বৃষ্টিমহল ২.২০

২০

ফানিমুনের সুরটা যে কেটে গেছে এটা বুঝতে বন্ধুদের খুব বেশি সময় লাগলোনা। কারো মুখে হাসি নেই। কেউ মুখ ফুটে কোনো কথাও বলছেনা। একটা চাপা উদ্বেগ খেলছে সবার ভেতর। কে কার পক্ষ নেবে এই নিয়েই যেন নিজেদের ভেতর একটা দ্বন্দ্ব চলছে ভেতরে ভেতরে। একবার সামির ওপর রাগ হচ্ছে, আবার পরমুহূর্তেই এক অন্ধ মায়া এসে প্রলেপ আঁকছে সেই রাগের ওপর। ভুল তো মানুষই করে। বিভার অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে। খারাপ লাগছে হৃদির জন্যেও। কে কী বলবে, কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা ওরা। বসার ঘরে সবাই সোফার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিল। সামি অবশ্য অন্য সবার সাথে একত্রে বসে নেই। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নেশাগ্রস্থের মতো একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছে। 

হৃদি খুব কাঁদছে। রীতিমত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। না নিজের জন্য না, সামির জন্যও না, সে কাঁদছে বিভার জন্য। বিভা এবং তার এই এতকালের নিষ্পাপ, পবিত্র বন্ধুত্বে হঠাৎ করে এমন কলঙ্কের দাগ লেগে যাবে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি কখনও। বিভা তার আত্মার অংশ। পৃথিবী গোল্লায় যাক, বিভাকে কষ্ট দিয়ে সে বেঁচে থাকতে পারবেনা। বিভা তাকে ভুল বুঝলে গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকবেনা তার জন্য। 

দুপুরে বিভা কিছুই খেলোনা। ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলো। বন্ধুরা ডাকাডাকি করল অনেক। সাড়া পাওয়া গেল না। দূর্গা রুই মাছ ভাজা আর ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ালো বন্ধুদের। খেতে পারলোনা কেউ ঠিকমতো। রুদ্র এমনিতেই মাছ টাছ তেমন একটা পছন্দ করে না। তার ওপর দূর্গার রান্নায় একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব থাকে সবসময়। প্রতিটা তরকারিতে মনে হয় যেন দু তিন চামচ চিনি মিশিয়ে দিয়েছে ইচ্ছে করে। ওদের ঝাল সওয়া মুখে তাই ওই মিষ্টি তরকারি ভালো লাগলনা। 

সন্ধ্যের পর বৃষ্টি নামলো। অভিজিৎ বাড়ি ফিরলো কাকভেজা হয়ে। বিভার বন্ধুদের ঝিম ধরা অবস্থা দেখে সে অবাক না হয়ে পারলোনা। এই চঞ্চল ছেলেমেয়ে গুলো শান্তশিষ্ট হয়ে বসে আছে এ যেন অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। সবচেয়ে বেশি অবাক হল সে বিভাকে দেখে। বিভা তার শোবার ঘরের বিছানায় নিস্তেজ অবস্থায় ত্যাড়া ব্যাঁকা হয়ে শুয়ে আছে। সচরাচর বিভা অভিজিতের বিছানায় শোয় না। দুপুরের দিকে গড়াতে মন চাইলে অন্য ঘরের বিছানায় গড়িয়ে নেয়। আজকে নিজের বিছানায় বিভাকে ওরকম অবসন্ন শরীরে লেপ্টে থাকতে দেখে অভিজিৎ স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারলো যে কিছু একটা ঘটেছে। 

অভিজিৎকে দেখে বিভা একটু অপ্রস্তুত ভাবে শোয়া থেকে উঠে বসল। দুর্বল গলায় বলল, ‘আপনি তো ভিজে গেছেন। 

অভিজিৎ তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে বিভাকে পরখ করল, ‘আপনার কী হয়েছে?’ 

—‘কিছুনা।’ 

—‘মুখ চোখ অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?’ 

—’এমনি।’ 

অভিজিৎ এগিয়ে এসে বিভার পাশে বসলো। কপালে আর গালে হাত ছুঁইয়ে উদ্বিগ্ন ভাবে বললো, ‘জ্বর টর আসেনি তো? 

ম্লান হাসলো বিভা, ‘না, আমি ঠিক আছি।’ 

সে জানেনা কেন, কিন্তু সারাদিন পর অভিজিৎকে দেখে তার কেমন শান্তি শান্তি একটা অনুভূতি হচ্ছে। চোখ ভরে সে অভিজিৎকে দেখলো আরেকবার। সাদা ফুলহাতা শার্ট, কালো টাই, কালো প্যান্ট পরা, চশমা ওয়ালা নিষ্কলুষ, সরল চেহারার মানুষটিকে তার হঠাৎ করেই খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে হল এবং জীবনে প্রথমবারের মতো সে এই সত্যটা গভীর ভাবে উপলব্ধি করল যে অভিজিৎকে আসলে সে ভালোবাসতেই চেয়েছিল। ভীষণ ভাবে চেয়েছিল। কিন্তু চাইলেই যে সব হয়না এ জীবনে! অভিজিতের প্রতি একটা মায়া আছে তার এ কথা ঠিক কিন্তু সেই মায়াটা কোন ঝড় তোলেনা ভেতরে। ঝড়ের মতো সর্বনাশা প্রেম একবারই এসেছিলো তার জীবনে। আজকে সেই প্রেমটাও কেমন মিথ্যে হয়ে গেল। মনে হতেই বিভার দু চোখের দেয়াল উপচে জলের ফোয়ারা নামল। অভিজিৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে আপনার? কী হয়েছে বলুন তো?’ 

কাঁদতে কাঁদতে বিভার হিক্কা উঠে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় সে অভিজিতের কাঁধে আলতো ভাবে মাথা রাখল। অভিজিৎ ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সান্ত্বনার গলায় বললো, ‘এভাবে কাঁদতে হয়না। কী হয়েছে আমাকে বলুন তো একবার!’

.

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর হৃদি একটু তাড়াতাড়িই বিছানায় গেল আজ। সামিকে সন্ধ্যার পর থেকে আর পাওয়া যাচ্ছেনা। তার ফোনও বন্ধ। শীত কালের বৃষ্টি মানেই ভয়ংকর ঠান্ডা। এই বৃষ্টি বাদলার রুক্ষ আবহাওয়ায় বন জঙ্গলের ভেতর ছেলেটা কোথায় গিয়ে বসে আছে তা বন্ধুরা কেউ জানেনা। 

উঠোনে চেয়ার পেতে বসেছিল রুদ্র, অমৃতা আর আকাশ। রুদ্র গিটারের তারে হাত চালাচ্ছিল আর অমৃতা, আকাশ নিজেদের সেলফোনের পর্দায় ডুবে ছিল। কারো মন ভালো নেই। মন ভালো করার প্রচেষ্টাও নেই। মনে হচ্ছে আরও কিছুক্ষণ এভাবেই কাটবে তারপর প্রকৃতির নিয়ম রক্ষার্থে যথাসময়ে সব স্থিরতা আবার ফিরে আসবে। এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। বৃষ্টি তখন ধরে গেছে। তবে ঝড়ো বাতাসটা চড়ে বেড়াচ্ছে সদর্পে। সেই মুহূর্তে, ঝিম ধরা ওই মন খারাপের রাতটায় হঠাৎ একটি আনন্দের ঘটনা ঘটল। লি আকাশের সাথে দেখা করতে আসল সম্পূর্ণ বিনা নোটিশে। খুব কাছেই ওদের রিসোর্ট। হাঁটতে হাঁটতে সে একাই চলে এসেছে এদিকটায়। আকাশ সকালেই বিভার বাড়ির ঠিকানা ওকে দিয়ে ফেলেছিল। 

স্বাভাবিক একটা সময় হলে আকাশ যতটা খুশি হত আজ ঠিক ততটা খুশি হতে পারলনা। তবে অখুশিও হল না। লি উঠোনে প্রবেশ করতেই তিন বন্ধুর মাঝে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। আকাশ চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘কী মামা বলছিলাম না? জাদু চাল গ্যায়া? থাক তোরা আমি একটু ওয়াক করে আসি নয়া বান্ধবীর সাথে।’ 

 আকাশ চলে যাবার পর রুদ্র বলল, 

—‘চাইনিজ মাইয়া তো পইটা গ্যাছে মনে হয়!’ 

অমৃতা মুখ বাঁকালো, ‘এসব আজাইরা, আকাশ একেবারেই সিরিয়াস না।’

—‘সিরিয়াস হতে কতক্ষণ?’ 

—‘হলে তো ভালই।’ 

—‘চাইনিজ মেয়ের সাথে সিরিয়াস হলে ভালো? কী বলতেছিস তুই এসব? সামি আর বিভারে দেইখে শিক্ষা হয়নায়? বিভা তো বাংলাদেশি ছিল তাতেই বিয়া হইল না।’ 

—‘তুই একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছিস আকাশের কোনো পিছুটান নাই। ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান যাকে ইচ্ছা বিয়ে করতে পারে।’ 

রুদ্র একটু গুম হয়ে উত্তর দিল, ‘এভাবে অবশ্য চিন্তা করিনি!’ 

ফোনের পর্দায় চোখ বুলাতে গিয়ে খবরটায় হঠাৎ চোখ আটকে গেল অমৃতার। একটা অনলাইন পত্রিকায় সামির আব্বা সম্পর্কে খবর ছাপা হয়েছে। শিরোনাম হল এমপি রাশেদুল হকের নিজ পুত্রের সাথে বিরোধ 1 এটাও একটা খবর হতে পারে? সাংবাদিকগুলোর কি খেয়ে দেয়ে সত্যি আর কাজ নেই? খবরটার ঠিক পাশে হকের একটি ছবি দেয়া আছে। রোদে পোড়া বাদামি চেহারা, লম্বাটে মুখ, শক্ত চোয়াল আর গভীর দুটি চোখ। এতকাল অমৃতার মনে হত চোয়ালের কঠোর ভাবটা বুঝি লোকটার চেহারায় একটি চৌকস পাকা রাজনীতিবিদের ভাব এনে দিয়েছে। কিন্তু আজ এই কঠোরতা টুকুকে ব্যক্তিত্ব বলে মনে হল এবং সেই সাথে একটি অপ্রাসঙ্গিক ভাবনা বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে গেল মস্তিষ্কে, অতি অল্প সময়ের জন্য। লোকটা বোধহয় ঠিক ততটাও খারাপ না, যতটা অমৃতা ভেবেছিল! 

লাল মাটির রাস্তাটা ধরে লি এর পাশে অন্ধকারে হাঁটছিল আকাশ। ঝাপটা বাতাসে বুনো ফুল আর ভেজা মাটির ঘ্রাণ ভাসছে। বুক ভরে সেই সুঘ্রাণ টেনে নিলে মনটা একদম বিশুদ্ধতায় ছেয়ে যায়। লি অনেক প্রশ্ন করছে। আকাশের বাবা মা, পরিবার, পড়াশোনা সব কিছু সম্পর্কে যেন আজ একদিনেই তার জেনে যাওয়া চাই। সবচেয়ে বেশি কৌতূহল তার বাংলাদেশ নিয়ে। সে কাজ করে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়। ভারত এসেছে তারা ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করার ইচ্ছে আছে বলে জানাল সে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটি অন্যরকম দৃশ্যে। সামনের অন্ধকার কুয়াশাচ্ছন্ন পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল দেহী হাতি। ওদেরকে দেখা মাত্র শুঁড় তুলে বিকট আওয়াজ করে ডেকে উঠল হাতি মহাশয়। আকাশ একটু ভয় খেল। থমকে দাঁড়ালো আচমকা। লি বলল, ‘আজকে দিনের বেলা এত চাইছিলাম একটা হাতির দেখা পেতে কিন্তু পেলামই না, এখন এই রাতের বেলা হাতির ছবি তুলব কী করে?’ এই কথা শুনে আকাশ ব্যাক্কল বনে গেল একদম। বিরক্তও হল বেশ মনে মনে। দৈত্য দেহী হাতি দেখে সে কিনা ভয় পেয়ে কোন দিকে দৌড় দেবে সেই চিন্তায় মারা যাচ্ছে আর এই মেয়ে পড়েছে ছবি তোলা নিয়ে। কী হবে হাতিটা যদি এখন পা দিয়ে তাদের পিষে ফেলে? সেই সময় উল্টো দিকের জঙ্গলের ঝোপ ঝাড় ডিঙিয়ে এলোমেলো পায়ে সামিকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। জঙ্গল পার হয়ে মাটির রাস্তায় উঠতেই সে হাতিটির মুখোমুখি পড়ে গেল। 

আকাশ গগন বিদারী এক চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ‘দোস্ত পালা! হাতি ইইইইইই!’ 

রাত গভীরের নিশ্ছিদ্র নীরবতায় সেই চিৎকার দিকে দিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল যেন। সামি হাতি দেখে নয়, বরং আকাশের চ্যাঁচামেচি শুনেই ভয় পেয়ে গেল। শুরু করল দৌড়। 

লি অবাক গলায় আকাশকে বলল, ‘তুমি কি ভয় পেয়েছ?’ 

আকাশ তখন আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিচ্ছিল। হাতিটা কিছুক্ষণের মধ্যে সরে পড়ল সামনে থেকে। আকাশ হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘ভয় পাবোনা? কী বিশাল জায়ান্ট সাইজের হাতি মাই গড!’ 

সামি আকাশের সাথে কোনো বাক্য বিনিময় না করেই ওদেরকে পাশ কাটিয়ে, হেঁটে ডাক বাংলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। 

আকাশ পেছন থেকে ডাকল ওকে, ‘ওই ছ্যাড়া, শুইনা যা।’ 

সামি তাৎক্ষণিক ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে আঙুল তাক করে কঠোর ভাবে বলল, ‘আমার সাথে কথা বলার ট্রাই করিস না ভুলেও, আজকে তুই অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলছস শালা। গার্লফ্রেন্ডের সাথে আছস বইলা ছাইড়া দিলাম নইলে মাইরা মাটির সাথে পিষা ফেলতাম হারামজাদা!’ 

আকাশ ‘দোস্ত লিসেন’ বলে এগিয়ে এসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। সামি চিৎকার করে থামিয়ে দিল, ‘ফাক অফ!’ 

বোঝা যাচ্ছে সামি ভালোই কষ্ট পেয়েছে। বিপদের সময় আকাশকে সে পাশে চেয়েছিল। আকাশ ওর পাশে না থেকে, সঙ্গ না দিয়ে উল্টো রাগের মাথায় ত্যাড়া কথা বলে ফেলেছিল এ কথা সত্য। কিন্তু বলার পর থেকেই তার ভেতরে একটি অপরাধ বোধ কাজ করছে, খারাপ লাগছে। 

লি বলল, ‘ও তোমার গার্লফ্রেন্ডের কথা কী বলল? তোমার কি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?’ 

আকাশ লাজুক গলায় বলল, ‘না আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।’

.

উপত্যকার গভীর জঙ্গলে একটি অচেনা রাতচরা পাখি ডাকছিল থেকে থেকে আর বৃষ্টি ছোঁয়া জেলো বাতাসটায় উড়ে বেড়াচ্ছিল মহুয়ার খুশবু। পাখিটির গলার স্বর ভারী সুন্দর। অমৃতা এই পাখির ডাক এর আগে কোনো দিন শোনেনি। আজকেই প্রথম! সামি ফিরল শুকনো মুখ আর আলতা পরা লাল চোখ নিয়ে। অমৃতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেই সদর দরজা দিয়ে সামিকে ঢুকতে দেখল। বেচারার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। হৃদি আর বিভার কথা চিন্তা করেও কষ্ট হচ্ছে। এভাবে রাগ করে যার যার মতো চুপচাপ গুম হয়ে থাকার চাইতে পরস্পরের সাথে খোলা মেলা কথা বলে সমস্যার সমাধান করে ফেলাটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ হত না? মিছিমিছি নিজেদের এমন কষ্ট দেবার কোনো মানে হয়? হক ঠিকই বলেছিলেন, তার বন্ধু গুলো একেকটা রামগাধা। সেলফোনটা বেজে উঠলো ঠিক তখনই, যখন ওই নামটা মনে এলো! 

অমৃতার হ্যালো বলা শুনে ভরাট কণ্ঠটা কোন ভূমিকা ছাড়াই বলে উঠল,’তোমার কি মন খারাপ নাকি?’ 

—‘কী করে বুঝলেন?’ 

—‘বোঝা যায়।’ 

মহুয়ার ঘ্রাণ ওয়ালা হাওয়ায় ডুবে বড় একটা নিশ্বাস নিল অমৃতা। বললো, ‘একটু খারাপ।’ 

হক সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললেন না। একটু সময় চুপ করে রইলেন। আজকে মেয়েটির গলায় সেই স্পর্ধিত, দৃপ্ত ভাবটি অনুপস্থিত বরং একটু যেন নরম, কোমল আর স্নিগ্ধ! ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা সমীচীন নয় বলে তিনি একটু ঘুরিয়ে প্রশ্নটা করলেন, 

—‘সব কিছু ঠিক আছে?’ 

—‘চলছে।’ 

—‘আমার ছেলে কেমন আছে?’ 

অমৃতা মিথ্যা বললো, ‘ভালো আছে।’ 

—‘কী করছে?’ 

—‘এ মুহূর্তে কী করছে আমি বলতে পারছিনা।’ 

—‘খাওয়া দাওয়া করেছে?’ 

সামি যে কিছুই খায়নি রাতে অমৃতা তা জানে। সন্তান অভুক্ত অবস্থায় আছে এটা জানার পর বাবা মায়ের ঠিক কী রকম লাগে, সেই অনুভূতি অমৃতা পুরোপুরি ভাবে না জানলেও কিছুটা অন্তত আঁচ করতে পারে। সামির ব্যাপারে আজকে কোন সঠিক তথ্য দিতে পারবেনা সে এই মানুষটাকে। সামি যে আপাতত ভালো নেই এই সত্যটা তার পিতা না জানলেও পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবেনা। সব কথা সবাইকে জানতে হয়না। বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের কিছু ব্যক্তিগত তথ্য বাবা মায়ের অজানা থাকাই বোধ হয় মাঝে মাঝে শ্রেয়। 

অমৃতা বললো, ‘হুম খেয়েছে।’ 

—‘আজকে কী খেয়েছে?’ 

—‘ইশ, আপনি এত বেশি প্রশ্ন করেন কেন?’ 

—‘তোমরা ঢাকা ফিরছ কবে?’

—‘দু তিন দিনের মধ্যেই। 

—‘সামি কি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে?’ 

—‘এখনো দেয় নি, তবে শীঘ্রই দেবে হয়তো।’ 

—‘তুমি কি জানো ও এই চাকরিটা করে ঠিক কত টাকা বেতন পেতো?’ 

—‘তিরিশ হাজার। 

—‘তিরিশ হাজার? ওর মা’ তো বলেছিল পঁচিশ।’ 

—‘স্টার্টিং এ পঁচিশ ছিল। পরে তিরিশ করা হয়েছে।’

—‘ও কোন সাবজেক্টের ক্লাস নিত?’ 

—‘ইকনোমিক্স।’ 

—‘কোন ক্লাস?’ 

অমৃতা হতাশ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘ক্লাস টেন।’ 

উত্তরটা দিয়ে বিরক্তিতে চুপ করে থাকল সে খানিকক্ষণ। তারপর স্বভাবসুলভ উকিল উকিল কঠিন কণ্ঠটা নিজের মধ্যে ফিরিয়ে এনে বললো, ‘মিস্টার হক, আপনার ইন্টারভিউ কি শেষ হয়েছে? নাকি আরো চলবে?’ 

—‘শেষ হয়নি। আরেকটা প্রশ্ন আছে।’ 

—‘শেষ করুন তাড়াতাড়ি। ইন্টারভিউ দিতে আমার ভালো লাগছেনা।’

—‘আচ্ছা শেষ করছি। শেষ প্রশ্ন টা হল, তুমি কেমন আছ?’ 

অমৃতা থমকালো। সে কেমন আছে? এক মুহূর্তের জন্য মনে হল যেন এটা পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর তার জানা নেই। তবে একটা ব্যাপার সে খুব ভাল মতোই জানে যে বন্ধুরা ভালো না থাকলে, তার নিজেরও ভালো থাকার আর কোন উপায় অবশিষ্ট থাকেনা। হৃদি, বিভা, সামি এরা কেউ ভালো নেই আজ রাতে। রুদ্র, আকাশেরও মন খারাপ। বন্ধুদের এমন দুঃসময়ে অমৃতা কী করে ভালো থাকবে? কিন্তু কেন যেন মনে হল, এই মহুর্তে তার এমন একটি প্রশ্নের ভীষণ প্রয়োজন ছিল! এতক্ষণ ধরে বুকের ভেতরে একটা অব্যক্ত চাপা আকাঙ্খা গুমরে গুমরে উঠছিল যেন। মনে হচ্ছিল কেউ একজন এই নিশ্ছিদ্র নীরব রাতের আরণ্যক গভীরতার মতোই, মনের গভীরতর স্তর থেকে গভীর ভাবে প্রশ্ন করুক, কিংবা জানবার ইচ্ছে ব্যক্ত করুক, যে অমৃতা কেমন আছে! 

—‘আপনি হঠাৎ আমার কথা জানতে চাইছেন?’ এবারে অন্যরকম শোনায় অমৃতার গলা। একটু অভিমানী, রাগী আর ছেলেমানুষি! 

—‘কেন? তোমার কথা জানতে চাওয়া কি বারণ?’ 

—‘আমার ভালো থাকা না থাকায় আপনার কী এসে যায়? আপনার ছেলে ভালো থাকলেই তো হল!’ 

—‘পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ভালো থাকার অধিকার আছে। আর তুমি বাচ্চা একটা মানুষ। বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকবে কেন? এটা তো ঠিক না।’ 

—‘আমি মোটেও বাচ্চা মানুষ না! আর কখনও আমাকে বাচ্চা বলবেন না। খুব রাগ হয়!’ 

কথাটা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলেন হক। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আচ্ছা শোন, আমার একটা ইম্পরট্যান্ট কল এসেছে। ফোন রাখছি।’ 

লাইন কেটে গেল। অমৃতার দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী চামড়ায় বিরক্তিসূচক ভাঁজ পড়ল একটা। মনে হচ্ছে অসমাপ্ত কনভারসেশনটা অনেক ক্ষণ ধরে বুকের মধ্যে কাঁটার মতো লেগে থাকবে খচখচ করে। লোকটা পেয়েছে কী? ইচ্ছে হলে ফোন করবে আবার ইচ্ছে হলে ফোন রেখে দেবে। ভাবটা এমন যে গোটা দুনিয়ার সব মানুষ তার কেনা গোলাম। অমৃতার মতামতের যেন কোন দাম নেই! রাগ লাগতে লাগল ভীষণ। ইচ্ছে হল এখুনি ফোন করে বলে, লিসেন মিস্টার হক, ফোন আমি করেছি, ফোনের লাইনও কাটব আমি। আপনি খবরদার লাইন কাটবেন না। যতক্ষণ আমি কথা বলব চুপ করে আমার কথা শুনবেন। যত ইম্পরট্যান্ট কলই আসুক না কেন আমার ফোনের লাইন আপনি কাটতে পারবেন না। মনে থাকবে? 

বিভা হঠাৎ তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঁচু গলায় বলল, ‘এই, তোরা কোথায় সব? এদিকে আয় আমার একটা কথা আছে।’ 

আকাশ বাদে বাকি সবাই মিনিট দুয়েকের মধ্যে হাজির হল ওর সামনে। আকাশ তখনও ফেরেনি। 

বিভা সামির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘সামি শোন, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিছি।’ 

বন্ধুরা সব নিমেষহারা চোখে চেয়ে ছিল বিভার দিকে। বিভাকে দেখাচ্ছে খ্যাপাটে পাগলের মত। তার চুল আলুথালু। ডাগর দুটি টানা চোখের নিচে কান্নার গাঢ় দাগ। মুখে একটি প্রলয়ংকরী ঝড়ের পূর্বাভাস। 

রুদ্র চেঁচিয়ে উঠে বললো, ‘কী সিদ্ধান্ত?’ 

বিভা তার কম্পিত অস্থির দৃষ্টিটা নিবদ্ধ করল সামির মুখের ওপর বড় একটা শ্বাস নিল। তারপর থেমে থেমে বলল, ‘সামি, আই এম ব্রেকিং আপ উইথ ইউ।’ 

সামির মুখখানা চকিতে রক্তশূন্য হয়ে গেল। চোখ হয়ে উঠল বিস্ফোরিত। মুহূর্তের জন্য থেমে গেল হৃদপিণ্ডের ধুকপুক। 

—‘তুই এসব কী বলছিস?’ চাপা আর্তনাদ করে উঠলো হৃদিতা। 

ব্রেকআপের কথাটা বলে ফেলার পর বিভাকে অনেকটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সে দৃঢ় গলায় বললো, ‘ঠিকই বলছি। সিদ্ধান্তটা যথেষ্ট ভেবে চিন্তেই নিয়েছি।’ 

প্রাথমিক ধাক্কাটা সামির মুখ থেকে বাকশক্তি কেঁড়ে নিয়েছিল। পাক্কা তিন চার মিনিট সে কোনো কথা পারলনা। ধীরে ধীরে বুকের ভেতরের ভাংচুরের ছায়াটা তার চেহারায় স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হল। মুখ হয়ে উঠলো রক্তিম। কপালের নীল রগ দপদপ করে ফুলে উঠে স্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠল ফর্সা চামড়ার ওপর। দাঁতে দাঁত চেপে রক্ত জল করা শীতল গলায় বললো, ‘কী বললি তুই?’ 

সামির ওই অত্যধিক ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বর বিভাকে একটু কাঁপাল ভেতরে ভেতরে। সে মৃদু ভাবে বললো,’তোর সাথে ব্রেকআপ করছি।’ 

এবার সামি পাগলের মতো বিকট চিৎকারে ফেটে পড়ল, ‘ফাইজলামি করিস তুই আমার সাথে?’ 

চিৎকারটা বিভাকে এক লোমহর্ষক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিল। দূর্গা দৌড়ে এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গেছে। তার চোখেমুখে এখন ছায়াছবি দেখার আনন্দ। আর এদিকে সামি বেহেড। তার বাহ্য জ্ঞান পুরোপুরি ভাবে লোপ পেয়েছে। দূর্গার সামনে এবার থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে। বিভারই ভুল। এভাবে সবার সামনে কথাটা বলে ফেলা তার একেবারেই উচিৎ হয়নি। 

বিভাকে চুপ থাকতে দেখে সামি আরো একবার হুঙ্কার ছাড়ল, ‘কথা বলিস না কেন?’ 

ঠিক সেই সময় ভেতর থেকে অভিজিৎ বেরিয়ে আসল। তার পরনে এখনো অফিসের প্যান্ট শার্ট। ভ্রু দুটি কুঁচকে আছে। মুখ গম্ভীর। সে দাঁড়িয়ে থাকা দলটার মাঝখানে এসে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘কী হচ্ছে এখানে?’ 

অভিজিৎ কে দেখে অমৃতা আর রুদ্র চোখ নামাল নিচে। লোকটার সামনে তারা লজ্জিত, কুণ্ঠিত এবং অপদস্থ বোধ করছে এই মুহূর্তে। হৃদির হাত পায়ে শিনশিনে একটা অনুভূতি হচ্ছিলো। তাকে ভীষণ রকম অপরাধবোধে পেয়ে বসেছে। মনে হচ্ছে এই সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী সে নিজে। সামি অন্য কোনো দিকে তাকালো না। বিভার দিকে যেমন রক্তিম চোখে চেয়ে ছিল ঠিক তেমন ভাবে চেয়ে থেকেই পুনরায় গর্জন করে বলে উঠল, খেলা পাইছিস তুই? খেলা লাগে জীবনটা?’

অভিজিৎ এবার অত্যন্ত কঠিন গলায় বিভাকে বলল, ‘বিভা, আপনি ভেতরে যান।’ 

বিভা সচকিত ভাবে একবার তাকাল অভিজিতের দিকে। খুব নার্ভাস হয়ে গেছে সে। সারা শরীর কাঁপছে উদ্বেগ আর উত্তেজনায়। অভিজিতের কথাটা সে ঠিকমতো বুঝি অনুধাবন করতে পারল না। বোকার মতো তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। অভিজিৎ আবারও শক্ত ভাবে বলল, ‘তাকিয়ে দেখছেন কী? বললাম তো ভেতরে যান!’ 

বিভা এবার বাধ্য মেয়ের মতো জায়গাটা থেকে সরে গেল। অভিজিৎ সামির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন, আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আপনি আমার স্ত্রীর সাথে এধরণের অফেন্সিভ আচরণ করবেন আর তা আমি মুখ বুজে সহ্য করব, এমনটা ভাবলে খুব বড় ভুল করবেন।’ 

সামি তীব্র চোখে তাকাল অভিজিতের দিকে। তার দুটি চোখ আলতা রঙে রাঙা। দেখা মাত্র বুক আঁতকে ওঠে। মনে হয় তাকে বুঝি বুদ্ধিবৈকল্যে পেয়েছে। এখুনি কিছু একটা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে। অভিজিৎ সামির ওই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি দেখে একটু থমকালো। অমৃতাকে বললো, ‘শুনুন, আপনাদের বন্ধুকে সামলান, উনার মনে হচ্ছে মাথার ঠিক নেই আজ।’ 

অমৃতা একটু অপ্রস্তুত ভাবে বললো, ‘আপনি ভেতরে যান। আমরা দেখছি ওকে।’ 

অভিজিৎ জায়গাটা থেকে সরে যাবার পর সামি বন্ধুদের দিকে হাতের আঙুল তুলে শাসানোর গলায় বললো, ‘তোরা কি দেখছিস ও আমাকে সেকেন্ড টাইম ঠকাইল? এর আগে কথা দিছিল যে ও আমাকে বিয়া করবে।’ 

রুদ্র মাঝখান থেকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘ও তোকে কখনোই বিয়ে করবে বলে কথা দেয় নাই সামি!’ 

সামির গলার জোর আরো বেড়ে যায়, পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে বলে, ‘আরে তুই কী জানিস? ও বলছিল সারা জীবন আমার সাথে থাকবে। এরপর ও আমাকে কিছু না জানায়া অভিজিৎকে বিয়া করছে। গত তিন চারমাস ধইরা বলছে যে অভিজিৎরে ডিভোর্স দিয়া আমার সাথে সেটেল হবে। নাও সাডেনলি শী ওয়ান্টস আ ব্রেকআপ। আমি জানতে চাই এসবের মানেটা কী?’ 

.

রুদ্র অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললো, ‘থাম তো মামা! কী এক ক্যাচাল লাগায় থুইসস। মাইয়াটার বিয়া হয়ে গেছে। এখন তো তুই এইসব আজাইরা স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর। ছাইড়া দে না রে বাপ। আল্লাহর ওয়াস্তে ছাইড়া দে। একটু শান্তিতে থাকতে দে ওরে।’ 

সামির চোখ দুটো এই পর্যায়ে হঠাৎ একটু জলসিক্ত হয়ে উঠলো। সে একটা ঢোঁক গিলে বললো, ‘ওকে ফাইন। তোরা সবাই আমাকেই ভুল বুঝতেছিস। গ্রেট। একটা লাস্ট কথা বলি শোন। বিভাকে বলিস আমি ওর সাথে আর নাই। আর বিয়া কি শুধু ও একাই করতে পারে? আমি করতে পারিনা? দাঁড়া আমিও বিয়া করব। এক মাসের মধ্যেই বিয়া করব আমি।’ 

কথাটা বলা শেষ করেই সে পকেট থেকে ফোন বের করে নিয়ে তার মায়ের নম্বরে ডায়াল করল। 

—‘হ্যালো মা, তোমরা আমার জন্য মেয়ে দেখতেছো বললা না? হ্যাঁ দেখো। আমি বিয়ে করব।’ 

একটু সময় চুপ থেকে সে ওপাশের কথা শুনল। এরপর আবার তারস্বরে বললো, ‘আরে সুন্দর হোক, পেত্নী হোক, শিক্ষিত, কুখ্যাত যা খুশি হোক। আমি বিয়ে করব এটাই ফাইনাল।’ 

ফোন রাখার পর একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে সে বন্ধুদের দিকে তাকালো, ‘এবার ঠিক আছে সব? তোমাদের বান্ধবীকে জানায় দিও খবরটা।’ একটু থেমে সে আবার বললো, ‘আমি এখানে আর একটা মুহূর্তও থাকবো না। সবাই রেডি হ, আমরা কালকে সকালেই লিভ করবো।’ 

.

বিভা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। অভিজিৎ একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা অবলোকন করছে অনেকক্ষণ ধরে। একটা সময় সে অধৈর্য গলায় বললো, ‘এসব আর কতক্ষণ চলবে?’ 

বিভা বালিশ থেকে মুখ তুলে বললো, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না কেন আজকে আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে!’ 

অভিজিৎ হাহাকার করে বলে উঠল, ‘হায় ভগবান! ব্রেকআপ তো মানুষেরই হয়। আপনি তো টিনএজ মেয়ে নন যে এরকম মরা কান্না করতে হবে ব্রেকআপের জন্য।’ 

—‘আপনি বুঝবেন না। আপনি কখনো কারুকে ভালোবাসেননি তো, তাই আপনি কখনই বুঝবেন না আমার কষ্ট।’

অভিজিৎ বিভার শেষ কথাটি শুনে গভীর চোখে তাকাল ওর দিকে। তারপর তার চেয়েও গভীরতর গলায় বলল, ‘সবার ভালোবাসা একরকম হয়না।’ 

—‘আপনার কি আমাকে খুব ঘেন্না হচ্ছে?’ হঠাৎ কেমন অন্য গলায় প্রশ্ন করল বিভা। 

—‘ঘেন্না হবে কেন?’

—‘এইযে, আপনার বাড়িতে কী একটা বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি হল আমার জন্য। সব তো আমারই দোষ। আপনার উচিৎ আমাকে ঘেন্না করা। আমি ভীষণ খারাপ একটা মেয়ে।’ 

অভিজিৎ ম্লান হাসলো, ‘আপনাকে আমি চাইলেও ঘেন্না করতে পারবনা বিভা!’ 

বিভা বড় বড় দুটি কান্না ভেজা চোখ মেলে ধরে অবাক হয়ে চায় অভিজিতের দিকে, ‘কেন?’ 

অভিজিৎ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। ক্ষীণ গলায় বলে, ‘কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখ ফুটে বলতে নেই। মন দিয়ে বুঝতে হয়। 

দরজায় কেউ একজন করা নাড়ছিল। অভিজিৎ এগিয়ে গিয়ে খুলল দরজার পাল্লাটা। হৃদি দাঁড়িয়ে আছে ফোলা চোখে। অভিজিৎকে দেখে সবিনয়ে বললো, ‘বিভাকে একটু ডাকবেন দুলাভাই? আমার কথা ছিল।’ 

অভিজিতের কিছু বলতে হলোনা। বিভা নিজেই শুনতে পেয়ে উঠে আসল। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দুচোখ ডলে কান্নার রেখা মুছতে মুছতে সে বললো, ‘আসছি, চল।’ 

দুই বান্ধবী পাশের ঘরটায় এসে দোর আটকালো। হৃদি একটু আড়ষ্ট ভাবে ইশারায় বিছানাটা দেখিয়ে দিয়ে বিভাকে বলল, ‘বস ওখানে। তোর সাথে কথা আছে।’ 

বিভা বিছানার ওপর পা তুলে বসলো। খোলা অবিন্যস্ত চুলগুলো দুহাত দিয়ে আগলে নিয়ে হাত খোঁপা বাঁধল সময় নিয়ে। এই খোঁপা বাঁধার বিস্তর সময়টুকুতে সে হৃদিকে খুব ভালো করে দেখে নিল। ওর শ্যামবর্ণ মুখখানায় সর্বদাই একটা মন কেমন করা ভালো লাগা ভর করে থাকে। কলেজ ইউনিভার্সিটি তে ওকে সবাই কাজল বলে ডাকত। ঠিক কাজলের মতোই লম্বা ছাঁচে ঢালা মুখ, জোড়া ভ্রু আর চোখের চাউনিতে বড্ড মায়া! এই মায়াবতী মেয়েটি যে বিভার কতটা কাছের, কতটা আপন আর কতটা প্ৰিয় তা এক বিভা আর তার ভগবান ছাড়া আর কেউ জানেনা। হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত নাম না জানা অনুভূতি ঝনঝন করে ব্যথার মত বেজে ওঠে। এই মেয়েটির ঠোঁট ছুঁয়ে গেছে তার জীবনের প্রথম প্রেম! এই মেয়েটি তার আত্মার অংশ আর সেই ছেলেটি তার আজন্ম সাধন ধন একমাত্র ভালোবাসার মানুষ! এই দুইয়ের মধ্যে বিভাকে যদি কখনও যে কোন একটিকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে সে কোনটি বেছে নেবে? ভালোবাসা? নাকি বন্ধুত্ব? 

হৃদি অনেকক্ষণ অবধি লজ্জা আর সংকোচে জাড় হয়ে ছিল। শেষ পর্যন্ত সে সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বিভার পাশে এসে বসলো। 

বললো, ‘হঠাৎ তুই এরকম সিদ্ধান্ত নিলি কেন?’ 

বিভা ঠাণ্ডা চোখে চাইল হৃদির দিকে। কিছু একটা খুঁজল ওর মুখে। তারপর থমথমে গলায় বলল, ‘তুই কবে থেকে ওকে ভালোবাসিস?’ 

প্রশ্নটা শোনা মাত্র হৃদির মুখখানা একেবারে পান্ডুর বর্ণ হয়ে গেল। চোখের পলক নেই। মুখেও কোন কথা নেই। থম ধরা চোখে শুধু তাকিয়ে রইল বিভার দিকে। পাক্কা দেড় মিনিট পর সে ধীরে ধীরে মুখটা নামিয়ে নিল নিচে। ক্ষীণ গলায় বলল, ‘এসব কী বলছিস?’ 

—‘তুই কি ভাবছিস আমি কিছু টের পাইনাই? তোকে আমি হাড্ডিতে হাড্ডিতে চিনি।’ 

হৃদির ভীষণ লজ্জা! বিভার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই। মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে কোন রকমে বলল, ‘কী বলতেছিস কিছুই বুঝতেছিনা।’ 

—‘আমার সাথে মিথ্যা কথা বলিস না হৃদি!’ 

হৃদির চোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল, ‘দোস্ত শোন। সামি তোকে ভালোবাসে। এর আগে তুই যখন ওকে ছেড়ে দিয়ে অভিজিৎকে বিয়ে করলি তখন ও একদম ভেঙে পড়ছিল। এবার আর ও সইতে পারবেনা। প্লিজ তুই ওর সাথে এরকম করিস না।’ 

বিভা অদ্ভুত হাসে। একটু শ্লেষ জড়ানো গলায় বলে, ‘তুই ওর পাশে থাকলেই হবে। তুই পাশে থাকলে সব কিছু সইতে পারবে ও।’ 

হৃদি এবার কঠিন হবার চেষ্টা করল, ‘বিভা আজেবাজে বকিস না। আমি ওর বন্ধু। বন্ধু হিসেবে সবসময়ই পাশে আছি। এর চেয়ে বেশি কিছু কখনোই সম্ভব না আমাদের মধ্যে।’ 

—‘কেন সম্ভব না?’ 

—‘কারণ সামি তোকে ভালোবাসে, আমাকে না।’ 

—‘আর তুই যে ওকে ভালোবাসিস? সেটার কী হবে হৃদি?’ 

—‘এসব মিথ্যা কথা। আমি মোটেও ওকে ভালোবাসিনা। বন্ধু হিসেবে বাসি তবে ওটা মোটেও রোমান্টিক লাভ না।’ 

—‘একটা ব্যাপার কী জানিস? সামির মধ্যেও কিছু পরিবর্তন এসে গেছে। আমি টের পাই।’ 

হৃদির বুকটা দুরুদুরু করে উঠল। ভয় ডোবা গলায় বললো, ‘কী টের পেয়েছিস তুই?’ 

—‘গত আট ন’ মাস তোরা খুব কাছাকাছি ছিলি, তাইনারে?’ 

হৃদি চুপ করে থাকে। 

—‘শোন। আমাকে ছাড়া বেঁচে থাকার মোটামুটি অভ্যাস হয়ে গেছে সামির। মানুষ অভ্যাসের চিরকালের বাঁধা দাস। অভ্যাসের চেয়ে বড় সত্য আর কিছুই নাই। আমাকে ছাড়া সামি থাকতে পারবে, কিন্তু তোকে ছাড়া থাকতে পারবেনা।’ 

—‘তোর সব ফাউল কথা বার্তা।’ 

—‘এটাই সত্য। তুই ওকে যেভাবে সময় দিয়েছিস, সাপোর্ট দিয়েছিস আমি কোনো দিন ওকে এত কনস্ট্যান্ট ভাবে সঙ্গ দিতে পারিনাই।’ 

হৃদি আর কিছু বলতে পারলনা। তার কেমন পাগল পাগল লাগছে। হৃৎপিণ্ডের জমিনের ওপর একটা নচ্ছার ঘোড়া সেই তখন থেকে খুরের আঘাত হানছে ক্রমাগত। 

—‘আমি যখন ঘটনাটা শুনেছি তখন প্রচন্ড কষ্ট হয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু পরমুহূর্তেই যখন মনে হল, যে মেয়েটাকে সামি চুমু খেয়েছে সে মেয়েটা অন্য কেউ না, তুই! তখন আস্তে আস্তে কষ্টটা ঝাপসা হয়ে আসল।’ 

একটু থামল বিভা, তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘তোর জন্য তো জান দিয়ে দিতে পারব দোস্ত! সামি তো কোন ছাড়।’ 

—‘তুই আমাকে এত ভালোবাসিস কেন?’ 

—‘এই প্রশ্নের কোন উত্তর হয়না।’ 

বলে বিভা একটু এগিয়ে আসল হৃদির কাছে। ওর দুটি হাত ধরে গভীর গলায় বলল, ‘তোকেই দিলাম ওকে। তুই সামলায় রাখিস কিন্তু! 

—‘সামি বলছে যেদিন সে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে, সেদিন নিজের কান কেটে ফেলবে। 

এই কথা শুনে বিভা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। বিভার হাসি দেখে খানিক বাদে হেসে ফেলল হৃদিও। ভারী অদ্ভুত একটা দৃশ্যের দৃশ্যায়ন হল সেই মুহূর্তে ওই ছোট্ট চতুষ্কোণ টিউবলাইট জ্বলা ঘরটায়। দুটি যুবতী একত্রে একইরকম সুরে ঘর কাঁপানো হাসি হাসছে অথচ দুজনেরই চোখ ভেজা। তাদের গালে চিকচিক করছে অশ্রুর দাগ। 

.

অমৃতা মনে মনে একটা ফোনের অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সেই ফোনটা সর্বদাই বড় অসময়ে আসে। আজ রাতেও এমন একটা মুহূর্তে আসল যখন অমৃতা বন্ধুদের সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেছে। উঠোনে জড়ো হয়েছে ওরা চারজন। রুদ্র, সামি, অমৃতা আর আকাশ। সামি বিয়ে করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। তার ধারণা একমাত্র এই একটি উপায়েই বিভাকে যথাযথ শিক্ষা দেয়া যাবে। বিভার নাকি একটা শিক্ষা পাওয়া অতিশয় জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশ সবে মাত্র ফিরেছে তখন। ঘটনা শুনে সে ব্যাক্কল বনে গেছে। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছেনা। সেই রকম একটা টান টান সময়ে ফোনটা আসল। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটু চোর চোর গলায় অমৃতা বন্ধুদের বলল, ‘মা ফোন দিছে। আসতেছি আমি।’ বাড়িতে ঢুকে ফোন নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল সে। 

ফোন ধরেই মুখ ঝামড়ে উঠে বললো,-’আপনি পেয়েছেন কী?’ 

—‘আমি আবার কী করলাম?’ 

—‘যখন ইচ্ছে ফোন করবেন আবার নিজের ইচ্ছে মতো ফোন রেখেও দেবেন। আমার তো কোনো সে নাই, এজ ইফ আমি অলওয়েজ আপনার ফোন ধরতে বাধ্য! যখন তখন, যা ইচ্ছা।’ 

হক একটু থতমত খেয়ে গেলেন অমৃতার ধমক শুনে। এমন উঁচু গলায় কথা বলবার মতো মানুষ আজকাল তার আশেপাশে একেবারে নেই বললেই চলে। এমন কি নিজ স্ত্রী পুত্রও তার সাথে এই স্বরে কথা বলেনি কোনো দিন। রোমেলার সাথে তার সম্পর্ক অনেকটা শান্ত, স্থির, মন্থর নদীর মতো। রাগ, ভালোবাসা, অভিমান এর কোন কিছুরই বাড়াবাড়ি বা আধিক্য নেই সেখানে। সামিটা বাউন্ডুলে এ কথা সত্য, কিন্তু একটি মূল্যবান শিক্ষা অন্তত তিনি ছেলেকে দিতে পেরেছেন যে, বড়দের সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে নেই। গুরুজনের সাথে কথা বলতে হয় চোখ নামিয়ে, নমনীয় ভাবে। এই মেয়েটিকে তার বাবা মা বোধহয় কিছুই শেখায়নি। হক তার চেয়ে বয়সে বড় শুধু এটাই নয়, তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের গুটি কয়েক অতিশয় ধনী এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের একজন। সমাজের প্রতিপত্তিশীল, যশস্বী লোকজনের সাথে যে সর্বদা নরম এবং তৈলাক্ত স্বরে কথা বলতে হয় এই অলিখিত নিয়মটুকু কি মেয়েটির জানা নেই? তবে চিন্তা সমুদ্রে ঝড় উঠলেও হক ঠিক রাগ করে উঠতে পারলেন না অমৃতার সাথে। মেয়েটির প্রতি এখন আর তার রাগ হয়না বরং এক ধরণের বিস্ময় বোধ হয়। এ বয়সী ছেলেমেয়ে দের সাথে তার মেলামেশা নেই বললেই চলে। নিজের ছেলেটার সাথে এক অপরিমেয় দূরত্ব রচনা হয়ে গেছে এই আট ন মাসে। সামি অবশ্য কোনোকালেই খুব একটা বাবা ঘেঁষা ছেলে ছিল না। বাবাকে সে ভালোবাসে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের পিতাপুত্রের মাঝে কখনোই বন্ধু ভাবাপন্ন সম্পর্ক বিরাজমান ছিলনা। তাই এই জেনারেশনটা সম্পর্কে তিনি একেবারেই অজ্ঞ। এরা কী ভাবে, কী করে, কীসে রাগ হয় বা আনন্দ পায় এসব ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। 

তিনি কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে স্থিরতার সাথে বললেন, ‘তোমার কোনো ধারণা নেই সারা টা দিন আমার ওপর দিয়ে কী গেছে! আমার চলতে হয় সময় মেপে মেপে। কাজের বাইরে এক কদম পা ফেলার অবকাশ নেই। তখন তোমার সাথে কথা বলবার সময় একটা খুব জরুরী ফোন চলে আসল। তাই…’ 

—‘এসব গল্প আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?’ বাঁধা দিয়ে উঠল অমৃতা। –’তুমি মিছিমিছি রাগ করছ বলেই তো শোনাতে হচ্ছে। 

—‘এসব বলে লাভ নেই, এরপর আপনি ফোন তখনই রাখবেন, যখন আমি বলব!’ 

হক অমৃতার ছেলেমানুষী আবদার শুনে হেসে উঠে বললেন, 

—‘ওরে বাবা! কঠিন আদেশ দেখছি!’ 

—‘হ্যাঁ কঠিন আদেশ। 

—‘রাত বাজে এগারোটা। আমি বারোটার মধ্যে বিছানায় যাই। উঠি ফজরের ওয়াক্তে।’ 

—‘এসব গল্প দিয়ে লাভ নেই। কথা শেষ হবার আগে আপনি ফোন রাখবেন না। আর রাখতে হলে এখনই রাখুন। কথার মাঝখানে হুট করে ফোন কেটে দিলে আমার খুব রাগ হয়। তাছাড়া আপনার জন্য আমাকে বন্ধুদের সাথে মিথ্যা বলতে হচ্ছে। লুকিয়ে ফোনে কথা বলতে হচ্ছে। আমি এর আগে কোনো দিন কারো সাথে চুরি করে কথা বলিনি।’ 

—‘বল কী? কারো সাথে লুকিয়ে কথা বলো নি কখনও?’ 

হক সত্যিই বেশ অবাক হলেন। এই বয়সী মেয়েরা সাধারণত বাবা মায়ের চোখের আড়ালে প্রেমিক ট্রেমিকের সাথে কথা বলে। অথচ এই মেয়ে বলছে সে নাকি কোনো দিন বাবা মায়ের কাছ থেকে বা কারো কাছ থেকেই কিছু লুকোয় নি। এটাও কি সম্ভব? 

—‘না কারো সাথে না।’ 

—‘ইশ, তাহলে তো আমার জন্য তোমার রুল ব্রেক হয়ে গেল।’ হক বললেন, আলগা আফসোসের গলায়। 

—‘হলোই তো।’ 

—‘তাহলে এখন কী হবে?’ 

—‘কী আবার হবে? আপনার একটা শাস্তি হওয়া উচিৎ।’ 

হক সাহেব আবার হাসতে শুরু করলেন। এভাবে তার সাথে কেউ কথা বলেনা। এই মেয়েটা সত্যিই ছেলেমানুষ একদম! 

—‘কী শাস্তি হওয়া উচিৎ বলো তো?’ 

—‘ভেবে চিন্তে বলবো।’ 

—‘আচ্ছা ভেবে নাও। সময় দিলাম তোমাকে। এখন আমি জরুরি কথাটা বলে নিই।’ 

—‘আমারও একটি জরুরি কথা বলার আছে।’ 

—‘ঠিক আছে তুমি বল আগে।’ 

—‘না আপনি আগে।’ 

—‘উঁহু, তুমি আগে।’

—‘আপনি আগে।’ 

—‘এ জন্যেই তোমাকে আমি বেয়াদব ডাকি।’

–’যা ইচ্ছে ডাকুন, আমার কিছু এসে যায়না।’

—‘তুমি কি সবসময়ই এরকম ড্যাম কেয়ার?’ 

—‘আমার বন্ধুরা আর আমার পরিবার, এই দুটি জায়গা ছাড়া অন্য কিচ্ছুতে আমার দুর্বলতা নেই। আমি কাউকে তোয়াক্কা করিনা।’ 

হক একটা নিশ্বাস ফেললেন, ‘এ কারণেই সামিকে তোমাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে বলেছিলাম।’ 

—‘এটার মানে কী?’ 

—‘মানে হল, আমার ছেলেটা তোমাদের সাথে থেকে থেকে দিন দিন বখে যাচ্ছে।’ 

অমৃতা একটু কড়া ভাবে বলল- ‘শুনুন, আই ডোন্ট এপ্রিশিয়েট দ্যাট টোন। এরকম মুরুব্বিয়ানা গলায় আমার সাথে কথা বলবেন না। আমি মুরুব্বিদের সাথে ফোনালাপ করে অভ্যস্ত ন‍ই।’

হক ভীষণ অবাক গলায় বললেন, ‘আমি তো মুরুব্বিই, আমার বয়স কত তোমার কোন ধারণা আছে? 

—‘রাখছি ফোন। মুরুব্বিদের সাথে কথা বলতে বিরক্ত লাগে।’

—‘দাঁড়াও দাঁড়াও!’ 

—‘দাঁড়াতে পারবনা।’ 

—‘শোনো অমৃতা, একটু আগে জানতে পারলাম যে আমার ছেলে নাকি বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছে। তার এই হঠকারী সিদ্ধান্ত আমাকে অত্যধিক দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?’ 

—‘লিসেন মিস্টার হক, আপনাকে একটা পরামর্শ দিতে চাই, নেবেন?’ 

এই পর্যায়ে হক কিঞ্চিৎ কৌতুক অনুভব করলেন। হাঁটুর বয়সী এক মেয়ের কাছ থেকে এখন তাকে পরামর্শ নিতে হবে? তিনি সকৌতুকে বললেন, 

—‘কী পরামর্শ?’

—‘আপনার ছেলের ব্যক্তিগত ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করা আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধ করে দিন। 

—‘বিয়ে করার সিদ্ধান্তটি কিন্তু একেবারে ব্যক্তিগত নয়। এই সিদ্ধান্তের সাথে দুটি পরিবার জড়িত।’ 

—‘হ্যাঁ বুঝেছি। কিন্তু সামি বিয়েতে রাজি হয়েছে এটাই কি আপনাদের জন্য যথেষ্ট নয়? এর পরেও এটা সেটা প্রশ্ন করে জল ঘোলা করার কি কোনো মানে হয়?’ 

হক একটু চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘দ্যাখো,আমি আমার ছেলেকে চিনি। একটা পরিবারের সাথে কথা হয়ে যাবার পরে সে যদি হঠাৎ করে বেঁকে বসে তাহলে আমরা সামাজিক ভাবে অপদস্থ হয়ে পড়ব। আমি জানতে চাই ওর এই সিদ্ধান্তের পেছনে কি হিন্দু মেয়েটার কোনো প্রকার ভূমিকা আছে? 

—‘হিন্দু মেয়েটার একটা নাম আছে মিস্টার হক!’ 

—‘নামটা ভুলে গেছি মিস অমৃতা!’ 

—‘ওর নাম বিভা। এরপর থেকে ওকে নাম ধরেই ডাকবেন।’ 

—‘নাম মনে থাকলে নিশ্চয়ই নাম ধরে ডাকব।’ 

—‘বিভার হাত আছে কি নেই সে বিষয়ে আমি আপনাকে কিছু বলতে পারবনা। আমি মানুষের প্রাইভেসিকে রেসপেক্ট করি।’ 

—‘বিভা সংসার করছে মন দিয়ে?’ 

—‘করবে।’ 

—‘যাক, নিশ্চিন্ত হলাম। এবার তাহলে আমার ছেলেটারও মন ঘুরবে আশা করি।’ 

—‘সামির জন্য আপনারা মেয়ে দেখে ফেলেছেন?’ 

—‘ওর মা দেখেছে।’

—‘আপনাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড?’

—‘অনেকটা সেরকমই।’ 

—‘মেয়ে কী করে?’ 

—‘অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশোনা করে এসেছে শুনলাম।’

—‘বাহ্ বেশ।’ 

—‘তোমরা সামিকে একটু সাপোর্ট করো কেমন? ও যেন হুট্ করে আবার সিদ্ধান্ত বদলে না ফেলে।’ 

—‘আচ্ছা শুনুন, আমরা কাল সকালে কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। তারপর সেখান থেকে ঢাকা।’ 

—‘তাই নাকি? খুব ভালো! যাক আজকে বেশ কিছু ভালো ভালো খবর পেলাম তোমার কাছ থেকে।’ 

—‘হ্যাঁ কলকাতা থেকে ফ্লাইটে যাবো ঢাকা। আশা করি এয়ারপোর্টে এই যাত্রায় কোনো পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকবে না আমাদের পাকড়াও করার জন্য।’ 

হক হাসলেন, ‘না থাকবেনা।’

—‘তাহলে আর কী? দেশে আমরা পৌঁছুনো মাত্র আপনার কানে খবর চলে যাবে, তাইনা?’ 

—হুম তা যাবে।’ 

—‘সো, আই গেস আমাকে আর প্রয়োজন হবেনা আপনার।’ 

—‘না তা হবেনা।’ 

অমৃতা নিশ্বাস চেপে রেখে বললো,-’আর কখনো ফোন দিয়ে বিরক্ত করবেন না তো?’ 

—‘না আর বিরক্ত করব না। শুধু কাল সকালে যাত্রা শুরু করার সময়, আমাকে একটা টেক্সট করে জানিয়ে দিতে পারবে?’ 

চেপে রাখা নিশ্বাসটা ধীরেধীরে ছাড়ল অমৃতা। বলল, ‘পারব।’ 

কয়েকটা মুহূর্ত নীরবে কাটল। অমৃতা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার ছোট্ট পরিসরে কয়েক বার পায়চারি করল। কপালের কাছের ছোট ছোট চুল গুলোতে চিরুনির মতো আঙুল চালাল বেশ কয়েকবার। গায়ে পরে থাকা জ্যাকেটের চেইন নাড়াচাড়া করলো অন্যমনস্ক ভাবে। সাবধানে বললো, ‘আর আমি যদি আপনাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত করি? রাগ হবেন?’ 

হকের কণ্ঠে হঠাৎ একটা তরঙ্গ টের পাওয়া গেল। 

—‘রাগ হব কেন?’ 

—‘সবাই যে বলে আপনি খুব রাগী!’ খুব আস্তে করে বলে অমৃতা।

—‘তাই নাকি? কে বলে?’

–’সবাই।’ 

—‘সবাই কি আমাকে নিয়ে খুব কথা বলে বেড়ায়?’ 

—‘আপনি নামকরা মানুষ। লোকে আপনাকে নিয়ে কথা বলবে, এটাই 

কি স্বাভাবিক নয়? সবাই আপনাকে ভয় পায়। 

—‘তাই বুঝি? এর মানে তুমিও নিশ্চয়ই ভয় পাও আমাকে।’ 

অমৃতা হাসে, ‘আমি আর ভয়? তাও আবার আপনাকে?’

–’তুমিই তো বললে সবাই আমাকে ভয় পায়।’

—‘সবার সাথে আমাকে মিলিয়ে ফেললেন?’

–’মেলানো উচিৎ বলেই তো আমার মনে হয়।’ 

—‘উচিৎ, অনুচিত মাথায় রেখে কি সব সময় সব কাজ করা যায়?’

—‘করা উচিৎ।’ 

—‘আপনি আমার কথা বুঝতে পারেন নি।’ 

—‘আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি।’ 

—‘আমি কি এখন ফোন রেখে দেব?’ 

—‘তোমার ইচ্ছা।’ 

অমৃতা কয়েক সেকেন্ড কিছু না বলে চুপ করে রইল। তারপর ফোন কাটার আগে ছোট করে বললো,’বেশ, উচিৎ অনুচিৎ নিয়েই থাকুন।’ 

.

বিভা শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়েছে উঠোনে। পোড়া পাতার ঘ্রাণে ছেয়ে আছে চারপাশ। অগ্নিশিখার কমলা আলোর আভায় তিরতির করে কাঁপছে সাদা রঙের কুয়াশা। মাথার ওপর হিমবর্ষী কালো বিস্তৃত আকাশ। নক্ষত্ররা জেগে নেই আজ। নিরুদ্দেশ ভাসছে মেঘ। জঙ্গলের গভীরে, কেমন মন খারাপের গলায় একটা টুই পাখি ডাকছিল অনবরত। হঠাৎ ঘুম ভেঙে বুঝি সে আবিষ্কার করেছে পাশে অনেকদিনের প্রিয় সঙ্গীটি আর নেই। তাই অন্ধকার জঙ্গলে জঙ্গলে ভারী করুণ গলায় সেই প্রিয় বন্ধুটিকে ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছে সে। দূর পাহাড়ে একটা মেয়ে আসামিয়া গান গাইছিল। মেয়েটা প্রায়ই গান গায় একা একা। বিভা এর আগেও শুনেছিল একদিন। 

বিভা আর হৃদি আগুনের পাশে বসেছিল পিঁড়ি পেতে। আগুনের আঁচ গায়ে লাগাতে আরাম লাগছে। অভিজিৎ অন্য বন্ধুদের সাথে নিয়ে বসেছে চেয়ারে। রুদ্র গিটারে টুংটাং করছিল। তাকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চায় কিন্তু কথাটা শুরু করবে কী করে তা ঠিক ভেবে পাচ্ছেনা। 

সে বেশ কয়েকবার গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর ভাবে বললো, 

—‘শোন আমার তোদেরকে একটা কথা বলার আছে। মানে একটা গুড নিউজ আছে।’ 

বন্ধুরা সবাই উৎসুক হয়ে তাকাল তার দিকে। হৃদি গদগদ হয়ে বললো, ‘বলে ফ্যাল না, সুখবর দিতে দেরি করতে নাই।’ 

রুদ্র কোলের ওপর ধরে থাকা গিটারটার তারের দিকে নিবিষ্ট চোখে চেয়ে থেকে বললো, ‘ইশে… আমার ইউএস এর একটা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন হয়ে গেছে। স্কলারশিপ পাইছি দোস্ত।’ 

দলটার মধ্যে অকস্ম্যাৎ এক অনাকাঙ্ক্ষিত নীরবতা জেঁকে বসল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সেই অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে অমৃতাই প্রথম কথা বললো, ‘ওয়াও! দ্যাটস ফ্যান্টাস্টিক! কনগ্রেস দোস্ত।’ 

রুদ্র মাথাটা নুইয়ে রেখেই বললো, ‘নেক্সট ইয়ার ফল সেমিস্টার থেকে শুরু করবো। সো আমার মনে হয় নেক্সট অগাস্ট বা সেপ্টেম্বরে যাইতে হবে।’ 

—‘কত দিনের জন্য?’ চাপা এক উৎকণ্ঠা ভেসে উঠল বিভার গলায়। 

—‘দুই বছর।’ 

হৃদির কান্না পেতে খুব বেশি সময় লাগেনা। সে কাঁপা গলায় বললো, ‘তুই চলে যাবি?’ 

রুদ্র অস্বস্তিতে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল, ‘চলে যাবো কেন? দুই বছরের ব্যাপার মাত্র।’ 

সামি গমগম করে বলে উঠল, ‘যাবি তো এখনই যা শালা। সেপ্টেম্বরে যাইতে হবে কেন? কালকেই যা।’ 

রুদ্র ম্লান হাসে, ‘তোরা এরকম করলে কিভাবে যাবো?’ 

রুদ্রর এ কথার পর কেউ আর টু শব্দটি করলো না। সবাই একদম গুম হয়ে বসে রইল। কী বলবে? কিচ্ছু তো বলার নেই। জীবন তরী যে বাইতেই হবে! মানুষ যত বড় হয়, যত দায়িত্ববান হয়, ততই যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে থাকে সর্ব সাধারণের মাঝে। নিজের আপন ছোট্ট ভুবনটা তখন বড়ই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পুরোনো অভ্যাস গুলো এক সময় স্মৃতি হয়ে যায়। হৃদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর বারবার বলছিল, ‘প্লিজ যাস না, রুদ্র। কী হবে আমেরিকা গিয়ে পড়াশোনা না করলে? আমাদের দেশে কি পড়া নাই?’ 

রুদ্র চুপ করে রইল। তার চোখের সামনেটাও হঠাৎ করেই কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছিল। অমৃতা বললো, 

—‘দোস্ত তুই চলে গেলে আমাদেরকে গান শোনাবে কে?’ 

রুদ্র গিটারের তারে হাত চালাতে চালাতে মন্থর ভাবে বলল, ‘ওসব বাদ দে এখন। গান শোন। গান করি।’ 

আসামিয়া মেয়েটি তখনও গাইছিল। কী অদ্ভুত সুন্দর তার গানের গলা! এই নিকষ কালো অন্ধকার সুন্দর রাত্রির মতোই গভীর আর পবিত্র যেন! 

রুদ্র হঠাৎ করে ধরলো গানটা- 

‘ওই দূর পাহাড়ের ধারে 
দিগন্তেরই কাছে 
নিঃসঙ্গ বসে একটি মেয়ে 
গাইছে 
আপন সুরে 
আপন সুরে 
আপন সুরে…’ 

রুদ্র এই গানটি পুরোপুরি শেষ না করে হঠাৎ অন্য গানে চলে গেল। 

I was a quick wet boy
Diving too deep for coins 
All of your straight blind eyes 
Wide on my plastic toys 

হৃদি তখনও ফিচফিচ করে কেঁদে যাচ্ছে। আকাশ বসা থেকে উঠে হৃদির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কাঁদিস না তো। ওঠ। আয় নাচি।’ 

অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হল হৃদিতাকে। সামি যেখানটায় বসেছে সেই জায়গা থেকে আগুনের কমলা রঙের আলোয় বিভার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে। রুদ্রর গাওয়া গানটা মনের মাঝে সেইদিনের স্মৃতিটা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। বিভার বিয়ের আগের রাতে তাদের উত্তরা বাড়ির হলরুমে এই গানে বিভার সাথে সে শেষবারের মতো নেচেছিল। শেষবারের মতো কাছে এসেছিলো দুজনে। বুকের ভেতর ক্রমশ এক বিষণ্ণতা ঘনিয়ে আসতে লাগল। দম বন্ধ করা একটা কষ্ট! বিভারও কি এখন মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা? 

তার হঠাৎ মনে হল সময়ের সাথে সাথে আসলে সব কিছুই একটু একটু করে পাল্টাতে থাকে। সেই পাল্টানো অংশ টুকু এতো বেশি সূক্ষ্ম যে প্রাথমিক ভাবে মানুষের তা চোখে পড়েনা। আজ সকাল বেলায় সে নিজে যেমনটা ছিল, এই রাতের আঁধারে ঠিক তেমনটি আর নেই। একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় টুকরো টুকরো ভাবে ছড়িয়ে থাকে বিভিন্ন সময়ের মাঝে। অতীতে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে। একেক সময়ে তার একেক রকম রূপ! 

হৃদি আর আকাশ একে অপরের হাত ধরে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে হালকা তালে পা ফেলে নেচে যাচ্ছিল। নাচের তালে তালে হৃদির মুখে ধীরে ধীরে একটি ক্ষীণ হাসির রেখা জন্ম নিচ্ছিল। শীত-গন্ধী বাতাসে উড়ছিল ওর খোলা চুল। 

‘Then when the cops closed the fair 
I cut my long baby hair 
Stole me a dog eared map 
And called for you everywhere’ 

বিভা উঠে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে হেঁটে সামির পাশের চেয়ারে এসে বসল। নরম ভাবে বললো, 

—‘সামি, প্রেমের ব্রেকআপ হয়। বন্ধুত্বের কখনো ব্রেকআপ হয়না। আমরা বন্ধু ছিলাম, বন্ধুই আছি।’ 

সামি কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে চুপ করে রইলো। তার মনের ভেতর এখন গানের সুরটা বাজছে। এই গানের সুরটা কী অদ্ভুত করুণ! একদম মনে গিয়ে লাগে! 

Have I found you? 
Flightless bird, jealous, weeping 
Or lost you? 

সামির মনে হল প্রতিটা মানুষ আসলে একেকটি ফ্লাইটলেস বার্ড। যার উড়বার কথা ছিল, কিন্তু কোনো এক অভিশপ্ত কারণে কোনো দিন সত্যিকারের ওড়া হয়ে ওঠেনি। সে একটা বড় নিশ্বাস চাপল। তার মনটা দুর্দান্ত রকমের খারাপ। বিভা তার জীবন থেকে চলে গেছে। রুদ্রও চলে যাবে! একদিন সবাই চলে যাবে! মহাকালের দাপটে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবেনা। 

বিভা উঠে এসে অভিজিৎকে বললো, ‘কী অভিজিৎ বাবু, নাচবেন নাকি?’

অভিজিৎ হাসে, ‘আমার দ্বারা ওসব হবেনা।’ 

বিভা জোর দিয়ে বলে, ‘আসুন, আসুন, আমি শিখিয়ে দেব।’ তারপর, শাল জামুনের গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ঝরছিল শিশির। রাত বাড়ছিল, আর আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে, ধীর লয়ে ওরা কজন নেচে যাচ্ছিলো। 

রুদ্র গাইছিলো তখনও, 

Have I found you? 
Flightless bird, brown hair bleeding 
Or lost you? 

২১

‘শোন তোরা, আজকে সন্ধ্যায় আমাকে দেখতে আসবে।’ পিৎজার স্লাইসে একটা বড় কামড় বসিয়ে সামি বলল, খুব জরুরি গলায়। 

কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পুরো টেবিলে হাসির রোল পড়ে গেল। রুদ্র ডাকাতের মত হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, ‘এত দিন জানতাম মেয়েদের দেখতে আসে। জীবনে প্রথম শুনলাম যে ছেলেদেরও দেখতে আসে। শালা মদন কোথাকার।’ 

ওরা বসে আছে সাত মসজিদ রোডের পিৎজা হাটের দোতলায়। টেবিলের ওপর দুইটা বেশ বড়সড় আকারের পিৎজা রাখা, সাথে কোকের গ্লাস। বাইরে তখন জানুয়ারির মিষ্টি দুপুর। রাজধানীর পথঘাট, রাস্তার ধারের গাছ, ফুটপাত অবশ্য ধূলোবালিতে ঢাকা, কিন্তু সেই ধূলোর আস্তরণের উপর যখন শীতের নরম রোদ এসে সোনালি ঝিলিক দেয় তখন এই শহুরে দুপুরটাকে সত্যিই ভারী মিষ্টি বলে মনে হয়। আজকেও ঠিক সেরকম একটি মিষ্টি দুপুরবেলা। 

পিৎজা চিবোতে চিবোতে সামি ভয়ংকর চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে, জাড় গলায় বলল,’দেখতে আসবে মানে মিট করতে আসবে।’ 

—‘কে?’ 

—‘মেয়ের পরিবার।’ 

—‘কোথায় আসবে?’ 

—‘পিঙ্ক সিটিতে মিট করবে বলছিল। এখন জানিনা ভেনু কি চেঞ্জ হইছে নাকি আগেরটাই আছে।’ 

আকাশ বলল, ‘তোর প্রিপারেশন কী? মানে কীভাবে সাজগোজ করবি?’ 

অমৃতা কোকের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে গম্ভীর গলায় বলল, ‘পার্লারে যাবি?’ 

—‘ফেসিয়াল করবি? নাকি স্পা?’ হৃদির প্রশ্ন।

সামির দুচোখ দিয়ে আগুন ঝরছিল। সে বন্ধুদের দিকে ওই আগুন ঝরা দৃষ্টিটা তাক করে রেখেই বলল, 

—‘আমার ওইসব কিসুই করা লাগবেনা, মাইয়া এমনিই আমারে দেইখা পছন্দ করব।’ 

হৃদি বলল, ‘বলা যায়না, যদি রিজেক্ট করে দেয়? একটু সাজগোজ করে নিলে ভালো করবি। সেইফ সাইডে থাকলি।’ 

—‘জীবনেও রিজেক্ট করবনা। 

—‘এত অহংকার ভালো না। 

—‘অহংকারের কিছু নাই, আচ্ছা যা বেট ধরলাম মাইয়া আমারে পছন্দ করলে তুই আমারে দশ হাজার টাকা দিবি আর পছন্দ না করলে আমি তোরে দিব।’ 

—‘দশ হাজার কেন?এত টাকা নাই আমার।’ 

—‘তাহলে আট।’ 

—‘আট টাকা?’ 

—‘আট হাজার।’ 

—‘না আট টাকা হইলে রাজি আছি।’ 

—‘ফকিরনী কোথাকার।’

—‘মাইয়া দেখতে কেমন?’ রুদ্রর প্ৰশ্ন। 

সামি মহা উৎসাহ নিয়ে বলল,’মেয়ে তো মামা সেইরকম সুন্দর। আমার মনে হচ্ছে ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে। মানে সেইরকম একটা ফিলিংস হচ্ছে মনে মনে, বুঝছিস?’ 

হৃদি ভেংচি কাটল, ‘শখ কত দ্যাখ না, আহা! ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটার বিয়ে হবে ঢাকা শহরের সবচেয়ে বান্দর ছেলেটার সাথে। জোশ তোহ! 

সামি কঠিন চোখে একবার হৃদিকে দেখে নিয়ে মোবাইলের ইন্সটাগ্রাম অ্যাপ খুলল। একটা ছবি খুঁজে বের করে নিয়ে মোবাইলটা বন্ধুদের মুখের সামনে মেলে ধরে বলল, ‘এই দ্যাখ।’

ছবির দৃশ্যপট দেশের বাইরের। ইওরোপ অথবা আমেরিকার কোনও এক উন্নত দেশের রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। পেছনে একটি গম্বুজ ওয়ালা লাল ইটের বিল্ডিং। আশেপাশে সাদা চামড়ার লোকজন দেখা যাচ্ছে। পরিষ্কার, ছিমছাম রাস্তায় দু একটা গাড়ি চলছে। মেয়েটির চোখে সানগ্লাস। পরনে হাঁটু অবধি ঝুলে থাকা একটি ছোট জামা। হাতে ব্যাগ। উঁচু হিলের জুতো। সিল্কের মত মসৃণ খোলা চুল। হৃদি আর অমৃতা হামলে পড়ে ফোনটা ছিনিয়ে নিল সামির হাত থেকে। হৃদি মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে পরখ করল ছবিটা। তারপর বিস্ময়ের গলায় অমৃতাকে বলল, ‘দ্যাখ না, এই মেয়ের তো মাথা থেকে পা পর্যন্ত ব্র্যান্ড! সুন্দর হইছে ব্র্যান্ডের জিনিস ইউজ কইরা। আসলে তো দেখতে পেত্নী। 

সামি ফোড়ন কাটল,’তোদের এত হিংসা কেন বলতো?’ 

অমৃতা বলল, ‘না, হৃদি ঠিকই বলছে। এই মেয়ের সারা গায়ে ব্র্যান্ড। তবে দেখতেও ভালো।’ 

হৃদি গলায় পূর্বের বিস্ময় ভাবটা বজায় রেখেই অমৃতাকে বলল, ‘হাতে লুই ভিটনের ব্যাগ। বুঝতেছিস কিছু?’ 

আকাশ অমৃতার হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে ছবিটা দেখল। হৈ হৈ করে বলে উঠল, ‘আরে, সুন্দর তো! সত্যি মিস ঢাকা মনে হচ্ছে।’ 

হৃদি তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ‘এর থেকে আমিও অনেক সুন্দর আছি ভাই, শুধু দামি জিনিস গায়ে লাগাইলেই সুন্দর হয়না।’ 

সামি ক্ষেপে গেল কথাটা শুনে, ‘নিজের চেহারা কখনো আয়নায় দেখছস?’ 

প্রশ্ন শুনে হৃদির চেহারার রং পাল্টে গেল। আকাশ ওর পাশেই বসে ছিল। হৃদির মুখের পাল্টানো রংটা খুব সহজেই ধরতে পারল সে। হাত বাড়িয়ে হৃদির হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল, ‘বাদ দে তো, এই শালার মাথা ঠিক নাই। ব্রেকআপ হইছে এক সপ্তাহও হয়নায়। ওর মাথা আউট। কী বলতেছে নিজেও জানেনা।’ 

হৃদি রেগেমেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হয়ে আসার আগেই তার মুখখানা অকস্ম্যাৎ হা অবস্থায় স্থির হয়ে গেল, দৃষ্টি গেল থমকে। বন্ধুরা তার দৃষ্টি অনুসরণ করল। দেখা গেল খয়েরি রঙের সোয়েটার পরে লম্বা ছিপছিপে দেহের এক ছেলে হাসি হাসি মুখে তাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটাকে ওরা সবাই চেনে, এই ছেলের নাম রবিন। 

অমৃতার মুখ দিয়ে বাক্যটা না চাইতেও বের হয়ে আসল, ‘এই শালা এইখানে কী করে?’ 

রবিন টেবিলের কাছাকাছি এসে মুখে তেলতেলে হাসি নিয়ে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বলল, ‘কী খবর তোমাদের?’ 

বন্ধুরা কেউ কোনো কথা বলছিল না। সবাই হতভম্ব হয়ে চেয়ে ছিল রবিনের দিকে। হৃদির হা হওয়া মুখটা তখনো হা হয়েই ছিল। রবিন ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কেমন আছ?’ 

হৃদি কথা বলল অনেক কষ্টে, ‘এইতো, তুমি এখানে?’ 

বন্ধুদের সূচালো দৃষ্টিটা তখন রবিনকে একটু অপ্রস্তুত করে তুলেছে। এরা কেউ কোনো কথা বলছে না, সবাই হিংস্র চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। যেন এখুনি চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। সে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘এসেছিলাম এক কলিগের সাথে। তোমার ফোন বন্ধ কেন?’

হৃদি এবার পরিষ্কার গলায় বলল, ‘নম্বর বদলে ফেলেছি, তাই।’ 

রবিন বাকি বন্ধুদের দিকে একবার অস্বস্তি নিয়ে তাকাল। বললো, ‘ইয়ে, হৃদিতা, তোমার সময় হবে? একটু কথা বলতাম?’ 

অমৃতা এবার মা মা গলায় বলে উঠল, ‘যা বলার এখানেই বল, আমাদের সামনে।’ 

রবিনের মুখে যেন চুনকালি পড়ল। একরোখা ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘তুমি কথা বলছ কেন আমাদের মাঝখানে? হৃদিতাকে ডিসিশন নিতে দাও। ইউ আর নট হার মম!’ 

—‘হৃদি, ওকে বল যা বলার আমাদের সামনে বলতে।’ ঠাণ্ডা গলায় হুকুম করল অমৃতা। 

হৃদি পড়ল ভীষণ বিপাকে। বেশ কিছুক্ষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগল সে। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘যা বলার সবার সামনেই বল।’ 

—‘এই জন্যেই আমি তোমার সাথে ব্রেকআপ করেছিলাম। তুমি নিজের বুদ্ধিতে চল না, বন্ধুদের কুবুদ্ধিতে চল।’ রাগটা আর চেপে রাখতে পারল না রবিন। 

বন্ধুদের মুখে অস্বস্তি খেলছে তখন। আশেপাশের টেবিলের লোকজন উৎসুক ভাবে চেয়ে আছে দলটার দিকে। বন্ধুরা অস্বস্তিতে কে কী করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। রুদ্র আর আকাশ কিছু করার না পেয়ে মনোযোগ দিয়ে পিৎজা খেতে লাগল। সামি কোকের গ্লাস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। শুধু মাত্র অমৃতা নাকের পাটা ফুলিয়ে কঠোর চোখে তাকিয়ে রইল রবিনের দিকে। 

আকাশ খানিক বাদে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘হৃদি, তুই চাইলে শুনে আসতে পারিস ও কী বলতে চায়। উই ওন্ট মাইন্ড।’ 

হৃদি কুঁকড়ে যাওয়া চোখে অমৃতার দিকে তাকাল। অমৃতা আঙুল তুলে শাসালো ওকে, ‘তুই কোথাও যাবিনা! এখানেই বসে থাক।’ 

রুদ্র বলল, ‘আচ্ছা আমি একটা জিনিস বুঝতেছিনা। ও যদি হৃদির সাথে জরুরি কিছু বলতে চায় তাতে তোদের সমস্যা কী? হৃদি কথা বলবে কি বলবেনা সেটা ওর উপরে ছাইড়া দে। 

—‘তোরা কি ভুলে গেছিস কক্সবাজারের সেই রাতটার কথা? হৃদিরে এই রবিনের বাচ্চা ক্যামনে কাঁদাইছিল?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল অমৃতা। 

রবিন বিস্মিত গলায় বলে উঠল, ‘আরে! এই মেয়েতো আমারে গালাগালি করছে রীতিমতো! হৃদি তুমি কিছু বলবে না?’ 

হৃদিকে দেখে মনে হচ্ছিল সে এখুনি কেঁদে দেবে। অমৃতার আগুন গরম চোখের সামনে পড়ে সে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছেনা। রবিনের প্রতি যে তার মনের মধ্যে কোনো প্রেমানুভূতি এখনও অবশিষ্ট আছে তা কিন্তু নয়। বরং এই ছেলেকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার অদম্য ইচ্ছা বুকের মধ্যে আগুনের মতো দাউদাউ করে জ্বলে আসছে অনেক দিন যাবৎ। ব্রেকআপের পর কয়েক সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই যে এই ছেলে নতুন বান্ধবী জুটিয়ে ফেলেছিল সেই ঘটনাটা হৃদি হাজার চেষ্টা করেও ভুলতে পারেনি। না, ভালোবাসা নেই, বরং প্রতিশোধের আগুন আছে। হয়তো অমৃতা যা করছে একদম ঠিক করছে। কিন্তু হৃদির মনটা যে বড়ই নরম! হাজার চেষ্টা করেও সে মানুষের সাথে কঠোর হতে পারেনা। এইযে ড্রাইভার বাঁদরের ওপর ভয়ংকর রেগে গিয়ে বাবার কাছে নালিশ করে চাকরি থেকে ভাগিয়ে দিল, সেই বাঁদর যখন কদিন আগে ফোন দিয়ে কাকুতি মিনতি করতে লাগল এই বলে যে, আপা চাকরিটা আমার বড়ই প্রয়োজন, আপনি প্লিজ আমার চাকরি ফিরায়ে দেন। হৃদি তখন সেই করুণ আকুতি শুনে একদম পানির মতো গলে গেলো। বাবাকে বলে চাকরিটা আবার পাইয়ে দিল বাঁদরকে। এখন সে বুঝতে পারছে মন, প্রাণ আর বুদ্ধি দিয়ে যে রবিনের সাথে তার সীমাহীন কঠোর হওয়া উচিৎ। বাজে ব্যবহার করে ছেলেটাকে তাড়িয়ে দেয়া উচিৎ। কিন্তু পারছেনা। কিছুতেই পারছেনা হৃদি। নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে। বিব্রত হয়ে যাচ্ছে। 

অনেক কষ্টে অমৃতার অগ্নি দৃষ্টি উপেক্ষা করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। বলল, ‘আচ্ছা আমি আসছি। কী বলবে বল।’ 

হৃদি আর রবিন হেঁটে একটু দূরে সরে যেতেই অমৃতা দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল, ‘এই হারামজাদারে আমার কী যে করতে মনে চাইতাছে!’ 

সামি বলল, ‘চল পিটাই।’ 

অমৃতা সায় দিল, ‘চল দোস্ত, আমার অনেক দিনের শখ রবিনরে একদিন ইচ্ছা মতো পিটামু।’ 

রুদ্র বলল,’শোন ওভার রিএক্ট করিস না। একটু কথা বললে কী হয়? ওরা তো আবার কোনো রিলেশনশিপে যাচ্ছেনা, তাইনা?’ 

আকাশ তাল মেলালো রুদ্রর সাথে, ‘সেটাই, মামা তোরাও না একটু বেশি বেশি করিস। দুইটা কথা বললে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাইব?’ 

হৃদিতা আর রবিন তখন একটি দুই চেয়ারের টেবিল নিয়ে বসেছে। রবিন হাত নেড়ে নেড়ে গম্ভীর ভাবে হৃদিকে কিছু একটা বলছে। হৃদি মন দিয়ে শুনছে তার কথা। সামি ওদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এই এসহোলের বাচ্চারে দেখলেই আমার গা কামড়ায় ক্যান?’ 

‘একদম রাইট। আমারও গা কামড়ায়।’ সহমত ব্যক্ত করল অমৃতা। 

সামি নিজের এক হাতের পাঁচ আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে অপর হাতের তালুতে কিল মারতে মারতে বলল, ‘দাঁড়া এসহোলটাকে মজা দেখাচ্ছি।’ 

—‘সামি প্লিজ, একটু শান্ত হয়ে বয়। কোনো ঝামেলা করিস না হুদাই।’ আকাশ বলল গম্ভীর গলায়। 

সামি কারো কথা কানে না নিয়ে এগিয়ে গেল হৃদিদের টেবিলটার দিকে। দাঁড়ালো টেবিলের সম্মুখে, রবিন আর হৃদির মাঝ বরাবর। ওকে দেখা মাত্র রবিন তারস্বরে বলে উঠল, ‘কী চাই?’ 

হৃদিকে বিব্রত দেখাল। সে সামির কনুইয়ে একটা হাত রেখে আকুলিবিকুলি হয়ে বলল,’দোস্ত যা তুই, আমি আসতেছি এখনই।’ 

—‘তুই কি বলছিস ওরে লাস্ট ট্যুরে আমাদের মধ্যে কী হইছিল?’

অপ্রাসঙ্গিক ভাবে প্রশ্নটা করে বসল সামি। 

হৃদি থমকে গেল। রক্তশূন্য দেখাল তার মুখ। এই ছেলে বলছে কী এসব? মাথা ঠিক আছে তো? হৃদির হতভম্ব, ভীত চাউনিটা সম্পূর্ণ ভাবে অগ্রাহ্য করে সামি খুব স্বাভাবিক গলায় রবিনকে বলল, ‘ও কি তোমাকে কিছু বলেছে?’ 

রবিনের চোখে তখন একাধারে খেলছে কৌতূহল, উদ্বেগ এবং বিরক্তি।

—‘না, ও আমাকে কিছু বলেনি।’ 

হৃদি উঠে দাঁড়ালো চট করে। সামির বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘দূর হ এখান থেকে। দূর হ বলতেছি।’ ধাক্কা খেয়েও সামি নির্বিকার। মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে সে ডাঁটিয়াল গলায় রবিনকে বলল, ‘উই কিসড!’ 

রবিনের মুখের চামড়া ঝুলে গেল। চোখ হয়ে গেল গোল গোল বোতামের মত। মুখ থেকে ছিটকে আসলো শব্দটা, ‘কী?’ হৃদি উঠে এসে সামির পিঠে উপর্যুপরি থাপ্পড় মারতে মারতে বলল, ‘কুত্তার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা! তুই যা এখান থেকে।’ 

সামি চড় থাপ্পড় সহ্য করে নিয়ে, রবিনকে অকপটে বলল, –’ইয়াহ, উই ডিড ইট। আস্ক হার। ইটস ট্রু!’ 

—‘ঘটনা কি সত্য?’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রবিন। 

রাগে দুঃখে অপমানে হৃদির চোখে পানি চলে আসছিল। সে ধপ করে চেয়ারের ওপর বসে পড়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। ক্ষীণ ভাবে বলল, ‘রবিন তুমি যাও, পরে কথা বলব তোমার সাথে।’ 

রাগে গজগজ করতে করতে জায়গাটা ছাড়ল রবিন। যাবার আগে হাতের আঙুল তাক করে শাসানোর ভঙ্গিতে বলে গেল,’তোমার এই বন্ধুদের জন্য একদিন তোমার সর্বনাশ হবে। লিখে দিলাম আমি।’ 

রবিন যাবার পর হৃদি তেড়ে এসে সামির শার্টের কলার চেপে ধরল, ‘তুই এই কুত্তামিটা কেন করলি?’ 

অন্য বন্ধুরা ততক্ষণে উপস্থিত হয়ে গেছে ঘটনাস’লে। সামি নিজের শার্টের কলার হৃদির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে হিসহিসে গলায় বলল, তোমার জন্য আমার ব্রেকআপ হইছেনা? মনে আছে আমার সব। আমার ব্রেকআপ করায়ে তুমি খুব প্রেম করবা মনে করছ? জীবনেও না।’ 

হৃদি হতভম্ব হয়ে গেল কথাটা শুনে। তার হাতের মুঠো আলগা হয়ে আসতে লাগল ধীরে ধীরে। চোখ হয়ে উঠল জলসিক্ত। আশ্চর্য শীতল গলায় বলল, ‘আমার জন্য তোর ব্রেকআপ হইছে?’ 

—‘তা নয় তো কী? 

অমৃতা হৃদির পিঠে একটা হাত রেখে সান্ত্বনার গলায় বলল, ‘আরে দোস্ত, ও মজা নিতেছে। পাত্তা দিস না।’ 

হৃদির চোখের কার্নিশে জল জমে উঠেছিল এক দু ফোঁটা। রুদ্র তাই দেখে একটা ধমক দিয়ে উঠল, ‘কিছু হওয়ার আগেই চোখ দিয়া পানির কল ছাইড়া দেস কেন মামা? মানে সমস্যা কী তোর? 

হৃদি কাঁপা গলায় বলল, ‘কিছু হয়নায় না? তোদের মনে হচ্ছে কিছু হয়নায়? ও আমাকে কত বড় বেইজ্জতিটা করল, এরপরও তোরা বলবি কিছু হয়নায়?’ 

—‘এখানে এত বেইজ্জতির কী আছে?’ সামি নির্বিকার। 

—‘তুই আমাদের ফ্রেন্ডশিপকে অপমান করছিস।’ 

—‘অপমানের কী আছে?’ 

—‘খুব খারাপ কাজ করলি তুই। জীবনে কোনও দিন ক্ষমা করব না তোকে। দেখে নিস।’ 

সামি তাজ্জব বনে গিয়ে বলল, ‘আজিব কারবার! এমন সিনেমা করার মানে কী?’ 

—‘আরেকটা কথা বললে তোর মুখে থুতু মারব আমি, কুত্তার বাচ্চা!’ 

হৃদির ধমক শুনে সামি এবার একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল বেশিরভাগ লোকজনের দৃষ্টি তাদের দলটার দিকেই নিবদ্ধ। সে চাপা গলায় বলল, ‘বাপ মা তুলে গালি দেয়া কিন্তু ঠিক না।’ 

—‘তোরে শুধু বাপ মা না, একশো গুষ্টি তুইলা গালি দিলেও আমার শান্তি হবেনা। তুই যদি আরেকটা কথা বলছিস এখন, আল্লাহর কসম আমি সবার সামনে তোর মুখে থুতু মারব।’ 

এটুকু বলে হৃদি টেবিলের ওপরে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমি যাচ্ছি।’ 

—‘কিন্তু দোস্ত, আজকে তো তোর আমাদেরকে রান্না করে দেয়ার কথা ছিল।’ হৃদির পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলল রুদ্র। 

—‘চল, রান্না করতে হইলে এখনই যাইতে হবে। রাতে আমার দাওয়াত আছে।’ কথাটা বলা শেষ করে হৃদি আর দাঁড়াল না। 

নিচে নেমে আসার পর রুদ্র বলল, ‘আমার একটু নীলক্ষেত যাইতে হবে। তোরা কেউ যাবি?’ 

আকাশের যেতে হবে ভার্সিটি। বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত পর পর দুটা ক্লাস নিতে হবে তার। অগত্যা আকাশের আর অন্য কোনো দিকে যাওয়া হচ্ছেনা আজ। ঠিক হল সামি আর হৃদি বসুন্ধরার এপার্টমেন্টে যাবে। অমৃতা আর রুদ্র যাবে নীলক্ষেত। সামির সাথে গাড়ি ছিল। হৃদি গাড়িতে উঠে বসেই একচোট শাসিয়ে নিল সামিকে, ‘এই শোন, আমার সাথে তুই কোনো কথা বলবিনা। কথা বললেই মুখে থুতু মারব।’ 

—‘সেই তখন থেকে তুই খালি থুতু মারব, থুতু মারব করতেছিস কেন? সমস্যা কী তোর? মেন্টাল হয়ে গেছিস?’ 

—‘মেন্টাল আমি না, তুই! এখন চুপ কর নইলে থুতু খাবি!’ 

সামি গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বিড়বিড় করল, ‘আজিব কারবার।’ 

.

রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে ওরা দুজন। রুদ্র আর অমৃতা। শীতের খরশান বাতাসে রুদ্রর আউল বাউল চুল গুলি উড়ছিল। 

—‘তোর চুল ঠিক কর। আমার নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।’

রুদ্র পকেট থেকে রাবার ব্যান্ড বের করে সময় নিয়ে নিজের চুল গুলো বাঁধল। আফসোসের গলায় বলল, ‘সামির তো মাথা পুরাই আউট হয়ে গেছে দোস্ত। কী হবে এখন ওই শালার?’ 

—‘আসলেই। পুরা পাগল হয়ে গেছে। শোন আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে।’ 

—‘কী প্ল্যান?’ 

—‘পরশুদিন সামির বার্থডে। মনে আছে?’ 

—‘ও, হ্যাঁ তাই তো। ভুলে গেছিলাম।’ 

—‘আমি ভাবতেছি ঐদিন ওরে একটা সারপ্রাইজ দিব।’ 

—‘কী রকম সারপ্রাইজ?’ 

—‘আমরা তো রাত বারোটার সময় কেক কাটবই। তো আমি ভাবতেছি ওর আব্বা আম্মাকেও ইনভাইট করব।’ 

রুদ্র চমকে উঠল, ‘আব্বা? মানে সামির আব্বা?’ 

—‘হ্যাঁ।’ 

—‘মাথা খারাপ!’ 

—‘মাথা খারাপের কী আছে?’ 

—‘ওই লোকটা কী ভয়ংকর রাগী তুই জানিস না? দেখলেই আমার ভয় লাগে। তাছাড়া সামির সাথে ওর আব্বার ঝামেলা চলতেছে।’ 

—‘আরে ঝামেলা চলতেছে বলেই তো আমাদেরকে কাজটা করতে হবে। দোস্ত আমাদের উচিৎ সামির সাথে এখন ওর ফ্যামিলির প্যাঁচআপ করায় দেয়া। দ্যাখ বিভার সাথে ওর যা ছিল তা তো এখন শেষ। শুধু শুধু ছেলেটা নিজের পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকবে কেন?’ 

—‘আমি জানিনা। আমার ওর আব্বারে অনেক ভয় লাগে।’ 

—‘তোদের কিছু করা লাগবে না। যা করার আমিই করবো।’ 

রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে অমৃতা বলল, ‘চা খাবি?’ 

—‘নাহ ইচ্ছা করতেছেনা।’

—‘বিড়ি খাবি?’ 

—‘ইচ্ছা নাই এখন।’

—‘বিড়ি খাইতে ইচ্ছা করতেছে না, চা খাইতে ইচ্ছা করতেছেনা,তাহলে কী করতে মন চাইতেছে তোর? এতো বোরিং কেন তুই?’ 

রুদ্র ওর এক আঙুল সমান দাড়ি গুলো হাতড়ে হাতড়ে চিন্তিত ভাবে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল, ‘ইয়ো ম্যান! কী করতে মনে চাইতেছে তোমার?’ প্রায় বিশ তিরিশ সেকেন্ড সময় লাগল তার উত্তরটা খুঁজে বের করতে। খুঁজে পেতেই বত্রিশ দাতঁ বের করে হেসে বলল,’মেক আউট করতে মনে চাইতেছে দোস্ত!’ 

—‘সব সময় খবিশ কথা বলিস কেন?’ ধমকে উঠল অমৃতা। 

—‘খবিশ কথা হবে কেন? তুই জিজ্ঞেস করলি কী করতে ইচ্ছা করতেছে। যা সত্যি তাই বললাম। ইশ যদি একটা গার্লফ্রেন্ড থাকত আজকে। তাইলে চিন্তা কর এইযে শীত শীত দুপুর…’ 

অমৃতা ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এসব কথা মনীষাকে গিয়ে বল না, আমাকে বলতেছিস কেন?’ 

—‘ছিঃ মনীষাকে ক্যামনে বলব। সব কথা তো সবাইরে বলা যায়না।’ 

অমৃতা ত্যাড়া চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক্যান, তোর তো মনীষার জন্য পিরিতির শ্যাষ নাই। যা গিয়া বল, মনের আশা পূরণ হইলেও হইতে পারে।’ 

—‘আরে না, ভালোবাসার মানুষকে কি অত সহজে এসব বলা যায় নাকি?’

—‘ভালোবাসা না, ছাই!’

—‘ভালোবাসা না?’ 

—‘অফকোর্স ভালোবাসা না।’ 

—‘লাইফে আমি দুইবার সিরিয়াস ক্রাশ খাইছি। প্রথমবার কলেজ লাইফে। আর দ্বিতীয়বার এই বুড়া বয়সে। ছাত্র পড়াইতে গিয়া।’ 

অমৃতা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কলেজ লাইফেরটা সিরিয়াস ছিল নাকি?’ 

—‘মজা নেও?’ 

—‘মজা নেয়ার কী হইল? আজিব, নরমাল একটা প্রশ্ন করলাম!’ 

রিকশা আটকে আছে তখন শাহবাগের সিগন্যালে। একটা বারো কি তেরো বছর বয়সী টোকাই মেয়ে হাতে গোলাপের তোড়া নিয়ে ওদের রিকশার কাছে এসে দাঁড়ালো। রুদ্রর দিকে গোলাপের তোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, ফুল কিনেন আপার জন্য। আপা চুলে লাগাইব।’ 

—‘এই আপার কি চুল আছে মাথায়?’ চোখ কটমটিয়ে বলল রুদ্র।

বাচ্চা মেয়েটা ফাজিল হেসে প্রত্যুত্তর করল, ‘তাইলে আপনে পইরেন, আপনের মাথায় তো অনেকডি চুল।’ 

অমৃতা হো হো করে হেসে উঠল। রুদ্র মেয়েটাকে মিনতির গলায় বলল, ‘অন্যদিকে যাও বাবু, এখন আমার ফুল কিনার মুড নাই।’ 

বাচ্চাটা ভেংচি কেটে দৌড়ে পালাল। পেছন থেকে একটা সিএনজি বিনা কারণে হর্ন দিয়ে যাচ্ছে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে। রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে সিএনজি ড্রাইভারকে কড়া গলায় বলল, ‘কী ভাই, সমস্যা কী? নতুন নতুন হর্ন দেয়া শিখছেন নাকি?’ 

ড্রাইভারের বয়স পঞ্চাশের ধারে কাছে হবে। মাথায় টাক। চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি। চোখের চাউনি দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ার সমস্ত জিনিসের উপর তার সীমাহীন রাগ। সে রুদ্রর ধমক শুনে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘তাতে তুমার কী? আমার হর্ন দিতে মনে চাইতেছে তাই দিতাছি।’ 

এ পর্যায়ে আশেপাশের উৎসুক জনতাদের একজন হুড তোলা রিকশা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে উঠল, ‘কী কন মিয়া, মনে চাইলেই আপনে হর্ন দিবেন নাকি? দ্যাশটা কি আপনের একার সম্পত্তি নাকি?’ 

রুদ্র হতাশ গলায় অমৃতাকে বলল, ‘আমাদের দেশের লোকজন বুঝছিস ডিপ্রেশন থেকে এইসব করে। মানে নিজের মনে শান্তি নাই, তাই অন্যরেও শান্তিতে থাকতে দিবেনা। হুদাই প্যারা দিবে মানুষকে।’ 

—‘হ ঠিকই আছে। আমি ভাল নাই, তুমি কেন ভালো থাকবা মামা?’

—‘ভালো থাকব ক্যামনে বল? আমরা তো ডেপ্রাইভড। সব কিছু থেকে ডেপ্রাইভড। এইযে মনে কর আমার মত একটা ইয়াং ছেলে ইচ্ছা থাকলেও গার্লফ্রেন্ডের অভাবে মেক আউট করতে পারতেছেনা। আমাদের জীবনে প্রেম নাই, সেক্স নাই, শালা কিছুই নাই।’ 

—‘সেক্স আর প্রেম ছাড়াও পৃথিবীতে আরও অনেক জিনিস আছে।’

—‘বেসিকই তো ঠিক নাই।’ রুদ্র উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল। 

—‘রুদ্র চুপ কর। অসহ্য লাগতেছে তোর এইসব কথা আমার।’ 

—‘সত্য কথা বলতে গেলেই লোকে বলবে চুপ কর, চুপ কর! এ জন্যেই এই দেশের কিছু হবেনা।’ 

.

রাত নটায় বাড়ি ফিরে দেখা গেল পিতৃদেব ড্রয়িং রুমের সোফার ওপর ঠ্যাং তুলে বসে টিভিতে খবর দেখছেন। কোমরে ময়লা রঙের লুঙ্গি প্যাঁচানো। খালি গা। আকাশ আজকাল লোকটাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। মুখোমুখি পড়ে গেলেও চোখ তুলে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনা। সুযোগ পেলেই এমন সব অসভ্য কথাবার্তা বলে বসে যে আকাশের দিনটাই মাটি হয়ে যায়। আজকেও সে লোকটাকে না দেখার ভান করে ভেতরের ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল। পেছন থেকে ডাক পড়ল অকস্ম্যাৎ, ‘কী ব্যাপার? আজকাল কি বাপের খোঁজ খবর নেয়ার একেবারেই সময় হয়না?’ 

আকাশের পা আটকে গেল। ধীরেধীরে ঘুরে দাঁড়ালো সে। নতমুখে বলল, ‘খবর তো পাচ্ছিই রোজ। আলাদা ভাবে আবার কী খবর নিব?’

—‘সারা দিন থাকা হয়েছে কোথায় শুনি?’ 

—‘ক্লাস ছিল।’ 

—‘এই মাস্টারির চাকরি ছেড়ে ভালো কোনও চাকরি খোঁজার কি চেষ্টা করা হচ্ছে?’ 

আকাশ চোখ তুলে তাকাল সামনে বসা মানুষটার দিকে। মানুষটার মুখের কালো চামড়ার ওপর নীল শিরা ভেসে আছে। চোখের রঙ মৃত প্রাণীর মত সাদা। দেখলেই মনে হয় এই লোক গভীর কোনও অসুখে ভুগছে। কীসের অসুখ লোকটার? শরীরের? নাকি মনের? 

আকাশ স্তিমিত গলায় বলল, ‘আপাতত এই কাজটাই মন দিয়ে করতে চাইছি।’ 

—‘সংসারের দিকে একটু খেয়াল করতে হবে তো নাকি? আমার তো ব্যাবসা বানিজ্য কিছুই নাই এখন। আমার পক্ষে এই সংসার টানা আর সম্ভব না। তোমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’ 

—‘সংসার?’ প্রশ্নটা করে আকাশ হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে থাকে লোকটার দিকে। 

—‘সংসার নয়? এই সংসারের প্রতি তোমার কোনও দায়িত্ব নাই?’ 

আকাশের মুখ ঘেন্নায় বেঁকে যায়। তার খুব বলতে ইচ্ছে করে সংসার চালানোর মুরোদ না থাকলে সংসার করতে যাওয়া কেন? বউ মরার চল্লিশ দিনের মাথায় দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় খেয়াল ছিল না যে নিজে একটা রাম অপদার্থ? যে লোক নিজের সন্তানের ভরণ পোষণ দিতে পারেনা সে লাফিয়ে লাফিয়ে বিয়ে করতে যায় কোন মুখে? 

আকাশ মাথা নিচু করে জায়গাটা থেকে সরে আসলো। ডাইনিং রুমের ওপর দিয়েই তার নিজের ঘরে যেতে হয়। ডাইনিং পার করার সময় আকাশ দেখল টেবিলের ওপর ঢাকনা দিয়ে খাবার রাখা আছে। ঝুমকি বসে আছে একটা চেয়ারে এবং ঝুমকির ঠিক পাশে একটি অচেনা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আড়ষ্ট ভাবে। ঝুমকির বাপের বাড়ির লোকজন এ বাড়িতে তেমন একটা আসেনা। তার কোনও বন্ধুবান্ধব আছে বলেও মনে হয়নি কখনও আকাশের। তাহলে এই মেয়ে কে? আকাশ ভালো মতো একবার তাকাল মেয়েটার দিকে। বয়স কত তা ঠিক প্রথম দেখায় ঠাওর করা যায়না। চোখে মোটা কাচের চশমা। লম্বা, পুরু এক বেণী ঝুলছে পিঠের ওপর। পরনে ঘিয়া রঙের সুতির সালওয়ার কামিজ। প্রচণ্ড রোগা। গায়ে একটু মাংস লাগলে হয়তো চেহারাখানা সুন্দর হলেও হতে পারত। আকাশকে দেখে সে লজ্জায় কেমন কাদা কাদা হয়ে গেল। আকাশ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ঝুমকির দিকে তাকাতেই ঝুমকি একটু অপ্রতিভ ভাবে বলল, ‘ও আমার বোনের মেয়ে।’ 

—‘ও।’ বলল আকাশ দায়সারা ভাবে। 

ঝুমকি একটু ইতস্তত করে আবার বলল, ‘কটা দিন থাকবে আমার সাথে।’ 

আকাশের পা দুটো নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘এখানে থাকবে? 

—‘হ্যাঁ, আসলে ওর বাড়িতে একটু ঝামেলা চলছে তো, তাই আমার কাছে নিয়ে এসেছি।’ 

আকাশ আর কিছু না বলে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। বোঝা যাচ্ছে এই মেয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্যেই ঘাড়ে চাপতে এসেছে। তার বাপের তো নিজের বউকে খাওয়ানোর সামর্থ্য নেই। বউয়ের বোনের মেয়েকে খাওয়াবে কোত্থেকে? তাছাড়া এই বাসায় মাত্র দুটো বেডরুম। একটা আকাশের, অন্যটা তার পিতা এবং পিতার স্ত্রীর। এই মেয়েটা রাতের বেলা কোথায় শোবে? বসার ঘরে কোনও প্রাইভেসি নেই। একজন প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে কি ওরকম পথের ওপর থাকতে দেয়া যায়? বিরক্তি আর দুশ্চিন্তায় কিছু ভালো লাগছিলনা আকাশের। দায়িত্ব! সম্পর্ক গুলোতে দায়িত্ব, কর্তব্য বোধের উৎপত্তি হয় ভালাবাসা থেকে। মায়া মমতা থেকে। যেখানে মনের টান নেই, ভালোবাসা নেই সেখানে দায়িত্ব ব্যপারটা তো কেবল মাত্র বোঝা বই অন্য কিছু নয়! কেন এই বোঝা ঘাড়ে চাপাবে সে? ঝুমকি তার কে হয়? নাহ লোকটার সাথে এ ব্যাপারে সরাসরি কথা বলতে হবে। গেল মাসেও বাজার খরচ বাবদ আকাশের কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। ইলেক্ট্রিসিটি বিলও সে নিজের পকেট থেকে দিয়েছে। পিতৃদেবের বউ নিয়ে এত সংসার করার ইচ্ছা থাকলে নিজের পয়সায় করবে। আকাশের খাটনির পয়সা দিয়ে এসব ঢং করা চলবেনা। ঝুমকির জন্য সে আর একটা গাঁটের পয়সাও খরচ করবেনা। তার ওপর আবার উড়ে এসে জুড়ে বসেছে বোনের মেয়ে। এই মেয়েকে খাওয়াবে কে? ইশ! বাড়ি ফিরতে তার ভালো লাগেনা একেবারেই। যতক্ষণ বন্ধুদের সাথে থাকে ততক্ষণ মাথার ভেতর দুশ্চিন্তার পোকাগুলো ঘুমিয়ে থাকে। আর বাড়িতে ঢোকা মাত্র সে একজন গোমড়ামুখো রগচটা মানুষে রূপান্তরিত হয়। 

দরজায় ধাক্কা পড়ছিল। আকাশ দরজা খুলে ঘাড় বের করে দেখল ঝুমকি দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে একটা সবুজ সুতির শাড়ি। কপালের কাছের চুলগুলিতে এর মাঝেই পাক ধরেছে। সেই পাক ধরা চুলে জবজবে তেল। মনে হচ্ছে তেল দিয়ে গোসল করেছে সে। তার মুখ ভর্তি পান। পান চিবোতে চিবোতে সে বলল, ‘খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’ 

—‘আসছি। যান আপনি।’ খুব সংক্ষেপে কথাটা বলে দরজা আটকে দিল আকাশ। আজকাল একটু কেমন বিস্ময় বোধ হয় তার ঝুমকিকে দেখে। এই মহিলার সাথে সে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এক টানা দুর্ব্যবহার করে আসছে, এরপরেও মহিলা তার সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে কেন? এর কি আত্মসম্মান বোধ বলতে কিছু নেই? তার বাপও যে এর সাথে ভালো ব্যবহার করে তা কিন্তু নয়। রোজ রাতে নিষ্ঠুর ভাবে পেটায়। এতসব সহ্য করে মহিলা এখানে মুখ বুজে পড়ে আছে কেন? চলে গেলেই তো পারে! 

খাবার টেবিলে তখনও রোগা মেয়েটা বসে ছিল। গালে হাত দিয়ে আকাশকে দেখেই উঠে দাঁড়াল তটস্থ ভাবে। যেন আকাশ তার স্কুলের মাস্টার। ঘরে প্রবেশ করা মাত্র দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। ঝুমকি রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া ওঠা গরম ডালের বাটি নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, ‘ডাল রান্না করেছে তারা।’ 

—‘তারা?’ আকাশ চোখ তুলে প্রশ্ন করল, ঝুমকিকে। 

ঝুমকি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘হ্যাঁ তারা। আমার বোনের মেয়ে।’ 

আকাশ চামচ দিয়ে প্লেটে ভাত তুলে নিতে নিতে মেয়েটিকে বলল, ‘আপনি চাইলে বসতে পারেন। কোনও পানিশমেন্ট দেয়া হয়নি আপনাকে যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। 

মেয়েটি এই কথা শুনে আরও কেমন চুপসে গেল। বিব্রত ভাবে খালার দিকে তাকাল একবার। ঝুমকি বলল, ‘বসে পড়। দাঁড়িয়ে কেন? 

২২

ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে হৃদি নাক কুঁচকে বলল, ‘এত নোংরা হয়ে মানুষ কীভাবে থাকে? সারা বাসায় কেমন বিচ্ছিরি একটা গন্ধ। 

—‘কই আমি তো কোন গন্ধ পাচ্ছিনা। তোর নাকে সমস্যা।’ সামি বলল, নির্বিকার গলায়। 

হৃদির চোখ মুখ থেকে ঝরছে বিরক্তি। তার মেজাজ মর্জি এমনিতেই ভালো নেই। রবিনের সামনে একটু আগে সামি যে কান্ডটা করে এসেছে তা সে কিছুতেই ভুলতে পারছেনা। সামিকে দেখলেই তার গলা টিপে ধরতে মনে চাইছে। তার ওপর এরকম অগোছালো, ধূলো বালিতে ভরা ফ্ল্যাটে এসে সারা গা কেমন ঘিনঘিন করে উঠল। সে হ্যান্ড ব্যাগটা সোফার ওপর ছুঁড়ে ফেলে রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। ফ্ল্যাটটা ছয় তলার ওপরে হওয়ায় বেশ ভালোই আলো বাতাস খেলে। দিনের বেলা আর আলগা বাতি জ্বালানো লাগেনা। খোলা জানালা আর বারান্দা দিয়ে যতটুকু আলো আসে, তাতেই ফকফক করে চারপাশ। ডাইনিং টেবিলের ওপর রাজ্যের জিনিস পত্র। চায়ের কাপ পড়ে আছে আধোয়া অবস্থায়। কলা খেয়ে কলার চোকলা টি পর্যন্ত ফেলা হয়নি। বিস্কুটের টিনের ঢাকনা খোলা। সারা টেবিলে ছড়িয়ে আছে বিস্কুটের গুড়ি। ঘরের টাইলসের মেঝে হয়ে আছে আঠালো এবং ধূলোটে। পা ফেলতেই বোঝা যাচ্ছে গত এক সপ্তাহ যাবৎ এই মেঝে সাফ করা হয়নি। 

হৃদি মাথায় হাত দিয়ে ডাইনিং এর চেয়ারে বসে পড়ল, ‘আল্লাহ! এরকম নোংরা জায়গায় আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, আমার এখুনি দম আটকে আসতেছে। তোদের একটা ছুটা বুয়া ছিল না? ঘর মুছে দিত যে, সে কোথায়?’ 

—‘ভাগছে।’ সামি উল্টো দিকের চেয়ারে বসতে বসতে বলল।

—‘ভাগছে কেন? বেতন দিস নাই?’ 

—‘বেতন তো দিছি। কিন্তু বেটি তো আমার কাছে মোবাইল চায় তার পোলার জন্য।’ 

—‘তা দিতি একটা মোবাইল।’ 

—‘ট্যাকা কি গাছে ধরে? আমি নিজেই এক বছর ধরে ফোনের মডেল চেঞ্জ করতে পারতেছিনা। প্রতিদিন কত নতুন নতুন ইলেকট্রনিক্সের আবির্ভাব হচ্ছে দুনিয়ায়। শুধু চোখ দিয়া চায়ে চায়ে দেখতেছি, কিনতে পারতেছিনা। আর ওই বেটিরে মোবাইল কিনা দিব?’ 

হৃদি চিন্তিত গলায় বলল, ‘কিন্তু তোদের বাসার তো খুব খারাপ অবস্থা। আমার দ্বারা এই নোংরা সাফ করা সম্ভব হবেনা। দাঁড়া দেখি কোনো ব্যবস্থা করা যায় নাকি। 

কিছুক্ষণের মাঝেই হৃদি একটা ব্যবস্থা করে ফেলল। তাদের বাসায় যে ছুটা বুয়াটা কাজ করে তাকে ফোন করে পাওয়া গেল। হৃদির প্রস্তাবে চট করে রাজিও হয়ে গেল সে। কিন্তু গাড়ি ভাড়া বাবদ আলাদা টাকা দেয়া লাগবে, সেই সাথে সার্ভিস চার্জ তো আছেই। বুয়া জানালো ঘন্টা খানেক সময় লেগে যাবে তার এখানে পৌঁছুতে। এর মাঝে হৃদি রান্নার কাজ শুরু করে দিল। তার পরনে ‘ইয়েলো’ থেকে কেনা ছয় হাজার টাকা মূল্যের একটি কুর্তি ছিল। এই জামাটি তার বড়ই পছন্দের। হালকা সবুজ রঙের সুতি কাপড়ের ওপর সবুজ সুতোর কাজ করা। জামার ঢংটাও চমৎকার। সামনের দিকে খাটো, পেছন দিকে পায়ের গোড়ালি ছোঁয়া লম্বা। এই সাধের জামা পরে এখন সে রান্না করবে? মশলার একটু দাগ লেগে গেলেই তো সর্বনাশ। 

সামি ড্রইং রুমের সোফায় আধশোয়া অবস্থায় হেলান দিয়ে বসে টিভি দেখছে। টিভিতে চলছে ‘স্ট্রেঞ্জার থিংগস’ সিজন থ্রি, এপিসোড টু। হৃদি সেখানে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘এইযে নবাব জাদা, ঠ্যাং তুলে বসে টিভি দেখলে হবে নাকি শুধু? আমাকে একটু সাহায্য করতে হবেনা? 

সামি টিভি থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিল, ‘আমি কোনো সাহায্য টাহাজ্য করতে পারবনা।’ 

হৃদি কোমরে হাত দিয়ে বলল, ‘কেন পারবিনা? আমি কি তোদের চাকর? কয় টাকা দিবি আমারে বল?’ 

—‘ঐটা তুই রুদ্রর সাথে নেগোশিয়েট করে নিস। আমি এসবের মধ্যে নাই।’ 

হৃদি রাগে গজগজ করতে করতে রিমোট হাতে নিয়ে ফট করে টিভিটা বন্ধ করে দিল। 

—‘সমস্যা কী তোর হৃদিতা? কেন বিরক্ত করতেছিস? একটু শান্তিতে থাকতে দে নারে বাপ!’ 

—‘আমাকে অশান্তিতে রেখে তুই নিজে শান্তিতে থাকতে চাস?’

—‘তোকে আমি কী অশান্তিতে রাখলাম? 

হৃদি একদম ঝগড়াটে গলায় বলে উঠল, ‘তুই রবিনকে কেন বলতে গেছিস ওই ফালতু কথাটা? তোর কি লজ্জা শরম নাই?’ 

—‘খুব ভালো করছি বলছি। একশো বার বলব। সবাইরে বলব। তোর কী তাতে?’ রাগে সামির ফর্সা গাল টকটকে লাল হয়ে গেছে তখন। 

হৃদি বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আমার কী তাতে? আমার নামে তুই বদনাম রটাচ্ছিস, আর বলছিস আমার কী তাতে? তোর কি মাথার স্ক্রু সবগুলা ঢিলা হয়ে গেছে? এখন রবিন যদি এই কথাটা সবাইকে বলে বেড়ায়? যদি… যদি আমার বাপ মায়ের কানে কথাটা চলে যায়?’ 

সামি অতটা সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা করেনি। কখনো করেও না। সে কথাটা শুনে একটুখানি চুপ করে থেকে বলল,’গেলেই কী? এটা এমন কোনো ঘটনা না। তুই প্রেগনেন্ট হয়ে যাস নাই।’ 

—‘তোর কথা শুনলে না, মাঝে মাঝে তোরে আমার সত্যি থুতু মারতে মনে চায়।’ 

সামি এবার তীক্ষ্ণ গলায় বললো, ‘আরেকবার থুতু মারার কথা বললে কিন্তু আমিই তোর মুখে থুতু মারব। মাইন্ড ইট।’ 

হৃদি টিভির রিমোটটা সামির দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল, ‘আমাকে একটা এপ্রন দে।’ 

সামি হাত বাড়িয়ে রিমোট টা লুফে নিল। তাকে দেখে মনে হল এমন আজগুবি কথা সে জীবনে কোনো দিন শোনেনি। অবাক হয়ে বলল, ‘এপ্রন কোথায় পাবো আমি?’ 

—‘তোর বাসায় কোনো এপ্রন নাই?’ 

—‘না!’ 

—‘আশ্চর্য!’ 

—‘আশ্চর্যের কী আছে? এপ্রন দিয়া আমরা কী করবো?’ 

—‘কী আর করবি, ভাজি করে খাবি। বাল! কোন দুঃখে যে আমি রান্না করার প্রস্তাবটায় রাজি হইছিলাম।’ 

—‘তোর সমস্যা কী আমি বুঝলাম না। তোরে আমার অসহ্য লাগতেছে হৃদি। প্লিজ দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। 

—‘আমাকে কিসু একটা দে।’ 

—‘কী দিব?’ সামি বিস্মিত।

—‘দে কিসু একটা, যেটা পরে আমি রান্না করতে পারব।’ 

‘রান্নার জন্য কি আলাদা পোশাক লাগে নাকি?’ 

—‘এখন লাগবে। কারণ এই জামাটা আমার অনেক প্রিয়। এই জামা পরে আমি রান্না করব না।’ 

—‘রান্না করার জামা আমি কোথায় পাব?’ সামি মহা বিরক্ত। 

—‘তোর টি শার্ট দে একটা।’ 

—‘আমার টি শার্ট তোর হবে?’ 

—‘পরা গেলেই হবে।’ 

অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হল সামিকে। খুঁজে পেতে একটা স্কাই ব্লু রঙের টি শার্ট নিয়ে আসল সে। হৃদির পরনে কালো টাইটস ছিল। টাইটসের ওপর সামির টি শার্ট টা গায়ে চড়াতেই ভারী অদ্ভুত দেখালো তাকে। টি শার্ট আরেকটু হলেই তার হাঁটু ছুঁয়ে ফেলবে। হাতা গুলো ঢলঢল করছে। দেখে সামি ডাকাতের মত হো হো করে হাসতে লাগল। বলল, ‘যা লাগতেছে না তোকে, এখন একটা ছবি তুলে রবিনরে পাঠায় দেই কেমন? ছবি দেইখাই ভাগবে শালা। 

সামির হাসি তামাশা সম্পূর্ণ ভাবে উপেক্ষা করে কাজে লেগে গেল হৃদি। ছুরি, চপিং বোর্ড নিয়ে বসে গেল সবজি কাটতে, ডাইনিং টেবিলে। টেবিলটা আগে পরিষ্কার করে নিতে হয়েছে তার। ওদিকে সোফায় হেলান দিয়ে বসে টিভি দেখছে সামি। তার গায়ে একটা সাদা কালো চেকের ফুল হাত শার্ট। মুখে এলোমেলো দাড়ি। গত কয়েকদিনেই বেশ একটু শুকিয়ে গেছে সে। দেখলে বোঝা যায় মানুষটার মনের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে। রোগা ভাব আসলেও তার মুখখানা এখনও বড়ই শ্রীময়, ধারালো এবং আকর্ষণীয়। ছুরি দিয়ে আলু কাটতে কাটতে হৃদি সামিকেই দেখছিল। ঠিক তখনই ঘটল অঘটন টা। ছুরির পৌঁচ আলুর ওপর না পড়ে, পড়ল আঙুলের ওপর। একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসলো হৃদির মুখ থেকে। চমকে উঠল সামি। দৌড়ে এসে দেখল হৃদির বাম হাতের কানি আঙুল রক্তাক্ত হয়ে আছে। অস্থির হয়ে গেল সে। ছুটে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসলো। হৃদির আঙুলে স্যাভলন সমেত তুলো চেপে ধরে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘পারিস না করতে একটা কাজ। কে বলছে তোরে এইসব রান্না বান্না করতে? এসব তোর দ্বারা হবেনা। করতে হবেনা কিছু।’ 

হৃদি কাঁচুমাচু হয়ে গেল, ‘না না রুদ্রকে আমি কথা দিছি।’

—‘কথা দিলে কিছু হয়না। তোর এত কষ্ট করতে হবেনা। আমি রুদ্রকে বুঝায় বলব।’ 

—‘না তুই কিছুই বলবিনা। খবরদার।’ 

আঙুলে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে সামি খুব বিষণ্ণ ভাবে বলল, ‘আমার হিমোফোবিয়া আছে। রক্ত দেখতে পারিনা। সমস্যা হয়। মাথা ঝিম ঝিম করতেছে এখন 

-‘হ্যাঁ জানি আমি। সরি। আচ্ছা যা টিভি দ্যাখ। আর বিরক্ত করবো না তোরে।’ 

সামি বিষণ্ণ মুখ নিয়েই উঠে গেল। হৃদি সবজি টবজি কেটে নিয়ে রান্নাঘরে আসলো। রান্না করা শিখেছে সে খুব বেশিদিন হয়নি। তিন চার মাস আগে মায়ের হঠাৎ টাইফয়েড ধরা পড়ল। বাড়িতে কাজের লোক ছিল কিন্তু কাজের লোকের হাতের রান্না বাবার মুখে রোচে না। মা বললেন তোমার বাবার পছন্দ মত রান্না কী করে করতে হয় আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। সেই প্রথম তার রান্নায় হাতেখড়ি হল। কদিনের মাঝেই আবিষ্কার করল যে তার রান্নার হাতটা আসলে বেশ ভালো এবং রান্না করে সে আনন্দও পায়। মা সুস্থ হবার পর বন্ধুদের একদিন বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়াল। তারপর আর কী, ঝুড়িতে প্রশংসা উপচে পড়ল! 

সামির টি শার্টটায় মনে হয় কোনো ম্যাজিক আছে। ওটা গায়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে হৃদির মন ভালো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সামি তার খুব কাছে আছে। একদম নিজের মানুষ হয়ে। সে মনে মনে ঠিক করল টি শার্টটা আর ফেরত দেবেনা। রেখে দেবে নিজের কাছে। রান্না শুরু করার খানিক বাদেই সামি এসে উঁকি দিল রান্নাঘরে। চুলার আগুনের আঁচ লেগে হৃদির মুখ লাল হয়ে গেছে। নাকের ডগার বিন্দু বিন্দু ঘাম জানালা দিয়ে আসা শেষ দুপুরের রোদে চিকচিক করছে। সামি কখন এসে দাঁড়িয়েছে হৃদি খেয়াল করেনি। হঠাৎ চোখ পড়তেই বলল, ‘কীরে, কী চাই?’ 

—‘তুই ঘামতেছিস কেন? তোর কি কষ্ট হচ্ছে?’ 

—‘না কষ্ট হচ্ছেনা।’ 

—‘দেখে মনে হচ্ছে তোর কষ্ট হচ্ছে।’ 

—‘একেবারেই কষ্ট হচ্ছেনা।’ 

—‘রান্নাবান্না খুব ঝামেলার কাজ। আমি আমার বৌকে কখনো রান্নাঘরে যেতেই দিব না।’ 

—‘তোর বৌকে রান্নাঘরে যেতে হবেনা। বড়লোকের বৌদের রান্না টান্না করতে হয়না।’ 

—‘আমি তো বড়লোক না। বড়লোক আমার বাপ।’ 

—‘ওই একই কথা। 

সামি আর কিছু বলল না। হৃদির কাজ দেখতে লাগল। বাইরে একটা কমলা রঙের পেলব দুপুর। রাস্তা থেকে ভেসে আসছে গাড়ির হর্ন আর রিক্সার টুংটাং। সামনের বাড়ির ছাদে কয়েকটা টিনএজ ছেলে রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। থেকে থেকে তাদের হাসির শব্দে কেঁপে উঠছে সারা পাড়া। শীত বাতাসে হালকা দোল খাচ্ছে ছাদের রশিতে শুকোতে দেয়া ঢাকাই শাড়ির আঁচল, বাচ্চা ছেলের শার্ট প্যান্ট, লুঙ্গি। নিত্যদিনের চিরচেনা এক দুপুর। তবুও, কোনো এক বিচিত্র কারণে সামির হঠাৎ মনে হল আজকের দুপুরটা যেন একটু অন্যরকম। বাতাসে কী যেন মিশে আছে! একটু সুগন্ধ, একটু শিহরণ! কিন্তু সব কিছুই বড় আবছা। সামি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে সেই অন্যরকম আবছা দুপুরের অস্তিত্বটাকে কিছুক্ষণ মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করল। তারপর নীরবে প্রস্থান করল। মিনিট দশেক বাদে আবার আসল। কোনো কথা না বলে দু তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলেও গেল। হৃদির মনটা বড়ই ফুরফুরে লাগছিল। ভালো লাগার ভোমরাটা গুনগুন করে উড়ে বেড়াচ্ছিল মনের পাশে, কানের কাছে। তার যেদিন একলা একটা সংসার হবে, এরকম ছুটির দিনের নিরালা দুপুর গুলোতে মন প্রাণ ভরে রান্না করবে। তারপর রান্নাঘরের দরজায় একটু পর পর ঠিক এমনি ভাবেই উঁকি দেবে ভালোবাসার মানুষটা। এটুকু ভাববার পরেই তার মনটা হঠাৎ ঝুপ করে খারাপ হয়ে গেল। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ল অজান্তেই। সেই ভালোবাসার মানুষটা কখনোই সামি হবেনা। সামি তো বিয়ে করতে যাচ্ছে অন্য একজনকে। অন্য যাকেই বিয়ে করুক না কেন, হৃদিকে সে কখনোই বিয়ে করবেনা। বলেই তো দিয়েছে, প্রয়োজনে নিজের কান কেটে ফেলবে, তবুও হৃদিকে বিয়ে করবেনা। ভাবতে ভাবতে হৃদির কপালে ভাঁজ পড়ে যাচ্ছিল। খুন্তি দিয়ে তরকারি নাড়ছিলো সে। পেছনে একটা ছায়া টের পেল হঠাৎ। চুলার আঁচ কমিয়ে পেছন ফিরতেই দেখলো সামি দাঁড়িয়ে আছে, খুব কাছে। 

—‘কী চাই?’ 

সামি টিস্যু পেপার দিয়ে খুব মনোযোগের সাথে হৃদির কপাল আর নাকের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল, ‘কিছু চাইনা।’ 

—‘বিরক্ত করছিস কেন? 

সামি হৃদির লালচে গালদুটোর দিকে স্থিরভাবে চেয়ে থেকে ভারী গম্ভীর গলায় বলল –’আর কোনো দিন রান্না করবিনা তুই।’ 

হৃদি হেসে ফেলল।

–’হাসছিস কেন?’ 

—‘আমি রান্না না করলে করবেটা কে? আমার বর?’ 

—‘হ্যাঁ প্রয়োজনে সেই করবে। বাড়িতে কাজের লোক রাখবে।’

—‘আমার বর তো তোর মত বড়লোক হবেনা। অত কাজের লোক রাখার টাকা পাবে কই?’ 

—‘টাকাওয়ালা লোকের সাথেই বিয়ে দেব তোকে।’ 

হৃদি মগ্ন চোখে চেয়ে ছিল সামির দিকে। কয়েক সেকেন্ড গড়াতেই সামির চোখেও দেখা দিল একটু কেমন বিভ্রম! সে হৃদির লালচে গালে একটা হাত রেখে বলল, ‘রবিনকে কথাটা বলেছি বলে তুই এত ক্ষেপলি কেন?’ 

হৃদি উত্তরটা জানে। রেগে যাবার কারণ হল রবিন সর্বদাই ওর ছেলে বন্ধুদের নিয়ে হাবিজাবি সন্দেহ করত। এখন সে সবাইকে সদর্পে বলে বেড়াবে যে হৃদি বন্ধুত্বের নাম করে ছেলেদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়। কথাগুলো সামিকে গুছিয়ে বলবে বলে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু ওই একলা দুপুরের কমলা রোদে, সামির অত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থেকে সে সব কথা গুলিয়ে ফেলল। দারুণ এক শব্দহীনতায় পেয়ে বসল তাকে। 

কলিং বেলটা তারস্বরে বেজে উঠল ঠিক সেই সময়েই। চমকে উঠল হৃদি। দৌড়ে ছুটে গেল দরজার কাছে। বুয়া এসেছে। দরজা খুলে দিয়ে রান্নাঘরে ফেরত এসে সে দেখল সামি তখনো দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। তার চোখে মুখে একটু কেমন বিহ্বল ভাব। হৃদি আসতেই সে অস্থির হয়ে বলল, ‘তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দিলিনা?’ 

হৃদির পেছন পেছন বুয়া ঢুকল রান্নাঘরে। হৃদি বলল, ‘তুই ভাগ এখান থেকে। 

—‘শোন হৃদি, রবিনকে আমরা কেউ পছন্দ করিনা। তুই কিন্তু কোনো ভাবেই ওর কাছে ব্যাক করার কথা চিন্তা করিস না।’ 

—‘সে পরে দেখা যাবে।’ 

—‘হোয়াট পরে দেখা যাবে। এটাই ফাইনাল।’ 

হৃদি হাসে, ‘ভাগবি? নাকি থুতু মারব? এখন গিয়ে শেভ টেভ করে একটু মানুষ হ। বিকালে তো যাবি মেয়ে দেখতে।’ 

.

হক সাহেব কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় বক্তব্য রেখে মঞ্চ থেকে নামছিলেন। সেই সময় তার মোবাইলে ফোনটা আসল। ধরতেই ওপাশ থেকে একটা চপল গলা বলে উঠল, ‘মিস্টার হক,সময় হবে আপনার?’ 

হক একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘খুব জরুরি কিছু বলার আছে কি?’ 

—‘হ্যাঁ জরুরি তো বটেই।’ 

—‘এখুনি বলতে হবে? নাকি পরেও বলা যাবে?’ 

—‘পরে বলা যাবে।’ 

—‘তাহলে অমৃতা, আমি রাতে বাড়ি ফিরে তোমাকে ফোন করি?’

—‘হ্যাঁ, শিওর!’ 

—‘এখন রাখছি।’ 

দরজায় করা নাড়ছিল কেউ একজন। অমৃতা দরজা খুলতেই দেখল বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। 

—‘কী করিস মা?’ 

—‘এইতো তেমন কিছুনা। এসো, ভেতরে এসো।’ 

বাবা ভেতরে ঢুকে বিছানার ওপর বসে বললেন, ‘তোর প্র্যাকটিস কেমন চলছে?’ 

—‘ভালোই।’ 

—‘সুপ্রিম কোর্টের পরীক্ষাটা কি এবার দিবি?’ 

—‘দেব বাবা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পড়াশোনার টাইম পাচ্ছিনা। প্র্যাকটিসের পাশাপাশি প্রজেক্টের কাজ করতে হচ্ছে তো!’ 

—‘ওই কাজটা আপাতত বন্ধ রাখ। 

—‘না বাবা তা হয়না। আমার তো দুই বছরের কন্ট্রাক্ট হয়েছে ওদের সাথে। এর আগে আমি কুইট করতে পারব না। তাছাড়া এখানে একটা সুবিধা হচ্ছে আমি বাসায় বসে অনলাইনে কাজ করতে পারি। রোজ অফিস যেতে হয়না। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট না?’ 

—‘হুম। তা বটে। আচ্ছা শোন তোর সেই বন্ধুর বাবার সাথে দেখা হয়েছিল গত কাল’

অমৃতা প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারলোনা বাবা ঠিক কার কথা বলছেন।

—‘কোন বন্ধুর বাবা?’ 

—‘ওই যে, এম পি সাহেব। গতকাল আমার বন্ধু আরিফের বাসায় গিয়েছিলাম, উত্তরা। সন্ধ্যার পর হাঁটতে বেরিয়েছি দুই বন্ধুতে মিলে। হঠাৎ উনার সাথে দেখা।’ 

অমৃতা কান খাড়া করল,’কোথায় দেখা হল?’ 

—‘রাস্তায়। উনি গাড়িতে ছিলেন। আমাকে দেখে গাড়ি দাঁড় করালেন। 

নেমে এসে নিজ থেকে কথা বললেন। 

—‘তাই নাকি? কী বললেন?’ 

—‘খুব অদ্ভুত একটা কথা বললেন। 

-‘কী কথা?’ একটা বাধঁছেড়া কৌতূহল অমৃতার নিশ্বাস আটকে দিচ্ছিল। 

—‘বললেন বছর তিনেক আগে তিনি নাকি আমাকে ভুল করে একটি অপমানজনক কথা বলে ফেলেছিলেন। সেজন্যে তিনি আন্তরিক ভাবে ক্ষমা প্রার্থী। তবে কথাটি তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে অপমান করার জন্য বলেননি, এবং বলার সময় তাঁর মনেও হয়নি যে কথাটা অপমানজনক। কিন্তু পরে রিয়ালাইজ করেছেন যে এমনটা বলে তিনি ঠিক করেন নি। আমি বুঝতে পারলাম না উনি কী বিষয়ে কথা বলছেন। জানতে চাইলে বললেন আমার মনে না থাকলে নাকি ঝামেলা এর মাঝেই চুকে গেছে। ওসব কথা আর তুলে লাভ নেই। 

জন্মগত ভাবেই অমৃতার বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা কম। বিস্ময় জিনিসটা তার ভেতরে নেই বললেই চলে। কিন্তু বাবার মাত্র বলা কথাগুলো তাকে বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে দিল। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা। সে হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আর কী বললেন?’ 

—‘আর তেমন কিছুই বলেন নি। তোর কথা জানতে চাইলেন। তুই কেমন আছিস, তোর প্র্যাকটিস কেমন চলছে এইসব।’ 

—‘ও আচ্ছা।’ 

—‘উনি কিসের কথা বলেছেন, তোর কি কোনো ধারণা আছে?’

—‘তোমার কিছু মনে নেই?’ 

—‘না, আমার তো কিছু মনে নেই রে মা!’ 

—‘তাহলে আমারও কিছু মনে নেই।’ 

—‘ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। তুই কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবি?’ 

—‘বাবা, বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। তুমি যাও এখন। আমার কাজ আছে।’ 

বাবা সাথে সাথে চলে গেলেন না। বসে থেকে অমৃতার কর্মজীবনের খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। উঠলেন আরো মিনিট দশেক সময় পরে। তিনি চলে যাবার পর অমৃতা কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে বসে রইল। লোকটা যে বাবার কাছে সরাসরি ক্ষমা চেয়ে বসবে এটা তার ধারণাতেও ছিলনা। পুরো বিষয়টা কেমন আশ্চর্য ঠেকছে তার কাছে। কিন্তু ভালোও লাগছে। কেন যে কথাটা শোনার পর থেকেই তার এত বেশি ভালো লাগছে তা সে জানেনা। কাজে মন বসছিলনা। একটু বাদে বাদে মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছিল সে। লোকটা বলেছে রাতে ফোন দেবে। রাত হতে আর কতক্ষণ বাকি? শেষবার কথা হয়েছিল দমদম এয়ারপোর্টে। বোর্ডিং হবার খানিক আগে ফোন করলেন। জানতে চাইলেন সব ঠিকঠাক আছে কিনা। খুব বেশিক্ষণ নয়, দুই তিন মিনিট সময় কথা হয়েছিল। সেদিনের পর কেটে গেছে আরো তিন দিন। মাত্র তিন দিন, অথচ অমৃতার মনে হচ্ছে যেন তিন বছরেরও অধিক সময়। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। কাজ পড়ে আছে। সে কাজ পাগল মানুষ। কাজ ছাড়া তার বেঁচে থাকাই দায়। ল্যাপটপ খুলে নিয়ে বিছানায় বসল সে। একটা রিট পিটিশন লিখতে হবে। ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজে তখন। রিট পিটিশন লিখতে গিয়েও অমৃতার চোখ দুটি মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে ছুটে যাচ্ছিল বারংবার। কিন্তু ফোনটা আর সে রাতে এলো না। ঘুমোতে যাবার আগে সে মনে মনে বলল, 

‘অমৃতা চৌধুরী, তোমাকে কি এসব ছোট খাটো বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া মানায়? আজকের পর থেকে আর কোনোদিন কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করবেনা তুমি, কেমন? তোমার জন্য লোকে অপেক্ষা করবে। তুমি কারো জন্য অপেক্ষা করবেনা। তোমাকে এসবে মানায় না।’ 

কথা গুলো বলে শেষ করে অমৃতা একটি প্রলম্বিত তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলল। নিজের সাথে বোঝাপড়ায় সে সর্বদা সক্ষম। তার মন বুঝ মেনে গেল। ঘুম আসতে খুব বেশি সময় লাগলো না। কাল সকালে আরেকটি কর্মব্যস্ত দিনের সূচনা হবে। শনিবার দিনও তার চেম্বার খোলা থাকে। কাজের সাথে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে বেঁচে থাকার জন্য কাজ করেনা, কাজ করার জন্য বেঁচে থাকে। কেজো মানুষের সময় মত ঘুমোতে হয়, সময় মত জাগতে হয়! 

হক সাহেব সাধারণ সভা থেকে সরাসরি গেলেন স্কয়ার হাসপাতালে তার ফুপুকে দেখতে। সেখানে আধা ঘন্টার মত সময় কাটিয়ে চললেন পার্টির মিটিং এ। পার্টির মিটিং গুলো লেট নাইট হয়ে যায়। আজকেও মিটিং শেষ হতে হতে বারোটা বাজল। বাড়ি ফিরলেন অত্যন্ত ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাতের খাবার খেয়েই শুয়ে পড়লেন তিনি। ঘুম ভাঙল ঠিক ফজরের ওয়াক্তে। ঘুমটা ভাঙার সাথে সাথেই মনে পড়ল, অমৃতাকে তাঁর একটা ফোন করার কথা ছিল। 

নামাজ আদায় করে তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। ঘরে তার স্ত্রী ঘুমোচ্ছেন। স্ত্রীর ভারী নিশ্বাসের শব্দ বারান্দা পর্যন্ত ভেসে আসছে। কাকদের দল জেগে উঠেছে এর মাঝেই। সদলবলে ডাকছে তারা। বাড়ির সামনেই একটি স্কুলের ক্যাম্পাস। সেই সুবাদে অনেক খানি খালি জায়গা পাওয়া গেছে। সম্মুখেই ফাঁকা স্কুল মাঠ। খোলা মাঠের ওপর বাতাস ইচ্ছে মত চড়ে বেড়ায়। বারান্দায় বা ছাদে দাঁড়াতে তাই ভালোই লাগে। অমৃতাকে এখন ফোন দেয়াটা কি উচিৎ হবে? হয়তো হবেনা, কিন্তু এখন কথা বলে না নিলে সারাদিন তিনি আর সময়ই পাবেন না। দিনের শুরুতে আর রাতের শেষেই তিনি নিজের জন্য যা একটু সময় পান। মেয়েটার কি ভোরে ওঠার অভ্যাস আছে? ভাবতে ভাবতে ফোনের ডায়াল লিস্ট থেকে নম্বরটা খুঁজে বের করলেন তিনি। ফোন করলেন। চতুর্থ বার রিং পড়ার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে গলাটা ভেসে আসল। 

—‘সিরিয়াসলি?’ 

হক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বললেন, ‘কী হল?’ 

অমৃতা লেপের তলা থেকে বলল, -’আপনার এতক্ষণে ফোন করার সময় হল?’ 

—‘তুমি কি ঘুমোচ্ছিলে?’ 

—‘এত ভোরে ঘুমোবো না তো কী করবো?’ 

—‘ওহ, সরি। আচ্ছা ঘুমোও,পরে কথা বলব।’ 

—‘ঘুমটা ভেঙে দিয়ে এখন পরে কথা বলব, মানে কী এসবের?’ 

হক বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। সারাদিন এতো হোমরা চোমরা লোকদের সাথে যে তিনি ওঠা বসা করেন, কেউ তাকে এমন বেকায়দায় ফেলতে পারেনা, যেমনটা এই মেয়ে পারে। ক্যাট ক্যাট করে কথা বলে মুখের ওপর। হক কী বলবেন খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইলেন। অমৃতা তেজি গলায় প্রশ্ন করল, ‘রাতে ফোন করেননি কেন?’ 

একই কথা একেক লোকে বলে একেক রকম ভাবে। ঠিক এই কথাটাই অন্য লোকে তার সাথে বললে তিনি হয়তো খুব রেগে যেতেন। বেয়াদব বলে গালাগালও দিয়ে বসতেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, অমৃতা যখন বলল, ভুলেও তার কাছে উদ্ধত কোনো আচরণ বলে মনে হলোনা বরং মনে হল যেন এই মেয়েটির তার সাথে ঠিক এভাবেই কথা বলার কথা। দোষ তো তাঁরই। তিনিই ফোন করতে ভুলে গেছেন। 

—‘দুঃখিত। আমি আসলে বাড়ি ফিরেছি খুব লেট নাইটে। টায়ার্ড ছিলাম, তাই তোমাকে আর ফোন করার সময় পাইনি।’ 

—‘কাজ তো শুধু আপনি একাই করেন। অন্য লোকের তো আর কাজ নেই। 

হক হেসে বললেন, ‘তুমি তো দেখি রেগে আছ খুব।’ 

—‘মোটেও রেগে নেই আমি। আমার এসব ফালতু ব্যাপার নিয়ে রাগ করার সময় নেই।

-‘ও তাই?’ 

—‘হ্যাঁ তাই।’ 

—‘কী যেন বলার ছিল তোমার?’ 

—‘আগামী কাল আপনার ছেলের জন্মদিন। মনে আছে?’ 

—‘হ্যাঁ মনে আছে।’ 

—‘শুনুন, আমরা একটা সারপ্রাইজ পার্টি করছি। আপনি কি আমাদের সাথে আছেন?’ 

—‘কী রকম সারপ্রাইজ পার্টি?’ 

—‘প্ল্যান হল যে কালকে বিকালে আমার বন্ধু রুদ্র, সামিকে নিয়ে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে যাবে। আপঝাপ নানা কাজে আটকে রাখবে ওকে। বাড়ি ফিরবে রাত বারোটায়। ততক্ষণে আমরা বাসা সাজিয়ে ফেলব। সামি রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে পুরাই সারপ্রাইজড হয়ে যাবে।’ 

—‘আচ্ছা… তো এখানে আমার কী ভূমিকা থাকতে পারে? 

—‘আপনি আন্টিকে নিয়ে চলে আসবেন রাত এগারোটার দিকে।’

—‘কোথায়?’ 

—‘কোথায় আবার, সামিদের ফ্ল্যাটে।’ 

হক চুপ করে গেলেন। ছেলের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়না প্রায় ন মাস। এই ন মাসে ছেলে তার সাথে নিজ থেকে কোনো যোগাযোগ করেনি। তিনিও আত্মসম্মান বোধ বজায় রাখার নিমিত্তে গায়ে পড়ে ছেলের সাথে কথা বলেননি। আজ এতদিন পর হুট করে না বলে কয়ে ছেলের বাসায় গিয়ে হাজির হওয়াটা কি তার জন্য সমীচীন হবে? অমৃতা অধৈর্য গলায় বলল, ‘কী হল? কথা বলছেন না কেন?’ 

—‘আসলে, আমার যাওয়াটা মনে হয় ঠিক হবেনা।’ 

—‘কেন?’

—‘দেখো সামির সাথে আমার কথা হয়না বেশ অনেক দিন যাবৎ। সে তো নিজ ইচ্ছায় আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি…’ 

—‘উফ মিস্টার হক আপনি কেন বুঝতে পারছেন না যে সামি আপনার ওপর অভিমান করে আছে। সে আপনাকে প্রচন্ড মিস করে। ঠিক আপনার মতো সেও ভাবছে যে আপনি কেন নিজের ইচ্ছায় ওর সাথে কথা বলছেন না।’ 

কিছুক্ষণ নীরবতা। অমৃতা বলল, ‘এতো কমপ্লেক্স কাজ করছে কেন আপনার ভেতরে? আমার কথা শুনুন, রাজি হয়ে যান। শেষটায় আপনিই জিতবেন। কথা দিচ্ছি।’ 

—‘আমি একটু চিন্তা করে দেখি। এখনই শিওর ভাবে কিছু বলতে পারছিনা।’ 

—‘এতো চিন্তা করতে হবেনা। আপনাকে আসতেই হবে। আন্টিকে নিয়ে ঠিক এগারোটায় চলে আসবেন।’ 

—‘এগারোটার মধ্যে আমার কাজ শেষ হবে কিনা তা তো বলতে পারছিনা।’ 

—‘হতেই হবে। আর আমি আন্টিকে ফোন করে বুঝিয়ে দেব প্ল্যানটা।’ হকের যেন হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল এমন গলায় বললেন, ‘সামির আম্মাকে তুমি আন্টি ডাকো কিন্তু আমাকে নাম ধরে ডাকা কেন? এ তো ভীষণ অন্যায়।’ 

অমৃতা কণ্ঠে কপট বিস্ময় ফুটিয়ে তুলে বলল- ‘তা, কী ডাকা উচিৎ আপনাকে?’ 

—‘বন্ধুর বাবাকে লোকে কি নাম ধরে ডাকে? আংকেল ডাকলেই তো পারো।’ 

—‘আংকেল ডাকব কেন? মাথা খারাপ নাকি?’ 

—‘মাথা খারাপের কী হল। এটাই তো স্বাভাবিক।’ 

অমৃতা এবার দৃঢ় গলায় বলল, ‘জীবনেও না। দুনিয়ার সবাইকে আংকেল ডাকলেও আপনাকে আমি কিছুতেই আংকেল ডাকব না! 

হক হেসে ফেললেন। কিঞ্চিৎ কৌতুকও বোধ করলেন। মজা পাওয়ার গলায় বললেন, ‘কেন?’ 

—‘সব প্রশ্নের উত্তর হয়না। ডাকব না, ব্যাস ডাকব না। এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন!’

.

—‘আজ তো ছুটি। সারাদিন কী করছেন?’ 

—‘কোনও প্ল্যান নেই তো! কেন আপনি কোথাও যেতে চান?’ খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বিভার প্রশ্নের উত্তর দিল অভিজিৎ। খাবার টেবিলের এক প্রান্তে বসে আছে সে, অন্য প্রান্তে বিভা। টেবিলের ওপর রাখা দুটি গরম চায়ের কাপ। চায়ের কাপ থেকে এঁকেবেঁকে নির্গত হচ্ছে ধোঁয়া। সেই ধোঁয়া উড়ে উড়ে মিশে যাচ্ছে সকাল বেলার স্বচ্ছ ঝকঝকে রোদের সাথে। উঠোনে বাকবাকুম শব্দে পায়রা গুলো ক্রমাগত ডেকে চলেছে। দূর্গা ওদের জন্য খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছে। মুখে ডাকছে, আ, আ, আ। 

—‘কোথায় যাব? আমি কি এখানে কিছু চিনি নাকি? যা জংলি এলাকা। একলা ঘর থেকে বেরোতেই ভয় হয়।’ 

—‘আপনাকে একা যেতে হবে কেন? 

—‘দোকা পাবো কোথায়? আপনার তো মশাই আমার জন্য সময়ই হয়না!’ 

ধোঁয়া মেশানো রোদের ভেতর দিয়ে অভিজিৎ বিভার দিকে তাকাল। বিভা একটু আগেই স্নান করেছে। তার পরনে একটা ফিরোজা রঙের সুতির সালওয়ার কামিজ। ভেজা চুলের মাঝ বরাবর সিঁথি ভর্তি সিঁদুর। গরম চায়ের কাপ থেকে উঠতে থাকা ধোঁয়া ভেদ করে, আয়নার মত স্বচ্ছ শীত সকালের মিষ্টি রোদের ভেতর দিয়ে, অভিজিতের দৃষ্টি যখন বিভার ওই সদ্য স্নান করা পান পাতার মত সতেজ মুখ খানির ওপর গিয়ে পড়ল, তখন মনে হল দূর অন্তরীক্ষের স্বর্গ লোক থেকে বুঝি একটি পবিত্র স্নিগ্ধতার ধারা, সুধা স্রোতের মতো এসে বাড়ি খেলো তার হৃদয় মাঝারে। সে কিছুটা ক্ষণ কোনও কথা বলল না। চুপটি করে চেয়ে রইল বিভার দিকে। 

বন্ধুরা চলে যাবার পর কেটে গেছে চারটি দিন। এই চারদিন অভিজিৎ ছিল সীমাহীন ব্যস্ত। তার অফিসের অডিট শুরু হয়েছে। এত কাজের চাপ যে মনে হচ্ছিল যেন নিশ্বাস ফেলার সময়টুকু পর্যন্ত নেই। এক এক দিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার হয়ে গেছে গভীর রাত। ফিরে এসে সে বিভাকে পেয়েছে ঘুমন্ত অবস্থায়। শুধু এক রাতে একটু অন্যরকম ঘটনা ঘটল। রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরেছিল অভিজিৎ। এসে দেখল বিভা খাবার টেবিলে বসে আছে বাড়া ভাত নিয়ে। তার মুখ শুকনো। চোখজোড়ায় গভীর হতাশার ছাপ। দেখলে কেমন বুক কেঁপে যায়। 

অভিজিৎ চমকে উঠে বলল, ‘সেকি! আপনি এখনও খান নি?’ বিভা বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘একা একা খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না।’ 

—‘দূর্গা কোথায়?’ 

—‘ঘুমিয়ে পড়েছে।’ 

অভিজিৎ অফিসেই রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বিভার জন্য তাকে আবার বসতে হল। অফিসের কাপড় না পাল্টেই হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে খেতে বসল সে। বিভা চুপচাপ অভজিতের প্লেটে খাবার তুলে দিল। নিজেও নিলো অল্প একটু ভাত আর বেগুনের তরকারি। 

—‘আপনার কি খুব মন খারাপ?’ অভিজিৎ প্রশ্ন করলো, সাবধানে 

বিভা একবার চোখ তুলে তাকালো অভিজিতের দিকে। কী নিষ্প্রভ সেই চোখের চাউনি! অভিজিতের মনটা ভারী খারাপ হল। মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ হয়েছে মাত্র কদিন আগে। এরকম নাজুক মানসিক অবস্থায় সারাদিন এই বাড়ির মধ্যে ভূতের মত একা একা দিন কাটাতে হচ্ছে। মনের কথা বলার একটি মানুষ নেই। করার মত কোনও কাজ নেই। এভাবে থাকলে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের পক্ষেও অসুস্থ হতে খুব বেশি সময় লাগবেনা। সে নিজে যে একটু সময় দেবে তাও তো সম্ভব হচ্ছেনা। অভিজিৎ বিভার ওই নিষ্প্রভ চোখের দিকে চেয়ে নরম গলায় বলল, ‘বলছিলাম কি, আপনি বরং কয়েকটা দিন ঢাকায় গিয়ে আপনার আব্বা আম্মার সাথে থেকে আসুন। ভালো লাগবে।’ 

মুহূর্তের মাঝে বিভার চেহারাটা পাল্টে গেল। বিষণ্ন চোখের তারায় ক্রোধের ঘষা লেগে ম্যাচের কাঠির মত ভস করে জ্বলে উঠল আগুন। সে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘আপনি কি আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছেন?’ 

অভিজিৎ গর্জন শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এত বেশি রেগে যাবার মত কিছু বলেছে কি সে? আমতা আমতা করে বলল, ‘না মানে, ভাবছিলাম যে…। 

বিভা ওর কথা শেষ হতে দিল না। খাবার বাসনটা হাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘আর কিছু বলতে হবেনা আপনাকে। যা বুঝার বুঝে নিয়েছি আমি। 

কথাটা বলে শেষ করে বিভা প্রায় দৌড়ে ছুটে গেল শোবার ঘরের দিকে। মুখের সামনে খাবারের প্লেট নিয়ে অভিজিৎ কিছুক্ষণ থ মেরে বসে রইল। তারপর হাত ধুয়ে নিয়ে খাবার গুলো ঢাকা দিয়ে রাখল। ঘরে এসে দেখল বিভা বিছানার ওপর পা ঝুলিয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কী যন্ত্রণারে বাবা! কান্নাকাটি জুড়ে দেবার মত কোনও ঘটনা হল নাকি এটা? অভিজিৎ হেঁটে এসে বিভার পাশে বসল। কান্নার দমকে বিভার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। অভিজিৎ বুঝতে পারছেনা তার এখন ঠিক কী করা উচিৎ, কী বলা উচিৎ। সমস্ত কিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী বলে মনে হচ্ছে। বুকের ভেতর বড্ড অপরাধী ভাব। মনে হচ্ছে যেন তার জন্যেই এই নিষ্পাপ মেয়েটির জীবন আজ তছনছ হয়ে গেল! 

—‘দেখুন, আপনি কষ্ট পাবেন জানলে আমি কথাটা বলতাম না।’

বিভা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এখন করুণা দেখাতে এসেছেন? লাগবেনা আমার আপনার করুণা।’ 

—‘করুণা দেখাচ্ছিনা। আপনার মন মেজাজ ভালো নেই। তাই আমাকে ভুল বুঝছেন।’ 

বিভা তার অশ্রু মাখা ডাগর দুটি চোখ অভজিতের দিকে মেলে ধরে বলল, ‘আমি চলে যাব অভিজিৎ বাবু। কথা দিচ্ছি। আমি জানি যে আমি চলে গেলে আপনার শান্তি হবে। বার বার বলতে হবেনা।’ 

—‘আমার শান্তির জন্য কথাটা বলিনি আমি। বলেছি আপনার মঙ্গল চিন্তা করে।’ 

—‘বেশ তো। উদ্ধার করেছেন আমাকে।

—‘আপনি মিছি মিছি রাগ করছেন।’ 

বিভা ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘বাদ দিন। আপনি ব্যস্ত মানুষ আপনার সময় বরবাদ করাটা উচিৎ কাজ হচ্ছেনা। আপনার ব্যাপারটা আমি বুঝে গিয়েছি। খুব বেশিদিন আর বিরক্ত করব না।’ 

অভিজিৎ বিভার হাত ধরে ফেলল, ‘আপনি কিছুই বুঝতে পারেন নি। আসল ব্যাপারটা হল…’ 

বলতে বলতে অভিজিৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল, ‘আসল ব্যাপারটা হচ্ছে আপনার কষ্ট দেখতে আমার ভাল লাগছেনা।’ 

—‘আমার কষ্ট দেখতে আপনার ভালো লাগছেনা?’ 

—‘একদম ভালো লাগছেনা। যে কটা দিন এখানে আছেন, সে কটা দিন একটু হাসিখুশি থাকতে পারবেন? প্লিজ?’ 

কথাটা শুনে বিভা কেমন চুপ মেরে গেল। তার চোখ থেকে হতাশার পুঞ্জীভূত মেঘের ছায়া একটু বুঝি আবছা হল। তারপর সেখানে উঁকি দিল এক টুকরো বিস্ময়। এই মানুষটাকে সে বুঝতে পারেনা। এতো সহজ, এতো স্বচ্ছ তবুও যেন এর মনের ভেতরটাকে পড়তে পারা ভারী দুষ্কর কাজ। এতো গুলো মাস প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা ঘণ্টা সে সামির সাথে ফোনে অথবা ম্যাসেজে কথা বলে কাটিয়েছে। হ্যাঁ, মানুষ অভ্যাসেরই দাস। সামির সাথে কথা বলার অভ্যাসটাই তাকে বাঁচিয়ে রাখত এতকাল। কিন্তু তার যে শুধু অভ্যাসের বিসর্জন দিতে হয়েছে তাই নয়। অভ্যাসের সাথে সাথে সে বিসর্জন দিয়েছে স্বপ্নের। এতকাল সে মনে মনে জানত যে সামির সাথে একদিন তার ঠিক ঠিক মিলন হবে। তাদের দুজনের বেঁচে থাকার মত একটা জীবন হবে, সংসার হবে। ভালোবাসার বৃষ্টিতে কানায় কানায় পূর্ণ হবে তাদের ছোট্ট ভুবন। হঠাৎ করে সেই এতদিনের লালিত, পালিত, কাঙ্খিত স্বপ্নটা এক করাল ঝড়ের কবলে পড়ে কাচের শিশির মতন ঝনঝন করে ভেঙে গেল। এই বাস্তবতা মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে! মাথার ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ কুয়াশার মতো কী যেন নেমে আসছে। সমস্ত চেতনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেই অদ্ভুত কুয়াশায়। সামনে পেছনে কিছু দেখতে পাচ্ছেনা সে। কেবলই শূন্যতা আর শূন্যতা। সেইরকম দারুণ বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত সময়টিতে অভিজিতের মাত্র বলা কথাটি তার কাছে প্রচন্ড খর রোদ্দুরে এক ঝাপটা হিমেল হাওয়ার মতো মনে হল। 

সে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে আলতো গলায় বলেছিল, ‘আচ্ছা।’ 

.

চায়ের কাপটা কাছে টেনে নিয়ে এসে অভিজিৎ বলল, -’আজ বিকেলে আপনাকে হাতির পিঠে চড়াব। চড়বেন?’ 

বিভা হাসলো, ‘কেন নয়?’

—‘অবশ্য বিকেল কেন? আমরা চাইলে এখুনি বেরিয়ে যেতে পারি।’ 

—‘না, এখন আমার কাজ আছে।’ 

—‘কী কাজ?’ 

—‘বাজারে যেতে হবে।’ 

—সে তো দূর্গাই করতে পারে।’ 

—‘দূর্গা সবকিছু মনে করে আনতে পারেনা। ভীষণ ভুলো মন মেয়েটার।‘

—‘ঠিক আছে। তাহলে বিকেল পাঁচটায় বেরোবো।’ 

২৩

ওয়াচ টাওয়ারের ওপর বিকেল বেলার ম্লান আলোয়, আবছা কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল ওরা দুজন। বিভা আর অভিজিৎ। বিভার গায়ে একটি হালকা আকাশি রঙের কাশ্মীরী শাল জড়ানো। দীঘল কালো লম্বা চুল পিঠময় ছড়িয়ে আছে। অভিজিৎ একটা বাদামি রঙের ফুল হাতা উলের সোয়েটার পরেছে। টাওয়ারের নিচে বইছে মূর্তি নদী। নদীর পাড় ঘেঁষেই শিমূল, জাম, শিরিষ আর বহেড়ার ঘন অরণ্য। গভীর সে অরণ্যের মাথায় মাকড়শার জালের মত ঝুলে আছে কুয়াশা। শীত বাতাসে বিভার চুল উড়ছিল হালকা। বিকেলের মরা আলোয় বিষণ্ন দেখাচ্ছে ওর প্রতিমার মত টানা দুটি চোখ। তবুও কী আশ্চর্য সুন্দর! অভিজিতের মনে হল এতো সুন্দর চোখ বুঝি এ পৃথিবীর অন্য কোনো নারীর নেই। এই চোখ দেখামাত্র যে কোনো পুরুষ প্রেমে পড়ে যাবে। আর যে পুরুষ এর প্রেমে পড়বেনা, সে কোনো পুরুষই না! আচ্ছা, বিভাকে কখনো এমন এক আনমনা মুহূর্তে, ভুল করে পেছন থেকে আচমকা জড়িয়ে ধরলে কি ও খুব রেগে যাবে? ভাবনার ঘোর পুরোপুরি কাটতে না কাটতেই বিভা ঘুরে তাকাল। অভিজিৎকে ওরকম থম মেরে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী ভাবছেন?’ 

অভিজিৎ অপ্রতিভ হল। কী যেন বলতে গিয়ে মুখ খুলেও চুপ করে গেল আবার। 

—‘কী হয়েছে আপনার? কী অত ভাবছেন?’

—‘যা ভাবছিলাম, তা আপনাকে বলা যাবেনা।’ 

—‘কেন?’ 

—‘বললে রেগে যেতে পারেন।’ 

বিভা চোখ সরু করে বলল, ‘তাই নাকি? তার মানে নিশ্চয়ই মনে মনে আমার নামে নিন্দা করছিলেন।’ 

অভিজিৎ হাসলো, ‘নিন্দে করছিলাম না।’ 

—‘তাহলে বলে ফেলুন।’ 

—‘আপনি রাগ করবেন না তো?’ 

—‘না রাগ করবোনা।’ 

অভিজিৎ লাজুক হেসে বলল, ‘কিছুনা।’

–’আপনি ভীষণ ভীতু!’ 

অভিজিৎ অবাক হয়, ‘আমি ভীতু?’ 

—‘তা নয়তো কী?’ 

—‘আমার ঠিক কোন আচরণটা দেখে আপনার কাছে আমাকে ভীতু মনে হয়েছে?’ 

—‘এইযে মনের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারেন না। আমি রেগে গেলেই বা আপনার কী? আপনি কি আমাকে ভয় পান?’ 

প্রশ্নটা শুনে অভিজিৎ একটু কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। আস্তে আস্তে বলল, ‘ভয় পাই তা ঠিক না। তবে…’ 

—‘তবে?’

—‘কেয়ার করি। 

—‘কেয়ার করেন?’ 

—‘হ্যাঁ কেয়ার করি। আপনি রেগে গিয়ে আমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করলে আসলে আমার খুব খারাপ লাগবে।’ 

বিভা বিস্ময় নিয়ে তাকায় অভিজিতের ভালো মানুষী চোখদুটির দিকে, ‘এত কিছুর পরেও আপনি আমাকে কেন কেয়ার করেন অভিজিৎ বাবু?’ 

অভিজিৎ চোখ নিচে নামায়, ‘সব কিছুর ওপরে তো মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকেনা, তাইনা?’ 

সেই মুহূর্তে বিভা ওই নত মুখের অভিজিতের দিকে চেয়ে থেকে আর কোনো কথা খুঁজে পেলোনা। মা প্রায়ই বলেন তার নাকি একটা দেবতার মত মানুষের সাথে বিয়ে হয়েছে। মা হয়তো ঠিকই বলেন। মাঝে মাঝে তার নিজের কাছেও এই মানুষটাকে দেবতার চেয়ে কম কিছু বলে মনে হয়না। কিন্তু সমস্যা হল দেবতার সাথে মানুষের মিলন বাস্তব পৃথিবীতে কখনোই সম্ভব না। বিভা রক্ত মাংসে গড়া মানুষদের আশেপাশে থেকে অভ্যস্ত। অভিজিতের এমন অস্বাভাবিক ভালো মানুষী গিরি দেখলে আজকাল তার কেমন দম বন্ধ ভাব হয়। লোকটা একটু সাধারণ আর একটু খারাপ হলে কী এমন ক্ষতি হত? বিভা অন্তত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারত দু দণ্ড। 

ওরা ন্যাশনাল পার্কে এসেছে বিকেল চারটায়। বের হবার আগ মুহূর্তে অভিজিৎ বলল, ‘আপনি একটা দুটা এক্সট্রা কাপড় নিয়ে নিয়েন। আজ রাতে হয়তো বাড়ি ফিরবোনা।’ 

—‘বাড়ি ফিরবো না তো থাকব কোথায়?’ 

—‘ও আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিন।’

অফিসের জিপগাড়ি করে রওয়ানা হল ওরা। গরুমারা অভয়ারণ্যের চেকপোস্ট পেরিয়ে আরো ছয় কিমি পথ পাড়ি দিতে হল বন বাংলোতে পৌঁছনোর নিমিত্তে। বিয়ের পরে এই প্রথম ওদের দুজনের এক সঙ্গে ঘুরতে বের হওয়া। বিভা একটা আবছা অনুভূতিতে ডুবে ছিল। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, কোনো অনুভূতিই তাকে বিশেষ ভাবে নাড়া দিচ্ছিলনা। তবে আজ সকাল থেকে একটা অন্যরকম বোধ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সেই বোধটা স্বস্তির। সামির সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে সারা রাত কথা বলার মাঝে রোমাঞ্চ আছে, তরঙ্গ আছে, আছে প্রেমের অনুভূতি। কিন্তু এইযে নিজের বিয়ে করা স্বামীর সাথে নিশ্চিন্ত মনের এক নির্বিঘ্ন ভ্রমণ, এই ভ্রমণে প্ৰেম বা রোমাঞ্চ না থাকলেও আছে শান্তি এবং নিশ্চয়তা। বিভা আজ সেই শান্তিটাকেই মন ভরে উপভোগ করছে। পুরো পথটায় খুব একটা কথা বলেনি সে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই মেয়েটিই বন্ধুদের সামনে পেলে অহেতুক, ভিত্তিহীন, নিরবিচ্ছিন্ন কৌতুক রসে ডুবে থাকতে পারে আকণ্ঠ। এ কদিনেই যেন বয়স বেড়ে গেছে তার। কথাবার্তা, আচার আচরণে এসে গেছে পরিপক্ক ভাব। মানুষের বয়স আসলে সময়ে বাড়েনা, বাড়ে অভিজ্ঞতা আর টানাপোড়েনে। 

দূর অন্তরীক্ষে পাখির পালকের মত সাদা, মসৃণ, পলকা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছিল নিরুদ্দেশ। বাতাসে অনবরত ভাসছে বনকুসুমের সুবাস। ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে দেখা যাচ্ছে সরু নদীর ওপারের রুপালি বালি, সবুজ ঘাস আর বৃক্ষরাজি। বালির ওপর দাঁড়িয়ে একপাল বাইসন নিশ্চিন্তে নদীর জল খাচ্ছে। অভিজিৎ হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা বিভা, আমাকে আপনার কেমন লাগে?’ 

—‘বোরিং!’ 

বিভার ঠোঁট দ্বারা মাত্র উচ্চারিত শব্দটা মোটা চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিজিতের সরল দুটি চোখে একটা মেদুর ছায়াপাত ঘটাল। বিভা সেটা লক্ষ্য না করেই বলল, ‘আপনি মানুষ ভালো, তবে কাহিনী কী জানেন? বেশি ভালোমানুষরা একটু বেশি বোরিং হয়।’ 

অভিজিৎ তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু বলতে পারলনা। মেয়েটা যে মুখের ওপর এভাবে তাকে বোরিং বলে বসবে এটা সে ভাবতেও পারেনি। কুয়াশায় আবছা হয়ে আসা দূরের বনের দিকে চোখ রেখে সে খানিক বাদে বলল,’বোরিং আর ভালো মানুষ, এই দুটি মাত্র অবজারভেশন আপনার?’ 

—‘আর কী জানতে চাইছেন? আপনি হ্যান্ডসাম কিনা? এট্রাকটিভ কিনা? এসব প্রশংসা শুনতে চাইছেন?’ 

অভিজিৎ বিব্রত ভাবে বলল, ‘না না, তা কেন?’ 

—‘তাহলে?’ 

—‘কিছুনা।’ 

—‘আপনার কি ‘কিছুনা’ রোগ হয়েছে নাকি আজকে?’ 

—‘কিছুনা রোগটা আবার কী জিনিস?’ 

—‘প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরে কিছুনা বলা। এটাকে বলে কিছুনা রোগ।’ 

—‘আপনি বড় বেশি ফালতু কথা বলেন।’ 

—‘আজ সারাদিন তো কোনো কথাই বলিনি। তবুও বিরক্ত হচ্ছেন কেন?’ অভিজিৎ একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘বিরক্ত হচ্ছিনা।’ 

-‘শীত করছে খুব। চলুন বাংলোয় ফিরে যাই। আর আপনি যে আমাকে হাতির মাথায় চড়াবেন বলেছিলেন? সেটা কখন হচ্ছে?’ 

—‘হাতির মাথায় নয়, হাতির পিঠে।’ 

—‘ওই একই।’ 

—‘এখন তো সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কাল সকালে হলেও হতে পারে।’ 

পার্কের ভেতরে বন দফতরের অফিস আছে। রাতের খাবারের ব্যবস্থা অভিজিতের অফিস থেকেই করা হল। অফিস ঘরের সামনে অনেক রাত অবধি চলল মাদলের তালে তালে পাহাড়ি নাচ। সত্যি বলতে কি, ভালো লাগছিল বিভার। গত চার দিন একটানা ঘরের ভেতর একাকী বসে থেকে মনের মাঝে যে চাপটা সৃষ্টি হয়েছিল সে চাপটা ধীরে ধীরে লঘু হয়ে আসছিল। একটু রাত করেই বাংলোতে ফিরলো ওরা। বাংলোর ঘরে আসবাব বলতে শুধু একটি ডাবল খাট, এবং এক কোণে রাখা কাঠের টেবিল চেয়ার। কাঠের দেয়ালে টাঙানো আছে বুনো হাতি এবং বাইসনের ছবি। ল্যাম্পশেডে জ্বলছে টিমটিমে একটি কম পাওয়ারের বাতি। সেই বাতিতে কিচ্ছু স্পষ্ট দেখা যায়না। কাঠের মেঝে বরফের মত ঠান্ডা। ক্লজেট খুলে দেখা গেল কোনো স্পেয়ার চাদর বা কম্বলও নেই। এরকম জানলে বাড়ি থেকেই চাদর, কম্বল এসব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসা যেত। বিভা ওয়াশরুমে গিয়েছিল কাপড় পাল্টাতে। ঘুমোনোর পোশাক পরে ওয়াশরুম থেকে সে বেরোতেই অভিজিৎ একদম কাঁচুমাচু হয়ে গিয়ে বলল, ‘সরি এখানে কোনো এক্সটা চাদর বা কম্বল নেই। মেঝে খুব ঠান্ডা। এই শীতের রাতে মেঝেতে ঘুমোনো কোনো ভাবেই সম্ভব না। এক কাজ করি। আপনি এখানে শুয়ে পড়ুন। আমি অফিসে চলে যাই। সোফায় দিব্যি রাত কাটানো যাবে।’ 

বিভা আঁতকে উঠে বলল,’সেকী! এই জঙ্গলের মধ্যে পুরো একটা ঘরে আমি একলা থাকবো?’ 

—‘ভয় পাবেন?’ 

—‘পাবোই তো!’ 

—‘ভয় কী? পাশেই তো আরো বাংলো আছে। হাঁক ডাক করলেই লোক পেয়ে যাবেন। 

—‘আপনি কোথথাও যাবেন না। এখানেই থাকবেন!’ হুকুম করল বিভা।

অভিজিৎকে চিন্তিত দেখালো, ‘তাহলে… আচ্ছা আমি দেখি কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা।’ 

পকেট থেকে মোবাইল বের করে সে ডায়াল লিস্ট ঘেঁটে কাকে যেন ফোন করতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় বিভা একটু নরম গলায় বলে বসল, ‘ইয়ে… আপনি মাইন্ড না করলে আমরা বেড শেয়ার করতে পারি।’ 

অভিজিৎ চমকে উঠল। বিস্মিত নয়নে তাকালো চকিতে বিভার দিকে। বিভা কথাটা বলেই মুখ নামিয়ে নিয়েছিল। বলার সময় লজ্জা লাগেনি কিন্তু বলে ফেলার পর অভিজিতের ওই চমকে ওঠা মুখখানা দেখে দারুণ এক লজ্জাজনক অস্বস্তি তে পেয়ে বসল তাকে। 

অভিজিৎ অস্ফুটে বলল, ‘কী বললেন?’ 

বিভা আঙুল দিয়ে বিছানার চাদরের ওপর আঁকিবুকি করতে করতে বলল, ‘না বলছিলাম যে, আপনার আপত্তি না থাকলে… আমরা বেড শেয়ার করতে পারি।’ 

অভিজিৎ এর মুখটা হয়েছিল দেখার মত। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। কিছুক্ষণ থ্ মেরে দাঁড়িয়ে থাকার পর খুব মন্থর ভাবে সে মোবাইলটা পকেটে পুরে রাখল। বিভার সেই মুহূর্তে ওর নার্ভাস চেহারা দেখে হাসি পেয়ে গেল। অভিজিৎ আড়চোখে হাসিটা দেখে নিয়ে বলল, ‘অত হাসির কী আছে?’ 

বিভা কিছু বলল না। হাসতেই লাগল। খানিক বাদে মাথায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল আগামীকাল সামির জন্মদিন। তার মুখে ঝুলে থাকা মিটমিটে হাসিটি ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল। ওরা নিশ্চয়ই সামির জন্মদিন উপলক্ষ্যে হৈ হুল্লোড় করবে অনেক। হৃদি বলেছিল কী নাকি সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করা হচ্ছে। সবকিছু থেকে বিভা বাদ। সবাই আগের মতোই আছে, শুধু বিভাকেই মেনে নিতে হচ্ছে এই বনবাসের একাকী জীবন। তার ভাগ্যটা এতো খারাপ হল কেন? দূর থেকে সেই কুয়াশাটা ধেয়ে আসছিল, ফিরে আসছিল মনের গুমোট। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। আজকাল বেশি মন খারাপের সময় দম আটকে আসার উপক্রম হয়। সে বড় একটা শ্বাস ফেলে কম্বলটা মুখের ওপর থেকে সরালো। অভিজিৎ ঘরের ভেতর চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে। বিভা উঠে বসতে বসতে বলল, ‘সারাক্ষণ এতো কী আকাশ পাতাল চিন্তা করেন আপনি? ভীষণ বোরিং ব্যাপার স্যাপার।’ 

অভিজিৎ হাঁটা থামিয়ে বিভার দিকে তাকাল। খুব জরুরি গলায় বলল, ‘আপনার প্ল্যান কী?’ 

—‘কীসের প্ল্যান?’ বিরক্তি ঝরে পড়ছে বিভার কণ্ঠ থেকে। 

অভিজিৎ হেঁটে আসল বিভার দিকে। বিছানায় বসল পা তুলে। গম্ভীর ভাবে বলল, ‘আপনি কী করবেন ভবিষ্যতে, কিছু ঠিক করেছেন?’ 

-‘কী সব আজাইরা কথা বলছেন আপনি? আমি আবার কী করব?’

–’না মানে, আপনি তো ডিভোর্স চেয়েছিলেন আমার কাছে, তাইনা?’ বিভা অভিজিতের বলা শেষ কথাটা শুনে একটু কেমন চুপসে গেল। দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল তাকে ক্ষণিকের জন্য। 

—‘আপনি ডিভোর্স দিতে চাইলে দিতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।’ 

—‘আর দিতে না চাইলে?’ 

বিভার বুকের ভেতর এক খন্ড কষ্টের মেঘ গুরুগুরু শব্দে ডেকে উঠে কান্নার বৃষ্টি নামানোর আয়োজন করছিল তখন। সে চিবুকটা গলার সাথে লাগিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘না দিলেও সমস্যা নেই।’ 

—‘আপনি তো আপনার বয়ফ্রেন্ডকে কখনো ভুলতে পারবেননা, পারবেন কি?’ 

বিভার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। সে তার জল টসটসে ডাগর চক্ষু দুটি অভিজিতের মুখের ওপর মেলে ধরে অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল, ‘অভিজিৎ, আমার মনটা অসম্ভব রকমের খারাপ। আপনি কি এসব ফালতু কথা বলা বন্ধ করে অন্য কিছু বলবেন দয়া করে?’ 

—‘অন্য কী বলব?’ 

—‘আমার মাথা আর আপনার মুন্ডু বলবেন। 

—‘তখন ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে যা ভাবছিলাম তা বলব এখন?’

-‘বলুন।’ 

অভিজিৎ একটা বড় নিশ্বাস ফেলল, ‘ভাবছিলাম আমি যদি আপনাকে কখনো হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরি, তাহলে আপনি কি খুব রেগে যাবেন কিনা। 

বিভা স্তব্ধ চোখে তাকাল অভিজিতের দিকে। অভিজিতের মুখে তখন খেলছে নিদারুণ এক অস্বস্তি। কথাটা বলে ফেলার পর তার মনে হচ্ছে না বলাই বুঝি ভালো ছিল। নিজেকে খুব ছোট লাগছে এখন মেয়েটার কাছে। নত মুখে স্থির হয়ে বসে রইল সে। বিভা কিছু বলছেনা। না বলাই শ্রেয়, কারণ অভিজিৎ জানে, মেয়েটা নিষ্ঠুর কথা মুখের ওপর বলে দিতে বড্ড ওস্তাদ। এখন নিশ্চয়ই এমন কোনো অপ্রীতিকর কথা মুখের ওপর ছুঁড়ে দেবে যা শুনে অভিজিতের অপমানে মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে পড়তে মন চাইবে। একেকটা সেকেন্ডকে একেকটা ঘন্টা মনে হচ্ছিল যেন। ভারী অস্বস্তি হাওয়ায়! একটা সময় বিভা ধীর স্বরে বলল, ‘না, রাগ করবো না।’ 

অভিজিৎ চমকে উঠল। তার হৃৎপিণ্ডটা কেউ একজন আকস্মিক ভাবে ধনুকে বাঁধা তীরের মত পেছন দিকে টেনে ধরে ছেড়ে দিল শূন্যে, ক্ষিপ্ৰ গতিতে। অনেকক্ষণ অবধি সে কোনো কথা খুঁজে পেলোনা। বিস্ময় ভরা চোখে চেয়ে রইল শুধু বিভার দিকে। তাকে যেন বুদ্ধি বৈকল্যে পেয়েছে। কিছু বলার না পেয়ে, করার না পেয়ে সে চোখ থেকে সময় নিয়ে মোটা কাচের চশমাটা খুলল। মাথা চুলকে বলল, ‘আচ্ছা।’ 

তারপর ধীরে ধীরে কম্বলটা গায়ে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল। বিভা ওর কান্ড দেখে আকাশ থেকে পড়ে বলল, ‘মানে কী? আপনি শুয়ে পড়লেন কেন?’ 

—‘কী… করব?’ 

—‘কী করবেন মানে? বললাম তো আমি রাগ করবো না!’ 

—‘শুনলাম তো!’ 

—‘তাহলে শুয়ে পড়লেন কেন?’ 

—‘আমি বলেছি হঠাৎ করে…। কথা বোঝেন নি?’ 

—‘হঠাৎ ফটাৎ বুঝিনা। যা করার এখনই করেন।’ 

-‘কী মুশকিল!’ 

—‘উঠুন! শোয়া থেকে উঠুন বলছি।’ 

অভিজিৎ অস্বস্তি নিয়ে উঠে বসল। তাকাল বিভার দিকে। 

—‘এবার আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন।’ আদেশ করল বিভা 

অভিজিতের বুক চিরে একটা দীর্ঘ কম্পন যুক্ত নিশ্বাস বেরিয়ে আসল। রুদ্ধ গলায় অতি কষ্টে বলল, ‘শ্রীমতি বিভাবরী দেবী! যা বলার ভেবে চিন্তে বলুন। আমি একবার ধরলে কিন্তু জীবনে আর কোনো দিন ছাড়ব না!’ 

এ কথার পর বিভা আর কিছু বলতে পারলোনা। তার চোখ থেকে অনবরত গড়িয়ে পড়তে থাকলো জল। 

২৪

রাত নয়টার পর আকাশ মোবাইল কেনার বাহানা করে সামিকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। বেরোনোর কথা ছিল রুদ্রর, কিন্তু যাবার আগ মুহূর্তে সে বন্ধুদের জানালো যে সামির জন্মদিনের গানটা এখনো লেখা হয়নি। তাই কিছু সময় তার নিরিবিলিতে কাটানো খুব জরুরি। সামিকে নিয়ে আকাশ বেরিয়ে যাবার আধঘন্টার মাথায় অমৃতা আর হৃদি চলে আসলো। অমৃতার হাতে মিস্টার বেকার থেকে কেনা বিশাল বড় কেক। হৃদির হাত ভর্তি ঘর সাজানোর সরঞ্জাম। এসেই ওরা দুজন কাজে লেগে গেল, আর রুদ্র গেল তার নিজের ঘরে গান লিখতে। এক কাপ কফি সঙ্গে নিয়ে। তার ভাব দেখে অমৃতা আর হৃদি হেসেই বাঁচেনা। হৃদি হাসতে হাসতে অমৃতাকে বলল, ‘রুদ্রকে দেখে আমার বিশ্ব কবি রোদ্দুর রায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আজকে নিশ্চয়ই সে বিশেষ কিছু পয়দা করবে। 

গান লেখা শেষ করে রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল সারা ফ্ল্যাট নীল আর সাদা বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। ডাইনিং রুমের দেয়ালে নীল ব্যানারের ওপর সাদা কাগজ দিয়ে লেখা হয়েছে, হ্যাপি টোয়েন্টি সিক্সথ বার্থডে টু সামি। খাবার আনা হচ্ছে বাইরে থেকে। সামির নান্নার বিরিয়ানি খুব পছন্দ তাই ঠিক হয়েছে আজকে সবাই নান্নার বিরিয়ানিই খাবে। আয়োজন দেখে রুদ্র মুখ গোঁজ করে বলল, ‘এইসব কী মামা? আমার জন্মদিনে তো এতকিছু হয়নায়। সামির জন্যে এত আয়োজন কেন হবে? এভাবে খেলবো না।’ 

অমৃতা জবাবে বলেছে, ‘সামির কয়দিন আগে ব্রেকআপ হইছে, বাপ মায়ের সাথেও সম্পর্ক ভালো না। তার মন ভালো করার জন্য এসব করা হচ্ছে। নিজের সাথে মিলাচ্ছিস কেন?’ 

কথাটা শুনে রুদ্র ভারী আহত হল-’তাতে কী? আমার তো সারাজীবন ধরেই ব্রেকআপ চলতেছে। বিরহের উপরেই আছি। এই জিনিসটা তোমরা একটু বিবেচনায় রাখবা না? এটা তো ফেয়ার হইলো না।’ 

—‘আচ্ছা তোর নেক্সট বার্থডের আগে একটা সত্যিকারের প্রেম করে সত্যি কারের ব্রেকআপ করিস। তারপর তোর জন্যেও এসব করা হবে।’ 

—‘নেক্সট বার্থডে তে আমি দেশেই থাকবো না।’ 

—‘তাহলে আর কী করা? তোর তখন কত নতুন নতুন বন্ধু হবে। বিদেশী বন্ধু সব। আমাদেরকে কি আর মনে থাকবে?’ 

—‘এসব কথা বলে লাভ নাই। আমি বুঝে গেছি তোরা সামিকে ভালোবাসিস, আমাকে বাসিসনা।’ 

—‘খুব ভালো বুঝছিস। ইঞ্জিনিয়ারদের যে এত বুদ্ধি তা আমি আগে জানতাম না। 

—‘না ইঞ্জিনিয়ারদের আর বুদ্ধি কোথায়, বুদ্ধি তো তোমাদের মত লায়ারদের একার সম্পত্তি।’ 

সব কাজ হয়ে গেলে ওরা ড্রইং রুমে এসে বসলো। এখন শুধু বারোটা বাজার অপেক্ষা। হৃদিতা পাশের বাসার এক দম্পতিকেও দাওয়াত করেছে। এই দম্পতি প্রায়শই রুদ্র সামির খোঁজ খবর নেয়। মেয়েটি মাঝে মাঝে ভালো মন্দ রান্না করে পাঠায়। স্বামী স্ত্রী দুজনেই সপ্রতিভ, মার্জিত এবং মিশুক প্রকৃতির। সিঁড়িতে বা লিফটে হঠাৎ দেখা হলে আপন লোকের মত হেসে কথা বলে। 

রুদ্র বসার ঘরে গিটার নিয়ে বসেছিল। তার আউলবাউল চুল গুলোর অনেকটা অংশ কপালের ওপর পড়ে আছে অবহেলায়। চোখ বন্ধ করে সে গিটারের তারে টুংটাং করছে। খানিক বাদে একটু গম্ভীর গলায় সে দুই বান্ধবীকে বলল, ‘তোরা কি গানটা একবার শুনে দেখতে চাস?’ 

হৃদি আর অমৃতা একত্রে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ‘না!’ 

রুদ্র ফাটা বেলুনের মত চুপসে গিয়ে বলল, ‘এতো বড় অপমান!’ ওর চুপসে যাওয়া মুখখানি দেখে অমৃতার বুঝি একটু মায়া হল। সে 

পর মুহূর্তেই গলার সুর পাল্টে ফেলল, ‘গাওয়া শুরু কর।’ 

—‘না এখন আর হবেনা। তোরা চান্স হারায় ফেলছিস।’ 

হৃদি বিড়বিড় করল,’শোকর আলহামদুলিল্লাহ যে চান্সটা হারায় গেছে।

—‘তুই আলহামদুলিল্লাহ বললি কেন?’ 

—‘ওমা, আলহামদুলিল্লাহ বলব না?’ 

—‘কেন বলছিস?’ 

—‘ফর এভরিথিং! এই যে আল্লাহ আমারে এত ভালো রাখছে। খাওয়াইতেছে, পরাইতেছে আমার তো উঠতে বসতে আলহামদুলিল্লাহ বলা উচিত। তোরাও বল।’ 

রুদ্র ব্যাপারখানা খুব ভালো মতোই বুঝল। বুঝতে পেরে তার মুখ ভার হয়ে গেল। বিষাদমাখা কণ্ঠে সে বলল, ‘গুণী জনের কদর করতে জানলি না রে তোরা। যখন থাকব না আর, তখন বুঝবি। তখন এই রুদ্রর গান শোনার জন্য কাইন্দা মরলেও রুদ্র আর আসবেনা গান শুনাইতে। দেইখা নিস।’ 

অমৃতা রুদ্রর কথা পাত্তা না দিয়ে হাতে রিমোট তুলে নিয়ে টিভি চালু করল। রুদ্রর গান তাদের খুবই পছন্দ কিন্তু বন্ধুদের জন্মদিন উপলক্ষে সে যে গান গুলো বাঁধে সেগুলো বড়ই অখাদ্য হয়। সেই অখাদ্য হজম করা খুব সহজ কাজ নয়। হৃদি ওর হ্যান্ডব্যাগের চেইন খুলে চিরুনি বের করতে করতে বলল,’তোর চুলগুলা কি জীবনে আঁচড়াস না?’ 

—‘এতক্ষণে দেখলি তুই?’ রুদ্রর কণ্ঠে অভিমান বেজে ওঠে ঝনঝন করে। 

—‘আহা আমারতো তোর চুলের দিকে চাইয়া বইসা থাকা ছাড়া আর কাজ নাই।’ 

হৃদি চিরুনি হাতে নিয়ে রুদ্রর সামনে এসে দাঁড়ালো। বাম হাত দিয়ে ওর গাল টিপে ধরে মুখটা খানিক উঁচু করল। তারপর ডান হাত দিয়ে ওই জট লাগা চুল গুলো আঁচড়াতে আঁচড়াতে খিটখিটে গলায় বলতে লাগলো, ‘চুলের যত্ন করতে পারেনা কিন্তু লম্বা চুল রাখা চাই তার। বিদেশে গেলে চুল আঁচড়ে দেবে কে? কী হবে তখন তোর?’ 

হৃদি গাল টিপে ধরে রাখায় রুদ্র কথা বলতে গিয়ে ঠিক মতো মুখ নাড়াতে পারল না। কিছু একটা বলল সে, যা শুনতে লাগলো, ব শ গ্লে বি শী মে দিয়ে।’ 

অমৃতা হেসে উঠে বলল, ‘এই শালা তো বিদেশ যাওয়ার আগেই বিদেশী ভাষায় কথা বলা শুরু কইরা দিছে।’ 

কলিং বেল বাজল। দরজা খুলে দেখা গেল পাশের বাড়ির ভাই ভাবি এসেছেন। সাথে তাদের ছয় বছরের বাচ্চা। বাচ্চা ছেলেটির নাম বুবুন। বুবুন হল দুষ্টুর শিরোমণি। রুদ্রকে দেখা মাত্র তার কোনও না কোনও উপায়ে ঘাড়ে উঠে বসা চাই আর ঘাড়ে চেপে বসা মাত্র শুরু হয়ে যায় চুল টানা টানির পালা। একবার তো বেশ কিছু চুল ছিঁড়ে গিয়ে তার হাতে চলে এসেছিল। বুবুনকে দেখে রুদ্রর মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। সে বুবুনকে দেখেও না দেখার ভান করে গিটার বাজাতে লাগল মনোযোগ দিয়ে। কী দরকার ছিল এই বিচ্ছুটাকে আজকে দাওয়াত করে আনার? দিনটাই খারাপ যাচ্ছে তার। কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল কে জানে। 

অমৃতা চুপচাপ টিভি দেখছিল। সব কিছু প্ল্যান মোতাবেকই হচ্ছে। সামির জন্য আজকের দিনের বিশেষ সারপ্রাইজ হল তার বাবা। অথচ সেই বিশেষ ব্যক্তিটিই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে কিছু জানান নি। একটু আগে অমৃতা টেক্সট করেছে। তিনি সেই টেক্সট এর উত্তরে কিছু লেখেন নি। উত্তর না পেয়ে অমৃতার মেজাজটা একটু চড়ে গেছে। রিমোট চাপতে চাপতে হঠাৎ একটি নিউজ চ্যানেলে চোখ আটকে গেল। চলছে লাইভ টক শো। একটা চেনা মুখ কথা বলছে। টক শো’র বিষয় বস্তু সাম্প্রতিক এক রাজনৈতিক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। অমৃতা চকিতে অভিনিবিষ্ট হয়ে উঠল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল, শুনতে লাগলো, বক্তার বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ, অঙ্গভঙ্গি এবং বাচনভঙ্গি। 

হৃদি হঠাৎ বলে উঠল, ‘আরে এটা তো সামির আব্বা।’ 

রুদ্র তাকালো একবার টিভির দিকে। অমৃতার নিরবিচ্ছিন্ন মনোযোগটা লক্ষ্য করে বলল, ‘আমাদের উকিল আফাও আর কদিন পরে এসব টক শো, ফক শো করে বেড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।’ 

—‘ঠিক বলছিস। আমার কী মনে হয় জানিস? মনে হয় একদিন আমাদের অমৃতা বিশাল কিছু হবে।’ 

—‘ফালতু কথা বলিস নাতো! শুনতে দে।’ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল অমৃতা। 

—‘এতো মনোযোগ দিয়ে শুনার কী হইল?’ 

অমৃতা হাত তুলে হৃদিকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘বললাম না চুপ করতে?’ 

—‘ওরে বাবা! হোয়াই সো সিরিয়াস?’ হৃদি অবাক। 

অমৃতার মাথায় হঠাৎ করেই ভাবনাটা আসলো। লোকটা এখন এই রাত পৌনে এগারোটার সময় নিউজ চ্যানেলে টক শো করছেন। চলতি অনুষ্ঠানটা শেষ হবে কখন তার নেই কোন ঠিক ঠিকানা। অতএব তিনি কোনও ভাবেই আজ আর এমুখো হবেন না। এতবার অনুরোধ করার পরেও ইনি রাজি হলেন না কেন? খুব রাগ হয়ে গেল অমৃতার। এতক্ষণের মসৃণ ছন্দময় তালটা গেল কেটে। অসহ্য লাগতে লাগল রুদ্রর গিটারের আওয়াজ, হৃদির অযথা বকবকানি, এবং আনুসাঙ্গিক সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়বস্তু! টিভি বন্ধ করে দিয়ে চট করে উঠে পড়ল সে। 

বুবুন রুদ্রর হাঁটু ধরে ঝুলে যাচ্ছে অনেকক্ষণ হল। সুর করে করে বলছে, ‘রুদ্র মামা! ঘাড়ে নাও! রুদ্র মামা! ঘাড়ে নাও!’ 

রুদ্র অনেক কষ্টে রাগ চেপে রেখেছে। দাঁত মুখ খিঁচে কানকাটার মতো বাজাচ্ছে গিটার। ভাবটা এমন যে বুবুনের কথা সে শুনতেই পাচ্ছেনা। এরকম বান্দরের রাজা সে গোটা জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখেনি। মনে চাইছে কষে একটা চড় মারতে বাঁদরটার গালে। ঠিক করল, এর বাপ মা এখান থেকে উঠে গেলেই আচ্ছা মতন একটা শিক্ষা দেবে বাঁদরটাকে। একটু ভেবে চিন্তে সে হৃদিকে বলল, ‘এই হৃদি, ভাইয়া ভাবিকে তোদের বার্থডে ডেকোরেশন দেখাইতে নিয়ে যা। ভাইয়া দেখে আসেন ওরা খুব সুন্দর করে ঘর সাজিয়েছে।’ 

এ কথায় কাজ হল। হৃদি লাফ দিয়ে উঠে বলল, ‘হ্যাঁ ভাবি আসেন, ভাইয়া আসেন, দেখে যান।’ 

ওরা উঠে পড়ার পর রুদ্র গিটার বাজানো থামিয়ে, দাঁত কিড়মিড় করে বুবুনকে বলল, ‘এই বান্দরের বাদশাহ! তর সমস্যা কী?’ 

বুবুন ফোকলা দাঁত বের করে হেসে, সুর করে বলল, ‘ঘাড়ে নাও, ঘাড়ে নাও।’ 

সিংহের মতো গর্জে উঠল রুদ্র,’ঘাড়ে নিব মানে? আমার ঘাড়টা কি তুই কলাগাছ পাইছস? এত সস্তা? পয়সা দে! ঘাড়ে উঠতে হইলে পয়সা দেয়া লাগব।’ 

বুবুনকে দেখে মনে হল সে রুদ্রর কথায় খুব মজা পাচ্ছে। হাঁটু ধরে ঝুলতে ঝুলতে এবার সে গান গেয়ে বলতে লাগল, ‘পয়সা লেবো! পয়সা লেবো!’ 

—‘আরে কী যন্ত্রণা, তুই কেন পয়সা লইবি, পয়সা লমু আমি। তোরে ঘাড়ে তোলার চার্জ 

বুবুন ফোকলা দাঁতে হাসে, সুর করে বলতে থাকে, ‘পয়সা লেবো! আমি পয়সা লেবো।’ 

বুবুনের বাবা মা ফিরে আসল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই। বুবুন এবার বাপ মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে নেচে নেচে গাইতে থাকল, ‘পয়সা লেবো, আহা আমি পয়সা লেবো! আহারে আমি পয়সা লেবো।’ 

বুবুনের বাবা অবাক গলায় বলল, ‘এ আবার কেমন কথা? পয়সা দিয়ে তুমি কী করবে?’ 

রুদ্র কান কাটার মতো হয়ে গিটার বাজাতে থাকল। এই বান্দরের বাদশাহ আজকে তাকে লোক সম্মুখে হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে। 

অমৃতা সামির ঘরের বাতি নিভিয়ে চুপচাপ অন্ধকারে বসে মোবাইলে গেম খেলছিল। হঠাৎ করেই তাকে ‘কিচ্ছু ভালো লাগেনা রোগে পেয়েছে। এই রোগটার তো কোনো নিয়ম কানুন নেই। সিম্পটম নেই। যখন তখন বিনা নোটিশে হাজির হয়ে যায়। কতক্ষণ কাটল কে জানে, আচমকা বেজে উঠল ডোর বেল। দুই মিনিটের মাথায় হৃদি দৌড়ে আসল এই ঘরে। দরজায় উঁকি দিয়ে চাপা গলায় বলল, 

—‘এই অমৃতা,ওঠ! সামির আব্বা আম্মা আসছে।’ 

কথাটা শোনা মাত্র অমৃতা জানেনা কেন, জীবনে প্রথমবারের মত সম্পূর্ণ বিনা কারণে তার বুক কেঁপে উঠল। স্নায়ু হয়ে উঠল টান টান! 

.

সামি রাগে গজগজ করতে করতে রাইফেল স্কয়ারের সামনের ময়লা ফুটপাতের ওপর বসে পড়ল। চারিদিকে লোকজন গিজগিজ করেছে। ফুটপাতের ধার ধরেই দাঁড়িয়ে আছে অগণিত রিকশা, সি এন জি, গাড়ি। শীতকাল হলেও শীতের আমেজ নেই তেমন একটা। রাত সাড়ে দশটা বাজে। সামিকে ওরকম হঠাৎ করে ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাতে বসে পড়তে দেখে আকাশ তাজ্জব বনে গিয়ে বলল, ‘কী মামা, কাহিনী কী?’ 

সামির রাগ তখন আকাশচুম্বি। সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ফাইজলামি পাইছস তুই? আমারে কি তর গাধা মনে হয়? গরু মনে হয়? ছাগল মনে হয়? দুম্বা মনে হয়?’ 

আকাশ গম্ভীর মুখে বলল, ‘চারটার একটাও মনে হয়না। অন্য কোনও অপশন আছে?’ 

—‘কুত্তা মনে হয়?’ 

—‘না দোস্ত!’ 

—‘তাহলে কী মনে হয়?’ 

—‘পাগল মনে হয়। শুধু আমার না। এই মুহূর্তে যত মানুষ তোরে দেখতেছে, সবাই পাগল ভাবতেছে। আমি শিওর।’ 

সামি জ্বলন্ত চোখে আশপাশটা একবার দেখল। মধ্যবয়স্ক এক ভিক্ষুক সামির ওই আগুন গরম মুখখানার দিকে চেয়ে হে হে করে হাসছিল ফুতপাতের এক কোণায় দাঁড়িয়ে। একটু আগে সামি তার ভিক্ষার থালায় দশ টাকার একটা নোট রেখেছে। এই মুহূর্তে ভিক্ষুকের অকৃতজ্ঞ হাসি দেখে তার গায়ে জ্বালা ধরে গেল। সে বিকট গলায় আকাশকে হুকুম করল, ‘ওর ভিক্ষার থালা থেকে দশটাকার নোটটা ফেরত ল।’ 

।হুকুম শুনে ভিক্ষুকের মুখ হয়ে গেল কালো। হে হে হাসি পালাল এক ছুটে। আকাশ বন্ধুর আদেশ মান্য করতে এগিয়ে গেল তার দিকে। ভিক্ষুক আকুলি বিকুলি হয়ে বলল, ‘এইটা কি কোন বিচার হইল ভাই?’ 

আকাশ উদাস গলায় বলল, ‘বিচার কোথাও নাই ভাই। এই দুনিয়া হইল অবিচারের জায়গা।’ 

থালা থেকে দশ টাকার নোটটা নির্বিকার ভাবে তুলে নিল সে। ভিক্ষুক বেচারার মুখের রঙ পাল্টে গেছে। তার ভিক্ষার থালায় আজকে এটাই সবচেয়ে বড় নোট ছিল। বোকামির বশে সেই নোটটাও হারাতে হল। আকাশ নিজের পকেট থেকে দশটাকার আরেকটা নোট বের করে থালায় রাখল। এবার ভিক্ষুক খুব হেসে হেসে বলতে লাগল, ‘এইডা একটা ভালো বিচার হইছে।’ 

আকাশ ফিরে আসতেই সামি ক্ষিপ্তবৎ হয়ে বলল, ‘এতক্ষণ কী করলি?’

—‘একটা ভালো বিচার করে দিয়ে আসলাম।’ 

—‘তামশা করস?’ 

—‘আরে কিয়ের তামশা, জিগা ওরে।’ এটুকু বলে আকাশ চিৎকার করে ভিক্ষুককে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী মামা কেমন বিচার হইল?’ 

ভিক্ষুক গদগদ ভাবে বলল, ‘খুব ভালো বিচার হইছে। 

—‘আমার ট্যাকা দে।’ 

আকাশ দশ টাকার নোটটা ফিরিয়ে দিল সামিকে। যে করেই হোক আর ঘণ্টা দেড়েক সময় এই ছেলেকে বসুন্ধরার ফ্ল্যাট থেকে দূরে রাখতেই হবে। সামির অবশ্য রেগে যাবার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। সীমান্ত স্কয়ার থেকে মোবাইল সেট কেনার কথা বলে বেরিয়েছিল আকাশ ওকে সঙ্গে নিয়ে। অনেকটা সময় ধরে বেশ কিছু দোকান ঘুরে তারা মোবাইল দেখেছে। সামি কাজটা করেছে বেশ আগ্রহ নিয়েই। ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসের প্রতি সে ভয়াবহ রকমের আসক্ত। প্রযুক্তি ছাড়া এই ছেলে কিছুই বোঝেনা। সীমান্ত স্কয়ারে প্রায় ঘন্টা দেড়েক সময় ঘুরাঘুরি করার পর আকাশ জানালো যে সে একবার বসুন্ধরা সিটি গিয়ে মোবাইল সেট যাচাই বাছাই করে দেখতে চায়। দাম দিয়ে একটা জিনিস কিনবে, যাচাই না করে হুট করে কিনে ফেলা নাকি উচিত হবেনা। সামি রাজি হল। বসুন্ধরা সিটি গিয়ে একটা গুগল পিক্সেল থ্রি এ সেট খুব পছন্দ হয়ে গেল তার। মূল্যও সুলভ। কিন্তু বেঁকে বসল আকাশ। এখন নাকি তার মনে হচ্ছে সীমান্ত স্কয়ারে যে স্যামসাং সেটটা দেখেছিল সেটাই বেশি ভালো। সেই মোবাইলটিই তার চাই। অগত্যা আবারো আসতে হল সীমান্ত স্কয়ারে। এরপর সেই স্যামসাং সেটের দোকানে গিয়ে আকাশের আকস্মিক ভাবে মনে পড়ল যে তার সাথে আসলে কোনো টাকা পয়সা নেই আজ। পকেট গড়ের মাঠ! সামি দিশাহারা হয়ে বলল, ‘টাকা নাই তো কী হইছে? ক্রেডিট কার্ড দিয়া কিনে ফ্যাল।’ 

আকাশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পকেট হাতড়ে, ওয়ালেট হাতড়ে, সামিকে জানালো যে ক্রেডিট কার্ড বাড়িতে ফেলে এসেছে। সেই থেকে সামির মেজাজ হয়ে আছে ফুটন্ত তেলের মত উত্তপ্ত। 

আকাশ, সামির পাশে বসে বলল, ‘দোস্ত আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে।’ 

—‘তোর প্ল্যানের আমি গুষ্টি কিলাই।’ 

—‘চেতস ক্যান মামা? শোন না আগে প্ল্যানটা।’ 

সামি পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে বলল, ‘না আমি আর তোর কোনো কথাই শুনবনা। তোর দান এখানেই শ্যাষ।’ 

আকাশ বলতে থাকল, ‘শোন আমরা ঠিক করছি তোর বিয়ের আগে আমরা একটা ব্যাচেলর পার্টি করুম। স্ট্রিপার ভাড়া কইরা আনমু। মদ উদ খাইয়া টাল হইয়া যাব পুরা। তারপর তুইও গান গাবি, কাল মেরা শাদী, আজ আজাদি! বুঝছস?’ 

—‘হ, আরো কিসু।’ 

—‘কারে ফোন করস?’ আকাশের প্রশ্ন। 

—‘তুই আমার সাথে কী কান্ডটা করছিস আজকে, এই কথাটা সবাইরে জানাইতে হবেনা?’ 

—‘তুই হৃদিরে ফোন করতেছিস তাইনা?’ 

সামি ফোন কানে নিয়ে বলল, ‘হ।’ 

আকাশ ছোঁ মেরে ওর কান থেকে ফোনটা টেনে নিয়ে বলল, ‘তুই কথায় কথায় খালি হৃদিরে ফোন দেস ক্যান? সমস্যা কী? গতকাল মাইয়া দেইখা তোর পছন্দ হইছে এই কথাটা তুই সবার আগে হৃদিরে বলছস। কথা ঠিক কিনা?’ 

‘হ ঠিক।’ 

—‘ওই শালা, আমারে না বইলা তুই হৃদিরে বলছিস কেন? তোর কাছে হৃদি বড় না, আকাশ বড়?’ 

ঠিক সেই সময় পেছন থেকে দুজনের পিঠের ওপরে একযোগে দুটি থাপ্পড় এসে পড়ল বজ্রপাতের মতো। চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে রাস্তার ফ্লুরোসেন্ট আলোয় ওরা একটা চেনা মুখ আবিষ্কার করল। স্কুল শিক্ষক, মামুন স্যার। সমাজ বিজ্ঞানের টিচার ছিলেন তিনি। থাপ্পড়টা এত জোরে এসে পড়েছে যে দুজনেরই পিঠ জ্বলছে তখনও প্রচন্ড ভাবে। স্যার ওদের কান খামচে ধরে বসা থেকে টেনে তুলতে তুলতে বললেন, ‘এই চামচিকা গুলা, তোরা দুইটা সব সময় একসাথে থাকিস কেন? ব্যাপারটা কী?’ 

মামুন স্যার দেখতে বেঁটেখাটো মানুষ। কিন্তু গায়ে প্রচন্ড জোর। স্কুলেও তিনি শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছাত্রদের পেটাতেন। কত বছর কেটে গেল মাঝে। লম্বায় আকাশ, সামি স্যারের উচ্চতাকে ছাড়িয়ে গেল কিন্তু স্যারের হাতের জোর এখনও বিন্দু মাত্র কমল না। মারামারি ছাড়াও স্যারের আরেকটি বদ অভ্যাস আছে। সেটা হল স্যার ছাত্রদের দেখলেই পেটে সুড়সুড়ি দেন। শুধু সুড়সুড়ি দিয়ে ক্ষান্ত হন না। একটা দুটা রাম চিমটিও কেটে দেন সুযোগ বুঝে। চিমটিটা সবচেয়ে ভয়ংকর। আকাশ স্যারের হাত থেকে নিজের কান ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল, ‘একসাথে থাকব না কেন স্যার? আমরা তো বি এফ এফ।’ 

—‘বি এফ এফ আবার কী জিনিস?’ 

উত্তরটা সামি দিল,’বেস্ট ফ্রেন্ড ফরএভার।’ 

কথাটা শুনে স্যার মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করলেন, ‘ঊঊঊ… বেস্ট ফ্রেন্ড ফরএভার? ছিনেমা না? লাইফটাকে ছিনেমা লাগে?’ বলতে বলতে তিনি আকাশের পেটের মধ্যে সুড়সুড়ি দিতে লাগলেন। আকাশ হো হো করে হাসা শুরু করল। স্যার বললেন, ‘বিয়া শাদী কিছু করিস নাই? তোদের বয়সে থাকতে তো আমি বাচ্চার বাপ হয়ে গেছিলাম।’ 

আকাশ দু পা পিছিয়ে গিয়ে স্যারের হাতের নাগালের বাইরে যাবার চেষ্টা করল, বলল, ‘স্যার, সামির বিয়া হইতে পারে এই বছর। দোয়া কইরেন।’ 

স্যার এবার সামির পেটে একটা রাম চিমটি কেটে আবারও মুখ দিয়ে সেই অদ্ভুত শব্দ করে বললেন, ‘উউউ… বিয়া করবি? দাওয়াত কই? স্যাররে দাওয়াত না দিয়া নাচতে নাচতে বিয়া করবি? এতো সাহস?’ 

—‘দাওয়াত পাবেন স্যার, যথা সময়ে দাওয়াত পাবেন।’ সামি বলল।

—‘তোদের দলে না একটা পাংকু ছিল? সেই পাংকু কোথায়?’ 

ওরা বুঝল স্যার রুদ্রর কথা বলছেন। 

-‘পাংকু তো স্যার বিদেশ যাইতাছে। পি এইচ ডি করতে।’

—‘তাই নাকি? কবে?’ 

—‘এইতো এই বছরের শেষে।’ 

স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ‘পাংকু করবে পি এইচ ডি, আর তোরা কী করবি? ফুটপাতে বসে ভিক্ষাবৃত্তি? বাসা থেকে বাইর কইরা দিছে নাকি? ফুটপাতে বইসা আছস ক্যান?’ 

আকাশ আর সামি স্যারের এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারা জানে মামুন স্যার আরো অনেকটা ক্ষণ যাবৎ অযথা বকবক করবেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সেই বকবকানি শুনতে হবে নিরুপায় হয়ে। স্কুলের স্যার বলে কথা। যতই বিরক্তিকর হোক না কেন স্কুলজীবনের শিক্ষকদের দেখলে যে আসলে মনটা পবিত্র হয়ে যায়, এ সত্যটা তারা দুজনেই ভেতরে ভেতরে গভীর ভাবে অনুভব করল। এছাড়া আকাশ মনে মনে নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে স্যারের উছিলায় অন্তত বাড়তি কিছু সময় সামিকে আটকে রাখা যাবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *