বৃদ্ধস্য ভার্যা
উমাশশী বারো হাত শাড়ি ধরেছেন সেই কোন যুগে—যখন তাঁর বয়স চল্লিশও হয়নি। এখন পঞ্চাশ চলছে। বারো হাতে আর কুলোয় না, যোলো হলেই যেন তাঁকে সবদিক থেকে মানাত। কিন্তু পাবেন কোথায়? দোকানে বাজারে বারো হাতই জোটে না সবসময়। এমনই বরাত উমাশশীর, পছন্দ মতন কোনো জিনিসই তাঁর ভাগ্যে এ-যাবৎ জুটল না। স্বামীও নয়।
অনেকটা বেলায় যখন কানাই এসে এক টুকরো কাগজ উমাশশীর হাতে তুলে দিল, কাগজের টুকরোয় বার দুই চোখ বুলিয়ে উমাশশী তাঁর বরাতের বহরটা দেখলেন। স্বামী গৃহত্যাগ করেছেন।
“আমি গৃহসংসার ত্যাগ করিলাম। বৃথা অন্বেষণ করিও না। তুমি তোমার সংসার লইয়া সুখে থাকো। ইহকালে আর সাক্ষাৎ হইবে না। পরকালেও যেন না হয়। ইতি সারদা গুপ্ত।”
“পুঃ : পথ খরচ হিসাবে কিছু লইয়া গেলাম।”
উমাশশী কচি খুকি নন, স্বামীর গৃহত্যাগের দৌড় তাঁর জানা আছে। বাষট্টি বছরের বুড়ো—যার এক গ্লাস জল গড়িয়ে খাবার ক্ষমতা নেই, দু পাটি দাঁতের অর্দ্ধেক বাঁধানো—সে করবে গৃহত্যাগ? ঢং কত!
ছোট মেয়েকেই ডাকলেন উমাশশী। ডেকে তাঁর শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। নিজে বেশি নড়াচড়া করতে পারেন না, ওঠা-বসা, কোমর নোয়ানো, উবু হওয়া—এসব তিনি প্রায় ত্যাগই করেছেন।
ঘরে এসে মেয়েকে বললেন, “আলমারি খোল, দেরাজ খোল। বাক্সটাজ যা আছে টেনে বার কর। দেখি তোর বাবা কী কী নিয়ে পালিয়েছে?”
মেয়ে মার কতটা বাধ্য বোঝা গেল না, বলল, “কোনটা আগে খুলব?”
“আলমারি।” আঁচল থেকে চাবিরর গোছা খুলে ঝনাৎ করে ফেলে দিলেন উমাশশী।
আলমারি, দেরাজ, কোণে রাখা ট্রাঙ্ক, ঘরের এ-কোন ও-কোন, তাক, খাটের তলা সমস্ত আঁতিপাঁতি খুঁজে মেয়ে—মানে আশা যখন গলদঘর্ম হয়ে উঠে দাঁড়াল তখন উমাশশী তাঁর প্রাথমিক তল্লাসি শেষ করে ফেলেছেন। ধোপা এবং সংসার খরচের খাতার একপাশে গোটা গোটা করে হারানো জিনিসের লিস্টি লেখা হয়ে গেছে।
তালিকাটা এইরকম ; নগদ টাকা চারশো ; একটি নবরত্ন আঙটি, একজোড়া ধুতি, একটি প্যান্ট, পায়জামা নতুন একটি, পাঞ্জাবি দুই, কর্তার বুশ শার্ট এক, গেঞ্জি দু’তিনটি, চাদর ও সোয়েটার একটি একটি, কর্তার দু’পাটি জুতো, এক শিশি মিল্ক অফ ম্যাগনেশিয়া, নতুন জবাকুসুম তেল ইত্যাদি।
ফর্দর দফা প্রায় এগারো হল। উমাশশী বুঝলেন, ঠিক যা যা বুড়োর লাগতে পারে—সবই নিয়ে পালিয়েছে। মায় একটা স্যুটকেস পর্যন্ত। পোস্ট অফিসের টাকা তোলার বই, ব্যাংকের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের চেক খাতা, বাড়ির দলিলপত্রের কাগজ—এ-সব অবশ্য রেখেই গেছে। একটা জিনিস কিন্তু নিয়ে যেতে ভুলে গেছে, বুড়ো তারক কবিরাজের দেওয়া অর্শের ওষুধ। বুঝবে ঠেলা।
আশা তখনও হাঁফ সামলাচ্ছিল। বলল, “মা, বাবা কি সত্যি সত্যি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে?”
উমাশশী বললেন, “রাগের মুখে আগুন। এঁচোড়ে পাকা বকাটে ছেলেদের মতন টাকা-পয়সা হাতিয়ে সোনাদানা চুরি করে পালাতে গেছে! লজ্জা করল না বুড়োর। যাবে যাও, ন্যাংটো ফকির হয়ে যাও। সংসারে যার অরুচি ধরেছে তার এত তল্পিতল্পা বাঁধা কেন?” জোরে কথা বললেই উমাশশীর গলায় কয়লার এঞ্জিনের ভোঁয়ের মতন সুর খেলে, বুক ধড়ফড় করে, ঘাম হয় মুখে। বুকে একবার হাত দিলেন তিনি। তিন ভরির বিছে হার গলায়। হারে আঙুল ঠেকতেই কেমন যেন সচেতন হয়ে হারটা দেখে নিলেন। এই হার সর্বক্ষণ তাঁর গলায় থাকে, হাতে তিন গাছা করে মোটা চুড়ি। চুড়িগুলো এমন করে বসে গেছে কজিতে যে ওগুলো খুলতে গেলেই উমাশশী জেগে যেতেন। খোলা অসম্ভব। তবে গলার হারটা খুলে নেওয়া যেত। সারদা গুপ্ত তা নেননি।
আশা বলল, “এখন কি করবে? দাদাকে খোঁজ নিতে পাঠাবে?”
উমাশশী মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “কেন, খোঁজ করব কেন? বাষট্টি বছরের বুড়ো গিয়েছেন ঘরসংসার ত্যাগ করে নিমাইসন্ন্যাস হতে! যাক না! মজাটা বুঝুক। যার নেই কাছার ঠিক তার আবার গৃহত্যাগ। আবার লম্বা লম্বা কথা—ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়—কোথাও নাকি দেখা হবে না। পরকালে আমি পেত্নি হয়ে তোমার ঘাড়ে চড়ে বসে থাকব—দেখি তুমি কেমন করে পালাও।”
আশা মুখ ফিরিয়ে জানলার দিকে তাকাল। মার মুখের দিকে তাকিয়ে একটুও যদি হেসে ফেলে, কুরুক্ষেত্র কাণ্ড হয়ে যাবে।
“তোমার দাদা কোথায়?” উমাশশী জিজ্ঞেস করলেন।
“বেরিয়েছে কোথায় সাইকেল নিয়ে, আসবে এখুনি।”
“যেমন বাপ তার তেমনি ছেলে। সকাল থেকে ইয়ার বন্ধু করে বেড়াচ্ছে। একটা লোক বাড়ি ছেড়ে পালাল একরাশ জিনিস নিয়ে, তোমরা কেউ জানতেও পারলে না। বাড়িতে একটা কুকুর থাকলে সেটাও ঘেউ ঘেউ করত।”
আশা একেবারে থ। মার চোখে তারা কুকুরেরও অধম হয়ে গেল! একটু তাকিয়ে থাকল মার দিকে। রাগলে এখনও মার গালটাল টকটকে হয়ে ওঠে। চোখ দুটো ঝকঝক করছে। সাহস হল না আশার ; মনে মনে বলল, ‘তুমি তো পাশেই শুয়ে থাকো বাবার—তুমিই জানতে পেরেছ বাবা কখন পালিয়েছে।’
এ-সব সময় কথাটথা বলা উচিত নয়। আশা চুপ করেই থাকল, গোবেচারি অপরাধী মুখ করে ; যেন স্বীকার করে নিল—তারা দুই ভাইবোন একেবারে অপদার্থ, কুকুরের চেয়েও অধম।
উমাশশী রুক্ষ চোখে কিছুক্ষণ ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে মেরের দিকে মুখ ফেরালেন। বললেন, “দাদা এলে বলো একবার থানায় যেতে হবে।”
“থানা?”
“থানায় গিয়ে ডায়েরি লেখাতে হবে। চুরির ফর্দটা আমি দিয়ে দেব।”
আশার মুখ আরও খানিকটা শুকিয়ে গেল। গলা পরিষ্কার করে বলল, “বাবার নামে থানায় ডায়েরি লেখাবে?”
“আলবত লেখাব। আমার বাড়ি থেকে জিনিস চুরি গেলে ডায়েরি লেখাব না? হাজার বার লেখাব। যা যা চুরি গিয়েছে—সব লেখাব”, উমাশশী তাঁর ফোলা ফোলা—পাকা কাঁঠালের কোয়ার মতন আঙুল তুলে শাসালেন, তারপর ডান হাতের তর্জনী বাঁ হাতের তালুতে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, “থাকত আমার বাবা বেঁচে তো দেখে নিতাম। পালাত কোথায় তোমাদের গুপ্তবাবু? আমার বাবার হুকুমে ঘাড় ধরে টেনে আনত পুলিশ ওই নিমাইসন্ন্যাসকে। বুঝতে পারত—কত ধানে কত চাল।” উমাশশী হাঁফ ফেললেন, বুকটা ধড়ফড় করছে। বার দুই ঢোঁক গিলে বললেন, “পালানো অত সোজা। এ কি খরগোসের বাচ্চা নাকি যে দিলাম ছুট আর বনে গিয়ে লুকোলাম! তোমাদের বাবার কেরানি আমার জানা আছে। অনেক হম্বিতম্বি, পালাপালির চেষ্টা করেছে আগে। পেরেছে? আমার বাবার এক দাবড়ানিতেই সব ঠাণ্ডা।”
আশা ভয়ে ভয়ে বলল, “দাদু ছিল ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার, দাদুর কথা আলাদা। এখানের এই ছোট্ট থানায় ডায়েরি লিখিয়ে তুমি কি করবে? ওরা কিছুই করতে পারবে না—শুধু শুধু লোক হাসাহাসি হবে।”
উমাশশী বললেন, “তোমায় কত্তামি করতে হবে না। আমি যা বলছি তাই হবে। তোমার দাদা এল কিনা দেখো! আর কানাইকে ডেকে দাও। আমি জানতে চাই—ওই চিরকুট সে কোথায় পেল।”
আশা আর দাঁড়াল না, পালিয়ে গেল।
উমাশশী বিছানার ওপর বসে থাকলে। মাথার দিকের জানলা খোলা, পায়ের দিকেরও। দু দিকের জানলাতেই ছোট ছোট পরদা, জানলার তলার দিকটা ঢাকা, ওপরটা ভোলা। মাথার জানলা দিয়ে বাইরের বাগান দেখা যায়, করবী আর কাঠচাঁপা, দু-একটা ঝাউ কিংবা জবাগাছ। বেশ রোদ পড়েছে বাগানে, ঝকঝক করছে। করবেই তো। এটা তো কার্তিক মাসের শেষ, কোথাও কোনো মেঘবাদলা নেই, সবই পরিষ্কার। বাগানে কাক চড়ই শালিখ ডাকাডাকি করছিল। উমাশশী কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। কার্তিক মাসে মানুষটা বাড়ি ছেড়ে পালাল। মাস বছর হিসেব করে না—এ কেমন লোক! আর ক’দিন পরেই অঘ্রাণ পড়ছে। বারোই অঘ্রাণ কর্তার জন্মদিন, তেষট্টি বছরে পড়বে। আর ঠিক এই সময়ে পালাল! বুড়ো হয়ে ভীমরতিতেই ধরেছে!
কানাই এসে দাঁড়াল নিচু মুখে।
“তুই ওই কাগজটা কোথায় পেয়েছিস?” উমাশশী ধমকের গলায় বললেন।
“বসার ঘরে”, কানাই বলল, “ঘরদোর ঝাট দিচ্ছিলাম, গোল টেবিলের ওপর থেকে পড়ে গেল।”
“টেবিলের ওপর থেকে এমনি এমনি কাগজ পড়ে যায়?” উমাশশী সন্দেহের গলায় বললেন।
কানাই থতমত খেয়ে বলল, “টেবিল সরিয়ে রাখছিলাম, মা।”
“কখন ঘুম থেকে উঠেছিস?”
“আজ্ঞে, ভোর কালে।”
“বাবু ভোরবেলায় ওঠেন, হাঁটাহাঁটি করেন—বাবুকে দেখিসনি?”
“না, মা।”
“না, মা! তুই ভোরবেলায় উঠিসনি? খাস কি রাত্তিরে? গাঁজা? গাঁজাখোরের মতনই তো চেহারা করেছিস! যতসব আমার কপালে জোটে। সব কটাকে তাড়িয়ে দেব একদিন। বাড়িতে চুরি ডাকাতি হয়ে গেলেও তোরা কুম্ভকর্ণের ঘুম ঘুমোবি!…কামিনীকে ডাক। তিনি তো রান্নাঘরে বসে বসে পান-জরদাই খেতে শিখেছেন।”
কানাই এ-বাড়ির পুরনো লোক। গিন্নিমার মতিগতি বোঝে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সরে গেল উমাশশীর চোখের সামনে থেকে।
উমাশশীর মাথা গরম হয়ে উঠেছে। মাথা গরম হলেই কপালের শিরা দপদপ করে। মাথার পেছনদিকে ঘাড় বরাবর ব্যথা হয় কেমন। গোপী ডাক্তারকে ডাকলেই ব্লাডপ্রেশার যন্ত্র বার করে বসে, একটা পট্টি বেঁধে দেয় হাতে, কানে তার স্টেথস্কোপের নল গোঁজে ; কি যে দেখে ছাই কে জানে! বলে, হাই। খাওয়া দাওয়ার ধরাকাটা করুন, আলুটালু খাবেন না, নুন না হলেই ভাল, এটা করবেন না ওটা করবেন না। নিকুচি করেছে তার ডাক্তারির! কিছুই করব না তো সংসারে রয়েছি কেন, চিতায় গিয়ে শুয়ে পড়লেই হয়।
কামিনী এল।
কামিনীর দিকে চোখ পড়তেই উমাশশী ঝাঁঝালো গলায় বললেন, “করছিলে কী তুমি?”
কামিনী বলল, “উনুনে আঁচ পড়ে যাচ্ছিল, ঝামা কয়লা। আঁচ তুলে কুটনো কুটতে বসেছিলাম।”
“আমার মাথা কুটতে বসেছিলে,—“ উমাশশী ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “পান সাজতে আর গালে পুরতে তোমার দিন চলে যায়। একগোছ করে পান আসে রোজ, কে অত পান খায়?”
কামিনী চুপ করে থাকল, একগোছ পানের প্রায় সবটাই যে গিন্নিমার মুখে যায়—এই সত্যি কথাটা তার বলার সাহস হল না। পান জরদার নেশা নিয়ে কামিনী এ-বাড়িতে কাজে ঢোকেনি, গিন্নিমার পান সেজে দিতে দিতে তারও নেশা ধরেছে।
“সকালে যখন ঘরদোরের তালা খুলে ঝাটপাট দিচ্ছিলে হেঁসেলের দিকে—বাবুর গলাটলা পাওনি?”
“না, মা।”
“সকালে বাবুর চা করোনি?”
“করেছি। চা নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে দেখি বাবু নেই। বারান্দাতেও ছিলেন না। বাগানেও দেখিনি বাবুকে।”
“দেখতে পেলে না তো আমায় ডাকলে না কেন?”
কামিনী চুপ করেই থাকল ; সকালে বাবুকে চা দিতে গিয়ে দেখতে না পেলে যে গিন্নিমার শোবার ঘরে গিয়ে তাঁর ঘুম ভাঙাতে হবে—কামিনীর তা জানা ছিল না। এই প্রথম জানল।
কত যেন অপরাধ হয়ে গেছে, কামিনী একটু চুপ করে থেকে মিনমিনে গলায় বলল, “বাবুকে সকাল থেকেই দেখছি না, মা! কোথায় গিয়েছেন তিনি?”
উমাশশী করকরে চোখে তাকালেন কামিনীর দিকে। সমস্ত মুখে বিরক্তি। কপাল ভুরু কুঁচকে রয়েছে। বললেন, “জানি না। গিয়েছেন কোথাও।…তুমি নিজের কাজে যাও। একটু জল দিয়ে যেও।”
কামিনী চলে গেল।
উমাশশী চুপচাপ বসেই থাকলেন বিছানায়। এ রকম অবস্থা তাঁর কখনো হয়নি। মানুষটা তাঁকে একেবারে বোকা বানিয়ে পালিয়ে গেল। পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে থাকেন দুজনে, ওরই মধ্যে কখন যে ও উঠল, জিনিসপত্র গোছাল, আলমারি দেরাজ খুলল—টাকাপয়সা আংটি হাতাল, তারপর চুপিচুপি পালিয়ে গেল—উমাশশী কিছুই বুঝতে পারলেন না। তাঁকে কি কালঘুমে পেয়েছিল? নাকি ওই বুড়ো তাঁকে চোর ডাকাতদের মতন বেঁহুশ করে রেখে কাজ গুছিয়ে পালিয়ে গেছেন।
প্রথম রাতের দিকে উমাশশীর ভাল ঘুম আসে না। হাঁটু, পায়ের গোছ, হাতের গাঁট—কোথায় না বাতের ব্যথা! তার ওপর মাথা গরমের ধাত, বুকেরও ধড়ফড়ানি রয়েছে। আজকাল দু-একদিন অন্তর ঘুমের বড়িও খেতে হয় এক আধটা। কালও খেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে মড়ার ঘুম কেন ঘুমোবেন?
প্রথম রাতের দিকে উমাশশী একরকম জেগেই থাকেন, মাঝরাত নাগাদ ঘুমিয়ে পড়েন। ভোরের দিকে উঠতে পারেন না। খানিকটা বেলা হয় ঘুম ভাঙতে। ঘুম ভাঙলে ঠাকুর নাম জপতে জপতে যান চোখেমুখে জল দিয়ে আসতে। কামিনী চা দেয়। চা খেয়ে দু-চারটে ছোটখাটো কাজ সেরে চলে যান স্নানে। স্নানের ঘর থেকে সোজা ঠাকুরঘরে। পুজোআর্চা সেরে নিজের ঘরে আসেন। গরদের শাড়ি ছেড়ে জামাকাপড় বদলে সংসারের কাজেকর্মে হাত দেন। এই সময়টায়—যতক্ষণ না তিনি সংসারের কাজে এসে হাত দিচ্ছেন—তাঁকে কেউ কিছু বলে না। বললেই সর্বনাশ। আজকেও উমাশশী ব্যাপারটা জানতে পারলেন অনেক পরে। কর্তা বাড়িতে নেই—এটা তাঁর কানে গিয়েছিল পুজোর ঘর থেকে বেরিয়েই। তাঁর কোনো কিছু মনে হয়নি, সন্দেহও নয়। কর্তা প্রায় সকালের দিকে স্টেশনের দিকে যান গল্পগুজব করতে, নন্দীমশাইয়ের বাড়ি যান আড্ডা দিতে, একটু আধটু বাজারটাজার ঘুরে আসেন, পোস্ট অফিসেও ঢুঁ মারেন।…মানুষটা বাড়িতে নেই বলে যে পালিয়ে যাবে এটা উমাশশী কেমন করে বুঝবেন?
বুঝলেন আরও খানিকটা পরে, কানাই যখন চিরকুটটা এনে দিল। পড়ে বিশ্বাস করতে পারেননি ; তারপর যখন দেখলেন ঘর থেকে নগদ টাকা, আংটি, জামাকাপড়, স্যুটকেস—সবই উধাও তখন বুঝলেন, মানুষটা পালিয়েছে।
কিন্তু পালাল কেন? কাল তো তেমন কোনো ঝগড়াঝাটি হয়নি। সকালে কর্তার মেজাজ খুব ভাল ছিল। উমাশশী ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে যখন শোবার ঘরে এলেন কাপড় চোপড় ছাড়তে কত তখন ঘরে, ওই জানলার সামনে বসে সিগারেট ফুঁকছেন। এখন আর লজ্জা শরমের বয়েস নেই, উমাশশী ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে জামা-কাপড় পরতে পরতে শুনলেন কর্তা একটু খাটো গলায় মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ফক্কুড়ির সুরে ‘গীতগোবিন্দ’-র গান ধরেছেন। ওই জিনিসটি ওঁর দখলে আছে। গান গাইতে গাইতে উঠে এসে কর্তা উমাশশীর গায়ের কাপড় ধরে টান মারলেন—‘বিগলিত-বসনং পরিহৃত-রসনং’ আরও কি কি ‘পয়োধর-ভার-ভরেণ’ বলতে বলতে সাত সকালে গাল চাটার জন্যে মুখ বাড়াতেই এক ঠেলায় কর্তাকে দশ পা হটিয়ে দিলেন উমাশশী। বুড়ো বয়েসে ঢংয়ের শেষ নেই। কর্তা এতেই চটে গেলেন। বয়েই গেল উমাশশীর। এরপর আর কিছু ঘটেনি। ভাতের পাতে বরাবরই খানিকটা ঘন দুধ খান কর্তার। বয়েস তো হয়েছে। দুধের জ্বাল ভাল হয়নি। রাগারাগি করছিলেন। তা উমাশশী তখন দু’কথা বলেছিলেন। বিকেলও কোনো অশান্তি হয়নি। সন্ধেবেলায় আবার একপশলা হয়েছিল, সেটাও তেমন কিছু নয়। রাত্রে বাক্যালাপই হয়নি। তা হলে মানুষটা পালাবে কেন?
কামিনী পান, জল নিয়ে এল।
উমাশশী জল খেলেন। পান জরদা মুখে পুরলেন। তারপর পাখাটা খুলে দিতে বললেন—গরম লাগছিল।
কামিনী চলে যাবার পর উমাশশী স্থির করলেন, বড় মেয়ে এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের চিঠি পাঠাতে হবে। নিজে লিখবেন না, মেয়ে কিংবা ছেলেকে দিয়ে লেখবেন। কোথাও গিয়ে দু’দিন গা ঢাকা দিয়ে উমাশশীকে জব্দ করবার চেষ্টা করছে বুড়ো। উমাশশী জব্দ হবার মানুষ কিনা! জব্দ তুমিই হবে। দু’দিনেই তোমার তেল শুকোবে। সাতকাল গিয়ে এককালে ঠেকল—এখন উনি হবেন নিমাইসন্ন্যাস! চোর জোচ্চোরের মুখে বড় বড় কথা!
উমাশশী জোরে জোরেই বললেন, “দেখব তোমার মুরোদ, করো না গৃহত্যাগ। তোমার ত্যাগ আমার জানা আছে।”
দিন দুই পরে আশা এসে মাকে বলল, “বাবার চিঠি এসেছে।”
উমাশশী জানতেন, আসবে। টিকি তো এখানেই বাঁধা ; যাবে কোথায়? ধরুক না একবার অর্শ। তখন তারক কবিরাজের মলম আর উমাশশীর তোয়াজ ছাড়া চলবে না। ডুকরে কাঁদতে হবে। বিজয়িনীর মুখ করে উমাশশী বললেন, “কই চিঠি?”
আশা মিনমিনে গলায় বলল, “দাদাকে লিখেছে।”
উমাশশী গ্রাহ্য করলেন না! মুখ আছে না সাহস আছে ওই গুপ্তবাবুর যে স্ত্রীকে চিঠি লিখবে। ছেলেমেয়েকেই লিখতে হবে, ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদুনিটা ওই ভাবেই গাইতে হবে এখন।
“দাদাকে ডাক।”
“আসতে চাইছে না।”
“ওর ঘাড় আসবে।”
আশা দাদাকে ডাকতে গেল।
উমাশশী অপেক্ষা করতে লাগলেন ছেলের।
তপন এল, সঙ্গে আশা।
“কখন এল চিঠি?” উমাশশী ছেলেকে দেখামাত্র জিজ্ঞেস করলেন।
“এই তো পিয়ন দিয়ে গেল”, তপন বলল।
“কোথায় গিয়ে বসে আছে?” পচুঠাকুরপোর কাছে না মণির কাছে?”
তপন চোরের মতনই এসেছিল ; দাঁড়িয়ে থাকল চোরের মতন। হাতে একটা খাম। মার দিকে ভাল করে চোখ তুলে তাকাচ্ছিল না। আশা ঠিক তার পেছনে।
“ঠিকানা লেখেনি”, তখন ঢোঁক গিলে বলল।
উমাশশী ছেলেকে ভুরু কুঁচকে দেখছিলেন। বাপের নখের যুগ্যিও নয় ছেলে। জোয়ান মদ্দ ছোঁড়া অথচ বাপের মতন লম্বা চওড়া কাঠামো নেই, বেঁটে লিকলিকে চেহারা, মাথায় রাজ্যের চুল, একেবারে মেয়ে-মেয়ে গড়ন পেটন।
“ঠিকানা দেবে না তো লিখবে কেন চিঠি?” উমাশশী ধমকে উঠলেন। “কী লিখেছে তোমার বাবা?”
তপন একবার মার দিকে চোখ তুলেই নামিয়ে নিল। চট করে দেখে নিল আশাকে। তারপর খামটা এগিয়ে দিল মার দিকে।
উমাশশী হাত বাড়িয়েই রেখেছিলেন। নিয়ে নিলেন চিঠিটা। খামের মুখ ছেঁড়া। ছেলেমেয়ে আগেই পড়েছে।
আশা তৈরি ছিল। চশমাটা এনে দিল দেরাজের ওপর থেকে।
চোখে চশমা আঁটলে উমাশশীকে আরও গম্ভীর গম্ভীর দেখায়। চশমা পরে চিঠিটা বার করলেন উমাশশী। মাথার দিকে কোনো ঠিকানা নেই।
চিঠিটা পড়তে লাগলেন:
“কল্যাণবরেষু,
তপু, আমি যে গৃহত্যাগ করিয়াছি, আশা করি তোমরা এতদিনে তাহা সুনিশ্চিতভাবেই বুঝিতে পারিয়াছ। যাহা ত্যাগ করিয়াছি তাহা আর গ্রহণ করিবার বাসনা আমার ইহজীবনে নই। আমি আর গৃহে ফিরিব না। গৃহের সুখশান্তি আমার বিলক্ষণ জানা হইয়া গিয়াছে। ত্রিশ বত্রিশ বৎসর গৃহসংসার করিলাম ; একটি কাঁঠালবিচি মাটিতে পুঁতিলে বত্রিশ বৎসরে বিরাট কাঁঠালবৃক্ষ হইয়া যায়, আর আমার ত্রিশ বৎসর বয়েসে তোমাদের দাদামহাশয় (তোমাদের গর্ভধারিণীর পিতা) যে বিচিটি আমার জীবনে পুঁতিয়া দিয়াছিলেন তাহাতে এই বত্রিশ বৎসরে আমার জীবনটি যে কীরূপ ফলময় হইয়া গিয়াছে তাহা তোমরা বুঝিবে না। কিছুটা বা অনুমান করিতেও পার। তোমরা আমার স্নেহের সন্তান। তোমাদের জন্যই দুঃখ হয়। তোমার দিদির বিবাহ হইয়া গিয়াছে, সে বাঁচিয়াছে। তোমার বোনের বিবাহ আজ অথবা কাল হইয়া যাইবে, সেও বাঁচিবে। তোমার গতি কী হইবে? তোমার জন্যই দুশ্চিন্তা।
আমি স্থির করিয়াছি—তোমাকে আমি মাঝে মাঝে পত্র দিব। উত্তর আশা করি না, কারণ আমার ঠিকানা তোমায় দিব না। দিবার উপায়ও নাই। কোথায় থাকিব বলিতে পারি না। এই যে পত্রটি লিখিতেছি—কোথা হইতে লিখিতেছি বলিতে পার? একটি মনোরম ধর্মশালা হইতে। ইহা সাধুসজ্জনের স্থান। শান্ত, নিরিবিলি ধর্মশালা। নিকটেই গঙ্গানদী। হু-হু করিয়া বাতাস আসিতেছে, জটাজূটধারী এক সন্ন্যাসী জলদকণ্ঠে গীত গাহিতেছে। আহা, কী সুন্দর।
আমি ভাবিয়া দেখিলাম যে, তুমি আমার একটিমাত্র পুত্র। তোমায় কিছু উপদেশ দেওয়া আমার কর্তব্য। সেই মতো আমি তোমায় পত্র লিখিব। আশাকেও পত্রগুলি পড়াইতে পার। তোমার মাতাঠাকুরানীকে না পড়াইলেই ভাল। কিন্তু তাঁহার নিকট হইতে কিছু লুকাইবার ক্ষমতা তোমাদের নাই। তাঁহাকেও পড়াইবে। আমি আর তাঁহাকে ডরাই না। তিনি আমার গ্রিনব্যানানা করিবেন।
তোমার প্রতি আমার প্রথম উপদেশ, কখনো পুলিশের মেয়েকে বিবাহ করিবে না। পুলিশের মেয়েকে বিবাহ করিয়া আমি সারা জীবন নষ্ট করিলাম। পুলিশের মেয়েকে যদি বিবাহ কর জানিবে তোমার সমস্ত স্বাধীনতা লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। ইহারা জামাইষষ্ঠিতেও আসামী ধরার মতন করিয়া নিজেদের জামাইকে ধরিয়া আনে। আমি ভুক্তভোগী। একবার নয়, অন্তত তিনবার আমার শ্বশুরমহাশয়—যিনি বিহার গভর্নমেন্টের এস. পি. জি. ছিলেন—আমাকে দুইবার মুঙ্গের হইতে, আর একবার ভাগলপুর হইতে একজোড়া কনস্টেবল পাঠাইয়া ধরিয়া লইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার এইরূপ অত্যাচারের আরও নমুনা পরে দিব। তবে জানিয়া রাখো আমার অমন পিতৃদত্ত নামটি সারদাপ্রসাদ গুপ্ত, সংক্ষেপে যাহাকে এস. পি. বলে, তাহা আমার কাছে চরম ব্যঙ্গের মতন শুনাইত। বন্ধুরা বলিতেন—এস. পি. জি. অর্থে ‘এস পি’র গোট।
তুমি মানুষ, ছাগল নও। পুলিশের মেয়ে বিবাহ করিলে তোমায় ছাগল হইয়া থাকিতে হইবে। আমার প্রথম উপদেশটি আজ তোমায় দিলাম। অবশ্য তুমি এখনও তেমন সাবালক নও। তোমার বিবাহেরও যথেষ্ট বিলম্ব আছে। তথাপি এখন হইতেই জানিয়া রাখা ভাল।
আমার লণ্ঠনের শিখাটি মিটিমিটি করিতেছে। বোধ হয় তৈল নাই। অদ্যকার মতন শেষ করিতেছি। আমি চমৎকার আছি। শরীর স্বাস্থ্য ভাল। গব্যঘৃত সহযোগে আতপচালের ভাত খাইতেছি। সুস্বাদু দুধ। ধর্মশালার ঘরটিও চমৎকার। গঙ্গার বাতাস, মুক্ত আকাশ, একটি কম্বলের বিছানা আর সাধুসজ্জনের সঙ্গ—ইহার অপেক্ষা আনন্দের কী আছে!
তোমার গর্ভধারিণী মহাতেজস্বিনী মাতাকে বলিবে—আমি বাঁচিয়া আছি, তিনি যেন সধবার আহার-বিহার করিয়া সুখে থাকেন। তোমরা আমার আশীর্বাদ লইবে। ইতি আশীর্বাদক, তোমাদের বাবা।”
চিঠিটা পড়ার সময় উমাশশীর মুখের ভাব কতবার পালটে যাচ্ছিল ছেলেমেয়েরা তা নজর করার সাহস করল না। তপন দাঁড়িয়ে থাকল—ভাবটা এমন যে, তার কোনো দোষ নেই, বাবা এরকম চিঠি লিখবে সে কেমন করে বুঝবে। এই জন্যেই তো সে চিঠি নিয়ে আসতে চাইছিল না।
চিঠিটা শেষ করে উমাশশী আগুনের ঝলকের মতন চোখ করে ছেলেমেয়ের দিকে তাকালে। চোখমুখ টকটক করছে। টান মেরে ফেলে দিলেন কাগজটা, তারপর চেঁচিয়ে বললেন, “পুলিশের মেয়ে বিয়ে করে উনি ছাগল হয়েছিলেন! আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন তো উনি সিংহ। ধর্মশালার আতপ আর ঘি খেয়ে গর্জন করছেন। আমিও দেখব।”
দুটো সপ্তাহ দেখতে দেখতে কেটে গেল। উমাশশী আশা করেছিলেন, হাতের নগদ টাকা ফুরোলেই কর্তাকে ফিরতে হবে। যেরকম কাছাখোলা, বেহিসেবি মানুষ তাতে চারশো টাকার তেজ বেশিদিন থাকবে না। অবশ্য যাবার সময় নবরত্নের আংটিটা চুরি করে নিয়ে গেছে ও। আংটির মালিক আংটি নিয়েছে তাতে কিছু নয় ; কিন্তু টান পড়লে সেটাও কি বেচে দেবে?
ছেলেমেয়েদের দিয়ে উমাশশী চিঠি লিখিয়েছেন সাত আট জায়গায় : কলকাতায়, পাটনায়, টাটানগরে, মিরজাপুরে, বেনারসে প্রায় সব জায়গাতেই—যেখানে কোনো কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন রয়েছে। একেবারে নিজের বলতে কর্তার কেউ নেই, উমাশশীরও নয়—এক বড় মেয়ে ছাড়া। খুড়তুতো জ্যাঠতুতো মাসতুতো ভাই বোনরাই যা রয়েছে দু’তরফের। আজকাল চিঠিপত্রেই যা যোগাযোগ, আগে মাঝে মাঝে তারা আসত-টাসত, এখন আর সে সময় কই, সুযোগই বা কোথায়!
উমাশশী কচি খুকি নন, তাঁর বোধবুদ্ধি যথেষ্ট। লোক হাসানোর কাজ তিনি করবেন না। ছেলেমেয়েদের বলে দিয়েছিলেন, “তোমাদের বাবা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন এ সব কথা কিছু লিখো না। লোকে হাসবে। তোমাদের বাবার তাতে মান বাড়বে না। গুণের তো শেষ নেই বাবুর। সবাই জানে। ঘর ছেড়ে পালানোর কথা লিখবে না ; একথা ওকথার পর শুধু লিখবে—তোমাদের বাবা এখন এখানে নেই, বাইরে গেছেন। ওতেই কাজ হবে। কোথাও যদি গিয়ে উঠে থাকেন তোমাদের বাবা ওদের জবাবে জানতে পারব। তোমাদের দিদিকেও ওইরকম লিখবে। তার শ্বশুরবাড়িতে দিদির মানসম্মান আছে। তার বাবা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে—এটা জামাইয়ের জানার দরকার নেই, তাতে তো তোমাদের মুখ উজ্জ্বল হবে না।”
ছেলেমেয়েরা চিঠি লিখে লিখে মাকে দেখিয়েছিল ; উমাশশী সব চিঠি আগাগোড়া পড়ে নিজের হাতে খামের মুখ এঁটে দিয়েছিলেন।
এই পনেরো দিনে অনেকের চিঠিরই জবাব এল, কিন্তু কেউ লিখল না কর্তার কারও কাছে গিয়ে উঠেছেন।
উমাশশী ভাঙবার পাত্রী নন, গুপ্তবাবুকে হাড়ে হাড়ে চেনেন। সারা জীবন ধরে জ্বলছেন উমাশশী ; অনেক রাগ অভিমান তর্জন গর্জন দেখেছেন ; গুপ্তবাবু হলেন গাদা বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ, আওয়াজ ছাড়া তাঁর কিছু নেই। কিন্তু নিজেকে যতই সামলান, থেকে থেকে মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। গেল কোথায় মানুষটা?
ছেলেমেয়ের কাছে ইতিমধ্যে আরও তিন চারটে চিঠি এসেছে কর্তার ; উমাশশী দেখেছেন। তাঁর বড় অবাক লাগে। চিঠিতে কোনো ঠিকানা নেই—। সে না হয় কর্তা না দিলেন, কিন্তু খামের ওপর পোস্ট অফিসের ছাপ দেখেও কিছু বোঝার উপায় নেই। এমনই ছাপ যে একটা অক্ষরও পড়া যায় না। চিঠিগুলো কোথা থেকে আসে বোঝা গেলেও না হয় উমাশশী ধরতে পারতেন কর্তার গতিবিধি কোন দিকে।
সেদিনও একটা চিঠি এল ছেলের নামে। যথারীতি উমাশশীকে দেখানো হল। উমাশশী দেখলেন, পড়লেন ; কিছু বললেন না। গুপ্তবাবু একতরফা চালাচ্ছেন, প্রত্যেকটি চিঠিতে উমাশশীর মুণ্ডপাত করছেন, খোঁচার ওপর খোঁচা, চিমটে গরম করে গায়ে ছেঁকা দিলেও এত লাগত না। এক একসময় উমাশশীর মনে হয়, তাঁর গায়ের চামড়া কেটে কেটে লেবুর রস আর নুন ছড়িয়ে গুপ্তবাবু যেন জ্বালাটা দেখবার চেষ্টা করছেন। কোনো উপায় নেই উমাশশীর, আড়াল থেকে যে-লোক লড়াই চালায় তাকে মানুষ ধরবে কেমন করে? সামনাসামনি হলে দেখে নিতেন তিনি। কাপুরুষ কোথাকার! সাহস নেই যে সামনে দাঁড়িয়ে লড়বে, আড়ালে গিয়ে উমাশশীকে চোরা বাণ মারছ, ভাবছ তাতে তোমার পৌরুষ বাড়ছে। ঘেন্না ধরে গেল তোমায় দেখে।
এক একদিন এই বয়েসেও চোখে জল চলে আসে উমাশশীর। বাবা বেঁচে থাকলে একবার দেখতেন সারদা গুপ্তকে, কোমরে দড়ি বাঁধিয়ে ধরিয়ে আনাতেন। আজ বাবা নেই, উমাশশী একেবারে অসহায়। এমনই কপাল তাঁর, নিজের পেটের ছেলেমেয়ে দুটোকেও নষ্ট করে দিচ্ছে তাদের বাপ, মার নামে লাগিয়ে লাগিয়ে একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড করছে। উমাশশী তো বলতে পারেন না, তোদের বাবার চিঠি তোরা পড়বি না—আমায় এনে দিবি—আমি আগুনে ফেলে দেব।’ ছেলেমেয়েরা শুনবে কেন? হয়তো দেখা যাবে, বাপের চিঠির কথা আর তারা মার কাছে জানাচ্ছে না। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ছে। এ তবু বোঝা যায়, চিঠিপত্তর এলে, মানুষটা কোথাও না কোথাও রয়েছে ; ছেলেমেয়েরা যদি চিঠির কথা লুকোয় উমাশশী কিছুই জানতে পারবেন না।
শরীরটা দুপুর থেকেই ভাল ছিল না। পূর্ণিমা সামনে। কোমরে, হাঁটুতে, আঙুলের গাঁটে বাতের টনটনানি। বিকেলের দিকে উমাশশী বাইরের বারান্দায় বসেছিলেন খানিক। তাড়াতাড়ি বেলা পড়ে যাচ্ছে আজকাল। সন্ধের মুখে বিকেলের কাপড় চোপড় ছেড়ে সোজা ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
শুয়ে থাকতে থাকতে মনটা বড় মুষড়ে পড়ল। জোড়া খাটের একটা আজ কতদিন ধরে ফাঁকা, বড় বড় বালিশগুলো টানটান হয়ে পড়ে থাকে, মাথার দাগ পড়ে না কোথাও। বিছানার চাদর-টাদরও একবিন্দু কোঁচকায় না। ঘরের কোণে আলনায় কর্তার একটা ময়লা পাজামার পা দু’টো ঝুলছে। যেন আড়ালে বসে ভূতের মতন গা দোলাচ্ছেন কর্তা। কর্তা ঘরে থাকলে তামাকের গন্ধ থাকে—কাগজ পাকিয়ে সিগারেট খান—সেই গন্ধও আর নেই। পায়ের চটি দুটো বরাবরই খাটের তলায় পড়ে থাকত ; তাও নেই।
বেশ ফাঁকাই লাগে আজকাল উমাশশীর ঘরটা। মেয়ে এসে শুতে চেয়েছিল রাত্তিরে ; উমাশশী না করে দিয়েছেন। তার বিছানায় কেউ কোনোদিন শোয়নি, কাউকে শুতে দেননি উমাশশী, ছেলেমেয়েরা যখন কচি ছিল তখনও নিজের বিছানায় রেখেছেন, তারপর আজ কতকাল তো দুই বুড়োবুড়ি এইভাবে শুয়ে এলেন। থাক, পড়ে থাক ফাকা বিছানা, উমাশশী নিজের ঘরে একাই শুতে পারবেন।
মনটা ভাল ছিল না। পাঁচ রকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তাঁর কী খেয়াল হল, কানাইকে ডাকলেন। কানাই এলে বললেন, “দিদিকে একবার ডেকে দে। কামিনীকে বল, আমায় একটু চা দিয়ে যাবে, আর পান।”
কানাই চলে গেল ; একটু পরেই আশা এসে দাঁড়াল।
উমাশশী বললেন, “তোমার বাবার চিঠিগুলো রেখেছ, না ফেলে দিয়েছ?”
“আছে।”
“চিঠিগুলো আমায় এনে দাও। সমস্ত চিঠি। খামগুলো আছে না গেছে?”
“রয়েছে।”
“ওগুলোও আনবে। …দাদা কোথায়?”
“এই তো বাড়ি ফিরল।”
“জানলার দিকের বাতিটা নিবিয়ে মাথার দিকেরটা জ্বেলে দাও। আমার চশমাটাও দিয়ে যাবে।”
মা’র হুকুম মতন আশা একদিকের বাতি নেবাল, মাথার দিকেরটা জ্বালল। চশমা এনে দিল। তারপর চিঠিগুলো আনতে চলে গেল ঘর ছেড়ে।
আশা সামান্য পরেই ফিরে এল চিঠি নিয়ে। কামিনীর দেরি হল আসতে। চা এনেছে, পানের ডিবে আর জরদার কৌটো।
উমাশশী ধীরে সুস্থে চা খেয়ে পান জরদা মুখে পুরলেন। জরদাটা ভাল নয়। কর্তা থাকলে পাঁচ দোকান খুঁজে এনে দেন; তিনি নেই, ছেলেকে বলেছিলেন উমাশশী, ছেলে যা পেয়েছে হাতের কাছে এনে দিয়েছে ; বিশ্রী জরদা। দায়সারা কাজ। এসব থেকেই বোঝা যায়, কর্তা না থাকলে উমাশশীকে কেউ তোয়াক্কাও করে না।
চোখে চশমা এঁটে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন উমাশশী। চিঠিগুলো গুছিয়ে নিলেন।
প্রথম চিঠিটা বাড়ি ছেড়ে যাবার দিন দুই পরে এসেছে। আবার একবার খুঁটিয়ে পড়লেন। উমাশশী আর উমাশশীর বাবাকে কী বিচ্ছিরি করে গালাগাল দিয়েছে দেখেছ। যেন পুলিশের মেয়েকে বিয়ে করে উনি বাঘের খাঁচায় ঢুকে পড়েছিলেন বেরুবার আর পথ পাননি, মেয়ে বাপে মিলে ওকে শুধু ভয় দেখিয়েছে, আঁচড়েছে, কামড়েছে।…ঠিক আছে কর্তা—ছেলের কাছে তুমি খুব সাধু সাজছ, নিরীহ গোবেচারি সাজছ। এ-রকম বেইমানি ধর্মে সইবে না। মা-বাপ মরা ছেলে, দেখতে শুনতে ভাল, বিদ্যেবুদ্ধি রয়েছে দেখে বাবা তোমায় যেচে জামাই করেছিলেন—নয়ত পাঁচ সাতটা অ্যাডভোকেট, ব্যারিস্টার ছেলে হাতে ছিল বাবার। কাঞ্চন ফেলে কাচ নিয়েছিলেন বাবা। অমন মানুষের গায়ে তুমি কাদা ছিটোলে! নিজের দোষটা দেখ না কেন গুপ্তবাবু? বিয়ে করেছিলে যখন তখন থাকার মধ্যে চাকরিটাই না হয় ছিল, আর কোনো সাংসারিক জ্ঞান ছিল তোমার? একটা ঘরভাড়া পর্যন্ত জোটাতে পারো না, বউকে নিয়ে আহ্লাদ করার ইচ্ছে। বাবা রাজি হননি বলে কত তেরিয়া-মেরিয়া। শ্বশুরবাড়ির ছায়া মাড়াবে না বলেছিলে। আমার বাবা তোমায় ধরে আনিয়েছিলেন। তাতে কোনো দোষ হয়েছে?…পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে বোলো না, তোমারই তাতে মাথা কাটা যাবে। আমার তখন প্রথম, পাঁচ ছ’ মাসে নষ্ট হয়ে গেল, আমি বিছানায় শুয়ে কেঁদে মরি আর তুমি স্বার্থপর ইয়ার বন্ধু নিয়ে নৈনিতাল বেড়াতে যাবার ফন্দি করছ। বাবা তোমায় ধরে আনিয়েছিলেন। বড্ড অন্যায় করেছিলেন আমার পুলিশ-বাবা? কোন একটা দলের সঙ্গে ক্যাম্প করতে গিয়েছিলে—যেখানে তোমার ঘাড় মটকাবার জন্যে মেয়ে জুটেছিল এক, দুজনে শীতের মধ্যে হু হু হি-হি করতে করতে আগুন সেঁকতে। এই নিয়ে অশান্তি করতে চেয়েছিলে তুমি। বলেছিলে, বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। বাবা তোমায় শাসিয়ে দিয়েছিলেন আড়াল থেকে। কত না গুণ ছিল তোমার গুপ্তবাবু। ছেলেমেয়েদের কাছে তো তোমার মতন নির্লজ্জ হয়ে সব কথা বলতে পারি না, তুমি আজ তাই আমার মুখে চুনকালি মাখাচ্ছ। মাখাও।
খুঁজেপেতে দ্বিতীয় চিঠিটাও সাজিয়ে নিলেন উমাশশী। পড়লেন আবার খুঁটিয়ে। ঠিকানা নেই। কিন্তু চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে, পুরনো ধর্মশালা ছেড়ে কর্তা নতুন জায়গায় গিয়ে উঠেছেন। অন্য কোথাও। লিখেছেন, এখানে ঝরনা আছে, বন আছে, গাছে গাছে অজস্র পাখি। পুরনো এক শিবমন্দির। শিবমন্দিরের সামান্য তফাতে এক আশ্রম মতন। চার পাঁচটি সাধু সন্ন্যাসী থাকেন। সকলেই অস্থায়ী। এক দু’মাস করে থাকেন, আবার চলে যান। সেখানে কোনো এক মহাসাধুর সাক্ষাৎ পেয়েছেন কর্তা। তিনি নাকি গুপ্তবাবুকে বলেছেন, “তুমি তো চাঁদি ছিলে বেটা, কিন্তু তোমায় এখন সিসে বলে মনে হচ্ছে—তোমার জেল্লা কেউ নষ্ট করে দিয়েছে।”
চিঠিতে কর্তা লিখেছেন : “তোমার মাতাঠাকুরানীর গণ আমি জানি না। রাক্ষসগণ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। আমি নরগণ। নর-রাক্ষসের লড়াইয়ে নরের পক্ষে জেতা সম্ভব নয়। তোমার মার জয় হইয়াছে ; আমি পরাস্ত হইয়া দলিত মথিত অবস্থায় পড়িয়া আছি। আমার আর জেল্লা কি করিয়া থাকিবে? তোমার মা আমায় সিসা করিয়া ছাড়িয়াছেন। বড়ই দুঃখ হয়, বুক ফাটিয়া যায়। আমার কী ছিল আর কী হইলাম। সোনা তামা হইয়া গেল। নদীটি মজিয়া নালা হইয়া গেলে এই প্রকারই হয়। তোমার প্রতি আমার উপদেশ, পুলিশের মেয়ে তো বটেই, এমন কি যে-মেয়ের চলনে-বলনে, আচারে-আচরণে বিন্দুমাত্র মদ্দানি ভাব দেখিবে, বুঝিবে সে তোমায় গলা ও বাহুর জোরে দাবাইয়া রাখিবে—কদাচ তাহাকে বিবাহ করিবে না। করিলেই মরিবে। তোমার ব্যক্তিত্ব সেই চণ্ডীস্বরূপা কন্যা অতি সহজেই আমের মতন চুষিয়া খাইবে।
আমি রীতিমত সুস্থ। এই স্থানের লাল আটার রুটি ও অড়হর ডাল যে কী অপূর্ব স্বাদের তাহা তুমি বুঝিবে না। ভিণ্ডির ঘেঁটটিও চমৎকার। কিঞ্চিৎ ছাগ দুগ্ধ পান করিয়াছি। উহা বড়ই উৎকট। মহাত্মাজি যা পারেন—সাধারণে তাহা কেমন করিয়া পারিবে। যাহা হউক, আমার জন্য চিন্তা করিও না। আমি শান্তিতে আছি। আমার বন্ধনদশা কাটিয়াছে ইহাই জগদীশ্বরের কৃপা। এখানে শীত পড়িয়াছে। ওখানে কি শীত পড়িল। শীত সমাগমে তোমার মা-জননী বাতব্যাধিতে কাবু হন। মাঝে-মাঝে আমি ভাবি, মনুষ্যরূপে না জন্মিয়া যদি বাতব্যাধিরূপে এ-সংসারে আসিতে পারিতাম আমার কিছু লাভ হইত। আমার কপাল মন্দ।”
উমাশশী চিঠিটা যথারীতি ভাঁজ করে খামে রেখে দিলেন। রাগে করকর করছিল চোখ, মাথাটাও দপদপ করছে। কিন্তু কার ওপর রাগ দেখাবেন? থাকত মানুষটা চোখের সামনে তো ঝাঁপ দিয়ে বুকের ওপর পড়তেন। নাগালের বাইরে গিয়ে আজ বলছেন আমি নাকি রাক্ষস, আর উনি নর। আমার হাতে পড়ে রুপোর তাল সিসে হয়ে গেছে? আজ এসব কথা তো লিখবেই। নেমকহারাম, অকৃতজ্ঞ। উমাশশীর হাতে পড়েছিল বলে বর্তে গিয়েছ। কিছুই তো ছিল না তোমার। এই ঘরবাড়ি, দুটো পয়সা গচ্ছিত রাখা, বড় মেয়ের বিয়ে সবই আমার জন্যে হয়েছে, তোমার কেরামতিতে নয়। ব্যারিস্টার বর ছেড়ে তোমার মতন হেজিপেজিকে বিয়ে করেছিলাম—আর আজ তুমি বলছ আমি রাক্ষুসি।
কাঁদতে ইচ্ছে করছিল উমাশশীর। কিন্তু কী হবে কেঁদে? কার জন্যে কাঁদবেন? ওই চোর, বাটপাড়, ভাগলু মানুষটার জন্যে?
তৃতীয় চিঠিটা বার করে নিলেন উমাশশী। এটা আবার আদিখ্যেতা করে মেয়েকে লেখা। পড়া চিঠি। আবার পড়লেন।
খুবই অবাক কাণ্ড, মানষুটা কোথাও দুদিন স্থায়ী হচ্ছে না।
আজ এখানে, কাল ওখানে। কোন পথ থেকে কোথায় চলেছে? হিমালয়ের দিকে নাকি? আগের বার যেখানে ছিল তার সামনে ঝরনা, বন, পাখি, শিবমন্দির কত কী! এবারে মেয়ের কাছে বর্ণনা করে লিখেছে, এক শেঠের বাড়ির দোতলার ঘরে রয়েছে। সামনে নর্মদা নদী। শয়ে শয়ে লোক সকাল থেকে স্নান পুজো-আর্চা করছে, সাধু সন্ন্যাসীদের আসা-যাওয়া, নর্মদা নদী তরতর করে বয়ে চলেছে, ঘাটের পাড়ে গাছের ছায়ায় সারাদিন ধুনি জ্বলে সাধুদের।।
কর্তা মেয়েকে লিখেছেন, “তীর্থে তীর্থে কত কী ছড়াইয়া রহিয়াছে। সংসারে থাকিলে জীব অন্ধ হয়, কিছুই দেখিতে পায় না। আমি যাহা দেখিতেছি তাহাতেই চমৎকৃত হইতেছি। এখানে এক বাঙালি সন্ন্যাসীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। আঠারো বৎসর বয়সে সংসার ত্যাগ করিয়া হিমালয়ের দিকে চলিয়া গিয়াছিলেন। বারো বৎসর গুহায় সাধনা করিয়াছেন। এখন আবার এই অঞ্চলে ঘুরিয়া বেড়ান। বয়স পঞ্চাশ হইবে। কী তেজপূর্ণ চেহারা। মহা পণ্ডিত ব্যক্তি, মস্ত সাধক। কিন্তু বড় বিনয়ী, নম্র, প্রাণখোলা।
স্বামীজি আমায় একটি দুটি উপদেশ দিয়াছেন। তোমার মঙ্গলের জন্যে লিখিতেছি। স্বামীজি বলেন, মানুষের কয়েক প্রকার স্বভাব আছে, সে কখনও কখনও বৃষ জাতীয় আচরণ করে, কখনও বৃশ্চিক জাতীয়। আবার কাহারও আকার প্রকার, আচার বিচার কুম্ভ জাতীয়। বৃষ জাতীয় মানুষ সংসারে খায় দায় ঘুমায়, কখনও কখনও সামনে পড়িলে গুঁতা মারে। বৃশ্চিক জাতীয় মানুষ ভীষণ, তাহারা শুধু কামড় দেয় না, বিষের জ্বালায় জ্বালায়। আর কুম্ভ জাতীয়রা গোবেচারি। তাহারা সহজেই ফাটিয়া যায়।
তুমি আমার কনিষ্ঠা কন্যা। তোমার স্বভাব যদি তোমার গর্ভধারিণীর মতন হয় তবেই মরিবে। তোমার মা যে বৃশ্চিক জাতীয় মানুষ তাহাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। তাঁহার কামড় যত, বিষও তত। আমি তো তাঁহাকে সজারুও বলিতে পারি। কাছে গেলে তাঁহার গা ফোলে, কাঁটা দিয়া বিদ্ধ করেন। তুমি কখনও মার স্বভাব গ্রহণ করিও না। আমাদের দেশের মেয়েদের নম্র, বিনীত, মিষ্টভাষী হইতে হয়। ইহাতেই তাহারা সকলকে সুখী করে নিজেও সুখী হয়। তুমি অন্য সংসারে গিয়া অন্যদের সুখী করো, নিজে সুখী হও—ঈশ্বরের কাছে ইহাই আমার প্রার্থনা। তুমি যে কেমন তাহা আমি জানি, তবু ভয় হয় তোমার মাতাঠাকুরাণী না তোমায় দলে টানিয়া লন। বৃশ্চিকম্ বিভেতি। সংস্কৃত ব্যাকরণ বিদ্যা আমার নাই। শুদ্ধ করিয়া নিবে। মোদ্দা কথাটি এই, বৃশ্চিক হইতে সাবধান।
আমার অল্পস্বল্প কাশি হইয়াছিল। এই অঞ্চলে শীত আসিয়াছে। ঠাণ্ডা লাগিয়াছিল বোধ হয়। মিছরির কৎ করিয়া আদা গোলমরিচ সহযোগে খাইয়াছি। কাশি আরাম হইয়াছে। মনে আমার স্ফূর্তি, প্রাণে মুক্তি। বেশ আছি। মোটা মোটা চাপাটি, বেগুনপোড়া, ছোলার ডাল, দহি দিন দুই খাইলাম। ভালই লাগিল। আধ লোটা দুধও জুটিয়াছিল গতকাল। ঘুমটুম ভালই হইতেছে।
তোমার মাকে বলিবে তিনি যেন আমার বিছানাটি গুটাইয়া ছাদে তুলিয়া দেন। আমার খাটটি ঘর হইতে বাহির করিয়া কলাবাগানে ফেলিয়া আগুনে দিবার ব্যবস্থা করেন। আমার যাহা কিছু আছে দানধ্যান করেন। সংসারের বাইরে যে শান্তি পাইয়াছি তাহা ছাড়িয়া কোন মূখে আর গৃহে ফেরে।”
উমাশশী চিঠি শেষ করে চোখ বুজে শুয়ে থাকলেন। মাথার মধ্যে টনটন করছে, ঘাড়ের কাছটায় ব্যথা। সর্বাঙ্গ জ্বালা করছে রাগে। এ কেমন শত্রুতা? দূর থেকে আড়াল থেকে আমার শত্রুতা করছ? সাধ্য থাকে, সাহস থাকে সামনে এসে দাঁড়াও। কে বৃশ্চিক আর কে কুম্ভ তোমায় দেখাচ্ছি। এমন অসভ্যতা মানুষে করে। ইতরোমির শেষ নেই। নিজের ছেলেমেয়েদের তুমি তাদের মা’র পেছনে লাগাচ্ছ? ছি ছি, ঘেন্নায় মরি।
অভিমানে উমাশশীর চোখে জল এল। দু’ফোঁটা কেঁদে চোখ মুছে নিলেন।
স্বামীর জন্যে চোখের জল উমাশশী অনেক ফেলেছেন। তখন বয়েস ছিল ফেলার, জলও ছিল পর্যাপ্ত। এ-বয়েসে আর কতই বা কান্নাকাটি করতে পারেন, সেই যে কর্তা ঢং করে গাইতেন ‘নয়নের বারি রেখেছ নয়নে’—সেই বারিও এখন শরীরের আর পাঁচটা পদার্থর মতন কমে এসেছে। কমে এসেছে, না অন্তঃস্রোতা হয়েছে তা অবশ্য উমাশশী বুঝতে পারেন না। তখন হাউমাউ করে কাঁদলেও বলার কেউ ছিল না ; ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট—তারা অতশত বুঝতে পারত না, উমাশশী অন্য কোনো কথা বলে কিংবা ছুতো দেখিয়ে প্রাণভরে কেঁদে নিতে পারতেন। এখন কি আর পারেন! ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারবে, মা, বাবার জন্যে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। দেখে আড়ালে হাসাহাসি করবে।
কান্নাটা তাই উমাশশীর বুকে বুকে রইল। নিজের ঘরে বসে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলেন, টপ টপ করে জল পড়ে চোখ বেয়ে, আঁচলে মুছে নেন। বুকের তলায় কষ্ট হয়, দুপুরে শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবেন—কোথা দিয়ে কেমন করে কর্তাকে ধরবেন, বুঝতেও পারেন না। বেনারস, এলাহাবাদ, হিল্লি-দিল্লি কোথায় গিয়ে রয়েছেন জানতে পারলেও একটা কথা ছিল—উমাশশী না হয় ছুটতেন, কিন্তু গুপ্তবাবু যে কোথায় তা জানার কোনো পথ রাখেননি।
উমাশশী একেবারে হাল ছেড়ে দেবার মানুষ নন। যদি তাই হতেন তবে কোন কালেই গুপ্তবাবুকে ছেড়ে দিতেন, আর গুপ্তবাবুও খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াতেন। উমাশশী অত বোকা বা কাঁচা নন, নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে গুপ্তবাবুকে স্বাধীন মুক্তপুরুষ হতে দেননি। পুরুষ মানুষ কেমন জিনিস তা তিনি জানেন, হাতের ফাঁক দিয়ে একবার গলে পড়ল তো পড়লই, কোন জলে গিয়ে ডুববে, তা কেউ জানে না। কার সাধ্য আর তাকে খুঁজে বার করে!
উমাশশী স্বামীকে আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলতে দেননি, খুব সাবধানে মুঠোর মধ্যে ধরে রেখেছিলেন। মুঠো একটু আধটু আলগা হলেই বুঝেছেন গুপ্তবাবু গলবার চেষ্টা করছেন। সঙ্গে সঙ্গে মুঠো আরও শক্ত হয়েছে। গুপ্তবাবু বুঝে নিয়েছেন, তিনি যদি যান ডালে ডালে উমাশশী ঘোরেন পাতায় পাতায়।
মানুষটাকে বরাবর এইভাবে বেঁধে রেখেছিলেন উমাশশী। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন—তোয়াক্কাও করেননি ; পালাবার পথ ছিল না কর্তার, খোঁয়াড়ের জীব ঠিকই ধরা পড়ে যাবে, উমাশশী জানতেন। আজ বাবা নেই, উমাশশী অসহায়, আর ঠিক এই সময়ে যখন উমাশশীর মনে কিছুমাত্র খল ছিল না, দুশ্চিন্তা ছিল না, তখন কর্তা তাঁকে ফাঁকি দিয়ে পালালেন। উমাশশী ভাবতেই পারেন না। এই বয়সে কেউ পালায়! যখন বয়েস ছিল পালাবার তখন যদি পালাতে পারতে, তোমায় আমি ত্যাজ্য করতুম। তখন তো মুরোদ ছিল না। এখন আমায় অক্ষম দেখে খুব সাহস দেখালে!
কুড়ি বাইশটা দিন তো কাটল। উমাশশী তো পাথর নন, মানুষ। তাঁরও গায়ে রক্তমাংস আছে। তুমি যতই তাকে রাক্ষসগণ বল, বল না কেন বৃশ্চিকের জাত, তার স্বভাব চরিত্র নিয়ে খোঁচা মার, তবু সে কেমন করে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারে! হাজার হোক, মানুষটি জোয়ানমদ্দ নয়, বয়েস হয়েছে, বুড়ো—; তার এখন নিয়মে থাকার কথা, একটা সহ্য হয় অন্যটা হয় না, আরাম-আয়াস ধরাবাঁধা দরকার ; সেই মানুষ লাল আটার রুটি, অড়হর ডাল, ঢেঁড়সের তরকারি আর ছাগলের দুধ খাচ্ছে, মাটিতে কম্বল পেতে শুয়ে আছে, ভাবলেই উমাশশীর বুকের মধ্যে কেমন যেন করে। তার ওপর লিখেছে, সর্দিকাশি হয়েছিল—মিছরির কৎ আর আদা খেয়ে আরাম হয়েছে।
উমাশশী বুঝতে পারছেন, একটা সর্বনাশ না করে গুপ্তবাবু ছাড়বেন না। অত জেদ, অত তেজ, স্ত্রীর ওপর পুষে রাখা তিরিশ বছরের গায়ের জ্বালা মেটাতে গিয়ে কর্তা কোথায় কোন ধর্মশালায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়বেন—তখন উমাশশীর ডাক পড়বে। ভবিষ্যতটা উঁকি মারলেই বুক কেঁপে ওঠে উমাশশীর। অর্শের রোগী, ওদিকে আবার শ্লেষ্মার ধাত, সামান্য গোলমাল হলেই বুকে কফ জমে, অল্পস্বল্প ডায়েবেটিস—, ঠাকুরের কত অঙ্গে কত খুঁত,—সেই মানুষ গিয়েছেন সংসার ত্যাগ করতে। আসলে সবই উমাশশীকে ভোগাবার জন্যে। কিন্তু এ-কথা কে কর্তাকে বোঝাবে—অত তেজ ভাল নয়, এটা আহম্মুকি। নিজে যখন চোখ উলটে পড়বে—তখন তোমার ভোগান্তিও কম হবে না।
কুড়ি বাইশ দিনের মাথায় আবার চিঠি এল। ছেলেমেয়েরা চিঠি লুকোয় না। মেয়েই চিঠিটা এনে দিল। উমাশশী তখন রান্নাঘর ঘুরে সবে নিজের ঘরে এসেছেন, একটু জিরিয়ে নেবেন, আশা এসে চিঠিটা দিল।
উমাশশী বললেন, “পিয়ন এসেছিল?”
আশা মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ইতস্তত করল। বলল, “না। দাদা একটু বেরিয়েছিল, পোস্ট অফিস থেকেই চিঠি নিয়েছে।”
“কোথায় দাদা?”
“ঘরে।”
উমাশশী খামটা উলটে পালটে দেখছিলেন। যথারীতি খামের মুখ ছেঁড়া। চশমা দিতে বললেন মেয়েকে।
আশা চশমা এনে দিল।
চশমা চোখে দিয়ে উমাশশী খামের ঠিকানাটা যেন একটু বেশি নজর করেই দেখলেন ; তারপর ডাকঘরের ছাপ। ব্যাপারটা তাঁর কাছে খুবই আশ্চর্যের মনে হয়। একটা দুটো নয়, আজ কুড়ি বাইশ দিনে চার পাঁচটা চিঠি এসেছে কর্তার, সব কটাই খামে, কিন্তু সবকটা চিঠিরই ডাক টিকিটের ওপর মারা ডাকঘরের ছাপ এত অস্পষ্ট কেন? কেন একটারও ছাপ পড়া যায় না? ছাপটা পড়া গেলে বোঝা যেত কর্তা কোথায় আছেন।
উমাশশী হঠাৎ ছেলেকে তলব করলেন। আশা দাদাকে ডাকতে গেল। উমাশশী চিঠিটা বার করলেন। সেই একই ব্যাপার, নিজের কোনো পাত্তা দেননি কর্তা, নি-ঠিকানা চিঠি লিখেছেন ছেলেকে। তপু এল। আশাও পিছু পিছু এসেছে। উমাশশী ছেলের দিকে তাকালেন। চোখে বিরক্তি। “তুমি পোস্ট অফিসে গিয়ে চিঠি নিয়েছ?”
তপু মাথা দোলাল। “চুল কাটতে গিয়েছিলাম সেলুনে। পোস্ট অফিস থেকে নিয়ে নিলুম চিঠিটা।”
“পোস্টমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলে না কেন?”
তপু মা’র চোখে চোখে তাকাল না। বলল, “কী?”
“এই যে তোমার বাবার চিঠিগুলো আসছে—এগুলো আসছে কোথা থেকে?”
তপু যেন থতমত খেয়ে গেল। বলল, “কেন? বাবা যেখান থেকে লিখেছে।”
“সেই জায়গাটা কোথায়?” উমাশশী ছেলেকে ধমকে উঠলেন। “একটা চিঠিরও টিকিটের ওপর ছাপ পড়া যায় না কেন?”
তপু রীতিমত ঘাবড়ে গেল। আশার দিকে তাকাল একবার। তারপর ঢোঁক গিলে বলল, “কি জানি। পোস্টমাস্টারবাবুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কেমন করে বলবেন। ছাপ তো পড়াই যায় না। আমার মনে হয় বাবা আর. এম, এস-এ চিঠি ফেলে।”
উমাশশী বললেন, “কেমন করে বুঝলে?
তপু বলল, “আমি দু’একটা খামে ‘আর আর’ দেখেছি। না রে আশা?”
আশা ঘাড় হেলিয়ে বলল, “আগের চিঠিটাতেই ছিল।”
উমাশশীর পছন্দ হল না। বললেন, “কাল পোস্ট অফিসে গিয়ে মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করবে। তিনি তো তোমাদের বাবার ইয়ার-বন্ধু ছিলেন। জিজ্ঞেস করবে, এ-রকম বে-আইনি চিঠি কেন আসে?”
আশা বলল, “বে-আইনি বলা যাবে না, মা।”
“কেন?”
“ছাপ তো থাকে।”
“তুমি আমায় আইন শেখাবে! আমার বাবার কাছে আমি অনেক আইন গুলে খেয়েছি।”
আশা চুপ করে গেল।
তপু কি যেন ভেবে নিয়ে বলল, “পোস্টমাস্টারবাবুকে বলব মা, যে বাবা রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন?”
উমাশশী আরও বিরক্ত হলে, অসহ্য লাগল তাঁর। বললেন, “তা আর বলবে না? বদ্যির ঘরে কি দামড়াই জন্মেছে! ঘরের কথা পাড়ার লোককে না বলে বেড়ালে তোমার বাবার মান আর বাঁচছে না।”
তপু অধোবদন হল।
উমাশশী বললেন, “তোমাদের বাবার এমনিতে তো আর গুণের ঘাটতি ছিল না, এখন এই বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ধরেছে, চুরি চামারি করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে—এটা আবার শহরময় ঢ্যাঁঢড়া পিটিয়ে বলে বেড়াও—তাতে তোমাদের বাবার আরও চারটে পা গজাবে। মুখ্যু, দামড়া কোথাকার।”
আশা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল।
তপুও পালাবার চেষ্টা করছিল, উমাশশী বললেন, “আমি পই পই করে না বলেছি, তোমাদের বাবা নিমাইসন্ন্যাস হয়েছে একথা কাউকে বলার দরকার নেই। শুনলে লোকে হাসাহাসি করবে, ছি ছি করবে। তোমাদের বাবা ক’দিনের জন্যে বাইরে গেছেন দরকারে—এর বেশি কিছু বলার দরকার তো করে না।”
তপু ঢোঁক গিলে বলল, “তাই তো বলি—কেউ জিজ্ঞেস করলে।”
“তাই বলো। যাও।”
তপু মা’র চোখের সামনে থেকে সরে পড়তে পারলেই যেন বাঁচে। সরে সরে ঘর ছেড়ে পালাল।
ছেলেমেয়েরা চলে যাবার পর উমাশশী কয়েক মুহূর্ত দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেন। রাগ, ক্ষোভ, অশান্তিতে তাঁর মুখচোখ অপ্রসন্ন দেখাচ্ছিল। এই রকম ছেলেমেয়ে তিনি আর দেখেননি।
একটা বুড়ো মানুষ, ঘরের কর্তা, তোদের বাবা—বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, দেখতে দেখতে প্রায় মাস পুরতে চলল, অথচ তোদের কোনো গা নেই। একটা দিনের জন্যেও দেখলাম না, তোরা তোদের বাপের জন্যে ছটফট করিস, মুখ শুকনো করে বসে থাকিস! চারবেলা খাচ্ছিস দাচ্ছিস, সাজন-গোজন করছিস, রেডিয়ো বাজিয়ে গান শুনছিস আর বাইরে বাইরে আড্ডা ইয়ার্কি মেরে বেড়াচ্ছিস! তোদের দেখলে মনে হয়, গলা কেটে কেটে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়ে আসি। বাপ বাড়ি নেই, সে-মানুষটা কোথায় কোন চুলোয় ছাতু ছোলা খেয়ে মাটিতে শুয়ে মরছে, আর তোরা দুজনে কেমন যে যার ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে নাক ডাকাচ্ছিস!
একেই বলে ছেলে মেয়ে! স্বার্থপরের দল! মা-বাপকে শুধু শুষতেই পারিস তোরা, তোদের মায়া মমতা ভালবাসা ভক্তি কিছু নেই। আজকালকার ছেলেমেয়েদের এই রীতি নীতি। উমাশশীদের সময় অন্যরকম ছিল। উমাশশী নিজেই বাবা বলতে অজ্ঞান ছিলেন। অবশ্য বাবাও ছিল সেইরকম। তোদের বাবার মতন চোর জোচ্চোর বাটপাড় বাবা নয়।
আসলে যেমন বাপ তার তেমনই ছেলেমেয়ে, উমাশশীর দুর্ভাগ্য, তিনি আর মাথা খুঁড়ে কেঁদেকেটে কী করবেন! ভগবান যার কপালে যা লিখেছেন তাই তো হবে।
বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ভারী বুকে উমাশশী এবার চিঠিটার ওর চোখ রাখলেন। ছেলেকেই লেখা হয়েছে।
কর্তা আর নর্মদার তীরে নেই। আগের আশ্রমটিও ত্যাগ করেছেন। লিখেছেন, এখন তিনি পরিব্রাজক। কোথাও আর স্থিত হচ্ছেন না। শুধু এগিয়ে চলেছেন।
“আমায় যে কোন বৈরাগ্য দেবতা অলক্ষ্য হইতে হাতছানি দিতেছেন তাহা আমি জানি না, তপু। আমি শুধু আমার ঝোলাঝুলিটা কাঁধে লইয়া তাঁহার ডাকে চলিতেছি। আমায় দেখিলে তোমাদের অবাক হইবার কথা। গালে দাড়ি, হাতে লাঠি, পায়ে কেড্স জুতা, কাঁধে একটা বোঁচকা। আমার কোথাও বিরাম নেই, চলিতেছি আর চলিতেছি। কখনও রেলে, কখনও বাস গাড়িতে, কখনও পদব্রজে। আমার সহিত একদল তীর্থযাত্রীর পরিচয় ঘটিয়াছিল। এই দলটি কম নয়, জনা পনেরো হইবে। নারী পুরুষ উভয়েই আছে। তবে নারীর সংখ্যা কম দুই তিনজন মাত্র। পথে ইহাদের সঙ্গে দেখা ও পরিচয়। শুনিলাম তাঁহারা উত্তর হইতে নামিয়া আসিতেছেন, এখন দক্ষিণে যাইবেন। তাঁহাদের নিকট জানিলাম, সাধুসঙ্গের প্রকৃষ্ট স্থান হিমালয়, পথে পথে কত সাধুসজ্জন। তাঁহাদের নিকট বরফানিবাবা নামের এক মহাপুরুষের নাম শুনিলাম। ইনি বরফের মধ্যে সমাধিস্থ হইয়া বসিয়া থাকেন বলিয়া লোকে ইহাকে বরফানিবাবা বলে। তাঁহার যে কত বয়েস তাহাও জানা যায় না। একশো সোয়াশে বছরও হইতে পারে। যাহা হউক, আমি এখন উত্তরের পথে পাড়ি জমাইয়াছি, হরিদ্বার হইয়া হিমালয়ের দিকে যাত্রা করিব। হিমালয় আমায় টানিতেছে।
একটি অদ্ভুত ঘটনার কথা তোমায় জানাই। রেলগাড়িতে এক ভদ্রলোকের সহিত ঘটনাচক্রে আমার আলাপ হইয়া যায়। তাঁহার পরিচয়, তিনি একসময় সিমলায় গভর্নমেন্টের হোমরা চোমরা অফিসার ছিলেন।
ভদ্রলোক জীবনে অনেক দুঃখশোক পাইয়া এখন সংসারধর্ম ত্যাগ করিয়াছেন, উচ্চশ্রেণীর তন্ত্রসাধনা করেন। তাঁহার কিছু ক্ষমতা জন্মিয়াছে। খগেনবাবু আমায় বলিলেন, আমার আত্মার ওপর একটা মোটা আবরণ ছিল, যেমন কাঠবাদামের ওপর শক্ত পুরু খোসা থাকে। এই খোসাটি আমার চৈতন্যকে এমনভাবে ঢাকিয়া রাখিয়াছিল যে আমার নাকি চৌরাশি জন্মের লক্ষণ ছিল। জীব হইয়া আমাকে নাকি চৌরাশি বার ভ্রমণ করিতে হইত। পরমেশ্বরের কৃপায় আমার সে দুভার্গ্য ঘুচিয়া গিয়াছে, আমি মুক্তি পাইয়াছি। এখন আমার চৈতন্য কাহারও কবজায় নাই, আমার কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত। খগেনবাবু বলিয়াছেন, অচিরেই আমি কোনো উন্নত সাধকের সাক্ষাৎ পাইব। কর্মবিপাকে আমি পাতক ছিলাম, এবার সাধক হইব।
খ-বাবু আমায় আরও একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখাইলেন। তিনি একটি আরশি বাহির করিয়া দিলেন, ছোট আরশি, আঙুল চারেক তাহার মাপ। আরশির ওপর কালচে রঙের কিছু মাখানো। আমার কপালে তাঁহার বুড়া আঙুল কয়েক মুহূর্ত ছোঁয়াইয়া রাখিলেন, তাহার পর আঙুল সরাইয়া আরশিটি দেখিতে বলিলেন। প্রথমটায় কিছু দেখিতে পাইলাম না। পরে দেখিলাম, কী আশ্চর্য, আরশির মধ্যে তোমাদের মাতাঠাকুরাণী। সাইজটা ছোট। দেখিলাম, তোমাদের গর্ভধারিণী বিছানার ওপর শুইয়া আছেন, বালিশের পাশে পানের ডিবা, জরদার কৌটা। তিনি হঠাৎ উঠিলেন, এবং কোথা হইতে একটা খাঁড়া যোগাড় করিয়া আমার দিকে ছুটিয়া আসিলেন। ভয়ে আমি আরশি ফেলিয়া দিলাম। খ-বাবু বলিলেন, গৃহী হইবার বিন্দুমাত্র বাসনাও যদি অন্তরে থাকে, ত্যাগ করুন। গৃহে ফিরিলে আপনি অবশ্যই অনুশোচনা করিবেন।
বাবা তপু আমি মন্ত্র তন্ত্র বিশ্বাস করিতাম না। কিন্তু খ-বাবুর আরশিতে তোমার মা-জননীর যে মূর্তি দেখিলাম, তাহাতে আমার হৃদকম্প হইল। এ-মূর্তি ভুলিবার নয়। পূর্বেও কত দেখিয়াছি, তবে যথার্থ খড়গধারিণী রূপে দেখি নাই, এই প্রথম, দেখিলাম। দেখিয়া বন্ধুবাবুর সেই গীতটি মনে পড়িল :‘নাচিছে তুরঙ্গ মোর রণ করে কামনা…’
তোমার মাতাঠাকুরাণীকে বলিবে, তাঁহার তুরঙ্গ যতই নাচুক না কেন তিনি আর ইহজীবনে রণসাধ মিটাইতে পারিবেন না। আমি তাঁহার খড়গ ও আস্ফালন হইতে বহুদূরে। তিনি আমার কেশাগ্রও স্পর্শ করিতে পারিবেন না। বরং ধর্মমতে ও শাস্ত্রমতে আমি যখন জীবিত—তখন বৃথা তুরঙ্গ না নাচাইয়া মহাশয়া যেন শয়নে-ভোজনে-তাম্বুলে চর্বণে তৃপ্ত থাকেন। তাঁহার ক্রোধ ও ক্লেশের কোনো কারণ নাই। আপদ বিদায় লইয়াছে, ইহাতে তো তাঁহার শান্তি পাইবার কথা।
আমি পরে তোমায় পত্র লিখিব। এইস্থানে ইতি করিতেছি। তোমরা আমার আশীর্বাদ জানিও।”
উমাশশী চিঠিটা বার দুই পড়লেন। পায়ের নখ থেকে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত গনগনে আঁচের মতন জ্বলছে। ঘাড় টনটন করছিল। কপাল ফেটে যাচ্ছে।
চোখের পাতা বন্ধ করে যেন নিজেকে খানিকটা সামলবার চেষ্টা করলেন।
সামলানো কি যায়! এই অসভ্যতা, ছোটলোকমির কোন জবাব উমাশশী দেবেন? পরিব্রাজকের এই কি লক্ষণ? যে-লোকের নাকি চৌরাশি জন্মের আর ভয় নেই, যার চৈতন্য জেগেছে—সেই লোক এমন সব নোংরা অসভ্য বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কথা লেখে? তাও আবার ছেলেকে!
উমাশশী আরও খানিকটা বসে থেকে উঠলেন। চোখে মুখে মাথায় জল ছিটিয়ে আসলেন। পা টলছিল উমাশশীর। গা দুলছিল। কলঘরে গিয়ে চোখে মুখে ঘাড়ে ভাল করে জল দিলেন। আঁজলা করে জল নিয়ে মাথায় থাবড়ালেন। জ্বালা কি যায়? না এই আগুন ভাবটা?
কলঘর থেকে বেরিয়ে কামিনীকে ডাকলেন। জল, পান দিতে বললেন।
ছেলেমেয়েদের গলা পাওয়া যাচ্ছে। হা হা হি হি করছে দুজনেই। রেডিয়ো বাজছে। কোনো শোক তাপ দুশ্চিন্তা উদ্বেগ নেই। ওদের বাপ এই দুই ছেলে মেয়েকে আস্কারা আর আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছিল। যেন ইয়ার বন্ধু। যারা তার বাপকে চিরটা কাল ইয়ার-বন্ধুর মতন পেয়েছে—তারা আর কতটুকু বুঝবে বাবা কী জিনিস।
এখনও ছেলেমেয়েদের কোনো জ্ঞান হল না, হুঁশ হল না, হবে, ঠিকই হবে—যখন আর এ-জগতে বাপ-মা বলে মানুষ দুটো থাকবে না—তখন হবে। যত সব অকর্মা, হারামজাদার দল।
নিজের ঘরে ফিরে আসতে আসতে উমাশশীর মনে হল, তিনি একটা মস্ত ভুল করেছেন। এই তো মাস দুই তিন আগে আশার একটা সম্বন্ধ এসেছিল বিয়ের। সতু ঠাকুরপো কলকাতা থেকে চিঠি লিখেছিলেন। ছেলের অন্য গুণ সবই ছিল, দোষের মধ্যে সে চেহারায় বেঁটে, রংটা কালো, একটু বাউণ্ডুলে গোছের, উমাশশী এক কথায় না বলে দিলেন। বেঁটে, কালোকেষ্ট জামাই তিনি করবেন না। সারদা গুপ্ত নিমরাজি ছিলেন। উমাশশীর চোখে তখন নিজের কর্তার চেহারাটা লেগে আছে। ফরসা রং, লম্বা চওড়া চেহারা। যৌবনকালে ওই চেহারা যে কী ছিল, তা উমাশশীই জানেন। স্বামীর গা ধুয়ে জল খেলেও যেন তৃপ্তি লাগত। নিজের স্বামীর মতন যে জামাইও জুটবে, উমাশশী তেমন আশা করতেন না। তবু নিজে যেমন পেয়েছিলেন মেয়েকে তার অর্ধেক যদি না দেন তবে মেয়ে কি মনে করবে! বড় মেয়েকে তো ভালই দিয়েছেন। ছোট মেয়ের বেলায় অন্য নজর হলে চলবে কেন?
উমাশশীর এখন মনে হচ্ছিল, তিনি ভুল করেছেন। আশার বিয়ে দিয়ে দেওয়াই উচিত ছিল। যার বাবা এমন দায়িত্বহীন, নির্বোধ ; যে-মানুষ ছেলেমেয়েকে সৎ শিক্ষার বদলে অসৎ শিক্ষাই দেয়—তার বাড়িতে আইবুড়ো মেয়ে রাখা উচিত নয়। ওই মেয়ে রাখা উচিত নয়। ওই মেয়ে এখন গলার কাঁটা হয়ে আটকে থাকবে। বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে উমাশশী ঝাড়া হাত-পা হতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেমন করে বুঝবেন, মেয়ের বাপ, বুড়ো-মদ্দ, তার ভেতরে ভেতরে এত ফন্দি ছিল। ঘর ছেড়ে সে পালাবে।
কামিনী জল এনে দিল। পান!
উমাশশী জল খেলেন। পান জরদা মুখে দিলেন।
শীত পড়ছে ধীরে ধীরে। খোলা জানলা দিয়ে টকটকে রোদ দেখা যায়। কাক চড়ুই ডাকছে। লাল করবী ফুলের গাছটা মাথা তুলে দিব্যি রোদ পোয়াচ্ছে। পাশেই এক কাঠচাঁপা। কর্তা শীতের দিন কাঠচাঁপা গাছের তলায় চেয়ার পেতে বসে বই পড়তেন। গাছতলাটা ফাঁকা। বিছানায় বসলেন উমাশশী। চিঠিটা বালিশের তলায় চাপা দেওয়া।
দুপুরে চিঠিটা আরও একবার পড়বেন উমাশশী। এখন আর পড়ে কাজ নেই।
পুরুষ মানুষ এই রকমই হয়। এমন কিছু বয়েসে পাকা গিন্নি হয়ে স্বামীর সংসারে তিনি আসেননি। তবু যখন থেকে এসেছেন তখন থেকেই হাল ধরেছেন সংসারের; বলতে নেই—নিজের আঁচলের আড়ালে রেখে যেন কর্তাকে এতটা পথ বয়ে এনেছেন। কোনো কিছু বুঝতে দেননি। সেই কর্তা আজ তাঁকে বলেছেন, কাঠবাদামের শক্ত খোসা, বলেছেন তিনি নাকি পাতক হয়ে ছিলেন এতকাল! একেই বলে নেমকহারাম। তোমায় কোন খ-বাবু আরশি দেখাল, আর তুমি দেখলে—তোমার সাতপাকের বউ বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে শুয়ে পান চিবোচ্ছে! বলিহারি তোমার খ-বাবুকে! যেমন নাপিত সে, তেমনি তার আরশি। এসো একবার, নিজের চোখে দেখে যাও না গুপ্তবাবু, তোমার যে পরম শত্রু, যার পাল্লায় পড়ে তোমার সব গিয়েছে—সেই উমাদাসী কোন আরামে শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছে! খাঁড়া নিয়ে তোমায় তাড়া করতে কোনোদিনই যাইনি বাপু, তেমন শিক্ষা আমার মা-বাবা দেয়নি। তুমিই বরং আমার গা গতরের ছাল ছিঁড়ে ছিঁড়ে ডুগডুগি বানিয়ে বাজিয়েছ এতকাল!
উমাশশীর বুকে এতই কষ্ট হচ্ছিল যে তিনি গায়ের আঁচল নামিয়ে দিলেন, জামার বোতাম খুলে আলগা করে দিলেন সব, তারপর বুকের ওপর ডান হাতটা জোরে জোরে বোলাতে লাগলেন।
মনে পড়ল, গুপ্তবাবু বাড়ি ছেড়ে পালাবার আগের দিন সাত সকালে এই বুড়ি মাগির কাছে এসে নেচে নেচে খাটো গলায় কত গান ধরেছিলেন। আবার বলেন কিনা গীতগোবিন্দের গান, উমাশশী সারা জীবন ধরে কর্তার অনেক গোবিন্দগীত শুনেছেন, বেহায়াপনা তাঁর জানা আছে। কম বয়সে সবই মানায়, ভালও লাগে, কিন্তু এই বুড়ো বয়সে কোন বেহায়া বুড়ি বউয়ের কাপড়ছাড়া দেখতে দেখতে গান গাইতে পারে—‘ঘটয়তি সুঘনে কুচ-যুগ-গগনে…!’
উমাশশী বুকের ব্যথা সামলাতে সামলাতে আড় চোখে নিজের বুক দেখলেন। কর্তা নেই, সারা বুক টনটন করে উঠল। কে জানত, গুপ্তবাবু এমন করে বুকে শেল মারবেন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে উমাশশী যেন গুপ্তবাবুকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, এক মাঘে শীত পালায় না কর্তা, তোমার জন্যেও শীত পড়ে থাকল।
উমাশশী এবার বড় মেয়েকে নিজেই একটা চিঠি লিখলেন। তাঁর সাংসারিক জ্ঞান প্রখর। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কখনও বাপের বাড়ির কেচ্ছা কেলেঙ্কারি জানাতে নেই। মেয়ের গলা কাটা যাবে লজ্জায়, হেনস্থার শেষ থাকবে না। যে যাই বলুক, মেয়েদের বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি হল তেল আর জলের মতন, কোনোদিন এই দুইয়ে মিশ খায় না।
বড় মেয়েকে চিঠি লেখার আগে উমাশশী অনেক ভেবেছিলেন। বড় মেয়ে খানিকটা মায়ের ধাতের; যদিও বাপ বলতে বরাবর অজ্ঞান ছিল—তবু অন্য দুজনের চেয়ে মায়ের দুঃখকষ্ট সে বুঝত খানিকটা। বিয়ের পর মেয়েরা আরও যেন মা-দরদি হয়। উমাশশী বড় মেয়েকে বিয়ের পর দেখেশুনে সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন।
বড় মেয়েকে আগেও চিঠি লেখা হয়েছে। লিখেছে তার ভাইবোনেরা। উমাশশী নিজে সে-চিঠি দেখেছেন। তাঁরই কথা মতন লেখা। গুপ্তবাবুর গৃহত্যাগের কোনো সংবাদ হয়নি, শুধু লেখা হয়েছিল, তিনি ক’দিনের জন্যে বাইরে গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছেন তার কোনো হদিশ দেওয়া হয়নি। মেয়ের জবাবও দেখেছেন উমাশশী। আর পাঁচটা খবরের সঙ্গে জানতে চেয়েছে, তার বাবা ফিরে এসেছে কিনা! এরপর আর কোনো চিঠি এ বাড়ি থেকে যায়নি।
উমাশশী ভেবেচিন্তে দেখলেন, বড় মেয়েকে আর একটা চিঠি লেখা দরকার। সরাসরি না হলেও মেয়েকে জানানো দরকার যে তাদের বাবার মাথায় হিমালয় টিমালয় বেড়াতে যাবার শখ চেপেছিল। কর্তা এখন বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। খবরটা জানিয়ে না রাখলে পরে কোন ফাঁক দিয়ে কী বেরিয়ে পড়বে বলা যায় না।
তা ছাড়া উমাশশীর আরও একটা ভয় হচ্ছিল। গুপ্তবাবুর জ্ঞানগম্যি নেই। এই বাড়িতে যেমন ছেলেমেয়েদের চিঠি লিখছেন, তেমনি হুট করে বড় মেয়েকেও তো চিঠি লিখতে পারেন। সেখানেও হয়ত জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি গৃহত্যাগ করেছেন। কিছু বলা যায় না। যদি তাই দিয়ে থাকেন তবে বড় মেয়ে এতদিনে সবই জানতে পেরেছে। জামাইও জেনেছে। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই, গুপ্তবাবু গৃহত্যাগের কারণ হিসেবে যে-লোকটিকে যোলো আনা দায়ী করেছেন সে-মানুষ তো উমাশশী।
যাই হোক বড় মেয়ের কাছ থেকে আর কোনো চিঠি আসেনি। উমাশশীও বুঝতে পারছেন না, মেয়ে তার বাপের কীর্তির কতটুকু জেনেছে বা জানেনি।
বেশ গুছিয়ে গাছিয়ে, চাপাচাপি দিয়ে একটা চিঠি লিখলেন উমাশশী বড় মেয়েকে। চিঠি লিখে জবাবের আশায় বসে থাকলেন।
এমন সময় একটা চিঠি এল সরাসরি উমাশশীর নামে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। উমাশশী আশাও করেননি, তাঁর নামে কর্তার চিঠি আসবে! যে-মানুষ গৃহত্যাগের সময় স্পষ্ট করে জানিয়ে গেছে, ইহকাল আর পরকাল—কোনো কালেই যেন স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ না হয়, সেই মানুষ লিখবে চিঠি!
ছেলেই চিঠি এনে মা’র হাতে দিল।
উমাশশী চিঠিটা হাতে নিয়ে প্রথমটায় বুঝতে পারেননি। পরে বুঝলেন। খামের ওপর উমাশশীর নাম লেখা। এতকাল ছেলেমেয়েদের নাম থাকত, এই প্রথম উমাশশীর নাম।
চা খাচ্ছিলেন উমাশশী। চিঠিটা উলটে পালটে দেখলেন। খামের মুখ বন্ধ। একটু ভারী ভারী লাগল।
উমাশশীর মুখে এতদিন পরে এই প্রথম চাপা হাসি ফুটল। কর্তার তেজ তা হলে ফুরিয়েছে। দিন দশ পনেরোর মধ্যেই তেজ ফুরোবার কথা, সে-জায়গায় প্রায় মাস পুরতে চলল, একটু বেশি তেজ দেখালেন এই যা!…তা হয়েছেটা কী? অর্শ চাগালো, না চাল কলা খেতে খেতে মাথা ঘুরে পড়েছেন কোথাও? নাকি হাত-পা ভেঙে পড়ে আছেন কোনো ডেরাভাণ্ডায়।
উমাশশী উঠলেন। পান মুখে দিয়ে সোজা ঠাকুরঘরে। নারায়ণকে একবার প্রণাম সেরে, চিঠিটা ঠাকুরের পায়ে ছুঁইয়ে ফিরে এলেন নিজের ঘরে। যে-মানুষ ঘর সংসার, স্ত্রী-পুত্র ফেলে পালায় তার খানিকটা শিক্ষা হওয়া উচিত। ভগবান যেন শিক্ষাটা ওকে দেন। উমাশশীকে আজ কতদিন নাকের জলে চোখের জলে করেছেন গুপ্তবাবু, সারারাত একরকম জাগিয়ে রেখেছেন—তার শাস্তি তাঁর পাওয়া দরকার। অবশ্য উমাশশী চান না, তার শাস্তিটা খুব ভারী কিছু হোক, অসখু-বিসুখ করে পড়ে থাকেন বেজায়গায়। ভগবানের কাছে সে-প্রার্থনাও তিনি জানিয়েছেন।
নিজেই চশমা নিয়ে চোখে দিলেন উমাশশী। তারপর খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠিটা বার করলেন।
না, কোনো ঠিকানা নেই, নিজের পাত্তা দেননি।
উমাশশী চিঠিটা পড়তে লাগলেন। কর্তা হরিদ্বার হৃষিকেশের দিকে চলে গেছেন।
হরিদ্বার, লছমনঝোলা উমাশশীর দেখা। একবার ছেলেবেলায় গিয়েছিলেন মা বাবার সঙ্গে। দ্বিতীয়বার যান স্বামীর সঙ্গে। চাকরি থেকে রিটায়ারের আগে স্বামী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বড় ভাল লেগেছিল। কর্তা বলেছিলেন, মেয়েদের বিয়ে থা হয়ে গেলে ঝাড়া হাত-পা হয়ে দুই বুড়ো বুড়ি মিলে এখানে এসে ডেরা বাঁধব, কি বল উমা?
কর্তা সেই হরিদ্বারের দিকেই গেছেন। অবশ্য সেখানেই থাকেননি, চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে হৃষিকেশ ছাড়িয়ে কোনো চটি টটিতে গিয়ে থেমেছেন।
কিন্তু কর্তার চিঠির সুরটাই যে বেখাপ্পা। এ-সব তিনি কি লিখেছেন:
“তোমায় পত্ৰ দিবার প্রয়োজন আমার ছিল না। বাধ্য হইয়া দিতেছি। সাংসারিক নিয়মে এবং আইনসঙ্গত ভাবে আমি তোমার স্বামী। যে-যাবৎ জীবিত থাকিব, স্বামী বলিয়াই গণ্য হইব। কিন্তু ধর্মত বলিতেছি, আমার স্বামীত্বে সাধ নাই, গৃহ সংসারেও বিন্দুমাত্র রুচি নাই। আমি এই অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে যেন ক্রমে ক্রমে চিনিতেছি। একটি বিরাট কুয়াশার জাল ছিন্ন হইয়া আমার সেই জন্মজন্মান্তরের রূপটি দেখা দিতেছে। এই রূপ হইবার কথা নয়। ঈশ্বর আমায় কেন জানি এই মহারহস্যের সম্মুখে দাঁড় করাইয়া দিয়াছেন। ভগবানের মতি, আমি সামান্য মানুষ, কী বুঝিব। তবু বুঝিতে পারিতেছি—ওই যে যোগিনী, উহার সহিত কিসের এক নিগূঢ় সম্বন্ধে যেন আমি বাঁধা পড়িতে যাইতেছি। উনি কে, আমি কে? আর তুমি, যে-তুমি আমায় তিরিশ বৎসর অধিকার করিয়া রাখিয়াছিলে—তুমিই বা কে? আমার এইরূপ সন্দেহ জন্মিতেছে, তুমি ঠিকানা ভুল করিয়াছ। তোমার পিতামহাশয় ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না, হিন্দুধর্মের মর্মটুকু তাঁহার মগজে প্রবেশ করে নাই। তিনি যদি ঠিকুজি কোষ্ঠী, গণনা ইত্যাদি মান্য করিতেন তবে, তোমার বা আমার ঠিকানা ভুল করিয়া একই স্থানে হাজির হইবার কথা নয়। তোমার যে কী মারাত্মক ভুল হইয়াছে তাহা তুমি জান না। আমিও জানিতাম না। সম্প্রতি জানিলাম। যোগিনী আমায় জানাইয়া দিলেন।
“এই যে যোগিনীর কথা লিখিতেছি ইনি নিজে একটি দুটির বেশি কথা বলেন না। লোকমুখে শুনিলাম, যোগিনী বিরাট বংশের মেয়ে, উচ্চশিক্ষিতা, অল্প বয়সেই ইঁহার মতিগতি অন্যপ্রকার হইয়া যায়। মাঝে মাঝে মূর্ছা যাইতেন। মূর্ছা ভাঙিলে কিছুক্ষণ ভাসা ভাসা এমন সব কথা বলিতেন যাহার অর্থ কেহ বুঝিতে পারিত না। বৎসর কয় পরে ইনি বলিতে লাগিলেন যে, তাঁহার পূর্বজন্মের কথা মনে পড়িতেছে। কেহ বিশ্বাস করিত না। শেষে দুই চারিটি প্রমাণ দিবার পর বাড়ির লোকজন বিশ্বাস করিল উনি জাতিস্মর। …যুবতী বয়সেই তিনি গৃহত্যাগ করিলেন। শুনিলাম উনি মানস সরোবরের দিকে কোথাও গিয়া দুই তিন বৎসর ছিলেন। একেবারে একা। সেখানেই যোগসাধনা করিতেন। হালে পাহাড় হইতে নামিয়া আসিয়া এখানে একটি কাঠের ঘর নির্মাণ করিয়া আছেন। তাঁহার একজন অনুচর আছে। সে নদী হইতে জল আনে, ফলমূল চাল ডাল যাহা পায় জোগাড় করে, চুল্লি ধরায়। যোগিনী নিজে নিত্য আহার করেন না। কোনো কোনোদিন দু’ গণ্ডুষ জলই তাঁহার আহার।
এখানকার লোকে যোগিনীকে রাধামাঈ বলে। বয়েস তো বেশি নয় চল্লিশও হইবে না। কিন্তু দেবীর মতন চেহারা। রংটি তপঃপ্রভাবে উজ্জ্বল তামাটে, মাথার চুল পায়ে আসিয়া নামিয়াছে, নাক চোখ প্রতিমার মতন। গেরুয়া শাড়ি পরনে। গলায় রুদ্রাক্ষ মালা।
রাধামাঈ সর্বজ্ঞ। তিনি মানুষ দেখিলেই তাহার ভূত ভবিষ্যৎ জানিতে পারেন। আমি গতকাল সন্ধ্যার দিকে তাঁহাকে দর্শন করিতে গিয়াছিলাম। সন্ধ্যার দিকেই যাইবার নির্দেশ ছিল।
রাধামাঈয়ের বাহির কক্ষে একটি শতরঞ্জি বিছানো ছিল। সামনে বাঘছালের আসন। সম্ভবত কর্পূর ও ধূপ পড়িতেছিল। সামান্য ধোঁয়ার সহিত ক্ষুদ্র কক্ষটিতে ধূপের গন্ধ ছড়াইয়া রহিয়াছে। আমি একা বসিয়াছিলাম। এমন সময় যোগিনী আসিলেন। আহা, কী রূপ। কী অসামান্য লাবণ্য। কক্ষটি যেন হঠাৎ গন্ধে ভরিয়া গেল। তিনি দাঁড়াইয়া রহিলেন। আমায় একদৃষ্টে দেখিতে ছিলেন। দেখিতে দেখিতে অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বলিলেন।
শুনিলে অবাক হইবে, তিনি আসনে বসিলে আমি ভক্তিভরে করজোড়ে তাহাকে নমস্কার জানাইয়া পরে প্রণাম করিতে গেলেই তিনি আসন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। একটি কুপির আলো জ্বলিতেছিল। আমি অবাক, অপ্রস্তুত। কখন যেন আমিও তাঁহার মুখোমুখি দাঁড়াইয়া পড়িলাম। তিনি নিষ্পলকে আমায় দেখিতে লাগিলেন। সেই দৃষ্টিতে কী ছিল আমি জানি না। আমার ভয় হইতে লাগিল, ঘন ঘন কম্পন লাগিল, কপালে গায়ে দরদর করিয়া ঘাম ছুটিল। তিনি নিশ্চল। আমার যেন সম্বিৎ লোপ পাইল। বঙ্কিমবাবুর সেই কপলাকুণ্ডলাকে যেন সাক্ষাৎ দেখিলাম।
শুনিলাম তিনি বলিতেছেন, ইয়ে কোন্ হ্যায়?
যোগিনী চলিয়া গেলেন। আমি বেহুঁশ হইয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলাম।
ফিরিবার সময় রাধামাঈয়ের অনুচর আমায় বলিল, মাতাজি আমায় আগামী পূর্ণিমার দিন যাইতে বলিয়াছেন। তিনি আমার প্রণাম গ্রহণ করিতে পারেন না, মাতাজি ডাকটিও তাঁহাকে বিচলিত করিয়াছে। কেন যে তাহা অনুচরটি জানে না। এরকম ঘটনা কখনো ঘটে নাই।
পরদিন দুপুরে রাধামাঈয়ের অনুচরটি আবার আসিল। আসিয়া জানাইল, মাতাজি বলিয়াছেন—আমার এই জন্মের সংসার জীবনে এক মায়াবিনী দূর স্থানে বসিয়া আমায় নাকাল করিবার ফন্দি আঁটিতেছে। তাহার ঘরে আমার ছবি, খাট বিছানা, জামাকাপড় সবই পড়িয়া আছে। এই সংসারের সামগ্রীগুলি লইয়া সে তুকর্তাক করিতেছে। যে-যাবৎ সে সমস্ত কিছু বাহিরে ফেলিয়া না দেয়—আমার যথার্থ পরিচয় প্রকাশ হইবার উপায় নাই। তুমি যে এখনও পিছন হইতে এমন করিয়া আঁকসি দিয়া টানিতেছ তাহা আমি কল্পনা করিতে পারি না। অনেক জ্বালা সহিয়াছি, আর কেন জ্বালা দাও? তোমার পায়ে ধরি, আমায় মুক্তি দাও।
জানি না, আগামী পূর্ণিমায় আমার কোন অভিজ্ঞতা হইবে।”
উমাশশী চিঠিটা রেখে দিলেন। মনের মধ্যে হু হু করতে লাগল। কে সেই যোগিনী? কেন তার অমন রূপ? কর্তা বলেছেন দেবীর মতন রূপ। কর্তা যতই দেবী দেবী করুন উমাশশী মোটেই দেবীতে ভুলবেন না। যোগিনী কেন প্রণাম নিল না কর্তার। সে নাকি জাতিস্মর, পূর্বজন্মের কথা জানে। এখানেই উমাশশীর বড় খটকা। যে যোগিনী শয়ে শয়ে লোকের প্রণাম নেয়, সে কেন তার প্রণাম নেবে না। তবে কি কার্তার প্রণাম নেবার অধিকার তার নেই। কেন? কোন দরকারে আবার পূর্ণিমার দিন যেতে বলেছে কর্তাকে?
উমাশশীর ভয় হচ্ছিল। যোগিনীরা অনেক কিছু পারে। তাদের অসাধ্য কিছু নেই। বুড়ো কর্তাকে তারা ছাগল ভেড়াও করে দিতে পারে। নিকুচি করেছে তোর কপালকুণ্ডলার।
কি যে করবেন উমাশশী কিছু বুঝতে পারলেন না। উঠলেন। পান খেলেন। বাতিটা নিবিয়ে দিলেন। বাইরে বেশ চাঁদের আলো। কাছেই পূর্ণিমা। হায় হায়, পূর্ণিমার দিন তাঁর কী সর্বনাশ হবে কে জানে।
উমাশশী হঠাৎ গলায় আঁচল জড়িয়ে ঠাকুর দেবতার পায়ে মাথা কুটতে কুটতে মানত করলেন, হে ঠাকুর তুমি কর্তাকে যেতে দিও না। কিছু একটা করে দাও ওঁর, যাতে বিছানা ছেড়ে উঠতে না পারে। হাত পা মচকে দাও, কোমরে ফিক ব্যথা ধরিয়ে দাও, না হয় কাবু করে দাও অর্শে। আমায় বাঁচাও।
নাটকে যেমন পট পরিবর্তন, সিনেমায় কলকাতা থেকে কার্শিয়াঙে গমন—সেই রকম এই কাহিনীর স্থান কাল পাত্রের কিছু পরিবর্তন ঘটল।
স্থানটি নিরিবিলি। কাছকাছি শালের পাতলা জঙ্গল। ছোট মতন এক বাংলো বাড়ি, সামনে দিয়ে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে পশ্চিমে। দু’ চারটে ইউক্যালিপটাস গাছও চোখে পড়ে বাংলোর কাছে। সময়টি শেষ বিকেল। এই মাত্র সূর্য ডুবল।
বাংলোর ঢাকা বারান্দায় তিন চারটি বেতের চেয়ার পাতা। একটি গোল বেতের টেবিল। চা খাওয়া শেষ হয়েছে, টেবিলের ওপর চায়ের পট, শুন্য কাপ, দুধ চিনি পাত্র, বিস্কিটের প্লেট পড়ে আছে। এক মহিলা এবং দুই ভদ্রলোক বসে আছেন চেয়ারে। দুই ভদ্রলোকের একজন সারদা গুপ্ত—উমাশশীর স্বামী। অন্যজন সারদা গুপ্তের ভায়রাভাই। নিজের নয়, সামান্য দূর সম্পর্কের। নাম পরিমল। মহিলা অবশ্যই সারদা গুপ্তের শ্যালিকা। নাম রেবা। উমাশশীর এক মাসির মেয়ে, কাজেই মাসতুতো বোন।
সারদা গুপ্ত চায়ের পর সিগারেট খাচ্ছিলেন, হাতে-পাকানো সিগারেট। চেহারাটি মন্দ নয়। এই বয়সেও শক্ত সমর্থ, গায়ের রং পরিষ্কার। মুখটি হাসিখুশি। মাথার চুল প্রায় সাদা হয়ে গেছে। পরিমল বয়েসে বেশ কিছু ছোট, বছর আটচল্লিশ হতে পারে। ছিপছিপে গড়ন। সরল চেহারা। রেবার বয়েস চল্লিশ-টল্লিশ হবে, সুশ্রী মুখ, নরম ধাতের ছাঁদ। নাকটি মোটা চোখ দুটি ডাগর।
পরিমল এবং রেবা কিছুক্ষণ সন্তর্পণে নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া চাওয়ি করছিল। যেন কিছু বলার আছে বলতে পারছে না। এমন সময় এঞ্জিনের হুইসল বাজিয়ে দূর দিয়ে একটা মালগাড়ি গোছের কিছু চলে গেল। পরিমল হুইসলের শব্দে রীতিমত ঘাবড়ে গেল, তাকাল স্ত্রীর দিকে। রেবা চোখে চোখে ইশারা করল কিছু।
পরিমল সারদা গুপ্তের দিকে তাকাল। ইতস্তত করল খানিকটা। তারপর বলল, “সারদাদা একটা—মানে একটা ব্যাপার হয়ে গেছে।”
“ব্যাপার?” সারদা বেশ আলসেমির চোখে ইউক্যালিপটাস গাছের নাচন দেখছিলেন। শীত আসি-আসি ভাব। বাতাস রয়েছে এলোমেলো। আকাশে আলো নেই। ঝপ করে অন্ধকার নেমে আসবে একটু পরেই। ভায়রার দিকে চোখ ফেরালেন সারদা। “ব্যাপার! কী ব্যাপার হে?”
পরিমল গলা ঝাড়ল, সোঁ সোঁ করে বার দুই নিঃশ্বাস টানল, তারপর অপরাধীর মতন করে বলল, “আজ সন্ধের ট্রেনে ইয়ে আসতে পারেন।”
“ইয়ে! ইয়েটা আবার কে?”
পরিমল তার গলার কাছটা চুলকোতে লাগল। জড়ানো গলায় বলল, “দিদি।”
“দিদি? কোন দিদি?”
“বড়দিদি—মানে উমাদিদি!”
সারদা গুপ্তকে যেন বিছেয় কামড়াল। লাফ মারলেন না, কিন্তু তাঁর চোখমুখ নীলচে হয়ে গেল। একেবারে স্তম্ভিত। গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হ’ল একটু। তারপর বললেন, “আমায় ভয় দেখাচ্ছ! তোমার বড়দিদি এখানে আসবে? কেমন করে আসবে?”
পরিমল একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সাহস সঞ্চয় করে নিল যেন, বলল “আসারই তো কথা। আমরা সন্ধের ট্রেনে দিদিকে এক্সপেক্ট করছি।”
বিশ্বাস করলেন না সারদা। মাথা নাড়লেন জোরে জোরে। “ধ্যুত, অসম্ভব। তোমার দিদি আমার ঠিকানা পাবে কোথায়! আমি তো এখন বিন্ধ্যটিন্ধ পেরিয়ে কোথায় চলে গেছি। হিমালয়ে। গঙ্গোত্রীর পথ ধরেছি। এক একটা ডোজ যা দিচ্ছি তোমার দিদিকে—উমারাণীর মাথায় চক্কর মারছে। মহিলাকে ম্যাপ খুলে বসে ট্রেস করতে হচ্ছে আমি কোথায়, হৃষিকেশে না কোনো হিমবাহতে। কিস্যু বুঝতে পারছে না। আমি বাজি ফেলতে পারি।”
পরিমল বলল, “কিন্তু একটা ব্যাপার যে হয়ে গেছে।”
“আবার ব্যাপার? কত ব্যাপার হবে তোমার?”
“কাল আমি একটা টেলিগ্রাম করেছি তপুকে। আজ সকালে নিশ্চয় পেয়েছে। আশা করছি বিকেলের ট্রেনে দিদিকে নিয়ে তপু এসে পড়বে।”
সারদা যেন চেয়ার ভেঙে মাটিতে পড়ে গেলেন এই রকম ভাব করলেন, অবাক, বিহ্বল, নির্বাক। হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন ভায়রার মুখের দিকে। “তুমি টেলিগ্রাম করলে?”
“আপনার শালী বলল।”
সারদা রেবার দিকে তাকালে। খুবই পছন্দ করেন শালীটিকে। যত্ন করেন।
রেবা বলল, “সবটাই আমি বলিনি জামাইবাবু, আপনার ভায়রাও বলেছে।”
“কেন?” সারদা শালীর দিকেই তাকিয়ে থাকলেন।
রেবা বলল, “আপনি রাগ করবেন না জামাইবাবু, আমি অন্যায় কিছু করিনি। আজ ক’দিন আপনার শরীর মোটেই ভাল যাচ্ছে না।”
“কে বলল ভাল যাচ্ছে না। খাচ্ছি, দাচ্ছি বেড়াচ্ছি। তোমাদের সঙ্গে গল্প করছি। হাতের কাছে বই পেলে পড়ছি। এর চেয়ে আর কী ভাল যাবে।”
মাথা নাড়ল রেবা। বলল, “না জামাইবাবু, আপনি প্রথম প্রথম এসে দিন সাতেক বেশ ফুর্তিতে ছিলেন। খাওয়া দাওয়া করেছেন। রাত্রে ঘুমোতেন। কিন্তু আস্তে আস্তে আপনার খাওয়া দাওয়া কমেছে। মুখে অরুচি এসেছে। রাত্রে ঘুমোতে পারেন না ভাল। আমরা তো পাশের ঘরে থাকি—রাত্রে আপনি চার পাঁচবার করে ওঠেন। বাথরুমে যান। ঘরের মধ্যে খুটখাট করেন। সকালের দিকে আপনাকে দেখলে বোঝা যায়, যেটুকু ঘুমিয়েছেন, তাও শান্তিতে নয়।”
“এ সবই ছুতো,” সারদা বললেন, “আমি ঠিকই ছিলাম, ঠিকই আছি। তোমরা আমার সঙ্গে শত্রুতা করলে; সেরেফ বেইমানি। যদি এই তোমাদের মনে ছিল, তা হলে আমি যখন লিখেছিলাম—কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে চাই, জায়গা হবে?—তখন তো বাপু বলে দিলেই পারতে সোজা কথাটা।”
পরিমল ভীষণ অপরাধীর মতন মুখ করে বসে থাকল! রেবা বোঝাতে লাগল সারদাকে। বলল, “ছি জামাইবাবু, কি যে বলছেন আপনি! আমরা তো এখানে বদলি হয়ে মাত্র দু’তিন মাস এসেছি। আপনাকে ছাড়া বড় কাউকে খবর দেওয়াও হয়নি। আপনার ভায়রা তো জঙ্গলে সারভে আর নকশার কাগজপত্র নিয়ে দিন কাটায়। আপনি আসবেন শুনে পর্যন্ত আমরা নাচতাম।”
“নাচতে বইকি! আমায় ভুলিয়ে ভালিয়ে এনে আমায় নাচাবার জন্যে নাচতে—” সারদা বললেন। মুখ গম্ভীর। যেন নাচানো পার্টির ফাঁদে পড়ে এখন তাঁর অনুশোচনা হচ্ছে।
পরিমল অপ্রস্তুত। স্ত্রীর দিকে তাকাল একবার। তারপর দুহাত জোড় করে মিনতি ভঙ্গিতে বলল, “দাদা, আপনার সঙ্গে আমাদের কি সেই সম্পর্ক! আপনার শালী আপনাকে কত খাতির করে, ভালবাসে, সে তো আপনি জানেন।”
“জানি হে, জানি। শালীর ভালবাসাও জানি, শালীর দিদির ভালবাসার ঘটাও জানি। এক জাতের মুরগি।”
রেবার হাসি পাচ্ছিল। হাসল না। সারদার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, “মুরগির জাত যেমনই হোক জামাইবাবু, আপনি যদি আমায় অবিশ্বাস করেন, আমি আর কথাটি বলব না।” বলে একটু থেমে অভিমানের গলায় রেবা আবার বলল, “আপনি আসবেন শুনে আমরা কী আনন্দ পেয়েছি! এসে পর্যন্ত, বলুন, আমাদের কত আনন্দেই দিন কেটেছে।”
সারদা হাত তুলে থামিয়ে দিলেন রেবাকে। নিজেরই কেমন মনে হল। একটু কড়া কথা বলে ফেলেছেন। সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “যা করেছ, বেশ করেছ! কিন্তু ওই বাঘের মুখে এই অধমকে ঠেলে দিলে। এটা কেমন হল জানো, ছাগলের গলায় দড়ি বেঁধে বাঘকে নেমন্তন্ন করা। এখন আমি করব কী?”
রেবা হেসে ফেলেছিল। বলল, “বাঘকে আমরা সামলাব।”
“ও তোমাদের কর্ম নয়। বত্রিশ বছরে আমিই পারলাম না—তোমরা সামলাবে!…তা হ্যাঁ হে পরিমল, কী লিখেছ টেলিগ্রামে?”
“লিখেছি, সারদাদা সিরিয়াসলি ইল। কাম ইমিডিয়েটলি উইথ দিদি।”
“আমি ইল? অসুস্থ? সিরিয়াসলি অসুস্থ?…এসব কেন লিখলে? আমার চেহারাটা কি ইলের মতন দেখাচ্ছে? সর্বনাশ করলে তুমি হে! একেই তো মাত্র পনেরো মাইল দূরে পালিয়ে এসে বসে আছি; বসে বসে ব্লাফ ঝাড়ছি—হিমালয় টিমালয় পর্যন্ত চালিয়েছি চিঠিতে। তার ঠেলা সামলাতেই বাবার নাম ভুলে যাব। তার ওপর মুরগির আণ্ডা ওড়ানো, ঘি দুধ সেবন করা এই চেহারাকে ইল বলে চালানো কী সোজা কথা! তোমার দিদি কচি খুকি? ঝিনুকে দুধ খায়!…ওরে বাব্বা, এ কী সর্বনাশ করলে তোমরা! ডবল ব্লাফ! আমার মাথার চুল উপড়ে ফেলবে তোমার দিদি। পরিমল, আমায় বরং এখানে সমাধি দিয়ে দাও।”
রেবা জোরে হেসে ফেলল। পরিমলও।
পরিমল বলল, “বাঃ অসুখ হতে পারে না। আপনার অসুখ হয়েছে।”
“কী অসুখ?”
কী অসুখ? পরিমল ঝঞ্চাটে পড়ে গেল। কোন অসুখ করবে সারদাদার?
কোন অসুখ? পাঁচ সাতটা অসুখের নাম যেন এর ওর গায়ে জড়িয়ে ফাঁদে লেগে গেল। ঝট করে একটা নামও পড়ে পড়ল না। তারপর ঝপ করে নিওমোনিয়া-র নামটাই মাথায় এল। পরিমল বলল, “নিওমোনিয়া।”
“নিওমোনিয়া!…তুমি মুখে বললে আর নিওমোনিয়া হয়ে গেল। অত সহজ ব্যাপার! হাই টেম্পারেচার, বুকে কনজেসান, দু’চারটে বুক ফাটানো কাশি—এসব পাব কোথায়!” সারদা বললেন।
পরিমল ফাঁপরে পড়ল। কানের ডগা চুলকে বলল, “জণ্ডিস হতে পারে না?”
সারদা নিজের চোখ দেখালে। “আমার চোখ কি হলুদ? গা ফ্যাকাশে? ন্যাবা আরও ডিফিকাল্ট।”
পরিমল স্ত্রীর দিকে তাকাল। রেবা দুচারটে অসুখের নাম করল, ছোটখাটো অসুখ, ডায়েরিয়া ডিসেন্ট্রি গোছের। তাতে সারদা খুশি হলেন না। লিখেছ ‘সিরিয়াসলি ইল’, এখন বলছ ডায়েরিয়া। রসিকর্তা নাকি?
সারদা বললেন, “একটা আজেবাজে ছুতো করে ডেকে পাঠালে তোমাদের দিদি কী ভাববে, বুঝতেই তো পারছ। ভাববে কলকাঠিটা আমিই নেড়েছি। আমার ইজ্জত তো যাবেই, তোমাদেরও রক্ষে রাখবে না।”
রেবা বলল, “আমাদের ওপর বড়দি এমনিতেই রেগে আগুন হয়ে গিয়েছে। আপনি এত দিন ধরে রয়েছেন এখানে। আমরা কেন কিছু জানাইনি।”
“তোমাদের ওপর রাগবে কেন—” সারদা বললেন, “তোমরা বলবে, জামাইবাবু বাড়িতে রেগুলার চিঠি লেখেন, আমরা কেমন করে বুঝব, তিনি কিছু লুকিয়ে রাখছেন।”
রেবা বলল, “দিদিকে অত সহজে বোঝানো যায়! ঠিকই বুঝে নেবে—সবই ষড়যন্ত্র।”
পরিমল বার বার ঘড়ি দেখছিল। ঝাপসা অন্ধকারে চাঁদ উঠেছে। বলল, “আমি আর দেরি করব না। স্টেশনের দিকে এগোই।”
সারদা বললেন, “তা তো এগুবে। কিন্তু আমার কী হবে?”
পরিমল উঠতে উঠতে বলল, “আমি স্টেশন থেকে দিদিকে ম্যানেজ করতে করতে আসব। বলব, হঠাৎ খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল, আমরা ভয় পেয়ে টেলিগ্রাম করেছিলাম। সারদাদা এখন ভাল। কোনো ভাবনা নেই আর!”
সারদা যেন বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমার মতন হাঁদা আমি আর জীবনে দেখিনি। তোমার দিদিকে না হয় বললে বাড়াবাড়ি হয়েছিল, কিন্তু কিসের বাড়াবাড়ি, তা বলতে হবে না? বাড়াবাড়িটা কিসের? কোন রোগের?”
পরিমল বলল, “ম্যালেরিয়া। এই বনজঙ্গল জায়গা। এখানে মশাটশা খুব। হঠাৎ ম্যালিগনান্ট টাইপের ম্যালেরিয়া হয়ে গিয়েছিল, একশো তিন চার জ্বর। ভীষণ কাঁপুনি। বিকার।…সে আমি ম্যানেজ করে বলে দেব।”
“ও-রকম বিকট ম্যালেরিয়াটা গেল কোথায়?” সারা জিজ্ঞেস করলেন।
“জ্বরটা ছেড়ে গেছে। কাল রাত্রে, কিংবা আজ সকালে।…ম্যালেরিয়ার জ্বর যখন তখন ছাড়তে পারে। কারও কিছু বলার নেই।”
“কী মুশকিল!” সারদা বললেন, “আমার চেহারাটাকে তো ম্যালেরিয়া রোগীর মতন করতে হবে। চকচক করছে চেহারা, কামানো মুখ, মাথায় জবাকুসুমের গন্ধ…। এখানে ম্যালেরিয়াকে আমদানি করবে কেমন করে! তুমি কনসিকুয়েন্সটা একেবারে বুঝতে পারছ না, পরিমল। তোমার দিদি পুলিশের মেয়ে, ওদের রক্তের মধ্যে সন্দেহ। অত সস্তায় শ্রীমতী উমাশশী গুপ্তকে ভোলানো যাবে না।”
পরিমল সমস্যায় পড়ল। সময় হয়ে আসছে। তাকে স্টেশনে যেতেই হবে। কম করেও মিনিট পনেরোর পথ। জিপ গাড়িটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে, নয়ত গাড়ি নিয়ে চলে যেত।
পরিমল বলল, “কিন্তু আমায় তো যেতে হবে। ট্রেনের টাইম হয়ে আসছে।”
রেবা কিছু ভাবছিল চুপচাপ। হঠাৎ মুখ তুলে বলল, তুমি যাও, আর দেরি কোরো না। আসার সময় একটা কিছু যোগাড় করে নিও। দিদিকে হাঁটিয়ে এনো না। হাঁটতে পারবে না ও।”
সারদা বললেন, “গড়িয়ে এনো।”
রেবা হেসে ফেলল। পরিমলকে বলল, “অসুখের কথা—মানে কী হয়েছিল তোমায় বলতে হবে না। বোলো, শরীরটা জামাইবাবুর খুব খারাপ হয়েছিল। এখানে ভাল ডাক্তার নেই। যাকে ডেকে দেখানো হয়েছিল, তিনি বলেছেন—হার্টের অসুখ।”
পরিমল একবার সারদার দিকে তাকাল।
সারদা যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বললেন, “তাই বোলো। হার্ট তো দেখা যায় না, ওটাই যা ভরসা।”
পরিমল ঘরের দিকে চলে গেল। হয়ত জামা পালটাতে, জুতো জোড়া পরে নিতে।
সারদা সিগারেটা আবার ধরিয়ে নিলেন।
একটু পরেই পরিমল বেরিয়ে এল। বলল, “আমি তা হলে আসছি।” বলে সে গেটের দিকে চলে গেল।
রেবা চায়ের পাত্র গুছিয়ে নিতে লাগল।
সারদা সামনের দিকে তাকিয়ে খুব পরিষ্কার চাঁদের আলো দেখতে পেলেন। এতক্ষণ ঠিক লক্ষ করেননি। বললেন, “আজই কি পূর্ণিমা?”
রেবা চাঁদের দিকে তাকাল। বলল, “বোধ হয়। গতকালও চাঁদটা এই রকম ছিল।”
সারদা বললেন, “পৃর্ণিমায় আমার যে যোগিনী রাধামাঈয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল।” বলে বেশ বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন সারদা।
“সে আবার কে?” রেবা জিজ্ঞাসা করল।
সারদা বললেন, “সে হল সাক্ষাৎ মোহিনী, যোগিনী, জাতিস্মর। অপরূপ-লাবণ্যময়ী কামিনী। বয়স চল্লিশের স্লাইট এপারে। আমার জন্মজন্মান্তরের গাঁটছড়া। তোমার দিদিকে ওটা লেটেস্ট দিয়েছিলুম। ওতেই উমারাণী কাত হয়ে পড়তেন। হচ্ছিলেনও একটু একটু, তোমরাই সব গণ্ডগোল করে দিলে।”
রেবা মুচকি হাসল। চায়ের পাত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠতে উঠতে বলল, “আপনার ঘরে বিছানাপত্তর ঠিক করে দিচ্ছি। খানিকটা পরে গিয়ে শুয়ে পড়বেন। আপনি কিন্তু হার্টের রোগী।” বলে হেসে উঠল!
সারদা বিছানায় শুয়েই ছিলেন। বড় বড় দুটো জানলার একটিমাত্র খোলা। ঘরে আসবাবপত্র বেশি নেই। সারদার খাটটিও ছোট, একার মতন। ঘরের কোণের দিকে কেরোসিনের টেবিল বাতি জ্বলছে। এখানে ইলেকট্রিক নেই। গায়ে একটা মোটা কম্বল চাপিয়েছেন সারদা। রেবা চাপিয়ে দিয়ে গেছে। কম্বল না চাপালে নাকি অসুখ-অসুখ দেখায় না। সারদা এই সন্ধেবেলা কম্বলচাপা হয়ে ঘামছিলেন। ঘামটা তাঁর ভাল লাগছিল না। কিন্তু হার্টের রোগী হিসেবে এটা সহ্য করছিলেন। মুখটা তাঁর এতই পরিষ্কার যে কিঞ্চিৎ মলিন না করলে চলছিল না বলে সারদা সামান্য পাউডারের সঙ্গে কাগজ-পোড়া ছাই মিলিয়ে মুখে মেখে নিয়েছেন পাতলা করে। উপায় নেই। শুয়ে শুয়ে বোধ হয় তিনি ভগবানের নাম জপছিলেন।
এমন সময় গাড়ির শব্দ। সারদার বুক কেঁপে উঠল। উমা কি এসেছে? না আসেনি?
সামান্য পরেই গলার আওয়াজেই বোঝা গেল, উমাশশী ছেলেকে নিয়ে হাজির হয়েছেন। সারদার বুক ধকধক করতে লাগল, গলা কাষ্ঠবৎ, গলগল করে ঘামতে লাগলেন। ছেলেবেলায় বলির পাঁঠা সম্পর্কে তাঁর যত মমতা ছিল নিজের ওপর তার চেয়েও বেশি মমতা হচ্ছিল। বলির পাঁঠা হতভাগ্য জীব, কিন্তু মানুষ আরও হতভাগ্য, পাঁঠার স্ত্রী থাকে না, মানুষের থাকে। অন্তত সারদার রয়েছে।
দরজায় পায়ের শব্দ। সারদা চোখের পাতা বুজে ফেললেন। জিব গলার দিকে টানতে লাগল। বুক আওয়াজ মারছে, নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছিলেন সারদা।
চোখ বন্ধ করেই সারদা বুঝলেন ঘরে উমাশশী, রেবা, পরিমল আর তপু এসে দাঁড়িয়েছে। আস্তে গলায় কথা বলছিল রেবা। “ডাক্তার বলেছেন, একেবারে চুপচাপ শুয়ে থাকতে। সাড়াশব্দ যেন না হয়। যত ঘুম হয় ততই ভাল। জামাইবাবু প্রথম দিকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। কাল রাত থেকে ভাল। আজ সকালে দু’ একবার বিছানায় উঠে বসেছিলেন। বিকেলে চা খেয়েছেন। এখন বোধ হয় ঘুমোচ্ছেন। ডাকব!
“থাক, তোকে ডাকতে হবে না, আমি দেখছি…” বলে উমাশশী বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
সারদা চোখ বুজেই থাকলেন। কম্বলের তলায় হাত পা কাঁপছিল।
“আলোটা একবার আন তো,” উমাশশী বললেন, বলে বিছানায় বসতে গেলেন, কুলোতে পারলেন না, কোনোরকমে বসলেন। কপালে হাত দিলেন সারদার, বুকে হাত রাখলেন।
পরিমল আলো হাতে এসে দাঁড়াল। বোধ হয় আসার সময় পলতেটা আরও কমিয়ে দিয়েছিল। তার হাতও কাঁপছে।
উমাশশী স্বামীর মুখের ওপর আরও ঝুঁকে পড়ে কী দেখলেন। নিবিষ্ট চোখে। তারপর বললেন, “বড্ড ঘেমেছে। কম্বলটা চাপিয়ে দিয়েছিস কেন? জানলা খুলে দে।” নিজের হাতেই কম্বল সরিয়ে দিলেন উমাশশী। রেবা জানলা খুলে দিল।
উমাশশী বললেন, “তোয়ালে-টোয়ালে দে একটা, ঘামটা মুছিয়ে দি। এত ঘাম গায়ে জমলে সর্দিকাশি হবে।” বলেই কি খেয়াল হল, আবার বললেন, “আচ্ছা থাক, আমি হাত পায়ে জল দিয়ে কাপড় চোপড় ছেড়ে এসে বসছি, তারপর যা করতে হয় করব।”
রেবা বলল, “সেই ভাল। চলল, তুমি কাপড় ছেড়ে একটু চা খেয়ে নাও। জামাইবাবুর ঘুমটা ভাঙুক।”
উমাশশীরা চলে গেলেন। পরিমল শুধু দাঁড়িয়ে থাকল।
সারদা খুব সাবধানে চোখে খুললেন। তারপর পরিমলকে বললেন, “কী বলল হে?”
“কিছু না।”
“সেকি! স্টেশন থেকে এতটা পথ এল, কিছু বলল না?”
“অসুখের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।”
“তুমি হার্ট ট্রাবল বলেছ তো?”
“বলেছি।”
“কেমন মনে হচ্ছে? ভয় পেয়েছে বুঝলে? ওয়ারিড?”
“তাই তো মনে হল।”
“…কোনো ফায়ারিং করল না?”
“কই! করল না!”
“খুবই আশ্চর্যের কথা।…দেখ কী হয়।…যাও, তুমি বাতি রেখে পালাও।”
পরিমল চলে গেল।
সারদা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভবিষ্যৎ-চিন্তা করতে লাগলেন। গিন্নির মতিগতি খানিকটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। গলার স্বরটাও যেন নরম লাগল। কপালে বুকে হাত দেবার সময় হাতের চাপটি ভালই লেগেছিল। তা হলে কি শ্রীমতী উমাশশী একটু কাবু হয়ে পড়েছেন? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
গা ধুয়ে কাপড় ছেড়ে উমাশশী একবার স্বামীর বিছানায় এসে বসেছিলেন। সারদার গায়ের ঘাম তখন অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। শাড়ির আঁচলে বুক মুছিয়ে দিলেন কর্তার। মুখটা। সারদা ঘুমের ভান করে চোখ বুজেই থাকলেন। কর্তার মুখ মুছিয়ে আঁচলটা কাঁধে ওঠাতেই কিসের গন্ধ মতন লাগল। গন্ধটা নাকের কাছে এনে শুঁকে নিলেন। সারদা বার দুই উঃ আঃ—করলেন ঘুমের ভানের মধ্যেই। উমাশশী কিছুই বললেন না। খানিকটা পরে উঠে বোনের কাছে চলে গেলেন।
অনেকক্ষণ থেকেই সারদা একবার ছেলেকে ডাকার ছুতো খুঁজছিলেন। পেরে উঠছিলেন না উমাশশীর ভয়ে। সুযোগ পেলেন আরও খানিকটা পরে। পরিমল মাঝে মাঝে তদারকি করতে আসছিল। অবশ্য ঠিক তদারকি নয়, উমাশশী আর রেবার মধ্যে যে সব কথা হচ্ছে, আড়ালে তার সমাচার জানাতে আসছিল। সারদা ভায়রাকে বললেন, “একবার তপুকে ডেকে দিতে পারো! বি ভেরি কেয়ারফুল।”
তপু একসময় চোরের মতন এসে ঘরে ঢুকল।
সারদা বললেন, “কিরে, পজিসন কী?”
তপু বলল, “তুমি খুব টাইমলি রিট্রিট করেছ। নয়ত কামানের গোলা খেতে। আমরা আর পজিসন ধরে রাখতে পারছিলাম না।”
সারদা বললেন, “আমার আরও একটা দুটো ফাইন্যাল অ্যাসাল্টের ইচ্ছে ছিল। তোদের মেসো মাসিই ডোবাল।”
তপু ফিসফিস করে বলল, “না না, আরও অ্যাসাল্ট হলে আমরা সরে যেতাম।” বলে তপু আর দাঁড়াল না। পালিয়ে গেল।
সারদার ভাল লাগছিল। তিনিই তো শেষ পর্যন্ত জিতেছেন। কিন্তু ভাল লাগাটা স্থায়ী হচ্ছিল না; ভয়ও হচ্ছিল। ভরসা পাচ্ছিলেন না। উমাশশীর সঙ্গে নিভৃত সাক্ষাতে তাঁর যে কী অবস্থা হবে, সে শুধু ভগবানই জানেন।
আসামাত্র স্বামীর সমস্ত কর্তৃত্ব উমাশশী নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন। কাজেই রাত্রে সারদার চনচনে খিদে হওয়া সত্ত্বেও এক কাপ দুধ আর দুটো মামুলি বিস্কিট ছাড়া কিছু জুটল না। হার্টের অসুখে পেট হালকা রাখতে হয়, নয়ত গ্যাস উঠে বুকে ঠেলা মারবে। উমাশশীর বাবা হার্টের রোগেই মারা গিয়েছিলেন, তা ছাড়া কতই না শুনছেন তিনি।
রাত হল। সারদার খাটটা ছোট। উমাশশী নিজের শোবার জন্যে মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে একটা বিছানা পেতে নিলেন। রেবা পরিমল অনেক আপত্তি করেছিল, উমাশশী শোনেননি। স্বামীর অসুখ, তাঁকে তো সারা রাত বসে বসেই কাটাতে হবে, নজর রাখতে হবে রোগীর ওপর, ওই একটা কম্বল মাটিতে পাতা থাকা—ওতেই হবে।
খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গেলে উমাশশী সারদার ঘরে এসে দরজায় ছিটকিনি তুলে নিলেন। পাশের ঘরটা রেবাদের। তার পাশে ছোট মতন বসার ঘর, তপুর বিছানা হয়েছে সেখানে।
ঘরে এসে উমাশশী আরও একটু জরদা মুখে দিলেন। বোধহয় আগেরটুকু কম হয়েছিল। বাতিটা কমিয়ে দিলেন। জানলা দুটো দেখলেন। ঠাণ্ডা আসছে সামান্য। মাথার দিকে জানালাটা ভেজিয়ে দিলেন। পাশের দিকেরটা খোলা থাকল। ঘরে চাঁদের আলো আসছে না, কিন্তু গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সারদার পেটে খিদে, অনেকক্ষণ সিগারেটও খেতে পারেননি, বেশ অস্বস্তি লাগছিল। তার ওপর উমাশশী ঘরে এসে ছিটকিনি তুলে দেবার পর থেকেই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
উমাশশী হঠাৎ পা দিয়ে নিজের বিছানা গুটিয়ে দিলেন। দিয়ে সারদার বিছানার কাছে এসে বললেন, “মটকা মেরে অনেকক্ষণ পড়ে আছ। দেখাচ্ছি তোমায়। ওঠো।”
সারদা চোখ বুজে ছিলেন। আরও চেপে চোখ বুজলেন। কানে যেন শুনতে পাননি। ঘুমিয়ে রয়েছেন।
ঠেলা মারলেন উমাশশী। “ন্যাকামি হচ্ছে! বুড়ো ঘুঘু!”
সারদা আরও ঘাবড়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন না, তাঁর হার্টের রোগটাকে আঁকড়ে থাকবেন, না বিসর্জন দেবেন। চোখ খুলে জড়ানো গলায় বললেন, “আঃ, কে? বুকের বাঁ দিকটায়…” বলে বাঁহাতে বুক চেপে ধরলেন।
উমাশশী খানিকটা ধাক্কা মেরেই স্বামীকে খাটের একপাশে সরিয়ে দিয়ে পাশে বসলেন। মাথায় কাপড় নেই, গায়ের আঁচলটাও বুকের তলায় নেমেছে।
সারদা বুঝতে পারলেন, আত্মরক্ষা না করলে অবধারিত পতন।
উমাশশী স্বামীর বুকে জোর একটা খোঁচা মারলেন, “এখনও ঢং করে চোখ পিটপিট করছ? তাকাও ভাল করে, নয়ত চোখ গেলে দেব।”
সারদা তাকালেন। বললেন, “আমার বুকে ব্যথা, খোঁচা মেরো না, মরে যাব।”
“তোমার বুকে আমি কিল মারব,” বলে উমাশশী সত্যিই মুঠো পাকালেন।
ভয়ে সারদা ধড়মড় করে উঠে বসলেন। হাত নয় তো হামানদিস্তে উমাশশীর, বার দুই বুকে পড়লে পাঁজরা ভেঙে যাবে। সারদা বললেন, “হচ্ছেটা কী? তুমি কি আমায় মারধোর করতে এসেছ?”
“কী করতে এসেছি, বোঝাচ্ছি তোমায়।…আগে বলো, নগদ চারশো টাকা কোথায়?”
সারদার সম্মানে লাগল। বললেন, “তোমার কাছে টাকার হিসেব দিতে হবে?”
“হবে।”
“আমার টাকা। আমি যা খুশি করব।”
“চেঁচামেচি কোরো না। আস্তে কথা বলল। ঘরে তোমার ডাকাত পড়েনি। বেহায়া মদ্দ!…আমার আলমারি ভেঙে সংসারের টাকা নিয়ে পালিয়ে এসেছ, চোর কোথাকার। আবার বলছ, তোমার টাকা!”
সারদা অশান্তি বাড়াতে চাইলেন না। বললেন, “টাকা ফেরত পাবে। গোটা পঞ্চাশ খরচ হয়েছে।”
“আংটিটা কোথায়?”
“আছে।”
“জামা, প্যান্ট, শাল সব আছে? না হারিয়েছ?”
“সব আছে। এদিক ওদিক পড়ে আছে। খুঁজে নাও গে যাও।”
উমাশশী কানই করলেন না, মুখটা বেঁকালেন। বললেন, “বুড়ো বয়েসে এই ঢং করবার কী দরকার ছিল?”
সারদা জবাব দিলেন না। রাগ, দুঃখ অভিমান, অপমান—সব যেন মনটাকে তেতো বিমর্ষ করে দিচ্ছিল। মুখ গুম করে থাকলেন।
উমাশশী বললেন, “কথা বলছ না যে বড়। বোবা হয়ে গেলে?”
সারদা আরও খানিকটা চুপ করে থেকে বললেন, “কী হবে বলে! তুমি আমাকে কুকুর বেড়ালের মতো মনে কর, সেইরকম ব্যবহার কর।”
উমাশশী যেন থ’। গালে হাত দিলেন। “কুকুর বেড়ালের মতন করে আমি তোমায় দেখি। এত বড় কথাটা তুমি বলতে পারলে। বত্রিশ বছর বিয়ে হয়েছে, আমিই বরং তোমার লাথিঝাঁটা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি।”
“নেভার। তোমায় লাথি মারার মতন পায়ের জোর আমার নেই।…”
“বোলো না, বোলো না। ও-কথাটি বোলো না। আমায় তো মারছই, আমার বাবাকেও ছাড়ছ না! গুরুজন মানুষ, কবে স্বর্গে গেছেন; তাঁকেও তুমি রেহাই দিলে না। ছেলেমেয়ের কাছে ওইসব কুচ্ছিত কথা লিখেছ। লেখে কেউ? আমায় তুমি যা খুশি বলল, সারা জীবনই শুনছি, তা বলে আমার বাবাকেও গালাগাল দেবে!”
সারদা বুঝলেন বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বোধহয়। বললেন, “তোমার বাবা আমার ঠিক টার্গেট নয়, তোমাকেই…”।
“জানি। কিন্তু কোন দোষটা আমার হয়েছে, কর্তা?”
সারদা চুপ।
উমাশী বললেন, “সেদিন তোমার দুধে মাছিও পড়েনি, টিকটিকিও পড়েনি। জ্বাল একটু কম হয়েছিল। তা আমার এই হাতির গতর নিয়ে রান্নাঘরে বসে দুধ জ্বাল দিতে আর পারি না। এই তো আমার দোষ!”
“দুধের কথা কেউ বলছে না।”
“তবে কি সন্ধেবেলার কথা বলছ? সন্ধেবেলায় মাথা গরম কে করেছে, আমি না তুমি? কোথায় তোমার দাঁতের পাটি, চশমা—সে কি আমি জানব, না আঁচলে বেঁধে রাখব।”
সারদা গম্ভীর। কথা বলছেন না।
উমাশশী বললেন, “রাগের কারণ থাকবে তো? কথায় কথায় মেজাজ, হম্বিতম্বি, গালমন্দ। কোন খানটায় তোমার ত্রুটি হয়? রং গোপালঠাকুরের মতন করে রাখি।”
সারদা বললেন, “গোপাল না গোবৎস?”
“মানে?”
“সেদিন তোমায় কতবার বললুম,” বলতে গিয়ে থেমে গেলেন সারদা।
“কী বললে?”
সারদার গলায় আর কথা ফোটে না। বার দুই ঢোঁক গিলে বললেন, “সেদিন সকালে তুমি যখন পুজো সেরে এসে কাপড়চোপড় ছাড়ছিলে—মাথাটাথা ঘষেছ চুলটুল এলোমেলো, কপালে চন্দনের টিপ, সেমিজ টেমিজ ইয়ে হয়নি—আমি তোমায় কী বলেছিলাম।”
“কী বলেছিলে? বলার মধ্যে তো দেখলাম, রস রসিকর্তা করে ওই হতকুচ্ছিত তোমার গীতগোবিন্দ গাইছিলে।”
“গাইছিলাম। কিন্তু হতকুচ্ছিত কোন জিনিসটা গেয়েছি?”
“গেয়েছ! আমি যেন কচি খুকি, তোমার ওই সব বাজে বাজে বিগলিত বসনং টসনং আমি বুঝি। যত সব অসভ্যতা।”
“তুমি কিছু বোঝ না।” সারদা রোয়াব করে বললেন যেন।
“বুঝি না। আমার বাবা আমায় মুখ্যু করে তোমার হাতে তুলে দিয়েছিল নাকি? তোমার ওই আধিখ্যেতার নিতম্ব, ঘটকুচ, তালফল সবই বুঝি কর্তা। কার সঙ্গে বত্রিশ বছর ঘর করলাম, তা আর জানি না।”
সারদা বললেন, “বোঝ তো সেদিন কেন বুঝলে না—যখন বললাম, দেহি মুখ-কমল-মধু পানম্…”
“বুঝব না কেন, খুব বুঝেছি। কিন্তু তখন চচ্চড়ে আলোয় ঘরের মধ্যে তোমার মধুপানের বহরটাই বা হয় কেন? ঢংয়ের বয়েস তোমার ফুরোয়নি?
“এক একটা সময়ের এক একরকম মুড। তখন একটা মুড এসেছিল। এখন ও-সব কথা বলা মিনিংলেস।”
উমাশশী কয়েক মুহূর্ত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর গায়ের আঁচল আরও আলগা করে, জামার বোতাম খুলে খাটে শুয়ে পড়লেন। সারদা বিছানায় বসে।
উমাশশী বললেন, “মেঝে থেকে বালিশটা এনে শুয়ে পড়। বাতিটা নিবিয়ে দিও। কেরাসিনের গন্ধ আমি সইতে পারি না।”
খাটটা ছোট। উমাশশীর ওই শরীরের স্থান কুলিয়ে সারদার দেহটি ধরবে কিনা—বুঝতে পারলেন না সারদা। টেনেটুনে একটু জায়গা হতে পারে।
সারদা বললেন, “তোমার কষ্ট হবে।”
উমাশশী জবাব দিলেন, “আমার কষ্ট তোমায় আর ভাবতে হবে না। এই বত্রিশ বছর অনেক ভেবেছ।” বলে একটু থেমে আবার বললেন, “এই কুড়ি পঁচিশটা দিন ঘরে একলা খাটে শুয়ে থেকেছি আর বুক আমার হু হু করেছে।”
উমাশশীর মুখে ‘হুহু’ শুনে সারদা লাফ মেরে মাটিতে নামলেন এবং অত্যন্ত ত্বরিত গতিতে বাতি নিবিয়ে মাটি থেকে বালিশ তুলে এনে স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়লেন।
স্বামীর দিকে পাশ ফিরেই শুলেন উমাশশী। মুখ থেকে পান আর জরদার গন্ধ আসছিল।
সারদা স্ত্রীর মোটাসোটা হাতটি বুকে টেনে নিয়ে বার কয়েক নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ছাড়তে ছাড়তে বললেন, “তুমি শুধু ‘দেহি মুখ-কমল-মধু পানম্’ পর্যন্তই দেখলে উমারানী, তার ক’ লাইন পরেই রয়েছে—‘তুমসি মম ভূষণং তুমসি মম জীবনং তুমসি মম ভব-জলধি-রত্নম। তুমি আমার ভূষণ, তুমিই আমার জীবন…”
উমাশশী রঙ্গ করে বললেন, “থাক থাক, অত ভূষণ-টুসন করো না, তোমার তো বুকে ব্যথা, হাতটা ছাড়, বুকে লাগলে ব্যথা করবে।”
সারদা বললেন, “বুক জুড়িয়ে যাচ্ছে! তোমার হাতটা এখনও কেমন নরম।…কিগো আঙুলের গাঁটটাট ফুলেছে নাকি? এখন তো পূর্ণিমা। বাতে কষ্ট হচ্ছে?”
উমাশশী মাথা নেড়ে বললেন, “বাতের কথা বাদ দাও। ও তো তোমারই দোসর।”
সারদা খুব খুশি হলেন। স্ত্রীর অঙ্গে প্রত্যঙ্গে বাত হয়ে থাকার বাসনাই তো তাঁর ছিল। বললেন, “বোস্টমদের সেই গান জান না? সেই রকম। তোমার গায়ে বাত হয়ে জড়িয়ে থাকাও যে কত শান্তির। আহা!”
উমাশশী এবারে এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। স্বামীর গালে তবলার বোল তোলার মতন করে একটা চুমু খেতে গেলেন, পারলেন না—এই বয়েসে তা কি সম্ভব! ছপ করে শব্দ হল কেমন, পান আর জরদার ছোপ আর গন্ধ লেগে গেল সারদার গালে।
সারদা চোখ বুজে বললেন, “এটা সেদিনের। আজকের আর একটা দাও। অন্য গালটা ফিরিয়ে দিচ্ছি। লাইক এ কৃশ্চান।”
দুজনে যখন পরম আনন্দে চোখ বুজে আছেন, উমাশশী বললেন, “হ্যাঁগো, তা তুমি তো এখানে বসে বসে চিঠিগুলি লিখতে। খামের ওপর ছাপ পড়ত ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া। কেমন করে পড়ত?”
সারদা বললেন, “সে তোমার ছেলে জানে। আমি তো আলগা স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিতাম খামে। তোমার ছেলে চিঠি পেয়ে সেগুলো তুলে পুরনো ধ্যাবড়া ডাক টিকিট লাগিয়ে দিত।”
উমাশশী অবাক। “ওমা, এসব ছেলেমেয়েরা করত। কী সর্বনেশে ছেলেমেয়ে। তাই দেখতাম, ওরা চোর-চোর ভাব করে থাকত। তুমি নেই—তাতেও ওদের মন খারাপ দেখতাম না।”
সারদা বললেন, “এটা ওদের ফাদারের সঙ্গে উইথ অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়েছিল।…আরে, তপুই তো আমায় একেবারে ভোরবেলায় সাইকেলে সুটকেস ঝুলিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে গেল।”
উমাশশী চুপ। খানিকটা পরে বললেন, “ছিছি, ছিছি, ছেলেমেয়েকেও একেবারে বাপের মতন তৈরি করেছ। বুঝবে ওরা মজা। সবাই তোমার উমা হবে না বুঝলে।” বলেই কি খেয়াল হল উমাশশীর, বললেন, “ছেলেমেয়েদেরও বলেছ নাকি, সেদিন তুমি আমার কাছে কী খেতে চেয়েছিলে?”
সারদা জোরে হেসে ফেললেন। বললেন, “ধ্যুত, আমি কি সত্যিই ছাগল নাকি। ওয়াইফ হাজব্যান্ডের ব্যাপার, ওদের কি বলতে আছে।”