বিষ্ণুপ্রিয়া
(নাটক)
চরিত্র
পুরুষ :
শ্রীগৌরাঙ্গ (নিমাই), শ্রী নিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত, শ্রীবাস, মুকুন্দ, গদাধর, ঈশান, সনাতন মিশ্র, চন্দ্রশেখর আচার্য, যাদব, বুদ্ধিমন্ত।
স্ত্রী :
শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া, শচীমতা, সর্বজয়া, মালিনী, সীতাদেবী, কাঞ্চনা, অমিতা, নদীয়া নাগরীগণ, কুল-ললনাগণ।
প্রথম দৃশ্য
(শ্রীগৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার বিবাহ-বাসর। সবেমাত্র কন্যা সম্প্রদান হইয়া গিয়াছে। বিপুল জনগণের (কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষের) মুহুর্মুহু আনন্দ-ধ্বনির সহিত অজস্র যন্ত্রের মধুর সংগীত ও বাদ্যধ্বনি শুনা যাইতেছে। হুলু ও শঙ্খধ্বনির যেন বিরাম নাই।)
জনৈকা কন্যাপক্ষীয় দাসী :
বর কনেকে এখন বাসর-ঘরে নিয়ে এসো না গো! কন্যা সম্প্রদান তো কখন হয়ে গেছে। ওদের ছাদনাতলায় ধরে রেখে যেন সব ঠাকুর দেখছেন।
বরপক্ষীয় জনৈক লোক :
হ্যাঁ গো ঠাকরুন! আমরা ঠাকুরই দেখছি, এই যুগল-মিলন তো তোমরা মেয়ের দল সারারাত ধরে প্রাণ ভরে দেখবে আর আমরা বেচারা পুরুষের দল বাইরে বসে কড়িকাঠ গুনব।
অন্য আর একজন :
বেঁচে থাক দাদা। জোর বলেছিস। যুগল-মিলনের এই গোলোক- ধামে ঠাকুর এক-চোখোমি করতে পারবে না। আর করলেও আমরা তা মানব কেন। আধাআধি বখরা করো – রাজি আছি। অর্ধেক রাত আমরা দেখব – অর্ধেক রাত তোমাদের ছেড়ে দেব।
অন্য আর একজন বরপক্ষীয় লোক :
হেরে গেছে! হেরে গেছে। আমাদের বর বড়ো – বর বড়ো!
কন্যাপক্ষীয় দুইজন :
কক্খনো না, কনে বড়ো। এই আমরা তুলে ধরলাম কনেকে।
বরপক্ষীয় দুইজন :
পিঁড়ি যতই উঁচু কর না দাদা, আমাদের বরের নাগাল পাচ্ছ না-পুরো পাঁচ হাত লম্বা বর।
যাদব :
কাকিমা মানা করছেন, তোমরা দিদিকে এত উঁচুতে তুলো না, দিদি পড়ে যাবে।
কন্যাপক্ষীয় দাসী :
ওগো, মা ঠাকরুনরা বলছেন, তোমাদের বরই বড়ো। এখন ওদের বাসর-ঘরে আনতে ছেড়ে দাও।
বরপক্ষীয় লোক :
হেরে গেছে! কনে হেরে গেছে! দুয়ো! দুয়ো!
যাদব :
(মুখ ভ্যাঙচাইয়া) হেঁরেঁ গেঁছেঁ। হেঁরেঁ গেঁছেঁ। কখ্খনো না, দিদি বড়ো, জামাইবাবু ছোটো!
বরপক্ষীয় লোক :
তোমরা যতই চ্যাঁচাও, আমরা যুগল-মিলনের গান না গেয়ে ছাড়ছিনে। কনেকে বরের বাম-পাশে দাঁড় করাও, আমরা দেখি, যুগল-মিলনের গান গাই তারপর, – না কি বল বুদ্ধিমন্ত!
বুদ্ধিমন্ত :
নিশ্চয়! তাহলে মুকুন্দ তুমিই গানটা গাও আর আমরা ধুয়া ধরি।
(মুকুন্দের গান)
একী অপরূপ যুগলমিলন হেরিনু নদিয়া-ধামে
বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী যেন রে গোলোক-পতির বামে॥
একী অতুলন যুগল-মুরতি
যেন শিব-সতী হর-পার্বতী
জনক-দুহিতা সীতা দেবী যেন বেড়িয়া রয়েছে রামে॥
গৌরের বামে গৌর-মোহিনী
(যেন) রতি ও মদন চন্দ্র-রোহিণী
(তোরা) দেখে যারে আজ মিলন-রাসে
যুগল রাধা শ্যামে॥
(হুলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, উভয়পক্ষীয় লোকের আনন্দ-চিৎকার, মধুর বাদ্যধ্বনি ইত্যাদি)
দ্বিতীয় দৃশ্য
বাসর ঘর
(বাসর-ঘরে নদিয়া নাগরীগণ ও কুলমহিলাগণের হুলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, কলগুঞ্জন, বলয়-কিঙ্কিণির সুমধুর ঝংকার।)
জনৈক মহিলা :
মাগো মা অনেক বিয়েও দেখেছি, বরযাত্রীও দেখেছি, কিন্তু এমন আদেখ্লে বরযাত্রী আর দেখিনি। ওরাই তো আদ্ধেক রাত্তির করে দিলে, তার ওপর বর-কনের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে গেল ঘণ্টাখানেক।
অন্য একজন মহিলা :
যা বলেছ দিদি, সব রস ওরাই নিংড়ে নিল ওদের কেঠো হাত দিয়ে। আমাদের দিল ছিবড়ে চিবুতে।
পূর্ব মহিলা :
নে লো নে,বাকি যেটুকু রাত আছে তাও হট্টগোল করে কাটিয়ে দিসনে। নাও, জামাইয়ের বামে একবার কনেকে নিয়ে বসাও দেখি। আহা, কি মানিয়েছে-ওলো তোরা দেখ, একবার নয়ন ভরে দেখ। সোনার গৌরের পাশে সোনার পিত্তিমে। বিয়ের এত আলো যেন এদের রূপের কাছে মিটমিট করছে।
অন্য একজন পুরস্ত্রী :
কী গো বর মশাই ? আজ যে বড়ো জিভ উলটে নিম্নমুখো হয়ে বসে আছ। তোমার চঞ্চলতায় নাকি সারা নবদ্বীপ কম্পমান, তোমার দাপটে নাকি গঙ্গার স্রোতে কাদা উঠে, আর আজ আমাদের সখীকে দেখে একেবারে গুটিসুটি মেরে বসে আছ। ভয় হচ্ছে নাকি?
নিমাই :
আজ বাসর-ঘরে আপনারই কর্ণধারিণী। আমার দেহ-তরির মাত্র দুটি কর্ণ, আর তা দেখে আপনাদের শত কর্ণধারিণীর দুশো হাত উসখুস করছে; তাই ভয় হচ্ছে – তরি আমার ভরা-ডুবি না হয়।
জনৈক মহিলা :
ওলো, চঞ্চলের মুখ খুলেছে। সাবধান! ভালো করে সব কর্ণ ধরিস, পাশে রয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া জোয়ারের টানের মতো। তাই বুঝি ওঁর ভরসা যে, আমাদের হাত থেকে কর্ণ ছাড়িয়ে চলে যাবেন।
জনৈক কিশোরী :
এই চঞ্চল আমাদের কম জ্বালিয়েছে, ভাই। গঙ্গায় এঁর জ্বালায় সোয়াস্তিতে নাইবার উপায় ছিল না। দল বেঁধে সাঁতরে গঙ্গাজলকে যেন দধি-কাদা করত। কখন যে কলশি নিয়ে মাঝগঙ্গায় ভাসিয়ে দিত, মেয়েদের কাপড় নিয়ে পুরুষদের ঘাটে, পুরুষদের কাপড় নিয়ে মেয়েদের ঘাটে রেখে আসত, আমরা টেরও পেতাম না। তারপর কুমীর হয়ে ডুব-সাঁতার দিয়ে পায়ে ধরে টান। আমরা কিছু ভুলিনি, আজ কড়ায়-গণ্ডায় তার শোধ নেব। বুঝলে চঞ্চল পণ্ডিত?
নিমাই :
আমায় পণ্ডিত বলে গালাগালি করছেন কেন? তার চেয়ে কঠিন করাঘাত ঢের মিষ্টি। যে চুরি করতে ভয় পায় না, শাস্তি নিতেও তার ভয় নেই।
অমিতা :
তুই এমন এলিয়ে পড়েছিস কেন লা বিষ্ণুপ্রিয়া? ক্লান্ত যদি হয়ে থাকিস বরের গায়ে হেলান দিয়ে বস না!
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(চুপিচুপি) ভাই অমিতা! আমার কিছু ভালো লাগছে না। বাসর-ঘরে আসবার সময় কেমন যেন অজ্ঞানের মতো এলিয়ে পড়েছিলাম।
অমিতা :
তা তো পড়বিই। এত সুন্দর বর পেলে সবাই মুর্ছে যায়।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ! শুনবে যে! না ভাই শোন–সেই সময় হোঁচট খেয়ে আমার আঙুল দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে।
অমিতা :
মাগো! কীহবে! এ কী অলুক্ষণে কথা গো!
দু-একজন মহিলা :
কী রে, কী হল অমিতা! কী বলছিস তোরা।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
চুপ! চুপ! বলিসনে কাউকে।
অমিতা :
কিচ্ছু না। এমনি। তোমরা চোরের শাস্তি দিচ্ছ দাও না। হ্যাঁ তারপর? কী করলি তুই?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমি বোধ হয় উহ্ করে উঠেছিলাম। অমনি উনি ওঁর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার পায়ে আঙুল চেপে ধরলেন। অমনি রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বেদনাও আর রইল না। তবু কেন যেন আমার বুক কাঁপছে ভাই ভয়ে।
বিধুমুখী :
কী হয়েছে মা! তোমার মুখ চোখ অমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কিচ্ছু না, কাকিমা। সত্যি,কিছু হয়নি।
অমিতা :
সারাদিন উপোস করেছে, তারপর খেয়েই এই হট্টগোল। তুমি যাও কাকিমা, আমরা আছি। বেশি ক্লান্ত হলে ওকে আমরা শুইয়ে দেব।
একজন মহিলা :
ইস্! শুইয়ে দিলেই হল আর কী। আমরা বুঝি যুগল-মিলন দেখব না। ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময় যেমন হেসে দুজন চোখ চাওয়া-চাওয়ি করেছিলে, তেমনি করে আর একবার চাও, নইলে ছাড়ছিনে।
নিমাই :
তা যত ইচ্ছে চিমটি কাটুন, ও অপকর্ম এত লোকের সামনে করতে পারব না।
উক্ত মহিলা :
কী! অমন সুন্দর মুখের দিকে চাওয়া বুঝি অপকর্ম। লুকিয়ে লুকিয়ে এর মধ্যে তো একশোবার দেখে নিলে, আমাদের চোখ তোমাদের চোখের মতো ডাগর না হলেও দেখতে পাই।
নিমাই :
তাহলে আবার ধরা পড়ে গেছি। চোরের আবার শাস্তি চলুক।
জনৈক তরুণী :
এবার শাস্তি হাত দিয়ে নয়, কথা দিয়ে।
অন্য একজন তরুণী :
শুধু কথার বাণ নয় লো, তাতে সুরের বিষ মিশিয়ে।
নিমাই :
প্রমীলার দেশে যখন এসে পড়েছি তখন আর উপায় তো নেই। আঁখি বাণ সহ্য করেও যদি বেঁচে থাকতে পারি, বাক্যবাণও বোধ হয় সইবে।
জনৈক তরুণী :
তাহলে বীর প্রস্তুত হও।
(গান)
প্রেম-পাশে পড়লে ধরা চঞ্চল চিত-চোর
শাস্তি পাবে নিঠুর কালা এবার জীবন-ভোর॥
মিলন রাসের কারাগারে
প্রণয়-প্রহরী রাখব দ্বারে
চপল চরণে পরাব শিকল নব অনুরাগ-ডোর॥
শিরীষ-কামিনী ফুল হানি জরজর করিব অঙ্গ
বাঁধিব বাহুর বাঁধনে দংশিবে বেণি-ভুজঙ্গ
কলঙ্ক-তিলক আঁকিব ললাটে হে গৌর-কিশোর॥
(হুলুধ্বনি, আনন্দধ্বনি ইত্যাদি–বাহিরে বাদ্য।)
তৃতীয় দৃশ্য
নিমাই পন্ডিতের ভবন
(কাঞ্চনা বিষ্ণুপ্রিয়াকে ফুলসজ্জায় সজ্জিত করিতেছে ও গুনগুন করিয়া গান করিতেছে। গানের শব্দ শোনা যাইতেছে না, তবে তাহার করুণ সুরে সারা গৃহ যেন ভরপুর হইয়া উঠিয়াছে।)
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি কেবলই গান করছ আর আমায় ফুলের গয়না পরাচ্ছ, তুমি কে ভাই? কতবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম তো বললে না। এখন কেউ নেই, এসো এইবেলা আমরা সই পাতিয়ে নিই। লোক এসে পড়লে আর কথা বলতে পারব না।
কাঞ্চনা :
সতিনের সঙ্গে সই পাতালে দুঃখ পাবে ভাই।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সতিন?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ সতিন। শুধু আমি নই ভাই, এই নদিয়া নগরের সকল কিশোরী কামিনী তোমার সতিন। তোমার ভাগ্যের ঈর্ষা করে, রূপের হিংসা করে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(হাসিয়া) ওঃ। সেই সতিন! তাহলে তোমায় সতিন বলে ডাকব?
কাঞ্চনা :
চুপ! দেয়ালেরও কান আছে। কেউ শুনতে পাবে এখন। আর অমনি সে ছুটে এসে আমাকে দেখিয়ে বলবে, ও নয়, আমিই তোমার সতিন। আচ্ছা ভাই গৌর-প্রিয়া–
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(কাঞ্চনার মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া) আমার নাম গৌর-প্রিয়া নয়, আমি বিষ্ণুপ্রিয়া।
কাঞ্চনা :
এতদিন বিষ্ণুপ্রিয়া ছিলে, এখন গৌর-প্রিয়া হয়েছ।
(সুরে)
তার কে গড়িল গৌর-অঙ্গ
চাঁদে চন্দন মাখিয়া গো
আমি শান্তি না পাই তারে কোথাও রাখিয়া গো
এই বুঝি হবে চুরি সদা ভয় ভয়
হৃদয়ে পাইয়া তবু কাঁপে এ হদয়
নয়নে পেয়ে যে চাঁদে তবু এ নয়ন কাঁদে
কোথা পাব হেন ঠাঁই যথা আর কেহ নাই
থাকিবে দুজন, গৌর আর গৌর-প্রিয়া গো॥
শচীমাতা :
পাগলি মেয়ে, বসে বসে গান গাচ্ছিস বুঝি? বউমাকে সাজানো হল?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ মা, কখন সাজানো হয়ে গেছে। দেখ দেখি কেমন মানিয়েছে।
শচীমাতা :
আহা মরে যাই! কী সুন্দর সাজাতে পারিস তুই কাঞ্চনা। চিরএয়োতি হয়ে বেঁচে থাকো মা। তোমার স্বামীকে ফিরে পাও। আমি আসি, তোমরা তাহলে ফুলশয্যার ব্যবস্থা করো।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোমার নাম কাঞ্চনা? কী মিষ্টি নাম। যেমন দেহের কাঞ্চন বর্ণ তেমনই নাম। আর গুণ –
কাঞ্চনা :
কোনো গুণ নাই তার কপালে আগুন।
কয়েকটি তরুণী :
মাগো! পান সাজতে সাজতে হাত আমাদের চুনে খেয়ে ফেললে। কাঞ্চনা বেচারি একা – ওলো দেখে যা, কী সুন্দর সুন্দর ফুলের গয়না দিয়ে কাঞ্চনা বউকে সাজিয়েছে। আহা! যেন দুগ্গো পিত্তিমে।
দুই-তিনজন :
চমৎকার!
একজন :
কাঞ্চনা আর জন্মে বৈকুণ্ঠের মালিনী ছিলি ভাই!
অন্য একজন :
কাঞ্চনা দিদি! মা মাসিমা কেউ নেই, এইবেলা এই ফুলসাজের একটা গান গেয়ে শোনা না ভাই! নতুন বউ জানুক যে তুই শুধু মালিনী নস – গানে – কী বলব ভাই? নাচেতে উর্বশী – গানে – গানে –
অন্য একজন মেয়ে :
সরস্বতী। নে ভাই, এইবেলা টুক করে গেয়ে নে, নইলে ভিড় জমলে তুইও গাইবিনে, আমরাও শুনতে পাব না।
(কাঞ্চনার গান)
মুকুল-বয়সি কিশোরী সেজেছে ফুল্ল ফুল-মুকুলে।
শিরে কৃষ্ণচূড়ার মুকুট, গলে মালতীর মালা দুলে॥
যুথী ফুলের সিঁথি-মোর, দোলন-চাঁপার দুল
কটিতটে চন্দ্রহার হলুদ-গাঁদার ফুল
অশোক-কুঁড়ির রাঙা নূপুর রাঙা চরণ-মূলে॥
কদম-ফুলের রত্ন-বাজু বকুল ফুলের চুড়ি
হাতে শোভে কেয়ূর কাঁকর কুন্দ বেলের কুঁড়ি।
আসবে কবে বনমালী ঘুমে ফুল-বালা পড়ে ঢুলে॥
চতুর্থ দৃশ্য
শচীমাতা :
নিমাই! এ ঘর ও ঘর করে কী খুঁজছিস বাবা?
নিমাই :
(আমতা আমতা করিয়া) কী যেন খুঁজছিলাম মা, খুঁজতে খুঁজতে ভুলে গেছি।
শচীমাতা :
(হাসিয়া) তুই থির হয়ে বস দেখি। আমি বউমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। (যাইতে যাইতে) বউমা! নিমাইকে পান দিয়ে এসো তো মা।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ছি ছি ছি ছি! মা কী মনে করছেন বলো তো। পড়াতে পড়াতে পাঁচ বার তো পান চাইতে বাড়িতে এলে।
নিমাই :
এবার কিন্তু পান চাইতে আসিনি । পড়াতে বসে কীসের যেন সূত্র ভুলে গেলাম–তাই একটা বই খুঁজতে এলাম॥
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি ভারী দুষ্টু! তুমি কখ্খনো বই খুঁজতে আসনি। আমি জানি তুমি কী খুঁজতে এসেছ।
নিমাই :
বউ খুঁজতে, – লক্ষ্মী?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আচ্ছা, তুমি আমায় আমার সতিনের নাম ধরে ডাক কেন বলো তো? লক্ষ্মী তো তোমার প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল। তুমি দিদি কে খুব ভালোবাসতে, না?
নিমাই :
খুব ভালোবাসলে সে কি ছেড়ে যেতে পারত? তাই এবার বিয়ে করে তোমাকে নিয়ে আবার খুব ভালোবাসার সাধনা আরম্ভ করেছি।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাও! সত্যি বলো না, কেন আমায় যখন তখন ওই বলে ডাক ?
নিমাই :
যিনি লক্ষ্মী তিনিই বিষ্ণুপ্রিয়া, যে বিষ্ণুপ্রিয়া সে-ই লক্ষ্মী। আচ্ছা, এবার থেকে তোমায় প্রিয়া বলে ডাকব, তাহলে খুশি হবে তো?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোমার পায়ে পড়ি, ওতে আমার আরও লজ্জা করবে, তার চেয়ে তুমি বরং লক্ষ্মীই বোলো।
নিমাই :
আরে, আমি কি পাড়ার লোক ডেকে সভা করে, তোমায় প্রিয়া বলে ডাকব? এই আড়ালে আড়ালে –দুজনে যখন এমনি একা থাকব, তখন। আমি অনেক দিন থেকে ভাবছি তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব প্রিয়া, তুমি সত্য করে বলবে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ও কী কথা বলছ তুমি। তুমি যে স্বামী, নারায়ণ, তোমার কাছে মিথ্যা বললে যে আমার মরলেও স্থান হবে না।
নিমাই :
আমি দোজবরে বলে কি তোমার মনে কোনোরূপ দুঃখ আছে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(অশ্রু ছল ছল কণ্ঠে) তোমার পায়ে পড়ি, তুমি অমন কথা বোলো না, ও-কথা শুনলেও পাপ হয়। আমি তোমার এই পা ছুঁয়ে বলছি–তোমার মুখে শোনবার আগে ও-কথা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি। তুমি কেন এ কথা বললে বলো! ও-কথা মনে আসবার আগে যেন আমার মরণ হয় – মরণ হয় –
নিমাই :
ওকী! এই সামান্য কথায় এমন করে কাঁদতে আছে? তুমি এত কষ্ট পাবে জানলে আমি কখনই এ-কথা বলতাম না। আমি এমনি রহস্য করে বললাম মাত্র, আর অমনি মানিনীর মানে আঘাত লাগল। আচ্ছা,আর একটি কথার উত্তর দাও দেখি। বিয়ের আগে তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাও! কে তোমাকে এ কথা বললে? তুমি সকলের অন্তর্যামী কিনা।
নিমাই :
নিশ্চয়ই। আমি যখন স্বামী অর্থাৎ কিনা নারায়ণ, কাজেই অন্তর্যামীও। নইলে তোমার অন্তরের কথা কী করে জানলাম?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি কিছু জান না। জানলে বিয়ের আগে অমন করে কাঁদতে না।
নিমাই :
ও! তোমার সঙ্গে বিয়ের আগে একবার সম্বন্ধ ভাঙে ভাঙে হয়েছিল, সেই কথা বলছ বুঝি? তাতে কিন্তু আমার কোনো দোষ ছিল না। আমাকে না জানিয়েই মা কাশী মিশ্রকে পাঠিয়ে ছিলেন সম্বন্ধ ঠিক করতে। তাই তোমাদের গণক ঠাকুরকে বলেছিলাম, আমি বিয়ের কিছু জানিনে। কিন্তু তারপর আমি তো আবার লুকিয়ে লোক পাঠিয়েছিলাম বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সে তোমার দয়া। সবাই বলে, তুমি করুণাময়। নইলে আমার কী দশা হত তাই ভাবি।
নিমাই :
তাহলে তোমারও দশা পাবার অবস্থা হয়েছিল বলো। তাই তো বলি, রোজ রোজ গঙ্গার ঘাটে আমার মাকে তোমার এত ঘটা করে প্রণাম করার মানে কী। আর দিনে দশবার করে গঙ্গার ঘাটে আসারই বা হেতু কী?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি পণ্ডিত মানুষ, ন্যায়শাস্ত্রবিদ, তাই ধোঁয়া দেখলেই সেখানে আগুনের সন্দেহ কর। আমার বয়ে গেছিল তোমাকে দেখতে যাবার জন্য। আমি যেতুম মাকে দেখতে।
নিমাই :
কিন্তু মা তো থাকতেন তোমার ঘাটেই, তুমি হাঁ করে আমি যে ঘাটে সাঁতার কাটতাম সেদিকে চেয়ে থাকতে কেন?
[দূরে কাঞ্চনার গান]
সিনান করিতে গিয়েছিনু সই সেদিন গঙ্গাতটে।
উদয় হলেন গৌরচন্দ্র অমনি হৃদয় পটে॥
নির্মল মোর মনের আকাশে
উঠিয়া সে চাঁদ মৃদু হাসে,
তারে লুকাইতে নারি, সখী ভয়ে মরি, বুঝি কলঙ্ক রটে॥
নিমাই :
(এক লাইন গানের পর) আমি পালালুম কিন্তু। তোমার মুখরা সখীকে আমার বড়ো ভয়। ও কোন দিন আমাকে ধরিয়ে দেবে দেখছি।
[প্রস্থান]
পঞ্চম দৃশ্য
কাঞ্চনা :
পণ্ডিতমশাই ভয়ে পালিয়ে গেলেন বুঝি?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কার ভয়ে কাঞ্চনা?
কাঞ্চনা :
ধরা পড়ার ভয়ে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
দূর পোড়ামুখী! আচ্ছা ভাই কাঞ্চনা, তুই যখন তখন ওকে কঠিন কথা শুনাস, তোর ভয় করে না?
কাঞ্চনা :
একটুকুও না। ওই দুরন্ত পণ্ডিত মশাইটি চিরকাল আমার কাছে জব্দ। ছেলেবেলায় ওর ভয়ে আর সব মেয়ে অস্থির থাকত, কিন্তু আমায় দেখলেই উনি একেবারে কেচোঁটি হয়ে যেতেন। আমি বলতাম, তোমাদের সকলের সঙ্গে আড়ি, আর আমার সঙ্গে ভাব কেন? উনি বলতেন – ভক্তিকে ভগবান বড়ো ভয় করেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আচ্ছা, ভয় না হয় নাই করলি, পর-পুরুষ বলে লজ্জাও হয় না?
কাঞ্চনা :
ওঁর সঙ্গে আমার এই ভাব তো লুকানো ছাপানো নয় ভাই গৌর-প্রিয়া, সারা নদিয়ার লোক জানে ওঁর-আমার এই প্রীতি। আমি এই পাড়ারই মেয়ে। ছেলেবেলা থেকে ওঁকে দেখেছি, আজন্ম ওঁর সঙ্গে খেলেছি – আর আমাদের সে খেলায় লজ্জার কিছু ছিল না। তা ছাড়া ওঁকে আমার কখনও পর-পুরুষ বলে মনে হয় না, যখনই দেখেছি মনে হয়েছে উনি আমার পরম পুরুষ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা, তোর মতো প্রেম যদি পেতাম –
কাঞ্চনা :
তাহলে ওঁর টোল এতদিন উঠিয়ে দিতে, আর রাতদিন উনি তোমারই পাঠশালায় প্রেমের পাঠ নিতেন, এই তো?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ! তোর সঙ্গে কথায় সরস্বতীও হার মেনে যায়–
কাঞ্চনা :
আর তোমার গুণে যে লক্ষ্মী স্বর্গে পালালেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুই আমাকে সতিনের কথা মনে করিয়ে দিস কেন বল তো? আচ্ছা ভাই, দিদি খুব সুন্দরী ছিলেন, না? আর তোর সঙ্গে ওঁর বুঝি আমার চেয়েও বেশি ভাব ছিল?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ, সুন্দরী খুবই ছিলেন, তবে তোমার মতো না। ওঁর রূপে চাঁদের জ্যোতির চেয়ে সূর্যের তেজ বেশি ছিল। আর ভাব আমার এতটুকু ছিল না ওঁর সঙ্গে। যখন তখন ওঁর সঙ্গে ঝগড়া করতাম আর বলতাম – ঠাকরুন তুমি বৈকুণ্ঠের অধীশ্বরী। আমাদের ব্রজেশ্বরীর আসবার সময় হল, এবার তুমি সরে পড়ো না। এ রসের ব্রজে ব্রজেশ্বরী আর গোপিনিদের লীলা তুমি সইতে পারবে না। ঠাকরুন ভালো মানুষ, এই সব শুনে এবং বুঝে স্বর্গে চলে গেলেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা, কেন তুই ওঁর কথা এলেই ওঁকে ভগবান ভেবে কথা বলিস বল তো? তোর কথা শুনে আমার বড়ো ভয় হয়, সই। উনি যদি সত্যি সত্যিই ভগবান হয়ে যান তাহলে আমার কী অবস্থা হবে? আমি কোথায় দাঁড়াব? এক একবার আমারও মনে হয় উনি ছল করে মানুষ সেজে এসেছেন। ওঁর চোখ মুখ রূপ গুণ সব যেন বলে দেয়, আমি কারুরই নই – আমি একা।
কাঞ্চনা :
সত্যিই উনি পরম একাকী। আমাদের নিয়ে যে ওঁর এই লীলা এ ওঁর অসীম দয়া। তোমার কেন ভয় হয় গৌর-প্রিয়া জানি না, আমার কিন্তু ভয় হয় না। না, না, ভয় হয় বলেই তুমি ব্রজেশ্বরী, গৌরবক্ষ-বিলাসিনী। তুমি যে প্রেমময়ী তাই মধুর রূপ ছাড়া তাঁর অন্য রূপের কল্পনাও করতে পার না। আমরা সাধারণ মানুষ, – তাই দেবতাকে প্রিয়রূপে ভাবতে পারি না।
নিমাই :
যাক। আমি আর পণ্ডশ্রম করে মরি কেন, কাল থেকে টোলের ছাত্রদের বলে দেব, এই ঘরেই তারা ভাগবতের পাঠ নেবে।
কাঞ্চনা :
(চিৎকার করিয়া) মা দেখে যাও, আবার আমাদের জ্বালাতন করছে। তোমার ছেলেকে সামলাও, নইলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
শচীমাতা :
নিমাই! আবার কেন ওদের সঙ্গে লাগতে গেলে বাবা? ওরা দুটিতে আপনার মনে আলাপ করছে –
নিমাই :
আলাপ নয় মা প্রলাপ, একবার শুনে যাও না এসে।
শচীমাতা :
তা ওরা যা ইচ্ছা বকুক, তোর তাতে কাজ কী বাপু? আমি তখন থেকে কলা আর দুধ নিয়ে বসে আছি – আয় খেয়ে নে।
কাঞ্চনা :
মা, দুধকলা খাইয়ে ওঁকে পুষছ – বুঝবে যখন দংশন করে চলে যাবে।
[ বলিতে বলিতে প্রস্থান।]
ষষ্ঠ দৃশ্য
শচীমাতা :
বউমা! একী মা লক্ষ্মী। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছ? ছি মা! কাঁদতে নেই, নিমাই-এর আমার অমঙ্গল হবে। এইমাত্র খবর পেলুম, নিমাই কাল গয়া থেকে ফিরে আসবে। পাগলি মেয়ে, বললাম দুদিন মায়ের কাছে গিয়ে থেকে এসো, তবু খানিকটা মন ভালো থাকবে। তা আমায় ছেড়ে যেতে চাইল না।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
মা, উনি যে যাবার সময় তোমার কাছে থেকে তোমার সেবা করতে বলে গেছেন। আর, তোমাকে মা পেয়ে আর কেউ যে আমার মা ছিল, তা ভুলেই গেছি।
শচীমাতা :
ও-কথা বলিসনে মা। আমার বেয়ান শুনতে পেলে আমায় ডাইনি বলবে। – এই কাঞ্চনা আসছে – তোমরা দুটি সখীতে বসে গল্প করো – হ্যাঁ মা, আর ওকেও বলো যে আমার নিমাই কাল ফিরে আসবে – আমি যাই – মালিনী সইকে, সর্বজয়াকে জানিয়ে আসি খবরটা।
[কাঞ্চনার গান]
প্রথম যৌবনে এই প্রথম বিরহ গো।
(তাই) সহিতে না পেরে রাই, কাঁদে অহরহ গো।
(ফুল) শয্যারে মনে হয় কন্টক শয্যা
কাঁদিতে পারে না, যত ব্যথা তত লজ্জা,
প্রবাসী বঁধুরে ঘরে আসিতে কহো গো॥
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা সই, তোর গান এখন রাখ। শোন, মা বলে গেলেন, উনি কাল আসবেন।
কাঞ্চনা :
(সুরে) কাল কাল করে গেল কতকাল
কালের নাহিকো শেষ –
কাল নাই যথা বন্ধুরে লয়ে
যাব আমি সেই দেশ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সত্যি বলছি, মা এইমাত্র ছোটো মাসিকে খবর দিতে গেলেন। মা-র সে কী খুশি ভাই, যত হাসেন তত কাঁদেন।
কাঞ্চনা :
আমার কিন্তু না-আসা পর্যন্ত বিশ্বাস হয় না, ভাই। যদি আসেন তাহলে বুঝব এবার নবদ্বীপে এসে ঠাকুর ভদ্রলোক হয়েছেন। ভদ্রলোকের যে কথা রেখে চলতে হয় এ জ্ঞান তো ওঁর ব্রজে ছিল না, আর ও-জ্ঞান হবেই বা কোত্থেকে! গয়লা ছোঁড়াদের সঙ্গে গোরু চরিয়ে কে কবে ভদ্রলোক হয়েছে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
না ভাই লক্ষ্মীটি, ঠাট্টা রাখ। এখন কী করব বল দেখি? আমার বুকের ভিতর যেন কেমন করছে, শরীর কাঁপছে।
কাঞ্চনা :
করবে আর কী। এসো, দুই সখীতে গলা ধরে ধেই ধেই করে নাচি। এতদিন যে বিরহ আমাদের কাঁদিয়েছে, সেই বিরহের বুকে বসে তার দাড়ি উপড়াই।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোর কথা আমার কিছু ভালো লাগছে না, কাঞ্চনা। কাল যদি ভোর না হতেই এসে পড়েন, তখন ফুল পাব কোথা। এখনও সন্ধ্যা লাগেনি, তুই পাড়ায় গিয়ে কার বাড়িতে কী ফুল পাওয়া যায়, দেখ না লক্ষ্মীটি।
কাঞ্চনা :
আচ্ছা, আমি চললাম। আমি কিন্তু বেছে বেছে সেই ফুল আনব, যে ফুলে কাঁটা আছে। (প্রস্থান)
শচীমাতা :
এই ঘরে বেয়ান, এই ঘরে তোমার মেয়ে। সর্বজয়া, মালিনী সই, তোমরাও এসো বউমার ঘরে – বউমা, বউমা, দেখো আমার দুই বেয়ানকে, তোমার মাকে, খুড়িমাকে ধরে এনেছি।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
একী! মা! খুড়িমা!
মহামায়া :
আহা! মা আমার এই কদিনে কী রকম শুকিয়ে গেছে, দেখেছিস বিধু।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমার কোলে বসে থাকতে লজ্জা করচে মা, নীচে নেমে বসি।
মহামায়া :
ওরে তোর কোলে ভগবান যদি সন্তান দেন, তখন বুঝবি সন্তানকে কোলে নিয়ে মায়ের কত সুখ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমি বুঝি এখনও খুকি আছি? ওই দেখো ছোটো মাসিমা, রাঙা মাসিমা আসছেন এ-ঘরে।
শচীমাতা :
ওতে লজ্জার কী আছে বউমা? নিমাই যেদিন বিয়ে করে প্রথম তোমায় নিয়ে এল ঘরে, আমিই যে সেদিন লজ্জার মাথা খেয়ে অত লোকের মাঝে তোমায় কোলে নিয়ে নেচেছিলাম। বউমা, এই যে, তোমার মাসিমারা এসেছেন, প্রণাম করে ওঁদের পান এনে দাও।
সর্বজয়া, মালিনী :
(একজনের পরে অন্যজনে) থাক থাক মা, বেঁচে থাকো চির-এয়োতি হয়ে।
যাদব :
দিদি! দিদি! কাল জামাইবাবু আসছেন। আমাকে যাবার সময় বলে গেছিলেন, তোমার জন্য লাল শাড়ি আনবেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(চুপে চুপে) আঃ! যাদব, চুপ কর।
নিমাই :
মা! মা! আমি এসেছি – আর তোমার জন্য গয়া থেকে এনেছি কৃষ্ণপ্রেম।
সপ্তম দৃশ্য
(তাহার পরদিন দুপুরবেলা)
শচীমাতা :
নিমাই! তোর কী হয়েছে বাবা? গয়া থেকে পিতৃতর্পণ করে এসে কেবলই কাঁদছিস। এই দুপুর পর্যন্ত বউমা কতবার এসে ঘুরে গেল, একবার তাকে ডেকে দুটো কথাও বললিনে? তোর চোখের জলে যে ঘর উঠোন কাদা হয়ে উঠল, বাপ।
নিমাই :
(অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে) মা, গয়া থেকে এসে আমার আর কিছু ভালো লাগছে না।
শচীমাতা :
কেন বাবা, কী জন্য কিছু ভালো লাগছে না? নদিয়ার শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বলে তোর খ্যাতি, সহস্র পড়ুয়া তোর ছাত্র, কন্দর্পের মতন রূপ, বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীর মতো আমার বউমা, তোর আবার দুঃখ কিসের, বাবা? আমি কত আশা করে বসেছিলাম, গয়ার কত গল্প শুনাবি এসে। কিন্তু এসে অবধি কেবলই অঝোর নয়নে কাঁদছিস। ভগবান আমাকে চিরদিন দুঃখ দিলেন। পর পর সাত মেয়ে মারা যাবার পর তোর দাদা বিশ্বরূপ এল আমার কোলে। কিশোর বয়সে সে আমাকে কাঁদিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেল, তারপর তোর বাবা স্বর্গে গেলেন। তুই ছাড়া এখন যে আর আমার কেউ নেই, মানিক। তোকে পেয়েই আমার সকল দুঃখ ভুলে ছিলাম। তুই যদি সুখী না হোস, তা হলে আমার আর এ জীবনে কাজ কী!
নিমাই :
কী করব, মা, আমি যে আর কিছুতেই অশ্রু সংবরণ করতে পারছিনে। আমি কেবলই দেখছি নব-জলধর শ্যাম সুন্দরকান্তি পরম মনোহর এক কিশোর কেবলই বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে আমায় ডাকছে। গয়া থেকে ফেরার পথে কানাই নাটশালা গ্রামে প্রথম দেখি সেই দুরন্ত কিশোরকে বাঁশিতে তার সে কী অশান্ত আহ্বান, মা, তা না শুনলে বোঝাতে পারব না। সে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে গেল বৃন্দাবনের পথে। আমিও ছুটলাম, কিন্তু পারলাম না তার সাথে যেতে – আমায় সকলে ধরে নিয়ে এল নদীয়ায়। মা, তুমি এখন যাও, বাইরে মুরারি গুপ্ত বসে আছেন, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসছি।
অষ্টম দৃশ্য
(নিমাই-এর বহির্বাটী)
নিমাই :
মুরারি, আমাকে চিনতে পারছ?
মুরারি :
তোমাকে চিনেছি যখন তুমি তোমাকে চেননি তখন থেকে। তোমার মনে নেই? তখন আমি যোগবাশিষ্ট পড়ি। রাস্তায় সহপাঠীদের সাথে ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের ঘোর নিন্দা করতে করতে চলেছি, এমন সময় তুমি ভীষণ বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠলে। তখন তোমার বয়স পাঁচ বৎসরের বেশি হবে না।
নিমাই :
হ্যাঁ, তারপর? আমার কিন্তু বিন্দু-বিসর্গ মনে নেই।
মুরারি :
এইরূপে, বারবার তুমি মুখ ভেঙচে আমাকে বিদ্রুপ করায় আমি রেগে গিয়েছিলাম, জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে এক অকাল-কুষ্মান্ড জন্মগ্রহণ করেছে। তাই শুনে তুমি যেন বললে, আচ্ছা এর শাস্তি পাবে। তারপর (মুরারি অভিভূতের মতো বলিতে লাগিলেন) দুপুরে যখন খেতে বসেছি তখন শঙ্খধ্বনির মতো কার কণ্ঠস্বর ভেসে এল ‘মুরারি’! আমি চমকিত হয়ে চেয়ে দেখি, তুমি গৌরসুন্দর নবনটবর শিশুরূপে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে।
নিমাই :
তুমি ভক্তলোক, তাই ভক্তিবলে অন্য কাউকে দেখেছ। যাক, বলো।
মুরারি :
তুমি আরক্ত নয়নে আমার পানে চেয়ে বললে, ভগবানকে ভক্তি ছাড়া শুষ্ক জ্ঞানচর্চায় যারা পেতে চায়, আমি তাদের থালায় প্রস্রাব করি। বলে আমার থালে প্রস্রাব করে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে। তারপর তোমায় দেখি শ্রীগঙ্গাধর পণ্ডিতের টোলে। সেখানে আমায় কেবল সিলেটি-বাঙাল বলে খ্যাপাতে। তোমার যন্ত্রণায় যখন আমি টোল ছাড়ব ছাড়ব করছি, তখন একদিন তর্কের ছলে আমার অঙ্গে শ্রীহস্ত বুলালে, আর অমনি আমার সকল প্রাণ মন তোমার পায়ে যেন লুটিয়ে পড়ল।
নিমাই :
আজ কি মনে করে এসেছ?
মুরারী :
তুমি ডেকেছ, নইলে তোমার সান্নিধ্য লাভ করতে পারে এমন ক্ষমতা কার আছে? আজ ভোরে স্বপ্ন দেখছিলাম, তুমি এসে আমায় ডাকছ– ‘মুরারি। তুমি আমায় যে রূপে দেখতে চেয়েছিলে, আজ সেই মহাপ্রকাশের উদয়-উষা দেখবে, এসো।’ আজ এসে তোমার কান্না-অরুণ চোখে সেই উদয়-উষার জবাকুসুমসঙ্কাশ দ্যুতি দেখলাম। তুমি নিজে ধরা না দিলে তোমায় ধরবে কে? তুমি নিজে দেখা না দিলে তোমায় দেখতে পাবে কার সাধ্য?
নিমাই :
মুরারি! শুনছ! কে বাঁশি বাজায়, ওই–ওই–দেখেছ–ওই মূর্তিই আমি দেখেছিলাম গয়া থেকে ফেরার পথে –
(সুরে)
নব কিশলয়-শ্যামল তনু ঢল ঢল অভিরাম
অপরূপ রূপ-মাধুরী হেরিয়া মুরছিত কোটি কাম।
গলে বনমালা শিরে শিখী-পাখা
পীতধড়া-পরা ত্রিভঙ্গ বাঁকা
বাজায় মুরলী রাধা রাধা বলি
নওল কিশোর শ্যাম॥
নিমাই :
ওই পালিয়ে যায় – মুরারি – মুরারি ধরো ওই চঞ্চলকে – ধরো ওই কৃষ্ণকে – কৃষ্ণ–কৃষ্ণ। (মূর্ছা)
মুরারি :
ঈশান! ঈশান! শিগগির জল আন, প্রভু মূর্ছা গেছেন।
নবম দৃশ্য
(বিষ্ণুপ্রিয়ার কক্ষ)
ঈশান :
দিদিলক্ষ্মী! বলি এমনি করে পড়ে পড়ে কাঁদলে কি এর কিনারা হবে? না, দাঠাউরকেও ঘরে বেঁধে রাখা যাবে? এই শালার পাঁচ ভূতে মিলে আমার সোনার ঠাকুরকে পাগল করে নাচিয়ে নিয়ে ফিরছে। দিদিলক্ষ্মী, যদি এজ্ঞে কর, তাহলে ওই বুড়ো ঈশানই ওই ভূতের বাপের ছেরাদ্দ করে ছাড়বে। যতসব আবাগের বেটা ভূত – এমন সোনার সংসার ছারেখারে দিলে গা!
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ঈশান, কারুর দোষ নয়। দোষ আমার অদৃষ্টের। আমার ওঁকে ধরে রাখার ক্ষমতা নেই বলেই ওঁকে সংসারে রাখতে পারলাম না।
ঈশান :
বলি, তোমার ক্ষমতাটা কীসে কম হল, দিদিলক্ষ্মী ? থাকত আমার গিন্নি বেঁচে, তাহলে তোমায় এমন বুদ্ধি বাতলে দিয়ে যেত যে, দাঠাউর আর একদণ্ড তোমায় ছেড়ে যেতে পারত না।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
দিদিমা বশীকরণ-মন্ত্র জানতেন নাকি ঈশানদা?
ঈশান :
মেয়েদের আবার মন্তর-ফন্তর লাগে নাকি, দিদিলক্ষ্মী, ভগবান তোমাদের সবচেয়ে বড়ো তুক দিয়েছেন, মান আর চোখের জল। এই দুই তুকের জোরে ভগবান পর্যন্ত কাবু, তা ঠাউর তো কোন ছার! যৈবনকালে আমি একবার রাগের মাথায় বাড়ি ছেড়ে দুদিনের জন্য পেলিয়েছিলাম, আর তাই পাড়ার লোকে রটিয়ে দিলে আমি সন্ন্যেসী হয়ে গিয়েছি। তারপর দিদিলক্ষ্মী, রাগ পড়লে বাড়ি যখন ফিরলাম, তখন সে যা কুরুক্ষেত্রকাণ্ড বাধল তা কইবার নয়। বেড়ালের লড়ুই দেখেছ?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
দিদিমা কি আঁচড়াতে কামড়াতে পারতেন?
ঈশান :
তারও বাড়া দিদিলক্ষ্মী, তারও বাড়া। চুল ছিঁড়ে, কাপড় ছিঁড়ে, কেঁদে কেটে, মাথা কুটে – বলি তাতেও কি রাগ থামে – শেষে দিদিলক্ষ্মী আমায় ধরে দে ধনাদ্ধন দে ধনাদ্ধন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
বল কী ঈশানদা, দিদিমণি তোমায় মারতে লাগল? সোয়ামির গায়ে হাত তুললে?
ঈশান :
আরে দিদিলক্ষ্মী, উনাকে যে তখন ভূতে পেয়েছিল। উনার কি তখন জ্ঞানগম্মি ছিল? আর ও-বয়সে পরিবারের মার কি গায়ে লাগে? আমার মনে হতে লাগল যেন পুষ্পবিষ্টি হচ্ছে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি এইরকম পুরুষমানুষ, ঈশান দা? তোমায় ধরে মারলে আর তুমি চুপ করে সয়ে গেলে?
ঈশান :
দিদিলক্ষ্মী, কইলে পাপ হয়, নইলে দাঠাউরকে দু-একটা ঠোনাঠুনি দিয়ে দেখ দেখি ওঁর কেমন মিষ্টি লাগে। এই আশিটা বছর বয়স হল, তবু সেদিনের কথা মনে হলে সুখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আমি বলি কী দিদিলক্ষ্মী, চোখের জলের অনুপান দিয়ে ওই ওষুধ অল্প মাত্রায় একটু দিয়ে দেখবে নাকি?
নিমাই :
কী ঈশান? কোন ওষুধের কথা বলছ? মাথায় তো মধ্যমনারায়ণ তেল মাখতে শুরু করেছ, এখন বাকি হাতে-পায়ে শিকল-বেড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা, তারই পরামর্শ আঁটছ বুঝি?
ঈশান :
এজ্ঞে, দাঠাউর! আমি দিদিলক্ষ্মীকে বলছিলাম, মধ্যমনারায়ণ তেল মাথায় না দিয়ে তোমার সঙ্গী ওই উনাদের মাথায় দিলে কাজ দিত। কী করি, বৈষ্ণব মানুষ, দিদিলক্ষ্মীও গো-বেচারি মুখচোরা মানুষ, নইলে ভূত তাড়াবার ওষুধ আমার কিছু জানা ছিল।
নিমাই :
কী ঈশানদা! ওঁরা ভক্ত লোক, ওঁদের নিন্দা করলে পাপ হয়।
ঈশান :
দাঠাউর! তোমায় তেনারা নারায়ণ বলেন, ভগবান বলেন। কিন্তু ভগবানের কি এই বিচার হল? আমি ছেলেবেলা থেকে তোমায় কোলেপিঠে নিয়ে মানুষ করলুম, তোমায় একদণ্ড না দেখলে আমার মনে হত যেন আকাশের সুয্যি নিভে গেছে। – যাক, আমার কথা না হয় বাদই দিলাম, তোমার অমন দয়াময়ী দুঃখিনী মা, এই বৈকুন্ঠের লক্ষ্মীর মতো বউ – এনারা তোমার কেউ নয়? আমরা ছাড়া বিশ্ব-সংসারের আর সবাই হল তোমার আপনার জন?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ছিঃ ঈশানদা, ওঁকে অমন করে বোলো না। উনি যাতে সুখী হন – আমার তাতেই সুখ।
ঈশান :
তুমি থামো দিদিলক্ষ্মী, আমি জন্মে থেকে এ বাড়ির চাকর, দাঠাউর তো দুধের ছেলে, ওঁর বাবা-মা পর্যন্ত কেউ আমাকে একদিনের জন্য একটা কথা বলতে পারেনি। আজ যদি রেগে দাঠাউর আমায় তাড়িয়ে দেয় –
নিমাই :
ওকী কথা বলছ ঈশান দা! তোমার পায়ের ধুলো পেলেও যে সে পরম ভক্ত হয়ে উঠবে – আমি তোমায় তাড়িয়ে দেব? তোমার পায়ে পড়ি, তুমি অমন কথা বোলো না –।
ঈশান :
হরেকিষ্ট! হরেকিষ্ট! দা ঠাউর, একী করলে তুমি? আমার পা ছুঁলে! কোটি জন্মেও যে আমার এ পাপের ক্ষয় হবে না। চিরটাকাল তুমি তোমার ধুলোমাখা পা নিয়ে আমার বুকে খেলা করেছ – ওই রাঙা পায়ের ধুলো পেয়ে চোখের জলে বুক ভেসে গেছে – হায় হরি – আজ তুমি এ কী করলে? যাই, দৌড়ে গঙ্গায় ডুব দিয়ে আসি।
(যাইতে যাইতে) হরেকিষ্ট, হরেকিষ্ট!
দশম দৃশ্য
(নিমাই-এর ভবন)
[একজন ভিখারি দ্বারে দাঁড়াইয়া গান করিতেছে –]
বিদায় দে মা, একবার দেখে আসি
(যে)
বৃন্দাবনে রাখাল সনে কালো শশী বাজায় বাঁশি॥
সারাদিনের কাজের মাঝে
দেখি যে সেই রাখাল-রাজে
(ওমা)
বাজে শুনি নিশীথ রাতে তারই বাঁশি মন-উদাসী॥
শচীমাতা :
বাবা, তোমার পায়ে পড়ি, আমার বাড়িতে এসে রোজ রোজ ওই গান গেয়ো না। তোমার যদি অন্য গান জানা না থাকে, তোমায় গান করতে হবে না, এমনি ভিক্ষা পাবে।
ভিখারি :
মা গো! শ্রীকৃষ্ণ জানেন, আমি ইচ্ছা করে এ গান গাই না তোমার বাড়িতে। তোমার বাড়ির দোরে এলেই আমার দু-চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। কে যেন জোর করে আমায় এই গান গাওয়ায়।
ঈশান :
দেখো বাবাজি বৈষ্ণব, অপরাধ হয় হবে, কিন্তু ফের যদি এসে ওই গান গাও, আমি তোমার গাবগুবাগুব ভেঙে, ঝোলা ছিঁড়ে, টিকি উপড়ে, ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢেলে ছাড়ব। ত্রিসংসারের লোক কি জোট পাকিয়েছে এই সোনার সংসার ছারেখারে দেওয়ার তরে? একে মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ। এমনেই দাঠাউরের মুখে ঘর ছাড়ব রব লেগেই আছে – তার ওপর –
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ঈশান দা!
ঈশান :
রও দিদিলক্ষ্মী। তুমি চোখ রাঙিয়ো না, এ বাড়িতে আমি বেহ্মা বিষ্ণুকে ভয় করি না। এই সোনার সংসারে আগুন লাগাবার জন্য যত হনুমান লেগে পড়েছে। সব হনুমানের আমি ল্যাজ কাটব তবে আমার নাম ঈশান।
নিমাই :
মা! মা! আমার দাদা ফিরে এসেছেন। এই দেখো, আমার দাদা বিশ্বরূপ।
শচীমাতা :
নিমু! কী বললি! আমার বিশ্বরূপ ফিরে এসেছে? এই কি আমার বিশ্বরূপ, আমার হারানো মানিক?
নিত্যানন্দ :
হ্যাঁ মা, আমিই তোমার বিশ্বরূপ। মন্দ লোকে আমায় মাতাল অবধূত বলে, আর দুষ্ট লোকে বলে নিত্যানন্দ।
শচীমাতা :
যে যা বলে বলুক তুই-ই আমার বিশ্বরূপ, আয় বাপ আমার কোলে আয়। ওরে! এত সুখ কি আমার সইবে? নারায়ণ! নারায়ণ!
নিমাই :
দেখলে মা, আমি গয়ায় না গেলে কি দাদা আসতেন, না তুমিই বিশ্বরূপ দেখতে পেতে?
শচীমাতা :
ওরে আমি বিশ্বরূপ দেখতে চাইনে। আমার কোল জুড়ে এমনি শিশু হয়ে, মানুষ হয়ে তোরা থাক, ওই আমার স্বর্গ মোক্ষ সব। যাক বাবা, আমার খ্যাপা নিমাই এত দিন অসহায় ছিল, এখন তুমিই তাকে দেখো। এতদিনে নারায়ণ আমার নিমুর জন্য দুর্ভাবনা দূর করলেন।
নিত্যানন্দ :
দোরের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন আর কাঁদছেন, ও মা লক্ষ্মীটি কে মা? – ও কী মা, তোমার চোখে জল কেন? তোমার লুকিয়ে থাকবার কোনো প্রয়োজন নেই, মা লক্ষ্মী। এইবার যে তোমারও প্রকাশের দিন এল। মা, এসো এসো, একবার নয়ন ভরে যুগল-মিলন দেখি।
শচীমাতা :
লজ্জা কী বউমা, এসো, এ যে আমার নিমুর দাদা, এসে প্রণাম করো।
নিত্যানন্দ :
দোহাই মা লক্ষ্মী, ওটি হতে দিচ্ছিনে। আমার পায়ের ধুলো অত সস্তা নয়। ওই পদ্মফুলের পাপড়ির মতো হাতে কি এই অবধূতের পায়ের ধূলো লাগাতে আছে। যে হাত দিয়ে নারায়ণের সেবা হয়, সেই হাতে পায়ের ধূলা! একবার নদের চাঁদের বামে গিয়ে দাঁড়াও তো মা, আমার সন্ন্যাস সার্থক হোক, জীবন ধন্য হোক দেখে। ওকী, পালালে? আচ্ছা মা লক্ষ্মী, আজ পালালে পালাও, কিন্তু যুগল-মূর্তি আমি দেখবই।
শচীমাতা :
ওমা! ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেই আছি, খেতে যে দিতে হবে তা মনেই নেই। আয় বাপ, তোরা দু-ভাইয়ে এসে খাবি। ঈশান!
ঈশান :
(অশ্রু গদগদ কণ্ঠে) মা?
শচীমাতা :
একী বাবা ঈশান, তুমি অমন ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে কেন? এ যে আমার বিশ্বরূপ, আমার বিশু, নিমাই ওকে ধরে এনেছে। চিনতে পারছ না? আমি দেখি গিয়ে কী আছে ঘরে।
ঈশান :
চিনেছি, মা। তবে আর কাউকে বিশ্বাস হয় না। তুমি যাও মা, আমি জায়গা করে দিচ্ছি।
নিত্যানন্দ :
ঈশানদা, আমাকে সন্দেহ হচ্ছে বুঝি?
ঈশান :
সত্যি করে বলো দেখি, তুমি কে? তুমি বিশ্বরূপ না বিষ-রূপী কেউ?
নিমাই :
ঈশানদা-র দিবারাত্রির সন্দেহ আর ভয়। এ বাড়িতে যে আসে তাকেই সে চোর বলে সন্দেহ করে।
নিত্যানন্দ :
ওর সন্দেহ ভুল নয় কানাই – থুড়ি – প্রভু, থুড়ি নিমাই। সোনার গৌরকে চুরি করার জন্যে ত্রিভুবনের চোর যে নদিয়ায় এসে জুটবে, তাতে আর সন্দেহ কী?
ঈশান :
ঠিক – ঠিক বলেছে সন্ন্যাসী ঠাউর। শুধু চোর-ডাকাত বাটপাড়-জোচ্চোরে নদিয়া ভরে উঠল – সকলের চোখ আমাদের এই সোনার গৌরাঙ্গের উপর। ডাকিনী-যোগিনী, ভূত-পেরেত, পিশাচ,যক্ষি-রক্ষি সব যেন জোট বেঁধে এসেছে। কী বলব, আমার হাতের খেঁটে লাঠি আমার হাতেই রইল, তা দিয়ে একটা মাথা ভাঙতে পারলেও আমার মনের জ্বালা কিছু কমত। যাই, খাবার জায়গাটা করে দিই গিয়ে।
নিত্যানন্দ :
(গান)
কানাইরে কই তোর চূড়া বাঁশরি!
তুই নাকি সেই নন্দদুলাল
এলি নদিয়ায় ব্রজ পাশরি?
নিমাই :
(গান)
কী পুছসি আমারে ভাই
এবার চূড়া বাঁশরি নাই।
ব্রজের খেলা বাঁশির তান
নদের খেলা হরি-গান;
ব্রজের বেশ ধড়া চূড়া, নদের বেশ কৌপীন পরা
ব্রজের খেলা রাখাল হয়ে, নদের খেলা ধূলি লয়ে।
নিত্যানন্দ :
(গানে) নদিয়াতে বিষ্ণুপ্রিয়া, ব্রজের রাই কিশোরী॥
একাদশ দৃশ্য
(নিমাই আহার করিতেছেন, শচীদেবী সম্মুখে বসিয়া–বিষ্ণুপ্রিয়া পরিবেশন করিতেছেন।)
শচীমাতা :
নিমাই, তুই খাবার অন্য দিকে চেয়ে কী ভাবিস বল তো? ভাবতে হয়, খাওয়া শেষ হলে ভাবিস।
(আড়ালে)কাঞ্চনা :
মা কি কিছু বুঝতে পারেন না সই?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কী বুঝতে পারেন না, কাঞ্চনা?
কাঞ্চনা :
তুমি যখন পরিবেশন কর, তখন উনি খাওয়া ভুলে হাঁ করে তোমাকেই গিলতে থাকেন দুচোখ দিয়ে। এরই মধ্যে চোখের মাথা খেয়েছ? তাও দেখতে পাও না?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ, তুই কী যে বলিস কাঞ্চনা?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ গো হ্যাঁ, তোমার পায়ের পাঁইজোরের শব্দ শুনলেই উনি উৎকর্ণ হয়ে ওঠেন। দেখছ না, এর মধ্যে তো একশোবার মুখের গ্রাস হাতে নিয়ে তোমাকে আড়চোখে দেখে নিলেন। মা ধমকে তাঁর এই মধুর ভাবটা নষ্ট করে দিলেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
পোড়ামুখী, আস্তে, মা শুনতে পাবেন।
শচীমাতা :
বাবা নিমাই, কাল রাত্রে আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি।
নিমাই :
কী স্বপ্ন, মা বলো।
শচীমাতা :
তুই আর নিত্যানন্দ দুইজনে যেন পাঁচ বছরের ছেলে হয়ে হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছিস বাড়িতে। এমন সময় দুইজন যেন ঠাকুর ঘরে ঢুকলি। তুই হাতে করে বলরাম নিয়ে বেরিয়ে এলি, আর নিত্যানন্দ বেরিয়ে এল হাতে শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে। তারপর আমার সামনে চারজন মিলে মারামারি হুল্লোড় করতে লাগলি। বলরাম আর কৃষ্ণ যেন বলছেন, তোমরা এ ঘর থেকে বেরোও। এ ঘরের ক্ষীর ননী দই সন্দেশ এসব আমাদের। তোমরা কেন ভাগ বসাতে এসেছ এখানে? নিতাই বললে – সে কাল আর নেই ঠাকুর – যে কালে ক্ষীর ননী লুটে খেয়েছ – এখন তোমরা বেরোও – এ গোপের বাড়ি নয়, ব্রাহ্মণের বাড়ি। বলরাম বললেন, – তা হলে আমাদের দোষ নেই, আমরা কিন্তু মেরে তাড়াব তোমাদের। নিতাই বললে তোমার শ্রীকৃষ্ণকে আমার ভয় নেই। গৌরচন্দ্র বিশ্বম্ভর আমার ঈশ্বর। এই বলে চারজনে কাড়াকাড়ি করে ঠাকুরঘরের সব খাবার খেতে লাগল। কেউ কারুর মুখের, কেউ কারুর হাতের খাবার কেড়ে নিয়ে খেতে লাগল। এমন সময় নিতাই ডেকে উঠল – ‘মা, আমার বড়ো খিদে পেয়েছে, খেতে দাও, ওরা সব কেড়ে খেয়ে নিলে।’এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল।
নিমাই :
মা, তুমি অপূর্ব স্বপ্ন দেখেছ। এ স্বপ্নের কথা কাউকে বোলো না যেন। তোমার ঘরের ঠাকুর বড়ো জাগ্রত। উনি যে প্রত্যক্ষ দেবতা সে বিশ্বাস আমার আরও দৃঢ় হল তোমার স্বপ্নের কথা শুনে। অনেকবার আমি দেখেছি, মা, ঠাকুরঘরের নৈবেদ্যের সামগ্রীর প্রায় অর্ধেক থাকে না। কে যেন খেয়ে চলে যায়। তোমার বউ-এর ওপর আমার সন্দেহ ছিল, আমি লজ্জায় এতদিন বলিনি। এখন দেখছি প্রত্যক্ষ ঠাকুরই নৈবেদ্যে খান। যাক, ঠাকুর তোমার বউমাকে বাঁচালেন, তোমার বউ-এর ওপর মিথ্যা সন্দেহ এতদিনে আমার ঘুচল।
শচীমাতা :
ওমা! নিমাই বলিস কী? আমার বউমা লক্ষ্মী, ওর অভাব কী যে, সে চুরি করে খাবে?
নিমাই :
উনি যদি লক্ষ্মীই হন মা, তাহলে তো নারায়ণের নৈবেদ্য ওঁর ভাগ আছে। যাক – নিত্যানন্দ প্রভুকে আজই নিমন্ত্রণ করে খাওয়াও, কারণ স্বপ্নে তিনি তোমার কাছে অন্নভিক্ষা করেছেন।
শচীমাতা :
হায় আমার পোড়া কপাল! ছেলেকেও নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে হয়?
নিমাই :
সন্ন্যাসীর যে আপন ঘর থাকতে নেই, মা। তাতে তিনি ধর্মভ্রষ্ট হন। দাদা শ্রীবাস আচার্যের বাড়িতেই আছেন। ও তো আমাদের নিজেরই ঘর।
শচীমাতা :
হুঁ, মালিনী সই-এর কপাল ভালো। যাক, আমি যাই, বলে আসি পাগল ছেলেকে ওবেলা খেতে।
ঈশান :
আমি তাহলে চললাম মা আজকের মতো।
নিমাই :
কেন ঈশানদা, তুমি যাবে কেন?
ঈশান :
যাবে কেন, সে এসে তো সমস্ত ভাত ডাল বাড়িময় ছড়াবে, ন্যাংটা হয়ে নাচবে, তারপর বাকি সকড়ি নিয়ে আমার মুখে মাথায় মাখাবে। রাত্তিরে গঙ্গাচান করলে আমায় সর্দি জ্বরবিকারে ধরবে।
নিমাই :
ঈশানদা, নিত্যানন্দ প্রভু যাঁকে স্পর্শ করেন তার জ্বর বিকার চিরকালের জন্য ছেড়ে যায়। তোমার ভয় নাই।
দ্বাদশ দৃশ্য
নিমাই :
নিত্যানন্দ ঠাকুর! তোমায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু চুপ করে সুবোধ বালকের মতো খেয়ে দেয়ে সুড়সুড় করে ফিরে আসবে। উৎপাত কোরো না যেন।
নিত্যানন্দ :
শ্রীবিষ্ণু! শ্রীবিষ্ণু! পাগলেই চঞ্চলতা করে। তুমি নিজে পাগল কিনা, তাই সকলকেই পাগল মনে কর।
ঈশান :
এই যে মাতোয়াল ঠাকুর এসেছেন। দাঁড়াও, ছিচরণ দুটো ধুইয়ে দিই, তারপর বাড়িতে ঢোকো। (পা ধোয়াইতে ধোয়াইতে) ওই পায়ের তো আর গুণের ঘাট নেই, ত্রিভুবনের বনের ময়লা কাদা পাঁক মেখে এসেছেন। পৃথিবীতে যা কিছু নোংরা সব বুঝি তোমার ছিচরণে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বৈতরণি পার হবার বুঝি আর কিছু পেলে না সব, এই অবধূতের চরণতরি ছাড়া?
শচীমাতা :
এই যে দুই ভায়ে এসেছ। আমি কখন থেকে পথ চেয়ে বসে আছি। বউমা, ভাত আনো।
নিতাই :
মা! এ ভাতের থালা না পর্বত? তুমি ভুল করেছ মা, আমি তো গিরি-গোবর্ধন ধারণ করিনি, আর বিশ্বম্ভরও আমি নই, বিশ্বম্ভর ওই নিমাই।
শচীমাতা :
নে এখন ফষ্টিনষ্টি রেখে খেতে বস দেখি। তুই-ই বা কীসে কম বাবা? নিমাই বিশ্বম্ভর, তুইও তো আমার বিশ্বরূপ। একী! একী! তোদের দুজনের অন্ন তিন ভাগ হল কেন? তোদের মাঝে কে ওই পঞ্চমবর্ষের দিগম্বর কৃষ্ণবর্ণ শিশু। ওই সুন্দর শিশুকেই তো কাল স্বপ্নে দেখেছিলাম। একী, কোথায় নিমাই, নিতাই কই! চতুর্ভুজ কৃষ্ণ ও শুক্লবর্ণ পরম মনোহর এক শিশু – হস্তে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-শ্রীহল-মুষল – বক্ষে শ্রীবৎস কৌস্তুভ, কর্ণে মকরকুণ্ডল – তাদের জায়গায় বসে আহার করছে। ওই–ওই– আমার পুত্র, পুত্রের হৃদয়ে আমার বধূমাতা – বিষ্ণুবক্ষে লক্ষ্মীর মতো বিরাজ করছে। একী মায়া! একী স্বপ্ন! নারায়ণ! নারায়ণ! একী খেলা তোমার? (মূর্ছা)
নিমাই :
অবধূত ঠাকুর, মা মূর্ছা গেলেন, ধরো! ধরো!
ঈশান :
মাতোয়াল ঠাকুর, ধরা পড়েছ। ধরা পড়েছ! আমি দেখেছি আমি চিনেছি তোমাদের! একী দেখলাম – একী দেখলাম আমি! আমি এখনও বেঁচে আছি তো? আমার জ্ঞান আছে তো? ঠাকুর! দাও, দাও তোমার উচ্ছিষ্ট আমার মাথায় মাখো, মুখে মাখো। তোমার পা ধোওয়া জল আমি ফেলিনি – রেখে দিয়েছি ঘড়ায় করে, ওকি আমি ফেলতে পারি? এই – এই আমি তা সব খেয়ে ফেলব, এক ফোঁটাও কাউকে দিচ্ছিনে। (জল পান) আজ চতুর্দশলোকে আমার মতো ভাগ্যবান আর কে আছে? অমৃত – অমৃত-কলশ পেয়েছি আমি – অমৃত-কলশ। (মূর্ছা)
ত্রয়োদশ দৃশ্য
[ ভোরবেলা – কাঞ্চনা গাইতেছে বিষ্ণুপ্রিয়ার শয়নকক্ষ-দ্বারে ]
ফিরে যাও গৌরসুন্দর চঞ্চল মতি
(তুয়া মনে কীসের পিরিতি)
এমন সোনার দেহ পরশ করিল কে
না জানি সে কোন রসবতী॥
অলসে অরুণ-আঁখি ঘুমে প্রেমে মাখামাখি
(আজু) রজনিতে হলে কার পতি
বদন-কমল কেন মলিন হইল হেন
ধোঁয়া দিয়ে করেছে কে তোমার আরতি॥
নদিয়া-নাগরী সনে নিশি যাপি নিরজনে
আসিলে হে নিলাজ কেমন করে।
সুরধুনী-তীরে গিয়া মার্জনা করগে হিয়া
তবে সে আসিতে দিব ঘরে॥
নিমাই :
আমি হরি-বাসর-বাসী অমিয় সাগরে ভাসি
কহে সখী বহু কটু ভাষ
থাকি না যথায় গিয়া হৃদে মোর বিষ্ণুপ্রিয়া
সেই মোর রাস-রানি আমি তাঁরই দাস।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তাই তো বলি, কাঞ্চনা এত ভোরে কার সাথে কলহ করছে?
কাঞ্চনা :
যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর। এক ঘণ্টা ধরে যে দোরগোড়ায় চ্যাঁচালাম, তা একবার ফিরে দেখলে না। মনে করলাম পাশ-বালিশটাকেই বুঝি পণ্ডিতমশাই মনে করে নিশ্চিন্তে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছ। এখন তো একজনের কণ্ঠস্বর শুনে ঘুম ভাঙতে এতটুকু দেরি হল না। বলি সারারাত ঘুমিয়েছ না অমনি জেগেই কাটিয়েছ।
নিমাই :
ঝড় উঠেছে, দেহ-তরি নিয়ে এই বেলা সরে পড়ি।
কাঞ্চনা :
সরে পড়লে চলবে না ঠাকুর। আজ তুমি স্পষ্ট করে বলো, তোমার মনে কী আছে। সারা নদিয়া আজ তোমার প্রেমে পাগল, তোমার করুণায় নাকি ত্রিভুবন ডুবুডুবু, নদে ভেসে যায়। শুধু আমার এই সখীটিই চরায় ঠেকে থাকলেন কেন? তোমার প্রেম-সমুদ্রের এক বিন্দু বারি পেলে যে বেঁচে যায় তাকে এ বঞ্চনা কেন?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(কাতর স্বরে) কাঞ্চনা!
কাঞ্চনা :
তুমি থামো। পাপ হয় আমার হবে। উনি ভগবান। পৃথিবীর দুঃখীকে উদ্ধার করতে এসেছেন, শুধু তুমি ছাড়া। রাম পৃথিবী ত্রাণ করেছেন সীতাকে সঙ্গে নিয়ে – বর্জন করে নয়। শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে নিয়ে, সত্যভামা, রুক্মিণী প্রভৃতিকে নিয়েই ভূ-ভার হরণ করেছেন। ইনি যদি নারায়ণই হন তবে লক্ষ্মীকে এত বেদনা দেন কোন অপরাধে, কোন শাস্ত্রমতে?
নিমাই :
আমি সত্যই অপরাধী, কাঞ্চনা, তাই তোমার সখীর কাছে মার্জনা ভিক্ষা করতে এসেছি।
কাঞ্চনা :
তা হলে বলো, দেহি পদ-পল্লবমুদারম।
নিমাই :
(সুরে) দেহি পদ-পল্লবমুদারম।
নিতাই :
দেখেছি যুগল মিলন দেখেছি – দেখেছি।
[ নিত্যানন্দের গান ও নৃত্য ]
এই যুগল-মিলন দেখব বলে ছিলাম আশায় বসে।
আমি নিত্যানন্দ হলাম পিয়ে মধুর ব্রজ-রসে।
রাই বিষ্ণুপ্রিয়া আর কানাই গউর
হেরো নদিয়ায় যুগল রূপ সুমধুর
তোরা দেখে যা দেখে যা, মধুর মধুর।
মধুর রাই আর মধুর কানাইর দেখে যা
দেখে যা মধুর মধুর।
[তাণ্ডব নৃত্য]
ঈশান :
এই হয়েছে! মাতোয়াল ঠাকুর আবার খেপেছে। ও বাব্বাঃ! ঠাকুর যে একেবারে দিগম্বর মূর্তিতে নেচে বেড়াচ্ছে গো! ও দাঠাউর! ধরো ধরো! সন্ন্যাসী ঠাউর যে ন্যাংটা হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে গো। মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে যে! বুড়ো লোক আমি কি সামলাতে পারি এই পাগলা হাতিকে!
নিমাই :
(হাসিয়া) একী হচ্ছে প্রভু! ছিঃ ! ছিঃ ! নাও কাপড় পরো।
নিতাই :
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইবার আমি যাব।
নিমাই :
আরে, যাওয়ার কথা কে বলেছে ? কাপড় পরো।
নিতাই :
আর খেতে পারব না। আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটে গেছে।
নিমাই :
আরে, আমি কী বলছি আর তুমি কী উত্তর দিচ্ছ।
নিতাই :
এই নিয়ে দশবার গেলুম, আর যেতে পারব না।
নিমাই :
আমার মাথা আর মুণ্ড! তাতে আমার কী দোষ?
নিতাই :
মা এখানে নেই। (উন্মত্ত হাসি ও নৃত্য)
শচীমাতা :
নিতাই, ঘরে এসো, সন্দেশ খাবে।
নিতাই :
?
বসন – বসন দে। মা ডাকলেন – শিগগির কাপড় আন।
শচীমাতা :
হল ভালো, ছিল এক পাগল, তার দোসর জুটল এসে উন্মাদ।
নিতাই :
তোমার বাবা পাগল, তোমার মা পাগল, তোমাদের গুষ্টি পাগল মা, তা আর ছেলেরা কোন ভালো হবে?
[অসমাপ্ত]