‘বুঝলা, হান্ড্রেড পার্সেন্ট নেতাজি’

‘বুঝলা, হান্ড্রেড পার্সেন্ট নেতাজি’

অসম থেকে বাবা যখন শিলিগুড়িতে বদলি হয়ে এলেন, তখন শিলিগুড়ি এখনকার মতো ফাঁদালো শহর হয়ে ওঠেনি। মফস্সলের গন্ধ তার অঙ্গে অঙ্গে। পুরনো বাজার, ভাল দোকানপাট নেই, রাস্তা ভাল নয়। হংকং মার্কেট বা নিউ মার্কেট তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। দুর্দশাগ্রস্ত হাসপাতাল। তিন ফুটের দোকান একটা-দুটো, ডাক্তারবদ্যি বলতে দু-চার জন। তবে হ্যাঁ, বেশ শান্তির জায়গা। প্রমোদ বলতে একটামাত্র সিনেমা হল, ছেলেদের আর মেয়েদের একটা করে স্কুল। ইংলিশ মিডিয়ম তখনও ছিল না শহরে। তবে এ কথাও সত্যি যে, তখন আমরা এ সব অভাব টের পেতাম না। অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

তখন রেডিমেড পোশাকের যুগ নয়। শার্ট-প্যান্টের কাপড় কিনে দরজিকে দিয়ে বানিয়ে নিতে হত। বাবা সাহেব আমলের রেলের অফিসার। ফলে শার্ট, প্যান্ট, কোট বা স্যুট নিয়ে তাঁর ছিল প্রবল খুঁতখুঁতুনি। কত দরজিকে যে মারতে উঠেছেন, তার হিসেব নেই। তবু কাটিহার এবং অন্য সব বড় জায়গায় এক-আধ জন ভাল দরজি পাওয়া যেত। শিলিগুড়িতে তা-ও ছিল না। কিন্তু পুজো-পার্বণে দরজি ছাড়া চলবেই বা কেমন করে! আমাদের দুই ভাইয়ের তেমন ঝামেলা নেই, কারণ ফিটিং নিয়ে আমাদের বক্তব্য তখনও তৈরি হয়নি। মুশকিল বাবাকে নিয়ে। যে দু-চার জন দরজিকে ট্রায়াল দিয়েছেন, তারা মোটেই সুবিধের নয়।

রেলের কোনও লোকই বোধহয় বাবাকে খবর দিয়েছিলেন যে, পুরনো বাজারের শেষের মাথায় একটা ছোট্ট দরজির দোকান আছে। অজিত বিশ্বাস হল সেই দোকানের মালিক। ভাল কাটার।

সেই অজিতকে এক দিন পাকড়াও করে আনা হল। বেশ হাসিখুশি মুখ, শ্যামবর্ণ। আমাদের বাড়িতে পা দিয়ে অবধি যে সে কথা শুরু করল, যত ক্ষণ ছিল শুধু বকবক করে গেল। আর সেই বকবকানির মূল বিষয় হল, এ শহরে তার মতো দরজি আর নেই। বাকি সব দরজিরা নিতান্তই আনাড়ি, কেউ কাজ জানে না ইত্যাদি। নিজের বাড়ির খবর, পূর্ববঙ্গের দেশের খবর, হিন্দুস্থান, পাকিস্তান, নেহরু, গাঁধী কিছুই বাদ ছিল না। বকবক বকবক। বাড়িসুদ্ধু তার কথার তোড়ে তিতিবিরক্ত হয়ে গেল। ওরই ফাঁকে ফাঁকে সে চা-বিস্কুট খেল এবং গজ-ফিতে দিয়ে বাবার আর আমাদের শার্ট-প্যান্টের মাপও নিয়ে নিল। সে বিদায় হওয়ার পর বাবা খুব হতাশ হয়ে বললেন, এই বাচালটারে দিয়া কি কাম হইব? আমাদেরও মনে হয়েছিল এ রকম বকবকবাজকে দিয়ে কাজ হবে না।

পরে বেরল তার আর এক গুণের কথা। তারই দেওয়া তারিখ পার করেও সে জামাপ্যান্ট দিয়ে উঠতে পারল না। এবং ক্রমেই ডেট পিছোতে লাগল।

ধমক-চমক করলেও সে অবশ্য রাগ করত না। সেই হাসিমুখেই নানা অজুহাত বানাত।

কিন্তু শেষ অবধি যখন সত্যিই জামাপ্যান্ট ডেলিভারি দিল, বাবা পর্যন্ত চুপ। কোনও খুঁত নেই। সামনাসামনি বাবা অবশ্য তেমন প্রশংসা করলেন না। কিন্তু সে বিদায় হওয়ার পর বললেন, হারামজাদার কথার তোড়ে মাথা ধইরা যায় ঠিকই, কিন্তু কাম করে বড় জব্বর।

অজিত বিশ্বাসকে আবিষ্কার করে বাবা খুশি হলেন। এর পর থেকে অজিতই আমাদের বাঁধা দরজি হয়ে গেল। যত বার তার দোকানে তাগাদা দিতে গিয়েছি, তত বারই রাজনীতি নিয়ে তার ভাষণ শুনতে হয়েছে। ননস্টপ। একটা মানুষ কাজ করতে করতে, সেলাই মেশিন চালাতে চালাতে বা মাপমত প্যান্ট শার্টের কাপড় কাটতে কাটতে কী করে যে এত কথা বলতে পারে, সেটাই বিস্ময়কর। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাজে ভুলচুক ছিল না। লোকে তাকে বলত মাস্টার কাটার।

এক দিন গিয়ে দেখি অজিতদা নেই। তার কর্মচারী বলল, উনি তো শৌলমারি গেছেন। নেতাজিকে দেখতে।

সেই যে শৌলমারি তার মাথায় ঢুকল, তার পর তার সব কথাই শৌলমারির সাধুকে নিয়ে। তিনিই যে নেতাজি, এ বিষয়ে তার তিলেক সন্দেহ ছিল না। আমাকে বোঝাত, বুঝলা রুনু, নাইনটিন থার্টিফোরে আমি নেতাজিরে দেখছিলাম বইলাই শৌলমারির সাধুরে চিনতে আমার দেরি হয় নাই। হান্ড্রেড পার্সেন্ট নেতাজি।

আমরা জানি, তৎকালের বাঙালি এবং বিশেষ করে উদ্বাস্তুরা রাজনীতির কূটকচালিতে, দেশভাগজনিত সমস্যায় কণ্টকিত হয়ে তিতিবিরক্ত মনে যে উজ্জ্বল উদ্ধারের স্বপ্ন দেখত, তার নায়ক ছিলেন নেতাজি। নিরুদ্দিষ্ট নেতাজি এক দিন ফিরে এসে দেশের হাল ধরবেন এবং ভারতবর্ষ পালটে যাবে— এই আশা অনেকের বড় বলবতী ছিল। আমারও তো কত দিন মনে হয়েছে, ওই দুঃসাহসী, সর্বত্যাগী মহান মানুষটি ফিরে এলে বড় ভাল হয়।

কিন্তু অজিতের দৃঢ় বিশ্বাস, নেতাজি এসেই গেছেন, আর কয়েক দিনের অপেক্ষা। সাধুর নির্মোক ছেড়ে তিনি স্বমূর্তি ধরবেনই। আর সেই দুর্মর আশায় সে প্রায় নিত্যই শৌলমারি যেত। সাধুর কাছাকাছি যাওয়ার উপায় ছিল না। দূর থেকে দেখতে হত, যখন তিনি খুব সামান্য ক্ষণের জন্য বাইরে পায়চারি করতে বেরতেন। ওই দর্শনটুকুই অজিতের পক্ষে যথেষ্ট। রোজগারের সব টাকাই প্রায় নেতাজির ফান্ডে জমা দিতে শুরু করল।

কিন্তু আমাদেরই হল মুশকিল। কারণ অজিতের ব্যবসা তখন প্রায় লাটে উঠেছে। সে আর কাটিং করে না। ব্যবসাতে মন নেই। শিলিগুড়ি ছেড়ে শৌলমারি তখন তার লক্ষ্যবস্তু। ফলে তখন আমাদের অন্যান্য দরজির শরণাপন্ন হতে হল। কিন্তু তারা কেউ অজিতের মতো মাস্টার কাটার নয়।

কী ভাবে তার মোহভঙ্গ হয়েছিল, জানি না। তবে কয়েক বছর লেগেছিল। বিস্তর টাকা ব্যয় হয়েছে। পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ। অজিত তখন ফিরে এল। একটু বিষণ্ণ, একটু হতাশ। কথাও কমে গেছে অনেক। কিন্তু ফের যখন কাজে লাগল, তখন দেখা গেল তার হাতের ম্যাজিক অক্ষুণ্ণই আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *