বৃষ্টিমহল ২.৫

কলিং বেলটা বাজছিল। আকাশ দরজা খুলল। অমৃতা দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে কালো ট্রাউজার, সাদা টি শার্ট। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। 

—‘কীরে? এই সময়?’ আকাশ অবাক। 

অমৃতা পানসে গলায় বলল, ‘আইলাম কথা কইতে।’ 

—‘কী কথা?’ 

—‘ঢুকতে দিবিনা?’ 

আকাশ দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো, ‘আয়’ 

রান্না ঘরের দরজায় ঝুমকির গোলগাল মুখখানা উঁকি দিতে দেখা গেল।

—‘ও, তুমি? এসো খাবে আমার সাথে।’ 

অমৃতা হেসে বলল, ‘না আন্টি, খেয়ে এসেছি। মা আজ খিচুড়ি রান্না করেছিল। জম্পেশ খানা খেয়ে দৌড় দিতে বের হলাম।’ 

ঝুমকি অবাক গলায় বলল, ‘ওমা, এই রাতে দৌড়তে বের হয়েছ তুমি?’

—‘হ্যাঁ। দিনে সময় কোথায়?’ 

—‘যাক, এসেছ ভালো হয়েছে। যাবার সময় দেখা করে যেও, কথা আছে।’

আকাশ ঝুমকি আর অমৃতার কথোপকথনটা খুব বেশি উপভোগ করছিল না। ক্রুর চোখে চেয়ে ছিল ওদের দুজনের দিকে। 

ঝুমকির সাথে কথা শেষ হলে অমৃতা আকাশের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আকাশ ত্যাড়া গলায় বলল, ‘আমার বাপের বউয়ের সাথে তোর অত খাতির কীসের রে?’ 

অমৃতা ঘরে ঢুকে পড়ার টেবিলের পাশে রাখা কাঠের চেয়ারে বসল, ঠান্ডা ভাবে বলল, ‘আছে হয়ত কোনো কথা। তুই সব সময় উনার সাথে এমন রুড বিহেভ করিস কেন? এটা ঠিক না।’ 

আকাশ ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ে বলল, 

—‘তা কেমন বিহেভ করা উচিত আমার উনার সাথে? কোলে তুইলা নাচব?’

—‘নাচবি ক্যান? নরমাল থাকবি।’ 

—‘আজাইরা কথা বলিস না। ক্যান আসছিস সেইটা বল।’ 

টেবিলের ওপর আকাশের ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতার বান্ডিল রাখা। অমৃতা হাত দিয়ে বান্ডিলটা নাড়া চাড়া করতে করতে বলল, ‘ভাবতেছি সামির আব্বাকে শিক্ষাটা কীভাবে দেয়া যায়।’ 

—‘কী করতে চাস?’ 

—‘অপমান করা যায়, ধর ভরা মজলিশে সবার সামনে। 

—‘মানে তুই সরাসরি উনারে কথা শুনাইতে চাইতেছিস?’ 

—‘হ্যাঁ’ 

—‘আরে না, যা করার আড়াল থেকে করতে হবে। ওই লোকের অনেক পাওয়ার, শেষে দেখা যাবে তোর কোনো ক্ষতি করে দিছে।’

—‘আমার কোনো ক্ষতি সে করতে পারবে না। কারণ আমার ক্ষতি 

করলে সামি ওরে জীবনেও মাফ করবেনা।’ 

কথাটা শুনে আকাশ একটু ভাবল, তারপর বলল, 

—তা ঠিক। 

—‘আর আড়াল থেকে করব কেন? আমি কি ওরে ডরাই নাকি?’

—‘না ডরাবা কেন? তুমি তো বীরপুরুষ! সরি বীরনারী, বীরাঙ্গনা!’

অমৃতা আকাশের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, কড়া ভাবে বলে, ‘সব সময় ফাজলামো করস কেন?’ 

আকাশ হাসে, ‘ফাজলামো হবে কেন? আচ্ছা শোন, তুই কি সত্যিই এখন থেকে মেয়েদের মত চলবি?’ 

অমৃতা মুখ বাঁকায়, ‘মেয়েদের মতো চলা আবার কী জিনিস? খ্যাত কোথাকার!’ 

—‘মেয়েদের মতো চলা মানে মেয়েদের জামা পরা, সাজগোজ করা, মানে এখন যেমন তোরে দেখলেই হিজড়া লাগে তখন আর সেইটা লাগবেনা।’ 

কথাটা শোনা মাত্র অমৃতার ফর্সা বেড়ালের মতো আদুরে গাল দুটোতে কিঞ্চিৎ রাগের আভাস পড়ল, ‘আমারে মোটেও হিজড়া লাগেনা দেখতে।’ 

—‘লাগে লাগে! বেশভূষা না পাল্টাইলে বয়ফ্রেন্ড পাবিনা।’ 

—‘বয়ফ্রেন্ড পাওয়ার জন্য আমার নিজেরে বদলাইতে হবে? হাহ, এমন বয়ফ্রেন্ড আমার লাগবেনা। আমি যেমন আছি তেমনই যদি কেউ আমাকে চায় তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারে’। 

—‘কেউ চাইবনা।’ হাসে আকাশ, হাসে ওর চোখ। 

—‘দেখা যাবে।’ বলে অমৃতা আত্মবিশ্বাসের গলায়। 

মানুষের নাম কখনো বাঁদর হয়? হওয়া কি উচিৎ? হৃদির মনে হল একজন মানুষের বাঁদর নামকরণ সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি চরম অপমানজনক ঘটনা। অবশ্য ডারউইনের থিওরি মোতাবেক মানুষ একদা বাঁদর ছিল। ধীরে ধীরে ইভল্যুশনের মাধ্যমে মনুষ্যজাতি বাঁদর থেকে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই হিসেবে পূর্বসূরিদের প্রতি গভীর সম্মান প্রদর্শন বাঁদর নামকরণের একটি যুক্তিযুক্ত কারণ হতে পারে। শাহবাগ মোড়ের রাস্তার জ্যামে বসে, গাড়ির এসির বাতাস খেয়ে খেয়ে এইসব অদ্ভুত ভাবনা ভাবছিল হৃদিতা। 

এমন ভাবনার কারণ হল তাদের নবনিযুক্ত ড্রাইভারের নাম বাঁদর। বাঁদরের বয়স তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে। তার শক্তপোক্ত চোয়াড়ে চেহারা। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল তার চেহারায় সত্যিই একটু বাঁদর বাঁদর ভাব আছে। তার আচার আচরণও অন্যান্য ড্রাইভারদের থেকে আলাদা। সে উঠতে বসতে সালাম দেয় না। দেখা হলে বলে, হ্যালো স্যার, হ্যালো ম্যাডাম। রাতের বেলা ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফেরার আগে সুর করে টেনে টেনে বলে, হ্যাভ আ গুডনাইট। কথার মাঝখানে থ্যাংক ইউ, আই এম রিয়েলি সরি, ও শিট, ও মাই গড এইসব ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করে সে প্রায়শই বাড়ির লোকজনদের চমকে দেয়। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে। শুধুমাত্র লোক শব্দটাকে লুক বলা আর ভালো কে ভালু বলা ছাড়া হৃদি এর বাংলা উচ্চারণগত কোনো সমস্যা ধরতে পারেনি। 

হৃদির আব্বা আম্মা এই অসম্ভব রকমের স্মার্ট ড্রাইভারের গুণমুগ্ধ ভক্ত। কিন্তু হৃদি জানে লোকটা তাকে লক্ষ্য করে। মেয়েদের মাথার পেছনেও বাড়তি দুটো চোখ লাগানো থাকে। সেই চোখ যে কোনো পুরুষমানুষের নজর পড়ে ফেলে অনায়াসে। লোকটা যে তাকে শুধু বাহ্যিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা -ই নয়। হৃদির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও তার রয়েছে গভীর কৌতূহল। যেমন একটু আগেই সে প্রশ্ন করলো ‘ম্যাডাম কি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবেন?’ 

হৃদি মনে মনে বললো, তাতে তোর কীরে হারামজাদা? 

মুখে বললো, ‘এখনো ঠিক করিনি।’ 

নিজের বাবার এই গাড়ি হৃদির খুব একটা ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনা। তার বাবার একটু কৃচ্ছতা সাধনের বাতিক আছে। তিনি খুব দরকার না পড়লে ছেলে মেয়েদের গাড়ি ব্যবহার করতে দেন না। ছোট ভাই হৃদয় কলেজে যাওয়া আসা করে বাই সাইকেলে। বাবা নিজে অফিস যান বাসে ঝুলে ঝুলে। আজকাল বয়সের কারণে বাস, রিকশায় চড়ে বেড়াতে কষ্ট হয় বলে মাস ছয়েক আগে তিনি এই সেকেন্ড হ্যান্ড টয়োটা করলা গাড়িটা কম দামে কিনেছেন। দুই হাজার দশের মডেল। বেশ পুরোনোই বলতে হয়। তিন মাস ড্রাইভার হীন অবস্থায় গাড়িটা পড়ে ছিল। ড্রাইভারদের ডিমান্ড আজকাল আকাশ ছোঁয়া। পনেরো হাজারের নিচে তাদের বেতন দেয়া চলেনা। হৃদির বাবা কৃপণ মানুষ। মাস শেষে এতো গুলো টাকা গাড়ি চালকের হাতে তুলে দিতে গিয়ে তার আত্মায় কাঁপন ধরে। বাঁদরের যেতন তেরো হাজার ধার্য করা হয়েছে। এত কম টাকায় একজন পাকাপোক্ত গাড়ি চালক পেয়ে হৃদির বাবা খুশিতে আটখানা। বাবা এখন বাঁদরের যাদুবলে মোহাবিষ্ট। যেকোনো কাজে তিনি বাঁদরকে নিজের সঙ্গী হিসেবে পেতে চান। বাজার করা থেকে শুরু করে ঘরের টিউবলাইট লাগানো পর্যন্ত প্রতিটি কাজে তার বাঁদরকে চাই। আজ বিকেলে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় বাবা নিজেই হৃদিকে ডেকে বললেন, ড্রাইভারটা বসে আছে। তুই বরং গাড়ি নিয়েই যা। 

আজ ক্লাস নেই। সে যাচ্ছে টি এস সি। বন্ধুরা সবাই জড়ো হয়েছে সেখানে। আড্ডা দেয়াই মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ক্লাস না থাকার ব্যাপারটা বাবাকে বলা যাবেনা। হৃদি মুখে ইচ্ছাকৃত ভাবে একটা গাম্ভীর্য টেনে এনে ঠিক আছে আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে’ বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। 

.

—‘আপনার এমবিএ শেষ হচ্ছে কবে?’ 

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হৃদিকে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে দিল। কথার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে ড্রাইভার না, ক্লাসমেট। হৃদি কটমটে চোখে সম্মুখের সিটে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকালো। ঠান্ডা গলায় বললো, ‘বাঁদর সাহেব, আপনার নামটা কে রেখেছে? আপনার বাবা নাকি মা?’ 

বাঁদরকে বিচলিত দেখালো না। সে স্ফীত একটি হাসি হেসে হালকা গলায় বললো, ‘আমার দাদা।’ 

—‘কেন এই নাম রেখেছিলেন তিনি?আপনার চেহারা বাঁদরের মতো দেখতে, সেই কারণে কি? 

বাঁদর স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘জি না সে কারণে না।’ 

—‘তাহলে কারণটা কী? আপনার স্বভাব বানরের মত এটা কি কারণ হতে পারে?’ 

—‘মানুষের স্বভাব বানরের মতো কী করে হয়? 

—‘হতে পারে, কিছু মানুষ বানরের মতো কথায় কথায় অন্যের মাথায় উঠে বসতে চায়।’ 

বাঁদর একটু কেশে গলা পরিষ্কার করল, ‘আমার আসল নাম বদরুজ্জামান। বাল্যকালে দুষ্টু ছিলাম বলে দাদা আদর করে নাম রেখেছিলেন বাঁদর।’ 

জ্যাম ছেড়েছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে হেলেদুলে। হৃদি আর কোনো কথা বাড়ালোনা। জানালার বাইরে চোখ রেখেও বুঝতে পারলো সামনের সিটে বসে ব্যাক মিররে চোখ রেখে বাঁদর তাকেই পরখ করছে। বাবার সাথে কথা বলতে হবে। এই বেয়াদবি বেশিদিন সহ্য করা যাবেনা। 

টি এস সি তে হৃদিকে নামাবার পর বাঁদর বললো, ‘ম্যাডাম, স্যার বলেছেন বসে থেকে একবারে আপনাকে নিয়ে যেতে। আমি গাড়ি পার্ক করে রাখছি। আপনার কতক্ষণ লাগবে? 

—‘বলতে পারছিনা। আমি ফোনে জানাবো আপনাকে।’ 

টিএসসির ভেতরে তার বন্ধুরা ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে ছিল। হৃদির মুখে অপ্রসন্নতা দেখে অমৃতা প্রশ্ন করলো, ‘কী হয়েছে তোর? কোনো সমস্যা?’ 

হৃদি স্যান্ডেল খুলে রেখে ঘাসের ওপর বসতে বসতে বললো, ‘আর বলিস না।আমার ড্রাইভারটা একটা আস্ত বেয়াদব।’ 

—‘লোকটা কম করে হলেও তোর থেকে বয়সে দশ বছরের বড় হবে। ড্রাইভার হয়েছে বলে কি তার মান সম্মান নেই? বেয়াদব বলতেছিস কেন?’ আকাশ বললো, অভিযোগের গলায়। 

—‘বয়সে বড় হয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? আজিব কারবার! সে একটা চাকরি করে। তার উচিত ফর্মাল বিহেভ করা। আমি আজকেই এই ব্যাপারে বাবার সাথে কথা বলব।’ 

—‘কথা বইলা কী করবি?’ 

‘কী করবো মানে? এই ব্যাটার চাকরি শেষ। নতুন ড্রাইভার খুঁজতে হইব।’ 

—‘বেতন কত দিবি?’ আকাশের প্রশ্ন। 

—‘এই ধর তেরো, চোদ্দ এই রকম।’ 

এবার আকাশ বেশ সিরিয়াস গলায় বললো, ‘তাই? আরেকটু বাড়ানো যায়?’ 

—‘মানে?’ 

—‘মানে ষোলো বা সতেরো করা যায়?’ 

হৃদি চোখ কপালে তুলে বললো, ‘মাথা খারাপ! আমার বাপ্ হার্ট ফেইল করবে। কিন্তু তুই এসব কেন জানতে চাইছিস?’ 

—‘না ভাবতেছিলাম ড্রাইভারের চাকরিটা নিব নাকি।’ 

—‘তোর তো চাকরি আছেই।’ 

—‘ধুর, এই চাকরি ভাল লাগেনা। ছেলেমেয়ে গুলা সব বেদ্দপ, বেত্তমিজ। কতা শোনেনা। তার উপর পরীক্ষার খাতা হারায় ফেলছি। বেশিদিন মনে হয় থাকবনা এই চাকরি।’ আকাশ বললো আফসোসের গলায়। 

অমৃতা উদাস ভাবে বললো, ‘আমার চেম্বারে মোক্তারের পদ খালি হইছে। দশ হাজার বেতন। করবি চাকরিটা?’ 

—‘মোক্তার জিনিসটা কী?’ 

—‘উকিলের সাহায্যকারী।’ 

—‘না উকিল টুকিল আমার সহ্য হয়না। অন্য কিছু থাকলে বল।’

অমৃতা গালে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করলো, তারপর বললো, ‘আমার এনজিও তে নতুন একটা পদ আসতেছে। একেবারে ইউনিক।’ 

—‘কী পদ? বেতন কত?’ 

—‘বেতন বিশ হাজার দিয়া শুরু।’ 

—‘কামটা কী?’ 

অমৃতা নড়েচড়ে বসে গম্ভীর গলায় বললো, ‘তুই তো জানিস, আমাদের সংগঠনটা মূলত হিজড়া জনগোষ্ঠীর রাইটস নিয়ে কথা বলে। সো আমাদের এমন কয়েকটা ছেলে মেয়ে দরকার যারা হিজড়াদেরকে একটু সময় দিবে, ধর দিনের পর দিন ওদের সাথে কাটাবে। ফোনে কথা বলবে, রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াবে, এক সাথে খাওয়া দাওয়া করবে।’ 

আকাশ ভূত দেখার মত চমকে উঠল, ‘সর্বনাশ! বলতেছিস কী তুই? কেন এইসব করতে হবে?’ 

—‘যাতে করে ওদের রিয়েল লাইফটা সম্পর্কে আমরা খুব ভালো মত জানতে পারি। ওদের লাইফ নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করার চেষ্টা করতেছি। করতে পারিস চাকরিটা। তেমন কষ্ট নাই। খানা খরচ ফ্রি।’ 

আকাশ শিউরে উঠল, ‘না মামা, হিজড়া দেখলে আমার ভয় লাগে। দেখলেই কেমন হাত তালি দিয়ে টাকা চাইতে আসে, গায়ের উপর পড়ে। মনে হয় যেন এক কামড়ে চিবায় খায় ফেলবে।’ 

অমৃতা কথাটা শুনে অপ্রসন্ন গলায় বললো, ‘এইটা কোনো কথা কইলি তুই? মানুষ দেখলে তোর ভয় লাগে?’ 

—‘হ্যাঁ এই জগতে মানুষই তো সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী।’ 

সন্ধ্যের বাতাসে খুব একটা শীত ভাব নেই আজ। তবে একটা শান্তির ছোঁয়া আছে। ঢাকা শহরে এখন বছরের শেষের দিকটায়ই যা একটু শীতকালটাকে অনুভব করা যায়। বাকি ঋতুগুলোর কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েনা। তবে এখনো শরৎকালের আকাশে মাঝে মাঝে পাল তোলা নৌকোর মতো মেঘের ভেলা ভাসতে দেখা যায় আর আছে কালবৈশাখী ঝড়ের দাপট। এই এতটুকু ঋতু বৈচিত্রই এখন এ শহরের শেষ মৌসুমী সম্বল। 

রুদ্র বাদামের খোসা ছাড়িয়ে মচ মচ শব্দ তুলে বাদাম খাচ্ছিল। খেতে খেতেই বললো, ‘ঐসব বাদ দে। এখন বল চান্দা দিতেছিস কবে? পার হেড পঁচিশ হাজার চান্দা।’ 

হৃদি পানসে গলায় বললো, ‘আমি আগেই কইছি। টাকা নাই, পয়সা নাই। এবার আমার যাওয়া হবেনা।’ 

শুনে রুদ্র ভারী করুণ গলায় বললো, ‘কিন্তু আমার গিফটটা? তোদের না আমারে ঢাকা কলকাতা এয়ার টিকেট গিফট করার কথা?’ 

—‘গিফটের ভাগ দিয়ে দিব। প্রত্যেকের ভাগে তিন হাজার করে পড়ছে।’ রুদ্র আশ্বস্ত হল। চীনা বাদাম চিবোতে চিবোতে তৃপ্ত গলায় বললো, ‘ও, তাইলে ঠিক আছে।’ 

সামি রুদ্রের মাথায় একটা গাট্টা মারলো, ‘শালা সেলফিশের বাচ্চা।‘ 

—‘কোনো ভাবে কি টাকা ম্যানেজ করা যায়না হৃদি? তোকে ছাড়া খুব খারাপ লাগবে। বিভাও কষ্ট পাবে তোকে না দেখলে।’ মন খারাপের গলায় বললো অমৃতা। 

—‘মনে হয়না। আমার বাপ তো কিপ্টার হাড্ডি। জীবনেও দিবেনা আর এখন জানিস নাতো উঠতে বসতে খোঁটা দেয়। বলছে এই বছরের মধ্যে চাকরি জোগাড় করতে না পারলে বিয়া দিয়া দিবে।’ 

আকাশ বললো, ‘আচ্ছা তুই চিন্তা নিস না। আমরা কিছু একটা ম্যানেজ করবো।’ 

সামি হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করে বসলো, ‘তোর কি আসলে যাবার ইচ্ছা নাই?’ 

গতকাল মেসেজ আদান প্রদানের পর থেকে সামির সাথে আর কোনো কথা হয়নি হৃদির। রাগটা এখনো বুকের ওপর দাঁত চেপে বসে আছে। হৃদি সামির চোখে চোখ না রেখে অন্য বন্ধুদের দিকে চেয়ে অনেকটা স্বগতোক্তির গলায় বললো, ‘মানে আমার ফ্রেন্ডরে নাকি আমার দেখতে যাওনের ইচ্ছা নাই। কিছু মাইনষের কথা শুনলে মনটা চায় কী যে করতে!’ 

—‘প্রশ্ন করছি আমি, উত্তরটা অন্য দিকে তাকায় দিচ্ছিস কেন? এসব ঢং কই থেকে শিখছিস?’ 

হৃদি সামির কথাটা পাত্তা দিলো না। আকাশকে বললো, ‘তোরা ম্যানেজ করবি মানে কী? তোদের কি টাকা বেশি হইছে? টাকার গাছ লাগাইছিস?’ 

—‘হ লাগাইছি। টাকা গাছ থেকে আসবে নাকি আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে নামবে তা নিয়ে তোর ভাবতে হবেনা। তুই যাওয়ার জন্য রেডি হ।’ 

—‘টাকা আসবে কোত্থেকে শুনি?’ 

—‘শোনা লাগবে না।’ 

—‘না শুনলে আমি যামুনা।’ 

—‘যাবিনা মানে? তুইলা নিয়া যামু তরে।’ আকাশ বললো জোরালো গলায়। 

পায়রার ডাকে ঘুম ভেঙেছিল বিভাবরীর। চোখ মেলে দেখলো বিমের খাঁজে খাঁজে নবাবী চালে ঘুরছে ফিরছে এক জোড়া ধবধবে সাদা পায়রা। খানিক বাদে বাদে ডানা ঝাপটাচ্ছে। ওগুলো কার কে জানে! অভিজিৎ কি পায়রা পোষে? 

বিছানায় তাকিয়ে দেখলো অভিজিৎ নেই। দেয়াল ঘড়ির কাঁটা বলছে বেলা দশটা বেজে গেছে। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি মা রোজ সকাল আটটায় দরজায় করাঘাত করে ডেকে তুলতেন তাকে। নাশতার টেবিলে বাড়ির প্রতিটি সদস্যের উপস্থিতি ছিল বাঞ্ছনীয়। আজ অনেক অনেক দিন পর বিভা এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো। রাতে ঘুম ভালো হয়েছে। শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। মনটাও চনমনে! 

এই ঘরে একটি মাত্র ডাবল খাট। পশ্চিমের মেঝে থেকে উপরে উঠে গেছে প্রায় সিলিং ছোঁয়া লম্বা এবং প্রশস্ত এক মেহগনি কাঠের আলমারি। তার পাশে মাঝারি আকারের ড্রেসিং টেবিল। সাথে বেশ বড়সর এক আয়না। পুরোনো দিনের আসবাবগুলোতে আভিজাত্যের একটা ছাপ আছে। কিন্তু ঘরে কোনো সোফা টোফা নেই। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ঘরে এসে অভিজিৎ ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘আপনি বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি মেঝেতে শোবো।’ 

—‘না না। আপনি কেন বিছানা ছাড়বেন? আমিই শোবো মাটিতে।’

—‘মেঝে খুব ঠান্ডা। আপনার অসুখ করবে।’ 

বিভা হালকা হেসে বলেছিল, ‘আমার অসুখ করলে কোনো সমস্যা নেই। আপনি কাজের মানুষ। আপনার সুস্থ থাকা চাই। অসুখ করলে অফিস করবেন কী করে? 

অভিজিৎকে একটু দ্বিধাগ্রস্থ দেখালো। একটুক্ষণ কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো, ‘এত কষ্ট করার কী দরকার? এ বাড়িতে আরো তিনটা বড় বড় ঘর আছে। আপনি যেকোনো একটি নিয়ে নিন। কোনো সমস্যা নেই।’ 

অভিজিতের কথাটা যথেষ্ট যৌক্তিক এবং তার বলার ধরণটাও বেশ আন্তরিক। কিন্তু বিভার কাছে কথাটা কেন যেন বড্ড অপমানজনক ঠেকলো। তার চোখের তারায় মুহূর্তের জন্য পড়ল একটা গাঢ় কালো ছায়া। একটা বড় নিশ্বাস টেনে নিয়ে সে অপমানের রেশটা কাটানোর চেষ্টা করল, তারপর কঠিন গলায় বললো, ‘আপনি কি মনে করছেন আমি আপনার সাথে এক ঘরে থাকার জন্য মরে যাচ্ছি? মোটেও না। আমি খুব ভালো ভাবেই জানি যে এই বাসায় আরো অনেকগুলো ঘর আছে। তা সত্ত্বেও আমি আপনার সাথে এক ঘরে ঘুমোতে এসেছি লোকলজ্জার ভয়ে। বাড়িতে এতগুলো চাকর বাকর রেখে বসে আছেন। আমি প্রথম দিনই অন্য ঘরে শুতে গেলে ওরা কী ভাববে? খুব সুনাম হবে কি আপনার?’ 

—‘কাজের লোক আমি রাখিনি। এরা সব সরকারি লোকজন। যাই হোক আপনি এতটা ম্যাচিওর্ড চিন্তা ভাবনা করতে পারেন, এটা জানতে পেরে অবাক লাগছে।’ 

—‘ম্যাচিওর্ড চিন্তা ভাবনা করতে গিয়েই তো আজ আমার এই দশা। সমাজের কথা না ভেবে থাকতে পারলে তো ল্যাঠা চুকেই যেত।’ 

—‘তা অবশ্য ঠিক। সামাজিক চাপ না থাকলে আপনি আজ আপনার বয়ফ্রেন্ডের সাথেই থাকতেন। সুখে থাকতেন।’ কথাটা বলে অভিজিৎ একবার চোরা চোখে দেখল বিভাকে, তারপর বিছানার ওপর পা তুলে বসলো। 

বিভা অভিজিতের দিকে পলক তুলে চাইলো। এই লোকটার চেহারায় একটা স্থায়ী ভালোমানুষীর ছাপ আঁকা আছে। মোটা চশমার কাচের ভেতর বড় বড় দুটি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। ঋজু চাহনি, শ্যামলা গায়ের রং আর ছিপছিপে গড়নের মানুষটাকে দেখলেই মনে হয় এ ভারী নিরীহ প্রকৃতির। অন্যের ভালো করা ছাড়া এই মানুষের বেঁচে থাকার অন্য কোনো পার্থিব উদ্যেশ্য নেই। কিন্তু এই পৃথিবীতে বিভাই একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা এই লোকটাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। বাইরে থেকে দেখতে তাকে যতটা সহজ সরল মনে হয়, ভেতরটা ঠিক ততটাও সহজ নয়। ঠান্ডা মাথায়, ঠান্ডা গলায় সে প্রতিপক্ষকে আঘাত করে কথা বলে। বলার ভাবটা এমন থাকে যে চট করে প্রতিক্রিয়া দেখানো যায়না। কিছু বলা যায়না, সওয়াও যায় না। 

বিভা অভিজিতের মাত্র বলা খোঁচা মারা কথাটা হজম করলো। আলমারির ভারী পাল্লা খুলে ওপরের তাক থেকে ভাঁজ করা একটি চাদর আর দু খানা কম্বল বের করলো। সে টের পাচ্ছিল অভিজিৎ তার দিকেই চেয়ে আছে। অভিজিৎ কিন্তু সচরাচর খুব একটা দেখেনা তাকে। লোকটার এই একটা গুণ আছে বলতে হবে। মেয়েদের মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকার অভ্যাস নেই। 

—‘কী হল?’ 

— দেখছি।’ 

—‘কী দেখছেন?’ 

—‘আপনার গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে আপনি যেন অনেক দিন ধরে এ বাড়িতে আছেন। এ যেন আপনার পরিচিত জায়গা। আলমারিতে স্পেয়ার চাদর রাখা আছে তা কী করে জানলেন? আমিই তো জানিনা!’ 

—‘ওমা জানবোনা কেন? ঐযে কাজের মেয়েটা, দূর্গা নাম। সে তো পৌঁছনো মাত্রই সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে আমাকে। কোথায় কী রাখা আছে সমস্ত কিছু পই পই করে বলে দিয়েছে।’ 

—‘তাই নাকি? অবাক কান্ড তো!’ 

বিভা মেঝেতে চাদর বিছিয়ে দিল। তার ওপরে মোটা কম্বল। বিছানার ওপর থেকে একটা বালিশ তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো মেঝেয়। তারপর বললো, ‘অত অবাক হওয়ার কী আছে? আমার সংসারের ভার আমাকে বুঝিয়ে দেবনাতো কাকে দেবে?’ 

অভিজিৎ চকিতে তাকালো বিভার দিকে। তার চোখে বিস্ময় খেলছে। মেয়েটাকে সে বুঝতে পারছেনা। কিছুক্ষণ অসাড় ভাবে চেয়ে থেকে অস্ফুটে বললো, 

—-’আপনার সংসার? 

বিভা এ পর্যায়ে একটু বিব্রত বোধ করলো। নিজের বলা কথাটা চিন্তা করে নিজেই যেন লজ্জা পেয়ে গেল। চোখ নামালো নিচে, 

—‘না মানে… লোকে তো অন্তত তাই ভাবে।’ 

কথাটা বলে বিভা গায়ে কম্বল টেনে নিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে বললো, ‘ঘুমোবেন না?বাতি নিভিয়ে দিন।’ 

অভিজিৎ কোনো কথা না বলে চুপচাপ আদেশ পালন করলো। বাতি নেভানোর সাথে সাথে ঘরটা হয়ে গেলো ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও এক রত্তি আলো নেই। পাহাড়ের শীত মানে ভয়ংকর ব্যাপার। ঘরের ভেতর একটা ছোট কম পাওয়ারের হিটার চলছে। তবুও শীত দমন করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

অভিজিৎ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিল। বিভাও স্থির হয়ে শুয়ে নেই। নড়াচড়া করে শীতটাকে কাবু করার চেষ্টা করছে সে। বাড়ির ভেতরটা একেবারে নিঃশব্দ। বাইরে ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকা। সাথে আরো কয়েকটি রাত চরা পাখি। বনের মাঝে শুকনো পাতায় সর সর শব্দ তুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে কোনো চারপেয়ে জন্তু। হঠাৎ হঠাৎ ডাকছে হাতি। হোউপ হোউপ করে ডাকছে কোনও নাম না জানা জানোয়ার। হনুমান কি? কে জানে! গভীর রাতেও অরণ্য তার নিজস্ব বাসিন্দাদের নিয়ে বুঝি পরিপূর্ণ ভাবে জাগ্রত। বিভা মন দিয়ে বাইরে থেকে আসা শব্দ গুলো শুনছিল। কোনটা কীসের শব্দ তা আলাদা আলাদা করে চেনার চেষ্টা করছিল। ঠিক সেই সময় অভিজিৎ হঠাৎ কেমন অচেনা গলায় বলে উঠলো, 

—‘অনেক ভালোবাসেন ওই ছেলেটাকে, তাইনা?’ 

প্রশ্নটা বিভার বুকে গিয়ে ঠঙ করে বাজলো। সেই ছেলেটা! সেই কোঁকড়া চুলো, ফর্সা, ছয় ফুট লম্বা, সিগারেট পোড়া কালো ঠোঁটের পাগল, বাউন্ডুলে, ছন্নছাড়া এবং একরোখা ছেলেটা। সাগর সৈকতে স্রোতে ভাসতে ভাসতে যে ছেলেটা ডাকাতের মতো জোর করে চুমু খেয়েছিল তাকে। সেই কিশোর বেলায় প্রথম দেখার দিনটিতে যে ছেলেটি অকপটে বলেছিল, তুমি হিন্দু না হলে তোমার সাথে ঠিক ঠিক প্রেম করতাম। যে ছেলেটা তার বন্ধু, তার প্রেমিক, তার সব কিছু! হ্যাঁ ভালোবাসে বিভা। বড় বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আজ অভিজিতের এই আকস্মিক প্রশ্নটা তাকে একটু অস্বস্তিতে ফেললো। একটু থেমে থেমে বললো, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’ 

মাথার কাছে রাখা সেল ফোনটা বিপ করে শব্দ করে উঠলো। অন্ধকার ঘরে ওই একটুখানি মোবাইলের আলো বিদ্যুতের ন্যায় চমকে উঠলো যেন। বিভা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো। সামি লিখেছে, ‘লাইনে আছিস?’ 

চট করে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে, অভিজিৎকে বললো, ‘আমি একটু আসছি।’ 

অভিজিৎ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। সে জানে বিভা কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। এ ব্যাপারে তার বলার কিছুই নেই। 

আজ সকালে নতুন একটা শাড়ি পরলো বিভা। কলাপাতা রঙের তাঁতের শাড়ি। সিঁথিতে আঁকল সিঁদুর। লম্বা চুল গুলো মুড়িয়ে হাত খোঁপা করল। তার খোঁপাটা এখন বেশ বড় হয়। ইন্ডিয়ায় আসার পর থেকে আর চুল কাটা হয়নি। আগে ছ মাস অন্তর অন্তর সে আর হৃদি একসাথে পার্লারে গিয়ে চুল কাটতো। হৃদির কথা মনে পড়তেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কত দিন দেখেনা শয়তান গুলাকে! কত করে বললো একটা বার ঘুরে যা কলকাতা থেকে। আসলোই না! বেশ তো বিভাও ভুলে যাবে ওদের কথা। একদম ভুলে যাবে! 

বাইরে ঝকঝকে একটি সকাল। শীতকালের কুয়াশা ভাসা মিঠা রোদ্দুর শুয়ে আছে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে। কিচিরমিচির ডাকছে পাখি। শোবার ঘর থেকে বেরিয়েই চোখে পড়লো বসার ঘরের ফুলদানিতে সাজানো তাজা কয়েকটি লাল গোলাপ। দেখে স্নিগ্ধ এক ঝাপটা এসে লাগলো মনের মাঝে। অনেক দিন বাদে বিভার আজ নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে, স্বাধীন মনে হচ্ছে! সে রসুইঘরে উঁকি দিল। দূর্গা মেঝেতে বটি নিয়ে বসে মাছ কুটছে। আঁশটে একটা গন্ধে ছেয়ে আছে রসুইঘর। এ ঘরের সাথে একটা দাওয়া আছে। একটা মোরগ দম্পতি ছানা পোনা নিয়ে সেই দাওয়ায় নিশ্চিন্তে কক কক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

বিভাকে দেখে এক গাল হেসে দূর্গা বললো, ‘কী গো বৌদিমণি? সকাল হল তোমার? দাদাবাবু বেরিয়েছেন সেই ভোরবেলায়। কত করে বললুম তোমায় একটিবার ডেকে তুলতে। সে শুনলোইনা কতা। বলে কিনা তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোটা নাকি উচিত কম্ম হবেনা।’ 

দূর্গার কথায় বিভা কী বলবে খুঁজে পেলোনা। একটু প্রশ্রয়ের হাসি হাসলো শুধু। 

দূর্গা আবার বললো, ‘তুমি কী খাবে? চা করে দিই?’ 

—‘আমি নিজেই করে নিচ্ছি। আজ কী রান্না হবে? 

—‘তুমি রাঁধবে? রুই মাছ করব। আর সুক্তোর তরকারি, সাথে বেগুন ভাজা।’ 

—‘আমার রান্নার হাত খুব একটা ভালোনা। বাড়িতে রোজ মা’ ই রান্না করতেন। তোমার দাদাবাবুর আমার রান্না খেয়ে অভ্যেস নেই। সে খেয়েছে হয় মায়ের রান্না, নয় তোমার রান্না। তুমিই কর রান্নাটা।’ 

—‘ঠিক আছে। আমিই করবো।’ শেষ কথাটা বলার সময় দূর্গাকে বেশ প্রফুল্ল দেখালো। 

বিভা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। ঘাসের ডগায় ডগায় এখনো শিশির বিন্দু ঝিকমিক করছে। সামনের ঘাস ওয়ালা জমিনটার পরেই জঙ্গলের শুরু। শাল, পলাশ, জামুন ইত্যাদি গাছের সমাহার। সারি সারি গাছ গুলোর ওপাশে ভারী নিশ্চিন্তে তির তির করে বইছে জলঢাকা নদী। এখান থেকে নদী দেখা যায়না। শুধু শব্দ শোনা যায়। জলের শব্দ, বাতাসের শব্দ। নদীর পরেই সটান দাঁড়িয়ে আছে আকাশ চুম্বি সবুজ আর মাটি রঙের পাহাড়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কয়েকটি বাঁশের তৈরী ঘর বাড়ি। ঘরের সামনে ছুটোছুটি করছে আদিবাসী বাচ্চারা। পাহাড়ের চুড়ো ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্বপ্নের মত উড়ে বেড়াচ্ছে ধোঁয়াটে মেঘ। সেই ধোঁয়া ধোঁয়া পলকা মেঘের ওপর স্পষ্ট রুপে ভেসে আছে সূর্য রশ্মি। 

সেলফোন হাতেই ছিল। বিভা সামিকে মেসেঞ্জারে ভিডিও কল করতেই সামি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করল। মোবাইলের ক্যামেরায় সামির মুখ ভেসে উঠলো। 

—‘কই তুই?’ বিভার প্রশ্ন।

—‘ড্রাইভ করি। স্কুলে যাই।’ 

‘ও রাস্তায় কি অনেক জ্যাম?’ 

—‘হ্যাঁ জ্যাম তো থাকবেই। শোন চাকরিটা মনে হয় ছেড়ে দিব।’

—‘কেনো?’ 

—‘বিরক্ত লাগে বাচ্চা পড়াইতে।’ 

—‘আগে অন্য কোনো ব্যবস্থা করে নে, তারপর নাহয় ছাড়িস।’ 

—‘নাহ, অন্য ব্যবস্থা পরে হবে। এই বালের চাকরি আর করবোনা।’ 

এটুকু বলে সামি ড্রাইভ করতে করতেই হঠাৎ বিভার কপালের দিকে চেয়ে কড়া গলায় বললো, ‘এই বিশ্রী জিনিসটা কি তোর প্রতিদিন লাগাইতে হয়?এখন তো শ্বশুর, শাশুড়ি নাই।এখন তুই কার ভয়ে এটা পরিস? হ্যাঁ?’ 

বিভা বুঝলো তার সিঁথিতে পরা সিঁদুর নিয়েই সামির অভিযোগ। সামি কখনোই এই লাল রঙটাকে বিশেষ পছন্দ করতে পারেনি। শ্বশুর বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে সিঁদুর উপড়ে ফেলার কোনো উপায় ছিলোনা। শ্বশুর শাশুড়ির দোহাই দিয়ে সামিকে নিরস্ত করা গেছে। কিন্তু কলকাতা শহর ছেড়ে এতদূরে এসেও যে সামাজিক বিধিনিষেধ গুলো বিভার মাথার ওপর থেকে পুরো দমে সরে যায়নি তা এখন সামিকে কে বোঝাবে? 

—‘এখানে কাজের লোক টোক আছেনা? সিঁদুর না পরলে ওরা কী বলবে?’ 

—‘সিরিয়াসলি বিভা? আগে বলতি ওই এসহোলটার বাপ্ মা নাকি রাগ করবে, আত্মীয় স্বজন কী বলবে, ব্লা ব্লা ব্লা।… আর এখন তুই আমাকে কাজের লোকের এক্সকিউজ দেখাচ্ছিস?’ 

বিভা একটু নিভলো। ঠোঁট বাঁকা করে বিরক্তিসূচক চ কারান্ত একটি শব্দ করে বললো, 

—‘সামি তোর সবকিছুতে তাড়াহুড়া। আরে আসছি মাত্র গতকাল। একটু তো সময় দিবি আমাকে, তাইনা?’ 

—‘সময় দিতে দিতে প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। আর কত সময় চাস তুই? ওই লোকটার বৌ সেজে থাকতে খুব ভাল লাগে তাইনা? লিসেন, আই ক্যান্ট টেক দিস এনিমোর।’ 

—‘আর কয়েকটা দিন সময় দে। 

—‘থাক তুই তোর সময় নিয়ে। জাস্ট গো এন্ড ফাক ইওরসেল্ফ।’ 

লাইন কেটে দিল সামি। বিভা প্রায় সাথে সাথেই আবার কলব্যাক করলো। সামি ধরলোনা। এরপর বিভা মায়ের নম্বরে ফোন করলো। কথা বলল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ফোন করল হৃদি আর অমৃতাকে। এভাবেই এর ওর সাথে ফোনে কথা বলে সকালটা কাটলো তার। দুপুরে দূর্গা এসে বললো, ‘বৌদি তুমি কি খেয়ে নেবে? নাকি দাদাবাবুর জন্য অপেক্ষা করবে?’ 

কঠিন প্রশ্ন। খিদেয় পেটের ভেতর ছুঁচো দৌড়োচ্ছে। এমন অবস্থায় না খেয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করে উপোস বসে থাকা কি সম্ভব? বিভা একটু নিস্তেজ গলায় বললো, ‘তোমার দাদাবাবু কখন আসবেন? 

—‘এইতো ঘন্টা খানেকের ভেতরেই চলে আসবেন। দুপুরে খেয়ে নিয়ে আবার ফিরে যাবেন অফিসে।’ 

—‘বেশ তো, অপেক্ষা করছি। তিনি আসুক। এক সাথেই খাবো।’ 

দুপুরে বিছানায় গড়ালো বিভা। একটু ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। ঘুম যখন ভাঙলো তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। অভিজিতের কোনো খবর নেই। সকাল থেকে দুটো শুকনো বিস্কুট আর চা ছাড়া কিছুই বলতে গেলে খাওয়া হয়নি। বিভা আর না পেরে দূর্গাকে বললো, ‘তিনি মনে হয় আজ খেতে আসবেন না। আমাকে খাবার দিয়ে দাও। খেয়ে নিই।’ 

দূর্গাকে চিন্তিত দেখালো, ‘বুঝলুম না। হঠাৎ কী হল দাদাবাবুর। রোজ ঠিক সময় মত এসে দুপুরের খাবার খেয়ে যান। অনিয়ম করাটা তার স্বভাবেই নেই।’ 

দূর্গার বলার ধরণে মনে হয় যেন অভিজিৎকে সে কত শত বছর ধরে চেনে। কেমন একটু অধিকার, দরদ আর মায়া মেশানো ওর কথাগুলোতে। বিভা দূর্গাকে ভালো করে লক্ষ্য করে। বয়স কত হবে? বাইশ কি তেইশ। বিভার চেয়ে বয়সে ছোটই হবে। চোখ দুটো গোল। মুখের ছাঁচটা একটু লম্বাটে কিন্তু মায়া মায়া একটা ভাব আছে। বাদামি গায়ের রং। দেহখানা ভরাট। এরকম একটা যুবতী মেয়ের সাথে অভিজিৎ একই বাড়িতে বছর দেড়েক সময় ধরে আছে। ওদের মাঝে কোনো অন্যরকম সম্পর্ক নেইতো? দূর্গার কি অভিজিতের প্রতি কোনো দুর্বলতা আছে? দাদাবাবু দাদাবাবু বলে অত কেন বাক বাকুম হওয়া? ভাবতেই বিভার কেমন গা গুলিয়ে উঠলো। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো দূর্গার উপস্থিতি তার এই মুহূর্তে আর ভালো লাগছেনা। সে একটু ধারালো গলায় বললো, 

‘দাদাবাবুকে নিয়ে তোমার অত ভাবতে হবেনা। আমি ফোন করে জেনে নেব তার খবর। তুমি যাও কাজ সেরে নাও। আর তোমাদেরও তো খেতে হবে নাকি? সারা দিন কি উপোস থাকবে? 

দূর্গা চলে গেলো। ভাতের প্লেট নিয়ে খাবার টেবিলে বসে বিভা বন্ধুদের ফোন করলো। বন্ধুরা তখন টি এস সি চত্বরে। ভিডিও ক্যামেরায় ওদের সব গুলার চেহারা ভেসে উঠতেই বিভা আয়েশ করে বললো, ‘বন্ধুরা, আমি একন বাত কাবো। তোমরা সবাই দেকো। মেকে মেকে বাত কাবো! কুব ট্যাশ।’ 

গাড়িতে উঠে বসে দরজা দিতেই দেখা গেলো কাচের জানালায় কেউ একজন আঘাত করছে। হৃদি তাকিয়ে দেখলো সামি। জানালার কাঁচ নামিয়ে বললো, ‘কী চাই?’ 

—‘দরজা খোল, বসতে দে।’ 

—‘কেন তোর রাইড লাগবে?’

—‘হ্যাঁ লাগবে।’ 

—‘সরি, আমি এখন অত দূর যাইতে পারবোনা। রাস্তায় জ্যাম অনেক।’ ড্রাইভার বাঁদর গলা বাড়িয়ে স্মার্ট হবার চেষ্টা করে বললো, ‘এক্সাক্টলি কোথায় নামাতে হবে উনাকে ম্যাডাম? মনে হয় পারবো।’ 

—‘আপনি চুপ থাকেন।’ হৃদি বললো ধমকের সুরে। 

সামি ক্রমাগত গাড়ির জানালায় আঘাত করে যাচ্ছে। ওর ঠিক পেছনেই রিক্সায় বসে থাকা বছর চল্লিশের এক ভদ্রলোক দৃশ্যটা হা করে গিলছে। হৃদি সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে দরজার লক খুললো। সামি ঝুপ করে গাড়ির ভেতর ঢুকে হৃদির পাশে বসে পড়লো। বাঁদর বললো, 

—‘ম্যাডাম কোথায় যাবো?’ 

হৃদি দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বিড়বিড় করে বললো, ‘জাহান্নামে যা!’

—‘জি ম্যাডাম?’ বাঁদর দ্বিধাগ্রস্থ। 

হৃদি হুংকার ছেড়ে বলল, ‘বাসায় যান।’ 

—‘এই স্যারকে নামাতে হবেনা?’ 

—‘আপনাকে যা করতে বলেছি তাই করুন। এতো ভাবতে হবেনা আপনার।’ 

বাঁদর গাড়ি ব্যাক এ নিয়ে পার্কিং লট থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে লাগলো। হৃদি একটা খ্যাঁক দিয়ে উঠে সামিকে বললো, 

—‘কী চাই তোর? সমস্যা কী?’ 

সামি একটু সরে এসে হৃদির গা ঘেঁষে বসলো। 

—‘তোর কী হইছে? আমাকে এভয়েড করতেছিস কেন?’ 

—‘এভয়েড করবো কেন? নিজেকে এতটা ইম্পরট্যান্ট ভাবার কোনো কারণ নাই সামি।’ 

সামি দিশাহারা ভাবে বললো, ‘তুই ইন্ডিয়া যাইতে চাচ্ছিস না কেন? -’আমার টাকা নাই। সিরিয়াসলি অনেক টানাটানির মধ্যে আছি এখন।’ 

—‘দ্যাখ আমরা সবাইই তো টানাটানির মধ্যেই আছি। কিন্তু অনেক দিন ধরে প্ল্যানটা করা হচ্ছে। সবাই এর মাঝেই টাকা পয়সা সেভ করছে এই ট্রিপের জন্য। তুই করিস নাই কেন? 

হৃদি হতাশ একটা নিঃশাস ফেলে ঘাড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, ‘উফ, সারাক্ষণ এই এক প্যাঁচাল পারতে ইচ্ছা করতেছেনা।’ 

—‘তুই কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছিস? গত দুই দিন ধরে একটা কথাও তুই আমার সাথে ভালো মত বলিস নাই।’ 

হৃদি সামির দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বললো, ‘তোরে আমার বিরক্ত লাগলে কি আমার কিছু করার আছে? এটাতো মানসিক ব্যাপার। আই ক্যান্ট হেল্প’ 

সামি বিস্মিত, ‘আমারে তোর বিরক্ত লাগে?’ 

—‘হ্যাঁ লাগতেছে কদিন ধরে।’ 

—‘কেন?’ 

হৃদি চোখ মেলে ভালো ভাবে একবার দেখলো সামিকে। তার গায়ে হালকা আকাশি রঙের ফুলহাতা শার্ট। কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো। ফর্সা গালে তিন চারদিনের দাড়ি। 

—‘তোর চেহারা সুরত বদখত হয়ে গেছে। দেখলে কেমন যেন জন্তু জন্তু মনে হয়।’ 

সামি হেসে ফেললো,–’ফালতু কথা বলিস না হৃদি।’

—‘ফালতু না সত্যি।’ 

হৃদি ওর লম্বা চুল গুলো বেণী করেছিল। পিঠের ওপর ঘোড়ার লেজের মতো পড়ে ছিল বেণীটা। সামি লম্বা পুরু বেণীটা হাতে নিয়ে হৃদির গালের ওপর চাবুকের মত হালকা ভাবে মারতে মারতে বললো, ‘আর তোকে দেখতে কেমন লাগে জানিস? বলিউডের নায়িকা কাজলের মতো।’ 

—‘কাজলের মতো লাগা মানে বুঝিস তুই, আমি কতটা সুন্দরী?’ 

সামি হো হো করে ডাকাতিয়া হাসি হাসে, ‘কাজলকে তোর সুন্দর লাগে? ইশ… কাজল? ক্যাটরিনা হইতে পারতি তো তুই, কাজল কেন হইতে গেলি? বিরক্ত লাগে।’ 

—‘তোর বিরক্ত লাগলে কিছু এসে যায়না। কাজলের অনেক অনেক ভক্ত আছে। রুদ্র আর আকাশকে জিজ্ঞাসা করে দেখিস। ওরা সব কাজলের ফ্যান।’ 

গাড়িটা চলছিল ধীরে ধীরে। সন্ধ্যার রাস্তায় অগণিত গাড়ির ভিড়। শুধু প্রাইভেট কারই নয়। তার সাথে পাল্লা দিয়ে সমান তালে চলেছে সি এন জি, রিক্সা, বাস। কালো ধোঁয়ায় সয়লাব চারপাশ। এর মাঝেই হৃদি টের পাচ্ছিল ড্রাইভারটার সমস্ত মনোযোগ পেছনের গদিতে। কান খাড়া রেখে শুনছে তাদের কথোপকথন। 

হৃদি একটু সতর্কতার গলায় সামিকে বললো, ‘তুই নেমে যা এখন। বাকি কথা পরে হবে। 

—‘নামব, তার আগে বল, তুই আমার সাথে এরকম করতেছিস কেন?’

—‘কিছুই করতেছিনা।’ 

সামি হৃদির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল। 

—‘দোস্ত প্লিজ, আমি জানি আমার সেদিনের কথাটায় তুই কষ্ট পাইছিস। কিন্তু আমি আসলে অত কিছু ভেবে বলিনাই। আমি জানি বিভা আর আমার রিলেশনটা অনেক বেশি কমপ্লিকেটেড। কিন্তু তুই যখন বার বার ব্যাপারটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় দিস তখন আমার খুব খারাপ লাগে।’ 

হৃদি স্তিমিত গলায় বললো, ‘ঠিক আছে, আর কোনোদিন কিছু বলবো না।’

—‘এইযে এইটা তো রাগের কথা।’ 

—‘না রাগের কথা না।সত্যি আমি আর কখনো তোদের ব্যাপারে কিছু বলবো না।’

সামি হতাশ হয়ে বলে, ‘উফ আল্লাহ! তুই এরকমই করতে থাকবি এখন?’ হৃদি বিরক্ত হয়, ‘আমি কী করতেছি?’ 

সামি করুণ গলায় বলে, ‘আচ্ছা আমি সরি। সেইদিন ওই কথাটা বলা উচিত হয়নায়। রিয়েলি সরি!’ 

বন্ধুদের ভেতরে তারা খুব একটা সরি টরি বলেনা। এই প্রথম সামি তার কোনো বন্ধুকে এমন অনুনয় বিনয় করে সরি বললো। সে জানে অন্য বন্ধুরা এই খবর জানতে পেলে খ্যাপানো শুরু করবে। মজা লুটবে। 

হৃদি হালকা গলায় বললো, ‘ঠিক আছে, বাদ দে এসব। আমি শুধু চাই তুই আর বিভা দুজনেই ভালো থাক।’ 

—‘সেটাতো আমি জানি।’ 

—‘জানলে ঐরকম করে বললি কেন? যে আমি হিংসা করতেছি?’ 

—‘এমনি বলছি। কিছু ভেবে বলিনাই।’ 

হৃদি চুপ করে থাকে। সামি ওর বিনুনীটা ধরে আবার ঝাঁকুনি দেয়, বলে, ‘আমরা ঠিক আছি?’ 

—‘ঠিক আছি।’ 

খানিক বাদে মৎস্যভবনের সামনে সামি নেমে গেলো। নামতেই বাঁদর বললো, 

—‘ম্যাডাম এই ছেলেটা কে?’ 

বিরক্ত হৃদি পাঁশুটে মুখে উত্তর দেয়, ‘বন্ধু।’

বাঁদর অদ্ভুত হাসে। রসিয়ে রসিয়ে বলে, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনার বয়ফ্রেন্ড। কেন যেন মনে হচ্ছিল এই ছেলেটার প্রতি আপনি গভীর ভাবে আসক্ত!’ 

হৃদি চমকে উঠলো। বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত অসহনীয় কম্পন অনুভূত হল তার আচমকা। একজন সাধারণ মামুলি বেতনভুক ড্রাইভারের মুখে এত বড় কথা! 

হৃদি কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘বাঁদর সাহেব, কাল থেকে আপনি আর আসবেন না।’ 

—‘জি? ঠিক বুঝলাম না।’ 

—‘আপনার চাকরি এখানেই শেষ। ইউ আর ফায়ার্ড!’ 

.

সন্ধ্যের মুখে মুখে ফিরে এলো অভিজিৎ। তার পরনে ফর্মাল সাদা শার্ট, কালো কাপড়ের প্যান্ট। চুল পরিপাটি করে জেল দিয়ে আঁচড়ানো। একেবারে ফিটফাট। তবে চোখদুটি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বিভা ড্রইংরুমে বসে একটি ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিল। অভিজিৎকে দেখতে পেয়েই সে ফিক করে হেসে দিল। 

—‘হাসছেন যে?’ সোফার ওপর বসে জুতো খুলতে খুলতে প্রশ্ন করলো অভিজিৎ। 

—‘এত সাজছেন কেন?’ বিভা বলে ফিচেল গলায়। 

—‘সাজের কী দেখলেন?’ 

—‘এইযে, ফর্মাল ইন করা শার্ট, মাথায় জেল, মানে সেইরাম অবস্থা!’ 

—‘ওমা অফিস যাবার জন্য ভদ্র পোশাক তো পরতেই হবে।’

—‘ভদ্র পোশাক পরা মানে কি ভোদাই মার্কা ড্রেসআপ করা?’ 

অভিজিৎ ভ্রু কুঁচকে ফেলে, ‘ভোদাই কী জিনিস? আপনি কিন্তু খুব অফেন্সিভ কথা বলেন সবসময়। এটা ঠিক না।’ 

বিভা নির্বিকার গলায় বলে, -’ওমা, রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি সর্বদা সত্য কথা বলার চেষ্টা করি। সত্য কথাগুলো অফেন্সিভ শোনালে আসলে আমার কিছু করার নেই। 

—‘অত সত্য বলার প্রয়োজন নেই। মাঝে মাঝে কিছু অপ্রিয় সত্য কথা চেপে যেতে হয়।’ 

—‘ও, তাই বুঝি? তা আপনি আজ দুপুরে খেতে এলেন না কেন? দূর্গা আপনাকে ভীষণ মিস করছিল। আরেকটু হলে কেঁদেই দিত।’ 

অভিজিৎ আড়চোখে দেখলো একবার বিভাকে। জুতো জোড়া একপাশে সরিয়ে রেখে স্তিমিত গলায় বললো, ‘যাক, কেউ একজন অন্তত আমাকে মিস করেছে শুনে ভালো লাগলো।’ 

—‘রোজ দুপুরে নাকি আপনি খেতে আসেন? আজ আসেননি কেন? আমি আছি বলে?’ 

—‘ফিল্ডে কাজ ছিল। সময় পাইনি। আপনার দিন কেমন কাটলো?’

—‘ভালোই। বেশ স্বাধীন স্বাধীন লাগছে নিজেকে অনেক দিন পর। আপনাদের সল্ট লেকের বাড়িটা একটা জেলখানা ছিল।’ 

—‘আপনি নিজের ইচ্ছেতেই সেই জেলখানার জীবন বেছে নিয়েছিলেন তাইনা? এখন আমাকে এসব কথা শুনিয়ে তো লাভ নেই।’

—‘নিজের ইচ্ছায় বেছে নেই নি। নিতে হয়েছে। এই যেমন এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার মতো ভোদাইয়ের সাথে একই বাড়িতে, একই ঘরে দিন কাটাতে হচ্ছে। সব কপালের খেলা, বুঝলেন?’ 

অভিজিতের মুখের রং পাল্টাতে বেশি সময় লাগলোনা। সে থম ধরা গলায় বলল, 

—‘মানুষকে অপমান করে কথা বলতে কি আপনার খুব ভালো লাগে?’

—‘সব মানুষকে নয়। তবে কিছু কিছু মানুষকে অপমান করতে আমার মাইরি, দারুণ লাগে।’ 

অভিজিৎ একটা হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘বিভা, মাঝে মাঝে আপনার কথাবার্তা খুব অসংলগ্ন শোনায়। আমার মনে হয় আপনি এখনো মানসিক ধাক্কাটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। দেখুন আপনাকে আমার সাথে থাকতে কেউ বাধ্য করছেনা। আপনি চাইলে দেশ থেকে ঘুরে আসতে পারেন। কিংবা একেবারে চলে যেতে পারেন। কেউ কিছু বলবেনা। 

কথাটা শুনে বিভা একটু গম্ভীর হয়ে যায়। রাগ রাগ গলায় বলে, ‘আপনি আমাকে তাড়াতে চাইছেন কেন? কাহিনীটা কী?’ 

অভিজিৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তাড়াতে চাইছিনা। সাহায্য করতে চাইছি আপনাকে।’ 

বিভা ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বললো, ‘আহা আপনি তো দেখি একজন লাইফ সেভার! কী ভাবেন নিজেকে? দাতা হাতেমতাই? মহাপুরুষ? নাকি দেবতা?’ 

অভিজিতের বুক থেকে দ্বিতীয় বারের মতো হতাশার নিশ্বাস টা পিছলে পড়লো। সে ধীর স্বরে বললো, ‘আপনার যেমন ইচ্ছে ভাবতে পারেন। আমার কিছু এসে যায়না। সারা দিন অফিস করে এসেছি এখন আমার বিশ্রাম দরকার।’ 

অভিজিৎ ড্রইং রুম ছেড়ে যাবার পর বিভা অনেকটা সময় থম ধরে বসে রইলো। মাথার ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। লোকটা কী বলে গেলো এইমাত্র? সে অসংলগ্ন কথা বলে? সে পাগল? অপ্রকৃতস্থ? 

সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো নিজের বাবা মায়ের ওপর। ওই দুটা মানুষের জন্যেই আজকে এই হাবাগোবা,রসকষহীন, ছাপোষা, মেনিমুখো লোকটি তাকে পাগল ডাকার সাহস করল। রাগে, ক্রোধে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল তার। কী করবে বিভা? কী করে নিজের বাবা মায়ের কাছে সত্যটা প্রকাশ করবে? কী করে বলবে যে এই আট ন মাস ধরে নিছক একটা মিথ্যে সম্পর্কের বোঝা নিভৃতে বয়ে বেড়াচ্ছে সে? কী করে জানাবে যে এই মানুষটার সাথে আদতে তার কোনো রকম সম্পর্কই নেই। না শারীরিক না মানসিক। শুধু মন্ত্র পড়লেই তো স্বামী স্ত্রী হওয়া যায়না! 

ভাবতে গিয়ে বিভার কপালের দুপাশের রগ দপদপ করে ওঠে। বুকটা ভারী লাগে। আজ নয়তো কাল সত্যটা প্রকাশ পাবেই। কী হবে তখন? বাবা মা আঘাতটা সইতে পারবে তো? এত খারাপ হল কেন বিভার ভাগ্যটা? তার তো সুখের একটা পরিবার ছিল! মনের মতো বন্ধু ছিল। বন্ধুর মতো প্রেমিক ছিল। নাচের মতো একটা নেশা ছিল। কী ছিলোনা সেই জীবনটাতে? আহা, ঢাকা শহরের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়লে তার বুক খালি হয়ে যায়। স্বর্গ স্রোতে ভেসে আসা ফুলের মতো একেকটা দিন ছিল! বিভার গলা ধরে আসে। বাপ্ মায়ের ওপর বড় বেশি অভিমান হয়। সুখে আছে তো তারা এখন? বিভাকে এই দূর বনবাসে পার করে দিয়ে জুড়িয়েছে তো তাদের আত্মা? থাকো সুখে থাকো তোমরা। বিভা আর কোন দিন তোমাদের ওই দুনিয়ায় ফিরবেনা। হ্যাঁ ঠিক তাই। দেশে ফিরে গিয়ে কাউকে কিছু না বলেই বিয়ে করবে সে আর সামি। তারপর নিজেদের ইচ্ছে মতো দূরে কোথাও চলে যাবে। কেউ জানবেনা। শুধু জানবে বন্ধুরা। 

কতক্ষণ কাটলো কে জানে। হঠাৎ অভিজিতের ডাকেই ঘোর ভাঙলো। 

—‘কী হল? অমন কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বসে আছেন কেন?’ 

বিভা নড়লনা, যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে থেকে একটা আচ্ছন্ন ভাব নিয়ে বললো ‘কিছু হয়নি।’ 

অভিজিৎ কাপড় পাল্টে ঘরের পোশাক পরেছে। ট্রাউজার, টি শার্ট আর তার উপরে চাদর। সে বিভার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কিছু একটা খুঁজে নিয়ে বললো, ‘বাইরে এসে বসুন। আপনার জন্য এই পাড়ার বাসিন্দারা একটি বিশেষ আয়োজন করেছে।’ 

—‘আয়োজন? আমার জন্যে?’ বিভা অবাক। 

—‘হ্যাঁ আপনার জন্য। আসুন তো। ওরকম দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বসে থাকলে লোকে আমাকে দোষ দেবে। মনে করবে আমি আপনাকে মানসিক অত্যাচার করছি।’ 

বিভা বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, ‘লোকের বলা না বলায় কী এসে যায়?’ 

—‘আপনার কিছু না এসে গেলেও, আমার একটু একটু এসে যায়। কারণ এই জায়গাটায় আমার মোটামুটি একটা সুনাম আছে। আর গ্রামের লোকজন বেশ নোজি। আমাদের নতুন জীবন সম্পর্কে তাদের সীমাহীন কৌতূহল।’ 

বাইরে সেদিন আকাশ ভরা তারা আর জমিনের ওপর সফেদ কুয়াশার আস্তরণ। উঠোনের এক কোণে জঙ্গলের কাছাকাছি শুকনো পাতা আর খড়কুটো জড়ো করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। পোড়া পাতার ঘ্রাণে সয়লাব চারপাশ। বিভা একটা লাল রঙের কার্ডিগান জড়িয়েছিল গায়ে। চুল গুলো খুলে দিয়েছিল পিঠময়। তার লম্বা সুগঠিত দেহখানা আর ডাগর দুটি প্রতিমার মতো চোখ সর্বদাই ভারী আবেদনময়। তার গায়ের রং ফর্সা না, পিতলের মত চকচকে। আজকে সে যখন খোলা চুলে নীল তারকাখচিত আকাশের নিচে ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল, তখন উপস্থিত লোকজনের মাঝে নিমেষে একটা কেমন নেশাড়ু আবেশ ছড়িয়ে গেল। সেই অন্ধকার আলোআঁধারির, নিশিপোকা ডাকা, কুহেলিকাময়, গভীর অরণ্যের বনজ ঘ্রাণ ওয়ালা রাত্রিটিতে রূপের দেবী আফ্রোদিতির মতোই আগমন ঘটলো তার। 

উঠোনে তিন চারটি চেয়ার পাতা আছে। একটি চেয়ারে অপরিচিত এক যুবক বসে ছিল। বিভাকে দেখে উঠে আসলো সে। হাসিমুখে বললো,’বৌদি আসুন। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ।’ 

বিভা দেখলো শাড়ি পরা পাহাড়ি মেয়েদের একটি দল দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আছে দুজন ঢোল বাদক, একজন বাঁশি ওয়ালা। অভিজিৎ ছেলেটিকে ইঙ্গিত করে বিভাকে বললো, ‘এ অসীম। আমার কলিগ।’ 

তৃতীয় পক্ষের সামনে নিজের স্ত্রীকে আপনি সম্বোধন করাটা উচিত হবে কিনা তা নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল অভিজিৎ। পরিচিতির পালাটা তাই খুব সংক্ষেপে শেষ করে সে চেয়ার গুলোর একটিতে গিয়ে বসলো। 

অসীম বিভাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি বাঙাল ভাষায় কথা বলতে পারেন?’ 

—‘ওমা পারব না কেন? আমি তো বাঙালই।’ 

—‘বাঙাল হলেই যে ওই ভাষায় কথা বলতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। আমাকেই দেখুন না। আমার ঠাকুরদা ছিলেন বাংলাদেশী রিফিউজি। দেশ বিভাগের আরো অনেক পরে, সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ছেড়ে ছিলেন।’ 

—‘তাই বুঝি? বাংলাদেশে কোথায় আপনাদের বাড়ি?’ 

—‘ময়মনসিংহ। আমি কখনো যাইনি। কিন্তু বাড়ির বয়স্ক সদস্যদের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি আপনাদের দেশের।’ 

এমন সময় দূর্গা হঠাৎ ছুটে এসে বিভার হাত চেপে ধরল। টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘বৌদি এসো। ওই চেয়ারটায় বসো। ওরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। 

বিভাকে অভিজিতের পাশের চেয়ারটায় বসিয়ে দিল দূর্গা। শীত পড়েছে জম্পেশ। মোটা উলের কার্ডিগানের নিচেও হাত পা জমে আসছে। অসীম অভিজিতের পাশের চেয়ারে এসে বসলো। খানিক বাদে ঢোল তবলা বাজতে শুরু করলো। সেই বাজনার তালে তালে পাহাড়ি মেয়েগুলো নাচতে আরম্ভ করলো সারি বেঁধে। নাচের সাথে সাথে গানও গাইছে তারা। নেপালি ভাষার গান। গানের শব্দে, ঢোলের শব্দে জলঢাকা নদীর স্রোতের তির তির করা সুর ঢাকা পড়ে গেলো। বিভা গানের কিচ্ছু বুঝতে পারছিলোনা। এই নাচের ধরণের সাথেও সে খুব একটা পরিচিত নয়। তবুও তার মনের ভেতর আগের দিনের সেই নাচুনে মনটা আবার অনেক দিন পর ফেরত আসলো। মনে চাইল পায়ে ঘুঙুর লাগিয়ে এখনই নাচতে উঠে যায়। 

ভেতরের হাঁসফাঁস করা ভাবটা কেটে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। অভিজিৎ হঠাৎ অসীম কে বললো, 

—‘তোমার বৌদিমণিও কিন্তু খুব ভালো নাচতে পারেন।’ 

—‘তাই নাকি? তা আমাদের কি সেই নাচ দেখার সৌভাগ্য হবে কখনো? নাকি সেটি শুধু দাদার জন্যেই বরাদ্দ?’ 

অভিজিৎ পলক তুলে তাকাল একবার বিভার দিকে। আগুন রঙের হালকা আলোয় ওর মুখের এক পাশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। অসীমের কথাটা শোনা মাত্র বিভাও চকিতে তাকিয়েছিল অভিজিতের দিকে। একটু বাদে কাচের গ্লাসে করে পানীয় নিয়ে আসলো সেই প্রথম দিনের প্রৌঢ় লোকটি। অসীম একটি গ্লাস বিভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘বৌদি নিন, সুরের সাথে একটি আকার যুক্ত না হলে আসর জমেনা।’ 

অভিজিতের গায়ের ওপর দিয়েই হাত বাড়িয়ে সুরার গ্লাস এগিয়ে দিয়েছিল অসীম। বিভা একটু সংকোচের সাথে গ্লাসটা হাতে নিল। উড়নচণ্ডী মেয়ে হলেও সে এর আগে কখনো মদ স্পর্শ করেনি। তার বন্ধুদের মধ্যে কারোরই মদ গাঁজার নেশা নেই। বিভা দ্বিধা নিয়ে গ্লাসটার দিকে চেয়ে ছিল। 

অভিজিৎ বললো, ‘চেখে দেখতে পারেন। পাহাড়িরা নিজেরাই বানায়। ভাত পঁচিয়ে। চোলাই মদ বলে একে।’ 

বিভা নাকের কাছে নিয়ে দেখল কী বিশ্রী একটা তীব্র গন্ধ! অভিজিৎ বললো, ‘নাক চেপে ধরে এক ঢোঁক খেয়ে দেখুন। 

বিভা তাই করলো। প্রথমে বাজে লাগলেও খানিক বাদে কিন্তু ভালোই লাগল। পর পর দু গেলাস খাবার পর তার মাথাটা ভারী ফাঁকা লাগছিল। চারপাশ কী রকম স্বপ্ন স্বপ্ন। শরীর পাখির মত হালকা। মনে হচ্ছে যেন উড়ে যেতে পারবে সে। শিন শিন করে একটা ভারী ঘোর ঘোর ভালো লাগার স্রোত বইতে লাগলো ধমনি দিয়ে। এই জিনিসটা বেশ তো! সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। কে তুমি, কী তোমার পরিচয়, কোথায় তোমার গন্তব্য সব কিছু ভুলে গিয়ে কেবল এক রিমঝিম নেশায় ডুবে থাকা। বাহ্, সারাটা জীবন এমনি ভাবে কেটে গেলে বেশ হত। বিভার ঠোঁটের কোণে একটি চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তারপর সেই হাসিটা ঠোঁটে লেগে রইলো অনেকক্ষণ ধরে! 

রাতে সে কিছুই খেলোনা। খুব তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলো। নিজের জন্য মেঝেতে বিছানা পাততেও ভুলে গেলো। অভিজিৎ নিজ উদ্যোগে ফ্লোরে চাদর আর ভারী কম্বল বিছিয়ে বিছানা করলো। বাতি নিভিয়ে শুতে যাবার আগে লক্ষ্য করলো বিভার সেলফোনটা ক্রমাগত ভাইব্রেট হচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সামি ফোন করছে। মেসেঞ্জারে। কেটে দিল। সাথে সাথেই আবার আসলো ফোন। আবার কাটলো অভিজিৎ। আবার আসলো। আসতেই থাকলো। অভিজিৎ বিভাকে চোখের কিনার দিয়ে দেখলো একবার। ঘুমোচ্ছে। তার চুলগুলি এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে বালিশে। বুজে রাখা ডাগর দুটি চোখের কার্নিশে একটু লেপ্টে থাকা কাজল। ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি। 

ফোনটা ধরলো অভিজিৎ। 

—‘হ্যালো!’ 

ওপাশে নীরবতা। অভিজিৎ আবার বললো, ‘হ্যালো।’ 

—‘বিভা কোথায়?’ কাটা কাটা ভাবে একটা পুরুষ কণ্ঠ কথা বলে উঠলো। গলাটা অভিজিৎ চেনে। বাংলাদেশে বিভার সাথে তার বিয়ের আগের রাত্রিটিতে ফোনে কথা হয়েছিল এই কণ্ঠটির সাথে। তারপর আর একবারও না। 

অভিজিৎ ঠান্ডা ভাবে বললো, ‘ঘুমোচ্ছে।’ 

—‘ঘুমাচ্ছে?’ 

—‘হ্যাঁ ঘুমাচ্ছে।’ 

—‘এতো তাড়াতাড়ি? ওর শরীর কি খারাপ?’ 

—‘না শরীর খারাপ না।’ 

ওপাশের গলাটা বিভ্রান্তিতে ভোগে। অভিজিৎ টের পায়। 

—‘ঠিক আছে।’ সামি বলে। 

—‘ঠিক আছে।’ বলল অভিজিৎও। 

লাইন কাটার সঙ্গে সঙ্গে বিভা নড়েচড়ে উঠল। আচমকা শোয়া থেকে উঠে বসে বললো, ‘সামি ফোন করেছিল?’ 

—‘হ্যাঁ।’ 

বিভা তড়িঘড়ি করে উঠে আসে। তার নেশা টেশা উড়ে ছাই। সামির ফোন এসেছে, এ যেন দুনিয়া উল্টানো ঘটনা। অভিজিতের হাত থেকে ছোঁ মেরে যন্ত্রটা নিয়ে নেয় সে। আফসোসের গলায় বলে, ‘ইশ… .আমাকে ডাকবেন না? আপনি যে কী!’ 

বলতে বলতে বিভা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অভিজিৎ একলা দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ কাঠ হয়ে। তারপর বাতি নিভিয়ে ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ে বিছানায়। 

পরদিন সকালে সামি ফোন করে অমৃতাকে বললো, ‘জানোস, আব্বা নাকি এয়ারপোর্টে লোক লাগাইছে, আমরা যাতে ইন্ডিয়া যাইতে না পারি। আমরা এয়ারপোর্টে ঢুকলেই নাকি পুলিশ ঝামেলা করবে। কেমন লাগে বলতো!’ 

অমৃতা চুপচাপ শুনল সামির কথগুল। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘চিন্তা করিস না। আমি দেখতেছি।’ 

সেদিন সকালে প্রথমেই জর্জ কোর্টে গেলনা সে। একটা সি এন জি নিয়ে সোজা চলে গেলো উত্তরা, সামিদের বাড়িতে। বাড়ির সামনে একটি ছোট খাটো জটলা। এক নজর দেখলেই বোঝা যায় এটি শহরের কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাড়ি। অমৃতা খবর নিয়ে জেনেছে দেশের একটি প্রথম সারির নিউজ চ্যানেলে আজ সামির আব্বার ইন্টারভিউ আছে। মিডিয়া এখন সর্বদা তৎপর। যে কোনো বিষয়ে তারা দেশের হোমরা চোমরা লোকদের টিভির সামনে নিয়ে আসে। সামির আব্বা টিভি স্টেশনে যাবেন না। ঘরে বসেই অল্প সময়ে তিনি নিজের মতামত ব্যক্ত করবেন। 

.

অমৃতা বাড়ির পাশের পাঁচিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো। সামির আব্বা রাশেদুল হকের উপর ওদের বন্ধুদের ক্ষোভটা আজকের নয়। বহু দিনের বিরক্তি,ঘৃণা, রাগ জমে জমে এখন মহিরুহর আকার ধারণ করেছে। 

একবার অমৃতার বাবাকে সামির আব্বা কথায় কথায় বলেছিলেন, আপনি সরকারি চাকরি করে যত টাকা বেতন পান, তার চেয়ে বেশি অংকের বেতন আমি আমার প্রতিষ্ঠানের সেকেন্ড গ্রেডের কর্মচারীদের দেই। 

অমৃতার বাবা শুধু হেসেছিলেন কথাটা শুনে। কিছু বলেন নি। বাবা হয়তো ভুলেও গেছেন। কিন্তু অমৃতা ভুলেনি। অমৃতা জানে সামির বন্ধুদের এই লোক মানুষ বলে গণ্য করেন না। আড়ালে আবডালে বলে বেড়ান সামির নাকি সব ক্লাসলেস মানুষের সাথে ওঠা বসা। শুধু এই নয়, পরিচিত এক স্বনামধন্য উকিল একবার সামির আব্বার কাছে অমৃতার কাজ সম্পর্কে প্রশংসা করায় সামির আব্বা প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ওই মেয়েটা একটা বেয়াদব। ওই মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করে আমার ছেলেও বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। সেই উকিলের আবার অমৃতাদের চেম্বারে নিয়মিত আসা যাওয়া। একদিন গল্পে গল্পে তিনি জানালেন, অমৃতার বন্ধুর আব্বা অমৃতার প্রতি ঠিক কী ধরণের ধারণা পোষণ করেন। 

সিগারেট শেষ করে ঠাণ্ডা মাথায় ভিড় ঠেলে অমৃতা গেটের ভেতর ঢুকলো। কেয়ার টেকার সুলেমান এ বাড়ির বহু দিনের পুরোনো কর্মচারী। সে অমৃতাকে দেখেই চিনতে পারলো। দৌড়ে এসে বললো, ‘আপা আপনি? 

—‘আপনাদের স্যার কোথায়?’ 

—‘স্যার তো এখন ব্যস্ত।’ 

অমৃতা চতুর চোখে আশপাশটা একবার ভালোভাবে দেখে নিল। খানিক দূরেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে এক অল্পবয়সী সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছে। অমৃতা একটু চিৎকার করে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, ‘কীসের এত ব্যস্ততা উনার?নিজের ছেলের কোন খবর নেয় না। কোন দায়িত্ব পালন করেনা। আর ঘরে বসে বসে দেশ উদ্ধার করেন, তাইনা?’ 

সুলেমান বিব্রত হয়ে পড়লো। কাছে দাঁড়ানো সাংবাদিকটি অমৃতার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। অমৃতা সুলেমান কে বললো, ‘আমাকে ভেতরে যেতে দিন। উনার সাথে কথা আছে।’ 

টোপ জায়গা মতোই পড়লো। সাংবাদিক ছেলেটা এগিয়ে এসে বললো, ‘এক্সকিউজমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?’ 

—‘বলুন।’ 

—‘এম পি সাহেবের ছেলের ব্যাপারে কী বলছিলেন?’

—‘উনার ছেলে তো উনার সাথে থাকেনা, জানেন না?’

—‘ও, তাই নাকি? কেন? থাকেন না কেন?’ 

—‘অনেক কাহিনী। সব এখন বলা যাবেনা। শুধু এটুকু জেনে রাখেন একমাত্র ছেলের সাথে উনার কোনো সম্পর্ক নাই। উনি মানুষ বেশি সুবিধার না। ছেলের সাথে বনে না।’ 

এটুকু বলে অমৃতা আর দাঁড়ালো না। বাড়ির ভেতরে নির্বিঘ্নেই ঢুকে পড়ল। ড্রইংরুমে রাশেদুল হককে পাওয়া গেল। বিশাল আকারের ঘরটি আধুনিক সাজসজ্জায় সজ্জিত এবং সম্পূর্ণ ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সামির আব্বার মুখোমুখি সোফায় একজন সাংবাদিক বসে আছেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। একটু দূরে ক্যামেরা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন আরো দুজন লোক। ঘরে এই তিনজন ব্যতীত আরো জনা কয়েক মানুষ ক্যামেরার পেছনে জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। এরা কেউ অমৃতার দিকে চোখ তুলে তাকাল না। হক সাহেব গম্ভীর স্বরে কথা বলছেন। ঘরে উপস্থিত বাকি লোকজন মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছে। অমৃতা মিনিট দুয়েক সময় দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা অবলোকন করল। লোকটাকে দেখলেই রাগে তার সারা গা রি রি করে। কত হবে লোকটার বয়স? পঞ্চাশ ছুঁয়েছে কি? কে জানে! এখনো বয়সের কোন ছাপই পড়েনি চেহারায়। কলেজের দিনগুলিতে অনেকেই ইনাকে সামির বড়ভাই ভেবে ভুল করত। দীর্ঘকায় শক্ত পোক্ত শরীর। গায়ের রং সামির মতো ফর্সা নয়, তাম্রাভ। তীক্ষ্ণ নাক, বুদ্ধিদীপ্ত গভীর চোখ। জুলপিতে একটু সাদা ছোপ। সামি বাবার গায়ের রং পায়নি। পেয়েছে মায়েরটা। কিন্তু বাবার সাথে তার চেহারার আদল মিলে যায় পুরোপুরি। 

.

—‘আপনার সমস্যা কী?’ 

আকস্মিক প্রশ্নটা ভাব গাম্ভীর্য পূর্ণ ঠান্ডা শীতল ঘরটায় একদম বোমার মতো গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাল। ক্যামেরাম্যান এবং উপস্থাপক ভদ্রলোক চমকে তাকাল অমৃতার দিকে। হক সাহেব থমকে গেলেন। স্তম্ভিত চোখে চেয়ে দেখলেন সামনে দাঁড়ানো ছিপছিপে দেহের, পুরুষালি পোশাক পরা, লম্বা, একরোখা, জেদি মেয়েটিকে। তার চোখদুটি দিয়ে প্রথমে ঝরে পড়লো বিস্ময়,তারপর কৌতূহল এবং সবশেষে ক্রোধ! তিনি ব্ৰিত ভাবে আশেপাশের উপস্থিত লোকজনের দিকে তাকালেন একবার। অমৃতা তখনো নাকের পাটা ফুলিয়ে ক্রুর চোখে তার দিকেই চেয়ে। 

—‘এক্সকিউজ মি, একটু পজ করেন ভিডিওটা।’ হক সাহেব বিনয়ের সাথে বললেন ক্যামেরাম্যানকে। 

ক্যামেরা ম্যান ভিডিও বন্ধ করলো। হক সাহেব অমৃতার দিকে চেয়ে হিমশীতল গলায় বললেন, ‘তুমি এখানে?’ 

—‘হ্যাঁ আমি এখানে। জানতে এসেছি আপনার সমস্যা কী?’ 

হক এই মেয়ের সাহস দেখে বিস্ময়ে একেবারে জমে গেলেন। মেয়েটা বরাবরই একটু বেয়াদব গোছের ছিল। কিন্তু সেই বেয়াদবির মাত্রা যে এমন ভয়াবহ ভাবে সীমা অতিক্রম করে ফেলবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। আগের শীতল ভাবটা গলায় বজায় রেখেই তিনি কেটে কেটে বললেন, 

—‘ঠিক কী বিষয়ে কথা বলতে এসেছ তুমি?এ মুহূর্তে আমি ব্যস্ত আছি। পরে এসো।’ 

—‘পরে আসার সময় নাই আমার। আপনি শুনে রাখেন যে আপনি যা করছেন ভুল করছেন। আমরা আগামী পরশু দিন ইন্ডিয়া যাচ্ছি, এবং যাবোই। দেখি কে ঠেকাতে পারে আমাদেরকে।’ 

হক সাহেব এ পর্যায়ে উপস্থিত লোকজনের সামনে কিঞ্চিৎ বিচলিত বোধ করলেন। অমৃতা ওই বিচলিত মুখখানার দিকে তাকিয়ে সারা শরীরে আনন্দের এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলো। তার বহুদিনের শখ ছিল এই অহংকারী লোকটাকে একদিন লোক সম্মুখে জব্দ করবে। সে ঠান্ডা গলায় বললো, ‘কোনো ঝামেলা করতে আসবেন না এয়ারপোর্টে। ঝামেলা করতে আসলে আপনার মুখোশ খুলে দিব সবার সামনে।’ 

বলে অমৃতা আর দাঁড়ালো না। ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলো। 

হক হতচেতন ভাবে শূন্য চোখে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ অমৃতার চলে যাওয়ার পথটার দিকে। উপস্থিত লোক গুলো থতমত খেয়ে গেছে। কারো মুখে কোন রা নেই। প্রায় মিনিট তিনেক সময় পার হবার পর হক কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘শুরু করুন।’ 

ইন্টারভিউ ভালো হলনা। হকের কপাল থেকে দুশ্চিন্তার রেখাটি সরল না কোন মতেই। 

খুব দ্রুত তিনি মিডিয়ার লোকজনদের বিদায় করলেন। আধা ঘন্টার মাঝেই তাকে সংসদে উপস্থিত হতে হবে। অধিবেশন শুরু হবে বেলা বারোটায়। কিছু প্রস্তুতিরও ব্যাপার আছে। দিন শুরুর এ সময়টায় তিনি স্টাডি রুমে বসে এক কাপ চা পান করতে করতে প্রয়োজনীয় কাজ গুলো গুছিয়ে নেন। সারা দিনে কী কী করতে হবে, কোথায় মিটিং, কার সাথে এপয়েন্টমেন্ট, এসব স্কেজিউল পরখ করে নেন। গেঁথে ফেলেন মগজে। আজকে তিনি স্টাডি রুমের দিকে না গিয়ে দোতলায় সরাসরি নিজের স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। সামির আম্মা গোসল খানায় গোসল করছিলেন। হক বাথরুমের দরজা ধাক্কা দিয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘রোমেলা, এই রোমেলা!’ 

—‘বল, শুনতে পাচ্ছি।’ 

—‘তোমার গুণধর ছেলের যে একটা টমবয় বান্ধবী আছে তার ফোন নম্বর কি তোমার কাছে আছে?’ 

দরজার ওপাশ থেকে বেশ খানিকক্ষণ কোনো উত্তর আসলোনা। হক প্রশ্নটি দ্বিতীয়বারের মতো উচ্চারণ করলেন। 

রোমেলা এবার ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘দেখতে হবে মোবাইলে। আমার ঠিক মনে পড়ছেনা।’

হক সাহেব আর সময় নষ্ট না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলেন। স্টাডি রুমে এসে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফোন করলেন। প্রথমেই ডায়াল করলেন উল্লিখিত নিউজ চ্যানেলের একজন কর্মকর্তার নম্বরে। এই কর্মকর্তা তার পরিচিত। ভদ্রলোককে পই পই করে বুঝিয়ে দেয়া হল যে আজ সকালে অনাহুত এক মেয়ে আকস্মিক ভাবে তার বাড়িতে এসে যে কান্ড করে গেছে তা যেন কোনো ভাবেই মিডিয়ায় নিউজ হিসেবে প্রকাশ না পায়। যেকোনো উপায়ে যেন খবরটা এড়িয়ে যাওয়া হয়। 

দ্বিতীয় ফোনটি করলেন তিনি পুলিশের ডি আইজি কে। সামিকে সেদিন কেবল ভয় দেখানো হয়েছিল যেন ভারত যাবার ট্রিপটা তারা ভয় পেয়ে বাতিল করে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শুধু ভয় দেখিয়ে কাজ হবেনা। ঘটনা ঘটানো আবশ্যক। অতএব বিমান বন্দরে পরশু দিন বিকেলে তার ছেলে এবং ছেলের বন্ধুদের পা পড়া মাত্র যেন পুলিশ তাদেরকে আটক করে ফেলে সেই মোতাবেক নির্দেশ দেয়া হল। 

তৃতীয় ফোনটি করলেন তিনি তাঁর পার্সোনাল সেক্রেটারিকে। অমৃতা নামের মেয়েটার ফোন নম্বর এবং সমস্ত ডিটেইলস তার চাই। সেই সাথে বলা হল মেয়েটির সমস্ত পদক্ষেপ যেন প্রতিনিয়ত অনুসরণ করা হয়। পাঁচ মিনিটের মাথায় অমৃতার ফোন নম্বর, ঠিকানা এবং পেশা সহ যাবতীয় তথ্যাদি তার কাছে ইমেইল করা হল। তিনি ফোন নম্বরটার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। খুব বেশি রেগে গেলে তাঁর শরীরে এক ধরণের কম্পন অনুভূত হয়। ডাক্তার তাকে রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। রাগ ছাড়া অন্য কোন শারীরিক ব্যাধি বর্তমানে তার নেই। তিনি একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে রাগ প্রশমন করার চেষ্টা করলেন। ডায়াল করলেন নম্বরে। 

তৃতীয় বার রিং পড়ার পর ফোনটা ওপাশ থেকে রিসিভ করলো এক নারীকণ্ঠ। 

—‘হ্যালো।’ 

—‘হ্যালো, অমৃতা বলছ?’ 

—‘হ্যাঁ বলছি। আপনি কে বলছেন?’ 

—‘আমি হক। সামির আব্বা কথা বলছি।’ 

ওপাশে ঝুপ করে নেমে আসল নিশ্ছিদ্র নীরবতা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপর অতীব বরফ শীতল গলায় হঠাৎ বলে ওঠা, 

—‘কী চাই?’ 

—‘আজ বিকেলে আমার সাথে দেখা করতে পারবে?’ 

—‘কেন? আপনার সাথে দেখা করতে হবে কেন?’ 

—‘আমি বললাম তাই।’ মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর গলায় টেনে টেনে কথা গুলো বললেন হক। 

—‘আপনি বললেই তো হলো না। আপনার কথা মানতে আমি বাধ্য নই।’

—‘অবাধ্য ছেলে মেয়েদের কী করে বাধ্য করতে হয় তা আমার জানা আছে।’ 

অমৃতা শ্লেষের হাসি হাসলো, ‘তাই বুঝি? এ কারণেই তো নিজের ছেলের সাথে আজ আপনার বনিবনা নেই।’ 

হক এই পুঁচকে মেয়েটির স্পর্ধা দেখে স্তব্ধীভূত হয়ে গেলেন। মিনিট দুয়েক সময় কোন কথা খুঁজে পেলেন না তিনি। 

—‘বিকেল পাঁচটায় তোমার চেম্বারের সামনে আমার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে উপস্থিত থাকবে। গাড়িতে উঠে সোজা আমার অফিসে চলে আসবে। চালাকি করার চেষ্টা করোনা। অতি চালাকের গলায় দড়ি পড়ে। এটা মনে রেখো।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *