বৃত্তের বাইরে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বৃত্তের বাইরে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রাত্তিরে শুতে যাবার আগে প্রত্যেকদিনই স্নান করা অভ্যেস রীনার৷ শীত গ্রীষ্ম মানে না৷ রীনাই দোতলার বাথরুমে নীল বালব লাগিয়েছে৷ সারা বাড়িটা যখন নির্জন হয়ে আসে, তখন শাওয়ার খুলে নিয়ে নীল আলো জ্বেলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে৷

একটা অস্পষ্ট চিৎকার রীনাও শুনতে পেয়েছিল, কিন্তু গ্রাহ্য করে নি, সারা গায়ে সাবান মেখে সে তখন স্পঞ্জ দিয়ে পিঠ ঘষার চেষ্টা করছিল, ঠোঁটে আলতো গুনগুন গান৷ আর একবার চিৎকার উঠতেই কোণের ঘরের দরজা খুলে মা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কে চেঁচাচ্ছে কে? বউমা? আমাদের বাড়িতে নাকি?

বন্ধ বাথরুমের ভেতর থেকে রীনা জবাব দিল, মনে তো হল কাঞ্চার গলা৷ আবার বোধহয় আজ ওর মাথায় ভূত চেপেছে!

বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে মা জিজ্ঞেস করলেন, এই কাঞ্চা, কাঞ্চা? কি হয়েছে কি? চেঁচাচ্ছিস কেন?

একতলার কোণের ঘর থেকে কাঞ্চা হাউমাউ করে কি যেন বলে উঠল৷ একটি বর্ণও বোঝা গেল না, কিন্তু মনে হল খুব ভয় পেয়েছে৷ বাথরুমের জানলা দিয়ে রীনা ধমকের সুরে বললো, এই কাঞ্চা, চুপ কর৷ এত রাত্তিরে মানুষজন ঘুমোবে না?

চিৎকার থামলো না, বরং সত্যিকারের আতঙ্ক ফুটে উঠল৷ মা ডাকলেন, দীপু, দীপু ঘুমিয়েছিস নাকি? আয় না একবার নিচে—বউমা, তাড়াতাড়ি বেরোও৷

রাত্তিরের স্নানটা তাড়াতাড়ি সারতে হলেই রীনা বিরক্ত হয়ে ওঠে৷ কিন্তু বেরুতেই হবে, সব জায়গায় স্পঞ্জ বুলোনো হল না, তাড়াতাড়ি জল ঢেলে সাবান ধুতে লাগলো৷ মা ততক্ষণে শিপ্রাকেও ডেকে তুলেছেন৷ দীপুর গম্ভীর গলা শোনা গেল, কি হয়েছে কি? আজ আবার জ্বালাচ্ছে তো কাঞ্চাটা! বলছি ওকে দেশে পাঠিয়ে দাও!

গত বছর কার্শিয়াং বেড়াতে গিয়ে এই নেপালী ছেলেটাকে নিয়ে আসা হয়েছিল৷ ওর বাবাই বলেছিল, এখানে খেতে পাচ্ছে না, কলকাতায় বাবুদের কাজ করে খেয়ে পরে তবু বাঁচবে৷ চোদ্দ-পনেরো বছরের হাসি-খুশি ছেলেটা, যেমন বিশ্বাসী তেমন খাটতে পারে, কোনো কথায় না নেই, বাড়িতে সবারই ছেলেটাকে খুব পছন্দ৷ কিন্তু একটা মুশকিল হয়েছে ছেলেটাকে নিয়ে—সন্ধ্যের পরই ও কেমন যেন বদলে যায়, মুখ-চোখে ভয়ের ছাপ পড়ে, অন্ধকারের মধ্যে একা পড়ে গেলেই চেঁচিয়ে ওঠে৷ দারুণ ভূতের ভয় ছেলেটার৷ প্রথম প্রথম বাড়ির সবাই হাসি ঠাট্টা করে ওর ভয় ভাঙাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বহু জন্মের পাহাড়ি কুসংস্কার সহজে যাবার নয়৷

নিচতলায় ভাঁড়ারঘরে শুতে দেওয়া হয়েছে কাঞ্চাকে, কিন্তু প্রায় রাত্তিরেই ও ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করে৷ আসলে একা ঘরে শোয়ার অভ্যেস ওর নেই৷ কিন্তু বাড়ির চাকরকে আর কোথায় শুতে দেওয়া হবে—কিছুদিন দোতলার বারান্দায় শুতে দেওয়া হয়েছিল, তাতেও ওর ভয় কমে নি তা ছাড়া নিচতলাটা একেবারে ফাঁকা পড়ে থাকে৷ এখন ওর সঙ্গী হিসেবে একটা কুকুর কিনে দেওয়া হয়েছে, কুকুরটা রাত্রে ওর ঘরে শোয়৷ এমনিতে ছেলেটা দিনের বেলা সাহসী, দুপুরবেলা বৈঠকখানায় যেবার চোর ধরা পড়লো তখন কাঞ্চাই তো ছুটে গিয়ে লোকটাকে জাপটে ধরেছিল, আর একটু হলে ভোজালি চালিয়ে দিত৷ অথচ রাত্তির হলেই ওর যত রাজ্যের ভয়৷ রোজ খাবার সময় ও রীনা আর শিপ্রাকে শোনায়—ভূতেরা নাকি ওর ঘরে ফিসফিস করে, ওকে ভয় দেখাবার জন্য হাসে৷ আসলে পুরোনো বাড়ি, মোটা মোটা দেয়ালে নোনা ধরার গন্ধ, দিনের বেলাতেও নিচতলাটা অন্ধকার হয়ে থাকে, সিঁড়ির তলার অন্ধকার জায়গাটার দিকে তাকালে এমনিতেই গা ছম ছম করে তবে কাঞ্চার আজকের চিৎকারটা যেন একটু বেশি চরম৷

ওরা তিনজন নিচে নেমে গেছে, গোলমাল থামে নি, সবাই মিলে উত্তেজিত ভাবে কি যেন বলছে৷ রীনা তাড়াতাড়ি ব্লাউজ সায়া পরে নিল, শাড়িটা জড়িয়ে নিয়ে ঝটাস করে দরজা খুলে বেরিয়ে এল৷ মাথাটা ভালো করে মোছা হয় নি, টপটপ করে জল ঝরছে৷ দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল নিচে৷

কাঞ্চার ঘরে উঁকি দিয়ে রীনা জিজ্ঞেস করলো, কি, কি হয়েছে কি? কাঞ্চার থেকেও এখন বেশি চেঁচাচ্ছে শিপ্রা, কিন্তু তার কথা শোনার আগে রীনা নিজেই দেখতে পেল৷ কাঞ্চার হাতে একটা শাবল, ঘরের মেঝেটা অনেকখানি খুঁড়ে ফেলেছে৷ এ ঘরের মেঝেটা অনেকদিন ধরেই এবড়ো-খেবড়ো, বহুকালের ড্যাম্পে মাটি এরকম ফুলে ফুলে ওঠে৷ কাঞ্চা প্রায় বলে, রাত্তিরে নাকি ওর বিছানার তলায় গুমগুম শব্দ হয়৷ তাই শুনে শিপ্রা বলেছিল, তোর ঘরের ঠিক নিচেই পাতাল পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ আছে৷ তাই না রে? আজ কাঞ্চা কারুকে কিছু না বলে শাবল দিয়ে সিমেন্টের মেঝেটা খুঁড়ে ফেলেছে৷ রীনা দেখতে পেল সেখানে একটা মড়ার মাথার খুলি৷

কাঞ্চা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, মুখখানা তার রক্তহীন ফ্যাকাসে, গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরুল না এখন৷ শিপ্রা তার মাকে জড়িয়ে ধরেছে, বাচ্চা কুকুরটা শুঁকছে সেই মড়ার মাথার খুলি—কুঁই কুঁই করে শব্দ করছে৷ রীনার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল, পায়ের জোর চলে গেল, মনে হল, এক্ষুনি মাটিতে ঝুপ করে পড়ে যাবে৷ পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তীব্র গলায় বললো, একি! সঙ্গে সঙ্গে মা আর শিপ্রার কান্না মেশানো চিৎকার৷

একমাত্র দীপুরই ঠাণ্ডা মাথা৷ সে জিজ্ঞেস করলো, এই ছোঁড়া, তুই হঠাৎ মাঝরাত্তিরে ঘর খুঁড়তে গেলি কেন?

মা বললেন, কি সর্বনাশ! এটা কি করে এখানে এল! এই দীপু—

—আমি তা কি করে জানব! পুরোনো বাড়ি, কবেকার কি সব ব্যাপার!

—তোর দাদাকে খবর দে! আমার মাথা ঘুরছে—এই শিপ্রা, ওরকম করছিস কেন?

—দাদাকে খবর দেবার কি হয়েছে?

মা আর শিপ্রার ভয় দেখে রীনার প্রথম আতঙ্কটা কেটে গেছে৷ মা শিপ্রা দু’জনে দুজনকে জড়িয়ে রয়েছেন, দু’জনেরই চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে৷ রীনা তাড়াতাড়ি উঠোনের আলোটাও জ্বেলে দিল৷ মাকে একটু সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে বললো, দেখেই তো মনে হচ্ছে বহুদিনের পুরোনো—

দীপু এগিয়ে পা দিয়ে খুলিটাকে ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো৷ মা আর্তস্বরে বললেন, ছুঁস না ছুঁস না—এই দীপু, সরে আয়—৷

মা দীপুর হাত ধরতে যেতেই দীপু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, দাঁড়াও না—আমার ডাক্তার বন্ধু আলোকের ঘরে দু’দুটো কঙ্কাল আছে, কতবার তাতে হাত দিয়েছি!

খুলিটা সত্যিই খুব পুরোনো, ভেতরে মাটি ভর্তি৷ চোয়ালের খানিকটা ফেটে গেছে, চোখের জায়গায় দুটো শূন্য গর্ত৷ শিপ্রা ভয়ে মা’র পিঠে মুখ গুঁজে দিয়েছে৷ দীপু বললো, মনে হচ্ছে এর নিচে আরো হাড়গোড় আছে, একটা গোটা মানুষই ছিল—শ’খানেক বছর আগে কেউ বোধহয় একটা লোককে খুন করে এখানে পুঁতে ফেলেছিল—কিংবা এমনও হতে পারে, এ জায়গাটা ছিল কবরখানা৷

রীনা বললো, কিন্তু বাড়ির ভিত খোঁড়ার সময় তা দেখে নি কেউ?

—হয়তো বাড়ির মালিকই কাউকে পুঁতে রেখেছিল৷ যাকগে, এই কাঞ্চা বেরিয়ে আয়, কুকুরটা নিয়ে আয়৷

ভয়, উত্তেজনা ও চেঁচামেচি চলল আরো কিছুক্ষণ৷ দীপু শেষ পর্যন্ত বললো, এখন এ ঘরে তালা দেওয়া থাক, কাঞ্চা আমার ঘরেই শুয়ে থাকুক আজ৷ কাল সকালে আমি বাকি মেঝেটা খুঁড়ে দেখব এখন৷

মা জিজ্ঞেস করলেন, কেন, তুই খুঁড়বি কেন?

রীনা বললো, বলা যায় না হয়তো গুপ্তধন টুপ্তধনও থাকতে পারে!

দীপু হেসে বললো, যা বলেছো! হয়তো গুপ্তধন পুঁতে যখ দিয়েছিল! আয় কাঞ্চা, তোর বিছানা নিয়ে আয়৷ বউদি, তুমিও না হয় মা’দের ঘরে গিয়ে শোও—ভয়-টয় পাবে রাত্তিরে৷

—আমি অত ভয় পাই না৷

—না-বৌমা, তুমি আমার ঘরেই এসো৷

—কাঞ্চার ঘর বন্ধ করে উঠোনের আলো নেভাবার পর নিচতলাটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ সিঁড়িতে ওঠার আগে শিপ্রা আবার মাকে জড়িয়ে ধরলো, রীনা রইলো সবার পেছনে৷ শিপ্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, মনে হচ্ছে উঠোনে এখনো একটা কিসের শব্দ হচ্ছে, না?

রীনা বললো, ধ্যাৎ! কোথায় শব্দ?

দীপু বললো, শিপ্রাটার সব সময়ই ভয়—এত বড় মেয়ে, চল তোকে এখন একবার একা রেখে আসি নিচে৷

—ওরে বাবা! শিপ্রা, দু’তিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে ওপরে উঠে এল৷

রীনা মা’দের ঘরে গেল না৷ নিজের ঘরেই এল শুতে৷ ভালো করে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে, খাটের নিচেও একবার উঁকি মেরে দেখলো৷

একা শোওয়া অভ্যেস আছে রীনার৷ এক সপ্তাহ অন্তর এক সপ্তাহ করে নাইট ডিউটি থাকে দেবনাথের৷ খবরের কাগজের চাকরি, রাত দুটো-আড়াইটের সময় ডিউটি শেষ হয়৷ বিয়ের পর প্রথম কয়েক মাস রাত আড়াইটের পরই হেঁটে বাড়ি ফিরে আসত, জেগে থাকত রীনা৷ এখন রীনাই তাকে বারণ করে দিয়েছে অত রাত্রে ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে, গুণ্ডা বদমাইসদের হাতে পড়তেই পারে, একদিন পুলিশের গাড়িও থানায় নিয়ে গিয়েছিল, নেহাত খবরের কাগজে চাকরি করে বলেই অফিসে টেলিফোন করে ছাড়া পায়৷

কলেজে পড়ার সময়ও রীনা বরাবর হোস্টেলে কাটিয়েছে৷ তার ঘরে অবশ্য আরো দুটি মেয়ে শুত, কিন্তু কখনো কখনো তারা হয়তো বাড়িতে গেছে, আর ফেরে নি—রীনা একা ঘরে শুয়ে থেকেছে, তার কোনোদিন ভয় করে নি৷

খাটের তলা-টলা দেখে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে রীনা শাড়ি ব্লাউজ সায়া খুলে নাইটি পরে নিল৷ সারা বাড়ি এখন আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, এ পাড়াটাও বেশ নির্জন৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে রীনা ভাবলো, শিপ্রার বড় বেশি বেশি ভয়৷ কচি খুকি! তেইশ বছরের মেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না জুড়ে দিয়েছে! কাঞ্চার চেয়েও ওর ভয় যেন বেশি৷

রীনার ভূতের টুতের ভয় নেই! কিন্তু চোর-ডাকাতকে তার বড্ড ভয়৷ রাতদুপুরে তার ঘরে যদি একটা চোর ঢোকে—ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখতে পেলেই রীনা হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবে৷ অবশ্য তার আগে ভালো করে দেখে নেবে সত্যিকারের চোর কিনা৷ দেবনাথের মতন করবে না৷ দেবনাথ একদিন মাঝরাতে বাথরুমে যাবার জন্য বেরিয়েছিল—সিঁড়িতে দীপুকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠেছিল, চোর! চোর! দীপুও তখন বাথরুমে যাবার জন্যই নিচে এসেছিল, সে যত বলে দাদা আমি—দেবনাথ শুনতেই পায় নি—তারস্বরে চেঁচিয়েছিল চোর, চোর!

চুল আঁচড়ানো শেষ করে রীনা মুখে ক্রিম মাখতে লাগলো৷ তারপর গ্লিসারিনের শিশি থেকে খানিকটা গ্লিসারিন মাখলো ঠোঁটে আর কনুইয়ের কাছে৷ অনেক মেয়ের দুই কনুয়ের কাছে কি রকম খরখরে হয়ে থাকে৷ রীনা একদম পছন্দ করে না৷ রীনা আবার ভাবলো, দীপুর কিন্তু সাহস আছে৷ দীপুর স্বাস্থ্য ভালো, কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো হলেও সবাই সাহসী হয় না৷ তবে এটা ঠিক, দীপু যখন পা দিয়ে মড়ার মাথার খুলিটায় ঠোক্কর মারছিল, তখন রীনারও বুকের মধ্যে শিরশির করছিল একটু একটু৷ ঠিক ভয় নয়, অন্য রকম কি যেন৷ সুইচ টিপলেই ইলেকট্রিক আলো, এর মধ্যে ভয় পাবার কি আছে? কিন্তু শুধু একটা মড়ার মাথা দেখলেই কি-রকম কি-রকম যেন লাগে৷ ওটা ওখানে এলই বা কি করে! ঘরের মেঝেতে মড়ার মাথা! কেউ কখনো এরকম শোনে নি৷

দেবনাথের বাবাই এই বাড়িটা কেনার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছিলেন, হঠাৎ তিনি এলাহাবাদে অফিসের কাজে গিয়ে সেখানেই হার্ট-ফেল করেন৷ দেবনাথরা পরে বাড়িটা কিনে ফেলে, সাঁইতিরিশ হাজার টাকায় বাড়িটা একটু সস্তাই বলতে হবে—যদিও বাড়ি খুব পুরোনো, কিন্তু জায়গা আছে অনেকটা৷ কিন্তু এ পর্যন্ত বাড়িটা সম্পর্কে কোনো দুর্নাম তো কখনো শোনা যায় নি৷ এই এগারো বছর ওরাও দেখে নি কিছু৷ রীনারই তো বিয়ে হয়েছে আট বছর৷

আলো নিবিয়ে খাটে উঠতে গিয়ে রীনার হঠাৎ একটু ভয় করলো৷ যতক্ষণ আলো জ্বালা ছিল, তার কিছুই মনে হয় নি৷ খালি তার মনে হচ্ছে, ঘরের মধ্যে যেন কেউ আছে৷ প্রথমে ভয়টা কাটিয়ে ফেলার জন্য রীনা চোখ বুজে শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ, অন্য কথা ভাবার চেষ্টা করলো, পুজোর সময় পুরী যাবার কথা বলেছিল দেবনাথকে, কিন্তু দেবনাথ কিছুতেই নাকি ছুটি পাবে না—প্রায় তিন বছর কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাওয়া হয় নি…৷ রীনা কিছুতেই ভয়টা তাড়াতে পারছে না৷ খালি মনে হচ্ছে মাথার কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে, তার নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে—তার মুখখানা রীনার মুখের খুব কাছে ঝোঁকানো৷

একটুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থেকে ভয়টা যখন ক্রমশ বাড়ছে, তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে, তখন ঝট করে রীনা চোখ মেলে তাকালো, ধড়মড় করে উঠে আলো জ্বালালো৷ কেউ কোথাও নেই৷ নিছক মনের বিকার৷ অন্য কোনো রাতে একরকম মনে হয় না৷ শুধু আজই—নিচতলার ওটা দেখার পর…মনটা দুর্বল হয়ে গেছে৷ খাটের তলা, আলমারি, আলনার পাশগুলো আবার ভালো করে দেখলো—কোনোরকম সন্দেহের বিন্দুমাত্র কারণই নেই৷ দরজা জানলা সব বন্ধ, ঘরের ভেতরটা একটু গুমোট হয়ে গেছে৷ সেইজন্যই বোধহয়…

রীনা দারুণ জেদী মেয়ে৷ অকারণে সে আজ ভয় পাচ্ছে বলে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে উঠল৷ একটা জানলা খুলে দিল রাস্তার দিকের—সেখান থেকে তাকিয়ে রইলো বাইরে৷ ঠুনঠুন করে একটা রিকশা যাচ্ছে, রিকশার ওপর কাত হয়ে শুয়ে আছে একটা লোক—তাছাড়া রাস্তায় আর জনমনুষ্য নেই৷ এক ঝলক হাওয়া এসে তার মুখে লাগতেই ভয়টা অনেক কেটে গেল৷

অন্য মেয়ে হলে ওইটুকুতেই খুশি হয়ে আবার এসে শুয়ে পড়ত৷ কিন্তু রীনা অকারণে ওরকম ভয় পাবার জন্য নিজের মনটাকে একটু শিক্ষা দিয়ে দিতে চাইলো৷ দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে এল৷ সাধারণত সে পাতলা স্বচ্ছ নাইটি পরে ঘরের বাইরে বেরোয় না রাত্তিরে—কিন্তু ড্রেসিং গাউনটা আজই কেচে দিয়েছে, এখনো শুকোয় নি৷ এখন সবার দরজা বন্ধ, কেউ তাকে দেখবে না অবশ্য৷

ভয়টাকে একেবারে শায়েস্তা করার জন্যই রীনা বারান্দার আলোও জ্বাললো না৷ অন্ধকারে রেলিং-এর কাছে এসে তাকালো উঠোনের দিকে৷ ওপরে তিনতলায় দীপুর ঘরে আলো নিবে গেছে৷ মা-শিপ্রার ঘরও অন্ধকার৷ রীনার ছিটকিনি খোলার শব্দ কেউ শোনে নি৷ অন্ধকারে চোখটা সইয়ে নেবার চেষ্টা করে রীনা উঠোনের দিকে চেয়ে রইল৷ তার ঘরের দরজা একটুখানি খোলা, একটা আলোর রেখা এসে পড়েছে বারান্দায়৷ নিচতলাটা সেইজন্য আরো বেশি অন্ধকার লাগছে৷ একটু বাদে চোখে খানিকটা সয়ে এল৷ কাঞ্চার ঘরটা তালাবন্ধ দেখা যাচ্ছে—ওর ভেতরে আছে মাথার খুলিটা—কিন্তু কোথাও কোনো শব্দ নেই৷ কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে রীনা পেছন ফিরতে যাচ্ছে—এমন সময় একটা শব্দ শুনতে পেল নিচে৷ কে যেন উঠোনের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে দৌড়ে গেল হাল্কা পায়ে৷

চোররা ভেতরে একটা বাচ্চা ছেলেকে আগে ঢুকিয়ে দেয়৷ হঠাৎ যেন তার সব ভয় চলে গেছে, অদম্য সাহস এসেছে বুকে৷ দৃষ্টি প্রাণপণে তীক্ষ্ন করে আবার তাকালো উঠোনে, খুঁজতে লাগলো৷ আবার সেই শব্দ!

রীনা চেঁচিয়ে ডাকলো, দীপু! দীপু৷ আলো জ্বালার জন্য ছুটে গেল সুইচের দিকে৷ যে দৌড়াচ্ছে সে মানুষ নয়—মানুষ হতে পারে না৷ রীনা এবার স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে একটা কালো কুচকুচে বালিশের মতন কিছু একটা উঠোনের এপাশ থেকে ওপাশে গড়িয়ে গেছে৷ লম্বা লম্বা চুলওয়ালা এটা মানুষের মাথাও হতে পারে—সেই সঙ্গে চাপা কান্নার মতন আওয়াজ৷

রীনার ডাক নিশ্চয়ই দীপু শুনতে পায় নি, মা-শিপ্রাও জাগে নি৷ কিন্তু আলো জ্বলতেই রীনা এবার দেখতে পেল তাদের কুকুরটা নিচতলার উঠোনে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে আর ডাকছে কুঁই কুঁই করে৷ কুকুরটাকেও দীপু তিনতলায় নিয়ে গিয়েছিল, কোন ফাঁকে আবার নিচে নেমে গেছে৷ কুকুরটা অকারণেই উঠোনের এপাশ-ওপাশ ছুটছে৷ এবার সত্যিই দারুণ ভয় পেয়েছিল রীনা৷ ইস, মানুষ এইভাবেই তো ভয় পায়! মনটা আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই কুকুরটাকেও চিনতে পারে নি৷ কালো রঙের বালিশ কিংবা শুধু কোনো মানুষের মাথা আবার উঠোন দিয়ে গড়াতে পারে নাকি! ভাগ্যিস দীপুরা ওঠে নি, নইলে দীপু নিশ্চয়ই তাকে ঠাট্টা করে করে একেবারে কাঁদিয়ে ছাড়ত৷ কুকুরটা ওখানে গিয়ে ওরকমভাবে ছোটাছুটি করছে কেন? জন্তু-জানোয়ারদের ব্যবহারের কি কোনো ঠিক আছে! রীনা ফিসফিস করে ডাকলো, লিজি, লিজি, ওপরে উঠে আয়৷

কুকুরটা তবুও শুনলো না, অনবরত উঠোনে ছোটাছুটি করছে, যেন কিছু একটা জিনিসকে সে তাড়া করে যাচ্ছে বার বার, অথছ কিছুই নেই৷ রীনা আবার ডাকলো, লিজি! লিজি! কাম হিয়ার!

তিনতলায় দীপুর ঘরে খুট করে আলো জ্বলে উঠল৷ একটু আগে রীনার চিৎকার সে শুনতে পায়নি, এখন এই ফিসফিসানি ডাকেই তার ঘুম ভেঙে গেছে৷

নেমে আসছে৷

রীনার তখন খেয়াল হল, সে সামান্য একটা পাতলা নাইটি পরে আছে৷ শরীরের সব কিছুই এতে স্পষ্ট দেখা যায়৷ এই পরে দেওরের সামনে দাঁড়ানো যায় না৷ রীনা ঝট করে নিজের ঘরে ঢুকে, আলো নিবিয়ে, দরজা বন্ধ করে দিল নিঃশব্দে৷ সে যে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, সেটাই দীপুর জানবার দরকার নেই৷ কিন্তু বারান্দার আলোটা নেবানো হয় নি৷

দীপু দোতলায় নেমে এসে একবার অনুচ্চ গলায় জিজ্ঞেস করলো, কে? কে কথা বলছিল?

রীনা কোনো সাড়া দিল না৷ মা আর শিপ্রা দু’জনেরই ঘুম বেশ গাঢ়, আজ আবার ভয় পাবার পর বোধহয় বেশি করে ঘুমোচ্ছে, দীপুর গলার আওয়াজে কেউ জাগল না৷ দীপু বারান্দার এদিকে এল, রীনার ঘরের দরজার সামনে একবার দাঁড়ালো, ভেতর থেকে রীনা সব বুঝতে পারছে৷ দীপু চাপাগলায় বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করলো, বউদি, ঘুমোচ্ছ! রীনা একবারও উত্তর দিল না৷ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে৷ দীপু উত্তর না পেয়ে নিঃশব্দে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো৷ তারপর বারান্দার আলো নিবিয়ে ডাকতে লাগলো, লিজি লিজি! আঃ আঃ, লিজি! রীনা শুনতে পেল, দীপুর গলার আওয়াজ ক্রমশ একতলার দিকে নেমে যাচ্ছে৷

রীনা সামান্য একটু হেসে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো৷ দু’হাতের পাঞ্জায় চোখ দুটো ঢেকে রইলো৷ এখন আর তার ভয় করছে না৷

দেবনাথ বললো, পুলিশে খবর দেওয়া দরকার৷ খুন-টুনের ব্যাপার মনে হচ্ছে!

দীপু বললো, কিন্তু দাদা, এ অন্তত পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই৷ পুলিশ এখন এর কি করবে?

—কি করে বুঝলি অত পুরোনো?

—দেখছ না, খুলিটা ছাড়া আর সবই ঝুরঝুরে হয়ে গেছে!

শিপ্রা দিনের আলেতেও ভয় পাচ্ছে, শুকনো গলায় বললো, ছোড়দা আরো একটু খুঁড়ে দেখো না, যদি আরো থাকে-টাকে?

—তা বলে সারা বাড়ির ভিতরই খুঁড়ে ফেলব নাকি?

দেবনাথ জিজ্ঞেস করলো, কি করে জানলি আর নেই?

—এমা! কবারখানা ছিল না, বোঝাই যাচ্ছে৷ ডেড বডিটাকে লম্বালম্বি শুইয়ে কবর দেওয়া হয় নি, একটা পুঁটলি মতন করে এখানে পুঁতে ফেলা হয়েছিল৷ বস্তা আর পুরোনো খবরের কাগজের টুকরোও রয়েছে৷

—অনেক সময় ছোট ছেলের মড়া ওই রকমভাবেই কবর দেয়৷

—ছোট ছেলে নয়, রীতিমতো বয়স্ক—স্কাল দেখলেই বোঝা যায়৷ খুব সম্ভবত কোনো মহিলার স্কেলিটন৷

—মেয়েছেলে?

—হ্যাঁ৷ জামা-কাপড়ের কোনো চিহ্ন নেই যদিও, কিন্তু দ্যাখো না, ভেতরে দু’তিনটে ভাঙা কাঁচের চুড়ি রয়েছে!

—যাঃ, তোকে আর ডিটেকটিভগিরি করতে হবে না৷ পুলিশে খবর দিয়ে আয়৷ পুলিশ কিছু করুক না করুক, খবর দেওয়া আমাদের কর্তব্য৷

মা বললেন, তখুনি আমি বলেছিলুম, এই পুরোনো বাড়ি কিনতে হবে না! অপয়া বাড়ি৷ এর চেয়ে মধ্যমগ্রাম কিংবা বারাসতে একটু ছোট দেখে নতুন বাড়ি হলে…

দীপুই সকালবেলা শাবল দিয়ে মেঝে অনেকখানি খুঁড়ে ফেলে হাড়গোড় সব বার করেছে৷ দীপুর উৎসাহ বেশি ছিল গুপ্তধন খুঁজে পাওয়ার৷ কতকগুলো হাড়গোড় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় নি৷ বেশ গভীর গর্ত করে মড়াটাকে পোঁতা হয়েছিল বোঝা যায়, যে কোনো কারণেই হোক—সেটা ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠেছে৷ ঘরের মেঝের খানিকটা জায়গা ঢিপি মতন হয়ে ফুলেছিল৷ পুরোনো বাড়ির মেঝে ড্যাম্প লেগে অনেক সময়েই এ রকম হয়—আগে ওদের কিছু মনে হয় নি এ সম্পর্কে৷

ব্যাপারটা যে অনেকদিনের পুরোনো তার আর একটা প্রমাণও পাওয়া গেল৷ গর্তটার মধ্যে ছেঁড়া চটের বস্তা আর খবরের কাগজের টুকরো ছিল কয়েকটা৷

ড্যাম্পে কাগজগুলো লালচে হয়ে পচে গেছে, তবুও দীপু তার পাঠোদ্ধার করার অশেষ চেষ্টা করে একটুখানি পড়তে পারলো৷ কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরের প্রস্তাবের একটা প্রতিবাদ সভার রিপোর্ট৷ কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ১৯১১ সাল পর্যন্ত, এ কাগজটা নিশ্চয়ই তারও আগের৷

বাড়িতে এ রকম একটা সাংঘাতিক কাণ্ড, রীনা কিন্তু তা নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত নয়৷ সে মাঝে মাঝে ওখানে এসে ঘুরে যাচ্ছে, আর অফিস যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে৷ কি করে খবর ছড়িয়ে যায় কে জানে, তাদের বাড়ির সামনে বিরাট ভিড় জমে গেছে, পাড়া- প্রতিবেশীরা এসে নানা উদ্ভট গল্প জুড়ে দিয়েছে৷ রান্নার ঠাকুরটা রাত্রে এখানে শোয় না—সে থাকে কাছেই একটা বস্তিতে৷ সকালবেলা সে এসে এই কাণ্ড দেখে হৈ চৈ করেছিল, রীনা তাকে ধমক দিয়ে নিয়ে এসেছে রান্নাঘরে৷ একটা মড়ার মাথা খুঁজে বার করা হয়েছে বলে কি বাড়িতে সবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হবে? কেউ অফিস-টফিস যাবে না? একটা ব্রিটিশ কোম্পানিতে স্টেনোগ্রাফারের কাজ করে রীনা, সে অফিসে হুট-হাট করে ছুটি নেওয়া যায় না৷

সবাই মিলে জেরা শুরু করেছে কাঞ্চাকে৷ দিনের বেলা কাঞ্চার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই৷ চোর-ডাকাত ধরার মতোই ভূতের রহস্য বার করে ফেলার কৃতিত্বে ও এখন গর্বিত৷ সে জোর দিয়ে বলছে—জিন মাটির তলায় আর থাকতে চাইছিল না, তাই রোজ রাত্তিরে সে শুয়ে পড়ার পর তার কানে কানে কথা বলত৷ জিন চেয়েছিল গর্ত খুড়ে তাকে বার করে দিতে৷

এই রহস্যটা নিয়ে সবাই খুব মশগুল হয়ে রইলো৷ এখন মড়ার মাথাটা দেখার পর—অনেকেই হয়তো ভয় পেতে পারে, কিন্তু কাঞ্চা আগে থেকেই টের পেয়েছিল কি করে? সে তো অনেকদিন থেকেই বলছিল, ও ঘরে ভূত আছে, ও ঘরের মাটির তলায় খুটখুট করে শব্দ হয়! সেটা কি করে সম্ভব? এর ব্যাখ্যা কি?

নাইট ডিউটি থেকে ফিরে সকাল দশটা-এগারোটা পর্যন্ত ঘুমোয় দেবনাথ৷ তখন ঘুমোতে পারে নি, এই জন্য মুখখানা তার বিরক্ত তার ওপর এই ঝঞ্ঝাট৷ সে একটু শান্তিপ্রিয় লোক, বেশি লোকজন তার পছন্দ হয় না৷ দেবনাথ ব্যস্তভাবে চেঁচিয়ে উঠল, এই, এই দীপু, ওকি করছিস! না, না—বারণ করছি—

দীপু ততক্ষণে হাতে শাবল নিয়ে গর্তটার মধ্যে নেমে পড়েছে৷ গেঞ্জী পরা তার সবল শরীরে ফুলে উঠেছে হাতের মাসল৷ হাসতে হাসতে বললো, দাঁড়াও দেখি না—নিচে আরো কিছু আছে কিনা!

—না, দেখতে হবে না৷ উঠে আয়! একটা ডেডবডি বছরের পর বছর পচেছে ওখানে, অস্বাস্থ্যকর জায়গা!

দীপু তার দাদার সব কথা শোনে না৷ উঠে না এসে শাবল দিয়ে এদিক ওদিক খুঁচিয়ে দেখতে লাগলো৷ ঘরের দরজার কাছে ভিড় একেবারে ভেঙে পড়লো, একটি অতি উৎসাহী ছেলে তো হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল৷ নতুন করে চেঁচামেচি শুনে রীনা আবার এসে জিজ্ঞেস করলো, আর কিছু পাওয়া গেল? রান্নার ঠাকুরকেও সেদিকে ছুটে আসতে দেখে তাকে ধমক দিয়ে বললো, আবার তুমি আসছ কেন? যাও ডালটা নামিয়ে ফেলো! ন’টা বাজে প্রায়৷

মা এসে পাগলের মতন চেঁচাতে লাগলেন, দীপু শিগগির উঠে আয়, শিগগির আয়—নইলে আমি…

দু’হাতের তালুতে ভর দিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে এল দীপু৷ হাসতে হাসতে বললো, নাঃ, আর কিছু নেই, ডেফিনিট৷ গুপ্তধন-টুপ্তধন নয়, ক্লিন মার্ডার কেস!

দেবনাথ বললো, তুই যদি পুলিশের কাছে না যাস, আমিই যাই তা হলে৷ অন্তত ভিড় সামলাবার জন্যও পুলিশ ডাকা দরকার৷

দীপু কোনো উত্তর না দিয়ে দাদার প্রস্তাবেই সম্মতি জানালো৷ অর্থাৎ মাটিমাখা গায়ে তার পক্ষে থানায় যাওয়ার চেয়ে, যেতে হলে দাদারই যাওয়া উচিত৷ বিরক্ত মুখে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেল দেবনাথ৷

মা বললেন, দীপু কারুকে ছুঁবি না, যা আগে চান করে আয়!

—যাচ্ছি যাচ্ছি, দাঁড়াও না!

—না, যাচ্ছি না,—কোন অজাত কুজাতের মড়া তার ঠিক নেই!

—মড়ার আবার জাত কি মা! মরার আগেই তো জাতফাতের ঝামেলা৷

ভিড়ের মধ্যে পাড়ার কয়েকজন প্রবীণ লোকও ছিল৷ দীপু তাদের জিজ্ঞেস করলো জ্যাঠামশাই, আমাদের আগে যারা এ বাড়িতে ছিল—তাদের ফ্যামিলিতে কোনো খুন-টুন কিংবা নিরুদ্দেশের ঘটনা শুনেছেন?

দু’তিনজন বৃদ্ধ একসঙ্গে কথা শুরু করলেন৷ তাদের কথা থেকে এইটুকু জানা গেল যে, আগে থাকত শুধু বুড়ো-বুড়ি আর তাদের একটি ছোট ছেলে৷ বুড়ো-বুড়ির বড় ছেলে চাকরি করত এলাহাবাদে, তার সঙ্গে বাপ মা’র বেশি বনিবনা ছিল না৷ বুড়ো মারা যাবার পর, বড় ছেলে এসে মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে গেছে এলাহাবাদে আর উকিলের মারফত বিক্রি করিয়েছে এ বাড়ি৷ বুড়ো মরার পর পাড়ার লোকেরাই তাকে পুড়িয়ে এসেছে, সুতরাং সে সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই৷

তবে এ বাড়ি অবশ্য বুড়ো-বুড়ির পৈতৃক ছিল না৷ তাঁরাও এ বাড়ি কিনেছিলেন বছর তিরিশেক আগে৷ কিন্তু বছর তিরিশেক আগে এ বাড়ি কার ছিল এ সম্পর্কে পাড়ার প্রবীণদের মধ্যে মতদ্বৈধ দেখা গেল৷ কেউ বললেন, আগে এ বাড়ির মালিক ছিলেন এক মুসলমান জমিদার, তিনি এ বাড়ি ভাড়া খাটাতেন৷ আবার কেউ বললেন, এখানে আগে ছিল একটা ইস্কুল৷ অর্থাৎ তিরিশ বছর আগেকার স্মৃতি কারুরই নিশ্চিত নয়৷

ভিড় ঠেলে বাড়ির একেবারে ভেতরে চলে এল এক যুবক৷ ধুতি আর হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পরা, পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো৷ হন্তদন্ত হয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার? বাড়ির সামনে এত ভিড় দেখে…শুনলাম নাকি খুন হয়েছে এ বাড়িতে?

দীপু তাকে বিশেষ পাত্তা দিল না, এক পলক তার দিকে তাকিয়ে আবার বৃদ্ধদের গালগল্প শুনতে লাগলো৷ ছেলেটি দীপুর হাত ছুঁয়ে আবার বললো, কি হয়েছে দীপুদা? কি ব্যাপার?

দীপু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে শুধু বললো, মড়ার মাথা! এমনভাবে সে উচ্চারণ করলো, যেন বলতে চায়, আমার মাথা!

ছেলেটি দমলো না, বললে, ভিড় দেখে আমি আর থাকতে পারলুম না৷ একটা কাজে যাচ্ছিলুম, তারপর বাড়ির সামনে এত ভিড় দেখে মনে হল, নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে!

ছেলেটির ভাব এমন যেন, এ বাড়ির কোনো বিপদ হলে তার প্রতিকার করা ওরই দায়িত্ব৷ সমস্ত কাজ তুচ্ছ করে তাকে ছুটে আসতেই হবে৷ দীপু তাকে বললো, ঐ শাবলটা সরিয়ে রাখো তো রমেন, গর্তে পড়ে যাবে!

রমেন নিচু হয়ে শাবলটা তুলতে তুলতে আড়চোখে একবার শিপ্রার দিকে তাকালো৷ কঙ্কালের খুলিটার দিকেও তার চোখ পড়েছিল, কিন্তু সেটা সে গ্রাহ্যই করলো না, বার বার তাকাতে লাগলো শিপ্রার দিকে৷ শিপ্রা ভিড় থেকে একটু সরে চলে এলো সিঁড়ির কাছে, রমেনও এক ফাঁকে এসে গেল তার পাশে৷

পুলিশ যখন এলো, রীনা তখন অফিসে বেরুচ্ছে৷ ভিড় ঠেলে রীনা বেরুতে পারছিল না, পুলিশের জন্যই ভিড় ফাঁকা হয়ে গেল৷ বাড়ির সামনের রাস্তাটা তখন লোকে লোকারণ্য৷ কত রকম গল্প লোকের মুখে মুখে তখন ফিরছে তার ঠিক নেই৷ এ বাড়ির প্রত্যেকটা লোকই এখন দর্শনীয়৷ সিনেমার অভিনেত্রীকে দেখার মতন লোকে ভিড় করে এসেছিল রীনাকে দেখার জন্য৷ অফিসে যাবার সময় রীনা সানগ্লাস পরে, হালকা লাল রঙের শাড়ি আর ব্লাউজে রীনাকে দেখাচ্ছে খুব সুন্দর৷

দেবনাথকে দেখে রীনা বললো, আমি অফিসে চললুম, বুঝলে? তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো, এসব ঝামেলা চুকিয়ে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ো৷

দেবনাথ, বলল, আজ না গেলে পারতে না?

—উপায় নেই৷ কালকে কয়েকটা ইনকমপ্লিট চিঠি আমার ড্রয়ারে রেখে এসেছি৷ সেগুলো আমি না গেলে কেউ খুঁজে পাবে না, আর চিঠিগুলো যদি আজ না যায়, ডেভিস সাহেব রেগে আগুন হয়ে যাবেন৷

দেবনাথ পুলিশ ইন্সপেক্টরের দিকে ফিরে বললো, ইনি আমার স্ত্রী৷ এঁর অফিস আছে, গেলে আপত্তি নেই তো?

ইন্সপেক্টরটি অতিরিক্ত ভদ্র হয়ে বললেন, না না, আপত্তি কিসের! অফিস যাবেন না কেন? যা কেস শুনছি—

রীনা হাতব্যাগ খুলে বললো, এই নাও আলমারির চাবি, তোমার পাজামা-টামা বার করে রাখতে একদম ভুলে গেছি৷ চলি তাহলে!

উঠোনে চেয়ার পেতে দেওয়া হয়েছে ইন্সপেক্টরকে৷ মুখ চোখ দেখলে মনে হয় এ ব্যাপারে যেন বিশেষ কোনো উৎসাহই নেই৷ নেহাত বেড়াতে এসেছেন৷

দেবনাথ হঠাৎ অকারণে শিপ্রাকে একটা ধমক দিয়ে বললো, এই খুকু, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চা কর না! সকাল থেকে চা খাই নি ভালো করে!

শিপ্রার পাশ থেকে রমেন ছিটকে সরে গেল৷ শিপ্রা অপ্রসন্ন মুখে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে৷

দীপু ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করলো, প্রথমে কার এজাহার নেবেন?

ইন্সপেক্টর হেসে বললেন, আপনি বুঝি খুব ডিটেকটিভ বই পড়েন?

—হ্যাঁ, না—মানে কেন বলুন তো?

—আপনার ভাব দেখলেই বোঝা যায়৷ শুনুন, সে রকম কিছু রোমাঞ্চকর ব্যাপার ঘটার আশা নেই৷ ইংরেজি গোয়েন্দা গল্প হলে হয়তো দেখা যেত, এই পঞ্চাশ বছরের পুরোনো কেস থেকেই একটা বিরাট রহস্য উদঘাটন হয়ে যেত৷ কিন্তু আমাদের এই বছরই এত কেস পেন্ডিং আছে যে পঞ্চাশ বছরের বাসি মড়া ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় আমাদের নেই৷

—তা হলে এগুলো কি হবে? এই হাড়টাড়? রাস্তায় ফেলে দেব?

—একটু বাদে থানা থেকে ডোম পাঠিয়ে দিচ্ছি, সে এসে বস্তায় ভরে সব নিয়ে যাবে৷ একটা রুটিন মাফিক ফরেনসিক টেস্ট হবে—তবে বোঝাই যাচ্ছে, এ নিয়ে কোনো কেস ওপন করা হবে না৷ এমনিতেই সব মার্ডার কেস সলভ করা যায় না, আর এ তো মশাই হাফ সেঞ্চুরি আগের ব্যাপার!

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ইন্সপেক্টর দেবনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তো মশাই খবরের কাগজের লোক৷ ভিয়েৎনাম যুদ্ধের ব্যাপার কি বুঝছেন? মিটবে শিগগিরই?

দীপু জিজ্ঞেস করলো, ফরেনসিক টেস্টে জানা যাবে, কঙ্কালটা কোনো পুরুষের না মেয়ের?

—তা জানা শক্ত নয়৷ কিন্তু জেনে কি হবে?

—আমার ধারণাটা ঠিক কিনা বুঝতে পারতুম৷ আমার ধারণা এটা একটা মেয়েরই, দুটো ভাঙা চুড়ির টুকরো—

—এমনও তো হতে পারে—কোনো মেয়েই এই লাশটা পুঁতেছিল৷ গর্ত খোঁড়ার সময় তার হাতের চুড়ি ভেঙে—

—একটা মেয়ের পক্ষে সেটা টু-মাচ! পঞ্চাশ ষাট বছর আগে একটা মেয়ে আর কাউকে খুন করে আবার নিজেই গর্ত খুঁড়ে ডেড বডি পুঁতে রাখবে, এতটা ভাবা—

ইন্সপেক্টর হা-হা করে হাসতে হাসতে বললেন, আপনার বুঝি ধারণা পঞ্চাশ ষাট বছর আগে মেয়েরা খুব শান্ত-শিষ্ট ছিল? তখন তারা খুনটুন করত না?

দীপু বললো, তখন কেন, এখনো কোনো মেয়ের পক্ষে অতটা করা সম্ভব নয়৷

ইন্সপেক্টর বললেন, মেয়েদের চেনেন না আপনি৷ আমাদের লাইনে থাকলে…দেখলুম তো অনেক, মেয়েরা যেমন দেবীর মতনও হতে পারে, তেমনি যদি আবার—ইন্সপেক্টর হঠাৎ মাঝপথে থেমে গিয়ে প্রসঙ্গ বদলে বললেন, নেপালী চাকরটাকে একবার থানায় পাঠিয়ে দেবেন৷ ওর একটা স্টেটমেন্ট নিয়ে রাখতে হবে—নিছক ফর্মালিটি আর কি!

ভিড় কাটতে কাটতে দুপুর গড়িয়ে গেল৷ খিদেয় পেট জ্বলছে দেবনাথের, কিন্তু খাবার উপায় নেই৷ শান্তিস্বস্ত্যয়নের জন্য মা পুরুতমশাইকে ডাকতে পাঠিয়েছেন, তার আগে খাওয়া হবে না৷ দীপু আর অফিসে যায় নি, শিপ্রা কলেজে যায় নি৷ রীনা গেছে বলে মা তখন থেকে গজগজ করছেন৷ রীনাকে একটু ভয় পান তিনি—রীনা যখন যায় তখন শাশুড়িকে বলেই গেছে, কিন্তু তখন তিনি আপত্তি করতে পারেন নি৷ এখন বলতে শুরু করেছেন, প্রেতাত্মার বিহিত মন্ত্র পড়ে না তাড়ালে কখন কি বিপদ হয় মানুষের! আজকের দিনে বাড়ি থেকে কারুরই বেরুনো উচিত নয়৷

দীপু ঠাণ্ডা করে বললো, ভূত কি বউদিকে অফিস পর্যন্ত তাড়া করবে নাকি?

মা বললেন, যা বুঝিস না, তা নিয়ে কথা বলিস না৷ ভূতের কথা বলছি নাকি? আত্মা বলে একটা জিনিস আছে, সেটা অন্তত মানবি তো? এতকাল মাটির তলায় চাপা পড়ে ছিল!

—আত্মা আবার কোথাও চাপা পড়ে থাকে নাকি? সে তো শুনেছি, হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়!

—তুই থাম তো! দেবু, তুই বউমার অফিসে একবার ফোন করে খবর নে না?

দেবনাথ বললো, খবর আবার কি নেব?

ঠিকমতো অফিসে পৌঁছেছে কিনা—তা ছাড়া বলে দে, আজ যেন সন্ধের আগেই বাড়িতে ফেরে৷

—এখন আর ফোন-টোন করতে যেতে পারব না৷ ঘুমে আমার চোখ টেনে আসছে পেটে খিদে জ্বলছে—কোথথেকে একটা মড়ার মাথা এসে বাধিয়েছে যত ঝামেলা!

রমেন নামের ছেলেটিই পুরুতমশাইকে খবর দেবার ভার নিয়েছিল৷ সে ফিরে এসে বললো, পুরুতমশাইকে পাওয়া গেল না, তিনি নবদ্বীপ গেছেন কি যেন কাজে৷ যেন দোষটা তারই, রমেনের মুখখানা সেই রকম কাঁচুমাচু৷

দেবনাথ বললো, ভালোই হয়েছে৷ দাও ঠাকুর, খেতে দাও৷ আর দেরি করতে পারছি না৷

দীপু বললো, রমেন, তুমিই তো বামুনের ছেলে, তুমিই ক’টা মন্ত্রটন্ত্র আওড়ে দাও না৷

—আমি তো মন্ত্র জানি না৷ অন্য পুরুতের খোঁজ করব?

মা জিজ্ঞেস করলেন, অন্য পুরুত কোথায় পাবে? আর কারুর ঠিকানা জানো?

—না, তা জানি না৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখব?

দীপু হাসতে হাসতে বললো, একি দুর্গাপুজো কিংবা সরস্বতী-পুজো পেয়েছ নাকি যে রাস্তা দিয়ে অনবরত পুরুত যাবে?

দেবনাথ বিরক্তভাবে বললো, আঃ, কি হচ্ছে কি! মা, আজকেই কি তোমার ওসব না করালে নয়? রবিবার দিন না হয় পুরুত ডেকে তোমার যা খুশি করিও৷ এখন খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করো, আমাকে আবার সারারাত জেগে আজ ডিউটি দিতে হবে৷

অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রাম-স্টপে দাঁড়িয়ে রীনা ঘড়ি দেখলো৷ ঠিক পাঁচটা পাঁচ৷ পাঁচটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই টাইপরাইটারে ঢাকনা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রীনা কি যেন ভাবলো৷ তারপর আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো ময়দানের দিকে—রাস্তা পেরিয়ে ও পাশের ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো৷

পার্ক স্ট্রিট ক্রসিং-এ অন্তত শ’খানেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে লাল আলোর সামনে৷ বেশ ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে আজ বিকেলে৷ রীনার একটু খিদে পেয়েছে, খুব ইচ্ছে করছে বাদামভাজা কিনতে কিন্তু একা একা রাস্তা দিয়ে বাদাম খেতে খেতে যেতে কি রকম যেন লাগে৷ রীনা একবার পেছনে তাকালো, তাকিয়ে সেই লোকটাকে আবার দেখতে পেল৷ অফিস থেকে বেরিয়েই গেটের উল্টোদিকে এই লোকটাকে দেখেছিল৷ তখন খেয়াল করে নি, কিন্তু ট্রাম স্টপেও লোকটাকে ঠিক তার পাশে এসে দাঁড়াতে দেখে সে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল৷ লোকটার চেহারা দেখলে তো অভদ্র মনে হয় না৷ রীনার চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিয়েছিল৷ তবু বোঝা যায়, লোকটা রীনার দিকেই চেয়ে আছে৷ এখন লোকটা আসছে তার পেছনে পেছনে৷ এসব রীনার গা-সহা হয়ে গেছে৷ অফিস থেকে বেরিয়েই রীনা ট্রামে ওঠে না৷ এসব পাড়ায় একা কোনো মেয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই কেউ না কেউ তার পিছু নেবে৷ এই লোকটাকে দেখলে তো মনে হয় শিক্ষিত ভদ্রলোক, কিন্তু চোরের মতন মুখ করে তার পেছনে পেছনে আসছে৷ সামনাসামনি এসে কথা বলার সাহস নিশ্চয়ই হবে না৷ বেশ খানিকটা বিরক্তির সঙ্গে অতি সূক্ষ্ম একটু আনন্দ এবং গর্বও বোধ করলো রীনা৷ তার এখন একত্রিশ বছর বয়েস—তবুও তাকে দেখে পুরুষ মানুষেরা আকৃষ্ট হয়৷

আর একটা কথা মনে পড়তেও রীনার একটু হাসি পেল৷ দেবনাথও বিয়ের আগে তাকে এই রকম অনুসরণ করত৷ কলেজ থেকে ফেরার পথে রীনা রোজ দেখত, করুণ ব্যর্থপ্রেমিকের মতন মুখ করে দেবনাথ তার পেছনে পেছনে আসছে৷ একদিন রীনা ওকে অনেক কড়া কথাও শুনিয়ে দিয়েছে৷

বড় গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল সুবিমল, রীনাকে দেখে তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ বললো, আজ একেবারে ঠিক সময় এসেছো!

রীনা বললো, আজ থাকতে পারব না, আজ এক্ষুনি চলে যেতে হবে৷

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো সেই অনুসরণকারী লোকটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ইতস্তত করছে৷ এদিকে আসতেও সাহস করছে না, আবার ঠিক উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটতেও পারছে না৷ লোকটা শেষ পর্যন্ত ময়দানের দিকে চলে গেল৷

সুবিমল জিজ্ঞেস করলো, আজ তোমার ওভার টাইম নেই?

—ওভার টাইম থাকলেও আজ আমাকে বাড়ি যেতে হত৷ আমাদের বাড়িতে আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছে৷ আমাদের বাড়িতে একতলার মেঝে খুঁড়ে একটা মড়ার মাথা পাওয়া গেছে৷

—অ্যাঁ? কি পাওয়া গেছে?

রীনা মৃদু হেসে বললো, এসো ঘাসের ওপর একটু বসি, বেশিক্ষণ না কিন্তু৷ বাদাম কেনো না!

সব শুনে সুবিমল বললো, এটা তোমার কাছে মজার ব্যাপার?

রীনা বললো, তা ছাড়া কি!

—আমি তো এমন ঘটনা কখনো শুনি নি, বাড়ির মধ্যে একটা কঙ্কাল পাওয়া গেছে আর সে বাড়ির বউ বলছে, এটা একটা মজার ব্যাপার! তোমার ভয় করে নি একটুও?

—সত্যি বলতে কি, কাল রাত্তিরে আমার একটু গা ছমছম করছিল৷ খালি মনে হচ্ছিল, ঘরের মধ্যে কে যেন আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে!

—তার আগেই মাথার খুলিটা তুমি দেখেছ?

—হুঁ৷

—তারপরও তুমি একা ঘরে শুতে পারলে?

—বাঃ, রোজই তো শুই৷ কালই বা শোব না কেন? তা ছাড়া কে শোবে আমার সঙ্গে?

রীনা মুচকি হেসে তাকালো সুবিমলের দিকে৷ সুবিমল দুঃখিতভাবে বললো, কেন, শিপ্রা তো তোমার সঙ্গে শুতে পারত!

—না, শিপ্রার সঙ্গে শুতে আমার একটুও ইচ্ছে করে না৷ তা ছাড়া মা একলা থাকবেন কি করে? মাও খুব ভয় পেয়েছেন!

—রীনা, তোমার সত্যিই খুব মনের জোর!

—মনের জোর না থাকলে কি আর এক বাড়ির বউ হয়েও তোমার সঙ্গে এখানে বসে গল্প করতে পারি?

—দেবনাথ যদি কোনোদিন দেখতে পায়, কি বলবে তুমি তখন?

—কি বলব, তখন ভেবে দেখা যাবে৷ তবে খুব বেশি চেঁচামেচি বা রাগারাগি করার মানুষ ও নয়৷ চাপা লোক, দুঃখ পেলেও মনের মধ্যে চেপে রাখবে৷

—রীনা সত্যি বলছি, দেবনাথের কথা ভাবলে আমার মাঝে মাঝে নিজেকে দারুণ অপরাধী বোধ হয়৷ ওর উদারতার সুযোগ নিয়ে ওকে ঠকাচ্ছি আমরা৷

—বেশ তো, কাল থেকে আর ঠকিও না!

—তুমি জানো, সে উপায়ও আমার নেই৷ তোমারও কি আছে? তুমি পারবে আমাকে ছেড়ে থাকতে?

আবছা অন্ধকার হয়ে এসেছে, ময়দানের সব দৃশ্য এখন অস্বচ্ছ৷ কাছাকাছি আরো কয়েক জোড়া নারী-পুরুষ খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে৷ সুবিমল আলতোভাবে রীনার কোমর জড়িয়ে ধরলো, তার নিরাবরণ বাহুতে হাত বুলোতে বুলোতে বললো, রীনা, কয়েকশো বছর আগে, যখন তুমি কোনো রাজার পুরীতে পাটরানি ছিলে, তখন কি তুমি কোনো হাট থেকে আমাকে ক্রীতদাস হিসেবে কিনেছিলে?

রীনা সুবিমলের বুকে মাথা হেলিয়ে হাসতে হাসতে বললো, কিনেছিলাম তো! এক কানাকড়ি দিয়ে কিনেছিলাম!

—তাহলে বলো রাজেন্দ্রাণী, আমার ওপর আর কি হুকুম তোমার? পদসেবা করে দেব?

—না, আপাতত তোমার বুকপকেট থেকে ফাউন্টেন পেনটা সরিয়ে নাও৷ আমার ঘাড়ে ওটাতে লাগছে৷

সুবিমল পেনটা সরাতে গিয়ে রীনার ঠোঁটে তার আঙুল ছোঁয়ালো৷ তারপর মুখটা নিচু করে রীনার চুলের গন্ধ শুঁকতে লাগলো৷ রীনা ঠোঁটের ওপর থেকে সুবিমলের আঙুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আরো এলিয়ে দিল শরীরটা৷ সুবিমল রীনার বুকের ওপর রাখলো তার হাত, মুখটা সরিয়ে রীনার ঠোঁটের কাছে আনতেই রীনা ধড়মড় করে উঠে পড়ে বললো, ইস, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব বলেছিলুম, দিলে তো দেরি করিয়ে!

—বাঃ, আমি দেরি করিয়ে দিলুম?

—নিশ্চয়ই৷ তুমি তো দেরি করালে৷ চলো, শিগগির আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দাও৷

—আমি তোমাকে খানিকটা পৌঁছে দিয়ে আসব?

—না৷

শিপ্রা চেঁচিয়ে ডাকলো, মা, মা! তুমি কি করছ ভেতরে?

কোনো সাড়া পেল না৷ বাথরুমের দরজা বন্ধ৷

শাড়ি সায়া গুছিয়ে শিপ্রা বাথরুমে যাবার জন্য ঘর থেকে বেরুতে যাচ্ছিল, দেখলো মা বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন বাথরুমের দিকে৷ ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার সময় শিপ্রা দেখলো, মায়ের মুখখানা কিছু একটা চিন্তায় থমথমে৷ মা কাপড়-টাপড় নিয়ে যান নি বলে শিপ্রা ভাবলো, মা বোধহয় হাত-টাত ধুতে গেছেন৷ এক্ষুনি বেরিয়ে আসবেন৷

সেই থেকে রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিপ্রা৷ সন্ধে হয়ে এসেছে, শিপ্রাকে এক্ষুনি যেতে হবে গানের ইস্কুলে৷ পাঁচ মিনিটের মধ্যেও মা বেরুলেন না৷ ব্যস্ত হয়ে শিপ্রা আবার ডাকলো, মা, মা, তোমার দেরি হবে?

কোনো উত্তর নেই৷

শিপ্রা গুনগুন করে গান ধরলো, ‘ওগো, কিশোর আজি তোমার দ্বারে—’ এই গানটা শেখানো হচ্ছে এই সপ্তাহে৷ একটু বাদে শিপ্রা রীতিমতো ঝাঁঝালো গলায় বললো, মা তুমি বেরুবে না কি? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে৷

এবারও কোনো উত্তর নেই৷

শিপ্রার কি রকম খটকা লাগলো৷ অনেকদিন আগে মায়ের ফিটের অসুখ ছিল৷ বাবা মারা যাবার পরই দেখা দিয়েছিল এই উপসর্গ, বছর-চার-পাঁচের মধ্যে আর হয় নি, আবার সেটা দেখা দিল নাকি? বন্ধ দরজার একেবারে কাছে এসে শিপ্রা বললো, মা, সাড়া দিচ্ছ না কেন?

তবু কোনো সাড়া নেই৷

বাথরুমের দরজার গায়ে জোর ধাক্কা দিতে যেতেই হাট করে খুলে গেল৷ ভেতরে নীল আলোটা জ্বলছে৷ কিন্তু ভেতরে কেউ নেই৷ পায়খানার দরজাটাও খোলা, সেখানেও কেউ নেই৷ শিপ্রার বুকের মধ্যে ছাঁৎ করে উঠল৷ সারা শরীরে একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে গেল৷ মা কোথায় গেল? নিজের চোখে সে মা-কে ঢুকতে দেখেছে, মা তো আর ছেলেমানুষ নয় যে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকে তার সঙ্গে খেলা করবে!

তবু শিপ্রা ভয়ে ভয়ে একবার তাকালো দরজার দু’পাশে৷ দীপু বাড়িতে নেই, বউদি এখনো ফেরে নি, দাদা শুয়ে আছে ঘরে—মা কোথায় গেল? শিপ্রা একেবারে বাড়ি-ফাটানো চিৎকার করলো কান্না মেশানো গলায়, মা! মা!—

—কি রে, চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?

—শিপ্রা আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালো৷ চোখ দুটো বিস্ফারিত৷ সমস্ত শরীরে শিহরন৷ মা তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন৷ মা কখন বেরিয়ে গেলেন বাথরুম থেকে? শিপ্রা তো বরাবর দাঁড়িয়ে আছে বাইরে! গান গাইবার সময় সে কি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল? এতখানি অন্যমনস্ক?

মা দোতলায় নেমে এসে আবার বললেন, কি রে, এত চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?

—মা, তুমি বাথরুম থেকে কখন বেরুলে?

—আমি আবার বাথরুমে গেলাম কখন?

—তুমি বাথরুমে যাও নি? আমি দেখলাম!

—যাঃ!

—মা, আমি নিজের চোখে দেখলাম, বিশ্বাস করো!

—আমি তো দীপুর ঘরে আলনা গোছাচ্ছিলাম—

বলতে বলতে মা গেলেন, বাথরুমের দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি একবার গিয়েছিলাম…

কিন্তু শিপ্রা তখন আর কিছু শুনছে না৷ ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো৷ তার শরীরটা থরথর করে কাঁপছে৷ অস্বাভাবিক গলায় চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, মা, আমি নিজের চোখে দেখেছি—এমন কি মুখ পর্যন্ত!

দেবনাথ বোধহয় ঘুমিয়েই ছিল৷ চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে এসে বললো, কি হয়েছে কি? এত জোরে জোরে কথা বলছিস কেন শুধু শুধু?

—দাদা, আমি দেখলাম…

মা তাকে বাধা দিয়ে বললেন, হয়েছে, হয়েছে! শিপ্রা চোখে কি ভুল দেখেছে৷

—না, চোখের ভুল নয়৷ ভুল হতেই পারে না৷

—যা, তাড়াতাড়ি গা ধুয়ে নে৷ গানের স্কুলে যাবি না?

—মা দেখ, আমার গা কাঁপছে৷ আমার বুকের ভেতরটা কি রকম করছে৷ আমাকে একটু ধরো তো—

মা ধরার সুযোগ পেলেন না, দেবনাথও ছুটে এসে ধরতে পারলো না, তার আগেই শিপ্রা নেতিয়ে পড়ে গেল, মাথাটা বেশ জোরে ঠুকে গেল মাটিতে৷

মা ছুটে ওর মাথাটা তুলে নিলেন৷ দেবনাথ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাড়াতাড়ি ওর একটা হাত তুলে মণিবন্ধ টিপে নাড়ি দেখতে লাগলো৷ বিশেষ কিছুই হয় নি, এমনি অজ্ঞান হয়ে গেছে৷ মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরুচ্ছে৷

দেবনাথ বললো, মা দ্যাখো, ওকে বোধহয় তোমার রোগটা ধরলো!

—না, মৃগী নয়৷ হঠাৎ ভয় পেয়েছে৷ শ্রী রাম রাম রাম! কি যে অনাসৃষ্টি হল বাড়িটায়!

—ভয় পেয়েছে? এখনো সাড়ে ছ’টাও বাজে নি, অন্ধকার হয় নি ভালো৷—কিসে ভয় পেল?

—কি জানি! আমি তিনতলা থেকে নেমে এসে দেখি বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে মা মা বলে চ্যাঁচাচ্ছে৷ ও নাকি আমাকে বাথরুমে ঢুকছে দেখেছে! অথচ আমি দু’ঘণ্টার মধ্যে বাথরুমে যাই নি৷ এক মগ জল নিয়ে আয় তো!

—হুঁ, বুঝলাম৷ পেট গরম হয়েছে৷ তা হবে নাই বা কেন? যা রোদ্দুরে ঘুরে বেড়ায়! কদিন আগে বাসে আসার সময় দেখলাম কলেজ পালিয়ে আর দু’তিনটে মেয়ের সঙ্গে হই-হই করে ঘুরছে৷ যা গনগনে রোদ্দুর তখন, আমাদেরই প্রাণ ওষ্ঠাগত আর ওরা শখ করে—

রীনা যখন ফিরলো, তখনো শিপ্রা ভালো করে সুস্থ হয় নি৷ ঘরে এনে খাটে শোয়ানো হয়েছে, মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে ব্যাকুলভাবে বলছে, কিন্তু আমি যে দেখলাম, বাথরুমের আলো জ্বলছে—আলো জ্বাললো কে?

দেবনাথ ব্যাপারটাকে হালকা করার জন্য বললো, যা যা, ভূতে কখনো আলো জ্বালে না! আমিই হয়তো কখন আলো জ্বেলে রেখে এসেছি!

—তুমি তো ঘুমোচ্ছিলে?

—ঘুমের ঘোরেই কখন হয়তো একবার উঠে চলে গিয়েছিলাম৷ তুই আমাকেই দেখিস নি তো?

—না না, আমি মুখ পর্যন্ত দেখেছি৷

বলেই আবার উঠে বিছানায় ঢলে পড়লো শিপ্রা৷ রীনা ব্যাপারটাকে মোটেই গুরুত্ব দিলো না৷ চুপচাপ করে ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে একটু দেখলো৷ মা প্রাণপণে ঠাকুরের সামনে ধূপধুনো দিচ্ছেন৷ রীনা ঘর থেকে বেরিয়ে নির্লিপ্তভাবে চলে এল নিজের ঘরে৷ তারপরই বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো৷

শিপ্রা আর একবার জ্ঞান ফিরে পেয়ে বললো, আমি গানের স্কুলে যাব!

মা ঠাকুরের ছবির সামনে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিলেন, মুখ ফিরিয়ে বেশ দৃঢ়স্বরে বললেন, না, আজ আর বাইরে বেরুতে হবে না৷

দেবনাথও বললো, একদিন গান শিখতে না গেলে কি হয়?

শিপ্রা আবার শুয়ে চোখ বুজলো৷ এবার আর সে অজ্ঞান হয় নি, এমনিই চোখ বুজে রইলো৷

আর ওদিকে শিপ্রার গানের ইস্কুলের উল্টোদিকে বকুল গাছটার তলায় অনবরত পায়চারি করতে লাগলো রমেন৷ অনবরত ঘড়ি দেখছে আর তাকাচ্ছে বাস-স্টপের দিকে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চোখ আর ঘাড় ব্যথা হয়ে এল৷

পাড়ার লাইব্রেরিতে ‘গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র’ এই বিষয়ে বিতর্ক ছিল, দীপু সেখানে জোরালো গলায় সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের সমর্থনে একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললো৷ বাড়ি ফিরলো সাড়ে ন’টার সময়৷ সমস্ত বাড়িটা তখন থমথমে—যদিও সব ক’টা আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে৷

শিপ্রা ঘুমিয়ে পড়েছে তখন৷ খানিকটা গরম দুধ খাইয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে, এ ছাড়া আর কিছু খেতে চায় নি৷ সব শুনে দীপু গম্ভীর হয়ে গেল৷ বললো, ভূতটুত সব বাজে কথা৷ বাড়িতে মানুষের হাড় পাওয়া গেছে তো, তাই এখন অনেকে অনেক কিছু ভাবে৷ কিন্তু বাড়িটার একটা কিছু রহস্য আছে, আজ বাড়িতে ঢোকার সময়ও কি রকম গা-ছমছম করলো৷

বারান্দায় খাবার দেওয়া হয়েছে৷ দু’ভাই আর রীনা খেতে বসেছে—মা একটা চেয়ার টেনে এমনিই বসে আছেন দূরে৷ শোবার ঘরের দরজা খোলা, বিছানার ওপর শুয়ে থাকা শিপ্রাকে স্পষ্ট দেখা যায়, মা চোখ রেখেছেন সেদিকে৷ মা বললেন, তোরা তো বিশ্বাস করিস না এসব৷ আমার বিয়ের পর, তোদের এক সম্পর্কের কাকা—তোর বাবার পিসতুতো ভাই, ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠেছিল—বাবা বাবা, আমি যাচ্ছি! আমি যাচ্ছি! তারপর সারাক্ষণ চেঁচাতে লাগলো ঐ কথা বলে, এমনভাবে সামনে চেয়েছিল যেন ঠিক কারুকে দেখতে পাচ্ছে! কত ডাক্তার ডাকা হল৷ তখনকার দিনের বিখ্যাত কবিরাজ গণনাথ সেনকেও ডাকা হয়েছিল—কিন্তু তিন দিনের দিন তোদের সেই কাকা মারা গেল৷

দেবনাথ বললো, তুমি চুপ করো তো! যতসব বাজে বাজে গল্প বলে আরো ভয় ধরিয়ে দেওয়া!

রীনা মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, কার ভয় ধরবে? তোমার?

দেবনাথ বললো, তুমিই তো ভয় পাবে! রাত্তিরে বাথরুমে যাবার সময় আমাকেই ডাকবে৷

—কোনোদিন ডেকেছি?

—দেখব আজ কি হয়!

—রীনা মুখের হাসিটি অম্লান রেখেই বললো, আমার ভূতের গল্প শুনতে ভালো লাগে৷ কিন্তু ভূতের ভয় করে না৷

—দেখা যাবে!

দীপু বললো, অনেকে অনেক রকম ভুল দেখে—কিন্তু শিপ্রা মাকে ভুল দেখলো কি করে? ভূতের গল্পেও তো কখনো ভূতেরা জ্যান্ত মানুষের চেহারা ধরে আসে না?

দেবনাথ বললো, এও এক ধরনের অটো সাজেসশান৷ শিপ্রা হয়তো কোনো কারণে মা-কে ভয় পাচ্ছে—

দেবনাথ আর যেটুকু বলতে চাইলো, তা হচ্ছে এই যে, শিপ্রা হয়তো মা’র কাছে এমন কিছু গোপন করে আছে—যা ধরা পড়ে গেলে মা ভয়ঙ্কর রাগ করবেন—কিন্তু ছোট ভাইয়ের সামনে এ কথা আর বললো না৷

খাওয়া শেষ হবার পর সবেমাত্র হাত ধুয়েছে ওরা, এমন সময় মাথার ওপর গুমগুম শব্দ হল৷

দীপু গম্ভীর গলায় বললো, মেঘ ডাকছে৷ রাত্তিরে নিশ্চয়ই দারুণ বৃষ্টি হবে৷

মা আর্তগলায় বললো, মেঘ কোথায়? এ তো ছাদে শব্দ হচ্ছে! ও দেবু, ও দীপু—

আর একবার শব্দ হল, যেন ছাদের ওপর দিয়ে কেউ একটা লোহার বল গড়িয়ে দিচ্ছে৷

মা আবার চিৎকার করতে যেতেই দেবনাথ বললো, দাঁড়াও, আগে থেকেই অত ব্যস্ত হয়ো না৷ ভালো করে শুনতে দাও৷

রীনা বারান্দায় গিয়ে ওপরের দিকে উঁকি মেরে বললো, আকাশে একটুও মেঘ নেই৷

দীপু বললো, গরমের দিনে ছাদে এরকম শব্দ হয়৷ দিনের বেলা প্রচণ্ড উত্তাপে সবকিছুই একটু বেড়ে যায়, রাত্তিরে ঠাণ্ডা পেয়ে যখন আবার কমতে শুরু করে তখন ঐ রকম শব্দ হয়৷

—আগে আর তো কখনো শুনি নি?

—শুনেছ নিশ্চয়ই, তখন গ্রাহ্য করো নি৷ ঠিক আছে আমি দেখে আসছি৷

দীপু সিঁড়িতে উঠতে যেতেই মা বললেন, না, তুই একা যাবি না৷ খর্বদার দীপু বারণ করছি—

রীনা দেবনাথকে বললো, তুমিও যাও না! চলো আমিও যাচ্ছি…

দেবনাথ বললো, তুমি নিচে থাকো মায়ের কাছে৷ আমি যাচ্ছি৷

দীপুই আগে উঠে এল৷ তিনতলায় তার একখানা ঘর, বাকিটা ছাদ৷ আবছা জ্যোৎস্নায় পুরো ছাদটা ফাঁকা পড়ে আছে৷ নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার ঘর খোলা, দরজার কাছে শাড়ি পরা একটি আবছা নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে৷

এক মুহূর্তের জন্য দীপুর সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল৷ চিৎকার করতে গিয়েও মুখ চাপা দিল, অস্ফুটভাবে জিজ্ঞেস করলো, কে?

নারীমূর্তি একবার যেন নড়ে উঠল, কোনো সাড়া দিল না৷ দীপু স্থিরদৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে দু’পা এগিয়ে যেতেই তার সমস্ত শরীরটা আবার হাল্কা হয়ে গিয়ে কুলকুল করে ঘাম বইলো৷

দূর ছাই, কেউ না! দরজার পর্দাটা হাওয়ায় উড়ে ঐ রকম দেখতে হয়েছিল৷ ঠিক যেন টাইটভাবে শাড়ি পরে একটি মেয়ে, নবনীতার মতন৷ ইস, এইরকম ভাবেই মানুষ ভয় পায়৷ তার নিজের পর্যন্ত এই রকম ভুল হয়েছিল৷ অবিকল মনে হয়েছিল নবনীতার মতন—এমন কি অসম্ভব হলেও তার একবার মনে হয়েছিল, নবনীতা৷ তাই বুঝি কোনো রকমে এসে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে…

পেছন থেকে দেবনাথ বললো, কিরে?

দীপু আলগাভাবে হেসে বললো, কই কিছু না!

দু’ভাই সারা ছাদটা ঘুরে দেখলো৷ এমন কি জলের ট্যাঙ্কের পাশে উঁকি দিতেও ছাড়লো না—যদি ভূত ওদের ভয়ে লুকিয়ে থাকে! কোথাও কিছু নেই৷ ট্যাঙ্কের পাশে কয়েকটা ফুলের টব, একটা খালি টব কাত হয়ে পড়ে আছে৷ সেটা গড়াবার জন্যই কি শব্দ? কিন্তু তাহলে সারা ছাদ জুড়ে শব্দ হবে কেন? ওসব কিছু নয়!

রীনা আর মা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে, কিন্তু দু’জনেই নিঃশব্দ৷

বছরখানেক ধরে দু’জনে পরস্পর কথা বলে না৷ অন্যদের সামনে অবশ্য সেটা বুঝতে দেয় না৷ রীনা প্রয়োজনীয় দু’একটা কথা বলে মা’র সঙ্গে, কিন্তু একা থাকলে কোনো কথা নেই৷

দু’ভাই নেমে এল একসঙ্গে৷ রীনা দীপুর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, কিছু দেখতে পেলে?

দীপুও হেসে উত্তর দিল, না বউদি, ভূতেরা দারুণ কাওয়ার্ড! কিছুতেই সামনাসামনি আসে না৷ অন্তত আমার সামনে কখনো আসে নি৷

মা আজ তিনতলায় দীপুকে কিছুতেই একা শুতে দেবেন না৷ দীপু শোবেই৷ দোতলায় আর একটা মাত্র ঘর আছে, সেটা মাল-পত্রে ঠাসা, তা ছাড়া সে ঘরটার মাত্র একদিকে জানলা বলে ভালো হাওয়া খেলে না৷ দীপুর একা ঘরে শোওয়া অভ্যেস, মা আর শিপ্রার সঙ্গে এক ঘরে সে কিছুতেই শোবে না৷

দেবনাথ বললো, শুক না ওপরে৷ এতদিন ধরে শুচ্ছে কিছু হয় নি—ওরকম বেশি বেশি করলে ভয় আরো পেয়ে বসবে তোমাদের৷

মা শেষ পর্যন্ত কান্নাকাটি শুরু করলেন, দীপু তবুও শুনলো না৷ এ বংশের ছেলেরা বড় গোঁয়ার!

দীপু বললে, কাঞ্চা তো সঙ্গেই আছে—তা হলে আর একা শোওয়া হল কোথা?

কাঞ্চা আর কুকুরটাকে নিয়ে দীপু ওপরে উঠে গেল৷

দেবনাথ নিজের ঘরে ঢোকার আগে মাকে বললো, ভালো করে দরজা জানলা বন্ধ করে শুয়ো৷ ভয়ের কিছু নেই৷ যদি কোনো কিছু হয়—আমাকে ডেকো কিন্তু৷

রীনা তখন বাথরুমে৷ তার চাপাগলায় গান পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে৷ ওই বাথরুমেই শিপ্রা আজ ভয় পেয়েছিল—রীনার সেসব ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত নেই৷ শোয়ার আগে গা না ধুলে তার চলে না৷

পাতলা নাইটি পরে বাথরুম থেকে বেরুলো রীনা, একবার নিচের উঠোনের অন্ধকারের দিকে, একবার ছাদের দিকে চেয়ে কিছুই দেখতে পেল না, ঘরে এসে ঢুকলো৷

দেবনাথ একটা বই বুকে নিয়ে সিগারেট টানছে শুয়ে শুয়ে৷ দুপুরে অনেক ঘুমিয়েছে৷ এখন সহজে ঘুম আসবে না৷ এক সপ্তাহ অন্তর নাইট ডিউটি থাকে বলে যে-কটা রাত্রে সে বাড়িতে ঘুমোয় সেই কটা রাতই তার ইচ্ছে করে রীনার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করতে৷ অন্যদিন রীনা দুপুরে অফিস যায়, সন্ধের পর যখন ফেরে তার একটু বাদেই দেবনাথকে অফিস চলে যেতে হয়৷ বউয়ের সঙ্গে কথাই হয় না প্রায়৷

দেবনাথ আড়চোখে দেখছে রীনার পাউডার ও ক্রিম মাখা৷ প্রত্যেকদিন সে প্রায় একই রকম ভাবে প্রসাধন করে, দেবনাথ বাড়িতে থাক বা না থাক৷ তার শেষ হয়ে গেলে সে দেবনাথকে জিজ্ঞেস করলো, আলো নেভাব, না তুমি পড়বে?

দেবনাথ বললো, আর পড়ব না, কিন্তু আলোটা থাক৷

মস্তবড় খাট, অঢেল জায়গা, রীনা এসে একটু দূরে শুতেই দেবনাথ হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁলো৷ ঘাড়ের তলায় হাত ঢুকিয়ে টেনে আনলো তাকে কাছে৷ বুকের ওপর আলতোভাবে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে আজ একটু গম্ভীর দেখছি কেন?

—কই গম্ভীর না তো! তোমার ঘুম পায় নি?

—না৷

দেবনাথের ইচ্ছে হল, রীনার ঠোঁটে একটা চুমু খায়৷ কিন্তু অনেকখানি ক্রিমে ঠোঁট দুটো চটচটে হয়ে আছে৷ রীনার বুকে সামান্য চাপ দিয়ে বললো, বাথরুমে এতক্ষণ ছিলে, তোমার ভয় করে নি?

—ভয় আবার কি?

—সব মেয়েরাই তো একটু একটু ভূতের ভয় পায়!

—আমি পাই না৷ আমি সারা জীবন মানুষকেই এত ভয় পেয়েছি—আজও একটা লোক—

—আজ আবার কি হল?

—আজ অফিসের গেটের কাছে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল—আমি যেখানেই যাই—আমার পেছনে পেছনে আসতে লাগলো৷

—অফিস থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?

—কোথায় আবার যাব! বাস-স্টপে এলাম—সেখানেও লোকটা, পর পর ক’টা বাস ছেড়ে দিলাম, তবু দাঁড়িয়ে রইলো৷

—লোকটাকে আগে কখনো দেখেছো?

—না৷ আমার এমন ভয় করছিল—

—ওরকম বাজে লোক অনেক ঘোরে এসপ্ল্যানেড পাড়ায়৷

—বিয়ের আগে তুমিও আমার পেছন পেছন আসতে৷

দেবনাথ হেসে বললো, আমিও তাহলে বাজে লোক! তুমি আমাকেও ভয় করো!

রীনা বললো, আমার দুর্ভাগ্য কিনা বলতে পারি না—অনেক ছেলেবেলা থেকেই আমার পেছনে পেছনে এ রকম একটা না একটা লোক ঘুরছে৷ তার মধ্যে তোমাকেই আমি শুধু বিয়ে করেছি৷

—আমাকে বিয়ে করাটাও বুঝি দুর্ভাগ্য?

—তাই বললাম নাকি? বললাম, তাদের মধ্যে শুধু তোমাকেই ভালো লেগেছিল বলে তোমাকে বিয়ে করেছি৷

—লেগেছিল? এখন আর লাগে না?

—তুমি সাংবাদিক হলে কেন? উকিল হলেই পারতে?

দেবনাথ আবার হেসে রীনাকে আর একটু কাছে টেনে আনলো৷ রীনা বাধা দিল না, নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলো না৷

দেবনাথ বললো, বাড়িতে যা শুরু হয়েছে, বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়াই ভালো মনে হচ্ছে৷

—বাঃ, ভূতের ভয়ে বাড়ি বিক্রি করে দেবে কেন? তাহলে তো আমার অফিসের গেটে লোক দাঁড়িয়ে থাকে বলে আমাকেও অফিস ছেড়ে দিতে হয়!

—কিন্তু খুকু ওরকম ভয় পেল কেন?

—এবার খুকুর বিয়ে দিয়ে দাও৷ ওর যে আর লেখাপড়া হবে না, তা তো বুঝতেই পারছো!

—কার সঙ্গে? ঐ রমেনের সঙ্গে? জুতিয়ে ওর মুখ ভেঙে দেব একদিন৷ রাস্কেল একটা—কাজ নেই, কর্ম নেই, শুধু মেয়েদের পেছন পেছন ঘোরা!

—মেয়েদের নয়, আমি যদ্দূর জানি, শুধু শিপ্রার পেছন পেছনই ঘোরে৷

—তাই বা ঘুরবে কেন? এখনো কোনো চাকরি-বাকরি জোটাতে পারে নি৷ বরং চাকরির জন্য ঘুরলে কাজ দিত৷

—তুমি যখন আমাকে ফলো করতে, তখন তোমারও কোনো চাকরি ছিল না৷

দেবনাথ এবার রীতিমতো চটে উঠল৷ স্ত্রীর শরীর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বললো, রীনা, তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি করছ! তুমি আমার সঙ্গে তুলনা করছ ঐ লোফারটার?

রীনা এবার নিজে থেকে হাত রাখলো দেবনাথের গায়ে৷ ঠোঁট থেকে ক্রিম মুছে একটা চুমু দিল দেবনাথের কপালে৷ কোমল গলায় বললো, তুমি রাগ করছ? আমি কিন্তু তোমাকে আঘাত দেবার জন্য কিছু বলি নি৷ আমি বলছিলাম, আমরা নিজেরা যখন কারুকে ভালোবাসি—তখন নিজেদের পক্ষে অনেকরকম যুক্তি তৈরি করি—কিন্তু অন্যদের বেলায় তা সইতে পারি না৷ শিপ্রা যখন রমেনকে ভালোবাসে—

—মোটেই না৷ ও এমনি চোখের ভালোবাসা৷ আমি কিছুতেই ঐ রাস্কেলটার সঙ্গে খুকুর বিয়ে দেব না৷

—ঠিক আছে, মাথা গরম করো না, এখন ঘুমোও!

—আমার ঘুম পায় নি৷ তুমি ঘুমোও!

—তুমি এখনো রাগ করে আছো তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না?

—ভালোবাসা? হুঁ! তুমি কত ভালোবাসো, তা তো জানা আছে!

রীনা একটা বড় রকমের নিঃশ্বাস ফেললো৷ দেবনাথের একেবারে বুকের কাছ ঘেঁষে এল, মিশে গেল দু’জনের বুক৷ জোর করে দেবনাথের মাথাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফিসফিস করে বললো, বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে দারুণ ভালোবাসি৷ প্রাণের মতন ভালোবাসি৷ এর মধ্যে একটুও মিথ্যে নেই৷ আমার যখন মন খারাপ হয়, আমার যখন একঘেয়ে লাগে—তখন আমি একথা খুব ভালো করে ভেবে দেখেছি! তোমাকে ভালো না বাসলে আমি অনেক কিছুর কারণ খুঁজে পেতাম৷ তুমি যে এত ভালো, তোমাকে ভালো না বেসে উপায় কি?

রীনার কথায় অত্যন্ত আন্তরিকতার স্পর্শ ছিল৷ দেবনাথ খানিকটা অভিভূত হয়ে পড়লো৷ আবিষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলো, সত্যি বলছো?

—এর থেকে সত্যি কথা আর কখনো বলি নি৷

চুমুতে চুমুতে দেবনাথের মুখ আচ্ছন্ন করে দিল রীনা৷ দেবনাথ ফের রীনার বুকের ওপর এক হাত রেখে অন্য হাতে নাইটিটা গা থেকে সরাতে গেল৷ রীনা সেটা চেপে ধরে বললো, আজ নয়, লক্ষ্মীটি, আজ আমার শরীর খারাপ৷

দেবনাথ বললো, ঠিক আছে, তা হলে আলো নিভিয়ে দাও৷

গরমের জন্য দরজা খুলে শুয়ে আছে দীপু৷ কাঞ্চা মেঝেতে শুয়ে ফিসফিস করে নাক ডাকছে আস্তে আস্তে৷ কুকুরটা শুয়ে আছে সিঁড়ির ওপর৷ সামান্য একটু তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ কুকুরটা দু’বার ডেকে উঠতেই দীপু ধড়মড় করে উঠে বসলো৷ কুকুরটা ছাদের ওপর কাকে যেন তাড়া করে গেল৷ দীপু তৈরি হয়েই ছিল, সঙ্গে সঙ্গে খাটের পাশ থেকে টর্চটা নিয়েই বাইরে বেরিয়ে এল৷ ছাদে কেউ নেই, কুকুরটা তবু কাকে যেন তাড়া করে ছুটছে!

তবে কি সত্যিই অশরীরী কিছু? কুকুররা কি অশরীরীদেরও দেখতে পায়?

আবছা জ্যোৎস্না উঠেছে, চতুর্দিকে নির্জন, মনে হয় গোটা শহরটাই এখন ঘুমন্ত৷ দীপুর হঠাৎ মনে হল, এখানে সে বড্ড একা! অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার গা ছমছম করছে৷ একবার ভাবলো কাঞ্চাকে ডাকবে কিনা৷ কুকুরটা তখনো কি একটা অদৃশ্য জিনিসকে তাড়া করছে সারা ছাদময়, মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে কুঁই-কুঁই৷ দীপু দু’বার ডাকলো, লিজি, লিজি! শোন এদিকে! কুকুরটা তার ডাকে পাত্তাই দিল না৷

টর্চের আলোটা আবার ভালো করে ফেলতেই দীপু দেখতে পেল, একটা ধেড়ে ইঁদুর৷ কুকুরটা ইঁদুরটাকেই তাড়া করছে৷ এতক্ষণ দীপু আলোছায়ার মধ্যে ওটাকে দেখতে পায় নি৷ দীপু হাসবে না কাঁদবে, বুঝতে পারলো না৷ ছি ছি ছি! সম্পূর্ণ অবিশ্বাস সত্ত্বেও সেও তো একটু একটু ভয় পেয়েছিল৷ নির্জন রাত্তিরে সামান্য কোনো কারণেই বিশ্বাস চলে যায়৷

দীপু আবার নিজের খাটে ফিরে এলো৷ কিন্তু ঘুম আর এলো না৷ ভয় ভাঙাবার জন্য দীপু তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে৷ তাকিয়ে তাকিয়ে তার চোখ ব্যথা হয়ে গেল, কিছুই দেখতে পেল না, শুধুই জ্যোৎস্না পড়ে আছে ম্লানভাবে৷

দরজার নীল পর্দাটা উড়ছে হাওয়ায়৷ সেটার দিকেও তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ৷ এই পর্দাটাকেই কিছুক্ষণ আগে তার নবনীতা বলে মনে হচ্ছিল৷ কিন্তু নবনীতাকে দেখলে তার ভয় পাবার কি আছে? নবনীতা তো জলজ্যান্তভাবেই বেঁচে আছে৷

খাট থেকে উঠে দীপু একটা সিগারেট ধরালো৷ আপন মনেই সামান্য হাসলো৷ নবনীতাকে আর একবার দেখা গেলে মন্দ হত না৷ এমনিতে তো আর নবনীতার সঙ্গে দেখা হয় না, তবু যদি দৃষ্টিবিভ্রমে দেখা যেত৷

সপ্তাহ দু’এক আগে নবনীতার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়েছিল, তখন দীপু মুখ ফিরিয়ে চলে গিয়েছিল৷ নবনীতাকে দেখে তার গা জ্বলে গিয়েছিল৷ মেয়েদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই৷ এই নবনীতাই একদিন তাকে বলেছিল, অরুণাংশুকে দেখলে তার গা জ্বলে যায়৷ গায়ে-পড়া ন্যাকা ছেলে, নেহাত বাবার টাকা আছে আর একটা পুরোনো আমলের অস্টিন গাড়ি আছে, তাই নিয়ে খুব চাল মেরে বেড়ায়৷ পাক্কা ক্যাপিটালিস্টের বাচ্চা৷

অথচ সেই নবনীতাকেই দীপু দেখেছে অরুণাংশুর গাড়িতে চেপে রেড রোড দিয়ে যাচ্ছে৷ দীপু তখন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের মিটিং-এ যাচ্ছিল৷ গাড়িতে ওরা দু’জন ছাড়া আর কেউ ছিল না, নবনীতা বসেছিল সামনের সিটে, কি একটা হাসির কথায় সে আর অরুণাংশু হেসে কুটি কুটি হচ্ছিল৷ কে জানে অরুণাংশুর একটা হাত নবনীতার ঊরুতে রাখা ছিল কিনা! কিছু বিশ্বাস নেই! নবনীতা যখন অমনভাবে হাসতে পারে—

সেদিন ভূত দেখার মতোই চমকে গিয়েছিল দীপু৷ যতদূর দেখা যায় সেই গাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল৷ তারপর অসম্ভব ক্রোধে তার শরীর একেবারে জ্বলে গিয়েছিল৷ সেদিন মিটিং-এ একটা কথাও তার কানে ঢোকে নি৷ প্রথমে সে ভেবেছিল, দু’তিনজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে অরুণাংশুকে বেদম ধোলাই দেবে৷ অবশ্য অরুণাংশুকে মারতে হলে বন্ধুদের সাহায্যের দরকার নেই, সে একাই যথেষ্ট৷ কিন্তু খানিকটা বাদে তার আবার মনে হয়েছিল, এক্ষেত্রে অরুণাংশুর কি আর দোষ! যে বড়লোকের বখাটে ছেলে, সে তো নবনীতার মতন সুন্দরী মেয়ের পেছনে ছোঁক ছোঁক করবেই! নবনীতা তার কাছে মিথ্যে কথা বললো কেন? নবনীতা কেন তাকে এরকম কথা বলে আবার অরুণাংশুর গাড়িতে চাপলো? অত হাসিই বা কিসের?

দীপু সেদিন ঠিক করেছিল, শুধু নবনীতা নয়, পৃথিবীর আর কোনো মেয়ের সঙ্গেই সে সম্পর্ক রাখবে না৷ মেয়েরা সবাই এরকম৷ মেয়েদের সঙ্গে প্রেম-ফ্রেম করাই এক ঝামেলা৷ একগাদা সময় নষ্ট, কত রকম ন্যাকামি যে সইতে হয়—তার ওপর যদি এরকম অবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়—

আজ ছাদে উঠে প্রথমবার নীল পর্দাটা দেখে তার বুকটা ধক করে উঠেছিল৷ ঠিক মনে হয়েছিল নবনীতা দাঁড়িয়ে আছে৷ তার দাঁড়াবার ভঙ্গির মধ্যেই একটা নম্র সলজ্জ ভাব৷ যেন নবনীতা তার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে৷ দূর! তাও কি হয় নাকি? নবনীতা এ বাড়িতে আসেই নি কোনোদিন৷ তিনতলায় সোজা উঠে আসা তো অসম্ভব কথা৷ একদিন শুধু গলির মোড় থেকে নবনীতাকে তাদের বাড়িটা দেখিয়েছিল দীপু৷

কিন্তু পর্দাটাকে নবনীতা বলে মনে হল কেন তার! সে তো ক’দ্দিন ধরেই নবনীতার কথা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছিল!

সিগারেটের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দীপু চিত হয়ে শুয়ে রইল৷ হঠাৎ তার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল৷ এ ক’দিন ধরে তার মন জুড়ে ছিল শুধু রাগ৷ এখন আর রাগ হচ্ছে না পৃথিবীর কারুর ওপর, শুধু অভিমান৷ পৃথিবীর কেউ তার কথা ভাবে না! নীল পর্দাটার দিকে আর একবার তাকিয়ে দীপু একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো৷

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো শিপ্রা৷ মুখে হাত দিয়ে সামলাবার চেষ্টা করলো, পারলো না৷ সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে একবার ছুটে গেল দরজার দিকে, দরজার ছিটকিনিতে হাত দিয়েও তার ভয় করলো৷ ফিরে এল জানলার নিচে নর্দমার কাছে৷ হুড়মুড় করে বমি করতে লাগল৷

একটু আধটু বমি নয়, একেবারে পেট খালি করা৷ রাত্তিরে কিছুই খায় নি, দিনের বেলার ভাত তরকারি পর্যন্ত উঠে এল বমির সঙ্গে৷

বেশ কিছুক্ষণ ধরে বমি করলো শিপ্রা৷ মাথাটা ঝিমঝিম করছে, চোখে অন্ধকার দেখছে, মা-কে ডাকতেও সাহস হল না৷ কোনো রকমে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো৷ খুট করে আলো জ্বেলে দেখলো, বেডসাইড টেবিলে এক জগ জল ঢাকা দেওয়া রয়েছে৷ জলটা আনতে গিয়ে তার পা টলে গেল, তাড়াতাড়ি সামলে নিল খাটের পায়া ধরে৷ শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছে এইটুকু সময়ের মধ্যেই৷

শিপ্রা আস্তে আস্তে আবার উঠে দাঁড়িয়ে কোনো রকমে জলের জগটা নিয়ে ফিরে এল নর্দমার কাছে৷ ভালো করে চোখ মুখ ধুলো৷ মা যাতে বুঝতে না পারে, সেই জন্যই জল ঢেলে বমি ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করলো মেঝে থেকে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলো না, বার বার তার চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে, মাথা ঘুরে যাচ্ছে৷ এখন শুয়ে পড়া ছাড়া উপায় নেই৷

খাটের কাছে ফিরে এসে শরীরটাকে হিঁচড়ে বিছানায় তুললো৷ মা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন, মায়ের মুখে একটা বিষণ্ণতার ছায়া৷ অবিকল এই রকম বিষণ্ণ মুখই সে দেখেছিল সন্ধ্যেবেলা বাথরুমের দরজার কাছে৷

ইস, আলো নেভানো হয় নি! আবার নামতে হবে? কিন্তু শরীর আর বইছে না৷ এর মধ্যেই গলা শুকিয়ে আবার তেষ্টা পেয়েছে, পেটের মধ্যে গুলোচ্ছে, কোমরের কাছটায় আর পিঠে অসহ্য ব্যথা৷ আলো জ্বালা থাকা সত্ত্বেও চোখের সামনে সব কিছু এক একবার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে৷

শিপ্রার দারুণ ভয় হল, সে ভাবলো, মানুষ মরে যাবার আগে কি এরকম হয়? আমি কি মরে যাচ্ছি? আমার মরণই ভালো৷ আমি আগেই আত্মহত্যা করলুম না কেন?

কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার বেঁচে থাকার দারুণ ইচ্ছে হল৷ একবার হাত বাড়িয়ে মাকে ডাকতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল৷ সারদিনে মায়ের অনেক খাটুনি যায়—এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন, এখন ডাকা উচিত হবে না৷ শিপ্রা বিছানায় উপুড় হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো৷

এক সময় কান্না থেমে গেল তার৷ একটা কথা মনে পড়ল, একতলার ঘরের মেঝে খুঁড়ে যে মেয়েটার কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল, সে কি আত্মহত্যা করেছিল? তার অবস্থাও কি শিপ্রার মতন হয়েছিল? সে কি এখন শিপ্রাকে টানছে? কাল থেকেই তার আত্মহত্যার কথা মনে হচ্ছে!

কি একটা আওয়াজে শিপ্রা উৎকর্ণ হয়ে উঠল, চোখ মুছে ভালো করে শোনার চেষ্টা করলো৷ এবার স্পষ্ট শুনতে পেল, সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে কে যেন নামছে৷ দরজা বন্ধ, বাইরের সামান্য পায়ের আওয়াজ শিপ্রার শুনতে পাবার কথা নয়, কিন্তু চারদিক এত উৎকট নিস্তব্ধ যে পিঁপড়ের চলার আওয়াজও যেন শুনতে পাওয়া যাবে৷

শব্দটা ক্রমশ জোর হচ্ছে৷ এবার আর কোনো ভুল নেই৷ ঘড়িতে আড়াইটে বাজে, এখন কে নামবে সিঁড়ি দিয়ে! শিপ্রা সোজা হয়ে বসলো৷ পায়ের শব্দটা এ ঘরের দিকেই আসছে, খুব কাছে৷

শিপ্রা আর থাকতে পারলো না, দু’হাতে মাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো, মা মা, শিগগির—

মা ধড়ফড় করে উঠে বসলেন৷

ঐ যে শোনো পায়ের শব্দ! শিপ্রার চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটো ড্যাবডেবে, আঁচল খসে পড়েছে৷

মায়ের ঘুমোর ঘোর ভালো করে ভাঙে নি৷ তিনি বললেন, কোথায় শব্দ? কিছু না তো! তুই ঘুমো!

—ঐ যে, ঐ যে—শোনো৷

—কই শুনতে পাচ্ছি না তো! আলো কে জ্বাললো?

—মা, এসে পড়েছে!

সঙ্গে সঙ্গে দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা পড়লো৷ মা আর শিপ্রা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন৷ শিপ্রার গলা দিয়ে চিৎকারও বেরুচ্ছে না, একটা অদ্ভুত চাপা ভয়ের বিকৃত আওয়াজ বেরুচ্ছে৷

মা-ই একটু সামলে নিলেন৷ কাঁপা গলায় বললেন, কে? কে?

—দরজা খোলো, আমি দীপু!

শিপ্রা আর্তনাদ করে উঠল, না মা, দরজা খুলো না—খুলো না! ছোড়দা নয়, এবার ছোড়দার রূপ ধরে এসেছে!

—দরজা খোলো না!

—মা খুলো না—খুলো না!

মা খাট থেকে নেমে দরজার কাছে এসেছেন, দরজা খুললেন না৷ হাতজোড় করে বললেন, তুমি কে বাবা, সত্যি করে বলো! আমরা তো কোনো দোষ করি নি!

—বলছি তো আমি দীপু!

—এত রাত্তিরে কি চাস?

—শিপ্রার ঘাড় মটকাব?

মা দরজা খুলে দিলেন৷ দীপুর চেহারা দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, চুলগুলো কপালের ওপর ছড়ানো, চোখ দুটো জ্বলছে৷ ভয়ঙ্কর বিকৃত গলায় সে বললো, শিপ্রাকে চাই, শিপ্রার ঘাড় মটকাব৷

মা আর শিপ্রা দু’জনেই অজ্ঞান হয়ে যাবার ঠিক আগেই দীপু হা-হা করে হেসে উঠল৷ হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিল কপাল থেকে৷ বললো, কি, ভয়ে একেবারে মরছিলে তো?

মা ভয়ঙ্কর রাগ করে বললেন, দ্যাখ দীপু, সব ব্যাপারেই ছেলেমানুষী, না? জানিস, অনেকে এতে হার্টফেল করে?

দীপুর হাসি তবু থামে না৷

মা সেই রকম ক্রুদ্ধভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, এত রাত্তিরে কি চাই তোর?

—জলতেষ্টা পেয়েছে৷ আমার ঘরে জল রাখো নি কেন?

—এত রাত হয়েছে যখন, সকালবেলা জল খেলে চলত না?

—দেখলাম তোমাদের ঘরে আলো জ্বলছে৷ জল না পেলে আমার ঘুম আসবে না৷

জলের জগটা আনতে গিয়ে মায়ের চোখে পড়লো, মেঝের ওপর ছড়ানো বমি৷ অস্ফুটভাবে বললেন, একি! আর কিছু বললেন না৷ দীপুকে এক গেলাস জল গড়িয়ে এনে দিলেন৷

দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে শিপ্রা৷ দীপু চলে যাবার পরও সে সেই রকম ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো৷ তখনো তার ঘোর কাটে নি৷ মা দরজা বন্ধ করে শিপ্রার দিকে ফিরলেন৷

শিপ্রা শুধু বললো, মা! আর কিছু বলতে পারলো না৷ আবার মা’র মুখে গাঢ় অন্ধকার ছায়া৷ শিপ্রার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কি হয়েছে? এত বমি করেছিস কেন? কি হয়েছে আমাকে বল তো?

উঠে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছলো শিপ্রা৷ এবার অনেকখানি সুস্থ লাগলো তার৷ মুখ নিচু করে বললো, মা, আমি আর এবাড়িতে থাকতে পারব না!

—কেন? তুই একাই এত বেশি ভয় পাচ্ছিস কেন?

—আমার সব সময় ভয় করছে৷ আর পারছি না!

—তুই তাহলে কাল থেকে তোর ছোট মাসির বাড়িতে গিয়ে ক’দিন থেকে আয়!

—ছোট মাসির বাড়িতে গেলেও আমার সারবে না৷ মা, আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে!

—কেন রে? কেন? এই খুকু—

শিপ্রা প্রায় ছুটে এসে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো৷

ফুলে ফুলে উঠছে তার সুন্দর সুঠাম শরীরখানি৷ মা বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কি হয়েছে কি? আমাকে বল—

—মা, আমাকে রমেনকে বিয়ে করতে দাও!

—রমেন? আবার সেই রমেন? কেন, সে ছাড়া অন্য ছেলে নেই?

—ছোটদা রমেনকে অপমান করেছে৷ কিন্তু রমেনকে ছাড়া আমার চলবে না!

—কেন, রমেন কেন? রমেন কি এমন ছেলে? তোর ছোট মাসি যে ছেলেটির খবর এনেছে, সে তো চমৎকার পাত্র৷ চেহারাও সুন্দর৷ ইঞ্জিনিয়ার—ভালো চাকরি করছে৷

—মা, অন্য কারুর সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়৷

—কেন সম্ভব নয়?

—মা, আমি দারুণ ভুল করে ফেলেছি৷ তোমরা এখন যদি বেশি বাধা দাও, আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে৷

—কি করেছিস? কি করেছিস?

শিপ্রা কাঁদতে কাঁদতেই একেবারে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বললো৷ মায়ের মুখখানা সঙ্গে সঙ্গে রক্তহীন বিবর্ণ হয়ে গেল৷ খুব ক্লান্তভাবে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলেন শুধু, ঠিক জানিস?

—হ্যাঁ৷ তোমরা যদি চাও আমি আত্মহত্যা করলেই সব মিটে যায়, তাহলে সত্যিই আমি—

মা এবার ধমক দিয়ে বললেন, এখন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড় তো! আর শরীরটাকে খারাপ করতে হবে না৷

আলো নেভাবার পরও অবশ্য দু’জনের কারুরই ঘুম হল না৷ মা আর শিপ্রা কথা বলতে লাগলো রাত ভোর না হওয়া পর্যন্ত৷

পরদিন আসল পুরুত ডাকিয়ে খুব ধুমধাম করে শান্তিস্বস্ত্যয়ন হল৷ মা সেই পুরুতকেই বললেন খুব কাছাকাছি একটা বিয়ের তারিখ দেখতে৷ দেবনাথকেও সব খুলে বললেন না৷ মনে মনে ভয় ছিল, দেবনাথ হয়তো দপ করে জ্বলে উঠবে৷

দেবনাথ কিন্তু শান্তভাবেই সবটা শুনলো৷ মুখের একটা রেখাও বদলালো না৷ যেন ছোটগোছের কোনো ব্যাপারে সে আর রাগবে না প্রতিজ্ঞা করেছে৷

ধীরগলায় বললো, ঠিক আছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে যা পাই ধার নেব, তুমি বিয়ের তারিখ-টারিখ দ্যাখো৷

—কিন্তু রমেন যে কোনো চাকরি-টাকরি করে না!

—আমিই খুঁজব এখন চাকরি ওর জন্য—

—ওর বাবা-মা’র সঙ্গেও তো কথা বলতে হবে! তাঁদের মত আছে কিনা!

—সে দায়িত্ব রমেনের৷

রীনা আজও যথাসময়ে খেয়ে-দেয়ে অফিসে বেরিয়ে গেল৷ দীপুও বেরুবার জন্য উসখুস করছে, কিন্তু বাড়ির কাজ না চুকলে বেরুতে পারছে না৷ খাওয়া-দাওয়ার পরই বেরিয়ে পড়লো৷ দেবনাথ বেরুলো একটু বাদে৷ ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে একটু পড়তে যাবে৷ আর মা বিছানায় শুয়ে একটু চোখ বোজামাত্র চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লো শিপ্রা৷

ভবানীপুরে শিপ্রার কলেজের বন্ধু সুজাতা থাকে, মাস আষ্টেক আগে তার বিয়ে হয়েছে৷ দুপুরবেলা তার স্বামী বাড়িতে থাকে না, সেই সময় প্রায়ই শিপ্রা যায় তার সঙ্গে গল্প করতে৷ সুজাতাদের টেলিফোন আছে৷ সেখানে পৌঁছে শিপ্রা বললো, জানিস সুজাতা, আমার একটা দারুণ ভালো খবর আছে!

সুজাতা জিজ্ঞেস করলো, কি রে?

শিপ্রা বললো, দাঁড়া আগে ওকে ডাকি!

রমেনদের বাড়িতে ফোন নেই, কিন্তু পাশের বাড়িতে ফোন করলে ওদের ডেকে দেয়৷ সেই জন্যই প্রায় কোনো দুপুরেই রমেন বাড়ি থেকে বেরোয় না৷ শিপ্রার গলা শোনা মাত্র সে বললো, দাঁড়াও, এক্ষুনি আসছি৷ রমেন বেকার, অথচ ট্যাক্সি ভাড়া করে ছুটে এল সুজাতার ফ্ল্যাটে৷ প্রায় সুজাতার সামনেই শিপ্রাকে জড়িয়ে ধরে আর কি!

শিপ্রা বলো, জানো, কাল মরতে বসেছিলাম প্রায়৷ একতলার ঘরে ঐ কঙ্কালটা পাওয়ার পর থেকে আমাদের সারা বাড়িটা এমন হয়ে আছে! কাল সন্ধ্যেবেলা আমি যা দেখলাম, সবাই বলছে আমার চোখের ভুল!

—কি দেখলি রে? কি দেখলি? সুজাতা জিজ্ঞেস করলো৷

সবিস্তারে গল্পটা শোনালো শিপ্রা—এখন দিনের বেলা অবশ্য ব্যাপারটা সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হয়৷ তারপর বললো, ঐরকম ব্যাপার হল বলেই তো মাকে বলতে পারলুম! নাহলে কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারছিলুম না৷ মা-ও এত সহজে মেনে নিলেন!

রমেন বললো, মেনে না নিলেও কোনো ক্ষতি ছিল না, আমরা আগামী সপ্তাহে রেজিস্ট্রি করতুমই৷

শিপ্রা বললো, বাজে বকো না! মায়ের মত না পেলে আমার মনে কিছুতেই শান্তি আসত না৷

সুজাতা বললো, তা হলে তোদের ভূতটাকে তোর ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, বল! ওর জন্যই তো হল অনেকটা!

শিপ্রা একটু গম্ভীর হয়ে গেল৷ আস্তে আস্তে বললো, কালকে অজ্ঞান অবস্থায় আমি স্বপ্ন দেখেছিলুম, ঐ কঙ্কালটা একটা মেয়েরই কঙ্কাল ছিল—আমারই বয়েসী৷ ওরও আমার মতন অবস্থা হয়েছিল, তারপর আত্মহত্যা করে৷

—সবটা স্বপ্নে দেখলে?

—কি জানি, স্বপ্নে দেখলাম না কল্পনা করেছি! মোটমাট আমার বিশ্বাস, ও ছিল ঠিক আমার মতন৷ তখনকার দিনে তো আত্মহত্যা ছাড়া উপায় ছিল না, এখন কত উপায় আছে৷ আমি কিন্তু মরতে পারতুম না৷ মরতে আমার দারুণ ভয় করে৷

সুজাতার অলক্ষ্যে রমেন শিপ্রার একটা হাত ধরে একটু চাপ দিল৷ সুজাতা বললো, তা হলে রমেন, সবই যখন ঠিকঠাক হয়ে গেল, তোমার উচিত আমাকে অন্তত একদিন খাওয়ানো!

রমেন বললো, নিশ্চয়ই খাওয়াব৷

শিপ্রা বললো, আমার এত আনন্দ হচ্ছে না, যে কান্না পেয়ে যাচ্ছে৷

দীপু গিয়ে বসে রইলো ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিনে৷ দুটো আড়াইটের সময় সেখানে নবনীতা আসবেই৷

নবনীতা আর তিনটি মেয়ের সঙ্গে এসে ঢুকেই দীপুকে দেখতে পেল৷ দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চলে গেল অন্য টেবিলে৷ সেখানে গিয়ে আবার তাকাতেই দেখলো, দীপু তার দিকেই চেয়ে আছে৷ নবনীতা আবার চোখ সরিয়ে নিল৷ একটু বাদে আবার যেই তাকালো, আবার চোখাচোখি হল৷ দীপু এক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে৷

খানিকটা বাদে নবনীতা যখন খাওয়া শেষ করে বন্ধুদের নিয়ে উঠে পড়লো, দীপুও উঠে দাঁড়ালো৷ একেবারে নবনীতার পাশাপাশি বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে, একটাও কথা বললো না৷

নবনীতার বন্ধুরা ঢুকে পড়লো ক্লাসে৷ নবনীতা বললো, আমি আজ চলি রে৷ আমি এই ক্লাসটা কাটব—বাড়িতে আজ দিদি জামাইবাবু আসবে!

লম্বা করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছে নবনীতা, দীপু তার কাছাকাছি, কেউ কোনো কথা বলছে না৷ সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেটের বাইরে এসে ট্রাম স্টপে দাঁড়ালো নবনীতা, দীপু পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ নবনীতাকে কিছু বললো না দীপু, এমনিই স্বগতোক্তি করলো, এখন ট্রামে খুব ভিড়!

নবনীতাও দীপুর দিকে তাকালো না৷ সেও স্বগতোক্তি করলো, যতই ভিড় হোক আমাকে যেতে হবেই!

—না৷

—হ্যাঁ৷

—না৷

নবনীতা আর কথা বাড়ালো না৷ হাঁটতে লাগলো হ্যারিসন রোডের দিকে৷ সঙ্গে সঙ্গে দীপু৷ প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট পেরুবার পর দীপু আবার স্বগতোক্তি করলো, এতদিনে বুঝি একবারও খবর দেওয়া যেত না৷

নবনীতাও স্বগতোক্তি করলো সবাই আমাকে ভুল বুঝবে কেন?

—ভুল বোঝার সুযোগ দিলেই ভুল বুঝতে হয়৷

নবনীতা থমকে দাঁড়ালো৷ এবার সরাসরি তাকালো দীপুর দিকে, দীপু অপরাধীর মতন মুখ করে বললো, যাক, আর কিছু বলতে হবে না!

—তুমি—

—বলছি তো, আর কখনো ভুল বুঝব না৷

এবার দু’জনেই হেসে ফেললো উজ্জ্বল মুখে৷

একটু বাদে কফি হাউসের টেবিলে মুখোমুখি বসে নবনীতা জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের বাড়িতে নাকি মানুষের হাড় বেরিয়েছে?

—সে খবর রাখো দেখছি!

—আমি সব খবর রাখি৷ তুমি না রাখলে কি হয়!

—কে বলেছে তোমায়?

—তা নিয়ে তোমার দরকার কি? বাবাঃ, বাড়ির মেঝেতে কঙ্কাল! তারপরেও সে বাড়িতে মানুষ থাকে! আর কিছু হয় নি?

—হ্যাঁ, আমাদের বাড়িতে খুব ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে৷

—কি রকম? কি হয়েছে বলো না?

—একটা খুব মিষ্টি মেয়ে ভূত, সে কারুর কোনো ক্ষতি করে না, এক এক সময় এক এক জনের চেহারা ধরে আসে৷ সে-ই আমাকে তোমার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে৷

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানের ভেতরের রেস্টুর্যা ন্টে পাশাপাশি বসে আছে রীনা আর সুবিমল৷ দু’জনেই একটু চিন্তিত৷

সুবিমল জিজ্ঞেস করলো, কাল বলেছিলে?

—না৷

—আর কবে বলবে?

—হয়তো কোনোদিনই বলা হবে না৷ কাল ঐ কথা বলতে গিয়ে তার বদলে বলে ফেললাম, আমি ওকে ভালোবাসি৷

সুবিমল একটু মুচকি হেসে বললো, ও, তাই বুঝি?

রীনা ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দিল, হ্যাঁ, তাই বলেছি৷ মিথ্যে কথা বলি নি, সত্যিই আমি ওকে ভালোবাসি৷

—তাহলে সুবিমল বোসের তো বিদায় নেওয়াই উচিত!

—তাই নাও না৷ বাঁচি তাহলে৷

—বিদায় নিতে পারছি কই? এমনভাবে বেঁধে রেখেছ কেন?

—তুমি একটা জিনিস বুঝতে পারবে না, ও সত্যি খুব ভালোমানুষ!

—দেবনাথ যে ভালোমানুষ, তা তো আমিও জানি৷

—তাহলে এটা জানো না যে, কোনো সত্যিকারের ভালোমানুষকে কিছুতেই ঠকানো যায় না!

—ঠকাবার দরকারটা কি, আমি চলে যাচ্ছি!

—আজ চলে গিয়ে আবার কাল ফিরে আসবে?

—যদি বারণ করো, তাও আসব না৷ চিরদিনের মতন চলে যাব৷

—পারবে?

—পারতেই হবে৷ এরকমভাবে তো আর চলে না৷

—কিন্তু আমি যে পারব না! সুবিমল, তোমাকেও যে আমি সত্যিকারের ভালোবাসি!

—ছি, বিবাহিতা মহিলার পক্ষে দু’জন পুরুষকে ভালোবাসা মোটেই উচিত নয়৷

—সুবিমল তুমি আমাকে ঠাট্টা করছ?

—একটুও করছি না৷

—তাহলে আমি কি করব বলে দাও!

—ঝগড়াঝাঁটি না করে একদিন ঠাণ্ডা মাথায় দেবনাথকে সব খুলে বলো৷ বলো যে, তুমি ঝোঁকের মাথায়, আমার ওপর রাগ করে ওকে বিয়ে করেছিলে৷ কিন্তু তুমি যে ধরনের মেয়ে, যে ধরনের আবহাওয়ায় তুমি মানুষ, তাতে কিছুতেই তুমি ও-বাড়িতে খাপ খাওয়াতে পারছ না৷ সুতরাং মিউচুয়াল কনসেন্টে ডিভোর্স হওয়াই ভালো৷

—আমি পারব না, পারব না—কিছুতেই পারব না৷ ওর তো কোনো দোষ নেই! ওকে তো আমি বললেই ও আলাদা বাড়িতে উঠে যেতে পারে!

—তাহলে বাড়িটা নিয়েই যত গণ্ডগোল?

—সুবিমল, কেন তুমি বোম্বে থেকে আবার ফিরে এলে? বেশ তো চাকরিতে বদলি হয়ে বোম্বে চলে গিয়েছিলে—

—বেশ তো, আবার চলে যাচ্ছি না হয়?

—তুমি বুঝতে পারছ না, দেবনাথকে আঘাত দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব৷ ওর তো কোনো দোষ নেই, আমি নিজেই তো ওকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলাম, আমাকে তো কেউ জোর করে বিয়ে দেয় নি৷ আমি ওর জীবনটা এখন তছনছ করে দেব?

—বেশ তো, দিয়ো না৷ আমি বোম্বে ফিরে যাচ্ছি৷

—তুমি এখানে ফ্ল্যাট পেয়েছো?

—হ্যাঁ, কেন?

—আমার মাথার ঠিক নেই৷ আমার একবার মনে হচ্ছে, আমি দেবনাথের ওপর অন্যায় করতে পারব না, আবার মনে হচ্ছে—তোমার সঙ্গে তোমার ফ্ল্যাটেই চলে যাই৷ চলো, তাই যাই৷ তোমার চিন্তা-ভাবনা করে দরকার নেই৷

—বসো, বসো৷ অত হুড়োহুড়ি করে এসব হয় না৷ তুমি খুব ভালো করে ভেবে দ্যাখো, দেবনাথ সম্পর্কে তোমার কোনো দুর্বলতা আছে কিনা?

—হ্যাঁ, আছে৷ আমি জানি৷ ও আমার সঙ্গে কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করে নি৷ এমন মানুষ সম্পর্কে কোনো মেয়ের দুর্বলতা না থেকে পারে?

—তুমি আমার কাছে যদি চলে আসো ঝোঁকের মাথায়—তাহলে দেবনাথের জন্য তোমার মনে একটা অপরাধ-বোধ থাকবে৷ তুমি শান্তি পাবে না৷ তুমি আমাকেও শান্তি দেবে না, দেবনাথেরও শান্তি নষ্ট করবে৷

—তাছাড়া আমি আর একটা কথা ভাবছি৷ দেবনাথের কাছে যদি আমি অবিশ্বাসী হই, তাহলে হয়তো একদিন তোমার কাছেও অবিশ্বাসী হব৷ ঐ যে লোকটা অফিসের গেট থেকে আমার পেছন পেছন আসে, ওর চেহারা যদি একটু সুন্দর হত, যদি ভদ্রভাবে আমার সঙ্গে আলাপ করত—

—যাঃ, তা হয় না!

—কেন হবে না? মেয়েরা একবার অবিশ্বাসী হলে বার বার অবিশ্বাসীও হতে পারে! দেবনাথকে যদি ঠকাই, তাহলে আবার কখনো যে তোমাকেও ঠকাব না—

—তাহলে দেবনাথকে না ঠকানোই তো উচিত মনে হচ্ছে৷

—কোনো মেয়ে কি সত্যিই দু’জন পুরুষকে একসঙ্গে ভালোবাসতে পারে না?

—পারে নিশ্চয়ই৷ কিন্তু দু’জন পুরুষের কেউই তা সহ্য করে না৷ শোনো রীনা, আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি—আমরা তো আর ছেলেমানুষ নই৷ ঝোঁকের মাথায় কিছু করা আমাদের মানায় না৷ তুমি আর কখনো আমাকে দেখা করতে বলো না৷ বরং দেবনাথকে সুখী করার চেষ্টা করো৷

—আর তুমি?

—আমি বোম্বে ফিরে যাব৷

—তোমাকে দেখলে আমি মাথার ঠিখ রাখতে পারব না…

—আমি তোমার মাথা ঠিক রাখতে চাই৷ আর দেখা হবে না৷

—সত্যি আর দেখা হবে না?

—না৷

ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে, বাস বন্ধ ছিল বলে হেঁটেই ফিরছিল দেবনাথ৷ শর্টকাট করার জন্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মধ্যে ঢুকেছিল৷ রেস্তোরাঁটার পাশ দিয়ে যাবার সময় তার চোখে পড়ল টেবিলের ওপর রাখা সুবিমলের হাতের ওপর রীনার হাত৷ দু’জন দু’জনের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে৷

বাগানটার অন্যান্য পাথরের মূর্তির মতন এক মুহূর্ত শুধু অনড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেবনাথ৷ তারপর মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে চলে গেল৷

সেদিন রাত্তিরে আর খাবার টেবিলে একসঙ্গে খাওয়া হল না৷ শিপ্রা বাড়ি ফিরে শরীর খারাপ, কিছু খাবে না বলে শুয়ে পড়েছে৷ আসলে সে হোটেলে খেয়ে এসেছে রমেনের সঙ্গে৷ দেবনাথ অনেক আগেই খেয়ে চলে গেছে নাইট ডিউটিতে৷ রীনাও একা খেয়ে নিয়ে ঢুকে গেছে নিজের ঘরে৷ মা দীপুকে একা খেতে দিয়েছেন৷

কাঞ্চা চাকরটা আর এ বাড়িতে থাকতে চায় না৷ কিছুক্ষণ আগে সে জামা-কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে চলে গেছে কাছাকাছি কোনো বাড়িতে তার গাঁওকা আদমির সঙ্গে শুতে৷ দীপুর ধারণা, ওকে নিশ্চয়ই কেউ কয়েক টাকা বেশি মাইনের চাকরির লোভ দেখিয়েছে—তাই ভূতের অজুহাত দেখিয়ে চলে গেল৷

দীপুকে আগে বলা হয় নি৷ খাবার টেবিলেই মা দীপুকে শিপ্রার কথাটা বললেন৷ দীপু তখন নবনীতার সঙ্গে আবার ভাব হয়ে যাওয়ায় এমন ডগোমগো যে, ব্যাপারটাতে সে তেমন গুরুত্বই দিল না৷ একদিন যদিও রমেনকে সে যথেষ্ট অপমান করেছিল, কিন্তু আজ বললো ঠিক আছে, দাদার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আর আমার বলার কি আছে!

আজ দীপু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ তবু মাঝরাত্রে তার ঘুম ভেঙে গেল৷ একটা মেয়েলি গলায় কান্নার আওয়াজ যেন শুনতে পাচ্ছে৷ চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো ছাদের আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি নারীমূর্তি৷ নীল কিংবা কালো রঙের শাড়ি, একরাশ চুল ছড়িয়ে আছে পিঠে৷

দীপু ভালো করে চোখ দুটো রগড়ালো৷ কালকের মতন ভুল দেখছে না তো? না, কোনো ভুল নেই৷ দীপুর দিকে পেছন ফেরা হলেও, নারীমূর্তি যে তাতে কোনো সন্দেহই নেই৷

আজ আর দীপুর কিন্তু ভয় হল না৷ অশরীরী কিছু যদি সত্যিই থাকে, আজ দীপু তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নিতে চায়৷

একটুও শব্দ না করে দীপু খাট থেকে নামল৷ আস্তে আস্তে টর্চটা তুলে নিল৷ তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল৷ মেয়েটি হাতের ওপর মাথা রেখে হেঁচকি তুলে কাঁদছে৷

মেয়েটির খুব কাছাকাছি গিয়ে দীপুর একটু ভয় করতে লাগলো৷ এ ঠিক ভয়ঙ্কর ভয় নয়, খানিকটা যেন মাদকতা মাখানো ভয়৷

আর কাছে গেল না দীপু, থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে?

মেয়েটি চমকে সোজা হয়েই দীপুর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো, দীপু দেখলো বউদি! তবু সতর্কভাবে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখত লাগলো, যদি সত্যিই বউদি না হয়! যদি বউদির মতন চেহারা নিয়ে…ধ্যাৎ! বাজে চিন্তা!

দীপু জিজ্ঞেস করলো, বউদি তুমি?

রীনা ততক্ষণে দ্রুত আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফেলেছে৷ বললো, হ্যাঁ, ভাই, আমি৷ তুমি ঘুম থেকে উঠে পড়লে কেন?

—তুমি এত রাত্রে এখানে কি করছ?

—এমনিই দাঁড়িয়ে আছি৷ দোতলায় অসহ্য গরম, ঘুম আসছিল না৷

দীপু এবার এগিয়ে বউদির পিঠে একটা হাত রেখে অনুভব করে নিল৷ তারপর বললো, বউদি, তুমি কাঁদছিলে?

—কই, না তো?

—হ্যাঁ, আমি শুনেছি৷ দাদার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়েছে বুঝি?

—না, ঝগড়া হবে কেন? দাদা-বউদির ঝগড়ার ব্যাপারে ছোট ভাইয়ের কৌতূহল দেখাতে নেই!

—বউদি, তোমার কি হয়েছে সত্যি করে বলো তো?

—কি আবার হবে! এমনিই গরমের জন্য দাঁড়িয়েছি৷

—এত রাত্তিরে, ছাদে? আমাকে ডাকলেও পারতে? যদি হঠাৎ ভয়-টয় পেতে—কাল শিপ্রা যে কাণ্ড করলো—

—আমার ভয় করে না৷

—তোমার ভয় করে না? যদি সামনে কেউ এসে দাঁড়াত—হঠাৎ মনে করো সেই মেয়েটিই যদি—

—কোন মেয়েটি?

—যার হাড় পাওয়া গেছে?

—সে যে মেয়েই ছিল সত্যিকারের, তা কি ঠিক হয়েছে?

—ও আমি ঠিক জানি৷

রীনা একটুখানি সরে দাঁড়িয়ে বললো, তা তাকে দেখলেই বা আমি ভয় পাব কেন? তার সঙ্গে না হয় গল্প করতাম! জিজ্ঞেস করতাম, সে মরলো কি করে? ওখানে পুঁতে রেখেছিল কেন—এই সব! কিংবা জিজ্ঞেস করতাম, আর আমার মতন একটা দুঃখ ছিল কিনা?

—বউদি, তোমার কি দুঃখ আমায় বলো—

—দীপু চলো, এবার শুতে যাওয়া যাক!

—তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো, আমি জানি, তুমি কাঁদছিলে৷ তোমার কি দুঃখ আমায় বলো, আমি যদি পারি—

ভারী অদ্ভুত এক রহস্যময়ভাবে হাসলো রীনা৷ সেই হাসির মধ্যে অনেক কিছু মিশে আছে৷ খানিকটা উদাসীনভাবে বললো, মেয়েদের দুঃখ ছেলেরা কখনো বুঝতে পারে না, ওকথা ছেলেদের কাছে বলতে নেই৷

গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

সেবার আমার দিদিমা পড়লেন ভারী বিপদে৷ দাদামশাই রেল কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সে আজ পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা৷ আমার মা তখনো ছোট্ট ইজের-পরা খুকি৷ তখন এত সব শহর নগর ছিল না, লোকজনও এত দেখা যেত না৷ চারধারে কিছু গাছগাছালি জঙ্গল-টঙ্গল ছিল৷ সেই রকমই এক নির্জন জঙ্গুলে জায়গায় দাদামশাই বদলি হলেন৷ উত্তর বাংলার দোমোহানীতে৷ মালগাড়ির গার্ড ছিলেন, তাই প্রায়সময়েই তাঁকে বাড়ির বাইরে থাকতে হত৷ কখনো এক-নাগাড়ে তিন চার কিম্বা সাতদিন৷ তারপর ফিরে এসে হয়তো একদিন মাত্র বাসায় থাকতেন, ফের মালগাড়ি করে চলে যেতেন৷ আমার মায়েরা পাঁচ বোন আর চার ভাই৷ দিদিমা এই মোট নজন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাসায় থাকতেন৷ ছেলে-মেয়েরা সবাই তখন ছোটছোট, কাজেই দিদিমার ঝামেলার অন্ত নেই৷

এমনিতে দোমোহানী জায়গাটা ভারী সুন্দর আর নির্জন স্থান৷ বেঁটে বেঁটে লিচুগাছে ছাওয়া, পাথরকুচি ছড়ানো রাস্তা, সবুজ মাঠ, কিছু জঙ্গল ছিল৷ লোকজন বেশি নয়৷ একধারে রেলের সাহেবদের পাকা কোয়ার্টার, আর অন্যধারে রেলের বাবুদের জন্য আধপাকা কোয়ার্টার৷ একটা ইস্কুল ছিল ক্লাস এইট পর্যন্ত৷ একটা রেলের ইনসটিটিউট ছিল, সেখানে প্রতি বছর দু-তিনবার কেদার রায় বা টিপু সুলতান নাটক হত৷ রেলের বাবুরা দল বেঁধে গ্রীষ্মকালে ফুটবল খেলতেন, শীতকালে ক্রিকেট৷ বড় সাহেবরা সে খেলা দেখতে আসতেন৷ মাঝে মাঝে সবাই দল বেঁধে তিস্তা নদীর ধারে বা জয়ন্তিয়া পাহাড়ে চড়ুইভাতিতেও যাওয়া হত৷ ছোট আর নির্জন হলেও বেশ আমুদে জায়গা ছিল দোমোহানী৷

দোমোহানীতে যাওয়ার পরই কিন্তু সেখানকার পুরোনো লোকজনেরা এসে প্রায়ই দাদামশাই আর দিদিমাকে একটা বিষয়ে খুব হুঁশিয়ার করে দিয়ে যেতেন৷ কেউ কিছু ভেঙে বলতেন না৷ যেমন স্টোরকিপার অক্ষয় সরকার দাদামশাইকে একদিন বলেন, ‘‘এ জায়গাটা কিন্তু তেমন ভালো নয় চাটুজ্যে৷ লোকজন সব বাজিয়ে নেবেন৷ হুটহাট যাকে তাকে ঘরে-দোরে ঢুকতে দেবেন না৷’’ কিম্বা আর একদিন পাশের বাড়ির পালিত-গিন্নী এসে দিদিমাকে হেসে হেসে বলে গেলেন, ‘‘নতুন এসেছেন, বুঝবেন সব আস্তে আস্তে৷ চোখ কান নাক সব খোলা রাখবেন কিন্তু৷ ছেলে-পুলেদের সামলে রাখবেন৷ এখানে কারা সব আছে, তারা ভালো নয়৷’’

দিদিমা ভয় খেয়ে বলেন, ‘‘কাদের কথা বলছেন দিদি?’’

পালিত-গিন্নী শুধু বললেন, ‘‘সে আছে, বুঝবেনখন৷’’

তারপর থেকে দিদিমা একটু ভয়ে ভয়েই থাকতে লাগলেন৷ একদিন হল কি, পুরোনো ঝি সুখীয়ার দেশ থেকে চিঠি এল যে তার ভাসুরপোর খুব বেমার হয়েছে, তাই তাকে যেতে হবে৷ একমাসের ছুটি নিয়ে সুখীয়া চলে গেল৷ দিদিমা নতুন ঝি খুঁজছেন, তা হঠাৎ করে পরদিন সকালেই একটা আধাবয়সী বউ এসে বলল, ‘‘ঝি রাখবেন?’’

দিদিমা দোনোমোনো করে তাকে রাখলেন৷ সে দিব্যি কাজকর্ম করে, খায়দায় বাচ্চাদের গল্প বলে ভোলায়৷ দিন দুই পর পালিত-গিন্নী একদিন সকালে এসে বললেন, ‘‘নতুন ঝি রাখলেন নাকি দিদি? কই দেখি তাকে?’’

দিদিমা ডাকতে গিয়ে দেখেন কলতলায় এঁটো বাসন ফেলে রেখে ঝি কোথায় হাওয়া হয়েছে৷ অনেক ডাকাডাকিতেও পাওয়া গেল না৷ পালিত-গিন্নী মিচকি হাসি হেসে বললেন, ‘‘ওদের ওরকমই ধারা৷ ঝিটার নাম বলুন তো?’’

দিদিমা বললেন, ‘‘কমলা৷’’

পালিত-গিন্নী মাথা নেড়ে বললেন, ‘‘চিনি, হালদার-বাড়িতেও ওকে রেখেছিল৷’’

দিদিমা অতিষ্ঠ হয়ে বললেন, ‘‘কী ব্যাপার বলুন তো?’’

পালিত-গিন্নী শুধু শ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘সব কি খুলে বলা যায়? এখানে এই হচ্ছে ধারা—কোনটা মানুষ আর কোনটা মানুষ নয় তা চেনা ভারী মুশকিল৷ এবার দেখেশুনে একটা মানুষ ঝি রাখুন৷’’

এই বলে চলে গেলেন পালিত-গিন্নী, আর দিদিমা আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলেন৷

কমলা অবশ্য একটু বাদেই ফিরে এল৷ দিদিমা তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘‘কোথায় গিয়েছিলে?’’

সে মাথা নিচু করে বলল, ‘‘মা, লোকজন এলে আমাকে সামনে ডাকবেন না, আমি বড় লজ্জা পাই৷’’

কমলা থেকে গেল৷ কিন্তু দিদিমার মনের খটকা-ভাবটা গেল না৷

ওদিকে দাদামশাইয়েরও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল৷ একদিন লাইনে গেছেন৷ নিশুতিরাতে মালগাড়ি যাচ্ছে ডুয়ার্সের গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে৷ দাদামশাই ব্রেকভ্যানে বসে ঝিমোচ্ছেন, হঠাৎ গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল৷ তা মালগাড়ি যেখানে-সেখানে দাঁড়ায়৷ স্টেশনের পয়েন্টসম্যান আর অ্যাসিসট্যান্ট স্টেশন মাস্টারেরা অনেক সময়ে রাতবিরেতে ঘুমিয়ে পড়ে, সিগন্যাল দিতে ভুলে যায়৷ সে আমলে এরকম হামেশা হত৷ সেরকমই কিছু হয়েছে ভেবে দাদামশাই বাক্স থেকে পঞ্জিকা বের করে পড়তে লাগলেন৷ পঞ্জিকা পড়তে তিনি বড় ভালোবাসতেন৷ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই৷ হঠাৎ দাদামশাই শুনতে পেলেন, ব্রেকভ্যানের পিছনে লোহার সিঁড়ি বেয়ে কে যেন গাড়ির ছাদে উঠছে৷ দাদামশাই মুখ বার করে কাউকে দেখতে পেলেন না৷ ফের শুনলেন, একটু দূরে কে যেন ওয়াগনের পাল্লা খোলার চেষ্টা করছে৷ খুব চিন্তায় পড়লেন দাদামশাই৷ ডাকাতরা অনেক সময় সাঁট করে সিগন্যাল বিগড়ে দিয়ে গাড়ি থামায়, মালপত্র চুরি করে৷ তাই তিনি সরেজমিনে দেখার জন্য গাড়ি থেকে হাতবাতিটা নিয়ে নেমে পড়লেন৷ লম্বা ট্রেন, তার একদম ডগায় ইঞ্জিন৷ হাঁটতে হাঁটতে এসে দেখেন, লাল সিগন্যাল ইতিমধ্যে সবুজ হয়ে গেছে কিন্তু ড্রাইভার তার ফায়ারম্যান কয়লার ঢিপির ওপর গামছা পেতে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে৷ ওদেরও দোষ নেই, অনেকক্ষণ নাগাড়ে ডিউটি দিচ্ছে, একটু ফাঁক পেয়েছে কি ঘুমিয়ে পড়েছে৷ বহু ঠেলাঠেলি করে তাদের তুললেন দাদামশাই৷ তারপর ফের লম্বা গাড়ি পার হয়ে ব্রেকভ্যানের দিকে ফিরে আসতে লাগলেন৷ মাঝামাঝি এসেছেন, হঠাৎ শোনেন ইঞ্জিন হুইসল দিল, গাড়িও ক্যাঁচ-কোঁচ করে চলতে শুরু করল৷ তিনি তো অবাক! ব্রেকভ্যানে ফিরে গিয়ে তিনি সবুজ বাতি দেখালে তবে ট্রেন ছাড়বার কথা৷ তাই দাদামশাই হাঁ করে চেয়ে রইলেন৷ অবাক হয়ে দেখেন, ব্রেকভ্যান থেকে অবিকল গার্ডের পোশাক পরা একটা লোক হাতবাতি তুলে সবুজ আলো দেখাচ্ছে ড্রাইভারকে! ব্রেকভ্যানটা যখন দাদামশাইকে পার হয়ে যাচ্ছে তখন লোকটা তাঁর দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে গেল৷

বহু কষ্টে দাদামশাই ফিরে এসেছিলেন৷

সেবার ম্যাজিশিয়ান প্রফেসার ভট্টাচার্য চা-বাগানগুলোতে ঘুরে ঘুরে ম্যাজিক দেখিয়ে দোমোহানীতে এসে পৌঁছোলেন৷ তিনি এলেবেলে খেলা দেখাতেন৷ দড়িকাটার খেলা, তাসের খেলা, আগুন খাওয়ার খেলা৷ তা দোমোহানীর মতো গঞ্জ জায়গায় সেই খেলা দেখতেই লোক ভেঙে পড়ল৷

ভট্টাচার্য স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে প্রথম দৃশ্যে একটু বক্তৃতা করছিলেন, হাতে ম্যাজিকের ছোট্ট কালো একটা লাঠি৷ বলছিলেন, ম্যাজিক মানেই হচ্ছে হাতের কৌশল, মন্ত্রতন্ত্র নয়৷ আপনারা যদি কৌশল ধরে ফেলেন, তাহলে দয়া করে চুপ করে থাকবেন, কেউ যেন স্টেজে টর্চের আলো ফেলবেন না…ইত্যাদি৷ এইসব বলছেন, ম্যাজিক তখনো শুরু হয়নি, হঠাৎ দেখা গেল তাঁর হাতের লাঠিটা হাত থেকে শূন্যে উঠে ডিগবাজি খেল, তারপর আবার আস্তে আস্তে ফিরে গেল ম্যাজিশিয়ানের হাতে৷

প্রথমেই আশ্চর্য খেলা দেখে সবাই প্রচণ্ড হাততালি দিল৷ কিন্তু প্রফেসর ভট্টাচার্য খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন৷ এর পরের খেলা—ব্ল্যাকবোর্ডে দর্শকেরা চক দিয়ে যা খুশি লিখবেন, আর প্রফেসর ভট্টাচার্য চোখবাঁধা অবস্থায় তা বলে দেবেন৷ কিন্তু আশ্চর্য, প্রফেসর ভট্টাচার্যের এই খেলাটা মোটেই সেরকম হল না৷ দর্শকরা কে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখবেন এই নিয়ে এ-ওকে ঠেলছেন৷ প্রফেসর ভট্টাচার্য চোখের ওপর ময়দার নেচি আর কালো কাপড় বেঁধে দাঁড়িয়ে সবাইকে বলছেন—চলে আসুন, সঙ্কোচের কিছু নেই, আমি বাঘ-ভাল্লুক নই…ইত্যাদি৷ সে সময়ে হঠাৎ দেখা গেল কেউ যাওয়ার আগেই টেবিলের ওপর রাখা চকের টুকরোটা নিজে থেকেই লাফিয়ে উঠল এবং শূন্যে ভেসে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর লিখতে লাগল, প্রফেসর ভট্টাচার্য ইজ দি বেস্ট ম্যাজিশিয়ান অফ দি ওয়ার্ল্ড! এই অসাধারণ খেলা দেখে দর্শকরা ফেটে পড়ল উল্লাসে, আর ভট্টাচার্য কাঁদো-কাঁদো হয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় বলতে লাগলেন, কী হয়েছে? অ্যাঁ? কী হয়েছে? তারপর তিনি আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন৷

আগুন খাওয়ার খেলাতেও আশ্চর্য ঘটনা ঘটালেন তিনি৷ কথা ছিল, মশাল জ্বেলে সেই মশালটা মুখে পুরে আগুনটা খেয়ে ফেলবেন৷ তাই করলেন, কিন্তু তারপরই দেখা গেল ভট্টাচার্য হাঁ করতেই তাঁর মুখ থেকে সাপের জিভের মতো আগুনের হলকা বেরিয়ে আসছে৷ পরের তাসের খেলা যখন দেখাচ্ছেন, তখনো দেখা গেল, কথা বলতে গেলেই আগুনের হলকা বেরোয়৷ দর্শকরা দাঁড়িয়ে উঠে সাধুবাদ দিতে লাগল, কিন্তু ভট্টাচার্য খুব কাঁদো-কাঁদো মুখে চার-পাঁচ-সাত গ্লাস জল খেতে লাগলেন স্টেজে দাঁড়িয়েই৷ তবু হাঁ করলেই আগুনের হলকা বেরোয়!

তখনকার মফঃস্বল শহরের নিয়ম ছিল বাইরে থেকে কেউ এরকম খেলাটেলা দেখাতে এলে তাঁকে কিংবা তাঁর দলকে বিভিন্ন বাসায় সবাই আশ্রয় দিতেন৷ প্রফেসর ভট্টাচার্য আমার মামাবাড়িতে উঠেছিলেন৷ রাতে খেতে বসে দাদামশাই তাঁকে বললেন, ‘আপনার খেলা গণপতির চেয়ে ভালো৷ অতি আশ্চর্য খেলা!’’

ভট্টাচার্যও বললেন, ‘‘হাঁ অতি আশ্চর্য খেলা—আমিও এরকম আর দেখিনি৷’’

দাদামশাই অবাক হয়ে বলেন, ‘‘সে কী? এ তো আপনিই দেখালেন!’’

ভট্টাচার্য আমতা আমতা করে বলেন, ‘‘তা বটে আমিই তো দেখালাম৷ আশ্চর্য!’’

তাঁকে খুবই বিস্মিত মনে হচ্ছিল৷

দাদামশাইয়ের বাবা সেবার বেড়াতে এলেন দোমোহানীতে৷ বাসায় পা দিয়েই বললেন, ‘‘তোদের ঘরদোরে একটা আঁশটে গন্ধ কেন রে?’’

সবাই বলল, ‘‘আঁশটে গন্ধ! কৈ, আমরা তো পাচ্ছি না!’’

দাদামশাইয়ের বাবা ধার্মিক মানুষ, খুব পণ্ডিত লোক, মাথা নেড়ে বললেন, ‘‘আলবাৎ আঁশটে গন্ধ! শুধু তোদের বাসাতেই নয়, স্টেশনে নেমেও গন্ধটা পেয়েছিলুম৷ পুরো এলাকাতেই যেন আঁশটে-আঁশটে গন্ধ একটা৷’’

কমলা দাদামশাইয়ের বাবাকে দেখেই গা-ঢাকা দিয়েছিল, অনেক ডাকাডাকিতেও সামনে এল না৷ দিদিমার তখন ভারী মুশকিল৷ একা হাতে সব করতে-কম্মাতে হচ্ছে৷ দাদামশাইয়ের বাবা সব দেখেশুনে খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘‘এসব ভালো কথা নয়৷ গন্ধটা খুব সন্দেহজনক!’’

সেদিনই বিকেলে স্টেশনমাস্টার হরেন সমাদ্দারের মা এসে দিদিমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, ‘‘কমলা আমাদের বাড়িতে গিয়ে বসে আছে৷ তা বলি বাছা, তোমার শ্বশুর ধার্মিক লোক, সে ভাল৷ কিন্তু উনি যদি জপতপ বেশি করেন, ঠাকুরদেবতার নাম ধরে ডাকাডাকি করেন, তাহলে কমলা এ-বাড়িতে থাকে কী করে?’’

দিদিমা অবাক হয়ে বলেন, ‘‘এসব কী কথা বলছেন মাসিমা? আমার শ্বশুর জপতপ করলে কমলার অসুবিধে কী?’’

সমাদ্দারের মা তখন দিদিমার থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘‘ও হরি, তুমি বুঝি জানো না? তাই বলি! তা বলি বাছা, দোমোহানীর সবাই জানে যে এ হচ্ছে ঐ দলেরই রাজত্ব৷ ঘরে ঘরে ওরাই সব ঝি-চাকর খাটছে৷ বাইরে থেকে চেহার দেখে কিছু বুঝবে না, তবে ওরা হচ্ছে সেই তারা৷’’

‘‘কারা?’’ দিদিমা তবু অবাক৷

‘‘বুঝবে বাপু, রোসো৷’’ বলে সমাদ্দারের মা চলে গেলেন৷

তা কথাটা মিথ্যে নয়৷ দোমোহানীতে তখন ঝি-চাকর কিংবা কাজের লোকের বড় অভাব৷ ডুয়ার্সের ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, মশা আর বাঘের ভয়ে কোনো লোক সেখানে যেতে চায় না৷ যাদের না গিয়ে উপায় নেই, তারাই যায়৷ আর গিয়েই পালাই-পালাই করে৷ তবু ঠিক দেখা যেত, কারো বাসায় ঝি-চাকর বা কাজের লোকের অভাব হলেই ঠিক লোক জুটে যেত৷ স্টেশনমাস্টার সমাদ্দারের ঘরে একবার দাদামশাই বসে গল্প করছিলেন৷ সমাদ্দার একটা চিঠি লিখছিলেন, সেটা শেষ করেই ডাকলেন, ‘‘ওরে, কে আছিস?’’ বলামাত্র একটা ছোকরামতো লোক এসে হাজির৷ সমাদ্দার তার হাতে চিঠিটা দিয়ে বললেন, ‘‘যা, এটা ডাকে দিয়ে আয়৷’’ দাদামশাই তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘লোকটাকে নতুন রেখেছেন নাকি?’’ সমাদ্দার মাথা নেড়ে বলেন, ‘‘না না, ফাইফরমাশ খেটে দিয়ে যায় আর কি! খুব ভালো ওরা, ডাকলেই আসে৷ লোক-টোক নয়, ওরা ওরাই!’’

তো তাই৷ মামাদের বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতেন ধর্মদাস নামে একজন বেঁটে আর ফর্সা ভদ্রলোক৷ তিনি থিয়েটারে মেয়ে সেজে এমন মিহিগলায় মেয়েলী পার্ট করতেন যে, বোঝাই যেত না তিনি মেয়ে না ছেলে৷ সেবার সিরাজদৌল্লা নাটকে তিনি লুৎফা৷ গিরিশ ঘোষের নাটক৷ কিন্তু নাটকের দিনই তাঁর ম্যালেরিয়া চাগিয়ে উঠল৷ লেপচাপা হয়ে কোঁ-কোঁ করছেন৷ নাটক প্রায় শিকেয় ওঠে, কিন্তু ঠিক দেখা গেল, নাটকের সময়ে লুৎফার অভাব হয়নি৷ একেবারে ধর্মদাস মাস্টারমশাই-ই যেন গোঁফ কামিয়ে আগাগোড়া নিখুঁত অভিনয় করে গেলেন—কেউ কিছু টের পেল না৷ কিন্তু ভিতরকার কয়েকজন ঠিকই জানত যে, সেদিন ধর্মদাস মাস্টারমশাই মোটেই স্টেজে নামেনি৷ নাটকের শেষে সমাদ্দার দাদামশাইয়ের সঙ্গে ফিরে আসছিলেন, বললেন, ‘‘দেখলেন, কেমন কার্যোদ্ধার হয়ে গেল! একটু খোনাসুরও কেউ টের পায়নি!’’

দাদামশাই তখন চেপে ধরলেন সমাদ্দারকে, ‘‘মশাই, রহস্যটা কী একটু খুলে বলবেন?’’

সমাদ্দার হেসে শতখান হয়ে বললেন, ‘‘সবই তো বোঝেন মশাই! একটা নীতিকথা বলে রাখি, সদ্ভাব রাখলে সকলের কাছ থেকেই কাজ পাওয়া যায়৷ কথাটা খেয়াল রাখবেন৷’’

মামাদের মধ্যে যারা একটু বড়, তারা বাইরে খেলে বেড়াত৷ মা আর বড়মাসি তখন কিছু বড় হয়েছে৷ অন্য মামা-মাসিরা নাবালক-নাবালিকা৷ মা’র বড় লুডো খেলার নেশা ছিল৷ তো মা আর মাসি রোজ দুপুরে লুডো পেড়ে বসত, তারপর হাঁক দিত, ‘‘আয় রে!’’ অমনি টুক করে কোথা থেকে মায়ের বয়সীই দুটো মেয়ে হাসিমুখে লুডো খেলতে বসে যেত৷

মামাদের মধ্যে যারা বড় হয়েছে, সেই বড় আর মেজো মামা যেত বল খেলতে৷ দুটো পার্টিতে প্রায়ই ছেলে কম পড়ত৷ ছোট জায়গা তো, বেশি লোকজন ছিল না৷ কিন্তু কম পড়লেই মামারা ডাক দিত, ‘‘কে খেলবি আয়!’’ অমনি চার-পাঁচজন এসে হাজির হত, মামাদের বয়সীই সব ছেলে৷ খুব খেলা জমিয়ে দিত৷

এই খেলা নিয়েই আর একটা কাজ হল একবার৷ দোমোহানীর ফুটবল টিমের সঙ্গে এক চা-বাগানের টিমের ম্যাচ৷ দোমোহানীর বাঙালি টিম জুত করতে পারছে না৷ হঠাৎ দোমোহানীর টিম খুব ভালো খেলা শুরু করল৷ দুটো গোল শোধ দিয়ে আরো একখানা দিয়েছে, এমন সময়ে চা-বাগান টিমের ক্যাপ্টেন খেলা থামিয়ে রেফারিতে বলল, ‘‘ওরা বারোজন খেলছে!’’ রেফারি গুনে দেখলেন না এগারোজনই৷ ফের খেলা শুরু হতে একটু পরে রেফারিই খেলা থামিয়ে দোমোহানীর ক্যাপ্টেনকে ডেকে বললেন, ‘তোমাদের টিমে চার-পাঁচজন এক্সট্রা লোক খেলছে!’’

দুর্দান্ত সাহেব-রেফারি, সবাই ভয় পায়৷ দোমোহানীর ক্যাপ্টেন বুক ফুলিয়ে বলল, ‘‘গুনে দেখুন!’’ রেফারি গুনে দেখে আহাম্মক—এগারোজনই৷

দোমোহানীর টিম আরো তিনটে গোল দিয়েছে৷ রেফারি আবার খেলা থামিয়ে ভীষণ রেগে চেঁচিয়ে বললেন, ‘‘দেয়ার আর অ্যাট লিসট টেন একস্ট্রা মেন ইন দিস টিম!’’

দর্শকদেরও তাই মনে হয়েছে৷ গুনে দেখা যায়—এগারোজন, কিন্তু খেলা শুরু হতেই যেন ঘাসের বুকে লুকিয়ে থাকা, কিম্বা বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে থাকা সব খেলোয়াড় পিলপিল করে নেমে পড়ে মাঠের মধ্যে৷ রেফারি দোমোহানীর টিমকে লাইন আপ করিয়ে সকলের মুখ ভালো করে দেখে বললেন, ‘‘শেষ তিনটে গোল যারা করেছে, তারা কই? তাদের তো দেখছি না একটা কালো ঢ্যাঙা ছেলে, একটা বেঁটে আর ফর্সা, আর একটা ষাঁড়ের মতো—তারা কই?’’

দোমোহানীর ক্যাপ্টেন মিনমিন করে সাফাই গাইল, তাতে রেফারি আরো রেগে টং৷ চা-বাগানের টিমও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাফসে পড়েছে, কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারছে না৷

খেলা অবশ্য বন্ধ হয়ে গেল৷ দাদামশাইয়ের বাবা লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে খেলার হালচাল দেখে বললেন, ‘‘আবার সেই গন্ধ! এখানেও একটা রহস্য আছে, বুঝলে সমাদ্দার?’’

স্টেশনমাস্টার সমাদ্দার পাশেই ছিলেন, বললেন, ‘‘ব্যাটারা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে!’’

‘‘কে? কাদের কথা বলছো?’’

সমাদ্দার এড়িয়ে গেলেন৷ দাদামশাইয়ের বাবা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক!’’

দাদামশাইয়ের বাবা সবই লক্ষ করতেন আর বলতেন, ‘‘এসব ভালো কথা নয়৷ গন্ধটা খুব সন্দেহজনক৷ ও বউমা, এসব কী দেখছি তোমাদের এখানে? হুট বলতেই সব মানুষজন এসে পড়ে কোত্থেকে, আবার হুশ করে সব মিলিয়ে যায়! কাল মাঝরাতে উঠে একটু তামাক খাওয়ার ইচ্ছে হল, উঠে বসে কেবলমাত্র আপনমনে বলেছি—একটু তামাক খাই৷ অমনি একটা কে যেন বলে উঠল, এই যে বাবামশাই, তামাক সেজে দিচ্ছি! অবাক হয়ে দেখি, সত্যিই একটা লোক কল্কে ধরিয়ে এনে হুঁকোয় বসিয়ে দিয়ে গেল! এরা সব কারা?’’

দিদিমা আর কী উত্তর দেবেন? চুপ করে থাকেন৷ দাদামশাইও বেশি উচ্চবাচ্য করেন না, বোঝেন সবই৷ কিন্তু দাদামশাইয়ের বাবা কেবলই চারধারে বাতাস শুঁকে শুঁকে বেড়ান আর বলেন, ‘‘এ ভালো কথা নয়৷ গন্ধটা খুব সন্দেহজনক৷’’

মা প্রায়ই তাঁর দাদুর সঙ্গে বেড়াতে বেরোতেন৷ রাস্তায়-ঘাটে লোকজন কারো সঙ্গে দেখা হলে তারা সব প্রণাম বা নমস্কার করে সম্মান দেখাত দাদামশাইয়ের বাবাকে, কুশল প্রশ্ন করত৷ কিন্তু দাদামশাইয়ের বাবা বলতেন, ‘‘রোসো বাপু, আগে তোমাকে ছুঁয়ে দেখি, গায়ের গন্ধ শুঁকি, তারপর কথাবার্তা!’’ এই বলে তিনি যাদের সঙ্গে দেখা হত তাদের গা টিপে দেখতেন, শুঁকতেন, নিশ্চিন্ত হলে কথাবার্তা বলতেন৷ তা তাঁর দোষ দেওয়া যায় না৷ সেই সময়ে দোমোহানীতে রাস্তায়-ঘাটে বা হাটেবাজারে যে সব মানুষ দেখা যেত, তাদের বারো আনাই নাকি সত্যিকারের মানুষ নয়৷ তা নিয়ে অবশ্য কেউ মাথা ঘামাত না৷ সকলেরই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল৷

অভ্যাস জিনিসটাই ভারী অদ্ভুত৷ যেমন বড়মামার কথা বলি৷ দোমোহানীতে আসবার অনেক আগে থেকেই তাঁর ভারী ভূতের ভয় ছিল৷ তাঁরও দোষ দেওয়া যায় না৷ ঐ বয়সে ভূতের ভয় কারই বা না থাকে! তাঁর কিছু বেশি ছিল৷ সন্ধের পর ঘরের বার হতে হলেই তাঁর সঙ্গে কাউকে যেতে হত৷ দোমোহানীতে আসার অনেক পরেও সে অভ্যাস যায়নি৷ একদিন সন্ধেবেলা বসে ধর্মদাস মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ছেন একা, বাড়ির সবাই পাড়া বেড়াতে গেছে৷ ঠিক সেই সময়ে তাঁর বাথরুমে যাওয়ার দরকার হল৷ মাস্টারমশাইকে তো আর বলতে পারেন না—আপনি আমার সঙ্গে দাঁড়ান, তাই বাধ্য হয়ে ভিতরবাড়িতে এসে অন্ধকারকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘‘এই শুনছিস?’’

অমনি একটি সমবয়সী ছেলে এসে দাঁড়াল, ‘‘কী বলছো?’’

‘‘আমি একটু বাথরুমে যাব, আমার সঙ্গে একটু দাঁড়াবি—চল তো!’’

সেই শুনে ছেলেটা তো হেসে কুটিপাটি, বলল, ‘‘দাঁড়াব কেন? তোমার কিসের ভয়?’’

বড়মামা ধমক দিয়ে বলেন, ‘‘ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না৷ দাঁড়াতে বলছি দাঁড়াবি৷’’

ছেলেটা অবশ্য দাঁড়াল৷ বড়মামা বাথরুমে কাজ সেরে এলে ছেলেটা বলল, ‘‘কিসের ভয় বললে না?’’

বড়মামা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘‘ভূতের৷’’

ছেলেটা হাসতে হাসতেই বাতাসে মিলিয়ে গেল৷ বড়মামা রেগে গিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘খুব ফাজিল হয়েছ তোমরা!’’

তা এইরকম সব হত দোমোহানীতে৷ কেউ গা করত না৷ কেবল দাদামশাইয়ের বাবা বাতাস শুঁকতেন, লোকের গা শুঁকতেন৷ একদিন বাজার থেকে ফেরার পথে তাঁর হাতে মাছের ছোট্ট খালুই, তাতে সিঙ্গি মাছ নিয়ে আসছিলেন, তো একটা মাছ মাঝপথে খালুই বেয়ে উঠে রাস্তায় পড়ে পালাচ্ছে৷ দাদামশাইয়ের বাবা সেই মাছ ধরতে হিমসিম খাচ্ছেন, ধরলেই কাঁটা দেয় যদি! এমন সময়ে একটা লোক খুব সহৃদয়ভাবে এসে মাছটাকে ধরে খালুইতে ভরে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, দাদামশাইয়ের বাবা তাকে থামিয়ে গা শুঁকেই বললেন, ‘‘এ তো ভালো কথা নয়, গন্ধটা খুব সন্দেহজনক! তুমি কে হে? অ্যাঁ, কারা তোমরা?’’

এই বলে দাদামশাইয়ের বাবা তার পথ আটকে দাঁড়ালেন৷ লোকটা কিন্তু ঘাবড়াল না৷ হঠাৎ একটু ঝুঁকে দাদামশাইয়ের বাবার গা শুঁকে সেও বলল, ‘‘এ তো ভালো কথা নয়৷ গন্ধটা বেশ সন্দেহজনক৷ আপনি কে বলুন তো? অ্যাঁ, কে?’’

এই বলে লোকটা হাসতে হাসতে বাতাসে অদৃশ্য হয়ে গেল৷

দাদামশাইয়ের বাবা আর গন্ধের কথা বলতেন না৷ একটু গম্ভীর হয়ে থাকতেন ঠিকই, ভূতের অপমানটা তাঁর প্রেস্টিজে খুব লেগেছিল৷ একটা ভূত তাঁর গা শুঁকে ঐ কথা বলে গেছে ভাবা যায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *