তত্ত্ব ও ধারণার রাজনীতি
পরিচিতির রাজনীতি
উপস্থাপনের রাজনীতি
অনুভূতির রাজনীতি

বিষয় প্রেম: নারীবাদী ইতিহাসচর্চার একটি প্রয়াস – অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

বিষয় প্রেম: নারীবাদী ইতিহাসচর্চার একটি প্রয়াস – অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় প্রেম, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বিসমকামী প্রেম। অর্থাৎ নারী-পুরুষের প্রেম। প্রেম হল সেই অনুভূতি যা সাহিত্যের, চলচ্চিত্রের প্রধান এবং অপরিহার্য উপজীব্য। তবে ভারতীয় নারীবাদী মহলে প্রেম এযাবৎ তেমন গুরুত্ব পায়নি। নারী-পুরুষ সম্পর্কের আরেকটি অনস্বীকার্য দিক— আধিপত্য-অধীনতার দিক, ক্ষমতার দিক, হিংসার দিক, সংঘাতের দিক যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, প্রেম বা ক্ষমতার সঙ্গে প্রেমের ঘাত-প্রতিঘাতের বিষয়টা নিয়ে এযাবৎ তত মাথা ঘামাননি নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা। নারী-পুরুষের সম্পর্কের একটা বিশেষ ধরনকে সমাজ ‘প্রেম’ হিসেবে চিহ্নিত করে, যে-সম্পর্কের মূল কথা হল পারস্পরিক আসঙ্গলিপ্সা, যার মধ্যে আবেগ, অনুভূতি এবং প্রকট বা প্রচ্ছন্ন যৌনকামনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই মিশেলের অনুপাত সম্বন্ধে নির্দিষ্ট কোনও ফরমুলা নেই। এই সম্পর্ক সাধারণত বিবাহমুখী, কিন্তু অনিবার্যভাবে নয়। অর্থাৎ বিবাহমুখীনতা প্রেমের সাধারণ বৈশিষ্ট্য কিন্তু আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য নয়। স্থান-কাল-পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্বিশেষে প্রেমের সারবস্তুটা একইরকম হলেও প্রেমের বহিঃপ্রকাশের ধরন, ভাষা এবং প্রেম সম্বন্ধে সামাজিক অনুশাসনের চেহারাটার স্থান-কাল অনুযায়ী তারতম্য ঘটে। বিশেষত, পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার সঙ্গে প্রেমের ঘাত-প্রতিঘাতের বিশেষ চরিত্র যুগ থেকে যুগান্তরে, স্থান থেকে স্থানান্তরে ভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। অর্থাৎ প্রেম একইসঙ্গে সার্বজনীন আবার পরিপ্রেক্ষিত-নির্ভর (Context-specific)। তাই প্রেমের ইতিহাস আছে। এই প্রবন্ধে আমি লিখতে চাই ঔপনিবেশিক কালপর্বে উচ্চবর্ণ বাঙালি হিন্দুসমাজের অন্তর্গত প্রেমের নারীবাদী ইতিহাস। উন্মোচন করতে চাই অনুভূতিজগতের অন্তর্লীন রাজনীতিকে। প্রবন্ধের প্রথম অংশে প্রেম এবং পিতৃতন্ত্রের সম্পর্কের নারীবাদী তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ধারাগুলি পর্যালোচনা করব। দ্বিতীয় অংশে ঔপনিবেশিক বাংলায় উচ্চবর্ণ হিন্দু সমাজে প্রেমের চেহারাটা চিনে নিতে সচেষ্ট হব। এইভাবে বিসমকামী প্রেমের নারীবাদী পাঠে প্রয়াসী হবে এই প্রবন্ধ।

পিতৃতন্ত্র ও প্রেম: নারীবাদী তত্ত্বায়ন

পাশ্চাত্য নারীবাদীদের মতে প্রেম হল পুরুষের আধিপত্য কায়েম করার একটি মোক্ষম হাতিয়ার। এ কথা প্রথম উচ্চারণ করেন সিমন দে বোভোয়া (Simone de Beauvoir) ১৯৪৮ সালে তাঁর দ্য সেকেন্ড সেক্স (The Second Sex ) গ্রন্থে। পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে একজন নারী জীবনের মানে খুঁজে পায়। এইভাবেই সে তার অস্তিত্বকে অতিক্রম করে। নারীচেতনা সততই আত্মত্যাগের মাধ্যমে, বন্দিত্বের মধ্যে মুক্তি খোঁজে।

দ্য ফেমিনিস্টস (The Feminists) নামের এক মার্কিন নারীবাদী গোষ্ঠী সিমন দে বোভোয়াকে অনুসরণ করে, আর তার সঙ্গে মার্কসীয় বিশ্লেষণ সংযুক্ত করে বললেন যে, প্রেম হল এমন একটা মতাদর্শগত হাতিয়ার, এমন এক ভ্রান্ত চেতনা যা শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, মেয়েদের পারস্পরিক বন্ধন গড়ে তুলতে বাধা দেয়। প্রেম এরকম একটা বিভ্রম তৈরি করে যেন মেয়েরা একইসঙ্গে প্রাপক এবং দাতা। এই গোষ্ঠী প্রেমের ধ্বংসের আর্জি জানায়। এই গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা টি-গ্রেস অ্যাটকিনসন (Ti-Grace Atkinson)-এর ভাষায়:

I propose that the phenomenon of love is the psychological pivot in the persecution of women. Because the internalisation of coercion must play such a key functional part in the oppression of women due to their numbers alone, and because of the striking grotesqueness of the one-to-one political units pairing the Oppressor and the Oppressed, the hostile and the powerless, and thereby severing the Oppressed from any kind of political aid, it is not difficult to conclude that women by definition must exist in a special psycho-pathological state of fantasy both in reference to themselves and to their manner of relating to the counterclass. This pathological condition, considered the most desirable state for any woman to find herself in, is what we know as the phenomenon of love.

সিমন দে বোভোয়ার অনুগামী আরেকটি নারীবাদী গোষ্ঠী, নিউ ইয়র্ক র‌্যাডিকাল ফেমিনিস্টস (New York Radical Feminists), মনে করেন যে পুরুষের ক্ষমতা কায়েম রাখতে বিবাহ, মাতৃত্ব, রতিক্রিয়া প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান জরুরি যার কেন্দ্রে আছে প্রেম। তাদের মতে, শোষণমূলক নারী-পুরুষ সম্পর্কে প্রেম একটি Emotional cement-এর কাজ করে যা পুরুষ-আধিপত্যকে জোরদার করে, দেয় যুক্তিগত ভিত্তি।

কেট মিলেট (Kate Millett) তাঁর সেক্সুয়াল পলিটিক্‌স্ (Sexual Politics) গ্রন্থে দেখিয়েছেন নারীর অধস্তন যৌনতা প্রেমের আখ্যানের মাধ্যমে কীভাবে জোরদার করা হয়। শুলামিথ ফায়ারস্টোন (Shulamith Firestone), তাঁর দ্য ডায়ালেকটিক অব সেক্স (The Dialectic of Sex) গ্রন্থে বলেছেন পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি পরজীবীর মতো মেয়েদের আবেগ-অনুভূতিকে শুষে নেয় কিন্তু পরিবর্তে কিছু দেয় না। রোম্যান্টিক প্রেমের অন্তর্লীন অসাম্য পিতৃতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করে। আন্ড্রিয়া ড্যরকিন (Andrea Dworkin) মনে করেন পুরুষের হিংসামূলক কার্যকলাপ এবং নারীনির্যাতনের মূলে আছে এমন এক ধরনের প্রেম যাকে তিনি বর্ণনা করেছেন এইভাবে— ‘frenzied passion which compels a woman to submit to a diminishing life in chains’।

এই প্রসঙ্গে, ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber)-এর বক্তব্য আলোচনা করা যেতে পারে। ওয়েবারের মতে, প্রেম এমন একটা বিভ্রম সৃষ্টি করে যেন সে হৃদয়ের গভীর তল থেকে উৎসারিত, যেন সে ক্ষমতার সম্পর্কের ঊর্ধ্বে, সামাজিক অনুশাসনের ঊর্ধ্বে। এইভাবে সে ক্ষমতার ব্যবহারের সহায়ক হয়ে ওঠে। তিনি লিখেছেন:

Unavoidably, the erotic relation is considered to be a relation of conflict. It is the most intimate coercion of the soul by the less brutal partner. This coercion exists because it is never noticed by the partners themselves. Pretending to be the most humane devotion, it is a sophisticated enjoyment of oneself in the other. No consummated erotic communion will know itself to be founded in any other way than through a mysterious destination for one another: fate, in this highest sense of the word. Thereby, it will know itself to be legitimized in an entirely amoral sense.

অর্থাৎ প্রেমের মধ্যে চলে ক্ষমতার অদৃশ্য এবং চতুর খেলা।

প্রেমের অন্তর্লীন অসাম্যকে সব নারীবাদীরাই যে স্বীকার করেন তা নয়। কেউ কেউ মনে করেন, নারী-পুরুষের প্রেমে অসাম্য নয়, পার্থক্য বিরাজমান। সমান কিন্তু পৃথক, এই তাত্ত্বিক অবস্থান যাঁরা গ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফ্রান্সেসকা কান্সিয়ান (Francesca Cancian)। তাঁর মতে, নারী-পুরুষের ভালবাসবার ধরনটা আলাদা এবং তা পরস্পরের পরিপূরক। তবে গত শতক থেকে প্রেমের ‘Feminization’ ঘটেছে, অর্থাৎ মেয়েদের ভালবাসার ধরনকেই স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, এবং মনে করা হচ্ছে, মেয়েরা ভালবাসায় বেশি দক্ষ।

সাম্প্রতিক কালে নিকলাস লাহমান (Niklas Luhmann),১০ বেক অ্যান্ড বেক-গেনশাইম (Beck and Beck-Gensheim),১১ অ্যান্টনি গিডেনস (Anthony Giddens)১২ প্রমুখ সমাজতত্ত্ববিদ মনে করেন, একসময় প্রেম অসাম্যে প্রোথিত হলেও সাম্প্রতিক কালে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার করালগ্রাস থেকে মুক্তিলাভ করেছে। শুধু তা-ই নয়, প্রেমের গণতন্ত্রীকরণ ঘটেছে। প্রেম সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের একটি অঙ্গ হয়ে উঠেছে। অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীবাদী গবেষকেরা এ কথা মানতে নারাজ যে প্রেম পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তিলাভ করেছে। প্রেমের সঙ্গে ক্ষমতার লড়াই বহাল রয়েছে। ৬৫টি সদ্যবিবাহিত দম্পতিকে সমীক্ষা করে পেনি মান্সফিল্ড ও জিন কলার্ড (Penny Mansfield and Jean Collard) (1988) দেখিয়েছেন আধুনিক প্রেমের ধারণার সঙ্গে যে আবেগ-অনুভূতির পরিতৃপ্তির প্রত্যাশা জড়িয়ে রয়েছে বাস্তবে তা পূরণ হচ্ছে না।১৩ ষাটটি দম্পতিকে সমীক্ষা করে জিন ডানকম্ব এবং ডেনিস মার্সডেন (Jean Duncombe and Dennis Marsden) (1993) এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মহিলারা স্বামীর কাছে যে গুরুত্ব এবং স্বতঃস্ফূর্ততা প্রত্যাশা করে, বাস্তবে তা অধরাই থেকে যায়। প্রেমের ধারণা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে অনিবার্যভাবে তাই ফারাক দেখা যায়।১৪

ওয়েন্ডি ল্যাংফোর্ড (Wendy Langford) মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রেমের ব্যবচ্ছেদ, ‘Anatomy of love’, করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বিসমকামী সম্পর্কে লিপ্ত পনেরো জন মহিলার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তিনি প্রেমের চরিত্রকে অনুধাবন করতে চেয়েছেন। পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাই যে প্রেমের চালিকাশক্তি সে ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ। মানবজাতি মানবিক এবং সাম্যভিত্তিক প্রেমের যুগে প্রবেশ করেছে (Mankind has entered an era of equal and humane love)— এই ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তাঁর সমীক্ষা উন্মোচিত করেছে প্রেমের অন্তর্নিহিত বৈষম্য, প্রেমের শাসন বা ‘Government by love’-এর অস্তিত্ব। প্রেমের শাসনে নারী যেন দাস আর পুরুষ যেন প্রভু, নারীসত্তার দাসত্বকরণেই যেন পুরুষের সত্তার সার্থকতা।১৫

এ.জি. জনাসডটির (A.G. Jonasdottir) ‘Love Power’-এর ধারণার অবতারণা করেছেন। এই তাত্ত্বিকের মতে প্রেম হল এমন এক উৎপাদনশীল শক্তি যা পুরুষ নারীকে শোষণ করার জন্য ব্যবহার করে। পুরুষ মেয়েদের প্রেমকে ব্যবহার করেই পুরুষ হিসেবে ক্ষমতা অর্জন করে।১৬

গত কয়েক বছর ধরে Interdisciplinary.Net নামের এক ব্রিটিশ সংস্থা ‘Gender and Love’ বিষয়ে বার্ষিক আলোচনা চক্রের আয়োজন করছে। লিঙ্গপরিচয় ও প্রেমের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে সারা বিশ্বে যে বহুজন গবেষণায় রত এই আলোচনা চক্রের পঠিত প্রবন্ধাবলির প্রকাশিত সংকলন থেকে তা জানা যায়।১৭ প্রেম যে বিশ্বজুড়ে নারীবাদী আলোকপাতের অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে তা প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।

তবে পিতৃতন্ত্র ও প্রেমের আন্তঃসম্পর্ক সম্বন্ধে এই তাত্ত্বিক চর্চায় ভারতীয় নারীবাদীদের কোনও লক্ষণীয় অবদান এযাবৎ চোখে পড়ে না। কিন্তু এই চর্চা উপেক্ষিত থাকলে, ভারতীয় প্রেক্ষিতে পিতৃতন্ত্রের বিশেষ রূপটা, প্রেম ও পিতৃতন্ত্রের ঘাত-প্রতিঘাতের বিশিষ্টতা পরিষ্কার হয়ে ওঠে না, নারীবাদী এষণা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বর্তমান প্রবন্ধে সেই খামতিটুকু দূর করার সামান্য প্রয়াস।

ঔপনিবেশিক বাংলায় উচ্চবর্ণ হিন্দুসমাজে প্রেম

উনিশ শতকের উচ্চবর্ণ বাঙালি হিন্দুসমাজে দাম্পত্যের অন্তর্গত নির্বাচন-নিরপেক্ষ, বাধ্যতামূলক প্রেম ছাড়া নারী-পুরুষের অন্য কোনও ধরনের প্রেমের অনুমোদন ছিল না। যদিও প্রাচীন ভারতে স্বয়ম্বর প্রথা ও গান্ধর্ব বিবাহের চল ছিল কিন্তু উনিশ শতকের বঙ্গসমাজে বিবাহের যে-আদর্শ অমোঘ এবং অলঙ্ঘনীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাতে প্রাক্‌বিবাহ নির্বাচনের কোনও স্থান ছিল না। বিবাহ হল একটি দৈব অনুগ্রহপ্রাপ্ত বন্ধন, অতএব এই বন্ধন চিরন্তন ও অবিচ্ছেদ্য এবং ব্যক্তিবিশেষের সম্মতি-অসম্মতির ঊর্ধ্বে। বিবাহের পর আবশ্যিকভাবে এবং পারস্পরিকতার প্রত্যাশা ছাড়াই স্বামীকে ভালবাসতে হবে। সে প্রেম আসলে স্বামীকে দেবতা হিসেবে, পরম গুরু হিসেবে পূজারই নামান্তর। স্বামী যেমনই হোক না কেন, স্বামীর কাছ থেকে ভালবাসা পাক বা না পাক, স্ত্রীকে স্বামীর প্রতি অনুগত থাকতেই হবে। স্বামীর আরও কয়েক জন পত্নী অথবা উপপত্নী বর্তমান থাকলেও। বিবাহবিচ্ছেদের কোনও শাস্ত্রসম্মত সুযোগ ছিল না। তবে হিন্দুবিবাহের অবিচ্ছেদ্যতা বজায় রাখার দায় স্ত্রীর, স্বামীর নয়। স্বামী উদাসীন, অত্যাচারী, ব্যভিচারী, যাই হোক না কেন, স্ত্রী স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারবে না। স্বামীসঙ্গ থেকে আগাগোড়া বঞ্চিত হলেও নয়। স্ত্রীর পুনর্বিবাহের কোনও প্রশ্ন নেই। অন্য দিকে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের রীতিনীতি না থাকলেও, পুরুষ সামান্য অজুহাতে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পারে। আর, পুনর্বিবাহ করতে হলে তাকে বর্তমান স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে হয় না। সে যখন খুশি যত বার খুশি বিবাহ করতে পারে। সতীত্ব ও পাতিব্রত্যের আদর্শকে নারীজীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে উপস্থাপিত করা হত। স্বামীর মৃত্যু হলেও মৃত স্বামীর প্রতি আনুগত্যে অবিচল থাকা হল স্ত্রীর কর্তব্য। এই অবস্থাটা ১৮৫৬ সালে বিধবার বিবাহের বৈধকরণের পর যে বিশেষ বদলাল তা নয়। বিবাহ ও দাম্পত্যের এই আদর্শ থেকে বিচ্যুতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হত। বিশদভাবে বললে, প্রাক্‌বিবাহ প্রেম, স্বনির্বাচিত বিবাহ, বিধবার বিবাহমুখী অথবা বিবাহনিরপেক্ষ প্রেম, সধবার স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষের সঙ্গে প্রেম, উচ্চবর্ণ হিন্দুসমাজে কঠোরভাবে দণ্ডনীয় পাপ হিসেবে বিবেচিত হত। কারণ এই ধরনের বিচ্যুতির ফলে কুলের মর্যাদাহানির আশঙ্কা। হিন্দু মূল্যবোধ-ব্যবস্থায় কুল হল মর্যাদা এবং সম্মানের প্রতীক। কুলকে এককথায় সংজ্ঞায়িত করা কঠিন কিন্তু বৃহত্তর পরিবারের জীবিত এবং মৃত, নারী এবং পুরুষ সমস্ত সদস্যরাই কুলের অন্তর্ভুক্ত।১৮ একজন বিবাহিতা নারীর তিন কুল— পিতৃকুল, মাতৃকুল এবং পতিকুল। একজন নারী বিবাহ ও দাম্পত্য সংক্রান্ত অনুশাসনের উল্লঙ্ঘন করলে তাকে ধিক্কার জানানো হত এই ভাষায়— সে কুলে কালি দিয়েছে, অর্থাৎ কুলের মর্যাদা বিনষ্ট করেছে। তার শাস্তি কুল থেকে বহিষ্কার— পরিবার, ঘর, ভদ্রসমাজ থেকে বহিষ্কার। বিভিন্ন ধরনের দৈহিক নির্যাতনও তার কপালে জুটত। এমনকী পরিবার বা গোষ্ঠীর সম্মান রক্ষার্থে তাকে হত্যা করারও নজির কম নয়। অন্য দিকে তার প্রেমিকটির কপালে হেনস্থা বা দৈহিক শাস্তি কখনও-সখনও জুটত ঠিকই, জাত-গোত্র-ধর্মের বেড়া লঙ্ঘন করে বিয়ে করলে বা বিধবার পাণিগ্রহণ করলে ত্যাজ্যপুত্র হবার নজির পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু কুলে তার সম্মানজনক অবস্থান অটুট থাকত।

উনিশ শতক এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকের সংবাদ-সাময়িকপত্র, মামলা-মোকদ্দমা সংক্রান্ত দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে এ কথা জেনে তাজ্জব হয়েছি যে সাধারণভাবে মেয়েরা পিতৃতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া সতীত্ব ও পাতিব্রত্যের আদর্শের যূপকাষ্ঠে নিজের মন-শরীরের চাওয়াকে বলি দিলেও বহু মেয়ে সমাজের চোখরাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিষিদ্ধ প্রেমের সম্পর্কে নিবিষ্ট হয়েছে। সমাজের অনুশাসনকে নিঃশব্দে অস্বীকার করে নিজের পছন্দের মানুষের সঙ্গে মিলিত হবার স্বাধীনতাকে জাহির করেছে, নিজের জীবনকে নিজের মতো করে বাঁচার অধিকারকে করেছে নিরুচ্চার ঘোষণা। নিজের পছন্দের মানুষের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে মিলিত হতে অভিভাবকের আপত্তিকে পাত্তা দেয়নি। এবং জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠীর দেওয়াল ভেঙেছে। সম্পর্ককে বৈধতার সিলমোহর দিতে ক্রমাগত বিবাহের শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছে, নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছে, কখনও ধর্মান্তরিত হয়েছে, অথবা প্রথাগত বিবাহপদ্ধতি অনুসরণ করেছে। এ কথা শুধুমাত্র অবিবাহিত মেয়েদের জন্য সত্যি তা নয়, বিধবাদের ক্ষেত্রেও সত্যি। ১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহের বৈধকরণ ঘটার আগেই ইয়ং বেঙ্গলের তেজস্বী নেতা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বিয়ে করেছেন বর্ধমানের বিধবা রানি বসন্তকুমারীকে এক বিচিত্র পদ্ধতি অনুসারে।১৯ এই আইন পাশ হবার প্রায় আশি বছর পরে কবি রাধারাণী দেবী তাঁর দ্বিতীয় স্বামী কবি নরেন দেবের সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠানে আত্মসম্প্রদান করেছেন কারণ তাঁর অভিভাবকদের সে বিয়েতে সম্মতি ছিল না। হিন্দু বিবাহের ক্ষেত্রে আত্মসম্প্রদানের ঘটনা ছিল অভূতপূর্ব।২০

আর সধবারা? কুলীন ঘরের বধূর ভাগ্যে তো স্বামীর সঙ্গে ঘর করাই কপালে জুটত না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কুলীন ঘরের মেয়েরা স্বামীসহবাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মামার বাড়ির আশ্রিতের মতো বেঁচে থাকাই তার ভবিতব্য। তার বহুপত্নীসংবলিত স্বামী বড়জোর এক-আধ বার টাকা এবং যৌনসুখ আদায়ের জন্য আবির্ভূত হয়ে ধন্য করে দিত। কিন্তু এই কপাল-লিখনকে যদি কেউ খণ্ডাতে চায়? আবার স্বামীর সঙ্গে এক ছাদের তলায় বসবাস করলেই কি ধরে নিতে হবে সে স্বামীর সোহাগধন্য? তার স্বামী হয়তো মাতাল, লম্পট, নয় অন্য নারীর প্রতি আসক্ত। অবহেলায় পড়ে থাকে সে ঘরের এক কোণে। অথবা রোজ তার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। সেই স্ত্রীর যদি অন্য কাউকে মনে ধরে তাহলে তার সঙ্গে বৈধভাবে মিলিত হবার একমাত্র উপায় ধর্মান্তরীকরণ। ইসলাম অথবা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে সে স্বামীকে সেই ধর্মগ্রহণ করার জন্য আবেদন করতে পারে। যদি স্বামী সাড়া না দেয়, তাহলে আইনসম্মতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব। এবং অতঃপর পছন্দের মানুষের সঙ্গে বিবাহ।২১

তবে বিবাহের বৈধতার কাঙাল ছিল না সবাই। বিয়ের তোয়াক্কা না করে কেউ কেউ পছন্দের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হত। বিশেষত বিধবা এবং কুলীন ঘরের বধূদের ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা গেছে। সমাজ সেই সম্পর্ককে চিনে ফেললে ব্যভিচার তকমা দিয়ে ধিক্কার দিত। মেয়েটি কুলটা, অসতী, ভ্রষ্টা, নষ্ট মেয়ে, এইসব বিশেষণে ভূষিত হত। বিধবাকে অনেকসময় ব্যভিচারের অভিযোগে মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হত। পরিবার, গৃহ থেকে বিতাড়িত করা হত তাকে। আবার কেউ কেউ প্রেমিকের সঙ্গে স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়ত। প্রেমিকের সঙ্গে স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়লে সে কুলত্যাগিনী। আর কুলত্যাগ করলে চিরকালের জন্য ঘরে, পরিবারে এবং ভদ্রসমাজে ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত। সেটাই ছিল তার শাস্তি। ঔপনিবেশিক বাংলায় কুমারী,‌ বিধবা বা সধবা— প্রেমাস্পদের সঙ্গে কুলত্যাগের ঘটনা ঘটত ভূরি ভূরি, ইংরেজিতে যাকে বলে Elopement। তবে কুলত্যাগ শব্দটি শুধুমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তার পুরুষ প্রেমিকটির ক্ষেত্রে নয়, প্রেমিকার সঙ্গে তার বেপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি সাময়িক শোরগোল তুললেও তার ঘরের ফেরার পথ বন্ধ হত না। চাইলেই সে ঘরে ফিরতে পারত। বলাই বাহুল্য তার জাতি, বংশ, কুলের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকত। সেখানে হয়তো তার পতিব্রতা পত্নী অপেক্ষারতা। কিন্তু একজন মেয়ে যদি একবার প্রেমিকের সঙ্গে ঘর ছাড়ে তাহলে তার আর ফিরবার উপায় নেই। ঘর ছাড়ার পর হয়তো বা সে প্রথাগত পদ্ধতিতে বিয়ে করত কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রেমিকযুগল বিবাহবিহীন সহবাসের পথটাকেই বেছে নিত। পাড়ি দিত কোনও দূরতর শহরে— কাশী, বৃন্দাবন অথবা জলপথে বর্মা মুলুকে, অথবা দক্ষিণ ভারতে বা সুদূর পশ্চিমে। স্বামী-স্ত্রীর মতোই সংসার পাতত তারা। সন্তানসন্ততির জন্ম দিত। আশেপাশের মানুষজনকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই, সেই দাম্পত্য-দাম্পত্য খেলার যবনিকা পড়তে বেশিদিন লাগত না। সমসাময়িক নথিপত্র অন্তত সেই কথাই বলে। পুরুষের যদি কোনও জীবিকার সংস্থান না থাকে, তাহলে এই বিবাহবিহীন সংসারের বোঝা ভারী মনে হলেই সে চম্পট দিত। পরিবারের কাছে ফিরে যেতে তার তো কোনও বাধা নেই। সন্তান হলে এই পলায়নের প্রবণতা অনেক গুণ বেড়ে যেত। প্রেমিকা ও সন্তানকে ফেলে রেখে নিজের আদি পরিবারের নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক বৃত্তে ফিরে যেত সে। পরিবার-পরিত্যক্ত, প্রেমিক-পরিত্যক্ত মেয়েটিকে কঠোর এক জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হত। অনেক ক্ষেত্রেই সে হার মানত, আত্মহননের পথ বেছে নিত। আর তার প্রেমিকটি পিতা-মাতা-স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে সানন্দে পুনর্মিলিত হত। সোনার আংটি আবার বাঁকা!২২

আরও মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটত। যাকে বিশ্বাস করে একটি মেয়ে ঘর ছাড়ল, যার হাত ধরে পরিবারকে চিরদিনের মতো ত্যাগ করে এল, অচিরেই বুঝতে পারল, সে আসলে আড়কাঠি, বেশ্যাপল্লির দালাল। তাকে বেশ্যাগৃহে ফেলে চম্পট দিয়েছে। অথবা সে ঠগ, প্রতারক। তার আসল ধান্দা, প্রেমিক সেজে মেয়েটির মন ভুলিয়ে তার গয়নাগাটি, টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেওয়া। প্রতারিত, পরিত্যক্ত, অকিঞ্চন অবস্থায় যে-মেয়েটিকে সে ফেলে রেখে গেল অনেকসময় আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ছাড়া তার আর কোনও উপায় ছিল না। আবার যারা ব্যভিচারের অভিযোগে পরিবার থেকে বিতাড়িত, তাদেরও একই হাল। তারা সকলেই হাভাতে, হাঘরে। পেটের ভাত জোগানোর সংস্থান নেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। জীবনের আসক্তি না ঘুচলে জীবিকানির্বাহের জন্য কোনও বৃত্তি বেছে নিতে হবে তো! কিন্তু তথাকথিত সম্মানজনক বৃত্তি বেছে নেওয়ার জন্য যেটুকু শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তা না থাকলে? হয়তো রাঁধুনি, ঝি, কলকারখানার শ্রমিক অথবা চা-বাগানের কুলির জীবিকা গ্রহণ করতে হত তাকে। অথবা বৈরাগী-বৈষ্ণবদের দলে ভিড়তে হত। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেশ্যাপল্লিই হত তার অন্তিম ঠিকানা।২৩

বিবাহবহির্ভূত প্রেম যে অসাম্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবার, বৈধ দাম্পত্যের বৃত্তের বাইরে জন্ম হত যে সম্পর্কের সে সম্পর্কও পিতৃতন্ত্রের থাকবন্দি কাঠামো ও ক্ষমতার খেলার আওতার বাইরে নয়। প্রেমের সম্পর্কে নারী-পুরুষ দু’জনের সমান অংশীদার। কিন্তু শাস্তি প্রাপ্য নারীর। কুলে কালি দেওয়ার অপবাদ মেয়েটির জোটে, তার প্রেমিক পুরুষটির নয়। গৃহচ্যুতি, পরিবারচ্যুতি, জাতিচ্যুতির শাস্তি মেয়েটির কপালে জোটে, পুরুষটির নয়। শাস্তি উপেক্ষা করে যদি-বা সে প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধল, সে ঘর খেলাঘরের মতো ধসে পড়ল। কারণ পুরুষের প্রতারণা, দায়িত্ববিমুখতা, পলায়নি মনোবৃত্তি। পুরুষটি মূল পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলিত হল, আর মেয়েটি কঠোর জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হল অথবা জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুকে আপন করে নিল।

এবার দাম্পত্যের প্রসঙ্গে আসি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে অভিজাত বাঙালিসমাজে হিন্দু/ব্রাহ্ম-সমাজে দাম্পত্য সম্বন্ধে পুনর্ভাবনা ঐতিহাসিক মহলে বহুচর্চিত বিষয়।২৪ পাশ্চাত্য সাহিত্যের সংস্পর্শে এসে দাম্পত্যে জন্ম নিল রোম্যান্টিক প্রত্যাশা। শিক্ষিত পুরুষেরা চাইতে লাগল শিক্ষিতা স্ত্রী, যে স্ত্রী তাকে মননশীল সাহচর্য দান করতে পারবে। কাঙ্ক্ষিত হল অন্তরঙ্গতা, গভীরতর নৈকট্য, এবং প্রেম যা শুধুমাত্র দৈহিক আদান-প্রদানে সীমাবদ্ধ নয়। কিন্তু এইসব প্রত্যাশা পুরুষের প্রত্যাশা। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পুরুষটির নারীর কাছে চাওয়ার ধরনটা বদলেছে। সে চায় স্ত্রীকে চিঠি লিখতে, সে চায় স্ত্রীর সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে। সে চায় স্ত্রী তার সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষাদান করবে। ঘরসংসার পরিচালনায় আনবে পরিচ্ছন্নতা, নান্দনিকতা। কিন্তু তার স্ত্রী কী চায় সে খোঁজ কেউ রাখেনি। আর প্রেমিকা হোক বা সঙ্গী হোক আর সহধর্মিণী হোক, সতীত্ব ও পাতিব্রত্যই যে হল নারীর জীবনের পরম আদর্শ এ কথা হাজারো প্রবন্ধে, উপদেশধর্মী পুস্তক-পুস্তিকায় পুনঃপুন উচ্চারিত হতে লাগল। স্ত্রীকে থাকতে হবে স্বামীর প্রতি আনুগত্যে অবিচল, বৈধব্য এলেও যে-আনুগত্যে চিড় ধরবে না। অতএব এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দাম্পত্যের ধারণায় যেটুকু পরিবর্তন এসেছিল তা প্রসাধনী-স্তরে, মূল কাঠামো অক্ষুণ্ণই ছিল। দাম্পত্যবহির্ভূত প্রেমের মতোই দাম্পত্য প্রেমও গভীর এক অসাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল, পিতৃতন্ত্রের করালগ্রাস কোনও ধরনের প্রেমকেই রেহাই দেয়নি।২৫

রাষ্ট্র ও প্রেম

১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সরকার পাশ করল হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ আইন। এই আইনের আওতায় এল সব বিধবারাই, স্বামীসহবাস যাদের ঘটেছে, যারা সন্তানবতী বা বয়স্কা তারাও। তবে বলা হল, নাবালিকা বিধবাদের অভিভাবকের অনুমোদন লাগবে। এই আইন অনুসারে নাবালিকা কে? শুধুমাত্র যার বয়সপ্রাপ্তি ঘটেনি সে নাবালিকা তা নয়, যার স্বামীসহবাস ঘটেনি সেও নাবালিকা। আর যার স্বামীসহবাস ঘটেছে সে আর নাবালিকা গণ্য হবে না তার বয়স সাবালকত্বের বয়স, অর্থাৎ আঠারোর কম হলেও। কোনও স্বামীসহবাসবঞ্চিত নাবালিকা বিধবা, যদি অভিভাবকের আপত্তি সত্ত্বেও প্রেমজ বিবাহ করতে চায়, তাহলে তার উপায় নেই। অভিভাবকের বিনা সম্মতিতে বিয়ে করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অবশ্য বিধবাটি সাবালিকা হলে অথবা তার স্বামীসহবাস ঘটে থাকলে তার অভিভাবকের অনুমোদন প্রয়োজন নেই। ধরা যাক সে অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে হিন্দু বিবাহের আচারপদ্ধতি মেনেই এই আইন অনুসারে বিয়ে করতে চায়। সেক্ষেত্রে কে তাকে সম্প্রদান করবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রাধারাণী দেবী ১৯৩৩ সালে আত্মসম্প্রদান করেছিলেন।

ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থা মেয়েদের দাম্পত্যবহির্ভূত প্রেমের জন্য কোনও শাস্তি বরাদ্দ করেনি। ১৮৬০ সালে চালু হওয়া Indian Penal Code বা ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনে Adultery অবশ্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু সে অপরাধের দায় প্রেমিকটির, বিবাহিত মহিলাটির নয়। মহিলাটির স্বামী প্রেমিকটির বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনতে পারত। তবে তাকে তার স্বামীত্ব প্রমাণ করতে হবে। এই কথা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, আমাদের শ্বেতাঙ্গ শাসকবর্গ হিন্দু সনাতন ধ্যানধারণাকে গ্রহণ করেছিল, যে-ধারণা অনুযায়ী স্ত্রী হল স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি, এবং সেই সম্পত্তি কেউ কেড়ে নিলে তার শাস্তি পাওনা। কিন্তু স্বামী কখনওই স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, তাই স্ত্রী ব্যভিচারী স্বামী অথবা তার প্রেমিকার বিরুদ্ধে কখনওই আইনি লড়াইয়ে নামতে পারত না। একইভাবে একজন বিবাহিত নারী প্রেমিকের সঙ্গে স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘর ছাড়লেও তার প্রেমিকের বিরুদ্ধে তার স্বামী Enticement বা প্রলুব্ধকরণের অভিযোগ আনতে পারত। স্ত্রীর বিরুদ্ধে সে কোনও অভিযোগ আনতে পারবে না। আবার স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে অনুরূপ কোনও অভিযোগ আনতে পারবে না। ব্যভিচার বা প্রলুব্ধকরণ এই দুই ক্ষেত্রেই ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন অনুসারে স্ত্রী অপরাধী গণ্য হল না ঠিকই কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় তার সক্রিয় নিযুক্তি, তার সচেতন পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতাকেই অস্বীকার করা হল না কি? তাছাড়া স্ত্রীকে তার ব্যভিচারী স্বামী বা তার প্রেমিকার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার না দিয়ে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন তার নৈতিক দ্বিচারিতাকে প্রকট করে তুলেছিল। তবে শুধুমাত্র বিবাহিত নারীর কুলত্যাগ বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক Adultery বা Enticement-এর অভিযোগের আওতায় আনা যেত। কুমারী মেয়েদের ক্ষেত্রে অপহরণ, Kidnapping বা Abduction-এর অভিযোগ আনা যেত। সে স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়লেও। বিধবাদের ক্ষেত্রেও এই অভিযোগ আনা যেত কিন্তু বিধবা শায়েস্তা করার আরেকটা রাস্তা ছিল তাকে মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা। আশ্চর্যের কথা হল এই, ব্রিটিশ আইন-আদালত অভিযুক্ত বিধবার সম্পত্তিবিচ্যুতি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অনুমোদন করত। জীমূতবাহনের দায়ভাগ উত্তরাধিকার আইনকে নিজের মতো ব্যাখ্যা করে ব্রিটিশ বিচারবর্গ ঘোষণা করলেন যে, বৈধব্যের পরে ব্যভিচার সংঘটিত হলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না, কিন্তু স্বামী বর্তমানে ব্যভিচার ঘটলে তার সম্পত্তির অধিকার থাকবে না। প্রাথমিকভাবে আদালতে উঠেছিল সেইসব মামলা যেখানে বৈধব্যের পরবর্তীকালে ব্যভিচারের অভিযোগ এসেছে, কিন্তু পরবর্তীকালে কয়েকটি মামলা উঠেছিল যাতে বিধবাটি সধবা অবস্থায় ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল। ওইসব মামলায় বিধবাটিকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার পক্ষেই রায় দিল ব্রিটিশ আদালত। তা ছাড়া আশ্চর্যের কথা হল এই যে, ব্রিটিশ বিচারকবর্গ কোনও মানবতাবাদী বা যুক্তিবাদী উদ্দীপনায় চালিত হয়ে নয়, হিন্দু শাস্ত্রকে অবলম্বন করেই ‘অসতী নারীর বিষয়াধিকার’ সংক্রান্ত মামলাগুলির বিচার করল, তা ছাড়া বিধবাদের ক্ষেত্রে তারা বিনা প্রশ্নে ‘ব্যভিচার’ বা ‘Unchastity’ শব্দটা ব্যবহার করল, একবারও তাদের মনে হল না, বিধবাবিবাহ বৈধকরণের পর প্রেমের সম্পর্কে লিপ্ত বিধবাকে এই তকমাটা দেওয়া যায় কি না। এইভাবে আপাতদৃষ্টিতে ‘White man’s burden’ মাথায় নিয়ে মেয়েদের পক্ষে কখনও-সখনও সওয়াল করলেও এবং সাধারণভাবে মেয়েদের শাস্তি থেকে অব্যহতি দিলেও, ব্রিটিশ আইন-আদালত যে হিন্দু শাস্ত্রের পিতৃতান্ত্রিক চরিত্র ও সমাজের নৈতিক দ্বিচারিতাকেই জোরদার করেছিল তা অনস্বীকার্য।২৬

শ্বেতাঙ্গ শাসকবর্গের ভারতীয় সমাজ নিয়ে মাথাব্যথার এক অনন্য এবং ব্যতিক্রমী ফসল হল তিন আইন। ১৮৭২ সালে ঔপনিবেশিক সরকার পাশ করল তিন আইন। এর পোশাকি নামটি হল Special Marriage Act অথবা Act III। স্বাধীন ভারতের অন্যতম বিবাহবিধি, ১৯৫৪ সালে পাশ হওয়া Special Marriage Act-এর পূর্বসূরি হল এই তিন আইন। এই আইন হিন্দুবিবাহ প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত লিঙ্গবৈষম্য ও নৈতিক দ্বিচারিতাকে বর্জন করে বিবাহের একটি ধর্মনিরপেক্ষ, আচারবর্জিত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, পারস্পরিক সম্মতিভিত্তিক ও চুক্তিনির্ভর রূপকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল, যা সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে ছিল যথার্থই বৈপ্লবিক।

তিন আইন অনুযায়ী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার অধিকার ছিল সেইসমস্ত নারী-পুরুষের যারা হিন্দু, মুসলিম, পারসি, জৈন, বৌদ্ধ অথবা খ্রিস্টান নয়। অর্থাৎ ভারতবর্ষে প্রচলিত এইসব ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন ব্যক্তিই এই আইনের সদ্ব্যবহার করতে পারত। ১৯২৩ সালে হরি সিং গৌরের উদ্যোগে এই আইনটি সংশোধিত হল। সংশোধনের বলে এই আইনের আওতায় আনা হল হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদের। উনিশ শতকের শেষ ভাগ এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকের বাংলায় প্রেমের বৈধ পরিণতির অন্যতম সহায় হয়ে উঠেছিল এই আইন।২৭

অবশ্য রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের ওজর-আপত্তিকে যে আইন প্রণয়নকারী সরকার গুরুত্ব দেয়নি তা নয়। তিন আইনের পূর্ববর্তী খসড়াগুলিতে বিবাহের নোটিশের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়সীমা পাঁচ দিন নির্ধারিত ছিল। চূড়ান্ত আইনে তা বাড়িয়ে চোদ্দো দিন করে দেওয়া হল। জাতীয় লেখ্যাগারের দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে পারভিজ মোদি দেখিয়েছেন কীভাবে হিন্দুসমাজ ভয় পেয়েছিল প্রেমিক-প্রেমিকারা অভিভাবকদের আপত্তির তোয়াক্কা না করে গৃহত্যাগ করে চুপিসারে কাগজের বিয়ে সেরে নেবে বলে। নোটিশের আগে-পরের সময়টা পাঁচ দিনের বদলে চোদ্দো দিন হলে অভিভাবকেরা উধাও হওয়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে সদলবলে পাকড়াও করে আনার জন্য হাতে একটু বেশি সময় পায়। নাহলে সমাজ রসাতলে যাবে। বেপরোয়া যুবক-যুবতীদের যৌন-নৈতিকতা উল্লঙ্ঘনের আশঙ্কায় আক্রান্ত রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের সঙ্গে আপস করতেই নোটিশের আগে-পরের সময়সীমা পাঁচ দিন থেকে চোদ্দো দিনে বাড়িয়ে দিল ব্রিটিশ সরকার। আপস, সমঝোতা, আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে গেলেও এই আইন যে পিতৃতন্ত্রকে জোরালো আঘাত করেছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই আইন অনুযায়ী বিয়ে করলে পাত্রীর বয়স হতে হবে কমপক্ষে চোদ্দো, সুতরাং অবোধ শিশুকন্যার গৌরীদানের রাস্তা বন্ধ। হিন্দুসমাজে পুরুষের ক্ষেত্রে বয়সের কোনও বিধি-নিষেধ নেই। আট থেকে আশি— যেকোনও বয়সি পুরুষই বিবাহযোগ্য। এই আইন পাত্রেরও ন্যূনতম বয়স আঠারোয় বেঁধে দিল। পাত্র-পাত্রীর স্ত্রী বা স্বামী বর্তমান থাকলে এ বিবাহ অসিদ্ধ, এবং এই তথ্য গোপন করে বিয়ে করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হিন্দু বৈবাহিক মতাদর্শ স্ত্রীর কাছে প্রত্যাশা করে স্বামীর প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য এবং নিঃশর্ত একগামিতা। অন্য দিকে পুরুষের বহুবিবাহে কোনও বাধা নেই। পুরুষের বহুবিবাহের দীর্ঘকালীন সামাজিক প্রবণতাকে কুঠারাঘাত করল এই আইন। একই কোপে স্ত্রী-পুরুষের ক্ষেত্রে নিয়মের ভিন্নতারও অবসান ঘটাল। বিবাহ-অনুষ্ঠানে পাত্র-পাত্রী দুই জনেরই সক্রিয় ভূমিকা, রেজিস্ট্রারের সামনে শপথ নিতে হবে দুই জনকেই, অর্থাৎ দুই জনেরই সমান সম্মতি বা Consent থাকলেই এ বিয়ে সম্ভব। হিন্দুসমাজের সম্মতিবিহীন, বিশেষত স্ত্রীর সম্মতি-অসম্মতির তোয়াক্কা না করে বিয়ে এই আইন অনুযায়ী একেবারে অচল। একুশ বছরের বেশি বয়স হলে অভিভাবকদের সম্মতির প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ, অভিভাবকের কর্তৃত্ব উপেক্ষা করে নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার পথ প্রশস্ত। তিন আইনের বলে স্ত্রী-পুরুষ দু’জনেই সমানভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় বিবাহবিচ্ছেদ এবং একইসঙ্গে পুনর্বিবাহের অধিকার পেল। এই ক্ষেত্রে সমাজের দ্বিচারিতাকে এই আইন প্রশ্রয় দিতে নারাজ। ঈশ্বরের নাম না উচ্চারণ করে, তাকে না সাক্ষী রেখে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে শুধুমাত্র সইসাবুদ, শপথগ্রহণের মাধ্যমে বিয়ে, এবং এই বিয়ের সঙ্গে জুড়ে আছে বিয়ে ভাঙার অধিকার। অতএব এই বিয়ে Sacrament নয়, Contract। এই বিয়ের রচয়িতা ঈশ্বর নয়, তাই এই বিবাহবন্ধন অবিচ্ছেদ্য নয়, চিরন্তন নয়, এ মানুষের তৈরি করা বন্ধন, তাই এ বন্ধন ভেঙে ফেলাও যায়। এই বিবাহ বিধবাদের পক্ষে বিশেষ সুবিধেজনক। যেকোনও বয়সের বিধবাই তার মনের মানুষকে বিয়ে করতে পারে অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াই। এরজন্য তার হিন্দুবিবাহের সম্প্রদান প্রভৃতি রীতি পালন করার প্রয়োজন নেই। এই আইন সেক্ষেত্রে পুনর্বিবাহে আগ্রহী বিধবাদের কাছে আশীর্বাদ। নিজের উদ্যোগে নিজের পছন্দসই মানুষকে এই আইনের জোরে সে বিয়ে করতে সক্ষম। আবার ভিন্ন জাত অথবা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিল এই আইন। ধর্মীয় পরিচয়ের অস্বীকারের সঙ্গে সঙ্গেই অবান্তর হয়ে গেছিল জাত বা সম্প্রদায়গত পরিচয়ও। গুরুত্বপূর্ণ ছিল শুধুমাত্র দুই জন বিবাহেচ্ছু নারী-পুরুষের ব্যক্তিসত্তা। এইভাবে নারীর দেহ-মন ও ব্যক্তিসত্তার ওপর পুরুষের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণকে কায়েম রাখার উদ্দেশ্যে নির্মিত ‘অবিচ্ছেদ্য দৈব আশীর্বাদপুষ্ট’ বিবাহের আদর্শের ছলনা এবং দ্বিচারিতা ভরা ফানুসটাকে ছিন্নভিন্ন করেছিল এই আইন। এককথায়, এই আইন পিতৃতন্ত্রের উদ্দেশে ছুঁড়ে দেওয়া একটি বারুদের গোলা যা তছনছ করে দিয়েছিল স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কের চেনা ছককে। মেয়েদের স্বকীয়তা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর প্রকাশ ঘটেছিল এই আইনের প্রয়োগকে কেন্দ্র করে। আবার মেয়েরা কেউ কেউ এই আইনের বলেই একটি ব্যর্থ, অশান্ত দাম্পত্য থেকে মুক্তি পেয়েছিল এবং পরবর্তীকালে পুনর্বিবাহ করতে পেরেছিল কোনও পছন্দের মানুষকে। এইভাবে এই আইনকে ব্যবহার করে ঔপনিবেশিক বাংলার মেয়েরা নিজেদের জীবনের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছিল। সংখ্যায় তারা অল্প হলেও, যে আইনের বলে তারা জীবনের মোড় ঘোরাতে সক্ষম হয়েছিল, সেই আইনের গুরুত্ব অস্বীকার করার নয়।২৮

ঔপনিবেশিক যুগের বাংলা উপন্যাসে প্রেম এবং পিতৃতান্ত্রিক প্রত্যাঘাত

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা সাহিত্যের আঙিনাতে এক অভূতপূর্ব জোয়ার এল। এল উপন্যাস, যা কখনও আখ্যায়িকা, কখনও নবন্যাস আবার কখনও-বা নবেল বা নভেল হিসেবে উল্লিখিত। এলেন একের পর এক শক্তিমান ঔপন্যাসিক: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। মহিলারাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে রইলেন না। নভেলের প্রধান উপজীব্য হল প্রেম, প্রাক্‌-বিবাহ প্রেম, দাম্পত্য প্রেম, সধবার বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম, বিধবার প্রেম ও পুনর্বিবাহ। দাম্পত্য প্রেম ততটা আপত্তিকর না হলেও, অন্য সব ধরনের প্রেমের চিত্রায়ণই বাঙালি বিদ্বৎসমাজের এক অংশের কাছে অত্যন্ত আপত্তিজনক মনে হয়েছিল। প্রেমের সম্পর্কে নারী ও পুরুষ যদিও অংশীদার তবু প্রেমে নারীর ভূমিকা নিয়েই যত আপত্তি। বিদ্বৎজনেরা ভয় পেয়েছিল, প্রেমের রসে মজা নভেলি নায়িকাদের কথা পড়ে নভেল-পড়ুয়া মেয়েরা অধঃপাতে যাবে। লেখাপড়া শিখলেও তারা তরলমতি, অল্পবুদ্ধি ও স্বভাবতই চপলা, বিপথে চলার জন্য পা বাড়িয়েই আছে। এই ব্যাপারে, স্ত্রীশিক্ষার সমর্থক ও স্ত্রীশিক্ষার পরিপন্থীদের ভাবনাচিন্তায় বিশেষ অমিল ছিল না। সংস্কারবিরোধী ও সংস্কার-সমর্থক সবার মনেই এই আশঙ্কা ছিল যে নভেল পড়ে মেয়েরা গুরুজনদের অমান্য করে নিজের পতি নিজে নির্বাচন করতে উঠে-পড়ে লাগবে। প্রেমার্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। গৃহবধূরা নভেলের নায়িকাদের হাবভাব নকল করতে গিয়ে কর্মক্লান্ত স্বামীর হাতে এক ঘটি জলও তুলে দেবে না। বুড়ি শাশুড়ির হাতে সংসারের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে পটের বিবি সেজে নভেল হাতে বসে থাকবে। সধবারা পাতিব্রত্যের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করবে, বিধবারা প্রেম ও পুনর্বিবাহের জন্য লালায়িত হবে। এইসব অদ্ভুত আশঙ্কায় জর্জরিত হয়ে উঠল সমাজ। নভেল ও তার স্রষ্টাদের সমালোচনায় সরব হয়ে উঠল। ব্যঙ্গবিদ্রূপের তির ছুঁড়তে লাগল লাগাতার। তবে এ প্রসঙ্গে একটা কথা খুব পরিষ্কার বুঝে নেওয়া দরকার যে, বটতলা ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত চটুল, কখনও-বা অশ্লীল ভাষায় লেখা নভেলগুলি সম্বন্ধে ততটা আশঙ্কাবোধ ছিল না যতটা ছিল পরিশীলিত, মার্জিত ভাষায় লেখা উচ্চগুণমানসম্পন্ন উপন্যাসগুলি সম্বন্ধে। এ প্রসঙ্গে সেযুগের একজন অন্যতম সমালোচক, যতীন্দ্রমোহন সিংহ, তাঁর সাহিত্যে স্বাস্থ্যরক্ষা প্রবন্ধে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, শিল্পগুণবর্জিত সাহিত্য সাময়িকভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে ঠিকই, কিন্তু এদের অশুভ প্রভাব কখনওই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। উঁচুদরের শিল্পই মনকে, নৈতিকতাকে ঘায়েল করতে পারে সবচেয়ে জোরালোভাবে।২৯ তাই সমালোচনার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ তেজস্বী ঔপন্যাসিকদের লেখা উপন্যাসের বিরুদ্ধে। নিন্দার তির প্রথম ছোড়া হয়েছিল বঙ্কিমের দিকে। কারণ বঙ্কিমের হাত ধরেই তো উপন্যাসের জয়যাত্রা শুরু। আর বঙ্কিমের উপন্যাসগুলির, কমপক্ষে প্রথমদিককার উপন্যাসগুলির প্রধান উপজীব্য হল প্রেম, বিশেষত প্রাক্‌-বিবাহ প্রেম। দুর্গেশনন্দিনী,৩০ রাধারাণী,৩১ মৃণালিনী,৩২ প্রভৃতি উপন্যাসগুলিকে ব্যঙ্গ করে একের পর এক প্রহসন লেখা হতে লাগল। শুধু বটতলায় প্রকাশিত, চটুল ভাষায় লেখা, অখ্যাত লেখকের প্রহসন নয়, এই নভেল-বিরোধী চর্চায় শামিল হয়েছিলেন সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্ম পরিবারের লেখকেরাও।৩৩ এইসব প্রহসনের নায়িকা অবধারিতভাবে একজন শিক্ষিতা, নভেল-পড়ুয়া তরুণী। নভেল পড়ে সে প্রেমের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে। হা প্রেম, হা প্রেম করে দিনরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। কল্পলোকের বাসিন্দা হয়ে উঠেছে। এবং বঙ্কিমি নায়িকাদের চালচলন, ভাবভঙ্গি, বেশভূষা, এমনকী প্রেমনিবেদনের ভাষাও অন্তরস্থ করে ফেলেছে।

উপন্যাসে কুমারীর প্রেমের চিত্রায়ণ ব্যঙ্গবিদ্রূপের বন্যা বইয়ে দিলেও, মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নভেলি প্রেমের কুপ্রভাবের আশঙ্কা অনেক বেশি তীব্র হয়েছিল বিধবার প্রেম ও সধবার প্রেমের ক্ষেত্রে। এইসব ক্ষেত্রে আর নাটক বা প্রহসন নয়, প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ, পুস্তিকার পর পুস্তিকা লেখা হয়েছিল, যেখানে বিধবাদের বিবাহ-নিরপেক্ষ অথবা বিবাহমুখী প্রেম অথবা সধবাদের বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম সহানুভূতির সঙ্গে তুলে ধরার জন্য নভেল ও তার স্রষ্টাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল হিন্দুসমাজের নৈতিকতার ধ্বজাধারীরা।

বিধবার প্রেমকে উপস্থাপিত করার জন্য বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ,৩৪ কৃষ্ণকান্তের উইল,৩৫ শরৎচন্দ্রের বড়দিদি,৩৬ পল্লীসমাজ,৩৭ রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি৩৮ প্রভৃতি উপন্যাস তীব্র ভাষায় নিন্দিত হল। সধবার বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমকে সহানুভূতির সঙ্গে তুলে ধরার জন্য বঙ্কিমের চন্দ্রশেখর,৩৯ রবীন্দ্রনাথের ঘরে-বাইরে,৪০ শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত,৪১ স্বামী,৪২ দেবদাস৪৩ প্রভৃতি উপন্যাসও প্রবলভাবে সমালোচিত হল। এক সমাজপরিত্যক্ত বিধবার প্রেম এবং আরেক সদ্য বিধবার একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের ‘পাপচিত্র’ অঙ্কন করার জন্য শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন৪৪ কড়া ভাষায় নিন্দিত হল। লেখকদের হিন্দুসংসারের অন্দরমহলকে কলুষিত করার দায়ে, হিন্দুনারীর ব্যভিচারপ্রবণতাকে উসকে দেওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত করা হল। মজার কথা হল এই যে, একমাত্র বিষবৃক্ষ ছাড়া আর কোনও উপন্যাসেই বিধবার প্রেম বিবাহে পরিণতি পায়নি। বিষবৃক্ষ–তেও সে-মিলন বড়ই বেদনাময় ও ক্ষণস্থায়ী। প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে দৈহিক নিবিড়তার বর্ণনা প্রায় অনুপস্থিত বললেই চলে। সধবাদের পরপুরুষের প্রতি প্রেম, তা বিবাহের আগে অথবা পরে, যখনই জন্ম নিক, কখনওই বিবাহ অথবা অবৈধ সহবাসে পরিণতি লাভ করেনি। বঙ্কিম, শরৎ ও রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নায়িকারা দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে গল্পের শেষে কাশীবাসিনী অথবা আত্মঘাতিনী এমনকী উন্মাদও হয়েছিল। অর্থাৎ নারীর সমাজ-নিষিদ্ধ প্রেমকে উপস্থাপিত করে লেখকেরা হিন্দুসমাজের তথাকথিত মূল্যবোধকে আঘাত করার স্পর্ধা জানালেও পরিণতি সম্বন্ধে তাঁরা যথেষ্ট সাবধানী ছিলেন। পরিণতি সম্বন্ধে তাঁরা যে সংশয়, অনিশ্চয়তায় ভুগতেন তা বঙ্কিমের বার বার কৃষ্ণকান্তের উইল পরিমার্জনার চেষ্টাতেই পরিষ্কার।৪৫  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চোখের বালি–র শেষটুকু বার বার সংশোধন করেছেন।৪৬ বিনোদিনীকে বিহারীর সঙ্গে বিয়ে দেবেন কি দেবেন না সে বিষয়ে তাঁর দ্বন্দ্ব ছিল, শেষপর্যন্ত চোখের বালি–র শেষটুকু যে তাঁর মনঃপূত হয়নি, তিনি যে বেশি মাত্রায় জনতোষী হয়ে পড়েছিলেন এ কথা নিজেই বুদ্ধদেব বসুকে লেখা চিঠিতে কবুল করেছেন।৪৭ কিন্তু প্রেমের পরিণতির ক্ষেত্রে লেখকেরা যথেষ্ট সতর্ক এমনকী জনতোষী হয়ে উঠলেও, তাঁরা গাল-মন্দ থেকে অব্যাহতি পেলেন না। বলা হতে লাগল, প্রেমের এইসব ধরনগুলি একেবারেই বিলিতি সমাজ থেকে আমদানি করা। সমালোচকগণ ঘোষণা করতে শুরু করলেন যে বাংলা উপন্যাসে প্রেমের যে-রূপটি উপস্থাপিত হয়েছে তা হল বিজাতীয় একটি দুর্ঘটনা, একটি জঘন্য অসুখের জীবাণু, বাঙালি হিন্দুসমাজে যার এযাবৎ কোনও অস্তিত্ব ছিল না। হিন্দুসমাজে শুধুমাত্র এক ধরনের প্রেমেরই অস্তিত্ব আছে, তা হল, স্ত্রীর স্বামীর প্রতি প্রশ্নাতীত প্রেম। সে প্রেমের জন্ম বিবাহের পরে। যে প্রেম বাধ্যতামূলক, নির্বাচনের স্বাধীনতারহিত এবং স্বামীর গুণাগুণের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন। স্বামীর মৃত্যু হলেও হিন্দু নারী স্বামীর প্রতি আনুগত্যে অবিচল। এই প্রেমে আবেগের ওঠা-নামা নেই, এই প্রেম ‘স্তিমিতপ্রবাহা নদী’র মতো স্থির, অচঞ্চল। এই প্রেম হৃদয়শাসিত নয়, সমাজশাসিত। চন্দ্রনাথ বসু এই প্রসঙ্গে লিখছেন:

প্রণয় কবি মাত্রেরই বড় আদরের বস্তু। কিন্তু প্রণয় লইয়াই নবেল লেখকদের ব্যবসা। কিন্তু এই প্রণয়ের ভাব ইংলণ্ডে একরূপ ও আমাদের দেশে অন্যরূপ। ইংলণ্ডীয়দের মতে প্রণয় হৃদয়ের কার্য্য। হৃদয় বলিল, অমুককে ভালবাস, অমনি তাহাকে ভালবাসিলাম। হৃদয় বলিল, অমুককে ভালবাসিও না, অমনি আমারও ভালবাসা বন্ধ হইল। আমার একজন স্বামী আছেন। কিন্তু আমি তাহাকে ভালবাসিতে পারিনি। কেন ? আমার হৃদয় আমাকে এ বিষয়ে সম্মতি দেয়না।… পূর্ব্বের ভাবগুলি ইংরেজদের। ইংরেজদের দেশে এটা সম্ভব। কারণ বালিকাকাল হইতেই যুবতী আপনাকে স্বাধীন দেখিতে পায়। তাহার যাহাকে ইচ্ছা সে তাহাকে বিবাহ করিতে পায়। ইহাতে তাহার সমাজে নিন্দা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে বিবাহের পর হইতে প্রণয়ের অঙ্কুর আরম্ভ হয়। বিবাহের পূর্ব্বে পাত্র কন্যা কেহ কাহাকে দেখিতে পায় না। আমাদের দেশে প্রণয় সমাজ প্রথার অধীন মাত্র। তোমার হৃদয়কে ইহাতে সমাজের বশে চলিতে হইবে…৪৮  

এইভাবে চন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ সমালোচকগণ হিন্দুসমাজের প্রেমের ভিন্নতা ও অনন্যতা তুলে ধরলেন। স্ত্রী-পুরুষের প্রাক্‌-বিবাহ অথবা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক এযাবৎ ব্যভিচার, ভ্রষ্টাচার, অসতীত্ব, দুর্নীতি প্রভৃতি নিন্দাসূচক শব্দের দ্বারা চিহ্নিত হত। বর্তমানে স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কের এই ধরনগুলিকে কখনও-বা প্রেম বা প্রণয় আখ্যা দিলেও, এই প্রেমকে বিজাতীয় চরিত্র আরোপ করে সমালোচকেরা ভুলে যেতে চাইলেন যে প্রাচীন ভারতে গান্ধর্ব ও স্বয়ম্বর বিবাহের শাস্ত্রীয় অনুমোদন ছিল, ভুলে গেলেন যে বৈষ্ণব সাহিত্যে রাধার পরকীয়া প্রেম অথবা বিদ্যাসুন্দর কাব্যের নিবিড় যৌনতানির্ভর প্রেম বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই অন্যতম অঙ্গ। তাঁরা এ কথাও মানতে চাইলেন না যে বিধবা ও কুলীন ঘরের বউদের ব্যভিচারপ্রবণতা তৎকালীন সমাজ-সংস্কারকদের দুশ্চিন্তার বিষয়। এ কথাও স্বীকার করতে চাইলেন না যে ১৮৫৬ সালের পর বিধবাদের পুনর্বিবাহ ও সুতরাং প্রেমের অধিকারও সম্পূর্ণ আইনানুগ। তাঁরা অভিযোগ করলেন, এইসব ধরনের প্রেম সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করে লেখকেরা হিন্দু অন্দরমহলের পবিত্রতা বিপন্ন করছে, এক দিকে অভিভাবক-নির্ধারিত বিবাহের হিন্দু আদর্শকে আঘাত করছে, অন্য দিকে সধবাদের ও বিধবাদের ব্যভিচারের পথে প্ররোচিত করছে, তাদের সতীত্ব ও পাতিব্রত্যর মহান হিন্দু আদর্শ থেকে বিচ্যুত করেছে। এইসব ঔপন্যাসিকেরা হলেন, এককথায়, বিলিতি পাপের ধারক ও বাহক। সমালোচক যতীন্দ্রমোহন সিংহ তাঁর ‘সাহিত্যে স্বাস্থ্যরক্ষা’ প্রবন্ধে বিধবার প্রেম, সধবার প্রেম ও গণিকার প্রেম দরদের সঙ্গে উপস্থাপিত করার জন্য বঙ্কিম, শরৎ ও রবীন্দ্রনাথকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন।৪৯ পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়,৫০ কালীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়,৫১ রাধাকমল মুখোপাধ্যায়৫২ প্রমুখ লেখকগণ রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি, ঘরে-বাইরে প্রভৃতি উপন্যাসগুলির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে লাগলেন। শিক্ষিত হিন্দু সমালোচকগণ আরও বলতে লাগলেন যে, হিন্দু নারী নভেলের কুপ্রভাবে সতীত্ব ও পাতিব্রত্যর আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে স্বেচ্ছাচারী ও ব্যভিচারিণী হলে শুধু যে হিন্দু পরিবার ও হিন্দুসমাজ বিপন্ন হবে তাই নয়, হিন্দু জাতিরও উন্নতির পথ রুদ্ধ হবে। এইভাবে সতীত্ব ও পাতিব্রত্যর পরাকাষ্ঠা এক আদর্শ নারীর ভাবমূর্তিকে হিন্দু জাতির কেন্দ্রস্থলে প্রতিস্থাপিত করলেন জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদেরা। হিন্দু জাতির উন্নতি ও মঙ্গলকে হিন্দু নারীর সতীত্ব ও পাতিব্রত্যর উপর নির্ভরশীল মনে করতে লাগলেন। একইসঙ্গে আদর্শচ্যুতির এক অভূতপূর্ব উদ্বেগে আক্রান্ত হয়ে উপন্যাস-সাহিত্যের বিরুদ্ধতায় মেতে উঠলেন। এইভাবে উদীয়মান হিন্দু পুনরুত্থানবাদী জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সঙ্গে মিশে গেল নভেল-বিরোধী চর্চা। এই মেলবন্ধনের চূড়ান্ত রূপ দেখতে পাই যতীন্দ্রমোহন সিংহের ভাবনায়। শরৎচন্দ্রের বিভিন্ন উপন্যাস ও বিশেষত তাঁর ‘স্বরাজ সাধনায় নারী’৫৩ প্রবন্ধটি সমালোচনা করতে গিয়ে সিংহ মহাশয় লিখলেন:

হিন্দু নারীর সতীত্ব ও পাতিব্রত্যই আমাদের গার্হস্থ্যজীবনের প্রধান অবলম্বন। হিন্দু জাতি যদি তাহাদের জাতীয় বিশেষত্ব বজায় রাখিয়া জীবিত থাকিতে ইচ্ছা করে, তবে হিন্দু নারীর পাতিব্রত্য অক্ষুণ্ণ রাখিতে হইবে। কারণ সেই পাতিব্রত্য দ্বারাই তাহার নারী-জীবনের চরম সার্থকতা এবং সেই পাতিব্রত্যই হিন্দু-জাতির প্রতিষ্ঠা।৫৪

যতীন্দ্রমোহনবাবু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন যে সাহিত্যিকের কর্তব্য হল হিন্দু জাতির মঙ্গলের উদ্দেশ্যে হিন্দু নারীর পাতিব্রত্যকে মহিমান্বিত করা। এইভাবে জাতীয়তাবাদী সমালোচকেরা শুধু যে নভেল ও তার স্রষ্টাদের নিন্দে করেই ক্ষান্ত হলেন তা নয়, সাহিত্যের উদ্দেশ্য, সাহিত্যিকের কর্তব্য নির্ধারণ করতে প্রয়াসী হলেন, এমনকী উপন্যাসের সাহিত্যগুণ মূল্যায়নের মাপকাঠিও নির্ণয় করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বলতে লাগলেন যে, সাহিত্যের উদ্দেশ্য হল চরিত্রগঠন, চিত্তবৃত্তির উৎকর্ষসাধন, জাতির মঙ্গলসাধন, এবং হিন্দু নারীর সতীত্ব ও পাতিব্রত্যের আদর্শকে আরও শক্তিশালী করে উপস্থাপিত করার মাধ্যমেই সাহিত্য তার অভীষ্ট উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে। আর যে সাহিত্য অথবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে যে উপন্যাস সতীত্ব ও পাতিব্রত্যের আদর্শকে আঘাত করে সে উপন্যাসকে স্ত্রীজাতির অপাঠ্য ঘোষণা করা হল এবং যে উপন্যাস সতীত্ব ও পতিব্রত্যের আদর্শকে আরও জোরদার করে সেই উপন্যাস স্ত্রীপাঠ্য বা সতীপাঠ্য হিসেবে অনুমোদিত হল। বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল, চন্দ্রশেখর  প্রভৃতি উপন্যাস স্ত্রীজাতির অপাঠ্য হিসেবে চিহ্নিত হলেও, দেবী চৌধুরাণী ৫৫ হিন্দু স্ত্রীর অবিচলিত পাতিব্রত্যকে মহিমান্বিত করার জন্য স্ত্রীপাঠ্য বিবেচিত হল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখের বালি, ঘরে-বাইরে, শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ, শ্রীকান্ত, দেবদাস প্রভৃতি উপন্যাস স্ত্রীজাতির অপাঠ্য আখ্যাত হল। পাশাপাশি একদল লেখক উপন্যাসের অবয়বে সতীত্বের মহিমা প্রচার করতে শুরু করলেন। প্রকাশিত হতে লাগল সতীলক্ষ্মী, সতী-সুহৃদ, সতী-রত্ন, এইসব নামের একের পর এক ‘সতীপাঠ্য’ উপন্যাস।৫৬ এইভাবে মেয়েদের মন-মননের উপর পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস কায়েম রইল।

তবে মজার ব্যাপার হল এই যে, এইসব স্ত্রীপাঠ্য উপন্যাসগুলির প্রতি পাঠিকাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। স্ত্রীজাতির অপাঠ্য হিসেবে চিহ্নিত মেয়েদের প্রেম উপস্থাপিত করা উপন্যাসগুলির প্রতিই তাদের বেশি আকর্ষণ। সুতরাং নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণকে বেপরোয়া অস্বীকারের আশঙ্কাও বলবৎ রইল। প্রেমের উপন্যাস পড়ে যাপিত জীবনে কতটা তারা প্রেমে পড়তে, প্রেমের সম্পর্কে লিপ্ত হতে উৎসাহিত হয়েছিল তা আজ নির্ণয় করার উপায় নেই, কিন্তু প্রেমের উপন্যাসের আকর্ষণ যে তারা এড়াতে পারেনি তা সহজেই অনুমেয়। ১৯৫৫ সালে Hindu Marriage Act বা হিন্দু বিবাহ আইন বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করেছে, বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দিয়েছে, একইসঙ্গে বিধবার পুনর্বিবাহকেও নতুন করে বৈধতার সিলমোহর দিয়েছে। এর আগের বছর পাশ হওয়া Special Marriage Act রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ধর্মবিযুক্ত বিবাহের সুযোগ করে দিয়েছে। এই আইন অনুযায়ী বিয়েতে অভিভাবকের সম্মতির প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র সাক্ষী হিসেবে তিন জন ব্যক্তির স্বাক্ষর প্রয়োজন। আন্তঃ-ধর্ম, আন্তঃ-সম্প্রদায়, আন্তঃ-জাতি বিবাহকে এই আইন বৈধতা দিয়েছে। সুতরাং প্রেমজ বিবাহের অনুকূল আবহ রচিত হয়েছে। ১৯৮৬ সালে বিধবার পুনর্বিবাহ আইনটি বাতিল করা হল কারণ তার আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। প্রেমের সম্পর্ককে বিবাহের মাধ্যমে বৈধকরণের সামনে আর কোনও আইনি বাধা না থাকলেও এই বিষয়ে সমাজের বাধা, মনের বাধা দূর হয়েছে কি? আসলে সময়টা পরিবর্তনশীল, তাই আমাদের মনে অনেক দ্বিধা, টানা-পোড়েন, স্ববিরোধিতা। সবমিলিয়ে একটা দ্বন্দ্বদীর্ণ স্ববিরোধিতাজর্জর মনোজগতেরই ইঙ্গিত পাই। সময়ই বলে দেবে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, প্রেম পিতৃতন্ত্রের শ্বাসরোধী গ্রাস থেকে শেষমেশ মুক্তি পাবে কি না, হবে কি না সমতার ভিত্তিতে অধিষ্ঠিত।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. Simone de Beauvoir, The Second Sex (London: Vintage Books Edition, 1989, first published 1949).

. Ti-Grace Atkinson, Amazon Odyssey (New York: Links Books, 1974), pp. 43-44.

. New York Radical Feminists, 1971, p. 442, quoted in Wendy Langford, The Revolutions of the Heart: Gender, Power and the Delusions of Love (New York: Routledge, 1999), p. 7.

. Kate Millett, Sexual Politics (New York: Doubleday, 1970).

. Shulamith Firestone, The Dialectic of Sex (New York: Morrow, 1970).

. Andrea Dworkin, Pornography: Men Possessing Women (London: Women’s Press, 1981).

. Max Weber, ‘Religious Reflections of the World and their Direction’ in H. Girth and C. Wrightmill (eds.), From Max Weber: Essays in Sociology (London: Routledge and Kegan Paul, 1948), pp. 323-359.

. Ibid., p. 348.

. Francesca M. Cancian, Love in America: Gender and Self-Development (University of California: Cambridge University Press, 1987).

১০. Niklas Luhmann, Love as Passion (Cambridge: Polity, 1986).

১১. Beck and Beck-Gensheim, The Normal Chaos of Love (Cambridge: Polity, 1995).

১২. Giddens, The Transformation of Intimacy, Sexuality, Love and Eroticism in Modern Societies (Cambridge: Polity, 1992).

১৩. See ‘Government by Love’ in Wendy Langford, The Revolutions of the Heart, p. 14.

১৪. Ibid., pp. 14-15.

১৫. See Langford, ‘Misguided Revolutions’ in Revolutions of the Heart, pp. 147-148.

১৬. A.G. Jonasdottir, ‘Feminist Questions, Mars’s Method and the Theorization of “Love Power”’ in A.G. Jonasdottir and K.B. Jones (eds.), The Political Interests of Gender Revisited (Manchester: Manchester University Press, 2009), pp. 58-83.

১৭. Angie Knaggs and Silke Frischmuth (eds.), Gender, Love and Intimacy (Inter Disciplinary Press, 2014, e-book).

১৮. R.B. Inden and R.W. Nicholas, Kinship in Bengali Culture (Chicago: University of Chicago Press, 1977).

১৯. মন্মথনাথ ঘোষ, রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় (কলকাতা: গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স, ১৯১৭)।

২০. রাধারাণী দেবীর রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং এবং স্কুল অব উইমেনস স্টাডিজ, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০০), পৃ. ৩৭৩-৩৮২।

২১. Aparna Bandyopadhyay, Desire and Defiance: A Study of Bengali Women in Love, 1850-1930 (New Delhi: Orient BlackSwan, 2016). See Chapter One: ‘Quest for Legitimacy: Love Marriages of Bengali Women’, pp. 40-84.

২২. Aparna Bandyopadhyay, Desire and Defiance, Chapter Four: ‘Kulatyag: Chronicles of Elopement and Cohabitation’ and Chapter Five: ‘The Outcast: Struggles for Survival’, pp. 173-201.

২৩. Aparna Bandyopadhyay, Desire and Defiance. See Chapter Five, pp. 202-219.

২৪. Meredith Borthwick, Changing Role of Women in Bengal 1849-1905 (Princeton: Princeton University Press, 1984); Tapan Raychaudhuri, ‘Love in a Colonial Climate: Marriage, Sex and Romance in Nineteenth Century Bengal’ in Perceptions, Emotions and Sensibilities: Essays on India’s Colonial and Post-Colonial Experiences (New Delhi: Oxford University Press, 1999), pp. 64-95.

২৫. Aparna Bandyopadhyay, Desire and Defiance. See Introduction, pp. 1-39.

২৬. Aparna Bandyopadhyay, Desire and Defiance. See Chapter Three: ‘Byabhichar: Love, Death and Punishment’, pp. 135-172.

২৭. Amiya P Sen, Hindu Revivalism in Bengal 1872-1905: Some Essays in Interpretation 1872-1905 (New Delhi: Oxford University Press, 1993); Perveez Mody, ‘Love and the Law: Love Marriage in Delhi’, Modern Asian Studies 36(1): pp. 223-56; Rochona Majumdar, Marriage and Modernity: Family Values in Colonial Bengal (New Delhi: Oxford University Press, 2009); Aishika Chakraborty, ‘Contract, Consent and Ceremony: The Brahmo Marriage Reform (1868-1920)’, Journal of History 26, pp. 64-98.

২৮. অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘তিন আইন সম্বন্ধে দুইচার কথা’, শুভ্রকুমার মুখোপাধ্যায়, ঈশিতা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সম্পাদিত নারী: অন্দরে বাহিরে (হুগলি: হুগলি মহসিন কলেজ, ২০১৪), পৃ. ৩৬-৪৭।

২৯. যতীন্দ্রমোহন সিংহ, ‘সাহিত্যে স্বাস্থ্যরক্ষা’,সাহিত্য, বৈশাখ-চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৭। সাহিত্য পত্রিকায় মাসিক কিস্তিতে প্রকাশিত হওয়া এই দীর্ঘ প্রবন্ধটি পরের বছর পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। দেখুন: যতীন্দ্রমোহন সিংহ, সাহিত্যে স্বাস্থ্যরক্ষা  (কলকাতা: ভট্টাচার্য্য অ্যান্ড সন, ১৩২৮ বঙ্গাব্দ)।

৩০. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দুর্গেশনন্দিনী, ১৮৬৫, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলী,  প্রথম খণ্ড (কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৯৭৯), পৃ. ১-৮৩।

৩১. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাধারাণী, ১৮৭৫, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪২৫-৪৩৮।

৩২. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মৃণালিনী, ১৮৬৯, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৩৭-২০৭।

৩৩. দেখুন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, এমন কর্ম্ম আর করব না (কলকাতা: আদি ব্রাহ্ম সমাজ, ১৮৭৭)। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত পরিমার্জিত সংস্করণের নাম অলীকবাবু । দেখুন: অলীকবাবু, বিজিত ঘোষ সম্পাদিত হাসির গল্পে প্রহসন, সপ্তম খণ্ড (কলকাতা: পুনশ্চ, ২০০৬), পৃ. ৪৩-৮৮।

৩৪. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিষবৃক্ষ, ১৮৭২, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২০৯-২৯০।

৩৫. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণকান্তের উইল, ১৮৭৫, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪৮৭-৫৫৪।

৩৬. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বড়দিদি, ১৯০৭, শরৎসাহিত্যসমগ্র,  প্রথম খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৩), পৃ. ১-২২।

৩৭. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পল্লীসমাজ, ১৯১৫, শরৎসাহিত্যসমগ্র,  প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৩৫-১৮৪।

৩৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চোখের বালি, বঙ্গদর্শন  (নবপর্যায়) ১৩০৮-১৩০৯ বঙ্গাব্দ, উপন্যাস সমগ্র,  প্রথম খণ্ড (কলকাতা: সাহিত্যম, ২০০৩), পৃ. ১৯৯-৩৬২।

৩৯. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রশেখর, ১৮৭৩, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলী,  প্রথম খণ্ড, পৃ. ৩৪৭-৪২৪।

৪০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঘরে-বাইরে, ১৯১৫, উপন্যাস সমগ্র,  দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা: সাহিত্যম, ২০০৩), পৃ. ৩৮৫-৫২২।

৪১. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত, ১৯১৫-১৯৩২, শরৎসাহিত্যসমগ্র,  প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৬৮-৫২৩।

৪২. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী, ১৯১৭, শরৎসাহিত্যসমগ্র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৭০৯-৭৫৮।

৪৩. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবদাস, ১৯১৭, শরৎসাহিত্যসমগ্র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৫২৪-৫৬৮।

৪৪. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চরিত্রহীন, ১৯১৪, শরৎসাহিত্যসমগ্র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৫৯১-৭০৮।

৪৫. যোগেশচন্দ্র বাগল, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, উপন্যাস-প্রসঙ্গ, বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১-২।

৪৬. দ্রষ্টব্য ‘চোখের বালি’, গ্রন্থপরিচয়, রবীন্দ্র রচনাবলী, ষোড়শ খণ্ড (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০০১), পৃ. ৮৫৬-৮৬০।

৪৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসুকে লেখা চিঠি, ২৪ জুন ১৯৪০, কবিতা, আশ্বিন ১৩৫২ বঙ্গাব্দ।

৪৮. চন্দ্রনাথ বসু, ‘নবেল বা কথাগ্রন্থের উদ্দেশ্য’, বঙ্গদর্শন , বৈশাখ ১২৮৭ বঙ্গাব্দ, বঙ্গদর্শন সংকলন, সপ্তম খণ্ড (কলকাতা: রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনস, ১৯৮২), পৃ. ৮৫৬-৮৬০।

৪৯. যতীন্দ্রমোহন সিংহ, ‘সাহিত্যে স্বাস্থ্যরক্ষা’, সাহিত্য, বৈশাখ-চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ।

৫০. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘চোখের বালি/বিধবা বিনোদিনী’, রঙ্গালয় পত্রিকা, ফাল্গুন ১৩০৮ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৬-১৩।

৫১. কালীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘আর্ট ও আর্ট রসিক’, সাহিত্য, আশ্বিন ১৩২৪ বঙ্গাব্দ; ‘সাহিত্যের আবর্জনা’, সাহিত্য, মাঘ-ফাল্গুন ১৩২৯ বঙ্গাব্দ; ‘সাহিত্যের পুষ্টি’, সাহিত্য, মাঘ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৮৪৯-৮৬১।

৫২. রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্রনাথের দুটি উপন্যাস’, ভারতবর্ষ, শ্রাবণ ১৩২৩ বঙ্গাব্দ; ‘বঙ্গের অবনতিশীল সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ’, নব্যভারত, মাঘ ১৩২৩ বঙ্গাব্দ, পৃ. ২২৪-২২৯।

৫৩. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘স্বরাজ সাধনায় নারী’ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ, স্বদেশ ও সাহিত্য, শরৎসাহিত্যসমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৩), পৃ. ১৯৬০-১৯৬২।

৫৪. যতীন্দ্রমোহন সিংহ, ‘সতীত্ব বনাম মনুষ্যত্ব’, মানসী ও মর্মবাণী, চৈত্র ১৩২৮ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১০৯।

৫৫. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবী চৌধুরাণী, ১৮৮৪, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৭৩৭-৮২০।

৫৬. সতীপাঠ্য বা স্ত্রীপাঠ্য হিসেবে বিজ্ঞাপিত কয়েকটি উপন্যাস হল: কালীকিঙ্কর যশ, গৃহলক্ষ্মী  (কলকাতা, ১৯০৮); অমরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, সাধ্বীসতী  (কলকাতা, ১৯১৭); সুবর্ণপ্রভা সোম, সতী-সুহৃদ  (কলকাতা: কে এম সোম, ১৯১৯); সতীসঙ্গিনী  (কলকাতা: কে এম সোম, ১৯১৯); অর্জুনচন্দ্র বসু, সতীলক্ষ্মী  (কলকাতা, ১৯২১) প্রভৃতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *