বি-এন-ডব্লুর ব্রাঞ্চ লাইনে

বি-এন-ডব্লুর ব্রাঞ্চ লাইনে

সে মূর্তি লাখের মধ্যেও দৃষ্টি আকর্ষণ করিত; সুতরাং গাড়ির মধ্যে যখন তৃতীয় ব্যক্তি আর ছিলই না, তখন মূঢ়ভাবে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকা ভিন্ন আর উপায়ই ছিল না।

কালো- সে যেমন তেমন কালো নয়; তাহার উপর একটা সুপুষ্ট চৈতন্য— যেন গোড়াটি সযত্নে বাঁধানো হইয়াছে। এক কানে একটা কলম, অপর কানে পেন্সিল। রগের পাশ দুইটা হাল-ফ্যাশানে চামড়া ঘেঁষিয়া ছাঁটা! রেল-কোম্পানির মার্কা-মারা কালো কোট এবং সেই মেলের’ পেন্টালুন পরিয়া গাড়িতে প্রবেশ করিলেন এবং বসিয়াই চটের ব্যাগটা খুলিয়া ফেলিলেন।

তাঁহাকে যে লোক বিস্ময়নেত্রে দেখেই—এ জ্ঞানটুকু বোধ হয় স্বভাবসিদ্ধ হইয়া গিয়াছে। আমার দিকে এক রকম না চাহিয়াই বলিলেন, “এই যে দাঁড়ান একটু, বলি সব—”  

কোট এবং প্যান্ট খুলিলেন। কালো পাঁঠার যেন ছালটা ছাড়াইয়া ফেলা হইল। কোটের নীচে শ্রীশ্রীকালী ছাপ দেওয়া লাল নামাবলী ও প্যান্টের নীচে রক্তচেলি বাহির হইয়া পড়িল। পেন্টালুন এবং কোট তাল পাকাইয়া এক পাশে রাখিলেন। ব্যাগ হইতে একটা টকটকে জবাফুল বাহির করিয়া টিকিতে বাঁধিলেন; কপালে একটু জ্বলজ্বলে সিঁদুরবিন্দু পরিলেন, তাহার পর ব্যাগটার মধ্যে কোট আর জামাটা ঠাসিতে ঠাসিতে দাঁত-মুখ খিঁচাইয়া ব্যাগটাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘বটে! নেব না ভেতরে? ভটচাজ্জির চটের ব্যাগ আবার ইংরিজি কায়দামত মিতাহারী হয়েছেন—তোর ব্যাগের নিকুচি করেছে।”

ভয়েই হউক আর যে জন্যই হউক, স্ফীতদার ব্যাগটি কোট ও প্যান্টটিকে আশ্রয় দিল। এ অঘটন-ঘটনে আমায় বিস্ময়নেত্রে চাহিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, “খুব সোজা কথা—এ দেশেরই কারিগরেরা না মসলিন তৈয়ার করে গেছে, যার একটা থানকে থান একটা ঝিনুকের খোলে লুকিয়ে রাখা যেত! যাক সে দুঃখের কথা। চাবিটা ক’যে দিই এই, তারপর দিচ্ছি সব পরিচয়। কত দূরের পাল্লা?”

উত্তর দিতে যাইতেছিলাম, এমন সময় দরজার কাছে শব্দ হইল—”দণ্ডবৎ বড়হমচারী বাবা, সাহেবকে কেমন দেখলেন? বোড্ডো গোস্মায়ে—সোব জবাবদেহি আপনারই কন্ধা পর—”

“আরে, হীরে সিং যে! হ্যাঁ, একটা ইঞ্জিন একটু ডিরেল হয়ে গেছে, তার আবার জবাবদিহি! জল ক’রে দিয়ে এসেছি। এই দেখ, এ কানে কলম, এ কানে পেন্সিল। দেখেই বেটা হেসে জিজ্ঞাসা করলে, ‘এ কি বাবু?’ যেন আকাশ থেকে পড়লাম, দেখেছ, কাজের ভিড়ে কলম পেন্সিল কানে যেন কায়েমী বাসা বেঁধেছে একেবারে; আর হুজুরের তলব শুনে কি আর জ্ঞানগম্যি কিছু ছিল? লোকে বলে, সিংহের ডাক। এই তাতটুকু দিতেই মন গলতে আরম্ভ হ’ল বেটার। বললে, “না, কাজ কর আর না-কর অমন বেতর মাতাল হয়ে ইষ্টিশনে ঢুকো না বাবু, অনেকগুলো দোষ জ’মে উঠেছে তোমার, এই ফাইল দেখ।’

“ব্যাগের মধ্যে ছ বোতল সেরা বিলিতী মাল নিয়ে গিয়েছিলাম, একেবারে আনকোরা; টেবিলের ওপর সারবন্দী ক’রে বললাম, ও পাটই উঠিয়ে দিয়েছি হুজুর, ছটি বোতল ছিল, হুজুরের কাছে জরিমানা দিয়ে যাচ্ছি—এই নাকে হাত দিলাম, এই কানে হাত দিলাম।

“একেবারে জল, বললে, ‘এখনও রিপোর্টটা পাঠাই নি, দেখি ভেবে তা হ’লে। কিন্তু, দেখো, সাবধান।”

“ছ আষ্টে আটচল্লিশটি টাকা লম্বা হয়ে গেল—তা আর কি করব? বেটা একটু টানে টোনে ব’লেই এই ক’রে চালিয়ে যাচ্ছি; না হ’লে চাকরি কি আর থাকত হীরে সিং? ব্যাগের দিকে চাইছিস? তিনটে বোতল কিনে নিলাম তাড়াতাড়ি—আজ আরার দাসু খুড়োর ওখানে মায়ের পুজো—তুই বেটা যাবি নি?”

হীরা সিং দুঃখের হাসি হাসিয়া বলিল, “মাকে পরনাম হোই দেওতা; আজ ডিউটি পড়িয়ে গেসে; নইলে হামার তো ষোড়হো আনা খাঁইস ছিল।”

“এই দেখ বেটার মতিচ্ছন্ন; নাম শুনেও ডিউটির খেয়ালে গরহাজির হয়ে একটা কাণ্ড বাধাবে দেখছি! নে, উঠে আয়। না, না, আর অমত করিস নি হীরে সিং; ওইটুকু ব’লেই মাকে ঢের চটিয়েছিস—তোর আমার আবার ডিউটি কি র‍্যা? এই আমি কার ওপর সব ছেড়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছি? তাঁর ডিউটি তিনি বুঝে নেবেন, তুই উঠে আয়।”

হীরা সিং ইতস্তত করিতেছিল, এমন সময় গার্ড হুইস্‌ দিল। বড়হমচারী আমার দিকে না দেখিয়াই বলিলেন, “রগের চুল-ছাঁটা দেখছেন? ওটা সবারই চোখে ঠেকে। দাঁড়ান ও বেটাকে তুলি আগে, তারপর সব বলছি। ওটা সেজো আবাগীর আবদার : কিন্তু সব কথা না বললে বুঝতে পারবেন না। হীরে সিং, উঠে আয়, বাপধন, দাসু খুড়ো আজ মার রাজসূয় যজ্ঞ করাচ্ছে; ‘কারণে’ আজ ডুব-সাঁতার কাটতে হবে—নে, উঠে আয়।”

গাড়ি ছাড়িয়া দিল।

“ডিউটি ছিল, কাল সাহেব গর্দানা লিবে।”—বলিতে বলিতে হীরা সিং গাড়িতে উঠিয়া পড়িল। দেওতার পায়ে হাত দিয়া, হাতটা কপালে ঠেকাইয়া সামনে বসিয়া পড়িল।

“জিতা রও বেটা, সুবুদ্ধি হোক।” বলিয়া দেওতা ব্যাগ খুলিয়া একটি সদ্য-ক্রীত বোতল ও একটা গেলাস বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলেন—”নে, সিলটা খুলে ফেল্ দিকিন, একটু পেসাদ ক’রে দিই, তার পরে সাধ থাকে ডিউটির কথা ভাবিস, বেটা কুসন্তান কোথাকার! এরই নাম জমাদার হীরা সিং। এই তিনটি বোতল তিন চুমুকে সাবড়ে ওই ভৈরবী নদীর নেড়া পুলের ওপর দিয়ে গটগট ক’রে পার হয়ে যেতে পারে। জংশন ইষ্টিশনের হেড পয়েন্টস্ম্যান, এক কথায় ডিউটি ফেলে মার টানে উঠে এল।”— শেষের কথাগুলি আমায় বলিলেন। হীরা সিং সম্বন্ধে পূর্বে কৌতূহলের তেমন বিশেষ কোন কারণ না থাকিলেও পরিচয়ে উদ্রেক হইল বটে; এবং হীরা সিংয়ের মহত্ত্ব ও জংশন-স্টেশনের আসন্ন বিপদের কথা ভাবিয়া মনে মনে শিহরিয়া উঠিলাম।

দেওতার পীতাবশিষ্ট পেসাদটুকু নিঃশেষ করিয়া হীরা সিং গোঁফজোড়া মুছিয়া একটু পাকাইয়া লইল; মনে হইল, সে এইবার গাড়ি হইতে লাফ দেওয়া কিংবা নেড়া পুল পার হওয়ার অনুরূপ একটা দুরূহ কার্যের জন্য তৈয়ার হইতেছে; কিন্তু সে সব কিছুই না করিয়া হীরা সিং আস্তে আস্তে আবার টলিতে টলিতে আমার গায়ের উপর তাহার মাথাটা চাপিয়া ধরিল এবং একটু পরে হাউ হাউ করিয়া ক্রন্দন আরম্ভ করিয়া দিল।

ভাবিলাম এ তো ভ্যালা বিপদ, বেটা আধ ছটাক খাইয়াছে কিনা ঠিক নাই! একেবারে ভূত!

বড়হমচারী ওর দুনো টানিয়াও নির্বিকার; বুঝিলাম হাঁ, বড়র মুখেই ক্ষুদ্রের প্রশংসা মানায় বটে। বলিলেন, “ওর অনেক দুঃখ সব বলব’খন। আর একটু সবুর করুন না। আজ গার্ড ড্রাইভার কে র‍্যা বেটা? নে উঠে আয়।”

হীরা সিং আমার পা আরও জোর করিয়া ধরিল; জড়িত অশ্রুনিরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল, “গরিব হীরা সিং ছ্যুমা মাঙছে।”

রাগে একটা হেঁচকানি দিয়া পা ছাড়াইয়া লইলাম, বলিলাম, “আচ্ছা মাতালদের পাল্লায় পড়া গেল তো!”

দেওতা হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন; বলিলেন, “আরে না, না, ও চুমো চাইছে না, ওকে ক্ষমা করতে হবে; বেটারা ‘ক্ষ’-কে ‘ছ্য’ ব’লে সব মাটি করে যে—ভয় নেই— হাঃ হাঃ হাঃ। আয় বেটা উঠে আয়, জিবের আড়টা ভেঙে নে দিকিন—একটু হলে কেলেঙ্কারি বাধাতিস আর কি! ভাব্‌দিকিন, উনি যদি কোন বড়ঘরের লেডি হতেন! আচ্ছা আমিই ওর হয়ে অ্যাপলজি চাইছি!”—বলিয়া উঠিয়া আসিয়া করুণভাবে আমার হাতটা চাপিয়া ধরিয়া আবার স্বস্থানে গিয়া বসিলেন। দেখিলাম ক্রমে ক্রমে তাঁহারও অবস্থা সঙিন হইয়া আসিতেছে।

হীরা সিং আবার বজ্রমুষ্টিতে আমার পা ধরিয়া ছিল। আমি নিরুপায় হইয়া তাহাকে ভাল কথায় বলিলাম, “নে, তোকে করলাম ছামা—আর যেন টানিস-টুনিস নি—যা, গিয়ে ব’স দিকিন এখন।”

“এ জিন্দগিমে আবার সরাব? এই গুরুর শপথ খাচ্ছি, হীরা সিংয়ের শপথকে ওই দেওতা চিনেন, দেওতার জন্যে আমার ধন-মান-কুল।” আবার গলা ভারী হইয়া আসিল।

দেওতা ডাক পাড়িতেছিলেন, হীরা সিং আস্তে আস্তে গিয়া পায়ের কাছে বসিল, গেলাসটি হাতে লইল, তাহার পর আমার দিকে বাঁ হাতটা আড়াল করিয়া চুমুক লাগাইল।

“বড় পাজি জিনিস। অ্যাজ এ ফ্রেন্ড অ্যাডভাইস্ দিচ্ছি, কেউ মাথার দিব্যি দিলেও ধরবেন না। আমার কথা? একটু মেডিসিনডোজে চালাই কখনও কখনও, তাও কেন যে ধরেছি সব কথা বললেই বুঝতে পারবেন, একটু সবুর করুন না।”

একটু সবুর করিবার পর গাড়ি আসিয়া পরের স্টেশনে থামিল। দেওতা বলিলেন, “যা বেটা দেখ দিকিন—গার্ড আর ড্রাইভার কে!” হঠাৎ চোখ রাঙাইয়া উগ্রভাবে বলিলেন, “যেই হোক টিকি ধ’রে টেনে নিয়ে আসবি, বলবি, বড়হমচারী বাবার হুকুম, ইয়ারকি না, যা।”—বলিয়া পৃথিবীতে তাঁহার হুকুমগুলো ঠিকমত তামিল হইতেছে না, বোধ হয় এই রকম একটা ধারণা করিয়া লইয়া রাগতভাবে মুখটা গোঁজ করিয়া বসিয়া রহিলেন।

হীরা সিং ভক্তিভরে তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া টলিতে টলিতে নামিয়া গেল; প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া শেষ বিদায়ের মত হাতজোড় করিয়া বলিল, “গরিবকে অসমরণ রাখবেন বাবা।”

দেওতা অবিচলিতভাবে বসিয়া রহিলেন, হীরা সিং চলিয়া গেলে আবার সহজ ভাব ধারণ করিয়া আমাকে বলিলেন, “সার্থক নাম বেটার, একখানি হীরের টুকরো!” তাহার পর যুক্তকর কপালে ঠেকাইয়া বলিলেন, “জংশনের পয়েন্টগুলো সামলে দিস্ মা, দশমহাবিদ্যারূপিণী; নয়তো দুর্নাম নিবি বেটী”-

চুপ করিয়া হীরার হীরাত্ব এবং মার আজ দশমহাবিদ্যার কোন্ রূপটি লইয়া পয়েন্টগুলির নিকট আবির্ভাব হইবে ভাবিতেছিলাম, এমনসময় হীরা সিং একটা মুসলমান ড্রাইভার ও একজন ফিরিঙ্গী গার্ডকে সঙ্গে করিয়া হাজির হইল। তাহারা আসিয়া হীরা সিংয়েরই মত বলিল, “দণ্ডবৎ বড়হমচারী বাবা।”

বাবা রক্ত চক্ষু এবং কম্পিত হস্ত তুলিয়া নীরবে আশীর্বাদ করিলেন, তাহার পর বোতলটা এবং গেলাসটা বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন, “তোর ইঞ্জিন চলছে না যে আলিজান, নে, একটু স্টিম ক’রে নে।—কে, পিটার গার্ড সাহেব? নাও, একটু চড়িয়ে নাও, ঘাট স্টেশন পৌঁছুতে যার নাম রাত দুটো। আজ দাসু খুড়ো মার পুজো করছে—নেমন্তন্ন রইল। ঘণ্টা দু’ত্তিন লাগবে; সেকেন্ড ক্লাসে কোন প্যাসেঞ্জার আছে নাকি?”

পিটার সাহেব গেলাস হাতে করিয়া তাচ্ছিল্যভরে ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত করিয়া বলিল, “ইয়েস, কোঠিয়াল সাহেব সিকিন কিলাসমে হ্যায়। আরে, হ্যায় তো হ্যায়; ওয়েসা সাহেবকো পিটার গার্ড ‘সাহেব’ নেহি কহতা—কভি ওসব ওলায়েৎ দেখা হ্যায়? হামারা গ্র্যান্ডফাদার—”

বড়হমচারী পিটারের মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া জড়িত কণ্ঠে বলিলেন, “ওর গ্র্যান্ডফাদার প্রকাণ্ড জাহাজের ফায়ারম্যান ছিল—কতবার যে বিলেতে যাওয়া-আসা করেছিল, তার হিসেব নেই; পিটার তো এদেশী সাহেবগুলোকে সাহেবই বলে না।” তারপর একটু হাসিলেন—বোধ হয় এহেন কুলীন পিটারের সাহচর্যগৌরবে।

পিটার সাহেব গেলাসে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে দিতে এদেশী সমস্ত সাহেবদিগের উপর অবজ্ঞা ও ক্রোধের নিদর্শনস্বরূপ গেলাসের আড়াল হইতে আমার পানে ঘন ঘন উগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল।

আলিজানের মুখ-চোখে রঙ ধরিয়া আসিতেছিল, দৃপ্তভাবে বলিল, “কেয়া, হাম্‌ভি সাদাচামড়াসে থোড়াই ডর করি। হাম দো ঘণ্টা, চার ঘণ্টা, দশ ঘণ্টা দেরি করেগা, খুশি হামারা! বোলাও সিকিন কিলাসকা সাহেবকো। কালীমাইকা সামনে আঙ্গরেজ?”

বড়হমচারী বাবা আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “করিম বক্স ডাকাত ওরই ঠাকুরদাদার বাবা ছিল কিনা;—ভয়ানক কালীভক্ত, পুজো ক’রে বেরুলে তাকে রাখে কে! কত কুঠিয়ালের মাথা নিয়েছিল, তার কি ঠিকানা আছে? সব একে একে বলছি, একটু সবুর করুন না, অত উতলা হ’লে চলবে কেন মশাই?”

আলিজান হঠাৎ বিরক্তভাবে পিটারের হাত হইতে গেলাসটি ছিনাইয়া লইয়া বোতল হইতে চাপাচাপি এক গেলাস ঢালিয়া লইল, তাহার পর এক নিঃশ্বাসে সেটা শেষ করিয়া বিনাবাক্যব্যয়ে গটগট করিয়া নামিয়া গেল। পিটার অবিচলিতভাবে শূন্য গেলাসটা পূর্ণ করিতে লাগিল। আলিজানের ভাব দেখিয়া বোধ হইল, তাহার ঘাড়ে হঠাৎ তাহার কুঠিয়াল- বিধ্বংসী পূর্ব-পুরুষের ভূত চাপিয়াছে। জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া সশঙ্কিতভাবে সেকেন্ডক্লাসে একটা হৈ-চৈয়ের প্রতীক্ষা করিতেছি, এমন সময় একটা প্রচণ্ড রকম ঝাঁকানি দিয়া গাড়িটা একেবারে ভৈরববেগে ছুটিতে আরম্ভ করিয়া দিল। মনে হইল, ড্রাইভারের ছোঁয়াচ লাগিয়া এঞ্জিনটাও যেন এক মুহূর্তে মাতাল হইয়া উঠিয়াছে।

পিটার সাহেব পকেট হইতে হুইল্টা বাহির করিল; সেইখানে বসিয়াই খুব জোরে ফুঁ দিয়া পকেটে রাখিয়া দিয়া বলিল, “হম আঙ্গরেজকা বাচ্চা, ডিউটি নেহি ভুল সাকতা।”

বড়হমচারী বাবা আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আলিজান একবার রাগলে কারও রক্ষে নেই।”

আমি গাড়ির মত্ত বেগ লক্ষ্য করিয়া বলিলাম, “রক্ষের তো উপায় দেখছি না ঠিক; তবে হঠাৎ রাগল কেন, তা তো বুঝতে পারি না। আপনারা মশায় এতগুলো লোকের প্রাণ নেবেন নাকি? আমি তো পরের স্টেশনে গিয়েই ডি.টি. এস-কে তার করছি।”

দেওতা ঈষৎ হাস্য করিয়া জড়িত কণ্ঠে বলিলেন, “অনেক সময় পাবেন; আমাদের ওখানে দু-চার ঘণ্টার বেশি লাগবে; তারবাবুর বাড়িতেই আজ মা অবতীর্ণা হবেন কিনা।”

হতাশ হইয়া চুপ করিয়া রহিলাম।

হীরা সিং নেশায় আচ্ছন্ন হইয়া অসাড়ভাবে পড়িয়া ছিল।

বড়হমচারী বাবা বোতলটা উপুড় করিয়া গলায় ঢালিয়া দিয়া বিষণ্ণ বদনে পিটারের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “পিটার গার্ড, কখনও তিনটে শাদি করিস নি বাপ, ধনেপ্রাণে মারা যাবি—চারটে কর্, আটটা কর্, তারা জোড়া বেঁধে নিজেদের মধ্যে ঝোটাঝুটি ক’রে মরবে। তুই দিব্যি ‘জিতু জিতু মোর মামা’ করবি; কিন্তু যদি একটি বেজোড় ছেড়ে রাখ, সেটি তোমার ঘাড়ে চাপবে। আমার সেজো আবাগীর কথাই ধর না ভাই; বড়য় মেজোয় হরদম মাথা ফাটাফাটি করছে—বেশ শান্তিতে থাকতাম; কিন্তু সেজো আবাগীকে এনেই-

গার্ড সাহেব আমার দিকে দেখাইয়া বলিল, “ই বাবু পিতে নেহি হ্যায়? দেওতা, দিয়া ইনকো?”

“নাঃ, উনি এদিকে নেই। কেত্তা কিসিমকা আজব আদমি জগদম্বা বানিয়েছে রে দাদা, দুনিয়াটা চিড়িয়াখানা। কি যে বলছিলাম, হ্যাঁ তিনটে শাদি ক’রো না পিটার সাহেব— জেরবার হবে। দশটা কর, বারোটা কর, ষোলটা কর বাধা দোব না; বেজোড়ের দিকে যেও না, পাঁচটা নয়, সাতটা নয়, একুশটা নয়—নাও বোতলটা খোল।”

পিটার সাহেব বোতলটা হাতে লইয়া বিমর্ষভাবে বলিল, “হামারি আওরাৎ আকেলিহি একেইশ হ্যায়। কাল দোঠো ওসাজিব বাত বোলনে গিয়া। ইয়ে দেখো নতিজা।” দেখাইয়া দিল।

“ও বাব্বা, তোকেই উল্টে মার দেয়! মেয়েমানুষের দাঁত-নড়ানো ঘুষি!”

“অওর কোই আধা সের লেহু নাকসে নিকলা।”

“ইংরেজ বউকে ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার বাবা, বেশ আছি। আমার কোনও আবাগী গায়ে হাত তোলে নি কখনও। ডাইভোর্স ক’রে দিস না কেন মাগীকে? তোদের জাত বুঝে যীশু তো সে ব্যবস্থা ক’রে গেছে।”

“বোলতি হ্যায়, ডাইভোর্স করনেসে খুন করেগি।”

“না করলেও বা কোন্ বাকি রাখছিস বাপু? এক কাজ কর্, আমি হদিস বাতলে দিচ্ছি—দেখবি, এমন দজ্জাল মাগ তো—একেবারে কেঁচো হয়ে গেছে। তিন-তিনটে বাঘিনী নিয়ে ঘর করছি যে দাদা, ওসব ঢের দেখা আছে। সেজো আবাগী অভিমান ক’রে বললে, ‘একটু ভাল ক’র ফিটফাট হয়ে থাকতে পার না? বুঝলাম, কথাটা যৌবনের রস; তার পরদিনই নাপতে ডাকিয়ে দুই কানের ওপরটার চামড়া বের করে ছোকরা বাবু হয়ে পড়া গেল। আর কিছু আবদার নেই, সব মিটে গেছে—এখন দেখলে নাক সিঁটকোয়। যে যেমন তার সঙ্গে সেই রকম চালাও। বড় আবাগী বললে, তোমার হাতে প’ড়ে পাপে তাপে তো জীবনটা দগ্ধে গেল, আর কেন? একটু তীর্থ-টির্থ করিয়ে আন না, এটুকুও হবে না? বললাম, সে কি কথা! হবে বইকি। এলাহাবাদ ত্রিবেণীর ঘাটে—ও-ও ডুব দিতে নামল, আমিও বগলে বোতল বাগিয়ে উঠলাম, সাত দিন দুজনের দেখা নেই—দু-মাস কথা কয় নি—আজ পর্যন্ত তীর্থের নাম করে না। একটু সবুর কর্ না, তোকে আমি এসা এক মতলব বাতলে দিচ্ছি—”

“আচ্ছা, একঠো খাসি চড়হানেসে তুমলোগোঁকী কালীজী কুছ বন্দোবস্ত কর্ সকতী?”

“খুব খুব; আরে, কালী আর তোদের যীশুর মা মেরী তো খুড়তুতো জাঠতুতো বোন ছিল—যার নাম ‘চাচেরা বহিন’—বুঝা? তোরা কি আর মার পর?”

এমন সময় দুই-তিন বার ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং শব্দ করিয়া গাড়িটা হঠাৎ থামিয়া গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে—’বড়মহচারী বাবা, ও বড়হমচারী বাবা, ‘দাদা দাদা’ ‘ও খুড়ো কোন্ গাড়িতে হে?’ ইত্যাকার কতকগুলা অসংলগ্ন আওয়াজে স্টেশন প্ল্যাটফর্মটা সরগরম হইয়া উঠিল। বি-এন ডব্লুর ট্রেন—বলাই বাহুল্য যে, কোনও গাড়িতে আলো ছিল না। শেষ পর্যন্ত দেওতার আওয়াজ ও পিটার গার্ডের হুইস্ লক্ষ্য করিয়া যখন উভয় পক্ষের মিলন হইল, তখনকার সেই পৈশাচিক উল্লাস ও চিৎকার মসীজীবী নিরীহ কলমের মুখে প্রকাশ করা যায় না।

দাসু খুড়োকে দেখিলাম। রাজসূয় যজ্ঞ করিবার মত লোক বটে—লিকলিকে, খর্ব; মদে যদি ভারি হইয়া অমন গড়াইয়া গড়াইয়া না পড়িত তো হাওয়ায় উড়িবারই কথা। যতক্ষণ দেখিলাম ডান হাতে ঘঁষি বাগানোই ছিল। বলিল, “দাদা, ব্যাটা ডেনফোর্ড তোমায় ডেকে পাঠিয়েছিল সামান্য একটু ডিরেলের জন্যে? আমি দেখে নোব সম্বন্ধীকে—এই একটি ঘুঁষি। আলিজান, পিটার গার্ড, ব্যাক কর গাড়ি—চল জংশনে—দেখেগা ক্যায়সা সাহেব হ্যায়—দেসো শালা বেঁচে, আর তোমার কাছে এক্সপ্ল্যানেশন চাইলে দাদা? আমাদের লর্ড বিশপের অপমান!

আলিজানের নেশাটা একটু ফুরাইয়া আসিয়াছিল। সেই জন্যই হোক আর যে কারণেই হোক, সে ব্যাক করিতে নারাজ হইল; তখন দাসু খুড়া নিজের শক্তি ও শৌর্যের অভিব্যক্তি সম্বন্ধে এদিকে নিরাশ হইয়া, মৃতপ্রায় হীরা সিংয়ের শরীরটা কাঁধে ফেলিয়া একলা বাসায় লইয়া যাইবার জন্য জিদ ধরিয়া বসিল। এ ব্যাপারের কিরূপ মীমাংসা হইত বলা যায় না, তবে এই নারকীয় গোলমালে এবং তাহার শরীরটা লইয়া টানাটানি করাতে হীরা সিংয়ের তন্দ্রা একটু ভাঙিয়া যাওয়ায় সে ‘ছ্যুমা’র জন্য আমার পা জড়াইয়া ধরিয়া হতাশভাবে কাঁদিতে লাগিল। এই সঙ্কল্প জানাইল যে, আমি চ্যুমা না করিলে বাঙালি তো কোন্ ছার, স্বয়ং হুমানজী আসিলেও তাহাকে নড়াইতে পারিবে না।

আমি প্রায় বিশ-পঁচিশ বার স্বীকার করিলে যখন তাহার আর মোটে সন্দেহ রহিল না, সে সবাইকে ঠেলিয়া-ঠুলিয়া আপনিই টলিতে টলিতে নামিয়া গেল।

বড়হমচারী বাবা, হীরা সিং, আলিজান আর ও-পক্ষের সবাই হৈ-হৈ করিতে করিতে, টলিতে টলিতে, পড়িতে পড়িতে দাসু খুড়ার বাসার দিকে চলিল। বলিলাম, “গার্ড সাহেব, মিঞা সাহেব, আমার কাল সকালের মধ্যে ঘাট স্টেশন পৌঁছানো চাই—গবর্মেন্টের কাজ—”

দাসু খুড়া টলিতে টলিতে ঠেলিয়া আসিয়া তাহার হাড্ডিসার ঘুঁষি আমার নাকের সামনে বাঁকাইয়া ধরিয়া বলিল, “একটি ঘুষিতে, গবর্মেন্টের বত্রিশ পাটি দাঁত খসিয়ে দোব। তাদের জরুরি কাজ তারা বুঝবে—আমার রিলিজিয়াস টলারেশনে হাত দেবার কে হ্যা?”

বড়হমচারী বাবা ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া—স্রোতের ধারের বেতগাছের মত দুলিতে দুলিতে বলিলেন, “আমারও তো ভোরের স্টীমারে ওপারের স্টেশন-মাস্টার রামদয়ালের বাড়িতে যেতে হবে—বড় ঘটা ক’রে রাধামাধবজীর পিতিষ্ঠে করবে কিনা; আপনার এই দাসানুদাসের ওপর সব ভার। ওপর থেকে আর ইস্তক জংশন পর্যন্ত সব ব্যাপারে বাবা এই কালী বেহ্মচারী। ডালে আছি, ঝোলে আছি, অম্বলে আছি। ঘাবড়ান কেন? একটু সবুর ক’রে ব’সে থাকুন——দেখবেন, আপনার এ গোলামের গোলামকে না হ’লে কারুর এক পা এগুবার জো নেই—শাক্ত হোক, বোষ্টম হোক, শৈব হোক, কেরেস্তান হোক—”

পিটার হঠাৎ তাঁহার হাতটা ধরিয়া একটা টান দিল, ঘৃণার সহিত বলিল, “আরে চলো, কভি শরাব নেহি পিতা, ওই তুমহারা কদর কেয়া বুঝেগা?”

বড়হমচারী তাঁহার অর্ধনিমীলিত চক্ষুপল্লব যেন হঠাৎ চাড়া দিয়া তুলিয়া আমার দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া শাপ দেওয়ার ভঙ্গীতে বলিয়া উঠিলেন, “আমার ‘কারণ’কে অপমান করেছিস—মনে থাকে যেন।”

র‍্যাপারটা টানিয়া লইলাম। মুড়িসুড়ি দিয়া রাত্রের মত বেঞ্চের উপর শুইয়া বি-এন- ডব্লুর মহিমার এই নূতন স্বরূপটির কথা ভাবিতে লাগিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *