বুকের ভিতরে
তিরি আমাকে এক ধাক্কা মারল। ওর হাত নাড়া দেখে মনে হবে যেন মাছি তাড়াচ্ছে, কিন্তু যে-প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ধাক্কাটা আমার বুকে এসে লাগল তাতে মনে হল যেন, হাত নয়, ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিন।
আমি ছিটকে পড়ে গেলাম পেছনে। পড়তে-পড়তেই শুনলাম, দেওয়ালের কোণে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো সুমিতা এক ভয়ংকর চিৎকার করে উঠেছে।
একটা ফাইবার গ্লাসের চেয়ার আমার শরীরের ধাক্কায় কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। সেটা ধরে ওঠার চেষ্টা করতেই তিরির পাশে দাঁড়ানো লোকটা চকিতে ছিটকে এল কাছে। ইস্পাতের পাতে মোড়া বুটের গুঁতো মারল আমার পেটে। চোখের সামনে হাজারটা নক্ষত্র ঝলসে উঠে অলৌকিক সুপারনোভা ঘটে গেল। পাঁচকোনা ঘরের ফাইবার গ্লাসের দেওয়ালগুলো নাগরদোলার মতো বনবন করে ঘুরপাক খেতে লাগল। আর তারই মধ্যে সুমিতা একের পর এক চিৎকার করে চলল। মনে হচ্ছিল, ঘুরপাক খাওয়া নাগরদোলাটা কখনও বুঝি থামবে না। আর সুমিতার চিৎকারও বোধহয় তাই।
এখনও বলে দাও, ওরা কোথায় লুকিয়ে রয়েছে।
তিরির রুক্ষ স্বরের প্রশ্নটা যেন সুদীর্ঘ এক টানেলের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গেল আমার কানে। অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল বারবার : ..কোথায় লুকিয়ে রয়েছে? কোথায় লুকিয়ে রয়েছে? কোথায়…।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে নিলাম কয়েকবার। হঠাৎই সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। কারা কোথায় লুকিয়ে রয়েছে? আমি তার কী জানি? সুমিতাই বা এখানে কী করছে?
আমার বুকে যে-লোকটা গুতো মেরেছিল তার মনে বোধহয় দয়া হল। ঝুঁকে পড়ে অনায়াসে চেপে ধরল আমার বাঁ-হাত। তারপর তার চেয়েও অনায়াসে এক ঝটকায় খাড়া করে দিল আমাকে। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, রুদ্রপ্রসাদ চৌধুরী, বীরত্ব দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। এই ঘরে তোমাদের অনেক ইয়ার-দোস্ত বহু বীরত্ব দেখিয়ে গেছে। সেসব বীরত্বের এঁটোকাটা এখন যেখান-সেখানে ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে। একটু থেমে আবার বলল, আমরা কাজ শুরু করলে শেষ না করে থামি না।
তিরি আমার কাছে সরে এল। আলতো ধাক্কায় আমাকে ঠেলে বসিয়ে দিল একটা চেয়ারে। তারপর আমার মুখের কাছে মুখ এনে জিগ্যেস করল, চৌধুরী, সত্যি করে বলো তো, এইরকম জেদের কোনও মানে হয়? কেন বেকার গোঁ ধরে বসে আছ?
আমি জোর-জোরে শ্বাস নিলাম। বুকের ভেতরে কষ্ট হচ্ছিল। জিভটা বুলিয়ে নিলাম ঠোঁটের ওপর। সত্যিই কি আমি ছেলেমানুষি গোঁ ধরে বসে আছি? একটু পরেই কি আমার বীরত্বের এঁটোকাটা এই ঘরের মেঝেতে নয়ছয় হয়ে পড়ে থাকবে? সুমিতার দিকে একবার দেখলাম। চিৎকার থেমে গেছে, তবে চোখ-মুখ ফোলা, চোখে জল, শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠছে। ওর সহ্যশক্তি এত কম তা আগে কখনও বুঝতে পারিনি। ও আমার সঙ্গে সিকিওরিটি কন্ট্রোল ডিভিশনে কাজ করছে আজ প্রায় বারোবছর। কিন্তু তা সত্ত্বেও নমনীয় রয়ে গেছে।
তিরি সোজা হয়ে দাঁড়াল। ডাকল, ইকা, চৌধুরীকে একটু জল দাও। ওর এখন জলের দরকার। তারপর হেসে বলল, আর যদি শেষ পর্যন্ত মুখ না-ই খোলে তাহলে শান্তিজলের দরকার পড়বে।
ঘরে আমরা মোট পাঁচজন। পঞ্চম লোকটির নামই বোধহয় ইকা। কারণ তিরির কথায় সে নড়ে উঠল। এতক্ষণ সুমিতার কাছাকাছি একটা টেবিলে ভর দিয়ে বসেছিল। চোখের চাউনি চতুর। বেশ মনোযোগ দিয়ে এতক্ষণ ধরে ঘরের কর্মকাণ্ড দেখেছে, কিন্তু কোনও কথা বলেনি। এখন, ফাইবার গ্লাসের একটা গ্লাস হাতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে-আসতে বলল, তিরি, এবার ছেলেটাকে ছেড়ে মেয়েটাকে ধরো, মনে হয় তাড়াতাড়ি কাজ হবে।
তিরি ধীরে-ধীরে মাথা দোলাল। বলল, কথাটা এমনিতে ঠিকই, তবে এখানে লাভ নেই। ওই টানেলের ম্যাপ শুধু চৌধুরীই জানে। এই লোকটা–এর মাথার ভেতরেই রয়েছে খবরটা আমার মাথায় আঙুলের কয়েকটা টোকা মারল তিরি ও সেটা যে করে হোক আমাদের বের করতে হবে।
আমার পাঁজরায় তীব্র ব্যথা। মাথা ঝিমঝিম করছে–যেন মাথার ভেতরে অসংখ্য উলের বল গুঁজে দিয়েছে কেউ। কতক্ষণ এই অত্যাচার চলবে কে জানে! চলুক। যে করেই হোক মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে আমাকে। কারণ, শুধু আমার ওপরেই নির্ভর করছে একশো শিশুর ভবিষ্যৎ মানবজাতির ভবিষ্যৎ।
বাড়িয়ে দেওয়া জলের গ্লাসটা কোনওরকমে মুঠোয় ধরে ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিলাম। খালি গ্লাসটা খসে পড়ল আমার দুর্বল হাত থেকে। ফাইবার গ্লাসের সঙ্গে ফাইবার গ্লাসের ঠোকাঠুকির শব্দ হল কয়েকবার।
সুমিতা আমার কাছে এগিয়ে এল এবার। তিরি সরে গেল একপাশে। ইকাও পাশ দিল সুমিতাকে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে আশার ছোঁয়া দেখতে পেলাম। সুমিতা হয়তো পারবে আমার মুখ খোলাতে। অন্তত ওরা তাই ভাবছে।
শ্যামলা রং। টানা-টানা ভুরু। দীর্ঘ চোখ। ধারালো নাক। চোয়ালের রেখা স্পষ্ট। মাথার ঘন চুল ঢলে পড়েছে গালে, চোয়ালের রেখাকে কিছুটা তরল করে তুলেছে। ওর বাঁ কানের খুব কাছে একটা বড় তিল আছে। এখন চুলের আড়াল থাকায় দেখা যাচ্ছে না।
এই হল সুমিতা।
প্রায় বারোবছর আমরা কাছাকাছি কাজ করেছি। একসঙ্গে হেঁটেছি অনেক পথ। প্রথমে ও ছিল শুধুই সহকর্মী। তারপর বন্ধু। তারপর…
ওর ঠান্ডা দুটো হাতের চেটো চেপে বসল আমার দুগালে। ওর হাতে আমার আঁজলা করা মুখ। সুমি সুমিতা। ও কান্না চাপতে পারছিল না। তার চেষ্টাও করছিল না।
রুদ্র–।
আমি ওকে দেখলাম ভালো করে। এখন দুর্বল হলে চলবে না। যতটা সম্ভব বেপরোয়া জেদ ফুটিয়ে তুললাম মুখে।
বলে দাও, রুদ্র। বলে দিলে পরে ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে।
কথাটা বলে শত্রু তিনজনের দিকে তাকাল সুমিতা। আশ্বাস চাইল।
তিরি নিষ্ঠুর হেসে মাথা ঝাঁকাল দুবার। হ্যাঁ, ছেড়ে দেবে আমাদের। এখন অন্তত তাই বলছে।
ঘরের পাঁচ দেওয়ালে পাঁচটা পোলারয়েড জানলা। সূর্যের তেজ বাড়লে জানলার কাচের রং কালচে হতে থাকে। সামনের জানলা দিয়ে দূরে রুক্ষ প্রান্তর চোখে পড়ছে। আর সেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা গাছের কঙ্কাল। পাতা নেই, সবুজ নেই, ক্লোরোফিল নেই।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে আমার শীত করছিল। অথচ টের পাচ্ছি, কপালে ঘাম।
সামনের মসৃণ টেবিলে পড়ে রয়েছে দুটো লেজার অটোমেটিক। আর তার পাশেই একটা কম্পিউটার টার্মিনাল আর ছোট কন্ট্রোল প্যানেল। কম্পিউটারের মনিটরে সবুজ লেখার হিজিবিজি। প্রকৃতির সব সবুজ কি এখন শুধু কম্পিউটারের পরদাতেই পাওয়া যাবে?
সামনে দাঁড়ানো তিনজন শত্রুকে দেখছিলাম আমি। তিরি, ইকা–তৃতীয়জনের নাম জানি না। জেনে কোনও লাভ নেই। কারণ ওরা তিনজনই সমান হিংস্র, সমান নিষ্ঠুর। আতঙ্ক ওদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
তিনজনের চেহারার মধ্যেও কি কোনও তফাত আছে? বোধহয় না। সেই একইরকম লম্বাটে মুখ, হনু দুটো বড় বেশি রকমের উঁচু, চোখ দুটো যেন ছুরিতে চেরা গর্ত, ভুরু প্রায় নেই, গোঁফ দাড়িহীন মাকুন্দ মুখ, উঁচু কপালের একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে কালো চুলের শুরু–চুলগুলো যেন আঠা দিয়ে মাথার সঙ্গে চেপে সাঁটা। আর সবমিলিয়ে ভাবলেশহীন মুখ কী ভয়ংকর।
ওদের পোশাকও অদ্ভুত। চামড়া আর ধাতুর পাত দিয়ে তৈরি। গায়ের সঙ্গে এমনভাবে চেপে বসে আছে যে, শরীরের শক্তিশালী পেশি দিব্যি জানান দিচ্ছে।
সুমিতা আমাকে আদর করছিল। ওর নরম হাত পরম আত্মীয়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার মুখে, গালে, ঠোঁটে, চোখে, মাথার চুলে। আকুল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নীরব মিনতি জানাচ্ছে ক্রমাগত ও বলে দাও, রুদ্র, বলে দাও।
কী বলে দেব? কিছুই মনে পড়ছে না। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে, ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।
আমার কিছুই মনে পড়ছে না, সুমি।
নাম-না-জানা তৃতীয় লোকটা যেন বাতাসে ভেসে ছিটকে চলে এল আমাদের কাছে। বাঁ হাতের এক ঝটকায় সুমিতাকে ঠেলে দিল। ও প্রায় পাঁচহাত দূরে গিয়ে পড়ল। চিৎকারও বোধহয় একটা করে থাকবে। সেটা আমি ঠিক শুনতে পাইনি, কারণ পরক্ষণেই উগ্র রাগে লোকটা আমার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে শুরু করেছে পাগলের মতো মনে পড়ছে না! ন্যাকা।
সল, কী হচ্ছে! তিরি এগিয়ে এসে লোকটাকে বাধা দিল।
সল গজগজ করতে করতে সরে গেল আমার কাছ থেকে। তিরি আলতো করে কয়েকটা থাপ্পড় মারল আমার গালে–যেন আমার চেতনা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। তারপর ওর বাঁ হাতটা তুলে ধরল আমার মুখের কাছে। হাতটাকে থাবার মতো করে আঙুলের নখগুলো দেখাল। ছোট্ট তেকোনা তীক্ষ্ণ নখ–ঈগল পাখির চেয়েও ধারালো। কড়ে আঙুলের নখটা আমার গালের ওপরে বসিয়ে টেনে দিল তিরি, বলল, আমি তোমাকে সব মনে করিয়ে দিচ্ছি, চৌধুরী।
গালে জ্বালা, যন্ত্রণা। গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। বুকের ভেতরেও প্রায় একই অবস্থা। কিন্তু তাও আমাকে যে মুখ বন্ধ করে থাকতেই হবে।
তিরি বলতে শুরু করল।
আমার চোখ বুজে আসছিল অবসাদে। মাথা ঢলে পড়তে চাইছে কাঁধের ওপর। আচ্ছন্ন এক অবস্থায় মধ্যে তিরির অলৌকিক ধারাবিবরণী ঢুকে পড়ছিল আমার কানে। অসংখ্য ভোমরা যেন গুনগুন করে চলেছে কানের কাছে।
পৃথিবীতে যে পারমাণবিক যুদ্ধ একটা হবেই সেটা আমরা জানতাম। আমাদের ভয় ছিল, সেই ভয়ংকর মহাযুদ্ধে মানবজাতি হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। শুধু থেকে যাবে প্রাণহীন কলকারখানা, বইপত্র, আর রুক্ষ পৃথিবী। তাই গত সত্তরবছর ধরে ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা। মাটির নীচে তৈরি হয়েছে অসংখ্য সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধা। মেঠো ইঁদুর যেমন মাটির নীচে গর্ত করে বাসা বাঁধে। তারপর সুড়ঙ্গের সঙ্গে সুড়ঙ্গ জুড়ে গিয়ে তৈরি হয়ে যায় জটিল ভুলভুলাইয়া। শুধু ইঁদুররাই পথ চিনে চলতে পারে সেই গলিপথে। বিজ্ঞানীরা বহু গবেষণা করেছেন এই সুড়ঙ্গবাসী ইঁদুরদের জীবনযাপন নিয়ে। তারপর তারই অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে আমাদের মাটির নীচের জগৎ। সেখানে রাখা হয়েছে একশোজন শিশুকে। পঞ্চাশটি পুরুষ-শিশু, পঞ্চাশটি নারী-শিশু। সুস্থ, সতেজ, সবল। আপাতত তাদের দেখাশোনার কাজে রয়েছে দশজন ধাত্রী-শিক্ষিকা।
সুড়ঙ্গের মধ্যেই তৈরি করা হয়েছে নিরাপদ আস্তানা। সেখানে মজুত রয়েছে কুড়িবছরের ঘন খাবার। রয়েছে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, বই-খাতা, গবেষণাগার। পারমাণবিক যুদ্ধের কোনওরকম আঁচ পৌঁছোবে না সেখানে।
সুতরাং কোনও মহাপ্রলয়ে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ মানবসভ্যতা–শেষ হয়ে গেলেও মাটির নীচে লুকোনো ওই শিশুরা নতুন করে একদিন গড়ে তুলবে নতুন মানবসভ্যতা। স্তব্ধ কলকারখানাকে ওরা আবার সচল করে তুলবে। আবার সবুজে-সবুজে ভরিয়ে দেবে চারদিক।
মাটির নীচের ওই লুকোনো জগতের খোঁজ পাওয়া নেহাত সহজ নয়। নানা জায়গায় ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে প্রায় একহাজার সুড়ঙ্গের মুখ। এই সুড়ঙ্গের পথ ধরে যদি কেউ নীচে নেমে যায়, তাহলে সে আর ফিরবে না। পথ হারিয়ে শেষ পর্যন্ত খিদে-তেষ্টায় প্রাণ দেবে। সুতরাং এরকম ঝুঁকি কেউ নেবে না। তিরিরাও নেয়নি।
মাত্র বছরদুয়েক হল ওই শিশুরা মাটির নীচে জীবনযাপন শুরু করেছে। ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ওরা। আর আমরা সিকিওরিটি কন্ট্রোল থেকে প্রতিটি মুহূর্তে নজর রেখেছি ওদের ওপর। এমনসময়…।
না, পারমাণবিক যুদ্ধ নয়। কোথা থেকে হাজির হল তিরি, সল আর ইকাদের দল। সবাই বলতে লাগল, ওরা এসেছে অন্য কোনও গ্রহ থেকে। কিন্তু ওদের মহাকাশযানটা আমরা কোথাও খুঁজে পাইনি।
ওরা এসে সব তছনছ করে দিল। ওদের শক্তিশালী মারণাস্ত্র হাজার-হাজার মানুষকে নির্বিচারে খতম করে চলল। ওদের ক্ষমতার কাছে আমাদের সবই অকেজো।
এর মধ্যে যতটুকু জেনেছি, তিরিরা এক অদ্ভুত রাসায়নিক নিষ্কাশন পদ্ধতি নাকি বের করেছে। এই পদ্ধতির সাহায্যে অত্যন্ত কম খরচে ওরা পৃথিবীর মাটি থেকে বের করে নিতে পারছে সিলিকন, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, ক্যালশিয়াম, আরও কত কী! গাছের পাতা থেকে ওরা বের করে নিচ্ছে হাইড্রোজেন, কার্বন, অক্সিজেন। আর পশুপাখির হাড় থেকে পেয়ে যাচ্ছে ক্যালশিয়াম। পশু বলতে তার মধ্যে মানুষও রয়েছে।
নিষ্কাশিত এই সব পদার্থ ব্যবহার করে আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির শিল্পের পত্তন করবে ওরা। মানবসভ্যতাকে পিষে গুঁড়িয়ে খতম করে শুরু হবে উন্নয়নের কাজ। এতে বাধা দেওয়ার কোনও উপায় নেই। বাধা দিতে গিয়ে সিকিওরিটি কন্ট্রোল প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে আমাদের তৈরি বহু যন্ত্রমানব-রোবট ও অ্যান্ড্রয়েড। গত তিনমাস ধরে ক্রমাগত অত্যাচারের পর পৃথিবী এখন আর সবুজ গ্রহ নেই। বরং এখন তার চেহারা বাদামি অথবা লাল।
তিরিদের খতমের খেলা এখনও থামেনি। নানান গোপন তথ্য খুঁচিয়ে বের করার জন্যে কিছু লোককে ওরা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। যেমন, পরিত্যক্ত এই সিকিওরিটি বিল্ডিং-এ এখন রয়েছি আমি আর সুমিতা।
তিরির কথায় সব মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। সব।
..তোমাদের সিকিওরিটি কন্ট্রোলের চিফ ব্রিগেডিয়ার রাজামানি আমাদের হাতে খতম হওয়ার আগে ওই সুড়ঙ্গের কথা বলে গেছে– দু-আঙুলের চাপে আমার গালের ক্ষতস্থান রগড়ে দিয়ে বলল তিরি, এ-ও বলে গেছে, তার লোকেশান ম্যাপ, কো-অর্ডিনেট, সব তোমার জানা। একমাত্র তুমিই জানো। তিরি হাসল নিষ্ঠুরভাবে। ওর লাল টুকটুকে ঠোঁট সামান্য ফঁক হল। বলল, কোনও লাভ নেই, চৌধুরী। তুমি কানাগলিতে ঢুকে পড়েছ। আর ওই খবর আমাদের জানিয়ে দিলে তোমার লজ্জা পাওয়ারও কিছু নেই। বললাম তো, তোমার চেয়ে অনেক বড়-বড় বীর এই ঘরে অনেক বীরত্ব দেখিয়ে গেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিরি। সেটা সাপের নিশ্বাসের মতো শোনাল। আর পরক্ষণেই কোমরের বেল্টের কোন অদৃশ্য পকেট থেকে বের করে নিল সরু তীক্ষ্ণ ফলার একটা ছুরি। ঘরের উজ্জ্বল আলোয় ছুরি ও তিরির মুখ একইরকম দেখাল–হিংস্র নেকড়ের মতো।
তিরি আমার ওপরে ঝুঁকে পড়ে সলকে বলল, সল, ভিডিয়োতে সুড়ঙ্গের মুখগুলো একে একে দেখাতে থাকো।
সল টেবিলে রাখা ছোট প্যানেলের বোতাম টিপল। সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের একটা দেওয়াল বিশাল ভিডিয়ো পরদা হয়ে গেল। সেখানে ফুটে উঠল পৃথিবীর রঙিন রুক্ষ জমি, আর সুড়ঙ্গের মুখ। প্রতিটা মুখের নির্দিষ্ট নম্বর রয়েছে। এখন যেটা দেখা যাচ্ছে, তার নম্বর একত্রিশ।
ছুরির তীক্ষ্ণ মুখ আমার রগে চেপে ধরল তিরি। বলল, চৌধুরী, কোথা থেকে খোদাইয়ের কাজ শুরু করব বলো।
সুমিতা কোথা থেকে যেন ছুটে এল আমার কাছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল। হাঁটুগেড়ে বসে মাথা ঘষতে লাগল আমার কোলে। তারপর অবুঝ মেয়েটা জড়ানো গলায় কিছুক্ষণ ধরে কী যে বলল কিছুই বোঝা গেল না।
অবশেষে মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে। চোখে সেই নীরব মিনতি। ওঃ, অসহ্য!
তিরি একটু সরে দাঁড়িয়েছিল। সেদিকে একবার তাকিয়ে সুমিতা বলল, রুদ্র, বলে দাও ওদের। তা হলে ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে। লক্ষ্মীটি– তারপর গলার স্বর প্রায় ফিসফিসের পর্যায়ে নামিয়ে এনে বলল, রুদ্র, আমরা তখন তৈরি করব নতুন সভ্যতা। তুমি আর আমি।
এত যন্ত্রণার মধ্যেও তেতো হাসি পেল আমার। অবুঝ রমণী! তোমার মা হওয়ার ক্ষমতা আর কতদিন? সাত বছর? আট বছর? তোমার কাছ থেকে মৃত পৃথিবী বড়জোর আটটি শিশু পেতে পারে। যদি তারা সবাই বাঁচে, তা হলে আবার ষোলো থেকে আঠেরোবছর অপেক্ষা। কিন্তু মাটির নীচের ওই শিশুজগৎ? মাত্র পনেরোবছর পরেই ওরা প্রতি বছরে পঁচিশজন করে বাড়বে। এইভাবেই গড়ে উঠবে নতুন মানবসভ্যতা। তা ছাড়া, এখন তিরিদের গোপন খবর বলে দিলেই যে ওরা আমাদের বাঁচতে দেবে তার কোনও মানে নেই। আর, আমি…আমি…।
না, সত্যি কথাটা এবার বলে দেওয়াই ভালো। মন শক্ত করে সেটাই স্পষ্ট গলায় বললাম সুমিতাকে। আমার কথা তিরি, সল আর ইকাও শুনতে পেল। এবং চারজনই চমকে উঠল ভীষণভাবে।
আমি বললাম, তুমি ভুল করছ, সুমিতা। আমি মানুষ নই–অ্যান্ড্রয়েড যন্ত্রমানব। যার শরীর আর চেহারা হুবহু মানুষের মতো কিন্তু চলে ব্যাটারিতে।
সুমিতা অপার বিস্ময়ে আমাকে দেখতে লাগল। ওর হাত স্পর্শ করল আমার শরীর। পরীক্ষা করতে চাইল আমার রক্ত-মাংস। জানি, পরীক্ষা করে কোনও তফাত টের পাবে না। সেটা ও ভালো করেই জানে। ও অবাক হয়েছে অন্য কারণে। সিকিওরিটি কন্ট্রোলের একজন হোমরাচোমরা কর্তা মানুষ নয়, অ্যান্ড্রয়েড, এই ব্যাপারটাই ও মেনে নিতে পারছে না। আসলে এটাও আমাদের সিকিওরিটির একটা ছক। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিচ্ছিদ্র করার জন্যেই এই পরিকল্পনা।
আমি সাধারণ রোবট নই, কারণ তার চেহারা যন্ত্রের মতো। বরং লোকঠকানোর কাজে অ্যান্ড্রয়েড অনেক বেশি সুবিধেজনক। তবে রোবটশাস্ত্রের সব সূত্রই আমরা মেনে চলি। সেইভাবেই তৈরি আমরা। সেটাই যে নিয়ম!
ইকা এগিয়ে এসে সুমিতাকে প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেল দূরে। তিরি আর সল আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াল। তিরি ছুরির ফলাটা চেপে ধরল আমার বাঁ-ভুরুর নীচে। জিগ্যেস করল ঠান্ডা গলায়, তুমি তা হলে বলবে না?
এইবার আমি মন খুলে হাসতে পারলাম। এবার তো ওদের বোঝা উচিত, মানুষের ক্ষতি হয় এমন কোনও গোপন খবর আমি কখনওই ফাস করতে পারব না। রোবটশাস্ত্রের প্রথম সূত্র আমাকে বাধা দেবে। আমার পজিট্রনিক ব্রেন তখন আর কাজ করবে না। সুতরাং প্রথম সূত্রটা স্পষ্টভাবে শুনিয়ে দিলাম ওদের ও রোবট কখনও কোনও মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না, অথবা নিষ্ক্রিয় থেকে কোনও মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে না।
আমি মাথা নাড়লাম আপনমনেই। আমার বাঁ-চোখের ওপরে চামড়া ফুটো হয়ে রক্ত গড়াল। কষ্ট করে তিরির দিকে তাকিয়ে বললাম, তিরি, তুমিই বলো, ওই সুড়ঙ্গের হালহদিস জানিয়ে কী করে আমি আগামীদিনের মানবসভ্যতাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিই।
সল রুক্ষ গলায় তিরিকে বলল, এর চামড়া, রক্ত, মাংস সবই তো মানুষের মতো। অথচ বলছে রোবট, মানে অ্যান্ড্রয়েড। লোকটা ব্লাফ দিচ্ছে না তো?
তিরি কী যেন ভাবছিল আপনমনে। অনেক অ্যান্ড্রয়েড ওদের হাতে ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু ওরা মানুষ ভেবেই সেগুলোকে ধ্বংস করেছে। এখন আমাকে নিয়ে কী করবে ও?
তিরি বিড়বিড় করে বলল, না, ব্লাফ নয়। অ্যান্ডয়েডরা জীবকোশ দিয়ে তৈরি। ওরা রোবট হলেও হুবহু মানুষের মতো। শুধু ওই ব্যাটারিটা ছাড়া।
আমি বিধ্বস্ত সুমিতাকে দেখছিলাম আর মনে-মনে আওড়াচ্ছিলাম, আমি রোবট, আমি অ্যান্ড্রয়েড, প্রথম সূত্র অমান্য করতে পারি না আমি। যত কষ্টই ওরা আমাকে দিক, যত যন্ত্রণাই হোক। রোবট কখনও মানুষের কোনও ক্ষতি করে না। কখনও না।
ইকা এগিয়ে এল এবার। ওর সঙ্গে সলের চোখাঁচাখি হল। দুজনে প্রায় একইসঙ্গে বলে উঠল, তিরি, তা হলে ওই ব্যাটারিটাই খোঁজা যাক–
চোখের পলকে আমাকে শূন্যে তুলে নিল ইকা ও সল। সটান আছড়ে ফেলল ফাইবার গ্লাসের মেঝেতে। তারপর বেপরোয়া হাত চালিয়ে খুলে নিতে লাগল পোশাক-আশাক।
ক্রমশ আমার শীত বাড়তে লাগল। দেওয়ালের পরদায় তখনও রুক্ষ প্রান্তরের ছবি, সুড়ঙ্গের একত্রিশ নম্বর মুখ।
সুমিতার দিকে দেখলাম। ওর চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। এই বারোবছরে একটা রোবটকে ভালোবেসে ফেলেছিল ও! যার হৃদয় প্লাস্টিকের তৈরি! যার চোখের পলক পড়ে শরীরের গভীরে লুকোনো ব্যাটারির জোরে!
বুকের বাঁ-দিকে ছুরিটা বসিয়ে দিল তিরি। ব্যাটারি খোঁজার কাজ শুরু হয়েছে। ছুরির আঘাতে ছিন্ন হচ্ছে স্নায়ু, ধমনী, শিরা। অসহ্য যন্ত্রণা। দাঁতে দাঁত চেপে সইতে চেষ্টা করলাম আমি। আমি মানুষবেশী রোবট। প্রথম সূত্র ডিঙিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। রোবট কখনও মানুষের ক্ষতি করে না। কখনও না! দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম।
যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করছিলাম, হাত-পা ছুঁড়তে চেষ্টা করছিলাম। চোখে আর বুকে অসহ্য জ্বালা।
সুমিতা তখনও অবাক চোখে আমাকে দেখছে। একটা রোবটকে আগে কখনও বোধহয় এমনভাবে শেষ হয়ে যেতে দেখেনি ও।
ইকা, সল আর তিরির ঠোঁট চিরে মাঝে-মাঝেই বেরিয়ে আসছিল জান্তব গর্জনের টুকরো। আমার বুকের ভেতরে ওরা প্রাণপণে খোঁড়াখুঁড়ি করে চলেছে।
আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল, চোখ বুজে আসতে চাইছে বারবার। কিন্তু আর কিছুক্ষণ সহ্য করতে পারলেই নিশ্চিন্ত হতে পারি আমি। কারণ, একবার অজ্ঞান হয়ে গেলেই আর কোনও ভয় নেই। তখন আর কোনওরকম যন্ত্রণা আমি টের পাব না। চোখের সামনে এই অমানুষগুলোকে আর দেখতে পাব না, দেখতে পাব না সুমিকে। আমার সুমিকে।
সুমিতা কোনওদিনই জানতে পারবে না, আমার বুকের ভেতরে সত্যি-সত্যি কোনও ব্যাটারি নেই। আর প্লাস্টিকও নেই ছিটেফেঁটা। প্রথম সূত্র শুধু আমাকে সহ্য করার শক্তি জোগাক, এই আমার প্রার্থনা। আমি যে রোবট, এই মিথ্যে কল্পনাকে আঁকড়ে ধরে আমি তিরিদের সঙ্গে এই লড়াইয়ে জিততে চাই।
ওরা আমার বুকের ভেতরে খুঁড়ে যাক অনন্তকাল। আমার বুকের গভীরতা ওরা জানে না। ওই অতল গভীর থেকে কখনওই ওরা খুঁজে বের করতে পারবে না ভবিষ্যতের মানবসভ্যতার ঠিকানা।