বুলেট খেলে মাথা ধরে – হিমাংশু সরকার

বুলেট খেলে মাথা ধরে – হিমাংশু সরকার

পার্ক স্ট্রীটের একটা নামকরা ‘রেস্টুরেন্ট ও নাইট ক্লাব’ থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন রাত অনেক। নেশায় আমার পা টলছে। এসি, লাইনে বিদ্যুৎ নেই। পথ অন্ধকার। রাস্তায় লোকজনও চলছে না। রাস্তার দুধারে, ডি.সি, লাইনের বাড়িগুলো থেকে সযত্নে টাঙানো জানলার পদাকে ফাঁকি দিয়ে সামান্য আলো এসে রাস্তায় পড়েছে।

মদ্যপান করার পর নেশা হলে আমি ‘অন প্রিন্সিপ্‌ল্‌ ট্যাক্সিতে উঠি না। ওতে অনেক সেয়ানারও বিপদ হয়েছে। নেশাটা আরেকটু কমলে ট্যাক্সিতে উঠব এই ভেবে ফুটপাথ ধরে পুবদিকে হাঁটতে লাগলাম। খানিকক্ষণ পর বেশ ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে বাতাস বইতে লাগল। আমার বেশ ভাল লাগছিল। হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাসের পেছন পেছন এল শ্রীমতী বৃষ্টি। ঝিরঝিরে হালকা তুষারের মত বৃষ্টি। আমার বেশ ভাল লাগছিল। আমার জন্মও শ্রাবণ মাসে। বৃষ্টি আমি খুব ভালবাসি।

ঠক। ঠক। ঠক। ঠক।—

শব্দটা হঠাৎ পেলাম। মনে হল, শব্দটা পুবদিক থেকে দ্রুত আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি ধরে ফেললাম ব্যাপারটা। হাইহিল জুতো পরে কেউ ছুটছে। আর হাইহিল জুতো মানেই মহিলা! এত রাতে রাস্তায় মহিলা হোটে কেন?

আমি তাড়াতাড়ি একটা বাড়িতে ওঠার দরজা পেয়ে ধাঁ করে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভেতরে অন্ধকারে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা ছুটতে ছুটতে আমার সামনে আসতেই একটা শব্দ হল—ঠস্‌-স্‌-স্‌। আর মেয়েটা আমাকে অতিক্রম করে ছিটকে গিয়ে পড়ল। আর উঠল না। শব্দটা আমি খুব ভাল করে চিনি। মেয়েটাকে নিশ্চয়ই কেউ সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল দিয়ে পেছন থেকে গুলি করেছে।

খুনীকে দেখার জন্যে আমি সামান্য ঝুঁকে বাঁ-দিকে তাকালাম। পিস্তলধারী নিশ্চয় অনেক দূরে আছে। কিন্তু সে এগিয়ে আসছে না কেন? তবে কি সে নিশ্চিত যে, তার লক্ষ্য ব্যর্থ হয়নি? অথচ পাঁচশ’ গজের মধ্যে আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে খুনী নিশ্চয় প্রফেশনাল।

আমি খুনীর আবির্ভাবের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ভাবতে লাগলাম। তিনটে জিনিস প্রমাণ করে যে, খুনী প্রফেশনাল। প্রথম : সে সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল ব্যবহার করেছে এবং পিস্তলটা নিশ্চয়ই খুব উঁচু দরের। উঁচু দরের এই জন্যে যে, ‘পাঁচশ’ গজ দূর থেকেও ধাবমান লক্ষ্যে গুলি করা যায় এবং পাঁচশ গজ দূর থেকেও গুলি খেয়ে একশ’ কুড়ি পাউন্ডের একটা মানুষ হাত ছয়-সাত ছিটকে যায়। খুন হবার পর আমি পাঁচশ’ গজের মধ্যে কাউকে দেখিনি। দ্বিতীয় : খুনী মাত্র একটি গুলি করেছে। একটির বেশি গুলি করার প্রয়োজন হয়নি তার। অথাৎ খুনীর হাতের লক্ষ্য অব্যর্থ। তৃতীয় : খুন করার পর বা গুলি ছোঁড়ার পর, ফলাফল দেখার জন্যে খুনী এগিয়ে আসেনি। তার মানে, নিজের ওপর তার অসীম বিশ্বাস। সে জানে যে গুলি তার লক্ষ্যে লাগবেই। এ সমস্তই প্রফেশনাল খুনীর লক্ষণ।

আমি জানি, এখন আত্মপ্রকাশ করা বোকামি। খুনী নিশ্চয় এখনও ঘটনাস্থল ছেড়ে যায়নি। আমি মিনিটখানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ সেই ক্ষীণ শব্দটা পেলাম। প্রায় নিঃশব্দে গাড়িটা এগিয়ে আসছে ফুটপাথ ঘেঁষে পুর্ব থেকে পশ্চিমে। অর্থাৎ রং সাইডে! আর রং সাইড মানেই রং ম্যান। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

গাড়িটা ধীর গতিতে এসে দাঁড়াল ফুটপাথের ধারে। বাঁ-হাতি স্টিয়ারিং। ড্রাইভারের পাশে একজন। দুজনের মধ্যে একজন বলল, ‘Get your ass out there, See if you can find it.’

স্টিয়ারিংয়ে যে লোকটা বসেছিল, সে নেমে এল। মেয়েটার হাতব্যাগটা খুলে টর্চ জ্বেলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। ব্যাগটা আবার ফেলে দিয়ে জুতোর ডগা দিয়ে মেয়েটাকে চিৎ করে দেখে বলল, ‘She’s got a headache.’

কথা শেষ করে সে আবার স্টিয়ারিংয়ে গিয়ে বসল। তারপর বিদ্যুৎ গতিতে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।

এবার আমি ধীরে ধীরে মেয়েটার মৃতদেহের পাশে এসে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে সিগারেটের গ্যাস লাইটারটা বার করে জ্বালালাম। মেয়েটাকে সুন্দরী না বললে মিথ্যা বলা হয়। হাতের আঙুলে একটা মূল্যবান হীরের আংটি। গলায় পাথর বসানো মূল্যবান হার। ডান হাতে একটা রোলেক্স ঘড়ি। মেয়েটার বয়স বাইশ-তেইশ হবে।

বলাই বাহুল্য, নেশা আমার অনেক আগেই কপূরের মত উবে গেছিল। মাথার মধ্যে কে যেন বলছে, হিমাদ্রি পালাও। কিন্তু আমি মেয়েটার পরিচয় জানার কৌতুহল কিছুতেই দমন করতে পারলাম না। মেয়েটার হাম্ব্যাগটা খুললাম। পৃথিবীতে এমন জিনিস কমই আছে, যা মেয়েদের হাতব্যাগের মধ্যে পাওয়া যায় না। কাজেই সেসব জিনিসের বর্ণনা দিয়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। ব্যাগের মধ্যে ছিল হাজার তিনেক টাকা। আততায়ীরা সেটা নেয়নি। হীরের আংটি নেয়নি। গলার মূল্যবান হারটাও নেয়নি। কাজেই টাকা পয়সার জন্যে হত্যা করা হয়নি।

ব্যাগের মধ্যে দ্বিতীয় জিনিস যেটা উল্লেখ করার মত, সেটা হল ওর পরিচয়পত্র। এয়ার হোস্টেস। গতকালও সে ভারতে ছিল না। নাম অনীতা রুদ্র।

হোটেলে ফিরে প্রথমেই আমি স্নান করলাম। তারপর স্কচের বোতলটা নিয়ে খাটের ওপর বসলাম। বোতলে কয়েক চুমুক দেবার পরই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল, কিন্তু ক্ষিধে গেল না। কিন্তু অত রাতে আর খাবারের সন্ধানে বেরোতে ইচ্ছা হল না।

পিস্তলটা কি জাতের? স্মিত অ্যান্ড ওয়েসন বা অন্য কোন পিস্তলের নাম আমার জানা নেই, যেটা পাঁচশ গজ…God! আমি একটা মহামূর্খ! আমি কেন আগে থেকে ধারণা করলাম যে, পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছে। যদি আমার এখনকার ধারণা সত্যি হয়, অর্থাৎ অনীতাকে যদি রাইফেল দিয়ে হত্যা করা হয়ে থাকে, তাহলে এই হত্যার গুরুত্ব আমি যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশি।

She’s got a headache! কথাটা বার বার টেপরেকর্ডারের মত আমার মনের মধ্যে বাজতে লাগল। রাতের অন্ধকারে (সামান্য মাত্র ছিটেফোঁটা আলো ছিল) পাঁচশ’ গজেরও দূরে ধাবমান লক্ষ্যে গুলি করতে পারে কে? কি ধরনের রাইফেল?

এবার আমি রীতিমত আগ্রহী হয়ে উঠলাম। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি ঝামেলাকে এড়িয়ে চলতে কিন্তু ঝামেলা আমাকে জড়িয়ে ধরে।

ভাবতে ভাবতে একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে দিলাম। তারপর হাত দিলাম বালিশের নিচে। সেখানে লাইটারটা নেই। কোটের পকেটে, প্যান্টের পকেটে হাত দিলাম। লাইটারটা কোথাও নেই। আর তখনই আমার মনে পড়ল।

সর্বনাশ! মেয়েটার মৃতদেহের পাশেই সেটা ফেলে এসেছি। লাইটারটা জ্বেলে মাটিতে রেখে অনীতার আই-ডি কার্ডটা পড়ছিলাম। তখনও নিশ্চয় আমার সামান্য নেশা ছিল এবং তাড়াতাড়িতে আসার সময় সেটা কুড়িয়ে নিতে ভুলে গেছি। লাইটারটা সোনার এবং ওতে আমার নাম লেখা আছে।

আমি তাড়াতাড়ি নেমে এলাম। লবিতে ফোন ছিল। বিকাশকে বাড়িতেই পেলাম। বিকাশ চৌধুরী এখন ডি-সি, ডি-ডি, হেডকোয়াটার্স। ডায়াল করতেই ঘুম-জড়ানো বিরক্তি মেশানো কণ্ঠ ভেসে এল : ‘কাকে চাই?’

‘বিকাশ চৌধুরী, ডি-ডি, ডি-সি।’

‘আপনি কে?’

‘সিরাজদৌল্লা।’

‘হোয়াট ওয়াজ দ্যাট?’ বিকাশ গর্জে উঠল।

Don’t get excited, boy…আমি হিমু।’ বললাম ঠাণ্ডা গলায়।

‘হিমু! তার মানেই তো ট্রাবল। বিকাশ ব্যঙ্গ করল।

‘ঠিক তাই, আমি ফোনের দিকে তাকিয়েই হাসলাম : ‘শোন বিকাশ, ঠাট্টা নয়। আমি সীরিয়াস।’

‘আমার দুভাগ্য। ঝামেলাটা কি? কোথাকার অ্যাম্বাসেডর মাডার হল?’

‘অ্যাম্বাসেডর নয়। অনীতা রুদ্র মাডার হয়েছে।’

‘সেটা আবার কে? লিজ টেলরের মাসতুতো বোন নাকি?’

একটু থেমে বললাম, না, অনীতা ছিল এয়ার হোস্টেস।’

‘এয়ার হোস্টেস। তাহলে এবার তুমি এয়ার হোস্টেসদের দিকে নজর দিয়েছ? বিকাশের গলায় তীব্র শ্লেষ।

আমি সেটা উপেক্ষা করে বললাম, ‘মাত্র একঘন্টা আগে পার্ক স্ট্রীটে ফুটপাথের ওপর অনীতা রুদ্রকে কেউ গুলি করে মেরেছে। আর, অ্যাক্সিডেন্টালি আমার সিগারেট লাইটারটা ওখানে পড়ে গেছে।’

‘হোয়াট? একটা মৃতদেহে পাশে তোর সিগারেট লাইটারটা গেল কি করে?’

‘ইট ওয়াজ এ মিস্টেক। আমি ফোন করছি অন্য কারণে। আমি পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট আর যে গুলিতে মেয়েটা নিহত হয়েছে, এ দুটোই চাই। আমি আশা করব আগামী পরত সুজাতার ঘরে ওগুলো তুই নিজে পৌছে দিবি।’

‘মানে? বিকাশ আবার গর্জে উঠল, “এটা আদেশ নাকি?’

‘না, অনুরোধ। তবে এটাকে অফিসিয়াল করতে আমার এক মিনিট সময় লাগবে না। আরেকটা কথা, আমাকে পুলিশ খুঁজবে। কিন্তু আশা করব You will give out nothing, তোমার প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখ।’

‘Damn it!’ প্রচণ্ড জোরে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। আমি এক মিনিট অপেক্ষা করে আরেকটা ফোন করলাম এক গোপন স্থানে। তারপর ওপরে এসে কাপড়-জামা পরে, সুটকেশ গুছিয়ে চলে এলাম পথে।

প্রণব রোজারীওর আস্তানা তালতলায়। প্রণব সম্রাট। ‘ডক’ তার কার্যক্ষেত্র। মোটা টাকা আসে ‘ডক’ থেকে। আমি ওর ওখানে এলাম।

বললাম, ‘সুটকেশটা রাখতে চাই প্রণব। এক রাতের জন্যে।’

‘বিপদ?’

‘খানিকটা।’

‘ব্যাপার কি হিমাদ্রি? এই কলকাতার সম্রাট ছিলে তুমি। একদিন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলে। তারপর দীর্ঘ বার বছর পর আবার এলে। এসেই শুরু করলে ঝামেলা। আজ একে মারছ, কাল তাকে মারছ। পঞ্চাকে সেন্ট্রাল থেকে সরালে। তোমার অনুপস্থিতিতে শেখর সেন সাউথে ফিরেছিল। সে আবার তোমার ভয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন এই রাত (ভোর) তিনটের সময় নিজের আস্তানা ছেড়ে এখানে এসে উপস্থিত। এসব কি হচ্ছে?’

বললাম, ‘সমস্ত ব্যাপার তোমায় খুলে বলতে পারছি না। কাল কাগজ পড়লে সামান্য সত্য জানতে পারবে।’

কথা শেষ করে বেরিয়ে এলাম। একটা ট্যাক্সিও পেয়ে গেলাম। সোজা চলে এলাম উড় স্ত্রীটের পাঁচতলা বাড়িটার সামনে। ট্যাক্সির ভাড়া ঢুকিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়েই বাধা পেলাম নাইট ওয়াচম্যানের কাছ থেকে ‘কাকে চাই?’

দুটো দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, ‘ইয়া ইয়া খানকে।’

টাকাটা হাতে নিয়ে সে হয়ে গেল পিসার হ্যালান টাওয়ার। তারপর একগাল হেসে বলল, ‘অনীতা মেমসাহেবের ফ্ল্যাটে যাবেন তো?’

আমি বিস্মিত হয়ে জবাব দিলাম, হ্যাঁ।

‘রেটটা আরেকটু বেশি, মানে পঞ্চাশ।’

‘পঞ্চাশ কেন? আগে তো আশী ছিল।’

‘না, পঞ্চাশ। কারণ উনি তো এখন ফ্ল্যাটে নেই। এত বড় রিস্ক নেব কি করে বলুন? |

ওর হাতে আরও তিনটে দশ টাকার নোট দিতেই ও বলল, কিন্তু একটা শর্ত আছে। আপনি ফিরে যাবার সময় আমি আপনাকে সার্চ করব।’

আমি বললাম, তার দরকার হবে না। ফেরার সময় আমি যে কাপড় পরে জন্মেছিলাম, তাই পরে নেমে আসব।’

লোকটা আমার কথা বুঝল কিনা জানি না। আমি সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। অনীতার ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল।

প্রথমেই ড্রইংরুম। সেখানে এক দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেছে। সোফা, দেওয়ালের ছবি সব তছনছ হয়ে আছে। শোবার ঘরে, রান্নাঘরে, বাথরুমে সর্বত্র সেই একই দৃশ্য। বুঝলাম অনীতাকে খুন করে ওরা এখানে এসেছিল। অনীতার কাছে এমন কিছু আছে, যা ওদের প্রয়োজন। আমি মিনিট দুয়েক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। পেটের মধ্যে সেই যন্ত্রণাটা আবার শুরু হল—যার অপর নাম ক্ষিধে। কাল সারাদিন আজ সারা রাত আমার কিছুই খাওয়া হয়নি।

রেফ্রিজারেটরে কিছু খাবার থাকতে পারে ভেবে আমি রান্নাঘরে এসে রেফ্রিজারেটর খুললাম। সেখানে কোন খাবার নেই। ক্ষিদেটা বাড়ছে। কিছু একটা খাওয়া দরকার। হঠাৎ মনে হল, এয়ার হোস্টেসরা অনেক সময় বিদেশী চকলেট আনে। আমি তাড়াতাড়ি ডিপফ্রিজটা খুললাম। সেখান থেকে প্রথমে বেরোল সেলোফেনে মোড়া জমাট শক্ত একটা কাঁচা মুগী। সোলোফেনে মোড়া একতাল রোস্টের মাংস। একটা ছোট্ট চার ইঞ্চি লম্বা আড়াই ইঞ্চি চওড়া সেলোফেনে মোড়া প্যাকেট। আমি কৌতুহলী হয়ে সেটা খুলেই থমকে গেলাম। ডিপফ্রিজের ভেতর ওই অদ্ভুত জিনিস দুটো দেখব বলে ভাবতে পারিনি। একটা ছোট্ট ডায়েরি আর একটা চাবি। চাবিতে লেখা ‘Made in U.S.A.’

ডায়েরিতে পেন্সিল দিয়ে লেখা আছে নানান ফিগার। রোমান হরফে কত কি সব লেখা ছিল। কিন্তু কোন কিছুরই মানে হয় না। দীর্ঘ তিন মিনিট ধরে মাত্র একটা লাইনের পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। বুঝলাম, ডায়েরিটা সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা।

চাবিটা আমি সমস্ত আলমারি ও বাক্সে লাগাবার চেষ্টা করলাম। কোথাও লাগল না। কোন রহস্যই সমাধান করতে না পেরে সে দুটো পকেটে ফেলে অদৃশ্য হলাম।

পরের দিন কাগজে হত্যার বিবরণ বেরোল। আমার সিগারেট লাইটারের ছবি ছাপা হয়েছে। অন্তত পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ছবি। তলায় লেখা : কলকাতার প্রখ্যাত গুণ্ডা হিমাদ্রি সরকারের নামাঙ্কিত এই সোনার সিগারেট লাইটারটা মৃতদেহের পাশে পাওয়া গেছে।

‘এ বিষয়ে ডি-সি, ডি-ডি শ্ৰীবিকাশ চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তবে কমিশনার শ্রীরবি সেন বলেন, এই হিমাদ্রি সরকার এককালে মধ্য কলকাতার অন্ধকার জগতের সম্রাট ছিল। কি এক অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘ বার বছর আগে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। দীর্ঘ বার বছর সে কোথায় ছিল, তা কেউ জানে না। এই দীর্ঘ বার বছর পর সে ফিরে এসে কলকাতায় ত্রাসের রাজত্ব বিস্তার করতে চাইছে। তবে এতদিন সে অন্ধকার জগতের সম্রাটদের সঙ্গেই সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। দীর্ঘ বার বছর কি চৌদ্দ বছর আগে সে মধ্য কলকাতার সম্রাট বদ্রিপ্রসাদকে সরিয়ে সিংহাসন দখল করেছিল। বার বছর পর ফিরে এসে সম্রাট পঞ্চাকে সরিয়েছে। এই প্রথম একটা নাগরিকের মৃত্যুর সঙ্গে তার যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে। পুলিশ তার খোঁজ করছে।’

কাগজটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখতেই প্রণব বলল, ‘গুরু, এবার তোমার ওপর পুলিশের নজর পড়েছে। এবার তুমি ফুটে যাও, কেননা, পুলিশ এখানেও তোমার খোঁজ করবে।’

আমি চুপ করে ভাবতে লাগলাম। প্রণব প্রশ্ন করল, ‘তোমার উদ্দেশ্যটা কি?’

আমি মুখ তুলে প্রশ্ন করলাম, মানে?

‘মানে তুমি কি চাও? সেই চোদ্দ বছর আগে এই রাজ্যজয়ের জন্যে তুমি বদ্রির সঙ্গে বিবাদে নামলে। বদ্রিকে খুন করে রাজ্য নিলে। সে রাজ্য ভোগ করলে না। একদিন হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলে। বার বছর তোমার পাত্তাই পাওয়া গেল না। ফিরে এসে পঞ্চাকে সরালে। শেখর সেন তোমার অনুপস্থিতিতে ফিরে এসেছিল সাউথে। আজ সেও অদৃশ্য। অথচ তুমি তো রাজ্যপাট খুলে জাঁকিয়ে বসলে না।’

টেবিলের ওপর কুকুরের গলায় বাঁধার একটা চেন ছিল। আমি সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। নানান চিন্তার ঢেউ আমার মনের মধ্যে।

আমি উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে গেল। দরজার ফ্রেমে দুটো মূর্তি। শেখর সেনকে চিনতে কষ্ট হল না। বেশ মোটা হয়েছে। অ্যালকোহলিক শরীর। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে অনেকখানি।

ওর পাশে যে লোকটি দাঁড়িয়েছিল, তাকে আমি কোনদিন দেখিনি। মাঝারি দৈর্ঘের পেশীবহুল শক্ত শরীর। ছোট্ট কপাল। চোখ দুটো প্রায় দেখাই যায় না। শেখরের হাতে একটা পিস্তল।

সেদিকে তাকিয়ে প্রণব বলল, ‘ওসব এখানে নয় শেখর। এটা আমার বাড়ি।’

শেখর বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘তোমার ঘরেই তো একটা খুনের আসামী লুকিয়ে আছে প্রণব। তুমি পুলিশকে খবর দাওনি কেন?’

‘তোমরা কি চাও? প্রণব প্রশ্ন করল।

‘ফেরার হিমাদ্রি সরকারকে গ্রেপ্তার করতে এসেছি। যাকে বলে ‘Citizen’s arrest’.

আমি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। সেই পেশীবহুল লোকটা দ্রুত এসে দাঁড়াল আমার সামনে। আমি তাকে উপেক্ষা করে বললাম, ‘কুত্তা কভি শের নহি বনতা।’

শেখর হেসে বলল, ‘কিন্তু হিমাদ্রি, শের কুত্তা বনতা হ্যায়।’

আমি বললাম, একদিন বদ্রির হয়ে তুমি আমায় খুন করতে এসেছিলে। তারপর আমি তোমায় হাতে পেয়েও ক্ষমা করেছিলাম।’

কিন্তু আমার নাকের পাশে, আমার ডান দিকের উরুতে সেই কাটা দাগ দুটো এখনও আছে হিমাদ্রি। তোমার কানপুরিয়ার দাগ। এই দেখ, আমার কড়ে আঙুলটা। সেদিন শায়েস্তা খাঁর মত অর্ধেক কড়ে আঙুল তোমার কাছে জমা রেখে পালিয়েছিলাম। আজ আমার দিন হিমাদ্রি! দীর্ঘ বার বছর পর তোমায় হাতের মুঠোয় পেয়েছি। ‘বাহারে ফিরতি আতি হ্যায়’।

বললাম, আমাকে ঘাটালে তোমার লাভের বদলে ক্ষতি হবে শেখর।’

ওঃ। পেটে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়লাম। সেই পেশীবহুল লোকটা প্রচণ্ড জোরে এক ঘুষি মেরেছে আমার পেটে। আমি হারানো দম ফিরে পাবার আগেই বাঁ দিকের কানের নিচে পড়ল আর একটা ঘুষি। আমি টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে টেবিলের ওপর পড়লাম।

শেখরের হাতে পিস্তল। আমি হাত চালাতে পারব না। অথচ আমাকে অসহায় হয়ে এই লোকটার কাছে মার খেতে হবে। আমি জানি লোকটা প্রস্তুত হয়ে আছে। আমি টেবিল থেকে মুখ তুললেই তলপেটে বা নাকের ওপর একটা ঘুষি পড়বে। বাধা দিলে শেখর গুলি করতে পারে।

আমি মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম। আমার হাত দুটো বুকের নিচে। আর হাতের নিচে কুকুরের চেনটা। আমার শরীরের পটুতা এবং ক্ষিপ্রতা সম্বন্ধে ওদের কোন ধারণা নেই। সেইটা কাজে লাগাতে হবে। এটাতে রিস্ক আছে। কিন্তু এটাই আমার একমাত্র সুযোগ।

আমি খুব সাবধানে কুকুরের চেনটার একপ্রান্ত হাতে ধরলাম। প্রণব বলছে, ‘আমার বাড়িতে এগুলো না করলেও পারতে শেখর।’

এবার শেখর নিশ্চয় প্রণবের দিকে তাকিয়েছে। আমি বিদ্যুৎ গতিতে শরীরটা শেখরের দিকে ঝুঁকিয়ে ডান হাতে চেনটা টিপ করে ঘুরিয়ে মারলাম শেখরের হাতে। শেখর প্রস্তুত ছিল না। শেখরের হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে যাবার সময় একটা গুলি বেরিয়ে গেল।

আমি আমার সমস্ত ক্রোধ ঢেলে দিলাম আমার ডান হাতের হাড় ও পেশীতে যেটা ছিটকে গিয়ে লাগল ওর নাকে। শেখর টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, আমি সেই পতনোম্মুখ শরীরটা লক্ষ্য করে তীব্র পাঞ্চ করলাম ডান হাতে। শেখর গড়িয়ে পড়ল। প্রণবকে বললাম, ‘ওকে বাঁধ।’ কিন্তু ওকে বাঁধার দরকার ছিল না। মাটিতে পড়ার আগেই শেখর জ্ঞান হারিয়েছিল।

আমি মুখ ফেরালাম সেই পেশীবহুল লোকটাকে শিক্ষা দেবার জন্যে। কিন্তু একি! সে তো নেই। আমি যখন শেখরকে নিয়ে ব্যস্ত, সেই সুযোগে সেই বীরপুরুষ অদৃশ্য হয়ে গেছে।

আমি একটা চেয়ারে বসে হাঁপাতে লাগলাম। প্রণব তাড়াতাড়ি একটা গ্লাস করে হুইস্কি ঢেলে নিয়ে এল। আমি রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললাম, ‘আমার গগলস্‌টা কোথায় পড়েছে দেখ তো।’

প্রণব কালো চশমাটা কুড়িয়ে এনে আমার হাতে দিতে দিতে বলল, ‘তুমি চিরদিন আমাদের অবাক করে আসছ, হিমু।’

‘আত্মরক্ষার মধ্যে আবার অবাক হবার মত কি দেখলে?’

বুদ্ধি এবং শরীরের ক্ষিপ্রতা। তোমার হাত-পা চালানোর গতিবেগ সত্যিই প্রশংসা পাবার মত।’

‘সামনে প্রশংসা করতে নেই প্রণব। প্র্যাকটিশ থাকলে তুমিও পারবে।’

‘কোথায় শিখলে এসব?’

‘তোমার মনে নেই, আমি ছেলেবেলা থেকে জিমনাস্টিক। জুড়ো শিখেছি?’

‘এ সমস্তই কি…?’

না। পৃথিবীর পাঠশালায় অনেক কিছু শিখতে হয় প্রণব। এ বিষয়ে আমার গুরু এবং বন্ধু ফ্র্যাঙ্ক জিৱেলি।

‘সেটা আবার কে?’

‘তুমি চিনবে না তাকে। ওস্তাদ লোক।’

এক মিনিট থেমে বললাম, আমার সুটকেশটা দাও প্রণব, এবার আমায় হারিয়ে যেতে হবে।’ আমি সুটকেশটা হাতে নিয়ে বললাম, পুলিশ আসবে প্রণব। শেখরকে তাদের হাতে দিও। যা দেখেছ, তাই বলবে।’

কথা শেষ করে পথে নেমে এলাম।

অ্যাটলান্টা এয়ারপোর্টে যখন নামলাম, তখন রাত আটটা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব জর্জিয়া প্রদেশের রাজধানীর নাম অ্যাটলান্টা। অনেকে বলেন ক্যাপিটাল অভ দি ডিক্সিল্যান্ড। গৃহযুদ্ধের সময় অ্যাটলান্টা ছিল কনফিডারেটের ঘাঁটি। Sherman আদেশ দিয়েছিলেন, অ্যাটলান্টাকে ধ্বংস করে দিতে। সেই গৃহযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা গন উইথ দি উইন্ড’ পড়েনি, এমন লোককে শিক্ষিতের মধ্যে গণ্য করা হয় না। সেই গল্পের লেখিকা মাগারেট মিচেল এই শহরেই গাড়ি চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলেন। ১৮৬৪ সালে জুলাই মাসে ৯৯,০০০ সৈন্য নিয়ে শেরম্যান অ্যাটলান্টায় ঢুকেছিলেন। মাত্র চারশ বাড়ি রক্ষা পেয়েছিল। একটা ইটের ওপর আর একটা ইট ছিল না। এই চারশ’ বাড়ি ছাড়া। কিন্তু সে সব গন্ উইথ দি উইন্ড। আজ অ্যাটলান্টাকে দেখলে অবাক হতে হয়। দক্ষিণের অন্যতম ব্যস্ত শহর।

অ্যাটলান্টায় আমার বাসস্থান ছিল। যাকে বলে, Home away from home, পিডমন্ট অ্যাভিন্যুতে মিসেস ম্যান্সফিল্ডের বাড়ি। আমি দীর্ঘদিন সেখানে ছিলাম। নিজের কোন ছেলেমেয়ে ছিল না। আমাকে ঠিক ছেলের মতই ভালবাসতেন। আমি তাঁকে American mother বলতাম। ওখানে সুটকেশ রেখে মিনিট দশেক কথাবার্তা বলে বেরিয়ে এলাম মিসেস ম্যান্সফিল্ডের গাড়িটা নিয়ে।

ডাউন টাউনে পীচট্রি স্ত্রীট-এর ওপরই F. B. I-এর Federal Field office.ইন্সপেক্টর বব্‌ লোগান একগাদা ফাইলের মধ্যে ডুবে ছিল। আমাকে দেখে আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। দুজনে করমর্দন করে বসলাম। আমি ওর বাড়ি উঠতে পারছি না শুনে দুঃখ পেল। তারপর নানান কথা হল। পুরোন দিনের কথা।

তারপর এক সময় এ প্রশ্ন করল, কত দিন থাকছ এখানে?’

বললাম, “দুচারদিন বব্‌। আমি বেড়াতে আসিনি। একটা বিশেষ দরকারে এসেছি। তোমার সাহায্য চাই।’

নিশ্চয়। বল, কি ধরনের সাহায্য চাও।

আমি পকেট থেকে বুলেটটা বার করে টেবিলের ওপর রাখলাম। বব্‌ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। আমি বললাম, এই গুলিটা পাঁচশ’ গজেরও বেশি দূর থেকে ছোঁড়া হয়েছিল। গুলিটা যার লেগেছিল, সে গুলি খাবার পরও হাত পাঁচ-ছয় ছিটকে গেছিল।

বব্‌ বলল, “তার মানে তখনো গুলিটার পেছনে প্রচণ্ড ফোর্স ছিল।

আমি বললাম, ঠিক তাই। অথাৎ গুলিটা এক হাজার গজ দূর থেকে এসে লাগলেও মৃত্যু অবধাবিত।’

‘দিনের কোন সময় লেগেছিল গুলিটা?

‘দিনে নয়, রাতে।’

‘রাতে! আলো হিল? বব খানিকটা অবাক হয়েছে।

সামান্য—খুব সামান্য আলো।’

‘আই ডোন্ট লাইক দিস, হিমু। তুমি নিজেই এর উত্তর জানো। এই গুলিটার ওজন কত?

‘তিনশ গ্রাম। স্টিল জ্যাকেট। ম্যাগনাম।

‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ! ব্রাউনিং, রেমিংটন, ওয়েসন অ্যান্ড স্মিত কেউ এ ধরনের রাইফেল তৈরি করে বলে শুনিনি আমি।’

বব্‌ বেল বাজাল। ঘরে এসে ঢুকল ওর সেক্রেটারি। বব বিস্তারিতভাবে মেয়েটিকে সবকিছু বলল। ওর হাতে গুলিটা দিয়ে বলল, ‘Take this to the all boys, Martha, ওদের ওই বর্ণনাটা দাও। দেখ, খুঁজে বার করতে পারে কিনা রাইফেলটার নাম।’

মেয়েটি চলে গেলে ব বলল, “রাতের অন্ধকারে অতদূর থেকে যে ধাবমান লক্ষ্যে গুলি করেছে, সে খুব সোজা লোক নয়, হিমু। সাবধান!

হেসে বললাম, ‘আমি মোটামুটি উত্তরটা জানি। তবু তোমাদের এক্সপার্টদের রিপোর্টটা পেলে ভাল হয়।’

‘পাবে। কিন্তু শুধু এইটুকু জানার জন্যে তুমি সাগর পার হয়ে এখানে এসেছ?

হেসে বললাম, না, আমি এই খুনের কিনারা করতে চাই। আর এই খুনের কারণ লুকিয়ে আছে এই দেশে।’

বব্‌ ভূ নাচিয়ে বলল, ‘Land of the criminals!’

আমি হাসতে হাসতে উঠে পড়লাম। বব্‌ বলল, ‘সকালে এসে রিপোর্টটা নিয়ে যেও।’

ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলাম পিডমন্ট অ্যাভিনিউতে মিসেস ম্যান্সফিল্ডের বাড়ি। বরাবরই উনি উপাদেয় খাদ্য প্রস্তুত করেন। খাবার টেবিলে বসে মন ভরে গেল। বহুদিন অত ভাল খাবার খাইনি।

পরের দিন ঠিক সময়েই ‘ফিল্ড অফিস’-এ এলাম। বব প্রস্তুত হয়ে ছিল। আমি ওর সামনের আসনে বসতেই ও একটা টাইপ-করা কাগজ বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বলল, ‘পড়।’

মাত্র কুড়ি লাইনের রিপোর্ট। আমার পকেটেও একটা রিপোর্ট আছে। দুটোর সারমর্ম একই। অর্থাৎ আমার ধারণাই ঠিক। আমার পড়া শেষ হলে ব বলল, ‘লং রেঞ্জ রাইফেল তাতে কোন সন্দেহ নেই। অন্ধকারে এক হাজার গজ দূর থেকে গুলি করতে হলে প্রয়োজন a telescopic sight with a top magnification of 30, এটা ওই রাইফেলে ছিল। শুধু তাই নয়, নিশ্চয় ওই টেলিস্কোপ-এর নিজস্ব রেঞ্জ-ফাইন্ডিং সিস্টেম আছে।’

বব্‌ থামল। আমি বললাম, ‘তিনশ’ গ্রাম ওজনের একটা ম্যাগনাম লোড’ বুলেট ছোঁড়ার জন্যে নিশ্চয়ই:375 চেম্বার দরকার।’

বব্‌ বলল, ‘কোন সন্দেহ নেই। বুলেটটা তো :375 ম্যাগনাম পোড়। অথাৎ high velocity, low trajectory.’

আমি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। মনস্থির করে বললাম, বব্‌, তুমি দীর্ঘ বিশ বছর এই চাকরি করছ। তুমি প্রায় সমস্ত নামকরা ক্রিমিনালদের চেনেনা, তাই না?’

সকলকে না হলেও প্রতিভাধরগুলোকে চিনি।’

‘বলতে পার বব্‌, আধমাইল দূর থেকে এই ধরনের একটা রাইফেল দিয়ে কে ধাবমান একটা লক্ষ্যে গুলি করতে পারে?’

বব্‌ একটু চিন্তা করে বলল, ‘একাধিক লোক একাজ করতে পারবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে আমি মাত্র একজনকেই জানি। সে একজন টপ ক্রিমিনাল। নাম ফ্রাঙ্ক জিরেলি। চিকাগোের ক্রাইম বস।’

আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, ‘আমাকে চিকাগো যেতে হবে বব্‌।’

‘বস হিমু, বস। জিরেলির সঙ্গে দেখা করার জন্যে চিকাগো যাবার দরকার নেই। He is right here in Georgea doing his time in the U.S. Penitentiary,’

আমি কয়েক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘তাহলে?’

বব্‌ হেসে বলল, ‘হাসিও না হিমু : জিরেলি নিশ্চয় জেল থেকে বেরিয়ে সমুদ্র পার হয়ে একটা মেয়েকে খুন করে আবার জেলের ভেতর ঢুকে যায়নি।’

জিরেলির সঙ্গে আমার ভাল পরিচয় আছে। কিন্তু একটা F.B.I-এর অফিসারকে সেকথা বলা যায় না।

বললাম, ‘জিরেলির সাথে আমি-দেখা করতে চাই। ক্যান ইউ ফিক্স ইট?

‘সিওর। কবে দেখা করতে চাও?’

‘আজ?’

‘কখন?’

‘লাঞ্চের পর।’

‘ঠিক আছে। আমি এখানেই থাকব। তোমাকে গাড়ি আনতে হবে না।’

আমি ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

মিসেস ম্যান্সফিল্ড অপেক্ষা করছিলেন। খেতে খেতে অনেক কথা হল। উনি বললেন, ‘আমি যদি কিছু সাহায্য করতে পারি তো জানিও। তুমি জান, আইক্যান ডু এনিথিং ফর ইউ।’

খাবার পর ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিলাম। জিরেলি আমায় চিনতে পারবে কিনা জানি না। অনেক বছর আগে আমি জিরেলির উপকার করেছিলাম। জিরেলির ক্ষমতা অসীম। ইচ্ছা করলে সে আমাকে সাহায্য করতে পারে।

দেড়টা নাগাদ জামা-কাপড় বদলে বেরিয়ে এলাম বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে। একটা ট্যাক্সি ধরে চলে এলাম ববের অফিসে।

বব্‌ হাতের ফাইলটা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। আমরা নিচে এসে গাড়িতে বসলাম। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বব বলল, ‘জিরেলির সম্পর্কে তুমি কিছু জান কিনা জানি না। সাঘাতিক বলতে যা বোঝায় জিরেলি ঠিক তাই। নিষ্ঠুরতায় তার জুড়ি পাওয়া মুশকিল। আমরা বহু চেষ্টা করেও তাকে ধরতে পারিনি। তুমি জান, অর্গানাইজেশনের সিস্টেম, ওপরের লোককে কিছুতেই ছোঁয়া যায় না। কিন্তু জিরেলির একটা দুর্বলতা ছিল। মেয়ে। একটা মেয়ের জন্য সে একজনকে খুন করে বসল। সেই মেয়েটাই সাক্ষী ছিল। জিরেলির জেল হল। কিন্তু মেয়েটাকে বাঁচাতে পারিনি। তিন দিন পর অ্যাটলান্টা স্টেডিয়ামের কাছেই তার মৃতদেহ পাওয়া গেল।’

বব্‌ থামল। আমি জিরেলির অনেক কাহিনী জানতাম। আমি বললাম, ‘বব্‌, আমি জিরেলির সঙ্গে এমন একটা ঘরে বসে কথা বলতে চাই, যেখানে কোন bugs বা মাইক্রোফোন নেই।’

বব্‌ হাসল, ‘O. K. boy’.

বব্‌ আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমাকে এনে একটা সুদশ্য ঘরে বসাল। জেলখানায় এত সুন্দর ঘর থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। আমেরিকায় বোধ হয় সবই সম্ভব। বব্‌ বলল, আমি এই প্রোটেকটেড এরিয়ার বাইরে অফিসে অপেক্ষা করব। তুমি এখানে বসে কথা বলবে।’

বব্‌ চলে যাবার মিনিট পাঁচেক পরে জিরেলি এল। জিরেলির দীর্ঘ সুগঠিত শরীর ঠিক আগের মতই আছে। ছোট ছোট চোখজোড়া হাসছে। এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘কি খবর হিমু?’

করমর্দন করে বললাম, ‘কেমন আছ?’

‘ভাল। বব্‌ লোগানের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে জানতাম না। ওর হয়ে আমার পেট থেকে কিছু কথা বার করতে চাও নাকি?’

আমি এক মুহূর্ত থমকে থেমে বললাম, “জিরেলি, আমি জীবনে কাউকে প্রতারণা করিনি।’

‘মানুষ বদলায় হিমু।’

‘আমি মানুষ নই, অমানুষ।’

জিরেলি শব্দ করে হেসে উঠল, ‘ভাল বলেছ। তা এ ঘরটায় রেকর্ডিং সিস্টেম নেই তো?’

‘আমি বলছি, আমি প্রতারণা করতে আসিনি।’

‘তুমি হয়তো জান না। বব্‌ লোগান প্রচণ্ড ধড়িবাজ। কত অল্প বয়সে ইন্সপেক্টর হয়ে গেছে, দেখছ না।’

‘জিরেলি, আর্মি ভারতীয় এবং ভারতের নাগরিক। I have no interestin Bobs affairs.

‘God, Shoot, কি কথা আছে, বল।’

আমি জিরেলির চোখের ওপর চোখ রেখে বললাম, ‘সমস্ত আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র সম্বন্ধে তোমার মত অভিজ্ঞ লোক আর দ্বিতীয় নেই।’

‘কথাটা শুনে গর্বিত হচ্ছি।’

‘আমি তোমার সাহায্য চাই জিরেলি।’

‘সাহায্য। জিরেলি প্রচণ্ড শব্দ করে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে বলল, ‘ভূতের কাছে ল্যাঙ্গট চাইছ?’

‘হাসছ কেন জিৱেলি?’

‘হাসব না? আমি জেলখানায় বন্দী আর তুমি এসেছ আমার কাছে সাহায্য চাইতে? আমি কি করে তোমাকে সাহায্য করব?’

বললাম, ‘তুমি জেলের ভেতর থাকলেও তোমার ক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়নি। তুমি জেলের ভেতর থেকেই রাজ্যশাসন করছ তা আমি জানি। এই রিপোর্টটা পড়। আমি জানি এত দূর থেকে তোমার মত আর কেউ গুলি করতে পারে না।’

জিরেলি রিপোর্টটা পড়ল। গম্ভীর হয়ে গেল ওর মুখ। আমি বললাম, কিছু বলবে জিরেলি?

তুমি কি বলছ যে আমিই এই খুনটা করেছি?’

‘না জিরেলি, সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু কেউ একজন করেছে। সেটা কে?’

জিরেলি অনেকক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘শ্রেষ্ঠ পাঁচজনের নাম বলতে পারি। নিউ ইয়র্কের মার্ক এবং লুসিয়ানো। ফ্লোরিডার জো মার্সিয়ানো। ‘ডেট্রয়িটের প্যাট অ্যাকার্তে এবং নিউ ইংলন্ডের জনসন।’

‘সকলেই সিসিলিয়ান?’

‘একজন ছাড়া।’

‘কে’

‘জনসন।’

‘সাদা আমেরিকান?’

‘কালো। ব্ল্যাক মাফিয়া। তুমি নিশ্চয়ই জান, ব্ল্যাক মাফিয়াদের কথা। প্রথম যুগে আমরা যেমন আইরিশদের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলাম, তেমনি ওরা আমাদের সাথে লড়াই করছে। এবং অর্ধেক সাম্রাজ্য ওদের হাতের মুঠোয় চলে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি অদূর ভবিষ্যতে ওরাই সমস্ত আমেরিকা নিয়ে নেবে বলে আমার মনে হয়। নিষ্ঠুরতায় ওরা আমাদেরও হার মানায়।’

জনসনের বিষয় কিছু জানতে চাই জিরেলি।’

জিরেলি খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কিন্তু পারবে না হিমু। একটা অগনাইজড দলের বিরুদ্ধে তুমি কিছুই করতে পারবে না।’

‘আমি শুধু ওর বিষয় জানতে চাই।’

‘জনসন হল, আমরা যাকে বলি ‘ট্রিগার ব্যাপি ম্যান’। ও কোরিয়াতে চমক সৃষ্টি করেছিল। বীরত্বের জন্যে সম্মান পেয়েছে। কিন্তু দেশে ফিরে হয়ে গেছে অপরাধী। সাহস এবং ধৈর্য দুটোই আছে।’

‘জনসন শিল্পী কেমন?’

আমার চেয়ে ভাল। আমি অল্প বয়সে যেমন ছিলাম। কিন্তু মানুষ হিসেবে জনসন ডেঞ্জারাস।’

‘আচ্ছা জিরেলি, তিনশ গ্রাম ওজনের হাই ভেলোসিটির ব্লাগ এক হাজার গজ দূরে ছোড়া যায় কোন রাইফেলের সাহায্যে?’

‘নিজের তৈরি রাইফেলে।’

‘নিজের তৈরি?

হ্যাঁ। বিভিন্ন রাইফেলের ভাল ভাল পার্টসগুলো যদি ঠিকমত লাগাতে পার, ভাল টেলিস্কোপ জোগাড় করতে পার, তাহলেই দেখবে you will have something new। এবং জনসন অনায়াসে ওই ধরনের একটা রি-মডেলড রাইফেল তৈরি করতে পারে।’

কথা শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল জিরেলি। জানলা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখতে লাগল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই হিমু।’

বললাম, বল জিরেলি।’

‘তুমি কি জন্যে এখানে মানে আমেরিকায় এসেছ?

‘আমি দুঃখিত জিরেলি। আমার পক্ষে কোন কিছু বলা সম্ভব নয়।

‘বেশ, আমি যদি বলি তুমি গত রাতে অ্যাটলান্টায় এসেছ এবং পিডমন্ট অ্যাভিনিউতে মিসেস ম্যান্সফিন্ডের বাড়ি উঠেছ, তাহলে তুমি কি বলবে?’

‘আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কি করে জানলে?’

জিরেলি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘Run friend, run.’

আমি চুপ করে রইলাম।

জিরেলি বলল, আমরা মাফিয়ারা বড় অদ্ভুত জীব হিমু। আমরা যেখানেই থাকি, খবর ঠিক পৌছয়। Cosa Nostra got the word that you are here on a darigerous mission and you are a very close friend of Bob Logan, সেই জন্যে তারা চিন্তিত।’

‘কে বলেছে তোমায়?’

‘আমার বন্ধু নিউ ইয়র্কের ক্রাইম বসু কালো গ্যামবিনো।’

‘তাকে বল, আমি শুধু জনসনকে চাই।’

‘কিন্তু আমি বলছি হিম, সাবধান। You better cary a biscuit or you are going to have a serious headache.’

জিরেলি সম্পূর্ণ মাফিয়াদের ভাষায় কথা বলছে, biscuit মানে পিস্তল, serious headache মানে মাথায় বুলেট। জিরেলি আবার বলল, আমার কথা শোনে ; ভারতে ফিরে যাও।’

আমার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেল। আমি ধীরে ধীরে বললাম, তুমি জান জিরেলি, আমি জীবনে কোনদিন কাউকে ভয় করিনি। তোমরা মাফিয়ারা সমাজ জীবনের ক্যান্সার। তোমাদের আমি ভয় করব?

‘ক্যান্সারকে সকলে ভয় করে, হিমু। মাফিয়াদের সমকক্ষ কেউ নেই।’

“তাহলে তুমি জেলের মধ্যে কেন?’

‘তোমার দেশপ্রেম তোমাকে ডোবাবে।’

বললাম, ‘জিরেলি, তোমরা তো ক্রিমিনাল। তোমাদের তো দেশপ্রেম থাকতে নেই। অথচ প্রেসিডেন্ট কেনেডির কথায়, সি-আই-এর প্ররোচনায় একজন মাফিয়া নিজের জীবন বিপন্ন করে ক্যাসট্রোকে খুন করতে প্রস্তুত হয়েছিল। কেন জিরেলি?’

জিরেলি হেসে বলল, ‘তুমিই জিতলে।’

‘তুমি আমায় বার বার ফিরে যেতে বলছ কেন?’

‘Because they are here in Atlanta, তোমার জন্যে জাল বিছিয়ে রেখেছে তারা।’

আমি হেসে বললাম, আমি মরলেও ওরা রেহাই পাবে না, জিরেলি।’

জিরেলি আবার হাসল, ‘ভাল কথা। মরবার সময় আমায় মনে করো, উইল করে তোমার আয়ুটা আমায় দিয়ে যেও।’

আমিও হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালাম। জিরেলির সাথে করমর্দন করে বেরিয়ে এলাম।

গাড়ি করে ফেরার পথে বব্‌ বলল, তোমাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে হিমু। আমি কি তোমায় কোনভাবে সাহায্য করতে পারি?’

আমি চিন্তিত হয়ে বললাম, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না বব্‌।

কিন্তু হিমু, বেআইনি কিছু করো না। আমেরিকান নাগরিকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে, এদেশের আইনের সাহায্য নেওয়া উচিত।’

আমি বললাম, ‘বব, She’s got a headache. এ ধরনের ভাষা কারা ব্যবহার করে?’

চমকে মুখ ফিরিয়ে বব্‌ তাকাল আমার দিকে, কি বলছ তুমি? ওটা মাফিয়াদের ভাষা। ও কথার মানে A bullet in the head.’

‘আমার তাই মনে হয়েছিল, বব্‌।’

বব্‌ বলল, ‘মাফিয়ারা সাঙ্ঘাতিক জীব, হিমু। সাবধান।

ওই ভাষা এবং ওই অদ্ভুত রাইফেলের ব্যবহার দেখেই আমি বুঝেছি, এটা মাফিয়াদের কাজ।

‘মাফিয়ারা ভারতে কি করছে?’

ওরা ভারতের দিকে হাত বাড়িয়েছে। আবুধাবী থেকে সোনা, হীরে এবং নানান জিনিস পাঠাচ্ছে চোরা পথে ভারতে। বিশেষ করে ভারতের পশ্চিম উপকূলে।’

বব্‌ বলল, তাহলে তো ভারতের ক্ষতি হচ্ছে। দেশে প্রচুর কালো টাকা জমছে।’

‘সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মনে হয় বন্ধ করা যাবে।’

ববের অফিসের সামনে এসে পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নেমে ববকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। উল্টো দিকের ফুটপাথে একটা পোস্টের নিচে একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ তার দুটো পা গজালো। সে ফুটপাথ পার হয়ে দূরত্ব রেখে আমার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল।

কিছু দূর আসার পর সামনেই দেখতে পেলাম ডেভিডসনের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। আমি ঢুকে পড়লাম। অটোমেটিক রোলিং সিঁড়ি ধরে দোতলায় এলাম। সামনে জুয়েলারী কাউন্টারে দাঁড়ালাম। সামনের আয়নায় দেখতে পেলাম তাকে। নিগ্রো। মাঝারি দৈর্ঘ। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, ওর জ্যাকেটের নিচে একটা আগ্নেয়াস্ত্র আছে। পথে বেরিয়ে এলাম।

আমি রাস্তা পার হয়ে বেকার স্ত্রীটে ঢুকলাম। খানিকটা গিয়েই ডান দিকে বাঁক নিলাম। সামনে একটা ফোন বুথ। ফোন বুথের ওপরটা কাচের। নিচের অর্ধেকটা কাঠের।

আমি ফোন বুথে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর বসে পড়লাম ভেতরে। বাইরে থেকে মনে হবে ফোন বুথে কেউ নেই। খানিকক্ষণ পর দরজার ফাঁক দিয়ে তাকে দেখতে পেলাম। লোকটা ফোন বুথের সামনে দাঁড়িয়ে দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

আমি আমার বগলের নিচ থেকে পিস্তলটা বার করে নিঃশব্দে দরজা খুলে ওর পেছনে দাঁড়ালাম, তারপর পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করলাম ওর মাথায়।

ওর দেহটা টেনে এনে ফোন বুথের মধ্যে ফেললাম। তারপর কাগজ বার করে লিখলাম ‘আমি তোমাকে চিনি, তবু পুলিশের কাছে যাইনি, কারণ আমি কাপুরুষ নই। আমি বিদেশী। একা। তুমি দল নিয়ে লড়ছ, কারণ তুমি কাপুরুষ এবং তুমি ভয় পেয়েছ। আমি যাচ্ছি স্প্রীং ষ্ট্রীট-এর হোটেলে। আমার কাছে শুধু একটা পিস্তল আছে। If you are man enough, come and get me.’।

কাগজটা ভাঁজ করে লোকটার পকেটে দিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলাম।

আমি বাসস্থান বদল করছি শুনে মিসেস ম্যান্সফিল্ড খুবই দুঃখিত হলেন। আমি তাকে বোঝালাম,’এ ছাড়া উপায় নেই। ওরা হয়তো ডিনামাইট দিয়ে গোটা বাড়িটা উড়িয়ে দেবে।

উনি বললেন, কিন্তু তুমি যখন তাকে চেন, তখন কেন পুলিশকে বলছ না? নিজে এই বিপদের মধ্যে যাচ্ছ কেন?’

আমি বললাম, ‘তার কারণ আমি প্রমাণ করতে পারব না যে, সে খুনী। তার চেয়েও বড় কথা, আমার জানা দরকার, কি কারণে অনীতাকে খুন করা হয়েছে।অর্থাৎ একটা ভারতীয় মেয়ে এদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল কি করে?

তাহলে তুমি যা ভাল বোঝ, তাই কর। কিন্তু সাবধান, হিম। মনে রেখ, পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য অপরাবাদের সঙ্গে তুমি পাঞ্জা ধরতে যাচ্ছ। সামান্য ভুলের জন্যে তোমার মৃত্যু হতে পারে।’

কথা শেষ করে উনি আমাকে নিয়ে প্রার্থনা করতে বসলেন। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, আমার প্রচুর আশীবাদের দরকার।

হোটেলটা প্রীং স্ট্রীটের ওপর। বলাই বাহুল্য ব্যয়বহুল এবং সুদৃশ্য। একটা কক্ষ ভাড়া নিলাম। পরিষ্কার হরফে নাম লিখলাম। শপক্ষ নিশ্চয় জানতে চাইবে যে আমি কত নম্বর ঘরে আছি। তারপর পাঠাবে আততায়ীকে।

আমি ওপরে এসে সুটকেশটা রেখে স্কচের বোতল বার করলাম।

টেবিলের ওপর মিনারেল ওয়াটার’ ছিল। গ্লাসে খানিকটা স্কচ ঢেলে জল মিশিয়ে খেতে লাগলাম।

হঠাৎ আমার চোখ পড়ল দরজার দিকে। দরজাটা দুটো ঘরের মধ্যে। অথাৎ দরজা খুললে পাশের ঘরে যাওয়া যায়। আগে জোড়া ঘর ছিল, এখন আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। দরজাটা ওপাশ থেকে বন্ধ।

আমি তাড়াতাড়ি নেমে এলাম। ফোন তুলে নিয়ে মিসেস ম্যান্সফিল্ডকে ফোন করলাম : ‘একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।’

‘বল, কি কাজ?’

একটা মেয়েকে জোগাড় করুন। আমার রুম নম্বর হল ৮৫, মেয়েটিকে বলবেন ৮৬ নম্বর ঘরটা নিতে। চাবিটা নিয়ে ওপরে আসবে। চাবিটা আমার ঘরের দরজার তলার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঠেলে দিয়ে হোটেলের পেছনের ‘ফায়ার ইস্কেপ দিয়ে আবার বেরিয়ে যাবে। ঠিকানা যেন আউট অফ টাউন লেখে।’

সামান্য একটু নীরব থাকার পর উনি বললেন, ‘বেশ, তাই হবে। হোপ ইউ নো হোয়াট ইউ আর ডুইং।’ উনি ফোন রেখে দিলেন।

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। চল্লিশ মিনিট পর আমার দরজার তলা দিয়ে চাবিটা ছিটকে এল।

দু-ঘরের মাঝের দরজায় এমন জায়গায় ফুটো করলাম যে সহজে কারুর নজরে পড়বার সম্ভাবনা রইল না। তারপর কাপড় বদলে নিচের লবিতে এলাম। দু-এক মিনিট উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করে ‘বারে’ এলাম। একটা ড্রাই মার্টিনির অডার দিলাম। ধীরে ধীরে পান করতে লাগলাম। আমি চাই শত্রু দেখুক আমায়।

মাটিনি পান করে উঠে দাঁড়ালাম। লবি পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গাড়ি বারান্দায় এলাম। দারোয়ান মুহুর্তের মধ্যে একটা ট্যাক্সি যেন পকেট থেকে বার করে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। দারোয়ানকে বকশিস দিতে দিতে মনে হল, কেউ যেন আমার পেছনে সিঁড়িতে পাড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করছে। আমি তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই ড্রাইভারকে বললাম, “Federal Field Office’, কথা শেষ করে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি প্রীং স্ট্রীট দিয়ে বেরোতেই ড্রাইভারকে বললাম, এমন একটা বারের সামনে থামাবে, যার পেছনের দিকে দরজা আছে। আমাকে সামনের দরজায় নামিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা পেছনের দরজায় এনে দাঁড় করাবে।’ একথানা দশ ডলারের নোট দিলাম ওর হাতে।

ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, ‘চোর-পুলিশ খেলছেন নাকি?

আমি হেসে বললাম, না। তোমার ড্রাইভিং মিররে দেখ না, আমার একটা লেজ গজিয়েছে। আই গট টু শেক ইট অফ।

ড্রাইভারের মুখে হাসি ফুটে উঠল। একটা বারের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, ‘সোজা ঢুকে পেছনে দিকে ল্যাট্রিন। তার পাশেই পেছনের দরজা।’

আমি যথারীতি সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে অপেক্ষমান ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। আমার অনুসরণকারী নিশ্চয় এখন সামনের রাস্তায় গাড়িটা পার্ক করে বসে আছে। ওর বিশ্রামের দরকার।

আমি জানি, আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে সে। আজ রাতেই প্রথম আক্রমণ হবে। অল ক্যাপন্‌-এর যুগে অ্যাটলান্টায় কাউকে খুন করবার দরকার হলে চিকাগো বা নিউইয়র্ক বা ফ্লোরিডা থেকে কাউকে পাঠানো হত। আততায়ী কোমরের দু-দিকে দুটো সিল্প শুটার ঝুলিয়ে কোথাও অপেক্ষা করত। তারপর শিকার দেখা দিলেই ব্যাং…ব্যাং…ব্যাং…

এখন টেকনিক পাল্টেছে। এখন মাডার ইনকরপোরেটের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ এখন নিত্য নতুন ফন্দি বার করা হয় খুন করার। আমাকে সেই ফন্দিটা ধরতে হবে।

সময় কাটানর জন্যে সোজা এলাম এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে একটা লং-ডিস্ট্যান্ট ফোন কল করলাম ভারতীয় দূতাবাসে। পার্সন টু পার্সন।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন বন্ধুবান্ধবদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। পথে একটা রেস্টুরেন্টে থেমে রাতের খাওয়া খেয়ে নিলাম। যখন ফিরলাম, তখন রাত দশটা। বলাই বাহুল্য হোটেলের পেছন দিকে ট্যাক্সিটা দাঁড় করালাম। আমার অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে চারদিকে দেখলাম। কোথাও কোন ছায়া দেখতে পেলাম না। সার্ভিস ইলিভেটরে করে ওপরে এলাম।

হলে এলাম। হলের দুদিকে সারি সারি কক্ষ। আমি পা টিপে টিপে একের পর এক ঘরগুলো পার হতে লাগলাম। আমার কক্ষ অর্থাৎ রুম নম্বর ৮৫ অতিক্রম করে রুম নম্বর ৮৬-তে ঢুকলাম। দরজাটা ভেতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে সতর্ক পদক্ষেপে দু-ঘরের মধ্যের দরজায় এসে দাঁড়ালাম।

সেই ফুটো দিয়ে ৮৫ নম্বর ঘরের ভেতর তাকালাম। ঘর অন্ধকার। ফুটোতে কান পাতলাম। ঘর নিস্তব্ধ ; কোন সাড়া-শব্দ নেই।

একটা সিগারেট ধরিয়ে খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলাম। পার্ক স্ত্রীটের রাস্তায় সাধারণ একটা হত্যা—অথচ তার পেছনে এই বিরাট রহস্য থাকতে পারে, তা আমি ভাবতে পারিনি। দীর্ঘদিন আগে আমি কয়েক বছর আমেরিকায় ছিলাম। তখন অনেক মাফিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ওদের কার্যকলাপ আমি জানি।

আমার নিজের জীবনের কথা মনে পড়ল। হিমাদ্রি সরকার যে-কোনদিন বিদেশের মাটিতে মরে পড়ে থাকতে পারে। কেউ জানতেও পারবে না। বদ্রিকে খুন করে মধ্য কলকাতায় রাজ্য স্থাপন করেছিলাম। গোটা কলকাতার ওপর প্রভুত্ব স্থাপন করেছিলাম। তারপর একদিন সব ছেড়েছুড়ে চলে গেলাম নিরুদ্দেশে। তারপর দীর্ঘ বার বছর পর আমার বন্ধু রঞ্জনের খুনীকে ধরার জন্যে কলকাতায় ফিরে আবিষ্কার করলাম এক গুপ্তচরচক্রের কার্যকলাপ।

আজ আবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। পৃথিবীর জঘন্যতম অপরাধী এই মাফিয়ারা। ইউরোপ ও আমেরিকা হল এদের লীলাভূমি। এবার এরা ভারতের দিকে হাত বাড়িয়েছে।

ঘর অন্ধকার করে রেখেছিলাম। বাতি জ্বাললাম। বোতলটা এনে খাটে বসলাম। বোতলে কয়েক চুমুক দিয়ে হাতঘড়িতে দেখলাম রাত বারটা। উঠে এসে মাঝের সেই দরজায় চোখ রাখলাম। কেউ নেই।

হঠাৎ হলে একটা শব্দ পেলাম। আমি আমার দরজার স্পাই-হোলে চোখ রেখে হলে দৃষ্টি ফেললাম। আমার রুমের সামনাসামনি ৭০ নম্বর ঘরে একজন মহিলা ঢুকছেন। তাঁর মুখ দেখতে পেলাম না। দেখা গেল তাঁর গাউনের প্রান্ত। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

আমি ফিরে এসে খাটে বসলাম। ওরা এখনো এল না। তাহলে কি আজ আর আসবে না? স্নায়ুর যুদ্ধ। যে ধৈর্য হারাবে, সেই হারবে। আমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। ৮৬ নম্বর রুমের সমস্ত জানলা বন্ধ ছিল। আমি জানলার পাশে এসে দাঁড়ালাম। জানলাটা সামান্য একটু ফাঁক করে রাস্তার দিকে তাকালাম। নিচে হোটেলের প্রবেশ-পথ। দু-একজন ঢুকছে বেরোচ্ছে। অদ্ভুত এই জাত। কখন এরা ঘুমোয় বলা মুশকিল। রাস্তায় দু-একটা মাতালকেও দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি উধ্বশ্বাসে ছুটছে।

আমার হোটেলের উল্টো দিকে, রাস্তার ওপারে একটা অফিস বিল্ডিং। বেনের জাত আমেরিকানরা। প্রতিদিন ব্যবসা বাড়াচ্ছে। চারদিকে শুধু বাড়ি হচ্ছে। আজ একটা দশতলা বাড়ি তৈরি করছে, কাল সেটাকে ভেঙে তুলছে একটা বিশতলা বাড়ি। স্ত্রীং স্ট্রীট, লাকি স্ট্রীট, পীচ ট্রি স্ত্রীট—সর্বত্র নতুন নতুন বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। আমি সে সব দেখছিলাম। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল একটা পাঁচতলা অর্ধসমাপ্ত বাড়ির দিকে।

বাড়িটা রাস্তার অপর প্রান্তে প্রায় দুশো গজ দূরে। একেবারে নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। অর্থাৎ হোটেলের জানলা আর সেই বাড়িটার জানলা একেবারে সামনাসামনি।

আমি মাঝের দরজাটা খুলে সুটকেশ থেকে দুরবিনটা নিয়ে এসে জানলার ফাঁকে রেখে দেখলাম। অসমাপ্ত বাড়িটা সম্পূর্ণ অন্ধকারে। শুধু পাঁচতলার একটা কক্ষে মাঝে মাঝে জোনাকির মত সামান্য একটু আলো জ্বলে উঠছে। বুঝলাম, মহাপুরুষ ওই অন্ধকারে রাইফেল নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ওই সামান্য আলো আর কিছু নয়—মহাপুরুষ ধূমপান করছেন।

ওরা জানে, আমি ৮৬ নম্বর কক্ষে নেই। সেই জন্যে ওরা আসেনি। কিন্তু ওরা যখন জানে যে, আমি ৮৫ নম্বর কক্ষে নেই, তখন রাস্তার ওপারে ওৎ পেতে বসে আছে কেন? তাহলে নিশ্চয় ওরা জানে যে, আমি ৮৬ নম্বর কক্ষে আছি। ওরা আসলে ঠকেনি। আমি ওদের ঠকিয়েছি মনে করে যেই ৮৬ নম্বর কক্ষের জানলাটা খুলব, অমনি ওরা একটা তপ্ত বুলেট পাঠিয়ে দিয়ে আমায় অবাক করে দিয়ে প্রমাণ করবে যে, আমার চালাকিটা ছেলেমানুষী ছাড়া আর কিছু নয়।

সাবাস!

একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ওরা হোটেলে এসে কোন অ্যাকশান করবে না। ওরা দূর থেকেই মৃত্যুকে পাঠাবে।

কিন্তু আমার ধারণা ভুল।

আমি জানলা থেকে মুখ ফেরাবার আগেই এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে গেল। ছিটকিনিটা দিয়ে দরজাটা বন্ধ করা ছিল, সেটা ক্রু সমেত মাটিতে পড়ে গেল। আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে, ওরা আগে থাকতে স্কুগুলো ঢিলে করে রেখেছিল। ওদের কার্যপদ্ধতি সত্যিই বোঝা খুব শক্ত।

দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে দৈত্যাকৃতি একটা নিগ্রো। হাতে একটা পিস্তল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কে তুমি?

সে বলল, ‘আমার মা আমায় মৃত্যু বলে ডাকত। চাবিটা দাও।’

‘চাবি! আমি অবাক হবার ভান করলাম, “কিসের চাবি?

Don’t kidd me Indian, Nobody idds us, দশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি, এয়ারপোর্টের লকারের চাবিটা দাও।’

আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। বুঝলাম, ও ইয়ার্কি করছে না। আমি চাবিটা দিলেও আমায় মরতে হবে, না দিলেও মরতে হবে। তবু চাবিটা দিলে যদি বাঁচতে পারি, সেই জন্যে পকেটে হাত দিলাম। হাতটা পকেট থেকে বার করার আগেই একটা ‘হিস…হিস শব্দ শুনে চমকে মুখ তুলে তাকালাম।

দৈত্যটা যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাক খেয়ে পড়ল। নড়ল না। আমি মাটি থেকে চোখ তুলে দরজার দিকে তাকালাম। আমার দরজার উল্টো দিকে ৭০ নম্বর কক্ষের দরজা খোলা। সেই খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছেন মিসেস ম্যালফিন্ড। তাঁর হাতের পিস্তলটা থেকে তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

আমি হতবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে। তিনি হঠাৎ ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কাঁদতে লাগলেন। আমি শুধু ধীরে ধীরে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। অনেকক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর চোখ মুছে তিনি বললেন, ‘I had to kill him. A mother had to save her son.’

আমি বললাম, আমি কল্পনা করতে পারিনি যে, আপনি এইভাবে গুলি করতে পারেন।’

‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন এদেশে প্রথম এসেছিল, তখন সবকিছু তাদের অপরিচিত। চারদিকে মৃত্যুর অট্টহাসি। সেদিন তারা বন্দুকের জোরেই জীবন রক্ষা করেছিল।’

আমি বললাম, ‘তাহলে আর একটা কাজ করতে হবে আপনাকে। রাস্তার ওপারে জনসন রাইফেল নিয়ে অপেক্ষা করছে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবে এই লোকটার ফেরার জন্যে। সেই সময়ের মধ্যেই ওকে আক্রমণ করতে হবে।’

‘কি করতে চাও?’

দরজার কোণায় লম্বা লাঠি আছে একটা। আপনি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে লাঠিটা দিয়ে ধীরে ধীরে জানলার পাল্লা দুটো ঠেলবেন। অর্থাৎ আপনার লাঠির ঠেলায় ধীরে ধীরে জানলাটা খুলে যাবে। ঘরের বাতিটা আগেই নিভিয়ে দেবেন। আপনার জানলা খোলা হলেই ওর ধারণা হবে যে, আমি জানলায় দাঁড়িয়ে জানলা খুলছি। তখনই ও গুলি করবে। ও অন্ধকারে বসে আছে। আমি ওর বন্দুকের আগুন দেখেই ওর প্রকৃত অবস্থানটা বুঝতে পারব। ঠিক তিন মিনিট পরে জানলাটা খুলবেন।’

কথা শেষ করে আমি লাঠিটা তাঁর হাতে দিয়ে বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে ৮৫ নম্বর ঘরে চলে এলাম। আমার Lugar-এ সাইলেন্সর লাগিয়ে নিলাম। ৮৫ নম্বর কক্ষের জানলাটা সামান্য ফাঁক করলাম। বলাই বাহুল্য, এ ঘরটাও অন্ধকার।

জানলার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ওপারের বাড়িটার দিকে তাকালাম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ডুবে আছে। মাত্র একটা সুযোগ পাব। আমার রিফ্লেক্স ঠিক মত কাজ না করলেই বিপদ।

ঠিক তিন মিনিট পর জানলার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ওপারের অন্ধকার জানলার মাঝামাঝি তাক্‌ করে সতর্ক হয়ে দাঁড়ালাম।

হঠাৎ অন্ধকার জানলায় দেখতে পেলাম এক ঝলক আলো। সঙ্গে সঙ্গে Lugar-এর ট্রিগারটা টিপলাম। পাশের ঘরের দেওয়ালে প্রচণ্ড একটা ধাক্কার শব্দ হল। তারপর সব চুপচাপ। এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ৮৫ নম্বর কক্ষে এলাম।

মিসেস ম্যান্সফিল্ড জানলার ধারে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি বাতিটা জ্বাললাম। তাঁকে এনে একটা চেয়ারে বসালাম। হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে খোলা জানলার ধারে গিয়ে দেখি, রাস্তার ওপারে বেশ ছোটখাটো ভিড়।

আমি ফিরে এসে বোতল থেকে হুইস্কি ঢেলে এক নিশ্বাসে পান করলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম পুলিশের সাইরেন।

মিসেস ম্যান্সফিল্ডের হাতে চাবিটা দিয়ে বললাম, ‘এটা আপনি কালকে ডাকে ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসীতে পাঠিয়ে দেবেন। একটা কাগজে লিখে দেবেন যে, এটা অ্যাটলান্টা এয়ারপোর্টের একটা লকারের চাবি। ওতে যা আছে, সেটা কাস্টম আমাকে নিয়ে যেতে দেবে না। আমি আধ ঘণ্টা পরেই পালাব।’

কথা শেষ করে নিচে নেমে এলাম। চাবিগুলো ফেরৎ দিলাম। দরোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাস্তার ওধারে অত ভিড় কেন?’

দরোয়ান জবাব দিল, একটা নিগ্রো খুন হয়েছে।’

‘খুন! সর্বনাশ! চলুন মিসেস ম্যান্সফিল্ড, পালাই।’

কলকাতায় সি-বিআই’র অস্থায়ী কার্যালয়ে কথা হচ্ছিল। উপস্থিত ছিলেন সি-বি-আই’ বড়কর্তা মিঃ মালহোত্রা, বিকাশ এবং সুজাতা। আমি সেই গুলিটা বিকাশের হাতে দিয়ে বললাম, ‘তুই রিপোটারদের কাছে মুখ খুলিসনি বলে ধন্যবাদ।’

টেবিলের ওপর সেই প্রাচীন বিষ্ণুমূর্তিটা ছিল। সেদিকে তাকিয়ে সুজাতা প্রশ্ন করল, ‘এই রহস্যের মূলে এই বিষ্ণুমূর্তিটা ছিল?’

মিঃ মালহোত্রা বললেন, এই বিষ্ণুমূর্তিটা চুরি গেছিল মাস তিনেক আগে। আমরা গোপন অনুসন্ধান করে জানতে পারি যে একটা আন্তজাতিক দল এটা চুরি করেছে। কিন্তু এটা যে মাফিয়াদের কাজ, তা জানতাম না।’

আমি বললাম, ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত স্যার। আমি সেদিন পার্ক স্ট্রীটে জনসনকে দেখেছিলাম। She’s got a headache’ কথাটা প্রমাণ করেছিল যে খুনী একজন মাফিয়া। কারণ কারো মাথায় গুলি লাগলে একমাত্র মাফিয়ারাই বলে headache’, আর ওই বুলেট। অতদূর থেকে গুলি করার মত রাইফেল এদেশে নেই। আমি জানতাম মাত্র একজনই ওই ধরনের রাইফেল ব্যবহার করে। জিরেলি। কিন্তু জিরেলি ছিল জেলে। শিল্পী শিল্পীকে চেনে। জিরেলির কাছেই জানতে পারলাম যে জনসন ওই ধরনের শিল্পী।’

একটু থেমে বললাম, আমি অনীতার হত্যার সাথে জড়িয়ে পড়লাম নিজের অনিচ্ছায়। লাইটারটা ফেলে এসেছিলাম মৃতদেহের পাশে। আমি মিঃ মালহোত্রাকে ফোনে সব বললাম। উনি বললেন, এয়ার হোস্টেসের মৃত্যু আর মাফিয়াদের আবিভাব। ‘fump into it.’

‘তারপর? প্রশ্ন করল বিকাশ।

‘আমি মিঃ মালহোত্রার আদেশ পেয়ে অনীতার ফ্ল্যাটে গেলাম। আবিষ্কার করলাম সেই চাবিটা আর ডায়েরিটা। ডায়েরিটা এনে দিলাম মিঃ মালহোত্রাকে।’

মিঃ মালহোত্রা বললেন, ‘ডিপার্টমেন্ট সাঙ্কেতিক ভাষার অর্থ উদ্ধার করে দিল। ডায়েরিতে লেখা ছিল কতকগুলো ভাল ভাল ছবি এবং মূর্তির নাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম প্রত্যেকটি চুরি গেছে। সেই জন্যেই হিমাদ্রিকে পাঠালাম ওদেশে। অনেক বছর আগে আমরা হিমাদ্রিকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলাম F. B. I. থেকে ট্রেনিং নিতে। অনেক অফিসার ওর পরিচিত। ওরা ওকে সাহায্য করবে বলে আশা করেছিলাম।

আমি বললাম, এই ব্যাপারে মিসেস ম্যান্সফিন্ডের কাছে আমরা সকলেই কৃতজ্ঞ। আমেরিকায় ট্রেনিং নেবার সময় তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়। সাহস আছে তাঁর।

বিকাশ বলল, তাহলে অনীতা রুদ্রের সাহায্যে ওরা ওইসব Work of Art চুরি করত?

‘হ্যাঁ। ওরা এখানে, জিনিসগুলো চুরি করে অনীতাকে দিত। অনীতা সেগুলো এয়ারপোর্টের লকারে রেখে দিয়ে চাবিটা ওদের দিয়ে দিত। ওরা সময় মত মালগুলো সরিয়ে নিত। এই মূর্তিটার ব্যাপারে অনীতা বোধ হয় বিগড়ে গিয়েছিল। মূর্তিটা নিয়ে গিয়ে লকারে রাখার পরই বোধ হয় ঝগড়া হয়েছিল। সম্ভবত টাকা পয়সার ঝগড়া।’

মিঃ মালহোত্রা বললেন, ‘এমনও তো হতে পারে যে অন্য কেউ অনীতাকে লোভ দেখিয়ে মূর্তিটা হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল?

বললাম, ‘হতে পারে স্যার।’

মিঃ মালহোত্রা বললেন, ‘ধন্যবাদ হিমাদ্রি। তুমি জীবন বিপন্ন করে দেশের সেবা করেছ। আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু সুজাতা, তুমি হিমাদ্রিকে বল এর পর যেন মাত্রা রেখে মদ খায়। ওর মত ট্রেইভ এজেন্টের পক্ষে ক্রাইমের ঘটনাস্থলে সিগারেট লাইটার ফেলে আসা খুব বড় অপরাধ। পরের বার এরকম হলে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। মনে রেখ, তোমাদের মত এজেন্টদের ওপর দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া আছে। এবং এই অপরাধের জন্যেই এবারেও তুমি ছুটি পেলে না।’

আমি সুজাতার দিকে তাকালাম। সুজাতা হেসে বলল, মানুষের জীবনে ছুটির প্রয়োজন নেই মিঃ মালহোত্রা। ছুটি পেলেই ও অলস হয়ে যাবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *