বৃন্দাবনের কৃষ্ণপ্রেম

বৃন্দাবনের কৃষ্ণপ্রেম

‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ’ এই নামটির সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ নর-নারীদের দুটি গভীর ভাব জড়িয়ে আছে। যার একটি হল তাঁকে ভালোবাসা দেওয়া এবং অপরটি হল তার কাছ থেকে ভালোবাসা নেওয়া। শ্রীকৃষ্ণ এখানে কেবলই ভালোবাসার প্রতীক। তাঁর জীবনে অন্যান্য অনেক ঐশ্বর্য আছে। বল আছে, বীর্য আছে। ক্ষমতা আছে, প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। আবার সাহস আছে, পরাক্রম আছে এবং ততোধিক বিনম্র ভাবও আছে। তাঁর জীবনের তুলনা তিনি ছাড়া আর কেউ নয়। তাঁর লীলার ঐশ্বর্যও চিন্তা করে শেষ করা যায় না। সর্বোপরি তাঁর প্রেমের ঐশ্বর্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তিনি প্রেমময় পরমপুরুষ। কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্। প্রেমেই তাঁর জগতে আগমন, প্রেমেই স্থিতি এবং প্রেমেতেই ইহজগৎ থেকে প্রস্থান। জীবদ্দশায় তাঁর সঙ্গে যাঁরাই মিলিত হয়েছিলেন সকলেই তাঁর অনুপম সৌন্দর্য দর্শনে ও দুর্লভ গুণের প্রেমে পড়েছিলেন। এমনকি তিনি জন্মানোর আগেই তাঁকে খতম করার জন্য প্রস্তুত সেই হিংস্র কংসও তাঁর চিন্তায় পাগলপারা হয়েছিলেন। তীব্র প্রেমের অশুভ রূপই হল বিদ্বেষ। সেই বিদ্বেষ ভাবের প্রাবল্যে কংসের এক অদ্ভুত ভাবান্তর হয়েছিল। তিনি কৃষ্ণের আবির্ভাবের পূর্বেই কৃষ্ণময় হয়ে গিয়েছিলেন। তাই কৃষ্ণ জন্মাবার আগেই তিনি খেতে, শুতে, উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে সব সময় ওই ‘প্রাণনাশকারী কৃষ্ণ’ আসছে বলে ভাবতে ভাবতে সারা জগৎই কৃষ্ণময় দেখতে লাগলেন। এতে তার চিত্তে অদ্ভুত আনন্দ ও বেদনা হতে লাগল। তিনি যেন পার্থিব জগতে থেকেও অপার্থিব ভাবলোকের সন্ধান পেতে লাগলেন। অপরদিকে পুতনা কৃষ্ণ জন্মানোর পরে তাঁকে বিষ স্তন পান করিয়ে হত্যা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সর্বগুণধর হরি স্তন পান করানোর মাতৃহৃদয়কেই দেখলেন—বিষ এবং হত্যাকে দেখলেন না—ফলে পুতনার মাতৃবাৎসল্য মনে রেখেই তাঁকে ধাত্রীগতি দিলেন। তাঁর আত্মও স্বর্গলোকে গমন করল এবং কংসও মরণের পর জ্যোতির্ময় লোকে এসে হাজির হলেন। তাই বলছিলাম যাঁকে বিদ্বেষ ভাবে ভালোবেসেও এঁরা মুক্তিলাভ করেছিলেন—তেমন একজনের প্রেম-ঐশ্বর্যের বর্ণনা এই সামান্য লেখনীতে কিভাবে ফুটে উঠবে? কিভাবে মহিমান্বিত করবে সেই প্রেমসত্তাকে? আর কিভাবেই-বা তাঁর এই অতুলনীয় প্রেমচিত্ত স্মরণ করে যে অশ্রুধারা বর্ষিত হয় তার প্রতিরোধ হবে? এ কেবল ‘কৃষ্ণ’ নাম বলেই সম্ভব। আর তাইতো মহান কৃষ্ণপ্রেমিক মহাপ্রভু বলে গেছেন—”হে জগদীশ, আমি ধন, জন, সুন্দরী স্ত্রী পাওয়া ও সর্বজ্ঞ হওয়ার বাসনা করি না; হে ভগবান, তোমাতে যেন জন্মে জন্মে আমার অহৈতুকী ভক্তি হয়। আহা! তোমার নাম গ্রহণে কখন আমার নয়ন অশ্রুতে প্লাবিত হবে এবং বদন বাষ্পরুদ্ধ বাক্যে ও শরীর রোমাঞ্চে পূর্ণ হবে?”

এই নাম ও নামী কৃষ্ণ অভিন্ন। কৃষ্ণ নামেই সমস্ত শক্তি নিহিত আছে। প্রশ্ন হল—কে এই কৃষ্ণ ভগবান? কী তাঁর মহাশক্তি? বেণুবাদনের ছদ্মবেশে ইনি কে? এই জিজ্ঞাসার উত্তর মিলেছিল মা যশোদার। তিনি সাক্ষাৎ শিশুরূপী কৃষ্ণের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড—তার অগণিত নক্ষত্র- গ্রহের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের জগৎকে। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের এবং পৃথিবীর সমস্ত কিছুই কৃষ্ণ মুখগহ্বরে স্তরে স্তরে বিরাজমান। সেই মুহূর্তে শুদ্ধচিত্ত যশোদার অনুভূতিতে ধরা পড়ল এই কৃষ্ণ কেবল আমার পুত্র নয়—ইনি সর্বব্যাপী নারায়ণ—সমস্ত জীবহৃদয়ে এবং বিশ্বের সমস্ত অণু-পরমাণুর মধ্যেই এঁর সত্তা ওতপ্রাোতভাবে জড়িত। গীতার ‘অষ্টম’ অধ্যায়েও দেখি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নারায়ণ রূপের কথা সখাকে মনে করিয়ে দিয়ে বলছেন, ”হে অর্জুন, অন্তর্যামী নারায়ণ সমস্ত জীবের অন্তরে অধিষ্ঠিত থেকে সকলকে যন্ত্রচালিত পুতুলের ন্যায় মায়া দ্বারা পরিচালিত করছেন।” ইতিপূর্বে কৃষ্ণের ‘বিশ্বরূপদর্শন’ দেখে ভয়তাড়িত অর্জুন তাঁকে স্তব করে বলেছিলেন, ”হে মহাত্মা, হে অনন্ত, হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস—আপনি ব্রহ্মারও গুরু এবং আদি কারণ। আপনাকে সকলে কেন নমস্কার করবে না? যা প্রকাশিত হয়েছে এবং যা এখনো প্রকাশিত হয়নি সেই অব্যক্ত তত্বও আপনি এবং এই উভয়ের অতীত বেদান্তবাক্য প্রসিদ্ধ যে অক্ষরব্রহ্ম পরমাত্মা তাও আপনি। সর্বাত্মক আপনি ছাড়া ত্রিভুবনে আর কেউ নেই।”

এসবই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনন্ত ঐশ্বর্য। এই ঐশ্বর্যের চিন্তায় তিনি যেন অনেক দূরে সরে যান। তাই প্রয়োজন হল তাঁকে কাছে বেঁধে রাখার একটা দড়ি। কিন্তু সর্বব্যাপী নারায়ণকে কি দড়ি দিয়ে বাঁধা যায়? কোনো দড়িই তো তাঁকে বাঁধার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কারণ তিনি অনন্ত এবং অসীম। তাহলে উপায় কি? জীবের কষ্ট দেখে স্বয়ং ভগবানই গলে দ্রবীভূত হয়ে জীবহৃদয়ে আশ্রয় নিলেন। ‘নারায়ণ’ তখন ‘প্রেম’ নামে সর্ব হৃদয়ের মাঝে বিরাজ করতে লাগলেন। আর এই প্রেমই হল রজ্জু। কৃষ্ণকে বাঁধার দড়ি। চিত্তের মধ্যেই এই প্রেম রজ্জু বাসা বেঁধে রয়েছে। চিত্ত শুদ্ধ কর ‘দড়িটা’ বেড়ে বেড়ে যাবে এবং শেষে অসীম ভাব ধারণ করবে। আর তখনই অনন্ত নারায়ণরূপী ‘কৃষ্ণ’ ভক্তহৃদয়ে বাঁধা পড়বেন। আর সেসময়ে জীবনের সমস্ত কিছুই লাভ হয়। জীবন পূর্ণতা পায়। সেজন্যই রসিক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ”ভক্তের হৃদয় ভগবানের বৈঠকখানা। ভক্তহৃদয়ে ভগবান বাস করেন।” আর ভক্তমাত্রই তো সাধুব্যক্তি। তাই তিনি আরো বললেন—সাধুর হৃদয় সব থেকে বড়। কেন এত বড়? তাঁর মতে, ”পৃথিবী সকলের চেয়ে বড়, সাগর তার চেয়ে বড়, আকাশ তার চেয়ে বড়, কিন্তু ভগবান বিষ্ণু একপদে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল, ত্রিভুবন অধিকার করেছিলেন। সাধুর হৃদয়মধ্যে সেই বিষ্ণুপদ। তাই সাধুর হৃদয় সকলের চেয়ে বড়।” তাছাড়া ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ বলা হয়েছে, ”সাধু শাস্ত্র কৃপায় যদি কৃষ্ণোন্মুখ হয়/সেই জীব নিস্তারে মায়া তাহারে ছাড়ায়।” কিনা সাধু ও শাস্ত্র কৃপায় যদি সাধারণ মানুষের অন্তর শুদ্ধ হয় তাহলে তাঁর মুখে কৃষ্ণনাম এবং অন্তরে কৃষ্ণপ্রেম জাগ্রত হয়। আর সেই ভক্ত মানুষ তখন কৃষ্ণপ্রেম লাভ করে সংসারের দুঃখ-শোক থেকে মুক্তি পায়।

যাহোক, কথা হল কৃষ্ণরূপী ভগবানের ঐশ্বর্যভাবের বিপরীতে রয়েছে তাঁর মাধুর্যভাব। যেখানে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের বশবর্তী হয়ে মা যশোদার স্নেহময় সন্তান হয়েছেন। সুদামার খেলার সাথী হয়েছেন। গোপীদের প্রেমিক হয়েছেন। অর্জুনের সখা হয়েছেন। বনের ফুলেদের আনন্দদাতা হয়েছেন। পক্ষীদের আশ্রয় হয়েছেন। গোবৎসদের ভালোবাসার সাথী হয়েছেন। এই মাধুর্যভাবের কোনো সীমা নেই। বলতে কি এই সমাজে তথা ব্যক্তিমনে, সম্পর্কে, সংসারে যেটুকু ভালো কিছু আছে, যা মানুষকে আশা, কল্পনা ও প্রেরণা জোগাচ্ছে তা হল প্রেম। বিশ্বজগতের সমস্ত কিছুর অন্তরের অন্তস্থলে প্রেমপ্রবাহ বইছে। এই প্রেমপ্রবাহের তীরে ‘প্রেমসুধা’ পান করার আশা নিয়ে বসে থাকা ছাড়া মানুষের আর কিসেই-বা আনন্দ আছে? কিছুতেই নেই। শ্রীকৃষ্ণ এই প্রেমস্বরূপ। তাঁকে ভালোবাসলেই ভগবানের অনন্ত প্রেম ও করুণার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিবিড় হয়। সকলের প্রাণটাও সেসময়ে শীতল ও আনন্দপূর্ণ হয়।

কিন্তু প্রেম প্রেম করলেই তো আর আমাদের কঠিন হৃদয়টা প্রেমে গলে না। সেখানে সহস্র বছরের আবর্জনা জমা আছে। অথচ প্রেমের স্বাদ না পেলেও জীবন বৃথা। তাই নারায়ণ এলেন ছদ্মবেশে যমুনাপুলিনে। হাতে নিলেন মধুর মুরলী। আর তাতে ফুৎকারে তুললেন সুরের লহরী। সেই অনন্ত প্রেমের সুর মূর্ছনার জীবজগতের বুকে লাগল নবচেতনা। তারা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল এক অচেনার স্পর্শে। সেই স্পর্শের নাম অশরীরী প্রেম। প্রেমময় ভগবান বংশীর ধ্বনির মধ্য দিয়ে আমাদের সারা দিনরাত ডেকে চলেছেন—কান পেতে শোন—তিনি তোমাকে ডাকছেন—তিনি তোমাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না—ক্ষুদ্র প্রেমকে বৃহৎ করার সাধনায় তোমাকে ডাক দিয়েছেন তিনি—সীমা থেকে অসীমের দিকে যাওয়ার নিরন্তর অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। কাজেই তোমাকে বংশীধ্বনির মধ্য দিয়ে আকর্ষণ করছে কৃষ্ণের অনন্ত প্রেমময় সত্তা। শুধু কি তোমাদের মতো নরনারীদের—না তা নয় গো—তাঁর প্রেমের মুরলীধ্বনিতে গোবর্ধনের পাষাণ যে গলে যায়, বেগবতী যমুনার বুকে উত্তাল তরঙ্গে বহে যায়, গোরুর দল ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে, গোপীমন সব ফেলে প্রেমাবেগে ধেয়ে যায়। এই তো প্রেম—যার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। যিনি চির স্থির ও দণ্ডায়মান—বেনু হাতে বাঁকা নয়নে আমাদের ডেকেই চলেছেন—এসো, এসো, তোমরা এসো—আমি মধুময়, প্রেমময়, নয়নভুলানো তোমাদের শ্যামসুন্দর—আমার বুকে অনন্ত প্রেম যে আর ধারণ করতে পারছি না—তাই মুরলীবাদনে তোমাদের ডেকে এনেছি—এই প্রেমসুধা পান করে তোমাদের তৃষ্ণা নিবারণ কর—এতেই তোমাদের সুখ, শান্তি, অনন্ত জীবনের সমস্ত চাওয়া পূর্ণ হবে।

এই হল মাধুর্যময় কৃষ্ণ। তিনি ভালোবাসা দিতে চান এবং ভালোবাসা গ্রহণ করতে চান। আমরাও সবাই তাই চাই। ভালোবাসা দিয়ে যত আনন্দ ও শান্তি হয়, তত গ্রহণে হয় না। ভালোবাসা বিলিয়েই তো জীবন সার্থক হয়। এই ভালোবাসার শক্তি ঘুমন্ত হয়ে সব হৃদয়ে বিরাজ করছে। কিন্তু এই শক্তি জীবের কিভাবে জাগ্রত হবে? তাই দেখাতেই ধরামাঝে আবির্ভাব হলেন শ্রীরাধা এবং মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ। যাঁদের নাম উচ্চারণে শুষ্ক হৃদয়ে প্রেমের বন্যা বহে যায় এবং নয়নে প্রেমাশ্রু বর্ষন হয় সেইসব প্রেমময় মহামানবদের কথা কিভাবে লিখব? এসময়ে আমাদের অন্তঃকরণে কৃষ্ণের বেনুবাদনের সুরের মাধুর্যটা তীব্র থেকে কেবল তীব্রতর হয়ে ওঠে।

শ্রীকৃষ্ণ যে কত সুন্দর, কত মধুর, কত মহান, কত প্রেমিক, কত রসিক—তা শ্রীরাধা ও শ্রীমহাপ্রভুর অনন্ত প্রেমময় জীবনের আলোকে অনুভব করা যায়। জগতের মানুষ গূঢ় কপট পুরুষ শ্রীকৃষ্ণকে বুঝতে পারে না। তাই তাঁর প্রেমমাধুর্য সাধারণের আস্বাদনের জন্য আবির্ভূত হলেন এই দুইজন—শ্রীরাধা ও শ্রীমৎ মহাপ্রভু এবং তাঁদের ঘিরে অন্যান্য গোপীরা ও নিত্যানন্দ সহ অন্যান্য মহাপুরুষরা। এঁরা উভয়েই সাধারণ ভগবৎ প্রেমহীন নরনারীদের বললেন যে তাঁদের অন্তরে কিভাবে কৃষ্ণপ্রেম প্রতিমুহূর্তে বৃদ্ধি পাবে তাঁর কথা—কিভাবে অনন্ত প্রেমময় কৃষ্ণকে পেয়ে জীবনে পরমানন্দ লাভ হবে তাঁর বাণী—আর এসব শ্রবণ করেই না সাধারণ জীবেরা কৃষ্ণনামে—কৃষ্ণপ্রেমে—কৃষ্ণ নাম শুনে মাতোয়ারা হতে চায়। কিন্তু কী সেই জিনিস যা আমাদের মনকে কৃষ্ণের চেতনার নিয়ে আসে? এই ব্যাপারে শ্রীরাধা, সখা অর্জুন এবং পরবর্তীকালে মহাপ্রভু চৈতন্যের ভাবধারার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এর মধ্যে শ্রীরাধা ও মহাপ্রভুর মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যময়তার বেশি প্রকাশ পেয়েছে এবং সখা অর্জুনকে গীতা উপদেশের মধ্য দিয়ে তাঁর অনন্ত জ্ঞান, বলবীর্য এবং দুষ্টদমন করে ধরাধামে ধর্ম স্থাপনের মহিমা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। আমরা এখানে শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যরসের কথাই কেবল বলব। পণ্ডিতদের মতে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধরাধামে ১২৫ বছর লীলা করে গেছেন। তার মধ্যে জন্মের পর থেকে প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত তাঁর গোকুল, বৃন্দাবন ও মথুরা লীলা এবং বাকি ১০০ বছর তাঁর দ্বারকা, কুরুক্ষেত্র ও প্রভাস লীলা। এই ১২৫ বছরে তিনি কোটি কোটি বছরের জীবনযাপন করে গেছেন। ধরাধামে সত্য, ন্যায়, সহনশীলতা ও সর্বোপরি মানুষে মানুষে পরস্পর ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রাণপাত করে গেছেন। এই মহা পুণ্যজীবনের প্রতিটি লীলা, তাঁর অনন্ত রূপ, গুণ, সৌন্দর্য, মহত্ব, মহানুভবতা এবং নানা জনের প্রতি তাঁর পরমপ্রেমকে আমরা কিভাবে স্মরণ করব? কিভাবে স্মৃতিতে ধরে স্মরণ-মনন করব, অন্তরে ধ্যান করে নিজেরা শুদ্ধ হব, প্রেমময় হব এবং বিশৃঙ্খল ধরণীকে শান্ত, স্নিগ্ধ ও সুন্দর করে গড়ে তুলব? পুরাকালে ভগবান ব্রহ্মার মনেও এই প্রশ্ন জেগেছিল। তাইতো ধ্যানে বসলেন সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর শুদ্ধ অন্তরে মানবাত্মার মুক্তির জন্য ফুটে উঠল এক অকল্পনীয় শুদ্ধ নাম—হরিনাম—যা মহাপ্রভুও প্রচার করে গেছেন সারাজীবন ধরে—সেই হল নাম—

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

এই হরিনাম কারা করবে? আসন্ন মৃত্যুগ্রস্ত জীবেরা। নরনারীরা। যাদের শিহরে মৃত্যু। তা এই পৃথিবীতে তো এমন কেউ নেই যাঁদের শিহরে মৃত্যুর খাঁড়া ঝুলছে না। তাই মহারাজ পরীক্ষিত কৃষ্ণপ্রেমী মহাসাধক শুকদেবকে প্রশ্ন করলেন গঙ্গার তীরে—”মহারাজ, আসন্ন মৃত্যু জীবের কর্তব্য কি—তা আমায় দয়া করে উপদেশ করুন।” বিনম্র মহারাজের প্রশ্ন শুনে সাধকশ্রেষ্ঠ ব্যাসপুত্র শুকদেব শোনালেন কৃষ্ণকথা, কৃষ্ণ গুণগাথা, কৃষ্ণনাম—আর সাতদিন ধরে নিরবচ্ছিন্ন কৃষ্ণ নামগুণগান ও কৃষ্ণচরিত শ্রবণ করে পরীক্ষিতের মৃত্যুভয় বিদূরিত হল এবং তিনি মৃত্যুর ভয় ছাড়িয়ে অমৃত লাভ করলেন।

আসল রহস্য হল এই ‘হরিনাম’ শ্রবণে এবং কীর্তন করলে শুদ্ধ চিত্তের নরনারীদের অন্তরে সমগ্র কৃষ্ণচরিত তথা কৃষ্ণলীলার সমস্ত মাধুর্যময়তা আপনা থেকেই অন্তরে প্রকাশ পায়। হরিনাম এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এক ও অভিন্ন। তাই নামবীজ যদি অন্তরে রোপন করা হয় তাহলে শুদ্ধমনে সমগ্র কৃষ্ণচেতনা লাভ হয়। এই হরিনামে তাই অফুরন্ত শক্তি এবং অনুপম মাধুর্য লুকিয়ে রয়েছে। এই হরিনাম হল প্রেমধর্মের প্রতীক। ভগবান জিনিসটা কেমন, তাঁকে কিরূপে পাওয়া যায়, ভগবানের প্রেম কী, প্রেমে অন্তর কেমন হয়, ভক্তের প্রেমরজ্জুতে ভগবান বাঁধা পড়লে ভক্তের হৃদয় তখন কেমন হয়—এইসবই যথার্থভাবে জানতে গেলে ‘হরিনাম’ করুন শ্রদ্ধা, ভক্তি ও নম্রচিত্তে। স্বয়ং হরিই আপনাকে সব কৃপা করে বুঝিয়ে দেবেন। এইজন্যই তিনি ‘নাম’ হয়ে স্বয়ং ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। মানুষেরা মায়ায় পড়ে এসব সময়ে সময়ে ভুলে যায় তাই মহাপ্রভু কলিযুগে এসেছেন হরিনাম প্রচার করতে। আর তাইতো বৈষ্ণব কবিরা আকুল প্রাণে লিখে গেছেন—

যদি গৌর না হত কি মনে হইত
 কেমনে ধরিতাম দেহ
শ্রীরাধার মহিমা প্রেমসিন্ধু সীমা
 জগতে জানত কে। …

এই হরির নামে মহাপ্রভু নৃত্য করতেন। তাঁর দেহ ও মনে গভীর পুলক সঞ্চার হত। তিনি সর্বাঙ্গ ধূলায় ধুসরিত হয়ে ভাবে বিহ্বল হয়ে যেতেন। শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণও বলতেন, ”যে শালা হরিনামে নাচতে পারবে না তার কিছুই হবে না।” মানুষের মনের সংকীর্ণ চিত্ত ও অজ্ঞতার কথা স্মরণ করে এই কথা তিনি বলেছেন। আসলে মুখে গোবিন্দের নাম নিলে, বাহু তুলে নাম সংকীর্তন করলে, অন্তরে গোবিন্দ প্রেমের জন্ম হলে সংসারতাপিত নরনারীদের সমস্ত দুঃখের নির্মূল হয়। এমনই হল হরিনাম তথা কৃষ্ণনামের মহিমা। আর এ-কারণেই আজ ইসকনের কৃষ্ণ নাম-সংকীর্তনের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য ভোগবাদ সমাজ কৃষ্ণনাম নামে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছে।

এই কৃষ্ণনামে, কৃষ্ণচিন্তায়, কৃষ্ণমহিমার গুণগানে মানুষের অন্তর সত্বর শুদ্ধ ও পবিত্র হয়ে যায়। ‘কৃষ্ণ’ মানে যিনি অন্তরের পাপরাশি কর্ষণ বা ছেদন করে তাতে শুদ্ধপ্রেম প্রদান করেন। অপরদিকে ‘রাম’ মানে হল অহৈতুকী আনন্দ তথা পরমানন্দ। যেমন অসাবধান বশে আগুনের কণায় তুলা স্পর্শ করলে সমস্তই নিমেষেই ভস্মীভূত করে দেয়, ঠিক তেমনি ‘রাম’ নাম অন্তরে গেলে জীবের মলিন চিত্তের সমস্ত পাপরাশি পুড়িয়ে তাকে শুদ্ধ করে তোলে। হরিনামের মধ্যে এই ‘রাম’ এবং ‘কৃষ্ণ’ দুটি অনন্ত ভাব ও প্রেমবাচক শব্দেই লুকিয়ে আছে। শাস্ত্রে বলে, নামের মহিমা ব্যক্ত করা যায় না। কারণ নাম ও নামী অভেদ। যেমন একটি অতি ক্ষুদ্র বটবীজের মধ্যে সমগ্র বিশাল বটবৃক্ষটা লুকিয়ে থাকে—তার শিকড়, কাণ্ড, ডালপালা, ফুল, ফল সবই ক্ষুদ্রবীজের ভেতরে ভাব-সংস্কাররূপে থাকে এবং কালে কালে তা প্রকাশিত হয়—ঠিক তেমনি ভগবান ‘রাম’ ‘কৃষ্ণ’ নামের মধ্যে সমগ্র বিশ্বজগৎ, অনন্ত নীহারিকা—নক্ষত্র-গ্রহ-সূর্য-পৃথিবী-নদী-সাগর-পর্বত-পশুপাখি-মানুষ-মানুষের মন এবং মনের প্রেম-প্রণয়-ভাব-মহাভাব, সমাধি সবই শ্রীনামের মধ্যে স্তরে স্তরে সজ্জিত থাকে। সাধক ব্যাকুল প্রাণে হরিনাম সংকীর্তন করলে বা নাম-জপ করা শুরু করলে ক্রমশ চিত্তটা বিস্তার থেকে বিস্তারিত হয়ে যায়। এসময়ে চিত্তটা সত্ব কিনা সর্বব্যাপক ভাব ধারণ করে এবং সর্বব্যাপক সেই চিত্ত পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মা লাভ করে জন্ম-মৃত্যুর বাইরে এসে পরমানন্দময় সত্তা মাত্র হয়ে যায়। এসবই হল হরিনামের মহাশক্তি।

এটা সাধারণভাবে দেখা যায় যে, আমরা যাকে ভালোবাসি তার নাম শুনলে চিত্তটা আনন্দে ভরে যায়। সেই ভালোবাসার পাত্রের রূপ, গুণ, ব্যবহারের প্রশংসা শুনলেও হৃদয়টা প্রসারিত হয়। প্রেমিক ভালোবাসার পাত্রের মহত্ব যত শোনে, ততই তার অন্তরে ভালোবাসা আরো বাড়তে তাকে। তাঁর রূপ ও গুণের চিন্তা যতই করা যায় ততই চিত্তটা প্রেমরসে মজতে থাকে। পার্থিব প্রেমেই যদি সাধারণের এমনটা হয় তাহলে চিরযৌবনের ঐশ্বরিক মনোলোভা প্রেমময় শ্যামসুন্দরের রূপে চিত্ত আটকে গেলে ভক্তের কি অবস্থা হবে? সেসময় ভক্ত ভগবানের জন্য তীব্র বিরহ অনলে পুড়তে থাকে। আর এই বিরহ তাপ প্রশমনের উপায় হল উচ্চস্বরে হরিনাম করা। এই হরিনাম চিত্ত শুদ্ধ করে মনকে প্রেমদান করে। এই প্রেম আবার স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ, ভাব অবস্থা অতিক্রম করে ‘মহাভাবে’র অবস্থায় এসে পৌঁছায়। এখানে প্রেমিক, প্রেমাস্পদ ও প্রেম—এক ও অভিন্ন হয়ে ওঠে। আর হরিনাম, হরি ও ভক্তের মধ্যেও এই অবস্থায় কোনো পার্থক্য থাকে না।

এই ‘হরিনামের’ অন্তরালে রয়েছে ‘রাধা ও কৃষ্ণের’ অনির্বচনীয় স্বর্গীয় প্রেমের চিরন্তন রূপ। রাধা হল জীবের তৃষিত অন্তর—যা ‘হরে’ নামে পরিচিত এবং ‘কৃষ্ণ’ হল চির পূর্ণতার প্রতীক যা ‘পূর্ণপ্রেম ও পরমাত্মা’ স্বয়ং। হরিনামের মধ্য দিয়ে রাধারূপী তৃষিত জীব পূর্ণ প্রেমময় ভগবান কৃষ্ণের সঙ্গে মিলতে আকুতি প্রকাশ করছে। ‘হরিনাম’ তাই জীব ও ভগবানের মিলনসেতু। হরিনাম তাই প্রেম। হরিনাম তাই আশা। হরিনাম তাই ব্যাকুলতা। হরিনাম তাই পুণ্য। হরিনাম তাই তপস্যা। হরিনাম তাই আনন্দ। হরিনাম তাই শান্তি। হরিনাম তাই পরমধন। হরিনাম তাই বেদের সারাৎসার। হরিনাম তাই পরমব্রহ্ম। হরিনাম তাই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। সেইজন্যই প্রেমসাধক মহাপ্রভু বলে গেছেন—

”কৃষ্ণনাম নিরন্তর যাহার বদনে।
সেই তো বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ ভজ তাহার চরণে।”

অর্থাৎ যিনি নিরন্তর মুখে কৃষ্ণনাম করেন তিনিই শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব—কিনা বিষ্ণুভক্ত। তাই মহাপ্রভু আরো বলে গেছেন—তোমরা হরিনাম কর। একমাত্র হরিনাম সংকীর্তনের মধ্য দিয়েই ভগবদ বিশ্বাস দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়। নামের অতুলনীয় শক্তিতে দেহে স্বাস্থে ও সৌন্দর্যে ভরপুর হয়ে ওঠে। মনে সদা আনন্দ বিদ্যমান থাকে এবং জীবনটাও শাশ্বত ও সুন্দর হয়ে যায় দিনে দিনে। এই হরিনামের দিব্যশক্তি মানুষের দেহধর্মের জৈবভাবকে চিরতরে নির্মূল করে দেয়। নামের অনন্ত শক্তিতে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, চিন্তা, অহঙ্কার, কর্তৃত্ববোধ, রোগ, শোক, ব্যাধি এবং মৃত্যু সবই দূরে পলায়ন করে। তাই চিরপ্রেমদাতা গৌর-নিতাই একযোগে ঘোষণা করলেন—কলি সন্তপ্ত জীবের একমাত্র সম্বল এই তারকব্রহ্ম নাম—

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

এই নামের শক্তি চঞ্চল মনকে ধীরে ধীরে বশীভূত করে দেয়। অন্তরে কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি করে। জিহ্বা পবিত্র করে এবং মনের মধ্যে দুর্লভ বস্তু যথার্থ প্রেমের স্পর্শ ঘটতে থাকে। কৃষ্ণের অনন্ত প্রীতি আস্বাদনের নামই প্রেম। অন্তরে কৃষ্ণপ্রেম জাগ্রত হলে হরিনাম মিষ্টি লাগে। শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের বশ। তিনি ঐশ্বর্যশালী ভগবান হয়েও বাৎসল্যভাবে মা যশোধার বন্ধন স্বীকার করেছেন। নন্দবাবার পাদুকা নিজ মস্তকে বহন করেছেন। নিজের খাদ্যদ্রব্য বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। সুদামাদের দেওয়া তন্দুল কণা প্রেমে বশীভূত হয়ে গ্রহণ করেছেন। গোপীদের প্রাণভরে সেবা করেছেন। সখা অর্জুনের রথের সারথী হয়েছেন এবং বিদুর রাণীর কলার খোসা ভক্ষণে তৃপ্তিলাভ করেছেন—তাই এহেন অনন্ত প্রেমিক কৃষ্ণের প্রেমের তুলনা কোথায়? এখন কথা হল—এই সমস্ত প্রেমের কিঞ্চিৎ কণা কিভাবে আমাদের মধ্যে আসতে পারে? তাও লেখা আছে ভাগবতে—

”শ্রবণং কীর্ত্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম্।
অর্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মানিবেদনম্।।”

অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণু বা কৃষ্ণের কথা শুনে, সংকীর্তন করে, স্মরণ করে, সেবা করে, অর্চনা, বন্দনা করে এবং তাঁকে প্রভু ও সখা ভেবে এবং আপনাকে দাস মনে করে—তাঁর চরণে আত্মনিবেদন করলেই ভগবানে ভক্তি লাভ হয়। এই হল নবধা ভক্তি। আর তা পাওয়ার উপায় কি? এখানে মহাপ্রভু বলে গেছেন—

তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।

অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়া সদা হরিঃ।।

অর্থাৎ যিনি নিত্য কৃষ্ণনাম নিয়ে অন্তরে প্রেমকে পেতে চান তাকে তৃণ হতেও অবনত, বৃক্ষ হতেও সহিষ্ণু হতে হবে এবং নিজে অভিমান ত্যাগ করে মানহীনকেও মান দিতে হবে, সম্মান প্রদর্শন করতে হবে আর কেবল এইভাবেই হরিনাম ফলপ্রসূ হবে এবং ভক্তহৃদয়ে কৃষ্ণপ্রেমের মহা উচ্ছ্বাস ফুটে উঠবে। এক্ষণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে বিনম্র চিত্তে প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আমাদের সকলের অন্তর শুদ্ধপ্রেমে ও আত্মনিবেদনের মাধুর্যে পূর্ণ করে দিন—

হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু দীনবন্ধো জগৎপতে।
গোপেশ গোপিকাকান্ত রাধাকান্ত নমোহস্তুতে।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *