বিহিত – সমরেশ বসু
নিঝুম দুপুরে স্তব্ধতাকে আচমকা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে, সেই ভয়ংকর জান্তব শব্দটা পাড়ার ভিতর দিয়ে নিমেষে বেরিয়ে গেল। পাড়ার দু’ পাশের বাড়িগুলোর দেওয়াল কেঁপে উঠল। ঠকঠকিয়ে ঝনঝনিয়ে উঠল দরজা জানালা। কোথা থেকে ভেসে এলো একটি শিশুর আর্ত চিৎকার। কোনও বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার হঠাৎ ঘুম ভাঙা চাপা গোঙানির শব্দও কি শোনা গেল? শান্ত পাড়াটা মুহূর্তেই যেন অশান্ত হয়ে উঠল, দরজা জানালা খোলার শব্দ। একটা কুকুর হঠাৎ ভয় পেয়ে ডেকে উঠেই চুপ করে গেল।
চৈত্রের দুপুর। আমি লিখছিলুম। এখন আমি দু কামরার এই ফ্ল্যাটটিতে একা আছি। এ সময়ে দরজা জানালা বন্ধ রাখি। পাখা খুলে দিয়ে, কাজে ডুবে থাকি। আমার কাজের ছেলে, অনন্ত এ সময়ে আমার আবাসগৃহে খেতে যায়। এখন বেলা আড়াইটে। অনন্ত আসবে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে বিকেল তিনটেয়। এসে মাকে চা দেবে।
আজ নিয়ে তিন চার দিন ধরে ঠিক এ সময়ে, এ ঘটনা ঘটছে। আমার এই ফ্ল্যাট তিন তলায়। পুব-দক্ষিণে দুটি ব্যালকনি আছে। আমার উল্টো দিকের চারতলা বাড়িটির, চারতলায় থাকেন সীতেশ সেন, বিশিষ্ট আইনজীবী। দোতলায় থাকেন তাঁর ছোট ভাই ডাক্তার বীরেন সেন। একজন চিকিৎসক এবং সমাজসেবী। পাড়ায় এঁরা ছাড়াও দু একটি পরিবারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় আছে। সকলেই সজ্জন প্রতিবেশী। পাড়াটি যাকে বলা যায় কসমোপলিটান, সেইরকম। খ্রিস্টান, পারসি, মুসলমান, হিন্দু, সবরকমের অধিবাসীই আছেন। অবিশ্যি হিন্দুই বেশি। বাঙালি অবাঙালি মিলিয়ে।
গতকাল সকালে ডাক্তার বীরেশ সেন আমাকে চেক আপ করতে এসেছিলেন। আমার হৃদযন্ত্রটি কিছু বিকল হওয়ায়, ডঃ সেন অনুগ্রহ করে আমাকে মাঝে মাঝে চেক আপ করেন। গতকাল তিনি যখন এসেছিলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? কে এই মোটরবাইক আরোহী-চালক, যে সাইলেনসিয়ার পাইপের পুরোটাই খুলে দিল। রোজ দুপুরে ওরকম বীভৎস শব্দ করে এ পাড়া দিয়েই বিশেষ করে কয়েকবার চক্কর দেয়?
‘আর বলবেন না।’ ডঃ সেন গম্ভীর বিষণ্ণ স্বরে বলেছিলেন, ‘শব্দটা বীভৎসের চেয়েও আরও ভয়ংকর কিছু। আমার শরীরও তো তেমন ভালো নয়। রোজ দুপুরে ওই সময় আমি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করি। আর এই ক’দিন ধরে ওই শব্দে হঠাৎ যে কেবল ঘুমের চটকা ভেঙে যায়, তা নয়। ওই শব্দে মনে হয়, হার্টবিটস বন্ধ হয়ে যাবে। আমার শিশু নাতিটি যে-ঘরে থাকে, সে-ঘরের দরজা জানালা খুব ভালো করে বন্ধ করা সত্ত্বেও, শব্দটা যেন দেয়াল ফুঁড়ে ভেতরে ঢোকে, আর নাতিটি ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। আমি বুঝি, পাড়ার শিশু, বৃদ্ধ আর অসুস্থদের এই শব্দের ধাক্কা সামলাতে কী অসহ্য কষ্ট হয়। কিন্তু কী করবেন বলুন। এই সব জীবদের আপনি কী করে দমাবেন?
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন, জীবটি কি এতই ক্ষমতাশালী, তাকে দমানো যাবে না? অন্তত তাকে অনুরোধ করা যেতে পারে, সে যেন তার মোটরবাইকের সাইলেনসিয়ার পাইপটি পুরোটা জুড়ে দেয়।’
‘তাই যদি দেবে তা হলে ওর মজাটাই মাঠে মারা যাবে।’ ডঃ সেন হতাশ হেসে মাথা নেড়েছিলেন।
আমি ব্যাপারটা কিছু না বুঝে, ডঃ সেনের মুখের দিকে অবাক জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিলুম। তিনি খোলা দরজা দিয়ে একবার বাইরের দিকে দেখেছিলেন। বলেছিলেন, এ পাড়ার চৌত্রিশ নম্বর বাড়ির—মানে, আমি সরখেলদের বাড়ির কথা বলছি। সরখেলদের বাড়ির এক মেয়েকে নাকি ও প্রেম নিবেদন করেছিল। কিন্তু মেয়েটি একটু ভিন্ন ধাতুর। কোননারকম সাড়া তো দেয়নি বটেই, বরং সরাসরি নাকচ করে দিয়ে নাকি ওকে জানিয়ে দিয়েছে, প্রেম ব্যাপারটা কিছু বাজারের বেচা-কেনার জিনিস নয়। ইচ্ছে করলেই দর দেওয়ার মতো, প্রেম নিবেদন করা যায় না। হঠাৎ কী হল? কিসের প্রেম নিবেদন? কথাবার্তা পরিচয় থাক বা না থাক, প্রেম নিবেদন করলেই হল? মেয়েটির কাছ থেকে ওরকম জবাব পাবার পরেও নাকি ও আরও চেষ্টা করেছিল। কিছুতেই যখন ওর আশা ফলল না, তখন থেকেই এই ভর দুপুরের ওই শুয়োর ডাকা চিৎকারের অভিযান শুরু হয়েছে। এটা হল, প্রতিশোধ নেবার শুরু। তারপরে কোন দিকে ব্যাপারটা মোড় নেবে, কেউ বলতে পারে না।’
‘ও বা ওর বলতে আপনি কাকে বোঝাতে চাইছেন? এই মোটরবাইকের চালককে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘কিন্তু ওর কী অধিকার আছে, একটি অপরিচিত মেয়েকে প্রেম নিবেদন। করবে?’
‘অপরিচিত নয়। মেয়েটিকে ও চেনে। কিন্তু পরিচয় বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না।’
ওটাকে অপরিচিতই বলে।’
‘তা বলে। কিন্তু ও যে জানে, ও যখন মেয়েটিকে চেয়েছে, তখন ওকে পেতেই হবে।’ ডঃ সেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ হেসেছিলেন।
আমি ডঃ সেনের চোখের দিকে তাকিয়েছিলুম। তাঁর কথার অন্তর্নিহিত অর্থটি যে ধরতে পারিনি, তা না। তবু আমি জিজ্ঞেস করেছিলুম, ‘একটা প্রবাদ আছে, খুটির জোরে মাড় নড়ে। ওর খুঁটিটা কী? কোথায়?’
‘ওর খুঁটি দু জায়গায়।’ ডঃ সেনের মুখ ও চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠেছিল। এবং কণ্ঠস্বরও, ‘লোকাল থানা আর বাজনৈতিক দল।’
ওইরকম কিছু শোনার আশঙ্কা আমার ছিল।
‘ও কে? কোথায় থাকে?’ আমি আবার জিজ্ঞেস করেছিলুম।
ডাঃ সেন বলেছিলেন, ‘এ পাড়ারই কাছে-পিঠের ভট্টাচার্য বাড়ির ছেলে। মোটামুটি লেখাপড়াও এক সময়ে শিখেছে। দেখছিলুম, কিছুদিন এক রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছে। তারপরে তো দেখছি, ওর হাত রক্তে মাখামাখি। ও এ এলাকার মুকুটহীন রাজা এখন।’
মনে মনে বলেছিলুম, সত্যি, কঠিন সমস্যা। কী এর সমাধান? ওই জাতীয় জীব বর্তমানে সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে। আর ওরা জানে, ওদের সবরকমের অধিকার আছে। ওরা যা চাইবে, তা ওদের পেতেই হবে। অতএব, মধ্য কলকাতার, শান্তিপ্রিয় অধিবাসীদের একটি পাড়ার সমস্ত লোককে কষ্ট দেবার অধিকার ওর আছে। এটা হচ্ছে ওদের এক ধরনের নিজের শক্তি-পরীক্ষা। শুধু সরখেলদের নয়, গোটা পাড়ার বাসিন্দাদের ও জানিয়ে দিতে চায়, ওর শিকারের দিকে ও হাত বাড়াচ্ছে। কারোর যদি বাধা দেবার ক্ষমতা থাকে, থানায় গিয়ে পাড়ার শান্তি রক্ষা করতে চায়, তারা সেই চেষ্টা করতে পারে। ডঃ সেন ঠিকই বলেছেন, প্রতিশোধ নেবার এটা হল শুরু যখন দেখবে, পাড়াটাকে ও ওর বিভীষিকার দ্বারা কব্জা করতে পেরেছে, তখন সকলের চোখের ওপর দিয়েই ও শিকার মুখে করে নিয়ে যাবে।
ডঃ সেন বিদায় নেবার আগে অন্যমনস্ক স্বরে বলেছিলেন, ‘জানিনে এর কী বিহিত হতে পারে।’
দরজা জানালা বন্ধ। লেখার টেবিলে, লেখা থামিয়ে যখন এইসব ভাবছি, তখন মোটর বাইকের সেই দেওয়াল কাঁপানো, কানের পর্দা ফাটানো, জান্তব শব্দটা দ্বিতীয় বারের পরিক্রমায় এগিয়ে আসছে। আমি কলমটা রেখে, পুবের দরজাটা খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালুম। ও দক্ষিণ থেকে ঝড়ের বেগে মোটরবাইক চালিয়ে এগিয়ে আসছে। ওর দৃষ্টি সামনে। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, ‘বুলেট’ নামে সাড়ে তিন অশ্বশক্তির দ্বিচক্রযানটির আরোহীর পরনে জিনস। গায়ে বোতাম খোলা একটা পাঞ্জাবি। গলায় চিকচিক করছে সোনার চেনা বাঁ হাতের কবজিতে ঘড়ি। ডান হাতে একটা স্টেনলেস স্টিলের বা রুপোর মোটা চেন। চুল উড়ছে। দেখলেই বোঝা যায়, দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যবান। মুখ-চোখও খারাপ না। মাথায় হেলমেট না রাখার আইনভঙ্গটার কোনো মূল্যই নেই ওর কাছে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
ও আমার কাছাকাছি হতেই, গলার স্বর যতটা সম্ভব চড়িয়ে ডাকলুম, ‘এই যে, শুনছেন?’
ও আমার কথার মধ্যেই বেশ খানিকটা এগিয়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু দুর থেকেই পেছন ফিরে একবার আমাকে তাকিয়ে দেখল। দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। আদৌ কোনও পাত্তাই দিল না। সেই জান্তব শব্দ তুলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। আমি ঘোর দুপুরের নির্জন খাঁ খাঁ রাস্তাটার দিকে দেখলুম। আশেপাশের কয়েকটি বাড়ির খোলা জানালায় দু চারটি মহিলা-পুরুষের মুখ। দোতলায়, পাশের খোলা জানালায় ডঃ সেনও দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক জিজ্ঞাসু চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্যান্যদের চোখও আমার দিকেই ছিল।
ও সাধারণত তিন থেকে চারবার এই রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। গত তিন চার দিনের অভিজ্ঞতা থেকে এটাই বোঝা গিয়েছে। আমি মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হতেই, দক্ষিণ থেকে বীভৎস জান্তব শব্দটা আবার এগিয়ে আসতে লাগল। আমি ধৈর্য হারালুম। দেখলুম ও দ্রুত, ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। আমি টেবিল থেকে জল ভরা গেলাসটা তুলে নিলুম। ব্যালকনিতে গেলুম। ও আমাকে পেরিয়ে যাবার আগেই, আমি গেলাসের জল ছুঁড়ে দিলুম। অব্যর্থভাবে জলটা ওর গায়ে-মাথায় পড়ল। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বেশ খানিকটা এগিয়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু ও দাঁড়াল। পিছন ফিরে দেখল না। আগে গায়ে মাথায় হাত দিয়ে দেখে নিল। তারপর মোটর বাইক ঘুরিয়ে আবার ব্যালকনিব নীচে এসে দাঁড়াল। মোটর বাইকের এঞ্জিন বন্ধ করল। চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। দুটি জ্বলন্ত বাঘের চোখ। আর বাঘের চাপা গর্জনের মতোই ‘শোনাল, আপনি আমার গায়ে জল দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ,’ আমি ঘাড় ঝাঁকালুম।
‘কেন?’
‘নইলে যে আপনি শুনতে পেতেন না।’
‘তাই জল ছুড়লেন গায়ে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী বলতে চান আপনি?’
‘আপনাকে একটা অনুরোধ করছি। আপনি দয়া করে আপনার মোটর বাইকের সাইলেনসিয়ার পাইপটা ঠিক করে নিন। শব্দটা বড় যন্ত্রণাদায়ক।’
‘সেইজন্য জল ছুড়লেন?’
‘হ্যাঁ।’
তিনতলা থেকে স্পষ্টই দেখলুম, ওর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে রাখা হাতের মুঠো দুটো মুঠি পাকিয়ে উঠছে। দু চোখ হিংস্র জ্বলন্ত দেখাচ্ছে। গলার স্বরের চাপা গর্জন শোনা গেল, ‘একবার নীচে নেমে আসবেন?’
‘আপনি বরং আমার ঘরে আসুন।’ আমি ডাকলুম।
ও কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে অপলক জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘আসছি।’ বলে মোটরবাইকের এঞ্জিন চালু করে, সেই জান্তব শব্দে গোটা পাড়া কাঁপিয়ে, দক্ষিণে চলে গেল।
আমি দেখলুম অনন্ত আসছে। তার মানে তিনটে বাজল। ঘরে ঢোকার আগে দেখি, ডঃ সেন ছাড়াও আশেপাশের বেশ কয়েকটা বাড়ির দরজা জানালায় কিছু মুখ উঁকি দিচ্ছে। তাঁদের সকলের চোখই আমার ওপর। কারোর মুখে বিস্ময়। কারোর মুখে উদ্বেগের ছায়া। আমি ডঃ সেনের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ঘরের মধ্যে ঢুকলুম। দরজাটা বন্ধ করে দিলুম।
আমার মধ্যেও কি অস্বস্তি বা উদ্বেগ একটুও ছিল না? ছিল বই কি। কিন্তু কোনো কোনো সময় আমি যে নিরুপায় বোধ করি। এটা যেন একটা অনিবার্য দায়বদ্ধতার মুখোমুখি আমাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। অনন্ত কলিং বেল টেপার আগেই আমি ভিতরের বারান্দায় গিয়ে বাইরের দরজা খুলে দিলুম। অনন্ত কলিং বেল-এ হাত দিতে যাচ্ছিল। আমি ডাকলুম, ‘আয়।’
অনন্ত ভিতরে ঢুকল। আমি পাশের ঘরে ঢুকলুম। অনন্ত দরজা বন্ধ করে পাশের ঘরে এলো। দেখছি ওর চোখে-মুখে উদ্বেগ ও উত্তেজনা, ‘আপনি কি এই ছেলেটাকে কিছু বলেছেন নাকি?’
‘হ্যাঁ। আমি ওর গায়ে জল ছিটিয়ে দিয়েছিলুম।’ বলে আমি কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে, একটা চাবির গোছা বের করলুম।।
অনন্ত উৎকণ্ঠিত স্বরে বলে উঠল, ‘সর্বনাশ! ওর গায়ে জল ছিটিয়ে দিয়েছেন? ও আপনাকে কী বলে গেল?’
‘ও আমাকে নীচে ডাকছিল।’ আমি আলমারির ভিতরে একটা চোরা খোপের চাবির মুখে চাবি গলিয়ে, খোপের ঢাকনা খুললুম। ‘আমি ওকে আমার ঘরে আসতে বললুম।’
অনন্তর গলার স্বর রুদ্ধ, উদ্বিগ্ন, ‘ও কী বললে?’
‘ও আসছে।’ আমি খোপের মধ্যে হাত ঢোকালুম।
অনন্ত আমার দিকে দু পা এগিয়ে এলো। ওর গলার স্বর উদ্বেগ-ব্যাকুল, ‘বাবা, আপনি এখনই ও বাড়ি ফিরে যান। একটা সর্বনাশ ঘটে যাবে। ও আসবার আগেই আপনি বাড়ি চলে যান।’
‘অনন্ত, আর তা হয় না। আমি সিক্স রাউন্ডারটা খোপ থেকে বের করলুম। কেউটে সাপের মতোই আগ্নেয়াস্ত্রটি চকচক করছে। আনলক করে খুলে দেখলুন। ছটি গুলি ভরা আছে। দু সপ্তাহ আগেও এটা পরিষ্কার করেছি। অনন্তর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে চোখ তুলে তাকালুম। ‘ও যখন আসছে বলে গেল, এখন আর আমি ঘর ছেড়ে যেতে পারিনে। কারণ আমি ওকে আসতে বলেছি।’
আমি আলমারির ভিতরে চাবির গোছা রেখে, পাল্লা বন্ধ কবলুম। অনন্ত আর্ত স্বরে বলল, ‘বাবা আমার পা কাঁপছে। আমি এ দরজা খুলে দেব না।’
‘তুই না দিলে আমাকেই দরজা খুলে দিতে হবে।’ আমি একটা চেয়ার তুলে, ঘরের এক কোণে নিয়ে গেলুম, ‘তোকে আমি বলছি, ভয় পাসনে। ভয় জিনিসটা ময়ালের মতো। কেবলই পাকে পাকে জড়ায়। জ্যান্তে মরা করে দেয়। তোকে ও কিছু বলবে না। তুই কেবল দরজা খুলে দিবি।’
আমি চেয়ারে বসতে না বসতেই সেই বীভৎস শব্দ দক্ষিণ থেকে ভেসে এল। অনন্ত ছুটে আমার লেখার ঘরে চলে গেল। পুব দিকের ব্যালকনির দরজা খোলার শব্দ পেলুম। অনন্ত ব্যালকনিতে যাচ্ছে। মোটরবাইকের জান্তব শব্দটা আমার তিনতলার নীচে এসে দাঁড়াল। জানি, সিঁড়ি ওঠার নীচের দরজা খোলা আছে। অনন্ত দৌড়ে এলো পাশের ঘরে। ওর কালো মুখ ফ্যাকাশে। দু চোখে আতঙ্ক। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘বাবা, ডাক্তারবাবু, আরও অনেক লোক দরজা জানালা খুলে দাঁড়িয়ে দেখছেন।’
‘দেখতে দে।’ আমি ডান হাতে রিভলভারটি নিয়ে, দরজার দিকে মুখ করে বসলুম।
‘দেখতে দে।’ আমি ডান হাতে রিভলভারটি নিয়ে, দরজার দিকে মুখ করে বসলুম।
অনন্ত আবার বোধ হয় লেখার ঘরে চলে গেল। মোটরবাইকের শব্দ থেমেছে। ও বোধ হয় এখন সিঁড়ি ভাঙছে। সমস্ত পাড়াটায় এখন নিঝুম দুপুরের সেই স্তব্ধতা নেমে এসেছে। কিন্তু সেই স্তব্ধতাও যেন গভীর উৎকণ্ঠায় কান পেতে আছে। কলিং বেল বাজল টুং টাং শব্দটা শোনাল যেন দুটো গুলির শব্দের মতো।
বাইরের দরজা খোলার শব্দ হল। এক সেকেন্ড। ও দরজার ভিতরে পা দিতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। জ্বলন্ত চোখে আমার ডান হাতের দিকে দেখল। ওর মুখে যেন বিদ্যুৎ ঝিলিক হেনে গেল। বাজ ডাকার মতো ওর গলার স্বর শোনা গেল, ‘ও! তৈরি হয়ে বসে আছেন দেখছি।’
‘হ্যাঁ, আপনাকে রিসিভ করার জন্য।’ আমি ওর চোখে স্থির চোখ রেখে উঠে দাঁড়ালুম, ‘কোমরের কাছ থেকে হাত সরান। আর বলুন, কেন আমাকে নীচে ডাকছিলেন?
ও নিজেও আমার চোখে চোখ রেখে, কোমরের কাছ থেকে হাত সরাল। একটু হাসল, ‘এখন তো আর বলা যাবে না, কেন আপনাকে ডেকেছিলাম। পরে এক সময়ে বলব।’ ও ওর তীক্ষ্ণ চোখ নামিয়ে আমার সিক্স রাউন্ডারের দিকে দেখল। চোখে এক ঝলকের জন্য সন্দেহ ফুটল। কেটেও গেল মুহূর্তেই। ওর নীচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল।
বোঝা যাচ্ছে, পারলে ও আমাকে ছিঁড়ে খায়। এবং সম্ভবত ওর জীবনে আমাদের মতো শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোকদের কাছে এরকম অভ্যর্থনা এই প্রথম কপালে জুটলো। ও সামান্য মাথা ঝাঁকাল। ‘আচ্ছা, আজ চলি। আবার দেখা হবে।’
‘আসবেন। আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললুম,’ ‘আর যদি আমার অনুরোধটা রাখেন, খুশি হব।’
ওর ভুরু কুঁচকে উঠল, ‘কোন অনুরোধ?’
‘মোটরবাইকের সাইলেনসিয়ার পাইপটা ঠিক করে লাগিয়ে নেবেন।’
ওর চোয়াল নড়া দেখে মনে হল, দাঁতে দাঁত ঘষছে, ‘নইলে কি আবার জল ছুড়বেন?’
‘ছুড়তে পারি!’
‘আমিও তৈরি থাকব।’ ও পিছন ফিরতে উদ্যত হল, ‘তবে আমি নিজের মর্জিতে চলি, কারোর অনুরোধের ধার ধারি না।’
‘পেছন ফেরার সময় হাত দুটো মাথার ওপরে তুলবেন।’ আমি এগিয়ে গেলুম।
ও পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে একবার দেখল। তারপর দু হাত মাথার ওপর তুলে বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজার পাশে অনন্ত দাঁড়িয়েছিল। ওর দু চোখে ঘৃণা আর ভয়। আমি অটোমেটিক লক দরজার পাল্লাটা ঠেলে দিলুম। লেখার ঘরে গিয়ে, অস্ত্রটি টেবিলের ওপর রেখে বাইরের ব্যালকনিতে গেলুম। ও ইতিমধ্যেই নীচে নেমে গিয়েছে। চেপে বসেছে মোটরবাইকের সিটে। আমি অবাক হয়ে দেখলউম, আশেপাশের অন্তত দশটা বাড়ির খোলা জানালায়, ব্যালকনিতে, গলিতে, দোতলা, তেতলা, চারতলায় মহিলা-পুরুষরা ভিড় করে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের সকলের দৃষ্টি এখন আমার দিক থেকে সরে নীচে ওর দিকে পড়েছে। ও রাস্তার দু ধারের বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপরে আর উত্তরে না গিয়ে দক্ষিণে ফিরে গেল। তখন আবার সবাই আমার দিকে তাকালেন। ডঃ, সেন, তাঁর স্ত্রী, পুত্রবধূ, সবাই আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। চোখাচোখি হতে হাসলেন।
আমি ফিরে গিয়ে লেখার টেবিলে বসলুম। অস্ত্রটা কী বিশ্রী বেমানান দেখাচ্ছে লেখার টেবিলে। ওটার সেফটি ক্যাচ লক করে টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দিলুম। কলম তুলে নিলেও, তখনই কাজে মনোনিবেশ করতে পারলুম না। ওর গায়ে জল দেওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত ঘটনাটা আদ্যোপান্ত একবার ভেবে নিলুন। অস্বীকার করার উপায় নেই, বেশ খানিকক্ষণ সময় একটা টেনশানে কেটেছে। এখানো তার ভাইব্রেশন রয়েছে। ভেবেই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হল, আমার বাসগৃহে যাবার সময় অস্ত্রটি নিয়েই আমাকে নীচে নামতে হবে। অবিশ্যি গাড়িতে ওঠার সময় দূর থেকে বোমা ছোড়াটা খুব একটা অসম্ভব ব্যাপার নাও হতে পারে। আমাকে সাবধানে থাকতেই হবে। আর আজ আমার স্ত্রীর উদ্বেগ শুরু হবে
টেলিফোনটা বেজে উঠল। অনন্ত পাশের ঘর থেকে লাইন ধরল। অবাক হব না, যদি আমার স্ত্রী ও বাড়ি থেকে টেলিফোন করে থাকে। কিন্তু অনন্ত এসে বলল, ‘ডাক্তারবাবু আপনাকে টেলিফোনে ডাকছেন।’
আমি টেবিলের বাঁ দিকে রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলুম। ‘বলুন ডঃ সেন, আমি বলছি।
‘আমি সমস্ত ঘটনাটা এখনই থানার ও সি-কে জানিয়ে দিলুম।’ ডঃ সেনের স্বরে উদ্বেগ ও উত্তেজনা স্পষ্ট, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’
হেসে বললুম, ‘ঠিক আছি। আমি জানতুম, ও প্রস্তুত হয়ে আসবে। আমিও প্রস্তুত ছিলুম।’
‘ও. সি, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার রিভলভারটির লাইসেন্স আছে কি না।’ ডঃ সেনের স্বরে ঝাঁজ ফুটল, ‘আমি বললুম, কার সম্পর্কে কী বলছেন? উনি বেআইনি অস্ত্র রাখবেন, এরকম কথা আপনি ভাবলেন কী করে? তারপরে অবিশ্যি ক্ষমা চাইলেন। বললেন, আমাদের পাড়ায় পুলিশ পিকেট বসাবেন।’
আমি হেসে বললুম, ‘থানাও তো ওর একটা খুঁটি। পুলিশ পিকেটে কি ওর ঔদ্ধত্য, অসভ্যতা বন্ধ করা যাবে? দেখুন কী হয়?’
‘ঘটনা যা ঘটল, আপনি একটু সাবধানে থাকবেন।’ ডঃ সেনের স্বরে অকৃত্রিম অনুরোধ।
আমি বললুম, ‘তা থাকব।’
রিসিভার নামিয়ে রাখলুম। অনন্ত ধূমায়িত চায়ের কাপ টেবিলে রাখল। বলল, ‘বাবা, আমার কিন্তু খুব ভয় লাগছে।’
‘ভয় করলে তো সব সময় চলে না। আমি কলম নামিয়ে রাখলুম, ‘তুই যেন বাড়ি গিয়ে আবার মাকে এত বড় করে লাগাসনি। যা বলবার তা আমিই বলব।’
অনন্ত এতক্ষণে একটু হাসল, ‘বাবা, মোটরসাইকেলের পেছনে ওর দলের একজননা, আমি আর মাকে কী বলব। ওকে ভয় পায় না, এ এলাকায় এমন লোক একজনও নেই। ওর দলের কয়েকজনকে আমি চিনি।’
আমি মাথা ঝাঁকালুম। কিছু না বলে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাজে মন দেবার চেষ্টা করলুম। কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল করিনি। মোটরবাইকের সেই জান্তব শব্দটা দক্ষিণ দিক থেকে আবার এগিয়ে আসতে লাগল। আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়লুম। এখন পাড়ার রাস্তায় কিছু ছেলে খেলা করছে। শব্দটা ঘরবাড়ি রাস্তা কাঁপিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। অনন্ত পুরো ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে ঢুকল। ওর ফ্যাকাসে মুখে ও চোখে উদ্বেগ, ‘বাবা’, মোটরসাইকেলের পেছনে ওর দলের একজন বসেছিল। ও তাকে হাত দিয়ে আমাদের তেতলার দিকে দেখাল।’
‘দেখাক।’ আমি বাঁ হাতের কবজির ঘড়ি দেখলুম। সাড়ে চারটে বাজে। আরও ঘন্টাখানেক কাজ করতেই হবে। নইলে সামলাতে পারব না।
পরের দিন!
আজ রবিবার। চাকরিতে ছুটি মেলে। নিজের পেশায় দুটি মেলে না। অতএব অন্যান্য দিনের মতো, আজও আমি কাজে বসেছি। গতকাল সন্ধ্যায় আমি নির্বিঘ্নেই বাড়ি ফিরে গিয়েছিলুম। এবং যা ভেবেছিলুম তাই হয়েছে। আমার স্ত্রী উদ্বেগে গত রাত্রে ঘুমোতে পারেননি। আমার আশ্বস্ত করার চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি চেয়েছেন, এখন থেকে দুপুরে তিনি এ ফ্ল্যাটে চলে আসবেন। অনেক বলে কয়ে ওঁকে নিবৃত্ত করেছি। তবে দুপুর থেকেই টেলিফোন শুরু হবে, এটা বুঝেছি।
অনন্ত বেলা একটায় আমাকে দুপুরের খাবার খাইয়ে চলে গিয়েছে। আমি কাজ করছিলাম। হঠাৎ এক সময়ে রবিবারের ক্লান্ত ঘুমন্ত নিঝুম দুপুরকে কাঁপিয়ে দিয়ে মোটরবাইকের সেই জান্তব বীভৎস শব্দ দরজা জানালা খটখটিয়ে দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। আমার কাজ থেমে গেল। প্রথম পরিক্রমা। ও তা হলে কথা রাখেনি। বরং সাইলেনসিয়ার পাইপের যেটুকু অবশিষ্ট রেখেছিল, সেটুকুও খুলে দিয়েছে। সেই শিশুর ভয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠা কান্নার শব্দ। ভয় পাওয়া কুকুরটার ডেকে উঠেই চুপ করে যাওয়া।
কী করা যায়? এ অন্যায় ঔদ্ধত্যের কী জবাব আছে? সকালে আসবার সময় দেখেছি, দক্ষিণের মোড়ে, ফুটপাথে দু’জন সশস্ত্র সেপাই টুলে বসে আছে। পুলিশ পিকেট। কিন্তু ওকে কে থামাবে? আর আমি রোজ একটা লোকের গায়ে জল ছিটিয়ে দিতে পারি? অসম্ভব। গতকাল ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জল ছুড়েছিলুম। রোজ রোজ আমি তা পারি না। মানায়ও না।
আমার চিন্তার মধ্যেই আবার শব্দটা ধেয়ে এল। যেন একটা ক্ষ্যাপা জানোয়ার প্রচণ্ড গর্জনে অন্ধ মত্ত হয়ে ছুটে চলেছে। ওর শিকার চাই। আব নিশ্চয়ই ও ঠোঁট বাঁকিয়ে আমার ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে। কিন্তু আমি ওর হাতের ক্রীড়নক হতে পারি না। ও আমাকে উসকে দেবার হাজার চেষ্টা করলেও না। অথচ এ ঔদ্ধত্য সহ্য করাও কঠিন। পুলিশ পিকেট কেন বসানো হয়েছে, কে জানে।
দ্বিতীয় পরিক্রমার পর, জন্তুর সেই বীভৎস জান্তব চিৎকার পাড়া কাঁপিয়ে তৃতীয় পরিক্রমায় ঝড়ের বেগে এগিয়ে এল। আসতে আসতে হঠাৎ আমার ফ্ল্যাট ছাড়িয়েই যেন শব্দটা থেমে গেল। তার মানে ও মোটরবাইকের এঞ্জিন বন্ধ করেছে? ও দাঁড়িয়ে পড়েছে? পুলিশ তা হলে ওকে বাধা দিয়েছে?
ব্যাপারটা কী দেখার জন্য আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলুম। পুবের ব্যালকনির দরজা খুলে বাইরে গেলুম। আমার চোখের সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! আমার সামনে এবং উত্তর-দক্ষিণে যতগুলি বাড়ি আছে, সব বাড়ির সব তলায়, ব্যালকনিতে, জানালায় মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে ভিড় করেছেন। তাঁদের অধিকাংশের হাতে জলের গেলাস। চওড়া পিচের রাস্তাটা দেখে মনে হচ্ছে, এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। আর ও মোটরবাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওর মাথার চুল থেকে টুপিয়ে জল পড়ছে। সিলকের বোতাম খোলা পাঞ্জাবিটা জলে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপটে গিয়েছে। আমার প্রতিবেশী মহিলা পুরুষ সবাই হাসছেন। সবাই একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। আর ও যেন চুড়ান্ত ভূতগ্রস্ত অসার অবাক চোখে পাড়ার এই চেহারা দেখছে। ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না।
রবিবার ছুটির দিনে আমাদের পাড়ায়, দুপুরে এমন একটা ছবি অকল্পনীয়। রবিবার বলেই, আজ প্রত্যেক বাড়িতে ভিড়ও বেশি।
ও মোটরবাইক থেকে নেমে, যানটিকে কেরিয়ারে দাঁড় করাল। দাঁড়িয়ে ডান দিকে বাঁ দিকে, উত্তর দক্ষিণে মুখ তুলে তাকাল, দেখল। ওর ডান হাত পাঞ্জাবির নীচে, কোমরের কাছে। ও কি রিভলভার বের করে হঠাৎ কোনোদিকে গুলি চালাতে আরম্ভ করবে?
আর একটি নতুন ঘটনা ঘটল। ও মোটরবাইক থেকে নেমে দাঁড়াতেই, যে কুকুরটা ভয়ে একবার ডেকেই থেমে যায়, সে আজ ফুটপাথ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড শব্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। কেবল ঘেউ ঘেউ করল না, তাড়া করার ভঙ্গিতে কয়েক পা এগিয়ে গেল। ও কুকুরটার দিকে দেখল। কুকুরটা আরও দু পা এগিয়ে এল। ও কোমরের কাছ থেকে হাত বের করল। হাতে একটা রিভলভার। হাত তুলে কুকুরটার দিকে তাগ করল।
কুকুরটার আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ও সমানে ঘেউ ঘেউ করে চলল। আমি ঝটিতি একবার দক্ষিণে মুখ ফিরিয়ে পুলিশ পিকেট দেখার চেষ্টা করলুম। কিন্তু কিছু চোখে পড়ল না। পাড়া কাঁপিয়ে একটা শব্দ হল, গুড়ুম। কুকুরটা শেষ বারের মতো একবার কঁকিয়ে উঠেই, খানিকটা ছিটকে গিয়ে ফুটপাথে লুটিয়ে পড়ল। এবং মুহূর্তেই চারদিক থেকে যেন বৃষ্টিপাত শুরু হল।
ও রিভলভার তুলে ধরল। তৎক্ষণাৎ একটি জলভবা কাচের গেলাস ওর মাথার পিছনে এসে পড়ল। গেলাসটা রাস্তায় পড়ে চৌচির হল। ওর মাথা কাটেনি, কাটেনি। এখন আর শুধু জল না। জলভরা কাচের গেলাস বৃষ্টি শুরু হল চারদিক থেকে। ও নিজেকে বাঁচাবার জন্য রিভলভার সহ দু হাত দিয়ে মাথা ঢাকল। আমি দেখছি, আমার প্রতিবেশীরা ব্যালকনি ছেড়ে, কেউ কেউ বাস্তায় নেমে আসতে শুরু করেছেন। ও দেখল, বেগতিক। জানি না, ওর রিভলভারে কতগুলো গুলি আছে। তবে ও বুঝতে পেরেছে,একটা রিভলভার দিয়ে এই মারমুখো বাহিনীর সঙ্গে লড়তে পারবে না। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে মানসিক শক্তিও নিঃশেষ। ও রিভলভারটা পকেটে ঢুকিয়ে, দ্রুত মোটরবাইকটা কেরিয়ার থেকে নামিয়ে, লাফ দিয়ে ঘোড়া চড়ার মতো সিটে বসল। এঞ্জিন স্টার্ট করতেই সেই জান্তব বীভৎস শব্দ। ও উত্তরে না গিয়ে, চোখের পলকে মোড় ফিরে দক্ষিণে চলে গেল ঝড়ের বেগে।
জল ভরা কাচের গেলাস বৃষ্টি থেমে গেল। রাস্তার অনেকখানি জলে ধুয়ে গিয়েছে। কয়েকজন মহিলা পুরুষ নারকেল কাঠির ঝটিা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কাচের টুকরো থেকে রাস্তাটাকে পরিষ্কার করতে হবে।
আমি আমার প্রতিবেশীদের দেখছে। চোখ ভরে দেখছি। জয় ও গৌরবের আনন্দে দেখছি।
লেখক মহাশয়,
আপনার ‘বিহিত’ নামে কাল্পনিক গল্পটি পড়লুম। পড়ে ভাবলুম, বাস্তবে যদি আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ওই রকম ঐক্যবোধ থাকত, যদি তাঁরা ওইরকম সাহসী হতেন, তা হলে অনেক অন্যায় ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি হওয়া যেত।
ইতি
সমরেশ বসু
১৯ এপ্রিল ১৯৮৭