বুলেটিন তিন
আমাদের সমস্ত সমস্যার একটা লিস্টি তৈরি করেছ?
করেছি স্যার।
অনুগ্রহ করে পড়ে ফ্যালো।
এক, আলো। দুই, জল। তিন, যানবাহন। চার, পথঘাট। পাঁচ, পথ দুর্ঘটনা। ছয়, ল অ্যান্ড অর্ডার। সাত, প্রশাসনিক শৈথিল্য। আট ইনটেলিজেনস গ্যাপ। নয়, দলগত সংঘর্ষ। দশ, উলটাপালটা স্টেটমেন্ট।
ব্যস, ব্যস আর না, আর না। সমস্যার সিকসটি ফোর কোর্স লাঞ্চ বানিয়ে ছেড়েছে। অত খাবে কে! আলো নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। ওটি ঈশ্বরের দান। তিনি বলেছিলেন, লেট দেয়ার বি লাইট এন্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট। এখন তিনিই আবার বলছেন, লেট দেয়ার বি ডার্কনেস অ্যান্ড দেয়ার ইজ ডার্কনেস। ঈশ্বরের এলাকায় আমি অনধিকার প্রবেশ করতে চাই না। জলের ব্যাপারে আমি সব জলবৎ তরলং করে দিয়েছি। আমি এখন পথ আর যানবাহন সমস্যাকে একটু প্রাঞ্জল করতে চাই। নাও লেখো :
বাঙালি এতকাল সমতল ভূমিতে হেঁটে-হেঁটে , বেতো ঘোড়া, আরও ভালো ধোপার গাধার স্বভাবপ্রাপ্ত হয়েছে। বাঙালি নিতান্তই ভারবাহী জীব। সংসারের জোয়াল কাঁধে টুকুস টুকুস করে হাঁটছে তো হাঁটছেই। মাঝে-মাঝে গাধার মতো ঘাড় গোঁজ করে থমকে দাঁড়ায়। পেছন থেকে ঠ্যালা মারলেই আবার চলতে শুরু করে। বাড়ি থেকে অফিস, অফিস থেকে বাড়ি। বাড়ি থেকে দুধের ডিপো, ডিপো থেকে বাজার, বাজার থেকে বাড়ি। বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি থেকে বাড়ি। পায়ে-পায়ে চটি টেনে-টেনে যাচ্ছে আর আসছে, আসছে আর যাচ্ছে। বৈচিত্রহীন জীবন। সমতলের প্রাণীদের চরিত্র এই জন্যে এলিয়ে যায়।
আমরা পাহাড় পাব কোথায়! কোথায় পাব চড়াই, উতরাই আর খাদ। এতকাল আমাদের সব পরিকল্পনাই ছিল, সমতল, ফ্ল্যাট, চরিত্রহীন। হয় কৃষি, না হয় পশুপালন, না হয় শিল্প। অনেক চেষ্টায় আমরা সমতলকে অসমতল করেছি। দুটো পা কখনই যাতে এক লেভেলে না থাকে সে ব্যবস্থা আমরা করেছি। এখন কুঁচকি আউরেছে বলে নাকে কাঁদলে হবে না। ভগবান যা করেন সব মঙ্গলের জন্য। চলতে চলতে কিম্বা গাড়িতে যেতে-যেতে এই ওঠো, এই পড়ো। কেন, বাঙালি, গান শোনোনি, ওঠা পড়া প্রেমের তুফান। যত উঠবে, যত পড়বে, তত প্রেম বাড়বে। নিশ্ছিদ্র বাসে, ট্রামে, মিনিতে, ট্রেনে বাঙালি নরনারীর ঠাস বুনোন। ট্রাম আর ট্রেন লাইনে চলে তাই তেমন ঢেউ খেলে না। বড় আফশোশ। ঠেসে দিলে, ঠাসাঠাসি ছাড়া আর বিশেষ কোনও অনুভূতি হয় না। ঠুসঠাস চলতে পারে, কিন্তু সেই গানটি আর আসে না, প্রেম যমুনায় হয়তো বা কেউ, ঢেউ দিল ঢেউ দিল রে! আকুল হিয়ার দুকুল বুঝি ভাঙল রে! বাসে আর মিনিতে বাঙালির অনেক সুযোগ। কখনও মনে হচ্ছে ওয়েলার ঘোড়া চেপে যুদ্ধে চলেছি। প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে এ ওর ঘাড়ে ঢলেঢলে পড়ছে। বাঙালি রে! এত প্রেম তোর কোথায় ছিল রে! ও রে ভাই, মুখে একবার হরিনাম বল। কীর্তনের সুরে না পারিস ভাই, ডিসকো সুরেই বল। সেই পাঁচশো বছর আগে একবার নদে ভেসে গিয়েছিল যে নামে, যাঁর নামে, তাঁকে একবার স্মরণ কর। প্রেম দাতা নিতাই বলে, গৌর হরি, হরি বোল। সে যে গান গেয়ে গেয়ে পড়ে ঢলে ঢলে। আহা কী দৃশ্য! চোখ জুড়িয়ে যায়। চার চাকার প্রেমরঙ্গ। জাগো বাঙালি। প্রেমে জাগো। খুনসুটিতে জাগো, ল্যাং মারায় জাগো, কনুই মারায় জাগো। ব্রিফ কেসের খোঁচা মারায় জাগো। ঘুমায়ে থেকো না আর।
সমতলবাসী নিরীহ বাঙালির চরিত্র বড় এলিয়ে ছিল। কোনও বীরত্ব ছিল না। পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, মামলা, তেল মালিশ আর বুট পালিশ করে বাঙালি দুশো বছর কাটিয়েছে। কবি দু:খ করেছেন, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি। কবি! একবার এসে দেখে যান, বাঙালিকে আমরা মানুষ করেছি। পাহাড়ি জাত তৈরি হয়েছে। চোখ মুখ কটমট। দাঁত কিড়মিড়। কোলের শিশুটি পর্যন্ত বলতে শুরু করেছে, মেরে লাশ ফেলে দেব। ঘুনশিতে পাঁউরুটি কাটা ছুরি বেঁধে ঘুরছে। বলছে, প্রা্যাকটিস করছি। এই তো চাই। এরই নাম হাইল্যান্ডার। মন শক্ত হচ্ছে, চামড়া কর্কশ হচ্ছে। বাপ বললে শালা বলছে। কথায়-কথায় কোতল করছে। আগে ছিল, স্যাকরার ঠুকঠাক, এখন হয়েছে কামারের এক ঘা। চাপে থাকলে বাড়ার ইচ্ছে হয়। মাথা হেঁট করে থাকলে মাথা তোলার ইচ্ছা হয়। বাসে কি মনে হয় বাঙালি! মিনিতে ঘাড় হেঁট অবস্থায় কি মনে হয় বাঙালি! গাছের ফলটিকে ন্যাকড়া বেঁধে রাখলে আয়তনে বাড়ে। বঙ্গবৃক্ষের বাঙালি ফলসমূহকে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছি, এবার তোমরা বড় হও। দেহে নয়, মেদে নয়, মনে।
ভাই সব, ইওরোপ, আমেরিকার কথা তুলো না। স্বাধীনতার এত বছর হল, অত বছর হল, ও সব অঙ্ক নাই বা করলে। শুধু শুধু নিজেদের উত্তেজিত করা। উত্তেজনা মোটেই ভালো জিনিস নয়রে বাপ! শরীর খারাপ হয় মানিক। ভোগ যে কত বড় দুর্ভোগ আমরা জানি। হার্ট ঝুলে পড়ে, রক্ত জমাট বেঁধে যায়, চিনি বাড়ে, চোখে চালসে ধরে। মালাই এক ধরনের খাপে মালাইওয়ালার হাঁড়িতে নুন মেশানো বরফে কেমন ঠাস থাকে দেখেছ! কি তার বাঁধুনি। খোল থেকে বেরোল, তো আতুরি সোনার মতো গলে গেল। আমাদের প্রশাসনিক উদাসীনতা হল সেই নুন মেশানো শীতল বরফ, তোমরা হলে ঠুঙির মালাই। ভাই সকল টাইট থাকো, টাইট। গলে যেও না। তোমরা আমাদের বড় আদরের ভাই। প্রেমে থাকো, প্রেম। প্রেম একটা ফ্রেম অফ মাইন্ড। বলো, একবার বলে ফ্যালো, সেই সুপ্রাচীন উক্তি, মেরেছ কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না।