বুবাই কাহিনি
এই বাসায় সন্ধেবেলা নিয়ম করে সবাইকে পড়তে বসতে হয়। পড়ক আর নাই পড়ক সবাইকে পড়ার টেবিলে বসে থাকতে হয়। আজকেও সবাই বসেছে এই মুহূর্তে শুধু শান্তকে দেখা যাচ্ছে না। এটি অবশ্যি নূতন কিছু নয়, পড়ার টেবিলে শান্তকে মাঝে মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় না।
যারা পড়তে বসেছে তাদেরও যে পড়াশোনায় খুব মনোযোগ আছে, সেটা বলা যাবে না। টুনি অনেক কষ্ট করে একটা অংক শেষ করেছে, আরেকটা শুরু করবে কি না চিন্তা করছিল, তখন শান্ত এসে হাজির হলো। সে গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো করে বলল, “দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত! দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত!”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কেন শান্ত ভাইয়া? দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত কেন?”
“দাদি সেজেগুঁজে সিঁড়ি দিয়ে নামছে।”
দাদি সেজেগুঁজে নিচে নেমে আসা এই বাসার বাচ্চাকাচ্চাদের জন্যে আসলেই একধরনের বিপদ সংকেত। দাদি (কিংবা নানি) তাঁর সব আত্মীয় স্বজন, এমনকি আত্মীয়-স্বজনের আত্মীয়-স্বজন এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজনেরও খোঁজখবর রাখেন। মাঝে মাঝেই দাদি সেই সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে যান। দাদি কখনোই একা যান না, তাঁর অনেক নাতি-নাতনির কোনো একজনকে ধরে নিয়ে যান। নাতি-নাতনিরা সাধারণত এই আত্মীয় স্বজনদের চিনে না, তাই কেউই দাদির সাথে যেতে চায় না। নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে খসে পড়ার চেষ্টা করে।
শান্তর বিপদ সংকেতে কোনো ভুল নেই। সত্যি সত্যি দাদি (কিংবা নানি) তাদের পড়ার ঘরে এসে হাজির হলেন। সত্যি সত্যি দাদি সেজেগুঁজে এসেছেন। দাদির বয়স যখন কম ছিল, তখন নিশ্চয়ই খুবই সুন্দরী ছিলেন, এখনো দেখলে বোঝা যায়। টুম্পা বলল, “দাদি তোমাকে খুবই সুইট লাগছে, শুধু ঠোঁটে একটু লিপস্টিক দিলে–”
দাদি বললেন, “তারপরে বলবি চোখে কাজল, মুখে পাউডার, চুলে কলপ–”
টুনি বলল, “না, দাদি আমরা কিছু বলব না। তুমি যে রকম আছ সে রকমই ভালো।”
দাদি বললেন, “আমি মারিয়ার বাসায় যাব। তোরা কে যাবি আমার সাথে আয়।”
তখন সবাই যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল, কেউ আস্তে কেউ জোরে। প্রমি বলল, “দাদি, তোমার সাথে যাওয়া হচ্ছে যন্ত্রণা। তোমার মারিয়া না ফারিয়ারা বসে শুধু ঘ্যানঘ্যান করে, হাজবেন্ডকে নিয়ে একশ’ রকম নালিশ করে আর আমাদের বসে বসে সব শুনতে হয়!”
টুম্পা বলল, “জোর করে হালুয়া খাওয়ায়। কী পচা হালুয়া!”
শান্ত বলল, “লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞেস করে। কত বড় সাহস! আমি লেখাপড়া করি আর না করি তাতে তাদের এত সমস্যা কী?”
দাদি বললেন, “আমি এত কিছু শুনতে চাই না। কে যাবি আমার সাথে।”
শান্ত বলল, “ঠিক আছে, লটারি করি। লটারিতে যার নাম উঠবে সে যাবে।”
তখন টুনি উঠে দাঁড়াল, “থাক শান্ত ভাইয়া, তোমার লটারি করতে হবে না। তোমার লটারি আমার জানা আছে, নিজের নাম না লিখে অন্য সবার নাম লিখে রাখবে।” তারপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো দাদি। আমি যাব তোমার সাথে।”
অন্য সবাই তখন আনন্দের মতো শব্দ করল।
.
টুনি তার ফ্রকটা পাল্টে নিয়ে একটা বই নিয়ে নিল। এখানে বসে বসে অংক করার থেকে মারিয়াদের বাসায় বসে গল্পের বই পড়া খারাপ কিছু না।
দাদি অনেক দরদাম করে একটা স্কুটার ঠিক করলেন। দরদাম করার মাঝে দাদি অনেক বড় এক্সপার্ট, কোনো কিছুই দরদাম না করে নেন না। স্কুটারে উঠে টুনি জিজ্ঞেস করল, “দাদি মারিয়াটা কে?”
“ওমা! মারিয়াকে চিনিস না? আমার যে খালাতো বোন আছে জোবেদা, তার ছোট মেয়ে।”
“তোমার আপন খালাতে বোন?”
“আপনের মতোই। মায়ের বান্ধবী।”
টুনি চুপ করে গেল, দাদির সব আত্মীয়-স্বজন এ রকম। লতায় পাতায়। তবে মজার ব্যাপার হলো, দাদি যখন কোনো খোঁজখবর না দিয়ে এ রকম হুট করে হাজির হয়, সবাই কিন্তু খুব খুশি হয়। এর কারণটা কী কে জানে।
স্কুটার থেকে নেমে দাদি একটা বাসার সামনে দাঁড়ালেন; খানিকক্ষণ বাসাটার আশেপাশে তাকালেন, তারপর বললেন, “এই বাসাটাই হবে।”
“তুমি সিওর না?”
“মোটামুটি সিওর। অনেক দিন পরে এসেছি তো, তাই প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে।”
বাসার দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এটি ঠিক বাসা নয়, পাশের বাসাটি ঠিক বাসা। কাজেই তারা পাশের বাসায় গেল। পাশের বাসায় আবার কঠিন নিরাপত্তা, কার কাছে যাবে জিজ্ঞেস করে ফোন করে পারমিশান নিয়ে তারপর উপরে ওঠার অনুমতি পাওয়া গেল।
লিফটে তিনতলায় উঠে দেখা গেল দরজা খুলে মারিয়া দাদির জন্যে অপেক্ষা করছে। দাদি লিফট থেকে বের হবার সাথে সাথে মারিয়া দাদিকে জড়িয়ে ধরল, তারপর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। সাথে যে টুনিও আছে সেটা মনে হয় দেখতেই পেল না।
ভিতরে ঢুকেই টুনি বুঝতে পারল এরা অনেক বড়লোক। দাদির আত্মীয় স্বজন বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত টাইপ। কেউ বেশি মধ্যবিত্ত কেউ কম মধ্যবিত্ত। এরা মোটেও মধ্যবিত্ত না, এরা যথেষ্ট বড়লোক। বড়লোকের বাসায় সবকিছু সাজানো-গোছানো থাকে, তাই সেখানে খুব সাবধানে থাকতে হয়। টাইলস দেয়া মেঝে থাকে, তাই জুতো খুলে ঢুকতে হয়, ঘরের চারপাশে নানা রকম শোকেস থাকে, সেখানে নানা রকম বিদেশি পুতুল থাকে। ঘরের দেওয়ালে দেখে কিছু বোঝা যায় না-এ রকম তেলরঙের ছবি থাকে। সোফার সামনে কফি টেবিলে বিদেশি ইংরেজি ম্যাগাজিন থাকে। মধ্যবিত্তের বসার ঘরেই টেলিভিশন থাকে, বড়লোকের টেলিভিশন থাকে ভিতরে। কাজেই বসার ঘরে কোনো টেলিভিশন নাই, টুনিকে পুরো সময়টা বসে বসে টেলিভিশন দেখতে হবে না। দাদির সাথে আলাপ-আলোচনা আরেকটু জমে ওঠার পর সে তার গল্পের বইটা খুলতে পারবে। এখনই গল্পের বইটা খুলে পড়া শুরু করা মনে হয় একটু বেয়াদপি হয়ে যাবে। টুনি ধৈর্য ধরে গল্পগুজব জমে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
দাদির খালাতো বোনের মেয়ে মারিয়া দাদির সাথে নানা ধরনের গল্প গুজব করছে। কথা বলার স্টাইলটা বড়লোকের কথা বলার স্টাইল, মেপে মেপে সুন্দর করে কথা বলা। টুনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে। বড়লোকেরা তাদের টাকা-পয়সার গল্প করতে ভালোবাসে কিন্তু সেই গল্পটি করে খুব কায়দা করে। যেমন-মারিয়া বলল, “বুঝলে খালা, তোমার জামাইয়ের কোনো বাস্তব বুদ্ধি নাই। সংসারে আমরা মাত্র তিনজন, কোথায় ছোট একটা গাড়ি কিনবে, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাসের মতো ঢাউস একটা গাড়ি কিনে ফেলল।”
দাদি বললেন, “বড় গাড়িই তো ভালো, সবাই হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসতে পারবে।”
“সেইটা অবশ্যি তুমি ঠিকই বলেছ খালা। গত মাসে শ্রীমঙ্গলের একটা রিসোর্টে গেলাম, জার্নিটা টেরই পেলাম না। বুবাই পর্যন্ত কোনো কমপ্লেইন করল না।”
“তোমার ছেলের নাম বুঝি বুবাই?”
“হ্যাঁ খালা। ভালো নাম আদনাফ আবেদীন। এমনিতে বুবাই ডাকি।”
দাদি বললেন, “যখন জন্ম হয়েছিল তখন হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। এখন নিশ্চয়ই বড় হয়েছে।”
“হ্যাঁ খালা, বড় হয়েছে। সামনের মাসে এক বছর হবে।”
“তোমরা দুজনই কাজ করো, বাচ্চাকে দেখে কে?”
আলাপের এই পর্যায়ে মারিয়া গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “খালা, আমাদের কপাল খুব ভালো, বাচ্চা দেখার জন্যে খুব ভালো একটা বুয়া পেয়েছি। আমার কোনো চিন্তাই করতে হয় না। সে সব দেখে শুনে রাখে।”
দাদি একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন, “বাচ্চাকে সবসময় বুয়ার হাতে ছেড়ে দিও না। ছোট বাচ্চাদের কিন্তু মায়ের আদর খুব দরকার।”
মারিয়া বলল, “না, না, সবসময় বুয়ার হাতে ছাড়ি না। অফিস থেকে আসার পর তো আমার কাছেই থাকে।”
“দেখি তোমার বাচ্চাটাকে।”
মারিয়া তখন গলা উঁচিয়ে ডাকল, “মর্জিনা! মর্জিনা! বুবাইকে নিয়ে এসো।”
কিছুক্ষণের মাঝেই মর্জিনা বুবাই নামের বাচ্চাটাকে নিয়ে এলো। বাচ্চাটা ছটফটে। মারিয়া বুবাইয়ের দিকে হাত বাড়াল কিন্তু বুবাই তার মায়ের কাছে আসতে চাইল না, মর্জিনাকে আঁকড়ে ধরে রাখল। বোঝাই যাচ্ছে মায়ের চাইতে এখন মর্জিনাই বুবাইয়ের বেশি আপন।
মারিয়া একটু লজ্জা পেল, তাই উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় টেনে মর্জিনার কাছ থেকে বুবাইকে নিজের কোলে নিয়ে এলো।
দাদি বললেন, “দেও দেখি তোমার বাচ্চা আমার কাছে আসে কি না।”
দাদি হাত বাড়ালেন, বুবাই তখন দাদির কাছে চলে এলো।
টুনির ছোট বাচ্চা দেখতে খুব ভালো লাগে, সে উঠে এসে বুবাইয়ের সাথে একটা খেলা জমানোর চেষ্টা করল। খেলাটা খুব জমল না। বুবাই বড় মানুষের মতো টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর তার কাছে কিছু চাইছে। সেভাবে হাত পাতল।
ছোট বাচ্চা, বয়স এখনো এক বছর হয়নি। ভালো করে মনে হয় বসতেই শিখেনি কিন্তু হাত পেতে কিছু চাওয়া শিখে গেছে। কী আশ্চর্য!
টুনি বাচ্চাটির নাক স্পর্শ করল, গাল টিপে আদর করল, তারপর কোলে নেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু বুবাই যেতে রাজি হলো না। সে দাদির দিকে তাকাল তারপর দাদির দিকে হাত পাতল।
দাদি হেসে বললেন, “দাদু, আমার কাছে তুমি কী চাইছ? তোমাকে দেওয়ার মতো কিছু তো নাই!”
মনে হলো বাচ্চাটা দাদির কথা বুঝে গেল। সে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে মুখ দিয়ে উঁ উঁ শব্দ করে হাত পেতে চাইতেই থাকল।
দাদি বাচ্চাটার ভাবভঙ্গি দেখে হি হি করে হেসে ফেললেন। তারপর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মারিয়া তোমার ছেলে এত বড় হয়ে গেছে, তাকে তো আমি কিছু দিলাম না।”
মারিয়া প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, “না না, কিছু দিতে হবে না। শুধু মন থেকে দোয়া করে দেন। তাহলেই হবে।”
দাদি বললেন, “দোয়া তো সবসময়েই করি।”
তারপর এক হাতে বুবাইকে ধরে রেখে অন্য হাতে ব্যাগটা খুলে একটা পাঁচশ’ টাকার নোট বের করে বললেন, “মা, তোমরা বড়লোক মানুষ, তোমাদের বাচ্চাকে ভালো কিছু দেওয়ার ক্ষমতা তো আমার নাই। এই যে এই টাকাটা দিয়ে আমার দাদুকে একটু চকোলেট কিনে দিও!”
দাদি নোটটা বের করার সাথে সাথে বুবাই খপ করে নোটটা ধরে ফেলল। তারপর সেটা টেনে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল। দাদি থতমত খেয়ে বললেন, “মারিয়া, তোমার ছেলের খুব বুদ্ধি! সে বুঝে ফেলেছে এটা দিয়ে তার জন্যে চকোলেট কিনে দেবে। সে জন্যে আগেই নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে।”
মারিয়া ভুরু কুঁচকে তার ছেলের দিকে তাকাল, তারপর হাত পেতে বলল, “বুবাই, ছিঃ! এটা দিয়ে দাও।”
বুবাই নোটটা মারিয়ার হাতে দিতে রাজি হলো না। শক্ত করে নিজের বুকের কাছে ধরে রেখে মর্জিনার দিকে তাকিয়ে আঁ আঁ করে ডাকতে লাগল।
মর্জিনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে কাছে এগিয়ে আসতেই বুবাই নোটটা মর্জিনার দিকে এগিয়ে দেয়। মর্জিনা নোটটা হাতে নিতেই বুবাই তার মাড়ি বের করে মর্জিনার দিকে তাকিয়ে হাসল, যেন সে অনেক বড় একটা কাজ করেছে।
মর্জিনা নোটটা নিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মারিয়া হাত বাড়িয়ে নোটটা নিতে চাইল কিন্তু বুবাই আঁ আঁ করে চিৎকার করে আপত্তি জানাল, তাই নোটটা মর্জিনার হাতেই থাকল।
মারিয়া মুখ শক্ত করে মর্জিনাকে ভেতরে গিয়ে একটু চা-নাশতা নিয়ে আসতে বলল। বুবাই মর্জিনার সাথে ভেতরে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু মারিয়া যেতে দিল না, নিজের কোলে রেখে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকল।
মারিয়া একটু ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলল, “বাচ্চাটা মর্জিনাকে খুব পছন্দ করে। আগে একেবারে খেতে চাইত না, মর্জিনা আসার পর খাওয়া নিয়ে কোনো ঝামেলা করে না।”
দাদি বললেন, “ও।”
মারিয়া বলল, “জন্মের সময় গায়ের রং খুব ফর্সা ছিল, এখন দেখি আস্তে আস্তে কালো হয়ে যাচ্ছে।”
দাদি বললেন, “পুরুষ মানুষ গায়ের রং দিয়ে কী করবে?”
টুনি আপত্তি করে বলতে চাইছিল মেয়েরাই বা গায়ের রং দিয়ে কী করবে? কিন্তু নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে টুনি কিছু বলল না, চুপ করে রইল।
দাদি বললেন, “একটা বাচ্চা সুস্থ থাকাটাই বড় কথা।”
মারিয়া বলল, “মাশাআল্লাহ্, বাচ্চা আমার সুস্থই আছে। এর বয়সী অন্য বাচ্চারা কেমন জানি লুতুপুতু হয়, আমার বুবাই শক্ত-সমর্থ।”
দাদি বললেন, “বাহ্।”
বুবাই থেকে আলোচনা অন্যান্য বাচ্চাদের দিকে ঘুরে গেল। সেখান থেকে বাচ্চাদের বড় করার সমস্যা। সেখান থেকে লেখাপড়া। সেখান থেকে শিক্ষাব্যবস্থা। সেখান থেকে রাজনীতি-একবার রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হবার পর আর থামাথামি নেই।
ততক্ষণে মারিয়ার স্বামীও চলে এসেছে। কমবয়সী বড়লোকদের যে রকম চেহারা হবার কথা ঠিক সে রকম চেহারা, থুতনিতে তিনকোনা একধরনের স্টাইলের দাড়ি। আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু ব্যবসা-বাণিজ্য ইমপোর্ট, ডলার, ইউরো এগুলো।
একসময়ে মর্জিনা নাশতা নিয়ে এলো। মোটেও অখাদ্য হালুয়া নয়, চিকন চিকন স্যান্ডউইচ, পনিরের স্লাইস এবং সন্দেশ। সাথে দার্জিলিং চা।
দাদি যখন বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্যে উঠলেন তখন মারিয়া আর তার তিনকোনা স্টাইলের দাড়িওয়ালা স্বামী শুধু নিচে নামিয়ে দিল না, তাদের ঢাউস গাড়িতে তুলে ড্রাইভারকে পৌঁছে দিতে বলল। ড্রাইভার বিরস মুখে
টুনি আর দাদিকে বাসায় পৌঁছে দিল। গাড়ি থেকে নেমে দাদি তার ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে ড্রাইভারকে চা খাওয়ার জন্যে দিলেন। “না
লাগবে না আন্টি, লাগবে না”, বলতে বলতে ড্রাইভার হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল।
বাসার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে দাদি বললেন, “বুঝলি টুনি, মারিয়ার বাচ্চাটা নিয়ে কিছু একটা গোলমাল আছে। গোলমালটা কী ধরতে পারছি না।”
টুনি বলল, “বড়লোকের বাচ্চাদের মনে হয় এ রকম গোলমাল থাকে।”
দাদি বললেন, “উঁহু। বড়লোকের বাচ্চার গোলমাল না। বড়লোকের বাচ্চারা এ রকম হয় না। মারিয়া বলেছে বাচ্চাটা কালো হয়ে যাচ্ছে,
আসলে কালো হচ্ছে না।”
“তাহলে কী হচ্ছে?”
“রোদে পুড়ে রং এ রকম হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা বাসায় থাকে, বাচ্চার গায়ের রং রোদে পুড়বে কেন?”
দাদির কথাটা শুনে টুনির ডিটেকটিভ মন পুরোদমে কাজ করতে শুরু করল। কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পেল না।
.
দুদিন পর বাচ্চারা সবাই মিলে স্কুলে যাচ্ছে। সবাই মোটামুটি একসাথে রওনা দেয়, তারপর যেতে যেতে একেকজন একেক রাস্তায় ভাগ হয়ে যায়। টুনির স্কুলটা সবচেয়ে দূরে, এতটুকু দূরত্ব কেউ হেঁটে যায় না। কিন্তু টুনির হেঁটে যেতে খুব ভালো লাগে, তাই সে সুযোগ পেলেই হেঁটে হেঁটে যায়। রাস্তায় তখন কত রকম মানুষকে দেখতে পায়। একেকজন মানুষ একেক রকম, একেকজন একেকভাবে কথা বলে, হাঁটে, ঝগড়া করে! টুনি মনে হয় শুধু মানুষগুলোকে দেখে দেখেই একটা জীবন পার করে দিতে পারবে।
টুনির স্কুলে যাবার রাস্তাটা যখন বড় রাস্তায় পড়েছে সেখানে গাড়ির ভিড় লেগেই থাকে। যেখানে গাড়ির ভিড় সেখানেই ফেরিওয়ালার ভিড় আর ভিখিরির ভিড়। ভিখিরিদের দেখতে টুনির খুবই মজা লাগে, যখন তারা কারো কাছে হাত পেতে কিছু চায় তখন তাদের চেহারা হয় খুবই কাঁচুমাচু কিন্তু যখন নিজেরা নিজেরা থাকে তখন তারা খুবই হাসি-খুশি। ভিক্ষা করার ব্যবসাটা মনে হয় খুবই লাভের ব্যবসা।
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে রাস্তা পার হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ভিখিরিদের লক্ষ করছিল; তখন সে একজন কম বয়সী মহিলাকে দেখতে পেল। ময়লা একটা শাড়ি পরে একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একটা গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাটি ছোট কিন্তু কী মায়াকাড়া চেহারা! মা যে রকম হাত পেতে ভিক্ষা করছে ছোট বাচ্চাটিও সে রকমভাবে হাত পাতছে! মা’কে দেখে এই গেন্দা বাচ্চাটাও ভিক্ষা করা শিখে গেছে।
টুনি হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। মারিয়ার বাচ্চা বুবাই ঠিক এভাবে হাত পেতেছিল! টুনি ভালো করে তাকাল, না এটি মারিয়ার বাচ্চা বুবাই না, অন্য কোনো বাচ্চা। টুনি দেখল একজন গাড়ির কাঁচ নামিয়ে একটি ময়লা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল, বাচ্চাটা খপ করে নোটটা হাতে নিয়ে নেয়, তারপর হাতটা তার মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয়। মা নোটটি নিয়ে বাচ্চাটিকে আদর করে এবং বাচ্চাটি মাড়ি বের করে রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে হাসল। ঠিক বুবাইয়ের মতন।
এই মাটি যে রকম তার বাচ্চাকে নিয়ে ভিক্ষে করছে মারিয়ার বাসার মর্জিনা কি একইভাবে বুবাইকে নিয়ে ভিক্ষে করে? সে জন্যেই কি বুবাইয়ের গায়ের রং রোদে পুড়ে কালো হয়েছে?
টুনি ভালো করে আবার মহিলাটি আর বাচ্চাটির দিকে তাকাল। সত্যিই কি এই বাচ্চাটি এই মহিলার? নাকি এই বাচ্চাটিও বুবাইয়ের মতো একটি বাচ্চা?
টুনি বেশিক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, স্কুলে দেরি হয়ে যাবে। সে রাস্তা পার হয়ে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। কিন্তু মাথা থেকে চিন্তাটাকে সরাতে পারে না।
.
সন্ধেবেলা টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে গেল। ছোটাচ্চু বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছে। টুনিকে দেখে ছোটাচ্চু বই পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করল, “কী খবর টুনি?”
টুনি বলল, “কোনো খবর নাই।”
ছোটাচ্চু বলল, “খবর না থাকলেই ভালো। খবর মানেই যন্ত্রণা।”
“খবর নাই কিন্তু প্রশ্ন আছে।”
ছোটাচ্চু বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাল, বলল, “সাত।”
“সাত?”
“হ্যাঁ।”
“সাত কী?”
“তোর প্রশ্নের উত্তর।”
টুনি বলল, “তুমি আমার প্রশ্নটাই শুনোনি, একটা উত্তর দিয়ে দিলে!”
“প্রশ্ন না শুনেই উত্তর দিতে হয়। প্রশ্ন শুনলে হয়তো দেখব উত্তরটা জানি না।”
টুনি বলল, “আমি তোমাকে যে প্রশ্নটা করব তুমি তার উত্তর জানেনা।”
“ঠিক আছে, কর প্রশ্ন।”
“তুমি কি একটা ডিটেকটিভ কাজ করবে?”
ছোটাচ্চু বইটা পেটের উপর রেখে বলল, “ডিটেকটিভ কাজ?”
“হ্যাঁ।”
“উঁহু। আমার এজেন্সি নাই, আমি কী কাজ করব? তোদের বলেছি না, আমি ডিটেকটিভ কাজ ছেড়ে দিব।”
“তুমি তাহলে কী করবে?”
“এখনো ঠিক করি নাই। বই লিখতে পারি।”
“কী বই?”
ছোটাচ্চু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “ডিটেকটিভ বই।”
টুনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি শেষ একটা ডিটেকটিভ কাজ করে দেবে?”
“তুইও তো ডিটেকটিভ। তুই করিস না কেন?”
“আমি পারলে করতাম, কিন্তু আমি পারব না।”
“কেন পারবি না?”
“আমি ছোট সেই জন্যে। কেউ করতে দেবে না।”
ছোটাচ্চু চুপ করে রইল। টুনি বলল, “তুমি এই কাজটা করে দাও, যদি দেখা যায় আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটা সত্যি, তাহলে অনেক বড় কাজ হবে।”
ছোটাচ্চু তবুও মুখ সুচালো করে বসে রইল। টুনি বলল, “প্লিজ ছোটাচ্চু। প্লিজ।”
ছোটাচ্চু শেষ পর্যন্ত বলল, “ঠিক আছে, বল। শুনি কী কাজ।”
টুনি তখন ছোটাচ্চুকে মারিয়ার ছেলে বুবাইয়ের কথা বলল, তার সন্দেহ হচ্ছে মারিয়ার বাসার কাজের মহিলা মর্জিনা বাচ্চাটাকে নিয়ে ভিক্ষে করতে বের হয়। মারিয়াদের বাসার সামনে অপেক্ষা করলেই দেখা যাবে মর্জিনা আসলেই বাচ্চাটাকে নিয়ে বের হচ্ছে কি না। যদি বের হয় তাহলে পিছু পিছু গেলেই দেখা যাবে বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় যায়, কী করে। খুবই সহজ-সরল কেস। কিন্তু টুনির স্কুলে যেতে হয় তাই সে এটার সমাধান করতে পারবে না। অন্যদের করতে হবে।
ছোটাচ্চু খানিকক্ষণ চিন্তা করল; তারপর বলল, “আমি তোর কেসটা নিতে পারি কিন্তু তুইও থাকিস আমার সাথে।”
টুনির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “আমাকে নেবে সাথে?”
“হ্যাঁ। তোর কেস তুই না থাকলে কেমন হবে? আমি তোর আম্মুকে বলে স্কুলে না যাওয়ার পারমিশান নিয়ে রাখব। এক দিন স্কুলে না গেলে কিছু হবে না।”
.
পরদিন খুব সকালে ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। সাথে একটা ক্যামেরা, তার লেন্স যথেষ্ট লম্বা। টুনি যে স্কুলে না গিয়ে ছোটাচ্চুর সাথে যাচ্ছে, অন্য বাচ্চারা সেটা টের পায়নি, টের পেলে একটা হুলস্থূল লাগিয়ে দিত।
টুনি বের হয়ে দেখল বাসার সামনে একটা স্কুটার দাঁড়িয়ে আছে। ছোটাচ্চুকে দেখে স্কুটারের ড্রাইভার স্কুটার থেকে নেমে একটা লম্বা সালাম দিল; বলল, ‘ভালো আছেন স্যার?”
“হ্যাঁ ভালো আছি জসীম। তোমার খবর কী?”
“আমার খবর আর কোথা থেকে হবে, আপনি আমাকে আর ডাকেন, জীবন খুবই পানসে!”
ছোটাচ্চু হাসার চেষ্টা করল; বলল, “কাজ ছেড়ে দিয়েছি, তোমাকে আর ডেকে কী করব!”
জসীম নামের স্কুটার ড্রাইভার তার স্কুটারের দরজা খুলে দিতে দিতে বলল, “আপনি কাজ ছাড়েন নাই স্যার, ওই বদমাইশের বাচ্চা আপনার কোম্পানি দখল করে নিয়েছে।”
ছোটাচ্চু স্কুটারে উঠতে উঠতে বলল, “নিয়েছে তো নিয়েছে, সমস্যা কী?”
“আপনি পারমিশান দিলেন না, স্কুটার দিয়ে ধাক্কা দিয়ে শালার দুইটা ঠ্যাং ভেঙে দিতাম, ছয় মাস হাসপাতালে থাকলে একেবারে সিধা হয়ে যেত।”
ছোটাচ্চু কোনো কথা বলল না। স্কুটারের ভেতর টুনি ছোটাচ্চুর পাশে বসার পর জসীম দরজা বন্ধ করে দিল। খাঁচার মতো এই স্কুটারগুলো খুবই অদ্ভুত, স্কুটারওয়ালা যখন বন্ধ করে দেয় তখন প্যাসেঞ্জার আর নিজে থেকে দরজা খুলতে পারে না! কোনো প্যাসেঞ্জার কোনোদিন সেটা নিয়ে আপত্তি করে না, কারণটা কী?
জসীম তার স্কুটার চালিয়ে রওনা দিল; কোথায় যেতে হবে কিছুই বলতে হলো না; টুনি অনুমান করল, আগে থেকেই বলে দেয়া আছে।
সত্যি সত্যি জসীম তার স্কুটার চালিয়ে মারিয়ার বাসার এলাকায় চলে এলো। বাসা থেকে খানিকটা দূরে রাস্তার পাশে জসীম তার স্কুটার থামাল, বলল, “এসে গেছি স্যার।”
ছোটাচ্চু টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “কোন বাসাটা মনে আছে?” “হ্যাঁ।” টুনি মাথা নাড়ল। “কালো গেট।”
কাজেই কালো গেট থেকে কে কে বের হয় সেটা দেখার জন্যে তিনজনই অপেক্ষা করতে থাকে।
.
অফিস টাইমের কাছাকাছি সময়, তাই আশেপাশের প্রায় সব বাসা থেকেই লোকজন কাজে যাবার জন্যে বের হতে শুরু করেছে। টুনি দেখল একসময় একটা অফিসের দামি মাইক্রোবাস এসে থামল এবং মারিয়ার স্বামী কোট টাই পরে বের হয়ে সেই মাইক্রোবাসে উঠে অফিস গেল। তার কিছুক্ষণ পর বাসা থেকে একটা বড় গাড়ি বের হয়ে এলো, সেই গাড়িতে মারিয়া বসে আছে, সে অফিস যাচ্ছে।
এরপর প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। একটা স্কুটারের ভেতর এক ঘণ্টা। বসে থাকা সোজা কথা নয়, তাই মাঝে মাঝে টুনি আর ছোটাচ্চু স্কুটার থেকে বের হয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল। টুনি ভেবেছিল অপেক্ষা করতে করতে ছোটাচ্চু বুঝি বিরক্ত হয়ে যাবে, কিন্তু ছোটাচ্চু মোটেও বিরক্ত হলো না। টুনি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, তুমি বিরক্ত হচ্ছ না তো?”
“না। একটা কাজে এসেছি, বিরক্ত হব কেন?”
“যদি দেখা যায় আমার সন্দেহটা মিথ্যা তাহলে তুমি আমার উপর রাগ হবে না তো?”
“রাগ হব কেন? খুশি হব। বাচ্চাটা সেফ আছে, ক্রিমিনালদের হাতে নেই জানলে রাগ হব কেন?”
টুনি একটু হাসল; বলল, “আগে তোমার মোটেই ধৈর্য ছিল না! ডিটেকটিভ হওয়ার পর অনেক ধৈর্য বেড়েছে।”
ছোটাচ্চু একটু হাসল; বলল, “সেটা তুই ভুল বলিসনি! আমার ডিটেকটিভ কাজের নব্বই ভাগ হচ্ছে কারো বাড়ির সামনে, না হলে কারো অফিসের সামনে বসে অপেক্ষা করা।”
দুজন যখন কথা বলছিল তখন সত্যি সত্যি মর্জিনা বুবাইকে কোলে নিয়ে বের হয়ে এলো। বাসার কাজের মহিলা একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়, বাসার দারোয়ানের তাকে থামানোর কথা। কিন্তু বাসার দারোয়ান তাকে থামাল না, বরং দেখা গেল দারোয়ান আর মর্জিনা দুজন একটু কথা বলল। শুধু তা-ই নয়, মর্জিনা তার কোমরে গুঁজে রাখা একটা নোট বের করে দারোয়ানের হাতে দিল। বোঝাই যাচ্ছে দুজনের মাঝে একধরনের বোঝাবুঝি আছে।
ছোটাচ্চু নিচু গলায় বলল, “টুনি, তোকে কগ্র্যাচুলেশন। তুই সত্যি সত্যি একটা বিরাট বড় কেস সলভ করেছিস।”
টুনি উত্তেজিত হয়ে বলল, “আগে পুরোটা দেখে নিই।”
ছোটাচ্চু জসীমকে বলল, “জসীম, এই মহিলাকে ফলো করতে হবে।”
জসীম বলল, “কোনো সমস্যা নাই।”
মর্জিনা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে থাকে। ছোটাচ্চু আর টুনি তখন স্কুটারে উঠে বসল। ছোটাচ্চু স্কুটারের ভেতর থেকে বুবাই আর মর্জিনার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিল।
মর্জিনা আরেকটু সামনে গিয়ে একটা রিকশায় উঠল। রিকশাটা রাস্তা ধরে এগোতে থাকে; জসীম একটু দূর থেকে রিকশাটার পিছু পিছু তার স্কুটার নিয়ে যেতে থাকে। জসীম অনেক দিন থেকে ছোটাচ্চুর সাথে কাজ করে আসছে, তাই কখন কী করতে হবে খুব ভালো জানে।
বড় রাস্তায় এসে মর্জিনা রিকশাটাকে ছেড়ে দিয়ে বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রথম দুটি বাস ছেড়ে দিয়ে মর্জিনা তিন নম্বর বাসটাতে উঠে পড়ল। জসীম তখন বাসটার পিছু পিছু যেতে থাকে, কাজটা সহজ নয় কিন্তু টুনি দেখল জসীম খুব ভালোভাবে বাসটার পিছু পিছু যাচ্ছে।
শহরের ঠিক মাঝখানে এসে মর্জিনা বুবাইকে কোলে নিয়ে নেমে পড়ল। ছোটাচ্চু আর টুনি স্কুটারের ভেতর বসে থেকে মর্জিনা কী করে সেটা লক্ষ করে। তারা দেখল মর্জিনা মোড়ের একটা টংয়ের ভেতর বসে থাকা একটা মানুষের সাথে কথা বলল, মানুষটা তখন আঙুল দিয়ে ব্যস্ত রাস্তার পাশে ফুটপাথে একটা জায়গা দেখিয়ে দিল। মর্জিনা সেখানে একটা ময়লা কাপড় বিছিয়ে বুবাইকে বসিয়ে দিল; টুনি অবাক হয়ে দেখল বুবাই সাথে সাথে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতে থাকল। দেখে মনে হলো ভিক্ষা করার ব্যাপারটা বুবাইয়ের বেশ পছন্দ, তার কাছে সেটা একটা খেলার মতো।
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু।”
ছোটাচ্চু বলল, “বল।”
“এখন মর্জিনাকে ধরা উচিত না?”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক বুঝতে পারছি না। এখানে মনে হয় বড় গ্যাং কাজ করছে। আমরা কিছু করতে চাইলে পুরো গ্যাং মনে হয় নেমে যাবে।”
“তাহলে?”
“আগে কাছে থেকে কয়েকটা ছবি তুলি।”
“ছবি তুললে সন্দেহ করবে না?”
“না। আমার লেন্সে একটা আয়না লাগানো আছে। একদিকের ছবি তোলার ভান করে অন্যদিকের ছবি তোলা যায়।”
ছোটাচ্চু তখন তার ক্যামেরা নিয়ে নেমে গেল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রাস্তার বাস, গাড়ি, স্কুটার, টেম্পোর ছবি তোলার ভান করে সে বুবাই আর তার কাছাকাছি বসে থাকা মর্জিনার অনেকগুলো ছবি তুলে নেয়। টুনি যেহেতু মারিয়ার বাসায় গিয়েছে এবং মর্জিনা তাকে দেখেছে তাই সে কাছাকাছি গেল না। দূরে স্কুটারের ভেতর বসে রইল।
বুবাই বেশ তাড়াতাড়ি টাকা রোজগার করতে থাকে। সামনে দিয়ে গেলেই সে হাত পাতে এবং সবাই বুবাইকে মাথা ঘুরিয়ে দেখে এবং অনেকেই তাকে টাকা-পয়সা দেয়। বুবাই তখন মানুষটাকে তার মাড়ি বের করে একটা হাসি উপহার দেয়। নোটটা সে দুই হাত শক্ত করে ধরে রাখে। এবং মর্জিনা কাছে এলে মর্জিনার হাতে তুলে দেয়।
বুবাই ফুটপাথে বসে বসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফুটপাথ থেকে ময়লা তুলে মাঝে মাঝে মুখে দেয়, স্বাদটা পছন্দ হলে খেয়ে ফেলে, পছন্দ না হলে থু করে ফেলে দেয়। টুনি একধরনের আতঙ্ক নিয়ে দেখল বুবাই একটা সিগারেটের গোড়া মুখে দিয়ে দিল, মাড়ি দিয়ে চিবিয়ে স্বাদটা পছন্দ না হওয়ায় মুখটা বিকৃত করে থু থু করে ফেলে দিল। কাছেই মর্জিনা নিরাসক্ত ভাবে বসে আছে, বুবাই কী মুখে দিচ্ছে, কী করছে, সে ব্যাপারে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।
ছোটাচ্চুর সন্দেহ সত্যি। এলাকাটা কিছু মানুষ কন্ট্রোল করে। মর্জিনার সাথে ভাগ-বাটোয়ারার ব্যবস্থা আছে। টুনি দেখল একসময় ডাকাতের মতো চেহারার একজন এসে মর্জিনার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে গেল।
.
দুপুরবেলা ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে একটা ফার্স্টফুডের দোকানে খেতে গেল। টুনি একটা হামবার্গার খেতে খেতে বলল, “আমার খুব খারাপ লাগছে ছোটাচ্চু।”
ছোটাচ্চু তার হামবার্গারে বড় একটা কামড় দিয়ে বলল, “কেন?”
“বুবাই রৌদ্রের মাঝে বসে ভিক্ষা করছে আর আমরা কিছুই করতে পারছি না।”
“করতে পারছি না কে বলেছে? ইচ্ছা করে কিছু করছি না। এখন কিছু করার চেষ্টা করলে সবগুলো পালিয়ে যাবে। সে জন্যে অপেক্ষা করছি।”
টুনি কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “পাজি মেয়ে মানুষটা বুবাইকে কিছু খেতে দিবে কি না কে জানে! বুবাইয়ের খিদে পেয়েছে। ফুটপাথ থেকে তুলে তুলে ময়লা খাচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম একটা সিগারেটের বাঁট মুখে দিল!”
ছোটাচ্চু বলল, “ওটা নিয়ে চিন্তা করিস না। বুবাই ফুটপাথে থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মনে হয় সিগারেটের বাঁটও হজম করে ফেলবে। আর মর্জিনা নিশ্চয়ই বুবাইকে কিছু খাওয়াবে, তার বিজনেসের জন্যে খাওয়াতে হবে!”
টুনি বলল, “তা ঠিক।”
ফার্স্টফুডের দোকান থেকে বের হয়ে দুজনেই দূর থেকে বুবাইকে লক্ষ করল। ভিক্ষা করে করে সে নিশ্চয়ই কাহিল হয়ে গেছে। এখন সে শক্ত ফুটপাথের উপর উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। প্রচণ্ড রোদ, মাছি ভনভন করছে কিন্তু তাতে বুবাইয়ের কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না।
ছোটাচ্চু আর টুনি আশেপাশে থেকে মর্জিনাকে আর বুবাইকে চোখে চোখে রাখল। তিনটার দিকে মর্জিনা তার ব্যবসা গুটিয়ে নিল। বুবাইকে কোলে তুলে নিয়ে মোড়ের টংয়ের কাছে গিয়ে কয়েকজন মানুষের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল, মনে হলো কোনো একধরনের লেনদেন হলো। তারপর সে বাসায় রওনা দিল। প্রথমে বাস, তারপর রিকশা এবং শেষ অংশ পায়ে হেঁটে।
মর্জিনার বাসায় ঢোকার পর টুনি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “যাক বাবা, বাসায় ফিরে এসেছে।”
ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করব?”
“মারিয়া আর তার হাজব্যান্ড বাসায় ফিরুক, তখন গিয়ে আমরা কথা বলব। মর্জিনাকে আটকাতে হবে। তার কাছ থেকে খবর নিয়ে পুরো গ্যাংটাকে ধরতে হবে।”
“আমরা এখন কোথায় অপেক্ষা করব?”
“বাসা থেকে ঘুরে আসতে পারি। মারিয়া আর তার হাজব্যান্ড কখন বাসায় আসবে কে জানে! রাস্তাঘাটে যা ট্রাফিক জ্যাম, অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে নিশ্চয়ই দুই-তিন ঘণ্টা লেগে যায়।”
.
সন্ধেবেলা ছোটাচ্চু আর টুনি মারিয়ার বাসায় ফিরে এলো। স্কুটার থেকে নেমে ছোটাচ্চু জসীমকে বলল, “জসীম, তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমরা কাজ সেরে আসি।”
জসীম বলল, “কোনো সমস্যা নাই। আমি আছি।”
টুনি ছোটাচ্চুকে মারিয়ার ফ্ল্যাটের সামনে নিয়ে এলো, বেল বাজাতেই মারিয়ার স্বামী দরজা খুলে দিল। ছোটাচ্চু বলল, “আমার নাম শাহরিয়ার, আমি একটা দরকারি কাজে এসেছিলাম। আমাকে আপনি চিনবেন না, আমার মা’কে চিনবেন। পরশু রাতে আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন।”
গলার স্বর শুনে মারিয়াও বের হয়ে এলো; টুনিকে দেখে সে চিনতে পারল; মুখে হাসি ফুটিয়ে ছোটাচ্চুকে বলল, “আসেন। শুনেছিলাম আপনি অনেক বড় ডিটেকটিভ অফিস দিয়েছেন—“
ছোটাচ্চু কিছু বলল না, টুনিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। টুনি দেখল পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে মর্জিনা ছোটাচ্চুকে দেখছে। দুপুরবেলা ছোটাচ্চু তার ক্যামেরা দিয়ে মর্জিনার পাশে দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তুলেছে। মর্জিনা কি ছোটাকে চিনে ফেলেছে?
টুনি দাঁড়িয়ে গেল, ছোটাচ্চুকে বলল, “ছোটাচ্চু তুমি কথা বলো, আমি এক্ষুনি আসছি।”
“কই যাচ্ছিস?”
“নিচে, জসীম ভাইয়ের কাছে। স্কুটারে একটা বই ফেলে এসেছি, নিয়ে আসি!”
ছোটাচ্চু একটু অবাক হলো, বের হওয়ার সময় টুনির হাতে বই ছিল সেটা মনে করতে পারল না। তবে এটাও সত্যি, টুনির কাজকর্ম বোঝা মুশকিল।
ছোটাচ্চু বসার ঘরে সোফায় বসে মারিয়া আর তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আপনাদের কয়েকটা ছবি দেখাই। আমি জানি এ রকম ছবি কারো বিশ্বাস হবার কথা নয় কিন্তু ছবিগুলো সত্যি।”
ছোটাচ্চুর গলার মাঝে কিছু একটা ছিল, যেটা শুনে মারিয়া আর তার স্বামী দুজনেই ভয় পেয়ে গেল। শুকনো মুখে বলল, “কীসের ছবি?”
“আপনাদের বাচ্চা বুবাই কোথায়?”
“ভেতরে। মর্জিনার কাছে।”
ছোটাচ্চু বলল, “তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসবেন, প্লিজ?”
মারিয়া মর্জিনাকে ডেকে বলল, “মর্জিনা, বুবাইকে দিয়ে যাও আমার কাছে।”
মর্জিনা বুবাইকে নিয়ে বাইরের ঘরে এলো। মারিয়া হাত বাড়িয়ে বুবাইকে নেওয়ার চেষ্টা করল। বুবাই মর্জিনাকে শক্ত করে ধরে রাখল, মারিয়ার কাছে আসতে চাইল না। শেষ পর্যন্ত একরকম জোর করে তাকে নিজের কোলে নিল। মর্জিনা সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, ছোটাচ্চু মর্জিনার দিকে
তাকিয়ে বলল, “আপনি একটু ভেতরে যাবেন, প্লিজ?”
মর্জিনা খুব অনিচ্ছার সাথে ভেতরে গেল। এ রকম সময়ে টুনি ফিরে এলো; ছোটাচ্চু বললেন, “টুনি দরজাটা বন্ধ করে দে।”
টুনি দরজা বন্ধ করে ছোটাচ্চুর পাশে এসে বসল। ছোটাচ্চু তার ক্যামেরার পিছনের স্ক্রিনে সকালে তোলা ছবিগুলো একটা একটা করে বের করে দেখাতে দেখাতে বলল, “এই যে দেখেন, আজকে সকালে আপনার বাসার গেটে ছবিগুলো তোলা হয়েছে। আপনারা দুজন কাজে বের হয়ে যাচ্ছেন। তার এক ঘণ্টা পর মর্জিনা আপনাদের ছেলেকে কোলে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।”
মারিয়া চমকে উঠে বলল, “বুবাইকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?”
ছোটাচ্চু দেখালেন, “এই যে আপনাদের ছেলে। রাস্তার ফুটপাথে। ভিক্ষা করানোর জন্যে বসিয়ে দিয়েছে।”
মারিয়া আর তার স্বামী কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারল না, তারপর অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, “কী বলছেন আপনি?”
“হ্যাঁ, আমি শুধু বলছি না। আপনাদের দেখাচ্ছি–”
মারিয়া হঠাৎ চিলের মতো চিৎকার করে ডাকল, “মর্জিনা মর্জিনা–”
মর্জিনা বেশ শান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। একটা হাত আঁচলে ঢাকা, হাতে মনে হয় কিছু আছে। টুনি একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই হঠাৎ যে ঘটনাটা ঘটল সেটার জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। মর্জিনা একটা ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে মারিয়ার কাছ থেকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বুবাইকে টেনে নিজের কাছে। নিয়ে নিল।
সবাই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তখন মর্জিনা হিংস্র গলায় বলল, “খবরদার কেউ কাছে আসবে না।” মর্জিনা এক হাতে বুবাইকে কোলে নিয়ে অন্য হাতটি আঁচলের নিচ থেকে বের করে আনল। সেই হাতে কোনো মারাত্মক অস্ত্র নেই, খুবই সাধারণ একটা ললিপপ। বুবাই ললিপপ দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, হাত বাড়িয়ে সেটা ধরতে চায়, কিন্তু মর্জিনা ললিপপটা বুবাইয়ের হাতে দিল না, তার মুখের সামনে একটু দূরে ধরে রাখল।
মারিয়া চিৎকার করে বলল, “কী হচ্ছে?”
মর্জিনা শান্ত গলায় বলল, “এই কাঠি লজেন্সটা ইন্দুর মারার বিষের মাঝে চুবাইয়া আনছি। আপনেরা একটু তেড়িবেড়ি করেন তো বুবাইয়ের মুখের মাঝে ঢুকাইয়া দিমু।”
মারিয়া চিষ্কার করে বলল, “কী বলছ তুমি?”
“ঠিকই বলছি। সবাই চুপ করে বসেন।”
সবাই আবার সোফায় বসল। মারিয়ার স্বামী কাঁপা গলায় বলল, “তুমি ভাবছ তুমি পার পেয়ে যাবে?”
“আগে অনেকবার পার পাইছি, কাজেই, মনে হয় এইবারও পার পাইমু। আর আমি যদি পার না পাই, তাহলে আপনাদের বাচ্চাও পার পাইব না। এই বাচ্চা আপনাদের চিনে না, আমারে চিনে।”
ছোটাচ্চু বলল, “কী চাও তুমি?”
মর্জিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর দৃষ্টিতে বিষ ঢেলে বলল, “দুপুরবেলা যখন ক্যামেরা নিয়ে আপনি খালি আমার পাশে দাঁড়াইয়া বাস-ট্রাকের ছবি তুলবার লাগছিলেন, তখনই আমার সন্দেহ হইছিল, কার ছবি তুলেন, বাস-ট্রাকের, না আমার?”
ছোটাচ্চু কিছু বলল না, মর্জিনা টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ছেমড়ি, পাকঘরে যাও। দেখো টেবিলের উপর একটা ব্যাগ আছে। ব্যাগটা নিয়া আসো। খবরদার কোনোরকম টেংরিবাজি করবা না।”
টুনি কোনো টেংরিবাজি করল না, রান্নাঘরে গিয়ে দেখল একটা ব্যাগ। টুনি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয়ে এলো। উঁকি দিয়ে দেখল, ব্যাগের ভেতর সোনাদানা, অলংকার, টাকা-পয়সা। মর্জিনা এগুলো অনেক দিন থেকে জমা করেছে।
মর্জিনা বলল, “ব্যাগটা একেকজনের সামনে নিয়ে ধরো। আর আপনারা ব্যাগের মধ্যে আপনাদের মোবাইল টেলিফোনটা রাখেন।”
মারিয়ার স্বামী আপত্তি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, মর্জিনা তখন একটা ধমক দিল; বলল, “খবরদার কোনো কথা নাই। আমার হাতে সময় নাই।”
টুনি একেকজনের সামনে ব্যাগটা নিয়ে ধরল এবং সবাই তার মোবাইল ফোন ব্যাগের মাঝে রাখল। টুনি ব্যাগটা মর্জিনার হাতে দেয়। মর্জিনা খুশি হয়ে বলল, “চমৎকার! এখন আপনারা আর কাউকে ফোন করতে পারবেন না।”
মর্জিনার কোলে বুবাই আশেপাশে তাকাল, কী হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। ললিপপটা খাবার জন্যে সে ব্যস্ত হয়ে সেটা ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মর্জিনা বলল, “এইবারে আমি যাচ্ছি। বাচ্চাটারে নিচে দারোয়ানের কাছে দিয়া যামু। সাথে নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল। বাচ্চাটা খালি জন্ম দিছেন আর কিছু করেন নাই। মানুষ যা করার আমি করছি।”
মর্জিনা দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, “বাসার চাবিটা দেন।”
মারিয়া শুকনো মুখে বলল, “বাসার চাবি?”
“হ্যাঁ। আমি জানি দুইজনের কাছে দুইটা চাবি থাকে। চাবি দুইটা, তাড়াতাড়ি।” মর্জিনা টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ছেমড়ি। চাবি দুইটা আমার কাছে নিয়া আসো।”
মারিয়া আর তার স্বামী চাবি দুটো টুনির হাতে দিল। টুনি চাবি দুটো মর্জিনার হাতে দিল। মর্জিনা দুই হাত দিয়েই বুবাই, ব্যাগ, ললিপপ আর চাবি দুটো ম্যানেজ করে দরজা খুলে বাইরে যেতে যেতে বলল, “খবরদার, কুনো চেঁচামেচি নাই। আমি যদি একটু শব্দ শুনি তাহলেই কিন্তু খবর আছে।”
মর্জিনা দরজা বন্ধ করল। বাইরে থেকে দরজায় তালা দিল। বাইরে থেকে বলল, “বেকুবের দল। কাঠি লজেন্সের মাঝে কিছু ছিল না! বুবাইকে খেতে দিলাম।“ তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।
মারিয়া এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তার স্বামী সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “কেঁদো না মারিয়া। এই মহিলা অনেক ডেঞ্জারাস, অনেক কিছু হয়ে যেতে পারত। ভাগ্যিস বেশি কিছু হয় নাই।”
“বুবাই, আমার বুবাইকে নিয়ে যাবে না তো?”
“না, না, নিবে না। বলেছে নিচে দারোয়ানের কাছে রেখে যাবে।”
“যদি না রাখে?” মারিয়া আবার কেঁদে উঠল।
টুনি এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবারে বলল, “আমার কি মনে হয় জানেন?”
সবাই টুনির দিকে ঘুরে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“মর্জিনা বেশি দূর যেতে পারবে না। সে এতক্ষণে নিচে আটকা পড়েছে।”
মারিয়া চোখ বড় বড় করে বলল, “কেন? এ কথা কেন বলছ?”
টুনি বলল, “এ রকম একটা কিছু হতে পারে আমার এ রকম সন্দেহ হয়েছিল। আমি তাই নিচে স্কুটারের ড্রাইভার জসীম ভাইকে বলে এসেছি।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কী বলে এসেছিস?”
“বলে এসেছি যে, যদি সে দেখে যে মর্জিনা বের হয়ে যাচ্ছে তাহলে সে যেন স্কুটার চালিয়ে কাছে যায়। মর্জিনা নিশ্চয়ই তাড়াতাড়ি একটা স্কুটারে উঠতে চেষ্টা করবে, তাকে যেন স্কুটারে নিয়ে নেয়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, সত্যি। আর স্কুটারের ভেতর উঠলে দরজা আর নিজে খোলা যায়। খাঁচার ভিতরে আটকা পড়ে যায়। জসীম ভাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে মর্জিনাকে আটকে ফেলেছে।”
মারিয়া হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার কাছে দরজার আরেকটা চাবি আছে। খুঁজে পাব কি না জানি না।”
মারিয়ার স্বামী বলল, “খুঁজে দেখো, না হলে দরজা ভেঙে বের হতে হবে।”
মারিয়া শোয়ার ঘরে ড্রেসিং টেবিলের উপর খোঁজাখুঁজি করে একটা চাবির গোছা পেয়ে গেল। সেটা হাতে নিয়ে ছুটে এসে চাবিগুলো দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে থাকে।
একটা চাবি দিয়ে সত্যিই দরজা খুলে গেল। চারজন সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে শুরু করে। দোতলার ল্যান্ডিংয়ে এসে সবাই থেমে গেল। সেখানে মেঝেতে বসে বুবাই চেটে চেটে ললিপপ খাচ্ছে। সবাইকে দেখে সে মাড়ি বের করে হেসে হাত পাতল।
মারিয়া ছুটে গিয়ে তার হাত থেকে ললিপপটা কেড়ে নিল। তারপর তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
অন্যেরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। সত্যি সত্যি বাসার সামনে জসীমের স্কুটার এবং স্কুটারের ভেতরে বসে মর্জিনা দরজা ধরে টানাটানি করতে করতে চিৎকার করছে। জসীমের ভেতর কোনো উত্তেজনা নেই; সে নেমে মর্জিনাকে বলল, “চিল্লাফাল্লা কইরা লাভ আছে? আমার স্কুটারের দরজা খাঁটি স্টিলের, খুলতে পারবা না।”
ছোটাচ্চু বলল, “ওয়েল ডান জসীম।”
জসীম দাঁত বের করে হাসল, টুনিকে দেখিয়ে বলল, “বুদ্ধিটা তো আমার না-বুদ্ধি এই ছোট আপার।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল; বলল, “হ্যাঁ, টুনির বুদ্ধি একটু বেশি। পরশু দিন এই বাসায় বেড়াতে এসেছিল, তখনই সন্দেহ করেছিল কিছু একটা ঘটেছে।”
জসীম বলল, “এখন কী করবেন স্যার?”
“পুলিশকে খবর দিতে হবে। কিন্তু আমার মোবাইলটা তো মর্জিনার কাছে।”
“দরজা খুলে ব্যাগটা বের করমু?”
ছোটাচ্চু বলল, “না, না। খাঁচার দরজা খোলা যাবে না। এই মহিলা খুব ডেঞ্জারাস। আগে পুলিশ আসুক।”
সবাই স্কুটার ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। স্কুটারের ভেতর আটকে থাকা মর্জিনা বিষদৃষ্টিতে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল।
টুনি কিছুক্ষণ মর্জিনার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর চোখ নামিয়ে সে সরে গেল।
কী কারণ কে জানে, সে নিজের ভেতর একধরনের বেদনা অনুভব করে।