বৃষ্টিমহল ৩.১০

১০

ডাইনিং রুমে বন্ধুদের পাওয়া গেলো। হৃদির মুখটা দুশ্চিন্তায় একদম ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু তার চোখে এখন জল নেই। মনের ওপর কেউ যেন একটা ভারি পাথর বসিয়ে দিয়েছে। সেই পাথরের ভারে চাপা পড়ে গেছে সব আবেগ, অনুভূতি। মিনিট না গড়াতেই স্টাডিরুমের দরজাটা খোলার শব্দ পাওয়া গেলো। ঠিক একই সময়ে একজোড়া পা সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছিল ওপর থেকে। ডাইনিং স্পেসে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েগুলোর আত্মা কাঁপছিল। প্রবল ঝড় আসার আগে প্রকৃতি যেমন হঠাৎ করেই অসম্ভব রকমের থমথমে হয়ে ওঠে, সেই রকম একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছিল ওদের চোখে মুখে। হৃদির হাঁটু কাঁপছিল ঠকঠক করে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না আর। চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। খুব দুর্বল লাগছে। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে চেতনা হারিয়ে ফেলবে। 

হক সাহেবই প্রথমে প্রবেশ করলেন ঘরে। এসে দেখলেন ছেলে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেকে ঘিরে রেখেছে তার বন্ধুরা। সেই মেয়েটি, যার সাথে ছেলে পালিয়েছিল, সে বসে আছে একটি চেয়ারে, জবুথবু হয়ে। 

বাবা সামনে এসে দাঁড়াতেই সামি মুখ নামিয়ে নিল নিচে। তার ভেতরটা এখন আত্মগ্লানিতে জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। সে কোনোদিনই চায়নি বাবা মাকে এভাবে কষ্ট দিতে। সে জানে তার জন্য বাবাকে এখন সামাজিকভাবে অপদস্থ হতে হবে। লোকে নানা রকম কথা বলবে। কিছু সংবাদ মাধ্যম রসিয়ে রসিয়ে এই খবর পত্রিকার পাতায় ছাপাবে। বাবাকে সে বরাবরই একটু ভয় পায়। সন্তান মানুষ করার নিমিত্তে বাবা অথবা মা এদের দুজনের একজনকে একটু কঠোর হতে হয়। যে কোনো একজনকে সন্তান শাসনের ভারটা হাতে তুলে নিতে হয়। যে সন্তানের বাবা মা দুজনেই নরম কিংবা আবেগী সেই সন্তানের বেড়ে ওঠাটা ঝরঝরে হয় না। বাবা মায়ের ভালোবাসায়ও একটা ব্যালেন্স দরকার। সামির ক্ষেত্রে কঠোর ভূমিকাটি পালন করে এসেছেন বাবা। মা কখনো তাকে সেভাবে শাসনই করেননি। মা মানেই তার কাছে সহজ, সরল, মিছরির মতো মিষ্টি একটি অনুভূতি। মায়ের কাছে চাইলে সব পাওয়া যায়। নিজের বুকের কলিজা কেটে দিতে বললেও মা আপত্তি করবেন না। 

সে অবনত মুখে ধীরস্বরে বলল, ‘বাবা, আই অ্যাম স্যরি!’ 

হক গম্ভীরভাবে চেয়ে ছিলেন পুত্রের দিকে। তাঁর কপালে ভাঁজ। ভ্রু জোড়া বক্র। সামি আজীবন বাবার এই রুদ্রমূর্তিটিকে ভয় পেয়ে এসেছে। আজও পাচ্ছে। সেই সময় উন্মাদিনীর বেশে ঘরে ঢুকলেন রোমেলা। ছেলেকে দেখামাত্র তিনি উত্তেজিতভাবে কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলেছিলেন। হক তৎক্ষণাৎ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি চুপ করো। আগে শুনে নিই ও কী বলতে চায়।’ 

হৃদির ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তবে বন্ধুরা সবাই মুখের সামনে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে বিধায় তার একটু সুবিধাই হয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকা শরীরগুলোর জন্য তাকে কেউ স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে না। 

সামি মুখ তুলে তাকালো মায়ের দিকে। মায়ের চোখ দুটি ফোলা। চুল অবিন্যস্ত। সারা মুখে একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব। ওই মুখটা দেখে বুক মোচড় দিয়ে উঠল তার। মনে হলো যেন কষ্টে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে যাবে। তবুও, মা এলো বলেই সে যেন একটু ভরসা পেলো। আজীবন বাবার রাগের প্রকোপ থেকে মা’ই তো তাকে বাঁচায়। এবারও, বাবা না বুঝলেও মা ঠিকই বুঝবে! 

সামি বাবার দিকে তাকাল না, মায়ের চোখে চেয়ে বলল, ‘মা, আমি তানিশাকে বিয়ে করব না। বিয়েটা তোমরা ক্যানসেল করো। আমি জানি আমি তানিশার সাথে অন্যায় করছি। কিন্তু কিছু করার নেই। বিয়েটা করে ফেললে আরো বড় অন্যায় হবে।’ 

স্ত্রীকে কিছু বলতে না দিয়ে কথা বললেন হক, ‘কেন? হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ কী?’ 

বাবার চোখে চোখে তাকানোর সাহস নেই সামির। সে পুনরায় চোখ নিচে নামালো, কম্পনযুক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি।’ 

এবার রোমেলাকে আর কেউ রুখতে পারল না। চিৎকারে ফেটে পড়ে তিনি বললেন, ‘কাকে পছন্দ করিস? ওই বেয়াদব, বেহায়া মেয়েটাকে? যে তোকে সবার সামনে আই লাভ ইউ বলেছিল?’ 

হৃদি চমকে উঠল। অপমানে ঝাঁঝাঁ করে উঠল সারা শরীর। 

—‘এভাবে কথা বলছ কেন তুমি?’ মায়ের দিকে করুণ চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল সামি। 

রোমেলা ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, ‘তোমার বিয়ে তানিশার সাথেই হবে। এই বিয়ে কোনোভাবেই ক্যানসেল করা যাবে না এখন।’

সামির মুখখানা মোচড়ানো কাগজের মতো কুঁকড়ে গেলো মুহূর্তের মাঝে।

-–’তানিশাকে আমি পছন্দ করি না। কেন বিয়ে করব ওকে?’ 

হক সাহেব দরাজ গলায় বললেন, ‘এই বিষয়টা নিয়ে তোমার প্রথমেই চিন্তা করা উচিত ছিল। বিয়ের আগের দিন বিয়ে ভেঙে যাওয়া একটা মেয়ের জন্য কতটা অপমানজনক তুমি বুঝতে পারছ?’ 

সামি এবার অসহায়ভাবে বন্ধুদের দিকে তাকালো। বন্ধুরা সব কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের মুখ ফ্যাকাশে। হৃদি মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে আছে মূর্তির মতো। এতক্ষণের থমকে থাকা কান্নাটা এবার তার চোখের কার্নিশে বাঁধ ভেঙেছে। টপটপ করে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। রোমেলা বললেন, ‘বিয়েটা তোমাকে করতেই হবে। এখন আর কিছু করার নেই।’ 

সামির দুহাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসলো অজান্তেই। দৃঢ় গলায় বলল, ‘অসম্ভব! এই বিয়ে আমি করতে পারব না।’ 

রোমেলা কথাটা শুনে এমনভাবে চিৎকার করে উঠলেন মনে হলো যেন একটু হলেই তাঁর কণ্ঠনালি ছিঁড়ে যাবে। তিনি হুংকার দিয়ে উঠে বললেন, ‘ওই বেহায়া মেয়েটা তোমাকে এসব কথা শিখিয়ে দিয়েছে তাই না? জাদু করেছে তোমার ওপর?’ এটুকু বলে তিনি ভিড়ের মাঝে কোণার চেয়ারে বসে থাকা হৃদিকে ঠিক ঠিক খুঁজে বের করলেন, হাত উঁচিয়ে শাসানোর গলায় বললেন, ‘তুমি কি মনে করেছ এসব করে এ বাড়ির বৌ হতে পারবে? জীবনেও না। তুমি জানো সামি কার ছেলে? আমাদের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস জানো তুমি? আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে ছেলের বৌ হিসেবে কোনো দিন মেনে নেব না!’ 

সামি প্রতিবাদ করে উঠল, ‘মা এসব কী হচ্ছে? তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না ওর সাথে!’ 

হক এগিয়ে এসে রোমেলার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘তুমি শান্ত হও। মাথা ঠান্ডা করো।’ 

এতক্ষণে অমৃতা কথা বলল। না সামির বাবা মায়ের সাথে না। সামিকেই সরাসরি বলল, ‘যা করার তোকেই করতে হবে। তানিশাকে ফোন দিয়ে বল যে তুই বিয়েটা করতে পারবি না। 

রোমেলা সাপের মতো ফুঁসে উঠলেন, ‘তোমার এত বড় সাহস? তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ছেলেকে কুবুদ্ধি দিচ্ছ?’ 

—‘আপনার ছেলে তানিশাকে পছন্দ করে না। হৃদিকে পছন্দ করে। এই সহজ কথাটা আপনার মাথায় ঢুকছে না?’ কিছুটা উগ্রভাবেই বলল অমৃতা কথাগুলো। 

সেই মুহূর্তে রোমেলা খুব সাংঘাতিক একটা কাজ করে বসলেন। খ্যাপাটে পাগলের মতো হনহন করে এগিয়ে এসে, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অমৃতার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন, ‘এত সাহস তুমি কোথায় পাও? বেয়াদব মেয়ে!’ 

ঘরের মধ্যে যেন একটা বজ্রপাত হয়ে গেলো। সবাই স্তব্ধ, বিস্মিত এবং বাকরুদ্ধ! থাপ্পড়টা অমৃতার ঘাড় কাত করে দিয়েছে। গালে হাত রেখে মূর্তির মতো স্থবির হয়ে আছে সে। 

মুহূর্তের মধ্যে হক সাহেব ছুটে আসলেন। স্ত্রীর বাহু খামচে ধরে বললেন, ‘তুমি এটা কী করলে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? যাও ওপরে যাও!’ কথাটা বলে তিনি নিজেই রোমেলাকে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। 

অমৃতার গায়ে কেউ কোনোদিন হাত তোলেনি। জীবনে এই প্রথমবারের মতো কেউ তাকে শারীরিক ভাবে আঘাত করল। থাপ্পড় খাওয়া গাল এক হাতে চেপে ধরে সে ঝাপসা চোখে দেখছিল জেদি মহিলাটিকে। মহিলার চোখ জ্বলছে বাঘিনীর মতো। সর্পিনীর ন্যায় পড়ছে নিশ্বাস। এই নারী সেই মানুষটার স্ত্রী। সেই মানুষটা, যাকে অমৃতা ভালোবাসে! অমৃতা যাকে খুব করে চায়, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই সেই মানুষটা এই মহিলার একান্ত নিজের। তবুও অমৃতা জানে, তার ভালোবাসায় এত শক্তি আছে যে চাইলেই সে ভালোবাসার যুদ্ধে এই রমণীটিকে হারিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু সেই যুদ্ধে তার কোনোদিনই যোগদান করা হবে না। কারণ এই মানবী শুধু তার ভালোবাসার মানুষটির স্ত্রীই নন। এই মানবী তার বন্ধুর মা। বন্ধুর জন্যেই… হ্যাঁ শুধু বন্ধুর জন্যেই অমৃতা এই অভদ্র, অবিবেচক মহিলাকে আজকের থাপ্পড়ের জবাব কোনদিন দিতে পারবে না! 

থাপ্পড়টা সে কোনো রকমে হজম করে গেলেও তার বন্ধুদের হজম করতে বেশ বেগ পেতে হলো। হৃদি একদম ঝগড়াটে গলায় সামিকে বলল, ‘কী ব্যাপার? তোর মা তোর সামনে অমৃতাকে থাপ্পড় মারলো, তুই কিছু বললি না যে?’ 

সামি তখন হতচেতন ভাবে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে চেয়ারের ওপর বসে আছে। শ্বাস পড়ছে অস্বাভাবিক ভাবে। রুদ্র এগিয়ে এসে সামির পিঠে একটা হাত রাখল, হৃদিকে বলল, ‘ওর তো কিছু করার নাই এখানে। ওর সাথে ঝগড়া করতেছিস কেন তুই?’ 

হৃদির গলা এবার আরো চড়ে গেলো, ‘কিছু করার থাকবে না কেন? সে তার বাপ মায়ের সামনে এমন মিউমিউ করে কেন? ওর মা আজকে অমৃতারে থাপ্পড় মারছে। কালকে আমারে থাপ্পড় মারবে।’ 

অমৃতা টানা মিনিট পাঁচেক সময় পরে নিজের গাল থেকে হাত নামাল। ঝটকাটা তখনো পুরোপুরি কাটেনি তার। ফর্সা মুখখানা চাপা রাগ আর অপমানের তোড়ে রক্তিম হয়ে আছে। একটু ভারি গলায় সে বলল, ‘এখন এসব বাদ দে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। সামি! তানিশারে ফোন দে।’ 

আকাশও সায় দিলো কথাটায়। বলল, ‘হ্যাঁ সেটাই। আর দেরি না কইরা তুই মেয়েটারে ফোন দিয়া খবরটা দে। অনেক রাত হয়ে গেছে। বেচারি হয়তো ঘুমায় পড়ছে এতক্ষণে।’ 

সামির বুক থেকে একটা বিধ্বস্ত কম্পিত নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। প্যান্টের পকেট থেকে একটু সময় নিয়েই মোবাইলটা বের করল সে। কাঁপা হাতে ডায়াল করলো তানিশার নম্বরে। লাউডস্পিকার অন করা ছিল। বন্ধুরা সব সামিকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ানো। নিশ্বাস বন্ধ করে উৎসুকভাবে চেয়ে আছে সবাই সেলফোনের দিকে। চার নম্বর রিংটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তানিশা ফোন ধরলো। তার গলার স্বর কিছুটা জড়ানো। একটু ঘুম ঘুম ভাব। 

সামির মুখটা তখন মাঝ সমুদ্রে প্রবল ঝড়ের মুখে পড়া দিকহারা নাবিকের মতো অসহায়। সে হাতে ধরা ফোনের পর্দায় বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো চেয়ে আছে। তানিশা ওপাশ থেকে ক্রমাগত হ্যালো হ্যালো বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটা মুহূর্ত পর অনেক কষ্টে সামি বলতে পারল, ‘তানিশা, তোমার সাথে জরুরি কথা ছিল!’ 

তানিশা খুব সহজ গলায় বলল, ‘কী কথা? তোমাকে এতবার ফোন দিলাম। ফোন ধরলে না কেন?’ 

সামি তার বন্ধুদের দিকে একবার চোখ মেলে তাকালো। বন্ধুরা চোখের ইশারায় তাকে সাহস দিল। আকাশ এক পা এগিয়ে এসে ওর একটা হাত চেপে ধরল। সামি রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘তানিশা, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না! 

কয়েকটা সেকেন্ড পিনপতন নীরবতা। মনে হচ্ছিল যেন এই অবিচল নিস্তব্ধতার নিশ্চুপ দাপাদাপিতে ওদের প্রত্যেকের বুকের ভেতর এখুনি একটা বিকট বিস্ফোরণ ঘটবে। তবে তার আগেই বিস্ফোরণটা ঘটল ফোনের অপর প্রান্তে। 

—‘কী বললা তুমি?’ তানিশার চিৎকারে কানের পর্দা ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হলো। 

—‘তানিশা আমি ভীষণ ভীষণ ভীষণ স্যরি! হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। প্লিজ পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও! আমি জানি আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি তোমার সাথে। কিন্তু বোঝার চেষ্টা করো বিয়েটা আমি করতে পারব না।’ 

মিনিট না গড়াতেই ফোনের ভেতর দিয়ে ধুপধাপ পায়ের শব্দ ভেসে আসতে লাগল। মনে হচ্ছে তানিশা যেন ছুটে যাচ্ছে কোথাও, ঝড়ের গতিতে। খানিক বাদে তাকে ত্রাসিত কণ্ঠে বলতে শোনা গেলো, ‘আম্মা! আব্বা! এই যে কথা বলো। শুনো কী বলছে এই ছেলে।’ 

একটা রক্ত হিম করা শীতল স্রোত সামির মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেলো। এবার তাহলে তানিশার বাবা মার মুখোমুখি হতে হবে! ভীষণ বিচলিত দেখাচ্ছিল তাকে। হৃদি দাঁড়িয়ে ছিল অমৃতার পাশে। তার মুখটা আতংকগ্রস্থ। কান্নায় লেপটে গেছে চোখের কাজল। টলটলে, ভাসা ভাসা দুটি চোখ নিয়ে সে সামির দিকে চেয়ে আছে চাতক পাখির মতো। সেই মুহূর্তে হৃদির ওই অশ্রুসজল নিষ্কলুষ মুখটার দিকে চেয়ে থেকে সামির হঠাৎ মনে হলো যে, এই মেয়েটার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফোটাবার জন্য সে গোটা পৃথিবীটা উল্টে দিতে পারবে। লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারবে সব কিছু… হ্যাঁ, স–ব কিছু! 

তানিশার আব্বা ফোন ধরল। -’হ্যালো!’ 

—‘হ্যালো আংকেল!’ 

—‘কী ব্যাপার? এত রাতে?’ 

—‘আংকেল আমি বিয়েটা করতে পারছি না। স্যরি!’ সামির গলা কাঁপছিল প্রবলভাবে। ওপাশ থেকে ভদ্রলোক কান ফাটানো চিৎকার করে উঠলেন –’কী বলছ তুমি এসব? হ্যাঁ? কালকে বিয়ে আর আজকে ফোন করে বলছ বিয়ে করতে পারবে না? এটা কি ফাইজলামি নাকি? কই তোমার বাবা কোথায়? ফোন দাও তাকে! 

—‘এখানে আমার বাবা মায়ের কোনো দোষ নেই আংকেল। আপনারা প্লিজ যা বলার আমাকে বলুন। বাবা মাকে কিছু বলবেন না।’ 

১১

বেডরুমে এসে স্ত্রীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হক তীব্রস্বরে বললেন, ‘তুমি মেয়েটার গায়ে হাত তুললে কেন?’ 

রোমেলা তখনো রাগে কাঁপছিলেন। কাঁপতে কাঁপতেই ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়লেন। তারপর দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘তুমি দেখনি অসভ্য মেয়েটা কী রকম কুবুদ্ধি দিচ্ছিল আমার ছেলেকে?’ 

—‘তাই বলে তুমি পরের মেয়ের গায়ে হাত তুলবে?’ 

রোমেলা সরু চোখে তাকালেন, আগুন গলায় বললেন, ‘হাত তুলবো না তো কী করব? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ওর বেয়াদবি সহ্য করব? মেয়েটা একটা পয়লা নম্বরের বেয়াদব!’ 

হক ধীরস্বরে বললেন, ‘বেয়াদব নয়।’ 

—‘বেয়াদব নয়?’ 

—‘না বেয়াদব না। মেয়েটা একটু অন্যরকম।’

—‘রোমেলা অস্ফুটে বললেন, ‘তাই নাকি?’ —‘হ্যাঁ তাই।’ 

—‘তুমি কী করে জানলে? 

—‘জানাজানির কিছু নেই। বোঝা যায়।’ 

রোমেলা স্বামীর মুখের ওপর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি রাখলেন। এর আগে এই লোকটা কোনোদিন কারো সম্পর্কে এমন দৃঢ় এবং একপেশে মতামত দেয়নি। কদিন আগে লোকটা নিজেই অমৃতাকে বেয়াদব বলে গালাগাল করেছিল। রোমেলার তা স্পষ্ট মনে আছে। এই কয়েক দিনে কী এমন ঘটে গেলো যে মেয়েটার সম্পর্কে তার ধারণা একদম ভেল্কি দিয়ে পাল্টে গেলো? 

হক বরাবরই একটু নাকউঁচু স্বভাবের মানুষ। নিজের শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, এবং বিত্ত বৈভব নিয়ে তাঁর দাম্ভিকতা আকাশচুম্বী। সচরাচর তিনি কারো প্রশংসা করেন না। বছর চারেক আগে এক মডেল কন্যার সাথে পরিচয় হয়েছিল একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর মডেল কন্যা তার অন্ধ ভক্ত হয়ে গেলো। পরদিন ফোন দিয়ে বলল, দেখা করবে। তিনি অফিসে আসতে বললেন। এ কথা, সে কথায় বোঝা গেলো মডেলের দেখা করার পেছনে কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ বা উদ্দেশ্য নেই। ইংরেজিতে ‘স্মল টক’ যাকে বলে তাইই করে যাচ্ছিল ক্রমাগত। তিনি মেয়েটাকে কেনো রকমে এড়িয়ে গেলেন। কদিন বাদে এক শুক্রবারে মেয়েটা হঠাৎ বিনা নোটিশে সরাসরি বাড়ি চলে এলো। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন করল তাঁর মোবাইলে। হক স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘শোনো, একটা মেয়ে এসেছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তুমি নিচে গিয়ে মেয়েটাকে খুব করে বকে দিয়ে আসো তো! এমনভাবে বকবে যেন সে আর কোনোদিন এ বাড়িতে না আসে।’ 

রোমেলা স্বামীর কথা মতন কাজ করলেন। নিচে নেমে দেখলেন গেটের সামনে ছিপছিপে শরীরের এক নারী দাঁড়িয়ে আছে। চোখে রোদ চশমা। বয়স তিরিশ ছুঁই ছুঁই হবে। কাটা কাটা নিখুঁত ছাঁচের মুখখানায় ঢলঢল করছে এক মায়াবী সৌন্দর্য। তিনি শক্ত গলায় বললেন, ‘তোমার কী চাই?’ 

মেয়েটি চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে বলল, ‘স্যারের সাথে একটু দরকার ছিল। স্যার কি আছেন বাসায়?’ 

–‘কী দরকার?’ 

মেয়েটি প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করল, ‘আপনার পরিচয়টা?’

—‘আমি উনার ওয়াইফ।’ 

একটু বিব্রত দেখালো সুন্দরীকে। আমতা আমতা করে বলল, ‘ইয়ে, স্যারের সাথে জবের ব্যাপারে একটু কথা ছিল।’ 

রোমেলা স্বামীর হুকুম মোতাবেক কাজ করলেন। একটা রাম ধমক দিয়ে উঠে বললেন, ‘জবের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছ ছুটির দিনে? ফাজলামোর জায়গা পাও না আর? যাও এখান থেকে। বাড়িতে উনি কারো সাথে দেখা করেন না!’ 

মেয়েটি ধমক খেয়ে নতমুখে প্রস্থান করল। ফিরে এসে রোমেলা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘বেচারি চাকরির জন্য কথা বলতে এসেছিল। তুমি তাড়িয়ে দিতে বললে কেন? মেয়েটি কিন্তু দেখতে দারুণ। মডেলদের মতো সুন্দর। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এই মেয়েকে কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই নিয়ে নিত চাকরিতে।’ 

হক ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘সুন্দরী হলে কী হবে? মাথার ভেতরে বুদ্ধি বলতে কিচ্ছু নেই। একদম নিরেট। সুন্দরীদের এটাই সমস্যা, তারা সৌন্দর্য দিয়ে দুনিয়ার সব পুরুষদের বশে আনতে চায়।’ 

—‘তোমার দেখার চোখই নেই।’ আক্ষেপের গলায় বললেন রোমেলা। 

হক হাসলেন, ‘বেশির ভাগ মেয়েরা একই রকম। বাইরের চাকচিক্যটাকেই তারা যোগ্যতা নির্ধারণের পরিমাপক বলে মনে করে। প্রসাধন সামগ্রী, শাড়ি, গয়না, টাকা পয়সা এর বাইরেও যে আরো কিছু ব্যাপার আছে সেটা এসব সাধারণ মেয়েদের মাথায়ই ঢোকে না।’ 

—‘আরো কিছু ব্যাপার বলতে কী বোঝালে?’ 

হক একটু আনমনা হলেন ক্ষণিকের জন্য। তারপর গাঢ়স্বরে বললেন, ‘অন্যরকম কিছু।’ 

—‘অন্যরকম?’ 

—‘হ্যাঁ অন্যরকম।’ 

ওই শব্দটা সেদিন রোমেলার কানে এবং মনে কেন যেন স্ট্যাপলারের পিনের মতো গেঁথে গিয়েছিল। কী করে যেন বুঝে গিয়েছিলেন তিনি যে, তার সুদর্শন, শিক্ষিত, ধনাঢ্য পতিদেবের মনটা আদতে ‘অন্যরকম’ কিছু চায়। এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং মার্জিত রুচি দেখে কিঞ্চিৎ গর্ববোধ করলেন। আবার কেন যেন একটু আহতও হলেন মনে মনে। তিনি জানেন তাঁর স্বামী রূপের মোহে আটক হওয়ার বান্দা না। সেরকম হলে মানুষটার মনের ঘরের সন্ধান বহু আগেই পেয়ে যেতেন। যৌবনে তিনি ছিলেন ডাকের সুন্দরী। কিন্তু সেই সৌন্দর্যের দুই আনা দামও তার স্বামী কখনো দেননি, দিতে জানেননি। কেন যেন মনে হয়েছে মানুষটা তাকে ঠিকমতো ভালোবাসছে না। তাঁর হৃদয়পুরের প্রবেশদ্বারটি চিরকালের জন্য বন্ধ। হ্যাঁ সংসার জীবনে লোকটার একাগ্রতা ছিল শত ভাগ। স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালনে তিনি কখনো কোনো কার্পণ্য করেননি। কিন্তু সব থেকেও কী যেন একটা নেই নেই ভাব ছিল আজীবন। এত কাছে থেকেও, নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েও মানুষটাকে তিনি আজ অবধি নিজের করে পাননি। অবশ্য শত ভাগ ভালো তো তিনি নিজেও বাসতে পারেননি কখনও লোকটাকে। প্রথম যৌবনের ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে বিবাগি জীবনের অনেকগুলো বছর। তাড়া করে বেড়ায় এখনও! 

কোনো এক বিচিত্র কারণে ওই ‘অন্যরকম’ শব্দটা তাঁর বুকের পরে কেমন শেলের মতো গিয়ে বিঁধল। তিনি আর কিছু ভাবতে পারছিলেন না। এদিকে তাঁর একমাত্র আদরের সন্তানের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ মেয়ে তার ছেলেকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু এই সমস্ত বাস্তবিক চিন্তাকে ছাপিয়ে তার বুকটা আচমকা এক অজানা, অদ্ভুত, নিষিদ্ধ শঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ছেলের এই বন্ধুদলটিকে আজকের পর থেকে এ বাড়িতে পরিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবেন। যে করেই হোক এই বাজে ছেলেমেয়েগুলোর হাত থেকে তাঁর পরিবারকে বাঁচাতেই হবে! 

সেলফোনটা বাজছিল। হক পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলেন। তানিশার বাবা ফোন করেছে। তাঁর বুক থেকে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস বেরিয়ে গেলো। জীবনে এতটা অপমানিত বোধ তিনি এর আগে কখনো করেননি। ছেলেটা তাঁর মান সম্মান ডুবিয়েই ছাড়ল! 

১২

সামির কাঞ্চনবর্ণ কপালে চিকচিক করছে কয়েকবিন্দু ঘাম। মুখ হা করে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে সে। অপরাধ বোধের প্রাবল্যে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে হৃদয়। কয়েকটা মিনিট নীরবে কেটে যাওয়ার পর আকাশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে গলায় একটা নকল উচ্ছ্বাস টেনে এনে হাততালি দিয়ে উঠে বলল, ‘সাবাশ ম্যান, ইউ ডিড ইট! কুডোস টু ইউ!’ 

ওর হাততালিতে সম্বিৎ ফিরল বন্ধুদের। বাকিরাও হাততালি দেওয়া শুরু করল। শুধু হৃদি কিছু বলল না। হাত তালিও দিল না। একটু কেমন লাজুক ভাবে বসে রইল চুপচাপ। বন্ধুদের উল্লাস দেখে সামির মুখ থেকে আস্তে আস্তে মেঘ সরতে লাগল। রুদ্র বলল, ‘এক কাজ করি কালকে তো কাজী সাহেব আসতেছেই। আমরা তাহলে সামির সাথে হৃদিরেই বিয়া দিয়া দেই। খাওয়া দাওয়াটা মিস হবে না তাহলে।’ 

একথা শুনে সামির যেন হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেলো। টেবিলের ওপরে তাজা ফলসহ একটা ফলের ঝুড়ি রাখা ছিল। তার পাশে একটি চকচকে ফল কাটার ছুরি। সামি ত্রস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের ওপর থেকে ছুরিটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু তার আগে আমার একটা কাজ করতে হবে।’ 

বন্ধুরা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো ওর দিকে। সামি গম্ভীর গলায় বলল, ‘কান কাটতে হবে! এমনটাই কথা ছিল।’ 

শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। যেন এমন মজার ঘটনা এর আগে কেউ কোনোদিন শোনেনি। সামি কিন্তু হাসল না। চকচকে রুপালি ছুরিটার দিকে অখণ্ড মনোযোগের সাথে চেয়ে থেকে অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলল, ‘কান কাটার সহজ উপায় কী?’ 

হৃদি কয়েক পা এগিয়ে এসে সামির মুখোমুখি দাঁড়ালো। ছুরিটা টেনে নিল নিজের হাতে। নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। তারপর সামির ডান কানের ডগায় আলতোভাবে একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল, ‘কান দুটো আমার। যখন প্রয়োজন হবে তখন কেটে নিবোনে। এখন থাক!’ 

কথাটা শুনে সামি ঘোলা চোখে টানা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে চেয়ে রইল হৃদির দিকে। তারপর আচম্বিতে ওর ঠোঁটে এঁকে দিল একটি তপ্ত, প্রলম্বিত চুম্বন। বন্ধুরা হইহই করে উঠল। আনন্দে শিস দিয়ে উঠল রুদ্র। শুধু বিভা, কোনো এক দুর্বোধ্য গোপন কারণে পুরো দৃশ্যটা চোখ মেলে চেয়ে দেখতে পারল না। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো চকিতে, অন্যদিকে। বুকে চিলিক দিয়ে উঠল এক চাপা যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। সামির সাথে হৃদির প্রেমটা হয়ে যাক এটাতো সে মনপ্রাণ দিয়ে চাইছিল। তবে আজ কেন ওদের দুজনকে অমন অন্তরঙ্গভাবে দেখে তার বুক জ্বলছে অনর্থকভাবে? 

নিজের জীবনে সে পরিপূর্ণভাবে সুখী। কখনো মুখ ফুটে বলেনি, কিন্তু সে জানে এবং মানে যে অভিজিৎকে সে ভালোবাসে। অমন একটা মানুষকে কি ভালো না বেসে পারা যায়? কিন্তু সামির সাথে অভিজিতের কোথায় যেন একটা বিশেষ পার্থক্য আছে। সামি খেপাটে এবং উন্মত্ত প্রেমিক। প্রেমে পড়লে সে অন্ধ হয়ে যায়, পাগল হয়ে যায়। অন্যদিকে সুশীল, ভদ্র এবং অমায়িক অভিজিতের প্রেমের ধরনটাও ভারি মার্জিত। বইপড়ুয়া অভিজিতের কাছে ভালোবাসাটা যেন এক রুচিশীল, উঁচুদরের শিল্প। সামি যেরকম ডাকাতের মতো দুনিয়া জাহান ভুলে সবার সামনে হামলে পড়ে প্রেমিকার ঠোঁটে চুমু খেলো, অভিজিৎ এমনটা কখনো পারবে না। ভালোবাসবে নিবিড়ভাবে কিন্তু ভালোবেসে পাগল হবে না, তারছেঁড়া হবে না, বৈরাগী হবে না। সামিটা পাগলাটে, নির্ভীক এবং জোরালো পুরুষ। প্রেমিক হলে, এরকমই হতে হয়। মনে হলো বিভার। কেন যে মনে হলো হঠাৎ, কে জানে! 

—‘সামি!’ বোমার মতো উড়ে এসে শব্দটা ফেটে পড়ল ঘরের মাঝে। রোমেলা আগুন ঝরা চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ডাইনিং এর দরজায়। হৃদি এক ঝটকায় দূরে সরে এলো সামির কাছ থেকে। 

—‘তোমার বন্ধুদের বেরিয়ে যেতে বলো এ বাড়ি থেকে, এখুনি!’ 

হিম শীতল গলায় বললেন রোমেলা। পুত্রের চোখের দিকে সরাসরি চেয়ে। সামিও যেন এরকম কিছু শোনার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে ছিল। রোমেলা কথাটা বলে শেষ করা মাত্র সে একটুও সময় ব্যয় না করে দৃঢ় গলায় বলল, ‘আমার বন্ধুরা যদি বেরিয়ে যায় এত রাতে, তাহলে আমারও আর এ বাড়িতে থাকা হবে না!’ 

রোমেলা বললেন, ‘তোমার কাছে যদি মায়ের চাইতে বন্ধুরা বড় হয়ে থাকে। তাহলে তুমিও বেরিয়ে যেতে পারো ওদের সঙ্গে। আমার কিছুই বলার নেই।’ 

মায়ের মুখ থেকে এ ধরনের নিষ্ঠুর এবং কঠোর কথা শোনার পর কোনো সন্তানেরই মাথা ঠিক থাকার কথা না। সামিরও থাকল না। সে অধৈর্য গলায় বলল, ‘আম্মা প্লিজ! একটু বোঝার চেষ্টা করো!’ 

অমৃতা ফোড়ন কাটল মা ছেলের কথার মাঝখানে, ‘সামি শোন, তুই থাক। আমরা আসছি।’ 

—‘কিন্তু তোরা যাবি কীভাবে এত রাতে? আচ্ছা চল তোদের নামায় দিয়ে আসি।’ সামি বলল ব্যাকুল গলায়। 

ছেলের কথা শুনে রোমেলা এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার মধ্যেও উপহাসটা করতে ভুললেন না। টিটকিরি মেরে বলে উঠলেন, যাও তোমার বন্ধুদের যার যার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসো সসম্মানে। তুমি ছাড়া যে ওদের আর কোনো গতি নেই। একটা গাড়ির ব্যবস্থাও তো কেউ করতে পারবে না।’ 

সামি কড়া গলায় বলল, ‘কথাটা ভুল। এখন অনেক রাত হয়ে গেছে বলেই রাস্তাঘাটে কিছু পাওয়া যাবে না। নইলে ঢাকা শহরে যানবাহনের অভাব নেই।’ 

আকাশ বলল, ‘কিছু পাওয়া যাবে না কেন? আমি উবার কল করতেছি। তোর যাওয়া লাগবে না।’ 

—‘আরে না, আমি থাকতে উবার ডাকবি কেন?’ সামি মাছি তাড়ানোর মতো উড়িয়ে দিল আকাশের সিদ্ধান্তটা। 

ধুপধাপ শব্দে সিঁড়ি ভাঙার আওয়াজ পাওয়া গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ডাইনিং এ প্রবেশ করলেন হক সাহেব। জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকালেন ঘরে উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে। তারপর সামির দিকে চেয়ে ভারি গলায় বললেন, ‘তোমার সাথে কথা আছে। একটু শুনে যাও।’ ‘ 

সামি বলল, ‘বাবা আমি আমার বন্ধুদেরকে নামিয়ে দিতে যাচ্ছি। ফিরে এসে কথা বলছি। একটু অপেক্ষা করো।’ 

—‘এখন তো অনেক রাত। কাল সকালে যেও তোমরা। আজ থেকে যাও।’

—‘না আংকেল। আমরা এখুনি বেরোবো।’ আকাশ মতামত জানালো। দৃঢ় গলায়। 

হক এবার আর কোনো দ্বিরুক্তি করলেন না। একবার তাকালেন অমৃতার দিকে। তাকালো অমৃতাও। হক লক্ষ্য করেছেন থাপ্পড়টা খাবার পর মেয়েটার চোখে মুখে এক অবিমিশ্র অন্ধকার নেমে এসেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো মেয়েটা চুপচাপ অপমান হজম করেছে। প্রতিবাদ করেনি। এই সহনশীল আচরণ তাঁকে বিস্মিত করেছে। এখন ওই অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন মুখখানা দেখে তাঁর মনটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেলো। মেয়েটি গত বেশ কিছুদিন যাবৎ তাঁকে নানাভাবে মানসিক শক্তি যুগিয়ে এসেছে। পুত্র বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। প্রতিদানে মেয়েটিকে তিনি কিছুই দিতে পারেননি। উপরন্তু তাঁর স্ত্রী আজ মেয়েটিকে চরমভাবে অপমান করে ছাড়ল। একটা সুতীব্র অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো তাঁর ভেতরটা। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড অমৃতার দিকে চেয়ে থেকে তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন। হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিলেন। হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল অমৃতাও। কিন্তু যে কথাগুলো হারিয়ে যাবার জন্যেই নির্দিষ্ট, সে কথাগুলো অনর্থক মুখে উচ্চারণ করে কোনো লাভ নেই জেনেই হয়তো ওরা কেউ কিছু বলল না শেষ পর্যন্ত। না বলাই থাক। বলে ফেললেই কথাগুলোর প্রাণময় রূপখানি নষ্ট হয়ে যাবে। 

গাড়িতে ওঠার সময় অমৃতার হঠাৎ চোখ পড়ল মূল গেটের পাশে প্রহরীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা সুলেমানের দিকে। অন্য কারো দিকে নজর নেই তার। শুধু অমৃতাকেই কুটিল বক্র দৃষ্টি দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে দেখছে ওই তীক্ষ্ণ দুটি চোখ। 

কেন জানে না, আরো একবার নতুন করে বুক কাঁপলো অমৃতার লাইব্রেরি ঘরে ঘটে যাওয়া ঘটনার একমাত্র সাক্ষী সুলেমান। লোকটা যদি কাউকে কিছু বলে দেয়? 

১৩

বসন্ত এসে গেছে। নগরের আনাচে কানাচে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো গাছের ডালপালায় উঁকি দিয়েছে নবীন পাতা। অলস দুপুরে কানে এসে লাগছে কোকিলের কুহুতান। বিকেলের দিকে হঠাৎ হঠাৎ বয়ে যাচ্ছে মন কেমন করা স্নিগ্ধ বাতাস। 

হৃদির আব্বা আম্মা বলেছিলেন সামিদের বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া না হলে রাহাতের সাথে হৃদির বিয়েটা ক্যানসেল করা হবে না। কিন্তু হৃদি তার বাবা মায়ের আদেশ অমান্য করে অসীম সাহসিকতার একটা কাজ করে ফেলেছে। রাহাতকে সব খুলে বলেছে। রাহাত বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন বিবেকবান ছেলে। সম্পর্কটা খুব বেশি দূর এগোনোর আগেই হৃদি সবকিছু খোলামেলাভাবে জানিয়ে দিয়েছে বলে সে কৃতজ্ঞ হলো। তার পরিবার এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদার এবং বিচক্ষণ মানসিকতার পরিচয় দিল। অযথা উচ্চবাচ্য করে জল ঘোলা করল না তারা। কিন্তু এ ঘটনার পর থেকে হৃদির পক্ষে নিজের বাবা মায়ের সাথে এক ছাদের নিচে দিন কাটানো রীতিমতো অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগল। বাবা তার চোখের দিকে চেয়ে কথা বলছেন না। মা উঠতে বসতে কথা শোনাচ্ছেন। সে এক দুঃসহ অবস্থা! 

রোমেলা বিয়ে ভাঙার পরদিন হৃদির আম্মাকে ফোন করে যা তা কথা বলেছেন। তার ছেলের বিয়ে ভাঙার দায় সমস্তটাই তিনি চাপিয়েছেন হৃদির ঘাড়ে। হৃদির আম্মাও অবশ্য কম যান না। তিনিও দু চার কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন সামির কারণেই আমেরিকা প্রবাসী ডাক্তার পাত্র হাতছাড়া হয়ে গেলো। দুই মায়ের তর্কযুদ্ধ চলল প্রায় ঘণ্টাখানেক। ফোন রাখার পর হৃদির আম্মা ঘোষণা দিলেন যে, কোনোমতেই তিনি নিজের মেয়েকে ওই জল্লাদ মহিলার বাড়িতে বিয়ে দেবেন না। 

এদিকে তানিশার বাবা মা সামির পরিবারকে চূড়ান্ত ভাবে অপমান করে ছাড়ল। সংসদ সদস্য এবং স্বনামধন্য শিল্পপতির একমাত্র পুত্রের বিয়ে ভেঙে যাবার ঘটনা কয়েকটি পত্রিকা ফলাও করে বড় বড় অক্ষরে ছাপিয়ে দিল। এর মাঝে দুটি সংবাদপত্র সামিকে কোটিপতির বখে যাওয়া ছেলে, মাদকাসক্ত এবং দুশ্চরিত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। সংবাদটি ভুল। কারণ সামির জীবনে সিগারেট ছাড়া অন্য কোন নেশা নেই। মদ গাঁজা সে ছুঁয়েও দেখেনি কখনো। ছাব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত তার জীবনে এসেছে শুধু দুজন নারী। দুই নারীই তার বন্ধু। দুজনকেই সে মন থেকে ভালোবেসেছে। তার ভালোবাসায় কখনো কোনো লাম্পট্য বা ছলচাতুরী ছিল না। বাবার পয়সা উড়ানোর মতো বাজে অভ্যাসটাও গত এক বছর যাবৎ সে পরিত্যাগ করেছে। অতএব এই খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং মনগড়া। এরকম বানোয়াট খবর প্রকাশ হবার পেছনে যে তানিশার পরিবারের হাত আছে ষোলো আনা সে বিষয় জলের মতো পরিষ্কার। একমাত্র পুত্র সম্পর্কে এই মিথ্যে অপবাদ হক এবং রোমেলাকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড দুর্বল করে দিল। যে পত্রিকাগুলো এই ভুল সংবাদ প্রকাশ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছেন হক। এর মাঝেই দুজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়েছে। তানিশার বাবা মেয়ের অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। হক দম্পতি তার বাড়িতে গিয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছেন। সামি নিজে অনুনয় বিনয় করে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছে। কিন্তু তানিশা এবং তার পরিবারের বরফ শীতল মন কিছুতেই গলছে না। ইতোমধ্যে কয়েকজন ভাড়া করা গুন্ডাকে উত্তরা বাসার সামনে টহল দিতে দেখা গেছে। উড়ো ফোন এসেছে বেশ কয়েকবার। জানে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। হক সাহেব নিজের জীবনের ভয় করেন না। তিনি রাজনীতির লোক। তাঁর চারপাশে শত্রুরা সর্বক্ষণ প্রেতের মতো ফোঁসফোঁস নিশ্বাস ফেলে ঘুরে বেড়ায়। এসব ঝুঁকি মাথায় নিয়েই বেঁচে আছেন তিনি। তবে তাঁর লোকবলের অভাব নেই। পার্টির মিটিং, সভা সমিতিতে তিনি নিজস্ব দেহরক্ষী সঙ্গে রাখেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের ওপর এর আগে কোনোদিন কোনো রকম হুমকি আসেনি। এই সমস্যাটা নতুন। ছেলেকে তিনি ঘরের বাইরে বেরোতে দিচ্ছেন না। থানায় জিডি করে রেখেছেন। তবুও দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। জোয়ান ছেলেকে কাঁহাতক ঘরবন্দি করে রাখা যায়? ঘরে থাকতে থাকতে ছেলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। রোমেলা ছেলের বন্ধুদের সাথে মেলামেশায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে সামির বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ বন্ধ। বাড়ির বাইরে বেরোনোও বন্ধ। শেষমেশ ঠিক হলো বাড়ি থেকে বেরোতে হলে দুজন দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে বেরোতে হবে। 

আকাশের ইউনিভার্সিটিতে সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। একটু ব্যস্ততার মধ্যেই কাটছিল তার দিন। তবে আজকাল তার আর কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে অতটা খারাপ লাগে না। ঝুমকির রান্নাটা ভালোই। বাড়ি ফিরে সে পেটপুরে ভাত খায়। ঘুমোতে যাবার আগে রোজ ঝুমকি গ্লাস ভর্তি দুধ ওর পড়ার টেবিলে রেখে যায়। মাঝে মাঝে হাতেও তুলে দেয় যত্ন করে। আকাশ আগের মতো ঝুমকিকে দেখে দূর দূর করে না। আগ্রহ নিয়ে ওর হাত থেকে গ্লাস তুলে নেয়। চুমুক দেয়। দেখে ঝুমকির চোখে জল আসে। ছেলেটা তাকে আর আগের মতো ঘেন্না করে না। তার শূন্য জীবনটা একটু একটু করে যেন ভরে উঠছে। আকাশ তাকে বাগান করার সরঞ্জামাদি কিনে দিয়েছে। এই ফ্ল্যাটের উত্তর দিকে একটা ছোট্ট ব্যালকনি আছে। সেই এক টুকরো বারান্দায় ঝুমকি এখন ফুলগাছ আর সবজির গাছ লাগিয়েছে। দুদিন হলো গোলাপ গাছে কলি এসেছে। 

রুদ্রর আম্মা ঢাকায় আসার কথা ছিল কিন্তু আসতে পারলেন না শেষ অবধি। হঠাৎ করেই তার এপেন্ডিক্সের ব্যথা উঠল। অপারেশন করা জরুরি হয়ে পড়ল। রুদ্র দুদিনের ছুটি নিয়ে চলে গেলো চট্টগ্রাম। এর মাঝে বিভা আর অভিজিৎ ঘুরে আসলো বিভার খালার বাড়ি দোঘর থেকে, সপরিবারে। অভিজিতের ছুটি ফুরিয়ে আসছে। বিভাকে এবার যেতে হবে। এবার যাবার পর আবার কবে নাগাদ ঢাকায় আসার সুযোগ পাবে সে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। 

সামির ডিপ্রেশনটা দিনদিন বেড়ে চলেছে। বাড়িতে মায়ের সাথে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। কাজকর্ম নেই। বাইরে বেরোলেই সর্বক্ষণ আশেপাশে দুজন বডিগার্ড ঘুরঘুর করছে। গেলো সপ্তাহে হৃদির সাথে দেখা করতে গিয়েছে বডিগার্ড সঙ্গে নিয়ে। ভারি বিরক্তিকর ব্যাপার। তানিশা প্রায়ই তাকে ফোন দেয়। ফোন দিয়ে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করে। সামি চুপ করে শোনে। 

তাদের কোম্পানি থেকে প্রতি বছর এ সময় একটি ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়। এ বছরও হচ্ছে। গতবছর সবাই গিয়েছিল নেপাল। এ বছর যাবে বান্দরবান। কোম্পানির প্রতিটি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর এই ট্যুরে অংশগ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। রোমেলা ফি বছর নিজের বোনদেরও সঙ্গে নিয়ে যান। এ বছরও নেবেন। সামি কখনোই এসব অফিসিয়াল ভ্রমণে বাবা মায়ের সাথে যায়নি। এবার হক একরকম জোরই করলেন ছেলেকে। তাঁর মনে হলো ছেলের এমন দুর্বল মানসিক অবস্থায় হাওয়া বদল আবশ্যিক। শুনে সামি শর্তজুড়ে দিল, যদি তার বন্ধুদের সাথে নেয়া হয়, তবেই সে যাবে। হকের আপত্তি না থাকলেও আপত্তি জানালেন রোমেলা। কিন্তু আপত্তিটা খুব বেশিক্ষণ টিকল না। শেষমেশ ছেলের মুখের দিকে চেয়ে তিনি রাজি হলেন। 

অমৃতার ব্যস্ততা নিছক কম নয়। সামনের মাসের শেষের দিকে তার সুপ্রিম কোর্ট নিবন্ধন পরীক্ষা। প্র্যাক্টিসের পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে হচ্ছে সমান তালে। চেম্বার থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। পড়তে হয় রাত জেগে। কিন্তু অমৃতা আর আগের মতো শুধু কাজপাগল মেয়েটি নেই। পড়তে পড়তে সে আজকাল হঠাৎ করেই আনমনা হয়ে যায়। পড়া ফেলে ইউটিউবে টক শো দেখে। একই শো বার বার দেখে। লোকটার খুব সাধারণ কথাও তার কাছে অশ্রুতপূর্ব আশ্চর্য সুন্দর বলে মনে হয়। আচ্ছন্ন হয়ে শোনে সে, বিভোর হয়ে দেখে। এক অদম্য মুগ্ধতার সঞ্চার হয় তার মনে। বুক দুরুদুরু করে। কষ্ট কষ্ট একটা অনুভূতি হয়। বৃষ্টির দিনে একলা বসে মেঘলা আকাশের দিকে চুপচাপ চেয়ে থেকে মানুষটার কথা ভাবতে তার ভালো লাগে। 

সেদিনও সন্ধে থেকে টানা বৃষ্টি। বারান্দায় বসে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ কবিতার কয়েকটি লাইনে চোখ আটকে গেলো। অমৃতা একেবারেই কবিতা পড়া মেয়ে না। কিন্তু এই কবিতাটির লাইনগুলো যেন ড্যাবড্যাব করে তার দিকেই চেয়ে আছে। এ কবিতা যেন তার জন্যেই লেখা। লোকটা সেই রাতে লাইব্রেরি ঘরে বলেছিল যে, অমৃতা যেন আর কখনো তার সাথে কোনরকম যোগাযোগ না করে। অমৃতা কথা রেখেছে। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। কিন্তু সেদিন একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলল সে। কবিতার পঙক্তিগুলো কপি পেস্ট করে মানুষটার ফোন নম্বরে পাঠিয়ে দিল। 

হক সাহেব একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে মাত্র বাড়ি ফিরেছেন। গাড়ি থেকে নেমেছেন সদ্য। সাথে আছেন তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র। এমন সময় টুং করে মোবাইলের মেসেজ টোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে তিনি দেখলেন অমৃতার নম্বর থেকে বার্তা এসেছে। গত সপ্তাহটা এমনই এক শ্বাসরুদ্ধকর ব্যস্ততার মাঝে কেটেছে যে মেয়েটার কথা তিনি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলেন। গতকাল মানহানির মামলা সংক্রান্ত কাজে জর্জ কোর্ট যেতে হয়েছিল একবার। কোর্ট পাড়ায় ঢুকতেই মেয়েটিকে খুব করে মনে পড়ল। কোথায় আছে, কেমন আছে, তা একটিবারের জন্য জানতে ইচ্ছে করছিল খুব। আজকে মেসেজটা পেয়ে তিনি বাড়ির দিকে আর পা বাড়ালেন না। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হেঁটে চলে এলেন লাইব্রেরি ঘরে। ঘরের বাতি নেভানো। তিনি অন্ধকারে বসলেন খোলা জানালার পাশে। অমৃতা লিখেছে, 

পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক, 
আমরা তখন প্রেমে পড়বো, 
মনে থাকবে? 
বুকের ভেতর মস্তবড় ছাদ থাকবে, 
শীতলপাটি বিছিয়ে দেবো, 
সন্ধ্যে হলে বসবো দু’জন। 
একটা দুটো খসবে তারা, 
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে, 
তখন আমি চুপটি করে দুচোখ ভরে থাকব চেয়ে 
মনে থাকবে? 

বৃষ্টির তোড় বাড়ছিল। শব্দ করে বাজ পড়ল কয়েকবার। জানলা গেলে আসা উতলা বাতাসে টেবিলের ওপর রাখা কাগজ উড়তে থাকল খসখস শব্দে। তিনি মেয়েটার পাঠানো কবিতার লাইনগুলো পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই হেসে উঠলেন। কী ভীষণ ছেলেমানুষি কথাবার্তা! হাসলেন ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ বিনা কারণে তার মনটা কেমন উদাস হয়ে উঠল। তিনি শেষের কয়েকটা লাইন আবার পড়লেন। 

এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেবো, 
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন!
আমার অনেক কথা ছিল, 
এ জন্মে তা যায় না বলা,
বুকে অনেক শব্দ ছিল
সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক 
কাব্য করে বলা গেলো না! 

—(কবি-আরণ্যক বসু)

১৪

থানচি পৌঁছুলো ওরা ছ’টা নাগাদ। তখনো সন্ধে পুরোপুরি নামেনি। নামব নামব করছে। ধোঁয়াটে মেঘে মেঘে আবীর রঙ ছড়িয়ে দিয়ে চিম্বুক পাহাড়ের পেছনে অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন দিনমণি। বসন্ত বাতাস প্রাণ স্পন্দনে ভরপুর! ভ্রমণের জন্য এর চেয়ে উত্তম দিন বুঝি আর হয় না! 

বান্দরবান থানচি সড়কের পাশ ঘেঁষে প্রায় আঠারোশ ফিট উপরে অবস্থিত যে রিসোর্টটিতে ওরা এলো, সে রিসোর্টটি এক কথায় নান্দনিক। বর্তমান বাংলাদেশের অভিজাত রিসোর্টগুলির মধ্যে অন্যতম। কোম্পানির প্রায় আশিজন লোক আজ রাতের মধ্যেই উপস্থিত হবার কথা এখানে। এখনও অবশ্য কেউ এসে পৌঁছয়নি। বন্ধুরা সবার আগে রওয়ানা দিয়েছে এবং আগেই এসে পড়েছে। বান্দরবান শহর থেকে জিপ গাড়ি করে রিসোর্টে পৌঁছুতে সময় লেগেছে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। সামি নিজের গাড়ি আনতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবা তাকে অনুমতি দেননি। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোটা ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাবে বলে এই নিষেধাজ্ঞা। নিজস্ব গাড়ি আনলে অবশ্য খুব একটা সুবিধাও হতো না। কারণ এই যাত্রায় তাদের দলের সদস্য একজন বেড়েছে। অভিজিৎ। সামির গাড়িতে ঠেসে ছয়জন এঁটে গেলেও সাতজন কোনো রকমেই আঁটানো সম্ভব না। 

রিসোর্টের ড্রাইভওয়েটি বেশ লম্বা এবং বড়। ওরা জিপ গাড়ি থেকে নামতেই দুজন সিকিউরিটি গার্ড এগিয়ে এলো। লাগেজ বলতে খুব বেশি কিছু নেই ওদের। সবার হাতে একটি করে ব্যাকপ্যাক। সিকিউরিটির লোক ব্যাগগুলো হাত বাড়িয়ে নিতে চাইল বিনয়ের সাথে। বন্ধুরা কেউ অবশ্য ব্যাগ হস্তান্তর করল না। গেটের সামনে থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। কাঠের প্রশস্ত সিঁড়ি পেরোনোর পর রিসিপশন রুম। বিশাল বড় হলঘর। আধুনিক সাজসজ্জা। ঠান্ডা একটা ভাব। এতদূর জার্নি করে আসবার পর ওই শীতল ভাবটায় সবার মনপ্রাণ একদম জুড়িয়ে গেলো। দু দিনের জন্য সামিদের কোম্পানি এই পুরো রিসোর্টের বিশটি কটেজ রিজার্ভ করে ফেলেছে। বন্ধুরাই প্রথম অতিথি। বাকিরা পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত হবে হয়তো! বন্ধুদের জন্য একটি কটেজের তিনটি ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে। একটা বিভা আর অভিজিতের। বাকি দুটো ছেলেমেয়েরা ভাগাভাগি করে নেবে। 

প্রায় বারো একর জমির ওপর তৈরি রিসোর্টটিতে কটেজগুলো বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাহাড়ি এলাকা বিধায় কটেজগুলির কোনোটির অবস্থান উঁচুতে আবার কোনোটির নিচুতে। এক কটেজ থেকে অন্য কটেজে যেতে বেশ অনেকখানি পথ হাঁটতে হয়। প্রতিটি কটেজের চারপাশে আছে ঘন সন্নিবেশিত বৃক্ষ রাজি। কটেজের ভেতরে অবস্থানরত পর্যটকদের মনে হবে যেন তারা গভীর জঙ্গলের ভেতর কোনো শান্ত সুনিবিড় কুটিরে বাস করছে। রিসিপশন রুম থেকে কটেজ পর্যন্ত যাবার জন্য রয়েছে চার চাকার গো কার্ট। অতিথিদের লাগেজ নিয়ে হাঁটতে যেন কষ্ট না হয় সে কারণেই গো কার্টের ব্যবস্থা। বিভা ছাড়া অন্য কেউ অবশ্য কার্টে উঠতে চাইল না। সবাই হাঁটতে চায়। অগত্যা বিভাকেও হাঁটতে হলো। সরু পিচঢালা পথ দুপাশে সবুজ গাছের ঝোপ নিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে। ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে উড়ছে পাখি, ডাকছে টিউ টিউ শব্দে। 

হৃদির পরনে আড়ং থেকে কেনা বাদামি রঙের একটা ঘেরওয়ালা কুর্তা ছিল। সাথে কালো জিন্স। কোমর পর্যন্ত গড়ানো লম্বা চুলগুলো মুড়িয়ে বড় একটা খোঁপা করেছে সে। চোখে ক্লান্ত ভাব। মুখে কোনো প্ৰসাধন নেই। এমন কি পাউডার পর্যন্ত না। তবে সহজাত ঈশ্বর প্রদত্ত প্রসাধনীতে তার মুখখানা সর্বদা এক সরল সৌন্দর্যে টইটম্বুর হয়ে থাকে। এখনো আছে! 

বিভা পরেছে একটি হালকা সবুজ রঙের কোমর অবধি টপ আর কালো কাপড়ের প্যান্ট। তার চোখে সবুজ আর রুপালি রঙের আইশেডো। পাঁপড়িতে মাশকারার ছোঁয়া। গালে ব্লাশন। এত লম্বা জার্নির পরেও তাকে দেখতে একটুও ক্লান্ত লাগছে না। সে সর্বদাই নজরকাড়া সুন্দরী, গ্ল্যামারাস! 

অমৃতার গায়ে ছিল লাল সাদা চেকের ঢলঢলে ফুল হাতা শার্ট। মাত্র গতকাল সে চুল কাটিয়েছে পার্লার থেকে। যে মেয়েটি চুল কেটে দিয়েছে সে বলেছে এই বিশেষ স্টাইলের কাটকে নাকি বলা হয় ডায়না কাট। প্রিন্সেস ডায়নার চুলের ধরন এমন ছিল। 

হৃদি চুইংগাম চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আল্লাহ, জায়গাটা না অনেক জোশ!’ 

হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র তার খোলা চুলগুলোতে চিরুনির মতো হাত বুলাচ্ছিল। তার অন্য হাতে ধরা গিটার, কাঁধে ব্যাকপ্যাক। ‘জায়গাটা অনেক এক্সপেন্সিভ কিন্তু। সামির জন্যেই আসা হইল।’ এটুকু বলে একটু থেমে সে আবার গদগদ গলায় হৃদিকে বলল, ‘তোর তো ভালোই হইল। এখন সামির বাপ মা রাজি হইয়া গেলেই কাহিনি খতম। প্রতি মাসে মাসে এরকম ট্যুর দিতে পারবি।’ 

রুদ্রর কথাটা শুনে হৃদি পেছন ফিরে তাকালো ওর দিকে। হাঁটা থামাল না। উল্টো পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই বলল, ‘এটার মানে কী?’ 

—‘মানে সিম্পল। সামির বাপ মা রাজি হয়ে গেলে তোদের বিয়েটা হয়ে যাবে। তারপর যখন তখন যেখানে ইচ্ছা বেড়াইতে যাইতে পারবি। টাকা পয়সা তোদের জন্য কোনো ব্যাপার হবে না। আমেরিকা চইলা আসবি আমারে দেখতে।’ 

হৃদি এবার থামল। রুদ্রর সহজ স্বাভাবিক নির্লিপ্ত মুখটার দিকে কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। ওর ওই নিষ্পলক চেয়ে থাকা দেখে রুদ্রও হাঁটা থামালো। থামল সামি আর অমৃতাও। আকাশ, বিভা আর অভিজিৎকে অবশ্য থামতে দেখা গেলো না। রিসিপশনের লোকটার দেখানো পথ ধরে হেঁটে যেতে থাকল ওরা। 

হৃদি বলল, ‘তুই এটা কেমন কথা বললি রুদ্র?’ 

রুদ্র অবাক, ‘ভুল কিছু বললাম কি?’ 

হৃদির একটা হাত নিজের অজান্তেই কোমরে উঠে গেলো, তিরিক্ষি গলায় বলল, ‘সামির বাপ মা রাজি হয়ে গেলেই কাহিনি খতম, এই কথা দিয়া তুই কী বুঝাইতে চাইলি? সামির বাপ মায়ের মতামতই সব? আমার বাপ মায়ের মতামতের কোনো দাম নাই?’ 

রুদ্র একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। হৃদি যে তার বলা সোজাসাপটা কথাগুলোর এহেন বিপ্রতীপ, কুটিল অর্থ দাঁড় করাবে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। বিস্মিত গলায় বলল, ‘আমি কি সেটা বলছি?’ 

—‘সেটাই তো বললি তুই।’ কথাটা বলে হৃদি অমৃতার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘কী অমৃতা? রুদ্রর বাচ্চার কথা শুইনা তোর কী মনে হইছে?’ 

অমৃতা ইতস্তত করে বলল, ‘আরে ও এত কিছু চিন্তা কইরা বলে নাই। ড্রপ ইট দোস্ত। ও ইঞ্জিনিয়ার হইলে কী হবে? আসলে একটা আস্ত গাধা।’ 

সামি বলল, ‘এত রেগে যাবার কী হইল? তুই ওভার রিঅ্যাক্ট করতেছিস ক্যান?’ 

হৃদির মুখ থেকে তিরিক্ষি ভাবটা তখনো গায়েব হয়নি। সে আগের মতো খ্যাপাটে গলায় বলল, ‘মানে রুদ্র বুঝাইতে চাইলো যে আমার বাবা মায়ের ডিসিশনের কোনো দাম নাই। কারণ আমার বাপের তো সামির বাপের মতো অত টাকা নাই। আর সামির সাথে বিয়ে হইলে আমি নামি দামি জায়গায় ঘুরতে যাইতে পারব। কারণ সামি বড়লোকের ছেলে। আর আমি তো ফকিরের মাইয়া, এইজন্যে আমি নিজের টাকায় কোথাও যাইতে পারব না।’ 

রুদ্র চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সিরিয়াসলি! দোস্ত ইউ আর রিডিকিউলাস! মানে আমি তো এত কিছু চিন্তা কইরা বলিনাই। আরে আজিব!’ 

—‘তোর অবচেতন মন এসব চিন্তাই করতেছে। তাই মুখ ফসকে বলে ফেলছিস। ক্লিয়ার!’ চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করল যেন হৃদি। 

সামি হৃদির দিকে চেয়ে তীক্ষ্ণভাবে বলল, ‘তোর প্রব্লেম কী? এত মিন কেন তুই? কুটনামি করতেছিস কেন?’ 

—‘লিসেন আমি কোন কুটনামি করতেছি না। একটা কথা তুই কান খুইলা শুইনা রাখ। আমার ফ্যামিলিকে যদি তোরা ডিউ রেস্পেক্ট না করিস তাহলে আমিও তোর ফ্যামিলিকে দুই পয়সার পাত্তা দিব না। আমার বাবা মা ভাইসা আসে নাই।’

সামি খ্যাক দিয়ে উঠল, ‘আজাইরা কথা বলতেছিস ক্যান?’ 

—‘তুই জানিস তোর মা সেদিন আমার মারে কী বলছে টেলিফোনে?’

—‘উফ! আবার শুরু হইল! হৃদি ফর গড সেক তুই কি এইসব টপিক দুইটা দিনের জন্য অন্তত ভুলতে পারবি?’ 

—‘আমি অপমানটা কিছুতেই ভুলতে পারতেছি না।’ 

সামি অমৃতার দিকে চেয়ে অসহায় গলায় বলল, ‘এই মেয়েটারে একটু সামলা দোস্ত। এর সমস্যা কী আমি বুঝতেছি না। 

হৃদির চোখ দুটো একটু ছলছল করছিল। আর কেউ না বুঝলেও অমৃতা বোঝে ওর অভিমানের জায়গাটুকু। রুদ্রর সত্যই এভাবে বলা উচিত হয়নি। রুদ্রটার বাস্তবজ্ঞান কবে যে হবে তা একমাত্র খোদা জানেন। অমৃতা হৃদির পিঠে একটা হাত রেখে বলল, ‘বাদ দে। অবশ্যই তোর ফ্যামিলির মতামতের গুরুত্ব আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই শুধুশুধু রাগ করিস না।’ 

সামি হিংস্র স্বরে বলল, ‘মানে ঝগড়াইট্টা একটা মেয়ের সাথে প্রেম করতেছি আমি। বালের কপাল আমার। তানিশার মতো সুন্দর মেয়েরে ছাইড়া এই ঝগড়াইট্টার সাথে আসছি এখন ভ্যাকেশনে।’ 

হৃদি ভস করে জ্বলে উঠল দিয়াশলাই কাঠির মতো। জ্বলতে জ্বলতে বলল, ‘তোর মতো কুত্তা আমি আমার জীবনে আর দুইটা দেখি নাই। হারামজাদা, তানিশা সুন্দর আর আমি কি বান্দর?’ 

—‘তুই বান্দর দেইখাই তো তোর সাথে বান্দরবান আসছি। বুঝস না?’ এবার সামির গলায় ঠাট্টার সুর। 

হৃদির অবশ্য এখন ঠাট্টা বোঝার মতো অবস্থা নেই। কিছুক্ষণ আগুন চোখে সামির দিকে চেয়ে থেকে আর একটাও কথা না বলে সে ঘুরে দাঁড়ালো। গটগটিয়ে হেঁটে যেতে লাগল সামনে। 

রুদ্র এগিয়ে গিয়ে হৃদির হাত চেপে ধরল পেছন থেকে। অনুনয় করে বলল, ‘শোন! আমি আসলে বুঝি নাই যে কথাটা তোকে এত হার্ট করবে। দোস্ত প্লিজ, ফানিমুনে আইসা এরকম রাগারাগি করলে তো ভাল লাগে না।’ 

হৃদি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রুদ্রর হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল। চিৎকার করে বলল, ‘হাত ছাড়! ফালতু কোথাকার!’ 

রুদ্র হাত ছাড়ল না। হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতেই বলল, ‘ভুল হইছে দোস্ত। মাফ কইরা দে।’ 

হৃদি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘এত সহজে তো মাফ হবে না।’ রুদ্রর করুণ মুখটা দেখে মনে হলো অনুতাপের ঠ্যালায় সে মারা যাচ্ছে। -’প্লিজ দোস্ত। ভুল কথা বলে ফেলছি। তোর বাবা মা হইল আসল সর্দার। উনারাই রাজা রাণী। উনারা হইল ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মালানিয়া ট্রাম্প! আজকে থেকে এইটা আর ভুলব না!’ 

—‘কানে ধর!’ 

রুদ্র চমকে উঠল, ‘কী?’ 

—‘মাফ পাইতে চাইলে কানে ধর। নইলে মাফ হবে না।’ 

—‘এইটা কোনো কথা হইল?’ 

—‘এইটাই কথা!’ 

রুদ্র আশেপাশে তাকালো একবার। রিসোর্টের কর্মচারীরা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরকম অবস্থায় কান ধরে উঠবস করাটা একেবারেই সমীচীন হবে না। সে বলল, ‘আচ্ছা কান ধরবো। এখন না। পরে।’ 

হৃদি ‘তাহলে মাফ করাও পরে হবে।’ বলে হাঁটা ধরল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *