বুরুডিপাসের আতঙ্ক – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
বাসাডেরা না বুরুডিপাস? চ্যাংজোড়া পেরোলে আরও ভয়ংকর। কাশীদা তামুকপালও অরণ্যময়। সাতগুড়ুম নদীর অববাহিকায় এবং সুবর্ণরেখার উভয় তীরে তখন দুর্ভেদ্য জঙ্গল। লক্ষ্মণ মেটের বাড়ি ছিল বাসাডেরায়। চ্যাংজোড়া পেরিয়ে যেতে হত। তার মুখে আরণ্যক জীবনের রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনে কাঁটা দিত গায়ে।ত্ত্বছয়শশভশফ এনতধনক্ষত্ব
আজ থেকে ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে আমার বয়সই বা কত? খুব জোর বিশ-বাইশ। বি. আর. আই-কেজিপি’-র ক্যাজুয়্যাল লেবার হিসেবে ‘নো ওয়ার্ক নো পে’-র একটা ছোটোখাটো চাকরি পেয়েছিলাম। ঘাটশিলা স্টেশনের অদূরে হিলকার্টের ধারে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিবাস কী মধুময়ই না ছিল! চারদিকে ঘন শাল-মহুয়ার বন। বড়ো-বড়ো সেগুন, পলাশ আর তাকে জড়িয়ে ঘন পাতার চিহড়লতায় যেন বর্ণের বাহার। বাঘ-ভালুকের ভয়ে সারারাত আগুন জ্বেলে পাহারা দিত নাইট গার্ড। প্রকৃতির দৃশ্য দেখে ভরে উঠত মন। দু-চোখ মেলে দূরের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আর কত কী ভাবতাম! এরই মধ্যে কাজের ফাঁকে অথবা ব্রিজে স্ক্র্যাপ করতে-করতে লক্ষ্মণ মেটের মুখে শুনতাম বুরুডিপাসের আতঙ্কের কথা। বুনো হাতির উপদ্রবে তছনছ হয়ে যাওয়া বাসাডেরা অথবা বিধ্বস্ত চ্যাংজোড়ার কাহিনি শুনে ভয় হত। এমনই একসময় মাঘের শেষে যখন পলাশবনে রঙের আগুন, তখনই একদিন ঠিক হল, আমাদের রেস্ট-ডে-তে আমরা দু-তিনজন বাসাডেরা গ্রামে গিয়ে লক্ষ্মণ মেটের বাড়িতে থাকব। তারপর ওখান থেকে সোজা চলে যাব বুরুডিপাস। হোক না ভয়ংকর, তবু অরণ্যের ভয়াবহতা কিছুটাও তো অনুভব করতে পারব!
ঘাটশিলার এক টিম্বার-মার্চেন্ট রোজ সকালে ধারাগিরির জঙ্গলে কাঠ আনতে যেতেন। তাঁরই ট্রাকে রওনা হলাম আমরা। রবি, আমি ও কেষ্টদা। লক্ষ্মণ মেটে একদিন আগেই চলে গেছেন। দু-দিনের নাগা। আমরা সেই অরণ্য-পর্বতের দেশে ট্রাক-বাহনে অভিযান শুরু করলাম। একসময় অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে বাসাডেরা গ্রামে যখন পৌঁছোলাম, তখন সে কী আনন্দ আমাদের! লক্ষ্মণ মেটে আমাদের জন্য পথের ধারেই অপেক্ষা করছিলেন। ট্রাক থামতেই আমরা ঝুপঝাপ নেমে পড়লাম।
সবিস্ময়ে আমরা বললাম, ‘সত্যি লক্ষ্মণদা, তুমি কী ভাগ্যবান! এত সুন্দর তোমার গ্রাম!’
লক্ষ্মণদা হেসে বললেন, ‘কিছুদিন থাকো না, তা হলেই বুঝবে এই সুন্দর কত রোমাঞ্চকর! কীভাবে আমরা বেঁচে আছি এই গভীর বনবাসে।’
লক্ষ্মণদা যাই বলুন না কেন, আমরা অভিভূত। লক্ষ্মণদার বউ আমাদের তেলমাখা মুড়ি, পেঁয়াজ, লঙ্কাভাজা আর ডিমের ওমলেট করে খাওয়ালেন। পাতার জ্বাল দিয়ে একটু ভেলি গুড়ের চায়ের ব্যবস্থাও হল। তাই যেন অমৃত। আশপাশ থেকে অনেক আদিবাসী ছেলেমেয়ে এসে ঘিরে ধরল আমাদের। শহরের মানুষ দেখতে লাগল।
আমরা জলযোগ সেরে নিয়ে গ্রামের মানুষদের বসবাসের বুনো ঝুপড়িগুলো দেখতে লাগলাম। সেগুলোর চেয়েও ভালো লাগল এখানে গাছের ওপর ঘর দেখে।
আমি বললাম, ‘লক্ষ্মণদা, গাছের ওপর ঘর কেন? কারা থাকে ওখানে?’
‘কেউ থাকে না। তবে খেতে ফসল হলে পাহারা দেওয়ার সময় পাহারদাররা থাকে। বুনো শুয়োর বা হাতির উপদ্রব খুব এখানে। তারা ফসল নষ্ট করতে এলে ওই মাচাঘরে বসে ক্যানেস্তারা পেটায় পাহারাদাররা। তখন হয় ওরা ভয়ে পালায়, নয়তো সবকিছু তছনছ করে। এমনিতে তো সামনে যাওয়া যায় না ওদের।’
‘এখানে বাঘ আছে?’
‘আছে বই কী! বাঘ আর ভালুকেরই তো দেশ। সন্ধ্যের পর তাই ঘর থেকে বেরোনো নয়। তবে দিনমানে সচরাচর বেরোয় না এরা।’
যাই হোক, আমরা যেজন্য এখানে এসেছিলাম, সেসব ব্যবস্থা হয়ে গেল। বুরুডির একটি বিস্তীর্ণ জলাশয়ের পাশে বসে আমরা পিকনিক করব। জায়গাটা নাকি ভারি মনোরম। লক্ষ্মণদা দু-একজন আদিবাসীকে তির-কাঁড় নিয়ে আমাদের সঙ্গে যেতে বললেন। মুরগিও জোগাড় করলেন দু-তিনটে। সবে রওনা হতে যাব, এমন সময় দুঃসংবাদ! বুরুডিপাসের আতঙ্ক আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। একটা বাঘ বেশ কিছুদিন ধরে উপদ্রব শুরু করেছে আবার। গ্রামবাসীদের গোরু-ছাগল খেতে-খেতে কাল একজন মানুষকে নাকি ভরদুপুরে টেনে নিয়ে গেছে।
অতএব আর যাওয়া নয়।
লক্ষ্মণদা বললেন, ‘এখন ওদিকে না যাওয়াই ভালো। বাঘ যখন নরখাদক হয়, তখন সে খুবই মারাত্মক। যদিও বুরুডিপাসের সেই আতঙ্ককে এখনও চোখে দেখেনি কেউ, তবুও সে আসে নি:শব্দে পদসঞ্চারে। মনের মতো শিকারটি তুলে নিয়েই উধাও হয়ে যায়।’
এত আশা, সবই জল। রবি, আমি, কেষ্টদা তিনজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।
আমি বললাম, ‘যা হয় হোক, এতদূর এসে বুরুডিপাস না দেখে যাচ্ছি না। সাবধানে থাকব আমরা। তা ছাড়া সন্ধ্যের আগেই তো ফিরে আসছি।’
লক্ষ্মণদা বললেন, ‘কিন্তু…।’
‘কোনো কিন্তু নয়। এই সুযোগ হাতছাড়া করলে আর হবে না। এখানকার কাজ আমাদের শেষ হয়ে আসছে। এরপর একেবারে সিনি কিংবা গিধনিতে। কবে অর্ডার আসে কে জানে!’
তাই আর দ্বিমত নয়। আমাদের যাত্রা হল শুরু।
বুরুডিপাসের সেই বিখ্যাত জলাশয়ের চারপাশ ঘিরে সে কী অরণ্যের গভীরতা! দিনমানেও যেন রাতের অন্ধকার সেখানে। আজ যারা বুরুডিতে পিকনিক করতে যান, ১৯৬১ সালের সেই বুরুডির পরিবেশ কল্পনাতেই আনতে পারবেন না তাঁরা। যাই হোক, বনের কাঠকুটো সংগ্রহ করে মুরগির মাংস আর ভাত রান্না করে খেতে খেতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। ঠিক এই সময় বাসাডেরায় ফিরতে গেলে বাঘে না খেলেও ভালুকের হাত থেকে নিস্তার নেই।
এদিকে বুরুডির গ্রামবাসীরা সেই নরখাদকের সন্ধানে তোলপাড় করছে চারদিক।
যাই হোক, লক্ষ্মণদা বলে-কয়ে আদিবাসীদের একটি ঝুপড়িতেই আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করলেন। আগেই বলেছি, আমার তখন অল্প বয়েস। আমি জেদ ধরলাম রাত্রিবাসই যদি করতে হয়, তাহলে ঝুপড়িতে নয়। এখানেও গাছের মগডালে যেসব ঘর আছে তারই একটিতে থাকব আমরা।
লক্ষ্মণদা বললেন, ‘পাগল নাকি? ওইভাবে কখনো তোরা থাকতে পারিস? ছেলেমানুষি করিস না। একটা বিপদ ঘটে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
কিন্তু রবি আর আমি দু-জনে নাছোড়বান্দা।
লক্ষ্মণদা বললেন, ‘যা ভালো বুঝিস কর। আমি কিন্তু গাছে উঠছি না। কেননা ওখানে আমার ঘুম হবে না। আর ঘুম না হলে কাল ডিউটি করব কী করে? তিনদিন নাগা হলে চাকরি থাকবে?’
রবি বলল, ‘কুছ পরোয়া নেই। তুমি যা করবে করো। আমরা গাছেই থাকব।’
আমি বললাম, ‘গাছে না থাকলে জঙ্গলের জন্তুজানোয়ার দেখব কী করে? তুমিই বলো?’
লক্ষ্মণদা বললেন, ‘তবে মর তোরা।’
কেষ্টদাও তখন পিছু হটলেন। বললেন, ‘আমিও এইসব দুষ্টমিতে নেই। আমি ঝোপড়িতেই থাকব।’ বলে লক্ষ্মণদার সঙ্গ নিয়ে চলে গেলেন আদিবাসী পল্লিতে। আমরা দু-জনে খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে দড়ির মই বেয়ে উঠে পড়লাম টঙে।
সে কী আনন্দ! দেখতে-দেখতে সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হল। অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক। কিরকিরে পোকার ডাকে কানে যেন তালা ধরে গেল। মশার কামড়ে আর পোকার কামড়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম আমরা। কিন্তু না পেলাম বাঘের দেখা, না দেখলাম…
হঠাৎ ও কী? একসময় দেখি জোড়া-জোড়া টর্চের আলো চারিদিকে যেন ঘোরাফেরা করছে। আমাদের কাছেও টর্চ ছিল। তাই জ্বেলেই দেখলাম কত-কত হরিণ! উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলাম আমরা। ভাগ্যিস টঙে উঠে বসেছিলাম, না হলে এই দৃশ্য কী দেখতে পেতাম কখনো? কিন্তু সে মুহুর্তের ব্যাপার। হঠাৎ কী যে হল, বিদ্যুৎগতিতে উধাও হয়ে গেল তারা।
এবারে যে দৃশ্য দেখলাম তা আরও অভিনব। বুরুডির জলাশয়ের ধারে হাঁকডাক করে ঘোরাফেরা করছে কিছু ভালুক। আর কিছু কালো পশমের ডেলা ঘোরাফেরা করছে তাদের ঘিরে। বুঝলাম ওগুলো ওদের শাবক। একসময় তারাও হারিয়ে গেল বনের অন্ধকারে।
রবি বলল, ‘জায়গাটা ভালোই পছন্দ করেছি আমরা। সমস্ত জন্তু-জানোয়াররাই জল খেতে আসবে এখানে। কিন্তু বাঘ? বাঘের দেখা নেই কেন?
বলার সঙ্গেসঙ্গেই টর্চের আলোর মতো দুটো জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি পড়ল আমাদের ওপর। আমরা ঝুঁকে পড়ে দেখছিলাম অরণ্যের নিশাচরদের। বইয়ে পড়েছিলাম চতুষ্পদ জন্তুদের চোখ রাত্রিবেলা জ্বলে, কিন্তু তা যে এইভাবে, তা আমাদের ধারণাতেও ছিল না।
রবি চিৎকার করে উঠল, ‘বাঘ! বাঘ! এই তো! এই তো বাঘ!’ ওর টর্চের আলো তখন বাঘের মুখে।
সঙ্গেসঙ্গে বনভূমি কাঁপিয়ে সে কী ভয়ংকর ডাক! হৃৎপিন্ডের ধুকপুকুনি যেন হঠাৎই থেমে যাওয়ার উপক্রম হল। প্রচন্ড একটা ঝাঁকুনিতে দুলে উঠল গাছের ঘরটা। আর সেই ঝাঁকুনিতেই যা ঘটবার তা ঘটে গেল। অর্থাৎ চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল রবিটা। কী সর্বনাশ! কোথায় গেল ছেলেটা! আমি ওর নাম ধরে কত ডাকলাম। কিন্তু সাড়াও নেই, শব্দও নেই। ভয়ে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমস্রোত নেমে এল যেন। আমি জোরে জোরে ক্যানেস্তারা বাজিয়ে ডাকতে লাগলাম সকলকে। একসময় গ্রামের দিক থেকে মশালের আলোর সংকেত দেখা গেলেও আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এল না কেউ।
সে-রাতটা যে কীভাবে কাটল, তা আমিই জানি।
পরদিন সকালে যখন এল ওরা, তখন আমার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা স্বর বেরিয়ে এল শুধু, ‘লক্ষ্মণদা, রবি…।’
‘কী হয়েছে রবির?’
লক্ষ্মণদাকে সব বললাম।
লক্ষ্মণদা ভীষণ রেগে বললেন, ‘ওই জন্যই আমি বারণ করেছিলাম তোদের। শুনলি না তো আমার কথা। এখন ফিরে গিয়ে সাহেবকে আমি কী বলব? তোদের এখানে আনাটাই আমার ভুল হয়েছে।’
আমি বললাম, ‘কাল যে আমি ক্যানেস্তারা পিটিয়ে অত করে তোমাদের ডাকলাম, একবার আসতে পারলে না কেউ?’
‘আমরা তো আসছিলাম। আলো দেখিসনি?’
‘আসছিলে তো এলে না কেন?’
‘বুনো হাতির দল যে ঘিরেছিল চারদিক। তাই বাধ্য হয়েই ফিরে গেলাম। অরণ্যের ওই গণেশ দেবতা খেপলে কী রক্ষা আছে? তাই আসতে সাহস হয়নি কারো। বাঘের যম হাতি। হাতির যম বাঘ। তোদের টর্চের আলোয় নয়, হাতি দেখেই ভয়ে চিৎকার করেছিল বাঘটা। আর তখনই ঘটে গেছে অঘটন। নিশ্চয়ই রবিটা ভয় পেয়ে পড়ে গেছে বাঘের মুখে। বাঘও তার শিকার পেয়ে কেটে পড়েছে নিজের ডেরায়।’
তবুও শুরু হল খোঁজার পালা।
ঠিক এই সময় এমন একটা দৃশ্য চোখে পড়ল যে, তা দেখে আমরা হাসব না কাঁদব, কিছু ঠিক করতে পারলাম না। আদিবাসীদের শিকারি কুকুরের চিৎকারে আমরা সেই জলাশয়ের ধারে গিয়ে দেখি, বাঘের গলা জড়িয়ে বাঘের পিঠে শক্ত কাঠ হয়ে শুয়ে আছে অচৈতন্য রবি। আর জলে-ভেজা ধূসর রঙের বাঘটা এমনই ক্লান্ত যে, জল থেকে ওঠার আর শক্তি নেই তার।
যাই হোক, আমরা বহুকষ্টে উদ্ধার করলাম রবিকে। আর আধমরা বাঘটাকে পিটিয়ে মারল সকলে।
অনেক পরে রবির জ্ঞান ফিরলেও, রাতের কথা কিছুই বলতে পারেনি সে। তবে আমরা অনুমানে বুঝলাম, বাঘের ডাকে ভয় পেয়ে রবি পড়বি তো পড় বাঘের ঘাড়েই। বাঘও আচমকা ওইরকম একটা ভারী বস্তু তার ঘাড়ে পড়ায় আরও ভয় পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অথই জলে। তারপর সাঁতার কেটে প্রাণ বাঁচায়। জলাশয়ের চারপাশে নিশ্চয়ই তখন বুনো হাতির দল। ফলে তাদের নজর এড়িয়ে পালানো সম্ভব না হওয়ায় অর্ধমৃত হয়ে জলেই থাকতে হয় সারারাত। কী কষ্ট বেচারির!
এখন একই গ্রহের ফেরে একজনের পুনর্জন্ম, আর-একজনের মোক্ষলাভ হলেও বাঘের সেই করুণ পরিণতির কথা আজও ভুলিনি আমি। রেলের চাকরি আমি পরের বছরই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু রবি? সে এখন মস্ত অফিসার।