এক বাবুর একটি বড় বুদ্ধিমান চাকর ছিল, তার নাম ভজহরি। একদিন ভজহরি পথ দিয়া যেতে যেতে দেখল, তার বাবু বড় ব্যস্ত হয়ে বাড়ির দিকে ছুটে চলেছেন। ভজহরি জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবু, কোথায় যাচ্ছেন?’ বাবু বললেন, ‘শিগ্গির এস ভজহরি, সর্বনাশ হয়েছে-আমাদের ঘরে আগুন লেগেছে।’ তাতে ভজহরি বলল, ‘আপনার কোন ভয় নাই বাবু, ও মিছে কথা। আগুন কি করে লাগবে? আমার কাছে যে ঘরের চাবি রয়েছে!’
ভজহরি গেল কলুর দোকানে, এক সের তেল কিনতে। কলু তাকে এক সের তেল মেপে দিল, তাতে বাটিটি ভরে গেল। তখন ভজহরি বলল, ‘ফাউ দেবে না।’ কলু বলল, ‘হ্যাঁ দেব বই কি। কিসে করে নেবে? ভজহরি ভাবল, ‘তাই ত কিসে করে নিই? কিন্তু ফাউ না নিয়ে গেলে যে বাবু আমাকে বোকা ভাববেন।’ তখন তার মনে হল যে বাটির তলায় একটু গর্ত আছে। অমনি সে বাটিটা উল্টিয়ে নিয়ে সেই গর্তটা দেখিয়ে কলুকে বলল, ‘এত ফাউ দাও।’ কলু হাসতে হাসতে সেই গর্তে ফাউ ঢেলে দিল, ভজহরি মহা খুশী হয়ে তাই নিয়ে বাড়ি এল।
ভজহরি তার বাবুর সঙ্গে নৌকায় চড়ে নদী পার হচ্ছে। নৌকায় ঢের লোক, ভজহরি ভাবল নৌকা বড্ড বোঝাই হয়েছে, যদি ডুবে যায়। এই ভেবে, সে তাদের পুটলিটা মাথায় করে বসে রইল। বাবু বললেন, ‘ভজহরি, পুটলিটা নামিয়ে রাখ না, মাথায় করে কেন কষ্ট পাচ্ছ।’ ভজহরি বলল, ‘আজ্ঞে না, নৌকা বড্ড বোঝাই হয়েছে, পুঁটলিটা তাতে রাখলে আরো বোঝাই হয়ে যাবে।’
বাড়িতে চোর এসেছে, ভজহরি তা টের পেয়েছে। সে ভাবল, বেটাকে ধরতে হবে। তখন সে মাথায় শিং বেঁধে লেজ পরে উঠানের কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মতলবখানা এই যে, চোর নিশ্চয় তাকে দেখে ছাগল মনে করে তাকে চুরি করতে আসবে, তখন সে তাকে জড়িয়ে ধরবে। চোর এল, ঘরে গিয়ে ঢুকল, ভজহরি উঠানের কোণ থেকে বলল, ‘ম্যা-আ-আ-আ।’ চোর ঘরের সব জিনিসপত্র বাইরে এনে একটি পুঁটলি বাঁধল। ভজহরি তাকে বলল, ম্যা-আ-আ-আ’। তা চোর তাড়াতাড়ি সেই পুটলি নিয়ে আঁস্তাকুড়ের উপর দিয়ে ছুট দিল। তখন ভজহরি হেসে গড়াগড়ি দিয়ে বলল, ‘ব্যাটা কি বোকা, আঁস্তাকুড় মাড়িয়ে গেল, এখন বাড়ি গিয়ে স্নান করতে হবে।’
রামধন লোকটি বেশ সাদাসিধে, কিন্তু একটু রাগী। সে গিয়েছে চোরেদের বাড়ি চাকরি করতে। রাত্রে চোরেরা এক জায়গায় চুরি করতে গেল, রামধনকেও সঙ্গে নিল। সেখানে রামধনকে একটা কচুবনে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুই এখানে চুপ করে বসে থাক্, আমরা চুরি করে জিনিস নিয়ে এলে সেগুলো বয়ে নিয়ে যাবি।’ রামধন বলল, ‘আচ্ছা।’
চোরেরা সিঁদ কাটছে, রামধন কচুবনে বসে আছে। সেখানে বেজায় রকমের মশা, রামধনকে কামড়িয়ে পাগল করে তুলল। বেচারা অনেকক্ষণ সয়ে চুপ করে ছিল, তারপর চটাস্ চটাস্ করে দু-একটা মারতে লাগল। শেষে রেগে দিয়ে লাঠি দিয়ে মেরে কচুবন তোলপাড় করে তুলল। সেই শব্দে বাড়ির লোক সব গেলে গিয়ে বলল, ‘কে রে তুই? এত গোলমাল করছিস?’ রামধন বলল, ‘আমি রামধন গো।’ বাড়ির লোকেরা বলল, ‘ওখানে কি করছিস? রামধন বলল, ‘আপনাদের ঘরে যে সিঁদ হচ্ছে!/
তখন ত আর ছুটোছুটি হাঁকাহাঁকির সীমাই রইল না। চোরেরা আর চুরি করবে কি, তাদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসাই ভার হল। ঘরে এসে তারা তারপর অবশ্যি রামধনের উপর খুবই চোটপাট লাগাল। সে বলল, ‘কি করি ভাই, আমার রাগ হয়ে গেল। যে ভয়ানক মশা!’ চোরেরা বলল, ‘আচ্ছা, খবরদার! আর কখনো এমন করিস নে।’
পরদিন চোরেরা আবার রামধনকে নিয়ে চুরি করতে গিয়েছে। এবারে রামধন ঠিক করে এসেছে যে মশায় তাকে খেয়ে ফেললেও আর টু শব্দটি করবে না। আর চোরেরাও বেশ বুঝে নিয়েছে যে, রামধনকে বাইরে রেখে ঘরে ঢুকলে বড়ই বিপদ হতে পারে। তাই তারা ভেবেছে ওকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে তারা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
একটা বাড়ির কাছে এসে চোরেরা বাইরে থেকেই কেমন করে তার একটা দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলল, তারপর রামধনকে বলল, ‘তুই চুপি-চুপি ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র বার করে আন্। দেখিস কোন শব্দ করিস না যেন।’ রামধন দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে গেল। দরজার কব্জায় ছিল মরচে ধরা, তাই দরজা ঠেলতেই সেটা বলল, ‘ক্যাঁচ্!’ রামধন থতমত খেয়ে অমনি থেমে গেল। তারপর আবার যেই ঠেলতে যাবে, অমনি দরজা আবার বলল, ‘ক্যাঁচ্! রামধন তাতে দাঁত খিঁচিয়ে ‘আঃ’ বলে আবার থেমে গেল। তারপর রামধন কিছুতেই আর রাগ সামলাতে পারল না। তখন সে পাগলের মত হয়ে প্রাণপণে সেই দরজা নাড়তে নাড়তে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘ক্যাঁচ্!- ‘ক্যাঁচ্!!- ‘ক্যাঁচ্!!!- ‘ক্যাঁচ্!!!!’ তারপর কি হল বুঝতেই পার।
এ-সব ত শুধু গল্প, এবার একটি সত্যিকারের চাকরের কথা বলি। তার নাম, ধরে নাও যে কেনারাম। কেনারাম সেজেগুজে একটা বোটের ছাতে উঠে বসে আছে-তার বাবুর সঙ্গে এক জায়গায় তামাশা দেখতে যাবে। খানিক বাদেই বোটের ভিতর থেকে জুতোর শব্দ এল। কেনারাম বুঝল বাবু বেরুচ্ছেন, এইবেলা যেতে হবে। সে অমনি তাড়াতাড়ি বোটের ছাত থেকে লাফিয়ে পড়ল-আর পড়ল ঠিক তার বাবুর ঘাড়ে।
প্রথম যখন কেনারাম আসে তখন একজন পুরনো চাকর বলেছিল, ‘বাবু কাছারি থেকে এল রোজ তাঁকে পান খেতে দিও।’ সেদিন বাবু কাছারি থেকে এসেই পায়খানায় গেলেন, কেনারামও তাড়াতাড়ি সেইখানেই গিয়ে তাঁকে বলল, ‘বাবু, পান এনেছি।’