বৃষ্টিমহল ২.২৫

২৫

হক সাহেব ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতেই উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে একটি অনভিপ্রেত চাঞ্চল্য দেখা দিল। ড্রইংরুমের সোফায় পা তুলে বসে থাকা রুদ্র তাঁকে দেখা মাত্র লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। পাশের বাসার দম্পতিও এই সম্মানটুকু দেখাতে দ্বিধা বোধ করলনা। এই ব্যক্তিটিকে চেনেনা এমন লোকের সংখ্যা বাংলাদেশে একেবারেই কম বর্তমানে। তিনি কেবল মাত্র দেশের ধনাঢ্য ব্যাক্তি তালিকার প্রথম সারির একজন তাই নয়, রাজনৈতিক অঙ্গনেও বেশ পরিচিত এক মুখ। রোমেলা এই বাসায় প্রায়ই আসেন ছেলেকে দেখতে। কিন্তু হকের এই প্রথম আসা। রুদ্র তো এঁকে যমের মত ভয় পায়। সর্বদা এড়িয়ে চলে। সামির বাড়িতে থাকা কালীন সময়ে লোকটার সাথে তার কথা হয়েছে হাতে গোনা দুই একবার। দৈবক্রমে সামনে পড়ে গেলে একটা সালাম দিয়েই পালিয়ে যেত সে। বলতে কি বন্ধুদের কেউই এই অহংকারী দম্পতি টিকে খুব একটা পছন্দ করেনা। সামির আম্মা অহংকারী এবং ঠোঁটকাটা হলেও আদতে দুর্বল বুদ্ধির অধিকারিণী। তাই তার ডাঁটিয়াল কথাবার্তা গুলো বোকামি মনে করে কোনও এক ভাবে হজম করে ফেলা যায়। কিন্তু হকের ব্যাপারটা অন্যরকম। তিনি একাধারে অহংকারী, বুদ্ধিমান, সপ্রতিভ এবং অটল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এঁর মুখের ওপর চট করে কিছু বলা যায়না। আবার খুব বেশিক্ষণ এঁর উপস্থিতি সহ্যও করা যায়না। হাঁসফাঁস লাগে। 

রোমেলা ঘরের ডেকোরেশন দেখে বললেন, ‘বাব্বাহ ভালোই তো সাজিয়েছ!’ 

—‘জ্বি আন্টি, ডাইনিং রুমটাও সাজিয়েছি। আসুন দেখে যান।’ রোমেলা হৃদির সাথে ডাইনিং এ চলে গেলেন। তাদের পেছন পেছন পাশের বাড়ির মেয়েটিও আসল। হক বসলেন ড্রয়িং রুমের সোফায়। রুদ্রদের দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে বললেন, ‘বসো, বসো, দাঁড়িয়ে কেন?’ 

পাশের বাড়ির ছেলেটার নাম ফয়সাল। বেশ মিশুক এবং স্মার্ট ছেলে। কিন্তু এ মুহূর্তে হক সাহেবের সামনে বসে থেকে তার মাঝে কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট ভাব কাজ করছে। এমন যশস্বী ব্যক্তির সাথে ঠিক কীভাবে কথা শুরু করা যায় তা সে বুঝে উঠতে পারছেনা। সে এবং রুদ্র দুজনেই বসে আছে নত মুখে। বিকার নেই শুধু বুবুনের। সে সমানে নেচে নেচে বলে যাচ্ছে তখনও ‘পয়সা লেবো! আমি পয়সা লেবো!’ 

হক বুঝতে পারছেন না এতটুকু বাচ্চা পয়সা দিয়ে কী করবে। তিনি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ বাচ্চা ছেলেটির দিকে চেয়ে থেকে ফয়সালকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার ছেলে?’ 

—‘জি স্যার।’ বলল ফয়সাল। 

—‘কী বলছে ও?’ 

ফয়সাল মিনমিন করে বলল,’কেন যে হঠাৎ পয়সা পয়সা করছে আমার ছেলেটা ঠিক বুঝতে পারছিনা।’ 

রুদ্র চোরের মত আড়চোখে তাকাল একবার বুবুনের দিকে। এই বুলি যে রুদ্র শিখিয়েছে সেই সত্য কথাটা আবার সবার সামনে ফট করে বলে বসবেনা তো বান্দরের বাদশাহ? কথাটা মাথায় আসতেই রুদ্র বড় ব্ৰিত বোধ করতে লাগল। 

হক এবার রুদ্রকে বললেন,’তোমার কী খবর?’ 

—‘এইতো আংকেল ভালোই।’ 

হক জানেন এই ছেলেটি ভালো ছাত্র। তার পুত্রের বন্ধুদের মধ্যে এই ছেলেটি এবং অমৃতা, এই দুটি ছেলেমেয়ের মাথা ভালো। তার পুত্র যে ছাত্ৰ খারাপ, তা নয়। কিন্তু পড়ালেখা বা ক্যারিয়ার নিয়ে সে কখনই খুব একটা সিরিয়াস ছিল না। একমাত্র সন্তানের লেখাপড়ার ওপর খুব বেশি চাপ সৃষ্টি করেননি তিনি কখনও। কিন্তু রুদ্র নামের ছেলেটি ছাত্র ভালো হলেও এর চলাফেরা উজবুকের মতো। মাথা ভর্তি লম্বা চুল নিয়ে গিটার বাজিয়ে ষাঁড়ের মত চ্যাঁচায় সারাদিন। এই একটি কারণেই তিনি ছেলেটিকে অপছন্দ করেন। কিন্তু তাঁর পছন্দ অপছন্দে কিছু এসে যায়না। সামির হৃদয়ে বন্ধুদের জন্য আছে এক সমুদ্র পরিমাণ ভালোবাসা। তিনি জানেন, তার পুত্রের বন্ধুরা একদিকে, দুনিয়া আরেকদিকে। 

রুদ্র কিছুক্ষণের মাঝেই অস্থির হয়ে উঠল। তার মনে হচ্ছে এমন বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে এর আগে সে কোনোদিন পড়েনি। অমৃতার ওপর রাগ হচ্ছে। কী দরকার ছিল এই রাগী, খিটখিটে লোকটাকে দাওয়াত করে ডেকে নিয়ে আসার? পার্টির আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল। সে একটু ইতস্তত ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এক্সকিউজমি আংকেল, আমার একটা জরুরি ফোন করতে হবে। আমি একটু আসছি।’ 

হক হেসে বললেন,’নো প্রব্লেম।’ তিনি জানেন তার পুত্রের বন্ধুদের মাঝে তার সম্পর্কে একটি ত্রাস বা শঙ্কা কাজ করে সর্বক্ষণ। এদের কারও সাথে তিনি কখনও খারাপ ব্যবহার করেন নি। ধমকও দেন নি। তবুও এরা তাকে সহজ ভাবে নিতে পারেনা। যমের মতো ভয় পায়। ব্যতিক্রম শুধু একজন! আচ্ছা, সেই বিচ্ছু মেয়েটি কোথায়? যার অনুরোধের ঢেঁকি গিলতেই এই ফ্ল্যাটে তাঁকে আসতে হল শেষ পর্যন্ত? হক ঘাড় ঘুরিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে তাকালেন। ড্রয়িং কাম ডাইনিং এর মাঝখানে পর্দা দিয়ে পার্টিশন দেয়া হয়েছে। পর্দার ফাঁকে ডাইনিং টেবিলের একাংশ দৃশ্যমান হয়ে আছে। টেবিলের সাথের লাগোয়া চেয়ারে বসে আছেন তাঁর স্ত্রী। অন্য কিছু দেখা যাচ্ছেনা। রুদ্র ঘর থেকে বেরোতেই বুবুন লাফঝাঁপ দিয়ে ওর পেছন পেছন দৌড়ে গেল। খানিক বাদে ফয়সালও টয়লেট যাবার বাহানা দিয়ে উঠে পড়ল। হক বসে রইলেন একা। 

অমৃতা ডাইনিং এ এসে দেখতে পেল সামির আম্মাকে। মহিলার পরনে হালকা সবুজ রঙের সিল্ক শাড়ি। গলায় কানে হীরের পাথর খচিত সোনার গয়না। ফর্সা গালে ব্লাশনের লাল ছোঁয়া। ঠোঁটে কফি কালারের লিপস্টিক। গা থেকে উড়ে আসছে বিদেশী দামি পারফিউমের ঘ্রাণ। ডাইনিং এর চেয়ারে বসে তিনি হাত নেড়ে নেড়ে হৃদির সাথে কথা বলছেন। অন্য কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছেন না। একবার কথা বলা শুরু করলে তিনি থামতে ভুলে যান। হৃদি এবং পাশের বাসার ভাবি হা করে তার কথা গিলছে। অমৃতা রোমেলার পাশে এসে দাঁড়াল। সালাম দিয়ে বলল, ‘আন্টি কেমন আছেন?’ 

রোমেলা এক গাল হেসে বললেন, ‘খুবই ভালো। আলহামদুলিল্লাহ। আমরা সামির এনগেজমেন্টের ডেট প্রায় ফিক্স করে ফেলেছি। আর জানোই তো, সামির মেয়ে খুব পছন্দ হয়েছে।’ 

অমৃতা হৃদির দিকে তাকাল এক পলক। সামি বন্ধুদের জানিয়ে দিয়েছে যে মেয়ে তার মোটামুটি পছন্দ। বিয়ে করলে নাকি সে এই মেয়েকেই করবে। কিন্তু অমৃতা লক্ষ্য করেছে সামির এই সিদ্ধান্ত শোনার পর থেকে হৃদির আচরণে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে গেছে। সে সামির বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তার চোখ মুখের ভঙ্গি। যেমন এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে বিয়ের টপিক নিয়ে আলোচনা করতে সে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেনা। 

রোমেলার বকবক শুনতে শুনতেই অমৃতা ড্রয়িং রুমের দিকে তাকাল। পর্দার ফাঁক দিয়ে লোকটার মুখের এক পাশ দেখা যাচ্ছে। সাদা পাঞ্জাবী তার পরনে। গালে কয়েকদিনের অযত্নের দাড়ি। জুলপিতে হালকা সাদা আঁচড়। রুদ্র কিংবা ফয়সাল কেউ নেই ওখানে। মানুষটাকে একলা বসিয়ে রেখে এরা অন্য ঘরে চলে গেছে। এদের কি ন্যূনতম ভদ্রতা জ্ঞান নেই? 

—‘তুই দাঁড়ায় আছিস ক্যান? বসে পড়।’ বলল হৃদি, অমৃতাকে। 

কী করবে অমৃতা? লোকটার সাথে একবার দেখা করে আসবে কি? নাকি এখানে বসে পড়বে হৃদির কথা মতো? সিদ্ধান্তহীনতায় সে খুব একটা ভোগেনা। তবে আজকে হালকা দোটানায় পড়ে গেল। সেই সময় লোকটা আচমকা তাকাল ঝুলন্ত দুটি পর্দার মাঝ বরাবর জায়গাটিতে। যেখানে এই মুহূর্তে অমৃতা দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চোখ পড়ল। কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তি। তারপর অমৃতা হৃদিকে আস্তে করে বলল, ‘দাঁড়া, আসতেছি।’ 

কথাটা বলা শেষ করে ধীর পায়ে হেঁটে আসল বসার ঘরে। একটা শিহরণ টের পাচ্ছিল সে ভেতরে ভেতরে। মনোবীণায় আজ বাজছে এক অন্যরকম সুর। এ সুর তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন এবং অচেনা। আশ্চর্য! এরকমও হয় নাকি? সে একটা বড় শ্বাস নিল। লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম!’ 

হক সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,’কেমন আছ?’ 

—‘ভালোই, আপনি?’ 

—‘এইতো চলছে। বসো। দাঁড়িয়ে কেন?’ 

অমৃতা বসল। উল্টোদিকের সোফায়, মুখোমুখি। হক চোখ তুলে তাকালেন সম্মুখে বসা মেয়েটির দিকে। কালো ঢোলা টিশার্ট। কালো জিন্স মুখে কোনো প্রসাধন নেই। ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে চুল ছাটা। এর আগে মেয়েটিকে কখনো এতটা নিবিড় ভাবে লক্ষ্য করা হয়নি। আগে যতবার দেখা হয়েছে একে অত্যন্ত উদ্ধত স্বভাবের একজন বলেই মনে হয়েছে তাঁর কাছে। হাঁটা চলায় পুরুষালি ভাব। এখনও বসে আছে দুই ঊরু একটু তফাতে রেখে। মেয়েরা সচরাচর এভাবে বসেনা। কিন্তু তার মুখখানা বড়ই মিষ্টি। ছোট ছোট চোখ, গোলাপি রঙের পাতলা দুটি ঠোঁট, টিকলো নাক। চন্দনের মতো গায়ের রং। দেখলে কেমন আদর আদর লাগে। কই উদ্ধত বা উগ্র তো লাগছেনা মোটেও! ভাবতে অবাক লাগছে যে, বেশ কয়েক জন পরিচিত লোকের কাছে তিনি এই মেয়েকে বেয়াদব বলে আখ্যায়িত করেছেন একটা সময়। তার জানা মতে কোর্ট পাড়ায় একে কম বেশি সবাই চেনে। সুনাম এবং দুর্নাম দুটিই আছে তার ঘটে। সুনাম আছে কাজের, আর দুর্নাম আছে ঠোঁট কাটা স্বভাবের। পরিচিত উকিল বন্ধুদের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, এই মেয়ে যখন কোর্টরুমে সাবমিশন রাখে তখন কোর্ট বারান্দায় হাঁটতে থাকা মানুষজন নাকি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুগ্ধ হয়ে শোনে। 

অমৃতা বুঝতে পারছিল এক জোড়া অভিজ্ঞ, গভীর চোখ তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বুঝতে পেরে ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে ছিল সে। মনে হচ্ছিল সামনা সামনি কথা বলার চাইতে ফোনে কথা বলা ঢের সহজ কাজ। নার্ভাস ফিল করছিল সে। জীবনে এই প্রথমবারের মতো, সম্পূর্ণ বিনা কারণে অমৃতা চৌধুরী নার্ভাস ফিল করছিল। তাজ্জব ব্যাপার!

—‘তোমার বন্ধু কোথায়?’ গমগমে গলায় পুরুষ কণ্ঠটা প্রশ্ন করল।

—‘আকাশ ওকে নিয়ে বাইরে গেছে। এইতো কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসার কথা।’ 

—‘তোমার কী মনে হয়? আমাকে দেখে ওর রিএকশন কেমন হবে?’

—‘প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী হবে তা বলতে পারছিনা। তবে মনে মনে যে ভীষণ খুশি হবে, এতটুকু নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি আপনাকে।’ 

হক পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। এবার তিনি এক পা নাচাতে নাচাতে বললেন, ‘তোমার খবর কী?’ 

—‘এইতো’ 

—‘প্র্যাকটিস কেমন চলছে?’ 

—‘ভালোই।’ 

—‘কোন দিকে যাবে বলে ঠিক করেছ? সিভিল? ক্রিমিনাল? নাকি কর্পোরেট?’ 

—‘কর্পোরেটে আমার ইন্টারেস্ট নেই একেবারেই। ক্রিমিনাল নিয়েই কাজ করার ইচ্ছে।’ 

—‘বেশ। তুমি তো শুনেছি এন জি ও তেও জব করছ। কী নাম যেন তোমাদের এন জি ও টার?’ 

অমৃতা নাম বলল। শুনে হক বললেন, ‘ফান্ড কারা দিচ্ছে?’

—‘ইউ এস এইড।’

হক লক্ষ্য করছিলেন মেয়েটির কথাবার্তায় একটা দারুণ স্মার্ট ব্যাপার স্যাপার আছে। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এতটা স্মার্টনেস সচরাচর চোখে পড়েনা। তার নিজের কোনো কন্যা সন্তান নেই। থাকলে হয়তো আজকে অমৃতার বয়সীই হয়ে উঠত। এরকম বুদ্ধিমতী, স্মার্ট এবং সপ্রতিভ একটি মেয়ে তার থাকলে কিন্তু দারুণ ব্যাপার হত। ভাবলেন ঠিকই, কিন্তু এই মুহূর্তে অমৃতা তার দিকে ঠিক যেভাবে চেয়ে আছে সেই চাউনিটা যে একেবারেই কন্যা সুলভ নয়, তা কি তার এই বয়সে বুঝে উঠতে খুব বেশি সময় লাগার কথা? 

—‘আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না।’ বললো অমৃতা। 

হক হেসে বললেন, ‘আসতেই হল!’ 

এই প্রথম অমৃতার মনে হল লোকটা হাসলে চমৎকার দেখতে লাগে! শুধু মাত্র কানের কাছের জুলপিতে হালকা পাকা চুলের আঁচড় ব্যতীত এঁর চেহারায় কোনো বয়সের ছাপ নেই। লম্বাটে ধারালো মুখ। শক্ত চোয়াল। চোখ জোড়া গভীর। ছিপছিপে লম্বা মেদহীন শরীর। গায়ের রঙ ফর্সা নয়, বাদামি। আচ্ছা, রোমেলাকে কি এর পাশে একটু বয়স্ক এবং বেশিই সাধারণ বলে মনে হয়না? ইশ… এসব কী ভাবছে সে? এবার ভাবনায় লাগাম টানা দরকার। এর আগে কোনোদিন নিজের ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি অমৃতা। কিন্তু আজকে যে লক্ষ্মীছাড়া সব ভাবনারা একেবারে সীমানা অতিক্রম করে ফেলছে! এবার রাশ টেনে ধরতে হবে। কিন্তু খানিক বাদেই সে আরো একটি গুরুতর বিষয় জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করল যে, মানুষের মনের রাশ টেনে ধরা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ গুলোর একটি। 

—‘পলিটিক্স কেন করেন?’ হঠাৎ প্রশ্নটা করলো অমৃতা। হক একটু তীক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ্য করলেন মেয়েটিকে। খুব সাধারণ প্রশ্ন। কিন্তু এই সাধারণ প্রশ্নটিই এর আগে তাকে কেউ কোনো দিন করেনি। তিনি পা নাচানো বন্ধ করে একটু নড়ে চড়ে বসলেন। অমৃতার চোখের দিকে সরাসরি চেয়ে লঘু গলায় বললেন, ‘শুরু করেছিলাম শখের বশে। কিন্তু এখন দায়িত্ব বলে মনে হয়।’ 

অমৃতা হেসে উঠল, শব্দ করে। 

—‘হাসছ যে?’ ধারালো কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন হক। প্রশ্নের ধরণ দেখে আচমকা হাসি থামিয়ে ফেলল অমৃতা। এজন্যেই মানুষটাকে লোকে বদরাগীবলে। কেমন ক্যাট ক্যাট করে কথা বলেরে বাবা! সে অপ্রতিভ ভাবে বলল, ‘না মানে। কেমন যেন লাগল কথাটা শুনতে।’ 

—‘কোন কথাটা?’ 

—‘এইযে বললেন, দায়িত্ব মনে করেন।’ 

হক ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘এটা তোমার কাছে হাসির কথা মনে হল কেন? অমৃতা একটু ইতস্তত করে বলল, ‘দায়িত্ব বলতে আপনি ঠিক কী বোঝালেন?’ 

—‘দেশের প্রতি তো প্রতিটি নাগরিকেরই দায়িত্ব, কর্তব্য থেকে থাকে। তাইনা?’ 

—‘হ্যাঁ কিন্তু সে জন্যে পলিটিক্স করতে হবে কেন?’ 

—‘পলিটিক্স না করেও দিব্যি দায়িত্ব পালন করা যায়। কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানো? শুধু দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা থাকলেই হয়না, ক্ষমতাটাও জরুরি। রাজনৈতিক অঙ্গনে আসার পর দেশের সাধারণ লোকের সাথে যোগাযোগটা আমার আগের চাইতে আরো অনেক বেশি পাকাপোক্ত হয়েছে।’ 

—‘আপনার কি ধারণা আপনি সফল ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন?’ 

—‘চেষ্টা করছি।’ একটু সময় চুপ থেকে তিনি আবার বললেন, ‘তুমি আইন পড়লে কেন? পৃথিবীতে বিষয়ের কি অভাব পড়েছিল?’ 

—‘আই জাস্ট লাভ ল’জ!’ অমৃতা হেসে বলল। 

—‘তাই? একজন ভালো লইয়ারের ঠিক কী কী গুণাবলী থাকা প্রয়োজন বলে তুমি মনে কর?’ 

—‘ভালো লইয়ার বলে কোনো শব্দ আমার ডিকশনারিতে নেই, আমি বলি কমপ্লিট লইয়ার! পরিপূর্ণ আইনজীবী!’ 

—‘বেশ। কমপ্লিট লইয়ার বলতে কী বোঝায়? সব আইন মুখস্থ রাখা? প্রশ্ন করতেই ধারা সহ সমস্ত ডিটেইলস গড়গড়িয়ে বলে ফেলা?’ 

—‘তা ঠিক নয়। লইয়ার নোজ হোয়্যার দ্যা ল ইজ। আমি জানি কোন আইন কোথায় আছে। সব সময় সব কিছু মুখস্থ রাখতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ইটস হিউম্যানলি ইম্পসিবল।’ 

—‘হুম কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জানো যে পলিটিশিয়ানদের নিয়ে তোমার যে ধারণাটি আছে, আম জনতার উকিলদের নিয়েও ঠিক এ ধরণেরই একটি ঋণাত্মক ধারণা আছে।’ 

অমৃতা খোঁচাটা টের পেলো। কথা সত্য, সাধারণ লোকে উকিল, পুলিশ এবং রাজনীতিবিদ এদের কাউকেই খুব একটা সাদা চোখে দেখেনা। অমৃতা স্পষ্ট গলায় বলল, 

—‘হ্যাঁ উকিলদের নিয়ে লোকজনের অনেক স্টেরিওটাইপ ধারণা আছে। কিন্তু ওকালতি একটি পেশা, রাজনীতি তো পেশা নয়। সরি টু সে, আমার কাছে ওয়ার্ল্ডের সব রাজনীতিবিদদের দুই নাম্বার বলে মনে হয়। জর্জ বার্নার্ডশ বলেছিলেন- ‘ He knows nothing; and he thinks he knows everything. That points clearly to a political career.’ 

—‘শ’ নিজেও কিন্তু পলিটিক্যাল একটিভিস্ট ছিলেন। এছাড়া একজন তরুণ নোবেল বিজয়ী কী বলেছেন জানো? বলেছেন, A doctor can only treat patients. A doctor can only help the people who are shot or who are injured. But a politician can stop people from injuries. শেষের লাইনটা হুবহু মনে পড়ছেনা। অনেকটা এরকম ছিল যে একজন পলিটিশিয়ান সমগ্র জাতিকে উদ্ধার করতে পারে, যেটা একজন ডাক্তার পারবেন না।’ 

—‘কে সেই তরুণ নোবেল বিজয়ী?’ 

—‘নাম বলবোনা। তুমি খুঁজে বের কর। এটা তোমার জন্য ধাঁধা। তাছাড়া শেখ মুজিবও কিন্তু রাজনীতি করতেন। তুমি কি তাঁর ক্ষেত্রেও একই রকম ধারণা পোষণ কর?’ 

—‘না না, উনার সাথে অন্য কারো তুলনা হয়না।’ 

—‘এর মানে তুমি মাত্র যে কথাটা বললে, যে জগতের সব রাজনীতিবিদদের তোমার দুই নাম্বার বলে মনে হয়, কথাটা ভুল। তোমার চিন্তা ধারাও কিন্তু স্টেরিওটাইপ!’ 

—‘বেশিরভাগ রাজনীতিবিদই দুই নাম্বার।’

—‘আমাকেও কি তোমার দুই নাম্বার বলে মনে হয়?’ 

অমৃতা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘আপনি রেগে যাচ্ছেন, মিস্টার হক!’

—‘না, রেগে যাচ্ছিনা।’ 

অমৃতা মুখে আগের হাসিটা বজায় রেখেই বলল, ‘হ্যাঁ রেগে যাচ্ছেন। আপনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।’ 

—‘আর আমার রাগ দেখে বুঝি তোমার খুব হাসি পাচ্ছে?’ 

অমৃতা হাসি লুকোতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রথমদিকে একটা নার্ভাসনেস কাজ করছিল। কিন্তু এখন আর সেই নার্ভাসনেসটা নেই। বন্ধুরা বাদে বেশিরভাগ লোকজনের সাথে কথা বলতে গেলে তার কম বেশি বিরক্ত লাগে। এই লোকটার সাথে কথোপকথন সে উপভোগ করছে। হক তখনো রাগ রাগ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সে হাসিটা অনেক কষ্ট করে গিলে নিয়ে বলল, ‘কই নাহ, হাসি তো পাচ্ছেনা!’ 

হৃদি পর্দার ফাঁক দিয়ে অমৃতার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। সে বুঝে উঠতে পারছেনা বাবার বয়সী একটা লোকের সাথে অত কীসের হাসি ঠাট্টা? অমৃতার এমন বিজলী বাতির মতো রসিক হাসি সে জীবনে এই প্ৰথম দেখছে! 

হক সরু চোখে অমৃতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি মেয়েটা কিন্তু খুব ফাজিল!’ 

—‘তাই নাকি? আর কিছু?’ 

—‘দুষ্টু।’ 

—‘আর কিছু?’ 

—‘ভীষণ পাকা!’ 

—‘পাকা বলছেন কেন? আমার বয়স কত আপনি জানেন?’ 

—‘আমার বয়স কত তুমি জানো?’ প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করেন হক।

—‘কত আর, নব্বই অথবা একশ হবে?’ বলে অমৃতা মিটমিটিয়ে হাসে। হক চোখ বড় করে বললেন, ‘আবার দুষ্টুমি হচ্ছে?’ 

—‘ও নব্বই নয়? তাহলে কত? সত্তর?’ 

—‘ঊনপঞ্চাশ। 

অমৃতা ঠোঁট টেনে গলায় একটা মেকী সুর এনে বলল, -’অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন আপনি। 

হৃদি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছিল বসার ঘরে। ঘরে উপস্থিত দুজন সদস্যের একজনও লক্ষ্য করেনি তাকে। কয়েক সেকেন্ড ঠান্ডা চোখে পর্যবেক্ষণ করলো সে দুজনকে। তারপর একটু কেশে অমৃতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘রেডি হ, আকাশ টেক্সট করছে। ওরা চলে আসছে। তিন চার মিনিট লাগবে।’ 

অমৃতা হৃদির আকস্মিক ডাকটা শুনে একটু চমকে উঠেছিল। অপ্রস্তুত হয়ে উঠেছিলেন হকও। হৃদি কথাটা বলে জায়গা থেকে সরে পড়েনি। অমৃতার উঠে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। চোখা ভাবে চেয়ে ছিল সে অমৃতার দিকে। অমৃতা অস্ফুটে বলল, ‘আসছি।’

—‘এখুনি আয়, রেডি হতে হবেনা?’ 

অমৃতার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। খেলায় মজে থাকা ছোট বাচ্চাকে আচমকা খেলা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পড়তে বসিয়ে দিলে যেরকম চেহারা হয় তার চেহারাটা তখন ঠিক সেরকম দেখাচ্ছিল। হক স্থির ভাবে দুই বান্ধবীকে লক্ষ্য করছিলেন। অমৃতা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলল, ‘সামি চলে আসছে। সো, ইউ নো হোয়াট টু ডু রাইট?’ 

হককে সেই মুহূর্তে খানিক বিচলিত দেখাল। দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললেন, ‘ঠিক কী করা উচিত বল তো?’ হৃদি লোকটার প্রশ্ন শুনে অবাক হল। কী আশ্চর্য! ইনি অমৃতার কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন নাকি? অমৃতা কবে থেকে উনার বস হয়ে গেল? মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে ব্যাক্কলের মতো চেয়ে রইল সে দুজনের দিকে। 

ওকে বুঝিয়ে বলবেন যে আপনি ওকে কতটা মিস করেন।’ 

হক চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, ‘এসব কথা আমি কখনোই বলতে পারিনা।’ অমৃতা জোর দিয়ে বলল, ‘বলতে হবে মিস্টার হক! আজকে আপনাকে বলতেই হবে!’ 

হৃদি আরো একবার বিস্ময়ের স্রোতে হাবুডুবু খেয়ে গেল। মিস্টার হক! কী হচ্ছে এসব? বন্ধুর বাবাকে কেউ নাম ধরে ডাকে নাকি? 

হক বললেন, ‘আচ্ছা, লেটস সি।’ 

—‘বেস্ট অফ লাক’ অমৃতা বলল।

—‘থ্যাংক ইউ।’ 

হৃদি পুরাই বেকুব বনে গিয়েছিল। নড়তে চড়তে পারছিলোনা একদম। অমৃতা এগিয়ে এসে ওর বাহুতে একটা হাত রেখে বলল, ‘দাঁড়ায় আছিস ক্যান? চল!’ 

আকাশ আর সামি ঠিক বারোটা বেজে দুই মিনিটে লিফ্ট দিয়ে উপরে উঠে আসল। সামির কাছে চাবি ছিল। এসেই সে তাড়াহুড়ো করে ওয়ালেট থেকে চাবি বের করে খুলে ফেলল সদর দরজা। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামি রাগী গলায় বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘রুদ্রর বাচ্চা পুরা বাসা কবর খানা বানায় রাখছে কেন? একটা লাইট তো অন্তত জ্বালায় রাখবে।’ 

ভেতরে ঢুকে সে প্রথমে ডাইনিং এর বাতি জ্বালালো। আলোটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়তেই চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল অনেক গুলো চেনা মুখ। এক গগন বিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ল চারপাশ। চেনা মুখগুলো সব সমস্বরে বলে উঠল, ‘হ্যাপি বার্থডে!’ 

চমকে উঠল সামি। বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেল। সত্যি ভুলে গিয়েছিল যে আজ তার জন্মদিন। জন্মদিন নিয়ে আহ্লাদ করার বয়সটা এখন আর নেই। জন্মদিন এলে কোনো বিশেষ অনুভূতিও হয়না আজকাল। তবুও প্রিয়জনদের কাছ থেকে একটু নির্ভেজাল মনোযোগ পাবার জন্য জন্মদিনের চাইতে উত্তম দিন বোধহয় মানুষের জীবনে আর একটিও নেই। বিস্ময়ের ঘোর পুরোপুরি কাটতে না কাটতেই সামির মুখে একটি শিশুসুলভ নির্মল হাসি ফুটে উঠল। সারা বাড়ি নীল সাদা বেলুন দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে পাগল গুলা। দেয়ালে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছে তার নাম। টেবিলের ওপর বিশাল আকারের এক কেক। কেকের ওপর গুণে গুণে ছাব্বিশটি মোমবাতি রাখা। বন্ধুরা সব চিৎকার করে গান গেয়েই চলেছে। রুদ্র তার নিজের বাঁধা গান গাইছে গলা ফাটিয়ে, ‘সামিউল হকের আজ জন্মদিন/সবাই নাচো তাধিন তাধিন/নাচো কোমর দুলিয়ে/দুদিন বাদে জমিয়ে/সামি করবে বিয়ে/টোপর মাথায় দিয়ে/’

গানের লিরিক্স শুনে সামির হাসি আরো জোরদার হচ্ছিল। এরকম আজব গানও মানুষ লিখতে পারে? কীভাবে সম্ভব? কিন্তু হাসিটা খুব বেশিক্ষণ তার মুখে স্থির হয়ে থাকলো না। মায়ের পাশে দাঁড়ানো লম্বা মানুষটার ওপর চোখ পড়তেই সে থমকে গেল। মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়ে ধীরে ধীরে ভর করল এক অচ্ছেদ্য বিমূঢ়তা। কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা। সংজ্ঞাহীন একরাশ আবেগ এবং অভিমান উথলে উঠল চোখের তারায়। কত দিন পর? নয় মাস? নাকি তারও বেশি? 

হক ছেলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন। সামি কি এই নয় মাসে আরো একটু বড় হয়ে গেছে? তাকে দেখাচ্ছে পূর্ণ বয়স্ক যুবকের মতো। চোখে মুখে আর আগের সেই কচি ছেলেমানুষি ভাবটি নেই। তার বদলে আছে এক প্রবল আত্মবিশ্বাসের ছায়া। যে ছেলেটি জন্মের পর থেকে পিতার সাহায্য ছাড়া এক কদম চলতে পারেনি, সেই ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের জিম্মায় একা একা কাটিয়েছে নয়টি মাস! এই নয়মাস সে পিতার কাছে একটি বারের জন্যেও হাত পাতেনি। হক ভেবেছিলেন দু তিন মাসের মাথায়ই ছেলে সুড়সুড় করে ঘরে ফিরে আসবে। তার আরাম আয়েশ করে অভ্যাস। স্ট্রাগল কী তা সে জানেনা। ক্ষমতাধর পিতার সাহায্য ব্যতীত এই কঠিন পৃথিবীতে একটি দিন টিকে থাকা পুত্রের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু তাঁর ধারণা পুরোপুরি মিথ্যে প্রমাণ করেছে সামি। অতএব ছেলে বদলে গেছে। ছেলে এখন আত্মনির্ভরশীল, সাহসী এবং পরিপক্ব। হক একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। তার পুত্র জিতে গেছে। তিনি হেরে গেছেন। তবে এই হারে তিনি এক ফোঁটাও গ্লানী বোধ করছেন না। বরং এক আশ্চর্য পরিতৃপ্তি তে ছেয়ে যাচ্ছে সারা মন। 

বাবাকে দেখে সামির থমকে যাওয়াটা বন্ধুরা লক্ষ্য করলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার নিমিত্তে তারা দ্রুত বার্থডে বয়কে টেনে নিয়ে আসলো কেক কাটার টেবিলে। সামির মুখখানা সে মুহূর্তে ভীষণ আবেগপ্রবণ দেখাচ্ছিল। চোখ দুটো লালচে হয়ে উঠেছে। নিশ্বাস ঘন। হাত কাঁপছে হালকা। সেই অবস্থায়ই কেক কাটা হল। হাত তালিতে মুখরিত হয়ে উঠল সারা ফ্ল্যাট। খাবার সার্ভ করার কিছু সময় আগে রোমেলা ছেলেকে কানে কানে বললেন, ‘তুই একটু ভেতরের ঘরে আয়। তোর আব্বা কথা বলবেন তোর সাথে।’ 

সামি উদ্বেলিত বুক নিয়ে নিজের ঘরে আসল। তার পিতা বসে আছেন পড়ার টেবিলের চেয়ারে। হাতে একাউন্টিং এর একটি বই। বইটা মনোযোগ দিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছেন তিনি। সামি ঘরের ভেতর ঢুকতেই তিনি চোখ তুলে তাকালেন এবং তাকানো মাত্রই মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করলেন যে এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নিজের সন্তানের চাইতে পবিত্র এবং সুন্দরতম বস্তু আর দ্বিতীয়টি নেই। নিজ পুত্রের ওই সুন্দর মুখখানার দিকে চাইতেই নিষ্কলুষ এক বিশুদ্ধ হাওয়া বইতে লাগল তার মনের অলিন্দ জুড়ে। মনে হল যেন মাইলের পর মাইল তপ্ত রোদে ঢাকা কন্টকাকীর্ণ মরুভূমি পার হয়ে আসার পর তিনি অবশেষে প্রাণ জুড়ানো, স্বচ্ছ, টলমলে এক বিন্দু জলের দেখা পেলেন। 

সামি বিছানার ওপর এসে বসল, নত মুখে। তার বুক একটু একটু কাঁপছে। বিশ্বাস হচ্ছেনা যে বাবা নিজ উদ্যোগে তার সাথে দেখা করতে এসেছেন। এ যেন বাস্তব নয়, এ যেন এক রূপকথার কাহিনী। তার চোখ জোড়া তখন বাষ্পময়। সে প্রাণপণে পিতার কাছ থেকে এই বাষ্পবারি লুকোতে চায়। জোয়ান ছেলের বাপ মায়ের সামনে কাঁদতে নেই। 

রোমেলা ছেলের পাশে বসলেন। কিছুটা সময় নীরবে কাটল। হক কাশতে লাগলেন ঘন ঘন। তিনি ভেতরে ভেতরে একটু নার্ভাস ফিল করছেন। আবেগের কথা, ভালোবাসার কথা তিনি কখনোই মুখ ফুটে বলতে পারেন না। পুত্রকে কখনোই বলা হয়নি যে তার জীবনে এক মাত্র সন্তানের গুরুত্ব কত খানি। ইমোশনাল কথাবার্তা বলা তার ধাতে নেই। কিন্তু আজ তাঁর ছেলেকে মনের কথা বলতে হবে। হ্যাঁ বলতেই হবে। অমৃতা বলে দিয়েছে, যে করেই হোক সামিকে জানাতে হবে, যে তাকে তিনি কতটা মিস করেন। পরমুহূর্তেই নিজের এই ভাবনাটা তাকে চমকে দিল। অমৃতা বলে দিয়েছে বলেই কি তিনি ছেলেকে কথা গুলো বলবেন? নাকি নিজের তাগিদে বলবেন? 

—‘শুভ জন্মদিন আব্বু!’ বললেন তিনি ছেলেকে। 

সামি চোখ নিচে নামিয়ে রেখেই অস্ফুটে বলল,’থ্যাঙ্ক ইউ।’ 

আবার কিছুক্ষণ বিরতি। হক শ্বাস নিলেন সময় নিয়ে। গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘শোনো সামি, তোমার জন্য আজ আমি কোন উপহার নিয়ে আসিনি। কেন নিয়ে আসিনি জানো? কারণ আমার মনে হয়েছে যে তোমাকে দেবার মতো কিছুই আসলে আমার নেই। আমার অর্থবিত্ত, সম্পদ, সুনাম, খ্যাতি এর কোনো টাই তোমাকে কখনো আকর্ষণ করেনি। আর একারণেই তুমি অন্য সবার চাইতে আলাদা। নয় মাস আগে নিজের বাড়ি ছেড়ে একলা পথে নেমে যে যুদ্ধটা তুমি শুরু করেছিলে সেই যুদ্ধে তুমি জিতে গেছ। আমি হেরে গেছি। কিন্তু এই হার অনেক বেশি সম্মানের। আমি বুঝে গেছি, জেনে গেছি যে আমার ছেলে এই পৃথিবীতে আমার সাহায্য ছাড়া সারভাইভ করতে পারবে। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য তার আর আমাকে প্রয়োজন নেই। আমি গর্বিত।’ 

সামির চিবুক গলার সাথে লেগে ছিল। সে কোনো কথা বলতে পারছিলনা। মা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন ধীরে ধীরে, আর মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছিলেন। 

—‘আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ করে আছ এখনো। কিন্তু একটু বোঝার চেষ্টা কর, যে মেয়েটিকে তুমি পছন্দ করেছিলে সেই মেয়েটির সাথে সারাজীবনের জন্য কোনো সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া তোমার পক্ষে কখনোই সম্ভব হত না। আমরা মেনে নিলেও মেয়েটির বাবা মা তোমাকে কোনোদিনই গ্রহণ করতেন না। আমি মেয়েটির বাবার সাথে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করেছিলাম। তার মেয়ের সাথে একটি মুসলমান ছেলের প্রণয় ঘটিত ব্যাপার আছে এটা জানতে পেরে তার বুকে ব্যথা উঠে গিয়েছিল। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।’ 

সামি নিশ্চুপ। আসলে সে মুহূর্তে কোনো ব্যাখ্যা, যুক্তি কিংবা কৈফিয়ৎ তার মাথায় ঢুকছিলনা। বাবা তার সাথে দেখা করতে এসেছে সমস্ত অভিমান ভুলে গিয়ে, রাগ ভুলে গিয়ে, এই একটি মাত্র ঘটনা তাকে বিহ্বল করে রেখেছিল, বাক্যহারা করে দিয়েছিল। 

হক বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ছেলের মাথায় একটা হাত রেখে ভারী গলায় বললেন, ‘তোমার হয়তো আমাদেরকে প্রয়োজন নেই। তুমি নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে শিখে গেছ। কিন্তু আমাদের তোমাকে প্রয়োজন আছে। তোমার মা এবং আমি, আমরা তোমাকে অনেক মিস করি সবসময়। তুমি… তুমি প্লিজ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসো।’ 

সামি কোনো বাক্যব্যয় না করে উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। তারপর আচমকা জড়িয়ে ধরল বাবাকে। তার চোখ দুটো তখন ভিজে উঠেছিল অশ্রুজলে। 

খাওয়া দাওয়ার পর রুদ্র দুই তিনটা গান শোনাল। পাশে বাসার মেয়েটিও গান জানে। তাই আসর বেশ জমে উঠল। যদিও হক সাহেবের উপস্থিতি বন্ধুদের মধ্যে একটি আড়ষ্ট ভাবের জন্ম দিয়েছিল। সামি বাদে অন্য কেউই সহজ হতে পারছিলোনা। আজ প্রথমবারের মতো লোকটা বন্ধুদের মাঝখানে এতক্ষণ সময় পার করলো। এই দলটাকে তিনি ঘেন্না করেন বলেই জানে সবাই। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব আগ্রহ নিয়েই উৎসবটা উপভোগ করছেন। সামির ভালো লাগছিল। অনেক দিন বাদে পরিবার আর বন্ধুদের একত্রে পেয়ে তার বুকটা ভরে উঠেছিল এক অনাবিল আনন্দে। শুধু একটি মানুষের অনুপস্থিতি সেই আনন্দতে কিঞ্চিৎ ঘাটতি এনে দিচ্ছিল। সেই মানুষটি বিভা। বিভা টেক্সট করেছে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে। সে প্রত্যুত্তর করেনি। হ্যাঁ, ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর থেকে আর একটিবারের জন্যেও সে বিভার সাথে কথা বলেনি। প্রেরণ করেনি কোনো বার্তা। 

বসার ঘরেই বসে ছিল সবাই। রুদ্র গাইছিল একটা লালন গীতি।

‘কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে, পেয়েছি এই মানব জনম…’ 

সবাই বুঁদ হয়ে শুনছিল ওর গান। ঘরের মূল বাতি নেভানো ছিল। জ্বলছিল একটি কম পাওয়ারের হলুদ আলোর ল্যাম্পশেড। সেই টিমটিমে হলদে আলোয় হৃদি একটি আশ্চর্য বিষয় আবিষ্কার করল যা অন্য কেউ টের পেলনা। সে দেখতে পেল একজোড়া নবীন চোখ বারংবার একজোড়া গভীর, অভিজ্ঞ চোখের ওপর আটকে যাচ্ছিল, থমকে যাচ্ছিল। চারটা চোখ মিলিত হচ্ছিল থেকে থেকে। দৃশ্যটা কেন যেন তার বুক কাঁপিয়ে দিল। এরকম আজব কান্ডও পৃথিবীতে ঘটে নাকি? 

সে রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সবারই একটু দেরি হয়ে গেল। সামিদের ফ্ল্যাট থেকে বেরোবার আগ মুহূর্তে হৃদি অমৃতাকে আড়ালে ডেকে এনে বলল, ‘এই তোর সমস্যা কী?’ 

—‘কীসের সমস্যা?’ 

—‘শুনো অমৃতা, সবাইকে বেকুব বানাইতে পারলেও আমাকে তুমি বেকুব বানাইতে পারবানা। তোমাকে আমি হাড্ডিতে হাড্ডিতে চিনি। 

অমৃতা বিস্মিত গলায় বলল, ‘কী বলতেছিস? কিছুই বুঝতেছিনা।’ 

হৃদি চাপা গর্জন করে উঠে বলল, ‘দাঁড়াও, বিভারে ডাকতেছি আমি বিভাকে এখন আমার খুবই দরকার। কারণ তুমি একদম ফালতু হয়ে গেছ। নষ্ট হয়ে গেছ। তোমারে দিয়া আমার পোষাইতেছে না।’ 

অমৃতা রুখে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওকে ফাইন, ডাকো বিভারে, আমারও অবজারভেশন আছে তোমারে নিয়ে। তুমি কি মনে করছ, আমার চোখে ধূলা দেয়া এত সহজ?’ 

হৃদি একটু চুপসে গেল, ‘আমাকে নিয়ে আবার কিসের অবজারভেশন?’

—‘আসুক বিভা, তারপর কথা হবে।’ 

.

বিভার মাথাটা রাখা ছিল অভিজিতের বুকের ওপর। দুজনের মধ্যে কোনো সংকোচ নেই আর, নেই কোনো দ্বিধা, ভয় কিংবা দূরত্ব। হ্যাঁ মনের দূরত্ব হয়তো এখনো রয়ে গেছে যোজন যোজন। কিন্তু শরীর? সে তো মনের মতো অত জটিল আর একগুঁয়ে নয়, তাকে বশে আনতে খুব একটা বেগ পেতে হয়না। শারীরিক সুখ কি মানসিক কষ্ট লাঘব করতে পারে? কে জানে! কিন্তু বিভা আজ রাতে খুব করে চেয়েছিল শরীর দিয়ে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে। হয়তো পেরেও ছিল কিছুটা। ব্যাপারটা হয়ে যাবার পর তার মনে হয়েছে, যা হবার ভালোই হয়েছে। এমনটাই বুঝি হবার ছিল। হৃদির ফোনটা আসলো রাত একটায়। বালিশের তলায় মোবাইল রাখা ছিল। হঠাৎ ভাইব্রেট করে ওঠায় ওরা দুজনেই চমকে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে হৃদির নামটা দেখলো বিভা। বুক কাঁপলো হালকা। এত রাতে ফোন কেন? কোনো বিপদ আপদ হয়নি তো? 

শুয়ে থাকা অবস্থাতেই বিভা ফোন রিসিভ করলো। মাথাটা শুধু সরিয়ে নিল অভিজিতের বুকের ওপর থেকে। 

—‘হ্যালো বিভা?’ 

—‘হ্যাঁরে, কী হয়েছে? এতো রাতে? সব ঠিক আছে তো?’ 

—‘শোন, কিছুই ঠিক নেই।’ 

—‘হয়েছে কী?’ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল বিভা। 

—‘তুই কবে আসতে পারবি বলতো?’ 

বিভা একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি… কবে আসতে পারবো… কী যেন ঠিক বলতে পারতেছিনা তো।’ 

—‘দোস্ত প্লিজ, অভিজিৎকে একটু ম্যানেজ কর। তোকে আমার খুব দরকার।’ 

—‘কী হয়েছে বলবি তো।’ 

—‘সামি তো বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছে।’ 

—‘আরে ধুর, রাজি টাজি কিছুনা। ওসব ফালতু কথা।’ 

-‘ফালতু কথা না মোটেও। তুই বিশ্বাস করতেছিস না?’ 

—‘না বিশ্বাস করতেছিনা।’ 

—‘সত্যি বিভা, সে তার বাপ মায়েরে জানায় দিছে অলরেডি। দুই তিন সপ্তাহের মধ্যেই এনগেজমেন্ট হয়ে যাবে।’ 

বিভা একটু সময় চুপ করে থেকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা শোন, তুই চিন্তা করিস না। দেখি আমি চেষ্টা করছি আসার।’ 

—‘চেষ্টা না। তোকে আসতেই হবে। আর জানিসনা তো, অমৃতা পাগল হয়ে গেছে।’ 

—‘ক্যান ওই আবার কী করছে?’ 

—‘বললে, বিশ্বাস করবিনা। আমার খুব একটা বাজে ধরণের সন্দেহ হচ্ছে। তবে আমি আল্লাহ আল্লাহ করতেছি আমার সন্দেহ যেন সত্য না হয়। কিন্তু ওই ছেমড়ির কোনো কিছু ঠিক নাই। দুনিয়ার সব অদ্ভুত কাণ্ড গুলাই ওর করতে হবে।’ 

বিভা শিউরে উঠল মনে মনে। উদ্বেলিত হয়ে বলল, ‘কী বলতেছিস তুই এসব? আমার তো ভয় লাগতেছে। কী হইছে?’ 

—‘এখন না, তুই ঢাকায় আয়। তারপর বলবো।’ 

ফোনটা রাখার পর বিভা কয়েক সেকেন্ড কেমন থম ধরে রইল। অভিজিৎ ওর মুখের ওপর মাথাটা ঝুঁকিয়ে এনে বলল, ‘কী ব্যাপার? 

বিভা থম ধরা গলায় বলল, ‘আমার দেশে যেতে হবে অভিজিৎ!’

–’হঠাৎ কী হল? কোনো দুঃ সংবাদ নয় তো?’ 

—‘সামির এনগেজমেন্ট হয়ে যাচ্ছে দু এক সপ্তাহের মধ্যেই।’ 

অভিজিৎ নিভে গেল। মাথাটা নিজের বালিশে ফিরিয়ে নিয়ে নিস্তেজ গলায় বলল, ‘ও।’ 

—‘আপনার আবার কী হল?’ 

—না মানে, আপনি কি সামির এনগেজমেন্ট খেতে দেশে যেতে চাইছেন?’ 

—‘সামির এনগেজমেন্টটা যেকোনো উপায়ে বাতিল করতে হবে। এ সম্পর্ক হতে পারেনা! 

অভিজিৎ বিস্ফোরিত চোখে তাকালো বিভার দিকে। কী বলছে এই মেয়েটা? মাত্র কদিন আগেই না সে ব্রেকআপ করলো ওই ছেলের সাথে? তাহলে এখন আবার এসব কী হচ্ছে? মেয়েটা পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছে নাতো? অভিজিতের ওই অদ্ভুত চাউনিটা দেখে বিভার এতক্ষণে বোধোদয় হল। 

—‘ওহো, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। মানে সামির বিয়েটা আসলে হৃদির সাথে হতে হবে। অন্য কারো সাথে নয়।’ 

অভিজিৎ কথাটা শুনে বিস্ময়ে একদম ঝুম হয়ে গেলো। এমন আজগুবি কথা সে জীবনে আর কোনোদিন শোনেনি যেন। হা হয়ে রইল তার মুখখানা প্রায় মিনিট দুয়েক সময় ধরে। অনেক কষ্টে সে বলল, ‘কী বলছেন আপনি? হৃদি কোত্থেকে আসল?’ 

—‘আসলে এই মুহূর্তে আমি আপনাকে সব কথা বলতে চাইছিনা। আপনি… আপনি শুধু আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখুন। প্লিজ!’ 

—‘বিশ্বাস?’ 

—‘হ্যাঁ আমার উপরে বিশ্বাস রাখুন। আমি আপনাকে ঠকাবোনা।’

—‘কবে যেতে চাইছেন?’ 

—‘দু একদিনের ভেতরেই।’ 

অভিজিৎ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ক্ষীণ ভাবে বলল, ‘আবার কখনও ফিরবেন কি?’ 

—‘না ফিরলেই বেঁচে যান মনে হয়?’ 

—‘তাই কি বলেছি?’ 

—‘তাহলে এ প্রশ্নটা কেন করলেন? আমার সংসারে আমি ফিরব না?’ 

অভিজিৎ কথাটা শুনে পাশ ফিরে শুলো। বিভার গালের ওপর একটা হাত রেখে বলল, ‘আপনি কি আমাকে একটু একটু ভালোবাসার চেষ্টা করছেন বিভাবরী?’ 

—‘একটুও না। আপনার মতো একটা বোরিং লোককে ভালোবাসবো আমি? ইম্পসিবল।’ 

২৬

রাত একটায় বাড়ি ফিরে এসে সদর দরজার সামনে দাঁড়াতেই আকাশ একটি নারী কণ্ঠের আর্ত চিৎকার শুনতে পেল। সেই সাথে অশ্রাব্য ভাষার গালাগাল। লোকটা জড়ানো গলায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বকে যাচ্ছে, তুই বেশ্যা, তোর গুষ্ঠি বেশ্যা, রেন্ডির ঘরের রেন্ডি… তোর মারে…’ এসব বাজে কথা শুনতে শুনতে এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আজকাল আর গায়ে লাগেনা। তবে বলতে নেই, একটা কেমন ভয় ঢুকে গেছে ইদানিং আকাশের মনে মধ্যে। কেবলই মনে হয় যে কোনো একদিন বুঝি সে বাড়ি ফিরে দেখবে ব্যাটা তার বৌকে খুন করে বসে আছে। আজকেই সেই ভয়ংকর দিনটি নয়তো? 

চাবি দিয়ে দরজা খুলল সে। লোকটার হাতে একটা চামড়ার বেল্ট সেই বেল্ট দিয়ে সপাং সপাং করে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে সে মারছে ঝুমকিকে। ঝুমকির ঠোঁট কেটে দরদর করে বেরোচ্ছে রক্ত। যন্ত্রণায় চ্যাঁচাচ্ছে সে প্রাণপণে। তবুও লোকটার মনে এতটুকু দয়া হচ্ছেনা। হবে কী করে? লোকটাতো তখন পাঁড় মাতাল। তার দুচোখ জ্বলছে আগুনের মতো। মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা। মানুষ বলে মনে হচ্ছেনা তাকে। মনে হচ্ছে হিংস্র জন্তু। ড্রইং রুমের দরজা ঘেঁষা পর্দার আড়ালে তারা দাঁড়িয়ে আছে। ঠকঠক করে কাঁপছে মেয়েটা ভয়ে। 

আকাশ এগিয়ে গিয়ে পিতার হাত থেকে বেল্টটা একরকম জোর জবরদস্তি করে কেঁড়ে নিল। পিতা এবার চড়াও হল তার ওপর। মরিস না কেন তুই? হ্যাঁ? কেন মরিসনা? তোর মা মরছে, তুই কেন মরিস না?’ 

লোকটার মুখ দিয়ে ভকভক করে মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। কী কুৎসিত! কী কদর্য! 

ঝুমকি তখন মেঝের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। তার চুল হয়ে আছে পাগলের মতো। পরনের শাড়ি গেছে প্রায় খুলে। ঠোঁট থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত। আকাশ ঝুমকির হাত ধরে টেনে তুলল ওকে। কড়া গলায় বলল, ‘উঠেন, এখানে বসে থেকে লাভ নাই।’ 

ঝুমকিকে নিয়ে আকাশ যখন ডাইনিং রুমে আসলো লোকটা তখনও অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে যাচ্ছে সমানে। ঘুম না আসা পর্যন্ত এসব চলতে থাকবে। আজ নিজের ঘরে যাবেনা সে। ড্রইং রুমের সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়বে। ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল তারা জড়োসড়ো হয়ে। এ বাড়িতে এসেছে সে বেশিদিন হয়নি। আসার পর এমন তাণ্ডব এই প্রথম। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার ধারণা হয়েছিল লোকটা তার খালাকে আজকে রাতে মেরেই ফেলবে। আকাশ না আসলে হয়তো এতক্ষণে সত্যিই একটা খুনোখুনির কাণ্ড হয়ে যেত। ঝুমকিকে ধরে ধরে বেড রুমে নিয়ে আসল আকাশ। তারাও আসল পেছন পেছন। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে ওড়না দিয়ে সে খালার ঠোঁটের রক্ত মুছে দিতে লাগলো। তার চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়ছে। হাত কাঁপছে ঠকঠক করে। আকাশ নিজের ঘরে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসল। তারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা নাও। এখানে তুলো, স্যাভলন আর ব্যান্ডেজ আছে।’ 

তারা আকাশের হাত থেকে বক্সটা নিল। ঝুমকি বিছানার ওপর বসে তখনো কেঁদে যাচ্ছে সমানে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আকাশ একটা চেয়ার টেনে এনে বসলো ওদের সামনে। বেশ কয়েকদিন ধরে সে ভাবছিল ঝুমকিকে কিছু কথা বলবে। মনে হচ্ছে আজ আর না বললেই নয়। 

রক্ত থেমে আসার জন্য অপেক্ষা করলো আকাশ। তারপর ধীর স্বরে বলল, ‘আপনার সাথে আমার একটু কথা আছে। জরুরি কথা।’ 

ঝুমকি অবাক চোখে চাইল আকাশের দিকে। এত গুলো বছরে এই ছেলেটি কোনোদিন তার সাথে নিজ থেকে কথা বলতে আসেনি। জরুরি কথা তো দূরে থাক, অতি সাধারণ বাক্য বিনিময় করতেও যেন ছেলেটির রুচিতে বাঁধে। সতীনের ছেলে হলেও ঝুমকি একে নিজের সন্তান হিসেবেই মেনে নিতে চেয়েছিল। আদর দিয়ে, মমতা দিয়ে, নরম গরম কথা বলে নানা উপায়ে একে সে কাছে টানার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। এই ছেলে তাকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করেনা। 

ঝুমকি বিস্ময়টা ঢাকা দিয়ে বলল, ‘কী কথা?’ 

—‘এসব আর কত দিন চলবে?’ একটু রূঢ় শোনায় আকাশের গলা। 

—‘কীসের কথা বলছ?’ 

—এইযে রোজ রোজ মারামারি, রক্তারক্তি, আমি এসব আর নিতে পারছিনা। মানুষের সহ্যের তো একটা সীমা থাকে।’ 

আকাশের মুখ থেকে কথাগুলো শুনতে পেয়ে ঝুমকি জানেনা কেন এই দুঃসময়েও তার একটু কেমন শান্তি বোধ হল। যাক ছেলেটা তাহলে আজকাল তার কথা একটু একটু ভাবছে। সন্তান হিসেবে নাহয় নাই ভাবলো, মানুষ হিসেবে তো অন্তত ভাবছে! 

তারা বসে ছিল ঝুমকির পাশে। পরনে একটি হলুদ রঙের সুতির সালওয়ার কামিজ। চুলে শক্ত করে বিণুনী বাঁধা। চোখজোড়া ভয়, শঙ্কা আর লজ্জা! 

ঝুমকি বলল, তোমার বাবা মদ খাওয়ার অভ্যাসটা না ছাড়লে, এসব কোনোদিনও থামবে না।’ 

আকাশ দৃঢ় গলায় বলল, ‘এই বদ অভ্যাস তার জীবনেও যাবেনা। অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।’ 

—‘কী ব্যবস্থা?’ 

আকাশ একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল, ‘আপনি এখানে পড়ে আছেন কেন? রোজ রোজ মার খান। কোনদিন আমার বাপ আপনাকে জানে মেরে ফেলবে তার কোনো ঠিক নেই। তবুও এখানে পড়ে আছেন কেন? 

ঝুমকি প্রশ্নটা শুনে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। তার জল ভেজা চোখ দুটোতে ভেসে উঠল এক প্রবল বিস্ময়। অনেক কষ্টে জিভ নেড়ে বলল, ‘পড়ে না থেকে কী করব? আর কী করার আছে আমার?’ 

—‘আপনার বাবার বাড়িতে চলে গেলেই তো পারেন। আপনাদের না নারায়ণ গঞ্জে একটা বাড়ি আছে? সেখানে যান না কেন? 

—‘তুমি… তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?’ 

—‘হ্যাঁ বলছি। কারণ এখানে থাকলে আপনি বাঁচবেন না। আপনার উচিৎ এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া। পালিয়ে গিয়ে নিজেও বাঁচুন, আমাকেও বাঁচতে দিন।’ 

ঝুমকির গোলগাল, ফর্সা, ধারহীন মুখটা তখন অপমানে টকটকে লাল। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। জোরে জোরে পড়ছে শ্বাস। 

—‘তুমি… তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?’ আবারো প্রশ্নটা করলো সে, ফ্যাসফ্যাসে গলায়। 

—‘বলছি আপনার ভালোর জন্যই। আর তাছাড়া আমার বাপ তো এখন সংসারে একটা পয়সাও দিতে পারছেনা। ছাই পাশ ব্যবসা না কী যেন ঘোড়ার ডিম করে, তা থেকে যা কামায় তা তো মদ কিনেই সাবাড় করে দেয়। গেল মাসে বাড়ি ভাড়া, বাজার খরচ সব দিতে হয়েছে আমার। আমি বুঝতে পারছিনা যে কেন আমি আপনার দায়িত্ব ঘাড়ে নেব। আপনাকে বিয়ে করার আগে আমার বাবা তো আমার কাছ থেকে পারমিশন নেয় নি! তাছাড়া বৌ চালানোর মত কোনো মুরোদ উনার নাই। আপনার উচিৎ অন্য রাস্তা দেখা।’ 

ঝুমকি কথাগুলো শুনে পাথরের মত অনড় হয়ে গেল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র যেন এক ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে তার বাড়ি, ঘর, সহায় সম্বল সব হারিয়ে গেছে। সে এখন সর্বহারা। অনেকটা সময় সে প্রস্তরীভূত হয়ে বসে থাকার পর ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ঠিকই বলেছ, আমার দায়িত্ব তুমি কেন নেবে? আমি তোমার কে? 

আকাশ বসে বসে নিজের হাতের নখ খুঁটছিল দাঁত দিয়ে। কথাগুলো সে অনেক দিন আগেই বলবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। আজ সাহস করে বলে ফেলার পর ভালো লাগছে। এবার ঝামেলাটা মাথা থেকে নামলেই হয়। 

—‘ঠিক আছে, আমি চলে যাব।’ একটা বড় শ্বাস ফেলে, ধরা গলায় বলল ঝুমকি। 

আকাশ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আপনি তৈরী থেকেন। কাল পরশু সময় করে আমি দিয়ে আসবো আপনাকে নারায়ণ গঞ্জে। আর বাবাকে এখন এসব কিছু বলার দরকার নেই। উনার মাথা ঠিক নাই। মাতাল মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেবার কোনো প্রয়োজন নেই।’ 

ঝুমকি এবার একটু তীক্ষ্ণ ভাবে বলল, ‘তোমার আমাকে কোথাও দিয়ে আসতে হবেনা। আমি নিজেই চলে যাব।’ 

আকাশ এ কথার পর আর কিছু বলল না। নিজের ঘরে ফিরে গেল। গরম জল দিয়ে একটু গোসল করতে ইচ্ছে হল। রাতের বেলা আজকাল বেশ শীত পড়ে। এই ফ্ল্যাটে গিজার নেই। চুলায় পানি গরম করে নিতে হয়। পানি গরম করতে গিয়ে তাই অনেকটা সময় নষ্ট হল। তারপর সেই গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে বেরোতে বেরোতে রাত তিনটে বেজে গেল ঘড়িতে। বেরোনোর পর শুনতে পেল কেউ একজন দরজার কড়া নাড়ছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে দরজা খুলল আকাশ। তার পরনে একটি কালো ট্রাউজার, খালি গা। দরজা খুলে দেখল তারা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার চোখ মুখ গম্ভীর। তবে একটু আগের ভীত ভাবটি আর নেই বরং একটু তেজের হলকা আছে চাউনিতে। 

—‘কী চাই?’ আকাশের প্রশ্ন। 

তারা কেটে কেটে বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলতে হবে? নাকি ভেতরে আসতে দেবেন?’ 

আকাশ অপ্রস্তুত হল, ‘ও আচ্ছা, হ্যাঁ এসো।’ 

তার ঘরটা বড়ই অগোছালো হয়ে আছে। বিছানায় ছড়িয়ে আছে বাসি জামা কাপড়। চাদর খানাও কুঁচকানো। পড়ার টেবিলে বইপত্র আর ছাত্রছাত্রীদের পরিক্ষার খাতার বাণ্ডিলের পাহাড়। এরকম অগোছালো ঘরে মেয়েটিকে কোথায় বসতে দেবে তাই ভেবে সে একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। তারাকে দেখে অবশ্য বোঝা গেল যে সে এখানে বসতে আসেনি, এসেছে জরুরি কিছু বলতে। 

—‘আপনার কি মনে একটুও দয়া মায়া নেই? আপনি কি মানুষ?’ আচমকা প্রশ্নটা করলো তারা। 

~’এটার মানে কী?’ গায়ে টিশার্ট চড়াতে চড়াতে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল আকাশ। 

—‘আপনি খালাকে চলে যেতে বললেন?’ 

—‘হ্যাঁ বলেছি, উনার ভালোর জন্যই বলেছি। তোমার কি মনে হয়না যে উনার একটা সুস্থ জীবন যাপনের অধিকার আছে? কেন উনি এভাবে নিজের জীবনটা শেষ করে দেবেন? কতই বা বয়স হবে উনার? চল্লিশ? পঁয়তাল্লিশ? সামনে অনেকটা সময় পড়ে আছে। চাইলে উনি আবার বিয়েও করতে পারবেন। এখানে কেন রাত দিন মার খেয়ে মুখ বুজে সব সহ্য করে পড়ে থাকতে হবে হ্যাঁ? আশ্চর্য!’ 

তারা ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘বিয়ে করবে আবার?’ 

—‘কেন নয়?’ 

তারা কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। তারপর টেনে টেনে বলল, ‘আপনি কি কিছুই জানেন না?’ 

—‘কীসের কথা বলছ? কিছু জানার কথা ছিল কি আমার?’ 

—‘আমার মামারা যে ভালো মানুষ না, এটা কি আপনি জানেন না?’ আকাশ বিস্মিত গলায় বলল, ‘না জানিনা। তোমাদের পারিবারিক ইতিহাস আমি কী করে জানব?’ 

—‘আপনি এটাও জানেন না তাইনা? যে খালা কখনো মা হতে পারবেন না?’ 

আকাশ থমকালো। বুকে কীসের একটা ধাক্কা এসে লাগল আচমকা। হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলল, ‘মানে?’ 

—‘আমার নানা নানী মারা গেছেন অনেক আগে। আছেন তিন মামা। মামারা মানুষ হিসেবে বেশি সুবিধার না। খালার একটা সমস্যা ছিল বিয়ের আগে থেকেই। সমস্যাটার কথা জানাজানি হওয়ার পর কোনো ভাবেই খালার বিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। মামারা উঠতে বসতে খোঁটা দিতেন। আমি তখন খুব ছোট। এসব গল্প শুনেছি মায়ের কাছ থেকে। শুনেছি যে একমাত্র আপনার বাবা, খালার সমস্যার কথা জানার পরেও তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন। আর খালাও খুশি হয়েছিল আপনাকে পেয়ে। ভেবেছিল নিজের যেহেতু ছেলেপুলে হবেনা কখনো তাই সতীনের ছেলেকেই নিজের সন্তানের মতো মানুষ করবেন।’ 

আকাশ একদম দৃঢ়ীভূত হয়ে গিয়েছিল কথাগুলো শুনে। তীক্ষ্ণ ফলার মত কী যেন একটা ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছিল তার কলিজার মধ্যে। কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছিলো না সে। তারা বলল, ‘এই অসহায় মানুষটাকে আপনি কী করে বললেন চলে যেতে? কোথায় যাবে? মামাদের কাছে? আমার মামারা তো আমাকেই বের করে দিতে চাচ্ছিল বাড়ি থেকে।’ এই পর্যায়ে তারার গলাটা একটু ধরে আসল। 

আকাশ কোনো রকমে বলল, ‘তুমি… তুমি কি তোমার মামাদের সাথে থাকো?’ 

—‘আমার মা মারা গেছেন গত বছর। বাবা সৌদিআরবে থাকেন। বছর দুয়েক হল তিনি আমার জন্য টাকা পয়সা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে সৌদিআরবের বিয়ে শাদী করে সংসার পেতেছেন। আমার খোঁজ খবর কিছুই নেন না। মামাদের সাথেই ছিলাম আমি। হঠাৎ… হঠাৎ একটা ঝামেলা হল তাই ওখানেও আর থাকা গেল না।’ 

আকাশের বুকের ভেতর ক্রমশ একটা ব্যথা ঘনিয়ে আসছিল। তারা খানিকক্ষণ চুপ থেকে অদ্ভুত শীতল গলায় বলল, ‘আমি আপনাদের এখানে আজীবন থাকতে আসিনি। হোস্টেল খুঁজছি। একটা পার্ট টাইম জব বা টিউশনি পেয়ে গেলেই চলে যাব। কিন্তু খালা কোথায় যাবে? মামারা তো তাকে নেবেনা। তার তেমন কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই যে নিজে কিছু করে খাবেন। আপনি… আপনি খালাকে আটকান। উনি এর মাঝেই সুটকেস গোছানো শুরু করে দিয়েছেন। বলেছেন কাল সকালেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। 

আকাশ চুপ। নিশ্বাস টান টান। বড় কষ্ট বুকের ভেতর! কী আশ্চর্য! তার যেমন মা নেই, ঝুমকিরও তেমন সন্তান নেই। তার মা কখনো ফিরে আসবেনা… ঝুমকিরও কখনো সন্তান হবেনা। দুজনের দুঃখ যেন একই সুতোর বুনোটে বাঁধা! 

.

হৃদিকে সামির আব্বা আম্মা নামিয়ে দিয়ে গেছেন ওর বাসায়। বাড়ি যখন ফিরল তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় একটা। মা ড্রইং রুমের সোফায় বসে অপেক্ষা করছিলেন। হৃদি ঘরে ঢুকতেই বললেন, ‘আজকাল প্রায়ই দেরি করে বাড়ি ফিরছিস। এসব হচ্ছেটা কী?’ 

—‘আজকে তো সামির জন্মদিন ছিল। তুমি বুঝি জানোনা?’ হৃদি বলল নতমুখে। 

—‘তা জন্মদিনের অনুষ্ঠান কি দিনে দিনে করে ফেলা যায়না? এত রাত অবধি কীসের জন্মদিন?’ 

—‘উফ মা, রোজ রোজ তোমার এসব লেকচার শুনতে আমার বিরক্ত লাগে!’ 

—‘তোর বাবা বলে দিয়েছে, রাত করে বাড়ি ফেরা আর চলবেনা।’

–’আমাকে সামির আব্বা আম্মা নামিয়ে দিয়ে গেছেন। তুমি ঘুমাওনি কেন? এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকার কী মানে? 

—‘কী মানে বুঝিস না তুই? তোর টেনশনেই তো ঘুমাতে পারছিনা।’

হৃদি ভেতরের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দায়সারা গলায় বলল, ‘অত টেনশনের কী আছে মা? আমি কোথায় যাই, কী করি সব তো তুমি জানো। লুকোইতো না কিছু।’ 

মা হৃদির পেছন পেছন হেঁটে এসে বললেন,’শোন তোর বড় চাচা ইউ এস এ থেকে আসছেন আগামী সপ্তাহে। আমার মনে হয় এবার উনি মনে মনে কোনো একটা প্ল্যান করে আসছেন।’ 

হৃদি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী রকম প্ল্যান?’ 

—‘উনি তোর বাবাকে বলেছেন যে, রাহাতের জন্য উনি তোকে পছন্দ করেছেন।’ 

—‘রাহাত ভাইয়া? পছন্দ করেছেন মানে কী? রাহাত ভাইয়া তো আমার চাচাতো ভাই।’ 

—‘তাতে কী?’ 

—‘কাজিনদের মধ্যে বিয়ে শাদী হওয়া ভালোনা মা। সমস্যা হয়।’

—‘ওসব কোনো সমস্যাই না।’ 

—‘তুমি কিছুই জানোনা, বড্ড বোকা তুমি।’ 

মা চোখ মটকে বললেন, ‘হ্যাঁ বুদ্ধি তো সব তোমার ঘটে। যা বলার তোমার বাবাকে গিয়ে বল যাও। তোমার বাবা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে রাহাতের সাথেই তোমার বিয়ে দেবেন।’ 

—‘বাবা সিদ্ধান্ত নিলে তো হবেনা মা। সিন্ধান্ত নিতে হবে আমার।’ 

—‘কেন তোর সমস্যাটা কোন জায়গায়? রাহাত ডাক্তার ছেলে। আমেরিকার মত জায়গায় ডাক্তারি প্র্যাকটিস করে। ওর বাবা তোর আপন চাচা। মাথায় করে রাখবে।’ 

হৃদি নিজের ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালো। হাতে ধরা পার্সটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানার উপর। মা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। হৃদি বুঝতে পারছে মায়ের লেকচার এখানেই শেষ নয়। আরও বেশ কিছুক্ষণ চলবে এই অযথা বকবকানি। হৃদি একটু বিরক্ত গলায় বলল, ‘মা ঘুমোতে যাও। রাত হয়েছে তো অনেক!’ 

মা তার ডান হাত বাড়িয়ে কী যেন একটা হৃদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এইটা রাখ।‘ 

হৃদি বিস্ময় নিয়ে মায়ের হাত থেকে জিনিসটা নিল। কালো সুতোয় বাঁধা একটি ছোট মাদুলি। 

—‘এটা দিয়ে কী করবো?’ 

—‘পীর সাহেবের কাছ থেকে কাল থেকে নিয়ে এসেছি। গলায় ঝুলিয়ে রাখ।’ 

—‘কী আশ্চর্য! কেন এটা গলায় ঝুলাবো আমি? কী হবে এটা পরলে?’ মা মিন মিন করে বললেন, ‘ভালো হবে।’ 

—‘কীসের ভালো?’ 

—‘ভালো চাকরি, ভালো বিয়ে।’ 

—‘উফ মা, এসবে কোনো লাভ হয়না। তুমি নামাজ পরে আমার জন্য দোয়া কর, তাতেই হবে। 

মা এবার একটু রেগে গেলেন, ‘তুই এত বেশি কথা বলিস কেন? যা বলি তা করতে পারিস না? পর, এখনই তাবিজটা গলায় পর।’ 

অতএব হৃদিকে জিনিসটা গলায় ঝুলাতেই হল। মা ঘরে উপস্থিত থাকা অবস্থায় পার্সের ভেতর হঠাৎ বাজনাটা বেজে উঠল, ‘তুই বন্ধু হয়ে আমার হাতটা ছুঁলে / আমি এ বিশ্ব সংসার যাবো ভুলে..’ কদিন হল ওরা সব বন্ধুরা রুদ্রর গাওয়া গানটা রিংটোন হিসেবে সেট করেছে। শীত কাল বলে চারপাশ বড় নীরব। ফ্যানের আওয়াজ নেই। নেই এয়ার কন্ডিশনের চিঁচিঁ শব্দ। গানের শব্দটা তাই বড্ড কানে লাগলো। হৃদি দ্রুত ব্যাগ খুলে সেলফোন বের করল। সামি ফোন করেছে। হৃদি ফোন কানে দিয়ে বলল, ‘এই শোন তোকে একটু পরে ফোন দিচ্ছি। দুই মিনিট পর।’ 

ফোন কাটতেই মা প্রশ্ন করলেন,’কে?’ 

—‘সামি।’ 

—‘এতো রাতে ফোন দিচ্ছে কেন?’ 

হৃদি অবাক চোখে তাকালো মায়ের দিকে,’তোমার আজকে কী হয়েছে মা? আমার বন্ধুদের কি রাত দিনের হিসেব আছে? ওরা তো যখন তখন ফোন দেয়। 

—‘এসব বেশি দিন চলবেনা।’ 

—‘মানে কী?’ 

—‘সামনে তোর বিয়ে হবে। এরকম রাত বিরেতে ফোন করলে শ্বশুর বাড়ির লোকে কী বলবে?’ 

—‘ওরকম শ্বশুর বাড়িতে আমি যাবইনা।’ 

—‘হৃদিতা শোন, সময় থাকতে নিজেকে শুধরে নে। এমন বন্ধু বন্ধু করে জীবনটা শেষ করে দিস না। বিভাকে দেখেছিস? কী সুন্দর সংসার করছে মন দিয়ে? তোকেও এরকম হতে হবে।’

—‘মা, তুমি যাও, ঘুম পাচ্ছে।’ 

—‘কত ঘুমাবি তা আমার জানা আছে। আমি চলে গেলেই ওই ছেলেটার সাথে ফুসুর ফাসুর করে কথা বলবি। গত রাতে তোরা ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কথা বলেছিস। আমি ফজরের নামাজ পড়তে উঠে তোর গলার আওয়াজ পেয়েছি।’ 

হৃদি কথাটা শুনে চুপসে গেল। আস্তে আস্তে বলল, ‘তুমি কান পেতে আমার কথা শোনো। এটা তো ঠিক না মা।’ 

মায়ের গলার স্বরটা হঠাৎ কেমন পাল্টে গেল, জরুরি ভাবে বলল, ‘হ্যাঁরে, এত কী কথা বলিস তোরা? অন্যরকম কোনো ঘটনা নয় তো আবার?’ 

হৃদি চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘না অন্যরকম কিছু না। সামির বিয়ে ঠিক হয়েছে। খুব শীঘ্রই ওর বিয়ে হবে।’ 

—‘ও, তাই নাকি?’ কথাটা বলে কয়েক সেকেন্ড নিজের মনে নিজে কিছু একটা ভেবে নিয়ে মা চিন্তিত গলায় বললেন, ‘কী জানি বাপু, আজকালকার ছেলে মেয়েদের মতি গতি আমি কিছু বুঝিনা। সারাদিন কথা বলে একজনের সাথে আর বিয়ে করে অন্য একজনকে।’ 

হৃদি হেসে বলল, ‘মা তুমি কি মনে মনে ভেবে রেখেছিলে যে এমপি রাশেদুল হকের ছেলের সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে হবে?’ 

মা চমকে উঠে বললেন, ‘ছিঃ ওসব কী কথা? আমি কেন মনে মনে অমন ভাববো? তবে হ্যাঁ, তোরা যদি একজন আরেকজনকে পছন্দ করে থাকিস, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’ 

—‘কী যে বল মা, ওরা কত বড়লোক। ওদের সাথে কি আমাদের মানায়? 

সেই সময় সেলফোনটা আবার বেজে উঠল, রুদ্র গাইতে লাগল গিটারের টুং টাং তারের সাথে, ‘তুই বন্ধু হয়ে আমার হাতটা ছুঁলে। হৃদি ফোন হাতে নিয়ে বলল, ‘সামি ফোন করছে মা। মনে হয় জরুরি কোনো কথা আছে।’ 

মা কথাটা শুনে আর দাঁড়ালেন না। ঘর ছাড়ার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে একবার বললেন, ‘রাত জেগে ফোনে কথা বলার অভ্যাসটা ত্যাগ কর। বিয়ের পর খুব সমস্যায় পড়বি।’ 

—‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তুমি যাও।’ 

মা বেরিয়ে যেতেই ঘরের দরজা আটকে দিয়ে হৃদি ফোনটা লাউড স্পিকারে দিল। আলমারি থেকে ঘরে পরার জামা বের করতে করতে বলল, ‘কী হইছে তোর, সামি? 

সামি ওপাশ থেকে খ্যাক দিয়ে বলে উঠল, কোন জাহান্নামে ছিলি শালী? এতক্ষণ লাগে তোর কল ব্যাক করতে?’ 

—‘মা ছিল আমার ঘরে।’ 

—‘তো?’ 

—‘তো আবার কী? কথা বলতেছিলাম।’ 

-‘কী কথা বলতেছিলি?’ 

—‘সেটা পরে বলব, আগে বল তোর এমন কী জরুরি দরকার পড়ল যে বার বার ডিস্টার্ব করতেছিস?’ 

-‘কী করতেছিস এখন?’ 

—‘ড্রেস চেঞ্জ করি।’ 

—‘মানে কী? তুই কি এখন নেকেড?’ 

—‘তাতে তোর কীরে হারামজাদা?’ 

—‘বল না!’ 

—‘না আমি মোটেও নেকেড না। 

—‘তাহলে তুই ড্রেস চেঞ্জ করতেছিস ক্যামনে? 

-‘সামি, তুই কি এসব ফালতু কথা বলার জন্য আমাকে ফোন করছিস?’

–’না না, শোন, তানিশা আমাকে মাত্র একটা ছবি পাঠাইছে বুঝছস? ছবিটা দোস্ত অনেক খোলামেলা। জোশ অনেক। তুই কি দেখবি?’ 

হৃদি ঝেঁঝে উঠে বলল, ‘বিয়া করবি তুই, আমি ছবি দেখে কী করব? আর তানিশা কে? ওই ঢঙ্গিটা?’ 

—‘কে আবার? আমার ফিয়ন্সে। 

—‘তোর ফিয়ন্সে তোরে কী সব বালের ছবি পাঠাইছে, সেই ছবি আমি কেন দেখব?’ 

—‘রুদ্রতো দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে।’ 

—‘তোর বৌয়ের ছবি দেখার জন্য ওই পাগল হইছে কেন?’ 

—‘জানিনা তো!’ 

-‘একটা থাপ্পড় মার ওর গালে।’ 

—‘তুই কি দেখবিনা?’ 

—‘জীবনেও না, আমি কি লেসবিয়ান নাকি?’ 

—‘মিস করলি কিন্তু মামা, মাইয়া কিন্তু হট!’ 

—‘রুদ্ররে গিয়া বল এইসব ফালতু কথা। আমারে বলতে আসিস না, নিজের বৌকে নিয়ে কেউ এসব কথা বলে?’ 

—‘বৌ তো হয়নায় এখনো! রুদ্ররে কি ছবি গুলা দেখাবো?’ 

—‘তোর কি মাথা ভর্তি গোবর?’ 

—‘আচ্ছা আন্টি তোকে কী বলতেছিল? এতক্ষণ ধরে?’ 

হৃদি ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে শুলো। ফোনের লাউডস্পিকার বন্ধ করে কানে নিয়ে বলল, ‘আমার বিয়ে দিতে চায়।’ 

—‘তোর বিয়ে?’ সামির কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল হৃদির বিয়ের ব্যাপারটা যেন খুব আশ্চর্যজনক কিছু। 

—‘এত অবাক হওয়ার মত কী হইলো? বিয়ে কি শুধু তোমরাই করবা? আমি করব না?’ 

—‘তোরে বিয়ে করবে কে রে? এক রবিন ছাড়া আর কেউ তোর ভাগ্যে জুটবেনা। আর রবিন হইল একটা মস্ত বড় বোকচোদ।’ 

—‘ফালতু কথা বলবিনা। আব্বা আমার এক কাজিনের সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা বলতেছে। কাজিন আমেরিকায় থাকে, ডাক্তার।’ 

সামি হো হো করে এক ডাকাতিয়া হাসি হেসে বলল, ‘ডাক্তার ছেলে বিয়ে করবে তোরে? তাও আবার আমেরিকান সিটিজেন ডাক্তার? আমেরিকায় এত সাদা সাদা সুন্দর হুরপরী ফেলে এসে তোর মত একটা কুৎসিত মেয়েকে সে কেন বিয়ে করবে বল তো? সে কি কানা? আমি তো কোনো লজিক খুঁজে পাচ্ছিনা। তুই তো পড়ালেখায়ও মিডিয়াম। কী দেখে তোকে পছন্দ করবে?’ 

হৃদির বুকটা হঠাৎ অভিমানে টলমল করে ওঠে। গম্ভীর গলায় বলে, -’সব সময় ফাজলামো করিস কেন, সামি? 

—‘ফাজলামো না, সিরিয়াসলি। আই মেন্ট ইচ এন্ড এভরি ওয়ার্ড।’

–’আমি যেমনই হইনা কেন দেখতে, তোর ওই ঢঙ্গি তানিশার থেকে অনেক ভালো আছি।’ 

—‘তানিশার গায়ের রং দেখছ তুমি? টকটকে লাল টমেটোর মত। ফিগার দেখছ?’ 

—‘তোর কি আসলেই ওই মেয়েটাকে পছন্দ হইছে সামি? সত্যি করে বল তো?’ 

—’জানিনা।’ 

—‘জানিনা মানে কী?’ 

—‘আমি শুধু জানি, যে বিভাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। ওরে শিক্ষা দেয়ার জন্য আমার বিয়া করা খুব দরকার। 

—‘বিভাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য নিজের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতেছিস?’ 

—‘শোন হৃদি, মুভ অন তো করতেই হবে, তাইনা? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেলাই ভালো।’ 

—‘পছন্দ না হলেও বিয়ে করতে হবে?’ 

—‘পছন্দ বলতে… ওয়েল টরুলি স্পিকিং মেয়েটারে আমার দেখতে শুনতে ভালোই লাগছে। স্মার্ট, মিশুক, সুন্দরী, লেখাপড়ায় খারাপ না। আর সবচেয়ে বড় কথা আমার মায়ের অনেক পছন্দ, বুঝছিস?’ 

—‘ওরাও তোদের মতো বড়লোক, তাইনা?’ 

—‘মেয়ের বাবার শুনছি ভালোই টাকা পয়সা। 

—‘তাহলে তো হয়েই গেল।’ 

—‘হুম… কিন্তু তোর কী হবে হৃদি? ডাক্তার তো তোকে পছন্দ করবেনা।’

—‘একশ বার করবে।’ 

—‘করবেনারে, তুই একটু ফেয়ার এন্ড লাভলি টাভলি মাখলে তো পারিস। মেয়েরা নাকি ওসব মেখে সুন্দর হয়। আচ্ছা শোন তানিশা আগামী মাসে সিঙ্গাপুর যাচ্ছে। ওকে আমি বলে দিব তোর জন্য ভালো ব্র্যাণ্ডের কিছু কসমেটিক্স নিয়ে আসতে। ওগুলো মেখে ডাক্তারের সামনে গেলে হয়তো পছন্দ করলেও করতে পারে।’ 

—‘লাত্থি খাবি কুত্তার বাচ্চা! ফোন রাখি।’ 

—‘দাঁড়া দাঁড়া, তানিশা আস্ক করতেছিল যে ফ্রেন্ডদের মধ্যে কারো সাথে আমার স্পেশাল কোনো রিলেশন ছিল কিনা। তো আমি বিভার কথা বলছি।’ 

—‘ভালো করছিস।’ 

—‘আর তোকে যে আমি বিভা মনে করে কিস করছিলাম, এটা কি বলার দরকার আছে?’ 

—‘আমি জানিনা। তোর ইচ্ছা।’ 

—‘নেক্সট উইকেন্ডে, ও তোদের সাথে মিট করবে বুঝছিস?’ 

—‘বেশ।’ 

—‘আজকে দোস্ত আমার মনটা অনেক ভালো। নয়মাস পর আব্বারে দেখলাম। ইট ওয়াজ আ গ্রেট সারপ্রাইজ টু মি! আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারতেছিলাম না।’ 

—‘হুম, ক্রেডিট গোজ টু …’ বলতে গিয়ে ঢোঁক গিলে ফেলল হৃদি।

—‘ক্রেডিট গোজ টু হুম?’ 

—‘না না মানে আঙ্কেলেরই ক্রেডিট। উনি নিজ থেকে দেখা করছেন তোর সাথে। সো নাইস অফ হিম।’ 

.

রাজশাহী থেকে অমৃতার এক দুঃসম্পর্কের চাচা এসেছেন ঢাকায়, চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। দু তিন সপ্তাহ থাকবেন তিনি অমৃতাদের ফ্ল্যাটে। দীপার ঘরটা তার জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছে। এই দু তিন সপ্তাহ দীপা অমৃতার ঘরে রাত কাটাবে। তার রাত জেগে পড়ালেখা করার বাতিক হয়েছে আজকাল। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল। পরীক্ষার কারণে রাত জাগার পরিমাণ বেড়েছে। এদিকে অমৃতার বাতি জ্বালানো থাকলে ঘুম আসেনা। সময় মতো ঘুমোনোটা তার জন্য খুব জরুরি। সকাল আটটার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয় রোজ। খুব বেশি রাত জাগা তার পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব না। রুম শেয়ার করতে গিয়ে তাই দুবোন খুব ভালো মুশকিলে পড়েছে। আজ এতো রাতে বাড়ি ফিরেও অমৃতা দেখলো দীপা ঘরের বাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করছে। 

অমৃতাকে দেখা মাত্র সে বলল, ‘আর এক ঘন্টা পড়ব। সমস্যা হবে তোর?’ 

অমৃতা একটু হতাশ গলায় বলল, ‘সমস্যা হলেই বা কী করার আছে?’

–’ড্রইং রুমে চলে যাব?’ 

—‘না থাক, এক ঘন্টায় খুব বেশি সমস্যা হবেনা।’ 

হাত মুখ ধুয়ে, কাপড় পাল্টে এসে বিছানায় গা রাখতে না রাখতেই ফোন এসে গেল। রুদ্রর গাওয়া ‘বৃষ্টিমহল’ বাজতে থাকল ফোনে। মোবাইলের স্ক্রীনে নামটা দেখে বুক চলকে উঠল হালকা। ফোন হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসল সে। দীপা দেখল ওর বেরিয়ে যাওয়াটা, আড়চোখে। ড্রইং রুমের সাথের লাগোয়া বারান্দায় এসে, রেলিং এর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফোনটা ধরলো সে, ‘জ্বি বলুন।’ 

জানুয়ারির মধ্যরাতের শীতল বাতাসটা গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাত পা ঠান্ডায় শিরশির করে উঠল। তাড়াহুড়োয় গায়ে কোনো গরম কাপড় না জড়িয়েই বাইরে চলে এসেছে সে। পরনে শুধু একটা পাতলা কাপড়ের টিশার্ট আর ট্রাউজার। গলির মুখে একটি নেড়ি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকছিল। আর খানিক বাদে বাদে শোনা যাচ্ছিল নাইটগার্ডের হুইসেলের আওয়াজ। এছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। নিশুতি রাত! 

—‘পৌঁছে গেছো বাসায়?’ 

—‘হ্যাঁ, এইতো একটু আগে। 

—‘আকাশ নামিয়ে দিয়েছে তোমাকে?’ 

—‘না। আমি আকাশকে নামিয়ে দিয়ে এসেছি।’ 

হক হেসে বললেন, ‘বাহ, বেশ তো! আজকাল সব কিছু উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। আগে ছেলেরা মেয়েদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসত। এখন মেয়েরা ছেলেদের পৌঁছে দিচ্ছে।’ 

—‘ছেলে মেয়ের আবার আলাদা আলাদা দায়িত্ব আছে নাকি? যাই হোক, আপনি বলুন? এতো রাতে ফোন করলেন কী ভেবে?’ 

—‘খুব বেশি অসময়ে করে ফেলেছি কি ফোনটা?’ 

—‘আপনার জন্য আমি অলওয়েজ এভেইলেবল।

—‘আমার জন্য?’ 

—‘হ্যাঁ আপনার জন্য।’ 

হক একটু থেমে থেমে বললেন,’ফোন করেছি, তোমাকে একটা ধন্যবাদ দেব বলে। অমৃতা! আমি বলে বোঝাতে পারবনা যে আমি তোমার কাছে কতটা কৃতজ্ঞ!’ 

কথাটা শুনে কেন যে অমৃতার এত ভালো লাগল কে জানে! ভালোলাগাটা একদম মুখের কথা কেঁড়ে নিল তার। আপ্লুত হয়ে কী যেন একটা বলতে গিয়েও বললোনা আবার। চুপ করে গেল। 

হক বললেন,’তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। তুমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছ আমার কাছে। একটা পুরস্কার তোমার প্রাপ্য।’ 

অমৃতার ট্রাউজারের পকেটে সিগারেটের বাক্স রাখা ছিল। সাথে লাইটারও। সে বক্স থেকে সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো। তার বুক কাঁপছিল হালকা। মনে হচ্ছিল ঠিক এই সময়, এই নির্দিষ্ট ফোনটা আসা খুব জরুরি ছিল। এই ফোনটা না আসলে বুঝি কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবার সম্ভাবনা ছিল আজ। সময় নিয়ে সিগারেটে একটা টান দিয়ে সে বলল, ‘যা চাইব তা দেবেন তো?’ 

—‘অবশ্যই! কী চাই তোমার, বল?’ 

—‘কথা দিলেন কিন্তু, যা চাইব ঠিক তাই দিতে হবে।’ 

—‘হ্যাঁ কথা দিলাম। তবে আশা করি তুমি আমার সামর্থ্যের বাইরে কিছু চাইবেনা।’ 

—‘আপনার সামর্থ্যের বাইরে কি কিছু আছে মিস্টার হক? আপনি তো ক্ষমতাবান লোক। 

—‘প্রতিটি মানুষেরই কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আমি মানুষ, দেবতা তো নই। 

—‘ঠিক আছে, তাহলে শুনুন আমি কী চাই।’ 

-‘হ্যাঁ বল, শুনছি।’ 

একটু সময় চুপ করে থেকে অমৃতা চপল গলায় বলল, –’আপনি আমার বন্ধু হবেন?’ 

—‘বন্ধু!’ 

—‘হ্যাঁ, বন্ধু।’ 

হক সাহেব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন এই কথা শুনে। তিনি বুঝতে পারছেন না যে এই মেয়েটা কি ফাজিল? ফচকে? নাকি পাগল? হাসতে হাসতেই তিনি বললেন, ‘কিন্তু অমৃতা, তোমার তো অনেক বন্ধু আছে। হঠাৎ নতুন বন্ধুর প্রয়োজন কেন পড়ল?’ 

—‘হ্যাঁ বন্ধু আমার আছে তা ঠিক। বলতে পারেন বন্ধুরা আমার অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। কিন্তু আমার কোনো বিশেষ বন্ধু নেই। 

—‘বিশেষ বন্ধু?’ 

—‘হ্যাঁ, বিশেষ বন্ধু।’ 

—‘বিশেষ বন্ধু বলতে ঠিক কী বোঝায়? আর সেটা কীভাবে হওয়া যায়?’

—‘সেটাও আপনি জানেননা?’ অমৃতা হাসে এবার। ফিচেল হাসি!  

—‘না, জানিনাতো!’

—‘আচ্ছা আমি শিখিয়ে দেব। যদিও আমার এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা একেবারেই কম।’ 

—‘কিন্তু তুমি তো আমার ছেলের বন্ধু! আমার বন্ধু কী করে হবে?’

—‘সামি আমার শুধুই বন্ধু। বিশেষ বন্ধু নয় তো! 

—‘এত বয়সের তফাতে কি বন্ধু হওয়া যায়?’ 

—‘এজ ইজ জাস্ট আ নাম্বার! আপনি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে আমি যা চাইব, তাই দেবেন।’ 

মেয়েটা যে এমন অদ্ভুত আবদার করে বসবে এটা তার ধারণার বাইরে ছিল। হক এবার বেশ একটু বিচলিত বোধ করতে লাগলেন। কিন্তু বিচলিত বোধটার পাশাপাশি বহু বছর পর তার মনের মধ্যে একটি নির্মল আনন্দের সঞ্চার হল। একটা সময় তার অগণিত বন্ধু ছিল। সময়ের ব্যবধানে সেইসব বন্ধুরা আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা জায়গায়। কারো সাথে যোগাযোগ নেই। কয়েকজন যাও বা যোগাযোগ রেখেছে তা নিছক প্রয়োজনের খাতিরে। বর্তমানে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সকলেই তাঁর দর্শন লাভ করতে চায় নানা মতলবে, তদবীরে আর স্বার্থের তাগিদে। আজকের এই ভীষণ স্বার্থসম্পন্ন, সঙ্কীর্ণচেতা, আত্মকেন্দ্রী পৃথিবীতে কেউ একজন তাঁর মতো ক্ষমতাবান, প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যক্তির কাছ থেকে উপহার হিসেবে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব পেতে চাইছে, এতো ভারী চমকপ্রদ একটি ব্যাপার! 

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অমৃতা অধৈর্য গলায় বলল, ‘কী হল? কথা বলছেন না যে?’ 

হক ভাবনার ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে কোনো রকমে বললেন, – ‘কিন্তু আমার ছেলে ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে বল তো?’ 

—‘ওটা আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিন। আর আপাতত ওকে কিছু বলার দরকার নেই।’ 

—‘আমি তোমাদের জেনারেশনটাকে ঠিক মতো বুঝতে পারিনা!’

—‘তাহলে আজ থেকে আপনি আমার বন্ধু, ঠিক আছে?’ তারিয়ে তারিয়ে আমুদে গলায় শব্দগুলো উচ্চারণ করে অমৃতা। 

—‘হুম, ঠিক আছে।’ 

—‘থ্যাংক ইউ!’ 

হক এই পর্যায়ে অস্বস্তিতে চুপ করে গেলেন। তিনি জানেন না এরপর তার ঠিক কী বলা উচিৎ। কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে তিনি বিপন্ন বোধ করতে লাগলেন। বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিলেন তাঁর স্ত্রী। তিনি স্টাডি রুমে বসে কথা বলছিলেন ফোনে। রোমেলা স্টাডিরুমের দরজাটা একটু ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দেখলেন স্বামীকে। দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে হক একটু অপ্রস্তুত ভাবে অমৃতাকে বললেন, ‘এখন তাহলে ছাড়ছি।’ কথাটা বলে তিনি অমৃতাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। ফোন কাটলেন চট করে। রোমেলা অবাক গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কার সাথে কথা বলছিলে?’ 

হক মোবাইল ফোনটা একেবারে সুইচড অফ করে দিলেন। কেন জানেন না তাঁর মনে হচ্ছিল অমৃতা আবার কল ব্যাক করে বসতে পারে। এই মেয়েটির কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তিনি স্ত্রীকে বললেন, ‘একটু জরুরি কথা বলছিলাম। 

—‘এত রাতে?’ 

—‘হুম…’ 

ছোট করে শব্দটা উচ্চারণ করে তিনি উঠে পড়লেন। স্ত্রীর সাথে সচরাচর মিথ্যা কথা বলেননা। প্রয়োজন পড়েনি কখনো। আজকে এই ছোট্ট মিথ্যা কথাটা বলে ফেলে তার মনের ভেতর কেমন পাপ বোধ কাজ করতে লাগল। তবে সেই সাথে একটা অন্যরকম নিষ্কলুষ ভালো লাগা টের পাচ্ছিলেন তিনি ভেতরে ভেতরে। অনেক অনেক দিন তার এই ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে এমন নিষ্কলুষ আনন্দের ছায়া পড়েনি! 

২৭

ঢাকা ফেরার আগের দুটা দিন বিভা কাটালো কলকাতায়, সল্টলেকের বাড়িতে। এবারে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার অন্যরকম রূপ দেখতে পেল। এই মেয়ে যেন কয়েকদিনের তফাতেই হয়ে উঠেছে পরিণত বয়স্ক, সপ্রতিভ এবং দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন। ডুয়ার্স যাবার পূর্বের আটটা মাস বাড়ির লোকের সাথে তার ব্যবহার ছিল অতিথির মত। সারাদিন নিজের ঘরের দোর দিয়ে বসে থাকত। শাশুড়ি মায়ের সাথে শুধু রোজ বিকেলে একটু হাঁটতে বেরোনো আর রাতের বেলায় শ্বশুর মশাইয়ের ঔষধ পত্র প্রেসক্রিপশন দেখে দেখে খাইয়ে দেয়া, এই এতটুকু ছিল তার সাংসারিক দায়িত্ব। খাবার টেবিলে কোনো বাড়তি কথা বলতোনা সে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে পড়ত। আত্মীয়স্বজন, ননদ, দেবররা গল্প করতে আসলে ফ্যালফ্যাল করে তাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকত। প্রশ্নের উত্তর দিত হ্যাঁ অথবা না বলে। অভিজিতকে একবার তার মা প্রশ্ন করেছিলেন, বৌমার কোনো মানসিক প্রতিবন্ধকতা নেই তো? কিছু বললে কেমন হা করে চেয়ে থাকে, যেন বাংলা বোঝেনা। জবাবে অভিজিৎ বলেছে, নিজের দেশ ছেড়ে দূরে চলে এসেছে, হয়তো হোমসিকনেস কাজ করছে। ঠিক হয়ে যাবে। বলেছিল ঠিকই, কিন্তু অভিজিৎ মনে মনে জানতো যে, এ কখনো ঠিক হবার নয়। এ সম্পর্ক মিথ্যা সম্পর্ক। শীঘ্রই এই মিথ্যে সম্পর্কের সত্যিকারের ইতি টানা হবে। বাবা মায়ের সামনে স্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণ তাকে বিব্রত করে তুলত প্রতি নিয়ত। না পারত কাউকে কিছু বলতে, না পারতো সইতে। কত রাত দুশ্চিন্তায় ঘুম হয়নি শুধুমাত্র এই ভেবে যে সত্য জানতে পারলে বাবা মায়ের কী অবস্থা হবে? তার বাবার বয়স সত্তর। মায়ের পঁয়ষট্টি। বাবার ডায়বেটিস সহ নানার রকম বার্ধক্যজনিত রোগ আছে। বড় দুই দাদা দেশের বাইরে সেটেলড। এক দিদি থাকেন স্বামীর সঙ্গে দিল্লীতে। ছোট ভাইটির এখনো লেখাপড়া শেষ হয়নি। তার সাবলম্বী হয়ে উঠতে আরো বছর পাঁচেক সময় লেগে যাবে। এমতাবস্থায় বাবা মায়ের একমাত্র অবলম্বন হল অভিজিৎ। এই বয়সে বুড়ো বাবা মাকে কেমন করে সে এতবড় দুঃসংবাদটা দেবে এবং এই দুঃসংবাদ জানতে পারার পর তাদের দুজনের ওপর দিয়ে কী ঝড়টা যাবে এই ভেবে ভেবে কত রাতের ঘুম হারাম হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বড় শখ করে বাড়িতে বৌ এনেছিলেন মা। সেই শখের বৌমা প্রথম তিনটা মাস শাশুড়ির সাথে হেসে একটি কথা পর্যন্ত বলল না। দশটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত নতুন বৌয়ের কাছ থেকে। কয়েকমাস পর তার মুখে কথা ফুটল ঠিকই কিন্তু সারাক্ষণ একটা কেমন আড়ষ্টতা কাজ করত তার ভেতরে। তবে শ্বশুর, শাশুড়িকে কখনোই সে অসম্মান করেনি। বরং শ্রদ্ধার চোখেই দেখেছে। ধীরে ধীরে একটা মায়াও জন্মে গিয়েছিল। কিন্তু সেই মায়ায় আপন আপন গন্ধ ছিলোনা, অধিকার ছিলো না, তার বদলে ছিল একরকম করুণা। 

এবার ঘটল সম্পূর্ণ অন্যরকম ঘটনা। বিভাকে এত হাসিখুশি শ্বশুর বাড়ির লোকে এর আগে কখনো দেখেনি। দুটো দিন সে শাশুড়িকে সঙ্গ দিল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘন্টা বাজিয়ে পূজো করল। রান্না করল। শ্বশুরকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। দেবরটাকে সাথে নিয়ে অভিজিৎ আর সে রাত জেগে মুভি দেখলো। সব মিলিয়ে এ যাত্রায় বিভা, অভিজিতের মন প্রাণ একদম ভরিয়ে দিল। সব কথাতো মুখে বলতে হয়না। কিছু না বলেই বিভা বুঝিয়ে দিল যে আপাতত অভিজিৎকে ছেড়ে যাবার কোনো পরিকল্পনা তার নেই। কিন্তু বিভার মতো একটা উড়নচণ্ডী মেয়ের ওপর কতটা ভরসা করা যায়? কী করে নিশ্চিত হবে অভিজিৎ, যে ঢাকা গিয়ে বিভা তার পুরোনো প্রেমিককে দেখতে পেয়ে মন পাল্টে ফেলবেনা? মেয়েটাকে সে যতটা দেখেছে, বুঝেছে যে ভেতরে ভেতরে সে এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছে। জীবনটা তার কাছে এখনো পুতুল খেলারই মতো। তাই হাসিখুশি, সংসারী বিভাকে দেখে অভিজিতের সুখানুভূতির পাশাপাশি একটু কেমন ভয় ভয়ও লাগছিল। তার পোড়া কপালে এই সুখ খুব বেশিদিন সইবে কি? 

বিভা ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলের ওপর বসে ছিল। তার গায়ে হালকা বেগুনি রঙের স্লিভলেস নাইটি। গলায় ঝুলছে স্বর্ণের লকেট। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল গুলো সামনে এনে বাম বুকের ওপর ছড়িয়ে রেখে আস্তে আস্তে চিরুনি বুলাচ্ছিল সে। গোছগাছ করতে করতেই রাত বারোটা বেজে গেছে। প্লেন ছাড়বে সকালে। বাড়ি থেকে বেরোতে হবে ভোর ছটায়। সাড়ে সাতটায় রিপোর্টিং। বিভাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে অভিজিৎ গাড়ি নিয়ে সোজা চলে যাবে ডুয়ার্সে। আজ অনেক দিন পর বিভার মনের মাঝে এক অনাবিল আনন্দ অনুভূত হচ্ছে। হবেইবা না কেন? প্রায় এক বছর পর সে নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে বাবা মায়ের কাছে, বন্ধুদের কাছে, প্রাণের শহরটার কাছে। ভাবতেই শরীরের প্রতিটি রক্তকণায় তিরতির করে ছড়িয়ে যাচ্ছে এক প্রবল উত্তেজনা। আর তর সইছেনা। 

আয়নায় নিজের পেছনে একটি লম্বা ছায়া দেখতে পেল সে হঠাৎ! অভিজিৎ নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। তার পরনে একটি ঘিয়া রঙের ফতুয়া। সাদা পাজামা। চোখে রোজকার মোটা কাচের চশমা। ওকে দেখতে পেয়ে বিভা চিরুনি চালানো বন্ধ করে, সন্দিহান হয়ে বলল, ‘কিছু বলবেন?’ 

অভিজিৎ একটু ম্লান ভাবে বলল, ‘তেমন কিছুনা।’ 

বিভা চুল আঁচড়ানো শেষ করে বডি বাটারের কৌটা হাতে নিয়ে বলল, ‘আপনার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি।’ 

—‘কী বুঝতে পারছেন?’ 

বিভা হাতে আর গলায় বডি বাটার মাখতে মাখতে বলল, ‘আমি চলে যাচ্ছি বলে আপনার মন খারাপ।’ 

অভিজিৎ মুখে একটা কপট গম্ভীর ভাব আনার চেষ্টা করে বলল, ‘না না!’

—‘না?’

—‘নাহ!’ 

—‘সত্যি না?’ 

—‘সত্যি না।’ 

—‘মিথ্যে কথা!’

—‘সত্য কথা! নিজেকে অতটা ইম্পরট্যান্ট ভাবার কিছু নেই।’ অভিজিৎ‍ বলল কপট গম্ভীর ভাবটা মুখে বজায় রেখেই। 

বিভা অবাক চোখে তাকাল চশমা ওয়ালা ভালমানুষ চেহারার ছেলেটার দিকে। বাঃ খুব চটাং চটাং কথা বলা হচ্ছে আজকাল! 

—‘তাহলে মুখটাকে ওরকম হাঁড়িপানা করে রেখেছেন কেন সেই তখন থেকে?’ বিভা বলে উঠল তেজালো কণ্ঠে 

অভিজিৎ হেঁটে এসে বিছানার ওপরে পা ঝুলিয়ে বসল, বলল, ‘আমার মুখটা একটু হাঁড়ির মতই হয়ে থাকে সবসময়। এ নতুন কিছুনা।’ 

বিভার মুখে একটা চাপা রাগ গনগন করছিল। সে বডি বাটার মাখা শেষ করে, উঠে এসে দাঁড়ালো অভিজিতের সামনে। চোখা ভাবে বলল, ‘এর মানে আমি চলে গেলে আপনি আমাকে একটুও মিস করবেন না?’ 

অভিজিৎ স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আপনাকে মিস করার কোনো কারণ নেই তো! আমাকে দেখাশোনা করার জন্য দূৰ্গা আছে।’ 

দূর্গার নামটা শুনে বিভার রাগ যেন আরো দশ গুণ বেড়ে গেল। সে বিষঢালা গলায় বলে উঠল, ‘ও আচ্ছা, তাই বলুন! বলি, দূর্গা আপনার মা হয়, নাকি বৌ হয়? যে তার ওপর এতো ভরসা?’ 

—‘ছিঃ আপনি ভীষণ ন্যারো মাইন্ডেড।’ 

—‘হ্যাঁ উচিৎ কথা বলতে গেলে তো ন্যারো মাইন্ডেড হবই আমি।’ এটুকু বলে বিভা আঙুল তুলে একদম ঝগড়াটে গলায় বলল, ‘দেখুন ওই মেয়েটাকে আপনি নিজের বেশি কাছে ঘেঁষতে দেবেননা। আমার এইসব একদম পছন্দ হয়না। বাড়ির কাজের লোক থাকবে কাজের লোকের মতো। অত সারাদিন দাদাবাবু দাদাবাবু করে গায়ের ওপর পড়া কেন শুনি?’ 

অভিজিৎ হেসে ফেলল এবার। আচম্বিতে হাত বাড়িয়ে বিভাকে কাছে টেনে এনে নিজের কোলের ওপর বসিয়ে ফেলল। তারপর ওর গালে চকাম করে একটা চুমু খেয়ে ফেলে বলল, ‘এত হিংসা পেটে নিয়ে বেঁচে আছেন কী করে?’ 

বিভা ওই আচমকা চুমুতে লাল হয়ে গেল একদম। রাগটা একটু নরম হল বুঝি। বলল, ‘কাজের মেয়েকে হিংসা করব আমি। খেয়ে দেয়ে তো আর কাজ নেই আমার। আর আপনাকে কতবার বলা লাগবে আমাকে আপনি সম্বোধন না করতে?’ 

বিভার গা থেকে ভুরভুর করে বডি বাটারের সুগন্ধ ভেসে আসছিল। ওর ডাগর দুটি চোখে তখন কী অদ্ভুত মাদকতা! অভিজিৎ ওই মাদক চোখের দিকে কয়েকটা সেকেন্ড মুগ্ধ ভাবে চেয়ে থেকে বলল, ‘তুমি আবার ফিরে আসবে তো? বিভাবরী?’ 

জানেনা কেন, প্রশ্নটা বিভার হৃৎপিণ্ডকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। মোটা কাচের চশমা পরা, ভালোমানুষি চোখের মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকে তার গলার কাছে একটা কান্নার ভাব সুড়সুড়ি দিয়ে উঠল হঠাৎ। কোনো এক অদ্ভুত কারণে এই মানুষটাকে ছেড়ে যেতে তার কষ্ট হচ্ছে। ডুয়ার্সের ওই ছোট্ট জংলী গ্রামটায় এই লোকটাকে একদম একলা দিন কাটাতে হবে, এই চিন্তাটা মাথায় আসলেই তার মন কেমন করছে। দেশে ফিরে যাবার আনন্দের জোয়ারে ভাটা পড়ছে। অথচ বিভা ওই গ্রামে যাবার আগে অভিজিৎ ওখানে একলাই থাকত। বিভাকে ছাড়া থাকতে তার কিন্তু খুব একটা সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু বিভার কেবলই মনে হচ্ছে যে ওই ছোট্ট গ্রামের ছোট্ট সংসারটা তার অভাবে একদম মুষড়ে যাবে, মুষড়ে পড়বে এই মানুষটাও। এক বছর আগে, বিয়ের পর দেশ ছেড়ে কলকাতায় আসার সময় মনে হয়েছিল বুঝি শুধুমাত্র শরীরটাই প্লেনে চড়ে এসেছে এই শহরে। মনটা রয়ে গেছে ঢাকায়, মা বাবার সাথে, বন্ধুদের সাথে, সামির সাথে। তারপর প্রায় অনেক দিন বাদে সেই হৃদয়হীন শরীরে বুঝি আবার নতুন করে একটি মন গজিয়ে ওঠার পায়তারা করতে লাগল। ক্ৰমে ক্ৰমে, বড় ঢিমেতালে নিজের অজান্তে গজিয়ে ওঠা সেই মনে একটু একটু করে সার পড়তে থাকল যেন। এভাবেই একদিন সে তার হৃদয়হীন শরীরটাতে পুনরায় প্রাণের স্পন্দন টের পেল। এখন কলকাতা ছেড়ে যাবার সময় তাইতো তার মনে হচ্ছে, এবারেও সে তার সম্পূর্ণটা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারছেনা। টুকরো টুকরো বিভাকে সে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে, এই সল্টলেকের বাড়িতে, ডুয়ার্সের কটেজে, আর অভিজিতের ওই ভালোমানুষি চোখের মাঝে! 

অভিজিৎ বিভার কানের ডগায় একটা আলতো চুমু খেয়ে বলল, ‘উত্তর দিচ্ছ না যে?’ 

বিভা উত্তর দিল না, কিন্তু অভিজিতের আদরে সাড়া দিল। বিছানায় অন্তরঙ্গ হবার সময় সে ফিসফিস করে বলল, ‘আমাকে যে ফিরে আসতেই হবে অভিজিৎ! আমার সবটা তো আমি নিয়ে যেতে পারছিনা এ যাত্রায়। যা ফেলে যাচ্ছি, সেই ফেলে যাওয়া অংশটুকু কুড়িয়ে নেবার জন্য হলেও, আমাকে ফিরতেই হবে!’ 

.

এয়ারপোর্টে বন্ধুরা চলে আসল সকাল আটটার মধ্যে। অমৃতা আজ কোর্টে যাবেনা। হৃদির ক্লাস নেই। সামি তো এক সপ্তাহ হল চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেনি শুধু রুদ্র আর আকাশ। তবে দুজনেই কর্মস’লে জানিয়ে দিয়েছে আজ কাজে যোগদান করতে বিলম্ব হবে। সামি এয়ারপোর্টে আসার ব্যাপারে শুরু থেকেই অনীহা দেখাচ্ছিল। তার অনীহা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে বিভার প্রতি তার রাগটা এখনো রয়ে গেছে। তবে বন্ধুদের জোরাজোরিতে সে বেশিক্ষণ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলোনা। ধরে বেঁধে একরকম বগল দাবা করে বন্ধুরা তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। সাথে এনেছে ফুলের মালা, এবং ব্লুটুথ স্পিকার। বিভা যখন বের হয়ে আসবে তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজবে। বন্ধুরা নাচতে নাচতে গিয়ে তার গলায় ফুলের মালা পরাবে। গান এবং ফুলের মালার আইডিয়া রুদ্রর। অমৃতা বলেছিল এসব খ্যাত কাজ কারবারের মধ্যে সে নেই। শুনে রুদ্র রেগে গিয়ে বলেছে, খ্যাত হইলে খ্যাত। খ্যাত কাজ কারবার করতেই আমাদের মজা লাগে। তোমার মনে চাইলে থাকো, মনে না চাইলে ভাগো। অর্থাৎ পুষ্পমাল্য পরানোর আইডিয়াটা শেষতক বাতিল করা গেল না। 

বিভার আব্বা আম্মা এয়ারপোর্টে আসেননি। উনারা বাড়িতে বসেই মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। বিভা নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেল যথা সময়ে। গানের তালে নাচতে নাচতে রুদ্র আর আকাশ তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করল। উপস্থিত লোকজন দৃশ্যটিতে বেশ বিনোদন খুঁজে পেতে লাগল। দু জন চ্যাংড়া বয়সী ছেলে উত্তেজনার বশে ভিডিও করা শুরু করল। একজন দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, ‘আফায় কি নেত্রী নাকি? কুন দল?’ 

অমৃতার দাদাগিরিতে অবশ্য উপস্থিত দর্শকরা খুব একটা সুবিধা করতে পারলনা। ভিডিও করতে থাকা ছেলেটির হাত থেকে সে ছোঁ মেরে ফোন কেঁড়ে নিল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আপনি ভিডিও করার পারমিশন নিয়েছেন? কোথায় পান এত সাহস?’ ছেলেটি অমৃতার হম্বিতম্বি দেখে একটু বুঝি ভয়ই পেলো। মিনমিন করে বলল, ‘আচ্ছা ভিডিও করবোনা। ফোনটা ফেরত দেন। 

গলায় দুটি ফুলের মালা পরে রাজ্য জয়ের হাসি হাসতে হাসতে বিভা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসল। বন্ধুরা সবাই তাকে দেখামাত্র আলিঙ্গন করেছে। শুধুমাত্র সামি বাদে। বিভা নিজ থেকে সামির কাছে এগিয়ে গেছে, জড়িয়ে ধরেছে। সামি কাঠ কাঠ গলায় যে কথাটা প্রথম বলেছে তা হল, ‘তুই কি আমার এনগেজমেন্ট খাইতে আসছিস?’ 

বিভা কৃত্রিম হাসি হেসে বলেছে, ‘আবার জিগ্‌স্‌! এনগেজমেন্ট, বিয়া সব একবারে খেয়ে যাবো।’ 

বিভাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছুলো ওরা গোটা এক ঘন্টার ট্র্যাফিক জ্যাম ঠেলে বিভার বিয়ের পর এই প্রথম বন্ধুদের আসা এ বাড়িতে। বিয়ের দিনটির কথা মনে পড়ছিল সবার। কী এক নিদারুণ কষ্টের দিন ছিল। কেউ কোনোদিন ভুলতে পারবেনা সেই দিনটির কথা। তবে আজ আর সেই দগদগে কষ্টটি নেই। বিভাকে ওরা পুনরায় ফিরে পেয়েছে। প্রকৃতি রোধন ও সমন্বয়নে সর্বদাই পটু। সময়ের সাথে সাথে স্থিরতা আসতে বাধ্য। বহমান সময়ের অমোঘ পরিক্রমায় মানুষের জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়ে যায়, আবার অনেক প্রাপ্তিযোগ ঘটে। হারিয়ে ফেলা আর খুঁজে পাওয়ার এই দুর্দমনীয় নিরন্তর প্রক্রিয়ার অপর নামই বোধহয় জীবন। 

বিভা কি এখন আর সামিকে ভালোবাসেনা? কিংবা সামি বিভাকে? নিশ্চয়ই বাসে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই ভালোবাসার রকম সকম হয়তো একটু বদলে গেছে। বাস্তবতার ছোবলে স্বর্গীয় প্রেম থেকে নেমে এসে সম্পর্কটা হয়ত মোড় নিচ্ছে বোঝাপড়ার দিকে। বন্ধুত্বের দিকে। বস্তুত, মানুষের হৃদয়রাজ্যের রহস্য সর্বদাই অমীমাংসিত। হৃদয়পুরের অভেদ্য রহস্য বুকে নিয়েই জীবন নামের রঙ্গমঞ্চে যার যার নির্দিষ্ট চরিত্রে অভিনয় করে যেতে হয়, শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত। হ্যাঁ, এটাই সভ্য ভাবে বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত। 

বিভাদের এপার্টমেন্টের নিচে পৌঁছেই সামি বলল, ‘আমি আর উপরে না যাই, তোরা সন্ধ্যায় দেখা করিস।’ 

বন্ধুরা বুঝলো, সামির সংকোচটা আসলে বিভার বাবা মাকে ঘিরেই। বুঝতে পেরে খুব একটা জোর করলোনা ওরা কেউ। তাছাড়া বিভার বাবা মাও সামিকে সহজ ভাবে গ্রহণ করবেন কিনা মেয়ের বন্ধু হিসেবে এ বিষয়ে এখনো সন্দেহ আছে। বাকি বন্ধুরা বিভাদের বাসায় সকালের নাশতা করল। রুদ্র আর আকাশ নাশতা সেরেই বেরিয়ে পড়ল অফিসের উদ্দেশ্যে। এরপর বিভার বেডরুমে বসল তিন বান্ধবীর জরুরী মিটিং। অনেক দিন পর, নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় এসে বিভার তখন আনন্দে দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা। তার মুখ থেকে হাসি আর সরছেইনা! 

হৃদি বিভার ঘরের দরজা লক করে গম্ভীর গলায় বলল, ‘বিভা কথা আছে তোর সাথে।’ 

অমৃতা লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল বিভার পাশে। ঘড়িতে তখন বেলা বারোটা। বাইরে চনমনে রোদ। একজোড়া চড়ুই পাখি অনেকক্ষণ যাবৎ কিচির মিচির করে ডেকে যাচ্ছে বারান্দার রেলিঙে বসে। সাত তলার ওপরের ফ্ল্যাটেও অনায়াসে ভেসে আসছে রাস্তা থেকে গাড়ির হর্নের আওয়াজ, লোকজনের উচ্চ স্বরের কথাবার্তা। 

বিভার চোখমুখ আনন্দে চকচক করছিল। সে জানে সময়টা এখন খুব একটা আনন্দ করার মতো নয়। সামির এনগেজমেন্টের দিন ঠিক হয়ে গেছে। যা করার আজ কালের মধ্যেই করতে হবে। সামি গাধাটাকে বোঝাতে হবে যে এই বিয়ে তার জন্য কোনোভাবেই ফলপ্রসূ নয়। বিয়ে থামাতে হবে। জানে বিভা সবই, তবুও এতদিন পরে দেশে ফিরে এসে, আপনজনদের কাছে পাবার আনন্দটা সে কোনোভাবেই লুকোতে পারছিলোনা। না চাইতেও একটা ভ্যাদভ্যাদে হাসি তার গালে আঠার মতো লেগে ছিল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। 

হৃদি পা তুলে বসলো বিছানার ওপর। কথা শুরু করল অমৃতা, ‘শোন বিভা, আমার কিন্তু হৃদিকে নিয়ে কিছু অবজার্ভেশন আছে।’ 

বিভা হাসতে হাসতেই বলল, ‘কী অবজারভেশন?’ 

হৃদি শানিত চোখে অমৃতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলে ফেল। আমারও বলার আছে অনেক কিছু তোমার নামে।’ 

বিভা চোখ সরু করে বলল, ‘কাহিনী কী? সালিশ বসাইছিস নাকি তোরা?’

অমৃতা গায়ে পরে থাকা কালো লেদারের জ্যাকেটটা খুলে নিয়ে, বিছানার ওপর রেখে বলল, ‘হ্যাঁ সালিশ বসাইছি।’ 

—‘বেশ তো, শুরু কর, কোন পক্ষ আগে বলবে?’ 

অমৃতা বলল, ‘আমিই বলতেছি। আমার মনে হয় হৃদির বাচ্চি আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকাইতেছে।’ 

বিভা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী লুকাইতেছে?’ 

হৃদি মুখ ঝামটা মারলো, ‘মাথা আর মুণ্ডু লুকাইতেছি।’ 

অমৃতা বলল,’শোন, যা বলার সরাসরি বলব, আমার মনে হয় আফটার দ্যাট কিসিং ইন্সিডেন্ট ইন ডুয়ার্স, হৃদি হ্যাজ স্টার্টেড টু হ্যাভ ফিলিংস ফর সামি।’ 

বিভা কথাটা শুনে হতাশ গলায় বলল, ‘ও, এই কথা? এটা তুই এতদিনে বুঝছিস?’ 

—‘তুই আগেই জানতি?’

—‘হ্যাঁ আমি তো এইটা ডুয়ার্সে থাকতেই বুঝছি।’ 

অমৃতা হৃদির দিকে চেয়ে কড়া গলায় বলল, ‘তুই বিভারে বলছিস, কিন্তু আমারে বলিসনাই? এটা কী ধরণের ফাইজলামি?’ 

হৃদি একটু অপ্রস্তুত ভাবে বলল, ‘আরে বিভারে আমি নিজে থেকে কিছুই বলিনাই।’ 

বিভা অমৃতাকে বলল, ‘তুই ওর উপর রাগ করিস না। ও একটা গাধী নাম্বার ওয়ান। ও আমারে কিছুই বলেনাই, আমি নিজেই বুঝছি।’ 

অমৃতা বিস্মিত ভাবে বলল, ‘কিন্তু সামি তো বিয়ে করতে যাচ্ছে অন্য মেয়েকে,আমার মাথায় কিছু ঢুকতেছেনা। হৃদির উচিৎ কনফেস করা।’ 

—‘এই জন্যেই আমি তাড়াহুড়া করে আসছি দেশে। লিসেন, উই নিড আ প্ল্যান!’ 

হৃদি হাত তুলে ভাষণ দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘শোন আমার কথা তোরা, কোনো প্ল্যান দরকার নাই। সামি আমাকে লাইক করেনা। এটা আমি খুব ভালো মত বুঝে গেছি।’ 

বিভা বলল, ‘ছাই বুঝছিস তুই।’ 

—‘যা বুঝার ঠিকই বুঝছি। সামির পছন্দটা অন্যরকম বুঝছিস? ও সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ করে। গ্ল্যামারাস মেয়ে পছন্দ ওর। সেই তুলনায় আমি খুবই সিম্পল। ফ্রেন্ড হিসেবে ও আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে, কিন্তু এরচেয়ে বেশি কিছু… 

অমৃতা বলল, ‘তুই কি কম সুন্দর নাকি?’ 

হৃদি একটা হতাশার শ্বাস ছাড়ল, ‘আমার মতো সিম্পল মেয়ে ওর পছন্দ না, দ্যাখ আমি ওর খুব কাছের বন্ধু। আমি জানি ওর টেস্ট কী রকম। কোথায় বিভা, আর কোথায় আমি। বিভা কত গ্ল্যামারাস, কী সুন্দর নাচ জানে, আর আমি…’ 

বিভা ধমকে উঠে বলল, ‘একটা থাপ্পড় খাবি। নিজের সম্পর্কে এতো হীনমন্যতায় ভুগিস কেন তুই সবসময়?’ 

—‘নারে দোস্ত, তোরা বুঝতেছিস না, জোর করে কিছু হয়না।’ 

—‘জোর করে না, আমার মনে হয় সামিরও তোর জন্য ফিলিংস আছে। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারতেছেনা। কিংবা হয়তো ও ভাবতেছে ফ্রেন্ডদের মধ্যে রোমান্টিক রিলেশনে জড়াইলে আবার ঝামেলা হতে পারে, যেহেতু প্রথম বার একটা ঝামেলা হইছে। ওর সাইকোলোজিটাও তো তোর বুঝতে হবে।’ অমৃতা বলল। এরপর একটু থেমে আবার বলল, ‘আমি কি ওর সাথে কথা বলব এ ব্যাপারে?’ 

হৃদি একদম আঁতকে উঠল প্রশ্নটা শুনে, ‘না না, অসম্ভব! প্লিজ আমাকে ছোট করিস না তোরা। কোনোভাবেই আমি ওকে এটা জানাতে চাইনা যে আমি ওকে পছন্দ করি। প্লিজ!’ 

বিভা এবার একটু রেগে গিয়ে বলল, ‘বাল! তাইলে আমি আসছি কেন এত দূর থেকে? সামিকে তো বিষয়টা বলতেই হবে আজ নয়তো কাল।’ 

হৃদি আগের চাইতেও জোরালো গলায় বলল, ‘অসম্ভব! তোরা কেউ কিচ্ছু বলবিনা। আমার ইমেজ খারাপ করবিনা বলে দিলাম। খবরদার।’ 

অমৃতা আর বিভা একজন আরেকজনের মুখের দিকে চাইল একবার। অমৃতা বলল, ‘কাউকে ভালো লাগাটা তো দোষের কিছু না, ভালোবাসার কথা জানানোর মাঝে ছোট হওয়ার কী আছে?’ 

হৃদির যেন হঠাৎ মনে পড়ল খুব জরুরি একটা কথা, ‘বিভা, তোরে আমি এখানে ডাকছি অন্য কারণে। একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তোর সাথে কথা বলাটা খুব দরকার।’ 

—‘কী বিষয়?’ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করল বিভা। হৃদি অমৃতাকে একবার আগাগোড়া দেখে নিয়ে নালিশ করার ভঙ্গিতে বিভাকে বলল, ‘ওরে জিগা তো, সামির বাপের লগে ওর এতো কীসের মাখামাখি আর হাসাহাসি?’ 

প্রশ্নটা শুনে থতমত খেয়ে গেল বিভা। বিস্ময়ে একশা হয়ে গিয়ে বলল, ‘সামির বাপ?’ 

অমৃতা তখন মুখ নিচের দিকে নামিয়ে মনোযোগ দিয়ে নিজের হাতের নখ দেখছিল। হৃদির কথা গুলো যেন তার কানেই যায়নি। হৃদি ক্ষুব্ধ ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ সামির বাপ। ওরে তুই এখনই জিজ্ঞেস কর, কাহিনীটা কী?’ 

বিভা দিশাহারা হয়ে বলল, ‘আমার মাথায় কিছুই ঢুকতেছে না। সামির বাপের সাথে আবার অমৃতার কী কাহিনী থাকতে পারে?’ 

—‘এটা তো বলতে পারবে শুধুমাত্র আমাদের অমৃতা চৌধুরী। পৃথিবীর সমস্ত আজব কাহিনী তো তার সাথেই ঘটে।’ বলল হৃদি চাপা রাগে গর্জন করতে করতে। 

অমৃতা এবার ফোঁস করে একটা বড় নিশ্বাস ফেলল। মুখ তুলে দেখল দুই বান্ধবীকে, নির্বিকার ভাবে বলল, ‘কী? কী হইছে তোদের? কী সমস্যা?’ হৃদি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘বুইড়া ব্যাটার সাথে এতো কিসের রঙ্গ রসিকতা তোর, হ্যাঁ? আমরা কিছু বুঝিনা মনে করছিস?’ 

অমৃতা তীব্র ভাবে বলল, ‘কে বুইড়া ব্যাটা? কার কথা বলতেছিস তুই? আমি কিছুই বুঝতেছিনা। 

—‘ইশ! এখন সে কিছুই বুঝতেছেনা! ন্যাদা বাচ্চা আসছে। দুদু খায়! কার কথা বলতেছি আবার? সামির বাপ। তোমার মিস্টার হক!’ 

অমৃতা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল,’সে বুড়া হতে যাবে কেন? ওর মতো হ্যান্ডসাম পুরুষ মানুষ তুই দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টা দেখছিস? আমি তো দেখিনাই! হি ইজ দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম গাই, আই হ্যাভ এভার সিন ইন মাই লাইফ!’ 

কথাটা শুনে দুই বান্ধবীর হার্ট এটাক করার অবস্থা হল। বিভার মুখখানা অনেকক্ষণ অবধি হা হয়ে রইল। নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল সে। বড় বড় ডাগর আঁখি দুটি মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেল বিস্ময়ে। হৃদিকে দেখে মনে হল তার বুকে খুব ব্যথা হচ্ছে। সে বুকে হাত দিয়ে কঁকিয়ে উঠে বলতে লাগল, ‘ও আল্লাহ! তুমি আমাকে এইটা কী শুনাইলা? আল্লাহ তুমি বাঁচাও!’ 

অমৃতা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল দুই বান্ধবীর কীর্তি দেখে। অবাক গলায় বলল, ‘মানে কী? এরকম মৃগি রোগীর মতো করতেছিস ক্যান? পাগল হয়ে গেছিস নাকি?’ 

হৃদি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘পাগল হইছ তুমি! বুড়া ব্যাটারে নিয়া এসব ফালতু কথা বলতে তোমার লজ্জা করেনা?’ 

অমৃতা হৃদির দিকে আঙুল তাক করে শাসানোর গলায় বলল, ‘আরেকবার বুড়া বললে তোরে লাখি মাইরা সাত তলার উপর থেকে ফালায় দিব।’ 

বিভা এতক্ষণে, অনেক কষ্টে, কোনো রকমে বলতে পারল, ‘অমৃতা! হ্যাভ ইউ লস্ট ইওর মাইন্ড? তুই এগুলা কী বলতেছিস?’ 

অমৃতা অকপটে বলল, ‘যা বললাম বাংলায়ই তো বললাম, হিব্‌রু ভাষায় তো বলিনাই। না বুঝার কী হইল?’ 

—‘বন্ধুর বাবাকে তোর কাছে হ্যান্ডসাম লাগতেছে কেন? তোরে কি পাগলা কুত্তায় কামড়াইসে?’ আতঙ্কে জমে গিয়ে বিভার গলার স্বর তখন ফাঁপা বাঁশের মতো শোনাচ্ছে। 

অমৃতা কী একটা বলার জন্য মুখ খুললো, তারপর দুই বান্ধবীর অগ্নি মূর্তি লক্ষ্য করে চুপ করে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর নিষ্প্রভ ভাবে বলল, ‘লিসেন ফোকস, যদি তোরা এরকম ওভার রিএক্ট করিস তাহলে আমি কিছুই শেয়ার করতে পারবনা তোদের সাথে। ডোন্ট প্লে মাই মম, জাস্ট ট্রাই টু বি মাই ফ্রেন্ড। ফরগেট এভরিথিং। সে কে, কার বাবা, কার হাজবেন্ড এগুলো সব ভুলে যা।’ 

অমৃতার এই গম্ভীর কথা গুলো ওদের দুজনকে কেমন কাঁপিয়ে দিল। বিভা কম্পিত বুক নিয়ে হৃদির দিকে তাকাল একবার। দুজনের চোখেই রাজ্যের বিস্ময়, ভয় আর উত্তেজনা। বিভা একটা ঢোঁক গিলে, নরম গলায় বলল, ‘আচ্ছা, ওভার রিএক্ট করবনা, তুই বল। তোর কথা শুনি আগে।’ 

অমৃতা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। জিনসের পকেটে হাত রেখে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে বলল, ‘ওকে, দ্যা থিংগ ইজ, আই হ্যাভ নেভার ফেলট দিজ ওয়ে বিফোর। আই থিংক, আই এম ফলিং ইন লাভ!’ 

বিভা আর হৃদি একত্রে আর্তনাদ করে বলে উঠল, ‘উইথ হুম?’ 

অমৃতা পায়চারি থামিয়ে বন্ধুদের দিকে চেয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘দ্যা গাই উই আর টকিং এবাউট।’ 

—‘সামির বাপ?’ 

—‘হুম।’ বলে অমৃতা আবার হাঁটা শুরু করল। 

কথাটা শুনে হৃদি আর বিভার মূর্ছা যাবার মতো অবস্থা হল। মুখ দিয়ে অদ্ভুত আর্তনাদ সূচক একটি গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল তারা দুজনে। যেন কোন অদৃশ্য শক্তি তাদের গলা টিপে ধরেছে শক্ত করে। শ্বাস আটকে আসছে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছেনা। চোখ উল্টে যাবার উপক্রম। অমৃতা ওদের দুজনের এই নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। অত্যন্ত ব্যথিত কণ্ঠে বলল, তোরা কি আমার ফ্রেন্ড? নাকি অন্য কিছু?’ 

হৃদি আর বিভার তখন কিছু বলার মতো অবস্থা নেই। হৃদির চোখ এর মাঝেই হয়ে উঠেছে ঝাপসা। বেশ অনেকক্ষণ পর সে কাঁদো কাঁদো গলায় অমৃতাকে বলল, দোস্ত, তোর কি একটু এজেড লোক পছন্দ? আমি তোর জন্য ডি ক্যাপ্রিওকে নিয়ে আসবো হলিউড থেকে, ব্র্যাড পিট আর শাহরুখ খানরে নিয়া আসব’ এটুকু বলে হৃদি আচমকা অমৃতার পা জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলতে লাগলো, ‘তুই শুধু সামির আব্বারে ছাইড়া দে দোস্ত! প্লিজ লাগে, প্লিজ!’ 

অমৃতা এবার খুব বিরক্ত হয়ে গেল, হৃদির কাছ থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল, ‘আরে আজব, এসব এত বলে কয়ে হয় নাকি?’ 

এবার বিভাও উঠে আসল, অমৃতার হাত ধরে কাতর গলায় বলল, ‘দোস্তো! ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা কর। লোকটা তোর ফ্রেন্ডের বাবা। অন্য কেউ হলে কোনো সমস্যা ছিলোনা। তুই সত্তর বছরের বুড়ার সাথে প্রেম করলেও আমাদের কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু এই লোকটা দোস্ত তোর জন্য প্রহিবিটেড। লোকটা তোর বন্ধুর বাবা। বন্ধুর বাবা তো নিজের বাবার মতো হয়। প্লিজ নিজের মনটাকে কন্ট্রোল কর।’ 

—‘এসব ফালতু কথা বলিস নাতো। আমি তো কিছু ইচ্ছে করে করিনি। হয়ে গেছে। 

বিভা অমৃতার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়ার ঢঙে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোর মনে একটু ওরকম ভাবনা এসেছে এটা তেমন দোষের কিছুনা। ভুলে গেলেই হবে। আমরা এরপর থেকে এটা নিয়ে আর কথা বলবনা। তুই এসব নিয়ে ভাববি না আর।’ 

—‘আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি। আই ক্যান্ট স্টপ থিংকিং এবাউট হিম।’ 

হৃদি চট করে নিজের মোবাইলে ইনস্টাগ্রাম খুলে একটা ছেলের ছবি বের করে বলল, ‘অমৃতা দ্যাখ, এই ছেলেটা আমাদের পাশের বাসায় থাকে। ও লইয়ার, জানিস? হাই কোর্টে প্র্যাকটিস করে। আমি কয়দিন থেকেই ভাবতেছিলাম তোর সাথে একে পরিচয় করায় দিব। দেখতে কিন্তু হেব্বি। কথা বলবি তুই?’ 

অমৃতা তাচ্ছিল্যের নজরে ছবিটা একবার দেখে নিয়ে শুকনো গলায় বলল, ‘এইসব লাল্টু পোলাপাইন আমার কখনোই পছন্দ হয়না। আমি ম্যাচিওর্ড মানুষজন পছন্দ করি। ম্যানলিনেস পছন্দ করি।’ 

বিভা মাথায় হাত দিয়ে বিছানার ওপর বসে পড়ল ধপ করে। অত্যন্ত হতাশ গলায় বলল, ‘তুই সামির কথাটা একবারও ভাবতেছিস না অমৃতা! সামি জানতে পারলে কী হবে? 

অমৃতা স্পষ্ট ভাবে বলল, ‘কী হবে আবার? ও আমার বন্ধু। বন্ধু কি বন্ধুকে বুঝবেনা?’ 

হৃদির চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল, ‘কী বুঝবে? তুই কি আশা করছিস যে, ও নাচতে নাচতে বলবে, যা তুই আমার বাবার সাথে প্রেম কর?’ 

—‘সেটা কেন? বাট আমার মনে হয় ও আমাকে বুঝবে।’ 

—‘অমৃতা, দোস্ত বাবা মা মানুষের সবচেয়ে সেনসিটিভ জায়গা। মানুষ ওই একটা জায়গা নিয়ে কখনো আপোষ করতে পারেনা!’ বিভা বলল আকুলি বিকুলি হয়ে। 

অমৃতা তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু বলল না। ঘরের ভেতর চিন্তিত মুখ নিয়ে আরো কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর ক্লান্ত ভাবে বিছানার ওপর বসে, ম্লান গলায় বলল, ‘সামি… সামি যদি আমাকে না বোঝে… তখন কী হবে?’ 

হৃদি এগিয়ে এসে অমৃতার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল মেঝের ওপর, ‘এই জন্যেই দোস্ত ব্যাপারটাকে আর এগোতে দেয়া ঠিক হবেনা। এখানেই দাঁড়ি টানতে হবে।’ বিভাও এসে বসল হৃদির পাশে, অমৃতার পায়ের কাছে। বলল, ‘হ্যাঁ, হৃদি ঠিকই বলছে। এখানেই স্টপ করতে হবে। আর… তুই কি উনার সাথে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেছিস? মানে উনার ভাবসাব কেমন? উনার তো বৌ আছে, এতো বছরের পুরোনো সংসার। তুই বললেই তো আর ওই লোক তোর সাথে প্রেম করবেনা, তাইনা?’ 

অমৃতা নিস্তেজ ভাবে বলল, ‘না, আমরা এখন শুধুই বন্ধু।’

—‘বন্ধু?’ হৃদি অবাক। 

—‘হ্যাঁ বন্ধু।’ 

—‘অনেক হয়েছে। আর কথা বলবিনা তুই উনার সাথে। কেমন?’ ছেলেভোলানোর গলায় বলে বিভা। 

—‘সম্ভব না।’ 

—‘অমৃতা, জিদ করিস না।’ 

—‘জিদ করছিনা। আমার একটা দিন উনার সাথে কথা না বললে ভালো লাগেনা। তোরা তো আমাকে চিনিস, এর আগে কোনোদিন আমার সাথে এরকম হয়নায়… এখন আমি কী করবো?’ 

—‘তুই একটা বার শুধু সামির কথা চিন্তা কর। সামি জানতে পারলে কী পরিমাণ কষ্ট পাবে তুই বুঝতে পারছিস?’ 

—‘সামি কষ্ট পাবে কেন? সামি আমার বন্ধু, শত্রু তো না। বন্ধু বন্ধুকে না বুঝলে কে বুঝবে? 

—‘সামি ওর মাকে ভালোবাসে। তোর জন্য যদি ওর মা কষ্ট পায় তাহলে, তুই কি মনে করছিস ও তোকে কখনো ক্ষমা করবে?’ 

শুনে অমৃতা চুপ করে গেল। হৃদি, বিভাও চুপ করে থাকল খানিকক্ষণ। অমৃতা কিছু সময় পরে ভারী করুণ গলায় বলল, ‘আচ্ছা, বন্ধু হতে তো দোষ নেই তাইনা? বন্ধু হয়ে থাকি?’ 

হৃদি আর বিভা অমৃতার ওই বিষণ্ণ, কাতর মুখখানার দিকে চেয়ে থেকে আর কিছু বলতে পারলনা। 

২৮

আজকের রাতটি বাস্তবিকই রুপালি। মধ্য আকাশে একটি রুপোর থালার মতো গোল চাঁদ ভেসে আছে। গত দুদিন ধরে শীত পড়ছে জমিয়ে। ঢাকা শহরের উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর গায়ে ঝুলে আছে কুয়াশা মাকড়সার জালের মত। ঘিঞ্জি গলির ভেতরও শীত বুড়ি ঢুকে পড়ছে অনায়াসে। দালান কোঠার মানুষগুলোকে হয়তো এই শীতের ছোবল খুব একটা কাবু করতে পারছেনা। লেপের তলায় ঢুকে বা রুম হিটার চালিয়ে তারা শীতের সাথে মোটামুটি একটা বোঝাপড়া করে ফেলেছে। কিন্তু এই প্রবল শীত রাস্তার গৃহহীন দুঃখী মানুষ গুলোর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশের রুপালি শোভা তাই রাজধানীর ফুটপাথের বাসিন্দাদের ভেতর কোনো মুগ্ধতার সঞ্চার করতে পারছিলোনা। গরীবের দেশে শীত মানে ঘন ঘোর বিপদ 1 কত লোকের যে প্রাণ কেড়ে নেবে এই সর্বনাশা মাঘী শীত তা কে জানে! 

কিন্তু প্রকৃতি বৈচিত্র ভালোবাসে। একই স্থানে, একই সময়ে, একই মঞ্চে একত্রে সংঘটিত হতে থাকে বিচিত্র সব ঘটনাবলী। এসব ঘটনার কোনোটা দুঃখের, কোনওটা সুখের, কোনওটা আবার নৃশংস! কোথাও জন্ম, কোথাও মৃত্যু, কোথাও প্রাপ্তি, কোথাও ত্যাগ,এই সমস্তকে একযোগে বহন করে অবিরাম ছুটে চলেছে সময় মহাকালের অতল সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। তাইতো শীতের এই শুষ্ক, জারিত, জীর্ণ রাত্রিটিতে ছয় বন্ধুর দলটি হৈচৈ করে বেরিয়ে পড়ল লং ড্রাইভের উদ্দেশ্যে। আকাশের রুপালি চাঁদ থেকে চুঁইয়ে পড়া থৈ থৈ নীল জোছনা, এই বন্ধুপাগল বন্ধুদের শেষ অবধি গৃহত্যাগী করেই ছাড়ল। 

সামি গাড়ি ড্রাইভ করছিল। ওর পাশে বসেছে অমৃতা। তারা যাচ্ছে আশুলিয়া। গতবছরের সেই কক্সবাজার যাত্রার পর তাদের আর একসাথে গাড়িতে চড়া হয়নি। পেছনে চারজন গাদাগাদি করে বসেছে। বিভা গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, ‘আমরা ছয়জন অনেক দিন পর একসাথে হইছি। সেই আনন্দে আমি কি একটা চিৎকার দিতে পারি?’ সামির লাল মার্সিডিজ বেঞ্চ তখন ওদের এপার্টমেন্টের গলি থেকে বেরোচ্ছে সবেমাত্র। বিভার প্রশ্নের উত্তরে আকাশ বলেছে- ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই, চিৎকার দেয়া তো এখন বাধ্যতামূলক। একটা চিৎকার দিতেই হবে সবাই মিলে। নইলে গুরুতর অপরাধ হয়ে যাবে।’ 

যেই বলা সেই কাজ। সামি বাদে বাকি পাঁচজন আনন্দে আটখানা হয়ে এক গগন বিদীর্ণকারী চিৎকার দিয়ে উঠল। গাড়ির জানালার গ্লাস নামানো ছিল বিধায় আশেপাশের লোকজনের কানে চিৎকারটি নির্দ্বিধায় পৌঁছে গেল। গলি থেকে বেরোনোর মুখেই একজন ষন্ডা চেহারার লোক গাড়ির সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়ে হাত দেখিয়ে থামবার নির্দেশ দিল। সামি ভ্রু কুঁচকে জানালা দিয়ে ঘাড় বের করে বলল, ‘কী ব্যাপার?’ 

ষন্ডা চেহারার লোকটা ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘এই গাড়ি থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল মাত্র। সব কিছু ঠিক আছে?’ 

সামি কিছু বলার আগেই অমৃতা ওপাশ থেকে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘তাতে আপনার কী?’ 

অমৃতার প্রশ্নের ধরণ দেখে লোকটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, ‘না মানে, ভাবলাম কোনো বিফদ, আফদ হইল নাকি আবার।’ 

লোকটার মুখ থেকে বিফদ আফদ শব্দদুটো শুনে বন্ধুরা হাসি আটকে রাখতে পারলনা। অমৃতা ত্যাড়া গলায় বলল, ‘আপনি কি এই পাড়ার মস্তান?’ 

সামি হাত উঁচু করে ‘আরে থাম তো’ বলে অমৃতাকে থামিয়ে দিল। তারপর লোকটাকে বলল, ‘ভাই আমরা ঠিক আছি। কোনো বিপদ হয়নি। ধন্যবাদ আপনাকে।’ 

কথাটা শেষ করে সে এক্সেলেরেটরে চাপ দিল। গাড়ির কাঁচ দিল তুলে। অমৃতাকে একটা ছোটোখাটো ধমক দিয়ে বলল, ‘সবখানে ঝগড়া করতে যাস কেন? একদম টিপিক্যাল লইয়ার হয়ে যাচ্ছিস তুই। যেখানে সেখানে কিচকিচ।’ 

হৃদি পেছন থেকে বলল, ‘ঠিকই আছে। আমাদের মন চাইছে আমরা চিৎকার করব। ওই ব্যাটার তাতে কী প্রব্লেম? এটা স্বাধীন দেশ মামা। যার যত ইচ্ছা চিক্কুর পাড়বে। 

আকাশ বলল, ‘লোকটা তো উপকার করতেই আসছিল। তোরা কৃতজ্ঞ না হয়ে উল্টা কিচকিচ শুরু করছিস। এই জন্যেই বাঙালি জাতির উন্নতি হবেনা।’ 

রুদ্রর হাতে প্রিঙ্গেলস চিপ্সের কৌটা ধরা ছিল, সে চিপস চিবোতে চিবোতে বলল, ‘গাইজ, এসব ফালতু প্যাঁচাল বাদ দিয়া এইটা বল রাতের খাবারটা আমরা কোথায় খাবো।’ 

—‘বিভা যেখানে খেতে চাইবে। সে অনেক দিন ভালো মন্দ খায়না। তাই ওর ইচ্ছাটাই প্রায়োরিটি পাবে।’ আকাশ বলল উদাস গলায়। 

বিভা চোখ কটমটিয়ে বলল,’কে বলেছে আমি ভালোমন্দ খাইনা? আমার জামাই কি আমারে না খাওয়ায় রাখছে নাকি?’ 

—‘কী খাওয়াবে? ওরা খাইতে জানে? গেছি না তোর বাসায়? সব তরকারি মিষ্টি!’ 

আকাশের কথা শুনে বাকি বন্ধুরা না চাইতেও হেসে ফেলল অনুচ্চ স্বরে। বিভা খুব রেগে গেল, ‘এতো খারররাফ কেন তোরা? দূর্গা বেচারি কত কষ্ট করে রান্না করছে তোদের জন্য। আর তোরা ওর রান্নার দুর্নাম করতেছিস? কী রকম নিমকহারাম!’ 

রুদ্র বিভার একদম গা ঘেঁষে বসে ছিল। বিভার রাগী রাগী কথাগুলো শুনতে পেয়ে সে ওর হাতের ওপর একটা হাত রেখে, আবেগে ভেসে গিয়ে বলল, ‘দোস্ত, এইজন্যেই কি তুই শুকায় গেছিস? না খাইতে পাইয়া?’ 

—‘কুত্তার মতো কথা বলতেছিস ক্যান?’ রাগে অন্ধ হয়ে গেল বিভা।

—‘কোন কুত্তা তোরে আজ পর্যন্ত জিগাইছে যে তুই শুকায় গেছিস কেন? মাথায় কোনো বুদ্ধি নাই তোর।’ 

—‘আমি শুকাইছি কারণ আই এম অন আ ডায়েট। কিটো ডায়েট করতেছি একমাস ধরে।’ 

সামি স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘কী করবে বেচারি খাওয়া দাওয়া পছন্দ হয়না, খাইতে না পাইয়া শেষে ডায়েট করা শুরু কইরা দিছে।’ 

বিভা দৃঢ় গলায় বলল, ‘মোটেও না, আমার শাশুড়ি মায়ের রান্না অপূর্ব!’ 

অমৃতা পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘মাইরি! কী বলচেন দিদি?’ 

আকাশ বলল, ‘তা দিদি, আপনি কি খেয়ে এসেচেন নাকি যেয়ে খাবেন? বিভা পেছন থেকে সামির মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, ‘ওই এসহোলের বাচ্চা, গাড়ি থামা!’ 

সামি আর্তনাদ করে বলে উঠল, ‘আরে আজব একসিডেন্ট করব তো!’ 

—‘থামা গাড়ি! যাব না আমি তোদের সাথে।’ 

হৃদি বিভার পিঠে সান্ত্বনার হাত রেখে বলল, ‘আরে চেতিস ক্যান? মজা নিতেছে ওরা।’ 

—‘এত মজা নিতে হবেনা। তোদের এসব বাঙ্গাল কথা শুনেও আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন মজা নেয়। ঠিকাছে?’ 

এবার বিভার ক্রোধ দেখে কেউ আর দুষ্টুমি করার সাহস করল না। ডিনার করতে আসল আশুলিয়ার লিটল ইটালি পিৎজা রেস্টুরেন্টে। একটা ছয় চেয়ারের টেবিল দখল করে হুড়াহুড়ি করে খাবার অর্ডার করলো ওরা। তারপর বিভা গদগদ গলায় বলল, ‘অনেকদিন পর আমরা ছয়জন একসাথে ডিনার করব। এই উপলক্ষ্যে আজকের দ্বিতীয় চিৎকারটা হয়ে যাক?’ 

বন্ধুসকলে সমস্বরে বলে উঠল, ‘আলবৎ! হয়ে যাক!’ 

অতএব গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল সবাই। সামি কিন্তু এসবের কিছুতেই অংশ নিচ্ছেনা। গালে হাত রেখে উদাস নয়নে সে বন্ধুদের বাঁদরামি দেখে যাচ্ছে। টানা দুই মিনিট সময় ধরে চলল এই চিৎকার। চিৎকার শুনে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসল। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘স্যার সব ঠিক আছে?’ 

সামি ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘সব ঠিক আছে। শুধু উনাদের মাথায় একটু ডিস্টার্ব আছে তো, তাই একটু পর পর চিৎকার মারে। 

ম্যানেজার সামির উত্তর শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এই ম্যানেজার সামিকে খুব ভালো মত চেনে। সামি এখানকার নিয়মিত কাস্টমার। সে কার ছেলে কী তার পরিচয় কোনো কিছুই এই ম্যানেজারের অজানা নেই। চেনাশোনা বলেই চট করে রেগে গেল না সে। যথেষ্ট সমীহ নিয়ে বলল, ‘ইয়ে আসলে এভাবে চিৎকার করলে আমাদের রেস্টুরেন্টের পরিবেশ নষ্ট হবে তো, অন্য কাস্টমাররা কমপ্লেইন করবেন। তাই…’ 

—‘আগে কমপ্লেইন করুক, তারপর বলতে আসবেন।’ 

ম্যানেজার আর কথা না বাড়িয়ে অসন্তুষ্টি নিয়ে ছেড়ে গেল জায়গাটা। পাশের টেবিলে একজন মেয়ে একা বসে ছিল। এছাড়া রেস্টুরেন্টে আর তেমন কোনো অতিথি নেই। একাকী মেয়েটির পরনে একটি পেঁয়াজ রঙের শিফন শাড়ি। গলায় কানে ঝুলানো মুক্তোর গয়না। মুখে প্রসাধনের কমতি নেই। টেবিলের ওপর ল্যাপটপ রাখা। পাশে পাস্তার একটি খালি ডিশ। বোঝা যাচ্ছে তার খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ। মনোযোগ দিয়ে সে ল্যাপটপে কাজ করছিল। চিৎকার শোনার পর থেকে সে থ বনে গেছে। কাজ থামিয়ে ডবডবে চোখে তাকিয়ে আছে বন্ধুদের দিকে। মুখে খেলছে আতঙ্ক। যেন এমন তাজ্জব ব্যাপার সে জীবনে এই প্রথম দেখল। 

বিভা মহিলার ওই ডবডবে চোখ দেখে বিড়বিড় করে বলল, ‘তাকিয়ে আছে ক্যামনে দ্যাখ না। অন্যদিকে তাকা বেটি! চোখ গেলে দেব একদম!’ 

হৃদি শুনে ফেলল কথাটা। ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, ‘কথাটা সামনা সামনি বলতে পারলে তোরে নগদ পাঁচশ টাকা দিব।’ 

ঠিক সেই সময় মেয়েটি গনগনে ভাবে বলল, ‘আপনারা অযথা চিৎকার করে উঠলেন কেন?’ 

শুনে বিভা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘মনে চাইছে তাই চিৎকার দিছি। আরো দিব। তাতে তোর কী?’ 

রুদ্র মুখে একটা গদগদ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘না আসলে আমাদের এক বন্ধুর মাথায় একটু সমস্যা আছে তো তাই…’ 

—‘মাথায় সমস্যা আছে? পাগল টাগল নাকি?’ মেয়েটি কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন করল। 

রুদ্র আগের চাইতেও নরম হয়ে গেল, বলল, ‘জ্বি, একটু পাগলই বলতে পারেন। একটু পর পর চেঁচিয়ে ওঠে, অন্যদেরও চ্যাঁচাতে হয় ওর সাথে, নইলে খুব মারে!’ 

—‘মারে?’ 

—‘জ্বি মেরে একদম হাড্ডি গুঁড়িয়ে দেয়, কী করবে বেচারি, মাথা ঠিক নেই!’ 

আকাশ মাঝখানে ফোড়ন কাটল, ‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।’ বিভা ত্যাড়া গলায় আকাশকে বলল, ‘যা, পা ধইরা মাফ চা।’ 

বিভার কথাগুলো মেয়েটির কানে অনায়াসে পৌঁছে গেল। শুনতে পেয়ে সে ভয়ংকর চোখে তাকাল বিভার দিকে, যেন এখনই সে বিভাকে কুটুরমুটুর করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। বিভা হৃদিকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘পাঁচশ টাকা দিবি তো?’ 

—‘নিশ্চয়ই!’ 

বিভা মেয়েটির দিকে সরাসরি চেয়ে ফট করে বলে বসল, ‘এমনে চায়ে আছস ক্যান? অন্যদিকে তাকা! চোখ গেলে দেব একদম!’ 

রেস্টুরেন্টে যেন মিসাইল পড়ল এই মাত্র। উপস্থিত সকলের মুখ ঝুলে গেল। যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা সেই মেয়েটির চেহারা তখন হয়ে গেছে বাংলার পাঁচের মতো। মুখখানি প্রবল বিস্ময়ে হা। নিশ্বাস গেছে আটকে। বেশ কয়েকটা সেকেন্ড ওরকম হা হওয়া মুখ নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে থেকে, একসময় সে ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল, ‘কী বললি তুই?’ 

রুদ্র উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। মহিলার সামনে এসে হাতজোড় করে বলল, ‘ম্যাডাম সরি! এটাই আমার সেই পাগল বান্ধবী। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড!’ 

রুদ্রর পেছন পেছন আকাশও উঠে এসেছে। সে মেয়েটির উল্টোপাশের চেয়ারটা হাত দিয়ে টেনে নিয়ে ঝপ করে বসে পড়ল। তারপর ওর আকাশময় সুন্দর হাসিটা হেসে বলল, ‘ও পাগলা গারদ থেকে ছাড়া পেয়েছে গতকাল। ওর কথায় কিছু মনে করবেন না।’ 

রুদ্র আর আকাশের নম্র, ভদ্র ব্যবহার দেখে মেয়েটির রাগ বুঝি একটু কমল। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে বলল, ‘এর তো প্রচন্ড খারাপ অবস্থা! এর চিকিৎসা দরকার। খুব ভালো চিকিৎসা। আপনারা এরকম পাগল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন?’ 

আকাশ একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে ভারী করুণ গলায় বলল, ‘কী আর বলব বলেন? পাগলেরও তো সাধ আহ্লাদ থাকে। বলল কতদিন পিৎজা খায়না। পিৎজা খেতে খুব ইচ্ছা করছে। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্ধুর ইচ্ছে পূরণ করতে আসলাম!’ 

রুদ্র টেবিলের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। সুযোগ বুঝে সে বলে ফেলল, ‘ম্যাডাম কি একা? আর কেউ নেই?’ 

মেয়েটি ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, ‘না একা নই, ঐযে ম্যানেজারকে দেখলেন, উনি আমার স্বামী।’ 

আকাশ কথাটা শোনা মাত্র তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে, চিঁ চিঁ করে বলল, ‘কাজ করেন ম্যাডাম, আমরা পাগলটাকে সামলাই।’ 

ততক্ষণে খাবার চলে এসেছে টেবিলে। ম্যানেজারের বৌ আড়চোখে একবার দেখে নিল বিভাকে। বিভা তখন ফ্যালফ্যাল করে তার দিকেই চেয়ে আছে। মেয়েটি তার দিকে তাকাতেই সে জিভ বের করে একটা ভেংচি কাটল। মেয়েটি ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে রাগী কণ্ঠে বলল, ‘ভয়ংকর পাগল দেখছি!’ 

আকাশ আর রুদ্র তখন সুড়সুড় করে নিজেদের টেবিলে ফিরে এসেছে। অমৃতা ওদের দেখে শিস দিয়ে উঠে বলল, ‘মানে কী একটা অবস্থা, যেখানেই দেখিবে নারী, করিতে হইবে বাড়াবাড়ি!’ 

হৃদি ফোড়ন কেটে বলল, ‘মাইয়া দেখলে এইগুলার মাথা ঠিক থাকেনা। খালি কিচকিচ!’ 

—‘একটা শব্দ পাইলে সেটা যেখানে সেখানে ইউজ করবিনা। কিচকিচ শব্দটা এখানে প্রযোজ্য নয়।’ বিরক্ত গলায় বলে উঠল সামি। 

—‘আসছে একজন ভাষাবিদ!’ ঠাট্টার ছলে বলল হৃদি। 

বিভা এবার হেসে হেসে আবৃত্তির ঢঙে বলল, ‘অমৃতা জোশ বলছিসতো! যেখানেই দেখিবে নারী, করিতে হইবে বাড়াবাড়ি!’ একটু থেমে সে আবার বলল, ‘ধুর এইসব বাদ দে। আমার কথা শোন। গাইজ, তোরা কি জানিস? আই এম নট আ ভার্জিন এনিমোর!’ 

শুনে বন্ধুরা সব হৈহৈ করে উঠল। রুদ্র টেবিল চাপড়ে বলে উঠল, ‘ওয়াও দোস্ত! কেমন ছিল?’ 

—‘অসাম মামা! অসাম!’ 

সামি হঠাৎ খুব গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুই কি এসব ফালতু কথা বলার জন্য বাংলাদেশে আসছিস?’ 

—‘না, এসব বলার জন্য আসব কেন? আসছি তো তোর বিয়া খাইতে!’

—‘তাহলে এইসব কেন বলতেছিস আমাদেরকে?’ 

—‘ওমা, ফ্রেন্ডদের বলব না তো কাকে বলব?’ 

—‘তুই কার সাথে শুইয়া আসছস, এইসব বুলশিট ইনফরমেশন জেনে আমরা কি বাল ফালাব?’ 

সামির গলা চড়ে গিয়েছিল। অমৃতা ওর পিঠে একটা হাত রেখে বলল, ‘দোস্ত, আস্তে! মানুষ শুনবে।’ 

সামি আগের চাইতেও জোরালো গলায় বলল, ‘শুনলে শুনুক! আমি কি ডরাই নাকি কাউরে।’ 

বিভাকে দেখে কিন্তু একটুও বিচলিত মনে হল না। সে সরাসরি সামির চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা ভাবে বলল, ‘দ্যাখ, এত ওভার রিএক্ট করার কিছু নাই। আর আমি যার তার সাথে শুইয়া আসিনাই। আমার বরের সাথে শুইছি। দুইদিন পর তুমিও তোমার বৌয়ের সাথে শুবা। এইটা নিয়ে এত তিড়িং বিড়িং এর কিছু নাই। আমি মুভ অন করছি, তুমিও মুভ অন কর।’ 

সামির চোখ দিয়ে তখন আগুন বেরোচ্ছিল, ‘মুভ অন করা এতো সোজা না। সবাই তোমার মতো ফালতু না।’ 

রুদ্র মনোযোগ দিয়ে টরটিলিনি পাস্তা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভারী গুরুগম্ভীর গলায় বলল, ‘এইসব কথা এখন বাদ দে। খেয়ে নে। তারপর ঝগড়া করিস। খাওয়া সামনে রেখে ঝগড়া করতে হয়না।’ 

ওর কথাটা বন্ধুরা কেউ খুব একটা পাত্তা দিলোনা। 

বিভা বলল, ‘আরেকটা কথা হচ্ছে, আমি অভিজিতের মতো ভালো মানুষ পাইছি বলে তুমিও যে ভালো মানুষ পাবা এটা কিন্তু কোন কথা না। তোমার ফিয়ন্সের ছবি দেইখা আমার একটা ফোঁটাও পছন্দ হয়নায়। কুটনি মার্কা একটা চেহারা। দেখলেই মনে হয় এই মাইয়া সারাদিন ঝগড়া করে আর মুখে মেকআপ ঘষে, তোমার উচিৎ ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া।’ 

এ কথার পর সামি আর বসে থাকতে পারলনা। খাবারের প্লেটটা এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিয়ে তড়াক করে উঠে পড়ল সে। কপাল কুঁচকে বন্ধুদের বলল, ‘এই ছেমড়ির আজকে কী হইছে? তখন থেকে উল্টাপাল্টা কথা বইলা যাইতেছে।’ 

বিভা একটুও না দমে বলল, ‘তোর উচিৎ আশেপাশে একবার তাকানো। ওই কুটনি মেয়েরে বিয়ে করতে হবে কেন? তুই তো হৃদিকে বিয়ে করলেই পারিস!’ 

হৃদি তখন বরফ ভাসা কোকের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। কথাটা কানে যাওয়া মাত্র তার কাশি উঠে গেল। টেবিলের ওপর মুখ থেকে ছিটকে পড়ল তরল পানীয়। রুদ্র খাবার মুখে নিয়ে স্থিরচিত্র হয়ে গেল। ভুলে গেল চিবোতে। আকাশ হতভম্ব। শুধু অমৃতাকেই একটু স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। সামি বিস্ময়ে কাদা কাদা হয়ে গিয়ে বলল, ‘কী আশ্চর্য! হৃদিকে কেন বিয়ে করব আমি?’ 

বিভা নির্বিকার গলায় বলল, ‘করলে সমস্যা কী? কিস করতে পারলে বিয়ে করতে পারবিনা?’ 

সামি টেবিলের ওপর দুহাত রেখে বিভার দিকে একটু ঝুঁকে বলল,’তোকে আর কয়বার বলতে হবে যে, দ্যাট ওয়াজ আ ফাকিং এক্সিডেন্ট?’ 

বিভা পরিষ্কার গলায় বলল, ‘এক্সিডেন্ট হবে কেন? মে বি দ্যা ইউনিভার্স ইজ ট্রাইং টু টেল ইউ সামথিং। এটা এক্সিডেন্ট ছিল না। হয়তো একটা সাইন ছিল।’ 

সামি ক্রুর চোখে বিভার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আর একটিও বাক্য ব্যয় না করে বেরিয়ে পড়ল। ও উঠতেই বিভা হৃদিকে বলল, ‘তুই যা তো, দ্যাখ গাধাটা কী করতেছে।’ 

—‘তোর এত কথা বলার কী দরকার ছিল? বেশি বেশি করিস তুই!’ 

বিভা হৃদিকে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দিল বাইরে। কুয়াশায় তখন চারপাশ আবছা। হৃদির গায়ে একটা চেরি ফুল রঙের জ্যাকেট ছিল। সাথে সাদা জিন্স। ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে হাতদুটো সে প্যান্টের পকেটে পুরে রেখেছিল। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আশেপাশে কোথাও সামিকে দেখা গেলোনা। কাঁচা মাটির পথ ধরে অন্ধকারে একটু এগিয়ে গেল সে। সামনেই হাইওয়ে। প্রবল গতিতে একটার পর একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে হাইওয়ে ধরে হুশ হুশ শব্দ তুলে। একটু হাঁটতেই সামিকে পাওয়া গেল। রাস্তার ধারের টঙের চায়ের দোকানে বসে আছে সে। কাঠের বেঞ্চের ওপর। পা নাচাতে নাচাতে সিগারেট ফুঁকছে। হৃদি গিয়ে বসলো ওর পাশে। সামির গায়ে কালো লেদারের জ্যাকেট। দাড়ি কামানো। কোঁকড়া চুলগুলো আঁচড়ানো পাট করে। বেশ ফিটফাট একটা ভাব। কিন্তু চোখদুটো তার বড়ই অপ্রসন্ন। মস্তিষ্কে খেলতে থাকা দুশ্চিন্তা যেন স্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠছে অস্থির চোখের পাতায়। হৃদি যে পাশে এসে বসেছে, তা সে খেয়ালই করেনি। রাস্তায় খুব একটা আলো নেই। তবে গাড়ির হেডলাইটের আলোতে খানিক বাদে বাদে স্পষ্ট হয়ে উঠছে চারপাশ। 

—‘এত রাগ করতেছিস কেন?’ হৃদির প্রশ্নটায় ঘোর ভাঙলো তার। সিগারেটে একটা টান দিয়ে সে শীতল গলায় বলল, ‘বিভার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ও এসব কী বলতেছে আবোল তাবোল?’ 

—‘কোন ব্যাপারটা তোর কাছে আবোল তাবোল লাগল?’ 

—‘সে তার বরের সাথে কী করছে না করছে, সেইসব হিস্ট্রি আমাদেরকে কেন শুনাইতেছে?’ 

—‘বন্ধুদের সাথে তো মানুষ সবই শেয়ার করে তাইনা? তোর খারাপ লাগছে কারণ তোর ভেতরে আসলে এখনো ওর জন্য ফিলিংস রয়ে গেছে।’ সামি বিষাদ মাখা কণ্ঠে বলল,’কোনো ফিলিংস নাই আমার ওর জন্য। মেয়েরা এমনই। রং পাল্টাইতে বেশি সময় লাগেনা।’ 

—‘এভাবে বলিস না। দ্যাখ বিভা অনেক কিছু সহ্য করছে এই একটা বছর ধরে। অনেক কষ্ট পাইছে মেয়েটা। এখন ফাইনালি সে একটু লাইফে সেটেল হইতে চাইতেছে, তুই মাঝখান থেকে ঘাপলা লাগাইস না।’ 

—‘কেউ ঘাপলা লাগাইতেছেনা। ওকে বলবি আমার সাথে যেন এইসব উল্টাপাল্টা কথা না বলে। কী সব ফালতু কথা বলতেছে। আমার নাকি তোরে বিয়ে করা উচিত। এটা কোনো কথা হইল?’ 

হৃদি মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। গলায় জোর করে একটা নিস্তরঙ্গ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল, ‘ওর ধারণা হয়েছে ওই ঘটনার পর থেকে তোর আর আমার মধ্যে কিছু চলতেছে।’ 

সামি ভারী অবাক চোখে তাকাল হৃদির দিকে। বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বলল, ‘এরকম কেন মনে হল?’ 

হৃদি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেই বলল, ‘জানিনা, আমি ওকে অনেকবার বলেছি, যে তোর টেস্ট অন্যরকম। তুই কখনোই আমাকে পছন্দ করবিনা। আমার মতো সিম্পল মেয়েকে তুই ভালোবাসবি, এটা হতেই পারেনা।’ 

সামি বেশ কিছুক্ষণ সময় হৃদির পাশ ফিরে থাকা মুখটার দিকে বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল। গাড়ির হেডলাইটের আলো আসছে, যাচ্ছে। হর্ন বাজছে, বাতাস বইছে সাঁই সাঁই করে। শীতের খর বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে হৃদির খোলা চুল। হঠাৎ সেই পাহাড়ি গ্রামের অন্ধকারাচ্ছন্ন মেয়েটির কথা পড়ল। সেই মেয়েটি তো বিভা ছিলো না, আবার ঠিক হৃদির মতোও ছিলোনা। অথচ মেয়েটিকে যখন সে কাছে টেনে নিল, মনে হল যেন কত সহগ্র বছরের চেনা একজন মানুষ! 

—‘আর তুই?’ 

হৃদি ফিরে তাকাল সামির দিকে।

—‘আমি?’ 

—‘হ্যাঁ, তুই আমাকে পছন্দ করবি?’ 

হৃদি হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘মাথা খারাপ? ওরকম কিছু হলে তো তোর কান কেটে ফেলতে হবে। সামিউল হক হয়ে যাবে কান কাটা সামি। সেটা কি কখনো সম্ভব?’ 

সামি হেসে ফেলল। একটুখানি চুপ করে থেকে কী যেন ভাবলো। ততক্ষণে চায়ের কাপ চলে এসেছে তার হাতে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সে একটু অন্যরকম গলায় বলল, ‘আচ্ছা হৃদিতা, একটা প্রশ্ন করি তোকে? 

হৃদি কৌতূহল নিয়ে বলল, ‘কী প্রশ্ন?’ 

—‘তোকে যখন আমি চুমু খেয়েছিলাম, তুই তো জানতিস যে ওটা আমিই ছিলাম, তাইনা?’ 

হৃদি কেঁপে উঠল হালকা। খুব নিস্তেজ ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ জানতাম। কেন?’ 

সামির একহাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে সিগারেট। সে সিগারেটে টান দিল সময় নিয়ে। সময় নিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। চোখজোড়া হাইওয়ের ছুটন্ত এক ট্রাকের উপর নিবদ্ধ রেখে বলল, ‘তাহলে আমাকে বাধা দিস নি কেন?’ 

হৃদি বরফের মতো জমে গেল কথাটা শুনে। একটা ভয়ংকর অস্বস্তি চেপে ধরল তাকে। দুরুদুরু করে কাঁপতে লাগল বুক। 

—‘আমি আসলে অনেক শকড ছিলাম। কিছু বলতে পারার মতো অবস্থা ছিলো না।’ অনেক কষ্টে বলল সে। 

—‘হুম, সাউন্ডস রিজনেবল। ওকে, ওয়ান কুইক কোয়েশ্চন ফর ইউ। হাও ওয়াজ ইট?’ 

হৃদি চমকে তাকাল, ‘কী? কীসের কথা বলছিস?’

—‘সব কিছু বানান করে বুঝিয়ে বলতে হয় কেন?’ 

হৃদি সত্যিই অবাক হয়েছিল সামির প্রশ্ন শুনে। সামির অন্ধকার মাখা মুখটার দিকে সরু চোখে চেয়ে থেকে সে অবিশ্বাসের গলায় বলল, ‘এটা কোনো প্রশ্ন হল?’ 

—‘উত্তর দে! এতো কথা বলিস কেন?’ 

—‘গ্রস ছিল।’ 

সামি হাসে, ‘হুহ, সিরিয়াসলি?’ 

—‘সিরিয়াসলি।’ 

—‘মিথ্যা কথা। আই এম আ গুড কিসার। আই নো দ্যাট। বিভাকে জিজ্ঞাসা করিস।’ 

—‘ফালতু। সিগারেট খাওয়া কালো ঠোঁট!’ 

—‘ও আচ্ছা, তোর কী রকম পছন্দ? লিপস্টিক দেয়া লাল ঠোঁট? গে নাকি?’ 

—‘চুপ থাক! তোর কী রকম লেগেছিল? তুই কিন্তু বলছিলি, তোর জীবনের সবচেয়ে সঠিক কাজটা তুই করছিস সেদিন। তুই বলছিলি, মনে আছে তোর?’ 

সামি থমকাল হালকা। মনে ছিল না, কিন্তু মনে পড়ল এই মুহূর্তে। বলল, ‘আমি তো ভাবছিলাম ওটা বিভা।’ 

—‘জানি।’ 

—‘কিন্তু জানিস? ওটা বিভা ছিল না, তুইও ছিলিনা। ছিল অন্য কেউ। হৃদি হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলল, ‘এটার মানে কী?’ 

—‘সত্যি, ওটা অন্য কেউ ছিল।’ 

হৃদি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘ওটা মনে হয় তোর ফিয়ন্সে ছিল। তানিশা!’ 

সামি হেসে ফেলল, ‘হতে পারে!’ 

—‘আমি যাচ্ছি। খাওয়া দাওয়া সব ঠাণ্ডা হয়ে যাইতেছে। রাক্ষস গুলা মনে হয় সব খায়াও ফেলছে এতক্ষণে। এখন না গেলে কিসু পাবিনা। তাড়াতাড়ি আয়।’ 

—‘পরশু দিন তানিশার সঙ্গে তোরা মিট করতেছিস, মনে আছে?’

—‘হ্যাঁরে ভাই, মনে আছে।’ 

২৯

সে রাতে ওরা সবাই রুদ্রদের ফ্ল্যাটেই থেকে গেল। এই ফ্ল্যাটে বিভার প্রথমবার আসা। কে জানত যার জন্য সামি বাবা মায়ের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এই চার রুমের ফ্ল্যাটে এসেছিল, সেই মেয়েটিই একদিন অভিজিতের স্ত্রী হিসেবে এ ফ্ল্যাটে পা রাখবে। বিভার ব্যবহার সত্যি মুগ্ধ করছে সবাইকে। তার কথা বার্তায়, কাজ কর্মে এত বেশি সাবলীল ভাব, যে কেউ বলতে পারবেনা সামির সাথে তার বন্ধুত্বের বাইরেও অন্যরকম একটি সম্পর্ক ছিল। কেউ বলতে না পারলেও হৃদি বুঝতে পারে, বিভার এরকম নির্বিকারত্বের কারণটা হল সে নিজে। হৃদিকে বিভা মন প্রাণ দিয়ে বোঝাতে চাইছে যে সামির জন্য তার মনের ভেতরে বিন্দু পরিমাণ অনুভূতিও আর টিকে নেই। বোকা মেয়েটা আকাশ কুসুম কল্পনা করে যাচ্ছে। কী করে বোঝাবে মেয়েটাকে হৃদি, যে সামি কখনোই তাকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারেনি। এমন কি ডুয়ার্সের সেই সন্ধ্যাবেলার ঘটনাটিও সামির মনে প্রভাব ফেলেছে অন্যরকম ভাবে। সে বিশ্বাস করে সেই মেয়েটি হৃদি ছিলোনা। সে চুমু খেয়েছিল অন্য এক অপরিচিতা মেয়েকে। অতএব সামির জীবনে হৃদি কোথাও নেই, কোনোভাবেই নেই। বিভাকে এই বাস্তব সত্যটা কে বোঝাবে? 

এলেক্সা গান বাজাচ্ছিল,’লোকা লোকা লোকা!’ 

ড্রইং রুমে কার্পেটের উপর হাত পা ছুঁড়ে নেচে যাচ্ছিল, আকাশ, অমৃতা আর রুদ্র। সোফার ওপর বসে ব্যাক্কলের মত তাকিয়ে তাকিয়ে ওদের নাচ দেখছিল বিভা, হৃদি আর সামি। অমৃতার ফোনটা সোফার ওপরে রাখা ছিল। ফোনের ভাইব্রেশনটা টের পেলো হৃদিতা। হাতে নিয়ে দেখলো একটা টি এন টি নম্বর থেকে ফোন আসছে। কোনো নাম লেখা নেই। তবে নম্বরটা একটু চেনা। 

হৃদি ফোনটা হাতে নিয়ে নাচনে ওয়ালাদের দিকে এগিয়ে গেল। অমৃতা খুব আনন্দ নিয়ে হাত পা ছুঁড়ছিল। হৃদি ওর মুখের সামনে ফোনটা ধরে গম্ভীর গলায় বলল, ‘এই যে ডিস্কো ড্যান্সার, ফোন আসছে আপনার।’ 

অমৃতা ফোনটা হাতে নিল। হৃদি অমৃতার হাতে ফোনটা দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল আগের জায়গায়। আকাশ পেছন থেকে ওর হাত ধরে ফেলল, বলল, ‘কই যাচ্ছিস? নাচ নাচ!’ এরপর সে বিভা আর সামিকে ইশারা দিয়ে ডাকল, ‘বসে আছিস কেন?’ 

খানিক বাদে বিভাও উঠে আসল ড্যান্স ফ্লোরে। ওদিকে বেডরুমে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে ফোন ধরল অমৃতা। হক ওপাশ থেকে উদ্বেগ নিয়ে বললেন,’তোমাদের গাড়ি থেকে চিৎকার ভেসে এসেছিল কেন? কোন ঝামেলা হয়নি তো?’ 

অমৃতা বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, ‘ও তাই বলেন, ওই মাস্তান লোকটা আপনার চামচা ছিল। তাইনা?’

—‘প্রশ্নের উত্তর দাও। সব ঠিক আছেতো?’ 

—‘সব ঠিক আছে।’ 

—‘এরকম হাঁপাচ্ছ কেন?’

—‘নাচতেছিলাম!’ 

—‘কী করছিলে?’ 

—‘নাচতেছিলাম আরকি, ফ্রেন্ডরা মিলে।’ 

হক হেসে ফেললেন। অমৃতা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘হাসছেন কেন? নাচ জিনিসটা কি হাসির ব্যাপার?’ 

—‘না না হাসির ব্যাপার হবে কেন? আচ্ছা শোনো, ফোন দিয়েছি একটা প্রয়োজনে।’ 

—‘আমি জানি, দরকার ছাড়া আপনি আমাকে ফোন দেন না। কখনো দেননি।’ 

—‘কখনো দেইনি?’ 

—‘না, দেন নি, অথচ বন্ধুকে প্রয়োজন ছাড়াই ফোন দিতে হয়।’

–’আমি বন্ধুত্বের অত কিছু বুঝিনা।’ 

—‘বোঝেন না কেন? আপনার কোন বন্ধু নেই?’ 

—‘আছে।’ 

—‘গার্লফ্রেন্ড আছে?’ 

হক প্রশ্নটা শুনে থমকে গেলেন। এরকম একটা ফাজিল কথা বলার জন্য তাঁর কি উচিৎ না মেয়েটিকে একটা বড়সড় ধমক দেয়া এই মুহূর্তে? কিন্তু তিনি ধমক দিতে পারলেন না। অমৃতার কথা শুনে আজকাল তাঁর রাগ হয়না। কেবলই বিস্ময় বোধ হয়। তিনি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অত্যধিক ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘আমার ওয়াইফ আছে। গার্লফ্রেন্ড দিয়ে কী করব?’ 

অমৃতা ফিচেল হাসল, ‘ওয়াইফ থাকলে কি গার্লফ্রেন্ড থাকা মানা? আপনি জানেন আমার সিনিয়রের ওয়াইফ আর গার্লফ্রেন্ড দুটোই আছে?’ 

—‘তুমি ভীষণ পাকা মেয়ে!’ 

অমৃতা হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনি রেগে যাচ্ছেন। আমি তো জোক করলাম। আপনার সেন্স অব হিউমার একেবারে লো।’ 

—‘তুমি অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছ অপ্রয়োজনীয় কথা বলে। আসল কথাটাই বলা হল না। এখন আমার হাতে আর সময় নেই। তুমি কি কাল একবার আমার সাথে দেখা করতে পারবে?’ 

বুক ধড়ফড়িয়ে উঠল ওই আচমকা প্রস্তাবটা পেয়ে। দম বন্ধ করে অমৃতা বলল, 

—‘কালকে… কখন?’ 

—‘লাঞ্চ টাইমে?’ 

অমৃতার আগামীকাল দুপুর দুটায় একবার এন জি ও’র অফিসে যেতে হবে। কিন্তু জীবনে এই প্রথম, কাজ পাগল মেয়েটা তার কাজের কথা বেমালুম ভুলে বসে থাকল। কলকল করে বলে উঠল, ‘শিওর, কোথায় দেখা করবেন?’ 

—‘আমার অফিসে চলে এসো। 

তারপর, অনেক অনেকক্ষণ ধরে অমৃতার মুখে চিলতে হাসিটা লেগে রইল। মধ্য রাত অবধি বন্ধুরা সবাই কার্ড খেলল, উনো খেলল। খেলায় পর পর দুইবার লাড্ডুগুড্ডু হয়েও অমৃতার মুখ থেকে হাসি সরলনা। আজকে সে বড়ই অন্যমনস্ক, আনমনা। 

রাত তিনটার পর ঘুমোতে যাবার আগে বিভা অমৃতাকে প্রশ্ন করল, ‘তর মনে এত হাওয়া লাগছে কেন? সেই তখন থেকে হাইসাই যাইতেছিস। কাহিনী কী মামা?’ 

অমৃতা পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করল। রুদ্রর ঘরে মেয়েরা আর সামির ঘরে ছেলেরা থাকছে আজ। অমৃতা দুই বান্ধবীর দিকে চেয়ে খুশিতে ঝুমঝুম হয়ে বলল,’গেস হোয়াট? কালকে দেখা হচ্ছে!’ 

হৃদি হতভম্ব গলায় বলল, ‘কার সাথে?’ 

অমৃতা এক লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে পড়ল, ‘কার সাথে আবার? আমার উনার সাথে! যাকে আমি ভালোবাসি!’ 

বিভা নাক মুখ কুঁচকে বলল,’তোর লজ্জা করেনা?’ 

অমৃতা লাজ শরমের মাথা খেয়ে বলল, ‘ভালো যখন বেসেই ফেলেছি, এখন আর লজ্জা পেয়ে কী হবে বল?’ 

হৃদি খুব রেগে গেল। রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘ওই ব্যাটার সমস্যা কী? তোর সাথে দেখা করতে চায় কেন? 

বিভা বলল, ‘আমার মনে হয় লোকটা অমৃতাকে ইউজ করতেছে। আমি শিওর। অমৃতা দোস্ত, তুই মনে করিসনা, যে ওই লোক তোকে পছন্দ করে। সে গ্রেফ তোকে কাজে লাগাইতেছে।’ 

হৃদি কপালে কুঞ্চন রেখা নিয়ে বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়। অমৃতা স্মার্ট, বুদ্ধিমতী, তাই লোকটা তার ছেলের পেছনে স্পাই হিসেবে লাগাইছে ওরে। আর এই গাধী মনে করতেছে অন্য কিছু।’ 

অমৃতা পরিষ্কার গলায় বলল, ‘আমি মোটেও অন্যকিছু ভাবতেছিনা। আমি জাস্ট… জাস্ট এনজয় করতে চাচ্ছি আমার ফিলিংসটাকে। কাম অন, আই নো ভেরি ওয়েল যে আমার লাইফে আর কখনো এই জিনিসটা হবেনা। আমি আমাকে চিনি। তাই আর কিছু হোক আর না হোক আমি চাই আমার অনুভূতিটাকে চেরিশ করতে।’ 

—‘মরবি তুই শালী, সাথে আমাদেরকেও মারবি।’ হৃদি বলল দাঁতে দাঁত চিবিয়ে। 

.

সকাল আটটায় হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। ওরা তখন নাশতার টেবিলে। সামি অবশ্য তখনও ঘুমোচ্ছে। তার চাকরি বাকরি নেই। সে এখন রোজ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। দরজা খুলতে গেল আকাশ। দরজায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির গায়ে ফিরোজা রঙের সুতির শাড়ি। চুল খোঁপা করে বাঁধা। মুখটা কী ভীষণ স্নিগ্ধ! আর সবচেয়ে নজরকাড়া ওর চোখ দুটি। কেমন যেন অন্যরকম। সাগরের মত গহন! এরকম সাগর চোখের মেয়ে, আকাশ এর আগে কোনোদিন দেখেনি! 

মেয়েটি আকাশের দিকে চেয়ে সুন্দর হাসল, মিষ্টি করে বলল, ‘রুদ্র কি বাসায় আছে? আমার নাম মনীষা। রুদ্রর সাথে একটু দেখা করা যাবে?’ 

আকাশ তাৎক্ষণিক ভাবে কোন প্রত্যুত্তর করতে পারল না। তার মুখে লেপ্টে থাকা হতভম্ব ভাবটা মনীষাকে বিব্রত করে তুলল। সে কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘সরি, আমি কি ভুল সময়ে চলে আসলাম?’ 

আকাশের যেন এতক্ষণে সম্বিত ফিরে আসল, 

—‘না না, ভুল সময় হবে কেন? আসুন না, প্লিজ আসুন।’ 

বলে আকাশ দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। মনীষা একটু সংকোচের সাথে ঢুকল ভেতরে। আকাশ সোফা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসুন। আমি রুদ্রকে ডাকছি।’ 

মনীষা সোফায় বসতে বসতে হাসি মুখে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই আকাশ?’ 

আকাশ সত্যি অবাক হয়ে গেল, ‘আপনি কী করে চিনলেন আমাকে? ছবি দেখেছেন?’ 

—‘না ছবি দেখিনি। তবে রুদ্রর বর্ণনা ছবির চাইতে কোনো অংশে কম ছিলোনা। তোমার হাসি দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আকাশ। তোমাদের সবার এতো গল্প করেছে রুদ্র যে, এখন আমাকে বলে দিতে হবেনা কে কোন জন। দেখামাত্র চিনে ফেলব।’ 

—‘আসলেই?’

—‘আসলেই।’ 

—‘ঠিক আছে, তাহলে পরীক্ষা হয়ে যাক। আমি ডাকছি সবাইকে।

—‘পরীক্ষা দেবার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত আমি।’ 

ডাইনিং রুমের পর্দা টানা ছিল। টেবিল চেয়ারে বসে চার বন্ধু নাশতা করছিল। আকাশ পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতেই হৃদি বলল, কে আসছে রে?’রুদ্র তখন নিবিড় মনোযোগের সাথে কাওয়ান পরোটা দিয়ে ডিমভাজি খাচ্ছিল আর টেবিলের ওপর রাখা খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল। আকাশের মুখে একটা চাপা খুশি উপচে পড়ছে। সে ফিসফিস করে বলল, ‘বিশ্বাস করবিনা!’ 

অমৃতা আর হৃদি একত্রে বলে উঠল, ‘কী বিশ্বাস করবোনা?’ 

আকাশ আনন্দে কাদা কাদা হয়ে গিয়ে বলল, ‘একজন গেস্ট আসছে। তোদের সাথে দেখা করবে। তাড়াতাড়ি চল।’ 

রুদ্র পরোটা, ডিম ভাজা চিবোতে চিবোতে গম্ভীর গলায় বলল, ‘খাওয়া শ্যাষ কইরা নেই। খাওয়া হচ্ছে একধরণের ইবাদাত। খাওয়া আগে, অন্য সব পরে।’ 

আকাশ রুদ্রর কথা পাত্তা না দিয়ে অমৃতা আর হৃদিকে বলল, ‘সামিরে ডাইকা তুল।’ 

অমৃতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ‘কাহিনী কী? কে আসছে?’ 

আকাশ বলল, ‘দাঁড়া, সবাই এক সাথে দেখবি। সামি আসুক আগে।’ 

অমৃতা কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও আর কোনো প্রশ্ন করল না। সামির ঘরের দিকে এগোল। নব ঘোরাতেই খুলে গেল দরজাটা। জানালা, দরজা সব আটকানো বলে ভেতরে সূর্যের আলো প্রবেশ করেনি এখনো। জানালায় ঝুলতে থাকা লাল পর্দার লালচে ছায়ায় ভরে আছে চারপাশ। মনে হচ্ছে যেন ছবিঘর। সামি দরজা খোলার শব্দ পেয়েই নড়ে উঠেছে। লেপের তলা থেকে গলা বাড়িয়ে দিয়ে জড়ানো গলায় বলল, ‘উফ বিরক্ত করিস না। দূর হ!’ 

অমৃতা ওর কথা পাত্তা না দিয়ে গটগট করে বিছানার দিকে হেঁটে গেল। ডান হাত বাড়িয়ে এক টানে সামির গায়ের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে। সামি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল বিছানায়, বিভীষণ গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘এই বেয়াদব মহিলা! কোন সাহসে তুই আমার কম্বল টাইনা নিলি?’ 

অমৃতা নির্বিকার গলায় বলল, ‘উঠে পড়।’ 

সামি বিছানার ওপর বসে থাকা অবস্থায় ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে মেঝে থেকে কম্বলটা তুলে নিল, বলল, ‘অসম্ভব। কিছুতেই উঠব না আমি।’ 

অমৃতা কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়াটে গলায় বলল,’কেন উঠবিনা? সকাল হইছে কতক্ষণ আগে খেয়াল আছে তোর? সবাই উঠছে তুই উঠবিনা ক্যান? তোর ঘুম শ্যাষ হয়না ক্যান?’ 

সামি কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। খুব গম্ভীর ভাবে বলল, ‘ঘুম শেষ হইছে। এখন একটু রেস্ট নিব।’ 

—‘মানে কী?’ 

—‘অনেকক্ষণ ঘুমাইছি! এখন আমার একটু রেস্ট দরকার।’ 

অমৃতা কথাটা শুনে ব্যাক্কল বনে গেল। হৃদি এসে দাঁড়িয়েছে তখন ঘরের দরজায়। অমৃতা হৃদিকে দেখে উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘এই গাধার বাচ্চা, ঘুম থেকে উঠে রেস্ট নিচ্ছে।’ 

হৃদি হেসে ফেলল, ‘ঠিকই আছে। ঘুমানোও তো একটা কাজ। ঘুম থেকে উঠে সবারই একটু রেস্ট নেয়া উচিৎ। আজকের পর থেকে তুইও নিস।’ 

অমৃতা ঘর থেকে বেরোনোর আগে বলল, ‘গাধাটারে বল ড্রইং রুমে গিয়া বইসা বইসা রেস্ট নিতে। আমরা ওয়েইট করতেছি। তাড়াতাড়ি আয় তোরা।’ সামি কম্বলের তলা থেকে আবারও মুখ বের করল, ‘তোদের কি মানুষের সুখ সহ্য হয়না?’ 

—‘না হয়না। এখন ওঠ, একজন বিশেষ গেস্ট আসছে। আকাশ চায় আমরা সবাই যেন তার সাথে একত্রে দেখা করি।’ বলতে বলতে হৃদি জানালার পর্দা একপাশে সরিয়ে দিল হাত বাড়িয়ে। 

আরো দুই মিনিট বিছানায় গড়াগড়ি করে সামি উঠল শোয়া থেকে, অবশেষে। বলল, ‘বিশেষ গেস্টটা আবার কে?’ 

সে তখনো চোখ খুলতে পারছেনা ঘুমের ভারে। চুল হয়ে আছে উষ্কখুষ্ক। হৃদি হেঁটে এগিয়ে গেল ওর কাছে। এলোমেলো কোঁকড়া চুল গুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘চল, গেলেই দেখতে পাবি।’ 

সামি ঘুমের ভারে ছোট হওয়া চোখ দুটো পিটপিট করে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আলতো ভাবে বলল, ‘আজকে একটা স্বপ্ন দেখছি, জানিস?’ 

—‘কী স্বপ্ন?’ 

সামি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটি উচ্চতায় তার চেয়ে খাটো। সে ঘাড় ঝুঁকিয়ে আয়নায় নিজের মুখখানি দেখল একবার। এলোমেলো চুল গুলি হাত দিয়ে সুবিন্যস্ত করতে করতে বলল, ‘স্বপ্নটা কেমন যেন অদ্ভুত!’ 

হৃদি বিছানায় ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো কম্বলটা ভাঁজ করে রাখছিলো। সামির কথা শুনে সে হাতের কাজ থামিয়ে বলল, ‘কী রকম অদ্ভুত?’ 

—‘ডুয়ার্সের সেই মেয়েটকে দেখলাম।’ 

—‘কোন মেয়েটা?’ 

—‘সন্ধ্যাবেলার মেয়েটা।’ সামি ঘুরে তাকালো হৃদির দিকে। 

-‘কী বলছিস পাগলের মত?’ 

—‘হ্যাঁ, ওই মেয়েটাকে আজকে স্বপ্ন দেখলাম।’ 

হৃদি স্তম্ভিত গলায় বলল,’সেই মেয়েটার চেহারা তোর মনে আছে?’

—‘চেহারা সেদিনও দেখিনাই, আজকে স্বপ্নেও দেখিনাই, কিন্তু কী করে যেন মেয়েটাকে চিনে ফেললাম।’ 

হৃদি এতো বেশি অবাক হয়ে গেল যে বেশ কিছু মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারলোনা। দুহাতে কম্বলটা আঁকড়ে ধরে থেকে স্থবির হয়ে চেয়ে রইল সামির দিকে। 

—‘স্বপ্নের মধ্যে মনে হচ্ছিল যে ওই মেয়েটাকেই যেন আমার চাই!’ 

.

পাঁচ বন্ধু পর্দার আড়ালে জড়ো হয়ে দাঁড়ালো। সবার মুখে খেলছে বিরক্তি। তারা বুঝতে পারছেনা আকাশের সমস্যাটা কী?এমন কোন মহামান্য অতিথি এসেছে যার সামনে সবাইকে লাইন ধরে গিয়ে দাঁড়াতে হবে? পর্দার ফাঁক দিয়ে অমৃতা অতিথির শাড়ির আঁচলের কিছু অংশ দেখতে পেল। সে চোখা গলায় আকাশকে বলল, ‘তোর গার্লফ্রেন্ড আসছে নাকি?’ 

আকাশ অমৃতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঝুলে থাকা পর্দাটা হাত দিয়ে একটু সরিয়ে দিল। এক গাল হেসে বলল, ‘সবাই চলে আসো একে একে 

ছয় মূর্তি ঘরের ভেতর উপস্থিত হওয়া মাত্র মনীষার মুখখানা এক উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। আকাশ বলল, ‘এবার চটপট সবার নাম বলে দিন।’ 

বন্ধুদের সবাই বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে গিয়েছিল। একটা নির্বাক কৌতূহল খেলছিল সবার চোখে মুখে। রুদ্রর চেহারা হয়েছিল দেখার মতো। সে প্রথমটায় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলনা। বিড়াল চোখ দুটোকে ড্যাবড্যাব করে মেলে ধরে অবিশ্বাসের গলায় বলল, ‘আপনি?’ 

—‘আমার এক চাচার বাসায় এসেছিলাম। আর দুটা বিল্ডিং পরেই উনার বাসা। কিন্তু বেশি সকালে চলে এসেছি। চাচা এখনো মর্নিং ওয়াক থেকেই ফেরেন নি। তাই ভাবলাম এই ফাঁকে তোমাকে একবার দেখে যাই। এখন মনে হচ্ছে খুব ভালো সময়ে এসেছি। তোমার সব বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেল। 

আকাশ বলল, ‘আপনাকে একে একে সবার নাম বলতে হবে।’ 

মনীষা প্রথমেই অমৃতার দিকে চেয়ে বলল, ‘এই ছোট চুলের মেয়েটা হল অমৃতা চৌধুরী।’ নিজের নামটা মনীষার মুখে শুনতে পেয়ে অমৃতা বিশ্ব জয়ের হাসি হাসল। হাত তালি দিয়ে বলে উঠল, ‘রাইট!’ 

—‘টানা চোখের সুন্দর মেয়েটা হল, বিভাবরী।’ 

প্রশংসা শুনে বিভা একদম লাল টাল হয়ে গিয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইউ!’

—‘নায়িকা কাজলের মতো দেখতে মেয়েটা হল হৃদিতা বিনতে জামিল। আর এই লম্বা, হ্যান্ডসাম ছেলেটা সামিউল হক। কি ঠিক বলেছি?’ 

হৃদি খুশিতে ঝুমঝুম হয়ে বলল, ‘কী করে চিনলেন আপনি সবাইকে? ছবি দেখেছেন কি?’ 

—‘না ছবি দেখিনি। রুদ্রর কাছ থেকে তোমাদের গল্প শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। 

সামি বলল, ‘আপনি বসুন না, দাঁড়িয়ে কেন? 

মনীষা বসলো। তার উল্টো দিকের দুটো সোফায় বন্ধুরা বসল পাশাপাশি, মনীষার মুখোমুখি। 

রুদ্র লক্ষ্য করছিল মনীষাকে দেখার পর থেকে তার বন্ধুদের মধ্যে একটা গদগদ ভাব চলে এসেছে। প্রত্যেকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মেয়েটার দিকে। দেখে মনে হচ্ছে যেন একেকটা ক্যাবলাকান্ত। এমনকি ব্যক্তিত্ববান, স্মার্ট অমৃতাও বেকুবের মতো দাঁত বের করে হাসছে। অর্থাৎ মনীষার জাদু সবার উপর কাজ করে গেছে। মনীষা হাসি হাসি মুখ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সবাইকে। একটা সময় সে বলল, ‘তোমরা অনেক কিউট!’ 

হৃদি হে হে করে বলে উঠল, ‘আপনিও…’ রুদ্র একদম ঠিক বলেছিল!’

মনীষা সন্দিহান হয়ে বলল, ‘রুদ্র কী বলেছিল?’ 

রুদ্র চমকে তাকালো হৃদির দিকে। এই গাধীর বাচ্চি এখন কী বলতে কী বলে বসবে আল্লাহ জানে! এদের মাথা পুরাপুরি আউট হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে মনীষা রুদ্রর ক্রাশ না শুধু, এদের সবার ক্রাশ। নিশ্বাস বন্ধ করে সে হৃদির দিকে চেয়ে রইল। বেফাঁস কিছু বলে না দেয়, গাধীটা। 

হৃদি গলায় পূর্বের হেহে ভাব বজায় রেখেই বলল, ‘ওমা, রুদ্র তো সবসময়ই বলে যে আপনি কত সুন্দর, আপনার চোখ…’ অমৃতা ওর পাশেই বসে ছিল। চট করে সে হৃদির হাতে একটা চিমটি কাটল। চিমটি খেয়ে হৃদি উপলব্ধি করলো যে সে নিশ্চয়ই অসংযত কিছু বলে ফেলেছে। ঢোঁক গিলে কথাটা পেটে পুরে ফেললো চকিতে। 

মনীষা আড়চোখে রুদ্রকে একবার দেখল। রুদ্র নিজের এক আঙুল সমান লম্বা দাড়ি ওয়ালা গালটা হাতড়াচ্ছিল। চোখে মুখে অস্বস্তি নিয়ে চেয়ে ছিল মেঝের দিকে। মনীষা উৎসুক গলায় বলল, ‘আমার চোখ?’ 

হৃদি বেকায়দায় একবার তাকালো রুদ্রর দিকে। সে যে বড়সড় একটা ভুল করে ফেলেছে এটা বুঝতে পেরে তার এখন কান্না পেয়ে যাচ্ছে। রুদ্রর মুখখানা বড়ই থমথমে। সে কখনো হ্যাংলার মতো মুখের ওপর মনীষার রূপের প্রশংসা করেনি। এমন কি মনীষা হয়তো জানেওনা যে রুদ্রর চোখে সে কতটা সুন্দর, কতটা অসাধারণ। আজ পর্যন্ত একটাবারের জন্যেও মনীষার ওই সাগর চোখের দিকে চেয়ে রুদ্র বলতে পারেনি, যে ওই চোখদুটো তার কতটা প্রিয়। বন্ধুদের সাথে সে খোলামেলা এবং প্রগলড়ভ এ কথা ঠিক। কিন্তু বাইরের লোকের সামনে যতটা সম্ভব আত্মসম্মান বজায় রেখেই চলার চেষ্টা করে। 

হৃদি অনেক কষ্টে বলল, ‘না… কিছুনা।’ 

অমৃতা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে প্রসঙ্গ পাল্টালো, ‘আপনি দেশে ফিরেছেন কবে?’ 

—‘এইতো হল এক সপ্তাহ।’ 

—‘আপনার ছেলে কেমন আছে?’ 

মনীষা একটা হতাশার শ্বাস ফেলে বলল, ‘খুব একটা ভালো নেই। মন টিকছেনা ওখানটায়। আসলে কখনো আমাকে ছেড়ে একলা থাকেনি তো।’ 

—‘ঠিক হয়ে যাবে ধীরেধীরে। প্রথম দিকে সবার ভেতরেই একটু হোমসিকনেস কাজ করে।’ 

বিভা বলল, ‘আমি শুনেছি আপনি খুব ভালো গান করেন। আপনার গান শুনতে পাবো কবে? রুদ্র আর আপনি ডুয়েট গান করবেন। আমরা আপনাদের গান একসাথে শুনতে চাই।’ 

—‘ডুয়েট?’ শব্দটা উচ্চারণ করে এক ভ্রু উঁচিয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল মনীষা। রুদ্র অপ্রস্তুত হাসল। এই গাধার বাচ্চা গুলা আজকে তার মান সম্মান ডুবিয়েই ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে। 

মনীষা বিভাকে বলল, ‘আমিও কিন্তু জানি যে তুমি খুব ভালো নাচতে পার। যেদিন তোমার নাচ দেখাবে, সেদিনই আমি গান শোনাবো তোমাদের।’ 

—‘আমাদের সামির সামনেই বিয়ে। আপনি সামির বিয়েতে গান করবেন, কেমন?’ 

রুদ্র এতক্ষণে কথা বলল, ‘হ্যাঁ, সামির এনগেজমেন্ট এ আপনার দাওয়াত রইল।’ 

—‘যার বিয়ে সে তো দাওয়াত দিচ্ছেনা!’ 

সামি খোঁচাটা বুঝতে পেরে মুচকি একটা হাসি হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই আসবেন।’ 

এরপর বন্ধুরা আর কোনো কথা খুঁজে পেলোনা। সবাই হাসি হাসি মুখ আর চিকচিক করা চোখের মণি নিয়ে তাকিয়ে রইল মনীষার দিকে। অতএব রুদ্রকেই আতিথেয়তার দায়িত্বটুকু পালন করতে হল। একটু আড়ষ্টতা নিয়ে বলল, ‘আপনি কী খাবেন? চা দেই?’ 

মনীষা রুদ্রর প্রস্তাব শুনে খুব একচোট হাসল, বাব্বাহ তুমি দেখি একদম পাকা সংসারী হয়ে উঠেছ। চা বানাতে পারো? 

রুদ্র বলল, ‘আমি পারিনা, কিন্তু আমার বন্ধুরা প্রত্যেকে পারে।’ 

সামি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি বানাচ্ছি চা।’ 

মনীষা বলল, ‘আরে না। তোমরা ছোট মানুষ, এসব ঝামেলা করতে হবেনা। বসে থাকো।’

সামি মনীষার বারণ শুনল না। বলল, ‘আপনি প্রথমবার এসেছেন। কিছু তো খেতেই হবে।’ 

সামির দেখাদেখি আকাশও উঠল। উঠে পড়ল অমৃতাও। অগত্যা হৃদি আর বিভাকেও উঠতে হল। মনীষা একটু অবাক গলায় বলল, ‘তোমরা সব কোথায় যাচ্ছ?’ 

আকাশ বলল, ‘আমার দশটার সময় একটা ক্লাস আছে।যেতে হবে।’ 

—‘ও আচ্ছা, আমি আসলে খুব বাজে একটা সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছি। রুদ্ররও তো অফিসে যেতে হবে, তাইনা?’ 

রুদ্র হালকা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ।’ 

মনীষা সোফায় রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে বলল, ‘আমি তাহলে আজ উঠি। অন্য একদিন চা খাবো।’ 

আকাশ বলল, ‘চা করতে পাঁচ মিনিটও লাগবেনা। আপনি বসুন প্লিজ। আমরা সবাই একসাথে চা খাবো।’ 

বন্ধুরা চলে যাবার পর মনীষা ব্যাগের চেইন খুলে একটা খাম বের করে রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার লাস্ট মাসের স্যালারি। অনেক দেরি হয়ে গেল। দুঃখিত।’ 

—‘আপনি এটা দিতে এসেছেন?’ একটু ত্যাড়া ভাবে প্রশ্ন করলো রুদ্র।

—‘ভাবলাম এদিকটায় যেহেতু আসা হল।এই সুযোগে দিয়ে যাই টাকাটা।’

রুদ্র বসা থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে খামটা নিল। নিয়ে আবার সোফায় এসে বসলো। মনীষার মুখোমুখি। সাগর চোখের মনীষা তখন বিড়াল চোখের রুদ্রকেই দেখছিল। ওর দাড়ি গোফের জঙ্গল ওয়ালা আউলবাউল মুখখানার দিকে তাকিয়ে ছিল কেমন অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে। রুদ্র কিছুতেই স্থির হতে পারছিলোনা। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে যাচ্ছে সমানে। এই অপ্রত্যাশিত স্নিগ্ধ সুন্দর ঘটনাটির সত্যতা মেনে নিতে তার বেগ পেতে হচ্ছে। ফিরোজা রঙের শাড়ি পরা পরীটা যেন বাস্তবে আসেনি তার বাসায়, এসেছে স্বপ্নে। 

—‘তুমি তোমার বন্ধুদেরকে কী বলেছ? আমার চোখের কথা?’ 

রুদ্র সতর্কতার সাথে বলল, ‘ওদের কথাবার্তার কোনো ঠিক নেই। আবোল তাবোল বলে। 

—‘তাই?’ 

—‘হুম তাই।’ ঘাড় পর্যন্ত ঝুলে থাকা এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বলল রুদ্র। 

—‘তোমার সব কেমন চলছে?’ 

—‘চলছে একরকম। আপনি কেমন আছেন?’ 

—‘মোটামুটি।’ 

—‘একা একা থাকতে সমস্যা হচ্ছেনা তো কোনো?’ 

মনীষা এ প্রশ্নের উত্তরে অদ্ভুত হাসলো, ‘সমস্যা হলেই বা কী করার আছে?’ 

রুদ্র চুপ করে রইল। এ বিষয়ে তার কিছু বলাটা সমীচীন হবেনা ভেবেই চুপ থাকলো, কিন্তু আদতে এই সমস্যা সমাধানের উপায় আছে। মনীষার বয়স তেত্রিশের আশেপাশে হবে। তার সামনে এখনো পড়ে আছে অনেকটা সময়। বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। বাস্তবিক অর্থেই সে একেবারে একা। জীবনে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা খুব জরুরি। একদম একা একা জীবন কাটানোটা কোনো মানুষের পক্ষেই সহজ কাজ নয়। কিন্তু মনীষাকে এসব কথা বলার মতো কোন অধিকার তার নেই। সে কে? 

—‘আমার বাসাটা পাল্টে ফেলব। রাইয়ানের তো প্রায় দুই বছর লেগে যাবে পড়া শেষ হতে। তো এই দুটা বছর ছোট একটা বাসা ভাড়া করে থাকব। ধরো দুই রুম হলেই চলবে।’ 

—‘কোন দিকে যাবেন কিছু ঠিক করেছেন?’ 

—‘ভাবছি অফিসের কাছাকাছি কোথাও উঠব।’

–’হুম, ঠিক আছে আমি বাসা খুঁজে দেখবো।’

—‘হ্যাঁ প্লিজ, পেলে জানাবে। অনেক জায়গায় আবার সিঙ্গেল মহিলাকে ভাড়া দিতে চায়না। এর মাঝেই বেশ কয়েক জায়গা থেকে আমাকে রিজেক্ট করেছে সিঙ্গেল বলে।’ 

রুদ্র হাতে ধরা খামটার দিকে নিবিড় চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘আমি চাকরি পেলে আপনাকে একটা ট্রিট দেবার কথা ছিল, মনে আছে?’ 

মনীষা হাসল, ‘মনে আছে।’ 

—‘কবে ফি আছেন?’ 

—‘যেকোনো উইকেন্ডে। 

অমৃতা পর্দার ফাঁক গেলে মাথা বের করে বলল, ‘আপু, একটু আসুন প্লিজ। চা খেয়ে যান। 

.

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অমৃতা নিজেকে দেখছিল। এভাবে এমন গভীরভাবে এর আগে কোনোদিন সে নিজেকে দেখেনি। প্রয়োজনই পড়েনি কখনও! আজকেও বা ঠিক কী প্রয়োজন তা অমৃতা জানেনা। কিন্তু কেন যেন আজ জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের চেহারা খানা যাচাই করে নেবার তাগিদ অনুভব করছে ভেতর থেকে। সে কোনোদিনই নিজের রূপ সম্পর্কে সচেতন ছিল না। কপালের কাছের চুলগুলো একটু লম্বা হয়ে গেছে। পেছনে দিকেও চুল ঘাড় ছুঁয়ে ফেলেছে। সে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে স্বগতোক্তি করল, ‘চুল কাটতে হবে।’ 

বিছানায় বিভা বসে ছিল হাতে মোবাইল নিয়ে। অভিজিতের নম্বরে পর পর তিনবার ফোন করল। অভিজিৎ লাপাত্তা। থেকে থেকে তার ডুয়ার্সের কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল তার একার ছোট্ট সংসারটার কথা। চায়ের কাপ থেকে শুরু করে ঘরের খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিসের প্রতি একটা টান অনুভব করছিল ভেতরে ভেতরে। দূর্গা সব কাজ মন দিয়ে করছে কিনা, অভিজিৎ সকালের চা’ টা সময় মতো পেল কিনা, পোষা পায়রাগুলোকে নিয়ম মতো খাবার দেয়া হল কিনা, এমনই সব অনর্থক দুশ্চিন্তারা অকারণে ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের কিনার ঘেঁষে। অমৃতার বিড়বিড় করে বলা কথাটা শুনে তার চিন্তায় ছেদ পড়লো। সে মুখ তুলে তাকাল অমৃতার দিকে এবং এই অস্বাভাবিক দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে রীতিমত চমকে উঠল। অমৃতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যত্নের সাথে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছে! এটা কী করে সম্ভব? সে বিস্ফোরিত চোখে দৃশ্যটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর থমকানো গলায় বলল, ‘তুই… কী করতেছিস?’ 

অমৃতা বিভার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার চুল গুলি একটু লম্বা হয়ে গেছে তাইনা? অদ্ভুত দেখাচ্ছে?’ 

বিভার ঠোঁট দুটো হা হয়ে গেলো বিস্ময়ে। এই মেয়েটাকে চেনে সে প্রায় পনেরো বছর ধরে। এই পনের বছরের সুদীর্ঘ সময়ে অমৃতা কোনোদিন ভুলে একটিবারের জন্যও নিজের চেহারা সম্পর্কে কোনো মতামত জানতে চায়নি বন্ধুদের কাছে। অমৃতার সাজ হল কোনোরকমে গায়ে একটি ঢোলা শার্ট জড়ানো আর ঘাসের ন্যায় ছোট করে ছাটা চুল গুলোতে চটপট হাত বুলিয়ে নেয়া। ব্যাস এটুকুই। 

বিভাকে ব্যাক্কলের মতো চেয়ে থাকতে দেখে অমৃতা বলল, ‘কী হইল?’

—‘তুই… তুই জানতে চাইতেছিস তোকে কেমন দেখাচ্ছে?’ 

—‘অদ্ভুত দেখাচ্ছে চুলের জন্য?’ অমৃতা বেশ সিরিয়াস।

বিভা হতভম্ব ভাবটা কাটিয়েই উঠতে পারছেনা। তার মুখে কোনো কথা নেই। অমৃতা আর উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজের কাজ করতে লাগল। 

কোর্টে যাবার পোশাক হল সাদা শার্ট, কালো কাপড়ের প্যান্ট আর কালো কোট। হাতে থাকে ইয়া বড় লম্বা কালো ভূতের মত গাউন। আজ ঠিক এগারোটায় সি এম এম কোর্টে তার একটা শুনানি আছে। সকালবেলা চা খেতে খেতে সে রোজ একবার মামলার নথি পত্র গুলোয় চোখ বুলায়। আজ মনীষা থাকার কারণে সেই কাজটা করা গেল না। তাছাড়া আজ তৈরী হবার পেছনেও একটু বেশি সময় লাগছে। সে মুখে কোনো প্রসাধন মাখছেনা। কিন্তু জামা কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ অবধি অকারণে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। একটু বাদে হৃদি আসলো ঘরে। অমৃতার ভাবসাব দেখে নিয়ে সে মন্তব্য করল, ‘দ্যাখ না, মনে হইতাছে যেন ডেটে যাইতাছে।’ 

বিভা বলল, ‘অনেক হইছে, বুইড়ার সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য তোমার অতো সাজতে হবেনা।’ 

অমৃতা ফোঁস করে উঠে বলল, ‘তোদেরকে না বুইড়া বলতে মানা করছি? আর কোনোদিন আমার উনাকে বুইড়া বলবি না।’’ 

বিভা হাহাকার করে বলে উঠল,’এর তো মাথা পুরাই খারাপ হয়ে গেছে!’ 

হৃদি দু পা এগিয়ে এসে অমৃতার মুখোমুখি দাঁড়াল। সরাসরি ওর চোখে চেয়ে বলল, ‘তুই আসলে কী করতে চাচ্ছিস?’ 

-‘কী করতে চাইব আবার?’ 

—‘সেই তখন থেকে আয়নার সামনে দাঁড়ায় আছিস কেন? সাজগোজ করবি?’ 

অমৃতা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, ‘আজাইরা কথা বলিস কেন? আমি কি সাজগোজ করি নাকি কখনো?’ 

—‘তাহলে করতে চাচ্ছিস কী?’ 

—‘জাস্ট ট্রাইং টু ফিগার ইট আউট যে আমাকে আসলে দেখতে কেমন লাগতেছে?’ 

বিভা চোখ ছোট করে বলল,’তোকে দেখতে পিকিউলিয়ার লাগে। বুঝছস? তোর উচিৎ আউটলুক চেঞ্জ করা। এরকম অদ্ভুত বেশভূষা নিয়ে ঘুরতে থাকলে কোনো ছেলে তোরে পছন্দ করবেনা। আংকেলরাও পছন্দ করবে না।’ 

শুনে অমৃতার চোখে একটা হালকা ছায়া পড়লো। একটু আহত গলায় বলল, ‘দ্যাখ, তোরা যদি প্রত্যেকটা কথায় আমাকে এরকম খোঁটা দিস, মানে বুইড়া তারপর আংকেল, এসব দোস্ত কন্টিনুয়াসলি চলতে থাকলে আমি তোদের সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে আর কথাই বলবো না। 

—‘বুইড়াকে বুইড়া বলবো নাতো কী বলবো? হ্যান্ডসাম হিরো?’ 

—‘ডেফিনিটলি হি ইজ হ্যান্ডসাম। ওটা বলতে না পারলে কিছুই বলিস না। ডোন্ট হার্ট মাই ফিলিংস। অকে?’ 

বিভা একটু ত্যাড়া ভাবে বলে উঠল, ‘কিছু না বলাই ভালো। কারণ ব্যাপারটা মনে পড়লেই আমার গায়ের মধ্যে শুয়ো পোকা কামড়ায় উঠে। বুঝছস? তুই এই ফালতু বিষয়টা নিয়া আমাদের সাথে আর কথা বলিস না। সেটাই ভালো হবে। 

হৃদিও বিভার সুরে সুর মেলালো। বলল, ‘আসলেও, আজকের পর থেকে বিষয়টা নিয়ে আমরা আর কোনো কথা বলবো না। মনে পড়লে আমার বমি আসে। বিশ্বাস কর!’ 

অমৃতা কিছুক্ষণ ব্যথাতুর চোখে দুই বান্ধবীর দিকে চেয়ে রইল। তারপর আর একটিও কথা না বলে ধীরে ধীরে গায়ে কালো কোটটা পরে নিল। পায়ে মোজা, জুতো পরল। ফাইল পত্র গুছিয়ে নিল ব্যাগে। এই পুরো সময়টাতে বিভা আর হৃদি কোনো কথা বলল না। নিশ্চুপ হয়ে, নিবিড় চোখ মেলে অমৃতার কাজ কারবার দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে তাদের দুজনেরই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজকে যদি কোনো সাধারণ মানুষকে অমৃতা ভালোবাসতো, তাহলে এই প্রথম দেখার দিনটি কতই না মধুর, সুন্দর আর অন্যরকম ভালোলাগার হতে পারত। তারা বন্ধুরা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় ছিল এই দিনটির। অমৃতা কারো প্রেমে পড়বে এই বিষয়টা চিন্তা করেই মনের ভেতর শিহরণ খেলে যেত তাদের। অমৃতার প্রেমে পড়াটা ছিল তাদের কাছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য তুল্য একটি বিষয়। হায়, সেই বহু কাঙ্খিত দিনটি আজ এলো সত্যিই, কিন্তু এলো ভয়ঙ্কর জীর্ণ রূপ নিয়ে। এই ভয়ংকর সত্যকে স্বাগত জানানোর মতো কোনো ইচ্ছা, রুচি কিংবা সাহস এর কোনওটিই তাদের নেই। 

বিভা আর হৃদির আচরণ অমৃতার ভেতরে একটা হতাশার ভাব উদ্রেক করে দিয়েছিল। মনের দিক থেকে সে সর্বদাই শক্ত পোক্ত। ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে সে না। কিন্তু আজ পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সে তার বন্ধুদেরকে পাশে পেয়েছে। তার পৃথিবী এক দিকে আর বন্ধুরা অন্যদিকে। এই প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করল যে, এবারের পথটিতে সে সম্পূর্ণ একা। পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো মানুষ নেই যে তাকে বুঝবে। বন্ধুরাই বুঝল না, অন্য লোকে কী করে বুঝবে? 

হয়তো ভুল পথেই পা বাড়িয়েছে সে। কিন্তু ভুল সঠিক নির্ধারণ করার যথাযথ মানদণ্ড কোনটি? মানুষের বিবেক? কার কখন কাকে ভালো লাগবে কিংবা খারাপ লাগবে এই বিশেষ অনুভূতি টিকে বিবেক দিয়ে কি কখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়? কে যেন কবে বলেছিল, এভরি থিঙ ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। অমৃতা কথাটা এখন শত ভাগ বিশ্বাস করে। অন্য কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, তার কিছু এসে যায়না। তবে তার মনে এখনও আশা আছে, যে বন্ধুরা একদিন তাকে ঠিকঠিক বুঝবে। সামিও বুঝবে। সামির কাছ থেকে তো সে তার বাবাকে ছিনিয়ে নিতে চায়নি! তাদের সংসারও ভাঙতে চায়নি। শুধুই ভালোবেসেছে। এতকাল সবাই বলেছে একটা প্রেম কর, প্রেম কর! আরে ভাই, প্রেম কি বললেই করা যায় নাকি, ওসব তো হয়ে যায়। যখন হল… হায়! সারা দুনিয়া চলে গেল তার বিপক্ষে। কপাল! 

না, ভালো লাগছিলোনা। বুকজোড়া এক গহন হতাশা বোধ! পৃথিবীটা এমন কেন? সমাজটাই সব? মনের কোনও দাম নেই? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *