেলেন। একমাত্র আদরের পুত্রের মুখোমুখি দাঁড়াবার মতো বিন্দু পরিমাণ সাহসও বুঝি তাঁর মাঝে আর অবশিষ্ট রইলো না। অস্থির চিত্তে ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করলেন তিনি। হেঁটে গিয়ে জানালার কাচ তুলে দিলেন। কম্পিত হাতে সিগারেট ধরালেন একটা।
অমৃতা শ্বাস রোধ করে চেয়েছিল মানুষটার দিকে। তার বুকের কলিজা এক নিদারুণ কষ্টে খণ্ড দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে। আজকে তার জীবনের সবচাইতে প্রিয় মানুষটার এহেন দুরবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী। সব দোষ তার। শুধু তার দোষেই আজ মানুষটা তার ছেলের কাছে ছোট হয়ে গেলো। ঠুনকো হয়ে গেলো। নিজের প্রতি একটা সুতীব্র ঘেন্নায় অন্তর বিষিয়ে যাচ্ছে তার। এত বড় অন্যায়ের পর, নিজেকে আর কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারবে না সে। কোনোদিন না!
—‘রাশেদ!’ হঠাৎ আকুলভাবে ডেকে উঠে কয়েক পা এগিয়ে এলো অমৃতা। রাশেদ ফিরে তাকালেন। অমৃতা দুই হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে ভূমিকম্পিত বক্ষ নিয়ে বলল, ‘রাশেদ লিসেন, আমি ভীষণ ভীষণ ভীষণ স্যরি! আমার জন্য আপনাকে আপনার ছেলের কাছে ছোট হতে হচ্ছে। আপনার তো কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার।’ বলতে বলতে অমৃতার গলা কেঁপে যাচ্ছিল। ঝাপসা হয়ে আসছিল দৃষ্টি। একটু থেমে সে আবার বলল, ‘কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সামিকে বুঝিয়ে বলব যে ব্যাপারটা পুরোই একতরফা ছিল। ওই চিরকুটে আমি আমার মনের ভাব ব্যক্ত করেছিলাম। নিজের দোষও স্বীকার করে নিয়েছিলাম। ঠিক এই কথাটিই আমি সামিকে ভালোমতো বুঝিয়ে বলব। ও খুব সহজেই এটা বিশ্বাস করবে যে আমার প্রতি আপনার কোনো দুর্বলতা নেই।’
রাশেদ কিছু বললেন না। শুধু নিশ্চল দুটি চোখের মণি অমৃতার দিকে তাক করে রাখলেন। সকাল বেলার নরম আলোতে ডুবে আছে মেয়েটার মুখ। হলদে রোদে চিকচিক করছে ওর চুল, গলা আর কণ্ঠাস্থির ছোট্ট সুন্দর গাঢ় রঙের তিলটা। চোখে টলমল করছে কয়েকবিন্দু জল। পাতলা সুন্দর ঠোঁট দুটো কাঁপছে থরথর করে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা… ভীষণ আচমকা একটা ভারি আশ্চর্য অনুভূতি তাঁর সমস্ত চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো মুহূর্তের জন্য। মনে হলো এই মুখটা সামনে থাকলে যত বড় তুফানই আসুক না কেন, হাসিমুখে সেই তুফান মোকাবেলা করতে পারবেন তিনি।
—‘কিছু বলছেন না যে?’ অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল অমৃতা।
রাশেদ আধখাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বাইরে। জানালার কাচ দিলেন তুলে। তারপর দু পা এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন অমৃতার মুখোমুখি। কুয়াশাময় আবছা কান্নার জাল ভেদ করে অমৃতা দেখল মানুষটা তার চোখের ওপর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি রেখেছেন। ওই গভীর দুটি চোখে আজ এক দুর্জ্ঞেয় এবং অব্যক্ত কষ্ট। বুক মোচড় দিয়ে ওঠে অমৃতার। এতক্ষণের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আর শঙ্কা আবছা হয়ে আসে এক বাঁধছেড়া সম্মোহনে। বশীভূতের মতো সামনে এগিয়ে যায় সে। তারপর জুতো পরা পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে দাঁড়ায়। দু হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে মানুষটাকে। গভীর আলিঙ্গনে… শ্বাসে শ্বাস মিশিয়ে বলে, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সামিকে আমি বুঝিয়ে বলব যে এই সম্পর্ক একতরফা। ও নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
রাশেদ অমৃতার নরম শরীরটা শক্ত করে চেপে ধরলেন নিজের বুকের সাথে। ওর বয়কাট ছাটের চুলগুলোতে নাক ডুবিয়ে কেমন অন্যরকম গলায় বললেন, ‘অমৃতা! তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য এবং আমাকে খুব সুন্দর কিছু অনুভূতি উপহার দেবার জন্য। তুমি না এলে আমি কখনোই জানতাম না যে টাকাপয়সা, ক্ষমতা এবং প্রাচুর্যের বিনিময়ে গোটা দুনিয়া কিনে ফেলা সম্ভব হলেও ভালোবাসা কখনোই কেনা সম্ভব না!’
এরপরের কয়েকটা ক্ষণ দুজন মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল পরস্পরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। কেউ কোনো কথা বলছিল না। শুধু চোখ বন্ধ করে শুনছিল একে অপরের হৃদস্পন্দন। গ্রীষ্ম সকালের চনমনে রোদে ভেসে যাচ্ছিল প্রশস্ত, পরিপাটি, আধুনিক সাজে সজ্জিত অফিস কক্ষটি। ভেসে যাচ্ছিল দুটি মানুষের মন স্নিগ্ধতা, পবিত্রতা আর ভালোবাসায়। কোথাও যেন আর কোনো ভয় নেই, উৎকণ্ঠা নেই, নেই কোনো দুশ্চিন্তা! শুধুই শান্তি! অমেয় শান্তি!
একটা ধুপধাপ পায়ের শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছিল কাছে। ওরা ঠিকমতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাঠের দরজাটা হাট করে খুলে ফেলল কেউ একজন। ঘরের ভেতর যেন হঠাৎ প্রকট শব্দে বজ্রপাত হলো। চমকে উঠে ছিটকে গেলো দুজন দুদিকে। ঝাপসা চোখে সামিকে দেখল অমৃতা খোলা দরজার সামনে।
—‘হোয়াট দ্যা ফাক ইজ গোয়িং অন?’ সামির গমগমে কণ্ঠস্বর মাঘ মাসের শৈত্যপূর্ণ হাওয়ার মতো ভেসে এসে জমিয়ে দিয়ে গেলো অমৃতার হাত পা। বুকের মধ্যে দুপদুপ করে ঢেঁকির পাড় পড়তে লাগল ক্রমাগত। বাকশূন্য, বুদ্ধিশূন্য হয়ে সে শুধু নিষ্পলক চেয়ে রইল সামির দিকে। কিছু বলতে পারল না। রাশেদ ছেলের দিকে তাকালেন একবার। তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন। ওই চোখের দিকে সরাসরি তাকাবার মতো সাহস তার নেই আজ।
সামি বিস্ফোরক চোখে সামনে দাঁড়ানো মানুষদুটোর দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখদুটো রক্তলাল। চুল অবিন্যস্ত। নাকের পাটা ফুলে ঢোল। হিংস্র, ক্ষুধার্থ, শিকারি ব্যাঘ্রের ন্যায় উত্তপ্ত এবং ক্রুদ্ধ তার নিশ্বাস।
রাশেদ ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা হেঁটে জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। অপরাধবোধ এবং গ্লানিতে তার চোখ জ্বালা করছে। বুকে চিলিক দিয়ে উঠছে এক অনির্বচনীয় ব্যথা।
সামি গটগটিয়ে হেঁটে এসে অমৃতার মুখোমুখি দাঁড়ালো। হাতে ধরা কাগজটা ওর চোখের সামনে মেলে ধরে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘এটার মানে কী?’
অমৃতার সর্বাঙ্গ তখন এপিলেপটিক রোগীর মতো থরথর করে কাঁপছিল। চোখের কার্নিশ উপচে গড়িয়ে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা রুপালি জল। সামি নিষ্কম্প, নিথর এবং বিস্ময়াভিভূত চোখে চেয়ে ছিল ওর দিকে। জীবনে এই প্রথম সে অমৃতাকে কাঁদতে দেখল। এই মেয়েটি যেন তার বহুদিনের পুরোনো চিরচেনা বন্ধুটি নয়। এ যেন সম্পূর্ণ অচেনা কেউ!
অমৃতা ঠোঁট চেপে কান্না রোধ করার চেষ্টা করল। ভাঙা গলায় অনেক কষ্টে বলতে পারল, ‘দোস্ত… স্যরি!’
—‘কী বললি?’ অবিশ্বাসের গলায় বলে উঠল সামি। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার চোখের চাউনি এখন অনেকটা অপ্রকৃতস্থের মতো। অবিরত হাঁপাচ্ছে সে। অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে ওঠানামা করছে বুক।
অমৃতা এবার ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘তুই যা শুনেছিস তা সঠিক। কিন্তু এটা ওয়ান সাইডেড।’ এটুকু বলে সে একটা লম্বা দম নিল। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বলল ‘আমি পছন্দ করি উনাকে। কিন্তু উনি আমাকে পছন্দ করেন না। দোষ আমার। উনার কোনো দোষ নাই।’
একটা হিংস্র বুনো আক্রোশে সামির ফর্সা মুখখানা রক্তিম হয়ে উঠল দু চোখ ভেসে গেলো জবজবে ঘেন্নায়।
বরফ শীতল গলায় সে কেটে কেটে বলল, ‘পছন্দ করিস? আমার বাবাকে?’
কথাটা বলে নিজের বাবার দিকে একবার বুদ্ধিভ্রংশ চোখে তাকালো সে। তারপর গগনবিদারি চিৎকারে ফেটে পড়ে বলে উঠল, ‘আমার বাবাকে?’
চিৎকারটা একদম শাণিত তীরের মতো সরাসরি কলিজায় গিয়ে বিঁধলো অমৃতার। ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল গা।
—‘ইউ নো হোয়াট? ইউ আর আ ফাকিং হোর!’ গলা দিয়ে বিষ উগরে দিতে দিতে উচ্চারণ করল সামি কথাগুলো।
—‘সামি! মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ!’ রাশেদের মুখ থেকে নির্দ্বিধায় ছুটে এলো গর্জনটা।
সামি বাবার কথা গ্রাহ্য করল না। অমৃতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ক্ষুরধার কণ্ঠে বলল, ‘বেশ্যা তুই একটা!’
রাশেদ এগিয়ে এসে ছেলের বাহু চেপে ধরলেন। প্রচণ্ড কড়া গলায় বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে?
সামি ভীষণ জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বাবার হাতটা সরিয়ে দিল, ‘সরো! তোমার সাথে কথা বলতে আমার ঘেন্না হচ্ছে!’
এবার তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল অমৃতা, ‘সামি! ইউ ক্যান্ট টক টু ইওর ফাদার লাইক দ্যাট!’ সামি পাগলের মতো চিৎকার করে বলতে লাগল –’চুপ থাক! আমার বাবার সাথে আমি কীভাবে কথা বলব তা তোর কাছ থেকে শিখতে হবে? দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে আমার বাবাকে কেন মনে ধরল তোর? আমার বাবার অনেক টাকা। এইজন্যে? শালি স্লাট কোথাকার!’ রাশেদের গলা এবার সপ্তমে চড়ল, ‘খবরদার! আর একটাও বাজে কথা বলবে না!’
—‘চুপ করো তুমি! আমার মায়ের কথা একটাবারও ভাবলে না? আমার কথা ভাবলে না? হাও কুড ইউ ডু দিস টু মি বাবা? হাও কুড ইউ?’
অমৃতা দু পা এগিয়ে এলো, ‘পাগলের মতো কথা বলছিস কেন? উনি তো তোদের কথাই ভেবেছেন সবসময়। তোর কানে কি যায় না যে আমি বারবার বলতেছি এটা ওয়ান সাইডেড?’ কথাটা বলামাত্র হঠাৎ মনে পড়ল অমৃতার। সামিকে পাঠানো ইমেইলে বলা হয়নি যে ব্যাপারটা একতরফা। দুই জায়গায় দু রকম কথা দেখে সামির মনে কি সন্দেহের উদ্রেক হবার সম্ভাবনা আছে? উফ! ভাবতে পারছে না আর সে। সব কিছু এলোমেলো লাগছে!
রাশেদ ক্ষিপ্তবৎ পুত্রের দিকে অবাক চোখে চেয়ে ছিলেন। তাঁর ভেতর থেকে ভয় এবং সংকোচ উভয়ই কেটে গেছে পুরোপুরিভাবে। এখন শুধু বুকজোড়া এক দগদগে ঘা বিরামহীনভাবে জ্বালাপোড়া করছে। একমাত্র প্রিয় পুত্রের হৃদয় ভাঙার অপরাধে তাঁর ভেতরটা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে নিদারুণ কষ্টে। কিন্তু পুত্রকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? আংশিক সত্য তো জেনেই গেছে, তাহলে পুরোটা জানাতে আর দ্বিধা কোথায়?
—‘ও ভুল বলছে। ব্যাপারটা একতরফা নয়। আমিও…’ এটুকু বলে বড় একটা শ্বাস টেনে নিলেন রাশেদ। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘আমিও ওকে পছন্দ করি। আমি জানি কথাটা শুনতে তোমার খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাই সত্য। আই অ্যাম স্যরি মাই সান! আই অ্যাম রিয়েলি রিয়েলি স্যরি!’
অমৃতা জড়ীভূত বক্ষ নিয়ে তাকালো রাশেদের দিকে। তার ভেতরে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এ মুহূর্তে। লোকটার এই অকপট স্বীকারোক্তি ক্ষণিকের জন্য যেমন একটা ভালোলাগা হয়ে ছুঁয়ে দিয়ে গেছে আলতোভাবে, তেমনি আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে গেছে তীব্র এক গা ছমছমে ভয়ে। ভয়টা সামিকে নিয়েই। দুচোখ ভর্তি গুচ্ছের আতঙ্ক নিয়ে সে সামনে দাঁড়ানো বন্ধুর চোখে চোখ রাখল। মনে হলো যেন এক শক্তিশালী মাতঙ্গ পায়ের তলায় পিষ্ট করে দিচ্ছে সামির হৃৎপিণ্ডখানি। রক্তলাল চোখজোড়া টলমল করছে কাচের মতো স্বচ্ছ জলে। মুখখানা কুঁকড়ে গেছে অসহনীয় যন্ত্রণায়। কয়েকটা মুহূর্ত সে বাবা এবং বন্ধুর দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দু ফোঁটা অশ্রুজল। তারপর আর একটাও কথা না বলে ঘুরে দাঁড়ালো। খুব দুর্বল পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে। তার মাথাটা তখন কোনো রকমে ঝুলে আছে কাঁধের সাথে। মনে হচ্ছে আরেকটু হলেই কাটা মুণ্ডুর মতো খসে পড়বে শরীর থেকে। অমৃতার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল প্রাণের অধিক প্রিয়বন্ধুর এই মর্মান্তিক দশা দেখে।
—‘সামি, দোস্ত! একটু শুনে যা।’ কম্পনযুক্ত গলায় কথাগুলো বলতে বলতে সামির একটা হাত পেছন থেকে খপ করে ধরে ফেলল অমৃতা। সেই হাতের ছোঁয়া লাগা মাত্র দুর্দান্ত এক বিধ্বংসী রাগে সরোষে কেঁপে উঠল সামির সমগ্র সত্তা। অসুরের শক্তি ভর করল যেন তার ওপর। ডান হাতটা শূন্যে তুলে নিমেষে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা চীনা মাটির খালি ফুলদানিটা হাতে তুলে নিল সে। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে অমৃতার মাথায় একটা প্রবল আঘাত করল। মাটির জিনিসটা সশব্দে আছড়ে পড়ল অমৃতার কপাল বরাবর। ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো নিমেষে। একটা আর্তচিৎকার ছিটকে বেরিয়ে আসলো অমৃতার মুখ থেকে। ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। আতঙ্কিত, স্তম্ভিত, আহত অবস্থায় ক্ষতস্থানে একটা হাত রেখে বন্ধুর দিকে বিস্ময়বিদ্ধ চোখে চাইল সে একবার। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না। ক্রমেই চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। আঙ্গুলের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। অসহ্য ব্যথায় লুপ্ত হচ্ছে চেতনা!
রাশেদ রুদ্ধশ্বাসে ছুটে আসলেন। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে কোলে তুলে নিলেন অমৃতাকে। ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। সামি চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা দেখল। নড়ল না, কিছু বললও না। অমৃতার মাথা চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়েছে মেঝেতে। সেই কাঁচা লাল রক্ত দেখে তার হাতে পায়ে কাঁপুনি ধরে গেছে। সে রক্ত সহ্য করতে পারে না। তার হিমোফোবিয়া আছে।
চোখের সামনে প্রিয় মানুষটার মুখ দেখতে পেল অমৃতা এক ঝলক, চোখ বন্ধ করার আগে। তারপর… চারপাশে শুধুই শব্দ, শব্দ আর শব্দ! সেইসব শব্দের আলাদা কোনো অর্থ নেই, বর্ণ নেই, গন্ধ নেই! সমস্ত ইন্দ্রিয়জুড়ে তখন শুধুই রক্তের গন্ধ। যন্ত্রণার গন্ধ। শব্দেরাও ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে যন্ত্রণার প্রকোপে। লাল রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে মুখে ঢুকে যাচ্ছে ঠোঁটের ফাঁক গেলে। জিবে নোনতা স্বাদ! সবগুলো বাতি নিভে যাচ্ছে একে একে। ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে এক মিশমিশে অন্ধকার। কে যেন কপালের ওপর শত সহস্র পিন ফুটিয়ে যাচ্ছে অনবরত! কেউ ওকে বারণ করো! কষ্ট হচ্ছে! বড়ই কষ্ট! সে কি মরে যাচ্ছে? যাক, মরেই যাক। প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে অন্তত মরতে পারছে। এমন ভাগ্য কজনের হয়? তমসাচ্ছন্ন দৃশ্যপটে হঠাৎ কয়েকটা মুখ তারার মতো জ্বলে ওঠে। বাবা, মা, ছোট বোন আর বন্ধুদের মুখ। জ্বলে উঠেই আবার মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। উত্তরমেরু থেকে কনকনে এক হিমবাহ ধেয়ে এসে শরীরের শেষ উত্তাপটুকুও কেড়ে নিয়ে যায়। হাত পা জাড় হয়ে আসে বরফের ন্যায়। এটাই মনে হয় মৃত্যু! কে মারল অমৃতাকে? তার বন্ধু? বন্ধুদের তো সে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল। ভালোবেসেছিল আরো একজনকে। দুটি ভালোবাসায় কাটাকাটি হয়ে গেলো। সুখ হলো না আর এ জীবনে! থাক, সবার জীবনে কি সুখ হয় বল? হয় না! তোমরা কেউ অমৃতার মতো ভুল করো না যেন! তোমাদের কারো ভাগ্য যেন অমৃতার মতো না হয়। মরে যাবার আগে তোমাদেরকে এতটুকুই শুধু বলে যেতে চায় অমৃতা
কাচের মতো ঝনঝন শব্দে কিছু একটা ভেঙে যাচ্ছে। অর্থহীন শব্দগুলো ফিরে এসেছে আবার। বর্ণহীন, অর্থহীন, বিদঘুটে শব্দগুলোর ভেতর দিয়ে কে যেন আবছাভাবে বলে উঠল, তোমার বৃষ্টিমহলটা ভেঙে যাচ্ছে! অমৃতা ভারি চোখের পাতা মেলে সামনে তাকানোর চেষ্টা করল। দেখল না কিছুই। চোখের সামনে শুধুই অন্ধকারের বন্যা। কিন্তু দূরের বজ্রপাতের মতো ভাঙচুরের শব্দটা কানে এসে লাগল ঠিকঠাক। ঝনঝন… ঝনঝন… ঝনঝন! আহা বৃষ্টিমহলটা বুঝি ভেঙেই গেলো! অমৃতার আজ একটাই দুঃখ! তোমরা শুনছ? শুধু একটা দুঃখ নিয়েই মরতে হলো অমৃতাকে। তার স্বপ্নের বৃষ্টিমহলটা ভেঙে গেছে!
বন্ধুরা সিএনজি তে করে অফিস বিল্ডিং এর সামনে উপস্থিত হওয়া মাত্র ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠল। রাশেদ অমৃতাকে নিয়ে পাজেরো গাড়িতে উঠে বসেছেন। অমৃতার মাথাটা চেপে ধরে আছেন নিজের বুকের সাথে। সাদা শার্ট লাল রক্তে ভিজে জবজব করছে। তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল। হৃদি, রুদ্র আর আকাশ হাহাকার করে ছুটে গেলো সেদিকে। কিন্তু তার আগেই গাড়ি চলতে শুরু করে দিল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তিন বন্ধু পাগলের মতো ছুটোছুটি করে একটা সিএনজি যোগাড় করল। তারপর চলল পাজেরো গাড়িটার পিছু পিছু।
১০২
সামির মস্তিষ্ক বেশ কিছুক্ষণের জন্য চেতন অবচেতনের মধ্যবর্তী একটা জায়গায় আটকে গিয়েছিল। হাতে পায়ে তীব্র কাঁপুনি নিয়ে সোফার ওপর এলিয়ে পড়েছিল সে। দাঁতে দাঁত লেগে খিঁচুনি ওঠার উপক্রম হচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে রইল অনেকটা সময় সোফার ওপর। মাথা পুরোপুরি ফাঁকা। তার যেন আর কিছুই ভাববার নেই, কোথাও যাবার নেই। যেন সব কিছু শেষ হয়ে যাবার পরে নিঃস্ব অবস্থায় একলা বসে আছে সে বোধশূন্য, বাকশূন্য এবং বুদ্ধিশূন্য হয়ে। হঠাৎ হঠাৎ শুধু মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল শীতল একেকটা স্রোত। বুকে চিলিক দিচ্ছিল চিনচিনে ব্যথা
প্যান্টের পকেটে মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে। অনেক কষ্টে যন্ত্রটা বের করে চোখের সামনে ধরল সে। মা ফোন করছে। কেটে দিল ফোন। হঠাৎ চোখ পড়ল। একটা ইমেইল এসেছে, অমৃতার ঠিকানা থেকে। কাঁপা আঙুলে ইমেইলটা খুলে দেখল সে।
সামি,
দোস্ত জানি না কথাটা তোকে কী করে বলব। বলতে গিয়ে ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। ভয়ও হচ্ছে বিশ্বাস কর! কিন্তু বলতে যে আমাকে হবেই। তুই খুব মন দিয়ে শোন। কিছু দিন আগে আমার এই ছাব্বিশ বছরের ছিমছাম, সুন্দর ছোট্ট জীবনটায় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। জীবনে কোনোদিন কোনো পুরুষের প্রতি দুর্বল না হওয়া এই আমি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম একজনকে দেখলে আমার বুক কাঁপে। একলা হলেই তার কথা মনে পড়ে। তাকে এক নজর দেখবার জন্য, তার গলার স্বর একটাবার শুনতে পাবার জন্য মনটা সারাক্ষণ খাঁচা বন্দি পাখির মতো ছটফট ছটফট করে। সারাক্ষণ তার কথা ভাবতে ইচ্ছা করে, বলতে ইচ্ছা করে, মন খারাপের সময়গুলোতে তার পায়ের কাছে চুপটি করে বসে থাকতে ইচ্ছা করে। কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে গেলোামরে দোস্ত! বিশ্বাস কর! নিজেকে কন্ট্রোল করার মতো কোনো শক্তিই আর আমার রইল না। ক্রমেই বুঝতে পারলাম এই অনুভূতি কোনো সাধারণ অনুভূতি নয়, মোহো নয়, ইনফ্যাচুয়েশন নয়। সেই মানুষটাও কোনো সাধারণ মানুষ নয়। সে আমার ভালোবাসা, আমার প্রথম প্ৰেম!
সামি, লক্ষ্মী বন্ধু আমার! বলতে বড়ই কষ্ট! তবুও বুকে পাথর চাপা দিয়ে আজ বলছি তোকে। আমার জীবনের এই বিশেষ মানুষটি অন্য কেউ নয়, স্বয়ং তোর বাবা। জেনে বুঝে, সজ্ঞানে কিছুই করিনি দোস্ত। হয়ে গেছে। বিশ্বাস কর! ব্যাপারটা হয়ে গেছে! কী করে যে হলো তা আমি নিজেও জানি না! কিছুতেই নিজেকে ফেরাতে পারলাম না। অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। আমি দুঃখিত! ভীষণ ভীষণ ভীষণ দুঃখিত! তুই হয়তো জানিস যে একটা সময় তোর বাবাকে আমি চরমভাবে ঘেন্না করতাম। কিন্তু যখন তাকে কাছ থেকে দেখলাম, মিশলাম, চিনলাম, তখন বুঝলাম যে এমন মানুষ আজকের পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া অতিশয় বিরল ব্যাপার। সত্যিই বিরল। তোর বাবা একজন অসাধারণ মানুষ দোস্ত! আজকে এ কথা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই!
তোর মা আমাকে কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারবেন না আমি জানি। তুই কি পারবি? দ্যাখ আমি একটা ব্যাপার অনেক ভেবে দেখেছি। আমরা সবসময় আমাদের বাবা মায়ের পারস্পরিক সম্পর্কটাকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড হিসেবে ধরে নেই। এটা ভুল। আমার বাবা মা হয়েছে বলেই সারাটা জীবনভর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের একজন আরেকজনের সাথে লটকে থাকতে হবে এমনটা ভাবা কোনো সন্তানের জন্যেই যৌক্তিক নয়। আমরা সন্তানেরা একটু বড় হবার পর বাবা মায়ের কাছে নিজের স্বাধীনতার দাবি করি। নিজেদের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে তাদের দখলদারিত্ব মেনে নিতে কষ্ট হয় আমাদের। অথচ বাবা মায়েরও যে কখনো কখনো মানুষ হিসেবে একটুখানি মানসিক স্বাধীনতার প্রয়োজন হতে পারে সে বিষয়ে কি কখনো স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করে দেখেছি? একদিন তুই তোর বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে চেয়ে নিয়েছিলি। আজকে যদি তোর বাবা কিংবা মা তোর কাছে নিজের জন্যে ঠিক এধরনের কিছুই চায়, তাহলে তুই কী করবি? কী করা উচিত? আমি জানি না দোস্ত, সত্য জানি না। তোর বিবেকের ওপরেই ছেড়ে দিলাম। শুধু এটুকু বলে দিই পরিষ্কারভাবে যে তোর বাবা মায়ের মধ্যকার সম্পর্কের দূরত্বের কারণ আমি নই। অনেক আগে থেকেই তাদের দুজনের মাঝে একটি শূন্যস্থান ছিল। যা আমি মাত্ৰ কয়েকদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম, কিন্তু তুই বুঝিসনি দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরেও! এ ঘটনার পেছনে অবশ্য আমার একটা আলাদা ব্যাখ্যা আছে। আমার বিশ্বাস, মানুষটা সবসময়ই আমার ছিল। আমি আমার বুকের গভীরে জানতে পেরেছি যে, আমার ছিল বলেই এতকাল ধরে কোনো দ্বিতীয় মানুষ তার মনের ঘরে বসত গড়তে পারেনি। আমাকে তার জীবনে আসতেই হতো। আবার একই সাথে তোকেও আমার বন্ধু হতেই হতো। তোরা দুজনেই আমার জীবনের অনেকটা জুড়ে থাকবি এমনটাই আসলে হবার ছিল। এটাই নিয়তি!
তোর নিশ্চয়ই রাগ হচ্ছে। আমি জানি ভীষণ রাগ হচ্ছে। খুন করতে ইচ্ছা হচ্ছে আমাকে দোস্ত? চাইলে করতে পারিস। আমি জানি আমি দোষ করেছি। তোর কাছে এবং তোর মায়ের কাছে আমি চিরকালের জন্য অপরাধী হয়ে রইলাম। তোরা যে শাস্তিই দিবি আমি মাথা পেতে নেব। সবার ভাগ্য তো তুই, হৃদি, বিভা… তোদের মতো ভালো হয় না! সবার জীবনে সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের আগমনও ঘটে না! এ জীবনে আমার হয়তো আর ভালো থাকা হবে না। তবুও তুই যদি একটাবার আমাকে ক্ষমা করতে পারিস তাহলে একটুখানি স্বস্তি অন্তত মিলবে। এই স্বস্তিটুকু আমাকে দিস প্লিজ! আমার বর্তমান জীবনে স্বস্তির বড়ই অভাব!
পুনশ্চ : তোকে একদিন প্রমিজ করে বলেছিলাম, আই উইল নেভার লেট ইউ ডাউন। আমি দুঃখিত। কথাটা রাখতে পারলাম না। মাফ করে দিস। আর জেনে রাখিস আমি এবং তোর বাবা, আমরা দুজনেই তোকে অনেক বেশি ভালোবাসি! তুই যা চাইবি তাইই হবে দোস্ত! আল্লাহর কসম!
ইতি,
অমৃতা
৩য় খণ্ডের সমাপ্তি