3 of 8

বুদ্ধি

বুদ্ধি

আমি গরিব মানুষ। আমার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। আয়ব্যয়ের ভয়াবহ পার্থক্য আমাকে বুদ্ধি খরচ করে মেটাতে হয়। টাকার অভাবে বুদ্ধি খরচ করি।

বুদ্ধি ব্যাপারটা খুব জটিল। যার আছে তার আছে, যার নেই তার নেই। বিদ্যা, অর্থ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি হয়তো চেষ্টা করে বাড়ানো যায়, বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু বুদ্ধি ব্যাপারটা অটল অনড়। তার আর বাড়াকমা নেই। অতি বার্ধক্যে সেনিলিটি বা মানসিক জড়তা না-আসা পর্যন্ত যার যতটুকু বুদ্ধি আছে, তার খুব কমতি হয় না। এই তো সেদিন বুদ্ধির ব্যাপারটা উঠেছিল ভারতীয় সংসদে। জনৈক মাননীয় সংসদ-সদস্য সদাসর্বদা টুপিপরা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কৌতুক করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এই গরমে মাথায় টুপি পরে থাকেন কী করে? অস্বস্তি হয় না, কষ্ট হয় না?’

এই অ-সংসদসুলভ প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী সরস জবাব দিয়েছিলেন, ‘আরে মশায়, টুপি নয়, টুপির নীচের জিনিসটাই আসল কথা।’ টুপির নীচে মাথা, মাথা মানেই বুদ্ধি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টুপির বদলে প্রশ্নটাকে ঘুরিয়ে তার বুদ্ধির দিকে নিয়ে গেছেন।

র‍্যালফ ওয়ালভো ইমারসন একদা বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিমান মানুষের নির্বোধ মানুষের ব্যাপারে একটা অধিকার আছে, সেই অধিকারটা হল নির্বোধকে পরামর্শ দেওয়া।’

বুদ্ধি বিষয়ে আরও-একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন অন্য এক বিদেশি প্রবন্ধকার। তাঁর বক্তব্য ছিল যে, বুদ্ধি হল টাকার মতো। যতক্ষণ না লোকে জানতে পারছে তোমার কতটা আছে, ধরে নিচ্ছে তোমার অনেক আছে।

কথাটা অবশ্য খুব সরল নয়। সোজা ব্যাপার হল—যার তেমন বুদ্ধি নেই, তার চুপচাপ থাকাই ভাল। তার বুদ্ধির দৌড় দেখলে লোকে বুঝে যাবে যে সে নির্বোধ। কিন্তু সে যদি বুদ্ধি প্রকাশ করতে না যায়, তা হলে হয়তো তাকে সবাই বুদ্ধিমান বলেই বিবেচনা করবে।

আমাদের ছোটবেলায় ‘বুদ্ধির অঙ্ক’ বলে একটা সমস্যা ছিল, হয়তো এখনও আছে।

সে এক ভয়াবহ ব্যাপার।

এক তেলতেলে বাঁশ বেয়ে বাঁদর উঠছে। সেই বাঁদর মিনিটে তিন ফুট ওঠে, আবার পরের মিনিটে আড়াই ফুট নেমে যায়। কতক্ষণে সে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতার বংশদণ্ডের শীর্ষে পৌঁছবে।

শ্ৰীমতী লীলা মজুমদারের গল্পে পড়েছি—এক সরেস ছাত্র এই অঙ্কের উত্তর বার করেছিল আড়াইখানা নাকি সাড়ে তিনখানা বাঁদর।

হয়তো অনেকেরই মনে আছে, আরও সব নানারকম বুদ্ধির অঙ্ক ছিল—চৌবাচ্চার দুই নল দিয়ে দুই ধারায় জল ঢুকছে আর ফুটো দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে, কতক্ষণে চৌবাচ্চা পূর্ণ হবে, কিংবা সেই অনৈতিক জিজ্ঞাসা, কতটা খাটি তেলে কতটা ভেজাল তেল মেশালে কত লাভ।

বুদ্ধির অঙ্ক নিয়ে আর এগিয়ে লাভ নেই। আমার সাহসও নেই, এ আমার বিষয় নয়, এ বিষয়ে আমি একেবারে কাঁচা। বরং বুদ্ধির গল্পে যাই।

সেদিন এক সাহিত্যবাসরে বিখ্যাত চিত্রকর শ্রীযুক্ত পরিতোষ সেন একটা গল্প বলেছিলেন। একবার এক চিত্রপ্রদর্শনীতে এক বালকের আঁকা একটি ছবি দেখেছিলেন। এই ছবিতে আছে গভীর বনের মধ্যে একটি লোক ঢুকেছে, কিন্তু বনের ওপরে যে আকাশ, সেই আকাশে চাঁদ ও সূর্য দুই-ই রয়েছে।

পরিতোষবাবু বালকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এটা কী করে সম্ভব? একই সঙ্গে দিনরাত, আকাশে চাঁদ আর সূর্য?’

বুদ্ধিমান বালকটি এই প্রশ্নের একটি অসম্ভব উত্তর দিয়েছিল। সে বলল, ছবির ওই লোকটি জঙ্গলে ঢুকেছে দিনের বেলায়, তখন আকাশ সূর্য ছিল কিন্তু তার জঙ্গল থেকে বেরতে বেরতে রাত হয়ে গেছে, চাঁদ উঠে গেছে, তাই জঙ্গলের ওপরে আকাশে একসঙ্গে প্রথমে সূর্য আর পরে চাঁদ এঁকে দিয়েছি।

এর পর এক ভুবনবিখ্যাত বৈজ্ঞানিককে নিয়ে একটি বুদ্ধির গল্প। তবে তার আগে নিউটনসাহেবের সেই মজার ঘটনাটি মনে করিয়ে দিই।

নিউটনসাহেব তাঁর পোষা খরগোশের জন্যে একটি বাক্স বানিয়েছেন। দুটো খরগোশ। একটা বড় খরগোশ আর একটা ছোট খরগোশ। নিউটনসাহেবের বাক্সে দুটো দরজা, একটা বড় দরজা, একটা ছোট দরজা। সবাই জানতে চাইল—দুটো দরজা কেন। নিউটন ব্যাখ্যা করলেন, ‘বাঃ রে! খরগোশ যে দুটো। এই বড় দরজা দিয়ে বড় খরগোশটা ঢুকবে আর ছোট দরজা দিয়ে ছোট খরগোশটা।’ অতবড় বৈজ্ঞানিককে কে বোঝাবে যে শুধু বড় দরজাটা থাকলেই হত, ছোট বড় দুটো খরগোশই সেই দরজা দিয়ে যাতায়াত করতে পারত। ছোট খরগোশের জন্যে আলাদা ছোট দরজা অপ্রয়োজনীয়।

অতঃপর যে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের প্রসঙ্গে আসছি, তিনি সত্যেন বসু। এই সাদাসিধে, উদার প্রকৃতির, সরলচিত্ত, দিলখোলা মানুষটিকে অনেক সময়েই দেখা যেত কলকাতার ট্রামে-বাসে সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করছেন। তাঁর যে পৃথিবীজোড়া খ্যাতি, তিনি যে বৈজ্ঞানিকদের বৈজ্ঞানিক—একথা তাকে দেখে বোঝা যেত না। তাঁর নিজেরও হয়তো খেয়াল থাকত না।

সে যা হোক, একবার তিনি একটা প্রাইভেট বাসে চড়ে আসছেন, কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে নামবেন। পরনে বাঙালি বেশ, একমাথা পাকা চুল। নামার সময় তাঁর কামিজের পকেট বাসের বেজার হ্যান্ডেলে আটকে গেছে। তিনি সামনের দিকে এগোতে পারছেন না। টানাটানি করছেন পকেটটাকে।

তখন বাসের কন্ডাক্টর তাঁকে একটু পিছিয়ে এসে বাসের হ্যান্ডেল থেকে পকেটটা ছাড়িয়ে নিয়ে নামতে পরামর্শ দিল। সেই পরামর্শমতো সঙ্গে সঙ্গে পকেটটা হ্যান্ডেল থেকে ছেড়ে গেল, সত্যেন বসু, বাস থেকে নেমে গেলেন। নামতে নামতে শুনতে পেলেন চলমান বাস থেকে কন্ডাক্টর তাঁর পাকামাথার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘এত বয়েস হল আপনার এখনও ব্রেনটাকে খাটাতে শিখলেন না।’

আরেকটা আখ্যান বাকি আছে। সেটা আমার নিজেকে নিয়ে।

কলকাতা থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা ছোট গ্রাম্য বাড়ি ছিল আমার। সেই বাড়ির ভেতরের উঠোন কুপিয়ে একটা তরকারির বাগান করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অসুবিধে হল প্রতিবেশীর পায়রাগুলোকে নিয়ে।

কোপানো উঠোনে ডাঁটা আর মুলো চাষ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু যেই ডাঁটার আর মুলোর বিচি ছড়িয়ে দিই, পায়রাগুলো এসে খুঁটে খুঁটে সেগুলো খেয়ে যায়। দু’বার-তিনবার এরকম হল।

যে-গোয়ালা আমাকে দুধ দেয়, সে একদিন সকালে আমার দুর্দশা দেখে বলল, ‘একটু বুদ্ধি খরচ করুন।’ আমি বললাম, ‘কীরকম?’

গোয়ালা তখন তার দুধের বলিতিটি বারান্দায় নামিয়ে রেখে বাগানের পাশে আমার কাছে এল। তারপর মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুড়ে খুলে ঢেলে এমন ভঙ্গি করল যেন বীজ ছিটিয়ে দিচ্ছে। পায়রাগুলো সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাগানে। কিন্তু বীজ খুঁজে না পেয়ে আবার গিয়ে সামনের গাছে বসল।

গোয়ালা পরপর তিন-চারবার কয়েক মিনিট অন্তর এইরকম বীজ ছোড়ার ভঙ্গি করল। প্রত্যেকবারই পায়রাগুলো নিরাশ হয়ে ফিরে গেল। অবশেষে শেষের বার আর জব্দ হওয়ার ভয়ে গাছ থেকে নামল না। তখন গোয়ালা আমাকে বলল, এবার বীজ বুনে দিন, ওরা আর খেতে আসবে না।’

সত্যিই তাই হল, বুদ্ধির জয় হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *