বুদবুদ
‘আমি বিভূতি’ মাইকের ডাণ্ডাটা বাঁহাতে চেপে ধরে ডানহাত হাওয়ায় ছুঁড়ে মঞ্চে দাঁড়ানো যুবকটি একটা অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করল। গলায় একটা গাঢ় নীল রঙের রুমালের ফাঁস। এক মাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। ডান হাতে স্টিলের কব্জি-বালা। গলায় সোনালি পদক। বুক, পালোয়ানের মতো টান টান। চোখে রঙীন চশমা। ‘আপনাদের আমি কিস্যু দোবো না, কিস্যু করবও না। ভোট দিতে হয় দেবেন, না দিলে গলায় ন্যাপকিন দিয়ে আদায় করব। সে টেকনিক আমার জানা আছে।’
আমার পাশে বসেছিলেন এক ভদ্রলোক। দুধের মত সাদা চুল। টকটকে ফর্সা রং, ভাঙা গাল! চোখে নিকেল-ফ্রেমের পুরু লেন্সের চশমা। কনুইয়ের খোঁচা মেরে বললেন, ‘এই তো চাই। শাবাশ ভাই। বাপের বেটা।’ খোঁচাটায় খুব বিরক্তি বোধ করলুম। থিয়েটার কী সিনেমায় এই ধরনের সহদর্শক ভীষণ জ্বালাতনের। মেয়েছেলে হলে মধুর লাগে। বুড়োর খোঁচায় মধু নেই। মনে মনে একটা গালাগাল দিলুম—‘ঘাটের মড়া।’
মঞ্চের যুবক তখন বলেছে, ‘আমি মশাই সাতচল্লিশের প্রোডাক্ট। আমার বাবা ছিলেন জেনুইন দেশসেবক। বিপ্লব-টিপ্লব করেছিলেন। দু-চারটে পটকা-মটকা ছুঁড়েছিলেন খেঁকুরে সাহেবদের দিকে। ওঁরা বলতেন বোম। আমি জানি পটকা। বোম হল আমাদের কালের মালা। মন্ডা-মিঠাইয়ের মতো আমরা ঘরে ঘরে তৈরি করি। আর মানুষ মারার উৎসব তো লেগেই আছে। কারুর একটু বেচাল দেখলেই ডজনখানেক টপকে দি। সব সময় একটা-দুটো মাল পকেটে মজুত। আমাদের কাছে জীব-জন্তুর দাম আছে, মানুষকে আমরা পশু বলেই মনে করি না। মানুষ হল ভুসি মাল, তরফের বিচুলি গোছা গোছা আঁটি বাধা গোরুর খাদ্য।’
বৃদ্ধ ভদ্রলোক খ্যাঁচ করে একটা খোঁচা মেরে বললেন, ‘বা:, বা: ছোকরা আচ্ছা বলছে।’ একটু কাত মেরে বসলুম। বিভূতি বলেই চলেছে—‘গুরুদেব বলেছিলেন, মরতে মরতে মরণটাকে শেষ করে দে একবারে। ওই একটা লাইনই মনে আছে গুরু। ছেলেবেলায় আমার বিপ্লবী বাবা এইসব খুব বলতেন নেচে নেচে। আমার বাবাকে দেখে সার বুঝেছি মশাই, টাকাটাই সব। মানি মানি সুইটার দ্যান হনি। ভোগের জন্যে টাকা, যোগের জন্যে টাকা। টাকা থাকলে, মান, সম্মান, ইজ্জত, যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি। টাকা না থাকলে আমার বাবা। বেশ ছিলেন বাউন্ডুলে মানুষ। পার্টি ইস্তাহার আদর্শ নিয়ে বায়ুভুক, নিরালম্ব। হঠাৎ কী হল শাদি করে বসলেন কচি একটা মেয়েকে। আমার মা ছিলে পয়লা নম্বর ইডিয়েট। আদর্শবান পুরুষ দেখে স্বয়ম্বরা হয়ে গেলেন। মা ছিলেন বাইশ সালের প্রোডাক্ট। চরকায় সুতো কাটতেন। লাল পাড় খদ্দরের শাড়ি পরতেন। স্বদেশী গান গাইতেন চোখ-মুখ লাল করে। আমার সেই স্বদেশি মা এখন মিড-ওয়াইফ। মানুষের বাচ্ছা বের করেন। আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আমার টাকায় মা আমার পেচ্ছাপ করে দেন বলেছেন। হে ধাত্রী পান্না! টাকার মহিমা তুমি কী বুঝবে বল? সে বোঝে আমার বউ।’
বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন, ‘একটু অশ্লীল হয়ে যাচ্ছে।’ আমি শুনেও শুনলুম না। আমার কান বিভূতির দিকে।
‘বিয়ের ব্যাপারটা আমি আগেই সেরে নিয়েছি। আপনারা সকলেই জানেন লেট ম্যারেজ আরলি অরফ্যান, আরলি ম্যারেজ লেট অরফ্যান। তেলকলওয়ালার এক ডবকা মেয়েকে বের করে এনেছি। শ্বশুরটা খুব বাগড়া দিচ্ছিল। ছোটো মতো একটা ঝেড়ে দিলুম। কলু ব্যাটা এখন পঞ্চভূতে মিশে গেছে। বউ আর তেলকল দুটোরই আমি এখন মালিক। তাই আমার এত তেলানি। মেয়েদের কাছে বাপের চে প্রেম বড়ো। প্রেমের চে পয়সা বড়ো। স্মাগল্ড সোনা দিয়ে আমার বউকে মুড়ে দিয়েছি। বাপের শোক ভুলে গেছে। মেয়েরা মশাই মজার জিনিস। ফিনফিনে মেনিমুখো ছেলের চেয়ে মেয়েরা গুন্ডাফুন্ডাদেরই একটু বেশি পছন্দ করে। আমার অফিসিয়াল বৌ একটা। আনঅফিসিয়াল অনেক। বুঝতেই পারছেন মেয়েদের উপর এমনিই আমার হোল্ড আছে। আমিও বিপ্লবী তবে আমার ফাদারের ফ্যাশানে নয়। আমার পথ আলাদা পথ।
সবাই বলে বৃটিশের জেল বাবাকে বীর্যহীন করে দিয়েছিল। আমার জন্মটা বকলমে। কে জানে শালা কে কি বলে। জ্ঞান হয়ে তক দেখে এসেছি আমার জীবিকাহীন বিপ্লবী বাবা আর স্বদেশি মা সংসার চালাতে অষ্টপ্রহর চুলোচুলি করছেন। অন্নপূর্ণার আবদারে মহাদেবের কাছা কোঁচ খুলে যাবার যোগাড়। দেশ স্বাধীন করে বাবা আমার কখনো মুদির দোকানের কর্মচারী কখনো বিড়ি বাঁধার শ্রমিক এরই মধ্যে দিয়ে পথ করে করে আমার যৌবন। ফাদারের হেড অফিসে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। গঙ্গার ধারে গিয়ে উবু হয়ে বসলেন। সারাদিনের কাজ ঢেউ গোনা, আর বিড়বিড় করে বকা। হাতে একটা গাছের ভাঙা ডাল নিয়ে ঘুরতেন। বাবা বলে ডাকলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেন। ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে বলতেন, ‘মারবি মার মার এই নে খুলে দিচ্ছি’ বলে কাপড় খুলে দিতেন। বিশ্বাস করুন হৃদয়টা আমার পাথরের তবু সে দৃশ্য আজও আমি ভুলতে পারিনি, গঙ্গার পাতায় গাছের ডাল হাতে আমার সর্বত্যাগী, উলঙ্গ বাবা। তাই আমি আজ ভোগী। আমার বাবার ত্যাগ, আমার মার ত্যাগ, আমি এক জীবনের ভোগ দিয়ে উসুল করে নেবো। আমি হারেম বানাবো, মদের ফোয়ারা ছোটাব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার, আমার টেবিলে। কাউকে কিছু দোবো না। দাঁড়ান একটু জল খেয়েনি।’ বিভূতি এক চুমুক জল খেল।
‘বাবার জন্যে পেনসানের ব্যবস্থা করতে গেলুম। কতৃপক্ষ জানালেন তিনি যে বিপ্লবী ছিলেন সার্টিফিকেট চাই। কে সার্টিফিকেট দেবে? কোনো প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী। শুনলেন কথাটা! বিপ্লবীদেরও ক্লাস আছে। প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ হওয়া চাই, নদীর ধারের নুড়িই সিংহাসনে শালগ্রাম। শুকতলা ক্ষয়ে গেল। একজনকে ধরলুম। সে মাল বললে পাগলের আবার সার্টিফিকেট। এক কলি গানও গাইলেন সেই গাইয়ে বিপ্লবী—যার পিতা-মাতা বদ্ধ পাগল ভালো কী হয় তাদের ছেলে। অবশ্য পেনসনের আর প্রয়োজন হল না। একদিন দেখা গেল গঙ্গার একটা পরিত্যক্ত ভাঙা ঘাটে বিপ্লবী বিপিনবাবু মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন হাতে তখনো সেই গাছের ডালটা মুঠো করে ধরা, পাশে মুখ চুন করে বসে আছে তাঁর শেষ জীবনের ফ্রেন্ড একটা লেড়ি কুত্তা, যার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর দার্শনিক আলাপ চলত।’
পাশের বৃদ্ধ হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে পাশের প্যাসেজে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রথমটা বুঝতে পারিনি বৃদ্ধি কি করতে চাইছেন? মঞ্চের দিকে মুখ করে যতদূর সম্ভব চিৎকার করে বৃদ্ধ বললেন, ‘ও বাবা বিভূতি তোর বাবা এখনো মরে নি রে। এই দেখ বেঁচে আছি। এই দেখ পায়ে আমার ছেঁড়া কেডস, কড়ে আঙুলটা বেরিয়ে আছে।’ বৃদ্ধ ডান পাটা তুলে দেখাতে গিয়ে ধড়াস করে পেছন দিকে পড়ে গেলেন। দর্শকের মধ্যে থেকে কে একজন বলে উঠলেন, বুড়ো মরে রে। প্যাসেজের পাশে যাঁরা বসেছিলেন তাঁদের মধ্যে দু-চারজন দৌড়ে এলেন। বিভূতি মাইক ছেড়ে মঞ্চের সামনে এসে বললে, ‘কে আপনি?’
বৃদ্ধকে ততক্ষণে ধরাধরি করে দাঁড় করানো হয়েছে। যন্ত্রণার গলায় বললেন, ‘আমি তোর বাবারে।’ বিভূতি বললে, ‘আপনি তা হলে আমার গডফাদার। সুরাট কংগ্রেসে সুরেন বাঁড়ুজ্যের দিকে জুতো ছুঁড়েছিলেন?’
‘না বাবা আমরা ছিলুম নরমপন্থী। টোটাল ফ্রিডম চাইনি বাবা। হোমরুলেই সন্তুষ্ট ছিলাম। জেল খেটেছি অনেক বছর। ক্ষমতা দখল করতে পারিনি। নেপোয় মেরে দিয়েছে দই। এখন এই ডানপায়ে একটা ছোটো মতো একজিমা সেইটাই গত তিরিশ বছর ধরে চুলকোচ্ছি। ডাকতার দেখিয়েছি বাবা, বলছে সারালে হাঁপানি হবে। কি করি বল তো? একজিমা ভালো না হাঁপানি ভালো! তুই এতসব জানিস বিভূতি এইটা আমায় বলে দে না?’
‘ভোট দেবেন আগে বলুন তাহলে বলব।’
‘লিস্টে নাম থাকলেই নিশ্চয়ই দোবো রে তুই যে আমার ছেলে।’
‘তাহলে একজিমাটাই থাক, উইপিং না ড্রাই?’
‘ড্রাই বাবা খুব চুলকোয় খোসা ওঠে শীতে বাড়ে।’
‘যাক তবু ভালো। খুব বেশি ছাড়াবে না হাঁপানিতে বড় শ্বাস কষ্ট। মার আছে দেখেছি তো হাঁপানিতে আবার পরমায়ু বেড়ে যাবে। আর কবছরই বা চুলকোবেন। ঘণ্টা তো শুনতেই পাচ্ছেন। এবার তো যেতে হবে।’
‘তা হবে তা হবে।’ বৃদ্ধকে আবার পাশে বসিয়ে দিয়ে গেল। আমি ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আর একটু সরে বসলুম। বিপ্লবী মাথায় থাকুন। একজিমা চুলকোনো হাতে গায়ে খোঁচা মারলে স্পষ্ট প্রতিবাদ করব। ইয়ারকি নাকি? বিপ্লব এক জিনিস একজিমা আর এক জিনিস। বিপ্লব তেমন ছোঁয়াচে নয়। বিপ্লব ধরলে পার পাওয়া যায়। প্রতিবিপ্লব দিয়ে বিপ্লবকে ঠেকিয়ে রাখা যায়। মিলিটারী দিয়ে বিপ্লব চুরমার করা যায়। বিপ্লবীদের মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়া যায়। কিন্তু একজিমা একবার ধরলে রক্ষে নেই। সারাজীবন চুলকে যাও ঘেঁসোর ঘেঁসোর করে।
বিভূতি আবার মাইকের সামনে চলে এসেছে। বাঁ হাত দিয়ে মাথার ঝাঁকড়া চুল ঠিক করতে করতে আবার সে শুরু করল, ‘আমি মশাই নেতা-ফেতা নই আমি একটা চামচে।’ বৃদ্ধ আমার দিকে সরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চামচে কী বাবা?’ আমি বললুম, ‘ইমপসিবল, আপনার পাশে বসে কারুর বাবার সাধ্য নেই থিয়েটার দেখে।’
‘আমি আর বিরক্ত করব না, শুধু চামচেটা বলে দাও বাবা।’
‘চামচে হল চাটুকার ফেউ।’ বৃদ্ধ আবার ঠিক হয়ে বসলেন। ইতিমধ্যে বিভূতি অনেক কথা বলেছে শোনা হয়নি। বিভূতির দিকে যখন কান দিলুম তখন সে বলছে, ‘পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর দুটো জাত খাদ্য আর খাদক, বাঘ আর ছাগল। নীতি একটাই, কিল অর বি কিলড, মারো আর না হলে মর। আমি যাঁর চামচে, পলিটিকসের তিনি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি খুলেছেন। রাজনীতি এখন মুদির দোকানে বিকোয়, কেউ নগদে কেনে কেউ ধারে। বেশীরভাগই ধারের খদ্দের। নগদে কেনার পয়সা মধ্যবিত্তের নেই। আমরা সেই গ্র্যান্ড পলিটিক্যাল গ্রোসারস শপের সেলসম্যান। আমরা যা বিক্রি করি সবই এডালটারটেড, ভেজালে ভর্তি। চিনিতে বালি, ঘিয়ে পশুর চর্বি, একসট্রাক্ট বের করা মশলা। ভেজালটাই এ যুগের প্রকৃষ্ট খাদ্য। খাঁটি আমাদের পেটে সহ্য হবে না। আপনারা সব বিদ্যেসাগর মশাইয়ের সুবোধ বালক গোপাল, যাহা পায় তাহাই খায়, কদাচ অবাধ্য হয় না। অবাধ্য হইলেই আমাদের হাতে দাওয়াই আছে তাহারই কয়েকটি প্রয়োগ করিলেই বুড়ো গোপালের দল বাধ্য, বশীভূত। এটা কি ল্যাটিন আমেরিকা, ভিয়েতনাম না আফ্রিকা, লিবারেশন, লিবারেশন করে দেশ জুড়ে আদিখ্যেতা চালাবেন! ও সব ইয়ারকির কোনো মানে হয়? একে এই গরম, তায় লিভার, ওদিকে শালা হার্টের ছেঁদা বুঁজে আসছে, রক্ত ঘন হয়ে জমাট বেঁধে যাচ্ছে, স্নায়বিক দুর্বলতা, লো প্রেসার, দাঁড়ালেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে, নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে, পলিউশান, সাফোকেশান, ইনফ্লেশান, ডিকটেশান, এবরশান, হাইপারটেনশান, কনজেশান, লিকুইডেশান, ম্যানিপুলেশান, মেনস্টুরেশান, কমপ্লিকেসান, স্টেরিলাইজেশান, সিভিলাইজেশান, ইনফেকশান, অ্যাফেকশান, অ্যাডিশান, সাবস্ট্র্যাকশান, ডিভিশান, মালটিপ্লিকেশান, জীবনটাকে একেবারে শানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। কে চায় মশাই রুককু ঝামেলা। ওসব পলিটিকসের ঝামেলায় ভদ্দর লোকে যায়। হয় বড়োলোক না হয় লোফার, ব্যবসাদার না হয় চোর এদের হাতেই ব্যাপারটা থাক না। আপনারা হঠাৎ মাথা গরম করে এমনিই গরম মাথাকে আরো কেন গরম করবেন? যুবকদের জন্যে হিন্দি ছবি আছে, রাস্তায় পেট পিঠ বের করা-জুলিয়েটরা আছে, চাকরির ধান্দা আছে, ডিগ্রি ডিপ্লোমার কসরত আছে, ব্যস্ত থাকার মতো আরো কত কী আছে! কবিতা আছে, সাহিত্য আছে, যাত্রা আছে, সৌখীন থিয়েটার আছে, বারোয়ারি আছে, কালচারাল ফাংশান আছে, চুল আছে, দাড়ি আছে, অফসেটে ছাপা সিনেমার কাগজ আছে, প্রেম আছে, বিরহ আছে, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ আছে, ড্রাগস আছে, ধেনো আছে, পরের পয়সায় বিলাইতি আছে, মড়া পোড়ানো আছে, পরচর্চা আছে, বাঁশ আছে, আরও কত কী আছে। কত কী ভালো কাজ আছে। ধেড়েদের জন্যে চাকরি আছে, বাকরি আছে, মাগ আছে, বখে-যাওয়া ছেলে আছে, প্রেম-লোটা মেয়ে আছে, মেয়ের পেছনের ফেউ তাড়ানো আছে, জামাই ধরার পনেরো টাকা রোজগার আছে, ঘুষ আছে, অফিসে পরস্পরের পেছনে কাঠি দেওয়া আছে, জন্ম-নিয়ন্ত্রণের বটিকা আছে, বাসে-ট্রামে লেডিজ সিটের কাছে দাঁড়াবার ধান্দা আছে, দক্ষিণেশ্বর, তারকেশ্বর, বক্রেশ্বর, রামেশ্বর আছে, ধার আছে, পাওনাদার আছে, ধান্দা আছে, ডাণ্ডা আছে, মাইনে বাড়াবার ঝাণ্ডা আছে, ছেলের চাকরির জন্যে চাকরি-দাতাদের পায়ে তেল দেওয়া আছে, গিন্নিকে পেটানো আছে, পাশের ফ্ল্যাটের কাপতেনের সঙ্গে সাপ্তাহিক ঝগড়া আছে, তাস আছে, জুয়া আছে, শালা আছে, শালী আছে। এতসব থাকতে আপনারা মাইরি খামোখা কেন জেনুইন পলিটিকস করবেন। রাজনীতি হল ত্যাগীদের জিনিস। আপনাদের কী ত্যাগের বয়েস হয়েছে গুরু। আমাদের ধাতে কি ত্যাগ সইবে মাইরি। আপনারা হলেন বরেণ্য ভোটার, আপনারা হলেন ডোনার, পোচার, সাফারার, চামার, ধামার, ব্লাফার। আপনারা শুধু ভোটটি বাক্সে ফেলে দেবেন। আপনারা সব কাস্টার। বছরে বছরে একটি করে সন্তান বৌয়ের পেটে কাস্ট করবেন। একটি করে ভোটার দেশকে উপহার দেবেন। ভোট হল আপনাদের মেয়ে। পাত্রস্থ করে দিন তারপর বরাতে যা থাক হবে। আর বরাত হল রেসের ঘোড়া। আমিরও করতে পারে ফকিরও করতে পারে। তবে জেনে রাখুন, ভোট দিয়ে কোনো শালা কোনো কালে বড়োলোক হতে পারেনি। চুরি ছাড়া বড়োলোক হবার জন্য কোনো রাস্তা নেই। আমি চ্যালেঞ্জ করতে বলছি। ভাগ্য ফেরাতে হলে লাইন দিতে হবে। তদবির লাগাতে হবে। ভেবে দেখুন ষাট কোটি মানুষ যদি পেছনে পেছনে লাইন দেয় কী অবস্থা হবে! আদ্দেক শালা ভারতমহাসাগরের জলে গিয়ে পড়বে। অতএব একজন দু-জন ভাগ্য ফেরাবে অন্যে তাকে ঈর্ষা করবে। ঈর্ষা করর মতো লোকও তো চাই। তা না হলে ঈশ্বরের দেওয়া ঈর্ষা বস্তুটা যায় কোথায়? ঈর্ষায় যদি জ্বলে পুড়ে শুদ্ধ না হলে তাহলে মরণকালে যে নরকবাস হবে মশাই।’
বৃদ্ধ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘আমি পেচ্ছাপ করব বিভূতি।’
‘কি করবেন?’
‘পেচ্ছাপ বাবা।’
‘কোথায়? আমার মুখে?’
‘ছি ছি বাবা! তোমার মুখে কেন, পেচ্ছাপখানায়।’
‘করে আসুন। কে আটকে রেখেছে আপনাকে?’
‘তুমি রেখেছো মানিক আমার। তুমি একটু থামো। ফিরে এলে শুরু কোরো।’
‘ঠিক আছে, ততক্ষণ দেশাত্মবোধক গান হোক।’
‘আমি যে দেশাত্মবোধক গান ভালোবাসি, নিজে যে একসময় এমনি করে হাত মুঠো করে গাইতুম, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়, কোন শূকরের বাচ্ছা পরাধীনতা চায়রে চায়?’ বৃদ্ধ সুর করে গেয়ে উঠলেন। বিভূতি মঞ্চের সামনের দিকে সরে এসে বললে,
‘ধুৎ মাইরি ওটা গান নয় কবিতা। সব গুলিয়ে ফেলেছেন দাদু। দেশাত্মবোধক গান হল এইটা,
বিভূতি পাছা দুলিয়ে দুলিয়ে টুসকি দিতে দিতে গেয়ে উঠল,
হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হ্যায়
আর চাবি খো যায়, হাম তুম
কোথা থেকে ম্যারাকাস বেজে উঠল, ঝ্যাঁক ঝ্যাঁক ঝ্যাঁক। বঙ্গতে বোল ফুটলো টাকা টাকা টাকাডুম, টাকা টাকা ট্রাকা ট্রাকা ডুমট্রাকা, টাকা ডুম। বিভূতি ঘুরে ঘুরে নাচছে
হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হ্যায়
বৃদ্ধ বললেন, ‘পাগল ছেলে, উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে, কি একটা গানকে স্বদেশী গান বলে চালিয়ে দিলে। জ্ঞানগম্মির মাথা খেয়ে বসে আছে। তুমি আমাকে একটু পেচ্ছাপখানায় নিয়ে যাবে?’
‘সে কি রে বাবা, এ তো আচ্ছা জ্বালা হল। না মশাই পারব না, আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।’
বৃদ্ধ গলা ছেড়ে চিৎকার করলেন, ‘বিভূতি বিভূতি।’ বিভূতি যেন আমাদের গার্জেন। বিভূতির গান থেমে গেল। চিৎকার করে বলল, ‘কি হল আবার!’
‘এই ইয়ংম্যানটি আমাকে পেচ্ছাপ করাতে নিয়ে যাচ্ছে না!’
‘সে কি? যুবকদের কাজই হল বুড়োদের পেচ্ছাপ করানো। যাও খোকা, ভ্রষ্টাচারের দায়ে পোড়ো না।’
বৃদ্ধ আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘শুনেছো বিভূতির আদেশ।’
‘আপনি আমার মুখের কাছে মুখ এনে কথা বলবেন না প্লিজ। আপনার মুখে দুর্গন্ধ।’
বৃদ্ধ আবার বিভূতিকে কমপ্লেন করলেন, ‘ও বিভূতি, এ বলে আমার মুখে দুর্গন্ধ।’
‘দুর্গন্ধ? আমাদের সকলের মুখেই দুর্গন্ধ। সব শালারই লিভার পচে মুখ গহ্বরে টাট্টিখানা বানিয়েছে। ও শালারও আছে। আমারও আছে। একে বলে হেলিওটোসিস। দ্যাটস আ ন্যাশনাল ডিজিজ। আমি তো ওই জন্যে সবসময় মুখে মাল ঢেলে বসে থাকি। মদের গন্ধে অ্যারিসট্রোক্র্যাসি, মুখের গন্ধে দূরে থাকি। দাদু আপনিও একটু মালটাল চালান, নইলে প্রেম হবে না। নাতনিরা বলবে তফাত যাও।’
‘তাহলে আমি চেপে রাখি!’
‘তাই রাখুন, কিংবা ওখানেই করুন না, ক ফোঁটাই বা হবে, আপনি তো চিনিগ্রস্ত, সুগার আছে না? থাকতেই হবে। সব ভেতো বাঙালিরই চল্লিশের পর চিনি হয়।’
‘এখানেই করব বাবা?’
‘কেন করবেন না? আমাদের ন্যাশনাল হ্যাবিটই তো, খাই যেখানে হাগি সেখানে। লাগিয়ে দিন। প্রকৃতির আহ্বান উপেক্ষা করবেন না। ভয় নেই পাঁচ আইন কাগজে আছে, ভিতরেও নেই বাইরেও নেই।’
বৃদ্ধ আসনে বসে পড়লেন। বসে পড়ে আপন মনে একটু হাসলেন। স্বগতোক্তি কানে এল, ‘সহযোগিতা! পাশাপাশি বসে সহযোগিতা হচ্ছে না, সহযোগিতা হবে সারা দেশ জুড়ে। পাশাপাশি বসে ঘেন্নায় মরে যাচ্ছে মুখে বলছে, সবার ওপরে মানুষ সত্য, সমালোচনা করছে সাদা চামড়ার দল কালোদের কেন ঘেন্না করে। অ্যাপারথিডের বিরুদ্ধে লম্ফঝম্ফ!’
বৃদ্ধকে এক ধমক লাগালুম, ‘চুপ করা সম্ভব না হলে বেরিয়ে যান দয়া করে।’
ধমক খেয়ে বৃদ্ধ সংযত হয়ে বসলেন। যেন কত শান্তশিষ্ট মানুষ।
বিভূতি আবার মাইকের সামনে ফিরে গেছে। ‘সমস্ত মানুষই অবস্থার দাস। দাসত্ব করার জন্যেই মনুষ্যত্ব। দাস কখনও প্রভু হতে পারে না। আপনারা মুক্তির স্বপ্ন দেখবেন কিন্তু মুক্ত করে দিলেই হাহাকার করে উঠবেন। ছোটো থেকে আরও ছোটো হওয়াতেই মানুষের আনন্দ। সবচেয়ে সুখী মানুষ সবচেয়ে বিড়ম্বিত মানুষ। জীবন একটা চটচটে আঠা, সেই আঠার সঙ্গে জুড়ে আছে হাজার সমস্যার পাতা। ছাড়াবার জন্যে যতই গড়াগড়ি দেবেন ততই আরো পাতা জড়িয়ে গিয়ে সেই বাঘের মত অবস্থা হবে। বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড়ো কৌশল হল ভুলে থাকা, জীবনের ভারে নুয়ে পড়ে ক্রীতদাসের মতো মৃত্যুর দরজার দিকে হেঁটে যাওয়া। অথচ মৃত্যুকেই মানুষের সবচেয়ে বড়ো ভয়। সেই মৃত্যুর ভয়ে আপনারা মৃত্যুকেই ভোট দেবেন। দিলেও মৃত্যু না দিলেও মৃত্যু। হাহা পরিস্থিতি এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। আমরা যেমন প্রগতি তেমনি অধোগতি, আমরা প্রাচুর্য, আমরা দুর্ভিক্ষ, আমরা ঝরা, আমরা ক্ষরা, আমরা উৎপাদন, অনুৎপাদন, আমরা মুক্তি, আমরা শৃঙ্খল।
‘তুমি একটি গাড়োল,’ উইংসের পাশ থেকে আর একটি লম্বা-চওড়া ছেলে বেরিয়ে এল, ‘এইভাবে মুর্খের মতো কথা বললে কেউ তোকে ভোট দেবে শালা। ভোট হল ভদ্দরলোকের জিনিস। তোর ওই পেটোপটকার চেয়ে অনেক শক্তিশালী। গায়ের জোরে ভোট হয় না গুরু, প্রেম হয় না গুরু। ওসব স্নেহ দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আদায় করতে হয়। আশার ছলনা দিয়ে পরে নিরাশ করতে হয়। বাস করবে ডেমোক্রেসিতে কথা বলবে ডিক্টেটারের ভঙ্গিতে, এটা কী তোমার মামার বাড়ি রাসকেল? ভোটের বক্তৃতা হবে এইরকম।’ দ্বিতীয় ছেলেটি বিভূতিকে সরিয়ে দিয়ে মাইক নিল।
‘বরেণ্য ভোটদাতারা, আপনারা দাতা আমরা গ্রহীতা। গ্রহীতার কিছু বিনয় থাকা প্রয়োজন। বিভূতির হঠাৎ কী হয়েছে জানি না। সে যা বলতে চেয়েছিল, বলতে পারেনি। মানুষ সাধারণত পড়ানো পাখি। ব্যবহারিক জীবনে যেকোনো কাজ আদায়ের জন্যে মন কথা বলে না কথা বলে তার উদ্দেশ্য। বিভূতির মন হঠাৎ ফসকে বেরিয়ে এসেছে। সে বলতে এসেছিল অন্য কথা! বিভূতি আপনাদের ছোটো করেছে, আপনাদের ভূমিকাকে খাটো করেছে। মানুষ যে অমৃতের সন্তান তা ভুলে গেছে। আত্মার শক্তিতে মানুষ যে তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে সেকথা স্বীকার করেনি। ভারতের অধ্যাত্মবাদ, পশ্চিমের রাজনৈতিক বিশ্বাস, জীবন স্বাধীনতা কোনোটাই সে মানতে চায়নি। অনেকটা জারের মতো কিংবা কাইজারের মতো কিংবা কসাইয়ের মতো কথা বলেছে। ব্যাটা বাঙাল। বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। উদো বঙ্কা। বিভূতিকে ভোট দেওয়া মানে, বিভূতির পাটিকে ভোট দেওয়া মানে একটা দলের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা। যে দলে অনেক মাথাওলা উদার লোক আছে যাদের নীতিও উদার সব দলেই তাই থাকে। বিভূতি হল দলের হাত, মাথা হলুম আমরা। আমরা যা বলব বিভূতি তাই করতে বাধ্য। বিভূতির নিজের কোনো স্বাধীনতা নেই। স্বাধীন হলেই বিভূতির মৃত্যু হবে। বিভূতিকে আমরাই ক্রিয়েট করেছি। সে একটি বুদবুদ। বেচাল দেখলেই একটি আলপিনের খোঁচা, ব্যাস, বিভূতিবাবু ফুট। আপনাদের চোখের সামনেই বিভূতির মতো কত মাল এল কত মাল গেল। আপনারা বেশ ভালোই জানেন, নেতা মে কাম নেতা মে গো লাইফ উইল কনটিনিউ ফর এভার। অ্যাণ্ড হোয়াট ইজ লাইফ। জীবন কী? ও শালা বলেনি। বলার মুরোদ নেই তাই বলেনি। শেক্সপিয়ার বলেছেন, লাইফ ইজ এ ওয়েকিং ড্রিম। গীতা বলেছেন, নটনং ছিন্দতি শস্ত্রানি, নৈনং দহতি পাবক। তার মানে কোনো শালা কোনো শালার কিছু করতে পারবে না। শালায় শালায় শালাশালী হলেও সব শালা অমর। বিভূতির পেটো, বিভূতির ছুরি-ছোরা আপনাদের কী করতে পারে, নাথিং, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। আপনাদের কত বড় গর্ব, মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি। তবে আপনারা ভিখিরি হতে যাবেন কেন? রাজার মতো ভোট দেবেন, রাজার মতো সংসার করবেন। তার বদলে হ্যাংলার মতো চাইবেন কেন। কবি কী বলেছেন, যা চাবি তা বসে পাবি খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে। চাইবেন নিজের কাছে, ধন দাও, মান দাও, চাকরি দাও, বাকরি দাও, জমি দাও, জমা দাও, জিনিসের দাম কমিয়ে দাও। নিজেকে জাগিয়ে তুলুম, বলুন জাগো বাঙালি। সেই ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছেন—সেলফ হেলপ ইজ দি বেস্ট হেলপ। তবু প্রথামত দেশের জন্যে দশের জন্যে আমাদের একাট কর্মসূচি আছে যেমন, সব ছেলে-মেয়েকে আমরা ভাল ভাল চাকরি দেবো, না থাকলেও দেবো, সব গরীবকে বড়লোক করে দেবো, জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেবো, আইবুড়ো মেয়েদের ব্যাংক তৈরি করে ভালো ভালো পাত্রের সঙ্গে বিনাপণে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবো, জন্মবর্ধন কর্মসূচি চালু করব, রাশি রাশি শিশুকে পোলট্রির কায়দায় মানুষ করে খেতে কিংবা নদী বুজিয়ে নতুন চাষের জমি বের করে খামারে ছেড়ে দেবো, জমি না থাকলে সাগর বোজাব। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ না করলে প্রকৃতি নিজেই মহামারী দিয়ে, দুর্ভিক্ষ দিয়ে জনসংখ্যায় সাম্য এনে দেবে। প্রকৃতিই যা পারে আমরা শুধু শুধু তা করে অপ্রিয় হতে যাই কেন। আমরা চোরকে চুরি করতে দেবো, গৃহস্থকে সজাগ হতে দেবো, দুর্নীতি রোধের জন্যে কমিটি করে দেব, সাধুকে সৎ হতে দেব, অসতীকে সতীসাধ্বী করার চেষ্টা করব না, ভেজাল জিনিসের দোকান, আসল জিনিসের দোকান দুটোই খোলা রাখব, গুন্ডা দমন করব না, সাধারণ মানুষকে পাহারা দেব, কারুর জীবিকা কেড়ে নেব না। আমাদের সব নীতিই পজেটিভ, ইতিবাচক। সাদা বাজার, কালো বাজার, স্বর্গ নরক পাশাপাশি থাকবে। বস্তি থাকবে প্রাসাদ থাকবে। গরিব থাকবে বড়লোকও থাকবে। সোস্যালিজম, ক্যাপিটালিজম, মার্কসিজম সমস্ত ইজম পুরোদমে চলবে। আমরা হব ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু। জীবন যেরকম আমরাও সেইরকম হব। তত্ত্বদর্শীরা বলেছেন, স্বর্গও এখানে, নরকও এখানে। অতএব আমাদের কর্মসূচিতে স্বর্গ আর নরক দুটোই গুলজার হবে। আমরা দেবদূত আবার যমদূত।’
বৃদ্ধ আবার উঠে দাঁড়ালেন, ‘হ্যাঁ বাবা, তোমার নামটা জানালে না, তোমাকে বিভূতির মাথা বলেই ডাকি, বুড়োদের জন্যে তোমাদের কোনো কর্মসূচি আছে?’
‘আছে বৈকি দাদু। যৌবনের একসটেনসানই হল বার্ধক্য। আপনাদের কি ফেলা যায়? আপনারা হলেন সমাজের ফরওয়ার্ড-ব্যাকওয়ার্ড ফোর্স। আপনারা যুবশক্তির লাগাম। আপনারা ক্রীতদাসের জন্ম দিয়েছিলেন বলেই প্রভুত্ব আছে, চাষি আছে, শ্রমিক আছে, সেরেস্তার মাসমাইনের কর্মচারী আছে, বয় আছে, বেয়ারা আছে, বেশ্যা আছে, বধূ আছে, আমাদের দলের হাত আছে, পা আছে, দালাল আছে, ফোড়ে আছে, হাফ গেরস্ত আছে, ফুটপাথের মানুষ আছে, পন্ডিত আছে, মূর্খ আছে, আমরা আছি, তাহারা আছে, বিশেষ্য আছে, সর্বনাম আছে, কর্তা আছে, করণ আছে। আপনাদের জন্যে পার্কে পার্কে আরও বেঞ্চি বাড়াব, তাসের দাম আরও সস্তা করে দেব, মেয়েদের ব্লাউজের মাপ আরও খাটো করে দেব, বিনা পয়সায় পর্ণগ্রাফি বিতরণ করব।’
‘বা: বাবা বা:, বেঁচে থাকো মানিক’ বৃদ্ধ ধপাস করে বসে পড়লেন।
বিভূতির মাথা আবার শুরু করলেন, আমরা সব ব্যাপারেই নিষ্ক্রিয় থাকব, তালে তাল দিয়ে যাব। আমরা জানি আমাদের ভোটদাতারা চেয়ে না পেলে মানিয়ে নিতে জানেন। কেউ এক-শো টাকায় সংসার চালায়, কেউ হাজার টাকায়। চলছে সকলেরই, সকলেরই অভাব। আপনাদের যা কিছু ক্ষোভ সব শোবার ঘরে বউয়ের ওপর। বেশি ক্ষুব্ধ হলে, রাস্তার মিছিলে চিৎকার, চলবে না, চলবে না। আপনাদের চাল-চলন আমাদের স্টাডি করা আছে। আপনাদের মত মানুষ সত্যি হয় না। আপনাদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো সোজা কাজ কিছুই নেই। চিড়িয়াখানার ম্যানেজারকেও এর চেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়। আমাদের সংঘর্ষ তো আপনাদের সঙ্গে নয়। আপনারা সব রবারের মানুষ, চাপলেই ছোটো হয়ে যান। যেদিকে খুশি দোমড়ানো যায়। আমাদের যত ক্ল্যাশ নিজেদের মধ্যে। ল্যাং মারামারি, কামড়া-কামড়ি। সেই জন্যে আমরা বিশেষ ইনসিয়োওরেন্স প্রথা চালু করব। আমাদের স্বার্থ দেখার জন্যে বোর্ড অফ ট্রাস্টি থাকবে! আমরা এবার থেকে আটঘাট বেঁধে নামব।’
বেশ কিছুক্ষণ আমার একঘেয় লাগছিল। নাট্যকার কী যে বলতে চাইছেন, কী যে করতে চাইছেন, এর পর কী করবেন, আমার মাথায় আসছে না। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলুম ভাল একটা নাটক দেখতে, তা আর হল না। আশা সব সময় পূর্ণ হয় না। নির্বাচন সব সময় মনের মতো হয় না, কী প্রতিনিধি নির্বাচন, কী নাটক নির্বাচন, এই সত্যটুকুই বোধ হয় আজকের নিট লাভ। পাঁচ টাকার জ্ঞান পকেটে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এই একই জ্ঞান অনেকে হয়তো দশ টাকা কিংবা দু-টাকায় সংগ্রহ করলেন। একই জ্ঞান বিভিন্ন মূল্যে সংগ্রহ করা যায়। জীবনের এইটাই বোধহয় পরম সত্য। মঞ্চে তখন দুই চরিত্রে কথা কাটাকাটি চলছে, বিভূতি বলছে, কোদালকে কোদাল বলাই ভালো, ভাঁওতা দিয়ে ক্ষমতা দখলের অর্থ বঞ্চিত মানুষকে বঞ্চনা করা। দ্বিতীয় চরিত্র বলছে মানুষ জেনে শুনেই বঞ্চিত হতে চায়। জীবনের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অসীম অথচ পাবার জন্যে যে মূল্য দেওয়া উচিত মানুষ কোনো কালেই তা দিতে প্রস্তুত নয়, ফাঁকতালেই মানুষ সব কিছু পেতে চায়। মানুষের স্বভাবেই রয়েছে ফাটকাবাজী, ধাপ্পাবাজী, শঠতা, প্রবঞ্চনা, ছলনা অতএব সেই চেনা রাস্তাতেই মানুষ ভাঙিয়ে মানুষকে কাজ আদায় করতে হবে। একসার মানুষ ঠেলে অন্ধকার প্যাসেজ বেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। মুক্ত আকাশ মাথার ওপর, শীতল বাতাস। মানুষ কত অল্পে খুশি! একটা পরিবেশ থেকে আর একটা পরিবেশে এলেই মন অন্যরকম হয়ে যায়! ভাবছি এবার কোন দিকে যাব। পেছন থেকে কাঁধের ওপর মৃদু হাতের স্পর্শ। চমকে উঠেছিলাম। তাকিয়ে দেখলুম সেই বৃদ্ধ। মুখে মৃদু হাসি। একটু আগের দেখা সেই অসহায় ভাব, সেই বোকা বোকা নেকামি নেই। সম্পূর্ণ অন্য ব্যক্তিত্ব। ঋজু, সরল, উজ্জ্বল এক মানুষ। প্রশ্ন করলেন, ‘উঠে এলে কেন? একজিমার ভয়ে? মুখের গন্ধের ভয়ে? সত্যি কিন্তু আমার একজিমা নেই, মুখে হয়তো গন্ধ থাকতে পারে, আগে কেউ বলে নি, তুমি আজ ধরিয়ে দিলে, সেলফ কন্সাস করিয়ে দিলে, এবার থেকে পকেটে বড়ো এলাচ রাখব।’ আমি হেসে ফেললুম। হলের বাইরে বৃদ্ধকে বেশ ভালোই লাগছিল। বললুম,
‘ভালো লাগছিল না বলে উঠে এলুম, আপনার জন্যে উঠে আসি নি।’
‘একটু সময় হবে, তোমার কিছু সময় আমাকে দেবে?’
‘একটু বিব্রতই হলুম। তবু বললুম, ‘কেন দেবো না?’
‘তা হলে আমার সঙ্গে একটু এসো।’
বৃদ্ধকে অনুসরণ করে সোজা চলে এলুম গ্রিন রুমে। বড়ো বড়ো আয়নার মাথায় চড়া পাওয়ারের আলো ঠিকরোচ্ছে। ঘর ভর্তি নারী আর পুরুষ চরিত্র। বিভিন্ন মেক আপে সেজে বসে আছেন। এক সুন্দরী মহিলা, তখনো নিজে হাতে মেক আপ নিয়ে চলেছেন। টানা টানা ভুরু আরও টানা টানা করছেন। কাগজের রেখায় চোখের প্রেম আরো চটুল। সারা ঘরে যেন আর এক জগৎ। দেহের গন্ধ, প্রসাধনের গন্ধ, পুরুষালি গন্ধ, মেয়েলি গন্ধ। বৃদ্ধকে দেখে সকলেই সম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালেন, ‘চলে এলেন আপনি? আপনার আর নেই’। বৃদ্ধকে বসার আসন ছেড়ে দিলেন। বসতে বসতে বললেন, ‘পলাতককে ধরে এনেছি। আমার নাটকের শেষ না দেখে চলে যাচ্ছে। জানতে চাই কেন? আমি তো অডিটোরিয়ামে বসে মাঝে মাঝে একটু ভাঁড়ামি করি, না করলেও নাটক আটকাবে না। বোসো, তুমি বোসো।’ মেক আপ নিচ্ছিলেন যে মহিলা তাঁর পাশের খালি চেযারে পেছন ফিরে বসলুম। টাটকা যৌবনের ঝাঁজ ও গন্ধ দুটোই পেলুম। বৃদ্ধ বললেন, ‘চা দাও।’
‘তুমি কি জীবনবিমুখ দর্শক? তুমি কী শুধুই প্রেম, মৃত্যু, বিবাহ, বিচ্ছেদ, সংঘাত, পরিণতি চাও? তুমি কী চাও সত্যম, শিবম, সুন্দরম?’
কি চাই তা তো জানি না। নাটক দেখি কিন্তু নাট্যকারের প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাই না। জীবন দেখি, জীবনদেবতার সন্ধান পাই না! কি চাই! আমি কি চাই! ‘বোধহয় ভালো লাগাটাই চাই।’
‘গুড, ভেরি গুড! কিন্তু জীবনের সব কিছুই কি তোমার ভালো লাগে?’
‘না।’
‘তবে জীবন থেকে সরে যাও না কেন?’
‘জীবন সরিয়ে দেয় না বলেই, ভালো হোক খারাপ হোক জীবনকেই আঁকড়ে থাকি।’
‘ভুল, ভুল। আমরা ভালো লাগার মুহূর্তটুকুতেই বেঁচে থাকি, খারাপ লাগার মুহূর্তে জীবনের হাল ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়াই, উদাসীন হয়ে যাই। পালিয়ে যাই। একেই বলে এলিয়েনেশান। আজকের জীবনের যা কিছু আয়োজন তাতে হৃদয় নেই, মন নেই, ভালোবাসা নেই, ভালোলাগা নেই, আমাদের শূন্যতা ভরে উঠছে না কার্যে ‘না-কারণে’। আমার এই নাটক হল সেই ‘না-জীবনের’ ‘না-নাটক’। এ জীবনে নেশা আছে পেশা আছে, জন্ম আছে মৃত্যু আছে আড়ম্বর আছে আয়োজন আছে, নেই কেবল দিশা। এ শূন্যতা সাধকের সাধনালব্ধ নয়, এ শূন্যতা মহাশূন্যের সৃষ্টির আয়োজন নয় এ শূন্যতা হল জীবনহীন ভ্যাকুয়াম। নাটকের বাইরে সবচেয়ে বড়ো অভিনয়। আমাদের অন্তর থেকে অন্তরটা উড়ে গেছে, আমাদের বোধ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, আমাদের আমিটা বাইরে প্রক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, অপরিচিতের মতো শূন্য প্রান্তরে গাছের তলায় সে দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে দেখি চিনতে পারি না। নির্জনতায় যখন সে তুমি তুমি করে ফিরে আসতে চায়, আমরা বলি পরে পরে, এখনও বড়ো ক্লান্ত, একটু ঘুমোই। ‘আমি শূন্য’ জীবনে ক্লান্তির প্রভুত্ব। এখন নাটকটাই জীবন, জীবনটাই নাটক। জীবন খারাপ লাগে বলেই তুমি পালাচ্ছিলে। তোমাকে কনসাস করতে চেয়েছি বলেই তোমার খারাপ লেগেছে।’ ভাঁড়ের চা হাতে এল। নাট্যকার বললেন, ‘খাও।’ এক চুমুক খেয়ে বললেন, ‘তুমি তো কিছু বলছ না?’
‘আমার কোনো প্রস্তুতি নেই। হয়তো আপনি ঠিকই বলেছেন আমার কনসাসনেসের মৃত্যু হয়েছে। বেঁচে আছে কিছু অভ্যাস। আর অভ্যাসকেই জীবন বলে ভুল করছি।’
‘তুমি ব্রেন ইনজিয়োওরড পেশেন্ট দেখেছো?’
‘না।’
আমি দেখেছি। হসপিটালের বেডে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মাসের পর মাস। শ্বাসপ্রশ্বাস আছে, জীবন আছে, জৈব প্রয়োজন আছে, খাদ্য চাইছে, জল চাইছে, সময় হলেই মলমূত্র ত্যাগ করছে, গরমে ঘামছে, শীতে গাঁয়ে কাঁটা দিচ্ছে কিন্তু সূক্ষ্মবোধের উৎসটা গুঁড়িয়ে গেছে। যুবতী রমণীর লাল ঠোঁটের চুমু তার কাছে অর্থহীন আলপিনের খোঁচা ব্যথাহীন আমি কি বলতে চাইছি বুঝেছো? চাওয়ার দুটো ধরন আছে, সচেতন চাওয়া অচেতন চাওয়া। তোমার মাথায় ডাণ্ডা মেরে তোমার সচেতন চাওয়াকে শেষ করে দিতে পারি, আর কীভাবে পারি, তোমাকে প্রতিমুহূর্তে বঞ্চনা করে, সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে ফেলে সমাধান থেকে দিনের পর দিন দূরে রেখে তোমাকে গুলিয়ে দিয়ে তোমার কনসাসনেসকে হত্যা করতে পারি। তুমি কেন চাও, কি চাও, শিব চাও কি বাঁদর চাও তুমি নিজেই জান না। অন্ধকার ঘরে দীর্ঘদিন তোমাকে বন্দী করে রাখলে তোমার চোখে আলো আর সহ্য হবে না। অন্ধকারটাকেই তখন তুমি ভালো বলবে। তুমি তোমার ভালোলাগাটাই সকলের ভালোলাগা বলে ভুল করবে। একেই বলে আইসোলেসন।
‘আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে।’
গুলিয়ে যাচ্ছে না তুমি নিজেই গুলিয়ে আছো। ওই দেখো আমাদের ব্যাষ্টি জীবনের চাহিদারা এক একটি চরিত্র হয়ে বসে আছে। ওই দেখো, বারবনিতা রাতের মন ভোলানো সাজে সাজছে। জিজ্ঞেস করো সে কী চায়? বলবে বেশ্যাবৃত্তি চলুক অপ্রতিহত কারণ এইটাই আমার বৃত্তি। ওই দেখো গৃহবধূ। সে কী চায়? বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করো কারণ ওই তার স্বামী, সব উপার্জন বেশ্যার সেবায় ফেলে দিয়ে ফতুর। স্ত্রী চায় স্বামীর নিরাপত্তা, অটুট সংসারের আশ্রয়। ওই দেখো কৃষক, সে চায় বর্ষার জল, ভরা ফসল। ওই দেখো মজুতদার কালোবাজারি, সে চায় দুর্ভিক্ষ, অনাহার, মূল্য বৃদ্ধি, ফাটকাবাজি। ওই দেখো শিল্পপতি, সে চায় একচেটে পুঁজি। ওই দেখো শ্রমিক, সে চায় তার শ্রমের ন্যায্য মজুরি। ওই দেখো মালিক, সে চায় আরও মুনাফা, চায় অটোমেশন, ছাঁটাই। ওই দেখো ছাত্র, সে চায় শিক্ষায় নৈরাজ্য। ওই দেখো শিক্ষক, সে চায় মানুষ গড়ার মতো শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা রাজনৈতিক ডামাডোল। ওই দেখো ফুটপাথের মানুষ, সে চায় পরিষ্কার দিন, হাওয়ার রাত, ধনীর কৃপা। ওই দেখো ধনী, সে চায় কম ট্যাক্স, ব্যাংকে লকার, আন ডিক্লেয়ারড ইনকাম। ওই দেখ অ্যাডমিনিস্ট্রেশান, সে চায় আরও ট্যাক্স, আরও বেহিসেবি খরচ। ওই দেখো মধ্যবিত্ত, সে চায় আরও সুযোগ, শ্রমহীন আরো উপার্জন। ওই দেখো বিদেশী মতবাদ, তারা চায় নাক গলাবার জায়গা। ওই দেখ পরচুল পরা পলিটব্যুরো, এক একজনের হাতে এক এক ফর্দ, সোসালিজম, ক্যাপিট্যালিজম, মার্কসিজম। আর তোমার মাথার ওপর ছড়ানো শূন্যতা, তোমার আমিটা দিশাহারা, ডানা ভাঙা পাখির মতো পাকসাট খাচ্ছে। ওই দেখো উজ্জ্বল আয়না, তোমার চেতনার দর্পণ, তোমার আমি তোমার দিকে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে আছে। তোমার সারামুখে তোমারই জীবনের মেকআপ। একদিকে সমষ্টির চাহিদা আর একদিকে ব্যষ্টির চাহিদা মাঝখানে ক্ষমতার মঞ্চ সামনে বিভ্রান্ত দর্শক। এই তো আমার নাটক। তুমি বলেছিলে না, আমার মুখে গন্ধ, তুমি সঙ্গেসঙ্গে আমাকে সেলফ কনসাস করেছো। আমি এখন থেকে কথা বলার সময়, হয় মুখে হাত চাপা দিয়ে কথা বলব, না হয় বড়ো এলাচ খাব। এই নাটকটা হল আমাদের সকলের মুখের দুর্গন্ধ। আত্মচেতনায় একটু আঘাত। অভিনয়ের অভিনয়, ড্রামার ড্রামা। বাকিটা দেখবে নাকি। মজা আছে।
বাকিটা আর দেখা হল না। সাজঘর থেকে সোজা রাস্তায়। রাতের কলকাতা রাস্তায় জ্বলছে, জানলার পর্দায় জমছে, বাতাসে উড়ছে, পথে পিষ্ট হচ্ছে। সারাদিনের উত্তাপ ঘোর হয়ে আছে পথের বাতির চোখে। দু-খন্ড মানুষ হয়ে পথ চলছি। বাসের স্টিয়ারিং হুইলে মাথা নীচু করে বসে আছে চালক। মানুষ ছুটছে ঘরমুখো। ফুটপাথে পাশ ফিরে শুচ্ছে ক্লান্ত মানুষ। দোকানের দরজা বন্ধ হচ্ছে, আলো নিভে আসছে একে একে। এদের মধ্যে কে জনতার প্রতিনিধি? আর একটু পরেই মানুষ যখন নিজস্ব হবে, তখন মধ্যযুগের কোনো খলিফা কি ছদ্মবেশে নগর ভ্রমণে বেরোবেন। জনপদের জানলায় উদগ্রীব দয়ালু মুখ উঁকি দিয়ে দেখে দেখে যাবে প্রতিটি মানুষের দুঃখ সুখের পরিধি! কে হবে কে হবে জনপ্রতিনিধি, কি হবে শাসনব্যবস্থা! একই সঙ্গে, কে হবে বারবনিতার বাবু, বনিতার কর্তব্যপরায়ণ স্বামী, কৃষকের কৃষি, শিল্পের শিল্পী, মালিকের বন্ধু, শ্রমিকের দাবি, দাসের দাস, ধনীর মূলধন। কে হবে ছাত্রের শিক্ষা, শিক্ষকের ফাঁকি, শাসনের জুলুম, অপব্যয়ীর অপব্যয়, মিতব্যয়ীর মিতব্যয়! কে হবে বিদেশের স্বার্থ, স্বদেশের স্বদেশ চেতনা।
কে যেন কাঁধে হাত রাখল! নাট্যকার নাকি! না আমি, তোমারই আমি। এতক্ষণ পাশাপাশি চলেছি। যতক্ষণ পাশে থাকব ততক্ষণ কষ্ট পাবে। আমি যাই। ‘আমি’ যেখানে ‘এক আমি’ সেখানে আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি। যেখানে প্রশ্নও নেই, সমাধানও নেই। তুমি বরং এক ঘুমে রাতটা পার করে দাও।