বিষবৃক্ষ

বিষবৃক্ষ

নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমাকে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলতে হচ্ছে। আমি খবরের কাগজের সম্মানিত রিপটার নই। তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টা, যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক (ইপাসনাল) ভাবে আপন বয়ান পাঠকের সম্মুখে পেশ করা। তৎসত্ত্বেও তারা মাঝে মাঝে কটুবাক্য শুনতে পান। পাঠকসাধারণ ভুলে যান, রিপটারও মাটির মানুষ, তারও ধর্মবুদ্ধি আছে, সে-ও অন্যায়-অবিচারের সামনে কখনও কখনও আত্মসংযম না করতে পেরে উত্তেজিত ভাষা ব্যবহার করে। ফলে কখনও-বা কটুবাক্য শুনতে হয়, কখনও-বা হাততালিও পেয়ে যায়। প্রকৃত রিপটার অবশ্য কোনওটারই তোয়াক্কা করে না। সে আত্মপ্রসাদ অনুভব করে যদি দেখে যে, সে নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করতে পেরেছে।

রিপরটার হওয়ার মতো শক্তি আমার নেই। তদুপরি দৈনন্দিন যেসব ঘটনা রিপরুটেড হচ্ছে, তার যদি কোনও ঐতিহাসিক মূল্য না থাকে, সে যদি আমাকে মানবসমাজের পতন উত্থান সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ চিন্তার খোরাক না যোগায় তবে সে জিনিসের প্রতি আপনার-আমার মতো সাধারণজনের চিত্ত আকর্ষিত হয় না।

যেমন ধরুন আরব-ইজরাএল দ্বন্দ্ব। কথার কথা কইছি, কাল যদি মার্কিন, ইংরেজ, ফরাসি, রুশ সবাই একজোট হয়ে একটা সমাধান করে দেন যার চেষ্টা এখন প্রতিদিনই হচ্ছে– তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, উভয় পক্ষই যখন শান্ত হয়ে গেছেন তখন আমরাও নিশ্চিন্ত মনে আর পাঁচটা খবরের দিকে নজর বুলাই। আর রিপরটারদের তো কথাই নেই। দুই প্রতিবেশী শান্তিতে আছে– এটা খবর নয়। দুই প্রতিবেশীতে খুনোখুনি হচ্ছে সেটা খবর। সংবাদ-সরবরাহ-ভুবনের আপ্তবাক্য- কুকুর মানুষকে কামড়ালে সেটা খবর নয়, মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সেটা খবর।

অথচ আমি বিলক্ষণ জানি, আরব-ইজরাএল সমস্যার প্রকৃত সমাধান যে কী, তার সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। নাসির বলছেন, আমি ইজরাএলকে সমূলে উৎপাটন করব। ওদিকে ইজরাএল যেটুকু জমির উপর এখন রাজ করছেন তা নিয়ে যে তিনি একদম সন্তুষ্ট নন, সেকথাও তিনি গোপন রাখেন না। অ্যানটনি ইডন-এর গোঁয়ার অভিযানের ফলে যখন ইজরাএল সৈন্য সবলে মিশরের সাইনাই (সিনাই, আরবিতে(১) সিনিন, সিনা) অধিকার করে তখন আনন্দে উল্লাসে কম্পিত, ভাবাবেগ দমনে অশক্ত ইজরাএল-প্রধান বেন গুরিয়ন যাজকসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেন তার অর্থ, আমরা আমাদের ন্যায্য ভূমি অধিকার করেছি, এ ভূমি আমরা আর কখনও পরিত্যাগ করব না। তাঁকে পরিত্যাগ করতে হয়েছিল (এবং আজ সেখানে পুনরায় দুই দল সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু তার বাক্যের প্রথমার্ধ, অর্থাৎ সাইনাই ইজরাএলের প্রাপ্য, এটা ইজরাএল-দৃষ্টিবিন্দু থেকে সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। রাজা সলমনের (আরবিতে সুলেমান) আমলে ইহুদি রাজত্ব কতখানি বিস্তৃত ছিল সেটা পাঠক বাইবেলের পিছনে যে প্রাচীন যুগের ম্যাপ দেওয়া থাকে সেইটে দেখলেই কিছুটা বুঝতে পারবেন। আজ তার বৃহৎ অংশ লেবানন, সিরিয়া, জর্ডন, মিশরের দখলে। কিন্তু হায়, বিশ্বের আদালত ইজরাএলের আড়াই হাজার বছরের তামাদি এ দাবি মানবে না। প্রায় দু হাজার বছর ধরে ইহুদিরা তাদের পুণ্যভূমি প্যালেস্টাইন ত্যাগ করে দলে দলে সেই সুদূর রুশ দেশ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু একথাও সত্য, ইহুদিদের যাজক-সম্প্রদায় কখনওই আপন পুণ্যভূমিতে ফিরে যাবার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি। কারণ, স্বয়ং ইহুদির সদাজাগ্রত প্রভু য়াহবে ধর্মগ্রন্থ তোরাতে প্রতিজ্ঞা করেছেন, আমি তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব, সেই দুগ্ধ-মধুর দেশে। এ স্বপ্ন বাস্তবে দানা বাঁধতে আরম্ভ করে প্রধানত ঊনবিংশ শতাব্দীতে এরই নাম জায়োনিজম এবং এর প্রধান কেন্দ্র ছিল জরমনিতে। মহাকবি হাইনে কিছুদিন বারলিনে এ আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিন্তু পরে সেটা ত্যাগ করেন; বস্তৃত জায়োনিজমের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই একদল শক্তিশালী ইহুদি এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তাঁদের বক্তব্য ছিল : প্যালেস্টাইনে স্বাধীন ইহুদি রাজ্য নির্মাণের প্রস্তাব দূরে থাক, সেখানে ইহুদিদের জন্য কোনও ধরনেরই খাস ন্যাশনাল হোম করা হবে ভুল। কারণ সে দেশ ছেড়েছি আমরা দু হাজার বছর পূর্বে, এখন (১৯/২০ শতাব্দীতে) সেখানে শতকরা দশজন ইহুদিও বাস করে না, বাদবাকি শতকরা ৭০/৮০ মুসলমান, ১৫/২০ খ্রিস্টান (হিসাবটা খুবই মোটামুটি, কারণ সে যুগে এ অঞ্চলের তুর্কি শাসনকর্তারা আদমশুমারিতে বিশ্বাস করতেন না। এখানে শত শত বছর ধরে বাস করছে (এবং এঁরা না বললেও আমরা জানি, এই মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের অনেকেই গোড়াতে ইহুদি ছিল, পরে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান-খ্রিস্টান হয়। প্রভু যিশু স্বয়ং ইহুদি ছিলেন এবং তিনি যাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দেন তার ৯৯% ছিলেন জাত-ইহুদি। পরবর্তী যুগে এঁদের অনেকেই হয়ে যান মুসলমান)। এঁদের অধিকাংশই চাষা, জেলে। এদের ভিটেমাটি কেড়ে না নিয়ে নবাগত ইহুদিদের বসাবে কোথায়?… তার চেয়ে বহুতর গুণে কাম্য আমরা, ইহুদিরা, যেন যেসব দেশে বাস করি সেইসব দেশের পূর্ণ নাগরিক হয়ে যাই। আমার যতদূর মনে পড়ছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন লয়েড জরজ ইহুদির জন্য ন্যাশনাল হোমের খসড়া বানাচ্ছেন তখন ভারত-খ্যাত ইহুদি (?) মনটাগু এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং বার বার বলেন, এতে করে আখেরে ইহুদিকুলের অমঙ্গল হবে।

কিন্তু যুক্তিতর্ক এক জিনিস আর অনাগত যুগের সুখস্বপ্ন দেখা অন্য বিলাস। রাজকুমারী মীরাকে রাজসভার গুণীজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই অত্যুত্তমরূপে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, বৃন্দাবনের পেভমেন্ট(!) সোনা দিয়ে গড়া নয়, যদ্যপি বর্ষারম্ভে মেঘাগমনে তথাকার আকাশ মেদুর হয় অতি অবশ্য, ঘন তমালমরাজি জনপদভূমিকে শ্যামল করে রাখে নিঃসন্দেহেই, কিন্তু সেস্থলে বিষধর সর্পও ঠিক ওই সময়েই গোপগোপীদের প্রাণহরণ করে, তদুপরি– তদুপরি নিশ্চয়ই সভাসদরা বিস্তর অকাট্য যুক্তিতর্ক দ্বারা সপ্রমাণ করেছিলেন যে, ওই সাতিশয় অগণ্ডগ্রাম রাজকন্যার বাসভূমি হওয়ার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত, তথাপি তিনি স্বপ্ন দেখছেন,

চাকর রহসু বাগ লাগাসু
 নিতি উঠি দরশন্ পাসুঁ
 বৃন্দাবনকে কুঞ্জগলিমে
তেরি লীলা গাসুঁ!

 পিস্তলের বুলেট দিয়ে যেরকম ভূত মারা যায় না, যুক্তিতর্কের খাণ্ডার দিয়েও সুখস্বপ্ন খণ্ডবিখণ্ড করা যায় না।

স্বপ্ন দিয়ে তৈরি আর স্মৃতি দিয়ে গড়া মেলা ঝামেলার ভিতর রিপটার অনুপ্রবেশ করে খামখা হয়রান হতে চান না তাই বলেছিলুম, আমি রিপটার নই, হবার মতো এলেম ও হক্কও আমার নেই।

কিন্তু সেই ১৯২৯ থেকে আমি গণ্ডায় গণ্ডায় ইহুদিদের সংস্পর্শে এসেছি। বোম্বাই অঞ্চলে শনিবারের তিলি নামে পরিচিত এদেশে অতি প্রাচীনকালে আগত ইহুদিদের সঙ্গে আমি বাস করেছি (ব্যক্তিগতভাবে আমি এঁদেরই ইহজগতের সর্বোত্তম ইহুদি বলে মনে করি), দিগ্বিজয়ী ইহুদি পণ্ডিতের কাছে হিব্রু শেখার নিষ্ফল প্রচেষ্টা আমি দিয়েছি (দোষ রাব্বির নয়, আমার) ইহুদির (তথা খ্রিস্টান ও মুসলমানেরও) পুণ্যভূমিতে আমি বাস করেছি, জরডনের পাক পানিতে ওজু করেছি, গ্যালিলীয় হ্রদের অতিশয় সুস্বাদু মৎস্য আমি দিনের পর দিন দু বেলা পরম তৃপ্তি সহকারে ভক্ষণ করেছি, বস্তুত প্যালেস্টাইনের উত্তরতম সীমান্ত থেকে যেখানে সিরিয়া আজ সৈন্য সমাবেশ করেছে দক্ষিণতম সীমান্ত গিজা অবধি, তথা পূর্বতম সীমান্ত (ট্র্যান্স) জরডন থেকে পশ্চিমতম সীমান্তের খাস ইহুদি নগরী তেলআবিব (বসগিরি) পর্যন্ত অবাধে যাতায়াত করেছি।

***

পরম পরিতাপের বিষয় উপরের ছত্রের কালি শুকোতে না শুকোতে মর্মান্তিক দুঃসংবাদ এসেছে যে, আরবে-ইহুদিতে কোনওপ্রকারের সমঝতা সম্ভবপর হল না বলে সশস্ত্র যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।

এ দুঃসংবাদের পর বিমূঢ় মূহ্যমান হয়ে আমার এ অক্ষম লেখনী আর এগোতে চায় না।

যদি ইজরাএল হারে তবে তার তিনদিকের আরব বেদুইন ও বাস্তুহারা আরব (প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার) যারা জরডন অঞ্চলে কেউ কুড়ি বছর ধরে, কেউ-বা এগারো বছর ধরে তাঁবুতে তাঁবুতে দুঃখদৈন্যের জীবন কাটাতে কাটাতে এই মহালগ্নের অপেক্ষা করছিল তারা পঙ্গপালের মতো সমস্ত ইজরাএলে ছেয়ে পড়ে বালবৃদ্ধনারী কাউকে নিষ্কৃতি দেবে না। হিটলারকে ছাড়িয়ে যাবে।

আর সম্মিলিত আরব জাতিপুঞ্জ যদি হেরে যায় তবে তাদের সে অবমাননা ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও তাদের সে অবমাননা, তাদের আত্মসম্মানবোধের পরিপূর্ণ পদদলিত বিনাশ তাদের করে তুলবে নিষ্ঠুরের চেয়েও নিষ্ঠুর, সর্বনেশে ভবিষ্যতের প্রতিশোধকারী জিঘাংসু জীবন্ত প্রেতাত্মার মতো।

মধ্যযুগের সেই নির্মম ক্রুসেডের মতো এর প্রস্তুতি চলবে পুনরায় শত বছর ধরে, পরিণাম হবে শত শত বর্ষব্যাপী।

প্রথম লেখনেই আরম্ভ করেছিলুম এই বলে যে, এ তো শুধু অবতরণিকা। মনে মনে দুরাশা করেছিলুম, এই বিষবৃক্ষের চারাটাকে বিশ্বমানবের শুভবুদ্ধি হয়তো-বা উৎপাটিত করে দেবে; এখন দেখছি, এই শিশু বিষবৃক্ষ মহীরুহ হয়ে উঠবে একদিন শত শত বছর ধরে এ বিষবৃক্ষ পাবে উভয়পক্ষের ক্রোধোন্মত্ত প্রতিশোধ কামনার অপবিত্র শূকররক্তের উর্বরতাদায়ক খাদ্যনিষ্কর্য।

এ বিষবৃক্ষকে তখন আর সমূলে উৎপাটিত করা যাবে না।

যদি যায়, কিংবা বিধির আদেশে কোনও দৈবাগত ঝঞ্ঝায় সে ভূপাতিত হয় তবে সে মৃত্যুবরণ করার পূর্বে সঙ্গে নিয়ে যাবে অসংখ্য নরনারী বালবৃদ্ধকে নিষ্পিষ্ট করে তাদের প্রাণবায়ু ॥

আরব-ইজরাএল যুদ্ধারম্ভ দিবস।

————

১. ইহুদি আরব উভয়ের কাছেই এ গিরি পূতপবিত্র। কুরানশরীফে আল্লাতালা এর নাম নিয়ে শপথ গ্রহণ করেছেন। ৯৫ সুরা, ২য় ছত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *