বিষম জাল

বিষম জাল 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

একদিন প্রাতে অফিসে বসিয়া আছি, এমন সময়ে টেলিফোনের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি যন্ত্রের নিকট গমন করিয়া বুঝিলাম, বড় সাহেব ডাকিতেছেন। অবিলম্বে তাঁহার নিকট গমন করিলাম। আমাকে দেখিয়া তিনি সাগ্রহে বলিয়া উঠিলেন, বাগবাজারের কোন ঘাটে একে ইংরাজের লাস পাওয়া গিয়াছে। তোমাকে এখনই সেখানে গিয়া সেই বিষয়ের অনুসন্ধান করিতে হইবে। 

সাহেবের নিকট বিদায় লইয়া আমি সত্বর সেখান হইতে বাহির লইলাম এবং একখানি ভাড়াটীয়া গাড়িতে আরোহণ করিয়া যথাস্থানে উপস্থিত হইলাম। 

বেলা আটটা বাজিয়া গিয়াছে। কিন্তু আকাশ কুাটিকায় আচ্ছন্ন থাকায় তখনও রৌদ্র উঠে নাই। মাঘ মাস—দারুণ শীত। শন্ শন্ করিয়া উত্তরে বাতাস প্রবাহিত হইয়া শীতের মাত্রা যেন দ্বিগুণ বর্দ্ধিত করিতেছে। 

শকট হইতে অবতরণ করিয়া চালককে ভাড়া দিয়া বিদায় করিলাম। পরে সেই লাসের দিকে গমন করিলাম। দেখিলাম, ভয়ানক জনতা, কয়েকজন মাত্র কনেষ্টবল তাহার নিকটে দাঁড়াইয়া অতি কষ্টে সেই জনতার হ্রাস করিতেছিল। আমাকে দেখিয়া তাহারা দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত উপস্থিত জনগণকে সেখান হইতে তাড়াইয়া দিল, আমি ভিতরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, লোকটি সত্য সত্যই ইংরাজ—সাধারণ বেশ-পরিহিত। মস্তকে টুপী নাই, গাত্রবস্ত্র সম্পূর্ণ জলসিক্ত, মস্তক ও নাসিকা দিয়া রক্ত নির্গত হইতেছে। 

পরীক্ষা দ্বারা জানিতে পারিলাম, লোকটি তখনও জীবিত, কেবল সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িয়াছেন। তখনই তাঁহার উপরের কোট ও কামিজটি খুলিয়া ফেলিলাম। দুই চারিজন লোক তখনও নিকটে দাঁড়াইয়াছিল, আমি তাহাদিগকে সেখান হইতে সরিয়া যাইতে আদেশ করিলাম। সর্ব্বাঙ্গ নিরীক্ষণ করিয়া আমার বোধ হইল, তাঁহার বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর, বেশ বলিষ্ঠ, গাত্রের কোন স্থানেই ক্ষতচিহ্ন নাই, নাসিকা ও মস্তকে রক্ত, তাঁহার মুখ মলিন ও পাংশুবর্ণ ধারণ করিয়াছে। অতিরিক্ত রক্তপাতই উহার কারণ বলিয়া বোধ হইল। 

নিকটেই একেটা মদের দোকান ছিল। একজন কনেষ্টবলকে আমি একটু ভাল ব্রাণ্ডি আনিতে বলিলাম। মদ্য আনীত হইলে আমি অল্প অল্প করিয়া তাঁহার ঠোঁটে মাখাইতে লাগিলাম। দুই এক ফোঁটা মুখের ভিতরও ঢালিয়া দিলাম, কিন্তু প্রথম দুই একবার উহা উদরস্থ হইল না। কিছুক্ষণ এইরূপ করিলে পর লোকটি হঠাৎ চক্ষু মেলিলেন। পরে একবার আমার দিকে ও নিকটস্থ কনেষ্টবলদিগের দিকে চাহিয়া সহসা বলিয়া উঠিলেন “আমি তোমার?” 

তাঁহাকে সজ্ঞান দেখিয়া আমি আনন্দিত হইলাম, বলিলাম, অধিক কথা কহিবেন না; আমরা সকলেই আপনার উপকারী বন্ধু। অগ্রে এই ব্রাণ্ডি পান করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন, পরে আপনার কথা শুনিব। আপাততঃ আপনাকে মেয়ো হাসপাতালে পাঠাইয়া দিবার বন্দোবস্ত করিতেছি। 

এই বলিয়া একজন কনেষ্টবলকে একখানি গাড়ি আনিতে আদেশ করিলাম। উহা আনীত হইলে লোকটিকে তাহাতে শয়ন করাইয়া হাসপাতালে প্রেরণ করিলাম। 

এই সমস্ত কাৰ্য্য শেষ করিতে বেলা প্রায় দশটা বাজিয়া গেল। তখন আমি একজন কনেষ্টবলকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিরূপ অবস্থায়, কখন এবং কোথায়ই বা লোকটিকে প্রথমে দেখা গিয়াছিল? কে তোমাকে প্রথমে সংবাদ দেয়? 

কনেষ্টবল একজন মাঝিকে দেখাইয়া দিয়া বলিল, এই মাঝি আমাকে প্রথমে সংবাদ দেয়। আপনি উহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিবেন। 

এই বলিয়া সে মাঝিকে আমার নিকট আনয়ন করিল এবং সমস্ত কথা আদ্যোপান্ত প্রকাশ করিতে আদেশ করিল। মাঝি যোড় হাত করিয়া আমার সম্মুখে দাঁড়াইল। বোধ হইল, তাহার বয়স প্রায় পঞ্চাশ, বর্ণ শ্যাম, শরীরের মাংস শিথিল, চক্ষু কোটরগ্রস্ত। 

আমার নিকটে আসিয়া মাঝি বলিল “আজ অতি প্রত্যূষে নৌকায় বসিয়া যখন মুখ ও হস্তপদাদি ধুইতেছিলাম, সেই সময়ে হঠাৎ তীরের দিকে আমার নজর পড়ে। প্রথমে আমার সন্দেহ হয়, বোধ হয়, যেন একটা শবদেহ পড়িয়া রহিয়াছে। প্রাণে কেমন একটা আতঙ্ক হইল; গতরাত্রে আমরা এই ঘাটেই ছিলাম, রাত্রি বারটার পর নিদ্রা যাই, তখনও কোনপ্রকার গোলযোগ শুনিতে পাই নাই। আজ ভোরে এই কাণ্ড দেখিয়া স্বভাবতঃই ভীত হইলাম। একা যাইলে পাছে বিপদে পড়ি, এই ভাবিয়া আমারই দুইজন দাঁড়ীকে লইয়া তিনজনে তীরে নামিলাম। যাহা দেখিয়াছিলাম, আপনিও এখানে আসিয়া সেই প্রকারই দেখিয়াছেন।” 

মাঝির কথা শুনিয়া, তাহার দুইজন দাঁড়ীকে ডাকিয়া আনাইলাম। তাহারাও প্রত্যেকে ওই কথাই বলিল। কিন্তু তাহাতে প্রকৃত কার্য্যের কোন সুবিধা বুঝিলাম না। প্রথম লোকটা কে? কেনই বা তঁহার ওই প্রকার অবস্থা হইল? কেই বা তাঁহার ওই প্রকার দুরবস্থা করিল? এ সকল প্রশ্নের কোন মীমাংসা করিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, লোকটার মুখে কোন কথা না শুনিয়া সহসা কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা যুক্তিসঙ্গত নহে। এই মনে করিয়া, আমি তখনই মেয়ো হাসপাতালে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

হাসপাতালে আসিয়া অগ্রে ডাক্তারের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, রোগী নিদ্রিত; তাহাকে চা ও ডিম খাইতে দেওয়া হইয়াছিল। পানাহার করিয়া তিনি অনেকটা সুস্থ হইয়াছেন। কেবল অতিরিক্ত ক্লান্ত হওয়ায় অত্যন্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছেন। সম্ভবতঃ কিছুক্ষণ পরেই জাগ্রত হইবেন। 

আমি তখন তাঁহার নির্দ্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, তিনি সত্য সত্যই গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত। অতি ধীরে ও নিঃশব্দে একখানি চৌকী আনিয়া আমি তাঁহারই শয্যার পার্শ্বে বসিয়া রহিলাম। 

অর্দ্ধঘণ্টা পরে রোগী চক্ষু উন্মীলন করিয়া সম্মুখেই আমাকে দেখিতে পাইলেন। বলিলেন “এ আবার কোথায় আসিয়া পড়িলাম? আমি কোথায় আছি? কেমন করিয়াই বা আসিলাম? ঘুসুড়ীর ঘাট হইতে কত দূরে আসিয়া পড়িয়াছিলাম?” 

লোকটির কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম “ঘুসুড়ীর ঘাট? সে ত গঙ্গার পরপারে। আমি একজন পুলিশের লোক। একজন মাঝি আজ প্রত্যূষে আপনাকে বাগবাজারের ঘাটে পড়িয়া থাকিতে দেখিতে পায়। সেই লোকই প্রকৃতপক্ষে আপনার জীবনদাতা। কেন না, সেই আপনার দুরবস্থা দেখিয়া আপনাকে মৃত মনে করিয়া একজন কনেষ্টবলকে সংবাদ দেয়, ক্রমে আমাদের কর্ণ গোচর হয়।” 

আমার কথা শুনিয়া তিনি যেন কিছু বিমর্ষ হইলেন, আবার চক্ষু মুদ্রিত করিলেন, তাঁহার মুখমণ্ডল আবার বিবর্ণ ও মলিন হইয়া গেল। আমি আর কোন কথা না বলিয়া তখনই ডাক্তারকে সংবাদ দিলাম। তিনি সত্বর তথায় আগমন করিলেন এবং রোগীকে আরও খানিকটা ব্রাণ্ডি ও কিছু খাদ্য আহার করিতে দিলেন। পানাহার করিয়া রোগী অনেকটা সুস্থ হইলে, আমি তাঁহার সমস্ত কথা শুনিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিলাম। 

আমার কথা শুনিয়া তিনি বলিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু অত্যন্ত দুর্ব্বল হওয়ায় তখনও পারিলেন না। আমিও বলিতে নিষেধ করিলাম, বলিলাম “এ অবস্থায় বসিতে পারিবেন না, যাহা বলিতে ইচ্ছা করেন শুইয়াই বলুন।” 

তিনি বলিলেন “সকল কথা আদ্যোপান্ত বলিবার পূর্ব্বে আপনি বলুন, আমি ঘুসুড়ীর ঘাট হইতে কতদূরে পড়িয়াছিলাম।” 

আমি বলিলাম “ঘুসুড়ীর ঘাট এ পারে নহে, আপনি তাহারই পরপারে বাগবাজারের একটা আঘাটায় পড়িয়াছিলেন।” 

তিনি আশ্চর্যান্বিত হইলেন; বলিলেন “সেকি! গত রাত্রে আমি এই পারের ঘাট হইতেই নৌকায় উঠিয়াছিলাম। পরপারে যাওয়াই আমার উদ্দেশ্য ছিল। এ পার অতিক্রম করিয়া নৌকাকে পরপার দিয়া যাইতেও দেখিয়াছিলাম। অথচ আমি এ পারেই পড়িয়াছিলাম, এ বড় অদ্ভুত রহস্য! কেন এমন হইল?” 

আমিও আশ্চর্যান্বিত হইলাম। কিছুক্ষণ পরে বলিলাম “বৃথা চিন্তায় কোন ফল হইবে না। আপনি এক কার্য্য করুন, সমস্ত কথা আদ্যোপান্ত ব্যক্ত করুন। আপনাকে দেখিয়া ও আপনার কথা শুনিয়া আমার স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, আপনি অতি অল্পদিনই এ দেশে আসিয়াছেন। কি জন্য— কোন্ সূত্রেই বা আপনি স্বদেশ ত্যাগ করিয়া এই দূরদেশে আসিয়াছেন বলুন? আপনার নাম কি এবং আপনি কি কার্য্য করেন?” 

কিছুক্ষণ চিন্তার পর তিনি বলিলেন “আমার নাম ভ্যাস্কো ভেল্ডার। আমার পিতা একজন পর্তুগীজ, কিন্তু আমার মাতা ইংরাজ। কর্ম্মোপলক্ষে পিতাকে অধিকাংশ সময় ইংলণ্ডেই থাকিতে হইত। সেই সূত্রেই এক ইংরাজ মহিলার সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। আমার পিতা একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি আমাকেও ওই কৰ্ম্ম শিক্ষা দেন। অল্পদিনের মধ্যে তাঁহার যত্ন ও পরিশ্রমে আমিও একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হই। ইংলণ্ড কিম্বা ইউরোপের আর কোন দেশে গিয়া কৰ্ম্ম করিতে আমার ইচ্ছা ছিল না। আমার প্রধান উদ্দেশ্য- ভারতবর্ষে আসিয়া কোন স্থানে চাকরী করি। পিতা পর্তুগীজ অর্থাৎ পর্তুগালবাসী এবং মাতা ইংরাজ মহিলা বলিয়া আমি ওই দুইটি ভাষায় অর্থাৎ ইংরাজী ও পটুগীজ ভাষায় বেশ বুৎপন্ন হইলাম। ওই দুই ভাষাতেই আমি বেশ কথাবার্তা করিতে পারি। 

আ। কতদিন পূর্ব্বে আপনি ভারতে আসিয়াছেন? 

ভ্যাস্কো। প্রায় দুই মাস পূর্ব্বে আমি বম্বে নগরে আসিয়া উপস্থিত হই। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ দেড় মাসের মধ্যে একটিও কাৰ্য্য না পাওয়ায়, আমি কলিকাতায় আসিয়াছি। প্রায় পনের দিন পূর্ব্বে যখন এখানে আসিলাম, দেখিলাম, আমার অর্থ কমিয়া গিয়াছে। কলিকাতায় বাস করিতে হইলে অল্প পয়সায় হইবে না ভাবিয়া, আমি ঘুসুড়ীর কলের নিকট একটি বাগানবাটী ভাড়া লই, এবং সেইখানেই এই কয়দিন বাস করিয়া আসিতেছিলাম। 

আ। এখানে আসিয়া কোন কাৰ্য্য পাইয়াছিলেন? 

ভ্যাস্কো। এতদিন পাই নাই। কলিকাতার বিখ্যাত সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়াছিলাম, বড় বড় প্লাকার্ডে নাম লিখিয়া সাধারণের গোচর করিয়াছিলাম কিন্তু তাহাতেও বিশেষ কোন ফল হইল না। ক্রমে আমার সমস্ত অর্থও নিঃশেষিত হইতে লাগিল, আমিও বড় ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম। গত রাত্রে আহারাদির পর আমি বারান্দায় একখানি চৌকী পাতিয়া বিশ্রাম করিতেছি, এমন সময়ে আমার ভৃত্য নিকটে আসিয়া একখানি কার্ড দিল। কার্ডখানি গ্রহণ করিয়া দেখিলাম, তাহাতে “রামরতন– স্বর্ণ রৌপ্যের অলঙ্কার ও বহুমূল্য প্রস্তরাদি বিক্রেতা” এই কয়টি কথা লেখা রহিয়াছে। 

আ। কার্ডখানি হস্তলিখিত না ছাপা? 

ভ্যাস্কো। হস্তলিখিত। 

আ। তাহাতে কি কোন ঠিকানা লেখা ছিল? 

ভ্যাস্কো। না-ঠিকানা নাই দেখিয়াই আমারও কেমন সন্দেহ হইয়াছিল। আমি তখনই তাঁহাকে আমার নিকট আনিবার জন্য ভৃত্যকে আদেশ করিলাম। সে চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরেই একজন দেশীয় লোককে লইয়া আমার নিকট পুনরাগমন করিল। 

আ। তাহাকে দেখিতে কেমন? 

ভ্যাস্কো। সাধারণ লোক অপেক্ষা তিনি দীর্ঘ। তাহার বয়স বোধ হয় চল্লিশ বৎসর। 

আ। তার পর? 

ভ্যাস্কো। আমার সহিত দেখা হইলে তিনি অতি পরিষ্কার বিশুদ্ধ ইংরাজী ভাষায় বলিলেন যে, তিনি আমার সহিত কিছুক্ষণ গোপনে কোন বিষয় কথোপকথন করিতে চাহেন। আমি তখন তাঁহাকে লইয়া একটি নির্জ্জন গৃহে প্রবেশ করিলাম। ভৃত্যকে বলিয়া দিলাম যেন, কোন লোক সহসা সে ঘরে প্রবেশ না করে। উভয়ে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলে পর তিনি বলিলেন, তাঁহার একটা প্রকাণ্ড কল আছে। সেই কলের সাহায্যে অস্থি চূর্ণ করা হয়। হঠাৎ উহার এক অংশ এরূপ অকৰ্ম্মণ্য হইয়াছে যে, তাহাতে তাঁহার কায-কৰ্ম্ম একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। যত শীঘ্র উহা মেরামত হইবে ততই মঙ্গল, এই ভাবিয়া তিনি সেই অসময়ে আমার নিকট আসিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কতদিন হইল তাঁহার কল খারাপ হইয়া গিয়াছে জিজ্ঞাসা করায়, তিনি উত্তর করিলেন, প্রায় এক সপ্তাহ। আমার তখনই কেমন সন্দেহ হইল। কলিকাতায় ইঞ্জিনিয়ারের অভাব নাই। যদি এক সপ্তাহই তাঁহার কল খারাপ হইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে ইতিমধ্যে তিনি আর কোন ইঞ্জিনিয়ারের সাহায্য লন নাই কেন? আর যদি আমারই সাহায্য লইবার আবশ্যক বিবেচনা করিয়া থাকেন, তাহা হইলে দিবাভাগে তিনি আমার নিকট আইসেন নাই কেন? ক্রমে সন্দেহভঞ্জনের জন্য ওই সকল কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি হাসিয়া বলিলেন, তাঁহার কল পর্তুগাল হইতে আনীত। এখানে যতগুলি ইঞ্জিনিয়ার আছেন, তাঁহাদের সকলেই ইংরাজ। আমার নাম শুনিয়া তিনি আমাকে টুগীজ মনে করিয়াছিলেন এবং আমিও ওই কল শীঘ্র মেরামত করিতে পারিব বুঝিয়া, আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। 

বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি কি সত্য সত্যই পর্তুগীজ?” 

ভ্যাস্কো। আজ্ঞে হ্যাঁ আমি পর্তুগীজ। তাহার পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আমাকে কখন সেখানে লইয়া যাইতে ইচ্ছা করেন? তিনি হাসিয়া উত্তর করিলেন “এখনই।” রাত্রি প্রায় নয়টা বাজিয়াছিল সুতরাং সেই রাত্রে একজন অপরিচিত লোকের সহিত অপরিচিত স্থানে যাইতে আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু যখন তিনি বলিলেন যে, কার্য সমাপ্তির পর আমাকে এক শত টাকা পারিশ্রমিক দিবেন, তখন আর আমার কোনপ্রকার ওজর আপত্তি করিতে সাহস হইল না। বলিতে কি, এক শত টাকার লোভ সংবরণ করা আমার পক্ষে তখন অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার বলিয়া বোধ হইল। কলিকাতায় আসিয়া অবধি একটিও কাৰ্য্য পাই নাই, আমার যাহা কিছু সম্বল ছিল, একে একে সমস্তই নিঃশেষিত হইয়াছিল, কাজেই আমি সম্মত হইলাম এবং কতদূরে যাইতে হইবে জিজ্ঞাসা করিলাম। ভাবিলাম, যদিও আমাকে কলিকাতায় আসিতে হইবে, তত্রাপি তিনি এমন বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছেন যে, বিনা ক্লেশে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমি যথাস্থানে পঁহুছিতে পারিব। একে অর্থলোভ, তাহার উপর অভাব সুতরাং আমি আর দ্বিরুক্তি না করিয়া সম্মত হইলাম এবং তখনই তাঁহার সহিত তাঁহার গাড়িতে আসিয়া বসিলাম। অন্ধকার রাত্রি, আকাশে চন্দ্ৰ উদিত হয় নাই, পরে অনেক দূর অন্তর এক একটা তৈলের আলোক। কোথায় যাইতেছি, কোন্ পথ দিয়া যাইতেছি, এ সকল কথা জিজ্ঞাসাও করিলাম না, কিম্বা তিনিও কোন কথা বলিলেন না। অনেকক্ষণ ধরিয়া গাড়ি চলিতে লাগিল। আমার বোধ হইল, পথ যেন আর ফুরাইবে না। কতক্ষণ পরে আমরা গঙ্গাতীরে উপনীত হইলাম। কোচম্যানকে বিদায় দিয়া আমরা উভয়েই তীরে যাইলাম। দেখিলাম, একখানি মাত্র নৌকা রহিয়াছে। রামরতন বলিয়াছিলেন, একখানি ক্ষুদ্র ষ্টিমার ঘাটে অপেক্ষা করিবে। তাহার সাহায্যে আমরা পরপারে গমন করিব। কিন্তু আমি ত কোন স্ত্রীমার দেখিতে পাইলাম না। রামরতনের মুখের দিকে চাহিবামাত্র তিনি ভয়ানক রাগান্বিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন “কি সৰ্ব্বনাশ! আমার হুকুম তালিম হয় নাই? ভয়ানক স্পর্দ্ধা।” পরে আমি বিনীত ভাবে বলিলেন, আমাদিগকে ওই নৌকা করিয়া পার হইতে হইবে। আমি অগত্যা সম্মত হইলাম। উভয়ে মিলিয়া সেই নৌকার ভিতর গিয়া বসিলাম। 

“পূর্বেই বলিয়াছি, রাত্রি ভয়ানক তমসাচ্ছন্ন, যখন নৌকায় উঠিলাম, তখন সহসা বাতাস বন্ধ হইল দেখিয়া, আমি আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। একটিও নক্ষত্র দেখিতে পাইলাম না। বুঝিলাম, ভয়ানক মেঘ উঠিয়াছে, কিছুক্ষণ পরেই ঝড় উঠিল। আমাদের নৌকা তখন নদীর মধ্যস্থলে। যদিও আমি সন্তরণপটু, তত্রাপি সেই ঝড়ে নৌকাখানি যে প্রকার দুলিতেছিল, তাহাতে আমার মনে ভয় হইয়াছিল। প্রায় দেড়ঘণ্টার পর আমরা নদী পার হইলাম। ঘাটে উঠিয়াই দেখিলাম, একখানি ঢাকা ব্রুহেম গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছে। রামরতন আমার হাত ধরিয়া দ্রুতপদে সেই গাড়ির ভিতরে গিয়া বসিয়া পড়িলেন এবং এরূপে দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন যে, আমি বাহিরের কোন বিষয় দেখিতে নাই পাই। একবার ইচ্ছা হইল, দরজা কিম্বা একটা জানালা খুলিয়া দিই। কিন্তু রামরতন এমন কৌশল করিলেন যে, আমি আর তাহা বলিতে সাহস করিলাম না। সুযোগও তেমনই ঘটিয়াছিল। ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে অল্প অল্প বৃষ্টি পতিত হওয়ায় তিনিও সাহস করিয়া গাড়িখানি আবদ্ধ রাখিতে পারিয়া ছিলেন। কতক্ষণ কত রাস্তা ঘুরিয়া ফিরিয়া অবশেষে একটা প্রকাণ্ড অট্টালিকার সম্মুখে গাড়িখানি থামিল। গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম। ভয়ানক অন্ধকার। আলো নাই বলিয়া রামরতন আবার রাগান্বিত হইলেন এবং ভৃত্যকে সহস্র গালি দিলেন। পরে দরজার সম্মুখে গিয়া সজোরে ধাক্কা দিতে লাগিলেন। চীৎকার করিয়া ভৃত্যকে ডাকিতে লাগিলেন, অবশেষে পকেট হইতে একটি বাঁশী বাহির করিয়া তিন চারিবার বাজাইলেন। কিছুক্ষণ পরেই ভিতর হইতে দরজা খুলিয়া গেল, আমরা উভয়ে ভিতরে প্রবেশ করিলাম। অতি সামান্য আলোকে দেখিলাম, একস্থানে স্তূপাকার অস্থিরাশি, কোথাও বা বড় বড় শিশিপূর্ণ নানাপ্রকার আরক, কোথাও বা ধাতু গলাইবার জন্য বিভিন্ন পাত্র, আবার কোথাও বা কয়লা। এই সমস্ত দেখিয়া ভাবিলাম, উহা কারখানারই একটি অংশ বিশেষ। 

“রামরতন আমাকে একটি গৃহের ভিতর লইয়া গেলেন। আমরা উভয়েই একটি টেবিলের নিকট এক একখানি চেয়ারে উপবেশন করিলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, পথে ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় আপনার যথেষ্ট কষ্ট হইয়াছে। আমার ইচ্ছা, কার্যারম্ভের পূর্ব্বে কিছু জলযোগ করেন। 

“আমিও হাসিয়া সম্মত হইলাম। কিন্তু তাঁহার এইরূপ উদারতায় অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইলাম, তিনি তখনই সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন এবং অবিলম্বে একজন ভৃত্যের সহিত পুনরায় আগমন করিলেন। ভৃত্য টেবিেেলর উপর মদ্য, সোডা, মাংসের দুই তিন প্রকার খাদ্য রাখিয়া চলিয়া গেল। আমি আহার করিয়া বাহির হইয়াছিলাম, সুতরাং রামরতন-প্রদত্ত আহার্য্যগুলির অধিকাংশই পড়িয়া রহিল। কেবল মদ্য ও সোডা পান করিয়া শ্রান্তি দূর করিলাম। 

“কিছুক্ষণ পরে রামরতন আমাকে সঙ্গে লইয়া সেই যন্ত্রের নিকট লইয়া গেলেন। যাইবার সময় অনেকগুলি ঘর ও দালানের ভিতর দিয়া যাইতে হইয়াছিল। সকল স্থানেই ব্যবহারোপযোগী কোন না কোন দ্রব্য স্তূপাকারে সজ্জিত। যন্ত্রটি অবলোকন করিয়া আমিও স্তম্ভিত হইলাম। বিলাতে এরূপ দুই চারিটি যন্ত্র দেখিয়াছি বটে, কিন্তু আমার বেশ ধারণা ছিল যে, ভারতবর্ষে এখনও এরূপ যন্ত্র হয় নাই। যন্ত্রটি দেখিয়া আমার সে ভ্রম দূর হইল। বিশেষতঃ যে ব্যক্তি উহা নিৰ্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তাঁহার গুণপনা দেখিয়া অতীব আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। বৈদ্যুতিক প্রবাহে কলটি গতিশীল হইয়া থাকে। কোন অজ্ঞাত কারণ বশতঃ সম্প্রতি গতিরোধ হইয়াছিল। তড়িৎ প্রবাহের সাহায্যেও যন্ত্রের গতি হয় নাই। এই জন্যই আমার সাহায্যের প্রয়োজন হইয়াছিল। ঘরটিতে বেশ আলো ছিল। অন্যান্য ঘরগুলি যেমন মৃদু আলোকে আলোকিত, এ ঘরটি তেমন নহে। চারিদিকে বৈদ্যুতিক আলোকে যেন দিনমান করিয়া রাখিয়াছে। 

“রামরতন আমারই নিকট দাঁড়াইয়া আমার কাৰ্য্য দেখিতে লাগিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমি যন্ত্রের সমুদায় স্ক্রুগুলি খুলিয়া ভিন্ন ভিন্ন অংশগুলি পৃথক করিয়া রাখিলাম। এত অগ্রাহ্য ভাবে আমি এই কাৰ্য্য করিতে লাগিলাম যে, রামরতন আমার শিক্ষায় মোহিত হইয়া গেলেন। যন্ত্রগুলি খুলিতে খুলিতে দেখিলাম, একখণ্ড ক্ষুদ্র টিন দুইখানি চাকার মধ্যে পড়িয়া যন্ত্রের গতি রোধ করিতেছে। আমি তখনই টিন তুলিয়া ফেলিলাম এবং পুনরায় স্ক্রু আঁটিয়া যন্ত্রটি পূর্ব্বের মত করিয়া দিলাম। 

“রামরতন তখন হাসিতে হাসিতে তড়িতের তার যন্ত্রের সহিত যোগ করিয়া দিলেন। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে সেই প্রকাণ্ড যন্ত্র শন্ শন্ শব্দে ঘুরিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে নানা স্থানে নানা প্রকার চাকাগুলি ঘুরিতে লাগিল। আমার কার্য্যে অত্যন্ত আনন্দিত হইয়া রামরতন তড়িতের তার খুলিয়া দিলেন। যন্ত্র পুনরায় স্থির হইল। তিনি আমাকে আর একদিন তাঁহার যন্ত্র দেখিবার জন্য অনুরোধ করিলেন, বলিলেন, একদিন দিবাভাগে সেখানে গিয়া যন্ত্রের কার্য- কিরূপে প্রকাণ্ড অস্থিরাশি চূর্ণ-বিচূর্ণ করিতেছে, কিরূপে নানা প্রকার ধাতু হইতে খাদ বাহির করিতেছে, এই সকল ব্যাপার দেখিবেন, দেখিলে নিশ্চয়ই স্তম্ভিত হইবেন। 

“আমি সম্মত হইলাম। তখন তিনি আমাকে আবার সেই ঘরে আনিয়া টেবিলের নিকট বসিতে বলিলেন। আমি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম। তিনি সেখান হইতে চলিয়া গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে আমাকে এক শত টাকা ও পাঁচখানি দশ টাকার নোট দিয়া বলিলেন যে, তিনি আমার কার্য্যে এত সন্তুষ্ট হইয়াছেন যে, প্ৰতিশ্ৰুত এক শত টাকার উপর আরও পঞ্চাশ টাকা দিতে বাধ্য হইয়াছেন। আমিও অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিয়া অস্পষ্ট ভাবে দুই একটা কথা বলিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে কথাগুলি আমি স্বয়ং বুঝিতে পারি নাই। 

“কিয়ৎক্ষণ পরে ভৃত্য আবার মদ্য ও সোডা আনিল। রামরতন পান করিতে অনুরোধ করিলেন। বলিলেন, দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমি বাসায় পৌঁছাইয়া দিব। রামরতনের অনুরোধ এড়াইতে পারিলাম না। মদ্যপান করিলাম। পরিশ্রমের পর অবশ্য সে মদ্য আমার ভালই লাগিল। মনে কেমন একপ্রকার স্ফূর্ত্তি আনয়ন করিল। রামরতন তখন আমাকে লইয়া পুনরায় সেই আবৃত রুহেম গাড়িতে আরোহণ করিলেন। গাড়িতে উঠিয়াই তিনি গাড়ি চালাইতে আদেশ দিলেন। কোচম্যানও তখনি শকট চালনা করিল। 

“শেষবার যে মদ্যপান করিয়াছিলাম, তাহাতে নিশ্চয়ই কোন বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত ছিল। নতুবা সেই মদ্যপান করিয়া অবধি আমার শরীর সেরূপ অবসন্ন হইবে কেন? আমার মস্তক বিঘূর্ণিত হইবে কেন? মদ্যপান আমাদের অভ্যাস, প্রত্যেক আহারের সহিত আমরা মদ্যপান করিয়া থাকি। কই, তাহাতে ত আমাদের মস্তিষ্ক এরূপ বিকৃত হয় না! সে যাহা হউক, কতক্ষণ পরে গাড়ি থামিল। দরজা খুলিয়া রামরতন আমাকে গাড়ি হইতে নামাইয়া দিলেন। আমি দেখিলাম, গঙ্গাতীরে উপস্থিত হইয়াছি এবং একখানি নৌকাও সেখানে অপেক্ষা করিতেছে। 

“রামরতনের অনুরোধে আমি সেই নৌকায় গিয়া বসিলাম। কিন্তু তখন আমার মন এত চঞ্চল হইয়াছিল যে, আমি বাহিরের কোন বিষয় লক্ষ্য করিতে পারি নাই। নৌকায় উঠিবামাত্র মাঝি নৌকা চালনা করিল। গঙ্গায় তখনও ভয়ানক তুফান হইতেছিল, কিন্তু সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপও ছিল না। কিছুক্ষণ অতিকষ্টে যাইবার পর আমার নাসিকা ও মুখ দিয়া রক্ত বাহির হইতে লাগিল। কেন যে এরূপ হইল, তাহা বলিতে পারি না। তবে আরও কয়েকবার আমার ওইরূপ পীড়া হইয়াছিল। একে মদ্যের উত্তেজনা, তাহার উপর অতিরিক্ত রক্তনির্গমন হওয়ায়, আমি অতিশয় দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িলাম এবং অবশেষে হতচেতন হইলাম। যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন আমি হাসপাতালে।” 

ভ্যাস্কো ভেলডার সাহেবের কথা শুনিয়া আমি আশ্চর্যান্বিত হইলাম। বলিলাম “কি আশ্চর্য্য! এরূপ অদ্ভুত ব্যাপার আমি পূর্ব্বে আর কখনও শুনি নাই। কিন্তু যেমন করিয়াই হউক, এ রহস্য ভেদ করিতে হইবে। ইহাও আশ্চৰ্য্য যে, আপনাকে পরপারে পৌঁছাইয়া দিবার জন্য যখন নৌকায় তুলিল, আর যখন সেই উদ্দেশ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া নৌকা চালনা করা হইল, তখন আপনি আবার এ পারে কেমন করিয়া আসিলেন? গঙ্গা অতি ক্ষুদ্র নদী, উহা পার হইতে বড় জোর অর্দ্ধঘণ্টা লাগে। আপনি প্রায় এক ঘণ্টা নৌকায় থাকিয়াও কেন যে পুনরায় এ পারেই পড়িয়াছিলেন, তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। এখন আমার কয়েকটি কথার উত্তর দিন। প্রথমত রামরতন আপনাকেই তাঁহার যন্ত্র মেরামত করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন কেন? বিশেষতঃ, এ পারে যখন অনেক সাহেব ইঞ্জিনিয়ার রহিয়াছেন, যখন তাঁহাদের দ্বারা অল্প খরচে তাঁহার যন্ত্র সংস্কার হওয়া সম্ভব, তখন তিনি আপনার সাহায্য লইলেন কেন?” 

ভ্যাস্কো। অর্থলোভে আমি সে কথা জিজ্ঞাসা করি নাই, তথাপি রামরতন কথায় কথায় সে কথা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, যন্ত্রটি পর্টুগালে প্রস্তুত; সেখান হইতেই উহা আনীত হইয়াছিল। সুতরাং রামরতনের বিশ্বাস এই যে, অন্যদেশীয় ইঞ্জিনিয়ার অপেক্ষা পর্তুগীজ ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা উহা সহজেই মেরামত হইবে, এই মনে করিয়া তিনি আমার সন্ধান লইয়াছিলেন। 

আ। রামরতন আপনাকে পর্তুগীজ বলিয়া জানিলেন কিরূপে?

ভ্যা। আমি বিজ্ঞাপনে পর্তুগীজ বলিয়াই পরিচয় দিয়াছিলাম। 

আ। যন্ত্রটি কি বাস্তবিকই পর্তুগাল হইতে আনীত? 

ভ্যা। আমার ত সেরূপ বোধ হইল না। রামরতন বলিয়াছিলেন বটে, উহা আমারই স্বদেশ হইতে আনীত; কিন্তু আমার বিশ্বাস, যন্ত্রটি সম্পূর্ণ বিলাতী – ইংলন্ডে প্রস্তুত। কিন্তু আমি এ কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতেও সাহস করি নাই। 

আ। অবশ্যই ইহার ভিতর কোন ভয়ানক রহস্য নিহিত আছে। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

সাহেব তখন অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন, সুতরাং আর কোন প্রশ্ন না করিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম। তাঁহাকে বলিলাম, কিছুক্ষণ পরেই পুনরায় সাক্ষাৎ হইবে। 

বাসায় ফিরিয়া কিছুক্ষণ সেই ভয়ানক রহস্যের বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম; কিন্তু কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। ভ্যাস্কোর নিকট হইতে যাহা শোনা গেল, তাহা হইতে কোন সূত্র পাইলাম না। যে পথ দিয়া গিয়াছিলেন, তাহা তিনি জানিতে পারেন নাই, কেন না, রামরতন পূর্ব্বেই তাহার বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। গাড়ির দরজা খোলা থাকিলেও ভ্যাস্কো তাহা মনে করিয়া রাখিতে পারিতেন না। তিনি এ দেশে আর কখনও আসেন নাই। তাঁহার নিকট সমস্ত পথগুলিই নূতন। 

কিছুক্ষণ এই প্রকার চিন্তা করিয়া হতাশ হইয়া পড়িলাম। ভাবিলাম, এ ভয়ানক রহস্য ভেদ করা বুঝি আমার অসাধ্য হইল। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। তখনই হাসপাতালে যাইয়া ভ্যাস্কোর সহিত দেখা করিলাম। 

কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “ঘাট হইতে সেই বাড়ীতে যাইতে যাইতে পথের কোন ঘটনা আপনার মনে পড়ে কি?” 

ভ্যাস্কো কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন “অমার বোধ হয় কোন গির্জার নিকট দিয়া গিয়াছিলাম। রামরতনের সেই কারখানা পৌঁছিবার কিছু পূর্ব্বে আমি যেন কোন গির্জ্জার ঘড়ীতে এগারটা বাজিতে শুনিতে পাইয়াছিলাম। আবার ফিরিয়া আসিবার সময়ও সেই গির্জ্জার ঘড়ীতে বারটা বাজিতে শুনিয়াছিলাম। পূর্ব্বে এ কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। 

ভ্যাস্কোর কথা শুনিয়া আমার মনে আনন্দ হইল। মনে করিলাম, এইবার হয়ত কোন সূত্র পাইব। ভাবিলাম, কলিকাতায় গিৰ্জ্জা অনেক আছে। কোন গির্জার নিকট দিয়া ভ্যাস্কো গিয়াছিলেন, তাহা নির্ণয় করা অত্যন্ত দুরূহ। ভ্যাস্কোকে জিজ্ঞাসা করিলাম, গঙ্গা পার হইয়া প্রথমত কোনদিকে গাড়ি দৌড়িয়াছিল? তিনি বলিলেন, দক্ষিণ দিকে। 

কিছুক্ষণ পরে ভ্যাস্কো বলিলেন “যদিও গত রাত্রে ভয়ানক দুর্যোগ গিয়াছিল, তথাপি সেই ভয়ানক অন্ধকার মধ্যে আমি একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়াছিলাম। নিকটস্থ বাড়ীগুলির অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, আমরা কলিকাতার প্রান্তে উপস্থিত।” 

ভ্যাস্কোর শেযোক্ত কথা শুনিয়া আমার বড়ই আনন্দ হইল। আমি আহ্লাদে বলিয়া উঠিলাম, এতক্ষণে একটা সূত্র পাইলাম। যখন কলিকাতার প্রান্তে গিয়াছিলেন অনুমান করিতেছেন, তখন আপনি নিশ্চয়ই বির্জ্জিতলার গির্জার ঘড়ীর শব্দ শুনিতে পাইয়াছিলেন, আমার বেশ বিশ্বাস হইতেছে। এ কথা আগে বলেন নাই কেন? কি ভয়ানক রহস্য! কি ভয়ানক ব্যাপার! স্মরণ করিলেও স্তম্ভিত হইতে হয়। যদি আমার অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে এক ভয়ানক কাণ্ড আজ আবিষ্কৃত হইবে। আপনার অবস্থা কেমন? আমার সহিত কিছু দূরে বেড়াইতে যাইতে পারিবেন কি? 

ভ্যাস্কো আমার কথায় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। পরে বলিলেন, তাঁহার শরীর পূর্ব্বাপেক্ষা অনেক সুস্থ, আমার সহিত কোথাও যাইতে তাঁহার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। 

ভ্যাস্কোর সম্মতি পাইয়া আমি তখনই হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবের সহিত দেখা করিলাম এবং তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিয়া সেখান হইতে বিদায় লইলাম। থানায় আসিয়া আমার বিশ্বাসী অনুচরকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “চূড়ামন! পাঁচ মিনিটের মধ্যে কোন ছদ্মবেশ করিতে পার? আজ রাত্রে একটি অতি ভয়ানক কাণ্ড ধরা পড়িবে। কিন্তু সে কাজ একা আমার দ্বারা সম্ভব নহে। তুমি শীঘ্র প্রস্তুত হও।” 

চূড়ামন হাসিয়া উত্তর করিল, পাঁচ মিনিটের কথা কি বলিতেছেন? আপনি দুই মিনিট কাল অপেক্ষা করুন, আমি এখনই ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া আসিতেছি। কিন্তু আর কোন লোক সঙ্গে লইলে হয় না? 

আমি বলিলাম “নিশ্চয়ই আরও অনেক লোকের দরকার। কিন্তু এখান হইতে লইলে অনেকে মনে সন্দেহ হইতে পারে। সেই জন্য স্থানীয় থানা হইতেই প্রয়োজন মত লোক সংগ্রহ করিতে হইবে।” 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

যথাসময়ে চূড়ামন ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া আমার নিকট আসিল। আমি তখনই তাহাকে লইয়া একেবারে হাসপাতালে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, ভ্যাস্কোও আমার জন্য প্রস্তুত হইয়া অপেক্ষা করিতেছেন। আমাকে দেখিয়া তিনি সন্তুষ্ট হইলেন, এবং অনেকগুলি প্রশ্ন করিলেন। কিন্তু তখন আমি তাঁহার কোন কথার উত্তর দেওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে বিবেচনা করিয়া বলিলাম, আর কিছু পরেই সমস্ত ব্যাপার স্বচক্ষে দেখিতে পাইবেন। 

ভ্যাস্কো আর কোন কথা কহিলেন না। আমি তখন হাসপাতালের সাহেবের অনুমতি লইয়া তাঁহাকে একখানি গাড়িতে তুলিলাম। চূড়ামন গাড়ির উপরেই ছিল, আমাদিগকে গাড়িতে উঠিতে দেখিয়া সে কোচম্যানকে শকট চালনা করিতে আদেশ করিল। অতি দ্রুতবেগে শকট চালিত হইল। 

প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেই গাড়িখানি আমার উপরিতন সাহেবের অফিসের দরজায় লাগিল। চূড়ামন গাড়ির উপরেই রহিল। আমি ভ্যাস্কোকে লইয়া সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। 

অসময়ে আমাকে দেখিয়া সাহেব আশ্চর্যান্বিত হইলেন এবং সাক্ষাতের কারণ কি জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি ভ্যাস্কোকে দেখাইয়া তাঁহার মুখে যাহা যাহা শুনিয়াছিলাম, সেই সমস্ত কথা আদ্যোপান্ত প্রকাশ করিয়া, বলিলাম “আমার ভয়ানক সন্দেহ হইতেছে যে, ইহার ভিতর কোন গূঢ় রহস্য নিহিত আছে। আপনি এ বিষয়ে আমাকে যেরূপ করিতে বলিবেন, আমি তাহাই করিতে সম্মত আছি।” 

সাহেব আমার কথা শুনিয়া কিছুক্ষণ অতি গম্ভীর ভাবে কি চিন্তা করিলেন। পরে ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “মুখার্জি! তোমার অনুমান বুঝিতে পারিয়াছি। আমার এখন স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, যন্ত্রটি অন্য কোন কার্য্যের জন্য স্থাপিত হইয়াছে। যন্ত্রের অধিকারী রামরতন এই সাহেবকে যেরূপ বলিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রথমতঃ সাহেব বলিতেছেন যে, যন্ত্রটি বিলাতী, ইংলণ্ড হইতে আনীত। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে যে কোন ইঞ্জিনিয়ার উহা মেরামত করিতে সমর্থ। তবে কেন রামরতন রাত্রি প্রায় দশটার সময় ঘুসুড়ী গিয়া ভ্যাস্কো সাহেবকে সেই যন্ত্র সংস্কারের জন্য লইয়া গেলেন? ইনি বলিতেছেন যে, অতি সামান্য কারণে যন্ত্রের কার্য্যে প্রতিবন্ধক হইয়াছিল। সুতরাং উহা মেরামত করিবার জন্য কোন বিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন ছিল না। বিশেষতঃ যখন সামান্য ব্যয়ে নিকটস্থ ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ওই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে পারিত, তখন ভ্যাস্কো সাহেবকে এক শত টাকা দিয়া ঘুসুড়ী হইতে আনিবার প্রয়োজন কি?” 

এই বলিয়া সাহেব আমার মুখের দিকে চাহিলেন। আমি তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া বলিলাম “আমার বিবেচনায় রামরতনের এমন ইচ্ছা ছিল না যে, তিনি কোন পরিচিত লোকের দ্বারা যন্ত্রটি মেরামত করিয়া লন।ভ্যাস্কো সাহেব সম্প্রতি বিলাত হইতে আসিয়াছেন, এখানকার পথ ঘাট তাঁহার জানা নাই, বিশেষতঃ সংবাদপত্রে তিনি আপনাকে একজন পর্তুগীজ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন, এইজন্যই রামরতন ইহার সমক্ষে যন্ত্রটি পর্তুগাল হইতে আনীত হইয়াছে, এরূপ বলিয়াছিলেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, যদি ইনি আপনাকে ফরাসি বলিয়া বিজ্ঞাপণ দিতেন, তাহা হইলে রামরতন নিশ্চয়ই যন্ত্রটী ফ্রান্স হইতে আনীত এরূপ বলিতেন।” 

সাহেব আমার কথায় সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “যথার্থ অনুমান করিয়াছ। রামরতনের একজন নূতন লোকের দরকার, সেই জন্য তাঁহাকে অনকগুলি মিথ্যাকথা বলিতে হইয়াছিল। তাহার পর যখন ইনি সেখানে গিয়া যন্ত্রটী দেখিলেন, তখন সেই যন্ত্রে প্রকৃত কোন কাৰ্য্য সমাধা হয় তাহা রামরতন জানিতে দেন নাই। তিনি বলিয়াছিলেন যে, সেই যন্ত্রের সাহায্যে অস্থি চূর্ণ করিয়া ধাতু নিষ্কাশন করা হয়। ইহাও সম্পূর্ণ মিথ্যা। যদিও ইনি সেখানে নানাপ্রকার অস্থি ও বোতলপূর্ণ আরক দেখিয়া আসিয়াছেন, তত্রাপি সেগুলি যে রামরতন কোনকালে ব্যবহার করিবেন, এরূপ বিশ্বাস হয় না। সাধারণের চক্ষে ধূলি দিবার জন্যই ওই সকল দ্রব্যের আয়োজন। কেমন, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য কি না?”

আমি বলিলাম, সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য। 

সাহেব বলিলেন, “তাহার পর ভ্যাস্কো সাহেব দ্বারা যন্ত্রটী মেরামত হইলে রামরতন এক শত টাকার পরিবর্ত্ত দেড় শত টাকা দিলেন। এমন অযাচিত দান আর কখনও শুনিয়াছেন কি? ভ্যাস্কোর যাহাতে যন্ত্রের কথা মনে না থাকে, এই উদ্দেশেই তিনি ওই প্রকার কার্য্য করিয়াছিলেন সন্দেহ নাই। তাহার পর যখন বিদায়ের সময় সাহেব মদ্যপান করিলেন, সে মদ্য বিষাক্ত ছিল। সাহেবকে অচেতন করা না হউক, তাঁহাকে সকল সকল কথা ভুলাইয়া দিবার জন্যই এই উপায়ের উদ্ভাবন। যখন ভ্যাস্কো নৌকায় উঠিলেন, তখন তাঁহার সমস্ত শরীরে আসহ্য যাতনা আরম্ভ হইয়াছে; তিনি উন্মত্তের মত নৌকার ভিতর বসিলেন। ঝড়ে নৌকাখানি ভয়ানক দুলিতেছিল। একে সেই বিষমিশ্ৰিত মদ্যপানে তাঁহার মস্তক বিঘূর্ণিত হইতেছিল, তাহার উপর নৌকার ভয়ানক গতি, তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না, তাঁহার মুখ ও নাসিকা দিয়া রক্তস্রোত প্রবাহিত হইতে লাগিল, কিছুক্ষণ পরে হতচেতন হইয়া পড়িলেন। নৌকায় দাঁড়ী মাঝির অত্যন্ত ভয় হইল, তাহারা সেই অন্ধকারময় রাত্রিতে সেই প্রচণ্ড ঝড়ের সময় অতি কষ্টে সেই আঘাটায় আসিয়া নৌকা লাগাইল এবং ভ্যাস্কোর অচেতন-দেহ তীরে রাখিয়া তথা হইতে পলায়ন করিল। 

সাহেবের কথা শুনিয়া আমি বলিলাম “আমারও ওই প্রকার অনুমান। কিন্তু ইহার ভিতর বোধ হয় আরও কিছু গূঢ় রহস্য আছে।” 

সাহেব হাসিয়া বলিলেন “নিশ্চয়ই।” 

তাহার পর তিনি ভ্যাস্কোর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “রামরতন আপনাকে যে টাকা দিয়াছিলেন, সে টাকা কোথায়?”

ভ্যা। আমার নিকটেই আছে। দেড় শত টাকার মধ্যে একখানি এক শত টাকার নোট আর পাঁচখানি দশ টাকার নোট। 

সা। নোটগুলি দেখিতে পাইব? 

ভ্যা। নিশ্চয়ই। 

এই বলিয়া পকেট হইতে নোটগুলি বাহির করিয়া ভ্যাস্কো সাহেব আমার সাহেবের হস্তে দিলেন। আমি নিকটে গিয়া নোটগুলি ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম, দশ টাকার নোটগুলি সমস্তই কলিকাতা সার্কেলের অন্তর্গত। চৰ্ম্মচক্ষে দেখিলে কোনপ্রকার ত্রুটী দিতে পাওয়া যায় না, কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা দেখিলে অনেক দোষ দেখিতে পাওয়া যায়। এক শত টাকার নোটখানির মধ্যে দুইটি এমন দাগ ছিল যে, আসল নোটে সেরূপ হওয়া সম্ভব নহে। অদ্য দশ টাকার নোটগুলি অন্যরূপে প্রমাণ করিতে পারিব না কিন্তু এক শত টাকার খানি পারিব। এ পর্য্যন্ত যতগুলি জাল নোট ধরা পড়িয়াছে, তাহাদের নম্বর আমার নিকট আছে। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, সেগুলি সমস্তই ভিন্ন ভিন্ন ব্যাঙ্ক দ্বারা করেন্সিতে পাঠান হইয়াছিল। কোথা হইতে যে সে সকল নোট ব্যাঙ্কে জমা হইল, তাহার কোন সন্ধান নাই। অবশ্য এখনও অনেক গোয়েন্দা এই কার্য্যে লিপ্ত আছেন, কিন্তু এতদিন হইল, কোনপ্রকার সন্ধান করিতে পারে নাই। এইবার বুঝি ঈশ্বর মুখ রক্ষা করিলেন। 

এই বলিয়া সাহেব আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন “এই ত তোমার রহস্য। কেমন মুখার্জি?” 

আমি হাসিয়া বলিলম “আজ্ঞে হাঁ, আমার অনুমানও ঠিক ওই প্রকার। কথায় কথায় রাত্রি প্রায় নয়টা বাজিয়া গেল। যদি অনুমতি হয়, আজই এই কার্যে নিযুক্ত হই।” 

সাহেব হাসিয়া সম্মত হইলেন। পরে বলিলেন “এ কার্য্য অল্প লোকের নহে। স্থানীয় পুলিস হইতে যত পারিবেন, লোক সংগ্রহ করিয়া লইবেন। ভ্যাস্কো সাহেব বড় দুর্ব্বল, অথচ উনি না চিনিলে তুমি কিছুই করিতে পারিবে না।” তাঁহাকে বাধা দিয়া ভ্যাস্কো বলিয়া উঠিলেন “আমার অপরাধ মার্জ্জনা করিবেন, আমি এখন আর তত দুর্বল নহি, অনায়াসে কার্য্যে যোগদান করিতে পারিব। আপনাদের নিকট যাহা শুনিলাম, তাহাতে স্তম্ভিত হইয়াছি, এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছি যে, অনেক সুকৃতি বশতঃ আমি সিংহের মুখ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছি। কি ভয়ানক, নোটগুলি সমস্তই জাল! একখানিও আসল নহে! আমার সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হইল। আমার সকল আশা নির্মূল হইল। আমি কি এই নোটগুলি চালাইতে পারিব না! “ 

সাহেব তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া বলিলেন “আপনার যাহাতে টাকা মারা না যায়, যাহাতে আপনি আপনার পারিশ্রমিক ফেরৎ পান, তাহার উপায় করা যাইবে। অগ্রে আসামী সকল ধৃত হউক, তাহার পর সে সকল বন্দোবস্ত হইবে।” 

এই বলিয়া তিনি আমাদিগকে বিদায় দিলেন। আমি ভ্যাস্কোকে লইয়া একখানি গাড়িতে আরোহণ করিয়া রাত্রি দশটার পূর্ব্বেই বিজ্জিতলার গির্জার নিকট উপস্থিত হইলাম। সেখানে উভয়ে শকট হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজে নিকটস্থ থানায় গমন করিলাম। গির্জ্জা ঘর হইতে থানা বড় অধিক দূর নহে। দুই তিন মিনিটের মধ্যেই আমরা থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সৌভাগ্যক্রমে দারোগাবাবুর সহিত আমার আলাপ ছিল। আমাকে দেখিয়া তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। 

প্রথম সম্ভাষণের পর আমি তাঁহাকে কাজের কথা বলিলাম। তিনি আমার কথা শুনিয়া স্তম্ভিত হইলেন। বলিলেন “কি আশ্চর্য! আমরা এত নিকটে থাকিতেও যে সকল লোক এমন কর্ম্ম করিতে সাহস করিয়াছে, তাহারা কি ভয়ানক লোক বলিতে পারি না; যতক্ষণ না তাহারা গ্রেপ্তার হয়, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না। আমার অধীনে অনেক কনেষ্টবল আছে; আমি সকলকেই এ কার্য্যে নিয়োগ করিতেছি। যদি আরও অধিক লোকের প্রয়োজন বিবেচনা করেন, তাহা হইলে ভবানীপুরের থানায় কিম্বা একেবারে লালবাজারের পুলিস হইতে লোকের বন্দোবস্ত করা যায়।” 

আমি দেখিলাম, আরও অধিক কনষ্টেবলের আবশ্যক হইলে হেড অফিস হইতে লোক আনিবার তত সুবিধা হইবে না, এই ভাবিয়া বলিলাম, আবশ্যক হইলে ভবানীপুর থানায় সংবাদ দিলেই যথেষ্ট হইবে। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় সমস্ত লোক একত্রিত হইল। আমি তখন দুইজন করিয়া আঠারটি দল করিলাম। এক এক দলকে এক এক দিকে পাঠাইয়া দিলাম। গির্জ্জার চারিদিকে এক ক্রোশের মধ্যে যত বাড়ী আছে সমস্তগুলির বিশেষ করিয়া সন্ধান লইতে আদেশ করিয়া সমস্ত লোককে বিদায় দিলাম। ভবিষ্যৎ উন্নতির লোভ দেখাইয়া, অর্থ পুরস্কারের প্রতিজ্ঞা করিয়া মিষ্টকথায় বশীভূত করত, যাহাতে শীঘ্র কার্য্যোদ্ধার হয়, তাহার উপায় করিলাম। কনেষ্টবল সকলই পুলিসের ইউনিফরম ত্যাগ করিয়া সাধারণ বেশ পরিধান করতঃ উৎসাহিত হইয়া কার্য্যে তৎপর হইল। 

আমি, ভ্যাস্কো, দারোগা ও দুইজন কনেষ্টবল ভিন্ন আর সকলেই সেই কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছিল। কনেষ্টবলদ্বয় বাহিরেই ছিল। আমরা তিনজন ভিতরে বসিয়া পরামর্শ করিতে লাগিলাম। 

অন্যান্য কথাবার্তার পর দারোগা জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি কখন তাহাদিগকে আক্রমণ করিতে ইচ্ছা করেন? আমার পরামর্শে রাত্রে বড় সুবিধা হইবে না।” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কেন সুবিধা হইবে না?”

দা। হয় ত সকল আসামী ধরা পড়িবে না? রাত্রি প্রায় একটা। বাড়ীটার সন্ধান বাহির করিতে আরও দেড়ঘণ্টা লাগিবে। সুতরাং আক্রমণ করিতে রাত্রি দুইটা বাজিবে। সে সময়ে যে কারখানায় সকল আসামী উপস্থিত থাকিবে, এমন বোধ হয় না। যদি ঠিক রাত্রিশেষে, অতি প্রত্যূষে আক্রমণ করেন, তাহা হইলেও কতকটা সম্ভব।” 

আমি বলিলাম “আমি প্রাতঃকালের পূর্বেই আসামীদিগকে ধরিতে ইচ্ছা করি। যদি ঈশ্বরের ইচ্ছায় শীঘ্রই বাড়ীটার সন্ধান পাওয়া যায়, তাহা হইলে ঠিক চারিটার পর আমরা এখান হইতে যাত্রা করিব।” 

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে একজন হাবেলদার দ্রুতপদে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। তাহার মূর্তি দেখিয়া আমি বুঝিতে পারিলাম, সে কোন সন্ধান পাইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম “কি হইয়াছে? কোন সন্ধান পাইয়াছ?” 

কনেষ্টবল করযোড়ে বলিল “থানা হইতে প্রায় এক মাইল দূরে একটা প্রকাণ্ড গুদাম-বাড়ীর বাহির হইতে যেন কোন যন্ত্র চালনার অতি সামান্য শব্দ শোনা যাইতেছে। পাছে ভুল হয়, এই জন্য সেখানে আমার জুড়ীদারকে রাখিয়া আমি আপনাকে সংবাদ দিতে আসিয়াছি।” 

কনষ্টেবলের কথা শুনিয়া আমি আন্তরিক আনন্দিত হইলাম এবং তখনই তাহার সহিত সেখানে যাইবার ইচ্ছা করিলাম, ভ্যাস্কোও আমার সহিত গেলেন। 

প্রায় এক মাইল পথ গমন করিয়া একজন লোককে এক বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিতে পাইলাম। নিকটে গিয়া দেখিলাম, সে আমাদেরই লোক। সে যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, তাহার সম্মুখেই একটা প্রকাণ্ড গুদাম-বাড়ী দেখিতে পাইলাম। বাড়ীটা বাহির হইতে দেখিলে কয় তলা তাহা বুঝিবার উপায় নাই। চারিদিকে অতি উচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। অট্টালিকার দরজা প্রকাণ্ড, কিন্তু সুদৃঢ়। দরজা ভাঙ্গিয়া প্রবেশ করা সামান্য বলের কর্ম্ম নয়। 

রাত্রি প্রায় একটা; জন-মানবের সাড়া শব্দ নাই। রাত্রি তমসাচ্ছন্ন। সরকারী আলোও সেখানে ছিল না। আমি ধীরে ধীরে সেই প্রকাণ্ড দরজার নিকট গমন করিলাম। ভ্যাস্কো সাহেবও আমার অনুসরণ করিলেন। 

দরজার সম্মুখে যাইতে না যাইতে ভ্যাস্কো অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া বলিলেন “মহাশয়! এই সেই বাড়ী। আর কোন ভুল নাই। এতক্ষণে আমি চিনিতে পারিয়াছি। এই সেই দরজা, এই সেই উচ্চ প্রাচীর।” 

আরও কত কি বলিতেন সন্দেহ নাই, কিন্তু আমি তাঁহাকে স্থির হইতে অনুরোধ করিলাম। তিনি তখনই চুপ করিলেন। তখন সেই নিস্তব্ধ নিশীথে সেই বাড়ীর ভিতর হইতে পরিষ্কার যন্ত্রের শব্দ শোনা যাইতে লাগিল। 

একবার মনে করিলাম, এখনই আক্রমণ করা যাউক। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম, যাহারা থানার এত নিকটে থাকিয়াও নোট জাল, মেকি টাকা করিতে পারে, তাহাদিগকে বিশেষ সতর্কতার সহিত আক্রমণ করাই যুক্তিসিদ্ধ। 

এইরূপ স্থির করিয়া আমরা সকলেই সেখান হইতে চলিয়া আসিলাম। ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, প্রায় সকলেই নিষ্ফল হইয়া থানায় প্রত্যাগমন করিয়াছে। অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই আবার সকলে একত্রিত হইল। আমি তখন তাহাদের সকলকে সেই বাড়ীটি ঘেরাও করিয়া বিশেষ সতর্কতার সহিত লক্ষ্য রাখিতে আদেশ করিলাম। বলিলাম, আমরা রাত্রে চারিটার সময় এখান হইতে যাত্রা করিব। সেখানে পৌঁছিলে আক্রমণের বন্দোবস্ত করিব। 

কনেষ্টবল চলিয়া গেল। রাত্রি তখন দুইটা। ভ্যাস্কোকে একখানি ক্যাম্পখাটে শুইতে বলিলাম। একে দুর্ব্বল শরীর, তাহার উপর এত পরিশ্রম, হয় ত সহ্য হইবে না। তিনিও সম্মত হইলেন এবং কিছুক্ষণ বিশ্রামার্থ শয়ন করিলেন। আমি ও থানার দারোগা সেই কনেষ্টবলগণের সহিত ওই বাড়ীর নিকটেই রহিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

সাড়ে চারিটার সময় আমরা কার্য্য আরম্ভ করিলাম। পূর্ব্বদিক তখনও পরিষ্কার হইতে আরম্ভ হয় নাই, পক্ষীকুল তখনও কুলা ত্যাগ করিয়া আহারান্বেষণে নিযুক্ত হয় নাই, দুই একটি শ্বাপদ জন্তু তখনও ছুটাছুটী করিতেছিল। 

বাড়ীটার চতুষ্পার্শ্ব ঘুরিয়া দেখিলাম, কনেষ্টবলগণ উহার চারিদিকে ঘেরাও করিয়া আমার অপেক্ষা করিতেছে। আমি একবার দরজার নিকট গেলাম, তখনও যন্ত্র চালনার মৃদু শব্দ বাহির হইতে শোনা যাইতেছিল। 

আর অপেক্ষা করা যুক্তিসিদ্ধ নহে বিবেচনা করিয়া, আমি কয়েকজন কনেষ্টবলকে দরজায় ধাক্কা দিতে আদেশ করিলাম। পূর্ব্ব হইতেই তাঁহারা প্রস্তুত ছিল; আমাদের কথাবার্তায় তাঁহারা বুঝিয়াছিল যে, ওই বাড়ীটীতে জাল নোট ও টাকা প্রস্তুত হয়।” সুতরাং সকলেই তাহার ভিতর প্রবেশ করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছিল। 

আমার আদেশ পাইতে না পাইতে আটজন কনেষ্টবল সজোরে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগিল। কিন্তু দরজাটি এত দৃঢ়রূপে নির্ম্মিত ছিল যে, তাহাতে তাহার কিছুই ক্ষতি হইল না। এদিকে ভিতর হইতে লোকজনের পদশব্দ শোনা যাইতে লাগিল। তাহাদের পদশব্দে বুঝিলাম, তাহারা আমাদের উদ্দেশ্য জানিতে পারিয়াছে এবং নিশ্চয়ই পলায়নের চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু আমি সেই বাড়ীকে এরূপে অবরোধ করিয়াছিলাম যে, তাহার ভিতর হইতে জনপ্রাণীরও পলায়নের উপায় ছিল না। 

সে যাহা হউক, কয়েকটি ধাক্কা দিয়া যখন কোন ফল হইল না, তখন আমি তাহাদিগকে কোন যন্ত্রের সাহায্যে দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে আদেশ করিলাম। মুহূর্ত্ত মধ্যে তাহারা আমার আদেশ পালন করিল। দরজা ভাঙ্গিয়া গেল। আমরা সকলেই সশস্ত্র ছিলাম। আমার নিকট দুইটি ক্ষুদ্র পিস্তল ছিল, ভ্যাস্কো সাহেবকেও একটি পিস্তল দেওয়া হইয়াছিল, দারোগাবাবুর নিকটও একটি পিস্তল ছিল। আপন আপন পিস্তল বাহির করিয়া কয়েকজন পাহারাওয়ালার সঙ্গে আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম। 

ভ্যাস্কো সাহেব পথ চিনিতেন, তিনি দক্ষিণ হস্তে পিস্তল ধরিয়া অগ্রে অগ্রে যাইতে লাগিলেন। আমরা উভয়ে তাঁহার অনুসরণ করিলাম। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, প্রথম কয়েকটি ঘরে কোন লোককে দেখিতে পাওয়া গেল না। ভাবিলাম, যদি উহারা পলায়ন করিয়া থাকে, তাহা হইলে বাহিরের কনেষ্টবলগণ কর্ত্তক অতি সহজেই ধৃত হইবে। এই প্রকার স্থির করিয়া আমরা ক্রমাগত অগ্রসর হইতে লাগিলাম। অবশেষে যে গৃহে যন্ত্র ছিল, ভ্যাস্কো সাহেব আমাদিগকে সেই ঘরে লইয়া গেলেন। তিনজন লোক সেই ঘরে কি কার্য্য করিতেছিল, আমাদিগকে দেখিয়া স্তম্ভিত হইল, কিন্তু পলায়নের চেষ্টা করিল না। আমি তখনই কনেষ্টবলগণকে ইঙ্গিত করিলাম। তাঁহারা সেই তিনজনকে গ্রেপ্তার করিল। 

বন্দী তিনজনকে একটি ঘরে আবদ্ধ করিয়া আমরা অপর গৃহে প্রবেশ করিলাম। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, যেখানে নোট বা টাকা প্রস্তুত হইতেছিল, সে ঘর দেখিতে পাইলাম না। আমার সমভিব্যাহারী কনেষ্টবলগণ চারিদিকে অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতে লাগিল, কিন্তু তাহাতে বিশেষ কোন ফল হইল না। বাড়ীটিতে যতগুলি ঘর ছিল, সমস্তগুলিই তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করা গেল, কিন্তু আর কোন লোক দেখিতে পাওয়া গেল না। বন্দীদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল, তাহারা তিনজন ভিন্ন আর কোন লোক তখন সেখানে ছিল না। কিন্তু যেরূপ ভাবে তাহারা ওই সকল কথা বলিল, তাহাতে আমার বিশ্বাস হইল না। 

আমি তখন আর তাহাদিগকে ব্যস্ত না করিয়া স্বয়ং অন্বেষণ করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, এই বাড়ীতে নিশ্চয়ই কোন চোরা কুটুরী আছে। কিরূপে উহার সন্ধান পাই, জানিবার জন্য আমি একগাছি লাটি লইয়া সমস্ত ঘরগুলির দেওয়ালে আঘাত করিতে লাগিলাম। 

প্রায় দশ মিনিট কাল ওই প্রকার আঘাত করিতে করিতে একস্থানে কেমন একপ্রকার ফাঁপা আওয়াজ হইল। ভ্যাস্কো সাহেবকে সেই স্থান দেখাইলাম। তিনিও সেই প্রকার বিবেচনা করিলেন। তখন সকলে মিলিয়া সেই দেওয়ালটি পরীক্ষা করিয়া উহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে আদেশ করিলাম। তৎক্ষণাৎ দেওয়াল ভাঙ্গিয়া ফেলা হইল। একটি গুপ্তদ্বার দেখা গেল। আমি, ভ্যাস্কো ও দারোগাবাবু সেই দরজায় প্রবেশ করিলাম। কিন্তু অধিক দূর যাইতে হইল না। কিছু দূর যাইতে না যাইতে একটি পিস্তলের শব্দ আমার কর্ণগোচর হইল এবং সেই সঙ্গে একটি গুলি আমার স্কন্ধের উপর দিয়া চলিয়া গেল। 

আমি স্তম্ভিত হইলাম! কিন্তু সে কেবল ক্ষণেকের জন্য। আমিও তখনই পিস্তল ছুড়িলাম। ভয়ানক শব্দে চারিদিক প্রতিধ্বনিত হইল। শব্দের শেষ হইতে না হইতে ভিতর হইতে মানুষের চীৎকার ধ্বনি কর্ণগোচর হইল। পরক্ষণেই আমরা ভিতরে গিয়া দেখিলাম, এক ভয়ানক আকৃতি দুর্বৃত্ত দস্যু দণ্ডায়মান। তাহার দক্ষিণ হস্তে আমার পিস্তলের গুলি লাগিয়াছিল বলিয়া তাহার হস্তস্থিত পিস্তল তাহারই পদতলে পড়িয়া রহিয়াছে। 

তাহাকে দণ্ডায়মান দেখিয়া আমি আর বিলম্ব করিলাম না। চক্ষের পলক পড়িতে পড়িতে আমি তাহাকে আক্রমণ করিলাম। দক্ষিণ হস্ত আহত হইলেও লোকটা অসুরের মত লড়াই করিল। সহজে তাহাকে বন্দী করিতে পারিলাম না। অবশেষে দারোগা ও ভ্যাস্কো সাহেবের সাহায্যে তাহাকে ধৃত করিলাম। 

তাহাকে দুইজন কনষ্টেবলের জিম্মায় রাখিয়া আমরা আরও ভিতরে গমন করিলাম। ঘরের অবস্থা দেখিয়া স্পষ্টই বোধ হইল, আরও কয়েকজন লোক সেখানে ছিল। কিন্তু অনেক অন্বেষণ করিয়াও আমরা তাহাদের কোন সন্ধান পাইলাম না। ঘরটির অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, ভিতর দিক হইতে বাহিরে পলায়ন করিবার আর পথ নাই। তবে লোকগুলি কোথায় গেল, জানিবার জন্য অত্যন্ত কৌতূহল জন্মিল। একবার ভাবিলাম, হয় ত কোন গুপ্তদ্বার আছে এবং সেই দ্বারা অন্বেষণ করিবার জন্য পূর্ব্বোক্ত উপায় অবলম্বন করিলাম। সেখানকার চারিদিকের দেওয়ালগুলিতে লাটির আঘাত করিতে লাগিলাম। ভ্যাস্কো ও দারোগাবাবু আমার কার্য্যের অনুসরণ করিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। তখন বুঝিলাম, লোকগুলি তখনও ভিতরে আছে। কিন্তু কোথায় আছে জানিবার জন্য চারিদিকে অন্বেষণ করিতে লাগিলাম। ঘরের মেঝের উপর রৌপ্য, তাম্র, শীশা, দস্তা প্রভৃতি নানা প্রকার ধাতু পড়িয়াছিল। কতগুলি বড় বড় মুচীও দেখিতে পাইলাম। বুঝিলাম, সে ঘরে টাকা, গিনি ইত্যাদি মুদ্রা জাল করা হয়। 

আরও ভিতরে গমন করিলাম। একটি সরু ক্ষুদ্র পথ দিয়া ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ আমাদের কর্ণ গোচর হইল। তিনজনে একেবারে তাহার ভিতরে প্রবেশ করা অসাধ্য বিবেচনা করিয়া আমি স্বয়ং অগ্রে গমন করিলাম। এবারে কিন্তু আমিই অগ্রে পিস্তল ছুড়িলাম। শব্দের শেষ হইতে না হইতে একেবারে দুইটি ভয়ানক শব্দ শ্রুত হইল। সাঁই সাঁই শব্দে বন্দুকের গুলি আমার মাথার উপর দিয়া চলিয়া গেল। কিন্তু আমি আহত হইলাম না। দারোগাবাবু আমার ঠিক পশ্চাতে ছিলেন। বিশেষতঃ তিনি একটি উচ্চস্থানে দাঁড়াইয়া ভিতরের লোকদিগকে দেখিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, বন্দুকের গুলি তাঁহারই মস্তকের একপার্শ্বে সামান্য জখম করিয়া চলিয়া গেল; তিনি অজ্ঞান হইয়া ভূমিতলে পড়িয়া, গেলেন। ভ্যাস্কো সাহেব মুহূর্ত্ত মধ্যে তাঁহার নিকটে আসিলেন এবং তখনই তাঁহার সেবায় নিযুক্ত হইলেন। আমার অন্য কোন কার্য্যের সময় ছিল না। কনেষ্টবলগণও অনেক পিছনে ছিল। সুতরাং আর বিলম্ব না করিয়া একাই তাহাদের দুইজনের সম্মুখীন হইলাম। 

লোক দুইজন আমাদের প্রথম বন্দী অপেক্ষা অনেক দুৰ্ব্বল বলিয়া বোধ হইল। আমি তাহাদের একজনকে হঠাৎ আক্রমণ করিয়া এমন একটি আছাড় মারিলাম যে, সে পড়িয়া গোঁ গোঁ শব্দ করিতে লাগিল। তাহাকে ফেলিতে না ফেলিতে অপর ব্যক্তি অগ্রেই আমায় ধরিয়া ফেলিল এবং যদি সেই সময় ভ্যাস্কো সাহেব আমার সাহায্যের জন্য উপস্থিত না হইতেন, তাহা হইলে আমার অবস্থা সাংঘাতিক হইত। 

কনেষ্টবলগণের সাহায্যে সেই দুইজনকেও বন্দী করিলাম। তাহার পর আমরা সমস্ত স্থান তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিলাম। কিন্তু আর কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। যন্ত্রটি দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। দেখিলাম, নোট টাকা গিনি ইত্যাদি যথেষ্ট পড়িয়া রহিয়াছে। কতকগুলি প্রস্তুত হইয়া গিয়াছে, কতকগুলির অর্দ্ধেক হইয়াছে, আবার কতকগুলির অতি সামান্য কাৰ্য্যই হইয়াছে। 

বাহিরে যে সকল কনেষ্টবল ছিল, একে একে তাহাদের অনেকেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল এবং যে যাহা সম্মুখে পাইল, সমস্তই গ্রহণ করিল। 

এই সময় কাৰ্য্য শেষ করিয়া কতকগুলি কনেষ্টবলকে সেখানে রাখিয়া অবশিষ্ট কনেষ্টবল, তিনজন বন্দী, আহত দারোগাবাবু ও ভ্যাস্কো সাহেবকে লইয়া আমি থানায় পঁহুছিলাম। এতদিন যাহার জন্য পুলিসের লোকে কোন কিনারা করিতে পারে নাই, সেদিন তাহা ধরা পড়িল। 

বিচারে তাহারা দোষ স্বীকার করিল। তাহাদিগের সকলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হইল। 

সম্পূর্ণ 

[ চৈত্র, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *