বুডঢার তরবারি – শুভংকর চক্রবর্তী

বুডঢার তরবারি – শুভংকর চক্রবর্তী

৫টি শিশু

বুডঢা

প্রথম দৃশ্য

[মঞ্চে পরপর সিঁড়ি উঠে গেছে। বুডঢা শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তরবারি টাঙাচ্ছে। বিরাট লম্বা তরবারি। ডগাটা ভাঙা। দর্শকদের দিকে পেছন করে বুডঢা কাজ করছে। চারটি শিশুর প্রবেশ]

শিশুরা। (কণ্ঠে বিস্ময়) কে তুমি? কে গো?

প্রথম শিশু। কথা বলছ না কেন?

দ্বিতীয় শিশু। শুনতে পাচ্ছ? তুমি কে?

তৃতীয় শিশু। তুমি কি কালা? ডাকছি যে?

চতুর্থ শিশু। কী করছ তুমি?

বুডঢা। কে? (কাঠিন্য মিশ্রিত কণ্ঠ)

শিশুরা। আমরা। কী করছ তুমি?

বুডঢা। টাঙাচ্ছি।

শিশুরা। কী?

বুডঢা। ত-র-বা-রি।

শিশুরা। তরবারি!

[বুডঢা ওদের দিকে ফেরে। হাতে তরবারি। হাজার বছরের বৃদ্ধ বুডঢা। কিম্ভূত পোশাক। নীচের ঘেরের প্রান্তদেশ রাজার পোশাকের মতো। বুকে উ, আ, পা, ই, অ, সি, জা অক্ষরগুলি পর পর লেখা। মাথায় ব্যাঘ্রলাঞ্ছিত মুকুট]

শিশুরা। তোমার কী বিশ্রী চেহারা!

বুডঢা। হা-হা-হা।

প্রথম ও দ্বিতীয় শিশু। তোমার পোশাকটা বিশ্রী।

বুডঢা। বটে, বটে, বটে।

তৃতীয় ও চতুর্থ শিশু। তোমার মুকুটটা দেখলে ভয় করে।

বুডঢা। হা-হা-হা-হা।

শিশুরা। তোমার বয়স কত?

বুডঢা। হাজার বছর। আরও হাজার বছর। হাজার হাজার বছর।

শিশুরা। তাই তুমি বুডঢা?

বুডঢা। বুডঢা? হো-হো-হো। বুডঢা? বেশ বলেছ।

প্রথম ও দ্বিতীয় শিশু। তোমার তরবারিটা অত লম্বা কেন?

তৃতীয় ও চতুর্থ শিশু। তরবারি দিয়ে তুমি কী কর?

বুডঢা। রক্তপান করি।

তখন আমি ঠিক এমনি করে তরবারি হাতে নেচেছি।

শিশুরা। (আতঙ্কিত) রক্ত!!!

বুডঢা। হ্যাঁ, হ্যাঁ। (তরবারিটা সামনের দিকে সোজা ধরে) হরিণের নধর বুকের রক্ত, পায়রার নরম বুকের রক্ত, শিশুর কচি বুকের রক্ত, মায়ের ও বাবার বুকের রক্ত।

প্রথম শিশু। না, না, তুমি আমার হরিণটার বুকের রক্ত খেয়ো না।

বুডঢা। হা-হা-হা-হা।

দ্বিতীয় শিশু। না, না, তুমি আমার নোটন পায়রার রক্ত খেয়ো না।

বুডঢা। হা-হা-হা-হা।

তৃতীয় শিশু। তুমি আমার মার বুকের রক্ত খেয়ো না।

বুডঢা। হা-হা-হা-হা।

চতুর্থ শিশু। আমার বাবার বুকের রক্ত খেয়ো না।

শিশুরা। (বুক চেপে ধরে) তুমি আমাদের বুকের রক্ত খেয়ো না।

বুডঢা। হরিণের নধর বুকের রক্ত, পায়রার নরম বুকের রক্ত, শিশুর কচি বুকের রক্ত, বাবার গভীর বুকের রক্ত, এই তরবারি আমায় কোষ ভরে ভরে দেয়। আমি ঠিক এমনি চোঁ চোঁ করে পান করি।

শিশুরা। তুমি রাক্ষস।

বুডঢা। উঁহু। আমি যখন যুবক ছিলাম (পোশাকের ঘেরের প্রান্তদেশ দেখিয়ে) এই ঝলমলে পোশাকে আমি ছিলাম রাজা। আমি দেখতে ছিলাম দেবতার মতো সুন্দর। তখন আমি ঠিক এমনি করে তরবারি হাতে নেচেছি। (তরবারি হাতে নৃত্য। নৃত্য শেষে) এমনি করে হরিণ আর পায়রা, শিশু আর তার মা-বাবার বুকে এই তরবারি বসিয়ে রক্ত টেনে এনে পান করেছি। (তরবারি বসাবার ও রক্তপান করবার ভঙ্গি)

শিশুরা। (ভয় ও ঘৃণা) বুডঢা, তুমি রাক্ষস।

বুডঢা। উঁহুঁ, উঁহুঁ! আমি যখন আরও যুবক (পেটের পোশাক দেখিয়ে) তখন আমি দেবতাদের রাজার মতো শক্তিশালী। এই তরবারি হাতে আমি এমনি করে নেচেছি। (নতুন ছন্দে তরবারি নৃত্য। নৃত্য শেষে)এমনি করে কোষভরে রক্তপান করেছি।

প্রথম ও দ্বিতীয় শিশু। তুমি এখান থেকে চলে যাও।

তৃতীয় ও চতুর্থ শিশু। তুমি রাক্ষস।

বুডঢা। উঁহুঁ। তখন আমাকে প্রভু বলেছে কত লোক। রাজা বলেছে কত লোক। দেবতা বলেছে কত লোক। তারপর যখন আরও বয়স হল আমি তখন সূর্যের মতো শক্তিশালী। আমার কত চমক (বুকের পোশাক দেখিয়ে) আমি তরবারি হাতে তখনও নৃত্য করেছি। আঁজলা আঁজলা রক্ত পান করেছি। আর এখনও আমি তরবারি নিয়ে নাচ দেখাই, আর নধর হরিণ, নোটন পায়রা আর বাবা আর মার রক্ত পান করি।

প্রথম শিশু। ওঃ তুমি কী ভয়ানক!

দ্বিতীয় শিশু। তুমি তো খুনি!

তৃতীয় শিশু। তুমি শয়তান!

চতুর্থ শিশু। তোমার তরবারি যদি ভেঙে ফেলি?

বুডঢা। ভেঙে ফেলবে? হা-হা-হা-হা-এ তরবারি ভেঙে ফেলবে? হা-হা, (তরবারি বাঁ হাতে ধরে ডান হাত দিয়ে দেখিয়ে) এতে হাজার হাজার বছরের ধার। রক্ত খেয়ে খেয়ে এ তরবারি ভারী হয়েছে। কত লোক চেষ্টা করেছে একে ভেঙে দিতে। অবশ্য একটু ভোঁতা হয়েছে। আমি আবার ধার দিয়েছি। (তরবারির ভাঙা ডগাটা লুকোতে চেয়ে চেপে ধরে)

প্রথম শিশু। তুমি ওরকম করে তরবারি ধরেছ কেন?

তৃতীয় শিশু। মুঠোটা খুলে দাও।

দ্বিতীয় ও চতুর্থ শিশু। হাত খুলে দাও।

বুডঢা। ও তোমরা বুঝবে না। ওখানে বসো, শোনো। (শিশুরা দূরে বসে। বুডঢা তরবারিটা টাঙাতে টাঙাতে) সে হাজার হাজার বছর আগের কথা। আমি পেট ভরে খেয়ে হিরা, চুনি, মুক্তোর পোশাক পরে, তরবারিটা টাঙিয়ে আর প্রহরীদের সতর্ক করে দিয়ে হাড়ের পালঙ্কে শুয়ে একদিন নিশ্চিন্তে এমনি করে ঘুমোচ্ছিলাম।

[বুডঢা তরবারিটা টাঙিয়ে পালঙ্কে শুয়ে পড়ে। একটি খালি গা বলিষ্ঠ চেহারার মানুষ দৃঢ় অথচ শঙ্কিত সতর্ক পায়ে মঞ্চে প্রবেশ করে। লক্ষ্য তার তরবারি। টাঙানো তরবারি ধরতে খুব কষ্টে সিঁড়ির এক ধাপ ওঠে। তরবারি ধরতেই ঘণ্টা বাজে। তার বুকে তরবারি বিদ্ধ হয়। আহত মানুষ গর্জন করে প্রস্থান করে]

হা-হা-হা। পারেনি, ওরা পারেনি। তবে ওদের বুকের রক্তে তরবারিটা একটু ভোঁতা হয়েছে। কিন্তু আমি আবার ধার দিয়েছি।

শিশুরা। তোমার তরবারিতে জাদু আছে?

বুডঢা। হুঁ-হুঁ-হুঁ- এমন একটা কলবল্টু আছে তা ওরা জানত না।

শিশুরা। কী সেই কলবল্টু?

বুডঢা। তোদের কী দরকার?

শিশুরা। যদি জানতে পারি?

বুডঢা। তাহলেই বিপদ। তবে আমার চর আছে। কলবল্টু যে-ই জানতে চায়- হরিণের মতো, পায়রার মতো তার বুক ফুটো করে দিই।

প্রথম শিশু। আর কেউ কখনো জানতে পারেনি বুডঢা?

বুডঢা। বারে বারে চেষ্টা করেছে।

শিশুরা। কে, কে, চেষ্টা করেছে? বলো, বলো।

বুডঢা। একদিন আমি তরবারিটা টাঙিয়ে রেখে আর প্রহরীদের খুব সজাগ থাকতে বলে আরাম করে আহার শেষে সোনার গড়্গড়ায় রুপোর নল লাগিয়ে মিষ্টি তামাক খেতে খেতে হাড়ের পালঙ্কে এমনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখন-

[তরবারি টাঙিয়ে বুডঢা শুয়ে পড়ে। একটি জীর্ণবস্ত্র বলিষ্ঠ মানুষ দৃঢ় অথচ শঙ্কিত এবং সতর্ক পায়ে মঞ্চে প্রবেশ করে। লক্ষ্য তরবারি। প্রথম ধাপ সে সহজে ওঠে। অর্থাৎ পূর্বের অভিজ্ঞতা আছে। দ্বিতীয় ধাপে সে পা দেয়, যেখানে পূর্বের লোকটি পা দেয়নি। এবার সে তরবারি চেপে ধরে। ঘণ্টা বেজে ওঠে। তরবারি তার বুকে বিদ্ধ হয়। সে ছিটকে পড়ে গর্জন করে প্রস্থান করে। বুডঢা জেগে ওঠে]

হা-হা-হা। এ ব্যাটা কলবল্টু ধরেছিল আর কি। কিন্তু পারেনি। আমার তরবারি ওর বুকের রক্ত পান করল। আবার একটু ভোঁতা হল, কিন্তু আমি আরও ঝকমকে করে ধার দিলুম।

প্রথম শিশু। ওকী তোমার তরবারিটা ছুঁচোলো নয় কেন?

বুডঢা। তা দিয়ে তোদের দরকার কী?

দ্বিতীয় শিশু। তাইতো, তাইতো। তুমি যে মুঠো করে ধরেছিলে, তাই দেখিনি। তোমার তরবারির ডগাটা কোথায়?

বুডঢা। ডেঁপো ছেলে, তা দিয়ে তোর দরকার কী?

তৃতীয় শিশু। তোমার তরবারির যে অনেকটা ভাঙা।

চতুর্থ শিশু। কেন? কী করে ভাঙল বুডঢা?

বুডঢা। (শিশুদের দিকে ভ্রূকুঁচকে তাকায়) হাজার হাজার বছরের তরবারি তো? ওই ডগার কয়েক আঙুল পলকা ছিল। ধার দেবার সময় শানদার তা দেখতে পায়নি, ভেঙে গেছে।

প্রথম শিশু। তবে তো সেই-ই ঠিক করে দিত।

বুডঢা। শানদারকে বলতে হবে।

দ্বিতীয় শিশু। শানদার তো জোড়ে না, শানদার তো শান দেয়।

চতুর্থ শিশু। নিশ্চয়ই কেউ ভেঙে দিয়েছে বলো?

বুডঢা। কে ভাঙবে অ্যাঁ? এমন বুকের পাটা কার?

তৃতীয় শিশু। কিন্তু ভেঙেছে তো? তুমি লুকোচ্ছিলে তো?

বুডঢা। ভেঙেছে তো ভেঙেছে।

শিশুরা। বলো, বলো, কেমন করে ভাঙল?

বুডঢা। একদিন…

শিশুরা। (প্রবল আগ্রহে) বলো, বলো।

বুডঢা। একদিন আমি তরবারি টাঙিয়ে রেখে, নতুন নতুন সব প্রহরীদের সজাগ থাকতে বলে, পেট ভরে আরাম করে খেয়ে, পাইপে ভাজা তামাক ভরে, টানতে টানতে হাড়ের পালঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। তখন-

[পূর্ববৎ বুডঢা তরবারি টাঙিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে। দৃঢ় অথচ সতর্ক পায়ে একজন লোক প্রবেশ করে। লক্ষ্য তার তরবারি। প্রথম দুটো ধাপ সে বেশ সহজে ওঠে। তৃতীয় ধাপ সে খুব কষ্টে ওঠে। কষ্টে উঠে সে তরবারি আঁকড়ে ধরে। ডগাটা মট করে ভেঙে দেয়। ঘণ্টা বাজে। হাতে তরবারির ডগা নিয়ে ঘুমন্ত বুডঢার পায়ে লাথি মারে এবং আনন্দের হুংকার তুলে প্রস্থান করে। বুডঢা ধড়মড় করে জেগে ওঠে। আতঙ্কে ক্রোধে হা হা করে ছুটে যায় এবং সতর্কতামূলক ‘প্রহরী প্রহরী’ চিৎকার করে গম্ভীর হয়ে যায়]

শিশুরা। কী হল? কী হল?

বুডঢা। আমার তরবারির ডগা ভেঙেছে। কিন্তু ধার তো যায়নি, আর ভারীও আছে যথেষ্ট। এখনও আমি হরিণের কোমল বুকের, পায়রার নরম বুকের, শিশু আর মা-বাবার বুকের রক্ত পান করি। তবে আমি সতর্ক হয়ে গেছি। আরও নতুন নতুন প্রহরী রেখেছি চারিদিকে সাজিয়ে। এখন আর আরামে নিশ্চিন্তে ঘুমোই না।

শিশুরা। তবে কী কর?

বুডঢা। এখন আমি আরাম করে খেয়ে হাড়ের পালঙ্কের ওপর বসে বসে চোখ ঘুরিয়ে দেখি, ছল করে হাসি, ছল করে কাঁদি, আরও নানা ছল করে তরবারির ধার দেখি।

শিশুরা। না ঘুমিয়ে কেউ পারে?

বুডঢা। তা ঠিক। বয়সও হয়েছে, একটু ক্ষয়িষ্ণু হয়েছি। তাই ঘুম পেলে হাড়ের পালঙ্কে বসে বসেই একটু ঝিমিয়ে নিই।

শিশুরা। আর তোমার তরবারি?

বুডঢা। এ তরবারি এখন অনেক অনেক চালাক লোকে পাহারা দেয়। আমি নিত্য নিত্য নতুন নতুন লোক রাখি-খুব চালাক-খুব ওস্তাদ লোক।

[শিশুরা। নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করে]

বুডঢা। কী হচ্ছে?

প্রথম শিশু। তুমি ঘুমোও না?

বুডঢা। না।

দ্বিতীয় শিশু। তুমি ঝিমোও?

বুডঢা। তা দিয়ে তোদের দরকার কী?

তৃতীয় শিশু। না, রাগ কোরো না, জিজ্ঞেস করছি।

বুডঢা। হ্যাঁ, আমি ঝিমোই মাত্র।

চতুর্থ শিশু। ও বেশ বেশ। আচ্ছা, বুডঢা তোমার তরবারি কেউ কেড়ে নিয়ে ভাঙতে পারবে না?

বুডঢা। আমি এখন খুব, খু-উ-ব সতর্ক (বুডঢা দাঁড়িয়ে ওঠে। হাত ঘুরিয়ে নেচে জাদুকরের মতো অং বং চং রেখা কাটে)

অং বং চং ফুসফুস ফাস

আমার মন্তর দেশে দেশে যাস।

ফাস ফুস ফুস আর অং বং চং

টুং টাং মন্তর দেখা যত ঢং।

ঝর ঝর ঢালরে রাশি রাশি দানা

চার চার দিকে, নয়া নয়া হানা।

ঝুম ঝাম সাই সাই টরর টরর টর

অং বং চং এই যন্তর মন্তর।

শিশুরা। ওকী, ওকী, ওকী করছ?

বুডঢা। আমি এখন প্যাঁচ খুলি আর প্যাঁচ আঁটি। এক প্যাঁচে আঁটি আর এক প্যাঁচে খুলি। আমি এক হাতে ছুরি নিয়ে নাচি, আর হাতে মধু নিয়ে ছুটি। (নেচে দেখাবে) কিন্তু-

শিশুরা। কিন্তু কী?

বুডঢা। কিন্তু তরবারি আমার আগের মতোই কাজ করে। আমি এখন ওর ধারে একটু মধু লাগিয়ে দিই, একটু খিদে লাগিয়ে দিই, একটু তেষ্টা লাগিয়ে দিই। আর ও মধু দিয়ে, খিদে দিয়ে, তেষ্টা দিয়ে হরিণের আর পায়রার শিশু আর মা-বাবার বুক চিরে রক্ত এনে দেয়।

প্রথম শিশু। না, না, তুমি মধু আর খিদে মাখিয়ে অমনি করে ছল করে আমার হরিণ মেরো না।

বুডঢা। হা-হা-হা।

দ্বিতীয় শিশু। অমনি করে আমার নোটন পায়রা মেরো না।

বুডঢা। হা-হা-হা।

তৃতীয় শিশু। অমনি করে আমার মায়ের বুক কেটো না।

বুডঢা। হা-হা-হা।

চতুর্থ শিশু। আমার বাবাকে মেরো না।

বুডঢা। হা-হা-হা।

শিশুরা। তোমার তরবারি আমরা কেড়ে নেব, ভেঙে দেব।

বুডঢা। পারবি না, পারবি না।

শিশুরা। কেন পারব না?

বুডঢা। (রেগে) নাঃ। তোরা এখন যা। আমার এখন অনেক কাজ। দেশ-বিদেশের খবর আসবে। আমার দশটা ছুরির নাচ আছে। দশটা মধুর নাচ আছে। যা, তোরা যা।

[বুডঢা মঞ্চের চারদিকে কয়েক সেকেন্ড করে দাঁড়িয়ে কর্মব্যস্ততা দেখায়। কর্মব্যস্ততার বিচিত্র ধ্বনি শোনা যায়। ইত্যবসরে শিশুরা কথা বলে]

প্রথম শিশু। আমার হরিণটার জন্য মন কাঁদছে। ওই বুডঢা আর ওর ওই তরবারি থাকতে আমার হরিণ বাঁচবে না।

দ্বিতীয় শিশু। ঠিক ভাই। ওই বুডঢা আর তরবারি থাকতে আমার নোটন পায়রা বাঁচবে না।

তৃতীয় শিশু। আমার মার জন্যে মন কেমন করে। ওই বুডঢা আর তরবারি থাকতে আমার মাও বাঁচবে না।

চতুর্থ শিশু। আমার বাবাও বাঁচবে না রে, আমরাও বাঁচব না। আয় তরবারি কেড়ে নিই।

শিশুরা। কেমন করে কাড়ব?

চতুর্থ শিশু। চল আমরা সবাই একসঙ্গে গিয়ে কেড়ে নিই।

তৃতীয় শিশু। শোন শোন। আমার মা একটা গল্প বলেছিল। পাঁচটা বাড়ির পাঁচটা কুড়ুল এক করে, সেই ভীম কুড়ুল সাহসী পাঁচটা মানুষ কাঁধে নিয়ে তবে একটা দানো মেরেছিল। আয়, আমরাও তাই করি।

শিশুরা। বেশ বলেছ, ঠিক বলেছ। তাই চলো।

[পরস্পরের কাঁধ ধরে প্রস্থান]

[বুডঢা কাজ শেষ করে হাততালি দিয়ে প্রহরী ডাকে। দুজন ভীম প্রহরী এসে দাঁড়ায়। বুডঢা তাদের তরবারি পাহারা দেবার ইঙ্গিত করে এবং প্রস্থান করে। ওরা পাহারারত। পাঁচ মহাদেশের পাঁচ রকমের পোশাক পরে পাঁচটি শিশু পাঁচমুখ এক কুড়ুল কাঁধে নিয়ে দৃঢ় অথচ সতর্ক পায়ে মঞ্চে প্রবেশ করে। লক্ষ্য তাদের তরবারি। তারা এগোতেই ভীম প্রহরী পথরোধ করে। ওরা মিলিত আঘাতে তাকে পরাজিত করে। আবার এগোতেই দ্বিতীয় প্রহরী। তাকেও ঘায়েল করে। এরপর তরবারির নীচে এসে পৌঁছোয়। প্রথম তিনটি ধাপ তারা সহজেই ওঠে। চতুর্থ ধাপে দাঁড়িয়ে পাঁচের ধাপে পা রেখে পাঁচজন একসঙ্গে কুড়ুলের বাঁট ধরে তরবারির ওপর আঘাত করে। ঘণ্টা বেজে ওঠে। বুডঢার চিৎকার-‘প্রহরী প্রহরী’। কুড়ুল দিয়ে ওরা দড়ি কাটে। বুডঢার আতঙ্কিত চিৎকার ‘প্রহরী, শত্রু’। তরবারির এক টুকরো ভেঙে প্রথম শিশু হাতে নেয়। বুডঢার চিৎকার-‘আমার হাত গেল।’ দ্বিতীয় শিশু দ্বিতীয় টুকরো নেয়। বুডঢার চিৎকার-‘আমার হাত গেল’। তৃতীয় শিশু তৃতীয় টুকরো নেয়। বুডঢার চিৎকার-‘পা গেল’। চতুর্থ শিশু চতুর্থ টুকরো নেয়। বুডঢার চিৎকার-‘পা গেল’। পঞ্চম শিশু পঞ্চম টুকরো নেয়। বুডঢা মৃত্যু চিৎকার করে গড়াতে গড়াতে মঞ্চে এসে পড়ে এবং স্তব্ধ হয়ে যায়। পাঁচ টুকরো হাতে নিয়ে পাঁচটি শিশু উত্তোলিত হাতে একটি স্তবক রচনা করে। মিলিত হাত উত্তোলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্বের মৃত্যু ঘণ্টা থেমে যায়। পাঁচটি শিশু নেচে নেচে গান গেয়ে ওঠে]

গান

আমাদের হাতে হল বুডঢা সংহার,

হরিণের বুকে নেই মৃত্যুর ভয়।

তরবারি ভেঙেছি এই পাঁচবার,

পায়রার মৃত্যু আর কভু নয়।

পিতামহ বীরদের প্রণাম জানাই,

শিশুদের ছোটো বুকে নেই ভয় আর।

এইখানে বিজয়ের নিশান টানাই,

রাশি রাশি হাসি ফোটে বাবা আর মার।

ফুল ফোটে, চাঁদ ওঠে কী বাহার কী বাহার,

তরবারি ভেঙে গেছে। হল বুডঢা সংহার।

[পরদা নেমে আসে]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *