বৃষ্টিমহল ২.১৫

১৫

রোজ বাড়িতে কেউ না কেউ দর্শন লাভের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। আজকেও আছে। হক নিজের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে পিতার নামে একটি হাসপাতাল তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। সে ব্যাপারে উকিলের সাথে একটা মিটিং হওয়ার কথা রাত দশটায়। সারাদিন সময় পান না বলে মিটিংটা এমন অসময়ে ধার্য করা হয়েছে। উকিল সাহেব রাত দশটা বাজার আগেই চলে এসেছেন। এছাড়াও গ্রামের বাড়ি থেকে তার ফুপাতো ভাই এসে বসে আছে সকাল থেকে। আজকাল নিজের আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে তিনি খুব একটা তৃপ্ত বোধ করেন না। এরা সবাই আসে নানা প্রয়োজনে এবং মতলবে। মনের টানে কেউ আসেনা। 

বেডরুমে ঢুকতেই রোমেলা বললেন, ‘খবর পেয়েছ? তোমার ভাই এসে বসে আছে।’ 

হক গলায় বাঁধা টাইয়ের গিঁট খুলতে খুলতে বললেন,’দেখেছি।’ 

রোমেলার চোখ মুখ দুশ্চিন্তায় ডোবা। তার মুখে সবসময়ই কিছু না কিছু প্রসাধন থাকে। আজকে কোনো প্রসাধন নেই। চুল আলুথালু। শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াচ্ছে। তাকে ভীত এবং বিষণ্ন দেখাচ্ছে। হক স্ত্রীর এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কী হয়েছে?’ 

রোমেলা অনুচ্চ স্বরে বললেন, ‘বাচ্চাটার কোনো খবর পাচ্ছি না গতকাল থেকে। ফোন দেই ফোন বন্ধ। ওর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। তালা দেয়া। কেউ নেই সেখানে!’ 

—‘ওরা ইন্ডিয়া গেছে।’ 

—‘তুমি খবরটা জানতে? 

—‘হ্যাঁ জানতাম।’ 

—‘সেকী! আমি তো ভেবেছি তুমি জানোই না। সামির বন্ধু, রুদ্রর আম্মার কাছে ফোন করে জানতে পারলাম যে ওরা দেশ ছেড়েছে গতকাল। আমি আরো তোমাকে ভয়ে ভয়ে জানাই নি তুমি রেগে যাবে বলে। কী আশ্চর্য! আমার বাচ্চাটা আমাকে কিছু না বলে চলে যেতে পারল?’ 

—‘তোমাকে বললে যে কথাটা আমার কানেও চলে আসতো! তাই তোমাকে না জানিয়েই সব কিছু করা হয়েছে। কিন্তু তোমার গুণধর পুত্র এটা জানে না যে তার কোনো বিষয়ই আমার কাছ থেকে লুকোনো থাকে না। 

রোমেলা আগের চাইতেও ভীত গলায় বললেন, ‘আচ্ছা ওরা কি ওই মেয়েটার শ্বশুর বাড়ি গেছে? ওদের কি কান্ড জ্ঞান বলতে কিছু নেই?’ 

—‘তোমার ছেলের কান্ড জ্ঞান কোনো কালেই ছিল না। তার বন্ধু গুলাও হয়েছে একটার চেয়ে একটা মাথা মোটা বেকুব। আর ওই বেয়াদব মেয়েটা ঐযে অমৃতা নাম। ওই মেয়েটাকে আমি সামনে পেলে নির্ঘাৎ কষে চড় বসাবো। সত্যি আমি এই জেনারেশনটাকে একদম বুঝতে পারিনা।’ 

হক কথাটা বলে উঠে পড়লেন। অনেক কাজ বাকি। প্রথমেই তিনি তার ফুপাতো ভাইকে ডেকে পাঠালেন। সে এসেছে একটি দুঃসংবাদ নিয়ে। ফুপু আম্মার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। অর্থ সাহায্যে হকের কার্পণ্য নেই। কিন্তু এখন শুধু টাকার ব্যবস্থা করলেই হবেনা, চিকিৎসা সমেত থাকা খাওয়ার সমস্ত দায়িত্বও তাকে নিতে হবে। ফুপু আম্মার থাকার ব্যবস্থা এ বাড়িতেই করতে হবে। স্ত্রী রোমেলা গ্রামের আত্মীয়-স্বজন খুব একটা পছন্দ করেন না। বাড়িতে গেঁয়ো লোকজন ঘুরে বেড়ালে তাঁর নাকি অস্বস্তি হয়। আত্মীয় স্বজনদের নানারকম অফেন্সিভ কথাবার্তা শুনিয়ে দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই তাড়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলেন তিনি। কিছু কূটচাল তার রক্তের সাথে মিশে গেছে। তিনি হাজার চাইলেও এখন আর এই ঘোরপ্যাঁচযুক্ত কূটিল মনোভাব থেকে বেরোতে পারছেন না। 

রোমালাকে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু জানালেন না হক সাহেব। স্ত্রীর সাথে মনের কথা খুলে বলায় খুব একটা অভ্যস্ত নন তিনি। রোমেলা তাঁর মানসিকতা আজ অবধি বুঝে উঠতে পারেননি, গুরুত্ব দেবার চেষ্টা করেননি তাঁর কোন ব্যক্তিগত মতামতকে। ভ্যাকেশনে তাঁর পছন্দ নির্জনতা, পাহাড় কিংবা সমুদ্র। অপরদিকে রোমেলার প্রকৃতির প্রতি কোন টান নেই। জগত দর্শনে আগ্রহ নেই। তাঁর সমস্ত মনোযোগ এবং আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে বিলাসিতা, কেনাকাটা এবং লোক দেখানোতে। 

ঠিক হল এক সপ্তাহের মধ্যেই ফুপু আম্মা এ বাড়িতে এসে উঠবেন। চিকিৎসায় যেন কোনো অযত্ন না হয় সে ব্যবস্থা হকই করবেন। ফুপাতো ভাইয়ের সাথে কথোপকথন সেরে তিনি লইয়ারের সাথে বসলেন। ঘন্টা খানেক সময় ধরে চললো আলোচনা। মানুষ যত বড় হয়, উঁচুতে ওঠে, তত বেশি সে নিজস্ব গন্ডি ছাড়িয়ে সর্ব সাধারণের হতে থাকে। তার নিজের জন্য বরাদ্দকৃত সময়টা হয়ে যায় সংকীর্ণ। এত কাজ, এতো দায়িত্বের ভারে প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেয়াই দায় হয়ে ওঠে। তার ওপর নিজের ছেলেটাকে তিনি চোখ ভরে কতদিন দেখেন না! একটা সময় রোজ রাতে খাবার টেবিলে ছেলের সাথে আলাপ হত। ওই পারিবারিক অল্প একটু সময় তিনি প্রাণ ভরে উপভোগ করতেন। ছেলের বন্ধু রুদ্র অনেক দিন যাবৎ টানা এ বাড়িতে থেকেছে। সেই সময় বাড়িটা সারাক্ষণ কম বয়সী ছেলেমেয়েদের ভিড়ে ঝুম ঝুম করতো। এখন বাড়িটা হয়েছে মরা বাড়ির মতো। হক ডিনারের পর গায়ে শাল জড়িয়ে ছাদে এসে বসলেন। সুইমিং পুলের পাশে। সারা দিনের মধ্যে ঘুমোতে যাবার আগের এই সময়টুকুই শুধুমাত্র তার নিজের। এই অল্প সময়টাতে তিনি কাজের বাইরের জগৎটাকে নিয়ে ভাবতে বসেন। প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেন। রাত বাজে এগারোটা। সব কিছু ঠিক থাকলে তার পুত্রের এতক্ষণে ভারত পৌঁছে যাবার কথা। তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে অমৃতাকে ডায়াল করলেন। 

পাঁচ ছয়বার রিং পড়ার পর ওপাশ থেকে অমৃতার গলার আওয়াজ ভেসে আসলো। 

—‘কী ব্যাপার?’ 

মেয়ের কথা বলার ধরণ দেখো! বন্ধুর বাবার সাথে কেউ এই টোনে কথা বলে? তিনি কিছু না বলে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে রাগ হজম করলেন। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অমৃতা বললো, 

—‘আপনি কি আমাকে মিস করছেন?’ 

হক দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘অমৃতা, পাকামো করোনা!’ 

—‘আপনি যেভাবে সকাল বিকাল আমাকে ফোন দিতে দিতে পাগল বানায় ফেলতেছেন। মনে হচ্ছে আমাকে ভীষণ ভাবে মিস করতেছেন। 

—‘তুমি কি সবার সাথে সব সময় এরকম বেয়াদবের মতো বল?’ 

—‘না, সবার সাথে না। প্রয়োজনে বলি।’ অমৃতা ফোন কানে নিয়ে উঠোনে বেরিয়ে এসেছিল। হক ফোনের ভেতর দিয়ে ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন। সেই সাথে বাতাস চলাচলের শব্দ। তিনি বললেন, 

—‘তোমরা যে জায়গায় গেছ, সেটা কি গ্রাম এলাকা?’ 

—‘তাতে আপনার কী?’ 

—‘মুখে মুখে তর্ক করোনা। প্রশ্নের উত্তর দাও।’ 

—‘কতবার বলতে হবে আপনাকে? যে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই?’ 

—‘তুমি কি চাও আমি তোমার বাবার কাছে ফোন দিয়ে তোমার নামে কমপ্লেইন করি?’ 

—‘কী কমপ্লেইন করবেন শুনি?’ 

হক একটু সময় চুপ থাকলেন। তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘তুমি যে একজন চেইন স্মোকার এই খবরটা কি তোমার বাবা মা জানেন?’ 

অমৃতা থমকে গেল। বিস্মিত ভাবে বলল, ‘এটা আপনি জানলেন কী করে?’

—‘আমি তো আগেই বলেছি, আমার সব খবর রাখতে হয়। আরেকটা কথা শোনো। তুমি যদি আমাকে প্রতি নিয়ত তোমাদের আপডেট না দাও তাহলে কিন্তু আমি বিভার বাবাকে ফোন করে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলবো। তুমি তো জানো বিভার বাবা হার্টের রোগী।‘ 

রাগে সারা শরীর রি রি করে উঠল অমৃতার। জ্বলতে জ্বলতে বললো, ‘কী জানতে চান আপনি?’ 

—‘তেমন কিছুই না, আমার সিম্পল কয়েকটা প্রশ্নের সিম্পল উত্তর দিলেই কিন্তু ঝামেলা চুকে যায়। তুমিই পানি ঘোলা করছ বেশি কথা বলে। 

অমৃতা এবার মুখ ঝামটা মেরে বলে উঠলো, ‘আরে বলেন না কী জানতে চান? আমার অত সময় নেই! 

—‘ঠিক মত পৌঁছে গেছো?’ 

—‘হ্যাঁ।’ 

—‘কয়দিন থাকছো?’ 

—‘এখনো ঠিক নেই। 

—‘সামি কী করছে?’ 

—‘আই ডোন্ট নো! আপনার ছেলের ওপর নজরদারি করা ছাড়াও আমার আলাদা একটা লাইফ আছে!’ 

—‘ও তাই নাকি?’ 

—‘ঠিক তাই।’ 

—‘ওই হিন্দু মেয়েটা, ও যেন আবার আমার ছেলের লেজ ধরে দেশে চলে না আসে। এ ব্যাপারটা তুমি খেয়াল রাখবে।’ 

—‘আমার বয়েই গেছে!’ 

—‘কী বললে?’ 

—‘কিছুনা, আর কিছু বলবেন?’ 

—‘সামিকে বলবে সে যেন তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নেয়। তার মা দুশ্চিন্তা করছে। আর আমি যে তোমার কাছ থেকে ওর খবর নিচ্ছি এ ব্যাপারটা যেন তার অজানা থাকে। ফোন ছাড়ছি।’ 

.

বাড়ি ফেরার মুখে সদর দরজার সামনে অমৃতাকে পাওয়া গেল। তার হাতে সেলফোন। বোধহয় কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল। সামিকে দেখতে পেয়ে সে বললো,’দোস্ত, বিড়ি খাবি?’ 

সামি পাশ কাটানো গলায় বললো, ‘নারে, এখন না।’ 

ড্রইং রুমে অভিজিতের সাথে আকাশ,রুদ্র বসে আছে। তিনজনকেই বেশ হাসিখুশি, স্বাচ্ছন্দ্য দেখাচ্ছে। সামির উপস্থিতিটা তাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ অস্বস্তির উদ্রেক করলো। ঘরে ঢুকে অপ্রস্তুত ভাবে একবার তাকালো সে দুই বন্ধুর দিকে। অভিজিৎ কিন্তু চোখ তুলে একটিবারের জন্যেও চাইলোনা সামির দিকে। সামির উপস্থিতি যেন সে টেরই পায়নি এমন ভাবে রুদ্রকে বললো, ‘আপনি শুনেছি অনেক ভালো গান করেন। তা সেই গান শোনার সৌভাগ্য কি হবে একবার?’ 

রুদ্র গদগদ হয়ে বললো, ‘নিশ্চয়ই হবে, নিশ্চয়ই হবে। আজকে রাতেই গানের আসর জমবে।ডোন্ট ওরি।’ 

আকাশ ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সামির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তর কী হইছে?সব ঠিক?’ 

সামি খুব ছোট করে বললো, ‘হুম ঠিক।’ 

কথাটা বলে আর দাঁড়ালোনা সে। মেয়েদের ঘরের দরজায় এসে টোকা দিল। সামি জানে ভেতরে এখন শুধু হৃদিই আছে। বিভা রান্নাঘরে। অমৃতা উঠোনে। অতএব এই ঘরের মালিক এখন হৃদি একা। একটু চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেলো। সামি নিঃশব্দে ঘরের ভেতরে ঢুকলো। হৃদি বিছানায় শুয়ে আছে পাশ ফিরে। তার চোখ দুটি বন্ধ। মুখ জুড়ে কেমন এক বিষণ্ণ অস্থিরতা। ইশ ওই মুখের দিকে চাইতেও এখন সামির লজ্জা করছে। বুকের ধুকধুকানি টা কমছে না। সব মিলিয়ে একটা বিশ্রী অনুভূতি। বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে হৃদির বাহুতে আলতো ভাবে একটি হাত রাখলো সামি চমকে উঠে চোখ খুললো হৃদি। সামিকে দেখা মাত্র শোয়া থেকে উঠে বসে তড়িঘড়ি করে হাতের আঙুলে পরে থাকা আংটিটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। যেন সামি এই আংটি ফেরত নেবার জন্যেই এসেছে এখানে। 

সামি বিছানায় হৃদির পাশে বসলো। কিছু না বলে আড়ষ্ট ভাবে চেয়ে দেখতে লাগলো হৃদিকে। আংটিটা খুলতে গিয়ে কী শারীরিক কসরৎই না করতে হচ্ছে তাকে। দুনিয়ার সব বাজে ঘটনা কি একই দিনে ঘটাটা জরুরি ছিল? আজকের দিনের দ্বিতীয় বাজে, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রিয় ঘটনাটি ঘটে গেল হৃদিতার সাথে সেই মুহূর্তে। আংটিটা বের করা যাচ্ছেনা। হৃদি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জিনিসটা আঙুল থেকে খুলে বের করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছেনা। সামি নির্বাক হয়ে বেশ খানিকক্ষণ এই কান্ড দেখে নিয়ে একটা সময় নিস্তরঙ্গ গলায় বললো, ‘থাক না! এত তাড়াহুড়া করতেছিস কেন?’ 

—‘থাকবে কেন?এটা কি আমার জিনিস নাকি?’ বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তির্যক গলায় বলল হৃদি। 

বাথরুমে বেসিনের সামনে গিয়ে সে হাতে সাবান লাগালো। তারপর শুরু হল সাবান দিয়ে হাতের আঙুল পিচ্ছিল করে আংটিটা বের করে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা। সামি বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, ‘তুই এসব বন্ধ করবি? কথা বলতে আসছিলাম তোর সাথে।’ 

হৃদি আগুন চোখে তাকালো সামির দিকে, ‘কী কথা?’ 

ঠিক সেই সময় অমৃতার আগমন ঘটলো ঘরের ভেতর। সে একটু অবাক গলায় বললো,

—‘কীরে তোরা দুইটা বাথরুমে কী করস?’ 

সামি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, ‘না কিছুনা, হৃদির নাকি মাথা ব্যথা। ওরে বললাম মাথায় একটু ঠান্ডা পানি দিতে।’ 

মিথ্যেটা বলে খারাপ লাগলো সামির। তাদের বন্ধুদের মধ্যে কোনোরকম রাখঢাক করার নিয়ম নেই। তারা একজন আরেকজনের কাছ থেকে কোনো কথা লুকোয়না। মিথ্যে বলেনা। কিন্তু আজকে নিয়তি এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে এই মুহূর্তে মিথ্যে না বলে উপায় নেই। 

অমৃতা বললো, ‘খেতে আয়। বিভা ডাকছে।’ 

সামি হৃদিকে দেখলো একবার। হৃদি তখনও আংটি নিয়ে ব্যস্ত। তার হাতের আঙুল লালচে বরণ ধারণ করেছে। আংটি দাঁত চেপে বসে আছে আঙুলের চামড়ায়। তবুও আংটি তার এই মুহূর্তেই খোলা চাই। 

সামি সরে আসলো জায়গাটা থেকে। অমৃতাকে বললো, ‘চল আমরা যাই, ও পরে আসবে।’ 

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিভা টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। সাদা ভাত, মুগের ডাল দিয়ে সবজি,কৈ মাছ ভাজা,মুরগির মাংস আর লুচি। অভিজিৎ হাসি মুখে অতিথিদের আপ্যায়ন করছিল। বিভাকে দেয়া কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। বিভার বন্ধুদের সাথে হেসে কথা বলছে, ভদ্র ব্যবহার করছে! 

আকাশ, রুদ্র কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছিল। বিভা, অভিজি‍ৎ তখনো শুরু করেনি। খালি দুটি চেয়ারে সামি আর অমৃতা এসে বসলো। 

সামির মুখোমুখি চেয়ারটাই অভিজিতের। লোকটার চোখে চোখে তাকাতে সামির কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে বিভারও। অভিজিতের সামনে সামির উপস্থিতি তাকে আড়ষ্ট করে তুলেছে। এতক্ষণ যে স্বাচ্ছন্দ্য ভাবটা তার মধ্যে বিরাজ করছিল সামি আসার পরপর সেই ভাবটা উবে গেছে। 

অমৃতা বললো, ‘আপনাদের এখানে ট্যুরিস্ট স্পট কী কী আছে? এসেছি যখন সবটা দেখে যেতে চাই।’ 

অভিজিৎ নিজের প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে বললো, ‘আছে কয়েকটা ভালো ভালো জায়গা। তবে এ জায়গার মূল আকর্ষণ হল বন বনানী আর বন্য জন্তু। গরুমারা ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে গেলে বেশ কিছু জন্তু জানোয়ার দেখতে পাবেন। চাইলে হাতির পিঠেও চড়ে দেখতে পারেন।’ 

—‘ওয়াও। সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং। কিন্তু দুলাভাই, আপনি আমাদেরকে আপনি আপনি করে বলছেন কেন? তুমি বলাতে কোনো পানিশমেন্ট নেই।’ 

বিভা ফোড়ন কাটলো, ‘উনি আবার একটু বেশি ভদ্র কিনা, তাই উনার মুখ দিয়ে তুমি বের হয়না।’ 

অমৃতা হাসতে হাসতে বললো, ‘আমরা সবাই কিন্তু খুব বেশি অভদ্ৰ। এটা আপনার জানা আছে তো? প্রিপারেশন নিয়ে রাখেন। নইলে আচমকা আমাদের অভদ্রতা দেখে আবার মূর্ছা যেতে পারেন।’ 

হৃদি এসে গেছে ততক্ষণে। তার মুখ ভার। এসে কারো সাথে কথা না বলে সে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লো। সামি আড়চোখে দেখলো হৃদিতাকে। তার হাতের আঙুলে এখনো আংটিটা রয়ে গেছে। খোলা যায়নি। হাপুস হুপুস করে খেতে খেতে রুদ্র খুব জরুরী গলায় বিভাকে বললো, ‘এই বিভা খুব গরম লাগতেছে। কাজের মেয়েটাকে বল ‘ই’ করতে।’ 

বিভা বুঝতে না পেরে বললো, ‘কী বলিস?’ 

রুদ্র মাংস চিবোনোতে বিভোর হয়ে মাথার উপরের ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘গরম লাগতেছে ওই মেয়েটাকে বল ইটা একটু ই করে দিতে।’ 

বিভা মহা বিরক্তি নিয়ে রুদ্রর দিকে একটু সময় তাকিয়ে থাকলো। কথাটা বলেই রুদ্র আবার খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। বিভা চেঁচিয়ে ডাকলো, ‘দূৰ্গা, এই দূৰ্গা!’ 

দূর্গা দৌড়ে আসলো। বিভা বললো, ‘ই’ টা একটু ই করে দাও।’

দূর্গা থ বনে গিয়ে চেয়ে রইল বিভার দিকে। 

—‘ফাজলামো করিস?’ চোখ গরম করে বলল রুদ্র, বিভাকে।

—‘ফাজলামোর কী আছে? তুইই তো বললি মেয়েটাকে বলতে ই টা একটু ই করে দিতে।’ 

রুদ্র মুখ গোঁজ করে বলল, ‘ফ্যান ছাড়তে কইছি গাধী।’ 

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। এমন কি শান্তশিষ্ট, সুশীল অভিজিৎও ওদের কান্ড দেখে না হেসে থাকতে পারলনা। হাসতে পারল না শুধু সামি। তার কেন যেন নিজেকে এ মুহূর্তে বড় বেশি অবাঞ্চিত বলে মনে হচ্ছে। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে, ঘেন্না হচ্ছে, কোন আক্কেলে সে এই লোকটার বাড়িতে যেচে পড়ে আসতে গেল? বিভাকে এক নজর দেখবার আকাঙ্খা তাকে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য করে তুলেছিল। পুরো বিষয়টা যে কতটা দৃষ্টিকটু দেখাতে পারে তা একবারের জন্যও ভেবে দেখেনি সে। 

সামি বিধ্বস্ত চোখে বিভার দিকে চাইল। বিভা কেন আসবে বলে কথা দিয়েও আসলো না? বিভা যদি সময়মত জায়গাটায় পৌঁছুতে তবে তো এই বিশ্রী কান্ডটা তার আর হৃদিতার সাথে ঘটতো না। অভিজিতের পাশে বসা হাসি মুখের বিভার দিকে চেয়ে সামির বুকের ভেতরটা আচমকা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। এই বিভাকে সে বুঝতে পারছেনা, চিনতে পারছেনা। তার প্লেট প্রায় শূন্য ছিল। সে অনেক ক্ষণ ধরে একটা লুচি আর অল্প একটু ডাল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অভিজিত সবার পাতেই এটা সেটা তুলে দিচ্ছিল শুধু সামি বাদে। বিভাও আগ বাড়িয়ে অভিজিতের সামনে সামিকে কিছু সাধতে পারছিল না। কে জানে অভিজিৎ আবার কীভাবে নেয় ব্যাপারটা F 

অভিজিৎ চোরা চোখে ফর্সা, কোকড়া চুল ওয়ালা ছেলেটাকে দেখছিল। এর আগে বাংলাদেশে যখন এর সাথে দেখা হয়েছিল তখন ঠিক সেরকম ভাবে খেয়াল করা হয়নি। তখনো অভিজিৎ জানতো না যে এই যুবকটি বিভার কাছে বিশেষ কেউ। তাই বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করাও হয়ে ওঠেনি এই যুবক নিঃসন্দেহে সুদর্শন। উচ্চতায় অভিজিৎকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু আচার আচরণে একটা উদ্ধত ভাব আছে যেটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। কিংবা কে জানে হয়তো ওর আচরণের এই উদ্ধত দিকটা শুধুমাত্র অভিজিতের জন্যই বরাদ্দ! সে শুনেছে এর বাবা বিরাট বড় শিল্পপতি এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতেও একজন পরিচিত মুখ। মেয়েরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই এ ধরণের ছেলেদের প্রেমে পড়ে। দেখতে ভালো, বাবার অঢেল টাকা, আর কী চাই? ধর্মের ফারাকটা না থাকলে বিভার বাবা মাও হয়ত খুশিতে আট খানা হয়ে একেই জামাতা হিসেবে বরণ করে নিতেন। অভিজিতের বুকে একটা অদ্ভুত, সূক্ষ্ম ব্যথা হচ্ছিল। অথচ তার তো খারাপ লাগার কথা ছিল না। দু দিন বাদেই বিভা চলে যাচ্ছে। তার চলে যাবার টিকেট অভিজিৎ নিজ উদ্যোগেই করেছে। এই যুবকটির সাথে তার নাম কা ওয়াস্তে স্ত্রীর প্রেমের খবরটা তার কাছে কখনওই অজানা ছিলনা। সব কিছু জেনে শুনে বিভাকে বিয়ে করেছিল সে শুধুমাত্র বিভার বাবার হার্ট টা বাঁচাতে, তাও আবার বিভারই অনুরোধে। অভিজিৎ বরাবরই বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। কোনো কিছু নিয়েই আবেগের বাড়াবাড়ি করাটা তার ধাতে নেই। কিন্তু আজকে তার সেই যুক্তিশীল মনটা কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে! এই ছেলেটাকে কেন সহ্য করতে পারছেনা সে? কেন এত দিন বাদে এসে তার অন্তরের অন্তরাত্মা না চাইতেও এমন প্রবল ভাবে বিদ্রোহ করে উঠছে? 

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকেবুকে যাবার পর দেখা গেল সবাই কম বেশি ক্লান্ত। গানের আসরটা সে রাতে আর বসলোনা। রুদ্রই সবার আগে বিছানায় গেল। বাকিরা বসার ঘরে সোফার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিল। হৃদি গুম হয়ে নিজের মোবাইল ঘাঁটছিল। সামি সবার সামনেই ওকে আচমকা বললো, ‘হৃদি, একটু এদিকে আয় তো, কথা আছে তোর সাথে।’ 

হৃদি ফোঁস করে উঠল,’কোন দিকে আসবো?’ 

—‘মানে অন্যদিকে, একটু প্রাইভেসি লাগবে।’ 

আকাশ হাহাকার করে বলে উঠলো, ‘মানে কী? ফ্রেন্ডদের মধ্যে আবার কীসের প্রাইভেসি?’ 

—‘পরে বলবো তোদেরকে।’ ঠান্ডা গলায় বললো সামি। 

—‘আমি এখন কোথাও যাইতে পারবোনা। বিরক্ত লাগতেছে।’ 

সামি হঠাৎ দুম করে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। দ্রুত হেঁটে হৃদির সামনে গিয়ে ওর হাত টেনে ধরে বলল, ‘ফাইজলামি করিস? বলতেছি কথা আছে। বাংলা বুঝিস না?’

হৃদিকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে হৃদির হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ভেতরের ঘরে। 

অভিজিৎ একটু বিস্ময় নিয়ে বিভাকে বললো, ‘উনি কি সব সময়ই এরকম? একটু উদ্ধত? এরোগ্যান্ট?’ 

বিভার অভিজিতের কথাটা ভালো লাগলো না। সামিকে নিয়ে কেউ খারাপ কিছু বললে তার ভালো লাগেনা। সে স্তিমিত গলায় বললো, ‘মোটেও না। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।’ 

অমৃতা আর আকাশ সমস্বরে প্রশ্ন করে উঠলো, ‘কিন্তু কী হয়েছে?’ 

হৃদির হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে ভেতরের ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় এক ধাক্কায় ফেলে দিল সামি। তারপর ভারী কাঠের দরজাটা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়াম শব্দ তুলে বন্ধ করল। 

তাল সামলাতে না পারা হৃদির শরীরটা ছিটকে পড়েছিল, বিছানার ওপর। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল এক আর্ত চিৎকার। 

কোঁকাতে কোঁকাতে লুটিয়ে পড়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে উঠে বসল সে। তার খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ফুলেফেঁপে আছে। শাড়ির আঁচল গেছে দুমড়ে মুচড়ে। হাতের কব্জি ডলতে ডলতে সে বাঘিনীর মতো গর্জে উঠে বললো, ‘কী ব্যাপার? তামশা করিস হারামজাদা?’ 

সামি তীব্র ভাবে তাকালো হৃদির দিকে। তার চোখে ধকধক করছে তেজ। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, 

—‘ঢং করার আর জায়গা পাস না?’ 

—‘সমস্যা কী তোর?’ 

—‘তোর সমস্যা কী? তোরে আমি সেই তখন থেকে বলতেছি উই নিড টু টক! তুই আমার কথা কানেই নিচ্ছিস না। মানে মানুষের সহ্যের একটা সীমা থাকে। 

—‘কী কথা বলবি তুই আমার সাথে? বাল, তোর সাথে কোনো কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নাই।’ 

—‘তোর সাথে কথা বলার জন্যেও আমি মইরা যাইতেছিনা বুঝছস? বাট উই নিড টু টক এবাউট আওয়ার কিস।’ 

হৃদির চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, ‘আওয়ার কিস মানে? আই ডিড নট কিস ইউ এসহোল! ইউ ডিড।’ 

সামির মুখখানায় আক্রোশের তীব্র রেখা দগদগ করে ওঠে। প্রচন্ড ঝাঁঝ নিয়ে বলে, ‘ওকে ফাইন। আই ডিড। বাট আমি জানতাম না এটা তুই। আমি তোকে বিভা ভাবছিলাম।’ 

—‘দ্যাটস নট দ্যা পয়েন্ট!’ 

—‘দ্যাট ইজ সো পয়েন্ট! আরে আজব কেন আমি তোকে শুধু শুধু কিস করতে যাবো। মানে আমাকে তোর এতটাই ফালতু মনে হয়? 

—‘ফালতুই তো তুই। লাস্ট টাইম কক্সবাজারে বিভার সাথে যা করেছিস এবার আমার সাথেও তাই করলি। মানুষ একই ভুল বার বার কীভাবে করে? বিভার সাথে ঘটনা ঘটার পর আচমকা তুই বিভাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলি। কে জানে কোন দিন হুট্ করে বলে বসবি আমাকেও তোর বিয়ে করা চাই।’ 

কথাটা মাটিতে পড়ার আগেই সামির ফর্সা গাল লাল টকটকে হয়ে গেলো। অপমানে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো কান। সে দিশাহারা হয়ে বলে উঠলো, ‘হ্যাঙ্গ অন, তুই কি ভেবেছিস আমি কাজটা ইনটেনশনালি করছি? সিরিয়াসলি? আই মিন হাও কুড ইউ ইভেন থিংক এবাউট ইট? আল্লাহ! তোকে?… মানে তোকে?’ 

হৃদি মুখ ঝামড়ে উঠে বলে, ‘করতেই পারিস। তোর কোনোকিছুর ঠিক আছে নাকি?’ 

সামি এবার খুব কঠিন ভাবে বললো, ‘ফালতু কথা বলিস না হৃদি, আমি কখনোই তোর সাথে এমন কাজ করব না, আর তোকে কখনো বিয়েও করতে চাইবো না।’ 

হৃদি কেটে কেটে শব্দ গুলো উচ্চারণ করলো, ‘তুই আমাকে কখনোই বিয়ে করতে চাইবি না?’ 

—‘কখনোই না! মাথা খারাপ!তুই আমার জাস্ট ফ্রেন্ড।’ 

হৃদি অদ্ভুত হাসে, ‘আর যদি কোনো দিন হুট্ করে তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস? তখন কী হবে? কী করবি তুই?’ 

সামির মুখটা আকস্মিক কেমন সন্দেহ প্রবণ হয়ে ওঠে। সে চোখ সরু করে প্রশ্ন করে, ‘তুই চাচ্ছিসটা কী বল তো?’ 

—‘আমার প্রশ্নের উত্তর দে, যদি… ধর যদি তোর কোনো দিন আমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছা হয়, তখন তুই কী করবি?’ 

—‘কী করবো আবার। যা, কান কাইটা ফেলবো। সামিউল হক থেকে হইয়া যাবো কান কাটা সামি। খুশি?’ 

—‘অকে, ইটস আ ডিল।’ 

সামি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, হেল ইয়াহ, ইটস আ ডিল! তুই কী যে ভাবছিস আমাকে হৃদি! মানে লুক এট ইওরসেল্ফ, ইউ আর নট মাই কাপ অফ টি। আর সেবার কক্সবাজারে বিভাকে আমি জেনেশুনে সজ্ঞানে চুমু খাইছিলাম। হ্যাঁ হঠাৎ করে হয়ে গেছিল এটা ঠিক, কিন্তু আমিতো জানতাম ওটা বিভাই। এবারও তো বিভা মনে করেই…… 

হৃদি হাত তুলে সামিকে থামিয়ে দিল, ‘ইউ আর নট মাই কাপ অফ টি এটার মানে কী?’ 

সামি অধৈর্য গলায় বললো, ‘মানে তোর প্রেমে পড়াটা আমার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব না। তুই ওরকম প্রেমে পড়া টাইপ মেয়ে না। আর তাছাড়া তুই আমার খুব ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। আকাশের পর পর, তুইই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তোকে নিয়ে অন্য কিছু চিন্তা করাও পাপ!’ 

হৃদি ডগডগে চোখদুটো মেলে ধরলো সামির মুখের ওপর। চেয়ে রইল একদৃষ্টে কয়েকটা মুহূর্ত। তার চোখের তেজটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো। তার বদলে চিকচিক করে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো কয়েক বিন্দু জল। সামি সেদিকে লক্ষ্য করলো না। সে তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে নিয়ে মেসেঞ্জার খুলে বিভার সাথে কথোপকথনের বক্সটা বের করল। হৃদির চোখের সামনে ফোন মেলে ধরে বললো, ‘এই দ্যাখ, বিভাকে আমি আসতে বলছিলাম বাইরে উঠানে। ঠিক ওই সময় বিভার আসার কথা ছিল। আল্লাহর কসম দোস্ত,অন্ধকারে তুই যখন হেঁটে আসতেছিলি তখন আমি ধরেই নিছিলাম এটা বিভা।’ 

হৃদি ঝাপসা চোখে মেসেজগুলো দেখলো। তার চোখ থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়লো কয়েক ফোঁটা জল। 

সামি দু পা এগিয়ে এসে হৃদির একটা হাত ধরার চেষ্টা করলো। হৃদি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলো। ধমকে উঠে বললো, ‘সামি প্লিজ, দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।’ 

১৬

বিভা আর অমৃতা ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করলো, ‘হৃদি, কী হইছেরে? তোর আর সামির মধ্যে কাহিনীটা কী?’ 

হৃদি লেপের তলায় গুটিশুটি হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে ছিল বিবশ হয়ে। এক তীব্র জ্বালা আর উত্তাপ তার ভেতরটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। কানে বারংবার বাজছে সামির মাত্র বলে যাওয়া কথাগুলো। নিজের সাথে একটা ভালো বোঝাপড়া দরকার তার। নিজেকে দেয়া দরকার বিস্তর সময়। কিন্তু সেই সময়টা কোথায়? সে একটুও না নড়ে পাথরের মতো গলায় উত্তর দিল, ‘কালকে বলবো, আজকে না। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাইতে দে। লাইট বন্ধ কর।’ 

অমৃতা আর বিভা একজন আরেকজনের মুখের দিকে চাইলো। কোনো কথা না বলে বিভা হেঁটে গিয়ে সুইচ টিপে বাতি নেভালো। নেভানোর সাথে সাথেই ঘরের ভেতর ঝুপ করে নামলো এক নিকষ কালো অন্ধকার। এই ঘরে কোনো হিটারের ব্যবস্থা নেই। বেশ ঠান্ডা। জানালা বন্ধ থাকার পরেও বাইরে থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার নিরবিচ্ছিন্ন ডাক। ভেসে আসছে শুকনো পাতার ওপর জন্তু চলাচলের শব্দ। হঠাৎ হঠাৎ ডাকছে হাতির দল। অন্ধকার চোখে সয়ে আসার পর বিভা আস্তে আস্তে হেঁটে অমৃতার কাছে এগিয়ে আসলো। তারপর কোনো ভূমিকা ছাড়াই আচম্বিতে সে অমৃতাকে দু হাত বাড়িয়ে জাপটে ধরলো। আনন্দে মাখামাখি হয়ে বললো, ‘কত দিন পর দোস্ত! আমি খুশিতে মইরা যাবো!’ 

দুই বান্ধবী আনন্দে কিছুক্ষণ তিড়িং বিড়িং করে নাচানাচি করল ইচ্ছে মতো হাত পা ছুঁড়ে। ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে মনের আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল তারা। যেন সদ্য বয়োসন্ধিতে পা দেয়া দুটি কিশোরী। একটু বাদে লাফ দিয়ে দুজনে উঠে পড়লো বিছানায়। কাঠের বিছানা মড়মড় শব্দ করে গোঙাতে লাগলো। হৃদি মহা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘কী ব্যাপার মাঝরাতে বিছানার ওপর লম্ফঝম্প শুরু করছিস কেন? ঘুমাইতে দে!’ 

বিভা হৃদির গায়ের ওপর থেকে লেপটা এক টানে সরিয়ে নিলো, ‘এতদিন পর তোদেরকে পাইছি, ঘুমাবি মানে?’ 

হৃদি লেপটা নিজের গায়ে আবার টেনে নিলো। কঠিন গলায় বললো, ‘আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করতেছে। বিরক্ত করিস না।’ 

অমৃতা বিভাকে বললো, ‘আচ্ছা থাক। ও ঘুমাক। আমরা তো আছি কয়েকদিন। তুই মন খারাপ করিস না।’ 

বিভা ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলল বাচ্চাদের মতো, ‘দ্যাখ না, এই হৃদির বাচ্চি কেমন যেন হয়ে গেছে। এত দিন পর আমারে দেখছে কিন্তু ওর মইধ্যে কোনো ফিলিংস নাই। ও আমারে আর ভালোবাসেনা।’ হৃদি কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শোয়া থেকে উঠে বসলো। হিসহিসে গলায় বললো, ‘এইসব ন্যাকা ন্যাকা বাংলা সিনেমার ডায়লগ কোত্থেকে শিখছিস? কলকাতার বাবুর কাছ থেকে?’ 

শুনে বিভা আর অমৃতা হিহি করে হেসে উঠল। বিছানার উপর গোল হয়ে বসেছে ওরা। বহুদিন পর তিন বান্ধবী এক ছাদের নিচে একত্রিত হয়েছে। আজকের রাতটা তাই আনন্দে মাখামাখি রূমঝুম করা এক রাত। এমন রূমঝুম রাতে সত্যিই কারো ঘুমোতে হয়না। 

অমৃতা বললো, ‘আমার ঈদ ঈদ লাগতেছে। ছোট বেলায় ঈদের আগের রাতে যেই ফিলিংসটা হইত। ঠিক সেইরকম।’ 

—‘চল প্ল্যান করে ফেলি, এই কয়েকদিন কী কী করবো, কোথায় ঘুরব সব আজকেই ঠিক করে ফেলি।’ বিভা বলল খুশিতে গদগদ হয়ে। 

দুই বান্ধবীর গলার স্বরের আনন্দের রেশটা একটু একটু করে হৃদিকে ও ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। বুকের ওপর চেপে বসে থাকা ভারটা নেমে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে। 

অমৃতা বললো, ‘কালকে কি আমরা ন্যাশনাল পার্কে যেতে পারবো?’ 

—‘না কাল অভিজিতের অফিস। আমি নিজেই এখন পর্যন্ত যাইনি। সো রাস্তা চিনে তোদের নিয়ে যেতে পারবোনা।’ এটুকু বলে বিভা একটু থেমে আবার বললো, ‘তবে আশপাশটা ঘুরে দেখতে পারিস। খুব কাছেই জলঢাকা ব্যারেজ। নদীর ওপারে ভুটান পাহাড়। খুব সুন্দর।’ 

হৃদি বললো, ‘ওখানে কি হেঁটে যেতে হবে?’ 

—‘হাঁটবি না তো কেমনে যাবি? কোলে কইরা নিয়া যাবে কে তোরে?’ বিভার প্রশ্ন। 

হৃদি ফিচেল গলায় বললো, ‘কে আবার? আমাদের দুলাভাই? তোমার হ্যান্ডসাম জামাই?’ 

বিভা খুব হাসলো, ‘হ, ভালোই বলছিস। বলিস তারে তোদের দুইজনকে কোলে কইরা নদীর পাড়ে নিয়া যাবে।’ 

অমৃতা বললো, ‘যাই বলিস, অভিজিৎ কিন্তু জোশ। আমার অনেক ভালো লাগে। তুই বল বিভা, উনার সাথে সব কেমন চলছে?’ 

বিভার আনন্দের জোয়ারে ভাসতে থাকা কন্ঠটায় এ প্রশ্নটা যেন আকস্মিক এক ভাটার সংকেত নিয়ে আসলো। নিভন্ত ভাবে বললো,’কেমন আবার চলবে। ও তো আমার জন্য টিকেট করছে দেশে যাওয়ার। এই উইকেন্ডেই চলে যাচ্ছি।’ 

কথা শুনে দুই বান্ধবী থমকে গেল। 

—‘চলে যাচ্ছিস মানে?’ হৃদি বিস্মিত। 

—‘এতো অবাক হওয়ার কী আছে? যেমনটা হবার কথা ছিল তেমনটাই হচ্ছে। দেশে চলে যাবো। তারপর ডিভোর্স দিব। দেন কিছুদিন পর আমি আর সামি, আমরা বিয়ে করবো।’ 

অমৃতা শীতল গলায় বললো, ‘তুই এসব কী বলতেছিস বিভা?’ 

বিভা অবাক হয়, ‘কী বলছি মানে? এটাই কি হবার ছিলো না?’ 

—‘তাহলে তুই অভিজিৎকে বিয়ে করলি কেন? ডিভোর্সই যদি দিবি?’ 

—‘বিয়ে করেছি কেন তুই জানিসনা? আমার বাবা মরে যাচ্ছিল।’ 

—‘এখন যদি তুই ডিভোর্স দিয়ে সামিকে বিয়ে করিস, তাহলে তোর বাবা বুঝি খুব বেঁচে থাকবেন? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? জীবনে সব সময় মন দিয়ে চিন্তা করলে হয়না, মাঝে মাঝে বিবেক বুদ্ধি দিয়েও চিন্তা করতে হয়।’ 

বিভা খুব অধৈর্য গলায় বলে উঠল, ‘আমি এতকিছু জানিনা, সামিকে আমার চাই। আমি ওকে ভালোবাসি। ভালোবাসলে অত বিবেক বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা যায়না। বুদ্ধি শুদ্ধি সব জানলা দিয়ে পালায়। তুই কখনো কাউকে ভালোবাসিস নি তো তাই বুঝতে পারছিস না।’ 

অমৃতা একটু চুপসে গেলো। ভালোবাসলে কি মানুষ হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে যায়? বাস্তব বুদ্ধি বিবর্জিত হয়ে যায়?সত্যিই সে তো কখনো কাউকে ভালোবাসেনি আজ অবধি! ভালোবাসলে কী রকম লাগে তা সে জানবে কী করে? 

হৃদি আস্তে করে বললো, ‘অভিজিৎ এতো ভালো একটা মানুষ। তার সাথে কি এমন অন্যায় কাজ করাটা ঠিক হচ্ছে?’ 

বিভা ক্যাটক্যাট করে বলল, ‘ভালো মানুষ বলেই তো হয়েছে আমার জ্বালা। একটু খারাপ হলেই তো বেঁচে যেতাম! খারাপ হলে আমার একে ছেড়ে যেতে এতো কষ্ট হতনা।’ 

অমৃতা চমকে উঠল, ‘কষ্ট হচ্ছে নাকি?’ 

—‘হচ্ছে তো দোস্ত, একটা কেমন গিলটি ফিলিংস হচ্ছে ভেতরে ভেতরে।’ বলতে গিয়ে একদম কাঁচুমাচু হয়ে গেল বিভা। 

কেউ একজন দরজার কড়া নাড়ছে খুটখুট করে। নিশ্চুপ শব্দহীন রাতে ওই খুটখুট শব্দটা বিস্ফোরণের মতো বুকে এসে লাগল। বিভা বিছানা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজার ওপাশের করিডোরে একটা হালকা নীল আলোর ডিম লাইট জ্বলছে। সেই নিষ্প্রভ আলোয় আকাশকে দেখা গেল। সে হুড়মুড় করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে বলল, ‘রুদ্রর বাচ্চা ঘড়ঘড় কইরা নাক ডাকতেছে। শালার নাক ডাকার জ্বালায় না পারতেছি ঘুমাইতে, না পারতেছি জাইগা থাকতে। আর সামির তো ভাব হইছে। ভাবের ঠ্যালায় ব্যাটা বারান্দায় গিয়া একটার পর একটা সিগারেট টানতাছে। কিছু জিগাইলেও উত্তর দেয়না। কাহিনী কী বুঝলাম না মামা।‘ 

শুনে বিভা বললো, ‘আমি ওর কাছে একটু যাই। মনে হয় আমার উপর রাগ করে আছে।’ 

সন্ধ্যে নামার পর সামির সাথে তার উঠোনে দেখা করার কথা ছিল। ভেবেছিল দুর্গাকে দ্রুত পেঁয়াজগুলো কেটে দিয়েই বের হয়ে আসবে। কিন্তু রান্নাঘর ছেড়ে বেরোবার মুখেই রুদ্র আর অভিজিতের প্রবেশ ঘটলো। এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে সময় কোনদিক দিয়ে কেটে গেল টেরই পেলোনা। অভিজিতের সামনে ফোন হাতে নিয়ে যে সামিকে একটা টেক্সট করবে সে উপায়ও রইলোনা আর। এরপর থেকেই সামি খুব রেগে আছে। খাবার টেবিলে একটা কথাও বলেনি। এমনকি ঠিক মতো খেতেও পারেনি বেচারা। বিভা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসল ঘর থেকে। 

আকাশ বিছানার ওপর উঠে বিভার জায়গাটা দখল করে বসল। অন্ধকারে মূর্তির ন্যায় বসে থাকা দুই বান্ধবীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী কথা হচ্ছিলো?’ 

—‘আরে বিভা একটা পাগল। কী বলে নিজেও জানেনা।’ অমৃতা বললো। 

—‘এটা তো নতুন কথা না। সবাই জানে।’ 

বিছানার মাথার কাছে রাখা শিমূল তুলোর একটা নরম বালিশ হাত দিয়ে খামচে ধরে নিজের কোলের ওপর তুলে নিল অমৃতা। বলল, –’শোন আমার কী মনে হয় জানিস?এ মুহূর্তে বিভার দেশে যাওয়াটা একেবারেই ঠিক হবেনা। অন্তত আরো দু এক মাস অপেক্ষা করা উচিৎ। এখন দেশে গেলে আমাদের প্রত্যেকের বাবা মা বলবে যে আমরা এখানে এসে বিভাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর সামির আব্বার কথা তো বাদই দিলাম। সে আমাকে জ্যান্ত গিলে খাবে।’

আকাশ একটু অবাক হয়ে বললো, ‘কিন্তু দেশে যাওয়ার কথা আসছে কেন? বিভাকে দেখে তো বেশ হ্যাপিই মনে হচ্ছে। আমার তো ধারণা অভিজিতের সাথে ওর ভালোই চলছে সব।’ 

হৃদি এতক্ষণে মুখ খুললো, ‘তুই তো জানিস না অভিজিৎ বিভার জন্য দেশে ফেরার টিকেট করে দিয়েছে। ওরা দুজনেই সেপারেশন চায়।’

—‘তাই নাকি? কী কাণ্ড!’ বলে আকাশ একটু সময় চুপ করে থাকলো। তারপর আবার বললো, ‘শোন আমার বাপের বৌ একটু আগে ফোন দিছিলো।’ 

—‘তাই? কী বললেন আন্টি?’ 

আকাশ চিন্তাযুক্ত গলায় বললো, ‘আমি বুঝিনা এই মহিলা এত অত্যাচারের পরেও কেন এই বাসায় পইড়া আছে। সমস্যা কী?’ 

অমৃতা সতর্ক ভাবে প্রশ্ন করল, ‘আবার কি কিছু হয়েছে?’ 

—‘কী আবার হবে? যা প্রতিদিন হয় তাই হইছে। আমার বাপ মাইরা তার কপাল ফাটায় দিছে। পরে কান্নার আওয়াজ শুইনা পাশের বাসা থেকে লোক ছুইটা আসছে। শাসায় গেছে নাকি এরপর এরকম কিছু হইলে নারী নির্যাতন আইনের আওতায় মামলা দিবে। 

—‘ঠিকই আছে, তোর বাপের একটা শিক্ষা হওয়া উচিত। শোন আন্টির সাথে আমার ঐদিন এ ব্যাপারে কথা হয়েছিল। আমি ঠিক করেছি তোর বাবা মা’ কে একদিন আমাদের এন জি ও’ র অফিসে ডাকবো।’ 

আকাশ অমৃতাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘বাবা মা বলছিস কেন? ওই মহিলা আমার মা না। আমার মা মরে গেছে!’ 

—‘আচ্ছা বুঝছি,তোর বাপ আর বাপের বৌ রে আমাদের অফিসে ডাকবো। জানি তোর বাপ আসতে চাইবোনা। সো আমি সামন পাঠাবো তোর বাসার ঠিকানায়।’

—‘কিছুই বুঝলাম না, অফিসে গিয়া কী করবে? আর কিসের সামন টামন? কী কইতেছিস এসব? তোদের ওখানে এসব হয় নাকি? তোরা না হিজড়া নিয়া কাজ করস?’ 

—‘ফ্যামিলি ল নিয়েও কাজ করা হয়। শোন কোর্টের বাইরে ফ্যামিলি প্রব্লেম সল্ভ করার একটা প্রসেস আছে। এটাকে বলে অল্টারনেটিভ ডিস্পিউট রিজলিউশন। এ ডি আর। সো নিয়ম মোতাবেক যে কোন এক পক্ষকে কমপ্লেইন করতে হবে। আমি আন্টির হয়ে কমপ্লেইন টা করে দেব ভাবছি। তোর আব্বার নামে নোটিশ যাবে।’ 

—‘এতে লাভটা কী হবে?’ আকাশ থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো। 

—‘কাউন্সেলিং হবে। তোর আব্বা আর তার ওয়াইফের মধ্যের প্রব্লেম ফিগার আউট করার চেষ্টা করবে কাউন্সেলর বা মেডিয়েশন অফিসার।’ 

—‘বালটা করবে। শোন এইসব হাবিজাবিতে কোন লাভ হবেনা। আমি ঠিক করছি এবার দেশে ফিরে গিয়ে ওই মহিলারে বলবো যে জানে বাঁচতে চাইলে তুমি তোমার বাপের বাড়ি ফিরা যাও। সিরিয়াসলি দোস্ত আমি এই টেনশন মাথায় নিয়া থাকতে পারবোনা। ওই লোকটা পুরাই পাগল, নেশাখোর, যে কোন সময় মহিলাকে খুন করে রেখে দেবে জানতেও পারবিনা।’ 

জলঢাকা নদী ঝিরঝির শব্দ তুলে বয়ে চলেছে অবিরাম। দূর অন্ধকার পাহাড়ের মাথায় সাদা মেঘের টোপর। কুয়াশাও হতে পারে। কোনটা কুয়াশা আর কোনটা মেঘ তা ঠিকমতো ঠাওর করে ওঠা যায়না। ঝিঁঝি পোকার নিরবিচ্ছিন্ন শব্দ, আর হঠাৎ হঠাৎ রাত পাখিদের বুক চমকানো ডাকে ভারী হয়ে আছে এলোমেলো বনজ বাতাস। প্রকৃতির এই অলৌকিক গা ছমছমে সৌন্দর্য গায়ে জড়িয়ে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সামি। বারান্দার রেলিঙের ধার ঘেঁষে। তার এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট,অপর হাতে সেলফোন। এই মাত্র মায়ের সাথে কথা বলে ফোন কাটলো সে। 

মা খুব কাঁদছিল। অকারণ এই কান্নার কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। মাত্র কদিনের জন্যই তো বেড়াতে এসেছে। আসার আগে সঙ্গত কারণেই মা’কে জানিয়ে আসা হয়নি। এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সের জোয়ান ছেলের পক্ষে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ বাবা মায়ের অবগতি এবং সম্মতি সাপেক্ষে নেয়া সম্ভব নয়। মায়ের মন অবশ্য আজ অন্য কারণেও খারাপ। গ্রামের বাড়ি থেকে চাচা এসেছেন দাদীজানকে নিয়ে। দাদীজানের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চিকিৎসা দরকার। ঢাকা শহরে চিকিৎসা করতে হলে চাচারা চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে তাদের বাড়িতে অবস্থান করবেন এটাই স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রম কিছু ভাবাই যায়না। কিন্তু সামির মায়ের গ্রামের লোকদের নিয়ে আছে ভয়ঙ্কর এলার্জি। বাড়ির মধ্যে টানা দুই তিন মাস গ্রামের লোক থাকবে এটা ভাবতেই তার গায়ে জ্বর চলে আসার উপক্রম হয়েছে। অথচ কাজ কিছুই তার নিজের হাতে করতে হয়না। ঝি চাকরে বাড়ি ভর্তি। সামি জানে বাবা সারাজীবন তার মা’কে রাণীর মতো মাথায় তুলে রেখেছেন। যে কোন ইচ্ছে প্রকাশ করা মাত্র আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের জ্বীন হয়ে স্ত্রীর ইচ্ছে পূরণ করেছেন তিনি। সারা দুনিয়ার সুখ তার মায়ের পায়ের তলায় এনে হাজির করার চেষ্টা করেছেন। বাবার এই চেষ্টায় কখনও কোন ত্রুটি দেখেনি সে। আজকে যদি বাবার আত্মীয় স্বজনদের বিপদের দিনে তাদেরকে অল্পবিস্তর আদর যত্ন করে বাবাকে একটু খুশি করা যায়, তবে এতটুকু করতে মায়ের বাঁধছে কোথায়? মাকে মাঝে মাঝে বড্ড ছেলেমানুষ বলে মনে হয় তার। একটু বোকাও। হ্যাঁ বোকা না হলে কি আর এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কেউ এতটা আপসেট হয়ে পড়ে? বলতে কী, সামি এখনও বাবা লোকটাকে খুব বেশি ঘেন্না করতে পারেনা। বরং এত কিছুর পরেও বাবার জন্য এক বুক ভালোবাসা তার ভেতরে টলমল করে সর্বদা। কিন্তু সেই ভালোবাসা দেখতে পাবার মতন মন বা চোখ কোনো টাই লোকটার নেই। আশপাশের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়কে নিজের আয়ত্তে রাখতে চাইবার বাজে অভ্যাস হয়ে গেছে তার। নিজের সন্তানকেও তাই আজ্ঞাধীন অধস্তন হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন তিনি সারাজীবন। সামির বুক পিছলে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস গড়িয়ে পড়লো আচম্বিতে। বাবার জন্য মন কেমন করছে। শেষবার দেখা হয়েছে নয় মাস দশদিন আগে। নয় মাস দশদিন! মা একটু আগেও বলছিল, তোমার বাবা খুব রেগে আছেন। বাবা কেন সবসময় রেগে থাকেন? রাগ নামক অনুভূতিটিতে কি বাবারই কেবল একচ্ছত্র অধিকার? সামিরও যে রাগ দুঃখ, ক্ষোভ,অভিমান এই সমস্ত অনুভূতির সমন্বয়ে সত্যিকারের একটা মানবিক মন আছে এই তথ্যটা কি বাবার এখনও অজানা? 

হঠাৎ নরম দুটি তুলতুলে হাত চুপিসারে সামিকে পেছন থেকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো। আকস্মিক এই স্পর্শ পেয়ে সামির নিশ্বাস গেলো থমকে, ক্ষণিকের জন্য। ভুটান পাহাড়ের মেঘ ছোঁয়া হু হু বুনো এক ঝলক বাতাস ওদের দুজনকে নিঃশব্দে আলিঙ্গন করে গেলো। উপত্যকার ওই ডাকবাংলোর এক চিলতে বারান্দাটায় ছড়িয়ে দিয়ে গেল মহুয়ার খুশবু। কী এক আশ্চর্য অলৌকিক আবেশে যে ভরে গেলো চারপাশটা মুহূর্তের মাঝে! সামি অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা নিশ্বাস টা ধীরে ধীরে ছাড়লো। ঘুরে দাঁড়িয়ে বিভার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিলো। অন্ধকারেও বিভার ডাগর দুটি চোখ পরিপূর্ণ বাঙ্ময়। এতো সুন্দর চোখ পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষের নেই! বিভা একটু অপরাধীর গলায় বললো, ‘সরিরে, তখন আসব বলে আসতে পারিনি। রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাও কাজ শেষ করে যেই না বেরোবো। দেখি অভিজিৎ হাজির।’ 

সামি বিভার দিকে একদৃষ্টি তে চেয়ে ছিল বাক্যহারা হয়ে। কয়েকটা সেকেন্ড ওই রকম মূর্তির মতই কাটিয়ে দিল সে। একটা সময় খুব দুর্বল গলায় বললো, ‘তুই কেন কখনোই কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিস না, বিভা? সব সময় কেন আসব বলেও আসিস না? কেন এভাবে কষ্ট দিস আমাকে?’ 

বিভা ভারী করুণ গলায় বলে, ‘সরি বললাম তো!’ 

সামি মোহাবিষ্টের মতো একটা হাত বিভার গালের ওপর আলতো করে ছোঁয়ালো। সেই ছোঁয়াটুকু বিভার শিরদাঁড়ায় একটি অনির্বচনীয় শিহরণ তুললো। হৃদপিন্ডে রক্তচ্ছাস টের পেলো সে। খুব করে চাইছিল সামি যেন তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এই মুহূর্তে। এতো জোরে যেন তার দম আটকে আসে। কিন্তু সামি এসবের কিছুই করলোনা। হতভম্ব বিহ্বল চোখে শুধু চেয়েই রইল। বিভা আরো একটু কাছে এগিয়ে আসলো তার। ঠিক সেই সময় চলচ্চিত্রের মতো সামির চোখের সামনে ভেসে উঠলো সন্ধ্যেবেলার ঘটনাটা। মনে পড়ল সেই আশ্চর্য নারীর কথা। কী এক তীব্র বাধঁছেড়া আকর্ষণে ভেতরটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল তার! পুরো দৃশ্যপট টা যেন সমস্ত সত্তার ভেতর গেঁথে গেছে। তার ঠোঁটে এখনো লেগে আছে সেই রহস্যময়ী নারীর ঠোঁটের স্বাদ, কানের কাছে তার নিশ্বাসের শব্দ। চতুর্দিক মাতোয়ারা এখনও ওই জাদুকরীর বশীকরণ মায়ায়! 

সামির ভেতরটা অজান্তেই কেমন কেঁপে ওঠে। সেই মেয়ে বিভা নয়, ঠিক হৃদিতাও নয়… কে জানে হয়তো হৃদিতাই… না না, হৃদিতা নয়। অন্য কেউ! 

কে ছিল?? 

জানেনা সামি, কিন্তু মনে হয়েছিল এর চেয়ে ভালো কিছু তার জীবনে এর আগে কোনো দিন ঘটেনি। এরকম কেন মনে হয়েছিল তার? বিভা ওর গালে একটা চুমু খেল হালকা ভাবে। চমকে উঠে বিভার কাছ থেকে একটু পিছিয়ে আসল সে। স্তিমিত গলায় বলল, ‘এখন থাক।’ 

বিভা আকুল হয়ে বলল, ‘সামি রাগ করিস না লক্ষীটি, আমি তোকে ভালোবাসি!’ 

—‘আমিও তোকে ভালোবাসি। এখন… এখন শুতে যা। কাল সকালে কথা হবে।’ 

১৭

এক জোড়া পাহাড়ি তিতিরের ডাকে ঘুম ভেঙেছিল আকাশের। চোখ মেলে দেখল পূবের বন্ধ জানালার পাল্লার ফাঁক ফোকর গেলে স্বচ্ছ একফালি কাচরঙা রোদ্দুর এসে পড়েছে অমৃতার ডান গালে। তার ঘুমন্ত মুখখানায় এখন শিশুসুলভ নির্মলতা। বুজে থাকা চোখের কোলে কোন ক্লান্তি নেই। ছোট টিকলো নাক, লালচে গাল আর পাতলা দুখানা ঠোঁট সদ্য ফোঁটা ফুলের মতোই সতেজ। অমৃতাকে তো সে রোজ দেখে। কিন্তু আজকের এই দিন শুরুর ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন প্রথম দৃষ্টিটা যখন সকাল বেলার প্রথম রোদে ডুবে থাকা ওই সুন্দর মুখখানার ওপর গিয়ে পড়ল, তখন মনে হল রোজকার দেখা অমৃতার সাথে এই ঘুমিয়ে থাকা স্নিগ্ধ অমৃতার যেন আকাশ পাতাল তফাৎ! 

—‘কীরে তুই অমন হা করে কী দেখছিস?’ হৃদির প্রশ্নে আকাশ ধরাধামে ফিরল। রাতে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল এখানেই। মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে। শেষ রাতের দিকে অবশ্য খুব শীত করছিল। শীতের ঠ্যালায় বার কয়েক ঘুমও ভেঙে গিয়েছিল। ঘুম খুব একটা জমেনি রাতে। সে নিজের গায়ের ওপরের ছাই রঙের কম্বলটা হাত দিয়ে সরিয়ে নিল। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সহজ ভাবে বলল, ‘অমৃতাকে দেখতেছিলাম।’ 

বীমের খাঁজে খাঁজে দুরন্ত পায়ে বাকবাকুম করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ধবল তিন চারটে পায়রা।ওদের বাকবাকুম আর তিতিরের হাঁকডাকে ঘুমিয়ে থাকা রীতিমত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। হৃদি শোয়া থেকে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙল। হাই তুলতে তুলতে বললো, ‘অমৃতাকে অত কী দেখতেছিস?’ 

—‘ওকে সুন্দর লাগতেছে!’ 

হৃদি তাকালো গুটিশুটি হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে আদুরে বেড়ালের মতো শুয়ে থাকা অমৃতার দিকে। অতর্কিতে তার মুখে ফুটে উঠল একটি প্রশ্রয়ের হাসি। হাসি ঠোঁটে নিয়েই সে বললো, ‘হুম… অমৃতাটা না, অনেক কিউট কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই তো তার দাদাগিরি শুরু হয়ে যাবে। দাদাগিরির ভয়ে কিউটনেস জানালা দিয়ে বাপের নাম তুলে পালাবে।’  

আকাশ কম্বল খানা দু হাত দিয়ে ভাঁজ করতে করতে বললো, ‘তাতো বটেই। বলেই দ্যাখ না একবার তাকে কিউট, জুতা খুইলা মারতে আসবে।’ 

হৃদি শাড়ি পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল রাতে। সুতির শাড়ির আঁচল কুঁচকে গিয়ে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। সে শাড়ির আঁচলটা ঠিক ঠাক করে নিল ভালোভাবে। এলোমেলো খোলা চুলগুলোতে নিজের হাতের আঙুল চালালো খানিকক্ষণ। বিষণ্ণ ভাবে কী যেন একটা গভীর ভাবনা ভাবল। তারপর ঘুমে ফোলা টসটসে চোখ দুটো নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ভারী করুণ গলায় বললো, ‘হ্যাঁরে আকাশ, তোর কখনো আমাকে দেখতে সুন্দর লাগেনা?’ 

আকাশ তখন ঘরের দেয়াল সংলগ্ন ক্লজেটের দরজা খুলে ভাঁজ করা দুটি কম্বল গুছিয়ে রাখছিল ভেতরে। হৃদির প্রশ্ন শুনে সে ভারী অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘লাগবেনা কেন? আজিব! তোর ঘুম মনে হয় এখনো ভাংগেনাই। ঘুমের ঘোরে আবোল তাবোল বকতেছিস। ঘুমা, ঘুমা! শুয়ে পড়।’ 

হৃদি আগের চাইতেও বেশি মন খারাপ করা গলায় বলল, ‘নারে সত্যি বলতেছি। কারো কারো কাছে আমাকে সুন্দর লাগেনা বুঝছিস?’ 

আকাশ বিরক্ত হতে গিয়েও হেসে ফেলল। তার বন্ধু গুলা একেকটা ফার্স্ট ক্লাস চিড়িয়া। চিড়িয়া গিরি করার বাই উঠলে কেউ মাথা বরাবর বন্দুক উঁচিয়ে ধরলেও এদের চিড়িয়া গিরি থামাতে পারবেনা। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘তুই তো সবসময় সুন্দর। বোকার মতো কথা বলতেছিস কেন?’ 

হৃদি বিছানা ছেড়ে নেমে জানালার পাল্লা দুটি খুলে দিল। খুলতেই হলুদাভ পেলব সূর্যের আলো ঝপ করে লাফিয়ে পড়ল ঘরের মধ্যিখানে। সেই সাথে মিহি হাওয়া। হৃদি জানালার বাইরে ঘোর লাগা এক দৃষ্টি রেখে বললো, 

—‘কেউ কেউ কী বলে জানিস? বলে আমি নাকি প্রেমে পড়ার মতো মেয়ে না।’ 

আকাশ হো হো করে ডাকাতের মতো হেসে উঠলো এবার, ‘তাই নাকি? কে বললো শুনি? আমার ফ্রেন্ডের প্রেমে পড়বেনা? হুম? কার এতো সাহস? নাম ধাম বল এমন কথা যে বলেছে শুধু সে না তার চোদ্দ গুষ্ঠি তোর প্রেমে পড়বে।’ 

হৃদি ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, ‘সিরিয়াসলি দোস্ত, আমি কি দেখতে খুবই বাজে?’ 

—‘তুই একটা পাগলী!’ 

—‘বিভা কি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর?’ 

আকাশ একটু থমকে গেল এবার। তার ঠোঁটে লেপটে থাকা হাসির রেখাটা মুহূর্তের মাঝে ফিকে হয়ে আসল। বিভ্রম নিয়ে প্রশ্ন করল, 

—‘তোর হয়েছে কী আজকে?’ 

হৃদি ঘুরে তাকাল আকাশের দিকে। নিস্তেজ ভাবে বললো, ‘কিছু না। ‘বিভার কথা কেন বললি?’ 

—’এমনি।’

আকাশ তীক্ষ্ণ চোখে দেখল হৃদিকে, বলল, ‘কে কার থেকে বেশি সুন্দর, এইসব লেইম জিনিস নিয়ে ভাবা শুরু করছিস নাকি আজকাল?’ 

হৃদি একটু লাজুক গলায় বললো, ‘এমনি বললাম দোস্ত, তুই আবার বিভাকে কিছু বলিস না।’ 

—‘তোর কি কিছু নিয়ে মন খারাপ? 

—‘না’ 

—‘হ্যাঁ তোর মন খারাপ।’ 

—‘একেবারেই না’ 

অমৃতার ঘুম ভেঙে গেছে। সে মুখ দিয়ে খানিক বাদে বাদে বিরক্তি সূচক চ’কারান্ত শব্দ করছে এবং এপাশ ওপাশ করছে। এবার সে ধমক দিয়ে বলে উঠলো, ‘ওই চখা চখির বাচ্চা,এই ঘর থেকে যা!ঘুমাইতে দে!’ 

আকাশ অমৃতার কথায় ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে কয়েক পা এগিয়ে আসল হৃদির দিকে। হৃদি মাথা হেঁট করে অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। নিজের মুখ নিঃসৃত বক্তব্যের কারণে যেন সে প্রকৃত অর্থেই ভারী লজ্জিত এখন। আকাশ ওর চিবুকে হাত রেখে মুখটা উপরে তুলে ধরে বললো, ‘আর কখনো এরকম মন ছোট করবিনা। বিভা বিভার জায়গায়, তুই তোর জায়গায়। এসব আজেবাজে চিন্তা করবি না, কেমন?’ 

হৃদির চোখ দুটো আচমকা একটু কেমন ছলছল করে উঠলো। ভারী গলায় বললো, ‘কী যে হচ্ছে আমার সাথে, বুঝতে পারছিনা।’ 

—‘কী হয়েছে হৃদি? বল আমাকে!’ 

হৃদি ঠোঁট টিপে কান্না চাপার চেষ্টা করল। আকাশ বিরক্তির সাথে বললো,’তোর এই ফিচ ফিচ কান্নার স্বভাবটা আমার অসহ্য লাগে।’ 

হঠাৎ আকাশের চোখ পড়ল হৃদির হাতের আঙুলে পরা হোয়াইট গোল্ডের আংটিটার দিকে। 

—‘এই আংটি তুই কোথায় পাইলি?’ 

হৃদি একটু অপ্রস্তুত ভাবে বললো, ‘ইয়ে… কই পাবো আবার, কিনছি!’ আকাশের চোখে সন্দেহ খেলা করে, ‘কিনছস?’ 

—‘হুম।’ অন্য দিকে তাকিয়ে দায়সারা ভাবে উত্তর দেয় হৃদি। তারপর একটু চুপ থেকে আবার বলে, 

—‘দোস্ত, তুই এসব নিয়ে এখন কারো সাথে কথা বলিস না কেমন? প্লিজ!’ 

অমৃতা উঠে বসেছে। ওদের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী কাহিনী?’ 

আকাশের মুখে বিরক্তির একটা ভাব তখন সদর্পে বিরাজমান। সে মুখ ঝামড়ে উঠে বললো, ‘তোর মাথা কাহিনী।’

—‘মাথা কাহিনীটা আবার কী?’ 

—‘মাথা কাহিনীটা হচ্ছে তোর মাথা আর আমার মুন্ডু।’ 

—‘সকাল সকাল এতো মাথা মুণ্ডুর পিছনে পড়লি কেন? আর কোনো কাজ নাই? 

—‘না নাই।’ 

.

আকাশ হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখলো সামি বসে আছে সোফায় হাত পা ছড়িয়ে। রান্নাঘর থেকে বিভার গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। রুদ্র আশেপাশে নেই। 

—‘রুদ্র কই রে?’ আকাশ জানতে চাইল, সামির কাছে। 

সামি একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনে আলগা ভাবে চোখ বুলাচ্ছিলো। আকাশের প্রশ্নটা শুনে সে চোখ তুলে তাকাল, ‘ও, উঠেছিস? মর্নিং!’ 

—‘মর্নিং, রুদ্র কই?’ 

—‘ঘুমায়।’ 

—‘ওই শালা আসার পর থেকে ঘুমাইতেছে কেন? হইছে কী ওর?’

সামি ঠোঁট উল্টে বললো, ‘আল্লাহ জানে!’ 

আকাশ শার্টের হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে খুব উদ্যমী গলায় বললো, ‘চল তো, গিয়ে দেখি ব্যাটার হইছে কী? মইরা টইরা গেছে নাকি?’ 

বিভা রান্নাঘর ছেড়ে ডাইনিং এ পা রেখেছিল সবে মাত্র, হাতে পরোটার প্লেট নিয়ে। আকাশের বলা মাত্র কথাটা তার কানে যেতেই সে আঁতকে উঠে উচ্চস্বরে বললো, ‘ছি ছি এসব কী কথা আকাশ? মরবে কেন? এসব অশুভ কথা বলার সময় বুক কাঁপেনা? কোথায় রুদ্র?’ 

—‘সেটা তো আমারও প্রশ্ন, চল গিয়ে দেখি।’ 

তিনজন মিলে ছেলেদের জন্য বরাদ্দ শোবার ঘরটায় আসল। দরজা খোলাই ছিল। দেখা গেলো রুদ্র বিছানায় বাঁকা চ্যাকা হয়ে শুয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তার গায়ের কম্বল সরে গেছে। মাথার বাবড়ি চুল এলোমেলো হয়ে কপালে এসে পড়েছে। দাড়ি গোঁফ ভর্তি ঘুমন্ত মুখটায় লেগে আছে এক টুকরো প্রাঞ্জল হাসি। 

আকাশ খুব চিন্তিত গলায় বলল, ‘ঘুমায় ঘুমায় হাসতেছে। নিশ্চয়ই কোনো মেজর প্রব্লেম হইছে শালার মাথায়।’ 

বিভা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘প্রব্লেমের কী আছে? বেচারা হয়তো ভালোমন্দ কোন স্বপ্ন দেখতেছে ঘুমের মধ্যে। তোদের ওর সুখ সহ্য হচ্ছেনা কেন?’ 

সামি বললো, ‘এতো সুখ কই পাইতেছে সে? ট্রেনেও খালি ঘুমাইছে পইড়া পইড়া। আবার বলতেছিল, ট্রেনে ঘুমানোর মজাই আলাদা। মনে হয় ছোট বেলার মতো দোল দোল দোলনি দিয়ে কেউ ঘুম পাড়াচ্ছে।’ 

—‘আহারে, বেচারা। ঘুমাচ্ছে একটু ঘুমাতে দে তোরা। হিংসা করিস না।’ বিভার কণ্ঠ দিয়ে মায়া ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। 

সামি বলল, ‘ওর ঘুমের চোটে তো আমরা কেউ ঘুমাইতে পারলাম না। রাত্রে বাঁশির মতো নাক ডাকতেছিল শালা। নাক ডাকার চোটে আমি ঘুমাইতেই পারিনাই।’ 

আকাশ তালে তাল মিলিয়ে বলল, ‘হুম রাইট, আমি তো ঘর ছেড়েই পালায় গেলাম ওর অত্যাচারে।’ 

সামি রুদ্রর হাস্যোজ্বল তৃপ্তি মাখা ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে চাটুকারিতার গলায় বলে উঠল, ‘শালারে একটা শিক্ষা দেয়া উচিৎ। কী করা যায় বল তো?’ 

রুদ্র তখনো হেসে হেসে নাক ডেকে ডেকে ঘুমাচ্ছে তো ঘুমাচ্ছেই। আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চল ধাক্কা মাইরা ফ্যালায় দেই বিছানা থিকা।’ 

—‘কানের ভিতর পোকা ঢুকায় দেই।’ সামি মতামত দিলো। 

—‘সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুম ভাঙায় দেই!’ আকাশের সাজেশন। 

বিভা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ইশ! তোরা এতো খাররাফ!’

—‘খাররাফ জিনিসটা আবার কী?’ আকাশের প্রশ্ন। 

বিভা জ্ঞানী লোকের মতো গম্ভীর মুখে বললো,-’মানুষ যখন ভয়াবহ রকমের খারাপ হয়ে যায় তখন তাকে খাররাফ বলে।’ 

ঠিক সেই সময় অমৃতা আর হৃদির আগমন ঘটল। 

—‘হচ্ছে কী এখানে? 

আকাশ বললো, ‘রুদ্র কুম্ভকর্ণের ঘুম ঘুমাইতেছে। একটা শিক্ষা দিতে হবে ওরে।’ 

শুনে অমৃতা হৈ হৈ করে বলে উঠলো, ‘এতো ঘুমাইতেছে ক্যান? এখুনি ব্যাটার মাথায় পানি ঢাল!’ 

এই আইডিয়া বিভা বাদে অন্য সবার পছন্দ হল। আকাশ আর সামি মহা আনন্দে নাচতে নাচতে বাথরুমে দৌড়ে গেলো বালতি ভর্তি পানি আনতে। বিভা রাগে গজগজ করতে করতে হৃদি আর অমৃতাকে বললো,’তোদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ 

হৃদি দাঁত বের করা হাসি হাসল, ‘আমার তো ভালোই লাগতেছে ব্যাপারটা। মজাই মজা!’ 

—‘এখন পানি ঢাইলা আমার ঘর নষ্ট করবা তোমরা। বিছানার চাদর ভিজাবা। কাজ বাড়াইতেছ কেন? এমনিতে আমি সংসার সামলাইতে সামলাইতে হিমশিম খাচ্ছি।’ 

অমৃতা বিভার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনার গলায় বলল, ‘আরে চিল দোস্ত। জাস্ট চিল। বিছানার চাদর বাইরে মেইলা দিলেই খটখটে শুকনা হয়ে যাবে। ভালো রোদ আছে আজকে।’ 

আকাশ আর সামি দুজনে মিলেমিশে এক বালতি পানি ঘুমন্ত রুদ্রর গায়ে ঝপাং করে দিল ঢেলে। ঠান্ডা জলের স্পর্শ পেয়েই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল রুদ্র। তার চক্ষু দুটো চড়কগাছ। চুল, দাড়ি, গায়ের টি শার্ট,প্যান্ট সব ভিজে একাকার। সে মুখ হা করে থ বনে গিয়ে চারপাশটা দেখছে। বড় বড় নিশ্বাস পড়ছে তার। চোখের সামনে সব ঝাপসা। মাথা ফাঁকা। গোটা একটা মিনিট পার হবার পর সে ঘোলা চোখে আবিষ্কার করল যে চার ডাকাত হো হো শব্দ করে হেসে যাচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে। এক ডাকাতের হাতে খালি বালতি ধরা। পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে আর সময় লাগলোনা। 

তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে ‘বান্দরের বাচ্চা!’ বলে এক বিকট চিৎকারে ফেটে পড়ল রুদ্র। এরপর তেড়ে উঠে মারতে আসল হাতে বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সামিকে। সামি তড়িঘড়ি করে বালতিটা ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। চকিতে লম্বা লম্বা পা ফেলে দিল ছুট। ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোর পেরোতেই দুম করে ধাক্কা খেল এক ছিপছিপে দেহের পুরুষের সাথে। ধাক্কাটা লাগা মাত্রই একটা আর্তচিৎকার ছিটকে বেরিয়ে আসল তার মুখ থেকে। চোখ তুলে দেখলো অভিজিৎ দাঁড়িয়ে আছে! দুজনেরই কপালে লেগে গেছে বেশ জোরেসোরে। অভিজিতের চোখের চশমা প্রায় খুলে পড়ে যাচ্ছিল মাটিতে। হাত দিয়ে ধরে ফেলে কোন রকমে বাঁচানো গেল চশমাটা। এই আকস্মিক তান্ডবের মুখে পড়ে সে রীতিমত ভীত, আতঙ্কিত এবং বিমূঢ় হয়ে গেল। চশমাহীন ফোলা চোখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাল সামির দিকে। সামি হাত দিয়ে নিজের কপাল ডলতে ডলতে ভারী আফসোসের গলায় বলল, ‘সরি ম্যান!’ 

পেছন থেকে তখন রুদ্র তেড়ে আসছে। সামি আর সময় নষ্ট না করে তার সম্মুখে দাঁড়ানো অভিজিৎকে ঠেলে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় দিল ভোঁ দৌড়। অভিজিৎ বিস্ফোরিত চোখে মুখ হা করে তাকিয়ে দেখল লম্বা চুল ওয়ালা ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটা ভিজে চুবুচুবু হয়ে তার স্ত্রীর হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ডকে বুনো মোষের মতো তাড়া করছে। 

বিভা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসল। অভিজিতের কপালে একটা হাত ছুঁইয়ে ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল, ‘আপনার লাগেনি তো?’ 

অভিজিৎ একটা ঢোঁক গিলল, ‘উনাদের… ক… কী হয়েছে?’ 

—‘আর বলবেন না। পাগলদের কিছু হওয়া লাগেনা। এমনিই পাগলামি করে কারণে অকারণে।’ 

এটুকু বলে একটু থেমে বিভা আবার বললো, ‘আসুন, আপনি নাশতা করে নিন। অফিসের দেরি হয়ে যাবে। 

ডাইনিং এ নাশতার টেবিলে অভিজিৎ বলল, ‘আজকে আমাদের অফিসে ক্রিকেট ম্যাচ আছে। আপনাদের মধ্যে কারো ক্রিকেটে ইন্টারেস্ট আছে কি?’ 

বিভা বলল, ‘আমাদের আকাশ কিন্তু খুব ভালো খেলত এক সময়।

—‘তাই নাকি? আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন। জায়গাটা ঘুরে দেখলেন। ম্যাচটাও এনজয় করলেন।’ 

আকাশ খুশি হয়ে বললো, ‘নিশ্চয়ই। আমার অন্য দুই বন্ধুও মনে হয় যেতে আগ্রহী হবে। ওদের জিজ্ঞাসা করে দেখি।’ 

অভিজিৎ গম্ভীর গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, যদি মারামারি করার পরে উনাদের গায়ে আর কোন জোর অবশিষ্ট থাকে, তবে।’ 

অভিজিতের বলার ঢঙে হেসে ফেললো সবাই। খানিক বাদে সামির কান পাকড়াও করে টেনে হিঁচড়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসল রুদ্র। তার মাথার চুল থেকে তখনও টুপটাপ ঝরে পড়ছে জল। গায়ের সাথে ভিজে লেপ্টে আছে টি শার্ট। সামি সমানে চ্যাঁচাচ্ছে গলা ফাটিয়ে, ‘আল্লাহ আমার কান ছিঁড়ে ফেলল। বাঁচাও! বাঁচাও!’ 

ওরকম লম্বা চওড়া সুঠাম দেহী এক যুবককে অমন নাস্তানাবুদ হয়ে চিৎকার করতে দেখে অভিজিৎ আর হাসি আটকে রাখতে পারলনা। রান্নাঘরের দরজার পেছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দূর্গাও খিক খিক করে হেসে উঠলো I 

রুদ্র প্রকৃত রুদ্রমূর্তি ধারণ করেই সিংহের ন্যায় গর্জে উঠে বললো, ‘এতো বড় সাহস! আমার সাধের ঘুমে পানি ঢাইলা দেয়! এর বিচার চাই আমি।’ 

হৃদি আকুলিবিকুলি হয়ে বলল, ‘আহা বেচারা ব্যথা পাচ্ছে কানে। ছেড়ে দে দোস্ত!’ 

—‘ছেড়ে দিব মানে? আমার ঘুম ভেঙে দিয়ে সে গায়ে হাওয়া লাগায় বেড়াবে? এতো সোজা?’ 

আকাশ আর অমৃতা চোরের মতো কান কাটা হয়ে পরোটা দিয়ে আলুর দম খাচ্ছিল। বিভা রহস্য ভরা কণ্ঠে বলল, ‘আসল ক্রিমিনালরা তো ধরা পড়লোনা!’ 

রুদ্র এবার সামির কান ছেড়ে দিয়ে বললো,’কে আসল ক্রিমিনাল?‘ 

ছাড়া পেয়ে সামি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কানের ডগা লাল হয়ে গেছে তার। কান ঘষতে ঘষতে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ‘শালার হাত নাকি লোহার সাঁড়াশি? আমার কান দিল শেষ করে!’ 

অভিজিৎ এতক্ষণে মুখ খুলল। রুদ্রকে বললো, ‘আসল ক্রিমিনাল আমরা ঠিক ঠিক খুঁজে বের করবো। আপনি দয়া করে মাথা টাথা মুছে আসুন। কাপড়টা পাল্টে নিন। নাশতা করুন।’ 

আকাশ খাওয়া থেকে মুখ তুলে তড়িঘড়ি করে প্রসঙ্গ পাল্টাল, ও আচ্ছা,আমরা দুলাভাইয়ের অফিসে যাচ্ছি। ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে।’ 

রুদ্র অভিজিতের কথা শুনে বাধ্য ছেলের মত ভেতরের ঘরের দিকে পা বাড়াল। যেতে যেতে আঙুল তুলে শাসিয়ে যেতে ভুলল না, ‘মূল অপরাধীর শাস্তি হবেই হবে!’ 

সামি চেয়ার টেনে বসে অবাক গলায় বললো, ‘অফিসে ক্রিকেট ম্যাচ?’ উত্তরটা অভিজিৎ দিলো, ‘হ্যাঁ প্রতিবছর এরকম একটা দুটা ম্যাচ হয়েই থাকে। কলিগরা মিলে একটা দিন ঠিক করে খেলা হয় আরকি। বিশেষ কিছু না। 

সামি চোখ তুলে তাকাল অভিজিতের দিকে। হালকা একটু হেসে বললো, ‘ও আচ্ছা বুঝেছি। বাই দ্যা ওয়ে,আই এম এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যা মেস। আপনি ব্যথা পেয়েছেন নাকি?’ 

—‘না না, ও কিছু না।’ হাসিটা ফিরিয়ে দিলো অভিজিৎ। 

তাদের কারো মুখ দেখেই এ মুহূর্তে বোঝা গেলনা যে গতরাত অবধিও দুজনের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর সম্পর্ক ছিল। কেউ কারো দিকে মুখ তুলে চাইছিল না পর্যন্ত। অথচ আজ কত সহজে সেই অস্বস্তিটা হাওয়ায় উবে গেলো। পৃথিবীতে আসলে একই সাথে সবচেয়ে সহজ এবং সবচেয়ে জটিল বিষয় হচ্ছে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক। চাইলেই একে পানির মতো তরল করা যায় আবার চাইলেই বরফের চেয়েও কঠিন। নির্ভর করে মানুষের ইচ্ছে শক্তির ওপর এবং সেই ইচ্ছে শক্তি কতটা প্রবল তার ওপর। 

অভিজিৎকে সামির এখন আর অতটা খারাপ লাগছেনা বরং চশমা চোখের ভালোমানুষী চেহারার লোকটার দিকে তাকিয়ে তার মনের মধ্যে হঠাৎ আজ এত দিন বাদে একটি অন্যরকম উপলব্ধির সৃষ্টি হল। মনে হল মানুষটাকে সে এতকাল মিছিমিছি ঘেন্না করে এসেছে। এর তো কোনো দোষ নেই! দোষ যদি কারো থেকে থাকে তা একমাত্র বিভার বাবা মায়ের। এমনকি এই অঘটনের পেছনে তার নিজের বাবার ভূমিকাও নিছক কম নয়। অভিজিৎ তো তার আর বিভার প্রেমের খবর জানতে পেরে বিয়ে নাকচ করেই দিয়েছিল। এতো কিছুর পরেও যে সে বিভার বন্ধুদের সাথে হাসিমুখে কথা বলছে এই তো বেশি। এমন উদারতা তো আজকের দুনিয়ায় বিরল। 

ছেলেরা নাশতা সেরে দ্রুত তৈরি হয়ে নিল অভিজিতের সাথে যাত্রা করার উদ্দেশ্যে। অমৃতাও খেলা দেখতে যাবে বলে মনস্থির করেছিল কিন্তু বাধ সাধল বিভা। আজকে হাটবার। একটু বাদেই সে দূর্গাকে নিয়ে বাজারে যাবে। এর আগে কোনো দিন তার এখানকার হাটে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আজকেই প্রথম। অতএব প্রথম বারের যাত্রা সঙ্গী হিসেবে সে দুই বান্ধবীকে পাশে চায়। বন্ধুদের যে চায়না তা নয়, কিন্তু বন্ধুদের যেহেতু অভিজিৎ আগে থেকেই দখল করে নিয়েছে তাই এখন আর কিছু বলা যাচ্ছে না। 

অগত্যা অমৃতাকে বাড়িতেই থেকে যেতে হল। হৃদি আর বিভা আজ অনেকদিন পর একত্রে রূপচর্চা করবে। দূর্গাকে বলা হয়েছে কাঁচা হলুদ আর মসুরের ডাল বেটে দিতে। এখন ঘড়িতে বাজে দশটা। ঠিক হল, বারোটার মধ্যে রূপচর্চা শেষ করে বাজারে যাবে ওরা। অতএব এই দুটি ঘন্টা অমৃতার কিছুই করার নেই। এ সময় বিভাদের কাছাকাছি থাকাটাও ঝুঁকি পূর্ণ। যেকেনো মুহূর্তে অমৃতার মুখে ওসব ছাই পাশ লাগিয়ে দেবে। অতএব এই বিপজ্জনক সময়টাতে দুই বান্ধবীকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সে দৌড়োনোর পোশাক পরে তৈরী হয়ে নিলো। 

বিভা রোজ দিনের এ সময়টায় মায়ের সাথে ফোনে একবার কথা বলে। তার বন্ধুরা এসেছে এ খবরটা মায়ের অজানা নেই। বাবা অবশ্য কিছুই জানেন না এ ব্যাপারে। মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে সামির উপস্থিতি তাদের জামাইবাবু কোন ভাবেই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেবেনা। মেয়ের সংসারে একটা অঘটন ঘটতে যাচ্ছে এই আশংকা তার রাতের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছে। বিভা তার মা’কে বোঝানোর দায়িত্বটা তাই হৃদির ওপর ছেড়ে দিল। হৃদি এখন ফোন কানে নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বিভার মাকে বোঝাচ্ছে যে সামির সাথে অভিজিতের সম্পর্ক আসলে কতটা ভালো, কতটা মধুর। আর বিভা যেহেতু এখন মন দিয়ে সংসার করছে তাই কোন নেগেটিভ চিন্তা মাথায় আনাটাই নাকি বোকামি। 

অমৃতা বেরোবার মুখে বিভার মুখোমুখি পড়ে গেল। –’দোস্ত, কোথায় যাচ্ছিস?’ 

—‘একটু দৌড়ে আসি।’ 

—‘দৌড়ে আসি মানে? এই বনে বাঁদাড়ে আবার মানুষ দৌড়ায় নাকি? এখানে তো দৌড়ায় পশুপাখি, বাঁদর ছাদর।’ 

—‘ছাদর জিনিসটা কী? 

—‘বাঁদরের ভাই বোন আত্মীয় স্বজন, হনুমান টোনুমান আর কি। 

—‘সমস্যা নাই। আমি ওদের সাথেই দৌড়াতে পারবো।’ 

একটা ফোন কল সেই মুহূর্তে অমৃতাকে বাঁচিয়ে দিল। অমৃতা দ্রুত পকেট থেকে ফোনটা বের করল। নম্বর তার চেনা। সে ‘চেম্বার থেকে ফোন আসছে’ বলে দ্রুত পায়ে ছাড়লো জায়গাটা। 

বাড়ির বাইরে বেরোবার সাথে সাথে আলো ঝলমলে সকালটা দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করল তাকে। পেয়ারা গাছের পাতার ফাঁক গলে শীতের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে উঠোনে। কত পাখি যে ডাকছে গাছে গাছে! কিন্তু অমৃতা এই সুন্দর সকালটায় তার প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধুর সাথে অসাবধানতা বশত একটা মিথ্যা বলে ফেলল। ফোনটা চেম্বার থেকে আসেনি। চেম্বারের নামটা ফট করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। 

উঠোন পেরিয়ে মাটির রাস্তায় উঠে ফোন ধরল সে। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আজকে এতো সকাল সকাল?’ 

—‘হ্যাঁ সকাল সকাল।’ হক বললেন একটু ব্যস্ত গলায়। ফোনের ভেতর দিয়ে গাড়ির হর্ন থেকে শুরু করে যাবতীয় শহুরে কোলাহল ফুড়ুৎ করে অমৃতার কানে উড়ে এসে লাগল। বোঝা গেলো ওপাশের ব্যক্তিটির অবস্থান এখন রাজধানীর যে কোন এক ব্যস্ততম সড়কে। 

—‘আমি ভেবেছিলাম আপনি রাতে ফোন করবেন।’ 

হক প্রত্যুত্তরে অমৃতাকে কিছু না বলে অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তির সাথে কিছু একটা বললেন। শুনে অমৃতা মহা বিরক্ত, ‘মিস্টার হক, আপনি আমাকে কেন ফোন করেছেন? আর আমাকে ফোন দিয়ে অন্যদের সাথেই বা কেন কথা বলছেন?’ 

হক তৃতীয় ব্যক্তির সাথে কথোপকথন শেষ করে অমৃতার কাছে ফেরত আসলেন মিনিট না গড়াতেই। প্রথম যে কথাটা তিনি বললেন, তা হল, 

—‘গাধাটা কী করে?’ 

—‘জানিনা।’ 

—‘জানোনা? তোমরা কি একসাথে নেই?’ 

—‘না নেই। আপনি কি বাংলাদেশেও রোজ গুপ্তচরের মাধ্যমে সকাল বিকাল নিয়ম করে আপনার ছেলের খোঁজ নেন?’ 

—‘প্রিটি মাচ।’ 

—‘ইশ! কী বিশ্রী ব্যাপার! সামি বেচারার জন্য খারাপই লাগছে আমার। বেচারার লাইফে প্রাইভেসি বলতে কিচ্ছু নেই। 

ধুলো ধূসরিত পথটায় অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ বড়সড় এক পাথরে অমৃতার পা আটকে গেলো। আরেকটু হলে হোঁচট খেয়ে পড়েই যেত। বিদ্যুত্রে মতো চিলিক দিয়ে একটা ব্যথা ছড়িয়ে গেলো পায়ের আঙুল থেকে গোড়ালি তে। অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে, অনেকটা গোঙানির মতো। হক একটু উদ্বেগ নিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে?’ 

অমৃতা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ব্যথাটা হজম করলো। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলোনা। হক আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি ঠিক আছ?’ 

অমৃতা এবার চাপা গর্জন করে বলে উঠলো, ‘ঠিক থাকবো কিভাবে? সকাল সকাল ফোন দিয়ে বিরক্ত করা শুরু করছেন। ঠিক থাকার উপায় আছে?’ 

—‘আমি জানতে চাইলাম তুমি ঠিক আছ কিনা।’ খুব শীতল শোনাল হক সাহেবের কণ্ঠস্বর। 

অমৃতা শ্লেষ যুক্ত হাসি হাসল, -’আপনি হঠাৎ আমার কথা জানতে চাইছেন?’ 

—‘আমি অফিস চলে এসেছি। সময় নেই। তোমাকে যা বলার জন্য ফোন করেছিলাম তা বলে নেই।’ 

—‘প্লিজ বলুন। বলে আমাকে উদ্ধার করুন। 

—‘গাধাটাকে মনে করিয়ে দিও যে আজকে তার মায়ের জন্মদিন। গতকাল রাতে সে তার মায়ের সাথে কথা বলেছে ফোনে। কিন্তু বার্থডে উইশ করতে ভুলে গেছে। আজকে যেন মনে করে উইশ করে দেয়।’ 

অমৃতা হঠাৎ চপল গলায় বললো, ‘আমি যে আপনার এতসব উপকার করে দিচ্ছি, এর বদলে আপনি আমাকে কী দেবেন?’ 

হক এই আকস্মিক প্রশ্নটা শুনে একটু বুঝি থমকে গেলেন। অপ্রস্তুত ভাবে বললেন, ‘কী দেব?’ 

—‘হুম, কী দেবেন?’ 

—‘কী চাই তোমার? যা চাইবে তাই পাবে।’ 

—‘রিয়েলি? আপনার কি একটা সব পেয়েছির দেশ আছে নাকি? যেখানে যা ইচ্ছা চাওয়া যায়, আর চাইলেই তা পাওয়া যায়?’ 

হক বোধহয় কথাটা পরিষ্কার ভাবে শুনতে পেলেন না। ফোনের ওপাশে নিরবিচ্ছিন্ন কোলাহল। তিনি উঁচু গলায় বললেন, ‘শোনো অমৃতা, কিছু শুনতে পাচ্ছিনা। ছাড়ছি। রাতে কথা হবে।’ 

ফোন কেটে গেল। ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে অমৃতার হঠাৎ মনে হল, লোকটা এতো দিক সামলায় কী করে? প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় দৌড়ল সে। বিভার বাংলোর আশেপাশেই। ফিরল ঘামে ভেজা জবজবে শরীর নিয়ে। ওকে দেখামাত্র বিভা প্রশ্ন করল, 

—‘কীরে? কেমন দৌড়াইলি বনে বাঁদাড়ে?’ 

অমৃতা সোফায় বসে পায়ের জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বলল, ‘বেশ ভালোই।’ 

—‘বাঁদর ছাদর দেখলি কিছু?’ 

—‘বাঁদর দেখিনি, ছাদর দেখেছি।’ 

—‘কেমন দেখতে তারা?’ 

অমৃতা জুতো জোড়া একপাশে সরিয়ে রেখে উদাস গলায় বললো, ‘একদম তোর মত!’ 

—‘আজাইরা!’ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল বিভা। 

বিভা আর হৃদির রূপচর্চা তখন সবেমাত্র শেষ হয়েছে। দুজনে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে বসেছে। তাদের পরনে এখন শাড়ি নেই। হৃদি ব্লু জিন্স আর অফ হোয়াইট ফুল হাত টপ পরেছে। বিভার গায়ে অফ হোয়াইট টিশার্ট, সাথে কালো জিন্স। দুজনের চুল বাঁধা একই ভঙ্গিতে। মাথার ওপর চুড়ো করে। ঘোড়ার ল্যাজের মত ছড়িয়ে আছে ঢেউ খেলানো চুলগুলো পিঠের ওপর। দেখে মনে হচ্ছে ঠিক যেন যমজ দুটি বোন। বাবা মা শখ করে দুজনকে একই রকম জামা কাপড় পরিয়ে একই ভাবে সাজিয়ে দিয়েছে পুতুলের মত। অমৃতা অবশ্য আর মিনিট পাঁচেক আগে আসলেই বিপদে পড়ত। বেঁধে ছেদে তার মুখেও ওসব ছাই পাশ ফেসপ্যাক লাগিয়ে দিত বান্ধবীরা।

বিভা বলল, ‘শোন, তোদের সাথে একটু কথা ছিল।’ 

—‘বলে ফ্যাল।’ সোফায় বসে পেপার টাওয়েল দিয়ে মুখ আর ঘাড়ের ঘাম মুছে নিতে নিতে বলল অমৃতা কথাটা। 

বিভা ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা একবার দেখে নিল। দূর্গা ধারে কাছে কোথাও নেই এ বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হবার পর সে গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘কালকে একটা ঘটনা ঘটছে।’ 

হৃদি আর অমৃতা কান খাড়া করলো, ‘কী ঘটনা?’ 

—‘সন্ধ্যার পর পর মানে তোরা আসার ঘন্টা খানেক পরে সামি আমারে টেক্সট করছে যে একটু বাইরে আয়। আমি উঠানে ওয়েইট করতেছি। তো ঘটনা যেটা হইছে,ইশে আমি তো রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছি। দুর্গার বাচ্চি এতো বেয়াদব আমারে বলে কি, বৌদি আমাকে একটু সাহায্য কর। তো ওই বেটিরে সাহায্য করতে গিয়ে আমি ফাঁইসা গেছি। যখন বাইর হইতে নিব দেখি অভিজিৎ আর রুদ্র আইসা পড়ছে রান্নাঘরে। আমি আর সামিরে এটা জানাইতেও পারিনাই যে আমি আসতে পারতেছিনা।’ 

কেউ লক্ষ্য করলো না হৃদির মুখের রংটা ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছিল। বুকের মধ্যে একটা অবিদিত ভয়ের খামচাখামচি। অপরাধের পাষাণভারে নুইয়ে পড়া কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামির মতো চোরা চোখে বিভার দিকে চেয়ে থেকে কথাগুলো শুনছিল সে। 

বিভা বলে যাচ্ছিল, ‘এরপর মনে কর সামি তো সেইরকম ক্ষেপছে। রাত্রে যখন ওর সাথে দেখা করতে গেলাম বারান্দায় তখন দেখি রাগের চোটে আমার সাথে ভালো মতো কথাই বলেনা!’ 

অমৃতা বললো, ‘কথা বলেনা মানে? কিছুই বলেনাই?’ 

—‘বলতেছে যে আমি সব সময় কেন এরকম করি? কেন কথা দিয়ে কথা রাখিনা। ব্লা ব্লা ব্লা… আর জানিস ও এখানে আসার পর থেকে আমারে একটা কিস পর্যন্ত করেনাই।’ 

অমৃতার হাতে ফোন ধরা ছিল। কথাটা শুনতে পেয়ে সে ফোনের পর্দা থেকে চোখ তুলে বিস্মিত গলায় বললো, 

‘বলিস কী? কেন?’ 

বিভা করুণ ভাবে বললো,- ‘আই হ্যাভ নো আইডিয়া গাইজ! ইনফ্যাক্ট, ইউ নো হোয়াট? আমি ওকে কিস করতে গেছি, কয় কি এখন না, থাক! মানে আমার বয়ফ্রেন্ড আমারে বলতেছে এখন না, থাক। কত বড় অপমান চিন্তা করছিস?’ 

হৃদি প্রচণ্ড এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। একটা আনকোরা, অন্যরকম, সুতীব্র শিহরণ তার সকল ইন্দ্রিয় কে কেমন বিকল করে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। আশ্চর্য ব্যাপার হল সমস্ত গ্লানি আর অপরাধবোধ ডিঙিয়ে এই মাত্র একটি সুমিষ্ট শীতল সু বাতাস তার হৃদয়তলের দেশটিকে প্রবল ভাবে আলোড়িত করে তুলল। সামি যে বিভার খুব কাছাকাছি যায়নি গতকাল রাতে, এই তথ্যটা জানতে পেরে তার এত ভালো লাগছে কেন? 

ভেতর থেকে সঙ্গে সঙ্গে একটা কড়া ডাক আসে। হৃদিতা! বিভা তোমার বন্ধু! 

হৃদি নড়ে চড়ে বসলো। কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা সে। কাল রাত থেকেই উড়ন্ত মেঘের মতো নানা জাতের চিন্তারা মাথায় আসছে, আবার পালিয়ে যাচ্ছে। কোনো ভাবনাই স্থায়ী হচ্ছেনা। তারা বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু লুকোয়না। গত সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটাও লুকোনো থাকবেনা সে জানে। সামির মুখ থেকে কিছু শোনার আগে তার উচিত নিজ থেকেই ব্যাপারটা বিভাকে খুলে বলা। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বিভাকে কিছুই বলতে পারলোনা। কেমন বোবায় ধরা চোখ নিয়ে চেয়ে রইলো সামনে 

বিভা বললো, ‘তর কী হইছে? এরকম হাঁসের মত চাইয়া আছস ক্যান?’ 

হৃদি বড় একটা নিশ্বাস নিলো। আস্তে আস্তে বললো, ‘না ভাবতেছি। শোন একটু টাইম দে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ 

বিভা হতাশ ভাবে বললো, ‘কী টাইম দিব বল? এতো রাগ করলে কি চলে? আর জানিস ও আমার জন্য কোন গিফটও আনেনাই। লাইক সিরিয়াসলি? তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে তুমি এতদিন পর দেখা করতেছো, তুমি একটা কিছু গিফট করবানা তারে?’ 

হৃদির আংটিটার কথা মনে পড়ল। হ্যাঁ, আজ একটা ভালো কাজ হয়েছে। সে আংটিটা খুলতে পেরেছে অবশেষে। নারকেল তেল দিয়ে অনেক ঘষাঘষির পর জিনিসটা বেরিয়ে এসেছে টুপ্ করে আঙুল থেকে। সে ব্যস্ত গলায় বললো, ‘নিশ্চয়ই কিছুনা কিছু এনেছে তোর জন্য। সময় হলেই পাবি।’ 

বিভাকে বিষণ্ণ দেখায়, নিস্তেজ ভাবে বলে, ‘নারে, কেমন যেন লাগতেছে সব কিছু। খুব উল্টাপাল্টা। 

অমৃতার চোখ তখন ফোনেই নিবদ্ধ ছিল। মনে হচ্ছে বিভার রিলেশনশিপের উত্থান পতন তাকে অতটা টানছেনা। সে হঠাৎ খুশি খুশি গলায় বললো, ‘বাদ দে এসব, সামির রাগ বেশিক্ষণ থাকেনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন আয় তোদের মুড ভালো করে দেই। এই দ্যাখ শার্টলেস ডেমন সালভাটর। ইনস্টাগ্রামে পেয়ে গেলাম।’ 

অমৃতা নিজের আই ফোন টেন এসের পর্দা বন্ধুদের চোখের সামনে মেলে ধরল। 

‘উফ! হট!’ দেখামাত্র মন্তব্য ছুঁড়ে দিল হৃদি। 

বিভা উঠে এসে অমৃতার হাত থেকে ফোনটা কেঁড়ে নিল,’দেখি দেখি, ও গড! হটনেস! মামা, হটনেস!’ বলে নিজের হাতের পাঁচটা আঙুল মুখের সামনে হাতপাখার মতো নাড়তে লাগলো সে। 

অমৃতা বললো, ‘দে একটা টাকলা কমেন্ট করে দেই।’

হৃদি হেসে বললো, ‘ওরা কি বাংলা বুঝবে নাকি?’

—‘বুঝবেনা দেখেই তো করব।’ 

বিভা বললো, ‘লিখে দে, এন সি (nc)’

হৃদি বলল, ‘না না, তুই লিখ, বেটিফুল (betiful)।’ 

অমৃতা হো হো করে হেসে উঠলো, ‘তার চেয়ে বরং আমি লিখি, ভাই এইসব ছাড়েন আর পর্দা করা শুরু করেন। আপনাদের এসব খোলামেলা ছবি মেয়েদের খারাপ করে দিচ্ছে।’ 

দূর্গা সে সময় খালি চায়ের কাপ ফিরিয়ে নিতে এসেছিল বসবার ঘরে। এসেই দেখলো বৌদিমণি এবং তার বান্ধবীরা মিলে ঝুলে মোবাইলে একটি হাফ ন্যাংটা ছেলের ছবি নিয়ে হাসি তামাশা করছে। সে তড়িঘড়ি করে খালি চায়ের কাপ গুলি ট্রেতে তুলে নিয়ে জিভ কেটে পালাল জায়গাটা থেকে। রাম রাম! এমন লক্ষ্মীছাড়া মেয়েছেলে সে বাপের জন্মে কোনো দিন দেখেনি। দাদাবাবুর জন্য তার বড়ই কষ্ট হয়। দাদাবাবুর মত দেবতার মত একজন মানুষের ভাগ্যে কিনা জুটলো এমন বেহায়া বেলেল্লা এক মেয়ে। না আছে সংসারে মন, না আছে পতিভক্তি। এখন আবার অর্ধ উলঙ্গ ব্যাটাছেলের ছবি নিয়ে তামশা করা হচ্ছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! 

.

খানিক বাদে দূর্গাকে সাথে নিয়ে ওরা হাটের উদ্যেশ্যে বেরোলো। হাট থেকে গোটা কয়েক মোরগ কিনলো। ঠিক হল আজ রাতে বারবিকিউ করা হবে। সেই সাথে পেয়ে গেলো দারুণ কিছু জিনিস। টাটকা বেলিফুলের মালা, কাচের চুড়ি। গ্রামের সহজ সরল আদিবাসীদের কাছ থেকে একেবারে কম দামে ঐসব শৌখিন জিনিস কিনতে পেরে বিভা আর হৃদি আনন্দে একেবারে ঝুমঝুম করে উঠলো। সেই ঝুমঝুম ভাবটা অনেকক্ষণ অবধি বাজতে থাকলো তাদের মনে। দুজনেই ঠিক করল আজ অনেক সাজবে। কত দিন হয়ে গেলো ওরা দুজনে একত্রে সাজগোজ করেনা! 

১৮

আকাশে আজ কৃষ্ণপক্ষের একাদশী চাঁদ। খুব একটা জোছনা হয়নি। তবে জোছনার অভাব ঘুচিয়ে দিয়েছে অসংখ্য হীরের টুকরোর মত উজ্বল নক্ষত্র। উঠোনে বারবিকিউ গ্রিল বসানো হয়েছে। তার পাশে একটি চৌপায়া টেবিল। টেবিলের ওপর রাখা বারবিকিউর নানা সরঞ্জাম। কয়লা পোড়া গন্ধে ভরে আছে চারপাশ। অমৃতা আর সামি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে লোহার শিকে মসলা মাখানো মাংস গেঁথে নিচ্ছে। তারপর বসিয়ে দিচ্ছে গ্রিলের কয়লার ওপর। কয়লা থেকে উঠে আসছে জ্বলন্ত আগুনের স্ফুলিঙ্গ। 

একটু দূরে চেয়ার পেতে বসে আছে রুদ্র আর আকাশ। বিভা, হৃদিতা সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। মাংস ধুয়ে মশলা মাখানো শেষ হতে না হতেই দেখা গেল কাজকর্মের চাইতে সাজগোজ করে তৈরী হবার দিকেই তাদের ঝোঁক বেশি। রুদ্র গিটার নিয়ে টুংটাং করছিলো। তার অবাধ্য চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে ঘাড়ের ওপর। গায়ে সাদা আর কালো রং মেশানো জ্যাকেট। সে গিটারের টুংটাঙের সাথে গুণগুণ করে কী একটা সুর ভাজছিল। হঠাৎ থেমে গিয়ে আকাশকে বলল, 

—‘দোস্ত, তুই খেলাটা আবার শুরু কর।’ 

আকাশ মনোযোগ দিয়ে সামি আর অমৃতার মোরগের মাংসে মশলা লাগানোর প্রক্রিয়া দেখছিলো। রুদ্রর কথা শুনতে পেয়ে তার একাগ্রতা ভাঙল। 

—‘ধুর, এখন আর ওসব হবেনা।’ 

—‘কেন হবেনা?’ 

—‘হবেনা দোস্ত। সময় শেষ। তাছাড়া আমার লাইফের কোন কিছু ঠিক নাই।’ 

—‘ঠিক থাকবেনা কেন? তুই একটা চাকরি করতেছিস। পাশাপাশি খেলাটা চালায় যা। মানুষের জীবনে বুঝছিস সবসময় একটা আলাদা জায়গা থাকা উচিৎ। শুধুমাত্র নিজের জন্য। ভালোলাগার একটা ব্যক্তিগত জায়গা। আমার যেমন গান। দিন শেষে এই গানই আমাকে বাঁচায় রাখে দোস্ত। গানের মধ্যে ঢুকলে আমি দুনিয়ার সব প্যারা ভুইলা যাই।’ 

আকাশ খুব স্পষ্ট গলায় বললো, ‘আসলে আমার ভুলে যাবার মত কিছু নাই, মনে রাখার মতও কিছু নাই। মনে রাখার মধ্যে আমি শুধু আমার মায়ের মুখটাই মনে রাখতে চাই রুদ্র। আর বাপ্ তো থাইকাও নাই। একটা জিনিস চিন্তা করে দ্যাখ আমার কিন্তু কোনো পিছুটান নাই। এইযে তোরা সবাই বেঁচে আছিস তোদের বাবা মায়ের জন্য, পরিবারের জন্য। আমারতো কারো প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নাই। বলতে গেলে আমি একা। জীবনটা নিয়ে আমি তাই অত ভাবিনা। এক ভাবে কেটে গেলেই হইল।’

—‘তুই একা হবি কেন? আমরা আছি না?’. 

—‘হ্যাঁ তোরা আছিস। তোরাই আছিস। তোরা ছিলি, তোরা থাকবি। ব্যাস এটাই আমার লাইফ।’ 

রুদ্র একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললো, ‘ইয়ে আকাশ, একটা খবর ছিল তোদেরকে দেয়ার। কাউকে বলিনাই। তোকেই বলি প্রথমে। তুই তো জানিস আমি ইউ এস এ’র কয়েকটা ভার্সিটিতে এপ্লাই করছিলাম। তো দুই জায়গা থেকে রিপ্লাই আসছে দোস্ত। একটা তে মোটামুটি ফান্ডের অবস্থা ভালো। স্কলারশিপ দিবে।’ 

আকাশ থমকায়। কিছুক্ষণ সরু চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থেকে সন্দিহান হয়ে বলে, ‘তুই চলে যাবি?’ 

রুদ্র মুখ নিচু করে গিটারে ডুবল আবার। পাশ কাটানো গলায় বলল, ‘চলে যাব কেন? কয়েকটা বছরের তো ব্যাপার। পড়া শেষ হলেই আবার চলে আসবো। সব কিছু ঠিক থাকলে হয়তো নেক্সট অগাস্ট ক্লাস থেকে শুরু।’ 

আকাশ কোনো কথা বলতে পারলোনা। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস তার শ্বাসনালীতে আটকা পড়ে আঁকুপাঁকু করতে লাগলো। অগাস্ট! এটা ডিসেম্বর। আর মাত্র সাতটা মাস পর রুদ্র দেশ ছেড়ে চলে যাবে? বিভা নেই, রুদ্রও থাকবেনা। বাংলাদেশে তাদের দিন গুলো এই দুজনকে ছাড়া কী করে কাটবে? আকাশের বুকটা খুব ভারী হয়ে উঠল। রুদ্র বিনা পয়সায় ভালো জায়গায় পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে। মেধা আর যোগ্যতা আছে বলেই সে এটা অর্জন করতে পেরেছে। তার উচিৎ বন্ধুর সাফল্যের কথা শুনে বন্ধুকে অভিবাদন করা, খুশি হওয়া। কিন্তু সে কিছুতেই খুশি হতে পারছেনা। খুশির বদলে ভেতর থেকে ঊর্ধ্বমুখী এক হাহাকার তীব্র আর্তনাদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। 

রুদ্র কেন চলে যাবে? বিভা কেন চলে গিয়েছিল? সবাইকে কেন চলে যেতে হয়? একই গণ্ডিতে, একই আকাশের নিচে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোকে কেন জীবনের একটা সময়ে এসে বেছে নিতে হয় ভিন্ন ভিন্ন সব গন্তব্য? 

গুম হয়ে যাওয়া আকাশকে খানিকক্ষণ ত্যাড়া চোখে পর্যবেক্ষণ করলো রুদ্র। তারপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘শালা, তোরা এরকম করলে আমি যাইতে পারবোনা। যাইতে চাইওনা। কিন্তু ফ্যামিলি থেকে প্রেশার আছে। বুঝতে হবে দোস্ত! 

আকাশ হাসার চেষ্টা করলো। হাসলোও একটু অনেক কষ্টে, বললো, ‘মনীষার কী হবে?’ 

—‘বিয়ে করে ফেলি। বৌ নিয়া যাইতে পারবো।’ 

—‘ওর ছেলের কী হবে?’ 

—‘ছেলেতো মালয়েশিয়ায়।’ 

—‘প্রেম নিবেদনই করতে পারিস নাই এখনো। আর বিয়ে! যাই হোক মনীষাকে নাহয় বিয়ে করে নিয়ে যাবি। কিন্তু আমাদের কী হবে? আমাদেরকে ছাড়া তুই থাকতে পারবি?’ 

—‘তোদেরকেও বিয়ে করে ফেলি।’

–’গুড আইডিয়া।’ 

.

কয়লা পোড়া মাংসের গন্ধে ভুরভুর করছে চারপাশ। ঝলসানো মাংসগুলো তুলে রাখার জন্য কোনো খালি পাত্র আনা হয়নি। অমৃতা সামিকে বললো, ‘যা তো ভেতরে গিয়ে একটা প্লেট নিয়ে আয়।’ 

—‘আমি কেন যাবো? তুই যা।’ 

—‘না, তুই যা।’ 

—‘অমৃতা তোর অভ্যাস বেশি খারাপ হয়ে গেছে। সব সময় সবাইকে আদেশ করিস কেন? 

—‘আমি আদেশ করতে ভালোবাসি।’ অমৃতার নির্বিকার স্বীকারোক্তি। সামি গমগম করে বললো – ‘আমি আদেশ পালন করতে ভালোবাসি না।’ 

~’তুই একদম তোর বাপের মত হইছিস। খটোমটো, কাঠখোট্টা।’

—‘আমার বাপকে যেন তুই কত চিনিস!’ 

—‘চিনিই তো। কাঠখোট্টা লোক একটা।’ 

জানা কথা হলেও কেন যেন সামির নিজের বাবা সম্পর্কে অমৃতার করা মন্তব্যটা এই মুহূর্তে ভালো লাগলোনা। সে কিছু না বলে চুপ করে গেলো। অমৃতা আবার খ্যাঁক দিয়ে উঠে বললো, ‘যা, প্লেট নিয়ে আয়।’ 

সীমাহীন বিরক্তির একটি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সামি অমৃতার মুখের ওপর। তারপর রাগে গজগজ করতে করতে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। বসার ঘর পার হয়ে ডাইনিং এ আসতেই বিভা আর হৃদিতার মুখোমুখি পড়ে গেলো সে। বিভা টেবিলের ওপর চপিং বোর্ড রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সালাদ কাটছিলো। তার পরনে একটি বেগুনি হাফ সিল্কের শাড়ি। খোঁপা বাঁধা চুলে বেলিফুলের গাজরা। চোখ ভর্তি কাজল। সুন্দর দামি পারফিউমের ঘ্রাণে ম ম করছে সারা ঘর। পাশে দাঁড়ানো হৃদি পরেছে রুপালি পাড়ের সাদা কাতান। তার চুলগুলো এলো করে ছাড়া। তাতে জড়ানো ফুলের মালা। ওদের দুজনকেই এতো বেশি সুন্দর লাগছিল যে দেখামাত্র সামি একটু কেমন থ বনে গেলো। অস্ফুটে বললো, ‘ওরে বাপরে, এতো সাজগোজ?’ 

এই গৌরবর্ণের কোঁকড়া চুলো যুবকের সহসা আগমন একটা স্নিগ্ধ কোমল বাতাসের ঝাপটার মতো ছুঁয়ে দিয়ে গেল দুই নারীকে। ঝলমলিয়ে উঠল বিভাবরীর ডাগর দুটি চোখের তারা। ওদিকে গতরাতের সেই ঝগড়ার পর থেকে এখন অবধি হৃদির আর কোনরকম বাক্য বিনিময় হয়নি সামির সাথে। আজ সারাদিন পর মানুষটার মুখ দর্শনে তার সর্বাঙ্গে কেন যে অমন বিনা কারণে রিমঝিম এক সুর বেজে উঠলো তা কে জানে! 

বিভা হাসল, ‘এতদিন পরে একসাথে হয়েছি আমরা। সাজবোনা?’

সামি ঠোঁট উল্টে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, ‘ও আচ্ছা।’ 

হৃদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করছিল। ভারী আনমনা দেখাচ্ছিল তাকে। সামি বিভাকে একবার আগাগোড়া দেখে নিল। তারপর মুগ্ধ গলায় বললো, ‘তোকে সুন্দর লাগছে!’ 

প্রশংসা শুনে বিভা তার রাজেন্দ্রাণী হাসিটা হাসলো। হৃদি আঁকিবুকি থামিয়ে দিয়ে সামির দিকে চোখ তুলে তাকালো একবার। বিভাকে সুন্দর লাগছে, আর হৃদিকে? চকিতে মনে পড়ল গতকাল রাতে সামি তাকে বলেছিল, তুই প্রেমে পড়ার মতো মেয়ে না। মনে পড়তেই একটা অন্ধ রাগ সাপের মতো ফণা তুলতে আরম্ভ করল বুকের ভেতর। সামি ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমাকে একটা প্লেট দিতে পারবি? মাংস রাখার জন্য একটা প্লেট লাগবে।’ 

–‘পারবো না। নিজে নিয়ে নে।’ সামির মুখের ওপর তির্যক ভাবে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে আর দাঁড়ালোনা হৃদি। গটগট করে হেঁটে সরে গেলো জায়গাটা থেকে। 

বিভা ভারী অবাক গলায় বলে উঠলো, ‘ওমা! এর আবার কী হইলো?’ 

হৃদির এই হঠকারী প্রস্থান সামির মুখমণ্ডলে একটি মেদুর ছায়াপাত ঘটাল। সেই মুহূর্তে দূর্গা হাতে কফির মগ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো, ‘বৌদিমণি, দাদাবাবুর কফিটা। তুমি যাবে? নাকি আমিই দিয়ে আসবো?’ 

—‘আমাকে দাও।’ বলে হাতে ধরা ছুরিটা টেবিলের ওপর রাখলো বিভা। দুর্গার হাত থেকে কফির মগটা নিতে নিতে বললো, ‘এই দাদাকে একটা খালি প্লেট দাও। বড় ডিশ।’ 

দূর্গা আদেশ পালন করতে রান্নাঘরে ফিরে গেলো। বিভা সামিকে বললো, ‘উনার কফিটা দিয়ে আসি। বুঝতেই তো পারছিস ওদিকটাও একটু খেয়াল রাখতে হচ্ছে। উনি যদি আবার রেগে যান?’ 

–‘কী হবে বিভা? উনি রেগে গেলে? তুই বানে ভেসে যাবি?’ 

—‘আহ, তুই বুঝতে পারছিস না সামি। ডিভোর্সটা তো এখনো হয়নি। আমাকে তো সবটা ম্যানেজ করতে হচ্ছে।’ 

সামি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,’শোন বিভা, তোর এসব শিটি ম্যানেজমেন্ট আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধ না করলে, ডিভোর্সটা জীবনেও হবেনা।’ 

দূর্গা একটি বড়সড় সিরামিকের প্লেট সমেত ফেরত আসলো। সামি প্লেটটা হাতে নিতে নিতে ম্লান চোখ মেলে চেয়ে দেখল কফির মগ হাতে নিয়ে বিভার দ্রুত পায়ে চলে যাওয়া। 

.

ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল হৃদি। তার মনটা হতাশা আর রাগে টানটান হয়ে আছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে এক টানে চুলে লটকে থাকা ফুলের মালাটা ছিঁড়ে ফেললো। ফুলগুলো ঝরঝর করে ঝরে পড়ল লাল সিমেন্টের মেঝের ওপর। কেন কে জানে, দমকা হাওয়ার মতো হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলির কথা। যে দিনগুলিতে সামির পাশে কেউ ছিলনা। ছিল শুধু হৃদি। হ্যাঁ এই হৃদি। যাকে কিনা সামি কোনো দিন চোখ মেলে ঠিকমতো দেখেনি পর্যন্ত! 

মনে পড়ল সেই ঝুম বৃষ্টির বিকেল। মনে পড়ল একটা সি এন জি। মনে পড়ল রিকশা, মানুষ, গাড়ি, কালো ধোঁয়া! মনে পড়ল পাশে বসে থাকা বোল শূন্য মূর্তির মতো সামিকে।একটু বাদে সামি থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল। হৃদি ওর কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখলো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ সি এন জি ওয়ালাকে গাড়ি ঘোরাতে বললো সে। ফিরে চললো অমৃতার বাসায়। তারপরের কয়েকদিন সামির কী ভীষণ জ্বর! টেস্ট করানোর পর টাইফয়েড ধরা পড়লো। অমৃতার তখন এন জি ওর নতুন প্রজেক্টের কাজ চলছে। তার সময় নেই। আকাশ সবেমাত্র চাকরিতে জয়েন করেছে। রুদ্রটার ঢাকা শহরে থাকবার জায়গা নেই। দুদিন ঢাকা, দুদিন চিটাগাং করে দিন কাটাচ্ছে সে। চাকরি খুঁজছে পাগলের মত। সামির পাশে দাঁড়াবার মত কেউ ছিলোনা। ছিল এক হৃদি। রোজ ক্লাস শেষে অমৃতার বাসায় চলে যেত সে সামিকে দেখতে। সামির আম্মা আসতেন ঠিকই কিন্তু অন্যের বাসায় খুব বেশিক্ষণ পড়ে থাকতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। বাবুর্চিকে দিয়ে রান্না করিয়ে ছেলের জন্য খাবার নিয়ে আসতেন রোজ। সেই খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব ছিল হৃদির। সামির আম্মা ছেলের সুস্থতার জন্য পর পর তিনদিন রোজা রাখলেন। সেই তিনদিন হৃদিও রোজা রেখেছিলো। এ খবর কেউ জানেনা, শুধু হৃদি আর হৃদির আল্লাহ জানেন। জায়নামাজে বসে কত কান্নাকাটি করেছে সে সামির সুস্থতার জন্য। কত রাত সে ওই জ্বর গায়ের ছেলেটার পাশে একটানা বসে থেকেছে। জ্বরের ঘোরে সামি বিভার নাম ধরে ডাকাডাকি করতো। সে খুঁজত বিভাকে কিন্তু তার পাশে বসে থাকত হৃদি। বিভাকেই তো ভালোবাসে সামি! ভালোবেসেছে সব সময়। বিভাই সবসময় সুন্দর তার চোখে, হৃদি তো নয়! এটা তো সবাই জানে। সব জেনে বুঝেও হৃদি কেন কষ্ট পাচ্ছে? বিভা তার বন্ধু! যে বিভাকে সে ভালোবেসে এসেছে মেয়েবেলা থেকে, সেই বিভাকেই এতো হিংসা? ছিঃ হৃদিতা ছিঃ, ধিক তোমাকে ধিক! 

.

অভিজিৎ বিছানায় বসে ছিল কোলের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে। তার পরনে একটি বাদামি উলের সোয়েটার। চশমাটা নাকের ডগায়। বিভা কফির মগ হাতে ঘরে ঢুকতেই সে মুখ তুলে তাকাল। তাকানো মাত্র তার মোটা চশমার আড়ালের ভালোমানুষী চোখের তারায় ঝিকমিক করে উঠলো একরাশ মুগ্ধতা। বিভাকে দেখতে কী ভীষণ সুন্দর লাগছে! এতো সুন্দর যে ভালো লাগায় একদম দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল। 

বিভা খাটের ওপর বসে থাকা অভিজিতের দিকে কফির মগটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘এই নিন।’ 

অভিজিৎ হাত বাড়িয়ে কফির মগ নিল। পুলকিত চোখে বিভার দিকে খানিক সময় চেয়ে থেকে বললো, 

—‘আজ কি কোন বিশেষ দিন?’ 

বিভা ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খোঁপায় বাঁধা ফুলের মালাটা জায়গা মতো আছে কিনা দেখে নিলো। তারপর সিঁদুরের কৌটা থেকে এক চিমটি লাল রং নিয়ে সিঁথির সিঁদুর গাঢ় করতে করতে বললো, ‘বিশেষ দিন হতে হবে কেন?’ 

—‘এতো সাজগোজ? 

বিভা হেসে বললো, দেশে থাকতে আমি আর হৃদি প্রায়ই একসাথে সাজগোজ করতাম। আজকে এতদিন পর দুজন একসাথে হয়েছি তো, তাই ভাবলাম একটু আগের মতো ফান করি।’ 

—‘ফান?’ 

—‘হ্যাঁ ফান, অত অবাক হচ্ছেন কেন?’ 

বলে বিভা ঘুরে দাঁড়াল। তাকাল অভিজিতের চোখে চোখ রেখে। অভিজিৎ কফির মগে চুমুক দিতে গিয়েও দিতে পারলনা। বড্ড গরম। ধোঁয়া বেরোচ্ছে। নিরস্ত হয়ে মগটা বিছানার সাইড টেবিলের ওপর রেখে সে বললো, ‘আপনার যে দুদিন পর ঢাকা ফিরে যাবার কথা। এ বিষয়ে কথা বলেছেন আপনার বন্ধুদের সাথে?’ 

বিভা নির্বিকার গলায় বললো, ‘এবার মনে হয় যাওয়া হবেনা।’ 

অভিজিৎ অবাক হয়, চোখ বড় করে বলে, ‘যাওয়া হবেনা মানে?’ 

—‘মানে, আমার বন্ধুদের ল্যাজ ধরে দেশে ফিরে গেলে আমার বাবা মা ওদের দোষ দেবে। বলবে যে ওরা আমাকে ফুসলিয়ে, কুমতলব দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। 

অভিজিৎ কোলের ওপর থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে রাখলো বিছানায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে খুব গম্ভীর গলায় বলল ‘ আপনার প্রেমিক কী বলেছে এ বিষয়ে?’ 

—‘তার সাথে এখনো কোনো কথাই হয়নি এসব নিয়ে। আপনি তো রেস্ট্রিকশন দিয়ে রেখেছেন। বলেছেন তার কাছাকাছি না যেতে, বলেন নি?’

—‘কাছাকাছি যেতে মানা করিনি। আপনারা যা খুশি করতে পারেন দ্যাটস নান অফ মাই বিজনেস। শুধু বলেছি আমার চোখের সামনে ওসব রংঢং করবেন না।’ 

বিভা ফিচেল হাসে। দু পা এগিয়ে এসে অভিজিতের মুখোমুখি দাঁড়ায়। টেনে টেনে বলে, ‘কেন? আপনার চোখের সামনে রংঢং করলে কী হয়? হিংসে?’ 

অভিজিৎ বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিল, ‘আপনার সবসময় ফালতু কথা।’

বিভা হাসতেই থাকে। অভিজিতের সোয়েটারের গলার ওপর কুঁচকে থাকা শার্টের কলারটা আলতো হাতে ঠিক করে দিতে দিতে হালকা গলায় বলে, ‘ধরেন আমি যদি আর কোনো দিন না যাই। সারাজীবন আপনাকে এভাবেই বিরক্ত করি। তখন কী হবে?’ 

এ কথার পর অভিজিৎ আকস্মিক ভাবে, খুব আকস্মিক ভাবে বিভার দুই বাহু খামচে ধরে টেনে নিয়ে আসল নিজের কাছে। অনেকটা ফিসফিস করে বলল, ‘ভালোবাসতে পারবেন আমাকে?’ 

চার চোখেতে বিদ্যুৎ বেগে বিভ্রম খেলে যায়। কয়েকটা মুহূর্ত কেউ কিছু বলতে পারেনা। কেমন এলোমেলো সবকিছু! খন্ডপ্রলয়টা কেটে যাবার পর বিভা খুব ধীরে ধীরে নিজেকে অভিজিতের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল। তার হাত পা কাঁপছিলো। ভেতরটা বড্ড অবশ। ভালোবাসতে পারবে কি? সামিকে দেখলে এখনো যে তার মন কেমন করে! ছেলেটা নেশার মতো তাকে সর্বক্ষণ টানতে থাকে নিজের দিকে। পারবে কি সে ওই মদির সম্মোহন থেকে বেরিয়ে আসতে কোনো দিন? ভাবতে ভাবতে কয়েক পা পিছিয়ে আসে সে। দরজার দিকে এগিয়ে যায় ধীর পায়ে। হঠাৎ তার মাথায় আসে অন্য এক চিন্তা। সে থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে নতমুখে আস্তে করে বলে, ‘আপনি পারবেন? আমাকে ভালোবাসতে? আমার মত একটা খারাপ মেয়েকে?’ 

—‘আপনি খারাপ এ কথা কে বললো?’ দুর্বল গলায় প্রশ্ন করল অভিজিৎ। 

বিভা স্নিগ্ধ চোখে তাকায় অভিজিতের দিকে, ‘খারাপ নই?’ 

—‘না!’ 

—‘আপনার মত ভালোও তো নই!’ 

.

দরজায় ধাক্কা পড়ছে। হৃদি চোখের জল মুছে নিল দু হাত দিয়ে ডলে ডলে খুব ভালো ভাবে। যেন কান্নার কোনো চিহ্ন লেগে না থাকে মুখে। দরজা খুলে দেখলো সামি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে বিশাল বড় এক সিরামিকের খালি প্লেট। ওর পরনে সাদা পুলওভার, কালো জিন্স। হৃদিকে সে জহুরি চোখে একবার পরখ করে নিয়ে বললো, ‘কী হইছে তর?’ 

হৃদি একটু অপ্রস্তুত হল। তার চুল হয়ে আছে আলুথালু। মেঝেতে পড়ে আছে ছেঁড়া ফুলের মালা। সবকিছু ছন্নছাড়া, বিশৃঙ্খল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি বিশৃঙ্খল হৃদি নিজে। তার দুচোখ জোড়া ভয়াবহ বিষণ্ণতা। নিশ্বাস পড়ছে ফোঁসফোঁস। সামির প্রশ্নে সে গর্জে উঠে বললো, ‘তাতে তোর কী? বিরক্ত করতে আসছিস কেন? 

সামি হৃদির খ্যাঁক শুনে একটু কাঁচুমাচু হয়ে গেল, বিব্রত গলায় বলল, ‘ওরে বাপরে, এতো রাগ করতেছিস কেন? ইদানিং তোর রাগ দেখলে আমার ভয় লাগে!’ 

কথাটা বলে সামি মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বিধ্বস্ত, ছেঁড়া ফুলের মালাটি দেখল এক নজর। ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে বললো, ‘এই খ্যাত জিনিসটা মাথা থেকে খুলে ফেলে একটা ভালো কাজ করছিস। সঙের মত লাগতেছিলো দেখতে।’ 

হৃদি জ্বলন্ত চোখ নিয়ে তাকাল সামির দিকে, প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘আমাকে সঙের মত লাগছে নাকি হুরপরীর মত লাগছে এই কথা তোর কাছে থেকে শুনতে হবে? তোর মত একটা থার্ড ক্লাস ছেলের কাছ থেকে? 

—‘আমি থার্ড ক্লাস?’ সামি হতবাক। 

—‘হ্যাঁ থার্ড ক্লাস।’ 

—‘আজিব কারবার! কোন এঙ্গেল থেকে আমাকে তোর থার্ড ক্লাস মনে হয়, হ্যাঁ?’ 

—‘সব এঙ্গেল থেকেই। এই যে বিবাহিতা গার্লফ্রেন্ডের বাসায় এসে নির্লজ্জের মত পইড়া আছস। কোন লেভেলের মানুষ এ ধরণের কাজ করতে পারে শুনি?’ 

এ কথা শুনে সামির ফর্সা মুখের রং রাঙা হয়ে উঠল, ‘তুই আমার ফ্রেন্ড হয়ে এমন একটা কথা বলতে পারলি? তুই জানিস না আমি না পারতে এই কাজটা করতেছি?’ 

হৃদি তার আউলা ঝাউলা চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিয়ে খোঁপা বাঁধছিলো। তার নাকের পাটা ফোলা। চোখের দৃষ্টি তীব্র। সামি ভাল মতো আরেকবার দেখে নিল হৃদিকে। ওর আচরণ স্বাভাবিক ঠেকছে না। মনে হচ্ছে কোন কারণে মন খারাপ। হাতের প্লেটটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখল সে। এরপর মেঝেতে পড়ে থাকা ছেঁড়া ফুলের মালাটা যত্ন করে তুলে নিল হাতে। হৃদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘সঙের মত লাগছিলোনা। সুন্দর লাগছিলো। আজকাল কি তুই জোকও বুঝিস না? এরকম হয়ে গেছিস কেন?’ 

হৃদির মুখে থমথম করছে এক বাঁধভাঙা কান্নার পূর্বাভাস। সে অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল। সামি ওর একটা হাত ধরে, হাতের মুঠো খুলে ফুলগুলো গছিয়ে দিল। হৃদির গাল হালকা ভাবে ছুঁয়ে দিয়ে নরম গলায় বললো, ‘তুই এখনো গত কালকের ব্যাপারটা নিয়ে আমার ওপর রাগ করে আছিস তাইনা? আমি সরি বলছিনা দোস্ত? তুই এরকম করলে কি আমার ভালো লাগে? তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড?’ 

ঠিক সেই সময় ঘরের আধ ভেজানো দরজাটা খুলে আচমকা বিভা এসে দাঁড়ালো ওদের সম্মুখে। সামির একটা হাত হৃদির হাতে ধরা, অন্য হাত ছোঁয়ানো ওর গালে। কেন কে জানে, বিভার ওই আকস্মিক আগমনে দুজনেই ভারী চমকে উঠল। সামি চকিতে এক পা পিছিয়ে আসল হৃদির কাছ থেকে। হৃদি স্তব্ধ চোখে, রুদ্ধ শ্বাসে তাকাল বিভার দিকে। 

বিভা অপ্রস্তুত এবং বাক্যহারা। কারো অত্যন্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তে হানা দেয়ার পরমুহূর্তে যেরকম অপরাধ বোধ হয় ঠিক সে রকম একটা বোধ জন্ম নিলো তার মনের মধ্যে। কোনো শিক্ষিত, বিবেকবান মানুষ অন্যের ব্যক্তিগত মুহূর্তে দখল দেয় না। বিভাও দিতে চাইলোনা। সে অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে বললো,’তোরা কী করতেছিস?’ 

কিছুক্ষণ বিরতি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বিভাই কথা বলল আবার, ‘আচ্ছা… আমি উঠোনে যাচ্ছি, তোরা আয়।’ 

এটুকু বলে সে আর দাঁড়ালোনা। চলে আসার সময় তার হঠাৎ মনে হল, দুজন বন্ধুর মাঝে খুব বেশি প্রাইভেট কিছু কি থাকা উচিৎ? আর বিশেষ করে তাদের এই ছয়জনের বন্ধুত্বে তো প্রাইভেসি বলতে কোনো বস্তু কোনো কালে ছিলনা। তার মাথাটা একটু এলোমেলো লাগতে লাগলো। কী করছিল ওরা? কী কথা বলছিল? 

বিভা চলে যাবার পর দুজনেই কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নিজেদের এই অস্বাভাবিক আচরণের কোন ব্যাখ্যা আপাতত নেই তাদের কাছে। হয়তো গত সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কারণে তারা দুজনেই মনে মনে বিভার কাছে ছোট হয়ে আছে। হয়তো বিভা যখন দুজনের মাঝখানে হঠাৎ পর্দা ফুঁড়ে এসে হাজির হয়েছিল তখন বিনা নোটিশে নিজের ভেতরের অপরাধী মনটা সচকিত হয়ে উঠেছিল। 

সামি একটু আড়ষ্ট ভাবে বলল, ‘ইয়ে… কী যেন বলছিলাম?’ 

হৃদি তখনো ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি। সে নিশ্বাস বন্ধ করে বললো, ‘বিভা কী ভাবলো?… ইশ আমার কেমন যেন লাগছে। তুই বিভার কাছে যা।’ 

—‘হুম…’ সামিকে অন্যমনস্ক দেখাল। 

—‘আর শোন তোর আংটিটা আমি খুলতে পেরেছি।’ বলে হৃদি হেঁটে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগের চেইন খুলে আংটিটা বের করলো। সামির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘এই নে, বিভাকে দিয়ে দিস।’ 

সামি হাত বাড়িয়ে আংটিটা নিল। তার চোখের তারায় আর নাকের ভাঁজে চিন্তা খেলা করছে। সে গম্ভীর গলায় বললো, ‘তোর কি মনে হয় ব্যাপারটা আমাদের সবাইকে বলা উচিৎ? মানে গত কালকের ঘটনাটা?’ 

—‘হ্যাঁ আমিও এটা নিয়ে তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। তুই কি মনে করিস, বলার দরকার আছে? 

সামি একটুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘দ্যাখ, ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে আমরা তো কিছুই লুকাইনা। আর তা ছাড়া বিভাকে ব্যাপার টা না বললে সারা জীবন আমার মধ্যে একটা গিলটি ফিলিংস কাজ করবে। আই ওয়ান্ট টু বি লয়্যাল টু হার।’ 

হৃদি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘হুম তাহলে সবার সামনেই বলবি। বাট অভিজিতের এবসেন্স এ। তার কানে যেন এসব না যায়।’ 

বাইরে উঠোনে আকাশের সাথে হাত পাঞ্জা লড়ছে অমৃতা। মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে আর চেয়ারের গদিদে কনুই রেখে। পাশে রুদ্র মুখ ভর্তি আলুর চিপ্স নিয়ে লাফঝাঁপ দিয়ে দুজনকে চিয়ার আপ করছে। চিপ্স চিবোতে চিবোতে অস্পষ্ট ভাবে কী সব যেন বলে যাচ্ছে নিজের মনে। অমৃতা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দাঁত মুখ খিচিয়ে পাঞ্জা লড়ছে। সেই অবস্থায়ই বলল, ‘রুদ্র তোর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছতেছিনা। চাইনিজ বলতেছিস নাকি?’ 

রুদ্র চিপস গিলে বলল, ‘চাইনিজ বলব কেন? বাংলা বলতেছি।’

—‘বাংলা বলতে পারিস তুই?’ 

—‘তুই পারিস?’ 

—‘আমি তোর থেকে ভালো পারি।’ 

—‘আন্ডা পারিস। বল দেখি মনীষা মানে কী?’ 

অমৃতার ভ্রু কুঁচকে গেলো। মনে হল মনীষা নামের অর্থ নিয়ে সে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। সেই দুশ্চিন্তার ফাঁক বুঝে আকাশ দিল অমৃতার হাত নামিয়ে। যেন তার জিতে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক এমন হালকা গলায় বলল, ‘আমি জানি মনীষা নামের অর্থ।’ 

অমৃতা তেড়ে মেরে এসে রুদ্রর পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল, ‘শালা তোর জন্য হারছি আমি। ফালতু প্যাঁচালের আর টাইম পাইলিনা?’ 

সামিকে দেখা গেলো হেলে দুলে হাতে কাচের বাসন নিয়ে এগিয়ে আসতে। অমৃতা এবার চড়াও হল তার ওপর। 

—‘একটা প্লেট আনতে গিয়া তো মানুষের যুগের পর যুগ লাইগা যায়। মানে কাহিনী কী বুঝলাম না আমি। ঘুমায় গেছিলি নাকি হাঁদারামের বাচ্চা? 

সামি কানকাটার মত হয়ে কথা গুলো হজম করল। কিছু বললোনা। রুদ্র বলল, ‘পারলিনা তো মনীষার অর্থ বলতে।’ 

অমৃতা মুখ ঝামড়ে উঠে বললো, ‘আমি কি মনীষার উপর ক্রাশ খাইছি যে ওর নামের অর্থ মুখস্থ করব?’ 

—‘মনীষা অর্থ প্রতিভা, প্রজ্ঞা। আমার সব ফ্রেন্ডদের মনীষা নামের অর্থ মনে রাখতে হবে। আকাশ পারে, সামি পারে, তুই কেন পারবিনা?’ কথাটা বলতে গিয়ে বেশ গম্ভীর হয়ে গেল রুদ্র। 

অমৃতা রুদ্রর কথা পাত্তা না দিয়ে বারবিকিউর মাংস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। রুদ্র কিন্তু দমল না। আবার বললো, 

‘তুই বাংলা ইংরেজি কিছুই ঠিক মতো পারিস না অমৃতা।’ 

—‘না, আমি কোত্থেকে পারব? সব তো পারবি তোরা ইঞ্জিনিয়াররা। আমরা লইয়াররা তো ঘাস খাই মামা। ঘাস খায়ে বেঁচে থাকি।’ 

—‘হ, ঠিক কথা। বল দেখি, এক অক্ষরে আকাশের একটা প্রতিশব্দ বল।’ আকাশ রুদ্রর পাশেই হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। অমৃতা অবাক চোখে আকাশের হাসি মাখা মুখখানার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বলল, ‘এক অক্ষরে আকাশ? মানে?’ 

—‘আরে এই আকাশ না, আসল আকাশ, মানে মাথার উপরের আকাশ। স্কাই।’ 

অমৃতার খুব রাগ ধরে গেলো, ‘তুই বল দেখি মঞ্জু শব্দের অর্থ কী?’ রুদ্র মুখ বাঁকা করে বলল, ‘হু দ্যা ফাক ইজ মঞ্জু?’ 

—‘জাস্ট টেল মি দ্যা ফাকিং মিনিং অফ দ্যাট নেইম!’ অমৃতার গলা চড়ে যায়। 

রুদ্রকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল। সামি দাঁড়িয়ে ছিল ওদের পাশে। কেমন অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ে আছে বারবিকিউ গ্রিলের কয়লা পোড়া ধোঁয়ার কুণ্ডলীর দিকে। মনে হচ্ছে সে বন্ধুদের কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনছেনা। রুদ্র সামির কনুইয়ে একটা গুঁতা মেরে বললো, ‘ইয়ো ম্যান, মঞ্জু মানে কী?’ 

সামি বিরক্তিতে কাদা হয়ে বললো, ‘তুই একটা বাল শালা, আজাইরা বকবকানির জায়গা পাস্ না।’ 

উঠোনে তখন বিভা, অভিজিৎ আর হৃদি এসে গেছে। সবাই গোল হয়ে বসেছে চেয়ার পেতে। বারবিকিউর কাজ শেষের পথে। রুদ্র গিটার নিয়ে বসেছে সবার মধ্যমণি হয়ে। বাতাসে হিমের গন্ধ। কৃষ্ণপক্ষের একাদশী চাঁদটা নীল হীরক কুচি তারাদের সঙ্গে নিয়ে বুঝি রুদ্রর গান শোনারই আয়োজন করছে। পুরো আকাশ জুড়ে ভারী উৎসব উৎসব একটা ভাব। 

রুদ্র গিটারে সুর তুলে ওদের চট্টগ্রামের একটা গান ধরলো, 

মধু হৈ হৈ 
বিষ খাওয়াইলা
মধু হৈ হৈ 
বিষ খাওয়াইলা 
হন কারনে… 
ভালবাসার দাম নও দিলা 
হন দোষ আণ পাই 
ভালবাসার দাম ন… দিলা…
আশা আছিল তোয়ারে লই
বাইন্দুম একখান সুখেরি ঘর
সুখের বদল দুঃখ দিলা 
হন কারনে
ভালবাসার দাম ন…দিলা 

বিভা রুদ্রর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসেছিল। হঠাৎ কী হল কে জানে! সে বসা থেকে উঠে, কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে গেল রুদ্রর দিকে। তারপর দাঁড়াল ওর চেয়ারের ঠিক পেছনে। হাত দিতে রুদ্রর আউল বাউল চুল গুলো নেড়েচেড়ে দিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল, ‘কত দিন আমার দোস্তটার গান শুনিনা! থ্যাংক ইউ দোস্ত। থ্যাংক ইউ সো মাচ!’ 

রুদ্র গান গাইতে গাইতে বিভার দিকে ঘুরে তাকিয়ে ভারী সুন্দর একটা হাসি হাসলো। তারপর হঠাৎ করেই তার গিটারের সুর পরিবর্তন হয়ে গেল। পূর্বের গানটির ইতি টেনে নতুন গান ধরল সে। 

‘তুই বন্ধু হয়ে আমার হাতটা ছুঁলে 
আমি এ বিশ্ব সংসার যাবো ভুলে 
ভুলব সব ভুল অংকের ভুল উত্তর 
শত দুঃখ বেদনা আর কষ্টের প্রহর’

গানটা ধরামাত্রই বন্ধুরা সব বসে থাকা অবস্থায় একে অন্যের হাত ধরল। চেয়ার গুলো কাছাকাছি ছিল বলে কাজটা খুব সহজেই করা সম্ভব হল। বন্ধুদের এই হাত ধরাধরি দেখে অভিজিতের মুখে একটি ব্যাঙ্গাত্বক তির্যক হাসি ফুটে উঠছিল ধীরে ধীরে। বিভা ফিরে আসল নিজের জায়গায়। বসল অভিজিতের পাশের চেয়ারে। বসা মাত্রই হৃদি তার হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলল। 

‘তুই বন্ধু হয়ে থাকলে আমার পাশে 
আমি কষ্ট গিলে খাই এক নিঃশ্বাসে’ 

সেই মুহূর্তে বিভা চট করে ধরে ফেলল অভিজিতের একটা হাত। অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে চাইল একবার বিভার দিকে। বিভা রুদ্রর সাথে গলা মিলিয়ে গাইছে তখন, 

‘তুই কাছে আয়, দূরে চলে যাই চল 
তোর জন্য গড়েছি স্বপ্নের বৃষ্টি মহল!’ 

সামি তেরছা চোখে চেয়ে ছিল বিভা আর অভিজিতের ধরে থাকা হাতদুটির দিকে। বিভা হাতটা ধরতেই লোকটার চোখ মুখের ভঙ্গি পাল্টে গেছে। বোকা লোকটা যে গভীর ভাবে বিভার প্রেমে পড়ে গেছে সে বিষয়ে সামি এখন শত ভাগ নিশ্চিত। নাহ, বুকের ভেতর কোন জ্বালা অনুভব করছেনা সে। মন খারাপ হচ্ছে এ কথা ঠিক। কিন্তু তার চেয়ে বেশি যা হচ্ছে তার নাম হতাশা। সম্পর্কগুলো বড় বেশি উল্টেপাল্টে গেছে। তিনটা মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর বিশৃঙ্খলতা। এই বিশৃঙ্খল, অরাজক তিনটি জীবনের জন্য দায়ী কে? বিভার বাবা মা? তাঁর নিজের বাবা? নাকি স্বয়ং বিভা? ভাবতে ভাবতে সামি ক্রমশ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। বিভা কেন হুট করে লোকটার হাত ধরতে গেল? হাতটা ধরা কি খুব বেশি জরুরি ছিল? অমৃতার স্বপ্নের বৃষ্টিমহলে অভিজিতের ঠিক কী ভূমিকা থাকতে পারে? 

পকেটে রাখা সেলফোনটা বাজছিল। ফোন হাতে নিয়ে অমৃতা সন্তর্পণে বন্ধুদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে আসল। হেঁটে হেঁটে উঠোন পেরিয়ে লাল মাটির পথটায় উঠবার ঠিক আগ মুহূর্তে পেছন থেকে আকাশের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো, ‘এই অমৃতা, কই যাস?’ 

অমৃতা উচ্চস্বরে উত্তর দিল, ‘একটা ফোন আসছে।’ 

এ রাস্তার দুপাশে ঘন বনের সারি। শাল, বাবলা, জামুন, গজারি আর কাটা বাঁশের ছড়াছড়ি। পায়ের আওয়াজ শুনে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা, ঘুমিয়ে থাকা রাত পাখি গুলি সচকিত হল। ডানা ঝাপটে উড়াল দিল এক ঝোপ থেকে আরেক ঝোপে। ধারে কাছে কোথাও ডেকে উঠলো প্যাঁচা। 

অমৃতা ফোন ধরে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘বলুন।’ 

—‘অমৃতা চৌধুরী!’ 

ভরাট এবং গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠটা এই রাত্রি কালীন গা ছমছমে, গভীর নিস্তব্ধতায়, অমৃতার মেরুদণ্ডে আচমকা একটি হিমেল শিহরণ তুলে দিয়ে গেল। 

—‘কী হয়েছে?’ উদ্বেগ টা আর চাপা থাকল না তার গলায়। 

—‘আজকে দেশের এক নামকরা নিউজপেপারে একটি খবর ছাপা হয়েছে। লেখা হয়েছে যে আমার একমাত্র পুত্রের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তাকে আমি ত্যাজ্য পুত্র করেছি।’ 

অমৃতা থমকাল। চুপ করে রইল কয়েকটা সেকেন্ড। তারপর ক্ষীণ গলায় বলল,’তো আমি কী করবো? আমাকে এসব কেন বলছেন?’ 

—‘এই খবরটা প্রচার হওয়ার পেছনে তোমার হাত আছে কি?’

সেদিন উত্তরায় সামিদের বাড়ির সামনে একজন সাংবাদিক ছেলের সাথে অমৃতার এ বিষয়ে কথা হয়েছিল। কাজটা সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই করেছিল এবং কাজটা করার পর বিন্দু মাত্র অপরাধ বোধ তার ভেতর কাজ করেনি। আজও করছেনা। কিন্তু হকের এই অকপট, চাঁছাছোলা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অন্যরকম একটা অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছে। সেদিন নিছক রাগের বশে কাজটা করে বসেছিল। এখন মনে হচ্ছে অতটা বাড়াবাড়ি না করলেও চলত। এই লোক যত খারাপই হোক না কেন, সামি তো তার বন্ধু! বন্ধুর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচার পাওয়া সংবাদটি জানতে পারার পর হাজার চেষ্টা করেও খুশি হতে পারছেনা সে। অস্বস্তি হচ্ছে, নিদারুণ অস্বস্তি। 

—‘আমি সঠিক জানিনা।’ 

—‘সঠিক জানোনা মানে?’ 

অমৃতা একটা বড় নিশ্বাস টেনে নিয়ে নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল। তারপর নির্ভয়ে বলল, ‘আমার হাত আছে কিনা এ ব্যাপারে আমি সুনিশ্চিত নই। আপনি ফেমাস মানুষ। সংবাদ মাধ্যম গুলো যে কোনো উপায়ে আপনার সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করতে পারে। দেয়ালেরও তো কান আছে। তবে হ্যাঁ, আমি একজন সাংবাদিকের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছিলাম, কিন্তু হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর না যে এটা তার কাজ।’ 

হক মেয়েটির স্পষ্টবাদিতা দেখে এক নিদারুণ বিস্ময়ে চুপ হয়ে গেলেন। মেয়েটি যেন কেমনতর! কথাবার্তা টানটান এবং জড়তা হীন। চট করে রেগে গিয়ে ধমক দেয়া যায়না আবার ছেলেমানুষ ভেবে এর বক্তব্য উড়িয়েও দেয়া যায়না। একে শাসন করার আগে দশবার ভেবে নিতে হয়। মেয়েটিকে তিনি দিনকে দিন যত আবিষ্কার করছেন ততই বিস্মিত হচ্ছেন। অল্প বয়সে এতটা ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ সচরাচর দেখা যায়না। ফোনটা করার আগে, মেয়েটির ওপর তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সামনে পেলে নির্ঘাত এক চড় মেরে এর দাঁ তের পাটি নাড়িয়ে দিতেন। একটা পুঁচকে মেয়ের এত সাহস হয় কী করে? কিন্তু এইমাত্র মেয়েটির দ্বিধা হীন অকপট স্বীকারোক্তি শুনতে পেয়ে তার ভিতরকার অগ্নিবৎ রাগটায় হঠাৎ যেন ঠাণ্ডা জলের ছিটে এসে পড়ল। রাগের চাইতে প্রকট হয়ে ধরা দিল কৌতূহল এবং বিস্ময়। 

—‘ঠিক কী বিষয়ে কথা বলেছিলে তুমি সাংবাদিকের সাথে?’ বেশ খানিকটা সময় নীরবতা পালন করার পর হক মুখ খুললেন। 

অন্ধকারে এক পা দু পা করে এগিয়ে, অমৃতা একটা ছোট টিলার উপর উঠে বসল। শীতটা এখন বড্ড দাপুটে। লেদারের জ্যাকেট ভেদ করে সরাসরি চামড়ায় গিয়ে কামড় বসাচ্ছে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধারালো অমৃতা। সময় নিয়ে। তারপর নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কালো অন্তরীক্ষের গায়ে ফুটে থাকা হীরক কুচি নক্ষত্ররাজির দিকে চেয়ে নিস্তরঙ্গ গলায় বলল, ‘বলেছিলাম আপনার ছেলে আপনার সাথে থাকেনা। আলাদা থাকে।’ 

—‘কেন বলেছিলে?’ 

—‘আপনাকে হ্যারাস করতে চেয়েছিলাম, তাই।’

–’কেন এমনটা চেয়েছিলে? কারণ কী?’ 

—‘আপনাকে আমার খুব একটা পছন্দ হয়না। এটাই কারণ।’ 

হক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। তার এই ঊনপঞ্চাশ বছরের সুদীর্ঘ, বিচিত্র অভিজ্ঞতা ময়, সফল জীবনটায় এর আগে কেউ কোনো দিন মুখের ওপর এহেন অপমান জনক এবং আক্রমণাত্মক কথা বলার সাহস পায়নি। তার ক্ষমতা সম্পর্কে এই মেয়েটির কোন ধারণাই নেই। মেয়েটি জানেনা তিনি চাইলেই এক লহমায় এর ভবিষ্যৎ জীবন তছনছ করে দিতে পারেন। একটা সুতীব্র অপমান বোধ টনটন করে উঠল তার ভেতরে। আর একটা শব্দও তিনি উচ্চারণ করলেন না। লাইন কেটে দিলেন। ফোনটা পকেটে পুরতে পুরতে অমৃতা নিঃশব্দে হাসল। লোকটাকে জব্দ করতে পেরে একটা দারুণ সুখানুভূতি হচ্ছিল তার মনে মনে। 

বাংলোর উঠোনে ফিরে এসে দেখা গেল খাওয়া দাওয়ার পালা এর মাঝেই শুরু হয়ে গেছে। সবার প্লেটে বারবিকিউ চিকেন আর পরোটা। গ্লাস ভর্তি সোডা। আকাশ তখন কোকের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিচ্ছিল। চুমুক দেয়া শেষে বেশ উৎসুক গলায় সে অমৃতাকে প্রশ্ন করলো, ‘কীরে? বয়ফ্রেন্ড নাকি? পলায় পলায় কার সাথে এত কথা বলিস?’ 

অমৃতা খুব হাসল, ‘বয়ফ্রেন্ড! হা হা হা। ভালো বলেছিস।’ 

ঠিক সে সময় ফোনটা আবার আসল। আগের নম্বর থেকেই। বন্ধুদের কাছ থেকে আবারও কিঞ্চিৎ দূরে সরে গিয়ে ফোন ধরল সে। চাপা গলায় বলল, ‘সিরিয়াসলি মিস্টার হক! এত বিরক্ত করলে হয়? আমার ফ্রেন্ডরা উল্টাপাল্টা ভাবছে।’ 

হক সন্দিহান হয়ে বললেন, ‘উল্টাপাল্টা ভাবছে মানে?’ 

—‘ওরা ভাবছে আমি বুঝি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছি।’ 

ইয়া আল্লাহ! মেয়েটার মুখে কি কিছুই আটকায় না? হক আরেক বার বাক্যবধির হলেন, বিব্রত হলেন, লজ্জিত হলেন! 

ওদিকে অমৃতা বলে চলেছে, ‘এভাবে চলতে থাকলে সামির কাছে ধরা পড়ে যাব। আর সামি যদি কোনভাবে জানতে পারে যে আপনি ওর প্রতিটা পদক্ষেপ এভাবে ফলো করছেন। তাহলে… বুঝতেই পারছেন।’ 

হক একটু অপ্রস্তুত গলায় বললেন, ‘ইয়ে… সামি কী করছে এখন?’

—‘খাচ্ছে। আন্টিকে উইশ করেছে সে। আপনার চিন্তার কিছু নেই।’

—‘হ্যাঁ জানি। তার মা খুশি হয়েছে।’

—‘আর কিছু বলবেন?’ 

—‘তুমি আমাকে অপছন্দ কর কেন?’ রয়ে সয়ে প্রশ্নটা করলেন হক। স্থির কণ্ঠে 

—‘ঠিক একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি তাইনা? আপনি আমাকে আর আমার বন্ধুদের এতটা অপছন্দ করেন কেন? আমাদের বাবা মায়েদের আপনার মতো কোটি কোটি টাকা নেই বলে?’ 

হক কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘এরকম কথা কি আমি কখনো বলেছি?’ 

অমৃতা হেঁটে হেঁটে বাড়ির ভেতর আসল। ভেতরে এখন কেউ নেই। সবাই উঠোনে। 

—‘বলেছেন। আপনার ছেলের সব চালচুলো হীন ছেলেমেয়েদের সাথে ওঠা বসা, এধরণের কথাবার্তা আপনি প্রায়শই বলে থাকেন। আমার কানে আসে।’ 

—‘ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়।’ 

—‘তাহলে ব্যাপারটা কী রকম?’ 

—‘ব্যাপারটা হল, তোমরা কেউই লাইফ নিয়ে সিরিয়াস নও। আমার ছেলের মতো তোমরাও একেকটা রামগাধা। সব গাধারা একসাথে জোট বেঁধেছ। আসলে আমার ছেলেটার কিছু শুদ্ধ সঙ্গ প্রয়োজন ছিল। ডিসেন্ট এবং বুদ্ধিমান কিছু বন্ধুর প্রয়োজন ছিল। সঙ্গ দোষেই আজকে তার জীবনের এই নাজেহাল অবস্থা হয়েছে।’ 

—‘আমরা প্রত্যেকে রামগাধা?’ 

—‘ঠিক তাই।’ 

—‘আমার বাবাকে আপনি একবার বলেছিলেন, তিনি সরকারি চাকরি করে যে বেতন পান তার চেয়ে বেশি টাকা বেতন পায় আপনার কোম্পানির সেকেন্ড ক্লাস কর্মচারীরা। একথা কেন বলেছিলেন?’ 

হক কিছু সময় নিশ্চুপ থাকলেন। তারপর প্রশ্ন বিদ্ধ গলায় বললেন, ‘বলেছিলাম নাকি? কই আমার তো মনে পড়েনা।’ 

—‘হ্যাঁ বলেছিলেন।’ 

—‘ও আচ্ছা। বলে থাকলেও ভুল কিছু তো বলিনি। ঘটনা ভীষণ সত্য।’ 

—‘সত্য হলেই বুঝি মুখের ওপর বলে দিতে হবে? এইযে আপনি আমাকে সারাক্ষণ বেয়াদব বেয়াদব করেন, আদব জিনিসটা কি ষোল আনা আপনার মধ্যেও আছে মিস্টার হক? থাকলে তো আপনি আমার বাবাকে এমন কথা বলতে পারতেন না। তিনি একজন রিটায়ার্ড সরকারি কর্মচারী। তার বয়স সিক্সটি সিক্স। আপনার চেয়ে বয়সে উনি বড়। তাহলে বেয়াদব কি শুধু আমরাই? আপনারা কী? ছেলেমেয়ের বাবা মা হয়েছেন বলে আপনাদের সব দোষ মাফ, তাইনা?’ 

—‘তুমি আসলেই বেয়াদব। তোমার বয়সে থাকতে আমরা এত কথা বলতে জানতামই না। জীবন যুদ্ধে ঠেকে ঠেকে কথা শিখেছি।’ 

—‘আমার বয়স খুব কিন্তু কাঁচা না। ছাব্বিশ হল এবার। আমার বয়সে থাকতে আপনি সন্তানের বাবা হয়ে গিয়েছিলেন। আমি প্রাপ্ত বয়স্কা। তাই কথায় কথায় বয়স নিয়ে খোঁটা দেবেন না।’

হক এ পর্যায়ে হেসে ফেললেন। ফোনের ভেতর দিয়ে অমৃতা সেই হাসির শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল। সে একটু কড়া ভাবে প্রশ্ন করল, ‘হাসছেন কেন?’ 

—‘আচ্ছা, আমার ছেলে কী খাচ্ছে?’ অমৃতার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন হক।

—‘বারবিকিউ চিকেন উইথ পরোটা।’ 

—‘বেশ, কে করলো বারবিকিউ?’ 

—‘বিভা আর হৃদি মাংস ধুয়ে দিয়েছে। আমি আর আপনার ছেলে মাংস ম্যারিনেট করেছি। পুড়িয়েছি।’ 

—‘সাউন্ডস গুড। এখন তাহলে রাখছি।’ 

—‘কাল কখন ফোন করবেন?’ 

—‘কেন জানতে চাইছ?’ 

—‘সময়টা জেনে রাখতে চাইছি। আপনার তো কোন কিছু ঠিক নেই। যখন তখন ফোন দিয়ে বসেন।’ 

—‘দেখি। যখন আমার ছেলের কথা মনে পড়বে ঠিক তখনই ফোন করব।’

—‘ছেলেকে এত মিস করেন, ওর সাথে সরাসরি কথা বলেন না কেন?’

—‘সেটা আপাতত সম্ভব নয়।’ 

—‘কেন সম্ভব নয়?’ 

—‘আরেকদিন বলবো। আপাতত গুড নাইট!’ 

—‘শুনুন, শুনুন!’ অমৃতার হঠাৎ যেন মনে পড়ল খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। 

—‘বল।’ 

—‘এক অক্ষরে আকাশের প্রতিশব্দ কী? জানা আছে আপনার?’ 

—‘খ?’ 

—‘হ্যাঁ, খ, কেন পড়নি? খ তে চড়ে যে, খেচর। খেচর মানে আকাশচারী।’ 

—‘ও… তাই তো!’ 

—‘ছাড়ছি। আর কিছু বলবে?’ 

~’এ মুহূর্তে আর কিছু মনে পড়ছেনা। 

—‘খাওয়া দাওয়া কর। খুব বেশি রাত জেগো না তোমরা।’ 

—‘রাত জাগব না মানে? আজ সারা রাত জেগে থাকব আমরা। বাবা টাইপ কথা বলবেন না তো! 

—‘আমি তো তোমার বাবারই মতো। 

—‘বাবার মতো হতে যাবেন কেন?’ 

—‘বন্ধুর বাবা কি বাবার মতো নয়?’ 

—‘আপনাকে আমার মোটেও বাবার মতো মনে হয়না।’ 

—‘তাই নাকি? কেন বল তো!’ 

—‘আরেক দিন বলবো।’ 

ফোনের ওয়েটিং লিস্টে একটা কল টুকটুক করে করা নাড়ছিল। অমৃতা বলল, 

—‘আমার আম্মু ফোন করেছেন। রাখি।’ 

—‘রাখো।’ 

১৯

পরদিন ওরা একটু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ল নাশতা সেরে। বাইরে ঝকঝকে একটি দিন। দিবাকর আজ বড্ড প্রফুল্ল। আকাশ আশ্চর্য নীল। শালবন আর ঝোপঝাড়ের গায়ে গায়ে শীত-গন্ধী কোমল হাওয়া। ঝিরঝিরে সেই হাওয়ায় ইচ্ছেমত উড়ে বেড়াচ্ছে কাচের টুকরোর মতো কুচি কুচি রোদ্দুর। বৃক্ষ ছায়াচ্ছন্ন ঘন সন্নিবিষ্ট এই অরণ্য যেন এক মায়া কানন। বিভা একটা হালকা হলুদ টপের সাথে নীল জিন্স পরেছিল। হৃদির গায়ের রংটা একটু চাপা বলে সে এসব গাঢ় রং বরাবরই এড়িয়ে চলে। কিন্তু আজকে বিভার পীড়াপীড়িতে গাঢ় রঙের জামাই পরতে হয়েছে তাকে। সে পরেছে নীল রঙের ফুল হাত শার্ট, সাথে কালো কাপড়ের প্যান্ট। শার্টটা তার নয়, বিভার। এখন রোদের মোটামুটি তেজ আছে বলে অতটা শীত করছেনা বরং রোদ গায়ে লাগাতে আরাম লাগছে। 

অভিজিৎ অফিসে। ছয় বন্ধু লাল মাটির সরু পথটা ধরে হাঁটছিল। সারা পথ বনপুষ্পের সুবাসে ছাওয়া। কোন সেই ফুল, কোথায় সে লুকিয়ে আছে তা কে জানে! দেখা যায়না, শুধু ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আকাশ হঠাৎ বলল, ‘এই, বনের মধ্যে যাবি?’ 

বিভা বলল, ‘এখন নয়। আগে নদীর পাড় থেকে ঘুরে আসি। পরে দেখা যাবে।’ 

দিনের বেলা বলে গ্রামের পথে এখন মেলা লোকজনের আনাগোনা। এর মাঝে একটি চাইনিজ টুরিস্ট দলও আছে। চাইনিজ দলে দুজন তরুণী এবং একজন তরুণ। তরুণীদ্বয়ের পরনে সাদা হাফপ্যান্ট। একজনের গায়ে নীল গেঞ্জি অপর জনের গায়ে বাদামি লেইস ওয়ালা একটি অদ্ভূত টপ। সেই টপের গলা এতো বড় যে বুকের অনেকখানি দেখা যায়। দলের পুরুষ সদস্যটি বেটে খাটো। একেবারেই চোখে পড়ার মত নয়। চাইনিজ দলটি বন্ধুদেরকে একটু বেশিই টানছে। দুই তরুণীর সিল্কের মতো ফিনফিনে রেশমি কালো চুল। মোমের মত ফর্সা, মসৃণ হাত পা। বন্ধুদলের ছেলেদের মনে চৈনিক মেয়েদুটির খোলা মেলা রূপ বেশ আনন্দের উদ্রেক করছে। তারা খানিক বাদে বাদে চীনা মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছে। দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। 

রুদ্রর চুলে আজকে বিণুনী করে দিয়েছে হৃদি। রুদ্র তার বেণী ওয়ালা চুল নিয়ে বড়ই বিব্রত। বিশেষ করে সুন্দরী রমণীদের উপস্থিতি তাকে তার বাহ্যিক রূপ সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছে। বিণুনীটা তার সহ্য হচ্ছেনা কিন্তু বন্ধু ভালোবেসে বেঁধে দিয়েছে বলে কিছু বলতেও পারছেনা। সে হাঁটতে হাঁটতে তার বিণুনীতে একটা হাত রেখে বললো, ‘আমাকে কি মেয়ে মেয়ে লাগতেছে?’ 

আকাশ গম্ভীর গলায় বলল, ‘হ্যাঁ একটু মেয়ে মেয়ে লাগতেছে।’ 

হৃদি বলল, ‘মেয়েদের মত লম্বা চুল রাখছস। মেয়ে মেয়ে তো লাগবোই।’ 

মাটির পথ ছেড়ে পিচ ঢালা রাস্তায় উঠতেই সামি হঠাৎ বলল, ‘রেস লাগবি?’ 

—‘কীসের রেস?’ আকাশের প্রশ্ন। 

—‘দৌড়ের’

অমৃতা উৎফুল্ল গলায় বলল, ‘নট আ ব্যাড আইডিয়া।’ 

—‘এখন রেস টেস হবেনা। অনেক রোদ। দৌড়াইলে মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে।’ বিভা জানিয়ে দিল স্পষ্ট ভাবে। 

হৃদি সায় দিল বিভার কথায়, ‘হুম রাইট। এখন আমরা দৌড়াবোনা।’

অমৃতা বিরক্তিতে কাদা হয়ে বলল, ‘তাইলে তোমরা মুড়ি খাও। কে কে রেস লাগবা আসো।’ 

দেখা গেলো হৃদি আর বিভা বাদে বাকি সবাই দৌড় প্রতিযোগিতার ব্যাপারে দারুণ উৎসাহী। চার বন্ধু দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত হল। হৃদি বললো, ‘এই পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তায় দোড়াদৌড়ি করার কোনো মানে হয়না। পইড়া গিয়া হাত পা ভাঙবি।’ 

—‘আর বলিস না। মাইয়া দেইখা সব পাগল হয়ে গেছে। মানে এখন কী করবে খুঁইজা পাইতাছেনা। কিছু একটা কইরা তো সিনে আসতে হবে বুঝস নাই?’ চাপা ফ্যাসফ্যাসে গলায় ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করল বিভা। 

হৃদি আর বিভার পাশে চীনা দলটাও দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনের রাস্তা চার বন্ধু আটকে রেখেছে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ে তারা দৌড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। অমৃতা ‘রেডি, স্টেডি এন্ড গো’ বলতেই চারজন দৌড়ানো আরম্ভ করলো। 

চাইনিজ মেয়ে দুটি ভোঁ দৌড় দেখে কেন যেন অতি আনন্দিত হয়ে উঠল। তারা হাত তালি দিয়ে গদ গদ হয়ে বলে উঠল, ‘হুয়ানহু!’ 

বিভা মুখ কচুপানা করে বলল, ‘বেটি কী কয়? এতো আনন্দের কারণ কী? 

চার বন্ধু তখন প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। এখন পর্যন্ত আকাশ সব থেকে এগিয়ে। মনে হচ্ছে রেসটা সেই জিতে যাবে। হৃদি হাঁটা শুরু করেছিল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘চারটা গাধা পাহাড়ি রাস্তায় দল বাইন্ধা দৌড়াইতেছে, এটা একটা বিনোদনের বিষয় না?’ 

চাইনিজ দল দৌড় প্রতিযোগিতা খুব উপভোগ করছে। একটু পর পর হুয়ানহু হুয়ানহু বলে চ্যাঁচাচ্ছে। হৃদি আর বিভা হুয়ানহু শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে পড়ল। বিভা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘বালের হুয়ানহু। এর মানে কী?’ 

—‘কেউ জানেনা!’ হৃদি বলল, উদাস গলায়। 

নদীর কাছাকাছি আসতেই জলের শব্দ তীব্র হল। পাহাড়ি উপত্যকার এই নদী পাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ছোট বড় পাথর। পাথরকুচির ওপর স্রোত এসে আছড়ে পড়ছে বলে শব্দ হচ্ছে জলপ্রপাতের মতো। হাওয়া শিফনের ন্যায় মসৃণ। স্রোতের পানির ওপর রোদ নাচছে ঝিকমিক করে। ভারী মনোরম একটি দিন! শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছিল বলে ভুটান পাহাড়ের গায়ের বৃক্ষরাজি এখন গাঢ় সবুজ। বাঁধের ওপর ঝুলছে ব্রিজ। খুব একটা লোকজন নেই এদিকটায়। ব্রিজের ওপর শুধু একটি শহুরে দল মহা উৎসাহে ছবি তুলে যাচ্ছে। চারবন্ধু দৌড়ে এসে ঘেমে টেমে একাকার হয়ে নদীতে নেমে গেছে। এদিকটায় নদীর পানি গভীর নয়। হাঁটু জল বলা যায়। সেই হাঁটুজল পানিতে নেমে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করছে ওরা। হৃদি আর বিভা একটি বড় পাথরের ওপর বসল পাশাপাশি। চাইনিজ দলটিও নাচতে নাচতে নদীতে নেমে গেছে। দেখা গেল বন্ধুদের দলের খুব কাছাকাছিই তাদের অবস্থান। বন্ধুরা চৈনিক দের দেখে উল্লসিত, আনন্দিত এবং আপ্লুত। 

.

বিভা হঠাৎ কেমন চপল গলায় বলে উঠল, ‘দ্যাখ, সামিকে কী সুন্দর দেখতে লাগছেনা?’ 

হৃদি তাকাল। সামির চোখে নীল কাচের রোদ চশমা। খোঁচা দাড়ি ওয়ালা কাঞ্চন বর্ণের গালে আয়নার মতো ঝিকোচ্ছে রোদ। তার গায়ে লালনের ছবি আঁকা সাদা রঙের একটি টিশার্ট। কালচে ঠোঁট জোড়ায় এক বঙ্কিম চিত্তাকর্ষক হাসি। 

হৃদি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল ওর দিকে। ওই মুখের দিকে তাকালে আজকাল কোত্থেকে যেন এক আশ্চর্য ভালোলাগা ভোমরার মতো গুনগুন করে মনের দেয়ালে এসে বসে। সেই আশ্চর্য ভালোলাগার ভ্রমরকে হৃদির দারুণ ভয়। সে শক্ত ভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘মোটেও না!’ 

বিভা চমকায়, ‘মোটেও না মানে?’ 

‘না।’ 

—‘কীসের না?’ 

—‘তেমন সুন্দরের কিছু নেই।’ 

—‘আমার বয়ফ্রেন্ডকে তুই অসুন্দর বলতে চাইছিস? তোর তো সাহস কম না?’

—‘তোর বয়ফ্রেন্ডটা আমার ফ্রেন্ড। এটা ভুলে যাস না।’ 

ঠিক সে সময় সামি ওদের দুজনের দিকে ঘুরে তাকাল। সানগ্লাস চোখে থাকায় বোঝা গেলোনা দুই রমণীর মধ্যে ঠিক কার দিকে তার দৃষ্টি। জল পায়ে ঠেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসল সে। কাছাকাছি এসে হঠাৎ একটা আজব কাণ্ড করে বসল। বিভাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে দ্রুত ফিরে চলল নদীর কাছে। বিভা ঘটনার আকস্মিকতায় গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠল প্রথমে, তারপর ভেঙে পড়ল এক খিলখিল করা আহ্লাদী হাসিতে। 

হৃদি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে দেখল দৃশ্যটা। বুকের মধ্যে অস্ফুট এক অনির্বচনীয় ব্যথা। চোখের দেয়ালে নোনা অশ্রুবিন্দুর সুড়সুড়ি। জল ছিটাছিটির এক পর্যায়ে বিভা সামিকে খুব শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরল। ফিসফিস করে বলল, ‘সাগর সৈকতের সেই দিনটার কথা তোর মনে আছে সামি?’ 

সামি হাসে,আলতো গলায় বলে, ‘মনে আছে!’ 

বিভা সামির দিকে গাঢ় চোখে তাকায়। তাকায় সামিও। একটা হালকা চুমু খায় সে বিভার কপালে। তারপর, ভালোবাসার মানুষটার খুব কাছাকাছি থাকার এই মোহময় সময়টাতে, আচমকা তার মনে পড়ে যায় সন্ধ্যাবেলার সেই অচেনা মেয়েটির কথা। কুয়াশা কেটে সেই যে মেয়েটির ধীরে ধীরে হেঁটে আসা, সেই অন্ধকার, সেই স্পর্শ! কী আশ্চর্য! বিভা তার কাছে আসলেই অন্ধকারের মেয়েটির কথা মনে পড়ছে কেন? তার কি বুদ্ধি ভ্ৰংশ হচ্ছে? পাগল হয়ে যাচ্ছে কি সে? 

সামি একটু সতর্ক গলায় বলল, ‘ইশে… এখানে তোর চেনা জানা মানুষজন থাকতে পারে। কেউ দেখলে সমস্যা হবেনা?’ 

বিভার যেন ঘোর ভাঙল। সে চকিতে সামির কাছে থেকে একটু দূরে সরে এসে বলল, ‘হুম, ঠিক বলেছিস।’ 

সামি তাকিয়ে দেখল হৃদি ওখানটায় একলা চুপটি করে বসে আছে। তার চোখদুটি কেমন ভাসা ভাসা। মুখখানা থমথমে। 

সামি এগিয়ে আসল। পাথরের ওপর এসে বসল, হৃদির পাশে। লাইটার জ্বালিয়ে ধরালো সিগারেট। হৃদির মাঝে বিনা কারণে এক অদ্ভুত আড়ষ্টতা কাজ করছে। বিভা হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে থেকে ওদেরকেই দেখছিলো। হৃদি বুঝতে পারছে বিভার চেহারার রংটা পাল্টে গেছে। বলতে নেই, সামির এই হঠাৎ করেই তার কাছে চলে আসা এবং আসবার পর বিভার মুখের রং পাল্টে যাওয়া, এই সমস্ত ঘটনাটি তার মেরুদণ্ডে এক সুখদায়ক শিরশিরে অনুভূতির জানান দিচ্ছিল। সাংঘাতিক এক নির্লজ্জ সুখে কেঁপে কেঁপে উঠছিল ভেতরটা। ঠিক সেই সময় কেউ একজন কড়া ডাক দিয়ে উঠল মন থেকে, কী হচ্ছে হৃদিতা? বিভা তোমার বন্ধু! 

আকাশ বিভার হাত ধরে টেনে টেনে নদীর আরো গভীরে নিয়ে গেল। তারপর বন্ধুদের দাপাদাপি, লাফালাফিতে বিভা আর পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ পেলোনা। 

অনেকক্ষণ ধরে ওরা কেউ কোনো কথা বলছিলনা। সামি নিঃশব্দে সিগারেট ফুঁকছে। একটা সময় নীরবতা ভঙ্গ করে হৃদি বলল, ‘কী ব্যাপার? প্ৰেম শেষ? 

সামি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল সময় নিয়ে, শ্লেষের গলায় বলল, ‘হচ্ছেনা, কেউ একজন বিরক্ত করতেছে।’ 

হৃদি মনের অন্দরমহল সচকিত হয়। 

—‘কে বিরক্ত করছে?’ 

—‘চিনিনা তাকে।’ 

—‘পাগল হয়ে গেছিস?’ 

—‘মনে হয়।’ 

চৈনিক মেয়েটি আচমকা দুম করে এক রাম ধাক্কা খেল আকাশের সাথে। দুজনের পিঠে পিঠে লেগে গেছে। ঘটনা দেখে রুদ্র সিটি বাজিয়ে হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘সিনেমা মামা! একদম সিনেমা!’ 

আকাশ ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো চৈনিক মেয়েটি হতচকিত ভাবে চেয়ে আছে তার দিকে। আকাশ তাকাতেই সে বিনীত ভাবে দুঃখ প্রকাশ করল ইংরেজিতে। আকাশের মুখে চওড়া এক হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে কৃতজ্ঞতায় মরে গিয়ে বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই। এরকম হয়েই থাকে।’

চৈনিক মেয়েটি আকাশের আকাশময় প্রাণখোলা হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘হাই আমি লি!’ 

আকাশ ওর হাত ধরল, ‘আমি আকাশ।’

—‘একাস?’ চৈনিক মেয়ে ভারী মিষ্টি ভাবে উচ্চারণ করলো নামটা।

আকাশ হেসে শুধরে দিল, ‘আকাশ।’ 

—‘নাইস টু মিট ইউ আকাস।’ 

রুদ্র এক রাশ জলের ঝাপটা ছুঁড়ে মেরে ভিজিয়ে দিল আকাশকে। আকাশ মহা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কী শালা শাউয়া, দেখতাছস না একটা প্রসেসিং এর মইধ্যে আছি আমি? বিরক্ত করতাছস কেন?’ 

অমৃতা ঠেস দেওয়া গলায় বলল, ‘এতো নাইচো না, চৈনিক তোমারে বেল দিবো না।’ 

—‘আরে দিবোনা মানে? ক্রাশ খাইয়াই ফেলছে অলরেডি।’ 

রুদ্র বলল, ‘ইশ কী ধাক্কাটা খাইলা মামা, সেই রকম!’

—‘সেইরকম মানে? পিঠ জ্বইলা যাইতাছে, উফ!’ 

অমৃতা বলল,’তোকে ডেয়ার দিলাম যা, তুই ওই মেয়ের সাথে গিয়া কথা বল।’ 

‘কী কথা বলব?’ 

—‘বল কথাবার্তা, এই ফোন নাম্বার টাম্বার নে, দ্যাখ একটা গতি হয় নাকি।’ 

—‘তোর কি ধারণা আমি কথা বলতে পারবনা?’ 

—‘বলেই দ্যাখ না। আই ডেয়ার ইউ।’ 

এদিকে বিভার ডাগর দুটি চোখ থেকে থেকে অবাধ্য বুনো পাগলা ষাঁড়ের মতো ছুটে ছুটে যাচ্ছিল, পাথর খণ্ডের ওপর বসে থাকা যুবক যুবতীর দিকে। সামি রোদ চশমা খুলে হাতে নিয়েছে। তার সুন্দর মুখখানায় এখন একটা অস্বস্তি খেলছে। এমনকি অস্বস্তি ফুটে উঠছে হৃদির আচরণেও। হঠাৎ এক নাম না জানা অভিশংকা ঝড়ো দমকা হাওয়ার ন্যায় তীব্র গতিতে তেড়ে এসে বিভাকে যেন লন্ডভন্ড করে দিতে লাগল। বুক কাঁপতে লাগল তার। গলা শুকিয়ে কাঠ! 

.

শিফনের মতো মসৃণ বাতাস হৃদির খোলা চুল নিয়ে এলোমেলো খেলছিল। এক হাত দিয়ে অবিন্যস্ত চুলগুলো ঠিক করতে করতে সে একটু অস্বস্তি নিয়ে সামিকে বলল, ‘তুই এখানে এসে আমার পাশে বসে আছিস কেন? বিভা কী ভাববে?’ 

—‘কী ভাববে আবার? তুই আমার ফ্রেন্ড। আমি তোর পাশে বসতে পারিনা?’ সামি নির্বিকার। 

এ কথার পর আর কিছু বলা যায়না। হৃদি চুপ করে গেল। ভুটান পাহাড়ের মাথায় নিরুদ্দেশ উড়ে বেড়াচ্ছে এক গুচ্ছ সাদা পলকা মেঘ। মেঘের পাড় ঘেঁষে রুপালি রেখা। হৃদির মুখ থেকে এখন বিষণ্ণ ভাবটা মুছে গেছে। জনাব বিষণ্নতা হঠাৎ বিনা নোটিশে ছুটি নিয়ে পালিয়েছে ঠিকই, তবে এই ছুটি কতক্ষণের বা কতদিনের তা সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছেনা। হয়তো একটু বাদেই আবার হেলেদুলে হাজির হবেন তিনি। এই মুহূর্তে অবশ্য জনাব বিষণ্নতাকে ছুটি দিতে পেরে হৃদির ভালো লাগছে। বিভা কি তাদের দুজনের দিকেই চেয়ে আছে? কী ভাবছে বিভা? সঠিক জানেনা হৃদি। তার কেন যেন মনে হচ্ছে শুধু বিভা নয় সারা পৃথিবীটা তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। বিভা যে তার বন্ধু, বিভাকে যে সে নিজের প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসে, এই সত্যটুকু, চেতনা টুকু এক মোহ বিদ্ধ, নেশাড়ু তুফান ঝড়ে বিলুপ্ত প্রায় হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু ভুলে গিয়ে হৃদির এখন স্বার্থপর হতে মন চাইছে, ভয়ংকর স্বার্থপর! ভালোলাগার ভোমরা টা গুনগুন করে উড়ে বেড়াচ্ছে কানের কাছে। সুযোগ পেলেই টুপ করে মনের দেয়ালে বসে পড়বে। সামি এখন এত কাছাকাছি বসে আছে যে হাত বাড়ালেই তার হাতটা ছোঁয়া যায়। হৃদির খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সামির হাতটা একবার ধরে! কিন্তু অনেক দিনের চেনা বন্ধুটির হাত ধরতে আজ বড় সংকোচ,বড় দ্বিধা! 

সামি হঠাৎ গম্ভীর গলায় বললো, 

—‘শোন, এখন তো অভিজিৎ নাই। সো আমরা বিষয়টা সবার সাথে এখনই শেয়ার করতে পারি।’ 

হৃদি একটু নড়েচড়ে বসল, ‘এখন?’ 

—‘হ্যাঁ এখনই। কজ সন্ধ্যার পরেই অভিজিৎ চলে আসবে। আর তুইই তো বললি অভিজিতের সামনে কথাটা না বলতে।’ 

হৃদি চিন্তাযুক্ত গলায় বলল, ‘আমার বিভাকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। ও কী রকম রিয়্যাক্ট করবে বুঝতে পারছিনা।’

—‘রিয়্যাক্ট করার তো আমি কোনো কারণ দেখছিনা। একটা ভুল হয়ে গেছে। ভুল তো ভুলই। ভালো তো আমি ওকেই বাসি তাইনা?’ 

শেষের প্রশ্নটা কাকে করলো সামি কে জানে! নিজেকে? নাকি হৃদিকে? 

হৃদি চোখ তুলে চাইল সামির দিকে। একটু সময় চুপটি করে চেয়ে থেকে বলল, ‘তোর ভালোবাসা যদি সত্য হয় তাহলে বিভা তোকে ভুল বুঝবেনা। নিশ্চিত থাক। 

হৃদি আর সময় নষ্ট না করে হাত তুলে বন্ধুদের ডাকল, ‘এই শোন তোরা! এদিকে আয়, কথা আছে।’ 

বিভাই আসলো প্রথমে। ভেজা জামা নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমাদের আকাশের তো চাইনিজ গার্লফ্রেন্ড হয়ে যাচ্ছে।’ 

—‘তাই নাকি?’ 

আকাশকে দেখা গেলো নাচতে নাচতে উড়তে উড়তে এগিয়ে আসতে। ওর পেছনে অমৃতা আর রুদ্র। সবাই কাক ভেজা হয়ে আছে। 

আকাশকে দেখা মাত্র হৃদি বলে উঠল, ‘কীরে, চীনা বেটি নাকি তোর গার্লফ্রেন্ড হয়ে গেছে?’ 

আকাশ এক গাল হেসে বললো, ‘হয়নায় এখনো, তবে হয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি। ইমেইল, ফেসবুক, টুইটার সব ঠিকানা নেয়া হয়ে গেছে। এমনকি আমি বাংলাদেশে যাওয়ার জন্যও ইনভাইট করে ফেলছি। সে বলেছে সম্ভব হলে এই যাত্রায়ই একবার বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসবে।’ 

অমৃতা ঠেস দেয়া গলায় বলল,’শেষ পর্যন্ত চৈনিক? তোর কপালে এই ছিল রে আকাশ!’ 

রুদ্র ফোড়ন কাটলো,’কেন ভালোইতো, বেশ খোলামেলা কাপড় চোপড় পরে। এরকম মেয়ে আশেপাশে থাকলে তো মন ভালো থাকে।’ 

আকাশ তাল মেলালো রুদ্রর সাথে, ‘রাইট! হট একটা গার্লফ্রেন্ড থাকলে আর কী লাগে মামা? তবে অমৃতা, তোকে থ্যাংকস তুই ডেয়ার না দিলে কাজটা হইতোনা।’ 

সামির মোবাইলে তার মায়ের ফোন নম্বরটা এই বড্ড অসময়েই কড়া নাড়লো। সে কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে ফোন রিসিভ করলো। রোমেলা প্রগলভ হয়ে বললেন, ‘বাচ্চা শোন, আমি আর তোর বাবা, আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ 

সামি বিরক্তিতে গোসল করতে করতে বললো, ‘কী সিদ্ধান্ত?’ 

—‘শোন আমরা ঠিক করেছি তোকে একটা বিয়ে দেব। বাড়িতে একটা ফুটফুটে সুন্দর বৌ আসবে। আমাদের এত বড় বাড়িটা সারাদিন খালি পড়ে থাকে…’ 

—‘আহ মা থামো তো! মানে যত সব আজাইরা চিন্তা ভাবনা তোমাদের। এসব কথা রাখো এখন।’ 

—‘আজাইরা চিন্তা হবে কেন? মেয়ে আমাদের দেখা আছে। খুবই সুন্দর, শিক্ষিত স্মার্ট মেয়ে।’ 

—‘উফ আম্মা, আমি রাখি। পরে কথা বলবো।’ 

ফোন রেখে সামি একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বন্ধুদের বললো, ‘লিসেন, আমাদের একটু জরুরি কথা আছে তোদের সাথে। বেটার হয় আমরা যদি কোথাও একটু বসি সবাই মিলে।’ 

—‘বসবি কোথায়? এখানে তো কোনো কফিশপ টপ আছে বলে মনে হচ্ছেনা।’ আকাশ বললো। 

—‘আরে কফিশপ লাগবেনা। ঘাস টাস দেইখা বইসা পড়।’ রুদ্র বললো। 

তার কথা মতোই কাজ হল। নদীর কাছেই সবুজ আগাছা ওয়ালা মাটির ওপর গোল হয়ে বসলো ওরা। গ্রামের লোকজনের আনাগোনা আছে বেড়েছে এখন এদিকটায়। এক ঝাঁক বাচ্চা ছেলে দল বেঁধে নদীতে নেমেছে। দেখা গেলো চৈনিক দলটা হেঁটে হেঁটে ব্রিজের ওপর উঠে গেছে। ফটোসেশন করছে। 

বন্ধুরা সবাই অখন্ড মনোযোগের সাথে তাকিয়ে আছে সামির দিকে। সামি বিব্রত বোধ করছে। কোথেকে যেন রাজ্যের জড়তা এসে ভর করেছে তার মধ্যে। বিভা ওর মুখ পানে চেয়ে আছে ড্যাবড্যাবে চোখে। সেই চোখে চোখ পড়তেই সামির বুকটা কেমন খালি খালি লাগতে লাগলো। মনে পড়লো হৃদির বলা কথাটা, তোর ভালোবাসা যদি সত্য হয় তাহলে বিভা তোকে ভুল বুঝবেনা। নিশ্চিত থাক।’ বিভা যদি তাকে ভুল বোঝে? কী হবে তখন? কী করবে সামি? 

বিভাই কথা বললো প্রথমে, ‘সমস্যা কী?এমন চোরের মত করতেছিস কেন? কী চুরি করছস?’ 

হৃদি মুখ নিচু করে বসে মাটির ওপর গজিয়ে থাকা ঘাস ছিঁড়ছিল। চোখমুখের ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ভেতরটা অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে আছে তার। 

আকাশ ধমকে উঠে বলল, ‘কথা কস না ক্যান?’ 

সামি বন্ধুদের কারো চোখে চোখে তাকালনা। অন্যদিকে চোখ রেখে স্তিমিত ভাবে বলল, ‘কাহিনী হচ্ছে… মানে… যেদিন আমরা আসলাম এখানে, সেদিনের ঘটনা। সন্ধ্যাবেলা আমি বিভা রে এস এম এস করছিলাম যে একটু বাইরে ইয়ার্ডে আয় তোর সাথে কথা আছে। বিভা আমারে এসএমএস ব্যাক করছিল যে ওয়েইট কর, আসতেছি।’ 

বিভার চোখমুখ উৎকণ্ঠায় ফেটে পড়ছে। সে বুঝতে পারছেনা সেদিন কী এমন ঘটনা ঘটতে পারে যার কারণে সামি এহেন ব্যাখ্যাতীত আশ্চর্য আচরণ করছে। সে নিশ্বাস বন্ধ করে সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে শুনতে লাগল সামির কথা। 

সামি এলোমেলো ভাবে বলে চলেছে, ‘তো আই একচুয়েলি ওয়েইটেড ফর সো লং, বাট শী ডিড’ন্ট শো আপ। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ওর দেরি দেইখা। দেন সাডেনলি আমি অন্ধকারে দেখলাম যে বিভা আসছে।’ 

বন্ধুরা সবাই একবার হার্টবিট মিস করলো। কারণ এই ঘটনা মোটামুটি সবার জানা যে বিভা সেই সন্ধ্যায় সামির সাথে উঠোনে দেখা করতে যায়নি। তাহলে বিভা সেজে কে গিয়েছিল সামির কাছে? 

সামি একটি প্রলম্বিত নিশ্বাস নিলো, বললো, ‘আমি দেখলাম বিভা অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসতেছে। শাড়ি পরা, চুল খোলা,এমন কি বিভার চুলের ঘ্রাণটাও বাতাসে উড়ে উড়ে আমার নাকে এসে ধাক্কা খাচ্ছিলো। তো আমি… আমি…’ সামি আটকে গেল। দিশাহারা হয়ে হৃদিকে বললো, ‘হৃদি, ক্যান ইউ প্লিজ হেল্প মি আউট? আমি বলতে পারতেছিনা।’ 

হৃদি এবার মুখ তুললো। কারো দিকে না তাকিয়ে হড়বড় করে বলে ফেললো, ‘কাহিনী হচ্ছে যে সামি বিভা মনে করে আমারে কিস করছে।’ 

অমৃতার মুখ থেকে তাৎক্ষণিক ভাবে একটি আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসলো। রুদ্র স্তম্ভিত ভাবে উচ্চারণ করলো শব্দ গুলো, ‘ইউ গট টু বি কিডিং মি!’ 

বিভার মুখ সাদা। দুচোখে বিশ্বের বিস্ময়। সে যেন এই ধরাধামে নেই।

হৃদি বলল, ‘বিভার জন্য সামি একটা রিং কিনে আনছিল, গিফট। তো ও সেই রিংটা আমার হাতে পরায় দিছিল বিভা মনে করে।’ 

বেশ কিছু মুহূর্ত কেউ কোন কথা বলতে পারলনা। একটা স্তম্ভিত, বিকৃত এবং অস্বস্তিকর বাতাস বইছিল ছয়জনের মধ্যে। বেশ অনেকক্ষণ পর আকাশ কড়া ভাবে বলে উঠলো, ‘এটার মানে কী? আমার মাথায় কিছুই ঢুকতেসেনা। মানে অন্ধকারে তুই কেন হৃদিকে বিভা মনে করবি? তুই কি টাল ছিলি শালা?’ 

অমৃতা একবার বিভার দিকে আড়চোখে চেয়ে নিয়ে আকাশের হাতে একটা আলতো চাপ দিয়ে পাশকাটানো গলায় বলল, ‘হতেই পারে। এরকম ভুল হতেই পারে। হৃদিও তো শাড়ি পরে ছিল। আর ওদের দুজনের ফিজিক্যাল স্ট্রাকচার একই রকম। আমিও মাঝে মাঝে দুজনকে পেছন থেকে দেখলে বুঝতে পারিনা কে বিভা, কে হৃদি।’ 

আকাশ অমৃতার ইশারার মর্মার্থ বুঝলোনা। সে বলেই চললো, ‘না এটা আমি মানতে পারলাম না। এর আগের বার কক্সবাজারে বিভা, এইবার হৃদি। মানে তুই আমাদের সব মেয়েদের সাথে এইসব করতে পারিস না। তামাশা নাকি?’ 

সামি এবার আকাশের চোখে চোখে চাইলো, ‘তামাশা মানে? তোর কি ধারণা আমি ইচ্ছা করে করছি?’ 

রুদ্র হাত তুলে বললো, ‘আচ্ছা থামো তোমরা। যা হবার হয়ে গেছে। এখন এটা নিয়ে ত্যানা প্যাঁচায়ে লাভ নাই।’ 

আকাশ থামলোনা, ‘না যা হবার হয়ে গেছে বললে তো হবেনা। নেক্সট টাইম কোন ট্যুরে গিয়া দেখা যাবে আবার কিছু কইরা বসবে। এইসব রিস্কি মানুষজন নিয়ে তো চলা যায়না ভাই।’ 

—’তুই এসব কী বলতেছিস? আমাকে তোর এতটা ফালতু মনে হয়?’ ক্ষুব্ধ অথচ ব্যথিত কণ্ঠে বলল সামি। 

—’তুই শালা ফালতুর চেয়েও বড় ফালতু। প্রথমে বিভা, এখন হৃদি। পাইছিসটা কী তুই?’ 

সামি মরিয়া হয়ে বললো, ‘আকাশ তুই আমাকে ভুল বুঝতেছিস এইভাবে? বিভার সাথে হৃদিকে কেন মিলাচ্ছিস? বিভাকে আমি ভালোবাসি। আর হৃদির ব্যাপারটা একটা ভুল ছিল! আ গ্রেভ মিস্টেক।’ 

‘আ গ্রেভ মিস্টেক’ কথাটা হৃদির কানে বাজলো ঝন ঝন করে, বুকে এসে লাগলো ধক করে! 

বিভা এতক্ষণে মুখ খুললো। সামির চোখের উপর কাচের মতো স্বচ্ছ দৃষ্টি রেখে হিম হিম জাড় কণ্ঠে বললো, ‘তোর কি হৃদির প্রতি কোনো ফিলিংস আছে?’ 

সামি সজোরে মাথা নেড়ে বললো, ‘জীবনেও না! আমি তো তোকে ভালোবাসি বিভা! প্লিজ তুই আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা কর।’ 

বিভা এবার হৃদির দিকে তাকাল, ‘হৃদি, তোর কি কোনো ফিলিংস আছে আমার বয়ফ্রেন্ডের জন্য?’ 

হৃদি নত মুখে বলল, ‘না।’ 

সামি উঠে আসল বিভার কাছে। হাঁটু গেড়ে বসল ওর পাশে। তারপর ওর দুটি হাত নিজের হাতে নিয়ে ভারী করুণ গলায় বললো, ‘বিভা প্লিজ, এসব আজেবাজে চিন্তা মাথায় আনিস না। তুই জানিস না তুই আমার কাছে কী?’

বিভা সামির চোখের দিকে না তাকিয়ে বললো, ‘তুই সত্যি বলছিস? তুই আসলেই হৃদির জন্য কিছু ফিল করিস না?’ 

—‘আল্লাহর কসম! তুই বললে আমি হৃদির সাথে জীবনে আর কোনো দিন কোনো কথাই বলবোনা।’ 

বিভা সামির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের বললো, ‘আমি বাসায় যাচ্ছি। তোরা ইচ্ছা হলে আসতে পারিস।’ 

বিভা চলে যাবার পর কেউ কোনো কথা বললোনা অনেকটা ক্ষণ। সবাই মূর্তির মতো বসে রইল। একটা সময় হৃদি হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা সামি, তুই এটা কী বললি? বিভা বললে তুই আমার সাথে জীবনে কোনো দিন কোনো কথা বলবিনা? এটার মানে কী? তোর কাছে প্রেমটাই সব? ফ্রেন্ড কিছুনা?’ 

সামি মাথায় হাত দিয়ে খেদোক্তি করে উঠল, ‘উফ আল্লাহ! মাফ কর আমারে তোরা। আমি কি সেটা বলছি নাকি?’ 

—‘হ্যাঁ সেটাই তো বলছিস। ভুলটা তোর ছিল, তাইনা? শাস্তি কেন আমাকে পেতে হচ্ছে? বিভা কেন আমাকে ভুল বুঝছে?তুই কেন বিভার জন্য আমাকে ছাড়বি? আমার সাথেই কেন এসব হচ্ছে?’ 

অমৃতা বলল,’শোন, একটা মিস্টেক হয়ে গেছে এখন তো কিছু করার নাই তাইনা? সামি শোন, তুই বিভার কাছে যা। ওর সাথে গিয়ে কথা বল। আর হৃদি তুই মাইন্ড খাচ্ছিস কেন শুধু শুধু? সামি তো ঐটা এমনিই বলছে বিভারে ম্যানেজ করার জন্য। বুঝতে হবে তো।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *