বুক পেতে মৃত্যু

বুক পেতে মৃত্যু

ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ বীরশ্রেষ্ঠ

সংসারের অভাব ঘোচানোর জন্য অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই তাঁকে চাকুরি নিতে হয়েছিল সেনাবাহিনীতে। প্রতিবেশীরা অনেকেই আপত্তি করে বলেছিলেন, ‘কচি ছেলেটাকে মিলিটারিতে দিলে? ও চাকরিতে কি মরণ-বাঁচনের ঠিক আছে?’

ছেলে শহীদ হবার দশবছর পরে ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফের মা বলেছিলেন, ‘পড়শিরা সেদিন আমাকে মানা করেছিল। তবু বুকের ছেলেকে ঠেলে দিয়েছিলাম যুদ্ধের মুখে। যুদ্ধেই হারিয়েছি ছেলেকে। কিন্তু তার জন্য আজ আর আমার মনে দুঃখ নেই। আমার রউফ দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। শ্রেষ্ঠ বীর হয়েছে।’বলতে বলতে পুত্রশোকাতুরা মা দুঃখে উথলে কেঁদে উঠে বললেন, ‘কিন্তু আমার বুক যে খালি হয়ে গেছে।’

.

ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারি থানার সালামতপুর গ্রামে শহীদ ছেলের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন মা মুকিদুন নেসা। এই গ্রামেই ১৯৪৩ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন মুন্সী আব্দুর রউফ। বাবা মুন্সী মেহেদী হোসেন ছিলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম। জমিজমা ছিল সামান্যই। সচ্ছলতা যাকে বলে তা ছিল না সংসারে। কিন্তু ইমাম সাহেব বলে মর্যাদা ছিল অনেক। গ্রামের যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত তাঁরই। রউফের লেখাপড়ার হাতেখড়ি বাবার কাছেই হয়েছিল। মা-ও কিছু লেখাপড়া জানতেন। ‘বিষাদ সিন্ধু’ বইটা তিনি তিনবার পড়েছিলেন। বিবি ফাতেমার নয়নের মণি ইমাম হোসেনের কারবালার যুদ্ধে শহীদ হওয়ার কাহিনী নিশ্চয় তঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাই হয়তো তিনি নিজের বুকের মানিককেও যুদ্ধে পাঠাতে দ্বিধা করেননি। যদিও পুত্রশোকে বুক তার ভেঙে গেছে। জীবন হয়েছে নিরবলম্ব।

রউফকে মা রব বলে ডাকতেন। দোহারা গড়নের দামাল প্রকৃতির ছেলে ছিলেন রব। সারাদিন টোটো করে ছুটে বেড়াতেন মাঠে-ঘাটে। লেখাপড়ায় মাথা ভালো ছিল, কিন্তু মন বসতে চাইত না কিছুতেই। একবার মা তাকে বকাঝকা করে পড়তে বসাবার চেষ্টা করেছিলেন বলে রব ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন। মা-ও ছুটেছেন পিছন পিছন। কিন্তু দস্যি দামাল রব ছুটতে ছুটতে একেবারে মধুমতী নদীর পাড়। মাকে ভয় দেখিয়ে বলেছেন, ‘আমাকে ধরতে এলে দেব নদীতে ঝাঁপ করে।

এই মধুমতী নদীকে কেন্দ্র করেই সালামতপুর গ্রামের অধিবাসীদের ভাগ্য ওঠানামা

.

মধুমতী নদীর ভাঙনে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে গ্রামবাসীদের চাষের জমি, বসতবাড়ি। বর্ষায় যে প্লাবন আসে মধুমতীর বুকে, তাতে ডুবে যায় সবুজধানের শীষে খরা জমি, কৃষকদের আশা-ভরসা। আবার খরার সময় নদীর বুক চিরে জাগে ধু-ধু বালুচর। তখন ধান বুনলে ধান হয় না। প্লাবনে ভাসে, খরায় পোড়ে সালামতপুর গ্রামের জমি, দুঃখ জমে সালামতপুর গ্রামের লোকদের জীবনে। রউফদের জীবনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একদিকে মধুমতী গ্রাস করেছে তাঁদের জমি, অন্যদিকে মৃত্যু ছোবল দিয়েছে মুন্সী মেহেদী হোসেনকে।

রউফ তখন খুব ছোট। চাদর-ঢাকা পিতার শায়িত দেহ দেখেও হয়তো ঠিকমতো বুঝতে পারেনি কী সর্বনাশ ঘটে গেছে। চারপাশে আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীর কান্নার রোলে হকচকিয়ে সে মাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘মা, বাবা কি সত্যি মরে গেছেন?’ মা তার জবাব দিতে পারেননি। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে আরো বেশি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।

মুন্সী মেহেদী হোসেন মারা গেলেন এক ছেলে রউফ এবং দুই মেয়ে জহুরা ও হাজেরাকে রেখে। অনিবার্যভাবেই এদের মানুষ করে তোলার ভার পড়ল মা মুকিদুন নেসার উপর। তিনি নিত্যদিন অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন তিনটি নাবালক সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য। অন্যের বাড়ির কাঁথা সেলাই করতেন, শিকা তৈরি করতেন। এভাবে কোনোমতে সংসার চলত। দুঃখের দিনগুলি ভবিষ্যতের সুখের স্বপ্ন দেখে কাটত। স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর রব বড় হবে, বড় হয়ে রোজগার করবে। তখন আর তাঁদের এত দুঃখ-কষ্ট অনটন থাকবে না।

সেই রব ক্রমে বড় হয়েছেন। ছোটবেলার দুরন্তপনা কমে লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। মেধাবী বলেও স্কুলে সুনাম রটেছে। কিন্তু অভাবের সংসারে ৮ম শ্রেণীর পর আর পড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। জীবিকার অন্বেষণে ১৯৬৩ সনের মে মাসে ভর্তি হন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল্সে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া কোনো ছেলের পক্ষে এটাই ছিল সম্মানজনক চাকুরি। তাছাড়া ছোট চাচা মুন্সী মোতালেব হোসেনও তখন ইপিআরের হাবিলদার। সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য সেটাও একটা প্রেরণা ছিল বই কী!

সংসারের টানে বাঁধা ছিল রউফ-এর মন। মাকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। চিঠি লিখতেন। ছুটি নিয়ে মাঝেমাঝে বাড়ি যেতেন। মাকে সান্ত্বনা দিতেন। বড় মেয়ের বিয়ের সময় তাকে শাড়ি দিতে পারেন নি, এই দুঃখে মা কেঁদেছিলেন। সে-সময় রব ছোট ছিল। তবু সেই অল্প বয়সেই মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘মা, কেঁদ না। আমি বড় হয়ে যখন চাকরি করব, তখন দেখো অনেক শাড়ি এনে দেব।’

সেই রউফ বড় হয়ে যখন চাকুরি শুরু করেন, মা’র মনে ভবিষ্যতের আশা, সুখের স্বপ্ন বড় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে। শেষের দিকে কেন জানি একটু কম বাড়ি আসতেন। মা ঘন ঘন আসার জন্য তাড়া দিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। রউফ চিঠির উত্তরে মাকে লিখেছিলেন, ‘এখন একটু কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে, তাই আগের মতো ঘন ঘন ছুটি পাই না। তার জন্য তুমি চিন্তা কোরো না। ছোট বোনের বিয়ে ঠিক করো। আমি নতুন শাড়ি নিয়ে বাড়ি আসব।’

.

রউফ-এর আর বাড়ি আসা হয়নি বোনের জন্য নতুন শাড়ি নিয়ে। মা জানতেনও না, তখন দেশে কী প্রলয়ংকর কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে। অনুধাবন করতে পারেননি, কেন ছেলে শেষের দিকে বাড়ি আসা কমিয়ে দিয়েছিলেন। দেশের সর্বস্তরের জনগণের মনে তখন পশ্চিম পাকিস্তানী একনায়ক শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালি কমিশন্ড-নন-কমিশন্ড সকল শ্রেণীর অফিসার ও কর্মচারীর মনেও ক্ষোভ— দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রামের এক দুঃখিনী মা মুকিদুন নেসা এসবের বিন্দুবিসর্গও জানতে পারেননি। জানতে পারেননি ২৫ মার্চের কালরাত্রে পাকিস্তানী বর্বরবাহিনী দেশের নিরীহ জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যার নেশায় মেতে উঠলে, সেই অন্যায়ের প্রতিবাদে, তাঁর ছেলে আরো অনেকের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন।

.

ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ ছিলেন মাঝারি মেশিনগান ডিটাচমেন্টের ১নং মেশিনগান চালক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে চট্টগ্রামে ১১ উইং-এ চাকুরিরত ছিলেন। পরে যুদ্ধ শুরু হলে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন। যুদ্ধে তিনি অপরিসীম সাহস ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়ে রচনা করেন অমর বীর গাথা।

মুক্তিযুদ্ধ কেবল শুরু হয়েছে।

চট্টগ্রামে প্রতিরোধ তুলে, মুক্তিযোদ্ধারা গড়ে তুলেছে ছোটখাটো প্রতিরোধ। সংগঠিত করেছে নিজেদের শক্তি I

পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই জলপথ দিয়ে পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনীর চলাচল প্রতিরোধ করার জন্য ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পনি বুড়িঘাট এলাকার চিংড়ি খালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষা-ঘাঁটি গড়ে তোলে। ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ এই কোম্পানিরই একজন যোদ্ধা ছিলেন।

.

৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।

সূর্য তখনো পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েনি। সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমেছে প্ৰায়। হঠাৎ বিশ্ব-চরাচর কাঁপিয়ে মুহুর্মুহু গর্জে উঠতে লাগল কামান ও মর্টার। বুড়িঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে ৭টি স্পিডবোট ও দুইটি লঞ্চে আনুমানিক দুই কোম্পানি সৈন্য। এরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২য় কম্যান্ডো ব্যাটেলিয়ানের কোম্পানি। এদের লক্ষ্য বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা-ঘাঁটি। সবচেয়ে আগে তীব্রগতিতে এগিয়ে আসছে দুটি লঞ্চ ও দুটি স্পিডবোট। ওগুলোর মধ্যে বসানো রযেছে ছয়টি তিন ইঞ্চি মর্টার আর অনেকগুলি মেশিনগান ও রাইফেল। সেগুলো থেকে শেল আর গুলি ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে। গোলাগুলির শব্দে আকাশ মাটি ফেটে যাচ্ছে যেন, নদীর পানিতে উঠছে বিষম আলোড়ন। তারা এগিয়ে যাচ্ছে মহালছড়ির দিকে। উদ্দেশ্য রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎখাত করে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করা।

বুড়িঘাট এলাকায় চিংড়িখালের দুপাশে মুক্তিসেনাদের যে প্রতিরক্ষা-ঘাঁটি আছে, সেখানে লোকবল খুবই কম। অস্ত্র-শস্ত্র নেই বললেই চলে। কিন্তু আছে অসীম মনোবল, দৃপ্ত প্রত্যয়, স্বাধীনতার অনির্বাণ শিখায় প্রজ্জ্বলিত দেশপ্রেম—যাকে কোনো দিন কোনো অস্ত্রে ভেদ করা যায় না। তা হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে বয়ে যায় অমরতার দিকে। তা চির অনিঃশেষ।

নির্ভীকচিত্তে অবস্থান নিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের অবস্থানের দিকে ছুটে আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি, আর মর্টারের গোলা। শত্রু-মর্টার চিহ্নিত করে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান। তীব্র গুলিগোলা বর্ষণে মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরক্ষা-ঘাঁটিতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।

ল্যান্সনায়েক রউফ দেখলেন এভাবে থাকলে সকলেই মারা পড়বেন। তিনি সৈনিকদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দিলেন। সহযোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে পিছু হটল।

শত্রু তখনো এগুচ্ছে।

এবার মুন্সী রউফ নিজ পরিখায় দাঁড়িয়ে গেলেন।

মেশিনগানটি তুলে ফেললেন উঁচুতে। অনবরত গুলি করতে লাগলেন স্পিডবোট- গুলিকে লক্ষ করে।

শত্রুসৈন্যদের বিরুদ্ধে তিনি একাই লড়তে লাগলেন। তাঁর এ-রকম দুর্দান্ত গলিবর্ষণের ফলে শত্রুর সাতটি স্পিডবোটই ডুবে যায় এবং সব আরোহী-পাকসেনা হতাহত হয়। এই আকস্মিক ক্ষতিতে শত্রুসেনার মনোবল ভেঙে পড়ে। পিছনের লঞ্চ দুটি তখন পশ্চাদপসরণ করে রউফের মেশিনগানের রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে সমগ্র প্রতিরক্ষা-এলাকার উপর মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে একভাবে লঞ্চ দুটি থেকে। শত্রুর একটি মর্টারের গোলা এসে সরাসরি ল্যান্সনায়েক রউফের ওপর পড়ে, ছিটকে পড়েন রউফ।

স্তব্ধ হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা, নীরব হয়ে মেশিনগানটি পড়ে থাকে তার পাশেই বিশ্বাসী বন্ধুর মতো।

শেষ বিকেলের সূর্যের লাল আলো ছড়িয়ে আছে প্রকৃতিতে, পাতায় পাতায়। নীরব প্রকৃতি যেন দেখল, সঙ্গীদের বাঁচিয়ে রাখতে এক দুঃসাহসী বুক পেতে নিল মৃত্যু।

মায়ের বুক খালি করে, সংসারের ভবিষ্যতের ভাবনা অসমাপ্ত রেখে, বোনের বিয়ের শাড়ির ব্যবস্থা না করেই দেশের মুক্তির জন্য শহীদ হলেন তিনি। শোণিতে নক্ষত্র জ্বেলে স্বাধীনতা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথ দেখালেন তিনি অন্যদের, কিন্তু নিজে ফিরতে পারলেন না। তাঁর এবং তাঁর মতো আরো অগণিত বীর শহীদের ঘরে না-ফেরার বেদনা নিয়ে উদ্‌ভাসিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শোণিতাক্ত সুর্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *