একাদশ পরিচ্ছেদ : সূর্যমুখীর পত্র
“প্রাণাধিকা শ্রীমতী কমলমণি দাসী চিরায়ুষ্মতীষু।
আর তোমাকে আশীর্বাদ পাঠ লিখিতে লজ্জা করি। এখন তুমিও একজন হইয়া উঠিয়াছ–এক ঘরের গৃহিণী। তা যাহাই হউক, আমি তোমাকে আমার কনিষ্ঠা ভগিনী ভিন্ন আর কিছুই বলিয়া ভাবিতে পারিতেছি না। তোমাকে মানুষ করিয়াছি। প্রথম “ক খ” লিখাই, কিন্তু তোমার হাতের অক্ষর দেখিয়া, আমার এ হিজিবিজি তোমার কাছে পাঠাইতে লজ্জা করে। তা লজ্জা করিয়া কি করিব? আমাদিগের দিনকাল গিয়াছে। দিনকাল থাকিলে আমার এমন দশা হইবে কেন?
কি দশা? এ কথা কাহাকে বলিবার নহে,-বলিতে দু:খও হয়, লজ্জাও করে। কিন্তু অন্ত:করণের ভিতর যে কষ্ট, তাহা কাহাকে না বলিলেও সহ্য হয় না। আর কাহাকে বলিব? তুমি আমার প্রাণের ভগিনী–তুমি ভিন্ন আর আমাকে কেহ ভালবাসে না। আর তোমাকে ভাইয়ের কথা তোমা ভিন্ন পরের কাছেও বলিতে পারি না।
আমি আপনার চিতা আপনি সাজাইয়াছি। কুন্দনন্দিনী যদি না খাইয়া মরিত, তাহাতে আমার কি ক্ষতি কি ছিল? পরমেশ্বর এত লোকের উপায় করিতেছেন, তাহার কি উপায় করিতেন না? আমি কেন আপনা খাইয়া তাহাকে ঘরে আনিলাম?
তুমি সে হতভাগিনীকে যখন দেখিয়াছিলে, তখন সে বালিকা। এখন তাহার বয়স ১৭/১৮ বৎসর হইয়াছে। সে যে সুন্দরী, তাহা স্বীকার করিতেছি। সেই সৌন্দর্যই আমার কাল হইয়াছে।
পৃথিবীতে যদি আমার কোন সুখ থাকে, তবে সে স্বামী; পৃথিবীতে যদি আমার কোন চিন্তা থাকে, তবে সে স্বামী; পৃথিবীতে যদি আমার কোন কিছু সম্পত্তি থাকে, তবে সে স্বামী; সেই স্বামী, কুন্দনন্দিনী আমার হৃদয় হইতে কাড়িয়া লইতেছে। পৃথিবীতে আমার যদি কোন অভিলাষ থাকে, তবে সে স্বামীর স্নেহ। সেই স্বামীর স্নেহে কুন্দনন্দিনী আমাকে বঞ্চিত করিতেছে।
তোমার সহোদরকে মন্দ বলিও না। আমি তাঁহার নিন্দা করিতেছি না। তিনি ধর্মাত্মা, শত্রুতেও তাঁহার চরিত্রের কলঙ্ক এখনও করিতে পারে না। আমি প্রত্যহ দেখিতে পাই, তিনি প্রাণপণে আপনার চিত্তকে বশ করিতেছেন। যে দিকে কুন্দনন্দিনী থাকে, সাধ্যানুসারে কখন সে দিকে নয়ন ফিরান না। নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে তাহার নাম মুখে আনেন না। এমন কি, তাহার প্রতি কর্কশ ব্যবহারও করিয়া থাকেন। তাহাকে বিনা দোষে ভর্ৎসনা করিতেও শুনিয়াছি।
তবে কেন আমি এত হাবড়হাটি লিখিয়া মরি? পুরুষে এ কথা জিজ্ঞাসা করিলে বুঝান বড় ভার হইত; কিন্তু তুমি মেয়েমানুষ, এতক্ষণে বুঝিয়াছ। যদি কুন্দননন্দিনী অন্য স্ত্রীলোকের মত তাঁহার চক্ষে সামান্য হইত, তবে তিনি কেন তাহার প্রতি না চাহিবার জন্য ব্যস্ত হইবেন? তাহার নাম মুখে না আনিবার জন্য কেন এত যত্নশীল হইবেন? কুন্দনন্দিনীর জন্য তিনি আপনার নিকট আপনি অপরাধী হইয়াছেন। এ জন্য কখন কখন তাহার প্রতি অকারণ ভর্ৎসনা করেন। সে রাগ তাহার উপর নহে–আপনার উপর। সে ভর্ৎসনা তাহাকে নহে, আপনাকে। আমি ইহা বুঝিতে পারি। আমি এতকাল পর্যন্ত অনন্যব্রত হইয়া, অন্তরে বাহিরে কেবল তাঁহাকেই দেখিলাম–তাঁহার ছায়া দেখিলে তাঁহার মনের কথা বলিতে পারি–তিনি আমাকে কি লুকাইবেন? কখন কখন অন্যমনে তাঁহার চক্ষু এদিক ওদিক চাহে কাহার সন্ধানে, তাহা কি আমি বুঝিতে পারি না? দেখিলে আবার ব্যস্ত হইয়া চক্ষু ফিরাইয়া লয়েন কেন, তাহা কি বুঝিতে পারি না? কাহার কণ্ঠের শব্দ শুনিবার জন্য, আহারের সময়, গ্রাস হাতে করিয়াও কাণ তুলিয়া থাকেন, তাহা কি বুঝিতে পারি না? হাতের ভাত হাতে থাকে, কি মুখে দিতে কি মুখে দেন, তবু কাণ তুলিয়া থাকেন,-কেন? আবার কুন্দের স্বর কাণে গেলে তখনই বড় জোরে হাপুস হাপুস করিয়া ভাত খাইতে আরম্ভ করেন কেন, তা কি বুঝিতে পারি না? আমার প্রাণাধিক সর্বদা প্রসন্নবদন–এখন এত অন্যমনা: কেন? কথা বলিলে কথা কাণে না তুলিয়া, অন্যমনে উত্তর দেন ‘হুঁ’;-আমি যদি রাগ করিয়া বলিল, “আমি শীঘ্র মরি,” তিনি না শুনিয়া বলেন ‘হুঁ’। এত অন্যমনা: কেন? জিজ্ঞাসা করিলে বলেন, “মোকদ্দমার জ্বালায় |” আমি জানি, মোকদ্দমার কথা তাঁহার মনে স্থান পায় না। যখন মোকদ্দমার কথা বলেন, তখন হাসিয়া হাসিয়া কথা বলেন। আর এক কথা–এক দিন পাড়ার প্রাচীনার দল কুন্দের কথা কহিতেছিল, তাহার বাল্যবৈধব্য অনাথিনীত্ব এই সকল লইয়া তাহার জন্য দু:খ করিতেছিল। তোমার সহোদর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি অন্তরাল হইতে দেখিলাম, তাঁর চক্ষু জলে পুরিয়া গেল–তিনি সহসা দ্রুতবেগে সে স্থান হইতে চলিয়া গেলেন।
এখন একজন নূতন দাসী রাখিয়াছি। তাহার নাম কুমুদ। বাবু তাহাকে কুমুদ বলিয়া ডাকেন। কখন কখন কুমুদ বলিয়া ডাকিতে কুন্দ বলিয়া ফেলেন। আর কত অপ্রতিভ হন! অপ্রতিভ কেন? একথা বলিতে পারিব না যে, তিনি আমাকে অযত্ন বা অনাদর করেন। বরং পূর্বাপেক্ষা অধিক যত্ন, অধিক আদর করেন। ইহার কারণ বুঝিতে পারি। তিনি আপনার মনে আমার নিকট অপরাধী। কিন্তু ইহাও বুঝিতে পারি যে, আমি তাঁহার মনে স্থান পাই না। যত্ন এক, ভালবাসা আর, ইহার মধ্যে প্রভেদ কি–আমরা স্ত্রীলোক সহজেই বুঝিতে পারি।
আর একটা হাসির কথা। ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের যহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে? এখন বৈঠকখানায় ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ আসিলে সেই গ্রন্থ লইয়া বড় তর্ক বিতর্ক হয়। সে দিন ন্যায়-কচকচি ঠাকুর, মা সরস্বতীর সাক্ষাৎ বরপু্ত্র, বিধবাবিবাহের পক্ষে তর্ক করিয়া বাবুর নিকট হইতে টোল মেরামতের জন্য দশটি টাকা লইয়া যায়। তাহার পরদিন সার্বভৌম ঠাকুর বিধবাবিবাহের প্রতিবাদ করেন। তাঁহার কন্যার বিবাহের জন্য আমি পাঁচ ভরির সোণার বালা গড়াইয়া দিয়াছি। আর কেহ বড় বিধবাবিবাহের দিকে নয়।
আপনার দু:খের কথা লইয়া তোমাকে অনেকক্ষণ জ্বালাতন করিয়াছি। তুমি না জানি কত বিরক্ত হইবে? কিন্তু কি করি ভাই–তোমাকে মনের দু:খ না বলিয়া কাহাকে বলিব? আমার কথা এখনও ফুরায় নাই–কিন্তু তোমার মুখ চেয়ে আজ ক্ষান্ত হইলাম। এ সকল কথা কাহাকেও বলিও না। আমার মাথার দিব্য, জামাই বাবুকেও এ পত্র দেখাইও না।
তুমি কি আমাদিগকে দেখিতে আসিবে না? এই সময় একবার আসিও, তোমাকে পাইলে অনেক ক্লেশ নিবারণ হইবে।
তোমার ছেলের সংবাদ ও জামাই বাবুর সংবাদ শীঘ্র লিখিবে। ইতি।
সূর্যমুখী।
পুনশ্চ। আর এক কথা–পাপ বিদায় করিতে পারিলেই বাঁচি। কোথায় বিদায় করি? তুমি নিতে পার? না ভয় করে?”
কমল প্রত্যুত্তরে লিখিলেন,-
“তুমি পাগল হইয়াছ। নচেৎ তুমি স্বামীর হৃদয়প্রতি অবিশ্বাসিনী হইবে কেন? স্বামীর প্রতি বিশ্বাস হারাইও না। আর যদি নিতান্তই সে বিশ্বাস না রাখিতে পার–তবে দীঘির জলে ডুবিয়া মর। আমি কমলমণি তর্কসিদ্ধান্ত ব্যবস্থা দিতেছি, তুমি দড়ি কলসী লইয়া জলে ডুবিয়া মরিতে পার। স্বামীর প্রতি যাহার বিশ্বাস রহিল না–তাহার মরাই মঙ্গল |”
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : অঙ্কুর
দিন কয় মধ্যে, ক্রমে ক্রমে নগেন্দ্রের সকল চরিত্র পরিবর্তিত হইতে লাগিল। নির্মল আকাশে মেঘ দেখা দিল–নিদাঘকালের প্রদোষাকাশের মত, অকস্মাৎ সে চরিত্র মেঘাবৃত হইতে লাগিল। দেখিয়া সূর্যমুখী গোপনে আপনার অঞ্চলে চক্ষু মুছিলেন।
সূর্যমুখী ভাবিলেন, “আমি কমলের কথা শুনিব। স্বামীর চিত্তপ্রতি কেন অবিশ্বাসিনী হইব? তাঁহার চিত্ত অচলপর্বত–আমিই ভ্রান্ত বোধ হয়। তাঁহার কোন ব্যামোহ হইয়া থাকিবে |” সূর্যমুখী বালির বাঁধ বাঁধিল।
বাড়ীতে একটি ছোট রকম ডাক্তার ছিল। সূর্যমুখী গৃহিণী। অন্তরালে থাকিয়া সকলের সঙ্গেই কথা কহিতেন। বারেণ্ডার পাশে এক চিক থাকিত; চিকের পশ্চাতে সূর্যমুখী থাকিতেন। বারেণ্ডায় সম্বোধিত ব্যক্তি থাকিত, মধ্যে এক দাসী থাকিত; তাহার মুখে সূর্যমুখী কথা কহিতেন। এইরূপে সূর্যমুখী ডাক্তারের সঙ্গে কথা কহিতেন। সূর্যমুখী তাহাকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবুর অসুখ হইয়াছে, ঔষধ দাও না কেন?”
ডাক্তার। কি অসুখ, তাহা ত আমি জানি না। আমি ত অসুখের কোন কথা শুনি নাই।
সূ। বাবু কিছু বলেন নাই?
ডা। না–কি অসুখ?
সূ। কি অসুখ, তাহা তুমি ডাক্তার, তুমি জান না –আমি জানি?
ডাক্তার সুতরাং অপ্রতিভ হইল। “আমি গিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছি,” এই বলিয়া ডাক্তার প্রস্থানের উদ্যোগ করিতেছিল, সূর্যমুখী তাহাকে ফিরাইলেন, বলিলেন, “বাবুকে কিছু জিজ্ঞাসা করিও না–ঔষধ দাও।”
ডাক্তার ভাবিল, মন্দ চিকিৎসা নহে। “যে আজ্ঞা, ঔষধের ভাবনা কি,” বলিয়া ডাক্তার পলায়ন করিল। পরে ডিস্পেন্সরিতে গিয়া একটু সোডা, একটু পোর্ট ওয়াইন, একটু সিরপফেরিমিউরেটিস, একটু মাথা মুণ্ড মিশাইয়া, শিশি পুরিয়া, টিকিট মারিয়া প্রত্যহ দুই বার সেবনের ব্যবস্থা লিখিয়া দিল। সূর্যমুখী ঔষধ খাওয়াইতে গেলেন; নগেন্দ্র শিশি হাতে লইয়া পড়িয় দেখিয়া বিড়ালকে ছুঁড়িয়া মারিলেন–বিড়াল পলাইয়া গেল–ঔষধ তাহার ল্যাজ দিয়া গড়িয়া পড়িতে পড়িতে গেল।
সূর্যমুখী বলিলেন “ঔষধ না খাও–তোমার কি অসুখ, আমাকে বল |”
নগেন্দ্র বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “কি অসুখ?”
সূর্যমুখী বলিলেন, “তোমার শরীর দেখ দেখি কি হইয়াছে?” এই বলিয়া সূর্যমুখী একখানি দর্পণ আনিয়া নিকটে ধরিলেন। নগেন্দ্র তাঁহার হাত হইতে দর্পণ লইয়া দূরে নিক্ষিপ্ত করিলেন। দর্পণ চূর্ণ হইয়া গেল।
সূর্যমুখীর চক্ষু দিয়া জল পড়িল। দেখিয়া নগেন্দ্র চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া উঠিয়া গেলেন। বহির্বাটী গিয়া একজন ভৃত্যকে বিনাপরাধে প্রহার করিলেন। সে প্রহার সূর্যমুখীর অঙ্গে বাজিল।
ইতিপূর্বে নগেন্দ্র অত্যন্ত শীতলস্বভাব ছিলেন। এখন কথায় কথায় রাগ।
শুধু রাগ নয়। একদিন, রাত্রে আহারের সময় অতীত হইয়া গেল, তথাপি নগেন্দ্র অন্ত:পুরে আসিলেন না। সূর্যমুখী প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া আছেন। অনেক রাত্রি হইল। অনেক রাত্রে নগেন্দ্র আসিলেন ; সূর্যমুখী দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। নগেন্দ্রের মুখ আরক্ত, চক্ষু আরক্ত নগেন্দ্র মদ্যপান করিয়াছেন। নগেন্দ্র কখন মদ্যপান করিতেন না। দেখিয়া সূর্যমুখী বিস্মিতা হইলেন।
সেই অবধি প্রত্যহ এইরূপ হইতে লাগিল। একদিন সূর্যমুখী, নগেন্দ্রের দুইটি চরণে হাত দিয়া গলদশ্রু কোনরূপে রুদ্ধ করিয়া, অনেক অনুনয় করিলেন ; বলিলেন, “কেবল আমার অনুরোধে ইহা ত্যাগ কর |” নগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, কি দোষ?”
জিজ্ঞাসার ভাবেই উত্তর নিবারণ হইল। তথাপি সূর্যমুখী উত্তর করিলেন, “দোষ কি, তাহা ত আমি জানি না। তুমি যাহা জান না, তাহা আমিও জানি না। কেবল আমার অনুরোধ |”
নগেন্দ্র প্রত্যুত্তর করিলেন, “সূর্যমুখী, আমি মাতাল, মাতালকে শ্রদ্ধা হয়, আমাকে শ্রদ্ধা করিও। নচেৎ আবশ্যক করে না |”
সূর্যমুখী ঘরের বাহিরে গেলেন। ভৃত্যের প্রহার পর্যন্ত নগেন্দ্রের সম্মুখে আর চক্ষের জল ফেলিবেন না, প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন।
দেওয়ানজী বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, “মা ঠাকুরাণীকে বলিও–বিষয় গেল, আর থাকে না |”
“কেন?”
“বাবু কিছু দেখেন না। সদর মফস্বলের আমলারা যাহা ইচ্ছা তাহা করিতেছে। কর্তার অমনোযোগে আমাকে কেহ মানে না |” শুনিয়া সূর্যমুখী বলিলেন, “যাঁহার বিষয়, তিনি রাখেন, থাকিবে। না হয়, গেল গেলই |”
ইতিপূর্বে নগেন্দ্র সকলই স্বয়ং তত্ত্বাবধান করিতেন।
একদিন তিন চারি হাজার প্রজা নগেন্দ্রের কাছারির দরওয়াজায় জোড়হাত করিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। “দোহাই হুজুর–নায়েব গোমস্তার দৌরাত্ম্যে আর বাঁচি না। সর্বস্ব কাড়িয়া লইল। আপনি না রাখিলে কে রাখে?”
নগেন্দ্র হুকুম দিলেন, “সব হাঁকায় দাও |”
ইতিপূর্বেই তাঁহার একজন গোমস্তা একজন প্রজাকে মারিয়া একটা টাকা লইয়াছিল। নগেন্দ্র গোমস্তার বেতন হইতে দশটি টাকা লইয়া প্রজাকে দিয়াছিলেন।
হরদেব ঘোষাল নগেন্দ্রকে লিখিলেন, “তোমার কি হইয়াছে? তুমি কি করিতেছ? আমি কিছু ভাবিয়া পাই না। তোমার পত্র ত পাইই না। যদি পাই, ত সে ছত্র দুই, তাহার মানে মাথা মুণ্ড, কিছুই নাই। তাতে কোন কথাই থাকে না। তুমি কি আমার উপর রাগ করিয়াছ? ত বল না কেন? মোকদ্দমা হারিয়াছ? তাই বা বল না কেন? আর কিছু বল না বল, শারীরিক ভাল আছ কি না বল |”
নগেন্দ্র উত্তর লিখিলেন, “আমার উপর রাগ করিও না–আমি অধ:পাতে যাইতেছি|”
হরদেব বড় বিজ্ঞ। পত্র পড়িয়া মনে করিলেন, “কি এ? অর্থচিন্তা? বন্ধুবিচ্ছেদ? দেবেন্দ্র দত্ত? না, এ প্রেম?”
কমলমণি সূর্যমুখীর আর একখানি পত্র পাইলেন। তাহার শেষ এই “একবার এসো! কমলমণি! ভগিনি! তুমি বই আর আমার সুহৃদ কেহ নাই। একবার এসো!”
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মহাসমর
কমলমণির আসন টলিল। আর তিনি থাকিতে পারিলেন না। কমলমণি রমণীরত্ন। অমনি স্বামীর কাছে গেলেন।
শ্রীশচন্দ্র অন্ত:পুরে বসিয়া, আপিসের আয়ব্যয়ের হিসাব কিতাব দেখিতেছিলেন। তাঁহার পাশে, বিছানায় বসিয়া, এক বৎসরের পুত্র সতীশচন্দ্র ইংরেজী সংবাদপত্রখানি অধিকার করিয়াছিলেন। সতীশচন্দ্র সংবাদপত্রখানি প্রথমে ভোজনের চেষ্টা দেখিয়াছিল, কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য হইতে না পারিয়া এক্ষণে পাতিয়া বসিয়াছিল।
কমলমণি স্বামীর নিকটে গিয়া গললগ্নীকৃতবাসা হইয়া, ভূমিষ্ঠা হইয়া প্রণাম করিলেন। এবং করজোড় করিয়া কহিলেন, “সেলাম পৌঁছে মহারাজ!”
(ইতিপূর্বেই বাড়ীতে গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রা হইয়া গিয়াছিল।)
শ্রীশচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “আবার শশা চুরি নাকি?”
ক। শশা কাঁকুড় নয়। এবার বড় ভারি জিনিস চুরি গিয়াছে।
শ্রী। কোথায় কি চুরি হলো?
ক। গোবিন্দপুরে চুরি হয়েছে। দাদাবাবুর একটি সোণার কৌটায় এক কড়া কাণা কড়ি ছিল, তাই কে নিয়া গিয়াছে।
শ্রীশ বুঝিতে না পারিয়া বলিলেন, “তোমার দাদাবাবুর সোণার কৌটা ত সূর্যমুখী –কাণা কড়িটি কি?”
ক। সূর্যমুখীর বুদ্ধিখানি।
শ্রীশচন্দ্র বলিলেন, “তাই লোকে বলে যে, যে খেলে, সে কাণা কড়িতে খেলে। সূর্যমুখী ঐ কাণা কড়িতেই তোমার ভাইকে কিনে রেখেছে–আর তোমার এতটা বুদ্ধি থাকিতেও ভাই___” কমলমণি শ্রীশচন্দ্রের মুখ টিপিয়া ধরিলেন। ছাড়িয়া দিলে শ্রীশ বলিলেন, “তা কাণা কড়িটি চুরি করলে কে?”
ক। তা ত জানি না–কিন্তু তার পত্র পড়িয়া বুঝিলাম যে, সে কাণা কড়িটি খোওয়া গিয়াছে–নহিলে মাগী এমন পত্র লিখিবে কেন?
শ্রী। পত্রখানি দেখিতে পাই?
কমলমণি শ্রীশচন্দ্রের হাতে সূর্যমুখীর পত্র দিয়া কহিলেন, “এই পড়। সূর্যমুখী তোমাকে এ সকল কথা বলিতে মানা করিয়াছে–কিন্তু যতক্ষণ তোমাকে সব না বলিতেছি, ততক্ষণ আমার প্রাণ খাবি খেতেছে। তোমাকে পত্র না পড়াইলে আহার নিদ্রা হইবে না–ঘুরণী রোগই বা উপস্থিত হয়।”
শ্রীশচন্দ্র পত্র হস্তে লইয়া চিন্তা করিয়া বলিলেন, “যখন তোমাকে নিষেধ করিয়াছে, তখন আমি এ পত্র দেখিব না। কথাটা কি, তা শুনিতেও চাহিব না। এখন কি করিতে হইবে কি, তাই বল |”
ক। করতে হবে এই–সূর্যমুখীর বুদ্ধিটুকু গিয়াছে, তার একটু বুদ্ধি চাই। বুদ্ধি দেয় এমন লোক আর কে আছে–বুদ্ধি যা কিছু আছে, তা সতীশ বাবুর। তাই সতীশ বাবুকে একবার গোবিন্দপুর যেতে তার মামী লিখে পাঠিয়েছে।
সতীশ বাবু ততক্ষণ একটা ফুলদানি ফুলসমেত উল্টাইয়া ফেলিয়াছিলেন, এবং তৎপরে দোয়াতের উপর নজর করিতেছিলেন। দেখিয়া শ্রীশচন্দ্র কহিলেন, “উপযুক্ত বুদ্ধিদাতা বটে। তা যাহা হোক, এতক্ষণে বুঝিলাম–ভাজের বাড়ী মশায়ের নিমন্ত্রণ। সতীশকে যেতে হলেই সুতরাং কমলমণিও যাবে। তা সূর্যমুখীর কাণা কড়িটি না হারালে আর এমন কথা লিখবে কেন?”
ক। শুধু কি তাই? সতীশের নিমন্ত্রণ ; আমার নিমন্ত্রণ আর তোমার নিমন্ত্রণ।
শ্রী। আমার নিমন্ত্রণ কেন?
ক। আমি বুঝি একা যাব? আমাদের সঙ্গে গাড়ু গামছা নিয়ে যায় কে?
শ্রী। এ সূর্যমুখীর বড় অন্যায়। শুধু গাড়ু গামছা বহিবার জন্য যদি ঠাকুরজামাইকে দরকার হয়, তবে আমি দুদিনের জন্য একটা ঠাকুরজামাই দেখিয়ে দিতে পারি।
কমলমণির বড় রাগ হইল। সে ভ্রূকুটি করিল, শ্রীশকে ভেঙ্গাইল, এবং শ্রীশচন্দ্র যে কাগজখানায় লিখিতেছিল, তাই ছিঁড়িয়া ফেলিল। শ্রীশ হাসিয়া বলিল, “তা লাগতে এসো কেন?”
কমলমণি কৃত্রিম কোপসহকারে কহিল, “আমার খুসি, লাগবো |”
শ্রীশচন্দ্রও কৃত্রিম কোপসহকারে কহিলেন, “আমার খুসি, বলবো |”
তখন কোপযুক্তা কমলমণি শ্রীশকে একটি কিল দেখাইল। কুন্দদন্তে অধর টিপিয়া ছোট হাতে একটি ছোট কিল দেখাইল।
কিল দেখিয়া, শ্রীশচন্দ্র কমলমণির খোঁপা খুলিয়া দিলেন। এখন বর্ধিতরোষা কমলমণি, শ্রীশচন্দ্রের দোয়াতের কালি পিকদানিতে ঢালিয়া ফেলিয়া দিল।
রাগে শ্রীশচন্দ্র দ্রুতগতিতে ধাবমান হইয়া কমলমণির মুখচুম্বন করিলেন। রাগে কমলমণিও অধীরা হইয়া শ্রীশচন্দ্রের মুখচুম্বন করিল। দেখিয়া সতীশচন্দ্রের বড় প্রীতি জন্মিল। তিনি জানিতেন যে, মুখচুম্বন তাঁহার ইজারা মহল। অতএব তাহার ছড়াছড়ি দেখিয়া রাজভাগ আদায়ের অভিলাষে মার জানু ধরিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন; এবং উভয়েই মুখপানে চাহিয়া উচ্চৈ:স্বরে হাসির লহর তুলিলেন। সে হাসি কমলমণির কর্ণে কি মধুর বাজিল! কমলমণি তখন সতীশকে ক্রোড়ে উঠাইয়া লইয়া ভূরি ভূরি মুখচুম্বন করিল। পরে শ্রীশচন্দ্র কমলের ক্রোড় হইতে তাহাকে লইলেন এবং ভূরি ভূরি মুখচুম্বন করিলেন। সতীশ বাবু এইরূপে রাজভাগ আদায় করিয়া যথাকালে অবতরণ করিলেন, এবং পিতার সুবর্ণময় পেনসিলটি দেখিতে পাইয়া অপহরণমানসে ধাবমান হইলেন। পরে হস্তগত করিয়া উপাদেয় ভোজ্য বিবেচনায় পেনসিলটি মুখে দিয়া লেহন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকালে ভগদত্ত এবং অর্জুনে ঘোরতর যুদ্ধ হয়। ভগদত্ত অর্জুন প্রতি অনিবার্য বৈষ্ণবাস্ত্র নিক্ষেপ করেন ; অর্জুনকে তন্নিবারণে অক্ষম জানিয়া শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বক্ষ পাতিয়া সেই অস্ত্র গ্রহণ করিয়া তাহার শমতা করেন। সেইরূপ, কমলমণি ও শ্রীশচন্দ্রের এই বিষম যুদ্ধে, সতীশচন্দ্র মহাস্ত্র সকল আপন বদনমণ্ডলে গ্রহণ করায় যুদ্ধের শমতা হইল। কিন্তু ইহাদের এইরূপ সন্ধিবিগ্রহ বাদলের বৃষ্টির মত–দণ্ডে দণ্ডে হইত, দণ্ডে দণ্ডে যাইত।
শ্রীশচন্দ্র তখন কহিলেন, “তা সত্যসত্যই কি তোমার গোবিন্দপুরে যেতে হবে? আমি একা থাকিব কি প্রকারে?”
ক। তোমায় যেন আমি একা থাকিতে সাধিতেছি। আমিও যাব, তুমিও যাবে। তা যাও, সকাল সকাল আপিস সারিয়া আইস, আর দেরি কর ত, সতীশে আমাতে দু-দিকে দুই জনে কাঁদতে বসবো।
শ্রী। আমি যাই কি প্রকারে? আমাদের এই তিসি কিনিবার সময়। তুমি তবে একা যাও।
ক। আয়, সতীশ! আয়, আমরা দুজনে দুই দিকে কাঁদতে বসি।
মার আদরের ডাক সতীশের কাণে গেল–সতীশ অমনি পেনসিলভোজন ত্যাগ করিয়া লহর তুলিয়া আহ্লাদের হাসি হাসিল, সুতরাং কমলের এবার কাঁদা হলো না। তৎপরিবর্তে সতীশের মুখচুম্বন করিলেন,-দেখাদেখি শ্রীশও তাহাই করিলেন। সতীশ আপনার বাহাদুরি দেখাইয়া আর এক লহর তুলিয়া হাসিল। এই সকল বৃহৎ ব্যাপার সমাধা হইলে কমল আবার কহিলেন, “এখন কি হুকুম হয়?”
শ্রী। তুমি যাও, মানা করি না, কিন্তু তিসির মরসুমটায় আমি কি প্রকারে যাই?
শুনিয়া কমলমণি মুখ ফিরাইয়া মানে বসিলেন। আর কথা কহেন না।
শ্রীশচন্দ্রের কলমে একটু কালি ছিল। শ্রীশ সেই কলম লইয়া পশ্চাৎ হইতে গিয়া কমলের কপালে একটি টিপ কাটিয়া দিলেন।
তখন কমল হাসিয়া বলিলেন, “প্রাণাধিক, আমি তোমায় কত ভালবাসি |” এই বলিয়া, কমল শ্রীশচন্দ্রের স্কন্ধ বাহু দ্বারা বেষ্টন করিয়া, তাঁহার মুখচুম্বন করিলেন, সুতরাং টিপের কালি, সমুদায়টাই শ্রীশের গালে গিয়া লাগিয়া রহিল।
এইরূপে এবারকার যুদ্ধে জয় হইলে পর, কমল বলিলেন, “যদি তুমি একান্তই যাইবে না, তবে আমার যাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দাও।”
শ্রী। ফিরিবে কবে?
ক। জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন? তুমি যদি গেলে না, তবে আমি কয় দিন থাকিতে পারিব?
শ্রীশচন্দ্র কমলমণিকে গোবিন্দপুরে পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু আমরা নিশ্চিত সংবাদ রাখি যে, সেবার শ্রীশচন্দ্রের সাহেবেরা তিসির কাজে বড় লাভ করিতে পারেন নাই। হৌসের কর্মচারীরা আমাদিগের নিকট গোপনে বলিয়াছ যে, সে শ্রীশ বাবুরই দোষ। তিনি ঐ সময়টা কাজকর্মে বড় মন দেন নাই। কেবল ঘরে বসিয়া কড়ি গুণিতেন। এ কথা শ্রীশচন্দ্র একদিন শুনিয়া বলিলেন, “হবেই ত! আমি তখন লক্ষ্মীছাড়া হইয়াছিলাম |” শ্রোতারা শুনিয়া মুখ ফিরাইয়া বলিল, “ছি! বড় স্ত্রৈণ!” কথাটা শ্রীশের কাণে গেল। তিনি শুনিয়া হৃষ্টমনে ভৃত্যদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, “ওরে, ভাল করিয়া আহারের উদ্যোগ কর। বাবুরা আজ এখানে আহার করিবেন |”
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ধরা পড়িল
গোবিন্দপুরে দত্তদিগের বাড়ীতে যেন অন্ধকারে একটি ফুল ফুটিল। কমলমণির হাসিমুখ দেখিয়া সূর্যমুখীরও চক্ষের জল শুকাইল। কমলমণি বাড়ীতে পা দিয়াই সূর্যমুখীর চুলের গোছা লইয়া বসিয়া গেলেন। অনেক দিন সূর্যমুখী কেশরচনা করেন নাই। কমলমণি বলিলেন, “দুটো ফুল গুঁজিয়া দিব?” সূর্যমুখী তাঁহার গাল টিপিয়া ধরিলেন। “না! না!” বলিয়া কমলমণি লুকাইয়া দুইটা ফুল দিয়া দিলেন। লোক আসিলে বলিলেন, “দেখেছ, মাগী বুড়া বয়সে মাথায় ফুল পরে |”
আলোকময়ীর আলো নগেন্দ্রের মুখমণ্ডলের মেঘেও ঢাকা পড়িল না। নগেন্দ্রকে দেখিয়াই কমলমণি ঢিপ করিয়া প্রণাম করিল। নগেন্দ্র বলিলেন, “কমল কোথা থেকে?” কমল মুখ নত করিয়া, নিরীহ ভাল মানুষের মত বলিলেন, “আজ্ঞে, খোকা ধরিয়া আনিল |” নগেন্দ্র বলিলেন, “বটে! মার পাজিকে!” এই বলিয়া খোকাকে কোলে লইয়া দণ্ডস্বরূপ তাহার মুখচুম্বন করিলেন। খোকা কৃতজ্ঞ হইয়া তাঁহার গায়ে লাল দিল, আর গোঁপ ধরিয়া টানিল।
কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে কমলমণির ঐরূপ আলাপ হইল,-“ওলো কুঁদী–কুঁদী মুদী দুঁদী–ভাল আছিস ত কুঁদী?”
কুঁদী অবাক হইয়া রহিল। কিছুকাল ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিল, “আছি|”
“আছি দিদি–আমায় দিদি বলবি–না বলিস ত ঘুমিয়া থাকিবি আর তোর চুলে আগুন ধরিয়ে দিব। আর নহিলে গায়ে আরসুলো ছাড়িয়া দিব |”
কুন্দ দিদি বলিতে আরম্ভ করিল। যখন কলিকাতায় কুন্দ কমলের কাছে থাকিত, তখন কমলকে কিছু বলিত না। বড় কথাও কহিত না। কিন্তু কমলের যে প্রকৃতি চিরপ্রেমময়ী, তাহাতে সে তখন হইতেই তাঁহাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়াছিল। মধ্যে কয় বৎসর অদর্শনে কতক কতক ভুলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু এক্ষণে কমলের স্বভাবগুণে, কুন্দেরও স্বভাবগুণে, সেই ভালবাসা নূতন হইয়া বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।
প্রণয় গাঢ় হইল। এদিকে কমলমণি স্বামীর গৃহে যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন; সূর্যমুখী বলিলেন, “না ভাই! আর দু-দিন থাক! তুমি গেলে আমি আর বাঁচিব না। তোমার কাছে সকল কথা বলাও সোয়াস্তি|” কমল বলিলেন, “তোমার কাজ না করিয়া যাইব না |” সূর্যমুখী বলিলেন, “আমার কি কাজ করিবে?” কমলমণি মুখে বলিলেন, “তোমার শ্রাদ্ধ,” মনে বলিলেন, “তোমার কণ্টকোদ্ধার |”
কুন্দনন্দিনী কমলের যাওয়ার কথা শুনিয়া আপন ঘরে গিয়া লুকাইয়া কাঁদিল, কমলমণি লুকাইয়া লুকাইয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ গেল। কুন্দনন্দিনী বালিসে মাথা দিয়া কাঁদিতেছে, কমলমণি তাহার চুল বাঁধিতে বসিল। চুল বাঁধা কমলের একটা রোগ।
চুল বাঁধা সমাপ্ত হইলে, কুন্দের মাথা তুলিয়া, কমল তাহার মস্তক আপনার কোলে রাখিলেন। অঞ্চল দিয়া তাহার চক্ষু মুছাইয়া দিলেন। এই সব কাজ শেষ করিয়া, শেষে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুঁদি, কাঁদিতেছিলি কেন?”
কুন্দ বলিল, “তুমি যাবে কেন?”
কমলমণি একটু হাসিলেন। কিন্তু ফোঁটা দুই চক্ষের জল সে হাসি মানিল না–না বলিয়া কহিয়া তাহারা কমলমণির গণ্ড বহিয়া হাসির উপর আসিয়া পড়িল। রৌদ্রের উপর বৃষ্টি হইল।
কমলমণি বলিলেন, “তাতে কাঁদিস কেন?”
কু। তুমিই আমায় ভালবাস।
ক। কেন–আর কেহ কি ভালবাসে না?
কুন্দ চুপ করিয়া রহিল।
ক। কে ভালবাসে না? গিন্নী ভালবাসে না–না? আমায় লুকুস নে।
কুন্দ নীরব।
ক। দাদাবাবু ভালবাসে না?
কুন্দ নীরব।
কমল বলিলেন, “যদি আমি তোমায় ভালবাসি–আর তুমি আমায় ভালবাস, তবে কেন আমার সঙ্গে চল না?”
কুন্দ তথাপি কিছু বলিল না। কমল বলিলেন, “যাবে?” কুন্দ ঘাড় নাড়িল। “যাব না |”
কমলের প্রফুল্ল মুখ গম্ভীর হইল।
তখন কমলমণি সস্নেহে কুন্দনন্দিনীর মস্তক বক্ষে তুলিয়া লইয়া ধারণ করিলেন, এবং সস্নেহে তাহার গণ্ডদেশ গ্রহণ করিয়া কহিলেন, “কুন্দ, সত্য বলিবি?”
কুন্দ বলিল, “কি?”
কমল বলিলেন, “যা জিজ্ঞাসা করিব? আমি তোর দিদি–আমার কাছে লুকুস নে–আমি কাহারও কাছে বলিব না |” কমল মনে মনে রাখিলেন, “যদি বলি ত রাজমন্ত্রী শ্রীশ বাবুকে। আর খোকার কাণে কাণে |”
কুন্দ বলিল, “কি বল?”
ক। তুই দাদাবাবুকে বড় ভালবাসিস।-না?”
কুন্দ উত্তর দিল না। কমলমনির হৃদয়মধ্যে মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
কমল বলিলেন, “বুঝিছি–মরিয়াছ। মর তাতে ক্ষতি নাই–কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনেকে মরে যে?”
কুন্দনন্দিনী মস্তক উত্তোলন করিয়া কমলের মুখপ্রতি স্থিরদৃষ্টি করিয়া রহিল। কমলমণি প্রশ্ন বুঝিলেন। বলিলেন, “পোড়ারমুখি চোখের মাথা খেয়েছ? দেখিতে পাও না যে __” মুখের কথা মুখে কথা রহিল–তখন ঘুরিয়া কুন্দের উন্নত মস্তক আবার কমলমণির বক্ষের উপর পড়িল। কুন্দনন্দিনীর অশ্রুজলে কমলমণির হৃদয় প্লাবিত হইল। কুন্দনন্দিনী অনেকক্ষণ নীরবে কাঁদিল–বালিকার ন্যায় বিবশা হইয়া কাঁদিল। সে কাঁদিল, আবার পরের চক্ষের জলে তাহার চুল ভিজিয়া গেল।
ভালবাসা কাহাকে বলে, সোণার কমল তাহা জানিত। অন্ত:করণের অন্ত:করণ মধ্যে কুন্দনন্দিনীর দু:খে দু:খী, সুখে সুখী হইল। কুন্দনন্দিনীর চক্ষু মুছাইয়া কহিল, “কুন্দ!”
কুন্দ আবার মাথা তুলিয়া চাহিল।
ক। আমার সঙ্গে চল।
কুন্দের চক্ষে আবার জল পড়িতে লাগিল। কমল বলিল, “নহিলে নয়।-সোণার সংসার ছারখার গেল |”
কুন্দ কাঁদিতে লাগিল। কমল বলিলেন, “যাবি? মনে করিয়া দেখ?__”
কুন্দ অনেকক্ষণ পরে চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, “যাব |”
অনেকক্ষণ পরে কেন? তাহা কমল বুঝিল। বুঝিল যে, কুন্দনন্দিনী পরের মঙ্গলমন্দিরে আপনার প্রাণের প্রাণ বলি দিল। নগেন্দ্রের মঙ্গলার্থ, সূর্যমুখীর মঙ্গলার্থ, নগেন্দ্রকে ভুলিতে স্বীকৃত হইল। সেই জন্য অনেকক্ষণ লাগিল। আপনার মঙ্গল? কমল বুঝিয়াছিলেন যে, কুন্দনন্দিনী আপনার মঙ্গল বুঝিতে পারে না।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : হীরা
এমত সময়ে হরিদাসী বৈষ্ণবী আসিয়া গান করিল।
“কাঁটা বনে তুলতে গেলাম কলঙ্কের ফুল,
গো সখি কাল কলঙ্কেরি ফুল।
মাথায় পরলেম মালা গেঁথে, কাণে পরলেম দুল।
সখি কলঙ্কেরি ফুল |”
এ দিন সূর্যমুখী উপস্থিত। তিনি কমলকে গান শুনিতে ডাকিতে পাঠাইলেন। কমল কুন্দকে সঙ্গে করিয়া গান শুনিতে আসিলেন। বৈষ্ণবী গায়িতে লাগিল।
“মরি মরব কাঁটা ফুটে,
ফুলের মধু খাব লুটে,
খুঁজে বেড়াই কোথায় ফুটে,
নবীন মুকুল |”
কমলমণি ভ্রূভঙ্গী করিয়া বলিলেন, “বৈষ্ণবী দিদি–তোমার মুখে ছাই পড়ুক–আর তুমি মর। আর কি গান জান না?”
হরিদাসী বলিল, “কেন?” কমলের আরও রাগ বাড়িল ; বলিলেন, “কেন? একটা বাবলার ডাল আন ত রে–কাঁটাফোটা কত সুখ মাগীকে দেখিয়ে দিই |”
সূর্যমুখী মৃদুভাবে হরিদাসীকে বলিলেন, “ও সব গান আমাদের ভাল লাগে না।–গৃহস্থবাড়ী ভাল গান গাও।”
হরিদাসী বলিল, “আচ্ছা |” বলিয়া গায়িতে আরম্ভ করিল,
“স্মৃতিশাস্ত্র পড়ব আমি ভট্টাচার্যের পায়ে ধরে।
ধর্মাধর্ম শিখে নিব, কোন্ বেটী বা নিন্দে করে ||”
কমল ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, “গিন্নী মশাই–তোমার প্রবৃত্ত হয়, তোমার বৈষ্ণবীর গান তুমিই শোন, আমি চলিলাম |” এই বলিয়া কমল চলিয়া গেলেন–সূর্যমুখীও মুখ অপ্রসন্ন করিয়া উঠিয়া গেলেন। আর আর স্ত্রীলোকেরা আপন আপন প্রবৃত্তি মতে কেহ উঠিয়া গেল, কেহ রহিল ; কুন্দনন্দিনী রহিল। তাহার কারণ, কুন্দনন্দিনী গানের মর্ম কিছুই বুঝিতে পারে নাই–বড় শুনেও নাই–অন্যমনে ছিল, এই জন্য যেখানকার সেইখানে রহিল। হরিদাসী তখন আর গান করিল না। এদিক সেদিক বাজে কথা আরম্ভ করিল। গান আর হইল না দেখিয়া আর সকলে উঠিয়া গেল। কুন্দ কেবল উঠিল না–চরণে তাহার গতিশক্তি ছিল কি না সন্দেহ। তখন কুন্দকে বিরলে পাইয়া হরিদাসী তাহাকে অনেক কথা বলিল। কুন্দ কতক বা শুনিল, কতক বা শুনিল না।
সূর্যমুখী ইহা সকলই দূর হইতে দেখিতেছিলেন। যখন উভয়ে গাঢ় মন:সংযোগের সহিত কথাবার্তা হওয়ার চিহ্ন দেখিলেন, তখন সূর্যমুখী কমলকে ডাকিয়া দেখাইলেন। কমল বলিল, “কি তা? কথা কহিতেছে কহুক না। মেয়ে বই ত আর পুরুষ না |”
সূ। মেয়ে কি পুরুষ তার ঠিক কি?
কমল বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “সে কি?”
সূ। আমার বোধ হয় কোন ছদ্মবেশী পুরুষ। তাহা এখনই জানিব–কিন্তু কুন্দ কি পাপিষ্ঠা!
“রসো। আমি একটা বাবলার ডাল আনি। মিন্সেকে কাঁটা ফোটার সুখটা দেখাই |” এই বলিয়া কমল বাবলার ডালের সন্ধানে গেলেন। পথে সতীশের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল–সতীশ মামীর সিন্দূরকৌটা অধিকার করিয়া বসিয়া ছিলেন–এবং সিন্দূর লইয়া আপনার গালে, নাকে, দাড়িতে, বুকে, পেটে বিলক্ষণ করিয়া অঙ্গরাগ করিতেছিলেন–দেখিয়া কমল, বৈষ্ণবী, বাবলার ডাল, কুন্দনন্দিনী প্রভৃতি সব ভুলিয়া গেলেন।
তখন সূর্যমুখী হীরা দাসীকে ডাকাইলেন।
হীরার নাম একবার উল্লেখ হইয়াছে। তাহার কিছু বিশেষ পরিচয় আবশ্যক।
নগেন্দ্র এবং তাঁহার পিতার বিশেষ যত্ন ছিল যে, গৃহের পরিচারিকারা বিশেষ সৎস্বভাববিশিষ্টা হয়। এই অভিপ্রায়ে, উভয়েই পর্যাপ্ত বেতনদান স্বীকার করিয়া, একটু ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকগণকে দাসীত্বে নিযুক্ত করিতে চেষ্টা পাইতেন। তাঁহাদিগের গৃহে পরিচারিকা সুখে ও সম্মানে থাকিত, সুতরাং অনেক দারিদ্র্যগ্রস্ত ভদ্রলোকের কন্যারা তাঁহাদের দাসীবৃত্তি স্বীকার করিত। এই প্রকার যাহারা ছিল, তাহাদের মধ্যে হীরা প্রধানা। অনেকগুলি পরিচারিকা কায়স্থকন্যা–হীরাও কায়স্থ। নগেন্দ্রের পিতা হীরার মাতামহীকে গ্রামান্তর হইতে আনয়ন করেন। প্রথমে তাহার মাতামহীই পরিচর্যায় নিযুক্ত হইয়াছিল–হীরা তখন বালিকা, মাতামহীর সঙ্গে আসিয়াছিল। পরে হীরা সমর্থা হইলে প্রাচীনা দাসীবৃত্তি ত্যাগ করিয়া আপন সঞ্চিত ধনে একটি সামান্য গৃহ নির্মাণ করিয়া গোবিন্দপুরে বাস করিল– হীরা দত্তগৃহে চাকরী করিতে প্রবৃত্ত হইল।
এক্ষণে হীরার বয়স বিংশতি বৎসর। বয়সে সে প্রায় অন্যান্য দাসীগণ অপেক্ষা কনিষ্ঠা। তাহার বুদ্ধির প্রভাবে এবং চরিত্রগুণে সে দাসীমধ্যে শ্রেষ্ঠা বলিয়া গণিত হইয়াছিল।
হীরা বাল্যবিধবা বলিয়া গোবিন্দপুরে পরিচিতা। কেহ কখন তাহার স্বামীর কোন প্রসঙ্গ শুনে নাই। কিন্তু হীরার চরিত্রেও কেহ কোন কলঙ্ক শুনে নাই। তবে হীরা অত্যন্ত মুখরা, সধবার ন্যায় বেশবিন্যাস করিত, এবং বেশবিন্যাসে বিশেষ প্রীতা ছিল।
হীরা আবার সুন্দরী–উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গী, পদ্মপলাশলোচনা। দেখিতে খর্বাকৃতা ; মুখখানি যেন মেঘঢাকা চাঁদ ; চুলগুলি যেন সাপ ফণা ধরিয়া ঝুলিয়া রহিয়াছে। হীরা আড়ালে বসে গান করে ; দাসীতে দাসীতে ঝগড়া বাধাইয়া তামাসা দেখে ; পাচিকাকে অন্ধকারে ভয় দেখায় ; ছেলেদের বিবাহের আবদার করিতে শিখাইয়া দেয় ; কাহাকে নিদ্রিত দেখিলে চূণ কালি দিয়া সং সাজায়।
কিন্তু হীরার অনেক দোষ। তাহা ক্রমে জানা যাইবে। আপাতত: বলিয়া রাখি, হীরা আতর গোলাপ দেখিলেই চুরি করে।
সূর্যমুখী হীরাকে ডাকিয়া কহিলেন, “ঐ বৈষ্ণবীকে চিনিস?”
হী। না। আমি কখন পাড়ার বাহির হই না। -আমি বৈষ্ণবী ভিখারী কিসে চিনিব? ঠাকুরবাড়ীর মাগীদের ডেকে জিজ্ঞাসা কর না। করুণা কি শীতলা জানিতে পারে।
সূ। এ ঠাকুরবাড়ীর বৈষ্ণবীর নয়। এ বৈষ্ণবী কে, তোকে জানতে হবে। এ বৈষ্ণবীই বা কে, আর বাড়ীই বা কোথায়? আর কুন্দের সঙ্গে এত ভাবই বা কেন? এই সকল কথা যদি ঠিক জেনে এসে বলিতে পারিস, তবে তোকে নূতন বারাণসী পরাইয়া সং দেখিতে পাঠাইয়া দিব।
নূতন বারাণসীর কথা শুনিয়া হীরার পাঁচ হাত বুক হইল, জিজ্ঞাসা করিল, “কখন জানিতে যেতে হবে?”
সূ। তোর যখন খুসি। কিন্তু এখনও ওর পাছু পাছু না গেলে ঠিকানা পাবি না।
হী। আচ্ছা।
সূ। কিন্তু দেখিস যেন বৈষ্ণবী কিছু বুঝিতে না পারে। আর কেহ কিছু বুঝিতে না পারে।
এমত সময়ে কমল ফিরিয়া আসিল। সূর্যমুখী তাঁহাকে পরামর্শের কথা সব বলিলেন। শুনিয়া কমল খুসি হইলেন। হীরাকে বলিলেন, “আর পারিস ত মাগীকে দুটো বাবলার কাঁটা ফুটিয়ে দিয়ে আসিস!”
হীরা বলিল, “সব পারিব, কিন্তু শুধু বারাণসী নিব না |”
সূ। কি নিবি?
কমল বলিল, “ও একটি বর চায়। ওর একটি বিয়ে দাও|”
সূ। আচ্ছা, তাই হবে–জামাই বাবুকে মনে ধরে? বল তা হলে কমল সম্বন্ধ করে।
হী। তবে দেখবো। কিন্তু আমার মনের মত ঘরে একটি বর আছে।
সূ। কে লো?
হী। যম।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ : “না”
সেই দিন প্রদোষকালে উদ্যানমধ্যস্থ বাপীতটে বসিয়া কুন্দনন্দিনী। এই দীর্ঘিকা অতি সুবিস্তৃতা; তাহার জল অতি পরিষ্কার এবং সর্বদা নীলপ্রভ। পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে, এই পুষ্করিণীর পশ্চাতে পুষ্পোদ্যান। পুষ্পোদ্যানমধ্যে এক শ্বেতপ্রস্তররচিত লতামণ্ডপ ছিল। সেই লতামণ্ডপের সম্মুখেই পুষ্করিণীতে অবতরণ করিবার সোপান। সোপান প্রস্তরবৎ ইষ্টকে নির্মিত, অতি প্রশস্ত এবং পরিষ্কার। তাহার দুই ধারে, দুইটি বহুকালের বড় বকুল গাছ। সেই বকুলের তলায়, সোপানের উপরে কুন্দনন্দিনী, অন্ধকার প্রদোষে একাকিনী বসিয়া স্বচ্ছ সরোবরহৃদয়ে প্রতিফলিত নক্ষত্রাদিসহিত আকাশপ্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। কোথাও কতকগুলি লাল ফুল অন্ধকারে অস্পষ্ট লক্ষ্য হইতেছিল। দীর্ঘিকার অপর তিন পার্শ্বে, আম্র, কাঁটাল, জাম, লেবু, লিচু নারিকেল, কুল, বেল প্রভৃতি ফলবান ফলের গাছ, ঘনশ্রেণীবদ্ধ হইয়া অন্ধকারে অসমশীর্ষ প্রাচীরবৎ দৃষ্ট হইতেছিল। কদাচিৎ তাহার শাখায় বসিয়া মাচাড় পাখী বিকট রব করিয়া নি:শব্দ সরোবরকে শব্দিত করিতেছিল। শীতল বায়ু, সরোবর পার হইয়া ইন্দীবরকোরককে ঈষন্মাত্র বিধূত করিয়া, আকাশচিত্রকে স্বল্পমাত্র কম্পিত করিয়া কুন্দনন্দিনীর শির:স্থ বকুলপত্রমালায় মর্মর শব্দ করিতেছিল এবং নিদাঘপ্রস্ফুটিত বকুল পুষ্পের গন্ধ চারি দিকে বিকীর্ণ করিতেছিল। বকুল পুষ্প সকল নি:শব্দে কুন্দনন্দিনীর অঙ্গে এবং চারি দিকে ঝরিয়া পড়িতেছিল। পশ্চাৎ হইতে অসংখ্য মল্লিকা, যূথিকা এবং কামিনীর সুগন্ধ আসিতেছিল। চারিদিকে, অন্ধকারে, খদ্যোতমালা স্বচ্ছ বারির উপর উঠিতেছিল, পড়িতেছিল, ফুটিতেছিল, নিবিতেছিল। দুই একটা বাদুড় ডাকিতেছে–দুই একটা শৃগাল অন্য পশু তাড়াইবার তাহাদিগের যে শব্দ, সেই শব্দ করিতেছে– দুই একখানা মেঘ আকাশে পথ হারাইয়া বেড়াইতেছে– দুই একটা তারা মনের দু:খে খসিয়া পড়িতেছে। কুন্দনন্দিনী মনের দু:খে ভাবিতেছেন। কি ভাবনা ভাবিতেছেন? এইরূপ;-“ভাল, সবাই আগে মলো–মা মলো, দাদা মলো, বাবা মলো, আমি মলেম না কেন? যদি না মলেম ত এখানে এলাম কেন? ভাল, মানুষ কি মরিয়া নক্ষত্র হয়?” পিতার পরলোকযাত্রার রাত্রে কুন্দ যে স্বপ্ন দেখিয়াছিল, কুন্দের আর তাহা কিছুই মনে ছিল না; কখনও মনে হইত না; এখনও তাহা মনে হইল না। কেবল আভাসমাত্র মনে আসিল। এইমাত্র মনে হইল, যেন সে কবে মতাকে স্বপ্ন দেখিয়াছিল, তাহার মা যেন, তাহাকে নক্ষত্র হইতে বলিয়াছেন। কুন্দ ভাবিতে লাগিল, “ভাল, মানুষ মরিলে কি নক্ষত্র হয়? তা হলে ত বাবা, মা, সবাই নক্ষত্র হইয়াছেন? তবে তাঁরা কোন্ নক্ষত্রগুলি? ঐটি? না ঐটি? কোন্টি কে? কেমন করিয়া জানিব? তা যেটিই যিনি হউন, আমায় ত দেখতে পেতেছেন? আমি যে এত কাঁদি–তা দূরে হউক, ও আর ভাবি না–বড় কান্না পায়। কেঁদে কি হবে? আমার ত কপালে কান্নাই আছে–নহিলে মা–আবার ঐ কথা! দূর হউক–ভাল, মরিলে হয় না? কেমন করিয়া? জলে ডুবিয়া? বেশ ত! মরিলে নক্ষত্র হব–তা হলে হব ত? দেখিতে পাব–রোজ রোজ দেখিতে পাব–কাকে? কাকে, মুখে বলিতে পারি নে কি? আচ্ছা, নাম মুখে আনিতে পারি নে কেন? এখন ত কেহ নাই–কেহ শুনিতে পাবে না। একবার মুখে আনিব? কেহ নাই–মনের সাধে নাম করি।ন–নগ–নগেন্দ্র! নগেন্দ্র, নগেন্দ্র,নগেন্দ্র, নগেন্দ্র, নগেন্দ্র। নগেন্দ্র আমার নগেন্দ্র! আলো! আমার নগেন্দ্র? আমি কে? সূর্যমুখীর নগেন্দ্র। কতই নাম করিতেছি–হলেম কি? আচ্ছা সূর্যমুখীর সঙ্গে বিয়ে না হয়ে যদি আমার–সঙ্গে হতো–দূর হউক–ডুবেই মরি। আচ্ছা, যেন এখন ডুবিলাম–কাল ভেসে উঠবো–তবে সবাই শুনবে, শুনে নগেন্দ্র–নগেন্দ্র! –নগেন্দ্র! –নগেন্দ্র! আবার বলি–নগেন্দ্র নগেন্দ্র নগেন্দ্র! -নগেন্দ্র শুনে কি বলিবেন? ডুবে মরা হবে না–ফুলে পড়িয়া থাকিব–দেখিতে রাক্ষসীর মত হব। যদি তিনি দেখেন? বিষ খেয়ে ত মরিতে পারি? কি বিষ খাব? বিষ কোথা পাব–কে আমায় এনে দিবে? দিলে যেন–মরিতে পারিব কি? পারি–কিন্তু আজি না– একবার আকাঙ্ক্ষা ভরিয়া মনে করি–তিনি আমায় ভালবাসেন। কমল কি কথাটি বলতে বলতে বলিল না? সে ঐ কথাই। আচ্ছা, সে কথা সত্য?–কিন্তু কমল জানিবে কিসে? আমি পোড়ারমুখী জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না। ভালবাসেন? কিসে ভালবাসেন? কি দেখে ভালবাসেন, রূপ না গুণ? রূপ–দেখি?” (এই কহিয়া কালামুখী স্বচ্ছ সরোবরে আপনার প্রতিবিম্ব দেখিতে গেল, কিন্তু কিছুতেই দেখিতে না পাইয়া আবার পূর্বস্থানে আসিয়া বলিল) “দূর হউক, যা নয় তা ভাবি কেন? আমার চেয়ে সূর্যমুখী সুন্দর; আমার চেয়ে হরমণি সুন্দর; বিশু সুন্দর; মুক্ত সুন্দর; ‘চন্দ্র’ সুন্দর; প্রসন্ন সুন্দর; বামা সুন্দর; প্রমদা সুন্দর; আমার চেয়ে হীরা দাসীও সুন্দরী। হীরাও আমার চেয়ে সুন্দর? হাঁ; শ্যামবর্ণ হলে কি হয়–মুখ আমার চেয়ে সুন্দর। তা রূপ ত গোল্লাই গেল–গুণ কি? আচ্ছা দেখি দেখি ভেবে।-কই, মনে ত হয় না। কে জানে! কিন্তু মরা হবে না, ঐ কথা ভাবি। মিছে কথা! তা মিছে কথাই ভাবি। মিছে কথাকে সত্য বলিয়া ভাবিব। কিন্তু কলিকাতায় যেতে হবে যে, তা ত যেতে পারিব না; দেখিতে পাব না যে। আমি যেতে পারব না–পারব না–পারব না। তা না গিয়াই বা কি করি? যদি কমলের কথা সত্য হয়, তবে ত যারা আমার জন্য এত করেছে, তাহাদের ত সর্বনাশ করিতেছি। সূর্যমুখীর মনে কিছু হয়েছে বুঝিতে পারি। সত্যই হউক, মিথ্যাই হউক, কাজে কাজেই আমাকে যেতে হবে। তা পারিব না। তাই ডুবে মরি। মরিবই মরিব। বাবা গো! তুমি কি আমাকে ডুবিয়া মরিবার জন্য রাখিয়া গিয়াছিলে__”
কুন্দ তখন দুই চক্ষে হাত দিয়া কাঁদিতে লাগিল। সহসা অন্ধকার গৃহে প্রদীপ জ্বালার ন্যায়, কুন্দের সেই স্বপ্ন-বৃত্তান্ত সুস্পষ্ট মনে পড়িল। কুন্দ তখন বিদ্যুৎস্পৃষ্টার ন্যায় গাত্রোত্থান করিল। “আমি সকল ভুলিয়া গিয়াছি–আমি কেন ভুলিলাম? মা আমাকে দেখা দিয়াছিলেন–মা আমার কপালের লিখন জানিতে পারিয়া আমায় ঐ নক্ষত্রলোকে যাইতে বলিয়াছিলেন–আমি কেন তাঁর কথা শুনলেম না–আমি কেন গেলাম না! –আমি কেন মলেম না! আমি এখনও বিলম্ব করিতেছি কেন? আমি এখনও মরিতেছি না কেন? আমি এখনই মরিব |” এই ভাবিয়া কুন্দ ধীরে ধীরে সেই সরোবরসোপান অবতরণ আরম্ভ করিল। কুন্দ নিতান্ত অবলা–নিতান্ত ভীরুস্বভাবসম্পন্না–প্রতি পদার্পণে ভয় পাইতেছিল–প্রতি পদার্পণে তাহার অঙ্গ শিহরিতেছিল। তথাপি অস্খলিতসঙ্কল্পে সে মাতার আজ্ঞাপালনার্থে ধীরে ধীরে যাইতেছিল। এমত সময় পশ্চাৎ হইতে কে অতি ধীরে ধীরে তাহার পৃষ্ঠে অঙ্গুলিস্পর্শ করিল। বলিল, “কুন্দ!” কুন্দ দেখিল–সে অন্ধকারে দেখিবামাত্র চিনিল–নগেন্দ্র। কুন্দের সে দিন আর মরা হলো না।
আর নগেন্দ্র! এই কি তোমার এত কালের সুচরিত্র? এই কি তোমার এত কালের শিক্ষা? এই কি সূর্যমুখীর প্রাণপণ প্রণয়ের প্রতিফল! ছি ছি! দেখ, তুমি চোর! চোরের অপেক্ষাও হীন। চোর সূর্যমুখীর কি করিত? তাহার গহনা চুরি করিত, অর্থহানি করিত, কিন্তু তুমি তাহার প্রাণহানি করিতে আসিয়াছ। চোরকে সূর্যমুখী কখন কিছু দেয় নাই ; তবু সে চুরি করিলে চোর হয়। আর সূর্যমুখী তোমাকে সর্বস্ব দিয়াছে–তবু তুমি চোরের অধিক চুরি করিতে আসিয়াছ! নগেন্দ্র, তুমি মরিলেই ভাল হয়। যদি সাহস থাকে, তবে তুমি গিয়া ডুবিয়া মর।
আর ছি! ছি! কুন্দনন্দিনি! তুমি চোরের স্পর্শে কাঁপিলে কেন? ছি! ছি! কুন্দনন্দিনী!–চোরের কথা শুনিয়া তোমার গায়ে কাঁটা দিল কেন? কুন্দনন্দিনী!–দেখ, পুষ্করিণীর জল পরিষ্কার, সুশীতল, সুবাসিত–বায়ূ তাহার নীচে তারা কাঁপিতেছে। ডুবিবে? ডুবিয়া মর না? কুন্দনন্দিনী মরিতে চাহে না।
চোর বলিল, “কুন্দ। কলিকাতায় যাইবে?”
কুন্দ কথা কহিল না–চক্ষু মুছিল–কথা কহিল না।
চোর বলিল, “কুন্দ! ইচ্ছাপূর্বক যাইতেছ?”
ইচ্ছাপূর্বক! হরি! হরি! কুন্দ আবার চক্ষু মুছিল–কথা কহিল না।
“কুন্দ–কাঁদিতেছ কেন?” কুন্দ এবার কাঁদিয়া ফেলিল। তখন নগেন্দ্র বলিতে লাগিলেন, “শুন কুন্দ! আমি বহু কষ্টে এত দিন সহ্য করিয়াছিলাম. কিন্তু আর পারিলাম না। কি কষ্টে যে বাঁচিয়া আছি, তাহা বলিতে পারি না। আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আপনি ক্ষত বিক্ষত হইয়াছি। ইতর হইয়াছি, মদ খাই। আর পারি না। তোমাকে ছাড়িয়া দিতে পারি না। শুন, কুন্দ! এখন বিধবাবিবাহ চলিত হইতেছে– আমি তোমাকে বিবাহ করিব। তুমি বলিলেই বিবাহ করি |”
কুন্দ এবার কথা কহিল। বলিল, “না |”
আবার নগেন্দ্র বলিলেন, “কেন কুন্দ! বিধবার বিবাহ কি অশাস্ত্র?” কুন্দ আবার বলিল, “না|”
নগেন্দ্র বলিল, “তবে না কেন? বল বল-বল–আমার গৃহিণী হইবে কি না? আমায় ভালবাসিবে কি না?”
কুন্দ বলিল, “না |”
তখন নগেন্দ্র যেন সহস্রমুখে অপরিমিত প্রেমপরিপূর্ণ মর্মভেদী কত কথা বলিলেন। কুন্দ বলিল “না |”
তখন নগেন্দ্র চাহিয়া দেখিলেন, পুষ্করিণী নির্মল, সুশীতল–কুসুম-বাস-সুবাসিত–পবনহিল্লোলে তন্মধ্যে তারা কাঁপিতেছে,-ভাবিলেন, “উহার মধ্যে শয়ন কেমন?”
অন্তরীক্ষে যেন কুন্দ বলিতে লাগিল, “না |” বিধবার বিবাহ শাস্ত্র আছে। তাহার জন্য নয়। তবে কুন্দ ডুবিয়া মরিল না কেন? স্বচ্ছ বারি–শীতল জল–নীচে নক্ষত্র নাচিতেছে–কুন্দ ডুবিয়া মরিল না কেন?
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : যোগ্যং যোগ্যেন যোজয়েৎ
হরিদাসী বৈষ্ণবী উপবনগৃহে আসিয়া হঠাৎ দেবেন্দ্র বাবু হইয়া বসিল। পাশে একদিকে আলবোলা। বিচিত্র রৌপ্যশৃঙ্খলদলমালাময়ী, কলকল-কল্লোলনিনাদিনী, আলবোলা সুন্দরী দীর্ঘ ওষ্ঠ চুম্বনার্থ বাড়াইয়া দিলেন–মাথার উপর সোহাগের আগুন জ্বলিয়া উঠিল। আর একদিকে স্ফটিকপাত্রে, হেমাঙ্গী একশাকুমারী টল টল করিতে লাগিলেন। সম্মুখে, ভোক্তার ভোজনপাত্রের নিকট উপবিষ্ট গৃহমার্জারের মত, একজন চাটুকার প্রসাদকাঙ্ক্ষায় নাক বাড়াইয়া বসিলেন, হুঁক্কা বলিতেছে, “দেখ! দেখ! মুখ বাড়াইয়া আছি! ছি! ছি! মুখ বাড়াইয়া আছি |” এক্শাকুমারী বলিতেছে, “আগে আমায় আদর কর! দেখ, আমি কেমন রাঙ্গা! ছি! ছি! আগে আমায় খাও!” প্রসাদাকাঙ্ক্ষীর নাক বলিতেছে, “আমি যার, তাকে একটু দিও|”
দেবেন্দ্র সকলের মন রাখিলেন। আলবোলার মুখচুম্বন করিলেন–তাহার প্রেম ধুঁয়াইয়া উঠিতে লাগিল। এক্শানন্দিনীকে উদরস্থ করিলেন, সে ক্রমে মাথায় উঠিতে লাগিল। গৃহমার্জার মহাশয়ের নাককে পরিতুষ্ট করিলেন–নাক দুই চারি গেলাসের পর ডাকিতে আরম্ভ করিল। ভৃত্যেরা নাসিকাধিকারীকে “গুরুমহাশয় গুরুমহাশয়” করিয়া স্থানান্তরে রাখিয়া আসিল। তখন সুরেন্দ্র আসিয়া দেবেন্দ্রের কাছে বসিলেন এবং তাঁহার শারীরিক কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর বলিলেন, “আবার আজি তুমি কোথায় গিয়াছিলে?”
দে। ইহারই মধ্যে তোমার কাণে গিয়াছে?
সু। এই তোমার আর একটি ভ্রম। তুমি মনে কর, সব তুমি লুকিয়ে কর–কেহ জানিতে পারে না, কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় ঢাক বাজে।
দে। দোহাই ধর্ম! আমি কাহাকেও লুকাইতে চাহি না–কোন্ শালাকে লুকাইব?
সু। সেও একটা বাহাদুরী মনে করিও না। তোমার যদি একটু লজ্জা থাকিত, তাহা হইলে আমাদেরও একটু ভরসা থাকিত। লজ্জা থাকিলে আর তুমি বৈষ্ণবী সেজে গ্রামে গ্রামে ঢলাতে যাও?
দে। কিন্তু কেমন রসের বৈষ্ণবী, দাদা? রসকলিটি দেখে, ঘুরে পড় নি ত?
সু। আমি সে পোড়ারমুখ দেখি নাই, দেখিলে দুই চাবুকে বৈষ্ণবীর বৈষ্ণবী যাত্রা ঘুচিয়ে দিতাম।
পরে দেবেন্দ্রের হস্ত হইতে মদ্যপাত্র কাড়িয়া লইয়া সুরেন্দ্র বলিতে লাগিলেন, “এখন একটু বন্ধ করিয়া, জ্ঞান থাকিতে থাকিতে দুটো কথা শোন। তার পর গিলো |”
দে। বল, দাদা! আজ যে বড় চটাচটা দেখি–হৈমবতীর বাতাস গায়ে লেগেছে নাকি?
সুরেন্দ্র দুর্মুখের কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিলেন, “বৈষ্ণবী সেজেছিলে কার সর্বনাশ করবার জন্য?”
দে। তা কি জান না? মনে নাই, তারা মাষ্টারের বিয়ে হয়েছিল এক দেবকন্যার সঙ্গে? সেই দেবকন্যা এখন বিধবা হয়ে ও গাঁয়ের দত্তবাড়ী রেঁধে খায়। তাই তাকে দেখতে গিয়াছিলাম।
সু। কেন, এত দুর্বৃত্তিতেও তৃপ্তি জন্মিল না যে, সে অনাথা বালিকাকে অধ:পাতে দিতে হবে! দেখ দেবেন্দ্র, তুমি এত বড় পাপিষ্ঠ, এত বড় নৃশংস, এমন অত্যাচারী যে, বোধ হয়, আর আমরা তোমার সহবাস করিতে পারি না।
সুরেন্দ্র এরূপ দার্ঢ্য সহকারে এই কথা বলিলেন যে, দেবেন্দ্র নিস্তব্ধ হইলেন। পরে দেবেন্দ্র গাম্ভীর্যসহকারে কহিলেন, “তুমি আমার উপর রাগ করিও না। আমার চিত্ত আমার বশ নহে। আমি সকল ত্যাগ করিতে পারি, এই স্ত্রীলোকের আশা ত্যাগ করিতে পারি না। যে দিন প্রথম তাহাকে তারাচরণের গৃহে দেখিয়াছি, সেই দিন অবধি আমি তাহার সৌন্দর্যে অভিভূত হইয়া আছি। আমার চক্ষে এত সৌন্দর্য আর কোথাও নাই। জ্বরে যেমন তৃষ্ণা রোগীকে দগ্ধ করে, সেই অবধি উহার জন্য লালসা আমাকে সেইরূপ দগ্ধ করিতেছে। সেই অবধি আমি উহাকে দেখিবার জন্য কত কৌশল করিতেছি, তাহা বলিতে পারি না। এ পর্যন্ত পারি নাই–শেষে এই বৈষ্ণবী-সজ্জা ধরিয়াছি। তোমার কোন আশঙ্কা নাই–সে স্ত্রীলোক অত্যন্ত সাধ্বী!”
সু। তবে যাও কেন?
দে। কেবল তাহাকে দেখিবার জন্য। তাহাকে দেখিয়া, তাহার সঙ্গে কথা কহিয়া, তাহাকে গান শুনাইয়া যে কি পর্যন্ত তৃপ্তি হয়, তাহা বলিতে পারি না।
সু। তোমাকে আমি সত্য বলিতেছি–উপহাস করিতেছি না। তুমি যদি এই দুষ্প্রবৃত্তি ত্যাগ না করিবে–তুমি যদি সে পথে আর যাইবে–তবে আমার সঙ্গে তোমার আলাপ এই পর্যন্ত বন্ধ। আমিও তোমার শত্রু হইব।
দে। তুমি আমার একমাত্র সুহৃদ। আমি অর্ধেক বিষয় ছাড়িতে পারি, তবু তোমাকে ছাড়িতে পারি না। কিন্তু তোমাকে যদি ছাড়িতে হয়, সেও স্বীকার, তবু আমি কুন্দনন্দিনীকে দেখিবার আশা ছাড়িতে পারিব না।
সু। তবে তাহাই হউক। তোমার সঙ্গে আমার এই পর্যন্ত সাক্ষাৎ।
এই বলিয়া সুরেন্দ্র দু:খিত চিত্তে উঠিয়া গেলেন। দেবেন্দ্র একমাত্র বন্ধুবিচ্ছেদে অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হইয়া কিয়ৎকাল বিমর্ষভাবে বসিয়া রহিলেন। শেষ, ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিলেন, “দূর হউক! এ সংসারে কে কার! আমিই আমার!” এই বলিয়া পাত্র পূর্ণ করিয়া ব্রাণ্ডি পান করিলেন। তাহার বশে আশু চিত্তপ্রফুল্লতা জন্মিল। তখন দেবেন্দ্র, শুইয়া পড়িয়া চক্ষু মুদিয়া গান ধরিলেন,
“আমার নাম হীরা মালিনী।
আমি থাকি রাধার কুঞ্জে, কুব্জা আমার ননদিনী।
রাবণ বলে চন্দ্রাবলি,
তুমি আমার কমল কলি,
শুনে কীচক মেরে কৃষ্ণ,
উদ্ধারিল যাজ্ঞসেনী!”
তখন পারিষদেরা সকলে উঠিয়া গিয়াছিল, দেবেন্দ্র নৌকাশূন্য নদীবক্ষ:স্থিত ভেলার ন্যায় একা বসিয়া রসের তরঙ্গে হাবুডুবু খাইতেছিলেন। রোগরূপ তিমি মকরাদি এখন জলের ভিতর লুকাইয়াছিল–এখন কেবল মন্দ পবন আর চাঁদের আলো! এমন সময়ে জানালার দিকে কি একটা খড় খড় শব্দ হইল–কে যেন খড়খড়ি তুলিয়া দেখিতেছিল–হঠাৎ ফেলিয়া দিল। দেবেন্দ্র বোধ হয়, মনে মনে কাহারও প্রতীক্ষা করিতেছিলেন–বলিলেন, “কে খড়খড়ি চুরি করে?” কোন উত্তর না পাইয়া জানেলা দিয়া দেখিলেন– দেখিতে পাইলেন, এক জন স্ত্রীলোক পলায়। স্ত্রীলোক পলায় দেখিয়া দেবেন্দ্র জানেলা খুলিয়া লাফাইয়া পড়িয়া, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ টলিতে টলিতে ছুটিলেন।
স্ত্রীলোক অনায়াসে পলাইলে পলাইতে পারিত, কিন্তু ইচ্ছাপূর্বক পলাইল না, কি অন্ধকারে ফুলবাগানের মাঝে পথ হারাইল, তাহা বলা যায় না। দেবেন্দ্র তাহাকে ধরিয়া অন্ধকারে তাহার মুখপানে চাহিয়া চিনিতে পারিলেন না। চুপি চুপি মদের ঝোঁকে বলিলেন, “বাবা! কোন্ গাছ থেকে?” পরে তাহাকে ঘরের ভিতর টানিয়া আনিয়া একবার এক দিকে আবার আর এক দিকে আলো ধরিয়া দেখিয়া, সেইরূপ স্বরে বলিলনে, “তুমি কাদের পেত্নী গা?” শেষে কিছু স্থির করিতে না পারিয়া বলিলেন, “পারলেম না বাপ! আজ ফিরে যাও, অমাবস্যায় লুচি পাঁঠা দিয়ে পূজো দেব–আজ একটু কেবল ব্রাণ্ডি খেয়ে যাও,” এই বলিয়া মদ্যপ স্ত্রীলোকটিকে বৈঠকখানায় বসাইয়া, মদের গেলাস তাহার হাতে দিল।
স্ত্রীলোকটি তাহা গ্রহণ না করিয়া নামাইয়া রাখিল।
তখন মাতাল আলোটা স্ত্রীলোকের মুখের কাছে লইয়া গেল। এদিক ওদিক চারিদিক আলোটা ফিরাইয়া ফিরাইয়া গম্ভীরভাবে তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া, শেষ হঠাৎ আলোটা ফেলিয়া দিয়া গান ধরিল,-“তুমি কে বট হে, তোমায় চেন চেন করি–কোথাও দেখেছি হে|”
তখন সে স্ত্রীলোক ধরা পড়িয়াছি ভাবিয়া বলিল, “আমি হীরা |”
“Hurrah! Three Cheers for হীরা!” বলিয়া মাতাল লাফাইয়া উঠিল। তখন আবার ভূমিষ্ঠ হইয়া হীরাকে প্রণাম করিয়া গ্লাস হস্তে স্তব করিতে আরম্ভ করিল;-
“নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ।
যা দেবী বটবৃক্ষেষু ছায়ারূপেণ সংস্থিতা ||
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ।
যা দেবী দত্তগৃহেষু হীরারূপেণ সংস্থিতা ||
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ।
যা দেবী পুকুরঘাটেষু চুপড়িহস্তেন সংস্থিতা ||
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ||
যা দেবী ঘরদ্বারেষু ঝাঁটাহস্তেন সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ||”
তার পর–মালিনী মাসি!–কি মনে করে?”
হীরা ইতিপূর্বেই বৈষ্ণবীর সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া দিনমানে জানিয়া গিয়াছিল যে, হরিদাসী বৈষ্ণবী ও দেবেন্দ্র বাবু একই ব্যক্তি। কিন্তু কেন দেবেন্দ্র বৈষ্ণবী-বেশে দত্তগৃহে যাতায়াত করিতেছে? এ কথা জানা সহজ নহে। হীরা মনে মনে অত্যন্ত দু:সাহসিক সঙ্কল্প করিয়া, এই সময়ে স্বয়ং দেবেন্দ্রের গৃহে আসিল। সে গোপনে উদ্যানমধ্যে প্রবেশ করিয়া জানেলার কাছে দাঁড়াইয়া দেবেন্দ্রের কথাবার্তা শুনিয়াছিল। সুরেন্দ্রের সঙ্গে দেবেন্দ্রের কথোপকথন অন্তরাল হইতে শুনিয়া হীরা সিদ্ধমনস্কাম হইয়া ফিরিয়া যাইতেছিল, যাইবার সময় অসাবধানে খড়খড়ি ফেলিয়া দিয়াছিল–ইহাতেই গোল বাধিল।
এখন হীরা পলাইবার জন্য ব্যস্ত। দেবেন্দ্র তাহার হাতে আবার মদের গেলাস দিল। হীরা বলিল, “আপনি খান |” বলিবামাত্র দেবেন্দ্র তাহা গলাধ:করণ করিলেন। সেই গেলাস দেবেন্দ্রের পূর্ণ মাত্রা হইল–দুই একবার ঢুলিয়া–দেবেন্দ্র শুইয়া পড়িলেন। হীরা তখন উঠিয়া পলাইল। দেবেন্দ্র তখন ঝিমকিনি মারিয়া গাইতে লাগিল;-
“বয়স তাহার বছর ষোল,
দেখতে শুনতে কালো কোলো,
পিলে অগ্রমাসে মোলো,
আমি তখন খানায় পোড়ে |”
সে রাত্রে হীরা আর দত্তবাড়ীতে গেল না, আপন গৃহে গিয়া শয়ন করিয়া রহিল। পরদিন প্রাতে গিয়া সূর্যমুখীর নিকট দেবেন্দ্রের সংবাদ বলিল। দেবেন্দ্র কুন্দের জন্য বৈষ্ণবী সাজিয়া যাতায়াত করে। কুন্দ যে নির্দোষী, তাহা হীরাও বলিল না, সূর্যমুখীও বুঝিলেন না। হীরা কেন সে কথা লুকাইল–পাঠক তাহা ক্রমে বুঝিতে পারিবেন। সূর্যমুখী দেখিয়াছিলেন, কুন্দ বৈষ্ণবীর সঙ্গে চুপি চুপি কথা কহিতেছেন–সুতরাং সূর্যমুখী তাহাকে দোষী মনে করিলেন। হীরার কথা শুনিয়া সূর্যমুখীর নীলোৎপললোচন রাঙ্গা হইয়া উঠিল। তাঁহার কপালে শিরা স্থূলতা প্রাপ্ত হইয়া প্রকটিত হইল। কমলও সকল শুনিলেন। কুন্দকে সূর্যমুখী ডাকাইলেন। সে আসিলে পরে বলিলেন, “কুন্দ! হরিদাসী বৈষ্ণবী কে, আমরা চিনিয়াছি। আমরা জানিয়াছি যে, সে তোর কে। তুই যা তা জানিলাম! আমরা এমন স্ত্রীলোককে বাড়ীতে স্থান দিই না। তুই বাড়ী হইতে এখনই দূর হ। নহিলে হীরা তোকে ঝাঁটা মারিয়া তাড়াইবে |”
কুন্দের গা কাঁপিতে লাগিল। কমল দেখিলেন যে, সে পড়িয়া যায়। কমল তাহাকে ধরিয়া শয়নগৃহে লইয়া গেলেন। শযনগৃহে থাকিয়া আদর করিয়া সান্ত্বনা করিলেন এবং বলিলেন, “ও মাগী যাহা বলে বলুক; আমি উহার একটি কথাও বিশ্বাস করি না |”
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : অনাথিনী
গভীর রাত্রে গৃহস্থ সকলে নিদ্রিত হইলে কুন্দনন্দিনী শয়নাগারের দ্বার খুলিয়া বাহির হইল। এক বসনে সূর্যমুখীর গৃহ ত্যাগ করিয়া গেল। সেই গভীর রাত্রে এক বসনে সপ্তদশবর্ষীয়া, অনাথিনী সংসারসমুদ্রে একাকিনী ঝাঁপ দিল।
রাত্রি অত্যন্ত অন্ধকার। অল্প অল্প মেঘ করিয়াছে, কোথায় পথ?
কে বলিয়া দিবে, কোথায় পথ? কুন্দনন্দিনী কখন দত্তদিগের বাটীর বাহির হয় নাই। কোন্ দিকে কোথায যাইবার পথ, তাহা জানে না। আর কোথাই বা যাইবে?
অট্টালিকার বৃহৎ অন্ধকারময় কায়া, আকাশের গায়ে লাগিয়া রহিয়াছে– সেই অন্ধকার বেষ্টন করিয়া কুন্দনন্দিনী বেড়াইতে লাগিল। মানস, একবার নগেন্দ্রনাথের শয়নকক্ষের বাতায়নপথে আলো দেখিয়া যায়। একবার সেই আলো দেখিয়া চক্ষু জুড়াইয়া যাইবে।
তাঁহার শয়নাগার চিনিত–ফিরিতে ফিরিতে তাহা দেখিতে পাইল–বাতায়নপথে আলো দেখা যাইতেছে। কবাট খোলা–শার্সি বন্ধ–অন্ধকারমধ্যে তিনটি জানেলা জ্বলিতেছে। তাহার উপর পতঙ্গজাতি উড়িয়া উড়িয়া পড়িতেছে। আলো দেখিয়া উড়িয়া পড়িতেছে, কিন্তু রুদ্ধপথে প্রবেশ করিতে না পারিয়া কাচে ঠেকিয়া ফিরিয়া যাইতেছে। কুন্দনন্দিনী এই ক্ষুদ্র পতঙ্গদিগের জন্য হৃদয়মধ্যে পীড়িতা হইল।
কুন্দনন্দিনী মুগ্ধলোচনে সেই গবাক্ষপথ-প্রেরিত আলোক দেখিতে লাগিল–সে আলো ছাড়িয়া যাইতে পারিল না। শয়নাগারের সম্মুখে কতকগুলি ঝাউগাছ ছিল–কুন্দনন্দিনী তাহার তলায় গবাক্ষ প্রতি সম্মুখ করিয়া বসিল। রাত্রি অন্ধকার, চারি দিক অন্ধকার, গাছে গাছে খদ্যোতের চাকচিক্য সহস্রে সহস্রে ফুটিতেছে, মুদিতেছে; মুদিতেছে, ফুটিতেছে। আকাশে কালো মেঘের পশ্চাতে কালো মেঘ ছুটিতেছে–তাহার পশ্চাতে আরও কালো মেঘ ছুটিতেছে–তৎপশ্চাতে আরও কালো। আকাশে দুই একটি নক্ষত্র মাত্র, কখনও মেঘে ডুবিতেছে, কখনও ভাসিতেছে। বাড়ীর চারি দিকে ঝাউগাছের শ্রেণী, সেই মেঘময় আকাশে মাথা তুলিয়া নিশাচর পিশাচের মত দাঁড়াইয়া আছে। বায়ুর স্পর্শে সেই করালবদনা নিশীথিনী-অঙ্কে থাকিয়া, তাহারা আপন আপন পৈশাচী ভাষায় কুন্দনন্দিনীর মাথার উপর কথা কহিতেছে। পিশাচেরাও করাল রাত্রির ভয়ে, অল্প শব্দে কথা কহিতেছে। কদাচিৎ বায়ুর সঞ্চালনে গবাক্ষের মুক্ত কবাট প্রাচীরে বারেক মাত্র আঘাত করিয়া শব্দ করিতেছে। কালপেঁচা সৌধোপরি বসিয়া ডাকিতেছে। কদাচিৎ একটা কুক্কুর অন্য পশু দেখিয়া সম্মুখ দিয়া অতি দ্রুতবেগে ছুটিতেছে। কদাচিৎ ঝাউয়ের পল্লব অথবা ফল খসিয়া পড়িতেছে। দূরে নারিকেল বৃক্ষের অন্ধকার শিরোভাগ অন্ধকারে মন্দ মন্দ হেলিতেছে; দূর হইতে তালবৃক্ষের পত্রের তর তর মর্মর শব্দ কর্ণে আসিতেছে; সর্বোপরি সেই বাতায়নশ্রেণীর উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছে–আর পতঙ্গদল ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছে। কুন্দনন্দিনী সেই দিকে চাহিয়া রহিল।
ধীরে ধীরে একটি গবাক্ষের শার্সি খুলিল। এক মনুষ্যমূর্তি আলোকপটে চিত্রিত হইল। হরি! হরি! সে নগেন্দ্রের মূর্তি। নগেন্দ্র–নগেন্দ্র! যদি ঐ ঝাউতলার অন্ধকারের মধ্যে ক্ষুদ্র কুন্দ কুসুমটি দেখিতে পাইতে! যদি তোমাকে গবাক্ষপথে দেখিয়া তাহার হৃদয়ঘাতের শব্দ–দুপ! দুপ! শব্দ–যদি সে শব্দ শুনিতে পাইতে! যদি জানিতে পারিতে যে, তুমি আবার এখনই সরিয়া অদৃশ্য হইবে, এই ভয়ে তাহার দেখার সুখ হইতেছে না! নগেন্দ্র! দীপের দিকে পশ্চাৎ করিয়া দাঁড়াইয়াছ–একবার দীপ সম্মুখে করিয়া দাঁড়াও! তুমি দাঁড়াও, সরিও না–কুন্দ বড় দু:খিনী। দাঁড়াও–তাহা হইলে, সেই পুষ্করিণীর স্বচ্ছ শীতল বারি–তাহার তলে নক্ষত্রচ্ছায়া–তাহার আর মনে পড়িবে না।
ঐ শুন! কালপেঁচা ডাকিল! তুমি সরিয়া যাইবে, আর কুন্দনন্দিনীর ভয় করিবে! দেখিলে বিদ্যুৎ! তুমি সরিও না–কুন্দনন্দিনীর ভয় করিবে! ঐ দেখ, আবার কালো মেঘ পবনে চাপিয়া যে যুদ্ধে ছুটিতেছে। ঝড় বৃষ্টি হইবে। কুন্দকে কে আশ্রয় দিবে?
দেখ, তুমি গবাক্ষ মুক্ত করিয়াছ, ঝাঁকে ঝাঁকে পতঙ্গ আসিয়া তোমার শয্যাগৃহে প্রবেশ করিতেছে। কুন্দ মনে করিতেছে, কি পুণ্য করিলে পতঙ্গজন্ম হয়। কুন্দ! পতঙ্গ যে পুড়িয়া মরে! কুন্দ তাই চায়। মনে করিতেছে, “আমি পুড়িলাম–মরিলাম না কেন?”
নগেন্দ্র শার্সি বন্ধ করিয়া সরিয়া গেলেন। নির্দয়! ইহাতে কি ক্ষতি! না, তোমার রাত্রি জাগিয়া কাজ নাই–নিদ্রা যাও–শরীর অসুস্থ হইবে। কুন্দনন্দিনী মরে, মরুক। তোমার মাথা না ধরে, কুন্দনন্দিনীর কামনা এই।
এখন আলোকময় গবাক্ষ যেন অন্ধকার হইল। চাহিয়া, চাহিয়া, চাহিয়া, চক্ষের জল মুছিয়া, কুন্দনন্দিনী উঠিল। সম্মুখে যে পথ পাইল–সেই পথে চলিল। কোথায় চলিল? নিশাচর পিশাচ ঝাউগাছেরা সর্ সর্ শব্দ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাও?” তালগাছেরা তর্ তর্ করিয়া শব্দ করিয়া বলিল, “কোথায় যাও?” পেচক গম্ভীর নাদে বলিল, “কোথায় যাও?” উজ্জ্বল গবাক্ষশ্রেণী বলিতে লাগিল, “যায় যাউক–আমরা আর নগেন্দ্র দেখাইব না |” তবু কুন্দনন্দিনী–নির্বোধ কুন্দনন্দিনী ফিরিয়া ফিরিয়া সেই দিকে চাহিতে লাগিল।
কুন্দ চলিল, চলিল–কেবল চলিল। আকাশে আরও মেঘ ছুটিতে লাগিল–মেঘ সকল একত্র হইয়া আকাশেও রাত্রি করিল–বিদ্যুৎ হাসিল–আবার হাসিল–আবার! বায়ু গর্জিল, মেঘ গর্জিল–বায়ুতে মেঘেতে একত্র হইয়া গর্জিল। আকাশ আর রাত্রি একত্র হইয়া গর্জিল। কুন্দ! কোথায় যাইবে?
ঝড় উঠিল। প্রথমে শব্দ, পরে ধূলি উঠিল, পরে গাছের পাতা ছিঁড়িয়া লইয়া বায়ু স্বয়ং আসিল! শেষে পিট্! পিট!–পট্ পট্!–হু হু! বৃষ্টি আসিল। কুন্দ! কোথায় যাইবে?
বিদ্যুতের আলোকে পথিপার্শ্বে কুন্দ একটা সামান্য গৃহ দেখিল। গৃহের চতুষ্পার্শ্বে মৃৎপ্রাচীর; মৃৎপ্রাচীরের ছোট চাল। কুন্দনন্দিনী আসিয়া তাহার আশ্রয়ে, দ্বারের নিকটে বসিল। দ্বারে পিঠ রাখিয়া বসিল। দ্বার পিঠের স্পর্শে শব্দিত হইল। গৃহস্থ সজাগ, দ্বারের শব্দ তাহার কাণে গেল। গৃহস্থ মনে করিল, ঝড় ; কিন্তু তাহার দ্বারে একটা কুক্কুর শয়ন করিয়া থাকে–সেটা উঠিয়া ডাকিতে লাগিল। গৃহস্থ তখন ভয় পাইল। আশঙ্কায় দ্বার খুলিয়া দেখিতে আইল। দেখিল, আশ্রয়হীনা স্ত্রীলোকমাত্র। জিজ্ঞাসা করিল, “কে গা তুমি?”
কুন্দ কথা কহিল না।
“কে রে মাগি?”
কুন্দ বলিল, “বৃষ্টির জন্য দাঁড়াইয়াছি |”
গৃহস্থ ব্যগ্রভাবে বলিল, “কি? কি? কি? আবার বল ত?”
কুন্দ বলিল, “বৃষ্টির জন্য দাঁড়াইয়াছি |”
গৃহস্থ বলিল, “ও গলা যে চিনি। বটে? ঘরের ভিতর এস ত?”
গৃহস্থ কুন্দকে ঘরের ভিতর লইয়া গেল। আগুন করিয়া আলো জ্বালিল। কুন্দ তখন দেখিল–হীরা।
হীরা বলিল, “বুঝিয়াছি, তিরস্কারে পলাইয়াছ। ভয় নাই। আমি কাহারও সাক্ষাতে বলিব না। আমার এইখানে দুই দিন থাক |”
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : হীরার রাগ
হীরার বাড়ী প্রাচীর আঁটা। দুইটি ঝরঝরে মেটে ঘর। তাহাতে আলেপনা–পদ্ম আঁকা–পাখী আঁকা–ঠাকুর আঁকা। উঠান নিকান–এক পাশে রাঙ্গা শাক, তার কাছে দোপাটি, মল্লিকা, গোলাপ ফুল। বাবুর বাড়ীর মালী আপনি আসিয়া চারা আনিয়া ফুলগাছ পুতিয়া দিয়া গিয়াছিল–হীরা চাহিলে, চাই কি বাগান শুদ্ধই উহার বাড়ী তুলিয়া দিয়া যায়। মালীর লাভের মধ্যে এই, হীরা আপন হাতে তামাকু সাজিয়া দেয়। হীরা, কালো-চুড়ি পরা হাতখানিতে হুঁকা ধরিয়া মালীর হাতে দেয়, মালী বাড়ী গিয়া রাত্রে তাই ভাবে।
হীরার বাড়ী হীরার আয়ি থাকে, আর হীরা। এক ঘরে আয়ি, এক ঘরে হীরা শোয়। হীরা কুন্দকে আপনার কাছে বিছানা করিয়া রাত্রে শুয়াইল। কুন্দ শুইল–ঘুমাইল না। পরদিন তাহাকে সেইখানে রাখিল। বলিল, “আজি কালি দুই দিন থাক; দেখ, রাগ না পড়ে, পরে যেখানে ইচ্ছা, সেইখানে যাইও |” কুন্দ রহিল। কুন্দের ইচ্ছানুসারে তাহাকে লুকাইয়া রাখিল। ঘরে চাবি দিল, আয়ি না দেখে। পরে বাবুর বাড়ীতে কাজে গেল। দুই প্রহর বেলায় আয়ি যখন স্নানে যায়, হীরা তখন আসিয়া কুন্দকে স্নানাহার করাইল। আবার চাবি দিয়া চলিয়া গেল। রাত্রে আসিয়া চাবি খুলিয়া উভয়ে শয্যা রচনা করিল।
“টিট্–কিট্–খিট্–খিটি–খাট্” বাহির দুয়ারের শিকল সাবধানে নড়িল। হীরা বিস্মিত হইল। একজনমাত্র কখনও কখনও রাত্রে শিকল নাড়ে। সে বাবুর বাড়ীর দ্বারবান, রাত ভিত ডাকিতে আসিয়া শিকল নাড়ে। কিন্তু তাহার হাতে শিকল অমন মধুর বলে না, তাহার হাতে শিকল নাড়িলে, বলে, “কট কট কটা:, তোর মাথা মুণ্ড উঠা! কড়্ কড়্ কড়াং! খিল খোল নয় ভাঙ্গি ঠ্যাং|” তা ত শিকল বলিল না। এ শিকল বলিতেছে, “কিট্ কিট্ কিটী! দেখি কেমন আর হীরেটি! খিট খাট্ ছন্! উঠল আমার হীরামন! ঠিট্ ঠিট্ ঠিঠি ঠিনিক্–আয় রে আমার হীরা মাণিক|” হীরা উঠিয়া দেখিতে গেল ; বাহির দুয়ার খুলিয়া দেখিল, স্ত্রীলোক। প্রথমে চিনিতে পারিল না, পরেই চিনিল–“কে ও গঙ্গাজল! এ কি ভাগ্য!” হীরার গঙ্গাজল মালতী গোয়ালিনী। মালতী গোয়ালিনীর বাড়ী দেবীপুর–দেবেন্দ্র বাবুর বাড়ীর কাছে–বড় রসিকা স্ত্রীলোক। বয়স বৎসর ত্রিশ বত্রিশ, সাড়ী পরা, হাতে রুলি, মুখে পানের রাগ। মালতী গোয়ালিনী প্রায় গৌরাঙ্গী– একটু রৌদ্র পোড়া–মুখে রাঙ্গা রাঙ্গা দাগ, নাক খাঁদা–কপালে উল্কি। কসে তামাকুপোড়া টেপা আছে। মালতী গোয়ালিনী দেবেন্দ্র বাবুর দাসী নহে–আশ্রিতাও নহে–অথচ তাঁহার বড় অনুগত–অনেক ফরমায়েশ–যাহা অন্যের অসাধ্য, তাহা মালতী সিদ্ধ করে। মালতীকে দেখিয়া চতুরা হীরা বলিল, “ভাই গঙ্গাজল! অন্তিম কালে যেন তোমায় পাই! কিন্তু এখন কেন?”
গঙ্গাজল চুপি চুপি বলিল, “তোকে দেবেন্দ্র বাবু ডেকেছে|”
হীরা কাদা মাখে, হাসিয়া বলিল, “তুই কিছু পাবি নাকি?”
মালতী দুই অঙ্গুলের দ্বারা হীরাকে মারিল, বলিল, “মরণ আর কি! তোর মনের কথা তুই জানিস! এখন চ!”
হীরা ইহাই চায়। কুন্দকে বলিল, “আমার বাবুর বাড়ী যেতে হলো–ডাকিতে এসেছে! কে জানে কেন?” বলিয়া প্রদীপ নিবাইল এবং অন্ধকারে কৌশলে বেশভূষা করিয়া মালতীর সঙ্গে যাত্রা করিল। দুই জনে অন্ধকারে গলা মিলাইয়া–
“মনের মতন রতন পেলে যতন করি তায়
সাগর ছেঁচে তুলবো নাগর পতন করে কায় ;”
ইতি গীত গায়িতে গায়িতে চলিল।
দেবেন্দ্রের বৈঠকখানায় হীরা একা গেল। দেবেন্দ্র দেবীর আরাধনা করিতেছিলেন, কিন্তু আজি সরু কাটিতেছিলেন। জ্ঞান টন্টনে। হীরার সঙ্গে আজ অন্য প্রকার সম্ভাষণ করিলেন। স্তবস্তুতি কিছুই নাই। বলিলেন, “হীরে, সেদিন আমি অধিক মদ খাইয়া তোমার কথার মর্ম কিছুই গ্রহণ করিতে পারি নাই। কেন আসিয়াছিলে? সেই কথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য ডাকিয়া পাঠাইয়াছি|”
হী। কেবল আপনাকে দর্শন করিতে আসিয়াছিলাম।
দেবেন্দ্র হাসিলেন। বলিলেন, “তুমি বড় বুদ্ধিমতী। ভাগ্যক্রমে নগেন্দ্র বাবু তোমার মত দাসী পেয়েছেন। বুঝিলাম তুমি হরিদাসী বৈষ্ণবীর তত্ত্বে এসেছিলে। আমার মনের কথা জানিতে এসেছিলে। কেন আমি বৈষ্ণবী সাজি, কেন দত্তবাড়ী যাই, এই কথা জানিতে আসিয়াছিলে। তাহা একপ্রকার জানিয়াও গিয়াছ। আমিও তোমার কাছে সে কথা লুকাইব না। তুমি প্রভুর কাজ করিয়া প্রভুর কাছে পুরস্কার পাইয়াছ, সন্দেহ নাই। এখন আমার একটি কাজ কর, আমিও পুরস্কার করিব |”
মহাপাপে নিমগ্ন যাহাদিগের চরিত্র, তাহাদিগের সকল কথা স্পষ্ট করিয়া লেখা বড় কষ্টকর। দেবেন্দ্র, হীরাকে বহুল অর্থের লোভ প্রদর্শন করিয়া, কুন্দকে বিক্রয় করিতে বলিলেন। শুনিয়া ক্রোধে হীরার পদ্মপলাশ চক্ষু রক্তময় হইল–কর্ণরন্ধ্রে অগ্নিবৃষ্টি হইল। হীরা গাত্রোত্থান করিয়া কহিল, “মহাশয়! আমি দাসী বলিয়া এরূপ কথা বলিলেন। ইহার উত্তর আমি দিতে পারিব না। আমার মুনিবকে বলিব। তিনি উহার উপযুক্ত উত্তর দিবেন |”
এই বলিয়া হীরা বেগে প্রস্থান করিল। দেবেন্দ্র ক্ষণেক কাল অপ্রতিভ এবং ভগ্নোৎসাহ হইয়া নীরব হইয়াছিলেন। পরে প্রাণ ভরিয়া দুই গ্লাস ব্রাণ্ডি পান করিলেন। তখন প্রকৃতিস্থ হইয়া মৃদু মৃদু গান গায়িলেন,
“এসেছিল বকনা গোরু পর-গোয়ালে জাবনা খেতে___”
বিংশ পরিচ্ছেদ : হীরার দ্বেষ
প্রাতে উঠিয়া হীরা কাজে গেল। দত্তের বাড়ীতে দুই দিন পর্যন্ত বড় গোল, কুন্দকে পাওয়া যায় না। বাড়ীর সকলেই জানিল যে, সে রাগ করিয়া গিয়াছে, পাড়াপ্রতিবাসীরা কেহ জানিল, কেহ জানিল না। নগেন্দ্র শুনিলেন যে, কুন্দ গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে–কেন গিয়াছে, কেহ তাহা শুনাইল না। নগেন্দ্র ভাবিলেন, আমি যাহা বলিয়াছিলাম, তাহা শুনিয়া, কুন্দ আমার গৃহে আর থাকা অনুচিত বলিয়া চলিয়া গিয়াছে। যদি তাই, তবে কমলের সঙ্গে গেল না কেন? নগেন্দ্রের মুখ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া রহিল। কেহ তাঁহার নিকটে আসিতে সাহস করিল না। সূর্যমুখীর কি দোষ, তাহা কিছু জানিলেন না, কিন্তু সূর্যমুখীর সঙ্গে আলাপ বন্ধ করিলেন। গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় কুন্দনন্দিনীর সন্ধানার্থ স্ত্রীলোক চর পাঠাইলেন।
সূর্যমুখী রাগে বা ঈর্ষার বশীভূত হইয়া, যাহাই বলুন, কুন্দের পলায়ন শুনিয়া অতিশয় কাতর হইলেন। বিশেষ কমলমণি বুঝাইয়া দিলেন যে, দেবেন্দ্র যাহা বলিয়াছিল, তাহা কদাচ বিশ্বাসযোগ্য নহে। কেন না, দেবেন্দ্রের সহিত গুপ্ত প্রণয় থাকিলে, কখন অপ্রচার থাকিত না। আর কুন্দের যেরূপ স্বভাব, তাহাতে কদাচ ইহা সম্ভব বোধ হয় না। দেবেন্দ্র মাতাল, মদের মুখে মিথ্যা বড়াই করিয়াছে। সূর্যমুখী এ সকল কথা বুঝিলেন, এজন্য অনুতাপ কিছু গুরুতর হইল। তাহাতে আবার স্বামীর বিরাগে আরও মর্মব্যথা পাইলেন। শত বার কুন্দকে গালি দিতে লাগিলেন, সহস্র বার আপনাকে গালি দিলেন। তিনিও কুন্দের সন্ধানে লোক পাঠাইলেন।
কমল কলিকাতায় যাওয়া স্থগিত করিলেন। কমল কাহাকেও গালি দিলেন না–সূর্যমুখীকেও অণুমাত্র তিরস্কার করিলেন না। কমল গলা হইতে কণ্ঠহার খুলিয়া লইয়া গৃহস্থ সকলকে দেখাইয়া বলিলেন, “যে কুন্দকে আনিয়া দিবে, তাহাকে এই হার দিব |”
পাপ হীরা এই সব দেখে শুনে, কিন্তু কিছু বলে না। কমলের হার দেখিয়া এক একবার লোভ হইয়াছিল–কিন্তু সে লোভ সম্বরণ করিল। দ্বিতীয় দিন কাজ করিয়া দুই প্রহরের সময়ে, আয়ির স্নানের সময় বুঝিয়া, কুন্দকে খাওয়াইল। পরে রাত্রে আসিয়া উভয়ে শয্যারচনা করিয়া শয়ন করিল। কুন্দ বা হীরা কেহই নিদ্রা গেল না–কুন্দ আপনার মনের দু:খে জাগিয়া রহিল। হীরা আপন মনের সুখ-দু:খে জাগিয়া রহিল। সেও কুন্দের ন্যায় বিছানায় শুইয়া চিন্তা করিতেছিল। যাহা চিন্তা করিতেছিল, তাহা মুখে অবাচ্য–অতি গোপন।
ও হীরে! ছি! ছি! হীরে! মুখখানি ত দেখিতে মন্দ নয়–বয়সও নবীন, তবে হৃদয়মধ্যে এত খলকপট কেন? কেন? বিধাতা তাহাকে ফাঁকি দিল কেন? বিধাতা তাহাকে ফাঁকি দিয়াছে, সেও সকলকে ফাঁকি দিতে চায়। হীরাকে সূর্যমুখীর আসনে বসাইলে, হীরার কি খলকপট থাকিত? হীরা বলে, “না |” হীরাকে হীরার আসনে বসাইছে বলিয়াই হীরা, হীরা। লোক বলে, “সকলই দুষ্টের দোষ |” দুষ্ট বলে, “আমি ভাল মানুষ হইতাম–কিন্তু লোকের দোষে দুষ্ট হইয়াছি|” লোক বলে, “পাঁচ কেন সাত হইল না?” পাঁচ বলে, “আমি সাত হইতাম–কিন্তু দুই আর পাঁচে সাত–বিধাতা, অথবা বিধাতার সৃষ্ট লোক যদি আমাকে আর দুই দিত, তা হইলেই আমি সাত হইতাম |” হীরা তাহাই ভাবিতেছিল।
হীরা ভাবিতেছিল–“এখন কি করি? পরমেশ্বর যদি সুবিধা করিয়া দিয়াছেন, তবে আপনার দোষে সব নষ্ট না হয়। এদিকে যদি কুন্দকে দত্তের বাড়ী ফিরিয়া লইয়া যাই, তবে কমল হার দিবে, গৃহিণীও কিছু দিবেন–বাবুকেই কি ছাড়িব? আর যদি এদিকে কুন্দকে দেবেন্দ্র বাবুর হাতে দিই, তা হলে অনেক টাকা নগদ পাই। কিন্তু সে ত প্রাণ থাকিতে পারিব না। আচ্ছা, দেবেন্দ্র কুন্দকে কি এত সুন্দরী দেখেছে? আমরা গতর খাটিয়ে খাই; আমরা যদি ভাল খাই, ভাল পরি, পটের বিবির মত ঘর তোলা থাকি, তা হলে আমরাও অমন হতে পারি। আর এটা মিন্মিনে, ঘ্যান্ঘ্যানে, প্যান্প্যানে, সে দেবেন্দ্র বাবুর মর্ম বুঝিবে কি? পাঁক নইলে পদ্মফুল ফুটে না, আর কুন্দ নইলে দেবেন্দ্র বাবুর মনোহরণ হয় না! তা যার কপালে যা, আমি রাগ করি কেন? রাগ করি কেন? হা: কপাল! আর মনকে চোখ ঠার্য়ে কি হবে? ভালবাসার কথা শুনিলে হাসিতাম। বলিতাম ওসব মুখের কথা, লোকে একটা প্রবাদ আছে মাত্র। এখন আর ত হাসিব না। মনে করিয়াছিলাম, যে ভালবাসে, সে বাসুক, আমি ত কখনও কাহাকে ভালবাসিব না। ঠাকুর বল্লে, রহ, তোরে মজা দেখাচ্ছি। শেষে বেগারের দৌলতে গঙ্গাস্নান। পরের চোর ধরতে গিয়ে আপনার প্রাণটা চুরি গেল। কি মুখখানি! কি গড়ন! কি গলা! অন্য মানুষের কি এমন আছে? আবার মিন্সে আমায় বলে, কুন্দকে এনে দে! আর বলতে লোক পেলেন না! মারি মিন্সের নাকে এক কিল। আহা, তার নাকে কিল মেরেও সুখ। দূর হোক, ও সব কথা থাক। ও পথেও ধর্মের কাঁটা। এ জন্মের সুখ-দু:খ অনেক কাল ঠাকুরকে দিয়াছি। তাই বলিয়া কুন্দকে দেবেন্দ্রের হাতে দিতে পারিব না। সে কথা মনে হলেও গা জ্বালা করে; বরং কুন্দ যাহাতে কখনও তার হাতে না পড়ে, তাই করিব। কি করিলে তাহা হয়? কুন্দ যেখানে ছিল, সেইখানে থাকিলেই তার হাতছাড়া। সেই বৈষ্ণবীই সাজুক, আর বাসদেবই সাজুক, সে বাড়ীর ভিতর দন্তস্ফুট হইবে না। তবে সেইখানে কুন্দকে ফিরিয়া রাখিয়া আসাই মত। কিন্তু কুন্দ যাইবে না–আর সে বাড়ীমুখো হইবার মত নাই। কিন্তু যদি সবাই মিলে ‘বাপু বাছা’ ব’লে লইয়া যায়, তবে যাইতেও পারে। আর একটা আমার মনের কথা আছে, ঈশ্বর তাহা কি করবেন? সূর্যমুখীর থোঁতা মুখ ভোঁতা হবে? দেবতা করিলেও হতেও পারে। আচ্ছা, সূর্যমুখীর উপর আমার এত রাগই বা কেন? সে ত কখন আমার কিছু মন্দ করে নাই; বরং ভালই বাসে, ভালই করে। তবে রাগ কেন? তা কি হীরা জানে না? হীরা না জানে কি? কেন, বলবো? সূর্যমুখী সুখী, আমি দু:খী, এই জন্য আমার রাগ। সে বড়, আমি ছোট,-সে মুনিব, আমি বাঁদী। সুতরাং তার উপরে আমার বড় রাগ। যদি বল, ঈশ্বর তাকে বড় করিয়াছেন, তার দোষ কি? আমি তার হিংসা করি কেন? তাতে আমি বলি, ঈশ্বর আমাকে হিংসুকে করেছেন, আমারই বা দোষ কি? তা, আমি খানখা তার মন্দ করিতে চাই না, কিন্তু যদি তার মন্দ করিলে আমার ভাল হয়, তবে না করি কেন? আপনার ভাল কে না করে? তা, হিসাব করিয়া দেখি, কিসে কি হয়। এখন, আমার হলো কিছু টাকার দরকার, আর দাসীপনা পারি না। টাকা আসিবে কোথা থেকে? দত্তবাড়ী বই আর টাকা কোথা? তা দত্তবাড়ীর টাকা নেবার ফিকির এই,-সবাই জানে যে, কুন্দের উপর নগেন্দ্র বাবুর চোখ পড়েছে–বাবু এখন কুন্দমন্ত্রের উপাসক। বড়মানুষ লোক, মনে করিলেই পারে। পারে না কেবল সূর্যমুখীর জন্য। যদি দুজনে একটা চটাচটি হয়, তা হলে আর বড় সূর্যমূখীর খাতির করবে না। এখন একটু চটাচটি হয়, সেইটে আমায় করিতে হবে।
“তা হলেই বাবু ষোড়শোপচারে কুন্দের পূজা আরম্ভ করিবেন। এখন কুন্দ হলো বোকা মেয়ে, আমি হলেম সেয়ানা মেয়ে ; আমি কুন্দকে শীঘ্র বশ করিতে পারিব। এরই মধ্যে তাহার অনেক যোগাড় হয়ে রয়েছে। মনে করলে, কুন্দকে যা ইচ্ছা করি, তাই করাতে পারি। আর যদি বাবু কুন্দের পূজা আরম্ভ করেন, তবে তিনি হবেন কুন্দের আজ্ঞাকারী। কুন্দকে করবো আমার আজ্ঞাকারী। সুতরাং পূজার ছোলাটা কলাটা আমিও পাব। যদি আর দাসীপনা করিতে না হয়, এমনটা হয়, তা হলেই আমার হলো। দেখি, দুর্গা কি করেন। নগেন্দ্রকে কুন্দনন্দিনী দিব। কিন্তু হঠাৎ না। আগে কিছু দিন লুকিয়ে রেখে দেখি। প্রেমের পাক বিচ্ছেদে। বিচ্ছেদে বাবুর ভালবাসাটা পেকে আসবে। সেই সময় কুন্দকে বাহির করিয়া দিব। তাতে যদি সূর্যমুখীর কপাল না ভাঙ্গে, তবে তার বড় জোর কপাল। ততদিন আমি বসে বসে কুন্দকে উঠ্ বস্ করান মকশ করাই। আগে আয়িকে কামারঘাটা পাঠাইয়া দিই, নহিলে কুন্দকে আর লুকিয়ে রাখা যায় না।”
এইরূপ কল্পনা করিয়া পাপিষ্ঠা হীরা সেইরূপ আচরণে প্রবৃত্ত হইল। ছল করিয়া আয়িকে কামারঘাটা কুটুম্ববাড়ী পাঠাইয়া দিল এবং কুন্দকে অতি সঙ্গোপনে আপন বাড়ীতে রাখিল। কুন্দ, তাহার যত্ন ও সহৃদয়তা দেখিয়া ভাবিতে লাগিল, “হীরার মত মানুষ আর নাই। কমলও আমায় এত ভালবাসে না |”