বৃষ্টিমহল ২.১০

১০

বিকেলের একটু আগেই বেরিয়ে গেল অমৃতা চেম্বার থেকে। চেম্বারের শত বছরের পুরোনো ক্ষয়া সিঁড়ি ডিঙিয়ে ইংলিশ রোডের এঁদো গলিতে নামতেই চোখে পড়লো গলির মুখে একটি পাজেরো গাড়ি দাঁড়ানো। অমৃতা গাড়িটা চেনে। সামিদের অফিসের গাড়ি। গাড়িটি দেখতে পেয়ে তার চেহারার রঙের কোন পরিবর্তন হলো না। শুধু ভ্রু দুটি একটু কুঁচকে গেল। সে ভয় খাবার মেয়ে না। তার ভেতরটা শক্ত। যে কোনো পরিস্থিতি বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবেলা কী করে করতে হয় তা তার জানা আছে। 

তার হাতে কালো গাউন। গায়ে সাদা শার্ট। কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ। চোখে রোদ চশমা। হাঁটার ভঙ্গিতে একটি ধারালো ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ। সে নির্বিকার ভাবে হেঁটে গলি থেকে বেরিয়ে আসলো। গাড়িটি রাখা ছিল গলির মুখোমুখি। অমৃতা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে একটি রিকশা ডাকলো হাত নেড়ে। মিনিটের মধ্যেই দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত লোক তাকে দুপাশ থেকে ঘিরে ফেললো। তাদের দুজনেরই মাথায় ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস। স্বাস্থ্য চমৎকার। একজন বললো, ‘ম্যাডাম, আপনাকে আমাদের সাথে একটু আসতে হবে।’ 

অমৃতা রোদ চশমা খুলে হাতে নিলো, ধারালো ভাবে বললো, ‘কেন? কে আপনারা?’ 

লোকটি ভদ্রতা বজায় রেখেই বললো, ‘আমাদেরকে বলা হয়েছে আমরা যেন আপনাকে হক সাহেবের অফিসে নিয়ে যাই।’ 

অমৃতা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘আর যদি আমি যেতে না চাই? জোর করবেন আমাকে?’ 

এ কথা শুনে প্রথম লোকটি একটু বিচিত্র হাসলো। দ্বিতীয় লোকটি বললো, ‘সেরকমই নির্দেশ আছে।’ 

—‘তাই না? ঠিক আছে। যাবোনা আমি। দেখি কী করে আপনারা আমাকে নিয়ে যান। 

কথাটা বলে অমৃতা আর কোন দিকে না তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলো। পেছন থেকে লোকদুটোর একজন বলে উঠলো, ‘ম্যাডাম, স্যারের সাথে দেখাটা করে ফেললে কিন্তু আপনার আর কোন ঝামেলার সম্ভাবনা নেই। না হলে আপনার ক্যারিয়ার সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। আপনার হাই কোর্টের লাইসেন্স কিন্তু এখনো হয়নি। আর বর্তমানে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট পদে যিনি নিয়োজিত আছেন তিনি স্যারের খুব ঘনিষ্ট একজন।’ 

অমৃতা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আপনাদের কি ধারণা আপনাদের স্যার ইচ্ছা করলেই সব করতে পারে? আমি হাই কোর্টে প্র্যাকটিস করব কি করব না তা এখন উনি ঠিক করে দেবেন?’ 

অমৃতার গায়ের চামড়ায় এবার শুয়োপোকা কামড়াতে শুরু করেছে। রাগে দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। সে গটগট করে হেঁটে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল, মুখে বলল, ‘চলেন, দেখি আপনাদের স্যার আমার কাছে কী চায়।’ 

সামিদের অফিস অর্থাৎ হক এন্টারপ্রাইজে অমৃতার এই প্রথম আসা নয়। এর আগে বেশ কয়েকবার সামির সাথে সে এসেছে এখানে। কিন্তু রিসিপশনেই বসে থাকা হয়েছে প্রতি বার। সামি বন্ধুদের নিচে বসিয়ে রেখে ওপর তলায় বাবার সাথে দেখা করতে গেছে। প্রতি বারই এসেছে সে বাপের কাছ থেকে টাকা চাইতে। বন্ধুরা রিসিপশনের লবিতে বসে তার ফিরে আসার অপেক্ষা করেছে। আজকে রিসিপশনে নয়। অমৃতাকে সরাসরি লিফটে করে ওপরে নিয়ে আসা হল। অফিসটি বেশ আধুনিক সাজসজ্জায় সজ্জিত। সাদা টাইলসের ঝকঝকে মেঝে। সিলিং থেকে ঝুলছে বিশাল বড় বড় ঝাড়বাতি। পরিপূর্ণ ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। লোকদুটো সামির আব্বার ঘর পর্যন্ত অমৃতাকে রীতিমত পাহারা দিয়ে নিয়ে আসলো। 

হক ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। পরনে অফ হোয়াইট রঙের ফুল হাত শার্ট, কালো টাই, কালো প্যান্ট। তার ঠিক পেছনেই একটি থাই এলুমিনিয়াম গ্লাসের প্রশস্ত জানালা। জানালায় পর্দা নেই। কাচের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক আর পিঙ্গল আকাশ। জানালা গেলে শেষ দুপুরের হলদে আলো এসে ছড়িয়ে গেছে সারা ঘরময়। সূর্যের আলোতেই ঘরটা বেশ ফকফকে। কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন হয়নি। 

ঘরের মাঝখানে একটি চওড়া কাঠের টেবিল। টেবিলের ওপর মোটা কাঁচ বসানো। দুটা ল্যাপটপ, একটি ট্যাব এবং অগণিত ফাইলপত্রে বোঝাই হয়ে আছে টেবিলখানা। ঘরের দুপাশের দেয়াল ঘেঁষে বসানো হয়েছে দামি সোফা সেট। মেঝেতে কালো আর সাদা রঙ মেশানো কার্পেট। অমৃতাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে লোক দুজন বেরিয়ে গেল। হক নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসলেন। ডান হাতের কনুই টেবিলে ঠেকিয়ে, চিবুকে হাত রেখে, অমৃতার দিকে চাইলেন তিনি কয়েক সেকেন্ডের জন্য, শীতল চোখে। মেয়েটিকে তিনি নিজের বাড়িতে বহুবার দেখেছেন কিন্তু সামনাসামনি কখনও কথা হয়নি। অমৃতার মুখ তখন রুদ্ধ রোষে জ্বলছে অগ্নির ন্যায়। তার নাকের পাটা ফোলা। ফর্সা গাল টকটকে লাল। 

হক বললেন, ‘বসো।’ 

—‘কেন ডেকেছেন?’ অনুচ্চ অথচ রাগে থমথম করা স্বরে প্রশ্ন করলো অমৃতা। 

হক সামনে দাঁড়ানো একরোখা জেদি মেয়েটির দিকে সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। এমন গোঁয়ার মেয়ে তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখেননি। তার একমাত্র পুত্রের খুব কাছের এই বন্ধুটি যে একজন নামকরা বেয়াদব সে বিষয়ে অবশ্য তিনি পূর্ব থেকেই অবগত ছিলেন। তবুও আজকে তার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চাইছেনা। 

তিনি যতটা সম্ভব শান্ত ভাবে বলার চেষ্টা করলেন ‘বসো। তারপর বলছি কেন ডেকেছি। 

অমৃতা ল্যাপটপের ব্যাগ টেবিলের ওপর রাখলো। হকের দিকে ক্রুর দৃষ্টিটা ছুঁড়তে ছুঁড়তেই বসলো চেয়ারে। 

হক অমৃতার চোখে চোখ রেখে নিজের মুখের ছিটে ছিটে দাড়ি হাতড়াতে হাতড়াতে কুশলী কণ্ঠে বললেন, ‘অমৃতা চৌধুরী, আসল নাম নূরে নাজনিন নিপা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে এল এল বি, এল এল এম…’

মাঝপথে অমৃতা হাত তুলে থামিয়ে দিল তাকে। একদম পেশাদার উকিলের গলায় বলে উঠলো, ‘আরে রাখেন রাখেন, এইসব সবাই জানে। এসব বলে আপনি আমাকে ইমপ্রেস করতে পারবেন না। অন্য কিছু বলেন।’ 

হক থতমত খেলেন। মেয়েটা কি একটু বেশি স্মার্ট? বেশি ড্যাম কেয়ার? একেবারে পাড়ার মাস্তান গোছের ড্যাম কেয়ার? এবার বিস্ময় কেটে গিয়ে খুব দ্রুত তার শরীরের কোষে কোষে রাগের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি একটা বড় নিশ্বাস চাপলেন। যে করেই হোক তার ছেলেকে এই মেয়েটার কাছ থেকে দূরে সরাতে হবে। এনাফ ইজ এনাফ। আজকের পর থেকে তিনি সামিকে আর কোনো ভাবেই এই বখাটে দলটার সাথে মিশতে দেবেন না। 

—‘তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্য কিছু বলা হয়নি। এটা জাস্ট একটা ইন্ট্রোডাকশন ছিল।’ 

—‘আরে রাখেন আপনার ইন্ট্রোডাকশন। আসল কথা বলেন। সময় নাই আমার। যা বলবেন ফটাফট বইলা ফ্যালেন।’ 

হক এ পর্যায়ে অপমানিত বোধ করলেন। থমথমে রাগে তার মুখখানা ছাই রঙা হয়ে গেল। মেয়েটি তার চোখে চোখ রেখে উদ্ধত ভাবে কথা বলছে। তার সাথে খুব কম লোকই এমন চড়া গলায় কথা বলার সাহস পায়। তিনি শুধুমাত্র এ দেশের প্রথম শ্রেণীর একজন ধনি এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই নন, বরং একজন দক্ষ রাজনীতিবিদও বটে। সমাজে পরিপূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত। তার সফলতা অবিমিশ্র, নির্জলা এবং নিখাদ। একটা পুঁচকে মেয়ে তার সামনে গলা উঁচিয়ে কথা বলছে এ ঘটনা অবিশ্বাস্য। 

—‘সকালে কেন এসেছিলে আমার বাড়ি?’ গমগমে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন হক। 

—‘আপনি নাকি আমাদের ইন্ডিয়া যেতে দেবেন না?’ প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করে অমৃতা।

—‘ঠিক শুনেছ।’ 

—‘কিন্তু কেন? আপনার ছেলে এখন প্রাপ্তবয়স্ক। আপনি নিজের ইচ্ছা কোনো ভাবেই আর তার ওপরে চাপিয়ে দিতে পারেন না।’ 

হকের তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয় অমৃতার দুর্দমনীয়, গোঁয়ার মুখখানার ওপরেই নিবদ্ধ ছিল। অমৃতার মাত্র বলা কথাটা তাঁর কপালে একটি অতিরিক্ত ভাঁজের সৃষ্টি করলো। তিনি কঠিন ভাবে বললেন, ‘আমার ছেলেকে আমি কীভাবে ট্রিট করবো তা তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে?’ 

—‘তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু এতে এত অপমানিত বোধ করার কী আছে? শেখার কোনো বয়স নেই!’ 

—‘তুমি কিন্তু সীমা অতিক্রম করছ। আমি তোমার বন্ধুর বাবা। তোমার উচিত আমার প্রতি নূন্যতম সম্মান রেখে কথা বলা। আদব কায়দা কিছুই কি শেখায়নি বাবা মা?’ 

অমৃতা ঠোঁট টেনে হাসলো, ‘এতকাল বন্ধুর বাবা হিসেবে আদবকায়দা দেখাতে গিয়েই আপনাকে কখনো কিছু বলিনি। কিন্তু এর মানে এই না যে আপনি যা ইচ্ছে তা করে যাবেন। গোটা দেশটা আপনার কেনা নয়। আদতে সীমা আপনি অতিক্রম করছেন। আমি না।’ 

—‘আমি সীমা অতিক্রম করছি?’ 

—‘ঠিক তাই।’ 

—‘তুমি যে সকাল বেলা মিডিয়ার লোকজন দের সামনে বলে আসলে যে আমার মুখোশ খুলে দেবে, সেই ব্যাপারটা আসলে কী ছিল? কিসের মুখোশ? আমি কি অপরাধী?’ 

—‘জি, আপনি অপরাধী।’

হক এবার কৌতূহল বোধ করলেন। মেয়েটির সাহসিকতা তাকে চমকে দিচ্ছে। ভেবেছিলেন একে ডেকে এনে কয়েকটা ধমক ধামক দিয়ে বিদায় করে দেবেন। তার ধারণা ছিল একটা রাম ধমক খেলে আর ক্যারিয়ার সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টির ভয় দেখালেই এই মেয়ে মুহূর্তের মাঝে সিধা হয়ে যাবে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা ক্যারিয়ার নিয়ে সর্বদাই একটু বেশি সতর্ক হয়। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে এই মেয়েটি আসলে পয়লা নম্বরের বদমাশ। লেখাপড়া, চাকরি বাকরি চুলোয় গেলেও বদমাইশি ছাড়বে না। 

—‘কী অপরাধ আমার?’ 

অমৃতা অকপট গলায় বললো, ‘আপনি নিজেকে সুপার হিরো মনে করেন। কিন্তু আসলে আপনি একটা জিরো।’ 

—‘জিরো? আমি জিরো?’ 

—‘ঠিক তাই। আপনি ভেবেছেন আপনি না চাইলে আমরা দেশের বর্ডার ক্রস করতে পারবোনা, তাইনা?’ এটুকু বলে অমৃতা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তারপর বললো, ‘দেখে নেবো আপনার দৌড় কদ্দূর!’ 

হকের মুখটা বিস্ময়ে একটু হা হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটা সেকেন্ড খাবি খাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছ?’ 

—‘হ্যাঁ চ্যালেঞ্জ করছি।’ 

—‘তোমার মেয়ে অনেক বেশি সাহস। ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হোয়াট ইউ আর আপ এগেইন্সট। আমি চাইলেই তোমার অনেক বড়সর ক্ষতি করতে পারি।’ 

—‘আপনি এসবের কিছুই করবেন না। কারণ আমি যে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি তা সামি জানে। আজকের পর আমার যদি কোনো রকমের ক্ষতি হয়, তাহলে সামি আপনাকে ছেড়ে দেবেনা।’ 

—‘ব্ল্যাকমেইল করছ?’ 

—‘কিছুই করছিনা। জাস্ট বলছি আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দিন। প্লিজ আমাদের লাইফে দখল দেয়া বন্ধ করুন। অনেক করেছেন। এটা আমরা কেউ ভুলিনি যে শুধুমাত্র আপনার কারণেই বিভা দেশছাড়া হয়েছে।’ 

—‘এসব বোঝার মতো ম্যাচিউরিটি তোমার এখনো আসেনি। যাই হোক আমি কেন কী করেছি সেই কৈফিয়ৎ তোমার কাছে দেবার মতো সময় বা ইচ্ছে কোনোটিই আমার নেই। তুমি শুধু এটা শুনে রাখো যে আমি চাইনা আমার ছেলে তার প্রাক্তন প্রেমিকার স্বামীর বাড়ি যাক। আন্ডারস্টুড?’ 

অমৃতা একটু সময় চুপ করে রইল। স্বীকার করতে ইচ্ছে হয়না তার, তবুও এ কথা সত্য যে ইনার বাচনভঙ্গি সুন্দর, মার্জিত এবং ঝকঝকে। কথা শুনলে এক বিন্দুও বোঝা যায়না যে লোকটা ভেতরে ভেতরে একটা আস্ত শয়তান। 

—‘কেন এতো কীসের ভয়? আপনার কি ধারণা আপনার ছেলে বিভাকে ওর বরের সামনে থেকে তুলে নিয়ে আসবে?’ 

মেয়েটির চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে হকের হাতে পায়ে খিল ধরে যাচ্ছিল। এ কেমন মেয়ে জন্ম দিয়েছে এর বাবা মা? কিচ্ছু শেখায়নি? ছিঃ, তার নিজের মেয়ে হলে সকাল বিকাল থাপ্পড়ের ওপর রাখতো। 

—‘অনেক কিছুই হবার সম্ভাবনা আছে। বিভার বাবা মা কি ব্যাপারটা জানেন?’ রাগ চাপা দিয়ে বললে তিনি। 

অমৃতার চোখ মুখ এবার শক্ত হয়ে গেলো, ‘আপনি কি আবারো আগের বারের মতো কিছু ঘটাতে যাচ্ছেন? বিভার বাবাকে ব্যাপারটা জানাবেন বলে ঠিক করেছেন?’ 

—‘আর কোনো উপায় না থাকলে তাই তো করতে হবে!’ 

অমৃতা হাতের আঙুল উঁচিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বললো, ‘লিসেন, মিস্টার হক, খবরদার এই কাজটা আপনি করতে যাবেন না। ভীষণ ভীষণ খারাপ হবে কিন্তু বলে দিলাম।’ 

হক অমৃতার ওই জাঁদরেল মূর্তি দেখে এবার হেসে ফেললেন। সেদিনকার এক মেয়ে তাকে কিনা আজ আঙুল উঁচিয়ে শাসাচ্ছে! 

ওই হাসি দেখে অমৃতার রাগ আরও বেড়ে গেলো, সে দাঁত কিড়মিড় করে বললো, ‘হাসছেন কেন?’ 

হক হাসি চেপে বললেন, ‘কী করবে তুমি শুনি?’ 

অমৃতা কিছুক্ষণ শূন্য চোখে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে বললো, ‘আমি কিছুই করবো না। কেউ কিছু করবেনা। কিন্তু আপনি আপনার ছেলেকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবেন।’ 

হক থমকে গেলেন। হাসির রেখাটা ধীরে ধীরে মুছে গেলো তাঁর ঠোঁট থেকে। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ভাবে বললেন, ‘এর মানে কী?’ 

—‘সামি আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবেনা। ওকে ফিরে পাবার যে ক্ষীণ আশাটি আছে আপনার, এবার যদি কোনো ঝামেলা করেন তাহলে সেই আশাটুকুও আর থাকবেনা। আমি লিখে দিলাম।’ 

—‘ও কি এই ব্যাপারে কিছু বলেছে?’ 

—‘হ্যাঁ বলেছে।’ 

—‘কী বলেছে?’ 

—’বলেছে এবার যদি বিভার বাবা মা’কে কিছু জানানো হয় তাহলে সে আপনাকে ত্যাজ্য পিতা করবে।’ এই অংশটা অমৃতার বানানো। কিন্তু সে এত চমৎকার ভাবে মিথ্যাটা বললো যে হক সাহেব বিভ্রান্তি তে পড়ে গেলেন। 

একটু সময় গম্ভীর ভাবে তিনি কিছু একটা চিন্তা করে নিয়ে দৃঢ় গলায় বললেন, ‘আমাকে ত্যাজ্য পিতা করলে কোনো সমস্যা নেই। আমি যেকোনো মূল্যে আমার পুত্রের ভালো চাই। কোনো ভাবেই ওই মেয়ের বাড়িতে তাকে যেতে দেয়া যাবেনা।’ 

অমৃতা হুশ করে একটা দীর্ঘ হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, ‘ও গড, ইউ আর ইম্পসিবল।’ 

হক এবার আদেশ দেবার ঢঙে বললেন, – ‘ট্যুরটা ক্যানসেল কর। এই টাকায় তোমরা অন্য কোথাও গিয়ে ঘুরে এসো, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুর। আমি স্পনসর করব।’ 

অমৃতা শ্লেষের হাসি হাসে, ‘ঘুষ দিতে চাইছেন?’ 

হক আর না পেরে বলে ফেললেন কথাটা, ‘তুমি কি জানো যে, তুমি ভীষণ বেয়াদব একটা মেয়ে?’ 

—‘সবাই বলে, নতুন কিছু নয়। ন্যায়ের কথা বলতে গেলেই লোকে বেয়াদব বলে। যেন মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করার আরেক নাম আদব লেহাজ।’ 

—‘বেশি সাহস দেখতে এসোনা অমৃতা। তোমার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।’ 

—‘আপনি কি ভেবেছেন আপনি চাইলেই আমার হাইকোর্টের সনদ নিয়ে ঘাপলা করতে পারবেন? করেই দেখুন না।’ 

—‘আমি কী করতে পারি,কতটুকু করতে পারি তার কোনো ধারণাই নেই তোমার।’ 

অমৃতা উঠে দাঁড়ালো। 

—‘করতে থাকুন। নো বডি কেয়ারস।’ 

১১

দূর পাহাড়ের দেশে বৃষ্টি নেমেছে। ধোঁয়াটে মেঘের গা থেকে নীরবে নিঃসরণ হচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল। দেখলে মনে হয় যেন আকাশটা খণ্ড খণ্ড হয়ে নেমে আসছে পাহাড়ের মাথায়। উত্তরের হাওয়া বুক ভরা হিম নিয়ে হু হু করে তেড়ে আসছে লোকালয়ের দিকে। এদিকের আকাশে এখন শুধুই মেঘ, বৃষ্টি নেই। বিভা অবাক চোখ মেলে দেখছিলো বৃষ্টিতে আবছা হওয়া পাহাড়ের মাথা। আজ বিকেলটায় পুরো বাড়িতে সে একদম একা। দূর্গা গেছে বাজারে। বলেছে ঘন্টা খানেকের ভেতরেই ফিরে আসবে। বিভার ইচ্ছে ছিল আশপাশটা ঘুরে দেখবে। কিন্তু আকাশের যা অবস্থা। যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একলা একলা এই গাঁও গেরামে ঘুরে বেড়ানো ঠিক হবেনা ভেবে আর বেরোলোনা। বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল সে। বাতাসে উড়ছিল তার খোলা চুল। 

হাওয়া ভারী ঠান্ডা। চাদর গায়ে জড়িয়েও তেমন একটা লাভ হচ্ছেনা। কাছেই কোথাও একটা ঘুঘু ডাকছে। মাথার ওপর টালির ছাদের ফাঁকে ফাঁকে কয়েক জোড়া পায়রা ক্রমাগত বাকবাকুম করছে। প্রকৃতির যে এতো রকম নিজস্ব শব্দ আছে বিভা তা এর আগে কখনো টের পায়নি। টের পাওয়ার মতো অবসরও বুঝি ছিলোনা তার। জীবনে কত জায়গায় বেড়াতে গেছে। কিন্তু প্রতিবারই ছুটির দিনগুলো কেটেছে হৈহুল্লোড় করে। একলা চুপটি করে বসে প্রকৃতির রূপ দেখার অবকাশ ছিলনা কোথাও। এবার জীবনে প্রথম বারের মতো উপলব্ধি করলো সে, প্রকৃতিকে বুঝতে হলে, জানতে হলে, সম্পূর্ণ ভাবে অনুভব করতে হলে আলাদা ভাবে সময় দিতে হয়। একান্তে কিছুটাক্ষণ তার সাথে কাটাতে হয়। যে সময়টুকুতে অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি থাকবেনা। শুধু একলা একটা মানুষ আর এই রূপবতী পৃথিবী। বিভা এখন জানে যে, এই বিশ্ব চরাচরও অবিরাম অজগ্র কথা বলে। সেই কথাটুকু, ভাষাটুকু বোঝবার মতো মন থাকতে হয় শুধু। বিভার এই বুঝদার মনটা আগে কোথায় ছিল কে জানে! নিজের ভেতরটাকে সে নতুন ভাবে আবিষ্কার করছে ধীরে ধীরে এত কাল বাদে এই বন পাহাড়ের দেশে এসে! 

হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখে সে চমকে উঠলো।সবুজ মাঠের পশ্চিম কোণে, পিটিস ঝোপের কাছে একটা ময়ূর নীল সাদা পেখম তুলে দাঁড়িয়ে আছে নাচের ভঙ্গিতে। কী সুন্দর তার পাখনা দুটি! রাণীর মতো মুকুট পরে পাখনা ছড়িয়ে যেন আসন্ন বৃষ্টিকে বরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। ময়ূর নাচ দেখে সেই মেঘলা মন কেমন করা একলা বিকেলটায় বিভারও অনেক দিন বাদে খুব নাচতে ইচ্ছে হল। সময় নষ্ট না করে ঘরের ভেতর দৌড়ে গিয়ে আলমারি থেকে ঘুঙুর বের করলো সে। পরলো পায়ে। তারপর ঝুম ঝুম শব্দ তুলে ঘরের মধ্যেই কয়েক পাক ঘুরে নিলো। জানালা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো হাওয়া। ল্যাপটপে ছেড়ে দিল গান। চাদর ফেলে রেখে হালকা গোলাপি সুতির শাড়ির আঁচলটা কোমরে নিল গুঁজে। 

তারপর তার সারা শরীর জুড়ে ধীরে ধীরে নেমে আসল নাচের নানা মুদ্রা। 

‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর নমো নম, নমো নম, নমো নম।
 শ্রাবণ-মেঘে নাচে নটবর রমঝম রমঝম, ঝমঝম…. 

বাইরে মেঘের ডাক। বৃষ্টির ঘ্রাণ। আর সারা ঘরময় গানের সুর আর ঘুঙুরের রূমঝুম। বিভা যেন আর তার মধ্যে নেই। এই মেঘলা রুপো রঙের বিকেল যেন এক অচেনা বলিষ্ঠ চিত্তহারী পুরুষের ন্যায় বশ করেছে তাকে। নৃত্যই এখন তার বশীভূত ভালোবাসা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম, একমাত্র ভাষা। জীবনে সে শুধু এই একটি কাজই ভালোবেসে করেছে। নাচের মাঝেই বারে বারে নিজের হারানো সত্তাকে খুঁজে পেয়েছে। 

দরজায় একটা ছায়ামূর্তি পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। কতক্ষণ কে জানে। গান শেষ হবার সাথে সাথে বিভা নাচ থামালো। তার চুল ঘামে লেপ্টে আছে কপালের সাথে। বুকের কাছ থেকে শাড়ির আঁচল সরে গেছে অনেক খানি। ফোঁস ফোঁস করে পড়ছে নিশ্বাস। কয়েকটা মুহূর্ত পর বিভা ধাতস্থ হল। কোমরে গোঁজা শাড়ির আঁচল খুলে নিয়ে কপালের আর নাকের ঘাম মুছতে মুছতে বললো, ‘আপনি কখন এলেন?’ 

অভিজিৎ নিষ্পলক চেয়ে ছিল বিভার দিকে। বাংলাদেশে এক গ্রীষ্মের বিকেলে এই মেয়েটির নাচ দেখার পর সে সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। সে রাতে তার বুকের মাঝে ধিকিধিকি অঙ্গার জ্বলেছিল। ভেতরটায় এমন অদ্ভুত কম্পন অন্য কোনো নারীর জন্য এর আগে কোনো দিন অনুভব করেনি সে। আজকে সেই নারী তার কতটা কাছে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। কিন্তু ছোঁবে কী করে? এর কোনো কিছুই যে তার নয়। এ নারীর ভেতর বাহির সমস্তটাই অন্য একজনের দখলে। 

অভিজিৎ দরজার কাছ থেকে সরে এসে ঘরের ভেতরে ঢুকলো। গলায় বাঁধা টাই খুলতে খুলতে বললো, ‘আজকে কি কোন বিশেষ দিন?’ 

বিভা একটু লজ্জা পাওয়া গলায় বললো, ‘না, কোনো বিশেষ দিন নয়।’

—‘ও আচ্ছা। কিন্তু আমার কাছে একটা খবর আছে, যে খবরটা শুনলে আপনার দিনটা প্রকৃত অর্থেই বিশেষ হয়ে উঠবে। আরো বেশি করে নাচতে মনে চাইবে।’ 

—‘কী খবর?’ 

—‘আপনার বাংলাদেশ যাবার টিকেট করে ফেলেছি। আগামী রবিবার ফ্লাইট। এইতো আর চারটা দিন পরেই।’ 

—‘তাই নাকি?’ বিভা বলে বিস্ময়ের গলায়। 

—‘হ্যাঁ তাই।’ 

—‘আপনার বাবা মাকে কী বলবেন?’ 

—‘ও নিয়ে আপনার অত ভাবতে হবেনা। আমি বলে দেব কিছু একটা।’ 

—‘আমাকে তাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন যে? মতলবটা কী? আবার বিয়ে শাদী করবেন নাকি?’ 

—এখনো সেসব নিয়ে কিছু ভাবা হয়নি।’ 

—‘তাহলে আমাকে বিদায় করার জন্য অত উঠে পড়ে নামলেন কেন? হ্যাঁ?’ 

অভিজিৎ বিভার দিকে তাকিয়ে অনুচ্চ অথচ শীতল গলায় বললো, ‘কেন আপনি যেতে চাইছেন না?’ 

বিভা অপ্রতিভ হল প্রশ্নটা শুনে। অপমানে লাল হয়ে বললো, ‘যেতে চাইবো না কেন? কী এমন মধু আছে এখানে?’ 

—‘নাকি ভাবছেন বাকি জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দেবেন। আমার বৌ সেজে থাকার অভিনয় করে যাবেন আর ওদিকে সারাদিন প্রেমিকের সাথে ফোনে কথা বলবেন। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙলনা।’ 

বিভার প্রতিমার মতো টানা চোখজোড়ায় অভিজিতের মাত্র বলা কথাটা এক গভীর বিষণ্নতার ছায়াপাত ঘটালো। সে একটু অপ্রস্তুত ভাবে বললো, ‘মোটেওনা।’ 

—‘দেখুন বিভা, রোজ রোজ আপনার বন্ধুবান্ধব আর প্রেমিক নিয়ে এসব বাড়াবাড়ি আমার আর ভালো লাগছেনা। আপনি এখানে আছেন কিন্তু আপনার মন সর্বদা পড়ে আছে বাংলাদেশে। চোখের সামনে এরকম একটা ভীষণ অসুখী, অস্বাভাবিক মানুষ দেখতে কার ভালো লাগে বলুন? আমার এসব আর সহ্য হচ্ছেনা। প্লিজ, আপনি আমাকে মুক্তি দিন।’ 

কেন কে জানে, বিভার চোখের কোণে দু ফোঁটা জল চিকচিক করে উঠলো হঠাৎ। সে চকিতে মুখ ঘুরিয়ে নিল, অস্ফুটে বললো, ‘ঠিক আছে।’ 

.

সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হল খুব দ্রুত। এয়ার টিকেট ক্যানসেল করে ট্রেনের টিকেট কাটল ওরা। ঠিক হল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেসে করে সোজা চলে যাবে নিউ জলপাইগুড়ি। সময় একটু বেশি লাগবে এ কথা ঠিক কিন্তু হক সাহেবের নজর এড়ানোর জন্য এর চেয়ে ভালো কোন পন্থা আপাতত আর নেই। 

ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত যাওয়াটাও একটা ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। হকের চরেরা সর্বত্র ওঁৎ পেতে আছে। রওয়ানা দেবার আগে ওরা সবাই জমায়েত হয়েছিল রুদ্রদের ফ্ল্যাটে। দেখা গেল অমৃতা নিউমার্কেট থেকে সস্তায় পাঁচজনের জন্য পাঁচটা বোরখা কিনে এনেছে। বোরখা দেখে আকাশ চোখ কপালে তুলে বললো, ‘মানে কী? এখন বোরখা পরে মেয়ে সাজতে হবে?’ 

—‘মেয়ে সাজার জন্য না, বোরখা পরবি নিজেকে আড়াল করার জন্য।’

—‘এইসব করতে পারবোনা।’ 

—‘না পারলে মর শালা। যারা বোরখা পরতে পারবে, আমার কথা শুনবে। শুধু মাত্র তারাই যাবে। বাদ বাকিরা পইড়া থাক এইখানে।’ বজ্রকণ্ঠে ঘোষনা দিল অমৃতা। 

সামি বললো, ‘মানে? বোরখা পরতে হবে কেন? অবস্থা কি এতই খারাপ? বাবা তোরে আসলে কী বলছে? একটু খুইলা বলবি আমারে? 

—‘তোমার আব্বার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। দেখা যাবে এই বাসার সামনেই লোক বসায় রাখছে। বের হবার সাথে সাথে ফলো করা শুরু করবে। আমাদের এমন ভাবে বাসা থেকে বের হতে হবে যেন কেউ আমাদের চিনতে না পারে। আর আমরা একসাথে পাঁচজন বের হবো না। আলাদা আলাদা ভাবে বের হব। মিট করবো একেবারে ট্রেনে উঠে।’ 

রুদ্র এবার হাততালি দিয়ে বলে উঠলো, ‘সাবাশ সাবাশ, এই না হলে উকিলের মগজ? দারুণ প্ল্যান মামা, দারুণ!’ 

সবার প্রথমে বের হবে সামি। সে বোরখা পরে নিয়েছে। আকাশ আর রুদ্রও পরেছে। সারা গা জুড়ে কালো বোরখা আর মুখে নেকাব। শুধু চোখ দুটি ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যায়না। সামির উচ্চতা বেশি বিধায় তার বোরখাটা একটু ছোট হয়েছে। শরীরের সাথে লেগে আছে আঁটসাঁট ভাবে, আবার পায়ের দিকেও কিছুটা উপরে উঠে আছে। 

বোরখা পরে নেকাবে মুখ ঢেকে, হাতে গিটার নিয়ে রুদ্র পানসে গলায় বললো, 

—‘আচ্ছা যদি বাই এনি চান্স ধরা পইড়া যাই, তাহলে কী করবো? আমার গিটার দেখলেই তো লোকে আমারে সন্দেহ করব। জীবনে কোন বোরখা পরা মেয়েকে গিটার নিয়ে ঘুরতে দেখছিস?’ 

আকাশ নির্বিকার গলায় বললো, ‘ধরা পড়লে কী আর করবো? বলবো যে আমরা তো কিছুই জানিনা, সব অমৃতা ম্যাডাম জানে। একচুয়েলি আমাদের চিন্তার কিছু নাই। সামির বাপ ধরলে অমৃতারেই ধরবে। আমরা তো সিনেই নাই।’ বলে আকাশ ভারী নিশ্চিন্তের একটা প্রাণ জুড়ানো হাসি দিল। 

অমৃতা কথাটা খুব একটা পাত্তা দিলো না। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,’শোন, বের হওয়ার আগে এক কাপ চা খাইতে চাই, কে কে খাবি?’ 

হৃদি আর আকাশ হাত তুললো। অর্থাৎ তাদের চা চাই। বোরখা আর হিজাব পরিহিতা অমৃতাকে বেশ মেয়ে মেয়ে দেখাচ্ছিল। অমৃতা চলে যাবার পর রুদ্র আফসোসের গলায় বললো, 

—‘ধুর, এমনে হয়না। আমাদের তিনজনকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আমরা মেয়ে না। সামনে দ্যাখ কেমন সমান। যে কেউ বুঝবে আমরা জোর কইরা মেয়ে সাজছি।’ 

শুনে বন্ধুরা হো হো করে হেসে উঠলো। রুদ্র কিন্তু হাসলো না, ভারী চিন্তিত গলায় বললো, ‘হাসির কথা না, মামা, আমি সিরিয়াস। এমনে বাসা থেকে বাইর হইলে ধরা খামু শিওর।’ 

হৃদি বললো,’কেউ তোমার বুকের দিকে তাকাবেনা। বোরখা পইরা আবার শরীর দেখাইতে চাও। এতো খারাপ!’ 

রুদ্র আগের চাইতেও বেশি গম্ভীর গলায় আকাশ আর সামির দিকে চেয়ে বললো, ‘কাম অন গাইজ, অমৃতা হ্যাজ বুবস। উই ডোন্ট! শেইম অন আস!’ 

সেই মুহূর্তেই অমৃতার প্রবেশ ঘটলো ঘরে। সে সাপের মত ফোঁস করে উঠে বললো, ‘অমৃতা হ্যাজ হোয়াট?’ 

রুদ্র অমৃতার সেই রুদ্রমূর্তির সামনে পড়ে বেশ ভড়কে গেলো। চিঁ চিঁ করে বলে উঠল, ‘না কিছুনা। 

অমৃতা তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করতে লাগল রুদ্রকে। রুদ্র কাঁচুমাচু হয়ে আবার বললো, ‘কিছুনা বললাম তো!’ 

আকাশ ফোড়ন কাটলো, ‘আরে ও বলছে অমৃতা হ্যাজ বুদ্ধি। তোর বুদ্ধির প্রশংসা করতেছিলাম আমরা।’ 

রুদ্রও তাল মেলালো সঙ্গে সঙ্গে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বুদ্ধির কথাই হচ্ছিলো। তুই মামা একটা জিনিয়াস। আমাদের গর্ব। এইসব বলাবলি করতেছিলাম।’ 

হৃদি আর সামি ঠোঁট টিপে হাসছিল। অমৃতা আর কথা না বাড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে বললো, ‘আসো বের হওয়ার আগে সবাই মিলে একটা সেলফি তুলি। 

সামি অমৃতার হাত থেকে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে বললো, ‘আমারে দে, আমার হাত সবচেয়ে লম্বা। সেলফি ভালো তুলি আমি।’ 

বোরখা পরা পাঁচ বন্ধু ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি হল। তারপর চা খাওয়ার পালা শেষ হলে সবার আগে বাসা থেকে বের হল সামি। দরজার বাইরে পা রাখবার আগে সে নেকাবের আড়াল থেকে মেয়েদের মতো চিকন গলায় বললো, ‘হেয়ার স্টার্টস দ্যা ফানিমুন, উইশ মি লাক গাইজ!’ 

বন্ধুরা সব সমস্বরে বলে উঠলো, ‘উইশ ইউ আ ভেরি হ্যাপি ফানিমুন দোস্ত!’ 

কথা মতোই কাজ হল। সবাই স্বতন্ত্র ভাবে স্টেশনে গিয়ে পৌঁছুলো। হৃদি প্রথমে ভুল বগিতে উঠে পড়েছিল। লম্বা চওড়া এক বোরখা ওয়ালি মহিলাকে সে আকাশ মনে করে পেছন থেকে পিঠে থাপ্পড় মেরে বলে উঠেছিল, ‘ওই শালা, পাইছি তোরে! আল্লাহ বাঁচাইসে, আমি তো মনে করছিলাম ভুল জায়গায় আইসা পড়ছি।’ 

বোরখা ওয়ালি থাপ্পড় খেয়ে কোঁ কোঁ করে উঠলো। তার স্বামী পাশেই দাঁড়ানো ছিল। ঘটনা ঘটা মাত্র মোচ ওয়ালা চোয়াড়ে চেহারার স্বামী হৃদিতার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো। মনের হল এক্ষুণি সে হৃদিকে জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে। হৃদি জিভ কেটে, ‘ব্রাদার! খুব ভুল হয়ে গেছে। সরি, ভেরি সরি!’ বলে পড়িমরি করে জায়গাটা ছাড়লো। 

দশটা চল্লিশের ভেতরেই সবাই নির্দিষ্ট বগিতে উঠতে পারলো। বেঞ্চ গুলো মুখোমুখি। প্রতিটি বেঞ্চ আবার দোতলা। দেখা গেল সব গুলো সিট ঠিক ঠাক আছে শুধু আকাশেরটা বাদে। আকাশের সিটে এক মোটা সোটা ভদ্র মহিলা হাত পা ছড়িয়ে আয়েশ করে বসে আছেন। মহিলার নাকের ডগায় চশমা। গায়ে সাদা উলের চাদর। 

সবাই ওভার হেড কাউন্টারে মালপত্র গুছিয়ে রাখলো। ট্রেন ছাড়তে তখনো মিনিট দশেক সময় বাকি। বন্ধুরা যার যার জায়গায় বসে পড়েছে। কারো মুখে রা নেই। এই পর্যন্ত কোন ঝামেলা হয়নি ঠিক কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাচ্ছেনা। 

আকাশ গোবেচারার মত মোটা ভদ্রমহিলার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আর না পেরে চিকন গলায় বললো, ‘এক্সকিউজমি আন্টি।’ 

মহিলা চশমার ওপর দিয়ে চোখ তুলে তাকালো। আকাশ মেয়েলি গলাটা ধরে রেখেই বললো, ‘এটা আমার সিট। আপনি ভুল জায়গায় বসেছেন। আপনার সিট পাশের আইলে। 

ভদ্র মহিলা আকাশের সর্বাঙ্গে একবার নজর বুলালো। সেই সাথে লক্ষ্য করলো বোরখা পরা আরো চার মূর্তিকে। একটু সন্দিহান গলায় বললো, ‘আপনার সিট নাম্বার কত?’ 

আকাশ টিকেট হাতে নিয়ে সিট নম্বর বললো। ভদ্রমহিলা বললো, ‘ও আচ্ছা,উঠে যাচ্ছি। এমনিতেও এটা আমার সিট নয়। এটা আমার মেয়ের সিট। ও একটু ওয়াশরুমে গেছে তো তাই এখানে বসে ওর ব্যাগ পাহারা দিচ্ছি আমি।’ এটুকু বলে ভদ্র মহিলা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আবার বললেন, ‘ঐতো আমার মেয়ে এসে গেছে।’ 

ছিপছিপে, লম্বা, স্লিভলেস কামিজ পরা চমৎকার দেখতে মেয়েটার দিকে চোখ পড়া মাত্র আকাশ খুশিতে বাকবাকুম হয়ে তার নিজস্ব গলায় বলে উঠলো, ‘ও উনার সিট? আচ্ছা কোনো সমস্যা নেই। উনি বসুক। আমি পেছনের চেয়ারেই বসব।’ 

ভদ্রমহিলা চমকে উঠলেন। আকাশ থতমত খেয়ে মুহূর্তেই গলা পাল্টে মেয়ে হয়ে বললো, ‘না মানে, উনি এখানে বসতে পারেন কোনো সমস্যা নেই।’ 

ভদ্রমহিলা সন্দেহের চোখে আরেকবার ওদের পুরো দলটা দেখে নিয়ে মেয়েকে বললো, ‘উর্মিলা, তোর সিট ওপাশে, এদিকে নয়।’ বোঝা গেল মেয়েকে তিনি এই বিপদজনক দলের কাছাকাছি রাখতে চাইছেন না। 

বন্ধুরা সব কাঠ হয়ে বসে রইলো প্রায় মিনিট পাঁচেক সময়। এই পাঁচ মিনিট যেন পাঁচ যুগের চেয়েও দীর্ঘ। সময় কাটছেইনা। 

ট্রেনটা হুইসেল দিয়ে নড়ে চড়ে উঠতেই আকাশ তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠল। বোরখা খুলতে খুলতে অধৈর্য গলায় বলল, ‘অনেক হইছে। আর না। সামি! এত কিছুর পর তর বাপের কোন চ্যালা যদি আমার সামনে আসে আমি তাহলে এক কোপে তার মাথা দোফালা কইরা দিমু।’ 

আশেপাশের মানুষজন দৃশ্যটা অবাক চোখে দেখলো। পাশের আইলে বসা রূপবতী উর্মিলা এবং তার মায়ের চক্ষু তখন চড়কগাছ। হা হওয়া মুখ নিয়ে উর্মিলার মা বলে উঠল, ‘এ কী কান্ড! 

টেন ঝিকঝিক করে চলতে শুরু করেছে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে বন্ধুরা সব একে একে বোরখা খুলে ফেললো। দুশ্চিন্তা এবং ছদ্মবেশ মুক্ত হয়ে সবাই হৈ হৈ করে উঠলো আনন্দে। রুদ্র কোমর দুলিয়ে শুরু করলো নাচ। বাকিরা হাত তালি দিয়ে গাইতে থাকল, 

সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি 
নাচো তো দেখি 
সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি 
নাচো তো দেখি 
বালা নাচো তো দেখি 
বালা নাচো তো দেখি 

আশেপাশের লোকজন হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল ওদের দিকে। এমন পাগলের কান্ড তারা এর আগে কোনো দিন দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে। 

১২

‘আমি যারে বাসি ভালো
কাজলের চেয়েও কালো
হয়না যে তার তুলনা
দিলোনা দিলোনা 
নিলো মন দিলোনা 
এতো যে নিঠুর বন্ধু 
জানা ছিলোনা গো… 

রুদ্র গিটার বাজিয়ে গাইছিলো। রাত বারোটা। ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাস কামরায় হলদে একটা মরা আলো জ্বলছে। এসির শীতল বাতাসে চারপাশ কনকনে ঠাণ্ডা। বেশির ভাগ যাত্রী কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর পায়তারা করছে। কিন্তু এই ঘুমকাতুরে যাত্রীদের মধ্যেও কয়েকজন পাওয়া গেলো যারা কিনা সত্যিকার অর্থেই সুরের সমঝদার। বাজনার শব্দ শুনতে পেয়ে তারা নিজেদের জায়গা ছেড়ে পায়ে পায়ে এসে গানওয়ালার কাছে ভিড় করেছে। সংখ্যায় তারা পাঁচজন। দুজন নারী, তিনজন পুরুষ। বয়স তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে। নারী দুজনকে বসার জায়গা দেয়া হয়েছে। তারা রুদ্রর পাশে বসেছে। মুখোমুখি বেঞ্চেই পা তুলে একই কম্বলের তলায় চাপাচাপি করে বসেছে আকাশ, হৃদি, অমৃতা আর সামি। 

সবার মধ্যেই একটা ফূর্তির ভাব বিরাজ করছিল। পাশের আইলে বসে থাকা উর্মিলার মায়ের মুখেই ছিল শুধু রাজ্যের বিরক্তি। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে তিনি ট্রেন ছেড়ে নেমে যাবেন। এই কামরার ভেতরে তার যেন নিঃশ্বাসটা পর্যন্ত নিতে কষ্ট হচ্ছে। উর্মিলা মায়ের পাশের সিটে বসে ঘাড় বাড়িয়ে খানিক বাদে বাদে গান বাজনার দলটিকে দেখছে। তার চোখ মুখের ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে এই দলটির প্রতি তার ভেতরে একধরণের মুগ্ধতা কাজ করছে। মায়ের কারণে সেই মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটানো সম্ভব হচ্ছেনা। 

রুদ্রর ঢেউ খেলানো বাবড়ি চুলগুলো খোলা। গান গাওয়ার তালে তালে তার মাথা দুলছে। চোখ দুটি মুদিত। যেন সুরের সাধনায় গভীর ধ্যানমগ্ন কোনো ঋষি। সে মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে গিটারের তারে আঙুল চালাচ্ছে আর গাইছে, 

চুল কালো আঁখি কালো… কাজল কালো আরো…
কাজলের চেয়ে কালো কি বলতে কি কেউ পারো। 
আমি যারে বাসি ভালো, কাজলের চেয়েও কালো। 

হয়না যে তার তুলনা। 

দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ গুলি ট্রেনের ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে হাতে তালি দিয়ে তাল দিচ্ছে। গলা মিলাচ্ছে। গলা মিলাচ্ছে রুদ্রর পাশে বসে থাকা নারী দুজনও। মিনিট দুয়েকের মধ্যে আরো একজন মধ্যবয়স্ক লোক ভিড়ের মধ্যে এসে যোগ দিল। 

আকাশ হঠাৎ গায়ের কম্বল সরিয়ে লাফ দিয়ে উঠে নিজের প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করলো। এরপর রুদ্রর পায়ের কাছে মেঝেতে বিছিয়ে দিলো রুমাল খানা। মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে রুমালের ওপর রাখলো। বন্ধুদের বললো, ‘টাকা পয়সা কিছু দে, ফ্রি তে গান শুনবি শালা?’ 

ঘটনা দেখে গানের সমঝদার ব্যক্তিরা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। হৃদি মৃদু ধমকের সাথে বললো, ‘এই আকাশ, এসব কী ধরণের ফাইজলামি?’ 

সামি মুখে একটা তির্যক হাসি নিয়ে কম্বলের তলা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, ‘ফাইজলামির কী আছে? গান শুনে খুশি হয়ে যার যা দিতে ইচ্ছা করে দিয়ে দে, বেচারা এত কষ্ট করে গাইতাছে, মাগনা লাগে নাকি? হ্যাঁ? শ্রমের একটা মূল্য আছে না?’ 

সামিও পাঁচটাকার একটি কয়েন রাখলো রুমালের ওপর। তার দেখাদেখি দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকদের একজন এগিয়ে এসে দশ টাকার একটি নোট রাখলো। আকাশ খুশিতে গদগদ হয়ে বললো, ‘ইয়েস! দেশে গিয়াই চাকরিটা ছাইড়া দিমু। তারপর শুরু করব আমাদের নতুন বিজনেস। রুদ্র রাস্তায় রাস্তায় গিটার নিয়া গান গাইব আর আমি তার পাশে রুমাল ধইরা দাঁড়ায় পয়সা কালেক্ট করবো।’ 

সামি বললো, ‘তুই একা কেন? আমিও থাকবো তর সাথে। আমারও চাকরি করতে ইচ্ছা করেনা।’ 

আকাশ ঘাড়ত্যাড়া ভাবে বললো, ‘জি না মামা, এইসব হবেনা। শুধু আমি আর রুদ্র। যা টাকা কামামু দিন শ্যাষে দুই বন্ধু ভাগ বাটোয়ারা কইরা নিমু। তুই মাঝখান থিকা আইসা কাবাব মে হাড্ডি হইস না প্লিজ।’ 

দু তিন মিনিটের মধ্যেই শ্রোতাদের প্রত্যেকে এগিয়ে এসে রুমালের ওপর খুচরা টাকা রাখতে রাখলো। তা দেখে সামি আর আকাশ এই দুই বন্ধুর চোখ লোভী ডাকাতের মতো চক চক করে উঠলো। সামি এক হাত বাড়িয়ে আকাশের কাঁধ জড়িয়ে ধরে স্বপ্নালু গলায় বলে উঠলো, ‘অসাম আইডিয়া!দোস্ত আজকের পর থেকে আমাদের অভাবের দিন শ্যাষ।’ 

আকাশ নিজের কাঁধ থেকে সামির হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে মুখ ঝামটা মেরে বললো, ‘তুই ভাগ শালা, এসহোলের বাচ্চা। আমার বাড়া ভাতে ছাই দিতে আসছো তাইনা?এই বিজনেস হবে শুধু আমার আর রুদ্রের মইধ্যে।রুদ্রর শ্রম আর আমার মেধা এই দুইয়ের সংমিশ্রণে।’ 

হৃদি অমৃতাকে চাপা গলায় বললো, ‘দ্যাখ না, এই দুইটা কী রকম ফকিরের মত করতেছে! মানে মনে হইতাছে বস্তি থেইকা উইঠা আসছে। ছিঃ!’ 

অমৃতা বললো, ‘ওরা চিরকালই ফকির। সামিটার বাপের টাকা আছে বইলা এক কালে ওর মধ্যে একটা পশ ভাব ছিল। এখন তো বাপের টাকার গরম নাই, তাই ফকির হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। খেয়াল করে দেখিস ওর চেহারায়ও একটা ফকির ফকির ভাব চলে আসছে। এখন দুই ফকির মিলে ভিক্ষা করতে নামছে। এটাই বাকি ছিল।’ 

রুদ্রর চোখ তখনও বন্ধ। মত্ত হয়ে গাইছে সে,

‘বৃক্ষ সবুজ, তৃণ সবুজ, সবুজ টিয়া পাখি।
টিয়া পাখির চেয়ে সবুজ কি আছে কও দেখি। 
আমি যারে ভালো বাসি, টিয়ার চেয়েও সবুজ বেশি। 
বন্ধু রঙের বাসনা… 
দিলোনা দিলোনা, নিলো মন দিলোনা।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না গো।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না।’ 

গান শেষ করে চোখ খোলা মাত্র রুদ্র একটু চমকে উঠলো। গান গাওয়ার সময়টায় সে পুরোপুরি ডুবে যায়। টেরই পায়নি এত লোক এসে কখন ভিড় জমিয়েছে! করতালির শব্দে ট্রেইনের ঝিকঝিক ঢাকা পড়ে গেলো খানিকক্ষণের জন্য। শ্রোতাদের প্রত্যেকেই রুদ্রর গানের প্রশংসায় একাকার। 

মেঝেতে বিছানো রুমালের ওপর রাখা টাকাগুলো দেখে রুদ্র বলল, ‘এসব কী?’ 

আকাশ হাত নেড়ে, চোখে মুখে একটা গুরুগম্ভীর ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো, ‘এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবেনা। তুমি গান গেয়ে যাও। আরেকটা গান ধরো। ট্রেইনের সব মানুষ যেন এই জায়গায় চলে আসে তোমার গান শুনে এমন ভাবে গান গাও।’ 

এমন সময় অমৃতা উঠে দাঁড়িয়ে একটু উঁচু গলায় বললো, ‘শুনুন সবাই, প্লিজ আপনাদের পয়সাগুলো ফেরত নিয়ে নিন। আমাদের বন্ধু একটু মজা করেছে জাস্ট। পয়সা দিয়ে আমাদের কে ছোট করবেন না প্লিজ।’ 

আকাশকে দেখে মনে হল তার ইহজীবনের সমস্ত অর্জনের ওপর এই মাত্র কেউ পানি ঢেলে দিয়েছে। সে হাহাকার করে বলে উঠলো, কেন ফেরত নিবে?ভালোবেসে দেয়া উপহার কখনো…।’ 

কথাটা বলে শেষ করার আগেই আকাশের হঠাৎ চোখ পড়লো উর্মিলার সুন্দর চোখজোড়ার উপর। হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে সে আকাশের দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে আকাশ চকিতে সুর পাল্টে বললো, ‘না মানে, ঠিকই তো, আমরা তো মজাই করছিলাম। এসব খুচরা টাকা দিয়ে আমরা কী করবো? নেন ভাই সবাই যার যার টাকা ফেরত নিয়ে নিন।’ 

আকাশ নিজেই এবার পয়সা সমেত রুমালটা মেঝে থেকে দুহাতে তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর সামনে মেলে ধরলো, 

—‘নিন ভাই সবাই যার যার টাকা বুঝে নিন। 

এটুকু বলে সে উর্মিলার দিকে আড়চোখে তাকালো, তারপর উদার হাসি হেসে বললো, ‘নিয়ে নিন, নিয়ে নিন, আরো লাগলে বলবেন, আমি দেবো আপনাদের। টাকা পয়সা কোনো ব্যাপারই না!’ 

একজন ভদ্রলোক মুখ ঝামটা মেরে বললেন, ‘আরো লাগবে কেন? আর লাগলে আপনার থেকেই বা নেবো কেন? আপনি কে?’ 

অমৃতা এগিয়ে এসে বললো, ‘ভাই রাগ কইরেন না,আমার এই বন্ধুটা একটু পাগল কিসিমের। উল্টাপাল্টা কথা বলে।’ 

রুদ্রর গান শুনে আগুন্তুকরা যতটা প্রফুল্ল হয়ে এখানে পা রেখেছিল আকাশের আচরণে তার চেয়ে বেশি অপ্রসন্ন, বিষণ্ণ এবং রাগান্বিত হয়ে জায়গাটা ছাড়লো। আকাশ চোখ থেকে অগ্নি কণা বর্ষণ করতে করতে অমৃতাকে চাপা গলায় বললো, ‘তুই কি বললি? আমি পাগল কিসিমের? উল্টাপাল্টা কথা বলি?’ 

অমৃতা বেঞ্চের উপর বসলো, হাই তুলে নির্বিকার গলায় বললো, ‘বলিসই তো।’ 

সবাই যার যার জায়গায় ফেরত গেছে তখন। দুই আইলের মাঝখানের চলাচলের রাস্তায় কেউ দাঁড়িয়ে নেই। রুদ্রকে তখনও গাতক ভূতটা ছাড়েনি পুরোপুরি। সে নিবিষ্ট মনে গিটারে টুং টাং করে কী একটা সুর ভাঁজছিলো। জগৎ সংসারের সাথে এখন তার কোনো যোগ নেই। সে এখন অন্য ভূবনের বাসিন্দা। 

আকাশ অমৃতার মাথায় একটা গাট্টা দিয়ে বললো, 

—‘এরকম একটা কাজ তুই করতে পারলি? ওই মাইয়াটা আমার দিকে কী একটা লুক দিতেছিল! সেটিং কইরাই ফেলছিলাম হান্ড্রেড পার্সেন্ট। তুই শালী দিলি সব বরবাদ কইরা।’ 

সামি আকাশের কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে বললো, ‘মোটেও তোর দিকে তাকায় নাই মেয়েটা। আমার দিকে তাকায় ছিল সারাক্ষণ।’ 

আকাশ পারলে সামিকে গিলে খায়। দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘ফালতু প্যাঁচাল পারার জায়গা পাওনা না?’ 

অমৃতা বললো,’মেয়েটা মোটেও তোদের দিকে তাকায় ছিলো না। আমার দিকে তাকায় ছিল। আমি যতবার ওর দিকে তাকাইছি, ততবার আবিষ্কার করছি সে মুগ্ধ হয়ে আমারেই দেখতেছে।’ 

ঠিক সেই সময় রুদ্র ওর গিটার ফেলে রেখে উঠে দাঁড়ালো। তার মুখ হাসি হাসি। বিড়াল দুটি চোখে ফূর্তির জোয়ার। রুদ্রর উঠে আসা দেখে সবাই তার দিকে প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে তাকালো। 

রুদ্র ওর কপালে পড়ে থাকা চুল গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে নিলো প্ৰথমে, তারপর হাঁটু গেড়ে বন্ধুদের সামনে বসে গদগদ গলায় বললো, 

‘দোস্ত, কাহিনী হইয়া গেছে। উর্মিলা মনে হয় আমার উপর ক্রাশ খাইছে। সেই তখন থেকে দেখতেছি আমার দিকেই তাকায় আছে এক দৃষ্টিতে।’ 

কথাটা শুনে বন্ধুরা সব ব্যাক্কল বনে গিয়ে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। 

‘আল্লাহ! আমারে বাঁচাও, একটা মানুষ এক সাথে এত জনের দিকে ক্যামনে তাকায়? জ্বীন পরী নাকি?’ আর্তনাদ করে উঠল হৃদি। 

.

হক সাহেব বাড়ি ফিরলেন ভারী অস্থির এক খানা মন নিয়ে। আজ বিকালের পর থেকে তার ছেলের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছেনা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার যে ফ্ল্যাটে তার ছেলে থাকে সেই ফ্ল্যাটের গলির মুখেই দুইজন গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছেন তিনি গত দু দিন ধরে। সামিকে আজ তারা সারা দিন বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেনি। সন্ধ্যের দিকে তার কয়েকজন বন্ধু এসেছিল, শুধুমাত্র এ পর্যন্ত খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই বন্ধুদের কাউকেই আর জায়গাটা ছাড়তে দেখা যায়নি। রাত এগারোটার পরেও যখন কেউ বেরোল না বাসা থেকে তখন এপার্টমেন্টের রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে ফ্ল্যাটে কেউ নেই। দরজায় তালা দেয়া। 

হক এই খবর শুনে রীতিমত হকচকিয়ে গেছেন। বিমান বন্দরে তার ছেলে এবং ছেলের বন্ধুদের টিকিটাও দেখা যায়নি। বাসা থেকে বেরোতেও দেখেনি কেউ। তাহলে এই পাঁচ মূর্তি গেলো কোথায়? 

তিনি বাড়ি ফিরেই স্ত্রীর খোঁজ করলেন। রোমেলা তখন মহা ব্যস্ত। একগাদা শাড়ি কাপড় নিয়ে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার এসেছেন তার কাছে। এই ফ্যাশন ডিজাইনার নিজেই ড্রেস ডিজাইন করেন এবং সেই ড্রেস চড়া দামে বিক্রি করেন অনলাইনে। এর মাঝেই তার ফ্যাশন হাউজের বেশ নাম ডাক হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে তার এপয়েন্টমেন্ট মিলেছে আজ। রোমেলা দামি কাস্টমার বলেই সময় দেয়া হচ্ছে তাকে। নইলে এই ডিজাইনার এর নাগাল পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তাই এমন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এর মাঝখানে স্বামীর ডাকটা পেয়ে বেশ বিরক্ত হলেন তিনি। বিরক্তি নিয়েই উপরে নিজের শোবার ঘরে উঠে আসলেন। হক বললেন, 

—‘তোমার ছেলের সাথে কথা হয়েছে?’ 

—‘হ্যাঁ হয়েছে তো।’ 

—‘কখন?’ 

—‘বিকেলে।’ 

—কী বলেছে?’ 

—‘বিশেষ কিছুই বলেনি। বললো সব ঠিক থাকে আছে।’ 

হক স্ত্রীর দিকে থমথমে মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ইন্ডিয়া যাবার ব্যাপারে কিছু বলেনি?’ 

—‘বললো তো ওই যাওয়া ক্যানসেল হয়েছে। প্লেনের টিকেটও ক্যানসেল করে দিয়েছে। 

এটুকু বলে রোমেলা চিন্তিত মুখে আবার বললেন, ‘কেন? কিছু হয়েছে নাকি?’ 

হক একটা হতাশার শ্বাস ফেললেন। রোমেলাকে কিছু বলে লাভ নেই। সে সমস্যার কোন সমাধান তো করতে পারবেই না উল্টো চেঁচামেচি করে ঝামেলা বাড়াবে। স্ত্রীর সাথে তিনি জীবনের সুখ, দুঃখ এবং চিন্তা গুলো ভাগ করে নিতে পারেন না কখনওই। তাদের দুজনের মানসিকতায় বিস্তর ফারাক আছে। তিনি ছোট করে বললেন, ‘কিছু হয়নি। যাও যা করছিলে তাই কর।’ 

মুক্তি পেয়ে রোমেলা ছুটে গেলেন ড্রয়িংরুমে অপেক্ষারত ডিজাইনারের কাছে। এদিকে তিনজন দর্শনপ্রার্থী হক সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছিল স্টাডিরুমে। তিনি ডিনারের টেবিলে যাবার আগে দর্শনপ্রার্থীদের সাথে দেখা করলেন। জরুরি আলাপ সারলেন। পাঁচ ছয়টা গুরুত্বপূর্ণ টেলিফোন করলেন। কিন্তু মাথার ভেতরের এলোমেলো ভাবটা কিছুতেই কাটছিলোনা। ছেলেটা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে তার বুকের ভেতর একটা স্থায়ী বিষণ্ণতা বসত গড়েছে। বাড়ি ফিরলেই তিনি বিষণ্ণতাটা খুব করে টের পান। কিছু দিন পূর্ব পর্যন্তও তার একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে সামি কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসবে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। কয়েকটা দিন গেলে, অভাবের মুখ দেখলেই সুরসুর করে গোয়ালের গরু গোয়ালে ফিরে আসবে। কিন্তু নিজের পুত্রকে তিনি একটু বেশি অবমূল্যায়ন করে ফেলেছিলেন। সামি অতটা দুর্বল নয়। সে ফেরেনি। আদৌ ফিরবে কিনা কখনো সে বিষয়ে আজকাল তার মনের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। 

খাবার টেবিলে তিনি রোমেলার সাথে খুব একটা কথা বললেন না। রোমেলাও ঘাঁটালেন না। তিনি জানেন তার স্বামী কাজের মানুষ। কাজকে কেন্দ্র করে করেই বেঁচে থাকা এই লোকের। সারা বছর দু তিনবার বিদেশে যেতে হয়, দেশের ভেতর এ শহর থেকে ও শহরে উড়ে বেড়াতে হয়, ব্যবসার কাজে, বিভিন্ন সভা সমিতির কাজে। ইনি সমাজের একজন গুরুতর মানুষ, ভারিক্কি মানুষ। ইনার মাথার ভেতরে সর্বদা গুরুতর বিষয় ঘুরপাক খায়। রোমেলা এসব খটোমটো বিষয়ের আগামাথা কিছুই বোঝেন না। বুঝতেও চান না। তার দুনিয়াটা পয়সা ওড়ানোর রঙিন নেশায় মত্ত। সপ্তাহে দুবার বসুন্ধরা গিয়ে ছেলেকে দেখে আসেন। সাথে করে কিনে নিয়ে যান একগাদা খাবার দাবার। ছেলের বিরোধটা মূলত বাবার সাথে। তার সাথে তো না! তিনি তাই এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে চান না। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে যাবার পর হক সাহেব ছাদে উঠে আসলেন। গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়ানো ছিল তার। সন্ধ্যের পর থেকে শীত পড়ছে। হাওয়া ঠান্ডা। তিনি নীরবে হেঁটে এসে সুইমিং পুলের পাশের চেয়ারে বসলেন। তার পুত্র ছিল এই ছাদটার একচ্ছত্র অধিপতি। ছেলের জন্যেই কোটি টাকা খরচ করে ছাদের ওপর সুইমিং পুল করলেন, ঘাস লাগালেন। এমন কি একমাত্র ছেলের আবদার রাখতে গিয়ে একটা জিম এবং মিউজিক প্যাডও তৈরী করতে হল তাকে এ বাড়িতে। সেই ছেলে এখন মাসের পর মাস পিতার খবর নেয় না। মানুষকে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ায় পিতার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি ফোন করলে ছেলে ফোন ধরেনা। স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে তার পিতা যেদিন সমস্ত দোষ স্বীকার করে নেবে শুধুমাত্র সেদিনই সে বাড়ি ফিরবে। অতএব ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে এখন নতজানু হতে হবে, বিসর্জন দিতে হবে নিজের মূল্য বোধ, ব্যক্তিত্ব এবং আত্মমর্যাদা। ছেলের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে তাকে মাথায় তুলে নাচতে হবে। নিজ পুত্রের প্রতি একটা পুঞ্জীভূত অভিমান, রাগ এবং হতাশা বোধ তার বুকটাকে ক্রমশ ভারী করে তুলল। 

তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে অমৃতার নম্বরে ডায়াল করলেন। তার মনে হচ্ছে এই মেয়েটিই আসলে নাটের গুরু। মেয়েটিকে একটি উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। বড় রকমের শিক্ষা। 

১৩

আকাশ অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে বললো, ‘দ্যাখ রুদ্র, তোর তো মনীষা আছে, সামি, তোর আছে বিভা আর অমৃতা তুই তো মেয়ে, তোর আগে থেকেই কোনো চান্স নাই। প্লিজ হাত জোড় করে বলতেছি আমার উর্মিলার তোরা ছাইড়া দে।’ 

সামি বললো, ‘এমনে হবেনা। আগে এইটা ফিগার আউট করতে হবে যে উর্মিলা কাকে চায়।’ 

হৃদি সামির দিকে বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে বললো, ‘তাই না? বলবো নাকি বিভাকে ফোন করে এখন ঘটনাটা?’ 

সামি মহা বিরক্ত হল, ‘আজিব কারবার। বলার সময় তো এখনও আসেনাই, আগে বুঝে নেই উর্মিলার ক্রাশ কে। যদি শিওর হইতে পারি যে আমিই ওর ক্রাশ তাহলে তো বিভারে আমিই বলবো। একটা মেয়ে আমার উপর ক্রাশ খাইছে এটা তো আমার গর্ব! তোর বলা লাগবেনা।’ 

একটু উঁচু স্বরেই বলে ফেলেছিল সামি কথাগুলো। উর্মিলা এবং তার মায়ের কানে বোধহয় কিছু একটা গেল। তারা দুজনে চকিতে গলা বাড়িয়ে দেখল একবার দলটাকে। উর্মিলার মায়ের চোখ দুটি দেখে মনে হচ্ছে যেন এক্ষুণি কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। সেই আগুন গরম চাউনির সামনে বন্ধুরা সব কাঁচুমাচু হয়ে গেল। সবাই ভয়ে চুপ। উর্মিলার মায়ের চোখ রগড়ানিতে ভস্মিত হয়ে যাচ্ছে সবাই। রুদ্র পরিস্থিতি হালকা করার নিমিত্তে মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে থাকা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের সিটে ফেরত গেলো। তারপর ঠোঁটে একটি অত্যন্ত নিষ্পাপ হাসি ফুটিয়ে টেনে টেনে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু আন্টি, ভালো আছেন?’ 

আন্টির নাকের পাটা ফুলে গেল। মোটাসোটা গাল দুটো রাগে হয়ে উঠলো টসটসে। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ ঝামড়ে বলে উঠলেন, ‘ঐদিকে কী দেখছিস একটু পর পর? হ্যাঁ? ঘুমা, চোখ বন্ধ করে ঘুমা বলছি!’ 

উর্মিলা মায়ের ধমক খেয়ে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললো। যে করেই হোক তাকে এখন ঘুমাতেই হবে। উর্মিলার মা এবার বখাটে দলটার দিকে পূর্ণ চোখ মেলে তাকালেন। কিছু বলার আগেই রুদ্র আর আকাশ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘জি আন্টি আমরাও ঘুমাচ্ছি। এক্ষুণি ঘুমাচ্ছি। আর কেউ কোনো কথা বলবেনা। প্রমিজ।’ 

আকাশ আর রুদ্র সত্যিই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করলো। হৃদি বিড়বিড় করে বলে উঠলো, ‘শালা, কী পাগলের পাল্লায় পড়লাম!’ উর্মিলার মা এ যাত্রায় রাগ হজম করে গেলেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে দ্বিতীয়বার একটু এদিকসেদিক হলে তিনি আর ছেড়ে দেবেন না। 

অমৃতার সেলফোন বেজে উঠলো ঠিক সেই সময়। নম্বরটা দেখে চিনতে পারলো সে। ধরতেই ওপাশ থেকে এক ভরাট পুরুষালি কণ্ঠ বলে উঠলো, ‘হ্যালো। তোমরা কোথায়?’ 

—‘আপনাকে বলতে হবে কেন?’ 

—‘আমার ছেলে কোথায়?’ টেইনের ঝিক ঝিক শব্দের তোড়ে কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। ভেঙে ভেঙে আসছে। সামি একটু কৌতূহলের চোখে তাকিয়ে ছিল অমৃতার দিকে। বাকি বন্ধুরাও। অমৃতা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে হেঁটে দূরে সরে আসলো বন্ধুদের কাছ থেকে। সামির সামনে সে হকের সাথে কোনো ধরণের বাক বিতণ্ডায় যেতে চায়না। হাজার হোক লোকটা সামির বাবা। কয়েক পা হেঁটে টয়লেটের সামনের প্যাসেজটায় এসে দাঁড়ালো সে। তারপর ঠান্ডা ভাবে বললো, ‘আপনি জানেন না আপনার ছেলে কোথায়?’ 

—‘জানিনা বলেই তো প্রশ্নটা করছি।’ 

অমৃতার ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো, ‘সেকী? আপনার অজানা কিছু আবার আছে নাকি এ পৃথিবীতে? কী করে সম্ভব?’ 

এ পর্যায়ে হক আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। অনেক ক্ষণ ধরে মনের ওপর জমে থাকা রাগ, ক্রোধ এবং দুশ্চিন্তা এবার ফেটে পড়ল যেন ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে। এক বিকট চিৎকার তীরের বেগে ছুটে এসে বিদ্ধ হল অমৃতার কর্ণকুহরে। 

—‘চুপ কর! বেয়াদব মেয়ে! সাহস তো কম না তোমার। সেই তখন থেকে আমার মুখে মুখে কথা বলে যাচ্ছো! বল আমার ছেলে কোথায়?’ 

অমৃতা আকস্মিক এই চিৎকারে চমকে উঠলো। মুহূর্তের জন্য তার মুখটা একটু রক্তশূন্য দেখালো। 

—‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনি জানেন? আমার নিজের বাবাও কখনো আমার সাথে এভাবে কথা বলেনি!’ 

—‘এ কারণেই তো এমন উচ্ছন্নে গেছো তুমি। যাই হোক, তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। আমার ছেলের খবর বল। সে কোথায়? সে কি তোমার সাথে আছে?’ 

—‘আমরা ইন্ডিয়া যাচ্ছি।’ 

—‘কাজটা তুমি ঠিক করলেনা। পস্তাতে হবে তোমাকে।’ 

—‘ফালতু কথা বলেন কেন সবসময় আপনি? দেখলেন তো আমার সাথে এসব বলে কোনো লাভ হয় না। আপনার নাকের ডগার ওপর দিয়ে আপনার ছেলেকে নিয়ে দেশ থেকে বের হয়ে যাচ্ছি। কোথায় গেল আপনার ক্ষমতা? কিচ্ছু তো করতে পারলেন না!’ 

হক একটু সময় নীরবতা পালন করলেন, তারপর বরফ শীতল গলায় বললেন, ‘আমার ছেলে কোথায় আছে, কী করছে, তার প্রতিটা পদক্ষেপের খবর চাই আমার। তুমি প্রতিটা নিউজ পই পই করে দেবে আমাকে।’ 

অমৃতা শেষের হাসি হাসে, ‘যদি না দেই?’ 

—‘এক্ষুণি আমি তোমার বাবার কাছে ফোন করছি। ফোন করে বলছি তোমার দুঃসাহসের কাহিনী। তুমি যে আমার ছেলেকে এক রকম কিডন্যাপ করে ইন্ডিয়া নিয়ে যাচ্ছো এই খবর কি তোমার বাবা মায়ের জানা আছে?’ 

অমৃতা একটু থমকে গেলো। সাবধানী গলায় বললো, ‘তারা জানে।’

—‘তাই বুঝি? ঠিক আছে তাহলে তো তোমার কর্মফল তাদেরই ভোগ করা উচিত। আমি তোমার বাবা মায়ের একটা ব্যবস্থা করছি, দাঁড়াও।’ 

—‘আচ্ছা, আপনি কি একটা মুহূর্তের জন্যেও সামিকে চোখের আড়াল করতে পারেন না? দেশে তো সারাক্ষণ ওর পিছনে স্পাই লাগায় রাখেন, মাত্র কয়েকটা দিনের জন্যে ছেলেটা দেশের বাইরে যাচ্ছে। এখনো আপনি ওকে আপনার নজরবন্দি করে রাখতে চাইছেন? সমস্যা কী আপনার?’ 

‘আমি শুধু আমার ছেলের খবর জানতে চাই। দেয়ার ইজ নাথিং মোর লেফট টু সে।’ 

অমৃতা একটা হতাশ নিশ্বাস ফেললো, ‘উফ আল্লাহ! আপনার ছেলে ভালো আছে। বন্ধুদের সাথে থাকলে সে ভালো থাকে।’

—‘ওই হিন্দু মেয়েটার বাড়িতে যাচ্ছো তোমরা?’ 

অমৃতা বিরক্তি নিয়ে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ।’ 

—‘আমার ছেলে যদি কোনো অঘটন ঘটায় তাহলে জেনে রেখো, তোমাকে আমি ছাড়বোনা।’ 

—‘আমাকে অত ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমি ভয় পাইনা।’ 

—‘ফোন করলে ফোন ধরবে, না ধরলে সাথে সাথে তোমার বাবার নম্বরে ডায়াল করবো। তুমি নিশ্চয়ই চাওনা তোমার করা কোন ভুলের কারণে তোমার বাবা মায়ের সমস্যা হোক।’ 

—‘ফালতু।’ অমৃতা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে। 

—‘কী?’ হক বজ্রের ন্যায় গর্জে ওঠেন। 

—‘শুনতে পান না? বয়রা নাকি আপনি? বার্ধক্যজনিত সমস্যা?’ হক হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে ফালতু বললে?’ 

—‘ঠিক শুনেছেন।’ 

হক কয়েকটা মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলেন না। তার মনে হল তিনি আরেকটু হলেই উত্তেজনার বশে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলবেন। 

—‘তুমি কি আমাকে চেনো মেয়ে? তুমি কি জানো যে আমি চাইলেই তোমার অনেক বড় ক্ষতি করে দিতে পারি? আমার ক্ষমতা সম্পর্কে কোন আইডিয়া আছে তোমার?’ 

—‘আমার কী ক্ষতি করবেন আপনি? মেরে ফেলবেন? নাকি গুম করবেন?’

—‘ইউ নেভার নো! যে কোনো বিপদ হতে পারে।’ 

অমৃতা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, ‘শুনুন মিস্টার হক, আমার মনে হয় আমাকে ভয় দেখানো ছাড়াও আপনার আরো অনেক কাজ আছে। দেশের মন্ত্রী উজিরদের সাথে আপনার উঠাবসা। সংসদে যেতে হয়। বড় বড় কথা বলতে হয়। দল নেত্রীর পা ধরতে হয়। আপনি বরং আমার পেছনে সময় নষ্ট না করে ঐসব গুরুত্ব পূর্ণ কাজ গুলো করুন দয়া করে। ফোন ছাড়ছি।’

.

সন্ধ্যের পর থেকে বিভা তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেনা। কেউ অনলাইনে নেই। মোবাইলেও ট্রাই করেছে অনেকবার। কিন্তু সবাই লাপাত্তা। দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে হৃদির আম্মাকে ফোন করল। তিনি বললেন সবাই খুব ভালো আছে। যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বিভা যেন এই দুদিন ওদের কাউকে বিরক্ত না করে। ওরা কেউ ফোনে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। শুনে বিভা ভীষণ অবাক হয়েছে। কী এমন রাজকার্য এসে গেলো হঠাৎ যে বিভার সাথে দু মিনিট কথা বলার কেউ সময় পাচ্ছেনা? যে সামি প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় তাকে মেসেজ না করে, তার গলার আওয়াজ না শুনে থাকতে পারেনা, সেই সামি কিনা টানা চার পাঁচ ঘন্টা সময় যাবত উধাও! 

বেশ তো, ওরা যদি বিভাকে ভুলে থাকতে চায় তো থাকুক। বিভাও আর বিরক্ত করবেনা ওদের। প্রগাঢ় এক অভিমানে ভেতরটা টলমল করে ওঠে বিভার। বন্ধুদের এই আকস্মিক অদ্ভুত আচরণের পেছনে কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পায়না সে। 

—‘আপনি ঘুমোবেন না?’ বিভা জানালার ধার ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। অভিজিতের প্রশ্নটায় ঘোর ভাঙলো তার। ঘুরে তাকালো পেছনে। অভিজিৎ একটু উদ্বেগ নিয়ে বললো, 

—’কী হয়েছে আপনার? মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?’ 

বিভা তার ডাগর দুখানা চোখ স্থির ভাবে অভিজিতের মুখের ওপর রেখে বলল, ‘আজকে না ঘুমোলে কেমন হয়?’ 

অভিজিৎ কথাটা ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারলোনা। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘মানে? কী বলছেন আপনি?’ 

বিভা জানালার ধার থেকে সরে আসলো। কোমর অবধি ঝুলে থাকা গোছা ভর্তি কালো চুলগুলি পেঁচিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বললো, 

—‘না বোঝার কী আছে? চলেই তো যাচ্ছি দুদিন পর। এ কটা দিন নাহয় আপনার সাথে একটু সময় কাটাই। কী বলেন অভিজিৎ বাবু?’ 

অভিজিৎ চট করে কিছু বললো না। সে জানে মেয়েটি দস্যিপনায় এক নম্বর। এই কথাটিও নিশ্চয়ই সে তামাশা করেই বলছে। খানিক বাদেই মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠবে, আপনার মতো ভোদাইয়ের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা যায়না। 

অভিজিৎ সতর্ক ভাবে প্রশ্ন করলো, ‘হঠাৎ আমার সাথে সময় কাটাতে চাইছেন কেন?’ 

—‘ওমা, বললামই তো, চলে যাবো তাই যাবার আগে আপনার সাথে একটু সুখ দুঃখের আলাপ করে যেতে চাইছি।’ 

—‘তা, আমার সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করে রাত কাটালে, আপনার বয়ফ্রেন্ডের কী হবে?’ 

বন্ধুরা যে সব লাপাত্তা সেই খবরটা বিভা ইচ্ছে করেই চেপে গেলো। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললো, 

—‘ওর কাছে তো যাচ্ছিই চিরদিনের জন্য। একটা রাত কথা না বললে কিছু হবেনা।’

অভিজিতের চোখ থেকে বিস্ময় রেখাটি সরেনি তখনও। তার ভেতরে একটা বড় সর প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ ঝলসে উঠতে চাইছিলো। সে প্রাণপণে চিৎকার করে বলে উঠতে চাইছিল, আপনি চাইলেই তো হবেনা। আমারও আপনার সাথে সময় কাটানোর ইচ্ছে থাকতে হবে। নিজেকে কী ভাবেন আপনি? আপনি যা চাইবেন তাই হবে? অন্যের মন নিয়ে খেলা করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? 

কিন্তু অভিজিৎ এসব কিছুই বলতে পারলোনা। বরং অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো যে, তার ভেতরে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গটা ঠিক মতো জ্বলে ওঠার আগেই কেমন নিভু নিভু হয়ে আসছে। 

বিভা শাড়ির ওপর চাদর জড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘চলুন, বাইরে থেকে হেঁটে আসি!’ 

অভিজিৎ নড়লোনা। দাঁড়িয়ে রইল কাঠ হয়ে। বিভা আলমারির দরজা খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলে থাকা অভিজিতের চারটা জ্যাকেটের মধ্যে থেকে কালো রঙের জ্যাকেটটি বের করে নিলো। অভিজিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘নিন, পরে নিন। খুব ঠান্ডা।’ 

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটা ক্ষয়া চাঁদ জেগে আছে ঠিকই কিন্তু মেঘের দাপটে তার উপস্থিতি বড় ম্লান। বাসা থেকে বেরিয়ে উঠোনের ওপর একলা দাঁড়িয়ে ছিল বিভা। বাতাসে তখন বৃষ্টির ঘ্রাণ। শাল, জাম আর শিমুল গাছের বনে কুয়াশা ঝুলে আছে মাকড়সার জালের মতো। রাতচরা পাখিরা ডাকছিল থেকে থেকে। আর হাওয়ায় ভেসে ভেসে উড়ে আসছিল তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলঢাকা নদীর ঝিরঝির করা স্রোতের শব্দ। 

অভিজিৎ দরজায় তালা দেয়ায় ব্যস্ত। এদিকটায় বেশ ডাকাতের উৎপাত আছে। বছর দেড়েক আগে, একবার এই বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল, গভীর রাতে। তখন অভিজিতের পরিবর্তে অন্য এক সরকারি অফিসার থাকতেন এখানে। ডাকাত দল টিভি থেকে শুরু করে কয়েক হাজার নগদ টাকা এবং অফিসারের স্ত্রীর দশ ভরি স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়েছিল। সে ঘটনার পর থেকে এই এলাকার সিকিউরিটি কড়া হয়েছে, তবে একেবারে শঙ্কা মুক্ত হয়নি এখনো। এছাড়া গ্রামে ছিঁচকে চোরেরও অভাব নেই। শহর থেকে মানুষ এসেছে শুনলেই গ্রামের চোরদের ভেতরে এক ধরণের ছোঁকছোঁকানি শুরু হয়। তারা ওঁৎ পেতে থাকে কখন সাহেব কর্তা রা একটু অসাবধান হবেন এবং তারা সেই অসাবধানতার সদ্ব্যবহার করবে। অতএব অসাবধান হওয়া যাবেনা। অভিজিৎ খুব সতর্কতার সাথে দরজায় তালা দিল। 

—‘এতক্ষণ লাগে আপনার? বাড়িতে তো দূর্গা আছে।’ বিভা ক্যাট ক্যাট করে বলল কথাগুলো। 

—‘দূর্গা ঘুমোচ্ছে। চোর ডাকাত আসলে টের পাবেনা।’ 

উঠোনের পরেই লাল মাটির ধূলো ধূসরিত পথ। উঁচুনিচু পাহাড়ি পথটি অসংখ্য পাথর কুঁচিতে ভরপুর। দুধারে জঙ্গল। চারিদিকে এক রাত্রিকালীন গা ছমছমে গুরুগম্ভীর আমেজ। জঙ্গলের একটু কাছে আসতে বোঝা গেল এর ভেতরকার বাসিন্দারা কেউ কেউ এখনো ঘুমোয়নি। জন্তুর পায়ের শব্দ, পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, শুকনো পাতার খস খস আর কত রকমের যে ফিসফাস! অভিজিৎ একটু পেছনে পড়ে গিয়েছিল। বিভা ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, 

—‘এমন পিঁপড়ার মত হাঁটছেন কেন?’ 

বিভা দাঁড়িয়ে পড়ায় দূরত্বটা অতিক্রম করতে অভিজিতের মিনিট লাগলোনা। পাশে এসে থেমে বললো, ‘এই অন্ধকারে আপনার ভয় লাগছেনা?’ 

—‘নাহ, ভয় লাগবে কেন? আমি ভীতু নাকি?’ 

—‘এখন যদি আমি আপনাকে ফেলে রেখে চলে যাই। চিনে চিনে বাড়ি ফিরতে পারবেন? 

বিভা একটু দমল কথাটা শুনে। অন্ধকারে অভিজিতের অস্পষ্ট মুখখানা ভালো মতো একবার দেখে নিয়ে বললো, ‘চলে যাবেন কেন?’ 

—‘যাব বলিনি, বলেছি যদি যাই তবে আপনি কি ফিরতে পারবেন বাড়ি?’ – ‘পারব।’ 

—‘বেশ তো, দেখা যাবে। চলুন সামনে চলুন।’ 

—‘চলুন।’ বললো বিভা, কিন্তু তার বুকের ভেতর একটু কেমন খচখচ করতে লাগলো। সত্যিই কি লোকটা তাকে এই অন্ধকারে ফেলে রেখে চলে যাবে নাকি? পথ চিনে চিনে বাড়ি সে ঠিকই ফিরতে পারবে। কিন্তু একদম একলা একলা এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার কথা চিন্তা করেই তার বুক ধড়ফড় করছে। যদি কোন হিংস্র জানোয়ার এসে তাকে আক্রমণ করে? যে জন্তুগুলোর পায়ের আওয়াজ আর ফোঁস ফোঁস তেজি নিশ্বাস রোজ রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পায়, আজ যদি সেই হিংস্র হায়েনারা তাকে বনের মধ্যে একলা পেয়ে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে কামড়াতে আসে, বিভা তখন কী করবে? 

ওরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছাকাছি চলে এসেছিল। কুয়াশায় আবছা হয়ে আছে নদীর ওপরের ব্রীজ। বাতাসে আঁশটে গন্ধ। পাথরের ওপর দিয়ে কুলকুল করে বইছে পানি। এই নদীটি মূলত তিনটি নদীর মিলনস্থান। এখানেই তৈরী হয়েছে বিন্দু ব্যারেজ বা বাঁধ। ঝালং এর জলঢাকা হাইডেল প্রজেক্টে পানি সরবরাহ করাই এই বাঁধ সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য। নদীর গা থেকে খাড়া হয়ে উঠে গেছে ভুটান পাহাড়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে কদাচিৎ দৃষ্টিগোচর হয় হিমালয়ের বরফ শৃঙ্গ। 

একটা পাথরের ওপর বসলো বিভা। অভিজিৎ ওর পাশে এসে দাঁড়াল নিঃশব্দে। 

স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরা পায়ে ধাক্কা খাচ্ছে নদীর স্রোত। ঠাণ্ডা জল শিরশিরে এক অনুভূতির সৃষ্টি করছে। মাথার ওপরের মেঘাচ্ছন্ন অন্তরীক্ষ, জলজ বাতাস, নদীর স্রোতের কুলকুল ধ্বনি, তক্ষকের ডাক, শিশিরের টুপটাপ, এই সমস্ত কিছুই বিভার মনকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল দূর থেকে দূরান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে! একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল তার বুকের ভেতর। একটা সীমাহীন একাকিত্ব! এই একাকিত্বের কোনো ব্যাখ্যা তার কাছে আপাতত নেই। ভেতরটা এমন ফাঁকা ফাঁকা কেন লাগছে? কয়েক ঘন্টা টানা সামির সাথে কথা হয়নি। এজন্যে কি? সামি কি জানেনা তার সাথে কথা না বললে, তার গলার আওয়াজ শুনতে না পেলে বিভার কী রকম মরে যাবার মতো অবস্থা হয়? সব জেনে বুঝেও সে কেন ইচ্ছাকৃত ভাবে এই দূরত্ব রচনা করছে? শুধু সামি নয়, অন্য বন্ধুরাই বা হঠাৎ সব একসাথে উধাও হয়ে গেলো কেন? এর কারণ কী হতে পারে? 

অভিজিৎ বিভাকেই দেখছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। বিভার মনটা যে বিভার মধ্যে নেই এ মুহূর্তে, বিষয়টা বুঝতে খুব একটা সময় লাগলোনা তার। সে বিভার পাশাপাশি আরেকটি পাথরের ওপর বসলো। 

—‘কী ভাবছেন?’ চমকে তাকালো বিভা। সামলে নিয়ে বলল, 

—‘তেমন কিছুনা।’ 

একটু থেমে কিছু একটা ভাবল সে। তারপর কিয়ৎ আড়ষ্ট গলায় বলল ‘অভিজিৎ বাবু, আপনার কাছে সিগারেট হবে?’ 

অভিজিৎ থমকালো, সরু চোখে চেয়ে বললো, ‘স্মোক করেন নাকি আপনি?’ 

—‘সব সময় না,অকেশনালি।’ 

—‘আজ হঠাৎ এমন কী অকেশন পড়ে গেলো জানতে পারি কি?’ 

—‘নির্জন রাত, তার ওপর শীত পড়েছে জব্বর। এখন একটু বিড়ি টিরি না টানলে কি হয়?’ 

অভিজিৎ কিছু বললো না। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বিভা বললো, ‘চুপ হয়ে গেলেন যে? আমি মেয়েটা কতটা খারাপ সেটাই ভাবছেন তো? আমি খারাপ হই, ভালো হই, আপনার কী এসে যায় বলুন? আমি তো আপনার সত্যিকারের বৌ নই। আপনি বড়ই ভাগ্যবান যে একটা খারাপ মেয়ের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছেন।’ 

অভিজিৎ ধীরে ধীরে বললো, ‘আমি সিগারেট খাইনা।’ 

—‘কিন্তু আপনার জ্যাকেটের পকেটে একটা সিগারেটের বাক্স আছে। আমি দেখেছি।’ 

—‘কী করে দেখলেন?’ 

—‘জ্যাকেটটা আলমারি থেকে নামাবার সময়ই হাতে লেগেছিল কিছু একটা। পরে বুঝেছি ওটা সিগারেটেরই বাক্স। সাথে ম্যাচের বাক্সও আছে। আপনি স্মোক না করে থাকলে ওগুলো আপনার কাছে কী করছে?’ 

—‘এক কলিগ উপহার দিয়েছিল। বিদেশী সিগারেট। কখনো খেতে ইচ্ছে হলে খাবো ভেবে রেখে দিয়েছিলাম।’ 

—‘বেশ তো, আর ফেলে রেখে লাভ কী? দিয়ে দিন আমাকে। অত ভাবতে হবেনা।’ 

অভিজিৎ জ্যাকেটের পকেট থেকে সিগারেটের বাক্সটা বের করলো। বিভার হাতে তুলে দিয়ে বললো, ‘আপনার আজকে কিছু একটা হয়েছে।’ 

—‘কিছুই হয়নি।’ 

অভিজিৎ ম্যাচের বাক্সে কাঠি ঘষে আগুন ধারালো। কমলা আলোয় চারপাশটা হঠাৎ রহস্যময় ভাবে ঝলক দিয়ে উঠলো। সেই আলোয় বিভার মুখখানা স্পষ্ট হয়ে উঠলো ক্ষণিকের জন্য। তার দুটি ভ্রুর মাঝখানে লাল টিপ, কপাল ভর্তি সিঁদুর। ডাগর চোখজোড়ায় কাজল রেখা টানা। অভিজিতের মাথায় এই প্রথমবারের মতো প্রশ্নটা এসে বাড়ি খেলো। বিভা কেন রোজ রোজ অমন যত্ন করে সিঁদুর দেয়? ওটা যে কেবল মাত্র প্রসাধনই নয়, বরং এক বৈধ, দাম্পত্য বন্ধনের স্বীকৃতির চিহ্ন এবং পরিচায়ক এ ব্যাপারটা কি ওর জানা আছে? 

বিভা সিগারেটে আগুন ধারালো। একটা বড়সড় টান দিয়ে হালকা ভাবে বললো, ‘আমার বন্ধুদের মধ্যে চেইন স্মোকার হচ্ছে সামি আর অমৃতা। অন্য কারো ওরকম নেশা নেই।’ 

অভিজিৎ ছোট করে বললো, ‘বেশ। 

—‘তারপর অভিজিৎ বাবু? হাও ইজ লাইফ? বনবাস কেমন লাগছে?’

প্রশ্নটা শুনে অভিজিৎ নিজের অজান্তেই একটু হাসলো। হাও ইজ লাইফ কিংবা কেমন আছেন এই প্রশ্নটার মতো অমূলক প্রশ্ন পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রশ্নকর্তা খুব ভালো ভাবে জানে যে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবেনা,অন্যদিকে উত্তরদাতাও জানে সঠিক উত্তর তার নিজেরই জানা নেই তবুও মানুষ এই অহেতুক প্রশ্নটাকে নিজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী বানিয়েছে উঠতে বসতে, চলতে ফিরতে মিথ্যে প্রশ্ন মিথ্যে উত্তরের আশায়। 

তবে আজকের এই প্রশ্নটি বাস্তবিকই একটু অন্যরকম গুরুত্ব বহন করল অভিজিতের কাছে। কারণ বিভা, এর আগে কোনো দিন জানতে চায়নি যে অভিজিৎ কেমন আছে! 

—‘মন্দ লাগেনা। প্রথম প্রথম অবশ্য খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু ধীরে ধীরে, সময়ের সাথে সাথে, আমিও সত্যচরণের মতো প্রকৃতির জারক রসে জীর্ণ হয়েছি। হয়েছি প্রকৃতির ভক্ত সেবক ও উপাসক।’ 

অভিজিতের ভাব গাম্ভীর্য পূর্ণ কথা শুনে বিভা ওর স্বভাবসুলভ খিক খিক হাসিটা হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো, ‘সত্যচরণটা আবার কে?’ 

ঠেসমারা হাসিটা অভিজিতের বুকে একটু হালকা জ্বালার উদ্রেক করলো, সে চোখা ভাবে বললো –’হাসছেন কেন? এখানে হাসির কী হল? সত্যচরণকে চেনেন না আপনি? বিভূতি বাবুর আরণ্যক পড়েন নি? আপনাকে দেখেই অবশ্য বোঝা যায়, যে আপনি একেবারেই বই পড়ুয়া মেয়ে নন।’ 

বিভা একটু থতমত খেয়ে বললো, ‘আরণ্যক পড়েছিলাম ছোট বেলায়। অত মনে নেই আমার।’ 

—‘তাই বলুন।’ 

বিভা চুপ করে আড়চোখে অভিজিৎকে দেখে নিলো একবার। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কিছু একটা ভাবলো গভীর ভাবে। তারপর বললো, 

—‘আমাকে আপনার বই পড়া মেয়ে মনে হয়না, তা বুঝলাম। কিন্তু ঠিক কী রকম মেয়ে বলে মনে হয় তা একটু বলবেন?’ 

অভিজিৎ উত্তরটা দেবার আগে খুব বেশি সময় নিল না। অকপটে বললো, ‘আপনি উড়নচণ্ডী। অস্থির, অপরিপক্ক, এবং অগভীর। 

—‘অগভীর?’ 

—‘আমার তো সেরকমই মনে হয়।’ 

হিম জড়ানো ঠান্ডা এক হাওয়ার ঝাপটায় বিভার সিগারেটের আগুন গেল নিভে। সে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘ম্যাচের বাক্সটা দিন।’ 

অভিজিৎ ম্যাচের বাক্স এগিয়ে দিল। দেবার সময় আঙুলে আঙুল লেগে গেলো হালকা ভাবে। বিয়ের পর থেকে আজ অবধি অভিজিৎ কখনও ভুল করেও বিভার হাত ধরেনি। অথচ বিভা সেই ফ্রক পরার সময় থেকে জানে যে সে সুন্দর। পুরুষ মানুষের চোখে নিজের প্রতি মুগ্ধতা দেখেই অভ্যস্ত সে। কিন্তু এই মানুষটা… সত্যি এই মানুষটা কি কখনোই তাকে দেখে মুগ্ধ হয়নি? এই তো মাত্র বললো বিভার মাঝে নাকি কোনো গভীরতা নেই। বিভাকে সে কী ভাবে? খুব ঠুনকো, বাজে আর ফালতু? 

দূর পাহাড়ে কেউ সুরেলা কন্ঠে একটা আসামিয়া গান গাইছে। রাত মোহনার নীরব চরাচরে সেই গান উড়ে উড়ে এসে একদম বুকের মধ্যখানে গিয়ে বাজতে লাগল ঝন ঝন করে। সুর মানুষকে চিরদিন দুর্বল করে তোলে। প্রকৃতি আর সুরের মধ্যে কোথায় যেন এক রহস্যময় সংযোগ আছে। দুইয়ের কাছাকাছি আসলেই মানুষের অন্তর্জগতে কিছু একটা তোলপাড় হয়ে যায়। বিভার ভগ্নহৃদয়, ছিদ্রিত, বিষণ্ণ ভাবনা গুলো ওই সুরের সাথে মিশে, মাঘ মাসের হিম-গন্ধী খরশান বাতাসে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে একটু কেমন আবছা হয়ে আসছিল। বিভা হঠাৎ আপন মনে হেসে উঠল, খিক খিক করে নয়, এবার তার হাসিটা রহস্যময়। 

—‘হাসছেন কেন?’ 

—‘আচ্ছা অভিজিৎ বাবু, এইযে একটা মেয়েকে আপনি বিয়ে করলেন, এতদিন কাছ থেকে দেখলেন। একটা বার তাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করলো না?’ 

অভিজিৎ অপ্রতিভ হল। এ ধরণের প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না একেবারেই। 

—‘ছুঁতে চাইলেই কি আপনি আমাকে ছুঁতে দিতেন?’ 

বিভা আবার হাসে, ‘তাও বটে। কিন্তু চান নি তো! কেন বলুন তো? আপনার কি মনে হয়না আমি যথেষ্ট সুন্দর?’ 

অভিজিৎ একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। চিন্তাগুলো খাপছাড়া। 

—‘সুন্দর হলেই কি? জোর করে কিছু হয় নাকি?’ 

—‘মনের ওপর জোর হয়না, শরীরের ওপর তো হয়!’ 

—‘আমার জোর করে কিছু পেতে ইচ্ছে করেনা। 

—‘আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন?’ 

অভিজিৎ চুপ। গানের সুরের সাথে এখন তবলার তাল যুক্ত হয়েছে। জাম শিমুলের জঙ্গলে কয়েকটা পাখি কিচির মিচির শব্দে জেগে উঠেছে গানের সুর শুনে। 

—‘কিছু বলছেন না যে?’ 

অভিজিৎ একটা বড় শ্বাস ফেলে অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবল, তারপর গভীর গলায় স্বগতোক্তি করল, 

—‘Let there be spaces in your togetherness, And let the winds of the heavens dance between you. 

বিরক্ত বিভা মুখ ঝামটা মেরে বলে উঠল, ‘কী সব ছাই পাশ বলেছেন?’ অভিজিৎ আবার বললো- ‘Love one another but make not a bond of love, Let it rather be a moving sea between the shores of your souls.’ 

—‘বাল, আমি কী প্রশ্ন করি আর ওই কী কয়! 

অভিজিৎ হাসে, ‘আপনি ভীষণ বাঙ্গাল!’ 

—‘আর আপনি ভীষণ আঁতেল।’ 

—‘বলেছি না, আপনার ভেতরে গভীরতা বলতে কিচ্ছু নেই।’ 

বিভা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, তীক্ষ্ণ গলায় বললো, ‘আমার ভেতরের গভীরতা উপলব্ধি করবার মত গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আপনার নেই।’ 

—‘ওরে বাবা!’ 

—‘হ্যাঁ, ওরে বাবা।’ 

—‘আপনার জিবরান ভালো লাগেনা?’ 

—‘ওগুলো কাহলিল জিবরানের কোট ছিল?’ 

—‘কবিতা।’ 

—‘আপনি কবি নাকি?’ 

—‘আমি কবি কে বললো?’ 

বিভা আফসোসের গলায় বলল- ‘কে আবার বলবে। ভাব সাব দেখে তো কবি বলেই মনে হচ্ছে। হায় ভগবান শেষ মেশ কিনা আমার ভাগ্যে এক কবি এসে জুটল!’ 

হঠাৎ একটি অন্যরকম দৃশ্যের ওপর তার চোখ আটকে গেল। খুব কাছেই একদল হরিণ অন্ধকারে নদীর পাড়ে এসেছে জল পান করতে। সংখ্যায় তারা দশ কি বারো। নিঃশব্দে এসেছে, নিঃশব্দে জল পান করছে। বিভার হাতে তখনো আধখাওয়া সিগারেট। সে আঙুলের ফাঁকে ধরে রাখা সিগারেট সমেত হাতটা অভিজিতের হাতের ওপর রেখে আতঙ্ক গ্রন্থ ভাবে বলে উঠলো,’দেখেছেন? সামনে কী হচ্ছে?’ 

জ্বলন্ত সিগারেটের ছেঁকা খেয়ে অভিজিৎ একটি চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। শব্দ শুনে হরিণ দল সচকিত হল। তাকালো মানুষ দুজনের দিকে। বিভা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘চলুন চলে যাই, ভয় লাগছে!’ 

—‘ভয়ের কী আছে? হরিণ আপনাকে কী করবে?’ 

—‘যদি মারতে আসে?’ 

অভিজিৎ হাসে, ‘আপনি মাইরি, একটা ফার্স্ট ক্লাশ চিড়িয়া।’ 

বিভা নিজের আধখাওয়া সিগারেট জলের ওপর ছুঁড়ে মারলো। তারপর অভিজিতের হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললো, ‘চলেন চলেন!’ 

কয়েক কদম চলার পর বিভার যেন বোধোদয় হল। আকস্মিক দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, ‘আপনার হাত পুড়ে যায়নি তো? 

—‘না।’ 

—‘শিওর? দেখি কোথায় পুড়ছে?’ 

অভিজিৎ ছেঁকা খাওয়া হাতটা বিভার দিকে এগিয়ে দিল। বিভা ওর ঠান্ডা মজবুত, সবল হাতটা নিজের পেলব হাতের মুঠোয় ধরে হালকা গলায় বললো, ‘সরি, আমি আসলে একটা ক্যালাস।’ 

মোবাইলের আলো জ্বেলে অভিজিতের হাতটা ভালো, মত পরখ করল বিভা, ‘কিছু হয়নি তো! 

অভিজিৎ গাঢ় চোখে দেখছিলো বিভাকে। ওরকম দেখতে দেখতেই বললো, ‘হয়েছে কিছু একটা।’ 

‘কই? দেখিনা তো!’ 

অভিজিৎ হাত ছাড়িয়ে নিলো। হাঁটতে শুরু করে বললো, ‘ও আপনি দেখতে পাবেন না। সব কিছু দেখা যায়না।’ 

তখন গানের আওয়াজ থেমে গেছে। বাতাসে মহুয়া ফুলের কী মিষ্টি গন্ধ! পাকদন্ডী পথ বেয়ে বেয়ে হাঁটছিল ওরা। বিভা একটু পিছিয়ে পড়েছিল। 

—‘অভিজিৎ বাবু, আপনি গান জানেন?’ 

—‘না।’ 

—‘আমার বন্ধুদের মধ্যে রুদ্র খুব ভালো গান গায়। রুদ্রর গান শুনে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। 

অভিজিৎ ঘুরে দাঁড়ালো, ‘বন্ধু দের ছাড়া আপনি অন্য কিছু ভাবতে পারেন না কখনো, তাইনা?’ 

বিভা নিভলো। স্তিমিত গলায় বললো, ‘না, তা কেন হবে?’ 

অভিজিৎ আবারও হাঁটে। বিভা নিজের গতি বাড়িয়ে দিয়ে অভিজিৎ এর কাছাকাছি চলে আসে। হাঁটতে হাঁটতে একটু হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বলে, 

—‘লাইনগুলো সুন্দর ছিল।’ 

—‘কোন লাইন?’ 

—‘জিবরানের কবিতার। Love one another but make not a bond of love: Let it rather be a moving sea between the shores of your souls. আপনি কথাগুলো বিশ্বাস করেন?’ 

—‘হ্যাঁ করি। ভালোবাসায় বন্ধন আবশ্যক নয়।’ 

—‘তাই বুঝি? আচ্ছা ধরুন, আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও গেলাম না। সারাজীবন আপনার সাথেই থাকলাম। কিন্তু সামির প্রতি আমার ভালোবাসাটাও ঠিক আগের মতোই রইল। কারণ আপনি এইমাত্র বললেন যে সব ভালোবাসায় বন্ধন আবশ্যক নয়। এর মানে সামিকে বিয়ে না করেও ওকে আমি ভালোবাসতেই পারি তাই না?’ 

অভিজিৎ থমকে দাঁড়ালো। 

—‘এ কথা কেন বলছেন? আপনার কি যাবার ইচ্ছে নেই?’ 

—‘যাবার ইচ্ছে আছে ষোল আনাই। এমনিই প্রশ্ন করলাম।’ 

—‘আপনার কি ভয় হচ্ছে যে আপনি দেশে ফেরার পর আপনার বয়ফ্রেন্ড আপনাকে গ্রহণ করবে না?’ 

—‘বয়ফ্রেন্ড গ্রহণ করবে না কেন? কী আশ্চর্য!’ 

—‘তাহলে কীসের ভয়? সমাজের?’ 

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে পড়ল বিভা। তার মাথা নত, সর্বাঙ্গে একটা আড়ষ্ট ভাব। অভিজিৎ দু পা এগিয়ে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল। 

—‘আপনি যেতে চাইছেন না?’ 

বিভা ওর ডাগর দুখানা চোখ মেলে অভিজিতের ভালোমানুষীতে ভরপুর মুখখানার দিকে নির্বাক চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে বলে, 

—‘সামিকে আমি ভালোবাসি ঠিক। কিন্তু আপনাকে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা। এরকম কেন হচ্ছে বলুন তো?’ 

.

রুদ্র দোতলার সিটে টান টান হয়ে শুয়ে পড়েছিল। ঘুমোনোর আগে ভারী জিভ টেনে টেনে একবার তাকে বলতে শোনা গেল,’ট্রেইনে ঘুমানোর শালা মজাই আলাদা। মনে হয় যেন ছোটবেলার মত কেউ দোল দোল দোলনি গান গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে।’ 

আকাশকে হাজার বার বলার পরেও ওপরের সিটে পাঠানো গেলনা। সে নিচেই থাকবে উর্মিলার কাছাকাছি। অতএব অমৃতাকেই ওপরে উঠতে হল। 

উর্মিলা তখন ঘুমে কাদা কাদা। আকাশের খুব ইচ্ছা উর্মিলা যেন ঘুম ভেঙে চোখ মেলার সাথে সাথে তার চাঁদ বদন খানাই দেখতে পায়। সে তাই ঘুমোচ্ছেনা। মোবাইলে অনলাইন লুডু খেলছে। আকাশের পাশে হৃদি বসে ছিল। আর ওদের মুখোমুখি সিটেই সামি। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সে। তার চোখ দুটো বোজা কিন্তু সেখানে ঘুমের উপস্থিতি নেই। সে একটু পর পর এপাশ ওপাশ করছে। 

আকাশ লুডু খেলতে খেলতে হঠাৎ বললো, ‘তোর কি মনে হয়? উর্মিলা আজকে রাতে ঘুম থেকে উঠবে? নাকি উঠবেনা?’ 

হৃদি কপাল কুঁচকে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললো, শোন আকাশ, উর্মিলার ঘুম বিষয়ক গবেষণা করা ছাড়াও আমার জীবনে আরো কাজ আছে।’ 

—‘বল না দোস্ত। এইযে আমি তখন থেকে ওর জন্য জাইগা বইসা আছি, সে তো একটাবারের জন্যও চোখ মেইলা দেখলোনা।’ 

—‘আজাইরা’ 

—আমার মনে হয় কি জানিস, ওর মা ওরে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় দিছিল। ও তো সেইরকম ক্রাশটা খাইছিল আমার উপর। চোখের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার মতো ক্রাশ! ঘুমের ওষুধ না খাওয়াইলে এই মেয়ে ঘুমাইতনা আজ রাইতে।’ 

—‘তোর কেন সবসময় মনে হয় যে দুনিয়ার সব মেয়ে তোরে দেইখা ক্রাশ খায়?’ 

—‘এটাই বাস্তব সত্য কথা।’ 

আকাশ কথাটা বলে আর দেরি না করে ঝুপ করে হৃদির কোলে মাথা রেখে সটান শুয়ে পড়ল। বললো, 

—‘আমি একটু শুই দোস্ত। উর্মিলা মনে হচ্ছে আজকে আর উঠবেনা।’ হৃদি বললো, ‘এইটার মানে কী? তোমরা সবাই শুয়ে শুয়ে আরাম করবা আর আমি সারা রাত পাহারা দিব তোমাদের?’ 

—‘হ্যাঁ দে, মানুষের উপকার কর একটু। সওয়াব পাবি।’ 

হৃদি আকাশের ছোট করে ছাটা ঘাসের মত চুলগুলোর ওপর একটা হাত রাখলো, বললো, ‘দোস্ত, আন্টি আংকেলকে বলে আসছিস তো আসার আগে, তাইনা?’ 

আকাশ ফোনে লুডু খেলতে খেলতেই বললো, ‘আরে ধুর, বলা না বলায় কিছু আসে যায়না।’ 

—‘তুই আন্টিকে বলে আসিস নাই?’ 

—‘কাউরেই কিছু বলিনাই।’ 

—‘কী আশ্চর্য, কেন?’

—‘বইলা কী করবো। আমি শিওর এখন এই মাঝরাতে আমার মাতাল বাপ্ তার গাধা বৌরে ধইরা বেদম পিটাইতেসে।’ 

—‘ইশ আকাশ! তুই এত নিষ্ঠুর কেনো?’ 

ঠিক সেই সময় সামি হঠাৎ শোয়া থেকে উঠে বসে জরুরি গলায় বললো, ‘আমার মনে হয় বিভারে কিছু জানানো উচিৎ। ও নিশ্চয়ই খুব টেনশন করতেছে।’

আকাশ বললো, ‘শুনো রোমিও, এখন মটকা মাইরা পইড়া ঘুমাও। আর কয়েকটা ঘন্টা পরেই তোমার জুলিয়েটের সাথে দেখা হবে ইন শা আল্লাহ। এখন জুলিয়েটরে একটু টেনশন করতে দাও। একটু টেনশন করলে কিছু হবেনা।’

সামির চোখে খেলছে দুশ্চিন্তা আর বিষণ্ণতা। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অস্থির গলায় বললো, ‘টাইম কেন কাটতেসে না? আর কতক্ষণ?’ 

শুনে আকাশ সুর করে গাইতে লাগলো, ‘কত দূর… আর কত দূর …’

‘তোর কেমন লাগতেছেরে? এতদিন পর বিভাকে দেখবি। হাও ডু ইউ ফিল?’ হৃদির প্রশ্ন, সামির উদ্দেশ্যে। 

সামি হৃদির দিকে ঘুরে তাকালো। উষ্ণ গলায় বললো, ‘আই ক্যান্ট এক্সপ্লেইন দোস্ত।’ 

একটু থেমে, একটা বড় নিশ্বাস চাপা দিয়ে সে আবার বললো, ‘ঘুমাতে পারছিনা!’ 

হৃদি হঠাৎ সেই প্রশ্নটা করে ফেলল যা সে এর আগে কোনো দিন করেনি, ‘বিভার মধ্যে বিশেষ কী আছে দোস্ত? যার জন্য তুই ওরে ভালোবাসলি?এমন কী আছে যা অন্য কারো নাই?’ 

সামি খুব অবাক হল প্রশ্নটা শুনে। হৃদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা আকাশও বিস্ময় নিয়ে তাকালো হৃদির দিকে। ওদের ওরকম চমকে ওঠা দেখে হৃদি নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো। চট করে অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো, ‘না মানে, এমনিই জানতে চাইছি।’ 

সামি একটু হাসলো, ‘কী আছে তা আমি সঠিক জানিনা। তবে কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে!’ 

হৃদি সামির হাসিটা ফিরিয়ে দিল নিঃশব্দে এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই আবিষ্কার করল যে তার কেন যেন কিছু ভালো লাগছেনা। এবারের ট্রিপটায় আগের দিনগুলোর মতো আনন্দ মিশে নেই। এর কারণ কী? সে কি বড় হয়ে গেছে? তার মন কি পাল্টে গেছে? ট্রেনে বসে তার থেকে থেকে নিজের বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে। ছোট ভাই হৃদয়ের কথা মনে পড়ছে। নিজের এমবিএ ক্লাসের কথা মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন অসমাপ্ত কোনো কাজ পড়ে আছে পেছনে। কোথাও কিছু একটা হওয়ার কথা ছিল। হয়নি এবারের যাত্রাটা যেন ঠিক তার জন্য নয়। সে এখানে অবাঞ্চিত, অনাহূত। অথচ এরকম মনে হওয়ার পেছনে কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। বন্ধুরা তার জান, প্রাণ এবং সর্বস্ব! বিভাকেও তো কতদিন দেখেনা! বিভা চলে যাওয়ার পর থেকে তার কেবলই মনে হত যে শরীরের অর্ধেকটা বুঝি কেউ কেটে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিয়েছে। বিভাকে ছাড়া সে অপূর্ণ, আংশিক এবং খণ্ডিত। বিভা তার বেস্ট ফ্রেন্ড! 

তার বুক থেকে একটা বড় নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো। আকাশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে স্বগতোক্তির মত বললো, ‘কোথায় কী যেন একটা ঠিক হচ্ছেনা।’ 

আকাশ মুখের সামনে থেকে ফোন সরিয়ে হৃদির দিকে উল্টো চোখে তাকালো, 

—‘কী কস?’ 

—‘কিসু কই না।’

—‘কইলি তো।’ 

—‘না কই নাই।’ 

.

ইমিগ্রেশন পার হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছুলো ওরা পরদিন বিকেলে। স্টেশন থেকে ভাড়া নেয়া গাড়ি করে রওয়ানা দেয়া হল বিন্দুর উদ্দেশ্যে। মাঝ পথে পড়ল ঝালং এর জলঢাকা হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্ট, চোখ জুড়ানো রঙিন কাঠের বাড়িঘর আর রাস্তার ধারের কমলা লেবুর বাগান। ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম বিন্দু। উঁচু নিচু কুয়াশাঢাকা পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেক দূর, যেখানটায় বিভাবরী আছে উতলা হয়ে বন্ধুদের বিরহে। আর তার বন্ধুরা সেই বিরহ ব্যথার টানে টানে হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে এই এলো বলে! 

১৪

কাল রাতে বিভার কথাটা শোনার পর অভিজিৎ আর একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনি। চুপচাপ বাড়ি ফিরেছে। বিভা ঘুমোতে যাবার আগে শুধু একবার অনুচ্চ স্বরে বলেছে, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমি চলে যাবো।’ 

অভিজিৎ তখনো নিরুত্তর। বিভার কথাটা যেন সে শুনতেই পায়নি 1 পরদিন খুব সকালে অভিজিৎ অফিসের জন্য বেরিয়ে গেল। বিভার ঘুম ভাঙল বেলা এগারোটায়। বন্ধুরা তখনও লাপাত্তা। সারাটা দিন কাটল অস্থিরতায়। একলা বিষণ্ণ অস্থির মনটাকে বোঝার মত লাগছিলো। দুপুরে কিছু খেতেও ইচ্ছে করলোনা। চুপচাপ ঘরে বসে থেকে কাঁদলো খানিকক্ষণ। মায়ের সাথে ফোনে কথা বললো। জানিয়ে দিল শীঘ্রই সে দেশে আসছে বেড়াতে। 

সন্ধ্যায় অভিজিৎ যখন অফিস থেকে ফিরল, বিভা তখন তাকে দেখামাত্র বলে উঠল, ‘আপনি এরকম করছেন কেন?’ 

—‘আমি আবার কী করলাম?’ 

—‘কাল রাত থেকে আমার সাথে কথা বলছেন না কেন?’ 

অভিজিৎ বিভার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো, ‘আপনি কি আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করছেন?’ 

কথাটা শোনামাত্র বিভার সুন্দর মুখখানায় একটা আক্রোশের ছায়া কেঁপে উঠলো, সে ভীষণ উত্তেজিত ভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় দূর্গা দৌড়ে এসে খবরটা দিল, ‘বৌদি, তোমার কাছে কজন লোক এসচে শহর থেকে। দেখা করতে চায়। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।’ 

—‘আমার সাথে দেখা করতে চায়?’ বিভা বিস্মিত। 

—‘হ্যাঁ।’ 

কপালে একটা প্রশ্ন বোধক চিহ্ন নিয়ে দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো বিভা। 

.

একটু আগে ঝুপ করে নেমে গেছে সন্ধ্যা। নীড়ে ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির পুরোপুরি থামেনি তখনও। দূর্গা উঠোনের মাঝখানে পোতা তুলসী গাছের গোড়ায় ধূপ জ্বালিয়েছিল। ধূপ জ্বালা গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। বিভাবরী ত্রস্ত পায়ে সদর দরজায় এসে দেখতে পেলো আবছা ধোঁয়াটে কুয়াশার মাঝে পাঁচজনের একটি দল দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমেই তার চোখ পড়লো ছিপছিপে লম্বা ছেলেদের মত ছোট করে চুল ছাটা মেয়েটির দিকে। তার পাশে লম্বা চুলের একটি ছেলে। ওদের প্রত্যেকের কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ। মুখগুলো ঝাপসা। 

বিভার হৃৎপিণ্ড কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্পন্দিত হতে ভুলে গেল। এক মহাসমুদ্রের ফেনীল জোয়ার এসে যেন ভিজিয়ে দিয়ে গেলো তাকে। তার বুক খালি, মাথাটা ফাঁকা, সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক শিহরণ! 

পাঁচ মূর্তি ওর দিকে নির্বাক চেয়ে আছে। চোখের পলক পড়ছেনা কারো। চোখের পলক পড়ছেনা বিভারও। সময় যেন থমকে গেছে। পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আটকে গেছে তার নিজস্ব কক্ষপথে। 

একটা সময় বিভা ধপ করে দরজার চৌকাঠের ওপর বসে পড়লো। লম্বা চুলের ছেলেটি এগিয়ে আসলো ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর ভেদ করে। বিভার কাঁধ ধরে ওকে টেনে তুলল বসা থেকে, দাঁড় করালো। বিভার ঠোঁট কাঁপছিল থরথর করে। হাত পায়ে শিরশিরানি। চোখের কোণে চিকচিক করছে কয়েকফোঁটা অশ্রুবিন্দু। ঝাপসা নয়নে রুদ্রর দিকে চেয়ে রইল সে কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর ডুকরে কেঁদে ওঠার আগে রুদ্রর বুকে মুখ লুকিয়ে শুধু একবার কোনো রকমে বলতে পারল, ‘আমি কি স্বপ্ন দেখতেছি?’ 

রুদ্র ওর মাথাটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললো, ‘স্বপ্ন নয়, আমরা সত্যিই এসে গেছি।’ 

আকাশ, হৃদি আর অমৃতা ছুটে এসে বিভাকে জাপটে ধরলো। বিভার আনন্দে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কী যে বাঁধনহারা এক সুখ তার বুকের ভেতরটায় দাপাদাপি করতে লাগলো তা আর ভাষায় প্রকাশ করার মত না। সে কি মরে যাবে নাকি খুশিতে? হৃদিতা ফিচফিচ করে কাঁদছিল। বিভা কাঁদতে কাঁদতে হৃদি আর অমৃতার মুখে চুলে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো। কী দেখলো কে জানে। যেন ওদের নাক মুখ চোখ সব ঠিক জায়গায় আছে কিনা তাই পরখ করতে লাগলো। 

উঠোনের ওপর, একটু দূরে, সন্ধ্যার আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে ছিল সামি। কাঁধে ব্যাগপ্যাক নিয়ে দু হাত প্যান্টের পকেটে পুরে বন্ধুদেরকেই দেখছিল সে। খানিক বাদে বিভার চোখ পড়লো ওর দিকে। কতদিন পরে দেখল সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে। ক-ত-দি-ন পর! 

ওই চোখে চোখ পড়তেই যেন সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে শিউলি ফুলের বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। তার সুখের, তার দুঃখের, তার স্বপ্নের,তার সমস্ত জীবনের,সব চাইতে প্রিয় মানুষটি এখন চোখের সামনে। পৃথিবীতে আজ আর কোন ক্লেশ নেই, মৃত্যু নেই, জরা নেই। সারা দুনিয়া জুড়ে বাজছে শুধু অবিরাম রিমঝিম এক সুখময় বাজনা। বিভা আর একটা মুহূর্তও নষ্ট না করে ঝড়ের গতিতে ছুটে গিয়ে সামির বুকের ওপর পড়ল। এই দৃশ্য দেখে রুদ্র সিটি বাজিয়ে উঠল আনন্দে। আকাশ ফিচেল গলায় বললো, ‘মামা তোমাদের কি আজ আমি কোথাও যাবোনা সিনেমাটার কথা মনে আছে?’ 

বন্ধুরা সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। তাদের মনে আছে। 

ঠিক সেই সময় অভিজিৎ নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো দরজার চৌকাঠে। সামি তখন বিভাকে জড়িয়ে ধরেছে। ওর সুগন্ধি চুলে নাক ডুবিয়ে ক্ষীণ গলায় বলছে,’কেমন আছিস? আমার বিভাবরী? অভিজিৎ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা অবলোকন করলো। বাকি চার বন্ধুকে অভিজিতের উপস্থিতিতে একটু অপ্রস্তুত দেখালো। অমৃতাই এগিয়ে আসল প্রথমে, ‘আরে জামাইবাবু, কেমন আছেন?’ 

অভিজিতের চোখ আটকে গিয়েছিল সামি আর বিভার দিকে। তার মুখ থমথমে, গম্ভীর। সে অমৃতার কথাটা শুনে একবার তাকালো অমৃতার দিকে। কোনো উত্তর দিলো না। তার চোখ জোড়া চুম্বকের মত টানছে সম্মুখে অন্ত রঙ্গ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক যুবতী। অমৃতা চট করে সামি আর বিভার দিকে দৌড়ে গেলো। বিভাকে সামির বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করতে মিনিটও লাগলোনা তার। বিভার কনুই টেনে ধরে বললো, ‘কীরে বাইরে দাঁড়ায় থাকব নাকি? ভেতরে নিবিনা আমাদের?’ 

বিভার চোখ পড়ল দরজায় দাঁড়ানো অভিজিতের দিকে। অপ্রতিভ হল সে। চট করে চোখের জল মুছে নিয়ে সামির কাছ থেকে একটু দূরে সরে আসল। বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ভেতরে আয়।’ 

অভিজিৎ কিন্তু কারো সাথে একটি বাক্য বিনিময়ও করলো না। যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো তেমন নিঃশব্দেই প্রস্থান করলো। 

বসার ঘরে এসে কার্পেটের ওপর ব্যাগগুলো ছুঁড়ে ফেললো সবাই। অনেক লম্বা জার্ণি ছিল। ক্লান্তিতে প্রত্যেকের চোখ ছোট হয়ে এসেছে। বিভা একদম পাকা গৃহিণীর মত প্রথমেই রান্নাঘরে ছুট দিল। দুর্গাকে বললো, ‘চট করে লেবুর শরবত বানিয়ে দাও। আমার বন্ধুরা অনেক দূর থেকে এসেছে। আর রাতের খাবারের ব্যবস্থাও করতে হবে।’ 

বললো ঠিকই কিন্তু শরবত বানালো সে নিজের হাতে। বিভাকে এত খুশি হতে এর আগে কখনো দেখেনি দূর্গা। সে তখন বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ কী রকম মেয়েছেলেগো বাবা, নিজের স্বামীর জন্য একটা কিছু যত্ন করে রান্না করেনা কোনোদিন কিন্তু এখন বন্ধুরা এসেছে তো খুশিতে বাক বাক হয়ে শরবৎ বানাচ্ছে! 

মিনিট দশেকের মধ্যেই ট্রেতে শরবৎ সাজিয়ে বসার ঘরে আসলো বিভা। তার পরনে কলাপাতা রঙের শাড়ি। সিঁথিতে সিঁদুর, দুহাতে শাঁখা। তাকে দেখতে বেশ বউ বউ লাগছে। সবাই সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়েছিল। হৃদি চারপাশটা দেখছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, মনোযোগ দিয়ে। বিভা ঘরে ঢুকতেই বললো, ‘এই তোর সংসার?’ 

বিভা এক গাল হাসলো, ‘হ্যাঁ, এই আমার সংসার।’ 

—‘আমার বিশ্বাস হইতেছেনা যে আমরা বিভার বাসায় আইসা পড়ছি!’ ট্রে থেকে শরবতের গ্লাস তুলে নিতে নিতে বলল রুদ্র। 

আকাশ বললো, ‘আসলেই, সব কিছু কেমন যেন অদ্ভুত লাগতেছে। মানে বিভা, আমাদের বিভা এখন ঘর সংসার করে। গেস্ট আসলে শরবত টরবত বানায় দেয়। বিশ্বাস হয়?’ 

ঘর সংসার বিষয়ক আলোচনা সামির খুব একটা ভালো লাগছিলোনা 1 সে ক্যাট ক্যাট করে বলে উঠলো, ‘আজাইরা কথা বলিস নাতো। এটা ওর সংসার হইতে যাবে কেন? শি ইজ নট পার্মানেন্ট হিয়ার।’ 

বিভা একটু চাপা গলায় বলে উঠলো, ‘ইশ সামি আস্তে কথা বল। কাজের মেয়েটা শুনতে পাবে।’ 

সামি আগের চাইতেও জোরালো গলায় বললো, ‘তোর কাজের মেয়েরে কি আমি ডরাই?’ 

—‘আমাদের জামাইবাবু কই? আমাদের দেইখা তো মনে হয় ছোটখাটো হার্ট এটাক হয়ে গেছে বেচারার। গিয়া দ্যাখ বাঁইচা আছে নাকি।’ শরবতের গ্লাসে লম্বা একটা চুমুক দিতে যাবার আগে আকাশ অনেকটা ঠাট্টার গলায় বলে উঠল কথাগুলো। 

বিভা ভ্রুক্ষেপ করলোনা। তার মুখ থেকে হাসি সরছেইনা। বন্ধুরা চলে এসেছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা। এখন সারা দুনিয়া চুলোয় যাক তার কিচ্ছু এসে যাবেনা। সে বন্ধুদের সবাইকে চোখ ভরে,মন ভরে দেখতে লাগল। 

অমৃতাটা আগের মতোই আছে। ছোট করে ছেলেদের মতো চুল ছাটা। গায়ে জিন্সের জ্যাকেট। মুখে কোনো প্রসাধন নেই। তবুও ওর গায়ের রংটা দেখার মত। একেবারে তপ্তকাঞ্চনবর্ণ! ছোট চোখ আর ছোট চোখা নাকের মুখটা বিড়ালের মতো আদুরে। পুতুলের মতো সুন্দর। বিভার ইচ্ছে হল গাল টেনে অমৃতাকে একটু আদর করে দেয়। আকাশের চোখদুটো এখনো আগের মতোই আকাশময়। ঠোঁট টিপে হাসছে আর সাথে হেসে যাচ্ছে ওর চোখ। ওর হাসিটা বিভার এত ভালো লাগে! আজ কত্তদিন বাদে দেখলো প্রিয় হাসিটা! রুদ্র আগের মতোই পাগল আছে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, দাড়ি গোফের জঙ্গল। কে বলবে এই ছেলে বুয়েট পাশ ইঞ্জিনিয়ার? ওদের বন্ধুদের মধ্যে সবচাইতে ভালো ছাত্র রুদ্র এবং সবচাইতে এলোমেলোও রুদ্র। আর ঐযে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা ছেলেটা! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটা! পৃথিবীর সবচেয়ে পাগল ছেলেটা! একটা কালো পুলওভার তার পরনে। দাড়ি কামিয়েছে বলে ফর্সা গাল আরো বেশি ফর্সা লাগছে। আরও বেশি সুন্দর লাগছে। 

হৃদি আগের চাইতে শুকিয়ে গেছে। চেহারায় অন্যরকম ধার এসেছে একটা। শ্যামলা গায়ের রংটা চকচক করছে। বিভা হঠাৎ বলে ফেললো, 

—‘কিরে হৃদি, তোরে এত সুন্দর লাগতেছে কেন? প্রেমে ট্রেমে পড়ছিস নাকি?’ 

হৃদি চমকে তাকালো বিভার দিকে। অথচ চমকানোর মত তো কোনো কথা বিভা বলেনি। বন্ধুদের মধ্যে এসব কথা হরহামেশাই হয়। আজকে নিজের চমকটা নিজের কাছেই বিশ্রী লাগলো তার কাছে। একটু বিব্ৰত ভাবে ঢোঁক গিলে বললো, ‘আর কাম নাই। প্রেম জীবনে একবারই করছি। রবিনই আমার শুরু আর শেষ। আর হবেনা।’ 

অমৃতা হঠাৎ জরুরি গলায় বললো, ‘বিভা। তুই প্লিজ অভিজিতের সাথে একটু কথা বলে আয়। আমরা তো উনার বাসায় আসছি তাইনা? উনি যদি এরকম ব্যবহার করে তাহলে আমাদের এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছা হবেনা।’ 

কথাটা শুনে বিভার মুখে অনেকক্ষণ ধরে ঝুলে থাকা হাসিটা সরল। একটা বিষণ্ণ ছায়া টলমল করলো চোখে। বললো, ‘আচ্ছা আমি দেখছি। তোরা এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। সে মানুষ ভালো। তোদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেনা।’ 

বিভার মুখে অভিজিতের প্রশংসা শুনে সামি একবার চোখ তুলে চাইল ওর দিকে। কী একটা যেন বলবার জন্য মুখ খুলল, কিন্তু বলল না শেষ পর্যন্ত। চেপে গেল। 

বিভা নিজের ঘরে এসে দেখলো অভিজিৎ বিছানার পাশের ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে দোল খাচ্ছে। তার মুখ ভার। চোখে প্রলয়ের আভাস। বিভা ঘরে ঢুকতেই সে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসলো। থমথমে দৃষ্টি রাখলো বিভার চোখে। বিভা থমকাল। অভিজিতের ভালোমানুষী চোখদুটোতে এমন কঠোরতা সে এর আগে কখনো দেখেনি। 

‘অভিজিৎ বাবু, আমার বন্ধুরা এসেছে।’ 

—‘কেন এসেছে ওরা?’ অভিজিতের গলার স্বরে তার ভিতরকার জ্বলন্ত 

আগুনের গনগনে আঁচটা টের পাওয়া যাচ্ছে। 

বিভা চোখ নামিয়ে বললো, ‘আমাকে দেখতে।’ 

অভিজিৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে বিভার সারা মুখে কী যেন খোঁজার চেষ্টা করলো খানিকক্ষণ। তারপর বরফ শীতল গলায় বললো, ‘আপনি আবারও আমাকে ইউজ করলেন, তাইনা?’ 

—‘মানে?’ 

—‘গতকাল থেকে আপনার বন্ধুরা আউট অফ নেটওয়ার্ক ছিল। তাই অন্য কিছু করার না পেয়ে আপনি আমার সাথে কথা বলে সময় কাটিয়েছেন। জাস্ট টাইম পাস্ করেছেন, তাইনা?’ 

বিভা অপরাধীর গলায় বললো, ‘ঠিক তা না।’ 

—‘তাহলে কী?’ 

বিভা বিব্রত ভাবে হাতের আঙুলের নখ কামড়াতে কামড়াতে স্তিমিত গলায় বললো, ‘ও আমি এমনিই আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাইছিলাম। ভাবছিলাম চলে যাবো যখন…. 

—‘চলে যাবেন যখন?’ 

—‘বাদ দিন না ওসব।’ 

অভিজিৎ কাটা কাটা গলায় বললো, ‘আপনার বন্ধুদের চলে যেতে বলেন।’ 

চমকে উঠলো বিভা, ‘বলছেন কী?’ 

—‘হ্যাঁ ঠিকই বলছি।’ 

—‘আপনি এতটা অভদ্র তা আগে জানা ছিলনা।’ 

—‘এ দেখি ভূতের মুখে রাম নাম! কিছু না বলে দুম করে কারো বাড়িতে চলে আসাটা কোথাকার ভদ্রতা শুনি? চলে যেতে বলুন ওদের, এখুনি।’ 

—‘না চলে যেতে বলব না। এটা কি শুধু আপনার একার সংসার?’ 

—‘অবশ্যই আমার একার সংসার। আপনি কে? আপনি তো চলেই যাচ্ছেন দুদিন পর।’ 

—‘এখনো যাই নি। ডিভোর্সও হয়নি এখনো। এ সংসারে আমার অধিকার এখন অবধি আছে ষোল আনা।’ 

—‘ঠিক আছে, তাহলে আমিই গিয়ে বলছি ওদের, এখানে থাকা যাবেনা।’ বলে অভিজিৎ পা বাড়ালো। বিভা পেছন থেকে ওর ডান হাতটা ধরে ফেলে আকুলিবিকুলি হয়ে বললো, ‘প্লিজ এরকম করবেন না। ওরা কত দূর থেকে এসেছে। আপনার মনে কি একটু দয়া মায়া নেই?’

—‘ঠিক আছে, তাহলে আপনারা থাকুন। আমিই চলে যাচ্ছি অন্য কোথাও।’ অভিজিতের গলার স্বরে ঝনঝন করে ছেলেমানুষী অভিমান বেজে উঠল। 

—‘আপনি কোথায় যাবেন?’ 

—‘যেখানে ইচ্ছা।’ 

বিভা অভিজিতের সামনে করজোড়ে দাঁড়ালো, আকুল হয়ে বলল, ‘প্লিজ এমনটা করবেন না। একটু ভালো ব্যবহার করুন ওদের সাথে। আপনার পায়ে পড়ি। আর কোনোদিন কিচ্ছু চাইবো না আপনার কাছে।’ 

—‘খুব পায়ে পড়তে শিখেছেন আপনি! এরকম হাতজোড় করে একদিন আপনাকে বিয়ে করতে বলেছিলেন, আপনার মনে আছে?’ 

বিভার চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা জল চিকচিক করছিল। ভারী গলায় বলল, ‘মনে আছে।’ 

—‘সেদিনও আপনি আমাকে ইউজ করেছিলেন। গতকাল রাতেও করেছেন। আজকেও করছেন। রূঢ় শোনালো অভিজিতের কণ্ঠস্বর। 

—‘কখনোই আমি আপনাকে ইউজ করিনি।’ 

—‘সর্বদাই করেছেন। আপনি খুব স্বার্থপর।’ 

বিভার চোখ থেকে টপ টপ করে কয়েক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল।

—‘বন্ধুদের দেখে আপনার রূপ পাল্টে গেল ভেলকি দিয়ে। কী তাজ্জব ব্যাপার!’ 

—‘প্লিজ, ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না। প্লিজ!’ 

অভিজিৎ একটা বড় নিশ্বাস নিলো। গম্ভীর ভাবে বললো, ‘ঠিক আছে। থাকুক ওরা। কিন্তু একটা শর্ত আছে। আমার চোখের সামনে ওই ছোকরাটার সাথে অত মাখামাখি করবেন না। রাগের মাথায় কিছু একটা করে বসতে পারি।’ 

বিভা চোখভর্তি কান্না নিয়েই কেন যেন হেসে উঠল, ‘আচ্ছা।’ 

—‘হাসছেন কেন? আপনার কাছে তামাশা মনে হচ্ছে আমার কথা গুলো?’

—‘হাসছিনা।’ 

—‘এইতো হাসছেন।’

—‘আপনি আমার বন্ধুদের সাথে হেসে কথা বলবেন, সেটা ভেবেই আনন্দে হাসছি।’ 

—‘আপনি স্বার্থপর, আপনি তা জানেন?’ 

—‘জানি।’ 

—‘আমি আপনার বন্ধুদের সাথে ভালো ব্যবহার করলে বিনিমিয়ে আপনি আমাকে কী দেবেন?’ 

—‘যা চাইবেন, তাই দেবো।’

—‘কথা দিচ্ছেন?’ 

—‘কথা দিচ্ছি।’ 

.

রান্নাঘরে উঁকি দেবার আগে বিভার মেসেঞ্জার শব্দ করে উঠল। সামি লিখেছে, আমি উঠোনে আছি। তুই একবার আয়। বিভা মেসেজের রিপ্লাই দিল, ‘এখন বাইরে গিয়ে দেখা করা কি ঠিক হবে?’ 

সামি লিখল, একশ বার ঠিক হবে। 

বিভা লিখল, আচ্ছা আসছি। একটু দাঁড়া। 

দূর্গা ফ্রিজ থেকে আস্ত মোরগ বের করেছে। লুচি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। অসময়ে রান্না করতে হচ্ছে বলে তার মুখ ভার। বিভা বলল, ‘দূর্গা, ওসব লুচি টুচি দিয়ে হবেনা। তুমি ভাত চড়াও। আমার বন্ধু গুলো বিশাল পেটুক, ওই ছোট ছোট লুচি খেয়ে ওদের পেটের এক কণাও ভরবেনা।’ 

দূর্গা একটু বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ও বৌদি, পেঁয়াজ আর লঙ্কা কেটে দাওনা গো। দিলে একটু উপকার হয় আমার।’

বিভা চোখ তুলে দূর্গাকে দেখলো একবার। মেয়েটি তাকে আদেশ করছে। রান্নার কাজের দায়িত্ব তো তার। বিভা কেন পেঁয়াজ কাটতে যাবে? মনে মনে রাগ হলেও মুখে কিছু বললোনা সে। ছুরি আর চপিং বোর্ড নিয়ে পেঁয়াজ কাটতে শুরু করলো। ওদিকে সামি অপেক্ষা করছে তার জন্য। দ্রুত পেঁয়াজের ওপর ছুরি চালাতে লাগলো সে। সামিকে বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলে নির্ঘাৎ রেগে যাবে। ইশ! জ্বালার শেষ নেই তার জীবনে। 

হৃদি গরম জল দিয়ে গোসল সেরে একটা হালকা সবুজ সুতি শাড়ি পরেছে। চুল ধুয়েছে বিভার শ্যাম্পু দিয়ে। তার চুল ভর্তি এখন বিভার চুলের মতোই সুগন্ধ ম ম করছে। আগে বিভা আর সে সবসময় এক সাথে শাড়ি পরতো। বিভা শাড়ি পরেছে কিন্তু হৃদি পরেনি এমনটা কখনো হয়নি। আজকেও হল না। 

অমৃতা শাওয়ার নিচ্ছিলো। হৃদি তৈরী হয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো ছেলেদের ঘরের দরজা দেয়া। সে কয়েক পা হেঁটে সদর দরজার কাছে আসল। দরজা খুলতেই হিম হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগলো নাকে মুখে। সেই সাথে ধূপের গন্ধ। উঠোনটা কুয়াশায় সাদা। পশ্চিম কোণে পেয়ারা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে লম্বা একজন মানুষ। হাতের আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটের আগুন উঠছে,নামছে। ভালো মতো তাকাতেই সিগারেটের আগুন আলোয় আবছা ভাবে সামির মুখটা দেখতে পেলো হৃদি। 

চারপাশ একদম নীরব। শুধু হাওয়া চলাচলের শব্দ, আর একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। শাল, শিমুলের গাছের পাতায় শর শর আওয়াজ তুলে ইচ্ছে মতো চড়ে বেড়াচ্ছে বুনো হাওয়াটা। জমাট বাঁধা অন্ধকারের ওপর সাদা কুয়াশা আঠার মতো লেগে আছে। সব কিছু ধোঁয়াশা, সবকিছু আবছা। সামির এক হাতে সিগারেট অন্য হাতে বিভার জন্য আনা উপহার। হোয়াইট গোল্ডের আংটি। হীরের কেনার ইচ্ছে ছিল কিন্তু টাকাপয়সার টানাটানিতে কেনা গেলোনা। সে পায়চারি করছিল চিন্তিত ভঙ্গিতে। এত দেরি করছে কেন বিভা? দশ মিনিটের বেশি হয়ে গেল। 

কুয়াশার ভেতর দিয়ে কেউ আসছে। শুকনো ঝরা পাতায় মড়মড় শব্দ তুলে। শাড়ি পরা, চুল খোলা একটি নারী মূর্তি। সামি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, শেষ পর্যন্ত আসলো বিভা! হাতে ধরা আংটিটা পুলওভারের পকেটে পুরে নিল সে। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল পাশের জঙ্গলে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যেতে লাগল মেয়েটির দিকে। তার বুকের ভেতর বড্ড তোলপাড়। কত দিন হয়ে গেল সে তার প্রিয় মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখেনা! নারী মূর্তিটির কোমরে সবল দুখানা হাত রেখে সে চট করে নিজের খুব কাছে টেনে নিয়ে আসল। কোনো কথা না বলে অন্ধকারাচ্ছন্ন নারীর ঠোঁটে তৃষ্ণার্তের মতো এঁকে দিল একটি নিবিড় চুম্বন। তারপর পকেট থেকে আংটি বের করে মেয়েটির ডান হাতের আঙুলে পরিয়ে দিল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘জীবনের সবচেয়ে সঠিক কাজটা এইমাত্র করলাম। মনে হচ্ছে এরচেয়ে সঠিক কোনো কিছু আমার জীবনে এর আগে হয়নায়!’ 

কেউ একজন গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে হাতে টর্চ নিয়ে পাশের রাস্তাটা দিয়ে আসছিল। সেই আলোতে সম্মুখে দাঁড়ানো মেয়েটির মুখখানা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। মেয়েটির চোখ ভর্তি জল। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। সামির বুকে একটা প্রবল ভয় খেলে গেল। মুখ হয়ে গেল কাগজের মত সাদা। চমকে উঠে দু পা পিছিয়ে গেল সে। আর্তনাদ করে বলে উঠল, 

‘হৃ দি-তা বিনতে জামিল! হোয়াট দ্যা ফাক আর ইউ ডুইং হেয়ার?’ 

হৃদি অন্ধকারে স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছেনা। কয়েকটা মূহর্ত কেটে যাবার পর সে খুব ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো। সামি পেছন থেকে বললো, ‘কই যাচ্ছিস, শোন হৃদিতা, কথা শুনে যা।’ 

হৃদি থামলোনা। কিছু বললও না। ভূতগ্রস্থের মতো হেঁটে হেঁটে মিশে যেতে লাগলো কুয়াশা ঢাকা আঁধারে। হৃদি চলে যাবার পর অনেকটা ক্ষণ সামি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতর মড়মড়িয়ে উঠছে এক তীব্র ব্যথা। হৃদযন্ত্রের গতি অস্বাভাবিক। কী হবার ছিল আর কী হয়ে গেল? কী আশ্চর্য, কী অদ্ভুত! ঘটনা ঘটানোর সময় একটা বারও তার মনে হয়নি যে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি বিভা নয়, অন্য কেউ। অথচ বিভাকে সে কতদিন ধরে চেনে! তার তো উচিত ছিল ঘোর অন্ধকারেও হৃদি আর বিভার মধ্যে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর পার্থক্যটুকু চিনে নেয়া। এখন মনে পড়ছে একটু একটু করে। অন্ধকারে হেঁটে আসা মেয়েটি হুবহু বিভার মতো দেখতে ছিলোনা। আবার হৃদির মতোও নয়। অথচ মেয়েটিকে দেখামাত্র মনে হয়েছিল এই যেন তার আজন্ম অপেক্ষার সেই কাঙ্খিত নারী। আর সে নারী তো বিভা ছাড়া অন্য কেউ নয়! তাই বিভা ভেবেই মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেছে সে। তাছাড়া ঠিক এ সময় বিভারই তো আসার কথা ছিল এখানটায়। তাহলে দোষটা কি শত ভাগ সামির ওপর বর্তায়? আর হৃদিই বা কেন তাকে বাধা দিলো না? হৃদি কি পারতোনা ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে? সামি নাহয় বিভা মনে করে ভুল করেছিল কিন্তু হৃদি তো জানতো এটা সামিই 1 

সামির বুকের ভেতরের বিবেচক মনটি বড্ড বেশি ঠোকর কাটতে লাগলো। গতবার কক্সবাজারে বিভার সাথে একটা কাণ্ড ঘটেছিল। এবার না চাইতেও হৃদির সাথে। কী ভীষণ বাজে ব্যাপার ঘটে গেলো। বন্ধুদেরকে মুখ দেখাবে কী করে সে? বিভা জানতে পারলে কিভাবে নেবে ব্যাপারটাকে? বুক দুরুদুরু করতে থাকে। আর হৃদি… হৃদি যদি তাকে ভুল বোঝে? 

সামি দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে গেল। হৃদির সাথে কথা বলা দরকার। বন্ধুদের কিছু বলার আগে তাদের দুজনের মধ্যকার ঝামেলাটা মিটমাট করে নেয়া খুব জরুরি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *