বৃষ্টিমহল ২.৩৫

৩৫

আকাশের বাসা থেকে কেউ যাবে না এনগেজমেন্ট এ। তারাকে খুব করে বলার পরেও সে রাজি হয়নি। আসলে তারার যে ওরকম বড়লোকের অনুষ্ঠানে যাবার মতো জাঁকজমক জামা কাপড় নেই এই সত্যটা তো আকাশকে বলা যাচ্ছে না। তাই, পরীক্ষার উছিলা দিয়ে দাওয়াতটা নাকচ করে দিল সে। ঝুমকির কদিন ধরে একটু জ্বরজ্বর ভাব আর সর্দি, কাশি। তাই সেও যেতে চাইল না। 

ঠিক হল আকাশ আর রুদ্র হোটেলে যাবার সময় মনীষাকে তুলে নিয়ে যাবে ওর বাসা থেকে। ট্যাক্সি, সি এন জি বা উবার যে কোন একটা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে সোজা চলে যাবে মনীষার বাসায়। তারপর সেখান থেকে বিভার বাড়িতে। ওখানেই তিন বান্ধবী সাজগোজ করে তৈরী হচ্ছে অনুষ্ঠানে যাবার জন্য। 

অমৃতাকে সাজানো নিয়ে হৃদি আর বিভার উত্তেজনা সীমাহীন! ঠিক হয়েছে অমৃতার মুখ সাজাবে বিভা এবং শাড়ি পরাবে হৃদিতা। মজার ব্যাপার হল শাড়ি পরা অমৃতাকে দেখতে তার মা এবং ছোট বোন এসে হাজির হয়েছে বিভাদের বাসায়। অমৃতার মা আনন্দ অশ্রু আটকে রাখতে পারছেন না। খানিক বাদে বাদে খুশিতে তার চোখ ভিজে উঠছে। অনেক বছর ধরে তিনি মনে মনে এই আশা পুষে রেখেছিলেন যে একদিন তার মেয়েটাও আর দশটা মেয়ের মত স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, মেয়েলি হয়ে উঠবে। আজ এতদিন বাদে তার আশা পূরণ হতে যাচ্ছে। এই আনন্দ তিনি কোথায় রাখবেন? মেয়েকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখার জন্য অমৃতার বাবাও আসতে চেয়েছিলেন বিভাদের বাসায়। কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবে শেষ মেশ ইচ্ছেটাকে ঢোঁক গিলে ফেলেছেন। তবে তিনি বাড়িতে বসে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করবেন। যত রাতই হোক জেগে থাকবেন। তার মনে বড় আশা, তার মেয়েটি আজকের পর থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। আল্লাহ পাক তাদের বাবা মায়ের দোয়া কবুল করেছেন। 

অমৃতার হয়েছে এক মস্ত জ্বালা। শাড়ি পরার পর থেকে তার কেবলই মনে হচ্ছে সবাই তার শরীর খানার দিকে ডবডবে চোখে চেয়ে আছে। কী যন্ত্রণায় যে পড়ল সে! সব মেয়েদের সাথেই কি এমন হয়? এই নিরন্তর দৃষ্টিবাণ সর্বক্ষণ সঙ্গে নিয়ে মেয়েরা চলাফেরা করে কী করে? 

শুধু যে চোখের দৃষ্টি দিয়েই লোকে তার সৌন্দর্য শুষে নিচ্ছে তা নয়, মুখের ওপর অনেকে বলেও দিচ্ছে, ‘কী সুন্দর তুমি!’ অমৃতার এসব প্রশংসা শুনে অভ্যাস নেই। কেউ প্রশংসা করলেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে। কান হয়ে উঠছে লাল। ধন্যবাদ দেয়া তো দুরের কথা, যে প্রশংসা করছে চট করে তার চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে সে। লোকে তবুও ক্ষান্ত হচ্ছে না। সুযোগ পেলেই জানিয়ে দিচ্ছে যে অমৃতা কতটা সুন্দর, এবং শাড়িতে তাকে কতটা মানিয়েছে। 

অবশ্য লোকেরই বা আর দোষ কী? সত্যিই তো তাকে লাগছিল দেখতে স্বর্গের অপ্সরীর মতো। তার ছোট ছোট বয়কাট চুল কোনো ভাবেই শাড়ির সৌন্দর্য লাঘব করতে পারেনি বরং ওই চুলের ধরণটা শাড়ির সাথে এনে দিয়েছে এক অন্যরকম আভিজাত্য। ধনুকের মতো বঙ্কিম ভ্রুযুগলের নিচের পুতুল চোখদুটিতে তার বান্ধবীরা আলগা পাঁপড়ি লাগিয়ে দিয়েছে। সোনালী,রুপালি আর কালোর মিশেলে আই শেডো দিয়ে এঁকে দিয়েছে চোখ। তারপর পরিয়েছে কাজল। গালে দিয়েছে ব্লাশন, আর পদ্মকোরকের ন্যায় পাতলা গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়ে দিয়েছে লাল ম্যাট লিপস্টিক।

হাফ হাতা গোল্ডেন ব্লাউজের সাথে সাদা নেটের ওপর সোনালী সুতোর কাজ করা শাড়ি। সাদা নেটের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠছে চন্দন রঙের ফর্সা পেট। নিয়ম করে দৌড়োয় বলেই হয়তো দেহের গাঁথুনি ভারী চমৎকার। তার ছাব্বিশ বছরের ছিপছিপে লম্বা কায়া এখন পূর্ণ যৌবনময়। শাড়ি জড়ানো অঙ্গে নারীত্বের তীব্র উচ্ছবাস! সরু কোমরখানি যেন হাতের মুঠোয় ধরা যাবে! 

অমৃতা যখন সেজে গুজে বিভার শোবার ঘর থেকে বেরোলো, তখন ড্রইং রুমে অপেক্ষারত অবস্থায় ছিল রুদ্র, আকাশ, মনীষা, অমৃতার ছোট বোন এবং মা। অমৃতার পেছন পেছন বিভা আর হৃদিও এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের সবার সাজগোজ শেষ। কিন্তু আজকে ওদের কেউ দেখছে না। সবার চোখ গিয়ে পড়েছে অমৃতার ওপর। অমৃতার মায়ের চোখ ভিজে উঠেছে। তিনি আনন্দ অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। দীপার চোখেও পানি। 

আকাশ আর রুদ্র দুজনে অনেকটা ক্ষণ অবধি কোনো কথা বলতে পারল না। রুদ্রর চোখ মুখ দেখে মুগ্ধতাটা টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আকাশকে দেখাচ্ছে কিঞ্চিৎ বিব্রত। সে যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তার এ মুহূর্তে কী বলা উচিত, কী করা উচিৎ। বলতে কী, অমৃতার ভারী লজ্জা করছিল। জীবনে এই প্রথম বারের মতো সে জানল, যে লজ্জা কী রকম একটা ভয়ংকর জিনিস। শাড়ি পরে হাঁটা চলা করাও ভারী ঝামেলার কাজ। এর মাঝেই সে অস্থির হয়ে উঠেছে এই অদ্ভুত পোশাকটা সামলাতে গিয়ে। 

অনেকটা ক্ষণ পরে আকাশ বলল, ‘নাহ, শাড়ি জিনিসটা তোর জন্য না। প্যান্ট শার্টেই বেশি মানায় তোরে।’ 

অমৃতা কিছু বলার আগেই অমৃতার মা বেশ প্রতিবাদী গলায় বলে উঠলেন, ‘একদম বাজে বকবেনা। আমার মেয়েকে শাড়িতে খুবই মানিয়েছে। তোমরা এসব কথা বললে ও তো আর কখনো শাড়ি পরবেই না!’ 

বিভা বলল, ‘আন্টি আকাশ মজা নিচ্ছে। আপনি মাইন্ড কইরেন না।’ 

শাড়ির চেয়ে প্যান্ট শার্টেই বেশি মানায় এই কথাটা শুনে অমৃতা আকাশের দিকে একবার ত্যাড়া চোখে তাকালো শুধু। মায়ের সামনে আর কিছু বলল না। 

হোটেল ওয়েস্টিনে ওরা পৌঁছুলো সাড়ে সাতটায়। হলরুমে ঢোকার মুখেই বরকে পাওয়া গেল। বরের পরনে ছাই রঙের স্যুট, সাদা শার্ট, কালো টাই। গালে দাড়ি নেই। কোঁকড়া চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। স্মার্ট, সুদর্শন বরের ভূমিকায় সামিকে মানিয়েছে দারুণ। কনে পক্ষ দেখা মাত্ৰ মুগ্ধ হতে বাধ্য! তার সামনে ফটোগ্রাফারদের ভিড়। ভিড়ের ভেতর দিয়ে তার মুখটা হঠাৎ হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠছে আবার হারিয়েও যাচ্ছে নিমেষে। মিডিয়ার লোকজনও চলে এসেছে। গেটের সামনের ভিড়টার জন্য বন্ধুরা তাৎক্ষণিক ভাবে হলের ভেতরে ঢুকতে পারলো না। লিফটের সামনেই দাঁড়িয়ে রইল। 

বিভা হালকা বেগুনি রঙের কাতান শাড়ি পরেছিল। পার্লারে গিয়ে চুল কার্ল করেছে সে। ওপরের দিকের চুল স্ট্রেইট আর নিচে কার্ল। চোখে স্মোকি আইশেডো। অভিজিতের পাঞ্জাবিটাও বেগুনি। আড়ং থেকে কিনেছে বিভা আজ দুপুরে, নিজের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে। লিফটের সামনের করিডোরে দুই জন ফটোগ্রাফার আগত অতিথিদের ছবি তুলছিল বেশ অনেকক্ষণ ধরে। যে আসছে তাকেই দাঁড় করিয়ে ছবি তুলছে ওরা। বিভা অভিজিতের হাত টেনে ধরে এগিয়ে গেল ফটোগ্রাফারদের দিকে। খুব গম্ভীর ভাবে ফটোগ্রাফারদের একজনকে বলল, ‘ভাই আমার আর আমার বরের ছবি তুলে দেন তো। সুন্দর করে তুলবেন। 

এরপর শুরু হল ছবি তোলার পালা। নানা ভঙ্গিতে একের পর এক ছবি তুলতে থাকলো বিভা তার বরকে পাশে নিয়ে। দু তিনটা ছবি তোলার পরেই অভিজিৎ বেশ বিরক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু বিভার উৎসাহ ক্রমবর্ধমান। তাকে দেখে মনে হচ্ছে একটা জীবন সে শুধুমাত্র ছবি তুলে কাটিয়ে দিতে পারবে। 

অমৃতার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল হৃদি। লিফটের দরজার দিকে পিঠ দিয়ে। সাটিন শিফনের হালকা গোলাপি জমিনের ওপর মেরুন সুতোর কাজ করা শাড়ি পরেছে সে। থ্রি কোয়ার্টার হাতার ব্লাউজ। খোলা চুল। খুব একটা সাজগোজ করেনি। তার ধারণা গায়ের রংটা একটু চাপা বলে বেশি সাজগোজ তাকে মানায় না। আজকেও তার মুখে হালকা প্রসাধন। মেরুন রঙের গোল টিপ কপালের মাঝ বরাবর। চোখে কাজল। ব্যাস এটুকুই। 

লিফটের দরজার বামপাশে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র, আকাশ আর মনীষা। মনীষা একটা নীল জামদানি শাড়ি পরেছে। মাথায় রজনীগন্ধার কাজরা। রুদ্র, আকাশের পরনে সাদা পাঞ্জাবি। বিভার বিরতিহীন ছবি তোলার অত্যাচারে পিষ্ট হয়ে যাওয়া অভিজিতের গোবেচারা মুখখানার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল ওরা দুজনে। বিভা সেই হাসি লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘তোমরা দুজন লুনুষ ব্যক্তি ব্যাক্কলের মত হাসতেছো কেন? হিংসা হয়?’ 

রুদ্র বলল,’আর কত ছবি তুলবি? তুই কি লাক্স সুপার স্টার? নাকি আজকে তোর বিয়া? তোর বর আরেকটু পরেই কাইন্দা দিবে।’ 

—‘এসব ফালতু কথা বলে আমার বরটাকে খারাপ বানাবি না। খবরদার!’ 

.

সেই মুহূর্তে লিফটের খুলে যাওয়া দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসলেন হক। নামকরা লোকদের ঘিরে সবসময় একটা ছোটখাটো ভিড় লেগে থাকে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। হক সাহেবকে ঘিরে আছে ছয় সাতজনের একটি দল। তাঁর গায়ে কালো স্যুট, সাদা শার্ট, সাদা কালোর মিশেলের টাই। হৃদি তাঁকে দেখা মাত্র সালাম দিল। তিনি মাথা নেড়ে সালামের উত্তর দিয়ে ব্যস্ত ভাবে হেঁটে এগিয়ে গেলেন সামনে। তাঁকে দেখতে পেয়ে সামনের ভিড়টা মুহূর্তের মধ্যে পাতলা হয়ে গেল। দলবল নিয়ে তিনি ঢুকে গেলেন ভেতরে। 

.

হলরুমের সিলিং সাজানো হয়েছে রুপালি, সাদা এবং সোনালী পর্দা দিয়ে। পর্দাগুলো ফুলের পাঁপড়ির মতো ছড়িয়ে আছে সিলিং জুড়ে। পর্দার ঝালরের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ডিমের মত হলুদ লাইট। হলদে আলোয় ঝকঝক তকতক করছে চারপাশ। সাদা রঙের আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে হলের প্রতিটি খুঁটি। মঞ্চের পটভূমিতেও একই রঙের পর্দা টাঙানো। বড় বড় ফুলদানিতে রাখা গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা ফুল। স্টেজের মাঝামাঝি সোনালী হাতল ওয়ালা দুটি রাজকীয় সোফা। গোল গোল খাবার টেবিলের ওপর সাজানো আছে তাজা গোলাপের তোড়া। প্লেট, ছুরি, কাঁটাচামচ, ন্যাপকিন। প্রতিটি প্লেটের সাথে রাখা একটি করে ছোট চকলেটের বাক্স। রুমের ভেতর হালকা শব্দে চালিয়ে দেয়া হয়েছে রবীন্দ্রসংগীত। সব মিলিয়ে বেশ মনোরম একটা পরিবেশ। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই হলরুমটি দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপস্থিতিতে ভরন্ত হয়ে উঠল। বৌ চলে আসলো যথাসময়ে। সামি স্টেজে উঠে বসেল তানিশার পাশে। তানিশার পরনে দিল্লী থেকে আনা চার লক্ষ টাকার লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গাটির রঙ ফিরোজার কাছাকাছি। গলায় থরে থরে সাজানো চারটি হীরের সেট। মাথায় সোনার মুকুট এবং টায়রা। এই জাঁকজমক সাজে তার চেহারা হয়ে গেছে সম্পূর্ণ অন্যরকম। জাঁকজমক দেখে মাথা ঘুরে যাবার মতো অবস্থা। স্টেজে বসে থেকে সামি বন্ধুদের খুঁজছিল চোখ ঘুরিয়ে। পেয়েও গেল। কাছেই একটা টেবিল দখল করে বসেছে সবাই। আজকে সে সবার থেকে আলাদা। ইচ্ছে থাকলেও বন্ধুদের সাথে গিয়ে এক টেবিলে বসা আজকের দিনটায় অন্তত কোনো ভাবেই সম্ভব না তার জন্য। স্টেজে বসে থেকে সে শাড়ি পরা অমৃতাকে দেখছে। নিজের চোখে না দেখলে এই দৃশ্য বিশ্বাস করতে পারতো না কোনোদিন। অমৃতার পাশাপাশি একে একে গোল হয়ে বসেছে আকাশ, রুদ্র, মনীষা, বিভা, অভিজিৎ, হৃদি। হৃদির মুখখানা দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। পেছন থেকে শুধু দেখা যাচ্ছে পিঠময় ছড়িয়ে থাকা একরাশ কালো চুল। কিন্তু এই মুহূর্তে তার হৃদির মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। হৃদি এদিকে তাকাচ্ছে না কেন? সকাল বেলা সব বন্ধুরা বাড়িতে আসল, শুধু সে আসলো না। এমনকি সারাদিনে একটা ফোন পর্যন্ত করলো না। হৃদি এসব কী শুরু করেছে? সমস্যা কী তার? এই এড়িয়ে চলা ভাবটা সামির মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। খুব ভাব নেয়া শিখেছে আজকাল। সামির ইচ্ছে হলো এই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে ওকে ভালো মন্দ দুটা কথা শুনিয়ে আসে। 

তার পাশে এখন তানিশার বাবা মা এসে বসেছেন। স্টেজের সম্মুখে পাঁচ ছয়জন ফটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে আছে। একটার পর একটা ছবি তুলে যাচ্ছে তারা। তানিশা হেসে হেসে কানে কানে তাকে কী যেন একটা বলল। সে শুনতে পেল না কিছুই। এতো কোলাহলের মাঝে ডুবে থেকেও তার চারপাশে এখন নিদারুণ এক শব্দহীনতা। সাদা কালো ক্যানভাসে ছাওয়া চারিদিক। সবার মুখ নড়ছে, হাত পা নড়ছে, আশেপাশের প্রতিটি ছবি চলনশীল, বলনশীল শুধু নেই কোনো শব্দ, নেই কোনো রং। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় এখন কেন্দ্ৰীভূত হয়ে আছে কয়েক গজ দূরে বসে থাকা খোলা চুলের মেয়েটির দিকে। সে বশীভূতের মত নামটা ধরে ডাকল একবার, ‘হৃদি!’ 

তানিশা কিছু শুনতে পেল কিনা কে জানে। সামির দিকে একবার তাকালো সে। সামির চোখ ক্যামেরার দিকে নেই। ক্যামেরা ম্যান তাকে বার বার হাত নেড়ে, ডেকে, দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্ট করছে। সে শুনতে পাচ্ছে না কিছুই। তার চারপাশে এখন ধূসর, সাদা কালো, শব্দহীন চলচ্চিত্র। আর বেশিক্ষণ এরকম অবস্থা চলতে থাকলে উপস্থিত সকলের চোখে পড়বে বিষয়টা। কিন্তু তার আগেই খোদার মেহেরবানিতে হৃদি পেছন ফিরে তাকাল। সরাসরি চোখ রাখল সামির মুখের ওপর। ওই চোখে চোখ পড়া মাত্রই ম্যাজিকের মতো সামির কর্ণকুহরে প্রবেশ করল জাগতিক সব কোলাহল। চকিতে সাদা কালো চলচ্চিত্র রূপান্তরিত হল রঙিন ছবিতে। তার বুক থেকে একটা স্বস্তির দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসল। সে বুঝতে পারলো যে আজ সকাল থেকে ওই মুখটা এক নজর দেখতে পাবার জন্যেই তার মনটা কেমন কেমন করছিল। অনেক ক্ষণ তৃষ্ণার্ত থাকার পর এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেলে যে তৃপ্তিটা হয়, তার ভেতরে এখন সেরকম একটা তৃপ্তি বোধ হচ্ছে। 

.

বিভা আর অমৃতা রেস্টরুমে এসেছিল। এদিকটায় এখন ওরা ছাড়া কেউ নেই। বিভা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করছিল। করতে করতে বলল, ‘আমাদের সামিকে দেখছিস? কী সুন্দর লাগতেছে?’ 

অমৃতা বিপন্ন গলায় বলল, ‘আমার তো ওর থেকে ওর বাবাকে বেশি সুন্দর লাগে! কী করব?’ 

বিভা ঝেঁঝে উঠলো একদম কথাটা শুনে, ‘অমৃতা এইসব কথা বলতে না তোরে মানা করছি? পুরাই পারভার্ট মনে হয় আমার তোকে, এসব শুনলে।’

অমৃতা একটা বড় শ্বাস ফেললো, ‘কিছু করার নাই দোস্ত। আমি ট্রাই করতেছি। পারতেছিনা।’ কী যেন চিন্তা করল সে, তারপর বলল, ‘আমি মনে হয় একটু খারাপই আছি। নইলে নিজেরে কন্ট্রোল করতে পারতেছি না ক্যান?’ 

বিভা এ কথা শুনে তাকালো ওর দিকে। একটু নরম ভাবে বলল, ‘খারাপ না মোটেও, তুই গাধা, বেকুব আর পাগল।’ মুখে বলল বিভা, কিন্তু মনে মনে বলল, তুই অন্যরকম রে অমৃতা। একটু বেশিই অন্যরকম। এতো অন্যরকম না হলেও পারতি! 

অমৃতা এবার প্রসঙ্গ পাল্টালো, ‘বেশির ভাগ লোকজনের নজর খারাপ বুঝছিস? তোরা থাকিস ক্যামনে এভাবে? খারাপ লাগে না?’ 

—‘অভ্যাস হয়ে গেছে।’ বিভার তখন শাড়ির কুচি ঠিক করা শেষ।

—‘আমার ভীষণ বিশ্রী লাগতেছে ব্যাপারটা। এরকম জানলে আমি শাড়িই পরতাম না।’ 

—‘এগুলা কোনো কথা না। এসব নিয়েই মেয়েদের চলতে হয়। আর তোমার ফিগার অনেক জোশ, তোমার উচিৎ প্রায়ই শাড়ি পরা।’ 

—‘হবে না আমার দ্বারা। আর যার জন্য পরলাম তার তো কোনো খবর নাই। একবার দেখলো না পর্যন্ত। 

বিভা ধারালো ভাবে বলল, ‘এটার মানে কী? তোমার কি ধারণা ছিল তোমাকে দেখা মাত্র উনি তুঝে দেখা তো নিয়ে জানা সানাম গান গেয়ে উঠে নাচতে নাচতে ছুটে আসবে?’ 

অমৃতা হেসে ফেলল, ‘তুই একটা ফাজিল। গান গাওয়া তো দূরের কথা, এক নজর তাকালোই না!’ 

—‘উনার এত টাইম নাই বুঝছ? ছেলের বিয়া বইলা কথা। তার উপর আসতেছে দেশের প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীরে তেল দিবে নাকি তোমারে দেখবে?’ 

অমৃতা একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলল, ‘হুম, দেখার সময়টুকু হবে বলে মনে হচ্ছে না।’ 

ঠিক সেই সময় দড়াম করে রেস্টরুমের দরজাটা খুলে গেল। ঝড়ের বেগে ভেতরে প্রবেশ করলো হৃদি। তার চোখ ভর্তি জল। মুখজোড়া থমথম করছে কান্না। দুই বান্ধবীকে দেখতে পাওয়া মাত্র সে কম্পনরত গলায় বলে উঠল, ‘আমি পারতেছিনা দোস্ত। সিরিয়াসলি আমি এসব আর সহ্য করতে পারতেছি না।’ 

অমৃতা আর বিভা থ বনে যাওয়া চোখে তাকিয়ে রইল হৃদির দিকে। হৃদি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘ওর পাশে তানিশাকে আমার সহ্য হচ্ছেনা। আমার মনে চাইতেছে মইরা যাই। কী করব আমি? হায় আল্লাহ! কী করব?’ 

দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে প্রবেশ করল চার পাঁচজন মেয়ের একটি দল। হৃদি তড়িঘড়ি করে বেসিনের কল ছেড়ে নিজের সারা মুখে জলের ছিটা দিতে শুরু করল। অমৃতা আর বিভা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। ব্যথাতুর চোখ নিয়ে। তাদের মুখে কোনো কথা নেই। 

.

তিন চারজন নামি দামী শিল্পী এসেছেন এ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করার জন্য। গান শুরু হবার আগে উপস্থাপক ঘোষণা দিলেন যে বর কনের পরিবার এবং বন্ধু বান্ধবদের জন্য একটি বিশেষ সেগমেন্ট রয়েছে। বর অথবা কনেকে নিয়ে এক লাইনের মধ্যে কিছু বলতে হবে। একটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে বর অথবা কনে সম্পর্কে মতামত, অনুভূতি বা সম্পর্কের গভীরতা। প্রথমে বর পক্ষের লোকজনদের ডাকা হল। সামির বন্ধুরাই এগিয়ে গেল নাচতে নাচতে। স্টেজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বরের চোখে চোখ রেখে বলতে হবে কথাটা। সবার প্রথমে আসলো আকাশ। সে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে খুব গম্ভীরভাবে বলল, ‘সামি, আজকের পর থেকে কিন্তু তুমি স্বামী!’ 

হল ভর্তি মানুষজন হেসে উঠলো কথাটা শুনে। সে অবশ্য এখানেই থামল না। বলল, ‘ওটা নকল কথা ছিল। এখন আসল কথাটা বলব।’ 

তানিশার কাজিনরা হৈ হৈ করে বলে উঠল, ‘হবেনা হবেনা, একবারই চান্স!’ 

আকাশ কারো কথা কানে না নিয়ে বলল, ‘সামি, ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড!’ 

সামি স্টেজের ওপর বসে থেকে ভারী সুন্দর হাসল আকাশের কথাটা শুনে। ঠোঁট নেড়ে স্পষ্ট ভাবে বলল, ‘নোটেড!’ 

আকাশের পর পর আসল রুদ্র। সে বলল, ‘সামি শোন, তুই আকাশের বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারিস, কিন্তু সবাই জানে যে, তোর বেস্ট ফ্রেন্ড হল রুদ্র, আকাশ না।’ এটুকু বলে সে উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘সামির বেস্ট ফ্রেন্ড কে?’ 

কয়েকজন উঁচু গলায় উত্তর দিল, ‘রুদ্র!’ 

সামি আর তানিশা দুজনেই খুব হাসতে লাগল এসব ছেলেমানুষি দেখে এরপর অমৃতার পালা। সে সামির চোখে চেয়ে বলল, ‘দোস্ত! আই উইল নেভার লেট ইউ ডাউন। আই প্রমিজ!’ 

সামির সরু চোখে তাকালো অমৃতার দিকে। ঠাট্টার স্বরে ছোট করে বলল, ‘রিয়েলি?’ আজকের সন্ধ্যায় সে অমৃতার বলা কথাটির মর্মোদ্ধার করতে পারল না। হয়তো কোনো একদিন ঠিক ঠিক পারবে। 

বিভা ভরা মজলিশে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘সামি! তুই বেকুব ছিলি, বেকুব আছিস, বেকুবই থাকবি।’ কথাগুলো বলল সে খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে। সাধারণ লোকে ঠাট্টা হিসেবে নিলেও বন্ধুরা বুঝলো যে কথাগুলো বিভা ঠাট্টা করে বলেনি, মন থেকেই বলেছে। 

হৃদি একেবারেই চাইছিল না এতো লোকের সামনে যেতে। কিন্তু সব বন্ধুরা কিছু না কিছু বলেছে। সে কিছু না বললে ব্যাপারটা ভারী দৃষ্টিকটু হয়ে যাবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাঁচুমাচু মুখে সামনে এগিয়ে আসল। মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। কী বলবে? তার গলা দিয়ে তো কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না! যাকে সে নিজের করে পেতে চেয়েছিল, সেই মানুষটা আজ অন্যের হতে চলেছে। এই কষ্ট বুকে চেপে রেখে তাকে এখন হাসিমুখে সাধুবাদ জানাতে হবে। নব দম্পতির মঙ্গল কামনা করতে হবে। পারবে কি সে এতটা ভালো অভিনয় করতে? 

তার চোখের নিচের কাজল লেপ্টে গেছে। সামি বুঝতে পারছে হৃদি এইমাত্র কান্নাকাটি করে করেছে। কোনো কারণে তার মন খারাপ। হৃদির কান্না নতুন কিছু নয়। তার স্বভাবটাই ছিঁচকাঁদুনে। কিন্তু আজকের এই আনন্দের দিনে সে কাঁদবে কেন? সামির বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল হৃদির ওই কান্না চাপা মুখটা দেখে। হৃদি, সামির দিকে তাকাল। তাকিয়েই রইল কয়েক সেকেন্ড। কেমন যেন অদ্ভুত ওর আজকের চাউনিটা। একটু বিব্রত বোধ করল সামি। তানিশা ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, ‘এই মেয়ের কী হয়েছে?’ 

সামি উত্তর দিতে পারল না। তার কেন যেন খুব বুক কাঁপছে! হৃদি মাইক্রোফোন মুখের সামনে নিয়ে অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল, ‘সামি!… আই লাভ ইউ!…’ 

উপস্থিত সকল মানুষ এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। আকস্মিক ভাবে কোথেকে যেন এক ভয়ঙ্কর শীতল নীরবতা নেমে আসল। সবাই নিজেদের কথাবার্তা ভুলে গিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল হতভম্ব ভাবে। সামির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি বিস্ময়ে লণ্ডভণ্ড! তানিশা স্তম্ভিত! 

হৃদির গাল বেয়ে নামছে একটা জলের ধারা। সেই জলের ধারা হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুছে নিয়ে সে কাঁপা গলায় বলল, ‘আই মিন, আই লাভ ইউ দোস্ত! ভালো থাকিস সব সময়!’ 

উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কোলাহল ফিরে আসল। হৃদি দৌড়ে পালিয়ে গেল জায়গাটা থেকে। সব কিছু আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। শুধু সামির মুখে অনেকক্ষণ অবধি লেগে রইল একটি দিশাহারা, বিহ্বল ভাব! 

হৃদি জায়গাটা থেকে প্রস্থান করার পরেও উপস্থিত অতিথিদের অনেকেই চমকটা কাটিয়ে উঠতে পারল না। একটি যুবতী মেয়ের কাঁদতে কাঁদতে বিয়ের বরকে সবার সামনে ‘আই লাভ ইউ’ বলে ফেলাটা কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। যদিও এ বিষয়টি মোটামুটি রকমের পরিষ্কার যে মেয়েটি বন্ধু হিসেবেই বলেছে কথাটা। তবুও কোথায় যেন একটা ‘কিন্তু’ থেকে যাচ্ছে। অনেকেই ফুসুরফাসুর করে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছে গোপনে। কনে পক্ষের মুরুব্বিরা মেয়েটির বিষয়ে উৎসুক হয়ে উঠেছেন। কে এই মেয়ে, কী তার পরিচয় এসব নানাবিধ সন্দেহ বিদ্ধ প্রশ্ন লোকমুখে ঘুরে ঘুরে হলরুমের বাতাসটাকে ভারী করে তুলছে। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা হল রোমেলার। একমাত্র ছেলের বিয়ে উপলক্ষে তিনি বেশ জবরজং একটা সাজ দিয়ে এসেছিলেন পার্লার থেকে। তার গায়ে লক্ষ টাকা দামের শাড়ি। গলায় কানে হীরের সেট। আজ সন্ধ্যে থেকেই তার মেজাজ বড় প্রফুল্ল ছিল। সব কিছু পরিকল্পনা মোতাবেকই হচ্ছে। তানিশার মতো একটি ধনী এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েকেই তিনি ছেলের বৌ হিসেবে চেয়েছিলেন। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে আল্লাহ তার মনের আশা পূরণ করেছেন। তার জীবনে এখন আর কোনো অতৃপ্তি নেই। নিজের আত্মীয় স্বজনদের চোখে মুখে তিনি হিংসের ঝলক দেখতে পাচ্ছেন। কেউ ভাবতেও পারেনি যে ছন্নছাড়া, পাগলাটে স্বভাবের সামি শেষ অবধি বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে রাজি হবে। আজকাল বাপ মায়ের আদেশ মেনে চলা ছেলে মেয়ে আছে নাকি দুনিয়ায়? পুত্র গরিমায় তাই তার ভেতরটা একদম রমরম করছিলো সারাটাদিন। কিন্তু এই হৃদি মেয়েটার সাহস দেখে তিনি অবাক না হয়ে পারলেন না। এতবড় একটা সিন ক্রিয়েট কেন করলো মেয়েটা? লজ্জা শরম বলতে কি কিছু নেই এর? বাবা মা কি কিছুই শেখায়নি? ছেলের মুখে তিনি একটি চরম অস্থির ভাব পর্যবেক্ষণ করছেন সেই ঘটনার পর থেকে। নিজের পেটে ধরা ছেলেকে তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন। ছেলের চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেছে। শেষ মুহূর্তে এসে কোনো অঘটন ঘটবেনা তো আবার? তার বুক কাঁপছে অনবরত। শরীর খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে বিপি হাই হয়ে গেছে। 

ব্যাপারটা নিয়ে তিনি কার সাথে কথা বলবেন বুঝে পাচ্ছেন না। তার স্বামী সর্বদা এত ব্যস্ত থাকেন যে হাতের নাগালে পাওয়াই মুশকিল। এই মুহূর্তে তিনি দলের নেতা কর্মীদের আপ্যায়ন করা নিয়ে ব্যস্ত। নেতা কর্মী ছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছে জনা দশেক বিদেশী বায়ার এবং ডেলিগেটস। অতএব নিজের ভেতরেই আপাতত দুশ্চিন্তাটা চেপে রাখলেন তিনি। পারত পক্ষে তানিশার বাবা মায়ের সামনে পড়লেন না। মনে হচ্ছে ঘটনাটা তাদের কাছেও দৃষ্টিকটু লেগেছে। ইচ্ছে করছে ওই মেয়েটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে হল থেকে বের করে দিতে। কত বড় সাহস মেয়ের! শ খানেক মানুষের সামনে তার ছেলেকে কিনা বলে আই লাভ ইউ? এইসব মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের খুব ভালো ভাবে চেনা আছে তাঁর। এরা বড়লোক বাবার সাদাসিধে ছেলেদের ওপর টোপ ফেলার জন্য সর্বদা ওৎ পেতে থাকে। তিনি আর কিছুই চিন্তা করতে পারছিলেন না। রাগে, উত্তেজনায় আর দুশ্চিন্তায় তার মাথার রগ দপদপ করতে থাকল। 

বন্ধুরা সব হলের একেবারে কোণার একটা টেবিল দখল করে বসেছিল। হঠাৎ করে সবার মধ্যে একটা কেমন স্থবিরতা চলে এসেছে। রুদ্র আর আকাশ দুজনেই কিছু একটা টের পেয়েছে। মনীষা, অভিজিৎ সঙ্গে না থাকলে তারা হয়তো বিষয়টি নিয়ে এখন আলাপ আলোচনা করত। কিন্তু ওই দুজন বাইরের মানুষের উপস্থিতির কারণে কোনো কথা খোলামেলা ভাবে বলা যাচ্ছেনা। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে সামির জন্য। তার মুখটা দেখা মাত্র বোঝা যাচ্ছে যে বেচারার ভেতরে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেই ঝড়ের দাপট বুকের মধ্যে চেপে রেখে তাকে ক্যামেরার সামনে বসে জোর করে হাসতে হচ্ছে। মিষ্টিমুখ করতে হচ্ছে। ব্যাপারটা যে ওর জন্য কতটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে তা অন্য কেউ না বুঝলেও বন্ধুরা ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে। 

এই থমথমে পরিবেশের মধ্যেই হঠাৎ বিভা আবিষ্কার করল রুদ্র অভিজিতের কানে কানে হাসিমুখে কিছু একটা বলছে। অভিজিৎও হাসছে খুব। একেবারে দাঁত বের করে। বিভা ক্যাটক্যাট করে রুদ্রকে বলল, ‘এই, আমার বরের সাথে এতো কীসের ফুসুর ফাসুর? তোকে না বলছি আমার ভালো বরটাকে খারাপ না বানাতে?’ এটুকু বলে সে অভিজিৎকে প্রশ্ন করল, ‘কী বলছিল ও তোমাকে? নিশ্চয়ই মেয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিল?’ 

আকাশ ফোড়ন কাটল, ‘আলবৎ মেয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিল। মেয়ে ছাড়া কোন কথা হয় নাকি?’ 

রুদ্র আর অভিজিৎ তখন বিভার বেকুবি দেখে মিটমিট করে হাসছে। বিভা আগের চাইতেও রাগী গলায় বলল, ‘খবরদার তোরা আমার জামাইকে লুনুষগিরি শিখাবি না।’ 

এ কথা শুনে আকাশ উঠে এসে বিভার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে দিল ওকে। বসল অভিজিতের পাশে। বলল, 

—‘জামাই বাবু, লুনুষ না হতে পারলে জীবন বৃথা। বুঝতে পারতেছি বিয়ের আগে আপনার জীবনটা পুরাই ডালভাত ছিল, কোন সমস্যা নাই এখন আমাদের হাতে পড়ছেন। দুইদিনে ম্যাজিকের মতো পাল্টায় যাবে আপনার লাইফ। ফুলটাইম লুনুষগিরি করতে পারবেন। 

.

বিভা তখন কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করে নাগিন নিশ্বাস ফেলছে। চেয়ে আছে আকাশের দিকে। মনে হচ্ছে আকাশকে পারলে সে গিলে খাবে। অভিজিৎ ওর রাগী গমগমে চেহারা দেখে হো হো করে হেসে ফেলল। রুদ্র বিভার দিকে তাকিয়ে দায়সারা ভাবে বলল, ‘তুই দাঁড়ায় আছিস কেন? দূরে গিয়ে বয়। এখন ক্লাস চলবে। ক্লাস শেষ হইলে জামাইবাবুকে তোর কাছে রাইখা আসা হবে।’ 

এদিকে হৃদি টের পাচ্ছে যে একটা বড়সড় ভুল করে ফেলেছে সে। ভুলটা করে ফেলার পর থেকেই একদম বেকুব বেকুব লাগছে নিজেকে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার। কিন্তু পারছেনা। খাওয়া দাওয়ার পালা শুরু করার আগে বর কনের প্যারেন্টস দের ডাকা হল নিজ নিজ সন্তানদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্যে। রোমেলা কিছুই বললেন না। তার এখন জনসম্মুখে বক্তব্য দেবার মত অবস্থা নেই। ওসব অভ্যাসও নেই তার। তিনি প্রথমেই প্রস্তাবটা নাকচ করে দিলেন। স্পিচ দিলেন হক। বেশ অনেকটা ক্ষণ ধরে তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে নিজপুত্র সম্পর্কে কথা বললেন। স্মৃতি চারণ করলেন। অমৃতা তার বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে শুনতে একটা সময় স্বগতোক্তি করে ফেলল, ‘ইশ… কথা বলাটা যে একটা শিল্প তা উনার কথা শুনে বোঝা যায়। এতো সুন্দর করে কীভাবে কথা বলে মনুষটা?’ 

খানিক বাদে ইউ এন ডিপির সেই টেকো ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়ে গেল। ভদ্রলোক অমৃতাকে দেখার সাথে সাথে বলে উঠলো, ‘মাই গড! তোমাকে তো দারুণ লাগছে!’ 

—‘কেমন আছেন?’ 

—‘আছি ভালোই। তুমি তো একবারও আসলে না আমার অফিসে! 

—‘আসবো কোনো এক সময়। অত তাড়া কীসের?’ বলল অমৃতা। কিন্তু তার দৃষ্টি আটকে গেছে কয়েক হাত দূরের একটা ছোট দলের দিকে। কোটের পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন বিদেশী ভদ্ৰলোক এবং ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলছেন তিনি। তাঁর মুখ হাসি হাসি। কথা বলার ভঙ্গিটি বরাবরের মতই চমৎকার। 

টেকো ভদ্রলোক অনেক কিছু বলছেন হাত টাত নেড়ে। কিন্তু তার চোখ অমৃতার মুখের ওপর নেই। জুলজুল করে জ্বলতে থাকা চোখদুটি ঘুরে বেড়াচ্ছে অমৃতার বুকে, পেটে, কোমরের খাঁজে। অমৃতা একটা সময় বলেই ফেলল, ‘আপনি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। শরীরের দিকে তাকাচ্ছেন কেন বার বার?’ 

টেকো লোকটার গাল ঝুলে গেলো। অপমানে থমথম করে উঠলো মুখ। তার কল্পনাতেও ছিল না যে মেয়েটা মুখের ওপর এরকম একটা কথা বলে দেবে। ঠিক সেই সময় চারটা চোখ মিলে গেল। দৈবাৎ! প্রথম নজরে তিনি ঠিক চিনে উঠতে পারলেন না। দ্বিতীয়বার তাকালেন। তাঁর মুখের কথা আটকে গেল। চোখের তারায় ঝিলিক দিল বিস্ময়! শুধুই কি বিস্ময়? বিস্ময়ের সাথে কি একটুও মুগ্ধতা মিশে নেই? 

টেকো ভদ্রলোক কাঁচুমাচু ভাবে বলল, ‘একজন জেন্টেল ম্যানের সাথে তুমি এভাবে কথা বলতে পারোনা।’ 

অমৃতার কানে কথাটা গেছে ঠিকই। কিন্তু উত্তর দেবার কোন প্রয়োজন বোধ করল না সে। সেই মানুষটা তার দিকে তাকিয়েছেন, এবং তাকিয়েই আছেন। এখন দুনিয়া রসাতলে গেলেও তার কিছুই এসে যায়না। টেকো লোককে পেছনে ফেলে সে সামনে এগিয়ে গেল। মানুষটাও এক দু পা হেঁটে আসলেন। দুজনে দাঁড়ালো মুখোমুখি। বাতাসে কী একটা যেন মিশে গেল নিমেষে। নেশার মতো কিছু। রক্তে কেমন ঝিমঝিম ভাব! 

তিনি অমৃতার চোখের দিকে চাইলেন সরাসরি, কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। হ্যাঁ চোখের দিকেই চাইলেন, শরীরের দিকে কিন্তু নয়। এ জন্যেই অমৃতার ভালো লাগে। বড় ভালো লাগে এটা বুঝতে পেরে যে, লোকটা অহংকারী হতে পারে, বদরাগী হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই আর দশটা সাধারণ পুরুষের মতো কামুক কিংবা দুশ্চরিত্র নন। 

কথা শুরু করার আগেই বাধা চলে আসে। এক মধ্যবয়স্ক মহিলা কোত্থেকে যেন উড়ে এসে, সালাম দিয়ে তাঁর সাথে কথা বলা শুরু করে দিলেন। প্রতিটা কথার শেষে একবার করে স্যার ডাকতে ভুলছেন না মহিলা। মহিলার কথা শেষ হতে না হতেই আরো একজন বয়স্ক ভদ্রলোক হাজির হয়ে গেলেন। এই ভদ্রলোক রাজনৈতিক নেতা। টিভিতে প্রায়ই ইনাকে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে দেখা যায়। অমৃতা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না জায়গাটা থেকে। মানুষগুলো আঠার মতো লেগে আছে। ছাড়তেই চাইছেনা। টানা পাঁচ মিনিট পর জায়গাটা একটু ফাঁকা হল। 

তিনি চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কী খবর অমৃতা? আছ কেমন?’

অমৃতা হাসল, ‘আমি ভালো আছি রাশেদ! আপনি কেমন আছেন?’

রাশেদ কিছু বলার আগেই উটকো ঝড়ের ন্যায় এক দঙ্গল লোক উপস্থিত হয়ে গেল। ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেল মুহূর্তের মাঝে। ক্যামেরাম্যান চলে আসল দুই তিনজন। কথা আর হলোই না। কথাগুলো হারিয়ে গেল হরেক লোকের ভিড়ে আর কোলাহলে। অমৃতার সতেজ, সুন্দর মুখখানা বাসি ফুলের মতো ম্লান দেখাতে লাগল। সরে পড়ল জায়গাটা থেকে। রাগে রি রি করতে থাকল সারা শরীর। আচ্ছা মুশকিল তো! শান্তিতে দুটা কথা বলার উপায় নেই। কী কথা আদতে বলার ছিল জানেনা সে, তবুও সেই অব্যক্ত, অবিদিত, আনকোরা, না বলা কথা গুলো লোহার হাতুড়ির মতো ঠকঠক আওয়াজ তুলে আঘাত হানতে লাগল বুকের পাঁজরে। কিন্তু সাচ্চা বিষয় হল যে, কখনো কখনো মানুষের মুখ কিছু না বললেও, চোখ বলে ফেলে অনেক কিছু! ভিড়ের মধ্যে বারে বারে দুই জোড়া চোখ লেগে যাচ্ছিল… থেমে যাচ্ছিল… কী যেন একটা বলে যাচ্ছিল। অমৃতা একটা খালি টেবিলের চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। এই টেবিলটা বর বৌয়ের জন্য রিজার্ভ করা। তাই এটায় আপাতত কেউ বসবে না। তিনি অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে বসলেন তার ঠিক সামনের টেবিলেই, মুখোমুখি। 

মুখোমুখিই কেন বসলেন? অমৃতার জন্যই কি? সম্ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই শিরশির করে মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শিহরণ বয়ে যায়। অপলক নেত্রে চেয়ে থাকে অমৃতা। চেয়ে থাকেন তিনিও। আশেপাশে এতো লোক, এতো কোলাহল, তবুও যেন কেউ নেই। কিছু নেই। এক আশ্চর্য মধুময় আবেশ সমৃদ্ধ কুহেলিকায় স্তব্ধ চারপাশ! হঠাৎ কী যেন একটা হয়ে গেল। তিনি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। অমৃতা টের পেল। নিঃশ্বাসটা ফেলার পর তিনি হাতে ধরা জল ভর্তি কাচের গ্লাসটার দিকে কিছুক্ষণ কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে চেয়ে রইলেন। অমৃতার মনে হলো মানুষটা এই মুহূর্তে তার কথাই ভাবছেন। কী ভাবছেন উনি? 

অমৃতার ধারণা সঠিক। স্বচ্ছ জল ভর্তি ঝকঝকে কাচের গ্লাসটার দিকে চেয়ে থেকে তিনি ভাবছিলেন যে, কোন অমৃতাকে দেখতে বেশি সুন্দর? ঢোলা শার্ট আর প্যান্ট পরা টমবয় অমৃতা? নাকি এই শাড়ি পরা রমণীয় অমৃতা? এটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ থমকে গেলেন। এমন ছেলেমানুষী ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয়া কি তাঁকে মানায়? এই বয়সে? তাঁর ভেতরে রসবোধ চিরদিনই একটু কম। তিনি কাজ পাগল মানুষ। তাঁর জীবন বাঁধা পড়েছে শৃঙ্খলা এবং নিয়মের পরাকাষ্ঠায়। কর্মজীবন এবং সংসার জীবনের বাইরে তাঁর আলাদা কোনো জগৎ ছিল না কখনো। খুব অল্প বয়স থেকেই টাকার পেছনে ছোটা আরম্ভ করেছিলেন। সফলতা এসেছে অতি অল্প সময়ে। নারী চিন্তা করার মতো অবসর তাঁর কখনোই ছিলনা। এখন, জীবন তরী যখন শেষ বন্দরে নোঙর ফেলতে যাচ্ছে… ভাবতে ভাবতে তিনি নিজের মনে হাসলেন। মেয়েটি তাঁর পুত্রের বয়সী… বাচ্চা একটা মেয়ে!… তাঁর নিজের সাতাশ বছরের পুরোনো সংসার… আজ তাঁর একমাত্র পুত্রের বিয়ে! গা ঝাড়া দেবার মতো তিনি মনটাকে ঝাড়া দিয়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। উঠে দাঁড়ালেন বসা থেকে। পদস্খলন তাঁর হয়নি আজ অবধি। না, এবারেও হবেনা! 

ওই আচমকা প্রস্থানটা অমৃতার ভেতরে এক অপমান সূচক অসন্তোষের জন্ম দিল। জীবনে প্রথমবারের মতো শাড়ি পরার দিনটা তার মোটেও ভালো কাটছেনা। আসলে কি, সব এই শাড়িরই দোষ। তার ভেতরে পিলপিল করে দলবদ্ধ পিঁপড়ার ন্যায় ফিরে আসছে সেই পুরোনো রাগ। মনে পড়ে যাচ্ছে কিশোরী বয়সে ঘটে যাওয়া বাজে ঘটনাটার কথা। পড়ানোর নাম করে রোজ বাড়িতে আসা বাজে লোকটার বিশ্রীভাবে গায়ে হাত দেয়া। ফিরে আসছে সেই ক্রোধ, সেই জিদ, সেই বিদ্বেষ! আবারও কিছু একটা লণ্ডভণ্ড করতে মন চাইছে। মনে চাইছে কোথাও আগুন লাগাতে। সেই বাচ্চা বয়সে অপমান সহ্য করতে না পেরে সে নাপিতের দোকানে গিয়ে চুল কেটে এসেছিল। পাল্টে ফেলেছিল লেবাস। বিসর্জন দিতে চেয়েছিল নিজের ভেতরের নারী সত্তাকে। আজ এতদিন পর এই মানুষটার জন্য সেই হারিয়ে ফেলা নারীত্বকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল সে। বোকামি, বোকামি, চরম বোকামি! চারপাশটা অন্ধকার লাগছিল তার। লোকটা এরকম মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল কেন? অমৃতাকে কি মানুষ বলে মনে হয় না? রাক্ষুসে এক রাগ তার সমগ্র চেতনাকে পূর্ণগ্রাস করে নিতে চাইছিল। তার আর খাওয়া দাওয়াও হলো না সেই রাতে। চুপচাপ হলরুমের কোণার একটা চেয়ারে বসে রইলো সে। অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ অবধি। 

৩৬

আংটি বদলের পালা নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হল। রাত দশটার দিকে অতিথিরা একে একে বিদায় নেয়া শুরু করল। বন্ধুরা যার যার বাড়ি ফেরার প্ল্যান করলেও সামি সেটা মানলো না। সে চায় বন্ধুরা যেন আজকের রাতটা তার বাড়িতেই কাটায়। তাছাড়া আগামীকাল সকাল দশটায় আকদ হওয়ার কথা, সুতরাং সকালে সবাইকে আর একবার আসতেই হবে। তাই শুধু রাতটা পার করার জন্য বাড়ি ফিরে কাজ নেই। অতএব বন্ধুরা সবাই চলল সামির বাড়ি। শুধু বিভা ছাড়া। বিভা, অভিজিৎ এবং মনীষা ফিরে গেল যার যার নিবাসে। আর বাকিরা চলল উত্তরা, বিয়ে বাড়িতে। 

বন্ধুরা সামির আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। বিয়ে বাড়ি আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে। ড্রইংরুম ভর্তি একগাদা মানুষ। ফুল ভলিউমে গান বাজছে স্পিকারে। বাচ্চাদের কেউ কেউ গানের তালে তালে নেচে যাচ্ছে। বিয়েবাড়ির আমেজ ষোলো আনাই আছে এখানে। বাড়ি ফিরে এসে লোকজনের ভিড়ের মধ্যে বন্ধুদের আবিষ্কার করল সামি। বরকে দেখতে পেয়ে আত্মীয় স্বজনরা নানা রকম আহ্লাদীপনা শুরু করল। সামি কাউকে গ্রাহ্য না করে কোন ভূমিকা ছাড়াই নামটা ডাকল, ‘হৃদি, একটু শুনে যা তো!’ 

হৃদির বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন কপালে নিয়ে উঠে আসল সে। বাকি বন্ধুরা দেখল ঘটনাটা। কেউ কিছু বলল না। সামির পেছন পেছন ছাদে উঠে আসল হৃদিতা। চারতলার ছাদটায় তখন অন্ধকার দাঁত চেপে বসেছে। সাদা কুয়াশার চাদর আলগা ভাবে জড়ানো আছে রাতের গায়ে। সুইমিং পুলের পার্শ্ববর্তী ঘাসযুক্ত অংশটুকুর রেলিং এর পাশে গিয়ে দাঁড়াল সামি। নিচতলা থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে, ‘আজ ফাল্গুনী পূর্ণিমা রাইতে, চল পলায়ে যাই।’ সেই গানের সাথে সারা বাড়ি কাঁপিয়ে নাচানাচি করছে ওর ফুপাতো, চাচাতো ভাইবোনরা। 

হৃদি একটু পিছিয়ে পড়েছিল। সামি রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল খানিক ক্ষণ। একটা সময় সিঁড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসল হৃদি। কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আবছা মুখের হৃদিকে হেঁটে আসতে দেখল সামি। অন্ধকারে ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না ঠিক মতো। বাতাসে খোলা চুল উড়ছে, উড়ছে শাড়ির আঁচল। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে নিজের পায়ের তলায় একটা ভূমিকম্প অনুভব করল সে। অনুভব করল বুকের ভেতরে এক অপ্রতিরোধ্য তুফান! এ যেন অবিকল ডুয়ার্সের সেই সন্ধ্যেবেলায় মেয়েটা! 

‘কী হইছে?’ হৃদি বলল, অনেকটা ধমকানোর সুরে। 

সামি কোন উত্তর দিল না। রেলিং এর পাশটায় রাস্তার হালকা আলো এসে পড়েছে। সেই আলোতে সামিকে আবছা চোখে দেখল হৃদি। কেমন যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে ওকে। চেহারায় একটা ভারী খেপা আর উন্মত্ত ভাব। দেখলে কেমন যেন ভয় লাগে। হৃদিই আবার কথা বলল, ‘কী ব্যাপার? কথা বলিস না কেন?’ 

—‘তুই হঠাৎ আই লাভ ইউ বললি কেন?’ অনুসন্ধানী গলায় প্রশ্ন করে সামি। 

হৃদি চমকে উঠল প্রশ্নটা শুনে। আরক্ত হয়ে উঠলো মুখ। বিব্রত ভাবে বলল, ‘মানে কী? আমার ফ্রেন্ডকে আমি আই লাভ ইউ বলতে পারবো না?’

কথাটা শুনে সামি অদ্ভুত হাসি হাসলো। ওই হাসিটা হৃদির ভেতরটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। সত্যি, সত্যি, সত্যি! একদম তিন সত্যি, যে সে সামিকে এর আগে কখনো এমন অদ্ভুত হাসি হাসতে দেখেনি। আজকে এই ছেলের হয়েছে কী? সামি অদ্ভুত হাসিটা মুখে ধরে রেখেই বলল, ‘আমার তো হঠাৎ তোর মুখে আই লাভ ইউ শুনে মনে হইছে যে রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার। একদম বুকের এইখানে গিয়ে লাগছে!’ কথাটা বলতে বলতে সামি নিজের বুকের বাম পাশটায় হাত রাখল। 

হৃদি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল, বলল, ‘কী সব ফালতু কথা!’ 

ওই পাশ ফেরানো মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল সামি, কিছুক্ষণ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে জীবনে প্রথমবারের মত অনুভব করলো যে, এমন প্রবল ভাবে এর আগে কোনোদিন কোন মুখ তাকে টানেনি। অনেক অনেক সুন্দর মেয়ে দেখেছে সে। কিন্তু কারো সৌন্দর্যই তার বুকের ভেতরে এমন নিকষিত, বিশুদ্ধ ভালোলাগার জন্ম দিতে পারেনি কখনো। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল এই ভালোলাগাটাকে তার কাছে নতুন কিছু বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যে এই অনুভূতিটি যেন জন্ম জন্মান্তরের পুরোনো। আজকে শুধু নতুন করে আবিষ্কার করল যে, অনুভূতিটির উৎস কোথায়। সে মোহাবিষ্টের মতো হৃদির হাতদুটো তুলে নিল নিজের হাতের মুঠোয়। দুর্বল ভাবে বলল, ‘আজকে সারা দিনে একটাও ফোন দিস নাই কেন?’ 

—‘সময় পাইনাই। 

—‘তখন কানতেছিলি কেন?’ 

—‘কখন?’ 

—‘যখন আমাকে ভালোবাসার কথা বললি? হোটেলে, সবার সামনে?’ হৃদি কম্পিত বক্ষ নিয়ে কোনরকমে বলল, ‘আমি তো এমনিই কাঁদি আমার কান্নার কোনো কারণ লাগে না।’ 

ফ্লুরোসেন্ট আলো এসে পড়া হৃদির আবছা মুখটার দিকে বেহেড চোখে চেয়ে থেকে সামি বলল, ‘কেন যেন দুই তিনদিন ধরে খুব অশান্তি লাগতেছে, জানিস?’ 

—‘অশান্তি? কেন? কীসের অশান্তি তোর?’ 

সামি খুব সন্তর্পণে হৃদিকে নিজের বুকের অনেক কাছে টেনে নিয়ে আসল। তার গায়ে এখনো স্যুট আর টাই, হাতে তানিশার দেয়া আংটি। হৃদির মাথা ভর্তি নরম রেশমি চুলে সে আংটি ওয়ালা হাতটা রেখে গম্ভীর গলায় বলল, ‘অশান্তিটা ঠিক কী কারণে তা জানিনা। তবে আমার একটা রোগ হইছে!’ 

—‘রোগ?’ 

হৃদি কাঁপছিল ভেতরে ভেতরে। সামি কাছে আসতেই ভালো লাগার ভোমরাটা কোত্থেকে যেন উড়ে এসে টুপ বসে পড়েছে মনের দেয়ালে। এখন শরীর জুড়ে, মন জুড়ে ক্রমাগত বেজে চলেছে সুখের দামামা! 

—‘সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ওই মেয়েটাকে কিস করার পর থেকে, অন্য কোন মেয়েকে আমার সহ্য হয়না। কী আজব কাণ্ড!’ 

হৃদি চুপ করে থাকে। বুক দুলছে উত্তেজনায়, ভয়ে এবং সুতীব্র এক কষ্ট কষ্ট সুখে! 

সামি চাপা গলায় বলল, তোকে দেখতে হঠাৎ হঠাৎ সেই মেয়েটার মতো লাগে। এখনো লাগতেছে।’ 

এটুকু বলে সামি ওর মুখটা হৃদির মুখের খুব কাছে নামিয়ে আনে। তারপর অনেকটা ফিসফিস করে বলে, ‘মনে চাচ্ছে আবারো তোকে কিস করি, সেদিনের মতো!’ কথাটা বলেই সে চট করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল হৃদির ঠোঁটে। নিমেষে রক্তের কণায় কণায় ছড়িয়ে পড়ল স্পর্শসুখের উন্মত্ততা। একটা তালা ভাঙার ঝনঝন আওয়াজ শুনতে পেল সে। মনে হল যেন দীর্ঘ দিনের কোন অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ হল। নিশ্বাসে মিশে গেল তরতাজা বাতাস। হৃদির মনে হচ্ছিল এটা বাস্তব নয়, গভীর রাতের কোনো এক গভীর সুখস্বপ্ন। এখুনি বুঝি স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। সে চায় না এই স্বপ্ন ভাঙুক। সে চায় এই একটা স্বপ্ন দেখতে দেখতেই কেটে যাক তার একটা জীবন। 

কয়েক মুহূর্তের বিভ্রম খেলে গেল দুজনের মধ্যে। তারপর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সমস্তকে ভুলে গিয়ে ওরা পরস্পরের ঠোঁটে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল অবিরত। যেন চুমুক দিয়ে পান করে নিতে চাইছে সমস্ত হৃদয়! 

বেশ খানিকক্ষণ পরে সামি প্রমত্ত গলায় বলল, ‘আমারও একটা ইচ্ছা জীবন চাই হৃদি। ইচ্ছা হলেই তোকে চুমু খাওয়া যায়, এমন একটা জীবন!’ 

হৃদি এবার কেঁদে ফেলল। অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা কান্নাটা চোখের কার্ণিশে এসে বাধ ভাঙলো এবার। নিচে তখনো গানটা বেজে যাচ্ছিল, 

‘আজ ফাগুনী পূর্ণিমা রাইতে, চল পলায়ে যাই…’ 

সামির মস্তিষ্কের ভেতর কে যেন গানের কথাগুলো স্ট্যাপলারের পিনের মতো গেঁথে দিল। সে অস্ফুটে বলে উঠলো, ‘চল পালাই!’ 

তীব্র এক বিদ্যুৎ অভিঘাতে চমকে উঠল হৃদি, ‘কী বলতেছিস?’ 

সামি বুদ্ধিভ্রষ্টের হয়ে হৃদির হাত খামচে ধরলো, জোরালো গলায় বলল, ‘ঠিকই বলতেছি। চল ভাগি। এখুনি!’ 

—‘তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে সামি! কালকে তোর বিয়ে। আর আজকে তুই পালাবি?’ 

—‘বিয়ের আগের দিনই তো লোকে পালায়। জানিস না?’ সামি বলল অনেকটা নির্বিকার গলায়। 

—‘জীবনটা সিনেমা না।’ 

সামি ঘাসের ওপর অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে বলল, ‘পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। তানিশাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না।’ 

—‘এই কথাটা তোর আজকে মনে হইছে? বিয়ার আগের দিন?’ এবার হৃদির কণ্ঠস্বরে একটু কঠিন ভাব টের পাওয়া গেল। 

—‘হ্যাঁ আজকেই মনে হইল। আল্লাহর রহমত যে বিয়ার পরের দিন মনে হয়নায়। মনে হইছে বিয়ার আগের দিন। এইজন্যে শোকর আলহামদুলিল্লাহ!’ 

হৃদি এ কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। দুশ্চিন্তা, ভয় এবং আনন্দ এই সমস্ত অনুভূতিতে মিলেমিশে তার ভেতরটা কেমন অবশ হয়ে আছে এই মুহূর্তে। হাতে পায়ে একটা শিরশিরে ভাব টের পাচ্ছে সে। বুক ধড়ফড় করছে প্রবল ভাবে। ঘটে যাওয়া ঘটনাটা এখনো তার শত ভাগ বিশ্বাস হচ্ছে না। সে কম্পনরত কণ্ঠে বলল, ‘পালানো কোনো সমাধান না। তুই তোর বাবা মায়ের সাথে কথা বল। উনারা বুঝবেন।’ 

সামি আঁতকে উঠল, ‘মাথা খারাপ? কোন মুখে কথা বলব আমি ওদের সাথে? মরে গেলেও কিছু বলতে পারব না।’ 

—‘কিন্তু কিছু না বলে পালিয়ে গেলে তো উনারা আরো বেশি কষ্ট পাবেন!’ 

—‘শোন, আম্মাকে এখন বিয়ে ভাঙার কথা বললেই কী হবে জানিস? আম্মা সঙ্গে সঙ্গে কান্নাকাটি করা শুরু করে দেবে। তখন দেখা যাবে তার কান্না দেখে আমি আর কিছু বলতে পারতেছি না। হয়তো আব্বা আম্মার মুখের দিকে তাকায়ে বিয়েটা করে ফেলতে হবে শেষ পর্যন্ত। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে পালায় যাওয়া। পালায় গেছি এটা জানার পর নিশ্চয়ই তানিশা আর আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না তাইনা? আমারও আর মুখ ফুটে আব্বা আম্মারে কিছু বলা লাগবে না।’ 

হৃদিকে বড়ই বিভ্রান্ত দেখাল। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘বুঝতেছিনা কী করা উচিৎ। এদিকে আমার রাহাতের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গ্যাছে। আজকে তোর সাথে পালাইলে রাহাত কি আমাকে আর বিয়ে করতে চাইবে?’ 

এ কথা শুনে সামি বিস্ময়াপন্ন ভাবে তাকাল অন্ধকারে আবছা হয়ে থাকা হৃদির মুখখানার দিকে। হতভম্ব গলায় বলল, ‘মানে কী? রাহাতকে বিয়ে করার খুব শখ হইছে তর?’ 

হৃদি সামির প্রশ্ন শুনে এই ঘন ঘোর বিপদের মধ্যেও হেসে ফেলল, বলল, ‘তাহলে কাকে বিয়ে করব? কান কাটা সামিকে?’ 

সামি অপ্রতিভ হল। জীবনে এই প্রথমবারের মতো হৃদির সামনে দাঁড়িয়ে সে কিঞ্চিৎ স্নায়বিক চাপ অনুভব করল ভেতরে ভেতরে। একটু অপরাধীর গলায় বলল,’কেন,কান কাটা সামিকে বিয়ে করতে তোর আপত্তি আছে?’ 

হৃদি হাসে, তারিয়ে তারিয়ে বলে, ‘ভেবে দেখতে হবে। এখনই কিছু বলতে পারতেছি না।’ 

—‘এসব কথা পরে হবে। এখন প্ল্যানটা শোন। আমি হাঁটতে যাচ্ছি বলে বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছি। কোনো ব্যাগ ট্যাগ নিব না। জাস্ট ওয়ালেট, মোবাইল, ক্রেডিট কার্ড এগুলো সঙ্গে নিব। তুই বাড়ি ফেরার নাম করে বের হয়ে যাবি আমার সাথে।’ 

—‘তারপর? তারপর কী করব? কোথায় যাব?’ হৃদি প্রশ্ন করলো নিশ্বাস বন্ধ করে। 

সামি দু পা এগিয়ে আসল সামনে। হৃদির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে আস্তে করে বলল, ‘তারপর আর কী? প্রতিবার তো ফানিমুনে যাই। এবার যাবো হানিমুনে!’ 

হৃদি একটা মৃদু ঝটকায় সামির হাত সরিয়ে দেয়। ভর্ৎসনার সুরে বলে, ‘ইশ শখ কত! আগে যা, কান কাইটা আয়।’ 

৩৭

অমৃতা দাঁড়িয়ে আছে লাইব্রেরি ঘরের সামনে। লোকটা ফিরে এসে বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি আর। সোজা চলে এসেছে লাইব্রেরিতে। অমৃতা জানে এই মুহূর্তে তার এখানে আসা একেবারেই উচিৎ কাজ হয়নি। কিন্তু আজকে যে তার নিয়ম ভাঙার দিন! কিশোরী বয়সের সেই বিদ্রোহী, বিপ্লবী মনটা আজ অনেকদিন বাদে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আজকে সে যা মনে চায়, তাইই করবে। কেউ বাধা দিতে পারবে না! 

দরজায় করাঘাত করল সে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ভেতর থেকে খুলে গেল দরজাটা। তিনি দরজার ফাঁক দিয়ে তাকালেন অমৃতার দিকে। হতভম্ব ভাবে চেয়ে থেকে বললেন, ‘তুমি?’ 

অমৃতা পরিষ্কার গলায় বলল, ‘ভেতরে আসতে দেবেন না?’ 

দরজা খোলা রাখা অবস্থায় তিনি কিছুক্ষণ ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন অমৃতার দিকে। শ্রাবণ মাসের ভ্রুকুটিবক্র মেঘলা আকাশের মতো রাগে থমথম করছে তাঁর মুখ।

—‘কিছু বলবে?’ 

—‘এটার মানে কী? যা বলার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই বলতে হবে?’ একগুচ্ছ অপমান চলকে উঠল অমৃতার চোখে মুখে। 

তাঁর কপাল কুঞ্চিত হল। ঠোঁট টিপে গম্ভীর ভাবে তিনি কিছু একটা ভাবলেন। তারপর দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এসো!’ 

অমৃতা ঢুকল ভেতরে। ঢুকতেই নাকে এসে ধাক্কা খেল আগরবাতির ঘ্রাণ। দেখল তাকিয়ে, ঘরের কোণে নিঃশব্দে জ্বলছে আগরবাতি। 

দরজা আটকে দিলেন হক। কী মনে করে যেন জানালার পর্দাও টেনে দিলেন। হেঁটে গিয়ে বসলেন টেবিল সংলগ্ন রিভলভিং চেয়ারে 

অমৃতা কিছুক্ষণ বন্ধ দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। কী যেন ভাবল আপন মনে। মিনিট দুয়েক পর এগিয়ে এসে বসল টেবিলের উল্টো পাশের চেয়ারে। হকের মুখোমুখি। হক সাহেবের পরনে এখন কোট নেই, শুধু ফুল হাতা ফরমাল সাদা শার্ট আর টাই। ল্যাপটপ খোলা ছিল,সামনে। তিনি ডিম সাইজের ছোট একটা মাউজ হাতের আঙুল দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে অমৃতাকে আগাগোড়া দেখে নিলেন একবার। দেখলেন অমৃতার গায়ের শাড়ি, হাতে ধরা ভ্যানিটি ব্যাগ, বাঁকা ভ্রুযুগল, ঘন পালক ঘেরা চোখ, পাঁপড়ির মতো দুটি লাল ঠোঁট, শিউলি ফুলের শুভ্রতা ছোয়া স্নিগ্ধ গাল… মেয়েটাকে আজকে যেরকম সুন্দর লাগছে এই সৌন্দর্যকে বলে বিপজ্জনক সৌন্দর্য। ডেঞ্জারাস বিউটি। তিনি এই বিপজ্জনক সৌন্দর্যের আশেপাশে থাকতে চাইছিলেন না। কমিউনিটি সেন্টারে থাকা অবস্থা থেকেই এড়াতে চাইছিলেন মেয়েটিকে। কিন্তু শেষ অবধি তা আর হয়ে উঠল না। তিনি একটি অসন্তোষ জনক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা তাঁকে বড্ড জ্বালাচ্ছে! 

আচ্ছা, নিজ সন্তানের বয়সী কোন মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হওয়া কি খুব বাজে ধরণের অপরাধ? তাঁর ভেতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে কেন? কেন থেকে থেকে মনে হচ্ছে যে তিনি কোন গর্হিত কাজ করছেন? এই মেয়েটি কি কোন ভাবে তার প্রতি আসক্ত? কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? একজন যুবতী সুন্দরী মেয়ে কেন তার বয়সী একজন লোকের প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে? এতো ভীষণ অসম্ভব একটা ব্যাপার! তাঁর কি উচিৎ না মেয়েটিকে একটি রাম ধমক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়া? কিন্তু বিষয়টা হল যে, এই মেয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ তাঁর পুত্রের ব্যাপারে নানা ভাবে উপকার করে আসছে। এ কারণে তিনি মেয়েটির প্রতি কৃতজ্ঞ। তাই এ মুহূর্তে খারাপ ব্যবহার করতে তাঁর বিবেকে বাঁধছে। এমতাবস্থায় হাজার চাইলেও তিনি তার মনকে পুরোপুরি বিদ্রোহী করে তুলতে পারছেন না। 

অমৃতার বুকের ভেতরে এতক্ষণ ধরে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা পাগলাটে আগুনটা এখন নিভু নিভু। চোরা চোখে দেখছিল তাম্রবর্ণের গম্ভীর সুন্দর মুখের মানুষটাকে। ধীরেধীরে নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল সে। হাতে পায়ে কেমন যেন ঝিম ঝিম ভাব। কোন সেনসেশনই সঠিক ভাবে কাজ করছে না। শুধু বুঝতে পারছে যে লোকটার সামনে বসে থাকতে তার ভালো লাগছে। শরীর এবং হৃদয় জুড়ে ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে দ্রিমদ্রিম করে ভালোলাগার এক নিরবিচ্ছিন্ন বাজনা! 

সে হঠাৎ কেমন ঘোর লাগা গলায় বলল, ‘রাশেদ, আপনি জানেন? আপনার মতো সুপুরুষ আমি জীবনে আর একজনও দেখিনি!’ 

চমকে উঠলেন হক। প্রথম কয়েকটা সেকেন্ড পূর্নব্যাদিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু। কিছু বলতে পারলেন না। পরমুহূর্তেই এক ভীষণ করাল ক্রোধ ঝংকার দিয়ে উঠল তার সারা মুখে। প্রচন্ড এক হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কী বললে?’ 

অমৃতা এই আচমকা হুংকার শুনে থমকে গেল ক্ষনিকের জন্য। বুকটা একদম কেঁপে উঠল তার। ধমক দিয়ে তার সাথে কেউ কথা বলে না। মা বাবা শেষ বার কবে শাসনের গলায় কথা বলেছে তা মনেও পড়েনা। সে বুদ্ধিমতী এবং বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন মেয়ে। পড়ালেখায় মনোযোগী, আত্মবিশ্বাসী এবং স্বাধীনচেতা মেয়েটিকে নিয়ে বাবা মায়ের ভাবনার তেমন কোনো কারণই ছিল না কখনো। শাড়ি, গয়না কসমেটিকস কিনে অযথা বাবার টাকা খরচ করার বাতিক নেই তার। এতো বয়স পর্যন্তও তার জীবনে আসেনি কোন প্রেম। ছোট বোন দীপাকে নিয়ে বাবা মা সর্বক্ষণ একটা নিদারুণ দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকেন। দীপা সুন্দরী, তার ওপর স্বভাব চঞ্চল। বাইশ বছর বয়সেই তার প্রাক্তন প্রেমিকের সংখ্যা তিন। মা তাই সারাক্ষণ দীপাকে নিয়ে একটা অতিমাত্রার দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে থাকেন। অপরদিকে মেয়ে হয়েও পরিবারের ছেলে সন্তানের মতো সাহসী এবং স্বাধীন হিসেবেই বেড়ে উঠেছে অমৃতা। স্বাধীনতার কোন অপব্যবহার সে আজ পর্যন্ত করেনি। তাই বাবা মায়ের শাসন করার প্রয়োজন পড়েনি কখনও। তবে একরোখা এবং জেদি হিসেবে আত্মীয়স্বজনদের মাঝে অমৃতার বেশ দুর্নাম আছে। সবাই জানে, যদি কোন জিদ চেপে বসে এই মেয়ের মাথায়, তবে সে হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে। যা করবে বলে একবার মনস্থির করে, তা করেই ছাড়ে। লোকে বলে, এই একরোখা ভাবটাই এমন অসাধারণ বুদ্ধিমতি মেয়েটির সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে একদিন। 

আজ অনেক দিন বাদে এমন বিকট গর্জনের তোপের মুখে পড়ে অমৃতা একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। কেঁপে উঠল তার লাল টুকটুকে পাতলা ঠোঁট জোড়া। ঘন পালক ঘেরা কাজল দুটি চোখ মেলে ধরে সে থমকানো গলায় বলল, ‘বকা দিচ্ছেন কেন?’ 

হক বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখের তারায় দপদপ করে জ্বলছে তেজ। অমৃতা এই মানুষটার রাগের কথা অনেক শুনেছে এতকাল। আজকে দেখল নিজের চোখে! হেঁটে এসে হ্যাঁচকা টানে ঘরের দরজাটা খুললেন তিনি। বরফ শীতল গলায় বললেন, ‘বাড়ি যাও।’ 

তীক্ষ্ণ এক বর্শার ফলা এসে বিঁধল অমৃতার হৃৎপিণ্ডে। চিলিক দিয়ে উঠল ব্যথা। হঠাৎ ঝাপসা হয়ে উঠল দৃষ্টি। কাচের টুকরোর মতো খান খান হয়ে ভেঙে যেতে লাগল চোখের সামনের দৃশ্যটা। বসা থেকে খুব ধীরেধীরে উঠে দাঁড়াল সে। হতভম্ব গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন?’ 

তিনি চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নিলেন, – ‘হ্যাঁ দিচ্ছি। তাড়িয়েই দিচ্ছি।’

—‘আমার দোষটা কী?’ 

—‘তুমি জানো না কাকে কী বলা যায়। ডিসেন্সি জিনিসটা তোমার মধ্যে নেই। নেই কোনো কমনসেন্স!’ 

অমৃতার দম আটকে আসছিল। হাতে পায়ে একটা কম্পন টের পাচ্ছে সে। শ্বাসনালীতে ঢুকে যাচ্ছে বাষ্প। ক্রমেই বেড়ে চলেছে বুকের ব্যথা। 

—‘অমৃতা, প্লিজ বেরিয়ে যাও। আর কোনো দিন এই ঘরে এসো না তুমি।’ অত্যন্ত কঠিন ভাবে কথা গুলো বললেন হক। 

—‘আর কোনো দিন আসব না?’ 

—‘না।’ 

অমৃতা অনেকক্ষণ নড়ল না। যেমন ছিল তেমন ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। থেকে থেকে ফুলে উঠছে তার নাকের পাটা। চোখ দুটি অপমানে আর অভিমানে টলটলে। কিছুক্ষণের মাঝেই তার চোখের ভেতরের চাপা কান্নাটা ক্রোধে রূপান্তরিত হল। সে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘এখন তো আপনার প্রয়োজন শেষ। আপনার ছেলে আপনাদের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করছে। এখন আর আমাকে লাগবে কেন আপনার? তাড়িয়ে তো দেবেনই!’ 

হক ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘ঠিক বলেছ।’ 

—‘ভীষণ স্বার্থপর আপনি।’ 

-‘ঠিক।’ একটা বড় নিশ্বাস চাপা দিয়ে বললেন হক। 

অমৃতার মুখটা এবার ঘেন্নায় কুঁকড়ে গেল, ‘আমি জানতাম আজকে এরকম কিছুই হবে। এজন্যেই আমি শাড়ি পরতে চাইনা। মেয়েদের পোশাক পরলেই আমার সাথে খারাপ কিছু হয়। সব এই শাড়ির দোষ!’ 

হক বিস্মিত চোখে তাকালেন মেয়েটির দিকে। মেয়েটা পাগলের মতো কী বলছে এসব? 

অমৃতার রক্তে রক্তে তখন আবারও ছড়িয়ে পড়েছে রাক্ষুসে রাগটা। শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে তীব্র এক জ্বালা। সে আর একটিও কথা না বলে হনহন করে বেরিয়ে আসল ঘর থেকে। হক দরজাটা আটকে দিলেন সন্তর্পণে। তাঁর মাথা টনটন করছে রাগে এবং উত্তেজনায়। এখন অবশ্য রাগের পাশাপাশি মেয়েটার জন্য কেমন যেন মায়াও হচ্ছে। আস্ত পাগল একটা। কী করবেন তিনি এই পাগলিটাকে নিয়ে? ধীরেধীরে হেঁটে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মনটা খুব খারাপ! 

গোল বারান্দায় কোন আলো নেই আজ। আকাশে মাঘ মাসের ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মসৃণ নীল জোছনা। সাদা রং কুয়াশায় চারপাশ আবছা। হাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। অমৃতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অস্থিরচিত্তে ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলল। একটা সিগারেট বের করে নিল। আগুন ধরালো লাইটার দিয়ে। অস্থির ভাবে টান দিল একটা। তার শরীর কাঁপছে থরথর করে। বীভৎস এক ক্রোধ তার সমস্ত চেতনা কেঁড়ে নিতে চাইছে। মস্তিষ্ক শূন্য। মনে হচ্ছে যেন রাগের চোটে নার্ভ গুলো সব ছিঁড়ে যাবে। 

হঠাৎ সে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সামনের উঠোনে। তারপর কাঁপতে কাঁপতে ব্যাগ থেকে লাইটার বের করে আগুন জ্বালালো। শাড়ির আঁচলের কোণা তুলে নিল এক হাতে। অপর হাতে ধরা লাইটারের জ্বলন্ত আগুনের লাল শিখাটা শাড়ির আঁচলের খুব কাছে নিয়ে আসল। দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। ছড়িয়ে পড়ল শাড়ির কাপড়ে। সেকেন্ডের মধ্যেই আগুনটা শাড়ির আঁচলের কোণ থেকে উঠে আসতে লাগল উপরের দিকে। অমৃতা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চেয়ে রইল জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে। আগুনের হলকা এসে লাগছে তার মুখে। কিন্তু সে নির্বিকার। সে যেন কিছুই দেখছেনা, বুঝতে পারছেনা। 

হক সাহেব জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তাঁর হৃৎপিণ্ড চলে আসল গলার কাছে। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ছুটে বেরিয়ে আসলেন তিনি ঘর থেকে। আগুনের শিখা আরেকটু হলেই ছুঁয়ে ফেলবে অমৃতার কাঁধ। হক নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলেন। ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে এক টানে অমৃতার কোমরে গোঁজা শাড়িটা খুলে ফেললেন। পুরো শাড়িটা খুলে আসতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। তৎক্ষণাৎ আগুন সমেত শাড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি গোল বারান্দার মেঝেতে। অমৃতা তখনো পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চক্ষু দুটি বিস্ফোরিত। মুখ রক্তশূন্য। হক বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে দেখলেন দূর থেকে কেয়ারটেকার সুলেমান ছুটে আসছে হন্তদন্ত হয়ে। তিনি চকিতে তাকালেন অমৃতার দিকে। তার পরনে শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট। আগুনের কমলা রঙের হলকায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার ফর্সা পেট আর বুকের অনেকখানি। তিনি প্রস্তরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অমৃতার হাত টেনে ধরে ধমক দিয়ে উঠে বললেন,’ভেতরে যাও!’ 

অমৃতা নড়তে পারলোনা। বরং তার হাত পা কেমন ভর শূন্য হয়ে গেল। মনে হল যেন এখুনি কাটা গাছের মতো লুটিয়ে পড়বে সে। সুলেমান দৌড়োতে দৌড়োতে গোল বারান্দার অনেক কাছে চলে এসেছে তখন। তার পরনে গেঞ্জি, প্যান্ট আর জুতো। মাফলারে গলা, মাথা ঢাকা। অমৃতা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নাড়ানো যাচ্ছেনা। উপায় না দেখে হক চট করে অমৃতাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলেন। ভেতরে যাবার আগে সুলেমানের উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে বললেন, ‘সুলেমান! এই ঘটনা যেন কারো কানে না যায়!’ 

সুলেমান শাড়িতে জ্বলতে থাকা আগুন পা দিয়ে দাপাদাপি করে নেভাতে নেভাতে বলল, ‘কারো কানে যাবেনা হুজুর!’ 

.

রুদ্র আর আকাশ ড্রইংরুমেই বসে ছিল। সামির চাচাতো, মামাতো ভাই বোনেরা অনেকক্ষণ যাবৎ একটি গানের সাথে নাচ তোলার চেষ্টা করছে। দুইজন ছেলে এবং দুই জন মেয়ে মিলে নাচার চেষ্টা করছে ‘ফাগুনি পূর্ণিমা গানটায়। রুদ্র তাদেরকে একটি বিশেষ স্টেপ দেখিয়ে দিচ্ছে। সে শেখাচ্ছে, ‘চল পলায়ে যাই’ লাইনটা যখন গানে আসবে তখন ঠিক কেমন মুদ্ৰায় মেয়েটির হাত ধরে টান দিতে হবে এবং মুখে কী রকম ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে হবে। সামির কাজিনরা রুদ্রর নৃত্য প্রতিভায় মুগ্ধ। তারা গভীর মনোযোগের সাথে রুদ্রর নাচের মুদ্রা এবং মুখের ভঙ্গিমা অনুকরণ করার চেষ্টা করছে। আকাশ গালে হাত দিয়ে বসে দেখছে রুদ্রর কাণ্ড। আপাতত তার আর কোনো কাজ নেই। 

সেই সময় হঠাৎ সামি আর হৃদির আবির্ভাব ঘটলো ঘরটায়। সামি এসেই বন্ধু দুজনকে বলল, ‘অমৃতা কোথায়?’ 

আকাশ বলল, ‘জানিনা, বলল চেম্বার থেকে ফোন আসছে। উপরে মনে হয়।’ 

সামি পকেট থেকে ফোনটা বের করে অমৃতার নম্বরে ডায়াল করল, বলল, ‘কই ফোন তো বিজি না। গেছে কই?’ 

—‘আল্লাহ জানে কোন চুলায় গেছে। আমি কী জানি?’ বিকারহীন গলায় বলল আকাশ। 

হৃদি একদম চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কেউ খেয়াল করলে দেখতে পেত তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। চোখের দৃষ্টি হয়ে আছে অস্থির। ভাগ্য ভালো যে কেউ তাকে লক্ষ্য করল না। সামি ফোনটা প্যান্টের পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘হুম, বাইরে চল, হাঁইটা আসি।’ 

নাচ প্রশিক্ষণে ব্যাঘাত ঘটায় রুদ্র বেশ বিরক্ত হল। কুঁকড়ে যাওয়া মুখ নিয়ে সামিকে বলল, ‘একটু দাঁড়া। বাচ্চা গুলা প্রায় শিখাই ফেলছে। আর একবার প্র্যাকটিস করলেই হবে। কালকে তোর আকদের অনুষ্ঠানের পর ওরা এই গানে নাচবে।’ 

সামি রুদ্রর শার্টের হাতা ধরার জন্য নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আরে নাচ পরে হবে। এখন হাঁটতে চল।’ 

রুদ্র সামির হাতের মুঠো থেকে নিজেকে বাঁচাতে কয়েক পা দূরে সরে গেল। মুখে বলল, ‘একটু ওয়েইট কর, নাচটা শ্যাষ হোক।’ 

রাগে গজগজ করতে করতে সামি এবার এক দৌড়ে এসে রুদ্রর খোলা চুলের মুঠিটা খামচে ধরল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘শালা, কথা কানে যায়না? কইতাছি হাঁটতে যামু! আসছে আমার ডিসকো ড্যান্সার!’ 

রুদ্র মুখ দিয়ে উঃ আঃ শব্দ করতে করতে অনেক কষ্টে সামির হাত থেকে নিজের চুল গুলোকে রক্ষা করল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মামা কী সমস্যা তোমার? হঠাৎ হাঁটাহাঁটির বাই উঠছে কেন?’ 

সামি আর কোনো কথা না বলে প্রস্থানোদ্যত হল। যেতে যেতে বলল, ‘আমি গেলাম, তোরা মনে চাইলে আয়।’ 

ওরা চারজন যখন বাইরে এসে দাঁড়ালো ঘড়িতে তখন বাজে কাটায় কাটায় এগারোটা। এই গলিটা কানা। এটাই রাস্তার শেষ বাড়ি। তাই সন্ধ্যের পর এদিকটায় লোকজন খুব একটা আসা যাওয়া করেনা। আজকে রাস্তা পুরোই খালি। সামনেই পাচিলের ওপারে ফাঁকা স্কুলের মাঠ। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে অতর্কিতে দাঁড়িয়ে পড়ল সামি। আকাশ বলল, ‘দাঁড়ায় পড়লি ক্যান? তুই না হাঁটবি?’ 

সামি প্রশ্নটা শুনে অত্যন্ত বিচলিত ভাবে কাশল একবার। দেখে মনে হল কিছু একটা নিয়ে সে দ্বিধায় পড়ে গেছে। অনেক কষ্টে বলল, ‘ইশে… ‘। আড়চোখে দেখল হৃদিকে। হৃদির চিবুক তখন গলা ছুঁয়ে ফেলেছে। দৃষ্টি নিবদ্ধ মাটিতে। আকাশ ধমকে উঠল, ‘সমস্যা কী তোর? চুরি করছস নাকি কিছু? এরকম চুরের মত করতেছিস ক্যান?’ 

সামি আবার বলল, ‘ইশে…’ 

রুদ্র এবার আচমকা লাফিয়ে উঠে সামির শার্টের কলার চেপে ধরল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘শালা আরেকবার ইশে বললে তোরে এইখানেই মাইরা পুঁইতা ফালামু আজকে। আমার সাধের নাচের ক্লাস বানচাল করছস তুই ইশে ইশে করার জন্য? 

সামি রুদ্রর হাত থেকে নিজের শার্টের কলার উদ্ধার করতে করতে বিব্রত ভাবে বলল, ‘আরে বলতেছি তো ছাড় আগে।’ 

রুদ্র ছাড়লো ওকে। কয়েক সেকেন্ড গড়ালো অস্বস্তিতে। তারপর হঠাৎ সামি ঝড়ের বেগে দু পা এগিয়ে এসে রুদ্রকে জাপ্টে ধরলো। অসহায় গলায় বলল,’দোস্ত, আমরা পালাইতেছি। প্লিজ হেল্প কর!’ 

রুদ্র, সামির এই আকস্মিক আক্রমণে একদম বেকুব বনে গেল। আকাশ চোখ দুটি ছানাবড়া করে বলল, ‘পালাইতেছি মানে? হোয়াট দ্যা ফাক!’ 

সামি তখনো রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে আছে। রুদ্র সামির বুকের চাপে পিষ্ট হতে হতে বলল, ‘পালাবি তো পালা, আমার কী দোষ? আমারে ক্যান চাপতেছিস?’ 

সামি রুদ্রকে ছাড়ল। এক নিশ্বাসে বলল, ‘দোস্ত আমি আর হৃদি পালাচ্ছি। তানিশাকে আমি বিয়ে করতে পারব না। তোরা এদিকটা ম্যানেজ কর।’ 

এক প্রবল বিস্ময় রুদ্র আর আকাশের মুখের কথা কেঁড়ে নিল। অনেকক্ষণ যাবৎ তারা শুধু বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল সামি আর হৃদির দিকে। কিছু বলতে পারল না। মিনিট দুয়েক পরে আকাশের মুখ থেকে যে কথাটি সবার প্রথমে বেরিয়ে আসলো, তা হল, ‘তুই তানিশারে বিয়া না করলে পক্ষী দুইটার কী হবে? পক্ষীরাও তো আমাদেরকে বর্জন করবে! 

রুদ্র নিজের এলোমেলো চুল গুলো হাতড়াতে হাতড়াতে অতি গম্ভীর গলায় বলল, ‘হৃদি তুই যাওয়ার আগে আমার চুলগুলা আঁচড়ায় দিয়া যা দোস্ত। প্লিজ! সামির বাচ্চা আমার চুলের মুঠি ধইরা পুরা আওলায়ে দিছে।’ 

হৃদি আর সামি একে অপরের দিকে তাকাল। এই বান্দর গুলা এমন বিপদের সময়েও ঠাট্টা মশকরা করার ধান্ধায় আছে। সামি শীতল চোখে দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের মজা নেয়া শ্যাষ হইছে?’ 

রুদ্র হাত তুলে বলল, ‘আরেকটু বাকি আছে।’ 

এটুকু বলে সে আকাশের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘দোস্ত, কী কপাল নিয়া জন্মাইছিলাম ক দেখি? চল পলায়ে যাই গানে আমি নাচতেছি সেই তখন থেকে কিন্তু পলাইতেছে এই সামির বাচ্চা সামি! প্রথমে বিভা, তারপর হৃদি! আমাদের ভাগ্যে কিছুই নাই। এইটা খোদার কেমন বিচার?’ 

আকাশ রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেবার গলায় বলল, ‘কী আর করবি! পোড়া কপাল!’ 

রুদ্র বলল, ‘চল, আমরাও পলাই।’ 

—‘তুই পলাবি আমার সাথে?’ 

—‘হ, সামির বাচ্চা তোর সাথে আর অমৃতার সাথে কিসু করার আগে আমি চাই তোদের সাথে একটা সেট আপ দিতে। ও যেন এরপর আবার তোদের দিকে হাত না বাড়ায়। সেই ব্যবস্থা এখনই করতে হবে।’ 

সামি এবার বাধা দিয়ে বলল,’তোদের ঢং শ্যাষ হইছে?’ 

আকাশ বলল, ‘আরেকটু বাকি আছে। গাইজ, তোমরা কি কেউ ‘আমরা পালাইতেছি’ সিনেমাটা দেখছ?’ 

হৃদি এবার একটা বড়সড় খ্যাঁক দিয়ে উঠল, ‘ফাইজলামি করার আর জায়গা পাস না? আমরা কত বড় একটা বিপদের মধ্যে আছি বুঝতে পারতেছিস?’ 

রুদ্র বলল, ‘আমার মাথার চুল আঁচড়ায়ে দে। তাহলে ফাইজলামি করা বন্ধ করব।’ 

হৃদি এবার রাগে পাগল হয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ল রুদ্রর ওপর। ওর এলোমেলো চুলগুলো নখ দিয়ে খামচে ধরল। চুল টানতে টানতে বলল, ‘কুত্তার বাচ্চা! তোর চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলব আজকে।’ 

সামি হৃদিকে থামালো। জরুরি ভাবে বলল, ‘থাম তো। শোন তোরা, আমরা যাচ্ছি। অমৃতা আর বিভাকে বলিস। এদিকটাও ম্যানেজ করিস। আমরা আজকে রাতে কারো ফোন ধরব না। কালকে সন্ধ্যার পর ফিরে আসব বাসায় ইন শা আল্লাহ। তোরা যে করেই হোক বিয়েটা ভাঙবি। আম্মা আব্বাকে বলবি এই বিয়ে আমার পক্ষে করা সম্ভব না। 

আকাশ বলল,’দোস্ত যা করতেছিস ভাইবা চিনতা করতেছিস তো? মানে আমার মাথায় কিছু ঢুকতেছেনা! 

—‘অনেক ভাবছি। এখন আর ভাবার সময় নাই। তোরা শুধু দোয়া করিস।’ এই বলে সে হৃদির একটা হাত চেপে ধরল। তারপর হৃদির দিকে তাকিয়ে ধীরস্বরে বলল, ‘চল, আল্লাহ ভরসা। এখানে আমাদের বন্ধুরা আছে। চিন্তার কিছু নাই!’ 

.

২য় খণ্ডের সমাপ্তি 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *