বীজতলা

বীজতলা

লোকাল ট্রেনের দুলুনিতে এক ধরনের মিঠে মউতাত হয়। অনেকদিন বাদে ট্রেনে চাপল নিবারণ। রতনপুর কলেজ মোড়ে তার জমজমাট মিষ্টির দোকান, এ ছাড়াও চাষবাস তদারকি করতে গিয়ে একটুকু ফুরসত পায় না বাইরে বেরোনোর। জ্ঞাতি-গুষ্টির বাড়ি যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। কেউ আশাও করে না তাকে। ওদিকটা সামলায় বউ রমলা।

আজ নিবারণ যাচ্ছে তার এক পরম আত্মীয়র বাড়িতে। রমলা জানে না। জানলে বাড়ি মাথায় তুলত। কিছুতেই যেতে দিত না তাকে। ছেলে পরেশকে ক্যাশে বসিয়ে বিকেল বিকেল দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছে নিবারণ। পরেশকে বলেছে, তোর মা যদি হঠাৎ এসে যায়, বলবি বাবা গেছে পঞ্চায়েত অফিসে। মিটিং আছে।

পঞ্চায়েত অফিসকে খুব মান্য করে রমলা। নিবারণ পঞ্চায়েতের মেম্বার। রমলার স্থির বিশ্বাস তার স্বামী একদিন প্রধান হবেই হবে। গাঁয়ের সমস্ত ঠাকুর থানের দোর ধরা আছে রমলার। নিবারণের সেরকম কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। সে আজ যা হতে পেরেছে, সেটাকেই যথেষ্টর থেকে বেশি মনে হয়। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে।

নিবারণের বাবা তারকেশ্বরে এক ধানকলে খাতা লিখতেন। বড় দুই মেয়ে। ছেলে ছোট। অভাবের সংসার। নিজস্ব জমি বলতে বিঘে তিনেক। আর কাঠা দশেকের বাঁশ বাগান। তবু বাবার খুব ইচ্ছে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করুক, দু’-চারটে পাশ দিক। বাবার নিজের তেমন পড়াশোনা হয়নি। কষ্টেসৃষ্টে হলেও নিবারণদের পড়াশোনা চলছিল, দুটো দিদিরই মাথা ভাল নয়, স্কুলের গণ্ডিই পেরোতে পারল না। নিবারণ দিদিদের থেকে অনেক ছোট, ফেল না করে টুকটুক করে ক্লাসে উঠছিল। পরপর দুই দিদির বিয়ে দিতে গিয়ে বাঁশজমি গেল, প্রচুর ধার হল নিবারণদের। বাবা বিছানা নিলেন। নিবারণ তখন সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে। শখের লেখাপড়া শিকেয় তুলে নিবারণ হাল ধরল সংসারের। প্রথমেই যোগ দিল বাবার চাকরিতে। তারপর নিজেদের বিঘে তিনেকের জমি নিংড়ে দিল ধান চাষে, সময় সময় তিল সরষে— বাস্তুটুকু ছাড়া ভিটের চারপাশটায় লাগিয়ে দিল নানান আবাদ। বাড়ি ঢোকার রাস্তাটুকু তখন খুঁজে পাওয়া দায়। মা-ও উদয়াস্ত পরিশ্রম করত নিবারণের সঙ্গে। বাবার ধারের ওপর ধার করে দুটো গোরু কিনল নিবারণ, দুধের কারবার করবে। সবেতেই সফল হল নিবারণ। সমস্ত ধার মিটে গেল। পরম শান্তিতে ইহধাম ছেড়ে চলে গেলেন বাবা। নিবারণের পড়াশোনা হল না বলে তাঁর আর কোনও দুঃখ ছিল না। মা দেহ রাখলেন বছর পাঁচেক হল। নিবারণের এখন নামে বেনামে বিঘে বিশেক জমি। ভাগচাষিদের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ভাল। গোয়ালে গোটা পাঁচেক গোরু। একটা বাদে সবক’টাই দুধ দিচ্ছে। মিষ্টির

দোকানটা এতটাই চালু, ওই দুধেও পোষায় না। বাইরে থেকে কিনতে হয়। কলেজটা বছর আটেক হয়েছে, তারপর থেকেই বিক্রিবাটা বেড়ে গেছে অনেক। কামারপাড়ার স্কুলের মাস্টার গঙ্গাধরবাবু নিবারণের উত্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ জানেন। তাঁর সঙ্গেই একমাত্র প্রাণের সব কথা খুলে বলে নিবারণ। মাস্টারমশাই প্রায়ই বলেন, নিবারণ, তুমি হচ্ছ গিয়ে সেলফমেড ম্যান। তোমার মতো মানুষকেই ভগবান দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেন। তুমি এগিয়ে যাও, তোমার এখনও অনেক পাওনা।

সেলফমেড ম্যান মানেটা মোটামুটি বোঝে নিবারণ। তবে ইদানীং ঈশ্বরের আশীর্বাদ মাথা পেতে নিতে কেমন যেন কুণ্ঠা হয়। গা ছমছম করে। প্রায় বছর ঘুরতে চলল, বড় একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছে নিবারণ। তারপর থেকেই মনটা হঠাৎ হঠাৎ তল হারিয়ে ফেলে। নিজের সফলতাকে আগের মতো উপভোগ করতে পারে না। অন্যায় কাজটা কাঁটার মতো বেঁধে।

সেই অন্যায্য কাজটার ছোটখাটো একটা প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছে নিবারণ। মনে একধরনের চাপা আশঙ্কা, কী জানি, ওরা যদি আমায় দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়।

নিবারণদের স্টেশন হচ্ছে কামারকুন্ডু। কর্ড লাইনের ট্রেনে চেপেছে। যাবে জৌগ্রাম। সেখান থেকে মাইলটাক হেঁটে মনসাতলা। রিকশাতেও যাওয়া যায়, সেটা বড্ড দেখানো দেখানো হয়ে যাবে।

দোকান থেকে বেরোনোর সময় এক হাঁড়ি রসগোল্লা নেবে ভেবেছিল। সম্পর্কটা সমাজ স্বীকৃত না হলেও, নিবারণ তো জানে, সে আসলে কুটুমবাড়িতেই যাচ্ছে।

শেষমেশ মিষ্টি নেয়নি। ঘটনা কোনদিকে গড়াবে আন্দাজ করা যাচ্ছে না। ও বাড়িতে ছেলেকে একবার পাঠিয়েছিল, ভীষণ হেনস্তা করেছে ওরা।

মনের ওপর ওপর যতই টেনশন থাক, ভেতরে একটা ফুরফুরে আনন্দের বুজকুড়ি কাটছে। ঠিক যেন জ্বাল দেওয়া হচ্ছে ঘন দুধ অথবা কাশফুল মাথা নাড়ছে নদীর পাড়ে। জীবনে আজ আর একটা সুখের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে নিবারণ। মনটা এতই চঞ্চল, একের পর এক স্টেশন পার হয়ে যাচ্ছে, নামগুলো পড়াই হচ্ছে না। আজকের বিকেলটা যেন বেশি উজ্জ্বল। বাতাস ভারী তাজা।

জানলার ধারে সিট পেয়েছে নিবারণ, ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা। ট্রেনের উলটো পানে দৌড়োতে থাকা চষা জমি এখন সজল। গত চারদিনে খেপে খেপে বৃষ্টি হয়েছে খুব। এবার ধান রোয়ার পালা। নিবারণেরও বীজতলা রেডি। রোয়া শুরু করে দিলেই হয়। আজ না কাল, পাঁজি-পুঁথি করেই সময় কাটাচ্ছে নিবারণ। আসলে সুখবরটা পাওয়ার পর থেকেই সে বড় উন্মনা। খালি মনে হচ্ছে যাই বংশের নতুন চারাগাছটিকে দেখে আসি, ওর জন্য বীজতলা তৈরি করতে হবে।

খবরটা দিয়েছে দোকানের দুধওলা নরেন। থাকে মনসাতলা থেকে দু’মাইল দূরে কচুবেড়িয়ায়। ওর মামার বাড়ি মনসাতলায়। আলেকালে কাজে কম্মে আসে। তখনই ফাঁকতালে ও বাড়ির খবরটা নেয়। এমনটাই নির্দেশ দেওয়া আছে নিবারণের। দিন ছয়েক আগে নরেন দোকানের টাটের কাছে এসে গলার স্বর নাবোতে রেখে বলল, নিবারণদা,

তুমি যে দাদু হয়েছ, সে খবর রাখো? আমি তো মাস পাঁচেক পর মামার বাড়ি গিয়ে শুনি এই কাণ্ড।

চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল নিবারণের। চাপা গলায় আগ্রহভরে জানতে চায়, ছেলে না মেয়ে? তুই নিজে চোখে দেখে এসে বুলছিস তো?

ছেলে গো ছেলে। অবিকল তোমার ছেলের মুখ বসানো। আমি নিজের চোখে দেখেই বলছি।

নরেনের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রখর। ছেলের মুখ বসানো। কথাটায় নিবারণ যে রাগ করবে না, সে জানে। নিবারণের অপরাধ বোধটা নরেন টের পায়। নরেন বলে যাচ্ছিল, মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে ছুতো করে এবার চলে গেছিলাম ওদের বাড়ি। গতিক সুবিধের ঠেকলনি। মেয়ের সেই গোঁয়ার দাদা লাকি বুলেছে, বুনকে ঘরে পালছি, ঠিক আছে। তা বলে পরের বাচ্চার খরচ জোগাতে পারবনি। যাদের বাচ্চা দিয়ে এসো।— ই সব কুথাই মেয়ের মা কাঁদতে কাঁদতে বুলছিল আমাদের।

আর মেয়ে কী করছিল তখন? জানতে চায় নিবারণ।

সে বেটি দাদার মতোই ট্যাটা। তার চোখে জল লেই। দিব্যি ডগডগে সিঁদুর পরে ছেলেকে কোলে লিয়ে দোল খাওয়াচ্ছে।

নরেনের বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা চোখে ভেসে উঠেছিল নিবারণের। একবার সাক্ষাতে মেয়েটার জেদ নিবারণ টের পেয়েছে। সেই দিনটা বারেবারে মনে পড়ে। তখন পঞ্চায়েত ভোটের দু’মাস বাকি। আগেরবার নির্বাচিত প্রতিনিধি নিবারণ সেবারেও নিজের অঞ্চল থেকে ক্যান্ডিটেড হয়েছে। জয় সুনিশ্চিত। এলাকার লোকেরা নিবারণকে দ্বিধাহীনভাবে ভোট দেয়। প্রতিবার এইভাবে জিততে থাকলে পঞ্চায়েত প্রধান হওয়া তার কেউ আটকাতে পারবে না। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর জন্য রমলা উত্তেজিত থাকলেও, নিবারণ সবসময় ঠান্ডা। সে জানে সৎভাবে কাজ করে গেলে ফল একদিন পাওয়া যাবেই। এই সরল বিশ্বাসে আঘাত লাগল সেইদিন দুপুরে। দোকানে খদ্দের নেই। নিবারণ বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে এসে, টাটে বসে ঝিমোচ্ছে। পরেশ গেছে খেতে। এমন সময় বছর কুড়িবাইশের শ্যামলা রঙের মেয়ে এসে দাঁড়াল দোকানের সামনে। মুখটা ঢলঢলে, কিন্তু শরীর জুড়ে নিঃসহায় ভাব।

কী দুব গো মেয়ে? জানতে চেয়েছিল নিবারণ।

খুবই নিস্তেজ গলায় মেয়েটি বলে, আপনার সঙ্গে

একটু কথা ছিল।

নড়েচড়ে বসেছিল নিবারণ। কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চায়, কী কথা?

মেয়েটা দোকানের ভেতরে চলে আসে। বাবু হয়ে বসা নিবারণের পা দুটো খুঁজে প্রণাম করে, নাম বলে, আভা। পদবিটা বেজাতের। তারপর বিশাল ঢোঁক গিলে বলে, আপনার ছেলে মনসাতলায় গিয়ে আমাদের বাড়িতেই থাকে…

মেয়েটা বলে যাচ্ছিল, কথাগুলো যেন ঠোকরাচ্ছিল নিবারণকে। কান মাথা ঝিমঝিম করছে, গলা শুকিয়ে কাঠ, শরীরের নীচে যেন মাটি নেই। মেয়েটার অভিযোগ পরেশের বিরুদ্ধে, পরেশ তাকে বিয়ে করবে কথা দিয়ে যথেচ্ছ মেলামেশা করেছে। হঠাৎই পরেশ

যাওয়া বন্ধ করেছে মনসাতলায়। মেয়েটি এখন গর্ভবতী, পরেশের সন্তান বহন করছে। চোখের ওপর সরষেফুল নাচছে, নিবারণ নেমে এসেছিল টাট থেকে। আভাকে বলেছিল, তুমি দুকানেই বোসো, আমি পরেশকে লিয়ে আসছি।

তড়িঘড়ি বাড়ির দিকে যেতে যেতে নিজেরই হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল নিবারণের জমি, ব্যাবসা দেখতে গিয়ে সংসারের দিকটা অবহেলা করা হয়ে গেছে, সেই ফাঁকে একমাত্র ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়ে গোল্লায় পাঠিয়েছে রমলা। ছেলে যে প্রায়ই মনসাতলায় বন্ধুর বাড়ি যায় নিবারণ শুনেছে। হঠাৎ হঠাৎ এক-দু’রাত ছেলে গায়েব থাকে তাও জানে। এ প্রসঙ্গে রমলাকে বার কয়েক সতর্ক করেছে নিবারণ, ছেলেকে এবার থেকে দুকানে গিয়ে বসতে বলো, লেখাপড়া তো আর হল না। রাত-বিরেত নেই হেথায় হুথায় চরে বেড়াচ্ছে।

উত্তরে রমলা বলেছে, বয়স অল্প। ক’টা দিন ঘুরে লিক, তারপর তো সারাজেবন পড়েই রইল দুকান সামলানোর তরে।

তা হলে আমার কথা একবার ভাবো, ওর বয়সে কী পরিশ্রমটাই না করেছি। তবেই না আজ…

কথা কেড়ে নিয়ে রমলা বলেছিল, সেটাই তো লিয়ম। তুমি খেটেছ যাতি তুমার বংশধররা একটু আরামে থাকে। হচ্ছেও তাই। আমরা সুখে থাকলে তোমার কি ভাল লাগে না বলো?

রমলার কথার মধ্যে বরাবরই মিষ্টির ভাগ বেশি। সংসারের অবস্থা যত ফিরেছে, মিষ্টি ঘন হয়েছে। খুব একটা অন্যায্যও কিছু বলেনি রমলা, দারিদ্র্যের শেষসীমায় পৌঁছে গিয়েও নিজের বংশমর্যাদা ফিরিয়ে এনেছে নিবারণ। আজ সে নিজের এলাকার অঘোষিত প্রভু। আগেকার দিনে ভাল জমিদারের মতো। পঞ্চায়েতের টাকা ছাড়াও, নিজের টাকা দিয়ে এলাকার অনেক উন্নতি করেছে। রাস্তাঘাট অনেক ভাল। প্রত্যেক ঘরেই রোজগেরে লোক আছে। ডেকে ডেকে চাষের কাজ দিয়েছে নিবারণ। তার অঞ্চলেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র করে দিয়েছে পঞ্চায়েত। নিবারণের তত্ত্বাবধানে সেখানে ডাক্তার, ওষুধ সবসময় বহাল। আর কাজের বহর দেখে পঞ্চায়েতের অন্য ব্লকের মেম্বাররাও যথেষ্ট করিতকর্মা হয়েছে। নিবারণ শুনেছে তাদের এই কাজকর্মের কথা উদাহরণস্বরূপ বিধানসভায় আলোচনা হয়েছে কয়েকবার। তার পর থেকেই রাইটার্স বিল্ডিংটা একবার চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে হয়, ফুরসত পাওয়া যায়নি।

এত সফলতার মাঝে মেয়েটা যেন দুষ্টগ্রহের মতো দোকানে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাড়ি ফিরে নিবারণ দেখে, মা বড় যত্ন করে ছেলেকে খাওয়াচ্ছে। ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছিল পরেশকে। খাওয়ার সময় শত্রুকেও মারার বিধান নেই। তাই গলা খাঁকারি দিয়ে নিবারণ বলে, আভা এসেছে দুকানে। তুর খোঁজে।

কে আভা? বলে রমলা ঘুরে তাকাল। পরেশ কিন্তু খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছে। নিবারণ বলেছিল, তুমার বেটাকে জিজ্ঞেস করো আভা কে। তারপর বরণডালা সাজ্জে লিয়ে এসো ঘরের বউকে।

রমলা কিন্তু মোটেই ঘাবড়াল না। মুখ থমথমে আর কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল মাত্র।

নিবারণকে শান্ত হয়ে বিছানায় বসতে বলে, শুরু করল পরেশকে জেরা। কোনও কথাই অস্বীকার করল না পরেশ। বলল, মেয়ের দাদা ওর বন্ধু। সেই সূত্রে ওদের বাড়ি যাতায়াত। আভার দাদা কাজ পেয়ে চলে গেছে কলকাতায়, ফি শনিবার বাড়ি ফেরে, সোমবার চলে যায়। মাঝের দিনগুলো পরেশ মাঝে মধ্যে ও বাড়িতে কাটিয়েছে। আজ না হয় কাল পরেশ বাবা-মাকে বলত মেয়েটার কথা। তার আগেই আভা হাজির।

সব শুনে রমলা ঘুরে তাকায় নিবারণের দিকে। বলে, মাথায় ঢুকল কিছু?

নিবারণের চোখে ঘোর বিস্ময়। এতে বোঝার কী আছে, সেটাই বুঝতে পারছে না। রমলা বলে, হাঁদার মতো তাকিয়ে আছ যে। মাথায় এটুকু বুদ্ধি আসছেনি, কায়দা করে আমার ছেলের ঘাড়ে মেয়েটাকে চাপ্পেছে।

উত্তরে নিবারণ বলে, সে না হয় হল। কিন্তু এখন কী করবে, মেয়েটা যে তুমার গুণধরের সন্তান পেটে লিয়ে এয়েছে।

কে বুলল ওটা পরেশের বাচ্চা? ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল রমলা।

তার মানে! তোমার ছেলেই তো এক্ষুনি সব স্বীকার গেল। ও তো বুলছে না, পেটেরটা ওর লয়।

তুমার মতো ভালমানুষ বলেই বুলছে না। কার না কার জঞ্জাল আমার ছেলের নামে চাইলে দিলেই হল। সব ফন্দিবাজি, ফিকির বুঝেছ। বড়লোকের ছেলে পেয়ে ফাঁসানোর ধান্দা। কোথাকার বেজাতের মেয়ে এসে আমার ছেলের বউ হবে, তার হাতে জল খাব আমি…

বলেই যাচ্ছিল রমলা। নিবারণ বুঝতে পেরেছিল, ছেলেকে ঘিরে দেখা এতদিনের স্বপ্নগুলো গুঁড়িয়ে যেতে দেখে রমলা মাথার ঠিক রাখতে পারছে না। রাগ দেখিয়ে শোক ভোলার চেষ্টা করছে। খাট থেকে নেমে এসে নিবারণ বউকে সান্ত্বনার সুরে বলে, শোনো রমলা, ইখন ইসব কুথা বলার সময় লয়। মেয়েটা হাটের মাঝে এসে বসে আছে, কুথা পাঁচ কান হওয়ার আগে ঘরে তোলো। তেমন হয় ছেলেকে আমি আলাদা ঘর তুলে দুব পুকুরধারে। উয়ারা লা হয় উখানেই থাকবে।

পরেশ কোনও কথা বলছিল না। তার মানে সায় আছে। নিবারণ ঘর থেকে বেরোতে যাবে, চিৎকার করে উঠেছিল রমলা, খপরদার তুমি মেয়েটাকে এখানে আনবে লা। দুকান থেকেই বিদায় দাও। ও মেয়ে ই বাড়িতে এলে, তুমার ছেলের থেকেও তুমার খেতি হবে বেশি। লোকে তুমায় ছি ছি করবে। পঞ্চায়েতের মেম্বারই থাকতে পারবে না, প্রধান হওয়া তো দূরঅস্ত। দুকানে খরিদ্দার উঠবে না পর্যন্ত।

তখনই হুঁশ ফেরে নিবারণের। তড়িঘড়ির মাথায় এদিকটা সে ভাল করে ভেবেই দেখেনি! ভীষণ ঘাবড়ে যায় নিবারণ। তার এত কষ্ট করে গড়ে তোলা রাজ্যপাট তা হলে কি নিঃশেষ হতে চলল। অসহায়ভাবে বউয়ের বুদ্ধির কাছে আত্মসমর্পণ করে নিবারণ। জানতে চায়, করা যায় বলো দিকিনি? কী বুলব মেয়েটাকে গিয়ে? কী

পরেশকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে রমলা বলে, বুলবে ছেলে বাড়ি নেই। মামার বাড়ি গেছে। মেয়েটা যেন আর একদিন আসে। তেমন বুঝলে যাতায়াতের খরচা ছাড়াও, আরও কিছু টাকা দিবে।

সে তো বুঝলাম। মেয়েটা যখন ফিরতি বার আসবে কী বুলব?

নিবারণের প্রশ্নের পর রমলা হিসহিসিয়ে বলে, আর আসবেনি। তার আগেই তুমি ওদের

বাড়ি যাবে, বেশ কিছু টাকা দিয়ে ব্যাপারটা ধামাচাপ দেবে। ওদের ঘরে এরকম চলে। নিবারণ তখন যেন জলে ভেসে যাওয়া মানুষ। রমলার পরামর্শ কুটোর মতো আঁকড়ে দোকানে আসে। দেখে, আভা জল-মিষ্টি খাচ্ছে। কিনে খাচ্ছে নিশ্চয়ই। কর্মচারীরা বিনে পয়সায় দেবে না। মেয়েটা তার মানে অভুক্ত ছিল।

নিবারণকে দেখে লজ্জা পায় আভা। প্লেট সাইড করে আকুল প্রত্যাশায় তাকায়। যথাসম্ভব নির্বিকার মুখে রমলার কথাগুলোই নিজের কণ্ঠে বলে নিবারণ। ভর দুপুরে মেয়েটির মুখে ঘন ছায়া নেমে আসে। মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আপনার ছেলে না আসা অবদি আমি এখানেই বসে থাকব। বাড়িতে বলে এসেছি আর কোনওদিন ফিরব না।

নিবারণ বলে, তা কী করে হয়। একটু পরেই দুকানে খরিদ্দার লাগবে। সব চেনা লোকজন। তুমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখলে, জানতে চাইবে তুমি কে? মেয়েটা সেই সময় একটা বেটপকা কথা বলে বসে, সত্যিটাই বলবেন।

মেজাজ বশে রাখতে পারে না নিবারণ। এমনিতেই সে যাকে বলে দায় পড়ে আছে, সেটা সামলাতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে, বুললেই হল সত্যি! ছেলে যতক্ষণ না এসে বুলছে, ততক্ষণ কুনো প্রমাণ লাই। আমি যে তুমার সনে ভদ্রভাবে দুটো কথা বুলেছি, বসতে দিয়েছি দুকানে এই ঢের। এখন যাও তো বাপু।

কথাগুলো বলার সময় সম্ভবত নিবারণের মুখটা ভয়ানক হয়েছিল। মেয়েটি রা না কেটে, সুড়সুড় করে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু স্বস্তিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি নিবারণের। অঞ্চলটা নিবারণদের পার্টির হলেও কিছু বিরোধী পক্ষ তো থাকেই। তাদের পাঁচ-ছ’জন নিয়ে মেয়েটা আবার দোকানের সামনে ফিরে এল। বিরোধী পার্টির ছেলেগুলো জানতে চায়, কী ব্যাপার নিবারণদা মেয়েটা কী সব বলছে…

তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে। দোকানের সামনে ভিড় বাড়ছে। নিবারণের পার্টির ছেলেরাও চলে আসে। তারা অধিক। ওদের মধ্যে কে একজন বলে ওঠে, এ সব সমস্যার সমাধান দোকানে বসে হয় না। চলো পঞ্চায়েত অফিসে যাওয়া যাক। প্রস্তাবটা ঠিক কে তুলেছিল খেয়াল করেনি নিবারণ। জানলে ভরপেট মিষ্টি খাইয়ে দিত। এর থেকে ভাল প্রস্তাব আর হয় না। পঞ্চায়েতে যাওয়া মানেই কেস নিবারণের কোর্টে।

মিটিং বসল। প্রধান অধীর মাইতি পার্টির ছেলেদের নির্দেশ দিলেন পরেশকে ডেকে আনতে। ওই নির্দেশের মধ্যে লুকোনো ছিল আরও অনেক কথা। মেয়েটি রাজনীতির কিছুই বোঝে না। একঝুড়ি দুঃখের মতো সুবিচারের আশায় বসেছিল পঞ্চায়েতের ঘরে। ওর দিকে তাকিয়ে একবার অন্তত নিবারণের মনে হয়েছিল, ভালবাসার পাত্রীকে এই অবস্থায় বসে থাকতে দেখে পরেশ সব দোষ কবুল করে নেবে। যতই হোক পরেশ তো নিবারণেরই ছেলে, একটু নরম ধাত কি পায়নি!

দেখা গেল নিবারণের গোপন আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে পরেশ বলছে, মেয়েটাকে আমি চিনি, ওদের বাড়িও গেছি, ওর দাদা আমার বন্ধু। মেয়েটার সঙ্গে মোটেই কোনও ঘনিষ্ঠ

সম্পর্ক তৈরি হয়নি আমার। ওর পেটেরটার বাবাও আমি নই।

অনভ্যস্ত ভাষায় কথাগুলো বলছিল পরেশ। হবে না কেন, সবই পার্টির ছেলে আর রমলার শেখানো, ওরা পাখি পড়া পড়িয়েছে পরেশকে। আভা কাঁদছিল। বারবার বলছিল, আমরা খুব গরিব, নিজেদেরই ভাত জোটে না, বাচ্চাটাকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করব কী করে? আমি নিজের জন্য আসিনি, বাচ্চাটার কথা ভেবেই…

পার্টির ছেলেরা আভাকে কথা শেষ করতে দিল না, লুফে নিল গরিব শব্দটা। বলল, গরিব বলেই কিছু টাকার ধান্দায় এসেছ। কিছুদিন আগে কোতুলপুরেও এরকম একটা ঘটনা শোনা গেছে। বলো, কত টাকা দিলে তুমি কেটে পড়বে?

এরকম নানা বিদ্রুপ, ছল-চাতুরীর মাঝে কান্না মুছে উঠে দাঁড়াল মেয়ে। তারপর পায়ে পায়ে বেরিয়ে গেল অফিস ঘরের বাইরে। নিবারণের মনটা খানিকটা খাবলে নিয়ে গেল। সে মনের চোখ নেই, বোধ আছে। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো নিবারণ তাই নরেনের মাধ্যমেই মেয়েটার বৃত্তান্ত শোনে। নিবারণ ভেবেছিল মেয়েটা বুঝি বাড়ি ফিরে বাচ্চাটা নষ্ট করবে। করেনি। যত দিন গেছে উৎকণ্ঠা বেড়েছে নিবারণের। মন আনচান। আভার কাছে যেতে না পেরে, চলে গেছে নিজের বীজতলার সামনে। সেখানে শিশু ধানগাছ হাওয়ায় তিরতির করে মাথা নাড়ছে।

তল হারা মনে মাঝেসাঝে অনেক বিভ্রমও দেখা দিচ্ছিল। এই তো কিছুদিন আগে মাঝরাতে প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। রমলা তখন গভীর ঘুমে। বাজ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে বসে আছে নিবারণ। হঠাৎ দোরে ঠক ঠক শব্দ। কেউ যেন খুলতে বলছে। বারকয়েক শব্দটা শুনে নিয়ে রমলাকে ঠেলা দিয়ে ডেকেছিল নিবারণ। ঘুম জড়ানো গলায় রমলা বলে, এত রাতে কে আসবে! কুকুর, শেয়াল কিছু হবে। শোও তো এখন।

যুক্তিটা মনোমতো হয়নি নিবারণের। দরজা ধাক্কানোটা মানুষের মতোই। ঝড়-বৃষ্টির রাতে হয়তো আশ্রয় নিতে এসেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়েছিল নিবারণ। দোর খুলতেই দেখে, ভিজে সপসপে হয়ে ঘোমটা মাথায় আভা দাঁড়িয়ে। ভীষণ অবাক হয়ে চোখ কচলায় নিবারণ। ভ্রম কাটে। বারান্দায় সদ্য জমি থেকে আদায় হওয়া তিলের বস্তা। বৃষ্টির ছাঁটে বস্তা ভিজছে। ওগুলো ঘরে তুলতে তুলতে নিবারণের মনে হচ্ছিল, এ সব আসলে সম্পদ নয়, বোঝা।

পরের দিনই নরেনকে ধরেছিল নিবারণ, কী রে অনেকদিন ওদের কোনও খবর দিসনি, যাচ্ছিস নাকি?

যাব। আজ কাল করেই যাব, বলে নরেন প্রায় একমাস পর খবরটা নিয়ে এল। খানিকটা আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়লেও, কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নেয় নিবারণ। নরেন দুধ দিয়ে চলে যাওয়ার পর পরেশকে ডাকে। পরেশ এখন বাবা-মা’র বাধ্য ছেলে। নিয়মিত দোকানে এসে বসে। এক ধাক্কায় অনেকখানি বদলে গেছে পরেশ। রমলা ওর জন্য পাত্রী দেখছে। যদিও পরেশ বিয়েতে মোটেই আগ্রহী নয়।

পরেশ সামনে এসে দাঁড়াতে নিবারণ খবরটা দেয়। বলে, যাবি নাকি একবার? এখন হয়তো দেখ রাগ কমেছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে পরেশ বলে, তুমি যাও।

পরেশ যে এরকমটাই বলতে পারে, আন্দাজ করেছিল নিবারণ। মাস চারেক আগে বেশ কিছু টাকাপয়সা দিয়ে ছেলেকে ও-বাড়ি পাঠিয়েছিল। উদ্দেশ্য ওদের মুখ বন্ধ করা নয়, গর্ভধারিণীর ওষুধ, ভাল খাবার দাবারের জন্য দিয়েছিল টাকাটা। পরেশকে বাড়ির চৌহদ্দি মাড়াতে দেয়নি আভার দাদা। বলেছে, বুনকে যদি বাড়ি নিয়ে যেতে পারিস যা। টাকা দিয়ে মেয়ে পুষতে আসিস না।

তারপর থেকে আরও যেন ভ্যাবলা মেরে গেছে পরেশ। বাবার সম্পত্তি প্রতিপত্তিতে লাথি মেরে আভাকে নিয়ে আলাদা থাকবে, সে ক্ষমতাও নেই। অতঃপর নিবারণকেই যেতে হচ্ছে মনসাতলায়। কপালে কী আছে কে জানে! খবরটা শোনার পর দিন পাঁচেক দেরি হওয়ার কারণ, হারু স্যাকরার কাছে বাচ্চার জন্য এক জোড়া সোনার বালা গড়িয়েছে নিবারণ। সেটা এখন তার ট্যাঁক থলিতে। সঙ্গে কিছু টাকাও আছে। ট্রেন এখন অনেকটাই ফাঁকা। শিবাইচণ্ডী এসে গেল। আর তিনটে স্টেশন পরেই জৌগ্রাম। কামরার পিছনের দিকে বাউল গান ধরেছে, জল-তুলসী সেবায় তাঁর যত সুখোদয়/ষোড়শোপচার পূজায় তত সুখ নয়।…

বড় মিঠে গলা। সুরটাও ভারী সুন্দর। পকেট থেকে দুটো টাকা বার করে রাখে নিবারণ। গান শেষ করার পর বাউল আসে না। হয়তো পাশের কামরায় চলে গেছে। বদলে পিছন ঘষটে আসা ভিখারি আসে। তাকেই টাকাটা দিয়ে দেয় নিবারণ। তারপর আসে লাল চুলের কালো ঝুলো কিশোরী ভিখারি, তাকেও কিছু দেয়। মনটা আজ বড় বাঁধভাঙা হয়ে আছে। ওরা যদি অপমানও করে গায়ে লাগবে না। পাশের কম্পার্টমেন্ট থেকে ভেসে আসছে গান, মনো তুমি কৃষি কাজ জানো না, এমন মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা, মনো তুমি…

এর মাঝে আরও অনেক ভিখারি এল, রিকেট বালক, শিশু কোলে মা, নুয়ে পড়া বুড়ো, সবাইকে কিছু কিছু দিল নিবারণ। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল জৌগ্রাম।

সন্ধে লেগেছে অনেকক্ষণ। রাস্তায় ঝুঁঝকো অন্ধকার। মাটির রাস্তার একটু ধার ধরে হেঁটে যাচ্ছে নিবারণ। মনসাতলা কীভাবে যেতে হবে ভাল করে বুঝে নিয়েছে নরেনের থেকে। তবু মনে হচ্ছে কাউকে একটু জিজ্ঞেস করে নিলে হত, পরক্ষণেই একরাশ কুণ্ঠা নিবারণকে আড়ষ্ট করছে। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে হঠাৎ হঠাৎ বেজে উঠছে শাঁখ, নিবারণ ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছে নানা আশঙ্কায়।

একসময় রাস্তা গুলিয়ে গেল। একটা দোকানে গিয়ে আভার দাদার নাম করতেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল রাস্তা।

সেই পথ ধরে হেঁটে নিবারণ এখন আভাদের বাড়ির উঠোন। বাস্তু ঘিরে কোনও বেড়া দেওয়া নেই। কীরকম যেন খাঁ খাঁ ভাব। সামনের দুটো চালাঘরের দোর বন্ধ। তবে একটাতেও কেউ আছে নিশ্চয়ই। জানলা দরজার ফুটোফাটা দিয়ে বেরিয়ে আসছে লণ্ঠনের আলো।

খানিক অপেক্ষা করে নিবারণ ইতস্তত কণ্ঠে ডাক দেয়, কেউ আছে, ভেতরে?

দ্বিতীয়বার ডাকার আগেই দরজা খুলে যায়। দরজায় এসে দাঁড়ায় সম্ভবত আভা।

নিজেদের ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া ম্লান আলোয় চিনতে পারে নিবারণকে। শান্ত গলায় বলে, আসুন।

এদের একটাই ঘর। মা-মেয়ে থাকে। পাশের চালাঘরটায় থাকে ছেলে, যখন কলকাতা থেকে ফেরে। সে এখন নেই। একটু যেন স্বস্তি পায় নিবারণ। কিন্তু হলে কী হবে, মেয়ের মা সেই তখন থেকে বিনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা বলে যাচ্ছে। নিবারণকে বসতে দেওয়া হয়েছে বিছানায়। আভার মা দু’বার পা ধরে নিতে, নিবারণ এখন আসনপিঁড়ি অবস্থায়। মা বলে যাচ্ছে মেয়েটার আমার পোড়া কপাল, তাই এমন হল। গেরামে ঢি ঢি পড়ে গেছে, হাটবাজারে যেতি পারিনি। পেটের ছেলেও বলছে দূর করে দিবে। আপনি একবারটি মেয়েটার দিকে মুখ তুলে দেখুন…..

ইতিমধ্যে মাকে দু’বার মৃদু ধমকেছে আভা। বাচ্চাটাকে দেখতে চেয়েছিল নিবারণ। পাশের বাড়ির কেউ নাকি নিয়ে গেছে, দিয়ে যাবে এক্ষুনি। আভা এখনও পর্যন্ত কোনও অনুযোগ, অভিযোগ করেনি। ভ্রূ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করেছে নিবারণের আগমনের হেতু। একসময় সে জিজ্ঞেস করে, চা খাবেন তো? তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে যায় চা করতে।

আভার মায়ের নাকেকান্না ক্রমশ অসহ্য ঠেকছে, বাচ্চাটিকে দেখার লোভও সামলাতে পারছে না নিবারণ। সময় যেন থমকে আছে এই ঘরে।

চা নিয়ে এল আভা। নিবারণ কাপে চুমুক দিতে যাবে ঘরে ঢুকল একটি মেয়ে, কোলে বাচ্চা। এই কি সে? মেয়েটা নিবারণের উপস্থিতি সেভাবে খেয়াল করে না। হুড়োতাড়া করে বাচ্চাটাকে ফেরত দেয় আভার কাছে বলে, আর এই নে আভা তোর ছেলের রোজগার।

একগাদা খুচরো পয়সা আভার হাতে দেয় মেয়েটা। মুহূর্তের মধ্যে শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে যায় নিবারণের। চায়ের কাপটা কাঁপা হাতে বিছানায় রাখে। বাচ্চা কোলে এই মেয়েটিকেই ট্রেনে ভিক্ষে দিয়েছে নিবারণ।

নকল মা চলে গেছে। ছেলে কোলে আভা আসে নিবারণের সামনে। বাচ্চাটা ঈশ্বরের মতো নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে নিবারণের দিকে। আভাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। সে তো জানে না ট্রেনের ঘটনাটা। আর নকল মায়ের যাওয়া আসাটা এত অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছে আভা নিশ্চিত পরেশের বাবা কিছু টের পায়নি।

আভার কোল থেকে নিজের নাতিকে নেয় নিবারণ, চাষি যেভাবে ধানচারা তুলে আনে বীজতলা থেকে। তারপর বলে, বউমা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। রাতের দিকে ট্রেন বড়ো কম। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।

তথ্যকেন্দ্র শারদ সাহিত্য, ২০০৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *