বৃষ্টিমহল ৩.১

ওরা যাচ্ছে কমলাপুর রেলস্টেশন। সিএনজির ভেতরে দুজনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে আধো আলোআঁধারিতে। শীতের খরবাতাস কেটে সাঁই সাঁই শব্দে ছুটে যাচ্ছে বাহনটা। সামি হৃদির কাঁধ জড়িয়ে ধরে বসেছিল। হৃদির মাথাটা আলতোভাবে ওর বুকের ওপর রাখা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এমন ঘন ঘোর বিপজ্জনক মুহূর্তেও হৃদিকে পাশে নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে সামি তার বুকের মধ্যে এক মনোরম শান্তি অনুভব করছিল। তার আর কোনো দুঃখ নেই আজ। ডুয়ার্সের সন্ধেবেলার সেই অলৌকিক মায়াবী মেয়েটাকে সে পেয়ে গেছে। চিরদিনের জন্য পেয়ে গেছে! 

কিন্তু হৃদিতার মনের ভেতর এখন বাস্তবতা ঠোকর দিচ্ছে। খচখচ করছে। কেবলই নিজের বাবা মায়ের মুখ ভেসে উঠছে চোখের সামনে। পালিয়ে যাওয়ার খবর শোনার পর ওই দুজন মানুষের মনের অবস্থা কী হবে, প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠছে সে বারেবারে। 

—‘মনে হচ্ছে পালায় যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। চল ফিরে যাই!’ অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলল হৃদি। 

—‘মাথা খারাপ! এখন ফিরে গেলেই তানিশাকে বিয়ে করতে হবে।’

—‘বেকুবের মতো কথা বলিস না সামি। তোর কি মুখ নাই? তুই মুখ ফুটে বলবি স্পষ্টভাবে যে তানিশাকে তুই বিয়ে করতে পারবি না।’ 

—‘আমি আম্মাকে ফেস করতে চাচ্ছি না হৃদি। আম্মা অনেক কষ্ট পাবে ব্যাপারটা জানার পর।’

—‘তুই পালায় গেছিস বিয়ের আগের রাতে এটা জানার পর কি উনি খুশি হবেন?’ 

সামি দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘ফিরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমি আম্মার মুখের সামনে দাঁড়ায়ে এই সব বলতে পারব না। ইম্পসিবল।’ 

—‘তুই একটা ভীতুর ডিম!’ 

—‘আচ্ছা শোন, এক কাজ করা যায়।’ 

—‘কী কাজ?’ 

—‘আকাশ, রুদ্র ওদেরকে বলি যে আব্বা আম্মাকে গিয়ে ব্যাপারটা বলতে।’ 

—‘কোন ব্যাপার?’ 

—‘মানে এইযে আমি তানিশাকে বিয়ে করতে পারব না।’ 

—‘তারপর?’ 

—‘তারপর… ওরা রিকোয়েস্ট করবে বিয়েটা ক্যানসেল করতে।’ 

—‘তোর বাপ মা জানতে চাইবেন না যে তানিশাকে তুই কেন বিয়ে করবি না?’ 

—‘জানতে চাইলে ওরা বলবে যে আমি তানিশাকে ভালোবাসি না, অন্য কাউকে ভালোবাসি।’ 

—‘অন্য কাকে ভালোবাসিস তুই?’ 

—‘আছে একটা পেত্নী টাইপ মেয়ে।’

—‘কী বললি?’ 

—‘কী আর বলবো, সুন্দরী তো জুটলো না আমার কপালে, পেত্নিই জুটলো শেষ পর্যন্ত।’ 

হৃদি খুব রেগে গেলো এ কথা শুনে। চকিতে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো। ক্যাটক্যাট করে বলল, ‘তোর মতো একটা কুত্তা মার্কা পোলার জন্য আমি লাইফ রিস্ক নিয়া বাপ মা ছাইড়া ভাগতেছি, মানে আমারে জুতা দিয়া পিটানো উচিত।’ 

সামি নির্বিকার গলায় বলল, ‘জুতা আমার পায়েই আছে। পিটানো শুরু করব?’ 

—‘একটা লাখি মেরে রাস্তায় ফালায় দিব হারামজাদা!’ 

সামি হাসে, তির্যক গলায় বলে, ‘ছিঃ তুই এসব কী বলতেছিস? বয়ফ্রেন্ডের সাথে মানুষ এভাবে কথা বলে?’ 

—‘বয়ফ্রেন্ড না ছাই!’ 

—‘বয়ফ্রেন্ড না?’ 

—‘নাহ, তোকে আমার মোটেও বয়ফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড মনে হচ্ছে না।’ 

হৃদি একটু দূরে সরে গিয়েছিল। সিএনজির খাঁচার ফাঁক গলে হুড়মুড় করে হাওয়ারা ঢুকছিল দল বেঁধে। ঝাঁপিয়ে পড়ছিল মাতালভাবে হৃদির খোলা চুলের গোছায়। সামি হৃদির কাছে সরে এসে বসলো। ওর পিঠময় 

ছড়িয়ে থাকা রেশমি, সুগন্ধি খোলা চুলগুলি ডান হাত দিয়ে সরিয়ে নিয়ে কণ্ঠগ্রীবায় একটি আলতো চুমু খেয়ে বলল, ‘এখন মনে হচ্ছে?’ 

—‘যা ভাগ, তোর সুন্দরী তানিশার কাছে যা। পেত্নীর সাথে অত কী, হ্যাঁ?’

—‘সুন্দরী তো ভাগ্যে জুটলো না। কপাল খারাপ।’ 

হৃদি এবার একটু ফিসফিস করে বলল, ‘বেশি কাছে আসিস না। ড্রাইভারটা একটু পরপর মিররের ভেতর দিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে। বিরক্ত লাগতেছে।’ 

সামি তাকিয়ে দেখল সত্যই দাড়িওয়ালা লম্বাটে চেহারার মধ্যবয়স্ক ড্রাইভার ব্যাক মিররের কাচ ভেদ করে তাদের দিকেই চোরা চোখে তাকিয়ে আছে। সে সাতপাঁচ কিছু না ভেবেই বিরক্ত গলায় বলল, ‘কী মামা বারবার পিছনে তাকাও ক্যান? গার্লফ্রেন্ডের সাথে আছি। প্রাইভেসি দরকার, বুঝো না ব্যাপারটা?’ সামির কথার ধরনে ড্রাইভার হেসে দিল। হেসে উঠল হৃদিও, মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিল করে। 

বন্ধু থেকে প্রেমিকপ্রেমিকায় রূপান্তরিত হবার এই সময়টি বড়ই অদ্ভুত আর অন্যরকম। দুজনের কেউই এখন অবধি এই অন্যরকম অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে উঠতে পারেনি। ধবধবে সাদা জল রঙের ওপর ফোঁটায় ফোঁটায় লাল রং মেশালে ঠিক যেমন করে সাদা রঙের মাঝে লাল রং একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবে ওদের বন্ধুত্বের সফেদ বর্ণ সম্পর্কের মাঝে ফোঁটায় ফোঁটায় প্রণয়ের অরুণ বরণ রংটা মিশছিল, খুব ধীরেধীরে। ভারি সুমধুর আর মনোরম এই সম্পর্ক বদলের রঙের খেলা! 

নিজের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল রুদ্র। চমকে উঠলো আকাশ। অতি মনোযোগ সহকারে সে তার এন্ড্রয়েড ফোনে কার্ড খেলছিল, অনলাইনে। রুদ্রর থাপ্পড়ের শব্দ শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে মুখ তুলে বলল, ‘সমস্যা কী? নিজেরে নিজে থাপ্পড় মারতেছিস কেন?’ 

—’মশা!’ 

ওরা বসে আছে ছাদের ওপর। পুল সাইডের পাশে। একটা হলুদ ডিম ডিম আলো জ্বলছে এদিকটায়। কুয়াশা জেঁকে বসেছে সেই ডিম আলোর গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে। মাঘ মাসের শীতল আকাশে একটা গোল চাঁদ জেগে আছে। কুয়াশা এবং হলুদ আলোর উপস্থিতিতে জোছনাটা ঠিকমতো টের পাওয়া যাচ্ছে না। 

—‘কোথায় মশা? আমারে তো কামড়াইতেছে না, তোরে ক্যান কামড়ায়?’ পুনরায় খেলায় মনোযোগ ফিরিয়ে নিয়ে বলল আকাশ। 

রুদ্র উদাস ভাবে বলল, ‘আমার রক্ত মিষ্টি। শরবতের মতো মিষ্টি।’

—‘কে বলছে?’ 

—‘আমি জানি।’ 

—‘ক্যামনে জানোস, তুই তোর রক্ত খাইয়া দেখছস?’ 

—‘হ, খাইছিলাম একবার। তুই খাবি? টেস্ট করতে পারিস, মজা আছে। মিষ্টি মিষ্টি।’ 

আকাশ আগুন গরম চোখে তাকালো রুদ্রর দিকে, ‘আমি কি ভ্যাম্পায়ার? রক্ত খাবো কেন?’ 

—‘বুদ্ধিমানরা রক্ত খায়। এই তথ্যটা কি তোর জানা ছিল?’ 

—‘ফালতু কথা বলিস না।’ 

—‘অন্য কিছু তো করার নাই। তাই বসে বসে ফালতু কথা বলেই টাইম পাস করতে হবে। সামি তো যেই পল্টিটা মারল মামা, এখন তো মনে করো যে বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে আমার একলা থাকা লাগব।’ 

—‘ক্যান আন্টি আইতাছে না?’ 

—‘আম্মা আইতাছে। তাও এতদিন একসাথে ছিলাম। অনেকটা স্বামী স্ত্রী টাইপ সম্পর্ক হয়ে গেছিল আমাদের মধ্যে। এখন তো আমি ওরে মিস করব, বুঝোস না?’ 

আকাশ নাক কুঁচকে বলল, ‘স্বামী স্ত্রী টাইপ সম্পর্ক ছিল নাকি তোদের মধ্যে? তলে তলে এইসব চলতেছে? ছিঃ!’ 

—‘সেইটা না। মানে মানসিক দিক দিয়া একটা এটাচমেন্ট ছিল না?’

—‘রুদ্র, তুই বাল ছাল বকতেছিস। চুপ থাক শালা! 

—’কিছু তো করার নাই।’

—‘নিউজ শোন।’ 

—‘সব নিউজ আমার জানা আছে। নতুন কিছুই নাই।’ 

—‘তাহলে বলা শুরু কর ‘পাখি পাকা পেঁপে খায়’ দেখি কয়বার বলতে পারস।’ 

—‘আমি বলতে পারব একশোবার, টানা! তুই বল দেখি, শী সেলস সি শেলস বাই দ্যা সি শোর’ 

আকাশ টেনে টেনে বলতে থাকল, শী সেলস সি শেলস বাই দ্যা সি শোর। 

তৃতীয় বার বলার সময় সে বলে ফেলল, সি শেলস শী শেলস বাই দ্যা…

রুদ্র মাঝখান থেকে বলে উঠল, ‘ব্লা ব্লা ব্লা, আগডুম বাগডুম ঘোড়ার ডুম’

—‘ডিস্টার্ব করস ক্যান মামা? বলতে দে।’ 

—‘কিছুই হচ্ছে না। তোর জিহ্বায় এমনিতেই প্রব্লেম আছে। নরমাল কথাই কইতে পারস না শালা এইটা ক্যামনে কইবি?’ 

ঠিক সেই সময় রুদ্রর ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। হৃদি ফোন করছে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে হৃদি হড়বড় করে বলল,’ রুদ্র, দোস্ত, তোদের একটা কাজ করতে হবে।’ 

রুদ্র একটু ভড়কে যাওয়া গলায় বলল, ‘কী কাজ?’ 

—‘সামির আব্বা আম্মারে গিয়ে বল, যে, ও তানিশারে বিয়া করবে না।’

—‘মাথা খারাপ! আমারে কি কুত্তায় কামড়াইছে?’ 

—‘প্লিজ দোস্ত, এই উপকারটা করতেই হবে। তোরা আঙ্কেল আন্টিকে বলার পর আমরা বাসায় ফিরে আসব।’ 

রুদ্র কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘এই কাজ আমরা কিছুতেই পারব না। অমৃতাকে বল।’ 

—‘অমৃতার বাচ্চি ফোন ধরতেছে না ক্যান? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না। 

—‘জানি না। বিভাকে ঘটনা জানাইছি। সে আর তার বর আসতেছে এখানে।’ 

—‘এখানে মানে?’ 

—‘মানে সামির বাসায়।’ 

—‘আইসা কী করবে?’ 

—‘নাচবে, ধেইধেই করে! শালি তোদের প্রব্লেম সল্ভ করার জন্য আসতেছে।’ 

—‘ও আচ্ছা। তাইলে তো হয়েই গেলো। আমার বিশ্বাস অমৃতা ব্যাপারটা সামলাইতে পারবে। কিন্তু ওই ছেমড়ি গেছে কই?’ 

—‘আমরা জানি না, অনেকক্ষণ ধরে ফোন করতেছি, ফোন রিসিভ করতেছে না।’ 

—‘আচ্ছা ঠিক আছে দোস্ত। কাজ হয়ে গেলে আমাদেরকে জানাইস।’

—‘তোরা কি ফেরত আসতেছিস?’ 

—‘হ্যাঁ।’ 

—‘গুড, এটাই ভালো হবে।’ 

—‘হুম, রাখি তাহলে।’ 

—‘ওকে, সি ইউ সুন।’ 

বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকেই পা দিয়ে ঠেলে কাঠের দরজাটা আটকে দিলেন হক। দুম করে একটা বিকট শব্দ হলো। তাঁর মুখে এখন লেপটে আছে এক গা ছমছমে কঠোরতা। বক্র ভ্রুর নিচের চোখদুটি জ্বলছে তেজের অঙ্গারে টেবিল সংলগ্ন চেয়ারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন তিনি অমৃতাকে। অমৃতার তখনও নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বুক কাঁপছে মুরগির দুর্বল সিনার মতো। দাঁড়ানোর পরেও পা দুটি টলছে। তার মাথাটা এখন লোকটার সবল, দৃঢ়, প্রশস্ত বুকের খুব কাছে। দামি কোনো পারফিউম মেখেছে মানুষটা। পারফিউমের সৌরভে অমৃতার ঘ্রাণেন্দ্রিয় তখন সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন। লোকটার বুকের ওপর এলোপাতাড়ি পড়ছে তার উষ্ণ, কম্পিত, ক্ষুরধার নিশ্বাস। কাঠের চেয়ারের হাতলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সে দুর্বলভাবে মুখ তুলে তাকালো একবার সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটার চোখের দিকে। সেই চোখের দৃষ্টি তখন বড়ই উগ্র, ক্রুর এবং হিংস্র। বিষধর সাপের মতো এক করাল রাগের থাবায় ফুলে ফুলে উঠেছে মানুষটার কপালের নীল রগ। সেই রাগান্বিত চেহারা দেখে অবশ্য অমৃতার তেমন কিছুই আসলো, গেলো না। সে অকপট চেয়ে রইল তার কাজল কালো মদির দৃষ্টি দুটি চোখ মেলে, অগ্নি দর্শন সেই মুখের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর তার ঠোঁট দুটো হালকা কেঁপে উঠল। চোখের তারা একটু একটু করে হয়ে উঠল ঝাপসা। গলায় সুড়সুড়ি দিতে লাগল কান্নার দলা। তার মুখ দেখে এখন বোঝা যাচ্ছে, নিজের কৃতকর্মের জন্য সে লজ্জিত। হক সাহেব তীব্রভাবে কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই অমৃতার অর্ধনিমীলিত ডান চোখের কার্নিশ উপচে একটি টলটলে জল বিন্দু টুপ করে গড়িয়ে পড়ল হেমরঙের গালে। কী আশ্চর্য সুন্দর যে দেখাল তখন তাকে! ওরকম শুভ্র, নৈকষ্যপূর্ণ সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে অসুরের হৃৎপিণ্ড ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, মানুষ তো কোন ছার! স্ফটিক ন্যায় জলের ফোঁটাটা প্রথমে গাল বেয়ে নেমে এলো ওর চন্দন রঙের কণ্ঠাহাড়ের কালো তিলের ওপর। তারপর গড়িয়ে পড়তে পড়তে একসময় মিশে গেলো বুকের ভাঁজের কাছে, ব্লাউজের বোতামের সাথে। 

তিনি চকিতে চোখ সরিয়ে নিলেন। সরে আসলেন জায়গাটা থেকে। থমথমে মুখ নিয়ে কয়েকবার পায়চারি করলেন ঘরের ভেতর। অমৃতা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লো জড়োসড়ো হয়ে। হঠাৎ কোত্থেকে যেন একরাশ কুণ্ঠা তেড়ে এসে জাপটে ধরেছে তাকে। লজ্জা শরমের বালাই তার কোনো কালেই ছিল না। কিন্তু আজকে এই ব্লাউজ আর পেটিকোট পরা অবস্থায়, একলা ঘরে লোকটার সামনে বসে থাকতে তার সীমাহীন লজ্জা লাগছে! মনে হচ্ছে যেন লজ্জায় সে মরে যাবে! 

আগরবাতির ঘ্রাণের সাথে অস্বস্তি মিশে গিয়ে বাতাস এখন গুমোট হয়ে আছে। হক চোখের কোণ দিয়ে মেয়েটিকে একবার দেখলেন। আড়ষ্টভাবে বসে আছে মেয়েটা। একটু একটু কাঁপছে। বড়ই বিব্রতকর পরিস্থিতি। এরকম অবস্থায় মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও তাঁর সংকোচ বোধ হচ্ছে। ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেছে এখন খুব দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিতে হবে। দৃশ্যটা যদি সুলেমান ছাড়া অন্য কারো চোখে পড়ে থাকে তাহলে একটা বড়সড় ঝামেলার সম্মুখীন হতে হবে তাঁকে। বিরাট স্ক্যান্ডাল হয়ে যাবে। মেয়েটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ঘর থেকে বিদায় করতে হবে। কিন্তু মেয়েটার পরনের শাড়ি গেছে পুড়ে। এই অবস্থায় একটা মেয়ে ঘরের বাইরে বেরোবে কী করে? দুশ্চিন্তায় তার মাথার রগ দপদপ করতে লাগল। আচ্ছা মুসিবতে পড়া গেলো তো! 

তিনি কথা শুরু করার আগে হেঁটে এসে পশ্চিম দেয়ালে লাগানো বাতির সুইচটা অফ করে দিলেন। ঝুপ করে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসলো সারা ঘরে। আলোটা অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গে অমৃতার বুকের কাছে কাঁটা হয়ে জমে থাকা দমবন্ধ-করা অস্বস্তিটা নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে গেলো। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে। শরীর থেকে জড়োসড়ো ভাবটা কেটে গেলো। আপাতত কেউ তাকে দেখছে না। লোকটার বুদ্ধির প্রশংসা না করলেই নয়! 

কিন্তু স্বস্তির প্রহর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীরব, নিষ্প্রভ রাতের গুমোট আবরণ ভেদ করে তীরের বেগে ছুটে আসলো হিংস্র এক গর্জন। 

—‘কী করতে যাচ্ছিলে তুমি?’ 

অমৃতা চমকে উঠল। এতটা চমকায়নি সে বহু বহুকাল ধরে! আজকের এই ঘটনা তার ব্যক্তিত্বের শক্ত খোলসটা কেমন যেন নড়বড়ে করে দিয়েছে। ঘা লেগেছে আত্মবিশ্বাসে। নিজের লাজহীন কৃতকর্মে নিজেই বিস্মিত, স্তম্ভিত এবং কুণ্ঠিত। তার উপর এই উঁচু গলার হিম হিম কঠিন ধমকটা একদম বুকের খাঁচায় হাতুড়ির মতো আঘাত হানল। 

—‘কথা বলছ না কেন? কী করতে যাচ্ছিলে তুমি? সুইসাইড?’ 

অমৃতা অন্ধকারে চোখ তুলে তাকাল সামনের দিকে। কিচ্ছু দেখা যায় না। শুধু বোঝা যায় লম্বা মানুষটা টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, স্থির হয়ে। অমৃতা সেই ছায়াবৃত অবয়বের দিকে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে একটা বড় শ্বাস টেনে নিল। বিক্ষিপ্ত মনের ভেতর গুড়িয়ে যাওয়া, ছড়িয়ে যাওয়া ভঙুর আত্মবিশ্বাস পুনরায় কুড়িয়ে নিয়ে একত্র করার চেষ্টা করল যেন সেই দীর্ঘ নিশ্বাসের সাথে। 

—‘সুইসাইড করতে চাইনি!’ 

—‘তাহলে কী ছিল এটা?’ 

অমৃতা একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি শুধু শাড়িটা… শাড়িটা পুড়িয়ে ফেলতে চাইছিলাম।’ 

হক দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন, ‘শাড়িটা যে তোমার গায়ে জড়ানো ছিল এই বিষয়টা কি তোমার মাথায় ছিল না? কী হতো যদি গায়ে আগুন ধরে যেত? কী হতো যদি সঠিক সময়ে আমি জায়গাটাতে না পৌঁছাতাম? তোমাকে আমি বুদ্ধিমতী মনে করেছিলাম। কিন্তু এখন তো দেখছি তুমি একটা কাণ্ডজ্ঞানহীন বোকা মেয়ে! যদি কোনো বিপদ হয়ে যেত তাহলে নিজের সাথে সাথে আমাকেও ডুবাতে তুমি। আমার মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতে।’ 

অমৃতা একটু ত্যাড়াভাবে বলল, ‘ও আচ্ছা, আপনি তাহলে নিজের মান সম্মান বাঁচাতেই ছুটে গিয়েছিলেন বারান্দায়। আমাকে বাঁচাতে নয়!’ 

হক টেবিলের সামনে রাখা একটি চেয়ার হাত দিয়ে টেনে নিলেন। মেঝেতে ঘর্ষণ তুলে বিচ্ছিরি আওয়াজ করল কাঠের চেয়ারটা। তিনি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘ঠিক ধরেছ। নিজের সম্মান বাঁচানোটাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।’ 

—‘এত স্বার্থপর কেন আপনি?’ 

—‘উত্তরটা জানা নেই।’ 

—‘আমি যদি পুড়ে যেতাম? মরে যেতাম? আপনার একটুও খারাপ লাগত না আমার জন্য?’ কেমন করুণ শোনাল অমৃতার কণ্ঠস্বর। 

—‘না লাগত না!’ কথাটা যথেষ্ট শক্তভাবেই বলার চেষ্টা করলেন তিনি। 

—‘সত্যি?’ 

—‘কেন এমন একটা বিপদজ্জনক কাজ করতে গিয়েছিলে তুমি?’

—‘শাড়িটার ওপর রাগ লাগছিল।’ 

—‘আশ্চর্য! কেন?’ 

অমৃতা একটু সময় চুপ করে থাকল। তারপর ভারি গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিলেন কেন রাশেদ?’ 

—‘তুমি বাধ্য করেছিলে।’ 

—‘কী দোষ ছিল আমার?’ 

—‘অমার্জিত এবং অসংলগ্ন কথা বলছিলে তুমি।’ 

—‘আজব তো! আপনাকে আমার সুন্দর লাগে, এই কথাটা বলা কি অন্যায়?’ 

—‘হ্যাঁ অন্যায়।’ 

—‘সত্যি কথা বলতে পারব না?’ 

—‘সব সত্যি কথা সবসময় সবাইকে বলতে হয় না। এসব তোমাকে শিখতে হবে!’ 

অমৃতা স্তিমিত গলায় বলল, ‘সবাইকে বলি নাতো! আপনাকেই বলেছি! জীবনে প্রথমবার! 

—‘আমি তাড়িয়ে দিয়েছি বলে তুমি শাড়ি পুড়িয়ে ফেলবে? এটা কেমন কথা?’ 

—‘সব ওই শাড়িরই দোষ!’ 

—‘অমৃতা! কী বলছ তুমি এসব? পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে। আর একটা কথা, তুমি স্মোক করছিলে কোন সাহসে? আমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে?’ 

—‘আপনার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা যাবে না। এটা কোন আইনে বলা আছে?’ 

—‘পার্লামেন্ট পাশ হওয়া আইনের বাইরেও পৃথিবীতে আরো কিছু নিয়মকানুন আছে। যাকে বলে ভদ্রতা বা চক্ষুলজ্জা। তুমি নিশ্চয়ই তোমার বাবার সামনে স্মোক করো না।’ 

—‘বাবার কথা টানছেন কেন? আপনি আমার বাবা নন। বাবার মতোও নন। আপনাকে আমি ওই চোখে দেখি না। অ্যান্ড আই অ্যাম প্রিটি মাচ শিওর যে আপনিও আমাকে মেয়ের মতো দেখেন না। তাই আর কোনো দিন বাবার প্রসঙ্গ টানবেন না।’ 

মেয়েটার চটাংচটাং কথা শুনে হক একদম থ বনে গেলেন। কয়েকটা সেকেন্ড নীরবে কাটলো। একটা সময় তিনি কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘তোমার এই স্মোক করার স্বভাবটা ছাড়তে হবে।’ 

—‘কেন? আপনি বুঝি স্মোক করেন না?’ 

—‘আমার কথা আলাদা।’ 

—‘আলাদা কেন হবে?’ 

—‘অমৃতা মুখে মুখে তর্ক করবে না!’ 

—‘তর্ক করছি কোথায়। শুধু জানতে চাইছি আমার স্মোকিংয়ে আপনার প্রব্লেমটা কোথায়?’ 

—‘তুমি একটা মেয়ে। এটা তোমার মাথায় রাখা উচিত।’ 

—‘আপনি একদম ব্যাকডেটেড লোকদের মতো কথা বলছেন। 

—‘আমি মানুষটাই ব্যাকডেটেড। এটা তোমার ভুলে গেলে চলবে না। তাছাড়া আমি শুনেছি তুমি কোর্ট এরিয়াতেও জনসম্মুখে স্মোক কর। লোকজন তোমার এসব উদ্ধত চলাফেরা নিয়ে আড়ালে বাজে কথা বলে, এটা কি তুমি জানো?’ 

—‘লোকজনের কথা পাত্তা দেওয়ার মতো অত সময় নেই আমার। আর তাছাড়া আমাকে নিয়ে কেউ খারাপ কিছু বললে আপনার কী? আপনি তো মাত্রই বললেন যে আমি পুড়ে গিয়ে মরে গেলেও আপনার কিছু আসবে যাবে না।’ 

হক একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন। প্রচণ্ড বিরক্ত গলায় বললেন, ‘তুমি আর কখনো সিগারেট খাবে না। কথাটা যেন মনে থাকে। আর হ্যাঁ, শাড়ির ওপর হঠাৎ রাগ হলো কেন?’ 

—‘আজকে আমি জীবনে প্রথমবারের মতো শাড়ি পরেছিলাম।’ 

—‘সেটা আমার জানা আছে।’ 

—‘প্রথম বারের মতো সাজগোজ করেছিলাম।’ 

—‘জানলাম।’ 

—‘সাজটা ছিল একজন বিশেষ মানুষের জন্য।’ 

হক এ কথার প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বললেন না। তিনি বুদ্ধিমান মানুষ। কথার ঢেউ ঠিক কোন নদীতে গিয়ে মিশতে চাইছে তা বুঝে উঠতে তাঁর খুব একটা বেগ পেতে হলো না। তিনি চুপ করে রইলেন। 

অমৃতার কণ্ঠে এবার অভিমান বেজে উঠল ঝনঝন করে, ‘কিন্তু সেই বিশেষ মানুষটা আমাকে একটাবার চোখ মেলে দেখলও না। উল্টো অপমান করে তাড়িয়ে দিল ঘর থেকে। আপনি বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা কত কষ্টের?’ 

হক ভেবে পেলেন না এই আবেগঘন আক্ষেপ শোনার পর তাঁর ঠিক কী বলা উচিত। একটি সমৃদ্ধ, সফল এবং ঘটনাবহুল জীবনের অনেকখানি পার করে আসার পরেও আজ তিনি জানেন না যে এ ধরনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে একটি অল্পবয়সী মেয়েকে ঠিক কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়। 

সারা ঘরে একটা নিস্তব্ধতার বলয় তৈরি হচ্ছিল ধীরেধীরে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু দুটি হৃদপিণ্ডের টিকটিক করে ডেকে যাওয়া অনবরত। অন্ধকার! অন্ধকারেরও নিজস্ব একটা আলো আছে। সেই আলোতে অমৃতা মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছিল। গুম হয়ে বসে আছেন চেয়ারে। কী ভাবছেন উনি? অমৃতার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল লোকটার ভাবনার শহর থেকে একটা বার অন্তত ঘুরে আসতে। 

এটা তো ভালো লাগার সময় না। তবুও কেন যে অমৃতার এত ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে ঠিক এমনিভাবে অন্ধকারে লোকটার মুখোমুখি চুপটি করে বসে থেকেই যেন সে গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। সে হঠাৎ অন্যরকম গলায় প্রশ্ন করল, ‘শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছিল, রাশেদ?’ 

আকস্মিক প্রশ্নটা সামনে বসে থাকা দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষটাকে একটু কেমন নার্ভাস করে তুলল। তিনি বিব্রতভাবে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা সেলফোনটা হাতে তুলে নিলেন। হয়তো এড়িয়ে যেতে চাইলেন প্রশ্নটা। কিন্তু অমৃতা তো নাছোড়বান্দা! 

—‘বলুন না!’ 

তিনি গমগম করে বললেন, ‘অমৃতা! আমি কমপ্লিমেন্ট দিয়ে অভ্যস্ত নই। অমৃতা মোবাইলের ফিকে আলোতে লোকটার বিপন্ন মুখখানা দেখতে পেল। হাসি পেয়ে গেলো তার। অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, –’নিজের বউকেও কমপ্লিমেন্ট দেন না নাকি আপনি?’ 

অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে তিনি বললেন, ‘খুবই কম।’ 

—‘আপনি একদমই রোমান্টিক না।’ 

—‘তুমি আবারও অভদ্র কথাবার্তা বলা শুরু করেছ। বকা খাবে কিন্তু আবার!’ 

—‘আবার তাড়িয়ে দেবেন?’ 

—‘প্রয়োজনে তাই করতে হবে!’ 

ঠিক সেই সময় হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে একটা পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো। সেই আচমকা পায়ের আওয়াজটা ঘরের ভেতরে বসে থাকা দুজন অসমবয়সী মানবমানবীর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল একদম। দুজনেরই স্নায়ু হয়ে উঠল টান টান। কড়া নাড়লো কেউ একজন। একবার নয়, পরপর তিনবার। তাঁর একলা থাকার সময়গুলোতে এই ঘরে সচরাচর কেউ আসে না। এই মুহূর্তে কে দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে? রোমেলা নয়তো? ভাবতেই তাঁর মুখটা দুশ্চিন্তায় ছোট হয়ে গেলো। 

ওদিকে কাঠের দরজায় ক্রমাগত টোকা পড়ছে। তমসাচ্ছন্ন নিষ্কম্প ঘরের ভেতরে প্রবল বেগে স্পন্দিত হচ্ছে দুটি হৃৎপিণ্ড। অমৃতার শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের একটা হিমেল স্রোত শিরশির করে বয়ে যাচ্ছিল। কয়েকটা সেকেন্ড কাটল বিমূঢ়তায়। হক উঠে দাঁড়ালেন। একটা শ্বাস টেনে নিলেন সময় নিয়ে। তারপর ধীরেধীরে এগিয়ে গেলেন দরজার কাছে। নব ঘুরিয়ে খুললেন দরজাটা। অমৃতা তখন নিশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে অন্ধকারে। যেন বাইরে দাঁড়ানো মানুষটি কোনোভাবেই তার অস্তিত্ব টের না পায়। দরজা অল্প ফাঁক হতেই আঁধার ঘরের মেঝেতে জোছনার এক টুকরো নীল আলো এসে পড়ল। হক দরজার সামনে এমনভাবে দাঁড়ালেন যেন বাইরে থেকে হাজার চেষ্টা করলেও ঘরের ভেতরটা দেখা না যায়। 

অমৃতা একটা পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেল ওপাশ থেকে। 

—‘স্যার!’ 

—‘কী ব্যাপার সুলেমান?’ 

সুলেমান একটু কাশল। তারপর গলাটা খাদে নামিয়ে সাবধানে বলল, ‘স্যার পার্টির লোক আসছে। কী একটা জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করতে। আপনাকে নাকি ফোন দিছেন কয়েকবার সম্পাদক সাহেব। আর ম্যাডাম ও খুঁজতেছিলেন আপনাকে। 

হক চিন্তিত গলায় বললেন, ‘আমার ফোনে চার্জ নেই। তুমি এক কাজ করো। ওদেরকে বলো আমার একটু লেট হবে। আধাঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে বলো। তোমার ম্যাডামকেও বলে দিও, কেমন?’ 

—‘জি হুজুর।’ 

সুলেমান শব্দ দুটো উচ্চারণ করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে গমনোদ্যত হলো। হক পেছন থেকে বললেন, ‘শোনো, একটা কাজ করতে হবে তোমার। তবে কাজটা করতে হবে খুব সাবধানে।’

—‘কী কাজ?’ 

—‘যে কোনো উপায়ে একটা শাড়ি যোগাড় করে দাও। খুব দ্রুত। পারবে?’ কথাটা বলার সময় আত্মগ্লানিতে তাঁর ভেতরটা টনটন করে উঠল। তিনি তো কোনো পাপ করেন নি, তবুও আশ্চর্যজনকভাবে ভেতরটা এক সীমাহীন পাপবোধে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাঁর প্রতি লোকের সম্মানটা অন্যরকমের। সমাজের এমনই এক উচ্চতর স্তরে তিনি আছেন, যে স্তরে পৌঁছুলে সাধারণ লোকের ন্যায় নীতি এবং সংস্কার বোধ হয়ে পড়ে বড্ড ক্ষীণ। সব পেয়েছির রাজ্যটা ক্রমশ তাদের ব্যক্তিগত জীবনকে করে তোলে উচ্ছন্ন, উদ্ধত এবং লালসাপূর্ণ। তিনি ব্যতিক্রম। প্রাচুর্য এবং ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তিনি তাঁর নিজস্ব নীতিবোধ কখনও বিসর্জন দেননি। আজ অবধি তাঁর চরিত্রে কোনো প্রকার দাগ লাগেনি। তাই এ মুহূর্তে সুলেমানের কাছে এরকম একটা নির্লজ্জ আবদার করতে রীতিমতো তাঁর রুচিতে বাঁধছে। 

—‘হুজুর, শাড়ি কি নতুন হতে হবে? নাকি যে কোনো একটা হলেই চলবে?’ 

—‘নতুন, পুরাতন, যে কোনো একটা হলেই চলবে। খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করো।’ 

কথাটা বলে তিনি পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে তিন হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেন সুলেমানের হাতে। সুলেমান প্রস্থান করল। দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তিনি অন্ধকারে বসে থাকা অমৃতার দিকে চেয়ে গমগমে স্বরে বললেন, ‘তোমার বোকামির মাশুল এখন আমাকে দিতে হচ্ছে। কী ভাবলো সুলেমান আমার সম্পর্কে? 

—‘কে কী ভাবলো তা নিয়ে এত মাথা ঘামান কেন? আপনার এই স্বভাবটা আমার একেবারেই পছন্দ না।’ 

হক ধমকে উঠলেন, ‘তোমার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে আমার কিছু এসে যায় না।’ 

অস্থিরভাবে কথাটা বলতে বলতে তিনি উত্তর দিকের জানালার একটা পাল্লা খুলে দিলেন। খুলতেই বদ্ধ ঘরটায় এক ঝলক উতলা বাতাস ঢুকে পড়ল বিনা অনুমতিতে। এতক্ষণের দমবন্ধ করা ভাবটা মুহূর্তের মাঝে কেটে গেলো। জানালার বাইরে তখন রুপালি রঙের মায়াবী চাঁদের রাত। কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে ছড়িয়ে আছে নরম জোছনা। বাড়ির পেছন দিক বলে এদিকটায় কোনো বৈদ্যুতিক আলো নেই। জানালার গ্রিলের ফাঁক গেলে জোছনার নীল আলো এসে পড়েছে মানুষটার মুখে, শার্টের কলারে। অমৃতা চেয়ারে বসে থেকে ওই ধারালো মুখের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছিল। দেখতে ভালো লাগছিল তার। একটু আগের ভয় ভীতিটা এখন আর কাজ করছে না। মন ফড়িং ফরফর করে উড়ে বেড়াচ্ছে ডানা মেলে। তার চিরদিনের শক্ত, ডানপিটে, একগুঁয়ে ব্যক্তিসত্তার আড়ালে যে এমনই এক আটপৌরে রমণীয় মন লুকোনো ছিল তা সে টের পেলো এতকাল পরে, এই ছাব্বিশে এসে। আজকের এই জোছনা মাখা নীলচে রাতের হিমস্পর্শী হাওয়ায়, অন্ধকারে চুপচাপ লোকটার সামনে বসে থেকে, সে মনে মনে গভীরভাবে অনুভব করল যে, বন্ধুদের হাসি ঠাট্টা, পারিবারিক টানাপোড়েন, আইনের মারপ্যাঁচ, কোর্ট বিল্ডিং এর বুক চাপা ভিড় এবং কর্মময় ব্যস্ত জীবনের বাইরেও আরো কিছু বাস্তবতা আছে এই পৃথিবীতে। যে বাস্তবতা সম্পর্কে এতকাল সে ছিল সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞাত। 

—‘এত রাগ করছেন কেন? আপনার বৌ তো আসেনি, এসেছে সুলেমান।’ 

হক জানলার বাইরে চোখ রেখেই বললেন–‘চুপ করে বসে থাকো। এ মুহূর্তে তোমাকে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে।’ 

—‘আবারও অপমান করছেন আপনি।’ 

—‘বেশ করছি।’ 

অমৃতা হাসে, ‘আমার কাছে কিন্তু এখন আর তেমন খারাপ লাগছে না। 

হক জানালার পাশ থেকে সরে আসলেন। ঘরের ভেতরের জমাট বাঁধা অন্ধকারটা এখন একটু ফিকে হয়ে এসেছে। তবুও কারো মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তিনি খানিক দূরে চেয়ারের ওপর সোজা হয়ে বসে থাকা আবছা অমৃতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কিন্তু খুব অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছ। তোমার মতো স্ট্রং পারসোনালিটির একটা মেয়ের কাছ থেকে এসব একেবারেই আশা করিনি আমি।’ 

—‘হয়তো আমার পারসোনালিটি স্ট্রং বলেই কথাগুলো আমি অকপটে বলতে পারলাম। দুর্বল চিত্তের হলে বলতে পারতাম না। আপনাকে যে আমার অসম্ভব ভালো লাগছে এই কথাটা আমি একশবার বলতে পারব। সব্বার সামনে বলতে পারব। আমার কোনো ভয় নেই। 

—‘চুপ করো!’ প্রচণ্ড এক হুংকারে কেঁপে উঠল ঘরটা। 

অমৃতা হুংকারটা শুনে একটুও চমকাল না। শ্লেষের গলায় বলল, –’চুপ করব কেন? আপনার মতো অদ্ভুত পুরুষ মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি। আপনার জায়গায় অন্য কোনো পুরুষ হলে…’

—‘আর একটা কথাও বলবে না তুমি!’ 

—‘রেগে যাচ্ছেন! সবাইকে ধমক দিতে দিতে আপনার অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে ধমক দিয়ে লাভ নেই। আমি অন্যদের মতো ভীতু না।’ 

—‘তুমি কি ভুলে গেছ যে তোমার বয়সী আমার একটি ছেলে আছে এবং সেই ছেলেটি তোমার খুব কাছের বন্ধু?’ 

—‘ভুলে যাব কেন? সামি আমাকে বুঝবে!’ 

হক প্রচণ্ড অবাক হলেন অমৃতার বলা শেষ কথাটা শুনে। স্তম্ভিত গলায় বললেন, 

—‘কী বললে? সামি তোমাকে বুঝবে? হ্যাভ ইউ লস্ট ইওর মাইন্ড?’

—‘বন্ধুই তো বন্ধুকে বুঝবে। আমার বন্ধুরা আমার অহংকার। ওরা কখনোই আমাকে ভুল বুঝবে না।’ 

—‘তুমি বিকারগ্রস্ত! ইউ আর সিক! পাগল হয়ে গেছ তুমি।’ 

অমৃতা হাসে, ‘হ্যাঁ পাগল তো হয়েছিই, আপনার জন্য!’ 

—‘শাট আপ!’ 

—‘দেখুন অত রাখঢাক করে কথা বলা আমার ধাতে নেই। আমি স্টেরিওটাইপ ধ্যান ধারণায় বিশ্বাস করি না। ছেলেরা মেয়েদেরকে প্রপোজ করবে সবসময়, এমন তো কোনো কথা নেই। আমার যাকে ভালো লাগে তাকে আমি ভালো লাগার কথা বলতেই পারি, তাই না?’ 

—‘আমি বিবাহিত। এবং তোমার চেয়ে বয়সে অনেক অনেক অনেক বড়! এটা তুমি ভুলে যেও না।’ 

—‘বয়স কোনো ব্যাপার না। ইউ আর স্টিল ইয়াং অ্যান্ড হ্যান্ডসাম! আই ক্যান সি দ্যাট!’ 

—‘আমার ক্ষমতা থাকলে তোমার গালে আমি এখন একটা কষে চড় বসাতাম। নেহাৎ মেয়েদের গায়ে আমি হাত তুলি না বলে তুমি বেঁচে গেলে।’ 

—‘আমি আপনার প্রশংসা করছি আর আপনি আমাকে মারতে চাইছেন। কী আজব!’ 

হক এই প্রশ্নের কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। গম্ভীরভাবে বসে রইলেন। তার চোখজোড়া নিবদ্ধ রইল জানালার বাইরে। অমৃতার যেন হঠাৎ করেই মনে পড়ল, ‘আমার ব্যাগটা কোথায় দেখেছেন?’ কথাটা বলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। অন্ধকারে টেবিলের ওপর হাতড়াতে লাগল। হক কাটা কাটা গলায় বললেন, ‘ব্যাগ দিয়ে এখন কী করবে তুমি?’ 

—‘ফোন চেক করা দরকার। অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। আমার বন্ধুরা বোধহয় খুঁজছে আমাকে। বাতিটা একটু জ্বালাবেন?’ 

—‘বাতি জ্বালানো যাবে না এখন। চুপ করে বসে থাকো।’ 

—‘ফোনটা আসলে দরকার ছিল। ওরা নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তা করছে।’ 

হক একটু কাষ্ঠ হেসে বললেন, ‘এক কাজ করো, ফোন করে তোমার বন্ধুদের বলে দাও যে একটু আগে ঠিক কী কাণ্ডটা ঘটিয়েছ তুমি।’ 

—‘সময় মতো বলবো। সামিকেও বলবো।’ 

হক চমকে উঠলেন, ‘সামিকে কী বলবে?’ 

অমৃতা হাসল, ‘বলবো, যে আপনি আমার বন্ধু।’ 

—‘মাথা খারাপ! আমি মোটেও তোমার বন্ধু নই। তুমি আমার ছেলেকে এসব উল্টাপাল্টা কথা বলবে না একদম। খবরদার!’ 

—‘আপনি আমার বন্ধু নন?’ 

—‘না।’ 

—‘কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন আমার বন্ধু হবেন। মিথ্যা বলেছিলেন কেন?’ 

—‘তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি বলে মিথ্যে বলেছিলাম। তুমি আমার উপকার করেছিলে। সেই উপকারের বিনিময়ে কিছু একটা দিতে চাইছিলাম তোমাকে। তাই বন্ধুত্বের আবদারটা যখন করে বসলে তখন না করতে পারিনি।’ 

অমৃতা স্তম্ভিত কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে কেন বলেছিলেন যে যা চাইবো তাই দেবেন?’ 

—‘এখনো বলছি, যা চাইবে তাই দেব। কিন্তু তোমার সাথে বন্ধুত্ব করা আমার পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।’ 

অমৃতা বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। কয়েকটা মিনিট পর আচ্ছনতার ঘোর থেকে জেগে উঠে সে ভারি করুণ গলায় বলল, ‘বন্ধুত্ব করতে পারবেন না, ভালোবাসতে পারবেন?’ 

—‘অমৃতা! ছেলেমানুষী করো না! 

—‘ছেলেমানুষী করছি না। আমার বয়স ছাব্বিশ। ষোলো নয়।’ 

—‘প্রাপ্তবয়স্কতা মানেই প্রাপ্তমনস্কতা নয়। তুমি এখনো অপ্রাপ্তমনস্ক। আজকের পর থেকে আর কোনো দিন তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। দেখা করবে না। এমন কি ফোনও করবে না। মনে থাকে যেন।’ 

অমৃতা চমকে তাকালো লোকটার অস্পষ্ট মুখের দিকে। বুকের ভেতর চিলিক দিয়ে উঠল এক অবর্ণনীয় ব্যথা। ছোটবেলা থেকেই তার জিদ বড় বেশি। যা একবার করবে বলে মনস্থির করে, তা সে করেই ছাড়ে! জীবন তাকে হার মানতে শেখায়নি। বরং তার একগুঁয়েমির কাছে হার মেনেছে জীবন বারেবারে। কিন্তু আজকে বুকের মধ্যে গুমরে ওঠা চিনচিনে ব্যথাটা তাকে প্রথমবারের মতো জানান দিল যে, জিদ করে জাগতিক নানা বস্তু নিজের করে পাওয়া গেলেও, কোনো মানুষের মন পাওয়া যায় না। তার চোখ দুটি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছিল। কোনো দিন কান্না না করা সবল চিত্তের মেয়েটিকে আজ এই লোকটি বোধহয় কাঁদিয়েই ছাড়ল। 

চাঁদনী রাতের মাঘী বাতাস জানালা গেলে উড়ে এসে শীতল করে তুলছিল ঘরটাকে। আগরবাতি নিভে গেছে তখন। কিন্তু রয়ে গেছে তার রেশ। চারপাশ ভরে আছে পবিত্র সৌরভে। হক জানালার বাইরেই চোখ রেখেছেন। কৃষ্ণচূড়ার ডালের ফাঁকে উঁকি দেওয়া গোল চাঁদটার দিকে চেয়ে থেকে তিনি ভাবছিলেন যে, ভালোবাসা জিনিসটা আদতে কীরকম সেই ব্যাখ্যা আজও তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। তাঁর ভেতরটা চিরকালই বড় শুষ্ক, অনেকটা মরুভূমির মতো। শুষ্ক সেই মরুভূমি খুঁড়ে খুঁড়ে জলের সন্ধান করার মতো অঢেল সময় কিংবা ইচ্ছা, এর কোনোটাই তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনে ছিল না। পুত্রকে তিনি ভালোবাসেন এ কথা সত্য। স্ত্রীর প্রতিও একধরনের টান আছে বৈকি। কিন্তু সাতাশ বছরের পুরোনো সংসারে মোটামুটি পর্যায়ের বোঝাপড়া থাকলেও, ভালোবাসা কিংবা প্রেম ছিল কতখানি? রোমেলা বরাবরই সাধারণ গোছের মেয়ে ছিল। শাড়ি, গয়না, কসমেটিক্স আর চার দেয়ালে আবদ্ধ সংসারের বাইরে সে কিছুই ভাবতে পারত না, আজও পারে না। অবশ্য মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয় যে সংসারের প্রতিও শতভাগ মনোযোগ নেই রোমেলার, শুধু বিলাসিতা ছাড়া তার জীবনে অন্য কোনো শখ নেই, হবি নেই। তার শুধু একটাই নেশা, টাকা ওড়ানো, আর লোক দেখানো। রোমেলা ছিল মায়ের খালাতো বোনের মেয়ে। মায়ের ইচ্ছাতেই বিয়ে হয়েছিল তাদের। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় তাঁর মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো। ক্যান্সার ধরা পড়ার তিন মাসের মাথায় তিনি বাইশ বছরের পুত্রকে একরকম তাড়াহুড়া করেই বিয়ে দিয়ে দিলেন। নাতির মুখ দেখে যেন মরতে পারেন সেই উদ্দেশ্যেই বিয়ে করানো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নাতির মুখ দেখা তার আর হয়ে উঠল না। সামির জন্ম হলো তাঁর মৃত্যুর দুমাস পর। মা মারা যাবার পর বাবা মানসিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লেন। ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব এসে পড়লো তাঁর কাঁধে। অতি অল্প বয়সেই তিনি সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে শিখলেন। ছুটতে শুরু করলেন টাকার পেছনে। জীবন কেটে গেলো এই অবিরাম ছুটোছুটিতে। কোন ফাঁকে যে কেটে গেলো এতগুলো বছর! 

—‘এত রাতে কীসের মিটিং আপনার?’ 

কাজের কথা শুনে তিনি একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন। চুপচাপ বসে না থেকে বরং কাজ নিয়ে কথা বলাটাই শ্রেয়। এই মেয়েটার একটা গুণ হলো মেয়েটার মাথা ভালো। এর সাথে কাজের কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। তিনি বললেন, ‘এই এলাকায় ডিজেবলড চিল্ড্রেনদের জন্য একটা স্কুল খোলা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে টিম আসছে আগামীকাল বাংলাদেশের টিচারদের ট্রেইনিং দেওয়ার উদ্দেশ্যে। তো এসব বিষয়ে কিছু ডকুমেন্টস সাইন করা লাগবে। বাজেটের ব্যাপারটা দেখতে হবে।’ 

—‘আপনারা হিজড়াদের নিয়ে কিছু করছেন না? 

—‘কিছু বলতে কী বোঝাতে চাইছো? কী করা উচিত?’ 

—‘না মানে, আমরা তো এখন ওদের নিয়ে একটা প্রজেক্ট রান করছি। দেখা যাচ্ছে যে এদের মধ্যে অনেকেই প্রাইমারি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না। কেউ ওদের চাকরি দিতে চায় না। পেট চালানোর দায়ে তাই এরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, মানুষের কাছে হাত পাতে।’ 

হক একটু চিন্তাযুক্ত গলায় বললেন, ‘চাকরি না দিতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকে নিগৃহীত, অবহেলিত হতে হতে এদের আচার আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায় হাজার চেষ্টা করলেও আর সমাজে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারে না।’ 

—‘আপনাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। মাইনরিটি পপুলেশনের জন্য একটু বেশি বেশি ভাবা উচিত। এই যে দেখুন হিন্দু বিবাহ নিবন্ধনটাও আপনারা এখনো বাধ্যতামূলক করলেন না। দু সপ্তাহ আগে একটি হিন্দু মেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় আমাদের এন জি ওর অফিসে আসলো। তার বর মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি ডিভোর্স চায়। কিন্তু তার বিয়ের কোনো লিগ্যাল ডকুমেন্ট নেই। তাই ডিভোর্স দেওয়ারও উপায় নেই। এমতাবস্থায় মেয়েটির বরকে ডেকে এনে মেডিয়েশন(মধ্যস্থতা) করা হলো। বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হলো। নারী নির্যাতনের মামলা দেওয়া হবে সেই ভয়ও দেখানো হলো। কিন্তু লাভ হলো না কিছুই। দুদিন পরে লোকটা আবারো বৌ পেটানো শুরু করল।’  

—‘দুই হাজার বারো অথবা তেরো সালে একটা হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন পাশ হয়েছে আমাদের দেশে।’ 

—‘রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়নি।’ 

—‘মেয়েটির স্বামীর এগেইন্সটে মামলা করোনি তোমরা?’ 

—‘হ্যাঁ আল্টিমেটলি মামলা করতেই হয়েছে। কিন্তু মেয়েটির এখন থাকার কোন জায়গা নেই। মা বাবা কেউ বেঁচে নেই। কোনো এক মাসতুতো দিদির বাসায় উঠেছে। ঝামেলা না মেটা পর্যন্ত ওখানেই থাকবে। কিন্তু মাসতুতো দিদির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। মেয়েটিও বেকার। এরকম অবস্থায় খুব বেশিদিন সে ওই বাড়িতে থাকতে পারবে না।’ 

—‘মেয়েটি পড়াশোনা করেছে কিছু?’ 

—‘এস এস সি পর্যন্ত পড়েছে।’ 

—‘হুম, তুমি মেয়েটাকে আমার অফিসে পাঠিয়ে দিও। দেখি কী করা যায়। 

দরজায় টোকা পড়ছে। হক সাহেব চট করে উঠে পড়লেন বসা থেকে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে খুললেন দরজাটা। সুলেমান একটা বড়সড় প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন তাঁর হাতে। তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। অমৃতার দিকে প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘চট করে শাড়িটা পরে নাও। হারি আপ।’ 

—‘অন্ধকারে কীভাবে পরবো?’ 

হক জানালার পাল্লা বন্ধ করলেন। পর্দা টেনে দিলেন ভালো মত। তারপর কামরার ভেতরের বাতি জ্বালালেন। অমৃতা ব্যস্ত গলায় বলে উঠল, ‘আপনি কিন্তু এদিকে তাকাবেন না।’ 

তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন, ‘আমি কেন তাকাবো? আশ্চর্য!’ 

কথাটা বলে তিনি দেয়ালের দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়ে রইলেন। চেয়ারে গিয়ে বসা এখন সম্ভব না। কারণ টেবিলের ঠিক মুখোমুখি অমৃতা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বইয়ের তাকে সাজিয়ে রাখা সারিসারি বইগুলোর মধ্যে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলেন। 

অমৃতা বিপন্নভাবে প্যাকেট থেকে শাড়িটা বের করল। আকাশি রঙের একটা ছাপা সুতির শাড়ি। কাঁপা বুক নিয়ে সে শাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। এখন সে করবে কী? জীবনে কোনো দিন তো শাড়ি পরেনি। কীভাবে গায়ে জড়ায় এই কিম্ভুত কাপড়টা সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই তার। ভয়, লজ্জা এবং অস্বস্তিতে একদম কাঁচুমাচু হয়ে গেলো সে। অন্ধকারে লোকটার সাথে সহজভাবে কথা বলা গেলেও বাতি জ্বালানোর সাথে সাথেই কোত্থেকে যেন একরাশ জড়তা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার মাঝে। লোকটা একটা বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করো। মিটিং আছে আমার। লোকজন অপেক্ষা করছে।’ 

অমৃতা শাড়ির ভাঁজ খুলল। নতুন শাড়ি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মুচমুচে একটা ভাব সারা কাপড়ে। শাড়ির একটা কোণ কোনো রকমে গুঁজলো সে কোমরে। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সাঙ্ঘাতিক রকমের স্নায়বিক চাপ অনুভব করছে। লোকটা সামনে না থাকলে এতটা নার্ভাস লাগত না। কোনো না কোনো উপায়ে পরে ফেলতো শাড়িটা। কিন্তু এখন মাথায় কোনো বুদ্ধি খেলছে না। একদম ফাঁকা হয়ে আছে মস্তিষ্ক। হাত পা কাঁপছে। অন্ধকারই ভালো ছিল। কোন দুঃখে যে সে আলোটা জ্বালাতে বলল! 

হঠাৎ মনে পড়ল বিপদের বন্ধু ইউটিউবের কথা। ইউটিউব দেখেই মুহূর্তের মাঝে শাড়ি পরা শিখে নিতে পারবে সে। হন্যে হয়ে ভ্যানিটি ব্যাগটা খুঁজতে লাগল চারপাশে চোখ বুলিয়ে। কিন্তু আজব কাণ্ড ব্যাগটা কোথাও নেই! টেবিলের ওপর নেই, চেয়ারে নেই। বইয়ের তাকগুলোর ফাক ফোঁকরেও নেই। কী করবে অমৃতা এখন? মোবাইল শুদ্ধ ব্যাগটা কোথায় গেলো? গলা শুকিয়ে কাঠ। বারো হাত মাপের শাড়িটাকে তার অথৈ সমুদ্র বলে মনে হচ্ছে। এর বুঝি কোনো কুল কিনারা নেই। কোর্ট রুম কাঁপানো স্পষ্টভাষী, সাহসী, বুদ্ধিমতী দারুণ স্মার্ট মেয়েটার যে কখনো এরকম নাস্তানাবুদ দশা হতে পারে তা লোকে কোনোদিন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। 

এমন সময় তিনি আবারও তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ডান?’ 

অমৃতা আর্তনাদের গলায় বলল, ‘আমি তো শাড়ি পরতে পারি না!’ 

প্রবল বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন হক। এরকম অদ্ভুত কথা এর আগে কোনো দিন শুনেছে কেউ? এত বড় একটা মেয়ে নাকি শাড়ি পরতে পারে না। এটাও কি সম্ভব? বইয়ের ওপর চোখ নিবদ্ধ রেখেই তিনি রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, ‘শাড়ি পরতে পারো না তো খুলতে বলেছিল কে?’ 

অমৃতা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘তখন তো মাথা ঠিক ছিল না।’ 

—‘তোমার মাথা কখনোই ঠিক থাকে না। আস্ত পাগল একটা তুমি! শাড়ি পরতে হবে না। কোনো রকমে জড়িয়ে নাও গায়ে। তারপর দয়া করে বিদেয় হও।’ 

রাগে দুঃখে অমৃতার চোখে পানি চলে আসার যোগাড় হলো। আজকের দিনটা তার খারাপ যাচ্ছে। বড়ই খারাপ। সে করুণ গলায় একবার স্বগতোক্তি করল, ‘হায় আল্লাহ, কী করবো আমি এখন! শাড়ি আনতে বললেন কেন? প্যান্ট শার্ট আনতে বললেই তো পারতেন।’ 

—‘বাজে কথা বল না। তাড়াতাড়ি কর।’ 

—‘এরকম তাড়া দিলে আমি সব গুলিয়ে ফেলব। আমার টাইম লাগবে।’ 

—‘আমার টাইম নেই। আমার জন্য লোকজন অপেক্ষা করছে। কেউ যদি চলে আসে এখন এখানটায়? তাহলে কী হবে তুমি বুঝতে পারছ?’ 

এ কথা শুনে অমৃতা আরো বেশি কুঁকড়ে গেলো। সত্যই তো। যদি সামি তাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে হঠাৎ? আর ভাবতে পারছিল না সে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল তার। 

শাড়ির অর্ধেক সে কোমরে গুঁজলো কোনো মতে। গোঁজার পর দেখা গেলো আঁচল একেবারে ছোট হয়ে গেছে। এত ছোট যে গায়ে আঁচল টানাই দায়। অগত্যা আবারও পুরোটা খুলতে হলো। এবার অধৈর্যভাবে হক ঘুরে দাঁড়ালেন, আচমকা! অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে গেলো অমৃতা। থমকে গেলো, স্তব্ধ হয়ে গেলো, হাত গেলো থেমে। 

—‘আপনি এদিকে ফিরেছেন কেন? প্লিজ ঐদিকে তাকান।’ 

হক অমৃতার কথা গ্রাহ্য না করে কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে এগিয়ে আসলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘তোমার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না! 

কথাটা বলে তিনি একটুও সময় নষ্ট না করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে থাকা শাড়ির একটা পাশ হাত দিয়ে তুলে ধরলেন। তার চোখ মেঝের দিকে নিবদ্ধ। তিনি নতমুখে ধমক দিয়ে উঠে বললেন, ‘এটা ধরো। গুঁজে ফেলো। তাড়াতাড়ি!’ 

অমৃতার হাত কাঁপছিল থরথর করে। শ্বাসনালিতে ঢুকে যাচ্ছিল বাষ্প। নিশ্বাস নিতে বড় কষ্ট! 

কাঁপা হাতে কাপড়ের একটা অংশ সে হাতে নিল। নেবার সময় হাতে হাত লেগে গেলো হালকা। চমকে উঠল মন! লোকটা একবারও অমৃতার দিকে না তাকিয়েই শাড়ি কীভাবে পরতে হবে তা বলে দিতে লাগলেন। খুব সুন্দর করে শাড়ির কুচিও করে দিলেন। এই কাজটা তিনি আগে কখনো করেন নি, তবে দেখেছেন। দেখে দেখেই একটা ধারণা হয়ে গেছে। নারী দেহ সর্বদাই পুরুষের দুর্বলতার কারণ! যথাসাধ্য দূরত্ব বজায় রাখা সত্ত্বেও অমৃতার ওই সুন্দর খাঁজযুক্ত মোমের মত সুডৌল শরীরটার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমশ তাঁর মুখখানা রক্তিম হয়ে উঠছিল। নিশ্বাস হয়ে উঠছিল ঘন। অমৃতা এক প্রবল শিরশিরানি নিয়ে ওই ধারালো সৌম্যদর্শন মুখটার দিকে চেয়ে ছিল। ক্রমে ক্রমে তাকে একটা তীব্র, বাঁধছেঁড়া আকর্ষণে পেয়ে বসছিল। কে বলবে যে এই লোকটার সামির বয়সী যুবক ছেলে আছে? দেখে মনে হয় না তো! 

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শাড়ি পরা হয়ে গেলো। তিনি চোখ তুলে তাকালেন অমৃতার দিকে। তাঁর চোখের দৃষ্টি এখন অনেকটাই নরম। আগের সেই ঝাঁঝালো ভাবটা নেই। চারটা চোখ বিনা বাক্যব্যয়ে কয়েক সেকেন্ড লেগে রইলো পরস্পরের সাথে। তারপর অমৃতা চোখ নামিয়ে নিল কুণ্ঠিতভাবে। হক সাহেব ঘরের বাতিটা আরো একবার নিভিয়ে দিলেন। যেন ঘর থেকে বেরোবার সময় দূর থেকে কেউ অমৃতাকে দেখতে না পায়। বাতি নেভানোর পর তিনি আলতো গলায় বললেন, ‘এবার যাও!’ 

ভূমিকম্পিত বক্ষ নিয়ে অমৃতা বলল, ‘যাবো?’ 

—‘আরো থাকার ইচ্ছে আছে?’ তেরছা গলায় প্রশ্ন করলেন তিনি। অমৃতা চিবুকখানি গলার সাথে লাগিয়ে সলজ্জ কণ্ঠে বলল, ‘আবার কবে দেখা হবে?’ 

—’তোমাকে তো বলেছি, দেখা আর হবে না।’ 

—‘কোনো দিনও না?’ 

—‘না হওয়াটাই উত্তম।’ 

—‘আপনি কি এই ভেবে ভয় পাচ্ছেন যে, আমি আপনার সংসার ভেঙে দেবো?’ 

—‘আমার সংসার এত ঠুনকো নয় যে কেউ চাইলেই তা ভেঙে দিতে পারে।’ তিনি বললেন, দৃঢ় গলায়। 

বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথাটা আবারো টের পায় অমৃতা। বাষ্পময় গলায় স্তিমিতভাবে বলে, ‘আমার ভালোবাসাও এত ঠুনকো নয় যে সে তার ভালোবাসার মানুষটার সংসার ভাঙতে চাইবে।’ 

হক কথাটা স্পষ্টতই শুনতে পেলেন। প্রত্যুত্তর করলেন না। নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন অন্ধকারে। অমৃতা কাঠের দরজা হাত বাড়িয়ে খুলল। কয়েকটা মিনিট হক জায়গাটা থেকে নড়লেন না। প্রস্তরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কিছু একটা ভাবতে লাগলেন, গভীরভাবে। 

অমৃতা বিচলিত পায়ে গোল বারান্দা পার হয়ে আসলো। চারপাশ তখন ভেসে যাচ্ছে নীল জোছনায়। সাদা জালের মতো কুয়াশা ঝুলে আছে সরু পথটার ওপর। শীত বাতাসে দুলছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল। বুকের ব্যথাটা বাড়ছিল ক্রমাগতভাবে। মন দুলছে এক ভয়ানক আশংকায়। সত্যি, যদি আর কোনো দিন দেখা না হয়? কথা না হয়? বেঁচে থাকবে কী করে অমৃতা? 

মাঘী পূর্ণিমার সেই মোহময় হিমগন্ধী রাতে, দুটি অসমবয়সী মানব- মানবীর হৃদয় রাজ্যে যে অলঙ্ঘনীয় তোলপাড়টি হয়ে গেলো, তার প্রত্যয়ক শুধু স্বয়ং বিশ্ববিধাতা ছাড়া আর কেউ নয়। 

তিন বন্ধু বাগানে বসেছিল জড়ো হয়ে। রুদ্র, আকাশ আর বিভা। বিভাকে নামিয়ে দিয়ে অভিজিৎ ফিরে গেছে। অমৃতাকে বাড়ির পেছন দিকের রাস্তা দিয়ে ছুটে আসতে দেখল বিভা। অমৃতার হাঁটার গতি এত বেশি ছিল যে সে কাউকেই লক্ষ্য করল না। হনহন করে হেঁটে বাগান অতিক্রম করে মূল বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। বিভা ডাকল, ‘অমৃতা! এই অমৃতা!’ 

অমৃতা চমকে ফিরে তাকালো। তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক নয়। চোখের দৃষ্টিতে একটা দিশেহারা ভাব। কপালে এই শীতের রাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিভা এগিয়ে এসে বলল, ‘কী হয়েছে তোর? 

রুদ্র আর আকাশও উঠে এসেছে। বিষয়টা সবার প্রথমে আকাশই খেয়াল করল, ‘তোর শাড়ি চেঞ্জ করলি কখন? আর সেই তখন থেকে তোরে ফোন দিতেছি। ফোন ধরোস না কেন?’ 

অমৃতা দুটি প্রশ্নের একটিরও উত্তর দিতে পারল না। কিন্তু তার মাথায় তাৎক্ষণিকভাবে ভ্যানিটি ব্যাগের চিন্তাটা চলে এলো। কোথায় হারিয়ে গেলো তার ব্যাগটা? কী আশ্চর্য! 

রুদ্র উত্তেজিতভাবে বলল, ‘কিছু বলতেছিসনা কেন?কী হইছে? সব ঠিক আছে তো?’ 

বিভা জহুরি চোখে দেখছিল অমৃতাকে। অমৃতা বাড়ির পেছন দিকের রাস্তা ধরে এসেছে। এর মানে সে এতক্ষণ লাইব্রেরি ঘরেই ছিল। একটা কূটসন্দেহ তার মনের মধ্যে উঁকি দিতে লাগল। এই মেয়ের পরনের শাড়ি পাল্টে গেছে কেন? শাড়ি পাল্টানোর মতো কী এমন ঘটনা ঘটল? আর তাকে এত বিচলিতই বা কেন দেখাচ্ছে? খারাপ কিছু ঘটেনি তো? এদিকে সামি আর হৃদি ফিরে আসছে। ওরা ফিরে আসার আগেই সামির বাবা মাকে জানাতে হবে যে, সামি কোনোভাবেই তানিশাকে বিয়ে করতে পারবে না। এতক্ষণ অমৃতার জন্যেই অপেক্ষা করছিল তারা। অমৃতা ছাড়া অন্য কেউ এই দুঃসাহসিক কাজটা করতে পারবে না। বিভা আর দুশ্চিন্তা সইতে পারছে না। উত্তেজনায় মনে হচ্ছে তার মাথার রগ ছিঁড়ে যাবে। 

অমৃতা কয়েকটা ক্ষণ নিষ্পলক বন্ধুদের দিকে চেয়ে থাকার পর শ্বাসরুদ্ধ গলায় বলল, ‘আকাশ, রুদ্র! তোদেরকে আমার একটা কথা বলার আছে।’ 

বিভা চট করে বুঝে ফেলল যে অমৃতা ঠিক কী বলতে চাইছে ওদেরকে। কিন্তু এই কথা বলার সময় এখন না। এমনিতেই সবাই সামি আর হৃদির ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত। অমৃতাকে আগে বর্তমান সমস্যাটার কথা জানানো উচিত। সে তড়িঘড়ি করে বলল, ‘অমৃতা, দোস্ত, আমাদের এখানে একটা সমস্যা হইছে।’ 

আকাশ বিভাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আরে দাঁড়া, ও কী বলতে চায় শুনি আগে।’ 

বিভা দমল না। জোরালো ভাবে বলল, ‘ওর কথা পরে শুনব। আগে সামির সমস্যাটা সলভ কর। সময় নাই।’ 

অমৃতা জিজ্ঞাসুনেত্রে চাইল বিভার দিকে, ‘সামির কী সমস্যা?’ 

সংক্ষেপে খুলে বলল ওরা পুরো ঘটনা। শুনে অমৃতা থ বনে গেলো। উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় ছোট হয়ে গেলো তার মুখ। সে সজোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘ইম্পসিবল, সামি এখন এই বিয়ের আগের রাতে এইটা করতে পারে না। তোরা বুঝতে পারতেছিস ওর বাপ মা কতটা কষ্ট পাবে?’ 

রুদ্র বলল, ‘কষ্ট পাইলেও কিছু করার নাই। শোন, সামি বলছে আমাদেরকে কথা বলতে আংকেল আন্টির সাথে। ও নাকি আন্টিকে ফেস করতে পারবে না।’

বিভা বলল, ‘অমৃতা তোকেই বলতে হবে। তুই আংকেলের সাথে কথা বল প্ৰথমে।’ 

অমৃতা দিশাহারা ভাবে বলল, ‘অসম্ভব! আমি এই কথা কিছুতেই বলতে পারব না। লোকটা হার্ট অ্যাটাক করবে এই খবর শুনে।’ 

বাড়ির ভেতর থেকে তখনো গান বাজনার শব্দ ভেসে আসছে। চারপাশ ঝুমঝুম করছে বিয়ে বাড়ির আনন্দে। অতিথিরা সবাই আকদের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোমেলা বসার ঘরে বোনদের সঙ্গে নিয়ে বিয়ের তত্ত্বসমূহ খুলে বসেছেন। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিচ্ছেন ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে আগত নানা উপহার। এরকম একটা সুখ ছড়াছড়ি সময়ে একজন মায়ের সামনে অমৃতা এই ভয়ংকর দুঃসংবাদটা নিয়ে দাঁড়াবে কী করে? ভাবতেই তার চোখে মুখে এক ঘোর অন্ধকার নেমে আসলো। সে নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘অসম্ভব! আমি পারব না!’ 

—‘পারতেই হবে অমৃতা! সামি আর হৃদির জন্য, আমাদের পারতেই হবে!’ আকাশ বলল শক্তভাবে। 

রুদ্র বলল, ‘চল, সময় নষ্ট না করে, এখনই যাই।’ 

—‘এখন তো রাশেদের মিটিং আছে। উনাকে এখন পাওয়া যাবে না।’

—‘রাশেদ কে?’ রুদ্রর প্রশ্ন। 

—‘আরে, সামির আব্বা।’ 

—‘তুই আবার আংকেলরে নাম ধইরা ডাকা শুরু করলি কবে থেকে?’ আকাশ অবাক! 

বিভা ফোড়ন কাটল, ‘সেই কাহিনি পরে হবে। এখন চল। আংকেলকে না পাইলে, আন্টিরেই বলব।’ 

অমৃতা বলল, ‘না। দুজনকে এক সাথেই বলতে হবে। আচ্ছা, ভেতরে চল। দেখি কী করা যায়।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *