বীর হাম্বীর

বীর হাম্বীর

‘সাধকের কাছে, প্রথমেতে ভ্রান্তি আসে
মনোহর মায়া-কায়া ধরি’; তার পরে
সত্য দেখা দেয়, ভূষণ বিহীনরূপে
আলো করি’ অন্তর বাহির!’

—রবীন্দ্রনাথ

এইবার রাজা বীর হাম্বীরের কথা বলতে যাচ্ছি। তিনি ছিলেন বর্তমান বাঁকুড়া জেলার অন্তঃপাতি বিষ্ণুপুরের রাজা। তার আগে তাঁদের বংশের বহু রাজা সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করে, বিষ্ণুপুর রাজ্যকে সুপ্রসিদ্ধ করে গিয়েছিলেন। বীর হাম্বীর যখন রাজত্ব করছিলেন তখন ভারতবর্ষের সম্রাট ছিলেন মোগল কুলতিলক আকবর শাহ। সম্রাট আকবর শাহ ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে চৌদ্দ বৎসর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ ও ১৬০৫ খৃষ্টাব্দে ৪৯ বৎসর রাজত্ব করে ইহধাম ত্যাগ করেন: তাঁর সময়ই বার ভূঁইয়াদের অভ্যুদয় হয় ও তিনিই ভূঁইয়া বা ভৌমিকপ্রথা রহিত করে বঙ্গদেশে জমিদারি প্রথার প্রবর্তন করেন। ভূঁইয়াগণ স্বাধীনভাবে আপনাদের বাহুবলের পরিচয় দিয়ে বাঙ্গালীর ভীরুতা দুর্নামের অনেকটা অবসান ঘটিয়েছিলেন, ভূঁইয়াদের চেষ্টায় বাঙ্গালী সৈন্য গড়ে উঠেছিল, রণকৌশলে অভ্যস্ত হয়েছিলেন আর তাঁদের উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই বাঙ্গালী জাতির দুর্গতি, বাঙ্গালী জাতির কাপুরুষতা ও অস্ত্রজ্ঞানশূন্যতা ঘনীভূত হয়েছিল। আজ তারা আত্মরক্ষায়ও অক্ষম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিষ্ণুপুরের রাজাদের সাধারণ উপাধি মল্ল, আর তাঁদের জ্যেষ্ঠ কুমারকে বলা হয়ে থাকে ‘ধারি’। মল্লরাজদের রাজত্বের স্থানকে মল্লভূমি বলা হতো। বাংলার অপরাপর প্রাচীন রাজবংশের ন্যায় এই রাজবংশেরও ইতিহাস নানা কিংবদন্তী ও ঘটনা এবং স্থাপত্য-শিল্পাদি হতে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। মল্লাব্দ বলে একটা অব্দ বা সালের প্রচলন আছে বিষ্ণুপুর রাজ্যে! এ অব্দটা আরম্ভ হয়েছে ৬৯৫ খৃষ্টাব্দ হতে। এতে করে আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে এখন হতে ১২৪১ বছর আগে এ বংশের পতন হয়।

রাজা আদি মল্ল এ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পিতা ছিলেন বৃন্দাবনের নিকটবর্তী জয়পুরের ক্ষত্রিয় রাজা।

তা যা-ই হোক— রাজা বীর হাম্বীর আবির্ভূত হয়েছিলেন, মোগল সম্রাট আকবরের সমসময়ে অর্থাৎ ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে। পৈতৃক রাজধানী বিষ্ণুপুরই ছিল তাঁরও রাজধানী। ধলকিশোর নদীর তীরবর্তী এই বিখ্যাত নগরী ভরে ছিল তাঁর পূর্বপুরুষদের অগণিত কীর্ত্তিকাহিনীতে।

ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব অবধি বিষ্ণুপুরের রাজারা প্রায় স্বাধীনই ছিলেন, কিন্তু এই শতাব্দীর প্রারম্ভে যিনি রাজা হন তাঁর নাম ‘ধারি মল্ল’ বলে ইতিহাসে বিখ্যাত। তিনি ঘটনাচক্রে বাংলার নবাবকে এক লাখ সাত হাজার টাকা খাজনা দিতে স্বীকৃত হন, কিন্তু এই অধীনতা অতি অল্প দিনের জন্যই তার ভাগ্যে ঘটেছিল। কিছুকাল পরেই আবার তিনি পূর্বভাব অবলম্বন করেন- ইচ্ছামতো কর দিতে আরম্ভ করেন। নবাবও তাঁর সঙ্গে মিত্রের মতো ব্যবহার করতে থাকেন।

রাজা ধারি মল্ল ইহলোক ত্যাগ করলে তার পুত্র বীর হাম্বীর হন রাজা। তাঁর রাজ্য রক্ষার ব্যবস্থা, শাসন করবার প্রণালী এবং সৈন্যদল গঠনের কৌশল এবং অসাধারণ শারীরিক শক্তি ও সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং প্রত্যুৎপন্নমতি দেখে সকলেই বিস্মিত হয়ে গেলেন। রাজা হয়েই তিনি তাঁর দুর্গগুলিকে সুদৃঢ় করে, চতুঃপার্শ্ববর্তী শক্তিশালী রাজাদের সঙ্গে ভাব করে, তাঁর রাজ্যকে সম্পূর্ণ নিরাপদ করে তুললেন। ইঙ্গিতমাত্র লক্ষ্য সৈন্য তাঁর জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হলো। সামন্ত রাজগণের সঙ্গে একান্তভাব সখ্য সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার বাইরের কোনো শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে তারা তার নির্দেশমতো অর্থ ও সৈন্যাদি দ্বারা সাহায্য করতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করতেন না।

রাজা বীর হাম্বীর নিজে বীর ছিলেন অন্যের বীরত্বেরও যথেষ্ট সমাদর করতেন। ফলে, তাঁর অধীন সামন্ত রাজগণকে তিনি নানাভাবে উৎসাহিত করে, তাঁদের প্রত্যেককে দিয়ে গড়ায়ে তুললেন তাঁর রাজ্যময় ভালো ভালো দুর্গ। উন্নতির আকাঙ্ক্ষায় তারা হয়ে উঠলেন উন্মত্ত। তাদের নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ শাসন প্রণালীতে তিনি কদাচ হস্তক্ষেপ করতেন না কারো স্বাধীনতা কোনো প্রকারে ক্ষুন্ন না করে নানাভাবে সদ্ব্যবহার ও সদ্ভাব প্রদর্শন করায় তারা উত্তরোত্তর রাজা বীর হাম্বীরের একান্ত বশীভূত ও অনুগত হয়ে পড়লেন। তাঁর সমসাময়িক সামন্ত রাজগণের মধ্যে জামকুঁড়ি, বগড়ি, মিশলাপাল, ইন্দ্রহাস, রাইপুর, ধারাপাট, মালিয়াড়া শূরভূম, ডুমনি, চন্দ্রকোণা, গড়বেতা, লোগা, বিহার প্রভৃতি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠল।

তিনি তাঁর নিজের গড় অর্থাৎ দুর্গকে সর্বতোভাবে দুর্ভেদ্য করবার জন্য তার চারদিকে খুব উঁচু করে মাটির স্তুপ গড়ে উঠালেন। পাহাড়ের মতো সেই উঁচু উঁচু জায়গায় স্থানে স্থানে বসানো হলো মজবুত সব কামান, আর স্থূপগুলোর বাইরে কাটানো হলো সুপ্রশস্ত সব খাল, বড় বড় বাঁধ দিয়ে ঘেরা হলো সারাটি রাজধানী। শত্রুর আক্রমণ হতে রাজধানীকে বাঁচাবার জন্য সবগুলো বাঁধকে সহজে যাতে এক এক করে দেওয়া যায় তার সুব্যবস্থা হলো, বাঁধগুলোর আয়তন করা হলো এক একটা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গ্রামের চেয়েও বড় বড়। এসব ছাড়াও রাজধানীর চারদিকে খোঁড়া হলো একটা মস্ত বড় খাল। কত জল তাতে! কে আসবে সে জল ডিঙ্গিয়ে সহজে? কামানগুলো যা বসানো হলো তার তুলনা মেলে না। আশ্চর্য লম্বা লম্বা সেগুলোর গঠনভঙ্গী আর পাল্লা। এখনো সেগুলোর নিদর্শন রয়েছে বিষ্ণুপুরে। বেশী না বলে, একটা কামানের কথাই বলছি, তার নাম ‘দলমাদল’। তেমন বড় কামান বড় দেখা যায় না। এখনো সেটি আছে। গভর্নমেন্টের প্রাচীন-স্মৃতি-রক্ষা আইন অনুসারে সেই কামানটাকে এখনো সযত্নে রাখা হয়েছে। এই কামান দলমাদলের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১২ ফিট, সাড়ে ৫ ইঞ্চি, পরিধি হচ্ছে সাড়ে ১১ ইঞ্চি। এত দিন গিয়েছে, এত রোদ-বাতাস লেগেছে, ধুলো-কাদা লেগেছে তার গায়ে তবু পড়েনি তাতে এতটুকুনও মরিচা! কত দামী, কেমন লোহা ছিল!

রাজা বীর হাম্বীরের পূর্ববর্তী রাজগণ, মোগলদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেই রাজ্য পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু রাজা বীর হাম্বীরের সময় নবাব সুলেমান, কর্ণাণীর ছেলে নবাব দাউদ খাঁ অসন্তুষ্ট হয়ে অকস্মাৎ তাঁর রাজধানী বিষ্ণুপুর করে বসলেন আক্রমণ। কিন্তু রাজা বীর হাম্বীর ভীত হওয়ার পাত্র ছিলেন না। যুদ্ধগুলোকে তিনি ছেলে খেলার মতোই মনে করতেন। অকুতোভয়ে, দুর্ধর্ষ সেই নবাবের বিপুল বাহিনীর সম্মুখীন হয়ে। তিনি অসীম পরাক্রম প্রদর্শন করে তাকে সম্পূর্ণ পরাজিত করলেন। নবাব দাউদ খাঁর অসংখ্য মহাবলপরাক্রান্ত সৈন্য এমন সাংঘাতিকভাবে আক্রান্ত ও নিহত হয়েছিল যে রাজা বীর হাম্বীরের দুর্গের পূর্ব দরজায় তাদের মুণ্ডে মুণ্ডময় ও শবে শবময় হয়ে গিয়েছিল, শত্রু নবাব পক্ষের সৈন্যগণের অগণিত মুণ্ড পতিত হয়েছিল বলে, সেই হতে সেই ঘাটেরই নাম হয়ে যায় মুণ্ডমালা ঘাট।

নবাব দাউদ খাঁর সেনাপতি ছিলেন বিখ্যাত বীর কুতুব খাঁ। তিনি পশ্চিমবঙ্গ জয় করে বৃহৎ সৈন্যদলসহ রাজা বীর হাম্বীরের রাজধানী বিষ্ণুপুর হতে ২১ মাইল পূর্বে সেনানিবাস স্থাপন করলেন এবং সেই স্থানের নাম তাঁর নামানুসারে কোতুলপুর বলে অভিহিত করলেন, প্রাধান্য স্থাপনের জন্য তাঁর অদম্য স্পৃহা উত্তরোত্তর বাড়তে দেখে সম্রাট আকবর তাঁকে দমন করবার জন্য তাঁর বিখ্যাত সেনাপতি মানসিংহ ও তাঁর ছেলে জগৎসিংহকে পাঠিয়ে দিলেন। কতুল খাঁ যে সে বীর ছিলেন না- পাছে কোনো বিপদ হয় ভেবে পরম বুদ্ধিমান রাজা বীর হাম্বীর জগৎসিংহকে পূর্ব হতেই সাবধান করে দিলেন। কিন্তু জগৎসিংহ তাঁর সে সাবধান হওয়ার ইঙ্গিত না মেনে বিপন্ন হয়ে পড়লেন। ইলিয়ট সাহেবের ইতিহাস ও আকবরনামায় এসব কথা বেশ খুলে লেখা আছে। রাজা বীর হাম্বীর জগৎসিংহকে বিপন্ন দেখে তাঁর বিপদুদ্ধারের জন্য চেষ্টিত হলেন। তাঁকে কৌশলে তাঁর রাজধানী বিষ্ণুপুরে সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ করলেন। এদিকে ঘোরতর যুদ্ধ বেঁধে উঠল। রাজা বীর হাম্বীরও নিশ্চিন্ত রইলেন না- মোগল সম্রাট, আকবর বাদশার সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে মিলে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, কতুল খাঁকে পরাস্ত করলেন। তাঁর অসীম প্রতাপ নিয়ে তিনি যদি মানসিংহকে সাহায্য না করতেন তাহলে সেবারকার সেই কতুল খাঁর যুদ্ধে মোগল সেনাপতি রাজা মানসিংহ ও তাঁর ছেলে জগৎসিংহের যে কি দশা হতো কে জানে! রাজা বীর হাম্বীরের অসংখ্য সৈন্য ছিল। শোনা যায়, এমন কতকগুলো পালোয়ান ও শক্তিশালী লাঠিয়াল ছিল যে তিনি তাদের সাহায্যে করতেন লুটতরাজ। শুধু রাজা বীর হাম্বীর এ কাজ করতেন তা নয়— তখনকার অনেক রাজারাজড়াই এতে কোনো পাপ হয় বলে মনে করতেন। এ ছিল তাঁদের একটা উপরি পাওনা। কেন বলছি শোনো :

রাজা বীর হাম্বীর রাজত্ব করছেন – দোর্দণ্ড তাঁর প্রতাপ। এমন সময় তাঁর রাজধানীর কাছ দিয়ে পরম বৈষ্ণব, শ্রীনিবাস আচার্য ও ঠাকুর নরোত্তম দাস, বৃন্দাবন হতে নানা বৈষ্ণবগ্রন্থে কয়েকটা গোরুর গাড়ি বোঝাই করে গৌড়ে যাচ্ছিলেন। বৃন্দাবন থেকে বিষ্ণুপুর এসে তারা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, জায়গাটা ভালো দেখে তাঁরা সেইখানে গাড়িগুলো থামিয়ে বিশ্রাম করতে লাগলেন। গাড়োয়ানেরা আর ঠাকুর মশাইরা যখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলেন তখন রাজা বীর হাম্বীরের লুটতরাজের লোকজনদের চোখে পড়ে গেল, তাঁদের গাড়িগুলো। সেগুলো ভর্তি ছিল মালপত্রে বেশ করে ছিল বাধা পুঁথিপত্র কি তৈজসপত্র, কি টাকা-পয়সা, না ধনদৌলৎ তারা তা ভালো করে বিবেচনা করবার সময় পেল না। তারা মনে করল, নিশ্চয়ই ও সব লুটের যোগ্য দামী দামী জিনিষ। হৈ হৈ, রৈ রৈ করে তারা লাঠি, সড়কী, বল্লম, ঢাল, তরোয়াল নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল, সেই গাড়িগুলোর উপরে। মুহূর্তে সব লুট করে, তারা সেই বস্তাবন্দী মালপত্র নিয়ে সরে পড়ল রাজবাড়ীতে। তাদের ডাক হাঁকে, ঠক্ ঠক্‌, ঢক ঢক শব্দে আর কোলাহলে গাড়োয়ানদের ঠাকুর মশাইয়ের ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখলেন সব পুঁথিপত্র লুট করে নিয়ে ডাকাতরা ছুটে চলেছে। কষ্টে অনুসন্ধান করে তাঁরা জানলেন— সে লোকগুলো সেখানকার রাজা বীর হাম্বীরের লোক।

মহাপণ্ডিত- বৈরাগী বৈষ্ণব মানুষ। পুঁথিগুলোর দাম তাদের কাছে তাদের প্রাণের চেয়েও ছিল বেশি। কি করবেন তাঁরা অনেক ভেবেচিন্তে শ্রীশ্রীগৌরহরির নাম স্মরণ করে, তারা রাজা বীর হাম্বীরের রাজ সভায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। কি সুন্দর সে রাজসভা- ঐশ্বর্য্যে ভরা বিচিত্র!

সৌভাগ্যক্রমে তারা অর্থাৎ পরম পণ্ডিত ও বিশ্ববিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য্য শ্রীনিবাস এবং পরম ভাগবত শ্রীল শ্রীনরোত্তম ঠাকুর, যখন রাজা বীর হাম্বীরের রাজসভায় প্রবেশ করলেন, তখন রাজা বীর হাম্বীরের সভা-পণ্ডিত মশাই পাঠ করছিলেন ভাগবত। সভা নীরব-নিস্তব্ধ। কান পেতে সকলে শুনছিলেন সে পাঠ। এমন সময় ‘গৌর গৌর’ বলতে বলতে তাঁরা দুজন সেই সভায় উপস্থিত হয়ে ষাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ প্রণাম করলেন! সভার সকলে তাদের অপূর্ব দৈন্যময় বৈষ্ণবমূর্তি দেখে তাঁদের দিকে অবাক-বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন। তাদের দেহড়ান্তিতে সভা ঝলমল করে উঠল। সকলেরই মনে কি যেন কিসের ঝড় বইতে লাগল। কপটী, পাষণ্ডের মনও এক নবভাবে আলোড়িত হতে থাকল। রাজা সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করলেন, কে আপনারা?

কি দৈন্যে ভরা তাদের সে আত্মপরিচয়! শ্রদ্ধাবনত শিরে রাজা তাঁদের অভ্যর্থনা করে, বসতে দিলেন। সভাপণ্ডিত পাঠ করতে থাকলেন— ভাগবত। অবসর বুঝে, আচার্য শ্রীনিবাস ঠাকুরও ব্যাখ্যায় যোগ দিলেন। তাঁর সে সুধামাখা ব্যাখ্যায় রাজা বীর হাম্বীরের রাজসভায় জোয়ার বয়ে গেল। কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনোরম ভঙ্গীতে বলেছেন :

‘সাধকের কাছে, প্রথমেতে ভ্রান্তি আসে

মনোহর মায়া-কায়া ধরি।’

রাজা বীর হাম্বীরের কাছেও এসেছিল ভ্রান্তি, তাঁর মায়াময় কায়া নিয়ে রাজা সংসারে বদ্ধ হয়েছিলেন, লুটতরাজ করতেও ইতস্তত করছিলেন না; কিন্তু ভাগ্যবান তিনি পূর্বজন্মের সুকৃতির ফলে দেখা পেলেন এমন দুজনের- যাদের মুহূর্ত সংস্পর্শে জন্মজন্মান্তরের সব পাপ ঝড়ের মুখে তুলোর মতো উড়ে যায়।

‘সত্য দেখা দিল- ভূষণ বিহীনরূপে

আলো করি, অন্তর বাহির।’

রাজা বীর হাম্বীর আর সে রাজা বীর হাম্বীর রইলেন না; তাঁর অন্তর বাহির আলো করে দেখা দিলেন গৌরহরি, তাঁর সত্যিকার ভূষণবিহীন সরল, সহজ, মধুর, দিব্যকান্তি নিয়ে। রাজার বিষয়-বাসনা দূর হলো। জলের উপর তেল যেমন ভাসে তিনি তেমনই তার সংসারে ভাসতে লাগলেন। তাঁর রত্নখচিত মুকুট নুয়ে পড়ল বৈষ্ণবাচার্য্য শ্রীনিবাস ঠাকুরের অভয় পায়। তিনি তাঁর নিকট দীক্ষিত হলেন। মল্লভূমের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় দেখা দিল।

অহর্নিশ বৈষ্ণব-সঙ্গে, হরিকথায় রাজা ডগমগ হয়ে উঠলেন। সর্বপ্রকার ঔদ্ধত্য দূর হয়ে রাজা আর তাঁর রাজবাড়ার সকলে হয়ে পড়লেন তৃণের চেয়েও সু-নীচ, কোথায় গেল সে অহঙ্কার-অভিমান, কোথায় গেল সে স্বার্থপরতা, সাধুসঙ্গের এমনই গুণ! সত্যি সত্যি সাধুসঙ্গ স্পর্শমণি। স্পর্শ করবামাত্র লোহা যায় হয়ে সোনা।

শুনা যায়- রাজা বীর হাম্বীর বিষ্ণুপুরকে বৈষ্ণব রাজত্বে পরিণত ও পরিবর্তিত করেছিলেন। তাঁর ভক্তি-গঙ্গায় যে জোয়ার বয়েছিল তার অবিরাম কলোচ্ছাসে বিষ্ণুপুর রাজ্য এখনো মুখরিত হচ্ছে আমোদিত ও নন্দিত হচ্ছে।

বৈষ্ণবের শ্রেষ্ঠ তীর্থ বৃন্দাবন ধামের দর্শন ভিখারী হয়ে হেঁটে চললেন সুদীনাত্মা রাজা বীর হাম্বীর। অপূর্ব উন্মাদনায় তিনি বিভোর হয়ে গেলেন। রাত-দিন অষ্টপ্রহর মুহুর্মুহু নামগান— বৈষ্ণব সঙ্গ— বৈষ্ণব সেবন করতে লাগলেন। তৃণাদপি সু-নীচ, তরুর মতো সহিষ্ণু, অমানী হয়ে মান দান ব্রতে তিনি উন্মাদ হয়ে উঠলেন। বৃন্দাবন হতে জাগ্রত বিগ্রহ মদনমোহনকে বহু যত্নে এনে তিনি তাঁর। রাজধানীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। সর্বস্ব ঢেলে তাঁকে সাজালেন। সাক্ষাৎ প্রাণের ঠাকুরের মতো পুজো-অর্চনা, ভোগরাগ, আরতির ব্যবস্থা করলেন।

যে রাজা বীর হাম্বীর একান্ত সংসারাসক্ত, সংসারের জন্য হিতাহিত, কর্মাকর্ম, পুণ্যাপুণ্যবোধিবর্জিত হয়েছিলেন তাঁরই হলো এই দশা। কোথায় রইল তাঁর সেই অপূর্ব যুদ্ধকৌশল, কোথায় রইল তাঁর অপূর্ব শোভামগ্ন। নানা শিল্পকার্যবিমণ্ডিত রাজপ্রাসাদ রাজধানী, তিনি মজে গেলেন ভ্রমরের মতো শ্রীহরের পদারবিন্দ-সুধায়।

বৃন্দাবন থেকে বহু কষ্টে শূন্য প্রাণে রাজধানীতে ফিরে এসে রাজা আকুল হয়ে রাতদিন চোখে পড়ে এমন সব জায়গায় নিজের মনের খোরাক ও প্রজাদের হিতকল্পে— ধর্মভাব বৃদ্ধির নিমিত্ত ‘যুমনা’, ‘কালিন্দী, ‘শ্যামকুণ্ড’, ‘রাধাকুণ্ড’ প্রভৃতি বাঁধ বেঁধে দিলেন। প্রিয়তম বৈষ্ণব ধর্মের সুপ্রচারের জন্য অষ্টপ্রহর নানাভাবে নানা প্রণালীতে চেষ্টা করতে থাকলেন। সর্বত্র, মৃদঙ্গ, করতালের ধ্বনি, নামকীর্ত্তন ও মহামহোৎসব হতে লাগল। নামে রুচির জন্য তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় বিষ্ণুপুর রাজ্য তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত জাগ্রৎ শ্রীশ্রীমদনমোহন মহাবিগ্রহ সুদীর্ঘকাল তাঁর রাজ্যকে নিরাপদ ও সর্ব সুখ-ঐশ্বর্য্যে পূর্ণ করে রাখলেন।

তাঁর বিষ্ণুপুরের মন্দির এখনো চোখ জুড়িয়ে দেয়। ছাঁচে ঢালা ইটে খোদা, পাথরে গাঁথা সে সব মন্দির। পাথরগুলোর আকার এক এক বর্গ ইঞ্চি হতে এক এক বর্গ গজ। মন্দিরে মন্দিরে খোদা রয়েছে, দশ অবতারের কত মূর্তি- কৃষ্ণলীলা, রাসলীলা, ভাগবত, রামায়ণ, মহাভারতের কত সব লীলা! বিষ্ণুপুর সঙ্গীতে ভারতের সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছিল। এখনো সেখানকার গাইয়ে, বাজাইয়ের তুলনা নেই। সে রাজ্য এখনো পরম বৈষ্ণব রাজা বীর হাম্বীরের অমর অবদানের কথা উদাত্ত সুরে ঘোষণা করছে।

বৈষ্ণবোত্তম রাজা বীর হাম্বীর দেহ রক্ষা করবার পর যারা রাজা হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে রাজা দামোদর অবস্থা-বৈগুণ্যে তাদের পরমারাধ্য কুল-দেবতা মদনমোহন জীউকে পর্যন্ত বিক্রয় করতে বাধ্য হন। কলকাতার বাগবাজারের সুবিখ্যাত ধনী গোকুল মিত্র মশাই সেই বিগ্রহ তিন। লাখ টাকায় কিনে এনে কলকাতায় তাঁর বাড়ীতে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই হতেই তাঁর সৌভাগ্যের সূত্রপাত হয়- বিষ্ণুপুরের হতে থাকে অধঃপতন। এখনো রাজা বীর হাম্বীরের সেই প্রাণের জাগ্রৎ ঠাকুর বাগবাজারে রয়েছেন।

মল্লভূমের এই পরম বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ রাজা ভূঁইয়া-কুলোত্তম বীর হাম্বীরের কনিষ্ঠ পুত্র বন্ধু রায়ের নামানুসারেই বাঁকুড়া বা বাকুণ্ডা শহরের নাম হয়েছে। পরম বৈষ্ণব রাজা বীর হাম্বীরের সেই বৈষ্ণব রাজ্য বিষ্ণুপুর তাঁর অজস্র বৈষ্ণব স্মৃতি নিয়ে বাঙ্গালী বৈষ্ণবের চিত্ত জুড়াতে এখনো রয়েছে – সেই কেবল সেই পরম বৈষ্ণব রাজা বীর হাম্বীর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *