গৌড়ানন্দ কবি ভনে

বি আর মোহান্ত সংরক্ষণের প্রস্তাব

বি আর মোহান্ত সংরক্ষণের প্রস্তাব

বালুরঘাটের বি আর মোহান্তগণ যাতে অবলুপ্ত হয়ে না যায়, তার জন্য পঁয়তাল্লিশ একর জমি নিয়ে এক অভয়ারণ্য সৃষ্টির প্রকল্প তৈরি করার চেষ্টা শুরু হয়েছে।

বি আর মোহান্ত সংরক্ষণ সমিতির সেক্রেটারি আমাকে জানান, ‘সরকার সুন্দরবনে বাঘ প্রকল্প এবং লবণ হ্রদে সাপ সংরক্ষণের জন্য বিলম্বে হলেও যে প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, তা দেখে আমি আশান্বিত হয়েছি। আমার ধারণা বালুরঘাটের বি আর মোহান্তদের ‘সংরক্ষণের জন্যও অনুরূপ এক প্রকল্প গ্রহণ করার সময় এখন এসেছে। দেরি হলে বি আর মোহান্তদের আর রক্ষা করা যাবে না।’

বি আর মোহান্ত সংরক্ষণ সমিতির সেকরেটারি জানালেন, তিনি তাঁর সমিতির পক্ষ থেকে এই প্রয়োজনীয় বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন।

‘তাতে আমি বলেছি যে বি আর মোহান্তদের উপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’

‘বি আর মোহান্তদের উপর খুব চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলছে বুঝি?’

চলছে না। ওই উৎপাতেই তো এরা প্রায় লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে। এক প্রজন্ম আগেও আমরা বি আর মোহান্তদের এই বালুরঘাটের যত্রতত্র নির্ভয়ে বিচরণ করতে দেখেছি তা জানেন আর বেশি কথা কী এক মাস আগেও আমি একদিনে অন্তত সাতটি বি আর মোহান্তর দেখা পেয়েছি এই বালুরঘাটেই। নদীর বাঁধে কোর্ট পাড়ায় কলেজের ওই ধরটার বেশি বয়েসী কম বয়েসী সব রকম বি আর মোহান্তেরই সাক্ষাৎ পেয়েছি। আজ চলুন বালুরঘাটে একটি বি আর মোহান্তের দেখা যদি পান তো সে আপনার ভাগ্য।’

‘বলেন কী। তা বি আর মোহান্তদের সংখ্যা হঠাৎ এত কমে গেল কেন?

‘আবার কেন? চোরা শিকারীদের কীর্তি। ওদের হামলায় অতিষ্ঠ হয়ে বি আর মোহান্তরা হয় পালিয়েছে নয় ধরা পড়ে ফৌত হয়েছে।’

‘তবে যে শুনতাম বালুরঘাটে নাকি একটা পাড়াই আছে মোহান্তদের। সেখানে অনেক মোহান্ত বাস করে?’

‘ঠিকই শুনেছেন। মোহান্ত পাড়ায় অনেক ধরনের মোহান্তের বাস। সব মোহান্তই যে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তা তো বলিনি। যদি ইংরাজি অক্ষর অনুসরণ করেন তো দেখবেন, এ বি মোহান্ত কি এ সি মোহান্ত কি এ ডি মোহান্ত এমনকি বি বি মোহান্ত থেকে শুরু করে বি কিউ মোহান্ত পর্যন্ত আবার বি এস মোহান্ত থেকে শুরু করে একেবারে সেই জেড জেড মোহান্ত পর্যন্ত সবাই সুখে আছে। মোহান্তরা অ্যাজ এ হোল অবলুপ্ত হচ্ছে না। কেন না তাদের কেউ ডিসটার্ব করছে না। মুশকিল শুধু ওই একটা প্রজাতিকে নিয়ে। চোরাশিকারীদের টার্গেট শুধু ঐ বি আর মোহান্ত ‘

‘এও তো বড় তাজ্জব। এত মোহান্ত থাকতে বেছে বেছে শুধু বি আর মোহান্তদের উপরেই বা এত আক্রমণ হচ্ছে কেন? ওরা কি খুব সুস্বাদু? ফরেন মার্কেটে চালান যাচ্ছে না কি?’

‘আরে না না। বি আর মোহান্তদের নিয়ে আমি সম্ভবত একমাত্র আমিই খুব গভীর স্টাডি করেছি। স্বাদুতায় বি আর মোহান্তদের সঙ্গে যে অন্যন্য মোহান্তদের কোনও হেরফের আছে এমন কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমি পাইনি। বিদেশীরাও যে বেছে বেছে কেবলমাত্র বি আর মোহান্তদের জন্যই বায়না পাঠাচ্ছেন এখন প্রমাণও নেই।

তবু আপনি বলছেন, বি আর মোহান্তদের উপর এমন আক্রমণ চলছে যে ওরা একেবারে লুপ্ত হবার মুখে এসে পড়েছে?’

‘আরে মশাই শুধু আমি বলব কেন? খবরের কাগজের রিপোর্টার কী বলছেন শুনুন। প্রত্যক্ষদর্শী সেই রিপোর্টার জানাচ্ছেন : বি আর মোহান্ত নামে যাকে পাচ্ছে তাকেই নিয়ে যাচ্ছে। কী সাংঘাতিক অবস্থা হয়ে উঠেছে বুঝতে পারছেন। অবিলম্বে এই ভ্যানডালিজম যদি বন্ধ করতে না পারা যায় তবে ইকোলজিতে সাংঘাতিক বিপর্যয় দেখা দেবে, তা জানেন?’

‘এতক্ষণে গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে পারলাম। সত্যিই তো এই সর্বনাশ বন্ধ করতে না পারলে বি আর মোহান্তরা দ্রুত এই পৃথিবী থেকে লোপাট হয়ে যাবে। এখন করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন।’

‘অবিলম্বে এক গণ আবেদনে অন্তত দুই লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে দাবী করতে হবে লুপ্তপ্রায় বি আর মোহান্তদের উপর পাইকারি আক্রমণ এখনই বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তারপর বালুরঘাটে পঁয়তাল্লিশ একর জমি সংগ্রহ করে বি আর মোহান্তরা যাতে নির্ভয়ে বসবাস করতে পারে তদুপযোগী এক স্যাংচুয়ারি অর্থাৎ অভয়ারণ্য নির্মাণ করা হোক। প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় অন্যান্য স্থানের বি আর মোহান্তদেরও এখানে এনে রাখবার বন্দোবস্ত করা হোক। তারপর বি আর মোহান্তদের সম্পর্কে সব প্রচলিত ধারণা আছে সেগুলো নিরসনকল্পে ফিলম প্রবন্ধ রেডিও ভাষণ প্রভৃতির মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষা পাবলিককে দেওয়া হোক। ‘বি আর মোহান্ত— প্রকৃতির সব থেকে নিরীহ প্রাণী এই নামে এক তথ্যচিত্র তোলবার জন্য শ্রীসত্যজিৎ রায়কে নিয়োগ করা হোক।’

‘বি আর মোহান্তরা কি সত্যিই নিরীহ? আমাকে জনৈক মন্ত্রী বলেছিলেন বি আর মোহান্তের চাইতে হিংস্র আর কিছু তিনি দেখেন নি।’

‘একেবারে ভুল ধারণা। এবং বি আর মোহান্তদের বর্তমান দুর্দশার মূলে যদি এই ধারণা কাল করে থাকে, তাহলে আমি অন্তত আশ্চর্য হব না। অথচ জানেন টেপির কি জেব্রা কি জিরাফ এবং যতটা নিরীহ, বি আর মোহান্তরা তার চাইতেও নিরীহ। অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং লাজুক শ্রেণীর প্রাণী।’

‘কিন্তু আপনি যাই বলুন, আমরা সকলেই জানি যে একবার একটা বি আর মোহান্ত আমাদের এক মান্যবর মন্ত্রী মহোদয়কে অতর্কিতে আক্রমণ করেছিল। মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যুৎপন্নমতিতে তিনি সে-যাত্রা রক্ষা পান। ভদ্রলোকের নার্ভাস ব্রেকডাউন হবার মতো অবস্থা হয়েছিল। এমন দৃষ্টান্ত অস্বীকার করি কী করে, বলুন?’

তবে এমন হতে পারে যে উক্ত মন্ত্রী মহোদয় কোনও বিশেষ এক বি আর মোহান্তের লেজে পা দিয়েছিলেন অথবা সে খুবই ক্ষুধার্ত হয়েছিল কিংবা সে বার্ধক্যে এমন অশক্ত হয়ে পড়েছিল যে অন্য উপায়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির কোনও সুযোগ নেই দেখে এই রকম স্বভাব-বিরুদ্ধ কাজ করে ফেলেছে। তবে টেক ইট ফ্রম মি একজন প্রাণী বিজ্ঞানী হিসাবে আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিয়ে ওই কথা বলতে পারি যে, বি আর মোহান্তরা স্বভাবত মন্ত্রী খাদক নয়।’

আচ্ছা এটা কি ঠিক যে বি আর মোহান্তদের মাথার ঘামে কেউ যদি তার বুকের রোঁয়া এক নিঃশ্বাসে উপড়ে নিয়ে তিনদিন ভিজিয়ে রাখে তারপর সেই ভিজে রোঁয়ার তাবিজ পরলে তার গায়ে নাকি তদন্ত কমিশনের কুদৃষ্টি লাগে না?’

‘নিছক কুসংস্কার অথচ দেখুন এইসব কুসংস্কারের জন্য কত প্রাণীর বারোটা বেজে যাচ্ছে। গন্ডারের শিং সম্পর্কেও তো এই ধরনের কত আজগুবি কাহিনী প্রচলিত আছে। আমার কাছেও খবর এসেছে যে কোন প্রভাবশালী মহল থেকে বি আর মোহান্তদের মাথার ঘাম সংগ্রহ করার জন্য সরকারি অফিসারদের উপর হুকুম জারী করা হয়েছে। একমাত্র বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচারের মাধ্যমেই এই ধরনের কুসংস্কার দূর করা যায়। কী বলেন?

‘তা ছাড়া আর দ্বিতীয় উপায় তো দেখিনে।’

১৭ জুলাই ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *