বিস্ময়বছর!
রোজ কত কী ঘটে যাহা-তাহা
এমন কেন সত্যি হয় না আহা!
কিন্তু তাই তো হয়েছিল— যাকে বলে মিরাকল-অবিশ্বাস্য, তবু সত্যি!
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনই ঘটিয়েছিলেন সেই মিরাকল বা আশ্চর্য ঘটনা।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন মিরাকল আর কি ঘটেছে? একটি বা দুটি নয়। পর-পর মিরাকল! অনেক বাধার মধ্যেও!
১৯০৪ সাল: আইনস্টাইনের একটি ছেলে হল, হান্স অ্যালবার্ট।
নতুন বাবা হয়েছেন আইনস্টাইন। ছেলের দায়িত্ব তো নিতেই হবে।
হান্স খেলা করছে দোলনায়। আর দোলনা পা দিয়ে দোলাচ্ছেন আইনস্টাইন।
ওইভাবে দোলনা দোলাতে দোলাতে আইনস্টাইন লিখছেন তাঁর গবেষণাপত্র, মেলাচ্ছেন অঙ্ক, সমাধান করছেন গভীর বৈজ্ঞানিক সমস্যার, সারাদিন অফিসে কাজ করার পরেও, সদ্যজাত ছেলেকে দেখতে দেখতে।
১৯০৫: আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে যেন হঠাৎ খুলে গেল নতুন নতুন উদ্ভাবনার ফ্লাডগেট।
মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর— এই সাত মাসে আইনস্টাইন লিখে ফেললেন এমন পাঁচটি গবেষণাপত্র যা চিরদিনের জন্য বদলে দিতে পারল বিজ্ঞানীদের বিশ্বচেতনা।
এই বছরটাকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নিজেই বললেন, দ্য মিরাকল ইয়ার।
এক বন্ধুকে চিঠি লিখলেন আইনস্টাইন—
I promise you four papers— the first of which deals with radiation and the energetic properties of light and is very revolutionary… The second paper is a determination of the true sizes of atoms… The third proves that bodies on the order of a magnitude of 1/1000 mm, when suspended in liquids, must already have an observable random movement. The fourth paper is only a rough draft at this point, and is about the electrodynamics of moving bodies that employs a modified theory of space and time.
আইনস্টাইন এ-চিঠিতে কিন্তু বন্ধুকে তাঁর পঞ্চম ‘পেপার’টি নিয়ে একটি কথাও লেখেননি।
কারণ এই সময়ে তিনি ভাবতেও পারেননি এই পঞ্চম গবেষণাপত্রটির কথা। সেটি অঙ্ক থেকেই আকস্মিক উঠে এল। আর এই পঞ্চম গবেষণাপত্রই পৌঁছল তাঁর ভুবনবিখ্যাত ইকুয়েশন-এ: E = mc২!
এই আশ্চর্য বছর সম্পর্কে আইনস্টাইন নিজে বলেছেন—
They were the happiest years of my life. Nobody expected me to lay golden eggs.
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়— কেউ আশা করেনি আমি এতগুলি সোনার ডিম প্রসব করব।
এবারে একটু ভেবে দেখা যাক সোনার ডিমগুলি কী!
আইনস্টাইন তাঁর ছাব্বিশতম জন্মদিনের তিনদিন পরে প্রথম সোনার ডিমটি প্রসব করেন!
প্রথম সোনার ডিম:
বিজ্ঞানীরা এতদিন আলোর চরিত্র নির্ধারণ করতে গিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তাঁদের মতে আলো হল electromagnetic radiation, যার মধ্যে রয়েছে যে-আলো আমরা দেখতে পাই সেই আলো, আছে বেতার তরঙ্গ, আছে এক্সরে, আছে মাইক্রোওয়েভস্, ইত্যাদি।
বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরাই বিশ্বাস করতেন আলো হল একটা ঢেউ।
আর নিউটনের মতো কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন, আলো হল কণিকাস্রোত, stream of particles.
আইনস্টাইন আলোকভাবনায় বিপ্লব নিয়ে এলেন। বললেন, light is both a wave and a particle! আলো একই সঙ্গে ঢেউ এবং কণা!
দ্বিতীয় সোনার ডিম:
অ্যাটমের অস্তিত্ব নিয়ে তখনও কিছু বিজ্ঞানীর মনে বেশ সন্দেহ। সেই সময়ে আইনস্টাইন বললেন, আমি অ্যাটমের আয়তন নির্ধারণ করেছি!
কী করে?
আইনস্টাইনের উত্তর: The answer is in a solution of sugar-water.
চিনির মলিকিউলের ডায়ামিটার নির্ধারণ করলেন আইনস্টাইন— ০.০০০০০০০৯৯ cm. অ্যাভোগাড্রোর নাম্বারও নির্ধারণ করলেন। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পিএইচ ডি থিসিস হল এই নিয়ে।
আরও একটি গবেষণাপত্রে প্রমাণ করলেন আইনস্টাইন, সত্যিই অ্যাটমের অস্তিত্ব আছে, ‘atoms actually exist’। অ্যাটমের অস্তিত্ব প্রমাণ করে আইনস্টাইন লিখলেন,
I have given you the answer— let somebody else confirm it with an experiment.
আইনস্টাইনের এই লেখাটির অনেক বছর পরে, ১৯৪৯ সালে বিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্ন লিখলেন—
It did more than any other work to convince physicists of the reality of atoms and modecules, of the kinetic theory of heat, and the fundamental part of probability in the natural laws.
চতুর্থ সোনার ডিম:
১৯০৫ সালে প্রকাশিত এই চতুর্থ গবেষণাপত্রের নাম দিলেন আইনস্টাইন— On the Electrodynamics of the Moving Bodies. আমরা এইটাকেই অন্য নামে জানি। সেই নামটি হল The Special Theory of Relativity. পদার্থ বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটাল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের এই চতুর্থ সোনার ডিম!
পাঁচ সপ্তাহ ধরে একটানা লিখলেন আইনস্টাইন। লিখছেন, বদলাচ্ছেন, আবার লিখছেন। ঘুম নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। তারপর স্ত্রী মিলেভার হাতে গবেষণাপত্রটি দিয়ে বললেন, তুমি অঙ্কগুলো একবার ভাল করে দেখে দাও, কোনও ভুল থেকে গেছে কিনা। আমি শুতে চললাম। দু’ সপ্তাহ শুয়ে রইলেন আইনস্টাইন। টানা বিশ্রাম।
এই চতুর্থ সোনার ডিমটি এল আইনস্টাইনের এই প্রস্তাব থেকে-the speed of light in a vacuum is the same for all inertial observers, regardless of the motion of the light source. এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে আইনস্টাইন বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এলেন মহাশূন্য ও সময় বিষয়ক ধারণায়।
পঞ্চম সোনার ডিম:
এই সেই বিখ্যাত সোনার ডিম— E = mc২. এই ফর্মুলাটি সরাসরি উঠে এসেছে আইনস্টাইনের স্পেশাল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির গণিত থেকে।
আইনস্টাইন লিখলেন, ‘The mass of a body is a measure of its energy content.’
‘এনার্জি’ এবং ‘মাস’ শুধু আত্মীয় নয়। তারা একই জিনিসের ভিন্ন আকার মাত্র, different forms of the same thing!
বন্ধুকে চিঠি লিখলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন—
The contemplation is amusing and attractive, but I don’t know if the good Lord is laughing at it and leading me around by the nose.
না, গুড লর্ড আইনস্টাইনকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাননি। তিনি সব সময়েই জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজতেন সহজতম ইকুয়েশন-এ। E = mc২ -এর থেকে সহজ, সংক্ষিপ্ত, অভিজাত আর কী হতে পারে?
‘মাস’ এবং ‘এনার্জি’-র সম্পর্ক এত সহজ? এই সম্পর্কই নির্ভুল, বলেছিলেন আইনস্টাইন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তাঁর এই গবেষণা কোনও স্বীকৃতি পেল না বৈজ্ঞানিক সমাজে।
এই পাঁচটি সোনার ডিমের প্রত্যেকটিই একটি করে নোবেল পুরস্কার এনে দিতে পারত আইনস্টাইনকে!
অথচ অনেক বছর নোবেল প্রাইজের জন্য অপেক্ষা করতে হল তাঁকে। নোবেল প্রাইজের জন্য প্রথম মনোনীত হলেন ১৯১০-এ। তারপর দশ বছর ধরে চলল তাঁর বারবার মনোনয়ন।
অবশেষে ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন আইনস্টাইন।
আমরা অনেকেই মনে করি, তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত থিওরি অফ রিলেটিভিটির জন্যে।
না, তা নয় কিন্তু! ১৯২১ সালে আইনস্টাইনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল ‘for his services to theoretical physics and especially for his discovery of the law of the photoelectric effect.’
মজার ব্যাপার হল, যখন নোবেল-ভাষণ দিলেন আইনস্টাইন, যাকে বলে ‘acceptance speech’, একটি কথাও তিনি বললেন না ফোটোইলেকট্রিক এফেক্ট বিষয়ে। বললেন শুধু রিলেটিভিটি নিয়ে।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের যে ভুবনজোড়া খ্যাতি, যে আকাশভরা নাম, তা কিন্তু তিনি সহজে পাননি। সারাজীবন অনেক সংগ্রাম আর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে।
এই বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়ে শিখরের গল্প। যে-গগনচুম্বী খ্যাতির শীর্ষে তিনি উত্তীর্ণ হলেন শেষ পর্যন্ত।