বিষাক্ত শহরে
শহরের বাতাস বিষাক্ত হতে শুরু করল। সেই বিষের নাম ‘প্রায়শ্চিত্ত’। গলির দেয়ালগুলো থেকে শুরু করে রাজপথের দেয়াল, সবখানে প্রায়শ্চিত্তের আহবান। শহরের মানুষ, যারা নিজের জীবনের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল, তারা এই প্রায়শ্চিত্ত করাতেই জীবনের অর্থ খুঁজে পেল। এখানে ওখানে পড়ে থাকতে শুরু করল মানুষের লাশ। প্রথমে রাজনীতিকদের দিয়ে এই লাশের মিছিল শুরু হয়েছিল। তারপর সেই মিছিলে যুক্ত হতে শুরু করল সাধারণ মানুষের লাশও।
এক বেকার যুবক নিজের বাবার চিকিৎসা করাতে দু তিনবার ছিনতাই করেছিল। সেই যুবকই এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে দিনে দুপুরে গুলি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। তার দাবি, সে ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু ওই কর্মকর্তা ঘুষ খেয়ে তার বদলে আরেকজনকে চাকরি দিয়ে দিয়েছে। তাকে বাধ্য হয়ে ছিনতাইয়ের মত পাপ করতে হয়েছে। তাই সে পাপের কারণ বিনাশ করতে গিয়েছে; কর্মকর্তাকে গুলি করে মারতে গিয়েছে।
শহরতলীতে এক যুবক এক যুবতীকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে খুন করে ফেরার হয়ে গিয়েছে। পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ছেলেটার সাথে মেয়েটার সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে ছেলেটা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। অনুমানমতে, সেই মাদকাসক্তির পাপের কারণ বিনাশ করতেই এই হত্যা।
নিম্নবিত্তের চাপা ক্রোধ রূপ নিল সহিংসতায়। উচ্চবিত্তদের দ্বারা চালিত এই সমাজব্যবস্থায় নিজেদের অনাকাঙ্খিত অবস্থান নিয়ে বেড়ে ওঠা অন্তর্দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে ম্যাগমার মত স্ফুরিত হল। রাস্তায় রাস্তায় ভাঙা শুরু হল গাড়ি। ভাঙা গাড়িগুলোর পার্টসপত্র খুলে নিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হল আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকল গাড়ি, অভিজাত হোটেল। কারণ নিম্নবিত্তদের সকল পাপের কারণ তো উচ্চবিত্তরাই!
কমবয়সী ছেলেদের কয়েকটা দল তৈরি হয়ে গেল। যারা এই পুরো ব্যাপারটাকে নিল একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে। প্রায়শ্চিত্তের দোহাই দিয়ে তারা বেপরোয়াভাবে মানুষ মারতে লাগল। দোকানপাট ভাংচুর হতে শুরু করল। ফুটপাথে বাড়ি ফেরা কেরানির লাশ, শহরের গোলচত্ত্বরে শিক্ষকের লাশ, পার্কের পাশে কোন কোন এক কমবয়সী মেয়ের লাশ- শহরের নীতি-নৈতিকতা ধসে পড়তে শুরু করল আস্তে আস্তে। ছিঁড়ে যেতে শুরু করল মানুষের সাথে ধর্মের সুতো। মৃত্যুর পরে কী হবে এইটা অনেক দূরের কথা, বর্তমানে পাপের প্রায়শ্চিত্তই বড় হয়ে দেখা দিল মানুষের কাছে।
বিষাক্ত বাতাস যখন বহরমপুর পেরিয়ে অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, তখন জাতীয় দৈনিকগুলোর টনক নড়ল। প্রথমে রাজনীতিকদের লাশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কাদা ছোড়াছুড়ি করছিল। ক্ষমতাসীন দলের কারও লাশ পাওয়া গেলে ক্ষমতাসীন দলগুলো বলছিল এটা বিরোধীদলের কাজ। আবার বিরোধীদলের কারও লাশ পাওয়া গেলে বিরোধীদল একইভাবে কাদা ছুঁড়ছিল ক্ষমতাসীনদের দিকে। কিন্তু, বিপদে পড়লে মানুষের ভেতরে গড়ে ওঠা রাজনীতি আর ধর্মের দেয়াল ভেঙে পড়ে। রাজনীতি দলের নেতা নেত্রীরা দেশ ছাড়তে শুরু করলেন গোপনে। কিছু কিছু সাধারণ মানুষও দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।
এমনই এক সন্ধ্যাবেলা তফিসুল বারী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিলেন।
“একটা জাতির জন্য সব থেকে লজ্জাজনক বিষয় অন্তর্ঘাত। যেটা এই দেশে শুরু হয়েছে সেটা খুবই হতাশাব্যাঞ্জক এবং ন্যাক্কারজনক। আমি জাতির উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, অবিলম্বে এই নোংরামী বন্ধ করা হোক। একটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে আরেকটা পাপ করা কখনওই পাপের প্রায়শ্চিত্ত বলে গণ্য হতে পারে না। এই ধরণের ঘটনা আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমাদের সুনাম ক্ষুন্ন করছে। আমি সবাইকে বলতে চাই, অস্থির হবেন না। ধৈর্য্যহারা হবেন না। এর থেকেও বড় সামাজিক দুর্যোগ আমরা মোকাবেলা করেছি, ভবিষ্যতেও করব। এই সরকার জনগণের সরকার। কোন বিচ্ছিন্নবাদীর স্থান এই দেশে দেওয়া হবে না।
“জাতীয় জীবনের মঙ্গলের জন্য আমি আমার নিজের জীবন উৎসর্গ করেছি। আজও জাতীয় জীবনের কথা চিন্তা করে আমি ঘোষনা দিচ্ছি, কাল থেকে প্রধান প্রধান শহরগুলোতে সান্ধ্য আইন চালু হবে। প্রত্যেকেটি প্রধান প্রধান শহর থেকে বের হওয়ার রাস্তাগুলোতে পুলিশ চেকপোস্ট বসানো হবে। এবং কে কখন বের হচ্ছে আর কে কখন আসছে তার সবকিছু লিপিবদ্ধ করা হবে। যদি প্রয়োজন হয় এলিট ফোর্স নামানো হবে। যারাই এই কাজ করছে, দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে দেখামাত্রই তাদেরকে ঘটনাস্থলে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হবে। আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। এই দেশ সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের দেশ। কোন ধরণের অরাজকতা এই দেশে সহ্য করা হবে না।”
.
ডঃ বশির জামান টিভি থেকে মুখ ঘুরিয়ে রোগার আলাস্কানের ব্যারেল পরিষ্কার করায় মন দিলেন। তার অভিব্যক্তি বরাবরের মতই শীতল, প্রতিক্রিয়াহীন। প্রধানমন্ত্রী যে চালাকিটা করলেন এটা খুব পুরনো একটা চালাকি। সব সময় সেই ইস্যুকে কেন্দ্র করে কথা বল যেটাতে সবাই বিশ্বাস করে। তুমি ঈশ্বরের নামে ভিক্ষা চাও, তোমাকে বেশিরভাগ মানুষই ভিক্ষা দেবে। ঠিক একই ভাবে সরকার ট্যাক্স বাড়ানোর সময় এমন একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ট্যাক্স বাড়ায়, যে ইস্যুটা বেশিরভাগ মানুষের জন্যই মঙ্গল। ঠিক একইভাবে প্রধানমন্ত্রীও জাতীয়তাকে কেন্দ্র করে এই আশ্বাসগুলো দিলেন, কারণ বেশিরভাগ মানুষ জাতীয়তায় বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। তারা নিজেদেরকে অন্য একটা দেশের থেকে অন্য মানুষদের থেকে আলাদা ভাবতে ভালোবাসে।
একটা বিশাল হলঘর। হলঘরের কোণায় একটা খাটের ওপরে এলোমেলোভাবে বসে বশির জামান রোগান আলাস্কানের ব্যারেল পরিষ্কার করছিলেন। একটু দুরে, মেঝেতে একটা ছোটখাট টিভি রাখা আছে। বশির জামান সেটাই দেখছেন একটু পর পর। হলঘরের ওপরের সিলিং থেকে কয়েকটা টিন সরে গিয়েছে। সেই ফাঁকা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে হলঘরের মেঝেতে। বশির জামান মেজর ইকবালকে ডাকলেন।
মেজর ইকবাল ছায়ার ভেতরে কোথাও স্নাইপার রাইফেল নিয়ে বসে ছিলেন। বশিরের ডাকে বেরিয়ে এলেন। বশির বললেন, “খবর শুনছ ইকবাল?”
ইকবাল মাথা নাড়লেন; বললেন, “এলিট ফোর্স নামলে একটু ঝামেলা হয়ে যাবে স্যার। কারণ, ওদের কাছে যেসব তথ্য প্রযুক্তি আছে তা আমাদের কাছে নেই।”
বশির রোগারটা বিছানার ওপরে রাখতে রাখতে বললেন, “প্রধানমন্ত্রী আমাদের কিছুই করতে পারেব না ইকবাল। কিছু না। উনি কিভাবে তেরোজন আসামীকে দিয়ে রাজনৈতিক হত্যা সংগঠন করিয়েছেন তার সব তথ্য প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। কাজেই আমাদের কিছু করতে গেলে আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে ফাঁস করে দেব।”
মেজর ইকবাল নীরবে মাথা নাড়লেন। বশির বললেন, “এই সমাজ আমরা বদলাবই ইকবাল। যেভাবেই হোক। এমন একটা সমাজ আমরা মানুষকে দিয়ে যাব, যেখানে আর অপরাধ করার প্রয়োজনই পড়বে না। তুমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা কর ইকবাল। আর আমাদের বন্দী তিনজনকে সেন্ট্রাল রুমে নিয়ে আস। আমি কথা বলব।”
ইকবাল মাথা নেড়ে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরে এসে মেজর ইকবাল বললেন, “স্যার। আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
বশির জামান সেন্ট্রাল রুমে গেলেন। পুরো ঘরটা অন্ধকার। মৃদু চাঁদের আলো এসে পড়ছে ঘরের শেষ প্রান্তে। বশির জামান বন্দীর তিনজনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনজনকে তিনটা চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে।
প্রথম চেয়ারে যাকে বেঁধে রাখা সে আর কেউ নয়, আশফাক চৌধুরী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। খুব বাজেভাবে পেটানো হয়েছে তাকে। তার রক্তাক্ত মুখমন্ডল দেখে মনে হল তিনি অচেতন। মাঝখানের চেয়ারে যাকে বেঁধে রাখা আছে সে মেজর রঞ্জন। ঠোঁটের কোণায় জমাট বাঁধা রক্ত দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তার ওপর দিয়েও খানিকটা ঝড় বয়েছে।
তৃতীয় চেয়ারে বেঁধে রাখা বন্দীকে দেখে চমকে উঠলেন ফিরোজ। নিজের অজান্তেই চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেল তার। শংকর! বশির খুব কাছ থেকে শংকরকে দেখলেন। তারপর মেজর ইকবালের দিকে তাকালেন। ইকবালকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে বললেন, “তুমি বলেছিলে শংকর মারা গিয়েছে। সে কিভাবে বেঁচে ফিরল?”
মেজর ইকবাল বললেন, “আমার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। সেদিনও হয়নি। ওর কাঁধে আর হাতে গুলি লেগেছিল, স্পষ্ট মনে আছে আমার। কিন্তু কিভাবে লোকটা ফিরে আসল বুঝতে পারছি না।”
বশির দেখলেন, এই নিয়ে তর্ক করতে গেলে শংকরের ফিরে আসার রহস্যের সমাধান হবে না। বশির নিজের আকাশ সমান বিস্ময়টা চাপা রেখে শংকরের কাছে ফিরে আসলেন। শংকরের দিকে তাকিয়ে একটা আন্তরিক হাসি হাসলেন যেন কিছুই হয়নি। বললেন, “আবার দেখা হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম আমাদের আর দেখা হবে না শংকর বাবু। যাই হোক। কি অবস্থা? কেমন আছেন?”
শংকর এক দলা থু থু ছিটিয়ে দিল বশিরের মুখ। বশির শার্টের আস্তিন দিয়ে থু থু মুছে হাসি মুখে বললেন, “জানি আমার ওপরে আপনি অনেক রেগে আছেন। আপনাকে আমি ঠিক ততটা সম্মান দিতে পারিনি যতটা আপনার প্রাপ্য। কিন্তু কি করব বলেন, সেই সময়টা আসলে আমার হাতে ছিল না। ছিল মেজর জেনারেল ফিরোজের হাতে।” বশির সরে যাওয়ার সাথে সাথে নিখিল বিশাল শরীর নিয়ে একটা ঘুষি মারতে গেল শংকরকে। বশির বললেন, “এই এই, না, একদম না। আমাদের যা দরকার সেটা আমরা পেয়ে গিয়েছি। আশফাক চৌধুরী বাদে বাকি দুজন আমাদের অতিথি।”
শংকর ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে বশিরের দিকে তাকালো। তারপর বলল, “সুলেখা আর সুতপা কোথায়? কোথায় ওরা?”
বশির ধীর পায়ে হেঁটে শংকরের চেয়ারের কাছে আসলেন। তারপর শংকরের প্রশ্নটা একেবারে অগ্রাহ্য করে বললেন, “সৃষ্টিকর্তা আপনাকে কেন ফেরত পাঠিয়েছে জানেন শংকর বাবু?”
শংকরের রাগ কিছু মাত্র কমলো না। বরং বাড়ল। বশির তার প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিয়ে দিলেন। বললেন, “প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। জানি না আপনি আশফাক চৌধুরীর গাড়িতে কি করছিলেন, কিন্তু এটুকু জানি, প্রতিশোধের আগুন নিয়েই আপনি এখনও জ্বলে পুড়ে মরছেন। ‘
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বললেন, “বলতেও খারাপ লাগছে। তারপরেও বলছি, সুলেখা আর সুতপাকে মেজর জেনারেল নিজে হাতে গুলি করে মেরেছে। আমার কথা হয়ত আপনার বিশ্বাস হবে না, তারপরেও বলছি, আপনাকে হত্যা করার আদেশ ফিরোজই দিয়েছিল। আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন শংকর। মেজর জেনারেল ফিরোজ বলছিল, আপনি বেঁচে থাকলে ওই তেরোজন কয়েদীদের ব্যাপারে সব ফাঁস করে দেবেন। আপনি সবাইকে সব বলে দেবেন। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে খুন করতে হয়। আমি আপনাকে খুন করতে পারতাম না বিশ্বাস করেন। তাই আমার হয়ে কাজটা করে ইকবাল। আপনি ক্ষমা না করলে আমরা দুইজন নিজেদের কাছে আজীবন অপরাধী হয়ে থাকব শংকর বাবু।”
শংকরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসল তার। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “ফিরোজ সুলেখা আর সুতপাকে মেরেছে? আর আমাকে খুন করার আদেশ উনিই দিয়েছিলেন? ফিরোজ কোথায়? কোথায় ফিরোজ?”
“অবশ্যই উনি দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকল্পের স্বার্থে আমাকে সব মেনে নিতে হয়েছে শংকর বাবু”
কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বশির আবার বললেন, “ মেজর জেনারেল আছে। সময় হলে আমিই মেজর জেনারেল ফিরোজকে আপনার হাতে তুলে দেব। আমাকে আপনার নিজের ভাই মনে করেন।” বশির বললেন। তারপর ইশারা করতেই বিকাশ এসে শংকরের হাতের বাঁধন খুলে দিল।
বশিরের ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠা ক্রুর হাসিটা প্রতিশোধে অন্ধ শংকরের চোখ এড়িয়ে গেল।
বিকাশ শংকরের ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন, “চলেন। কফি খেতে খেতে গল্প করি। আপনার ফিরে আসার গল্প।”
বশিরের ওপর থেকে শংকরের সব রাগ কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল।