ময়মনসিংহ শহরে আমাদের বাড়ি ছিল হিন্দু পাড়ায়। একাত্তরে পাড়ার হিন্দুরা ঘরবাড়ি জিনিসপত্র যেভাবে ছিল, সেভাবে ফেলে চলে গিয়েছিল ভারতে। আমাদেরও শহর ছেড়ে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল গহীন গ্রামে। একবার দেশ স্বাধীন হয়েছে এরকম একটি খবর পেয়ে গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছিলাম। এসে দেখি পাড়া বদলে গেছে। হিন্দুদের বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকছে অচেনা উর্দুভাষী লোক। শুনলাম ওরা বিহারি। ওই বিহারিদের কেউ নিশ্চয়ই পাক আর্মিকে খবর দিয়েছিল। আমাদের বাড়িকে বড়লোকের বাড়ি হিসেবেই বিচার করা হতো। তারপর এক রাতে আমাদের বাড়িতে ঢুকে যা কিছু ছিল লুট করে নিয়েছে পাক আর্মি, টাকা পয়সা, সোনা রূপা। আমার নানির, মা’র খালাদের, মামীদের সবার গয়না ছিল একটা ঝুড়িতে, যে ঝুড়িটা নানি আগলে আগলে রাখতো যেখানেই যেতো। পাক আর্মি সেই ঝুড়িটা নিয়ে গেছে। ওরা বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে নানি আর মা ধর্ষণ বা খুন থেকে বাঁচতে তড়িঘড়ি কোথাও লুকিয়েছিল। ঝুড়িটা নানির পাতা জায়নামাজের পাশেই ছিল। মা’র অনন্ত বালা ছিল রেহেলে রাখা খোলা কোরানের ওপর। সব নিয়ে গেছে পাক আর্মি। আলমারি খুলে যা টাকা পয়সা ছিল নিয়েছে। বয়স আমার খুব অল্প ছিল বলে আমাকে তুলে নিয়ে যায়নি ক্যাম্পে।
অনেক বিহারিই একাত্তরে রাজাকার, আল বদর, আল শামসের খাতায় নাম লিখিয়েছে। যে মাটিতে বাস করছে, সেই মাটির মানুষের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। পাকিস্তানের কাছে মাথা নুইয়েছে। পাক আর্মির সঙ্গে জোট বেঁধে লুটপাট, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ সবই করেছে এবং করতে সাহায্য করেছে। যে পনেরো লক্ষ বা তিরিশ লক্ষ বাঙালি খুন হয়েছে, তার সবই পাক আর্মি দ্বারা নয়, বিহারি দ্বারাও। দু’লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছে, সব ধর্ষণই পাক আর্মি করেনি, বিহারিও করেছে। এই বিহারিদের খুব সংগত কারণে বাঙালিরা পছন্দ করে না। আমার মামা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মামার মুখে শুনেছি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন ন’মাস পর বাড়ি ফিরছেন, তখন শহরের বোম্বাই কলোনিতে ঢুকে যত বিহারি পেয়েছেন মেরে এসেছেন।
সেই যে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় ভারতের বিহার থেকে মুসলমানের দেশ পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিল দশ লক্ষ বিহারি মুসলমান, সেই থেকে তারা এখানেই। যে পাকিস্তানের জন্য অন্যায় অবিচার করতে বাধেনি বিহারিদের, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই পাকিস্তান তাদের দিকে ফিরে তাকায়নি। কিন্তু হায়! বিয়ালি্লশ বছর পেরিয়ে গেছে, আজও বিহারিরা শরণার্থী ক্যাম্পে পড়ে আছে। বিহারিদের মধ্যে একাত্তরে যারা শিশু ছিল, বা একাত্তরের পরে যারা জন্মেছে, তাদের বাংলাদেশের নাগরিক করে নেওয়া হয়েছে, নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে নিজের দেশ বলে মনে করে, এ দেশেরই নাগরিকত্ব চায়। কিন্তু পুরোনো বিহারিরা এখনও পাকিস্তানের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। একদিন পাকিস্তান নামক প্রমিজ ল্যান্ডে বাস করার সুযোগ তাদের হবে, এই স্বপ্ন। বিহারিদের পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে চুক্তি হয়েছিলো। ১৯৭২ সালের সেই শিমলা চুক্তির পর ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে দিলি্ল চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে। তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই চুক্তিতে সই করেছিলেন। কামাল হোসেন, সরদার শরণ সিং, আজিজ আহমেদ। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের জেনারেল জিয়াউল হক প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে বিহারিদের পাকিস্তানে নেবেন। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের আল-আলম আল-ইসলামী বিহারিদের পাকিস্তানে নেওয়ার জন্য কয়েক কোটি টাকার ফান্ড জোগাড় করেছিলেন। ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে ঢাকার পাকিস্তানি দূতাবাস যে বিহারিদের পাকিস্তানে নেওয়া হবে তার একটি লিস্টও বের করেছিলো। ১৯৯১ সালের ১২ নভেম্বর তারিখে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেছিল, বিহারিদের পাকিস্তান নেওয়া হবে। ১৯৯২ সালের ১১ আগস্ট তারিখে খালেদা জিয়া যখন পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন, তখনও পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেছিলো, বিহারিদের শীঘ্র পাকিস্তানে নেওয়া হবে। নওয়াজ শরিফ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ১৯৯২ সালে, ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে বেনজির ভুট্টো প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ১৯৯৫ সালের ২৫ এপ্রিল তারিখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন বিহারিদের নেবেন। ১৯৯৬ সালের ৮ আগস্ট তারিখে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব নাজিমুদ্দিন শেখ বলেছিলেন নেবেন। নওয়াজ শরিফ যখন দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলেন, কথা দিয়েছেলেন বিহারিদের নেবেন, তারিখটা ছিল ২৫ মার্চ, ১৯৯৯। আর জেনারেল পারভেজ মুশাররফ যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন ২০০২ সালের ৩০ আগস্টে, বলেছিলেন বিহারিদের নেবেন। সরকারি লোকেরা প্রতিজ্ঞাই করে গেছেন, কাজের কাজ কেউ কিছু করেননি। বেসরকারি লোক আল-আলম আল-ইসলামীই বরং কিছু করেছিলেন। তাঁর সহযোগিতায় পঞ্চাশ হাজার বিহারিকে পাকিস্তানে নেওয়া হয়েছিলো। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর সমর্থন পেয়ে পাঞ্জাবে বসতি শুরু করার সুযোগ পেয়েছিল ওই বিহারিরা। নওয়াজ শরিফ এখন তৃতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন। এবার তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হোক, দু’দুবার প্রতিজ্ঞা করেও যে প্রতিজ্ঞা তিনি রাখেন নি, এবার যেন রাখেন। অনেক সময় তৃতীয়বারে কাজ হয়। শেখ হাসিনা এ নিয়ে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে কথা বলুন। আরও দশজনকে বলুন তাঁকে বলতে। যে করেই হোক তাঁকে রাজি করান। মানবজীবন নিয়ে এমন অমানবিক খেলা এবার বন্ধ হোক। পাকিস্তানে পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় যুগের পর যুগ বসে থাকা বিহারিদের ‘উদ্বাস্তু পাকিস্তানি’ বলে ডাকা হয়। সারা জীবন উদ্বাস্তু হিসেবে কাটিয়ে দিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবেই মৃত্যুবরণ করে। এই বিহারিরা মনে মনে নিজেদের পাকিস্তানের নাগরিক ভেবে সুখ পায় হয়তো, কিন্তু আসলে ওরা কোনও দেশেরই নাগরিক নয়। ওরা পাকিস্তানের নাগরিক নয়, ওরা ভারতের বা বাংলাদেশের নাগরিকও নয়। ওরা অনেকটা ফিলিস্তিনিদের মতো। যারা চিরকালই শরণার্থী ক্যাম্পেই কাটিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের একশ ভাগ নাগরিকই, আমার বিশ্বাস, উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের পক্ষে, অনেকে ওদের জন্য চোখের জল ফেলে, অনেকে ওদের মানবাধিকারের পক্ষ নিয়ে অনেক বক্তৃতাও দেয়। কিন্তু চোখের জল ফেলা লোকগুলোর মধ্যে ক’জন দাঁড়ায় রাজ্যহীন রাষ্ট্রহীন বিহারিদের পাশে? কেউ কেউ বলে, বিহারিদের ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। সবাই বিহারি-বোঝাটি নানাজনের ঘাড়ে ফেলে হালকা হতে চায়। ভারত থেকে ধরে ধরে যেখানে বাংলাদেশের মুসলমান তাড়ানো হচ্ছে, সেখানে লক্ষ লক্ষ বিহারি মুসলমানকে ভারত ফেরত নেবে তার তো প্রশ্ন উঠে না। পাকিস্তান যদি এবারও গড়িমসি করে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে। তবে বাংলাদেশই না হয় দিয়ে দিক সবাইকে নাগরিকত্ব।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট নতুন প্রজন্মের বিহারি ছেলেমেয়েদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু সবাইকেই নয় কেন। কি কারণে বিহারিরা আজও শরণার্থী ক্যাম্পে পড়ে থাকবে, কার আশায় পড়ে থাকবে! কেউ তো তাদের কোথাও কোনও আশ্রয় দিচ্ছে না। তার চেয়ে যে দেশটায় তারা অর্ধ শতাব্দীরও বেশি হলো বাস করছে, সেই দেশটাই তাদের বরণ করে নিক, ক্ষমাঘেন্না করে নতুন জীবন যাপনের সুযোগ দিক, তাদের নাগরিক করুক। অন্ধকারে ওই গলিগুলোয় পড়ে থাকলে ধর্ম, কুসংস্কার, অবিজ্ঞান আর অশিক্ষায় খেতে থাকে আপাদমস্তক। বাংলাদেশই দেখাক মহত্ত্ব। মানুষগুলোর দুঃসহ দেশহীন বাস্তুহীন জীবনের ইতি ঘটুক। লেখাপড়া করার, চাকরিবাকরি করার, দারিদ্র ঘোচাবার, ব্যাংক একাউন্ট খোলার, ভোটের অধিকারের, মাথা উঁচু করে চলার সুযোগ পাক। পৃথিবীর ধনী এবং বড় দেশগুলো ক্ষুদ্র দরিদ্র বাংলাদেশের কাছ থেকে মানবিকতা শিখুক।
সেদিন মিরপুরের বিহারি ক্যাম্পে শবে বরাতের আতশবাজি নিয়ে কোন্দল হলে দশজন বিহারি মারা গেছে। কেউ কেউ বলছে পুলিশের গুলিতে, নাকি আতশবাজির আগুনে, তা স্পষ্ট নয়। কেউ বলছে, বাঙালিরা মেরেছে, কেউ বলছে, পুলিশ, কেউ বলছে, বিহারিরা নিজেদের মধ্য লড়াই বাধিয়েছিল। কেউ বলছে, একটা ঘরে দশজন বিহারিকে তালাবন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। জানি না সঠিক কী ঘটেছিল। যা কিছুই ঘটুক, চাইলে এই মৃত্যু এড়ানো যেতো বলে আমার বিশ্বাস। তবে এ তো জানিই, বিহারিদের পছন্দ করার লোক বাংলাদেশে খুব একটা নেই। নোংরা জেনেভা ক্যাম্পের বস্তিতে গরু ছাগলের মতো বাস করছে, রিঙ্াচালক, বাস ট্রাকের ড্রাইভার, নাপিত, কসাই, দরজি এ রকম ছোটখাটো কাজ করছে, তাদের পক্ষে কারা আর দাঁড়াবে। আজকাল দরিদ্রর পাশে দরিদ্ররাও দাঁড়ায় না। বাঙালিরা বিহারি পুড়িয়ে মেরেছে এরকম একটা দুঃসংবাদ হাওয়ায় ভাসছে। হিংসে আর ঘৃণা বাঙালির কম নেই জানি, বাঙালি ঠাণ্ডা মাথায় যে কারও গলাই কাটতে পারে। খুন ধর্ষণ তো প্রতিদিনের ঘটনা। কিন্তু বাঙালি তো ভালোও বাসতে জানে, ক্ষমাও করতে পারে। একবার ক্ষমা করে, একবার উদার হয়ে দেখাক। জগত দেখুক।