৩০
দুপুর দেড়টায় অমৃতা এসে পৌঁছুল হকের অফিসে। তার কেমন যেন সংকোচ হচ্ছিল। অথচ সংকোচের তো কোন কারণ নেই। লোকটা নিজেই ডেকেছেন তাকে। এমন তো নয় সে যেচে পড়ে দেখা করতে এসেছে। এসেছে কাজে। অযথা গল্প করার জন্য তো আসেনি!
রিসিপশনে যে মেয়েটি বসে আছে তার সাজগোজের কমতি নেই। চেহারাখানাও ভালো। হঠাৎ দেখায় মনে হয় যেন বিজ্ঞাপনের মডেল। চুলে ব্লন্ড কালারের হাইলাইট করা। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। গা থেকে ভেসে আসছে কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ। একেবারে এলাহী কাণ্ড! সে অমৃতার কথা শুনে কঠিন মুখে বলল, ‘স্যার তো মিটিং এ। এখন তো দেখা করা সম্ভব না।’
—‘আমার উনার সাথে ঠিক এই সময় দেখা করার কথা ছিল। উনিই ডেকেছেন। আপনি কি একটু ফোন করে বলবেন?’
—‘দেখুন মিটিং এর মাঝখানে ফোন করার নিয়ম নেই। স্যার খুব রেগে যান কেউ এ সময় বিরক্ত করলে। আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।’
—‘মিটিং কখন শেষ হবে?’
—’তা বলা যাচ্ছেনা।’
কী আশ্চর্য! লোকটা তার সাথে দেখা করার বিষয়টা বেমালুম ভুলে গেল? মিটিংই যদি থেকে থাকে তাহলে অমৃতাকে আসতে বলা কেন? অমৃতা ওয়েটিং রুমের সোফায় গিয়ে বসল। হকের নাম্বারে ফোন করলো পর পর দুবার। ফোন ধরলেন না তিনি। একটা ডাইনি রাগ ক্রমশ তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছিল। আজকে তার এন জি ও’র অফিসে গিয়ে মামলার আপডেট দেয়ার কথা ছিল। এই লোকের সাথে দেখা করার জন্য অসুস্থতার বাহানা দিয়ে অফিস কামাই করল। সে তো নিজের জরুরি কাজ ফেলে রেখে চলে এসেছে লোকটার সাথে দেখা করতে। অথচ লোকটা… নাহ খুব রাগ হচ্ছে তার। অধৈর্য হয়ে রিসিপশনের মেয়েটিকে বলল, ‘আপনি আপনার স্যারকে একটাবার ফোন করুন। উনি বলেছেন উনার জরুরি দরকার আছে আমার সাথে। আমি যে এখানে এসেছি এই তথ্যটা উনার জানা প্রয়োজন।’
মেয়েটি তার গাঢ় লিপস্টিক দেয়া ঠোঁটে একটা খটখটে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘সরি ম্যাডাম, আমি এ মুহূর্তে কিছুতেই ফোন করতে পারবনা। স্যার প্রচন্ড রেগে যাবেন। চায়না থেকে বায়ার এসেছে। খুব ইম্পরট্যান্ট মিটিং। উনার যদি জরুরি দরকার থাকে তাহলে মিটিং শেষে উনি নিজেই আপনাকে ডেকে নেবেন। আর তাছাড়া খুব জরুরি কিছু হলে উনি আগেই আমাদেরকে বলে রাখতেন। যেহেতু বলেন নি, এর মানে…’
—‘এর মানে?’ অমৃতার গলা চড়ে গেল।
রিসিপশনিস্ট অমৃতার তেজি ভাবটা লক্ষ্য করছিল অনেকক্ষণ ধরে। পুরুষ মানুষের বেশভূষার এই ওভার স্মার্ট মেয়েটিকে প্রথম থেকেই তার খুব একটা পছন্দ হচ্ছেনা। একটা অহংকারী ভাব আছে মেয়েটার মধ্যে। সে অহংকারী মেয়েটিকে জব্দ করার সুযোগ হাতছাড়া করল না, কড়া ভাবে বলল, ‘বলতে চাইছি সেরকম জরুরি কোনো কাজ থাকলে স্যার নিজেই আপনাকে ডেকে নেবেন। মিটিং এর মাঝখানে উনাকে বিরক্ত করার কোনো নিয়ম নেই। আপনি অপেক্ষা করুন।
অমৃতা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আপনাকে বললাম তো একবার ফোন দিন আপনি।’
—‘সরি, আমি পারব না।’
অমৃতাও নাছোড়বান্দা,’কেন পারবেন না?’
—‘আশ্চর্য! আমি কি চাকরি খোয়াবো নাকি আপনার জন্য? বললাম তো অপেক্ষা করুন। হয়তো পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই মিটিং শেষ হয়ে যাবে। এতো অস্থির হচ্ছেন কেন?’
অমৃতা একটা বড় নিশ্বাস টেনে রাগ দমন করার চেষ্টা করল। এক প্রকট অপমান বোধ জোয়ারের মতো তেড়ে এসে ক্রমশ ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাকে। কারো হুকুম মেনে চলার অভ্যাস তার একেবারে নেই বললেই চলে। আর একটি মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে গটগট করে হেঁটে অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসল সে। এক ভয়ঙ্কর করাল রাগে চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছিল তার। নিজের প্রতি তীব্র ঘেন্নায় গা বিষিয়ে উঠছিল। কী দরকার ছিল কাজ কর্ম ফেলে রেখে লোকটার সাথে নাচতে নাচতে দেখা করতে আসার? ওই অহংকারী ডাঁটিয়াল লোকটা তো তার আসবার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে। কান্নাকাটির সাথে খুব একটা সখ্যতা নেই অমৃতার। শেষ বার কবে কেঁদেছিল মনে পড়েনা। আজ বহু দিন পর কান্নার মতো কী যেন একটা বিঁধছিল গলার কাছে। অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে শীতের পিঙ্গল ধুলোটে আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে সে কান্নাটাকে ঢোঁক গিলে ফেলার চেষ্টা করল। তার মনটা আজ ভয়ংকর খারাপ!
আচ্ছা, আজ কি একটু বৃষ্টি নামবে? হঠাৎ মনে হল এই মুহূর্তে বৃষ্টি নামলে বুঝি তার মন ভালো হয়ে যেত। কিন্তু আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। বৃষ্টি নামার লক্ষণ নেই কোনো। শুধুমাত্র বৃষ্টিমহল ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো স্থানেই ইচ্ছে মতো বৃষ্টি নামানো যায়না। বৃষ্টিমহলের বন্ধুরা চাইলেই বৃষ্টি নামাতে পারে। কিন্তু আজ বৃষ্টিমহলেও বৃষ্টি নামবে না। কারণ বৃষ্টিমহলে একা একা বৃষ্টি নামানো যায়না। আজ তার বড় বেশি একা একা লাগছে। সারাটা মন জুড়ে দাপাদাপি করছে এক ভয়ঙ্কর একা ভাব!
—‘এক্সকিউজমি ম্যাডাম!’
ডাকটা শুনে পেছন ফিরে তাকাল অমৃতা। খাঁকি পোশাক পরা মোটাসোটা এক সিকিউরিটি গার্ড অফিস বিল্ডিং এর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অমৃতা তাকাতেই সে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনাকে স্যার ডাকছেন।’
মন খারাপের অতল গভীর কূপ থেকে দুটা শব্দ প্রতিধ্বনির মতো বেরিয়ে আসল অমৃতার স্বরনালি দিয়ে,’কে ডাকছেন?’
সিকিউরিটি গার্ড বিনয়ের সাথে বলল, ‘আমাদের স্যার ডাকছেন আপনাকে। উনার মিটিং শেষ হয়েছে। রিসিপশনিস্ট আপা বললেন আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে ভেতরে।
ব্যাপারখানা বুঝে উঠতে অমৃতার কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল। যখন বুঝল তখন টের পেল যে এই ডাকটা আজকে এই মুহূর্তে না আসলে ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারত তার জীবনে। এমন বাধঁছেড়া একাকীত্ব এবং অপমান বোধ একই সাথে এর আগে কখনো তাকে ঘায়েল করেনি। মন খারাপ হলেই খুব দৌড়োতে ইচ্ছে করে। সমস্ত কিছুকে পেছনে ফেলে তীরের বেগে সাঁই সাঁই করে ছুটতে ইচ্ছে করে ওর। গতির মধ্যে এক প্ৰবল মুক্তির স্বাদ খুঁজে পায় সে। কিন্তু এ মুহূর্তে হাতে জরুরি কাগজ পত্রের ব্যাগ, ল্যাপটপ, ওকালতির পোশাক এই সমস্ত কিছু সঙ্গে নিয়ে কোনো ভাবেই তার পক্ষে দৌড়নো সম্ভব হচ্ছিল না। অথচ মনে হচ্ছিল যেন দৌড়োতে না পারলে সে মরে যাবে। তাই এই ডাকটা সেই এক টুকরো সুনিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আপাতত বাঁচিয়ে দিল তাকে।
একটা ঘোর কাজ করছিল ভেতরে। সিকিউরিটি গার্ডের পেছন পেছন নিঃশব্দে হেঁটে ফিরে আসল বিল্ডিং এর ভেতর। রিসিপশনিস্ট তাকে দেখতে পেয়ে একটু ধারালো ভাবে বলল, ‘মিটিং মাত্র শেষ হয়েছে। আপনি তো অপেক্ষা না করেই চলে গেলেন ম্যাডাম! এতো অধৈর্য হলে কি হয়?’
অমৃতা খোঁচাটা এড়িয়ে গেল। লিফটে ঢুকে ছয় নম্বর বোতাম চাপল। তিনি বসেন সাত তলায়। এর আগেও একদিন এসেছিল অমৃতা তাঁর ঘরে। ওঁর চামচারা জোর করে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছিল তাকে। সেদিন বুকের ভেতর ছিল ক্রোধের আগুন আর তীব্র ঘেন্না। অথচ আজ আশ্চর্য এক ফিনফিনে তরল অনুভূতিতে ডুবে আছে মন। লিফ্টের বন্দি বাক্সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অমৃতা ভাবছিল যে, সত্যিই মানুষ বেঁচে থাকলে বদলায়, আর মরে গেলে পঁচে যায়। প্রকৃতির সাথে মানুষের একটি বিশেষ মিল হল, প্রকৃতির মতই মানুষও ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টায়। শুধু তফাৎ এ জায়গায় যে প্রকৃতির ঝরে যাওয়া রূপ বারে বারে ফেরত আসে। কিন্তু মানুষ হাজার চাইলেও, একবার যা হারায়, তা আর ফিরে পায়না।
দরজায় করাঘাত করল অমৃতা। একবার, দুবার… তিনবারের সময় ভেতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসল।
—‘কাম ইন!’
অমৃতা দরজার নব ঘুরিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। হক সাহেব বসে আছেন টেবিল সংলগ্ন রিভলভিং চেয়ারে। তিনি একা নন, তাঁর মুখোমুখি বসে আছেন আরো দুজন ভদ্রলোক। হক কথা বলছিলেন লোক গুলোর সাথে। অমৃতাকে দেখতে পেয়ে তিনি কথা থামিয়ে বললেন, ‘এসো। ভেতরে এসো।’
অমৃতা ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটা আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিল। হক উপস্থিত ব্যক্তি দুজনের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন আবার। অমৃতা একটু অস্বস্তি নিয়ে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হেঁটে গিয়ে সোফার ওপর বসল। এই ঘরটা বেশ প্রশস্ত আর খোলামেলা। পশ্চিমের দেয়াল জুড়ে বিশাল বড় এক জানালা। সে জানালার থাই এলুমিনিয়াম কাচের গায়ে মাঘ মাসের মিঠা দুপুরটা আলতো ভাবে লেপটে আছে। জানালার ওপারে পিঙ্গল আকাশ। তার ঠিক নিচেই দেখা যাচ্ছে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা। রাস্তায় চলেছে সারি সারি গাড়ি, সি এন জি, রিকশা। ফুটপাতের ওপর হাঁটছে অগণিত মানুষ। ওই যান্ত্রিক কোলাহলের ছিটেফোঁটাও এই চকচকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস রুমে এসে পৌঁছচ্ছে না। এ ঘরে আসবাব বলতে আছে বড় একখান কাঠের টেবিল, সোফা সেট আর কাচের সেন্টার টেবিল। এক কোণায় একটি ছোট টেবিলের ওপর প্রিন্টার আর কম্পিউটার রাখা। দেয়াল জুড়ে টাঙানো বেশ কিছু দামি পেইন্টিং। সিলিং এ চমৎকার একটি ঝাড়বাতি ঝুলে আছে। ঝাড়বাতির হলদে আলোয় ঝকঝক করছে চারপাশ। অবশ্য ঘরটায় সূর্যের আলোর উপস্থিতি এতো প্রকট যে ঝাড়বাতি জ্বালানোর কোন প্রয়োজনই পড়েনা।
অমৃতা হাতে ধরা গাউনটা সোফার ওপর রাখল। তাকাল সম্মুখে বসা আলোচনারত মানুষগুলোর দিকে। লোকটার পরনে একটি অফ হোয়াইট ফুল হাতা শার্ট। গলায় কালো টাই। গালভর্তি বরাবরের মতোই ছিটে ছিটে দাড়ি। ছোট করে ছাটা চুল। চোখ দুটো…’ বলতে কী, অমৃতার সবচাইতে ভালো লাগে ওই গভীর, বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। ভালো লাগে কথা বলার ভঙ্গিটা। নাকি সবচেয়ে ভালো লাগে ওঁর গলার স্বর?…’ কিংবা কথার ফাঁকে হঠাৎ চিন্তিত ভাবে ঠোঁট টিপে ফেলা?
লোকটা হাত নেড়ে নেড়ে কোন জরুরি কথা বলছেন সামনে বসা মানুষদুটোর সাথে। ফাইল ঘাঁটছেন,ল্যাপটপ ঘাঁটছেন, কী সব লিখছেনও আবার কাগজে খসখস শব্দ তুলে। হঠাৎ কী কারণে যেন একটু রেগে গেলেন। খিটখিটে গলায় ধমক দিয়ে বসলেন মানুষ দুজনকে। আশ্চর্য জনক ভাবে এই ধমকটাও অমৃতার ভালো লেগে গেল। সোফার পিঠে হেলান দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে, পা নাচাতে নাচাতে সে বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল লোকটার দিকে। হঠাৎ গভীর চোখ দুটি অমৃতার চোখের ওপর পড়ে গেল। থমকে গেল অমৃতা। পা নাচানো বন্ধ করে নড়ে চড়ে উঠে ভদ্রভাবে বসার চেষ্টা করল।
ভদ্রলোক দুজন মিনিট পাঁচেক পর উঠে চলে গেল। এরপর প্রশস্ত খোলা মেলা ঘরটায় শুধু অমৃতা, আর ওই মানুষটা। অমৃতা তখনো সোফাতেই বসে ছিল। তিনি টেবিলের ওপর রাখা ফাইল পত্র গুছিয়ে রাখলেন। ল্যাপটপ সুইচড অফ করলেন। তারপর অমৃতার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘কী খবর?’
.
—‘এইতো।’ অমৃতা বলল মৃদু স্বরে।
হক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হেঁটে অমৃতার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, ‘লাঞ্চ করেছ?’
—‘না।’
—‘আমিও করিনি। কী খাবে?’
অমৃতা সংকোচের গলায় বলল, ‘একটা কিছু হলেই হয়।’
অমৃতার সংকোচ হচ্ছে এটা একটা বিরল ব্যাপার। হক সেই বিরল ব্যাপারটা আড়চোখে দেখলেন একবার। মেয়েটাকে এমন নরম সরম এর আগে কখনো লাগেনি। আজকে একে একটু কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে। সেই অন্যরকম ব্যাপারটা আদতে কী তা তিনি ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারলেন না। গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘চল!’
—‘যাবো?’
—‘হ্যাঁ!’
—‘কোথায়?’
—‘লাঞ্চ করতে!’
—‘ও আচ্ছা!’
অমৃতা বসা থেকে উঠল। দ্রিমদ্রিম শব্দে ক্রমাগত একটা বাজনা বেজে যাচ্ছিল বুকের ভেতর। কোন কথা না বলে হাতে গাউন আর ব্যাগ নিয়ে লোকটার পেছন পেছন বেরিয়ে আসল সে। লিফ্টের সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল ওরা। মুখের ওপর বন্ধ হল দরজা। তারপর ছোট্ট চারকোণা যান্ত্রিক বাক্সটার ভেতর শুধু ওরা দুজন। অমৃতা অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে রইল। লিফট নামতে থাকল নিচে। হক সাহেবের ফোন বেজে উঠল এর মাঝেই। তিনি ফোনে কথা বলা শুরু করলেন। লিফ্ট গন্তব্যে এসে পৌঁছুল। হককে দেখে রিসিপশনের মেয়েটি সহ ফ্রন্ট ডেস্কে বসে থাকা আরো তিনজন কর্মচারী উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। রিসিপশনের মেয়েটির তীক্ষ্ণ নজর টের পাচ্ছিল অমৃতা। এই নজরের প্রকৃত অর্থ কী তা সে জানেনা, তবে বুঝতে পারছিল কোম্পানির কর্ণধারের সাথে তার এই একত্রে বেরিয়ে আসাটা মেয়েটি ঠিক সাদামাটা ভাবে দেখছেনা। তার চোখে খেলা করছে সীমাহীন কৌতূহল।
বিল্ডিং এর সামনে একটি মিতশুবিশি পাজেরো রাখা ছিল। ওরা নিচে নামতেই ড্রাইভার সসম্মানে পেছনের সিটের দরজা খুলে দিল। হক ফোনে কথা বলতে বলতেই গাড়ির পেছনের গদিতে উঠে বসলেন। অমৃতা বুঝতে পারছিলনা তার ঠিক কোথায় বসা উচিৎ? লোকটার পাশাপাশি বসতে তার কেমন কুণ্ঠা বোধ হচ্ছে। খুব বেশি কিছু চিন্তা না করে সে সামনের সিটে উঠে বসল, ড্রাইভারের পাশে। গাড়ির ব্যাক মিররে দেখল অমৃতা, লোকটা মনোযোগ দিয়ে ফোনেই কথা বলে যাচ্ছেন। অন্য কোনদিকে নজর নেই তাঁর। খানিক বাদে গুলশান দুইয়ের একটি ফাইভ স্টার হোটেলের গেটের ভেতর গাড়ি ঢুকল। ধনী লোকদের সাথে মেলামেশা করার এই এক যন্ত্রণা। বিলাসবহুল জায়গা ছাড়া এরা হ্যাংআউট করতে পারেনা। সত্যি বলতে জায়গাটা অমৃতার পছন্দ হল না। এতো বেশি আড়ম্বর পূর্ণ স্থান তার কখনওই পছন্দ না। কিন্তু কিছু বলার নেই। লোকটা যে এখানে প্রায়ই আসেন সেটা বোঝা গেল তখন, যখন তাঁকে দেখে হোটেলের রিসিপশনের লোকজন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসল। ক্ষমতাবান ব্যক্তির সামনে পড়লেই এদেশের সাধারণ মানুষের মুখে তেলতেলে হাসি ফুটে ওঠে। অযথা ব্যাক্কলের মতো হাসতে থাকে। এই হোটেলের লোকজনও তার ব্যতিক্রম নয়। সাদা শার্ট আর কালো টাই পরা এক কর্মচারী হাত কচলে অতিরিক্ত বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি এসেছেন খুবই ভালো লাগছে। আজ কি কোনো মিটিং হবে?’
হক কান থেকে ফোন সরালেন এতক্ষণে। বললেন, ‘না কোনো মিটিং নেই। লাঞ্চ করব। লাঞ্চের ব্যবস্থা করুন।’
কর্মচারী বিনয়ে কাদা কাদা হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই স্যার। আজকের সব স্পেশাল লাঞ্চ আইটেম পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি।’
হক একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘স্পেশাল কিছু পাঠাতে হবেনা। আমার জন্য শুধু সাদা ভাত আর সবজি। আর এই বাচ্চাটা কী খাবে তা ওর কাছে থেকে জেনে নিন।’
শব্দটা কানে লাগল অমৃতার, ‘বাচ্চাটা!’
হোটেলের এই কর্মচারী হকের সাথে অল্পবয়সী মেয়েটিকে দেখে একটু সন্দিহান হয়ে উঠেছে। তার চোখে তখন অনুসন্ধানী দৃষ্টি। জানা মতে এম পি সাহেবের নিজের কোন মেয়ে নেই। আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে তিনি এই হোটেলে সচরাচর খেতে আসেন না। বেশির ভাগ ধনী ব্যক্তিদের অল্পবিস্তর মেয়েমানুষের দোষ থাকে। এই হোটেলে অনেকেই শহরের দামি দামি কলগার্লদের নিয়ে আসে। রাত কাটায়, ফূর্তি করে। কিন্তু এম পি সাহেবের সেরকম কোনো দোষ নেই। এতো দিন অন্তত ছিল না। তাছাড়া এই মেয়েটিকে দেখতে আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোও না। এর পোশাক আশাক চলন বলন সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এতো কিছু মনে মনে ভেবে ফেললেও মুখে পূর্বের সেই বিনয়মাখা হাসিটি বজায় রেখেই সে অমৃতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের বুফে আছে। ম্যাডাম বুফে ট্রাই করে দেখতে পারেন।’
অমৃতা ছোট করে বলল, ‘না।’
মাঝারি সাইজের টেবিলে মুখোমুখি দুটি চেয়ারে বসলো ওরা। অমৃতা এই হোটেলের ভেতরে আগে কখনো আসেনি। বাইরে থেকে দেখেছে শুধু। সাজসজ্জা অত্যন্ত আধুনিক এবং ঝাঁ চকচকে। পাঁচতারা হোটেল গুলো সাধারণত যেমন হয় আরকি। সুন্দর একটা মসৃণ হলুদ আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে। টেবিলের ওপর প্লেট, কাঁটাচামচ, ন্যাপকিন সাজানো। হালকা সুরে মিউজিক বাজছে। আশেপাশের সবগুলো টেবিল খালি। মিউজিকের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। ওয়েটার মেনু নিয়ে আসতেই অমৃতা চটপট অর্ডার দিয়ে দিল। সাদা ভাত, সবজি, ডাল আর মুরগির মাংস।
ওয়েটার চলে যাবার পর অমৃতা টের পেল লোকটা বুদ্ধিদীপ্ত চোখ মেলে তার দিকেই চেয়ে আছেন। গায়ের কোট আর গাউন সে গাড়িতে রেখে এসেছে। এখন তার পরনে সাদা ঢোলা শার্ট। এতই ঢোলা যে তাকালে বোঝা যায়না ওই পোশাকের আড়ালে একটি চমৎকার গড়নের নারী শরীর লুকিয়ে আছে। এমনকি এই পোশাকের কারণে একটু দূর থেকে দেখলে তাকে কোন অল্পবয়সী তরুণ বলে ভ্রম হয়। কিন্তু মুখখানা তার বড়ই মিষ্টি। ভ্রুপ্লাক সে কখনো করেনা কিন্তু জন্ম থেকেই তার ভ্রু দুটোর আকৃতি নির্ভুল এবং নিখুঁত। সূচাল সুন্দর দুটি ভ্রুর নিচে ছোট ছোট পুতুলের মতো দুটি চোখ। টিকলো নাক আর পাতলা দুটি ঠোঁট। সে লিপস্টিক দেয়না, বরং সিগারেট খায় রোজ, তবুও তার ঠোঁটজোড়া কালচে নয়, গোলাপি!
বুদ্ধির ঝিলিক দেয়া গভীর এবং অভিজ্ঞ চোখ দুটোর সামনে অস্বস্তি লাগছিল অমৃতার। সে নার্ভাস ভাবে এদিক সেদিক চাইতে লাগল। লোকটা কোন কথা বলছেনা কেন? তার নিজেরই কি কথা শুরু করা উচিৎ?
—‘আপনি কেন ডেকেছেন আমাকে?’ অনেক কষ্টে প্রশ্নটা করল অমৃতা। হক পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিলেন। কয়েক ঢোঁক পানি চুমুক দিয়ে খেয়ে গ্লাসটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘আমি খবর পেয়েছি বিভা বাংলাদেশে এসেছে।’
—‘হ্যাঁ এসেছে।’
—‘কেন?’
—‘আশ্চর্য! নিজের দেশে আসবেনা?
—‘কিন্তু এই মুহূর্তে কেন? সে কি জানে যে সামির এনগেজমেন্টের তারিখ পড়ে গেছে?’
—‘জানে। সামির এনগেজমেন্ট খেতেই এসেছে সে।’
হক এ কথা শুনে ভালোই অবাক হলেন। বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘বলছ কী?’
—‘হ্যাঁ ঠিকই বলছি।’
—‘আমার কেমন যেন একটা সন্দেহ হচ্ছে। মেয়েটার অন্য কোন মতলব নেইতো?’
—‘কী ধরণের মতলব? আপনার ছেলেকে কিডন্যাপ করবে নাকি?’
হক খুব চিন্তিত ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা তা না। মেয়েটাকে দেখে সামি যদি তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে? এই বয়সে কখন মাথায় কী ভূত চাপে তার কোন ঠিক আছে নাকি? আর আমার ছেলেটার মাথার তার এমনিতেই ছেঁড়া।’
—‘সামি সিদ্ধান্ত বদলাবে কি বদলাবে না তা আমি জানিনা। তবে এটুকু জানি যে সামি আর বিভার মধ্যে এখন বন্ধুত্বের বাইরে অন্য কোন সম্পর্ক নেই
—‘তুমি শিওর?
অমৃতা দৃঢ় গলায় বলল, ‘হ্যাঁ শিওর।’
—‘সামি আবার হুট করে বিয়েটা নাকচ করে দেবেনা তো?’
—‘আপাতত এরকম কোন সম্ভাবনা নেই। তবে সুনিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাচ্ছেনা। সামির কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
—‘খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। এই ছেলে শেষ মেষ আমার মান সম্মান ডোবায় কিনা আল্লাহ মালুম।’
—‘মান সম্মান ডুবানোর কথা কেন আসছে?’
—‘একটা পরিবারের সাথে কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে। এখন যদি সে হুট্ করে বেঁকে বসে তাহলে সামাজিক ভাবে আমাদের অপদস্থ হতে হবে।’
অমৃতা গোমড়া মুখে বলল, ‘আপনার সমাজকে অনেক ভয়, তাইনা?’ হক প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে গেলেন। এটা কোনো সাধারণ প্রশ্ন নয়। কোনো সাধারণ মানুষ এমন প্রশ্ন করতেও পারেনা। মেয়েটি সাধারণ নয় বলেই এর কথাবার্তার ধরণ অন্যরকম। বয়সের এতো তফাৎ থাকা সত্ত্বেও এর সাথে অনায়াসে মন খুলে কথা বলা যায়। যা কিনা কোন সমবয়সী পরিণত বয়স্ক লোকের সাথেও সব সময় বলা যায়না।
—‘সমাজ নিয়েই তো আমাদের চলতে হয়।’
—‘সামি বিয়েটা নাকচ করে দিলে কি আপনি এবং আপনার স্ত্রী খুব কষ্ট পাবেন?’
হক দিশাহারা হয়ে বললেন, ‘বলছ কী? নাকচ করার চান্স আছে নাকি? সামি কি এরকম কিছু বলেছে তোমাকে?’
অমৃতা একটা হতাশ নিশ্বাস ছাড়ল, ‘কিছুই বলেনি আমাকে। আমি প্রবাবিলিটির কথা বলছি। সমাজ নিয়ে অত ভাববেন না। সমাজের চাইতে মানুষের অনুভূতির দাম অনেক বেশি।’
চিন্তার রেখাটা হকের চোখ মুখ থেকে সরলনা। জানালা ভেদ করে দূরে দৃষ্টি রেখে তিনি অতি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ছেলেটাকে আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনা।’
—‘আমার মনে হয় আপনার উচিৎ ছেলের ওপর একটু বিশ্বাস রাখা।’
—‘করতে তো চাই। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছিনা কেন যেন। আমার ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল মনে হয় ওকে। কখন কী করে বসে ঠিক নেই।’
খাবার চলে এসেছে ততক্ষণে। ওয়েটার ওদের প্লেটে খাবার সার্ভ করে দিল। ওই সময়টা কেউ কোনো কথা বলল না। ওয়েটার চলে যাবার পর অমৃতা বলল, ‘আপনার কি মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে?’
—‘সামির মায়ের তো খুব পছন্দ হয়েছে।’ ভাত আর সবজি চিবোতে চিবোতে বললেন তিনি।
—‘আমি আপনার কথা জানতে চাইছি।’
হক অমৃতার চোখে চেয়ে স্মার্ট গলায় বললেন,’মেয়েটি শিক্ষিত। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভাল। অপছন্দ করার তো কোনো কারণ নেই।’
—‘মেয়েটির বাবার নিশ্চয়ই অনেক টাকা?’
—‘এটা কেন জানতে চাইছ?’ হক সাহেবের চোখের দৃষ্টি সরু হয়ে আসল।
—‘না মানে, আপনি নিশ্চয়ই সম্পদশালী হওয়াটাকে একটা যোগ্যতা বলে মনে করেন?
হক খাওয়া থামিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটির দিকে খানিক ক্ষণ। তারপর একটু কেটে কেটে বললেন,
—‘ধনবান হওয়াটা কোনো যোগ্যতা কিনা জানিনা তবে আমি নিশ্চয়ই চাইব এমন একটি পরিবারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে যারা কিনা আমার সোসাইটিতে বিলং করে। সামাজিক মর্যাদা বলে তো একটা কথা আছে।’
অমৃতা খেতে খেতে চোখা ভাবে বলল, ‘এইসব সমাজ টমাজ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না আপনি তাইনা? সামি যদি কোন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে পছন্দ করত, তাহলে কী করতেন? মেনে নিতেন?’
হকের কাছে প্রসঙ্গটা ভাল লাগছিলনা। এই মেয়েটি নিতান্তই বাচ্চা। সে এখনো বুঝে ওঠেনি যে আবেগ দিয়ে জীবন চলেনা। আজকের পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে আবেগ টাবেগ সব বিসর্জন দিয়ে তারপরেই যুদ্ধে নামতে হয়। তিনি অনেক অল্প বয়স থেকে টাকার পেছনে ছুটছেন, সাফল্যের পেছনে ছুটছেন। আজকে যা কিছু তিনি অর্জন করেছেন তা রক্ত জল করা পরিশ্রমের বিনিময়ে এসেছে, এমনি এমনি আসেনি। তাই এতো কষ্টের বিনময়ে অর্জিত অর্থবিত্ত আর খ্যাতির কী মূল্য বা ওজন তা এই অল্পবয়সী মেয়েটি কিছুতেই বুঝবেনা। তিনি প্রসঙ্গ পাল্টাবার নিমিত্তে একটু লঘু গলায় বললেন, ‘তোমার কি কোন কারণে মন খারাপ? একটু আপসেট দেখাচ্ছে তোমাকে।’
অমৃতা ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল। কী আশ্চর্য! এই একটা মাত্ৰ প্ৰশ্ন শোনার জন্য তার মনটা অনেক অনেক ক্ষণ ধরে তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল। মন খারাপের সময় গুলোতে কেবলই মনে হয় পাশে বসে থাকা আপন মানুষটি একবার অন্তত প্রশ্ন করুক, তোমার কি মন খারাপ? প্রশ্নটা ওষুধের মতো কাজ করে। শোনা মাত্র অনেকখানি কষ্ট লাঘব হয়ে যায়।
অমৃতার আজ সকাল থেকেই মন খারাপ। কিন্তু চোখ মুখ দেখে সেই মন খারাপ আঁচ করে ফেলার মত কোন আপন মানুষ তার পাশে ছিল না সারাদিন। সামনে বসা মানুষটা তার কাছের কেউ নয়। কিন্তু অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ। তাই এই প্রিয় মানুষটার মুখ থেকে যখন বিশেষ ঔষধি প্রশ্নটা শুনতে পেল, তখন তার মনের জানলা দরজা গুলি আপনা আপনি খুলে গেল। এক ঝাপটা হিমেল বাতাস মুহূর্তের মাঝে ছুটে এসে ছুঁয়ে গেল তার অন্তরের অন্তর্দেশ।
সে নরম চোখে তাকাল লোকটার দিকে, ‘সকাল থেকেই মন খারাপ।’
—‘কেন?’
অমৃতা কিছু বলল না। চেয়েই রইল।
—‘মন খারাপের কারণটা কি আমাকে বলা যাবে?’
—‘আচ্ছা, আপনার কি কখনো একা একা লাগে?’
হক বেশ একটু অবাক হলেন প্রশ্নটা শুনে। তার মনে পড়েনা এমন অর্থহীন প্রশ্ন শেষ বার তাঁকে কে কবে করেছে। তার এই সীমাহীন ব্যস্ত জীবনে একা একা লাগলেও সেই একাকীত্বকে খুব বেশিক্ষণ প্রশ্রয় দেবার সময় আছে নাকি? তিনি তো এখন পুরোপুরি মানুষ নন। মানুষ কম যন্ত্ৰ বেশি। যন্ত্রদের কি কখনো একা লাগে?
তিনি বললেন, ‘প্রতিটি মানুষই একা! তবে একা একা লাগার বয়সটা আমি অনেক আগে পার করে এসেছি।’
—‘ধুর, সব সময় ওরকম মুরুব্বিদের মতো কথা বলবেন না তো! একা লাগার আবার বয়স আছে নাকি?’
—‘আমি তো মুরুব্বিই।’
—‘মুরুব্বি না ছাই, আপনি আমার বন্ধু। ভুলে গেছেন?’
এই অসম্ভব অবাস্তব কথাটা শুনে হক না হেসে থাকতে পারলেন না।
—‘হাসছেন কেন?’
—‘বন্ধুর বাবার সাথে কখনো বন্ধুত্ব করা যায়?
—‘কেন যাবেনা? এইতো করে ফেললাম।’ অমৃতাও হাসছে এখন। তার মনের মেঘ কেটে গেছে।
—‘তুমি বেশ পাগল আছ।’
—‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলেনা। বলুন না, আপনার কি কখনো একা লাগে?’
—‘চান্স কোথায়? সারাদিন ব্যস্ত থাকি। একা লাগার অবকাশ নেই তো!’
—‘আপনার কখনো মন খারাপ হয়?’
—‘প্রায়ই হয়।’
—‘মন খারাপ হলে আপনি কী করেন?’
—‘খুব মজার একটা কাজ করি।’ মুচকি হাসি হেসে বললেন তিনি।
-‘কী কাজ?’
—‘মন খারাপ হলেই আমি খাঁচা বন্দি পাখি কিনে আনি। তারপর পাখি গুলোকে একে একে আকাশে উড়িয়ে দিই। বন্দি পাখিগুলি মুক্ত হয়ে আকাশে উড়ে যাবার সাথে সাথে আমার মনটাও ভালো যায়।’
—‘তাই?’ গালে হাত রেখে মুগ্ধ চোখে মানুষটার দিকে চেয়ে থাকে অমৃতা।
—‘হ্যাঁ তাই। তুমি ট্রাই করে দেখতে পারো। কথা দিচ্ছি, মন ভালো হয়ে যাবে। পাখির জায়গা হচ্ছে খোলা আকাশে। পাখি কেন খাঁচা বন্দি থাকবে? আমার সামর্থ্য থাকলে পৃথিবীর সব খাঁচা বন্দি পাখিকে মুক্তি দিয়ে দিতাম।’
—‘দারুণ তো ব্যাপারটা!’
—‘হুম। এর পেছনে অবশ্য একটা গল্প আছে। আমার চাচা একবার একদম বাচ্চা একটা পাখিকে ধরে নিয়ে আসলেন কোত্থেকে যেন। পাখিটা তখনো উড়তে শেখেনি। সেই উড়তে না পারা সদ্য জন্মানো পাখিটির জীবন শুরু হল খাঁচার মধ্যে। স্বাভাবিক ভাবেই উড়তে শিখলোনা পাখিটা। একে একে কেটে গেলো দশটি বছর। সেই খাঁচার ভিতরেই পাখিটি মৃত্যু বরণ করল। তুমি চিন্তা করতে পারো একটি পাখি তার সারা জীবনে একটাবারের জন্যেও আকাশে উড়তে পারল না! এই অপরাধ কি ক্ষমা করা যায়? সেই ঘটনাটা আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। এরপর থেকে আমি রাস্তা ঘাটে খাঁচা বন্দি পাখি দেখলেই কিনে ফেলি। তারপর উড়িয়ে দেই খোলা আকাশে। মনটা ভালো হয়ে যায়।’
—‘ওয়াও!’ এই একটা শব্দ পিছলে আসল অমৃতার মুখ দিয়ে, অনেকক্ষণ পর।
—‘তোমার মন খারাপ হলে তুমি কী কর?’
—‘দৌড়াই।’
—‘হ্যাঁ?’
—‘দৌড়াই, খুব দৌড়াই।’
—‘কোথায়?’
—‘রাস্তায়। লেকের ধারে।’
—‘এতে মন ভালো হয়ে যায়?’
—‘হ্যাঁ ভালো হয়ে যায়।’
—‘গুড।’
—‘আপনি ওয়ার্ক আউট করেন?’
—‘নাহ, সময় কোথায়?’
—‘করেন না? কিন্তু আপনি তো বেশ ফিট! কীভাবে সম্ভব?’
—‘নিয়ম মেনে চলি। হেলদি খাওয়া দাওয়া করি। হয়তো এ কারণেই।’ একটু থেমে হক জরুরি গলায় বললেন, ‘শোনো অমৃতা, সামিকে বল বাড়ি ফিরে আসতে। তোমার উপর এই দায়িত্বটা দিলাম। কেমন?’
—‘আমি বললে হবেনা। আপনি বলুন।’
—‘আমি বলেছি অলরেডি।’
—‘আবার বলুন। আমরাও বলব।’
—‘এই সপ্তাহের মধ্যেই ছেলেকে আমি বাড়িতে ফেরত পেতে চাই।’
—‘আমার কী করার আছে এখানে?’
—‘তুমি তোমার বন্ধুকে বোঝাও।’
.
আকাশ বাড়ি ফিরলো বিকেল চারটায়। ঘরে ঢোকার সাথে সাথে তারা বলল, ‘ভাইয়া আপনি কি খেয়ে এসেছেন?’
—‘না, খাইনি তো! কেন?’
তারা এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলল না। মুখটা একটু নিচু করে অন্যদিকে সরে গেলো। ডাইনিং রুমে ঝুমকি বসে ছিল। আকাশ লক্ষ্য করল অন্যান্য দিনের মতো আজকে টেবিলের ওপর খাবার বাড়া নেই। শুধু দুটা পাউরুটির টুকরো পড়ে আছে।
‘আপনারা খেয়েছেন?’ আকাশের প্রশ্ন ঝুমকির উদ্দেশ্যে।
ঝুমকি থমথমে মুখে বলল, ‘বাড়িতে তো কোন বাজার নেই, তোমার আব্বা বাজার করার নাম করে সকালে বের হল বাসা থেকে, এরপর তো হাওয়া। একটু আগে ফোন দিলাম, বলল বারে গিয়ে মদ গিলছে। বাজার টাজার করতে পারবেনা।’
দুটো মানুষ সকাল থেকে অভুক্ত অবস্থায় আছে এটা চিন্তা করে ভীষণ খারাপ লাগল আকাশের। তার উচিত ছিল খেয়াল করে গতকাল সন্ধ্যায় বাজারটা করে রাখা। পিতৃদেব আজকাল কোন দায়িত্বই ঠিকঠাক পালন করেন না। ওই লোকটা তার জীবনে থাকা আর না থাকা একই কথা। সংসারের বোঝাটা না চাইতেও তার ঘাড়ে চেপে গেছে। এখন এই বোঝা হাজার চাইলেও সে ঘাড় থেকে নামাতে পারবেনা অত সহজে। সেদিন রাতে ঝুমকি বাসা ছেড়ে চলে যেতে চাইছিল। আকাশ যেতে দেয়নি। একজন অসহায় মহিলাকে রাস্তায় নামিয়ে দিতে শেষ মেষ তার বিবেকে বেঁধেছে। ওই বিবেকের বশবর্তী হয়েই আকাশের আজ নিজের কান্ডজ্ঞানহীন, মাতাল, লম্পট বাবার বিবাহিত স্ত্রীর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিবেক টিবেক সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে খুব স্বার্থপর হতে মন চায় তার। সে ফ্যাকাশে মুখে বলল, ‘সরি আমার একদম মাথায় ছিল না বাজারের ব্যাপারটা। ভুলে গিয়েছিলাম।’
—‘আমাকে সরি বলার কিছু নেই, আমার না খেয়েও দিব্যি দিন কেটে যাবে। কিন্তু তুমি কী খাবে? সারাদিন পর এসেছ। তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে খুব?’
আকাশ একটুক্ষণ কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘না আমি ঠিক আছি। চলুন আমরা বাইরে কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি।’
ঝুমকি থমকালো। বলতে কী, তার পুরো জীবনে সে কোনো দিন বাড়ির বাইরে খেতে যায়নি। বিয়ে বাড়িতে খেয়েছে অসংখ্য বার কিন্তু রেস্তোরাঁয় গিয়ে টাকা খরচ করে খাওয়া হয়নি কখনো। তার যৌবন কেটেছে ভাইদের সংসারের ঘানি টানতে টানতে। ভাইদের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হলেও রেস্টুরেন্টে খেতে যাবার মতো শৌখিন মানসিকতা তাদের কখনও ছিল না। আজকাল ভাইয়ের বাচ্চা কাচ্চারা বায়না করলে তাদের মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়ানো হয় বলে শুনেছে সে। কিন্তু এর আগে তাদের পরিবারে এই চলটা কখনো ছিলনা। বিয়ের পর তার দিন কেটেছে স্বামীর লাথি ঝাঁটা খেয়ে। বাইরে গিয়ে খাবার খাওয়ার মত বিলাসবহুল ব্যাপার স্যাপার সে ভাবতেই পারেনা।
একটু অপ্রস্তত গলায় বলল, ‘তুমি যাও, গিয়ে খেয়ে এসো।’
—‘না, গেলে সবাই একসাথেই যাব। আসার সময় বাজার করে নিয়ে আসব। যা যা লাগবে আপনি নিজে দেখে কিনে নিলেন। আমার চেয়ে আপনিই ভালো বুঝবেন।’
ঝুমকিকে কেমন যেন বিব্রত দেখাতে লাগল। বাইরের দুনিয়াটার সাথে তার যোগাযোগ একেবারেই ক্ষীণ। গত সাত মাস ধরে সে এ বাড়ির বাইরে বেরোয়না। প্রয়োজনও পড়েনা। লেখা পড়া তার জানা নেই খুব একটা হাতে টাকা পয়সাও থাকেনা যে অযথা বাইরে গিয়ে টাকার শ্রাদ্ধ করবে। তাই অনেক অনেক দিন বাদে হঠাৎ বাইরে যাবার প্রস্তাবটা পেয়ে সে কেমন যেন বোকা বনে গেল।
আকাশ বলল, ‘তৈরি হয়ে নিন। এখুনি বেরোবো।’
ঝুমকি একটু ভয়ে ভয়ে তাকাল আকাশের দিকে। সেদিনের পর থেকে ছেলেটা আশ্চর্যজনক ভাবে তার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। যে ছেলে গত দশ বারো বছরে বোমা পড়লেও একটা কথা বলেনি তার সাথে, সেই ছেলে এখন কারণে অকারণে সেধে সেধে তার সাথে কথা বলছে।
আকাশ তাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘কী হল? বসে আছেন কেন?’
তারা রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নিয়ে বেরিয়ে আসছিল। আকাশ ওকে বলল, ‘তুমিও চল!’
—‘আজকে কি কোনও বিশেষ দিন?’
—‘না কোনো বিশেষ দিন নয়।’
—‘হঠাৎ ট্রিট দিচ্ছেন?’
—‘বাড়িতে খাবার নেই বলে।’
—‘আপনারা যান। আমার পড়তে হবে। এক্সাম আছে।’
—‘কী পরীক্ষা তোমার?’
—‘অনার্স ফাইনাল চলছে।’
—‘কাল পরীক্ষা আছে?’
—‘পরশু আছে।’
—‘তাহলে চল। পড়ার সময় আছে অনেক।
—‘না থাক’
—আরে মেয়ে! কথা শোনো না কেন? বড়দের কথা শুনতে হয়!’
সন্ধ্যের মুখে মুখে ওরা তিনজন বেরিয়ে পড়ল। ঝুমকির গায়ে সাদা রঙের এক বোরখা। সাদা রংটা অনেকটাই মলিন হয়ে গেছে। হলদে ছোপ ছোপ দাগ বেশ কয়েক জায়গায়। আকাশের মনে হল ঝুমকিকে এবার একটা নতুন বোরখা কিনে দেয়া দরকার। গত সাত আট বছর যাবত এই মহিলাকে সে একই বোরখা গায়ে দিয়ে আসতে দেখেছে। ওদিকে তারা একটা হালকা আকাশী রঙের জর্জেট সালওয়ার কামিজ পরেছিল। কিন্তু কামিজটা একেবারেই আধুনিক ডিজাইনের নয়। আকাশের বন্ধুরা কেউ এ ধরণের জামা পরেনা। তার মনে হল বিভা আর হৃদি তারার চাইতে আরও অনেক বেশি স্মার্ট, পরিপাটি এবং স্টাইলিশ। আর অমৃতার সাথে তো কারো তুলনাই হয়না। তারাকে সে এর আগে কখনো এমন নিবিড় ভাবে লক্ষ্য করেনি, যেভাবে আজ করল। মেয়েটা অতি মাত্রায় সাধারণ। হ্যাঁ, হৃদির চাইতেও সাধারণ। লম্বাটে রোগা চেহারা। বড় দুটি চোখ আর ঠোঁটের নিচে একটি গাঢ় কালো তিল। রোগা ভাবটা না থাকলে মেয়েটিকে আরো অনেক বেশি সুন্দর দেখাতো বলে মনে হল আকাশের।
দুইটা রিকশা ভাড়া করে ওরা চলে আসল স্টার হোটেলে। ঝুমকির ভালো লাগছিল। তার ভীষণ রকমের এই একঘেয়ে জীবনটাতে আজ একটু অন্য রকম কিছু ঘটল অন্তত। ভালো লাগছিল আকাশেরও। টানা পোড়েনের মধ্যবিত্ত জীবনে আসলে ভালো লাগানোর জন্য খুব বেশি টাকাপয়সার প্রয়োজন হয়না, প্রয়োজন শুধু একটু আন্তরিকতার। কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে খেতে তারার সাথে আড্ডাটাও খুব জমে গেল। আকাশ ওর বন্ধুদের গল্পই বেশি করছিল। তারা একসময় আকুল হয়ে বলে উঠল, ‘আকাশ ভাইয়া, আপনার বন্ধুদের খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কবে দেখা করাবেন?’
—‘হবে হবে, সামনেই সামির এনগেজমেন্ট। তোমাদেরকে ওর এনগেজমেন্টে নিয়ে যাব। তখন সবার সাথে দেখা হয়ে যাবে।’
বলে আকাশ হাসে। হাসে চোখ। সুন্দর দেখায়!
.
হক সাহেবকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে, মিতশুবিশি পাজেরো অমৃতাকে তার বাসায় ড্রপ করে দিল। চলে আসার সময় অমৃতা ড্রাইভারের সামনেই লাজ শরমের মাথা খেয়ে বলে ফেলল, ‘আবার কবে দেখা হচ্ছে?’
প্রশ্নটা শুনে অনেক বছরের পুরোনো ড্রাইভারের সামনে হক ব্ৰিত বোধ করলেন। খুব ছোট করে বললেন, ‘দেখি।’ এটুকু বলে তিনি আর দাঁড়ালেন না। ওই ড্যাম কেয়ার ভাবটা অমৃতার বিরক্ত লাগল। সারা দিনের ভালো লাগাটা যেন ওই ক্ষুদ্র এক টুকরো উদ্ধত আচরণেই অনেক খানি লাঘব হয়ে গেল। বাসায় ফেরার পর অনেকক্ষণ অবধি তার আর কোন কাজেই মন বসল না। সবকিছু কেমন বিষণ্ণ লাগছিল। এই বিষণ্নতার কোন কারণ নেই। আজ দুপুরেই লোকটার সাথে দেখা করে আসল। অথচ এই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মনে হচ্ছে যেন কত বছর দেখা হয়না!
বিকেল পাঁচটার দিকে ডোর বেল বেজে উঠল। দরজা খুলল অমৃতা সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে দুটি পাখির খাঁচা। প্রতি খাঁচায় এক জোড়া করে মুনিয়া পাখি। কিচির মিচির করছে পাখি গুলি অনবরত। গার্ড বলল, ‘আপা, একজন লোক এসে এই পাখি গুলা দিয়ে গেছে আপনার জন্য।’
অমৃতা আনন্দে আটখানা হয়ে পাখির খাঁচা দুটি তুলে নিল হাতে। দৌড়ে চলে গেল ছাদে। তারপর খাঁচা থেকে ছোট্ট সুন্দর, ছটফটে পাখি গুলোকে বের করে এনে, একে একে উড়িয়ে দিল আকাশে। ডানা ঝাপটে উড়ে গেল পাখি গুলি, মিশে গেল শেষ বিকেলের আগুন রঙের আকাশে। অমৃতার মনে হল এতো সুন্দর দৃশ্য কোনদিন বুঝি দেখেনি সে! ভালো লাগতে লাগলো। ভীষণ ভালো!
৩১
সামির জন্য আজ একটি বিশেষ দিন। বিশেষ হবার কারণ দুটি। প্রথম কারণ হল আজ তানিশার সাথে বন্ধুদের দেখা হবে। দ্বিতীয় কারণটি হল আজ রাতে সে দীর্ঘদিন পর বাড়িমুখো হবে। আজ তার বাবা মায়ের সাতাশতম বিবাহ বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে সন্ধ্যের পর বাড়িতে বেশ কিছু অতিথি আসবেন। অতিথিরা স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ির একমাত্র ছেলের উপস্থিতি প্রত্যাশা করবেন। তাছাড়া বাবার সাথে সামির আর তো কোন বিরোধ নেই। যে বিরোধটুকু ছিল বাপ ব্যাটার মধ্যে, তা চুকে বুকে গেছে। তাই এখন বাড়ি ফিরে যেতে আর তেমন কোন আপত্তি নেই তার। ফিরে যাবে সে, নিজের বাবা মায়ের কাছে, পুরোনো জীবনের কাছে, অর্থবিত্ত আর প্রাচুর্যের কাছে। যার জন্য ছেড়েছিল এই সমস্ত কিছু, সেই মানুষটি তো দিব্যি আছে হেসে খেলে। এবার সামিও দেখিয়ে দেবে তাকে, ভালো থাকা কাকে বলে!
আজকের দিনে অবশ্য আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের সাথে তার বন্ধুদেরও দাওয়াত করা হয়েছে বাড়িতে। মা নিজে ফোন করে সব বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন। এমনকি বিভাকেও যেতে বলেছেন তিনি। প্রথমবারের মতো বাবা মা তার বন্ধুদেরকে এতটা সম্মান দেখাল। বাড়িতে সর্বদাই বন্ধুদের অবাধ যাতায়াত ছিল। কিন্তু কখনোই পারিবারিক মিলনায়তনে তাদের জায়গা হয়নি। আজ বন্ধুদের প্রতি মায়ের এই মার্জিত এবং আন্তরিক আচরণ তাকে মুগ্ধ করছে। সকাল থেকে তাই মনটা ভরে আছে একদম! স্নিগ্ধ হয়ে আছে! সেই স্নিগ্ধতার সাথে আবার বিদ্যুতের মতো একটা চমক লেগে গেল তখন, যখন আচমকা তানিশা এসে হাজির হল তার দুপুরবেলার শুনশান একলা ফ্ল্যাটে। গালে শেভিং ফোম মেখে দাড়ি কামাচ্ছিল সে। আদুর গা, পরনে শুধু ছাই রঙের এক ট্রাউজার। রুদ্র গেছে অফিসে। সারা ঘরময় দস্যি ছেলের ন্যায় একা একা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভর দুপুরের চড়া রোদ্দুর। সামি গাল ভর্তি শেভিং ফোম আর আদুর গা নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ডোর হোলে চোখ রেখে দেখল কে এসেছে। দেখা মাত্র স্নিগ্ধতায় মাখামাখি মনটায় এসে ধাক্কা খেলো বিদ্যুতের মতো এক চনমনে চমক। মেয়েটি একটার পর একটা বেল দিয়ে যাচ্ছে। এখুনি দরজা না খুললে যেন সে দরজা ভেঙে ফেলবে। সামি আরেকবার চোখ রাখল ডোর হোলে। আসলেই কি তানিশা এসেছে?
দরজা খুলল সে। হ্যাঁ, মূর্তিমানই বটে! সামির সাদা ফেনাওয়ালা মুখখানা দেখে হতভম্ব মূর্তিটা অবাক গলায় বলল, ‘এই অবস্থা কেন?
তানিশা একটা হালকা নীল রঙের গাউন পরেছে। তার ছিপছিপে দেহের সাথে গাউনটা লেগে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। মুখে হালকা প্রসাধন। রং করা চুল ছড়িয়ে আছে পিঠময়। গা থেকে ভুরভুর করে উড়ে আসছে দামি পারফিউমের ঘ্রাণ। পায়ে হাই হিল জুতো। তার রূপ বড়ই উত্তপ্ত এবং উত্তেজক। হাঁটার ভঙ্গিটি ভারী ছন্দময়। প্রতিটি দেহভঙ্গিতে তরঙ্গায়িত যৌবন প্রকট এবং প্রকাশ্য। সব মিলিয়ে চোখে ধাঁধা লেগে যায় একদম!
সামি দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি?’
—‘হ্যাঁ আমি। ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেব, কিন্তু এখন তো উল্টা আমিই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।’
তানিশা ওর হাই হিল জুতোয় টকটক আওয়াজ তুলে ঢুকল ঘরের ভেতর।
সামি বলল, ‘তুমি একটু বসো। আমি আসছি।’
—‘এখানে বসে থাকতে হবে? তোমার ঘরে যাওয়া বারণ?’
সামি অপ্রতিভ ভাবে বলল, ‘না না, বারণ কেন হবে? তুমি চাইলে আসতে পার।’
তানিশা হাই হিলে টুকটুক শব্দ তুলে সামির পেছন পেছন হেঁটে আসল বেডরুমে। ঘরের অবস্থা যা তা। বিছানার চাদর কুঁচকে আছে। কম্বল পড়ে আছে মেঝেতে। টেবিলের ওপর দুনিয়ার হাবিজাবি জিনিস। একটা আধ খাওয়া কোকের ক্যান উল্টো হয়ে পড়ে আছে পড়ার টেবিলের ওপর। ক্যানের ভেতর থেকে পানীয় গড়িয়ে পড়ে ভেসে গেছে টেবিল। ভিজে গেছে বইপত্র, প্রয়োজনীয় চিঠির খাম, মোবাইলের চার্জার। ঘরের এই বেহাল অবস্থা দেখামাত্র তানিশা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এটা তোমার ঘর?’
—‘হ্যাঁ এটাই আমার ঘর।’ সামি বাথরুমে ঢুকে দরজা দেয়ার আগে ছোট করে বলে গেল। মিনিট পনেরো পরে, গোসল সেরে বেরোনোর পর দেখলো তানিশা কুঁচকানো চাদরের ওপর দিব্যি পা ঝুলিয়ে বসে আরামসে মোবাইল টিপছে মনোযোগ দিয়ে। ঘরের কোন জিনিস সে এদিক সেদিক করেনি। সব আগের মতই আছে। হৃদি হলে কিন্তু এতক্ষণে সব গুছিয়ে ফেলত। সামি গোসল সেরে বেরোনো মাত্র চোখের সামনে আবিষ্কার করত পরিচ্ছন্ন এক ঘর। হৃদি এই ফ্ল্যাটে আসলে সবকিছু একদম পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখে যায়। শুধু এই ঘর না, ড্রইং রুম থেকে শুরু করে রুদ্রর ঘর, রান্না ঘর, সব! এমন কি, সামির মনে হল, অমৃতা থাকলেও এতক্ষণে বিছানার চাদরটা অন্তত টান টান করে রাখত। কোকের ক্যান থেকে টেবিলে গড়িয়ে পড়া তরল পদার্থটুকু মুছে নিত। কিন্তু তানিশা এলোমেলো ঘরের মাঝেই রাজরাণী হয়ে বসে আছে। মেয়েরা এত অগোছালো হলে একটু কেমন যেন লাগে!
সামি তোয়ালে দিয়ে ওর কোঁকড়া চুল গুলো মুছতে মুছতে বলল, ‘চা কফি কিছু খাবে?’
সামির পরনে একটা সাদা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার ছিল। দাড়ি কমানোর পর তার ফর্সা গাল আরো বেশি ফর্সা লাগছে। আফটার শেভের ঘ্রাণে ম ম করছে চারপাশ। তানিশা ওর কান্তিময় মুখখানার দিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে থেকে বলল, ‘তুমি কি আজ তোমাদের বাড়িতে ফিরে যাবে?’
—‘মে বি।’
—‘তোমার মা আমাকেও ইনভাইট করেছেন। আজকের পার্টিতে।’
—‘গ্রেট!’
সামি তোয়ালেটা চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে রেখে আয়নার সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিল হাত দিয়ে। তানিশা সন্তর্পণে ওর পেছনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি ভালোই লম্বা। তার উপর যুক্ত হয়েছে হাইহিল জুতো। তার উচ্চতা এখন সামির গলা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
—‘আমি যে তোমাকে সারপ্রাইজ দিলাম, তুমি খুশি হওনি?’
সামি ঘুরে দাঁড়িয়ে তানিশার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘খুশি হবোনা কেন?’ তানিশা আরো এক পা এগিয়ে আসল সামির কাছে। দুহাত বাড়িয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে লাস্যময়ী হাসি হেসে বলল, ‘তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না খুশি হয়েছ।’
মেয়েটি কাছে আসতেই সামি তার ধমনী দিয়ে বয়ে যাওয়া রক্তে একটা উষ্ণ উছ্বাস টের পেলো। সে তানিশার কৃশকায়, বঙ্কিম ঢেউ যুক্ত কোমর খানিতে একটি হাত রেখে আলতো ভাবে বলল, ‘খুশি হয়েছি।’
কথাটা বলা শেষ করে সামি মাথা নত করে তানিশার লিপস্টিক দেয়া ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে থেমে যেতে হল মাঝপথে। রোদ ডোবা ওই ফকফকা দুপুর বেলায়, সুন্দরী হবু স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ তার চোখের সামনেটা কেমন সন্ধ্যার মত আবছা হয়ে আসল। মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল সেই আশ্চর্য সন্ধ্যাবেলা, ভেসে উঠল সেই শাড়ি পরা, চুল খোলা অপরিচিতা মেয়েটার আবছা অবয়ব। ঠোঁটে ফিরে আসল সেই অলৌকিক চুম্বনের স্বাদ!
আচ্ছা, তার কি কোন অসুখ করেছে? ভয়ংকর কোন অসুখ?
সামিকে অমন পাথরের মতো থমকে যেতে দেখে তানিশা অস্থির হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হল তোমার?’
সামির চোখের তারায় তখন সন্ধ্যা!… চোখের তারায় কুয়াশা!… চোখের তারায় শাড়ি!…, খোলা চুল, খুব চেনা আবার চির অচেনা রহস্যময়ী এক নারী…, যে নারীকে সে কখনো চোখ মেলে দেখেনি কিন্তু অনুভব করেছে তার সমস্তটা দিয়ে!
তানিশার বাহু বন্ধন থেকে নিজের গলা ছাড়িয়ে নিয়ে স্তিমিত গলায় বলল, ‘আজ থাক।’
তানিশার মুখে একটা গনগনে ভাব ফুটে উঠল চকিতে। তিরিক্ষি গলায় বলল,’হোয়াটস রঙ উইদ ইউ? ওই দিনও তুমি একই কথা বলেছিলে। আমাদের বাসায়। ক্যান ইউ রিকল?’
সামি নিশ্চুপ। মাথা নত
—‘সিরিয়াসলি, প্রব্লেমটা কী তোমার? লিসেন, ইওর প্রব্লেম উইল নেভার গো এওয়ে আনটিল ইউ ডিল উইথ ইট। আমি জানতে চাই প্রব্লেমটা কি মেন্টাল নাকি ফিজিক্যাল? নাকি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাওনা?’
সামি হতাশ ভাবে বলল, ‘আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই তানিশা! তুমি… তুমি কি আমাকে একটু সময় দিতে পারবে?’
—‘দুদিন পরে আমাদের এনগেজমেন্ট। এখন তুমি সময় চাইছ?’
সামি খুব বিচলিত ভাবে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে লাগল। হ্যাঁ তানিশা ঠিকই বলেছে সেদিনও হুবহু এরকম ঘটনাই ঘটেছিল তানিশাদের বাসায়। তানিশা কাছে আসতেই ডুয়ার্সের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। তারপর হাত পায়ে নেমে আসল এক অসাড় ভাব। সব কিছু বিস্বাদ! সেদিনও তানিশাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে। এমন কি ডুয়ার্সে বিভাকে আদর করতে যাবার সময়ও এই একই কান্ড ঘটেছিল। এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? এই অসুখ নিয়ে সে বেঁচে থাকবে কী করে?
সামি একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে তানিশার দিকে চাইল। নিজের সমস্ত চেতনাকে জড় করে সম্পূর্ণ ভাবে মনোনিবেশ করতে চাইল সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। এই বাজে অসুখ থেকে তাকে বেরিয়ে আসতেই হবে। যে করেই হোক! তানিশা হঠাৎ একটু বাঁকা ভাবে বলল, ‘তুমি কি তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে এখনো ভুলতে পারোনি?’
সামি সজোরে মাথা নেড়ে বলে, ‘আরে না, ওসব তো কবেই শেষ!
–’তুমি কি আসলেই আমাকে বিয়ে করতে চাও?’
সামি এগিয়ে এসে তানিশার একটা হাত ধরল, অত্যন্ত নরম গলায় বলল, ‘খুব চাই। বিশ্বাস কর!’
—‘বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।’
—‘ইচ্ছেটা পূরণ কর। প্লিজ!’
—‘তোমার বন্ধুরা কি আজকে আমার সাথে মিট করবে?’
বন্ধুদের প্রসঙ্গ উঠতেই সামির চোখের তারা একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দে চিকচিক করে উঠল। সে ব্যস্ত ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, বিকেল পাঁচটায় ওদের আসার কথা।’
—‘আমার ফ্রেন্ডসরাও আসবে। কোথায় আসতে বলব ওদের?’
—‘এখানেই আসতে বল। রাতে তো সবাই আমাদের বাসায়ই যাচ্ছি একসাথে যাওয়া যাবে।’
.
বন্ধুরা আসল ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে। আজ তানিশার সাথে প্রথমবারের মতো দেখা হবে বলে হৃদি আর বিভা বেশ একটু সাজগোজ করেছে। বিভার মধ্যে গ্ল্যামার ব্যাপারটা খুব প্রত্যক্ষ ভাবেই আছে। ওর সাজসজ্জায় সর্বদাই একটা জাঁকজমক লেগে থাকে। অন্যদিকে হৃদি যতই সাজুক না কেন লাক্সারি বা জাঁকজমক জিনিসটা তার মাঝে কখনোই আসেনা। একটু কেমন মোলায়েম আর কোমল ওর সৌন্দর্যটা। চট করে চোখে ধরা পড়েনা। কিন্তু সময় নিয়ে ওই মুখটার দিকে চাইলে ওর মসৃণ সৌন্দর্যটা সারাটা মনে হাওয়াই মিঠাইয়ের মিষ্টতার মতো লেগে থাকে, অনেকক্ষণ!
বিভা একটা সি গ্রীন কালারের টপ আর লং স্কার্ট পরেছিল। তার টপটা কিন্তু বেশ দামী। বেছে বেছে সবচাইতে দামি কাপড়টাই আজকে পরে এসেছে। জামার সাথে রং মিলিয়ে গলায় একটা স্টোনের পেন্ডেন্ট পরেছে। চোখ সাজিয়েছে যত্ন করে। কোন দিক দিয়েই যেন তাকে তানিশার চেয়ে কম সুন্দর না লাগে সেই প্রচেষ্টা সে ষোলো আনাই করেছে। লাগছিলোও তাকে সব চাইতে সুন্দর। হ্যাঁ, বিভা প্রকৃত অর্থেই সুন্দরী। সেই সত্যটা সামি অনুভব করল তখন, যখন বিভা ওর সমুদ্র সবুজ সাজ নিয়ে টিউব লাইটের সাদা আলোর নিচে তানিশার সম্মুখে এসে উপস্থিত হল। বিভার ওই মোহনীয় রূপের কাছে ধনীর দুলালি, স্টাইলিশ, স্মার্ট তানিশাও হঠাৎ ফুঁস করে কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল।
হৃদি একটা পেঁয়াজ রঙের কুর্তা পরেছিল সাদা ডিভাইডারের সাথে। কানে মুক্তোর দুল। সাজেনি খুব একটা। শুধু চোখ ভর্তি করে কাজল দিয়েছে। কিন্তু তার কাজল কালো চক্ষু জোড়া গোঁড়াতেই এক রকম গলদ বাঁধিয়ে দিচ্ছিল। ফ্ল্যাটে ঢোকার সাথে সাথে তানিশা নামের মেয়েটা বলল, ‘ফাইনালি, তোমরা এসেই গেলে। আমি সেই দুপুর থেকে অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্য।
টং করে বুকে বাড়ি খেল কথাটা। দুপুর থেকে? এই ফ্ল্যাটে তো সারাদিন শুধু সামি ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। এর মানে মেয়েটা সামির সাথে এতটা সময় একদম একলা একলা ছিল? চিন্তাটা মাথায় খেলতেই হৃদির চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে সামলে নিল নিজেকে। কান্না করলেই কাজল যাবে লেপ্টে। আজকের দিনে অন্তত লেপ্টে যাওয়া কাজল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে চায়না সে।
তানিশার সাথে বন্ধুদের পরিচয় পর্ব শেষ হতে না হতেই তানিশার তিন বন্ধু এসে হাজির হল। দুজন মেয়ে, একজন ছেলে। মেয়ে দুজনের সাজসজ্জা চোখ ধাঁধানো। আঁটোসাঁটো লো কাট পোশাক, গাঢ় লিপস্টিক, রিপড জিন্স! রুদ্র আর আকাশ একদম আনন্দে বাক বাকুম হয়ে গেল মেয়েদুটোকে দেখে। তাদের চোখে মুখে ঈদের খুশি ঝিলমিল করতে লাগল। তারা মুগ্ধ, আপ্লুত এবং কৃতজ্ঞ!
তানিশার ছেলে বন্ধুটি চশমা পরা লাজুক চেহারার যুবক। চেহারা লাজুক হলে কী হবে, কথা বলা শুরু করার পর বোঝা গেলো সে বেশ সপ্রতিভ। ড্রইং রুমেই বসেছিল সবাই। তানিশা আর সামি একটি গদিতে পাশাপাশি বসেছে। তানিশা সামির হাত ধরে আছে। দুজনে বসেছে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে। দৃশ্যটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল হৃদির। বিভাও তানিশা মেয়েটাকে এক রত্তি পছন্দ করতে পারছেনা। মেয়েটার মধ্যে একটা লোক দেখানো ভাব আছে। বোঝাই যাচ্ছে সামির সাথে ঢলাঢলিটা সে ইচ্ছাকৃত ভাবে করছে। বিভাকে দেখাচ্ছে যে, তোমার এক্স এখন আমার হাতের মুঠোয়!
হৃদি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমরা কী খাবে? চা নাকি কফি?’
তানিশা কটাক্ষ করে বলল, ‘তুমি কোথায় চললে? এটা কি তোমার বাসা নাকি?’
প্রশ্নটা অনাকাঙ্ক্ষিত, রুক্ষ এবং অপমানজনক। হৃদি প্রশ্নটা শুনে একদম স্তম্ভিত হয়ে গেল। সামিকেও বেশ বিচলিত দেখাল। সে বুঝতে পারছে তার কিছু একটা বলা উচিৎ এ মুহূর্তে কিন্তু মাথায় কোন শব্দ আসছেনা। উত্তরটা দিল অমৃতা। পরিষ্কার গলায় বলল, ‘বন্ধুর বাসা তো নিজের বাসাই। বন্ধু কি পর নাকি?’
কথাটা বলা শেষ করে অমৃতা হৃদির হাত ধরে টেনে নিয়ে আসল পাশের ঘরে। বিভাও বসে থাকল না। দুই সখীর পেছন পেছন এগিয়ে গেল। এদিকে আকাশ আর রুদ্র মেয়েদুটির সাথে বেশ ভালোই জমিয়ে দিয়েছে। ছেলেটিও খুব কথা বলছিল। কিন্তু মেয়েদুটির প্রতি আকাশ, রুদ্রর অভিনিবেশ ছিল বেশ প্রকাশ্য এবং বিকশিত।
রান্না ঘরে এসে হৃদি গজগজ করতে করতে বলল, ‘অসহ্য রকমের পাবলিক কতগুলা। বিরক্তিকর!’
বিভার রাগও নিছক কম নয়। চাপা গর্জন করে সে বলে উঠল, ‘এই বেটি তো পুরাই ডাইনি একটা। ভাব দেখে মনে হইতেছে সামির কোলে উইঠা যাবে পারলে। অসম্ভব! সামির পাশে আমি কিছুতেই একে সহ্য করতে পারবোনা। এতো কিসের ঘেঁষাঘেঁষি?’
অমৃতা হেসে বলল, তোরা এতো হিংসুটে কেন? দুইদিন পরে ওদের বিয়ে হবে। এখন ঘেঁষাঘেঁষি করবেনা তো কখন করবে?’
অমৃতার কথায় হৃদির মন নরম হল না। রাগে আর অপমানে তার কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আজকে এখানে না আসলেই ভালো হত। শুধু শুধু এসেছে মরতে!
হাতে চা সমেত ট্রে নিয়ে ওরা তিনজন আসল ডাইনিং রুমে। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখল মেয়ে দুটি রুদ্র আর আকাশের সাথে আলাদা ভাবে বসে আছে। গল্পে মশগুল প্রত্যেকেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বসার ঘরে এখন তিনটি জুটি উপস্থিত। সামি- তানিশা, রুদ্র -তানিশার বান্ধবী, আকাশ- তানিশার বান্ধবী। তাদের সাথে একটি মাত্র নিঃসঙ্গ যুবক। যে কিনা মনোযোগের সাথে টিভি দেখছে। গোটা দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে রাগে গ তিন বান্ধবীর পিত্তি জ্বলে খাঁক হয়ে যাবার উপক্রম হল।
বিভা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আকাশ আর রুদ্ররে দেখছিস? কেমন ক্যালাইতেছে সেই তখন থেকে? মেয়ে দেখে আমাদেরকে ভুইলাই গেছে। মানে একদম লুইচ্চা দি গ্রেট!’
অমৃতা বলল, ‘আসলেই, মানে প্রব্লেম কী এদের? এমন হে হে করতেছে কেন মাইয়া গুলারে দেখার পর থেকে?’
বিভা চক্রান্তকারীর গলায় বলল, ‘দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা! সব গুলার প্রেম বের করতেছি।’
-‘কী করবি?’
—‘কী আর করব? ডিস্টার্ব করব। যাতে প্রেম করতে না পারে।’
কথাটা বলা শেষ করেই সে চট করে দুই ঘরের মাঝখানের পর্দাটা সরিয়ে দিল হাত দিয়ে। তারপর দ্রুত গতিতে ড্রইং রুমের মূল বাতি দিল নিভিয়ে। জ্বালালো হালকা সবুজ আলোর ডিম লাইট। উপস্থিত তিন জুটি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এমন মধুর সময়ে বিরক্ত করার জন্য আকাশ মনে মনে একটা গালিও দিয়ে ফেলল বিভাকে। বিভা কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে সাইড টেবিলের ওপর রাখা এলেক্সাকে উঁচু গলায় হুকুম করল গান চালিয়ে দিতে। তৎক্ষণাৎ সবুজ বাতি জ্বলে উঠল এলেক্সা নামক স্পীকারটার গায়ে। প্রথমে হুকুমকারীকে যান্ত্রিক গলায় উত্তর দিল সে, তারপর বাজাতে শুরু করল একটি ইংরেজি গান। বিভা হাত নেড়ে অমৃতা আর হৃদিকে ডেকে বলল, ‘দাঁড়ায় রইলি ক্যান? আয় নাচি।’
অমৃতা আর হৃদি সময় নষ্ট না করে বিভার কথা মতো কাজ করল। কার্পেটের উপর এসে নাচ শুরু করল হাত পা ছুঁড়ে। তানিশা বিস্মিত হয়ে সামিকে বলল, ‘ওদের কী হয়েছে? ওরা কি পাগল হয়ে গেছে?’
সামি তার বন্ধুদের পাগলামি দেখে অবাক হল না। এরা যে পাগল সেটা সবাই জানে। তানিশাও জানবে ধীরে ধীরে। সে কিছু না বলে চুপ করে রইল। রুদ্রর পাশে বসা মেয়েটির নাম জোয়ানা। জোয়ানার গায়ে একটি লো কাট, বড় গলার ব্লাউজ আর রিপড জিন্স। একটু ঝুঁকলেই তার বুকের অনেকখানি অংশ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ফকফকা টিউব লাইটের আলোয় রুদ্র ওর বারংবার নানা বাহানায় ঝুঁকে কথা বলাটা উপভোগ করছিলো। বিভার বাচ্চি হঠাৎ এসে বাতি নিভিয়ে দিয়ে তার বিনোদন মাটি করে দিল রেগেমেগে তাই মনে মনে সে বিভার চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল। জোয়ানা ভারী অবাক গলায় রুদ্রকে বলল, ‘তোমার বান্ধবীদের কী হল হঠাৎ?’
রুদ্র স্বগতোক্তির মত বলল, ‘মৃগী ব্যারাম হইছে মনে হয়।
জোয়ানা ঠিক ঠাক কথাটা শুনতে না পেয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী বললে?’
রুদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বিভা ঝড়ো বাতাসের মত উড়ে এসে রুদ্রর হাত খামচে ধরে টেনে তুলল বসা থেকে। বলল, ‘বইসা আছোস ক্যান? নাচতে আয়।’
মিনিটের মধ্যেই হৃদি টেনে নিয়ে আসল সামিকে আর অমৃতা আকাশকে। খানিক বাদে দেখা গেলো ওরা ছয় বন্ধুই দুনিয়াদারি ভুলে গিয়ে নাচে মত্ত হয়ে গেছে। অতিথিরা থ মারা চোখ মেলে চেয়ে চেয়ে দেখছে সেই নাচ।
ডিম ডিম সবুজ আলোটায় একটু কেমন সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব ছিল। সেই সন্ধ্যা সন্ধ্যা আলোটায় খোলা চুলের হৃদির দিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই, সামির অন্তরাত্মা আচমকা কেন যে অমন থরথর করে কেঁপে উঠল কে জানে! হৃদিকে এখন অনেকটা সেই মেয়েটার মত লাগছে। কী আশ্চর্য হৃদি তো তার বন্ধু! হৃদিকে সে ভালোবাসে ঠিক, কিন্তু সেই ভালোবাসায় কোন তরঙ্গ ছিলোনা কখনো। আজকে এই সবুজাভ ফিকে আলোয় হৃদিকে হঠাৎ অমন অচেনা মেয়ে বলে হচ্ছে কেন? তার নিজের ভেতরে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে?
গানের ট্র্যাক বদলে গেছে। এলেক্সা তখন বাজাচ্ছিল, We got that Coca Cola bottle shape, shape, shape
জোয়ানাকে নাচের নেশায় পেয়ে গেছে। সে ড্যান্স ফ্লোরে এসে শরীর দুলিয়ে চমৎকার নাচ নাচতে লাগল। ওর নাচের দমকে সবাই চমকে গেল একদম। থম ধরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সেই উদ্দাম নৃত্য। রুদ্র আর আকাশ তো নাচ দেখে হা হয়ে গেছে। কী চমৎকার নাচের ভঙ্গি! কী ভীষণ এক্সপ্রেশন! নায়িকাদেরকেও হার মানায়!
সন্ধ্যা সাতটার সময় ওরা সবাই সামিদের বাসায় যাবার জন্য তৈরী হল। নিচে নামার পর দেখা গেল তানিশার বন্ধুদের প্রত্যেকের সাথে একটি করে প্রাইভেট কার আছে। অর্থাৎ চারজন মানুষের চারটা গাড়ি। এদিকে সামির বন্ধুদের কারো সাথে গাড়ি নেই। ওর এক মার্সিডিজ বেঞ্চই সবার ভরসা। তানিশা খোঁটা দেয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করল না। সে সবার সামনে চোখ কপালে তুলে মেকি গলায় বলল, ‘তোমার বন্ধুরা কেউ গাড়ি আনেনি?’
সামি গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল, ‘না!’
—‘কেন? এতজন যাবে কিভাবে?’
রুদ্র হড়বড় করে বলল, ‘আমার গাড়ি নাই। আকাশ অমৃতারও গাড়ি নাই। হৃদি আর বিভার আছে। কিন্তু ওদের দুজনের বাবাই ভীষণ কিপটা গাড়ি দিতে চায়না।’
রুদ্রর কথা শুনে বিভার ইচ্ছে হল পায়ের স্যান্ডেলটা খুলে ছুঁড়ে মারে ওর মাথায়। বোকামির একটা সীমা থাকা উচিৎ! তানিশা আগের চাইতেও বেশি ন্যাকা গলায় বলে উঠল, ‘অ… এই অবস্থা? ইশ… আমি তোমাদেরকে রাইড দিতে পারি। আমাদের সাথে চারটা গাড়ি।’
সামি বলল,’তোমার রাইড দিতে হবেনা। ওরা আমার সাথেই যেতে পারবে।’
—‘একটা মাত্র গাড়িতে এতজন! সিরিয়াসলি?’
—‘আমাদের অভ্যাস আছে।’ সামি বলল।
গাড়িতে উঠে বসল সবাই। শুধু অমৃতা উঠল না। বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, ‘সামি! দোস্ত আমার একটু বাসায় যাইতে হবে। বাবা ডাকতেছে, কী নাকি দরকার আছে।’
—‘মানে কী? তুই যাবিনা আমার বাসায়?’ সামি অবাক।
—‘না দোস্ত। আমাকে বাদ দে আজকে।’
সামি ম্লান গলায় বলল, ‘আজকে এতদিন পর আমি বাসায় যাচ্ছি। তুই আমার পাশে থাকবিনা?’
অমৃতা একটা বড় শ্বাস ফেলল। ওই লোকটার এনিভার্সারি সেলিব্রেট করার মতো কোন মন মানসিকতা যে এই মুহূর্তে অমৃতার নেই তা সামিকে কে বোঝাবে? শুধু সামি কেন, পৃথিবীর কোন মানুষকেই বোঝানো সম্ভব না। দায়টা শুধুই অমৃতার একার। একাই বইতে হবে আজীবন!
যা হবার হোক, সবার আগে বন্ধুত্ব! সামি তাকে পাশে চায়। এটাই মুখ্য, বাকি সব গৌণ! সে সামির করুণ মুখখানার দিকে চেয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আচ্ছা যাচ্ছি, চল!’
ঢাকার উত্তরায় সামিদের প্রাসাদতুল্য বাড়িটি যেন এই ব্যস্ত নগরীর কোনও অংশ নয়। ওই অট্টালিকার দিকে আচমকা চোখ পড়লে মনে হয় এই মাত্র আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্য হাতের করতলে করে প্রাসাদটি বয়ে এনে বসিয়ে দিয়েছে রাজধানীর বুকে। একটা সময় বন্ধুরা ঘন ঘন আসত এ বাড়িতে। কে কখন আসল আর গেল তা দেখার মতো উপায় বা সময় কোনটিই বাড়ির মালিক বা মালকিনের ছিল না। এ বাড়ির মনিবের সাথে রোজ অসংখ্য দর্শনার্থী আসে দেখা করতে নানা তদবিরে আর কাজে। সামির বন্ধুরা সেইসব গড়পড়তা দর্শনার্থীদের ভিড়েই মিশে ছিল আজীবন। বিশেষ কোন আপ্যায়ন তাদেরকে কখনো করা হয়নি।
আজকের দিনটি অবশ্য একটু অন্যরকম। কারুকার্য খচিত কালো রঙের দামি কাঠের তৈরি সদর দরজার সামনে, পোর্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার এবং মিসেস হক, তাদের একমাত্র পুত্রকে বরণ করার নিমিত্তে। গাড়িবারান্দার ঘাসযুক্ত মাটি থেকে শুরু করে শ্বেত পাথরে বাঁধানো চার ধাপের প্রশস্ত সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে, পোর্চ পর্যন্ত। সেই সিঁড়ির ধাপে ধাপে সারি বেঁধে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে সামির নানা বয়সী কাজিনরা। আজ টানা নয়মাস পর এ বাড়ির একমাত্র অমূল্য মানিক রত্নটির গৃহপ্রবেশ ঘটবে। এটা কোনো যেন তেন ঘটনা না। বাবা মা দুজনেই এই ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখতে চান। ছেলের ফিরে আসা উপলক্ষে আজ সকাল থেকে পাচঁজন মৌলবী ডেকে এনে, বাড়িতে কোরআন খতমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোরআন খতমের পর বিশেষ মোনাজাত করা হবে। অতএব আজকের উৎসবটি নাম কা ওয়াস্তেই হক এবং তাঁর স্ত্রীর বিবাহবার্ষিকী। আদতে আজ তাদের পুত্রের গৃহপ্রবেশ। তবে বিবাহ বার্ষিকীর জন্যে যে একেবারে কোন আয়োজন করা হয়নি তা কিন্তু নয়। বিশাল সাইজের এক কেক নিয়ে এসেছেন সামির ছোট খালা এবং খালু। নানা রকম উপহার সামগ্রী হাতে নিয়ে এর মাঝেই হাজির হয়েছেন কাছের আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে দূর পাল্লার নানা চেনা লোকজন। উচ্চ পদস্থ কিছু অফিসিয়াল লোকজনদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। এছাড়াও দলের বড় বড় নেতা কর্মীরা এসে হাজির হবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। পঞ্চাশ জনের ওপরে লোক খাবে আজ বাড়িতে। খাবার অর্ডার দেয়া হয়েছে বাইরে থেকে। বাড়িতে কিছুই রান্না করা হয়নি।
সামির গাড়ির পেছন পেছন আসছিল তানিশাদের তিন গাড়ি। সবগুলো গাড়ি লাইন ধরে এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনের ড্রাইভ ওয়েতে। কেয়ার টেকার সুলেমান দৌড়ে গিয়ে সামিকে বলল, ‘ছোট সাহেব, আপনি নাইমা যান। ড্রাইভার গাড়ি রাখবে গ্যারেজে।’
অতএব আর কথা না বাড়িয়ে সামি নেমে আসল গাড়ি থেকে। নামল তার বন্ধুরাও। বিভার একটু অস্বস্তি লাগছিল। শেষবার এ বাড়িতে যখন এসেছিল তখন বুকের মধ্যে ছিল অন্যরকম এক স্বপ্ন। এখানেই শেষবারের মতো চুমু খেয়েছিল তাকে সামি। এই বাড়ির হল রুমে। গভীর রাতে! সেই রাতটার কথা মনে পড়লে আজও মেরুদণ্ডে একটা শিরশিরানি ভাব টের পায় সে। কষ্টের মতো কী যেন একটা খাবি খায় মনে। অথচ সব কিছুতো পাল্টে গেছে, তাইনা? তার জীবনে এখন অভিজিৎ আছে। সামির আছে অন্য কেউ। প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। খালিঘর পূরণ করে দেয় কোনও না কোন উপায়ে। সামির বাবা মায়ের সামনে যেতে একটু সংকোচ হচ্ছে তার। তাদের কাছে তো কিছুই অজানা নেই। এতকিছুর পরেও বিভা নাচতে নাচতে চলে এসেছে সামির এনগেজমেন্ট খেতে, এ ব্যাপারটা তারা সহজ ভাবে নিচ্ছেন কি? তাঁরা তো বুঝবেন না যে বিভার কাছে প্রেমের চাইতেও বড় হল বন্ধুত্বটা। বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে পুরোনো সব হৃদয়ঘটিত ইতিহাস ভুলে গিয়ে, সংকোচ গিলে ফেলে সামির পাশে থাকতে হবে, যে করেই হোক!
বাড়ির একমাত্র ছেলের গৃহপ্রবেশ নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হল। ঢোকার সময় ওদের সবার মাথায় গাঁদা ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েরা। বাড়িতে ঢোকার পর সবাই মাথার চুলে আটকে থাকা সেই ফুলের পাঁপড়ি ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। তানিশার আজ প্রথম আসা এ বাড়িতে। বাড়ির জাঁকজমক এবং আড়ম্বরপূর্ণ শোভা দেখে তার চোখ মুখ থেকে খুশি উপচে উপচে পড়ছে। সামির আম্মা আনন্দে আটখানা হয়ে তানিশাকে সব আত্মীয় স্বজনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রথমেই। পরিচয় করিয়ে দিলেন সামির বন্ধুদেরকেও। এই প্রথমবারের মতো!
এ বাড়ির বৈঠকখানাটি বিশাল। ঢোকার মুখেই চোখে পড়ে দেয়ালজুড়ে বাঁধাই করা ভার্টিক্যাল গার্ডেন। নানারকম পাতাবাহার ঝুলে আছে সেই দেয়াল থেকে। এস্টোরিয়া গ্র্যান্ডের তিন সেট সোফা এঁটে গেছে অনায়াসে। ঘরের মাঝখানে কালো কাঠের কাজ করা লম্বাটে সেন্টার টেবিল। তার ওপর পোর্সেলিনের চমৎকার দুটি নীল রঙের ফুলদানি। ফুলদানির মাথা আলো করে উঁকি দিয়ে আছে এক গুচ্ছ তাজা লাল এবং সাদা গোলাপ। ঘরের পশ্চিম দিকে মেঝে থেকে সিলিং অবধি উঁচু হয়ে উঠে গেছে একটি বড়সড় কাচের দরজা। দরজায় ঝোলানো পর্দা সরালেই ওপাশের ফুলের বাগান দেখা যায়। বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে লাল মাটির একটি নারী মূর্তি। সেই মূর্তি ঘিরে তৈরী হয়েছে জলের ফোয়ারা। দিনের বেলা এই ঘরটার সৌন্দর্য একদম অন্যরকম। আলোর বন্যায় ভেসে যায় চারপাশ। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সোফায় বসে নিভৃতে বাগানের ফুল আর জলের ফোয়ারা দেখতে দেখতে মন স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে।
এখন রাতের বেলার দৃশ্যটিও অবশ্য কম নজরকাড়া নয়। বাড়ির একমাত্র ছেলের এনগেজমেন্ট উপলক্ষে বাগানে লাইটিং করা হয়েছে। জলের ফোয়ারায় নানা রঙের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। স্ট্রিং লাইট ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে গাছের ডালে ডালে, ফুটে থাকা ফুলের গায়ে গায়ে।
বৈঠকখানা নানা বয়সী লোকজনে গিজগিজ করছে। এতো ভিড় ভালো লাগছিলোনা সামির। আজ অনেক দিন পর সে নিজের জায়াগায় ফিরলো। তার জন্ম হয়েছে এই বাড়িতে। সে সময় এটা নিতান্তই পুরোনো আমলের সাদামাটা এক বিল্ডিং ছিল। দাদা সাহেব বেঁচে ছিলেন তখন। এখানেই কেটেছে সামির শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের বেশ কিছু সময়। এতদিন পর নিজের একান্ত আপন ভুবনটিতে ফিরে এসে তার মনের ভেতরে ক্রমশ একটি পেলব, কোমল অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল। শান্তি আর স্বস্তির সাথে সমান তালে তাকে পেয়ে বসেছিল নস্টালজিয়ায়। দিন গুলো কী দ্রুত কেটে যাচ্ছে! বিরতিহীন ট্রেনের ন্যায় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে সময়। তার মনে হচ্ছিল নিজের বাবা মায়ের মতো এই অনেক দিনের পুরোনো ইট, কাঠ, পাথরের বাড়িটিও বুঝি আজ তাকে ফিরে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে আছে। এ বাড়িরও বুঝি প্রাণ আছে। হ্যাঁ সামি আজ এই ভরা মজলিশে একদম চুপচাপ বসে থেকে, সমগ্র চেতনা দিয়ে, এই বাসভবনটির প্রাণের অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল।
—‘সামি, বাবা বসে না থেকে তানিশাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাও!’
মায়ের কথাটা তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটালো। কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল তার কথাটা পুরোপুরি আত্মস্থ করতে। করার পর উঠে দাঁড়িয়ে তানিশাকে বলল,
বলল, ‘এসো আমার সাথে।’ একটু থেমে কী মনে করে যেন বন্ধুদের বলল, ‘তোরাও আয়।’
সামির আম্মা ফোড়ন কেটে বললেন, ‘ওরা কি এ বাড়িতে নতুন নাকি? তুমি তানিশা আর ওর বন্ধুদের নিয়ে যাও।’
আকাশ বলল, ‘আমরা ঠিক আছি। তুই যা সমস্যা নাই।’
কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে সামি আবার ফেরত আসল। হেঁটে হেঁটে হৃদির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুই কি চার্জারটা আনছিলি?’
বসুন্ধরার ফ্ল্যাট থেকে বেরোবার আগমুহূর্তে হৃদি, সামিকে মোবাইলের চার্জার সাথে নেয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। সামি তবুও চার্জারটা সঙ্গে নেয়নি। হৃদি মনে করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিল জিনিসটা। সামি জানতো যে, হৃদি নিবেই। তাই নিজে বয়ে নিয়ে আসার প্রয়োজন বোধ করেনি।
হৃদি তড়িঘড়ি করে করে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে চার্জার বের করতে করতে বলল, ‘নিজের জিনিস নিজে গুছায় রাখতে পারিস না? আমি না আনলে কী করতি এখন?’
সামি দায়সারা গলায় বলল, ‘না আনলে মাইর দিতাম তোরে। আমি আনব কেন? তুই আছিস কীসের জন্য?’
তানিশা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে সরু চোখে পুরো ঘটনাটা অবলোকন করল। সামি চার্জার হাতে নিয়ে ফিরে আসার পর সে আগুন গরম গলায় বলল, ‘তোমার ফোনের চার্জার ওর কাছে কেন?’
সামি প্রশ্নটা শুনে চোখ মেলে তাকাল তানিশার দিকে। খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘ওর কাছে থাকবে না তো কার কাছে থাকবে?’
—‘এটার মানে কী?’
—‘মানে ও আমার ফ্রেন্ড!’
পাশাপাশি সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল ওরা। তানিশা এবার একটু উঁচু স্বরে বলল, ‘এতো ফ্রেন্ড ফ্রেন্ড কর কেন সবসময়? ফ্রেন্ড কি আমাদের নাই? শুধু তোমার একারই ফ্রেন্ড আছে?’
প্রায় অনেকক্ষণ যাবৎ সামির মনের ভেতর একটা বিরক্তি ভাব বুদবুদের মতন ভেসে বেড়াচ্ছিল। বিরক্তির কারণটা এতক্ষণ অস্পষ্ট থাকলেও এই মুহূর্তে তানিশার কথাটা শোনা মাত্র কেমন করে যেন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠল। সে বুঝল বিরক্তির কারণ হল তানিশা। মেয়েটার কথাবার্তা আজকে দুপুর থেকেই বিরক্ত লাগছে তার। সিঁড়ির মাঝখানে থেমে পড়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
—‘তানিশা শোনো, একটা ব্যাপার তোমার জেনে রাখা উচিৎ যে, আমার বন্ধুরা একদিকে আর পৃথিবী অন্যদিকে। তাই এরপর থেকে আমার বন্ধুদের নিয়ে কিছু বলার আগে দশবার ভেবে নেবে।’
তানিশার মুখটা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল কথাটা শুনতে পেয়ে। সামি আর কিছু না বলে ওপর তলায় উঠে আসল। তানিশা এবং তার বন্ধুদের ঘুরে ঘুরে দেখাল প্রতিটা ঘর, বারান্দা, মিউজিক প্যাড, জিম এবং ছাদের ওপরের সুইমিং পুল। কিন্তু তানিশার মুখ থেকে দুশ্চিন্তার ছাপটা সরছিল না। এক অবিদিত আশংকায় তার মনটা অস্থির হয়ে আছে।
ওরা নিচতলায় ফিরে আসার পর মৌলবী সাহেব মোনাজাত করলেন। অনেক সময় নিয়ে। মোনাজাতের পর শুরু হল কেক কাটার পালা। সামির আব্বা বরাবরের মতোই জানিয়ে দিয়েছেন কেক টেক তিনি কাটবেন না। এইসব আনুষ্ঠানিকতা তাঁর কখনোই পছন্দ না। অতএব বাবার হয়ে মায়ের সাথে কেক কাটবে সামি। বাবা দাঁড়িয়ে থাকবেন পাশে, কিন্তু কেকের ছুরিতে হাত লাগাবেন না। কেক কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাইরে লনে। সবুজ লনের ওপর টেবিল পেতে, সেই টেবিলের ওপর রাখা হয়েছে তিন তলা কেক। কেকের চারপাশে ভিড় করে আছে নানা রকম স্ন্যাক্স এবং শীতকালীন পিঠা। চা কফিরও ব্যবস্থা আছে। স্ট্রিং লাইটের মনোরম আলোতে চারপাশ এখন বেশ ঝলমলে এবং রোমান্টিক। হালকা সুরে মিউজিক বাজছে। সন্ধ্যে নামার পর শীতটাও জমেছে বেশ। জালের মত সাদা কুয়াশা আটকে আছে শূন্যে। সব মিলিয়ে বেশ ভালো লাগার মত এক পরিবেশ। লনে ভিড় করেছে প্রায় জনা পঞ্চাশেক মানুষ। কেউ বসে আছে চেয়ারে, কেউ দাঁড়িয়ে। বন্ধুরা ভিড় থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে বসেছে। ঘাসের ওপর চেয়ার পেতে, গোল হয়ে।
সামি তার বাবা মায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল। টেবিলের চারপাশে অতিথিরা জড়ো হয়ে আছে। হরেক লোকের ভিড়ের মাঝে লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিল অমৃতা। গায়ে একটা ধূসর রঙের শাল জড়িয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ছেলের পাশে। লোকটার স্ত্রী সেজেছেন খুব। একেবারে বিয়ে বাড়ির সাজ।
আকাশ, অমৃতা পাশাপাশি বসেছিল। ওদের মুখোমুখি বসেছে হৃদি, বিভা আর রুদ্র। আকাশ বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ অমৃতাকে লক্ষ্য করছিল। এখানে আসার পর থেকেই অমৃতা অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ হয়ে গেছে। মুখখানা ম্লান, চোখ দুটোতে কেমন বিষণ্ণতা। মনে হচ্ছে যেন তার দেহটাই শুধু আছে এখানটায়, কিন্তু মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। আকাশ হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করলো, ‘এই অমৃতা, তোর কী হইছে?’
অমৃতা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমার আবার কী হবে?’
—‘কেমন যেন লাগতেছে তোকে।’
—‘কেমন লাগতেছে?’
—‘কেমন জানি বিরহ বিরহ ভাব।’
অমৃতার কথাটা ভালো লাগল না। কিছুক্ষণ করাল চোখে আকাশের দিকে চেয়ে থেকে সে ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল, ‘ফালতু কথা বলিস না!’ কথাটা বলে উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। আকাশ পেছন থেকে প্রশ্ন করল, ‘কই যাস?’ অমৃতা কোন উত্তর দিল না। হনহন করে হেঁটে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল।
বিভা আর হৃদির অবস্থান ছিল খুব কাছাকাছি। দুজনে একনিষ্ঠ ভাবে সামির পুরো পরিবারটাকে পর্যবেক্ষণ করছিল অনেকক্ষণ ধরে। বিভা এক পর্যায়ে হৃদির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘দোস্ত, একটু কূটনামি করি চল।’
হৃদি নড়েচড়ে বসল, ‘ভালোই বলছিস, আমারও একটু কূটনামি করতে মনে চাইতেছে।’
বিভা খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে চাপা গলায় বলল, ‘আমি যা ভাবতেছি, তুইও কি তাই ভাবতেছিস?’
—‘তুই কী ভাবতেছিস?’
বিভা ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা একবার দেখে নিল। তারপর গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘ভাবতেছি অমৃতা লোকটার মধ্যে এমন কী মধু দেখল?’
—‘আল্লাহ! কসম দোস্ত! আমিও এই কথাটাই ভাবতেছিলাম। বিশ্বাস কর!’
—‘হুম, কী দেইখা অমৃতা এমন দিওয়ানা হইয়া গেল সেটাই বুঝার চেষ্টা করতেছি।’
হৃদি আগের চাইতেও তীক্ষ্ণ নজরে সামির পাশে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকাল। উচ্চতায় লোকটা সামিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ছিপছিপে শরীর। গায়ে ধূসর রঙের শাল। গালে ছোপ ছোপ দাড়ি। হৃদি ধীরস্বরে বলল, ‘ওয়েল, আমি মনে হয় একটু একটু বুঝতেছি। আগে তো উনাকে দেখছি বন্ধুর বাপ হিসেবে। এখন দেখতেছি বন্ধুর ক্রাশ হিসেবে। দুইটা তো আলাদা!’
বিভা অনেকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘দোস্ত, একটা কথা স্বীকার করতেই হবে উনারে দেখলে বোঝা যায়না যে উনার সামির বয়সী একটা ছেলে আছে।’
হৃদি অপরাধীর গলায় বলল, ‘আরেকটু কূটনামি করি?’
—‘কর। অল্প, বেশি না কিন্তু!’
—‘ওর বৌকে ওর থেকে বয়স্ক লাগে।’
—‘ঠিকই বলছিস। আগে কখনো সেভাবে খেয়াল করিনাই, তবে আজকে মনে হচ্ছে, আসলে উনি… থাক দোস্ত কিছু বলব না। আমার শ্বশুর হইলেও হইতে পারত।’
হৃদি মিনমিন করে বলল ‘ফ্রেন্ডের বাপরে আবার কেউ অত খেয়াল করে নাকি? কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ব্যাটা দেখতে জোশ!’
—‘থাক এসব বলিস না। সামির সাথে তোর বিয়ে হইলে ব্যাটা তোর শ্বশুর হবে।’ বিভা বলল সতর্ক ভাবে।
—‘হইলে হবে। তাতে কী? শ্বশুরের প্রশংসা করতে পারব না? আর তাছাড়া সামি বিয়ে করতে যাচ্ছে ওই তানিশা নামের উইকেড হুইচকে। আমার সাথে ওর বিয়ে হবেনা।
—‘মনে রাখিস অমৃতাকে কিন্তু কোন ভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা। ওর সামনে এই ব্যাপারটা নিয়ে কোন কথাই তুলবিনা। আরেকটা ব্যাপার কি জানিস? অমৃতা শুধু চেহারা দেখে পাগল হয়নায়।
—‘তাহলে কী দেখেছে? টাকা?’
—‘আরেনা, লোকটা বুদ্ধিমান এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। আমার জানা মতে অসম্ভব কাজ পাগল একজন মানুষ। অমৃতাও কাজপাগল, জানিসই তো।’
—‘পছন্দ হইলেই তো হবেনা। লোকটার বৌ আছে। ছেলে আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা উনার ছেলে অমৃতার বন্ধু। তাও যেন তেন বন্ধু না। খুব কাছের বন্ধু।’
—‘সেটাই, ধুর, এই জিনিসটা মাথায় আসলে আমার আর কিছুই ভালো লাগেনা জানিস? একবার চিন্তা কর তোর বাবার সাথে যদি এরকম হত?’
কথাটা শুনে হৃদি খিলখিল করে হেসে উঠল, ‘আমার টাক্কু ভুঁড়ি ওয়ালা বাবা, আর অমৃতা? আল্লাহ!’
—‘আরেনা, অমৃতা হবে কেন? ধর অন্য কেউ। যদি কেউ একজন হুট্ করে এসে তোদের ফ্যামিলিতে অশান্তি করে তখন তোর কেমন লাগবে?’
—‘কেমন লাগবে আবার, মেরে ফেলব একদম।’
—‘সেটাই, অমৃতাকে বোঝাতে হবে। এখানে আসার পর ওর চেহারা দেখছিস? কী রকম আপসেট হয়ে আছে?’
—‘দেখছি রে, আমার তো কেমন খারাপ লাগতেছিলো ওকে দেখে। এই পর্যায়ে আকাশ অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, ‘তোরা কী ফিসফাস করতেছিস সেই তখন থেকে?’
বিভা আর হৃদিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, রুদ্র প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলল, ‘খাওয়া দিচ্ছেনা কেন? মনটা সেই তখন থেকে খাই খাই করতেছে।
—‘রাক্ষসদের মন সব সময়ই খাই খাই করে। তাদের শুধু পেটের খিদা না, মনেরও খিদা থাকে।’ হৃদি বলল ত্যাড়া গলায়।
রুদ্র খোঁটাটা পাত্তা না দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা স্ন্যাক্স গুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীর ভাবে বলতে লাগল, ‘কী খাই?কী খাই? কীইইই খাই? কীইই যে খাই!’
তাকে দেখে মনে হল সে কী খাবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়াটা এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আকাশ এদিক সেদিক তাকিয়ে রস টইটম্বুর কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের পাখিগুলা কই মামা?’
রুদ্রর ও যেন হঠাৎ মনে পড়ল, ‘আসলেই তো কই গেলো পক্ষী গুলা?’ বোঝা গেলো ওরা তানিশার বান্ধবী দুজনকেই পক্ষী বলে সম্বোধন করছে।
—‘আচ্ছা তোদের প্রব্লেমটা কী হ্যাঁ? মাইয়া দেখলেই খালি লুইচ্চামি করিস কেন?’ হৃদি বলল ক্যাটক্যাট করে।
—‘লুইচ্চামির কী আছে আজিব! তুই দেখছিস মেয়ে দুইটারে? কী ফিগার মামা!’ চোখ গোল করে রুদ্র বলল।
আকাশ রুদ্রর কথায় তাল মিলিয়ে বলল, ‘আসলেই! সাইজ দেখছিস তুই? সেই রকম…’
হাত টাত নেড়ে আকাশ আরো কী কী যেন বলতে যাচ্ছিল। বিভা একটা খ্যাঁক দিয়ে উঠে বলল, ‘চুপ থাক, ফাজিলের গাছ! এতো খারররাফ নজর তোদের। ছিঃ ছিঃ ছিঃ তোরা আসলে মানুষ না, তোরা হচ্ছিস লুনুষ।’
—‘সেটা আবার কী?’
বিভা খুব গম্ভীর ভাবে বলল-’লুইচ্চা মানুষদেরকে বলা হয় লুনুষ। লুইচ্চা প্লাস মানুষ ইকুয়েল টু লুনুষ।’
শুনে বন্ধুরা সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
৩২
ড্রইং রুমে এ মুহূর্তে তেমন কেউ নেই। অতিথিরা সবাই লনে। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে মেয়ে ছুটোছুটি করে খেলছে সারা ঘরময়। অমৃতা চুপ করে বসে আছে সোফার ওপর। চোখ দুটি শূন্যে রাখা। নীড় নষ্ট হয়ে যাওয়া পাখির মতো অসহায় সেই চোখের দৃষ্টি। অনেক ক্ষণ যাবৎ তীক্ষ্ণ কাঁটার মত কী যেন একটা লেগে আছে বুকে। প্রতিবার নিশ্বাস নেবার সময় সেই কাঁটাটা বিঁধছে হৃদযন্ত্রে। কষ্ট হচ্ছে!
পৃথিবীটা এমন অদ্ভুত কেন? কেন যে যাকে চায়, তাকে পায়না? আবার যাকে পায়, তাকে চায়না? চাওয়া আর পাওয়া এ দুইয়ের সমন্বয় ঘটানো কি এতটাই কঠিন ব্যাপার? অমৃতা তো বোকা নয়, অবিবেচক নয়, অশিক্ষিতও নয়, তবু কেন সে তার মনকে বশে আনতে পারছেনা? এখানে আসার পর থেকে লোকটা একটাবারের জন্যেও তার চোখে চোখে তাকায়নি। অমৃতাকে যেন তিনি চেনেনই না। এমনকি গতকাল রাতে লোকটা তার ফোন ও রিসিভ করেননি। পাখিগুলোর জন্য একটা ধন্যবাদ দিতে চেয়েছিল শুধু সে। সেই সুযোগটা পাওয়াই গেল না শেষ পর্যন্ত। ভোর পর্যন্ত জেগেছিল অমৃতা। নিশাচর শ্বাপদের মতো নিশ্ছিদ্র অপেক্ষা তাকে এক মুহূর্তের জন্য ঘুমাতে দেয়নি। একটা ফোনের অপেক্ষা করেছিল সে সারা রাত। কিন্তু ফোন আর আসেনি। এমন কি কোন মেসেজও না। ভোর হওয়া খুব একটা দেখা হয়না। গতকাল সে ভোর হওয়া দেখল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দেখল উদিত সূর্যের বিপরীতে উড়ে যাওয়া পাখিদের ঝাঁক। দেখল পূবের আকাশে দিনমণির বর্ণাঢ্য, স্নিগ্ধ আগমন। তারপর সেইদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে পারল যে, আসলে প্রয়োজন ছাড়া মানুষটা তাকে কোন দিন ফোন দেয়নি, দেবেও না। তাঁর ছেলে বাড়ি ফিরে আসছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। এখন অমৃতাকে তাঁর আর প্রয়োজন নেই। হৃদযন্ত্রে বিঁধে থাকা কাঁটার সূচাল মাথায় ঘর্ষণ খেয়ে একটি রক্তাক্ত দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসল তার বুক চিরে। আসলে কী, সবার জীবনে ভালোবাসা আশীর্বাদ হয়ে আসে না। কারো কারো জীবনে আসে অভিশাপ হয়ে!
৩৮১
দামী কার্পেট মোড়া মেঝের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে অমৃতা ভাবছিল যে, লোকে বলে ভালোবাসা নাকি এক মন থেকে অন্য মনে উড়ে চলে যায়। এটাই ভালোবাসার অলৌকিক শক্তি। যদি তাই হয় তাহলে লোকটা কেন বোঝে না যে অমৃতা তাকে কতটা চায়? তার বুকের ভেতরের ভালোবাসা কেন চুম্বকের মতো মানুষটাকে টেনে আনে না কাছে?
—‘তুমি ঠিক আছ?’ হঠাৎ কানে এসে লাগা প্রশ্নটা ধরাধামে ফিরিয়ে আনল অমৃতাকে। ঘোর লাগা চোখ মেলে তাকাল সামনে। চকিতে তার নিষ্প্রভ চোখের তারা দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কয়েকটা দমবন্ধ করা, উদ্বেল মুহূর্ত কাটার পর অমৃতা কোনও রকমে বলতে পারল, ‘আমি ঠিক আছি।’
,
—‘ইউ লুক অ’ফুলি পেইল।’
—‘ডু আই?’
—‘ইয়েস ইউ ডু!’
তিনি সামনে এসে দাঁড়াতেই একটি অভ্রভেদী কুহকী ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে যাচ্ছিল চারপাশে। অমৃতার মাথায় চট করে একটা লাইন চলে আসল, Meeting you wasn’t a coincidence, it was a miracle! হ্যাঁ মিরাকেলই তো! এইযে তাঁকে দেখামাত্র অমৃতার বুকের ভেতর একটা শিরশিরে অনুভূতির সৃষ্টি হয়, চট করে রং পাল্টে ফেলে পৃথিবী, সেটাও একটা মিরাকেল। মিনিট না গড়াতেই বাড়ির ভেতর হুড়মুড়িয়ে এক গাদা লোকজন ঢুকে গেল। মাত্র প্রবেশ করা দলটার মধ্যে দুজন মাত্র নারী। বাদ বাকি সবাই পুরুষ। এদের মধ্যে আছেন দেশের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথিতযশা ভদ্রলোক। খবরের কাগজে এবং টিভির পর্দায় এদেরকে প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। একজন ভদ্রলোককে তো অমৃতা বেশ ভালোভাবে চেনে। তিনি সুপ্রিম কোর্টের এপেলেট ডিভিশনের জাস্টিস। একবার সে তার সিনিয়রের সাথে গিয়েছিল এই জাস্টিসের চেম্বারে একটি আপিল বিভাগের মামলার ব্যাপারে পরামর্শ করতে। অতিথিরা ভেতরে ঢুকতেই হক সাহেব তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। অমৃতা উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। বোঝা যাচ্ছে এই দলটা হকের দাপ্তরিক লোকজনে ঠাসা। অমৃতার আর এখানে থাকা মানায় না। অনিচ্ছাসত্বেও সে প্রস্থানোদ্যত হয়ে পা বাড়িয়েছিল। হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর তার নাম ধরে ডেকে ওঠায় থেমে যেতে হল তাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ইউনিভার্সিটির এক চেনা বড় ভাই।
—‘আরে, তুর্য ভাইয়া! আপনি এখানে?’
৩৮২
—‘আমারও তো একই প্রশ্ন, তুমি এখানে কী কর? -’এটাতো আমার ফ্রেন্ডের বাসা।’
—‘তাই নাকি?’
—হ্যাঁ, কিন্তু আপনি?’
—
—‘আমি তো এই বাড়ির মালিকের কোম্পানিতে জব করি। ল অফিসার।’
—‘ও তাই? আপনি কোম্পানি ল নিয়ে কাজ করছেন জানতাম না তো!’
—‘খুব বেশি দিন হয়নি জয়েন করেছি। আমি এসেছিলাম স্যারের কাছে একটা কাজে। একটা কন্ট্রাক্ট পেপারে উনার সাইন দরকার ছিল। এসে দেখি পার্টি হচ্ছে। স্যার বললেন খাওয়া দাওয়া করে যেতে।’
—‘গ্রেট! নাইস টু সি ইউ ভাইয়া।’
—‘তোমার খবর কী? যাচ্ছ কোথায়? বসো, বসো, কথাবার্তা বলি। কত দিন পর দেখা!’
অমৃতা আড়চোখে হককে একবার দেখে নিল। তিনি পায়ের ওপর পা তুলে বসে অতিথিদের সাথে কথা বলছেন। অমৃতাও বসে পড়ল টুপ করে তুর্যর পাশে। এমনিতেও যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। ভাগ্যিস তুর্যর সাথে দেখা হয়ে গেল!
টাক মাথার একজন ভদ্রলোক বেশ উঁচু গলায় কথা বলছিলেন। বোঝা যাচ্ছে তিনি সরকার পক্ষের লোক। এই মজলিশ অবশ্য খুব স্বাভাবিক ভাবেই সরকারি আমলাদের উপস্থিতিতে ঠাসা। টাক মাথা ভদ্রলোক কথা বলছেন ভাষণ দেবার ভঙ্গিতে। নানা ভাবে তিনি সরকারের প্রশংসা করে যাচ্ছেন। অমৃতা কোন দল করেনা। কিন্তু এক তরফা প্রশংসা তার কখনওই মনঃপূত হয়না। ভদ্রলোক কথা বলছেন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে। রোহিঙ্গা সংকট সরকার কী চমৎকার ভাবে সামলে নিয়েছে এবং নিচ্ছে এই বিষয়টিই তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে প্রকাশ করতে চাইছেন। উপস্থিত সকলে চুপচাপ তার কথা শুনছে। কয়েকজনের চেহারায় দ্বিমতের আভাস ফুটে উঠেছে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলছেনা। অমৃতা বরাবরই খোলামেলা কথা বলতে ভালোবাসে। কারো ভালো লাগুক আর না লাগুক, নিজের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সে কোনদিন পিছপা হয়না। আজকে এত বয়স্ক জ্ঞানী-গুণী লোকের সভায় চট করে মুখ খোলাটা ঠিক হবে কিনা ভাবছিল সে। কিন্তু ভাবতে পারল না খুব বেশিক্ষণ, তার আগেই ঠোঁটকাটা মুখটা আগ বাড়িয়ে বলে উঠল, ‘দেখুন, গরীব দেশ হয়েও শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক
৩৮৩
ভাবে হয়ত বাংলাদেশ বেশ কিছু প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছে, কিন্তু আমি বলব এই বিষয়ে সরকার একটি ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আরো স্ট্রং রুলস এন্ড রেগুলেশন দরকার ছিল।’
অমৃতার পরিষ্কার স্বরের দৃঢ় মন্তব্যটি ঘরভর্তি লোকজনের দৃষ্টি কাড়ল। টেকো ভদ্রলোক ঘুরে তাকালেন তার দিকে। এতক্ষণ ভিড়ের মাঝে তিনি এই তরুণী মেয়েটিকে একেবারেই লক্ষ্য করেন নি। কয়েক সেকেন্ড সরু চোখে অমৃতার দিকে চেয়ে থেকে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ত্রুটিযুক্ত পরিকল্পনা বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাইলেন আপনি?’
অমৃতা একটু কেশে নিয়ে বলল, ‘শরণার্থীদের শুরুতেই নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়নি কেন? এর সুযোগ নিয়ে তো অনেক রোহিঙ্গাই সাধারণ জনগণের সাথে মিশে গেছে। একটা দেশ এথনিক ক্লিনজিং করছে, সেই দায়ভার সম্পূর্ণটা আমাদের ঘাড়ে এসে কেন পড়বে? এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর দিকে একবার চোখ মেলে তাকান, এরা আসলে কারা? মায়ানমার এদেরকে জাতিগত ভাবে কোন স্বীকৃতি দেয়নি। এদের পাসপোর্ট নেই, শিক্ষা নেই। এরা খুব ভালো মতো জানে যে বাংলাদেশটা এদের নিজের দেশ নয়। ইতোমধ্যেই স্থানীয়দের সাথে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক তেমন ভালো না। ভালো হবার কোন চান্সও নেই। হ্যাঁ মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি কঠোর পরিকল্পনার আশ্রয় নেয়া উচিত ছিল। এখন যেভাবে বিষয়টা চলছে, এতে মনে হচ্ছে এই বিশাল জনগোষ্ঠী দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি হুমকি বৈ কিছুইনা। লাভের মধ্যে লাভ যা হয়েছে বিদেশী মুদ্রা আসছে দেশে সমানে। এটাই একমাত্র বেনিফিট বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।’
অন্য কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হক বললেন, ‘তাহলে এই বড়সড় জনগোষ্ঠী নিয়ে কী করা উচিৎ ছিল বলে তোমার মনে হয়? কেটে ভাসিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল জলে? নাকি হিটলারের মতো গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলা উচিৎ ছিল?’
হুট করে এই মানুষটাকে কথা বলে উঠতে দেখে অমৃতা একটু ভড়কে গেল এবং প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করল যে, সে মনে হয় মানুষটাকে একটু একটু ভয় পায়। নইলে অমন করে বুক কাঁপল কেন লোকটার প্রশ্ন শুনে? সে একটু মিন মিন করে বলল, ‘না, তা কেন হবে? আমি বলতে চাইছি পলিসিটা আরেকটু স্ট্রিক্ট হওয়া উচিৎ ছিল। যে সমস্যা গুলোর মুখোমুখি এখন হতে হচ্ছে সেগুলোর প্রিকশন নেয়া উচিৎ ছিল আগে
থেকেই। শরণার্থী শিবিরের অবস্থা তো বড়ই করুণ। যে শিশু গুলো ওখানে বেড়ে উঠছে তাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছেনা ঠিক মত।’
হক বললেন, ‘হ্যাঁ, অসংখ্য নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ মানবতার খাতিরে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে তোমাদের জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের তো গর্বিত হওয়া উচিৎ। মাত্র কিছুদিনের মধ্যে যখন কোন দেশে অন্য দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ গিয়ে উপস্থিত হয় তখন সেই পরিস্থিতি তাৎক্ষণিক ভাবে সামলে ওঠা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। একাত্তরে এ দেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি। তার মধ্যে অসংখ্য মানুষ বর্ডার ক্রস করে পাশের দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সীমান্ত অতিক্রম করেও কিন্তু সেইসব মানুষেরা ভালো ছিল না। ভারতের পক্ষে সেই বিশাল জনগোষ্ঠীকে লালন পালন করাটা বেশ কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পশ্চিম বাংলার শরণার্থী শিবিরের করুণ অবস্থা দেখে মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ লিখেছিলেন সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। রোহিঙ্গা ক্রাইসিস একাত্তরের ক্রাইসিসের তুলনায় কিছুইনা। যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের জীবনে কী দুর্যোগটা নেমে আসে তা বাঙালি জাতির চাইতে ভালো করে মনে হয় কেউ জানেনা। আমরা ভুক্তভোগী। এরপরেও তুমি বলছ নিরীহ মানুষগুলোকে আশ্রয় না দেয়াটাই হতো বুদ্ধিমানের কাজ? আমাদের প্রধান মন্ত্রী বলেছেন প্রয়োজনে আমরা খাদ্য ভাগ করে খাবো। একজন দেশপ্রধানের মুখে কিন্তু এরকম কথাই মানায়!
—‘আপনি ভুল বুঝছেন মিস্টার হক, আমি একবারও বলিনি আশ্ৰয় দেয়াটা উচিৎ হয়নি। আমি বলেছি রুলস এন্ড রেগুলেশনের কথা। আর তাছাড়া একাত্তরের শরণার্থীদের অনেকেই দেশে ফিরে এসেছে। এদের কিন্তু ফিরে যাবার কোন চান্স নেই।’
—‘মানবিকতার কোনো রুল, রেগুলেশন হয় না অমৃতা। পররাষ্ট্র মন্ত্রী তো বলেছিলেন বাংলাদেশ শরণার্থী কনভেনশনে সাক্ষর করা কোন দেশ নয়। তাই বাংলাদেশের কোন দায় নেই। তুমি কি তাঁর এই কথাটা সমর্থন কর? দেখবে কাশ্মীরি মুসলিমদের জন্য যে আন্দোলন হবে সেটা রোহিঙ্গাদের জন্য হবেনা। কারণ রোহিঙ্গাদের জন্য তো জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। স্বার্থে যখন টান পড়ে তখন ধর্মের সূতাও ঢিলা হয়ে যায়।’
অমৃতা একটু ধীরস্বরে বলল,’যেকোনো উপায়ে ওদেরকে নিজের দেশে ফেরৎ পাঠাতে হবে। এটাই একমাত্র সমাধান।’
বৃষ্টি মহল (২)-২৫
৩৮৫
—‘ফেরৎ পাঠানোর চেষ্টা তো করা হচ্ছে। মায়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে নানা ভাবে। আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত বিষয়টা গড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।’
টেকোভদ্রলোক এতক্ষণে কথা বললেন, ‘আসলে এটা ভীষণ কন্ট্রোভার্শিয়াল একটা ইস্যু। একেকজন একেকরকম মতামত দিচ্ছে। কিন্তু ইয়াং লেডি তোমার কথাবার্তা আমার পছন্দ হয়েছে। তোমার পরিচয়টা কী বল তো?’
অমৃতা হাসি মুখে নিজের সম্পর্কে বলল, সংক্ষেপে যতটুকু বলা যায়।
ভদ্রলোক পরনের কোটের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে নিজের একটা কার্ড এগিয়ে দিলেন অমৃতার দিকে। বললেন, ‘আমি ইউ এন ডিপি তে আছি। তুমি আমার সাথে দেখা করো তো সময় করে। তোমাদের মত শার্প ছেলেমেয়ে খুব দরকার, বুঝলে?’
অমৃতা খুশি হয়ে কার্ডটা হাতে নিল। তাকাল একবার হকের দিকে গর্বিত চোখে। হক কিছু বললেন না। গম্ভীর ভাবে ঠোঁট টিপলেন শুধু একবার। রাজনৈতিক আলাপ আরো অনেকক্ষণ অবধি চলল। পুরুষালি বেশভূষার বিচক্ষণ, স্মার্ট তরুণীটি খানিক বাদে বাদে স্পষ্ট বক্তব্য পেশ করে সবাইকে চমকে দিচ্ছিল। এই মজলিশে সে সর্ব কনিষ্ঠা। কিন্তু তার আচার আচরণ এবং কথাবার্তা অতিশয় পরিপক্ক, সুশীল এবং সপ্রতিভ। তবে আলোচনায় তার উৎসাহে ভাটা পড়লো তখন, যখন রোমেলা হঠাৎ উপস্থিত হয়ে ঘর ভর্তি মানুষের সামনে তার স্বামীকে বললেন, ‘এইযে, একটু শুনবে?
হক অতিথিদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে উঠলেন। স্ত্রীর পেছন পেছন পাশের ঘরে হেঁটে গেলেন।
অমৃতা ম্লান চোখ মেলে নিঃশব্দে চেয়ে দেখল সেই চলে যাওয়া। নিজেকে সে এতকাল প্রখর যুক্তিবাদী হিসেবেই জানত। অথচ আজ এক অনির্বচনীয় মহাপাতক অনুভূতির দৌরাত্ম্য তার যুক্তিবাদী মনটাকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বানিয়ে ছাড়ছে।
খাওয়া দাওয়ার পালা নির্বিঘ্নেই সমাপ্ত হল। ঠিক হল রাতে সব বন্ধুরা এই বাড়িতেই থাকবে। সামির আম্মার অনুরোধেই থাকার সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়েছে। বৌয়ের বাড়িতে যেসব তত্ত্বব পাঠানো হবে সেগুলো গোছগাছ করার জন্য নাকি সাহায্য দরকার। হঠাৎ কী কারণে সামির আম্মা, পুত্রের
৩৮৬
বন্ধুদের ব্যাপারে এতটা সদয় হয়ে উঠলেন তার কারণ নির্ণয় করা কিছুটা কঠিন। তবে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তিনি অল্প বিস্তর বুঝতে পেরেছেন যে সামির জীবনে তার বন্ধুদের ভূমিকা বা দখল কতখানি। তাই তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন ছেলের মন জুগিয়ে চলার।
খাওয়া দাওয়ার পর ছাদের ওপর, পুল সাইডের পাশে ঘাসের ওপর বসেছিল ওরা। শীত শীত আমেজটা ভালো লাগছিল সবার।
তানিশা হঠাৎ উপস্থিত হল জায়গাটায়। এসেই খুব জরুরি গলায় সামিকে বলল, ‘আমি যাচ্ছি। তুমি কি একটু আসবে আমার সাথে? নাকি বন্ধুদের সাথে বসে থাকবে এখানে?’
সামি তানিশার ওই আগুন গরম কথায় একটু ভড়কে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে থতমত খেয়ে বলল, ‘হ্যাঁ আসছি।’
নিচে নেমে আসল ওরা। গাড়িতে উঠতে যাবার আগ মুহূর্তে বেশ একটু উত্তেজিত ভাবে তানিশা সামিকে বলল,’শোনো, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?’
সামি একটু বিব্রত ভাবে বলল, ‘কী প্রশ্ন?’
—‘তুমি কি এভরি নাইট হৃদির সাথে ফোনে কথা বল?’
সামি বিস্মিত গলায় বলল, ‘এটার মানে কী?’
—‘মানে হচ্ছে, আমি প্রায়ই তোমার ফোন ওয়েটিং এ পাই। জিজ্ঞাসা করলে বল যে, ফ্রেন্ডের সাথে সাথে কথা বলি। নাও আই ওয়ান্ট টু নো, যে সেই ফ্রেন্ড টা কে? হৃদি নাকি বিভা?’
—‘তোমার সমস্যাটা কী? আমি কোন ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলি সেই কৈফিয়ৎ তোমাকে দিতে হবে?’
—‘নিশ্চয়ই হবে।’
—‘যদি না দেই?’
—‘না দিলে…’ তানিশাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখায় এক মুহূর্তের জন্য। বড় করে শ্বাস নেয় সে একটা। তারপর দৃঢ় গলায় বলে, ‘না দিলে আমি তোমাকে বিয়ে করব না।’
—‘হোয়াট দ্যা ফাক
—‘শুনো সামি, হৃদির সাথে গভীর রাতে তুমি ফোনে কথা বলতে পারবা না।
সামির চোখের তারায় প্রথমে ফুটে উঠল সীমাহীন বিস্ময়। এরপর তার মুখখানা তীব্র এক রোষের ঝংকারে আলোড়িত হয়ে উঠল। সিংহের ন্যায় গর্জে উঠে বলল, ‘কী বললা তুমি?’
৩৮৭
—‘তুমি হৃদির সাথে রাতের বেলা ফোনে কথা বলতে পারবা না। এটাই আমার শেষ কথা।’ এটুকু বলে তানিশা আর একটা মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না। চট করে উঠে পড়ল গাড়িতে।
সামি বাড়ি ফিরে আসল বিধ্বস্ত অবস্থায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র সে কোন ভয়ংকর ঘটনা প্রত্যক্ষ করে এসেছে কিংবা শুনে এসেছে কোন দুঃসংবাদ। তার বাবা মা দুজনে সদরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন অতিথিকে বিদায় জানাচ্ছিলেন। ছেলের এই উৎসন্ন, সর্বনাশা অবস্থা দেখে তাঁদের আত্মা কেঁপে উঠল। সামির আম্মা ছেলের পেছন পেছন দৌড়ে গেলেন। পেছন থেকে ডাকতে লাগলেন ছেলেকে নাম ধরে। কোনো লাভ হলোনা। একটা বারও পেছন ফিরে তাকালো না ছেলে। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরতলায় নিজের ঘরে ঢুকে গেল। দড়াম করে আটকে দিল দরজাটা মায়ের মুখের ওপরে। তিনি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সমানে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘কী হয়েছে? বাবা দরজাটা খোল! কী হয়েছে আমাকে বল!
প্রতি রাতে হৃদির সাথে ফোনে কথা বলাটাকে কখনো কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হয়নি তার আজ পর্যন্ত। বিভার সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন সময়েও রোজ রাতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও হৃদির সাথে ফোনে কথা হত। প্রয়োজনে নয়, অভ্যাসের খাতিরে। কথা বলতেই হবে এমন কোন তাগিদ কখনো ছিলোনা। বললে চলে, না বললেও চলে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে যেই না তানিশা নিষেধাজ্ঞা জারি করল, যে আজ থেকে হৃদির সাথে রাতের বেলা ফোনে কথা বলা যাবেনা ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে তার মনে হচ্ছে প্ৰতি রাতের ওই অংশটুকু আসলে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ!
না না কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ আসলে তার বন্ধুত্ব। সে বন্ধুদের সাথে রাতের বেলা কথা বলবে, নাকি চাঁদে অথবা মঙ্গলে গিয়ে কথা বলবে সেটা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব ব্যাপার। তানিশা কে এসব নিয়ে কথা বলার? মা তখনও দরজা ধাক্কাচ্ছেন। সামি দরজা খুলল। মায়ের পাশে বাবাও দাঁড়িয়ে আছেন এখন। দরজা খুলতেই ব্যস্ত ভাবে ঘরের ভেতর ঢুকলেন তাঁরা। দুজনের চোখজোড়া উৎকণ্ঠা। রোমেলা ছেলের শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে হাহাকার করে বলে উঠলেন, ‘কী হয়েছে তোমার?’
—‘তানিশা তো আবোল তাবোল কথা বলছে।’ সামি বলল হতাশ ভাবে।
৩৮৮
কথা শুনে বাবা মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। দুদিন বাদে এনগেজমেন্টের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। এখন কি ছেলে বেঁকে বসবে নাকি? রোমেলা নিশ্বাস বন্ধ করে প্রশ্ন করলেন, ‘কী বলেছে?’
—‘সে বলছে আমি নাকি রাতের বেলা হৃদির সাথে ফোনে কথা বলতে পারবোনা।’
বাবা মা পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। ছেলেকে দেখে মনে হচ্ছে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। এতো ক্ষুদ্র একটি ব্যাপারে এমন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক নয়। গোটা একটা মিনিট ধরে বাবা মা দুজন ছেলের মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন। তাঁরা বুঝে পেলেন না যে এ ধরণের পরিস্থিতিতে ছেলেকে ঠিক কী বলা যায়।
হক স্ত্রীর দিকে তাকালেন একবার অসহায় ভাবে। রোমেলাই কথা শুরু
করলেন,
—‘হৃদির সাথে রাতের বেলা ফোনে কথা বলতে বারণ করেছে তো হয়েছে কী? বলবে না। দিনের বেলা বলবে।’
সামি বিস্ফোরিত চোখে তাকাল মায়ের দিকে। হক বললেন,
—‘বাবা শোনো, কোনো মেয়েই তার স্বামীর মেয়ে বন্ধুদেরকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেনা। এটা খুব সিম্পল একটা ব্যাপার। আর তানিশা তো বলেনি তোমাকে তোমার বন্ধুদেরকে ছেড়ে দিতে। সে একটা নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলেছে। আমার মনে হয়না এমন কোনো অযাচিত কিছু সে বলে ফেলেছে।
কথাটা বলে শেষ করে তিনি ছেলের পাশে এসে বসলেন। ছেলের মাথায় একটা হাত রেখে বললেন, ‘একটা সম্পর্কে অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হয় বাবা! মানিয়ে চলার মতো মনটাকে প্রথম থেকেই তৈরী করে নিতে হবে।’
সামি গোঁ ধরা গলায় বলল, ‘আমি কখন আমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলব সেটা আমি ডিসাইড করবো। সে কে এসব নিয়ে কথা বলার?’
,
রোমেলা বললেন, ‘তোমার জীবন নিয়ে কথা বলার শতভাগ অধিকার আছে তোমার স্ত্রীর।’
হক সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে। তাঁর হঠাৎ মনে হচ্ছে ছেলের বিয়ের ব্যাপারে একটু তাড়াহুড়া করা হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন যে তার ছেলে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। বুঝতে পেরে তার মনটা বড়ই অশান্ত হয়ে উঠল। আশ্চর্য হলেও
৩৮৯
সত্য, যে দুশ্চিন্তাটা পেয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অমৃতার কথা মনে পড়ল। মনে হল মেয়েটার সাথে একবার কথা বলতে পারলে ভালো হত। আদতে তার ছেলের মনের মধ্যে চলছে কী? এ ব্যাপারে কি অমৃতা কিছু জানে? সঠিকভাবে কিছু জানাতে না পারলেও, অমৃতার কথাবার্তায় কী যেন একটা আছে। দুশ্চিন্তা কমে যায়। এই প্রথমবারের মতো তাঁর মনে হল, অমৃতাকে ছেলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নয়, বরং নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করবার জন্যেই ভারী দরকার এই মুহূর্তে!
সামি উঠে পড়ল। হঠাৎ তার মনের মধ্যে একটা বিষয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। হৃদি কি তানিশাকে ডুয়ার্সের ঘটনাটা নিয়ে কিছু বলেছে? যদি না বলেই থাকে তাহলে তানিশা হঠাৎ হৃদির পেছনে লাগল কেন? দ্রুত পায়ে সে ছাদের ওপর উঠে আসল। পুল সাইডের পাশে তখনো বসে আছে ওরা। শুধু বন্ধুরাই। আর কেউ নেই। সামি দলটার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটু ভারী গলায় হৃদিকে বলল, ‘আচ্ছা তুই কি তানিশাকে ডুয়ার্সের ঘটনাটা নিয়ে কিছু বলছিস?’
হৃদি হতবাক হয়ে গেল, ‘কেন বলতে যাব? আমারে কি কুত্তায় কামড়াইছে?’
—‘তাহলে তানিশার সমস্যাটা কোন জায়গায়? ও আমারে তোর সাথে ফোনে কথা বলতে মানা করতেছে। বলতেছে আমার চার্জার কেন তোর কাছে থাকবে? ব্লা ব্লা ব্লা, এসবের মানে কী?
হৃদি স্তব্ধীভূত গলায় বলল, ‘আমার সাথে ফোনে কথা বলতে মানা করছে?’
—‘হ্যাঁ, রাত্রে বেলা নাকি তর সাথে ফোনে কথা বলা যাবেনা।’
রুদ্র স্বগতোক্তি করল, ‘খাইছে, বিয়ার আগেই এত নিয়মকানুন। বিয়ার পর কী হবে মামা?’
হৃদির বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। সামির সাথে তাহলে এখন থেকে আর ফোনেও কথা বলা যাবেনা? এত বড় শাস্তি? গলায় স্বাভাবিক ভাব আনার চেষ্টা করে সে বলল, ‘বেশ তো, কথা বলতে নিষেধ করছে তো হইছে কী? কথা বলবিনা!’
সামি ত্যাড়া চোখে তাকায় হৃদির দিকে, ‘কথা বলব না?’
—‘তোর বৌ নিষেধ করছে। ক্যামনে বলবি বল?’
—‘তোর কোনো আপত্তি নাই এ ব্যাপারে?’
৩৯০
হৃদি ঢোঁক গিলে বলল, ‘আমার আবার কিসের আপত্তি। ফোনে কথা বলাটা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।’
—‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না?’ সামি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে
পারছেনা।
—‘না!’ হৃদি বলে মিনমিন করে।
সামিকে কয়েকটা সেকেন্ড কেমন বিভ্রান্ত দেখায়। তারপর, আকস্মিক… খুব আকস্মিক ভাবে সে বিভার দিকে চেয়ে ধারালো কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘তুই জানিস? সব দোষ তোর! সব তোর দোষ!’
কথাটা বলে সে আর দাঁড়ায়না। ঝড়ের বেগে ছুটে বেরিয়ে যায় ছাদ থেকে। তার শেষের বলা কথাটা বন্ধুদের সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তারা থম ধরে বসে রইল প্রত্যেকে। অনেকটা ক্ষণ!
শীত শর্বরীর পেলব নির্জনতা ভেদ করে, বিভার মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল আচমকা। রুদ্রর গাওয়া গান, ‘বৃষ্টিমহল!’
ফোনের স্ক্রিনে অভিজিতের নাম। বিভা মোবাইল হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বন্ধুদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ছাদের রেলিঙে।
—‘হ্যালো!’
—‘বিভাবরী! আছেন কেমন?’
—‘সারাদিনে এই আপনার সময় হল?’
—‘ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম।’
—‘রাতে খেয়েছেন?’
—‘হুম খেলাম তো!’
‘কী রান্না করেছে আজ দূর্গা?’
—‘চিংড়ির চচ্চড়ি, আলুর দম।’
–’বাহ্, বেশ ভালোই তো।’
—‘আপনার কী খবর?’
—‘আমরা এখন সামিদের বাসায়। দুদিন বাদে ওর এনগেজমেন্ট। আন্টি বলেছেন আমাদের আজ রাতটা থাকতে হবে, উনাকে হেল্প করতে হবে মেয়ের তত্ত্বব গোছানোর কাজে।’
—‘তাই?’
—‘হুম। আপনি কবে আসছেন?
৩৯১
—‘কোথায়?’
—‘ঢাকায়?’
—‘আমি আসব কেন? আমি তো নেমন্তন্ন পাইনি।’
বিভা একটু ফ্যাকাশে হাসল, ‘দাওয়াত পেলে আসবেন কি?’
—‘সে ভেবে দেখা যাবে। আগে পেয়ে নিই।’
—‘তা আপনার সব ঠিকঠাক চলছে, তাইনা?’
অভিজিৎ ধীরে ধীরে বলল, ‘ঠিক না থাকলে খুশি হতেন বুঝি?’
—‘না, তা কেন?’
—‘আপনার বন্ধুরা কেমন আছে?’
—‘ভালোই।’
—‘আপনি যে মিশন নিয়ে ঢাকা গেলেন। সেই মিশন তো সাকসেস ফুল হল না।’
—‘সে আশায় গুড়ে বালি! হৃদি তো সামির কাছে কনফেস করবে না। আর সামি এমন গাধার বাচ্চা গাধা, সে বুঝতেই পারছেনা যে সে আসলে হৃদিকেই চায়।’
—‘সে বোঝেনি, আর আপনারা সবাই মিলে বুঝে বসে আছেন। চমৎকার!’
—‘আপনার আমাকে তুমি সম্বোধন করার কথা ছিল।’
অভিজিৎ চুপ। বিভাও চুপ। খানিক দূরে বন্ধুদের দলটায় হাসির হিড়িক লেগেছে। হো হো করে ডাকাতিয়া হাসি হাসছে সবকটা মিলে। অভিজিৎ সেই হাসির শব্দ শুনতে পেয়ে বলল, ‘খুব মজায় আছ দেখছি তোমরা।’
—‘হুম, ঐগুলার আর কোনো কাজ নাই সারাদিন হি হি করা ছাড়া। তুমি চলে আসো। ভালো লাগবে।’
—‘আচ্ছা বিভা, তুমি কি আমাকে মিস করছ?’
বিভা বিষাদ মাখা গলায় বলল, ‘মিস করছি বলেই তো বার বার আসতে বলছি। তুমি কি এটা বোঝোনা?’
—‘আমি আসলে পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারছিনা।’
—‘কী বুঝতে পারছোনা?’
—‘তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এরকম একটা সময়ে তুমি আমাকে মিস করছ? এটা কী করে সম্ভব?’
৩৯২
বিভা এ প্রশ্নের উত্তরটা তাৎক্ষণিক ভাবে দিতে পারল না। এখানে আসবার পর থেকে সে একটা সূক্ষ্ম ব্যাপার খুব ভালো মত টের পাচ্ছে যে, শারীরিক ভাবে কাছে আসা আর মানসিক ভাবে কাছে আসার মধ্যে আসলে বিস্তর তফাৎ। অভিজিতের সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস কালীন সময়ে তারা দুজনে শুধুমাত্র শারীরিক ভাবেই কাছে এসেছিল। মানসিক ভাবে নয়। কিন্তু এত দূরে চলে আসার পর, শরীর যখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেল তখন হাত বাড়িয়ে সে কেবল ওই মানুষটার মনটাকেই ছোঁয়ার চেষ্টা করল। কতটুকু পারল কে জানে! কিন্তু তার মনে হল যেন শারীরিক দূরত্ব কিছুটা হলেও মানসিক দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে।
—চুপ করে আছ যে?’
—‘সামির বিয়েটা আমার মধ্যে কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছেনা।’
—‘এটা মিথ্যে কথা। নিজেকে ধোঁকা দিচ্ছ তুমি বিভাবরী!
—‘মিথ্যে নয়। জানিনা কাল পরশু কী রকম লাগবে, তবে আজ এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার মনে হচ্ছে যে ভগবান যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। এখানে আসবার পর থেকে বন্ধুদের সাথে এবং বাবা মায়ের সাথে খুব ভালো সময় কাটাচ্ছি এ কথা ঠিক। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তোমাকে মনে পড়ছে। এই মনে পড়াটাকে তুমি কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবে জানিনা। এটা যদি মিস করা হয় তাহলে হ্যাঁ, আমি তোমাকে মিস করছি।’
অভিজিৎ চুপ করে থাকে। বিভা বলে, ‘তোমার কি আমাকে মনে পড়ে?’ অভিজিৎ একটা বড় শ্বাস ফেলে, ‘পড়ে!
—‘সেই মনে পড়াটা কি শারীরিক, নাকি মানসিক?’
—‘আমাকে কি তোমার শরীর সর্বস্ব বলে মনে হয়?’
—‘না, তা কেন?’
—‘তাহলে এই প্রশ্নটা কেন করলে?’
—‘বুঝতে চাইছি তোমাকে। বুঝতে চাইছি যে আমার প্রতি তোমার আকর্ষণটা শুধুই ফিজিক্যাল নাকি মনের দিক থেকেও কোন টান আছে।’
—‘মন এবং শরীর তো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, তাইনা? চন্ডীদাসের রজকিনী প্রেম বলতে তো কোন বস্তু আসলে বাস্তব পৃথিবীতে নেই।’
—‘রজকিনী প্রেম কী?’
— চন্ডীদাস বলেছেন, রজকিনী প্রেম, নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়।’
—‘ও বুঝতে পেরেছি। প্লেটোনিক লাভ।’
৩৯৩
—‘হ্যাঁ প্লেটোনিক লাভ। আসলে ওসব ন্যাকামো ছাড়া কিছুইনা। শরীর বর্জিত প্রেম সম্ভব না। আবার মনের প্রভাব না থাকলে রোমান্টিসিজম ব্যাপারটা আসবেনা। রবীন্দ্রনাথই যথার্থ বলেছেন যে, প্রেমের কাছে দেহের অপরূপ রূপ প্রকাশ পায়। লোভের কাছে তার স্থুল মাংস।’
1
বিভা চুপ করে থাকে। অভিজিৎ বলে, ‘এই সবকিছুর বাইরে মানুষের সাথে মানুষের আরেকটি সম্পর্ক আছে, সেই সম্পর্কটা বিশ্বাস, স্বস্তি এবং নির্ভরশীলতার। আমি তোমাকে সেই সম্পর্ক দিয়েই বাঁধতে চাই বিভা এইযে তুমি এতো দূরে তোমার প্রাক্তন প্রেমিকের বাড়িতে গিয়ে সময় কাটাচ্ছ, বিষয়টি ভালো না লাগলেও, এ নিয়ে তোমাকে আমার কিছুই বলার নেই। কারণ আমি জানি, এক সঙ্গে বেঁচে থাকতে হলে তোমাকে বিশ্বাস আমার করতেই হবে। সংসার করার জন্য রোমান্টিকতার চাইতেও বেশি জরুরি হল বোঝাপড়া। বোঝাপড়া থেকেই স্বস্তি আসে, আর স্বস্তি থেকে সুখ।’
বিভা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘এতো কঠিন কঠিন কথা এখন বলতে ভালো লাগছেনা অভি! তুমি চলে আসো। আমার… আমার তোমাকে প্রয়োজন।
অভিজিৎ জানে, বিভা আর যাই করুক না কেন, মিথ্যা কথা বলা তার ধাতে নেই। মনে পড়ে, বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশে এক গ্রীষ্মের দুপুরে একটি অসম্ভব সুন্দর মেয়েকে ময়ূরের মত নাচতে দেখেছিল সে। সেদিন থেকে সেই মেয়েটিকে নিজের করে পাবার এক অদম্য বাসনা চেপে বসেছিল মন গভীরে। সেই মেয়েটা আজকে থেকে তার!
৩৯৪
নিজের বেডরুমে এসে রোমেলা স্বামীকে বললেন, ‘ছেলের মতিগতি তো আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। চিন্তায় আমার মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ তুমি কিছু কর!’
হক গায়ে জড়ানো চাদরটা খুলে চেয়ারের হাতলে রাখলেন। কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে বসলেন চেয়ারে। দুশ্চিন্তায় তার মাথার রগ দপদপ করছে। আগামী কাল বেলা এগারোটায় সংসদে অধিবেশন আছে। বিকেলে আছে আরো দুই জায়গায় সভা। বেশ কিছু কাজ তার আজ রাতের মধ্যে গুছিয়ে নেয়া দরকার। বিশেষ কিছু প্রয়োজনীয় ফোন কল করা দরকার দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে। এসব কিছুই করার মতো মনোবল পাচ্ছেন না তিনি। একটু আগে ফোন এসেছে তার ফুপু আম্মার শরীর বিশেষ ভালো না। ডাক্তার আর মাস চারেকের মতো সময় বেঁধে দিয়েছে। এটি একটি বড় ধরণের দুঃসংবাদ। এই দুঃসংবাদ শোনার পর থেকে তাঁর মনটা অত্যধিক খারাপ হয়ে আছে। তিনি স্ত্রীকে বললেন,
—‘ফুপু আম্মার শরীর ভালো না। ডাক্তার বলেছে সময় খুব একটা নেই হাতে।’
রোমেলা অস্ফুটে বললেন, ‘আহারে! ইশ!’
—‘ফুপু আম্মাকে এই কয়েক মাস আমার বাড়িতেই রাখতে চাই। এ সময় গ্রামে গেলে চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটবে। আগামীকাল হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে।
—‘সামনে আমার ছেলের বিয়ে। এ সময় বাড়িতে একটা অসুস্থ মানুষ এসে পড়ে থাকবে। কেমন লাগে ব্যাপারটা?’
—‘তাহলে কী করা উচিৎ বলে মনে হয় তোমার?’
—‘আমার প্রব্লেম ছিল না। কিন্তু একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। তুমি কি ব্যাপারটা বুঝতে পারছনা?’ এটুকু বলে তিনি একটু থামলেন। পরমুহূর্তেই আবার অধৈর্য ভাবে বলে উঠলেন, ‘কিন্তু আমার ছেলেটার কী
৩৯৫
হবে? নিজের ছেলেটাকে নিয়ে একটু ভাবো, বুঝলে? সারা জীবন তো শুধু মানুষের জন্যেই করে গেলে।’
>
হক একটা প্রলম্বিত নিশ্বাস ফেললেন। এই রমণীটি সংসারের কোন সমস্যাই নিজ উদ্যোগে, নিজ বুদ্ধিতে সমাধান করতে পারেন না। প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি স্বামীর উপর নির্ভরশীল। মাঝে মাঝে তাঁরও তো ইচ্ছে করে মাথার দুশ্চিন্তা গুলো সরিয়ে রেখে অন্য কারো ওপর নির্ভর করতে। ছেলেটিও হয়েছে আস্ত একটা রাম গাধা। ভেবেছিলেন, পড়াশোনা শেষ হলে ব্যবসার কোন একটা দিক ছেলের হাতে তুলে দেবেন। তা করা গেলে অন্তত একটা দিক দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারতেন। ছেলের যে যোগ্যতা নেই তা কিন্তু না। ছেলের মাথা ভালো। প্রপার গাইডনেস পেলে ছেলেটা তাঁর ঠিকই মানুষের মতো মানুষ হত। তিনি খুব অল্প বয়স থেকেই ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটেছেন। ছেলেকে সেভাবে সময় দিতে পারেন নি। মা হিসেবে রোমেলা যদি সঠিক পথ প্রদর্শন করতে পারত, তাহলে আজ এই দিন হয়তো তার দেখতে হতো না।
তিনি স্থির কিন্তু তীক্ষ্ণ ভাবে কিছুক্ষণ রোমেলার দিকে তাকিয়ে থেকে কখনো যা বলেন না, আজ তাই-ই বলে ফেললেন,
—‘আমার কী করার আছে এখানে? তুমি তো মা! খোলামেলা কথা বললেই পারো নিজের ছেলের সাথে। আর এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোমার কি উচিৎ ছিল না, ছেলের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া?’
রোমেলা ঝেঁঝে উঠে বললেন, ‘এখন আমার দোষ?’
—‘দোষ গুণের কথা নয়!’
—‘তাহলে আমাকে কথা শোনাচ্ছ কেন তুমি? তোমার ছেলের ঐসব বন্ধুবান্ধবীর দলটাকে আমি শুরু থেকেই পছন্দ করিনা। এইসব মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ছেলেমেয়েরা মনের মধ্যে নানারকম ধান্ধা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ। কে জানে হৃদি মেয়েটা ইচ্ছে করে কোন ষড়যন্ত্র করছে কিনা! আমার তো সন্দেহ হচ্ছে।’
হক চেয়ারের হাতলে কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন। সামির বন্ধুদের তিনিও খুব একটা পছন্দ করতেন না কোন কালে বরং সব সময় এই দলটা থেকে ছুটে আসার পরামর্শই দিয়ে এসেছেন তিনি নিজ পুত্রকে। কিন্তু ইদানিং তাঁর মনে হয় ওই ছেলেমেয়ে গুলো আর যাই করুক না কেন, সামির কোন ক্ষতি সাধন করা তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবেনা। সামিকে ওরা বাস্তবিকই ভালোবাসে।
৩৯৬
রোমেলা বলতে থাকলেন, ‘ওর বন্ধুগুলা একটার থেকে একটা কিম্ভুত। রুদ্র ছেলেটাকে দেখেছ তুমি? কী রকম পাগলের মতো চুল দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দেখলে আমার গা ঘিনঘিন করে ওঠে। আর আরেকজন তো ছেলে নাকি মেয়ে তা বুঝে ওঠাই মুশকিল। মেয়েমানুষ হয়ে ছেলেদের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। কী অদ্ভুত লাগে দেখতে! আজকে আবার দেখি ড্রইং রুমে পায়ের ওপর পা তুলে বসে সব মুরুব্বিদের সাথে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছে! ভারী বেয়াদব কিন্তু মেয়েটা। আমার একদম পছন্দ না ওই মেয়েটাকে।’
হক একটু বিরক্ত ভঙ্গিতে হাত ঘড়ি দেখলেন। প্রসঙ্গটা তাঁর ভালো লাগছিলো না। বিশেষ করে অমৃতাকে নিয়ে তাঁর স্ত্রীর মাত্র বলা কথা গুলোয় তিনি কোন ভাবেই একমত হতে পারলেন না মনে মনে। বসা থেকে উঠে পড়লেন। কাজ গুলো এখন সেরে না নিলেই নয়।
রোমেলা আর কথা না বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের সাজসজ্জা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি জানেন তাঁর স্বামীর সাথে এখন কোন সাংসারিক আলাপ করা বৃথা। উনাকে এখন কাজে পেয়েছে। এই লোকের একটাই দোষ, কাজ ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না ইনি। কাজ নিয়ে কেমন নেশাড়ু মাতাল হয়ে থাকে সারাটাক্ষণ। মাঝে মাঝে রোমেলার মনে হয় এই মানুষটা যেন অন্য জগতের বাসিন্দা। ধন, সম্পদ, প্রাচুর্য সমস্ত কিছু দিয়েও লোকটা যেন কিছুই আদতে দেয় না তাকে। জীবনের রাস্তায় দুজনে চমৎকার ভাবে পাশাপাশি হেঁটে গেছেন বছরের পর বছর, কিন্তু মনের রাস্তাটা বরাবরই ছিল বড় কুহেলিকা ময়, ঝাপসা! তবে এসব নিয়ে তিনি খুব একটা ভাবেন না। লোকটা একটু অমন ধারাই। তাঁর জীবনের একমাত্র ভালোবাসা হল কাজ, কাজ আর কাজ। সাংসারিক দায়িত্ব পালনে তাঁর কোন কার্পণ্য নেই। স্ত্রী, পুত্রের প্রতি তিনি সর্বদা যত্নশীল। তাদের সাধ আহ্লাদ পূরণে কখনওই কোন কমতি রাখেননি। পরিচিত জনদের মধ্যে অনেকেই রোমেলার কপাল দেখে হিংসে করে। এমন রাজরাণীর নসিব সবার হয় না। তাঁর স্বামী সুদর্শন, সম্পদশালী, খ্যাতিমান এবং পণ্ডিত ব্যক্তি। সবকিছুর এমন চমৎকার কম্বিনেশন কজনের জীবনে থাকে? তাছাড়া লোকটার চরিত্রগত দিক দিয়ে কোন সমস্যা নেই। অনেক সময় অনেক মেয়েরা তাঁর কাছে আসার চেষ্টা করেছে, রোমেলা সে খবর রাখে। কিন্তু তাঁর স্বামীর মেয়েমানুষের বাতিক নেই। এই একটা দিক দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত। ভালোবাসাটা সেরকমভাবে টের পান নি কোনদিন লোকটার প্রতি
৩৯৭
,
এ কথা সত্য, কিন্তু ভরসা আছে ষোল আনা। তবে ভালোবাসা রোমেলার জীবনেও এসেছিল। আবার চলেও গেছে থাক ওসব ভেবে আর কাজ নেই। এক জীবনে সবার সব কিছু মন মতো হয়না। যা গেছে তা একেবারেই গেছে! তিনি তো দিব্যি ভালো আছেন। শুধু ছেলেটার জন্যেই একটা দুশ্চিন্তা বুকের মধ্যে কাঁটার মতো লেগে থাকে সর্বক্ষণ। আল্লাহ তাঁর ছেলেটার একটু সুমতি দিক।
ড্রইং রুমের কার্পেটের ওপর এক গাদা শাড়ি কাপড় বোঝাই করে রাখা হয়েছে। সাথে আছে নানা ধরণের নামি দামি বিদেশী ব্র্যাণ্ডের কসমেটিক্স। হরেক রঙের, হরেক আকারের ডালা কুলায় শাড়ি, সালওয়ার কামিজ, কসমেটিক্স একে একে গুছিয়ে রাখা হবে এখন। যে পরিমাণ জিনিস আছে তাতে মনে হয় পঞ্চাশটার মতো ডালা লেগে যাবে। সামির খালাতো বোন গত সপ্তাহে ইন্ডিয়া থেকে সমস্ত শপিং করে এনেছে। সেই খালাতো বোন নিজে এখন উপস্থিত নেই। জিনিস পত্র বাঁধাই করছে সামির বন্ধুরা। সামিও উপস্থিত আছে। রোমেলা খানিক বাদে বাদে এসে তদারক করে যাচ্ছেন। বন্ধুরা হাসিমুখে কাজ করছে। হৃদিকে শুধু অত্যধিক ম্লান দেখাচ্ছে। তার একটা বড় দোষ হল সে কান্না লুকোতে জানেনা। যেখানে সেখানে, যখন তখন ঝরঝর করে ঝরতে থাকে অশ্রু ধারা। কোন মতেই চোখের জলের লাগাম টেনে ধরতে পারেনা সে। এখন ঝাপসা চোখে কসমেটিকসের ডালায় ইস্কচটেপ লাগাচ্ছে। ছাদের ওপর সামির বলা শেষ কথাটা বুকের পাঁজরে ঠক ঠক করে পেরেক ঠুকে যাচ্ছিল ক্রমাগত। বিভার সব দোষ, এই কথাটা দিয়ে সামি কী বোঝাতে চাইল? প্রথমে মনে হয়েছিল হৃদির সাথে ফোনে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা এসেছে বলেই তার রাগ। কিন্তু সবশেষে বিভার ওপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দেয়া থেকে কি এটাই প্রকাশ পায় না, যে বিভার প্রতি সে এখন অবধি দুর্বল? হ্যাঁ তাই তো! এ কথাতো দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে সামি এখনো বিভাকে, শুধু বিভাকেই ভালোবাসে! হৃদি কোথাও কখনো ছিল না। থাকবেও না!
বসার ঘরে সবার সামনে ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে সে মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। সে ঠিক করল সামির সাথে রাতের বেলা কেন, কোন বেলাতেই সে আর কোন দিন ফোনে কথা বলবেনা। বন্ধু হলেই যে ফোনে কথা বলতে হবে এমন নিয়ম নেই। ফোনে কথা না বলেও বন্ধু হয়ে থাকা যায়।
৩৯৮
হৃদির কান্নাটা সকলের দৃষ্টি কাড়ল। সামি বিরক্ত গলায় বলল, ‘সব সময় এরকম ফিচফিচ কইরা কান্দস ক্যান তুই? এখন ক্যান কানতেছিস?’
আকাশ উঠে এসে হৃদির পাশে বসল। ওর মাথায় একটা হাত রেখে কোমল ভাবে বলল, ‘দোস্ত, কী হইছে তোর? মন খারাপ হইছে কেন? আমাদেরকে বল।’
হৃদি কিছুই বলল না। ঠোঁট কামড়ে কান্না গেলার বৃথা চেষ্টা করল শুধু। অমৃতা বলল- ‘তানিশার কথাটা ওর খারাপ লাগছে। এইজন্যেই কানতেছে।
সামি অসহিষ্ণু গলায় হৃদিকে বলল, ‘আরে আজব, তানিশা বললেই কি আমি তানিশার কথা শুনতেছি নাকি? আমি কি একবারও বলছি যে আমি
তোর সাথে কথা বলা বন্ধ করব?’
—‘তুই কে বলার হ্যাঁ? আমি বলতেছি তুই শুনে রাখ কান খুলে। আজকের পর থেকে আর কখনো তুই আমাকে ফোন দিবিনা। খবরদার! তোর সাথে আমি মরে গেলেও কখনো ফোনে কথা বলব না।’
চিৎকার করে কথাগুলো বলা শেষ করে, আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ঘর ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল হৃদি। সামি পাথর হয়ে গেল। তার মুখখানা কিঞ্চিৎ হা। চোখ বিস্ফোরিত।
বাকি বন্ধুরাও বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কেউ কোনো কথা বলতে পারছিল না। বেশ অনেকটা ক্ষণ পরে সামি দিশাহারা হয়ে স্বগতোক্তি করল, ‘আমি কী করলাম বুঝলাম না। মানে আমার ফল্টটা কী?’ কথাটা বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়াল। মনের সাথে সাথে তার শরীরটাও এখন খারাপ লাগছে। ক্লান্তি আর অবসাদে ভেতরটা বিধ্বস্ত।
হৃদি কেন তার ওপরে রাগ করছে? এখানে তার দোষটা কোথায়? দোষ করেছে তানিশা কিন্তু শাস্তি পাচ্ছে সে। এটা কি ঠিক? নিজের মনে মাথা নাড়ে সামি। কিছু একটা গড়মিল হচ্ছে। হিসাব মিলছেনা। না মেলা হিসেবটা তার স্বস্তি কেঁড়ে নিচ্ছে। হৃদিকে ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছে সে। হৃদি ফোন ধরছেনা। এ বাড়িটা এতো বড় যে, এর সীমানার ভেতরে গা ঢাকা দিয়ে থাকা খুব সহজ। হৃদি কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে আল্লাহ জানে! সামি নিজের মনে বিড়বিড় করে, ‘আশ্চর্য মেয়েতো! উধাও হয়ে গেল নাকি?’
এরপর দিশাহারা হয়ে সারা বাড়িময় পাগলের মতো খুঁজতে লাগল সামি সেই আশ্চর্য মেয়েটাকে
৩৯৯
রোমেলা এক বস্তা কাপড় চোপড় নিয়ে উপস্থিত হলেন ঘরের ভেতর। বস্তা থেকে শাড়ি বের করতে করতে বললেন, ‘মেয়েরা শাড়ি বেছে নাও তোমাদের পছন্দ মতো।’
অমৃতা তো শাড়ি পরেনা। আর হৃদি এখানে উপস্থিত নেই। তাই বিভাই এগিয়ে এলো। মনোযোগ দিয়ে শাড়ি বাছতে লাগল। বাছতে বাছতে অমৃতাকে বলল, ‘অমৃতা, সামির এনগেজমেন্ট উপলক্ষে তুই একটা শাড়ি পর।’
অমৃতা হাসে, ‘মাথা খারাপ!’
সামির আম্মা বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার জন্যেও একটা শাড়ি রেখেছি আমি। বেছে নাও। তুমি না পরলে তোমার মা কিংবা বোনকে দিয়ে দিও। আমার তরফ থেকে উপহার।’
রোমেলার হাসি মুখের মিঠা কথা শুনে কেউ ধারণাও করতে পারবেনা একটু আগে তিনি নিজের বেডরুমে বসে এই মেয়েটিকে নিয়ে কতটা কঠোর সমালোচনা করেছেন। অমৃতার অবশ্য এসব কিছুতেই মন লাগছিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিলো যে এতো কাছে থেকেও একটা মানুষ কী করে এতটা দূরের হতে পারে! সে জানে ওপরতলাতেই তিনি আছেন। চাইলে এক ছুটে দৌড়ে চলে যেতে পারে সে মানুষটার কাছে। কিন্তু দুজনের মাঝখানে এতো বড় অদৃশ্য এক সীমানা কাটা আছে যে, হাজার চাইলেও সেই সীমানা অতিক্রম করা সম্ভব না। থেকে থেকে সে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। এমনই অন্যমনস্ক যে নিজের কাজের কথাও ভুলে যাচ্ছিল বারংবার। কাল বেলা তিনটায় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের মুট কোর্ট ক্লাবে যেতে হবে। সেখানে একটা প্রেজেন্টেশন আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে টানা পাঁচটা বছর সে নিয়মিত মুটার ছিল। একবার আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিজয়ী হয়ে এসেছে। এখনো ক্লাব থেকে প্রায়ই ডাক পড়ে নানা সেমিনারে কিংবা প্রতিযোগিতায়। কালকের প্রেজেন্টেশনের জন্য তার প্রস্তুতি প্রয়োজন। সকালে কোর্টে যেতে হবে অতএব সকাল বেলা প্রস্তুতি নেবার
কোন সময় পাওয়া যাবেনা।
দেখা গেল ছেলেদের জন্যেও আছে পাঞ্জাবি। রুদ্র আর আকাশকে বলা হল পাঞ্জাবি পছন্দ করে নিতে। কিন্তু পাঞ্জাবির দিকে তাদেরকে সেরকম মনোযোগ দিতে দেখা গেল না। ওদের ভাবসাব দেখে মনে হল পাঞ্জাবি পছন্দ করার চাইতে ডালা প্যাকিং করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক।
অমৃতা দীপার জন্য একটা শাড়ি বেছে নিল। সাদা নেটের ওপর সোনালী এমব্রয়ডারি কাজ করা। দিপাকে এক্ষুণি সে শাড়িটার ছবি তুলে
800
পাঠাবে। ছবি দেখেই দীপা খুশিতে বানভাসি হয়ে যাবে। ছবি তোলার জন্য পকেট হাতড়ে মোবাইলটা বের করতে গেল সে। কিন্তু মোবাইল সেখানে নেই। খুব সম্ভবত পাশের ঘরে ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে এসেছে। শাড়িটা বুকে জড়িয়ে ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। ড্রইং রুম থেকে বেরোতেই সদর দরজার সামনে মানুষটার মুখোমুখি পড়ে গেল, দৈবাৎ! হৃৎপিণ্ড খামচে ধরল কে যেন। এক মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস গেল আটকে
—‘হাই!’
—‘হ্যালো।’ হাসলেন তিনি।
—‘কোথায় যাচ্ছেন?’
—‘যাচ্ছি আমার লাইব্রেরীতে। একটা কাজে। তুমি আমার লাইব্রেরীটা দেখেছ কখনো?’
—‘না!’
—‘চাইলে আসতে পার।
বুকের সাথে দুহাত দিয়ে শাড়িটা জড়িয়ে ধরে রেখে অমৃতা আগ পিছ কিছু চিন্তা না করেই পা বাড়ায় সামনে। সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনো কিশোরীর মতো অকারণ উচ্ছবাসে উথলে উঠে ঘোর লাগা গলায় বলে, ‘চলুন!’
৩৩
‘অনেক কাজ করছি। আর না!’ কথাটা বলে রুদ্র গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘাড়ের ওপর ছড়িয়ে থাকা আউল বাউল চুলগুলো হাত দিয়ে সুবিন্যস্ত করার চেষ্টা করল। তারপর গোমড়া মুখে বলল, ‘এখন কিছু খাওয়া দরকার।’
—‘কীসের কাজ শেষ? আরো কত কিছু পইড়া আছে দ্যাখোস না?’ ঝেঁঝে উঠল বিভা।
রুদ্র মুখে গম্ভীর ভাবটা বজায় রেখেই আদেশ দিল, ‘ঐগুলা সবাই ভাগাভাগি কইরা বাড়িত নিয়া যা।’
আকাশ সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, চোখ বড় করে বলল, ‘নট আ ব্যাড আইডিয়া!’
—‘এসব কথা বলিস না, পরে সামির আম্মা তোদের চোর বলবে।’ অনেকটা ফিসফিস করে বলল বিভা।
—‘বললেই কী? এতক্ষণ এত কিছু গুছায় দিলাম এখন এই কয়টা জিনিস আমরা ভাগা ভাগি কইরা নিতেই পারি। তবে সব তো মাইয়াদের জিনিস আমাদের তো নেয়ার মত কিসু নাই।’
আকাশ বলল, ‘নিয়া নে, মনীষারে গিফট কইরা দিস।’
বিভা একটা মাঝারি আকারের ডালায় তখন পান সাজাচ্ছিল। আকাশের কথাটা শুনে হাতের কাজ থামিয়ে সে নাক কুঁচকে বলল,’তোদের এই অবস্থা কেন? এতদিন মেয়ে দেখলে লুনুষগিরি করছস। এখন মেয়েদের জিনিস দেইখাও লুনুষগিরি করতেছস। প্রব্লেম কী?’
রুদ্র বিভার কথা পাত্তা দিলোনা, খুব করুণ ভাবে বলল, ‘খাওয়া দরকার কিছু।
বিভা রুদ্রর পাতলা গড়নের শরীরটার দিকে তাকিয়ে খিটখিট করে উঠল, ‘এতো খাস, তাও মোটা হস না কেন? তোর পেটে কি কৃমি আছে?’
রুদ্র চোখ পাকিয়ে বলল, ‘ফালতু কথা বলিস কেন?’
—‘ফালতু কথা না, সত্যি। সারা দিন রাক্ষসের মত খাই খাই করিস, কিন্তু শরীরে লাগেনা কিস্স! নিশ্চয়ই পেটে কৃমি আছে।’
রুদ্র ভীষণ বিরক্ত গলায় বলল,’মোটেও আমার পেটে কৃমি নাই। তর পেটে আছে। শালী মুটকি! আমার স্লিম ফিগার দেইখা হিংসা হয়, না? সব বুঝি।’
বিভা রাগে ফেটে পড়ে একদম, ‘কী বললি? আমি মুটকি? আমাকে তর মুটকি লাগে দেখতে?’
—‘তা নয়তো কী? মনীষারে দেখছিস তুই? কী ফিট! ঐরকম হইতে পারিস না?’
বিভা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘রুদ্রর বাচ্চা, আমি একটুও মোটা না। আমার সব কিছু ঠিকঠাক আছে।’
রুদ্র বাঁকা ভাবে বিভার পেটের দিকে চোখ দিয়ে বলল, ‘তর যে ভুঁড়ি হইছে সেই খবর আছে?
বিভা চকিতে নিজের পেটের দিকে তাকাল। পরনের টপ আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে কোমরের সাথে। বসার ভঙ্গির কারণে তল পেটের দিকটা একটু ফেঁপে আছে। সে নড়েচড়ে বসে, নাকের পাটা ফুলিয়ে, ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘আমি গত এক মাস ধইরা ডায়েট করতেছি। তর মত সারাদিন খাই খাই করিনা। মেপে মেপে খাই। আমার মোটা হওয়ার কোন চান্সই নাই। তুমি তো অপুষ্টিতে ভুগো। তোমার পেটের কৃমি সব পুষ্টি নিয়ে নেয়। এইজন্যে আমার সুঠাম সুন্দর সবল দেহ দেখে তোমার হিংসা হচ্ছে।’
—‘আহা হা হা! যা সুঠাম দেহ! তর বডি স্ট্রাকচারে প্রব্লেম আছে। তুই সেটা জানিস না।’
বিভা হাতের কাজ ফেলে রেখে উঠে দাঁড়ায়। কোমরে হাত রেখে রোষানলে জ্বলতে জ্বলতে আকাশকে বলে, ‘তুই দেখছিস? ও কেমনে আমাকে অপমান করতেছে? তুই কিছু বলবিনা?’
আকাশ উদাস গলায় বলল, ‘অপমানের কী আছে? ওর কাছে যা মনে হইতেছে, তাই বলতেছে। এইটা নিয়ে এতো কিচকিচ করার কী আছে?’
বিভা দাঁত কিড়মিড় করে রুদ্রকে বলল, ‘তুই একটা এসহোলের বাচ্চা। তর পেটে যে শুধু কৃমি আছে, তাইনা। তুই নিজেও একটা কৃমি। ফালতু, নষ্ট, লুনুষ দি গ্রেট…’ রুদ্র একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘হায়রে সত্য বলাই পাপ এই দ্যাশে। ফ্রিডম অফ স্পিচ বইলা কিছু নাই আসলে।’
বিভা তখনও রাগে গজগজ করতে করতে গালি দিয়েই যাচ্ছে, ‘লুনুষ নাম্বার ওয়ান! মনীষার উচিৎ তরে উঠতে বসতে লাখি মারা। জীবনেও ওই মেয়ে তোর সাথে প্রেম করবেনা। অভিশাপ দিলাম আমি। আমার অভিশাপে ছারখার হয়ে যাবি তুই। আমাকে মোটা লাগে তোর? দেখিস তোর বউ হবে আস্ত একটা হাতি। তারপর সারাদিন তুই আর তোর হাতি বৌ মিলে খাই খাই খাই খাই করবি। খাবি আর ফুলবি।’
সামির আম্মা ঘরের ভেতর পুনরায় প্রবেশ করলেন। ঢুকেই বললেন, ‘শাড়ি গুলো সামির কাজিনরা এসে প্যাক করবে আগামী কাল। তোমরা শুধু কসমেটিক্স গুলোই কর আজ। কেমন?’
কথাটা বলে তিনি সোফার ওপর বসলেন। বিভা রোমেলাকে দেখে রাগটা হজম করল কোনোমতে। কার্পেটের উপরে বসে পড়ে পুনরায় কাজে হাত দিল। আকাশ আর রুদ্রও কাজে লেগে গেল।
—‘বাকিরা সব কোথায়?’ রোমেলার প্রশ্ন।
বন্ধুরা উত্তর দিতে পারল না। তারা জানেনা অমৃতা, সামি আর হৃদি এই মুহূর্তে কোথায় কী করছে? বিভা ফোন হাতে নিয়ে বলল, ‘আমি দেখছি।’
হৃদি আর সামিকে ফোন করে পাওয়া গেল। তারা জানালো মিনিট দশেকের মধ্যে আসছে। পাওয়া গেল না শুধু অমৃতাকে। ফোন করতেই তার মোবাইল বাজতে লাগলো ডাইনিং রুমের টেবিলের ওপর। অর্থাৎ মোবাইলটা এখন তার সাথে নেই।
রোমেলা চুপচাপ বসে বিভাকে দেখছিলেন। বিভা মনোযোগ দিয়ে পানের ডালা সাজাচ্ছে। এই মেয়েটি নিঃসন্দেহে সুন্দরী। কিন্তু রূপবতী হলে কী হবে? নিতান্তই মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। অন্য ধর্মের না হলে এর সাথে তার ছেলের বিয়ে হয়তো কোনো ভাবেই আটকানো যেতো না। কিন্তু সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে এই মেয়েটির পরিবার কোন ভাবেই তাদের সাথে মানানসই নয়। ভাগ্যিস ছেলেকে শেষমেশ ফেরানো গেল। তার একটা মাত্র ছেলে। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে এই মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েটির ছত্র ছায়া থেকে তার ছেলে বেরিয়ে এসেছে। তার বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে গেল, অজান্তে।
.
হৃদিকে পাওয়া গেল দোতলার লিভিং রুম সংলগ্ন ঝুল বারান্দায়। এই বারান্দাটা পেছন দিকে। বারান্দায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে সারি বদ্ধ ভাবে বেড়ে ওঠা তিন চারটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছ গুলোর ওপাড়ে একটা ছোট গোল বারান্দা ওয়ালা দোচালা ঘর। হৃদি ওই ঘরটাতে কোন দিন যায়নি। এমনকি ওই জায়গায় যে একটি ঘর আছে এ তথ্যটাই তার জানা ছিল না এতকাল।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল সে বারান্দার রেলিং এ ভর দিয়ে। কানে মোবাইল। মা ফোন করেছেন।
—‘ওই ছেমড়ি! কী করতেছিস?’
সামির ধারালো প্রশ্নটা শুনে ঘাড় ঘুরালো হৃদি। ফোন কানে ধরেই বলল, ‘আচ্ছা এখন রাখি… হ্যাঁ কাল দুপুরের মধ্যে চলে আসব… ঠিক আছে। ভালো থাকো।’
সামি তারস্বরে পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘কার সাথে কথা বলিস?’
হৃদি কান থেকে ফোন নামিয়ে বলল, ‘মা।’
—‘ও।’
—‘রাহাত ভাই আসছে দেশে। কালকে আমাদের বাসায় আসবে।’
—‘রাহাত ভাইটা আবার কে?’
—‘আমার কাজিন।’
—‘ও, সেই ডাক্তার?’
—‘হুম।’
—কেন আসবে তোদের বাসায়?’
—‘বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে মনে হয়।’
—‘বিয়ে করার জন্য এতো পাগল হইছিস ক্যান?’
—‘তোরা সবাই বিয়া কইরা ফেলতেছিস। আমি বইসা থাকব?’
—‘অমৃতা, আকাশ, রুদ্র ওরা তো বইসাই আছে। তোর এতো কী?’
—‘ফ্যামিলি থেকে প্রেশার আসতেছে।’
—‘তুই কেন বলছিস আমার সাথে ফোনে কথা বলবিনা?’ হঠাৎ অন্যরকম শোনায় সামির গলা।
—‘তোর বউ নিষেধ করল, শুনিসনাই?’
—‘আমার বৌরে কি তুই জীবনের দেবতা বানাইছস? কবে থেকে বানাইলি?’
হৃদি একটু ম্লান ভাবে বলল,’দেবতা বানানোর কিছু নাই। আফটার অল সে তোর লাইফ পার্টনার হইতে যাচ্ছে। সো আমাদের উচিত তার ইচ্ছা অনিচ্ছা এবং মতামতকে গুরুত্ব দেয়া।’
—‘বিয়া কি আমি করতেছি নাকি তুই করতেছিস?’
—‘তুই করতেছিস, আর তোর উচিত তোর বৌয়ের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া।’
—‘আমি আমার ফ্রেন্ডদেরকে নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে পারব না।’ গোঁ ধরা গলায় বলে সামি।
-‘ফ্রেন্ডের চাইতে লাইফপার্টনারের গুরুত্ব অনেক বেশি।’
–’বেশি কথা বলবিনা। ফোন দিলে ফোন ধরবি।
—‘জীবনেওনা।’
—‘মানে কী?’
—‘মানে আমি মনে মনে শপথ নিয়া ফ্যালাইছি। তোর সাথে আমি ফোনে কথা বলব না আর।’
সামি অবাক হয়। বলে,
—‘আমার সাথে কথা না বলে তুই থাকতে পারবি?’
—‘থাকতে তো হবেই। তাছাড়া বিয়ের পর তোর অত সময়ও থাকবেনা।
সামিকে একটু কেমন বিভ্রান্ত দেখায়। সে দ্বিধাগ্রস্ত চোখে হৃদির দিকে চেয়ে থাকে, অন্ধকারে। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক ভরে যায় এক টুকরো সন্ধ্যেবেলার স্মৃতিতে। সেই সন্ধ্যাবেলাটা একটা ভুল ছিল সে জানে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল আজকাল তার সেই ভুলটার কথা মনে পড়লে বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা ব্যথার মতো সূক্ষ্ম সুখানুভূতি হয়। হৃদিকে কি বলবে সামি তার অসুখটার কথা? বলবে কি যে, সেদিনের পর থেকে তার সব কিছু কেমন উল্টেপাল্টে গেছে? এখন যে কোন মেয়ের কাছাকাছি গেলেই তার চোখের সামনে দমকা হাওয়ার মতো উড়ে আসে সেই স্মৃতি। কিন্তু সেই মেয়েটাতো হৃদি না। হৃদি তার বন্ধু। তবুও হৃদিকে দেখলেই কেন কারণে অকারণে আজকাল সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে? নিজের ভেতরটা নিজের কাছে বড় দুর্বোধ্য ঠেকতে থাকে।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখ পড়ল কৃষ্ণচূড়া গাছের পেছনের দোচালা ঘরটার দিকে। ঘরের সামনে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। গোল বারান্দায় একটা টিম টিমে হলদে বাল্ব জ্বলছে। সেই আলোতে সে বাবার পেছনে গুটিশুটি হয়ে অমৃতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ভারী অবাক গলায় বলল, ‘অমৃতা কী করে বাবার সাথে?’
হৃদি ঘাড় ঘুরিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যটা দেখল। বুক কেঁপে উঠল তার। বেশ কয়েকটা মুহূর্ত সে কোন কথা বলতে পারলনা। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল শুধু দৃশ্যটার দিকে। সামিও ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে সেদিকে। হৃদি ভীত কম্পনযুক্ত বক্ষ নিয়ে বলল, ‘ওই ঘরটা কিসের?’
—‘দাদা সাহেবের লাইব্রেরি ছিল। এখন পরিত্যাক্ত ভাবে পড়ে আছে। বাবা ছাড়া কেউ ওই ঘরে যায়না।
—‘ও তাহলে মনে হয় অমৃতা বই টই কিছু আনতে গেছে।’ বলল হৃদি,অনেক কষ্টে।
সামিকে দেখে মনে হল হৃদির কথাটা তার খুব একটা যৌক্তিক মনে হয়নি। সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে দেখতে লাগল দোচালা ঘরটার সামনে দাঁড়ানো মানুষ দুটোকে। একটা সময় মানুষ দুজন ঘরের ভেতর ঢুকল। সেকেন্ড না গড়াতেই বন্ধ হয়ে গেল ঘরের দরজা।
.
লাইব্রেরি ঘরটা মূল দালান থেকে একটু দূরে। দেউড়ির ঠিক উল্টো দিকের গাড়ি বারান্দা ধরে হেঁটে, বাগান পেরিয়ে একটি পুরোনো দোচালা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন হক। ঘরটির সামনেই রয়েছে একটি গোল বারান্দা। মেঝের রং লাল। সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে চাবি দিয়ে দরজার তালা খুললেন তিনি। অমৃতার বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করছিল। ভয়, আনন্দ, সংকোচ, উৎকণ্ঠা… এতরকম বিচিত্র অনুভূতির সমাহার তার জীবনে এইই প্রথম! লোকটার পেছন পেছন চুপচাপ হেঁটে এসেছে সে। এত বছর ধরে এ বাড়িতে তার যাতায়াত, কিন্তু এপাশটায় কখনো আসা হয়নি।
ঘরের ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালালেন তিনি। ঘরটি চারকোণা এবং প্রশস্ত। চারিদিকের দেয়াল জুড়ে ঠেসে আছে শুধু বই আর বই! দক্ষিণ দিকে রয়েছে তিন পাল্লার পুরনো আমলের একটি কাচের জানালা। জানালার গ্রিলের ওপর ঝুলে আছে বাগান বিলাসের লতানো ডাল। হাওয়ায় দুলছে মৃদু ভাবে। ঘরটির মাঝ বরাবর একটি লম্বা সেগুন কাঠের টেবিল। টেবিলের একপাশে রাখা আছে দুটি কাঠের চেয়ার এবং অন্য পাশে একটি রেক্সিনের গদিযুক্ত রিভলভিং চেয়ার। টেবিলের ওপর বোঝাই হয়ে আছে ফাইলপত্র, কলমদানি, পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া কাগজ, পানির জগ এবং গ্লাস।
অমৃতা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, ‘এই সব গুলো বই আপনার?’
হক ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। জানালার দুটি পাল্লা দিলেন খুলে। বললেন, ‘না। সব আমার নয়। বেশিরভাগই আমার বাবার।’
অমৃতা মুগ্ধ চোখে দেয়াল জোড়া বইগুলোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলল, ‘বিশাল সংগ্রহ! সামি তো কখনো বলেনি ওর বাড়িতে এত বড় একটা লাইব্রেরি আছে!’
ঘরের কোণায় মেঝের উপর একটি আগরবাতির স্ট্যান্ড রাখা ছিল। হক প্রথমেই ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগরবাতি গুলো জ্বালিয়ে দিলেন। তারপর টেবিল সংলগ্ন রিভলভিং চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘সে নিজে জানে কিনা তা নিয়েই আমার সন্দেহ আছে।’
দেয়ালের তাক গুলো মেঝে থেকে শুরু করে সিলিং অবধি উঠে গেছে। প্রতি খোপে বই সাজানো। আছে রবীন্দ্র রচনাবলীর বিশাল ভাণ্ডার। শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, শেক্সপিয়ার, চার্লস ডিকেন্স সবই আছে। অমৃতা সাহিত্য অত বোঝেনা। তার চোখ গিয়ে পড়ল অর্থনীতি এবং দর্শন শাস্ত্রের বই গুলোর ওপর। আইনের বই নেই দেখে মনে মনে একটু আফসোসও হল। বুকের সাথে শাড়ির প্যাকেটটা দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখে মুগ্ধ হয়ে বই দেখছিল সে। দেখতে দেখতে মনটা একদম অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল। হৃদয় কপাট খুলে গিয়ে বিশুদ্ধ বাতাসে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল ভেতরটা।
একটা সময় তার চোখজোড়া বইয়ের সমাহার থেকে দূরে সরে আসল, গিয়ে পড়ল কিঞ্চিৎ দূরে বসে থাকা দীর্ঘকায় মানুষটার ওপর। ধূসর রঙের আলোয়ান গায়ে জড়ানো তাঁর। একটু আনমনা ভাবে চেয়ে আছেন জানালার বাইরে। কপাল কুঞ্চিত। এপাশ থেকে চেহারাটা বেশ ধারালো দেখাচ্ছে।
—‘আপনি এখানে কোন কাজে এসেছেন?’
—‘না, ঠিক কাজ নয়।’ অন্যমনস্ক গলায় উত্তর দিলেন তিনি। অমৃতা ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘হঠাৎ এই রাতের বেলা লাইব্রেরি আসলেন যে?’
হক পাঞ্জাবির পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। একটু গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘দুশ্চিন্তার সময় গুলোতে আমি বাবার এই ঘরটায় এসে আগরবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকি মাঝে মাঝে। ভালো লাগে। বাবার আগরবাতির ঘ্রাণ খুব প্রিয় ছিল।’
অমৃতা হেঁটে এসে মানুষটার মুখোমুখি বসল, কাঠের চেয়ারে।
—‘আপনার কি মন খারাপ?’
হক ভেতরে ভেতরে একটু চমকে উঠলেন মেয়েটির প্রশ্ন শুনে। অনেক অনেক দিন বাদে তাকে কেউ এমন আন্তরিক প্রশ্ন করল। তাঁর ভেতরেও যে মন বলতে কিছু আছে সে বিষয়টি তিনি প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন। দুশ্চিন্তা হওয়া আর মন খারাপ হওয়া এই দুটোতে বিস্তর ফারাক আছে। মন খারাপের মতো বাহুল্য অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেবার মতো সময় তাঁর ব্যস্ত জীবনে আছে নাকি? বাবা মারা গেছেন চার বছর আগে। বাবার মৃত্যুতেই শেষ বারের মতো মন খারাপ হয়েছিল তাঁর। এরপর থেকে মন খারাপ আর হয়না, হয় দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা।
—‘মনে হয়না মন খারাপ।’
—‘মন খারাপ হলে পাখি ওড়াচ্ছেন না কেন?’
হক হাসলেন, ‘আমার মন খারাপ হয়না আজকাল। দুশ্চিন্তা হয়। তবে পাখি আনার জন্য লোক পাঠিয়েছি। ভোরের আকাশে পাখি ওড়ানো হবে।’
—‘কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন?’ অমৃতা শুধোয়
টেবিলের ওপরে রাখা একটি পাথরের পেপার ওয়েট হাত দিয়ে অযথা নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি বললেন, ‘ছেলেটাকে নিয়েই দুশ্চিন্তা হচ্ছে!’
—‘আবার কী হল?’
—‘তোমাদেরকে কিছু বলেনি সে?’
—‘তানিশার ব্যাপারে?’
হক চোখ তুলে চাইলেন অমৃতার দিকে, ‘হ্যাঁ, তানিশার ব্যাপারে। কিছু বলেছে কি?’
—‘তানিশা, হৃদির সাথে ফোনে কথা বলা নিয়ে অবজেকশন দিয়েছে। এইতো?’
—‘হুম, ব্যাপারটা নিয়ে আমার ছেলে দেখলাম ভীষণ আপসেট হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছিনা যে এতটা আপসেট হওয়ার কারণ কী? তোমার কী মনে হয়?’
অমৃতা তাৎক্ষণিক ভাবে প্রশ্নটার কোন উত্তর দিল না। এতক্ষণে একটা বিষয় তার কাছে পরিষ্কার হল যে লোকটা তাকে এখানে ডেকে এনেছেন নিজ পুত্র সম্পর্কে এসব খুঁটিনাটি ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার নিমিত্তে। এতকাল ভাড়া করা গোয়েন্দা লাগিয়ে রাখতেন ছেলের পেছনে। এখন ছেলের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে দিয়ে সেই গোয়েন্দাগিরির কাজটা বিনে পয়সায় করিয়ে নিচ্ছেন। চমৎকার! বিষয়টা মাথায় আসতেই মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল তার।
মন খারাপ হলেও রাগ করতে পারে না অমৃতা। বরং কুয়াশার মতো আবছা একটা তৃপ্তি বোধ টের পায় সে ভেতরে ভেতরে। মনে হয় ক্ষতি কী তাকে কয়টা প্রশ্ন করে মানুষটা যদি একটু শান্তি পায়? এইযে সামনে বসে একান্তে দুটা কথা বলছে তার সাথে, এটাও তো কম পাওয়া নয়! সে ধীর স্বরে বলল, ‘আমার যা মনে হয় তা আপনাকে খোলা মেলা ভাবে বলব?’
—‘হ্যাঁ, প্লিজ বল।’
—‘আমার মনে হয় সামি নিজেকেই নিজে বুঝতে পারছে না।’
—‘আমার কাছেও মনে হয়েছে সে চরম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ওর মধ্যে ম্যাচিওরিটি জিনিসটা একেবারেই গ্রো করেনি।’
অমৃতা, হক সাহেবের চোখে চেয়ে পরিষ্কার গলায় বলল, ‘আপনারাই তো তাড়াহুড়ো করলেন। বিয়ের জন্য হঠাৎ এত প্রেশার দেয়া শুরু করলেন কেন?’
—‘ভুল বলছ তুমি। আমরা মোটেও প্রেশার দেইনি। সে নিজেই বলেছে বিয়ে করবে এবং এটাও বলেছে যে বিয়েটা সে খুব শীঘ্রই করতে চায়।’
—‘আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?’
—‘কর।’
—‘সামি যদি এখন হুট করে বলে বসে যে সে তানিশাকে বিয়ে করতে চায় না। তাহলে আপনারা কী করবেন?’
—‘সে কি এ ব্যাপারে কিছু বলেছে তোমাকে?’
অমৃতা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘এই দেখুন, কিছু বললেই আপনি উত্তেজিত হয়ে যান। এভাবে কি কথা বলা যায়?এতো দুশ্চিন্তা করলে হয় নাকি?’
—‘দুশ্চিন্তা করব না বলছ? ছেলে যদি এখন বিয়ে নাকচ করে দেয় তো সোসাইটিকে কী জবাব দেব আমরা?’
—‘সোসাইটিকে আপনার কেন জবাব দিতে হবে? এটা তো আমি বুঝলাম না।’
হক নিজের মাথায় একটা হাত রেখে, ভারী গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘সেটা তুমি বুঝবেনা।’
—‘আপনার কাছে আপনার ছেলের চাইতে আত্মীয়-স্বজন আর সমাজ বড় হয়ে গেল?’
—‘বড় ছোটোর কথা না। হাজারের ওপর মানুষ দাওয়াত দেয়া হয়ে গেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকদের নিমন্ত্রণ করা হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় এই ছেলে যদি কোন ঝামেলা বাঁধায় …’
অমৃতা দৃঢ় গলায় বলল, ‘আমাকে একটা কথা বলেন তো, আপনি আসলে কোনটা চান? আপনার ছেলের সুখ? নাকি নিজের সম্মান বা সামাজিক মর্যাদা?’
মাথা থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে চোখ তুলে তাকালেন তিনি অমৃতার দিকে, ‘দুটোই।’
—‘না যে কোন একটা বেছে নিতে হবে আপনাকে।’
—‘নিশ্চয়ই আমি চাই আমার ছেলেটা যেন ভালো থাকে।’
—‘তাহলে আমার কথা শুনুন। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করা একদম বাদ দিন।’
—‘বাদ দিব?’
—‘হ্যাঁ বাদ দিন। সামির ওপর ছেড়ে দিন পুরো ব্যাপারটা। আর তাছাড়া বিয়ে করবে না এমন কথা তো ও এখনো বলেনি তাইনা? আগে থেকেই কেন এতো দুশ্চিন্তা করছেন আপনারা বুঝতে পারছিনা।’
—‘দুশ্চিন্তা শুধু একটা বিষয় নিয়ে নয়। আমি ভেবেছিলাম এ বছর সামি আমার অফিসে জয়েন করবে। ইয়াং ছেলে কোনো কাজ টাজ না করে ঘরে বসে থাকে। তার বাবার এতো বড় ব্যবসা থাকতে সেই ব্যবসায় যোগদান না করে সে স্কুল শিক্ষকের চাকরি করতে গেল। সেই চাকরিটাও টিকিয়ে রাখতে পারল না। ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুবই শঙ্কিত।’
—‘এতো টেনশনের কিছু নেই।’
হক চিন্তাযুক্ত দৃষ্টি মেলে জানালায় নুইয়ে পড়া অন্ধকারাচ্ছন্ন বাগানবিলাসের দিকে চেয়ে ছিলেন
অমৃতা ডাকল, ‘হ্যালো! মিস্টার! আপনার সাথে কথা বলছি… শুনতে পাচ্ছেন?’
হক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। অমৃতার কথার ধরণ তার ঠোঁটে হালকা হাসির উদ্রেক করল। তিনি হেসে বললেন, ‘জি শুনতে পাচ্ছি, বলুন।’
—‘দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি সামির সাথে কথা বলব এ ব্যাপারে।’
—‘কোন ব্যাপারে?’
—‘আপনার অফিসে কাজ শুরু করার ব্যাপারে।’
—‘ও তোমার কথা মেনে নেবে বলে মনে হয়?’
অমৃতা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই নেবে। আপনি শুধু আরেকটু ধৈর্য ধরুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না। আমি আছি।’
হক সাহেবের চেহারায় একটা নিগূঢ় ভাবান্তর পরিলক্ষিত হল। তাঁর মনে হল এই মূহুর্তে বুঝি তিনি ঠিক এরকম প্রত্যয় মিশ্রিত কিছু কথাই শুনতে চাইছিলেন আদতে। বড্ড প্রয়োজন ছিল এই আশ্বাস বাণীটুকুর! খুব করে চাইছিলেন কেউ একজন ভরসা দিয়ে বলুক, চিন্তা কর না, আমি আছি। তিনি কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালেন মেয়েটির দিকে। একটা সাদা গেঞ্জির ওপরে লাল, কালো ফুল হাতা চেক শার্ট পরে আছে মেয়েটা শার্টের বোতাম গুলো খোলা। খোলা বোতামের ভেতর দিয়ে সাদা রঙের ঢিলাঢালা গেঞ্জিটা স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে। বয়কাট চুল গুলো সামনের দিকে একটু উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন অনেক দিন ওই চুলে চিরুণী চালানো হয়নি। এলোমেলো ঘাসের মত ছোট চুল গুলি হালকা উড়ছে জানালা দিয়ে আসা হিম হিম হাওয়ায়। লোকটাকে ওভাবে চেয়ে থাকতে দেখে অমৃতার মুখখানা একটু একটু করে আরক্ত হয়ে উঠছিল। ধনুকের মত বাঁকা ভ্রুর নিচের পুতুল পুতুল ছোট্ট চোখদুটিতে ক্রমে ভর করছিল একটি লাজুক ভাব। পাতলা গোলাপি ওষ্ঠাধর কাঁপছিল অস্বস্তিতে। একটা সতেজ লাবণ্য শিখায় ঢলঢল করছিল তার মিষ্টি মুখটা।
—‘তোমার হাতে এটা কী?’
শাড়ির প্যাকেটটার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি প্রশ্ন করলেন।
—‘শাড়ি, আন্টি দিলেন।’
—‘তুমি শাড়ি টারি পর নাকি?’
অমৃতা চোখ নামাল নিচে, ‘কখনো পরিনি।’
—‘কেন? পরলেই তো পারো মাঝে মাঝে।
অমৃতা আরক্ত মুখে বলল, ‘আপনি বলছেন পরতে?’
হক এবার ওর মুখের লালিমা টুকু লক্ষ্য করলেন। অপ্রস্তুত হলেন সামান্য। বুঝতে পারলেন যে, তার হয়তো এ ব্যাপারে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু বুঝতে পারার পরেও, তিনি অনিচ্ছাসত্বে শব্দ দুটো উচ্চারণ করে ফেললেন,’কেন নয়?’
অমৃতা মৃদু গলায় বলল, ‘আচ্ছা।’
হক জানতেও পারলেন না, সামনে বসে থাকা মেয়েটির তাঁর কথায় হুট করে শাড়ি পরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাটা যে কত বড় একটা সাংঘাতিক ঘটনা! খুব ছোট বেলায় একটা বাজে লোকের হাতে উৎপীড়িত হবার পরে সে মন প্রাণ দিয়ে শপথ করেছিল যে জীবনে আর কোনো দিন মেয়েদের পোশাক পরবে না। মেয়েদের মতো চলাফেরা করবেনা। মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই তার কাছে মনে হয়েছিল একটা অপরাধ। এতো গুলো বছর ধরে সে তার শপথ রক্ষা করে এসেছে। ভাঙ্গেনি। কিন্তু আজ, জীবনের ছাব্বিশটা বসন্ত পার করবার পরে, প্রথমবারের মতো, এই একটা মানুষের জন্য সে তার নারীত্বকে পুনরায় ফিরে পেতে চাইছে!
কেউ কোন কথা বলছিল না। একটা কেমন অস্থিরতা মিশে ছিল আগরবাতির খুশবু ওয়ালা হাওয়াটায়। অমৃতা বুকের ধুকপুক শব্দটা নিজের কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল!
একটা সময় তিনি বললেন- ‘আমার কিছু জরুরি ফোন কল করতে হবে।’
বুঝল অমৃতা। এ কথার মানে হল, তুমি এখন যেতে পার। তার মুখটা একটু শুকিয়ে গেল। চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।’
—‘না না, তোমাকে যেতে বলিনি। তুমি চাইলে বসতে পার। আমি তোমার সামনে কথা বলতে পারব। নো প্রব্লেম।’
অমৃতার শুকনো মুখখানা চকিতে আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হেসে বলে, -’না থাক। আমি আসি। ফোন নিয়ে আসিনি। বন্ধুরা হয়তো খুঁজছে আমাকে। এই জায়গাটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। মাঝে মাঝে আমি এখানে আসতে পারব?’
—‘নিশ্চয়ই।’
তিনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটা আরো কিছুক্ষণ এখানটায় বসে থাকলে বুঝি ভালো লাগত। এমনটা মনে হওয়ায় কি কোন গোপন পাপ আছে? কিংবা কোন গোপন আনন্দ?
অমৃতা বলল, ‘আরেকটা কথা।’
—‘হুম, বল।’ অমৃতার চোখে চোখে তাকালেন তিনি।
—‘আপনার নাম তো রাশেদুল হক, তাইনা?’
—‘হুম।’
—‘আমি এখন থেকে রাশেদ নামেই ডাকব।’
তিনি হাসলেন, ‘তুমি খুব পাকা একটা মেয়ে।’
—‘এ কথা আগেও বলেছেন। এখন যাই।’
—‘এসো।’
.
অমৃতা ফিরতেই দেখল হৃদি সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। চোখ ভর্তি উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে। অমৃতাকে দেখতে পেয়ে সে সতর্ক গলায় বলল, ‘এদিকে আয়, দরকার আছে তোর সাথে।’
কথাটা বলে হৃদি ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়াল। ডাইনিং স্পেসে বিভাকে পাওয়া গেল। সে টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছিল। দুই বান্ধবীকে দেখতে পেয়ে ঈষৎ ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, ‘রুদ্রর বাচ্চা আমারে মোটা বলে, চিন্তা করতে পারিস ওই চিকনা চামালের পেটে কত হিংসা?’
হৃদি ভ্রুকুটি করে বলল, ‘চামাল আবার কী জিনিস?’
বিভা ঢকঢক করে গলায় পানি ঢেলে নিয়ে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঠোঁট মুছল, বলল, ‘চামাল হচ্ছে চামেলির পুং লিঙ্গ।’
হৃদি বিভার কথাটা খুব একটা পাত্তা দিল না। ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ে থাকা অমৃতার সেলফোনটার দিকে তাকিয়ে একটু চোখা ভাবে বলল, ‘উকিল আপার মোবাইল কোথায় সেই খবর কি আছে?’
প্রশ্নটা শুনে অমৃতা বিচলিত হল না। বুকের সাথে দুহাত দিয়ে শাড়িটা জড়িয়ে রেখে খুব ধীরস্থির ভাবে এগিয়ে এসে টেবিল থেকে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল, বলল, ‘ওহ, ভুলে গিয়েছিলাম।’
হৃদি আশপাশটা একবার ভালো মত দেখে নিল। এই বাড়িতে ঝি চাকরের অভাব নেই। বড় বড় কামরা এবং মোটা দেয়াল বলে এক ঘরের কথা অন্য ঘরে শোনা যাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু চাকর বাকররা ডাইনিং স্পেসের চারপাশে কারণে অকারণে বিচরণ করে সর্বদা। তাই গোপন কথা বলার জন্য এই জায়গাটা অনুকূল নয় বলেই তার মনে হল। সে দুই বান্ধবীকে বলল, ‘চল ছাদে যাই। কথা আছে।’
ছাদের ওপর কুয়াশা জেঁকে বসেছে। বাতাসে জোর নেই, তবে শীতের তীব্রতা আছে। পুল সাইডে একটা নীল রঙের কম পাওয়ারের বাতি জ্বলছিল। নীল বাতির নিচে এলোমেলো ভাবে কয়েকটা চেয়ার রাখা। হৃদি চেয়ার গুলোর একটাতে বসে পড়ে অমৃতাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিল। তারপর ঠেস দেওয়া গলায় বলল, ‘কী? খুব রং লাগছে মনে, তাইনা?’
অমৃতা সরু চোখে তাকাল, ‘মানে কী?
—‘কোথায় গেছিলি তুই?’ ভয়ঙ্কর ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করে হৃদি। বিভা এগিয়ে এসে হৃদির পাশের চেয়ারে বসল। কৌতূহল চাপাতে না পেরে বলল, ‘কী হইছে?’
অমৃতা একটা লম্বা শ্বাস নিল সময় নিয়ে। তারপর হৃদির প্রশ্নের উত্তরটা দিল, ‘লাইব্রেরি ঘরে।’
—‘সামি জিজ্ঞেস করলে কী বলবি?’ হৃদির প্রশ্ন।
—‘সামিকে টানছিস কেন এখানে?’ একটু রূঢ় ভাবে বলে অমৃতা
—‘সামিকে আমি টানছিনা। সামি নিজের চোখে দেখে ফেলছে তোকে আর তার বাবাকে ওই লাইব্রেরি ঘরের সামনে। এমনকি ঘরের ভেতর ঢুকতেও দেখছে।’
অমৃতা থমকালো। ডিম ডিম আলোটার ভেতর দিয়ে ওর মুখের রং পাল্টানোটা স্পষ্ট ধরা পড়ল বাকি দুই বান্ধবীর চোখে। ভয়ের মতো কী
যেন একটা উঁকি মেরে গেল দুচোখের তারায় ক্ষনিকের জন্য। একটা ঢোঁক গিলল সে। বলল, ‘কীভাবে?’
—‘আমরা তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম গোল বারান্দায় লাইব্রেরির দরজার সামনে তোরা দুজনে দাঁড়িয়ে আছিস। তারপর তালা খুলে ভেতরে ঢুকলি। ঢুকে দরজা আটকে দিলি।’
বিভা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সর্বনাশ! দরজা আটকায়ে একলা ঘরে কী করছিস তোরা? হায় ভগবান! লোকটা তোর গায়ে হাত দেয়নায় তো?’
অমৃতা ঝেঁঝে উঠল, ‘ধুর, বাজে কথা বলিস না!
বিভা বলল, ‘বাজে কথা না মোটেও। পুরুষ মানুষকে তুমি সুযোগ দিবা। আর সে সুযোগ নিবেনা, এটা কখনো সম্ভব?’
অমৃতা অত্যধিক কড়া গলায় বলল ‘ উনি মোটেও ওরকম না। ফালতু কথা বলার আর জায়গা পাস না।
—‘উনি কী রকম তা তুই এই দুইদিনে বুঝে গেলি তাইনা? সব পুরুষ মানুষই এক। মেন উইল বি মেন!’ বিভার স্পষ্ট উক্তি।
হৃদি একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বিভাকে বলল, ‘ন নাহ, আমার মনে হয়না উনি অতটা মিন। আর যাই করুক না কেন অন্তত গায়ে হাত দেয়ার মত বাজে কাজ উনি করবেন না।’
অমৃতা তার কণ্ঠে কড়া ভাবটা বজায় রেখেই বলল, ‘কারো সম্পর্কে কিছু বলার আগে ভেবে চিন্তে বলবি। তোদের চাইতে অনেক বেশি মানুষজনের সাথে মিশি আমি, ঠিক আছে? পুরুষ মানুষ কী রকম হয় তা আমার খুব ভালো মত জানা আছে। উনি অন্য সবাব মত না। সবাই একরকম হয় না। তোর অভিজিৎ কী রকম? তুই যে এতকাল উনার সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকলি উনি কি কখনো অনুমতি ছাড়া তোর গায়ে হাত দিছে?’
—‘অভিজিতের কথা আলাদা।’
অমৃতা দৃপ্ত কণ্ঠে বলল, -’আমার উনার কথাও আলাদা।’
—‘তুই লাইব্রেরিতে কেন গিয়েছিলি?’ হৃদির প্রশ্ন।
—‘কাজ ছিল।’
—‘সামিকে কী বলবি?’
—‘বলা যাবে কিছু একটা।’ কথাটা বলে অমৃতা বেশ একটু গম্ভীর হয়ে গেল।
বিভা বলল,’তোর উচিৎ সাবধানে চলা অমৃতা। সামির জায়গায় ওই দৃশ্যটা যদি সামির আম্মা দেখে ফেলত। তাহলে কী হত?’
—‘কী আবার হত? আরে আজব আমি কি ডাকাতি করতে যাচ্ছিলাম নাকি? তোদের প্রব্লেম টা কী বলতো? সবসময় আমার সাথে এরকম করিস কেন?’ কথাটা বলতে বলতে অমৃতা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে বিভা আর হৃদির সঙ্গটা এই মুহূর্তে তার ভালো লাগছেনা।
বিভা বলল, ‘এরকম করছি বিকজ উই লাভ ইউ। আমরা তোর ভালো চাই।’
—‘ফাইন। লিসেন, ইফ ইউ লাভ মি, দেন ট্রাই টু রেস্পেক্ট মাই লাভ এন্ড মাই ফিলিংস। ওকে?’
কথাটা বলে অমৃতা ঘুরে গেল। কয়েক পা এগিয়ে থেমে পড়ল হঠাৎ। ফিরে তাকাল, বলল, ‘ব্লাউজ বানাস কোথায় তোরা? কোন টেইলরের কাছে? একদিনের মধ্যে বানিয়ে দিতে পারবে?’
দুই বান্ধবীর চোখের তারা ঝিলিক দিয়ে উঠল সুতীব্র কৌতূহলে। হৃদি অনুসন্ধানী স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
অমৃতা হাতে ধরা শাড়িটার দিকে একবার তাকাল। একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল তাকে মুহূর্তের জন্য। চোখে খেলে গেল মৃদু কুণ্ঠা।
—‘আমি শাড়ি পরব!’
দুই সখী বিস্মিত, স্তম্ভিত এবং চলতশক্তি রহিত! কয়েকটা মুহূর্ত কাটল শব্দহীনতায়। হৃদির মুখ তখন কিঞ্চিৎ হা। বিভার ডাগর দুটি চোখ পূর্ণব্যাদিত।
‘কী বললি তুই?’ কণ্ঠনালী দিয়ে অনেক কষ্টে শব্দ গুলো বের করল হৃদি।
অমৃতা স্পষ্ট ভাবে বলল, ‘আমি শাড়ি পরব।’
বিভাকে দেখে মনে হল সে তার চোখের সামনে মৃত মানুষকে জ্যান্ত হয়ে যেতে দেখল এই মাত্র। তীব্র বিস্ময়ে হাবুডুবু খেতে খেতে সে কোন রকমে বলল, ‘অমৃতা পরবে শাড়ি? আমি কি স্বপ্ন দেখতেছি?’
—‘তোরা যখন টেইলরের কাছে যাবি, আমাকেও নিয়ে যাস।’ গম্ভীর গলায় বলল অমৃতা। তারপর আর দাঁড়াল না সে। গটগট করে হেঁটে সিঁড়িঘরে চলে আসল। কয়েকটা থমকানো মুহূর্ত কেটে যাবার পর হৃদি বলল, ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা।’
বিভা হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে রসিক গলায় বলল, ‘ইয়েস, অনেক দিনের শখ ছিল অমৃতাকে সাজাবো। এবার আমার আশা পূরণ হবে। ইয়েস… ইয়েস!’ কথাটা বলে সে তিড়িং বিড়িং করে কয়েকটা লাফ দিয়ে দিল। হৃদি কঠিন ভাবে বলল, ‘জি না, আমি সাজাবো। আমার অনেক দিনের শখ।
—‘লাখি খাবি, ছেমড়ি। আমি সাজাবো।’
—‘না আমি!’ হৃদি উত্তেজনার বশে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
—‘আমি!’
—‘না আমি ডিসিশন নিয়ে ফেলছি। তবে তোর কি মনে হয়, অমৃতাকে ওই লোক বলছে শাড়ি পরতে?’
—‘হতে পারে।’
—‘তুই বুঝতে পারতেছিস কী ভয়ংকর বিপদ আসতেছে সামনে?’
—‘অমৃতাটা এবার গেছে। শি ইজ লিটারেলি ফলিং ফর হিম।’
—‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা যে অমৃতা শাড়ি পরবে।’ –যাই হোক, অমৃতাকে আমি সাজাবো। তুই না।’ হৃদি বদ্ধপরিকর।
—‘অসম্ভব, আমি সাজাবো। মনে মনে শপথ নিয়ে ফেলছি।’
হৃদি খুব সিরিয়াস ভাবে বলল, তোর শপথের গুষ্টি কিলাই। অমৃতাকেই জিজ্ঞাসা করা হোক। সে কার কাছে সাজতে চায়।’
—‘তবে তাই হোক!’ নাকের পাটা ফুলিয়ে, সদর্পে বলে বিভা।
.
ফোয়ারার জল ঝিরঝির শব্দ তুলে অবিরত ঝরছে। স্ট্রিং লাইটের রোমান্টিক আলোয় চারপাশ বেশ মনোরম। সেই মনোরম আলোয় চিকচিক করছে ঘাসের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির কণা। কৃষ্ণচূড়ার ডালের ফাঁকে ফাঁকে ঘাপটি মেরে আছে ঘোলা কুয়াশা। হিমগন্ধী বাতাসে মৃদু দুলছে বাগানের ডালিয়া আর কসমসের সতেজ পাঁপড়ি।
মাঘ মাসের পরিষ্কার আকাশটার দিকে মুখ তুলে চেয়ে সামি বেশ সময় নিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল। নিমেষেই তার চোখের সম্মুখে ক্ষনিকের জন্য একটি ধূম্রজাল তৈরী হল। সেই ধূম্রজালের ভেতর দিয়ে সে আকাশকে দেখল এগিয়ে আসতে। আকাশ সামির পাশের চেয়ারটা হাত দিয়ে টেনে নিয়ে বসল ওর পাশে, লঘু গলায় বলল, ‘কী অবস্থা?’ কথাটা শুনতে লাগল, ‘কী বস্তা?’
—‘এইতো। রুদ্র কোথায়?’
—‘ওর আম্মার সাথে ফোনে কথা বলে। তুই কী করস একা একা?
—‘বিড়ি টানি।’
—‘মুড অফ?’
—‘ধুর শালা আমার আবার মুড!’
আকাশ তীক্ষ্ণ চোখে দেখল একবার পাশে বসা বন্ধুকে। সামির গায়ে একটা কালো জিনসের জ্যাকেট। গাল ভর্তি দুদিনের দাড়ি। চোখে একটা উদাস উদাস ভাব। তবুও সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। আকাশ জানে, তাদের বন্ধুদের মধ্যে সামিই সবচাইতে সুদর্শন এবং স্মার্ট। তবে এ নিয়ে সামির মধ্যে কখনোই কোনো অহংবোধ বা হামবড়া ভাব ছিল না। বিত্তবান ঘরের ছেলে হয়েও তার চলাফেরা অতি সাধারণ ছাপোষা মানুষের মত। নিজের উপযুক্ততা সম্পর্কে এই আত্মভোলা ছেলেটি ছিল সর্বদাই বড্ড অসচেতন। সামির এই নিরহংকার পরিপাটি মনটার জন্যেই, ওর প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি আকাশের রয়েছে এক ধরণের শ্রদ্ধা। এই ছেলেটাকে সে চেনে ছোট্টবেলা থেকে। আর চেনে বলেই কদিন ধরে একটা বিষয় সূক্ষ্ম ভাবে টের পাচ্ছে সে। টের পাচ্ছে যে, তার বন্ধুটি আসলে খুব একটা ভালো নেই। ভালো থাকার চেষ্টা করা আর বাস্তবিক ভালো থাকার মধ্যে আছে বিস্তর ফারাক। অবিরাম ভালো থাকার মিথ্যা চেষ্টা করে যাবার চাইতে ভালো না থাকাও ঢের ভালো। ভালো থাকার চেষ্টা করে যাওয়া শুধু চেষ্টা নয়, ওটা একটা যুদ্ধ। আর এ কথা কে না জানে, যে জগতের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হল, নিজের মনের বিরুদ্ধে করা যুদ্ধ।
আকাশ একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল, বলল, ‘কাহিনী কী বল তো?’
—কীসের কাহিনী?’
—‘তোরে কেমন জানি আপসেট দেখাইতেছে। তানিশা হৃদির সাথে কথা বলতে মানা করছে। এইজন্যে?’
সামি ধোঁয়া ছাড়ে মুখ দিয়ে। তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, ‘আরে নাহ, হৃদি আমার ফ্রেন্ড। আমার ফ্রেন্ডের সাথে আমি কথা বলব কি বলব না সেই বিষয়ে মতামত দেবার তানিশা কে?’
—‘তাহলে মুখ বানায়ে বইসা আছস ক্যান?’
সামি চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে আকাশের মুখোমুখি বসল। ওর চোখে চেয়ে একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘তোর কী মনে হয়? যা হচ্ছে, ঠিক হচ্ছে?’
—‘তোর মন কী বলে? তানিশাকে ভালোবাসিস তুই?’
—‘ধুর ব্যাটা, ভালোবাসা এতো সোজা নাকি?
—‘আচ্ছা ভালো না বাসলি, ভালো লাগে তো, তাইনা?’
—‘হ্যাঁ তা তো লাগে!’
—‘তাহলে প্রব্লেম কী?’
—‘প্রব্লেমটা অন্য জায়গায়।’
—‘কোন জায়গায়?’
সামিকে একটু অপ্রতিভ দেখাল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আশেপাশে সতর্ক একটা নজর বুলিয়ে নিল সে। ত্রিসীমানায় কেউ নেই। সে কণ্ঠস্বর নিচে নামিয়ে বলল, ‘ডুয়ার্সের ওই ঘটনাটার পর থেকে… আমার… মানে আমি না এরপর থেকে অন্য কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারতেছিনা। নট ইভেন বিভা।’
—‘এটার মানে কী? ইট ডাজন’ট মেক এনি সেন্স।’
সামি একবার ঢোঁক গিলল, বিপন্ন গলায় বলল, ‘আচ্ছা খুলেই বলি, তানিশা কাছে আসলেই দোস্ত ডুয়ার্সের মেয়েটার কথা মনে পড়ে।
আকাশ হতভম্ব হয়ে গেল, ‘ডুয়ার্সের মেয়েটা বলতে তুই কী বুঝাচ্ছিস? ওইটা তো হৃদি ছিল।
—‘হ্যাঁ আমি জানি ওটা হৃদি ছিল কিন্তু যে মেয়েটাকে আমি কিস করছিলাম সেই মেয়েটা কোন ভাবেই হৃদি ছিল না।’
—‘সামি, পাগলের মতো কথা বলিস না।’
—‘প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর।’
—‘ওই মেয়েটা হৃদিই ছিল।’
—‘হৃদি ছিলোনা। ইম্পসিবল।
—‘তুই দেখি দিন দিন একটা আস্ত গাধায় পরিণত হচ্ছিস!’
—‘বোঝার চেষ্টা কর, ওটা হৃদি হতেই পারেনা। আমার মনে হইছিল ওই মুহূর্তটা আমার লাইফের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। মনে হইছিল যে সেই মেয়েটার জন্যই আমি মনে মনে এতকাল অপেক্ষা করে ছিলাম। বিভাকে আমি ভালোবাসি ঠিক, কিন্তু ওই মেয়েটা যেন ভালোবাসার চাইতেও বেশি কিছু। মেয়েটা যেন আমারই একটা অংশ। আমার একান্ত নিজের!
আকাশ ব্যথিত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সামির দিকে। এই ছেলেটার হয়েছে কী? তার কথাবার্তা এমন অসংলগ্ন কেন? সে চিন্তিত গলায় বলল,’দোস্ত শোন। এনগেজমেন্টটা পিছায় দে। আর কয়টা দিন সময় নে তুই। চিন্তা ভাবনা করে দ্যাখ।’
সামি মাথা নাড়ে, ‘নাহ, আব্বা আম্মা কষ্ট পাবে। বাবাকে হয়তো ম্যানেজ করা যাবে সাম হাও। বাট মা কষ্ট পাবেরে। মাকে কষ্ট দিতে পারব না। এমনিতেই একটা বছর দূরে ছিলাম। মা অনেক কষ্ট পাইছে এই এক বছর।
সেই সময় মাঘী কুয়াশার সফেদ আস্তর ভেদ করে ধীর পায়ে অমৃতাকে হেঁটে আসতে দেখা গেল বাগানের দিকে। ফোঁয়ারার পাশে বসে থাকা দুই বন্ধুর সামনে এসে দাঁড়াল সে। ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘তোদের ব্রোম্যান্স শেষ হইছে?’
মনে পড়ল সামির। একটু আগে সে তার বাবার সাথে অমৃতাকে লাইব্রেরি ঘরে যেতে দেখেছিল। এটা এমন কোন বিশেষ ঘটনা নয়, তা সে জানে। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে ঘটনাটা তার মনে দাগ কেটে গেছে। বাবা তার বন্ধুদের খুব একটা পছন্দ করেন না, সেই খবর সে রাখে। আকারে ইঙ্গিতে, এ কথা সে কথায় প্রায়শই তিনি তার বন্ধুদের প্রতি অভক্তি এবং অসম্মানটা না চাইতেও প্রকাশ করে ফেলেন। তবে গত কয়েকদিন যাবৎ বাবার ব্যবহারে সে একটি আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। সে অনুভব করেছে বাবা যেন তার বন্ধুদেরকে ঠিক আগের মতো বক্র চোখে দেখছেন না। বন্ধুদের প্রতি তার মনোভাবটা যেন আগের চাইতে অনেক খানি সহজ এবং তরল। ব্যাপারটা টের পেয়ে ভালো লেগেছে সামির। তৃপ্তিতে মন ভরে গেছে। আজ হঠাৎ এই মুহূর্তে মনে হল বাবার এই আচমকা পরিবর্তনের পেছনের কারণটা কি অমৃতা? অমৃতার কি প্রায়ই কথা হয় তার বাবার সাথে? কই সামিকে তো এ ব্যাপারে অমৃতা কখনো কিছু বলেনি? অথচ বললে তো সামি খুশিই হত। সে তো চায় তার বন্ধুদের সাথে বাবার সম্পর্কটা সহজ হোক। অমৃতার বাসায় গেলে অমৃতার বাবা হাসিমুখে সব বন্ধুদের সাথে কী সুন্দর গল্প করেন! অমৃতার বাবাকে দেখে কতবার সামির মনে হয়েছে, ইশ কতই না ভালো হত যদি তার বাবাও তার বন্ধুদেরকে এমন স্নেহের চোখে দেখতেন! কিন্তু মনে মনে সে জানতো যে বাবা কখনোই তার বন্ধুদেরকে অমন সহজ ভাবে মেনে নেবেন না। বাবা এবং মা, দুজনের ভেতরেই একটা ভীষণ রকমের অহংবোধ কাজ করে সর্বক্ষণ। বলতে নেই, নিজের বাবাকে নিয়ে সামিরও মাঝে মাঝে একটু আকটু গর্ব বোধ হয় বৈকি। কী নেই তার বাবার? শিক্ষা, খ্যাতি, বিত্ত, বৈভব সমস্ত দিক দিয়েই তার বাবা একশতে একশ! তার মাও বা কম কীসে? কিন্তু বাবা মায়ের যে জিনিসটা সামির সবচাইতে অপছন্দ ছিল তা হল মধ্যবিত্তদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। সে জানে তার বন্ধুরা মধ্যবিত্ত বলেই তার বাবা মা ওদের দাম দিতে চান না। আজকে সেই বাবা তার মধ্যবিত্ত বন্ধুদের সাথে হেসে, সম্মান দিয়ে কথা বলছেন, এর চেয়ে বড় পাওয়া সামির জীবনে আর কী হতে পারে?
—‘কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’ স্বাভাবিক গলায় সামি প্রশ্ন করল, অমৃতাকে
অমৃতা একটুও নার্ভাস না হয়ে বলল, ‘গিয়েছিলাম তোদের লাইব্রেরীতে।’ উত্তরটা দেবার পর সে মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিল। ভাগ্যিস হৃদি কথাটা জানিয়েছিল তাকে। নইলে সামির সামনে বেকায়দায় পড়তে হত তাকে।
—‘লাইব্রেরীতে?’
অমৃতা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল, বলল, ‘হ্যাঁ লাইব্রেরীতে। তুই জানিস তোর দাদার একটা চমৎকার লাইব্রেরী আছে?’
—‘হ্যাঁ জানি, বাবা ছাড়া ওখানে আর কেউ যায়না। তুই হঠাৎ ওখানে গেলি কেন?’
সামির প্রশ্নের ধরণটা যেন কেমন ধারা! অমৃতা একটু অবাক চোখে চায় এতদিনের পুরনো বন্ধুটির দিকে। তার একটু একটু বুক কাঁপে। ভয় ভয় লাগে!
কে জানত? জীবনে এমন দিনও আসবে! সে চোখ নামিয়ে বলল, ‘উনার সাথে একটু কথা ছিল।’
—‘কার সাথে?’
—‘তোর আব্বার সাথে।’
—‘তাই?’
—‘হ্যাঁ,ঐযে… ইশে… ইউ এনডিপির এক ভদ্রলোক আমাকে একটা চাকরির অফার দিছে, বুঝছস? তো ভদ্রলোক উনার পরিচিত।’
সামি আবার প্রশ্ন করল, ‘উনিটা কে?’
—‘তোর আব্বা।’
—‘ও… আব্বার পরিচিত?’
—‘হ্যাঁ, তো ওই ব্যাপারে উনার সাথে কথা বলতে গেছিলাম।’
—‘ও’ আলতো ভাবে বলে সামি। এই মুহূর্তে তার মনের মধ্যে একটা অব্যাখ্যেয় অনুভূতি হচ্ছে। একদিক দিয়ে এটা ভেবে ভালো লাগছে যে, তার পিতার সাথে তার বন্ধুদের দূরত্ব একটু একটু করে হয়তোবা ঘুঁচে যাচ্ছে। আবার একই সাথে এটাও মনে হচ্ছে যে, অমৃতা তো তার বন্ধু। বাবার সাথে চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপারে কথা বলার আগে অমৃতার কি উচিৎ ছিল না সামিকে একটাবার তথ্যটা জানানো? ব্যাপারটা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতো হয়ে গেল না? নিজের ভাবনায় নিজে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে সামি। এতটা টিপিক্যাল সে কবে থেকে হল? অশান্তির আগুন জ্বলছে বুকের ভেতর। সবকিছু কেমন এলোমেলো, অগোছালো আর বিধ্বস্ত বলে মনে হচ্ছে। কোথাও এক রত্তি শান্তি নেই। ধুর ছাই, ভালোই তো ছিল এই নয়টা মাস। কোন কুক্ষণে যে সে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে গেল?
আকাশ বলল, ‘ইউ এন ডিপির চাকরি তো ভালো। চান্স নিয়া দেখতে পারিস।’
—‘হুম’ বলল অমৃতা অন্যমনস্ক ভাবে। একটা অস্বস্তির কাঁটা বুকের মধ্যে খচখচ করছিল অবিরত। সামির আব্বাকে ব্যাপারটা কি জানিয়ে রাখা উচিৎ যে সামিকে সে বলেছে লাইব্রেরি ঘরে চাকরির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছিল? হ্যাঁ মনে হচ্ছে জানিয়ে রাখা উচিৎ। সামি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন করলে যেন তিনি অপ্রস্তুত না হয়ে পড়েন।
বিভা, হৃদি আর রুদ্র পৌঁছে গেল খানিকক্ষণের মধ্যেই। হৃদি দৌড়ে এসে অমৃতাকে বলল, ‘আগে থেকে বলে রাখলাম তোকে কিন্তু আমি সাজাবো।’
বিভা হৃদিকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিয়ে হড়বড় করে বলল, ‘হবে না এসব। আমি সাজাবো তোকে। এটা আমার আজীবনের স্বপ্ন।’
আকাশ বিস্ময় ডুবি কণ্ঠে বলল, ‘মানে কী? অমৃতার বিয়া হইতাছে নাকি?’ অমৃতা দুই বান্ধবীর কান্ড দেখে মুচকি মুচকি করে হাসছিল। বিভা ঘোষণা দেয়ার গলায় বলল, ‘অমৃতা শাড়ি পরবে। সামির এনগেজমেন্ট এ।’
কথাটা মাটিতে পড়ার আগেই রুদ্র আর সামি হৈ হৈ করে উঠলো। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে আকাশ। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বেশ অনেকটা সময় চুপ করে থেকে সে আচ্ছন্ন গলায় বলল, ‘অমৃতা পরবে শাড়ি?’
অমৃতা হাসে, মৃদু ভাবে বলে, ‘পরলাম না হয় একদিন। সামির বিয়া বলে কথা!’
আকাশ অমৃতার দিকে অবিশ্বাস ভরা এক দৃষ্টি তাক করলো, ‘হঠাৎ তোর কী হইল অমৃতা? ইজ এভরিথিং অলরাইট?’
অমৃতা কিছু বলল না। মুখ নামাল নিচে। একটা বিষাদ ছোঁয়া নিশ্বাস পড়ল তার বুক থেকে। আকাশ আর রুদ্রর কাছ থেকে অনেক কিছুই লুকোনো হয়ে যাচ্ছে আজকাল। ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছেনা। তাদের বন্ধুদের মধ্যে তো এসব লুকোছাপা কখনো ছিল না। সব কিছু কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
৩৪
পরের দুটা দিন কাটলো ঝড়ের বেগে। এনগেজমেন্ট খেতে সামিদের গ্রামের বাড়ির আত্মীয় স্বজন চলে এসেছে। রোমেলা তার শ্বশুর বাড়ির দিকের গ্রাম্য লোকজনদের একেবারেই পছন্দ করেন না। তার শ্বশুররা ছিলেন তিন ভাই। তিন ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র তার শ্বশুর আব্বাই ঢাকা শহরে সেটেল্ড ছিলেন। বাকিরা সব গ্রাম্য চাষাভুষা। তাঁর স্বামী জন্মের পর থেকে ঢাকা শহরে বসবাস করলেও গ্রাম্য স্বজনপ্রীতি কোনো রকমেই কাটিয়ে উঠতে পারেননি এখন অবধি।
রোমেলারা সব মিলিয়ে তিন বোন। তিন বোনের মধ্যে বড় জন থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। সামির এনগেজমেন্টে তিনি আসতে পারছেন না। তবে বিয়েতে অবশ্যই আসবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তার ছোট বোন ঢাকার বারিধারায় থাকেন। এই দুবোন ছাড়া নিকটাত্মীয় বলতে তার আর তেমন কেউ নেই। গ্রামের লতাপাতার আত্মীয় স্বজনদের সাথে তিনি কোনো সম্পর্কই রাখেন নি। গরিব আত্মীয়রা কোনো কাজে আসেনা। উপরন্তু দুদিন পর পর শুধু হাত পাতার ধান্ধায় থাকে। তাঁর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজনদেরও এই হাত পাতার বাতিক আছে। এর মাঝে আবার জুড়ে বসেছে অসুস্থ ফুপু শাশুড়ি। অসুস্থ রোগীর জন্য আলাদা একজন কাজের লোক রাখতে হয়েছে। গ্রাম্য লোকজন সারা বাড়ি নোংরা করছে ইচ্ছে মতন, বাথরুম করে ফেলছে কাদা কাদা। এদের জন্য নিচের তলার চারটা গেস্ট রুম বরাদ্দ করা হয়েছে, তারপরেও এদের বাচ্চা কাচ্চারা সুযোগ পেলেই উপর তলায় উঠে আসছে। একটু আগে তার খালাতো ননদের তিন বছরের বাচ্চা দোতলার সিঁড়ির গোড়ায় পেশাব করে দিয়েছে। এসব কতক্ষণ সহ্য করা যায়? তার ছেলেটাও হয়েছে বাপের মতো। গ্রামের চাষাভুষা গুলোর সাথে তার মাখনের মতো ভাব। একটু আগে তিনি দেখেছেন পেছনের উঠোনে ছেলে তার গ্রাম থেকে আগত কাজিনদের নিয়ে ক্রিকেট খেলছে। বাপ ব্যাটা আছে বেশ আনন্দে। আর এদিকে সংসারের ঘানি টানতে টানতে তার হয়েছে মরণ দশা! কাজের লোক থাকলেই কি হয় নাকি? কাজে লোক চালানোও যে একটা কত বড় দায়িত্ব তা কজনে বোঝে?
এদিকে রাহাত যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছে বাংলাদেশে। সামির এনগেজমেন্টের আগের দিন রাহাতের বাবা মা হৃদির বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলেন। মোটামুটি একটা কথা পাকাপাকি হয়ে গেল যে এই ফেব্রুয়ারির কোনো এক শুক্রবারে ওদের আকদ হয়ে যাবে। রাহাতকে দেখেছিল হৃদি অনেক আগে, স্কুলে পড়ার দিন গুলোতে। সেই সময় রাহাত সুদর্শনই ছিল বলা চলে। কিন্তু এ কয়েক বছরে আমেরিকার বাতাস লেগে তার শরীর হয়ে গেছে দ্বিগুণ চওড়া। সে লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভালো। পেশায় ডাক্তার। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি হাসপাতালে প্র্যাকটিস করে। ভালো অংকের বেতন পায়। এমন পাত্র আজকাল বিয়ের বাজারে বিরল। তবে তার দোষ শুধু একটাই, বড্ড মোটা!
কিন্তু হৃদি কোনো আপত্তি করল না। চুপচাপ বাবা মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিল লক্ষ্মী মেয়েটি হয়ে। মোটা হলেই বা কী? মানুষের মনটাই আসল, বাইরের আবরণটা কিছুই না। বিভা পারলে সে কেন পারবেনা? হ্যাঁ হয়তো রাহাতও, অভিজিতেরই মতো ভালো মনের একজন মানুষ। হৃদিও ভুলে যাবে সামিকে। সংসার করবে মন দিয়ে। খুব মন দিয়ে!
অনেক রাত অবধি নিঃশব্দে কাঁদল সে। কেউ টের পেলোনা। টের পেলো শুধু তুলো ভর্তি বালিশ, আর বিছানার চাদর। আগামী কাল সামির এনগেজমেন্ট। উড়ো খবর পেয়েছে হৃদি, হয়তো আকদ হলেও হয়ে যেতে পারে। হয়ে যাক! ক্ষতি কী? হৃদির আর কিছুই এসে যায় না। সে তো যাচ্ছেই চলে, প্রবাসে!
সামির ফোনটা আসলো রাত তিনটায়। গত রাতেও সামি ফোন করেছিল অসংখ্য বার। সে ধরেনি। একটা সময় ফোন সুইচড অফ করে দিয়েছিল। আজকে কী করবে? আগত ফোন কল হৃদির কান্নার দমক বাড়িয়ে দিল। বুকের ভেতর অদম্য, অবাধ্য, প্রলয়ঙ্কর এক ঝড় বইছে। বুক কাঁপছে, হাত কাঁপছে, দমে পড়েছে টান।
অনেক গুলো রিং পড়ার পর সে ফোনটা ধরলো। কান্না থামাতে পারলোনা। থামানোর চেষ্টাও করলোনা। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘কেন ফোন দিচ্ছিস? কী সমস্যা?’
‘কানতেছিস ক্যান?’ শুরুতেই একটা ধমক দিয়ে ওঠে সামি।
—‘মনে চাইছে তাই কানতেছি। তুই এই মাঝরাত্রে কী চাস?’
—‘তোর এই যখন তখন কান্না করার স্বভাবটা পাল্টা। বিরক্ত লাগে।’
হৃদি শোয়া থেকে উঠে বসল। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বিছানার সাইড টেবিলে রাখা টিস্যুর বাক্স থেকে কয়েকটা টিস্যু পেপার বের করে নিল। চোখ মুছলো। নাক টানলো বার কয়েকবার। কেশে গলা পরিষ্কার করে ভারী ভাবে বলল, ‘কী হইছে? ফোন দিছিস ক্যান?’
—‘তুই গতরাতে আমার ফোন ধরিস নাই ক্যান?’
—‘আমার ইচ্ছা।’
সামি দুর্বল গলায় বলল- ‘কালকে আমার এনগেজমেন্ট। এরকম একটা সময়ে তুই আমার পাশে থাকবিনা?’
—‘ফালতু কথা বলিস না সামি, পাশে তো আছিই। পাশে আছি এটা বোঝানোর জন্য কি ফোনে কথা বলাটা জরুরি?’
—‘আমার যখন তোকে লাগবে তখন যদি না পাই, তাহলে এই বালের পাশে থাকার মানে কী?’
—‘আমাকে তোর কেন লাগতেছে? কীসের জন্য?’
এ প্রশ্নের কোনো তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে পারল না সামি। কয়েকটা নীরব ক্ষণ বিষাদ মাখা জেলো বাতাসে সাঁতার কাটতে থাকল দুজনের মধ্যে, টেলিফোনের অন্তর্জালে। শীতকালের রাত বলে চারপাশে কোনো শব্দ নেই। রাস্তায় একটা নেড়ি কুকুর শুধু নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তারস্বরে ডেকে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। কেমন কান্নার মতো শোনাচ্ছে ওর ডাকটা। বুকের ভেতরটা চমকে চমকে উঠছে ওই ডাকে। কী কারণে অমন গলা ফাটিয়ে কাঁদছে খোদা মালুম!
হৃদি অধৈর্য ভাবে বলল, ‘কথা বলতেছিস না ক্যান?’
—‘তোকে এতবার ফোন করলাম হৃদিতা, একটা বার ফোন ধরার প্রয়োজন বোধ করলিনা?’
—‘কোনো দরকার ছিল?’
সামি বড় শ্বাস ফেলে। আস্তে করে বলে, ‘কথা বলতে ইচ্ছা করতেছিল, তোর সাথে!’
একটা সাধারণ বাক্য। অথচ কী অসীম এর শক্তি! এক নিমেষে কথাটা হৃদির চারপাশটাকে হোলির ময়দানে রূপান্তরিত করে দিল। জানালার বাইরে আটকে থাকা শীত শর্বরীর ধোঁয়াটে কুয়াশায় মুহূর্তের জন্য মিশে গেল রংধনুর সাত রং!
হৃদিকে চুপ করে থাকতে দেখে সামি বলল, ‘আসলে তোর সাথে কথা বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে তো, এই জন্যেই হয়তো…’
হৃদি একটা বড় নিশ্বাস গোপন করল। হোলির ময়দানের সাত রং ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো। অভ্যাস, শুধুই কি অভ্যাস সামি? এর চেয়ে বেশি কিছু নয়?
—‘অভ্যাস?’ শব্দটা উচ্চারণ করে হৃদি। টেনে টেনে স্পষ্ট ভাবে।
সামি বিভ্রান্ত গলায় বলে, ‘অভ্যাসই মনে হয়।’
একটা নাম্বার সামির ফোনের ওয়েটিং লিস্টে ঢুকে টুংটুং করে ঘন্টা বাজাচ্ছিল। নাম্বারটা দেখে নিয়ে সামি বিরক্ত গলায় বলল, ‘তানিশা ফোন দিচ্ছে।’
—‘তোর ফোন ওয়েটিং এ পাচ্ছে ও। এখন কী বলবি?’
—‘কী বলব আবার, যা সত্য তাই বলব।’
—‘এটা ঠিক হচ্ছে না সামি। মেয়েটাকে তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস। তোর উচিত ওর পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দেয়া।’
—‘লেকচার দিস না তো। এখন লেকচার শুনার মুড নাই।’
—‘তোর নাকি আকদ হয়ে যেতে পারে কালকে? কথা কি সত্য?’
—‘আকদ মনে হয় পরশু দিন সকালে হবে।’
—‘বেশ, এখন ফোন রাখ। তোর বৌকে আমার কথা বলিস না। বলিস যে অন্য কারো সাথে কথা বলতেছিলি।
—‘আমি মিথ্যা বলতে পারব না। আর এখন আমি ফোন রাখবো ও না।’
—‘রাখবিনা মানে? তানিশা ফোন দিচ্ছে তো!’
—‘দিক। এখন আমি তোর সাথেই কথা বলবো।’
—‘কী সাঙ্ঘাতিক কথা! মেয়েটা কষ্ট পাবে সামি। এরকম করিস না।’
—‘তোর ডাক্তার কি দেশে আসছে?’
—‘হ্যাঁ, আসছে তো। বিয়ের কথা মোটামুটি পাকা হয়ে গেছে।’
—‘তাই?’
—‘হুম, চলে যাবো দোস্ত, আমেরিকা।’
সামি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। তার মনটা অসম্ভব রকমের খারাপ। বিভা চলে গেছে, হৃদি চলে যাবে, চলে যাবে রুদ্রও! এ দুদিন ধরে তার সিগারেট খাওয়ার পরিমাণ আরো বেড়েছে। কিছু ভাল্লাগেনার জগতে ওই নিকোটিনের ধোঁয়াটাই কোথেকে যেন একটু ভালো লাগার ছোঁয়া এনে দেয়। সে বুঝতে পারছে তানিশার ফোনটা তার ধরা উচিৎ। হৃদির সাথে রোজই কথা হয়। এনগেজমেন্টের আগের রাতে হৃদির সাথে ফোনে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না। যার সাথে বিয়ে হবে তাকে সময় দেয়াটাই এখন জরুরি এবং সেটাই নিয়ম। কিন্তু নিয়ম মেনে কি সব হয়? গত রাতে হৃদি যখন তার ফোন ধরছিল না, তানিশা তখন তার সঙ্গে ছিল, সেলফোনে। সেই থাকাতে লাভটা হয়েছে কী? তানিশা তো কোনো ভাবেই হৃদির অভাব পূরণ করতে পারেনি। মনে হচ্ছিলো হৃদিকে অন্তত একটা গুডনাইট বলতে না পারলে তার ঘুম হবে না। সামি হিসাব করে দেখেছে গত তিনশত সত্তরটা রাতের মধ্যে একটা রাতও হৃদিতাকে গুডনাইট না বলে সে ঘুমোতে যায়নি। এই তিনশত সত্তর দিনের অভ্যাস কি এতো সহজে কাটিয়ে তোলা সম্ভব?
—‘কী করবি আমেরিকা গিয়ে?’ হঠাৎ বলে উঠল সামি।
—‘জানি না।’
—‘কী রকম জীবন চাই তোর?’
—‘কী রকম জীবন?’ প্রশ্নটা যেন নিজেকেই নিজে করে হৃদি। চুপ করে ভাবে। আস্তে আস্তে বলে, ‘জানিস, আমার একটা ইচ্ছা জীবন চাই। এই ধর, ইচ্ছা হলেই কপালের মাঝখানে একটা টিপ পরব, কানের পাশে ফুল গুঁজব, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিব, রিকশার হুড খুলে বৃষ্টিতে ভিজব, ইচ্ছা হলেই ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরব, তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাব… ইত্যাদি, ইত্যাদি… ইচ্ছা গুলা অতি সাধারণ। কিন্তু এই অতি সাধারণ ইচ্ছা গুলোই কারো কারো জীবনে পূরণ করাটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।’
—‘তুই কি রবিনকে এখনো ভালোবাসিস?’ সামি বলে, গম্ভীর গলায়। এ কথা শুনে হৃদির ভেতরে অনেক দিন ধরে চেপে রাখা একটা প্রশ্ন হৃৎপিন্ড চিরে কণ্ঠনালী দিয়ে ঊর্ধমূখী হয়ে বেরিয়ে আসে, আপনাআপনি!
—‘তুই কি বিভাকে এখনো ভালোবাসিস?’
সামি থমকে গেল। আচমকা এক অনির্বচনীয়, অনাহূত, এবং সম্পূর্ণ অচেনা বোধ তার সমস্ত চেতনাকে মুহূর্তের জন্য কেমন বিবশ করে তুলল। মস্তিষ্কের নিউরনে বিপবিপ করে কেউ একজন ছড়িয়ে দিল একটা বার্তা 1 বার্তাটি এমন যে, হৃদির একটা সময় রবিন ছিল, সামির ছিল বিভা। যখন বিভা ছিল না, রবিন ছিল না, তখন শুধুই তারা দুজনে ছিল, আর যখন শুধুই তারা দুজনে ছিল, তখন তারা ভালোই ছিল!
শুধু হৃদি আর সামি…!
তার হঠাৎ মনে হল হৃদি প্রবাসে চলে গেলে সে বোধহয় মরেই যাবে!
তানিশার ফোন কড়া নাড়ছে, তো নাড়ছেই। সামির ভাবনা গুলো ধীরেধীরে এলোমেলো হয়ে উঠছিল। কেমন একটা ভয় ভয় লাগছিল তার। মনে হচ্ছিল যেন ট্রেন থামতে যাচ্ছে ভুল স্টেশনে। সঠিক স্টেশনটা চোখের সামনে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে সে। এক্ষুনি সঠিক জায়গায় ট্রেনটা থামানো বড্ড জরুরি। কিন্তু কোনও এক পরাশক্তি প্রবল যাদুবলে তাকে স্থবির করে দিয়েছে, অশ্মীভূত করে দিয়েছে। সে কিছু বলতে পারছে না, নড়তেও পারছে না।
সে অনেক কষ্টে হৃদিকে বলল, ‘তানিশা খুব বিরক্ত করতেছে। রাখি কেমন?’
—‘আচ্ছা।’
—‘গুড নাইট।’
—‘গুডনাইট।’ সামি ফোন কাটলো। আজকে সে হৃদিকে গুডনাইট বলতে পেরেছে। যাক, আজকের রাতটা অন্তত গতরাতের মত নির্ঘুম কাটবে না। কিন্তু তারপর…?
.
জানালার পর্দার ফাঁক গেলে মাঘী সকালের স্ফটিক রঙা রোদ্দুর ঢুকে পড়েছিল বিভার শোবার ঘরে। ইচ্ছে মত চারিয়ে বেড়াচ্ছিল রোদটা, গায়ে জড়ানো নরম লেপের ওপর, বালিশে ছড়িয়ে থাকা দীঘল কালো চুলের ওপর। চোখের ঢাকনায় ওই স্ফটিক রোদ্দুরের দাপাদাপিতে শেষ রাতে পাওয়া আরাধ্য ঘুমটা ছুটি নিতে বাধ্য হল। জেগে উঠতেই পুজোর ঘর থেকে মায়ের গানের গলার আওয়াজ শুনতে পেলো সে, তার সাথে ঘন্টার ঢং ঢং। গায়ের ওপর থেকে লেপটা সরিয়ে সেলফোন হাতে নিল। রোজ সকালে অভিজিৎ একবার ফোন দেয়। অফিস যাবার আগে। আজকে সেলফোনটা চেক করে দেখা গেল কোনো মিসড কল নেই।
কলিং বেল বেজে উঠল, সাত সকালে। টিং টিং করে একটা বিশ্রী বাজনা, তারপর এক নারী কণ্ঠের বলে ওঠা, প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর। খুব বিশ্রী লাগে বিভার এই ডাকটা। ঘড়িতে কাঁটায় সকাল সাতটা। এতো সকালে কে আসলো? প্রশ্নটা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরটাও কানে চলে এলো। স্পষ্ট শুনতে পেলো মায়ের গলা, ওমা! জামাই বাবু দেখি! বিভা, এই বিভা! দেখে যা কে এসেছে!
বিভা চমকে ওঠে। কিশোরীর মতো মেতে ওঠে আহ্লাদে। খুশি বাজতে থাকে ঝনঝন করে, হৃদমন্দিরে! তীব্র হর্ষাবেশে ছেয়ে যায় তার ভিতর, বাহির সমস্তটা। চট করে উঠে পড়ে। আয়নায় নিজেকে দেখে নেয় নিমেষে। এক মুহূর্তও দেরি না করে তোয়ালে হাতে নিয়ে ছুটে যায় বাথরুমে। সাবানের ফেনা তুলে ভালো মতো চান করে। তারপর একটা লেবুপাতা রঙের সদ্য ভাঁজ ভাঙা শাড়ি পরে নেয়। ভেজা চুল ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নেয়। যত্ন করে সিঁদুর পরে সিঁথিতে। মনের আনন্দের ছাপ তার মুখে এসে পড়ে। এমন বাঁধ ভাঙা লাবণ্যের জোয়ার নিজের মধ্যে সে এর আগে কখনও দেখেনি! কে যেন কবে বলেছিল, প্রেমে পড়লে মেয়েরা সুন্দর হয়ে ওঠে। বিভা তাহলে প্রেমেই পড়েছে। অভিজিৎ নামের ওই স্বল্পভাষী, চশমা পরা, ভালো মানুষী চোখের অতি সাধারণ লোকটার প্রেমে পড়েছে সে!
বসার ঘরে অভিজিৎ বাবার সাথে কথা বলছিল। তার মুখে একটু ক্লান্তির ছাপ। শেষ রাতের ফ্লাইট ধরেছিল সে। রাতে ঘুম হয়নি। কিন্তু সেই রাত জাগার ক্লান্তিটা তার মুখ থেকে চকিতে পালিয়ে গেল, যখন লেবুপাতা রঙের শাড়ি পরা বিভা, মাঘী সকালের স্ফটিক রোদ্দুর মাথার চুলে মেখে ওর সামনে এসে দাঁড়াল, স্নিগ্ধ চোখে সে চেয়ে দেখল বিভাকে কয়েক সেকেন্ড। তারপর মৃদু ভাবে বলল, ‘আপনার বন্ধু যদিও দাওয়াত করেনি আমায়, তবুও চলে এলাম এনগেজমেন্ট খেতে।’
.
এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান হবে হোটেল ওয়েস্টিনে। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই সবার সেখানে উপস্থিত হয়ে যাবার কথা। দুপুরে সামির কতিপয় কাজিন এবং বন্ধু মিলে মেয়ের বাড়ি গিয়ে পানচিনির তত্ত্ব দিয়ে আসলো। সব মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশটা ডালা হয়েছে। এতগুলো ডালা বহন করার জন্য মানুষও লাগলো কমসে কম তিরিশ জনের মত। বন্ধুরা সবাই আসল, এমনকি অভিজিৎও আসলো। কিন্তু আসলো না শুধু হৃদি। তার নাকি মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। সামির কেন যেন মনে হল মাইগ্রেনের ব্যথাটা একটা বাহানা মাত্র। হৃদি তাকে এড়াতে চাইছে। এই ভাবনাটা তাকে ভেতরে ভেতরে চিন্তিত করে তুলল।
বন্ধুরা আর কাজিনরা যখন তানিশাদের বাড়িতে, সামি তখন বাবার সাথে জুম্মার নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাচ্ছিল। মসজিদ কাছেই। হেঁটে যাওয়া যায়। দুজনের গায়ে খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। রোমেলা গত ঈদে আড়ং থেকে কিনে এনেছিলেন। বাপ ছেলের জন্যে একই রঙের, একই ডিজাইনের দুটি পাঞ্জাবি। একই ডিজাইনের পাঞ্জাবি পরা দুজনের দিকে হঠাৎ চোখ পড়লে, বাবা ছেলে বলে মনে হয় না। মনে হয় বুঝি বড় ভাই, ছোট ভাই।
বাপ ব্যাটা হাঁটতে হাঁটতে তখন মসজিদের কাছাকাছি চলে এসেছিল। সেই সময় হক হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাকে এরকম আপসেট দেখাচ্ছে কেন আব্বু? সব ঠিক আছে তো?’
সামি বাবার দিকে তাকালো। অনেক বয়স পর্যন্ত তার একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, তার বাবা পৃথিবীর সব সমস্যা সমাধান করতে পারে। গোটা দুনিয়ায় এমন কোনো জিনিস নেই যা তার বাবার সাধ্যের বাইরে। ক্রমে ক্রমে ধারণাটা পাল্টে গেছে। এখন সে জানে যে জীবনে কিছু সমস্যা আছে যেগুলো চাইলেই মানুষ সমাধান করতে পারে না। প্রকৃতি মানুষকে সেই বিশেষ সময় গুলোতে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তার মানবিক সীমাবদ্ধতা। বাবার অনেক টাকা, অনেক ক্ষমতা। কিন্তু সেই ক্ষমতা কোনো ভাবেই সামির মনোজগতে চলতে থাকা অবর্ণনীয়, ভাষাতীত, অব্যাখ্যেয় বিগ্রহের মীমাংসা করতে পারবে না। টাকা দিয়ে সব কেনা যায়, যায় না শুধু কেনা মানব মনের প্রকৃত সুখ!
—‘ঠিক আছে বাবা। সব ঠিক আছে।’ সামি বলল, ম্লান গলায়।
হক ছেলেকে ভালো মত দেখলেন। অভিজ্ঞ চোখে যাচাই করলেন নিজ পুত্রকে। বললেন, ‘তুমি কি এই বিয়েটা মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে করছ?’
সামি মুখ নামালো নিচে। বাবা হয়ে ছেলেকে এসব প্রশ্ন করা মানায় না। তবুও হক সাহেব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললেন, ‘তুমি কি ওই মেয়েটিকে এখনো ভুলতে পারোনি?’
সামি অপ্রস্তুত হাসলো। তানিশাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা বাবা মা তার ওপরে চাপিয়ে দেননি। এটা সম্পূর্ণ তার একক স্বাধীন সিদ্ধান্ত ছিল। তাই এই সিদ্ধান্তের সুফল বা কুফল যাই আসুক না কেন তা সামিকে একাই বইতে হবে। এ সিদ্ধান্তের দায়ভার কোন ভাবেই বাবা মায়ের ওপর বর্তায় না। সে নিজে সুখী না হলেও চলবে। কিন্তু বাবা মায়ের থাকতে হবে চিন্তামুক্ত। সামি বাবার চোখে চেয়ে হাসলো, ‘আরে না, এসব কিছুই না। চিন্তা কর না তুমি। রাতে ঘুম হয়নি তো। তাই একটু শরীরটা খারাপ লাগছে।’
হক আর ঘাঁটালেন না ছেলেকে। কিন্তু তার মনটা খচখচ করতে থাকল।