তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

বুদ্ধিমান

বুদ্ধিমান

আমরা কি কম বুদ্ধিমান! আমরা দুটোই রেখেছিলাম। মোটর গাড়ি আর ঠেলা গাড়ি। বৈদ্যুতিক পাখা আর হাতপাখা। গ্যাস আর তোলা উনুন। গোবর আমাদের নৈবেদ্য। ঘুঁটে আমাদের শ্রেষ্ঠ কারুশিল্প। আমরা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। আর হবই বা না কেন? যে দেশে এত ঋষি মহাপুরুষ জন্মেছেন, যে দেশের মোড়ে-মোড়ে জ্যোতিষীদের আখড়া। এপাশে, ওপাশে দুটো লম্বা লাইন কেরোসিন তেলের আর হাত দেখাবার, সে দেশের মানুষ নিজেদের দূর ভবিষ্যৎ দেখতে পাবে না তো কে পাবে।

আমরা জানতুম পেট্রল নামক পদার্থটি এক সময় আর পাওয়া যাবে না। দিনে-দিনে দাম বাড়বে। অবশেষে মধ্যপ্রাচ্যে তেল নিয়ে একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড হবে। আর তেলের মালিকরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরে বসে থাকবে। কুয়েতের তৈল-কূপে ইরাকিরা আগুন দিয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—বছরতিনেক ধরে জ্বলবে। পেট্রল হল তরল সোনা। সোনার লড়াই এই বিশ্বে কোনও দিন শেষ হবে না।

আমরা সাত্বিক, শান্তিপ্রিয় জাতি। দু-চারটি কৃষ্ণের জীব রোজই খুনটুন হয়। পাঞ্জাবে, কাশ্মীরে, কী অসমে, অথবা পশ্চিম বাংলার জেলায়-জেলায়, কলকাতায়, হাওড়ায়। সে হল গীতার প্রাকটিক্যাল ক্লাস। মানুষ মরেও না, জন্মায়ও না, আত্মা ফুটো করা যায় না, ফাঁসানো যায় না, পোড়ানো যায় না, গলানো যায় না। সেই বোধে-বোধি হওয়ার জন্যেই রোজ আমরা দু-দশটা লাশ ফেলি। যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে আমরা নেই। যারা কেরোসিনই পায় না, তারা আশা করবে পেট্রল! আমাদের শাস্ত্র আমাদের শিখিয়েছেন অর্জন নয়, বর্জন।

এক সময় মহাহট্টগোল হয়েছিল এই শহরে, ঠেলা, রিকশা, গরুর গাড়ি, এই সব চলবে কেন! মডার্ন এক। আমেরিকা অ্যাটম ফাটিয়েছে। চাঁদে চক্কর মারছে, মহাকাশে যাচ্ছে পিকনিকে, আমেরিকার নিউ জার্সির টার্নপাইক রোডে এক সঙ্গে বিশ সারি গাড়ি ছোটে। মসৃণ রাস্তা, বেগে ধাবমান অটোমোবিল, এই তো হল উন্নত সভ্যতার আদল। আমরা কম কীসে। আমরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন করব। প্রতিটি গ্রামে বৈদ্যুতিক আলোয় ফোয়ারা ছোটাব। ব্যস্ত শহরের চওড়া রাজপথ ধরে সত্তর কিমি বেগে ছুটবে মোটর, বাস। টাইম ইজ মানি। এমনকী, এ-ও শোনা গেল, ট্রামকেও বিদায় করা হবে। কলকাতার মতো শহর! সেই শহরে ঢিকির ঢিকির গাড়ি চলতে পারে না। নিউইয়র্কের পরেই কলকাতা না কলকাতার পরে নিউইয়র্ক, এই নিয়ে সেমিনারও হয়ে গেল।

অলক্ষ্যে হাসলেন ভাগ্যদেবতা। তিনি জানতেন, এ দেশের ভাগ্য কী? বেশি লপচপানি ধাতে সইবে না। টেমির আলো, রাম-রাবণের যুদ্ধ, হরিনাম সংকীর্তন, জন্ডিসের মালা, ভূতে ধরা, ওঝার ঝাঁটা, বর্ষার কাদা, মশার ভ্যানভ্যান, ম্যালেরিয়া, বয়েল গাড়ি, তেচাকার রিকশা, পঞ্চায়েতের ঘোঁট, বধূ-নির্যাতন, পরস্পরের কাছা ধরে টানাটানি। এই হল যুগপ্রবাহ। এরই নাম, চলছে, চলবে। এই পরিবেশে কোন ধরনের যানবাহন মানাবে? অবশ্যই গরুর গাড়ি। ঠেলা। সাইকেল ভ্যানও বেমানান। মহাভারতের যুগের রথ কোনওমতেই নয়; কারণ তা রাজশক্তির প্রতীক। তা ছাড়া ঘোড়ার প্রয়োজন। প্রয়োজন উন্মুক্ত প্রান্তরের। রাজশক্তিকে আমরা যখন বিদায় করেছি, রাজবাহন আমরা ফেরাই কোন আক্কেলে!

একটা হতে পারে, রাজ্যের যাঁরা শাসকবর্গ তাঁরা তো রাজন্যগোষ্ঠীর। তাঁরা রথ চাপতে পারেন। রথে চেপে রাইটার্সে, কী অ্যাসেম্বলিতে। মুখ্যমন্ত্রীর রথের মাথায় থাকবে সোনার তবক-মোড়া ছাতা। টুলটুল করে দুলবে। লাল পতাকা উড়বে পতপত করে। সাইরেনের বদলে বাজবে রামশিঙা। কে বাজাবেন? নিজের শিঙা নিজে বাজালে ক্ষতিটা কি? নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মতো। আর একটা শব্দ আছে শিঙাফোঁকা। শিঙা ফুঁকে দাও, মানে সব শেষ। তা প্রায় সেইরকম একটা অবস্থাই তো এসে গেছে। বক্তা আর প্রবক্তা ছাড়া কারই বা ফুসফুসের তেমন জোর আছে। ফুঁয়ের জোর। ফুঁ মেরে যাঁরা সব উড়িয়ে দিতে পারেন, তাঁরাই ফ্রেশ র‌্যাঙ্কার। সমস্যা সমাধান, মারো ফুঁ। ঝড়ফুঁক। পদযাত্রা তো প্রায়ই হবে, তখন মন্ত্রীমন্ডলীর বিভিন্ন আকারের রথ সেই মহামিছিলের শোভা বর্ধন করবে। এমনও মনে হতে পারে, রামরাজত্ব বুঝি এসেই গেছে। আমরা সব মহাবীরের দল। পাঁউরুটির বদলে চাঁপাকল। খেতে-খেতে মিছিলে সামিল হব। মাঝে-মাঝে বলব, রাম নাম সত্য হায়।

দূরদৃষ্টি কাকে বলে? একেই বলে। মটোর তো আর পথে থাকবে না, থাকবে ঘুগনিতে। পরিকল্পনাটা না জেনেই চিৎকার, চেঁচামেঁচি, বিক্ষোভ, লেখালিখি। কী অভিযোগ! রাস্তার এই হাল কেন? কেন সারানো হয় না! কী আশ্চর্য কথা! রাস্তার কোনও প্রয়োজন আছে। গরুর গাড়ির দুলকি চলনের জন্যে যা যা প্রয়োজন, তা -ই করা হচ্ছে। ভুল করে দক্ষিণ কলকাতার দিকের পাতালরেলটা হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্য সেই অঞ্চলের মানুষের। আমেরিকার প্রাচুর্যের অসুস্থ মানুষের উদ্দাম গতির পীড়ায় তাঁরা আপাতত পীড়িত। তবে কথা এই, ব্যাধি সেরে যাবে। ডাক্তার-বদ্যির অভাব নেই। অসুখের মূলে তাঁরা পৌঁছে যাবেনই। অসুখের উৎস হল পাওয়ার প্ল্যান্ট। প্ল্যান্ট মানে আগাছাও হতে পারে। সেই আগাছা নির্মূল করে দিতে পারলেই আরোগ্য। উত্তরে আমরা ঠিক সময়ে চেপে ধরতে পেরেছি। খেল খতম। মাটির তলায় ধনতন্ত্র হচ্ছিল। ধনতন্ত্রের হর্টিকালচার। সুড়ঙ্গ পর্যন্ত আমরা সহ্য করেছি। তারও একটা কারণ ছিল। আমাদের দূরদৃষ্টি। এক নম্বর, আমেরিকা যদি আমাদের বারোটা বাজাবার জন্যে নাপামের সম্ভার নিয়ে তেড়ে আসে, তাহলে আমরা উত্তর কলকাত্তাইরা সব সিঁধিয়ে যাব। ওইখান থেকে আমরা আমাদের স্কাড ছাড়ব। আমাদের স্কাড হল বক্তৃতা আর স্লোগান। মাঝেমধ্যে ওপরে উঠে এসে, একটা করে কুশপুত্তলিকা দাহ করব। পেট্রলের অভাব থাকলেও খড়ের অভাব নেই। নাটকও করব, যুদ্ধ-বিরোধী নাটক। আমাদের অস্ত্র হল গর্ত আর সংস্কৃতি। আর বলদ আমাদের আদর্শ। কলুর বলদ, সংসারের বলদ, হালের বলদ। সেই কারণেই আমরা বলদর্পী। দু-নম্বর, ওই সুড়ঙ্গে আমরা খাটাল তৈরি করব। খাটা পায়খানা করব, মাছের বাজার, স্মাগলড গুডসের বাজার বসাব। গরুর গাড়ি বা ঠেলায় চেপে যখন অফিসে যাব তখন গায়ে একটু বিলিতি সেন্টের ফ্যাঁসফোস লাগবে। বলদের গায়ে একটু স্প্রে করে দিয়ে ভাবব বিলিতি বলদ। আমাদের ‘ফোরেন’ প্রীতি কে না জানে। আমাদের সংবিধান বিদেশি, আমাদের মতাদর্শ বিদেশি, আমাদের মান্য চিন্তাবিদ রাজনীতিবিদরাও বিদেশী। দেশের ঠাকুর কল্কে পায় না।

আর মাত্র কয়েকটা দিন। তলানি তেল যেটুকু পড়ে আছে শেষ হল বলে। তখন কী মজা! একটা বড় মাপের প্যারাম্বুলেটার মন্দ হবে না। ‘ম্যানেজিং ডিরেক্টার’ অফিসে যাবেন, কী কোনও আই এ এস সেক্রেটারি। অফিসের গাড়ি এসেছে, না বলে বলা হবে প্যারাম্বুলেটার এসে গেছে। কে ঠেলবে? ঠেলার লোকের অভাব হবে না। দেশে উমেদার আর চামচার অভাব নেই। লাইসেন্স আর পারমিটের লোভে অধিকর্তার প্যারাম্বুলেটার ঠেলবেন ঢনঢনিয়া, ঠনঠনিয়া, অগ্রবাল, কোই বাত নেহি। কাম কে লিয়ে। ইনকাম ট্যাক্সের বড় কর্তার প্যারাম্বুলেটার ঠেলবেন ট্যাক্সপেয়ার। সারাটা পথ একই বুলি—একটু দেখবেন স্যার, একটু দেখবেন। সেকালের পালকি বেহারারা সর্বক্ষণ মুখে শব্দ করত, হুঁ হুঁ ম না, হুঁ হুঁ ম না। সেই শব্দটাই বদলে গিয়ে হবে, একটু দেখবেন, একটু দেখবেন, স্যার! এই তো আমাদের পেট্রল। এই তো আমাদের তেল। অন্যের তেলেই তো আমাদের গাড়ি চলে। দাদাদের প্যারাম্বুলেটার ঠেলবেন চামচারা। কোই বাত নেই। আর ট্রাক-ড্রাইভারদের ঠেলবেন ট্রাফিক পুলিশ। তাঁদের জন্যেই তো সর্বাধিক ভাবনা। রোজগার একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। লরিই তো মা লক্ষ্মী। দেখতে দামড়ার মতো। চালকের ইয়া গোঁফ। মাথাটা মানুষের মতো; কিন্তু বুদ্ধিতে দানব। সবই মানছি; কিন্তু মা লক্ষ্মী। যত জ্যাম তত কামাই। লরি গেলে রইলটা কী? আর যখন আমরা বয়েল গাড়ি নিয়ে পথে নামব তখন কি আর ট্রাফিক পুলিশের প্রয়োজন হবে।

আমি সেই দিনের কথা ভাবছি—ক্যালকাটা ক্লাবে পার্টি, মিস্টার মিটার আসছেন উত্তর কলকাতা থেকে। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আসছেন গরুর গাড়িতে। তখন হয় তো মোটর-বিলাসিতার মতো গরুর গাড়ির বিলাসিতা চালু হবে। পয়সা আছে আমার গাড়িকে সেইভাবে সাজাব। বাঁশের বদলে পলিথিনের পাইপ দিয়ে তৈরি হবে চালি। ছই-বোনা হবে বহুবর্ণের ‘প্ল্যাস্টিক কেস’ দিয়ে। রাজস্থানের শিল্পী এসে নকশা তুলবে। চালির ওপর রবার ফোম; তার ওপর মখমল। সেলফ ড্রাইভিং এর মতো মিস্টার মিটার নিজেই বুলক কার্ট ড্রাইভ করবেন। পেছনে কম্পিউটার নাম্বার, 02-4691 B.C. । বি. সি. মানে বুলক কার্ট। এইচ. সি. মানে হ্যান্ডকার্ট। স্ট্যাটাস দেখাবার জন্যে বাবুরা গরুর গাড়ির চাকায় মনোনিবেশ করতে পারেন। ভালো মিস্ত্রি এনে কোনারকের চাকার মডেলে চাকা তৈরি করাতে পারেন। কারুকার্য-মণ্ডিত। টায়ারের দামও তো কম ছিল না। টায়ার আর টায়রার দাম তো প্রায় একই। এমনও হতে পারে, বড়-বড় টায়ার কোম্পানি উঠে না গিয়ে নানা ডিজাইনের গরুর গাড়ির চাকা তৈরি করবেন। তারই বিজ্ঞাপনে টিভি মাত হবে। বিদেশি টিম আসবে ফুটবল খেলতে। তারাও বুলক কার্টে চড়ে নিউ মার্কেট যাবেন শপিং করতে। তাদের কী পুলক!

দৃশ্যটা ভাবলেই পুলকিত হয়ে যাচ্ছি। তলায় একটি বাহারি লন্ঠন দুলছে। শহর কলকাতায় কোনও পথঘাট নেই। নেই কোনও স্ট্রিট, রোড, লেন। শুধু কপি-কোদলানো প্রান্তর। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ড্রাইভ করে যাচ্ছেন। নতুন মডেলের বুলক কার্ট-বি. সি. টেন। পয়সা আছে। তাই গরুকে মারার ছপটির হাতল হাতির দাঁতের তৈরি। মাঝে-মাঝে গরুর লেজ মলতে হবে। গাড়োয়ানরা যা করেন আর কি। সেই কারণেই গরুর লেজ শ্যাম্পু করা। ক্যাটল শ্যাম্পু বিশেষ এক ধরনের কন্ডিশানার দেওয়া। স্ত্রীর চুলেও শ্যাম্পু, গরুর লেজেও শ্যাম্পু। কোই বাত নেহি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *