গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

বিষকন্যা

বিষকন্যা

যে কালের উপর চিরবিস্মরণের পর্দা পড়িয়া গিয়াছে, সেকাল মিলনোৎকণ্ঠিতা নবযৌবনা নাগরী যখন সন্ধ্যাসমাগমে ভবনশীর্ষে উঠিয়া কেশপ্রসাধনে প্রবৃত্ত হইতেন, তখন তাঁহার স্বর্ণমুকুরে যে উৎফুল্ল-উৎসুক স্মিত-সলজ্জ মুখের প্রতিবিম্ব পড়িত, তাহা এ কালেও আমরা সহজে অনুমান করিতে পারি। চিরন্তনী নারীর ঐ মূর্তিটিই শুধু শাশ্বত— যুগে যুগান্তরে অচপল হইয়া আছে। কেবলমাত্র ঐ নিদর্শন দ্বারাই তাঁহাকে সেই নারী বলিয়া চিনিয়া লইতে পারি।

কিন্তু অন্য বিষয়ে—?

সে যাক। প্রসাধনরতা সুন্দরীর দ্রুত অধীর হস্তে গজদন্ত-কঙ্কতিকা কেশ কর্ষণ করিয়া চলিতে থাকে। ক্রমে দুটি একটি উন্মূলিত কেশ কঙ্কতিকায় জড়াইয়া যায়; প্রসাধনশেষে সুন্দরী কঙ্কতিকা হইতে বিচ্ছিন্ন কেশগুচ্ছ মুক্ত করিয়া অন্যমনে দুই চম্পক-অঙ্গুলীর দ্বারা গ্রন্থি পাকাইয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। ক্ষুদ্র কেশগ্রন্থি অবহেলার লক্ষ্যহীন বায়ুভরে উড়িয়া কোন্‌ বিস্মৃতির উপকূলে বিলীন হইয়া যায়, কে তাহার সন্ধান রাখে?

তেমনই, বহু বহু শতাব্দী পূর্বে একদা কয়েকটি মানুষের জীবন-সূত্র যেভাবে গ্রন্থি পাকাইয়া গিয়াছিল, ইতিহাস তাহার সন্ধান রাখে না। মহাকালভুজগের যে বক্ষচিহ্ন একদিন ধরিত্রীর উপর অঙ্কিত হইয়াছিল, তাহা নিশ্চিহ্ন হইয়া মুছিয়া গিয়াছে। মৃন্ময়ী চিরনবীনা, বৃদ্ধ অতীতের ভোগ-লাঞ্ছন সে চিরদিন বক্ষে ধারণ করিয়া রাখিতে ভালবাসে না। নিত্য নব নব নাগরের গৃহে তাহার অভিসার। হায় বহুভর্তৃকা, তোমার প্রেম এত চপল বলিয়াই কি তুমি চিরযৌবনময়ী?

দুই সহস্র বৎসরেরও অধিক কাল হইল, যে কয়টি স্বল্পায়ু নর-নারীর জীবনীসূত্র সুন্দরীর কুটিল কেশকুণ্ডলীর মতো জড়াইয়া গিয়াছিল, তাহাদের কাহিনী লিখিতে বসিয়াছি। লিখিতে বসিয়া একটা বড় বিস্ময় জাগিতেছে। জন্মজন্মান্তরের জীবন তো আমার নখদর্পণে, সহস্র জন্মের ব্যথা-বেদনা আনন্দের ইতিহাস তো এই জাতিস্মরের মস্তিষ্কের মধ্যে পুঞ্জীভূত হইয়া আছে, তবু যতই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আমার বিগত জীবনের আলোচনা করি না কেন, দেখিতে পাই, কোনও না কোনও নারীকে কেন্দ্র করিয়া আমার জীবন আবর্তিত হইয়াছে; জীবনে যখনই কোনও বৃহৎ ঘটনা ঘটিয়াছে, তখনই তাহা এক নারীর জীবনের সঙ্গে জড়াইয়া গিয়াছে। নারীদ্বেষক হইয়া জন্মিয়াছি, কিন্তু তবু নারীকে এড়াইতে পারি নাই। বিস্ময়ের সহিত মনে প্রশ্ন জাগিতেছে— পৃথিবীর শত কোটি মানুষের জীবন কি আমারই মতো? ইহাই কি জীবনের অমোঘ অলঙ্ঘনীয় রীতি? কিংবা— আমি একটা সৃষ্টিছাড়া ব্যতিক্রম?

ন্যূনাধিক চব্বিশ শতাব্দী পূর্বের কথা। বুদ্ধ তথাগত প্রায় শতাধিক বর্ষ হইল নির্বাণ লাভ করিয়াছেন। উত্তর ভারতে চারিটি রাজ্য— কাশী কোশল লিচ্ছবি ও মগধ। চারিটি রাজ্যের মধ্যে বংশানুক্রমে অহি-নকুলের সম্বন্ধ স্থায়িভাব ধারণ করিয়াছে। পাটলিপুত্রের সিংহাসনে শিশুনাগবংশীয় এক অশ্রুতকীর্তি রাজা অধিরূঢ়।

শিশুনাগবংশের ইতিবৃত্ত পুরাণে আদ্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে লিপিবদ্ধ হইতে পায় নাই, অজাতশত্রুর পর হইতে কেমন যেন এলোমেলো হইয়া গিয়াছে। তাহার কারণ, অমিতবিক্রম অজাতশত্রুর পর হইতে মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের অভ্যুদয় পর্যন্ত মগধে এক প্রকার রাষ্ট্রীয় বিপ্লব চলিয়াছিল। পিতাকে হত্যা করিয়া রাজ্য অধিকার শিশুনাগরাজবংশের একটা বৈশিষ্ট্য হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, বিপুল রাজপরিবারের মধ্যে সিংহাসনের জন্য হানাহানি অন্তর্বিবাদ সহজ ও প্রকৃতিসিদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। বংশের একজন শক্তিশালী ব্যক্তি রাজাকে বিতাড়িত করিয়া নিজে সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন, ইহার কিছুকাল পরে পূর্ববর্তী রাজা শক্তি সংগ্রহ করিয়া আবার সিংহাসন পুনরুদ্ধার করিলেন— এইভাবে ধারাবাহিক শাসন-পারম্পর্য নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। বলা বাহুল্য, প্রজারাও সুখে ছিল না। তাহারা মাঝে মাঝে মাৎস্যন্যায় করিয়া রাজাকে মারিয়া আর একজনকে তাহার স্থানে বসাইয়া দিত। সেকালে প্রকৃতিপুঞ্জের সহিষ্ণুতা আধুনিক কালের মতো এমন সর্বংসহা হইয়া উঠিতে পারে নাই, প্রয়োজন হইলে ধৈর্যের শৃঙ্খল ছিঁড়িয়া যাইত। তখন শ্রীমন্মহারাজের শোণিতে পথের ধূলি নিবারিত হইত, তাঁহার জঠর-নিষ্কাশিত অন্ত্র দ্বারা রাজপুরী পরিবেষ্টিত করিয়া জিঘাংসু বিদ্রোহীর দল প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিত।

সে যাক। পুরাণে শিশুনাগবংশীয় মহারাজ চণ্ডের নাম পাওয়া যায় না। চণ্ডের প্রকৃত নাম কি ছিল তাহাও লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল। মহিষের মতো আকৃতির মধ্যে রাক্ষসের মতো প্রকৃতি লইয়া ইনি কয়েক বৎসর মগধে রাজত্ব করিয়াছিলেন। তার পর— কিন্তু সে পরের কথা।

রাজ-অবরোধে এক দাসী একটি কন্যা প্রসব করিয়াছিল। অবশ্য মহারাজ চণ্ডই কন্যার পিতা; সুতরাং সভাপণ্ডিত নবজাত কন্যার কোষ্ঠী তৈয়ার করিলেন।

কোষ্ঠী পরীক্ষা করিয়া পণ্ডিত বলিলেন— ‘শ্রীমন্‌, এই কন্যা অতিশয় কুলক্ষণা, প্রিয়জনের অনিষ্টকারিণী— সাক্ষাৎ বিষকন্যা। ইহাকে বর্জন করুন।’

সিংহাসনে আসীন মহারাজের বন্ধুর ললাটে ভীষণ ভ্রূকুটি দেখা দিল; পণ্ডিত অন্তরে কম্পিত হইলেন। স্পষ্ট কথা মহারাজ ভালবাসেন না; স্পষ্ট কথা বলিয়া অদ্যই সচিব শিবমিশ্রের যে দশা হইয়াছে, তাহা সকলেই জানে। পণ্ডিত স্খলিত বচনে বলিলেন— ‘মহারাজ, আপনার কল্যাণের জন্যই বলিতেছি, এ কন্যা বর্জনীয়া।’

কিন্তু মহারাজের ভ্রূকুটি শিথিল হইল না। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘কোন্‌ প্রিয়জনের অধিক অনিষ্ট হওয়া সম্ভব?’

পণ্ডিত পুনরায় কোষ্ঠী দেখিলেন, তারপরে ভয়ে ভয়ে বলিলেন— ‘উপস্থিত পিতা-মাতা সকলেরই অনিষ্ট-সম্ভাবনা রহিয়াছে। মঙ্গল সপ্তমে ও শনি অষ্টমে থাকিয়া পিতৃস্থানে পূর্ণদৃষ্টি করিতেছে।’

কে কোথায় দৃষ্টি করিতেছে তাহা জানিবার কৌতূহল মহারাজের ছিল না। তাঁহার মুখে স্ফুরিত-বিদ্যুৎ বৈশাখী মেঘ ঘনাইয়া আসিল। মহারাজের সাম্যদৃষ্টির সম্মুখে অপরাধী ও নিরপরাধের প্রভেদ নাই— অশুভ বা অপ্রীতিকর কথা যে উচ্চারণ করে সেই দণ্ডার্হ। এ ক্ষেত্রে শনি-মঙ্গলের পাপদৃষ্টির ফল যে জ্যোতিষাচার্যের শিরে বর্ষিত হইবে না, তাহা কে বলিতে পারে? পণ্ডিত প্রমাদ গণিলেন।

সভা-বিদূষক বটুকভট্ট সিংহাসনের পাশে বসিয়াছিল। সে খর্বকায় বামন, মস্তকটি বৃহদাকার, কণ্ঠস্বর এরূপ তীক্ষ্ণ যে, মনে হয় কর্ণের পটহ ভেদ করিয়া যাইবে। পণ্ডিতের দুরবস্থা দেখিয়া সে সূচ্যগ্রসূক্ষ্ম কণ্ঠে হাসিয়া উঠিল, বলিল— ‘বিষকন্যা! তবে তো ভালই হইয়াছে, মহারাজ! এই দাসীপুত্রীকে সযত্নে পালন করুন। কালে যৌবনবতী হইলে ইহাকে নগর-নটির পদে অভিষিক্ত করিবেন। আপনার দুষ্ট প্রজারা অচিরাৎ যম-মন্দিরে প্রস্থান করিবে।’

বটুকভট্টকে রাজ-পার্ষদ সকলেই ভালবাসিত, শুধু তাহার বিদূষণ-চাতুর্যের জন্য নয়, বহুবার বহু বিপন্ন সভাসদ্‌কে সে রাজরোষ হইতে উদ্ধার করিয়াছিল।

তাহার কথায় মহারাজের ভ্রূগ্রন্থি ঈষৎ উন্মোচিত হইল, তিনি বামহস্তে বটুকের কেশমুষ্টি ধরিয়া তাহাকে শূন্যে তুলিয়া ধরিলেন। সূত্রাগ্রে ব্যাদিত-মুখ মৎস্যের ন্যায় বটুক ঝুলিতে লাগিল।

রাজা বলিলেন— ‘বটু, তোর জিহ্বা উৎপাটিত করিব।’

বটুক তৎক্ষণাৎ দীর্ঘ জিহ্বা বাহির করিয়া দিল। রাজা হাস্য করিয়া তাহাকে মাটিতে নামাইলেন। পণ্ডিতের ফাঁড়া কাটিয়া গেল।

ভৃঙ্গারে মাধবী ছিল। রাজার কটাক্ষমাত্রে কিঙ্করী চষক ভরিয়া তাঁহার হস্তে দিল। চষক নিঃশেষ করিয়া রাজা বলিলেন— ‘এখন এই বিষকন্যাটাকে লইয়া কি করা যায়?’

গণদেব নামক একজন চাটুকার পার্ষদ বলিল— ‘মহারাজ, উহাকেও শিবমিশ্রের পথে প্রেরণ করুন— রাজ্যের সমস্ত অনিষ্ট দূর হউক।’

মহারাজ চণ্ডের রক্ত-নেত্রে একটা ক্রূর কৌতুক নৃত্য করিয়া উঠিল, তিনি স্বভাবস্ফীত অধর প্রসারিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘মহাসচিব শিবমিশ্র মহাশয় এখন কি করিতেছেন, কেহ বলিতে পার?’

গণদেব মুণ্ড আন্দোলিত করিয়া মুখভঙ্গি সহকারে বলিল— ‘এইমাত্র দেখিয়া আসিতেছি, তিনি শ্মশানভূমিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হইয়া শ্মশান-শোভা নিরীক্ষণ করিতেছেন। ব্রাহ্মণভোজন করাইব বলিয়া কিছু মোদক লইয়া গিয়াছিলাম, কিন্তু দেখিলাম ব্রাহ্মণের মিষ্টান্নে রুচি নাই।’ বলিয়া নিজ রসিকতায় অতিশয় উৎফুল্ল হইয়া চারিদিকে তাকাইল।

মহারাজা অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন, বলিলেন— ‘ভাল। অদ্য নিশাকালে শিবাদল আসিয়া শিবমিশ্রের মুণ্ড ভক্ষণ করিবে।’ তারপর ভীষণ দৃষ্টিতে চতুর্দিকে চাহিয়া বলিলেন— ‘শিবমিশ্র আমার আজ্ঞার প্রতিবাদ করিয়াছিল, তাই আজ তাহাকে শৃগালে ছিঁড়িয়া খাইবে। — তোমরা এ কথা স্মরণ রাখিও।’

সভা স্তব্ধ হইয়া রহিল, কেহ বাক্য উচ্চারণ করিতে সাহসী হইল না।

রাজা তখন সভা-জ্যোতিষীকে বলিলেন— ‘পণ্ডিতরাজ, আপনার অভিমত রাজ্যের কল্যাণে এ কন্যা বর্জিত হউক। ভাল, তাহাই হইবে। কন্যা ও কন্যার মাতা উভয়েই আদ্য রাত্রিতে শ্মশানে প্রেরিত হইবে। সেখানে কন্যার মাতা স্বহস্তে কন্যাকে শ্মশানে প্রোথিত করিবে। তাহা হইলে দৈব আপদ দূর হইবে তো?’

পণ্ডিত শিহরিয়া উঠিয়া বলিলেন— ‘মহারাজ, এরূপ কঠোরতা নিস্প্রয়োজন। কন্যাকে ভাগীরথীর জলে বিসর্জন করুন, কিন্তু কন্যার মাতা নিরপরাধিনী— তাহাকে—’

রাজা গর্জিয়া উঠিলেন— ‘নিরপরাধিনী! সে এরূপ কন্যা প্রসব করে কেন?— যাক, আপনার বাগ্‌বিস্তারেতে প্রয়োজন নাই, যাহা করিবার আমি স্বহস্তে করিব।’ বলিয়া মহারাজ সিংহাসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

যাহার দুর্দম দানবপ্রকৃতি মর্ত্যলোকে কোনও বস্তুকে ভয় করিত না, দৈব আপদের আশঙ্কা তাহাকে এমনই অমানুষিক নিষ্ঠুরতায় জ্ঞানশূন্য করিয়া তুলিয়াছিল যে, নিজ ঔরসজাত কন্যার প্রতি তাহার চিত্তে তিলমাত্র মমতার অবকাশ ছিল না।

পাটলিপুত্র নগরের চৌষট্টি দ্বার, তন্মধ্যে দশটি প্রধান ও প্রকাশ্য। বাকিগুলি অধিকাংশই গুপ্তপথ।

এই গুপ্তপথের একটি রাজপ্রাসাদসংলগ্ন; রাজা বা রাজপরিবারস্থ যে কেহ ইচ্ছা করিলে এই দ্বারপথে নগর-প্রাকারের বাহিরে যাইতে পারিতেন। তাল-কাণ্ডের একটি শীর্ণ সেতু ছিল, তাহার সাহায্যে পরিখা পার হইতে হইত। এই স্থানে গঙ্গাপ্রবাহের সহিত খনিত পরিখা মিলিত হইয়াছিল।

পরিখার পরপারে কিছু দূর যাইবার পর গঙ্গাতটে পাটলিপুত্রের মহাশ্মশান আরম্ভ হইয়াছে;— যত দূর দৃষ্টি যায়, তরুগুল্মহীন ধু ধু বালুকা। বালুকার উপর অগণিত লৌহশূল প্রোথিত রহিয়াছে; শূলগাত্রে কোথাও অর্ধপথে বীভৎস উলঙ্গ মনুষ্যদেহ বিদ্ধ হইয়া আছে, কোথাও শুষ্ক নরকঙ্কাল শূলমূলে পুঞ্জীভূত হইয়াছে। চারিদিকে শত শত নরকপাল বিক্ষিপ্ত। দিবাভাগেই এই মহাশ্মশানের দৃশ্য অতি ভয়ঙ্কর; অপিচ, রাত্রিকালে নগরীর দ্বার রুদ্ধ হইয়া গেলে এই মনুষ্যহীন মৃত্যুবাসরে যে পিশাচ-পিশাচীর নৃত্য আরম্ভ হয়, তাহা কল্পনা করিয়াই পাটলিপুত্রের নাগরিকরা শিহরিয়া উঠিত। দণ্ডিত অপরাধী ভিন্ন রাত্রিকালে মহাশ্মশানে অন্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল— চণ্ডালরাও মহাশ্মশানের অনির্বাণ চুল্লীতে কাষ্ঠ নিক্ষেপ করিয়া সন্ধ্যাকালে গৃহে প্রতিগমন করিত।

সে-রাত্রে আকাশে সপ্তমীর খণ্ড চন্দ্র উদিত হইয়াছিল। অপরিস্ফুট আলোক শ্মশানের বিস্তীর্ণ বালুকারাশির উপর যেন একটা শ্বেতাভ কুজ্ঝটিকা প্রসারিত করিয়া দিয়াছিল। তটলেহী গঙ্গার ধূসর প্রবাহ চন্দ্রালোকে কৃষ্ণবর্ণ প্রতিভাত হইতেছিল। শ্মশান ও নদীর সন্ধিরেখার উপর দূরে অনির্বাণ চুল্লীর আরক্ত অঙ্গার জ্বলিতেছিল।

প্রথম প্রহর রাত্রি— প্রাকাররুদ্ধ পাটলিপুত্রে এখনও নগরগুঞ্জন শান্ত হয় নাই; কিন্তু শ্মশানে ইহারই মধ্যে যেন প্রেতলোকের অশরীরী উৎসব আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। চক্ষে কিছু দেখা যায় না, তবু মনে হয়, সূক্ষ্মদেহ পিশাচী-ডাকিনীরা চক্ষু-খদ্যোত জ্বালিয়া লুব্ধ লালায়িত রসনায় গলিত শবমাংস অন্বেষণ করিয়া ফিরিতেছে। আকাশে নিশাচর পক্ষীর পক্ষশব্দ যেন তাহাদেরই আগমনর্বাতা ঘোষণা করিতেছে।

এই সময়, যে দিকে রাজপ্রাসাদের গুপ্তদ্বার, সেই দিক হইতে এক নারী ধীরে ধীরে শ্মশানের দিকে যাইতেছিল। রমণীর এক হস্তে একটি লৌহখনিত্র, অন্য হস্তে বক্ষের কাছে একটি ক্ষুদ্র বস্তুপিণ্ড ধরিয়া আছে। ক্ষীণ চন্দ্রের অস্পষ্ট আলোকে রমণীর আকৃতি ভাল দেখা যায় না; সে যে যুবতী ও এক সময় সুন্দরী ছিল, তাহা তাহার রক্তহীন মুখ ও শীর্ণ কঙ্কালসার দেহ দেখিয়া অনুমান করাও দুরূহ। অতি কষ্টে দুর্ভর দেহ ও লৌহখনিত্র বহন করিয়া জরাজীর্ণ বৃদ্ধার মতো সে চলিয়াছে। রুক্ষ কেশজাল মুখে বক্ষে ও পৃষ্ঠে বিপর্যস্তভাবে পড়িয়া আছে। রমণী মাঝে মাঝে দাঁড়াইতেছে, ত্রাস-বিমূঢ় চক্ষে পিছু ফিরিয়া চাহিতেছে, আবার চলিতেছে।

শ্মশানের সীমান্তে পৌঁছিয়া সে জানু ভাঙিয়া পড়িয়া গেল। তাহার কণ্ঠ হইতে একটি কাতর আর্তস্বর বাহির হইল; সেই সঙ্গে বক্ষের বস্ত্রপিণ্ডের ভিতর হইতেও ক্ষীণ ক্রন্দনধ্বনি শ্রুত হইল।

কিছুক্ষণ পড়িয়া থাকিবার পর রমণী আবার উঠিয়া চলিতে লাগিল। ক্রমে সে শ্মশানের বীভৎস দৃশ্যাবলীর মাঝখানে আসিয়া উপস্থিত হইল।

একবার সে চক্ষু তুলিয়া দেখিল, সম্মুখে দীর্ঘ শূল প্রোথিত রহিয়াছে; শূলশীর্ষে বিকট ভঙ্গিমায় এক নরমূর্তি বিদ্ধ হইয়া আছে, শূলনিন্মে দুইটা শৃগাল ঊর্ধ্বমুখ হইয়া সেই দুষ্প্রাপ্য ভক্ষ্যের দিকে তাকাইয়া আছে। চন্দ্রালোকে তাহাদের চক্ষু জ্বলিতেছে।

রমণী চিৎকার করিয়া পলাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু অধিক দূর যাইতে পারিল না, কয়েক পদ গিয়া আবার বালুর উপর পড়িয়া গেল।

এবার দীর্ঘকাল পরে রমণী উঠিয়া বসিল। বোধ হয় সংজ্ঞা হারাইয়াছিল, উঠিয়া বসিয়া ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিল। বক্ষের বস্ত্রপিণ্ড ভূমিতে পড়িয়া গিয়াছিল, সেদিকে দৃষ্টি পড়িতেই সে উন্মত্তের মতো উঠিয়া খনিত্র দিয়া বালু খনন করিতে আরম্ভ করিল।

অল্পকালমধ্যে একটি নাতিগভীর গর্ত হইল। তখন রমণী সেই বস্তুপিণ্ড তুলিয়া লইয়া গর্তে নিক্ষেপ করিল— আমনই ক্ষীণ নির্জীব ক্রন্দনধ্বনি উত্থিত হইল। রমণী দুই হাতে কান চাপিয়া কিয়ৎকাল বসিয়া রহিল, তারপর বালু দিয়া গর্ত পূরণ করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু পারিল না। সহসা দুই বাহু বাড়াইয়া বস্ত্রকুণ্ডলী গর্ত হইতে তুলিয়া লইয়া সজোরে নিজ বক্ষে চাপিয়া ধরিল। একটা ধাবমান শৃগাল তাহার অতি নিকট দিয়া তাহার দিকে গ্রীবা বাঁকাইয়া চাহিতে চাহিতে ছুটির গেল; বাহ্য-চেতনাহীন রমণী তাহা লক্ষ্য করিল না।

অতঃপর মৃগতৃষ্ণিকাভ্রান্ত মৃগীর মতো নারী আবার এক দিকে ছুটিতে লাগিল। তখন তাহার আর ইষ্টানিষ্ট-জ্ঞান নাই— কোন্‌ দিকে ছুটিয়াছে তাহাও জানে না; শুধু পূর্ববৎ এক হস্তে খনিত্র ধরিয়া আছে, আর অপর হস্তে সেই বস্ত্রাবৃত জীবনকণিকাটুকু বক্ষে আঁকড়িয়া আছে।

কিছু দূর গিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল; সম্মুখে দূরে গঙ্গার শ্যামরেখা বোধ করি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। কয়েক মুহূর্ত বিহ্বল-বিস্ফারিত নেত্রে সেই দিকে তাকাইয়া থাকিয়া, যেন সহসা উদ্ধারের পথ খুঁজিয়া পাইয়াছে, এমনই ভাবে সে হাসিয়া উঠিল। তারপর অসীমবলে অবসন্ন দেহ সেই দিকে টানিয়া লইয়া চলিল।

মানব-মানবীর জীবনে এরূপ অবস্থা কখনও কখনও আসে— যখন তাহারা মৃত্যুকে বরণ করিবার জন্য হাহাকার করিয়া ছুটিয়া যায়।

জাহ্নবীর শীতল বক্ষে পৌঁছিতে আর বিলম্ব নাই, মধ্যে মাত্র ছয়-সাত দণ্ড বালুভূমির ব্যবধান, এই সময় রমণীর মুহ্যমান চেতনা পার্শ্বের দিকে এক প্রকার শব্দ শুনিয়া আকৃষ্ট হইল। শব্দটা যেন মনুষ্যের কণ্ঠস্বর— অর্ধব্যক্ত তর্জনের মতো শুনাইল। রমণীর গতি এই শব্দে আপনিই রুদ্ধ হইয়া গেল। সে মুখ ফিরাইয়া দেখিল, চন্দ্রালোকে শুভ্র বালুকার উপর একপাল শৃগাল কোনও অদৃশ্য কেন্দ্রের চারিধারে ব্যূহ রচনা করিয়া রহিয়াছে। তাহাদের লাঙ্গুল বহির্দিকে প্রসারিত। ঐ শৃগালাচক্রের মধ্য হইতে মনুষ্যকণ্ঠের তর্জন মাঝে মাঝে ফুঁসিয়া উঠিতেছে, অমনি শৃগালের দল পিছু হটিয়া যাইতেছে। আবার ধীরে ধীরে অলক্ষিতে তাহাদের চক্র সঙ্কুচিত হইতেছে।

রমণী যন্ত্রচালিতের মতো কয়েক পদ সেই দিকে অগ্রসর হইল। শৃগালের একজন জীবন্ত মনুষ্যকে আসিতে দেখিয়া দংষ্ট্রাবিকাশ করিয়া দূরে সরিয়া গেল। তখন মধ্যস্থিত বস্তুটি দৃষ্টিগোচর হইল।

মাটির উপর কেবল একটি দেহহীন মুণ্ড রহিয়াছে। মুণ্ডের দুই বিক্ষত গণ্ড হইতে রক্ত ঝরিতেছে, চক্ষে উন্মত্ত দৃষ্টি। মুণ্ড রমণীর দিকেই তাকাইয়া আছে।

রমণী এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখিয়া অস্ফুট চিৎকার করিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

মুণ্ড তখন বিকৃত স্বরে বলিল— ‘তুমি প্রেত পিশাচ নিশাচর যে হও, আমাকে উদ্ধার কর।’

মানুষের কণ্ঠস্বরে রমণীর সাহস ফিরিয়া আসিল। সে আরও কয়েক পদ নিকটে আসিল; রুদ্ধ শুষ্ক কণ্ঠ হইতে অতি কষ্টে শব্দ বাহির করিল— ‘কে তুমি?’

মুণ্ড বলিল— ‘আমি মানুষ, ভয় নাই। আমার দেহ মাটিতে প্রোথিত আছে— উদ্ধার কর।’

রমণী তখন কাছে আসিয়া ভাল করিয়া তাহার মুখ দেখিল, দেখিয়া সংহত অস্ফুট স্বরে বলিল— ‘মন্ত্রী শিবমিশ্র!’ — তারপর খনিত্র দিয়া প্রাণপণে মাটি খুঁড়িতে আরম্ভ করিল।

মৃত্তিকাগর্ভ হইতে বাহিরে আসিয়া শিবমিত্র কিয়াৎকাল মৃত্যুবৎ মাটিতে শুইয়া রহিলেন। তারপর ধীরে ধীরে দুই হস্তে ভর দিয়া উঠিয়া বসিলেন। রমণীর ক্ষীণ অবসন্ন দেহ তখন ভূমিশয্যায় লুটাইয়া পড়িয়াছে।

শিবমিশ্রের শৃগালদ্রষ্ট গণ্ড হইতে রক্ত ঝরিতেছিল, তিনি সন্তর্পণে তাহা মুছিলেন। রমণীর রক্তলেশহীন পাংশু মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন— ‘দুর্ভাগিনি, তুমি কোন্‌ অপরাধে রাত্রিকালে মহাশ্মশানে আসিয়াছ?’

রমণী নীরবে পাশ্বর্স্থ বস্ত্রপিণ্ড দেখাইয়া দিল, শিবমিশ্র দেখিলেন— একটি শিশু। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘তোমার পরিচয় কি? তুমি আমার প্রাণদাত্রী, তোমার নাম স্মরণ করিয়া রাখিতে চাহি।’

রমণী নির্জীব কণ্ঠে বলিল— ‘আমার নাম মোরিকা— আমি রাজপুরীর দাসী।’

শিবমিশ্র সচকিত হইলেন, বলিলেন— ‘বুঝিয়াছি। তুমি কবে এই সন্তান প্রসব করিলে?’

‘আজ প্রভাতে!’

শিবমিশ্র কিছুক্ষণ স্তব্ধ রহিলেন।

‘হতভাগিনি! কিন্তু তুমি শ্মশানে প্রেরিত হইলে কেন? পরমভট্টারকের সন্তান গর্ভে ধারণ করা কি এতই অপরাধ?’

মোরিকা বলিল— ‘সভাপণ্ডিত গণনা করিয়া বলিয়াছেন, আমার কন্যা রাজ্যের অনিষ্টকারিণী বিষকন্যা— তাই—’

‘বিষকন্যা!’ শিবমিশ্রের চক্ষু সহসা জ্বলিয়া উঠিল— ‘বিষকন্যা! দেখি!’

শিবমিশ্র ব্যগ্রহস্তে শিশুকে তুলিয়া লইলেন। তখন চন্দ্র অস্ত যাইতেছে, ভাল দেখিতে পাইলেন না। তিনি শিশুকে ক্রোড়ে লইয়া দূরে চুল্লীর দিকে দ্রুতপদে চলিলেন।

চুল্লীর অঙ্গারের উপর ভস্মের প্রচ্ছদ পড়িয়াছে। শিবমিশ্র একখণ্ড অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠ তাহাতে নিক্ষেপ করিলেন— অগ্নিশিখা জ্বলিয়া উঠিল।

তখন সেই শ্মশান-চুল্লীর আলোকে শিবমিশ্র নবজাত কন্যার দেহলক্ষণ পরীক্ষা করিলেন। পরীক্ষা করিতে করিতে তাঁহার রক্তলিপ্ত মুখে এক পৈশাচিক হাস্য দেখা দিল।

তিনি মোরিকার নিকট ফিরিয়া গিয়া বলিলেন— ‘হাঁ, বিষকন্যা বটে।’

মোরিকা পূর্ববৎ ভূশয্যায় পড়িয়া ছিল, প্রত্যুত্তরে একবার গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিল।

শিবমিশ্র আগ্রহকম্পিত স্বরে বলিলেন— ‘বৎসে, তুমি তোমার কন্যা আমাকে দান কর, আমি উহাকে পালন করি। কেহ জানিবে না।’

মোরিকা পুনরায় অতি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিল।

শিবমিশ্র বলিলেন— ‘তুমি ফিরিয়া গিয়া বলিও কন্যাকে বিনষ্ট করিয়াছ। আমি অদ্যই উহাকে লইয়া গঙ্গার পরপারে লিচ্ছবিদেশে পলায়ন করিব। তারপর—’

মোরিকা উত্তর দিল না। তখন শিবমিশ্র নতজানু হইয়া তাহার মুখ দেখিলেন। তারপর করাগ্রে শীর্ণ মণিবন্ধ ধরিয়া নাড়ি পরীক্ষা করিলেন।

ক্ষণেক পরে তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দুই হস্তে শিশুকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া উদ্দীপ্ত চোখে দূরে অর্ধদৃষ্ট রাজপ্রাসাদশীর্ষের দিকে চাহিলেন। কহিলেন— ‘এই ভাল।’

এই সময় আকাশের নিকষে অগ্নির রেখা টানিয়া রক্তবর্ণ উল্কা রাজপুরীর ঊর্দ্ধে পিণ্ডাকারে জ্বলিয়া উঠিল, — তারপর ধীরে ধীরে মিলাইয়া গেল।

সেই আলোকে শিশুর মুখের দিকে চাহিয়া শিবমিশ্র বলিলেন— “এ নিয়তির ইঙ্গিত। তোমার নাম রাখিলাম— উল্কা।”

তারপর মগ্নচন্দ্রা রাত্রির অন্ধকারে জাহ্নবীর তীররেখা ধরিয়া শিবমিশ্র পাটলিপুত্রের বিপরীত মুখে চলিতে আরম্ভ করিলেন।

মোরিকার প্রাণহীন শব মহাশ্মশানে পড়িয়া রহিল। যে শিবাকুল তাহার আগমনে সরিয়া গিয়াছিল, তাহারা আবার চারিদিক হইতে ফিরিয়া আসিল।

অতঃপর ষোল বৎসর কাটিয়া গিয়াছে।

কালপুরুষের পলকপাতে শতাব্দী অতীত হয়; কিন্তু ক্ষুদ্রায়ু মানুষের জীবনে ষোল বৎসর অকিঞ্চিৎকর নয়।

মগধে এই সময়ের মধ্যে বহু পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে। পূর্বাধ্যায়বর্ণিত ঘটনার পর পাটলিপুত্রের নাগরিকবৃন্দ ত্রয়োদশ বর্ষ মহারাজ চণ্ডের দোর্দণ্ড শাসন সহ্য করিয়াছিল; তাহার পর একদিন তাহারা সদলবলে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। জনগণ যখন ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে, তখন তাহারা বিবেচনা করিয়া কাজ করে না— এ ক্ষেত্রেও তাহারা বিবেচনা করিল না। ক্রোধান্ধ মৌমাছির পাল যদি একটা মহিষকে আক্রমণ করে, তাহা হইলে দৃশ্যটা যেরূপ হয়, এই মাৎস্যন্যায়ের ব্যাপারটাও প্রায় তদ্রূপ হইল।

গর্জামান চণ্ডকে সিংহাসন হইতে টানিয়া নামাইয়া বিদ্রোহ-নায়কেরা প্রথমে তাহার মণিবন্ধ পর্যন্ত হস্ত কাটিয়া ফেলিল। মহারাজ চণ্ডকে এক কোপে শেষ করিয়া ফেলিলে চলিবে না, অন্য বিবেচনা না থাকিলেও এ বিবেচনা বিদ্রোহীদের ছিল। মহারাজ এত দিন ধরিয়া যাহা অগণিত প্রজাপুঞ্জকে দুই হস্তে বিতরণ করিয়াছেন, তাহাই তাহারা প্রত্যার্পণ করিতে আসিয়াছে। এই প্রত্যর্পণক্রিয়া এক মুহূর্তে হয় না।

অতঃপর চিণ্ডের পদদ্বয় জঙ্ঘাগ্রন্থি হইতে কাটিয়া লওয়া হইল। কিন্তু তাহাতেও প্রতিহিংসাপিপাসু জনতার তৃপ্তি হইল না। এভাবে চলিলে বড় শীঘ্র মৃত্যু উপস্থিত হইবে— তাহা বাঞ্ছনীয় নয়। মৃত্যু তো নিষ্কৃতি। সুতরাং জননায়করা মহারাজের বিখণ্ডিত রক্তাপ্লুত দেহ ঘিরিয়া মন্ত্রণা করিতে বসিল। হিংসা-পরিচালিত জনতা চিরদিনই নিষ্ঠুর, সেকালে বুঝি তাহাদের নিষ্ঠুরতার অন্ত ছিল না।

একজন নাসিকাহীন শৌণ্ডিক উত্তম পরামর্শ দিল। চণ্ডকে হত্যা করিয়া কাজ নাই, বরঞ্চ তাহাকে জীবিত রাখিবার চেষ্টাই করা হউক। তারপর এই অবস্থায় তাহাকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া প্রকাশ্য সর্বজনগম্য স্থানে বাঁধিয়া রাখা হউক। নাগরিকরা প্রত্যহ ইহাকে দেখিবে, ইহার গাত্রে নিষ্ঠীবন ত্যাগ করবে। চণ্ডের এই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখিয়া ভবিষ্যৎ রাজারাও যথেষ্ট শিক্ষালাভ করিতে পরিবে।

সকলে মহোল্লাসে এই প্রস্তাব সমর্থন করিল। প্রস্তাব কার্যে পরিণত হইতেও বিলম্ব হইল না।

তারপর মগধবাসীর রক্ত কথঞ্চিৎ কবোঞ্চ হইলে তাহারা নূতন রাজা নির্বাচন করিতে বসিল। শিশুনাগবংশেরই দূর-সম্পর্কিত সৌমকান্তি এক যুবা— নাম সেনজিৎ— মৃগয়া পক্ষিপালন ও সূরা আস্বাদন করিয়া সুখে ও তৃপ্তিতে কালযাপন করিতেছিল, রাজা হইবার দুরাকাঙক্ষা তাহার ছিল না— সকলে তাহাকে ধরিয়া সিংহাসনে বসাইয়া দিল। সেনজিৎ অতিশয় নিরহঙ্কার সরলচিত্ত ও ক্রীড়াকৌতুকপ্রিয় যুবা; নারীজাতি ভিন্ন জগতে তাহার শত্রু ছিল না; তাই নাগরিকগণ সকলেই তাহাকে ভালবাসিত। সেনজিৎ প্রথমটা রাজা হইতে আপত্তি করিল; কিন্তু তাহার বন্ধুমণ্ডলীকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখিয়া সে দীর্ঘশ্বাস মোচনপূর্বক সিংহাসনে গিয়া বসিল। একজন ভীমকান্তি কৃষ্ণকায় নাগরিক স্বহস্তে নিজ অঙ্গুলি কাটিয়া তাহার ললাটে রক্ত-তিলক পরাইয়া দিল।

সেনজিৎ করুণবচনে বলিল— ‘যুদ্ধ করিবার প্রয়োজন হইলে যুদ্ধ করব, কিন্তু আমাকে রাজ্য শাসন বা বংশরক্ষা করিতে বলিও না।’

তাহাই হইল। কয়েকজন বিচক্ষণ মন্ত্রী রাজ্যভার গ্রহণ করিলেন; মহারাজ সেনজিৎ পূর্ববৎ মৃগয়াদির চর্চা করিয়া ও বটুকভট্টের সহিত রসালাপ করিয়া দিন কাটাইতে লাগিল। নানা কারণে কাশী কোশল লিচ্ছবি তখন যুদ্ধ করিতে উৎসুক ছিল না; ভিতরে যাহাই থাকুক, বাহিরে একটি মৌখিক মৈত্রী দেখা যাইতেছিল,— তাই মহারাজকে বর্ম-চর্ম পরিধান করিয়া শৌর্য প্রদর্শন করিতে হইল না। ওদিকে রাজ-অবরোধও শূন্য পড়িয়া রহিল। কঞ্চুকী মহাশয় ছাড়া রাজ্যে আর কাহারও মনে খেদ রহিল না।

মগধের অবস্থা যখন এইরূপ, তখন লিচ্ছবি রাজ্যের রাজধানী বৈশালীতেও ভিতরে ভিতরে অনেক কিছু ঘটেতেছিল। মহামনীষী কৌটিল্য তখনও জন্মগ্রহণ করেন নাই, কিন্তু তাই বলিয়া রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কূটনীতির অভাব ছিল না। বৈশালীতে বাহ্য মিত্রতার অন্তরালে গোপনে গোপনে মগধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলিতেছিল।

শিবমিশ্র বৈশালীতে সাদরে গৃহীত হইয়াছিলেন। লিচ্ছবিদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত— রাজা নাই। রাজার পরিবর্তে নির্বাচিত নায়কগণ রাজ্য শাসন করেন। শিবমিশ্রের কাহিনী শুনিয়া তাঁহারা তাঁহাকে সসন্মানে মন্ত্রণাদাতা সচিবের পদ প্রদান করিলেন।

কেবল শিবমিশ্রের নামটি ঈষৎ পরিবর্তিত হইয়া গেল। তাঁহার গণ্ডের শৃগালদংশনক্ষত শুকাইয়াছিল বটে, কিন্তু ক্ষত শুকাইলেও দাগ থাকিয়া যায়। তাঁহার মুখখানা শৃগালের মতো হইয়া গিয়াছিল। জনসাধারণ তাঁহাকে শিবামিশ্র বলিয়া ডাকিতে লাগিল। শিবমিশ্র তিক্ত হাসিলেন, কিন্তু আপত্তি করিলেন না। শৃগালের সহিত তুলনায় যে ধূর্ততার ইঙ্গিত আছে, তাহা তাঁহার অরুচিকর হইল না। ঐ নামই প্রতিষ্ঠা লাভ করিল।

দিনে দিনে বৈশালীতে শিবামিশ্রের প্রতিপত্তি বাড়িতে লাগিল। ওদিকে তাঁহার গৃহে সেই শ্মশানলব্ধ অগ্নিকণা সাগ্নিকের যত্নে বর্ধিত হইয়া উঠিতে লাগিল।

চণ্ড ও মোরিকার কন্যা উল্কাকে একমাত্র অগ্নির সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। যতই তাহার বয়স বাড়িতে লাগিল, জ্বলন্ত বহ্নির মতো রূপের সঙ্গে সঙ্গে ততই তাহার দুর্জয় দুর্বশ প্রকৃতি পরিস্ফুট হইতে আরম্ভ করিল। শিবামিশ্র তাহাকে নানা বিদ্যা শিক্ষা দিলেন, কিন্তু তাহার প্রকৃতির উগ্রতা প্রশমিত করিবার চেষ্টা করিলেন না। মনে মনে বলিলেন— ‘শিশুনাগবংশের এই বিষকণ্টক দিয়াই শিশুনাগবংশের উচ্ছেদ করিব।’

তীক্ষ্ণ-মেধাবিনী উল্কা চতুঃষষ্টি কলা হইতে আরম্ভ করিয়া ধনুর্বিদ্যা, অসিবিদ্যা পর্যন্ত সমস্ত অবলীলাক্রমে শিখিয়া ফেলিল। কেবল নিজ উদ্দাম প্রকৃতি সংযত করিতে শিখিল না।

মগধের প্রজাবিদ্রোহের সংবাদ যেদিন বৈশালীতে পৌঁছিল, সেদিন শিবামিশ্র গূঢ় হাস্য করিলেন। এই বিদ্রোহে তাঁহার কতখানি হাত ছিল, কেহ জানিত না। কিন্তু কিছু দিন পরে যখন আবার সংবাদ আসিল যে, শিশুনাগবংশেরই আর একজন যুবা রাজ্যাভিষিক্ত হইয়াছে, তখন তাঁহার মুখ অন্ধকার হইল। এই শিশুনাগবংশ যেন সর্পবংশেরই মতো— কিছুতেই নিঃশেষ হইতে চায় না।

তারপর আরও কয়েক বৎসর কাটিল; শিবামিশ্র উল্কার দিকে চাহিয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

যেদিন উল্কার বয়স ষোড়শ বৎসর পূর্ণ হইল, সেই দিন শিবামিশ্র তাহাকে কাছে ডাকিয়া বলিলেন— ‘বৎসে, তুমি আমার কন্যা নহ। তোমার জীবন-বৃত্তান্ত বলিতে চাহি, উপবেশন কর।’

ভাবলেশহীন কণ্ঠে শিবামিশ্র বলিতে লাগিলেন, উল্কা করলগ্নকপোলে বসিয়া সম্পূর্ণ কাহিনী শুনিল; তাহার স্থির চক্ষু নিমেষের জন্য শিবামিশ্রের মুখ হইতে নড়িল না। কাহিনী সমাপ্ত করিয়া শিবামিশ্র বলিলেন— ‘প্রতিহিংসা-সাধনের জন্য তোমায় ষোড়শ বর্ষ পালন করিয়াছি। চণ্ড নাই, কিন্তু শিশুনাগবংশ অদ্যাপি সদর্পে বিরাজ করিতেছে। সময় উপস্থিত— তোমার মাতা মোরিকা ও পালক পিতা শিবামিশ্রের প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ কর।’

‘কি করিতে হইবে।’

‘শিশুনাগবংশকে উচ্ছেদ করিতে হইবে।’

‘পন্থা নির্দেশ করিয়া দিন।’

‘শুন, পূর্বেই বলিয়াছি, তুমি বিষকন্যা; তোমার উগ্র অলোকসামান্য রূপ তাহার নিদর্শন। পুরুষ তোমার প্রতি আকৃষ্ট হইবে, পতঙ্গ যেমন অগ্নিশিখার দিকে আকৃষ্ট হয়। তুমি যে পুরুষের কণ্ঠলগ্না হইবে তাহাকেই মরিতে হইবে। এখন তোমার কর্তব্য বুঝিয়াছ? মগধের সহিত বর্তমানে লিচ্ছবিদেশের মিত্রভাব চলিতেছে, এ সময়ে অকারণে যুদ্ধঘোষণা করিলে রাষ্ট্রীয় ধনক্ষয় জনক্ষয় হইবে, বিশেষত যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত। মগধবাসীরা নূতন রাজার শাসনে সুখে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আছে— রাজ্যে অসন্তোষ নাই। এরূপ সময় রাজ্যে রাজ্যে যুদ্ধ বাধানো সমীচীন নয়। কিন্তু শিশুনাগবংশকে মগধ হইতে মুছিয়া ফেলিতে হইবে, তাই এই পন্থা অবলম্বন করিয়াছি। বর্তমান রাজা সেনজিৎ ব্যসনপ্রিয় যুবা, শুনিয়াছি রাজকার্যে তাহার মতি নাই, — সর্বপ্রথম তাহাকে অপসারিত করিতে হইবে। — পারিবে?’

উল্কা হাসিল। যাবক-রক্ত অধরে দশনদ্যুতি সৌদামিনীর মতো ঝলসিয়া উঠিল। তাহার সেই হাসি দেখিয়া শিবামিশ্রের মনে আর কোনও সংশয় রহিল না।

তিনি বলিলেন— ‘এখন সভায় কি স্থির হইয়াছে, বলিতেছি। মগধে কিছু দিন যাবৎ বৈশালীর প্রতিভূ কেহ নাই, কিন্তু মিত্ররাজ্যে প্রতিনিধি থাকাই বিধি, না থাকিলে সৌহার্দ্যের অভাব সূচনা করে। এজন্য সঙ্কল্প হইয়াছে তুমি লিচ্ছবি-রাষ্ট্রের প্রতিভূস্বরূপ পাটলিপুত্রে গিয়া বাস করিবে। প্রতিভূকে সর্বদা রাজ-সন্নিধানে যাইতে হয়, সুতরাং রাজার সহিত দেখা-সাক্ষাতে কোনও বাধা থাকিবে না। অতঃপর তোমার সুযোগ!’

উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল— ‘ভাল। কিন্তু আমি নারী, এজন্য কোনও বাধা হইবে না?’

শিবামিশ্র বলিলেন— ‘ বৃজির গণরাজ্যে নারী-পুরুষে প্রভেদ নাই, সকলের কক্ষা সমান।’

‘কবে যাইতে হইবে?’

‘আগামী কল্য তোমার যাত্রার ব্যবস্থা হইয়াছে। তোমার সঙ্গে দশ জন পুরুষ পার্শ্বচর থাকিবে, এতদ্ব্যতীত সখী পরিচারিকা তোমার অভিরুচিমত লাইতে পার।’

উল্কা শিবামিশ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, অকম্পিত স্বরে বলিল— ‘পিতা, আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করিব। যে দুর্গ্রহের অভিসম্পাত লইয়া আমি জন্মিয়াছি, তাহা আমার জননীর নিষ্ঠুর হত্যার প্রতিশোধ লইয়া সার্থক হইবে। আপনি যে আমাকে কন্যার ন্যায় পালন করিয়াছেন, সে ঋণও এই অভিশপ্ত দেহ দিয়া প্রতিশোধ করিব।’

শিবামিশ্রের কণ্ঠ ঈষৎ কম্পিত হইল, তিনি গম্ভীর স্বরে বলিলেন— ‘কন্যা, আশীর্বাদ করিতেছি, লব্ধকামা হইয়া আমার ক্রোড়ে প্রত্যাগমন কর। দধীচির মতো তোমার কীর্তি পুরাণে অবিনশ্বর হইয়া থাকিবে।’

পাটলিপুত্রের উপকণ্ঠে রাজার মৃগয়া-কানন। উল্কা ভাগীরথী উত্তীর্ণ হইয়া, এই বহু যোজনব্যাপী অটবীর ভিতর দিয়া অশ্বারোহণে চলিয়াছিল। তাহার সঙ্গী কেহ ছিল না, সঙ্গী সহচরদিগকে সে রাজপথ দিয়া প্রেরণ করিয়া দিয়া একাকী বনপথ অবলম্বন করিয়াছিল, পুরুষ রক্ষীরা ইহাতে সসম্ভ্রমে ঈষৎ আপত্তি করিয়াছিল কিন্তু উল্কা তীব্র অধীর স্বরে নিজ আদেশ জ্ঞাপন করিয়া বলিয়াছিল— ‘আমি আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ। তোমরা নগরতোরণে পৌঁছিয়া আমার জন্য প্রতীক্ষা করিবে। আমি একাকী চিন্তা করিতে চাই।’

স্থির আচপল দৃষ্টি সম্মুখে রাখিয়া উল্কা অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়া ছিল, অশ্বও তাড়নার অভাবে ময়ূরসঞ্চারী গতিতে চলিয়াছিল; পাছে আরোহিণীর চিন্তাজাল ছিন্ন হইয়া যায় এই ভয়ে যেন গতিছন্দ অটুট রাখিয়া চলিতেছিল! শষ্পের উপর অশ্বের খুরধ্বনিও অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছিল।

ছায়া-চিত্রিত বনের ভিতর দিয়া কৃষ্ণ বাহনের পৃষ্ঠে যেন সঞ্চারিণী আলোকলতা চলিয়াছে— বনের ছায়ান্ধকার ক্ষণে ক্ষণে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে। উল্কার বক্ষে লৌহজালিক, পার্শ্বে তরবারি, কটিতে ছুরিকা, পৃষ্ঠে সংসর্পিত কৃষ্ণ বেণী; কর্ণে মাণিক্যের অবতংস অঙ্গারবৎ জ্বলিতেছে। এই অপূর্ব বেশে উল্কার রূপ যেন আরও উন্মাদকর হইয়া উঠিয়াছে।

কাননপথ অর্ধেক অতিক্রান্ত হইবার পর সহসা পশ্চাতে দ্রুত-অস্পষ্ট অশ্বত্থুরধ্বনি শুনিয়া উল্কার চমক ভাঙ্গিল। সে পিছু ফিরিয়া দেখিল, একজন শূলধারী অশ্বারোহী সবেগে অশ্ব চালাইয়া ছুটিয়া আসিতেছে; তাহার কেশের মধ্যে কঙ্কপত্র, পরিধানে শবরের বেশ। উল্কাকে ফিরিতে দেখিয়া সে ভল্ল উত্তোলন করিয়া সগর্জনে হাঁকিল— ‘দাঁড়াও।’

উল্কা দাঁড়াইল। ক্ষণেক পরে অশ্বারোহী তাহার পার্শ্বে আসিয়া কর্কশ স্বরে বলিল— ‘কে তুই?— রাজার মৃগয়া-কাননের ভিতর দিয়া বিনা অনুমতিতে চলিয়াছিস্‌? তোর কি প্রাণের ভয় নাই?’ এই পর্যন্ত বলিয়া পুরুষ সবিস্ময়ে থামিয়া গিয়া বলিল— ‘এ কী! এ যে নারী!’

উল্কা অধরোষ্ঠ ঈষৎ সঙ্কুচিত করিয়া বলিল— ‘নারীই বটে! তুমি কে?’

পুরুষ ভল্ল নামাইল। তাহার কৃষ্ণবর্ণ মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটিয়া উঠিল, চোখে লালসার তীক্ষ্ণ আলোক দেখা দিল। সে কণ্ঠস্বর মধুর করিয়া বলিল— ‘আমি এই বনের রক্ষী। সুন্দরি, এই পথহীন বনে একাকিনী চলিয়াছ, তোমার কি দিগ্‌ভ্রান্ত হইবার ভয় নাই?’

উল্কা উত্তর দিল না; বল্গার ইঙ্গিতে অশ্বকে পুনর্বার সম্মুখদিকে চালিত করিল।

রক্ষী সনির্বন্ধ স্বরে বলিল— ‘তুমি কি পাটলিপুত্র যাইবে? চল, আমি তোমাকে কানন পার করিয়া দিয়া আসি!’ বলিয়া সে নিজ অশ্ব চালিত করিল।

উল্কা এবারও উত্তর দিল না, অবজ্ঞাস্ফুরিত-নেত্রে একবার তাহার দিকে চাহিল মাত্র। কিন্তু রক্ষী কেবল নেত্রাঘাতে প্রতিহত হইবার পাত্র নয়, সে লুব্ধ নয়নে উল্কার সর্বাঙ্গে দেখিতে দেখিতে তাহার পাশে পাশে চলিল।

ক্রমে দুই অশ্বের ব্যবধান কমিয়া আসিতে লাগিল। উল্কা অপাঙ্গ-দৃষ্টিতে দেখিল, কিন্তু কিছু বলিল না।

রক্ষী আবার মধু-ঢালা সুরে বলিল— ‘সুন্দরি, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? তোমার এরূপ কন্দর্প-বিজয়ী বেশ কেন?’

উল্কা বিরস-স্বরে বলিল— ‘সে সংবাদে তোমার প্রয়োজন নাই।’

রক্ষী অধর দংশন করিল; এ নারী যেমন রূপসী, তেমনই মদগর্বিতা! ভাল, তাহার মদগর্ব লাঘব করিতে হইবে; এ বনের অধীশ্বর কে তাহা জানাইয়া দিতে হইবে।

রক্ষী আরও নিকটে সরিয়া আসিয়া হস্তপ্রসারণপূর্বক উল্কার হাত ধরিল। উল্কার দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল, সে হাত ছাড়াইয়া লইয়া সর্প-তর্জনের মতো শীৎকার করিয়া বলিল— ‘আমাকে সম্পর্শ করিও না— অনার্য।’

রক্ষীর মুখ আরও কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিল। সম্পূর্ণ অনার্য না হইলেও সে আর্য-অনার্যের মিশ্রণজাত অম্বষ্ঠ বটে, তাই এই হীনতা-জ্ঞাপক সম্বোধন তাহাকে অঙ্কুশের মতো বিদ্ধ করিল। দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া সে বলিল— ‘অনার্য! ভাল, আজ এই অনার্যের হাত হইতে তোমাকে কে রক্ষা করে দেখি!’ — বলিয়া বাহু দ্বারা কটি বেষ্টন করিয়া উল্কাকে আকর্ষণ করিল।

উল্কার মুখে বিষ-তীক্ষ্ণ হাসি ক্ষণেকের জন্য দেখা দিল।

‘আমি বিষকন্যা— আমাকে স্পর্শ করিলে মরিতে হয়।’ বলিয়া সে রক্ষীর পঞ্জরে ছুরিকা বিদ্ধ করিয়া দিল, তারপর উচ্চৈঃস্বরে হাসিতে হাসিতে বায়ুবেগে অশ্ব ছুটাইয়া দিল।

পাটলিপুত্রের দুর্গতোরণে যখন উল্কা পৌঁছিল, তখন বেলা দ্বিপ্রহর। শান্তির সময় দিবাভাগে তোরণে প্রহরী থাকে না, নাগরিকগণও মধ্যাহ্নের খর রৌদ্রতাপে স্ব স্ব গৃহচ্ছায়া আশ্রয় করিয়াছে; তাই তোরণ জনশূন্য। কেবল উল্কার পথশ্রান্ত সহচরগণ উৎকণ্ঠিতভাবে অপেক্ষা করিতেছে।

উল্কা উন্নত তোরণ-সম্মুখে ক্ষণেক দাঁড়াইল। একবার উত্তরে দূর-প্রসারিত শূল-কণ্টকিত শ্মশানভূমির দিকে দৃষ্টি ফিরাইল, তারপর নিবদ্ধ ওষ্ঠাধরে তোরণ-প্রবেশ করিল।

কিন্তু তোরণ উত্তীর্ণ হইয়া কয়েক পদ যাইতে না যাইতে আবার তাহার গতি রুদ্ধ হইল। সহসা পার্শ্ব হইতে বিকৃতকণ্ঠে কে চিৎকার করিয়া উঠিল— ‘জল! জল! জল দাও!’

রুক্ষ উগ্রকণ্ঠের এই প্রার্থনা কানে যাইতেই উল্কা অশ্বের মুখ ফিরাইল। দেখিল, তোরণপার্শ্বস্থ প্রাচীরগাত্র হইতে লৌহবলয়-সংলগ্ন স্থূল শৃঙ্খল ঝুলিতেছে, শৃঙ্খলের প্রান্ত এক নিরাকার বীভৎস মূর্তির কটিতে আবদ্ধ। মূর্তির করপত্র নাই, পদদ্বয়ও জঙ্ঘাসন্ধি হইতে বিচ্ছিন্ন— জটাবদ্ধ দীর্ঘ কেশে মুখ প্রায় আবৃত। সে তপ্ত পাষাণ-চত্বরের উপর কৃষ্ণকায় কুম্ভীরের মতো পড়িয়া আছে এবং লেলিহ রসনায় অদূরস্থ জলকুণ্ডের দিকে তাকাইয়া মাঝে মাঝে চিৎকার করিয়া উঠিতেছে— ‘জল! জল!’ মাধ্যন্দিন সূর্যতাপে তাহার রোমশ দেহ হইতে স্বেদ নির্গত হইয়া চত্বর সিক্ত করিয়া দিতেছে।

উল্কা উদাসীনভাবে সেই দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার মনে করুণার উদ্রেক হইল না। শুধু সে মনে মনে ভাবিল— এই মগধবাসীরা দেখিতেছি নিষ্ঠুরতায় অতিশয় নিপুণ।

শৃঙ্খলিত ব্যক্তি জন-সমাগম দেখিয়া জানুতে ভর দিয়া উঠিল, রক্তিম চক্ষে চাহিয়া বন্য জন্তুর মতো গর্জন করিল— ‘জল! জল দাও!’

উল্কা একজন সহচরকে ইঙ্গিত করিল; সে জলকুণ্ড হইতে জল আনিয়া তাহাকে পান করাইল। শৃঙ্খলিত ব্যক্তি উত্তপ্ত মরুভূমির মতো জল শুষিয়া লইল। তারপর তৃষ্ণা নিবারিত হইলে অবশিষ্ট জল সর্বাঙ্গে মাখিয়া লইল।

উল্কা জিজ্ঞাসা করিল— ‘কোন্‌ অপরাধে তোমার এরূপ দণ্ড হইয়াছে?’

গত তিন বৎসর ধরিয়া বন্দী প্রতিনিয়ত বিদ্রূপকারী নাগরিকদের নিকট এই একই প্রশ্ন শুনিয়া আসিতেছে। সে উত্তর দিল না— হিংস্রদৃষ্টিতে উল্কার দিকে তাকাইয়া পিছু ফিরিয়া বসিল।

উল্কা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল— ‘কে তোমার এরূপ অবস্থা করিয়াছে? শিশুনাগবংশের রাজা?’

শ্বাপদের মতো তীক্ষ্ণ দন্ত বাহির করিয়া বন্দী ফিরিয়া চাহিল। তাহার ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইল, একবার মুক্তি পাইলে সে উল্কাকে দুই বাহুতে পিষিয়া মারিয়া ফেলিবে। উল্কা যে তাহাকে এইমাত্র পিপাসার পানীয় দিয়াছে, সে জন্য তাহার কিছুমাত্র কৃতজ্ঞতা নাই।

সে বিকৃত মুখে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া বলিল— ‘পথের কুক্কুর সব, দূর হইয়া যা। লজ্জা নাই? একদিন আমি তোদের পদতলে পিষ্ট করিয়াছি, আবার যেদিন এই শৃঙ্খল ছিঁড়িব, সেদিন আবার পদদলিত করিব। এখন পলায়ন করা— আমার সম্মুখ হইতে দূর হ।’

উল্কার চোখের দৃষ্টি সহসা তীব্র হইয়া উঠিল; সে অশ্বপৃষ্ঠে ঝুঁকিয়া জিজ্ঞাসা করিল— ‘কে তুমি? তোমার নাম কি?’

ক্ষিপ্তপ্রায় বন্দী দুই বাহু দ্বারা নিজ বক্ষে আঘাত করিতে করিতে বলিল— ‘কে আমি? কে আমি? তুই জানিস্‌ না? মিথ্যাবাদিনি, আমাকে কে না জানে? আমি চণ্ড— আমি মহারাজ চণ্ড! তোর প্রভু। তোর দণ্ডমুণ্ডের অধীশ্বর! বুঝিলি? আমি মগধের নায্য অধিপতি মহারাজ চণ্ড।’

উল্কা ক্ষণকালের জন্য যেন পাষাণে পরিণত হইয়া গেল। তারপর তাহার সমস্ত দেহ কম্পিত হইতে লাগিল, ঘন ঘন নিশ্বাস বহিল, নাসা স্ফুরিত হইতে লাগিল। তাহার এই পরিবর্তন বন্দীরও লক্ষ্যগোচর হইল, উন্মত্ত প্রলাপ বকিতে বকিতে সে সহসা থামিয়া গিয়া নিষ্পলক নেত্রে চাহিয়া রহিল।

উল্কা কথঞ্চিৎ আত্মসম্বরণ করিয়া সহচরদের দিকে ফিরিল, ধীরস্বরে কহিল— ‘তোমরা ঐ পিপ্পলীবৃক্ষতলে গিয়া আমার প্রতীক্ষা কর, আমি এখনই যাইতেছি।’

সহচরীগণ প্রস্থান করিল।

তখন উল্কা অশ্ব হইতে অবতরণ্‌ করিয়া বন্দীর সম্মুখীন হইল। চত্বরের উপর উঠিয়া একাগ্রদৃষ্টিতে বন্দীর মুখ নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিল— ‘তুমিই ভূতপূর্ব রাজা চণ্ড।’

চণ্ড সবেগে মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘ভূতপূর্ব নয়— আমিই রাজা। আমি যত দিন আছি, তত দিন মগধে অন্য রাজা নাই।’

‘তোমাকে তবে প্রজারা হত্যা করে নাই?’

‘আমাকে হত্যা করিতে পারে, এত শক্তি কাহার?’

রক্তহীন অধরে উল্কা জিজ্ঞাসা করিল— ‘মহারাজ চণ্ড, মোরিকা নাম্নী জনৈকা দাসীর কথা মনে পড়ে?’

চণ্ডের জীবনে বহুশত মোরিকা ক্রীড়াপুত্তলীর মতো যাতায়াত করিয়াছে, দাসী মোরিকার কথা তাহার মনে পড়িল না।

উল্কা তখন জিজ্ঞাসা করিল— ‘মোরিকার এক বিষকন্যা জন্মিয়াছিল, মনে পড়ে?’

এবার চণ্ডের চক্ষুতে স্মৃতির আলো ফুটিল, সে হিংস্রহাস্যে দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল— ‘মনে পড়ে, সেই বিষকন্যাকে শ্মশানে প্রোথিত করাইয়াছিলাম। শিবমিশ্রকেও শ্মশানের শৃগালে ভক্ষণ করিয়াছিল।’ অতীত নৃশংসতার স্মৃতির মধ্যেই এখন চণ্ডের একমাত্র আনন্দ ছিল।

উল্কা অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল— ‘সে বিষকন্যা মরে নাই, শিবমিশ্রকেও শৃগালে ভক্ষণ করে নাই। মহারাজ, নিজের কন্যাকে চিনিতে পারিতেছেন না?’

চণ্ড চমকিত হইয়া মুণ্ড ফিরাইল।

উল্কা তাহার কাছে গিয়া কর্ণকুহরে বলিল— ‘আমিই সেই বিষকন্যা। মহারাজ, শিশুনাগবংশের চিরন্তন রীতি স্মরণ আছে কি? এ বংশের রক্ত যাহার দেহে আছে, সেই পিতৃহন্তা হইবে। — তাই বহুদূর হইতে বংশের প্রথা পালন করিতে আসিয়াছি।’

চণ্ড কথা কহিবার অবকাশ পাইল না। উদ্যতফণা সর্প যেমন বিদ্যুদ্বেগে দংশন করে, তেমনই উল্কার ছুরিকা চণ্ডের কণ্ঠে প্রবেশ করিল। সে ঊর্ধ্বমুখ হইয়া পড়িয়া গেল, তাহার প্রকাণ্ড দেহ মৃত্যু-যন্ত্রণায় ধড়ফড় করিতে লাগিল। দুইবার সে বাক্য-নিঃসরণের চেষ্টা করিল কিন্তু বাক্যস্ফুর্তি হইল না— মুখ দিয়া গাঢ় রক্ত নির্গলিত হইয়া পড়িল। শেষে কয়েকবার পদপ্রক্ষেপ করিয়া চণ্ডের দেহ স্থির হইল।

উল্কা কটিলগ্ন হস্তে দাঁড়াইয়া দেখিল। তারপর ধীরপদে গিয়া নিজ অশ্বে আরোহণ করিল, আর পিছু ফিরিয়া তাকাইল না। তাহার ছুরিকা চণ্ডের কণ্ঠে আমূল বিদ্ধ হইয়া রহিল। নির্জন তোরণপার্শ্বে মধ্যাহ্ন-রৌদ্রে ষোল বৎসরের পুরাতন নাট্যের শেষ অঙ্কে যে দ্রুত অভিনয় হইয়া গেল, জনপূর্ণ পাটলিপুত্রের কেহ তাহা দেখিল না।

এইরূপে শোণিতপঙ্কে দুই হস্ত রঞ্জিত করিয়া মগধের বিষকন্যা আবার মগধের মহাস্থানীয়ে পদার্পণ করিল।

মদন-মহোৎসবের পূর্বেই এবার গ্রীষ্মের আবির্ভাব হইয়াছে। বিজিগীষু নিদাঘের জয়পতাকা বহিয়া যেন অশোক, কিংশুক, কৃষ্ণচূড়া দিগ্‌দিগন্তে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তবু, কুসুম্ভ ও রঙ্গনের শোণিমা প্রত্যাসন্ন বসন্তোৎসবের বর্ণ-বিলাস বক্ষে ধারণ করিয়া উৎসুক নাগরিকাদিগকে যেন জানাইতেছে— ‘ভয় নাই! মাধবের অরুণ নেত্র দেখিয়া শঙ্কা করিও না, এখনও মধুমাস শেষ হয় নাই।’ তাহাদের সমর্থন করিয়াই যেন চূতমুকুল-লোভী মদারুণিত-চক্ষু কোকিল বারম্বার কুহরিয়া উঠিতেছে — ‘কুহকের কাল সমাগত, কুহকিনীরা প্রস্তুত হও।’

মগধের রাজপ্রাসাদেও এই নব-বসন্তজাত মদালসতা অলক্ষ্যে সঞ্চারিত হইয়াছিল। প্রধান তোরণের প্রতীহার-ভূমিতে লৌহ-শিরস্ত্রাণ পরিহিত শূলহস্ত দ্বারী উন্মনভাবে এক প্রফুল্ল কর্ণিকার-বৃক্ষের পানে তাকাইয়া ছিল; বোধ করি, নির্জন কর্মহীন দ্বিপ্রহরে ঐ বৃক্ষের দিকে চাহিয়া কোনও তপ্তকাঞ্চনবর্ণা যবনী প্রতীহারীর নীলাব্জ-নয়নের কথা ভাবিতেছিল। তোরণের অভ্যন্তরে ভবনে ভবনে নারী-সৈন্যের পাহারা। মহারাজের অবরোধে মহাদেবী নাই বটে, কিন্তু চিরাচরিত প্রথা অনুসারে ধনুষ্পানি যবনী সেনা পূর্ববৎ আছে। প্রাসাদের বিভিন্ন মহলে— মন্ত্রগৃহে, মল্লাগারে, কলাভবনে, কোষাগারে— সর্বত্র দ্বারে দ্বারে যবনী প্রহরিণী দ্বার রক্ষা করিতেছে। তাহাদের বক্ষে অতিপিনদ্ধ বর্ম, হস্তে ধনু, পৃষ্ঠে তূণীর। শ্রেণিভারমন্থর-গতিতে তাহারা দ্বারসম্মুখে পদচারণ করিতেছে, কখনও অলস উৎসুক নেত্রে অলিন্দের বাহিরে সুদূর-দৃষ্টি প্রেরণ করিতেছে। হয়তো তাহাদের মনেও দূরদূরান্তস্থিত জন্মভূমির দ্রাক্ষারস-মদির স্বপ্ন জাগিতেছে।

এই তন্দ্রালস ফাল্গুনের দ্বিপ্রহরে মন্ত্রগৃহের এক শীতলকক্ষে মহারাজ সেনজিৎ কয়েকজন বয়স্যের সহিত বিরাজ করিতেছিলেন। বিদূষক বটুকভট্টও ছিল, নিরুৎসুকভাবে রাজা ও বিদূষকে অক্ষক্রীড়া চলিতেছিল। প্রতি দ্বারে ও বাতায়নে জলসিক্ত উশীরগুচ্ছ ঝুলিতেছে, বাহিরের আতপ্ত বায়ু তাহার স্পর্শে স্নিগ্ধ-সুগন্ধি হইয়া মহারাজের চন্দনপঙ্কচর্চিত দেহ অবলেহন করিতেছিল। একজন বয়স্য অদূরে বসিয়া সপ্তস্বরার তন্ত্রী হইতে অতি মৃদুভাবে বসন্তরাগের ব্যঞ্জনা পরিস্ফুট করিবার চেষ্টা করিতেছিল।

কিয়ৎকাল ক্রীড়া চলিবার পর মহারাজের চঞ্চল চিত্ত আর অক্ষবাটে নিবদ্ধ থাকিতে চাহিল না; তিনি এদিক-ওদিক চাহিতে লাগিলেন। বাদ্যরত বয়স্য বসন্তের সহিত পঞ্চম মিশাইয়া ফেলিতেছিল, রাজা তাহার ভ্রম-সংশোধন করিয়া দিলেন। শেষে অক্ষ ফেলিয়া, পার্শ্বস্থিত কপিত্থ-সুরভিত তক্রের পাত্র নিঃশেষপূর্বক উঠিয়া দাঁড়াইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘বসন্তোৎসবের আর বিলম্ব কত?’

বটুকভট্টের আকৃতি ও কণ্ঠস্বর পূর্ববৎ আছে, শুধু মস্তকশীর্ষে গ্রন্থিধৃত কেশগুচ্ছ একটু পাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। সে অক্ষক্রীড়ায় জিতিতেছিল; মহারাজের পেশল দেহকান্তির দিকে এক ক্রুদ্ধ কটাক্ষপাত করিয়া বলিল— ‘মদনের সহিত যাহার মৌখিক পরিচয় পর্যন্ত নাই, সে বসন্তোৎসবের সংবাদ জানিয়া কি করিবে? বিল্বফল পাকিল কি না জানিয়া পরভৃতের কি লাভ?’

মহারাজ হাসিলেন। হাসিলে মহারাজকে বড় সুন্দর দেখাইত। তাঁহার তরুণ মুখের সদা-স্ফূর্ত হাসিতে যেন অন্তরের নিরভিমান অনাড়ম্বর সরলতা প্রতিবিম্বিত হইত।

তিনি সকৌতুকে বলিলেন— ‘বটুক, আমাকে কাক বলিলে না কোকিল বলিলে?’

বটুকভট্ট বলিল— ‘মহারাজের যেটা অভিরুচি স্বীকার করিয়া লইতে পারেন।’

মহারাজ বললেন— ‘তবে কোকিলই স্বীকার করিলাম। কোকিল অতি গুণবান পক্ষী; দোষের মধ্যে সে কাকের নীড়ে ডিম্ব প্রসব করে।’

বটুক বলিল— ‘এ বিষয়ে মহারাজ অপেক্ষা কোকিল শ্রেষ্ঠ।

স্মিতমুখে সেনজিৎ প্রশ্ন করিলেন— ‘কিসে?’

‘কোকিল তো তবু পরগৃহে বংশরক্ষা করে, মহারাজ যে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন।’

মহারাজের মুখ ঈষৎ বিষণ্ণভাব ধারণ করিল, তিনি ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘দেখ বটুক, তোমাকে একটি গোপনীয় কথা বলি। নারীজাতিকে আমি বড় ভয় করি— এই জন্যই বসন্তোৎসবের সময় আমার প্রাণে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। নারীজাতি এই সময় অত্যন্ত দুর্দমনীয় হইয় উঠে।’

বটুকভট্টও বিষণ্ণভাবে শিরা নাড়িয়া বলিল— ‘সে কথা সত্য। এই সময় স্ত্রীজাতি তাহাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র শাণিত করিয়া পুরুষের প্রতি ধাবিত হয়। আমার গৃহিণীর সাতটি সন্তান, বয়সেরও ইয়ত্তা নাই; কিন্তু কয়েক দিন হইতে লক্ষ্য করিতেছি, তিনি আমার প্রতি তীক্ষ্ণ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিতেছেন।’

হাস্য গোপন করিয়া মহারাজ বলিলেন— ‘বড় ভয়ানক কথা বটুক, তবে আর তোমার গৃহে গিয়া কাজ নাই। আমার অন্তঃপুর শূন্য আছে, তুমি এইখানেই এ কয় দিন নিরাপদে যাপন কর। এ বয়সে গৃহিণীর কটাক্ষবাণ খাইলে আর প্রাণে বাঁচিবে না।’

বটুকভট্টের মুখ অধিকতর বিষণ্ণ হইল, সে বলিল— ‘তাহা হয় না, মহারাজ। এই বসন্তকালে দেশসুদ্ধ কোকিল পরগৃহে ডিম্ব উৎপাদন করিবার জন্য ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। এখন গৃহত্যাগ করিলে আবার অন্য বিপদ আসিয়া পড়িবে।’

বয়স্যেরা সকৌতুকে উভয়ের রসোক্তি-বিনিময় শুনিতেছিল, বটুকের কথার ভঙ্গিতে সকলে হাসিয়া উঠিল। একজন বয়স্য বলিল— ‘মহারাজ, বটুকভট্ট অকারণে আপনাকে নারীজাতি সম্বন্ধে বিতৃষ্ণ করিয়া তুলিতেছে। আমি অপরোক্ষ অভিজ্ঞতা হইতে বলিতে পারি, নারীজাতি— বিশেষত সুন্দরী ও যৌবনবতী নারী— অবহেলার বস্তু নয়, পুরুষমাত্রেরই সাধনযোগ্য। কণ্টকীফলের মতো বাহিরে দুষ্প্রধর্ষা হইলেও অন্তরে তাহারা অতি কোমল ও সুস্বাদু।’

মহারাজ বলিলেন— ‘নারীজাতি তাহা হইলে কণ্টকীফলের সহিত তুলনীয়া! ইহাই তোমার মত?’ \

‘হাঁ মহারাজ! একমাত্র ভোক্তাই এই ফলের রসজ্ঞ, দূর হইতে যে ব্যক্তি কেবল নিরীক্ষণ করিয়াছে, তাহার কাছে ইহার রস অব্যক্ত।’

‘বটুক, তোমার কি অভিমত?’

বটুক গভীরভাবে বলিল— ‘আমার অভিমত, নারীজাতি একমাত্র বিল্বফলের সহিত তুলনীয়। যে ক্ষৌরিত-চিকুর হতভাগ্য একবার বিল্বতলে গিয়াছে, সে আর দ্বিতীয়বার যাইবে না।’

এইরূপ রঙ্গপরিহাসে কিছুকাল অতীত হইবার পর একজন বয়স্য রাজাকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘মহারাজ, সত্য বলুন স্ত্রীজাতির প্রতি আপনার বিরাগ কি জন্য? বিশেষ কোনও কারণ আছে কি?’

মহারাজ ঈষৎ গম্ভীর হইয়া বলিলেন— ‘রুচির অভাবই প্রধান কারণ। যদি এ কারণ যথেষ্ট মনে না কর, তবে বলিতে পারি, এই নারীজাতিই পুরুষের সুখ-স্বচ্ছন্দ্যের হন্তারক। ভাবিয়া দেখা শ্রী রামচন্দ্রের কথা, স্মরণ কর কুরু-পাণ্ডবের কাহিনী। যে ব্যক্তি সুখের অভিলাষী, সে এই সকল দৃষ্টান্ত দেখিয়া নারিজাতিকে দূরে রাখিবে।’

বয়স্য বলিল— ‘কিন্তু মহারাজ-বংশধর?’

সেনজিৎ সহসা শিহরিয়া উঠিলেন, তাঁহার মুখ হইতে পরিহাসের সমস্ত চিহ্ন লুপ্ত হইল। ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া তিনি বলিলেন— ‘বংশধর! ভানুমিত্র, শিশুনাগবংশে বংশধরের কথা চিন্তা করিতে তোমার ভয় হয় না? শুনিয়াছি, শিশুনাগবংশে আর কেহ জীবিত নাই, আমার ঐকান্তিক কামনা, আমার সঙ্গে যেন এই অভিশপ্ত বংশ লুপ্ত হয়।’

বয়স্য সকলে অধোমুখে নীরব রহিল; একটা প্রতিবাদ বাক্যও কাহারও মুখে যোগাইল না।

কিয়ৎকাল নীরবে কাটিল। তারপর সহসা এই কুণ্ঠিত নীরবতা ভেদ করিয়া মন্ত্রগৃহের প্রতীহার-ভূমিতে দ্রুতছন্দে পটহ বাজিয়া উঠিল।

বিস্মিতভাবে ভ্রূ তুলিয়া রাজা বলিলেন— ‘এ সময় পটহ কেন? বটুক, কে আসিল দেখ। বলিও, এখন আমি বিশ্রাম করিতেছি, কল্য প্রভাতে সভায় সাক্ষাৎ হইবে।’

মহারাজ সাধারণত কোনও দর্শনপ্রার্থীকে ফিরাইতেন না, কিন্তু আজ উল্লিখিত আলোচনার পর তাঁহার মনের প্রসন্নতা নষ্ট হইয়া গিয়াছিল।

বটুকভট্ট প্রস্থান করিল। সেনজিৎ ঈষৎ কুঞ্চিত ললাটে বাতায়নের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন।

অল্পক্ষণ পরেই বটুকভট্ট সবেগে প্রায় মুক্তকচ্ছ অবস্থায় কক্ষে পুনঃপ্রবেশ করিয়া একেবারে মহারাজের পদমূলে বসিয়া পড়িয়া হাঁপাইতে লাগিল। মহারাজ বলিলেন— ‘বটুক, কি হইল?’

বটুক উন্মুক্ত বক্তৃপথে ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করিতে করিতে বলিল— ‘মহারাজ, জঙ্ঘাবল প্রদর্শন করিয়াছি।’

‘তাহা তো দেখিতেছি। কিন্তু পলাইয়া আসিলে কেন? কে আসিয়াছে?’

‘ঠিক বলিতে পারি না। বোধ হয় দিব্যাঙ্গনা।’

‘সে কি! স্ত্রীলোক?’

‘কদাচ নয়। উর্বশী হইলেও হইতে পারে, নচেৎ নিশ্চয় তিলোত্তমা। কিন্তু বক্ষে কঞ্চুলী নাই, তৎপরিবর্তে লৌহজালিক— মহারাজ, পলায়ন করুন।’

মহারাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া বয়স্যদের দিকে চাহিলেন; তাঁহার তিন বৎসরব্যাপী রাজ্যকালে এরূপ কাণ্ড কখনও ঘটে নাই। তিনি বলিলেন— ‘নারী— আমার নিকট কি চায়?’

এই সময় যবনী প্রতিহারী প্রবেশ করিয়া জানাইল যে, বৈশালী হইতে এক নারী রাজকার্য উপলক্ষে মহারাজের সাক্ষাৎপ্রার্থিনী। মহারাজ ক্ষণেক স্তম্ভিত থাকিয়া ক্ষীণকণ্ঠে বলিলেন— ‘লইয়া এস।’

প্রতীহারী নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল। পরক্ষণেই চারিদিকে রূপলাবণ্যের স্ফুলিঙ্গ বিকীর্ণ করিয়া উল্কা কক্ষে প্রবেশ করিল।

মহারাজ সেনজিৎ দ্বারের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন, উল্কা প্রবেশ করিতেই উভয়ের চোখাচোখি হইল। পাঁচ গণিতে যতক্ষণ সময় লাগে, উল্কা ও সেনজিৎ ততক্ষণ পরস্পর চোখের ভিতর চাহিয়া রহিলেন। উল্কার চোখে গোপন উৎকণ্ঠা, মহারাজের নয়নে প্রচ্ছন্ন বিস্ময়! তারপর দু’জনেই চক্ষু ফিরাইয়া লইলেন।

মহারাজ সেনজিৎ ভূমির দিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন— ‘ভদ্রে, শুনিলাম তুমি বৈশালী হইতে আসিতেছ; তোমার কি প্রয়োজন?’

উল্কার ওষ্ঠাধর বিভক্ত হইয়া দশনপংক্তি ঈষৎ দেখা গেল। সে গ্রীবা বাঁকাইয়া মহারাজের দিকে একটু অধীরভাবে তাকাইল, বলিল— ‘আমি পরমভট্টারক শ্রীমন্মহারাজ সেনজিতের দর্শনপ্রার্থিনী— তাঁহার নিকটেই আমার প্রয়োজন নিবেদন করিব।’

‘আমিই সেনজিৎ।’

‘মহারাজ! ক্ষমা করুন’ — উল্কার বিস্ময়োৎফুল্ল নেত্র ক্ষণেকের জন্য অর্ধ-নিমীলিত হইয়া আসিল। তারপর সে দুই পদ অগ্রসর হইয়া মহারাজের পদপ্রান্তে নতজানু হইয়া বসিল; যুক্ত করপুট ললাটে স্পর্শ করিয়া সসম্ভ্রমে প্রণাম করিল।

মহারাজ অস্ফুটভাবে কালোচিত সম্ভাষণ করিলেন। তখন উল্কা নিজ অঙ্গাত্রাণের ভিতর হইতে জতুমুদ্রালাঞ্ছিত পত্র বাহির করিয়া মহারাজের হস্তে দিল।

জতুমুদ্রা ভাঙ্গিয়া সেনজিৎ পত্র পড়িতে লাগিলেন। উল্কা নতজানু থাকিয়াই আর একবার মহারাজকে নয়নকোণে ভাল করিয়া দেখিয়া লইল। তাহার মুখের ভাব বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হইল না, কিন্তু সে মনে মনে ভাবিল— ‘ইনিই মগধের মহাপরাক্রান্ত প্রজাপূজিত সেনজিৎ! ইঁহার চন্দন-চর্চিত সুকুমার দেহে বলবীর্যের তো কোনও লক্ষণই দেখিতেছি না। এই সুখলালিত পৌরুষহীন বিলাসীকে জয় করিতে কতক্ষণ সময় লাগিবে?’ উল্কা মনে মনে অবজ্ঞার হাসি হাসিল।

পত্রপাঠ শেষ করিয়া সেনজিৎ চক্ষু তুলিলেন, দেখিলেন, উল্কা তখনও নতজানু হইয়া তাঁহার সম্মুখে বসিয়া আছে। তিনি শুষ্কস্বরে বলিলেন— ‘ভদ্রে, আসন পরিগ্রহ কর। দেখিতেছি, তুমি মিত্ররাজ্য লিচ্ছবির প্রতিনিধি— সুতরাং আমরা তোমাকে সাদরে সম্ভাষণ করিতেছি। বৈশালীর প্রজানায়কগণ যে একটি পুরাঙ্গনাকে প্রতিভূরূপে প্রেরণ করিয়াছেন ইহা তাঁহাদের প্রীতির প্রকৃষ্ট নিদর্শন বটে, অপিচ কিছু বিস্ময়করও বটে।’

উল্কা আস্তরণের উপর আসন গ্রহণ করিয়া ঈষৎ হাস্যে মহারাজের দিকে মুখ তুলিল, কিন্তু সে প্রত্যুত্তর দিবার পূর্বেই বটুকভট্ট তাহার অতি ক্ষীণ অথচ কর্ণবিদারী কণ্ঠে বলিয়া উঠিল— ‘ইহাতে বিস্ময়ের কি আছে? বৈশালীতে নিশ্চয় পুরুষের অভাব ঘটিয়াছে, তাই তাহারা এই সুন্দরীকে পুরুষবেশে সাজাইয়া প্রেরণ করিয়াছে। মহারাজ, বৈশালী যখন আপনার মিত্ররাজ্য তখন মিত্রতার নিদর্শনস্বরূপ আপনিও কিছু পুরুষ বৈশালীতে প্রেরণ করুন। এইভাবে মিত্রতার বন্ধন অতিশয় দৃঢ় হইয়া উঠিবে।’

উল্কা চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। এতক্ষণ সে রাজা ভিন্ন অন্য কোনও দিকে দৃক্‌পাত করে নাই, এখন খর্বকায় বংশীকণ্ঠ বটুকভট্টকে দেখিয়া তাহার অধরে বিদ্রূপের হাসি ফুটিল। সে অবজ্ঞাপূর্ণ স্বরে বলিল— ‘মগধে পুরুষ প্রতিনিধির প্রয়োজন নাই বুঝিয়াই বোধ হয় মহামন্য কুলপতিগণ এই পুরকন্যাকে প্রেরণ করিয়াছেন। নচেৎ লিচ্ছবিদেশে প্রকৃত পুরুষের অভাব নাই।’

ছদ্ম গাম্ভীর্যে শিরঃসঞ্চালন করিয়া বটুকভট্ট বলিল— ‘বৈশালিকে, লিচ্ছবিদেশে যদি প্রকৃত পুরুষ থাকিত, তবে তাহারা কখনই তোমাকে মগধে আসিতে দিত না।’

উল্কার গণ্ড আরক্তিম হইয়া উঠিল, সে চকিতে রাজার দিকে ফিরিয়া তীক্ষ্ণস্বরে বলিল— ‘মহারাজ, এই বিট কি আপনার বাক্‌-প্রতিভূ?’

সেনজিৎ উত্ত্যক্তভাবে বিদূষকের দিকে চাহিলেন, কহিলেন— ‘বটুক, চপলতা সংবরণ কর, এ চপলতার সময় নয়।’

বটুক ভীতভাব প্রদর্শন করিয়া জানু-সাহায্যে হাঁটিয়া একজন বয়স্যের পিছনে লুকাইল।

সেনজিৎ তখন বলিলেন— ‘ভদ্রে—’

উল্কার মুখ আবার প্রসন্ন হইল, সে হাস্য-মুকুলিত অধরে বলিল— ‘দেব, আমার নাম উল্কা।’

বটুকভট্ট অন্তরাল হইতে আতঙ্কের অভিনয় করিয়া মৃদু স্বরে বলিল— ‘উঃ!’

সেনজিৎ একবার সেদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া গভীর মুখে বলিলেন— ‘ভাল। উল্কা, পুনর্বার তোমাকে স্বাগত-সম্ভাষণ জানাইতেছি। বৈশালী রাষ্ট্রের মিত্রতার চিহ্ন নারী বা পুরুষ যে মূর্তিতেই আগমন করুক, আমাদের সমাদরের সামগ্রী। কল্য হইতে সভায় অন্যান্য মিত্রগণের মধ্যে তোমার আসন নির্দিষ্ট হইবে।’

উল্কা অকপট-নেত্রে চাহিয়া বলিল— ‘সভায় নিত্য নিয়ত উপস্থিত থাকা কি আমার অবশ্য-কর্তব্য? রাজকীয় সভার শিষ্টতা আমি কিছুই জানি না— এই আমার প্রথম দৌত্য।’ বলিয়া একটু লজ্জিতভাবে হাসিল।

সেনজিৎ বলিলেন— ‘সভায় উপস্থিত থাকা না থাকা পাত্রমিত্রের প্রয়োজন ও অভিরুচির উপর নির্ভর করে। তুমি ইচ্ছা করিলে না আসিতে পার।’

উল্কা শুধু বলিল— ‘ভাল মহারাজ!’

উক্তরূপ কথোপকথন হইতে প্রতীয়মান হইবে যে, মহারাজ সেনজিৎ রাজকার্য অমাত্যদের হস্তে অর্পণ করিলেও নিজে একান্ত অপটু ছিলেন না।

অতঃপর তিনি বলিলেন— ‘বহু দূর পথ অতিক্রম করিয়া তুমি ও তোমার পরিজন নিশ্চয় ক্লান্ত; সুতরাং সর্বাগ্রে তোমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু পূর্বাহ্ণে সময় না থাকায় তোমার সমুচিত আবাসগৃহের ব্যবস্থা হইতে পায় নাই। এরূপ ক্ষেত্রে—’

বটুকভট্ট উঁকি মারিয়া বলিল— ‘কেন, মহারাজের অন্তঃপুর তো শূন্য আছে— সেইখনেই অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা হউক না।’

মহারাজ রুষ্টমুখে তাকাইলেন।

কিন্তু উল্কার চোখে গোপনে বিজলি খেলিয়া গেল; সে ভ্রূভঙ্গ করিয়া মহারাজের দিকে মুখ তুলিল— ‘মহারাজের অন্তঃপুর শূন্য! তবে কি মহারাজ অকৃতদার’

অপ্রসন্ন ললাটে সেনজিৎ নীরব রহিলেন; কেবল বটুকভট্ট সশব্দ দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিল।

উল্কা তখন বলিল— ‘মহারাজ, সত্যই আমরা পথশ্রান্ত। যদি আপনার অপ্রীতিকর না হয়, তবে অবরোধেই আশ্রয় লইতে পারি। আমি নারী, সুতরাং অবরোধে মহারাজের আশ্রয়াধীনে থাকাই আমার পক্ষে সুষ্ঠু হইবে।’

ভ্রূবদ্ধ ললাটে মহারাজ কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন, তারপর বিরস স্বরে বলিলেন— ‘ভাল। আপাতত অন্তঃপুরেই বাস কর, আমি সেখানে পদার্পণ করি না।’ তারপর প্রধানা যবনীকে ডাকিয়া তাহাকে যথোচিত উপদেশ দিয়া বলিলেন— ‘ইহাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ত্রুটি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখিও। পরে আমি অন্য ব্যবস্থা করিতেছি।’

উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইল। ‘জয়োস্তু মহারাজ!’ বলিয়া সে যবনী সমভিব্যাহারে রাজসকাশ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতেছিল, এমন সময় বটুকের মুণ্ড আর একবার উঁচু হইয়া উঠিল। সে কৃতাঞ্জলিপুটে বলিল— ‘বৈশালিকে, রাজকার্য তো সুচারুরূপে সম্পন্ন হইল, এখন একটি প্রশ্ন করিতে পারি? বৈশালীর সকল সীমন্তিনীই কি সদাসর্বদা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া থাকে? ভ্রূকুটির ভল্ল ও বক্ষের লৌহজালিক কি তাহারা উন্মোচন করে না?’

প্রস্থানোদ্যতা উল্কা ফিরিয়া দাঁড়াইল। অনুচ্চস্বরে বলিল— ‘তোমার মতো কিম্পুরুষ দেখিলে বৈশালীর নারীরা অস্ত্র ত্যাগ করে।’ বলিয়া ক্ষিপ্রহস্তে যবনীর তূণীর হইতে একটি তীর তুলিয়া লইয়া নিক্ষেপ করিল। বটুকভট্ট আর্তনাদ করিয়া উঠিল; তীর তাহার মস্তকশীর্ষস্থ কুণ্ডলীকৃত কেশকলাপের মধ্যে প্রবেশ করিল।

উল্কা চকিতচপল নেত্রে একবার সেনজিতের মুখের দিকে চাহিয়া হাস্যবিম্বিত রক্তাধরে কৌতুক বিচ্ছুরিত করিতে করিতে প্রস্থান করিল।

তীর জটা হইতে বাহির করিবার জন্য বটুক টানাটানি করিতে লাগিল। মহারাজ তাহার ভঙ্গি দেখিয়া হাসিয়া ফেলিলেন; বলিলেন— ‘তোমার প্রগল্‌ভতার উপযুক্ত শাস্তি হইয়াছে— বৈশালিকার লক্ষ্যবেধ অব্যর্থ। তুমি আর উহার সহিত রসিকতা করিতে যাইও না।’

বটুক তীরফলক অতিকষ্টে কেশ হইতে মুক্ত করিয়া করুণ স্বরে বলিল— ‘না মহারাজ, আর করিব না। একাদশ রুদ্রের কোপ ও দ্বাদশ সূর্যের তাপ সহ্য করিতে পারি; কিন্তু আগুন লইয়া খেলা এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের আর সহ্য হইবে না।’

মহারাজ বলিলেন— ‘এখন যাও, কঞ্চুকীকে ডাকিয়া আনো, তিনি আসিয়া অন্তঃপুরের সুব্যবস্থা করুন।’

বটুকভট্ট অমনই উঠিয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল, বলিল— ‘তাহাই করি। তবু যদি দেবী আমার প্রতি প্রসন্না হন।’

‘দেবী’ শব্দের মধ্যে হয়তো একটা ব্যঙ্গার্থ ছিল, মহারাজের কর্ণে সেটা বিঁধিল; কিন্তু তিনি কোনও প্রকার প্রতিবাদ করিবার পূর্বেই ধূর্ত বটুকভট্ট কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

8

কয়েক দিন কাটিয়া গেল। উল্কা সখীপরিজনবেষ্টিতা হইয়া অন্তঃপুরেই বাস করিতে লাগিল। পুরী পরিত্যাগ করিয়া যাইবার কোনও আগ্রহ সে প্রকাশ করিল না— মহারাজও অন্য বাসভবনের উল্লেখ করিলেন না। বৃদ্ধ কঞ্চুকী বহুদিন পরে নিজ কার্য ফিরিয়া পাইয়া মহা উৎসাহে উল্কার তত্ত্বাবধানে লাগিয়া গেলেন। কোথাও বিন্দুমাত্র ত্রুটির ছিদ্র রহিল না।

রাজসভাতেও উল্কা কয়েক দিন নিজ আসনে গিয়া বসিল। সূক্ষ্ম বস্ত্রাবরণের ভিতর উল্কার আলোকসামান্য রূপ যেন শারদ মেঘাচ্ছন্ন শশিকলার প্রভা বিকিরণ করিতে লাগিল। রাজসভা এই নবচন্দ্রোদয়ে কুমুদ্বতীর মতো উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। ভিতরে ভিতরে সভাসদ্‌গণের মধ্যে নানা উৎসুক জল্পনা চলিতে লাগিল।

মহারাজ সেনজিৎ কিন্তু তাঁহার নিরুৎসুক নিস্পৃহতার মধ্যে অটল হইয়া রহিলেন। উল্কাকে তিনি পদোচিত মর্যাদা ও সমাদর প্রদর্শন করিতেন; কিন্তু তাহার বেশি কিছু নয়। উল্কা বিস্মিত হইয়া লক্ষ্য করিল, মহারাজের আচরণে নারীজাতি সম্বন্ধে একটা নীরস ঔদাসীন্যের ভাব রহিয়াছে— রাজন্যবর্গের পক্ষে ইহা যেমন অসাধারণ, তেমনই বিস্ময়কর। উল্কা হতাশ হইল না, বরঞ্চ মহারাজকে কুহকমন্ত্রে পদানত করিবার সঙ্কল্প তাহার কুলিশ-কঠিন হৃদয়ে আরও দৃঢ় হইল।

কিন্তু একদিন রাজসভায় একটি ঘটনা দেখিয়া উল্কা অধিকতর বিস্ময়াপন্ন হইল। মহারাজের ব্যবহারে অনাড়ম্বর মৃদুতা দর্শনে উল্কার বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, সেনজিৎ স্বভাবত দুর্বলপ্রকৃতি— চিত্তের দৃঢ়তা বা পুরুষোচিত সাহস তাঁহার নাই। এই ভ্রান্তি তাহার সহসা ভাঙ্গিয়া গেল।

মহারাজ সেনজিৎ সেদিন যথারীতি সিংহাসনে আসীন ছিলেন। সভামধ্যে চণ্ডের রহস্যময় মৃত্যু সম্বন্ধে নানা জল্পনা ও কৌতুকের অনুমান চলিতেছিল, উল্কা আকুঞ্চিত অধরে অর্ধ-নিমীলিত নেত্রে শুনিতেছিল, এরূপ সময় রাজা-মহামাত্র দৌড়িতে দৌড়িতে সভায় প্রবেশ করিয়া বলিল— ‘আয়ুষ্মন্‌, সর্বনাশ উপস্থিত, পুষ্কর ক্ষিপ্ত হইয়াছে। সে শৃঙ্খল ছিঁড়িয়া এই দিকেই ছুটিয়া আসিতেছে।’

‘পুষ্কর’ রাজার পট্ট হস্তীর নাম। এই সংবাদ শুনিয়া সভামধ্যে বিষম চাঞ্চল্য ও গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। কিন্তু সেনজিৎ কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন— ‘তোমরা শান্ত হও, ভয় নাই— আমি দেখিতেছি।’ বলিয়া তিনি বাহিরের দিকে চলিলেন।

মহামাত্র সভয়ে বলিল— ‘আয়ুষ্মন্‌, পুষ্কর তাহার রক্ষককে শুণ্ডাঘাতে বধ করিয়াছে, আমিও তাহাকে শাসন করিতে পারি নাই। এ অবস্থায় আপনি তাহার সম্মুখীন হইলে—’

মহারাজ তাহার কথায় কর্ণপাত করিলেন না, বহু স্তম্ভযুক্ত উন্মুক্ত সভামণ্ডপের প্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সঙ্গে সঙ্গে উদ্যতশুণ্ড প্রকাণ্ড উন্মত্ত হস্তী বৃংহিতধ্বনি করিতে করিতে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। হস্তীর গণ্ড হইতে মদবারি ক্ষরিত হইতেছে, চরণে ছিন্ন শৃঙ্খল, ক্ষুদ্র চক্ষুর্দ্বয় কষায়বর্ণ ধারণ করিয়া ঘূর্ণিত হইতেছে। এই দৃশ্য দেখিয়া সভাসদ্‌গণ কাষ্ঠপুত্তলীর ন্যায় হতগতি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। উল্কাও নিজ আসনে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে বিস্ফারিত-নয়নে স্পন্দিতবক্ষে চাহিয়া রহিল। কাহারও মুখে বাক্য সরিল না।

সেনজিৎ সভাচত্বর হইতে অবতরণ করিয়া হস্তীর আরও নিকটবর্তী হইলেন। মদস্রাবী মাতঙ্গ প্রহার-উদ্যমে শুণ্ড ঊর্ধ্বে তুলিল। তখন সেই রুদ্ধশ্বাস নীরবতার মধ্যে সেনজিৎ মৃদু র্ভৎসনার সুরে বলিলেন— ‘পুষ্কর! পুষ্কর!’

পুষ্করের শুণ্ড ঘোরাবেগে অবতরণ করিতে করিতে অর্ধ-পথে থামিয়া গেল। মত্ত হস্তী রক্তনেত্রে মহারাজের দিকে চাহিয়া যেন বিদ্রোহ করিতে চাহিল, একবার দ্বিধাভরে তাহার করদণ্ড ঈষৎ আন্দোলিত হইল— তারপর ধীরে ধীরে শুণ্ড অবনমিত করিয়া সে নম্রভাবে দাঁড়াইল। কয়েক মুহূর্তমধ্যে ধ্বংসের মূর্তিমান বিগ্রহ যেন শান্তিময় তপোবনামৃগে পরিণত হইল।

মহারাজ সস্নেহে তাহার শুণ্ডে হাত বুলাইয়া তাহার কানে কানে কি বলিলেন; পুষ্করের প্রকাণ্ড দেহ লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া গেল, সে অধোবদনে ধীরে ধীরে পশুশালা অভিমুখে ফিরিয়া চলিল। মহারাজ তাহার সঙ্গে চলিলেন। এতক্ষণে হস্তিপক সাহস পাইয়া মহারাজের অনুবর্তী হইল।

এই ঘটনা উল্কার মনে গভীর রেখাপাত করিল। শত্রুর শক্তি সম্বন্ধে অন্ধ থাকিতে নাই; উল্কাও মহারাজ সম্বন্ধে সতর্ক ও অবহিত হইয়া তাঁহাকে জালবদ্ধ করিবার উপায় চিন্তা করিতে লাগিল।

ওদিকে মহারাজ সেনজিৎ বর্মাচ্ছাদিত যোদ্ধার ন্যায় অক্ষতদেহে বিরাজ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অন্তরে কন্দর্পজনিত কোনও বিক্ষোভ উপস্থিত হইয়াছে কি না কেহ অনুমান করিতে পারিল না।

একদা প্রাতঃকালে মহারাজ যথাবিহিত স্নানাদি সম্পন্ন করিয়া পক্ষিভবনে গমন করিলেন। পক্ষিপালন মহারাজের অতি প্রিয় ব্যসন; বহুজাতীয় বিহঙ্গ তাঁহার পক্ষিশালায় নিরন্তর কলরব করিত, তিনি প্রত্যহ প্রাতে স্বহস্তে তাহাদিগকে আহার করাইতেন।

একটি শুক স্বর্ণদণ্ডের উপর বসিয়া ছিল, সেনজিৎ তাহার নিকটে যাইতেই সে ডানা ঝটপট করিয়া উড়িয়া গেল। তাহার চরণের সুবর্ণশৃঙ্খল কোনও উপায়ে কাটিয়া গিয়াছিল; মহারাজ দেখিলেন, শুক উড়িয়া অন্তঃপুরসংলগ্ন উপবনের এক আমলকীবৃক্ষের শাখায় গিয়া বসিল।

এই শুক মহারাজের অতি আদরের পক্ষী, বহুকাল শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকিয়া ভাল উড়িতেও পারে না। তাহাকে ধরিবার জন্য কি করা যায়, মহারাজ চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় তিলক-পুণ্ড্রক-চিত্রিত ললাটে বটুকভট্ট আসিয়া স্বস্তিবাচন করিল। তাহাকে দেখিয়া মহারাজ বলিলেন— ‘ভালই হইল। বটুক, আমার শুকপাখিটা উড়িয়া গিয়া অন্তঃপুরের ঐ আমলকীবৃক্ষে বসিয়াছে। তুমি যাও, উহাকে ধরিয়া আন। উদ্যানপালিকাকে বলিলেই সে ধরিয়া দিবে।’

বটুকভট্টের চক্ষু গোলাকৃতি হইল, সে বলিল— ‘রাজার আদেশ অলঙ্ঘনীয়, কিন্তু অনাহূতভাবে রাজ-অবরোধে প্রবেশ করা কি উচিত হইবে? লোকে যদি নিন্দা করে?’

‘নিন্দা করিবে না— তুমি যাও।’

বটুক অতিশয় গম্ভীরমুখে বলিল— ‘অকলঙ্ক-চরিত্র ব্রাহ্মণ-সন্তানকে সর্বদাই সাবধানে থাকিতে হয়—

মহারাজ শ্লেষ করিয়া বলিলেন— ‘এত ভয় কিসের?’

তখন সত্য কথা বাহির হইয়া পড়িল, বটুক কম্পিতস্বরে কহিল— ‘যদি আবার তীর ছোঁড়ে?’

মহারাজ হাসিয়া উঠিলেন— ‘ভয় নাই। রসিকতার চেষ্টা করিও না, তাহা হইলে আর কোনও বিপদ ঘটিবে না।’

ক্ষুব্ধস্বরে বটুক বলিল— ‘যাইতেই হইবে?’

তাহার কাতরভাব দেখিয়া মহারাজ স্মিতমুখে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন— ‘হাঁ।’

সশব্দ দীর্ঘনিশ্বাস মোচনপূর্বক বটুক অনিচ্ছা-মন্থরপদে অন্তঃপুরের দিকে চলিল, মহারাজকে শুনাইতে শুনাইতে গেল— ‘এই জন্যই প্রজারা মাৎস্যন্যায় করে। সামান্য একটা পক্ষীর জন্য—’

কয়েক পদ গিয়া বটুক আবার ফিরিয়া আসিল, বলিল— ‘মহারাজ, আমি বলি, আপনিও আমার সঙ্গে চলুন না, দু’জন থাকিলে বিপদে আপদে পরস্পরকে রক্ষা করিতে পারিব।’

মহারাজ হাসিতে লাগিলেন, বলিলেন— ‘মূর্খ, আমিই যদি যাইব, তবে তোমাকে পাঠাইতেছি কেন?’

বটুকভট্ট তখন জোড়করে করুণবাচনে বলিল— ‘মহারাজ, রক্ষা করুন, আমাকে একাকী পাঠাইবেন না। ঐ বিদেশিনী যুবতীটাকে আমি বড় ভয় করি।’

মহারাজের স্মিতমুখে ক্ষণকালের জন্য ঈষৎ ভাবান্তর দৃষ্ট হইল; তিনি যেন বিমনা হইয়া কি ভাবিলেন। তারপর বাহিরে দৃঢ়তা অবলম্বন করিয়া বলিলেন— ‘না, তুমি একাকী যাও, আমি যাইব না।’

এবার বটুকভট্ট প্রতিশোধ লইল, রাজার বাক্য ফিরাইয়া দিয়া বলিল— ‘কেন, আপনার এত ভয় কিসের?’

রুষ্ট বিস্ময়ে মহারাজ বলিলেন— ‘ভয়? আমি কি তোমার মতো শিখা-সর্বস্ব ব্রাহ্মণ।’ বটুক উত্তর দিল না, শুধু মিটিমিটি চাহিতে লাগিল। তখন মহারাজ অধীরভাবে বলিলেন— ‘ভাল, একাকী যাইতে ভয় পাও, চল, আমি রক্ষক হিসাবে যাইতেছি। নারীভয়ে ভীত ব্রাহ্মণকে রক্ষা করাও সম্ভবত রাজধর্ম।’

রাজা অগ্রবর্তী হইয়া অন্তঃপুর অভিমুখে চলিলেন। যাইতে যাইতে বটুকভট্টের কণ্ঠ হইতে একবার একটা অবরুদ্ধ হাসির শব্দ বাহির হইল। রাজা সন্দিগ্ধভাবে তাহার দিকে ফিরিলেন; কিন্তু বটুকভট্টের মুখে দুর্জয় গাম্ভীর্য ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না।

সঙ্কীর্ণ পরিখার ভিতর হইতে অনুচ্চ প্রাকার-বেষ্টনী— তন্মধ্যে রাজ-অবরোধের চক্রাকৃতি বিস্তীর্ণ ভূমি। ভূমির কেন্দ্রস্থলে সৌধ— চতুর্দিকে নানা বৃক্ষ-লতা-শোভিত উপবন।

উদ্যানে প্রবেশপূর্বক কয়েক পদ গমন করিবার পর মহারাজ সেনজিতের গতি ক্রমশ শ্লথ হইয় শেষে থামিয়া গেল। যে আমলকীবৃক্ষটা তাঁহার লক্ষ্য ছিল, তাহার অনতিদূরে এক পুষ্পিত রক্ত-কুরুবকের ছায়ায় তাঁহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। তিনি দেখিলেন, সদ্যস্নাতা উল্কা একাকিনী বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া কর্ণে কুরুবক— কোরকের অবতংস পরিতেছে! তাহার কটিতটে চম্পকবর্ণ সূক্ষ্ম কার্পাসবন্ত্র, বক্ষে কাশ্মীর-রঞ্জিত নিচোল— উত্তরীয় নাই। দর্পণের ন্যায় ললাটে কুঙ্কুম-তিলক, চরণপ্রান্তে লাক্ষারাগ, সিক্ত অবেণীবদ্ধ কুন্তলভার পৃষ্ঠে বিলম্বিত হইয়া যেন এই সম্মোহিনী প্রতিমার পটভূমিকা রচনা করিয়াছে।

মহারাজের উত্তরীয় আকর্ষণ করিয়া উত্তেজিত নিম্নস্বরে বটুকভট্ট বলিল— ‘মহারাজ, দেখুন, দেখুন, সাক্ষাৎ কন্দর্পের জয়শ্রী বৃক্ষতলে আবির্ভূতা হইয়াছে। হে কন্দর্পারি, এই দুরন্ত বসন্তকালে তুমি আমাদের রক্ষা কর।’

পরিপূর্ণ নারীবেশে মহারাজ ইতিপূর্বে উল্কাকে দেখেন নাই— আজ প্রথম দেখিলেন। উল্কা যখনই প্রকাশ্যে বাহির হইয়াছে, নারীসুলভ প্রসাধন বর্জন করিয়া দৃপ্ত যোদ্ধৃবেশে দেখা দিয়াছে। তাই আজ তাহার সুকুমার নারীমূর্তি যেন দর্শকের চিত্তে বিপ্লবের সৃষ্টি করিয়া দিল।

উল্কাও দূর হইতে মহারাজকে দেখিতে পাইয়াছিল; সে রিমঝিম মঞ্জীর বাজাইয়া, অঙ্গসঞ্চালনে লাবণ্যের তরঙ্গ তুলিয়া সেই দিকে অগ্রসর হইল। জঘনভারমন্থর মদালস গতি, যেন প্রতি পদক্ষেপে ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। উত্তরীয়ের অভাবে ব্যক্ত দেহভাগ সুমধুর নির্লজ্জতায় নিজ গৌরব-গর্ব ঘোষণা করিতেছে। মন্ত্ররুদ্ধবীর্য সর্পের ন্যায় মহারাজ স্থির হইয়া রহিলেন।

উল্কা মহারাজের সম্মুখে উপস্থিত হইল। মুখে একটু ভঙ্গুর হাসি, আয়ত চক্ষুপল্লবে শ্যামস্নিগ্ধ ছায়া। উল্কা মহারাজের পদপ্রান্তে জানু নত করিয়া বসিল, কূজন-মধুর স্বরে বলিল— ‘প্রভাতে উঠিয়া রাজদর্শন করিলাম, আজ আমার সুপ্রভাত। দেবপ্রিয়, দাসীর অর্ঘ্য গ্রহণ করুন।’ বলিয়া কপোতহস্তে কয়েকটি কুরুবক-কলি তুলিয়া ধরিল।

মহারাজ মূক হইয়া রহিলেন।

বটুকভট্ট উল্কার আগমনে মহারাজের পশ্চাতে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সেখান হইতে হস্ত উত্তোলন করিয়া বহু অলঙ্কারযুক্ত ভাষায় সাড়ম্বরে আশীর্বচন করিতে লাগিল। তাহার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে মহারাজের চমক ভাঙ্গিল।

আত্মবিস্মৃতির তন্দ্র হইতে জাগিয়া উঠিয়াই মহারাজ মুখভাব কঠিন করিলেন, ললাটে ভ্রূকুঞ্চন দেখা দিল। তিনি ধীর-হস্তে উল্কার অঞ্জলি হইতে একটি পুষ্প তুলিয়া লইয়া সংক্ষিপ্ত স্বরে বলিলেন— ‘স্বস্তি!’

উল্কা চপলনেত্রে আনন্দ বিকীর্ণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, কর্ণভূষণ দুলাইয়া পরিহাস-তরল-কণ্ঠে বলিল— ‘মহারাজ, এতদিনে বিদেশিনীকে স্মরণ হইল? রাজকার্য কি এতই গুরু?’

উল্কাকে এত হাস্যরহস্যময়ী মহারাজ পূর্বে দেখেন নাই; কিন্তু তিনি আকাশের দিকে চোখ তুলিয়া বলিলেন— ‘আমার একটা শুকপক্ষী উড়িয়া ঐ আমলকীবৃক্ষে বসিয়াছে, তাহাকে ধরিতে আসিয়াছি।’

কলকণ্ঠে হাসিয়া উল্কা বলিল— ‘সত্য? কই, আসুন তো দেখি।’

ক্রীড়াচঞ্চলা বালিকা যেন নূতন খেলার উপাদান পাইয়াছে, এমনই ভাবে চটুলপদে উল্কা আগে আগে চলিল, মহারাজ তাহার অনুবর্তী হইলেন। যাইতে যাইতে গ্রীবা বাঁকাইয়া উল্কা জিজ্ঞাসা করিল— ‘মহারাজ, আপনার শুকের নাম কি?’

মহারাজ গম্ভীরমুখে বলিলেন— ‘বিম্বোষ্ঠ।’

‘বিম্বোষ্ঠ! কি সুন্দর নাম!— কঞ্চুকী মহাশয় আমাকেও একটা শুকপক্ষী দিয়াছেন— সে ইহারই মধ্যে কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু এখনও তাহার নামকরণ হয় নাই। কি নাম রাখি বলুন তো?’

মহারাজ ললাটের উপর দিয়া একবার হস্তচালনা করিলেন, উল্কার পক্ষীর নামকরণ সহসা করিতে পারিলেন না।

ক্রমে উভয়ে আমলকীবৃক্ষতলে উপনীত হইলেন। রাজা পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, সাবধানী বটুক তাঁহার সঙ্গে আসে নাই, বৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া আছে। তিনি মনে মনে ভীরু ব্রাহ্মণকে কটূক্তি করিলেন।

আমলকীবৃক্ষ বসন্ত ঋতুর সমাগমে নবপত্রে শোভিত হইয়াছে, তাহার ভিতরে হরিদ্বর্ণ পক্ষী সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। উল্কা ও মহারাজ ঊর্ধ্বমুখ হইয়া অন্বেষণ করিতে লাগিলেন।

সহসা উল্কা সেনজিতের হাত ধরিয়া টানিয়া বলিয়া উঠিল— ‘ঐ দেখুন মহারাজ, ঐ দেখুন, আপনার ধূর্ত বিম্বোষ্ঠ পত্রান্তরালে বসিয়া ফল ভক্ষণ করিতেছে।’

মহারাজ ধীরে ধীরে হাত ছাড়াইয়া লইলেন, তারপর রুক্ষস্বরে কহিলেন— ‘বিম্বোষ্ঠ, নামিয়া আয়!’

মহারাজের কণ্ঠস্বর শুনিবামাত্র বিম্বোষ্ঠ নখঘৃত ফল ফেলিয়া দিয়া সতর্কভাবে ঘাড় বাঁকাইয়া নীচের দিকে তাকাইল, কিন্তু নামিয়া আসিবার জন্য কোনও ব্যস্ততা প্রদর্শন করিল না।

মহারাজ আবার তর্জন করিলেন— ‘বিম্বোষ্ঠ, শীঘ্র নামিয়া আয়।’

কোনও ফল হইল না; বিম্বোষ্ঠ পাশের দিকে সরিয়া গিয়া এক শাখার আড়ালে লুকাইবার চেষ্টা করিল।

উল্কা বিভক্ত ওষ্ঠাধরে দেখিতেছিল, এবার সে পলাতক মুক্তিবিলাসী পক্ষীকে আহ্বান করিল; ভ্রূবিলাস করিয়া কপট ক্রোধমিশ্রিত কৌতুকের স্বরে বলিল— ‘ধৃষ্ট পাখি, মহারাজের আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে তোর সাহস হয়? এখনও নামিয়া আয়, নচেৎ তোর দুই পায়ে শিকল দিয়া পিঞ্জরে বাঁধিয়া রাখিব।’

এত বড় শাসনবাক্যেও বিদ্রোহী পাখি অটল রহিল। তখন উভয়ে বহুপ্রকারে তাহাকে প্রলুব্ধ করিবার চেষ্টা করিলেন, উল্কা আরক্ত বিম্বাধর স্ফুরিত করিয়া, করকঙ্কণ ক্বণিত করিয়া তাহাকে তর্জন অনুনয় করিল; কিন্তু বিম্বোষ্ঠ গ্রাহা করিল না।

তখন সেনজিৎ হতাশ হইয়া বলিলেন— ‘এখন উপায়?’

উল্কা গণ্ডে তর্জনী রাখিয়া চিন্তা করিল। তারপর সহসা মুখ তুলিয়া বলিল— ‘উপায় আছে, মহারাজ! ক্ষণেক অপেক্ষা করুন, আমি আসিতেছি।’ বলিয়া রহস্যময় হাসিয়া দ্রুতশিঞ্জিত-চরণে ভবন অভিমুখে প্রস্থান করিল। সেনজিৎ তাঁহার চঞ্চল নিতম্বলুণ্ঠিত কেশজালের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করিয়াই চক্ষু ফিরাইয়া লইলেন।

কিয়ৎকাল পরে উল্কা ফিরিয়া আসিল। মহারাজ দেখিলেন, তাহার মণিবন্ধে একটি দীর্ঘপুচ্ছ শুক পক্ষী।

মহারাজ আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলেন— ‘পাখি দিয়া পাখি ধরিবে?’

উল্কা পূর্ণ-দৃষ্টিতে মহারাজের দিকে তাকাইল, বলিল— ‘হাঁ। কেন, তাহা কি অসম্ভব?’

মহারাজের গণ্ড ঈষৎ উত্তপ্ত হইল, তিনি পুনর্বার কণ্ঠস্বর নীরস করিয়া বলিলেন— ‘বলিতে পারি না। চেষ্টা করিয়া দেখিতে পার।’

উল্কা তখন মৃদুহাস্যে বাহু ঊর্ধ্বে তুলিয়া কুহক-মধুর স্বরে ডাকিল— ‘আয়, আয় বিম্বোষ্ঠ! এই দ্যাখ, তোর সাথী তোর জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে। আয়!’

বিম্বোষ্ঠ কৌতূহলীভাবে নীচের দিকে তাকাইল, ঘাড় বাঁকাইয়া বাঁকাইয়া নিরীক্ষণ করিল। তারপর উড়িয়া আসিয়া উল্কার অংসের উপর বসিল।

বিজয়োজ্জ্বল দৃষ্টিতে উল্কা বলিল— ‘দেখিলেন, মহারাজ?’

‘দেখিলাম।’

দুই পক্ষী কিছুক্ষণ নীরবে পরস্পরের পরিচয় গ্রহণ করিল। তারপর বিম্বোষ্ঠ অবজ্ঞাসূচক একটা শব্দ করিয়া উল্কার কর্ণবিলম্বী রক্তবর্ণ কুরুবক-মুকুলে চঞ্চু বসাইয়া টান দিল।

উল্কা বিপন্নভাবের বিভ্রম করিয়া বলিয়া উঠিল— ‘মহারাজ, রক্ষা করুন, আপনার দস্যু পক্ষী আমার কর্ণভূষা হরণ করিতে চায়।’

সেনজিৎ পক্ষীকে ধরিতে গেলেন। পাখি ঝটপট করিয়া পলায়নের চেষ্টা করিল, কিন্তু মহারাজ তাহার চরণবিলম্বিত স্বর্ণশৃঙ্খলের অংশ ধরিয়া ফেলিয়াছিলেন। পাখি পলাইতে পারিল না— মহারাজের উন্মুক্ত বক্ষের উপর গিয়া পড়িল। ভীত পক্ষীর তীক্ষ্ণ নখ তাঁহার বক্ষে অবলম্বন অন্বেষণ করিতে গিয়া কয়েকটা আঁচড় কাটিয়া দিল।

দেখিতে দেখিতে নখচিহ্ন রক্তিম হইয়া উঠিল; তারপর দুই বিন্দু রক্ত ধীরে ধীরে সঞ্চিত হইয়া গড়াইয়া পড়িল।

উল্কা সত্রাসে বলিয়া উঠিল— ‘সর্বনাশ! মহারাজ, এ কি হইল!— ওরে কে আছিস্‌, শীঘ্র আয়! বান্ধুলি। বিপাশা!— শীঘ্র অনুলেপন লইয়া আয়! মহারাজ আহত হইয়াছেন।’

মহারাজের মুখ লজ্জায় রক্তবর্ণ হইল, তিনি প্রায় রূঢ়স্বরে বলিয়া উঠিলেন— ‘এ কিছু নয়, সামান্য নখ ক্ষত মাত্র।’

‘সামান্য নখক্ষত! মহারাজ কি জানেন না, পশু-পক্ষীর নখে বিষ থাকে?’ ব্যাকুলভাবে গৃহের দিকে তাকাইয়া বলিল— ‘কই, কেহ আসে না কেন? বিলম্বে বিষ যে দেহে প্রবেশ করিবে। বান্ধুলি! সুজাতা!’

মহারাজ আবার আরক্তমুখে আপত্তি করিলেন। তখন উল্কা হঠাৎ যেন পথ খুঁজিয়া পাইয়া বলিয়া উঠিল— ‘মহারাজ, আপনি স্থির হইয়া দাঁড়ান, আমি বিষ নিষ্কাশন করিয়া লইতেছি!’

উল্কার উদ্দেশ্য মহারাজ সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করিবার পূর্বেই সে মহারাজের একেবারে নিকটে গিয়া দাঁড়াইল, তারপর দুই হাত তাঁহার স্কন্ধের উপর রাখিয়া ক্ষরণশীল ক্ষতের উপর তাহার কোমল অধরপল্লব স্থাপন করিল। মহারাজ ক্ষণকাল স্তম্ভিত অভিভূত হইয়া রহিলেন, তারপর সবলে নিজেকে উল্কার আশ্লেষমুক্ত করিয়া লইয়া পিছু সরিয়া দাঁড়াইলেন।

উল্কার অধরে মহারাজের বক্ষ-শোণিত। সে অর্ধস্ফুট বিস্ময়ে বলিল— ‘কি হইল!’

তিক্ত ঘৃণাজর্জরিতস্বরে সেনজিৎ বলিলেন— ‘নারীর পুরুষভাব আমি ক্ষমা করিতে পারি, কিন্তু নির্লজ্জতা অসহ্য!’ বলিয়া উল্কার দিকে আর দৃক্‌পাত না করিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন।

যতক্ষণ মহারাজকে দেখা গেল, উল্কা স্থিরনেত্রে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার চোখে ধিকি-ধিকি আগুন জ্বলিতে লাগিল। তারপর সে সজোরে দন্ত দিয়া অধর দংশন করিল। মহারাজের বক্ষোরুধিরে উল্কার রুধির মিশিল।

প্রত্যাখ্যাতা খণ্ডিতা নারীর চিত্ত-গহনে কে প্রবেশ করিবে? শিকার-বঞ্চিতা ব্যাঘ্রীর ক্ষুধিত জিঘাংসাই বা কে পরিমাপ করিতে পারে? উল্কার নয়নে যে বহ্নি জ্বলিতে লাগিল তাহার অন্তর্গূঢ় রহস্য নির্ণয় করা মানুষের সাধ্য নয়। বোধ করি দেবতারও অসাধ্য।

সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে সেনজিৎ রাজোদ্যানে একাকী বিচরণ করিতেছিলেন। মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মন্দীভূত হইয়া অগ্নিকোণ হইতে মৃদু শীতল মলয়ানিল বহিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সুদূর চম্পারণ্যের চাঁপার বন হইতে সুগন্ধ আহরণ করিয়া মহারাজের আতপ্ত ললাট স্নিগ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছিল।

মহারাজের চক্ষের উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টি তাঁহার অশান্ত চিত্তের প্রতিচ্ছবি বহন করিতেছিল। পাদচারণ করিতে করিতে তিনি অন্যমনে যূথীগুল্ম হইতে পুষ্প তুলিয়া নখে ছিন্ন করিতেছিলেন, কখনও ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া আকাশে যেখানে সূর্যাস্তের বর্ণ-বিলাস চলিতেছিলেন সেই দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চাহিতেছিলেন।

এই সময় রাজ্যের মহামাত্য ধীরপদে আসিয়া মহারাজকে আশীর্বাদ করিয়া দাঁড়াইলেন। অপ্রসন্ন সপ্রশ্ন মুখে মহারাজ তাঁহার প্রতি চাহিলেন। কোনও কথা হইল না; মন্ত্রী নীরবে একটি ক্ষুদ্র লিপি বাহির করিয়া তাঁহার হস্তে দিলেন।

ভূর্জপত্রে লিখিত লিপি; তাহাতে এই কয়টি কথা ছিল—

‘বৈশালিকা নারী সম্বন্ধে সাবধান। কোনও কুটিল উদ্দেশ্যে সে মগধে প্রেরিত হইয়াছে। সম্ভবত মহারাজকে রূপমোহে বশীভূত করিয়া লিচ্ছবির কার্যসিদ্ধি করা তাহার অভিপ্রায়।’

পত্র পাঠ করিয়া মহারাজ আরক্ত মুখ তুলিলেন; মন্ত্রী অন্য দিকে চাহিয়া ধীরস্বরে বলিলেন— ‘বৈশালী হইতে আমাদের গুপ্তচর অদ্য এই পত্র পাঠাইয়াছে।’

মহারাজ কথা কহিলেন না, লিপির দিকে কিছুক্ষণ বিরাগপূর্ণ নেত্রে চাহিয়া থাকিয়া ভূর্জপত্র খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া বাতাসে উড়াইয়া দিলেন। মন্ত্রী অবিচলিত মুখচ্ছবি লইয়া পুনর্বার মহারাজকে আশীর্বাদপূর্বক প্রস্থান করিলেন।

ক্রমে রাত্রি হইল, আকাশের আভুগ্ন চন্দ্রকলা এতক্ষণ মলিন-মুখে ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বীর তিরোভাবে এখন যেন বাঁকা হাসি হাসিয়া উঠিল। মহারাজের সন্নিধাতা স্বর্ণপাত্রে স্নিগ্ধ আসব লইয়া উপস্থিত হইলে মহারাজ একনিশ্বাসে সুরা পান করিয়া পাত্র দূরে নিক্ষেপ করিলেন।

তারপর একে একে বয়স্যরা আসিল। কিন্তু মহারাজের মুখে প্রকট বিরক্তি ও নির্জনবাসের স্পৃহা লক্ষ্য করিয়া তাহারা সঙ্কুচিতভাবে অপসৃত হইয়া গেল। বটুকভট্ট আসিয়া মহারাজের চিত্তবিনোদনের চেষ্টা করিল, তাহার চটুলতা কিয়ৎকাল ধৈর্যসহকারে শ্রবণ করিয়া মহারাজ তাঁহার প্রকৃত মনোভাব ব্যক্ত করিলেন, বলিলেন— ‘বটুক, তোমাকে শূলে দিবার ইচ্ছা হইতেছে।’

বটুক দ্রুত পলায়ন করিতে করিতে বলিল— ‘মহারাজ, ও ইচ্ছা দমন করুন, আমি শয্যায় শুইয়া শুইয়া মরিতে চাই।’

রাত্রি ক্রমশ গভীর হইতে লাগিল। উৎকণ্ঠিত সন্নিধাতা মহারাজের আশেপাশে ঘুরিতে লাগিল; কিন্তু কাছে আসিতে সাহস করিল না। সদা-প্রসন্ন মহারাজের এরূপ ভাবান্তর পূর্বে কেহ দেখে নাই, সকলেই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। রাজপুরীর সূপকার হইতে সম্বাহক পর্যন্ত সকলের মধ্যেই কানে কানে বার্তা প্রচারিত হইয়া গেল— দেবপ্রিয় মহারাজের আজ চিত্ত সুস্থ নাই। যবনী প্রতীহারীরা ঊর্ধ্ব-চোখে চাহিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল; তাহাদের বর্মাচ্ছাদিত বক্ষও মহারাজের জন্য ব্যথিত হইয়া উঠিল।

সেনজিৎকে রাজ্যের আপামর সাধারণ সকলেই ভালবাসিত। বিশেষত পুরপরিজন তাঁহাকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করিত, তাঁহার অল্পমাত্র ক্লেশ দূর করিবার জন্য বোধ করি প্রাণ দিতেও কেহ পরাঙ্মুখ হইত না। রাজা যেখানে প্রজার বন্ধু সেখানে এমনই হয়। কিন্তু তবু আজিকার এই মধুর বসন্ত-রজনীতে মহারাজ বক্ষে অজ্ঞাত সন্তাপের অগ্নি জ্বালিয়া একাকী পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন, পত্রমিত্র বয়স্য পরিজন কেহ সান্ত্বনা দিবার জন্যও তাঁহার সম্মুখীন হইতে সাহসী হইল না।

রাত্রি দ্বিপ্রহর হইতে যখন আর বিলম্ব নাই তখন মহারাজ দ্রুত পাদচারণ করিতে করিতে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন। নিস্তব্ধ বাতাসে সুমধুর বীণা-ধ্বনি তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল। ধ্বনি অন্তঃপুরের দিক হইতে আসিতেছে। অতি মৃদু ধ্বনি, কিন্তু যেন প্রাণের দুরন্ত আক্ষেপভরে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে।

ব্যাধ-বংশী-আকৃষ্ট মৃগের মতো মহারাজের পদদ্বয় অজ্ঞাতসারে ঐ বীণা-ধ্বনির দিকে অগ্রসর হইল, তিনি পরিখার প্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

পরিখার পরপারে প্রাচীরের অন্তরালে বসিয়া কে বীণা বাজাইতেছে। ক্রমে বীণাধবনির সহিত একটি কণ্ঠস্বর মিশিল। তরল খেদ-বিগলিত কণ্ঠস্বর— মনে হয় যেন জ্যোৎস্না কুহেলির সহিত মিশিয়া মিলাইয়া যাইতেছে। মহারাজ তন্ময় একাগ্র হইয়া শুনিতে লাগিলেন। প্রথমে দুই-একটি কথা, তারপর সম্পূর্ণ সঙ্গীত তাঁহার শ্রুতিগোচর হইল।

আধ-আধ প্রাকৃত ভাষায় গ্রথিত সঙ্গীত, তাহার মর্ম—

হায় ধিক্‌ কন্দর্পদর্পাহতা!

মন্মথ তোমার মন মথন করিল,

প্রিয়জনকে নিকটে পাইয়া তুমি লজ্জা বিসর্জন দিলে।

হায়, কেন লজ্জা বিসর্জন দিলে?

প্রিয়জনের ঘৃণা তোমার অঙ্গ দহন করিল,

মদন তোমার অন্তর দহন করিল—

তুমি অন্তরে বাহিরে পুড়িয়া ভস্মীভূত হইলে!

হায় ধিক্‌ কন্দর্পদর্পাহতা!

বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাসে সঙ্গীত মিলাইয়া গেল। মহারাজ কয়েক মুহূর্ত পাষাণমূর্তির মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন, তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে সে স্থান ছাড়িয়া উদ্যান উত্তীর্ণ হইয়া নিজ শয়নভবনে প্রবেশ করিলেন।

শুষ্ক ইন্ধনে অগ্নি অধিক জ্বলে। সে রাত্রে মহারাজের নয়নে নিদ্রা আসিল না।

একে একে ফাল্গুনের মদোচ্ছ্বাসিত দিনগুলি কাটিতে লাগিল। মহারাজের চিত্তে সুখ নাই, মুখে হাসি নাই— তিনি দিন দিন শীর্ণ হইতে লাগিলেন।

মহারাজের প্রকৃতি যেন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গেল। অকারণ ক্রোধ— যাহা পূর্বে কেহ দেখে নাই— তাঁহার প্রতি কার্যে প্রতি সম্ভাষণে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল। মানুষের সাহচর্য বিষবৎ অসহ্য হইয়া উঠিল। প্রত্যহ সন্ধ্যা হইতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত উদ্যানে উদ্‌ভ্রান্তের ন্যায় বিচরণ করা তাঁহার নিত্যকার্য হইয়া দাঁড়াইল।

একমাত্র বটুকভট্টই বোধ হয় মহারাজের চিত্তবিক্ষোভের যথার্থ কারণ অনুমান করিয়াছিল; কিন্তু ব্রাহ্মণ বাহিরে মূর্খতার ভান করিলেও ভিতরে তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন— সে ঘুণাক্ষরে কাহারও কাছে কোনও কথা প্রকাশ করিল না। নারীবিদ্বেষী মহারাজের এত দিনে চিত্তবিকার উপস্থিত হইয়াছে, এ কথা তিনি স্বয়ং যখন গোপন করিতে চান তখন তাহা প্রকাশ করিয়া দিলে তাঁহার লজ্জা বৃদ্ধি পাইবে। এরূপ ক্ষেত্রে আপাতত এ কথা প্রচ্ছন্ন রাখাই শ্রেয়। মহারাজ যখন কন্দর্পের নিকট পরাভব স্বীকার করিবেন, তখন আপনিই সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িবে।

কিন্তু মহারাজের চিত্তে প্রফুল্লতা আনয়ন করিবার চেষ্টাও বটুকভট্টের সফল হইল না। সে সহজভাবে ইহাই বুঝিয়াছিল যে, মহারাজ যখন উল্কার প্রতি মনে মনে অনুরক্ত হইয়াছেন, তখন উভয়ের মিলন ঘটাইতে পারিলেই সব গণ্ডগোল চুকিয়া যাইবে। মহারাজের নারীবিদ্বেষ ও বিবাহে অনিচ্ছা যদি এইভাবে পরিসমাপ্তি লাভ করে, তবে তো সব দিক দিয়াই মঙ্গল। মগধের পট্টমহাদেবী হইতে উল্কার সমকক্ষ আর কে আছে?— এই ভাবিয়া বটুক তাহার সমস্ত ছলা-কলা ও রঙ্গভঙ্গ ঐ উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত করিয়াছিল। কিন্তু হায়, মহারাজের হৃদয় মন্থন করিয়া যে একই কালে অমৃত ও গরল উঠিয়াছে, তাহা অনুগত বটুক জানিতে পারে নাই।

এমনই ভাবে দিনগুলি ক্ষয় হইতে লাগিল, ওদিকে আকাশে চন্দ্রদেব পূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিলেন। শেষে একদিন বসন্তোৎসবের মধুরাকা আসিয়া উপস্থিত হইল।

দেশসুদ্ধ নরনারী উৎসবে মাতিল। সকলের মুখেই আনন্দের— তথা আসবের মদবিহ্বলতা। এমন কি যবনী প্রতীহারীরাও মাধবী পান করিয়া অরুণায়িত-নেত্রে পরস্পরের অঙ্গে কুঙ্কুম-পরাগ নিক্ষেপ করিয়া, বীণ বাজাইয়া, দ্রাক্ষাবনের গীত গাহিয়া উৎসবে মগ্ন হইল।

কেবল মহারাজ সেনজিৎ ভ্রূকুটি-ভয়াল মুখে সহচরহীন নিঃসঙ্গতার মধ্যে বিরাজ করিতে লাগিলেন।

সেদিন সন্ধ্যার পূর্বে তিনি ক্লান্তদেহে উদ্যানে গিয়া একটি মর্মরবেদীর উপর উপবেশন করিয়া শূন্যদৃষ্টিতে আকাশের দিকে চাহিলেন। অমনি সম্মুখে পরিখার পরপারে অন্তঃপুর-ভবনের শুভ্রচূড়া চোখে পড়িল। মহারাজ সেদিকে পশ্চাৎ ফিরিয়া বসিলেন। উদ্যানে কেহ নাই, উদ্যান-পালিকারাও আজ উৎসবে গা ঢালিয়া দিয়াছে; মহারাজকে কেহ বিরক্ত করিল না।

ক্রমে সন্ধ্যা হইল। পূর্ব-দিগন্তে পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি মারিল। দিনের আলো সম্পূর্ণ নিভিয়া যায় নাই, অথচ চাঁদের কিরণ পরিস্ফুট হইতে আরম্ভ করিয়াছে— দিবা-রাত্রির এই সন্ধিক্ষণে মহারাজের চিত্তও কোন্‌ ধূসর বর্ণপ্রলেপহীন অবসন্নতায় নিমগ্ন হইয়া গিয়াছিল, এমন সময় অকস্মাৎ একটি তীর আসিয়া তাঁহার পাশে পড়িল। চকিতে মহারাজ তীরটি তুলিয়া লইলেন; তীরের অগ্রভাগে ধাতু-ফলকের পরিবর্তে অশোকপুষ্প গ্রথিত, তীরগাত্রে একটি লিপি জড়ানো রহিয়াছে। কম্পিত হস্তে লিপি খুলিয়া মহারাজ পড়িলেন— লাক্ষারাগ দিয়া লিখিত লিপি—

‘আজ বসন্ত-পূর্ণিমার রাত্রে নির্লজ্জা উল্কা প্রার্থনা জানাইতেছে, মহারাজ একবার দর্শন দিবেন কি?’

মহারাজ পত্রখানি দুই হাতে ধরিয়া দুরন্ত আবেগে মুখের উপর চাপিয়া ধরিলেন। রুদ্ধ অস্ফুট স্বরে বলিলেন— ‘উল্কা মায়াবিনি—’

বাসনা প্রতিরোধেরও সীমা আছে! মহারাজ সেনজিতের অন্তর্দ্ধন্দ্ব শেষ হইল।

সেদিন প্রভাতে শয্যা ত্যাগ করিবার পর হইতেই উল্কা মনে মনে মহারাজের আগমন প্রতীক্ষা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এ কয় দিন মহারাজ তাহাকে দেখেন নাই, কিন্তু সে সৌধশীর্ষ হইতে লুকাইয়া মহারাজকে দেখিয়াছিল। তাই মদনোৎসবের প্রভাতে ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনে হইয়াছিল— আজ তিনি আসিবেন। পুরুষের মন এত কঠিন হইতে পারে না, আজ মহারাজ নিশ্চয় ধরা দিবেন।

কর্পূর-সুবাসিত জলে স্নান করিয়া সে প্রসাধন করিতে বসিয়াছিল। সখীরা তাহাকে অপরূপ সাজে সাজাইয়া দিয়াছিল; কিন্তু তবু তাহার মনঃপূত হয় নাই। বার বার কবরী খুলিয়া নূতন করিয়া কবরী বাঁধিয়াছিল— অঙ্গের পুষ্পাভরণ ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছিল, চন্দনের পত্রলেখা মুছিয়া বক্ষে কুঙ্কুমের পত্রলেখা আঁকিয়াছিল, আবার তাহা মুছিয়া চন্দনের চিত্র লিখিয়াছিল। শেষে রাগ করিয়া সখীদের বলিয়াছিল— ‘তোরা কিছু জানিস্‌ না। আজ আমার জীবনের মহা সন্ধিক্ষণ, এমন করিয়া আমাকে সাজাইয়া দে— যাহাতে মহেশ্বরের মনও জন্য করিতে পারি।’

সখীরা হাসিয়া বলিয়াছিল— ‘সেজন্য সাজিবার প্রয়োজন কি?’

কিন্তু প্রভাত বহিয়া গেল, মহারাজ আসিলেন না।

উল্কার পুষ্পাভরণ অঙ্গ-তাপে শুকাইয়া গেল, সে আবার নূতন পুষ্পভূষা পরিল। দ্বিপ্রহর অতীত হইল, অপরাহ্ণ ক্রমে সায়াহ্নে গড়াইয়া গেল, তবু মহারাজ দর্শন দিলেন না। সখীরা উল্কার চোখের দৃষ্টি দেখিয়া ভীত হইল।

সন্ধ্যার সময় প্রাসাদে-চূড়ে উঠিয়া উল্কা দেখিল— মহারাজ উদ্যানে বসিয়া আছেন, তাঁহার মুখ বিপরীত দিকে। তিক্ত অন্তঃকরণে উল্কা ভাবিল— ‘ধিক্‌ আমাকে!’

তারপর মহারাজের সমীপে তীর নিক্ষেপ করিয়া, বসন-ভূষণ ছিঁড়িয়া দূরে নিক্ষেপ করিয়া উল্কা শয্যায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। উল্কার চোখে বোধ করি জীবনে এই প্রথম অশ্রু দেখা দিল।

রাত্রি হইল। নগরীর প্রমোদ-কলরব ক্রমশ মৌন রসনিমগ্ন হইয়া আসিতে লাগিল। চন্দ্র মধ্যগগনে আরোহণ করিলেন।

উল্কার সখীরা সপ্তপর্ণ-বৃক্ষের শাখায় হিন্দোলা বাঁধিয়াছিল। উল্কা যখন দেখিল মহারাজ সত্যই আসিলেন না, তখন সে বুকের কঞ্চুকী কবরীর মালা ফেলিয়া দিয়া কেশ এলাইয়া সেই হিন্দোলায় গিয়া বসিল। তারপর শুষ্ক চোখে চাঁদের দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিল— ‘ব্যর্থ! ব্যর্থ! পারিলাম না! এত ছলনা চাতুরী সব মিথ্যা হইল। কোন্‌ দর্পে তবে মগধে আসিয়াছিলাম? এখন এ লজ্জা কোথায় রাখিব? উঃ— এত নীরস পুরুষের মন? ধিক্‌ আমার জীবন? আমার মৃত্যু ভাল!’

‘উল্কা!’

কে ডাকিল? কণ্ঠস্বর শুনিয়া চেনা যায় না। উল্কা গ্রীবা ফেরাইয়া দেখিল, বৃক্ষচ্ছায়ায় এক পুরুষ আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

‘উল্কা! রাক্ষসি! আমি আসিয়াছি।’

উল্কা চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহার সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। তরুপত্রের ছায়ান্ধকারে ঐ মূর্তি দেখিয়া সে প্রতিহিংসা ভুলিয়া গেল, মগধ ভুলিয়া গেল, বৈশালী ভুলিয়া গেল। দুর্দমনীয় অভিমানের বন্যা তাহার বুকের উপর দিয়া বহিয়া গেল। এমন করিয়াই কি আসিতে হয়? সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা নির্মূল করিয়া, অভিমান-দর্প ধূলায় মিশাইয়া দিয়া কি আসিতে হয়? নির্লজ্জার প্রগল্‌ভ লজ্জাহীনতার কি ইহার বেশি মূল্য নাই?

মহারাজ উল্কার অতি নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন, দুই হস্ত তাহার শ্লথবাস স্কন্ধের উপর রাখিয়া ক্ষুধিত নয়নে তাহার চক্ষের ভিতর চাহিয়া বলিলেন— ‘উল্কা, আর পরিলাম না। আমি তোমায় চাই। আমার রক্তের সঙ্গে তুমি মিশিয়া গিয়াছ, আমার হৃৎস্পন্দনে তোমার নাম ধ্বনিত হইতেছে— শুনিতে পাইতেছ না? এই শুন।’ বলিয়া তিনি উল্কার মুখ নিজ বক্ষে চাপিয়া ধরিলেন।

অভিমানও ভাসিয়া গেল। এই থরথর ব্যাকুলতার সম্মুখে মান-অভিমান বিলাস-বিভ্রম কিছুই রহিল না; শুধু রহিল চিরন্তন প্রেমলিপ্সু নারী প্রকৃতি। উল্কা স্ফুরিত অধরোষ্ঠ সেনজিতের দিকে তুলিয়া ধরিয়া স্বপ্ন-বিজড়িত দৃষ্টিতে চাহিল, পাখির তন্দ্রাকূজনের ন্যায় অস্ফুটকণ্ঠে বলিল— ‘প্রিয়! প্রিয়তম—!’

মহারাজের তপ্ত অধর বারম্বার তাহার অধরপাত্রে মধু পান করিল। তবু পিপাসা যেন মিটিতে চায় না! শেষে মহারাজ উল্কার কানে কানে বলিলেন— ‘উল্কা, সত্য বল, আমাকে ভালবাস? এ তোমার ছলনা নয়?’

উল্কার শিথিল দেহ সুখ-তন্দ্রায় ডুবিয়া গিয়াছিল, মহারাজের এই কথায় সে ধীরে ধীরে সেই তন্দ্রা হইতে জাগিয়া উঠিল। তাহার মুকুলিত নেত্র উন্মীলিত হইয়া ক্রমে বিস্ফারিত হইল; তারপর মহারাজের বাহুবন্ধনমধ্যে তাহার দেহ সহসা কঠিন হইয়া উঠিল।

অভিনয় করিতে করিতে নটীর আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছে; ছলনা কখন সত্যে পরিণত হইয়াছে হতভাগিনী জানিতে পারে নাই।

কিন্তু এখন? কর্ণমধ্যে সে বজ্রনির্ঘোষ শুনিতে পাইল— তুমি বিষকন্যা!

সবলে নিজ দেহ মহারাজের বাহুমুক্ত করিয়া লইয়া সে সরিয়া দাঁড়াইল, ত্রাস-বিবৃত চক্ষে তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না; শুধু তাহার কণ্ঠের শিরা দপ্‌ দপ্‌ করিয়া স্পন্দিত হইতে লাগিল।

মহারাজ দুই বাহু বাড়াইয়া অগ্রসর হইলেন— ‘প্রাণাধিকে—’

‘না না রাজাধিরাজ, আমার কাছে আসিও না—।’ উল্কা আবার সরিয়া দাঁড়াইল।

মৃদু ভর্ৎসনার সুরে মহারাজ বলিলেন— ‘ছি উল্কা! এই কি ছলনার সময়?’

উল্কা স্খলিতস্বরে বলিল— ‘মহারাজ ভুল বুঝিয়াছেন, আমি মহারাজকে ভালবাসি না।’

সেনজিৎ হাসিলেন— ‘আর মিথ্যা কথায় ভুলাইতে পরিবে না। — এস— কাছে এস।’

ব্যাকুল হৃদয়-ভেদী স্বরে উল্কা কাঁদিয়া উঠিল— ‘না না— প্রিয়তম, তুমি জানো না— তুমি জানো না—’

সেনজিতের মুখ ম্লান হইল, তিনি ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘বোধ হয় জানি। তুমি ‘বৈশালীর কুহকিনী, আমাকে ভুলাইতে আসিয়াছিলে; কিন্তু এখন আর তাহাতে কি আসে যায় উল্কা?’

‘কিছু জানো না; মহারাজ, আমাদের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। তুমি ফিরিয়া যাও, আর আমার মুখ দেখিও না। মিনতি করিতেছি, তুমি ফিরিয়া যাও।’

তাহার ব্যাকুলতা দেখিয়া মহারাজ বিস্ময়ে তাহার দিকে আবার অগ্রসর হইলেন। তখন উল্ক ব্যাধ-ভীতা হরিণীর ন্যায় ছুটিয়া পলাইতে লাগিল; তাহার কণ্ঠ হইতে কেবল উচ্চারিত হইল— ‘না না না—’

সেনজিৎ তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিলেন, কিন্তু ধরিতে পারিলেন না। উল্কা গৃহে প্রবেশ করিয় দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।

অধীর ক্রোধে মহারাজ দ্বারে সবেগে করাঘাত করিতে লাগিলেন। কিন্তু দ্বার খুলিল না।

দ্বারের অপরদিক হইতে উল্কা বলিল— ‘রাজাধিরাজ, বিস্তীর্ণা ধরণীতে আপনার যোগ্যা নারীর অভাব হইবে না। আপনি উল্কাকে ভুলিয়া যান।’

তিক্ত বিকৃতকণ্ঠে মহারাজ বলিলেন— ‘হৃদয়হীনা, তবে কেন আমাকে প্রলুব্ধ করিয়াছিলে?’

মিনতি-কাতরস্বরে উল্কা বলিল— ‘আর্য, বুদ্ধিহীনা নারীর প্রগল্‌ভতা ক্ষমা করুন। আপনি ফিরিয়া যান— দয়া করুন। আমাদের মিলন অসম্ভব।’

‘কিন্তু কেন— কেন? কিসের বাধা?’

দ্বারের অপর পার্শ্বে উল্কার দুই গণ্ড বহিয়া অশ্রুর বন্যা নামিয়াছে, তাহা মহারাজ দেখিতে পাইলেন না; শুধু শুনিতে পাইলেন, অর্ধব্যক্ত স্বরে উল্কা কহিল— ‘সে কথা বলিবার নয়।’

দন্তে দন্ত চাপিয়া মহারাজ বলিলেন— ‘কেন বলিবার নয়? তোমাকে বলিতে হইবে, আমি শুনিতে চাই।’

‘ক্ষমা করুন।’

‘না, আমি শুনিব।’

দীর্ঘ নীরবতার পর উল্কা বলিল— ‘ভাল, কল্য প্রাতে বলিব।’

মহারাজ দ্বারে মুখ রাখিয়া কহিলেন— ‘উল্কা, আজিকার এই মধুযামিনী বিফল হইবে?’

‘হাঁ মহারাজ।’

যেন বক্ষে আহত হইয়া মহারাজ ফিরিয়া আসিলেন। ক্লান্তির নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন— ‘ভাল। কল্য প্রভাতেই বলিবে?’

‘বলিব।’

‘তারপর তুমি আমার হইবে?’

উল্কা নীরব।

মহারাজ বলিলেন— ‘উল্কা, তুমি কি? তুমি কি নারী নও? আমাকে এমন করিয়া দগ্ধ করিতে তোমার দয়া হয় না?’

উল্কা এবারও নীরব।

অশান্ত হৃদয় লইয়া মহারাজ চলিয়া গেলেন। উল্কা তখন দ্বারসম্মুখে ভূমিতলে পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল, আর নিজ মনে বলিতে লাগিল— ‘ফিরিয়া গেলেন, মহারাজ ফিরিয়া গেলেন! প্রিয়তম, কেন তোমাকে ভালবাসিলাম? কখন বাসিলাম? যদি বাসিলাম তো আগে জানিতে পারিলাম না কেন? শ্মশানের অগ্নিশিখা আমি, কেমন করিয়া এই অভিশপ্ত দেহ তোমাকে দিব?’

শ্মশানের প্রেত-পিশাচরা বোধ করি শ্মশান-কন্যার এই অরুন্তুদ ক্রন্দন শুনিয়া অলক্ষ্যে অট্টহাস্য করিয়া নিঃশব্দে করতালি দিয়া নাচিতে লাগিল।

হায় উল্কা, তোমার পাষাণ-হৃদয় পাষাণই থাকিল না কেন? কেন তুমি ভালবাসিলে?

বিনিদ্র রজনীর গ্লানি-অরুণিত-নেত্রে উল্কা শয্যায় উঠিয়া বসিতেই একজন সখী আসিয়া বলিল— ‘বৈশালী হইতে পত্র আসিয়াছে’— বলিয়া লিপি হস্তে দিল।

জতুমুদ্রা ভাঙ্গিয়া ক্লান্ত চক্ষে উল্কা লিপি পড়িল। শিবামিশ্র লিখিয়াছেন—

‘কন্যা, চণ্ডের মৃত্যু-সংবাদ পাইয়াছি, তোমার মাতৃঋণ শোধ হইল। কিন্তু শিশুনাগবংশ এখনও নিঃশেষ হয় নাই। স্মরণ রাখিও।’

অন্যমনে পত্র ছিন্ন করিতে করিতে উল্কা পাংশু হাসিয়া বলিল— ‘সখি, জানিস, পিতা একটি কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। আমার দেহেও যে শিশুনাগবংশের রক্ত প্রবাহিত, এ কথা তাঁহার স্মরণ নাই।’

সকলে উল্কাকে শিবামিশ্রের কন্যা বলিয়া জানিত, এই রহস্যময় কথার অর্থ বুঝিতে না পারিয় সখী অবাক্‌ হইয়া চাহিয়া রহিল।

উল্কা শয্যা ত্যাগ করিয়া বলিল— ‘ভাল, তাহাই হইবে। শেষ করিতে না পারি, শিশুনাগবংশকে ক্ষীণ করিয়া যাইব।’ কল্য রজনী যে সঙ্কল্প তাহার মনে ছায়ার মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, শিবামিশ্রের পত্রে তাহা দৃঢ় হইল।

স্নান সমাপন করিয়া উল্কা যথারীতি বেশভূষা পরিধান করিল। কিন্তু আজ তাহার প্রসাধনে উৎকণ্ঠা নাই, সখীরা যেমন সাজাইয়া দিল তেমনই সাজিল। একবার দর্পণে মুখ দেখিল— দেখিয়া নিজেই শিহরিয়া উঠিল। সে ভাবিয়াছিল, তাহার বুকের মধ্যে যে অগ্নি সারা রাত্রি জ্বলিয়াছে, তাহাতে তাহার রূপও পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে। কিন্তু কই— দেহে তো তাহার একবিন্দু আঁচ লাগে নাই। বরং নয়নের অলস অরুণ চাহনিতে, গণ্ডের হিমশুভ্র পাণ্ডুরতায়, সর্বাঙ্গের ঈষৎক্লান্ত শিথিলতায় যেন রূপ আরও অলৌকিক হইয়া উঠিয়াছে। বিষকন্যাদের বুঝি এমনই হয়, ভিতরের আগুনে রূপের বর্তিকা আরও উদ্দীপ্ত হইয়া উঠে।

প্রসাধন শেষ হইলে উল্কা একজন সখীকে দুইখানি তরবারি আনিতে আদেশ করিল। সখী বিস্মিতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, কিন্তু প্রশ্ন করিতে সাহস করিল না, নিঃশব্দে প্রস্থান করিল।

তরবারি আসিলে উল্কা তাহাদের কোষমুক্ত করিয়া পরীক্ষা করিল। তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল খরধার অস্ত্র— উল্কা বাহুবল্লরী বিলোলিত করিয়া তাহাদের ঊর্ধ্বে তুলিল; মনে হইল, যেন কক্ষের ভিতর এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল।

এতক্ষণে একজন সখী সাহসে ভর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল— ‘প্রিয় সখি, আমাদের বড় ভয় হইতেছে, তরবারি লইয়া কি করিবে?’

উল্কা অল্প হাসিল— ‘মহারাজের অস্ত্র-কৌশল পরীক্ষা করিব।’ তারপর গম্ভীর মুখে বলিল— ‘আমি উদ্যানে যাইতেছি, তোমরা কেহ সেখানে যাইও না। যদি মহারাজ আসেন, তাঁহাকে বলিও আমি মাধবীকুঞ্জে তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছি।’ বলিয়া তরবারি হস্তে উদ্যান অভিমুখে প্রস্থান করিল।

সখীরা ভীতনির্বাক্‌ কাষ্ঠপুত্তলির মতো দাঁড়াইয়া রহিল।

মহারাজ সেনজিৎ মাধবীকুঞ্জের লতাবিতানতলে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, দুই হস্তে স্থির বিদ্যুতের মতো দুইখানি তরবারি লইয়া উল্কা দাঁড়াইয়া আছে, তাহার চোখে নবীন আষাঢ়ের দলিতাঞ্জন মেঘ, আসন্ন মহাদুর্যোগের প্রতীক্ষায় দেহ স্থির।

তিনি থমকিয়া দাঁড়াইলেন; উত্তপ্ত আরক্ত চক্ষু তরবারির প্রতি নিবদ্ধ হইল। বলিলেন— ‘উল্কা, এ কি?’

উল্কা রক্তাধরে ক্ষীণ হাসিল, বলিল— ‘এই আমার উত্তর।’

‘কিসের উত্তর?’

‘কাল যে কথা জানিতে চাহিয়াছিলেন, তাহার উত্তর।’

সেনজিৎ অধীরপদে উল্কার দিকে অগ্রসর হইয়া গেলেন। তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বজ্রগর্ভকণ্ঠে বলিলেন— ‘উল্কা, আজ আবার এ কি নূতন ছলনা? হৃদয় লইয়া বার বার ক্রীড়া পরিহাস ভাল লাগে না— বল, কাল কেন আমাকে বঞ্চনা করিলে? আমাদের মিলনে কিসের বাধা?’

‘তাহাই তো বলিতেছি মহারাজ। আমাদের দু’জনের মধ্যে এই তরবারি ব্যবধান।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ আমাকে অসিযুদ্ধে পরাজিত না করিলে লাভ করিতে পরিবেন না।’

মহারাজ যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, বলিলেন— ‘সে কি?’

উল্কা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল— ‘ইহাই আমার বংশের চিরাচরিত প্রথা।’

এইবার মহারাজের মুখে এক অপূর্ব পরিবর্তন হইল; মুহূর্তমধ্যে ক্লেশ-চিহ্নিত রেখা অন্তর্হিত হইয়া মুখ আনন্দের আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন— ‘এই বাধা!— কিন্তু তুমি নারী, তোমার সহিত অস্ত্র যুদ্ধ করিব কিরূপে?’

উল্কা গ্রীবা বঙ্কিম করিয়া চাহিল— ‘মহারাজ কি আমাকে অস্ত্রবিদ্যায় সমকক্ষ মনে করেন না?’

সেনজিৎ হাসিলেন, বলিলেন— ‘তাহা নয়। তোমার অস্ত্রবিদ্যার পরিচয় পূর্বেই পাইয়াছি, এখনও এ বক্ষ তোমার অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত। কিন্তু যদি আমি যুদ্ধ না করি?’

‘তাহা হইলে আমাকে পাইবেন না।’

‘যদি বলপূর্বক গ্রহণ করি?’

‘তাহাও পরিবেন না, এই তরবারি বাধা দিবে।’

‘ভাল— বাধা দিক’— বলিয়া মহারাজ সহাস্যমুখে বাহু প্রসারিত করিয়া অগ্রসর হইলেন।

কম্পিত স্বরে উল্কা বলিল— ‘মহারাজ, কাছে আসিবেন না— নচেৎ—’ বলিয়া তরবারি তুলিল।

‘নচেৎ—?’ মহারাজ অগ্রসর হইয়া চলিলেন। তরবারির অগ্রভাগ তাঁহার বক্ষঃস্থল স্পর্শ করিল, তথাপি তাঁহার গতি রুদ্ধ হইল না। তখন উল্কা ক্ষিপ্রপদে সরিয়া গিয়া তরবারি নিজ বক্ষে স্থাপন করিয়া বলিল— ‘আর অধিক আছে আসিলে এই আসি নিজ বক্ষে বিঁধিয়া দিব।’

মহারাজ হাসিয়া বলিলেন— ‘আমি জানিতাম, তুমি আমার বক্ষে অসি হানিতে পরিবে না— সেজন্য অন্য অস্ত্র আছে—’ বলিতে বলিতে বিদ্যুদ্বেগে তিনি উল্কার হস্ত হইতে তরবারি কাড়িয়া লইলেন, তাহার বাহু ধরিয়া কপট কঠোর স্বরে বললেন— ‘আজ তোমাকে কঠিন শাস্তি দিব।’

উল্কা কাঁদিয়া বলিল— ‘নিষ্ঠুর! অত্যাচারী! তোমার কি কলঙ্কের ভয় নাই? অসহায়া নারীর উপর পীড়ন করিতে তোমার লজা হয় না?’

মহারাজ পরিতৃপ্ত হাস্যে তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া বলিলেন— ‘না— হয় না। এবার এস, যুদ্ধ করি।’ বলিয়া একখানি তরবারি তুলিয়া লইয়া তাহার হাতে দিলেন।

এইবার উল্কা বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো সজল বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া রহিল। সেনজিৎ কহিলেন— ‘পাছে তুমি মনে কর, নারীর সহিত যুদ্ধ করিতেও আমি ভয় পাই— তাই অসি ধরিলাম। — এস।’ দ্বিতীয় তরবারি তুলিয়া লইয়া মৃদুহাস্যে বলিলেন— ‘কিন্তু উল্কা, যদি সত্যই তোমার হাতে পরাজিত হই? তবে আর তুমি আমার হইবে না?’

উল্কার অধর কাঁপিতে লাগিল, সে উত্তর দিতে পারিল না। মনে মনে বলিল— ‘আর না, আর না! এত লোভ আমি সংবরণ করিতে পারিব না। আমাকে মরিতে হইবে— মরিতে হইবে। — কিংবা যদি পরাজিত করিতে পারি— পারিব কি?’

অসংযত কণ্ঠস্বর সবলে দৃঢ় করিয়া উল্কা বলিল— ‘প্রতিজ্ঞা করুন, পরাজিত হইলে আর আমাকে স্পর্শ করিবেন না?’

ঈষৎ গর্বের সহিত সেনজিৎ বলিলেন— ‘প্রতিজ্ঞা করিলাম, যদি পরাজিত হই কখনও স্ত্রীজাতির মুখ দেখিব না।’

তারপর সেই মাধবীবিতানতলে দুই প্রেমোন্মাদ নরনারীর অসিযুদ্ধ আরম্ভ হইল। পুরুষ যুদ্ধ করিল নারীকে লাভ করিবার জন্য, আর নারী যুদ্ধ করিল তাহাকে দূরে রাখিবার জন্য। উভয়ের হৃদয়েই দুর্দম ভালবাসা, উভয়েই জয়ী হইতে চায়। এরূপ যুদ্ধ জগতে বোধ করি আর কখনও হয় নাই।

অসিযুদ্ধ আরম্ভ করিয়া সেনজিৎ দেখিলেন, উল্কার অসি-শিক্ষা অতুলনীয়। তাহার হস্তে ঐ অসিফলক যেন জীবন্ত বিষধরের মূর্তি ধারণ করিয়াছে। সেনজিৎ সাবধানে সতর্কভাবে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। শুধু বিজয়ী হইলে চলিবে না, উল্কার বরতনু অনাহত অক্ষত রাখিয়া তাহাকে পরাস্ত করিতে হইবে।

কিন্তু উল্কার হাত হইতে ঐ বিদ্যুৎশিখাটাকে কাড়িয়া লওয়াও অসম্ভব। তিনি লক্ষ্য করিলেন, উল্কাও অপূর্ব নিপুণতার সহিত তাঁহার দেহে আঘাত না করিয়া তাঁহাকে পরাস্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে; আঘাত করিবার সুযোগ পাইয়াও আঘাত করিতেছে না। বায়ু-কম্পিত পুষ্পের চারিপাশে লুব্ধ ভ্রমরের মতো উল্কার অসি তাঁহার দেহের চতুর্দিকে গুঞ্জন করিয়া ফিরিতেছে।

এইভাবে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলিল। সেনজিৎ বুঝিলেন, সহজ পন্থায় উল্কাকে পরাজিত করিতে সময় লাগিবে। তাহার দেহে এখনও ক্লান্তির চিহ্নমাত্র দেখা যাইতেছে না, নিশ্বাস স্বাভাবিকভাবে বহিতেছে; কেবল নাসাপুট অল্প স্ফুরিত হইতেছে মাত্র। তখন তিনি মনে মনে হাসিয়া এক কৌশল অবলম্বন করিলেন।

সহসা যেন অসাবধানতাবশতঃই তাঁহার একটু পদস্খলন হইল। উল্কার অসির নখ তাঁহার বক্ষের নিকট আসিয়াছিল, পদস্খলনের ফলে পঞ্জরে একটা আঁচড় লাগিল। উল্কা সত্রাসে নিশ্বাস টানিল, তাহার তরবারির বিদ্যুৎগতি সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হইল। সেই মুহূর্তে মহারাজ সেনজিৎ এক অপূর্ব কৌশল দেখাইলেন, তাঁহার অসি উল্কার অসির সঙ্গে জড়াইয়া গেল, তারপর তিনি ঊর্ধ্বদিকে একটু চাপ দিলেন। অমনি উল্কার হস্তমুক্ত অসি উড়িয়া গিয়া দূরে পড়িল।

মহারাজ বলিলেন— ‘কেমন, হইয়াছে?’

বিস্ময়-বিমূঢ় মুখে সভয়ে দ্রুতস্পন্দিতবক্ষে উল্কা চাহিয়া রহিল; তারপর থরথর-দেহে কাঁপিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল। এক দিকে নিজ দেহ-মন প্রিয়তমের বুকের উপর নিঃশেষে বিসর্জন করিবার দুর্নিবার ইচ্ছা, অপর দিকে প্রিয়তমের দৃষ্টির সম্মুখ হইতে নিজেকে নিশ্চিহ্ন করিয়া মুছিয়া ফেলিবার বাসনা— অন্তরের মধ্যে এই সুরাসুর দ্বন্দ্ব যখন চলিতে থাকে, তখন নারীর কাঁদিবার শক্তিও আর থাকে না। তখন গর্ব ও দীনতা, আকাঙ্ক্ষা ও নৈরাশ্য, চরম ব্যর্থতা ও পরম সিদ্ধি একসঙ্গে মিশিয়া প্রেম-নির্মথিত নারীচিত্তে যে হলাহল উত্থিত হয়, তাহা বোধ করি এ জগতের বিষকন্যারাই আকণ্ঠ পান করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারে।

উল্কা দুই বাহুতে ভর দিয়া নতমুখে বসিয়া রহিল। সেনজিৎ তরবারি ফেলিয়া তাহার পাশে নতজানু হইয়া বসিলেন, পৃষ্ঠে হস্ত রাখিয়া স্নেহ-ক্ষরিত কণ্ঠে বলিলেন— ‘উল্কা, আর তো বাধা নাই।’

শুষ্ক চক্ষু তুলিয়া উল্কা বলিল— ‘না, আর বাধা নাই।’

দীর্ঘকাল সে অপলক দৃষ্টিতে মহারাজের মুখ নিরীক্ষণ করিল, যেন রাক্ষসীর মতো তাঁহার প্রতি অবয়ব দুই চক্ষু দিয়া গিলিতে লাগিল। মহারাজও মুগ্ধ তন্ময় হইয়া উল্কাকে দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার মুখ হর্ষোৎফুল্ল— বক্ষে রোমাঞ্চ। তিনি ভাবিলেন— ‘প্রেম এত মধুর! এত দিন জানিতাম না, উল্কা, তুমি আমাকে ভালবাসিতে শিখাইলে! উল্কা— প্রেয়সী!’

উল্কার চোখের দৃষ্টিতে যে কত কি ছিল, মহারাজ তাহা দেখিতে পাইলেন না। উল্কা তখন ভাবিতেছিল— পাইলাম না— পাইলাম না! প্রিয়তম, তোমাকে পাইয়াও পাইলাম না!

কুঞ্জ-বাহিরে উৎকণ্ঠিতা সখীর কঙ্কণধ্বনি শুনিয়া দু’জনের বাহ্য চেতনা ফিরিয়া আসিল। উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইল; চোখ দুটি মহারাজের মুখের উপর পাতিয়া একটু হাসিল। তারপর অনুচ্চ অতি অস্ফুট স্বরে বলিল— ‘আজ নিশীথে বাসকগৃহে আমি মহারাজের প্রতীক্ষা করিব।’

দীপের তৈল ফুরাইয়া আসিতেছে; আকাশে চন্দ্রও ক্ষয়িষ্ণু। বিষকন্যা উল্কার বিষদগ্ধ কাহিনী শেষ হইতে আর বিলম্ব নাই।

নিশীথ প্রহরে মহারাজ আসিলেন। উল্কা পুষ্প-বিকীর্ণ বাসকগৃহের মধ্যস্থলে একাকী দাঁড়াইয়া ছিল। তাহার হস্তে এক গুচ্ছ কমল-কোরক।

সেনজিৎ তাহাকে দুই বাহু দিয়া জড়াইয়া লইলেন। কমল-কোরকের গুচ্ছ উভয়ে বক্ষের মাঝখানে রহিল।

‘উল্কা— প্রাণময়ি—’ বিপুল আবেগে উল্কার বরতনু মহারাজ বক্ষে চাপিয়া ধরিলেন। তাঁহার বক্ষে ঈষৎ বেদনা অনুভূত হইল। ভাবিলেন— আনন্দ-বেদনা!

উল্কা তাঁহার বক্ষে এলাইয়া পড়িল, মধুর হাসিয়া বলিল— ‘প্রিয়তম, তোমার বাহুবন্ধন শিথিল করিও না। এমনিভাবে আমায় মরিতে দাও।’

সেনজিৎ তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন; পূর্ণ মিলনের অন্তরায় কমল-কোরকগুলি ঝরিয়া পড়িল। তখন মহারাজ দেখিলেন, সূচীবৎ তীক্ষ্ণ ছুরিকা উল্কার বক্ষে আমূল বিদ্ধ হইয়া আছে। তাঁহারই বক্ষ-নিষ্পেষণে ছুরিকা বক্ষে প্রবেশ করিয়াছে।

সেনজিৎ উন্মত্তের মতো চিৎকার করিয়া উঠিলেন— ‘উল্কা! সর্বনাশী! এ কি করিলি?’

উল্কা তাঁহার কণ্ঠ জড়াইয়া ধরিয়া অনির্বচনীয় হাসি হাসিল, বলিল— ‘এখন অন্য কথা নয়, শুধু ভালবাসা। প্রিয়তম, আরও কাছে এস, তোমাকে ভাল দেখিতে পাইতেছি না।’

সেনজিৎ তাহাকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া বলিলেন— ‘কিন্তু কেন— কেন উল্কা? কেন এমন করিলে?’

উল্কার মুখের হাসি ক্রমশ নিস্তেজ হইয়া আসিল, চোখ দিয়া দুই বিন্দু জল গড়াইয়া পড়িল;— সে অতি ক্ষীণ নির্বাপিত স্বরে বলিল— ‘প্রাণাধিক, আমি বিষকন্যা—’

সেবারে শিবামিশ্রের প্রতিহিংসা পূর্ণ সফলতা লাভ করিল না। সার্ধ শত বৎসর পরে একজন কুটিল ব্রাহ্মণ তাঁহার প্রারব্ধ কর্ম সমাপ্ত করিয়াছিলেন।

বহুদূর অতীতের এই বিয়োগান্ত নাটিকায় আমি— এই জাতিস্মর— কোন্‌ ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছিলাম, তাহা উল্লেখ করি নাই; করিবার প্রয়োজনও নাই। হয়তো বিদূষক হইয়া অবতীর্ণ হইয়াছিলাম, হয়তো রাজটীকা ললাটে ধারণ করিয়াছিলাম, কিংবা হয়তো শৃগালের দংষ্ট্রাক্ষত গণ্ডে বহন করিয়াছিলাম। পাঠক যেরূপ ইচ্ছা অনুমান করুন, আমি আপত্তি করিব না।

শুধু একটা প্রশ্ন এই সংস্কার-বর্জিত বিংশ শতাব্দীতে বসিয়া মাঝে মাঝে মনে উদয় হয়। উল্কা যদি প্রিয়প্রাণহন্ত্রী বিষকন্যাই ছিল, তবে সেনজিৎ না মরিয়া সে নিজে মরিল কেন।

৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪২

4 Comments
Collapse Comments

আচ্ছা আমি কি এই Wabesite -এ কিছু গল্প লিখতে পারি?

আমি কি এই Wabesite -এ কিছু গল্প লিখতে পারি?

আমি কি এই wabesite-এর হয়ে কিছু গল্প লিখতে পারি?

Bangla Library (Administrator) October 1, 2020 at 6:18 pm

পারেন। info অ্যাট evergreenbangla ডট com-e মেইল করতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *