বিসাশন

বিসাশন

ঠুক ঠুক করে অনেকক্ষণ ধরে দুলাই তক্তা পিটছিল। নৌকাখান ফুটো হয়েছিল তা আজ দিন দুয়েক হল। প্রত্যেক বর্ষায় দু থেকে চারবার ফুটো সারানো দুলাইয়ের অভ্যাস হয়ে গেছে। নৌকা না বলে একে অবশ্য শালতি বলাই ভালো। ঘরের দাওয়ায় তক্তাপোশের তলায় জমানো পিতৃপুরুষের পুরোনো ডিঙার ভাঙাচোরা যে তক্তা জমানো আছে, তার থেকে বেছে বেছে তক্তা দিয়ে আজই নৌকা সারানোর কাজ শেষ করবে দুলাই। আশ্বিন শেষ হয়ে কার্তিক পড়বে পড়বে করছে, কিন্তু সূর্যের তাপে গা পুড়ে যায় এখনও। ঘামের ফোঁটাগুলো মাটিতে পড়লে মাটি শুষে নেয় সঙ্গে সঙ্গে। কুড়ুল দিয়ে কাঠ চেলা করতে করতে পাশের বাড়ির উঠানের দিকে চোখ পড়ে দুলাইয়ের। চিন্তামণি কুর্মির নৌকাটা খোল উল্টে ফেলা আছে সেখানে। নতুন আলকাতরা করেছে চিন্তা নৌকায়। নৌকাটাকে দেখে নিজের পুরোনো শালতিটার দিকে আরেকবার চোখ বুলায় দুলাই। কেলে রঙটায় সূর্যের আলো পড়ে কেমনতর চিকচিকাচ্ছে চিন্তার নৌকাটা। আর নৌকা তো চিন্তামণির একখান নয়, আরেকখান আছে। দামোদরে মাছ ধরার পারমিট আছে, রঘুনাথপুরের বাজারে বড় মহাজন ধরা আছে, চিন্তা আর কীসের? দুলাইয়ের মত এপাড়া, ওপাড়া, বেপাড়ার খাল বিল পুকুর ছেনে মীনের চারা ধরতে তো হয় না। দুলাইয়ের শালতি মাঝে মাঝেই ফুটো হয়, বয়স হয়েছে কাঠগুলার অনেক। নতুন বড় নৌকা না কিনে নদীর পারমিট চাওয়াও যাবে না। গেল বছর সামন্তের পুকুরটারে ইজারা নিতে চেয়েছিল দুলাই। বলে কিনা, হাজার পাঁচেক লাগবে। অত্ত টাকা দুলাই কেন, তার মত আরও সাতটা কুর্মি দেখেছে নাকি?! চিন্তামণি হয়তো চাইলে পারে এ পুকুর ইজারা নিতে, তার অনেক টাকা। কিন্তু চিন্তার এসবে মন নেই, তার যে কিসে মন, সে বোঝা দুলাই বা আর চারটে সাধারণ জেলের কর্ম নয়।

টাকা ছাড়াও চিন্তামণির অনেক গুণ, তার শরীরখান চকচকে, পুকুর থেকে যখন স্নান করে ওঠে, রোদ এসে গায়ের উপর ঝিলিক মারে। নৌকায় যখন দাঁড় টানে হাতের পেশীগুলো ফুলে ফুলে ওঠে। এই মাঝ বয়সেও চারপাশের গাঁয়ে খুঁজলে অমন চটকদার শরীর আর পাওয়া যাবে না । বৌটা সগ্গে গেছে গেল বছর। বিয়া করে নাই ফের। বিয়া করার জন্য মেয়েছেলেও কিছু কম নাই গাঁয়ে, কিন্তু চিন্তাকে বিয়া করার মত বুকের পাটাআলা মেয়েছেলে নাই। টাকাপয়সার দিক থেকে চিন্তামণি ছোটখাটো মহাজনও বটে। জেলে পাড়ার এমন কোনও ছোটোখাটো জেলে নেই যে ওর খাতক নয়, কিন্তু বিয়ার জন্য শুধু টাকা নয়, আরও তো কিছু দেখতে হয়। চিন্তাকে ভয় পায় না এমন মেয়েছেলে জেলেদের এ গাঁয়ে নেই। সকলে বলে চিন্তা জাদু জানে, আর সে জাদু যে সে জাদু নয়, কালা জাদু, জাদুর গুণেই চিন্তার এত্ত টাকা, এত্ত প্রতিপত্তি। চিন্তামণি জাদু শিখেছে তার বাপ দুখাই কুর্মির কাছে। গাঁয়ের সকলে বলে দুখাই কুর্মি মস্ত বড় গুণিন ছিল, দেবতা বশে রাখতে পারত। রোগ ব্যাধি দূর করত, ভূত অপদেবতা তাড়াত, দূর গ্রামের থেকে লোকে এসে ডেকে নিয়ে যেত দুখাই কুর্মিকে। চিন্তামণিদের অবস্থা ফিরেছে দুখাইয়ের জাদুতেই। মরার আগে ছেলেকে বোধ হয় দুখাই সে গুণ শিখিয়ে গেছে। মরেছে নাকি সেও অবশ্য জানা যায়নি। এ এক আজব ঘটনা, পনেরদিন আগে রাতেরবেলা থেকে সেই যে সে নিখোঁজ হল, আর তারে কেউ দেখে নাই। গাঁয়ে মাঝে মাঝে অনেক রাতে চিন্তাকে দেখা যায়, হাতে ছড়ি, কাঁধে ঝোলা নিয়ে সে যেন কোথায় যায়, গাঁয়ের শেষ কিনারায় অশ্বত্থ গাছের তলায় বসে আগুন জ্বালায়, শুকনো লতা কাঠি জোগাড় করে আগুনে দেয়, খুড়িতে করে তাড়ি খায়।

অত রাতে গাঁয়ে তখন কোনও আলো জ্বলে না, কোনও জনমনিষ্যি পথে হাঁটে না, সেই সময় কখনও যদি কেউ চিন্তামণির মুখোমুখি পড়ে, তাকে দেখে সে মানুষের বুকের রক্ত জল হয়ে যায়।

আগুনের শিখায় চিন্তামণির লালচে মুখটা আরও লালচে দেখায়, চোখগুলো মরা মানুষের মত হয়ে যায়, হলদেটে চোখের শিরায় লাল রক্তেরা ভিড় করে। পলক পড়ে না চোখের। বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ে চিন্তামণি কুর্মি।

“কীসের পূজা করিস রে চিন্তা?” প্রশ্ন করলে চিন্তার মরা চোখে আগুন জ্বলে, তাড়ির ঘোরে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে, “কেনে? এ সাধনা আছে বটে, তুঁদের ঘটে ঢুকবেক লাই। এ পৃথ্বী, জল, বায়ু সবকে ধইরে রাখবার সাধনা আছে। শিখবি তুঁরা?”

তারপর আকাশ কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসে। রাতের বেলার অন্ধকার খান খান করে সে হাসি শোনা যায় দূর থেকে।

গাঁয়ের লোকের অসুখবিসুখে চিন্তামণি কবজ মাদুলি দেয়, বাপের মত অপদেবতা ভাগাতে পারে। পাশের চারপাঁচটা গাঁ থেকেও আজকাল চিন্তার ডাক আসে, রোগ সারানোর জন্য, সাপের বিষ ঝাড়ানোর জন্য, অপদেবতা তাড়ানোর জন্য, পরবে পূজার জন্য। পরবের সংখ্যা কুর্মি মাহাতোদের কিছু কম নয়, রইহন আছে, টুসু আছে, বড়াম দেবতার পূজা আছে, জাওয়াপরব আছে, নয় নয় করে বছরজুড়ে দশবারোটা পরব তো বটেই। এসব পরবে চিন্তা পূজা করে, কিন্তু পূজা করার ঢঙ তার বাকি কুর্মিদের থেকে আলাদা। পুজো করার সময় সে চিৎকার করে, চিৎকার করে দেবতাদের ডাকে, তার চোখ তখন কপালে ওঠে, সারা শরীর কাঁপে, সরু করে পেঁচানো লাল কাপড়টা কোমর জড়িয়ে থাকে সাপের মত, কোমর বেঁকিয়ে শরীরটাকে মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে বার বার দেবতার থানে মাথা ঠোকে চিন্তামণি। মাথা ঠুকে ঠুকে রক্ত বার করে সেই রক্ত দিয়ে থানে মাখায়। বিকট উল্লাসে হাসতে হাসতে তারপর দেবতার পায়ে সে ফুল চড়ায়। সে দিকে তাকালে দুলাই শিউরে ওঠে, দুলাইয়ের বৌ মেনকা অবাক হয়ে মুখে আঁচল চাপা দেয়, ছোট ছোট ছেলেরা খেলা ভুলে থানের চারপাশে ভিড় জমায়। পূজা শেষে গাঁয়ের মাদীপুরুষ যে যেমন পারে টাকা ঠেকায় চিন্তার পায়ে। দুলাই অবাক হয়, ছোট্ট থেকে যে চিন্তাকে দেখে সে বড় হয়েছে সে অচিন মানুষের মত ব্যবহার করে। ভক্তি যত না হয়, ভয় হয় ঢের বেশি। তবে, দুলাই একটা জিনিস বোঝে, বিপদে আপদে চিন্তাই এ গাঁয়ের ভরসা। গাঁয়ের লোকে তাকে মানে, ডরায়ও বটে।

*****

গ্রামের শেষ সীমানায় পড়ে থাকা ডোবাটার ধারে বনমালির সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন গোপাল ভটচাজ। গ্রামের বসতি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আরও তিন চার ক্রোশ দূরে এ ডোবা। ডোবার পাশে সারি সারি টিলা। টিলাগুলি যেন ডোবাকে ঘিরে গাঁয়ের সীমানা বেঁধে দিয়েছে। টিলার ওপারে ঝাড়খন্ড, ওদিকেও বিস্তীর্ণ বনভূমি। নির্জন ছমছমে পরিবেশ। পারতপক্ষে এ তল্লাটে কেউ আসে না, সাধারণ কোনও আদিবাসী গ্রামবাসী তো নয়ই। গোপালবাবু এসেছেন, কারণ কাল রাতে একটা বিদঘুটে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে গোপালবাবুর। স্বপ্নকে বিদঘুটে না বলে ভয়ানক বলাই ভালো। ঘুমের মধ্যে নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার মত হয়েছিল তাঁর। অনেক দিন পরে স্বপ্নে এসেছিলেন দাঠাকুর। দাঠাকুরের হাত ধরেই তো পূজা আচ্চা সব শেখা গোপাল ভটচাজের। বারবার স্বপ্নে ডোবাটাকে দেখছিলেন গোপাল ভটচাজ। স্বপ্নে পরিষ্কার দেখলেন ডোবার রঙ রক্ত লাল, তা থেকে উঠে আসছে পচাগলা গন্ধ, কারা যেন সেই রক্তপুঁজআলা জলে ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তাদের আর্তনাদে কানে তালা লাগছিল গোপালবাবুর। ডোবার দিকে হাত বাড়িয়ে কী যেন বলতে চাইছিলেন দাঠাকুর, ফর্সা ছায়াময় শরীরটা জলের উপর ঘুরপাক খেয়েছিল বারকয়েক, পৈতে হাতে তুলে নিয়ে গোপালবাবুর দিকে তর্জনী তুলে কী যেন বলতে চেয়েছিলেন তিনি। একইসাথে অবাক হয়েছিলেন আর ভয়ও পেয়েছিলেন গোপালবাবুর। যে ইতিহাস মুছে গেছে পাড়া গ্রাম থেকে ছশ বছর আগে, ছোটবেলায় যে ইতিহাস শুনে শিউরে শিউরে উঠতেন, যে কিংবদন্তী জায়গা করে নিয়েছে গ্রামের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে, এ গাঁয়ে ভুলক্রমেও যে অতীতের দরজা খুলে তাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনা বারণ, আজ আবার এত দিন পরে সে ইতিহাসের স্মৃতি ফিরে আসে কেন ঘুমে?

ডোবার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে ওঠে গোপালবাবুর। শান্ত কালচে জলে বিকট গন্ধ, বহুদিনের অব্যবহারে নোংরা আবর্জনা জমেছে অনেক, উপর থেকে দেখে মনে হয় জলে নামলেই প্যাচপ্যাচে পাঁকে আটকে যাবে শরীর। নাকে হাত চাপা দিয়ে বনমালিকে জিজ্ঞাসা করেন গোপালবাবু, “জলের থেকে এত গন্ধ আসে কেন রে?”

“জলে তো কেউ লাবে না বঅ, কার অত সাহস আছে বলেন? পচি গেছি হবে, দিখিছেন জল কেমন কালচি পইড়ে গেছে।” বনমালি বলে ওঠে।

সামনের টিলাটার উপর বন্ধ মন্দিরের দিকে তাকান গোপালবাবু। সন্ধে নেমে আসছে মানভূমে, আঁধার হতে শুরু করেছে চারিধার। সেই আঁধার আলোয় দূরের মন্দিরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ইষ্টদেবের কাছে প্রার্থনা করেন গোপালবাবু।

“সন্ধ্যিবেলা এ অলক্ষুণে জাগায় কী করইবেন বঅ? বাড়ি চলুন।” বনমালি উসখুস করে ওঠে।

“গাঁয়ে নতুন কিছু খবর আছে নাকি বনমালি?”

“কিরম খবর বঅ?”

“কোনও অমঙ্গলের খবর!”

বনমালি চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করে।

“সেরম কিছু তো মনে পড়েক লাই। আপনে তো জানেন কজনার ঘর থিক্যে ছাগল, ভেড়া এসব হারাইছিল। পাশের গাঁয়ের থিক্যেও পশু হারাইছে। থানা থিক্যে পুলিশ এসিছিল, কোনো লাভ হয় লাই! উয়ারা বলে, বিহার থিক্যা চোরের দল ইসেছে, ভেড়া, ছাগল চুরি করইছে। আর একটা কথা বঅ, আগের অমেবস্যেতে চিন্তামণির বাবা সেই যি হারাই গিল, আর ফিরে লাই। আর কেউ খুঁজ পেল না, মানষটা বেবাক হারায় গেল।”

“চিন্তামণি? ও সেই জেলেটা? ওঝাগিরিও করে না ও!”

“জেলে লয়েক বঅ, উয়া জাদু জানে বটেক। তিলকের নুনুটারে বোশেখে সাপ কামড়েছিল, সঅল শলীলটা লীল পড়ইছিল, চিন্তামণি মন্ত্র পড়ে লাশের মত শলীলটাকে বসায়ে কাঁসার থালা পিঠে ছুঁইড়ে মারল, পরখনেই থালায় মাটি ছুঁইড়ে মারল আর আমরা সঅল কুর্মি অবাক হয়ে দেখলাম…”

“কী দেখলে?”

“থালাতে মাটিগুলা ল্যিগে গিল বঅ, একটুও খসে পইড়লনি।”

“তারপর?”

“দশ মিনিট হবে বঅ, সে নুনু আবার চোখ মেলে চাইল। একদম ডেরা ডেরা চোখে।”

“নিজের বাপটাকে খুঁজে পেল না?”

“যারে কাল কাটে, তারে কে বাঁচায় বঅ?!”

সামনের টিলাটার দিকে আবার তাকান গোপাল ভটচাজ। চারপাশের টিলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু এটাই। মন্দিরের দরজা বন্ধ, দূর থেকে দেখা যায়, ঠিক যেমন ছশ’ বছর আগে বন্ধ হয়েছিল। শাল, পলাশ আর মহুয়ার জঙ্গলে ছেয়ে গেছে টিলা, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আজও মন্দিরের দরজার মুখটায় কোনও জংলা গজায়নি। সে ভয়ংকরী দেবী মন্দিরের চাতালের সামনেটা ঢালু হয়ে নেমে এসেছে ডোবার ধারে। ডোবার জলে নামলে কি এখনো… ?!

ছোটবেলার স্মৃতিতে ডুবে যান গোপালবাবু।

*****

“উয়াদের ঘরে ইকবার লিয়ে চল না কেনহে?”

“তুঁই থাম রে মেনকা! অকবকাও না অত! হামার পয়সা লেই জানিস লয়?”

“তর ভাবনা ভাইবা হামি কী কৈরব রে? নুনুর গা খান তো জরে পুড়াই যায়।”

চিন্তামণির ঘরের দিকে একবার তাকায় দুলাই। ছেলের জ্বর এসেছে গত পরশু। শিউলির পাতা বেটে খাইয়েছে মেনকা গত দুদিন ধরে। আপদ জ্বরের এখনও পালাবার নাম নেই। চিন্তামণির ঘরের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ভ্রু কুঁচকে যায় দুলাইয়ের। আগের বার যখন ছেলের জ্বর হয়েছিল, কুড়িটাকার নোট নিয়েছিল চিন্তা। জ্বর সেরেছিল বটে, কিন্তু দুদিন ভাত জোটেনি বউছেলেদের। এবার তো ঘরে দশটাকারও জোর নেই।

একবার হাতে পায়ে ধরে দেখবে চিন্তামণিকে, মনে মনে এটাই ঠিক করে দুলাই।

এই সুযোগে একবার জাদু শেখবার ইচ্ছাটাও বলে দেখবে দুলাই, যদি এ মরা অবস্থা ফেরে, যদি বিষ তাড়ানোর বিদ্যেটা একবার শেখা যায়, যদি সাকরেদ বানাতে রাজি হয় চিন্তামণি। সেরম হলে ওর পায়ে হত্যে দিয়ে পড়বে দুলাই। চিন্তামণির সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবে, দরকারে ওর সেবা করবে।

চিন্তামণির ঘরের টিনের দরজাটা ঠেলে ঢোকে দুলাই, ক্যাঁচ আওয়াজটায় দেওয়ালে বসা কালো টিকটিকিটার ঘুম ভাঙে। টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠে দুলাইয়ের। টিকটিকিটা অস্বাভাবিক বড়, সারা গায়ে কালো ছিটছিটে দাগের সঙ্গে ছোট ছোট লাল সিঁদুরের টিপের মত দাগ, কেউ যেন সিঁদুরের ফোঁটা পড়িয়ে রেখেছে। এমন টিকটিকি এর আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারে না দুলাই। ঘরের কোণে একটা থালায় উল্টে পড়ে আছে একটা রুপোলি কাতলা, মাথাটা কেটে ধড় থেকে আলাদা। আর ধড়টাকে লম্বালম্বি কেটে কে যেন নাড়িভুড়ি সমেত রেখে দিয়েছে। লাল রক্তে মাখামাখি থালা, মাছের মুড়োটাতেও মোটা করে মাখানো সিঁদুর। মাছি ভনভন করছে চারদিকে। দুলাই মাছ ভালোবাসে খুব, কিন্তু থালায় উল্টানো মাছের শরীরটায় চোখ পড়ে পেট গুলিয়ে বমি আসে ওর। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার, জানলা এমন সাঁটিয়ে বন্ধ করে রেখেছে চিন্তা যে ঘরে একফোঁটা সুয্যির আলো ঢোকার জো নেই।

সারা ঘরে একটা বিকট দমচাপা ভ্যাপসা গন্ধ, নাকে হাত চাপা দিয়ে দুলাই ডাকে, “বঅ… বঅ! কুথায় তুঁমি বঅ?”

ঘরের ভিতর থেকে ঘড়ঘড় শব্দে আওয়াজ আসে। কিছুক্ষণ পরে, অন্ধকার ঘরের মধ্য দিয়ে মেঘলা সাঁঝালো বিকেলের কালি পড়া চেহারা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে চিন্তামণি। ওকে দেখে অবাক হয় দুলাই। চোখের দৃষ্টি ঘোলা, মাথার লালচে চুলগুলোয় গিঁট পাকিয়ে চুড়োয় বাঁধা, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুলাইকে চিনতে পারে না যেন সে।

“বঅ? ঠিকাছ তুঁমি?”

“বলহ।”

“নুনুর কাল থিক্যা জ্বর বঅ। এক পয়সা লাই হামার কাছহে, নুনুরে তুঁমি বাঁচাবে না বঅ?”

“পয়সা লাই?”

চিন্তামণির পায়ে পড়ে যায় দুলাই।

“বাঁচা বঅ। হামার অন্তরটা পুইড়্যা যায়। আমায় তুঁর লাইগ্যা জাদু শিখ্যাইবি? বিষ ঝাড়া শিখ্যাইবি? কটা লোট হামিও লারব না বঅ?”

ঘরের বাইরে দাওয়াটায় উবু হয়ে বসে চিন্তামণি। তার ঘোলা চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। অস্বস্তি হয় দুলাইয়ের। চোখের মণি কাঁচের গুলির মত নিষ্প্রাণ লাগে। দুলাইয়ের দিকে তাকিয়ে চিন্তামণি প্রশ্ন করে,

“হামি কার পূজা করহি জানিস তুঁই?”

দুলাই মাথা নাড়ায়। “কুদরা দেবতার?”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে চিন্তামণি।

“না রে, হামি যার পূজা করি সে সাতশ কুদরারে পুষে।”

দুলাই কুদরাদেবতার কথা শুনেছে লোকমুখে, কুদরাদের বশ করে টাকাপয়সার মালিক হয় অনেকে, চিন্তামণির অবস্থায় তার সন্দেহ হয়েছিল সে নির্ঘাত কুদরার পূজা করে। তার চেয়েও শক্তিশালী কোনও আসুরিক দৈবীশক্তি চিন্তামণির অধীনে, এ কল্পনা করে দুলাই অধীর হয়ে ওঠে।

“সে কোন দেবতা বঅ?”

“আছে। সে দেবতা কঠিন রে দুলাই।”

“তুঁমার কথা শুনহে?”

“শুনহে। তুঁরও শুনবে।”

“কি করহে?”

“হামি যেইহানে যাতি বলব, সেইহানে তুঁরে যাতি হবে। হামিও যাব তুঁর ল্যগে। দেবতাকে খুশী করলে তবে তুঁই হামি প্রসাদ পাব, নুনুর জ্বর সারহে যাবে।”

“ঠিক বঅ। কখন আসইব?”

“রেতে। হামি ডাকি লিব তুঁকে। কোনোকে বলিস না তুঁ হামার সাথহে যাবি। তুঁর বৌরেও লয়।”

অনেক রাতে, শাল পাতার শুকনো গালিচায় মচমচ শব্দ তুলে দুলাই আর চিন্তামণি হারিয়ে যায় ঘন জঙ্গলের পথে। পথে জেগে থাকে শুধু অন্ধকার, ঘন কালো গাঢ় সে অন্ধকারে ওদের শরীরদুটো আস্তে আস্তে মিশে যায় নিরুদ্দেশে।

*****

“তুমি আমায় বলেছিলে গল্পটা বলবে দাদাই! আজই বলো।”

বারো বছরের অর্ক তার দাদুর দিকে তাকিয়ে আবদার করে ওঠে। গোপাল ভট্টাচার্যের একমাত্র পৌত্র পুজোর একমাস লম্বা ছুটিতে পাড়াগ্রামে এসেছে কলকাতা থেকে। মন্দির আর দেবদেবীতে ছেলেটার অসীম আগ্রহ। এককালে শিখরভূমের রাজধানী ছিল এই পাড়ায়। পঞ্চকোট রাজাদের স্থাপিত চারটে মন্দির এখনও এ গাঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে গৌরবময় পুরাকালের নিদর্শন হিসাবে। চণ্ডীমন্দির, লক্ষ্মীমন্দির, রাধারমণ মন্দির, রঘুনাথ মন্দির— চারটে মন্দির ঘুরেও অর্কর কৌতূহল মেটেনি, তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন গ্রামের প্রায় বাইরে টিলার উপর মন্দিরটি। ওই মন্দিরে কেন কেউ যায় না, কেন পূজা হয় না, এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কারুর কাছে না পেয়ে অর্কর আগ্রহ আরও উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। আজ সে কিছুতেই তার ঠাকুরদাকে ছাড়বে না।

চোখের চশমাটা খুলে নামিয়ে রাখেন গোপাল ভটচাজ। হাতের তালপাতার পাখাটায় নাতিকে হাওয়া করতে করতে তারপর বলে ওঠেন,

“ছশ বছর আগের কথা দাদুভাই, উড়িষ্যা থেকে সদ্য এসে পঞ্চকোট রাজপরিবারের কল্যাণেশ্বরী মায়ের পুজোর সেবাইতের দলে যোগ দিয়েছিলেন তরুণ দ্বারকেশ্বর ভটচার্য। পাড়া গ্রামে তখন সে রাজপরিবারের রাজ্যপাটের প্রায় শেষ অধ্যায়। রাজধানী গুটিয়ে তারা পঞ্চকোটে চলে গেলেন। কিন্তু এই সময় জলবসন্ত হয়ে দ্বারকেশ্বরের এক চোখ নষ্ট হয়ে পড়ায় তিনি কল্যাণেশ্বরীর পূজার অধিকার হারান। রাজপরিবারের সাথে তিনি যাননি। রাজা তাঁর নামে দুটো মৌজা লিখে দেন আর তিনি পাড়াগ্রামেই থেকে যান। কিন্তু, কল্যাণেশ্বরী মায়ের অনুপস্থিতিতে তাঁর মন ভীষণ খারাপ হয়।” গোপালবাবু দম নেন।

“তারপর?”

“এখন এ গ্রামকে যেমন দেখছ দাদুভাই, ছশ বছর আগে এ গ্রাম কেমন ছিল তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। গ্রামের বাইরে যে ঘন জঙ্গল দেখো, সেই রকমই জঙ্গলে এ গ্রাম ঢাকা ছিল। দূর থেকে গ্রামে ঢোকার পথে চোখে পড়ত একটি সবথেকে উঁচু এক টিলা, সেই টিলায় স্থাপিত এক শিলাকে দেবী মূর্তিরূপে প্রতি অমাবস্যায় স্থানীয় কোল, ভিল, মুন্ডা, কুর্মিরা পূজা দিতে যেত। সেই দেবীশিলার পূজারি ছিলেন এক ভীষণদর্শন কাপালিক। দ্বারকেশ্বর সেই কাপালিকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। লোকে বলত, সেই কাপালিক অসীম বিভূতির অধিকারী হয়েছিলেন শুধুমাত্র দেবীশিলার পূজা করে, তাঁর নাকি চাঁদ সূর্য বশ করার ক্ষমতা ছিল। টিলার সেই কাপালিকের প্রতি দ্বারকেশ্বর সব সমর্পণ করলেন। নাওয়া খাওয়া ভুলে টিলায় পড়ে থাকতেন। কাপালিক আর তিনি মিলে দেবীশিলাকে পূজা করতেন। কিন্তু…”

“কিন্তু কী দাদাই?”

“ভারী অদ্ভুত আর বীভৎস ছিল সেই পূজা পদ্ধতি।”

“কী রকম দাদাই?”

গোপালবাবু চুপ করে যান। বারো বছরের কিশোরের সামনে সে নারকীয়তার বর্ণনা দিতে তাঁর অস্বস্তি হয়। তাঁর দাদামশাইয়ের কাছে শোনা সে অসভ্য বর্বর পূজা পদ্ধতি তাঁর চোখের সামনে ভেসে আসে।

“বলো না দাদাই?”

চিত্রার্পিতের মত গোপালবাবু বলে চলেন। “দেবীশিলার সামনে আগুন জ্বালিয়ে দুদিকে দুটো খুঁটি পুঁতে দড়ি টাঙানো হত। তারপর সেই দড়িতে উল্টে ঝুলিয়ে দেওয়া হত সদ্য মাথা কাটা কোনো মৃত পশুদেহের শরীর। সেই মৃতশরীর থেকে রক্ত টুপটুপিয়ে পড়ত শিলার শরীরে। আগুনের শিখা কেঁপে কেঁপে উঠত অস্থির হাওয়ায়। রক্ত মেখে কাপালিক আর দ্বারকেশ্বর নারকীয় উল্লাসে মেতে উঠতেন। শিলার আঁধারচ্ছন্ন দেহে চিত্রিত সিঁদুরে আঁকা দেবীর চোখমুখে যেন খেলা করত বিচিত্র এক হাসি। ক্রূর সে হাসিতে ছিল রৌরবের আহ্বান।”

“রৌরব কী দাদাই?”

“নরক, নরক দাদুভাই।”

“তারপর কী হলো?”

“আমাদের সেই পূর্বপুরুষ দ্বারকেশ্বর ভট্টাচার্য ধীরে ধীরে সেই কাপালিকের সম্পূর্ণ বশীভূত হয়ে পড়লেন। প্রতি অমাবস্যায় পশুবলি বাঁধা ছিল দেবীর কাছে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত দ্বারকেশ্বর টিলায় এসে বসে থাকতেন। ঘোরের মধ্যে থাকতেন, সংসারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করলেন, কিন্তু যে বীভৎস ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করেছিল তাঁর জন্য তা হয়তো তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।”

“কী ভবিষ্যৎ?”

ইতস্তত করে গোপাল বাবু বলে ওঠেন, “সে বড় ভয়ানক পরিণতি দাদুভাই! একদিন আমাদের সেই পূর্বপুরুষ দ্বারকেশ্বর ভট্টাচার্যের মুণ্ডহীন শরীর পড়ে থাকতে দেখা গেল টিলার উপর। কাপালিকও সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হলেন টিলা থেকে, যদিও কোনও প্রমাণ ছিল না তাও লোকের বুঝতে বাকি রইল না কে এই ব্রাক্ষ্মণ সন্তানের মুণ্ডচ্ছেদ করে দেবীকে ভোগ চড়িয়েছে। নরবলি দিয়ে দেবীকে সন্তুষ্ট করে হয়তো আরও অলৌকিক বিভূতির অধিকারী হতে চেয়েছিল সে কাপালিক। দ্বারকেশ্বর হত্যার খবর পৌঁছাল পঞ্চকোট রাজার কাছে। তাঁর রাজ্যে ব্রাক্ষ্মণ হত্যায় রেগে গিয়ে তিনি পেয়াদা বরকন্দাজ পাঠিয়ে বন্ধ করে দিলেন নরবলি, পশুবলি। দেবীশিলাকে উঠিয়ে নিয়ে এসে টিলার মাথাতেই মন্দির নির্মাণ করে তাতে স্থাপন করবেন বলে ঠিক করা হল। ঘটা করে মন্দির নির্মাণও হল; কিন্তু…”

“কিন্তু?”

“শিলাকে সরানো গেল না। রাজার কোনও পাইক পেয়াদার ক্ষমতা হল না সে শিলাকে সরায়। শিলা মাটি আঁকড়ে বসে রইল একশ টন ওজনের পাথরের মত। কোনও কুর্মি, কোল আদিবাসীরা শিলার গায়ে হাত দিয়ে তাকে সরাতে রাজি হল না। শিলা যে কে সেই মন্দিরের বাইরে পড়ে রইল আর রাজার মন্দির পড়ে রইল দেবশূন্য হয়ে।”

“শিলাকে আর কেউ পুজো করত না?”

“কে করবে? আদিবাসীরা বিশ্বাস করত দেবীশিলার সামনে পশু বলি না দিলে পূজা সম্পূর্ণ হবে না, এদিকে রাজার ভয়ে কেউ ঐভাবে পূজা করতে পারছিল না। তারা এ মন্দির পরিত্যাগ করল, তাদের ধর্মাচরণে বাধা তারা বোধহয় সর্বান্তকরণে মেনে নেয়নি।”

“তারপর?”

“তারপরেই নেমে এল ঘোর বিপর্যয়, একদিন সেই নিরুদ্দেশ কাপালিকের মুণ্ডহীন, ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীর পড়ে থাকতে দেখা গেল। কে তাকে ওইভাবে হত্যা করল কেউ জানতে পারল না। গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়ি থেকে প্রতি অমাবস্যায় অন্তর্হিত হতে লাগল মানুষ, সকাল হলে তাদের রক্তশূন্য শরীরের খণ্ডবিখণ্ড টুকরো পড়ে থাকতে দেখা যেতে লাগল টিলার সামনের ডোবাটায়, কে যেন তাদের শরীর চিবিয়ে খেয়ে হাড়গোড়টুকু খালি ফেলে দিয়েছে জলে। গ্রামের লোকে ওই ডোবার নাম কী দিল জানো?”

“কী?”

“হাড়গোড়ের গাভা।”

“কিন্তু কে এমন কাজ করত?”

“তা আর বুঝলে না দাদুভাই? সেই দেবী যে রক্তপিপাসু দাদুভাই! নররক্তে যে পূজা কাপালিক তাঁর শুরু করেছিল, সে পূজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি কুপিতা হবেন না? সারা গাঁ প্রায় উজড়ে যাওয়ার পর দেবীর ক্রোধ শান্ত হয়েছিল, যারা বেঁচে রইল তারা নানা রোগে ভুগে হল অশক্ত, অক্ষম, অকালবৃদ্ধ।

ধীরে ধীরে মন্দির সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হল, জলাজংলায় ছেয়ে গেল টিলা। হিংস্র শ্বাপদের আনাগোনায় ওরাস্তায় যাতায়াত বন্ধ হল মানুষের। এখনও ওই টিলায় কেউ যায় না দাদাভাই, দেবী জেগে উঠলে যে গ্রামের ঘোর বিপদ!”

“ওই গাভায় হাড়গোড় বেরোতে তুমি দেখেছ?”

গোপালবাবু উত্তর দেওয়ার আগেই বাইরে উঠোনে ভীষণ হই হট্টগোল শোনা যায়।

নাতিকে গল্প শোনানো বন্ধ করে বাইরে আসেন গোপালবাবু। বনমালি আর আরও অনেক সাধারণ মানুষের ভিড় তার ঘরের দরজায়।

“কী হয়েছে?”

“তরাই চলুন বঅ। বিপদ হইছে।”

“কী হয়েছে?!”

প্রায় কুড়ি পঁচিশ জন আদিবাসীদের একটা দলের সঙ্গে গোপাল ভট্টাচার্য ছুটলেন গ্রামের প্রান্তে। আদিবাসীদের উত্তেজিত স্বরে বুঝলেন, দিনদুয়েক আগে দেখা তাঁর স্বপ্নের প্রাসঙ্গিকতা। ডোবার ধারে পৌঁছানোর কিছু দূর আগেই বিকট গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা মারল গোপালবাবুর।

আদিবাসীদের দলের বেশ একটা বড় অংশ থেমে গেল আগেই। ডোবার কাছে গেলেন তিনি, বনমালি আর কুর্মিসমাজের কিছু ভারিক্কী মানুষ। গোপালবাবু মনে মনে বুঝতে পারছিলেন যে বীভৎস ভয়ানক কোনও দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। দেবীশিলার সেই কাপালিকের শরীরের অবশেষও পাওয়া গিয়েছিল এই ডোবায়, তার রক্তহীন মুণ্ড পড়েছিল ডোবার ধারে জলাজমিতে। যেন কেউ ভয়ানক ক্রোধে রক্তপান করে শুষে নিয়েছিল শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত। তাঁর ছোটবেলাতেও ডোবার জল থেকে মানুষের হাড় গোড় করোটি বের হওয়ার গল্প শুনেছেন তিনি। রাতের বেলা তাই এ তল্লাটে গাঁয়ের লোকের আসে না, মহা ভয়ঙ্করী প্রবলা সে দেবীকে ডরায় না গাঁয়ে তেমন মানুষ নেই।

জলাশয়ের ধার ধরে গজানো ঘাসের অবরোধের মধ্য দিয়েও দেখা যাচ্ছে জলকে। রক্তলাল সে জলের রঙ, অবিকল যেমন দেখেছিলেন গোপালবাবু তার স্বপ্নে। সেই রক্তলাল ফেনা ফেনা জলে ভাসছে ফুলে ফেঁপে থাকা মনুষ্য শরীরের মুণ্ডহীন ধড়ের অংশ, সমস্ত শরীরের খণ্ডগুলো ডোবার জল শুষে ফুলে ফেঁপে বিকট আকার ধারণ করেছে।

গোপালবাবুর পা টলে যায়, সারা জীবনে অনেক নারকীয় ঘটনার গল্প তিনি শুনেছেন, কিছু চাক্ষুষ করেছেন, কিন্তু এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যে তাঁর বুকের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত শুকিয়ে যায়, বনমালিকে ধরে বসে পড়েন তিনি। ডোবার পাশেই এক হতদরিদ্রা মহিলা ডাক ছেড়ে কাঁদছে, সম্ভবত চিনতে পেরেছে তার ঘরের লোককে। বনমালি কেঁদে ওঠে, “এ তো জেলে পাড়ার দুলাই, উয়ার বউ চিনতি পারাইছে উয়ারে! কী হইবে বঅ? দেবী ফির ঘুইরে আইল গাঁয়ে? ফির বলি চায় উয়া?”

ষাটোর্দ্ধ গোপাল ভটচাজের মন কু ডেকে ওঠে,যে প্রশ্ন বনমালির মনে, তাঁর মনেও যে সেই একই প্রশ্ন ঝড় তুলেছে! এই নরহত্যা, হাড়গোড়ের গাভায় সেই মনুষ্যশরীরের খণ্ডবিখণ্ড পাওয়া যাওয়া, এ কোন বিষম বিপদের দিকে ইঙ্গিত করছে? তবে কি? বনমালির কান্নার কোনও উত্তর না দিয়ে গোপাল ভট্টাচার্য বলে ওঠেন, “বনমালি, থানায় একটা খবর দাও।”

*****

টিলার উপর থেকে শুধু পাড়া গ্রাম নয়, চারদিকে নজর ফেরালে মানভূমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দেখা যায়। রুক্ষ পাথুরে জমি চিরে চিরে মেঠো রাস্তা গেছে দূরে, বহু দূরে। পলাশ, শাল আর মহুয়ার ঘন বনানীর মাথায় এখন শুধু কালো মেঘের আবরণ। আজ কার্তিক মাসের প্রথম অমাবস্যা, সমস্ত প্রকৃতি অদ্ভুতভাবে নিশ্চুপ, যেন কারুর অবরুদ্ধ ক্রোধ ফেটে পড়বে এক্ষুণি। মন্দিরের দরজা বন্ধ, ঠিক যেমন বন্ধ হয়েছিল বহুবছর আগে, মন্দিরের চাতালের শেষে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে আছে চিন্তামণি, গত ছমাস ধরে টিলাটায় প্রতি অমাবস্যায় এসেছে সে। প্রথম এসেছিল নিজের বাপের সাথে, রাতের অন্ধকারে চিন্তাকে শেখাতে শেখাতে দুখাইয়ের চোখ জ্বলত হিংস্র শ্বাপদের মত। ছশ বছরের ঘুমন্ত দেবীকে জাগাতে পারলে জাগতিক যা কিছু চাহিদা তার আর কিছু বাকি থাকবে না। ভূত, দৈত্য, পিশাচের অদ্ভুত বিদেহী শক্তিতে তৈরী হবে সীমাহীন ক্ষমতার আধার। আর সে আধারের একমাত্র অধিপতি হবে চিন্তামণি। দেবীকে তাই সন্তুষ্ট করতেই হবে। শিলার গোরে মাথা ঠুকতে ঠুকতে রক্ত বেরোত দুখাইয়ের, সে রক্ত হাতে নিয়ে চিন্তামণির দিকে হাত বাড়িয়ে দুখাই বলে উঠত, “কী দেখিস চিন্তা? উয়া রকত চায় বটে! দিতি লারবি?”

বাপের মুখপান চেয়ে চিন্তামণি ক্রূর হাসত। “কতক রকত লাগইবে? সব আনি দিইব।”

সেই শুরু, বাপ ছেলে মিলে গাঁয়ের বাছুর, ভেড়া চুরি করে জঙ্গল পথে উঠে আসত টিলাচূড়ায়, তারপর অসহায় পশুদের মুণ্ডচ্ছেদ করে সেই রক্ত দেবীশিলাকে অর্পণ করে আবার নেমে আসত গ্রামে। পশুদের ছিন্ন ভিন্ন শরীর ঠাঁই পেত ডোবার জলে, নিশ্চিন্ত ছিল চিন্তামণি, হারিয়ে যাওয়া পশুদের খুঁজতে কেউ অন্তত এ তল্লাটে আসবে না। কিন্তু দীর্ঘ ছমাসেও অবস্থার বিশেষ কোনও পরিবর্তন না হওয়ায় অধৈর্য হয়ে পড়ছিল চিন্তামণি। বাপকে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করত বারবার, অবশেষে গত অমাবস্যার রাতে দুখাইয়ের মুখে শুনেছিল নিষিদ্ধ, ভয়ানক সেই সত্য! দেবী হয়তো নরবলি চান! ছশ বছর আগে যে বলি বন্ধ করাতে কুপিতা হয়েছিলেন তিনি, আজ আবার তাঁর চরণে যে সেই একই ভোগ দেবে তাকে কি তিনি ফেরাবেন?

একমুহূর্ত চিন্তা করেনি চিন্তামণি, যে খাঁড়ায় কেটেছিল গাঁয়ের পশুদের মাথা, সেই খাঁড়ার এক কোপে আলাদা হয়েছিল দুখাই কুর্মির ধড় আর মুণ্ড। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা উত্তপ্ত রক্তে ভিজে উঠেছিল টিলার জমি, শিলাগাত্র। দুখাই কুর্মির আর্তনাদ হারিয়ে গিয়েছিল ঘন বনের নিস্তব্ধতায়। পাক খেতে খেতে দুখাইয়ের মাথা গিয়ে থেমেছিল দেবীশিলার গায়ে, পিতৃহত্যার রক্ত অবলীলায় শরীর থেকে মুছেছিল চিন্তা।

কিন্তু সেই ঘটনার পরও পনেরদিন কেটে গেছে। এই পনেরদিনে চিন্তা বুঝেছে দেবী এখনও মুখ তুলে তাকাননি তার দিকে, যদিও তার বিষ ঝাড়ার বিদ্যে একবারের জন্যও ভুল পড়েনি, গাঁয়ে গাঁয়ে তার নাম ছড়িয়েছে আরও, মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে ভয় বেড়েছে বিস্তর কিন্তু যে ক্ষমতার কথা সে শুনেছিল তার বাপের কাছে, সেই ক্ষমতার সিকিভাগও হাতে আসেনি তার। দেবী যে নররক্ত চান! বাপের রক্ত পাওয়ার পর থেকেই যেন দেবীর ক্ষিদে বেড়েছে, প্রতি রাতে তিনি চিন্তার স্বপ্নে আসেন, তাঁর জিভ থেকে ঝরে লাল, বিকট হাঁ মুখের সর্বগ্রাসী অন্ধকারে দেবী যেন গিলে নিতে চান সমস্ত সৃষ্টিকে। ছশ বছরের অবদমিত বুভুক্ষার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে চিন্তামণি।

দুলাইয়ের ভোগটা যেন দেবীই ব্যবস্থা করেছিলেন নিজের জন্য। না হলে, কথা নেই, বার্তা নেই, এমন নিশ্চিন্তে চিন্তার সঙ্গে এ টিলায় পা দেয় বোকা লোকটা। কুর্মিদের কেউ তো এমন নেই, যারা এ টিলার রহস্য জানে না। জাদু শেখার নেশায় সে মনে হয় ভয়ডর, বাস্তব বুদ্ধি সব ভুলেছিল। দুলাইকে নিয়ে টিলায় চড়েছিল চিন্তামণি। অন্ধকার মন্দিরের চাতালে হাঁফিয়ে বসেছিল দুলাই। দেবীশিলার সামনে ধুনি জ্বালিয়ে পূজা করে চিন্তা ডেকেছিল দুলাইকে, বলেছিল, “ইহাই সে দেবী রে দুলাই, মাথা নুয়া, আশীর্বাদ চা, মাথা নুয়া রে দুলাই।”

বিনা বাক্যব্যয়ে দেবীশিলার সামনে গড় হয়ে লুটিয়েছিল দুলাই, জানতেও পারেনি কখন খাঁড়ার কোপে মাথাটা আলাদা হয়ে যাবে শিলার ঠিক সামনে। পৈচাশিক হাসিতে মুখটা ভরে উঠেছিল চিন্তার, দেবীর কৃপা পাওয়া আর তো শুধু সময়ের অপেক্ষা! দুলাই মাহাতোর দেহের অবশেষ ঠাঁই পেয়েছিল হাড়গোড়ের গাভায়। তার জোয়ান শরীরের রক্তে ভেসেছিল শিলাশরীর, রক্তস্রোতে লাল হয়েছিল ডোবার জল। দেবীশিলার দিকে নিঃশেষে তাকিয়েছিল চিন্তামণি, দ্বিতীয় নরবলি পেয়েছেন দেবী, আর, আর কতদিন বঞ্চিত রাখবেন তিনি চিন্তামণিকে? কতদিন পরে আর তাঁর কৃপা পাবে চিন্তা?

আজও অমাবস্যা কিন্তু আজ আর কোনও মানুষকে বলি দেওয়ার জন্য যোগাড় করতে পারেনি চিন্তা। দুলাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই পুলিশের আনাগোনা বড্ড বেড়েছে গ্রামে। পুলিশ অবধি যে খবর পৌঁছাবে বুঝতে পারেনি চিন্তামণি। দুলাইয়ের শরীরটাকে ডোবায় ফেলে ভুলই করেছিল ও। গাঁয়ের লোকের খবর পেয়ে ডোবা থেকে পুলিশ তুলেছে ওর শরীরকে। দুলাইয়ের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন শরীরের সঙ্গে উঠে এসেছে চিন্তার বাপের পচাগলা শরীর আর পশুশরীরের কঙ্কাল। সকাল বিকাল এখন পুলিশ টহল দেয় ডোবার ধারে। গাঁয়ের লোকেরাও সাবধান হয়েছে বড়। কারুর অলক্ষ্যে যে কোনও বাচ্চাকেও তুলে আনবে, তারও উপায় নেই। আগলে আগলে রয়েছে সবাই সবাইকে। আজ তাই দেবীর কাছে একটা ছাগল বলি দিয়েই ক্ষান্ত দিতে হয়েছে। মাথা ঠুকে ক্ষমা চেয়েছে সে দেবীর কাছে। হাওয়া শান্ত হলে আবার ভোগ চড়াবে সে।

ঝড়ের মত শনশন হাওয়া বইতে শুরু হয়েছে হঠাৎ। সন্ধেবেলা বলি দিয়ে, পূজা করে, তাড়ি খেয়ে, মন্দিরের চাতালটায় ঘুমিয়ে পড়েছিল চিন্তামণি, ঝড়ের শোঁ শোঁ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙেছে এখন। চারিদিকে স্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে ঝড়টা যেন শুধু মন্দিরের চারপাশেই উঠেছে আজ। শুকনো পাতাগুলো উড়ে গোল হয়ে ঘূর্ণির মত সৃষ্টি করেছে, ধুলো আর পাতার ঝড়ে চোখ মেলতে পারছে না চিন্তামণি। চোখের বালি ঢুকে চোখ কটকট করতে শুরু করেছে তার, চোখ ডলতে ডলতে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে দেবীশিলার দিকে তাকিয়ে চমকে দাঁড়িয়ে যায় চিন্তামণি। দেবীশিলার জায়গাটি ফাঁকা, শিলার জায়গাটিতে মাটির মধ্যে হাঁ হয়ে রয়েছে গভীর এক গর্ত।

হঠাৎ চোখ পড়ে টিলার নীচের ডোবাটার দিকে, ডোবা থেকে উঠে আসছে যেন অপার্থিব এক আলো, সেই আলোর জ্যোতিতে চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারে চিন্তা, এতদিনে, এতদিনে দেবী বোধহয় মুখ তুলেছেন ওর দিকে। টিলা থেকে নেমে দৌড়ে ডোবার দিকে এগোয় চিন্তামণি। ডোবার জলের মাঝখানে জ্বলছে সেই মায়াবী আলো, ডোবার এক বুক জলে নেমে চিন্তামণি দ্রুত সাঁতরে সেই আলোর দিকে এগোতে চায়, হঠাৎ নিভে যায় সে আলো। ডোবার জলে আরও এগোতে গিয়েও পা আটকে যায় চিন্তামণির, অসহ্য দুর্গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসে তার। জলের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে আর ঘেন্নায় পাথর হয়ে যায় সে। মল, রক্ত, পুঁজ, চুল, হাড়, অস্থিমজ্জা, নখ, মাংস, মেদ কী না ভাসছে সে জলে? পাঁকের মতো সেই পাশবিক শরীরাংশ জড়িয়ে ধরে ওর পা, সহসা হাতে পায়ে গলায় তীব্র শূলের মত দংশন টের পায় চিন্তামণি, এক লক্ষ সূঁচ একসঙ্গে শরীরে ফুটলে যেমন ব্যথা লাগে তেমন ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে চিন্তা। ঘাড়ের কাছটায় ক্রমশঃ তীব্র হয় সে দংশন, ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই চিন্তামণি দেখতে পায় তাকে। ভয়ংকরী লোলজিহ্বা এক নারীমূর্তি, রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন তার দিকে, নারী শরীরের কোথাও কাপড়ের একটুকরোও নেই, পরিবর্তে সর্বাঙ্গ থেকে ঝরে পড়ছে রক্ত। রমণীর বাম হস্তে খাঁড়া আর ডান হস্তে শূল। আসুরিক শক্তিতে এবার শূলের আগায় চিন্তাকে তুলে নেন সে রমণী। মুহূর্তের মধ্যে বাম হস্তের খাঁড়া নেমে আসে চিন্তার গলায়। স্কন্ধকাটা চিন্তার শরীরে মুখ ডুবিয়ে সে ভীষণা নারীমূর্তি আকন্ঠ পান করেন রক্ত। নররক্তপিপাসু তিনি, ছশ বছরের সুপ্তি শেষে যে স্বাদ তিনি পেয়েছেন, সে স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে তাকে কোন দুর্বল মানবসন্তান? পান শেষে, চিন্তার রক্তশূন্য শরীরটাকে ভীষণ নখের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন করে আকাশে মিশিয়ে দেন তিনি। শরীরের টুকরো টুকরো খণ্ডাংশ এসে পড়ে ডোবার জলে। চিন্তামণির মাথাটা ছুঁড়ে ফেলেন ডোবার ধারে, যেন দেবী প্রমাণ রাখতে চান তাঁর কৃতকর্মের। জলের মধ্যে আলোড়ন তুলে দেবীমূর্তি তারমধ্যে অন্তর্হিত হন, ডোবার জল আবার ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায়।

*****

পুলিশের কর্ডনটায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কাউকে, পাড়া গাঁয়ের কুখ্যাত গাভায় আবার পাওয়া গেছে মনুষ্য শরীরের অংশ। দূর থেকে মৃত স্তূপাকৃতি শরীরাংশ দেখে মাথাটা ঘুরে যায় গোপাল ভট্টাচার্যের। অনেক চেষ্টায় পেটের নাড়িভুড়ি গুলিয়ে উঠে আসা টক জ্বালাধরানো বমি ভাবটাকে চেপে ডোবার পাশ থেকে সরে আসার সময়ই একটি ধড়হীন রক্তশূন্য মুণ্ডে চোখ পড়ে আঁতকে ওঠেন গোপাল বাবু। এক কোনায় ছিটকে কোনওভাবে এসে পড়েছে মাথাটা, এ মুণ্ড কোনও পশুর নয়, লালচে খয়েরি চুলে লেগে থাকা জল টুপটুপাচ্ছে এখনও, মৃত্যুর সময় যে আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়েছিল চোখদুটি, মৃত হলদেটে উন্মুক্ত চোখে এখনও সে বিস্ফারিত আতঙ্কের ছাপ। জিভের অধিকাংশ অংশ ঝুলছে মুখগহ্বরের ফাঁক দিয়ে, বোঝা যাচ্ছে বড় যন্ত্রণা পেয়ে মৃত্যু হয়েছে এই মধ্যবয়সী মানুষটির। মাথাটা সদ্য কাটা, হয়তো কালই এ নরমুণ্ডকে ধড় থেকে আলাদা করা হয়েছে। নরমুন্ডটাকে দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না গোপালবাবুর, সারা গাঁয়ের লোক একে একডাকে চেনে। এ মুণ্ড আর কারুর নয়,জেলেপাড়ার চিন্তামণি কুর্মির। হুবহু ছশ বছর আগের কাপালিকের মত কে যেন তার ছিন্ন মুণ্ড গভীর আক্রোশে ছুঁড়ে ফেলেছে হাড়গোড়ের গাভার ধারে।

রক্ত, পুঁজ, পিত্ত, হাড়মাসে ভরা ডোবার জলের দিকে আবার তাকান গোপালবাবু। প্রত্যহ পঠিত দেবী ভাগবত পুরাণে বর্ণিত পুতিগন্ধময় সেই নরকের কথা মনে পড়ে তাঁর, অবিরত যাতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে প্রাণী শরীর। জীবহত্যার রক্তে পুষ্ট হচ্ছে ভীষণ সেই জগৎ। মানুষ বা মনুষ্যেতর প্রাণীর দেহাবশেষ, রক্ত, মল, মূত্রে ভরা সেই নরক থেকে উঠে আসছে বীভৎস গন্ধ। বিসাশনা নাম্নী সেই নরকে পাপীদের শরীরে কষাঘাত করছে যমদূতেরা। তাদের শরীরের ছিন্নাংশে ভরে উঠছে নরক। টিলার মন্দিরের দিকে তাকিয়ে ছয় শতাব্দী পূর্বের পূজিতা ভয়াল দেবীকে স্মরণ করে শিউরে ওঠেন গোপালবাবু। এ কী নরক সৃষ্টি করলেন দেবী? কে জানে কী আছে তাঁর মনে? আরও কত নররক্তে শান্ত হবেন ভয়ঙ্করী সে দেবী! সম্পূর্ণ ধ্বংসই কি তবে পাড়া গ্রামের ভবিষ্যৎ!

[পাড়া গ্রামে সত্যিই কিংবদন্তী রুক্মিণী দেবীর মন্দির রয়েছে এখনও, হাড়গোড়ের গাভাটিও দৃশ্যমান… এই সেই দেবী যাকে ধলভূমে পরে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং প্রথিতযশা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে নিয়ে কিংবদন্তী গল্প লেখেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *