১
কেউ একজন দুম দুম শব্দে দরজা ধাক্কাচ্ছে। রুদ্রর কাঁচা ঘুমটা ছুটে গেল। চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘কে?’
আগুন্তুক এই প্রশ্নের উত্তরে আরো জোরেসোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। কারো গলার স্বর শুনতে পাওয়া গেল না ওপাশ থেকে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে আসল রুদ্র। দরজা খুলতেই সামিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তার চোখ দুটি হাসি হাসি। মুখখানা উজ্জ্বল। সে ঘুম কাতুরে রুদ্রর দিকে চেয়ে বিস্ময় মাখা গলায় বলল,
—‘দোস্ত ঘুমাচ্ছিলি?’
রুদ্র দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘শালা! ঘুম থেকে ডাইকা তুইলা জিগাইতেছিস ঘুমাইতেছি নাকি? এইটা কোন ধরণের ফাইজলামি?’
—‘শোন, একটু ড্রইং রুমে আয় তো! কথা আছে।’
—‘কীসের কথা?’
—‘আরে আয় না! এত পকপক করস ক্যান?’
রুদ্রর ঘাড় অবধি ঢেউ খেলানো চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে আছে। ক্যাটস আই চোখে দপদপ করছে বিরক্তি। সে হাঁড়িপানা মুখ করে সামির পেছন পেছন নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। দেখা গেল ড্রইং রুমের সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে আকাশ, অমৃতা আর হৃদি। তিন মূর্তিকে দেখে রুদ্র বিস্মিত গলায় বললো, ‘কী কাহিনী?তোরা সব এত রাত্রে আমাদের বাসায় কী করস?’
অমৃতা বললো, ‘আজকে থেকে ছাব্বিশ বছর আগে এই দিনে একটা প্রথম শ্রেণীর গাধার জন্ম হইছিল। সেই গাধাকে জন্মদিনের উইশ করতে আসছি।’
—‘মানে কী? কোন গাধা?’
আকাশ বললো, ‘বুয়েট পাশ গাধা।’
রুদ্র এবার একটু ভড়কে যাওয়া গলায় অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, ‘আজকে কত তারিখ?’
সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখা কেকের বাক্সটা খুলতে খুলতে উত্তর দিল সামি, ‘ডিসেম্বরের দশ তারিখ।’
শুনে রুদ্র ধপ করে সোফার উপর বসে পড়ল, ‘শালা! জীবন থেকে আরো একটা বছর চলে গেলো!’
—‘তাহলে কি এখন আমাদের আনন্দ করার বদলে শোক পালন করা উচিত?’ হৃদির বক্র কণ্ঠী প্ৰশ্ন।
রুদ্র ওর আউলবাউল চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে উদাস গলায় বললো,’দোস্ত আজকে আমার বার্থডে সেলিব্রেট না করলে হয়না? আজ আমার মনটা খুবই খারাপ।’
রুদ্রর পাশে একই সোফায় কিছুটা দূরত্বে সামি বসে ছিল। বাকি বন্ধুরা অন্য দুটি সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। এই ফ্ল্যাটটায় আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই। ড্রইং-কাম-ডাইনিং জুড়ে রয়েছে পাঁচ গদি বিশিষ্ট সেগুন কাঠের পুরোনো আমলের সোফা সেট, আর একটি পারটেক্স এর ডাইনিং টেবিল। তিন চার মাস হয়ে গেল রুদ্র আর সামি বসুন্ধরার এই ফ্ল্যাটে উঠেছে। ভাড়া পঁচিশ হাজার। সামি এদিককার একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ও লেভেলের শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছে সম্প্রতি। রুদ্র রহমানেরও চাকরি হয়েছে, একটি স্বনামধন্য ডেভলপার কোম্পানিতে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। মাসে চল্লিশ হাজার বেতন। এই স্বল্প আয় নিয়ে দুই বন্ধু বলতে গেলে এক রকম দুঃসাহস করেই বাসাটা ভাড়া নিয়ে ফেলেছে। না নিয়ে উপায় ছিলোনা। প্রয়োজনটা এত বেশি ছিল যে বিকল্প কিছু ভাববার সময় পায়নি তারা।
—‘মন খারাপ কেন? মনীষার জন্য?’ প্রশ্ন করল সামি।
—‘মনীষার কী হইছে? আমি তো কিছুই জানিনা!’ আকাশ বিস্মিত। হৃদিতা বাতাসে রহস্যের গন্ধ পেয়ে উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘আমিও তো জানিনা। কী হইছে মনীষার? মরে গেছে নাকি?’
শুনে রুদ্র আগুন চোখে তাকালো হৃদির দিকে। মানুষের চোখ দিয়ে ড্রাগনের মতো আগুন ছুঁড়ে মারা সম্ভব হলে রুদ্র এই মুহূর্তে নির্ঘাৎ অগ্নি বর্ষণ করে হৃদিকে ঝলসে দিত। হৃদি সেই আগুন দৃষ্টির সামনে কাঁচুমাচু হয়ে বললো, ‘এভাবে তাকাচ্ছিস কেন?কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে তোকে! চুল পাগলের মতো, চেহারা ভূতের মতো!’ এটুকু বলে একটু থামলো হৃদি। দু চোখ মেলে রুদ্রকে আগাগোড়া ভারী মনোযোগ দিয়ে দেখলো একবার। তারপর খুব সিরিয়াস ভাবে বললো, ‘তোর এই কিম্ভূত চেহারা দেখে ভয়ে পালাইছে নাকি মনীষা? সেই সম্ভাবনা আছে অবশ্য।’
হৃদির বলার ঢঙে বাকি বন্ধুরা হেসে ফেললো।
আকাশ বললো, ‘আসলেই, মনীষার কাহিনী কী?’
বেনসনের বাক্স খুলে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরল সামি- ‘আজ সকালের ফ্লাইটে সে তার ছেলেকে নিয়ে মালয়েশিয়া গেছে। ছেলে মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করবে।’
হৃদি বিস্ময় নিয়ে বললো, ‘ওমা!তাতে সমস্যা কোথায়?রুদ্র এমন মরা কান্না কানতাছে কেন?আমি তো মনে করছি মারাত্মক কিছু ঘটছে বুঝি।’
অমৃতা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লাইটার জ্বালিয়ে নিল। তারপর মোমবাতিতে আগুন ধরাতে ধরাতে বললো, ‘মরা কান্নার কারণ হচ্ছে, মনীষার ছেলেকে রুদ্রর আজকের পর থেকে আর পড়াইতে হবেনা। এর মানে মনীষার বাসায়ও এরপর থেকে রুদ্রর আর যাওয়া হবেনা। অতএব মনীষার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার রাস্তা আপাতত বন্ধ।’
হৃদি খুব বিশাল কিছু বুঝে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, ‘ও! তাই বল!’
—‘আরে ধুর, এইটা কোনো কথা হইলো? মনীষা তো ব্যাটা সিঙ্গেল। ছেলেও থাকবো না এখন। তোর রাস্তা আরো ক্লিয়ার। শালা গাধার বাচ্চা গাধা, বুদ্ধি বলতে কিছুই নাই তোর মাথায়।’ বলল আকাশ বিজ্ঞ গলায়।
আকাশের এমন উজ্জ্বল জাঁকালো ভবিষ্যৎ বাণী শোনার পরেও রুদ্রকে খুব একটা তৃপ্ত হতে দেখা গেলো না। পাঁচটা লম্বা লম্বা মোমবাতিতে ততক্ষণে আগুন ধরে গেছে। অমৃতা উঠে গিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল, ফ্যান বন্ধ করলো। মুহূর্তের মাঝে আগুন রঙের আলোয় ভরে গেলো সারা ঘর।
রুদ্র বললো, ‘পাঁচটা মোমবাতি কী মনে কইরা আনলি? আমার কি পাঁচ বছর বয়স নাকি?’
রুদ্রর প্রশ্ন গ্রাহ্য না করে বন্ধুরা সব সোফা ছেড়ে সেন্টার টেবিলের চারপাশে কার্পেটের ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসল, গোল হয়ে। সামি রুদ্রর হাত ধরে টেনে নামাল মেঝেতে। হাতে কেক কাটার ছুরি ধরিয়ে দিয়ে বললো,’নে কেক কাট।’
—‘আগে মোমবাতিতে ফুঁ দে।’ আদেশ করলো অমৃতা।
—‘দাঁড়া দাঁড়া!’ বাধা আসল হৃদির তরফ থেকে।
বন্ধুরা বিরক্তি প্রকাশ করলো, ‘কী হইলো আবার?’
হৃদি সোফার উপর থেকে ওর ভ্যানিটি ব্যাগটা এক টানে হাতে তুলে নিল। চেইন খুলে বের করল একটা লাল রঙের চিরুনি।
—‘বার্থডে বয়ের চুল দেইখা মনে হইতেছে এই চুলের উপর দিয়া ঘূর্ণিঝড় বইয়া গেছে। চুলটা ঠিক কইরে দেই।’ বলে হৃদি খুব যত্ন নিয়ে রুদ্রর মাথার চুল আঁচড়ে দিলো। ব্যাগ থেকে খুঁজে পেতে একটা রবার ব্যান্ড বের করে ঝুঁটিও করে দিল।
ঠিক সেই সময় অমৃতার ফোনে টুংটুং করে একটা বাজনা বেজে উঠলো।
বিভাবরী ফোন করেছে মেসেঞ্জারে। বিভার ফোন দেখে রুদ্রর বিষণ্ণ, ম্লান মুখখানা কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল হল। তার মনের ভেতরে এতক্ষণ অবধি চাপা একটা ভয় কাজ করছিল যে বিভা হয়তো তার জন্মদিনের কথা ভুলে বসে আছে। শেষ মুহূর্তের এই কলটা তার বুকের ভেতর থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিংড়ে বের করে আনল। মোবাইলের ক্যামেরায় উঁকি দিল বিভা। তার খোলা চুল ছড়িয়ে আছে ঘাড়ময়। সিঁথিতে গাঢ় লাল রঙের সিঁদুর। প্রতিমার মতো টানা দুটি চোখে হালকা কাজল কালো আভাস। মোবাইলের পর্দায় বন্ধুদের মুখ ভেসে উঠতেই সে উচ্ছ্বল গলায় বললো, ‘কই, বার্থডে বয় কই?’
অমৃতা ফোনের ক্যামেরা ঘুরিয়ে দিল রুদ্রর দিকে, বললো-’এইযে বার্থডে বয় এইদিকে।
—‘শোন রুদ্র, তোর জন্মদিন উপলক্ষে আমি একটা ছোট ছড়া লিখছি এখন সেই ছড়ায় সুর দিয়ে গান গাবো। তারপর আমরা কেক কাটবো। ওকে?’
অমৃতা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘বিভাবরী লিখছে গান?সূর্য আজকে কোনদিকে উঠছিল?’
বিভা আর কথা না বাড়িয়ে গান গাওয়া শুরু করলো,
‘রুদ্র রহমানের আজ জন্মদিন
চারপাশটা তাই খুশিতে রঙিন
বয়স ছাব্বিশ বছর
জন্মদিনের প্রহর
রুদ্র রহমানের হাসি
আমরা ভালোবাসি!’
ছড়াগান শুনে বন্ধুরা সবাই একচোট হাসলো। মনীষার বিচ্ছেদের যাতনায় কাতর রুদ্রর মুখেও একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠলো। হৃদি হৈ হৈ করে উঠলো, ‘বিভার বাচ্চি এই গান তুই লিখছস?নাকি রুদ্র লিখছে?অন্যের লেখা গান নিজের বলে চালায় দিচ্ছিস?চুরনি কোথাকার!
বিভা নির্বিকার গলায় বললো, ‘রুদ্র লিখেছে তার প্রমাণ কী?প্রমাণ দে! -’আমরাই প্রমাণ। আমাদের সবার মনে আছে গত বছর তোর জন্মদিনে রুদ্র এই গানটা লিখছিল।’
অমৃতা একটু ধমকের সুরে বললো, ‘আরে রাখতো এইসব প্যাঁচাল এখন! গান শেষ এখন কেক কাটার পালা। আয় কেক কাটি।’
রুদ্র ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভালো। সবগুলো মোমবাতি একে একে নিভে যাবার পর সারা ঘর ডুবল অন্ধকারে। অমৃতা উঠে গিয়ে বাতি জ্বালালো। কেক কাটার আনুষ্ঠানিকতা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবার পর সামি বললো, ‘এবার বল, কী চাই তোর বার্থডে উপলক্ষে?’
—‘যা চাই তাই দিবি?’ রুদ্রর প্রশ্ন।
—‘চেষ্টা করে দেখবো।’
রুদ্র মাথা চুলকে, দাড়ি হাতড়ে কয়েক সেকেন্ড খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবলো, তারপর গম্ভীর গলায় বললো,’দোস্ত এই মুহূর্তে আমি একটা টপলেস মেয়ে দেখতে চাই।’
কথাটা ওর মুখ থেকে বের হওয়া মাত্র বন্ধুদের মধ্যে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। আকাশ আর সামি হো হো করে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো। অমৃতা ভ্রু কুঁচকে জহুরি চোখে তাকালো রুদ্রর দিকে আর হৃদিতা মুখ ঝামটা মেরে বলে উঠলো, ‘ছি ছি ছি! এতো ফাজিল কেন তুই রুদ্র?ফাজিলের গাছ কোথাকার!’
রুদ্র মুখ গোঁজ করে বললো,- ‘ফাজিলের গাছ হব কেন? হইলে ফাজিলের মানুষ হব। গাছ হইতে যামু কোন দুঃখে?’
—‘কী মামা?আবোল তাবোল কথা কও কেন?মজা নেও?’ অমৃতার প্রশ্ন।
রুদ্র মাথা ঝাঁকিয়ে গম্ভীর ভাবে বললো, ‘মজা নেওয়ার মুড নাই আমার আজকে। সিরিয়াসলি গাইজ! আই ওয়ান্ট টু সি আ টপলেস গার্ল, ফর রিয়েল!’
বিভাবরী তখনো অনলাইনে। রুদ্রর বলা কথাগুলো তার চারশ স্কয়ার ফিটের লম্বাটে শোবার ঘরে একেবারে বোমার মতো বিস্ফোরণ ঘটাল যেন। অভিজিৎ বিছানার পাশে রাখা একটি ইজি চেয়ারে বসে কোলের ওপর ল্যাপটপ রেখে কাজ করছিল। রুদ্রর বলা শেষ বাক্যটা তাকে নাড়িয়ে দিলো। সে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো স্ত্রীর দিকে।
বিভা সোফায় শুয়ে শুয়ে আরাম করে কথা বলছিলো বন্ধুদের সাথে। অভিজিৎ কে ওরকম পিলে চমকে উঠতে দেখে সে উদ্বেগ নিয়ে বললো,
‘আপনার আবার কী হল?’
অভিজিৎ কোনো কথা বললোনা। হতচেতন ভাবে চেয়ে রইল শুধু। আর ওদিকে রুদ্র বলেই যাচ্ছে, ‘আমার বয়স ছাব্বিশ ঠিক আছে?এত বয়স হয়ে গেলো কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি কোনো সত্যিকারের টপলেস মেয়ে দেখিনাই। চিন্তা করতে পারিস? এইটা কোনো লাইফ হইলো?’
বিভার মুখে একটু হালকা অস্বস্তি খেলা করতে লাগলো। শোয়া থেকে উঠে বসলো সে ধীরে ধীরে। বিরক্তি নিয়ে অভিজিৎকে বললো, ‘এরকম ব্যাক্কলের মত তাকিয়ে আছেন কেন? কী হয়েছে আপনার?
অভিজিৎ এবার স্বগতোক্তি করলো যেন, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ।‘
বিভা ফোন কাটলো। এই লোকটা তার জীবনটা একেবারে নরক বানিয়ে ছাড়বে। বন্ধুর জন্মদিনেও দু দণ্ড শান্তিতে কথা বলার জো নেই।
—‘এতো ছি ছি করছেন কেন? সমস্যা কী?’
অভিজিৎ ল্যাপটপের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শীতল অথচ অনুচ্চ গলায় বলল, ‘রাত দুপুরে একটা ছেলে একটা মেয়ের কাছে এমন জঘন্য আবদার করতে পারে? ছিঃ’
বিভা একটু অপ্রতিভ হল কথাটা শুনে। রুদ্র যে ফট করে এসব বলে বসবে তা কে জানতো! এই ছেলের কান্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই। আজ দোষটা অবশ্য বিভার নিজের। তার উচিত ছিল অভিজিতের চোখের আড়ালে গিয়ে কথা বলা। কিন্তু এই বাড়িতে আড়াল কোথায়?একান্নবর্তী পরিবার এটা। এক বাড়িতে একত্রে তিনটি পরিবারের বাস। তার ওপর বিভার ছোট দেবরটি গত এক সপ্তাহ যাবৎ টাইফয়েডে ভুগছে। তাকে দেখতে কাছের দূরের সকল আত্মীয় স্বজন বলা নেই, কওয়া নেই যখন ইচ্ছে তখন হাজির হচ্ছে।
বিভা কোনোকালেই ঘরোয়া মেয়ে ছিলো না। সে বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। ছিমছাম, ছোট্ট, পরিবার তাদের। সাংসারিক কোনো দায় তার ওপর কখনো চাপানো হয়নি। এ কথা সত্য যে, সব মেয়েদের জীবনেই বাপের বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ির তফাৎটা ভারী প্রকট এবং প্রকাশ্য। কিন্তু বিভার ক্ষেত্রে সেই তফাৎটা একেবারে হয়ে গেছে আকাশ পাতাল। বিভার মতো আমুদে, চপল, দুরন্ত এবং সর্বপরি ছটফটে স্বভাবের একটি মেয়ে যেন এ বাড়ির বৌ হিসেবে একেবারেই বেমানান।
এই বেমানান জীবনটার সাথেই আপাতত তার মানিয়ে চলার যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সেই সাথে অভিজিৎ এর মতো রসকষ হীন এক জড়পদার্থকে দিনের পর দিন সহ্য করতে হচ্ছে। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন যে কোন জন্মের পাপের শাস্তি ভোগ করছে সে। অপ্রতিভ ভাবটা কাটিয়ে নিয়ে বিভা একটু কড়া গলায় বললো, ‘জঘন্য আবদার বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?’
অভিজিতের চোখদুটোতে অস্বস্তি খেলছে। তার দাড়ি কামানো পরিষ্কার তামা বরণ গালে একটু রাঙা ভাব। চুল পরিপাটি। চোখে একটি মোটা ফ্রেমের চশমা। তার কথা বলার ভঙ্গিটিও ভারী মার্জিত। পুরোদস্তুর ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায় আর কি। কিন্তু ভদ্র হলে কী হবে,বিভা জানে মনে মনে লোকটা ষোল আনা শয়তান। নইলে কেন বিভার ফোনে অমন চুপিচুপি আড়ি পাতা? এই লোকের অভিধানে কি প্রাইভেসি বলে কোনো শব্দ নেই?
অভিজিৎ ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই বললো, ‘একটা এডাল্ট ছেলে একটা এডাল্ট মেয়েকে কী করে এমন অসভ্য কথা বলতে পারে?’
—‘একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আপনি কোথায় পেলেন হ্যাঁ? এটা একটা গ্রুপ কনভারসেশন ছিল। ছয়টা ছেলেমেয়ে একসাথে কথা বলছিল। আপনি বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখছেন কেন?’
—‘এরকম একটা কথা বলতে আপনার বন্ধুর বাঁধলোনা?’
বিভা একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘রুদ্র জানতো না যে আপনি আমাদের কথা গিলছেন বসে বসে, জানলে জীবনেও এমন কথা বলতো না আপনার সামনে।’
অভিজিৎ থমথমে গলায় বললো, ‘ও এটা রুদ্র ছিল?আমি তো ভেবেছিলাম এ আপনার বয়ফ্রেন্ড।’
বিভা এবার বিরক্ত হলো, ‘আপনি কথায় কথায় আমার বয়ফ্রেন্ডকে টেনে নিয়ে আসেন কেন?’
—‘আমি টানার কে? টানবেন তো আপনি। একটু পরেই ফোন কানে নিয়ে ফুসুর ফাসুর শুরু হবে। চলবে সারা রাত।’
—‘হ্যাঁ চলবে। কিন্তু তাতে আপনার সমস্যা হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। আপনিই তো অনুমতি দিয়েছেন আমাকে, তাইনা? আপনি তো বলেছেন যে আমার একশোটা বয়ফ্রেন্ড থাকলেও আপনার কিছু আসবে যাবেনা, বলেন নি?
—‘হ্যাঁ বলেছি। আপনাকে আমি এও বলেছি যে এভাবে একটা সম্পর্ক টেনে হিঁচড়ে জোর করে টেনে নিয়ে যাবার মানে হয়না। আমাদের উচিত ডিভোর্স নিয়ে নেয়া।’
—‘হ্যাঁ নেবো। বলেছি তো বাবার শরীর একটু সুস্থ হলেই নেবো। এতো তাড়াহুড়ার কী আছে?’
অভিজিৎ এবার বিভার দিকে সরাসরি তাকায়, অকপট ভাবে বলে, ‘আপনি আসলে ভীষণ স্বার্থপর একটা মানুষ। আপনার অনুরোধে আমি আপনাকে বিয়ে করেছিলাম…’
বিভা অভিজিৎকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ঝগড়াটে গলায় বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমার সব মনে আছে। আপনি আমাকে বিয়ে করে আমার বাবার জীবন ভিক্ষা দিয়েছিলেন। আমার মান সম্মান বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু এসব কথা এখন কেন তুলছেন? আমার বন্ধুদের কথা শুনলেই আপনি এমন জ্বলে উঠেন কেন সবসময় বলুন তো? হিংসে হয় ওদের?
অভিজিৎ ল্যাপটপ বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে রেখে উঠে দাঁড়ালো। পায়ে চপ্পল লাগাতে লাগাতে খিটখিটে গলায় বলতে লাগলো, ‘চলেই যাচ্ছি আমি। ইচ্ছামতো প্রেম করুন এবার!’
বলতে বলতে অভিজিৎ গায়ে চাদর জড়িয়ে পা বাড়ালো বাইরে। এদিকে সামি ল্যাপটপ চালু করতে করতে বলল, ‘তুই ন্যুড মেয়ে দেখতে চাস? দাঁড়া দেখাচ্ছি।’
রুদ্র বিরক্তিতে কাদা হয়ে গেলো, ‘ধুর শালা, ভার্চুয়াল না। সামনা সামনি, সত্যিকারের! ভার্চুয়াল তো সারাদিনই দেখি।’
হৃদি ফোড়ন কাটল, ‘সারাদিন? লজ্জা শরমও নাই, খুব বাহাদুরির গলায় বলতেছে আবার। আল্লাহ!’
ঠিক সেই সময় রুদ্রর মোবাইলে একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসল। রুদ্র একটু দ্বিধান্বিত ভাবে চেয়ে রইলো নম্বরটার দিকে খানিকক্ষণ। ফোন রিসিভ করলো ভ্রু কুঁচকে। বন্ধুরা কেউ কোনো কথা না বলে সকল মনোযোগ ঢেলে দিল তার দিকে। রুদ্র ‘হ্যালো’ বলার পর কয়েকটা সেকেন্ড কাটলো নিভৃতে। ধীরে ধীরে তার কুঁচকে থাকা ভ্রু সহজ হল। বিড়াল চোখের ধূসর তারা দুটি চকচক করে উঠলো। এক অত্যুজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল দাড়ি ভর্তি গালে। সে মোবাইলের স্পিকার হাতের তালু দিয়ে ঢেকে মুখটা একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বন্ধুদের বললো, ‘মনীষা!’
শুনে বন্ধুরা এক চাপা উল্লাসে ফেটে পড়লো। সামি শিস দিয়ে উঠলো আনন্দে। আকাশ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে খুব নিচু স্বরে ‘ইয়েস ইয়েস! বলে হাত পা ছুঁড়ে দুই তিনটা লাফ দিলো। রুদ্র ফোন হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে। রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন কানে নিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ মনীষা, বলুন।’
—‘কোনো সমস্যা?’ মনীষার প্রশ্ন।
—‘না সমস্যা নয়। আমার ফ্রেন্ডরা হৈচৈ করছে তো, তাই আপনার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না।’
—‘ও, তোমরা জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে বুঝি?’
—‘না পার্টি কিছুই না। ওরা কেক নিয়ে এসেছিল। আপনার খবর কী?রাইয়ান কেমন আছে?’
—‘ভালোই। আজকে ওর এডমিশনের সব ফর্মালিটিস কমপ্লিট হল। নেক্সট উইক থেকেই ক্লাস শুরু।’
—‘বাহ্ বেশ ভালো। ওর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে?’
—‘হ্যাঁ হোস্টেলেই থাকবে। যাই হোক, জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ফোন করলাম তোমাকে। তুমি ভালো আছো তো?’
ধুপ ধাপ করে শব্দ হল পেছনে। রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বারান্দার দরজার ওপাশে তার বন্ধুরা নিজেদের মাঝে ধস্তাধস্তি করছে। অর্থাৎ কে কার আগে কান পেতে কথা শুনবে সেই প্রতিযোগিতা চলছে ওদের মাঝে। বিরক্ত রুদ্র হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজাটা আধ খোলা অবস্থায় ছিল। রুদ্র দরজার ফাঁক গলে মাথা বের করতেই সবকটা বান্দর পড়িমরি করে জায়গাটা থেকে সরে দাঁড়ালো। সামি ঝড়ের বেগে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে হৃদিতাকে একটা অনিচ্ছাকৃত ধাক্কা দিয়ে ফেলল। হৃদি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কার্পেটের ওপর। পড়েই তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘এই হাতির বাচ্চা হাতি!দেখে শুনে চলতে পারিস না? পিষে দিলি তো আমাকে!’
শুনে সামি চোখে মুখে এক অদ্ভুত কায়দা ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘আমি হাতির বাচ্চা? আর তুই কী? আমি হাতির বাচ্চা হইলে তুই হাতির নানী!’
রুদ্র দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। এখন বন্ধুরা কেউ ওর দিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র করছেনা। ভাবটা এমন দেখানো হচ্ছে যেন রুদ্রর উপস্থিতি তারা টেরই পাচ্ছেনা।
—‘তোরা কি আমার কথা শোনার চেষ্টা করতেছিস?’ বিরক্তি ঝরে পড়ল রুদ্রর কণ্ঠ থেকে।
অমৃতা তেরছা গলায় বলল, ‘আমাদের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নাই। বইসা আছি তোর কথা শোনার জন্য।’
—‘হেই এলেক্সা! প্লে আ সং ফ্রম মাই প্লে লিস্ট।’ ঘরের পশ্চিম কোণে রাখা পারটেক্স এর বুকশেলফটার দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় বলল রুদ্র। এলেক্সা নামক গোলাকার সাউন্ড বক্সটিতে তাৎক্ষণিক ভাবে সবুজ বাতি জ্বলে উঠলো, যান্ত্রিক গলা উত্তর দিল, ‘প্লেইং আ মিউজিক ফ্রম ইওর প্লেলিস্ট।’ তারপর চলতে শুরু করলো গান।
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘গান বাজনা বাজায় দিলি ক্যান? আমরা তো একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ করতাছি দোস্ত! তোর জন্য টপলেস মাইয়া খুঁজতেছি। ডিস্টার্ব করলে তো হবেনা।’
রুদ্র আর কোনও কথা না বলে নিজের মাথাটা টেনে নিয়ে গেল দরজার ওপাশে।
এদিকে এলেক্সা তখন গান শোনাচ্ছে, ‘নক নক নকিং অন হেভেন্স ডোর।
গানের শব্দে এতো জোর যে রুদ্রর ফোনে আড়ি পাতার চেষ্টা বৃথা হয়ে গেল। অতএব বন্ধুরা রুদ্রকে ছেড়ে দিল এই যাত্রায়। সামি হঠাৎ খুব জরুরি গলায় বলে উঠলো, ‘চল,রুদ্রর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা খুব ফাটাফাটি একটা কাণ্ড করে ফেলি। বিভার বাসায় গিয়ে ওকে সারপ্রাইজ দেই!’
আকাশ আঁতকে উঠে বলল, ‘বিভার বাসায় মানে?ইন্ডিয়া?’
—‘হ্যাঁ, আমাদের সবার পাসপোর্ট আর ভিসা তো রেডিই আছে।’
—‘কিন্তু বিভা খুব সম্ভবত দু তিনদিনের মাঝে জলপাইগুড়ি চলে যাচ্ছে। ওর বরের সাথে।’ অমৃতা বলল।
—‘আমরা তো জলপাইগুড়িই যাব।’
হৃদি মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘হ, জলপাইগুড়ি যাবা তুমি, অন্যের বউয়ের লগে পিরিত করার জন্য।’
এ কথায় সামির ফর্সা খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গালে লালচে আভাস লাগলো। হৃদির দিকে স্থির চোখে চেয়ে সে জোরালো গলায় বলল,
—‘অন্যের বউ আবার কী? ওদের ডিভোর্স তো হয়েই যাচ্ছে কদিন পর। বিভা আমার গার্লফ্রেন্ড, মনে রাখিস!’
—‘আমি এসবের মধ্যে নাই। তোরা গেলে যা।’ হৃদি মাছি তাড়ানোর মতো উড়িয়ে দিল প্রস্তাবটা।
আকাশ বলল, ‘কেন? আমার তো আইডিয়াটা জোশ মনে হচ্ছে। আর আমরা অনেকদিন ধরেই বিভাকে দেখতে যেতে চাচ্ছিলাম। যাব যাব করে কয়েক মাস হয়ে গেল। আমার মনে হয় আর দেরি করা ঠিক হবেনা।’
—হুম। ঠিক বলেছিস। লেটস মেক আ প্ল্যান।’ মতামত জানাল অমৃতা।
২
কেকের টুকরা মুখে দেয়ার সাথে সাথে রুদ্র বলে উঠলো, ‘এই কেকটা কে কিনছে?’
—‘কেন কী সমস্যা?’ সামির প্রশ্ন।
—‘বল না, কে কিনছে?’
—‘অমৃতা।’
—‘এই ছেমড়ি, তুই জানোস না আমি চকলেট কেক পছন্দ করিনা? চকলেট কেক কেন কিনছস?’
অমৃতা একটু নিভলো, ‘ওহ ভুইলা গেছিলাম দোস্ত। সরি!’
—‘সরি বললে তো হবেনা। দে পাঁচশ টাকা দে!’
—‘মানে কী?’
—‘মানে কী বুঝোনা?কেক পছন্দ হয়নায় আমার,তাই ক্ষতিপূরণ দিবি এখন।
—‘ইশ, শখ কত!’
রুদ্র হাত পেতে নাছোড়বান্দা গলায় বললো, ‘দে ট্যাকা দে, একটা কেক ঠিক মতো আনতে পারবি না, টপলেস মাইয়াও দেখার ব্যবস্থা করতে পারবিনা, আবার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ট্যাকাও দিবিনা! এইটা তো হয়না মামা!’
—‘আরে আমরা তো তরে ইন্ডিয়া নিয়া যাইতেছি। এর চেয়ে বড় গিফট কী হইতে পারে?’ সামি বলল।
—‘ইন্ডিয়া যাওনের খরচ তাইলে ফ্রি?’
—‘হ ফ্রি!’
রুদ্র কেক চিবোতে চিবোতে উদাস গলায় বলল, ‘আচ্ছা সেইটা তো এক সপ্তাহ পরের কথা, এখন আমারে পাচঁশ ট্যাকা দে।’
—‘দিমু না।’ অমৃতার দৃঢ় সিদ্ধান্ত।
ওরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে সোফার ওপর বসে ছিল। হৃদি বসেছে রুদ্রর পাশের গদিতে। সে ছোঁ মেরে রুদ্রর হাত থেকে কেকের প্লেটটা টেনে নিল। ধমকে উঠে বললো, ‘চকলেট কেক তো তোর পছন্দ না। তবুও রাক্ষসের মত গপগপ কইরা খাইতেছিস কেন?’
—‘তোরা কষ্ট করে কিনে আনছিস। এখন না খাইলে তোদের মন খারাপ হবেনা? তাই জোর করে খাইতেছি।’
রুদ্রর আধখাওয়া কেকটা টুপ করে মুখে পুরে দিল হৃদি। চিবোতে চিবোতে বললো, ‘আমাদের মোটেও মন খারাপ হবেনা। তুই না খাইলে বরং আমাদের ভাগে বেশি পড়বে। আমরা খুশি।’
—‘তাইলে টাকা দে!’ আদেশ করলো রুদ্র
আকাশ খ্যাঁক দিয়ে উঠে বললো, ‘এই ফকিরের বাচ্চা ফকির! খালি ট্যাকা ট্যাকা করতেছিস, সমস্যা কী তর? মনীষা কী কইছে সেইটা কস না ক্যান?
—‘দুই তিনদিনের ভিতর ফিরবে দেশে।’
—‘তারপর?’
রুদ্র নির্বিকার গলায় বলল, ‘তারপর আমরা বিয়ে করব।’
এ কথা শুনে বন্ধুরা প্রথমে ওর দিকে চোখ বড় করে চাইল, তারপর ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে।
—‘হাসতেছিস ক্যান? অসম্ভব কিছু বলে মনে হচ্ছে?’ রুদ্রর গলার স্বরে একটু তেজের আঁচ টের পাওয়া গেল।
অমৃতা বললো, ‘অবশ্যই অসম্ভব কিছু।’
রুদ্র এবার কোমর বেঁধে তর্কে নামলো,’কেন?অসম্ভব কেন?’
‘মনীষা তোকে বিয়ে করবে না।’
—‘কেন করবেনা?’
—‘কেন করবে?’ কাটখোট্টা প্রশ্ন অমৃতার।
সামি ফ্রিজ থেকে একটা কোকের বোতল বের করে নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রেখেছে। সাথে পাঁচ টা কাচের গ্লাস। গ্লাসে কোক ঢালতে ঢালতে সে বিজ্ঞ গলায় রুদ্রকে বলল, ‘শোন মামা, পছন্দ হইছে তোমার মহিলারে, এখন প্রেম করার চান্স থাকলে প্রেম কর। কিন্তু বিয়া শাদীর চিন্তা ভুলেও মাথায় আইনো না।’
—‘বিয়ে করতে না পারলে প্রেমও করব না।’ বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বলল কথাটা রুদ্র।
শুনে বন্ধুরা সব হৈ হৈ করে উঠল।
—‘খাইছে! রুদ্র রহমানের মুখে এমন সিরিয়াস কথা! ক্যামনে কী!’ বিস্ময়ে কাদা হয়ে গেল অমৃতা।
হৃদি বললো, ‘মনীষা তো মনে হইতাছে ওরে তাবিজ টোনা করছে।’
‘হায় মনীষা!’ সামির বুক থেকে যেন বেরিয়ে আসল হতাশা বিদ্ধ এক খেদ। অমৃতা ঠিক সামির সুরটাই নকল করলো, ‘ইশ মনীষা!’
—‘উফ মনীষা!’ আকাশও ধরল তাল।
রুদ্রর ভ্রু দুটি বেঁকে গেল, ‘আজকে আমার একটা জন্মদিন। কোথায় তোমরা নেচে গেয়ে আমাকে বিনোদন দিবা, তা না উল্টা আমারে নিয়াই মজা করতেছ?’
সামি বলল-’তোমারে বিনোদন দেয়ার জন্যেই তো ইন্ডিয়ার প্ল্যান করলাম। আচ্ছা শুনো সবাই, আগামী বৃহস্পতিবার রাতে তাহলে আমরা রওয়ানা হচ্ছি। আমি টিকেট বুকিং দিতেছি কালকেই।’
—‘ঢাকা থেকে কলকাতা নাহয় ফ্লাইটে গেলাম। কিন্তু কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি যাবো কেমনে?’ আকাশের প্রশ্ন।
—‘আমি দেখতাছি, তোদের টেনশন নিতে হবেনা।’
অমৃতা বলল, ‘তাহলে মাথাপিছু খরচ কত পড়তেছে?’
—‘শুধু টিকেট ভাড়াই তো লাগছে। থাকা খাওয়া ফ্রি। মানে বিভার বাসায়ই তো যাচ্ছি। ও নিশ্চয়ই থাকতে দিবে, আর থাকতে দিলে খাইতেও দিবে। কী বলিস?’ আকাশ বলল।
—‘আহা মনে মনে কত আশা! যাইব, থাকব আবার খাইবও। এই না হইলে বাঙালি, বইতে দিলে শুইতে চায়।’ ফোড়ন কাটলো হৃদি। তারপর উঠে দাঁড়ালো। তাড়া দিয়ে বলল, ‘আমার বাসায় যাইতে হবে। কাজিন আসছে বেড়াতে।’
ঘড়িতে তখন রাত একটা বাজে। হৃদির বাসা থেকে এর মাঝেই বেশ কয়েকবার ফোন এসে গেছে। বাড়িতে বলা আছে যে আজ রুদ্রর জন্মদিন, তাই বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। মূল দরজার চাবিও রাখা আছে সাথে। মাকে বলেছে ফিরতে দেরি হলে যেন ঘুমিয়ে পড়ে। অযথা জেগে থাকার কোনো মানে হয়না। কিন্তু এই মাত্র মায়ের নম্বর থেকে আসা এস এম এস টাই বলে দিল যে তিনি ঘুমান নি এখনো। ঠিক ঠিক জেগে বসে আছেন মেয়ের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়।
আকাশ বললো, ‘আজকে থাইকা যা, আন্টিরে বল।’
—‘না না, এখন আর কিছু বলা যাবেনা। তোরা থাক। তাছাড়া আমার কাজিনটাও ওয়েইট করতেছে। আমি যাই।’
—‘এত রাতে যাবি কেমনে একা একা?’ সামি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘চল, আমি নামায় দিয়ে আসি তোরে।’
উল্লেখ্য, সামির লাল মার্সিডিজ বেঞ্চটি তার মালিকানায় ফেরত এসেছে পুনরায়। নিজের বাবার টাকাকড়ি, সম্পদ এবং প্রভাব প্রতিপত্তি এই সমস্তই সে পরিপূর্ণরূপে বর্জন করেছে সত্য, কিন্তু তার মা শেষ পর্যন্ত তাকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার কখনো পায়ে ঠেলতে হয়না। এই গাড়িটি তার পিতা তাকে চব্বিশতম জন্মদিনে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। মায়ের মত হল যে, পিতৃদেবের কাছ থেকে হাত খরচ না নিলেও উপহার হিসেবে পাওয়া বিশেষ জিনিসটি কোনোভাবেই অবহেলা করা ঠিক হবেনা। কিন্তু একটা চার চাকার গাড়ির খরচা জোটানোর মতো আর্থিক অবস্থা সামির এখনো হয়ে ওঠেনি। মা সেই সমস্যারও সমাধান করেছেন। ব্যাংকে সামির নামে মোটা অংকের টাকার এফ ডি আর করে রেখেছেন তিনি। প্রতি মাসে ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত ইন্টারেস্ট বা সুদের দিয়েই গাড়ির খরচ চালিয়ে নেয়া যায় দিব্যি।
অমৃতা আর আকাশ আজ সামিদের ফ্ল্যাটেই থেকে যাবে। রাত জাগবে, আড্ডা দেবে। কাল শনিবার, ছুটির দিন। কারো অফিস যাবার তাড়া নেই। হৃদিতা সাধারণত উইকেন্ডের এসব রাতজাগা আসর গুলো মিস করতে চায়না। বন্ধুরা সব চাকরি জীবনে প্রবেশ করেছে। তার নিজেরও এমবিএ ক্লাস থাকে সপ্তাহে তিন দিন। ছুটির দিনগুলোতেই যা একটু আড্ডা টাড্ডা দেয়ার সুযোগ হয়। সেই সুযোগটাও আজ হৃদি হাতছাড়া করছে বলে বন্ধুরা বুঝি মনে মনে খানিকটা অসন্তুষ্ট হল। রুদ্র একটু মন খারাপের গলায় বলল,’থেকে গেলেই পারতি।’
—‘কাজিনটা না আসলে থাকতাম। ও আমার সাথে থাকার জন্যেই আসছে, সিলেট থেকে।
হৃদি আর সামি যখন নিচে নেমে গ্যারাজে আসলো তখন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ঝুমঝুম করা রাত। চারপাশ বড্ড নীরব। রাজপথের উপর আলগোছে মাকড়সার জালের মতো ঝুলে আছে কুয়াশার কৃশকায় এক সাদাটে চাদর। নগর জীবন ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ শুধু শোনা যাচ্ছে রাত জাগা প্রহরীর হুইসেল আর নিশাচর কুকুরের ঘেউ ঘেউ
হৃদির গায়ে একটা পাতলা শাল জড়ানো ছিল। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে শীতের প্রকোপ তেমন একটা বোঝা যায়নি। এখন বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। সোয়েটার বা জ্যাকেট সাথে করে না নিয়ে আসাটা বোকামি হয়ে গেছে। সামির পরনে বাদামি রঙা লেদারের জ্যাকেট। সে মনোযোগের সাথে জ্যাকেটের চেইন আটকাতে আটকাতে বললো, ‘এ বছর শীত ভালোই পড়ছে। জলপাইগুড়িতে শীত কেমন হবে কে জানে। গরম জামা কাপড় নিয়ে যাইতে হবে ঠিক মতো, বুঝছিস?’
হৃদি হালকা গলায় ‘হুম’ বলে গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসলো। উঠল সামিও।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো, ‘তোর হঠাৎ কী হইলো? ইন্ডিয়া যাওয়ার প্ল্যানটা পছন্দ হয় নায়?’
চলতে শুরু করতেই ঠান্ডা বাতাস ধাক্কা খেলো চোখে মুখে। খোলা চুলগুলো দুহাত দিয়ে পেঁচিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে হৃদি বললো, ‘জানালার গ্লাস উঠায় দে, ঠান্ডা লাগে।’
সামি জানালার কাঁচ উঠালো, বললো, ‘কথার উত্তর দিস না ক্যান?’
হৃদি নিরুত্তাপ গলায় বললো, ‘তোর কি ধারণা কাজটা ঠিক হচ্ছে?’
—‘ঠিক হবেনা কেন?’
—‘ভুলে যাস না বিভা এখন অন্য বাড়ির বৌ। তোকে দেখে অভিজিতের রিএকশন কী হবে বুঝতে পারছিস?’
—‘অভিজিৎ আমার আর বিভার ব্যাপারটা খুব ভালো মতোই জানে।
—‘ঠিক আছে, যা ইচ্ছে কর। আমি এসবের মধ্যে নেই।’
—’মানে কী? তুই যাবিনা?’
—’নাহ!’
সামি গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরে রেখেই হৃদির দিকে তির্যক ভাবে তাকায়। বিভ্রম নিয়ে বলে, ‘সত্যি যাবিনা?’
—‘না।’
—‘বলিস কী? ফানিমুন মিস করবি তুই? গাধা নাকি?’
শুনে হৃদি মৃদু হাসলো। ফানিমুন! শব্দটা প্রথম শুনেছিল আকাশের কাছ থেকে। বড্ড অসময়ে!
সেদিন খুব শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। বিভার বিয়ের বয়স তখন এক মাস ও হয়নি। সামি বিভার বিরহে পাগলপ্রায়। অমৃতার বাসায় তার আশ্রয় জুটেছে মাত্র কয়েকদিনের জন্য। বন্ধুরা সবাই সেই পাগল, অসুস্থ সামিকে দেখতে অমৃতার বাসায় গিয়েছে। যাওয়া মাত্রই শুরু হল কালবৈশাখীর প্রলয়ঙ্করী ঝড়। সেই সাথে শিলাবৃষ্টি। ওরা সব জড়ো হল অমৃতার বাসার ঝুল বারান্দায়। এর মাঝেই হঠাৎ বিভা ফোন করল। বন্ধুরা সব বিভাকে পেয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, কেউ দেখলোনা, টেরও পেলোনা যে সামি নীরবে সেই জায়গাটা থেকে সরে গেছে। শুধু টের পেয়েছিল হৃদি। সে পায়ে পায়ে হেঁটে সামির পেছন পেছন নিচে নেমে আসলো। মুষলধার বৃষ্টির মাঝে সামিকে পেছন থেকে ডাক দিল। সামি তখন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য। তার মুখ দেখলেই বোঝা যায় প্রথম প্রেমের ব্যর্থতা তার হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। হৃদি ওকে অনেক করে বোঝালো। কিন্তু বুঝল না সামি।
—‘আমার আর হবেনারে, আগের মতো করে আর কিছুই হবেনা!’ কথাটা বলেই সামি হনহন করে হাঁটা শুরু করে দিয়েছিল। পেছন পেছন হৃদিও। সামি রাস্তার মোড়ে এসে একটা সি এন জি নিলো। টুপ্ করে ওর পাশে উঠে বসলো হৃদি। তার পরনের কামিজ ভেজা। চুল দিয়ে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির জল। সামিও ভিজে চুবচুবু। হৃদির দিকে ফিরেও চাইছে না সে। গাঁট হয়ে বসে আছে। চোখজোড়া এক সর্বনাশা শূন্যতা। হৃদির বুক ধড়ফড় করছিল। এই পাগলটা আবার কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসবেনাতো? কী করবে সে এখন? বন্ধুদের ফোন করে বলবে কি এই পরিস্থিতির কথা? ঠিক সেই সময় মনে পড়লো তার সাথে ফোন নেই। নিচে নামার সময় ফোন ছাড়াই বেরিয়ে গেছে। হৃৎপিণ্ড টা চলে আসল গলার কাছে। কী হবে এখন?
সামিকে প্রশ্ন করলো, ‘সি এন জি নিলি যে?তোর কাছে টাকা আছে?’ সামি কেমন রিক্ত চোখে তাকালো, নিস্তরঙ্গ গলায় বলল, ‘না।’
—‘তাহলে সি এন জি নিলি কেন? হায় আল্লাহ! আমিও তো টাকা আনিনাই।’
সামির মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে আগের মত তরঙ্গহীন গলায়ই বললো, ‘তুই নেমে পড়, রিক্সা নিয়ে বাসায় ফেরত যা।’
—‘আর তুই?’
—‘আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমি একটু একা থাকতে চাই।’
—‘অসম্ভব তোকে আমি একা ছাড়ছিনা।’
—‘হৃদিতা প্লিজ! বিরক্ত করিস না।’
—‘একশোবার করব। ফাইজলামি পাইছিস তুই? একা থাকতে হবে কেন?’ ঠিক সেই সময় সামির পাঞ্জাবির পকেটে রাখা সেলফোনটা বিপ বিপ করে শব্দ করে উঠলো। সামি নিজের ফোন পিত্রালয়ে ফেলে এসেছে বলে অমৃতার একটা পুরোনো নকিয়া ফোন তাকে সাময়িক ভাবে ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। সামির পকেট থেকে হৃদিই বের করে নিল ফোনটা। ধরতেই ওপাশ থেকে আকাশ হড়বড় করে বললো, ‘কী মামা কই উধাও হইলা তুমি? হৃদিরেও তো পাইনা,ও কি তোমার সাথে আছে?’
—‘হ্যাঁ আকাশ আমি হৃদি বলছি।’
—‘কীরে তোরা হুট কইরা উধাও কেন? ফানিমুনে চইলা গেলি নাকি?’
-‘ফানিমুন আবার কী?
আকাশ হেসে উঠে বললো, ‘ফানিমুন মানে কী জানিস না? ম্যারিড কাপল একসাথে বেড়াতে গেলে বলা হয় হানিমুন আর বন্ধুরা কোন ট্যুরে গেলে তাকে বলে ফানিমুন।’
হৃদি খুব বিরক্ত হয়েছিল সেই মুহূর্তে আকাশের অযথা বকবকানি শুনে। তার বন্ধুরা সত্যিই পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতে পারেনা কখনো। শেখেইনি বিষয়টা।
—‘চুপ করে আছিস কেন?কথা বল!’
হৃদির ভাবন ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। ঘোর ভাঙল। অতীত থেকে বর্তমানে অবতরণ করল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে সামির মুখের দিকে চেয়ে বললো, ‘না দোস্ত, আসলে টাকা পয়সাও নাই হাতে। তাই এখন মনে হয় যাওয়া হবেনা।’
—‘টাকার চিন্তা করতে হবেনা।’
—‘টাকার চিন্তা না করলে চলবে কী করে? তোর বড়লোক বাপ তো এখন মাথার উপর ছাতা হয়ে আর নাই। তুই তো শালা এখন আমাদের মতই ফকির।’
—‘আমার নিজের টাকা আছে ব্যাংকে। টাকা তুলে নিবো।’
—‘না সামি। ওই টাকায় এখন হাত দিস না। কখন কী দরকার পড়ে বলা যায়না।’
—‘আমারটা আমি বুঝব। জ্ঞান দিতে আসিস না আমাকে।’
হৃদি চুপ করে গেলো। এ কথা সত্য যে বিভাকে তার দেখতে বড়ই ইচ্ছে করে। আগের দিনগুলোকে সে কী ভীষণ ভাবে মিস করে তা কথায় প্রকাশ করবার মতো শব্দ বুঝি তার ভাষার ভাণ্ডারে মজুদ নেই। কিন্তু কেন যেন হুট্ করে না বলে কয়ে অভিজিতের বাড়িতে গিয়ে ওঠার পরিকল্পনাটা তার ঠিক মনঃপুত হচ্ছেনা। বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা কুডাক ডেকে উঠছে থেকে থেকে।
রাস্তা খালি বলে পুরানা পল্টনে হৃদিদের বাসায় এসে পৌঁছুতে খুব একটা সময় লাগলোনা। হৃদির আম্মা জেগে বসে ছিলেন বসার ঘরে। সামি দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই সালাম ছুঁড়ে দিলো হৃদির মায়ের উদ্দেশ্যে। তিনি বসা থেকে উঠে আসলেন, কৃতজ্ঞ গলায় বললেন, ‘যাক বাবা তুমি এসেছো সাথে? আমি একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম এত রাতে মেয়েটা একলা বাড়ি ফিরছে বলে।’
সামি হেসে বললো, ‘না আন্টি একলা ছাড়তামনা তো ওরে এই মাঝরাতে। আপনি শুধু শুধু টেনশন করেছেন।’
মা বললেন, ‘এসেছ যেহেতু ভেতরে এসে বসো একটু। আমি শরবত বানিয়ে দিচ্ছি।’
—‘না না আন্টি আজকে আসি। অন্য একদিন হবে এসব।’
দরজার কাছে হৃদিতার মামাতো বোন তানিয়া উঁকি দিল। সামি এই মেয়েকে চেনেনা। এর আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু মেয়েটা সামিকে দেখামাত্র বলে উঠল, ‘আপনি সামি ভাইয়া না?’
সামি একটু অপ্রস্তুত হাসলো, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।’
হৃদি ফোড়ন কেটে বললো, ‘এইটা আমার কাজিন। ছবি দেখছে তোদের সবার। তাই চেহারা মুখস্ত। তুই আসবি ভিতরে? আসলে আয়, না আসলে ভাগ।’
সামি আর কথা না বাড়িয়ে ‘চলি এখন।’ বলে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াল।
সামি চলে যাবার পর শোবার ঘরে এসে তানিয়া কলকল করে বলে উঠল, ‘হৃদিপু, তোর বন্ধুদের মধ্যে সামি ভাইয়াই সবচেয়ে সুন্দর।’
কথাটা হৃদির খুব একটা পছন্দ হলো না। সে বাঁকা ভাবে বললো, ‘কেন অন্যরা কী দোষ করলো?
—‘না মানে, আকাশ ভাইয়ার চেহারা সুন্দর, দেখলেই মায়া লাগে কিন্তু সামি ভাইয়া হ্যান্ডসাম, বুঝছিস?’
হৃদি খিটখিট করে উঠল, ‘কেন?আমাকে কি তোর কম সুন্দর মনে হয়?
—‘না তুই তো তুইই। তুই তো আমার বোন। তোকে তো আমি জন্ম থেকে দেখে আসছি।’ এটুকু বলে তানিয়া নিজের চিবুকে হাত রেখে কী যেন ভাবল, তারপর আবার বলল, ‘বিভা আপু জোশ! উনার স্কিনে কী লাগায় আসলে? রুপের রহস্যটা কী? সবসময় এরকম চকচক করে কেন উনার গাল? অমৃতা আপু তো পুরা বিড়াল একটা, উনার পার্সোনালিটি আমার অনেক ভালো লাগে। আর রুদ্র ভাইয়া আস্ত পাগল, দাড়ি, গোফ চুলের জন্য উনার চেহারাই দেখা যায়না… আসলে তোর ফ্রেন্ডসরা সবাই অনেক ইন্টারেস্টিং, আই উইশ আমার যদি এমন একটা ফ্রেন্ড সার্কেল থাকত!’
শেষের কথা শুনে হৃদি উদ্ধত হাসল, ‘এমন বন্ধু সবার ভাগ্যে জোটেনা!’
৩
কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজছিল। আবছা এক নরম ভোর তখন অভিজিৎদের সল্টলেকের তিনতলা বাড়ির ঘুলঘুলি পেরিয়ে নেমে এসেছে পায়ে পায়ে। জানালায় পর্দা টানা। আধো আলো অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে তড়িঘড়ি করে বেড সাইড টেবিলের ওপরে রাখা এলার্ম ঘড়িটার শব্দ বন্ধ করলো অভিজিৎ
আজ সকাল দশটার বাসে ওরা জলপাইগুড়ি যাবে। অভিজিৎ আর বিভা। বিভা এই প্রথমবারের মতো বরের সাথে দূরে কোথাও যাচ্ছে। বিয়ে হয়েছে প্রায় আট মাস হয়ে হয়ে গেল। বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই অভিজিৎ চাকরির সুবাদে বাড়ি ছেড়েছিল। বিভা রয়ে গিয়েছিল সল্টলেকের এই একান্নবর্তী পরিবারে। অভিজিৎ কিন্তু নিজ থেকে একবারও বলেনি বিভাকে যাত্রা সঙ্গী হতে। বিভাও চায়নি খুব একটা। বাড়ির লোকেরা একরকম জোর করেই পাঠিয়ে দিচ্ছে তাকে বরের কাছে।
অভিজিৎ শোয়া থেকে উঠে রসে বিভার দিকে চাইল এক নজর। বিভা পাশ ফিরে সোফার ওপর শুয়ে আছে। কোমর পর্যন্ত একটি পাতলা চাদর জড়ানো। সিঁদুর লেপ্টে গেছে কপালে। বালিশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে এলো চুল। পরনের নাইটির গলার কাছের হুক খুলে গেছে অসাবধানতা বশত। সেই খোলা অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার সাদা কবুতরের মতো বুক দুটির অনেক খানি। নিশ্বাসের সাথে সাথে উঠছে, নামছে। এই সাবান ঘোলা পানি রঙের আবছা আলোতেও ওর শরীরের গাঁথুনি টা অভিজিতের নজর এড়ালনা। বালিশের কাছেই সেলফোন রাখা। গতকাল অনেক রাতে, বিভাকে ফিসফিস করে কথা বলতে শুনেছে সে। প্রায়ই শোনে। শুনে শুনেও না শোনার ভান করে মটকা মেরে পড়ে থাকে। অথচ মাত্র কয়েক হাত দূরে শুয়ে থাকা এই অপ্সরীর মতো সুন্দর দেখতে মেয়েটি কিন্তু সম্পূর্ণ তার নিজের হতে পারতো। আজকের শিশির ভেজা, স্নিগ্ধ, সুন্দর ভোরবেলাটা কাটতে পারত এই নারীর বাহুবন্ধনে, গভীর আলিঙ্গনে, এবং নিবিড় ভালোলাগায়!
বিভা নড়ে উঠল। ঘুমে ডোবা অর্ধনিমীলিত চোখে দেখতে পেল, অভিজিৎ চেয়ে আছে তার দিকে। একদৃষ্টে!
—‘কী ব্যাপার? অমন হাবলার মতো চেয়ে আছেন কেন? সমস্যা কী?’ ভারী জিভ নেড়ে বলল বিভা কোনো রকমে।
অভিজিৎ এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে একটু অপ্রতিভ হল। চোখ নামিয়ে বলল, ‘কিছুনা,উঠে পড়ুন। তৈরী হয়ে নিন। সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি থেকে বের হতে হবে।
—‘যেতেই হবে?’
প্রশ্নটা করল ঠিকই বিভা কিন্তু মনে মনে সে আসলে ভীষণ ভাবে চাইছিল এ বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। টানা আটটা মাস চার দেয়ালে বন্দি হয়ে একগাদা রসকষহীন ভারিক্কি মানুষজনের সাথে জীবন যাপন করতে গিয়ে রীতিমতন হাঁপিয়ে উঠেছে সে। জলপাইগুড়িতে অন্তত পারিবারিক বা সামাজিক দায়িত্ব বলতে কিছু থাকবে না। নিয়ম করে রোজ একই সময়ে খাবার টেবিলে উপস্থিত হতে হবেনা। খাবার সময় নিজের পাতে নজর না দিয়ে অন্যের পাতে কী কী তরকারি উঠবে তা নিয়ে ভাবতে হবেনা। আর সবচেয়ে বড় কথা হল জলপাইগুড়িতে পাওয়া যাবে অখণ্ড অবসর। যখন তখন সামির সাথে ফোনে কথা বলা যাবে। আড্ডা দেয়া যাবে বন্ধুদের সাথে। মনে মনে তাই এই দিনটার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল সে। তবুও নিজের ঠাঁট বজায় রাখতে গিয়ে গলায় জোর করে খানিকটা তাচ্ছিল্যের সুর ঢেলে দিয়ে প্রশ্নটা করেছিল সে, ‘যেতেই হবে?’
অভিজিতের চোখে একটি মেদুর ছায়া পড়ল। কেটে কেটে বলল, ‘যেতে না চাইলে যাবেন না। কেউ আপনাকে জোর করছেনা।’
বিভা অভিজিতের গলায় বাজতে থাকা অভিমানের সুরটা টের পেয়ে গেল। অমন ঝুলে যাওয়া মুখ দেখে একটু দুষ্টুমি করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলনা সে। শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে রসিক গলায় বললো, ‘অমন কান্নাকাটির কী আছে?বলেছি তো যাবো!’
অভিজিৎ বিস্মিত, ‘কে কাঁদছে?’
—‘আপনি!’ বিভা নির্বিকার।
—‘আমি কাঁদতে যাবো কেন? আপনার যাওয়া না যাওয়ায় আমার কিছুই এসে যায়না। আমি তো বাবা, মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আপনাকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য রাজি হয়েছি।‘
—‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু আমার যে এখন থেকে রোজ আপনার অমন আলুর মতো মুখখানা সকাল বিকাল না চাইতেও দেখতে হবে? কীভাবে সহ্য করব বলুন তো!’
অভিজিৎ হতভম্ব হয়ে গেল -’আমার মুখ আলুর মতো?’
এই প্রশ্নে বিভা অভিজিতের দিকে তাকায়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ভান করে, গম্ভীর ভাবে বলে, ‘একদম আলুর মত।’
—‘মোটেওনা, আমার মুখ লম্বাটে।’
—‘আলু কি সবসময় গোল হয় নাকি? লম্বা আলু কখনো দেখেননি?’
অভিজিৎ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল বিছানা ছেড়ে। খিটখিটে স্বরে বলল, ‘বড্ড বাজে বকেন আপনি সবসময়। ফালতু কথা বলা ছাড়া থাকতে পারেন না।’
বিভা হাসে, ‘তা ঠিক, ফালতু কথা বলতে না পারলে আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।’
স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিল বিভা। গোলাপি রঙের একটা লাল আর বাদামির মিশেলের তসর সিল্ক শাড়ি পরল সে। প্রতিমার মতো টানা দুটি চোখে ছোঁয়ালো কাজল। সিঁথি ভর্তি করে আঁকল সিঁদুর। কপাল বরাবর পরল লাল টিপ। লাল টুকটুকে বউয়ের মতো সেজেগুজে বাড়ির সবার সাথে একত্রে বসে নাশতা করল। বেরোবার মুখে শ্বশুর শাশুড়িকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেও ভুলল না। শাশুড়ি মা তাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন-
—‘শোনো বৌমা, আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো। সংসারে একটু মন দিও। তোমার তো যা উড়নচণ্ডী স্বভাব! বড্ড দুশ্চিন্তা হয়।’
বিভা একটা বড় শ্বাস ফেলল। এ বাড়ির প্রতি তার আলাদা রকমের কোনো টান নেই। পুত্রবধু হিসেবে তেমন কোনো গুরু দায়িত্ব সে আজ অবধি পালন করেনি। বাড়ির লোক গুলোকে আপন বলেও ভাবেনি কখনো। তবুও এই দুটি বয়স্ক মানুষ অতি অল্প সময়ের মধ্যে তার মনের ভেতরে একটা অন্যরকম জায়গা করে নিয়েছে। জায়গাটা কেমন যেন অস্বস্তির। বিভা না পারে সইতে, না পারে ফেলতে। ভালোবাসা আর স্নেহের অত্যাচারে দম বন্ধ হয়ে আসে তার মাঝে মাঝে। শাশুড়ি মানুষটা ঠোঁটকাটা এ কথা সত্য। কিন্তু বিভা জেনে গেছে কয়েক মাসের মধ্যেই, যে ভেতরে ভেতরে তিনি বড্ড সাদাসিধে, সরল।
—‘চিন্তা করবেন না মা। সব ঠিক থাকবে।’
—‘আর হ্যাঁ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। খুব শীঘ্রই যেন একটি সুখবর শুনতে পাই, কেমন? আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি নতুন অতিথিকে বরণ করব বলে।’
শেষ কথাটি বিভাকে আড়ষ্ট করে তুলল। চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল নিজের অজান্তেই।
—‘ওমা, কী হল? অমন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা কেন? কিছু বল!’ বিভা এবার চোখ তুলে তাকাল, ‘মা, আপনি আশীর্বাদ করুন।’ শাশুড়ি বিভার মাথায় হাত রাখলেন। প্রসন্ন গলায় বললেন, ‘শতায়ু হও মা। ধনে পুত্রে ভরে উঠুক তোমার সংসার।’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠতেই অভিজিৎ সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলো, ‘মা কী বললেন?’
‘তেমন কিছুনা।’
—‘আপনাকে কেমন চিন্তিত দেখাচ্ছে। দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু বলেছেন কি মা?’
বিভা এবার সরাসরি তাকালো অভিজিতের দিকে, ‘বললেন মন দিয়ে সংসার করতে, আর খুব শীঘ্রই তাঁদেরকে একটি সুসংবাদ দিতে।’
—‘সুসংবাদ? কীসের সুসংবাদ?’
—‘নতুন অতিথির।’
অভিজিৎ যেন প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারলনা বিভার বলা কথাটা। কপালে প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে নির্বাক চেয়ে রইল বিভার দিকে। তারপর খানিক বাদে যখন বুঝলো, তখন চকিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ও আচ্ছা।’
.
হৃদি আজ তিন বন্ধুর কাছ থেকে জরুরি ফোন পেয়েছে। অমৃতা, সামি, আকাশ, এরা তিনজনেই ফোন দিয়ে বলেছে, ‘কথা আছে, সন্ধ্যার পর মিট কর।’
হৃদির ক্লাস ছিল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। অমৃতা চেম্বার থেকে বের হয়েছে আধা ঘন্টা আগে। বসে আছে গুলিস্থানের জ্যামে। সামি আর আকাশ রাস্তায়। রুদ্রর অফিস ছুটি হবে সন্ধ্যে ছটায়। অর্থাৎ এখন এই শীতকালের মিষ্টি নরম শেষ বিকেলটায় হৃদিতার একা একা টি এস সি চত্বরে একটি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। অবশ্য সম্পূর্ণ একা বলা যাবেনা। এতক্ষণ অবধি তিতলি নামের একটি মেয়ে তার সঙ্গ দিয়েছে। তিতলি মেয়েটার সঙ্গ অবশ্য তেমন উপভোগ্য নয়। তার বেশিরভাগ গল্পই বড়লোক আপা দুলাভাইকে নিয়ে। দুলাভাই কোন কোন দেশ ঘুরলো, তার জন্য কী গিফট আনল, আপা কত টাকা দিয়ে শাড়ি কিনল এইসব আজেবাজে কথা বলেই সে টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট কাটিয়ে দিল। ভীষণ বিরক্ত লাগছিল শুনতে। একটা সময় হৃদি হাই তুলতে তুলতে বলল, তোমার আপা দুলাভাই ছাড়া তোমাদের পরিবারে আর কোনো বড়লোক নাই?’
মেয়েটি এই প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে গেলো, ঢোঁক গিলে বলল, ‘থাকবেনা কেন? আশ্চর্য তো!’
হৃদি হাসল, ‘আরও আছে? ওয়াও! তাহলে তাদের গল্পও একটু করো, শুনি। টাকার গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে, বল?’
মেয়েটির মুখ তখন অপমানে থমথম করছে। চট করে বসা থেকে উঠে পড়ে বলল, ‘থাক, আরেকদিন বলব। আজকে যাই।’
হৃদি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। পা নাচাতে নাচাতে চায়ের কাপে একটা তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বলল ‘সাবধানে যেও। ফি আমানিল্লাহ।’
বিকেলের রোদটা গায়ে লাগাতে আরাম লাগছে। বাতাসে ধূলোর গন্ধ। ছাত্রছাত্রীদের হৈচৈ আর কোলাহলে মুখরিত হয়ে আছে টি এস সি চত্বর। সবার প্রথমে আসলো আকাশ। তার পরনে একটা ফর্মাল ফুল হাত সাদা শার্ট। হাতে কনুইয়ে ঝুলিয়ে রাখা খয়েরি উলের সোয়েটার। চুল আঁচড়ানো পাট করে। অমন পরিপাটি আকাশকে দেখে হৃদি প্রথমেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ‘এত সাজছস ক্যান?বিয়া লাগছে নাকি?
আকাশ হৃদির পাশে ঘাসের উপর বসতে বসতে বললো, ‘বিয়া লাগলে তো ভালোই হইছিল।’
—‘তাইলে কী হইছে? হঠাৎ এত মাঞ্জা?’
—‘মাঞ্জা হবে কেন?ভার্সিটি থেকে আসলাম তো।’
—‘এতো সাইজা গুইজা ক্লাস নিতে যাও তুমি? তোমার মতিগতি তো বেশি সুবিধার মনে হইতাছে না।‘
আকাশ একটু চিন্তাযুক্ত গলায় বললো, ‘দোস্ত একটা ঝামেলায় পইড়া গেছি।’
—‘কী ঝামেলা?’
—‘দাঁড়া সবাই আসুক, একসাথে বলি সবাইরে।’
সামি আর অমৃতা এসে পড়লো আধা ঘন্টার মধ্যেই। গোল হয়ে ঘাসের উপর বসে গেলো সব। সন্ধ্যে নামার মুখে একটু একটু কুয়াশা ভেসে উঠেছিল বাতাসে। ছড়িয়ে পড়েছিল একটা হিমহিম ভাব। অমৃতার গায়ে ঝুলছিল কালো কোট। দেখে আকাশ নাক কুঁচকে বললো, ‘এই উকিলের পোশাকটা খুইলা ফ্যাল এখনই। পুরাই ছেলে ছেলে একটা লুক চইলা আসছে তোর ভিতর।’
—‘আসলে আসুক, তোর সমস্যা কী?’
—‘কথা সত্য। আজকে তোকে একটু বেশিই ছেলে ছেলে লাগতেছে। কাহিনী কী?’ সামির কৌতূহলী প্রশ্ন।
অমৃতা গমগম করে উত্তর দিল, ‘চুল কাটছি গতকাল। এইজন্যে হইতে পারে। তোরা কি এখন এইসব ফালতু প্যাঁচাল পারতে থাকবি নাকি জরুরি কথাগুলা বলবি?’
আকাশ নড়ে চড়ে উঠে বললো, ‘জানিস নাতো ঝামেলা হইছে একটা।’
–’আমার সাথেও একটা বাজে ঘটনা ঘটছে।’ অমৃতা বললো।
—‘আমারও একটা জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে তোদের সাথে।’ বললো সামি।
.
—‘প্রথমে অমৃতা বল।’ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে নেতৃত্ব দেয়ার ঢঙে আঙুল উঁচিয়ে বললো হৃদিতা।
অমৃতা কোটের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলো। লাইটার জ্বালিয়ে ধরালো আগুন। প্রথম টানটা দিতে যাবে ঠিক তখনই রুদ্র এসে হাজির।
‘আজকে আমি একটা অদ্ভূত প্রশ্নের সম্মুখীন হইছিলাম।’ অমৃতা বলল, চোখ বুজে ভারী আয়েশ করে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে।
—‘উফ আল্লাহ এত ঢং না কইরা বইলা ফ্যাল না তাড়াতাড়ি। ঢং দেখলে মনটা চায় একটা লাখি মারি পাছায়।’ বিরক্তিতে কাদা কাদা হয়ে হৃদি বললো।
—‘বলতেছি তো। আরে আমার চেম্বারে একটা এসহোলের বাচ্চা আছে, যুঁথি নাম। স্যারের নতুন জুনিয়র। ওই শালী আজকে আমারে হুট্ কইরা কী কয় জানোস? কয় কি, আচ্ছা, মিস অমৃতা আপনার কি ছেলে পছন্দ নাকি মেয়ে পছন্দ?’ এটুকু বলে থামল অমৃতা। বন্ধুদের মুখভঙ্গি এক নজর চেয়ে নিয়ে আবার বলল- ‘সিরিয়াসলি গাইজ? ক্যান ইউ ইমাজিন? শী জাস্ট আস্কড মি আমার ছেলে পছন্দ নাকি মেয়ে পছন্দ? আই মিন… হোয়াট দ্যা ফাক! আমার কেন মেয়ে পছন্দ হতে যাবে?’
বন্ধুরা কেউ কিছু বলল না। বোঝা যাচ্ছে অমৃতা প্রশ্নটা ঠিকমতো হজম করে উঠতে পারেনি এখনো। তাই হুট করে বেকায়দায় কিছু বলে বসা ঠিক হবেনা। বন্ধুরা তাই সময় নিলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগল অমৃতাকে। সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে অমৃতা খ্যাঁক দিয়ে উঠে বললো, ‘তোরা কিছু বলছিস না যে?’
আকাশ একটু ন্যাতানো গলায় বলল, ‘তারপর কী হল? তুই কী বললি?’
—‘আমি বললাম যে এটা কেমন ধরণের প্রশ্ন? অফকোর্স আই এম ইন্টারেস্টেড ইন মেন! বেটি তখন কয় কি, ও! আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম তোমাকে। তুমি আবার মাইন্ড করোনি তো?’
রুদ্রর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা, ‘আসলেই কি তোর ছেলে পছন্দ? মাঝে মাঝে আমারও কেমন সন্দেহ হয়।’
অমৃতা আগুন চোখে তাকালো রুদ্রর দিকে, ‘এটার মানে কী? আমারে কি তোর গে মনে হয়?’
রুদ্র বেফাঁস কথা বলে ফেলে অমৃতার রুদ্রমূর্তির সামনে একটু বেকায়দায় পড়ে গেল। মিনমিন করে বলল, ‘না মানে ইউ নেভার হ্যাড আ বয়ফ্রেন্ড, নট ইভেন আ ক্রাশ।’
অমৃতার ভেতরের তেজটা চোখে মুখে ঝিলিক দিচ্ছিল তখন। হৃদি পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বললো, ‘আচ্ছা থাক, কে কী বলল তাতে কিছু এসে যায় না। আর আমার মনে হয় যুঁথি মেয়েটা আসলে সম। তাই অমৃতাকে পার্টনার হিসেবে চাচ্ছিলো।’
আকাশ এতক্ষণে মুখ খুলল। অমৃতার চোখে চেয়ে কিছুটা গম্ভীর ভাবে বললো, ‘দ্যাখ অমৃতা, ওই মহিলা হয়তো নিজের মনের কথাটা তোর সাথে শেয়ার করছে বলে তুই ওরে দোষ দিতেছিস। কিন্তু তুই ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা একটু চিন্তা কইরা দ্যাখ। আমার মনে হয় তোর চালচলন দেইখা যে কেউই এ ধরণের ধারণা করতে পারে।’
হৃদি খুব কড়া একটা ধমক লাগালো আকাশকে, ‘চুপ থাকবি তুই? যতসব আজাইরা কথা!’
অমৃতা আকাশের দিকে চেয়ে ছিল বিস্ময় বিদ্ধ চোখে। আকাশের মাত্র বলা কথাটা যেন সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেনা। সামি একটা কৃত্রিম হাসি হেসে ওকে বললো, ‘আরে আকাশের বাচ্চা মজা নিতেছে, তুই চেতিস না।’
আকাশ কিন্তু দমল না। সে আগের চাইতেও দৃঢ় গলায় বললো, ‘না না আমি মজা নিচ্ছিনা। দ্যাখ আমার কথা হচ্ছে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য, স্বাধীন ভাবে চলার জন্য তোর তো পুরুষ মানুষের লেবাস নেয়ার দরকার নাই। ট্রাই টু একসেপ্ট ইওরসেল্ফ ফর হু ইউ আর।’
—‘তুই বলতে চাইছিস আমার প্রব্লেম আছে?’
—‘মোটেও আমি এমনটা বলতে চাইছিনা। আমার প্রশ্ন হল আল্লাহ তোকে মেয়ে বানায় দুনিয়ায় পাঠাইছে। তুই হুদাই ক্যান ছেলে সাইজা থাকবি?
অমৃতা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। তার চোখ দুটিতে দ্বিধা, কৌতূহল এবং সংশয়। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই চমৎকার সামলে নিলো সে নিজেকে। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, ‘যাই হোক, তোদের কথা বল, কী ঘটনা ঘটেছে শুনি?’
আকাশ বললো, ‘মামা আমি তো মহা ঝামেলায় পড়ছি। দুইটা সেকশনের পরীক্ষার খাতা হারায় গেছে।’
বন্ধুরা আঁতকে উঠলো।
—‘মানে কী? পরীক্ষার খাতা আবার ক্যামনে হারায়?
—‘ক্যামনে হারাইছে তা আমি জানিনা। বাট আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি আমার অফিস রুমের টেবিলের ড্রয়ারে রাখছিলাম। আজকে সকালে দেখি দুই সেট খাতা গায়েব।’
—‘ঠিক মতো খুঁজছস তুই সবখানে?’ সামির প্রশ্ন।
—‘হ, খুঁজছি। ক্যামনে কী হইল আল্লাহ জানে। আমার মাথায় কিছু ঢুকতেছেনা।’
—‘খাতার কি পা গজাইছে নাকি, যে হাঁইটা হাঁইটা অন্য কোথাও চইলা গেছে?’ হৃদি বললো।
—‘আমি জানিনা দোস্ত। খাতা খুঁজে না পাইলে খুব ঝামেলা হয়ে যাবে। ফাইনাল সেমিস্টারের খাতা ছিল। পোলাপাইনগুলা আবার পরীক্ষা দিতে চাইবই না। কী যে করি!’ চিন্তিত শোনালো আকাশের গলা।
—‘আল্লাহ ভরসা। খুঁজে পাবি কাল পরশুর মইধ্যেই। আমার মন বলতেছে।’ হৃদি অভয় দিল।
‘সামি তোর কিছু একটা বলার ছিল। ইম্পরট্যান্ট কিছু।’ স্মরণ করিয়ে দিল অমৃতা।
—‘ও আচ্ছা হ্যাঁ। শোন তোরা, আমি টিকেট বুকিং দিয়ে ফেলছি। আমরা নেক্সট থার্সডে বিকালে রওয়ানা দিব ইন শা আল্লাহ। কিন্তু ঝামেলা শুরু করছে আমার বাপ। আমি অনেক বড় ভুল করছি আম্মারে ব্যাপারটা জানায়ে। আম্মার পেটে তো কোনো কথাই থাকেনা। আম্মা সোজা গিয়া বইলা দিছে আমার বাপরে। এখন ওই ভদ্রলোক তো মনে কর কোমর বাইন্ধা নামছে আমার ইন্ডিয়া যাওয়ার প্ল্যান ক্যানসেল করার জন্য।’
রুদ্র আফসোসের গলায় বলে উঠলো, ‘শিট… এখন যদি উনি বিভার বাবাকে ফোন করে বলে দেয়?’
—‘সমস্যাটা এখানেই। আমার বাপরে আমি আর পাত্তা দেই না। কিন্তু বিভার বাবার কানে যদি কথাটা যায় তাহলে তো খুবই সমস্যা হয়ে যাবে।’
অমৃতার মেজাজ মর্জি আজ এমনিতেই ভালো নেই। সামির কথা শুনে সে দিয়াশলাই কাঠির মতো ভস করে জ্বলে উঠল, ‘তোর বাপ কী বলছে আসলে, খুইলা বল তো!’
—‘আমারে ডিরেক্টলি কিছু বলেনাই। বাট আম্মারে বলছে ইন্ডিয়া গেলে নাকি আমি আমার চাকরি হারাবো। উনি স্কুলের প্রিন্সিপালকে বলে আমার চাকরি নট করায় দিবে। অর্থাৎ আমারে ইন্ডিরেক্টলি হুমকি দিছে। প্রিন্সিপালের সাথে তার খাতির আছে এটা আমি জানি। আর আমি রিসেন্টলি খবর পাইছি ওই স্কুলের ট্রাস্টি বোর্ডে তার নাম আছে। শালা মাঝে মাঝে মনে হয় পুরা দেশটাই আমার বাপ কিন্না ফেলছে।’
অমৃতা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘ওই লোকটা এত বিরক্তিকর কেন? সামি শোন, তোর বাপ না হইলে আমি লোকটাকে একটা শিক্ষা দিয়েই ছাড়তাম। মনটা চাইতাছে মুখের মধ্যে ঘুষি মাইরা আসি কয়েকটা। মাইন্ড করিস না দোস্ত, বাট সিরিয়াসলি আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে।’
—‘রাগ তো আমারও হচ্ছে। তুই পারলে লোকটাকে একটা শিক্ষা দেন। আমি কিছুই মাইন্ড করবো না।
হৃদি বললো, ‘দ্যাখ, আমার মনে হয় আংকেল ঠিকই বলতেছেন। বিভার সাথে যে সামির অন্যরকম একটা সম্পর্ক ছিল সেটা সবাই জানে। সামির এরকম হুট করে বিভার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হওয়াটা দৃষ্টিকটু দেখাবে।’
—‘তোর সমস্যা কী? সব সময় খালি নেগেটিভ কথা কস ক্যান? হিংসা হয় নাকি?’ সামির গলাটা চড়ে গেল আচমকা।
চমকে তাকাল হৃদি সামির দিকে। অপমানে থমথম করে উঠলো মুখ। ভীষণ রেগে গিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না আবার। চুপ করে গেল।
অমৃতা হঠাৎ শক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘নাহ, সামির আব্বা লোকটা বেশি ঝামেলা করতাছে। ব্যাটারে একটা শিক্ষা দিতে হবে!’
৪
ডুয়ার্সের যে ছোট্ট গ্রামটিতে আজ বিভাবরীর পায়ের ছাপ প্রথমবারের মত পড়লো, তার নাম ‘বিন্দু’। গ্রামটি মূলত ভুটান এবং ভারতের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত একটি পাহাড়ি উপত্যকা। এর গা ঘেঁষে বইছে জলঢাকা নদী। পাথরের ওপর দিয়ে জল বয়ে যায় বলে সর্বক্ষণ জলপ্রপাতের মতো শব্দে মুখরিত হয়ে থাকে সারা গ্রাম।
অভিজিতের ডাক বাংলোর গেইটে যখন গাড়ি এসে পৌঁছুলো তখন সন্ধ্যে পুরোপুরি নেমে গেছে। ধোঁয়াটে এক অতীন্দ্রিয় কুয়াশায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। থেকে থেকে ডাকছে তক্ষক আর ঘুরঘুরে পোকা। ঘুরঘুরে পোকার ডাকটা বেশ নূপুরের ধ্বনির মতো শুনতে লাগছিল। কোলাহল রহিত নিশ্চুপ নীরব সন্ধ্যায় প্রকৃতি যেন নূপুরের তালেতালে নৈঃশব্দকেই উদযাপন করছে সদর্পে। সেই সাথে আছে জলপ্রপাতের শব্দ, তিরতির করে বয়ে যাওয়া নদীর ঝিরঝির করা ডাক।
বাস স্টেশনে অফিসের গাড়ি এসেছিল। স্টেশন থেকে এখানে পৌঁছুতে প্রায় চল্লিশ মিনিটের মত লেগেছে। আসবার পথে অভিজিতের অফিস হয়ে এসেছে ওরা। অফিসে বিভার আগমন উপলক্ষে জল খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অভিজিতের ইমিডিয়েট বস বিভাকে এক জোড়া স্বর্ণের কানের দুল উপহার দিয়েছেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে পারেন নি বলে আন্তরিক ভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
অভিজিতের অফিস গরুমারা ন্যাশনাল পার্কের কাছে। একটা বিষয় কিছুতেই বিভার বোধগম্য হচ্ছিলো না যে একজন শহুরে মানুষ কী করে দিনের পর দিন এমন জংলা জায়গায় বাস করতে পারে! তার বুকের মধ্যে একটা চাপ অনুভূত হচ্ছিলো। সে শহরের মেয়ে। জীবনে কখনো গ্রামে গিয়ে থাকেনি। একবার বাবার সাথে খুলনা সুন্দরবন বেড়াতে গিয়েছিল তিনদিনের জন্য। সুন্দরবন তাকে মুগ্ধ করেছিল এ কথা ঠিক, কিন্তু ভুলেও কখনো সেই বনের মধ্যে গিয়ে বসত গড়ার ইচ্ছে হয়নি তার। বনে মানুষ যাবে বেড়াতে, থাকতে নয়।
সেই সন্ধ্যায় ডাক বাংলোর সম্মুখে গাড়ি থেকে নামবার পর কুয়াশা ঢাকা দোচালা বাড়িটির দিকে তাকিয়ে বিভার মনে হল এখানে বুঝি স্থায়ী ভাবে থাকতে নয়, আসলে বেড়াতেই এসেছে সে। কিন্তু আপন জন ছাড়া একলা একলা কোনোদিন কোথাও বেড়াতে যায়নি সে। গিয়েছে হয় বাবা মায়ের সাথে, নয় বন্ধুদের সাথে। নিজের মনের মানুষদের ছাড়া প্রকৃতির সৌন্দর্য কখনো ষোলো আনা উপভোগ করা যায়না। এবার তার সাথে কেউ নেই। আছে এই রসকষ হীন, স্বল্পবাক এবং অমিশুক অভিজিৎ! ফাটা কপাল বোধহয় একেই বলে। বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস পিছলে পড়লো তার। বন্ধুদেরকে বড্ড মনে পড়ছে। ইশ, বান্দরগুলা যদি আজ পাশে থাকত!
দরজার সামনে একজন মধ্যবয়স্ক লোক, একটি যুবতী নারী এবং বছর পনেরোর এক কিশোর দাঁড়িয়ে ছিল। লোকটির গায়ে মোটা উলের চাদর জড়ানো। মাথা ঢাকা কান টুপিতে। সে বিভাকে দেখা মাত্র খুশিতে আটখানা হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘বৌদি মণি এসে গেছেন। মা লক্ষী এসে গেছেন আমাদের বাড়িতে!’
শাড়ি পরা মেয়েটি এগিয়ে আসলো। বিভার পা ছুঁয়ে প্রণাম করার জন্য ঝুঁকতেই বিভা হাত দিয়ে ধরে ফেলে নিরস্ত করলো তাকে।
মেয়েটাএক গাল হেসে প্রগলভ হয়ে বললো, ‘শেষ অবধি আপনার দেখা মিললো। দাদাবাবুকে কতবার বলেচি আপনাকে একটিবার নিয়ে আসতে!’
—এইত এসে পড়লাম।’ বলল বিভা, হালকা হেসে।
‘হয়েছে হয়েছে, এসব ন্যাকামো পরে করলেও চলবে। আগে ঢুকতে দে ভেতরে!’ হাঁক দিয়ে উঠল অভিজিৎ।
মেয়েটি শশব্যস্ত হয়ে বললো, ‘একটু দাঁড়াও।’
শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে বিভার গৃহ প্রবেশ হল। বাংলোটা এক তলা। সাজসজ্জা একেবারে সাদামাটা। আধুনিকতার ছাপ নেই, কেমন একটা পুরোনো পুরোনো ভাব। ঢুকেই সামনে পড়লো হলঘর। তাতে ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা সোফা। মাঝের টেবিলে কাচের ফুলদানীতে রাখা কিছু তাজা লাল টুকটুকে গোলাপ। হলঘরের পাশের লাগোয়া লম্বাটে ঘরটাতে খাবার টেবিল বসানো। মেঝে ছাই রঙের। বিভা পায়ের জুতো খুলে প্রথমেই সারা বাড়িটায় একবার চক্কর দিল। মোট তিনখানা বড় বড় ঘর। রান্নাঘর প্রশস্ত। সবচয়ে বড় কথা পেছনের বারান্দা থেকে সুস্পষ্ট ভাবে দেখা যায় আকাশ ছোঁয়া ভুটান পাহাড়। সব দেখেশুনে বিভার মনটা ভরে গেলো। বুকের চাপ ধীরে ধীরে হালকা হতে শুরু করল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামিকে একবার ফোন করল সে। নেটওয়ার্ক খুব একটা ভালো পাওয়া যাচ্ছেনা। অনেক কষ্টে ফোন লাগলো।
—‘হ্যালো, সামি!’
—‘কী হইছে? তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?’
তখন জলঢাকা নদীর আঁশটে গন্ধ বুকে নিয়ে হুহু করে বইছে হিম জড়ানো হাওয়া। দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কুহেলিকাময় গম্ভীর পাহাড়। মাথার ওপর এক আকাশ ভরা তারা। বিভা ওই শীত ছোঁয়া মোহময় সন্ধ্যায় আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে কেমন অন্যরকম গলায় বললো,
—‘আমি না, তোরে এই মুহূর্তে প্রচন্ড মিস করতেছি।’
—‘তুই তো নাকি সবসময় ই আমারে মিস করস। অন্য সময় তার মানে গল্প দাও, তাইনা?’
—‘আরে না! এখন একটা জোশ সময়। আমি জলপাইগুড়ি আসছি আজকে। ডুয়ার্সে।’
—‘ডুয়ার্স?’
—‘হ্যাঁ ডুয়ার্স। জায়গাটা খুব সুন্দর রে, তার চেয়ে বেশি সুন্দর আমার বাসাটা। বাসার বারান্দা থেকে পাহাড় দেখা যায়। চিন্তা করতে পারিস? সব কিছু একদম স্বপ্নের মতো!’
—‘তাই?’
—’হুম তাই। শোন সামি আমাদের বিয়ের পর আমরা পাহাড়ে হানিমুন করতে যাবো, কেমন?’
—‘ঠিক আছে।’ বলে সামি একটু থামে, তারপর আবার বলে, ‘আমরা যাব বুলগেরিয়া। বুলগেরিয়া অসাম।’
—‘আচ্ছা এখন ফোন রাখ, আমি হৃদি আর অমৃতারে ফোন দেই। এক কাজ করি চল, গ্রুপ কল করি। সবাইরে মিস করতেছি খুব।’
ঠিক সেই সময় বিভা লক্ষ্য করলো একটা লম্বা কালো ছায়া তার ঠিক পেছনে বারান্দার দরজার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চকিতে ফিরে তাকালো সে। অভিজিৎকে দেখতে পেল সন্ধ্যার ধোঁয়াশা আলোয়। বিভা একটু বিষম খাওয়া গলায় সামিকে বললো, ‘আচ্ছা এখন রাখি।’
ফোন কেটে নিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে, আড়ে আড়ে তাকায় সে অভিজিতের দিকে, আধো গলায় বলে, ‘কিছু বলবেন?’
অভিজিৎ তাৎক্ষণিক ভাবে কোনো উত্তর দিল না। কপালে ভেসে থাকা প্রশ্নচিহ্নটা সুতীক্ষ্ণ হল শুধু। অস্বস্তিতে কাঠ হয়ে রইল বিভা। অভিজিৎ কি তার সব কথা শুনে ফেলেছে?হানিমুনের কথাটাও?
‘আপনার পাহাড়ে হানিমুন করার খুব শখ,তাইনা?’ একটা সময় অভিজিৎ বলল, অনেকটা চাপা গলায়।
বিভা অপ্রতিভ হয়, মুখ নামায় নিচে।
—‘আসলে আপনাকে আমার ডিভোর্সটা খুব তাড়াতড়িই দিয়ে ফেলা উচিত। আপনি এক কাজ করুন কালকেই চলে যান ঢাকায়। আমার বাবা মাকে কিছুদিন পরে জানালেই হবে। আমি বুঝিয়ে বলব ওদের। ও নিয়ে আপনার ভাবতে হবেনা। আর আপনার বাবা মা কে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আপনার। সেই দায়ভার আমি নেবোনা।’
বলে অভিজিৎ আর দাঁড়ায় না। গটগট করে হেঁটে ভেতরে চলে যায়। বিভা বারান্দা ছেড়ে ঘরে এসে সচকিত ভাবে একবার আশপাশটা দেখে নেয়। চাকর বাকরদের কেউ শুনে ফেললে খুব খারাপ হবে। আসা মাত্র এসব ব্যক্তিগত ব্যাপার সম্পূর্ণ অচেনা কিছু মানুষকে সে জানাতে চায়না।
.
সামি ঘরের বাতি নিভিয়ে লেপের তলায় শুয়ে শুয়ে ফোনে কথা বলছিল। বিভার অমন আকস্মিক লাইন কেটে দেয়া তাকে খানিক বিচলিত করে তুলেছে। সে মুহূর্তের মাঝেই কল ব্যাক করল। উত্তর দিল না বিভা। পাশের ঘর থেকে কিছুক্ষণ পর পর রুদ্রর অট্টহাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। সে প্রতিবার একই তালে,একই সুরে হেসে যাচ্ছে। যেন কোন নাটকের হাসির মহড়া চলছে। এই মাত্র পঞ্চম বারের মতো তার হাসির আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল।
সামি বিরক্তি নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। মেঝেতে পা ফেলার ঠিক আগ মুহূর্তে তার মনে হল হৃদিকে একটা ফোন দেওয়া দরকার। সন্ধ্যা বেলায় সেই কথা কাটাকাটির পর থেকে হৃদি তার সাথে আর একটি কথাও বলেনি। চলে আসার সময় সামি যেচে পড়ে খোদা হাফেজ বলেছে কিন্তু হৃদি প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ ছিল। সামি তৎক্ষণাৎ হৃদির নম্বরে ডায়াল করল। একবার নয়, গুনে গুনে পাঁচবার। কিন্তু হৃদি লা পাত্তা। ওদিকে রুদ্রর ডাকাতের মতো অট্টহাসি একটু পর পর ঘর কাঁপাচ্ছে। সামি ভাঁজযুক্ত কপাল নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসল। রুদ্র পায়ের ওপর পা তুলে মহা আরামের ভঙ্গিতে সোফার ওপর বসে আছে। হাতে চিপ্সের প্যাকেট। তার চোখ মুখ থেকে উপচে পড়ছে খুশি। সামি ওর হি হি করে হাসতে থাকা মুখটা দেখামাত্র দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল, ‘সমস্যা কী তোর?’
রুদ্র মুখে হি হি বজায় রেখেই উত্তর দিল, ‘দোস্ত টেভার নোয়াহ দেখতেছি, নতুন শো। দেখলে আয়।’
সামি কোনো কথা না বলে একটা কঠোর দৃষ্টি রুদ্রর মুখের ওপর নিক্ষেপ করতে করতে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তার মাথা ধরেছে। এক কাপ চা এখন বাঞ্ছনীয়। এই বাসায় কোনো কাজের লোক নেই। টানাটানির সংসারে কাজের লোক রাখাটা বিলাসিতা বৈ অন্য কিছু নয়। সামির বেড়ে ওঠা অফুরন্ত অর্থবিত্ত এবং প্রাচুর্যের মাঝে। সে ছিল এক ‘না চাইতেই সব পেয়েছি’র জীবন। এক গ্লাস পানিও কখনো তাকে নিজ হাতে ঢেলে খেতে হয়নি। বাড়িতে এত এত ঝি চাকরের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ছিল যে সামি এদের কারো চেহারা ঠিক মতো মনে রাখতে পারতোনা। মনে রাখার চেষ্টাও করেনি কখনো। এ কথা কে জানত, যে বড়লোকের একমাত্র ছেলে সামিউল হককে একদিন উত্তরার সেই বিলাসবহুল, প্রাচুর্যমন্ডিত বাড়ি ছেড়ে এই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার চোদ্দশ স্কয়ার ফিটের ভাড়া ফ্ল্যাটে নিজ হাতে চা বানিয়ে খেতে হবে। হ্যাঁ, মধ্যবিত্ত জীবন যাত্রার সাথে সে বরাবরই পরিচিত ছিল। তার বন্ধুরা সবাই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে। কিন্তু দূর থেকে নদীর স্রোত দেখা, উপভোগ করা এবং জলে নেমে সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে সাঁতার কাটার মাঝে যে আসলে কতটা তফাৎ সামি তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বিলাসব্যসন বড় কঠিন নেশা। একবার কেউ এই নেশায় আসক্ত হয়ে গেলে, সেই আসক্তি কাটিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। সামি এই অসম্ভব কাজটাকে অনেকাংশেই সম্ভব করে তুলেছে।
চা বানানো হয়ে গেলে সামি ধোঁয়া ওঠা চায়ের মগ হাতে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে ফিরে চলল। ড্রইং রুম পার হয়ে তার শোবার ঘরে যেতে হয়। যাবার সময় আবারও রুদ্রর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মুখ ভর্তি চিপ্স সমেত হা হা হাসিটা দিতে যাচ্ছিল রুদ্র। সামির কটমটে চোখের সামনে পড়ে গিয়ে সে তার সাধের হাসিটির পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে পারল না। চিপ্স গিলে ফিনফিনে গলায় বলল, ‘বুন্দু, একা একা চা কাচ্চো?’
সামি বুঝল যে, রুদ্রর এই মুহূর্তে ফাজলামো মুড অন হয়ে আছে। এখন যে কোনো মূল্যে সে কথায় কথায় লেইম জোক ছুঁড়ে মারবে।। কিন্তু সামির এখন লেইম জোকের মুড নাই। সে নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা দড়াম করে রুদ্রর মুখের ওপর আটকে দিয়ে খিটখিট করে বলল, ‘মর শালা!’
রুদ্র উঠে এসে সামির ঘরের দরজায় করাঘাত করে বললো, ‘মামা কী হইছে?সব ঠিকঠাক?’
সামি ভেতর থেকে চিৎকার করে বললো, ‘প্যারা দিস না, যা ভাগ!’
—‘কিন্তু হইছেটা কী?’
—‘তোর মাথা হইছে।’
—‘আমার মাথা তো আমার মাথায়ই আছে। তোর কাছে গেল কেমনে।’
—‘ভাগ শালা!’
বললো সামি কিন্তু মিনিট খানেকের মধ্যেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলো। তার কোঁকড়া চুল এলোমেলো হয়ে কপালে এসে পড়েছে। ভ্রু কুঁচকানো, দেখে মনে হচ্ছে কোনো গভীর চিন্তা তাকে গ্রাস করেছে।
সে ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র হুঙ্কার ছেড়ে বললো, ‘হৃদিরে একটা ফোন লাগা তো।’
—‘তোর ফোনের কী হইছে?’
—‘পক পক না কইরা যা করতে বলছি কর।’
রুদ্র আদেশ পালন করলো। সামি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসলো সোফার ওপর। রুদ্র বসলো না। দাঁড়িয়েই রইল। তার পরনে হাফ প্যান্ট আর ঘিয়া রঙের টি শার্ট। ঘাড় পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুল ফুলে ফেঁপে আছে। সে ফোন কানে নিয়ে গালের জংলা দাড়ি হাতড়াতে হাতড়াতে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করছে। একটা সময় হৃদি ফোন ধরলো।
—‘কীরে? কী চাই?’
রুদ্র সামির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,’ফোন ধরছে!’
সামি চট করে উঠে পড়ে ছোঁ মেরে রুদ্রর হাত থেকে ফোন নিয়ে নিল।
—‘হ্যালো হৃদি?’
—‘কে?’
—‘আমি।’
সামির গলাটা চিনে নিতে হৃদির খুব বেশিক্ষণ লাগলোনা। ওপাশে খানিক নীরবতা। তারপর কান ফাটানো চিৎকার
—‘সমস্যা কী তোর? সেই তখন থেকে আমারে বিরক্ত করতেছিস কেন?’
—‘তুই আমার ফোন ধরিস নাই কেন? রুদ্রর নাম্বার দেখে তো ঠিকই ধরলি।’
—‘তোমার ফোন আমি কেন ধরবো?আমি তো তোমারে হিংসা করি, তুমি জাননা?’
সামি একটু অপরাধীর গলায় বললো, ‘আরে, ঐটা তো এমনিই বলছি।’ —’এমনি বলছ তাইনা? শুনো তুমি মোটেও এমনি বলো নাই। যা বলছ ভাইবা চিন্তাই বলছ। তোমার চেহারা দেইখাই আমি টের পাইছি।’
এ কথা শুনে হঠাৎ করেই সামির গলা থেকে অপরাধী ভাবটা দূর হয়ে গেলো। তার বদলে উড়ে আসলো এক ধরণের গাম্ভীর্য।
—‘লিসেন, তুই নিজেই এমনটা ভাবতে আমাকে বাধ্য করছিস।’
—‘আমি বাধ্য করছি?’
—‘হ্যাঁ করছিস। দ্যাখ হৃদিতা, সেই প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত তুই একটা মুহূর্তের জন্যেও আমার আর বিভার সম্পর্কটাকে সহজ ভাবে নিস নাই। ইউ নেভার এক্সেপ্টেড দ্যা ফ্যাক্ট দ্যাট আমি আর বিভা উই আর একচুয়ালি ইন আ সিরিয়াস রিলেশনশীপ।’
—‘মেনে নেই নাই কারণ মেনে নেয়ার মত কোনো সম্পর্ক এটা না। আমি বিভার ভালো চাই, তোর ভালো চাই। এই কারণে তোদের প্রেম কখনো সাপোর্ট করিনাই। বাট আজকে আমি সত্যি অবাক হইলাম, তুই ভাবছস আমি তোদেরকে হিংসা করি বলে সব সময় নেগেটিভ কথা বলি? সিরিয়াসলি? মানে আমি এতটা মিন?’
সামিকে এই পর্যায়ে একটু বিচলিত দেখাল। সে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘না, ঠিক সেটা না।’
—‘তাহলে কী?’
সামি কথা খুঁজে পায়না। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে সময় নিয়ে। ওপাশ থেকে হৃদি অনেকটা ধরা গলায় বলে, ‘ইউ নো হোয়াট? তোর মনটা খুব নোংরা।’
লাইন কেটে গেল। সামি ফোন হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ বসে রইল থম ধরে। রুদ্র বলল, ‘কাহিনী কী?’
সামি উত্তর দিল না। যেমন ছিল তেমন হয়েই বসে রইলো। তার কপালের ভাঁজ সরছেনা। রুদ্র পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টায় বললো,
—‘বাদ দে এইসব। হৃদি কালকের মইধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। ওরে নিয়ে চিন্তার কিছু নাই।
সামি এবার একটু নড়ে উঠল। ফোন নামিয়ে রেখে চায়ের কাপটা হাতে নিল। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। চুমুক দিতেই মুখ বিস্বাদ হয়ে গেল।
—‘দাঁড়া তোর মুড় ভালো করতেছি। পর্ন দেখবি? নিউ কালেকশন। লেসবিয়ান পর্ন।’ ফূর্তি ঝরে পড়তে লাগল রুদ্রর কণ্ঠ বেয়ে।
—‘আমি কি হৃদিকে কথাটা বলে ভুল করছি?’ সামির হতাশা বিদ্ধ প্ৰশ্ন।
–’অবশ্যই ভুল করছিস। হৃদি কষ্ট পাইছে। কিন্তু ব্যাপার না, বন্ধুদের মধ্যে এসব হয়ই। ঠিক হয়ে যাবে। এতো চিন্তার কিছু নাই।’
সামিও জানে চিন্তার কিছু নেই। জেনে বুঝেও সে ভীষণ চিন্তা করছে ব্যাপারটা নিয়ে। শুধু চিন্তা নয় একেবারে দুশ্চিন্তা!
কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে তারা বন্ধুরা অনেক হাবিজাবি কথা বলে সারাক্ষণ। কেউ এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়না। শুধু কান দিয়ে শোনে, মনে লাগায় না। কিন্তু সামির আজকের কথাটা হৃদির হঠাৎ এত মনে লাগল কেন? আর হৃদির মনে লাগাটা বুঝতে পেরে সামিরই বা অমন উচাটন লাগছে কেন সেই তখন থেকে? এইসব মানসিক টানাপোড়েন বন্ধুদের ভেতর মানায়না। নাহ, বিগড়ে থাকা মেজাজটা ঠিক হচ্ছেনা। সামি রেগে মেগে সেলফোন থেকে হৃদিকে টেক্সট করল,
ঢং দেখানোর জায়গা পাস্ না শালী, দূরে গিয়া মর।
একটু বাদে হৃদি টেক্সট ব্যাক করলো, তুই মর হারামজাদা, দূরে কাছে যেখানে ইচ্ছা!