বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়
নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরই আমরা পুরোনো বাসা থেকে আমাদের জিনিসপত্র একটু একটু করে গোছাতে শুরু করলাম। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, ফ্ল্যাটটা এখনও পুরোপুরি বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। বাথরুমের ভেতরে স্লাইডিং দরজা দেওয়া বাকি, বারান্দার টাইলসের কাজ বাকি, আপা-দুলাভাইয়ের শোবার ঘরে দেয়ালের ভেতরে কাঠের নতুন আলমারিটার কাজ আগায়নি। এসব বাদেও নানা কিছু অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে। সব শেষ হতে হয়তো আরও মাসদুয়েক লাগত, কিন্তু গত সপ্তাহের ঘটনার পর বলা যায় রীতিমতো ফাস্ট ফরোয়ার্ড করেই আমাদের বাসা ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। এই তেতলা বাড়িতে আমরা প্রায় সতের বছর ধরে ভাড়া আছি। কয়েক বছর আগে আম্মা আচমকা মারা যান। বড় কোনো অসুখ নেই, কিছু নেই। কেমন যেন বিনা নোটিসে গুম হয়ে যাওয়ার মতো তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর তেত্রিশ দিনের মাথায় আব্বা হন ঘর-ছাড়া। আপা আর আমি, যখন আব্বা হারিয়ে গেছেন কিংবা আত্মহত্যা করতে গেছেন ভেবে দুকূল ছাপানো নদীর পানির মতো কাঁদছি, সেজো মামাকে নিয়ে থানায় জিডি করে সব আত্মীয়ের বাসায় ফোন করছি, আব্বা তখন মধ্যরাতে ফোন করে জানালেন তিনি দুদিন পর বাড়ি ফিরবেন। আমি অবশ্য সেই ফোন পেয়ে আশ্বস্ত হওয়ার বদলে আরও শঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল, খুব খারাপ কিছু ঘটবে। থেকে থেকে চোখের সামনে আম্মার লাশটা ভেসে উঠছিল। আর ভাবছিলাম আব্বা বাড়ি ফেরার পথে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় কোনো দ্রুতগতির ট্রাক এসে উনাকে মেরে ফেলবে না তো? আপার সাথে ছোটবেলা থেকেই আমার কেমন যেন চেনা-অচেনা দূরত্ব ছিল। মাঝে মাঝে তাকে মনে হতো খুব চেনা, আবার মাঝে মাঝে মনে হতো অপরিচিত। তাই আপাকে আমার সব দুশ্চিন্তা বলার মতো সুযোগ ছিল না। আব্বা অবশ্য বেঁচেবর্তে, সুস্থভাবেই ফিরে এসেছিলেন বাসায়। তবে আমার চিন্তাটুকু ভুল ছিল না। তিনি একা আসেননি, তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মেয়েকে বিয়ে করে এনেছেন। দ্রুতগতির ট্রাকের চেয়ে এই ঘটনা কম বিপজ্জনক নয়। তবে আমি কেন যেন অবাক হলাম না। শুধু আব্বাকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস এবং উনার সাথে মেরুন রঙের শাড়ি পরা জবুথবু তরুণীটিকে দেখে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম। তবে আপা এই ঘটনা সহ্য করতে পারল না। মূর্ছা গেল একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে।
সেই রাতে তাকে ওজু করে সারা রাত কোরআন শরিফ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখেছিলাম। প্রায় নিঃশব্দ কান্না। খুব আলতো করে কান পাতলে শুধু শোনা যাবে ঝড়ের বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের মতো একটা মৃদু হু হু শব্দ হচ্ছে তার ভেতর থেকে। আমি তখন আমাদের প্রাচীন আমলের উঁচু খাটের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলাম। আব্বার শোবার ঘরের দরজা ছিল বন্ধ। সাঁইত্রিশ দিন আগেও যে ঘরে গেলে আম্মাকে খবরের কাগজ পড়তে বা রেডিওতে গান শুনতে দেখা যেত, যে ঘরের দরজা রাতের বেলা খোলা থাকলে আব্বার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যেত। সেই ঘর আজ ভেতর থেকে বন্ধ। এক অচেনা নারী আমার আম্মার স্থানে ঘুমাচ্ছেন, কিংবা হয়তো অন্যকিছু করছেন। আমি যা ভাবতে চাই না। কল্পনা করতে চাই না। তাই দু-হাতে আমার দু-চোখ চেপে ধরলাম। কানে হাত চাপা দিলে শব্দ আসা থেমে যায়। চোখে হাত চেপে যদি আমি কল্পনা থামানোর চেষ্টা করতে পারি, তবে ক্ষতি কী?
আমাদের ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে রাতের ঠান্ডা বাতাস আসতে শুরু করল। চারদিক সুনসান নীরব। আমি চোখ চেপে ধরে রেখেই বসে বসে সামনে পেছনে দুলতে লাগলাম। আপা এখনও কাঁদছেন। অল্প অল্প শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো আব্বাদের ঘর থেকে খুট করে একটা শব্দ হলো। আমি কি ভুল শুনলাম? মনে হয় না। তারমানে আব্বা ও সেই মেয়েটি জেগে আছে এখনও! ঘর থেকে শব্দটা আসা মাত্রই আপার কান্না তীব্র হলো। কী লাভ হবে কেঁদে? কাদলেই কি আম্মা ফিরে আসবেন? ওই মেয়েটি হারিয়ে যাবে আমাদের জীবন থেকে সারা রাত কেন আজীবন কাদলেও কি কিছু বদলাবে? কিছুই হবে না। আমাদের শুধু বিপন্নতার দিকেই এগিয়ে যেতে হবে। আমি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে যাই। ইচ্ছে হয় আপাকে ধমক দিয়ে থামাই। কিন্তু পারি না। শুনতে পাই, কাঁদতে কাঁদতে আপা বিড়বিড় করে বলছেন, ইয়া আল্লাহু, ইয়া রাহমানু, ইয়া রাহিমু…
এবার আমি চোখের বদলে দু-হাতে চেপে ধরি আমার কান। আম্মার হারিয়ে যাওয়ার সুরটা আমাকে খুব নিঃসঙ্গ করে তোলে। পৃথিবীর সব পাখির গানকে বড় কুৎসিত করে ফেলে। খাবারকে এত বিস্বাদ আগে লাগেনি যেমনটা তখন লাগত। আমরা দুই বোন দিনের বেশিরভাগ সময়ে বাসায় থাকলেই মোমের মূর্তির মতো ঠায় বসে থাকতাম। আপা সবসময় আগে খেয়ে নিত। এরপর ক্লাসের জন্য বের হয়ে যেত। আব্বা আর ওই নতুন মেয়েটার সাথে সে কখনো খেতে বসত না। শুধু আমি বসতাম। অল্প খাবার নাড়াচাড়া করে, প্লেট ও হাত ধুয়ে চলে আসতাম নিজের ঘরে। ভাগ্যিস আমাদের রান্না করে দেওয়ার জন্য একজন বুয়া ছিল। নয়তো নতুন মেয়েটির রান্না খেতে হলে আপা নির্ঘাত বমি করে ঘর ভাসাত কিংবা না খেয়ে খেয়ে শয্যাশায়ী হতো। এদিকে আব্বা কয়েকবার সূক্ষ্মভাবে আমাদের সাথে নতুন মেয়েটির স্বাভাবিক কথাবার্তা শুরু করাতে চেয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই আমাদের ঘর থেকে ওকে নেইল কাটার কিংবা মাথা ব্যথার ওষুধ আনতে পাঠাতেন। কিছুটা অপ্রস্তুত আর বিব্রত মেয়েটি আমাদের ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ করে কথা বলার চেষ্টা করতে করতে চিকন স্বরে বলত, নেইল কাটার কই আছে জানেন? আপা তখন উত্তর দিত না। আমি শুধু নিঃশব্দে উঠে এসে টেবিলের ড্রয়ার খুলে তার কাক্ষিত বস্তুটি বের করে হাতে দিয়ে দিতাম। সে তখন নিচু কণ্ঠে বলত, থ্যাঙ্ক ইউ। আমি দেখতে পেতাম সেই পোশাকি ধন্যবাদ শুনে আপা মুখ বিকৃত করে অন্যপাশের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। নতুন মেয়েটিকে আমি ঘৃণা করতাম না। মেয়েটির নাম বাদে তার পরিবার সম্পর্কেও খুব বেশি কিছু জানতাম না। শুধু মামার কাছে শুনেছিলাম মেয়েটি আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। অভাবী ঘরের সন্তান। আরও বেশ কিছু বোন আছে তার। তাই বাবা-মা অনেকটা খুশি হয়েই তাকে আব্বার সাথে বিয়ে দিয়েছে। মেয়েটির একটা সুন্দর নাম ছিল। ডাকনাম। তবে আব্বা তাকে সেই নামে না ডেকে ভালো নাম আফসানা বলে ডাকতেন। আমার মেয়েটিকে কোনো নামেই ডাকতে ইচ্ছে করত না। কোনো সম্বোধনেও না।
দিন দিন বাসায় আমাদের নিশ্বাস নেওয়াটুকুও দুষ্কর হয়ে পড়ছিল। সকালকে মনে হতো পাহাড়ের মতো ভারী। দুপুরকে গনগনে আগুন আর রাত নামলেই দুঃস্বপ্ন মনে হতো সব। এক রাতে খুব ভ্যাপসা গরম পড়েছিল। এমনিতেই আমাদের দু-বোনের ঘুম আসে না। আমরা চুপচাপ শুধু শুয়ে থাকি। ভোরের দিকে হয়তো কিছুটা ঘুমাই। তাও বলা যায় আমি ঘুমাই। আপা তো আজানের সাথে সাথে উঠে যায়। সেদিন প্রচণ্ড গরমে শুয়ে থাকতেও পারছিলাম না আমরা। মনে হচ্ছিল তোশকের নিচ থেকে লাভা বের হচ্ছে। আপা একসময় বলল, এই রত্না চল ছাদে পানি ঢেলে আসি। ঘরটা একটু ঠান্ডা হবে। আমার একবার মনে হয়েছিল বলি, আমি যাব না। তুমিই যাও। কিন্তু কী মনে করে যেন রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের তেতলা বাড়িতে আমাদের ঘরের ছাদটা সবচেয়ে উত্তপ্ত হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তাই আমরা বালতি নিয়ে গিয়ে ছাদের কল থেকে পানি ভরে সারা ছাদ ভিজিয়ে আসি। এতে করে ঘরের গরম অনেকটাই কমে আসে। সেদিন গভীর রাতে আমরা বালতি আর মগ নিয়ে পা টিপে টিপে ছাদে চলে গেলাম। বাইরের বাতাস কিছুটা গরম হলেও আকাশে সাঁতারকাটা মেঘের সারি। কেমন যেন নরম আলো। ভালোই লাগছিল। কিন্তু কলের কাছে যাওয়ার আগেই হালকাভাবে আব্বার আর মেয়েটির কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে এলো ছাদের অন্যপাশ থেকে। আমরা কিছুটা দূর থেকে দেখতে পেলাম আব্বা মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরেছেন। মেয়েটি হাসতে হাসতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। তিনি ছাড়ছেন না। তার ভারী কণ্ঠে হাস্যরস। কিছুটা আহ্লাদ।
আপা এক ছুটে বাসায় ফিরে এলো। আমি শুনতে পেলাম সে টয়লেটে গিয়ে বেসিনে হড়হড় করে বমি করছে। আমি বুঝতে পারলাম, সে আরও ভেঙে পড়েছে। একা হয়ে পড়েছে। যখন বেদনা জেগে ওঠে মানুষ একা হয়ে যায়। আহত চাঁদের মতো একা, কিংবা বিষণ্ণ রাতের মতো একা। আর আগে জানতাম অসুস্থ হলে মানুষের বমি হয় তবে প্রচণ্ড ধাক্কায় কিংবা বেদনায় যে বমি হতে পারে আমি সেদিনই প্রথম জানলাম। মনে মনে হিসাব কষলাম। আম্মা মারা গেছেন তিন মাস, পাঁচ দিন, আট ঘণ্টা।
সত্যি বলতে গেলে, আমরা যাকিছু জীবনে করতে চাই তা আসলে করা হয়। আমি বহুবার ভেবেছি বাসা ছেড়ে পালিয়ে যাব। যেতে পারিনি। অথচ বছর তিনেকের মাথায় আব্বা চাকরির পদোন্নতি নিয়ে মেয়েটিসহ অন্য শহরে চলে গেল। আমাদের জানাল, আমরা এখানে ভালোই থাকব। উনি মাসে মাসে আমাদের টাকা দিবেন। বাড়ি ভাড়া দিবেন। আর প্রতি সপ্তাহে দেখতে আসবেন। ততদিনে আপার মাস্টার্স শেষের পথে। আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেছি। আব্বার এই সিদ্ধান্তে আমাদের খুব বেশি ভাবান্তর হলো না। কিংবা বলা যায় হয়তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা। আমার মাথায় শুধু চিন্তা ছিল আব্বা আমাদের ভরণ-পোষণ দেওয়া বন্ধ করে দেন কি না। কিংবা একদম যোগাযোগ বন্ধ করে বাড়ি ভাড়ার দেনায় জর্জরিত করে ফেলেন নাকি। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে তিনি নিয়মিতই অর্থকড়ি পাঠিয়ে দিতেন। তবে সপ্তাহে নয় প্রথম দিকে মাসে একবার আসতেন, পরে তাও কমে এসেছিল। তাতে আমাদের কোনো সমস্যা হতো না। আমরা নিজেদের মতো থাকতাম। নীরবতার সীমারেখা খুব একটা ভাঙতাম না। আব্বাদের ঘরে আমি ঘুমাতাম। আমাদের ঘরে আপা একা থাকত। আমরা গুছিয়ে নিয়েছিলাম। আবার বিস্মৃত কোনো নদীর মতো ভাসতে শুরু করেছিলাম।
আমাদের নিচের তলায় থাকতেন ব্যবসায়ী আমজাদ মিয়া ও তার পরিবার। পেশায় ব্যবসায়ী হলেও আদতে অনেক বড় কোনো ব্যবসা উনার ছিল না। এলাকার সবগুলো ডিশ ও ইন্টারনেটের লাইন আসত উনার দোকান থেকে। একটা সুপারশপ আর কিছু সিএনজি, এই ছিল উনার ব্যবসা। তবে সবগুলোই চলত বেশ রমরমা। সে কারণে বেশ সচ্ছল ছিলেন। প্রাইভেট লেখা অটোরিকশা করে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। সবসময় সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতেন। চোখে সুরমা দিতেন, মাথায় টুপি। আর মাঝে মাঝে বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানার সময় মাথার টুপি খুলে রেখে দিতেন পকেটে। যেন টুপি পরে ধূমপান করা মস্ত বড় পাপ। সেই আমজাদ মিয়ার স্ত্রী আটপৌরে চেহারার ফর্সা সুন্দরী। সারাদিন বাড়িতেই থাকেন। বাইরে বের হলে নীল বোরখা পরে বের হন। তাদের দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলেটি দ্বিতীয় সন্তান। লাল একটা বাইক চালাত ও। বড় মেয়েটার জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছিল বহুদিন ধরে আর একদম ছোট মেয়েটা আমার চেয়ে কিছুটা ছোট। এই ছিল পরিবার। আমাদের সাথে প্রতিবেশী হিসেবে তেমন কোনো হৃদ্যতা ছিল না। চলতি পথে সিঁড়ির নিচে দেখা আর ঈদ কিংবা শব-ই-বরাতে অল্প ইফতার বা নাস্তা দিয়ে যাওয়া, এই ছিল সম্পর্ক। শুধু আব্বা চলে যাওয়ার পর পর আমজাদ মিয়ার স্ত্রী তার ছোট মেয়েটিকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। দুই ট্রে ভর্তি খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন প্রথম আমি তাকে দেখেছিলাম বোরখা ছাড়া। চৌকো ফর্সা চেহারা, বড় বড় চোখ। ভাবলেশহীন মুখ। খাবার দিয়ে চলে যাওয়ার আগে সেই ভদ্রমহিলা আমার আর আপার মাথায় দীর্ঘক্ষণ হাত বুলিয়ে গেলেন। আমি বুঝতে পারলাম উনি হয়তো আমাদেরকে সান্তনা দেওয়ার মতো কিছু কথা বলতে চাইছেন। হয়তো আসার আগে কথাগুলো সাজিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন বলতে পারছেন না। আমার মায়াই লাগল উনার জন্য। সহানুভূতি দিতে এসে সহানুভূতি পেয়ে যাওয়া মর্মাহত হওয়ার মতো বিষয়।
এদিকে স্মৃতিবদলের পাতা উলটে একদিন আপা তার এক সহপাঠীকে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে বসল। আমি খুব ভালো করে লোকটিকে খেয়াল করলাম। এবং বুঝতে পারলাম আপা ঝোঁকের বশে, একাকিত্ব থেকে বিয়ে করেছে লোকটিকে। সে সুখী হবে না। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আপা সম্পর্কিত সব চিন্তা বাদ দিয়ে বেদনাজলে ডুবে গেলাম। চুপ করে বসে রইলাম ছাদে। দীর্ঘক্ষণ।।
আমজাদ মিয়ার বাসা থেকে মাসখানেক ধরেই ঝগড়া শোনা যেত। কী কী বলত খুব বেশি বোঝা না গেলেও, টের পাওয়া যেত তুমুল ঝগড়া। এভাবে প্রায় প্রায় একই ঘটনা ঘটতে থাকল। সপ্তাহখানেক আগে এক বিকেলে শুনতে পেলাম ঝনঝন শব্দে ভেঙে গিয়েছে জানালার কাঁচ। আর পুরুষ কণ্ঠে টুকরো টুকরো অকথ্য গালির শব্দ তীরের মতো ছুটে আসছে বাইরে। আমি পায়ে পায়ে হেঁটে গেলাম বারান্দায়। আমজাদ মিয়ার কণ্ঠ ভেসে এলো, স্পাই লাগাইছস আমার পিছে? এত বড় সাহস মাগির! লাথি মাইরা তোর…
আমজাদ মিয়ার কণ্ঠ ঢাকা পড়ে যায় তার স্ত্রীর চিঙ্কারে। সম্ভবত ভদ্রমহিলা কাঁদছেন কিংবা ঝগড়া করতে করতে কণ্ঠ ভেঙে গেছে উনার। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে তিনি উচ্চস্বরে বলছেন, মাইয়ার বয়সি কারো সাথে শুইতে লজ্জা করে না? পাড়ার সবাইরে বইলে দেব আমি। সবাইরে।
আমজাদ মিয়ার প্রচণ্ড গর্জন শোনা যায়, আর সেই সাথে তার স্ত্রীর আর্তনাদ। আমার বুকের ভেতর যেন একটা সাপ ফণা তুলে ছোবল মারে। আমি বুঝতে পারি আমজাদ মিয়া তার স্ত্রীকে বেধড়ক পিটাচ্ছে। মহিলা আর্তনাদ করেই যাচ্ছে। সেই সাথে কিছুক্ষণ পর যুক্ত হয় তার ছোট মেয়েটির আকুতি-মিনতি। মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে মার খাচ্ছে মেয়েটিও আশপাশের বাড়ির বারান্দায় বেশ কিছু মহিলা ও কাজের মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে বাসায় হচ্ছেটা কী? তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আপা-দুলাভাই বাসায় নেই। আমার কি যাওয়া উচিত উনাদের বাসায়? আমি গিয়েই বা কী করব? আমার কথা কেউ কেনই বা শুনবে? আমজাদ মিয়ার ছেলেটা কোথায়? সে কেন কিছু করছে না? নাকি সেও তার বাবার মতোই? আমার ভাবনাটুকু শেষ হয় না, তার আগেই বাড়ির গ্যারাজে ইঞ্জিনের শব্দ তুলে, হর্ন বাজানোর শব্দ শুনি। আমি বাইরের ঘরে ছুটে যাই। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ছেলেটি এসেছে। বাইকের পেছনে বসা তার বড় বোন। দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে বাসায় দিকে ছুটে যায়। ভদ্রমহিলার আর্তনাদ আগের চেয়ে ক্ষীণ হয়ে এসেছে, শুধুই শুনতে পাচ্ছি ক্লান্ত, পরাজিত একটা ভাঙা কণ্ঠ ও আল্লাহ, আমার আল্লাহ্ বলে ডেকে চলেছে। ঘন ঘন বেল বাজার শব্দ হয় নিচের তলায়। কেউ দরজা খোলে না। আমজাদ মিয়ার ছেলে এবার অধৈর্য হয়ে দরজায় লাথি মারছে। আমজাদ মিয়া দরজা খুলছে না। ভদ্রমহিলা আল্লাহকে ডাকছেন। ছোট মেয়েটার স্পষ্ট কান্না বা কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ছেলেটির দরজায় লাথি মারার শব্দ আরও তীব্র হচ্ছে। এভাবে টানা লাথি মারলে এই পুরোনো বাড়ির কাঠের দরজা ভেঙে যাবেই। আরও কিছুক্ষণ দমাদম লাথির শব্দ। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। এরপর ক্ষণিকেই সব চুপ। আমার হাতের তালু ঘেমে একাকার। ইচ্ছে করছে দরজা খুলে রেলিংয়ে ঝুঁকে নিচতলায় উঁকি দিই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সম্ভব না। আমি নিশ্চুপ হয়ে কান পেতে রাখি। অল্প কিছু উত্তপ্ত কথা ভেসে আসে আমজাদ মিয়া আর তার ছেলের। হঠাৎ শুনি ছেলেটি বলছে,
প্রমাণসহই আছে। আমি নিজে গিয়া বাসা দেইখা আসছি। যেখানে তুমি ওই বেটির সাথে লুকায়ে থাকতে যাও। আর এদিকে বড় গলায় কথা বইলা আমার আম্মার গায়ে হাত তুলো?
আমজাদ মিয়া গর্জে উঠে বলে, আরও হাত তুলুম, কী করবি?
আর একবার এই কথাটা বলল, এরপর দেখো কী করি।
আরও হাজার বার ওই মাগির গায়ে হাত তুলুম, লাথি দিমু। কী করবি তুই কর। কর, কর।
কথা শেষ হওয়ার আগেই ধুম করে একটা শব্দ হয়। তারপর চারপাশ মধ্যরাতের গ্রামের মতো নীরব হয়ে যায়। শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাকের বদলে সরু একটা কান্নার শব্দ ভেসে এসেই পলকে থেমে যায়। বাতাস ভারী লাগতে থাকে আমার। কী হলো? কেউ কিছুই বলছে না কেন? শব্দ প্রতিরোধক কাঁচের ভেতরে যেন সবাই বন্দি হয়ে আছে এমন অবস্থা হয়ে গেছে। কই গেল সব? আমি লম্বা সময় বারান্দায় বসে অপেক্ষা করলাম। আশপাশের বাসার বারান্দায় থাকা অনেকেই ঘরে ফিরে গেল। আমি বসে রইলাম। রাতে আপা-দুলাভাই যখন এলো তখনো নিচতলা থেকে কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। যেন বিকেলের সেই ঘটনাগুলো ছিল কোনো ইতিহাস। অল্পদামে বিকিয়ে গেছে সংবাদপত্রের কাছে। আমার মনে হলো আমি বারান্দাতেই বাকি ঘটনাটুকু জানার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। পুরো রাতটুকু আমি একটা চেয়ার পেতে বসে থাকলাম। আপা ঘুমাতে যেতে ডেকেছিল। পাত্তা দিলাম না। কোন অন্তরালে নিজেকে হারালাম, নিজেও বুঝলাম না। প্রায় সারা রাত নিঘুম থেকে খুব ভোরে ছাদে গিয়ে বসে থাকলাম। সাড়ে ছয়টা নাগাদ একটা সাদা অ্যাম্বুলেন্স এসে আমাদের বাড়ির সামনে থামল। আমি দেখতে পেলাম কিছুক্ষণ পর স্ট্রেচারে করে সাদা কাপড়ে ঢেকে কাউকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাশে পাশে হাঁটছে আমজাদ মিয়ার স্ত্রী, দুই মেয়ে আর ছেলে। একতলার এক ভদ্রলোক মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? আমজাদ মিয়ার স্ত্রী শুধু মাথার ঘামটাটুকু আরেকটু টেনে লম্বা করতে করতে বললেন, উনি স্ট্রোক করছেন। হাসপাতালে নেওয়া হইতেছে। দোয়া কইরেন।
অ্যাম্বুলেন্সটার সাথে ছেলেটিও চলে গেল। ভদ্রমহিলা দুই মেয়েকে শক্ত করে দুহাতে আঁকড়ে রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। সেই সকালের পর আমজাদ মিয়া এই বাড়িতে আর ফিরে আসেনি। সেদিন উত্তপ্ত মুহূর্তে তিনি কি নিজের ছেলের হাতেই আহত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন নাকি আসলেই অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে স্ট্রোক করেছিলেন? নাকি ছেলের ক্ষতি হতে পারে ভেবে বাঁচানোর জন্য আমজাদ মিয়ার স্ত্রীই তার পেছন থেকে আঘাত করেছে তা আমার জানা নেই।
আমি শুধু জানি, এখন দুপুর। ছায়া ছায়া রোদ খেলা করছে চারপাশে। এমন দুপুরকে নাকি অনেকেই বলে মরা দুপুর। দুপুর কি কখনো মরে? নাকি মৃত মানুষেরা ছায়া ছায়া স্মৃতি হয়ে যায় বলেই দুপুরের এই নাম! আমি এই দুপুরের নাম দিয়েছি মায়া দুপুর। এই যে আমার সতের বছরের জমে যাওয়া সব জিনিস, আসবাবপত্র আর স্মৃতি নিয়ে এ বাসা থেকে চলে যাচ্ছি আমরা আর মায়াভরা স্মৃতি ফেলে যাচ্ছি। তাই এই দুপুর মায়া দুপুর। আর হ্যাঁ, আমি এটাও জানি আমজাদ মিয়ার পরিবারের কাছে কীভাবে তার প্রতারণা প্রমাণসহ ফাস হয়ে গিয়েছে। কেউ একজন, হ্যাঁ কেউ একজন আমজাদ মিয়াকে একটি অল্পবয়সি মেয়ের সাথে দেখে ফেলেছিল। তারপর পিছু নিয়ে ওদের থাকার জায়গাটুকুও চিনে এসেছিল। আর কে না জানে, উড়ো খবরের নামে সত্য খবর দিতে একটা বেনামি সিম কার্ডই যথেষ্ট। আমজাদ মিয়ার পরিণতি নিয়ে আমার মধ্যে কোনো অনুতাপ নেই। কারণ, পৃথিবীতে স্বার্থপর বাবার চেয়ে মায়ের মমতামাখা আঁচলের মূল্য অনেক। মায়া দুপুরের আলো বেলা গড়াতে গড়াতে আরও নরম হয়ে আসে। সেই আলোতে আমি আমার মুঠোফোন থেকে বেনামি সিম কার্ডটা বের করে দুই টুকরা করে ফেলি। এই নম্বরটির আর কোনো প্রয়োজন নেই।